১১. মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সমাজ

একাদশ অধ্যায় – মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও সমাজ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের (Industrial Revolution) পূর্বে অভিজাত গোষ্ঠী ও সমাজের নিম্নতম শ্রেণির মধ্যে আরও একটি শ্রেণি ছিল। ছোটোছোটো ভূমির মালিক, ব্যাবসাদার, কৃষক ও কারিগর—এরা ছিল এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। স্থানীয় ভূস্বামীদের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় এরা ভূমি ভোগ করত। কৃষকেরা প্রচলিত প্রথানুসারে বা খাজনা দিয়ে খণ্ড—খণ্ড ভূমি দখল করত। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু তা তারা নিজেরাই উৎপাদন করত। ‘স্বাধীনতা’ অহংকার ছিল এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সকলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারাই ছিল তাদের নিজেদের প্রভু, এবং এই আত্মপ্রভুত্বের ধারণা তাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। জীবনে চারদিক থেকে তারা বেশ নিরাপত্তা অনুভব করত। ইংল্যান্ডের বর্তমান যুগের মধ্যবিত্তেরা, আত্মপ্রভুত্ব, স্বাধীনতাপ্রীতি, অহংকার প্রভৃতি যাবতীয় মনোবৃত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাচীন মধ্যবিত্তদের কাছ থেকেই পেয়েছে। যদিও প্রাচীন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে এদের পার্থক্য অনেক তবু সেই প্রাচীন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেই যে এদের বিকাশ তা অস্বীকার্য নয়। পুরাতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি।

শিল্পবিপ্লব এসে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। সেই আঘাতে এই শ্রেণির খানিকটা অংশ ধসে গেল, অবশিষ্ট অংশ উপরে ভেসে উঠল। ছোটো ব্যাবসাদার ও কারিগরেরা কারখানার শ্রমিক। নূতন উৎপাদনপদ্ধতি, অর্থাৎ নূতন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে তাদের প্রাধান্য গেল কমে। ক্রমে তারা নিজেদের উপার্জিত মজুরির উপর নির্ভরশীল হল। মুষ্টিমেয় একদল ভিন্ন প্রায় সকলেই অর্ধ—স্বাধীন মধ্যস্তর থেকে বিচ্যুত হয়ে নিম্নস্তরের শ্রমজীবী হল। যারা এই শ্রমজীবীর স্তরে স্থানান্তরিত হতে চাইল না তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ছোটো ব্যাবসাদারদের ক্ষেত্র পূর্বের চাইতে প্রসারলাভ করল, কারণ নূতন শ্রমজীবী শ্রেণির চাহিদা বাড়ল। সুতরাং প্রাচীন মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধ্বংসের পাশাপাশি, দোকানদার, ব্যাবসাদারদের নিয়ে একটি অংশ পূর্বকার ‘আত্মপ্রভুত্ব’ ও ‘স্বাধীনতা’ বজায় রাখল। এইসময় শাসনকার্যের জন্যও উপযুক্ত লোকের তাগিদ এল। ভূমির মালিকদের মধ্যে উপরের স্তরভুক্ত যারা তারা শ্রেণিচ্যুত হয়ে এই নূতন কাজের ভার গ্রহণ করল। ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের প্রাথমিক অবস্থায় ব্রিটেনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এইভাবে পরিবর্তন আসে।

শস্য আইন (Corn Laws) নাকচের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ব্রিটেনের পরবর্তী অগ্রগতি সূচিত হয়। ভূমির অধিকারী অভিজাত গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই আইন পাশ করেছিল। শস্যের চড়া মূল্য ঠিক রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। নূতন ধনিক শিল্পপ্রভুরা এই আইনের বিরোধী ছিল, শুধু পুরাতন অভিজাত শাসকশ্রেণিকে বিচ্যুত করে নিজেরা শাসনাধিকার লাভের জন্য নয়, শস্যের মূল্য সস্তা হলে শ্রমিকশ্রেণিকে কম মজুরি দেওয়া সম্ভব হবে এবং উৎপাদনের খরচ কমবে বলে। ১৮৪৬ সালে নূতন শ্রেণির, অর্থাৎ শিল্পপ্রভুদেরই জয় হল, শস্য আইন উঠে গেল। পৃথিবীর বাজারে সস্তা ব্রিটিশ দ্রব্য প্রচুর সরবরাহ করা হল। ধনতন্ত্রের নূতন, গৌরবময় যুগ এল ব্রিটেনে।

প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর ষষ্ঠ দশক পর্যন্ত শ্রেণিবিন্যাস মোটামুটি ঠিকই রইল। ষষ্ঠ দশকে ব্রিটেন পণ্য রপ্তানি থেকে মূলধন রপ্তানির দিকে বেশি নজর দিল, এবং ব্রিটিশ ধনতন্ত্রের বিকাশের নূতন পর্যায় আরম্ভ হল। ধনতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নিল, এবং সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মুষ্টিমেয় ধনিকগোষ্ঠীর মনে হল যেন শান্তি ও প্রাচুর্যের উপর তাদেরই চিরস্থায়ী অধিকার আছে, জীবনের অবিচ্ছিন্ন শান্তি থেকে তারা আর কোনোদিন বঞ্চিত হবে না। পুরাতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে ধ্বংসাবশেষ তখনও ছিল, তারা পূর্বাপেক্ষা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধে আরও বেশি নিশ্চিন্ত হল। ব্রিটিশ শিল্প—ব্যাবসা তখনও সংঘবদ্ধ হয়নি। শিল্পসংঘ(Combiness), শিল্পের কেন্দ্রীকরণ (Centralisation) বা র‍্যাশানালাইজেশন তখনও ব্রিটেনে খুব মন্থরগতিতে চলেছে। শিল্পজাত দ্রব্যের রপ্তানি র‍্যাশনালাইজেশন দ্বারা কমানো হয়নি, মূলধনের রপ্তানির দ্বারা তাকে সংকুচিত করা হয়েছিল। মূলধন রপ্তানির ফলে মূলধন নিয়ন্ত্রণের ভারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ব্যাঙ্কের প্রাধান্য বাড়া খুব স্বাভাবিক। ধনব্যবস্থার (Financial System) এই বিকাশের ফলে, এবং সাম্রাজ্য স্থাপনের সমারোহের সঙ্গে সঙ্গে, নূতন একদল অফিসের কর্মচারী, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক প্রভৃতির চাহিদা বাড়ে। এই চাহিদা এত বেশি তীব্র হয় যে এমনকী শ্রমিকদের শিক্ষালয় থেকেও ‘best brain’—দের তলব পড়ে।

বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত এইচ. জি. ওয়েলস—এর (H. G. Wells) শৈশব ও যৌবন ব্রিটেনের এই ‘best brain’—এর কলরবমুখরিত প্রতিবেশের মধ্যে অতিবাহিত হয়। ওয়েলস যৌবনে তাঁর রঙিন চোখ মেলে দেশের দিকে চেয়ে দেখলেন যে তাঁর শ্রেণিভুক্ত যাঁরা, দিব্যি আরামে তাঁরা নূতন সাম্রাজ্য—প্রমত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার দিন কাটাচ্ছেন, এবং শুধু ধারালো মগজের মালিক হলেই জীবনের নিরাপত্তা সম্বন্ধে দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ থাকবে না। মস্তিষ্ক দিয়ে বুর্জোয়া প্রভুদের নূতন সাম্রাজ্যবাদী উদ্যমে যাঁরা সহায়তা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ওয়েলসও একজন ছিলেন। জীবনের সেই মোহ ও ভ্রম, ব্যক্তিগত জীবনের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে ক্রমে বেড়েছে এবং ওয়েলস প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা আজও তাই ‘best brain’, ‘originative intellectual’, ‘directive elite’ প্রভৃতির কলরব থেকে বিরত হননি। ধনতন্ত্রের সাময়িক পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীর শ্রেষ্ঠত্বের উপর তাঁদের যে ভুল বিশ্বাস জন্মেছিল, সে—বিশ্বাস আজও অন্তর্ধান তো করেইনি, উপরন্তু মনের ভিতর বদ্ধমূল হয়ে গিয়ে বাইরে বিকৃতরূপে আত্মপ্রকাশ করছে।

ধনতন্ত্রের ক্রমবিকাশের ফলে নূতন সাম্রাজ্যবাদী জীবন আরম্ভ হল। চারদিকে নির্বিচার শোষণের ফলে বিরোধ ও সংঘর্ষ মূর্ত হয়ে উঠল। এই সংঘর্ষের প্রথম ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হল বোয়ার যুদ্ধ (Boer War)। সংগ্রামে ব্রিটেনের জয় হল, এবং তারপর থেকে ধনস্বার্থ প্রথম স্থান অধিকার করল, পণ্য রপ্তানির প্রাধান্য গেল কমে। এইভাবে ধনিকবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যোৎপাদনের জন্য ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাঙ্কের বিকাশও লক্ষণীয়। অর্থ লেনদেনের কর্তব্য সম্পাদন থেকে ব্যাঙ্ক ক্রমে গচ্ছিত ধন থেকে নিজেরা মূলধন সৃষ্টির দায়িত্ব গ্রহণ করল। ব্যাঙ্কের এই গচ্ছিত ধন হল নৈর্ব্যক্তিক গচ্ছিত ধন (Impersonal Investment)। বিভিন্ন ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগিতার জন্য ব্যাঙ্কের এই মূলধন সৃষ্টির প্রণালী আরও বেশি তীব্রতর হল। বুর্জোয়াদের ব্যক্তিগত দায়িত্ব একরকম প্রায় লোপ পেল, এবং শিল্পের এজমালি প্রথার (Joint-stock System) সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কেও এজমালি প্রথা প্রবর্তিত হল। ন্যস্তধন (Investment) কারও ব্যক্তিগত মূলধন না হয়ে, মূলধনের মূলধন হল, অর্থাৎ ব্যাঙ্কের নানারকম গচ্ছিত ও আমানতের (Deposits) একটি অংশ হল মূলধন। ব্যাঙ্কের প্রধান কর্তব্যের মধ্যে বুর্জোয়া অর্থনীতিতে “Loans create deposits”—এর যে কাহিনি আছে তার অর্থ হল এই।* মূলধন যদিও শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিরই মূলধন রইল, তবু সেই মূলধনকে ন্যাস করবার (Invest) পদ্ধতি হল নৈর্ব্যক্তিক, এবং তখন মূলধন ব্যক্তির না হয়ে, বেনামী মূলধন হল। যে পাঁচটি বৃহৎ ব্রিটিশ ব্যাঙ্কের কথা আমরা শুনে থাকি তাদেরই মধ্যে এই মূলধন কেন্দ্রীভূত রইল। ব্যাঙ্কের দ্বারা ব্যাঙ্কের মারফত গচ্ছিতের এই বেনামি মূলধনকেই (Anonymous Capital) আমরা ‘Finance Capital’ বলে থাকি।

এই যে ব্যাঙ্ক ও শিল্পের উন্নতি হল, এবং নানারকম প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেল, সেগুলিকে পরিচালনা করবার ভার পড়ল কাদের উপর? এই প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলিকে কারা বুদ্ধি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখল? নূতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপরের স্তরভুক্ত যাঁরা তাঁরাই এ—কাজের দায়িত্ব নিলেন। পণ্যোৎপাদনের অবস্থা থেকে মূলধন রপ্তানি পর্যন্ত ধনতন্ত্রের যে পরিবর্তন হল, প্রাথমিক সঞ্চয়ের গৃহান্তর্গত প্রচেষ্টা থেকে সাম্রাজ্যবাদের বহির্মুখী প্রসারে ধনতন্ত্র যে—রূপ গ্রহণ করল, তাতে বুর্জোয়া শ্রেণির পরিবর্তন হল। ধনতন্ত্রের প্রাথমিক সঞ্চয়ের যুগে বুর্জোয়া শ্রেণিরও পরিবর্তন হল। ধনতন্ত্রের প্রাথমিক সঞ্চয়ের যুগে বুর্জোয়াশ্রেণি ছিল সক্রিয়, তখন গঠন করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। দেশের ও সমাজের রূপ আমূল পরিবর্তন করবার দায়িত্ব তখন তারা নিয়েছিল। আজ বুর্জোয়া শ্রেণির অধিকাংশের আয় বিদেশি গচ্ছিতের উপর নির্ভর করে। আজ ব্রিটেনের যেকোনো খাঁটি ধনিক হচ্ছেন ‘anonymous dividend-drawer’, বেনামি গচ্ছিতের মোটা লাভাংশ থেকেই তাঁর মেদবৃদ্ধি হয়। এ—কথা বিখ্যাত বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ জে. এম. কিনসই (J. M. Keynes) স্বীকার করেছেন। স্ট্যালিন—ওয়েলস কথোপকথনের সমালোচনা প্রসঙ্গে কিন্স বলেছেন :

Queen Victoria died as the monarch of the most capitalistic empire upon which the sun has (or has not) set…. The leaders of the City and the captains of industry were tremendous boys at the height of their glory… When the giants fell with the years, a different sort of tree was found growing underneath… The capitalist has lost the source of his inner strength…his self-assurance, his untameable will, his belief in his own beauty and unquestionable value to society… Thus for one reason of another. Time and the joint Stock Company and the Civil Service have silently brought the salaried class into power.” (J. M. Keynes on Stalin-Wells Talk).

রানি ভিক্টোরিয়া যে বৃহৎ ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন, সে—সাম্রাজ্যের সূর্য আজ অস্তাচলে…শহরের নেতৃবৃন্দ ও শিল্পের নায়কেরা তখন বালসুলভ স্ফূর্তিতে গৌরবের উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিল… যখন তাদের পতন হল তখন নীচ থেকে আর—একটি বৃক্ষ ক্রমে বাড়তে লাগল…নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তি, আত্মবিশ্বাস, অদম্য সংকল্প, সমাজের কাছে নিজেদের মূল্য ও সৌন্দর্য ধনিকশ্রেণি হারাল… এবং এই কারণে ক্রমে এজমালি প্রথা ও সিভিল সার্ভিসের জন্য বেতনভোগী একটি শ্রেণি ক্ষমতা লাভ করল। কিন্সের এই যুক্তি বিশেষভাবে প্রণিধেয়, কারণ এর মধ্যেই মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের আত্মবিশ্বাসের, আত্মশক্তির ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের মূল নিহিত আছে। কিনস বাহ্যিক সত্যকে স্বীকার করেও মধ্যবিত্তদের ক্ষমতালাভের ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করতে পারেননি।

তাহলে ধনতান্ত্রিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বিকাশের প্রত্যেক স্তরের ঘাতপ্রতিঘাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ উপরে ক্রমে বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে মিশে যায় এবং আর—একটি অংশ ক্রমে নীচের দিকে নামতে থাকে। উপরের স্তরে যারা উন্নীত হয় তাদের সংখ্যা খুব অল্প, এবং যারা ক্রমে নেমে আসে শ্রেণিচ্যুত হয়ে তাদের সংখ্যা হাজারগুণ বেশি। শিল্প ব্যাবসা ক্রমে কেন্দ্রীভূত ও সংঘবদ্ধ হওয়ার ফলে এই শ্রেণি—ভাঙন ঘটে। আমেরিকা, ইতালি, জার্মানি প্রভৃতি দেশে যেখানে শিল্পব্যবস্থার এই সঙ্ঘবদ্ধতা ব্রিটেনের চাইতে তীব্রতর, সেখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির—বাস্তব জীবনের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক জীবনের অবনতি আরও বেশি দ্রুত ঘটেছে। ফলে জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিজম—এর অভ্যুত্থান হয়েছে শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণির দিক থেকে ‘ফিনান্স ক্যাপিটালে’র সমর্থন থাকার জন্য।

টেকনিশিয়ান, বৈজ্ঞানিক, লেখক, ডাক্তার, শিক্ষক প্রভৃতি যাদের বুর্জোয়া শ্রেণি একসময় নিজেদের সুবিধা ও স্বার্থসিদ্ধির জন্য কর্মক্ষেত্রে আহ্বান করেছিল সাদরে, আজ তাদের সংখ্যা ভীষণভাবে না কমিয়ে দিলেও সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্র তাদের স্বল্প বেতনে নিযুক্ত রেখেছে শুধু যান্ত্রিক উপায়ে কর্তব্যপালনের জন্য। বুর্জোয়া শ্রেণি বিকাশের জন্য, স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য একদিন যেসব মধ্যবিত্ত শিক্ষিতেরা নিজেদের মস্তিষ্ককে সৃষ্টিকার্যে নিয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিল, আজ তাদের সেই সৃষ্টিই বুর্জোয়াদের ভয়ের কারণ হয়েছে। বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নতি বুর্জোয়া শ্রেণি কামনা করে না, কারণ বিজ্ঞানের যে শ্রেষ্ঠ উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণসাধন করা, জীবনের সচ্ছলতা আনা, তার সঙ্গে আধুনিক স্বখাতসলিলে নিক্ষিপ্ত বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্দেশ্যের বিরোধ ঘটবে। বিজ্ঞানের উপর আজ তাই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, বৈজ্ঞানিক আজ তাঁর বীক্ষণাগারে শৃঙ্খলিত বন্দি। বৈজ্ঞানিকের গবেষণার মূলে আজ মানুষের হিতৈষণার প্রেরণা নেই। আজ ধনিকগোষ্ঠীর জিঘাংসাবৃত্তি বৈজ্ঞানিকের মনে সংক্রামিত হয়েছে, তাই মানুষকে হত্যা করবার জন্য বিষাক্ত গ্যাসের ফর্মুলাতে তিনি মনোনিবেশ করেছেন। সেই বিষাক্ত গ্যাসের দুর্গন্ধি প্রতিবেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক অন্ধ হয়ে গর্বিত স্যামসনের মতো কখনো বুর্জোয়া ফিলিস্টাইনদের অভিশাপ দিচ্ছেন, কখনো দিগ্ভ্রান্ত হয়ে বলছেন জীবন অর্থহীন, এ—বিশ্ব রহস্যময়। আর এইচ. জি. ওয়েলসের মতো বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা সারাজীবন মস্তিষ্ক খাটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণির অক্লান্ত সেবা করে এসেছেন, তাঁরা একদিকে তারস্বরে চিৎকার করছেন ‘outwitter’, ‘cheated’, ‘frustrated’ হয়েছেন বলে, আর—একদিকে প্রাক্তন, সাবলীল, মন্দাক্রান্তা ছন্দবদ্ধ মধ্যবিত্ত জীবনের মোহ ও কল্পনার নাগপাশ ছিন্ন করতে না পেরে বলছেন যে একমাত্র ‘directive elite’, ‘orginative intellectual’—রাই সমাজের মুক্তি ও স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে পারে। শিল্পীদের অবস্থাও হয়েছে বৈজ্ঞানিকের মতো। একসময় নূতন বুর্জোয়া শ্রেণির জীবনের উল্লাস ও উদ্দামতা দেখে, চারদিকে কর্মমুখর বুর্জোয়াদের সৃষ্টিকার্যে অনুপ্রাণিত হয়ে, নূতন সমাজের রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে শিল্পীরা ও সাহিত্যিকরা মানুষের সমাজের ও জীবনের যে জয়গান গেয়েছিলেন, আজ সেই বুর্জোয়া শ্রেণির কদর্য পরিণতি, সেই বুর্জোয়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকৃত মলিন রূপ তাঁদের মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়েছে, নৈরাশ্যবাদ, অবিশ্বাস, মৃত্যুচিন্তা, মানুষের স্বাভাবিক দৌর্বল্য ও হীনতায় বিশ্বাস, এইসব অনিষ্টকর ধারণার ইন্ধন জুগিয়েছে। আজ তাঁরা বুর্জোয়া শ্রেণির বীভৎস পরিণতির সঙ্গে নিজেদের জড়িত দেখছেন। মুষ্টিমেয়, সংখ্যালঘিষ্ঠ ধনিকদের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে তাঁরা বৃহত্তম মানবগোষ্ঠীকে অভিশাপ দিচ্ছেন, মানবসভ্যতাকে ধ্বংসোন্মুখ বলে ঘোষণা করছেন। তার কারণ পূর্বেই বলেছি যে তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, এবং বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে বহুদিনের আত্মীয়তার স্মৃতি আজ পীড়াদায়ক হলেও তাঁরা সম্পূর্ণ তা ভুলতে পারেননি।

এই কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্বন্ধে মার্কস ও এঙ্গেলস ‘Communist Manifesto’—তে বলেছেন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, ছোটো ব্যাবসাদার, দোকানদার—এরা সব বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে সংগ্রাম করে শুধু নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখবার স্বার্থ নিয়ে। এইজন্যই তারা বিপ্লবী নয়, বিপ্লব—বিরোধী ও রক্ষণশীল। এরা সমাজের প্রগতিকে বাধা দেয়, ইতিহাসের প্রবহমান ধারাকে প্রতিরোধ করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি কীভাবে ক্রমে ধনতান্ত্রিক বিকাশের ফলে শ্রমজীবীদের সঙ্গে এসে যোগ দেয় সে—সম্বন্ধেও মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন যে সাধারণত দুটি কারণে এদের ভাঙন আরম্ভ হয়। প্রথম কারণ হল যে তাদের স্বল্প মূলধন বর্তমান যুগোপযোগী নয়, অর্থাৎ বর্তমান যুগে ব্যাবসায় উন্নতি করতে হলে যতটা মূলধন থাকা দরকার তা তাদের নেই, এবং সেই কারণে তারা প্রচুর মূলধনের মালিক ধনিকগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়। দ্বিতীয় কারণ হল এই যে বর্তমান যুগের উৎপাদন—প্রণালির নিষ্পেষণে তাদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কদর কমে যায়। এমনি করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ক্রমে একটি দল ভেঙে এসে শ্রমজীবীদের দলের সঙ্গে মিলিত হয়। মার্কস ও এঙ্গেলস এ—কথাও বলেছেন যে প্রাচীন যুগে যেমন অভিজাত সম্প্রদায়ের একদল বুর্জোয়াদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, তেমনি এ—যুগের বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যস্থিত একদল এই শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে যোগ দেবে। বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যস্থিত এই দল বলতে মার্কস ও এঙ্গেলস মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশকে ইঙ্গিত করেছেন। ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র মধ্যে বলা হয়েছে যে বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্য থেকে যে—দল শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে যোগ দেবে তারা বিশেষ করে বৈপ্লবিক আদর্শ ও ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনবাদ ভালোভাবে বুঝেছে। এ—উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। রুশ—বিপ্লবের নজির বাদ দিলেও দেখা যায় যে ইয়োরোপে মধ্যবিত্তদের একদল শ্রমজীবী শ্রেণি সংগ্রামের আদর্শ উপলব্ধি করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, এমনকী একদল শিল্পী ও সাহিত্যিকও আজ শ্রমজীবী শ্রেণির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে রূপ দিচ্ছেন। পূর্বে বলেছি যে মধ্যবিত্তদের সামনে আজ মাত্র দুটি পথ উন্মুক্ত রয়েছে—একটি নৈতিক অবনতির ভিতর দিয়ে ‘ফিনান্স ক্যাপিটাল’—কে সমর্থন করে ফ্যাসিজম—এর দিকে, আর—একটি ধনিকবাদ ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সংগ্রামমুখী সকলের সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য গণমহড়া গঠনের দিকে। প্রথম পথের যাত্রী হয়েছেন স্পেংলার, ওয়েলস, হাক্সলে প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা; দ্বিতীয় পথের যাত্রী হয়েছেন, আঁদ্রে জিদ, রোলাঁ, ওজাঁফা, স্পেন্ডর, ডে—ল্যুইস প্রমুখ শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা। আরও পরিষ্কার করে বলতে হলে বলা যায় যে বুর্জোয়া শ্রেণির প্রশস্ত পথে স্বচ্ছন্দে চলতে চলতে আজ মধ্যবিত্ত শ্রেণি, শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা তিনটি পথের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছেন—একদিকে প্রাচীন বুর্জোয়ার পথে ফিরতে হবে, অর্থাৎ ফ্যাসিজমকে আলিঙ্গন করতে হবে, একদিকে বেপরোয়া হয়ে একা বিশাল শূন্যতা ও হতাশার পথে আত্মগোপন করতে হবে, আর—একদিকে বহু দূর বিসর্পিত প্রশস্ত সমাজতন্ত্রের পথ, যে—পথে আবার নূতন উদ্যমে, নূতন উৎসাহে অগ্রসর হতে হবে। এ ভিন্ন আর অন্য কোনো পথ নেই।

বুর্জোয়া শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত শিল্পীদের ব্যক্তিগত শ্রেয়োবুদ্ধি, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সম্বন্ধে কিছু না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বুর্জোয়া সভ্যতা আজ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার নাম করে সত্যকার স্বাধীনতাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে—‘‘Bourgeoisdom crucifies liberty upon a cross of gold, and if you ask in whose name it does this, it replies,, ‘In the name of personal freedom.’’* রাসেল, ফর্স্টার, ওয়েলস প্রমুখ ইয়োরোপের বিখ্যাত মনীষীরা অভিযোগ করছেন যে সামাজিক সম্বন্ধই মানুষের পরাধীনতার কারণ, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করে সমাজব্যবস্থা। যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এ—কথার অর্থ এই হয় যে অসামাজিক যারা, অর্থাৎ জঙ্গলের পশুরাই একমাত্র স্বাধীন, কারণ কোনো সামাজিক বন্ধনই তাদের স্বাধীনতার স্বতঃস্ফূর্তিকে বাধা দেয় না। স্বাধীনতার এই সংজ্ঞার প্রধান সমর্থক ছিলেন রুশো—‘‘Man is born free but is everywhere in chains”—এবং স্বাধীনতার সেই স্বপ্নরাজ্য আজও বুর্জোয়া শ্রেণি ও বুর্জোয়ার আওতায় লালিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছাড়তে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতার স্বরূপ কি তা—ই? তা—ই যদি হয় তাহলে যেদিন থেকে সমাজের জন্ম হয়েছে সেদিন থেকে মানুষ পরাধীনতাকে বরণ করে পশুর চাইতেও অধম হয়েছে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু কেমন করে তা স্বীকার করব, মানুষ তো বাস্তবিক তা হয়নি। সমাজ অন্তর্গত মানুষই পশুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে। এই সমাজের প্রধান ধর্ম হল অর্থনৈতিক উৎপাদন। একা মানুষ তার চাহিদা মেটাতে পারে না, সেইজন্য তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সে সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতার মধ্যেই সে স্বাধীনতা লাভ করে। যার সাহায্যে মানুষ বহির্জগৎ সম্বন্ধে সচেতন হয় সেই বিজ্ঞান সেইজন্য সামাজিক। যার দ্বারা মানুষ অনুভূতি সম্বন্ধে সচেতন হয় সেই শিল্পও (Art) সামাজিক। যার দ্বারা মানুষের অনুভূতির সঙ্গে ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহের সঙ্গে বহির্জগতের সামঞ্জস্য স্থাপিত হয়, সেই অর্থনৈতিক উৎপাদনই বিজ্ঞান ও শিল্পের জনপ্রিয়তা। সংঘবদ্ধভাবে এই অর্থনৈতিক উৎপাদনের জন্যই মানুষ স্বাধীন এবং মানুষের সঙ্গে জঙ্গলের পশুর প্রভেদ। কডওয়েল বলেছেন : “Thus freedom of action, freedom to do what we will, the vital part of liberty, is seen to be secured by the social consciousness of necessity, and to be generated in the process of economic production. The price of liberty is not eternal vigilance, but eternal work”.

কর্তব্য ও সুযোগ—সুবিধার ভিত্তির উপর যে সামাজিক সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত ছিল, বুর্জোয়া—বিপ্লব তাকে ধ্বংস করে অর্থের সম্পর্কে পরিণত করল। বুর্জোয়া তার ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য উৎপাদন করে। অতএব তাকে বাজারের জন্য উৎপাদন করতে হয়; ব্যবহারের জন্য নয়, কারণ বাজারের প্রতিযোগিতার মুনাফা মেলে। বুর্জোয়ার সমস্ত কর্তব্য ও দায়িত্বের একমাত্র মাপকাঠি হল টাকা। সমস্ত সামাজিক বন্ধনের, স্নেহের, প্রেমের, প্রীতির মূলগ্রন্থি হল টাকা। সামাজিক সম্পর্কের এই শৈথিল্যের ফলে বুর্জোয়ারা যে—স্বাধীনতা লাভ করল সে হচ্ছে ভুয়ো স্বাধীনতা, পশুর স্বাধীনতা। জঙ্গলে পশু নিজের জন্য পরিশ্রম করে, সংগ্রাম করে, বুর্জোয়ারাও নিজের মুনাফালাভের জন্য সংগ্রামে প্রবৃত্ত হল। কিন্তু জঙ্গলের পশু যে—অর্থে স্বাধীন নয়, সেই মানুষিক অর্থে বুর্জোয়াও স্বাধীন নয়। সূচনা থেকেই বুর্জোয়া স্বাধীনতার ভিত্তি সেইজন্য মিথ্যা ও ভ্রমের উপর প্রতিষ্ঠিত।

সম্পত্তিলাভের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণি সমাজকে দু—ভাগে ভাগ করল। সমাজের মধ্যে একদল হল নিঃস্ব, আর—একদল হল সমস্ত সম্পত্তি ও মূলধনের মালিক। এই নিঃস্বরা যদি বুর্জোয়া স্বাধীনতার সংজ্ঞানুসারে নিজেদের ইচ্ছামতো মালিকদের মূলধন বলপূর্বক ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করত, তাহলে অরাজকতার সৃষ্টি হত। সে—অবস্থায় সমাজ অন্তর্ধান করত, এবং মানুষ সত্যই জঙ্গলের পশু হয়ে যেত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে প্রারম্ভ থেকেই বুর্জোয়া শ্রেণির স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ব্যবহারের ও ঘটনার বিরোধ রয়েছে। প্রথম থেকেই শক্তি প্রয়োগ করে বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। পুলিশ, সৈন্য, আইন প্রভৃতির সাহায্য নিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি নিঃস্বদের স্বাধীনতাবাদীর বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করেছে। এর চাইতে মিথ্যা, ভুয়ো ও ধাপ্পাবাজি আর কী হতে পারে? স্বাধিকারপ্রমত্ত বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীনতার যে নূতন ব্যাখ্যা করল, সঙ্গে সঙ্গে নিঃস্বরা যাতে সেই ‘স্বাধীনতা’র দাবি পেশ না করে তার জন্য প্রয়োজন হল অস্ত্র তৈরির, সৈন্যশিক্ষার, আইন প্রণয়নের। এই হল বুর্জোয়া স্বাধীনতার স্বরূপ। নিজেরই পাতা ফাঁদে নিজে জড়িয়ে পড়ে মিথ্যা স্বাধীনতার ধূমল পরিবেশের মধ্যে বুর্জোয়ার দম বন্ধ হবার উপক্রম হল।

আজ সেইজন্য সত্যই যাঁরা স্বাধীনতার প্রেমিক তাঁরা সমাজতন্ত্রবাদের আবির্ভাবের জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করছেন। কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজে মানুষ অনেক বেশি স্বাধীন হবে, তখন যুদ্ধ থাকবে না, শোষণ, অত্যাচার, প্রতারণা, অর্থনৈতিক সংকট প্রভৃতি থাকবে না। মার্কস সেইজন্য বলেছেন :

The slavery of bourgeois seciety is in appearance the greatest liberty, because it seems to represent the total independence of the individual, who mistake for his own liberty the unrestricted movement, freed from all human shackles, of ‘elements’ alien to his life, such as property, industry, religion, etc. whereas it is a matter rather of his total enslavement and the total loss of his humanity.—The Holy Family

বুর্জোয়া সমাজের যে—স্বাধীনতা সে হচ্ছে দাসত্বেরই ছদ্মবেশ। সমস্ত প্রকার বাধাবিপত্তি ও যোগসূত্র ছিন্ন করে যে—স্বাধীনতা ব্যক্তির অবাধ ও অনিরুদ্ধ মুক্তির মধ্যে আশায় সন্ধান করে, তার প্রকৃত রূপ হচ্ছে পরিপূর্ণ দাসত্ব ও মানুষিক অবনতি। পণ্ডিতমূর্খ ওয়েলস সমাজতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি—স্বাধীনতার খর্বতার বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ জানিয়েছিলেন তখন স্ট্যালিন জবাব দিয়েছিলেন :

…There is not, there ought not to be any antagonism between the interests of the individual and of the collectivity. The two must be reconciled. Only the Socialist society can make room, in the largest measure, for individual interests. Socialist society represents, moreover, the only solid guarantee of the defence of individual’s interest.—Stalin Wells Talk.

সমষ্টি ও ব্যক্তির স্বার্থ পরস্পর—বিরোধী নয়, পরস্পরাপেক্ষিক। দুইয়ের মিলন ঘটবেই। সমাজতান্ত্রিক সমাজেই ব্যক্তিস্বার্থের সিদ্ধি সম্ভব, এবং একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজই ব্যক্তি—স্বাধীনতার আশ্রয়দাতা। এই সত্যকে আধুনিক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা যেদিন উপলব্ধি করবেন সেদিন তাঁদের চলার পথে আপাত প্রতীয়মান প্রতিবন্ধক দূরে সরে যাবে। সেদিন তাঁরা কর্মমুখর ও গতিশীল জীবনের স্পন্দন অনুভব করবেন।

……..

* Dr. Walter Leaf-এর ‘‘Banking” দ্রষ্টব্য।

* Christopher Candwell-এর ‘‘Studies in a Dying Culture” নামক পুস্তকের অষ্টম অধ্যায় (Liberty) পঠিতব্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *