১০. হ্যারিকেনের চিমনি

১০

বেশ অন্ধকার ক’রে রুচি ফেরে। শিবনাথ ঘরের মেঝেয় উবু হয়ে ব’সে হ্যারিকেনের চিমনি পরাতে ব্যস্ত। মা’র ফিরতে দেরি দেখে মঞ্জু কাঁদছিল এবং এতক্ষণ মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে সান্ধ্যবাতি লাগার সঙ্গে সঙ্গে শিবনাথ আলোটা জ্বালতে পারেনি। কাজেই রুচি ভিতরে ঢোকার পরও ঘর অন্ধকার ছিল।

আলো জ্বলতে সে ঘরে একটা নতুন জিনিস দেখতে পেল। ‘ওটা কখন কিনলে?’

‘দুপুরে, একটা ফেরিওলা এসেছিল।’ শিবনাথ অল্প হাসল।

কিন্তু বাক্সের ওপর রাখা অ্যাশট্রেটা হাতে নিয়ে রুচি একবার দেখল না। হাতের থলেটা নামিয়ে রেখে সে কাপড় বদলাতে ব্যস্ত হয়।

‘বেশ নতুন ডিজাইন। দেখে পছন্দ হ’ল।’ নতুন কেনা অ্যাশট্রেটা হাতে নিয়ে শিবনাথ নাড়াচাড়া করে। ‘সাড়ে ছ’ আনা, দাম খুব বেশি না।’

‘ঘরে তো পয়সা ছিল না, যে ক’ আনা ছিল আমি সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম। পয়সা পেলে কোথায়?’

স্ত্রীর এই প্রশ্নে শিবনাথ একটু গর্বিত-ভঙ্গিতে তাকায়। অ্যাশট্রেটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলল, ‘তোমার কি মনে হয়?’

‘কি ক’রে বলব!’ বেশ গম্ভীর হয়ে রুচি উত্তর দেয়। ফর্সা ব্লাউজ ছেড়ে সে ময়লা মতন ব্লাউজটা গায়ে চড়ায়; মঞ্জু আর অপেক্ষা না করে মা’র কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শিবনাথ যতটা উৎসাহ নিয়ে কথা বলবে বলে মনে মনে ঠিক ক’রে রেখেছিল, রুচির চেহারা দেখে তা আর পারল না। তবু যতটা সম্ভব হাসি-হাসি মুখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে এসেছি, একটু একটু ক’রে এখন সকলের সঙ্গে জানাশোনা হচ্ছে। তখন জিনিসটা পছন্দ হ’তে ভাবলাম কোথা থেকে দাম দিই, ফেরিওয়ালারা কখনো ধারে কিছু বিক্রি করে না, এমন সময় বনমালী নিজে থেকে বললে, ‘তার জন্যে কি, আমি পয়সাটা দিয়ে দিচ্ছি, পরে একসময় আমাকে দিলেই চলবে।’

‘দুপুরেও বুঝি মুদিদোকানের সামনে তোমাদের আড্ডা জমেছিল।’ রুচি এবার ঘাড় ফেরায়

‘কে কে ছিল?’

শিবনাথ ঈষৎ লজ্জিত হয়। ‘আমি, কে. গুপ্ত।’ একটু থেমে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি বেরিয়ে গেলে কাজে, মঞ্জু ঘুমোচ্ছিল, একলা একলা আর কি করি তখন–’

‘কারো কাছে কিছু খোঁজখবর পেলে? এ-মাস তো কাবার হ’তে চলল। সামনের মাসে একটাও অন্ততঃ ট্যুইশানি যদি না যোগাড় করতে পার খুব মুশকিলে পড়তে হবে আমাদের।’

শিবনাথ নীরব।

মঞ্জুকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে রুচি হাত-মুখ ধুয়ে এল।

‘তা ছাড়া, এ্যাদ্দিন সবাই আমরা আশায় আশায় ছিলাম, কম হোক বেশি হোক এবছর একটা ইনক্রিমেন্ট হবে। আজ সেক্রেটারির কথায় বুঝলুম, এবছর তা হবার আশা কম, কম কি নেই-ই একরকম। সিনিয়র টিচারদেরও বেতন বাড়বে বলে মনে হয় না। ইস্কুলের ফান্ডের অবস্থা নাকি ভাল না।’

শিবনাথ তেমনি চুপ থেকে হাতের নখ খোঁটে।

ও-বেলা রুটি-তরকারি ক’রে রেখেছিল রুচি। ঠাণ্ডা পড়েছে। এখন এক বেলার জিনিস আর এক বেলায় রেঁধে রাখলেও নষ্ট হবার আশঙ্কা নেই, তাই শিবনাথই রুচিকে এ-প্রস্তাব দিয়েছে। কেবল কয়লা বাঁচবে বলে নয়, খেটেখুটে এসে আবার এসব কাজে হাত লাগাতে রুচির কষ্ট হবে চিন্তা করে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মঞ্জুকে খেতে দিয়ে রুচি বলল, ‘চাকরিবাকরি যখন শীগগির হবার সম্ভাবনা নেই, তখন ট্যুইশানির চেষ্টা করাই ভাল।’

‘আমি চেষ্টা করছি।’শিবনাথ বলল, ‘নতুন জায়গা, দু’চারদিন যাক, আর একটু জানাশোনা হয়ে গেলেই একটা দু’টো অন্ততঃ জুটবেই। হ্যাঁ, অনেক পয়সাওলা লোকও এসব অঞ্চলে আছে টের পাচ্ছি, তাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় প্রত্যেকেই ইস্কুল কলেজে যায়!’

হঠাৎ শিবনাথ থামল।

কেননা একটা চামচিকে ঘরে ঢুকে ফরর্ শব্দ করে মাথার ওপর অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে দেখে মঞ্জু খিলখিল করে হেসে উঠল, রুচিও খুব হাসতে লাগল। আবহাওয়া তরল হয়েছে অনুমান ক’রে শিবনাথ ঢোক গিলল এবং ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা অ্যাট্রেটার দিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে আস্তে বলল, ‘দুপুরবেলা আজ বাড়িতে এক কাণ্ড হয়েছে।’

‘কি?’ রুচি শিবনাথের দিকে তাকায়।

‘অমল আজ তার বৌকে খুব মেরেছে।’

‘কে অমল?’ রুচি অবাক হয়ে তাকাল।

দশ নম্বর ঘরের ভাড়াটে। কিরণ। কিরণের স্বামীর নাম অমল চাকলাদার।’

রুচি চুপ করে রইল। বস্তুত এ বাড়ির প্রায় সব ক’টা ঘরের নম্বর এবং বাসিন্দাদের নাম শিবনাথ যেমন মনে রাখছে রুচি তা পারছে না। কেবল গোলমাল হচ্ছে ওর। এতগুলো মুখ, তাদের নাম ও প্রত্যেকের ঘরের নম্বর ঠিক রাখতে মনের যে স্থৈর্য, নিশ্চিন্ততা ও সময়ের প্রয়োজন, রুচির তা নেই যদিও। শিবনাথ অপেক্ষাকৃত নিশ্চিন্ত, ঠাণ্ডা মেজাজের এবং চাকরিটি গেছে পর থেকে সময় তো প্রচুর পাচ্ছেই।

একটু বাঁকা সুরে রুচি প্রশ্ন করল, ‘কি দোষ করেছিল তোমাদের কিরণ?

খোঁচাটুকু শিবনাথ হয়তো বুঝল, কিন্তু গায়ে মাখল না। বলল, ‘আমিও তখন বাড়িতে ছিলাম না, বনমালীর দোকানের সামনে ব’সে আছি, সেখানেই লোকটার কাছ থেকে অ্যাশট্রেটা কিনি। পরে বাড়িতে এসে শুনলাম, ফেরিওয়ালাটা অনেকক্ষণ এই উঠোনে দাঁড়িয়েছিল। আর দশটি মেয়ে যেমন দাঁড়িয়ে জিনিস কিনছিল, কিরণও ছিল তাদের সঙ্গে। কিন্তু আর দশটি মেয়ের হাতের সঙ্গে হাত না ঠেকে কিরণের হাতের সঙ্গেই নাকি লোকটার হাত ঠেকছিল। ঘরের ভেতর থেকে জিনিসটা তার স্বামীর নজরে পড়েছিল। পড়তেই উঠোনে ছুটে এসে বৌকে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে ভীষণ প্রহার। চিৎকার ক’রে সারা দুপুর কাঁদছিল বেচারা।’

কথা শেষ ক’রে শিবনাথ হাসল। রুচি গম্ভীর।

‘লেখাপড়া না শেখার যা দোষ। অত্যন্ত কনজারভেটিভ এই লোকটা। অমল চাকলাদার। এদিকে কিন্তু শ্রীমানের চাকরি নেই। চায়ের দোকানে উনিশ টাকা বাকি।’

কিন্তু রুচি হঠাৎ একটু বেশিরকম গম্ভীর হয়ে আছে দেখে শিবনাথ চুপ করল।

মঞ্জুর খাওয়া শেষ হ’তে হাতমুখ ধোয়াতে রুচি উঠে যায়। শিবনাথ সিগারেট ধরায়। সিগারেট ধরিয়ে ভাবে এই অবস্থায় সকালের সেই কে. গুপ্ত এবং তার সিনেমার বন্ধু চারু রায়ের মধ্যে এ বাড়ির মক্ষীরাণী কিরণকে নিয়ে যে-গল্পটা হয়েছিল, রুচিকে সেটা বলা ঠিক হবে কিনা। অবশ্য এ-গল্পের সঙ্গে রুচিও এক জায়গায় সূক্ষ্মভাবে জড়িয়ে আছে। ভেবে শিবনাথ মনে মনে হাসল। কিন্তু আবার মঞ্জুর হাত ধরে স্ত্রীর ঘরে ফিরে আসার পর তার চেহারা দেখে শিবনাথ বলতে সাহস পেলে না গল্পটা। রাত্রে বহুক্ষণ সেটা কেবল তার মগজের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে লাগল।

রাত্রে শিবনাথ এবং রুচি দু’জনেই শুনল পাশের কোন্ একটা ঘরে অত্যন্ত কর্কশ গলায় কে কাকে গালাগাল দিচ্ছে।

‘আমি তোমায় পুনঃপুনঃ নিষেধ করেছি মুদিরদোকান থেকে আর ধারে জিনিস এনো না, ও চার আনার সওদা ধারে আনলে অমনি খাতায় আট আনা–ডবল দাম লিখে রাখে, বনমালী হারামজাদা আমাদের সর্বস্ব গিলতে চাইছে তুমি কি জান?‘

প্রতিপক্ষের গলা শোনা গেল না।

‘এটায় কুলাচ্ছে না, ওটা ফুরিয়ে গেল–রব ছাড়া তোমার মুখে আমি অন্য কথা শুনি না, যখনই ঘরে আসি।’

‘আমার তো একটা মুখ না। ঘর ভরে ফেলছ বাচ্চা দিয়ে, চাল থেকে নুন, ডাল থেকে কয়লা, চিনি থেকে কাঠ কেরোসিন কোটা কম লাগছে, এর চেয়ে কম দিয়ে কে চালাতে পারে? একবার তুমি ঘরে এসে আসন পেতে দ্যাখ না।’—স্ত্রী-কণ্ঠ।

‘না, আমি বাইরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছি, বেশত, একবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দ্যাখো না ক’ টাকা রোজগার ক’রে আনতে পার। হ্যাঁ, আমি ভাত সেদ্ধ করছি।’ পুরুষের বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠ।

‘তোমার চেয়ে অনেক বেশি পারি আমি। তোমার মত গাধা না সবাই। এমন মোটা বুদ্ধি! ইস্কুলের মাস্টারি ছাড়া সংসারে আর টাকা রোজগারের পথ নেই!’ বিদ্রূপ আরও কড়া।

‘কি করতে, সিনেমায় নামতে, ওই চেহারায়? বারোটি সন্তানের মা হয়ে? গায়ে থু-থু দেবে সব, হা-হা।’ পুরুষ হেসে উঠল।

‘এই, সাবধানে কথা বলো বল্‌ছি, অসভ্য! না হলে গায়ে ভাতের গরম মাড় ঢেলে দেব। কী কুৎসিত চরিত্র হয়েছে তোমার দু’টো গাধা মেয়ে পড়িয়ে পড়িয়ে। কেন আমি কি বলেছি নাকি যে সিনেমায় নামব। সাধনা, মমতা, রইল তোদের সংসার, রান্না; ভাইবোন মানুষ করা। আমি কালই ডিহিরি তোদের মামাবাবুর বাসায় চলে যাব। দাদা সেদিন এই সংসারের ও আমার নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলছিলেন, ‘চল্ লক্ষ্মী! ক’দিনের জন্য ডিহিরি, তোর বৌদির কাছে থাকবি। কালই আমি চলে যেতে পারি ইচ্ছে করলে, আমায় বেশি ঘাঁটিও না বলছি। লক্ষ্মীমণির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একঘর শিশু কলরব করে উঠল, ‘না মা, তুমি যেও না, তুমি চলে গেলে বাবা আমাদের শুধু শুকনো চিঁড়ে আর মুলো খাইয়ে মেরে ফেলবে। আমরা মরে যাব।

‘এই চুপ, চুপ্ শুয়ারের দল!’ বিধু মাস্টারের প্রচণ্ড গর্জন রাত্রির অন্ধকারে কেঁপে উঠল, ‘তা আমি একলা হাতে ক’দিক সামলাব, ইস্কুল, ভাত-রান্না, ট্যুইশানি একসঙ্গে তিনটে হয় না। হ্যাঁ, চিঁড়ে কেন, এবার যদি তোদের মা কোথাও বেড়াতে চলে যায়, তোদের গুষ্টিকে আমি স্রেফ্ গোবর খাইয়ে রাখব। আমি বদমাশ কম না।’

এরপর লক্ষ্মীমণির গলা একবারও শোনা গেল না। রাত বাড়তে লাগল। ঘরে ঘরে শোনা যেতে লাগলো কেবল ঘুমের গর্জন, লম্বা লম্বা নিশ্বাস। এর সবটাই ঘুম না। সবাই ঘুমোয় না। জেগে থেকে বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাসের করাত চালিয়ে অন্ধকার চিরছে অনেকে। রুচি জেগে ছিল। শিবনাথ অনেকক্ষণ ঘুমোচ্ছে।

দিনের বেলা রুচি শিবনাথকে বেশ কড়াভাবে বলল, ‘হুট, ক’রে ধার ক’রে সাড়ে ছ’ আনা দিয়ে একটা অ্যাশট্রে কেনার বিলাসিতা তাকে ছাড়তে হবে, না হলে মঞ্জুকে নিয়ে সে রাঁচিতে তার কাকাবাবুর কাছে চলে যাবে। এভাবে একটা বস্তিতে বাস ক’রে সারারাত সব মধুর কণ্ঠের দাম্পত্যালাপ শুনে জীবন-যাপন করতে রুচি রাজী নয় এবং দুপুরবেলা সে মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে ইস্কুলে পড়াতে চলে গেল।

সারাদুপুর মন খারাপ করে রইল শিবনাথ। তারপর একটা ট্যুইশানির চেষ্টায় বেরোবে ব’লে এক সময় পাঞ্জাবি ও চাদর গায়ে দিয়ে রাস্তায় নামল।

পিছনটা দেখেই শিবনাথ দু’জনকে চিনতে পারল। কমলা এবং ন’ নম্বর ঘরের বীথি। টেলিফোনে কাজ করে প্রীতি, তার ছোট বোন।

সাধারণতঃ রুচি যে-ধরনের চুল বাঁধে এদের দু’জনের চুল বাধার ধরন তা থেকে একটু আলাদা।

কমলার চুল ভাঁজ করে রাখা টুপির মতন। বীথির মাঝখানটা গর্ত রেখে ধারগুলো বেলুনের মত ফাঁপানো। একজনের কানে রিং, একজনের ছোট্ট দুটো বল। মটরদানা। লাল আর বেগুনি শাড়ি। একজনের পায়ে চটি আর একজনের সু। নার্সদের স্মার্ট হয়ে চলতে হয় তাই কমলার সু, শিবনাথ অনুমান করল।

ওরা বাঁক ঘুরে মেন রোডে পড়তে শিবনাথও সেই রাস্তা ধরে চলল।

কমলা নুয়ে একটা লোকের কাছ থেকে চিনাবাদাম কিনল, তারপর বীথির হাতে এক মুঠো দিয়ে দু’জনে বাদাম ভেঙ্গে মুখে দিয়ে আবার কথা বলতে বলতে চলল।

পিছনে থেকে শিবনাথ সিগারেট ধরায়।

‘প্রীতি রাস্তা খুঁজে পেয়েছে, আর ভয় নেই। হ্যাঁ, আমিই ওকে বলেছিলাম টিচারি ছেড়ে দে। যদি পয়সার মুখ দেখতে চাস আপিসে ঢোক্‌। তাই তো ও টেলিফোনে ঢুকেছে।

‘আমি তো খুঁজছি কমলাদি। আমি একেবারে সুবিধে করতে পারছি না। সেই জন্যেই তো তোমাকে বলা।’ বীথি ইচ্ছা ক’রে ডান হাতটা কমলার কোমরে ঠেকাল। ‘দিদির মত একটা সুবিধে ক’রে দাও।’

উত্তরে কমলা কিছু বলল না। থুতনিটা আকাশের দিকে তুলে কি একটু ভাবল।

‘হ্যাঁ, দিদি আমার চেয়ে স্মার্ট। কথাবার্তায় ঢের বেশি চোখামুখা! তাই তো দিদির হয়ে গেল।’

‘তোরও হবে। কমলা বীথির দিকে চোখ নামাল। ‘অ্যাদ্দিন তো আর রাস্তায় বেরোসনি। ভাবছিলি বেলেঘাটাটাই বুঝি কোলকাতা শহর।

শুনে বীথি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।

‘হ্যাঁ, তা-ও বটে। এই সেদিনও কেমন ভয়-ভয় করছিল একলা বেরোতে। শেয়ালদা পর্যন্ত যেতে ও বাসে উঠতে অনেক দিন সাহস পেতাম না। বেশি ভিড় দেখলে তো কথাই নেই। তাছাড়া ঠিক করে রেখেছিলাম গুরু-ট্রেনিং পাস করে দিককারই একটা ইস্কুলে-টিস্কুলে ঢুকে পড়ব।’

‘দূর বোকা! কেন ইস্কুলে মরতে যাবি। কী হয়েছে তোর যে, ইস্কুল ছাড়া গতি নেই?’ সোহাগ-মাখা অথচ শাসনের সুর কমলার।

বীথি আবার লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল।

‘এমন যার ভুরু, এমন নাক, তার কিনা–’ কথাটা শেষ করল না।

‘শুধু চেহারা ভাল হলেই চাকরি পায় মেয়েরা এমন চাকরি আছে কমলাদি?’

‘আছে’, কমলা বলল, ‘লেখাপড়া জানা দূরের কথা, বলতে পারে না, কানে শোনে না–এমন কি চোখেও দেখে না, অন্ধ মেয়ে চেহারা ভাল হওয়াতে চাকরি পেয়েছে কোনো অফিসে আমি জানি।’

ভ্রূ কুঞ্চিত ক’রে কি যেন ভাবল বীথি। তারপর প্রশ্ন করল, ‘কি কাজ? চোখে দেখতে পায় না সে আবার কাজকর্ম করবে কী।

‘অই আর কি। চোখে দ্যাখে না কাজকর্ম যা করে সবটাই ভুল হয়। কাজের দিকে মন না রেখে কাজ করলে যা হয়?’

‘বকুনি খায় না ভুলের জন্যে?’

‘বকতেই তো ভিতরে ঘন-ঘন ডাক পড়ে।’

‘কার, মেয়েটার? কে ডাকে?’

‘ওপরওলা।’

‘কতদিন বকছে? এভাবে তবে আর ওকে রাখছে কেন?’

‘এত ভাল-চোখের-পাতা-মেয়ে হুট্ করে পাওয়া যায় না বলেই। যে-দিন পাওয়া যাবে সেদিন হয়তো মন দিয়ে কাজ করে না বলে ওর চাকরিটি যাবে।’

বীথি চুপ করে রইল।

‘মাইনে তো বকুলের জলখাবার কেনার পয়সা। ‘

‘অথচ ওই টাকা মানে নব্বুই টাকাই তো বকুল ফি-মাসে ঘরে আনে এবং এই দিয়ে সারা মাসের ওদের সংসার খরচ চলে। মায় রাণী-টুনির ইস্কুলের বেতন। এই দিয়ে কুলোতে পারছে না বলে বকুল সন্ধ্যার পর একটা গনের ট্যুইশানি নিয়েছে।

‘হ্যাঁ, অই একটা ট্যুইশানির টাকায়ই তো ও গেল মাসে হার গড়িয়েছে।’

‘হার নাকি ওর কোন্ জ্যাঠামশাই দিয়েছে?’

‘বাড়িতে বকুল একথা বলেছে নাকি, বাড়ির লোকেরা কি তাদের এমন একজন আত্মীয় আছেন জানতেন না। বকুলের বাপ না খেয়ে রাত জেগে জেগে প্রেসের কাজ ক’রে শেষটায় টি. বি. হয়ে মরল। এই তো মাস ছয়েকের কথা না। জ্যাঠামশাই ব’লে কেউ উঁকি দিতে এলেন না, আর আজ অমনি বকুলকে আহ্লাদ ক’রে চার ভরি সোনা দিয়ে হার গড়িয়ে দিলেন!’

যেন বীথিরও একটু চোখ খুলল।

‘কে তবে এই জ্যাঠামশাই?’

‘আফিসের ম্যানেজার।’ কমলা বলল, ‘তার কাছেই রোজ সন্ধ্যার পর যায়, গান শেখাতে নয়, শোনাতে।’

বীথি অতিমাত্রায় গম্ভীর।

লক্ষ্য ক’রে কমলা হাসল।

‘যাকগে সেসব আফিসে কাজ নিয়ে আমার দরকার নেই। অত টাকাও আমাদের লাগে না, দিদি যা পাচ্ছে আর আমার যদি মোটামুটি রকম একটা ইনকাম থাকে তবেই যথেষ্ট’। বীথি কমলার দিকে তাকাল।

‘হ্যাঁ, তা তো বটেই।’ ঘাড় নাড়ল কমলা। সেসব আফিসে ঢুকে চোখ দেখিয়ে গায়ের রং দেখিয়ে তুই মোটা ইনকাম করবি আমি বলছি না। বলছিলাম চেষ্টা থাকলে এই বিদ্যায় এই চেহারায় তুইও বকুলের মতন, মতন কেন, বেশি রোজগার করতে পারিস।’

‘থাক!’ অস্ফুট একটা শব্দ করল বীথি।

‘কিন্তু তা ব’লে ইস্কুলে টিচারি করতে তুমি যেও না,’ কমলা আবার আকাশের দিকে তাকাল। –ওতে কোনোদিনই অবস্থার পরিবর্তন হয় না, দিনের নাগাল পাওয়া যায় না। গরীব থেকে যাবে।’

বীথি একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল।

‘তা কি আর বুঝি না, তা কি চোখে দেখছি না।

‘বারো নম্বর ঘরের নতুন ভাড়াটে রুচিদিকে দেখলি তো কাল?‘

বীথি ঘাড় নাড়ল।

‘দেখতে-শুনতে এমন ভাল, তার ওপর বি-এ পাস। অথচ কি বা ঘরের চেহারা, কি তাঁর শাড়ি-ব্লাউজ! আমি তো দেখে অবাক্। এ-বাড়িতে, বাড়িতে কেন, পাড়ায় খুঁজলে ক’টা আর বি-এ পাস মেয়ে পাওয়া যায়। তার সংসারে এই ছিরি?’

‘আমার মনে হয় শিবনাথবাবুর চাকরি নেই। মুখে প্রকাশ করছ না বটে, কিন্তু দেখলে বোঝা যায়।’ ফিক্ করে বীথি হাসল।

কমলা হাসল না।

‘না-ই বা থাকল স্বামীর চাকরি। না থাকা অস্বাভাবিকও না। চারদিকে এত ছাঁটাই চলেছে। কিন্তু তুমিই বা কোন্ বুদ্ধিতে ইস্কুলে পড়ে আছ। বরং ও বেচারার এখন কাজ নেই, একটা অফিসে ঢুকে–’

কমলা কথা শেষ করল না।

‘বুদ্ধির দোষ’। বীথি বলল।

‘নাহলে আড়াই জনের সংসার,’ কমলা এবার অল্প ক’রে হাসল। ‘দু’জনের চাকরি না করলেও চলে। ইস্কুলের চাকরি ছাড়া আর কিছু করব না পণ থাকলে অবশ্য অন্য কথা

বীথি নীরব।

‘তাই বলছিলাম।’ কমলা শেষ করল, ‘এ-দিনে, এই দুর্দিনে এতটা রুচিবাগীশ হয়ে লাভ কি, কষ্ট পাওয়া ছাড়া!’ কথা শেষ ক’রে সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। দেখাদেখি বীথিও কচুপাতা-রঙ ছোট্ট রুমালটি কপালে মুখে বুলিয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগে পুরল। শেয়ালদার বাস্ এসে গেছে দু’জন গিয়ে গাড়িতে উঠল।

লাইট-পোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিবনাথ ভীষণ ঘামছিল। রুমাল দিয়ে ঘাড় এবং কপাল মুছল।

শিবনাথ ভেবে অবাক হল এতক্ষণ, এতটা সময় দাঁড়িয়ে কথা বলল দু’জন, একবার পিছন ফিরে তাকাল না, দেখল না কে এপাশে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাকালে শিবনাথই কি বেশি লজ্জা পেত না?

বাস সরে গেছে।

ধারে-কাছে পরিচিত কেউ নেই দেখে শিবনাথ বিড়ি ধরায়। বিড়ি খাচ্ছে ব’লে শিবনাথের দুঃখ হয় না। দুঃখের অন্য কারণ আছে, ভাবল সে।

১১

ছুটতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলাই। তার হাঁটু ছড়ে গেছে, কপাল কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। নাকের ডগায় এসে খানিকটা রক্ত জমাট বেঁধে নোলকের মত ঝুলছে। বাঁ-হাতের তেলো দিয়ে বলাই সেটা মুছে ফেলে। পরনের ময়লা লুঙ্গি ও গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জিতে রক্ত লেগে চচট্ করছে। যন্ত্রণায় বলাই চিৎকার করে কাঁদত, কিন্তু বুঝি তার সময় ছিল না। ঘাড় ফিরিয়ে বার বার পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখছে, পুলিসের গাড়ি আছে কি চলে গেছে। না, তখনো গাড়িটা দাঁড়িয়ে। আর দেখতে না দেখতে গাড়ি বোঝাই হয়ে যাচ্ছে ফল, সবজি, পেঁয়াজ, আলু, পান, বাতাসা, তেলেভাজা খাবার ও চিনাবাদামের ঝুড়ি ঝাঁকা টিন ও ডালায়। রাস্তার ওধারে গেঞ্জি, গামছা ও মনোহারী জিনিসের দোকান সাজিয়ে যারা বসেছিল তারাও রেহাই পেলে না। জিনিসপত্রের সঙ্গে সঙ্গে দোকানীকেও পাকড়াও করে পুলিস গাড়িতে তুলছিল। বলাইর মত যারা দোকান ফেলে পালিয়ে গেল তারা অবশ্য বাঁচল। কিন্তু সবাই তো আর দোকানের মায়া ছাড়তে পারে না। ‘হল্লা’এসেছে শুনে তাড়াহুড়ো করে কেউ হয়তো দোকান গুটোতে শুরু করে, কিন্তু ইতিমধ্যে হুড়মুড় করে গাড়ি এসে যায় আর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠির গুঁতোয় সব লণ্ডভণ্ড ক’রে দেয়। কিছু জিনিস গাড়িতে উঠে, কিছু রাস্তার ধুলোয় ছড়ে ছিটকে পড়ে।

ঘাড় ফিরিয়ে বলাই তাকিয়ে দেখছিল তার ফেলে-আসা বেগুনের ঝুড়িটা পুলিস বুটের ডগা দিয়ে ঠুকছে। ঝুড়িটা কাত হয়ে গড়াতে গড়াতে প্রায় নর্দমার কাছে চলে যায়। বেগুনগুলো অনেক আগেই রাস্তার মাঝখানে ছড়িয়ে পড়েছিল।

‘এগুলো গাড়িতে তুললো না?’

‘নাঃ, কানা বেগুন সব।’ বলাই এই প্রথম শিবনাথকে দেখে ঈষৎ হাসল এবং বাঁ-হাতের তেলো দিয়ে আর একবার নাকটা মুছল।

‘তুলত হয়তো’, কে আর একজন শিবনাথের পিছন থেকে বলল, ‘গাড়িতে আর জায়গা হচ্ছে না বলে ছেড়ে দিল।’ কথা শেষ করে লোকটি হাসে।

‘এগুলো নিয়ে লাভ কি।’ একজন বলল, ‘গরীব লোক সব। দু’চার পাঁচ টাকার জিনিস নিয়ে রাস্তায় বসেছিল, কিন্তু তা-ও তাদের বেচতে দেবে না। দিনে পাঁচবার ক’রে গাড়ি আসছে আর সব লণ্ডভণ্ড ক’রে দিচ্ছে।’

‘লাভ আর কি।’ গম্ভীর হয়ে শিবনাথ বলল, ‘রাস্তার ওপর দোকান সাজিয়ে বসলে ভিড় জমে, গাড়িঘোড়া লোকজনের চলাফেরার অসুবিধা।’

‘ওকথা বলবেন না, স্যার।’ শিবনাথের পিছনের লোকটি চড়া গলায় বলল, ‘রাস্তার মাঝখানে তো আর কেউ দোকান দিয়ে বসে না। বসে একেবারে ধার ঘেঁষে। গাড়ি-ঘোড়া লোকজনের চলাফেরা করার অনেক জায়গা থাকে। খামকা বেচারাদের হয়রানি করা।’

‘হাতে অন্য কাজ নেই তো, গভর্নমেন্ট কি আর ওমনি বসিয়ে বসিয়ে বাছাধনদের খাওয়াবে? তাই কাজ দেখাতে পুলিস এসব কর্ম করে।

ভিড়ের জন্যে শিবনাথ লোকটার চেহারা দেখতে পেলে না। কিন্তু তা হলেও সে বলতে ছাড়ল না। ‘গাড়িঘোড়া লোকজনের চলাফেরার অসুবিধা ছাড়া আরো একটা জিনিস আছে যা আমাদের বুঝে চলা উচিত। এটা শহর,–এখানে সব কিছুরই একটা নিয়ম আছে, শৃঙ্খলা আছে। দোকানের জায়গায় দোকান থাকবে, সব্‌জি ফল কাপড়চোপড় সব কিছু বিক্রি করার জন্যে বাজারের ভিতর আলাদা আলাদা জায়গা ক’রে দেওয়া হয়েছে। এলোমেলো ছত্রখান শহরময় এটা ওটা ছড়িয়ে রাখলে শহরের সৌন্দর্য থাকে না, তাই পুলিস রাস্তার ওপর দোকান বসাতে দিচ্ছে না।’

‘এটা শহর না, স্যার শহরতলী।’ পিছনের লোকটি দু’পা এগিয়ে এল।

‘অই একই কথা।’ যেন লোকটির দিকে তাকিয়ে শিবনাথ করুণা করে হাসল। ‘এখানেও কর্পোরেশনের নিয়ম চলছে, আমাদের জল দিচ্ছে, আমরা ইলেকট্রিক পাচ্ছি, রাস্তা সাফ করতে দু’বেলা ঝাড়ুদার আসছে, শহর না-ই বা কি ক’রে বলছি।’ একটু চুপ থেকে শিবনাথ বলল, ‘আসল কথা আমরা ডিসিপ্লিন মেনে চলি না, সিভিক সেন্স বলে আমাদের কিছু নেই, সেজন্যেই এসব কাজ করি, রাস্তায় দোকান খুলি, হাসপাতালে ঢুকে হৈ-চৈ শব্দ করি, ইষ্টিশানে টিকিট কাটতে গিয়ে মারামারি করি।’

যে লোকটি এগিয়ে এসেছিল সে চুপ করে রইল। পিছনের লোকটি বলল, ‘যে দেশের লোক খেতে পায় না তারা ডিসিপ্লিন বোঝে না, সিভিক-সেন্স কাকে বলে জানে না।’

‘শিক্ষিত লোক হয়ে আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন।’ শিবনাথ একটু বেশিরকম গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ইউরোপ আমেরিকায়ও এমন দিন হয় যখন লোকে খেতে পায় না। তাই বলে তারা ডিসিপ্লিন রেখে চলতে ভোলে না।’

‘ওরা না খেয়েও যা খায় তা আমাদের দেশের লোকের চেয়ে সর্বদাই ঢের বেশি খাওয়া হয়।’ যেন লোকটি টিপ্পনি কাটল।

একটু রাগের সুরে শিবনাথ বলল, ‘আরো বেশি ইলিটারেটের মত আপনার কথাগুলো হ’ল।’

‘মশাই আপনিই বা কোন্ মহা লিটারেটের মত কথাগুলো আওড়াচ্ছেন শুনি।’ যে- লোকটি এগিয়ে এসে চুপ করে ছিল সে হঠাৎ চোখ লাল করল। ‘পুলিসকে সাপোর্ট করুন ক্ষতি নেই, কিন্তু লোকের সঙ্গে কথা বলতে ভদ্রভাবে কথা বলবেন, ইতর।’

‘এই, আপনি মুখ সামলে কথা বলবেন।’ শিবনাথ জামার আস্তিন গুটোয়। ‘রাস্কেল’! ‘ ‘ইডিয়ট!’

‘মূর্খ!’

‘আহাম্মক।’

‘ননসেন্স!’

‘স্টুপিড!

‘আপনি…আপনি…আপনি…’ শিবনাথ উত্তেজনায় আর কিছু কথা বলতে পারে না। দাঁতে দাঁত ঘষে।

‘তুমি আমার কাঁচকলা করবে, পাঁঠা–’ বলতে বলতে সামনের লোকটি স’রে গেল। পিছনের যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল, সে-ও বিড় বিড় করে কি বকতে বকতে শিবনাথের দিকে শেষবারের মত বিষকটাক্ষ নিক্ষেপ করে আগের লোকটির অনুগমন করল।

অদ্ভুত মেন্টালিটি মানুষের, গায়ে প’ড়ে ঝগড়া করতে আসে। নিজের মনে বলল শিবনাথ এবং সমর্থন পাবার আশায় এদিক-ওদিক তাকাল। কিন্তু তখন আর কেউ বড় একটা সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। পুলিসের গাড়ি চলে গেছে, আস্তে আস্তে যে যার কাজে সরে যাচ্ছে। বলাই ইতিমধ্যে কানা বেগুনগুলো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ঝুড়িতে তুলে ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছে।

‘আপনাদের ঝগড়া থামল?’ শিবনাথের দিকে তাকিয়ে সে মুখ টিপে হাসে।

‘আর বলো না, যত সব মূর্খ আসে তর্ক করতে।’ শিবনাথ একটু হাসতে চেষ্টা করল। ‘তারপর? আজ আর বেগুন বিক্রি করা হবে না বুঝি।

‘নাঃ।’ বলাই মাথা নাড়ল। ‘এমনি মন্দার বাজার, তার ওপর সাতবার হল্লা এসে দোকান ভেঙ্গে দিলে বাজার জমে কখনো!’

শিবনাথ হঠাৎ কিছু বলল না। বলাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

‘শালার বেগুন দিয়েও সুবিধা করতে পারছি না।’ হাঁটতে হাঁটতে বলাই একবার মুখ খলল, চার পয়সা সের তা-ও লোকে এখন কিনতে পারছে না।’

‘হুঁ’, শিবনাথ গম্ভীরভাবে বলল, ‘হার্ড ডেজ্। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সব কিছুরই অবস্থা খারাপ।’

বলাই কিছু বলল না।

‘সাবান দিয়ে বুঝি সুবিধা হল না?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।

‘নাঃ।’ বলাই বলল, ‘সারা বিকেল ব’সে থেকে আড়াই সের চালাতে পারলাম না। এক সের বেগুন বেচে ক’পয়সা লাভ থাকে বলুন। এভাবে তিনটে পেট চলে?’

‘পাগল!’ শিবনাথ মাথা নাড়ল। একটু চুপ থেকে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘কিন্তু তোমার সুবিধে ছিল।’

‘কি রকম?’ বলাই ঝুড়িসুদ্ধ মাথাটা ঘোরাল।

‘না, বলছিলাম, একটু লেখাপড়া যদি শেখাতে মেয়েটাকে, একটা আপিস-টাপিসে ঢুকে পড়লে দুটো পয়সা রোজগার করে তোমাকে হেল্প করতে পারত।’

বলাই গম্ভীর হয়ে গেল।

‘আমি অবশ্য সিনেমায় দিতে বলছি না। কাল সকালে কে. গুপ্ত তাই তোমাকে বলছিল না?’

‘ওর কথা ছেড়ে দিন। পাগল। পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।’ বলাই ঈষৎ হাসল।

শিবনাথ হাসল।

‘এককালে বড় চাকরি করত।’

‘এককালে আমারও বড় কারবার ছিল।’

‘ও বলছে বেবিকে সিনেমায় দেবে।’

‘যা খুশি করুক গে।’ বলাই হাসি বন্ধ করল। ‘আমার কথা হ’ল কি শিবনাথবাবু, শেষ পর্যন্ত দেখব। ফলের কারবার গেছে, পরে সাবান ধরেছিলুম, সাবানে সুবিধা হয়নি দেখে বেগুন ধরেছি। বেগুনে কিছু না করতে পারলে আমড়া ফিরি করব। যদি তাতেও সুবিধে না হয় লোকের জুতো সাফ করব। আর জুতো সাফ করেও যদি দেখি পেট চালাবার মতন রোজগার হচ্ছে না, তখন চুরি করতে আরম্ভ করব, সিঁদ কাটব, পকেট কাটব, হ্যাঁ চুরিতে সুবিধে না হলে লোকের মাথায় বাড়ি মেরে গলায় ছোরা বসিয়ে টাকা আদায় করব ঠিক ক’রে রেখেছি। উপোস থেকে মরবার আগে একবার শেষ চেষ্টা করব তো, তাই ব’লে ঘরের বৌ আর মেয়ের রূপযৌবন ভাঙিয়ে পেটের ভাতের যোগাড় করতে যাব না।’

কেমন একটা অদ্ভুত গুমগুম শব্দ বেরোচ্ছিল বলাইর গলার ভিতর থেকে। তার কথা বন্ধ হবার পরও যেন শব্দটা বাতাসে ভেসে ভেসে চলতে লাগল। শিবনাথ নীরব। দু’জনে খালের ধারে এসে গেল। বলাই আর কথা বলছে না। সন্ধ্যার ঘোর নেমেছে। দূরে কোথাও করাত-কলের ঘস-ঘস শব্দ হচ্ছিল। দম বন্ধ করা ধোঁয়ার চাদরে চারিদিক ঢাকা পড়ে গেছে। খালের জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে জোনাকি পোকাগুলো নাচানাচি করছিল।

খেয়া পার হয়ে বলাই বলল, ‘আপনি কি এখন ঘরে ফিরবেন?’

‘না, আমি একটু বেড়াব।

‘আমি চলি।’

কথা না বলে শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। বলাই বাড়ির রাস্তা ধরল। শিবনাথ উল্টোদিকের রাস্তা ধ’রে হাঁটতে লাগল।

.

লোকটা সরে যেতে শিবনাথ স্বস্তিবোধ করল। অশিক্ষিত, তাই এমন গোঁয়ার, ভাবল সে। না খেয়ে মরবার আগে চুরি-ডাকাতি করব। বৌ বা মেয়ের রূপ-যৌবন ভাঙিয়ে পেটের ভাতের যোগাড় করব না। যত নিচের দিকে তাকাচ্ছে শিবনাথ, মানে যেসব জায়গায় শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, স্ত্রীলোকের সতীত্ব সম্পর্কে পুরুষরা বড় বেশি সচেতন, সতর্ক, সতীত্ব যবে মনে করে বড় বেশী সন্ত্রস্ত সব, এটাই যেন বেশি দেখছে। আমল চাকলাদারকে দেখেছে শিবনাথ, এখন বলাইয়ের কথাগুলো শুনল। মরুকগে। যেমন-তেমন একটা সুবিধে হয়ে গেলেই এ বাড়ির এদের সঙ্গ ত্যাগ করব আমি, শিবনাথ মনে মনে আর একবার প্রতিজ্ঞা করল এবং বেশ একটু জোরে পা ফেলে হাঁটতে লাগল। এক সময় শিবনাথের মনে পড়ে কপাল ও পা কেটে গেছে, রক্ত পড়ছে, সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই বলাইয়ের। শিবনাথ হলে পৃথিবীর আর কিছু ভাবনা ভাববার আগে কাটা জায়গাগুলোতে আইডিন লাগাতে চেষ্টা করত। পয়সা সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলে ধার-কর্জ না পেলে জুতো জামা, চশমা–যা হোক একটা কিছু বাঁধা রেখে হলেও টাকা যোগাড় করে একটা অন্ততঃ অ্যান্টিটিটেনাস্ ইঞ্জেকসন নিয়ে নিত। অর্থাৎ যে জায়গায় সতর্ক হবার, যেটি সম্পর্কে সন্ত্রস্ত থাকবার, তা থাকত শিবনাথ এবং এখনও তাই আছে। বলা যায় কি, বলা যায় না। হয়তো রাত ভোর হলে সবাই শুনবে, দেখবে বলাই ধনুকের মত বাঁকা হয়ে বিছানায় মরে আছে। বিছানার পাশে ব’সে বৌ ও মেয়ে কাঁদছে এবং বলাইকে কোনরকমে একটা ফার্স্ট-এড নিতে বলতে ভুলে গেছে বলে শিবনাথের মনে এখন একটুও অনুতাপ হ’ল না। হয়তো রাগ করে সে শিবনাথের সৎপরামর্শ কানেই তুলত না, মেয়েকে সিনেমায় দিতে কে. গুপ্তর মত সে- ও পরামর্শ দিচ্ছে ভাবতে ভাবতে এখন হয়ত ঘরে ফিরছে বলাই। শিবনাথ নিজের মনে হাসল। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীদের অজ্ঞতা এবং রুক্ষতা নিয়ে এখানে এই শহরে, শহরতলীতে আরো কত শত লোক আছে, চিন্তা করতে করতে শিবনাথ বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ-দিকের গলিতে ঢুকল।

টিমটিমে গ্যাসের আলোটা আজ বোধ হয় আর জ্বলেনি। কড়ি গাছের নিচেটায় অন্ধকার ছমছম করছিল। তার ওপর কুয়াশা এবং পাশের খোট্টা বস্তি থেকে উঠে আসা কাঠের ধোঁয়া। চোখ জ্বালা করে। চোখ বুজে শিবনাথ গলিটা পার হয়ে এসে মাঠে পড়ল। এখানে তারা- ছড়ানো আকাশের নিচে অন্ধকার খুব পাতলা। অন্ধকারকে আর অন্ধকারই মনে হয় না, যেন একটা ঘোলাটে কাঁচ। পরিষ্কার দেখা না গেলেও বোঝা যায় ওখানে একটু দূরে ওটা গাছ কি মানুষ, গরু কি গাড়ি। মাঠ পার হয়ে শিবনাথ কপি-ক্ষেতের ধারে চলে এল। ঝোঁপটা সে চিনতে পারল। শব্দ না হয় এমনভাবে পা ফেলে আস্তে আস্তে সে ঝোঁপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। অনুমান তার মিথ্যা হয় না। একটু সময় কান পেতে শিবনাথ দু’জনের কথা শুনতে পেল।

‘আমি খেয়েছি, তুই খা।’

‘আমি তো খেলাম তিনটে, তুই এটা খা।’

‘কাশীর পেয়ারা।’

‘তা হবে। চার আনার ছটা পেলাম।’

‘কোথায় পেয়েছিলি পয়সা?’

‘চুরি করেছি।’

ছেলেটির কথা শুনে মেয়েটি একটু সময় যেন ভাবল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘কাদের ঘরে ঢুকেছিলি, রুচিদির? ওদের খুব পয়সা আছে মনে করিস না।’

‘তা চার-ছ’আনা কি আর থাকবে না ঘরে।’ ছেলেটি বলল। ‘না বাপু, বাড়ির লোকের পয়সা চুরি আমি করি না। শত হতেও আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে এ বাড়িতে। বাবা এত বড় চাকরি করত। আমাকে সন্দেহ করবে ভাবতে মন খারাপ লাগে।’

‘যাদের বেশি আছে, তাদেরটা চুরি করতে ক্ষতি কি।’ মেয়েটি বলল, ‘আমি হিরুদের ঘর থেকে সেদিন চার কোঁটো চাল চুরি করে এনেছি।’

‘না বাপু, আমি বাড়ির লোকের ঘরে সাহস পাই না।’

‘চার আনা কোথায় পেলি?’

‘ফেরিওলার ডালা থেকে তুলে নিলাম। ব্যাটা তার জিনিস বিক্রি করে পয়সাগুলো ডালায় রাখে, দেখিস না?

‘হুঁ।‘

‘সবাই যখন এটা-ওটা হাতে নিয়ে দেখছিল, আমিও একটা চা-ছাকনি তুলে দাম জিজ্ঞেস করছিলাম।’

‘তারপর?’

‘ডান হাতে ছাকনিটা তুলে নিয়ে ওর চোখের সামনে ধরলাম।’

‘তারপর?’

‘বাঁ-হাত বাড়িয়ে সিকিটা তুলে নিলাম।’

‘বেশ পরিষ্কার হাত তো তোর, তবে আর কারোর ঘরে ঢুকে একটা কিছু তুলে আনতে ভয় পাস কেন?’

‘ধ্যেৎ, বাড়িতে সবগুলো ঘরে এত লোকজন।

‘ফেরিওলার সামনে তো লোকজন কম ছিল না।’

‘তাই তো সুবিধা হ’ল। ফেরিওলা যদি টের পায়, ওর ত’বিলে চার আনা সর্ট আছে তো এ বাড়ি সবাইকে সন্দেহ করবে, আমার মতন উঠানে এসে সবাই দাঁড়িয়েছিল দোকান দেখতে। তা ছাড়া ভিড় থাকলেও পয়সার দিকে কেউ চেয়ে ছিল না, কাঁচে গ্লাস আর আরশি আলতা চিরুনির দিকে চোখ ছিল সবার। ‘

‘আমি একদিন একজনের জিনিস সরাব। ‘

‘কা’র শুনি না?’ ভয়ানক নিচু গলায় কিশোর প্রশ্ন করল। ‘কি জিনিস?’

‘কমলাদির রিস্টওয়াচ।’

যেন কিছুক্ষণ কি ভাবল ছেলেটি।

চুরি করে এনে তোর কাছে দেব।’ মেয়েটি বলল।

‘আমি কি করব?’ প্রস্তাব মনঃপুত হল না রুণুর।

‘বিক্রি করবি, বাইরে কারো কাছে বেচে দিয়ে টাকা আনবি।’ ময়না বলল।

রুণু আবার ভাবে।

ফিসফিসে গলায় ময়না বলল, ‘আমায় দিয়ে তো আর ও-কাজ সম্ভব হবে না। ক’টা টাকা হলে দুজনে রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে, সিনেমা দেখা হবে।’

‘ও, তার জন্যে চুরি করবি!’ রুণু খুশি গলায় হাসে। ‘দেখিস আবার না ধরা পড়িস।’

‘তোর চেয়ে আমি ঢের বেশি চালাক।’ ময়নার সরু গলা। ‘যেদিন এনে ঘড়িটা তোর হাতে তুলে দেব, সেদিন না আবার বলিস আমার ভয় করবে বিক্রি করতে, আমি পারব না।‘

‘ধ্যেৎ, আগেই তোর ওসব ভাবনা। আন্ না তুই। বিক্রি করে টাকা আনতে পারি কি না পারি, দেখবি।’

‘কোন্ রেস্টুরেন্টে খাব আমরা?’ কোমল আব্দারের সুরে ময়না প্রশ্ন করল।

‘চৌরঙ্গী, চৌরঙ্গীর ভাল রেস্টুরেন্টে যাব একদিন তুই আর আমি।’ কে. গুপ্তর ছেলে সেয়ানা সুরে বলল, ‘ইস, কতকাল মুরগী খাই না জানিস। যখন বাবার চাকরি ছিল, আমরা মুরগীর মাংস আর ভাত ছাড়া রাত্তিরে অন্য কিছু খাইনি।’

‘এখন শুধু মুলো-সেদ্ধ চালাচ্ছিস।’ ময়না নিচু গলায় হাসল।

‘তোরা মাছ-ভাত খাস্ নাকি।’ রুণু খোঁচা দেয়। ‘কৈ, গন্ধ পাই না তো একদিনও রান্নার। দেখি, হাতটা শুঁকি। গন্ধ লেগে থাকবে। কি মাছ খেয়েছিলি তোরা দুপুরবেলা?’

‘আঃ, ছাড়ো, লাগে।’ ময়না ব্যস্ত গলায় ফিসফিস করে উঠল।

‘ননী শরীর, মাখনের শরীর, গলে যায়। দাও এবার গালটা শুঁকি।’

‘ইস্, কী অসভ্য?’

সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ওঠে শিবনাথের; সিসিরে হাওয়ার সঙ্গে ওলকপির মিষ্টি গন্ধটা তাকে অনেকক্ষণ ঝোঁপের পাশে ধরে রাখল।

.

‘কি মশাই, দাঁড়িয়ে কেন, আসুন ভেতরে আসুন।’

দোকানে ঢুকতে গিয়ে শিবনাথ দাঁড়িয়ে পড়েছিল, ইতস্ততঃ করছিল।

কিন্তু রমেশ রায় এমনভাবে আদর-অভ্যর্থনা জানাল যে, শিবনাথ আর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে না থেকে চৌকাঠ পার হয়ে ভিতরে চলে এল।

‘বসুন বসুন।’ রমেশ রায় নিজের হাতে বেঞ্চটা মুছে দিল। ‘তারপর খবর কি, আজ যেন দেরি করে ফেললেন চা খেতে আসতে।’

আগের দিন এই সময় না আরও আগে এখানে এসে ঢুকেছিল, ঠিক মনে করতে পারল না শিবনাথ। শূন্য বেঞ্চটার এক পাশে সে বসল।

‘বেবি!’

‘যাই।’

‘বাবুকে ভাল করে এক কাপ চা করে দাও।’ পর্দার কাছ থেকে সরে এসে রমেশ শিবনাথের সামনে দাঁড়াল।

শিবনাথ আড়চোখে পর্দাটা দেখে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল।

‘বেড়াত বেরিয়েছিলেন, কদ্দুর গেছলেন?’ রমেশ বেঞ্চের আর এক পাশে বসল।

‘মাঠ পর্যন্ত, বেশিদূর গেলাম না।’ শিবনাথ লক্ষ্য করল ক্ষিতীশ নেই। ‘ছোট ভাই বাইরে গেছে বুঝি?’ প্রশ্ন করল সে।

‘হ্যাঁ, একটু কাজে পাঠিয়েছি। রমেশ মাথার গরম টুপিটা খুলে ফেলল। ‘আজ ঠাণ্ডাটা কম, কি বলেন।’

‘তাই মনে হয়।’ বলে শিবনাথ হঠাৎ ঘাড় ফেরাতে দেখল, পর্দা সরিয়ে চা নিয়ে আসছে কে. গুপ্তর মেয়ে। শিবনাথকে দেখে আগের দিনের মত ততটা লজ্জাবোধ করছে না যেন ও। বরং একটু হাসতে চেষ্টা করছে।

এই হাসতে চেষ্টা করাটাই বেবির ভুল হ’ল, হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল পেয়ালা টেবিলে রাখতে গিয়ে। টেবিলের কোনায় বাড়ি খেয়ে ওটা উল্টে ওর হাত থেকে নিচে পড়ে গেল। ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল গরম চা, আর পেয়ালার ভাঙা টুকরো

এক সেকেন্ড চুপ। এক সেকেন্ড চুপ থেকে সবটা দৃশ্য দেখল রমেশ রায়। তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গিয়ে বেবির বেণী ধরে এমন জোরে টান মারল যে, ও মাটিতে ছিটকে পড়ে গেল।

‘ইয়ার্কি করতে আসিস এখানে, ছোটলোক, ছোটলোকের মেয়ে’! রমেশ গর্জন করে উঠল। ‘চা নষ্ট হ’ল, একটা পেয়ালা ভাঙল আমার, জানিস একটা পেয়ালার কত দাম?’

মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে বেবি। দুই হাতে মুখ ঢাকা। কাঁদছে কি? শিবনাথ ঠিক বুঝতে পারল না। হয়তো লজ্জায় মুখ ঢেকেছে, ভাবল সে।

‘আবার দাঁড়িয়ে ঢং করা হচ্ছে!’ রমেশ আবার ওর বেণীতে হাত দেয় কিনা শিবনাথ আশঙ্কা করল, কিন্তু তা না করে গলায় একটা ধাক্কা মেরে বেবিকে পর্দার ওপারে পাঠিয়ে দিয়ে রমেশ চীৎকার ক’রে বলল, ‘যা, চা ক’রে নিয়ে আয়। বাবু কতক্ষণ বসে থাকবেন। হুকুম শেষ ক’রে সে টেবিলের কাছে ফিরে এল। শিবনাথের সঙ্গে চোখোচোখি হতে রমেশ অল্প হাসল।

‘একটু শাসন না করলে বেড়ে যায়, বুঝেছেন তো, আমি রোজ মুখ খুলি না, রোজ গায়ে হাত তুলি না; কিন্তু বেয়াদপি দেখলে, বেসামাল হয়েছে দেখলে টেম্পার ঠিক রাখতে পারি না।’

‘তা তো সত্যি কথা।’ মাথাটা ঈষৎ আন্দোলিত করল শিবনাথ এবং একটু হাসতে চেষ্টা করল। ‘চার ছ’আনা একটা পেয়ালার দাম।’

‘একটা পেয়ালা!’ শিবনাথের কানের মধ্যে মুখ ঢোকাতে চেষ্টা করে রমেশ ফিসফিস করে উঠল : ‘চা-চিনি কিছু দিয়ে আমি কুলোতে পারছি না মশাই, কী করব। ঠেকেছে, বিপদে পড়েছে। শত হলেও তো ভদ্রলোকের মেয়ে!’

‘তা তো ঠিকই।’ শিবনাথ আবার মাথা নাড়ল।

না হ’লে আমি কি আর পারি না বাইরের একটা ছেলেকে মাইনে দিয়ে রাখতে বরং আমার আরো দুটো একটা কাজের সুবিধে হত।’

‘তা’ তো হতই।’

‘কিন্তু লোকে তো আর তা দেখবে না, শুধু দেখছে, বলাবলি করছে বিনি পয়সায় আমি কে. গুপ্তের মেয়েকে দোকানে খাটাচ্ছি।’

একটু বিস্মিত হয়ে শিবনাথ রমেশের দিকে তাকায়। তবে কি সত্যিই এই মেয়েকে দিয়ে ইংরেজিতে যাকে বলে টি-গার্লের কাজ করানো হচ্ছে, ভাবল সে। ওর মা ওর বাবার অনুমতি আছে কি এতে? প্রশ্নটা যখন মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছে, তখন বেবি চা নিয়ে এল। এবার আর হাসি নেই, গম্ভীর আনত মুখ। বাটিটা টেবিলে সাবধানে নামিয়ে রেখে পর্দার দিকে সরে যাচ্ছিল ও, রমেশ রায় গম্ভীর গলায় বলল–রাত হয়েছে এখন ঘরে যা।’

বেবি ঘুরে দাঁড়ায়।

‘চা খেয়েছিস?’

বেবি ঘাড় নাড়ল।

‘একটা মগে করে চা তৈরি ক’রে বাড়ি নিয়ে যা। তোর মা চায়ের জন্য হাইফাই করছে।’

বেবি ঘাড় কাত করল।

‘কেক-বিস্কুট আজকে শর্ট আছে। কিছু নিবি না।’

‘না।’ অস্ফুট শব্দ করল বেবি ও রমেশের দিকে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে পর্দার ওপারে চলে গেল।

১২

শিবনাথ নিঃশব্দে তার পেয়ালার চাটুকু শেষ করল। বেবি চা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। রমেশ এবার চড়া গলায় বলল, ‘বুঝেছেন মশাই, দারিদ্র্যের অনেক দোষ–অভাবে স্বভাব নষ্ট হয়–শাস্ত্রকাররা কি আর মিছিমিছি ব’লে গেছে?’

শিবনাথ চোখ তুলে রমেশের দিকে তাকাল। ততটা চড়া স্বর না হ’লেও বেশ জোরে জোরে রমেশ বলল, ‘ক্ষিতীশ আমার কাছে গোপন করে, কিন্তু করলে হবে কি, আমি টের পাই, বেশ টের পাই,–দোকানে সর্বদা থাকি না, কিন্তু বুঝি এতটা চিনি লাগতে পারে না। দিনে ক’-কাপ চা কাটে আর কতটা চিনির দরকার তা কি আর আমাকে শেখাবি তুই।’ রমেশ মুখের বিকৃত ভঙ্গি ক’রে হাসল।

‘ক্ষিতীশ চুরি গোপন করছে কেন?’ প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এলেও শিবনাথ চুপ ক’রে রইল।

‘হাতে-নাতে অবশ্য ধরতে পারছি না।’ রমেশ গলার স্বর পরিবর্তন করল। কিন্তু যেদিন ধরব সেদিন আর মেয়েটাকে আস্ত রাখব না, হ্যাঁ, ক্ষিতীশকেও ব’লে রেখেছি।’

‘তবে আর মেয়েটাকে দোকানে রাখা হচ্ছে কেন।’ বলতে চেষ্টা ক’রেও শিবনাথ বলতে পারল না।

রমেশ বলল, ‘আমি কি আর সাধ ক’রে বেবিকে দোকানে ঠাঁই দিয়েছি’ মশাই, মেয়েটা দোকানে থাকে ব’লে ক্ষিতীশও দোকান ছেড়ে আর বড় একটা এখন এদিক সেদিক যায় না। একটা অর্থব্যঞ্জক হাসি রমেশের স্থূল ঠোঁটে ঝুলতে থাকে। ‘না হলে কি আর হারামজাদাকে দিয়ে আমি রেস্টুরেন্ট চালাতে পারতাম! কোথায় ফ্লাশের আড্ডা, কোন্খানে পাশা চলছে, কেবল সেদিকে দিশা ছিল ভায়ের আমার। যেদিন থেকে বেবি এখানে এসে ঘুর ঘুর করতে লাগল, ক্ষিতীশও ভারি কাজের মানুষ হয়ে দোকানের দিকে মন দিয়েছে, হা–হা’।

ফ্যাল্ ফ্যাল্ ক’রে শিবনাথ রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘এইটুকুন তো মেয়ে।’ যেন বলতে যাচ্ছিল সে, রমেশ বলল, ‘তা মন্দের ভাল, দোষ দেখি না আমি কিছু, ভায়েরও আমার উঠতি বয়েস,–কিন্তু, না, চুরিফুরি আমি বেশিদিন সহ্য করব না। বাবা, চা-টা বিস্কুটটা খাইয়ে যত ইচ্ছে পীরিত কর আপত্তি নেই, তা ব’লে রোজ পোয়া-আধপো চিনি শর্ট পড়বে এ কেমন কথা, কি বলেন আপনি?’

কিছুই বলল না শিবনাথ।

‘এমন ধারা চলতে থাকলে আমি ঠিক করবার গুটিয়ে ফেলব, কাজ নেই আমার চা বেচে।’ দস্তানা-পরা হাতটা শূন্যে ঘুরিয়ে রমেশ অনেকটা যেন নিজের মনে বলল, রেস্টুরেন্ট তুলে দিলে তারপর দেখব তুমি কোন্ চুলোয় যাও,–কি করে খাও। মা’র পেটের ভাই, বয়সেও অনেক ছোট, আমার কর্তব্য ছিল তোমার একটা হিল্লে ক’রে দেওয়া। এখন তুমি যদি লাভের অর্ধেক পিঁপড়েকে খেতে দাও তো আমার সেখানে করবার কী আছে, কী করতে পারি বলুন।’

প্রসঙ্গটা আরো অনেকক্ষণ চলবে ভেবে শিবনাথ অস্বস্তিবোধ করছিল। কিন্তু চট্ ক’রে সে উঠতে পারছিল না। সঙ্গে পয়সা ছিল না। চায়ের দামটা বাকী থাকবে বলতে সে ইতস্ততঃ করছিল! যেমন ইতস্ততঃ করছিল দোকানে ঢুকতে। চালাক লোক রমেশ। শিবনাথের চেহারা দেখে বুঝল কথাগুলো তেমন মনোযোগ দিয়ে শুনছে না সে। তাই যেন অধিকতর চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ তুলতে রমেশ সোজা হয়ে বসল, বলল ‘ব্যাটাকে আজ ধরেছিলাম এই রাস্তার মাঝখানে, বাড়িতে তো সুবিধে হয় না, ধরে হিড়হিড় ক’রে টেনে এনেছিলাম দোকানের ভেতরে।’

কার কথা হচ্ছে হঠাৎ বুঝতে না পেরে শিবনাথ আবার ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে রমেশের মুখের দিকে তাকায়।

‘রাস্তায় তখন লোকজন ছিল না, তাই ঘড়ে ধরা সত্ত্বেও চাঁদ একবার মুখ খোলেনি, হা–হা’–রমেশ হাসতে লাগল।

শিবনাথ ঢোক গিলল, কিন্তু হাসতে পারল না।

‘আর ধরুন, আশে-পাশে অন্য লোক আছে, তখন ঘাড়ে ধরব কি, একটু কড়াভাবে আমার পাওনার কথাটা তুললেও শালা চোখ লাল ক’রে উঠত, এই করে ওরা, কেবল কি অমল চাকলাদার,–কত হারামজাদাকে দেখলাম। যেন ধারে খাইয়ে আমি ঠেকেছি, একবারের বেশি দু’বার তাগিদ দিলে নদের চাঁদদের প্রেষ্টিজে লাগে।’

‘তারপর?’ শিবনাথ এবার একটু হাসল। ‘কি বললে অমল?’

‘স্রেফ পায়ে ধরল, বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই’, রমেশ মোজা-পরা একটা-পা টেবিলে তুলে দিয়ে বলল, ‘এই পা ধরে কত কাকুতি-মিনতি, আর দুটো দিন অপেক্ষা করুন–আর একটা চাকরি খুব সম্ভব পেয়ে যাব ইত্যাদি–হা-হা।’ রমেশ আরো টেনে টেনে হাসতে লাগল।

শিবনাথও শব্দ ক’রে হাসল।

‘আপনি কি বললেন?’

‘মোক্ষম কথাটা তুললাম আর কি, রমেশ সবেগে দুবার মাথাটা নেড়ে বলল, ‘সুযোগ পাচ্ছিলাম না এ্যাদ্দিন; আজ সুযোগ আসতে প্রস্তাবটা দিতে আর বিলম্ব করিনি হা–হা–’

‘কিসের প্রস্তাব?’ শিবনাথ বিড়বিড় করে প্রশ্ন করল।

‘আরে মশাই, আমি,আমার কি ইচ্ছা যে, তুই তোর সুন্দরী বৌকে ঘরের বাইরে পাঠা,–দেখছি ঘরে হাঁড়ি চড়ে না, উপোস থেকে থেকে দু’জনেই চিমসে লেগে যাচ্ছিস, তাই তো কথাটা না ব’লে পারলাম না।’

‘ওর বৌ চাকরি করবে বুঝি।’ কথা শেষ ক’রে শিবনাথ আর একটা ঢোক গিলল।

রমেশ টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসল।

‘মশাই, গণ্ডায় গণ্ডায় ঘরের বৌ-ঝি’রা ঢুকছে ওর গেঞ্জির কারখানায়। বলি তোর বৌ গিয়ে ওখানে কাজ করলে কি আর পারিজাত কিছু হাতে চাঁদ পাবে! উপোস আছিস, খেতে পাস না, ঘরভাড়া বাকি পড়ছে, কথাটা কানে উঠতে সেদিন পারিজাত আমার বললে, এমনি খুব যে একটা ইয়ের ভাব নিয়ে রায় সাহেবের ছেলে প্রস্তাবটা দিয়েছিল তা নয়।’

শিবনাথ বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘তা ছাড়া, যদি ইয়ের ভাব নিয়ে কথাটা বলেও থাকে, আমি কিছু দোষের দেখি না। ওরা পয়সার ওপর ঘুমোয় মশাই, অনেক রকম সাধ থাকতে পারে। বাগানে দশরকমের ফুলগাছ লাগায় দশরকমের ফুল ফুটছে নিজে দেখবে এবং আরো দশজন দেখে তারিফ করবে বলে, এ-ও তেমনি–দশটা মেয়ে ওর কারখানায় কাজ করছে, তোর সুন্দরী বৌ সেখানে ঢুকে কারখানার ভেতরটাকে আর একটু আলো ক’রে দিক, পারিজাতের এইরকম একটা ইচ্ছে থাকা স্বাভাবিক, কি বলেন?’

‘কি বললে অমল?’

‘নিমরাজী হয়েছে, কথার ভাবে বুঝলাম’, কথা শেষ ক’রে আবার টেনে টেনে রমেশ হাসল। শিবনাথ একটু অবাক।

‘অথচ কাল দুপুরে ফেরিওলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ব’লে বৌকে কী মারই না মারলে।’

‘জানি জানি, শুনেছি আমি সব রাত্রে বাড়িতে গেছি পরে।’ রমেশ হঠাৎ হাসি বন্ধ করল। চোখ দু’টো গোল বিস্ফারিত করে শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওসব আব্দারের দিন গেছে,–ছিল, যখন তোমার চাকরি ছিল, বৌকে কাগজে মুড়ে বাক্সে পুরে কি শিকেয় ঝুলিয়ে রাখতে, কারো কিচ্ছু বলবার ছিল না। আজ ওসব বললে শোনে কে।’

বাইরে অন্ধকারের দিকে চোখ ফিরিয়ে রমেশ কি যেন একটু ভাবল। শিবনাথ আবার অস্বস্তিবোধ করে। তৎক্ষণাৎ উঠতে পারে না, কেননা তার আগে একটা কথা বলতে হবে দোকানদারকে।

‘না, আমিও একটু অবলিগেশনের মধ্যে আছি পারিজাতের কাছে। সময়ে ও আমার উপকার করেছিল। রেললাইনের ওধারে দীঘিটা দেখেছেন তো। ওটা ইজারা নেবার সময় পারিজাত আমায় খুব হেল্প করেছিল। তা ছাড়া আর একটা জমি কেনার কথা চলছে। কোথায় জমি, কি তার বৃত্তান্ত আমি অবশ্য এখনি আপনার কাছে আউট করতে পারছি না মশাই, তবে জেনে রাখুন রমেশ রায় একটার তালে নেই, অনেক ধান্দায় আছে,–থাকতে হচ্ছে, যে দিনকাল এসে পড়ছে, কি বলেন, বাঁচতে হবে তো।’

শিবনাথ ক্লান্ত বিমর্ষভাবে মাথা নাড়ল

‘যাকগে, পারিজাত উপকার করেছে আমার, আরো করবে। কাজেই একবার যখন আমার কাছে মনের ইচ্ছে খুলে বলেছে, আমি তার ইচ্ছা পূরণ করবই, হ্যাঁ, আপনারা দেখবেন, রমেশ রায় পারে কিনা কিরণকে কারখানায় ঢোকাতে। জলে আগুন ধরানোর মত অসম্ভবকে আমি সম্ভব ক’রে তুলব। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে বুঝি, আপনি উঠবেন?’

‘হ্যাঁ।’ রমেশ ঈষৎ হেসে মাথা নাড়ল। ‘ইয়ে, আপনাকে–’

‘বলুন, বলে ফেলুন। আমার কাছে কিছু বলতে আপনার সঙ্কোচ কেন। শত হোক, এক বাড়িতে আছি, এক ইঁদারায় জল খাচ্ছি।’

‘না, না, সঙ্কোচ না।’ শিবনাথ আর ইতস্ততঃ করল না। ‘সঙ্গে খুচরো পয়সা নেই, চায়ের দামটা কাল সকালে-–’

কথা শেষ করতে পারল না সে, চোখ বুজে রমেশ রায় তালুর সঙ্গে জিহ্বা ঠেকিয়ে মৃদুরকম একটা শব্দ বার করল মুখ দিয়ে, ‘এর জন্যে আবার আমাকে বলতে হবে, মুশকিল, আপনারা মানুষ চেনেন না, হ্যাঁ, চিনবেন বা কি করে–কাজ করবার তো আর হয়নি এতকাল, হয়তো শুধু লোকের মুখে শুনেই এসেছেন রমেশ রায় মাছ কাঠ চা নিয়ে আছে, গায়ের চামড়াটা তার ভয়ানক পুরু। চামড়া পুরু হলেও আত্মাটা তার কাদার মত নরম, আস্তে আস্তে পরিচয় পাবেন। আপনার যখন খুশি দোকানে ঢুকে চা খাবেন, কেক্ বিস্কুট খাবেন যা ইচ্ছে,–দামের জন্য কি, আপনিও পালিয়ে যাচ্ছেন না, আমারও যে পরমায়ু একেবারে শেষ হয়ে এসেছে তা মনে করি না।’

কথা শেষ করে রমেশ রায় প্রবলবেগে হাসতে লাগল।

একটু সময় সে-হাসিতে যোগ দিয়ে সৌজন্যতাসূচক মাথাটা একবার নেড়ে শিবনাথ বলল, ‘আচ্ছা চলি।’

রাস্তায় নেমে শিবনাথ যেন সহজভাবে নিশ্বাস নিতে পারল। এই সামান্য কথাটা রমেশকে বলতে মনে মনে তাকে এতক্ষণ কী যুদ্ধটাই না করতে হয়েছে। অবশ্য তার কারণ ছিল। অমল চাকলাদারের চেহারাটা শিবনাথের চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠছিল। ননসেন্স। বিড়বিড় করে বলল এখন শিবনাথ। লোকটার মাথায় কিছু নেই। এতগুলো টাকা ধার জমতে দিয়েছিলি তুই কোন্ সাহসে। অপমান–অপমান করার অধিকার রমেশ রায়ের আছে। শিবনাথ রমেশকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করল।

‘শুনুন, শুনুন!

প্রথমটায় বুঝতে পারেনি শিবনাথ। ঘাড়টা ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে ফের সে ঘাড় সোজা ক’রে হাঁটে।

‘আপনাকে, স্যার, হ্যাঁ আপনাকেই ডাকছি।’

গলার স্বরটা এবার পরিচিত ঠেকল। হাঁটা বন্ধ ক’রে শিবনাথ দাঁড়াল। জোরে পা চালিয়ে লোকটা শিবনাথের সামনে এসে যায়। বিধুমাস্টার।

‘কি খবর?’

‘খুব ভাল।’ মাস্টার মাথাটাকে একদিকে কাত করে বলল, ‘জাল জুয়াচুরি করি না, ব্ল্যাকমার্কেট কথাটা শুনি কিন্তু কিভাবে তাতে ঢুকতে হয় সেই কৌশল জানি না। খেটে খুটে যা আনি তা দিয়ে শাকভাত হোক, মাছভাত হোক খেয়ে আছি ছেলেমেয়েগুলোকে খাওয়াতে পারছি। গড় ফেভারে আছে বলতে হবে। আমার তো মনে হয় সৎপথে থাকলে ঈশ্বর চালিয়ে নেন।’

‘তা নেন বৈকি।’ সংক্ষেপে বলল শিবনাথ।

‘তার প্রমাণ আমি অনেকবার পেয়েছি এবং আজ আবার পেলাম।

‘কি রকম?’

বিধুমাস্টার হাসল।

‘একদিনে আকবরের প্যাসেজটা বুঝিয়ে দিলাম, সবগুলো কঠিন শব্দের মানে লিখিয়ে দিলাম, তাতেই মিসেস্ চ্যাটার্জি খুশী। তিনি বুঝতে পারলেন, এভাবে কোচ্ ক’রে গেলে মেয়েকে ম্যাট্রিকুলেশনের বাবাও আটকাতে পারে না।’

‘কে মিসেস্ চ্যাটার্জি?’ অস্ফুট গলায় প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল শিবনাথ, তার আগেই বিধুমাস্টার পরিচয় দিলেন। ‘চামেলীর মা। সিলেকশনে যতগুলো স্টোরি আছে, ওই আকবরটাই সবচেয়ে কঠিন। ইংরেজীটা খটমটে। নিজেও শিক্ষিতা তিনি। চামেলীকে যখন কাল পড়াই, দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। আজ যেতেই বললেন, একটা আওয়ার ঠিক করে এই তিন মাস আপনি চামেলীকে কোচ্ করুন। আমি আপনাকে ওর প্রাইভেট টিউটর নিযুক্ত করছি।’

‘ভালই তো।’ শিবনাথ খুশি হবার ভান করল।

‘পনরো টাকা চেয়েছি।’ কিন্তু তিনি বারোর উপরে উঠতে চাইছেন না। তা উঠবেন না আমি জানি। বলেছি আপনাকে, ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই এখন বেশি। যত না পড়ছে মাস্টারের সংখ্যা হয়েছে তার তিনগুণ। হ্যাঁ, প্রাইভেট টিউটরের কথা বলছি। কাজেই–’

মাস্টার থামল।

শিবনাথ কিছু প্রশ্ন করবে কিনা ভাবল।

‘তারপর যখন উঠে আসি তেরো টাকা বললেন, কন্ডিশন–ওর ছোট ছেলেটাকেও মাঝে মাঝে একটু দেখিয়ে দিতে হবে। আমি রাজী হয়ে গেলাম ফোর্থ ক্লাসের ছেলে, একটুও কষ্ট নেই, কি বলেন?’

শিবনাথ মাথা নাড়ল।

ধোঁয়া ও কুয়াশা বেশি ছিল, তাই বিধুমাস্টার তা দেখতে পেল না।

‘আপনি হয়তো বলবেন, খাটুনির তুলনায় টাকাটা কম। আমি ভাবছি গড়স্‌ গ্রেট ফেভার। এই ট্যুইশানি জোটাতে আমাকে আরো এক মাস বিনি পয়সায় খাটতে হত। তাই করে আজ সবাই জোটাচ্ছে মশাই। ট্যুইশানির বাজারের কী অবস্থা আপনি জানেন না।’

শিবনাথ চুপ।

‘বলেছি কাল আপনাকে। একটা টাকা কর্জ চেয়েছিলাম বলে দ্যাট আনকালচার্ড দ্যাট্ ব্রু হোমিওপ্যাথ আমাকে ইন্‌সালটিং ল্যাঙ্গুয়েজে কত কী না বলল। বলেছি তো কাল আপনাকে।

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’ সংক্ষেপে বলে সারতে চেষ্টা করল শিবনাথ।

কিন্তু মাস্টার তাকে সেখানেই অব্যাহতি দিল না। কালকের মত আজ আবার মুখটা শিবনাথের কানের ভিতর ঢোকাতে চেষ্টা করল। ‘মশাই যা পাচ্ছি তা-ই এখন আমাকে হাত পেতে নিতে হবে। এক মাস পর ওয়াইফ লেবারে উঠছে, দেখছেন তো ওর শরীরের অবস্থাটা। হস্পিট্যালের ডাক্তার ডেট্ বলে দিয়েছে। টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারী, ডেট বড় একটা নড়চড় হয় না আমার স্ত্রীর। কতবার লক্ষ্য করলাম। ঠিক টোয়েন্টি ফার্স্ট ফেব্রুয়ারী রাত্রে কি পরদিন সকালে পেন্ আরম্ভ হবে।

পয়সার অভাব বা সুনীতি চর্চাও কারণ হতে পারে, বিন্ধুমাস্টার পান সিগারেট খায় না। কানের কাছে মুখ নিয়ে যখন কথা বলছিল, মুখের একটা পচা ভ্যাপসা গন্ধ শিবনাথের নাকে লাগল। শিবনাথ মুখটা সরিয়ে নিলে। বিধুমাস্টার শব্দ করে হেসে উঠল। ‘বুঝতে পারছি, এসব বিষয়ে আপনি খুব শাই। আমি মশাই ফ্রাঙ্ক। কি, আমার ছাত্রী বিদিশার মা পর্যন্ত জানে ডেলিভারি ডেট কবে পড়েছে। সব বলি আমি, সবাইকে বলি। চামেলীর মাকে আজ বললাম। আমার তো মনে হয় সেই বিবেচনা করেই তিনি মেয়ের ট্যুইশানি করতে আরো বেশি গরজ করলেন। শিক্ষিতা মহিলা। তা ছাড়া,’ মাস্টার আবার শিবনাথের কানের মধ্যে মুখ ঢোকাতে চেষ্টা করল : ‘মেয়েদের এই অবস্থায় মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি সিম্পেথেটিক হয়, কি বলেন আপনি?’ পচা ভ্যাপসা গন্ধটা শিবনাথের নাকে এবার প্রবলভাবে এসে ঢুকল।

‘আপনি কি বাড়ি ফিরছেন?’

‘হ্যাঁ, আপনি? চলুন রাত হল।’

‘না, ওদিকে আমার একটু কাজ আছে।’ আঙুল দিয়ে সামনের রাস্তাটা দেখাল শিবনাথ এবং মিথ্যা কথা বলল।

‘আচ্ছা চলি, চলি।’

শরীরে মোচড় দিয়ে মাস্টার ডান দিকের গলিতে ঢুকল। শিবনাথ ‘সহজভাবে নিশ্বাস ফেলল। বলাইর সঙ্গে হাঁটবার সময় যেমন বিরক্তিবোধ করছিল, অমল চাকলাদারকে মনে পড়ে যেমন অস্বস্তিবোধ করছিল, তেমনি এই মাস্টারটাকে দেখে শিবনাথের খারাপ লাগছিল ভয়ানক বিশ্রী লাগে তার লোকগুলোকে। কারণ? দারিদ্র্য এবং মূর্খতা। এরা না থাকলে বাড়িটার একটা শ্রী থাকত, মনে মনে বলল শিবনাথ।

একটা জাহাজের মত মনে হয় বাড়িটাকে। বারোটা কামরা জাহাজের বারোটা কেবিন কোনোটায় আলো জ্বলছে। কোনোটা অন্ধকার। অন্ধকার আকাশের নিচে সাঁতার কেটে চলেছে জাহাজটা। যাত্রীরা খাচ্ছে, গল্প করছে, কথা বলছে, কথা শুনতে শুনতে কেউ ঘুমে ঢুলছে। কোনো কামরার দরজা হাঁ-খোলা, কোনোটার দু’টো পাল্লাই ভেজানো। জানালা কারো খোলা, কোনোটার বন্ধ। দরজা জানলা দুটোই বন্ধ থাকলে সেই ঘরে কি হচ্ছে উঠোনে দাঁড়িয়ে কিছু দেখা যায় না। ঘরের লোকেরা যদি ফিসফিস করে কথা বলে তবে কথাও শোনা যায় না কোন্ বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। বাসনকোসনের শব্দ হ’লে বোঝা যায় খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। যে ঘরে কোনো রকম শব্দ নেই, সে ঘরের খাওয়া-নাওয়া শেষ হয়েছে বুঝতে হবে এবং কোনো সময়ই যদি শব্দ না হয়ে থাকে বোঝা গেল, সেই ঘরের লোকের উপোস চলছে। নির্জীব হয়ে থাকে ঘরটা। ভিতরের মানুষগুলো ঘুমিয়ে কি চুপ ক’রে শুয়ে রাত্রির প্রহর গুনহে তা বোঝা যায় না। কিন্তু সেই নির্জীবতাকে উপেক্ষা ক’রে পাশের কামরার লোকেরা শব্ করে বাসন-কোসন নাড়াচাড়া করতে, বাটনা বাটতে, মাছ কুটতে, হাসতে, হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে দ্বিধা করে না। রাত গম্ভীর হতে গভীরতর হয়। আকাশে সপ্তর্ষি ঘুরে যায়। বাড়ির পিছনে হরিতকী গাছে এক সময় একটা পেঁচা ডেকে ওঠে। দূর্–দূর্!’–একটা ঘর থেকে কে যেন চীৎকার করে গালাগাল দেয়, ‘অলুক্ষুণে। লক্ষ্মীকে আনতে ক্ষমতা নেই, ডাকাডাকি সার।’

‘আসছে দিদি। তোমার ঘরে এখন লক্ষ্মী বাঁধা থাকবে। বীথি যখন এত ভাল অপিসে কাজ পেয়ে যাচ্ছে, তোমার আর ভাবনা কি।’ হিরুর মা ভাত খেয়ে পান মুখে পুরে বীথিদের দরজায় এসে দাঁড়ায়।

‘না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।’ বীথির মা’র মুখ তেমন প্রসন্ন না।

‘হবে, হয়ে যাবে। কেন হবে না, কমলা আমাকে বলল, বড় সাহেব নাকি ওকে দেখেই বলেছে চাকরি তৈরি আছে, যদি বীথি রাজী হয় কাল থেকেই লাগতে পারে।’

বীথির মা আর কিছু বলল না।

‘কোন্ আপিসে দিদি? কি কাজ?’

‘নাম তো জানি না ভাই, আমেরিকানদের আপিস।’

‘আরো মেয়েছেলে কাজ করছে বুঝি?’

‘সব মেমসাহেব।

‘তোমার মেয়ে দেখতে ভাল।’–হিরুর মা গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল।

হিরুর মা’র পিছনে এসে দাঁড়ায় প্রমথর দিদিমা। তার পিছনে আট নম্বর ঘরের হিরণ বিধুমাস্টারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণি এবং আরো দু’ একজন। বীথির মা’র ঘরের দিকে আজ সকলে ঈর্ষার দৃষ্টি।

এখনো সে-ঘরের খাওয়া-দাওয়া হয়নি। বীথির মা কা’কে দিয়ে বাজার থেকে একটা ফুলকপি আর একপো চিংড়ি মাছ আনিয়েছে। বীথির খবর শুনে তখনি বাজারে পাঠিয়েছিল সন্ধ্যার পর। প্রীতি ঘরে ফিরে বোনের চাকরি হচ্ছে শুনে খুশি হয়ে নিজের পয়সা দিয়ে বাজার থেকে আধ সের রসগোল্লা আনিয়েছে।

রাত ন’টা অবধি চা মিষ্টির পর্ব লেগে ছিল। প্রীতির দু’জন সখী এসেছিল। বীথির দু’জন পরিচিত মেয়ে এসেছিল এ-পাড়ার। খবর শুনে সবাই খুশি।

কমলা সকলের আগে চা ও সবচেয়ে বেশি রসগোল্লা খেয়ে আবার বেরিয়ে গেছে। আজ ওর নাইট ডিউটি। তাই ওর ঘরে তালা ঝুলছে। কমলার প্রশংসা সকলের মুখে মুখে ঘুরছিল। বীথির চাকরির মূলে ও।

সখীরা চলে যেতে প্রীতি বীথি এখন কুয়োতলায় বসে সাবান দিয়ে স্নান করছে। গল্প করছে। অবশ্য এত আস্তে দু’বোন কথা বলছে যে, তাদের কথা কেউ টের পাচ্ছে না। কেবল তাদের গা থেকে উঠে-আসা সাবানের মিষ্টি গন্ধটা উঠোনে বাতাসের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।

বীথির চাকরি হ’চ্ছে শুনে রুচিও জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, এইমাত্র আবার নিজের ঘরে ফিরে গেছে। শিবনাথ শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানছে।

বীথিদের দরজায় একজন অনুপস্থিত ছিল।

ডাক্তারের স্ত্রী।

প্রভাতকণার ঘরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ডাক্তার ফিরবে অনেক রাত্রে, ধাপার দিকে একটা কল-এ বেরিয়েছে। কলেরা কেস্। একটা দু’টো কলেরা হচ্ছে ওধারটায়।

ডাক্তারের জন্য রুটি তরকারী দুধ আলাদা করে ঢেকে রেখে মা মেয়ে বসে গল্প করছে। দরজার দুই পাল্লা ভেজানো। জানালা ভেজানো। এই ঠাণ্ডা রাত্রে বাইরে পাতকুয়োর নিচে ব’সে প্রীতি-বীথির সাবান মেখে স্নান করা দেখে প্রভাতকণা তার স্ব-জেলা ঢাকার গল্প করছে মেয়ের কাছে। মার হাঁটুর উপর দুই কনুইয়ের ভর রেখে মেঝের ওপর হাঁটু গেড়ে বসেছে সুনীতি। তার কানের জুঁইপাতা মাকড়ি দু’টো হারিকেনের কমানো আলোয় চকচক করছে। টেবিলে ডাক্তারের টাইমপিস ঘড়িটা টিকটিক করছে।

প্রভাতকণার ঢাকা শহরের বাসার পাশে আর এক বাড়িতে একরকম দু’বোন ছিল। মেয়ে দু’টো ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান! ওরা এমনি ঠাণ্ডা রাত্রে গায়ে সাবান মেখে স্নান করত।

‘ওরা এখন কোথায় মা?’ সুনীতি ব্যগ্র স্বরে প্রশ্ন করল।

‘কি ক’রে বলব, কবে ছেড়ে এসেছি ঢাকা। আর তো যাইনি।’

‘ওদের বিয়ে হয়নি?’

প্রভাতকণা মাথা নাড়ল এবং চোখ দু’টো বড় ক’রে ঘরের বাইরে পাতকুয়োটাকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে মেয়েকেই বলল, ‘এদেরও হবে না। প্রীতির তো অনেকদিন আগেই বয়েস গেছে। বীথির তবু আশা ছিল। এখন এটাও ডুবল।’

মার দিকে তাকিয়ে থেকে সুনীতি একটা বড় ঢোক গিলল আর চুপ করে রইল। ‘যাক, মাকড়িটা গড়িয়ে রাখলাম, আরো চার গাছা চুড়ি গড়িয়ে রাখতে পারলে বিয়ের অলঙ্কারের ভাবনা আমার একরকম শেষ হয়ে গেল।’

প্রভাতকণার কথাগুলো মেয়ে কান পেতে শুনল।

.

তেমনি দশ নম্বর ঘরের দু’টো পাল্লাই ভেজানো। জানালাও ভেজানো।

পেটের তলায় বালিশ-চাপা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে অমল তার স্ত্রীকে এখন চাপা গলায় শাসন করছে : ‘এত যদি ব্যাটাছেলে ঘেঁষে দাঁড়াবার শখ হয় তো বাজারে নাম লেখালেই পারো। ওই হওয়া ছাড়া আর উপায় কি। লেখাপড়া তো আর শেখনি যে আপিসে ঢুকবে। সেখানেও অবশ্য ঘেঁষাঘেঁষি করার সুবিধে আছে।’

ঘর অন্ধকার। তেলের অভাবে কোনদিনই আর রাত্রে এখন আলো জ্বলে না।

কিরণ মাটির ওপর মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। কথা বলছে না। যেন ঘুমিয়ে আছে। ঘুমোয়নি। শ্রান্ত, অচৈতন্য। পিঠের কাপড় সরে গিয়ে আর একদিকে মেঝেয় লুটোচ্ছে। এত ফর্সা কিরণের গায়ের রঙ যে, অন্ধকারেও সাদা দেখাচ্ছিল পিঠটাকে, যেন আলোর একটা ঢেউ।

বকতে বকতে হঠাৎ চুপ করে কটমট করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অমল।

১৩

এই অবস্থা। যাত্রীদের বিভিন্ন অবস্থায় বুকে নিয়ে জাহাজবাড়িটা রাত্রির গাঢ় জলে সাঁতার কেটে চলছিল। সপ্তর্ষি আরো খানিকটা ঘুরে গেল। আর একটা ঘরের দরজায় পাল্লা দুটো এই সবে বন্ধ হ’ল।

রুণু বেবির মা অর্থাৎ কে. গুপ্তর স্ত্রী চুপ করে শ্রান্ত অচৈতন্যর মত বিছানায় শুয়ে আছে। ফ্রকের তলা থেকে বেবি এতবড় একটা পাঁউরুটি আর কাগজের মোড়ক করা চিনিটা মার বিছানার পাশে রাখল। কোন প্রশ্ন না করে পাঁউরুটিটা হাতে নিয়ে বেবির মা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে লাগল।

এইমাত্র রুণু ঘরে ফিরেছে। হাতে চারটি বড় মুলো। মাঠ থেকে তুলে এনেছে। চুরি করে এনেছে একটু বেশি রাত্রে। পাহারাওয়ালা যখন ছিল না।

সুপ্রভা চিনি দিয়ে পাঁউরুটি খেয়ে আবার চোখ বুজে শুয়ে রইল। এইবার রুণু ও বেবি খেতে বসল। মেঝের ওপর মুখোমুখি বসে দু’জন নুন ও লঙ্কা দিয়ে কাঁচা মুলো কচ্‌কচ্ করে খেতে লাগল।

‘একদিন ধরা পড়বি।’ বেবি এতবড় একটা মূলোর টুকরো চিবোতে চিবোতে বলল, ‘ধরলে পাহারাওয়ালা হাড় ভেঙে দেবে।’

‘ধরলে তোকেও রমেশ রায় আস্ত রাখবে না।’

‘ইস্, আমি ক্ষিতীশকে দেখিয়ে আনি।’

রুণু আর কিছু বলল না।

‘তোর সঙ্গে আর কে ছিল?’

‘ময়না।’

‘ময়না আর তোতে খুব ভাব হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে দু’জনে বেড়াতে যাওয়া হয়, আমি টের পাই।’

‘ধ্যেৎ।’ রুণু ধমক দিয়ে বেবিকে মারবার ভঙ্গি করে শূন্যে হাত নাড়ে। বেবি খিলখিল হাসে। ‘আমি টের পাচ্ছি, তোমাদের হাবভাব দেখে সব বুঝি।’

‘এই বেবি চুপ কর।’ভাই বোনকে তেড়ে মারতে যায়। কালি-পড়া হ্যারিকেনের ঝাপসা আলোয় ঘরের দেওয়ালে করোগেটেড টিনের ওপর দু’টো ছায়া চঞ্চলভাবে নড়ে। বেবির মাথা রুণুর মাথা। অনেকদিন তেল নেই চুলে। ছায়ার মধ্যেও যেন ধরা পড়ে সেই রুক্ষতা, বিবর্ণতা। স্থির অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে সুপ্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

পাশাপাশি ঘর বলে সেই দীর্ঘশ্বাসও রুচি শুনতে পেল। চুপ করে সে-ও শুয়েছিল। সিগারেটটা নিভে যাওয়ার পর শিবনাথও অন্ধকারে চোখ মেলে চুপচাপ শুয়ে।

দু’জনের মাঝখানে মঞ্জু; কেবল মঞ্জুর নিশ্বাসের শব্দ হচ্ছিল।

এক সময় রুচি শিবনাথের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, দুপুরে কোথায় বেরিয়েছিলে?’

‘নারকেলডাঙ্গায়।’

‘কেন?’

ট্যুইশানির খোঁজে।’

‘হবে? কিছু কথা দিয়েছে?’

‘করব না।’

‘কেন?’

‘কম মাইনে।’

রুচি চুপ করে রইল।

‘প্রাইভেট ট্যুইশানি করা ছোটলোকের কাজ। দেখতে পাও না বিধুমাস্টারকে! কী বা পোশাক, কী বা চেহারা! মাস্টারগুলোকে দেখলে আমার ঘেন্না করে।’

অন্ধকারে শিবনাথ মুখ বিকৃত করল।

‘আমিও ইস্কুলে মাস্টারি করছি, আশা করি ভুলে যাও নি।’ বলে রুচি একটা ছোট নিশ্বাস ফেলল।

‘আহা, সে-কথা হচ্ছে না।’ শিবনাথ তাড়াতাড়ি নিজেকে সংশোধন করল। ‘তার জীবন আর তোমার, মানে আমাদের জীবনে অনেক তফাত, প্রায় আকাশ-পাতাল বলতে পারো।’ একটু চুপ থেকে পরে শিবনাথ বলল, ‘বারো টাকায় ট্যুইশানি নিয়েছে ম্যাট্রিকের এক মেয়েকে পড়াবে, জানো?’

রুচি চুপ করে রইল।

‘কেন নেবে না, হাজার গণ্ডা বাচ্চার জন্ম দিলে এই অবস্থা হয়।’ শিবনাথ বলল, ‘আউটলুক নিয়ে কথা হচ্ছে। এধরনের ইচ্ছা করে গরিব হয়ে থাকা মানুষগুলোকে আমি ঘৃণা করি।’

‘তুমি কি বড়লোক হয়ে গেছ নাকি?’

‘নিশ্চয়, ওর তুলনায়, ওদের তুলনায় আমি রাজা। পাঁচ গণ্ডা সন্তানের বাপ নই আমি। আমার একটা মেয়ে।

রুচি আর কোন কথা বলল না।’

এমন সময় বাইরে এক গণ্ডগোল শোনা গেল। শিবনাথ শয্যা ছেড়ে উঠল; রুচি উঠল না।

দরজা খুলে শিবনাথ বারান্দায় এলো।

হাতে লণ্ঠন নিয়ে বাড়ির সরকার মদন ঘোষ। সঙ্গে ওটা কে? শিবনাথ অনুমান করল বাড়িওয়ালার দারোয়ান, হাতে লম্বা লাঠি। একজন না, দু’জন দারোয়ান। তিনজন বলাই- এর ঘর মুখ করে উঠোন দাঁড়িয়ে।

শিবনাথ শুনল, একজন আর একজনকে বলছে, লাঠি দিয়ে দরজায় ধাক্কা মারো।

মদন ঘোষ দু’বার ‘বলাই’ ‘বলাই’ করে ডাকল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

‘জেগে ঘুমোচ্ছে।’ একজন বলল।

‘তা বললে চলবে না।’ যেন ঘরের ভিতরের জাগ্রত ঘুমন্ত বলাইকে সম্বোধন করে মদন ঘোষ চেঁচিয়ে বলল, ‘ভাড়া না দিলে কাল সকালের মধ্যে ঘর খালি করে দেবে।’

এমন সময় ঘরের ভিতর থেকে সাড়া পাওয়া গেল। দরজা খোলার শব্দ হয়। উঠোনের লোকেরা দরজার কাছে সরে গেল। খুলতে ময়নাকে দেখা গেল। বলাই-এর মেয়ে।

তোর বাবা কোথায়?’ মদন ঘোষ প্রশ্ন করল।

‘ঘুমোচ্ছে।’

ভাল করে কথা বলতে পারছে না মেয়েটা। কেমন যেন ভয় পেয়ে গিয়ে কাঁপছে।

‘ডেকে দে শালাকে।‘

মদন ঘোষ বিকৃত মুখে ভঙ্গি করল।

কিন্তু ময়না ডাকবার আগে বলাই উঠে এল।

‘কাল সকালে তুমি ঘর ছেড়ে দিও, অন্য ভাড়াটে আসছে।’

আর ঘর ভাড়ার তাগিদ না দিয়ে সরকার সোজা কথাটা বলে ফেলল।

বলাই মুখ তুলছে না। নীরব!

ময়না বাবার পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

লণ্ঠন ও লাঠিওয়ালারা উঠোনের আর একদিকে চলে গেল।

অমলের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল তিনজন।

অমলবাবু ঘরে আছেন?’

‘কে?’

সরকারের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে অমল ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

‘ঘর-ভাড়া দিন।’ মদন ঘোষ হাতে পাতল।

‘টাকা পাইনি।’ অমল ভয় পায়নি মুখের এমন ভাব করল। কিন্তু মদন ঘোষ তা গ্রাহ্য করল না। সরস গলায় বলল, ‘তাই ভাল, আবার যখন টাকা হবে এ-ঘরে এসে বাস করবেন। দয়া করে কাল দুপুরের মধ্যে জিনিস-পত্তর বার করে ঘর খালি করে দেবেন। নতুন ভাড়াটে আসছে।

ব’লে সরকার লাঠিওয়ালাদের সঙ্গে করে আর এক ঘরের দরজার দিকে সরে গেল। ‘ইয়ার্কি আর কি। ন’মাস ভাড়া দিয়ে এসেছি। দু’মাস ভাড়া দিচ্ছি না, ঘর ছাড়ো, সেই দিন এখন গেছে। রেন্ট-কন্ট্রোল আছে। আমিও ফাইট্ করব।’

‘তাই কর দাদা, তাই করে দ্যাখো!’ প্রতিবেশী কোন ঘরের লোক গলা বড় করে বলল, ‘বাড়িওয়ালার জুলুম এখন টেঁকে না।’

মদন ঘোষ দলবল নিয়ে কে. গুপ্তর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে। শিবনাথ লক্ষ্য করল কে. গুপ্তর ছেলে ও মেয়েটি মুখ কালো করে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

‘তোমাদের বাবা কোথায়, খুকি?’

‘বাবা এখনো ঘরে ফেরেনি।’ বেবি বলল।

‘কোথায় গেছে?’

‘জানি না।’ রুণু বলল।

একটু ইতস্ততঃ করে মদন ঘোষ বলল, ‘তোমাদের মা ঘরে আছেন কি?’

একটু ভেবে বেবি বলল, ‘ঘুমোচ্ছেন। মার শরীর ভাল না।’

সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে সরকার সরস গলায় বলল, ‘দ্যাখো, দ্যাখো ভাই, বাবুদের কী অবস্থা আজ। লোকটার হাজার টাকার ওপর মাইনে ছিল। এখন হাঁড়ি চড়ছে না নিয়ম মতন।

রুণু ও বেবি পরস্পর মুখের দিকে তাকায়।

মদন ঘোষ একটু ভেবে পরে বলল, ‘আচ্ছা খুকি, বাবাকে বলবে, সরকার এসেছিল। তিন মাসের ভাড়া পরিষ্কার করে না দিলে ঘর ছেড়ে দিতে হবে দু’চার দিনের মধ্যে।’

রুণু ও বেবি একসঙ্গে মাথা কাত করল।

সঙ্গীদের নিয়ে সরকার উঠোন ছেড়ে চলে গেল। আর কাউকে ঘর ছাড়তে বলা হল না, তার অর্থ বাকি সব ঘরের ভাড়া পরিষ্কার আছে। তারা, যাদের ভাড়া পরিষ্কার, প্রায় সবাই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণ চুপচাপ ছিল আর দাঁড়িয়ে শুনছিল মদন ঘোষ কোন্ কোন্ পরিবারকে ঘর ছাড়তে শাসিয়ে গেল।

সরকার চলে যেতে এখন এক এক করে মুখ খুলল। শিবনাথ কিছু বলল না, শুনে গেল।

‘একটু বেশি কড়াকড়ি আরম্ভ হয়েছে বলে মনে হয়।’

‘শুনছি, এই বস্তি রাখবার ইচ্ছে নেই রায় সাহেবের। পরিজাতও তাই চাইছে। বস্তি তুলে দিয়ে কারখানা খুলবে। বস্তির অনেক হাঙ্গামা।’

‘সে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে দাদা, আমরা যারা নিয়মিত ভাড়া গুনছি, তাদের তুলবে কেমন করে। বস্তি ভেঙে দিতে ওকে দিচ্ছে কে।’

‘বস্তি দিয়ে তেমন আয় হয় না। তাই এখানে কারখানা খোলার মতলব।’

‘বটে। কিসের কারখানা?’

‘চামড়ার।’

‘না-না, ওসব বাজে কথা। আমার সঙ্গে এই বিকেলেও পারিজাতের কথা হচ্ছিল। মানে যারা ভাড়া দিতে পারছে না, ডিফল্টার হয়ে আছে, তাদের পারিজাত তুলে দেবে। এখন ভাল ভাল সব লোকজন আসছে এখানে ঘর ভাড়া নিতে।’

‘তা ভাড়াও তো এক একটা ঘরের কম না! মাস যেতে আঠারটি টাকা।’

‘তা তো বটেই। আমরা বস্তি বস্তি করে নাক সিঁটকাই, তা এই বস্তিতেই বা থাকতে পারছে ক’জন।’

‘এই এক বছরের মধ্যে কত ভাড়াটে গেল, কত এল।’

‘হ্যাঁ, যদি একটা ফিক্সড ইনকাম না থাকে, তবে আমার তো মনে হয়, এত ভাড়া দিয়ে এখানে থাকাটা ঠিক না।’

‘তা ছাড়া একজনের দরুন বাকি তিনজনকে সাফার করতে হয়। পারিজাত বলছিল, কবেই ইলেকট্রিক আনা হয়ে যেত। কিন্তু হচ্ছে না, কেন আনা হচ্ছে না–বুঝতে পারছেন তো?’

‘তা আর বুঝি না! আমি মশাই এটা পছন্দ করি না। যখন যেমন আয়, সেভাবে থাকতে হবে বৈকি। আরো সস্তায় ঘর আছে, টেংরা ধাপার দিকে। আট-দশ টাকায় ঘর পাওয়া যায়। এখানে এত ভাড়া দিয়ে থাকার কি অর্থ হয়।’

’আমি মশাই ভাড়ার ব্যাপারে ভয়ানক পার্টিকুলার। পান খাই না, সিগারেট খাই না কি কম দুঃখে। এমনি এতগুলো সন্তান। আর ওপর কী দুর্মূল্য হয়েছে জিনিসপত্তর।’

শিবনাথ ঘাড় ফিরিয়ে দেখল বিধুমাস্টার কথা বলছে। আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে না থেকে শিবনাথ ঘরে চলে এল। কিন্তু সেখান থেকে বাইরের লোকের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল।

‘টেংরা-ধাপায় যাব কেন। এখানেই থাকব। কিন্তু ঘড়ভাড়া বারো টাকার বেশি দেব না। এই ঘরের, যে-বাড়িতে কল চালু নেই, ইলেকট্রিক নেই, ছ’ ফুট ন’ ফুট একটা ঘরের ভাড়া বারো কেন দশ হওয়া উচিত। আঠারো টাকা জুলুম। বাড়িওয়ালার জুলুম আর টেকে না। রেন্ট-কন্ট্রোল আছে।’

‘কিন্তু আমরা সকলে এক হ’তে পারছি কই। ইউনিটি ইজ স্ট্রেংথ। এই দুর্দিনের বাজারে কারোরই উচিত না আঠারো টাকা ভাড়া দেওয়া। একসঙ্গে সকলের ভাড়া বন্ধ করা উচিত।’

‘তা কি আর হয় দাদা। এখানে সেই হ্যাঁভ্স এন্ড হ্যাঁভ্ নস্-এর দলাদলি। শুনলেন না, শেখর ডাক্তার কি বলল, যাদের ফিক্সড ইনকাম নেই, তাদের ঘর ছেড়ে দিয়ে টেংরা-ধাপায় চলে যাওয়া উচিত।’

‘বটে, যাচ্ছি, আসুক না কাল মদন ঘোষ। কি করে আমাকে তোলে, আমিও দেখে নেব।’ কিছুক্ষণ আর কারো গলা শুনল না শিবনাথ। রুচি ঠিক ঘুমুচ্ছে কি না, বুঝতে পারল না। মঞ্জুর নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মশারির একটা ধার সাবধানে তুলে আস্তে আস্তে সে ভিতরে চলে গেল। কিন্তু সেখানে থেকেও শিবনাথ বাইরের লোকের কথা শুনতে পেল। যেন আবার শেখর ডাক্তার বিধু মাস্টারকে বলছিল, ‘দশ টাকা ভাড়া করলেও কি তুমি মনে করো সবাই নিয়মিত তা দিয়ে যাবে। তখনও ডিফল্টারের সংখ্যা এখনকার মতনই থাকবে। বাড়তেও পারে।’

‘যা বলেছ। হ্যাঁ, ক্রমশই হার্ড ডেজ আসছে। না, ভাড়া কমানো-টমানোর প্রশ্ন উঠবে না। ও সবাই ওঠার আগে এসব বলে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করে, তারপর যেদিন যাবার ঠিক উঠে যায় পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে। কতজনকে দেখলাম।’

‘তাই বলছিলাম, বস্তি বস্তি করে আমরা নাক সিঁটকাই বটে, কিন্তু এই ঘরেই বা থাকতে পারছে ক’জন।’ শেখর ডাক্তারের গম্ভীর গলা শোনা গেল, ‘চল মাস্টার একটু রকে গিয়ে বসি।’

‘হিম পড়ছে।’ বাইরে রকে গিয়ে বসতে বিধু মাস্টার গররাজী, বোঝা গেল।

‘আরে ধ্যেৎ, হিম। তোমার দেখছি,–চল প্রাইভেট কথা আছে।’

মাস্টারকে আর আপত্তি করতে শোনা গেল না। প্রাইভেট কথা শুনতে ডাক্তারের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। অথচ দু’জনের মধ্যে ভিতরে ভিতরে কী অহি-নকুল সম্পর্ক শিবনাথ জেনে ফেলেছে। কিন্তু এখন বোঝা যায় না, এখানে মনের সেই ভাব অনুপস্থিত। কেন না, দুজনের ঘরভাড়া পরিষ্কার আছে।

যাদের বাড়িওয়ালার লোক শাসিয়ে গেল, শিবনাথ তাদের গলা আর শুনতে পেল না। বাড়িটা এবার ঝিমোচ্ছিল, শিবনাথের প্রায় তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ এমন সময় বাইরে কার মোটা উঁচু-সমর্থ গলা শোনা গেল। কান খাড়া করে ধরল শিবনাথ। রমেশ রায় কথা বলছিল।

‘ওসব আইডিয়া ছেড়ে দিন, ভাড়াটাড়া বন্ধ করার হাঙ্গামা আছে। তাছাড়া বাড়ির সকলে একজোট হতে পারছেন কই। আমি হয়তো আপনাকে সমর্থন করলাম, আর তিনজন করবেন না। চোখে দেখতে পাচ্ছেন না?’

ঠিক কাকে কথাগুলো বলা হচ্ছে, শিবনাথ বুঝতে পারল না।

‘দিনের হালচাল বদলে গেছে এখন। যখন যেমন, ঠিক সেইভাবেই চলতে হবে, না হলে বিপদ। ছি, ছি, মদন ঘোষ এত সব কথা শোনায় আপনাকে, কেন, আপনি কি জলে পড়েছেন।

‘ছোটলোক। আমি বলেছি, সামনের মাসে সব পরিষ্কার করে ফেলব, কিন্তু শুনছে না।’

শিবনাথ বুঝল, অমল কথা বলছে।

‘যাকগে, আমি বলব পারিজাতকে কথায় বলে, মনিবের চেয়ে চাকরের গলা বড়–বলে দেব, এখানে সবাই ভদ্রলোকের ছেলে, মদন ঘোষ কথাবার্তা যেন একটু সাবধানে বলে।’

‘সাধারণ একটা সরকারের কী তেজ!’ অমল বলল।

‘ছেড়ে দিন, বললাম তো চাকর চাকরই।’

রমেশ রায় বোঝায়। ‘এসব ভেবে আর মন খারাপ করবেন না। আমি আপনাকে ওবেলা যা বলেছিলাম ভেবে দেখেছেন কি?’

শিবনাথ আরো মনোযোগ দিতে বালিশ থেকে মাথাটা তুলে ধরল।

রমেশ বলছিল, ‘যখন যেমন সেভাবে চলতে জানলে ঠেকতে হয় না, অপমানও শুনতে হয় না। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা তা-ই বলছে মশাই,–‘

‘সুতরাং বুদ্ধিমানের মত, এখনকার মত সেই রকম ব্যবস্থাই করুন। তারপর আপনার একটা সুবিধে হয়ে গেলে, বুঝলেন না?’

অমল মাথা নাড়ল কি নাড়ল না, ঘরে থেকে শিবনাথ দেখতে পেল না। কিন্তু এখনকার মত কি ব্যবস্থা করতে রমেশ সদুপদেশ দিচ্ছে বুঝল।

রমেশ রায়ের গলা আর এক ঘরের সামনে শোনা যায়। উঠোনের আর এক দিকে সরে গেছে সে, শিবনাথ টের পেল।

‘হাতের কাছে লাঠি থাকলেও সুবিধে হত না বলাই, রাগের মাথায় বলছ বটে, কিন্তু মদন ঘোষের মাথায় বাড়ি মারলে তুমি জেলে যেতে–বাড়ির পাঁচটি ঘর তোমার হয়ে সাক্ষী দিত, কিন্তু বাকি সাতঘর যেন মদনের পক্ষে,–যাবে। এই এ-বাড়ির দস্তুর।’ বলাই চুপ।

‘কাজেই ওসব অসম্ভব ভাবনা না ভেবে আমি যে-কথাটা বলেছি, ভাল করে সেটাই ভেবে দেখ। আমার প্রস্তাবটা জলে ফেলে দিও না।’

কি প্রস্তাব–বলাইকে কি ভাবতে রমেশ রায় সৎ পরামর্শ দিচ্ছে, শিবনাথ বুঝতে পারল না।

‘ব্যবসার হালচাল বদলে গেছে, আগের দিন আর নেই, বেগুন মাথায় নিয়ে সারাদিন ঘুরলে ঘাম ঝরাবে, পয়সা চোখে দেখবে না।’

যেন বলাই ভাবছিল। কথা বলছে না।

রমেশ রায় বলল, ‘কাজেই যেভাবে চললে ঠেকবে না, ঠকবে না, বুদ্ধিমানের মত তাই তোমাকে করতে বলা হয়েছে। রাজী যদি থাক তো কাল সকালে আমায় জানিও।’

বলাই মাথা নাড়ল কি না শিবনাথ দেখল না। বৌকে কারখানার কাজে লাগাতে অমলকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। বলাইকে? ময়নাকেও কি রমেশ রায় কারখানায় দিতে বলছে? না কি অন্য কোন পরামর্শ! শিবনাথ ঠিক বুঝতে পারল না। রমেশ রায়ের গলা আর শোনা গেল না। বাড়ির কলরব এখন একেবারে থেমেছে। অন্ধকারে সাঁতার কাটতে কাটতে জাহাজ হেলেদুলে চলেছে। পিছনের হরীতকী গাছের পেঁচাটা আর একবার ডেকে উঠল। আর কেউ এখন ‘দুর্ দুর্’ করল না। আরো কিছুক্ষণ পর, আলপিন পড়লে তার শব্দ শোনা যায়, চারদিক যখন এমন নীরব হয়ে এসেছে, তখন গমগম করে উঠল একজনের কণ্ঠস্বর : Beauty Beauty Beauty Beauty…

‘এ-বাড়ির সকলের চেয়ে কে. গুপ্ত সুখী।’ কে জানি বলল।

‘আজ আর বোতল না, পিপেসুদ্ধ ঢেলে এসেছে।’ আর এক ঘর থেকে একজন বলে উঠল, ‘মদন ঘোষের বাবার সাধ্য কি মহাদেবকে অপমান করে।’

শুনে দু-তিনটা ঘরের স্ত্রী-পুরুষ ও শিশুরা একসঙ্গে হেসে উঠল। বস্তির মানুষের চোখে ঘুম খুব কম, শিবনাথ জেগে থেকে ভাবে।

১৪

পরদিন সকালবেলা স্বামী-স্ত্রীতে বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে গেল! এবং কথাগুলো, দুজনের কেউ আস্তে বলল না। রুচি বলল, ‘তোমার যদি সামনের মাসের মধ্যে একটা সুবিধা না হয়, আমি নৈহাটি চলে যাব।’

নৈহাটিতে রুচির দিদি থাকে। দিদির বর সেখানে রেলের চাকরি করে।

এই ধরনের শাসানি শিবনাথ আগে কোনদিন স্ত্রীর মুখে শোনেনি। বস্তিতে এসে এই প্রথম শুনছে।

মুক্তরামবাবু স্ট্রীটের বাসায়ও এই ক’টা মাস তারা ভয়ানক কষ্টেই কাটিয়ে এসেছে।

কিন্তু ভয় পেয়ে রুচি একদিনও দিদির কাছে কি কাকাবাবুর কাছে পালিয়ে যাবার কথা তোলেনি।

রুচির শাসানিটাকে শিবনাথ অন্য কাজে লাগাল। ভয় পেয়ে তার মুখ শুকনো হল না। বরং সূক্ষ্ম একটা রসবোধ হয়েছে, মুচকি হাসির মধ্য দিয়ে সে তা ফুটিয়ে তুলল। বেশ জোরে বলল, ‘তা আমার কাজের সুবিধে হচ্ছে না বলে রাগ করে তুমি চলে যাচ্ছো, আমি বলব এটা তোমার সেলফিশ মনের কথা। হ্যাঁ, দিদির কাছে গিয়ে তো তুমি থাকতে পারোই। জামাইবাবু বড় চাকুরে। চাকরি-বাকরি কিছু না করেও সেখানে স্বচ্ছন্দে ছ’মাস কাটাতে পার। : রোজ মাছের মাথা খাবে, বাঁধাকপি খাবে। গুড্‌সে আছেন তোমার ব্রাদার-ইন-ল। রোজ প্রচুর ভেট পান। এখানে বস্তিতে থেকে পুঁটি চচ্চড়ি খেয়ে অসুখ-বিসুখ বাঁধানোর কী দরকার। মঞ্জুকেও নিয়ে যাও।’

শিবনাথ একবার থেমেছিল দরজার দিকে তাকিয়ে। অনেক মেয়ের মুখ দরজায় উঁকি দিয়েছে। সরল দাম্পত্যকলহ দাঁড়িয়ে দেখতে মেয়েদের চেয়ে উৎসাহশীল জীব পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

তা ছাড়া আর দশটা ঘরের যেমন পর্দা ছিল না, এ-ঘরেও তা ছিল না। মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের পর্দাটা আনা হয়েছিল। কিন্তু এখানে খুলে দেখা গেল, ইঁদুরে জায়গায় জায়গায় খেয়ে গাঙ করে ফেলেছে, দরজায় টাঙানো যায় না।

এবং পর্দা না থাকার দরুন উঠোনে দাঁড়িয়েও অনেকে এ-ঘরের নতুন ভাড়াটেদের স্বামী- স্ত্রীর ঝগড়া দেখল।

কেউ কিছু মন্তব্য করল না। দাম্পত্যকলহে বাইরের লোকের নাক ঢোকানো পাপ। জানে বলেই সকলের মুখে কাপড় অথবা হাত। আড়ালে তারা হাসছে কি দুঃখ করছে বোঝা যায় না।

শিবনাথও তা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজনবোধ না করে রুচির দিকে তাকিয়ে সোজা বলে ফেলল, ‘আমার সুবিধা হচ্ছে না বলে মনে দুঃখ হচ্ছে তোমার, কিন্তু আমারও তো দুঃখ হয় তোমার হাবভাব দেখে।’

কী রকম!’ রুচি বড় করে স্বামীর দিকে তাকালো।

‘হাই ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা অফিসে ঢুকলে এর ডবল মাইনে পেতে তুমি। আমাদের তাহলে অন্ততঃ বস্তিতে থাকতে হয় না।’

তারপর একটু চুপ থেকে পরে বেশ অভিমানের সুরে বলল শিবনাথ, ‘আমিও কিছু আর চিরকাল এখানে পড়ে থাকতে আসিনি। আমারও চাকরি হবে। এবং ভাল চাকরি হবে। কোলকাতায় আবার ভাল বাড়িতে আমি ফিরে যাচ্ছি শীগগিরই।’

রুচি আর কোন কথা বলেনি। মঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে পড়াতে বেরিয়ে গেল।

.

শিবনাথও ঘরে বসে রইল না।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই ঝগড়া বেধেছিল। শিবনাথ শহরে যেতে রুচির কাছে কিছু পয়সা চেয়েছিল। কিন্তু রুচি দেয়নি। শিবনাথ কাল ধার করে অ্যাশ-ট্রে কিনেছে। রুচি আজ সকালেও একথাটা জোরে জোরে বলল। বাড়ির সবাই শুনল। সেজন্যেই শিবনাথ আহত হল বেশি। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আজকাল আর অত প্রেষ্টিজ নিয়ে মেয়েরা চলে না। অফিসে কাজ করছে সব মেয়েই কিছু খারাপ না।’

শিবনাথ যখন কথাগুলো জোরে জোরে বলছিল, রুচি তখন রাস্তায় নেমে গেছে। কাজেই শিবনাথের কথাগুলো কানে গেল না। শিবনাথের স্বগতোক্তিটা বাড়ির আর পাঁচজন উপভোগ করল। আর পাঁচটি মেয়ে।

শার্ট গায়ে চড়িয়ে দরজায় তালা দিয়ে শিবনাথও এক সময় রাস্তায় নামল।

মনে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল। একটা কিছু সুবিধা তাকে কয়েক দিনের মধ্যেই করে নিতে হবে। না হলে,–না হলে যে ঠিক কী হবে শিবনাথও বুঝল না।

.

শিবনাথ তিনজনের মুখে পড়ে গেল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দেখল বেঞ্চের এপাশে বসে কে. গুপ্ত, ও-পাশে অমল এবং দোকানের ভিতরে বসা বনমালী। তিনজন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। যেন কে. গুপ্ত ও বনমালী কি বলাবলি করছে।

শিবনাথ গিয়ে সামনে দাঁড়াতে দুজন চুপ করল।

‘কোথায় বেরুচ্ছেন?’ বনমালী ভুরু কুঁচকে প্রথম প্রশ্ন করল। ‘কাজে বেরোচ্ছেন নাকি?’ হুট্ করে শিবনাথ মিথ্যা কথাটা বলতে পারল না। ঘুরিয়ে বলল, ‘না, অফিসে একটা গণ্ডগোল আছে, সে জন্যেই বেরোচ্ছি না কদিন। আজ বেরোব কি না তাই ভাবছি।’

‘ও, আপনার আপিসে স্ট্রাইক চলছে, ছাঁটাই হচ্ছে বুঝি? তবে আর খামাকা বেরোচ্ছেন কেন। সীক-লীভ্ চেয়ে পাঠিয়ে চুপ করে বসে থাকুন বাড়িতে। একটা মাসের মাইনে পাবেন। ওখানে গিয়ে দরজায় চেহারা দেখিয়ে স্ট্রাইকার লিস্টে নাম তুলছেন কেন?’

শিবনাথ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল বক্তা অমল। একটা সিগারেট মুখে।

কে. গুপ্তর মুখেও সিগারেট জ্বলছে। সিগারেট ঠিক কে অফার করেছে শিবনাথ বুঝতে পারল না।

‘বসুন বসুন।’ কে. গুপ্ত এতসব ভূমিকা করল না। ‘ও এমনিও গেছে অমনিও যাবে। আপনার স্ত্রী তো আমার আর অমলের স্ত্রীর মতো অশিক্ষিত নন। তা ছাড়া অলরেডি একটা চাকরি করছেনও। আমাদের তুলনায় আপনি যে মশায় লাটসাহেব। বসুন বসুন, আপনার আবার বেকার থাকার ভাবনা কি?’

প্রায় শিবনাথের হাত ধরে কে. গুপ্ত তাকে বেঞ্চের পাশে বসায়।

‘তারপর, খবর কি বলুন, কন্যাকে আজ সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন গিন্নি, দেখলাম?’

‘হুঁ’।’শিবনাথ সংক্ষেপে উত্তর সারতে চেষ্টা করল। বাড়িতে একলা থাকলে মঞ্জু কাঁদাকাটি করে।’

‘তা করবেই তো, নতুন জায়গা।’ বনমালী বলল

শিবনাথ চোখ তুলে আর একবার অমলকে দেখল।

‘যাক গে সুখী লোক, আপনার কথা আলাদা।’ একটা নিশ্বাস ছেড়ে কে. গুপ্ত বলল, ‘মশায় শুনেছেন বোধ হয়, এঁর বিপদের কথা।’ কে. গুপ্ত থুতনি তুলে ইঙ্গিতে অমলকে দেখাল। ‘কাল বাড়িওয়ালার লোক এসে নোটিশ দিয়ে গেছে।’

‘হ্যাঁ, জানি আমি। আমি বাড়িতে ছিলাম।’ শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।

‘তোমায়ও তো নোটিশ দিয়েছে, বনমালী বলল, ‘তোমারটাও বলো ওঁকে।’

কে. গুপ্ত বনমালীর কথায় কর্ণপাত করল না। শিবনাথের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘মশায়, চাকরি-বাকরি নেই বেচারার, ভাবনায় পড়েছে। আর তার মধ্যে কিনা উল্লুকটা অমলের পেছনে লেগেছে।’

‘কে উল্লুক?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।

‘রমেশ রায়।’ বনমালী বলল, ‘অমলকে ফুসলাচ্ছে বৌকে পারিজাতের গেঞ্জির কারখানায় পাঠাতে।’

‘মশায়, পয়সার গরম।’ কে. গুপ্ত চোখ বুজে বলল, ‘দুটো পয়সা আছে তাই কাছে কোন্ কথা বলছে, রমেশ রায় দিশা করতে পারছে না।’

শিবনাথ আড়চোখে অমলকে দেখল। বিমর্ষ, আধোবদন। সিগারেটটা টানছে না। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলছে।

কে. গুপ্ত চোখ খুলল।

‘এ্যাঁ, না হয় অবস্থায় পড়ে আজ শহরে এসেছে। পাড়াগাঁ-র মেয়ে। চিরটাকাল নুন দিয়ে কূল খেয়েছে, মাঘমণ্ডল ব্রত করেছে, শিবচতুর্দশীতে রাত জেগেছে, পিঠে গড়েছে, চটের টুকরোয় ফুল তুলে লক্ষ্মীর আসন তৈরী করেছে, সেই মেয়েকে কিনা হারামজাদা বলছে গেঞ্জির করে ঢুকতে, আক্কেলটা দেখলেন মশায়।

শিবনাথ নীরব।

বনমালী মুখ টিপে হেসে কে. গুপ্তকে বলল, ‘রমেশ রায় তো তোমাকে এ-প্রস্তাব দিতে পারে, তখন করবে কি?’

‘কে আমি?’ কে. গুপ্ত চোখ বড় করল। শালার মাথায় লাঠি ভাঙব। আমাকে এমন একটা কু-প্রস্তাব দিতে এলে রমেশ রায়কে খুন করব।’

কথা শেষ করে কে. গুপ্ত গম্ভীরভাবে অমলের দিকে তাকায়। কিন্তু অমল আর একবারও চোখ তুলছে না। একটু পর সে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘আচ্ছা, আমি এখন যাই।’

‘কোথায় যাবে?’ বনমালী আলগা একটা প্রশ্ন করল। কিন্তু অমল তার উত্তর দিলে না। মাথা নিচু করে রাস্তায় নেমে একদিকে চলে গেল। অমল অদৃশ্য হ’তে বনমালী শব্দ করে হেসে উঠল এবং হাসতে হাসতে সে যা বলল, তা থেকে শিবনাথ বুঝতে পারল অমলের মনের ভাবটা একটু নেড়েচেড়ে দেখবে বলে তারা তাকে এখানে ডেকে এনেছিল। রমেশ রায়ের ওপর অমলের ভীষণ রাগ। তার রেস্টুরেন্টে সামান্য ক’টা টাকা বাকী পড়েছে বলে সে অমলকে এমন অভদ্র প্রস্তাব দেবার সাহস পেলে। কেন, অমলের দিন কি ফিরবে না? তখন সে রমেশ রায়ের ওপর প্রতিশোধ নেবে। সে উপোস আছে, তা বলে কি রমেশ রায়ের দরজায় ভিক্ষে করতে গেছে। উঁহু, কিছুতেই সে বৌকে ঘরের বাইরে পাঠাবে না। পাড়াগাঁয়ে থেকে মানুষ, লেখাপড়া শিখে নাক মুখ যে চোখা করছে তাও না, আর সবচেয়ে বড় কথা কিরণ পাঁচটা-সাতটা সন্তানের মা হয়ে বুড়ী সাজেনি, কাজেই–

কথা শেষ করেও বনমালী হাসে।

‘তারপর, গুপ্ত, দেখলে তো বৌ সম্পর্কে অমল কেমন সজাগ। সিনেমার প্রস্তাবটা তুমি ওকে দেবে কেমন করে?’

কে. গুপ্ত হঠাৎ কথা বলল না। আকাশের দিকে মুখ তুলে অনেকটা নিজের মনে হাসল।

‘কাল বাদে পরশু তোমার বন্ধু আসছে মনে আছে তো।’

‘আছে।’বনমালীর চোখে চোখ রেখে কে. গুপ্ত একটা নিশ্বাস ফেলল। চারু যেমন পাগল হয়েছে কিরণ দেখে, এখন দেখা যাক কি করতে পারি।’

শিবনাথ অস্বস্তিবোধ করছিল। কে. গুপ্ত ঘাড় ফিরিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতে সে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

‘কি মশায়, আপনিও যে দেখছি একেবারে রসকষশূন্য মানুষ। কী এমন হাতি-ঘোড়া কাজ ফেলে এসেছেন যে এরই মধ্যে উঠছেন। কে. গুপ্ত শিবনাথের হাতে ধরতে যাচ্ছিল, শিবনাথ আর একটু সরে দাঁড়ায়। হাত জোড় ক’রে ব্যস্তভাবে বলে, ‘না, এখন না, অন্য সময়, আর একবার এসে গল্প করব, একটু কাজে বেরোচ্ছি।’

‘আহা, আড্ডাটা সবে জমতে আরম্ভ করেছিল। অমলের মত আপনিও যে দেখছি রসের আসরে জল ঢেলে দিয়ে পালাচ্ছেন, ব্যাপার কি–’

শিবনাথ বনমালীর দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পায়ে রাস্তায় হন্ হন্ ক’রে হাঁটতে আরম্ভ করল। চারিদিকে চন্‌চ করছিল রোদ। একটা ধুলোর ঘূর্ণি উঠল। এক ঝলক ধুলো নাকে মুখে লাগতে শিবনাথ পকেট থেকে রুমাল বার করল।

‘শুনুন, আপনাকে ডাকছি।’

রাস্তার ওপাশ থেকে কে যেন শিবনাথকে ডাকে। শিবনাথ ঘাড় ফেরায়। উর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুন।’ প্রকাণ্ড সাইনবোর্ড দরজায় এ-মাথা ও-মাথা জুড়ে। তার নিচে দাঁড়িয়ে পাঁচু ভাদুড়ী। হাত তুলে শিবনাথকে ডাকছে : ‘দয়া ক’রে একবার পায়ের ধুলো দিন স্যার, আসুন।’

গালে হাত বুলোয় শিবনাথ। সেলুন চোখে পড়লে হাত দিয়ে গাল অনুভব করা শহরের লোকের অভ্যাস। এবং শিবনাথ টের পেল তার গালের অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। আজ সকালে দাড়ি কামানোর কথা। কিন্তু রুচির সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে তা আর হয়নি। শিবনাথ গাল থেকে হাতটা নামিয়ে নেয় এবং দাঁড়িয়ে থেকে ইতস্ততঃ করে।

ভাদুড়ী ততক্ষণে চৌকাঠের বাইরে চলে আসে।

‘এক বাড়িতে আছি অথচ একদিনও দর্শন দিলেন না, চলে আসুন স্যার।’

শিবনাথ আর ইতস্ততঃ করল না। রাস্তা পার হয়ে উর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুনের দরজায় চলে গেল। ভাদুড়ী হাতে ধরে শিবনাথকে ভিতরে টেনে নিয়ে যায়।

‘বসুন স্যার।’

গদি-আঁটা উঁচু উঁচু চেয়ার, চার দেয়ালে টাঙ্গানো মোটা ফ্রেম-বাঁধানো বড় বড় আরশি, কাঁচ পরানো আলমিরায় চুল কাটার ক্লিপ, কাঁচি, বুরুশ, শেভিং সোপ, ক্রিম পাউডারের ডিবে ঝকঝক করছে। একদিকে ব্রাকেটে ভাঁজ করে রাখা ধবধবে তোয়ালে। কোন কোনায় যেন ধূপকাঠি জ্বলছে।

‘তারপর কোথায় যাওয়া হচ্ছিল?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে পাঁচু পকেট থেকে সিগারেট কেস্ তুলল। ‘নিন স্যার।’ একটা সিগারেট শিবনাথের হাতে তুলে দিয়ে নিজে একটা ধরায়। স্যার, কোলকাতা থেকে নতুন এসেছেন, জানি ক্যানেল সাউথ রোডের সেলুনে ঢুকতে আপনাদের মন ওঠে না, একদিন পরীক্ষা ক’রে দেখুন।’

‘না না, সে একটা কথা কি। দাড়ি কামাতে চুল ছাঁটতে কি আর রোজ কোলকাতায় যাওয়া পোষায়।’ উদ্ধত ভঙ্গিটাকে একটু খাটো করল শিবনাথ। চারদিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘সাজ-সরঞ্জাম সবই তো আছে দেখছি, শহরের সেলুনের চেয়ে কম বা কি।’

‘তা শুধু সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে তো আর সেলুন চলে না কর্তা, শিবনাথের আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলিয়ে ভাদুড়ী দাঁত বার করে হাসল। ‘হাতের কাজ, হাত ভাল না হলে ও শালা জার্মান বলুন ইংলিশ ফ্রেঞ্চ জাপানি,–শালার কোনো রেজার ক্লিপে সুবিধে হয় না।’ ভাদুড়ীর দাঁতগুলো ভীষণ নোংরা। মদখোরের দাঁত অপরিচ্ছন্ন থাকে কার কাছে যেন শুনেছিল শিবনাথ। কদম ফুলের মত মাথার চুলগুলো সমান ক’রে ছাঁটা। নিকেলের ফ্রেম-বাঁধানো চশমা চোখে হাত-কাটা ফতুয়া গায়ে। পায়ে চটি। চটি পুরোনো হয়ে চামড়া ফাটো ফাটো করছে। কিন্তু তা হলেও নিয়ম মত কালি ও বুরুশ লাগিয়ে ভাদুড়ী পায়ের জুতো বেশ পরিষ্কার রাখে বোঝা গেল। গায়ের জামা পরনের কাপড়টিও ফরসা। শিবনাথ লক্ষ্য করল। সেই তুলনায় তার জামা কাপড় জুতো জোড়া মলিন অপরিচ্ছন্ন বৈকি। অত্যন্ত সতর্কভাবে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবং সেটা ঢাকতে শিবনাথ হেসে প্রশ্ন করল, ‘তা সেলুনের নাম ‘উর্বশী’ কেন, উর্বশীরা এখানে আসে নাকি?’

‘আসে আসে, স্যার।’ভাদুড়ীর সবগুলো নোংরা দাঁত দেখা গেল। ‘অপনি কি মনে করেন গড়পার ইলি শ্যামবাজার ভবানীপুরের উর্বশীরা কেবল সেলুনে ঢোকে। বেলেঘাটা টেংরা চিংড়িঘাটার উর্বশীদেরও এখন খেয়াল চাপছে সিঙ্গল করা মাথা না হ’লে তারা সেকেলে থেকে যাবে।’

শিবনাথ শব্দ করে হাসে!

‘মাটির ঘর টিনের ঘর ছেঁচা বাঁশের ঘরে থাকে এক একজন, মশাই, কিন্তু যখন হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে আঁচর দুলিয়ে সিঙ্গল করা মাথাটি টান ক’রে রাস্তায় হাঁটে আপনার সাধ্যি কি টের পান যে–’

শেষ টান দিয়ে ভাদুড়ী সিগারেটের জলন্ত টুকরোটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ভাদুড়ী ব্রাকেট থেকে তোয়ালে টেনে আনে। শিবনাথ একটু গম্ভীর হয়ে ওঠে। ‘বড় হবে স্যার, না কেবল ছোট?’

প্রশ্নটা হঠাৎ বুঝতে পারল না শিবনাথ। ফ্যালফ্যাল করে ভাদুড়ীর মুখের দিকে তাকায়।

‘বলছি চুল দাড়ি দুটোই হবে, না কেবল দাড়ি?’

বড় ও ছোটর অর্থ এতক্ষণে বুঝতে পেরে শিবনাথ মৃদু মন্দ হাসল। ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘না না, চুল ছাঁটতে সময় নেবে, আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে। কেবল দাড়িটা,–মুখটা ইয়ে করলেই এখনকার মত আজকের মত চলে।’

‘সোজা হয়ে বসুন।’ ব’লে গম্ভীর হয়ে তোয়ালেটা শিবনাথের বুকের ওপর বিছিয়ে দিয়ে ভাদুড়ী সাবান ব্রাশ রেজার আনতে আলমিরার কাছে সরে যায়। সেই ফাঁকে শিবনাথ জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাতটা তখনি আবার তুলে আনল। তারপর সতর্কভাবে একটা নিশ্বাস ফেলল।

‘মানুষই মানুষের বড় শত্রু বুঝলেন স্যার, তারপর সেই মানুষ যদি পাড়ায় থাকে কি এক বাড়ির বাসিন্দা হয় তো কথাই নেই।’শিবনাথের গালে সাবান মাখাতে মাখাতে ভাদুড়ী বলল, ‘হ্যাঁ, আমি কুকুরটার কথা বলছি! চোরাবাজারে ঘুরে পাঁচটা লোকের সর্বনাশ করে আজ তুই দুটো পয়সা করেছিস, তাই না লম্বা চওড়া কথা মুখে লেগেই আছে। আমি? সৎপথে থেকে এক পয়সা রোজগার করি দু’পয়সা রোজগার করি আফসোস নেই। লোকের গলায় ছুরি বসাইনে, কি বলেন?’

গালে ক্ষুর উঠেছে তাই শিবনাথ মুখ নাড়তে পারলে না, কেবল ‘হুঁ’ শব্দ করল।

‘কুত্তার বাচ্চা, আপনি শুনেছেন কি, আমার ওপর নোটিশ জারি করেছে, তার দোকানে ঢুকে চা খেতে পারব না।’

‘কেন?’ শিবনাথের মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে পড়ল।

‘আমার সিফিলিস আছে, আমি বেশ্যাবাড়ি যাই, পাঁচটা ভদ্রলোক তার রেস্টুরেন্টে চা খায়, কাজেই পাঁচু ভাদুড়ীর সেখানে ঢোকা নিষেধ। ‘

একটা গাল শেষ করে ভাদুড়ী শিবনাথের আর একটা গাল ধরল।

তা আমিও এর শোধ তুলব, হ্যাঁ তুই যে জলের কুমির আমিও সেই ডাঙ্গার বাঘ। আমার নামে বদনাম দিস শালা। কিন্তু দিনের নাগাল কি পাব না। আমার বড় ব্যামো আছে, কিন্তু তোর? আমি যদি বলি তোর শালা গণোরিয়া আছে। ওর ছোট ছেলেটাকে দেখছেন তো স্যার? আড়াই বছর বয়স হয়েছে, দেখলে মনে হয় ছ’মাস ন’মাসের বেশি হবে না। পাকাটির মত হাত পা শেখর ডাক্তার বলে দিয়েছে রমেশের বাচ্চার রিকেটি রোগ। তা রিকেটি তো এ বাড়ির আরো পাঁচটা ঘরের শিশুদের আছে মশাই, সে একটা কিছু না। রমেশের ছেলে জন্মান্ধ আপনি সে খোঁজ রাখেন?’

শিবনাথ হঠাৎ উত্তর দিতে পারল না। বাড়ির এতগুলো শিশুর মধ্যে একটি অন্ধ শিশু আছে কি না তাও সে এখন ঠিক মনে করতে পারছে না। হয়তো থাকবে। ভাল করে সে লক্ষ্য করেনি।

‘মশাই, ভাল জামা কাপড় পরে থাকলে কি হবে। পাপ ঢেকে রাখা যায় না। ঈশ্বর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। শেখর ডাক্তারের কাছ থেকে আমি আসল কথাটা বার করতে পারলাম না সেদিন, বললে না ও,আর ও শালা ডাক্তারির জানেই বা কি। চিংড়িঘাটার সুকুমার ডাক্তারকে চেনেন? চারটে টাইটেল আছে মশাই, আর কত বড় ডিস্পেন্সারী ওর মুন্সিবাজারে। হ্যাঁ, ওই সুকুমার ডাক্তারের কাছে চুপি চুপি গিয়েছিল রমেশ ছেলের চোখের চিকিৎসা করাতে। তা সুকুমারের কম্পাউন্ডার ললিত হ’ল গিয়ে আমার খদ্দের। ললিত সেদিন এই আপনার চেয়ারে বসে দাড়ি কামাতে কামাতে বলে গেল গুহ্য কথাখানা। সুকুমার ডাক্তার নাকি স্রেফ বলে দিয়েছে রমেশকে তার গণোরিয়া আছে, গণোরিয়া রোগীর ছেলে জন্মান্ধ হয়।’

ক্ষুরটা এতক্ষণ গালে লাগানো ছিল বলে শিবনাথ পাঁচুর মুখে দেখতে পারেনি। ক্ষুর আলগা হতে এবার মুখ তুলল। নোংরা দাঁত বার করে পাঁচু হাসছে।

‘পাপ কি আর ঢেকে রাখতে পারে কেউ, ও শালা আপনা থেকে বেরিয়ে পড়ে–হা-হা। ফরসা জামাকাপড় পরে থাকলে হবে কি?’

‘ফিটকিরি আছে কি?’ শিবনাথ হঠাৎ প্রশ্ন করল।

‘তা থাকবে না, বলেন কি স্যার।’ভাদুড়ী হাতের ক্ষুর রেখে দিয়ে এতবড় একটা ফিটকিরির চাকা তুলে শিবনাথের মুখে জোরে জোরে ঘষতে লাগল। ‘না, আমার এই সেলুনে আপনাদের কল্যাণে যত খদ্দের আসে সবাই ভদ্দরলোক, বাজে লোকের মুখে আমি ক্ষুর লাগাইনে। বলা যায় কি কোন্ হারামজাদার কি ব্যামো আছে। শালার যত সিফিলিস আর একজিমার রোগী এ তল্লাটে গিসগিস করছে মশাই। তবু সাবধানের মার নেই। ভদ্দরলোকদেরও ফরসা জামাকাপড়ের নিচে কি ব্যাধি লুকোনো আছে কে জানে। রমেশ শালার মত আরো দু দশজন থাকতে পারে বৈকি। আমি বাবা একবারের জায়গায় পাঁচবার তাই ক্ষুরখানা চামড়ায় ঘষে নিই, গরম জল দিয়ে ব্রাশ ধুই, একদিন অন্তর তুয়ালেগুলো ডাইংক্লিনিং থেকে সাফ করিয়ে আনি। আর এই দেখুন স্যার, কত ভাল স্নো আছে আমার সেলুনে। একটু স্নো দেব কি আপনার মুখে?’

হাতের ফিটকিরি রেখে ভাদুড়ী স্নো-র কৌটো তুলে আনে। কৌটোর গায়ের লেবেলটায় চোখ বুলিয়ে শিবনাথ সন্তুষ্ট হয়ে ঘাড় নাড়ল।

‘তাই বলি, তোর দোকানে চা খাব দূরে থাক আমি পেচ্ছাব করতেও যাব না সেখানে, বেলেঘাটা ট্যাংরা চিংড়িঘাটায় কি আর চায়ের দোকান নেই। আর আমি দেখে নেবো তুই কোন্ সেলুনে ঢুকে চুল কাটিস দাড়ি কামাস। আমি রাষ্ট্র করে দেব, এ তল্লাটের সবগুলো হাতুড়ে নাপিতকেও বলে দেব রমেশের গণোরিয়া আছে–’

‘হল?’ যেন এতক্ষণ পর শিবনাথ উসখুস করছিল। ‘আমাকে এক্ষুনি আবার একটা কাজে—’

‘হয়েছে, এই তো হয়ে গেল স্যার, চুলটা একটু ব্রাশ করে দিই। আপনার চুলও বেজায় বড় হয়েছে।’

শিবনাথ কথা বলল না। ভাদুড়ী স্নো-র কৌটো রেখে শিবনাথের চুলে ব্রাশ বুলোতে লাগল। শিবনাথ এবার ঘাড় সোজা করে দেয়ালের আরশিতে নিজের পরিচ্ছন্ন মুখ দেখে খুশি হ’ল।

‘হয়েছে স্যার।’ ভাদুড়ী হাতের ব্রাশ সরিয়ে রাখল।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শিবনাথ কি যেন বলতে ইতস্ততঃ করে।

‘কি. বলুন, আর কিছু বলবার আছে স্যার, কেন জুলপিজোড়া ঠিক করে কাটিনি?’ ভাদুড়ী ঈষৎ হেসে বলল, ‘চমৎকার দেখাচ্ছে মাইরি, কেন দেখাবে না, সুখী লোক আপনারা ভাল করে শেভ করলে মুখখানা ডিমের মত চকমকে হয়ে ওঠে!’

শিবনাথ অল্প হাসল এবং ইতস্ততঃ না ক’রে বলল, ‘দামটা আজ থাকবে, কাল আমি ইদিকে আবার যখন আসব–’

‘ছি ছি ছি!’ শিবনাথের কথা শেষ হতে দিলে না ভাদুড়ী। ‘আমি কি বলেছি আপনাকে, এখনি আমার পাওনা মিটিয়ে দেন। লজ্জা দেবেন না স্যার। এক বাড়িতে আছি, এক ইঁদারার জল খাই। যখন খুশি, যেদিন খুশি, আপনার সুবিধে মতন দিয়ে যাবেন। আপনিও কিছু রাতারাতি পালিয়ে যাচ্ছেন না, আমিও আর কালই মরে যাব না–হা-হা’

হৃষ্টচিত্তে শিবনাথ ‘উর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুন’ থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামল।

ভাল লাগছিল না শিবনাথের এখানকার লোকগুলোকে। যেন কি এক অদ্ভুত কথা তারা তার কানে তুলে দিতে সারাক্ষণ গলা বাড়িয়ে আছে, যেন অদ্ভুত দক্ষতায় সঙ্গে তারা তাকে জড়িয়ে ধরেছে, টেনে নিতে চাইছে নিজেদের মধ্যে, নিজেদের নোংরামি, কুশ্রীতা, বীভৎসতার গভীর পঙ্কে।

বনমালী, কে. গুপ্ত. বলাই, বিধু মাস্টার, রমেশ রায়, পাঁচু ভাদুড়ী।

প্রত্যেকটি চেহারা তার কাছে খারাপ লাগছে। যেভাবেই হোক, যে কারণেই হোক।

আর সেই জন্যেই শিবনাথ চাইছিল তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরতে। আজ আরো বেশি খারাপ লাগছে সকালে রুচির কথার পর

নৈহাটীতে দিদির কাছে চলে যাবে ও। যেন শিবনাথ এখানে পড়ে থাকবে এই টিনের ঘরে। পাঁচু ভাদুড়ী আর বলাই…আর–

জোরে পা চালাচ্ছিল শিবনাথ বাস্-স্ট্যান্ড লক্ষ্য ক’রে হঠাৎ তার ঘাড়ে কে হাত রাখল। থমকে দাঁড়াল সে। সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে শেখর ডাক্তার।

‘কোথায় চলেছেন?’

‘কোলকাতায় যাব।’

‘এখন? এই অবেলায়?

রাগে বিরক্তিতে শিবনাথ হঠাৎ এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। ডাক্তারের মুখে বিড়ি। গায়ে একটা আলপাকার কোট। জামার রঙটা এককালে কালো ছিল। ক্রমাগত রোদে পুড়ে এখন ধূসর হয়ে গেছে। পায়ে কাপড়ের জুতো। জুতোর রঙ লাল কি বাদামি ছিল, এখন বোঝা যায় না। ধুলো ও কাদার পুরু পলেস্তারা ভেদ করে জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া চটের মতন এক একটি অংশ উঁকিঝুঁকি মারছিল। হাতে এতবড় একটা ফাইবারের সুটকেশ। গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলছে।

শিবনাথ অন্য দিকে চোখ ফেরাতে চাইছিল, কিন্তু ডাক্তার তা হতে দিলে না।

‘মশাই আছেন সুখে। বাঁধা মাইনের চাকরি। তার ওপর ছুটিছাটা ভোগ করছেন। ক’দিনের ছুটি? এখন কোন কাজে যাচ্ছেন শহরে, না সিনেমা-টিনেমা দেখবার ইচ্ছে?’

‘এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করব।’ গম্ভীর হয়ে বলল শিবনাথ এবং জোর ক’রে চোখটা অন্য দিকে সরাতে চেষ্টা করল।

‘গিন্নী গ্র্যাজুয়েট, তিনিও চাকরি করছেন। একটিমাত্র সন্তান। সত্যি আপনাকে দেখলে ঈর্ষ হয়।’

কথা বলল না শিবনাথ, কিন্তু বুঝল পাল্টা একটা দুটো প্রশ্ন না করেও সে সেখান থেকে নড়তে পারবে না। তাই অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করল : ‘তারপর, কি খবর, কোথায় যাওয়া হয়েছিল ডাক্তারবাবুর?’

‘পাগলাডাঙার ওধারে, একটা কলেরা কেস; বাঁচতেও পারে না-ও বাঁচতে পারে, কিন্তু আমি বার বার বলে এসেছি এ-অবস্থায় সেলাইন ইঞ্জেকশন চলবে না।

শিবনাথ আকাশের দিকে তাকাল।

‘এখনও ছিটে-ফোঁটা রকমের হচ্ছে, পাইকারীভাবে আরম্ভ হয়নি।’ আর একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে ডাক্তার বলল, ‘জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি থেকে শুরু হবে, জেনারেলি তা-ই হয়,–জলটা তখন পচতে আরম্ভ করে, মাছে পোকা হয়, কপিতে পোকা, বেগুনে পোকা,–খারাপ জল আর যাচ্ছেতাই খাদ্য থেকে এসব অসুখের সৃষ্টি, আপনারা শিক্ষিত মানুষ জানেন স্যার।’

কর্পোরেশন থেকে কলেরা ভ্যাকসিন দেবার ব্যবস্থা নেই এসব অঞ্চলে?’ শিবনাথ ডাক্তারের চোখের ভিতরে তাকায়।

‘কেন থাকবে না, খুব আছে,–~তা আপনারা যতই ভ্যাকসিনের গুণকীর্তন করুন মশাই, আমরা হোমিওপ্যাথরা এসবের ওপর একটু কম আস্থা রাখি। কেন, টিকা নেবার পর কলেরা হয়েছে এরকম ক’টা কেস আপনি জানতে চান। আর, এত বড় একটা ছুঁচ বিঁধিয়ে পোয়াটেক জল শরীরে ঢুকিয়ে তিনদিন বেদনায় হৈ-হৈ করে কাটাবার মতন অবসর আমার আপনার হয়তো আছে মশাই,–কিন্তু যাদের মোট বইতে হয়, ঠেলাগাড়ি ঠেলতে হয়, রিকশা টানতে হয়, করাত দিয়ে কাঠ চিরতে হয়, কপি ক্ষেতের মাটির চাকা ভাঙতে হয়, জাল টেনে মাছ ধরতে হয়, তামা-কাঁসা পিটতে হয় তাদের,–তারা কাজ করতে পারবে না ভয়ে পারতপক্ষে কলেরার ইঞ্জেকশন নিতে চায় না, কাজেই–’

‘আপনার রোগী বেশির ভাগ এরাই বুঝি?’

যেন শিবনাথের প্রশ্নে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ আছে ধরে নিয়ে ডাক্তার চড়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার–এখন এরাই আমার রোগী। ভদ্দরলোকদের চিকিচ্ছে করা আমি বন্ধ করে দিয়েছি, ভদ্দরলোকের চেয়ে জেলে ছুতোর কামার কুমোর ভাল, ক্যান্ ইউ বিলিভ, স্যার, এই চিংড়িঘাটা বেলেঘাটায় আমার দেড় হাজার টাকার ওপর ওষুধের দামই পাওনা পড়ে আছে, হ্যাঁ, আপনার আমার মতন জেন্টেলম্যানরা খেয়েছেন, তাদের পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চার অসুখ হলে ওষুধ নিয়ে যেয়ে খাইয়েছে।’

শিবনাথ কথা বলল না।

‘সাধে কি আর মশাই এখান থেকে নড়ছি না। আমি নড়তে পারছি না। আমার ধরে রেখেছেন আপনারা, অবশ্য আপনাকে আমি ঠিক মিন্ করছি না, এই আপনার মতন দি সো- কল্ড ভদ্দরলোক ক্লাস।’ কথা শেষ করে ডাক্তার হাসল এবং একটু থেমে থেকে পরে বলল, ‘কিন্তু আমিও দেখে নোব, বকেয়া ওষুধের দাম, প্রেসক্রিপশনের ফি, ভিজিটের টাকা কি ক’রে আদায় করতে হয়, ‘

‘এটা অন্যায়, ডাক্তারের টাকা এভাবে ধরে রাখা’–সৌজন্যতার খাতিরে শিবনাথকে বলতে হ’ল, ‘ঠিক না।’

‘রাখুক, আমি এখন শব্দ করছি না।’ ঘাড় নেড়ে স্টেথস্কোপ দুলিয়ে শেখর ডাক্তার বলল, ‘মশাই, এক মাঘে শীত যায় না–ফট্টি নাইন ফাঁক গেছে, ফিফটিতে কিছু হয়নি, কিন্তু এবার? হেঁ―হেঁ—থার্ডইয়ার—’

কথাটা বুঝতে না পেরে শিবনাথ ফ্যালফ্যাল্ ক’রে ডাক্তারের মুখের দিকে তাকায়।

দু’টো বছর আমরা চোখমুখ বুজে থাকি। তারপর তিন বছরের মাথায় আবার শুরু হয় এপিডেমিক। ও শালার ভ্যাকসিন্ ফ্যাসিন কিছুতেই আটকাতে পারে না। নেচার, নেচারকে কে ঠেকাতে পারে মশাই, বলুন! আর রোগ বাড়লে রোগী বাড়লে আমাদের সুবিধে বোঝেনই তো।’

‘এটা বুঝি কলেরা ইয়ার?’ বিড় বিড় করে শিবনাথ প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, জানেন তো দেখছি, কাজেই–’ অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে শেখর ডাক্তার, যেন অনেকটা নিজের মনে কথা বলল এবং দাঁতে দাঁত ঘষল, ‘কাজেই আমিও এবার সব চাঁদকে দেখে নোব–’

কাঠ-বোঝাই একটা লরি আসছিল। দুজন রাস্তার এক পাশে সরে দাঁড়ায়। আবার একটা ধুলোর ঘূর্ণি ওঠে। শিবনাথ নাকে রুমাল দেয়। শেখর ডাক্তার রুমাল দেয়া দূরে থাক মুখের হাঁ-টাকে যেন আরো বড় করে ধুলোর দিকে মেলে ধরে কি ভাবে।

‘আচ্ছা, চলি, আমার একটু–’

শিবনাথ পা বাড়াতে চেষ্টা করতে ডাক্তার খপ্ ক’রে তার হাত চেপে ধরল।’

‘না, না, শুনুন, বেড়াতে বেরোচ্ছেন তো অত তাড়া কি,–আরও কথা আছে, আর একটা কথা বলব বলে আমি আপনাকে ক’দিন ধ’রে মনে মনে খুঁজছি।’

‘আমি তো বাড়িতেই আছি।’ বলতে চেষ্টা করেও শিবনাথ বলল না, চুপ ক’রে রইল। বড় অস্বস্তি বোধ করছিল সে।

শেখর ডাক্তার আর এক পা সরে এসে শিবনাথের শরীর ঘেঁষে দাঁড়াল এবং বলাইয়ের মত রমেশ রায়ের মত বিধু মাস্টার ও পাঁচু ভাদুড়ীর মত মুখটা শিবনাথের কানের মধ্যে ঢোকাতে চেষ্টা ক’রে বলল, ‘বিধু আমার ফ্রেন্ড; একসঙ্গে ওঠা-বসা গল্প করা সবই হচ্ছে, আপনারাও দেখছেন, কিন্তু উঃ কী জঘন্য ওর চরিত্র, মশাই বললে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।

শিবনাথ নীরব। মুখটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল।

‘অ্যাঁ, আজ বলে আট আনা ধার দাও, কাল বলে একটা টাকা চাই, পরুশু পাঁচ সিকে দরকার–কিন্তু ফিরিয়ে দেবার নামটি নেই; আমি স্টপ করে দিয়েছি ওকে ধার দেওয়া। আর সেই রাগে সেই খেদে ও কি না আমার নামে এর-ওর কাছে দুর্নাম গেয়ে বেড়াচ্ছে।’

ডাক্তার সম্পর্কে সেদিন বিধুমাস্টার কি সব উক্তি করেছিল শিবনাথের মনে আছে। কিছু বলল না সে। চুপ ক’রে রইল।

আমার চিকিচ্ছের পদ্ধতি ভাল না, আমার ওষুধে কারও কোন কাজ হয় না, আমি কলেরা ডিসেন্ট্রির কেসগুলো খামকা হাতে নিই, আমার হাতে রোগী বাঁচে না, কেবল এই সব, এ- ধরনের কথাবার্তা ফাঁক পেলেই ও এখন লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে অথচ বাইরের লোকে জানে,–বাড়ির লোক আপনারাও দেখেছেন, আমার চেয়ে মাস্টারের বড় ফ্রেন্ড কেউ নেই, ছিল না এবং ভবিষ্যতেও হবে না।’

‘ভালই তো’ শিবনাথ ডাক্তারকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করল, ভবিষ্যতে মাস্টারের পরিবারের কারো যদি একটা কিছু অসুখ-বিসুখ হয় তখন আপনাকে ডাকলে,আপনি–তা ছাড়া এটা যখন এপিডেমিক ইয়ার–’ শিবনাথ এবার অল্প হাসতে চেষ্টা করল।

‘অ, আপনি আমাকে সেই আশায় থাকতে বলছেন,–তবেই হয়েছে।’ ডাক্তারও প্রচণ্ড শব্দ ক’রে হেসে উঠল। ‘মশাই, চারবার পক্স ছ’বার কলেরা এপিডেমিক হয়ে গেল এ- তল্লাটে। উহুঁ, ওই বিধু মাস্টারের ঝাঁক ঠিক আছে, একদিন একটাকে কলেরা দূরে থাক পেটের অসুখে ভুগতে দেখি না, পক্স হবে কি, খোস-পাঁচড়াটি হবার নাম নেই কারও মাস্টারের ঘরে।’

শিবনাথ এবারও না হেসে পারল না।

‘কেন, ওদের সকলের স্বাস্থ্য খুব ভাল বুঝি?’

‘আপনি তা বলতে পারেন, কিন্তু আমি একে বলি চাষাড়ে স্বাস্থ্য’। শেখর ডাক্তার মাথা নাড়ল। ভদ্দরলোকের ঘরে আবার অসুখবিসুখ থাকে না নাকি। কিন্তু এখানে আপনি তা পাবেন না। বিধুর কোন দিন মাথা ধরতে দেখি না মশাই, তেমনি তাঁর স্ত্রী। একবেলা দাঁতের কনকনানিতে ভুগছে আজ অবধি শুনলাম না। আর তেমনি হয়েছে ছেলেমেয়েগুলো,–খাচ্ছে তো স্রেফ মুলো আর ভেণ্ডি সেদ্ধ। শীতে মুলো বর্ষায় ভেণ্ডি।’ একটু থেমে থেকে পর ডাক্তার বলল, ‘অভাব অভাব করছে, তা অভাব ওর কী ক’রে যাবে। এত পরিবারের এত ছেলেমেয়ে এই সেই ব্যারামে ব্যারামে মরে, কিন্তু বিধুর ঝাঁক বাড়ছে ছাড়া কমছে না।’ বলতে বলতে মুখটা হঠাৎ শিবনাথের কানের ভিতর ঢোকাবার চেষ্টা ক’রে ডাক্তার ফিফিস করে উঠল : ‘অ্যানাদার ওয়ান্ ইজ কামিং। মূর্খ, মূর্খ ছাড়া বিধুঁকে আমি আর কিছু বলি না। মশাই, বিজ্ঞানের যুগে এত ভাল ভাল ব্যবস্থা থাকতে আবার এসব কেন? বেশ তো আমায় বল্, আমি এক ডোজ ওষুধ দিই তোর পরিবারকে, দেখি কেমন, কিন্তু, কাকে বলব মশাই, চোরের কাছে হরিনাম।’ ডাক্তারের হাসির শব্দে কানে তালা লাগে। শিবনাথ লক্ষ্য করল এখন আর ঘূর্ণি হাওয়া নেই, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। অদূরে বাদামগাছের পাতাগুলো কাঁপছে, সূর্য হেলে পড়েছে অনেকখানি।

‘আচ্ছা, চলি।’শিবনাথ আবার পা বাড়ায়। ডাক্তার এবার তার হাত ধরে না। কেবল ঘাড়টা ঘুরিয়ে টেনে টেনে হাসে। ‘যাবেনই তো মশাই, আমি যাব আপনি যাবেন, সবাই যাবে, কেউ থাকতে আসিনি হা-হা, থেকে যাবে শুধু বিধু আর বিধুর ঝাঁক। জল আগুন মড়ক দুর্ভিক্ষ কিছুতেই ওদের কিছু করতে পারে না, কেবল বাড়ছেই বাড়ছে।’

শিবনাথ কিছু শুনল কিছু শুনল না, দ্রুত পা চালিয়ে বাস-স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *