১১. চার্লস এভেরি

১১.

চার্লস এভেরি তাঁর হতে যাওয়া নতুন সম্পদের তালিকাটা পরীক্ষা করে দেখছেন। রাগে গা জ্বলছে তার। যখন কোনো পুরোনো ও বিরল কোনো গুপ্তধন তিনি নিজের আয়ত্তে আনতে না পারেন, তখন মেজাজ ঠাণ্ডা করেন দেউলিয়া অবস্থার ধারে থাকা কোম্পানিগুলোর খোঁজ নিয়ে। যৎসামান্য বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোম্পানিটা কিনে নিবেন উনি, তারপর একটু একটু করে ধ্বংস করে দিবেন ওটাকে। এবং সাথে সাথে বেশ ভালো অংকের একটা লাভও তুলে আনবেন। অবশ্য এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর বেকার কর্মচারীদের হতাহতের ঘটনাও শোনা যায়। কিন্তু সাফল্য পেতে হলে তো কিছু জীবনকে উৎসর্গ করতেই হয়। এটাই ভাবতে পৃষ্ঠাগুলো উলটে উলটে দেখছেন তিনি। ডেস্কের উল্টোপাশে বসে তার মতামতের অপেক্ষা করছে তার প্রধান অর্থনির্বাহী অফিসার।

সংখ্যাগুলোতে বেশ সন্তুষ্ট এভেরি। ফাইলটা বন্ধ করে বললেন, অন্য কেউ কি এগুলোর ওপর আগ্রহ দেখিয়েছে?

না, স্যার। এখনো না।

কোম্পানির সূচনালগ্ন থেকে মার্টিন এডওয়ার্ডস তার প্রধান অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে। অর্থায়নের ব্যাপারে মার্টিনের ওপর অগাথ বিশ্বাস রয়েছে তার। তোমার কোনো রিকমেন্ডেশন?

 সবকিছু বিবেচনা করলে- কলিন ফিস্ককে রুমের দিকে আসতে দেখে কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলো মার্টিন।

বাধা দেওয়ার জন্য দুঃখিত, মুখে বললেও তার গলার স্বরে দুঃখের ছিটেফোঁটাও নেই, তবে আমার কাছে এমন একটা খবর আছে, যেটা প্রকাশ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারছে না।

ফিস্কের দিকে তাকালেন এভেরি। লোকটার হাবভাব দেখে খবরটা ভালো না খারাপ তা বুঝার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ফিস্কের মুখে কোনো অভিব্যক্তিই নেই। তাই মার্টিনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন, সংখ্যাগুলোই তো তাদের হয়ে কথা বলছে। অবশ্য যদি আমার চোখের আড়ালে কিছু থেকে থাকে, তাহলে আলাদা কথা।

না, স্যার। আমার মত হলো, আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।

তাই করো। আর এখন যদি পারো, আমাদেরকে একটু একা ছেড়ে দাও। ব্যবসাবিষয়ক কিছু কথা আছে আমাদের।

দেরি না করে কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়িই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মার্টিন।

মার্টিন পুরোপুরি চোখের আড়াল হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করচলেন এভেরি। তারপর ফিস্কের দিকে ফিরে বললেন, কাজটা কি সম্পন্ন হয়েছে?

 আমরা বই আর চাবিটা পেয়ে গেছি। রাস্তায় আছে এখন, স্বল্প সময়ের ভিতরেই আপনার হাতে চলে আসবে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন এভেরি। ফলাফলে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। আর ফার্গোরা? তারা কি গল্পটা বিশ্বাস করেছে?

সত্যি বলতে, ঠিক ওভাবে করেনি। তারা আমার লোকদের অনুসরণ করে ওয়্যারহাউজ পর্যন্ত চলে এসেছিলো।

আমাকে জানাও যে তাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পালিয়ে গেছে ওরা। আমার দুজন লোকও তাই করেছে। তবে তারা এখন কোনো বড়ো সমস্যার কারণ হবে না।

চেয়ারের হাতলে খাবলে ধরলেন এভেরি। রাগে কোনো কিছু ভেঙে চুরমার করতে ইচ্ছা করছে তার। ফার্গোরা ইতিমধ্যেই তার যথেষ্ট পরিমাণ সময় ও টাকা নষ্ট করেছে। আমি এই গুপ্তধন শিকারীদের ব্যবস্থা হওয়া দেখতে চাই।

এই মুহূর্তে তারা আমাদের জন্য গোলাপের কাটা ছাড়া আর কিছুই না।

কাটাগুলোর বিষাক্ত হয়ে উঠার ক্ষমতা আছে। যদি পরবর্তীতে আমার কোনো অপারেশনে তাদের ছায়া দেখা যায়, তাহলে সরাসরি মেরে ফেলবে।

বস, ইতিমধ্যেই আমার পরিকল্পনাটা কাজ করতে শুরু করেছে।

 কী রকমের প্ল্যান?

দুই মহিলাকে জড়িয়ে। পিকারিংর মেয়ে এবং ভাতিজি। এতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের জন্য ওরা বেশ উপকারী দিকই ছিলো। যদি সবকিছু প্রত্যাশামতো এগিয়ে যায়, তাহলে হয়তো এক-দুই দিনের ভিতরেই ভালো কোনো সংবাদ শোনার সম্ভাবনা আছে আমাদের।

.

১২.

জেটের কেবিনে একে-অপরের সামনাসামনি অবস্থানে আছে স্যাম ও রেমি। দুইজনই তাদের সঙ্গ উপভোগ করছে। ওক আইল্যান্ডের ইতিহাস এবং বিখ্যাত মানি পিটের ব্যাপারে জানা তথ্যগুলো স্মরণ করে দেখছে রেমি। আর স্যাম ওদিকে চার্লস এভেরির ব্যাপারে সেলমার পাঠানো রিপোর্টটা পড়ে দেখছে।

বেশ কিছুটা পড়ার পর স্যাম রেমির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কেন যেন লোকটাকে পরিচিত লাগছিলো। এখন মনে পড়েছে, নামটা ফোর্বসে পড়েছিলাম। কর্পোরেশন রেইডিংর মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে লোকটা। আর যখন রেইডিংর কোনো কাজ না থাকে, তখন উপকূলীয় অ্যান্টিক সংগ্রহ করে। এই ব্যাপারে লোকটা নিজেকে বেশ দক্ষও ভাবে বটে।

তাহলে আমরা কেন আগে লোকটার ব্যাপারে কিছু শুনিনি।

কারণ আগে কখনো আমাদের পথ ক্রস করেনি। আর লোকটা এখন পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষের ব্যবসা অকেজো করে দিয়েছে, তাতে আশা করছি লোকটার সাথে যেন আমাদের কখনোই কোনো দ্বন্দ্ব না হয়।

 স্যামের কথা শুনে হেসে উঠলো রেমি। ঠিক তখনই ব্রিও এসে উপস্থিত হলো কেবিনে। ঘুমানোর কারণে বেশ তরতাজা দেখাচ্ছে এখন তাকে। কিছুটা ভালো লাগছে এখন? রেমি জিজ্ঞেস করলো।

অনেকটাই।

সাইডবোর্ডে থাকা ডিনার দেখিয়ে স্যাম বলল, খেয়ে নাও তাহলে। সেলমা ওদিকে আগামীকাল বিকালের দিকে তোমার বাসায় ফিরে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

ধন্যবাদ। তারপর টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, ওক আইল্যান্ড? আপনারা নিশ্চিত যে ল্যারেইন এই জায়গার কথাই বলেছিলো?

 এখন পর্যন্ত পাওয়া সমস্ত তথ্য বিবেচনা করার পর এটাকেই একমাত্র যৌক্তিক উপসংহার বলা যায়। আর বইয়ের এন্ডপেপারে যে ম্যাপটা ছিলো সেটার সাথেও ওক আইল্যান্ডের বেশ মিল আছে। আইল্যান্ডের ব্যাপারে কিছু জানো তুমি?

অল্প কিছুটা। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে দুই কিশোর ওখানে খুঁড়ে কিছু পাথর এবং ওক গাছের গুঁড়ি খুঁজে পেয়েছিলো। এরপর থেকেই অবাস্তব গুপ্তধনের আশায় শিকারিদের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে ওখানে।

হ্যাঁ, সতেরোশো পঁচানব্বই সালের কথা ওটা, বলল রেমি। সত্যি বলতে, পাইরেটস অ্যাণ্ড প্রাইভেটিয়ার্সও তখনই এসেছিলো বাজারে।

কাকতালীয় ঘটনা? ব্রি জিজ্ঞেস করলো।

রিপোর্টের কাগজটা থেকে চোখে তুলে তাদের দিকে তাকালো স্যাম। আমার মত জানতে চাও? হ্যাঁ, কাকতালীয় ব্যাপারই। সত্যি বলতে, আমার কখনো মনে হয়নি যে ওক আইল্যান্ডে কোনো গুপ্তসম্পদ আছে। আর বছরের পর বছর ধরে বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের গবেষণার প্রতিবেদনও আমার ধারণার স্বপক্ষেই কথা বলছে।

টেবিল থেকে দ্বীপের ব্যাপারে লেখা কাগজগুলোর একটা হাতে তুলে নিলো ব্রি। বলল, তাহলে এভেরির লোকেরা ওখানে যাচ্ছে কেন? ধরে নিলাম চার্লস এভেরিই রয়েছে এসবের পিছনে।

এগুলো পড়ে যা বুঝলাম, সেলমার পাঠানো কাগজগুলো দেখিয়ে বলছে স্যাম, তাতে আমি নিশ্চিত এসব এভেরিরই কাজ। আর যদি তাদের ওখানে গিয়ে গুপ্তধন খোঁজার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে থাকো-তাহলে বলবো, সবাইই কিন্তু প্রমাণের ওপর বিশ্বাস করে না।

ট্যাবে ডাউনলোড করা পাইরেটস বইয়ের ছবিগুলো থেকে কিছু একটা খুঁজছে স্যাম। এন্ডপেপারের আড়ালে থাকা ম্যাপের ছবিটা খুঁজে বের করে বাড়িয়ে দিলো বির দিকে। তারপর ও আইল্যান্ডের আসল ম্যাপটা দেখিয়ে বলল, আমার মতটা অবশ্য বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করা না। তবে ম্যাপদুটো দেখো। বইয়ের ম্যাপটার সাথে অদ্ভুত মিল রয়েছে ওক আইল্যান্ডের। তারপর স্যামের দিকে ফিরে বলল, এমনকি, তোমাকেও মানতে হবে যে ম্যাপদুটো আসলে দেখতে প্রায় একই রকম।

ম্যাপটার সাথে কিন্তু আটলান্টিকে থাকা অন্যান্য ছোটোখাটো দ্বীপেরও মিল আছে। ঐসময় স্যাটেলাইট ছবি তোলার ব্যবস্থা থাকলে ভালোই হতো।

রেমি অবশ্য এতে ক্ষেপে যায়নি। ওক আইল্যান্ডে পাওয়া ঐ সাইফার স্টোনটার ব্যাপারে কী বলবে যেটায় লেখা ছিলো দ্বীপের মাটির চল্লিশ ফুট গভীরে দুই মিলিয়ন পাউন্ড লুকিয়ে আছে?

 তুমি কি ঐ রহস্যময় পাথরটার কথা বলছে যেটা হুট করেই পিটে পাওয়া গিয়েছিলো? যেটা কেউ কখনো দেখিনি-হুঁট করেই হাজির হয়ে গেলো। ওটার তো মিথ্যা গুজব হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

 ওক আইল্যান্ডের গুপ্তধনের ব্যাপারে স্যামের অনাগ্রহের ব্যাপারটা ভালো করেই জানে রেমি। দেখে হয়তো ওরকমই মনে হবে। তবে যাই হোক, আমাদের কিডন্যাপাররা তো নিশ্চয় কোনো কারণ ছাড়া ঐদিকে যায়নি। তাই আমাদেরও ঐ দ্বীপটার ব্যাপারে সব গল্পই জেনে রাখা উচিৎ। আর এটাও যদি তোমার আগ্রহ বাড়ানোর মতো যথেষ্ট না হয়ে থাকে, তাহলে ওখানে থাকা শিপরেকগুলো হয়তো তা বাড়াতে পারবে। আমরা যেটা খুঁজছি সেটাও হয়তো কপাল ভালো হলে ওখানেই থাকতে পারে।

টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে রেমির দিকে ফিরে বলল, আপনাদের সাহায্য করতে পারলে আমি খুশি হব।

এবং আমরাও তোমার সাহায্য পেলে খুশি হব। স্যাম?

 হ্যাঁ, অবশ্যই। বির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল স্যাম। রেমি ঠিকই বলেছে। আমরা কী ভাবছি সেটা আসলে কোনো বিষয়ই না। তারা যদি ওদিকে গিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই কোনো কারণেই গেছে। আর গত কয়েকদিনে তারা আমাদের যতটা বিপদের মধ্যে ফেলেছে-বিশেষ করে তোমাকে-এরপর আমি এখন শুধু কারণটাই বের করতে চাচ্ছি।

অবশ্য অল্প সময়ের ভিতরেই নোভা স্কশিয়ায় পৌঁছে যাওয়ায় দ্বীপের রহস্যের ব্যাপারে খুব একটা বেশি কিছু জানতে পারলো না ওরা। এটুকুই জেনেছে যে গত কয়েক শতাব্দী ধরে অনেকেই মানি পিট খোঁড়ার কাজে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। তাদের বিশ্বাস মানি পিটের মাটির নিচে নাকি গুপ্তধন লুকানো আছে। রেমি আশা করছে স্বশরীরের দ্বীপে গেলেই হয়তো ওরা আরো বেশি কিছু জানতে পারবে।

পরদিন সকালে হ্যাঁলিফ্যাক্স থেকে ভাড়া করা গাড়িতে করে ম্যাহোন বের পশ্চিমা উপকূলে অবস্থিত ওক আইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করলো স্যাম ও রেমি। ব্রি আসেনি তাদের সাথে। জেট ক্রুদের সাথেই রয়ে গেছে ও। বলেছে, ওখানেই নাকি ও বেশি নিরাপদবোধ করছে।

 সেলমার মাধ্যমে বিখ্যাত মানি পিট টুরের দুটো স্পট রিজার্ভ করে নিয়েছে ওরা। গন্তব্যে পৌঁছুতে বেশিক্ষণ লাগলো না। গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রেমি স্যামকে জিজ্ঞেস করলো, পর্যটকদের ভিড়ে থাকাটা কি ঠিক হবে বলে মনে হয় তোমার?

 রেমির উদ্বেগ বুঝতে পেরে তাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো স্যাম। তারপর নিশ্চয়তা দিয়ে বলল, ব্রি আর ল্যারেইনকে আক্রমণ করা মানুষগুলো কিন্তু চাক্ষুস সাক্ষী না রাখার ব্যাপারে বেশ সতর্ক ছিলো। একটু ভেবে দেখো তুমি। তারা যদি এখন এই ট্যুরে থেকেও থাকে, তাহলেও কিন্তু এত ভিড়ের মধ্যে কিছু করতে পারবে না। যদিও আমার মনে হয় না যে তারা এখানে আসবে। তারপরও যদি আসে, তাহলে এই ভিড়ই আমাদের নিরাপদে রাখবে।

হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। আর জায়গাটায় আসলেই প্রচুর প্রত্যক্ষদর্শীর উপস্থিতি রয়েছে। রেমি জানতে দ্বীপটা বেশ জনপ্রিয়, কিন্তু কখনো ভাবেনি যে দুইঘণ্টা ওয়াকিং টুরের জন্য এতো মানুষ জড়ো হবে। আবহাওয়াটা খুবই চমৎকার। আকাশ পুরোপুরি নীল, মেঘমুক্ত। সাথে বইছে মৃদু বাতাস।

পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চা সবাই জড়ো হয়েছে এখানে। কারো হাক শুনে সবাইই ফিরে তাকালো শব্দের দিকে। হাকটা তাদের টুরিস্ট গাইডের। গাইডের বয়স অল্প, বিশের কোঠায় হবে খুব সম্ভবত। তার ডাক শুনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পর্যটকরা এসে এক জায়গায় জড়ো হতে শুরু করেছে। রেমি আর স্যামও এসে দাঁড়ালো ভিড়ের পিছন থেকে। প্রায় ত্রিশ জনের মতো পর্যটক আছে এখানে। ভিড়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো রেমি। বলল, বেশ ভালোই জনপ্রিয় দেখছি জায়গাটা।

আসলেই। তবে এর মধ্যে পরিচিত কোনো মুখ দেখতে পেয়েছো?

পরিচিত মুখ বলতে এভেরির লোকদের বুঝিয়েছে স্যাম। রেমি এটা ধরতে পেরে বলল, না। আর আমরা আসলে কী খুঁজছি এখানে?

ভালো একটা প্রশ্ন। সময় গড়ালেই হয়তো জানা যাবে।

আগ্রহের ভান ধরে গাইডের কথা শুনছে ওরা। গাইড এখন দ্বীপের ইতিহাসের ইতিবৃত্তান্ত শোনাতে শোনাতে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে থাকা একমাত্র ওক গাছটার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দলটাকে। যদি ইতিহাসের বক্তব্যগুলো সঠিক হয়ে থাকে, গাইড বলছে, পিটে সর্বপ্রথম খুঁড়া ছেলেরা মাটির নিচে কয়েকস্তর বিশিষ্ট বিদেশী পাথর এবং প্রতি দশ ফুট দূরে দূরে বেশ কিছু ওক গাছ আবিষ্কার করেছিলো। প্রায় ত্রিশ ফুট পর্যন্ত খুঁড়ার পর হাল ছেড়ে দিয়েছিলো ওরা। তারপর উনিশ শতকের শুরুর দিকে তাদের একজনের পুনরায় মনে পড়ার আগ পর্যন্ত গর্তটা ওভাবেই পড়েছিলো। এর আগ পর্যন্ত কেউ আর স্পর্শও করেনি। এরপর থেকেই শুরু হলো হাজার হাজার মানুষের টাকা খরচ করে এখানে খুঁড়ার কাজ। ঐ দুই ছেলের কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে ভবিষ্যতে জায়গাটায় খননের জন্য প্রচুর পরিমাণ অর্থের খরচ করবে মানবজাতি। আর খনন করে কী খুঁজছে সবাই? কী রহস্য লুকিয়ে আছে এখানের মাটির নিচে? টেম্পলারদের গুপ্তধন? নাকি ভুলে যাওয়া কোনো যাজকের সমাধিকক্ষ? নাটকীয়ভাবে বলে থেমে গেলোলোকটার। তারপর ধীরে ধীরে বলল, কেউ জানে না তা। তবে ওক আইল্যান্ডের নতুন মালিকেরা সেটা বের করার জন্য বেশ তৎপর হয়েই নেছে। আর আপনারা কী করবেন সেটার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারও আমরা আপনাদের ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি। এখন আপাতত উপভোগ করুন জায়গাটা। আসুন আমার সাথে…।

বলে সবাইকে নিয়ে পিটের ভিতরের দিক বরারব এগিয়ে যাচ্ছে এখন। হাঁটতে হাঁটতে জায়গাটার ব্যাপারে আরো ইতিহাস বলছে গাইড লোকটা। তবে অজানা কোনো ইতিহাস জানা গেলো না গাইডের থেকে। ইন্টারনেট ঘেটে যতটুকু জানা গেছে, গাইডও সেগুলোই বলছে। পিট, চিহ্ন সম্বলিত কিছু পাথর, কেউ বেশি খুঁড়ে ফেললে সুড়ঙ্গের মাধ্যমের গর্তের পানিতে ভরে যাওয়া… সবই আগে থেকে জেনে এসেছে ওরা।

সত্যি বলতে, দুইঘন্টার ভ্রমণটাকে পুরোপুরি সময়ের অপচয় বলে মনে হচ্ছে তাদের। হাঁটতে হাঁটতে এখন বাইরের উপকূলে এসে উপস্থিত হয়েছে পর্যটকের ভিড়টা। এখানেও রহস্যময় চিহ্নসম্বলিত একটা পাথর রয়েছে। মানি পিটের দিকে নির্দেশ করে আছে পাথরের মুখটা। পাথরের উপস্থিতিটা মানি পিটের কিংবদন্তিকে আরো জোরালো একটা মাত্রা দিচ্ছে। ঠিক তখনই স্যাম রেমি বলে উঠলো, শুনেছো?

পানির ওপর থেকে মোটরবোটের জোরালো শব্দ ভেসে আসছে।

ওখান থেকে আসছে, বলে তাদের থেকে পূর্ব দিকে থাকা একটা ছোটো দ্বীপের দিকে নির্দেশ করলো স্যাম। রেমি ওদিকে তাকিয়ে দেখলো একটা মোটরবোটে করে দুইজন পুরুষ দ্বীপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

 ঐ ডাকাতগুলোই কি? জিজ্ঞেস করলো ও। স্যাম ওদিকে বাইনোকুলার দিয়ে তাকিয়ে আছে লোকগুলোর দিকে।

 দেখে তো তাই মনে হচ্ছে, বলে বাইনোকুলারটা রেমির দিকে বাড়িয়ে দিলো স্যাম।

বাইনোকুলারের ফোকাসটা ঠিক করে ওদিকে তাকালো রেমি। দেখলো দ্বীপের দক্ষিণ উপকূলের ধারের পানিতে একটা বোটে ভেসে আছে। বোট থেকে ব্যাকপ্যাক ও কোদাল নিয়ে একজনকে নামতে দেখলো ও। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে কিছু একটা খুঁজছে লোকটা। লোকদুটোকে চিনতে কোনো সমস্যা হলো না তার। আমাদের বই ডাকাত এবং নকল পুলিশদের একজন।

স্পষ্টতই তারা এমন কিছু একটা জানে যেটা আমরা জানি না।

আরো কিছুটা হেঁটে গিয়ে হঠাৎ করেই রেমিকে ভিড় থেকে সরিয়ে আনলো স্যাম। পিটের দিকে না গিয়ে বরং এখন গাছের সারির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে তাকিয়ে আছে অন্য দ্বীপে থাকা লোকদুটোর দিকে।

কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, বলল ও। বড়ো পাথরটার পিছনে খুঁড়ছে এখন।

এক্সকিউজ মি, হঠাৎই কেউ একজন বলে উঠলো তাদের পিছন থেকে। আপনাদের তো এখানে থাকার কথা না।

তাকিয়ে দেখে ট্যুর গাইডদের একজন দাঁড়িয়ে আছে তাদের থেকে কয়েক ফুট দূরে।

দুঃখিত, স্যাম বলল, আমরা বুঝিনি যে…

অন্যদের সাথে জড়ো হওয়া উচিৎ আপনাদের।

গাইডকে অনুসরণ করে আবারো দলটার সাথে এসে একত্রিত হলো ওরা।

স্যাম গাইডের কাছে জানতে চাইলো, ওখানে একটা দ্বীপ দেখলাম। নাম কী ওটার?

গাইড স্যামের নির্দেশ করা দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে বলল, ওটা? ওটা ফ্রগ আইল্যান্ড।

রেমি জানতে চাইলো, ওক আইল্যান্ডের রহস্যের কোনো অংশ ওটা?

 এখানের কোন অংশটা রহস্য না?

 নির্দিষ্ট কোনো রহস্য আছে ওটাকে ঘিরে?

রেমির দিকে ভালো করে তাকালো লোকটা। তারপর বলল, সত্যি বলতে এমন কিছু গুজব চালু আছে। একটা সময় নাকি ফ্রগ আইল্যান্ডের সাথে এক আইল্যান্ডের কানেকশন ছিলো। পানির নিচের কোনো সুড়ঙ্গের মাধ্যমে। যদিও আমি ভেবে পাই না কোনো ধরনের ফ্লাডিং ঘটানো ছাড়াই কিভাবে সম্ভব এটা। হয়তো কেউ গুপ্তধনের আশা খুঁড়ছিলো, আর তখনই নতুন গুজবটা চালু হয়েছে। বলতে বলতে তটরেখার দিকে নির্দেশ করলো লোকটা। বোট দাঁড়িয়ে থাকা ঐ উপসাগরটা দেখতে পাচ্ছেন? গুজব অনুযায়ী ওখানেই নাকি সুড়ঙ্গটা বানানো হয়েছিলো।

 স্যাম ও রেমি তাকালো ওদিকে। দেখলো যে লোকদুটো এখন আবার বোটের কাছে ফিরে গেছে। তাদের ব্যাগ ও কোদালগুলো ছুঁড়ে রাখছে বোটে। আপনার কি এই গুজবটা সত্য বলে মনে হয়? রেমি জানতে চাইলো।

হেসে উঠলো লোকটা। অবশ্যই আশা করি আমি। যদিও মানুষকে টাকা অপচয় করে এখানে খুঁড়াখুঁড়ি করতে দেখে খারাপই লাগে। একই জায়গায় জায়গায় বছরের পর বছর ধরে একই জিনিস খুঁজে যাচ্ছে ওরা। কে জানে হয়তো জিনিসটা এখানে নেইও।

ভালো বলেছেন, বলল রেমি। এরপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তাদের থেকে বিদায় নিয়ে আবারো দলটার সাথে গিয়ে যুক্ত হলো লোকটা। গাইড চলে যেতেই গাছের ফাঁক দিয়ে আবারো দ্বীপটার দিকে তাকালো রেমি। বোটটা চোখের আড়াল হয়ে যেতে শুরু করেছে। দৃশ্যটা দেখে স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, তো, এখন কী?

রাতে আবার আসবো এখানে এবং খুঁজে দেখবো ঐ দ্বীপটাতে তাদের আগ্রহ জাগানোর মতো এমন কী আছে!

.

১৩.

হোটেলে ফিরে রেমির ট্যাবলেটে করে সেলমাকে স্কাইপ করলো স্যাম।

 শুভ সকাল, মি, ফার্গো, তার ডেস্ক থেকে বলল সেলমা। আপনি জেনে হয়তো খুশি হবেন, ব্রি নিরাপদেই তার ফ্লাইটে চড়তে পেরেছে। আর কয়েকঘন্টার মধ্যেই এখানে এসে ল্যান্ড করবে।

চমৎকার, বলল স্যাম।

রেমিও সোফায় স্যামের পাশে বসে বলল, তো, এখন পর্যন্ত কী কী থিউরি আবিষ্কার করেছো তুমি?

 লাযলো বলছে সাইফার হুইলটা নাকি খুবই সহজ একটা সাবস্টিটিউশন কোড।

ঠিক তখনই পর্দায় সেলমার পিছনে দাঁড়ানো লাযলোর মুখটা দেখতে পেলো ওরা। চমৎকার দেখিয়েছেন আপনারা দুইজন, বলল লাযলো, কণ্ঠে কড়া ব্রিটিশ টান মিশে আছে। মিস মার্শাল আমাকে আপনাদের সময়মতো ছুটে আসার ব্যাপারে জানিয়েছে। নিশ্চয় খুব ভয়ঙ্কর ছিলো ঘটনাটা।

হ্যাঁ, ওরকমই বলা যায়, স্যাম বলল। এখন সাইফারটার ব্যাপারে…?

ওহ হ্যাঁ। গুপ্ত ম্যাপটা অনুযায়ী আমার যেটা মনে হয়, আপনারা যে শিপরেকটা খুঁজছেন সেটা দ্বীপের দক্ষিণ দিকে রয়েছে। বলে কয়েকটা কাগজের ভিতর থেকে এন্ডপেপারের পিছনে লুকিয়ে রাখা ম্যাপের ছবিটা তুলে দেখালো। লেখার কিছু অংশের অর্থ বের করেছি আমি, তবে পুরোটা করতে পারিনি। পুরোটা করতে হলে চাবি মানে সূত্রটা লাগবে আমার। দুঃখের বিষয় প্রফেসর ম্যাপে থাকা সাইফার হুইলের যে ড্রয়িংটা খুঁজে পেয়েছে ওটা শুধুই একটা ছবি মাত্র। যতটুক জেনেছি সত্যিকারের একটা সাইফার হুইলের অস্তিত্বও আছে। ধারণা করা হয় জাহাজডুবিতে হারিয়ে গেছে ওটা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললল রেমি। কখনোই সহজ কিছু না, তাই না?

স্যাম জিজ্ঞেস করলো, জাহাজ ডুবার জায়গাটা কি বের করতে পেরেছো?

দ্বীপের ম্যাপ দেখে আমি বের করার চেষ্টা করছি এটা কোথায় পড়ে আছে বা এটা কোথায় ডুবেছিলো। ধরে নিচ্ছি, আমি অর্থটা ঠিকমতোই ধরতে পেরেছি। লেখাটায় একটা শব্দ দুইবার এসেছে, সারপেন্স। ল্যাটিন শব্দ। এটার মানে হতে পারে সাপ, ড্রাগন বা নাগ।

এটার তো কোনো নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে দেওয়ার কথা, স্যাম বলল।

অনেকটাই, বলে সেলমার ট্যাবলেটটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো লায়লো। আরো একটা শব্দও এসেছে, যেটাতে মনে হয়েছে এটা হয়তো দ্বীপের দক্ষিণ বা এর আশেপাশের কোনো অংশে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

কথাটা শুনেই একে অপরের দিকে তাকালো স্যাম ও রেমি। এজন্যেই হয়তো তারা ওখানে খুঁড়াখুঁড়ি করছিলো, বলল রেমি।

কারা? লাযলো জানতে চাইলো।

এভেরি লোকেরা। ওক আইল্যান্ডের পাশের দ্বীপে দেখেছিলাম ওদেরকে। তারপর তারা কী কী দেখেছে সেটা লাযলো ও সেলমাকে ভেঙে বলল রেমি।

আহ, তারা দেখছি সাইফারের অর্থ বের করার দিক দিয়ে আমাদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে আছে। আশা করছি তারা এখনও আসল সাইফার হুইলটা খুঁজে পায়নি। আমি নিশ্চিত কোনো অবস্থান জানি না। তবে তারা যদি ওখানে খুঁড়ে থাকে, অন্ততপক্ষে এটুক নিশ্চিত যে আমরা ঠিক পথেই আছি, লাযলো বলল।

তখন পর্দায় আবার সেলমার মুখ ভেসে উঠলো। বলল, আমরা আরো কিছু জানতে পারলে সাথে সাথেই জানিয়ে দিবো আপনাদের।

রেমি বলল, তোমাদের ওপর সেই বিশ্বাস আছে আমার।

আর এই ফাঁকে, সেলমাকে বলছে স্যাম, আমাদের জন্য একটা মোটরবোটের ব্যবস্থা করে দেও। খুব বড়ো কিছু না, আমরা দুইজন নড়াচড়া করতে পারবো এমন আকৃতির হলেই চলবে।

ওকে, ব্যবস্থা করছি, সেলমা জানালো। আরো কোনো সরঞ্জাম?

আমার মনে হয় না আর কিছু লাগবে, স্যাম বলছে। আমাদের কাছে ওয়েটস্যুট এবং ডাইভ গিয়ার আছে। আমার মনে হয় এটাই জানতে চাইছিলে তুমি।

 বলে স্যাম কলটা কেটে দিতে যাবে, ঠিক তখনই রেমি বলে উঠলো, ইনস্যুরেন্সের কথা ভুলো না।

কথাটা সেলমার ভ্রু কুঁচকে গেছে কিছুটা। ইকুইপমেন্টগুলো আপনারা যেভাবে ব্যবহার করেন, এরপরও কি এটা আর বলা লাগে? সাথে পুরো পরিকল্পনাটাও জানিয়ে দেন, যাতে করে কোনো বিপদ ঘটলে আপনাদের খুঁজে বের করতে পারি।

সেলমার কথা শুনে অপমানিত হওয়ার ভান করে স্যাম বলল, আমাদের ওপর তোমার এতো কম ভরসা জেনে দুঃখ পেলাম।

আপনাদের ওপর না, মি, ফার্গো। আপনারা যেই ধরনের মানুষের সাথে লেগেছেন তাদের ওপর ভরসা নেই। লোভী লোক সবাই। আর লোভই তাদের মনে শয়তানের সৃষ্টি করেছে।

****

সূর্যোদয়ের দুই ঘন্টা পূর্বে ওয়েটস্যুট পরে সতেরো ফুট দৈর্ঘ্যের বোস্টন ওয়ালারে চড়ে বসলো স্যাম ও রেমি। ম্যাহোন বের উত্তর প্রান্তের গোল্ড রিভার ম্যারিনা থেকে ফ্রগ আইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করেছে ওরা। যদিও তাদের যানটা খুব দ্রুতগতির না, তারপরও সূর্যোদয়ের পূর্বেই গন্তব্যে পৌঁছে অন্যান্য বোটদের সাথে মিশে যেতে পারবে।

যদিও ওক আইল্যান্ডের গাইড বলেছিলো যে দুটো দ্বীপের মধ্যে একটা আন্ডারওয়াটার প্যাসেজ আছে, তবে স্যাম বা রেমি কেউই এটা বিশ্বাস করতে পারেনি। সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর কারো ওরকম দক্ষতা ছিলো বলে মনে হয় না ওদের।

তবে এটা ছাড়াও ফ্রগ আইল্যান্ডের প্রতি স্যামের আকর্ষণ জাগার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কারণ রয়েছে। বিগত শতাব্দীগুলোতে নোভা স্কশিয়ার অঞ্চলজুড়ে নাবিকদের বেশ আনাগোনা ছিলো। ফ্রেঞ্চ, ইংরেজদের থেকে শুরু করে জলদস্যুদের সবাই ই চলাফেরা করতো এদিক দিয়ে। গুজব আছে এদিকের কোথাও নাকি গুপ্তধন লুকানো আছে। এজন্যেই ওক আইল্যান্ডটা এদিককার খুবই জনপ্রিয় একটা জায়গা।

কিন্তু ফ্রগ আইল্যান্ড? এখানকার অন্যান্য অসংখ্য ছোটো দ্বীপগুলোর মতো এটাও ব্যক্তি মালিকানার অধীনে রয়েছে। দ্বীপের দক্ষিণ পাশেই একটা বোসর বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খুব সম্ভবত কারো ভ্যাকেশন হাউজ ওটা। স্যাম আশা করছে, এখন হয়তো ঐ বাড়িটায় কেউ নেই। যদিও তারা ওখানে বেশিক্ষণ অবস্থান করবে না, তারপরও অন্য কারো উপস্থিতি না থাকলেই ভালো।

 বোটটা দ্বীপের একদম দক্ষিণ কোণ ঘেষে থাকা উপসাগরটার দিকে দিক ঘুরিয়ে নিলো স্যাম। এভেরির লোকদের দেখা জায়গাটা ভালো করে দেখতে চাচ্ছে ওরা। লোকগুলো ওখানে কী করছিলো তা হয়তো যে কেউই আন্দাজ করতে পারবে, কিন্তু তারা যেভাবে খুঁড়ছিলো তাতে স্যামের সন্দেহ তারা আসলেই লাযলোর বলা সাইফার হুইলটা খুঁজছিলো কিনা।

 দেখো, আকাশের দিকে নির্দেশ করে বলল রেমি। আবোরা বোরাইলিস।

ওপরে তাকালো স্যাম। যদিও আকাশটা ছাড়া ছাড়া মেঘে ঢেকে আছে, তারপরও একটা ক্ষীণ সবুজাভ আভা দেখা যাচ্ছে আকাশে। ধীরে ধীরে স্পন্দিত হচ্ছে আভাটা। কপাল খারাপ যে আকাশটা পরিষ্কার না।

নাই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভালো। এই মুহূর্তে মেঘটা আমাদের ভালোই উপকারে দিবে। চাঁদের আলোয় কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই আপাতত।

 যুক্তি আছে তোমার কথায়। উপসাগরের কাছে পৌঁছেই বোটের গতি কমিয়ে দিলো স্যাম।

আরেকটু কাছে পৌঁছে উপকূলের ধারের দিকে আলো ফেললো রেমি। দেখে মনে হচ্ছে ওরা এই জায়গাটাতেই খুঁড়াখুঁড়ি করছিলো। ঐ হার্ট-শেপড় পাথরটার কথা মনে আছে আমার।

ওটা হার্ট? পানির ধারে থাকা প্রকাণ্ড পাথরটার দিকে তাকিয়ে বলল স্যাম। গ্রুটলের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছে। বোটটা এখন ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে এগুচ্ছে শুধু। ওটাকে দেখতে তো দুই কুঁজওয়ালা উটের পিঠের মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে।

তোমার রোমান্সের কোনো সেন্সই নেই, ফার্গো।

যদি বলি আরোরা বোরাইলিসটা আমি তোমার জন্য অর্ডার করে এনেছি?

দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার লাইন হারিয়ে ফেলেছে।

আমার তো মনে হয় এটা বেশ ভালো একটা লাইন।

আরে তোমাকে বলিনি। দেখো একটা ফিশিং লাইন। কেউ তার মাছধরা বঁড়শি ফেলে গেছে। বলে স্যামকে দেখানোর জন্য পাথরের গোড়ায় আলো ফেলল রেমি।

কিন্তু কিছু পাথর ও ঢেউয়ের আছড়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না স্যাম। কই?

 ঐ হার্ট… মানে উটের কুঁজের মতো পাথরটা থেকে এক ফুট দূরে। গোড়ার বাম দিকে দেখো। হালকা শেওলা বা এমন কিছু লেগে আছে ওটার সাথে।

এবার দেখতে পেয়েছে স্যাম। পানির ধারা থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে একটা নাইলনের সুতোতে হালকা শেওলা বা অন্য কোনো সামুদ্রিক উদ্ভিদের অংশ লেগে আছে। সুতোটা খুব সম্ভবত পাথরটার আড়ালের কোনো কিছুতে বেঁধে রাখা হয়েছে। আলো পড়ায় চকচক করছে সুতোটা। সুতোটা অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকালো স্যাম। বাম দিকে গিয়ে গায়েব হয়ে গেছে ওটা। ডানে তাকালো, এদিকেও একই অবস্থা।

 সুতোটা নিশ্চিতভাবেই শক্ত কিছুতে বেঁধে রাখা হয়েছে। স্রোতের প্রভাবে তাদের বোটটা দোল খেলেও, সুতোটা একদম স্থির হয়ে আছে।

পাগল বা প্যারানয়েড যাই বলো আমাকে, বলতে বলতে ভালো করে দেখার জন্য বোটটা পাথরের একপাশে সরিয়ে নিচ্ছে স্যাম, আবার বেশি কাছে যেন চলে না যায় সেদিকেও সতর্ক রয়েছে, ওটাকে দেখে আমার ট্রিপওয়্যার জাতীয় কিছুই মনে হচ্ছে।

তোমার কি মনে হয় তারা কোনো বোমা পেতে রেখেছে?

নিশ্চিতভাবেই কাজটা করার মতো যথেষ্ট সময় পেয়েছে ওরা। তবে এর থেকেও বড়ো প্রশ্ন হলো, তারা কি জানতো যে আমরা এখানে এসে খোঁজার চেষ্টা করবো? নাহলে এরকমটা করার কারণ কী?

তোমার ধারণা তারা আমাদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে? বলে আলোটা বড়ো পাথর এবং এর পিছনে পড়ে থাকা ছোটো ছোটো পাথরের স্তূপটার ওপর তাক করে ধরলো রেমি।

স্যাম দেখতে পেলো নাইলনের সুতোর মতো তারটা পাথরের স্তূপের মধ্যে গিয়ে গায়েব হয়ে গেছে।

 আমরা আসলেই গাধা, হঠাৎ বলে উঠলো রেমি। অবশ্যই তারা ফাঁদ পেতে রেখেছে। নাহলে এমনটা করবে কেন? তাদের বোটের ইঞ্জিনের শব্দটা প্রচুর জোরালো ছিলো। আমরা যেন শব্দটা শুনে তাদেরকে দেখতে পারি, তাই এমনটা করেছিলো। তারা জানতোই যে আমরা এখানে খুঁজতে আসবো…

 তোমার আলো আর কতোটা দূরে যেতে পারবে? আলোকরশ্মিটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্যাম।

উপসাগরের বাম দিকে আলোটা সরিয়ে নিলো রেমি। একটা মরা দেবদারু গাছ পড়ে আছে পানিতে। দূর থেকেও গাছের শাখা প্রশাখায় পেঁচিয়ে রাখা তারটা হালকা হালকা দেখতে পাচ্ছে ওরা। যতদূর মনে পড়ে তাদেরকে ওদিকটায় একবার যেতে দেখেছিলাম আমি।

পাথরটাকে ডান দিক থেকে পাশ কাটিয়ে বোটটা দক্ষিণ দিকে ঘুরিয়ে নিলো স্যাম। নাইলনের সুতোর মতো তারটা গাছ পেরিয়ে তীরের কাছে থাকা পানি পর্যন্ত চলে গেছে। এর মানে হলো কেউ যদি তীরের কাছে ঘেষার চেষ্টা করে, তাহলেই…আমাদের তদন্ত বাদ দেওয়া উচিৎ এখন। ফিরে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো দরকার। দক্ষরাই বোমাগুলো সামলাক।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, বলে লাইটটা বন্ধ করে দিলো রেমি।

বোটটা ঘুরিয়ে নিলো স্যাম। উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবার এগিয়ে যাচ্ছে। ওক আইল্যান্ডের উত্তর প্রান্তের কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো, অন্য একটা যান এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

স্যাম…।

আমিও দেখতে পাচ্ছি, বলে থ্রটল টেনে দক্ষিণ দিকে ঘুরাতেই দেখালো ওক আইল্যান্ডের দক্ষিণ দিক থেকেও দ্বিতীয় আরেকটা নৌযান ধেয়ে আসছে তাদের দিকে।

কী করবে বুঝতে না পেরে মানি পিটের কেন্দ্রে জ্বলতে থাকা উজ্জ্বল আলোটার দিকে তাকালো স্যাম। তারপর ফিরে তাকালে দুই পাশ থেকে ধেয়ে আসতে থাকা বোটদুটোর দিকে। বুঝতে পারছে না মানিপিটের দিকেই যাত্রা করবে কিনা।

অবশ্য অটোমেটিক অস্ত্রের মাজলের ঝলকানি দেখেই দুঃশ্চিন্তাটা তার মাথা থেকে দূর হয়ে গেছে।

সময়মতো মানিপিটে গিয়ে পৌঁছুতে পারবে না তারা। অন্তত এই আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগুনো সম্ভব না। আর তাছাড়া এই ফিশিং বোটের গতিও তাদেরকে সময়মতো পৌঁছে দেওয়ার মতো যথেষ্ট না।

শক্ত করে বোটের ধার আঁকড়ে ধরে রেখেছে রেমি। এই মুহূর্তে আশা করছি তুমি কোনো চমৎকার ও কার্যকরী প্ল্যানের কথা বলবে আমাকে।

স্যরি।

না, আমি এটা শুনতে চাইনি।

 বোটদুটোকে আরেকবার দেখে ফগ আইল্যান্ডের দিকে ফিরে তাকালো স্যাম। বুঝতে পারছে যে শত্রুরা তাদেরকে ধাওয়া করে বোমাগুলোর দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। আচ্ছা, এটাই হবে তাহলে, মনে মনে বলে বোটটা ফ্রগ আইল্যান্ডের দিকে ঘুরিয়ে নিল স্যাম।

রেমি, বোটের হুকটা নিয়ে আসো, স্টেয়ারিং হুইল ঘুরাতে ঘুরাতে বলল স্যাম। বড়ো পাথরটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।

স্যাম

আমি বোটটা সরাসরি ঐ ট্রিপওয়্যারের দিকেই নিয়ে যাচ্ছি।

পানির চাপ

যদি পানিতে সুতোটার সাথে কোনো বোমা বেঁধে রাখা থাকে, তাহলে পানিতে চাপ পড়লেই মরতে হবে তাদেরকে। এই ক্ষেত্রে অবশ্য স্যাম আশা করছে বোমাটা পানিতে নেই। বড়ো পাথরে আড়ালে রয়েছে বোমাটা, যেহেতু সুতোর লাইনটা ওখান পর্যন্ত গিয়েই গায়েব হয়ে গেছে। একটা ঝুঁকি! যদিও জায়গাটাতে একের অধিক বোমা থাকারও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে আছে কিনা সেটা জানার উপায় একটাই। এমন না যে এগুলো নিয়ে সে রেমিকে জিজ্ঞেস করবে। তাদের যদি মরতেই হয়, তাহলে সেটা অজানা থাকলেই বেশি ভালো। তোমার কি মনে হয় মরা গাছটা পর্যন্ত পৌঁছার আগ পর্যন্ত তুমি শ্বাস আটকে রাখতে পারবে?

গাছটার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো রেমি।

হুক দিয়ে বোটের স্টেয়ারিং হুইলটা আটকে দিলো স্যাম, যাতে করে বোটের গতিপথ পরিবর্তিত না হয়।

আচ্ছা, তাহলে প্রস্তুত হও লাফ দেওয়ার জন্য।

.

১৪.

ধেয়ে আসতে থাকা বোর্টগুলোর দিকে একবার তাকালো স্যাম। বন্দুকের মাজলের আরো আলোক ঝলকানো দেখা যাচ্ছে। সে আশা করছে এগিয়ে আসা লোকগুলো হয়তো তাদেরকে বোটের পাশ দিয়ে নেমে যেতে দেখবে না। রেডি?

রেডি।

তারপর বোটের ধার পেরিয়ে টুপ করে পানিতে নেমে পড়লো দুইজনই। ওদিকে বোটটা ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।

ঠাণ্ডা পানিতে পড়েই সাঁতরাতে শুরু করলো স্যাম। রেমিও যে তার পাশে। পাশে সাঁতরে আসছে সেটাও টের পাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পরই বিকট শব্দের সাথে পানিকে জ্বলে উঠতে দেখলো ওরা। বিস্ফোরণের তীব্রতায় পানিতে কম্পন অনুভব করতে পারছে। বিস্ফোরণের জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে পানিতে। আগের থেকেও আরো দ্রুত হাত-পা চালানো শুরু করেছে ওরা। স্যাম শুধু আশা করছে বোটের গলুইটা যেন এখনই বিস্ফোরিত না হয়। সাঁতরে কতটুক দূরত্ব পেরিয়েছে এই ব্যাপারেও কোনো ধারণা নেই ওদের। ওদের একমাত্র লক্ষ্য এখন গাছের গুঁড়িটার কাছে পৌঁছানো। আরো কিছুক্ষণ সঁতরানোর পর অবশেষে হাতে গাছের গুঁড়ির স্পর্শ পেতেই গুঁড়িটা আগলে ধরলো স্যাম।

তারপর হালকা ঘুরে পিছনে থাকা রেমির হাত খাবলে ধরে তাকেও নিয়ে এলো গাছের গুঁড়িটার কাছে। দুইজনই পানি থেকে মাথা ওপরে তুলে হাঁপাচ্ছে এখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরো একটা বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এলো গুঁড়ির অন্যপাশ থেকে বোটের ইঞ্জিনের শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে এসেছে এখন।

গাছের একটা শাখা ধরে একটু ওপরে উঠে দৃশ্যটার দিকে তাকালো স্যাম।

বিস্ফোরণের তীব্রতায় তাদের ছোটোখাটো ফিশিং বোটটা গুঁড়িয়ে গেছে। বোটের খোলসে আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে এখন।

বন্দুকধারীদের বোটদুটোও এখন আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে আগুন জ্বলতে থাকা নৌযানটার একটু বেশিই কাছে চলে এসেছে। কাছে। এসেই অনবরত গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলো বোটের লোকদের একজন। বোটের খোলস এবং পানিতে এখন বুলেট বর্ষণ চলছে শুধু। ঝাঁঝরা হয়ে গেছে নৌকার খোলসটা।

.

বেশ কিছুক্ষণ গোলাবর্ষণ করার পর অবশেষে থামলো লোকটা। আশেপাশটা একবার দেখে নিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করলো বোটটা নিয়ে সামনে এগুনোর। যানটাকে তাদের দিকে আসতে দেখেই আবারো টুপ করে পানিতে নেমে গেলো স্যাম। বোটদুটোকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখা ছাড়া এখন আর কিছুই করার নেই ওদের। উত্তরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যানদুটো।

 বোটদুটো চলে যাওয়ার পরও জায়গাটা থেকে নড়ার সাহস পাচ্ছে না স্যাম ও রেমি। ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত ওভাবেই চুপ করে পড়ে রইলো ওরা। শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি অনুকুলে আছে ভেবে জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এলো স্যাম। তারপর রেমিকে নিয়ে সাঁতরে এগিয়ে গেলো দ্বীপের অন্যপাশটার দিকে।

বিস্ফোরণের তীব্রতায় তাদের ভাড়া করা বোটটা এখন উপসাগরের তলায় ডুবে গেছে। ওপরে থাকা বড়ো পাথরটাও এখন আর অতোটা বড়ো নেই। মাঝখান থেকে দুই ভাগ হয়ে গেছে পাথরটা। বিস্ফোরণের তীব্রতায় একটা অংশ পুরোপুরিই গুঁড়িয়ে গেছে, আর অন্য অংশটা ছিটকে গেছে উপকূলের ধারের দিকে।

 বোটটটার দিকে নজর ফিরালো স্যাম। যানটার অবস্থা দেখে আঁৎকে গেছে। রেমি ওই ট্রিপওয়্যারটা না দেখলে তাদের কী অবস্থা হতো, অথবা খুঁড়ার ধরণ দেখে তার যদি সন্দেহ না জাগতো-তাহলে কী হতো সেটা নিয়ে ভাবতেও চাচ্ছে না ও।

 এমনকি দৃশ্যটা দেখে রেমির চোখ থেকে অশ্রু ঝড়তে শুরু করেছে।

 চলো যাই এখন, স্যাম বলে উঠলো।

কোথায়?

ওক আইল্যান্ড পর্যন্ত সাঁতরে যেতে পারবো আমরা। পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্রে অবশ্যই ফোন রয়েছে। না থাকলেও অসুবিধা নেই। ওখান থেকে তো বাইরের রাস্তাটা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া যাবে।

 সাঁতরে প্রায় অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়েছে ওরা, ঠিক তখনই পানিতে কোনো বড়ো সামুদ্রিক যানের এগিয়ে আসার কম্পন টের পেলো স্যাম। প্রায় হাজার ফুটের মতো দূরে রয়েছে যানটা। দক্ষিণের দিক থেকে এগিয়ে আসছে।

ভয়ে ভয়ে জাহাজটার দিকে তাকালো স্যাম। সে ভাবছে হয়তো এভেরির লোকেরাই আবার ফিরে আসছে। তবে বোটটা আরো কাছে আসতেই বোটের ওপরে জ্বলতে থাকা টিমটিমে ইমার্জেন্সি লাইট ও পানির ওপর ভেসে বেড়ানো স্পটলাইট দেখে বুঝতে পারলো যে সাহায্য এগিয়ে আসছে তাদের জন্য।

দুজনেই চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করলো বোটটার উদ্দেশ্যে। হাত নেড়ে নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। জাহাজের স্পটলাইটটা তাদের ওপর পড়তে দেখে অবশেষে কিছুটা স্বস্তি পেলো ওরা। যদিও স্পটলাইটের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য অন্ধ হয়ে গেলেও, সাহায্য আসছে দেখে অনেকটা শান্তি পাচ্ছে খন।

রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের যান এটা। কাছে এসে দুজনকেই জাহাজে টেনে তুললো জাহাজের কর্তৃপক্ষ। জাহাজে উঠে শরীর মুছতে মুছতে ক্যাপ্টেনের কাছে কী কী ঘটেছে তার সবই খুলে বলল স্যাম। সব শুনে ক্যাপ্টেন মন্তব্য করলেন, তো আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনারা আন্ডারওয়াটার একটা বিস্ফোরণ থেকে সারভাইভ করেছেন?

না। আমি বলছি, বিস্ফোরণ ঘটেছিলো পানির ওপরে। আর আমরা পানির নিচে ডুব দিয়ে সেটা থেকে সারভাইভ করেছি। ঐ পাথরটা- বলতে বলতে পাথরটার দিকে নির্দেশ করলো স্যাম, বা ওটার যতটুক অংশ এখন অবশিষ্ট আছে, ওটাই বিস্ফোরণের ধাক্কার বেশির ভাগটা সামলে নিয়েছে। নাহলে কপালে খারাপিই ছিলো।

কপাল দেখছি খুবই ভালো আপনাদের, ক্যাপ্টেন বললেন।

বলতে গেলে তাইই।

 তো কেন মনে করছেন যে তারা আপনাদেরকেই টার্গেট করেছিলো?

রেমির দিকে এক পলক তাকালো স্যাম। রেমি এখন তাদের সামনের টেবিলে একটা মোটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে বসে আছে। অনেক লম্বা একটা গল্প।

আমাকে তো ঘণ্টা হিসেবেই বেতন দেওয়া হয়, তাই না? তো বলে ফেলুন।

সংক্ষেপে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঘটা সবকিছুই ক্যাপ্টেনকে খুলে বলল স্যাম। স্যান ফ্রান্সিসকো ভ্রমণ, ব্রির অন্তর্ধান, তারপর কিডন্যাপারদের মুখে তাদের আলোচনার অংশ শোনাসহ সবই।

বেশ একটা গল্প, মি, ফার্গো, ক্যাপ্টেন বললেন। এই গল্পের সত্যতা পাওয়া যাবে কি?

 খুব সহজেই পাবেন। স্যান ফ্রান্সিসকো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং নর্থ ক্যারোলিনার কারটিট কাউন্টির কাছে খোঁজ করলেই হবে।

আচ্ছা, ওটা খতিয়ে দেখবো আমরা। তা, আপনাদের এই কর্মী মানে ব্রি মার্শাল, আপনি কি নিশ্চিত মানুষটা বিশ্বাসযোগ্য? আপনার কি মনে হয় না মহিলাই এসব কিছুর সৃষ্টি করেছে?

কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? স্যাম জানতে চাইলো।

বলতে চাচ্ছি একমাত্র ঐ মহিলাই কিন্তু ওক আইল্যান্ডের ব্যাপারে আলোচনাটা শুনেছিলো।

কথাটা শুনেই কিছুটা খেঁকিয়ে উঠলো রেমি। আমি তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি।

আর, আমিও, আমার স্ত্রীর বিচার-বিবেচনাকে বিশ্বাস করি, সাথে যোগ করলো স্যাম।

 আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলছি। ভিতরের কারোর বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা কিন্তু এটাই প্রথম না। বলে নোটগুলোতে একবার দেখলেন ক্যাপ্টেন, তারপর আবার স্যামের দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হয় এখনের জন্য এই প্রশ্নগুলোই ছিলো আমার।

আমার একটা প্রশ্ন আছে, স্যাম বলল, আপনি আমাদের খুঁজে পেয়েছেনে এই কথাটা পাবলিকলি না জানানোর কি কোনো উপায় আছে?

ঠিক বুঝতে পারিনি প্রশ্নটা।

আপনি যদি আমাদেরকে খুঁজে না পেতেন, তাহলে ক্রাইম সিনের ব্যাপারের কী রিপোর্ট দিতেন?

প্রথম দর্শনের ওপর ভিত্তি করে? বলতাম যে বিস্ফোরণের কারণে একটা বোটে আগুন ধরে গেছে। রিকভারি অপরাশেন। কেউ বেঁচে আছে কিনা তার খোঁজ চলছে।

তো প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে আপনি কি এখন এই কথাটা বলতে পারবেন না?

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ স্যামের দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন। আইডিয়াটার খুঁটিনাটি সুবিধা-অসুবিধাগুলো ভেবে দেখছেন। এক মুহূর্ত ভাবার পর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, অবশ্যই। আপনার বলা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যদি আপনাদের গল্পের সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে খুব সম্ভবত এটা করতে পারবো আমরা।

করলে আমাদের জন্য ভালো হয়, রেমির অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করেই ক্যাপ্টেনকে কৃতজ্ঞতা জানালো স্যাম।

****

হোটেলে ফিরে যাওয়ার পথে রেমির দিকে তাকালো স্যাম। যদিও সদ্য উদিত সূর্যের মৃদু আলোয় সে রেমির মুখের হাবভাবটা দেখতে পাচ্ছে না, তবে তার মধ্যে থাকা উদ্বেগটা ঠিকই বুঝতে পারছে। কী?

তুমি কি সত্যিই এটা চাচ্ছো যে অন্য সবাই আমাদেরকে মৃত ভাবুক?

এটা খুবই চমৎকার একটা প্ল্যান, রেমি।

না, খুবই বাজে একটা প্ল্যান। গত কয়েকদিন ব্রি যেসবের ভিতর দিয়ে গেছে, তারপরও কি তুমি ভাবছো সে আমাদের মৃত্যুর ধাক্কাটা ঠিকমতো সামলাতে পারবে? সে কি নিজেকে দোষী ভাববে না?

এটা তো মাত্র এক কি দুই দিনের জন্য।

আর সেলমার ব্যাপারে কী? আমাদের অন্যান্য স্টাফদের ব্যাপারে?

অবশ্যই, তাদেরকে সব খুলে বলবো আমরা।

তাহলে ব্রিকে কেন নয়?

 তুমি তো ক্যাপ্টেনের কথা শুনলেই। ভিতরের কারো কাজও হতে পারে।

 এটা তো শুধুই একটা সাজেশন মাত্র, স্যাম। উনি তো কথাটা সিরিয়াসলি বলেননি।

 এখন পর্যন্ত আমাদের সাথে যা যা ঘটেছে, তার সবগুলোর সাথেই কিন্তু ব্রির সংযোগ আছে।

সে নিজেও কিন্তু ঘটনাগুলোর শিকার, স্যাম।

রেমির দিকে ভালো করে চোখ তুলে তাকালো স্যাম। একমুহূর্ত ওভাবেই তাকিয়ে থাকার পর আবারো রাস্তার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে আনতে বলল, তুমি কি নিশ্চিত?

তুমি কিভাবে উল্টোটা ভাবতে পারলে?

তুমি বলেছিলে ব্রির চাচা তোমার আগমনের কোনো আশা করছিলো না। আর এর কিছুক্ষণ পরেই তোমার দিকে বন্দুক তাক করে ডাকাতি ঘটলো জায়গাটায়। তুমি মেসেজ দিলে আমরা রিট-কার্লটন হোটেলে আছি এবং অল্প সময়ের ভিতরেই বন্দুকধারী হাজির হলো ওখানে। এরপর ঘটলো তার কল্পিত অপহরণ

কল্পিত?

-অপহরণের ঘটনা। আর সে তোমাকে ফোনে করে বইটা তার কাজিনের কাছে নিয়ে যেতে বলল। এবং বইটা দেওয়ার পর তাকে বাঁচাতে গিয়ে কিন্তু আমরা রীতিমতো মরতেই বসেছিলাম। আর, সবশেষে সে আমাদের ওক আইল্যান্ডের গল্প বলল এবং আমরা আবারো প্রায় মারা পড়তে বসেছিলাম।

আমি বিশ্বাস করছি না তোমার কথাগুলো।

 রেমি… অফিসারের কথাগুলো কিন্তু তুমি নিজ কানেই শুনেছো।

কাকতালীয় ঘটনা। পুরোটাই কাকতালীয় ঘটনা। এবং বলতেই হয় যে সাথে কপালও খারাপ। দেখো, তুমিই কিন্তু আমাকে অনেকবার বলেছে যে গুপ্তধনের লোভে মানুষের ভিতর থেকে তার সবচেয়ে খারাপটাও বাইরে বেরিয়ে আসে। বলোনি?

হ্যাঁ, বলেছি। আর তোমার কি মনে হয় না এমনই কোনো কিছুর লোভে ব্রির ভিতর থেকেও তার সবচেয়ে নিকৃষ্টটা বেরিয়ে আসতে পারে?

 না, হাত ভাঁজ করে বলল রেমি। এবং আমি তোমাকেও ওরকম কিছু ভাবা থেকে বিরত থাকতে বলছি। তো, ভিন্ন কোনো পরিকল্পনার চিন্তা করো এখন।

আমার মনে হয় আমরা কোথাও একটা ভুল করছি।

হোক ভুল, চাঁছাছোলা কণ্ঠে বলল রেমি। এটাই নিশ্চয় আমাদের প্রথম ভুল না। এর আগেও অনেক ভুল করেছি আমরা।

রিয়ারভিউ মিররে তাকালো স্যাম। বেশ কয়েকমাইল ধরেই দেখছে একটা হেডলাইটকে তাদের পিছন পিছন আসছে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো কেউ হয়তো তাদেরকে অনুসরণ করছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য গাড়ির গতি কিছুটা কমিয়ে দিলো স্যাম। সাথে সাথেই শো করে তাদের পাশ কেটে চলে গেলো গাড়িটা। না, তাদেরকে অনুসরণ করছে না কেউ।

হয়তো সে আসলেই আতঙ্কিত হয়ে আছে। অবশ্য একটু আগেই মরতে মরতে বেঁচে আসার পর এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। এই মুহূর্তে, কিছু ব্যাপার পছন্দ না হলেও তাকে মেনে নিতে। এমনকি রেমিকেও এটা বুঝতে দিতে হবে যে স্যামের সাথে তর্কযুদ্ধে সে ই জিতেছে। আর যেহেতু ব্যাপারটার সাথে রেমির নিরাপত্তাও জড়িয়ে আছে, তাই সে কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। হোটেলে গিয়ে প্ল্যান বি তৈরি করবো আমরা।

অবশ্যই রেমির প্ল্যান বি এর সাথে স্যামের প্ল্যান বির অনেক পার্থক্য রয়েছে। রেমি চাচ্ছে হোটেলে পৌঁছেই সেলমাকে ফোন করে জানাতে যে তারা ঠিকঠাকই আছে, আর স্যাম চাচ্ছে এখনই কাউকে তেমন কিছু খুলে না বলতে।

তোমার আগের প্ল্যানের সাথে এটার পার্থক্য কই রইলো?

কেউ তাদের সাথে যোগাযোগ করে বলবে না যে আমরা মৃত, আবার এটাও বলবে না যে আমাদের বোটটা খুঁজে পাওয়া গেছে।

সুইটে পৌঁছেই সরাসরি বেডরুমে চলে গেলো রেমি। স্যামও আসছে তার পিছে পিছে। রুমে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই রেমি দরজার মুখে থামিয়ে দিলো তাকে। প্ল্যানের ব্যাপারে একমত না হওয়া পর্যন্ত ঘুমাতে পারবো না আমি।

আর কী একমত হব?

এটাই যে আমি ঠিক আর তুমি ভুল।

এই মেয়েটা দেখছি তার রূপের মতোই প্রচণ্ড জেদী, মনে মনে ভেবে রেমিকে জড়িয়ে ধরে তাকে চুমু খেলো স্যাম। বলল, তুমি তো জানোই, আমি সবসময়ই সঠিক।

তাই নাকি? তাহলে চলো রক-পেপার-সিজর্সের এক রাউন্ড হয়ে যাক?

 এভাবে সিদ্ধান্ত নিবে তুমি? বাচ্চাদের খেলার মাধ্যমে?

এটা আগেও কাজ করেছে।

ক্লান্তিতে বিছানায় ঢলে পড়লো স্যাম। আচ্ছা, ঠিক আছে, চোখ বন্ধ করে বলছে ও, তার আগে এক মিনিট বিশ্রাম করে নেওয়া দরকার আমার…

এক মিনিটের কথা বলে বেশ গভীরভাবেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলো স্যাম। তার সেই ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংয়ের শব্দে। এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আছে ও। কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঘুম ঘুম চোখে উঠে নাইটস্ট্যান্ডের ওপর থাকা ফোনের এক্সটেনশন রিসিভারটা কানে লাগালো। কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেললো, হ্যালো?

মি. ফার্গো। ফোনের ওপাশ থেকে সেলমার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনেই আচ্ছন্নতা কেটে গেছে স্যামের। আপনাদের কোনো খবর না পেয়ে বেশ দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি।

আমরা ঠিক আছি, বলল স্যাম। ঠিক তখনই বেডরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেলো। তাকিয়ে দেখে রেমি দাঁড়িয়ে আছে দরজার মুখে। সাদা সিল্কের একটা রোব পরে আছে মেয়েটা। সেলমার ফোন, স্যাম বলল তাকে।

 এক্সটেনশন ডেস্কের কাছে গিয়ে ওখানের রিসিভারটা কানে লাগালো রেমি। বলল, হ্যালো, সেলমা।

 মিসেস ফার্গো। আপনাদের কথা শুনে দুঃশ্চিন্তা কাটলো আমার। শুধু এটাই জানতে চাচ্ছি গতরাত কেমন কাটলো আপনাদের?

দরজার মুখ দিয়ে স্যামের দিকে তাকিয়ে রেমি বলল, হয়তো উত্তরটা তুমি দিলেই ভালো হবে।

সত্যি বলতে রেমি এখনো তাদের পরিকল্পনায় সম্মত হওয়ার ব্যাপারটা এখনো ভুলেনি। বোট বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিপদে পড়তে হয়েছিলো আমাদের।

আমি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করছি।

সত্যি বলতে, স্যাম বলছে, যদি পারো, আপাতত এই ব্যাপারটা একটু চেপে রাখো।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।

রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ বলেছে তারা আমাদের উদ্ধারের ব্যাপারটা আপাতত কিছু সময়ের জন্য গোপন রাখবে। এতে করে হাতে কিছুটা সময় পাবো আমরা।

কিসের জন্য সময়? সেলমা জিজ্ঞেস করলো।

আমারও একই প্রশ্ন, রেমিও যোগ করলো সাথে।

যদি গতরাতে কেউ আমাদের ফাঁদে ফেলে থাকে, সে এখন ভাবছে আমরা মৃত। আমি নিশ্চিত আবার খুব দ্রুতই লোকটা আমাদের পিছে লাগতে চাইবে না। আর এটাও আশা করছি, এই সময়ের ভিতরে আমরা ম্যাপের অর্থ ও সাইফার হুইল খোঁজার ব্যাপারে তথ্য যোগাড় করে কাজ কিছুটা এগিয়ে নিতে পারবো।

সমস্যা শুধু একটাই, রেমি বলছে, আমরা এই হোটেলে আমাদের আসল নাম ব্যবহার করে চেক ইন করেছি।

 ভালো পয়েন্ট, ভাবলো স্যাম। আশা করো যেন তারা ঐ বিস্ফোরণটাতেই শান্ত থাকে। মনে হয় না, আমরা বেঁচে আছি কিনা সেটা জানার জন্য এরিয়ার সব হোটেলে হোটেলে খুঁজে দেখবে ওরা। এখন ঐ সাইফার হুইলটার ব্যাপারে বলো।

 এটার জন্যই আমি আসলে আপনাদেরকে ফোন করেছি, সেলমা বলছে। ব্রি আপনার আইডিয়াটার ব্যাপারে বলেছে। আপনি নাকি ম্যাপের আউটলাইনের সাথে অন্যান্য দ্বীপগুলোর মিল সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন।

 আমার আইডিয়া?

ও বলেছে আপনি নাকি প্লেনে থাকাকালীন সময়ে এটা নিয়ে কথা তুলেছিলেন। বলেছিলেন আটলান্টিকের তীরে আরো বেশ কিছু দ্বীপের সাথে মিল আছে ম্যাপটার। ও সাজেশন দিয়েছে যে অঞ্চগুলোতে পাইরেটদের আনাগোনা ছিলো না সেগুলো বাদ দিয়ে দিতে এবং ওক আইল্যান্ডের মতো যে দ্বীপগুলোতে গুপ্তধন আছে বলে গুজব আছে সেগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখতে।

ওটাতে অবশ্য পরিণতি ভালো হয়নি আমাদের।

সেলমা তার গলা খাকরে পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, যাই হোক গত রাতে সাইফার কোডটা নিয়ে বেশ কিছুটা কাজ করেছি আমরা। যদিও খুব একটা এগুতে পারিনি। ব্রি তখন পাইরেটস বইটার ম্যাপটা নিয়ে-যেটাকে আমরা ওক আইল্যান্ড বলে ভেবেছিলাম-আটলান্টিকের দ্বীপগুলোর আকৃতির সাথে মিলিয়ে দেখেছে। আমার মনে হয় ব্রাজিলের উপকূলের কাছাকাছি থাকা দ্বীপ খুঁজে পেয়েছে ও। দ্বীপটার সাথে ম্যাপটার অনেক মিল রয়েছে। ইলআ দা কাইমাদা গ্রান্দে নাম ওটার, মানে কাইমাদা গ্রান্দে আইল্যান্ড। ঐ দ্বীপটার সাথে লায়লোর খুঁজে পাওয়া ল্যাটিন সারপেনস শব্দটারও মিল রয়েছে।

স্যাম খেয়াল করে দেখলো রেমির মুখ থেকে আত্মবিশ্বাসী ভাবটা উবে গেছে এখন। যদিও তারা কেউ কখনো স্বশরীরে ঐ দ্বীপটাতে যায়নি, তবে তারা ঐ অঞ্চলটার সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। দ্বীপটার ডাকনাম স্নেক আইল্যান্ড, মানে সাপের দ্বীপ। সোনালি ল্যান্সহেডের বাসস্থল দ্বীপটা। ভাইপারের একটা প্রজাতি ওটা। সাপটা এতোই বিষাক্ত ও ক্ষীপ্র যে ব্রাজিলিয়ান নেভিরাও ঐ এলাকাটা এড়িয়ে চলে। দ্বীপটার ভৌগলিক ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে যে, প্রায় এগারো হাজার বছরের মতো আগে সমুদ্রের উচ্চতার কারণে দ্বীপটা মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। এই পৃথকীকরণের ফলেই সেখানকার ভাইপারগুলো কীভাবে যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। সামুদ্রিক কিছু পাখি ছাড়া ঐ দ্বীপে অন্য কোনো শিকার ছিলো না। তাই সাপগুলোর তড়িৎ কাজ করে এমন একধরনের বিষের প্রয়োজন পড়েছিল, যাতে করে পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আগেই তারা ওগুলোকে শিকার করতে পারে। সাপ ছাড়াও ঐ দ্বীপটার আশেপাশে বেশ কিছু জাহাজডুবির ঘটনাও ঘটেছে বলে শোনা যায়।

আর আমরা ওখানে আসলে কী খুঁজব?

যদি ম্যাপটা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে দ্বীপের দক্ষিণ মাথার দিকে একটা শিপরেক রয়েছে।

 এমনকি যদি আমরা কয়েকবছর ধরেও ওখানে খোঁজাখুঁজি করি, তারপরও কিন্তু সাইফার হুইল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাটা খুবই ক্ষীণ।

যদি, সেলমা বলছে, আমরা আসলেই সাইফার হুইলটা খুঁজি আর কী! তবে আমি এখন আশা করছি অন্য একটা কাজের ওপর। কাজটা হলো, জাহাজটা খুঁজে বের করা।

 কথাটা শুনে রেমির ভ্রু কুঁচকে গেছে। আমি কি কিছু মিস করছি এখানে?

এমনকি স্যামও হতভম্ব হয়ে গেছে সেলমার কথায়। এটা আমাদেরকে কিভাবে সাহায্য করবে?

লাযলোর ধারণা চোরাইকত সাইফার হুইলটা আসলে নকল একটা কপি। আর এটা জাহাজের ক্যাপ্টেন বানিয়েছিলো আসল হুইলটা কারো কবলে পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। এরমানে হলো আসল সাইফার হুইলটা এখনো ওখানেই আছে। জাহাজটা কোথায় এবং কবে তৈরি করা হয়েছিলো সেটা জানতে পারলেই ঘোষণাপত্রের সূত্রধরে এর মালিককে চিহ্নিত করতে পারবো আমরা। আর মালিককে খুঁজে পেলেই

-আমরা আসল সাইফার হুইলটাও খুঁজে পাবো, বাক্যটা শেষ করে দিলো স্যাম। তোমার কাছে যা যা তথ্য আছে পাঠাও আমাদের।

 আপনার ইনবক্সে পৌঁছে যাবে তা। সাথে সাথে আপনার ফ্লাইট কুকে ব্রাজিল ভ্রমণের ব্যাপারেও কিছু তথ্য পাঠিয়ে দিবো।

কথা শেষে রিসিভারটা ক্রেড়ালে রেখে বিছানা থেকে নামলো স্যাম। তারপর এগিয়ে গেলো অন্যরুমে থাকা রেমির কাছে। ভ্রমণটাকে বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক শোনাচ্ছে।

 এটা কি কোনো ধরনের ক্ষমা চাওয়া? স্যামের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল রেমি।

তোমাকে নিরাপদে রাখতে চাওয়ার জন্য তো আমি ক্ষমা চাইতে পারি না।

ব্রির ব্যাপারে তোমার ধারণা ভুল। সে চার্লস এভেরির কোনো চর না। আমাদের প্রতিটা পদক্ষেপই এভেরিকে জানাচ্ছে না ও।

তবে কিছু একটা অবশ্যই চলছে আড়ালে আড়ালে। তবে কী চলছে সেটা ধরতে পারছে না স্যাম। অবশ্য সন্দেহ প্রকাশ করে রেমির সাথে এই সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করারও কোনো ইচ্ছা নেই তার। তাই বলল, আমার আচরণে হয়তো তুমি ভেবেছো আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি না। এটার জন্য ক্ষমা চাইছি আমি। কখনোই এরকম কিছু বুঝানোর ইচ্ছা ছিলো না আমার।

রেমি তার হাত দুটো স্যামের কাঁধে ঠেকিয়ে বলল, তোমার ক্ষমা গ্রহণ করা হলো।

তো, তাহলে এখন ব্রাজিল ভ্রমণ? স্যাম জানতে চাইলো।

অবশ্যই। বছরের এই সময়ের ব্রাজিলকে ভালোবাসি আমি।

.

১৫.

জেটে করে প্রথমে মিয়ামিতে গিয়ে পৌঁছালো স্যাম ও রেমি। সেখান থেকে তাদের জন্য সেলমার পাঠানো প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো তুলে নিয়ে আবারো ছুট লাগালো ব্রাজিলের সাও পাওলোর উদ্দেশ্যে। মিয়ামি থেকে ওখানকার গরম আবহাওয়ার উপযোগী কিছু কাপড়চোপড়ও নিয়ে নিয়েছে। সাও পাওলোতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটার মতো লেগে গেলো তাদের।

 রাতটা বিশ্রামে কাটিয়ে পরদিন সকালে স্যাম বেরিয়ে পড়লো স্নেক আইল্যান্ডে খোঁজাখুঁজির জন্য সরকারি অফিসিয়ালদের কাছ থেকে অনুমতি ও জরুরি কাগজপত্র নিয়ে আসার জন্য। রেমি অবশ্য হোটেলেই রয়ে গেছে। ট্যাবলেটে করে সেলমার সাথে সান্তোস বন্দরের বোট এবং ক্রুদের নিয়ে কথা বলছে।

সব বিবেচনা করলে, সেলমা বলছে, তারাই এই কাজের জন্য যোগ্য।

শুনে বেশ ভীতিজনক মনে হচ্ছে।

ওখানে হয়তো কিছু হচ্ছে এখন। হয়তো উইকএন্ড বলেই হচ্ছে। সব চার্টারই আগে থেকে বুক রেখেছে অন্যরা। তবে লোকগুলোর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি আমি। আর সত্যি বলতে, আপনাদের দাবিদাওয়া অনুযায়ী ওটাই ছিলো ঐ অঞ্চলে অ্যাভেইলেভল থাকা শেষ বোট। একরাত পানিতেও থাকতেও কোনো আপত্তি নেই তাদের।

স্ট্যান্ডে রাখা ট্যাবলেটের পর্দার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো রেমি। সে জানে সেলমা তার সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছে। সেলমার সাথে কথা বলতে আরো একবার যন্ত্রপাতির লিস্টটা চেক করে দেখছে ও। মেটাল ডিটেক্টর, পোর্টেবল সাইড-স্ক্যান সোনার সিস্টেম, আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা ও লাইটসহ আরো অনেক কিছু রয়েছে তালিকাটায়। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের দরকারি সবকিছুই পাঠিয়ে দিছো তুমি।

হ্যাঁ। এখন তাহলে বোট মালিককে বলে দেই যে আপনারা তার সাথে আজ সন্ধ্যায় বা আগামীকাল যোগাযোগ করবেন। আমার মনে হয় গতরাতে লাযলোর পাঠানো কাগজগুলো আপনারা দুইজনই পড়েছেন?

শুনে টেবিলের দিকে তাকালো রেমি। বলল, হ্যাঁ, দেখেছি। খুঁজে পাওয়া দুটো শিপরেকদুটোর অবস্থান দেখলাম দ্বীপের একদম দক্ষিণ মাথায়। রহস্যময় ম্যাপটা কয়েক শতাব্দী ধরে পাইরেটস অ্যান্ড প্রাইভেটিয়ার্স বইয়ের এন্ডপেপারে আড়ালে লুকানো থাকলেও, এই শিপরেকগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে অনেক আগেই। খুব সম্ভবত লুট করে নিঃশেষও করে ফেলা হয়েছে। প্রথম জাহাজ থেকে প্রাপ্ত সম্পদগুলো থেকে ধারণা করা যায় যে ওটা স্প্যানিশ মালিকানার অধীনে ছিলো। অবশ্য সেলমা নিশ্চিত, তারা ইংরেজদের জাহাজটাই খুঁজছে। মূলত এই কারণেই স্নেক আইল্যান্ডের একদম দক্ষিণ মাথায় থাকা দ্বিতীয় শিপরেকে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্যাম। এছাড়া রেকর্ডবইয়ে ঐ শিপরেকটার ব্যাপারে খুব বেশি কিছুর উল্লেখও করা নেই। লাযলো কি ম্যাপের চাবির অনুবাদ নিয়ে নিশ্চিত?

 ওখানে সে সমুদ্র ও সারপেন্স শব্দগুলো দেখেছে-এটার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী ও

 কপাল খারাপ যে সে ওখানে সমুদ্র ও ডলফিন শব্দগুলো দেখেনি। ভাইপারের থেকে ডলফিন ভালো।

আসলেই। তবে যাই হোক, ব্রি না বললে হয়তো স্নেক আইল্যান্ডের কথা জানা যেতো না। এটা শুধু সম্ভাব্য একটা লোকেশন মাত্র। সকালে আমি আবার ম্যাপটা দেখছিলাম, আর… বলতে বলতে স্নেক আইল্যান্ডের ম্যাপের একটা স্কেচ পর্দার সামনে তুলে ধরলো সেলমা। হুম, এটার সাথে আসলেই অনেক মিল আছে দ্বীপটার। তবে এটাই কি সঠিক জায়গা কিনা তার কিন্তু নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। আপনাদেরকে ওখানে গিয়েই নিশ্চিত হতে হবে।

ব্রির কী অবস্থা? জানতে চাইলে রেমি। কপাল ভালো যে স্যাম এখন তার সাথে নেই। রেমি খুব ভালো করেই জানে ব্রি কখনো তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তবে পরিস্থিতির বিবেচনায় স্যামের ধারণাটাও অযৌক্তিক না।

ঠিকঠাকই আছে ও, সেলমা বলল। এই মুহূর্তে সে মানচিত্রের পাশে থাকা সাইফার হুইলের অর্থ বের করায় লায়লাকে সাহায্য করছে। ঐ সময়কার ইতিহাস নিয়ে বেশ ভালোই জ্ঞান আছে ওর।

শুনে ভালো লাগলো। স্যাম কি ওর ব্যাপারে কিছু বলেছে তোমাকে?

না। শুধু কেমন আছে, কী করছে এসবই জানতে চেয়েছিলো একবার।

 আর কিছু না?

জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলো সেলমা। কয়েক সেকেন্ড থেমে থাকার পর বলল, মিসেস ফার্গো, আমার জানা প্রয়োজন এমন কোনো কিছু ঘটেছে কি?

না। তবে একটা উপকার করো আমার। ব্রির ওপর চোখ রেখো। ওকে? স্যাম… তাকে নিয়ে কিছুটা সন্দেহে আছে।

ওকে, মিসেস ফার্গো। নজর রাখবো ওর ওপর।

কথা বলা শেষে কানেকশন কেটে দিলো রেমি। স্যামকে সে কখনোই উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কারো ওপর অভিযোগ আনতে দেখেনি। এমন না যে সে ব্রিকে অপরাধী বলেছে। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশের ক্যাপ্টেন বলার পরই ধারণাটার দিকে ইঙ্গিত করেছে শুধু। যদিও রেমি প্রায় নিশ্চিত যে শত্রুদের সাথে তার বন্ধু চক্রান্তের নকশা আঁকছে না, কিন্তু সন্দেহের বীজ একবার বপন হয়ে যাওয়ায় সেটা সহজে দূরও করতে পারছে না মন থেকে। আসলেই তো বেশ কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসতে হয়েছে তাদের।

ব্রির ব্যাপারে যদি তার ধারণাটা ভুল হয়ে থাকে, তাহলে এতে করে সে এবং স্যাম দুজনই বিপদে পড়বে। এই ঝুঁকিটা নেওয়ার সুযোগ নেই তার হাতে। তাই সেলফোনটা তুলে আবারো সেলমাকে কল করে বলল, কোথায় আছো তুমি? প্রাইভেট কথা ছিলো কিছু।

অফিসেই আছি। হ্যাঁ, বলুন। দাঁড়ান, দরজাটা আটকে দিয়ে আসি। তারপর এক মুহূর্ত পর সেলমা ফিরে এসে বলল, কোনো ঝামেলা?

কথাটা বির ব্যাপারে, বলে ব্রিকে নিয়ে স্যামের সন্দেহের কারণটা খুলে বলল রেমি। ব্যক্তিগতভাবে, আমি এটাকে সত্য মনে করছি না। তবে স্যামের ধারণাও কিন্তু অযৌক্তিক না। এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। স্যামের ধারণা ভুল হয়ে থাকলে, আমি চাই না ব্রি তা জেনে দুঃখ পাক। আর যদি সত্যি হয়ে থাকে…।

বুঝেছি, মিসেস ফার্গো। ব্রি এখন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কিছু করেনি, তবে এখন থেকে নিশ্চিতভাবেই তার ওপর ভালো করে নজর রাখবো আমি।

সেলমাকে স্যামের সন্দেহের ব্যাপারে সব খুলে বলার পর নিজেকে এখন অনেকটা চাপমুক্ত মনে হচ্ছে রেমির। কাঁধে বিশাল বোঝা হয়ে চেপেছিলো ব্যাপারটা। এখন খুব সহজেই যাত্রার পরবর্তী অংশ নিয়ে পরিকল্পনায় মনস্থির করতে পারছে ও। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো যাত্রার ব্যাপারে একটা খসড়াও সাজিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যে স্যাম তাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে, হোটেলে ফিরে আসছে ও।

 আরো প্রায় ঘণ্টাখানেক পর হোটেলে ফিরে এলো স্যাম। হাতে করে উজ্জ্বল সূর্যমুখী ফুলের একটা তোড়া নিয়ে এসেছে। শুনেছি হলুদ ফুলের সাথে যাত্রা শুরু করলে নাকি যাত্রা বেশ ভালো হয়।

তাই?

তাই তো মনে হচ্ছে। এটা হয় এই হলুদ ফুল নয়তো বেগুনি মণিটার কারণে ভালো হবে। আর সত্যি বলতে চমৎকার একটা মেয়ের জন্য একমাত্র এটাই খুঁজে পেয়েছি আমি। যে মেয়েটা কিনা নিজে থেকেই সব কাজ করে, সাথে সাথে এক স্বামীকেও সামলায় যে কিনা যখন-তখন নির্বোধ কিছু বুদ্ধি দিয়ে বসে।

ফুলগুলো হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে দিলো রেমি। তারপর হাত দিয়ে স্যামকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, নির্বোধ না, তুমি সবসময়ই বুদ্ধিমান, ফার্গো।

এরমানে আমাকে ক্ষমা করা হয়েছে?

জবাবে শুধু তাকে চুমু খেলো রেমি। তারপর পিছিয়ে গিয়ে স্যামের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কি এটা বলার মতো সঠিক সময় যে, ব্রির ব্যাপারে তোমার সন্দেহের ব্যাপারটা আমি সেলমাকে জানিয়ে রেখেছি?

তারমানে তুমি বলছো আমি সঠিক ছিলাম?

আমি শুধু বলছি, তোমার সন্দেহটায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। যুক্তি আছে বলেই তাকে জানিয়ে রেখেছি। তবে এরমানে কিন্তু এই না যে সবাই আমাদেরকে মৃত ভাবুক জাতীয় কিছু চাচ্ছি আমি।

মানে দাঁড়ালো, পুরোপুরি সঠিক না হলেও প্রায় সঠিক ছিলাম আমি? দ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্যাম। তার ঠোঁটের কোণে মদ হাসি ফুটে আছে।

ফার্গো, বেশি চাপাচাপি করো না।

****

সান্তোস বন্দরে যাওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিলো রেমি। ওখানে গিয়েই গলফিনহোর ক্যাপ্টেন এবং ক্রুদের সাথে দেখা করবে ওরা। যাত্রার জন্য ভোর সকালেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লো। আকাশটা সিঁদুরের মতো লালচে হয়ে আছে, সাথে মিশে আছে একধরনের নীলচে-সবুজাভ আভা।

সকালের লাল আকাশ। মানে নাবিকদের সতর্ক হওয়া উচিৎ।

আকাশটা দেখেই পুরোনো এই প্রবাদটা মনে পড়ে গেলো রেমির। যদিও আবহাওয়ার পূর্বাভাস বেশ কয়েকবার চেক করে দেখেছে ও। পূর্বাভাসে বলছে পরেরদিন সন্ধ্যার দিকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে পারে। এর আগ পর্যন্ত দুঃশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই।

গাড়িটা তাদের হোটেলের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। নিচে নেমে দেখে ড্রাইভার গাড়ির ফ্রন্ট ফেডারে ঠেস দিয়ে তার ফোনে কিছু একটা দেখছে। ড্রাইভারের বয়স খুব বেশি না। কৈশোর পেরুনো এক যুবক মাত্র। কালো চুলের ছেলেটা বেশ লম্বা ও হ্যাংলা পাতলা। তাদেরকে গাড়ির এগিয়ে আসতে দেখেই তাড়াতাড়ি করে ফোনটা পকেটে ঠেলে দিলো ছেলেটা। বলল, মি. অ্যান্ড মিসেস ফার্গো?

হ্যাঁ, বলল রেমি। ধারণা করলো ছেলেটার বয়স খুব সম্ভবত আঠারো উনিশের মতো। তুমি নিশ্চয় এন্টোনিও আলভেজ?

 চওড়া হাসি ফুটে উঠলো ছেলেটার মুখে। আমাকে ভাড়া করার জন্য ধন্যবাদ। আপনারাই আমার প্রথম বড়ো ক্লায়েন্ট। আপনাদের হতাশ করবো না আমি, গাঢ় কণ্ঠস্বরে বলল ছেলেটা। প্রতিটা শব্দই বেশ সতর্কভাবে উচ্চারণ করছে।

স্যাম ওদিকে কার্টে করে তাদের লাগেজ বহন করে আনা হোটেলে বেয়ারাকে টিপ দিচ্ছে। এন্টোনিওর শেষ কথাটা শুনে চোখ তুলে তাকালো ছেলেটার দিকে। আমি তো শুনেছিলাম যে তুমি একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভার।

হ্যাঁ, ভালো ড্রাইভার, কার্ট থেকে লাগেজগুলো গাড়ির ট্রাঙ্কে উঠাতে উঠাতে বলল এন্টোনিও। আমি সবসময়ই ড্রাইভ করি। যদিও এর আগে সান্তোস পর্যন্ত কেউ ভাড়া করেনি আমাকে। আপনারাই আমার প্রথম বড়ো ক্লায়েন্ট। আমার কাজিন, হোটেলের প্রহরী আমার ব্যাপারে গ্যারান্টি দিতে পারবে।

এর জন্যই ছেলেটাকে রিকমেন্ড করা হয়েছে, মনে মনে ভাবলো রেমি।

এন্টোনিও এগিয়ে গিয়ে রেমির জন্য প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে বলল, প্লিজ, ভিতরে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নিন।

স্যাম অবশ্য তরুণ ছেলেটার গাড়ি চালানোর দক্ষতা নিয়ে এতোটা নিশ্চিত হতে পারছে না। তুমি কি নিশ্চিত এতো লম্বা দূরত্ব ড্রাইভ করতে পারবে তুমি?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো এন্টোনিও। স্কুলের খরচ মেটানোর জন্য আমি আমার চাচার ফিশিং বোটে কাজ করতাম আগে। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। তাই শহরে কাজ করাটা সহজ হয়ে গেছে আমার জন্য। তবে, আজ কোনো ক্লাস নেই। তাই আপনাদের নিয়ে যেতে পারছি।

রেমি বলল, তোমার কাজিন নিশ্চয় এটাও বলেছে যে আমাদেরকে আবার ফিরতি নিয়ে আসার জন্য তোমাকে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে? একদিনের বেশি হতেও পারে সময়টা।

হ্যাঁ। যেতে যেতে আমার ইংরেজির প্র্যাক্টিসটাও হয়ে যাবে, আর আপনারা ডাইভিং করার সময় অন্য পড়াও পড়ে ফেলা যাবে। এইভাবে আমাদের সবারই কাজ হয়ে যাবে, তাই না?

ছেলেটার কথা শুনে বেশ ভালো লাগলে রেমির। ছেলেটাকে পছন্দ করে ফেলেছে ও। ভালো উদ্যম আছে ছেলেটার। অবশ্যই।

এমনকি স্যামেরও ছেলেটাকে বেশ ভালো লেগে গেছে। উষ্ণসুরে কথা বলছে এখন। তো, কিসের ওপর পড়াশোনা করছো তুমি?

এখন তো ফার্স্ট ইয়ারে, তাই মোটামুটি সবই পড়া লাগছে। গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, পলিটিক্স-সবই। আমার ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আছে। তবে ঐ পর্যন্ত যেতে এখনো অনেক দেরি আছে। এভাবেই আলাপ করতে করতে পার্বত্য পথটা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। যাত্রার পথে মোহনীয় দৃশ্যগুলো দেখছে, ওগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করছে। এন্টোনিওও তার স্কুলের কথা বলছে, তার সাত ভাই ও এক বোন, তার জেলে চাচা, হোটেলের প্রহরী কাজিনের ব্যাপারে বলছে। তার কাজিনও নাকি তারমতো করেই স্কুলে পড়ছে। পুরো পরিবারের মধ্যে তাদের দুজনেরই আসলে পানিতে বিচরণের তেমন একটা আগ্রহ নেই। এভাবেই আলাপ করতে করতে কিছু বুঝে উঠার আগেই সান্তোস বন্দরে পৌঁছে গেলো ওরা। যাত্রায় বিরক্ত হওয়ার সুযোগও পায়নি কেউ।

এন্টোনিও গাড়ির ট্রাংক থেকে তাদের মালপত্রগুলো নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় ডাইভিং করবেন আপনারা?

স্নেক আইল্যান্ডের দক্ষিণ মাথায়।

শুনেই হাসিটা মুছে গেলো ছেলেটার মুখ থেকে। সতর্ক থাকবেন তাহলে। আমার চাচা ওদিককার পাইরেটের ব্যাপারে অনেক গল্প বলেছে। কী ধরনের বোট ভাড়া করেছেন আপনারা?

এটা আসলেই একটা ভালো প্রশ্ন করেছে, স্যাম বলছে। আমরা অতোটা জানি না। শুধু গলফিনহো নমটাই শুনেছি।

নামটা শুনেই আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এন্টোনিওর চেহারা। ক্যাপ্টেন ডেলগাড়ো। আমার চাচা লোকটার অনেক প্রশংসা করে।

শুনে ভালো লাগলো, বলল স্যাম। তো, বন্দরে ফিরে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো কিভাবে?

এন্টোনিও শহরের দিকে ইশারা করে বলল, আমার চাচার বাসা এখান থেকে খুব একটা দূরে না। ওখান থেকে ডকগুলো এমনিই দেখা যায়। উইকেন্ড হয়ে ভালো হয়েছে, এক রাত থাকতেও কোনো অসুবিধা হবে না আমার। কাল রাতের দিকে গলফিনহোকে ফিরতে দেখলেই চলে আসবো আমি। বলে আকাশের দিকে তাকালো ও। যদিও আকাশের এক বিন্দু মেঘের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে, তারপরও বলল, আশা করছি ঝড় আসার আগেই ফিরে আসবেন আপনারা।

****

ক্যাপ্টেন ডেলগাডো দেখতে এন্টোনিওর ঠিক উলটো যেন। লোকটার বয়স চল্লিশের কোঠায়, শরীরের উচ্চতা খর্বাকৃতির, মোটা, এবং সেই কপালে স্থায়ী বিরক্তির ভাজ লেগে আছে যেন। সে এবং তার দুজন লোক দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে রেমিদের জন্য। এন্টোনিও চলে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন এগিয়ে গিয়ে বলল, ফার্গো?

স্যাম ও রেমি, জবাব দিলো স্যাম। আপনাদের বোটটা কোথায়?

ঐ তো, ওখানে, বলে সবচেয়ে কাছের ডকের শেষপ্রান্তের দিকে ইশারা করে দেখালো ডেলগাড়ো।

পানিতে থাকা একদম নতুন কাটামারান রিসার্চ ভেসেলটা দেখে বেশ আনন্দিত হলো রেমি। এটাকে দেখে তো চমৎকার লাগছে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এই বোটটার সামনে থামলো না। বরং আটচল্লিশ ফুট দৈর্ঘ্যের চকচকে বোটটা পেরিয়ে গিয়ে থামলো শেষপ্রান্তে থাকা বিয়াল্লিশ ফুট দৈর্ঘ্যের একটা ভাঙাচোরা জেলে নৌকার সামনে। ফ্যাকাসে সবুজ বর্ণের যানটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে আরো কয়েক দশক আগেই নৌকাটা তার শেষ দেখে ফেলেছে। এ… এটাই গলফিনহো?

দাঁত বের করে হাসলো ডেলগাড়ো। তামাক পাতা চিবুতে চিবুতে দাঁতগুলো হলুদ হয়ে লোকটার। ধারের দিকে কিছুটা জং ধরে গেছে। তবে এখনো সমুদ্রে চলার মতো শক্তি আছে এটার।

স্যাম নৌকাটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি নিশ্চিত?

খুবই ভালো বোট এটা। দ্রুত গতির। আর তাছাড়া পাইরেটরাও এটাতে আক্রমণ করবে না। ভাববে হয়তো কোনো পয়সা নেই আমাদের কাছে। তাই না? বলে হেসে উঠলো ডেলগাডো।

 রেমি আর স্যামও হাসছে লোকটার সাথে, তবে তাদের হাসিতে প্রাণ নেই অতোটা। জলদস্যুদের ব্যাপারে এন্টোনিওর সতর্কবাণীটা বাজছে রেমির কানে। এদিকের পানিতে পাইরেটের সংখ্যা কি অনেক বেশি?

আছে বেশ কিছু। তবে আমাদের কাছে বন্দুক আছে। আমরাই রক্ষা করবো আপনাদের। বলে তার লোকদেরকে ফার্গোদের মালপত্রগুলো বোটের উঠানোর নির্দেশ দিলো ক্যাপ্টেন ডেলগাডো। আপনারা প্রস্তুত থাকলে রওনা করে দেওয়াই ভালো। আমাদের আবার আগামীকাল বৃষ্টি শুরুর আগেই ফিরে আসতে হবে।

আবহাওয়ার সতর্কবাণী শুনে ফোন বের করে আরো একবার পূর্বাভাসটা দেখে নিলো রেমি। হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির চিহ্নটার সাথে এখন বজ্রপাতের চিহ্ন জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পরেরদিন সন্ধ্যার আগে এই বজ্রবৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। এর আগ পর্যন্ত আবহাওয়ার তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। যদি আগামীকালের ভিতর তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা খুঁজে না পায়, তাহলে হয়তো বৃষ্টি থামার পর আরেকবার আসতে হতে পারে।

 পানিতে চলতে শুরু করার পরই আবহাওয়া ও বোট নিয়ে রেমি সমস্ত দুঃশ্চিন্তাই উবে গেছে। যানটার খোলসের হালকা ক্যাচক্যাচ শব্দ ছাড়া একদম মসৃণভাবেই স্নেক আইল্যান্ডের এগিয়ে যাচ্ছে। সাথে করে প্রায় নতুন একটা যোডিয়াকও একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে বোটটা। লক্ষ্যভ্রষ্ট বলেও মনে হচ্ছে না। সেলমা ক্যাপ্টেন এবং তার কুর বেশ প্রশংসা করে রেমিকে বলেছিলো যে লোকগুলো বেশ নির্ভরযোগ্য। আর তাছাড়া এন্টোনিওও বলেছিলো যে তার চাচাও নাকি গলফিনহোর ক্যাপ্টেনকে বেশ সম্মানের চোখে দেখে। এতগুলো প্রশংসা বাক্যের তো অবশ্যই কোনো কারণ আছে। যদিও ক্যাপ্টেন ডেলগাডো এবং তার চার ক্রুর তিনজনকে দেখতে জেলের মতো লাগছে না। বরং অনেকটা জলদস্যুদের মতো দেখাচ্ছে লোকগুলোকে। তাদের চতুর্থ ও সবচেয়ে তরুণ সদস্য নুনোকে দেখতে এন্টোনিওর মতো লাগছে রেমির কাছে। দুজনেরই বয়স ও শারীরিক গড়ন প্রায় একই রকমের। যদিও এই ছেলেটাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই রেমির দিকে তাকাচ্ছে ছেলেটা, কিন্তু রেমি তার দিকে তাকালেই আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।

 রেমি বুঝতে পারছে না তার উপস্থিতির কারণেই ছেলেটা এতো অস্বস্তি বোধ করছে, নাকি অন্য কোনো কারণে করছে। যাই হোক, ছেলেটার দিকে আর না তাকানোর সিদ্ধান্ত নিলো ও।

স্যামও লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা। রেমির পাশে এসে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, কুর সদস্যরা বেশ অদ্ভুত, তাই না?

ওরকমই লাগছে। তবে গলফিনহো যদি আমাদেরকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে এবং ওখান থেকে অক্ষত অবস্থায় আবার বন্দরে ফিরিয়ে আসতে পারে, তাহলে এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করবো না আমি।

সন্ধ্যার দিকে দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে পুরোনো ক্রু মেম্বারদের একজনের হাতে হাল ছেড়ে দিয়ে স্যাম ও রেমির দিকে এগিয়ে গেলো ক্যাপ্টেন ডেলগাডো। স্যামের পাশে গিয়ে বোটের দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, তো, আপনারা ঐ দ্বীপে যাচ্ছেন কী মনে করে?

জাহাজডুবির প্রমাণ খোঁজার জন্য, বলল স্যাম।

গুপ্তধন? মুচকি হেসে বলল ক্যাপ্টেন। আমি শুনেছিলাম এটাই আপনাদের বিশেষত্ব।

 হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। তবে এবার গুপ্তধন খুঁজতে যাচ্ছি না। ধ্বংসাবশেষে কী কী আর্টিফ্যাক্ট আছে সেটার বিবরণ আনতে যাচ্ছি।

 আপনাদের সাহস আছে বলতে হবে। আমার থেকেও বেশি, ক্যাপ্টেন বলছে দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে। অনেক বেশি সাপ ওখানে।

আমাদেরও কপাল ভালো বলতে পারেন, স্যাম বলল। আমাদের কাজ শুধু পানিতে।

 ভালো। তবে ঐ পাথরটার নিচে কয়েক পুরুষ ধরে বসে বসে খাওয়ার মতো ধনসম্পদ থাকলেও আমি কখনো ওদিকে যাবো না। সাপের কামড় খাওয়া ধনীর থেকে কাঙাল হয়ে মরা অনেক ভালো।

বলে হেসে উঠলো ডেলগাডো। লোকটার হাসি শুনে রেমির মেরুদণ্ড বরাবর শিহরণ বয়ে যাচ্ছে যেন। ঐ মুহূর্তেই রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ায় বেশ খুশিই হলো ও। ডিনারের সময় নুনোর পাশেই বসলো ওরা। তবে ছেলেটার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে রেমিকে। ভদ্রভাবেই রেমিকে এড়িয়ে গেছে ছেলেটা।

যাই হোক, আবহাওয়ার অবস্থা এখনো আগের মতোই আছে। খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। খাওয়ার পর রাতে ঘুমটাও বেশ ভালোই হয়েছে তাদের।

পরদিন একদম ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়লো ওরা। ঘুম থেকে উঠেই স্যাম জানালো যন্ত্রপাতিগুলো একবার চেক করে দেখে ডাইভিং স্যুট পরে তাদের তৈরি হয়ে যাওয়া উচিৎ। হাল ধরার আগে ক্যাপ্টেন ডেলগাড়োও এসে দেখে গেছে তাদের। জানতে চেয়েছে তাদের কোনো সাহায্য লাগবে কিনা। সাহায্য লাগবে না জেনে তারপর আবার ফিরে গেছে হাল ধরতে।

দ্বীপের দক্ষিণ মাথা থেকে বেশ কিছুটা দূরে থাকা অবস্থাতেই নোঙ্গর ফেলে থামলো গলফিনহো। আগের দিন ক্যাপ্টেন ডেলগাড়ো একটা পাথরের কথা বলাবলি করেছিলো। ঐ পাথরটা থেকে বেশ দূরেই রয়েছে ওরা। গত কয়েক শতাব্দী ধরে অনেকগুলো জাহাজকে পানির নিচে ডুবিয়ে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে ঐ অভিশপ্ত পাথরটার। তারা যে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে এসেছে সেটাও এই পাথরের খোঁচাতেই তলিয়ে গিয়েছিলো। এটা ভাবতেই ভাবতেই পনেরো ফুট দৈর্ঘ্যের যোডিয়াক সি-রাইডারটারকে প্রস্তুত করতে দেখছে রেমি।

নুনো মই ধরে নেমে গিয়ে তাদের মালামালগুলো রাখছে যোডিয়াকে। এগুলোর মধ্যে পোর্টেবল সাইড-স্ক্যান সোনার ইউনিটের বিশাল একটা বাক্সও আছে। সব যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখার পর স্যামকে নামতে সাহায্য করলো ছেলেটা। তারপর স্যাম নামতে সাহায্য করলো রেমিকে। তরুণ ছেলেটা এখনো সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না, তবে এখন বেশ ভদ্র আচরণ করছে তাদের সাথে। সাহায্য করতেও বেশ উদ্যমি হয়ে আছে। সব যন্ত্রপাতি ঠিকঠাক ভাবে দেখে নেওয়ার পর দ্রুতই তারা রওনা করল ইলআ দা কাইমাদা গ্রান্দের অভিমুখে। কাছাকাছি পৌঁছুতেই দ্বীপের সৌন্দর্যটা রেমির ধরা চোখে পড়লোর। অভিশপ্ত পাথুরে উপকূলটা জঙ্গলটাকে খাড়াভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। এটা যদি অন্য কোনো জায়গায় হতো, তাহলে হয়তো রেমি পাথর বেয়ে চূড়ায় উঠে যেতো ওপর দিকে পানির দৃশ্য দেখার জন্য। তবে দ্বীপে থাকা সাপগুলোর কথাও মনে আছে ওর। তার এবং সাপগুলোর মাঝখানে পানির স্তর আছে ভেবে কিছুটা স্বস্তিই পাচ্ছে এখন।

স্যাম ওদিকে সাইড-স্ক্যান সোনার ইউনিটটা সেট-আপ করছে। নুনোকে যোডিয়াকের গতি ও দিক ঠিক রাখতে বলে স্ক্যানারটা পানির পৃষ্ঠের সমতলে ধরে রেখেছে। সাথে সাথে চোখ রাখছে স্ক্যানারের মনিটরেও। এই মুহূর্তে পানি বেশ শান্তই আছে। তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে যা বলছে, পরবর্তীতে পানির আচরণ উত্তালও হয়ে উঠতে পারে। ডোবার জায়গাটা খুঁজে বের করাটা আসলে যন্ত্রগুলোর নির্ভুলতা এবং ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। সাথে এটাও আশা করছে যেন সঠিক জাহাজটাই খুঁজে পাওয়া যায়। নাহলে আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়ার পর আবারো একই কাজটার পুনরাবৃত্তি করতে হবে ওদেরকে।

যদি ভাগ্য ভালো হয়ে থাকে, তাহলে হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত বস্তুটিও পেয়ে যেতে পারে। অবশ্য রেমি এমনটাও আশা করছে না যে প্রথম ধাক্কাতেই তারা আসল সাইফার হুইলটা পেয়ে যাবে। জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে বস্তু খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। বেশির ভাগ সময়ই জাহাজ যেখানে ডুবে সেখানেই সব কিছু পাওয়া যায় না। কিছু জিনিস দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে, নাহলে ডুবে যায় আরো গভীরে। আর তাছাড়া আসন সাইফার হুইলটা যে এখনো পানির নিচেই আছে এটারও নিশ্চয়তা নেই। হয়তো অনেক আগেই ওটা উদ্ধার করা হয়ে গেছে। কে জানে এখন হয়তো ওটা কোনো সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় পড়ে আছে। হয়তো ওটার মালিক এটার আসল গুরুত্বটাও পর্যন্ত জানে না।

অবশ্য, এই মুহূর্তে তাদের কাজ হলো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করে জাহাজটা কোন প্রকৃতির ছিলো সেটা নির্ধারণ করা। এটা ভেবেই আবারো বিষাক্ত দ্বীপটার চোখ চলে গেলো ওর। ভাবছে, ডুবন্ত জাহাজের বেঁচে থাকা মানুষগুলো হয়তো নিরাপত্তার আশায় তীরের দিকেই সাঁতরে গিয়েছিলো। কল্পনা করছে, মানুষগুলোর অনেকেই হয়তো পাথরের সাথে সংঘর্ষ ঘটার আগেই লাফিয়ে নেমে পড়েছিলো উত্তাল পানিতে, তারপর কোনোরকমে সঁতরে গিয়েছিলো ঐ দ্বীপটায়…

 রেমির উদ্বেগটা ধরতে পারছে স্যাম। সোনারের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কোনো সমস্যা?

জাহাজডুবি নিয়ে ভাবছিলাম। ভেবে দেখো, এতো কাছেই একটা তীর, হয়তো ভাববে, ওখানে গেলেই নিরাপত্তা পাওয়া যাবে…

রেমির সাথে সাথে স্যামও তাকালো দ্বীপটার দিকে। আমার মনে হয় ভাইপারের কামড় খেয়ে মরার চেয়ে ডুবে মরাকেই বেছে নিবো আমি।

আমি কোনোটাই বেছে নিবো না।

রেমির গালে ধরে মুখটা তার দিকে ঘুরিয়ে নিলো স্যাম। তোমার তীক্ষ্ণ দষ্টির সাহায্য কাজে লাগাতে পারতাম আমি।

এরপর আর দ্বীপের কথা না ভেবে স্যামের পাশে বসে সোনারের রিডিংর দিকেই মনোযোগ দিলো রেমি। পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হলো অযথাই পুরোটা দিন নষ্ট করেছে ওরা। একটা সময় বাতাসের আচরণও পালটে গেলে কিছুটা, পানিও ফোঁসফোঁস করতে শুরু করেছে। সব দেখে স্যামকে আজকের দিনের মতো ক্ষান্ত হতে বলতে যাবে, ঠিক তখনই স্যাম সোনারের পর্দার দিকে নির্দেশ করে বলল, মনে হয়, আমরা আমাদের জাহাজটা পেয়ে গেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *