॥ ১১ ॥
ফেলুদার সঙ্গে এতবার এত জায়গায় ঘুরেছি রহস্যের পিছনে পিছনে— সিকিম, লখনৌ, রাজস্থান, সিমলা, বেনারস—কোনওখানেই অ্যাডভেঞ্চারে কমতি পড়েনি; কিন্তু এই কলকাতাতে বসেই এমন একটা রক্ত-হিম-করা রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়তে হবে এটা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।
বিশেষ করে আজকের দিনটা, লালমোহনবাবু যেটার নাম দিয়েছিলেন ব্ল্যাক-লেটার ডে—যদিও সেটাকে আবার পরে বদলিয়ে করলেন ব্লাক-লেটার নাইট। আর পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘ছেলেবেলায় মেজো জ্যাঠা বুঝিয়েছিলেন ওটাকে বলে গোরস্থান, কারণ ওখানে গোরাদের সমাধি আছে। এখন মনে হচ্ছে নামটা হওয়া উচিত গেরোস্থান। এমন গেরোয় এর আগে পড়িচি কখনও তপেশ? তোমার মনে পড়চে?’
সত্যি বলতে কী, অনেক ভেবেও মনে করতে পারিনি।
লালমোহনবাবু এমনিতেই পাংচুয়াল; গাড়ি হবার পর মেজাজটা আরও মিলিটারি হয়ে গেছে। আগে কড়া নাড়তেন, আজ দেখি নক করলেন। আমরা দুজনেই খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে বসেছিলাম। আজ ফেলুদার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও হান্টিং বুট পরতে হয়েছে। আমারটা গত বছর কেনা, ওরটা এগারো বছরের পুরনো। বোধহয় অবস্থাটা খুব ভাল নয় বলে বিকেলে দেখেছিলাম ও নিজেই সুকতলায় কী সব মেরামতের কাজ করছে। এখন একটু খোঁড়াচ্ছে দেখে মনে হল মুচি ডাকিয়ে কাজটা করালেই ভাল হত। এই বিপদের রাতে খোঁড়ালে চলবে কেন?
দরজায় টোকা পড়তেই আমরা উঠে পড়লাম। ফেলুদার কাঁধে খয়েরি রঙের শান্তিনিকেতনি ঝোলা, তার ভিতর থেকে লাল খামের খানিকটা বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। এখানে বলে রাখি, ওরই হুকুমমাফিক আজ আমরা সকলে গাঢ় রঙের পোশাক পরেছি। লালমোহনবাবু পরেছেন একটা কালো টেরিকটের সুট।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘মডার্ন মেডিসিন কোথায় পৌঁছে গেল মশাই!—একটা নতুন নার্ভ-পিল বেরিয়েছে—নামটায় আবার দুটো ‘এক্স’— ভবেন ডাক্তারের সাজেশনে ডিনারের পরে একটা খেয়ে নিলুম—এরই মধ্যে সমস্ত শরীরে বেশ একটা কলপ-দেওয়া ফিলিং হচ্ছে। তপেশ ভাই, যা থাকে কপালে—লড়ে যাব, কী বলো?’ কীসের সঙ্গে লড়বেন সেটা অবিশ্যি উনিও জানেন না, আমিও জানি না।
ফেলুদা আগেই ঠিক করেছিল গাড়িটা গোরস্থানের গেট থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখবে— ‘গাড়ির রংটা আপনার আজকের পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ করলে অতটা চিন্তা করতাম না।’ সেন্ট জেভিয়ার্স ছাড়িয়ে রডন স্ট্রিটের মোড়ের একটু আগেই ও গাড়িটা থামাতে বলল। ‘তোরা এগিয়ে যা’ গাড়ি থেকে নেমে বলল ফেলুদা, ‘আমি হরিপদবাবুকে কয়েকটা ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসছি।’
আমরা এগিয়ে গেলাম। ফেলুদা কী ইনস্ট্রাকশন দিল জানি না, কিন্তু এটা জানি যে হরিপদবাবু এ ক’দিন আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে আর কথাবার্তা শুনে রীতিমতো উৎসাহ পেয়ে গেছেন। এটা ওঁর হাবেভাবে বেশ বোঝা যায়।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফেলুদা ফিরে এল। বলল, ‘আপনার লাক ভাল মিঃ গাঙ্গুলী যে আপনি এমন একটি ড্রাইভার পেয়েছেন। ভদ্রলোককে কাজের দায়িত্ব দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।’
‘কী দায়িত্ব দিলেন মশাই?’
‘এদিকে গণ্ডগোল না হলে কোনও দায়িত্ব নেই, আর হলে ওঁর উপর বেশ খানিকটা ভরসা রাখতে হবে।’
এর বেশি আর ফেলুদা কিছু বলল না।
লোহার ফটকের সামনে পৌঁছে দেখি সেটা খোলা। ফেলুদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করাতে ও ফিসফিস করে উত্তর দিল যে এমনিতে এ সময় খোলা থাকে না। কিন্তু আজ সেটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘পাঁচিলের উপর কাচ বসানো, টপকানো রিসকি, তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু বরমদেও আছেন কি?’
দারোয়ানের ঘরে টিমটিম করে বাতি জ্বলছে, কিন্তু সেখানে কেউ আছে বলে মনে হল না। আমরা ঘরের আশপাশটা ঘুরে দেখলাম। কেউ নেই। পার্ক স্ট্রিট থেকে আসা ফিকে আলোতে দেখতে পাচ্ছি ফেলুদার ভ্রূকুটি। বুঝলাম দারোয়ানের সঙ্গে যা ব্যবস্থা হয়েছিল তাতে ওর থাকবার কথা।
আমরা এগিয়ে গেলাম। আজ আর মাঝখানের সেই পথটা দিয়ে নয়। সেটা দিয়ে কয়েক পা গিয়েই ফেলুদা বাঁয়ে ঘুরল। আমরা সমাধির ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম। বাতাস বইছে বেশ জোরে। আকাশে ফালি ফালি মেঘের স্রোত। তার ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে ফিকে আধা-চাঁদটা উঁকি মেরেই আবার লুকিয়ে পড়ছে। সেই চাঁদের আলোতে ফলকের নামগুলো এই আছে এই নেই। এই আলোতেই বুঝলাম আমরা স্যামুয়েল কাথবার্ট থর্নহিলের সমাধিতে আশ্রয় নিলাম। এটা সরু হয়ে উঠে যাওয়া ওবেলিস্ক নয়। এর নীচে বেদি, বেদির উপর চারিদিকে ঘিরে থাম আর মাথায় গম্বুজ। তিনজন লোকে দিব্যি ঘাপটি মেরে থাকতে পারে। এখানে আলো পৌঁছায় না, তবে সুবিধে এই যে ডান দিকে চাইলে অন্য সমাধির ফাঁক দিয়ে লোহার ফটকের একটা অংশ দেখা যায়।
এ গোরস্থান এখন আমরা ছাড়া কেউ থাকতে পারে না ভেবেই ফেলুদা মুখ খুলল; তবে গলা তুলল না।
‘এটা ছড়িয়ে দিন তো একটু আশেপাশে।’
ফেলুদা ঝোলা থেকে একটা ছিপি-আঁটা বোতল বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
‘ছোছ্—ছড়িয়ে?’
‘কার্বলিক অ্যাসিড। সাপ আসবে না। চারদিকে হাত চারেক দূর অবধি ছিটিয়ে দিলেই হবে।’
লালমোহনবাবু আজ্ঞা পালন করে এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে বললেন, ‘যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। সাপের ভয়টা মশাই নার্ভ-পিলেও যায় না।’
‘ভূতের ভয় গেছে?’
‘টোট্যালি।’
ব্যাঙ ডাকছে। ঝিঁঝি ডাকছে। একটা ঝিঁঝি বোধহয় আমাদের পাশের কবরেই আস্তানা গেড়েছে। চলন্ত মেঘের এক-একটা খণ্ড বোধহয় একটু বেশি ঘন বলেই অন্ধকারটা হঠাৎ-হঠাৎ গাঢ় হয়ে উঠছে। তার ফলে সমাধিগুলো তালগোল পাকিয়ে চোখের সামনে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আবার যেই চাঁদ বেরোচ্ছে অমনি সমাধিগুলোর এক পাশে আলো পড়ে সেগুলো পরস্পর থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে।
ফেলুদা পকেট থেকে চিকলেট বার করে আমাদের দিয়ে নিজে দুটো মুখে পুরল।
গাড়ির শব্দ ক্রমেই কমে আসছে। এক দুই তিন করে সেকেন্ড গুনে হিসাব করে দেখলাম একটানা প্রায় আধ মিনিট ধরে ব্যাঙ ঝিঁঝি আর দমকা হাওয়ায় পাতার সরসর ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
‘মিডনাইট’, চাপা স্বরে লালমোহনবাবু বললেন।
মিডনাইট কেন বললেন? আমি দু মিনিট আগে হাত বাড়িয়ে আমার রিস্টওয়াচে চাঁদের আলো ফেলিয়ে দেখেছি বেজেছে এগারোটা পঁচিশ। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘না, এমনি বলছি। মিডনাইটের একটা বিশেষ ইয়ে আছে তো!’
‘কী ইয়ে?’
‘গোরস্থানে মিডনাইট তো!—তার একটা বিশেষ ইয়ে আছে। কোথায় যেন পড়িচি।’
‘তখনই ভূত বেরোয়?’
লালমোহনবাবু কয়েকবার ‘এক্স’ ‘এক্স’ বলে শেষের বার এক্স-এর ‘স’টাকে সাপের মতো কিছুক্ষণ টেনে রেখে চুপ মেরে গেলেন। আমার পাশে একটা প্রায়-শোনা-যায়-না খচ শব্দ থেকে বুঝলাম ফেলুদা হাতের আড়ালে দেশলাই জ্বালাল। তারপর হাতের আড়ালেই একটা চারমিনার ধরিয়ে হাতের আড়ালেই টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
আকাশে মেঘ বাড়ছে। গাড়ির আওয়াজ হাওয়া। হাওয়ার আওয়াজ হাওয়া। সব সাড়া, সব শব্দ শেষ। কাছের ঝিঁঝি ঠাণ্ডা। আমার শরীর ঠাণ্ডা, গলা শুকনো। ঠোঁট চেটে ঠোঁট ভিজল না।
চী-এর পরে একগাদা ঋ-ফলা দিয়ে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। এক সঙ্গে দুটো থাপ্পড়ের আওয়াজে বুঝলাম লালমোহনবাবু হাত দিয়ে হাইস্পিডে কান ঢাকলেন। ফেলুদা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
একটা গাড়ি থেমেছে। কতদূরে, সেটা এত রাত্রে বোঝা যাবে না। দরজা বন্ধর শব্দ। মন বলছে শব্দটা উত্তরে পার্ক স্ট্রিট থেকে নয়, পশ্চিমের রডন স্ট্রিট থেকে। ওদিকে গেট নেই, পাঁচিল আছে; পাঁচিলের উপর কাচ বসানো।
আমাদের চোখ তবু লোহার গেটের দিকে। লালমোহনবাবু মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন, ফেলুদা আমার কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে ওঁর কাঁধে চাপ দিয়ে থামিয়ে দিল।
কিন্তু কেউ তো আসছে না গেটের দিকে।
হয়তো গাড়ি অন্য কোথাও অন্য কারণে থেমেছে। কত বাড়ি তো রয়েছে চারপাশে। হয়তো কেউ নাইট-শো দেখে ফিরল। আশা করি তাই; তা হলে আর এ-গাড়িটা নিয়ে ভাববার কিছু থাকে না।
ফেলুদা কিন্তু সটান দাঁড়িয়ে আছে, পিছনের দেয়ালের সঙ্গে সেঁধিয়ে। তার সামনেই একটা থাম। চারিদিকে বাদুড়ে অন্ধকার। কেউ দেখতে পাবে না আমাদের।
কিন্তু আমরা তাদের দেখব কী করে? যদি তারা এসে থাকে?
দেখবার দরকার নেই। একটু পরেই সেটা বুঝতে পারলাম। চোখের দরকার নেই। কাজ করবে কান।
ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ…ঝুপ…
মাটি খোঁড়ার শব্দ। কিছুক্ষণ চলল শব্দ। আমরা রুদ্ধশ্বাসে শুনছি।
ঝুপ…ঝুপ…
শব্দ থেমে গেল।
একটা আলো। দূরে দুটো ওবেলিস্কের ফাঁক দিয়ে ঘাসের উপর ক্ষীণ আলো। প্রতিফলিত আলো।
আলোটা স্থির নয়—দুলছে, নড়ছে, খেলছে। টর্চের আলো।
এবার নিভে গেল।
‘পাঁচিল টপকে এসেছে’ দাঁত চিপে মন্তব্য করল ফেলুদা। তারপর বলল, ‘ফলো করব।’ বুঝলাম আবার গাড়ির আওয়াজের অপেক্ষা করছে ফেলুদা।
এক মিনিট।
দু মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট।
‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলল ফেলুদা।
কোনও শব্দ আসছে না আর পার্ক স্ট্রিট থেকে। রডন স্ট্রিট থেকেও না। যে গাড়িটা এসেছিল সেটা থেমেই আছে। তা হলে?
আরও দু মিনিট গেল। আবার মেঘে ফাটল। চাঁদ বেরোল। কেউ কোথাও নেই।
‘ধর এটা—’
ফেলুদা তার ঝোলাটা আমায় দিয়ে ঘাসে নামল। যেদিকে আলোটা দেখেছিলাম সেদিকে এগিয়ে গেল। ভয় নেই—ওর পকেটে কোল্ট ৩২। মন বলছে শিগগিরই তার গর্জনে এই গোরস্থানের জমাট নিস্তব্ধতা খান-খান হতে চলেছে। কিন্তু পা যে খোঁড়া ওর! সামান্য হলেও খোঁড়া। কেন যে সর্দারি করে নিজে জুতো সারাতে গেল জানি না।
কিন্তু কই? কোল্টের গর্জন?
‘ভুল করলেন,’ ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন জটায়ু। ‘তোমার দাদা ভুল করলেন।’
আর যেন কথা না বলেন তাই আমি জিভ দিয়ে সাপের শব্দ করে ওকে থামিয়ে দিলাম। ফেলুদা কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। কী ঘটছে ওই সমাধিস্তম্ভগুলোর মধ্যে কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা শব্দ পাওয়া গেল কি? কানের ভুল নিশ্চয়ই।
মিডনাইট? এটা কোন ঘড়ি? সেন্ট পলস্? হাওয়া ওদিক থেকেই। পশ্চিমে হাওয়া হলে রাত্তিরে আলিপুরের চিড়িয়াখানার সিংহের গর্জন শোনা যায় আমাদের বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে।
ওই যে গাড়ির শব্দ!
দরজা বন্ধ হল। স্টার্ট নিল। তারপর হুস্।
আর বসে থাকা যায় না। ভয় করছে না; শুধু ভাবনা।
উঠে পড়লাম দুজনেই। লালমোহনবাবুর বিড়বিড়ানিতে কান দেব না; সময় নেই।
এগিয়ে গেলাম দ্রুত পায়ে। মেরি এলিসের কবর। কবরের দেয়ালে হাত ঘষে ঘষে এগোচ্ছি। জটায়ু আমার শার্ট খামচে আছেন পিছন থেকে। পায়ের তলায় ঘাস এখনও ভিজে, এখনও ঠাণ্ডা।
জন মার্টিনের কবর। সিনথিয়া কোলেট। ক্যাপ্টেন এভানস। এবার একটা ওবেলিস্ক। কালো ফলকের উপরে—
খচ্—
পায়ের তলায় কী জানি পড়ল। মৃদু শব্দ করে চেপটে গেল। পা সরিয়ে নীচের দিকে চাইলাম। চাঁদের আলো রয়েছে। হাতে তুলে নিলাম জিনিসটা।
চারমিনারের প্যাকেট।
খালি না। অনেক সিগারেট রয়েছে ভিতরে। সব চ্যাপটা। ফেলুদা—
আর কিছু মনে নেই—কেবল মুখের উপর একটা চাপ, আর লালমোহনবাবুর এক চিলতে আর্তনাদ।