আবু জুনায়েদের দুলালি দীলু একটা মস্ত কাণ্ড করে বসল। আবেদ হোসেনকে দিয়ে গোয়ালঘরের দরজায় একটা নেমপ্লেট লাগিয়ে দেয়া হলো। গরুটির যেহেতু তরণী নামকরণ করা হয়েছে, সুতরাং গোয়ালটির নাম হলো তরণী নিবাস। আরো কিছু কথা যোগ করার ইচ্ছে দীলুর ছিল- যেমন এই প্রজাতির গরু বাংলাদেশে এই একটিই আছে এবং গরুটির মা-বাবা উভয়েই শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ভুক্ত। বাবা অস্ট্রেলিয়ান, মা সুইডিশ। আবেদ হোসেন দীলুকে বুঝাতে সক্ষম হলেন, যে তার কোনোই প্রয়োজন নেই। গরুটি যে একবার দেখবে প্রথম দর্শনেই বুঝে যাবে এটা ভিন্ন জাতের গরু। বাংলাদেশের গরু সম্প্রদায়ের আত্মীয়স্বজন কেউ নয়; এই চতুষ্পদের বেটি। তারপরেও জাতীয়তার বিচারে তরণীকে বাংলাদেশী বলতে হবে, কারণ তার জন্মস্থান বাংলাদেশ। অন্য কেউ হলে দীলুকে অত সহজে নিবৃত্ত করা যেত না। তবে আবেদ হোসেনের কথা আলাদা। আবেদ ভাই দেখতে কী হ্যান্ডসাম। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছেন, অথচ একটুও অহংকার নেই। কী রকম সপ্রতিভভাবে কথা বলেন। পাজেরোর স্টিয়ারিং হুইল ধরার ভঙ্গিটা কী চমৎকার। দীলুর তো ইচ্ছে করে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে একটু ঘুরে টুরে আসে।
তরণী, হ্যাঁ গরুটিকে এখন থেকে এ নামেই ডাকতে হবে। অস্ট্রেলীয় বাবার ঔরসে সুইডিশ মাতার গর্ভে যার জন্ম, বাংলাদেশের মাননীয় পশু বিশারদেরা দেশী নৌকার সঙ্গে যার আকৃতির সাদৃশ্য দেখতে পেয়ে এই চমৎকার নামটি দিয়েছেন, তার প্রতি সম্মান না দেখালে অন্যায় করা হবে। তরণী ‘তরণী নিবাসে’ আসার পর থেকে আবু জুনায়েদের পারিবারিক জীবনে নানারকম গণ্ডগোল ঘটতে আরম্ভ করল।
আবু জুনায়েদ অতিশয় কর্মব্যস্ত মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদায়, কর্মচারীমণ্ডলী, ছাত্রছাত্রীর কাছে কোথাও না কোথাও একটা ঘাপলা প্রতিদিন লেগেই আছে। কোথাও খুন হচ্ছে, কোথাও ভাঙচুর চলছে, মাইনে বাড়ানো, পরীক্ষা পেছানো এই জাতীয় কত রকমের দাবি বর্শার চকচকে ফলার মতো ধারালো হয়ে জেগে উঠছে। সরকারের মন্ত্রিমহোদয় চোখ রাঙাচ্ছেন, বিরোধী দলের নেতা হুংকার দিচ্ছেন, সবকিছুর দায়ভাগ শেষ পর্যন্ত আবু জুনায়েদকেই বইতে হয়। কোন্ দিক তিনি সামলাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন বাঁধা প্রশাসনিক কাজের পরিমাণও অল্প নয়। সামাল দিতে গিয়ে আবু জুনায়েদকে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। তার উপর চারদিকে অসন্তোষ। তার নিজের দলটির শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই আছে। অনেক কিছুর আশায় যারা ডোরাকাটা দলে যোগ দিয়ে আবু জুনায়েদকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের অনেকেই তার বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছেন। দল ছেড়ে যাবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরা প্রচার করতে আরম্ভ করেছেন, প্রাক্তন উপাচার্য আবু সালেহ পাঁচ বছরে যে পরিমাণ অনিয়ম করতে পারেননি আবু জুনায়েদ পাঁচ মাসে তার দুগুণ করে ফেলেছেন। শুধু তার দলের শিক্ষকদেরই পদোন্নতি ঘটেছে। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তারাই হাতিয়ে নিয়েছেন, তাদের নামেই বাড়িগুলো বরাদ্দ হয়েছে। প্রভোস্ট, হাউস টিউটর থেকে শুরু করে দারোয়ান, মালি পর্যন্ত সবগুলো চাকরি আবু জুনায়েদের লোকেরা বাগিয়ে নিয়েছে। চারদিকের তাপ চাপে আবু জুনায়েদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। আবু জুনায়েদের নিশ্বাস ফেলার ফুরসত মেলে না। সকালে মিটিং, দুপুরে মিটিং, সন্ধ্যেয় মিটিং। সবগুলো মিটিংয়ে তাকে প্রিসাইড করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও কোথাও নিজের মতামত আরোপ করতে পারেন না। প্রায় সময়ই আবু জুনায়েদকে নিজের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। মাঝে-মাঝে আবু জুনায়েদের মনে হয়, মাছঅলা তরকারিঅলার সঙ্গে দরাদরি করার সময় তিনি যে ব্যক্তিত্বের স্বাদ পেতেন, স্বাধীনতার যে উত্তাপ অনুভব করতেন, উপাচার্যের চেয়ারে বসার পর সেসব উধাও হয়ে গেছে। তিনি একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন। তিনি কিছুই করছেন না, তাকে দিয়ে করিয়ে নেয়া হচ্ছে। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই।
আবু জুনায়েদের মন মেজাজ ইদানীং খুব খিচরে থাকে। মন খুলে কথা বলার মতো কোনো বন্ধু তার নেই। নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে তার কোনোরকম ভাব বিনিময় সম্ভব নয়। এখন নুরুন্নাহার বানুর অধীনে অনেক চাকর বাকর। নিজের হাতে কুটোটি ছিঁড়তে হয় না। এই বাড়তি সময় তিনি রূপচর্চার কাজে ব্যয় করেন। মেয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখে কাঁচা হলুদ, মশুর ডাল বাটা এসব মাখেন। শ্যাম্পু দিয়ে মাথার হাল্কা হয়ে আসা চুলগুলো ফুঁপিয়ে ফুলিয়ে তোলেন। জুতোর হিলের উচ্চতা বৃদ্ধি করেই যাচ্ছেন। যখন তখন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান, আবু জুনায়েদ প্রয়োজনের সময়ও গাড়ি পান না।
ভেতর বাইরে দুদিকের চাপ যখন প্রবল হয়ে ওঠে, আবু জুনায়েদ তরণী নিবাসে গরুটির কাছে ছুটে যান। ক্রমাগত যাওয়া-আসার ফলে গরুটি তাকে চিনে ফেলেছে। তিনি যখন সামনে গিয়ে দাঁড়ান, গরুটি তার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তিনি যে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন, গরুটি বুঝতে পারে। আবু জুনায়েদ তরণীর মসৃণ পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। কুচিকুচি করে কাটা ঘাসের চুপড়িটা সামনে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। তরণী ধীরে-সুস্থে মন্থরভাবে অল্প-অল্প ঘাস গলায় চালান করতে থাকে। তরণীর কাছে যতক্ষণ থাকেন তিনি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়ে যান। তার মনে কোনো সন্তাপ, কোনো দুশ্চিন্তা থাকে । তিনি নিজের কাছে অনেক পরিমাণে লঘু হয়ে উঠতে পারেন। শেখ তবারক আলী যে লোকটিকে নিয়োগ করেছেন, তার কাছ থেকে তরণী সংক্রান্ত নানা সংবাদ খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চেষ্টা করেন। তিনি জেনেছেন তরণী এখন তিনমাসের গাভীন। ছয় মাসের মধ্যে তার বাচ্চা হবে। তখন তরণী মাসে আধমন করে দুধ দেবে। কিন্তু গাভীন অবস্থায় এ ধরনের গরুকে খুব সাবধানে রাখতে হয়। গরুকে নিয়মিত হাঁটা চলা করানো প্রয়োজন, যাতে করে তার শরীরের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সচল থাকে। প্রসব করার সময় যে কঠিন শ্রম করতে হবে, তার জন্য নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে আসন্ন গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তরণীকে প্রস্তুত করতে হবে। কী কী করতে হবে, তার সবটা লোকটিরও জানা নেই। যখন সময় ঘনিয়ে আসবে তবারক সাহেব বলেছেন, নিয়মিত ডেয়ারি ফার্ম থেকে পশু ডাক্তার এসে দেখে যাবেন। তরণীর পেটের বাচ্চাটির সম্বন্ধেও আবু জুনায়েদ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। স্থির করলেন কীভাবে নিরাপদ প্রসব করানো যায়, সে বিষয়ে তিনি খবরাখবর নেবেন।
এই চতুষ্পদ দুহিতার কাছে আসা-যাওয়া করতে গিয়ে আবু জুনায়েদের সামনে শব্দ এবং রূপের একটা নতুন জগৎ উন্মোচিত হলো। আবু জুনায়েদ গ্রামের ছেলে। গ্রামে থাকতে তিনি কখনো পাখির ডাক শুনেছেন মনে পড়ে না। গাছে পাতা হয়, এ তথ্য তার অজানা ছিল না। কিন্তু মাঘ মাসে শীর্ণ গাছের শরীর থেকে কী করে পত্রাঙ্কুর বিকশিত হয়, তিনি দেখেননি। পড়ন্ত বিকেলে নিরিবিলি গরুটিকে সঙ্গ দান করতে গিয়ে গাছের ডালে ডালে পাখিদের ওড়াউড়ি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি ঘুঘুদের গলা ফুলিয়ে ডাকতে শোনেন। বুলবুলির টুকরো টুকরো মিষ্টি আওয়াজ, শালিকের কিচিরমিচির ডাক, দোয়েলের একটানা শিস শুনতে শুনতে আবু জুনায়েদ ভিন্ন জগতের মানুষ হয়ে যেতেন। তিনি ভাবতে থাকেন, মানুষের ভেতর এত প্রতিহিংসা, এত রেষারেষি, এত উঁদুর দৌড় কেন? মানুষের জীবন কত সংক্ষিপ্ত । পাখিদের ডাক শুনেই তো একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। তরণী নিবাসের পাশের জারুল গাছটির ডালে পাতা গজাতে আরম্ভ করেছে। পয়লা রঙ ছিল বেগুনি, এখন সবুজ হয়ে উঠেছে। জন্মানো থেকে ঝরে পড়া পর্যন্ত গাছের পাতারও একটি নিজস্ব জীবন আছে। এ রকম সময়ে আবু জুনায়েদকে এক ধরনের দার্শনিকতায় পেয়ে বসে। ইতিপূর্বে যে কথা তার মনে আসেনি, সেসব বিষয় আস্তে আস্তে চিন্তার ভেতর ঘাই মারতে থাকে। মানুষের পরমায়ু কত সংক্ষিপ্ত। এই যে মানব জীবন, তা কি একেবারে অর্থহীন? নাকি মানব জীবনের একটা লক্ষ্য আছে।
আবু জুনায়েদের জীবন নিজের অজান্তেই তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিয়মিত অফিসে যান, আসেন। নিজের দলের লোক তাকে অপদার্থ বলে সমালোচনা করেন। বিরুদ্ধপক্ষের লোক তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ এনে জনমত তৈরি করছেন। সরকার ধাতানি দেন, বিরোধী দল হুমকি দেন। ছাত্রেরা প্রতিদিন চেপে ধরে স্পঞ্জের মতো রস বের করে ছাড়ছে। পাশাপাশি রয়েছে তার পারিবারিক জীবন। আবু জুনায়েদেরা তিনটি প্রাণী মাত্র। স্ত্রী নুরুন্নাহার বানু, মেয়ে দীলু এবং স্বয়ং তিনি। পারিবারিক জীবনেও আবু জুনায়েদ সুখী নন। নুরুন্নাহার বানুর চাহিদা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। তার দুর্মূল্য জড়োয়া গয়না হয়েছে। হুকুম তামিল করার চাকর-বাকর হয়েছে, এমনকি লাবণ্যও অনেকদূর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিধি অনেকদূর বিস্তৃত। বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার শিক্ষক গিন্নি যারা অতীতে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি, দেখিয়ে দিতে চান, ফারাকটা কতদূর। নুরুন্নাহার বানু কোথায়, আর তারা কোথায়? তার ভাইরা যে সমস্ত ছোট লোকদের মেয়েদের বউ করে এনেছেন, তাদের সঙ্গেও একটা ফয়সালা করতে হবে বৈকি। সারা জীবন ভায়ের বউরা তাকে অবজ্ঞা করে এসেছে, এবার নুরুন্নাহার বানুর জবাব দেবার পালা। শেখ তবারক আলীর বাড়িতে যে অত্যাধুনিক বহুমূল্য গৃহ সরঞ্জাম দেখে এসেছেন, সে রকম সাজসরঞ্জাম তারও চাই । নুরুন্নাহার বানু মুখে না বললেও স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তার এই সমস্ত দাবি আবু জুনায়েদকেই পূরণ করতে হবে। তিনি তার সমস্ত সাধ আহ্লাদ পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকজনের সামনে কলেমা পড়ে বিয়ে করেছেন। আবু জুনায়েদ কোন মুখে কোন সাহসে এখন না করবেন। নুরুন্নাহার বানু কি যেমন তেমন বাপের বেটি। তার আব্বা কি আবু জুনায়েদের লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেনি? দিনে দিনে আবু জুনায়েদের পারিবারিক জীবনটা একটা নরককুণ্ড হয়ে উঠল। অফিস এবং পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি হালফিল আবু জুনায়েদ আরেকটা গোপন জীবনের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। আবু জুনায়েদ মনে করেন, এই দিকটি যদি তার সামনে প্রকটিত না হতো, তার জীবন আরো অনেক বেশি ব্যথা-দীর্ণ হয়ে উঠত। মনে মনে আবু জুনায়েদ গরুটার কাজে ঋণী অনুভব করেন। গরুটা সময়মতো তার গোয়ালে এসেছিল বলেই আবু জুনায়দের কাছে জীবন অনেকখানি সহনীয় হয়ে উঠেছে। তিনি রাতের বেলা ঘুমোতে যাবার আগে চিন্তা করেন সকালে ঘুম থেকে উঠে গরুটার মুখ দেখবেন। অফিসে যাওয়ার সময় ভাবেন, ফিরে এসে গরুটাকে দেখতে পাবেন। এমনি করে গরুকে কেন্দ্র করেই তার গোটা জীবনের মধ্যে একটা চোরা আবর্ত সৃষ্টি হলো।
একদিন বিকেলবেলা ফিন্যান্স কমিটির মিটিং ছিল। বরাবরের মতো আবু জুনায়েদ প্রিসাইড করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন্ খাতে কত টাকা বরাদ্দ করা হবে, বাজেট তৈরির বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এই মিটিংয়ে কোষাধ্যক্ষ সাহেবও ছিলেন। নিরপেক্ষ এবং ন্যায়বান শিক্ষক হিসেবে ড. আকরাম সকলের শ্রদ্ধার পাত্র । আলোচনার এক পর্যায়ে ইতিহাস বিভাগের এক ফাজিল ছোকরা সরাসরি আবু জুনায়েদের চোখে চোখ রেখেই বলে বসলেন, আবু জুনায়েদের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর অর্থের অপচয় হয়েছে। তিনি তার দলভুক্ত কতিপয় অযোগ্য ব্যক্তিকে নানা প্রকল্পের পরিচালক করে দিয়েছিলেন। বাজেটের টাকা শেষ হয়ে গেছে, অথচ কোনো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। ফসিউদ্দিনের কাছ থেকে আবু জুনায়েদ ওরকম ব্যবহারই আশা করেছিলেন। ফসিউদ্দিনের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছিল না। একটা থার্ডক্লাস এবং ব্রেক অব স্টাডি ছিল। একজন ছাত্রীর অভিভাবকও শিক্ষক সমিতির কাছে সরাসরি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি তার কন্যাকে উত্যক্ত করেছেন। এত সব সত্ত্বেও আবু জুনায়েদ একা এককাট্টা হয়ে তাকে প্রফেসর বানিয়েছেন। অনেক প্রবীণ ব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে তাকে ফিন্যান্স কমিটিতে নিয়ে এসেছেন। সেই লোকটি আজ মিটিংয়ে তাকে তুলোধুনো করে ছাড়লেন। সবচাইতে দুঃখের কথা হলো, আকরাম সাহেব ফসিউদ্দিনের পক্ষেই কথা বলেছেন। কমিটির কেউ তাকে সমর্থন করতে এগিয়ে এলেন না।
আবু জুনায়েদ ঠাণ্ডা স্বভাবের মানুষ। মুখের উপর গালমন্দ করলেও চটার স্বভাব তার নয়। মেজাজের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দিলরুবা খানম বলে থাকেন আবু জুনায়েদের শরীরে মাছের রক্ত। তার মাথাটা অপেক্ষাকৃত ছোট বলেই দিলরুবা খানম ইদানীং বলতে আরম্ভ করেছেন, মানুষের শরীরে বোয়াল মাছের মাথা জুড়ে দিলে যেমন লাগে আবু জুনায়েদকে অবিকল সে রকম দেখায়। রসিকতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গেছে। আবু জুনায়েদের কানেও এসেছে। বোবা প্রাণীর মতো সহ্য করা ছাড়া আবু জুনায়েদের করবারই বা কী আছে! কিন্তু আজকে ফিন্যান্স কমিটির মিটিংয়ে নাজেহাল হওয়ার ব্যাপারটি তাকে প্রচণ্ড রকম জখম করে ফেলল। তার মনে হতে লাগল তিনি কতগুলো হিংস্র প্রাণীর সমাজে বাস করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা ছিল। তার মনটা এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে ঠিক করলেন যাবেন না। ব্যক্তিগত সহকারীকে বলে দিলেন, যেন জানিয়ে দেয়া হয়, তিনি সুস্থ বোধ করছেন না, সুতরাং অ্যালুমনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভায় যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। আবু জুনায়েদ সরাসরি বাড়িতে চলে এলেন।
বাড়িতে এসে দেখেন নুরুন্নাহার বানু রেগে আগুন হয়ে আছেন। আজ তার বড় বোনের ছোট মেয়ের গায়ে হলুদের দিন। নুরুন্নাহার বানু গাড়িতে করে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। তিনি বলে দিয়েছিলেন, ড্রাইভার যেন বেলা চারটার দিকে এসে নিয়ে যায়। ড্রাইভার তাকে আনতে যায়নি। এসে যখন কারণ জানতে চাইলেন ড্রাইভার একগাল হেসে জানালো সাহেব তাকে না করেছে। আসলে তিনি এরকম কিছু বলেননি। তিনি বলেছিলেন ফিন্যান্স কমিটির মিটিংয়ের শেষে তিনি অ্যালুমনাই। অ্যাসোসিয়েশনের সভায় যাবেন। ড্রাইভারকে সেখানে তাকে নিয়ে যেতে হবে । মিটিং শেষ করে আবু জুনায়েদ ফিরে আসবেন, তারপর ড্রাইভারের ছুটি।
আবু জুনায়েদ বাড়িতে এসে দেখলেন, এই ভর সন্ধ্যেবেলা নুরুন্নাহার বানু খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন। তিনি প্রমাদ গুনলেন। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। ফাটাফাটি না বাঁধিয়ে নুরুন্নাহার বানু ছাড়বেন না । আবু জুনায়েদ ভীষণ শঙ্কিত হলেন। তিনি কপালে হাত রাখলেন। শরীর ঠাণ্ডা। আস্তে আস্তে গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন, এই ওঠো, এই সন্ধ্যাবেলায় শুয়ে থাকলে শরীর খারাপ করে। নুরুন্নাহার বানু ওইটুকুর অপেক্ষা করছিলেন। চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
-আমার শরীর খারাপে তোমার কী আসে যায়। প্রতিদিন নিজে অপমান করো, আজ ড্রাইভার দিয়ে এই এতগুলো মানুষের সামনে অপমান করালে। তোমাকে ছোটলোকের বাচ্চা না বলে বলব কী? ছোটলোকের বাচ্চা নুরুন্নাহার বানু তাকে এই প্রথম বলছেন না, বিয়ের পর থেকেই এই ডাক শুনে আসছেন এবং শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না ড্রাইভার কীভাবে অপমান করতে পারে। তিনি ড্রাইভারের সন্ধানে গেলেন। দারোয়ান জানালো, ড্রাইভার গ্যারেজে গাড়ি রেখে চলে গেছে। আবু জুনায়েদকে ঘটনাটি মেয়ে দীলুর কাছ থেকে শুনতে হলো। দীলু জানালো, কথামতো না যাওয়ায় তাকে এবং তার আম্মাকে বেবিট্যাক্সি করে মীর হাজিরবাগ থেকে আসতে হয়েছে। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন, ড্রাইভার বেচারির কোনো দোষ নেই। আবু জুনায়েদের নিজের ভুলের জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি মনে করলেন, এই কথাটা নুরুন্নাহার বানুকে বুঝিয়ে শান্ত করতে চেষ্টা করবেন। তিনি যখন ব্যাখ্যা করার জন্য ঘরে ঢুকলেন, দেখেন নুরুন্নাহার হাপুস-হুপুস শব্দ করে কাঁদছেন। আবু জুনায়েদকে দেখামাত্র তার মুখ ছুটে গেল। শ্রীমুখ থেকে নানা রকমের গালাগাল নির্গত হতে লাগল। নুরুন্নাহার বানুর সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো এই যে, কাপড়চোপড়ে কেশবিন্যাসের দিক দিয়ে তিনি শহরের অভিজাত মহিলাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার কথা চিন্তা করলেও যখন প্রয়োজন হয়, সুপ্ত উৎস থেকে গ্রাম্য গালাগালগুলো তার বাকযন্ত্র দিয়ে কই মাছের মতো উজিয়ে আসতে থাকে। মুখের সুখ মিটিয়ে শান্ত হলেন না। তারপর দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলেন। অত যত্নে বিউটি পারলারে গিয়ে বাঁধানো খোঁপা খুলে যাওয়ার ভয়ে অধিক ঢুসাটুসি করলেন না। রাগ প্রকাশের অধিক একটি কার্যকরী পন্থা বেছে নিলেন। পানির জগ, চায়ের পেয়ালা, পিরিচ, ফুলদানি যা হাতের কাছে পেলেন আছড়ে আছড়ে ভাঙতে থাকলেন। আবু জুনায়েদ টু শব্দটি করলেন না। চাকরবাকরেরা শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে এই প্রলয় কাণ্ড দেখল। আবু জুনায়েদ সকলের সামনে দিয়ে দাগী আসামীর মতো মুখ করে শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাকে কারো কিছু বলার সাহস হলো না।
সে রাতে আবু জুনায়েদ খাবার স্পর্শ করলেন না। কারো সঙ্গে কথা বললেন না। তিনি দোতলার বারান্দায় পায়চারী করতে থাকলেন। দুবার ফোন এসেছিল, বলে পাঠিয়েছেন কথা বলতে পারবেন না। রাত যখন এগারটার মতো বাজে আবু জুনায়েদ উপাচার্য ভবনের বাইরে এসে বাগানে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তার ঘরে প্রবেশ করতে ইচ্ছে হলো না। পায়ে পায়ে তিনি তরণী নিবাসে চলে এলেন। দেখাশোনা করার লোকটি রাতের বেলা থাকে না। আটটা বাজলেই চলে যায়। তিনি গোয়াল ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দেখেন তরণী লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। আবু জুনায়েদ মশারির দড়ি খুলে দিয়ে গরুটার শরীর স্পর্শ করলেন। আবু জুনায়েদের ছোঁয়া লাগামাত্রই গরুটা একলাফে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। তরণীর চোখে আবু জুনায়েদের চোখ পড়ে গেল। তার মনে হলো গরুটি ছলোছলো দৃষ্টিতে তার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছে। আবু জুনায়েদ সবকিছু ভুলে গিয়ে গরুটাকে আদর করতে থাকলেন। তরণী একটু পেছনে হটে গিয়ে আবু জুনায়েদের হাত পা গাল চাটতে লাগল। আবু জুনায়েদের মনে হলো এই বোবা প্রাণীটি ছাড়া তার বেদনা অনুভব করার কেউ এই বিশ্বসংসারে নেই। গরুটা নির্বাক নয়নে আবু জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আবু জুনায়েদের ওলানের দিকে চোখ গেল। বাচ্চা হবে, বাঁটগুলো আস্তে আস্তে পুষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। হঠাৎ করে ওলানটা ধরে দেখবার ইচ্ছে তাকে পেয়ে বসল। প্রথম গরুটা দেখার সময়ও এরকম একটা ইচ্ছে তার মনে জেগেছিল। কিন্তু তিনি সংকোচবশত ওলানের তলায় হাত দিতে পারেননি। কোনো মানুষের সামনে এটা করা কোনোদিনই সম্ভব হতো না। গভীর রাতে সবকিছু বাঁধন আলগা হয়ে পড়ে, এমনকি চেতনার শাসন অস্বীকার করে স্বপ্নেরা ভিড় করে বাইরে আসার অবকাশ পায়। সুতরাং, আবু জুনায়েদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছেটা পূরণ করতে বাধা কোথায়। তিনি ওলানের তলায় হাত দিয়ে বাঁটগুলো টিপে টিপে দেখছিলেন। তরণীর বোধহয় এই স্পর্শসুখ ভালো লাগছিল। গরুটি পেছনের পা-দুটি ফাঁক করে আবু জুনায়েদকে অধিকতর অবকাশ করে দিল। ওলানটা রক্তিম বর্ণের। এই তুলতুলে মাংসপিণ্ড স্পর্শ করামাত্রই তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল, আজ থেকে অনেকদিন আগে, যখন তার সবে গোঁফ গজিয়েছে, শিশ্নের মধ্যে বীর্যসঞ্চার হয়েছে, এক দূর সম্পর্কীয়া মামী আবু জুনায়েদকে দিয়ে তার বিশাল বিশাল স্তন মর্দন করিয়েছিলেন। আবু জুনায়েদের মনে সেই পুলক, সেই অনুভূতি জেগে উঠল। আবু জুনায়েদের মনে হলো তরণীর এই রক্তিম ওলান, এই স্ফীত বাটগুলোর মধ্য দিয়ে চরাচরের নারীসত্তা প্রাণ পেয়ে উঠেছে।
আবু জুনায়েদের হাতে ঘড়ি ছিল না। রাত কত হয়েছে ধারণা নেই। একসময় দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবু জুনায়েদ উঠে দাঁড়ালেন। মশারিটা ফের খাঁটিয়ে দিতে গিয়ে দেখতে পেলেন জানালার পাশে মনুষ্যছায়া বাঁকা হয়ে পড়েছে। আবু জুনায়েদ একটু শিহরিত হলেন। এতরাতে এই গোয়াল ঘরে তার খোঁজ করতে কে আসতে পারে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কে?
আমি, নুরুন্নাহার বানুর কণ্ঠস্বর।
–তুমি এখানে কেন এসেছ, আবু জুনায়েদ জানতে চাইলেন।
আবিয়ানো গাইয়ের ওলানে কী খোঁজ করছ একটু দেখে জীবন সার্থক করতে এলাম।
আবু জুনায়েদ আশা করেন নি নুরুন্নাহার বানু এভাবে তার উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারেন। প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা সামলে উঠলেন। চরম বিতৃষ্ণায় তিনি চিন্তা করলেন, এই মেয়ে মানুষটির হাত থেকে এ জীবনে তিনি নিষ্কৃতি পাবেন না । নুরুন্নাহার বানুর কথার জবাব দিতে গিয়ে সমান রূঢ়তাসহকারে বলে বসলেন।
–সেটা জেনে তোমার লাভ কী? তোমার কী আছে? তুমি ওলানের মধ্যে কী খোঁজ করছি এটা জানতে এখানে গুপ্তচরগিরি করতে এসেছ? তুমি ঝগড়া-ঝাটির একটা বাক্স ছাড়া আর কি?
–এ কথা তো তুমি বলবে। তোমার বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টি সকলে গরুর সঙ্গে কুকর্ম করেছে, তুমি সেই বংশের ছাওয়াল একই কাজ তোমাকে করতে হবে । নুরুন্নাহার বানুর চোখ দুটো থেকে ঠিকরে আগুন বেরিয়ে এল। আবু জুনায়েদ আবছা অন্ধকারে লাল চোখ দেখতে পেলেন।
সেই কুৎসিত বাদ-প্রতিবাদের রাত নুরুন্নাহার বানু এবং আবু জুনায়েদ কীভাবে কাটিয়েছেন, এ নিয়ে চাকর-বাকরেরা একেকজন একেক রকম কথা বলে থাকে। তার পরে আরো কিছু ঘটনা ঘটে গেল । সেগুলো সবিস্তারে না তোক সংক্ষেপে বলা প্রয়োজন। উপাচার্য ভবনে আবেদ হোসেনের অবারিত গতায়ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন কাজ তদারক করতে এলে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যান। নুরুন্নাহার বানু তবারক চাচার এই সুদর্শন জামাইটিকে পছন্দ করেন। কারণ শুধু তার চেহারা নয়, স্বভাব চরিত্র কথাবার্তা সব সুন্দর। মাঝে-মাঝে আবেদকে নুরুন্নাহার বানুর ছোট ভাইটির মতো আদর করতে ইচ্ছে হয়। সব দিন নুরুন্নাহারের সঙ্গে আবেদের সাক্ষাৎ হয় না। এদিকে নুরুন্নাহার বানুর মনে অন্য রকম একটা ভাবনা কাজ করছিল। সেই রাতেই তিনি ঠিক করে ফেলেছেন আবু জুনায়েদের শখের গরুটাকে সময় এবং সুযোগ এলে তিনি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবেন। সিদ্ধান্তটা কীভাবে কার্যকর করা যায় এ নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করছেন। গরুটা মারা গেলে আবু জুনায়েদ কী রকম কষ্ট পাবেন, সে কথা চিন্তা করে একধরনের বিকৃত সুখ পেয়ে থাকেন। আবু জুনায়েদের এই শখের গরু যখন অক্কা পাবে, যখন নড়বে না, চড়বে না, নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকবে, তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বলবেন তোমার আদরের গাভী প্রেমিকার কবরের উপর একটা তাজমহল বানিয়ে দাও। যুগ যুগ তোমার নাম থাকবে।
লোকজন যখন থাকে না, লুকিয়েচুরিয়ে গরুটাকে দেখে আসেন। গরুটাকে অনেকটা সতীনের মতো ধরে নিয়ে গোয়াল ঘর থেকে ঝাড় কুড়িয়ে নিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেন।
একদিন তিনি গোয়াল ঘরের কাছে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ পেলেন। তার ভেতরের সংস্কারটি চাড়া দিয়ে উঠল । কে জানে কোনো জিন পরি আবার গাভীর আকার ধরে তার স্বামীর উপর ভাগ বসাতে এসেছে কি না। তিনি আরো একটু এগিয়ে গেলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলেন, তার সেই মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হলো। কী করবেন ভেবে পেলেন না। মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে রইলেন। আবেদ হোসেন দীলুর স্তন টিপে টিপে আদর করছেন। আর দীলু তার গলা জড়িয়ে ধরে খিল খিল করে হাসছে। নুরুন্নাহার বানুর মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে গেল,
–হারামজাদি আজ তোর একদিন, আমার একদিন।
আবেদ হোসেন গলার আওয়াজ শুনে তড়িতাহতের মতো উঠে দাঁড়ালেন,
–আপা আপনি!
–বেরো কুত্তার বাচ্চা, বেরো!
আবেদ হোসেন মুখটা নিচু করে নুরুন্নাহার বানুর সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এবার নুরুন্নাহার বানু প্রচণ্ড রোষে তার মেয়ের চুলের মুঠি ধরতে ছুটে গেলেন। মুখ দিয়ে গালাগালির খই ফুটতে থাকল। তার ওই মূর্তি দেখে মেয়েটি কিন্তু একটুও ভয় পেল না।
–তুমি এরকম চেঁচামেচি করছ কেন? কী হয়েছে?
–কী হয়েছে হারামজাদি তোমাকে দেখাব?
তিনি চুলের মুঠিতে হাত দিতে যাচ্ছিলেন। দীলু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
–আম্মা বলে দিচ্ছি গায়ে হাত দিয়ো না। ভালো হবে না কিন্তু।
–হারামজাদি আজ তোর গোর দিয়ে ছাড়ব।
–গোর দেয়া অত সহজ কাজ নয়। যা বলার বলো, গায়ে হাত দিতে চেষ্টা করো না। গায়ের জোরে আমার সঙ্গে তুমি পারবে না।
–হারামজাদি এই কুত্তার সঙ্গে করছিলি কী?
–যা ইচ্ছে করছিলাম, তোমার কী? আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে মজা করছিলাম।
–মজা করছিলি হারামজাদি, তোর কোন মায়ের পেটের ভাই, একটা আলগা বেটাকে তুই বুনি টিপতে দিলি?
–সো হোয়াট, আমি আবেদ ভাইকে বিয়ে করব।
মেয়ের দুঃসাহস, নির্লজ্জতা এবং স্পর্ধা দেখে নুরুন্নাহার বানুর মুখ দিয়ে সহসা কথা বেরুল না।
–বিয়ে করবি, জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
–কেন নয়, আবেদ ভাইকে আমার দারুণ ভালো লাগে ।
–বিয়ে করবি হারামজাদি, তার বউ আছে, বাচ্চা আছে।
–থাকুক না কেন, আবেদ ভাই এই বউকে নিয়ে সুখী নয় ।
–তুই হারামজাদি সুখী হবি?
–অনেক গালাগালি করেছ। আর চিৎকার করলে আমি এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাব। সুখী হব না হব আমার ব্যাপার। তোমার তাতে কী?
নিজের মেয়ের সঙ্গে নোংরা বচসার পর হঠাৎ করে নুরুন্নাহার বানু অনুভব করলেন, তার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তার তলার সবটুকু মাটি সরে গেছে। স্বামী তার অনুগত নয়। তাকে বিছানায় একা ফেলে একটা গরুর সঙ্গে রাতে এসে কী সব করে। আর নিজের মেয়েটির বাজারের খানকি হতে আর বাকি কই। তবারক আলীর জড়োয়া গয়না, বেনারশি শাড়ি, সুন্দর করে বানানো গোয়াল ঘর, লক্ষ টাকা মূল্যের গাভীন গরু তাকে একদিক দিয়ে সর্বস্বান্ত করে ফেলেছে। তিনি মনে মনে অনুভব করলেন তবারক আলী একজন শয়তান। তিনি যা কিছু স্পর্শ করবেন সেখানে পাপ ছাড়া আর কিছুই জন্মাতে পারে না। তার সারা গা জ্বালা করতে লাগল। এই অবস্থায় শোয়ার ঘরে ঢুকে আধাদিন ফুলে ফুলে কাঁদলেন। তারপর এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। বিকেল চারটের দিকে ঘুম ভেঙেছিল। সারা শরীরে অসম্ভব ক্লান্তি । নুরুন্নাহার বানুর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। নুরুন্নাহার বানুর ইচ্ছে হলো এক্ষুনি যদি তিনি তবারক আলীর দেয়া সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন, তাহলে বাঁচার একটা উপায় হয়তো খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু শাড়ি গয়না ওসব তিনি ছুঁড়ে ফেলে দেবেন কোথায়? কাজের লোকজনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন। কাজের বেটির গায়ে জড়োয়া গয়না কী মানায়! তার চেয়ে নুরুন্নাহার বানুর কাছেই থাকুক। নারী হৃদয় বড় বেশি সোনার বশীভূত।
আবু জুনায়েদ অফিস থেকে এসে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। নুরুন্নাহার বানুও কোনো কথা বলতে চেষ্টা করলেন না। এই একদিন একরাতের মধ্যে তাদের মধ্যে একটা দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টা করেও কেউ কারো কাছে আসার উপায় পাচ্ছে না। নুরুন্নাহার বানুর মন থেকে ক্রমাগত ধিক্কার ধ্বনি উঠছিল। সমস্ত পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা আছে যেখানে তার এই মস্ত ক্ষতির কথা প্রকাশ করতে পারবেন। তিনি কোথায় যাবেন? তার মুখ দিয়ে তেতো ঢেকুর উঠছিল। এই বাড়িতে তিনি কীভাবে বাস করবেন। অনেক ভেবে, অনেক চিন্তা করে স্থির করলেন, রেবা, তার ছেলে এবং বরকে আনিয়ে নেবেন।
.
১১.
হাত পায়ের একটা হাড় ভেতর থেকে ভেঙে গেলে যে রকম হয়, বাইরে কোনো রক্তপাত ঘটে না অথচ টনটনে ব্যথাটা ঠিকই থাকে; আবু জুনায়েদের সংসারেরও সে অবস্থা। নুরুন্নাহার বানু এবং আবু জুনায়েদের মধ্যে কথা বলাবলি বন্ধ। বিয়ের পর এরকম অবস্থা আগে কোনোদিন হয়নি। নুরুন্নাহার বানু এখন বড় হওয়ার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দীলু আপন ইচ্ছেমতো সবকিছু করছে। যখন তখন বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এসকল কথা জিজ্ঞেস করে দেখার কোনো প্রয়োজন নুরুন্নাহার বানু অনুভব করেননি। তিনি মনে করছেন তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। শেখ তবারক আলী তাদের গোটা পরিবারটাকে সর্বনাশ করে ফেলেছেন। এই সংসারের প্রতি কোনো কর্তব্য, কোনো টান তিনি বোধ করেন না। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই তিনি এই বাড়িতে পাপী মানুষজনের সঙ্গে দিন-রজনী যাপন করছেন।
নুরুন্নাহার বানুর বিষয়ে একটা সত্য কথা হলো এই যে তিনি যখন ভেবেচিন্তে কিছু করেন, অবশ্যই ভুল করে বসেন। ঝোঁকের মাথায় যেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, পরে দেখা গেছে, সেগুলোতেই তার দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয়েছে। রেবা তার ছেলে অম্ভ এবং বর ইকবালকে কিছুদিন বরিশাল থেকে এখানে আনিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে খুবই ভালো কাজ করেছেন। মেয়ে জামাই এবং নাতি আসাতে পরিবারের গুমোট হাওয়াটা অনেকখানিই কেটে গেছে। মেয়ে জামাই আসাতে খুবই ভালো হয়েছে, এ কথা আবু জুনায়েদও স্বীকার করেন। কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেননি। নুরুন্নাহার বানু আঁকড়ে ধরার মতো একটা অবলম্বন খুঁজে পেলেন। রেবা মেয়েটি ঠাণ্ডা স্বভাবের এবং অনেক বিচক্ষণ । রেবার যখন জন্ম, নুরুন্নাহার বানুর বয়স সবে মোল। আবু জুনায়েদ তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। পাস করার পরে জুনায়েদকে চাকরি পেতে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। রেবাকে মানুষ করতে গিয়ে অনেক ঝড় ঝাঁপটা মাথার উপর দিয়ে গেছে। আবু জুনায়েদের সঙ্গে এক রুমের একটি টিনের ঘরে নুরুন্নাহার দাম্পত্য জীবন শুরু করেছেন। তখন তাদের সংসারে প্রাচুর্য বলতে কিছুই ছিল না। দুধের পয়সার জন্য নুরুন্নাহার বানুকে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তার আব্বার কাছে হাত পাততে হতো। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়েছে বলেই রেবার মধ্যে দয়ামায়ার ভাগটা খুব বেশি। দীলুর কথা স্বতন্ত্র। সে যখন জন্মেছে, নুরুন্নাহার বানুদের অবস্থা ফিরতে আরম্ভ করেছে। অধিকন্তু ঝুলি ঝাড়া সন্তান বলে দীলু সব সময় মা-বাবা দুজনেরই অবারিত স্নেহ লাভ করেছে। এখন নুরুন্নাহার বানুর আফসোস হয়, ছোটবেলা থেকে যদি মেয়েটাকে কড়া শাসনে রেখে মানুষ করতেন, আজকে তাকে এরকম একটা কুৎসিত অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না।
দীলুর উপর তার কোনো নৈতিক অনুশাসন চলছে না। নুরুন্নাহার বানু খুব ভয়ে ভয়ে আছেন। যদি কোনো ফাঁকে দীলু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবেদ হোসেনের সঙ্গে কিছু একটা করে বসে, তখন নুরুন্নাহার বানু মানুষের সামনে মুখ দেখাবেন কেমন করে? এ ব্যপারটা নিয়ে আবু জুনায়েদের সঙ্গে আলোচনা করারও উপায় নেই। নুরুন্নাহার বানু গভীর বেদনার সঙ্গে অনুভব করছেন আবু জুনায়েদ তার দিক থেকে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবেন, তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। নুরুন্নাহার বানুর ভেতরটা কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে। রেবা এসে পড়ায় তিনি একটি খুঁটি পেয়ে গেলেন। একদিন দরজা বন্ধ করে মা মেয়েতে দীলু এবং আবেদ হোসেনের ব্যাপারটা আলোচনা করলেন। রেবা সবকিছু শুনে শিউরে উঠল। সে নিজে থেকে এগিয়ে এসে আবু জুনায়েদকে সব কথা জানালো। সব কথা শুনে আবু জুনায়েদ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেন। সহসা তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না। দীলু যে এরকম একটি কাজ করতে পারে আবু জুনায়েদ ভাবতেও পারেননি। মেয়েটি সবে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আবু জুনায়েদের অবস্থা এমনিতে সবদিক দিয়ে টলোমলো হয়ে উঠেছে। এই ঘটনা যদি কোনো ফাঁক দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে একটা ভূমিকম্পের সৃষ্টি হবে। আবু জুনায়েদের অস্তিত্বটাই বরবাদ করে ফেলবে। বার হাত কাঁকুরের তের হাত বিচির মতো সমস্ত গোপন বিষয় মানুষের সামনে বেরিয়ে আসবে। সকলে জানবেন তিনি ঠিকাদার শেখ তবারক আলীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছেন। শেখ তবারক তার স্ত্রীকে জড়োয়া গয়নার সেট, কন্যাকে বেনারশি শাড়ি এবং সোনার ঘড়ি উপহার দিয়েছেন। তিনি নিজে থেকেই শেখ তবারককে একটা গাভী গরু কিনে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। ঠিকাদার সাহেব তাকে মহামূল্যবান গরু এবং গোয়ালঘর দুই উপহারস্বরূপ করে দিয়েছেন। এসবের সঙ্গে দীলুর কথাটা যখন যোগ হবে, মানুষ আপনা থেকেই বলবে, আবু জুনায়েদ এত লোভী এবং চামার যে তিনি আপন মেয়েটিকেও তবারক আলীর জামাতার হাতে তুলে দিতে কুণ্ঠিত হননি। আবু জুনায়েদ আর অধিক কিছু চিন্তা করতে পারলেন না। তার কপালের বাম পাশটা প্রচণ্ডভাবে ব্যথা করছিল। প্রেসার চড়ে যাচ্ছিল। কোনো রকমে কপাল চেপে ধরে খাটে শুয়ে পড়তে পড়তে বললেন।
-যা হয় কিছু একটা করো। আমি তো চোখে পথ দেখছিনে।
রেবা একাই সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিল। মা-বাবার মধ্যে একটা কাজ চলা গোছের সম্পর্কও তৈরি করে ফেলল । কিন্তু সেটাকে স্বাভাবিক সম্পর্ক বলা চলে না। একেবারে নিসম্পর্কিতভাবে মানুষের এক সঙ্গে থাকা চলে না। রেবা ভীষণ বুদ্ধিমতি মেয়ে। দীলুকে সব সময় চোখে চোখে রাখে। কোনোক্রমেই বাড়ি থেকে একা বেরোতে দেয় না। কলেজে যাবার সময় রেবা কিংবা তার স্বামী দীলুর সঙ্গে কলেজের গেট অবধি যায়। আবার ছুটি হওয়ার পরে কলেজ গেট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। কলেজের প্রিন্সিপাল ভদ্রমহিলার সঙ্গে আবু জুনায়েদের পরিচয় আছে। তিনি তাকে টেলিফোন করে বলেছেন, তার এই মেয়েটি বড় আদুরে এবং খেয়ালি। কখন কী করে বসে কোনো ঠিক নেই। সুতরাং বেগম হাসনা বানু যদি অনুগ্রহ করে মেয়েটির প্রতি কড়া নজর রাখেন তবে আবু জুনায়েদ খুবই উপকৃত বোধ করবেন। কলেজ সম্পর্কিত অনেক কাজে উপাচার্যের কাছে হাসনা বেগমের ঠেকা আছে। তাই বেগম হাসনা বানু কথা দিয়েছেন, হাঁ মেয়েটির প্রতি তিনি প্রখর দৃষ্টি রাখবেন। তবে এও বলেছেন, এসব টিন এজারদের কন্ট্রোল করা খুবই মুশকিলের ব্যাপার।
রেবার বর ইকবাল ছেলেটিকে নুরুন্নাহার বানু খুবই পছন্দ করেন। তার এই বিপদের দিনে যেভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, যেভাবে নীরবে মচকে যাওয়া সংসারটির শুশ্রূষা করে যাচ্ছে, দেখে নুরুন্নাহার বানু অভিভূত হয়ে গেছেন। নুরুন্নাহার বানুর কোনো ছেলে নেই। ছেলে না থাকলে নারীর মনে একটা হাহাকার থেকেই যায়। নুরুন্নাহার বানু ছেলেটাকে তাদের সঙ্গে একেবারে রেখে দেয়ার কথা চিন্তা করেন। কিন্তু ইকবালের বদলির চাকরি। তার থাকার উপায় নেই। নুরুন্নাহার বানু ভাবেন, ঢাকাতে যদি কোনো কাজকর্ম পাওয়া যেত ছেলেটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে পারতেন। সরকারি চাকরি হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যে কোনো ধরনের একটা দ্ৰ চাকরি হলেই চলে যায়। আবু জুনায়েদ এত বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। প্রতিদিন তার হাত দিয়ে কত লোকের চাকরি হচ্ছে। অথচ এমন সোনার টুকরো জামাই, তাকে একটা চাকরি দেয়ার ক্ষমতা আবু জুনায়েদের নেই। শেখ তবারক আলীর কথা কেন জানি তার মনে উদয় হলো। আর সারা শরীর কেঁপে গেল, এখনো নুরুন্নাহার বানু শেখ তবারকের কাছ থেকে উপকার প্রত্যাশা করেন।
রেবার ছেলে অন্তু এই মনস্তাপপীড়িত বাড়িতে এক ঝলক ফাল্গুনের হাওয়া এনে দিয়েছে। তার বয়স সবে দুই পেরিয়েছে। বয়সের তুলনায় তার বাড় অনেক বেশি। এই দুরন্ত সর্বাঙ্গে প্রাণপূর্ণ শিশুটি ছোট ছোট পায়ে টলমল টলমল করে যখন হাঁটে দেখে মনে হয় তার চরণের ছন্দের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীর প্রাণস্পন্দন ধ্বনিত হয়ে ওঠে। অন্তু যখন নব উথিত সাদা দাঁতগুলো দেখিয়ে হাসে দেখে মনে হয় জগতের যা কিছু সুন্দর, নিষ্পাপ এই শিশুটির শুভ্র হাসির মধ্য দিয়ে ফুলের মতো বিকশিত হয়ে উঠেছে। একদণ্ড বিশ্রাম নেই অন্তর । গাছে পাখি দেখলে আ আ করে ডাকে। আপনি নাচে আপনি হাসে, ঝরনার মতো শিশুকণ্ঠে কল কল করে কথা বলে যায়। এই নাতিটিকে দেখলে নুরুন্নাহার বানু সমস্ত দুঃখ, সমস্ত বেদনার কথা ভুলে যান। তাকে বুকে টেনে আদর করেন। অন্তু নানির কোল থেকে মার কোলে, মার কোল থেকে নানার কোলে, নানার কোল থেকে দীলুর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে বড় বেশি ভালবাসে। সকালবেলা নাস্তা খাওয়ার পর ক্রমাগত কোল বদল করা অন্তর একটা চমৎকার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়ির পরস্পরের কাছ থেকে দূরে দূরে সরে যাওয়া মানুষদের মধ্যে অন্তু একটা নতুন যোগসূত্র রচনা করেছে।
অন্তর মুখে সবে কথা ফুটতে আরম্ভ করেছে। আবু জুনায়েদকে যখন নানা বলে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, শত ব্যস্ততার মধ্যেও অন্তুকে একটু আদর করে, তার শিশুমুখে চুমো খেয়ে একটা অনাবিল শান্তির পরশ খুঁজে পান। অল্প আবু জুনায়েদের ফাইল ধরে টানাটানি করে। গোছানো কাগজপত্র আউলা করে ফেলে। একটুও বিরক্ত হন না আবু জুনায়েদ। হাসিমুখে অন্তুর সমস্ত উৎপাত অত্যাচার সহ্য করেন। খালামনি বলতে এই শিশুটি পাগল । দীলুর কোলে একবার উঠলে আর নামতে চায় না। সে তার চুল ধরে টানে, কানের ফুল নিয়ে খেলা করে। দীলুর বেশ লাগে। দীলু কলেজে গেলে খালামনি খালামনি করে অন্তু চিৎকার করতে থাকে। কেঁদে কেঁদে ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে। উদ্ধত স্বভাবের দীলুকে বদলে যেতে দেখে মনে মনে খুব খুশি হন। অন্তুর সঙ্গে দীলুর এই সার্বক্ষণিক মেলামেশা তার মন থেকে আবেদ হোসেনের চিন্তা সরিয়ে রাখতে অনেকখানিই সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করেন।
অন্তু মাঝে-মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে বড় পছন্দ করে। সে খাটের তলায় অথবা ঘরের কোনো কোণাকানচিতে লুকিয়ে থাকে। খুঁজে পাওয়া না গেলে সারা বাড়িতে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়, অন্তু কোথায়, অন্তু কোথায়। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজে খুঁজে সকলে যখন হয়রান, খাটের তলা থেকে অন্তু মাথায় ঝুলকালি মেখে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসে। এই একটুখানি শিশু কত চাতুরি জানে। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে, কোন ফাঁকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। একেবারে আঙিনায় বেরিয়ে এসে ফড়িঙের পেছনে ছুটোছুটি করে। হাতের কাছে যা পায়, মুখের ভেতর চালান করে দেয়। একবার একটা আস্ত কেচো মুখ থেকে বের করা হয়েছিল ।
একদিন অন্তুকে পাওয়া গেল না। সবখানে খোঁজা হলো। সবগুলো খাটের তলা দেখা হলো, রান্নাঘরে খোঁজ করা হলো। স্টোর রুম, নিচের অফিস ঘর তন্ন তন্ন করা হলো। না অন্তু কোথাও নেই। সকলেরই একটা প্রশ্ন, অন্তু কোথায়, কোথায় যেতে পারে অন্তু। এই শিশুটি অতি অল্পে যেমন সকলকে আনন্দ দিতে পারে, তেমনি আবার অতি অল্পে সকলকে ব্যতিব্যস্ত করেও তুলতে পারে। কোথাও যখন পাওয়া গেল না নুরুন্নাহার বানুর সহজাত প্রবণতা মনে করিয়ে দিল, যদি অন্তু গোয়াল ঘরে গিয়ে থাকে। সত্যি সত্যি গোয়াল ঘরেই অন্তুকে পাওয়া গেল। কীভাবে এই এতদূর চলে এসেছে কেউ চিন্তাও করতে পারেননি। নুরুন্নাহার বানু দেখেন, অন্তু ছোট ছোট হাতে গরুটির ওলানের বাঁট নিয়ে খেলা করছে। এই দৃশ্য দেখে নুরুন্নাহার বানুর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। শেখ তবারক গরুর আকারে তার জীবনের মধ্যে একটা শনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই গরুটির কারণে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে, কন্যাটি বিপথগামী হয়েছে, এখন নাতিটিকেও ধরে টান দিচ্ছে। নুরুন্নাহার বানু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন, গরুটিকে তিনি ইঁদুর মারা বিষ দিয়ে খুন করবেন ।
রেবা আসার পর পরিবারে একটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। আবু জুনায়েদ এবং নুরুন্নাহার বানুর মধ্যে, নুরুন্নাহার বানু এবং দীলুর মধ্যে যে একটা সংঘাত আসন্ন হয়ে উঠেছিল তার বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে ওঠার ক্ষমতা অনেক পরিমাণে হাস পেয়েছে। নুরুন্নাহার বানু তার নাতি, কন্যা এবং জামাতাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আবু জুনায়েদ যা ইচ্ছে করুন, তার কথা না ভাবলেও তার চলে। আবু জুনায়েদ তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তার মধ্যে এক ধরনের নির্লিপ্ততাবোধ জন্ম। নিয়েছে। যা ঘটবার আপনিই ঘটবে। উপাচার্য থাকুন, আর নাই বা থাকুন, তিনি পরোয়া করেন না। মাঝে-মাঝে তিনি বিষয়টা নিয়ে এ রকম চিন্তা করেন, আমার তো উপাচার্য হওয়ার কথা ছিল না। উপাচার্যের চাকরি তার জীবনের মহত্তম দুর্ঘটনা। এই চাকরি যদি চলেই যায়, যাবে । লোকে কী ভাববে, কী মনে করবে এ নিয়ে আর বিশেষ তোয়াক্কা করেন না। তার নিজের মতো করে বেঁচে থাকার একটা পদ্ধতি তার মধ্যে ভেতর থেকে সংহত হয়ে উঠছে। গরুটার প্রতি তার পক্ষপাত কম্পাসের কাটার মতো হেলে রয়েছে। যদিও নুরুন্নাহার বানু গরুটাকে যাবতীয় অকল্যাণের হেতু বলে মনে করছেন এবং তার সঙ্গে এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করেছেন, তার মনোভাব অপরিবর্তিতই থেকে গেছে।
সকাল বেলা তিনি গরুর সঙ্গে কাটান। ঘুম থেকে উঠে আবু জুনায়েদ গোয়াল ঘরে যাবেনই । আজকাল শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। তাই দুপুরের গরু সন্দর্শনে যাওয়া ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। বিকেলবেলা অবশ্যই তিনি গোয়াল ঘরে যান। সভা-সমিতিতে যাওয়ার বিশেষ স্পৃহা তিনি বোধ করেন না। তার বক্তৃতার নিন্দে করার মানুষের অভাব নেই। সবদিক থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। বিকেলের সমস্ত সময়টা তিনি নিজের জন্য রাখেন এবং গোয়াল ঘরে চলে আসেন। কোনো কোনোদিন নাতিটাকেও সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসেন। গরুর প্রতি নাতিটারও একটা টান পড়ে গেছে। তিনি যদি কোনোদিন অন্তুকে রেখে আসেন, অন্তু চিৎকার করতে থাকে,
-নানু হাম্বা যাব, হাম্বা যাব ।
নুরুন্নাহার বানু এটা মোটেও পছন্দ করেন না। তার নজরে পড়লে তিনি অন্তুকে জোর করে কোলে উঠিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যান। অল্প পা আছড়ে কাঁদতে থাকে।
আরবির শিক্ষক মাওলানা আবু তাহের মাসুম এক সময় আবু জুনায়েদের প্রতিবেশী ছিলেন। আবু জুনায়েদ আগে মাওলানা তাহেরের সঙ্গে প্রাতভ্রমণে বের হতেন। আবু জুনায়েদ উপাচার্য হওয়ার কারণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র একজন মানুষ যদি খুশি হয়ে থাকেন, তিনি মাওলানা আবু তাহের। মাওলানা তাহেরের সঙ্গে আবু জুনায়েদের একটা হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল। মাওলানা রসিক মানুষ। আজানুলম্বিত দাড়ি, লম্বা আচকান এবং কানপুরি টুপিতে ঢাকা মাওলানার শরীর । এই দাড়ি টুপি এবং আচকানের ভেতর থেকে এমন রসিকতা প্রকাশ পেত শুনলে অত্যন্ত গোমরা মানুষেরও পেটে খিল ধরে যেত। এখনো আবু জুনায়েদ যে মাঝে মাঝে নামাজের পাটিতে দাঁড়ান, মাওলানার প্রভাবে সেটা হয়েছে। মাওলানার সঙ্গে আবু জুনায়েদের বিশেষ আঁটাআঁটি নেই । উপাচার্য অফিসে হোক কি বাড়িতে হোক, মাওলানা আবু তাহের আবু জুনায়েদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কারো তোয়াক্কা করেন না। সরাসরি চলে আসেন। এক সন্ধ্যেয় মাওলানা আবু জুনায়েদকে তার বাড়িতে এসে তালাশ করলেন। আবু জুনায়েদের বেয়ারা জানালে তিনি পেছনের গোয়াল ঘরে রয়েছেন। বাড়ির পেছনে আবু জুনায়েদ যে একটি গোয়াল ঘর তৈরি করেছেন, মাওলানা জানতেন না। গোয়াল ঘরের অবস্থান জেনে মাওলানা এসে দেখেন, আবু জুনায়েদ আপন হাতে টুকরো করে, কাটা নেপিয়র ঘাস অল্প অল্প করে গরুর মুখে তুলে দিচ্ছেন। তিনি বললেন,
-আসসালামু আলাইকুম জুনায়েদ সাহেব। মাসখানেক আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতে পারিনি, গুস্তাকি মাফ করবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-আরে মাওলানা সাহেব আসেন, আসেন, কয়েকদিন থেকে আমি মনে মনে আপনাকেই খুঁজছিলাম। আবু জুনায়েদ নেপিয়র ঘাসের চুপড়িটা গরুর সামনে রেখে উত্তর দিকের শেডটার বাতি অন করলেন। ঝলমল করে আলো জ্বলে উঠতেই গরুটা মাওলানার নজরে পড়ে গেল। এক ঝলক দেখেই মাওলানার কণ্ঠ দিয়ে বিস্ময়সূচক একটি ধ্বনিই বেরোল :
-মাশাল্লাহ, এই সুন্দর জিনিস আপনি পেলেন কেমন করে? পিঠে দুইখানি পাখা থাকলে অনায়াসে বলা যেতে পারত এটা বুররাক।
আবু জুনায়েদ বললেন, আল্লাহ দেনেঅলা, তিনিই মিলিয়ে দিয়েছেন।
মাওলানা সাহেব কোরআনের একটা আয়াত আবৃত্তি করলেন, তার অর্থ দাঁড়াবে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছে দান করেন, যাকে ইচ্ছে কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছে সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছে লাঞ্ছিত করেন। তারপর দুহাতে আলগোছে দাড়ি মুঠি করে বললেন,
-আপনি সঠিক পথটি বেছে নিয়েছেন। বেবাক দেশ খবিশ এবং খান্নাসের আওলাদ, নাতিপুতিতে ভরে গেছে। এই জাতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার চাইতে হাইওয়ানের মহব্বত অনেক বেহেতর। আপনার গরুটি সম্পর্কে তাই একটি কথাই আমি বলব । আপনার গরুটির চেহারা সুরত যে রকম, কোরআন মজিদের সুরা বাকারায় এই রকম একটা গরুর কথা বলা হয়েছে। কেবল দুইটা তফাৎ। সুরা বাকারায় যে গরুটির কথা উল্লেখ আছে, সেটির গায়ের রঙ উজ্জ্বল হলুদ আর আপনার গরুটির রঙ লাল। আর আপনার গরুর চাকা চাকা দাগ আছে। সুরা বাকারার গরুতে তেমন কোনো দাগের কথা উল্লেখ নেই ।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-মাওলানা সাহেব গরুর ভাগ্য আর আপনার এলেমের তেজ।
মাওলানা আবু তাহের দাঁতে জিভ কাটলেন,
-ভাই ওই রকম কথা বলবেন না। আল্লাহ আপনাকেই এলমে লাদুন্নি বখশিস করেছেন। এই এলমে লাদুন্নি ছিল বলেই আপনি এত উপরে উঠতে পেরেছেন । আমি অতিশয় এক নাদান বান্দা। আমি তাই আপনাকে বিশেষ একটা অনুরোধ করব। যদি আপনি রাখেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
–বলুন আপনার অনুরোধ কী
মাওলানা সাহেব জবাব দিলেন,
-আমি আপনাকে স্বার্থপরের মতো আচরণ না করতে বলব ।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-আমি স্বার্থপরের মতো আচরণ কোথায় করলাম। আপনিও এ কথা বলেন?
-আমি না বললে কে বলবে আপনি এ বাড়ির পেছনে এমন এক সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন প্রথমত সে কথা জানাননি। দ্বিতীয়ত একা একা এই জান্নাতের শান্তি উপভোগ করছেন, বন্ধু-বান্ধবকে তার হিস্যা দিচ্ছেন না।
আবু জুনায়েদ একটু অবাক হয়ে বললেন,
-মাওলানা আপনি আমাকে কী বলতে চাইছেন বুঝতে পারছি না। যা হোক, বলুন আমাকে কী করতে হবে।
মাওলানা আবু তাহের উচ্চহাস্য করে উঠলেন এবং তারপর বললেন,
-এইখানে আপনি চমকার বসার বন্দোবস্ত করেছেন। সন্ধ্যেবেলা বন্ধু বান্ধবদেরও বসার বন্দোবস্ত করে দিন। চমৎকার এক জায়গা। চারদিকে গাছ গাছালিতে ঢাকা। এখানে বসে একটু প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলা যাবে। আমাদের এলাকায় শান্তিতে নিরিবিলিতে কোথাও বসার জায়গা নেই। যেখানেই যান দেখবেন, মানুষ মানুষকে নলদাত মেলে কামড়াতে আসছে।
মাওলানা আবু তাহেরের প্রস্তাবটা আবু জুনায়েদের মনে ধরল। এই গরুটাকে সকলের সঙ্গে শেয়ার করার ইচ্ছে তার ছিল। কিন্তু তবারক সাহেবের হুঁশিয়ারিতে তিনি দমে গিয়েছিলেন। মাওলানা আবু তাহের যখন নিজে থেকেই প্রস্তাবটা করলেন আবু জুনায়েদ হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন। মাওলানার প্রস্তাবে সায় দিয়ে বললেন,
-তা মাওলানা আপনারা এসে বসুন, গল্পগুজব করুন । আপনাদের বারণ করেছে কে?
-ভাই আপনি এরকম বলবেন আমি জানতাম। আমরা অবশ্যই আসব । একটা বসার জায়গা হলো, আসব না, সে কেমন কথা। কিন্তু আপনাকে তার জন্য আরো কিছু খরচ করতে হবে। এমনিতে আপনার রুচির তারিফ না করে পারিনে। গোয়ালটা বানিয়েছেন চমৎকার। মাশাল্লাহ গরুটিও হয়েছে খুব খুবসুরত । আপনি আরো কিছু পশুপাখি কিনুন। যেমন ধরুন ময়না, টিয়ে, দোয়েল, বুলবুলি আর শালিক। যদি সম্ভব হয় এক দুটি ভালো জাতের কুকুরও রাখবেন।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-মাওলানা কুকুর আমার দুচোখের বিষ । এই জিনিস আমাকে রাখতে বলবেন না।
-ভাই আপনি ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? আপনি জানেন না একটা কুকুর বেহেশতে যাবে। আসহাবে কাহাফের সঙ্গে যে কুকুরটি ছিল, সে সরাসরি পুলসিরাতের উপর দিয়ে হেঁটে বেহেশতে চলে যাবে। মাওলানা গালিবের একটা উর্দু কবিতাংশ পাঠ করে শোনালেন, মানুষ যদি কুকুরের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা শিক্ষা করতে পারত এতদিনে দুনিয়া জান্নাত হয়ে যেত।
আবু জুনায়েদকে গলানো গেল না। বরং তিনি মাওলানা তাহেরকে উল্টো দিক থেকে চেপে ধরলেন।
-মাওলানা আপনার এত কুকুর প্রীতি কেন? বুড়ো বয়সে কি গায়ে সাহেবদের হাওয়া লাগল?
মাওলানা তাহের বললেন, আচ্ছা কুকুরের দাবি উঠিয়ে নিলাম। ঘুঘু, শালিক, টিয়া, ময়না, চন্দনা, দোয়েল, বুলবুল এসব রাখুন। একটা ছোটখাট চিড়িয়াখানা হয়ে যাবে। আপনার এই মিনি চিড়িয়াখানা এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হবে।
আবু জুনায়েদের প্রস্তাবটা ভীষণ মনে ধরেছে। তবু তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,
-অনেক খরচাপাতির ব্যাপার, দেখার লোক কই। তাছাড়া নানা রকম কথা উঠতে পারে ।
মাওলানা তাহের ফোড়ন কেটে বললেন,
-জুনায়েদ সাহেব আপনি হাসালেন। হাতি খরিদ করার পর বলছেন রশির কিবা দাম। আপনার গোয়াল ঘর বানাতে কত খরচ পড়েছে। এই বুররাক মার্কা গরু কিনতে গেছে কত টাকা। এই চিড়িয়া সবগুলো কিনতে পাঁচ হাজার টাকার বেশি খরচ পড়বে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে এই টাকা খরচ করার অধিকার নিশ্চয়ই উপাচার্যের আছে। থাক টাকার বিষয় নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এই গরিব বান্দা খাতা দেখার টাকা থেকে এই চিড়িয়াগুলো কিনে দেবে।
আবু জুনায়েদ বললেন, কিন্তু দেখাশোনা করবে কে? মাওলানা বললেন, কেন গরু যে দেখাশোনা করে তার উপর চিড়িয়ার দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। বেটা তো কেবল খায় আর ঘুমোয়? সপ্তাহ গত হতেই মাওলানা আবু তাহের একটি পায়ে টানা ভ্যানের উপর দশ বারটি খাঁচা চাপিয়ে একেবারে সরাসরি উপাচার্য ভবনের কম্পাউন্ডে এসে হাজির হলেন। তিনি দারোয়ান এবং বেয়ারার সাহায্যে খাঁচাগুলি নামিয়ে একেবারে গোয়ালঘরে নিয়ে এলেন। আবু জুনায়েদ উত্তরের শেডে বসে নাতি অন্তুর সঙ্গে হাম্বা হাম্বা খেলা করছিলেন। অন্তু আবু জুনায়েদকে বলছে, নানু হাম্বা বলো। নাতিকে খুশি করার জন্য আবু জুনায়েদ বললেন, হাম্বা। অন্তু অত অনুচ্চ ডাকে খুশি হওয়ার ছেলে নয়। তার পাঞ্জাবির কোণা আকর্ষণ করে বলল, নানু আরো জোরে বলো, হাম্বা ।
আরো জোরে হাম্বা বলতে গিয়ে আবু জুনায়েদ দেখতে পেলেন তার মুখোমুখি মাওলানা আবু তাহের দাঁড়িয়ে আছেন। দারোয়ান এবং বেয়ারা মিলে একটা দুটো করে সবগুলো খাঁচা উত্তরের শেডে এনে রাখল। দেখে আবু জুনায়েদের চক্ষু চড়কগাছ। অস্ফুটে উচ্চারণ করে বসলেন, মাওলানা এ কী কাণ্ড করলেন।
মাওলানা বললেন, সব কাণ্ড এখনো শেষ হয়নি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনি দেখুন, এখনো কিছু কাণ্ড বাকি আছে।
মাওলানা আবু তাহের পেরেক, হাতুড়ি এসব নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে এসেছিলেন। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ঠুকে ঠুকে দেয়ালে পেরেক বসিয়ে খাঁচাগুলো ঝুলিয়ে দিলেন । শালিক, চন্দনা, টিয়া, ময়না, দোয়েল, বুলবুল যে সকল পাখির নাম মাওলানা বলেছিলেন সব প্রজাতির পাখি জোড়ায় জোড়ায় খাঁচাতে ভরে এনেছেন। নতুন জায়গায় আসার কারণে, একসঙ্গে সবগুলো পাখি ডেকে উঠল । পাখিদের কলকাকলিতে আচমকা নির্জন গোয়াল ঘর মুখরিত হয়ে উঠল। অন্তু হাত তালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, ও নানু পাখি, অ-নে-ক পাখি।
আবু জুনায়েদ বললেন, হ্যাঁ নানু অনেক পাখি। জনার্দন চক্রবর্তী হলেন আবু জুনায়েদের মিনি চিড়িয়াখানার প্রথম দর্শক। তার বিষয়ে কিঞ্চিৎ ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন। তিনি সংস্কৃতের প্রবীণ শিক্ষক। চাকরির মেয়াদ অনেকদিন আগেই ফুরিয়েছে। যেহেতু সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠেছে, তাই দুবছর একসূটেনশন দিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি এত দিন পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন তরুণ দুলাল বিশ্বাস ব্যাকরণ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রে ডক্টরেট করে এসেছেন। এবার জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি নবায়নের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু জুনায়েদ নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর চাকরি নবায়ন করেছেন। এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আবু জুনায়েদ সেসব আমলে আনেননি । জনার্দন চক্রবর্তীর প্রতি এই পক্ষপাতের একটা কারণ অবশ্য আছে। জনার্দন চক্রবর্তীর বাড়ি আবু জুনায়েদের এদিকে । আবু জুনায়েদ যে স্কুলের ছাত্র সেখানে তিনি সংস্কৃত এবং বাংলা পড়াতেন। স্কুলে থাকার সময়ে তিনি টোল থেকে আদ্য মধ্য এবং উপাধি পাস করেছিলেন। একবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাঘা সংস্কৃত অধ্যাপকের অন্বয় নির্ধারণে ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ভদ্রলোক তাকে টুলো পণ্ডিত বলে অবজ্ঞা করেছিলেন। ঘা খেয়ে তিনি প্রাণপণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে সংস্কৃতে তিনি এম, এ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। জনার্দন চক্রবর্তী সে জেদ প্রমাণ করে ছেড়েছেন। জনার্দন চক্রবর্তীর বয়স এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। এখনো বেশ শক্তসমর্থ আছেন। কেবল সামনের চোয়ালের দাঁত কটি পড়েছে। বাড়িতে এখনো কাষ্ঠপাদুকা ব্যবহার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময়ে বিদ্যাসাগরী চটি পরে চটাং চটাং শব্দ করে ক্লাস নিতে আসেন।
জনার্দন চক্রবর্তী এখনো আবু জুনায়েদকে তুমি সম্বোধন করেন। ছোট ছোট ব্যাপারে আবু জুনায়েদকে বকাবকি করতেও ছাড়েন না। তিনি মনে করেন, এখনো তার সে অধিকার আছে। জনার্দন বাবু যখন রেগে যান, পাঞ্জাবির বুকে হাত দিয়ে শুভ্র উপবীতটি টেনে বের করে বলেন, আমি খাঁটি ব্রাহ্মণ, উপবীত স্পর্শ করে যদি শাপ দেই লেগে যাবে। ভয় অনেককেই দেখিয়েছেন, কিন্তু শাপ কাউকে দিয়েছেন কেউ বলতে পারবে না। কথা বলার সময় তৎসম শব্দ ব্যবহার করার দিকে ঝোঁকটা বেশি। অবশ্য ঘরে তিনি তার জেলার উপভাষাটি ব্যবহার করে থাকেন। সাধু ভাষায় কথা বলতে পারলে তিনি স্বস্তি অনুভব করেন। এক সন্ধ্যেবেলা তিনি হেলতে দুলতে আবু জুনায়েদের মিনি চিড়িয়াখানায় এসে হাজির। আবু জুনায়েদ তখনো নিজের হাতে টুকরো টুকরো নেপিয়র ঘাস গরুকে খাওয়াচ্ছিলেন। জনার্দন চক্রবর্তী এসে হাঁক দিলেন,
-বৎস বিশ্বস্ত সূত্রে আমি অবগত হইলাম তুমি রামায়ণে বর্ণিত সুবর্ণ মৃগের মতো একটি রূপ যৌবনসম্পন্ন স্ত্রী জাতীয় গরুরত্ন সংগ্রহ করিয়াছ। কথাটি শ্রবণ করিবার পরেও আমার মনে প্রত্যয় হয় নাই। ভাবিলাম চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া আসি।
আবু জুনায়েদের কিছু বলার পূর্বেই পাখির খাঁচাগুলোর দিকে জনার্দন বাবুর চোখ পড়ল। তিনি বলে বসলেন, সাধু সাধু বৎস আবু জুনায়েদ আমি আপন অক্ষি গোলকে প্রত্যক্ষ করিলাম, তুমি অনেকগুলি বিহঙ্গকেও প্রশ্রয় দিয়াছ। আমি জানিতাম তোমার অন্তঃকরণ জীবের প্রতি প্রেমে পরিপূর্ণ। সংসারে যাহারা প্রকৃত মানুষ, তাহারা জীবের মধ্যে শিবের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেন। সেই দিক দিয়া বিচার করিলে তোমার স্থান অত্যন্ত উঁচু হওয়া উচিত। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলে। তা তোমার গাভীটি কোথায়?
জনার্দন বাবুর দৃষ্টিশক্তি হালে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। তিনি ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছিলেন না। আবু জুনায়েদ তাকে একেবারে হাত ধরে গোয়াল ঘরের একান্ত সন্নিকটে গিয়ে বাতিটি জ্বালালেন। তারপর মশারি উন্মোচন করে বললেন,
-এই যে স্যার দেখুন।
জনার্দন চক্রবর্তী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তিনি সামনে পেছনে গিয়ে গরুটাকে বেশ ভালো করে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন। গরুটি ঘাড় উঠিয়ে জনার্দন চক্রবর্তীর মাথা চাটতে ছুটে এল। তিনি দুপা পিছু হটে এসে বলতে থাকলেন,
-বৎস আবু জুনায়েদ তোমাকে একটা মনের কথা বলিব।
আবু জুনায়েদ বললেন, বলুন স্যার।
-শোন বৎস আমাদের শাস্ত্রে গাভীকে মাতার সঙ্গে তুলনা করা হইয়াছে। যে পাষণ্ড গাভীর মধ্যে মাতৃমূর্তি দর্শন করিতে না পারে, তাহাকে জন্ম জন্মান্তর তীর্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হইবে। এই হইল গিয়া তোমার শাস্ত্রের বিধান। তথাপি তোমার এই চতুষ্পদের কন্যাটিকে দেখিয়া আমার মনে ভিন্ন ধরনের জল্পনা শুরু হইয়াছে। সংস্কৃত কাব্যে এক ধরনের সুন্দরী রমণীকে হস্তিনী রমণী বলিয়া মহাকবিগণ শনাক্ত করিয়া গিয়াছেন। তোমার গাভী দর্শন করিয়া আমার কী কারণে হস্তিনী নায়িকার কথা মনে হইতেছে বলিতে পারি না। মহাকাব্যের যুগে যেই ধরনের গাভীকে কামধেনু বলা হইত তোমার গাভীটি সেই জাতের। ইহাকে যত্ন করিয়া রাখিবে।
আবু জুনায়েদ জনার্দন চক্রবর্তীর কথায় খুব তুষ্ট হলেন। বললেন, আশীর্বাদ করবেন স্যার।
-বৎস আমার আশীর্বাদ নিরন্তর তোমাকে ঘিরিয়া রহিয়াছে। আমার আশীর্বাদের গুণে তুমি উপাচার্যের আসনে বসিয়াছ। এখন আশীর্বাদ করিতেছি তুমি রাষ্ট্রদূত হও। মন্ত্রী হও। ভগবান তোমাকে রাষ্ট্রপতির আসনে উপবেশন করাইবেন। মনে রাখিবে, আমি খাঁটি ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ কদাচ মিথ্যা হইবার নয়।
.
১২.
আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরের উত্তরের শেডে সান্ধ্য আচ্ছাটি চালু হয়ে গেল। যে সকল শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে যেতে অপছন্দ করেন গাছের গুঁড়ির আড্ডায়ও যেতে পারেন না, এই নতুন আসরটি চালু হওয়ায় অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব একটি বাজার। সেখানে তাস চলছে, দাবা চলছে, টেনিস, ব্যাডমিন্টন এমনকি রাতের বেলা জুয়া পর্যন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলাদলির প্রধান আখড়া হলো এই ক্লাব। সর্বক্ষণ সভা হচ্ছে, গুজ-গুজ ফুসফুস চলছে। কে কাকে ল্যাং মেরে এগিয়ে গেল। কে সরকারের চামচাগিরি করতে গেল, কে আধারাতে বউকে ধরে পেটায়, কাজের বেটির সঙ্গে কে লটরটর কাণ্ড করেছে এই সকল মুখরোচক সংবাদ ক্লাবের হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়ায়। যে সকল শিক্ষক নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, ক্লাবের এই পাঁচমিশালি আড্ডায় বড় বেচারা বেচারা অনুভব করেন।
ক্লাব ছাড়া শিক্ষকদের আরো একটি আড্ডা আছে। আবাসিক এলাকার ভেতরে ড. আহমদ তকির বাড়ির সামনে একটা গাছের গুঁড়ির উপর সন্ধ্যেবেলা এই আচ্ছাটি বসে। ঝড় বৃষ্টি হলে লোকজন ড. আহমদ তকির ড্রয়িং রুমে এসে আশ্রয় নেন। একবার ঝড়ের সময় প্রকাণ্ড একটি শিশু গাছ কাণ্ডসুদ্ধ উপরে উঠে এসে ভূপাতিত হয়েছিল। ডালপালা সব ছেটে ফেলে সরানো হয়েছে, কিন্তু ড. আহমদ তকি এবং তার মতো আরো কতিপয় প্রবীণ শিক্ষক এই গুঁড়িটি সরাতে দেননি। তারপর থেকেই গুঁড়িটি সান্ধ্য আড্ডার স্থান হিসেবে এন্তার কুখ্যাতি অর্জন করেছে। কী কারণে এই গুঁড়ির আড্ডাটির দুর্নাম একটু বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে। ড. আহমদ তকি ঘোষণা করেছেন তিনি নাস্তিক। আল্লাহ রসুলের ধার তার না পারলেও চলে। কোরান-হাদিসে তার বিশ্বাস নেই। এই আড্ডায় মাঝে-মাঝে নাস্তিকতা বিষয়ক আলাপ-সালাপ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু সিনিয়র শিক্ষক, এমনকি তরুণদের মধ্যেও কেউ কেউ নিজেরা সরাসরি নাস্তিক না হয়েও ড. আহমদ তকিকে পছন্দ করে থাকেন। কারণ ড. আহমদ তকি একদিকে যেমন গোঁয়ার, তেমনি আবার রসিকও বটে। এ ধরনের মানুষ যিনি নিজের বিজ্ঞতা বা অজ্ঞতা চিৎকার করে প্রকাশ করতে পারেন তার কিছু চেলা জুটে যাবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। ড. আহমদ তকিই হলেন গাছের গুঁড়ির আড্ডার প্রধান ব্যক্তি। অন্যদের ভূমিকা নিতান্তই গৌণ। সাম্প্রতিককালে প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেই এই গাছের গুঁড়ির আড্ডায় আসতে আরম্ভ করেছেন। ড. আহমদ তকির ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ তার একমাত্র কারণ নয়। ড. আহমদ তকি ভদ্রলোকটি একাধারে নাস্তিক এবং আবু জুনায়েদ বিরোধী। কোনোরকম রাখঢাক না করেই উপাচার্য আবু জুনায়েদকে তিনি ছাগল, বলদ, গাধা ইত্যাকার নামে সম্বোধন করে থাকেন। প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকেরই আবু জুনায়েদের প্রতি জন্মগত বিতৃষ্ণা রয়েছে। তাদের মতো উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব থাকতে আবু জুনায়েদের মতো একজন ওঁচা মার্কা মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আসনে বসল এই ঘটনাটি কি আবু জুনায়েদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়ার মুখ্য কারণ হতে পারে না? কিছুদিন থেকে কয়েকদিন অন্তর অন্তর সুন্দরী দিলরুবা খানম এই আড্ডায় অংশগ্রহণ করতে আরম্ভ করেছেন। যদিও প্রবীণ শিক্ষকদের স্ত্রীরা দিলরুবা খানমকে ভীষণ অপছন্দ করেন, কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা দিলরুবার সঙ্গে মেলামেশা করেন। দিলরুবা যখন আসেন তার পিঠ ঝাপা এলানো চুলের সৌরভে বাতাস পর্যন্ত গন্ধময় হয়ে ওঠে। কাঠ কয়লায় আগুনের ছোঁয়া লাগলে যেমন নতুন করে আগুন জ্বলে ওঠে, তেমনি দিলরুবা খানম এলেই বুড়ো অধ্যাপকেরা রক্তের মধ্যে যৌবনের তেজ অনুভব করতে থাকেন। দিলরুবা ঝড়ের মতো আসেন, ঝড়ের মতো চলে যান। এই গতিময়তাই তাকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তিনি এসেই আবু জুনায়েদের কুকীর্তির কথা পাঁচ কাহন করে বলতে থাকেন। তার মধ্যে সত্যের ভাগ যথেষ্ট নয়, তথাপি তার বলার ভঙ্গিটি এমন মনোরম যে সকলকে তার মতে সায় দিতে হয়। আবু জুনায়েদকে দেখলে মানুষের শরীরে বোয়াল মাছের মাথা লাগানো এক কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীর মতো মনে হয়, এই আশ্চর্য সাদৃশ্যটি তিনি এই আড্ডায় এসে আবিষ্কার করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যারা যান না, গাছের গুঁড়ির নাস্তিকদের আড্ডায় যেতে ঘৃণাবোধ করেন, সেই সমস্ত শিক্ষকেরা আবু জুনায়দের গোয়ালঘরে সন্ধ্যেবেলা আসতে আরম্ভ করেছেন। আবু জুনায়েদ ভেবে দেখলেন এবারেও বিনা প্রয়াসে ভাগ্য তাকে অনুগ্রহ করেছে। তিনি ভীতি এবং আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটচ্ছিলেন। মানসিক নিঃসঙ্গতাবোধ তাকে ভয়ানক রকম পীড়ন করছিল। বাড়িতে নুরুন্নাহার বানুর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ঝগড়ার সম্পর্কও একটি সম্পর্ক আবু জুনায়েদ গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন। তার প্রবল শঙ্কা শেখ তবারক আলীর দেয়া গরু এবং গোয়াল বিষয়ক ঘটনাগুলো প্রকাশিত যদি হয়ে পড়ে তিনি সমাজে সর্বকালের সবচাইতে দুর্নীতিপরায়ণ উপাচার্য হিসেবে নিন্দিত হবেন। আত্মহত্যা করেও তিনি কলঙ্কের দায় থেকে মুক্ত হতে পারবেন না।
এই আড্ডাটি জমে উঠতে দেখে তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন । মনে মনে ভাবলেন, তিনি যে মাঝে-মাঝে শুক্রবার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন, আল্লাহতায়ালা তার কিছু ফল দিতে আরম্ভ করেছেন। নইলে বলা নেই, কওয়া নেই, বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকে এই আচ্ছাটি জমে উঠত না। মাওলানা আবু তাহের শুভ সূচনাটি করে দিয়েছেন, একথা সত্য বটে। কিন্তু আল্লাহ তো তার রহমত কোনো ব্যক্তির অছিলায় বখশিস করে থাকেন।
আবু জুনায়েদের গোয়ালঘরের আড্ডায় যে সমস্ত শিক্ষক আসতে শুরু করেছেন, তাদের সম্পর্কেও কিছু না বললে অন্যায় করা হবে। মাওলানা আবু তাহের নিছক খেয়ালের বশে মিনি চিড়িয়াখানার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন। তারপরে জনার্দন চক্রবর্তী চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করার জন্য এসেছিলেন। তারপরে এসেছিলেন পালি বিভাগের ড. সুমঙ্গল বড়ুয়া। বড়য়া বাবু তার জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দের তদবির করতে এসেছিলেন। আবু জুনায়েদ এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি বাড়ি পেতেও পারেন, আবার নাও পেতে পারেন। পেতে পারেন কারণ তার চাকরি অনেক দিনের। আবার না পেতে পারেন কারণ বাড়ি খুব অল্প, দাবিদার অনেক। যা হোক তিনি চেষ্টা করবেন। তারপর থেকে সুমঙ্গল বাবু আড্ডায় স্থায়ী সদস্য হয়ে গেলেন। তিনি আবু জুনায়েদের গরু এবং পাখিগুলোকেও পছন্দ করে ফেললেন। ড. সুমঙ্গল বড়য়ার পর ফিজিক্স বিভাগের ড. দেলোয়ার হোসেন। ড. দেলোয়ার হোসেনের ইন্টারমিডিয়েটে থার্ড ডিভিশন ছিল। সেটাই তার প্রফেসর হওয়ার পথে মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূরি ভূরি থার্ড ডিভিশন পাওয়া শিক্ষক প্রফেসর হয়ে গেছেন। সেটা আসল কথা নয়, বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সঙ্গে ড. হোসেনের সম্পর্ক ভালো নয়। বিভাগীয় চেয়ারম্যান অনুমোদন করছেন না বলেই তার প্রমোশন ঠেকে আছে। উপাচার্য সাহেবকে গোয়ালঘরে নিরিবিলিতে পাওয়া যায়। তার উপর যে দীর্ঘকাল ধরে অবিচার চলছে সেই দুঃখের কথাটি জানাতে এসেছিলেন। আবু জুনায়েদ জানিয়েছিলেন ফিজিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান খুব ঘাউরা টাইপের মানুষ। তবু তিনি তার প্রভাব খাঁটিয়ে চেষ্টা করবেন, কিছু করা যায় কি না। তারপর থেকে সন্ধ্যে হলেই ড. দেলোয়ার হোসেন আড্ডায় হাজির থাকতে আরম্ভ করলেন। এভাবে তিন মাসের মধ্যে অর্থী প্রার্থী মিলে বিশ পঁচিশ জন শিক্ষক গোয়ালঘরে নিয়মিত হাজিরা দিতে আরম্ভ করলেন। দর্শন বিভাগের আয়েশা খানম আসতে আরম্ভ করায় আড্ডাটির কিঞ্চিৎ জৌলুশ বেড়েছে। আয়েশা খানমের তেমন কোনো দাবি নেই। তবে তিনি পুরুষ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে যৌন সুখের মতো এক প্রকার সুখ অনুভব করে থাকেন। এই মহিলাকে সকলে কেন এড়িয়ে চলতেন, এক কথায় বলা মুশকিল। হয়তো তার বয়স একটু বেশি, হয়তো তার স্কুল বপু এবং পানদোক্তা খাওয়া গ্যাটগেটে লাল দাঁতের কারণে পুরুষ শিক্ষকেরা তাকে পছন্দ করেন না। মাছ যেমন পানিতে সাঁতার কাটে, পাখি আকাশে ওড়ে আয়েশা খানমও এই আড্ডার মূল কুশীলবদের একজন হয়ে গেলেন। তিনি সদস্যের জন্য বাড়ি থেকে কখনো চিড়ে ভাজা এবং কোরানো নারকেল এনে সকলকে খেতে দিতেন। মাঝে-মাঝে আবু জুনায়েদকেও কিছু গাঁটের পয়সা উপুড় করতে হতো। আড্ডার সদস্যদের নিয়মিত চা এবং বিস্কুট সরবরাহ করতে হতো। নিরামিষ আড্ডা স্থায়ী হয় না। একবার তিনি সেরা দোকান থেকে তন্দুরি এবং শিক কাবাব এনে সকলকে খাইয়েছেন। আরেকবার নাতি অন্তুর জন্মদিনে সকলকে সন্দেশ পায়েশ এবং শবরি কলা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন।
আবু জুনায়েদ লক্ষ্য করেছেন, তার এখানে যারা আসেন তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগুনি, হলুদ এবং ডোরাকাটা দলের সঙ্গে যুক্ত নন। সকলেই আলাদা আলাদা ব্যক্তি। কারো দলীয় পরিচয় নেই। ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত থাকাই নির্দলীয় শিক্ষকদের সবচাইতে বড় দল। আবু জুনায়েদ ভাবনাচিন্তা করতে আরম্ভ করেছেন, এই ভাঙাচোরা শিক্ষকদের সংগঠিত করেই তিনি ইচ্ছে করলে একেবারে নিজস্ব একটি দল খাড়া করতে পারেন। তার নিজের ডোরাকাটা দলটির কোনো কোনো শিক্ষক তাকে এমনভাবে নাজেহাল করতে আরম্ভ করেছেন, আত্মরক্ষার্থে এরকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি না, একথাটা তার বিবেচনার মধ্যে রয়েছে।
আবু জুনায়েদের চুটিয়ে আড্ডা দেয়ার একটা অসুবিধা হলো, টেলিফোন এলে তাকে বারে বারে ছুটে গিয়ে কল রিসিভ করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে তো সরকারি বেসরকারি নানা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যেতে হয়। বার বার উঠে যেতে হয় বলেই গল্পগুজবের মাঝখানে ছেদ পড়ে যায়। এক সন্ধ্যেবেলা জনার্দন চক্রবর্তী একটা অভিনব প্রস্তাব করে বসলেন :
-বৎস আবু জুনায়েদ তোমাকে টেলিফোনে কথা কহিবার জন্য বারে বারে উঠিয়া যাইতে হয়, ইহা আমাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত অশোভন বলিয়া প্রতীয়মান হয়। উপাচার্য কেন বার বার টেলিফোন যন্ত্রের কাছে ছুটিয়া যাইবে। ইহার অন্যরকম একটা বিহিত বাহির করিতে চেষ্টা করো।
আবু জুনায়েদ বললেন,
-স্যার কী করতে বলেন, তাহলে টেলিফোন কি রিসিভ করব না?
-বৎস আবু জুনায়েদ আমার কথার মর্ম তুমি অনুধাবন করিতে পার নাই। তুমি টেলিফোনের কাছে যাইবে কেন, টেলিফোন যন্ত্র তোমার কাছে ছুটিয়া আসিবে।
-কী করে সম্ভব স্যার।
-বৎস তুমি সরল জিনিসটি বুঝিতে পারিলে না। তুমি বাড়ি হইতে টেলিফোন যন্ত্রের শাখা অত্র স্থানে টানিয়া আনার হুকুম করো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মও এইখানে বসিয়া তুমি সম্পন্ন করিতে পারিবে । জায়গাটি অতীব মনোরম। গাভীটি তো অনিন্দ্যসুন্দর । বিহঙ্গগুলির কলকাকলি শুনতেও বেশ লাগে। আধারাত কাজ করিলেও শরীরে মনে কোনো শ্রান্তি অনুভব করিবে না। আমরা যেমন প্রত্যহ আসিয়া থাকি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মে যাহারা তোমার দর্শন লাভ করিতে চায়, তাহারাও এখানে আসিবে। তুমি হুকুম করো।
জনার্দন চক্রবর্তীর ঝুনো মস্তকে এরকম সুন্দর একটি পরামর্শ লুকিয়ে থাকতে পারে, কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। মাওলানা তাহের বললেন,
জনার্দন বাবু একটি চমৎকার প্রস্তাব করেছেন। ওল্ড মানে গোল্ড এই কথা প্রমাণিত হলো। দুনিয়াতে বুড়ো মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না। বাদশাহ সিকান্দার জঙ্গে যাওয়ার সময় একদল বুড়ো মানুষ সঙ্গে সঙ্গে রাখতেন। কোনো বিপদ আপদ হলে তারা মুশকিল আসানের পথ বাতলে দিতেন, একবার হলো কী জানেন…?
আয়েশা খানম মাওলানা তাহেরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, তারপর আপনি একটা গল্প শুরু করলেন। কিন্তু আমরা চাই আগামী কালই টেলিফোনের এক্সটেনশন লাইন নিয়ে আসা হোক। দুচারদিনেই গোয়ালঘরের উত্তরের শেডে টেলিফোনের এক্সটেনশন নিয়ে আসা হলো। টেবিল পাতা হলো। কোণার দিকে দুটো শেলফ বসে গেল। গোয়াল ঘরে উপাচার্যের একটা নতুন অফিস তৈরি হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের খুচরোখাচরা কাজগুলো মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ নতুন অফিসে বসেই সারতে লাগলেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে যারাই দেখা করতে আসেন, তাদেরকে উত্তরের শেডে আসতে বলা হলো। মোগল সম্রাটেরা যেমন যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন। দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিণ্ড হয়ে উঠল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটাই পৃথিবীর একমাত্র গোয়ালঘর, যেখান থেকে আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়।
আর কিছুদিন না যেতেই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছড়িয়ে গেল। উপাচার্য সাহেব বিকেলবেলা গোয়ালঘরে বসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তার গরু এবং মিনি চিড়িয়াখানা সম্বন্ধেও নানারকম আজগুবি খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকল। এটাকে ঠিক গরু বলা যাবে কি না সে ব্যাপারেও বিতর্ক আছে। গরুটির গর্ভধারিণী হলো সুন্দরবনের একটা শিঙাল মাদি হরিণ এবং বাবা অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়। মাদী হরিণের গর্ভে এবং অস্ট্রেলিয়ান ষাঁড়ের ঔরসে উপাচার্য সাহেবের গরুটি পয়দা হয়েছে। গরুটির আকার প্রকার গরুর মতো। গায়ের রঙ, চোখের দৃষ্টি, স্বভাবের চঞ্চলতা সবটা হরিণের মতো। গরুটি এই অল্প সময়ের মধ্যে উপাচার্য সাহেবের কলিজার টুকরো হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদণ্ড দৃষ্টির আড়াল করতে চান না। নিজের হাতে উপাচার্য সাহেব গরুটিকে খাওয়ান, নিজে গোসল করান, সাধ্যমতো মলমূত্রও নিজে পরিষ্কার করেন। অন্য কাউকে গরুটির ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেন না।
এটাই একমাত্র গুজব নয়। গরুটাকে কেন্দ্র করে আরো একটা কাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী এবং মহিলা মহলে চালু হয়ে গেছে। একটা জিন কিংবা পরীর সঙ্গে উপাচার্য আবু জুনায়েদের গভীর ভালবাসা হয়েছে। এই পরীটাই দিনের বেলা সুন্দর একটা গরুর বেশ ধরে গোয়ালঘরে শুয়ে থাকে। রাত গম্ভীর হলে অনিন্দ্যসুন্দর একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আবু জুনায়েদের সঙ্গে রঙ-ঢঙ মতো কিছু করে। আবু জুনায়েদ রাতে ঘরে থাকেন না। পরী কন্যার সঙ্গেই গোটা রাত আশনাই করে কাটিয়ে দেন। এখন আবু জুনায়েদের সঙ্গে তার বড় পত্নী নুরুন্নাহার বানুর কোনো সম্পর্ক নেই। স্বামী স্ত্রীতে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ। তৃতীয় আরেকটি গুজব টিচার্স ক্লাবে তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে বিশেষ চমৎকারিত্ব নেই। নিতান্ত সাদামাঠা ধরনের। সেটা এরকম-আবু জুনায়েদ নাকি স্থির করেছেন, উপাচার্যের চাকরির মেয়াদ ফুরোলে তিনি দুধের ব্যবসা করবেন। কারণ তিনি হিসেব করে দেখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার চাইতে গাভী পুষে গয়লাগিরি করা অনেক লাভজনক।
কিছুদিন বাদেই নিউজপ্রিন্টে ছাপা একটি লিফলেট হাতে হাতে তামাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছড়িয়ে গেল। লিফলেটের শিরোনাম দেয়া হয়েছে উপাচার্য না গো আচার্য। কারা এই লিফলেট ছেপেছে, কারা বিলি করেছে তার কোনো উল্লেখ নেই। মূল বয়ানটা এরকম- ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন কর্মচারী এবং দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দের কাছে আকুল আবেদন : আপনাদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গরীয়ান ঐতিহ্যের কথা অজানা থাকার কথা নয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে বাংলাদেশের গর্ব করার সম্পদ দ্বিতীয়টি নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকেরা এই অঞ্চলে একটি নতুন ইতিহাসের ভিত্তিভূমি রচনা করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ভ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান মেধা মনীষায় একদা সমস্ত ভারতবর্ষে একটা বিশিষ্ট স্থান দখল নিয়েছিল। মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী ভাইবোনেরা, সম্মানিত দেশপ্রেমিক নাগরিকবৃন্দ আপনারা সকলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণোজ্জ্বল গৌরবমণ্ডিত দিনের কথা স্মরণ করে অশ্রুপাত করুন। আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অতীত দিনের গৌরবের লেশমাত্রও অবশিষ্ট নেই । বিশ্ববিদ্যালয়ে হরদম খুনাখুনি হামলাহামলি চলছে। নিয়মিত ক্লাস বসছে না, পরীক্ষা হতে পারছে না, সেশনজট লেগে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরুতে ছেলেদের চাকরির বয়স চলে যায়, মেয়েদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সর্বত্র দুর্নীতির আখড়া বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত সমস্ত অপকর্মের জন্য দায়ী ডোরাকাটা দল। ওই দলটি কতিপয় দেশদ্রোহী শিক্ষকদের একটি সংগঠন। তারা ছলেবলে কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা আপন মুঠোয় নিয়ে এই সুপ্রাচীন বিদ্যাপীঠটি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে সর্বক্ষণ তৎপর রয়েছে। ডোরাকাটা দল এমন এক ব্যক্তিকে উপাচার্যের পবিত্র আসনটিতে বসিয়েছে, জ্ঞান বিদ্যার প্রতি যার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধও নেই। ওই উপাচার্যটি তার পোষা গরুর পেছনে যত সময় ব্যয় করেন, গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তার তিনভাগের এক ভাগ সময়ও ব্যয় করেন না। এই ব্যক্তি এই ঐতিহ্যমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোশালায় পরিণত করার বন্দোবস্ত একরকম পাকা করে এনেছেন। এই ব্যক্তি যদি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধু কঙ্কালটিই টিকে থাকবে। এখনো সময় চলে যায়নি। সকলের কাছে উদাত্ত আহ্বান রাখছি আমাদের এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়কে ডোরাকাটা দল এবং তাদের মনোনীত উপাচার্য আবু জুনায়েদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার জন্য সকলে এগিয়ে আসুন।
এই লিফলেটের কয়েকটি কপি যথারীতি গোয়ালঘরের সান্ধ্য আসরে এসে পৌঁছাল। আড্ডায় রীতিমতো একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। সকলেরই একটা প্রশ্ন। এরকম নোংরা কর্ম কে বা কারা করতে পারে। সকলেরই ধারণা গাছের গুঁড়ি অলাদের সঙ্গে এই লিফলেটের একটা সম্পর্ক অবশ্যই আছে। ড. দেলোয়ার হোসেন নিশ্চিত করে বললেন,
-ড. আহমদ তকির উস্কানিতেই এই লিফলেট ছাড়া হয়েছে। তকি সাহেবের সার্ভিস এক্সটেনশনের আবেদনপত্রে উপাচার্য সাহেব সুপারিশ করেননি বলেই তার বিরুদ্ধে তিনি উঠে পড়ে লাগতে এসেছেন।
দর্শন বিভাগের আয়েশা খানম ড. দেলোয়ার হোসেনের মুখের কথা টেনে নিয়ে মন্তব্য যোগ করলেন,
-উপাচার্য সাহেব যদি একটিও ভালো কাজ করে থাকেন, আমার মতে সেটি হলো ড. তকির সার্ভিস এক্সটেনশনের আবেদনে সুপারিশ না করা। ড. তকি একজন ঘোরতর নাস্তিক-সেটা যথেষ্ট নয়, তিনি মাস্তান শিক্ষকদের নেতাও বটে। ফার্মেসী বিভাগের ড. ফারুক আহমদ একটু ভিন্নরকম কথা বললেন। তার মতে :
-এই লিফলেটের সঙ্গে ড. আহমদ তকির একটা সম্পর্ক আছে অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমার বিশ্বাস ভাষাটা তকি সাহেবের নিজের নয়। তকি সাহেব গদ্য লেখার সময় তৎসম শব্দের অপপ্রয়োগ করেন এবং তার যে কোনো লেখায় স্নিক প্রত্যয়ান্ত শব্দ অবশ্যই থাকতে বাধ্য। আপনারা লিফলেটটি আবার পড়ে দেখুন, সেরকম একটি শব্দও খুঁজে পাবেন না। আমার বিশ্বাস এই লিফলেটটির লেখার সঙ্গে কোনো মহিলার হাত অবশ্যই আছে। রচনার রীতি দেখে মনে হয় লিফলেটটি রচনা করে থাকবেন দিলরুবা খানম।
উপস্থিত সকলের মতামতও তাই। হ্যাঁ দিলরুবা খানমের কলম থেকে এরকম একটি লিফলেট জন্ম নিতে পারে। বোটানি বিভাগের ড. মাহমুদুল আলম গম্ভীরভাবে বললেন,
-এই লিফলেট কে লিখেছেন বা কারা লিখেছেন সেটি বিচার্য বিষয় নয়। আমার কথা হলো এই নোংরা লিফলেটের একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন জবাব দেয়া প্রয়োজন। বুঝিয়ে দেয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয় নোংরামির জায়গা নয়। উপাচার্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলেন স্যার?
আবু জুনায়েদ চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে জবাব দিলেন,
-আমি কী বলব। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাদের, আপনারা যা উচিত মনে করেন, করবেন।
সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হলো অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাষায় এই লিফলেটটির একটি জবাব দেয়া হবে। সেটি লেখার ভার বাংলা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. আনোয়ারুল আজিমের উপর দেয়া হলো। তিনি আগামী কাল সন্ধ্যেবেলা খসড়াটি করে আনবেন কথা দিলেন।
পরের দিন সন্ধ্যেবেলা গোয়ালঘরের সান্ধ্য আসরে সকলে অধীরভাবে প্রতীক্ষা করছেন। কিন্তু ড. আজিমের দেখা নেই। সকলের উল্কণ্ঠা বেড়ে গেল। ড. দেলোয়ার হোসেন বিরক্ত হয়ে বললেন,
-ড. আজিম পারবেন না বললেই হতো। না হয় বাংলা একটু কম জানি। তবু তো চেষ্টা করে দেখা যেত।
ড. আয়েশা খানম মন্তব্য করে বসলেন,
-খোঁজ নিয়ে দেখেন গিয়ে হয়তো ড. আহমদ তকির খপ্পরে পড়ে গেছেন। এক সময় তো আজিম তকি সাহেবের পেছনে ছায়ার মতো ঘোরাঘুরি করতেন।
মাওলানা আবু তাহের বললেন,
-সে তো চাকরি পাবার পূর্বের ঘটনা। এখন জমানা পাল্টে গেছে। একটু অপেক্ষা করুন। দেখেন আসবেন।
সত্যি সত্যি ড. আজিম এলেন। লিফলেটের খসড়াটি তার হাতে ধরা রয়েছে। তিনি কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন,
-আমি দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল। তিন চারবার কপি করতে হলো কিনা।
দেলোয়ার হোসেন সাহেব বললেন, আপনাকে আর ভণিতা করতে হবে না। কী লিখে এনেছেন পড়ে ফেলুন।
ড. আজিম জামার খুটে কাঁচ মুছে মুছে চশমাটি নাকের ডগায় চড়ালেন। প্রথমে একটা গলা খাকারি দিলেন। তারপর লাজুক ভঙ্গিতে বললেন,
-আমাদের লিফলেটেরও একটা শিরোনাম দেয়া হয়েছে। আর সেটা হলো মহান উপাচার্য : বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
মাওলানা তাকে বললেন, চমৎকার পড়ে যান।
ড. আজিম আবার একটু ভণিতা করলেন,
-আমি গোটা লিফলেটটি সাধু ভাষাতেই রচনা করিয়াছি। সাধু ভাষার একটা বিশেষ প্রসাদগুণ রয়েছে।
ড. ফারুক আহমদ একটু অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। তিনি বললেন,
-ড. আজিম লেখাটা পড়ে যান। পরে গুণাগুণ বিচার করব, আমরা শিশু নই।
অতএব ড. আনোয়ার আজিম পড়তে আরম্ভ করলেন :
-জগৎ পরিবর্তনশীল। কাল সহকারে কত কিছুরই পরিবর্তন হইতেছে। দিবস আঁধারে মিলাইতেছে, নদী সমুদ্রে পড়িতেছে। রাজ্য ও সাম্রাজ্য বিনষ্ট হইতেছে, আবার নতুন রাজ্য গড়িয়া উঠিতেছে। শিশু কিশোর হইতেছে, কিশোর যুবক হইতেছে এবং বৃদ্ধ মৃত্যুর মুখে ঢলিয়া পড়িতেছে। সুতরাং দেখা যাইতেছে পরিবর্তন জগতের ধর্ম। যে কেহ পরিবর্তনকে মানিয়া লইবে না সে আপনার মৃত্যুর পথ আপনি প্রশস্ত করিবে আপনার কবর আপনি খনন করিবে।
জাতীয় জীবনে আমাদিগকে এত দুর্ভাগ্যের বোঝা বহন করিয়া বেড়াইতে হইতেছে, তার মূল কারণ কী হইতে পারে? কারণ একটাই। আমরা পরিবর্তনকে মানিয়া লই নাই। আমাদের প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এত অত্যাচার, এত অন্যায়, এত খুন, এত জীবনের অপচয়, সময়ের অপচয়, অর্থের অপচয় কেন অহরহ ঘটিতেছে তার কারণ কি কেহ চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন কি? ঐ একটাই কারণ জাতীয় জীবনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা পরিবর্তনকে মানিয়া লই নাই । তাহার ফল এই হইয়াছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় আসিয়া ঠেকিয়াছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিদায় লইয়াছে, পাকিস্তানিরা চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমরা ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানিদের সমস্ত নিয়মকানুন আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিয়াছি। ব্রিটিশ আমলে উপাচার্যেরা যে ধরনের কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিতেন, সেইভাবে জনবিচ্ছিন্নভাবে গজদন্ত মিনারে অবস্থান করিয়া ক্ষমতার মহিমা এবং স্বাতন্ত্র প্রকাশ করিতেন, পাকিস্তানি আমলের উপাচার্যেরা সেই জীবন পদ্ধতির অক্ষম অনুকরণ করিয়াছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানি আমলের উপাচার্যদের অনুকরণ করিয়াছেন। এই পৌনঃপুনিক অনুকরণের কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনেকদিন পর্যন্ত মৌলিক চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কোনো বাংলাদেশী উপাচার্যের নিকট হইতে সঠিক দিক নির্দেশনা লাভ করিতে পারে নাই। স্বাধীনতার পর হইতে বেগুনি দলটি নানারকম তালবাহানা করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়াছিল। তাহারা নিজেদের স্বার্থেই পরিবর্তনের স্রোত রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। এই পরিবর্তনকে ঠেকাইতে গিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকে কলুষিত করিয়া ফেলিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত অনিয়ম হইতেছে, এত অন্যায় হইতেছে, এত খুন হইতেছে, এত সেশনজট হইতেছে, জীবনের এত অপচয় হইতেছে সবকিছুর জন্য বেগুনি দলই দায়ী। ডোরাকাটা দল তাহাদের অন্যায় অবিচার সংশোধন করিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করিবার জন্য সদাসর্বদা তৎপর রহিয়াছে। তাহাদের মনোনীত উপাচার্য মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদ সাহেব কোনোরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব না করিয়া ঔপনিবেশিক আমলের উপাচার্যের জীবন পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। তিনি একেবারে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের একই সমতলে নামিয়া আসিয়াছেন। তিনি গাছপালা পশুপাখির মধ্যে জীবনের পূর্ণতা এবং সার্থকতা আবিষ্কার করিতে তৎপর হইয়া উঠিয়াছেন। ইহা কি একটি মহান বৈপ্লবিক দৃষ্টান্ত নয়? অতীতে কোন উপাচার্য সাজানো-গোছানো অফিসের মায়া ছাড়িয়া একজন সরল গ্রামীণ মানুষের মতো একটি চালঘরে নিজের দপ্তর প্রতিষ্ঠিত করিয়া গবাদি পশুর সঙ্গে, বিহঙ্গের সঙ্গে জীবন এবং কর্তব্য ভাগ করিয়া লইয়াছেন। যাহাদের দৃষ্টি নীচ তাহারা সর্বত্র নীচতা দেখিতে পাইবেন তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। বর্তমান বিশ্বে সর্বত্র পরিবেশ রক্ষার আওয়াজ বুলন্দ হইয়া উঠিয়াছে। আধুনিক পৃথিবীর সভ্য মানুষের পরিবেশ রক্ষার উদাত্ত আহ্বান তাহাদের মর্মে প্রবেশ করে নাই। তাহারা মধ্যযুগের অন্ধকারে চক্ষু আবৃত করিয়া রাখিয়াছেন, দিনের আলোক দেখিতে পাইতেছেন না। প্রকৃতি মানুষের একার নয়। মানুষকে পশুপাখি, গাছপালার সঙ্গে প্রকৃতি সমানভাবে ভাগ করিয়া লইতে শিক্ষা করিতে হইবে। এইটাই হইল সভ্যতার মর্মবাণী। আবু জুনায়েদ সাহেব বাংলাদেশের শতকরা পঁচাশি জন কৃষিজীবী মানুষের জীবনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করিবার জন্য অনেক কষ্ট করিয়া একটি গবাদি পশুকে আদর করিয়া পুষিতেছেন। পরিতাপের বিষয় হইল বেগুনি দলের লোকেরা তাহার এই দৃষ্টান্তমূলক কর্মটির অপব্যাখ্যা করিতেছে। দেশের মানুষ ভালো করিয়া জানে কে বন্ধু, কে শত্রু। আমাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন গরুকে লইয়া যাহারা ব্যঙ্গ করে, দেশের মানুষ তাহাদের চিনিয়া লইতে ভুল করিবে না। সুতরাং আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক কর্মচারী এবং কোটি কোটি দেশবাসীর পক্ষ হইতে বলিব, মহান আবু জুনায়েদ আপনি আপনার বৈপ্লবিক জীবনদর্শন লইয়া আগাইয়া চলিতে থাকুন, আমরা সকলে আপনার পেছনে রহিয়াছি।
ড. আজিম পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে লিফলেটের খসড়াটি পাঠ করে গেলেন। শেষ হলে সকলেই একবাক্যে বললেন, চমৎকার। আবু জুনায়েদ ড. আজিমের দিকে প্রথম নতুন চোখে তাকাতে আরম্ভ করলেন। তার কর্মের মধ্য থেকে একটা জীবনদর্শন আবিষ্কার করা রীতিমতো সেয়ানা মস্তকের কাজ। ঠিক করলেন প্রফেসর পদে তার প্রমোশন দেয়া যায় কি না চেষ্টা করে দেখবেন। সেদিন সন্ধ্যেবেলা উপাচার্য সাহেব দোকান থেকে বিরিয়ানি আনিয়ে সকলকে খাওয়ালেন। একেবারে তার নিজের একটি দল তৈরি হয়ে গেল।