১১. নতুন আশার সঞ্চারে

নতুন আশার সঞ্চারে মতির মন আবার মোহে ভরিয়া যায়। চৌকিতে সে সযত্নে বিছানা পাতে; টেবিলে সাজাইয়া রাখে তাহার সামান্য প্রসাধনের উপকরণ; কাপড়-জামা কুচাইয়া গুছাইয়া রাখে আলনায়। টেবিলল্যাম্পে তেল ভরিয়া সন্ধ্যা হইতে-না-হইতেই জ্বালিয়া দেয়। বার বার সলিতাটা বাড়ায় কমায়। কতখানি বাড়াইবে ঠিক করিতে পারে না।

আর বাড়াব? না কমিয়ে দেব? একটু কমিয়েই দি, কী বলো?

কুমুদ হাসিয়া বলে, থাক না, ওই থাক।

জয়াই এবেলা রাধিয়াছে। রাত্রির খাওয়াদাওয়ার পর জয়ার জন্য ঘরে যাইতে মতির আজ প্রথম লজ্জা করিল। জয়া দাঁত মাজিতে মাজিতে বলিল, দাড়িয়ে কেন? ঘরে যাও।

তুমি আগে যাও দিদি।

কার ঘরে যাব, তোর? হাসির চোটে দাঁত মাজা হল না জয়ার। মতি অবাক মানে। কী এমন রসিকতা যে এত হাসি! তারপর মুখ ধুইয়া মতির হাত ধরিয়া জয়া তাহাকে ঘরে লইয়া গেল। বলিল, ঘরে আসতে বউ তোমার লজ্জা পাচ্ছে কুমুদ।

কুমুদ চিত হইয়া বই পড়িতেছিল। বলিল, তাই নিয়ম যে। বসো।

না যাই, ঘুম পেয়েছে, বলিয়া জয়া সেই যে চেয়ারে বসিল আর ওঠে না। বসিয়া বসিয়া গল্প করে কুমুদের সঙ্গে। কী যে সে গল্প আগামাথা কিছুই মতি বুঝিতে পারে না, থাকিয়া থাকিয়া জয়ার মুখ হইতে ইংরেজি শব্দ ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে আঘাত করে। বন্ধু, জয়া কুমুদের বন্ধু। কুমুদ যখন রাজপুত্র প্রবীরের রূপ ধরিয়া গাওদিয়ায় উদয় হয় নাই তখন হইতে বন্ধু। ঈর্ষায় মতির ছোট বুকখানি উদ্বেলিত হইয়া ওঠে। সন্ধ্যার আনন্দের আর চিহ্ন থাকে না।

 

হোটেলে বন্দিজীবন ও কুমুদের বন্ধুদের আড্ডা হইতে মুক্তি পাইয়া মতি এখানে হাপ ছাড়িয়াছে, এখন শুধু গাওদিয়ার জন্য মন কেমন করে। আশায় কচি মেয়েটা বুক বাঁধিয়াছে, স্বপ্ন তো সে কম দেখিত না, সেগুলি যদি সফল হয় এবার। কিন্তু নিজেকে এখানেও সে মিশ খাওয়াইতে পারে না। আজন্মের অভ্যাস ও প্রকৃতি ওখানেও ঘা খাইয়া আহত হয়। গায়ের চেনা রূপ, চেনা মানুষগুলির কথা মনে পড়িয়া মতির চোখ ছলছল করে। কতদিন ওদের সে দেখিতে পায় নাই। সন্ধ্যার সময় পরাণ হয়তো মোক্ষদা ও কুসুমের সঙ্গে তার কথা বলাবলি করে। শশীও হয়তো কোনোদিন আসিয়া বসে। কবে কুমুদ তাহাকে গাওদিয়ায় লাইয়া যাইবে কে জানে!

মতি বলে, এখেনে তো আমরা থির হয়ে বসলাম, এবার দাদাকে একটি পত্র দাও! কত ভাবছে ওরা।

কুমুদ বলে, এর মধ্যে ভুলে গিয়েছ মতি?

কী? কী ভুলে গিয়েছি?

আমায় বলোনি গাওদিয়ার কথা ভুলে যাবে-কোনো সম্পর্ক থাকবে না গাওদিয়ার সঙ্গে? ভালো করে তোমায় আমি বুঝিয়ে দিইনি বিয়ের আগে, আমার সঙ্গে আসতে হলে জন্মের মতো আসতে হবে? চিঠি লেখালেখি চলবে না, তাও বলেছিলাম মতি।

সেই কথা। তালবনের সেই অবুঝ বিহবল ক্ষণের প্রতিজ্ঞা কুমুদ সেকথা মনে রাখিয়াছে মতির বড় ভয়। কুমুদ যা বলিয়াছিল তা-ই সে স্বীকার করিয়াছিল বটে, কিন্তু সে তো তখন বুঝিতে পারে নাই রাজপুত্র প্রবীরের সঙ্গে থাকিলেও গাওদিয়ার জন্য কোনোদিন তাহার মন কেমন করিবে। নতুন জীবন, নতুন জগৎ, পুতুলের মতো কুমুদের হাতে নড়াচড়া–এ কল্পনাতেই তার যে ভাবিবার বুঝিবার শক্তি থাকিত না। কুমুদ কি সেকথা আজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করিবে নাকি?

মতি ক্ষীণস্বরে বলে, সে তো সত্যি নয়।

তাই বুঝি ভেবেছিলে তুমি, তামাশা করছি?

দিন কাটিয়া যায়। জীবনে আর কোনোদিন গাওদিয়ায় যাইতে পাইবে না ভাবিয়া মতির যখন কষ্ট হয় না, কাঁচা মনে তখন কম-বেশি আশা আনন্দের সঞ্চার হয়। শৃঙ্খলার যথেষ্ট অভাব থাকিলেও জীবন এখানে মোটামুটি নিয়মানুবর্তী। আর মাঝে মাঝে কুমুদকে যতই ভয়ানক, নির্মম ও পর মনে হোক, কী একটা আশ্চর্য মন্ত্রে কুমুদ তাহাকে মুগ্ধ করিয়া রাখে। একটু নির্ভর শিখিয়াছে মতি। সে জানে আবোল-তাবোল খরচ করিয়া যত নিঃস্বই কুমুদ হোক, টাকার জন্য কখনও তার আটকায় না। তা ছাড়া চারিদিকে ধার করিয়া রাখিয়া কপদকশূন্য অবস্থাতেই কুমুদ যেন সুস্থ থাকে। টাকা দিতে কামড়ায়; ঘরে টাকা থাকিলে রাত্রে যেন তার ঘুম আসে না। তা ছাড়া, আর একটা ব্যাপার মতি ক্রমে ক্রমে টের পাইয়াছে। তাহাকে ভাঙিয়া গড়িবার কল্পনাটা কুমুদ শুধু মুখেই বলিতে ভালোবাসে, কাজে কিছু করিবার তার উৎসাহ নাই জীবনে আর কিছুই কুমুদ চায় না, যখন যা খেয়াল জাগে সেটা পরিতৃপ্ত করিতে পারলেই সে খুশি। নিয়ম, দায়িত্ব, ভালোমন্দ, উচিত-অনুচিত এগুলি তার কাছে বিষের মতো। কথাসর্বস্বও বটে কুমুদ। সে যখন বড় বড় কথা বলে, সায় দিয়া যাওয়াই যে যথেষ্ট, এটুকু জানিয়াও একদিকে মতি খুব নিশ্চিন্ত হইয়াছে। তবে কুমুদের সেবা করিয়া মতি বড় শ্রান্তিবোধ করে, জ্বালাতন হয়। এক এক সময় তাহার মনে হয় যে, কুমুদের বুঝি সে বউ নয়, দাসী। সিগারেট ধরানো হইতে পা টিপিয়া দেওয়া পর্যন্ত অসংখ্য সেবা করিবে বলিয়া অত ভালোবাসিয়া কুমুদ তাহাকে বিবাহ করিয়াছে। একটু খেলা চায় মতি, নিজের একটু আরাম বিলাস। কুমুদের জ্বালায় তা জুটিবার নয়।

আগ্রহের সঙ্গে মতি জয়া ও বনবিহারীর জীবনযাত্রা লক্ষ করে। জীবনকে ওরা এই ক্ষুদ্র গৃহাংশে আবদ্ধ করিয়াছে, বাহির হইতে কোনোরকম বৈচিত্র্য আহরণের চেষ্টা নাই। সারাদিন ছবি আঁকে বনবিহারী, শুধু ছবি বেচিবার জন্যে বাহিরে যায়, বাকি সময়ে ধরে বন্দি করিয়া রাখে নিজেকে। কখনও সচ্ছলতা আসে, কখনও অভাব দেখা দেয়।

টাকাপয়সা সম্বন্ধে বনবিহারী কুমুদের ঠিক বিপরীত। একটি পয়সা সে কখনও ধার করে না। এ বিষয়ে জয়া আরও কঠোর। দুটি পরিবার এক বাড়িতে বাস করিতেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে আলু-পটলের বিনিময়ও জয়া বরদাপ্ত করিতে পারে না। একদিন জয়াকে বাড়িতে তরকারি দিতে গিয়া মতি যা ঘা খাইয়াছিল, কোনোদিন সে ভুলিবে না।

নষ্ট হবে, ফেলে দেব, তবু নেবে না দিদি?

না রে না। দেওয়া-নেওয়া আমি ভালোবাসি না।

আচ্ছা আচ্ছা, বেশ! আমি যদি কোনোদিন তোমার কাছে একটুকরো লেবু পর্যন্ত নেই—

কে দিচ্ছে তোকে?

রাগ হইলে মতির গ্রাম্যতা প্রকাশ পায়। সে বলিয়াছিল, তোমার বড় ছোট মন দিদি। অহংকারে ফেটে পড়ছ।

জয়া কিছু বলে নাই। একটু হাসিয়াছিল।

মতির রাগকে শুধু নয়, তাহার গ্রাম্যতা ও সংকীর্ণতাকেও জয়া হাসিয়া উপেক্ষা করে। সংকীর্ণতাও মতির এক বিষয়ে নয়। তারা আসিয়া পৌঁছিবার আগেই জয়া যে সুযোগ পাইয়া ভালো ঘরখানা যে দখল করিয়াছিল, মতির মনে সেকথা গাঁথা হয়েই আছে। সোজাসুজি কিছু না বলিলেও নিজের অজ্ঞাতে কতবার সে মনের ভাব প্রকাশ করিয়া ফেলিয়াছে। একই রান্নাঘর তাদের, পাশাপাশি উনান। মতি যেদিন ভালো মাছ-তরকারি রাধে, সেদিন রান্নাঘরের আবহাওয়া হইয়া থাকে সহজ। কিন্তু জয়া সেদিন রান্নার ঘটায় তাহাকে ছাড়াইয়া যায় সেদিন মতির অস্বস্তিও সীমা থাকে না। সে যেন ছোট হইয়া যায়। আড়চেখে আড়চোখে সে জয়ার রান্না তরকারির দিকে তাকায়, মুখখানা কালো হইয়া আসে মতির। বনবিহারী জয়াকে বড় ভালোবাসে, যত নির্বাক ও নেপথ্যে হোক সে ভালোবাসা, মতিরও বুঝিতে বাকি থাকে না। জয়ার কাছে তাই সে অন্ধকারে ইঙ্গিতে কুমুদের অসীম ভালোবাসা প্রমাণ করিতে চাহিয়া হাস্যকর অবস্থার সৃষ্টি করিয়া বসে।

জয়া নীরবে হাসে।

হাসছ যে দিদি?

হাসব না? তুই যে হাসাস।

মতি গম্ভীর হইয়া বলে, অত হাসি ভালো নয়।

জয়ার সঙ্গে খাপ খায় না মতির। মেলামেশা আছে, গল্পগুজব আরছে, প্রতি যেন তবু জমে না। আত্মীয়ার মতো ব্যবহার করিয়াও জয়া যেন অনাত্মীয়া হইয়া থাকে, ছোটবোনটির মতো তাহার প্রতি নির্ভর রাখিয়া মতি সুখ পায় না। মিলিয়া মিশিয়া যে দিনটা ভালোই কাটে, সেদিন সন্ধ্যায় মৃদু ক্ষোভের সঙ্গে মনে হয়, সবই তো আছে, ভালোবাসা কই? আসিবার সময় পথে ট্রেনে একটি বউএর সঙ্গে মতির গলায় গলায় ভাব হইয়াছিল, এও যেন তেমনি পথের পিরিতি। এত ঘনিষ্ঠতায় সমবেদনার আনন্দ কই? টাকাপয়সা এবং আরও কয়েকটি সুবিধার জন্যই কি তারা একত্র বাসা বাঁধিয়াছে, আর কোনো সম্বন্ধ গড়িয়া উঠিবে না তাদের মধ্যে? জয়ার দোষ নাই। কাঁচা মনের উচ্ছসিত আবেগে সে যা চায়, খানিক উচ্ছ্বাসভরা আদর-মমতা, জয়া কেন তা দিতে পারবে? তার শিক্ষাদীক্ষা অন্যরকম। গেঁয়ো বলিয়া অবহেলা সে মতিকে করে না, রাঁধিতে শেখায়, চুল বাঁধিয়া দেয়, সদুপদেশ শোনায়, সাস্তুনা দেয়। ভাবপ্রবণতা জয়ার নাই। মতি তাকে নিষ্ঠুর মনে করে।

তাছাড়া জয়ার মনে একটা গভীর দুঃখ আছে। স্বামীর প্রতিভা তাহার অর্থাভাবে ব্যর্থ হইতে বসিয়াছে। বিবাহ সে করিয়াছিল আর্টিস্টকে, যার ভবিষ্যৎ ছিল ভাস্বর, ঘর সে করিতেছে পটুয়ার। সমবেদনার প্রয়োজন জয়ার নিজেরও কম নয়। অথচ মতি তার এ দুঃখের স্বরূপ বোঝে না। একদিন মতিকে বলিতে গিয়া তাহার বুঝিবার শক্তির অভাবে জয়া আহত হইয়াছে। বিপুল সম্ভাবনাপূর্ব কতবড় একটা জীবন যে ঘরের পাশে পঙ্গু হইয়া আছে, মতির তাহা ধারণা করিবার ক্ষমতা পর্যন্ত নাই জানিয়া মেয়েটার প্রতি একটু বিরূপ হইয়াছে বইকী জয়ার মন!

হাসিয়া উড়াইয়া দিলেও কুমুদ ও তার সম্বন্ধে মতির ঈর্ষা ও সন্দেহটা কিছু কিছু জয়া টের পাই নায় এমন নয়।

বেপরোয়া কুমুদ যে জয়াকে কিছু কিছু ভয় করে, মতি আজকাল তাহা বুঝিতে পারিয়াছে। এখানে সে যে অনেকটা সংযত হইয়া আছে তা জয়ার জন্যই।

এমন বাঁকাভাবে মতি জয়াকে এই কথাটা শোনায় যে জয়া মনে মনে রাগ করে।

কী যে তুই বলিসা কেন, আমাকে ভয় করে চলবে কেন?

তোমাকে যেন সমীহ করে চলে দিদি।

কী করে তুই তা জানলি?

মতি সগর্বে বলে, আমি ওসব জানতে পারি দিদি, যত বোকা ভাবে অত বোকা আমি নই!

জয়া বিরক্তিভাবে বলে, তাই দেখছি।

হোটেলে বনবিহারী অল্পসময়ের জন্য যাইত, তখন তাকে মতির যেরকম মনে হইয়াছিল এখানে দেখিল সে একেবারে অন্যরকম। ভয়ানক ব্যস্ত মানুষ, সময়ের সবসময়েই অভাব। ছবি আকিতে আকিতে শ্রান্তিও কি আসে না লোকটার! তুলিটি হাতে ধরাই আছে। প্রথমে মতির মনে হইয়াছিল সে বুঝি হাসি-তামাশা খুব ভালোবাসে, হোটেলের ঘরে কীভাবেই সে হাসাইত মতিকে এখানে বনবিহারীকে তার মনে হয় একটু ভোঁতা, একটু নিস্তেজ। তার কাছে স্বামীকে জয়া একদিন যেরকম প্রতিভাবান তেজস্ব মানুষ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহিয়াছিল, বনবিহারী সেরকম একেবারেই নয়। বরং তাকে ভীরু বলা যায়। জয়াকে সে যে অন্তত খুব ভয় করে, কুমুদের চেয়ে বেশি, তাতে সন্দেহ নাই। এমন নিরীহ সাধারণ লোকটির সম্বন্ধে জয়ার ওরকম ধারণা কেন মতি বুঝিতে পারে না! খুব বড়ো কিছু করিতে পারিত বনবিহারী, দেশ-বিদেশে নাম ছড়াইত, কেবল দারিদ্র্যের জন্য পারিয়া উঠিল না,-মতির মনে হয় এই আপসোস জয়া তৈরি করিয়াছে নিজে। ছবি আঁকিয়া মানুষ নাকি আবার বড় হয়।

প্রতিভা, আর্ট, শিল্পীর প্রতিষ্ঠালাভ—এসব যে কী পদার্থ, মতির তা জানা নাই, তবু জয়া ও বনবিহারীর সম্পর্কের খাপছাড়া দিকটা সে বেশ উপলব্ধি করিতে পারে। তেজ যা আছে জয়ারই আছে, স্বামীকে সে মনে করে, হইতেপারিত লাটসাহেব! নিজের ক্ষমতার পরিচয় রাখিয়াও জয়ার ভয়ে বনবিহার এতে সায় দিয়া চলে, নিপীড়িত বঞ্চিত সাজিয়া থাকে জয়ার কাছে। গরিব গৃহস্থকে স্ত্রীর কাছে রাজ্যচ্যুত রাজার অভিনয় করিতে হইলে যেমন হয় বনবিহারীরও তেমনি বিপদ হইয়াছে।

জয়া বলিয়াছিল, আমার যদি টাকা থাকত মতি! টাকার জন্যে ওকে যদি ছবি আঁকতে না হত।

টাকার জন্যই তো সবাই সব কাজ করে দিদি, করে না?

বাজে লোকে করে। যারা কবি, আর্টিস্ট, তাদের কি ও তুচ্ছদিকে নজর দিলে চলে?

মতি একটু ভাবিয়া বলিয়াছিল, টাকা জমাও না কেন? হাতে টাকা এলেই যা করে সব খরচ করো, তোমার স্বভাবও ওর মতো দিদি।

জয়া বলিয়াছিল, তুই ওসব বুঝবি না মতি। শিল্পীর মন কত কী চায়, কিছুই যোগাতে পারি না। টাকা থাকলে তবু দুদিন সচ্ছলভাবে চালাই, কোনো খোরাক তো পায় না প্রতিভার।

মতি গিয়া কখনও পিছনে দাঁড়াইয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে বনবিহারীর ছবিআঁকা দ্যাখে। বনবিহারীর ছবিতে গাছপালা, বাড়িঘর, মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ সবই তার কেমন অদ্ভুত মনে হয়। টের পাইয়া বনবিহারী ফিরিয়া তাকায়। তাকায় স্নেহপূর্ণ চোখে। বলে, সময় পেলেই তোমার একখানা ছবি একে দেব খুকি!

ছবি চাই না।–মতি বলে।

কেন রাগ হলে কেন?

খুকি বলতে বারণ করিনি?

বনবিহার হাসে। বলে, যদিন তোমার খুকি না হয়, খুকি ছাড়া তোমাকে কিছুই বলব না বোন, কিচ্ছুটি নয়।

এদিকে মতির চোখে পড়ে জয়া ইশারায় ডাকিতেছে। কাছে গেলে জয়া গম্ভীর মুখে বলে, ছবি আঁকবার সময় ওঁকে বিরক্ত করিস না মতি।

মতি রাগিয়া ভাবে, ওঃ একবার হুকুম শোনো মুটকির!

 

একদিন মতি তাহার হারটি খুঁজিয়া পায় না। শশীর উপহার দেওয়া হার, কী হইল সেটা? আগের দিন কুমুদ দোকানে কিছু টাকা দিয়াছে, বাড়িভাড়ার টাকা দিয়াছে জয়ার হাতে। মতির তা মনে পড়ে, তবু বাক্স-প্যাটরা আনাচ-কানাচ সে পাতি-পাতি করিয়া খোজে। তালপুকুরের ধারে একদিন তার কানের মাকড়ি হারাইয়াছিল, না বলিতে কুমুদ তাহাকে কিনিয়া দিয়াছিল নূতন মাকড়ি। আজ কি সে শশীর উপহার, তার বিবাহের অলংকার, তাকে না বলিয়া আত্মসাৎ করিবে?

হার হারাইয়াছে শুনিয়া জয়া অস্বস্তিবোধ করিতে লাগিল। দুটি গরিব পরিবারের একসঙ্গে বাস করার এই একটা শ্রীহীন দিক আছে। একজনের দামি কিছু হারাইলে অন্যজনের মনে এই চিন্তাটা খচখচ করিয়া বিধিতে থাকে যে, কে জানে কার মনে কী ভাব জাগিয়াছে! এ আর কে না জানে যে দারিদ্র্য সবই সম্ভব করিতে পারে?

খোঁজ মতি, ভালো করে খোঁজ। কলতলায় পড়েনি তো? রান্নাঘরে?

মতি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, গলায় পরিনি,তো, বাস্কয় ছিল! ও আর পাওয়া যাবে না দিদি।

কুমুদ ফিরিলে জয়াই তাহাকে খবরটা দিল। কুমুদ বলিল, হারাবে কেন? আমি বিক্রি করেছি।

সে কী কুমুদ? জয়ার চমক লাগিল।

কুমুদ বলিল, হার থেকে কী হত? টাকাটা কাজে লাগল।

মতি কাঁদিতেছিল। জয়া বলিল, টাকা কাজে লাগে, হার কি কাজে লাগে না কুমুদ?

কুমুদ বলিল, গয়না যে সব মেয়েমানুষের সর্বস্ব আমি তাদের দুচোখে দেখতে পারি না।

জয়া এবার রাগ করিয়া বলিল, মেয়েমানুষ বোলো না কুমুদ, ছেলেমানুষ বলো।

ছেলেমানুষ তো গয়না সম্বন্ধে আরও উদাসীন হবে।

জয়ার রাগ বড় আশ্চর্য। মুখে চোখে দেখা যায় না, কণ্ঠস্বরে ফুটিয়া ওঠে না, তবু টের পাওয়া যায়। সে বলিল, জগৎটা যদি তোমার মনের মতো হত, কী করে তাতে বাস করতাম ভাবি। বাড়িভাড়ার টাকা না হয় পরেই দিতে?

কুমুদ বলিল, তুমি বুঝি ভেবেছ বাড়িভাড়ার টাকা দেবার জন্যই আমি হার বিক্রি করেছি?

অনেকদিন থেকে তোমায় জানি কুমুদ, আমার কাছে হেঁইয়ালি কোরো না। জয়া আর দাঁড়াইল না। সজল চোখে মতি আজ চাহিয়া দেখিল যে জীবনে আজ প্রথম কুমুদের মুখ কালো হইয়া গিয়াছে!

তখন সকাল। সারাদিন মতি মুখভার করিয়া রহিল। কুমুদ তাহাকে একবারও ডাকিল না। বেলা পড়িয়া আসিতে মতির বুক ফুলিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। এ কী অবহেলা কুমুদের? গয়নার জন্য কত কষ্ট হইয়াছে তার মনে, ডাকিয়া দুটি মিষ্টি কথা পর্যন্ত সে তাকে বলিল না হয়তো হারটির জন্য এতটুকু দুঃখও আর তার থাকিত না।

সন্ধ্যার খানিক আগে কুমুদ হঠাৎ ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিল, কলের নিচে মাথাটা পাতিয়া দিয়া মতিকে বলিল, বেড়াতে যাবে তো, কাপড় পরে নাও।

মতি রোয়াকে তার সাধের টেবিলল্যাম্পটি সাফ করিতেছিল, কথা বলিল না। শুধু শেডটা নিচে পড়িয়া ভাঙিয়া গেল।

মাথা মুছিতে মুছিতে কুমুদ আবার বলিল, কাপড় পরে নিতে বললাম যে মতি!

মতি সজলসুরে বলিল, আমি যাব না।

চলো, থিয়েটার দেখাব।

না, বলিয়া মতি ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কিন্তু কুমুদের কাছে তাহার অভিমান টিকিবার নয়। সাজিয়া গুজিয়া কুমুদের সঙ্গে মতিতে থিয়েটারে যাইতেই হইল। সেইখানে, স্টেজে যখন মাতাল যোগেশ ‘সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’ বলিয়া মতির বুকে কান্না ঠেলিয়া তুলিতেছে, কুমুদ তাকে খরবটা জানাইল!

এখানে চাকরি পেয়েছি মতি।

মতি মুখ ফিরাইয়া বলিল, কী বললে?

এই থিয়েটারে চাকরি পেয়েছি। একশো টাকা মাইনে দেবে।

যোগেশের সাজানো বাগানের শোক পলকে মতির কাছে মিথ্যা হইয়া গেল। সে রুদ্ধশ্বাসে বলিল, এখানে তুমি পাট করবে? কবে করবে?

এ নাটকের পরে যে নাটকটা হবে, তাতে।

তারপর আর মতির মনে একটুকু ব্যথা বা আপসোস থাকে না। সব কুমুদের ছল, হোটেলের ঘরে বন্ধুদের আনা, ম্যানেজারকে ঠকানো, জয়ার সঙ্গে মাখামাখি, হার বিক্রি করা, সবু কুমুদ তাকে পরীক্ষা করার জন্য করিয়াছে ওসব খেলা কুমুদের। এতদিন মজা করিতেছিল তাকে লইয়া, এবার কুমুদ তাকে ঘিরিয়া তার কল্পনার স্বর্গটি রচনা করিয়া দিবে। আলোকোজ্জ্বল স্টেজের দিকে চাহিয়া যোগেশকে মতি আর দেখিতে পায় না, দ্যাখে রাজপুত্র প্রবীরের বেশে কুমুদকে। সুখে গর্বে মন ভরিয়া ওঠে মতির। বাড়ি ফিরিয়া জয়াকে খবরটা শোনাইতে মতির তর সয় না। জয়া শুনিয়া বলে, এরকম চাকরি তো নিচ্ছে, আর ছাড়ছে, কমাস টিকে থাকে দ্যাখ। এক কাজ করিস মতি, কুমুদকে লুকিয়ে কিছু কিছু টাকা জমাস।

মনে মনে মতি তা করিতে অস্বীকার করে। লুকাইয়া টাকা জমাইবে না কচু! কী দরকার? টাকার জন্য কুমুদের যে কোনোদিনই আটকাইবে না, এখন হইতে মতির তাহাতে অক্ষুন্ন বিশ্বাস। সাজ খুলিতে খুলিতে উত্তেজনায় মতির চোখ জ্বলজ্বল করে। সে বোধ করে একটা অভূতপূর্ব বেপরোয়া ভাব,-কিসের হিসাব, ভাবনা কিসের? কে তোয়াক্কা রাখে কবে কিসে কী সুবিধা অসুবিধা হইতে পারে? কী প্রভেদ গয়না থাকায় আর না-থাকায়? কুমুদের যেমন তুলনা নাই, কুমুদের মতামতগুলিও তেমনি অতুলনীয়। মজা তারপর যা হয় হইবে। কুমুদের বুকে মতি বাপাইয়া পড়ে। আহ্বাদে গলিয়া গিয়া বলে, ওগো শোনো, নাচগান শেখাবে আমায়, আজ যেমন নাচছিল? ঘরে খিল দিয়ে তোমার সামনে নাচব?

বলে, রোজ থেঠার দেখিও, রোজ। বিকেলে বিকেলে রেধে রেখে চলে যাব, অ্যাঁ?

বলে, বেচে দেবে তো দাও না, সব গয়না, বেচে দাও। ফুর্তি করি টাকাগুলো নিয়ে।

ইশ, কী নেশা দায়িত্বহীনতার, গা-ভাসানোর কী মাদকতা এই তো সেদিন বিবাহ হইয়াছে মতির, গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি, এর মধ্যে কুমুদের রোগটা তার মধ্যে সংক্রমিত হইয়া গেল? তবে, একথা সত্য যে বিবাহ বেশিদিনের না হোক সম্পর্ক কুমুদের সঙ্গে তার অনেকদিনের। তালপুকুরের ধাপে সাপের কামড় খাওয়ার দিন হইতে ভিনদেশী এই কাচপোকা গায়ের তেলাপোকাটিকে সম্মোহন করিয়া আসিতেছে।

কুমুদ খুশি হইয়া বলে, আজ তুমি যে এমন মতি?

মতি বলে,—

বিন্দে শুধায় আজকে তুমি এমন কেন রাই,
অধর কোণে দেখছি হাসি, শ্যাম তো কাছে নাই?

কুমুদ বলে, মানে কী হল?

মতি বলে, বলি গো বলি–

রাই কহিলেন, ওলো বিন্দে, চোখের মাথা খেলি!
ওই চেয়ে দ্যাখ কদমতলে আমরা গলাগলি।

কুমুদ আবার বলিল, মানে কী হল?

মানে? আনন্দের নেশায় এতটুকু গেঁয়ো মেয়ে ছড়া বলিয়াছে, তারও মানে চাই? মানে তো মতি জানে না। অপ্রতিভ হইয়া সে মুখ লুকায়।

দিন পনেরো পরে নূতন নাটক আরম্ভ হইল। পর পর তিন রাত্রি মতি অভিনয় দেখিতে গেল। জয়াকে অনেক সাধ্যসাধনা করিয়াও একদিনের জন্য কুমুদের অভিনয় দেখাইতে সে লইয়া যাইতে পারিল না। কেবল বনবিহারী জয়াকে লুকাইয়া একদিন দেখিয়া আসিল। চুপি চুপি মতির কাছে প্রশংসা করিয়া বলিল যে অ্যাক্ট করার প্রতিভা আছে কুমুদের।

অভিনয় না থাকিলে দুপুরে অথবা সন্ধ্যায় কুমুদ রিহার্সেল দিতে যায়। কুমুদ না থাকিলে রাত্রে জয়া মতির কাছে শোয়। ভোরে মতির ঘুম ভাঙে না। কুমুদ বাড়ি আসিয়া মুখের পেন্ট তুলিতে তুলিতে একবার তাকে ডাকে, তারও অনেক পরে মতি ওঠে। কুমুদকে চা করিয়া দেয় জয়াই। অনেক কিছুই করে জয়া মতির জন্য, তবু অনেক বিষয়ে পর হইয়া থাকে।

এমনই ভাবে দিন কাটিতে লাগিল মতির, ঘরের কাজ করিয়া থিয়েটার বায়স্কোপ দেখিয়া বেপরোয়া ফুর্তি ও গাওদিয়ার জন্য মনোবেদনায়, আর জয়াকে কখনও ঈর্ষা করিয়া কখনও ভালোবাসিয়া। জয়ার কাছে একটু লেখাপড়া শিখিতেও আরম্ভ করিয়াছে। যে নাটকে কুমুদ পার্ট বলে সাতদিনের চেষ্টায় সেখানা মতি পড়িয়াও ফেলিল। মনে আবার আকাশম্পর্শী আশার সঞ্চার হইয়াছে। কত কী কল্পনা করে মতি, গাওদিয়ার সেই পুরানো কল্পনার স্থানে নব নব কল্পনার আবির্ভাব ঘটিয়াছে। তাছাড়া, এতদিনে আবার যেন নূতন করিয়া কুমুদকে সে ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছে। মনে হয়, এই যেন আসল ভালোবাসা; গাওদিয়ার তালবনের ছায়ায় শুধু ছিল খেলা, এতদিনে রোমাঞ্চকর গাঢ় প্রেমের সম্ভাবনা আসিয়াছে। মাঝখানে কী হইয়াছিল মতির? মনটা কি তার অবসন্ন হইয়া গিয়াছিল? কই কুমুদের চুম্বনে এমন অনির্বচনীয় অসহ্য পুলক তো জাগিত না,— যেন কষ্ট হইত, ভালো লাগিত না। বসন্তকালে এবার কি জীবনে প্রথম বসন্ত আসিল মতির? কুমুদ যখন বই পড়ে কাজের ফাঁকে বারবার তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে পাইয়াই কত সুখ হয় মতির; কুমুদ যখন বাহিরে থাকে তখন দেহে মনে অকারণে কী এক অভিনব পুলক প্রবাহ অবিরাম বহিয়া যায় শিথিল অবসন্ন ভঙ্গিতে বসিয়া থাকিতে যেমন ভালো লাগে, তেমনি ভালো লাগে চলা-ফেরা হাত-পা নাড়ার কাজ। বাসন-মাজার মধ্যেও যেন রসের সন্ধান মেলে। এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর সমস্ত দৃশ্যে যেন সুধা ছড়ানো আছে।

জয়া বলে, কী রে, কী হয়েছে তোর? চাউনি যেন কেমন কেমন, থেকে থেকে এলিয়ে পড়িস, গদগদ কথা বলিস,-ব্যাপারখানা কী?

কী হইয়াছে মতি নিজেই কি তা জানে? মুড়ের মতো একটু মাথা নাড়ে। জয়া হাসিয়া বলে, তোকে চৈতে পেয়েছে। কাব্য লেগেছে তোর মতি।

তখন গেঁয়ো মেয়ে মতি জয়াকে কী একটা বুঝাইতে চাহিয়া বলে, মনটা উডু উডু করছে দিদি।

তাকেই চৈতে পাওয়া বলে।

জয়া একটু গম্ভীর হইয়া যায়। একপ্রকার নূতন দৃষ্টিতে সে যেন বিশেষ মনোযোগ সহকারে তাকায় মতির দিকে। মতি একটু অশ্বপ্তি বোধ করিয়া বলে, তোমার ক-বছর বিয়ে হয়েছে দিদি?

দু-বছর।

মোটে? অনেক বয়সে বিয়ে হয়েছে বলো?

তোর তুলনায় অনেক বইকী। চল তো মতি তোর ঘরে যাই, কটা কথা জিজ্ঞেস করব।

কুমুদ কোথায় কী ভাবে মতিকে আবিষ্কার করিয়াছিল সে কথা জানিতে জয়া কখনও কৌতুহল দেখায় নাই। আজ মতিকে খুঁটিয়া খুঁটিয়া অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল। প্রায় সব কথাই। গভীর ও গোপন যেসব কথা কারো কাছে কোনোদিন প্রকাশ করা চলিতে পারে বলিয়া মতি ভাবিতেও পারে নাই। এতকাল পরে হঠাৎ জয়ার সমস্ত জানিবার আগ্রহ দেখিয়া মতি আশ্চর্য হইয়া গেল। সংক্ষেপে, রাখিয়া-ঢাকিয়া যে বলিবে জয়া তাও করিতে দিল না। সত্যের উপরে আরও কিছু বাড়াইয়া বলিলেই সে যেন খুশি হয়।

তারপর জয়া বলিল, তবে তো কুমুদ তোকে সত্যিই ভালোবাসে মতি?

এমন করিয়া একথা বলিবার মানে? কুমুদ তাকে ভালোবাসে না-তাই ভাবিয়াছিল নাকি জয়া? মতি সগর্বে জয়ার দিকে তাকায়। ভুল তো ভাঙিল তোমার, কুমুদের অনেকদিনের বন্ধু? আর মতির সঙ্গে চালাকি করিতে আসিও না।

কুমুদ শেষে তোকে ভালোবাসল মতি? জয়া বলে।

মতি আহত হইয়া জবাব দেয়, বাসবে না তো কী? আমি ওর কত জন্মের বউ তা জানো?

তাও জানিস মতি, জন্মে জন্মে তুই ওর বউ ছিলি? তুই অবাক করেছিস মতি। রূপ গুণ বিদ্যাবুদ্ধি নাচ গান নিয়ে কেউ যাকে বাঁধতে পারেনি তাকে তুই কাবু করলি, একফোঁটা মেয়ে? কম তো নোস তুই!

কে ওকে বাঁধতে পারেনি দিদি? সে কে? চেনো?

চিনি, তোকে বলব না।

বলো না দিদি বলো। পায়ে পড়ি বলো।

জয়া মৃদু বিপন্ন সুরে বলিল, বলে তোকে একটু কষ্ট দিতে সত্যি ইচ্ছা হচ্ছে মতি। তবু বলব না। কী করবি শুনে? তারা সব কে কোথায় ছিটকে পড়েছে, কে কী অবস্থায় আছে, কিছুই ঠিক নেই। তাছাড়া তোর ভয় কী মতি? কেউ আর পারবে না ছিনিয়ে নিতে। ফিরে গিয়েছিল, একবার চলে এসে তোর জন্যে আবার ফিরে গিয়েছিল গাওদিয়ায়!

জয়ার ভাব দেখিয়া মনে মনে বড় ভয় পায় মতি, হঠাৎ কী হইল জয়ার? কুমুদকে যারা বাধিতে পারে নাই জয়াও কী তাদের একজন নাকি? তা যদি হবে তবে তো বড় কষ্ট জয়ার মনে তাকে লইয়া কোন বুদ্ধিতে কুমুদ এখানে জয়ার সঙ্গে একত্রে বাস করিতে আসিয়াছিল? জয়ার জন্য ক্রমে ক্রমে মতির মন মমতায় ভরিয়া যায়। হিংসার চেয়ে সমবেদনাই সে বোধ করে বেশি।

কদিনের মধ্যেই মতি বুঝিতে পারে জয়ার যা হইয়াছে তা সাময়িক নয়। সে যেন স্থায়ীভাবেই মুষড়াইয়া গিয়াছে। কাজে যেন উৎসাহ পায় না, প্রতিভাবান স্বামীর সুখসুবিধা ও আরামের ব্যবস্থা করিতে সবসময় ব্যাকুল হইয়া থাকে না, ভ্ৰকুঞ্চিত করিয়া কী যেন একটা দুর্বোধ্য ব্যাপার বুঝিবার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়। মাঝে মাঝে মতি টের পায় কুমুদ ও তার মধ্যে প্রকাশ্য কথাও ভাবের আদানপ্রদানগুলি জয়া নিবিড় মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করিতেছে। কী আছে জয়ার মনে? এমন তার নজর দেওয়া কেন? ভয়ে মতির বুক টিপটিপ করে।

অবসর সময়ে, কখনও কাজ ফেলিয়াও একটা বড় ক্যানভাসে বনবিহারী তুলি বুলায়। এই ক্যানভাসটিকে জয়া এতদিন গৃহদেবতার মতো যত্ন করিত, সাবধানতার সীমা ছিল না। এটি নাকি বিক্রির জন্য নয়, লোকের ফরমাশি নয়, প্রতিভার ফরমাশে প্রেরণার মুহূর্তগুলিকে বনবিহার এত রঙ দেয়; একদিন দেশবিদেশের একজিবিশনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া এই ছবিটি চিত্রকরকে যশস্ত্রী করবে। অতসব মতি বোঝেনা। সে শুধু জানে সমস্ত ছবির মদ্ধে এই ছবিখানা বিশেষ একটা কিছু শেষ হইয়া গেলেই ছবিখানাকে উপলক্ষ করিয়া বড় বড় ব্যাপার ঘটিতে থাকিবে। দিনের-পর-দিন জয়া ও বনবিহারীকে ছবিখানার বিষয়ে সে আলোচনা শুনিয়াছে। কদিন এ আলোচনাতেও জয়ার যেন প্রবৃত্তি ছিল না। অথচ মাঝে মাঝে ঢাকা তুলিয়া তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সমাপ্ত-প্রায় ছবিখানার দিকে মতি তাহাকে চাহিয়া থাকিতে দেখিয়াছে। জয়ার মত ঈষৎ স্থূলকায়া এক রমণী কঙ্কালসার এক শিশুকে ফেলিয়া ব্যাকুল আগ্রহে এক পলাতক সুন্দর দেবশিশুর দিকে হাত বাড়াইয়া আছে- ছবিখানা এই। কোথায় কী অদ্ভুত আছে ছবিটিতে মতির চোখে তো কখনও পড়ে নাই, তবে সেটা নিজের চোখের অপরাধ বলিয়া জানিয়া লইয়াছে। জয়ার কথা কে অবিশ্বাস করিবে যে এরকম ছবি পৃথিবীতে দু-চারখানার বেশি নাই?

কয়েকদিন পরে সকালবেলা এই ছবিখানাই জয়া ফ্যাসফ্যাস করিয়া ছিড়িয়া ফেলিল।

তেমন কান্ড, জয়ার তেমন মূর্তি, মতি কখনও দ্যাখে নাই। কুমুদ বাড়ি ছিল না, বেলা তখন প্রায় দশটা। মতি রান্না প্রায় শেষ করিয়া আনিয়াছিল। জয়া সকাল হইতে ভয়ানক গম্ভীর হইয়া ছিল, রাত্রে বোধ হয় স্বামীর সঙ্গে তার কলহ হইয়াছে। দু-একটা কথা বলিয়া জবাব না-পাওয়ায় কথা বলিতে মতির আর সাহস হয় নাই। কিছুক্ষণ আগে ভাত চাপাইয়া জয়া রান্নাঘরের বাহিরে গিয়াছিল। হঠাৎ জয়া ও বনবিহারীর মধ্যে তীক্ষ্ণ কথার আদানপ্রদান মতির কানে আসিল! তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া মতি দেখিল, বিশিষ্ট ছবিখানার সামনে তুলি হাতে আরক্ত মুখে বনবিহারী দাঁড়াইয়া আছে। অদূরে জয়া। তার মুখও লাল, সে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।

ফেলে দাও, ফেলে দাও ও-ছবি ছুড়ে। প্রেরণা ছবি আঁকতে জানো না, তোমার আবার প্রেরণা! লজ্জা করে না প্রেরণার কথা বলতে?

জয়ার গলা রুদ্ধ হইয়া আসিল। বনবিহার রাগ চাপিতে চাপিতে বলিল, এতকাল পরে এসব বলছ যে জয়া?

এতদিন অন্ধ হয়ে ছিলাম যে, মুখেই যে তুমি বিশ্বজয় করতে পারো। বড় বড় কথা বলে ভুলিয়েছিলে আমায়–তুমি ঠক জোচ্চোর!

বনবিহারী ভীরু, একথা সহ্য করিবার মতো ভীরু নয়। সে বলিল, তা হতে পারি। এতদিন যদি অন্ধ হয়ে ছিলে, আজ দিব্যদৃষ্টি পেলে কোথায়? কে চোখ খুলে দিল শুনি? কুমুদ নাকি?

তারপরেই জয়ার বঁটিতে ক্যানভাসখানা ফালা হইয়া গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া গেল। জয়া ঘরে ঢুকিয়া বন্ধ করিল দরজা। বঁটিখানা তুলিবার সময় জয়ার বোধ হয় হাত কাটিয়াছিল, কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত রোয়াকে পড়িয়া রহিল।

এসব কী ভীষণ দুর্বোধ্য ব্যাপার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি জয়ার? বাকি রান্না মতি সেদিন রাঁধিতে পারল না। অনেকক্ষণ পরে জয়ার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে ধাক্কা দিয়া সে মৃদুস্বরে জয়াকে ডাকিল। বারকয়েক ডাকাডাকি করিতে ভিতর হইতে জয়া বলিল, যা মতি যা, বিরক্ত করিস না আমাকে।

কুমুদ ফেরা পর্যন্ত মতি চুপ করিয়া ঘরে বসিয়া রহিল। সে বড় বিপন্নবোধ করিতেছিল। এসব জটিল খাপছাড়া ব্যাপার সে বুঝিতে পারে না; স্বামী-স্ত্রীর কলহ খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু এ কোনদেশী কলহ? জয়া যা বলিল, বনবিহারী যা বলিল, কী তার মানে? মতির মনে হইতেছিল এর মধ্যে কোথায় যেন তারও স্থান আছে, একেবারে জয়া ও বনবিহারীর মধ্যেই কলহটা সীমাবদ্ধ নয়। কী করিয়াছে সে, কী দোষ তার? কেহ যদি বলিয়া দিত মতিকে। অনেক বেলায় কুমুদ ফিরিয়া আসিল। ঘরে বসাইয়া চাপাগলায় মতি তাহাকে যতখানি পারে গুছাইয়া সব বলিল।

কুমুদ বলিল, তা হলেই সর্বনাশ মতি।

মতি ব্যাকুলভাবে বলিল, কিসের সর্বনাশ? কী হয়েছে? বলো না বুঝিয়ে আমায়? মাথাটাথা ঘুরতে লেগেছে বাবু আমার।

কুমুদ বলিল, পরে বুঝিয়ে বলল মতি, ভালো করে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না কিছু। কী বিশ্রী গরম পড়েছে দেখছ? বাতাস করো দিকি একটু।

মতি আজ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিল, নতুবা বাতাস করিবার জন্য বলিতে হইত না। ঠাণ্ডা হইয়া কুমুদ স্নান করিতে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর সটান বিছানায় চিত হইয়া আয়োজন করিল ঘুমের। মতি বলিল, দিদিকে ডাকবে না একবার?

এখন? রেগে দরজা দিয়া আছে, কে এখন ওকে ঘাটাতে যাবে বাবা। মারতে আসবে আমাকে। যাও, খেয়ে এসো।

স্নান করিয়া মতি সবে খাইতে বসিয়াছে, জয়া দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। রান্নাঘরে চুকিয়া কলসি হইতে এক গেলাশ জল গড়াইয়া খাইল।

মতি ভয়ে ভলে বলিল, তোমাদের ঝগড়া হল কেন দিদি?

জয়া বলিল, তুই ছেলেমানুষের মতোই থাক না মতি!

তারপর জয়া মতির ঘরে প্রবেশ করিল। মতির আর খাওয়া হইল না। উঠিতে ভয় করে, থালার সামনে থাকাও অসম্ভব। কৌতুহল মতি দমন করিতে পারিল না। উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল।

জয়া বলিতেছিল, কুমুদ, এখানে তোমাদের আর থাকা হবে না। একশো টাকা মাইনে পাও, অন্য কোথাও থাকো গিয়ে, সুবিধামতো বাড়িটাড়ি আজকালের মধ্যেই দেখে নাও একটা।

কুমুদ বিছানায় উঠিয়া বসিয়াছিল, বলিল, বোসো না জয়া। বসে কী হল খুলে বলো সব।

জয়া চেয়ারটাতে বসিল, বলিল, বলাবলিতে লাভ নেই কুমুদ। তোমরা না গেলে, আমরা চলে যাব। কালের মধ্যেই যাব।

কুমুদ শান্তভাবে বলিল, বেশ তো, আমরাই উঠে যাব কাল। সেটা কিছুই কঠিন নয়।কিন্তু কী হয়েছে আমাকে না বললে সে কোনদেশী কথা হবে?

তোমাকে বলতে বাধা নেই কুমুদ না বলে পারবও না। এখনি শুনবে শোনো। বুঝবে কি-না জানি না কুমুদ। তুমি তো জানো আমি ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম? হঠাৎ জানতে পেরেছি তা সত্য নয়।

কিসে তা জানলে?

তোমাদের দেখে কুমুদ। তুমি তো ভালোবাস মতিকে?

কুমুদ মৃদু একটু হাসিয়াই গম্ভীর হইয়া গেল, ঠিক জানি না জয়া। খুব সম্ভব বাসি। আরও কিছুদিন পরে হয়তো সঠিক জানা যাবে।

জয়া বলিল, না, তুমিও ওকে ভালোবাস, ও-ও তোমাকে ভালোবাসে। কদিন আগে। হঠাৎ আমার সন্দেহটা হয়। আগে তো খেয়াল করিনি। তারপর কদিন তোমাদের লক্ষ করে আমি বুঝতে পেরেছি প্রেম সম্বন্ধে এতকাল আমার ধারণাই ভুল ছিল। আমি ওকে ভালোবাসিনি, ওর প্রতিভাকে ভালোবেসেছিলাম। কুমুদ, যেদিন এটা বুঝতে পারলাম সেইদিন কী দেখলাম জানো? ওর প্রতিভাও ভুয়ো-সব আমার কল্পনা।

তোমার ভুলও তো হতে পারে?

জয়ার চোখে জল আসিতেছিল; তার কষ্টের পরিমাণটা সহজেই বোঝা যায়। অল্প একটু সমানে ঝুঁকিয়া সে বলিল, আর সব বিষয়ে মানুষের ভুল হতে পারে কুমুদ, ভুলভাঙার বিষয়ে কখনও ভুল হয় না। লজ্জায় দুঃখে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কী করে এমন ভুল করলাম? এতকাল মিথ্যার মানস-স্বর্গ কী করে বজায় রাখলাম? কী আমার আত্মবিশ্বাস ছিল! মনে হত আমি ভিন্ন জগতে, কেউ আমার মতো ভালোবাসতে পারেনি, আমার ভালোবাসাই সত্যি, আর সকলের ছেলেখেলা। খাঁটি একজন আর্টিস্টের ব্যর্থ জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন গেথে তার প্রতিভাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে দুঃখের তপস্যা করছি ভেবে কত আত্মপ্রসাদ ছিল, সকলের ভোঁতা সাধারণ জীবনের কথা ভেবে মনে মনে কত হেসেছি। আমার তৈরি মিথ্যা আমাকে তাই গুড়ো করে দিল। কী বলো তুমি কুমুদ, মতির কাছে মুখ দেখাতে আমার লজ্জা করছে জানি না তুমি বুঝতে পারছে কি না

বুঝতে পারছি বইকী। তবে কী জানো, তোমার অনুভব করা আর আমার বোঝার। মধ্যে অনেক তফাত। কুমুদ একটু থামিল, এই, একটা কথা বলতে সাহস পাচ্ছি। হেসে উড়িয়ে দিতে পারো না?

জয়া সোজা হইয়া বসিল, তাই কি হয়? যা নিয়ে এতকাল বেঁচে ছিলাম, সব ভেঙে গেল।-চোখের পলকে জয়ার যেন ঝিম ধরিয়া যায়, মৃতের মতো দেখায় তাহাকে। তারপর সে বলিল-এটা খালি বুঝতে পারছি না, এতদিন এমন তেজের সঙ্গে কী করে নিজেকে ভোলালাম। এমন সর্বাঙ্গসুন্দর ভুল মানুষের হয় আমি তো বোকাহাবাও নই কুমুদ!

কুমুদ বলিল, কী জানো জয়া, সবাই নিজেকে ভোলায়। খিদে-তেষ্টা পেলে তা মেটানো, ঘুম পেলে ঘুমানো, এসব ছাড়া জীবনটা আমাদের বানানো, নিজেকে ভোলানোর জন্য ছাড়া বানানের কষ্ট কে স্বীকার করে? বেশিরভাগ মানুষের এটা বুঝবারও ক্ষমতা থাকে না, সারাজীবনে ভুলও কখনও ভাঙে না। বুঝতেই যদি না পারা যায়, ভুল আর তবে কিসের ভুল? কেউ কেউ টের পেয়ে যায়, তাদের হয় কষ্ট। জীবনকে যারা বুঝে, বিশ্লেষণ করে বাঁচতে চায় এইজন্য তারা বড় দুঃখী। বড় যা-কিছু আঁকড়ে ধরতে চায় দেখতে পায় তা-ই ভুয়ো। এইজন্য এই ধরনের লোকের মনে জীবন থেকে বড় কিছু প্রত্যাশা থাকা বড় খারাপ-যতবড় প্রত্যাশা থাকে ততবড় দুঃখ পায়। তুমি জানো আমি চিরদিন কীরকম খেয়ালি, দায়িত্বজ্ঞানহীন, আজ এটা ধরি কাল ওটা ধরি, জীবনটা গুছিয়ে নেবার কোনো চেষ্টা নেই, সংসারের একটুকু কাজে লাগাবার জন্যে মাথাব্যথা নেই। এরকম কেন হলাম কোনোদিন কারুকে বলিনি। অনেকদিন থেকে জানতাম। জীবনে বড়কিছু চাইতে গেলেই আমারও তোমার মতো অবস্থা হত জয়া, অনেককিছু সংগ্রহ করে দেখলাম সব ভুয়ো। তার চেয়ে যখন যা ইচ্ছে হয় তাই চাই। জোর করে কিছু চাই না- যা জোটে তাই গ্রহণ করি, কোনো প্রত্যাশা রাখি না। বড় লাভ হলে তাও অবহেলার সঙ্গে নিই। মতিকে ভালোবাসি বলছিলে, কাল যদি ওর সঙ্গে আমার চিরবিচ্ছেদ হয় দুদিনে সামলে উঠব। মতিকে দিয়ে আমি পা টেপাই জয়া।

পা টেপাও? বেশ করো। অদ্ভুত, খাপছাড়া কিছু না করলে তুমি বাঁচবে কেন? আমি যদি মতি হতাম—

অন্যকিছু করতে,-অদ্ভুত, খাপছাড়া। বাঁচার আনন্দটাই যে খাপছাড়া জয়া, খাপছাড়া কিছু না করলে—

জয়া বলিল, হ্যা। এসব জানি। আর কিন্তু বক্তৃতা দিও না কুমুদ ওবেলা বাড়ি দেখে এসে কাল তোমরা চলে যাও। চোখের সামনে তোমরা ভালবাসবে আমি সইতে পারব না।

চোখের আড়ালেও পারবে না।

সে আলাদা কথা।

বলিয়া জয়া যেন হঠাৎ আশ্চর্য হইয়া গেল।-কী ভাবলে তুমি, কী ভেবে ওকথা বললে? তুমি নিশ্চয় জানো কুমুদ, ওভাবে আমাকে তুমি কোনোদিন টানতে পারেনি? ওরকম আকর্ষণ আমার কাছে তোমার কোনোদিন ছিল না?

কুমুদ একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, তা জানি। সেইরকম ইঙ্গিত করিনি জয়া। আমরা এসে তোমার ঘর ভেঙে দিয়ে গেলাম, তাই বলছিলাম চলে গেলেও আমাদের স্মৃতি তোমার অসহ্য ঠেকবে।

জয়া ক্ষীণভাবে একটু হাসিয়া বলিল, কী চমৎকার তুমি বলতে পারো কুমুদ।-ও মতি আয় ঘরে আয়। শোন যত পারিস, এসব কথা তুই বুঝবি না। আমরা একেলেধরা মানুষ কত হেঁয়ালিই করি।

আবার বাড়ি বদলের হাঙ্গামা? জয়া তাদের এখানে থাকিতে দিবে না? না দিক। ভালোই। নতুন বাড়িতে তারা সুখেই থাকিবে। রাগে মতি মুখ ভার করিয়া থাকে। কিসে কী হইল বেচারি এখনো তা বুঝিতে পারে নাই, কুমুদের ব্যাখ্যা করার পরেও নয়। জয়াকে সে শোনায়, কী অপরাধ করেছিলাম বাবা তোমার কাছে তুমিই জানো, ভালো করলে না দিদি, তাড়িয়ে দিয়ে ভালো করলে না। মনে রাখব। বলব সবাইকে।

কী বলবি?

তুমি কীরকম ভীষণ মানুষ তাই বলব। তোমার মনে এক, মুখে আর। কত ভালোবাসাই দেখাতে! গেল কোথায় সেসব? আমিও শক্ত মেয়ে আছি, নামটি যদি মুখে আনি তো মুখে যেন পোকা পড়ে।

নাম মুখে না আনলে সবাইকে বলবি কী করে?

মতি কাঁদো-কাদো হইয়া যায়। আর কথা বলে না।

বনবিহারী বিকালেই ফিরিয়া আসিয়াছিল, গম্ভীর বিষণ্ণ বনবিহারী। মতি দেখিল সকালবেলার কাণ্ডে ওদের কথাবার্তা বন্ধ হয় নাই। বনবিহারী খাওয়াদাওয়া করিল, জয়াকে কয়েকটা টাকাও দিল। তবে দুজনের মধ্যে যেন অপরিচয়ের ব্যবধান আসিয়াছে, বড় মনমরা দুজনে। মতি বলিল, থিয়েটারে যাবে না আজ? কুমুদ বলিল, না।

পরদিন সকালে গাড়ি ডাকিয়া জিনিসপত্র তোলা হইল। জয়া কেবল একবার বলিল যে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করিয়া গেলে ভালো হইত না? বনবিহারী কিছুই বলিল না। জয়ার কাছে বিদায় না লইয়া মতি গটগট করিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিল। কুমুদের সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে জয়া আসিয়া দাঁড়াইল দরজায়।

কুমুদ বলিল, আবার একদিন দেখা হবে জয়া।

জয়া বলিল, কে জানে হবে কি-না।

খবর নেব নাকি মাঝে মাঝে?

নিও। একা এসো।

মতির মনের গুমরানো আগুন দপ করিয়া জুলিয়া উঠিল। একা এসো কেন, জয়া কি ভাবিয়াছে তার সঙ্গে দেখা করিতে না আসিলে মতির মুখে ভাত ঢুকিবে না? গাড়ি ছাড়িলে সে কুমুদকে বলিল, কখনও আসতে পাররে না তুমি খবর নিতে। ও আমাদের তাড়িয়ে দিলে!

কুমুদ কিছুই বলিল না। মতি আবার বলিল, ও কেমন স্বার্থপর তা প্রথমদিনেই জেনেছি। আমরা আসবার আগে দিব্যি কেমন ভালো ঘরখানা দখল করে বসেছিল।

ওসব তুচ্ছ কথা মনে রেখো না মতি।-কুমুদ বলিল।

এক বাড়ির তিনতলায় দুখানা ঘর কুমুদ ভাড়া করিয়াছিল, আলাদা একটি রান্নাঘরও আছে। একখানার বদলে দুখানা ঘর পাওয়া উন্নতির লক্ষণ, মতি খুশি হইল।

জয়ার জন্য ক-দিন এখানে মতির মন কেমন করিল। কতকগুলি বিষয়ে জয়ার উপরে সে নির্ভর করিতে শিখিয়াছিল। তবে জয়ার কথা বেশি ভাবিবার অবসর মতির ছিল না। পার্থিব বিচার-বিবেচনা, মানুষের সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত, এসব হইয়া গিয়াছে অপ্রধান, কুমুদের কাছে ছাড়া আর সব বিষয়ে সকল দাবিদাওয়া হইয়া গিয়াছে তুচ্ছ।

এদিকে নূতন বাড়িতে আসিয়া কুমুদ আর থিয়েটারে যায় না। শুইয়া বসিয়া বই পড়িয়া সিগারেট টানিয়া দিন কাটায়। মতি একদিন কৈফিয়ত দাবি করিল, থিয়েটারে যাও না যে!

কাজ ছেড়ে দিয়েছি মতি।

কেন?

নাটক চলল না। বললে মাইনে কমিয়ে দেবে, তাই ইস্তফা দিলাম। ব্যাটারা নাটক নেবে যা-তা, না চললে দোষ দেবে অ্যাক্টরের। থিয়েটারের চেয়ে যাত্রা ঢের ভালো মতি।

মতি চোখ বড় বড় করিয়া বলিল, তোমার পাট ভালো হয় না বললে ওরা?

কথাটা তাই দাঁড়ায় বইকী। নাটক যখন চলল না, নিশ্চয় পাট বলার দোষ। নাম-করা অ্যাক্টর তো নই যে দুটো-একটা নাটক না চললেও খাতির করবে। ভালোই হয়েছে মতি, থিয়েটারে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না।

মতি মুখখানা পাকা গিন্নির মতো করিয়া বলিল, এবার কী করবে?

কুমুদ হাসিয়া বলিল, করব, যাহোক কিছু করব! সেজন্য ভাবনা কী? দরকার হলে গয়না দেবে না দু-একটা তোমার?

মতি বলিল, নিয়ো।

অম্লান বদনে বিনাদ্বিধায় মতি একথা বলিল। আমাদের সেই গেঁয়ো মেয়ে মতি, কুমুদ চাকরি ছাড়িয়াছে শুনিয়া সে বিচলিত হইল না, গয়না দিবার কথায় মুখখানা হইল না মান। কিসে এমন পরিবর্তন আসিল মতির? কুমুদ জাদুকর বটে। খেয়ালি যাযাবর কুমুদ, মানুষকে বশ করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। জগতের নীতি রীতি নিয়মকানুন না মানুক, নিজের নিয়মগুলি সে নিষ্ঠার সঙ্গে মানিয়া চলে। তেজস্বিতা কম নয় কুমুদের, দুরন্ত তাহার চিত্তবৃত্তি। নিজের বাঁচিবার জগৎট নিজের শক্তিতে গড়িয়া তোলাও সহজ পৌরুষের কথা নয়। কুমুদের কাছে মনোবেদনা ভোলা যায়, সে ভাবে না, কাদে না, দুঃখ-দুর্দশাকে গ্রাহ্য করে না, হিসাবি সাবধানী মনেরও তার কাছে আরাম জোটে।

দিন যায়। আবির্ভাব ঘটে বর্ষার। ঘরের জানালা দিয়া, রেলিং-দেওয়া সরু বারান্দায় দাঁড়াইয়া শুধু ইটের অরণ্য চোখে পড়ে মতির, তবু তারও মধ্যে সে গাওদিয়ার ছাপ আবিষ্কার করে। দক্ষিণের দোতলা বাড়িটা ডিঙাইয়া কোনো এক বড়লোকের বাগান চোখে পড়ে, সেখানকার পামগাছগুলি যেন ইঙ্গিতে মতিকে গাওদিয়ার তালবনের কথা জানায়। নিচে গলিতে উড়িয়ার মুড়ি-মুড়কির দোকান দেখিয়া মতির মনে পড়ে গাওদিয়ার বিপিন ময়রার দোকালের কথা—গ্রাম্যবেশে অচেনা লোককে পথ দিয়া যাইতে দেখিলে গাওদিয়ার চেনা লোকের কথা মনে পড়ে। এখানকার আকাশে যে চিল বাসিয়া বেড়ায়, তাদেরও গাওদিয়ার আকাশের চিলের মতো দেখায় আকাশে মেঘ ঘনাইয়া বৃষ্টি নামা ও গাওদিয়ার চিরপরিচিত বর্ষার নিখুঁত নকল।

একদিন সত্য সত্যই মতির গহনা লইয়া কুমুদ বেচিয়া আসে। কিছুক্ষণের জন্য মতির যে একটু খারাপ লাগে না তা নয়, প্রথমবারে হারের জন্য যেরকম কান্না আসিয়াছিল সেরকম দুঃখ মতির একেবারেই হয় না। কুমুদ ফিরিয়া আসিতে আসিতে মৃদু অশাস্তিটুকুও তাহার মন হইতে মুছিয়া যায়। আবদার করিয়া বলে, গয়না বেচলে আমার, কী আননে শুনি আমার জন্যে?

কুমুদ বলে, কিছু আনিনি।

তা আনবে কেন, আনবে তো না-ই!

অভিমানে কুমুদের গলা জড়াইয়া ধরে মতি, বুকে মুখ লুকাইয়া ছলনাভরে  মৃদু মৃদু হাসে। বিরাট শহরের কয়েক ফিট উর্ধ্বে এই ছোট শহরের ঘরখানায় অভিনেতা স্বামীর কণ্ঠলগ্ন মতিকে দেখিয়া কেহ চিনিবে না সে গাওদিয়ার সেই মতি। বিপজ্জনক মানুষ কুমুদ, বাঁধন কাটিয়া কাটিয়া তার এতকাল জীবন কাটিল, দায়িত্বজ্ঞানহীন নির্মম মানুষ সে, তারি পরে আজ মতির নিশ্চিন্তনির্ভর দেখিলে চমক লাগে।

তখন কুমুদ বলে, তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি মতি।

কই, দাও।

কুমুদ তাহাকে পকেট হইতে সেই হার বাহির করিয়া দেয়, আজ যে গয়না বেচিতে গিয়াছিল তাও ফেরত দেয়। নাটক করিয়া করিয়া কী নাটকই কুমুদ করিতে শিখিয়াছে। সহজভবে সরলভাবে কোনো কাজ করা কুমুদের কুষ্ঠিতে লেখে না। আহ্বাদে মতির কথা জড়াইয়া যায়। এ তো শুধু গয়না পাওয়া নয়। আরও কত কী কুমুদ এইসঙ্গে তাহাকে দিয়াছে, তাহার অবোধ বালিকা বধূকে।

টাকা পেলে কোথায়?

বড়লোক বন্ধুর কাছে ধার করলাম।

মতি হি-হি করিয়া হাসে, ধার না ছাই, ফেরত যা দেবে তা জানি!

কুমুদও হাসিয়া বলে, তার ঢের টাকা আছে। না দিই না দেব ফেরত, তার কিছু এসে যাবে না তাতে।

অন্য লোক দিয়া বিনোদিনী অপেরার অধিকারীর কাছে কুমুদ একটা খবর পাঠাইয়াছিল। দুদিনের মধ্যে কুমুদের ঘরে তাহার আবির্ভাব ঘটিল। ঘরে ঢুকিয়াই বলিল, আচ্ছা লোক বটে তুমি যা হোক কুমুদ কী বলে অমন করে পালিয়ে গেলে শুনি?-একেবারেই পাত্তা নেই তোমার!

কুমুদ হাসিয়া বলিল, বসুন ঘোষমশায় বসুন। ভালো আছেন? দলটা চলছে কেমন?

খাসা চলছে। তুমি যাবার পর দলের আরও উন্নতি হয়েছে।

কুমুদ বলিল, বেশ বেশ, শুনে বড় সুখী হলাম। বড় রেগেছেন আমার পরে না?

একথার জবাবে কুমুদকেই মধ্যস্থ মানিয়া অধিকারী বলিল, রাগ হয় কিনা তুমিই ভেবে দ্যাথো। আগাম অতগুলো টাকা নিয়ে কোথায় যে পালিয়ে গেলে–

পালাব কেন ঘোষমশাই, পালাইনি। কমাসের ছুটি নিয়েছিলাম, বিয়েটিয়ে করলাম। কি-না। আজকালের মধ্যে একবার যাব ভাবছিলাম আপনার কাছে।

অধিকারী বিস্মিত হইয়া বলিল, বিয়ে করেছ নাকি? বিয়ে তাহলে তুমি করলে? – কথাটা সহজে সে যেন বিশ্বাস করে না। তারপর গম্ভীর হইয়া বলিল, তাই যদি করলে বাপু, আমার মেয়েটাকে করলে না কেন? আমার মেয়ে কী দোষ করেছিল শুনি?

কুমুদ চুপ করিয়া রহিল। অধিকারী খানিকক্ষণ একটু অন্যমনা হইয়া রহিল।

অমন মেয়ে পেতে না কুমুদ। দেখেছ তো বাপু তাকে। বলো তো, তুমিই বলো, ও রকম মেয়ে সহজে মেলে? তাকে তোমার তখন মনে ধরল না! পাগল কী বলে সাধে!

অনেকক্ষণ বসিয়া অধিকারী অনেক কথা বলিল। একটা বোঝাপড়াও হইয়া গেল কুমুদের সঙ্গে। কুমুদ আবার বিনোদিনী অপেরায় যোগ দিবে। আগাম যে টাকাটা লইয়াছিল সেটা বাতিল হইয়া গেল, বিবাহের যৌতুক বলিয়া ধরিয়া নেওয়া গেল সেটা। কুমুদের সঙ্গে তো আর পারা যাইবে না, অধিকারীর সর্বনাশ না করিয়া সে ছাড়িবে কি!

দলটা আবার ভালো করে গড়ে নিতে হবে কিন্তু বাপু তোমায়, শুধু পার্ট বললে চলবে না!

কুমুদ হাসিয়া বলিল, তাই কি চলে? দল ভালো না হলে আমার পার্টও জমবে কেন?

মুখভরা হাসি লাইয়া অধিকারী সেদিন বিদায় হইল।

 

কুমুদ তো আবার যাত্রা করিবে, এদেশে ওদেশে ঘুরিয়া রাজপুত্র প্রবীর সাজিবে। মতির কী হইবে? সে থাকিবে কোথায়? কার কাছে? এ বড় সহজ সমস্যার কথা নয়। কিন্তু মতির কোনো ভাবনাচিন্তা আছে বলিয়া মনে হয় না। আনন্দের যে মাদকতায় সে মশগুল হইয়া আছে, ভাবনাচিস্তার ক্ষমতাও যেন তাহাতে ক্রমেই লোপ পাইয়া আসিয়াছে।

কুমুদ শেষে কথা তুলিল। বলিল, আমি এখন যাত্রা করতে যাব, তুমি কোথায় থাকবে মতি?

মতি ঘাড় কাত করিয়া বলিল, তুমিই বলো না?

গাওদিয়া যাবে?

গাওদিয়া? মতির যেন চমক লাগে। গাওদিয়ার কথা মন হইতে মুছিয়া ফেলিবার আদেশ যে দিয়াছিল, সে আবার যাচিয়া সেখানে যাওয়ার কথা বলিতেছে। কুমুদের চোখে মতি চোখ মেলায়। কী খোজে মতি কুমুদের চোখে? পলকে কুমুদ খোলস বদলায়, আজ যা বলে কাল তা বাতিল করিয়া দেয়, তবু কি তার মধ্যে এমন একটা অপরিবর্তনীয়তা থাকা সম্ভব যার মৌলিকতা মতির মতো মেয়েকেও বিহবল করিয়া দেয়।

গাওদিয়া যেতে বলছ?

তাই থাকো গিয়ে ক মাস। আমি এদিকটা একটু গুছিয়ে নি।

কী গুছাবে?

কুমুদ গম্ভীরভাবে বলে, দলটা গড়ে তুলব, টাকাপয়সা জমাব, সবই তো গুছোতে বাকি।

খুবই সুবিবেচনার কথা। তবু শুনিয়া মতির যেন কষ্ট হয়। এ ধরনের কথা কি মানায় কুমুদের মুখে? তিন মাস আগেও হয়তো কুমুদকে হিসাবি বিবেচক দেখিলে মতি খুশি হইত। এখন আর সে চায় না। তেমনি কুমুদই তার ভালো, যে বড় বড় কথা বলে, কাজের বদলে শুইয়া থাকে, ভালোবাসে তবু পা টেপায়।

কুমুদ বলে, এসে নিয়ে যাবার জন্য তোমার দাদাকে একখানা চিঠি লিখে দাও মতি।

তুমি লেখো না?

না, তুমিই লেখো।

মতি গম্ভীর মুখে বলে, তুমি তবে ঠিকানা লিখে দিও, অ্যাঁ?

মতির এই চিঠির জবাবে পরাণ ও শশী দুজনেই কলিকাতা আসিল। শশীর আগমনটা শুধু মতিকে দেখিবার জন্য, কাজ ছিল। কুমুদকে শশী অনেক কথা বলিবে ভাবিয়াছিল। কিছুই বলা হইল না। মতিকে দেখিয়া সে বাক্যহারা হইয়া গেল। এই মতি কি তার চোখের সামনে বড় হইয়াছিল গাওদিয়ার গ্রাম্য আবহাওয়ায়? এ যেন শশীর অচেনা মেয়ে, অচেনা জগতে এতকাল বাস করিয়া আজ প্রথম তার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ফ্যালফ্যাল করিয়া হাবার মতো যে চাহিয়া থাকিত, জলে-ধোয়া আলোর মতো কী স্লিন্ধোজ্জল তার চাহনি এখন। কী ভারী চলন মতির, কী রমণীয় তার ভঙ্গিমা। মতির অঙ্গুলি-হেলনও আজ যেন মধু, অর্থময়। মনে হয়, তার দেহ-মন অহরহ করে আকর্ষণ ও আহানের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত উদ্যত, উৎকীর্ণ হইয়া আছে।

কুমুদ একান্তে বলিল, কীরকম দেখছিস শশী মতিকে?

ওকে তুই কী করেছিস কুমুদ?

কিছুই করিনি। শুধু কথা বলেছি আর চুপ করে থেকেছি।

বিন্দুরও পরিবর্তন হইয়াছিল, এও পরিবর্তন। শশী ভাবিত হইয়া বলিল, গাওদিয়া পাঠাচ্ছিস, সেখানে থাকতে পারবে কি-না ভাবছি কুমুদ।

এ তোর কীরকম ভাবনা শুনি? গাওদিয়ায় বড় হল, সেখানে গিয়ে থাকতে পারবে না?

বিন্দুও গাওদিয়ায় বড় হইয়াছিল, সেখানে গিয়া থাকিতে পারো নাই। কিন্তু শশী আর কিছু বলিল না। সারাদিন সে বিমনা হইয়া রহিল। মতির চোখে যখন বিদ্যুৎ চমকিয়া যায় কুমুদের চোখের সঙ্গে তখন সে তুলনা করে। এ আলো তাহার চোখে নাই। কুমুদের কাছে আজ আবার নিজেকে শশীর ছোট মনে হইতে থাকে।

মতির সুখে আনন্দে উজ্জ্বল মুখচ্ছবি, মতির পুলকমন্থর গতিশ্ৰী দেখিয়া মাঝখানে কুমুদের সম্বন্ধে যতটুকু অবজ্ঞা মনে আসিয়াছিল সব যেন আজ মুছিয়া যায়। কুমুদের জীবনের যা মূলমন্ত্র তার সন্ধান শশী কখনও পায় নাই, আজ ওই বিষয়েই শশী চিত্তা করে। কী আছে কুমুদের মধ্যে দুর্বোধ্য গোপন সম্পদ, জীবনকে আগাগোড়া ফাকি দেওয়া সত্ত্বেও যাহা জীবনকে তাহার ঐশ্বর্যে ভরিয়া রাখিয়াছে?

এতকাল খবর না-দেওয়ার জন্য পরাণ ও শশীর কাছে মতি প্রথমটা একটু সংকোচ বোধ করিতেছিল, ও বিষয়ে কেহ অনুরোগ না দেওয়ায় অল্পক্ষণের মধ্যেই সে কথাটা ভুলিয়া গেল। পরাণ খুব রোগ হইয়া গিয়াছে, তাহার বিষণ্ণ শুষ্ক মুখ দেখিয়া বড় মমতা হইতে লাগিল। বারবার সে জিজ্ঞাসা করিল কী অসুখ হইয়াছে পরনের। তারপর খুঁটিয়া খুঁটিয়া গ্রামের কথা, মোক্ষদা ও কুসুমের কথাও জানিয়া লইল। একটু সলজ্জ মতি, একটু সাহসী। একজনের বউ হিসাবে দাদা ও শশীর কাছে ধরিতে গেলে এই তার প্রথম দাঁড়ানো, নিজের বাড়িতে নিজের সংসারে বাপের বাড়ির সংবাদ জানিতে একটু গৃহিণীর মতো ভাব দেখানোর অধিকারও তার ন্যায্য। ভাদ্রমাসের গরম, পাখা লইয়া মতি ওদের বাতাস করিল, তৃষ্ণায় যোগাইল শীতল জল। মতির কাজ আজ কত নিখুঁত, কত কোমল তাহার সামান্য সেবা। অনেক যত্ন করিয়া মতি আজ রান্না করিল। খাইতে বসিয়া শশী প্রশংসা করিল রান্নার, পরাণ কিন্তু একরকম কিছু খাইল না। মতি অনুযোগ দিলে বলিল, গলায় একটা ঘা হয়েছে মতি, ঝোল-তরকারি খেতে কষ্ট হয়।

গলায় ঘা হয়েছে? কেন?

মতির ব্যাকুল প্রশ্নে অবাক হইয়া শশী হাসিতে ভুলিয়া গেল। মনে যার ভাবসমুদ্র উথলিতে থাকে, কারো গলায় ঘা হইয়াছে শুনিলে সে-ই শুধু এমন ব্যাকুল হয়। পরাণ অত বোঝে না, সে একটু হাসিয়া বলিল, গলায় ঘা হয় কেন আমি তা জানি? ছোটোবাবু ডাক্তার মানুষ ওঁকে শুধো।

মতি আরো ব্যাকুল হইয়া বলিল, কী দিয়ে তুমি ভাত খাবে? আগে কেন বললে না, তরকারিতে ঝাল কম দিতাম?

ঝাল কম দিলেও তরকারি খেতে পারি না মতি।

তবে দুধ খাও, দই খাও। মিষ্টি আনাই।

এবার পরানের চোখে জল আসিল। সে চাষাভূষা মানুষ, জীবনে কারো কাছে সে এমন মোলায়েম আদর পায় নাই।

পরাণই মতির মনকে গাওদিয়ার দিকে টানিতেছিল বেশি করিয়া। গলায় ঘা হওয়ায় কিছু সে খাইতে পারে না, না-খাইয়াই দাদার এতবড় প্রকান্ড শরীরটা শুকাইয়া গিয়াছে। গাওদিয়া গিয়া এবার দাদার খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করিবে, নিজের সুখসুবিধার সম্বন্ধে এমন উদাসীন পরাণ! কত কাজ কত সেবা সে যে শিখিয়াছে, কীরকম চালাক চতুর হইয়া উঠিয়াছে, সকলকে তাহা দেখাইবার লোভটাও মতির মনে জাগিয়া উঠিতেছিল। সকলে অবাক হইয়া যাইবে। না জানি কী বলিবে কুসুম গায়ের মেয়েরা আসিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করবে, এতকাল সে কোথায় ছিল, কী বৃত্তান্ত।

দুদিন পরে কুমুদকে যাইতে হইবে,-অনেকদূর বিনোদিনী অপেরার আহবান আসিয়াছে। কী পার্ট করিবে কুমুদ? সেই রাজপুত্র প্রবীরের—আহা, মতি আর প্রবীরবেশী কুমুদকে দেখিতে পাইবে না, শুনিতে পাইবে না তার রোমাঞ্চকর বক্তৃতা। ভাবিয়া মুখ স্নান করা ছাড়া আর কী করা যায়? মতি যে মেয়েমানুষ, বে যে মতি আহা, মানুষ যদি পুরুষ, পুরুষেরা হইতে পারিত মেয়ে।

কুমুদ বলে, হচ্ছে মতি, আজকাল তা হচ্ছে।

কুমুদকে সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়া মতি বলে, যাঃ!

কুমুদ হাসে, বলে, কেন, তুমি নিজের চোখেই তো দেখে এসেছ। জয়া ছিল পুরুষ, বনবিহারী ছিল মেয়ে। নয়?

মতি হাসে না।

জয়াদিদিকে দেখতে যাবে না একবার?

যাব যাব, ব্যস্ত কী?

বলিয়া হাই তোলে কুমুদ।

আগামী বিরহের ছায়া ও গাওদিয়া ফিরিবার আগাম আনন্দের আলো দুদিন ধরিয়া মতির মুখখানাকে খেলিয়া বেড়াইল। তারপর আসিল কুমুদের যাওয়ার দিন।

বিকালে গাড়ি। কুমুদের যাওয়ার সময় আগাইয়া আসিলে মতি ভয়ানক উতলা হইয়া উঠিল; এত কষ্ট হইতে লাগিল যে মতি নিজেই সেজন্য আশ্চর্য হইয়া গেল। গাঁ ছাড়িয়া আসিবার সময়ও তাহার মন কাঁদিতেছিল, সে কষ্ট তো এরকম নয়? কষ্টই বা কেন? কী সে হারাইতে বসিয়াছে চিরদিনের জন্য? হয়তো পনেরো দিন, হয়তো একমাস কুমুদকে সে দেখিতে পাইবে না। তাতে কাতর হওয়ার কী আছে? মন তবু বোঝে না মতির। শশী ও কুমুদ গল্প করে, করুণচোখে কুমুদের দিকে চহিয়া মতির বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে থাকে।

শশী একসময় বলিল, চলো। মতি, আমরা স্টেশনে গিয়ে কুমুদকে গাড়িতে তুলে দিই। যাবি?

হ্যাঁ-না মতি কিছু বলিল না। যাওয়ার আগে কাপড় পরিয়া জুতা পায়ে দিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিল। শশী বারবার বিস্মিত চোখে তাহার বিষণ্ণ মুখ, ছলছল চোখের দিকে চাহিতেছিল। এক অপূর্ব ভাবাবেগে সেও উতলা হইয়া উঠিতেছিল। সংসারে হয়তো এমন অনেক আছে, মতির মতো এমন করিয়া ভালো হয়তো অনেকেই বাসে, কিন্তু, মতি ইহা শিখিল কোথায়? অনুভূতির এমন গভীরতা তাহার আসিল কোথা হইতে?

এ যে ভাবপ্রবণতা নয়, কাঁচা মনের অস্থায়ী আবেগ নয়, বালিকা মতির বিরহকাতরতায় এক অপূর্ব ধৈর্যের সমাবেশ দেখিয়া শশী তা বুঝিতে পারিয়াছিল।

স্টেশনে যখন তাহারা পৌঁছিল তখনও আকাশ-ভরা রোদ। গাড়ি ছাড়িতে বিলম্ব ছিল। গাড়িতে ভিড় ছিল না, খানিকক্ষণ কামরার মধ্যে বসিয়া কুমুদের সঙ্গে কথা বলিয়া পরাণকে ডাকিয়া শশী নামিয়া আসিল। বলিল, তোরা বোস, আমরা একটু ঘুরে আসছি।

ওরা চলিয়া গেলে মতি পাংশুমুখে কুমুদকে বলিল, তুমি যেও না। থাকতে পারব না, মরে যাব।

কুমুদ বলিল, স্টেশনে বিদায় দিতে এলে ওরকম মনে হয় মতি।

কাল থেকে এমনি হচ্ছে।

কাল থেকে হচ্ছে। কাল তো কিছু বলেনি? আর হচ্ছে যদি হোক না,–এও তো কম মজা নয়!

মজা? সমস্ত পৃথিবী যে তার চোখে অন্ধকার হইয়া আসিতেছে। কুমুদ কি তা বুঝিতে পারিতেছে না, যে সব বোঝে? কুমুদের নিষ্ঠুরতাকেও ভালোবাসিতে শিখিয়াছিল, তবু আজ সে আহত হইল। পাশের লাইনে একটা যাত্রী-বোঝাই গাড়ি ছাড়িয়া গেল,-মতির মন তাহার চাকার তলে পিষিয়া যাইতেছে। আর সময় নাই, আর উপায় নাই। আর ফেরানো যায় না কুমুদকে। এ গাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার পর বুকটি ফাটিয়া যাইবে, তবু সে তো রদ করিতে পারিতেছে না। কেমন করিয়া কুমুদকে সে তার ব্যাকুলতা বুঝাইবে এখন? যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠিয়া কেউ কী ফেরে?

কুমুদের দুটি পা ধরিয়া সে যে কাঁদিয়া উঠিবে সে উপায়ও নাই। গাড়ির লোকগুলি বোধ হয় হা করিয়া তার দিকেই চাহিয়া আছে।

কুমুদ একথা ওকথা বলে, চিরদিনের মতো ধীর স্থির অবিচল কুমুদ। মতির কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিতে চায়, তবু প্রাণপণে সে কথার জবাব দেয়। মিনিটগুলি একে একে পার হইয়া যাইতে থাকে। গাড়ি ছাড়িবার অল্প আগে ফিরিয়া আসে শশী ও পরাণ। কী কুক্ষণেই ওদের মতি কলিকাতা আসিতে লিখিয়াছিল!

তারপর শশী বলে, চলো মতি, আমরা নামি এবার।

মতি বলে, আপনার নামুন, আমি একটা কথা কয়ে নিয়ে নামছি।

 

মতির এই স্বাভাবিক নির্লজ্জতায় শশী ও পরাণ স্তম্ভিত হইয়া যায়,–শশী যেন একু রাগ করিয়াই গাড়ি হইতে নামে। প্রেম আসিয়াছে বলিয়া এত কী বাড়াবাড়ি অতটুকু মেয়ের!

কুমুদ মৃদুস্বরে হাসিয়া বলে, পাকা গিন্নির মতো করলে যে মতি? কী কথা বলবে?

বলছি দাঁড়াও,—আসছি।

বলিয়া কুমুদকে পর্যন্ত স্তম্ভিত করিয়া দিয়া মতি ল্যাভাটরিতে ঢুকিয়া গেল। গাড়ি ছাড়ার ঘণ্টা পড়িল, গার্ড নিশান দেখাইল, প্ল্যাটফর্মে শশী ও পরাণ অস্থির হইয়া উঠিল, তবু মতি বাহির হইল না। গাড়ি ছাড়িলে গাড়ির সঙ্গে চলিতে চলিতে শশী বলিল, আমরা কেউ উঠব নাকি কুমুদ, পরের স্টপেজে ওকে নামিয়ে নেব?

কুমুদ বারণ করিয়া বলিল, না না, দরকার নেই। আমিই ব্যবস্থা করব শশী।

গাড়ি প্লাটফর্ম পার হইয়া গেলে মতি বাহির হইয়া আসিল। বলিল, এ কী হল? আমি যে নামতে পারলাম না?

কই আর পারলে?

কী হবে তবে?

কুমুদ হাসিয়া বলিল, কিছু হবে না মতি, বোসো। এরকম ছলনা করলে কেন? বললেই হত সঙ্গে যাবে?

মতি বসিয়া বলিল, ওরা ছিল যে, গোলমাল করত।

গাড়ির সমস্ত লোক সকৌতুকে তাহাদের দিকে চাহিয়া ছিল, কারো তা খেয়াল ছিল না। গাড়ির গতি বাড়িতে বাড়িতে মতির মুখের বিবর্ণতা ঘুচিয়া যাইতেছিল। বারকয়েক সে জোরে জোরে নিশ্বাস গ্রহণ করিল।

কুমুদ বলিল, সঙেগ তো চললে, কোথায় থাকবে কী করবে সে সব ভেবে দেখেছ?

কুমুদের মতো বেপরোয়াভাবে মতি বলল, ওর আর ভাবব কী?

গৃহবিমুখ যাযাবর স্বামীর সঙ্গে মতিও আজ এলোমেলো পথের জীবনকে বরণ করিল-আমাদের গেঁয়ো মেয়ে মতি। হয়তো একদিন ওদের প্রেম নীড়ের আশ্রয় খুঁজিবে, হয়তো একদিন ওদের শিশুর প্রয়োজনে নীড় না বাঁধিয়া ওদের চলিবে নাজীবনযাপনের প্রচলিত নিয়মকানুন ওদের পক্ষেও অপরিহার্য হইয়া উঠিবে। আজ সে কথা কিছুই বলা যায় না। পুতুলনাচের ইতিকথায় সে কাহিনী প্রক্ষিপ্ত—ওদের কথা এখানেই শেষ হইল। যদি বলিতে হয় ভিন্ন বই লিখিয়া বলিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *