১১৩. মণীশের শরীর খারাপ হয়েছিল

মণীশের শরীর খারাপ হয়েছিল এ খবরটা বুবকাকে পাঠানো হয়েছিল খুব সতর্কতার সঙ্গে পুজোর ছুটির আগে। যাতে বুকার পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। চিঠি পেয়েই বুবকা ট্রাংক কল করল এক সন্ধেবেলায়। সেই সরল বালকের মতো গলা এখনও।

বাবা কেমন আছে মা? আমাকে আগে কেন জানি।

ওরে, তেমন কিছু নয়। এখন ভাল আছে।

কেমন ভাল? হান্ড্রেড পারসেন্ট।

হ্যাঁ। অফিসে যাচ্ছে তত।

তোমাকে বলে দিচ্ছি মা, বাবার শরীর খারাপ হলেই আমাকে খবর দেবে। আমার পড়ার ক্ষতির কথা ভেবো না। ওসব আমি মেকআপ করে নেবো।

আমরা তো আছিই তোর বাবাকে ঘিরে। চিন্তা কিসের?

বাবার জন্য আমার ভীষণ টেনশন হয়। আচ্ছা মা, বাবা কি পিরমানেন্ট হার্ট পেশেন্ট হয়ে গেল?

না, তা কেন? সাবধানে থাকলে সেরে যাবে। ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই।

বাবা কি বাড়ি ফিরেছে?

না তো।

এত দেরি হয় কেন ফিরতে?

একটু বাদেই ফিরবে, রোজ যেমন ফেরে।

আমি আর তিন-চার দিনের মধ্যেই আসছি। কিপ হিম ফিট অ্যান্ড ফ্রেশ।

আচ্ছা রে আচ্ছা।

আধা ঘন্টা বাদে মণীশ ফিরল। স্মিতমুখে বুকার ফোন করার কথা শুনল। বলল, তোমার কী যে দুর্বদ্ধি অপু! কেন ওকে আমার অসুখের কথা জানাতে গেলে। ওর কত পড়ার চাপ বলো তো! আমার তো এমন কিছু হয়নি যে জানাতে হবে!

অপর্ণা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, এমনিতে জানতাম না। কিন্তু পুজোয় তোমার সবাইকে নিয়ে কুলু-মানালি যাওয়ার কথা না? বুবকা হয়তো আশা নিয়ে আসবে, হয়তো বন্ধুদের কাছে গল্পও করবে। যাওয়াটা যে হচ্ছে না তা জানিয়ে দিলাম।

মণীশ অবাক হয়ে বলল, যাওয়া হচ্ছে না কে বলল? কেনই বা যাওয়া হবে না? যাওয়া-আসার রিজার্ভেশন কবে হয়ে গেছে।

অপর্ণা গম্ভীর হয়ে বলে, যাওয়া যে হচ্ছে না তার একটা খুব সহজ সরল কারণ আছে।

কি কারণ অপু?

আমি যেতে দিচ্ছি না।

মণীশ ব্যথিত মুখে বলে, কেন অপু? আমার তো কিছু হয়নি। ভাল আছি। ছেলেটা আশা করে আসবে। ছেলেটার কত খাটুনি যাচ্ছে, ওর একটু রিলিফ হত।

ওর বয়স পড়ে আছে। সারা দুনিয়া চষে বেড়াতে পারবে। কিন্তু তোমাকে আমি এই শরীরে কিছুতেই ঘরের বার হতে দেবো না।

মণীশ একটু হেসে বলে, এভাবে বাক্সে পুরে রাখতে চাও? সেটাই কি বেঁচে থাকা?

বেঁচে থাকো তো আগে, বেড়ানো অনেক হয়েছে। বেঁচে থাকলে আরও হবে। নিশিপুরের ধকলেই কেমন বিগড়ে গিয়েছিলে বলো তো। এখন দৌড়ঝাঁপ একদম বন্ধ।

খুব হতাশ করে দিলে ভাই। টিকিটগুলো কাটা ছিল। এই পুজোর বাজারে কনফার্মড টিকিট। তিন মাস আগে কেটে রেখেছিলাম।

কালকেই টিকিট ফেরত দাও।

করুণ মুখ করে মণীশ বলে, আর একবার ভেবে দেখ। আমি না হয় গিয়ে হোটলের ঘরেই বসে থাকব, তোমা ঘুরে বেড়িও।

অপর্ণা একটু ধমকের গলায় বলে, আচ্ছা, কী আছে বলে তো ওসব জায়গায়? পাহাড় পর্বত আর প্রকৃতি তো? রাজ্যের লোক সেখানে গিয়ে জুটছে প্রত্যেক সিজনে। এমন কিছু রিমোট বা নতুন জায়গাও নয়। আমরা তো ঘুরে এসেছি একবার।

তখন বুবকা ছোট ছিল। ওর মনে নেই।

বড় হলে আবার যাবে। যদি ওর ইচ্ছে হয়।

মণীশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কথাটা তুমি বোধ হয় ঠিকই বলেছ। নির্জন, দুৰ্গম, অচেনা বলে আর কোনও জায়গাই থাকছে না। সর্বত্র পিলপিল করে লোক যাচ্ছে। এমন কি এভারেস্টে এত লোক উঠছে যে তাদের ফেলে আসা আবর্জনা আর কৌটো-বাউটোয় নাকি এভারেস্টই এখন আস্তাকুঁড় বলে স্বয়ং এডমন্ড হিলারি দুঃখ করেছেন। তা হলে এবারটা বাদ দিতে বলছ?

নিশ্চয়ই।

কাছেপিঠে কোথাও?

হ্যাঁ, গাড়ি করে একদিন দুদিনের জন্য বেরোতে পারি। তাও কাছেপিঠে। দূরে কোথাও নয়।

মণীশ একটু হাসল। বলল, তথাস্তু। তুমি হলে সুপ্রিম কোর্ট, তোমার ওপর তো কথা চলে না। কিন্তু তোমাকে বলি, এবারে কিন্তু আমার হার্টের প্রবলেম ছিল না। ডাক্তার তো বলেইছে পেটে গ্যাস জমে ওপর দিকে প্রেশার দিয়েছিল বলে ওরকম হয়েছিল।

হয়তো তাই। হয়তো নিশিপুরে যাতায়াতের ধকলটা তোমার সহ্য হয়নি।

মণীশ মাথা নেড়ে বলে, না না, তা নয়। নিশিপুর এমন কিছু দুর্গম জায়গা তো নয়।

বিচ্ছিরি জায়গা। খাড়া খাড়া পাড় বেয়ে নামা ওঠা, তার ওপর ভটবটির ডিজেলের গন্ধ, ভাটির সময় কাদা। মাগো। কি করে যে ওরকম জায়গা হেমাঙ্গ বেছেছিল ও-ই জানে!

শুনলে বেচারা দুঃখ পাবে।

পাক। ওর ঘাড় থেকে নিশিপুরের ভূত নামানো দরকার।

মণীশ হাসল, সবাই কি তোমার চোখ দিয়ে দুনিয়াটা দেখে? যার কাছে যা সুন্দর লাগে তা লাগতে দেওয়াই তো ভাল। কেন বেচারার নিশিপুর তুমি কেড়ে নিতে চাও?

কেন চাই? সে তুমি বুঝবে না। বলে অপৰ্ণা একটু মুখ টিপে হাসল।

বুকার যেদিন আসার কথা সেদিনই একটু বেলার দিকে এল আপা। তার তেমনই শীর্ণ চেহারা। তেমনই অমনোযোগী পোশক। তেমনই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখশ্ৰী। এসেই বলল, অনীশ এখনও আসেনি? আমাকে যে চিঠি দিয়েছিল আজ, শনিবার আসবে। আমি যেন অবশ্যই আসি।

মণীশের আজ ছুটির দিন। ছুটি না থাকলেও সে আজ ছুটি নিত। আজ বুবকা আসবে, আজ একটা বিশেষ দিন। সে হেসে বলল, বুবকা এসে যাবে আপা। তুমি ঘরে এসে বোসা। কতকাল পরে এলে! তোমার নতুন সব অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলবে না আমায়?

আপা হতাশার সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, আমার দ্বারা ডাক্তারি পড়া হবে না কাকাবাবু। আমি খুব হতাশ।

দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর মুখে হতাশার কথা শুনতে আমি রাজি নই আপা। এসো, তোমার প্রবলেমটা শুনি।

ওঃ, আমার যে কত সমস্যা কাকাবাবু। যেখানে যাই সেখানেই সমস্যা চোখে পড়ে। সবাই আমাকে কী বলে জানেন? বলে, আপা ইনভাইটস্ প্রবলেম।

ঘরে এসে আপা ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ারে বসল। তাকে দেখতে রান্নাঘর থেকে অপর্ণা, অন্য দুই ঘর থেকে অনু আর ঝুমকি বেরিয়ে এল। সকলের কাছেই আপা এক কৌতূহলের বস্তু। সে যে কখন কী করে বসে তার তো ঠিক নেই।

বাতাসটা একটু খুঁকে নিয়ে আসা বলল, উঃ, আজ তো দারুণ সব রান্না হচ্ছে কিমা! নিশ্চয়ই ফ্ৰায়েড রাইস বা বিরিয়ানি! আর মুর্গি বোধ হয়।

অপর্ণা হেসে ফেলে বলে, তা হচ্ছে। বহুদিন বাদে বুবকা আসছে তো। তুমি আজ খেয়ে যাবে কিন্তু।

আপা একগাল হেসে বলে, আমার পাকস্থলী কতটুকু জানেন? একটা পিংপং বলের মতো ছোট। আমি তো একটুখানি খাই। তার ওপর আমরা কট্টর তামিল ব্রাহ্মণ, মাছ মাংস খাই না।

ওঃ, তাই তো? আমার মনে ছিল না। কিন্তু কোনও অসুবিধে নেই। নিরামিষ পদও অনেক হচ্ছে।

ঝুমকি বলল, আমি দোসা ইডলি সব বানাতে পারি। খাবে?

মাথা নেড়ে আপা বলে, ইডলি দোসা লাগবে না। আমরা কলকাতায় থাকতে থাকতে খাদ্যাভ্যাস অনেক পাল্টে ফেলেছি। সাদামাটা বাঙালি খাবারও চলবে।

খাদ্যাভ্যাস কথাটা শুনে মণীশ হাসল, তুমি এখনও সাধু বাংলায় কথা বলে। ফুড হ্যাবিট না বলে খাদ্যাভ্যাস বললে। ভাল লাগল।

ইংরিজিটা আমি সহজে বলি না। একটা দুটো বলে ফেললে কী করি জানেন? কটা ইংরজি বলেছি তা হিসেব করে রাতে শোওয়ার সময় ততবার নিজের কান মলে দিই।

সবাই খুব হাসল।

আপা ম্লান মুখে বলল, একটু আগেই কিন্তু বলেছি ইংরিজি।

কী বলেছ?

বলেছি, আপা ইনভাইটস্ প্রবলেম। দুবার কানমলা পাওনা হয়েছে।

হাসতে হাসতে মণীশের মনটা অনেকটা হালকা হয়ে গেল। বলল, তুমি ইম্পসিবল। কিন্তু প্রবলেমটা কি?

সমস্যা কি একটা কাকাবাবু? আর যত সমস্যা সব আমার এই পোড়া চোখেই পড়বে। ডাক্তারি পড়ছি তো, ডাক্তারির প্রথম কথাই হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা, জীবাণুমুক্ত পরিবেশ, শান্তি, নিস্তব্ধতা—না হলে রুগী ভাল থাকবে কি করে বলুন। আমাদের হাসপাতালগুলো তো আপনি জানেন।

মণীশ যেন শিউরে উঠে বলে, নরক। যখন প্রেস ফটোগ্রাফার ছিলাম তখন কলকাতার হাসপাতাল নিয়ে একটা ফটো-ফিচার করেছিলাম। বীভৎস।

সত্যিই তাই কাকাবাবু। টয়লেট থেকে শুরু করে বিছানাপত্র, খাবারদাবার সব কিছু এত খারাপ যে আমার মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়।

অনু বলল, এই আপাদি, তুমি কিন্তু এইমাত্র টয়লেট বলেছ।

আপা হাসল, জানি। এই দেখ কড় গুনছি কটা হল। বলে সত্যিই আঙুল দেখাল আপা। কড়ে আঙুলের তিন নম্বর কড়ের ওপর বুড়ো আঙুলটা দেখে সবাই ফের হেসে খুন।

অপৰ্ণা বলল, আহা ইংরজি বললে কী হয়? কত শব্দ তো ইংরজি ছাড়া নেই। ইনজেকশনকে কী বলবে?

ওটার বাংলা আছে কাকিমা। সূচিকাভরণ।

অপর্ণা হেসে ফেলে বলে, হাঁ, হ্যাঁ, মনে ছিল না। কিন্তু সূচিকাতরণ বললে কেউ কি বুঝবে?

আমি চালু করে দিয়েছি। তবে সূচিকাভরণ নয়। হিন্দিতে উঁইয়া বলে, বাংলা করেছি ছুঁচ। রুগীকে বলি, এবার আপনাকে উঁচ দেওয়া হবে। প্রথম প্রথম অবাক হত। এখন হচ্ছে না।

উঃ বাবা, তুমি অদ্ভুত মেয়ে। অথচ বাংলা তো মাতৃভাষা নয়।

ওটাই তো ভুল কাবিমা। কে বলল বাংলা আমার মাতৃভাষা নয়? ভারতের সব ভাষাই আমার মাতৃভাষা। আমি সব কটা ভাষা শিখবার চেষ্টা করছি।

মণীশ বলল, তুমি বোধ হয় পেরেও যাবে। তারপর তোমার প্রবলেমের কথা বলে।

তাই তো বলছি। হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে এসব দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেল। আঁটা বালতি নিয়ে পায়খানা, কলঘর পরিষ্কার করে ফেললাম একদিন। রুগীদের বিছানার চাঁদর পাল্টে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তার পর হামলা চালালাম রান্নাঘনে, এসব কী খাবার দেওয়া হচ্ছে?

সঙ্গে অন্য ছেলেমেয়েরা ছিল? তাদের সাপোর্ট পেয়েছ?

প্রথমে নয়। সবাই ভয় পেত। নতুন এসেছে তো, ব্যাপারটা বুঝতে সময় নিচ্ছিল। পরে অবশ্য দু-চারজন করে সমর্থক পেয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু লেগে গেল ধাঙর মেথর ঝাড়ুদার ওয়ার্ডবয়দের সঙ্গে, তারপর সুপারের সঙ্গে, তারপর কায়েমী স্বার্থের লোকজন-অৰ্থাৎ ঠিকাদার, সাপ্লায়ারদের সঙ্গেও। অনু, আমি হিসেব রাখছি, আরও তিনটে হল। ওয়ার্ড বয়, সুপার আর সাপ্লায়ার।

অনু বলল, কিন্তু এগুলোর তো বাংলা হয় না আপাজি, এগুলো ক্ষমা করা যায়।

সাপ্লয়ারের বাংলা হতে পারে সরবরাহকারী। সুপারের হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক। ওয়ার্ডবয়েরও বাংলা হয় বোধ হয় না মনে পড়ছে না এখন। একটা কী যেন করেছিলাম। যাকগে, এসব করতে গিয়ে লেখাপড়া মাথায় উঠল। কর্তৃপক্ষ তাড়ানোর হুমকি দিতে লাগল। নিম্নবর্ণীয় কর্মীরা একদিন কাজ করল না। তাদের দাবি, আপাকে সরাতে হবে।

তারপর?

খুব অশান্তি গেল কয়েকদিন। আমি খুব গলাবাজি করলাম। ঠেলা ধাক্কাও পেলাম। যারা পেশাদার রক্তদানকারী তারাও একদিন চড়াও হল। শুনছি, আমার নামে মন্ত্রীর কাছে নালিশ গেছে। আমি ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু ভাবছি, এসব করে কিছু হবে না কাকাবাবু। সবাই মিলে, অর্থাৎ শহরের সব লোক মিলে যদি হাসপাতালগুলিতে হানা দেওয়া যায় মাঝে মাঝে তাহলে হয়তো হয়। সরকার তো কিছু করতে পারে না। কোনও ক্ষমতাই নেই।

কেন পারে না আপা?

সরকার তো দেশটার সব ডাইমেনশন দেখতে পায় না। তার দেখাটা হয় একবৰ্মা, একপেশে। তারপর সরকার চালায় রাজনীতি এবং দল। দল মানেই চোখে রঙিন চশমা, দলের গাইডলাইন মেনে বিচার বিবেচনা সিদ্ধান্ত করতে হয়। তাই নিরপেক্ষতা থাকে না। রাজনীতিকে চলতে হয় দুনীতিবাজদের কাঁধে ভর রেখে। কী করে কী হবে কাকাবাবু? সরকার তো কত নীতি বানায়, আইন বানায়, সেগুলো হয়তো খুব ভালও। কিন্তু মানুষ যে সেসব আইন বা নীতির খবরই রাখে না, হাসপাতালের রুগী কি জানে যে তার কতটা পাওনা আর কতটুকু তাকে দেওয়া হচ্ছে? তার বিছানার চাঁদর কেন পাল্টানো হয় না, তাকে কেন বেডপ্যান দেওয়া হয় না, কেন শৌচাগারগুলো অমন নোংরা, এসব নিয়ে প্রশ্নই নেই তাদের।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মণীশ বলে, সব জানি আপা! সব জানি। তুমি একটু সাবধান থেকো। অর্গানাইজড না হয়ে ভীমরুলের চাকে ঢিল মারা ঠিক নয়।

আপা নির্বিকার মুখে বলে, আমি কাউকে শক্ত বা প্রতিপক্ষ বলে ভাবি না কাকাবাবু। আমি এদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে, ইচ্ছে করলেই হাসপাতাল অনেক পরিচ্ছন্ন রাখা যায়, রুগীদের অনেক আরাম দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ নিজেকে পাল্টাতে চায় না, যা হয়ে আসছে, যা চলে আসছে তার পরিবর্তন করতেও কেউ রাজি নয়। তারা বলে, এত রুগীর ভিড়, জায়গা নেই, ডাক্তার বা ওষুধের অভাব, মাইনে কম। সব সত্যি। তবু ওর মধ্যেই করা যায়। এদেশে কেউ তো যথাসাধ্য করে না। সবাই গা-ছাড়া ভাব। আমি তাদের উৎসাহ দিতে চেষ্টা করি মাত্র।

মণীশ মাথা নেড়ে বলে, তবু সাবধান থেকে আপা। টেক গার্ড।

আপা স্নিগ্ধ হেসে বলল, আমি একটা রোগা দুৰ্বল মেয়ে কাকাবাবু। আমাকে কজন মারবে? কবার মারবে? সবাই যে কেন আমাকে মারবে বলে হুমকি দেয় সেটাও বুঝি না। আমাদের হাসপাতালের একজন গুপ্তা ধরনের লোক আমাকে শাসাতে এসেছিল, আমি তাকে বললাম, আপনি আমার চেয়েও দুর্বল। কারা মারতে চায় জানেন? যাদের নিজেদের। সাফাই গাওয়ার মতো যুক্তি নেই, যারা ধরা পড়ার ভয়ে কাটা হয়ে আছে, যারা অসৎ এবং দুর্বল। লোকটা আমাকে চড় তুলেছিল। অন্যরা ধরে ফেলায় মারতে পারেনি।

ট্যাক্সি থামল বাইরে। হইহই করতে করতে ঘরে এসে ঢুকল বুকা। সঙ্গে সুটকেস-বিছানা আর দুজন বন্ধু। মুখে এক গাল হাসি।

মা! বাবা! মিট ভাস্কর অ্যান্ড পথিক। ওদের সময় নেই। আমাকে নামিয়ে ওরা একজন টালিগঞ্জ আর অন্যজন বেহালা যাবে। জাস্ট সে হ্যালো। ওঃ আপা! গ্রেট প্লেজার। হাই দিদি! হাই অনু!

বন্ধুরা খুব তাড়াহুড়ো করেই চলে গেল। তারপর বুবকা ছেলেমানুষের মতো জড়িয়ে ধরল মণীশকে।

কী হয়েছিল বাবা তোমার?

মণীশ বুকার মাথাটা কাঁধে চেপে ধরে বলল, কিছু নয়। আই অ্যাম ফাইটিং ফিট।

তুমি যদি এরকম আর করে তাহলে আমি পড়া ছেড়ে চলেই আসবো বলে দিচ্ছি।

মণীশ একটু হাসল। বুকার গা থেকে পুরুষ মানুষের মতো তাপ ও গন্ধ আসছে না? কোমল দাড়ি ও গোফে। সমাচ্ছন্ন ছিল মুখ। এখন দাড়ি কামাচ্ছে। গোঁফ রাখছে। বুবকা এখন যুবক। পরিপূর্ণ মানুষ।

অপর্ণার মুখ খুশিতে উপচে পড়ছে। দুটি বোনের মুখ উজ্জ্বল। বাড়ির অনুপস্থিত একজন লোক ফিরে এলে যেন নিজের অস্তিত্বেরই একটি হারানো অংশ ফিরে আসে।

সকলকেই একটু একটু উঁয়ে দেখল বুবকা। তারপর আপার দিকে চেয়ে বলল, আপা, আই স্যাম মিসিং অল ফ্রেন্ডস ভেরি মাচ। আমরা চারজন আই আই টিত, তুমি ডাক্তারিতে, সঞ্জয় আর সিংজী যাদবপুর ইলেকট্রিক্যালসে। কোথায়, কোথায় ছড়িয়ে পড়লাম আমরা। অল সেপারেটেড। একটা গেট টুগেদার অ্যারেঞ্জ করো না!

আপা মাথা নেড়ে বলল, আমার সঙ্গে প্রায় সকলেরই যোগাযোগ আছে। সহজে করা যাবে। ওখানে নতুন বন্ধু-বান্ধব। কেমন হল?

অনেক। তবে পড়ার চাপ আছে। বেশি আড্ডা হয় না। তবে তোমার কথা আমরা খুব বলি। তোমার নতুন অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলো আপা।

আপা একটু হাসল, কাকাবাবু আর কাকিমার কাছে শুনে নিও। আমি এখন চলে যাবো অনীশ, অনেকদিন বাদে তুমি বাড়ি এসেছ, একজন বাইরের লোক বসে থাকলে তোমাদের ছন্দ কেটে যাবে।

অপর্ণা হাঁ হাঁ করে উঠল, বলে কী রে মেয়েটা। এই যে বললাম খেয়ে যাবো। তুমিও তো রাজি হলে।

মুখখানা ম্লান করে আপা বলে, আমাকে খাইয়ে আপনি খুশি হবেন না কাকিমা, আমি যে খেতেই পারি না।

সে জানি। তোমাকে খাইয়ে দেখেছিও, তবু একটু কিছু মুখে দাও। সাদা ভাত আর পটলের কারি আছে।

দিন তবে ছোট্ট করে। হাসপাতালে একটা পোড়া রুগী আছে। শতকরা পঁয়তাল্লিশ ভাগ পোড়া। সতেরো-আঠেরো বছর বয়সের ফুটফুটে মেয়ে। সে আমাকে খুব খোজে। তার জন্যই এখন যেতে হবে।

অপর্ণা ছলছলে চোখে বলে, আহা রে। বাঁচবে তো?

ঠোঁট উল্টে আপা বলে, কে বলতে পারে কাকিনা? গঁয়তাল্লিশ ভাগ পোড়া তো ভাল হওয়াই উচিত। কিন্তু সেরকম যত্ন যদি পায়। নইলে দ্বিতীয় সংক্রমণে মরে যাবে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি বাঁচানোর।

একটু অবাক হয়ে অনীশ বলল, আপা, আজকাল যে বঙ্কিমী ভাষায় কথা বলছ?

চেষ্টা করছি। তুমিও শুরু করে দাও। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করলে দাঁড়ানোর জমি পাবে না। বাঙালিরা বড্ড তাড়াতাড়ি আন্তর্জাতিক হয়ে যায়। তাই তাদের শক্তি কম।

ও বাবা, তুমি তো আরও পেকেছ দেখছি। আগে তবু মাসিমা গোছের ছিলে, এখন তো দেখছি পুরো দিদিমা।

একটু হাসাহাসি, আরও কিছু পুনসুটির পর আপা তার চড়াই পাখির মতো খাবারটা শেষ করে উঠে পড়ল। বলে গেল, তোমার পুনর্মিলনের ব্যাপারটা সংগঠিত করছি। দেখা হবে।

নাঃ, তোমার সঙ্গে কথা বলতে হলে এখন থেকে বাংলা ডিকশনারিটা হাতে নিয়ে বসতে হবে দেখছি।

মণীশ বলে, ওকে ঠাট্টা করি না বুবকা, ও যে একটা মিশন নিয়ে চলে, সেটা তো কম কথা নয়। আজকাল পাবি ওরকম মেয়ে।

বুকা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, তা ঠিক বাবা। আমরা একে ঠাট্টা করলেও ভীষণ রেসপেক্টও করি। আমি তো বলি, আপার মতো এমন মহৎ বন্ধু আমার আর নেই।

অনু আর ঝুমকি মিলে বুকার বাক্স-বিছানা খুলে ফেলছিল। ঝুমকি, চেঁচিয়ে উঠল, এঃ মা! জামাকাপড় কিরকম নোংরা করে এনেছে, দেখ মা!

অনু বলল, বিছানার চাঁদর আর বালিশের কভার দেখ মা, একদম স্লাম ড়ুয়েলারদের মতো।

তুই কী রে বুবকা?

বুবকা হেসে বলে, না না, রেগুলার কাচি। এবার বাড়িতে আসব বলে গত দশ বারো দিন সব জমিয়ে রাখছিলাম।

অপর্ণা বলল, আচ্ছা থাক না, কেচে দেওয়া যারে। ও কি কখনও কাঁচাকুচি কবেছে? এই তো সবে হাতেখড়ি। হ্যাঁ রে, তাদের হস্টেলে লন্ড্রি নেই।

ধোবি আছে। তবে আমি নিজেই কেচে নিই। ধোবি শুধু মাঝে মাঝে ইস্তিরি করে দেয়।

সারা দিন গল্পে গল্পে কেটে গেল। বিকেলে বুবা তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেল। একটু বেশি রাতের দিকে সবাই শুয়ে পড়লে বুবকা হানা দিল দিদির ঘরে।

অ্যাই দিদি, ঘুমোচ্ছিস?

ঝুমকি জেগেই ছিল। উঠে বসে মায়াভরা গলায় বলল, আয়। বোস এসে।

বুবকা ঝুমকির চেয়ারটায় বসল। বিছানায় ঝুমকি।

হ্যাঁ রে দিদি, তোর নাকি বিয়ে হয়ে যাবে?

যাঃ। কে বলল?

অনু বলছিল।

অনুটা খুব পেকেছে দেখছি।

ও তো বলছিল সব ঠিকঠাক। শুনে আমার এত মনটা খারাপ হয়ে গেল, বাড়ি এসে তোকে দেখতে পাবো না ভাবতেই পারি না। আচ্ছা, বিয়ের পর মেয়েদের পদবী-টদবী সব চেঞ্জ হয়ে যায় এটা কিরকম নিয়ম বল তো! তোর সব পরিচয় মুছে যাবে নাকি?

বাজে সব নিয়ম। কে যে করেছিল।

আচ্ছা দিদি, আর ইউ ইন লাভ? সত্যি করে বল তো! আমাকে ছুঁয়ে বল।

উঃ, তোকে নিয়ে আর পারি না। গাছে কাঁঠাল গোফে তেল। কোথায় কী?

অনু এমনভাবে বলল যে বিয়ে হুট করে হয়ে যাবে। হেমাঙ্গদাকে আমি দু-একবার দেখেছি অবশ্য। এ পাবসোনেল ম্যান।

ঝুমকি মুখটা একটু ঘুরিয়ে নিল। বলল, এখনও কিছু ঠিক নেই।

কেন ঠিক নেই?

সুমকি হঠাৎ মুখটা তুলে বুকার দিকে চেয়ে বলল, বোধ হয় আমার পক্ষে ও একটা ভুল লোক।

ভুল লোক? তার মানে?

একা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝুমকি মাথা নেড়ে বলে, জানি না। ও মেয়েদের ভয় পায়। একা থাকতে ভালবাসে। নানা রকম খেয়াল নিয়ে চলে।

বাট হি ইজ এ নাইস ম্যান। ভদ্র, বিনয়ী, আন্তরিক।

সেটা তো সবাই বলে।

তোকে প্রোপোজ করেছে?

না। প্রোপোজ করতেই তো ভয়।

তাহলে অনু যে বলল, ভদ্রলোক তোর জন্য পাগল!

অতটা নয়। তবে কিছু সফটনেস্ আছে হয়তো।

তোর?

আমার! না, আমার তেমন কিছু ব্যাপার নেই।

তুই রাজি নোস?

তাও জানি না।

লোকটাকে তোর ভাল লাগে?

ঝুমকি একটু ভেবে বলল, সেটা তো প্রেম নয়।

তাহলে কী রে দিদি?

ঝুমকি হেসে ফেলল, তুই সেই ছেলেমানুষটাই রয়ে গেছিস।

কেন রে?

এখনও তারি সহজ সরল আছিস তুই। নইলে এভাবে জিজ্ঞেসই করতে পারতি না।

বুবা হাসল, বিয়েটা করেই ফেল দিদি। এ লোটা ভাল। আই অ্যাপ্রুভ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *