১০. শিখার অগ্নি-পরীক্ষা

শিখার অগ্নি-পরীক্ষা

এক – পরিচয়

বেলা আটটা বাজে—মুখ—হাত ধুয়ে শিখা এসে বসেছে দোতলায় তার পড়ার ঘরে—টেবিলে রতন রেখে গিয়েছে চায়ের পেয়ালা আর এক প্লেট হালুয়া। খেতে খেতে শিখা খবরের কাগজ পড়ছে…হঠাৎ ফোন বাজলো!

উঠে রিসিভার তুলে শিখা বললে—”হ্যালো—”

জবাব এলো—”কে? শিখা? আমি অসীমা। কি করছিস?”

শিখার মামাতো বোন অসীমা…সে থাকে মাণিকতলা ষ্ট্রীটে—হেদুয়ার কাছে।

শিখা বললে—”কেন? হঠাৎ সকালে উঠে আমার খোঁজ কেন?”

”দরকার আছে!” অসীমা দিলে জবাব, বললে—”ব্যস্ত আছিস?”

”না। কি খবর বলো, শুনি? তোমার বিয়ে নাকি?”

”ধেৎ!…ঠাট্টা—তামাসা নয়…বিপদ!”

”বিপদ! কারো অসুখ?”

”না, না।” অসীমা বললে—”সেই রাগিণীকে মনে আছে? রাগিণী গাঙ্গুলী। মাণিকতলার পুল পার হয়ে বাগমারীতে বাড়ী…আমার বন্ধু…সেই যাদের বাড়ীর ছাদে ষ্টেজ বেঁধে আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্লে করেছিলুম…শ্রীপতি গাঙ্গুলীর ভাইঝি। বিগ—মার্চেণ্ট শ্রীপতি গাঙ্গুলী। মনে আছে?”

শিখা বললে—”মনে আছে। তা এটুকু বলেই থামলে কেন? বলে যাও…যে রকম বর্ণনা সুরু করেছো, আমি ভাবছিলুম, সাতকাণ্ড রামায়ণ বলবে, না, অষ্টাদশ পর্ব্ব মহাভারত!”

বাধা দিয়ে অসীমা বললে—”শোন, সেই রাগিণীর বাড়ীতে বিপদ…তার কাকা শ্রীপতিবাবু খুন হয়েছেন। বাড়ীতে পুলিশ। রাগিণী এসে আমাকে ধরেছে…বলে, তোমার বোন শিখা রায়—তার সঙ্গে পুলিশের খুব জানাশোনা আছে—তাকে চাই। পুলিশকে তার ভারী ভয়। যদি অপমান—টপমান করে!”

শিখা বলে—”তা আমাকে কি করতে হবে?”

অসীমা জবাব দিলে—”ফোনে কথা হয় না। রাগিণীর সঙ্গে আমি এখনি যাচ্ছি তোর কাছে। সব শুনে যা করবার, তোকে করতে হবে!”

শিখা বললে—”এসো। দেরী করো না।”

জবাব এলো—”না। রাগিণীর মোটর আছে। সে নিজে ড্রাইভ করে। তার মোটরে করে এখনি আমরা যাচ্ছি।”

আধঘণ্টা…রাগিণীকে নিয়ে অসীমা এলো। দু’জনকে এনে শিখা বসালো দোতলার পড়ার ঘরে।

অসীমা বললে—”পিসীমাকে বলেছিস নাকি, আমি আসছি?”

শিখা বললে—”না। মা স্নান করতে গেছে!”

”তোর রতন গিয়ে না বলে!”

”বললোই বা! মার সঙ্গে পরে দেখা করো’খন। এখন বলো—ব্যাপার শুনি।”

অসীমা তাকালো রাগিণীর দিকে, বললে—”বলো ভাই রাগিণী…সব কথা গোড়া থেকে। সব শুনলে তবে তো শিখা বুঝবে, কি ব্যাপার।”

রাগিণী একটা নিশ্বাস ফেললো—বেশ বড় নিশ্বাস। নিশ্বাস ফেলে রাগিণী বললে শিখার দিকে চেয়ে—”আমাদের বাড়ীটা আপনার মনে আছে?”

শিখা বললে—”ফটক, কম্পাউণ্ড, বাগান মনে আছে আর গাড়ীবারান্দা থেকে উঠে সেই বড় হল—যেখানে বসে ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্লে—র রাত্রে খেয়েছিলুম। অন্য ঘর—টর তো আর দেখিনি সে রাত্রে। তা যাক, আগে সব কথা শুনি। আপনি বলুন।”

রাগিণী তাকালো অসীমার দিকে…শিখা একাগ্রদৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাগিণীর দিকে। রাগিণী বেশ সুশ্রী…তবে সে সৌখীন সমাজের লবঙ্গলতা—কিশোরীদের মত নয়…কথায়—বার্ত্তায় চালচলনে সেই পুতুলের মত ভাব—গায়ে হাওয়া লাগলে যেন উড়ে যাবে—আধো—আধো ন্যাকাসুরে কথা কওয়া—তেমন নয় মোটে। দেহ হালকা। কিশোরী হলেও গড়ন বেশ বলিষ্ঠ—মুখে—চোখে দম্ভের ভাব। তাকে দেখলে মনে হয়, নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস তার খুব।

রাগিণী অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর অসীমাকে উদ্দেশ করে বললে—”তুমি গোড়ার ঘটনা বলো ভাই—আমাদের সংসারের কথা—বাবার ব্যবস্থার কথা।”

অসীমা বললে—”বেশ। শোন শিখা, বলি। শ্রীপতিবাবু হলেন রাগিণীর কাকা। ওর বাবা সুরপতিবাবু মারা গেছেন প্রায় তিন বছর হলো—মা আগে মারা গেছেন…বাবা মারা যাবার এক বছর আগে। ভাই—বোন নেই। শ্রীপতিবাবু বিয়ে করেন নি। ওঁরা দু’ ভাই একসঙ্গে থাকতেন—দু’ ভাইয়ে ভাব ছিল খুব। রাগিণী বাড়ীর এক সন্তান…সকলের আদরে—আদরে—তা সত্য কথাই বলছি—ও হয়েছে ভারী একরোখা, যা ধরবে, করবেই—কারো মানা মানে না। ওর বাবা শেষটায় ওর ওপরে বেশ কড়া হয়েছিলেন, কিন্তু তাতে মেয়েকে বশে আনতে পারেন নি। কাকাও বেশ কড়া মানুষ—আর ওঁরা কতক বিষয়ে একটু সেকেলে ধরণের। মেয়েকে স্বাধীনতা দিলেও তার একটা সীমা ওঁরা মেনে চলতে বলেন, কিন্তু রাগিণী তা মানে নি কখনো। মোটর হাঁকাবার সখ হলো—চালালো, নিজে লাইসেন্স নিয়ে—তাতে কাকা কোনো আপত্তি করেন নি। কিন্তু…”

এই পর্য্যন্ত বলে অসীমা থামলো—থেমে রাগিণীর দিকে চেয়ে বললে—”এরপর তুমি বলো রাগিণী।”

একটা নিশ্বাস ফেলে রাগিণী বললে—”আমার মেজাজ ভারী খারাপ। আছি তো বেশ আছি কিন্তু কোনো কারণে যদি মেজাজ একটু বেগড়ায়, তাহলে আগুনের মত জ্বলে উঠি একেবারে—আর তখন সত্যি—আমি সব করতে পারি যেন! কিন্তু সে—কথা থাক! কাকাবাবুর সঙ্গে ইদানীং আমার খুব মন—কষাকষি চলছিল। অসীমা যা বলেছে, আমার মেজাজ খারাপ। আমি একরোখা,—আমি জানি। তাছাড়া আমি ভয়ানক উড়নচণ্ডী। …টাকাকে টাকা বলে মনে করি না। ছেলেবেলা থেকে যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। বারো—তেরো বছর বয়স থেকে বাবা আমাকে হাত—খরচের জন্য দিতেন একশো করে টাকা—সে টাকা আমি যেমন খুশী খরচ করতুম। তার কৈফিয়ৎ দিতে হতো না কখনো। টাকা যেদিন পেতুম, তার পাঁচ—ছ’ দিনের মধ্যে খরচ হয়ে যেতো। যা তা জিনিষ কেনা! খেয়াল হলো—একঝাঁক পাখী কিনলুম, নয়তো কুকুর কিনলুম, ছবি কিনলুম। তাছাড়া কেউ যদি টাকা চাইতো, হাতে থাকলে আমি তাকে দিতুম। মা খুব রাগ করতেন, বাবাকে বলতেন—কি স্বভাব করে দিচ্ছ মেয়েটার। এমন উড়নচণ্ডী হলে, মা লক্ষ্মীকেও লক্ষ্মীছাড়া হতে হয়। বাবা হাসতেন, বলতেন—টাকা খরচ করতে পারা ভালো—তাতে মন দরাজ হয়। লোকের দুঃখ—কষ্ট ঘোচাতে পারবে। আসলে টাকার উপর মায়া হ’লে মানুষ শুধু কৃপণ হয় না—স্বার্থপর হয়, ইতর হয়। কিন্তু মা মারা যাবার পর বাবা দেখলেন, আমার উড়নচণ্ডী স্বভাব বেড়ে চললো। শুধু তাই নয়…মা মারা গেলে বাবা আমার বিয়ের সম্বন্ধ করেন ইউনিভার্সিটির রত্ন ঐ সুবিনয় ঘোষালের সঙ্গে। এম—এ—ইংলিশে ফার্ষ্ট ক্লাশ ফার্ষ্ট। অবস্থা ভালো নয়। বাবা বললেন—আমাদের কাছে জামাই থাকবে—কারবার করবে। আমি বেঁকে বসলুম—না, কখনো না। বাবার রাগ হলো। বাবা বললেন, বিয়ে করতেই হবে। আমি বললুম, তোমার রিভলভার আছে—তাহলে সেই রিভলভারের একটি গুলিতে আমি সাফ হয়ে যাবো! বাবা তখন আর কিছু বললেন না—কিন্তু তাঁর সম্পত্তির ব্যবস্থা করলেন। কাকাবাবুকে ট্রাষ্টী করে তাতে সর্ত্ত রইলো, কাকাবাবুর অমতে যদি বিয়ে করি, তাহলে কাকাবাবু আমাকে ও সম্পত্তিতে বঞ্চিত করে কোনো চ্যারিটীতে সব দেবেন। তবে মাসে মাসে আমি হাত—খরচের জন্য পাবো—বাবা মারা গেলে পাঁচশো করে টাকা! এমনি চলে আসছিল। কিন্তু…”

রাগিণী থামলো; থেমে অসীমার পানে তাকালো।

অসীমা বললে—”তারপর বছরখানেক আগে ওর ভারী ভালো লাগলো শচীন মিত্তিরকে। স্কটিশে একসঙ্গে দুজনে পড়তো। শচীন মিত্তিরের চেহারা ভালো, চমৎকার গান গায়। তার কাছে গান শেখার ব্যবস্থা হলো। শচীনের বাড়িতে গান শেখার ক্লাশ… সেই ক্লাশে আসা। শচীনকে তার জন্য দিত মাসে দুশো করে টাকা মাহিনা। এই থেকে দুজনে হলো লভ…রাগিণী চায় তাকে বিয়ে করতে। কাকাবাবুকে এ—কথা বলতে তিনি ক্ষেপে উঠলেন, বললেন—ব্রাহ্মণের মেয়ে বিয়ে করবে কায়েতের ঘরে? নেভার! রাগিণী বললে—নিশ্চয়, শচীন মিত্তিরকে ছাড়া আর কাকেও বিয়ে করবে না! এই নিয়ে দুজনে খুব মন—কষাকষি। কাকাবাবু মাসহারা বন্ধ করে দিয়েছেন আজ চার মাস। রাগিণী কাল ওর কাকাবাবুর সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করে এই বিয়ে নিয়ে, বলে—এক পয়সা সে চায় না…বিয়ে সে করবেই। কাকাবাবু তখন তাঁর বেয়ারাকে ডেকে বললেন—ঘরে চাবি বন্ধ করে রাখ! চাকর তা পারে কখনো? রাগিণী রেগে বাড়ী থেকে বেরোয়…তখন প্রায় নটা…গ্যারেজ থেকে মোটর নিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর এখানে—ওখানে ঘুরে বাড়ী ফেরে রাত প্রায় বারোটায়—ফিরে দেখে, বাড়ীতে হুলস্থূল ব্যাপার! কাকাবাবু খুন হয়েছেন। কে তাঁর মাথায় লাঠি মেরেছে—এমন যে তাতেই মাথা ফেটে তাঁর মৃত্যু! শুনে রাগিণী প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে! রাত্রে আর জ্ঞান হয়নি, সকালে জ্ঞান হতেই দেখে, কাকাবাবু নেই! পাগলের মতো আমার কাছে এসেছে। বাড়ীতে পুলিশ একেবারে গিসগিস করছে। এখনি তোমাকে যেতে হবে ওদের ওখানে। খুনী সন্দেহ করে পুলিশ নাকি কাকাবাবুর খানসামা বেহারীকে গ্রেফতার করেছে। রাগিণী বলে, বেহারী এ—কাজ করে নি—সে করতে পারে না! তাকে কেউ লক্ষ টাকা দিলেও সে কখনো এ—খুন করবে না।”

দুই – কুজ্ঝটিকা

বাগমারীতে শ্রীপতি গাঙ্গুলীর মস্ত বাড়ী…বাগান। রাগিণী আর অসীমা মাণিকতলা ষ্ট্রীটে অসীমার বাড়ীতে নামলো—শিখা একা এলো বাগমারীতে ট্যাক্সিতে করে। এসে দেখে, মস্ত কম্পাউণ্ড…লাল—পাগড়ী কনষ্টেবলে ভরে আছে। পুলিশের তিনখানা জীপ…একখানা ট্রাক…মাণিকতলা থানার ইনস্পেক্টর বীরেন্দ্রবাবু শিখাকে দেখে তার কাছে এগিয়ে এসে বললেন—”শিখা দেবী যে! আপনি হঠাৎ!”

চেয়ে শিখা দেখে বীরেন্দ্রবাবুর পিছনে যতীন্দ্রনাথ…অবনীশও রয়েছেন। যতীন্দ্রনাথ বললেন—”খবরের কাগজে এখনো এ খবর ছেপে বেরোয় নি, আপনি কোথা থেকে এ—খবর পেলেন?”

শিখা বললে—”পেয়েছি। শুধু পাওয়া নয়—এ ব্যাপারে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই—যাতে আসল তথ্য জানা যায়!”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কার জন্য আপনি…? নিশ্চয় কেউ এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য প্রার্থনা করেছে। এসে আমি যা শুনছি, তাতে আপনার কথা আমারও মনে হয়েছে। পারিবারিক ব্যাপার…এর মধ্যে বেশ কিছু জটিল রহস্য আছে, তাই। তা কথায় বলে, মেঘ না চাইতে জল! আপনি নিজে থেকেই যখন এসেছেন, আমার চক্ষুলজ্জা কাটলো।”

”কি ব্যাপার যতীনবাবু?’ শিখা করলে প্রশ্ন।

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”ভিতরে আসুন। বীরেন ততক্ষণ চাকর—বাকরদের জবানবন্দী নেওয়া শেষ করুক।”

এ—কথা বলে শিখাকে নিয়ে যতীন্দ্রনাথ এলেন বসবার ঘরে…অবনীশও এলেন সঙ্গে।

এ—ঘরে দু—তিনজন ভদ্রলোক—তাঁদের মধ্যে একজনের বয়স হয়েছে—বেশ বনিয়াদী—ধরণের চেহারা, বেশভূষায় বনিয়াদী ছাপ। যতীন্দ্রনাথ পরিচয় করিয়ে দিলেন—”ইনি হলেন শ্রীপতিবাবুর পার্টনার আর অতি অন্তরঙ্গ বন্ধু মনোহর চাটুয্যে। আর এ মেয়েটি হলেন কুমারী অগ্নিশিখা রায়…প্রাইভেট ডিটেকটিভ। শিখা রায়ের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?”

”মেয়ে—পুলিশ!” মনোহর চাটুয্যে মন্তব্য করলেন।

”না, পুলিশ নন! পুলিশে চাকরি করেন না। নানা কেসে নিজে থেকে আমাদের অনেক সাহায্য করেন। সাহায্য বলি কেন—বহু কেসে ইনিই করেছেন সত্য নির্ণয়। ক্রিমিনলজি সম্বন্ধে এঁর ষ্টাডি বেশ এবং যেমন বুদ্ধি, তেমনি আশ্চর্য্য ভাবে যুক্তি অনুমানে নির্ভর ক’রে কঠিন কেসের মীমাংসা করতে পারেন।”

মনোহরবাবু একাগ্রমনে যতীন্দ্রনাথের কথা শুনলেন—তাঁর দু’চোখের দৃষ্টি শিখার মুখের উপর নিবদ্ধ। লজ্জায় শিখার মুখ—চোখ রাঙা হয়ে উঠলো। সঙ্কোচভরে শিখা বললে—”এসব কথা থাক যতীনবাবু। ব্যাপারটা যদি বলেন—জানবার জন্য আমি অধীর হয়ে আছি।”

মনোহরবাবু বললেন—”আমি বলছি মা…শোনো।”

মনোহরবাবু যে—কথা বললেন, তার মর্ম্ম : ”খুড়া—ভাইঝির মধ্যে মাস কয়েক ধরে রীতিমত মনান্তর চলেছে এবং সে মনান্তরের ফলে দুজনে ক’দিন বাক্যালাপ পর্য্যন্ত বন্ধ ছিল—এ—কথা তিনি শুনেছেন। এ ছাড়া মনোহরবাবু বললেন—কাল রাত্রে শ্রীপতিবাবু তাঁর অফিস কামরায় বসে কাজ করছিলেন, রাগিণী এসে দেখা করে বলে—তার বাপের টাকা সে চায় বুঝে নিতে। বলে, এ বাড়ীতে সে থাকবে না—শচীনকে বিয়ে সে করবেই। কাকাবাবু যদি তাকে এক পয়সাও না দেন, তবু…তবু বিয়ে করবে। শ্রীপতিবাবু গর্জ্জন করে ওঠেন…বলেন—এ বিয়ে তিনি হতে দেবেন না—পুলিশ দিয়ে শচীনকে তিনি গ্রেফতার করাবেন। রাগিণী ভয়ানক বদরাগী…এ কথায় সে যেন ক্ষেপে ওঠে! ক্ষেপে সে বলে—বাড়ী থেকে সে চলে যাচ্ছে, গঙ্গায় ডুবে, না—হয় চলন্ত মোটর কি ট্রেনের চাকায় পড়ে মরবে তবু এ জুলুম সে সহ্য করবে না। এ—কথা বলে সে বেরিয়ে যায়। শ্রীপতি তখন আমাকে ফোনে বলেন—তিনি উইল করবেন। আমাকে আসতে বলেন। ফোনের এ আহ্বানে আমি বিলম্ব না করে তখনি এখানে আসি। আমি এসেছিলাম বংশীবাবুর মোটরে…বংশীবাবু কলকাতার একজন অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট—তিনি তখন বিশেষ কাজে আমার কাছে এসেছিলেন। এ বাড়ীতে যখন এসে হাজির হই বংশীবাবুও তখন আমার সঙ্গে ছিলেন। তবে তিনি বাড়ীর ভিতরে ঢোকেন নি। মোটরেই বসে ছিলেন; শ্রীপতিবাবুর সঙ্গে দেখা হতে তিনি বলেন রাগিণীর বৃত্তান্ত; বলেন, তিনি সম্পত্তির ব্যবস্থা করতে চান সেই রাত্রেই। পার্টনারশিপ কারবারের কখানা খাতা তিনি আনতে বলেন তাঁর সেক্রেটারী কুমারেশকে…সেগুলো আমার মোটরে তুলে দিতে বলেন। আরো বলেন, কুমারেশ যেন আমার সঙ্গে আমার ওখানে যায়—গিয়ে বসে থাকবে—শ্রীপতিবাবুও আধঘণ্টার মধ্যে তাঁর নিজের মোটরে করে আসবেন আমার ওখানে। কথামত আমি আর কুমারেশ এসে উঠি বংশীবাবুর মোটরে…মোটর তখন তাঁদের নিয়ে বেরোয়। ফটক পার হয়ে পথে খানিকটা আসবার পর কুমারেশ চীৎকার করে ওঠে—গাড়ী থামান! গাড়ী থামানো হলো। কুমারেশ বলে, বাড়ীর দিকে সে চেয়েছিল, গাড়ীতে বসে শ্রীপতিবাবুর বসবার ঘর দেখা যায়—কুমারেশ বলে, শ্রীপতিবাবুর ঘরে আলো জ্বলছে…সে স্পষ্ট দেখেছে কে একজন মানুষ লাঠি হাঁকড়েছে শ্রীপতিবাবুর মাথায়—সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো গেছে নিবে!

এ—কথা শুনে তখনি গাড়ী ফিরিয়ে আনা হলো বাড়ীতে। গাড়ীবারান্দায় গাড়ী রাখবার আগেই কুমারেশ মোটর থেকে নেমে ওপরে ছোটে…আমরাও নেমে উপরে গেলুম! গিয়ে দেখি, ঘরে আলো জ্বলছে, আর ঘরে বড় ডেস্কের ধারে পড়ে আছে শ্রীপতির দেহ…মাথা ফাটা…জামার পকেট উলটানো—তাঁর বড় ব্যাগটা মেঝেয় পড়ে আছে। তখনি আমি মাণিকতলা থানায় ফোন করলুম। তারপর ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে চোখে পড়ে পাশের ঘরের একদিককার খড়খড়ি খোলা। নীচে নেমে এসে দেখি, খোলা খড়খড়ির নীচে মাটিতে পায়ের দাগ—খড়খড়ি দিয়ে ঝাঁপ খেয়ে কোনো মানুষ নীচে পড়েছে, বেশ বোঝা গেল। বড় পায়ের দাগ…পা নয়, জুতো…মোটা পায়ের জুতোর দাগ…ঘরে একটা লাঠি পড়ে আছে—মোটা লাঠি—মাথাটা রূপো বাঁধানো…জুতোর দাগ দেখে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে বেহারীকে!”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”পুলিশ এসে আপনাকে রাগিণী দেবীর কথা কিছু বলেছিল?”

মনোহরবাবু বললেন—”হ্যাঁ, পুলিশ এসে বলে, রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা—মানে, আমরা শ্রীপতিবাবুর ওখানে যাবার আগে—শ্রীপতিবাবু ফোন করেছিলেন মাণিকতলা থানায় যে, তাঁর ভক্সল গাড়ীখানা চুরি গেছে গ্যারেজ থেকে। বলেন, তাঁর ভাইঝি রাগিণী দেবী গাড়ী নিয়ে গেছে…পুলিশ যেন সে গাড়ী পাকড়াও করে আর তাঁর ভাইঝি রাগিণী দেবীকেও গ্রেফতার করে। আমরা আসতে শ্রীপতিবাবু আমাকে এ—কথা বলেছিলেন, আর তাই তিনি চেয়েছিলেন রাত্রেই রাগিণীর বিষয়ের ব্যবস্থা কমপ্লীট করবেন। তারপর এই ব্যাপার।”

শিখা বললে—”রাগিণী দেবীর সঙ্গে এ সম্বন্ধে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?”

”না। সে ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়েছিল। আমি ডাকলুম—সাড়া পাই নি।”

”ও! আপনার সন্দেহ বেহারীর ওপর।”

”তাই মনে হয়।”

”বেহারী কিছু বলেছে?”

”বলেছে, সে কিছু জানে না।”

”আচ্ছা, ভক্সল গাড়ী পাওয়া গিয়েছিল?”

”পুলিশ এসে গ্যারেজে সে গাড়ী দেখেছিল। তবে গাড়ী যে বেরিয়েছিল আর রাগিণী নিয়ে গিয়েছিল শ্রীপতিবাবুর ড্রাইভার গণেশ তা দেখেছিল।”

”গণেশ পুলিশকে কি বলেছে?”

”মদ খেয়ে ভোঁ…কি বলবে? লোকটা প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠে বসেছিল। শ্রীপতিকে আমি অনেকবার বলেছি ওটাকে বিদায় করো, কিন্তু তিনি বলতেন, পুরোনো লোক—তার উপর এ বয়সে আবার বিয়ে করেছে…বৌটার দুর্গতির সীমা থাকবে না। এখানে তবু ছাউনি আছে…নিরাপদ আছে।”

”গণেশের বয়স কত?”

”তা প্রায় পঞ্চাশ বছর হবে। চেহারা ভালো। যেন কার্ত্তিক।”

”বৌয়ের বয়স?”

”বিশ—বাইশ বছর হবে!”

শিখা বললে—”রাগিণী দেবীর জবানবন্দী দরকার। তাঁর সম্বন্ধে এত বড় কথা!”

মনোহরবাবু বললেন—”নিশ্চয়! তবে যত বদরাগী হোক, সে এমন কাজ করবে না! কিন্তু কোথায় গেল সে? তাকে পাচ্ছি না তো!”

শিখা বললে—”আমি তাঁকে নিয়ে আসছি। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন—শোকে অভিভূত একেবারে।”

মনোহরবাবু বললেন—”হবেই তো। যত বদমেজাজী হোক—মনটা ওর কড়া নয়, মা। রাগলে জ্ঞান থাকে না এই যা দোষ! কিন্তু তারপর দুঃখে নেতিয়ে পড়ে একেবারে।”

তিন – পুলিশ তদারকী

মাণিকতলা থানার ইনসপেক্টর বীরেন্দ্রবাবু এসে যতীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ করে বললেন—”এবারে ওঁর ঘরটি সার্চ করবেন, চলুন স্যর।”

”চলো” বলে যতীন্দ্রনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। মনোহরবাবু এবং শিখাকে তিনি বললেন—”আপনারাও আসুন।”

কজনে এলেন শ্রীপতিবাবুর দোতলার অফিস—ঘরে—লাশ তেমনি পড়ে আছে। যতীন্দ্রনাথ বললেন—”ফটোগ্রাফার এখনো এলো না? আর পুলিশ—সার্জ্জন?”

বীরেন্দ্রবাবু বললেন—”ফটোগ্রাফারকে নিয়ে আসছে আমার ড্রাইভার শ্যামল। পুলিশ—সার্জ্জন ফোন করেছেন, এখনি আসবেন বলে। ততক্ষণ সার্চ।”

”হ্যাঁ।”

ঘর সার্চ হলো। যে লাঠির ঘায়ে শ্রীপতিবাবুর মৃত্যু…সে লাঠিটা ঘরের কোণে পড়ে আছে বহুকাল—দু—তিন মাস আগে শ্রীপতিবাবুর পায়ে বাত হয়েছিল—শুয়ে থাকবার মানুষ ছিলেন না কোনোদিন—ঐ মোটা লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করতেন। মনোহরবাবু ও—লাঠি চেনেন। ব্যাগে তিনখানা শুধু দশ টাকার নোট আর কিছু রেজকি পাওয়া গেল। ব্যাঙ্কের পাশ—বই এবং চেক—বই থেকে জানা গেল কালই ব্যাঙ্ক থেকে শ্রীপতিবাবু বিশ হাজার টাকা ড্র করে এনেছিলেন, সব একশো টাকার নোট। সিন্দুক খালি। ও টাকার বাণ্ডিল পাওয়া গেল না। কোটের পকেট ওলটানো…কেন, কে জানে। তাতে পাওয়া গেল একখানা ডায়েরী। তাতে মোটর গাড়ীর মাইল টোকা তারিখ—সমেত।

দেখে মনোহরবাবু বললেন—”তাঁর এক আশ্চর্য্য স্বভাব ছিল—ভক্সল গাড়ী তিনি ব্যবহার করতেন। কবে কখন কোথা থেকে কোথায় গেলেন…ক’ মাইল পথ চলা হলো—এ ডায়েরীতে নিজের হাতে টুকে রাখতেন।”

ডায়েরীর পাতা উল্টে সকলে দেখলেন—তাই বটে। কাল বেলা একটায় গিয়েছিলেন বাড়ী থেকে ব্যাঙ্কে—গাড়ীর মাইল লেখা—বাড়ী থেকে বেরুবার সময় মাইলের অক্ষর ছিল ১৫২৯৪.৩—তারপর সোজা ব্যাঙ্কে পৌঁছুনো—মাইলের মাপ ১৫২৯৯.৫; বাড়ী ফেরা—১৫৩০৪.৭; ফেরবার পথে গাড়ীর ট্যাঙ্কে পেট্রোল রয়েছে তিন গ্যালন।

মনোহরবাবু বললেন—”টাকাটা আমার মনে আছে, আমি যখন ওঘর থেকে বেরিয়ে আসি, তখন নোটের তাড়া টেবিলের উপর ছিল। আমাকে বললেন, টাকাটা সিন্দুক থেকে বার করেছি—তোমার ওখানে নিয়ে যাবো। এ থেকে কাকে কাল, কি দেবো ফর্দ্দ করে তোমার কাছে রেখে আসবো। ও যখন ক্ষেপেছে, বিশ্বাস নেই—যদি টাকাটা নিয়ে যায়! মেয়েটাকে একটু ঢিট করতে চাই।”

যতীন্দ্রনাথ হঠাৎ প্রশ্ন করলেন—”ওঁর সেক্রেটারী……কি নাম বললেন?”

মনোহর বললেন—”কুমারেশ।”

”তাঁকে দেখছি না যে! তিনি কোথায়?”

বীরেন্দ্রবাবু বললেন—”আমি খোঁজ করেছিলুম। তাঁর বাড়ী বাগবাজারে। শুনলুম, তিনি আজ সকালে বাড়ী গেছেন।”

যতীন্দ্রনাথ যেন চমকে উঠলেন, বললেন—”বাড়ী! এখানে এই ব্যাপার…তিনি বাড়ী যান কি বলে!”

মনোহর বললেন—”লোকটা তেমন শার্প নয়…তবে এম—এ পাশ। ইংরেজী ভালো জানে, অফিসের কাজ করে বেশ মন দিয়ে!”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”তাহলেও এমন সময়ে তাঁর বাড়ী যাওয়া অদ্ভুত!”

”পুলিশের কাছে তিনি কোনো ষ্টেটমেণ্ট দেন নি?”

”না।”

”তাঁকে ডাকিয়ে পাঠান।”…এ—কথা বলে যতীন্দ্রনাথ তাকালেন মনোহরবাবুর পানে, বললেন—”চাকররা তাঁর বাড়ী জানে, নিশ্চয়?”

”জানে। আমি তাকেও পাঠাচ্ছি।” এই বলে মনোহরবাবু হাঁকলেন—”জোগু।”

একজন বেয়ারা এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। মনোহরবাবু তাকে বললেন—”এখনি যাও কুমারেশবাবুর বাড়ী। তাঁকে এখনি আসতে হবে। বলবে, তিনি যেন ট্যাক্সি করে চলে আসেন।”

”জী” বলে জোগু তখনি চলে গেল।

শিখা যতীন্দ্রনাথকে বললে, ”তিনিই প্রধান সাক্ষী, কারণ তিনিই গাড়ীতে বসে বাইরে থেকে দেখেছেন, ঘরে কে লাঠি মেরেছে শ্রীপতিবাবুকে। আচ্ছা, যে জায়গা থেকে তিনি এ—কথা বলেছিলেন, সে—জায়গাটা দেখেছেন যতীনবাবু? সেখান থেকে ঘরের কতখানি দেখা যায়…”

”ঠিক বলেছেন। না, দেখি নি তো! দেখা দরকার। এখানকার কাজ চুকিয়ে চলুন, সকলে গিয়ে দেখি।”

এই পর্য্যন্ত বলে যতীন্দ্রনাথ তাকালেন মনোহরবাবুর দিকে, বললেন—”আপনার ঠিক খেয়াল হবে তো?”

”হবে। সেখানটায় একধারে আছে বড় একটা জামগাছ। আমার ঠিক খেয়াল আছে।”

শিখা প্রশ্ন করলো মনোহরবাবুকে—”সংসারের ব্যবস্থা কার হাতে জানেন মনোহরবাবু? রাগিণী দেবী যে—রকম মেয়ে, তিনি নিশ্চয় এ ঝামেলার মধ্যে নেই। বাড়ীতে কোনো আত্মীয়া বা আত্মীয় কেউ আছেন, সংসার দেখাশুনা করেন?”

মনোহরবাবু বললেন—”হ্যাঁ। শ্রীপতিবাবুর এক বিধবা বোন থাকেন বাড়ীতে। শ্রীপতিবাবুর ছেলেমেয়ে নেই—তিনিই আছেন…আপন বোন নন। তাঁর নাম দাক্ষায়ণী দেবী। তিনি সংসার দেখেন, খরচপত্র ব্যবস্থা করে গুণময়…শ্রীপতিবাবুর সরকার। তারো স্ত্রী আর এক ছেলে এখানে থাকে। তবে তারা নিরীহ, নির্ব্বিকার মানুষ। গুণময়ের বয়স হয়েছে। পঞ্চান্ন—ছাপ্পান্ন বছর বয়স।”

বীরেন্দ্রবাবুও এদিককার কাজ চুকিয়ে বললেন—”রাগিণী দেবী গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রায় ঐ সময়েই—ভক্সল—গাড়ী—এরপর গাড়ীর মাইল—মিটার দেখা দরকার…যে মাইল শ্রীপতিবাবু রেকর্ড করে রেখেছেন, তারপর গাড়ী কত মাইল আরো চলেছিল।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”হুঁ! সেই সঙ্গে রাগিণী দেবীর ষ্টেটমেণ্টটাও দরকার। তাকে আনাবার ব্যবস্থা করা দরকার—”

শিখা বললে—”আমি ফোন করে দিলেই সে আসবে। কোথায় ফোনটা?”

মনোহরবাবু বললেন—”এই যে মা, এইখানেই।”

শিখা রিসিভার তুলে ফোন করলো অসীমাকে।

চার – কুমারেশ

গাড়ীর মাইল—মিটার দেখতে কজনে নীচে নামলেন…নামবামাত্র দেখা কুমারেশের সঙ্গে। মনোহরবাবু বললেন—”এই যে কুমারেশ!”

সকলে দেখেন, গাড়ীবারান্দা থেকে যে টানা বারান্দা, কুমারেশ সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে—যেন কাষ্ঠমূর্ত্তি!

মনোহরবাবু বললেন—”তুমি কেমন মানুষ হে!…এখানে এই ব্যাপার আর তুমি এখানে নেই—দিব্যি বাড়ী গিয়ে বসে আছো!”

একটা নিশ্বাস ফেলে অপ্রতিভ ভঙ্গীতে কুমারেশ বললে—”আজ্ঞে, বাড়ীতে আমার মায়ের খুব অসুখ স্যর, নিউমোনিয়া।”

”তাহলেও সে—কথা বলে যাওয়া উচিত ছিল তোমার। এঁরা তোমাকে খুঁজছেন। তুমি চোখে দেখেছো, লাঠি মারার ব্যাপার…তোমার জবানবন্দী বিশেষ দরকার।”

যতীন্দ্রনাথ বীরেন্দ্রবাবুকে বললেন—”ইনি কি বলেন—আগে শোনা যাক। তারপর আর যা করবার—”

কুমারেশকে নিয়ে সকলে এসে বসলেন নীচেকার অফিস—ঘরে।

কুমারেশকে প্রশ্ন করে যা জানা গেল—রাত তখন প্রায় দশটা…কুমারেশ বাড়ী যায় দশটায়—কাল যাওয়া হয় নি। তার কারণ, শ্রীপতিবাবু বলেছিলেন, মনোহরবাবুর আসবার কথা আছে বিশেষ কাজে—সে কাজ সারা হলে কুমারেশ বাড়ী যাবে। মনোহরবাবু আসেন দশটা বেজে তখন দশ মিনিট…তার একটু আগে রাগিণী দেবীর সঙ্গে শ্রীপতিবাবুর রীতিমত ঝগড়া। কুমারেশ তখন ঘরের বাহিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওঁদের যে কথা হচ্ছিল—রাগিণী দেবী বলেছিলেন, তিনি টাকাকড়ি চান না—তিনি বিবাহ করবেন শচীনবাবুকে। তাতে শ্রীপতিবাবু বলেন, যা—খুশী করতে পারেন রাগিণী, তবে তিনি তাঁকে এক পয়সা দেবেন না—সে অধিকার তাঁর আছে। এর পরেই রাগিণী দেবী দুমদাম শব্দে বেরিয়ে যান। একটু পরে ভক্সল—গাড়ী বেরিয়ে যায়। শব্দ শুনে শ্রীপতিবাবু বলেন কুমারেশকে খবর নিতে। খবর নিয়ে কুমারেশ তাঁকে জানায়, রাগিণী দেবী বেরিয়ে গেলেন বাড়ী থেকে ভক্সল—গাড়ী নিয়ে। শুনে শ্রীপতিবাবু তখনি মাণিকতলা থানায় ফোন করে দেন—তাঁর গাড়ীর জন্য…গাড়ী আর আসামী যেন পাকড়ানো হয়। ফোন করে তিনি বসেছেন এমন সময় মনোহরবাবু আসেন। মনোহরবাবুর সঙ্গে তাঁর কি কথা হয়, কুমারেশ জানে না। কুমারেশ তখন নীচের অফিস কামরায় আসে শ্রীপতিবাবুর কথায় দুটো ফাইল নিতে। তারপর মনোহরবাবু বেরিয়ে যান—কুমারেশ তখন ফাইল নিয়ে শ্রীপতিবাবুর হাতে দিলেন। ওঁরা গাড়ীতে ষ্টার্ট দিয়েছেন, তখন শ্রীপতিবাবু বারান্দা থেকে মনোহরবাবুকে গাড়ী রাখতে বলেন। বলেন, কুমারেশকে নিয়ে যাও তেমার গাড়ীতে—ও কতকগুলো ফাইল নিয়ে এখনি গাড়ীতে গিয়ে উঠবে। তারপর তিনিও যাবেন আধঘণ্টার মধ্যে। একথা বলে শ্রীপতিবাবু ঘর থেকে কতকগুলো ফাইল এনে কুমারেশের হাতে দিয়ে বলেন—এগুলো নিয়ে মনোহরবাবুর গাড়ীতে করে যেন তাঁর ওখানে সে যায়, এবং তিনি না যাওয়া পর্য্যন্ত অপেক্ষা করে। এই ব্যবস্থামত কুমারেশ ফাইল নিয়ে মনোহরবাবুর গাড়ীতে এসে ওঠে…ড্রাইভারের পাশে সে বসে—পিছনের সীটে ছিলেন মনোহরবাবু আর অপর একজন ভদ্রলোক!

যতীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন—”মনোহরবাবু গাড়ীতে গিয়ে বসবার কতক্ষণ পরে আপনি ফাইল নিয়ে গাড়ীতে এসে ওঠেন?”

কুমারেশ বললে—”প্রায় আধঘণ্টা পরে।”

”এই আধঘণ্টা সময় শ্রীপতিবাবু ফাইল দেন নি?”

”না।”

যতীন্দ্রনাথ তাকালেন মনোহরবাবুর দিকে…মনোহবাবু বললেন—”তা হ’তে পারে, কারণ, আমি তখন বংশীবাবুর সঙ্গে কথা কইছিলুম।”

শিখা প্রশ্ন করলে—”আধঘণ্টা লেগেছিল ফাইল বাছতে?”

কুমারেশ বললে—”হ্যাঁ।”

”বেহারী খানসামা তখন কোথায়?”

”দোতলায় শ্রীপতিবাবুর অফিস—কামরার পাশে ছোট কামরা…সেই ছোট কামরায়। শ্রীপতিবাবু যতক্ষণ অফিস—কামরায় থাকতেন, বেহারীর ডিউটী ছিল পাশের ঐ ছোট কামরায় হাজির থাকা।”

”আপনি যখন ফাইল নিয়ে বেরিয়ে যান, তখন কি তাকে দেখেছিলেন?”

”না। ছোট কামরায় নজর চলে না। তাছাড়া দেখবার দরকারও ছিল না।”

”ঐ আধঘণ্টার মধ্যে বেহারীকে শ্রীপতিবাবু ডাকেন নি?”

”না।”

”সিন্দুক খোলা হয়েছিল আপনার সামনে?”

”না।”

”সিন্দুক শ্রীপতিবাবু নিজে খুলতেন? না, আপনি বা বেহারীও খুলতো তাঁর কথায়?”

”তিনি নিজে খুলতেন।”

”সিন্দুকের চাবি কোথায় থাকতো?”

”তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে। ড্রয়ারের চাবি ছোট রিঙে তিনি সবসময় কাছে রাখতেন।”

”কোথায় রাখতেন?”

”জামার পকেটে।”

”আপনাদের সামনে তিনি সিন্দুক খুলতেন?”

”হ্যাঁ।”

”সিন্দুকে কি জিনিষ রাখতেন? শুধু টাকাকড়ি? না, কাগজপত্র?”

”টাকাকড়ি…নগদ টাকা। দরকারী দলিলপত্রও রাখতেন।”

শিখা বললে—”গতকাল ব্যাঙ্ক থেকে অনেক টাকা নিয়ে আসেন?”

”হ্যাঁ। বিশ হাজার…সব একশো টাকার নোট।”

”আপনি কি করে জানলেন?”

”ব্যাঙ্কে যখনি যেতেন, আমাকে সঙ্গে নিতেন। উনি প্রায়ই গাড়ীতে বসে থাকতেন, আমি ব্যাঙ্কে চেক দিয়ে টাকা নিয়ে আসতুম। অবশ্য টাকা তোলবার সময়েই এমনি হতো। না হলে চেক জমা দেওয়া, সে ডিউটী আমার ছিল, আমি একা ব্যাঙ্কে যেতুম।”

”এ টাকা নিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে সোজা বাড়ী ফেরা হয়?”

”হ্যাঁ।”

”টাকাটা এনে তাঁর হাতে দেন, না, আপনার কাছে ও টাকা থাকে?”

”না, এনেই গাড়ীতে ওঁর হাতে দি—নোটের এতবড় তাড়া…বড় খামে ভরে। সেটা তিনি রাখেন তাঁর বড় ব্যাগে।”

”বাড়ী এসে সে টাকা সিন্দুকে রাখেন?”

”বাড়ী এসে আমি নীচেকার অফিস—ঘরে বসি। চিঠিপত্র নিয়ে উনি একা দোতলায় যান।”

”সেই ব্যাগ নিয়ে?”

”হ্যাঁ।”

”এ টাকা কেন আনা হয়, জানেন?”

”না।”

”এর বেশী টাকা আর কখনো ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছেন?”

”অনেক বার।”

”এ টাকা কেন তোলা হলো, খাতায় আপনাকে তা লিখতে বলেন নি?”

”না। শুধু বলেছিলেন, এ টাকাটা খাতায় এখন জমা করো না।”

শিখা বললে—”আপনি কখন বাড়ী গেলেন?”

”রাত তখন তিনটে হবে।”

”পুলিশ তখন এসেছে?”

”হ্যাঁ।”

”পুলিশকে বলে গিয়েছিলেন?”

”না। মার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না তো। পুলিশ এসেছে—ওঁরা সব দেখছেন—তার উপর মনোহরবাবু রয়েছেন, আমি ভাবলুম, চট করে একবার বাড়ীটা ঘুরে আসি।”

”অত রাত্রে কিসে করে গেলেন?”

”মাণিকতলা পুল পর্য্যন্ত হেঁটে…তারপর সেখান থেকে রিক্সা নি।”

”এত বেলা হলো আসতে—একবার ভাবলেন না, এখানে আপনাকে দরকার?”

”মার অবস্থা খারাপ গেছে রাত্রে, সকালে ডাক্তারের কাছে যেতে হলো, ডাক্তার চলে যেতেই আমি এসেছি। মার অবস্থা এখন ভালো। টালটা সামলে উঠেছেন।”

শিখা আরো কি জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল—যতীন্দ্রনাথ বাধা দিলেন, বললেন—”চলুন আমাদের সঙ্গে পথে…সে জায়গা দেখিয়ে দেবেন আমাকে—যেখান থেকে আপনি বাড়ীর দিকে চেয়ে ঘরে এ ব্যাপার দেখেছিলেন।”

সকলে পথে বেরুলেন।

পাঁচ – মোটরের মাইল-মিটার

বাগানের খড়খড়ির নীচে সকলে এলেন—মনোহরবাবু এবং কুমারেশ আছে সঙ্গে। বেহারীর জুতা যেখানে পাওয়া গেছে—সেখানে মাটিতে জুতার দাগ স্পষ্ট—উপর থেকে কেউ যদি জুতা পায়ে লাফিয়ে পড়ে, তাহলে যেমন দাগ হয়, তেমনি! শিখার বিস্ময় বোধ হলো, বেহারী যদি খুন করে থাকে, সে তাহলে খড়খড়ি দিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়বে কেন? তার নিজের ছোট ঘরে থাকতে পারতো…অন্দরের দিকে যেতে পারতো। বিশেষ করে কুমারেশের কথা মানতে হয় যদি, এ ঘরে তখন কোনো লোক ছিল না। তাছাড়া জুতার দাগ খানিক দূর গিয়ে তারপর আর নেই! কুমারেশ বললে,—”এইখানে জুতাজোড়া পাওয়া গেছে।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বেহারীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল—তার জুতা এখানে এলো কি করে?”

বীরেন্দ্রবাবু বললেন—”হ্যাঁ। সে বলে, সে জানে না। মোট কথা সে বলে, সে খুন করে নি। কেন করবে? কুমারেশবাবুরা যখন বেরিয়ে যান, তখন সে ছিল অন্দরে। কর্তাবাবুর শোবার ঘরে বিছানা করছিল। হঠাৎ চীৎকার শুনে সে দেখে, ও ঘরে ঐ ব্যাপার।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”চলুন এবার পথে।”

কজনে পথে এলেন—সেই বড় জামগাছটার ধারে। কুমারেশ বললে—”এখান থেকে আমি দেখেছি।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”হঠাৎ দেখবার কি কারণ ঘটেছিল?”

কুমারেশ বললে—”ঘরের সার্সি বন্ধ হলো বেশ জোরে, তাই চেয়ে দেখেছিলুম।”

শিখা বললে—”ঘরে আলো ছিল?”

”ছিল।”

”সে আলো নিবলো কখন?”

”একটু পরেই।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আপনি ফাইল নিয়ে গাড়ীতে আসবার আগে মনোহরবাবুরা কতক্ষণ গাড়ীতে বসেছিলেন?”

কুমারেশ বললে—”আধঘণ্টার বেশী হবে না।”

শিখা বললে—”মনোহরবাবু কতক্ষণ ছিলেন শ্রীপতিবাবুর ঘরে?”

মনোহরবাবু বললেন—”তা আধঘণ্টার বেশী হবে না!”

এই সময় একখানা মোটর এলো—মোটরে পুলিশ—সার্জ্জন। তাঁর গাড়ী ফটকে ঢুকলে এঁরা এলেন বাড়ীতে।

অনেকক্ষণ ধরে লাশ দেখে পুলিশ—সার্জ্জন বললেন—”যা দেখছি, মোটা লাঠির একটি ঘা—তাতেই সব শেষ! দুটি ঘা নয়…উনি তখন ডেস্কের সামনে বসে ছিলেন। হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।”

আধঘণ্টা পরে পুলিশ—সার্জ্জন চলে গেলেন, বলে গেলেন লাশ পাঠাবার ব্যবস্থা করুন—পোষ্ট—মর্টেমটা সেরে ফেলা দরকার।

বীরেন্দ্রবাবু তখন লাশ পাঠাবার ব্যবস্থা করতে গেলেন। যতীন্দ্রনাথ আর শিখা—দুজনে এলেন ঘরের বাহিরে বারান্দায়। কুমারেশ রইলো সেখানে। মনোহরবাবু ”এখনি আসছি।”—এ কথা বলে বিদায় নিয়ে গেলেন।

শিখা বললে—”বীরেন্দ্রবাবু তো ভক্সল গাড়ীর মাইল—মিটার দেখলেন না। চলুন, আমরা দেখে আসি।”

শিখার সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ চললেন গ্যারেজে গাড়ী দেখতে। কুমারেশ হলো অনুগামী।

গ্যারেজে রয়েছে গাড়ী—যতীন্দ্রনাথ গ্যারেজে ঢুকলেন,…মাইল—মিটার দেখলেন…দেখে আশ্চর্য্য হলেন। ডায়েরীতে শ্রীপতিবাবুর নিজের হাতে মাইল নোট করা—ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ী ফেরার মাইল ১৫৩০৪.৭! তাহলে? রাগিণী এ গাড়ী নিয়ে চক্র দিয়েছে বললে—তাই যদি হবে তাহলে তো মাইলের সংখ্যা বেশী হওয়া উচিত! তবে কি রাগিণী মিথ্যা কথা বলেছে? কেন? মনোহরবাবুও বলছেন…বীরেন্দ্রও বলেছে মাণিকতলা থানায় শ্রীপতিবাবু ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর ভক্সল গাড়ী চুরি গেছে! তাঁর মনে রীতিমত মেঘ…কিন্তু মনের সে ভাব তিনি কাকেও জানালেন না। তিনি কুমারেশকে জিজ্ঞাসা করলেন—”ভক্সল গাড়ী গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে গেছে, এ খবর কে দিয়েছিল শ্রীপতিবাবুকে?”

কুমারেশ বললে—”উনি বেরুবেন বলে আমাকে বললেন, ড্রাইভার গণেশকে খবর দিতে। গ্যারেজে এসে আমি দেখি, ভক্সল গাড়ী নেই, আছে অষ্টিন গাড়ী।”

”অষ্টিন গাড়ী কে ব্যবহার করতেন?”

”রাগিণী দেবী।”

”তারপর?”

”গ্যারেজে ভক্সল গাড়ী নেই দেখে তখনি আমি গণেশকে ডাকি। গণেশ মদ খেয়ে যা হয়ে আছে…ভয়ানক মাতাল! তাকে গাড়ীর কথা জিজ্ঞাসা করতে সে বলে, দিদিমণি ভক্সল নিয়ে বেরিয়ে গেছেন।”

”তারপর ও গাড়ী কখন আবার ফিরলো, জানেন?”

”না। তবে, এ ব্যাপার ঘটবার পরে, মনে হয়!”

”কিসে এমন মনে হয়?”

”কেন না, গোলমালের সময় রাগিণী দেবীকে দেখি নি—তাঁকে দেখি অনেক রাত্রে…পুলিশ আসবার পর।”

”পুলিশ তাঁকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেছিল?”

”আমি জানি না। কেন না, আমি বাড়ী চলে গিয়েছিলুম।”

”ও, ঠিক।”

রাগিণী এলো তার অষ্টিন হাঁকিয়ে একা। গ্যারেজের কাছে এলো। শিখাকে দেখে গাড়ী থামিয়ে সে এলো শিখার কাছে, এসে বললে—”কিছু পেলেন?”

যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিখা রাগিণীর পরিচয় করিয়ে দিলে। যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আপনাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে।”

”আসুন, অফিস—কামরায় যাই। শিখা দেবী আপনার সঙ্গে থাকবেন?”

শিখা এবং যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাগিণী এলো একতলার বড় অফিস—কামরায়। কুমারেশ বললে—”আমার একটু কাজ আছে…দশ—পনেরো মিনিটের জন্য যেতে পারি?”

”বেশ। কিন্তু বাড়ীতেই থাকবেন। বাড়ী থেকে বাহিরে কোথাও যাবেন না।”

”আচ্ছা।”

ছয় – রাগিণীর কথা

শিখা প্রশ্ন করলে রাগিণীকে—”আপনি শুনেছেন, আপনার কাকা মাণিকতলা থানায় ফোন করেছিলেন, রাত তখন প্রায় এগারোটা…ফোন করে বলেছিলেন, আপনি তাঁর ভক্সল গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গেছেন—চুরি করে নিয়ে গেছেন।”

রাগিণী বললে—”’শুনেছি। আমি গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছিলুম।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”মাপ করবেন…আপনি কি জানতেন না যে, আপনার কাকা তাঁর ডায়েরীতে নোট করে রাখতেন বরাবর গাড়ী করে কোথায় গেলেন—এলেন…ক’ মাইল গাড়ী চললো…”

”জানতুম।”

”তাই যদি হয়, তাহলে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ী ফিরে মাইলের যে অঙ্ক ডায়েরীতে নোট করে রেখেছিলেন…এইমাত্র মাইল—মিটার দেখেছি—তাতে এখনো নোট করা দেখলুম…ঐ নম্বর।”

উদাসকণ্ঠে রাগিণী বললে—”তা জানি…তবে আমি বেরিয়েছিলুম।”

”বেরিয়ে থাকতে পারেন, তবে ভক্সলে বেরোননি।”

রাগিণী দু’—মিনিট চুপ করে রইলো, তারপর বললে—”আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবেন?”

শিখা বললে—”কটা নাগাদ খুন হয়েছে, বলতে পারেন?”

রাগিণী বললে—”কি করে বলবো? আমি তখন বাড়ীতে ছিলুম না। কুমারেশবাবু বলেছেন, তিনি গাড়ীতে বসে দেখেছেন কাকার মাথায় লাঠি মারছে। তিনি নিশ্চয় টাইম বলেছেন।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”সেদিন ব্যাঙ্ক থেকে আপনার কাকা একশো টাকার নোটে বিশ হাজার টাকা তুলে এনেছিলেন—আপনি জানেন?”

”আমি জানি না।”

”যদি বলি, এনেছিলেন—সে টাকা কেন এনেছিলেন—সে সম্বন্ধে আপনার কোনো ধারণা আছে?”

”টাকাকড়ির কথা আমি বলতে পারি না। ওসব খবর জানেন কুমারেশবাবু আর কাকার পার্টনার—এই মনোহরবাবু।”

এ কথার সঙ্গে সঙ্গে মনোহরবাবু ঘরে ঢুকলেন—তাঁর পিছনে জোগু বেয়ারা, জোগুর হাতে একখানা বড় ট্রে…ট্রেতে দুখানা প্লেটে একরাশ মিষ্টান্ন এবং চায়ের কেটলি।

খাবারের ঘটা দেখে শিখা এবং যতীন্দ্রনাথ অবাক! জোগু ট্রেটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে চলে গেল।

মনোহরবাবু তখন বিনয়ে গদগদ হয়ে দুই করপুট অঞ্জলিবদ্ধ করে বললেন—”একটু কিছু মুখে দিন!”

”ক্ষেপেছেন মনোহরবাবু! এ কি লৌকিকতার সময়? না, না, না, এ একেবারে অসম্ভব! বাড়ীতে এই ব্যাপার…আর আপনি…এ সব এখনি নিয়ে যেতে বলুন।”

শিখা কোনো কথা বললে না। মনোহরবাবুর এ আচরণে তার মন ঘৃণায় রি—রি করে উঠলো! রাগিণীও আশ্চর্য্য হলো—কাকার পার্টনার—কত অন্তরঙ্গতা, তাঁর এমন শোচনীয় অপমৃত্যু…শোকে কাতর বিহ্বল হবেন, এ সময়েও শিষ্টাচার পালন! রাগিণী যেন ক্ষেপে উঠলো, ”জোগু!”

জোগু এলো। রাগিণী বললে—”নিয়ে যা এ—সব। শ্রাদ্ধের ভোজ দেখছি।”

মনোহরবাবু একবার অপাঙ্গ—দৃষ্টিতে তাকালেন রাগিণীর দিকে…তারপর জোগুকে বেশ শান্ত সহজ কণ্ঠে বললেন—”নিয়ে যা রে!”

জোগু ট্রে নিয়ে চলে গেল। মনোহরবাবু তখন যতীন্দ্রনাথের দিকে চেয়ে বললেন—”মাপ করবেন, আমার মনে হলো—যত বিপদই আমাদের হোক, আপনারা—”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কুমারেশবাবু কি করছেন, দয়া করে যদি একবার দেখেন।”

”বেশ, যাচ্ছি।” মনোহরবাবু চলে গেলেন।

তাঁর এই চকিত আসা—যাওয়ার মধ্যে শিখার মনে একটা সংশয় জেগে উঠলো। যতীন্দ্রনাথকে অতি মৃদু—কণ্ঠে সে বললে—”কারবারের অবস্থার সম্বন্ধে—”

বাধা দিয়ে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”সে কথা আমার মনে হয়েছে শিখা দেবী…তবে ধীরে ধীরে!” তারপর রাগিণীর দিকে চেয়ে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”এঁরা বেহারীকে সন্দেহ করছেন। আপনার তাকে সন্দেহ হয়?”

রাগিণী বললে—”মোটেই না।”

”ড্রাইভার গণেশকে পাওয়া যাবে?”

”দেখছি। হয়তো যাবে, ডেকে দেবো তাকে?”

”না, আপনি আসুন। তাকে একটু পরে পেলে চলবে।”

এই সময় শিখা বললে—”বেশ জটিল ব্যাপার মনে হচ্ছে।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”হ্যাঁ, আপনার সাহায্য চাই।”

শিখা বললে—”বীরেন্দ্রবাবু হিমসিম খেয়ে যাবেন; আপনি এক কাজ করুন। বাড়ীতে যত লোক থাকে, সকলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন, কে কি জানে। আর কারবারের অবস্থা কেমন?”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”লাশ বেরুক আগে, তারপর ব্যবস্থা করবো।” তিনি তাকালেন রাগিণীর দিকে, বললেন—”কাকার সঙ্গে আপনি খুব ঝগড়া করেছিলেন, শুনেছি।”

”হ্যাঁ!”

”আর কেউ শুনেছিল সে ঝগড়া?”

রাগিণী বললে—”বেহারী শুনেছিল, কুমারেশবাবু শুনেছিলেন, আরো বাড়ীর অন্য লোকজন।”

”মনোহরবাবু কখন এ বাড়ীতে এসেছিলেন, জানেন?”

”আমি বেরিয়ে যাবার পর।”

”কিন্তু আপনি বেরোন নি রাগিণী দেবী। মাপ করবেন, যা সত্য নয়, কেন তা বলছেন? এ কথায় আপনার অনিষ্ট হতে পারে। শিখা দেবীর কাছে আমি সব কথা শুনেছি। আপনি সত্য কথা বলুন, কোনো কথা গোপন করবেন না।”

রাগিণী একাগ্র দৃষ্টিতে যতীন্দ্রনাথের পানে চেয়ে বললে—”কি আপনি জানতে চান?”

”প্রথম কথা জানতে চাই, শচীনবাবু কাল এ বাড়ীতে এসেছিলেন কি না?”

একটা উদ্যত নিশ্বাস চেপে রাগিণী বললে—”এসেছিল। সে ছিল আমার ঘরে। আপনাকে সত্য কথা বলি তবে—মানে, পরশু তার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে রেজিষ্ট্রী করে। বিয়ের পর আমি ঠিক করলুম—এ খবর কাকাবাবু জানেন না, জানলে কি যে না করবেন! তাই আমি টাকা নেবো ঠিক করলুম। এমন ঝগড়া করেছি যে মনে হলে এখন আমার কান্না পায়! কাকাবাবু আমাকে খুব ভালোবাসতেন—আমিও বাসতুম। তাঁকে ছাড়া আমি আর কাকেই বা জানি! কিন্তু আমার মেজাজ ভারী খারাপ। আমি যাকে বিয়ে করতে চাই…কেন উনি বাধা দেবেন? আমার সুখই যদি চান, তার বারণ কেন? আমি টাকা নেবোই…বললুম, স্বেচ্ছায় টাকা না দেন, আমি মোটর হাঁকিয়ে এমন এ্যাকসিডেণ্ট করবো যে হাত—পা ভেঙ্গে চুর হয়ে যাবে। কাকাবাবু বললেন, টাকা দেবেন…তবে দু—দিন পরে। মনোহরবাবুকে বলে কিছু শেয়ার বেচে টাকা দেবেন। আমার সবুর সইলো না। আমার স্বামী ছিল আমার ঘরে—তাকে বললুম, বসো, আমি গহনাপত্র যা পারি, নিয়ে আসি। তারপর তোমার সঙ্গে যাবো। এ কথা বলার মানে, আমি চলে গেলে কাকাবাবু নিশ্চয় আমার জন্য কাতর হবেন, আর তখন টাকা—কড়ি দেবেন।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কিন্তু টাকা তো তিনি দেবেন, বলেছিলেন।”

”হ্যাঁ। মনোহরবাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে তবে। আপনি জানেন না, মনোহরবাবুর ইচ্ছা, ওঁর ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। কাকাবাবুর কাছে সে কথা অনেকবার বলেছিলেন। কাকাবাবু তাতে রাজী হন নি। ওঁর ছেলে দারুণ বকাটে…ফার্ষ্ট—আর্টস পর্য্যন্ত পড়েছে। বাপের বহু টাকা উড়িয়েছে, কাবলীওয়ালার কাছে পর্য্যন্ত দেনা। উনি কাকাবাবুর বিজনেশ—পার্টনার হতে পারেন কিন্তু ওঁর ছেলেকে যে আমি ঘৃণা করি, তা কাকা জানতেন। সেজন্য আমার উপর ওঁর মনের ভাব ভালো হতে পারে না।”

”বুঝেছি। আচ্ছা, কারবারের অবস্থা কেমন, জানেন?”

”না।”

”শচীনবাবু সে রাত্রে চলে গিয়েছিলেন?”

”সে আর আমি একসঙ্গে গিয়েছিলুম। আমাদের যেতে দেখেছে ড্রাইভারের বৌ পার্ব্বতী। নিশ্চয় সে গিয়ে লাগিয়ে থাকবে।”

”বেশ কথা। তাহলে এবারে সত্য করে বলুন তো, কিসে করে আপনারা গেলেন?”

”ট্যাক্সিতে। পথে বেরিয়ে বড় রাস্তায় ট্যাক্সি পেয়েছিলুম।”

”ফিরলেন কখন?”

”তখন বারোটা বেজে মিনিট পনেরো—কুড়ি হয়েছে…এসে দেখি, বাড়ীতে পুলিশ। ভয়ে ভয়ে আমি নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। অনেক রাত্রে জানতে পারি, কাকাবাবু খুন হয়েছেন। শুনে আমার হাত—পা ঝিমঝিম করতে লাগলো—বোধ হয়, জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান হলো, দেখি, ভোর হয়েছে। বাড়ীতে পুলিশ…লোকজন। আমার কি যে মনে হলো—খিড়কীর দিক দিয়ে বেরিয়ে ঘুরে বাইরে আসি। এসে আমার অষ্টিন নিয়ে বেরুই, বেরিয়ে আমি অসীমার বাড়ীতে যাই…তাকে সব কথা বলি…সে আমাকে নিয়ে যায় শিখা দেবীর কাছে।”

”আপনার কাকে সন্দেহ হয়?”

”আমার সন্দেহ হয় সকলকে…আবার কাকেও নয়। কেন না, কাকাবাবুর মেজাজ খারাপ হলেও তাঁর কোনো শত্রু ছিল বলে আমি জানি না।”

”বিশ হাজার টাকাও চুরি গেছে। বেহারী করেনি এ কাজ?”

”ককখনো না। চোখে দেখলেও আমি বিশ্বাস করবো না।”

যতীন্দ্রনাথ তাকালেন শিখার পানে। শিখা বললে—”একবার বংশীবাবুর সঙ্গে দেখা করা উচিত নয় কি? তিনি কি বলেন শোনা দরকার।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”নিশ্চয়ই!”

”তাহলে নিঃশব্দে। এখানে কাকেও বলবেন না। আর একটা কথা।”

”কি?”

শিখা তাকালো রাগিণীর দিকে, বললে—”ঐ কুমারেশবাবু কেমন মানুষ?”

”মোসাহেব। জল নীচু তো জল নীচু…জল উঁচু তো জল উঁচু…এমনি টাইপ।”

”উনি থাকেন বাগবাজারে?”

”সেইরকমই শুনেছি।”

”ঠিকানা কেউ জানে?”

”চাকররা নিশ্চয় জানে।”

”আমরা চাই ওঁর ঠিকানা। আর আমি যে ঠিকানা নিচ্ছি, এ কথা কেউ যেন না জানতে পারে।”

”কেউ জানবে না।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”শিখা দেবীর পরিচয় আপনি জানেন, আমি শিখা দেবীকে বলেছি, উনি হামেশা এ বাড়ীতে আসবেন আপনার কাছে, আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু যেন। বুঝলেন, সেই ভাবে।”

”বুঝেছি।”

সাত – পার্টনারশিপ কারবার

মাণিকতলার বীরেনবাবুর কাছে নির্দ্দেশ এলো লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্ট থেকে—শ্রীপতিবাবুর কেস তাঁকে তদন্ত করতে হবে না…এ কেসের তদন্ত করবেন লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের তরফ থেকে যতীন্দ্রনাথ। যতীন্দ্রনাথ আবার শিখা আর বিমলেন্দুর উপর এ কেসের তদন্তভার দিলেন। অবশ্য তিনি সঙ্গে থাকবেন কথা হলো।

হেসে শিখা বললে বিমলেন্দুকে—”তোমার পপিকে নাও সঙ্গে বিমলদা, এ পর্য্যন্ত শুধু বসে আছে বেচারী…ওর জন্মভূমির গুণ দেখাতে পারছে না! ওকে তুমি চান্স দিচ্ছ না, সত্যি, ভারী অন্যায় তোমার।”

এ কথায় বিমলেন্দু ভ্রূকুটি—কুটিল নেত্রে শিখার পানে তাকালো। দেখে শিখা বেশ জোরে হেসে উঠলো, বললে—”ভাগ্যে এ যুগে ব্রহ্মতেজে সিগারেটটা পর্য্যন্ত জ্বলে ওঠে না, তাই রক্ষা।”

যতীন্দ্রনাথ হেসে বললেন—”না শিখা দেবী, তামাসা নয়, হয়তো এ কেসে পপি সাহায্য করতে পারবে। বিমলকে আপনি ওর কুকুরের কথা নিয়ে চটাবেন না।”

”মাপ করো বিমলদা। আর আমি তোমার পপির কথা নিয়ে কিছু বলবো না।”

নিশ্বাস ফেলে বিমল বললে—”এদেশে আমরা এখনো এসব কুকুরের দাম বুঝতে শিখি নি। বিলেতে এসব কুকুর কত সাহায্য করে।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কুকুর নিয়ে এখানকার পুলিশ কেউ তো ষ্টেজে নামে নি বিমল, কাজেই তোমার এ খেদের কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু থাক, আর নয়…কাজে লাগো দুজনে। এবার কি কাজ, মনে আছে শিখা দেবী?”

শিখা বললে—”বংশীবাবুর জবানবন্দী নেওয়া।”

”হ্যাঁ।” যতীন্দ্রনাথ বললেন—”’সব চেয়ে ভালো হয়, ওঁকে যদি লালবাজারে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়। উনি অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট…এতে দোষ নেবেন না।”

তাই হলো। বংশীবাবুকে বেশ বিনীত ভাবে পত্র লিখে তাঁকে লালবাজার পুলিশ—অফিসে ডাকা হলো। তিনি এলেন। ম্যাজিষ্ট্রেট হলেও সরকারের কাছ থেকে মাইনে পান না, সেজন্য সরকারী কাজে এ সব ম্যাজিষ্ট্রেটের চাড় অত্যন্ত বেশী।

তিনি এলে তাঁকে তিনতলায় একটা ঘরে নিয়ে বসানো হলো।

শিখার প্রশ্নের উত্তরে বংশীবাবু বললেন—”আমি কতটুকুই বা জানি! সে রাত্রে মনোহরবাবুর সঙ্গে আমার এনগেজমেণ্ট ছিল—ওঁর একটা এফিডেভিট করবার ছিল, তাছাড়া কিছু পরামর্শ…তাই আমার গাড়ীতে করেই ওঁর ওখানে আমি যাই রাত প্রায় পৌণে নটার সময়। বাড়ীতে খাওয়া—দাওয়া সেরে….রাত্রে আমি খেয়ে নিই সাড়ে আটটায়…অভ্যাস।”

শিখা বললে—”আপনাদের পরামর্শ চুকলো কতক্ষণে?”

”প্রায় দশটার সময়…তারপর আমি চলে আসবো, মনোহরবাবু বললেন, তাঁর কাজ আছে, শ্রীপতিবাবুর ওখানে যেতে হবে। আমার যদি অসুবিধা না হয়, আমার গাড়ীতে যাবেন। আমি বললুম, না অসুবিধা কি? চলুন। তাঁকে তখন গাড়ীতে তুলে আমি আসি শ্রীপতিবাবুর বাড়ী।”

”শ্রীপতিবাবুর বাড়ীতে আপনিও নেমেছিলেন?”

”না। মনোহরবাবু নেমে গেলেন। আমি গাড়ীতে বসে রইলুম। শ্রীপতিবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ—পরিচয় ছিল না,…তার উপর ওঁদের বৈষয়িক আলোচনা চলবে, সেখানে আমি যাবো কেন? গাড়ীতে বসে রইলুম।”

”কতক্ষণ বসে রইলেন?”

”তা প্রায় এক ঘণ্টা। তবে এক ঘণ্টা বসে ছিলুম না। মনোহরবাবু নেমে যান যখন, আমি জিজ্ঞাসা করি, কত দেরী হবে? উনি বলেন—প্রায় এক ঘণ্টা। তিনি আমাকে বলেন, আমার অপেক্ষা করবার দরকার নেই। আমি তাঁকে বলি—এধারে আসা হয় না তো…যখন এসেছি, তখন বাগমারীর শেষে রেল—লাইনের গায়ে আমার এক পিসতুতো ভাই থাকে, তার নাম জলধিবাবু। আমি তার ওখানে যাবো, ঘণ্টা খানেকের বেশী লাগবে না। সেখান থেকে ফেরবার পথে আবার আসবো, এসে ওঁকে নিয়ে যাবো। আর তাই আমি করি। জলধির ওখানে আধঘণ্টা থেকে আমি আবার আসি শ্রীপতিবাবুর বাড়ীতে…এসে জিজ্ঞাসা করি, মনোহরবাবু আছেন কি না? শুনি, আছেন। তখন গাড়ীতে বসে থাকি।”

”প্রায় আধঘণ্টা বসেছিলেন?”

”হ্যাঁ।”

”এর মধ্যে কাকেও শ্রীপতিবাবুর কোনো গাড়ী বার করতে দেখেছিলেন?”

”না।”

”কোনো চেঁচামেচি গোলমাল শুনেছিলেন?”

”যখন প্রথমবারে আসি, তখন মেয়ে—গলার চেঁচামেচি শুনেছিলুম।…রেগে ঝগড়া করছেন যেন! সে প্রায় দশ মিনিট।”

”তারপর?”

”কারো গলা শুনি নি।”

”কাকেও বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন?”

”না। বেরিয়ে গেলেও যেতে পারে, আমি তেমন সজাগ হয়ে কোনো কিছু লক্ষ্য করি নি তো। গাড়ীতে হেলান দিয়ে একটু তন্দ্রাও বোধ হয়…”

”বুঝেছি।”

”মনোহরবাবু যখন গাড়ীতে ফিরলেন, তখন আপনি চোখ বুজে ছিলেন?”

”হ্যাঁ। উনি এসে আমাকে ডাকেন…তখন চোখ চেয়ে তাকাই। উনি এসে গাড়ীতে বসেন, বলেন—বড় দেরী হলো।—তোমারও হায়রানি! আমি বলি, না, না, আমি ঘুরে এলুম খানিকটা।”

”তারপর গাড়ী চালাতে বললেন?”

”হ্যাঁ! গাড়ীতে ড্রাইভার ষ্টার্ট দেবে, তখন বারান্দা থেকে একজন চাকর হাঁকলো—ড্রাইভার, ড্রাইভার বলে। সে ডাক শুনে ড্রাইভার বললে—ডাকছে। তাতে মনোহরবাবু গাড়ী থেকে নামলেন। তিনি নামতে আমি শুনলুম…শ্রীপতিবাবুর গলা বোধ হয়। তিনি বললেন—ওহে মনোহর, গাড়ী একটু রাখো। তোমার গাড়ীতে কুমারেশকে যদি নিয়ে যেতে পারো—ফাইলগুলো ও নিয়ে যাক। আমার ড্রাইভার তো রাত্রে বেহেড হয়ে থাকে, তাকে চাঙ্গা করে তুলে গাড়ী বার করতে দেরী হবে। কুমারেশ ফাইলগুলো তোমার ওখানে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি আধঘণ্টার মধ্যে খাতাপত্র নিয়ে যাবো—নিজেই গাড়ী চালিয়ে যাবো। এ কথায় মনোহরবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কুমারেশকে নেওয়া যাবে কিনা গাড়ীতে? আমি বলি, নিন। তার প্রায় পনেরো মিনিট পরে কুমারেশ আসে একগাদা ফাইল হাতে…এসে গাড়ীতে উঠে বসে। সে বসে ড্রাইভারের পাশে, ফাইল সমেত। তারপর গাড়ী চলে। ফটক থেকে বেরিয়ে একটু এগুতেই কুমারেশ চীৎকার করে গাড়ী থামাতে বলে…বলে, সে দেখেছে—উপরের ঘরে শ্রীপতিবাবুকে কে লাঠির ঘা মারলো। তখনি গাড়ী ফিরিয়ে আনা হয়। গাড়ী ফিরতে মনোহরবাবু আর কুমারেশবাবু নেমে ছুটতে ছুটতে উপরে যান।”

শিখা প্রশ্ন করে—”আপনি উপরে যান নি?”

”গিয়েছিলুম বৈ কি। আমার একটা দায়িত্ব আছে তো। অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট…এমন খবর শুনে চুপ করে থাকতে পারি না। কাজেই…”

”গিয়ে কি দেখলেন?”

”দেখি, শ্রীপতিবাবু ডেস্কের ধারে পড়ে আছেন, মাথা ফেটে চৌচির, রক্তে রক্ত! বীভৎস ব্যাপার! মেঝেয় পড়ে রয়েছেন। শুনলুম, বিশ হাজার টাকার কারেন্সি নোট ছিল নাকি, কিছু নেই!”

”কে বললে, বিশ হাজার টাকার কথা?”

”মনোহরবাবু বললেন। বললেন, তিনি যখন বেরিয়ে আসেন, তখন শ্রীপতিবাবু সিন্দুক খুলছিলেন। বলেছিলেন—বিশ হাজার টাকার কারেন্সি নোট নিয়ে তিনি ওঁর ওখানে আসবেন।”

”সিন্দুকের চাবি দেখেছিলেন?”

”না।”

”চাবির খোঁজ করেছিলেন মনোহরবাবু?”

”না, আমার সামনে নয়। ব্যাপার দেখে তিনি প্রথমটা আঁৎকে উঠলেন। আমাকে বললেন—দেখছেন ব্যাপার, আপনি হাকিম মানুষ…সঙ্গে আছেন…বসুন…উপায় নেই। আমি পুলিশকে ফোন করি…আপনার সামনেই পুলিশের এনকোয়ারি হোক। এ কথা বলে তিনি ফোন করেন মাণিকতলা থানায়।”

শিখার প্রশ্নে বংশীবাবু যে জবাব দিচ্ছিলেন, বিমলেন্দু সঙ্গে সঙ্গে তা নোট করে নিচ্ছিল। লেখা শেষ হতে বিমলেন্দু বললে বংশীবাবুকে—”আপনি পড়ে দেখুন, কোথাও কোনো ভুল, কি কিছু বাদ গেছে কিনা।”

এ কথা বলে লেখা কাগজখানা বিমলেন্দু দিল বংশীবাবুর হাতে। তিনি পড়লেন, পড়ে বললেন—”একটু যোগ করে দিন—পুলিশ এসে লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমার সামনে…সব কথা শুনে বোঝা যায়, বেহারী ছাড়া এদিকে সে সময় তখন আর কেউ ছিল না! তাছাড়া তার জুতো পাওয়া যায় বাহিরে…ও—ঘরের খড়খড়ির নীচে।”

শিখা বললে—”জুতো কখন পাওয়া গেল?”

বংশীবাবু বললেন—”মনোহরবাবু আর কুমারেশবাবু খুনীর সন্ধানে এধার—ওধার ঘুরছিলেন—আমি তখন সেই ঘরে বসে—পুলিশ জবানবন্দী নিচ্ছিল…হঠাৎ কুমারেশবাবু জুতো হাতে এসে বলেন, নীচে পড়েছিল খড়খড়ির ঠিক নীচে—ওদিকটাতে ঝোপ—ঝাড়…কেউ বড় চলে না!…জুতো সনাক্ত হয়, বেহারীর বলে! বেহারীকে পুলিশ জিজ্ঞাসা করে—তোমার জুতো ওখানে গেল কি করে? সে বলে—সে জানে না!”

বিমলেন্দু বলে উঠলো—”ঐ জুতো দেখেই সকলে ঠিক করলেন, বেহারী আসামী?”

”একরকম তাই।”

শিখা বললে—”টাকা চুরি গেছে…কখন জানা গেল?”

”সঙ্গে সঙ্গে। মনোহরবাবু বললেন—কিছু চুরি গেল না তো? তখন পুলিশ সার্চ করে দেখে, সিন্দুকের চাবি খোলা—সিন্দুক তছনছ হয়ে আছে…টাকা নেই। শ্রীপতিবাবুর জামার পকেট ওলটানো…টেবিলে কাগজপত্র ছড়ানো…এ—সব কথা লেখা হলো—প’ড়ে আমি প্রত্যেক পৃষ্ঠার নীচে নাম সই করলাম।”

শিখা বললে—”এসব কথা গোপনীয়। আপনি নিশ্চয় এ—সম্বন্ধে কারো সঙ্গে আলোচনা করবেন না।”

”নিশ্চয় নয়। এ আর আমি জানি না, ভাবেন! আমি একজন অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট…পনেরো বছর ম্যাজিষ্ট্রেটের কাজ করছি। কত ডাইইং ষ্টেটমেণ্ট নিতে পুলিশ আমাকে ডাকে! না, না, এর জন্য আপনি ভাববেন না।”

বংশীবাবুর জবানবন্দী নিয়ে তাঁকে বিদায় দিয়ে শিখা আর বিমলেন্দু এলো যতীন্দ্রনাথের ঘরে! এসে দেখে, যতীন্দ্রনাথ পড়েছেন একরাশ খাতা নিয়ে…আর তাঁর পাশে চেয়ারে বসে মনোহরবাবু।

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আপনারা একটু…শিখা দেবী এখানেই বসতে পারেন—বিমলেন্দু তুমি যাও…অবনীশকে একটা কাজ করতে বলেছি, তুমি যাও তার সঙ্গে…তোমাকেও দরকার হবে!”

বিমলেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল…শিখা বসলো সামনের চেয়ারে। যতীন্দ্রনাথ পড়লেন মনোহরবাবুকে নিয়ে—”আপনাদের কারবারে দু’চারটে বেশ মোটা লোকসানের কথা বললেন…পাঁচ—সাত লাখ টাকার কটা বণ্ড আর শেয়ার সিকিউরিটি—বাজার—দর ভয়ানক নেমে গেছে! ভালো! কিন্তু ট্রাষ্ট—প্রপার্টির অবস্থা?”

”ভালো। আর শেয়ারে আড়াই লক্ষ যা আছে, তাতে মোক্ষম লাভ—সে সবের দাম বেড়ে চলেছে। তার অঙ্ক নিখুঁত করে কষা! পার্টনারশিপের খাতাতেও তাই।”

কারবারের খাতাপত্রে যতীন্দ্রনাথ দেখলেন—কারবারের অনেক টাকা দেনা…হুইলার্স ব্যাঙ্ক থেকে ওভার—ড্রাফট নেওয়া হয়েছে প্রায় ন’ লক্ষ টাকা। মনোহরবাবু অস্বীকার করতে পারলেন না। অথচ ঐ ব্যাঙ্কে তাঁর নিজের হিসাবে দেখাচ্ছেন পাঁচ হাজার টাকা। এছাড়া আরো দুটি ব্যাঙ্ক থেকে ওভার—ড্রাফট নেওয়া হয়েছে তিয়াত্তর হাজার এবং এক লক্ষ সতেরো হাজার টাকা। এসব ওভার—ড্রাফট নেওয়া হয়েছে মনোহরবাবুর একার সহি—করা স্বীকৃতিপত্রে। মনোহরবাবু বললেন—”শ্রীপতিবাবু এ ব্যাপার জানতেন—তবে সে সম্বন্ধে তিনি কোনো লিখিত প্রমাণ অবশ্য দিতে পারেন না।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”এত টাকা কেন ওভার—ড্রাফট নেওয়া হলো? নিজের স্পেকুলেশনের জন্য?”

”অনেক বিদেশী মাল সওদা করবার কথা ছিল। কথা ছিল ব্যাঙ্কে মোটা টাকা জমা থাকা চাই…তাই অন্য ব্যাঙ্ক থেকে টাকা না নিয়ে ঐ হুইলার্স ব্যাঙ্ক থেকে ওভার—ড্রাফট নেওয়া হয়।”

”ডিউ ডেটের উপর এ ওভার—ড্রাফট নেওয়া হয়?”

”হ্যাঁ।”

”শ্রীপতিবাবুর ঘর থেকে পাওয়া চিঠিপত্র যা দেখছি, তাতে দেখছি, যে তারিখে উনি খুন হন—ঐ তারিখে হুইলার্স ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া এ ওভার—ড্রাফট শোধ দেবার তারিখ ছিল?”

”আমি জানি না।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”এ টাকা কারবারের জন্য—তার প্রমাণ দিতে পারবেন?”

একটা ঢোক গিলে মনোহরবাবু বললেন—”সময় চাই, খাতাপত্র ঠিক করতে হবে।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বেশ, সময় পাবেন। কিন্তু মাপ করবেন মনোহরবাবু, আপনাকে জামিন—মুচলেকা দিতে হবে। এ ব্যাপারের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত আপনি আমাদের না জানিয়ে কলকাতা থেকে কোথাও যেতে পাবেন না এবং যখনি আপনাকে তলব করা হবে আপনি হাজির হবেন। রাজী আছেন?”

মনোহরবাবুর কপাল স্বেদসিক্ত…তিনি নিশ্বাস ফেলে বললেন—”আপনাদের যখন অভিরুচি…”

”ধন্যবাদ!”

আট – সচল মেশিন

শিখা এবং অবনীশের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের যথারীতি নির্দ্দেশ দিয়ে যতীন্দ্রনাথ চলে গেলেন। অবনীশ অফিস—কামরার দরজায় একজন পাহারাওয়ালা মোতায়েন করলেন—সদরেও দুজন কনষ্টেবল। তারপর অবনীশও বিদায় নিয়ে গেলেন।

শিখা এলো রাগিণীর ঘরে। রাগিণী একটা সোফায় হেলান দিয়ে পড়ে আছে—শিখা এসে সামনের সোফায় বসলো।

রাগিণী বললে—”বেহারী বেচারা হাজতে আছে! আমার মনে হয়, তাকে আমি যদি পেতুম—তাহলে এ ব্যাপারের কিছু জানা যেতো।”

শিখা বললে—”যতীনবাবু বলেছেন, তাকে জামিনে খালাশ দেবেন। কুমারেশবাবুকে তিনি বলে গেছেন—একজন মোক্তার নিয়ে লালবাজারে গেলেই বেহারীকে সেই মোক্তারেরা জামিনে ছেড়ে দেবেন।”

নিশ্বাস ফেলে রাগিণী বললে—”ভালো। আমি জানি, বেহারী কোনো দোষে দোষী নয়। কাকাবাবুর কি মেজাজ—তাঁর মেজাজ বেহারী ছাড়া আর কেউ সয়ে থাকতে পারে না।…অমন নিঃশব্দে!”

এ—কথা শিখার কাণে গেল না। শিখা কি ভাবছিল, শিখা বললে—”শচীনবাবুর কি খবর? তাঁকে দেখছি না—অথচ আপনাদের বিয়ে হয়েছে।”

রাগিণী বললে—”সে একটা চাকরি পেয়েছে। বোম্বাইয়ের এক ফিল্ম কোম্পানি তাকে এনগেজ করেছে…তাদের ছবিতে মিউজিক দেবার জন্য। যে—রাত্রে কাকাবাবু মারা যান, তার পরের দিন ভোরে তার হাজারিবাগে যাবার কথা—ফিল্ম—ওয়ালার মোটরে হাজারিবাগ থেকে মালিকের ম্যানেজারকে নিয়ে সেখান থেকে ওরা বোম্বাই রওনা হবে।”

শিখা বললে—”আপনি সে রাত্রে মোটর নিয়ে বেরোন নি, তা আমরা জেনেছি। কোথায় ছিলেন সে সময়?”

রাগিণী বললে—”বলেছি তো, শচীন তখন আমাদের এখানে—এই ঘরে। কাকাবাবুর সঙ্গে ঝগড়া করে আমি যাই শোবার ঘরে…সে ঘরের আলমারিতে আমার গহনাপত্র আর টাকাকড়ি যা কিছু ছিল, একটা সুটকেসে করে নিয়ে খিড়কী দিয়ে আমরা দুজনে বাড়ী থেকে বেরিয়েছিলুম। শচীন তার বাড়ীতে নামে আমার সুটকেস নিয়ে…তারপর আমি চলে আসি। বাড়ী আসতেই ঐ ব্যাপার—”

”কুমারেশবাবুর বাড়ীর ঠিকানা?”

”ও…হ্যাঁ। আমি লিখে রেখেছি।”

টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা শ্লিপ বের করে রাগিণী শিখার হাতে দিলে। শ্লিপে কুমারেশের ঠিকানা লেখা—

 ৭ নম্বর আশু মিত্তিরের লেন

 মদনমোহনের মন্দিরের পিছনে

 বাগবাজার।

শ্লিপখানা শিখা নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে বললে—”ঠিক আছে। আমি এখন আসি। যখনি দরকার হবে, আমাকে ফোন করবেন।”

শিখা উঠছে এমন সময় ফোন বাজলো। ফোনটা শ্রীপতিবাবুর অফিস—কামরা থেকে সরিয়ে রাগিণীর ঘরে আনা হয়েছে। যতীনবাবুর পরামর্শেই করা হয়েছে। রাগিণী রিসিভার নিলে—বললে—”হ্যালো…”

অসীমা ফোন করছে…অসীমা বললে—”একা ওখানে…এ ব্যাপারের পর! পাগল হয়ে যাবি রাগিণী—আমার কাছে আসিস!”

শিখাকে রাগিণী এ কথা বললে, শিখা বললে—”যেতে পারেন। তবে সেখানে থাকা চলবে না। এখানে কখন কি দরকার হয় পুলিশের।”

”আমি বলছি ওকে এ—কথা।”

শিখা নিলে রিসিভার রাগিণীর হাত থেকে, বললে—”আমি শিখা।”

অসীমা বললে—”রাগিণীর কাছে আমি সব শুনেছি। সত্যি, কি কাণ্ড শিখা! জলজ্যান্ত মানুষ…চকিতে খুন হলেন! কাকে সন্দেহ হয় তোমার?”

”সকলকেই।”

অসীমা বললে—”আমার বিশ্বাস, তুই যখন পুলিশের সঙ্গে লেগে আছিস, আসল লোক ধরা পড়বেই। তোর কিন্তু অগ্নি—পরীক্ষা শিখা।”

হেসে শিখা বললে—”দেখি, পাশ হতে পারি কি না। তবে তুমি যে রাগিণী দেবীকে বলেছো, তোমার ওখানে গিয়ে থাকতে, তা হয় না ভাই—কেননা, আমাদের কখন ওঁকে কি জন্য দরকার হবে—তখনি না পেলে মুস্কিল তো!”

”হুঁ, তাহলেও মাঝে মাঝে আসতে পারো তো?”

”তার চেয়ে তুমি বরং এখানে এসো মাঝে মাঝে।”

আরও দু—চার কথার পর রিসিভার ছেড়ে শিখা বিদায় নিয়ে চলে গেল।

সে সোজা লালবাজারে যতীন্দ্রনাথের কামরায় গিয়ে হাজির হলো। তাঁর কামরায় কুমারেশ।

শিখাকে দেখে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”ইনি এক মস্ত প্রমাণ নিয়ে এসেছেন—বলছেন, শচীন মিত্তিরের লেখা চিঠি…রাগিণী দেবীকে শচীন মিত্তির লিখেছেন।”

যতীন্দ্রনাথ চিঠি দিলেন শিখার হাতে।

শিখা পড়লো। চিঠিতে লেখা,—

রাগিণী তুমি লিখেছো—তোমার কাকাবাবুর কথায় তোমার ন্যায্য পাওনা ত্যাগ করবে না! আজ রাত্রেই চূড়ান্ত হেস্তনেস্ত করবে। কিন্তু তোমাদের দুজনের যেরকম মেজাজ—আমার ভয় হয়—কি করতে কি না হয়ে যায়! আমি আসবো তোমার ওখানে রাত আটটা নাগাদ। সদর দিয়ে নয়। আমি আসবার পর তোমার কাকাবাবুর সঙ্গে কথা কয়ো—তার আগে নয়। জানো তো, কাল ভোরেই আমাকে হাজারিবাগে যেতে হবে—সেখান থেকে বোম্বাই। বোম্বাইয়ে ভালো ফ্ল্যাট ঠিক করে তারপর তোমাকে নিয়ে আসা।

 —শচীন।

চিঠি পড়ে শিখা বললে—”এতদিন পরে এ—চিঠি কোথায় পাওয়া গেল?”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”উনি বলছেন, রাগিণীর ঘরের বাহিরে কুড়িয়ে পেয়েছেন।”

”চাকররা ঘর ঝাঁট দিয়ে জঞ্জাল ফেলেছিল—চিঠিখানা উড়ে একটা ফুলগাছের তলায় পড়েছিল, উনি সকালে দেখেন…দেখে কুড়িয়ে নিয়েছেন। উনি বলছেন ঐ ‘হেস্তনেস্ত’ কথাটি—তার জন্য ওঁর কেমন সন্দেহ হয় শচীনবাবুকে!”

শিখা তাকালো কুমারেশের দিকে, চকিতের জন্য—দেখলো, কুমারেশের ললাট কুঞ্চিত, দু’চোখের দৃষ্টিও ঈষৎ কুঞ্চিত।

শিখা বললে—”এ চিঠি রাগিণী দেবীকে দেখানো উচিত, তিনি কি বলেন এ চিঠির সম্বন্ধে!”

”নিশ্চয়, এ ভার আপনি নিন—চিঠিখানা সঙ্গে রাখুন। তাঁকে দেখাবেন—এ সম্বন্ধে তিনি কি বলেন।”

চিঠিখানা ভাঁজ করে শিখা রাখলো নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে।

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বেহারীকে জামিনে ছেড়ে দিচ্ছি। তার আগে একটা ব্যাপার আছে…মানে, বেহারীকে সন্দেহ শুধু কুমারেশবাবুর কথায়। ইনি বলছেন—চকিতক্ষণে তিনি যে—মানুষটাকে লাঠি উঁচোতে দেখেছেন, তাকে বেহারী বলেই মনে হয়েছিল ওঁর। ওঁর চোখের জোর কেমন, তার পরীক্ষা করা দরকার—বেহারীকে অপরাধী করবার আগে। তাই আমি ঠিক করেছি, আজ রাত্রে একটা ‘টেষ্ট’ নেবো।”

শিখা বললে—”তার মানে?”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”মানে, রাত এগারোটা নাগাদ বংশীবাবুর গাড়ীতে করে আমরা বেরুবো এঁকে নিয়ে—শ্রীপতিবাবুর ও ঘরে দু’তিনজন মানুষকে রাখবো ঠিক সেই পোজিশনে—যেখানে উনি বলছেন বিহারীকে দেখেছিলেন। গাড়ীতে উনি বসবেন ড্রাইভারের পাশে…পিছনের সীটে থাকবো আমি, বংশবীবাবু, আর যদি ইচ্ছা করেন আপনিও থাকতে পারেন আমাদের সঙ্গে। সেই জামগাছের কাছে গাড়ী এলে উনি ঘরের দিকে তাকাবেন—তাকিয়ে বলবেন কাকে দেখলেন ঘরে—সে রাত্রে উনি যেমন সেখানে বেহারীকে দেখেছিলেন…আইডিয়াটা কেমন মনে করেন?”

”খুব ভালো আইডিয়া।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”তাহলে আপনি সন্ধ্যা থেকে ও বাড়ীতে হাজির থাকবেন কুমারেশবাবু—নিশ্চয়?”

কুমারেশ বললে—”থাকবো। এর অন্যথা হবে না।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”এখন তাহলে আসুন কুমারেশবাবু! রাত আটটায় দেখা হবে।”

”নিশ্চয়!”

কুমারেশ চলে গেল। যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কারবারের খাতাপত্র যা দেখছি, মনোহরবাবু মানুষটি সোজা নন…আমি লোক লাগিয়েছি—ওঁর পেছনে ছায়ার মতো ওঁকে ফলো করবে, বাড়ী থেকে বেরিয়ে কোথায় কোথায় যান, কি করেন। মনে হয়, টাকাটা…”

তাঁর কথা শেষ হলো না—আর্দ্দালী ঢুকলো একখানা কার্ড নিয়ে…কার্ড দেখে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”ব্যাঙ্কের ম্যানেজার।”

নয় – বিপরীত স্রোত

রাত্রে পরীক্ষার আয়োজন। বাড়ীতে যত বেয়ারা খানসামা দরোয়ান সকলকে ডেকে জড়ো করা হলো। মনোহরবাবুকে আনা হলো—কুমারেশও হাজির রাত আটটা থেকে।

যতীন্দ্রনাথ, অবনীশ এলেন—শিখাকে তাঁরা নিয়ে এলেন। পরীক্ষার বিধি সম্বন্ধে গাড়ীতে পরামর্শ—শুনে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”চমৎকার ব্যবস্থা বলেছেন শিখা দেবী। আমরা মামুলি পুলিশী পদ্ধতিতে অর্থাৎ যে ভাবে আসামী সনাক্ত করা হয়, সেই রীতির কথাই ভাবছিলুম। আপনার এ পরামর্শ খুব ভালো।”

রাগিণী এসেছে শিখার সঙ্গে—ক’দিনে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হয়েছে বেশ ভালো রকম। শচীনবাবুর সম্বন্ধে রাগিণী বলেছে, ”হেস্তনেস্ত কথার অর্থ যদি ধরেন খুনখারাপি, তাহলে কথা নেই! কিন্তু শচীনবাবু এর অনেক আগে এ বাড়ী থেকে চলে গেছেন—তার প্রমাণ আপনারা পাবেন।”

এ কথায় শিখা বলেছে—”প্রমাণ একটু চাই—দরকার।”

পরীক্ষার যে ব্যবস্থা হলো…বাড়ীর লোকজনদের মধ্যে বেহারী থাকবে গায়ে মোটা চাদর জড়ানো—শুধু মুখ থাকবে খোলা এবং লোকজনদের মধ্যে একজনকে দাঁড় করানো হবে যে জায়গায় কুমারেশ বলছে, সে রাত্রে বেহারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সেখানে—গণ্ডী মার্কা দিয়ে রাখা হবে; ঘরে সেই ল্যাম্প জ্বলবে এবং পথের দিককার সার্শি থাকবে খোলা—গাড়ীতে করে যাবেন কুমারেশকে নিয়ে যতীন্দ্রনাথ এবং বংশীবাবু—শ্রীপতিবাবুর ঘরে থাকবেন মনোহরবাবু, অবনীশ, শিখা দেবী, রাগিণী দেবী…যে লোককে গণ্ডীতে দাঁড় করানো হবে সে এবং পাড়ার বিশিষ্ট গণ্যমান্য দুজন ভদ্রলোক; চাকর—বাকরদের রাখা হবে ঘরের বাহিরে বারান্দায় এবং এ ব্যাপারের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি কথা লিখবেন মনোহরবাবু এবং সে লেখায় সহি করবেন গণ্যমান্য ঐ দুটি ভদ্রলোক—শিখা দেবী, অবনীশ আর মনোহরবাবু নিজে সাক্ষীস্বরূপ।

গণ্ডীর মধ্যে কাকে দাঁড় করানো হবে, শিখা ঠিক করবে এবং তাকে শিখা দাঁড় করাবে ওঁরা যখন বাহিরে মোটর ষ্টার্ট দেবেন—সেই শব্দ শুনে।

যথাসময়ে বংশীবাবু ও কুমারেশকে সঙ্গে নিয়ে যতীন্দ্রনাথ মোটরে করে বের হলেন। শিখার কেবলি মনে হচ্ছে অসীমার কথা—শিখার অগ্নি—পরীক্ষা…কুমারেশের দৃষ্টি—পরীক্ষা নয়…অগ্নি—পরীক্ষা!

দেখা যাক, ভাগ্য! এই ভেবে শিখা গণ্ডীর মধ্যে দাঁড় করালো গায়ে চাদর জড়ানো বেহারীকেই…ঘরে বসে মনোহরবাবু, অবনীশ, রাগিণী, পাড়ার দুজন ভদ্রলোক আর শিখা…

শিখার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা ভয়ানক দুলছে! মনে হচ্ছে, কি হয়, কি হয়! উৎকর্ণ হয়ে সে শুনছে বাহিরে গাড়ীর শব্দ…ঐ মোটর ফটক পার হলো…ঐ চলেছে…এবারে থামলো…শিখার বুকখানা ধ্বক করে উঠলো। তারপর মোটর ফিরলো—মোটর ফটকে ঢুকলো…ঐ থামলো। সকলে নামছেন।

অবনীশ বললে মনোহরবাবুকে—”লিখুন, গণ্ডীর মধ্যে কে, আর ঘরে কারা…সাক্ষী।”

মনোহর লিখলেন যন্ত্রচালিতের মতো…

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ—সকলে ঢুকলেন ঘরে। যতীন্দ্রনাথের হাতে একখানা কাগজ…যতীন্দ্রনাথ কাগজখানা দেখে বললেন—”এ কাগজে কুমারেশবাবু লিখেছেন নিজের হাতে…লিখেছেন গাড়ী থেকে তিনি দেখেছেন বাড়ীর বামুন ঠাকুরকে। কিন্তু আসলে দেখছি, ঠাকুর এ—ঘরে নেই! ওখানে…”

কুমারেশের মুখ বিবর্ণ…জবাব নেই।

যতীন্দ্রনাথ ধমক দিলেন—”বলুন, চোখে দেখছেন তো। কাকে দেখছেন?”

কুমারেশ বললে—”বেহারী।”

কুমারেশের লেখা কাগজখানা বংশীবাবুর হাতে দিয়ে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”নিন স্যর…আপনি ম্যাজিষ্ট্রেট…এ কাগজে সহি করুন, সব নোট করে—সেই সঙ্গে যা যা আর লিখতে হয়। এঁরাও সাক্ষী…এ কাগজে সহি করবেন।”

রাগিণী বলে উঠলো—”বেচারীকে তাহলে খালাশ দেবেন তো?”

”নিশ্চয়। কালই ওকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।”

”তাহলে এখন?” রাগিণী করলে প্রশ্ন।

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”বিপদ! আমাদের খাটুনি বাড়লো। আমাকে আসামী ধরতে হবে। শুধু খুন নয়, চুরিও। যা দেখছি, এ চুরি নয়, রবারি।”

পরের দিন বেলা প্রায় বারোটা…কুমারেশকে নিয়ে অবনীশ শ্রীপতিবাবুর অফিস—ঘরে বসে কারবারের পুরানো খাতাপত্র, চেক—বহি, ব্যাঙ্কের হিসাবপত্র নিয়ে পড়ছেন, শিখা বেরিয়েছে বাগবাজারের দিকে। যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করে নার্সের মেক—আপে সে গিয়েছে।

মদনমোহন—তলায় আশু মিত্তিরের গলিতে ৭ নম্বরে ছোট দোতলা বাড়ী…ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। দরজায় কড়া নাড়তে একজন দাসী এসে দরজা খুলে দিল—”কাকে চাই?”

শিখা বললে—”বাড়ীতে কে আছেন?”

ঝি বললে—”মাঠাকরুণ।”

”বাবুরা?”

”না।”

”মাঠাকরুণকে বলো, তাঁর সঙ্গে কথা আছে। আমি এসেছি বাড়ী—ঘর পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে—নালী—নর্দ্দামা কলতলা…সব দেখবো।”

ঝি চলে গেল…একটু পরে ফিরলো, তার সঙ্গে বর্ষীয়সী এক মহিলা।

মহিলা বললেন—”কে গা?”

শিখা বললে—”আমি মিউনিসিপ্যালিটির স্বাস্থ্য—বিভাগের লোক। চারিদিকে কলেরা হচ্ছে বড্ড…তাই সব বাড়ী দেখে বেড়াচ্ছি…নালী—নর্দ্দমা সব পরিষ্কার আছে কিনা দেখতে চাই।”

”এসো বাছা।” বলে মহিলা শিখাকে ভিতরে নিয়ে গেলেন।

শিখা সব দেখলো…ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একখানা পকেটবুক বার করে প্রশ্ন করলো—”এ বাড়ীর মালিকের নাম?”

মহিলা বললেন—”কুমারেশ চক্রবর্ত্তী।”

”তিনি কি কাজ করেন?”

”শ্রীপতিবাবু ছিলেন—সম্প্রতি মারা গেছেন…তাঁর ওখানে চাকরি করে।”

”মাইনে পান কত?”

”তিনশো টাকা আর বাড়ী—ভাড়ার দরুণ ত্রিশ টাকা।”

”বিয়ে হয়েছে?”

”না।”

”আপনি তাঁর কে?”

”আমি তার মা।”

”এর মধ্যে আপনার কোনো অসুখ—বিসুখ হয়েছিল?”

”না বাছা। এর মধ্যে কেন—তিন—চার বছরের মধ্যে আমার কোনো অসুখ করেনি।”

”দেখুন মনে করে—নিউমোনিয়া?”

”না।”

আপনি লিখতে পড়তে জানেন?”

”জানি।”

”তাহলে এক কাজ করুন—আমার এই খাতায় লিখে দিন—দু—তিন বছর বা এক মাসের মধ্যে আপনার কোনো অসুখ—বিসুখ হয়নি…আপনি সুস্থ আছেন।”

মহিলা তাই লিখে দিলেন শিখার নোটবুকে।

শিখা বললে—”তনয় আপনার নাম সহি করুন…আর আজকের তারিখ লিখুন।”

মহিলা তাই করলেন। শিখা বললে—”আচ্ছা, নমস্কার! তাহলে আসি।”

শিখা চলে এলো। মহিলা ঝিকে বললে—”খুব ভালো তো রে…পাছে কারো অসুখ—বিসুখ হয় এমন করে নালী—নর্দ্দামা দেখে বেড়াচ্ছে! সাধে বলি, কলকাতার মতন সহর কি আর কোথাও আছে!”

ঝি বললে—”যা বলেছো মা। এই যে গো, দেশে যাই, তা পাঁচ দিনের বেশী ছ’দিন থাকতে পারি না সেখানে।”

দশ – গ্রন্থি-মোচন

পরের দিন সকালে শিখা এলো রাগিণীর কাছে। রাগিণী চিঠি লিখছিল। শিখাকে দেখে রাগিণী বললে—”নতুন কিছু পেলেন?”

শিখা বললে—”পাবার আশা রাখি। আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল একজনের সম্বন্ধে…কাল বুঝেছি, সন্দেহটা নেহাৎ অমূলক নয় যেন। এখন এসেছি, আপনাদের ড্রাইভারকে দু’চারটে কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।”

রাগিণী বললে—”তাকে দেখছি।”

রাগিণী ডাকলো জোগুকে, বললে—”ড্রাইভারকে দ্যাখতো—তাকে এখানে আসতে বল, আমি ডাকছি।”

জোগু চলে যাচ্ছিল, রাগিণী বললে—”মদ খেয়ে ভোঁ হয়ে নেই তো?”

জোগু বললে—”না দিদিমণি…ক’দিন মদ ছোঁয়নি…ও হতভম্ব হয়ে আছে।”

”তুই যা।” রাগিণী তাকালো শিখার দিকে, বললে—”তাকে হঠাৎ?”

”এখনি বুঝবেন।”

ড্রাইভার এলো…যেন চোর! মাথা নীচু করে আছে, মুখ তুলে চাইতে পারছে না। রাগিণী বললে—”ইনি যা জিজ্ঞাসা করবেন, জবাব দেবে—সত্য কথা বলবে।”

শিখা প্রশ্ন করলো—”সে রাত্রে তুমি বলেছিলে মনোহরবাবুকে—দিদিমণি গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গেছেন?”

ড্রাইভার সবিনয়ে বললে—”আজ্ঞে, এ—কথা আমি বলি নি।”

রাগিণী বললে—”আমি জানি, বলবার মতো ওর অবস্থা ছিল না। রাত সাড়ে নটার পর থেকে ও আর মানুষ থাকে না।”

শিখা বললে—”কথাটা তাহলে মনোহরবাবুর মন—গড়া! এবং তা যদি হয়, তিনি এ—কথা অকারণে বলেন নি।”

রাগিণী কোনো জবাব দিলে না; দু—চোখে প্রশ্ন ভরে তাকিয়ে রইলো শিখার পানে।

শিখা বললে—”আর এক কথা, কুমারেশবাবুর মার অসুখ হয় নি মোটে, উনি বলেছিলেন, নিউমোনিয়া…তাই এখানে অমন ভয়ানক ব্যাপার হলো, আর উনি চলে গেলেন এ—বাড়ী ছেড়ে! কাজেই আমার মনে হয়, ড্রাইভারকে নিয়ে ও—কথা বলা মনোহরবাবুকে; এবং কুমারেশবাবুর অমন সময়ে সরে পড়া…আপনি ভাবেন, এর উদ্দেশ্য ছিল না?”

রাগিণীর মুখে কথা নেই। সে শুধু বড় একটা নিশ্বাস ফেললো।

শিখা বললে—”এ—কথা আমি আজ সকালে উঠেই যতীনবাবুকে জানিয়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথাও হয়েছে। আমি চাই আপনাদের বেহারীকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে।”

রাগিণী বললে—”সে যা হয়ে আছে…বাড়ী এসে দোতলায় আর ওঠে নি…নীচে একটা ঘরে পড়ে আছে। কারো সঙ্গে কথা নয়। রাত্রে কিছু খাবে না—আমি গিয়ে কত বলে, কত বুঝিয়ে তাকে একটু খাইয়েছি। জানেন, কাকাবাবুর কাছে বেহারী কাজ করছে…পঁচিশ—ত্রিশ বছর…আমার জন্ম হবার আগে থেকে।”

”সেই বেহারী হঠাৎ মনিবকে খুন করে তাঁর টাকা চুরি করেছে! মাণিকতলার ইনস্পেক্টরের বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।”

রাগিণী বললে—”বেহারীকে আমি নিজে গিয়ে ডেকে আনছি।”

শিখা বসলো—তার মনের মধ্যে চিন্তার তরঙ্গ বয়ে চলেছে।

রাগিণী এলো, সঙ্গে বেহারী।

শিখা তাকে আশ্বাস দিয়ে বুঝিয়ে বললে—”যা হয়ে গেছে, এখন তা মনে রেখো না। মনিবের জন্য তোমার মনে বেশ চোট লেগেছে…বুঝি! তবু মনকে এখন বাঁধো বেহারী, যে সব শয়তানরা এমন কাজ করেছে, তাদের ধরা চাই, তাই তোমাকে আমি যা—যা জিজ্ঞাসা করবো, তুমি যা জানো, বলো। বললে তবেই খুনীকে ধরতে পারবো।”

বেহারী চোখ তুলে তাকালো শিখার দিকে।

শিখা বললে—”সে—রাত্রে তুমি বাবুর ঘরের পাশে তোমার ঘরে ছিলে তো, যখন তোমার দিদিমণির সঙ্গে তাঁর তর্ক হয়?”

”আজ্ঞে, হ্যাঁ। ছিলুম।”

”দিদিমণি যখন বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে, তার কত পরে মনোহরবাবু এলেন?”

”প্রায় সঙ্গে সঙ্গে!”

”তিনি আসতে কি কথা হলো—তুমি শুনেছিলে?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ! মনোহরবাবু আসতেই বাবু তাঁকে বললেন—ব্যাঙ্ক থেকে এ চিঠি কেন দিলে আমাকে? এত টাকা ব্যাঙ্ক থেকে ধার করা হয়েছে কেন?”

”এ কথা স্পষ্ট শুনেছিলে?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি তখন বাবুর কাছে…তাঁর গা ডলে দিচ্ছি। রোজই ঐ সময়ে তাঁর গা ডলে দিতুম কিনা আমি।”

”এ—কথার জবাবে মনোহরবাবু কি বললেন?”

”মনোহরবাবু খুব নরম হয়ে নীচু গলায় বললেন—রাগ করবেন না, বুঝিয়ে দিচ্ছি। তবে বেহারীকে যেতে বলুন। বাবু তখন আমাকে চলে যেতে বললেন। আমি পাশের ঘরে গেলুম। একটু পরে বাবু বললেন—ওখানে নয়—তুই নীচে যা। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে এলুম।”

”নীচে গেলে না?”

”না। সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইলুম।”

”তারপর?”

”তারপর বাবুর হুমকি। বাবু বললেন—তোমাকে পুলিশে দেবো, তুমি চোর।”

”মনোহরবাবু কিছু বললেন?”

”তাঁর কথা শুনতে পাইনি। বাবু বললেন, আমি থানায় ফোন করবো এখনি…তোমাকে তারা নিয়ে যাবে।”

”তারপর?”

”তারপর বাবু ডাকলেন চেঁচিয়ে—বিহারী! আমি গেলুম। যেতে বাবু বললেন—কোথায় আছে কুমারেশবাবু…তার কাণ ধরে নিয়ে আয় আমার কাছে।

এ—কথা শুনে আমি ছুটলুম কুমারেশবাবুকে ডাকতে। তাঁর অফিস—ঘরে তাঁকে পেলুম না। কে বললে, তিনি বাথরুমে গেছেন। আমি অফিস—কামরায় দাঁড়িয়ে রইলুম প্রায় পনেরো মিনিট…তারপর দেখি, মনোহরবাবু নীচে নামলেন। নেমেই আমাকে বললেন—একখানা ট্যাক্সি ডেকে আনো তো, বাবু বেরুবেন এখনি…ড্রাইভার তো এ সময় মদ খেয়ে বেহুঁশ! তাই বাবু বললেন—ওকে দিয়ে গাড়ী চালানো চলবে না। এ—কথা শুনে আমি বেরিয়ে গেলুম ট্যাক্সি ডাকতে।”

”ট্যাক্সি এনেছিলে?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ! ট্যাক্সি কি এখানে মেলে? বাগমারীর মোড়ে এসে ঘুরতে ঘুরতে একখানা ট্যাক্সি পাই। তাতে করে যখন বাড়ী ফিরি, তখন দেখি, বাড়ীতে হুলস্থুল কাণ্ড!”

শিখা শুনলো, শুনে কি ভাবলো…তারপর বললে—”এ—সব কথা তুমি মাণিকতলার ইনস্পেক্টরবাবুকে বলোনি কেন?”

”আজ্ঞে, আমাকে কিছু বলতে দিলেন না। তাছাড়া আমার মাথার ঠিক ছিল না তখন। কেবলি মনে হচ্ছিল, যেন স্বপ্ন দেখছি। ওঁরা যখন হাজতে পুরলেন, তখন আমার সম্বিৎ হলো। কিন্তু তখন কি বলবো? কাকে বলবো?”

শিখা বললে—”ট্যাক্সি নিয়ে যখন এলে, বাড়ীতে কারো প্রাইভেট মোটর ছিল?”

”আজ্ঞে হ্যাঁ। মনোহরবাবু আর কুমারেশবাবু সেই মোটরে বেরিয়ে গেলেন।”

”তারপর আবার তাঁরা এসেছিলেন?”

”হ্যাঁ! আমি তখন বাবুর ঐ অবস্থা দেখে বাবুর ঘরের মেঝেয় বসে পড়েছি…কেমন হতভম্বের মতো।”

বেহারীকে শিখা বললে—”আমার সঙ্গে তুমি এখন লালবাজারে চলো, এ—সব কথা বলতে হবে তোমাকে! আচ্ছা, থাক—আমি অবনীশবাবুকে ফোন করে দিই। তিনি আসবেন—তোমার কথা, ড্রাইভারের কথা লিখে নেবেন।”

শিখা ফোন করলো অবনীশবাবুকে। তাঁকে বাড়ীতে পাওয়া গেল। তাঁকে শিখা সব কথা বলতে, তিনি বললেন—”আমি এখনি আসছি। আপনার সঙ্গে আরো কথা আছে, দেখা হলে বলবো।”

বিশ মিনিটের মধ্যেই অবনীশ এলেন। তিনি নিলেন বেহারীর আর ড্রাইভারের জবানবন্দী। তারপর বললেন—”ডেপুটি সাহেব যে—লোককে রেখেছিলেন, ছায়ার মতো মনোহরবাবুর সঙ্গে থাকবে বলে—সে আজ ভোরে গিয়ে ডেপুটি সাহেবকে খবর দিয়েছে—রাত প্রায় বারোটার সময় মনোহরবাবু বাড়ী থেকে বেরিয়ে একখানা রিক্সা নিয়ে যান বাগবাজারে আশু মিত্তিরের গলিতে এক বাড়ীতে। সে বাড়ীতে তিনি থাকেন প্রায় দু—ঘণ্টা। গিয়েই রিক্সা ছেড়ে দেন। দু—ঘণ্টা পরে বেরুলেন তিনি আর তাঁর সঙ্গে ছোকরা—বয়সী এক ভদ্রলোক—হাতে বড় একটা ব্যাগ। দুজনে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসেন কুমারটুলির মোড়ে। সেখানে ট্যাক্সি নেন। নিয়ে ট্যাক্সিতে করে দুজনে যান চাঁপাতলায়। একটা বাড়ীর সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে বাড়ীর দরজার কড়া নাড়েন। কে এসে দরজা খুলে দেয়। তখন মনোহরবাবু ট্যাক্সি থেকে নামেন। নেমে সেই ব্যাগটা সে—লোকের হাতে দেন। তিনজনে কি—সব কথা হয়। তারপর ব্যাগ নিয়ে লোকটা বাড়ীর মধ্যে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। ওঁরা ট্যাক্সি চালিয়ে চাঁপাতলার ওদিকে আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীট ধরে বেরোন…বেরিয়ে ট্যাক্সি প্রথমে যায় বাগবাজারে; সেখানে মদনমোহনের বাড়ীর সামনে ছোকরাবাবু নেমে যায়। মনোহরবাবু ট্যাক্সিতে করে নিজের বাড়ীতে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দেন।”

শুনতে শুনতে শিখার মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সে বললে—”তার পর?”

অবনীশ বললেন—”ডেপুটি সাহেব সার্চের ব্যবস্থা করেছেন। তিন বাড়ীতে… চাঁপাতলার বাড়ী…মনোহরবাবুর বাড়ী আর কুমারেশবাবুর বাড়ী। তিনি আপনার খুব তারিফ করছিলেন…বললেন—শিখা দেবী গোড়া থেকেই বলছেন, ঐ দুটি ভদ্রলোকের উপর নজর রাখতে। বলতে কি, আপনার কথাতেই কারবারের খাতাপত্র টেনে দেখা। নাহলে আমার কথা স্পষ্ট বলি, আমি এমনি সাধারণ রবারি কেস ভেবেছিলুম।”

শিখা বললে—”লালবাজারে দশটার সময়ে গিয়ে শুনবো আপনাদের বিজয়—কাহিনী। রাগিণী দেবীকেও নিয়ে যাবো।”

এগারো – অতঃপর

শিখার মাথায় একটা কথা ঘুরছে—মাণিকতলা থানায় তাহলে গাড়ী চুরির নালিশ কেন হয়? ড্রাইভার নেশায় এমন ভোঁ…তার তখন সামর্থ্য নেই যে ভক্সল গাড়ীর খবর রাখবে বা সে খবর বলবে! তবে?

অবনীশ চলে গেলেন সার্চের খবর দিয়ে। শিখা মাণিকতলা থানায় চললো—সে রাত্রের ডায়েরী স্বচক্ষে দেখবার জন্য। তার মনে একটা চিন্তা…দেখা যাক, কি হয়।

অসীমার সেই কথা—অগ্নি—পরীক্ষা!

মাণিকতলা থানায় বীরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি নমস্কার করে বললেন—”আসুন শিখা দেবী। তারপর কিনারা কিছু হলো?”

সে কথার জবাব না দিয়ে শিখা বললে—”সে তারিখের ডায়েরী দেখি…শ্রীপতিবাবু গাড়ী চুরির কথা বলেছিলেন না?”

ডায়েরী আনিয়ে বীরেন্দ্রবাবু দিলেন শিখাকে, শিখা খুললো সে তারিখের পাতা। রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিট…ডায়েরীতে লেখা ফোন কল…২২ নম্বর বাগমারী রোড থেকে…শ্রীপতি গাঙ্গুলী…এখনি যেন পুলিশ আসে—ক্রিমিনাল কেস…আসামী গ্রেফতার করতে হবে…এইটুকু লেখার পর কথা বন্ধ…প্রায় পাঁচ মিনিট…

ডায়েরীতে লেখা…বারবার ডাকবার পর…আবার কথা শোনা যায়—হ্যাঁ…আমার ভক্সল গাড়ী চুরি—নাম্বার ডব্লু—সী ১৬০৬৮—চোর ধরা চাই—গাড়ী উদ্ধার করা চাই—এখনি যেন পুলিশ আসে…

এ—ডায়েরী লেখেন বীরেন্দ্রবাবু নিজের হাতে—এবং লেখা শেষ হতেই তিনি আসেন জীপ—এ চড়ে থানার ক’জন কনষ্টেবল নিয়ে…

তাহলে? মনে যেন বিদ্যুতের চকিত—চমক!…শিখা বললে বীরেন্দ্রবাবুকে—”এ ডায়েরীর লেখা আপনি দেননি কেন? এ লেখা ফাইল করা উচিত ছিল!”

একটি অল্প বয়সের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে বীরেন্দ্রবাবু জ্বলে উঠলেন! কিন্তু মনের সে—ভাব মুখে প্রকাশ করলেন না—কমিশনার সাহেব পর্য্যন্ত যে—মেয়েকে মাথায় তুলে নৃত্য করছেন…তাকে ফস করে একটা কড়া কথা বলা…বীরেন্দ্রবাবুর ভয় হলো, কে জানে, তার ফলে কি না হতে পারে!

বীরেন্দ্রবাবু বললেন—”ডায়েরীতে এমন কি কথা…তাছাড়া এর কপি দিয়েছি।”

বাধা দিয়ে শিখা বললে—”এ ডায়েরী কেসের মস্ত প্রমাণ—এ ডায়েরী এখনি লালবাজারে পাঠিয়ে দিন—স্পেশাল—মেসেঞ্জার দিয়ে! যদি কথা ওঠে, কার কথায় ডায়েরী পাঠানো হলো—লিখে দেবেন—আমার কথায়। আমি লিখে দিচ্ছি নোট…সেটাও আপনার ডায়েরীর সঙ্গে পাঠাবেন।”

এ—কথা বলে শিখা আর বসলো না—দাঁড়ালো না—এলো লালবাজারে।

লালবাজারে হুলস্থুল পড়ে গেছে—চাঁপাতলার সে—বাড়ী থেকে পাওয়া গেছে সে—রাত্রের সেই ব্যাগ। ব্যাগটি মনোহরবাবুর—ব্যাগের মধ্যে বিশ হাজার টাকা—একশো টাকা করে কারেন্সি নোট—নোটের নম্বর পর—পর চলেছে—ব্যাঙ্ক থেকে যে—নোট শ্রীপতিবাবু সে—তারিখে তুলে এনেছিলেন।

চাঁপাতলার সে—বাড়ীর মালিক গোপেশ্বরবাবু। তিনি হলেন মনোহরবাবুর সম্বন্ধী। কুমারেশের বাড়ী থেকে পাওয়া গেছে শ্রীপতিবাবুর উইল—তাঁর নিজের হাতে লেখা—উইলের সাক্ষী মনোহরবাবু এবং কুমারেশ। এ উইলে শ্রীপতিবাবু ব্যবস্থা করেছেন—তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর যথাসর্ব্বস্ব পাবেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী শ্রীমতী রাগিণী দেবী…রাগিণী দেবীর পৈত্রিক যা—কিছু—তাও রাগিণী দেবী পাবেন!…উইলের তারিখ—যে—তারিখে শ্রীপতিবাবু মারা যান—তার দু—দিন আগের তারিখ…

মনোহরবাবুর বাড়ী থেকে পাওয়া গেছে—ব্যাঙ্কের সঙ্গে তাঁর যে—সব চিঠিপত্র চলেছিল—ওভার—ড্রাফট সম্বন্ধে—তাঁর লেখা চিঠি—আর ব্যাঙ্ক যে জবাব দিয়েছে; এবং আরো পাওয়া গেছে কুমারেশের লেখা চিঠি। এ—চিঠিতে কুমারেশ লিখেছে—

উনি ভয়ানক চটেছেন স্যার—আজ রাত্রে আপনি নিশ্চয় আসবেন। কর্ত্তা পুলিশ—কেস করবেন বলে পুলিশ—কোর্টের উকিল বনমালী সেনের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন—তাঁকে বাড়ীতে আনিয়ে। বনমালীবাবু বলেছেন—ক্লীয়ার কেস। কর্ত্তা তখনি নালিশ করতে চান—আমাকে বলেন—তাঁর তরফে ফরিয়াদী হয়ে কাছারিতে দাঁড়াতে। আমি অনেক করে বুঝিয়েছি—মনোহরবাবুকে ডাকিয়ে তাঁকে বলুন—টাকা যদি তিনি দেন—তাহলে আর মামলা—মকোর্দ্দমার হাঙ্গামা কেন? টাকা আদায় নিয়ে কথা। আমার এ—কথায় তিনি চিঠি পাঠাচ্ছেন—সেই সঙ্গে আমিও আপনাকে লিখছি—রাত্রে আসবেন—এগারোটায় কাঁটায় কাঁটায়—না হলে রক্ষা থাকবে না। আপনি আজ রাত্রে না এলে কাল সকালে কোর্টে নালিশ রুজু হবে—তখন মহা বিপদ। আমার অবস্থাও চিন্তা করবেন।

 —ইতি।

চিঠির তারিখ…যে—রাত্রে শ্রীপতিবাবু মারা যান এবং চিঠির নীচে কুমারেশের নাম—সহি!

মনোহরবাবু এবং কুমারেশকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে—সেই সঙ্গে মনোহরবাবুর চাঁপাতলার সম্বন্ধী গোপেশ্বরবাবুও।

গোপেশ্বরবাবুর কাছ থেকে জানা গেল যে, মনোহর ছ—সাত লক্ষ টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিলেন। স্পেকুলেশনের পর স্পেকুলেশন। তিনি মানা করেছিলেন—উনি শোনেননি। তারপর সে—রাত্রে ব্যাগ নিয়ে এসে উনি বলেন—গোপেশ্বরবাবুর কথা রাখবেন—স্পেকুলেশন আর নয়। একথা বলে ব্যাগটা দেন, বলেন—এগুলো যেন তিনি রাখেন—চল্লিশ হাজার উদ্ধার হয়েছে। মনোহরের কাছে এ—টাকা থাকলে আবার যদি স্পেকুলেশনে নামেন—তাই তিনি এ টাকা নিজের কাছে রাখবেন না। এর বেশী তিনি আর কিছু জানেন না।

তারপর মাণিকতলা থানার ডায়েরী দেখিয়ে শিখা বললে যতীন্দ্রনাথকে—”আমার যা মনে হচ্ছে শ্রীপতিবাবুর সঙ্গে রাত্রে ঝগড়া—শ্রীপতিবাবু থানায় ফোন করেন—মনোহরবাবুকে পুলিশের হাতে দেবেন! তখন, আমার মনে হয়, ঐ যে ক’মিনিট ফোন বন্ধ—তারপর হঠাৎ গাড়ী—চুরির নালিশ। এ থেকে আমার মনে হয়, পুলিশ আসবে শ্রীপতিবাবুর ফোন পেয়ে, তখন মরিয়া হয়ে মনোহরবাবু লাঠি মারেন শ্রীপতিবাবুকে। সেই একটি মোক্ষম ঘা খেয়ে শ্রীপতিবাবু পড়ে যান। তখন থানায় ঐ ফোন—মনোহরবাবু বুদ্ধি করে সে—ফোন ধরে গাড়ী—চুরির গল্প বানিয়ে বলেন। বলেন, ড্রাইভার ওঁকে বলেছিল, রাগিণী দেবী গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মিথ্যা কথা। ড্রাইভার তখন নেশায় বেহুঁশ। তার উপর মস্ত প্রমাণ—গাড়ীর মাইল—মিটার—শ্রীপতিবাবু ব্যাঙ্ক থেকে বেরুবার পর ও গাড়ী আর গ্যারেজ থেকে বেরোয়নি!”

শিখা আরো বললে—”কুমারেশবাবুর ঐ চিঠি—ঐ তারিখের চিঠি। এ থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে—এ ব্যাপারে দুজনের ষড়যন্ত্র! খুনের মতলব গোড়ায় ছিল না—কিন্তু নিরুপায় হয়ে খুন। এবং এ—খুনে কুমারেশবাবুর সংস্রব—তারো প্রমাণ প্রচুর।”

কুমারেশের দিকে চেয়ে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”গাড়ী থেকে লাঠি মারতে দেখা—খাশা গল্প বানিয়েছিলেন কুমারেশবাবু। কিন্তু তা টিকলো না। ভাগ্যে ‘টেষ্ট’ নেওয়া হয়। তার উপর হাকিম বংশীবাবু—তিনি বলেন, তিনি অপেক্ষা করেছিলেন অনেকক্ষণ—প্রায় একঘণ্টা অথচ মনোহরবাবু বলেন আধঘণ্টা!”

শিখা বললে—”আসামী যত হুঁশিয়ার হোক, আমার যা অভিজ্ঞতা, আমি দেখেছি, কোথাও না কোথাও এমন গলতি থাকে—যাতে আসামী কোনো কালে শেষ রক্ষা করতে পারে না।”

জেরায় জেরায় মনোহরবাবুকে আর কুমারেশকে স্বীকার করতে হলো। মনোহরবাবু বললেন—”পুলিশে শ্রীপতিবাবু ফোন করেন, তাঁকে অ্যারেস্ট করিয়ে দেবেন বলে—তখন মরিয়া হয়ে উঠি। লাঠি মারি ওঁর মাথায়। মারা যাবেন, ভাবিনি। কিন্তু ভয় হলো ওদিকে পুলিশের সঙ্গে ফোনের লাইন! তখন ঐ গল্প—”

মনোহরবাবু এবং কুমারেশকে চালান দেওয়া হলো কোর্টে।

দায়রার বিচারে মনোহরবাবুর হলো দশ বৎসর কারাদণ্ড—কুমারেশের হলো সাত বৎসর কারাদণ্ড।

শচীন্দ্রবাবুকে স্বামী পেয়েও রাগিণী দেবীর মনে আনন্দ নেই। শ্রীপতিবাবুর সঙ্গে তার ঐ ঝগড়া—বিবাদ—মনে কাঁটা বিঁধে আছে যেন! এ কাঁটার যাতনা রাগিনী জীবনে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না!

[মূল বানান অপরিবর্তিত]

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *