১০. ম্যাডাম, চিনতে পারছেন

দশ

—ম্যাডাম, চিনতে পারছেন?

—না মানে ঠিক…কে বলুন তো?

—আমি কিংশুক। কিংশুক গুহ। আগে কয়েকবার এ বাড়িতে স্যারের কাছে এসেছি।…এইটিসেভেনের ব্যাচ। স্যার কি আছেন?

—ও। এসো এসো, ভেতরে এসো। মন্দিরা দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, কিন্তু তোমাকে তো একটু বসতে হবে। তোমার স্যার স্নানে ঢুকেছেন।

—এত তাড়াতাড়ি? কিংশুক ঘড়ি দেখল। সাতটা পঁয়ত্রিশ। সাতসকালে হাঁ হাঁ করে ছুটে এল, তবু কি কথা বলা যাবে না? বেতের সোফায় বসতে বসতে একটু আশঙ্কিত মুখেই জিজ্ঞেস করল, স্যার কি এখনই বেরিয়ে যাবেন?

—না না, উনি তো বেরোবেন সেই সাড়ে নটায়। আটটার মধ্যে স্নান সারা ওঁর অভ্যেস। সে কী বা গ্রীষ্ম, কী বা শীত। মন্দিরা অন্দরের দিকে এগোল, বোসো, আমি বলে আসছি।

ছোট্ট ঘরখানায় বসে থাকতে থাকতে একটা চাপা উদ্বেগ অনুভব করছিল কিংশুক। পাখাটা যেন যথেষ্ট জোরে ঘুরছে না, অল্প অল্প গরম লাগছে। পকেট থেকে তোয়ালে রুমাল বার করে মুছল ঘাড় গলা, টেনশান কমাতেই আলগা চোখ বোলাল ঘরে। স্ট্রেঞ্জ, ঘরটার কিচ্ছু বদলায়নি! সেই মান্ধাতার আমলের বুককেস, সেই জগদ্দল টেবিল, কোনায় টুলের ওপর টিভি! জানলার পর্দাগুলোও যেন একই রকম আছে! বাহারি, কিন্তু ছিটকাপড়ের। হঠাৎ ঢুকে মনে হয় বুঝি কালই সে এসেছিল এখানে, মাঝে যে প্রায় একটা যুগ কেটে গেছে, ঘরে তার কোনও চিহ্নই নেই!

মন্দিরা ঘুরে এসেছে। মুখে হাসি হাসি ভাব, আচ্ছা, তুমি খুব মিষ্টি খেতে ভালবাসতে না?

কিংশুক লাজুক মুখে বলল, হ্যাঁ। একবার এখানে এক সঙ্গে দশটা রাজভোগ খেয়েছিলাম।

—দেখেছ, আমার ঠিক মনে আছে। ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল মন্দিরা। উল্টো দিকে বসেছে। ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি খুব দুষ্টুও ছিলে। খুব ভাল ক্যারিকেচার করতে।

কিংশুকের হাসি চওড়া হল, আপনার দেখি সবই স্মরণে আছে!

—তা তুমি এখন করছ কী? আছ কোথায়?

—কয়েক বছর মেডিকেল সার্ভিসে ছিলাম। গায়নোকলজিতে এম ডি করলাম…এখন সেভাবে কোথাও অ্যাটাচড নেই।…মানে প্রাইভেট প্র্যাকটিসই করছি। বলেই খানিকটা কৈফিয়তের সুরে কিংশুক বলল, সার্ভিসে আর জয়েন করলাম না…শরীরে ঠিক স্যুট করল না…

—ভাল করেছ। প্রাইভেট প্র্যাকটিস তো করতেই হবে। তোমার স্যারদের হাসপাতাল আর কতটুকু কভার করে! সবাই মিলেই তো…। মন্দিরা মৃদু হাসল আবার, বিয়ে থা করেছ নিশ্চয়ই?

ঘাড় নাড়ল কিংশুক, একটিই ছেলে। থ্রি প্লাস।

—বাহ্। খুব ভাল।

কিংশুক আলগাভাবে জিজ্ঞেস করল, স্যারের ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল না?

—হ্যাঁ। ও তো যাদবপুর থেকে পাশ করেছে। এখন চাকরি নিয়ে পুনেতে আছে। আর মেয়ের তো গত বছর বিয়ে দিলাম। শ্রীরামপুরে। মেয়ে জামাই দুজনেই পড়ায়। কলেজে।

—আপনিও কোথায় যেন পড়াতেন না?

—এখনও পড়াই।…স্কুল এখন বন্ধ, হাত পা ছড়িয়ে দুটি উপভোগ করছি।

কথা বলে বলে ভেতরের চাপা আন্দোলনটা প্রশমিত হচ্ছিল কিংশুকের। এখন অনেকটা সহজ বোধ করছে সে। ছাত্রমহলে ডি এস এম বরাবরই খুব পপুলার ছিল, পড়ানোর গুণে। আজ স্যারের ছেলেমেয়েরা থিতু হয়ে গেছে শুনে বেশ ভালই লাগছিল। তাদের নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করছিল আরও, মন্দিরা জবাব দিচ্ছিল।

দেবশঙ্কর এসে গেছে। কালোকুলো গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, হাতে সিগারেট দেশলাই। কিংশুককে দেখে কয়েক সেকেন্ড থেমে রইল দেবশঙ্কর, বুঝি চিনে নিতে সময় নিল একটু। তারপর স্বাভাবিক স্বরে মন্দিরাকে বলল, তুমি ওকে চা-টা খাইয়েছ?

—এই তো, যাই।

—আমার জন্যও কোরো এক কাপ।

মন্দিরা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবশঙ্করের স্বর বদলে গেল। গম্ভীর মুখে বলল, তুমি কি আমার কাছে তোমার কেসের ব্যাপারে এসেছ?

এক লহমায় বদলে গেছে ঘরের হাওয়া। কিংশুক থতমত মুখে বলল, হ্যাঁ স্যার। শুনলাম আপনি ইনভেস্টিগেশান টিমে রয়েছেন…

—তাই আমার সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে চলে এলে?

—হ্যাঁ স্যার। কিংশুক সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করল, ভাবলাম কোয়্যারি করার জন্য আপনি তো আমায় সাম-ডে অর আদার ডাকবেনই।

—জাস্ট ফর দিস রিজন? নাথিং মোর নাথিং লেস?

—অফ কোর্স স্যার। আপনি তো আমাকে আগে থেকেই চেনেন, তাই নিজের পজিশানটা আপনার কাছে ক্লিয়ার করতে এসেছি। অফ মাই ওউন।

কপালের কুঞ্চিত পেশি শিথিল হল দেবশঙ্করের, ও কে। আজ আমার হাতে খুব একটা টাইম নেই, তবু কিছু কথা তো হতেই পারে।

কিংশুক টান টান। বলল, স্যার, আমি কেসটা নিয়ে সত্যিই মেন্টালি ডিস্টার্বড আছি।

—হুম্‌। এক সেকেন্ড। বলেই উঠে গেল দেবশঙ্কর। তার হাঁটাচলার ভঙ্গিটি বেশ দ্রুত। বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই, এখনও শরীরের কোষে তার কোনও ছাপ পড়েনি। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঘুরে এসেছে, হাতে একটা মোটাসোটা ফাইল। খুলতে খুলতে বলল, তুমি তো প্রি-অপারেটিভ চেক আপ ঠিক ঠিকই করে নিয়েছিলে দেখলাম।

—হ্যাঁ স্যার। ই সি জি ওয়াজ অ্যাবসোলিউটলি নরমাল। সুগার পি পি নাইনটিএইট।

—আর হিমোগ্লোবিন ছিল থারটিন পয়েন্ট ওয়ান, রাইট?

—ইয়েস স্যার।

—ডিওরিং অপারেশন ব্লাড লস কেমন হয়েছিল?

—হয়েছিল। বাট নট দ্যাট সিগনিফিক্যান্ট।

—ও টিতে তোমায় কে অ্যাসিস্ট করেছিল?

—আর এম ও প্রতিম মুখার্জি।

—কেসটা সিজারিয়ানই করার দরকার পড়েছিল কেন? হোয়াই নট নরমাল?

—লেবার প্রোগ্রেস করছিল না স্যার। স্টেশন একেবারেই নামছিল না। ইট ওয়াজ অলমোস্ট ইন জিরো।

—তুমি কতক্ষণ ওয়েট করেছ?

মুহূর্তের জন্য থমকাল কিংশুক। সেদিন ওই কেসে আরও কিছুক্ষণ হয়তো অপেক্ষা করা যেত। বিকেল সন্ধে অবধি দেখলে ডেলিভারি নরমাল হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু সে কথা কি এখন দেবশঙ্কর মিত্রকে বলা যায়!

গলা ঝেড়ে কিংশুক বলল, পেইন আগের রাত্তিরেই স্টার্ট করে গেছিল স্যার। পেশেন্ট এগ্‌জস্ট করে যাচ্ছিল। তাই পার্টিকে জানিয়ে, তাদের সম্মতি নিয়েই…

—পার্টি নয়, বলো নিয়ার রিলেটিভ।

—হ্যাঁ স্যার, আত্মীয়। কিংশুক তাড়াতাড়ি সংশোধন করে নিল। পেশেন্টের বাড়ির লোককে পার্টি বলা পছন্দ নয় ডি এস এমের, মনে পড়ে গেছে। ক্লাসে একবার এই নিয়ে ঠাট্টা করে কী যেন বলেওছিলেন ডি এস এম। যত্ত সব ফালতু মূল্যবোধ!

দেবশঙ্কর ফাইল উল্টোচ্ছে। আলগাভাবে বলল, তোমরা, আজকালকার ছেলেরা বড় ইম্‌পেশেন্ট হয়ে গেছ কিংশুক। হোয়াই কানট ইউ ওয়েট এ বিট লংগার ফর নরমাল ডেলিভারি?

কিংশুক চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করল। সিজারিয়ান সার্জারি ভাল, না নরমাল ডেলিভারি, এ নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষকের সঙ্গে তর্ক জোড়ার পরিণতি তার পক্ষে সুখদায়ক নাও হতে পারে।

দেবশঙ্কর মুখ তুলল, ইউটেরাসে নিশ্চয়ই কোনও অ্যাবনরমালিটি ছিল না?

—না স্যার। নাথিং কংকারেন্ট ওয়াজ ফাউন্ড। নো ফাইব্রয়েড, নো র‍্যাপচার…

—তুমি নিশ্চয়ই ডায়োথারমি ইউজ করোনি?

—না স্যার। সিজারিয়ানে তো সুইচারিং করি।

—ঠিকই করো। সেটাই ভাল…সুইচারিং কি তুমি নিজের হাতে করেছিলে?

—হ্যাঁ।

শব্দটা বেশ জোরের সঙ্গেই উচ্চারণ করল কিংশুক। এ কাজটা সত্যিই সে এখনও নিজের হাতে করে, অনেক প্রবীণ ডাক্তারদের মতো জুনিয়ারের হাতে ছেড়ে দেয় না।

ফাইল থেকে একটা কাগজ বার করে নিল দেবশঙ্কর। চোখ বুলিয়ে বলল, আচ্ছা, তুমি ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছ কার্ডিও রেসপিরেটারি ফেলিওর ইন কেস অফ পেরিটোনাইটিস উইথ শক…

—হ্যাঁ স্যার।

—তুমি কি করে শিওর হলে পেশেন্টের পেরিটোনাইটিসই হয়েছিল? মেয়েটির পেট তো আর তুমি ওপেন করতে পারোনি?

—সিম্পটমগুলো সেদিকেই ঠেলেছে স্যার। প্রেশার হু হু করে ফল করে গেল, অ্যাবডোমেনে অ্যাকিউট পেইন, সাংঘাতিক রিজিডও হয়ে গিয়েছিল অ্যাবডোমেন, পেট ফুলে যাচ্ছিল, বডি ব্লু হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ, পালস অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশান পয়েন্ট প্রায় সেভেনটি…প্রাইমারি হেমারেজ ছাড়া আর কী হতে পারে স্যার?

—অ্যাপারেন্টলি অবশ্য আমারও তাই মনে হচ্ছে…

মন্দিরা চা এনেছে। সঙ্গে প্লেটে সন্দেশ আর কাজু। ঢাউস টেবিলে ট্রে রেখে বলল, ঘরে রাজভোগ নেই, এই সন্দেশেই কাজ চালাতে হবে।

দেবশঙ্করকে মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পেরে অনেকটাই হালকা বোধ করছিল কিংশুক। হাসিমুখে বলল, আমি কিন্তু মিষ্টি খাওয়া এখন অনেক কমিয়ে দিয়েছি ম্যাডাম।

দেবশঙ্করের স্বরও আবার সহজ। ডাক্তারি জেরার কণ্ঠ বদলে এখন সে আবার স্নেহময় শিক্ষক, কেন, তোমার কি সুগারের টেন্ডেন্সি আছে নাকি?

—না, এমনিই…। মিষ্টি আজকাল আর তত ভাল্লাগে না।

—অর্থাৎ তোমার রুচির বদল হয়েছে, অ্যাঁ? ভাল ভাল। তোমরা আজকালকার ছেলেরা বেশ তাড়াতাড়ি বদলে ফ্যালো নিজেদের।

কথাটায় কি কোনও সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে? কিংশুক বুঝতে পারল না।

মন্দিরা টিপ্পনি কাটল, অথচ যার নিজেকে বদল করার প্রয়োজন সে কিন্তু একই রকম রয়ে গেল। এই তোমার স্যার। সুগার লেভেল তো ধার ঘেঁসে যাচ্ছে, এদিকে উনি মনের সুখে কাঁড়ি কাঁড়ি মিষ্টি খেয়ে চলেছেন।

—আরে, শোনো শোনো। প্রত্যেক মানুষের লাইফেই সব কিছুর একটা কোটা আছে। সুখ আনন্দ ভোগ খাওয়া দাওয়া…। চেষ্টা করলেও কেউ সেই কোটা পার হতে পারবে না। আমার মিষ্টির কোটাটা যেদিন ফুরিয়ে যাবে, দ্যাট ডে আই উইল স্টপ। আমার যুক্তি কি খারাপ, কিংশুক?

কিংশুক ঘট করে মাথা নেড়ে দিল বটে, কিন্তু সেভাবে হাসতে পারল না। দেবশঙ্কর মিত্রর গোটা জীবনটাই কাটল ছাত্র পড়িয়ে আর সরকারি হাসপাতালে রুগি ঘেঁটে। জীবনে কোনওদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেনি, লাখ টাকা দিলেও কোনও ভি আই পি পেশেন্টকে আলাদা ভাবে দেখবে না দেবশঙ্কর। কলেজে গল্প চালু ছিল মফস্বলে থাকাকালীন নিজের বউকেও নাকি বাচ্চা হওয়ার সময়ে হেলথ সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছিল, এবং বেড না পেয়ে নাকি মাটিতেই শুয়ে পড়তে হয়েছিল মন্দিরাদেবীকে। থাকে এই তিন কামরার ভাড়াবাড়িতে, এখনও নিজের একটা বাড়ি পর্যন্ত তৈরি করেনি। স্ত্রীরোগ আর ধাত্রীবিদ্যার জগতে দেবশঙ্কর মিত্র এক উজ্জ্বল নাম, লোকটার বাড়িতে ঢুকে তা কি টের পাওয়া যায়? গাড়িও নেই, মিনিবাসে হাসপাতাল যায় দেবশঙ্কর, বড় জোর শেয়ার ট্যাক্সিতে। এমন কৃচ্ছসাধন করা ব্যক্তি সুখ আনন্দ ভোগের কীই বা বোঝে? কোটার কথাই বা তোলে কেন? এ যেন দেবশঙ্করের এক চোরা অহঙ্কার, আর পাঁচজনকে ছোট করে দেখানোর অপচেষ্টা। অন্তত কিংশুকের তো তাই মনে হয়।

মন্দিরা স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আজ কখন খেতে বসবে?

—যেমন খাই। ডট অ্যাট নাইন।

—তা হলে আমি রান্নাঘরে যাই, তোমরা কথা বলো।…কিংশুক, তুমি কিন্তু সন্দেশ ফেলে রাখবে না, আমি তা হলে খুব দুঃখ পাব।

কত কারণেই যে মানষ ‘খুব দুঃখ’ পায়! কিংশুকের চোখের সামনে ঝলক ফুটে উঠল রম্যাণির মুখ, ঝলকে মিলিয়ে গেল। বাপেরবাড়িতে নিশ্চয়ই এখন সুখে আছে রুমি, মজাসে আছে। আর যাই হোক, কিংশুকের মতো পাপীতাপীর মুখ তো আর তাকে দেখতে হচ্ছে না!

চা শেষ করে দেবশঙ্কর সিগারেট ধরিয়েছে। ভারী চশমার ওপারে চোখ দুটো যেন ঈষৎ চিন্তামগ্ন।

হঠাৎ কথা শুরু করল, আচ্ছা কিংশুক, তুমি যে সিম্পটমগুলোর কথা বললে কোনওটাই তো তোমার ফার্স্টহ্যান্ড ইনফরমেশান নয়, তাই না?

কিংশুক একটা সন্দেশে সবে কামড় দিয়েছিল, বিষম খেয়ে গেল। সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁঅ্যা…তবে আমি যখন নার্সিংহোমে পৌঁছেছি, তখনও পেশেন্ট এক্সপায়ার করেনি। তা ছাড়া আগাগোড়াই আমার আর এম ও-র সঙ্গে কনট্যাক্ট ছিল।

—তবু এটা তো বলা যায় পেশেন্টের কন্ডিশানের গ্র্যাজুয়াল চেঞ্জটা তুমি অবজার্ভ করতে পারোনি?

—ফিজিকালি পারিনি, বাট…আমি আটমোস্ট চেষ্টা করেছিলাম। পেশেন্টের সামনে থাকলেও যে স্টেজে যা অ্যাডমিনিস্টার করা হত, পর পর করা হয়েছে। ডোপামিন অক্সিজেন হিমাকসিল হোল ব্লাড…একেবারে সিস্টেমেটিকালি।

—আফটার সার্জারি তুমি পোস্ট অপ পেশেন্টকে কতক্ষণ ওয়াচ করেছিলে?

—ঘণ্টা খানেক তো ছিলামই। ছোট করে মিথ্যে বলল কিংশুক। অপারেশানের আধ ঘণ্টা পরেই সে মুনলাইট থেকে বেরিয়ে পড়েছিল এ তথ্য দেবশঙ্করের জানার কী প্রয়োজন! তাড়াতাড়ি বলল, পেশেন্ট তখন কোয়াইট স্টেবল ছিল স্যার।

—পেশেন্টের কন্ডিশান খারাপ হচ্ছে, এ খবর তুমি পেয়েছিলে কটায়?

—অ্যারাউন্ড ফাইভ স্যার।

—কিন্তু পেশেন্টের বাড়ির লোকের স্টেটমেন্ট বলছে চারটে দশে নাকি তোমায় প্রথম কল দেওয়া হয়েছিল?

—তাই কি? কিংশুক চিন্তার ভান করল, হতেও পারে। আমি হয়তো ঠিক টাইমটা নোট করিনি।

—আর তুমি নার্সিংহোমে পৌঁছেছিলে সওয়া সাতটায়, পেশেন্ট এক্সপায়ার করার হার্ডলি মিনিট দশেক আগে, ঠিক?

কিংশুক আড়ষ্টভাবে ঘাড় নাড়ল। আবার ঘামছে অল্প অল্প।

—অতক্ষণ তুমি ছিলে কোথায় হে? কোনও সিরিয়াস পেশেন্ট অ্যাটেন্ড করছিলে?

হ্যাঁ বলে দেবে? যদি ক্রস চেক করে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিংশুক মাথা নামাল, না স্যার।

—চেম্বারে আটকে ছিলে?

—নো স্যার।

—তা হলে করছিলেটা কী? এজাহার বলছে তোমায় বার বার কল দেওয়া হয়েছিল…!

—গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

—ট্যাক্সি ধরে চলে আসতে পারতে!

—না মানে…এমন সিলি ভাবে স্টার্টটা বন্ধ হয়ে গেল, মিস্ত্রি টিস্ত্রি ডাকতে হল, তারপর জ্যাম…বোঝেনই তো স্যার, কলকাতার রাস্তায় একবার আটকে গেলে আর …

—না কিংশুক, খুব কনভিন্সিং হল না। স্টেটমেন্টেও তুমি গাড়ি খারাপ হওয়ার কথা বলেছ, কিন্তু ওভার ফোন একবারও তা জানাওনি। আমি অবশ্য তোমার আর এম ও-কে আর একবার জিজ্ঞেস করে নেব…। তা ছাড়া অলটারনেট ওয়ে অফ রিচিং যখন রয়েছে, তখন তুমি আটকেই বা যাবে কেন? নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ এই তিনটে ঘণ্টা সময় চরম ভাইটাল ছিল?

—কিন্তু আমি কোনও ত্রুটি রাখিনি স্যার। পেশেন্টের ক্রাইসিসের প্রতিটি স্টেজে আমি অক্ষরে অক্ষরে মেডিকেল রুল ফলো করেছি।

—রুল বলে কিছু নেই কিংশুক। বিপদের সময়ে ঝুঁকি নিয়েও অনেক চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পৌঁছে গেলে তুমি হয়তো নিতেও। হয়তো দু ঘণ্টা আগেই পেট ওপেন করতে।

কিংশুক গোঁয়ারের মতো বলল, জানি না স্যার। আই অ্যাম নট শিওর। যা যা করেছি, হয়তো ওখানে প্রেজেন্ট থাকলে তাই তাইই করতাম।

—স্টিল ইট উড হ্যাভ বিন এন এফর্ট। ঠিক বা ভুল ডাক্তারদের হতেই পারে। যে কোনও মানুষেরই হয়। তোমার ভুলে হয়তো পেশেন্ট মারা যেতে পারত, তবু তোমার চেষ্টাটা টোটাল এবং অনেস্ট হলে তখন আর বাঁচা-মরা ঠিক-ভুল কিছুই ম্যাটার করে না। দেবশঙ্কর বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। হেলান দিয়েছে সোফায়, চোখ বুজল। মন্দ্র স্বরে বলল,—তুমি ভাল স্টুডেন্ট ছিলে কিংশুক, ডাক্তার হিসেবেও তোমার প্রশংসা আমার কানে আসে…। সেদিন অপারেশানটাও পসিবলি তুমি নিখুঁত করেছিলে, যদি কোনও ছোটখাটো গণ্ডগোল থেকেও থাকে সে আর এখন ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়, আর সেটা তোমার ইচ্ছাকৃতও নয়। কিন্তু এই কর্তব্যে অবহেলাটাকে তো আমি সেভাবে দেখতে পারছি না কিংশুক।

—আই ওয়াজ ইন এ ফিক্স স্যার। কিংশুকের গলা কেঁপে গেল, আমি ওই মুহূর্তে বড় দোলাচলে পড়ে গেছিলাম।

—কেন? কারণ তোমার জীবনে কোন কাজটা অগ্রাধিকার পাবে সেটাই স্থির করতে পারোনি। একজন মানুষ হয়েও একটা মানুষের মৃত্যু আর তোমার একটা কাজ, মে বি গাড়ি সারানো, মে বি এনি ড্যাম থিং, এ দুটোকে নিক্তির দু পাল্লায় চাপিয়ে তুমি নাড়াচাড়া করেছ। হিপোক্রিটাসের শপথবাক্য তুমি ভুলে গেলে? দিস ইজ হাইলি আনএথিকাল কিংশুক।

দেবশঙ্করের শেষ বাক্যটা কিংশুকের কানে প্রতিধ্বনির মতো আছড়ে পড়ল। ক্ষণিকের জন্য বোধহীন কিংশুক, যেন কানে তালা লেগে গেছে। বুকের মধ্যে মারুতি গাড়ির ইঞ্জিন চলছে, লাফাচ্ছে রক্তকণিকারা। একটা বুনো রাগও যেন ফুঁসে উঠল শরীরে। এই তেঁএটে একবগ্গা লোকটার কাছে এসে কোনও লাভ হল না। মিছিমিছি। সাতসকালে কিছু অমৃতবাণী…

পথে বেরিয়েও নিজের ওপর রাগটাকে বাগে আনতে পারছিল না কিংশুক। বিস্বাদ মেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে। ফুটপাথের একটা আধা উলঙ্গ বাচ্চা দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিল, ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল, অশ্লীল খিস্তি করল ছেলেটাকে। শালা, চাকার তলায় এসে গেলেই ভাবতে হত কোনটা জীবনের প্রায়োরিটি ছিল! শালা নীতিকথা শোনায়। হারামজাদা। উফ্‌, কী কুক্ষণে যে কিংশুক লোকটার কাছে গেল! শখ করে গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়া! কী ভেবেছিলি কিংশুক, অ্যাঁ? স্যার এককালে খুব ভালবাসত, প্রিয় ছাত্রকে দেখে গলে জল হয়ে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ফেবারে নোট দিয়ে দেবে? তেল মারতে গিয়েছিলি শালা? ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে, কেমন গুয়ে বসিয়ে দিল তোকে! কপাল কপাল, যাকে খুশি করতে গিয়ে আজ কিংশুকের মানসম্মান যেতে বসেছে, তিনি তো দিব্যি গোঁসা দেখিয়ে বাপেরবাড়ি! সেখানে কিংশুকের কী কুচ্ছো গেয়ে বেড়াচ্ছে কে জানে!

রোদ্দুর এর মধ্যেই বেজায় চড়া। খুনে মেজাজে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে সূর্য, ঝলসে দিচ্ছে পৃথিবীকে। বর্ণহীন আকাশে পোড়া পোড়া ঝাঁঝ। বাতাস আছে, তবে যেন ধেয়ে আসছে মরুভূমি থেকে। শুকনো, গা জ্বালানো। সবে সাড়ে নটা, এখনই যেন তাপে ধুঁকছে শহর। পিচ গলছিল।

জুপিটারে কিংশুকের পেশেন্ট আছে, আগে তার ওখানেই যাওয়ার কথা। তবু সোজা মুনলাইটে চলে এল কিংশুক।

ঢুকেই দেবমাল্যর মুখোমুখি। টপকে প্রায় চলে যাচ্ছিল কিংশুক, হেঁকে উঠল দেবমাল্য, কী রে ছুটিস কেন? কটায় ও টি?

—ও টি নেই। মিস্টার লালের সঙ্গে দেখা করব।

—হঠাৎ? এখন?

—একটা আরজেন্ট ব্যাপার আছে। মিস্টার লাল এসেছে কি না জানিস?

—এসেছে। কিচেন টয়লেট সব ঘুরে ঘুরে দেখছিল।…তোর মুখটা এমন ভেটকে আছে কেন রে? দেবমাল্য এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামাল, লালের সঙ্গে কিছু ডিসপিউট হয়েছে?

—না রে, অন্য ব্যাপার।

দেবমাল্যর চোখ টেরচা। খানিক ইতস্তত করে দাঁড়িয়ে গেল কিংশুক। এখানে দেবমাল্য চেম্বার করে এখন, গোটা চার পাঁচ পেশেন্টও এসেছে, তবু তার সঙ্গে ঢুকে পড়ল খুপরিটায়। বসল। উগরোল বিশ্রী সকালটাকে। একটু বুঝি লাঘব হল ভার। কিছু কিছু অপমান একা একা বহন করা বড় কঠিন।

দেবমাল্যর ঠোঁট সরু হচ্ছে। মাথা নাড়ল, ওফ্‌, ওই খোঁচোটা দিনকে দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে! ব্যাটার লাইফটাও তেমন হয়েছে! সব দিকে ডলা খাচ্ছে ব্যাটা!

—মানে?

—ছেলে তো জোর দাগা দিয়ে গেছে! রেজাল্ট তো তেমন সুবিধের হয়নি, চাকরি বাকরিও জোটেনি এদিকে, কী একটা কাজ নিয়ে পুনে গেছিল…

—হ্যাঁ, স্যারের বউটা বলছিল বটে। এখন ওখানেই নাকি সেটল্‌ড…

—হ্যাহ্, সেটল্‌ড! একটা মরাঠি মেয়েকে টুপিটাপা দিয়ে বিয়ে করে সে এখন শ্বশুরের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। নামেই ম্যানেজার, আসল কাজ লেবার খাটানো। ছেলে তো দেবশঙ্করকে সাফ বলে দিয়েছে এ তল্লাটে আর ফিরছে না। সারা জীবন আমি কত সৎ আমি কত সৎ করে ভড়ং দেখিয়ে ওই তো ছেলে পয়দা করেছে দেবশঙ্কর মিত্তির!

—তুই এত খবর পেলি কোথ্‌থেকে?

—সোর্স আছে। দেবমাল্য ভুরু নাচাল, আমার বোনের শ্রীরামপুরে বিয়ে হয়েছে, দেবশঙ্করের মেয়ের প্রতিবেশী। বোনই বলে, দাদাটা অমানুষ। অবশ্য বোনটিও কিছু দেবী নয়। কলেজে পার্টটাইম করে ফুলটাইমারকে লটকেছে। এখন সকালসন্ধে বরকে মাদুর শতরঞ্চি বিছিয়ে দেয়। হলুদ নোট নাড়িয়ে বর দেদার কামাচ্ছে আর বউ সারাক্ষণ বাপের সততার গরবে মটমট করছে! এদিকে বর যে কালো টাকার কুমির সে ব্যাপারে স্পিকটি নট।

—শ্বশুরও নিশ্চয়ই জামাই-এর নিন্দে করে না?

—ফুঃ, বয়েই গেছে। দেবশঙ্কর তো নিজের মাথার পেছনের জ্যোতিতেই বিভোর! আর কটা দিন যেতে দে, রিটায়ারটা করুক, সব জ্যোতি নিবে যাবে। তখন ঝাঁপ খুলে দুশো পাঁচশো হাঁকবে। কম তো দেখলাম না…দীপেন তালুকদার, সততার দেমাকে গগন ফাটাত, প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে ওয়াক থু করত…সরকারি চাকরিটি যেই গেল, ওমনি গান্ধীবাবার চেলা! গান্ধীমার্কা কাগজ পকেটে না ঢুকিয়ে শালা এখন রুগির নাড়ি স্পর্শ করে না।

উন্নতশির মানুষদের অধঃপতিত হওয়ার কাহিনী শুনতে শুনতে হর্ষ জাগছিল কিংশুকের। নিজেকে যেন আর তত ছোট লাগছে না।

বলল, কিন্তু আমার কেসটা কী করা যায় বল তো? শালা দেবশঙ্কর তো শিওর এগেনস্টে রিপোর্ট দেবে…

—বাকি দুজন কী বলছে?

—এক ডক্টর নাহা, ফরেনসিক মেডিসিনের, ওকে মোটামুটি ম্যানেজ করা গেছে। লালের সঙ্গেও ওর খুব র‍্যাপো। এসেওছিল তো এখানে, সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। ও লোক ভাল, জাস্টিস করবে। আর আছে ডক্টর সুকুমার পাইন। একদম মাটির মানুষ, সাতে পাঁচে থাকেন না, নিজের ফার্টিলিটি ক্লিনিক নিয়ে সদা ব্যস্ত। আমি বেশ কয়েকটা জটিল কেস ওঁর কাছে পাঠিয়েছি, হি উইল নট ডু এনি হার্ম টু মি। তবে দেবশঙ্করের চোনাটুকু পড়লে হয়তো সব গড়বড় হয়ে যাবে।

দরজায় সিস্টার, স্যার স্লিপগুলো দিয়ে যাব?

—কজন আছে?

সিস্টার গুনল, সাত।

—কাজের কথা চলছে। একটু পরে ডাকছি।

সিস্টারের মুখ অন্তর্হিত হওয়ার পর দেবমাল্য বলল, তা লালের সঙ্গে তোর কী কাজ? কেস নিয়ে?

—হ্যাঁ, মিস্টার লালই তো লইয়ার ঠিক করে দিয়েছিল। ভাবছিলাম ওর সঙ্গে একটু ডিসকাস করে ওকে নিয়েই লইয়ারের কাছে যাই।

—দ্যাখ, কথা বল। তবে আমার একটা সাজেশন শুনবি? কেসটা একেবারে ডাইরেক্ট ফয়সালা করে ফ্যাল।

কিংশুক ঝুঁকল, কী ভাবে?

—কেসটা যে করেছে তার হাতে স্ট্রেট কিছু ধরিয়ে দে না। কী করে সে?

—পেটি পিওন। গভর্নমেন্ট অফিসের।

—পিওন? তার মানে হাঁ খুব বড় নয়। এবং নিজের বুদ্ধিতে কেস করেনি, কেউ করিয়েছে।…ওর গব্বায় লাখখানেক গুঁজে দিয়ে হাত ধুয়ে ফ্যাল। কেন এ সব উটকো ঝামেলা গড়াতে দিচ্ছিস!

—মন্দ বলিসনি। কিংশুক ঘাড় দোলাল, কিন্তু লোকটাকে অ্যাপ্রোচ করা যায় কী করে? পিওন ক্লাস, যদি প্রস্তাব শুনেই হাত ফাত চালিয়ে দেয়?

—আরে ছাড়। টাকার গন্ধে গোখরো সাপও ফণা নামায়। তা ছাড়া তুই কেন অ্যাপ্রোচ করবি? পয়সা দিয়ে উকিল পুষছিস কী জন্যে? সে যোগাযোগ করবে, সে সেটল করবে। ঢের টাকা বেঁচে যাবে তোর, আই ক্যান অ্যাশিওর ইউ।

জব্বর আইডিয়া! এত সরল পন্থাটা আগে মাথায় আসেনি কেন? কিংশুক মনে মনে দেবমাল্যর তারিফ করল। ব্যাটা শুধু নাক কান গলায় টর্চ মেরে মেরেই মানবচরিত্রের অনেকটাই দেখে নিয়েছে। সত্যি, তেমন কিছু করা গেলে বেশ হয়। গৃহবিবাদও কাটে, বিবেকের ট্যাংকিও সাফ। যার বউ মরেছে সে নিজেই যদি কেস মিটিয়ে নেয়, কার কী বলার আছে!

যদি লেগে যায়…! যদি টোপ গেলে…! হাহ্ হাহ্‌ হা, রম্যাণির সামনে একসঙ্গে জোড়া বুড়ো আঙুল নাচাবে কিংশুক।

এগারো

তাপসীর গলা উত্তরোত্তর চড়ছিল, ও কথা বোলো না নন্দাদি, জিভ খসে পড়বে। আমরা কি কোনওদিন তোমাদের জন্য কিছু করিনি?

দোতলা থেকে ঝাঁঝাঁলো জবাব উড়ে এল, অনেক উপকার করেছ! এত বড় বাড়ির আধখানা প্রায় বিনি পয়সায় গিলে বসে আছ, এতেই না আমি বর্তে গেছি!

—তা তো বলবেই। কাজের সময়ে কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি! মনে পড়ে, বাবলুর বাবা না থাকলে তোমার বরকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার লোক জুটত না?

—সব মনে পড়ে! বাড়ি থেকে পি জি হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার জন্য বাবলুর বাবা আমার কাছ থেকে দশ টাকা নিয়েছিল, তাও মনে আছে!

—কেন নেবে না? টাকা কি খোলামকুচি? তোমার বর মদ খেয়ে লিভার পচাবে, তার জন্য আমার ঘর থেকে সোনাদানা যাবে?

—বটেই তো। বটেই তো। তোমরা উপুড়হস্ত করবে কেন? তোমার টাকা সোনাদানা, আমার টাকা কুড়িয়ে আনা! আরও বলি তাপসী, আমার বর যাই খাক, তোমাদের ভাড়ার পয়সায় খায়নি! ওতে আমার বরের একটা বোতলের দামও হত না! আমার বর মদখোর, তো তোমার বর চশমখোর!

—ঘুষখোর তো নয়! লোকের ট্যাঁক তো কাটেনি!

—তোমার ছেলের থেকে ভাল। সে তো লোকের গলা কাটছে! রুগি মেরে টাকা কামাচ্ছে!

তাপসীর পিত্তি জ্বলে গেল। কী আস্পর্ধা কী আম্পর্ধা, বাবলুকে তুলে কথা! বাবলু তোর মেয়েকে ভাল ডাক্তার দেখিয়ে দেয়নি? এক পয়সা ফি দিতে হয়েছিল তোদের? মনে কী প্যাঁচ, সামান্য দশটা টাকা দিয়েছিল, তাও এখনও স্মরণে রেখেছে! আসুক বাবলুর বাবা বাজার থেকে, ওই বুড়ির সঙ্গে আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। কদিন ধরে কী আরম্ভটা করেছে কী? কথায় কথায় পা বাধিয়ে ঝগড়া! ওই ভাইপোটাই হাড়ে হারামজাদা। আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে! তাতাচ্ছে পিসিকে! মেঘনাদ মেঘনাদ! হচ্ছে তোর দাঁড়া।

কিংশুক স্নান সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়েছে। ঘরে যেতে যেতে বিরক্ত মুখে বলল, সাতসকালে এসব কী হচ্ছে মা? বাড়িতে তো কাক চিল বসতে পারছে না!

—আমি কী করলাম? নন্দাদিই তো শুরু করল! চিরকাল সকালবেলা আমাদের উঠোনের কলটা খোলা থাকে, আজ বলে কিনা ওই কল বন্ধ রাখতে হবে!

—তা বলে ওই ভাষায় ঝগড়া করতে হবে? এটা কি অশিক্ষিতর বাড়ি? বস্তি পেয়েছ?

তাপসী দমে গেল, আমি কী খারাপ কথা বলেছি? ওই তো তোর বাবাকে চশমখোর…

—আমার কানে সব এসেছে মা। প্লিজ নিজেকে একটু কন্ট্রোল করো।…আমার এ সব নোংরামি পছন্দ হয় না।

তাপসী ম্রিয়মাণ মুখে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মাথা শান্ত না হোক, চটপট বাবলুর খাবারটা তো করে দিতে হবে। ইদানীং খাওয়াতে খুব পিটপিটানি বেড়েছে বাবলুর। পাঁউরুটিতে মাখন বেশি লাগালে খেপে যাচ্ছে, কলা নরম হলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, কাল ডিমসেদ্ধ একটু শক্ত হয়ে গিয়েছিল বলে স্রেফ সরিয়ে রাখল, মুখে ছোঁয়াল না পর্যন্ত।

মেজাজটাও সারাক্ষণ বড় তিরিক্ষে থাকছে বাবলুর। কারণটা অবশ্য তাপসী আন্দাজ করতে পারে। রুমির সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় ছটফট করছে বাবলু, এদিকে ভাঙবে তবু মচকাবে না।

পরশুই রাত্রে তাপসী বলেছিল, হ্যাঁ রে বাবলু, আট দিন হল ওরা গেছে, একদিন শিবপুর থেকে ঘুরে এলি না?

—কেন? কী করব গিয়ে?

—বউ ছেলে কেমন আছে একবার দেখে আসবি না?

—নিজেরাই তো দিনে দশ বার করে ফোন করছ, আমার আবার আলাদা করে খবর নেওয়ার দরকারটা কী?

—এ কেমন কথা বাবলু? রুমিটা রাগ করে চলে গেল…

—তোমায় বলেছে রাগ করে গেছে?

—বলার দরকার হয় না। বোঝা যায়।

—তুমি আমাদের ব্যাপারে একটু কম বুঝবে মা?

বলেই বাবলু দুম করে খাওয়া ফেলে উঠে গেল। বুকটা চিনচিন করে উঠেছিল তাপসীর। এক সময়ে এই মা ছাড়া চলত না বাবলুর, মন প্রাণের সব কথা মাকে এসে ব্যাকব্যাক করে না বললে পেটের ভাত হজম হত না। এই রুমির সঙ্গেই যখন ভাবভালবাসা চলছে, রোজ এসে আজ রুমি এই বলল মা, আজ রুমি এই করল…! রুমিকে কেমন দেখলে মা, অ্যাপ্রুভ করছ তো…! সেই ছেলে এখন ভাল কথা বলতে গেলে বলে নাক গলাচ্ছ! বউ-এর জন্য বাবলুর মন পুড়বে, এটাই তো নিয়ম, এমনটাই তো হওয়া উচিত। তাপসীও তো চায় রুমি বাবলু সুখে শান্তিতে থাকুক। কী একটা তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে যে মনোমালিন্য হল দুজনের! রুমিটারও জেদ কম নয়, একটুও নত হতে শেখেনি। বরকে যদি বউ নাই বুঝল, তাহলে আর বরবউ সেজে থাকা কীসের!

ওপরে আবার চেঁচাচ্ছে নন্দাদি। তাপসী কান পাতল না, নন্দার ব্যবস্থা বাবলু বেরিয়ে গেলে করা যাবে। প্লাগ লাগিয়ে টোস্টারে পাঁউরুটি সেঁকতে দিল। গ্যাসে ফ্রাইপ্যান বসিয়েছে, চিলতে ঘি ছিটিয়ে মুরগির ডিমের পোচ বানাচ্ছে। জ্বাল দেওয়া দুধ ছড়ানো কাঁসিতে ঢেলে রাখল, বাবলু গরম দুধ খেতে পারে না।

অতীন বাজার নিয়ে এসে গেল। খুশি খুশি মুখ, আজ ভাল পাবদা পেয়ে গেলাম, বুঝলে। বিশাল বিশাল, আটটাতে এক কেজি। ইলিশও ছিল, একশো আশি। বাংলাদেশের মাল। নিতে গিয়েও নিলাম না, রুমিটা নেই, মেয়েটা এত ইলিশের ভক্ত…

দুধ গেলাসে ঢালল তাপসী, বাবলুর কলা এনেছ?

—এই তো। ব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি এক ছড়া মর্তমান কলা বার করেছে অতীন, তৈরি কলা, বাবলু খেতে পারবে।

—বাবলুকে ডাকো তো। বলো ওর খাবার রেডি।

ডাকতে হল না, মোবাইল কানে চেপে বাবলু হাজির। অতীনও খবরের কাগজ নিয়ে টেবিলে বসল। চোখ বোলাচ্ছে হেড লাইনে, আলগা আলগা।

ফোনালাপ সেরে বাবলু টোস্ট চিবোচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, তোমাদের হলটা কী মা? নন্দাজেঠিমার সঙ্গে বেশ তো সখীত্ব ছিল, হঠাৎ লেগে গেল কেন?

অতীন ঝট করে কাগজ থেকে চোখ তুলেছে,—আজও লেগেছিল বুঝি?

—সে কি! রোজই হচ্ছে নাকি?

—হচ্ছে তো। তাপসী ভার মুখে বলল, পান থেকে চুন খসলে নন্দাদি আজকাল মুখ খিঁচোচ্ছে।

—চায় কী? ভাড়া বাড়াতে হবে?

—না নাহ্। অতীন গলা ঝাড়ল। ধূর্ত হেসে বলল, আমাদের মুরগি করতে চেয়েছিল। পারেনি তো, তাই খুব জ্বালা ধরেছে।

—মুরগি?

—ইয়েস। উনি নিজের বাড়ি সারাবেন, আমাদের সে জন্য তিরিশ হাজার টাকা দিতে হবে। তাও আবার অ্যাডভান্স ট্যাডভান্স নয়, একেবারে উপঢৌকন। মামদোবাজি পায়া? আমি স্ট্রেট না বলে দিয়েছি।

—হঠাৎ বাড়ি সারানোর বাসনা হল?

—মর্জি। বাড়ি উনি ভাঙবেন না, প্রাণ থাকতে প্রোমোটারকেও দেবেন না…ভাইপোটা ঘুরঘুর করে না, ওই পিসিকে বাড়ি সারানোর জন্য উসকোচ্ছে। ফ্ল্যাট যখন হলই না, এখান থেকেই যদি দু-পয়সা খামচানো যায়!

—হুম্‌। কিংশুক দুধে চুমুক দিল, তা পিসির পয়সা ভাইপো উড়োক পুড়োক যা খুশি করুক, আমাদের কী? আমরা মিছিমিছি অশান্তিতে যাচ্ছি কেন? আমার তো মনে হয় ওই সামান্য কটা টাকা দিয়ে দেওয়াই ভাল।

অতীন আকাশ থেকে পড়ল, কী বলছিস কী? এই ঝরঝরে বাড়ির পেছনে আমরা কেন আরও গাঁটের কড়ি খরচা করব?

—দোষ কী! রাইটটা আরও পাকাপোক্ত হবে! যবেই ফ্ল্যাট হোক, গুহফ্যামিলিকে কোনওভাবেই বঞ্চিত করতে পারবে না।

তাপসী ফস করে বলে উঠল, কিন্তু আমরা যদি এখানে না থাকি, তাহলে মিছিমিছি টাকা ঢেলে কী লাভ?

—থাকবে না কেন? এত ভাল পজিশান…ছাড়ে নাকি কেউ?

—তুইই তো বলিস নতুন ফ্ল্যাট ট্যাট খুঁজছিস!

—ফ্ল্যাট খোঁজা মানে কি এ বাড়ি ছেড়ে দেওয়া? খাওয়া থামিয়ে কী যেন ভাবল কিংশুক। তারপর দুম করে বলল, তোমাদের বলা হয়নি, একটা ফ্ল্যাট আমি পছন্দ করে ফেলেছি।

—তাই? কোথায়? স্বামী-স্ত্রীর স্বর একযোগে বেজে উঠেছে।

—খুব বেশি দূর নয়, গলফ গার্ডেনে। কিংশুক প্লেটের দিকে চোখ নামিয়ে বলল, বুক করাও হয়ে গেছে।

—ও মা, বলিসনি তো?

—সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমাদের।

—রুমিও জানে না?

—নাহ্, ও জানে। দেখেও এসেছে।

—ও।…কত বড় ফ্ল্যাট? কটা ঘর? আমাদের এত জিনিস ধরে যাবে তো?

—এখানকার মাল তেমন কিছু যাবে না। এই আমাদের খাটটা আলমারি ড্রেসিংটেবিল আর দুটো চারটে ফার্নিচার, ব্যস।

—ও মা, সে কি! স্বামী স্ত্রী মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, আমাদের মালপত্র কি রাস্তায় ফেলে যাব?

কিংশুকের হাতের কাঁটা ডিমের কুসুম ঘাঁটছে, একটু যেন চঞ্চল ভাবে। থামল। সরাসরি তাপসীর চোখে চোখ রেখেছে কিংশুক। নরম গলায় বলল, সবাই মিলে এখান থেকে গেলে চলবে? এ বাড়ির দখলটা চলে যাবে না?

—মানে? তাপসীর স্বর যেন পুরো ফুটল না।

—তোমরা আপাতত এখানেই থাকো। তুমি বাবা…। কিংশুকের গলা আরও নেমেছে,—ফ্ল্যাটটা চারতলা মা, তোমাদের বয়স হচ্ছে, বার বার ওঠানামা করতে অসুবিধে হবে। তা ছাড়া এতদিন এ পাড়ায় আছ, এত চেনাশুনো, এত লোকজন…ওরকম একটা ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে অ্যাডজাস্টও করতে পারবে না তোমরা। বাবার ক্লাব থাকবে না, তোমারও সমিতি টমিতি মাথায় উঠবে…

তাপসী বুঝি বজ্রাহত, চোখের পাতাও পড়ছে না। অতীন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে।

কিংশুক দুজনকেই দেখল একটুক্ষণ। হঠাৎই হেসে উঠেছে, তোমাদের মুখগুলো এরকম হয়ে গেল কেন? আমরা কি আলাদা হয়ে যাচ্ছি নাকি? রোজই তো আমাদের দেখা হবে। হয় আমি আসব, নয় রুমি আসবে, তোমরাও সব সময়ে যাবে…। এ তো জাস্ট মিউচুয়াল কনভিনিয়েন্সের জন্য আলাদা আলাদা ছাদের নীচে রাত্রিবাস। চাও তো তাতানকেও তোমরা মাঝে মাঝে রেখে দিতে পারো। হ্যাঁ, বলতে পারো সেপারেট দুটো এস্ট্যাব্লিশমেন্ট হয়ে যাবে, খরচ বাড়বে…কিন্তু আমার তো এখন সামর্থ হয়েছে, আই ক্যান বেয়ার ইট নাউ।

উদগত অশ্রু দমন করে তাপসী বলল, না না, সে তুই ভালই করেছিস। যা ভাল বুঝেছিস করেছিস। আমরা এখানেই থাকব।…তোরা যাচ্ছিস কবে?

—ইচ্ছে তো ছিল জুলাই-এ…রুমির বাচ্চা টাচ্চা হবে…ধরে নাও এ বছরটা এখানেই আছি। তবে গৃহপ্রবেশটা আগে করেও নিতে পারি, তুমি একটা ভাল করে সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজন করে ফেলো।

ভেতরে ভেতরে বিদীর্ণ হচ্ছিল তাপসী, তবে মুখে তার প্রকাশ হল না। শুকনো হাসল, তুই যদি চাস করব।

—দ্যাটস দা স্পিরিট। হাত বাড়িয়ে মাকে আলগা জড়িয়ে ধরল কিংশুক, আমি জানতাম তুমি অন্তত আমাকে বুঝবে।

কিংশুক বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। টুকিটাকি ঘরোয়া কাজ সারছিল তাপসী। নিঃশব্দে। কাজের মেয়েটির সঙ্গে বাক্যালাপ হচ্ছে না কোনও, সে কী মশলা করল, ঘরদোর কী ঝাড়ল, কাপড়-চোপড় ঠিকমতো কাচল কিনা, মেলল কিনা, কিছুই দেখছে না আজ। চুপচাপ বসে ছিল কিছুক্ষণ, সে যেন আরও অসহ্য। সাজানো কাপ ডিশ ফের সাজাচ্ছে তাকে, কৌটোবাটা ওলটপালট করছে, তারই মাঝে ঠেলে ঠেলে ওঠে দীর্ঘশ্বাস। আশ্চর্য, বুকের মধ্যে ঝড় বইছে, অথচ চোখে জল নেই। কান্নার উৎস কি শুকিয়ে গেল?

আকাশে এখন হালকা হালকা মেঘ। কালচে, পাঁশুটে, ধূসর। থমথমে গরম। বাতাস নেই।

তাপসী ঘরে এল। শুকনো শাড়ি পাট করছে। অতীন স্থির শুয়ে আছে বিছানায়, চক্ষু দুটি বোজা। স্ত্রীর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাল।

কৃত্রিম লঘু সুরে বলল, কী, ছেলে ছেলে করার পরিণাম দেখলে তো?

খর চোখে স্বামীকে দেখল তাপসী। ধীরে ধীরে ঝাঁঝ মরে এল দৃষ্টির। উদাসভাবে বলল, পরিণামের কী আছে? সে সুখে থাকলেই আমাদের সুখ।

—কাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ তপু?

সে কি তাপসীই জানে? নাকি জেনেও স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছে?

তাপসীর বুক নিংড়ে উষ্ণ বাতাস গড়িয়ে এল। কত তাপসীকে যে সে দেখতে পাচ্ছে এখন! ক্ষুদে বাবলুর স্কুলের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় অপেক্ষমান তাপসী…। বাবলুর পা ভেঙে গেছে, বন্ধুদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছেলের জন্য ক্লাসনোট সংগ্রহ করে বেড়ানো তাপসী…। অনেক রাত অবধি পড়ছে বাবলু, পাছে ছেলে ঢুলে পড়ে পাহারাদারের মতো পাশে নিষ্পলক জেগে থাকা তাপসী…। টিউটোরিয়াল থেকে ছেলের ফিরতে দেরি হলে পাগলের মতো ছুটে বেড়ানো তাপসী…। একমাত্র ভায়ের বিয়েতে সবাই আনন্দফুর্তি করছে, তাপসী গেল না, ছেলের পড়ার ক্ষতি হবে বলে ছেলেকে ঘিরে বসে আছে…। বাবলুর জয়েন্ট এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে, বাবলু অতীন কারোরই দেখতে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না, তাপসী একাই ট্যাক্সি ধরে দৌড়ল…

অতীন ডাকছে, কী ভাবছ?

তাপসী দু দিকে মাথা নাড়ল। খাটের কোণে এসে বসেছে, কিছু না।

—ভেবে আর লাভও নেই। আমার কী খারাপ লাগছে জানো? জীবনের কোনও হিসেবই মিলল না। আমার ছোটবেলাটা তো জানো, কী রকম কষ্ট গেছে, তিন বোনের বিয়ে দেওয়ার ভাবনায় বাবার চুল সর্বদা খাড়া হয়ে থাকত…। সপ্তাহে দুদিন মাছ জুটত, তাও এক বেলা। গোটা ডিম কখনও খাইনি, মা সুতো দিয়ে কেটে অর্ধেক করে দিত, সেটাকে থালার এপাশ ওপাশ গড়িয়ে হাপুশ হুপুশ ভাত খেতাম। টিউটরের কাছে পড়ার কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, ওভারটাইম করে এসে বাবা নেতিয়ে পড়ে থাকত, অঙ্ক বুঝিয়ে দিতে বললে ঠাস করে চড় মারত…। পুজোয় দু সেট জামাপ্যান্ট, পয়লা বৈশাখে এক সেট, ব্যস তাতেই বছর কাটছে…। অতীন হঠাৎই থেমে গেল। আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। চোখ যেন বহু দূরে, এই স্যাঁতসেঁতে প্রাচীন বাড়ি ফুঁড়ে যেন অন্য কোথাও। আচ্ছন্নের মতো বলল, তাও তো গড়িয়ে গড়িয়ে পাশ করে গেছি। বি কম পাশ করে ওই তো চাকরি জুটল…একটা হীন জীবন…সর্বক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকা সাহেব কীসে খুশি হবে, সাহেব কী সে রেগে যাবে…। দুর্বল মানুষ কখনও সৎ থাকতে পারে না, এদিক ওদিক করে পয়সা নিয়েছি দু-চারটে…সে তুমিও জানো, আমিও জানি। সবই ছেলের জন্যে।

—ভেবেছিলে নিজে যা পাওনি সব ছেলের ভেতর দিয়ে পাবে! তাই খেয়ে না খেয়ে টিউটোরিয়ালে পড়ানো, আলাদা মাস্টার রাখা, ডাক্তারি পড়ার হাতির খরচ জোগানো…! কী, না ছেলে মনুমেন্টের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়াবে!

—আমি একা ভেবেছি?…তোমার চাওয়াটা তো আরও সাংঘাতিক ছিল। ছেলেকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ছিলে, ছেলে ছাড়া জগৎ ছিল না…! অতীন বিষগ্ন হাসল, কিন্তু পথের শেষে এসে কী দেখছি? এ বিগ জিরো। স্ট্রাগল ফর এ রং কজ।

—তা কেন, বাবলু তো শাইন করেছে!

—তাতে আমাদের ঘণ্টা হয়েছে। বিয়ের পরও আমরা দুজন ছিলাম, এখনও সেই দুজনে একা একা থাকব।

—রুমিটাও কী রকম দ্যাখো, কেমন দিব্যি সব গোপন করে গেছে। তাপসী ক্ষোভটা চেপে রাখতে পারল না, মুখে সারাক্ষণ মধু ঝরছে, আর পেটে পেটে…

—ওর কী দোষ, ও তো পরের মেয়ে, নিজের ছেলেকে দ্যাখো। কী সুন্দর বুঝিয়ে দিল চারতলা ওঠানামা করতে তোমাদের কষ্ট হবে, পাড়া ছাড়তে বুক ফেটে যাবে…হাহ্!

—অথচ এই বাবলু এককালে মা ছেড়ে এক রাতও থাকতে পারত না! তুমি তো গল্প করেছিলে, লাইগেশান করতে আমি যেদিন হাসপাতালে গেলাম, সারা রাত বাবলু আমার শাড়ি আঁকড়ে শুয়েছিল!

দুঃখী দম্পতি উজাড় করছে স্মৃতি। টুকরো টুকরো সুখ, চাপ চাপ দুঃখ। অশ্রু ঘাম রক্ত। অ্যালবামে ঝলসে ওঠে ছবি, আবছা হয়ে যায়।

তাপসী হঠাৎই বলল, বাবলুটা এত স্বার্থপর হয়ে গেল কেন বল তো?

অতীন ম্লান হাসল, হয়তো আমাদেরই দোষ। সারাজীবন ধরে শুধু দিয়ে দিয়েই হয়তো ওকে…। ওকে বড় করাতেও হয়তো কোনও ত্রুটি থেকে গেছে।

—হবে। তাপসী হাত উল্টোল, হয়তো আমাদের খামতিগুলোই ওকে…

—যাক গে, মরুক গে, নিজের মতো থাকুক। তবে আমি কিন্তু সাফ বলে রাখছি, বাড়ি সারানোর টাকা যদি আমি নন্দাদিকে দিইও, তার জন্য আমি তোমার ছেলের কাছে হাত পাতব না।

—কেন?

—আমরা যখন এ বাড়িতে থাকব, আমরাই খরচ করব। যেটুকু সঞ্চয় আছে তার থেকেই ঢালব। আর আমাদের এই সংসারও আমি চালাব বাবলুর খয়রাতি ছাড়াই।

—চলবে?

—আধপেটা খেয়ে থাকব। মুড়িজল খেয়ে পেটে কিল মেরে ঘুমোব।

—অত সহজ! ছেলের পেছনে এতদিন যা টাকা গেছে, খাটুনি গেছে, সব এমনি এমনি যাবে? আমি একটি একটি করে হিসেব ওর কাছ থেকে বুঝে নেব। তাপসী ফুঁসে উঠল, জীবনে কটা সাধআহ্লাদ মিটিয়েছি, অ্যাঁ? মনে করতে পারো, তোমার সার্ভিস লাইফে কোনওদিন বেড়াতে গেছি? পাহাড় জঙ্গল সমুদ্র কিচ্ছু দেখেছি? এবার আমি দুইয়ে দুইয়ে নেব, তুমি চুপ করে থাকবে।

—পারবে?

—পারতেই হবে। মা বাপ হয়ে আমরা কিছু চোরের দায়ে ধরা পড়িনি!

দোতলা থেকে একটা খুনখুন কান্নার আওয়াজ আসছে। মঞ্জু। কদিন ধরেই মাঝে মাঝে খুব কাঁদছে মেয়েটা। নন্দা কি পেটাচ্ছে মেয়েটাকে? মনের ঝাল ঝাড়ছে? বেচারা।

উহুঁ, বেচারা নয়। তাপসী একটা ভিজে ভিজে শ্বাস ফেলল। তুই পাগলি হয়ে বেঁচে গেছিস মঞ্জু, তোকে মা হতে হয়নি!

বারো

তাতানকে ঘুম পাড়াচ্ছে সর্বাণী। নিদ্রাকর্ষণের জন্য অদ্ভুতুড়ে সব কাহিনী চাই তাতানের, সর্বাণী সেটা বেশ ভালই পারে। বাঘ সিংহ হাতি ভাল্লুকের সঙ্গে মানুষ আর ভূত মিশিয়ে লম্বা লম্বা গল্প ফাঁদে সে, তাতানও তাকে আজব আজব প্রশ্ন করে যায় অবিরাম। সর্বাণী গল্প শোনালে তাতান চোখ বুজতেই চায় না।

আজ অবশ্য তাড়াতাড়িই নেতিয়ে পড়ল তাতান। দিনভর খুব হুল্লোড় করেছে। দুপুরে রানা তাকে বাড়ির পুকুরে সাঁতার শেখাতে নামিয়েছিল, প্রথম দিকে খুব ভয় পেত তাতান, এখন জল ছেড়ে উঠতেই চায় না। খেয়ে উঠেও শোয়নি আজ, বায়না জুড়ে পিনাকেশের সঙ্গে বোটানিকাল গার্ডেন ঘুরে এল। এর পর আর কি তার রাতে গল্প শোনার ক্ষমতা থাকে!

রম্যাণি শুয়ে শুয়ে একটা মেয়েলি ম্যাগাজিন উল্টোচ্ছিল। পড়ছে না, এমনিই দেখছে। পাশে তাতান, তার ওপাশে সর্বাণী। এ বাড়িতে সে ছেলে নিয়ে দিদির ঘরেই শোয়।

তাতানকে ঠিক করে শুইয়ে সর্বাণী বলল, কী আজেবাজে পত্রিকা পড়ছিস? ভাল বই পড়তে পারিস না?

রম্যাণি ম্যাগাজিন বন্ধ করে হাই তুলল, এনে দিস লাইব্রেরি থেকে।

—পড়বি সত্যি সত্যি? না শুধু চোখের সামনে ধরে রাখবি?

—না পড়ার কী আছে?

—তাই? এই তো, শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাসের কালেকশান টেবিলে পড়ে,

ছুঁয়ে দেখেছিস?

রম্যাণি উত্তর করল না। কী করে দিদিকে বোঝায় তার এখন কিছু ভাল লাগে না। বই পড়তে না, গল্প করতে না, টিভি দেখতে না…। সারাক্ষণ বুকটা শুধু হু হু করছে। সর্বক্ষণ মনে হয় কী যেন নেই, কী যেন হারিয়ে গেল…!

সর্বাণী হাত বাড়িয়ে ছুঁল বোনকে, তোকে একটা কথা বলব রুমি?

—বল।

—শুধু শুধু গুমরে মরিস না, কিংশুকের সঙ্গে ঝগড়াটা মিটিয়ে ফ্যাল।

—কী মেটাব? আমাদের তো তেমন কিছু হয়নি!

—দ্যাখ, সব বুঝতে পারি। কী চলছে তাহলে তোদের? মান অভিমান?

—না রে দিদি, তাও না।…তোকে তো বলেছি…

—কী? সর্বাণি হাসল, কিংশুক তোকে সহ্য করতে পারছে না? রম্যাণি চুপ।

—শোন রুমি, অত সহজেই দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলিস না। মানুষকে কি অত সহজে হিসেব করা যায়?

—কিংশুককে যায়। ও নিজেকে ছাড়া কিছু বোঝে না। নিজের জন্যই ওর সব কিছু। একটা রম্যাণি, একটা তাতান, নামযশ, টাকাপয়সা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য…। সব কিছুই ও মাপে মাপে বুঝে নেয়। কোথাও মাপটা পছন্দসই না হলে কিংশুক সেটা বরদাস্তই করতে পারে না।

—সেটা কে পারে রে? তুই পারছিস?

ক্ষণেক থমকাল, রম্যাণি। ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কী যেন। হঠাৎ অসহায় মুখে বলে উঠল, কিন্তু কিংশুক এত ক্যাজুয়াল কেন হবে? কেন এমন একটা মৃত্যুতেও তার সামান্যতম রিঅ্যাকশান হবে না? মানলাম ও ডাক্তার, ডাক্তারদের কাছে লাইফ ডেথ সবই গা সওয়া, তবু সে একটা হিউম্যান বিয়িংও, নয় কি?

—কী করে বুঝছিস ওর রিঅ্যাকশান হয়নি? তুইই তো বলেছিস কেসটা নিয়ে ও পারটার্বড হয়ে আছে!

—কেসটা আর মৃত্যুটা কি এক? মামলাটা ওর জীবনের ছন্দটাকে একটু ডিসটার্ব করতে পারে, তার বেশি কিছু না। কিন্তু মৃত্যু মানে একটা মানুষের ইয়েস থেকে নো হয়ে যাওয়া। তার পেছনে কিংশুকের যদি কোনও দায় থাকে, মনে তার একটুও ছাপ পড়বে না? একটু দাগ তো থাকবে ভেতরে, না কী? কেন ও নিজের ফেভারে নিচ্ছিদ্র যুক্তি গেঁথে নিষ্কলঙ্ক সাজবে?

—দূর পাগলি, কিংশুককে একা দুষছিস কেন? মানুষই তো এখন এরকম হয়ে গেছে। পথেঘাটে কারোও কোনও ব্যাপারে কোথাও কোনও রিঅ্যাকশান দেখিস? সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। দ্যাখ গিয়ে হয়তো মেয়েটার বরও মেয়েটার মৃত্যুকে ক্যাশ করে…

—হতেই পারে। তাতে আমার কী যায় আসে? আমি শুধু কিংশুকে আগ্রহী। কারণ কিংশুক আমার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

—তাহলে আর কিংশুকে আর তোতে তফাত কোথায়! সর্বাণী হেসে উঠল, তোর কী মুশকিল হয়েছে জানিস রুমি? তোর নিজস্ব কোনও জগৎ নেই। তুই শুধু কিংশুককে কেন্দ্র করে ঘুরছিস…জাস্ট লাইক এ উপগ্রহ। কিংশুক পুণ্য করলে তুই তার রিফ্লেক্টেড গ্লোরিতে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে কিরণ ছড়াবি। কিংশুক পাপ করলে তোর জীবনে অন্ধকার। হাউ সিলি!

কথা বলতে বলতে উঠে পড়েছে সর্বাণী। বাথরুমে গেল। ফিরেছে ঠাণ্ডা জলের বোতল নিয়ে। গরম পড়েছে খুব, ঢকঢক বোতল উপুড় করল গলায়। আঁজলায় জল নিয়ে ছেটাল মুখে চোখে। খাটের পাশে ছোট্ট টুল, রাখল বোতলটা। আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, —আর ভাবিস না, ঘুমিয়ে পড়।

রম্যাণি দিদির কথাগুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল। কিংশুকও সেদিন এরকমই কী একটা যেন বলছিল না?

অন্ধকারে রম্যাণির গলা দুলল হঠাৎ, কিন্তু আমি তো এরকমই রে দিদি।

—বদলা নিজেকে। বোনের মাথায় আলগা হাত রাখল সর্বাণী, শোন, কেন তুই ভাবতে পারছিস না তুই আর কিংশুক দুটো আলাদা মানুষ? কিংশুকের নিজস্ব প্রফেশান আছে, সেখানে ওর সাকসেস ফেলিওর ভুলভ্রান্তি, অ্যান্ড ফর দ্যাট ম্যাটার ওর নিজস্ব সাফারিংও আছে। সেখানে তুই নেই। আর তাই তোর চোখে কিংশুক একটা ভাঙা মানুষ। আজ যদি তোরও একটা নিজের পৃথিবী থাকত, তুই তাহলে এত কষ্ট পেতিস? কী বলছি বুঝতে পারছিস? ধর, দুটো গাছ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে…তারা একই হাওয়া গায়ে মাখছে, ঝড়ঝায় একই সঙ্গে দুলছে…কিন্তু একজনকে পোকায় খেলেও অন্য জন টিকে থাকে। পরগাছার ক্ষেত্রে কি তেমনটা ঘটে রে রুমি? ভাব ভাব, যা বলছি ভাব।

—ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না রে। আমি হঠাৎ নিজেকে বদলাব কী করে?

—তাহলে মর। আমার ঘুমটা চটকাস না।

ঠাট্টার ছলে বলা কথা, তবু যেন রম্যাণির অন্তঃস্থলে গিয়ে বাধল। সত্যিই যেন তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন। নাহ্, দুঃখের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়াটাই তার নিয়তি।

রাত বাড়ছে। রম্যাণির দু চোখের পাতা এক হচ্ছিল না। যাকে ভুলে থাকতে পারলে শান্তি হয়, সেই যে ঘুরে আসে বার বার! দশ দিন হয়ে গেল, একবারও ফোন করেনি কিংশুক। এখনও কি গরগর করছে রাগে? ছেলেটার জন্যও কি মন কেমন করে না? আবার আসছে একজন। এখনও তার অস্তিত্ব সেভাবে বোঝা যায় না, তবু সেও তো আছে। খবরটা শুনে খুব খুশি হয়েছিল কিংশুক। দেখো, এবার আমার মেয়ে হবে! একটা ছেলে একটা মেয়ে, বাঁধা গতের ইচ্ছে! মেয়ে না হলে কিংশুক কি ক্ষুব্ধ হবে…?

সর্বাণীর নাক ডাকছে। দিদিটা কেমন শুলেই ঘুমিয়ে পড়ে। নিজের কাছে নিজে একদম স্বচ্ছ বলেই কি? আশ্চর্য, দিদি ওই পাত্রটাকেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে! সহজ যুক্তি—ও খোঁড়া, আমি খুঁতো, আমাদের কোনও কমপ্লেক্স থাকবে না! লোকটা নাকি দিদির লাইব্রেরিতে গিয়েছিল, দুজনের আজকাল খুব দেখাসাক্ষাৎ হয়। দিদির একটা নিজস্ব জগৎ আছে, লোকটারও…বিয়ে করলে দিদি নিশ্চয়ই রম্যাণির চেয়ে ভাল থাকবে! দিদির মধ্যে ভারি সুন্দর একটা লাবণ্য ফিরে এসেছে, বেশ লাগে দেখতে দিদিকে এখন।

কোমল ভাবনা স্নায়ুকে শিথিল করে দেয়, কখন যেন একটু তন্দ্রা মতন এসেছিল রম্যাণির। খানিক পরে একটা স্বপ্নও বুঝি উঁকি দিল। ছেঁড়া ছেঁড়া। এলোমেলো। মাথামুণ্ডহীন। দিদির বিয়ে হচ্ছে লোকটার সঙ্গে, খুব সেজেছে দিদি, রম্যাণিও। হঠাৎ বাসরে একটা ফোন বেজে উঠল, এক্ষুনি আসুন, কিংশুক ধরা পড়েছে…! রম্যাণি উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটছে ছুটছে ছুটছে…। ছুটতে ছুটতে একটা জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। ঝোপঝাড়ের মাঝে একটা ভাঙাচোরা বাড়ি, অনেকটা ভবানীপুরের বাড়ির মতো, তবে সর্বাঙ্গে তার গাছের শিকড়। রম্যাণি বাড়িটায় ঢুকে পড়তেই সামনে এক প্রকাণ্ড সাপ। শঙ্খচূড়। সাপটা ফোঁস করে ফণা তুলল, রম্যাণি অনড়, সাপটার সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ছোবল মারল সাপটা…। কোত্থেকে কিংশুক চিৎকার করে উঠল, সরে এসো রুমি, ভাবের ঘরে চুরি কোরো না…!

সকালবেলাতেও স্বপ্নটা আবছা আবছা মনে রইল রম্যাণির। ভাঙাচোরা মেজাজে ঘুরছে ফিরছে, কথা বলছে টুকটাক। পিনাকেশ সকালে হলদিয়া চলে গেল, কোন কারখানায় যেন মেশিন বিগড়েছে, পরিদর্শন করতে হবে। সর্বাণীও বেরিয়ে গেল কাজে, ফিরবে সেই রাত আটটায়। রানাকে সম্প্রতি কম্পিউটার কিনে দিয়েছে পিনাকেশ, এখন রানা বাড়ি থেকে বেরোয় না, নিজের যন্ত্রগণকেই মজে আছে, সেও এক সময়ে ঢুকে গেল নিজের ঘরে। রানার এখন প্রচুর কম্পিউটার ফ্রেন্ডস, তাদের সঙ্গে অনবরত ই-মেল চালাচালি করে। মাল্টিমিডিয়ার কাজও পেয়েছে কিছু, তাই নিয়েও সে বেজায় ব্যস্ত। তাতান একা একাই ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। এ বাড়িটা অনেক খোলামেলা, বড়সড়, একতলা দোতলা মিলিয়ে খান আষ্টেক ঘর, উঠোন, পেছনে বেশ খানিকটা বাগান। বাগান মানে তেমন সাজানো গোছানো কিছু নয়, আছে হরেক রকম গাছগাছালি ঝোপঝাড় আর ছোট্ট একটা পুকুর। বছরে দু একবার বাগান পরিষ্কার করায় পিনাকেশ, কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই আবার সেই জঙ্গল জঙ্গল ভাব। তাতানের সর্বত্রই অবাধ বিচরণ, এই সিঁড়িতে লাফাচ্ছে, এই উঠোনে নেমে গেল, এই বাগানে। সারাক্ষণ তার পিছনে দৌড়তে দৌড়তে অঞ্জলির জিভ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। তবু অঞ্জলি মহা খুশি। বছরে নাতিকে কদিনই বা কাছে পায়, এই ছুটোছুটিটাও তার কাছে এক লোভনীয় উপহার।

দুপুরেও নাতিকে নিয়ে অঞ্জলি নিজের ঘরে মগ্ন। রম্যাণি দাঁড়িয়ে ছিল জানলায়। গরাদের ওপারে জংলা বাগান, দেখা যায় পুকুরটাও। এখানে দাঁড়ালে অদ্ভুত এক বুনো-বুনো গন্ধ এসে লাগে নাকে, রম্যাণির মনটা আরও উদাস হয়ে যাচ্ছিল। জানলার গায়েই জামরুল গাছ, একটা কাঠবেড়ালি ডাল বেয়ে ব্যস্তসমস্ত ভাবে ওঠানামা করছে, কোনও দিকেই তাকাচ্ছে না, শুধু আরোহন অবরোহণেই তার অখণ্ড মনোযোগ। এ বছর গাছটায় তেমন ফল আসেনি, অল্প কয়েকটা ঝুলছে এদিক ওদিক, কাঠবেড়ালি জামরুলের খোঁজে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। রমাণির চোখ সামান্য উৎসুক, কিন্তু আর দেখতে পেল না কাঠবেড়ালিটাকে। একদম মগডালে উঠে গেছে কি? ওখানে কেন গেল? ওদিকে তো একটাও জামরুল নেই!

ইয়া বড় গেলাস হাতে ঢুকল অঞ্জলি, কী রে, ওখানে কী করছিস?

—কিছু না। রম্যাণি জানলা থেকে সরে গেল।

—শুলি না কেন একটু?

—শুয়েছিলাম তো। ভাল্লাগছে না।

—নে, ডাবের জলটা খেয়ে নে। তোর জন্য তোর বাবা গাছ থেকে পাড়িয়েছে। খুব মিষ্টি…কত জল হয়েছে দ্যাখ।

—এখন কী ডাব খাব! পেট আইঢাই করছে।

—যতটা পারিস খা।…তোর ছেলেকে দিতে গেলাম, থু থু করে ফেলে দিল।

—বাঁদরটা কোথায়? সাড়াশব্দ পাচ্ছি না যে?

—এই ঘুমোল। এতক্ষণ আমার সঙ্গে লুডো খেলছিল।

—এখানে এসে আমাকে আর পাত্তাই দিচ্ছে না!

—দেবে কী করে? যে রকম মুখ ভেটকে আছিস সারাক্ষণ! বাচ্চারা বড়দের মুড খুব বোঝে।

রম্যাণি ঈষৎ অস্বস্তি বোধ করল। এক্ষুনি আবার উপদেশ শুরু হবে না তো?

অঞ্জলি খাটে বসেছে। মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিল গেলাস। হঠাৎই জিজ্ঞেস করল, এই, তোর শ্বশুর শাশুড়ির ফোন আসছে না তো রে?

—আসছে না?

—কোথায়! দিনে যেখানে পঁচিশ বার নাতির সঙ্গে কথা হত…কাল তো মোটে একবার করল, আর আজ তো এখনও পর্যন্ত…! বেয়াই বেয়ানের কারোও শরীর খারাপ হল না তো?

অতীন তাপসী কাউকেই তেমন অসুখে কাহিল হতে দেখেনি রম্যাণি, তাই বুঝি সেও চিন্তিত হল একটু। বলল, দেখি, বিকেলে একবার খোঁজ নেব।

—নিস মনে করে। অঞ্জলি মাথা নাড়ছে, হ্যাঁ রে, সুনুর সঙ্গে কিছু কথা হল?

ডাবের জল অর্ধেকটা খেয়ে গেলাস নামিয়ে রাখল রম্যাণি। মুখ মুছল, কী ব্যাপারে?

—জেনে বুঝে ঢং করিস কেন? সুনুর বিয়ে নিয়ে।

—ও যখন রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করতে চাইছে করুক না মা। তুমি মিছিমিছি জোর করছ কেন?

—তোর বিয়েটা এত ঘটপটা করে দিলাম, ওর বেলা একটু অনুষ্ঠান না করলে ভাল দেখায়? বলতে বলতে অঞ্জলি হঠাৎ উঠে গেছে জানলায়। চেঁচাচ্ছে, হ্যাট হ্যাট যা যা…

—কী হল? কাকে তাড়াচ্ছ?

—ওই দ্যাখ না, একটা গোরু ঢুকেছে। পাঁচিলটা এমন ভেঙে গেছে…দ্যাখ না দ্যাখ গোরু কুকুর ছাগল…

রম্যাণি হেসে ফেলল। উঁকি দিয়ে একবার গোরুটাকে দেখে নিয়ে বলল, ভেঙেছে তো সারিয়ে নিচ্ছ না কেন?

—কত কী সারাব? পুকুরটারও তো সংস্কার করা দরকার। পাড় ধসে পড়ছে, গাছগুলো জলে নেমে যাচ্ছে…

—বাঁধিয়ে নাও চারদিকটা।

—কত টাকার ধাক্কা জানিস? তোর বাবার হাতে এখন কি আর অত পয়সা আছে। রে? তাও তো শীতে বাড়িটা রং করাল…। তখনই পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমার পালা শেষ, এবার যা করার পরের জেনারেশান করবে। তার ওপর রানার কম্পিউটার কেনা হল, তাতেও তো প্রায় হাজার সত্তর গেল…। অঞ্জলি লাইন পেয়ে গেলে আর তাকে রুখে রাখা মুশকিল। বলেই চলেছে, তোর বাবার তো প্রভিডেন্ড ফান্ড গ্র্যাচুয়িটি নেই! যে বয়সে পৌঁছেছে সেখানে কি আর সঞ্চয়ের টাকা পুকুর পাঁচিলে ঢালা যায়?…আমি বলেছিলাম তোর কাকাকে বলার জন্য। সে লন্ডনে থাকুক আর যেখানেই থাকুক, সম্পত্তির অংশ তো এখনও ছাড়েনি! অনেক তো রোজগার করছে, পাউন্ডের পাহাড় জমিয়ে ফেলেছে…! তা তোর বাবাকে তো জানিস কী রকম মানুষ, শুনেই তার মানে লেগে গেল। কী, না তারা ভোগ করে না, দু-পাঁচ বছরে একবার বেড়াতে আসে, তাদের কাছ থেকে আমি টাকা চাইব…!

পিনাকেশ মৈত্রর আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত প্রখর, রম্যাণি জানে। তার কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত মতাদর্শও আছে। এক সময়ে নিজের হাতে একটা কারখানা গড়েছিল পিনাকেশ, রানিহাটির কাছে। অ্যালুমিনিয়াম তার বানানোর মেশিন তৈরি করত। মার্কেটে পিনাকেশের তৈরি ড্রয়িংমেশিনের সুনামও ছিল। বছর পনেরো আগে দারুণ মন্দা এল বাজারে, একটাও অর্ডার হাতে নেই, বেশ টালমাটাল অবস্থায় পড়েছিল পিনাকেশ। রোজ রাতে বাড়ি ফিরে গুম হয়ে বসে থাকত। রম্যাণির ছোটমামা তখন একবার বলেছিল, কারখানাটায় আপাতত তালা ঝুলিয়ে দিন না পিনাকেশদা, অর্ডার পেলে তখন না হয়…এস্ট্যাবলিশমেন্ট কস্টটা তো বেঁচে যাবে…! পিনাকেশ স্তম্ভিত মুখে বলেছিল, তুমি ও কথা উচ্চারণ করতে পারলে দিলীপ? ওরা আমার সাথী, কো-ওয়ার্কার, আমার গুডউইল তৈরি করে দিয়েছে, আজ বিপদের দিনে ওদের আমি বসিয়ে দেব…? অনেকদিন লড়েছিল পিনাকেশ, শেষে অনন্যোপায় হয়ে বেচে দিয়েছিল কারখানা, এক গুজরাতির কাছে। প্রায় জলের দরে। সস্তায় বিক্রির একটাই শুধু শর্ত ছিল—তিন বছর কোনও কর্মচারীকে ছাঁটাই করতে পারবে না রমেশ পটেল। পিনাকেশের থিয়োরি, প্রত্যেকটি মানুষকে আলাদা আলাদা করে দেখতে শেখো। মনে রেখো, একটা মানুষ মানে একটা পরিবার, তাকে ঘিরে জন্ম হয়েছে একটা ছোট্ট পৃথিবীর। সেখানে অনেকেরই চাওয়া পাওয়া আছে, স্বপ্ন আছে, দুঃখ আছে, আনন্দ আছে…

রম্যাণি এই গরমেও একটা বাষ্পমাখা বাতাসের অস্তিত্ব অনুভব করছিল। বুকে, কিংবা আরও গহীনে কোথাও। বাবাই কি তার অবচেতনায় প্রভাব ফেলেছে? এই জন্যই কি সেই মেয়েটাকে কিছুতেই অকিঞ্চিৎকর ভাবতে পারল না রম্যাণি?

গোরু তাড়াতে অঞ্জলি নীচে নেমে গেছে। ফিরে আর রম্যাণির কাছে এল না, ঘরে গিয়ে শুল বোধহয়।

রম্যাণি শরদিন্দুর বইটা টানল। পড়ছে। রাজকাহিনী। রাজকন্যার উপাখ্যান। নৌকোয় চেপে দূরদেশে চলেছে বিদ্যুম্মালা আর মণিকঙ্কণা…। যুদ্ধে হেরে গেছেন কলিঙ্গরাজ, মেয়েদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিজয়নগরে, সেখানে রাজা তাদের গ্রহণ করবে। এক মেয়ে দুঃখী হয়ে আছে, অন্য মেয়ে সুখের আশায় ডগমগ…

টেলিফোন বেজে উঠল। এই দুপুরে কার ফোন? রানার?

একটুক্ষণ অপেক্ষা করল রম্যাণি, কেউ তুলছে না দেখে প্যাসেজে এসে রিসিভার উঠিয়েছে, হ্যালো?

—রুমি?…আমি বলছি।…ঘুমোচ্ছিলে?

শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে গেল রম্যাণির। কিংশুকের তা হলে মনে পড়েছে অভাগিনীকে!

বুকের কাঁপন গলায় ফুটতে দিল না রম্যাণি। শান্ত স্বরে বলল, —না এমনিই…বই পড়ছিলাম।…কেমন আছ?

—আছি।…তোমার শরীর কেমন? ওষুধ খাচ্ছ তো ঠিকঠাক?

—হুঁ।

—তাতানের কী খবর?

—তাতানের মতোই আছে।

—আমার কথা কিছু বলে টলে?

—হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করে।

কিংশুক কয়েক সেকেন্ড নীরব। তারপর বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা জানানোর ছিল।

—বলো।

—গলফ গার্ডেনের ফ্ল্যাটটার কথা মা বাবাকে বলে দিয়েছি। ওরা মোটামুটি খুশি মনে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে।

রম্যাণি অস্ফুটে বলল, খুশি মনে?

—তাই তো মনে হল। দোতলার সঙ্গে বাড়ি রিপেয়ারিং নিয়ে কী সব মন কষাকষি শুরু হয়েছিল, দোতলা কিছু শেয়ার করতে বলছিল, আমি তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে দিয়েছি বাবাকে। ব্যস, ওদের আর কোনও ঝামেলা নেই, অনন্তকাল ওখানে থাকতে পারবে।

—ও।

—ভাল করিনি? বাবা মার টেনশান কত কমে গেল বলো?

—ভালই তো করেছ।

—আমায় একটু ফিল করার চেষ্টা করো রুমি। আমি মানুষটা খুব খারাপ নই। কিংশুক যেন এতক্ষণ সামান্য আড়ষ্ট ছিল, এখন অনেকটাই সহজ। বলল, আর একটা খবর আছে। সেটা আমি মিটিয়ে নিচ্ছি।…ভেবে দেখলাম গলদ তো আমার একটু ছিলই…। কোর্টের বাইরেই সব অ্যাডজাস্টমেন্ট করে নিচ্ছি।

রম্যাণি নিঝুম। শুনছে।

—তুমি তো চেয়েইছিলে আমি প্রায়শ্চিত্ত করি। চাওনি?

রম্যাণি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল।

—খুশি হয়েছ তো রুমি? চুপ করে আছ কেন? এবার তোমার ঘাড় থেকে ভূতটা নামবে তো?

রম্যাণি কি হুঁ বলল? নিজেও বুঝতে পারল না।

—রাখছি। ভাল থেকো। ফোন-টোন কোরো। আমার তো মাঝে মাঝে তোমার গলা শুনতে ইচ্ছে করে, না কী?

—করব।

—আর হ্যাঁ শোনো, অ্যাই…আমি হয়তো রোববার শিবপুর যেতে পারি। তোমার দিদিকে একবার কনগ্রাচুলেট তো করে আসতে হয়।…শনিবার কনফার্ম করে দেব।

—আচ্ছা।

—আই লাভ ইউ রুমি।

—জানি তো।

—আই রিয়েলি লাভ ইউ ডার্লিং। আয়াম মিসিং ইউ।

—…।

কিংশুক ফোন ছেড়ে দিল। একটা ধাতব ঝিল্লিধ্বনি।

রম্যাণির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। জিতে গেল কিংশুক? জিতেই গেল? ও মাগোঃ।

—কী রে, যক্ষিনীর পোজ মেরে টেলিফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

রানার গলা।

তড়িঘড়ি রিসিভার নামিয়ে দিল রম্যাণি।

রানা নিজের গুহা থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে দণ্ডায়মান। পরনে বারমুডা, গা উদোম, পৈতে দিয়ে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে নিরীক্ষণ করছে ছোড়দিকে, কার ফোন এসেছিল রে?

—কেউ না। রম্যাণি এড়িয়ে গেল, রং নাম্বার।

—তাই এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলি? তোরা মেয়েরা পারিস, রং নাম্বারেও দশ মিনিট! রানা হ্যা হ্যা হাসল, সারা দুপুর করছিসটা কী? বড়দির পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছাইপাঁশ গিলছিস?

—তো আর কী করব?

—আমার কাছে এসে কম্পিউটার শিখতে পারিস। তাতানটা তো দিব্যি মাউস নাড়তে শিখে গেছে। মনে হচ্ছে ও সাঁতার শেখার আগে কম্পিউটার শিখে ফেলবে।

—ওই তাতানই শিখুক। আমার ও দিয়ে কী হবে?

—ইইই, বলিস না। রানা যেন প্রায় আঁতকে উঠল, এখন সব ডট কম। যা চাইবি ডট কম, যেদিকে তাকাবি ডট কম। এখন হল ডট কম সভ্যতা ডিয়ার। লাইক মহেঞ্জোদরো, সুমেরু…। দিস ইজ মোস্ট মর্ডান ফর্ম অফ সিভিলাইজেশান। ওরা যেমন লোহা ব্যবহার করতে শিখেছিল, তেমন তোকে কম্পিউটার জানতে হবে। নইলে এই সিভিলাইজেশান থেকে তুই আউট হয়ে যাবি। বলতে বলতে চোখ টিপল রানা, জানিস তো, স্বামী স্ত্রীর রিলেশনশিপ ঝালাই করার জন্যও ডট কম আছে!

—থাকুক। আমার জানার দরকার নেই। তোমরাই ডট কম সভ্যতায় বিচরণ করো।

—ঘাবড়াস না, এই সভ্যতাও বেশি দিন নেই।

—কেন রে?

—ভাইরাস। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভাইরাসই একে একদিন ফিনিশ করে দেবে। দেখিসনি, কদিন আগে একটা ‘লাভ বাগ’ ঢুকে পড়ে কী ভাবে সভ্যতাটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল!

শুধু কি কম্পিউটারেই ভাইরাস ঢুকবে? কত বিপজ্জনক সিগনাল যে মানুষের হৃদয়ে ঢুকে গেছে রানা কি তার খবর রাখে? অনুশোচনাহীন প্রায়শ্চিত্তে বিবেক নির্মল করে দেয় কোন জীবাণু?

শিথিল পায়ে নীচে নেমে এল রম্যাণি। খিড়কি দরজা দিয়ে সোজা বাগানে। গাছপালা ভেদ করে এদিকটা রোদুর আসে না তেমন, এই তিনটে চারটের সময়ে ছায়ায় ছায়ায় হাঁটতে আরাম লাগে।

ঝোপ আগাছার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে পুকুরপাড়ে চলে গেছে সরুপথ। রম্যাণি এগোচ্ছে দু পা, থামছে একটুক্ষণ। নির্জনতার ঘ্রাণ নিচ্ছে। চতুর্দিক ভীষণ রকম শুনশান, একেবারে নিস্তব্ধ, একটা পাখি পর্যন্ত ডাকছে না। যেন এক তীব্র শূন্যতা নিষ্প্রাণ ভঙ্গিতে ছেয়ে আছে চরাচরে। একটা প্রাণ চোখে পড়ল। গিরগিটি। পাতার সঙ্গে নিপুণ ভাবে মিশিয়ে দিচ্ছে গায়ের রং, আবার হঠাৎ হঠাৎ সোনালি আভায় উদ্ভাসিত। ওই ভোল বদলে বদলেই কেমন শিকার ধরে চলেছে টুপটাপ।

দেখতে দেখতে রম্যাণি কখন পুকুরের কাছটাতে। শেষ দুপুরের রোদ্দুর পড়ে চিকচিক করছে জল, তিরতির কাঁপছে, দুঃখের মতো। একটা শুকনো পাতা টুপ করে খসে পড়ল জলে। ভাসল একটু, ডুবে গেল।

সহসা বাতাসের ঝাপটা এল একটা। গাছেরা কেঁপে উঠল, শিউরে শিউরে উঠেছে পাতারা, শব্দ বাজছে সরসর।

তখনই রম্যাণি স্পষ্ট শুনতে পেল, দাঁড়িয়ে কেন? নেমে এসো।

সেই মেয়েটা!

রম্যাণির শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত।

আবার জলে মৃদু আলোড়ন, কী হল, এসো!

রম্যাণি দুর্বল স্বরে বলল, কেন?

—প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। এসোই না।

—আমি ডুবব না যে। আমি যে সাঁতার জানি।

—ভুলে যাও।

—পারব?

—দ্যাখোই না চেষ্টা করে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক পা এক পা করে এগোচ্ছে রম্যাণি। শিরশির করছে শরীর, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বিচিত্র অনুরণন। এক আধিভৌতিক আহ্বান। স্নায়ু অসম্ভব শিথিল এখন, কোনও ইচ্ছেশক্তিই আর কাজ করছে না, নেশার মতো টানছে দুঃখী জল।

তবু থামল রম্যাণি। পায়ের নীচে মাটিটা হড়হড় করছে। একবার ক্ষীণভাবে কিংশুককে মনে পড়ল। ঝাপসা হতে হতে মিলিয়েও গেল মুখটা। পেটের ওপর হাত রাখল। না, এখনও নড়ে না। এই পৃথিবীতে আদৌ না এলে এর কী এমন লোকসান হবে? কিন্তু তাতান? তাতানের কী হবে…? নিশ্চয়ই বেড়ে উঠবে, নিশ্চয়ই ভাল থাকবে, এত লোক আছে ওর চারপাশে…! ওই মেয়েটার বাচ্চা তো আরও ছোট, সেও তো বেঁচে আছে…

অঘটন ঘটেই গেল। পা পিছলে পড়ে গেল রম্যাণি।

তেরো

—তাহলে ডাক্তারবাবু, একটু মিষ্টিমুখ হয়ে যাক।

—হ্যাঁ হ্যাঁ, শুভদিনে মিষ্টি এসেনশিয়াল। কত বড় একটা ভুল বোঝাবুঝির অবসান হল বলুন তো?

তা বটে তা বটে। কী লীলাই না দেখাল দু তরফের উকিল!

চমৎকার ভুজুং ভাজুং দিয়ে পেড়ে ফেলেছে দুই লক্কড়কে! কখনও নরমে, কখনও গরমে, কখনও হাসিমুখে, কখনও ভয় দেখিয়ে সুচারুভাবে পুরে ফেলল ঝাঁপিতে! সত্যি সত্যি যে সওয়া দু লাখে ফয়সালা হয়ে যাবে, এ কিংশুকের ধারণার অতীত ছিল। নাহ্‌, দেবমাল্যটা অ্যাসট্রোলজির লাইনে গেলেও শাইন করত।

বিনা বাক্যব্যয়ে একটা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিল কিংশুক।

রণজিৎ সমাদ্দার গলা ভারী করে ডাকল, নবীন…? নবীন কোথায় গেলে?

পলকে পর্দা সরিয়ে হাজির বছর পঞ্চাশের ধুতিশার্ট। রণজিতের খাস কর্মচারী। ফাইল ব্রিফকেস বওয়া থেকে উঁচু তাকের পেল্লাই পেল্লাই কেতাব পাড়া, এবং যাবতীয় ফাইফরমাশ খাটা তার ডিউটি। মামলা মোকদ্দমায় সাহায্য করতে অন্য লোক আছে রণজিতের।

নবীনের হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে রণজিৎ জিজ্ঞেস করল, শুধু মিষ্টি আনাব ডাক্তারবাবু? না সঙ্গে নোন্‌তা কিছু?

সঙ্গে সঙ্গে ও পক্ষের উকিল অসীম হাজরা হাঁ হাঁ করে উঠেছে, না না না, শুধু মিষ্টি শুধু মিষ্টি। দুপুরে কোর্টে কচুরি খেয়ে অম্বল হয়ে আছে।

তবু খাওয়া চাই! প্রাপ্তিযোগ তো ভালই হল, তার পরও এত নোলা? খা খা, কলকবজা যখন বিগড়োবে, তখন ডাক্তারই ওই মিষ্টির হাজার গুণ পেট থেকে সাইফন করে নেবে!

রণজিৎ সমাদ্দারের বাড়িতেই চেম্বার। চল্লিশে পৌঁছেই জব্বর একখানা বাড়ি হাঁকিয়েছে নিউ বালিগঞ্জে, চেম্বারটিও দেখনসই। প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল, নিজের জন্য পুরু গদিমোড়া ঘুরন সিংহাসন, মক্কেলদের জন্য সুদৃশ্য কেদারা, লম্বা টানা সোফা, দেওয়ালে ইনবিল্ট কাচ আলমারিতে আইনশাস্ত্র, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-সারদামা। এবং সম্ভবত নিজের পিতা। জানলা দরজায় চেকনাদার পর্দা ঝুলছে।

বিশ্বজিৎ আর নিরঞ্জন বসে আছে সোফায়। বিশ্বজিৎ সামান্য আড়ষ্ট, নিরঞ্জনের চোখ ঘুরছে বনবন।

নবীন চলে যেতেই অসীম বিশ্বজিৎদের ঘুরে দেখল, তা মশাই, এদিকটা তো চুকল, এবার আপনাদের শুভকাজটা লাগছে কবে?

বিশ্বজিৎ চমকাল একটু। রা কাড়ল না।

অসীম সহাস্যে বলল, আরে, আমাদের কাছে কিছু লুকোনোর উপায় আছে রে ভাই? খোদ ঘোড়ার মুখ থেকে খবর পেয়েছি। আপনার শালাবাবু বলে গেছেন।…কবে সারছেন বিয়েটা?

কিংশুকের চোখ বড় বড়। বউ মরার চার মাসের মধ্যেই বিয়ে? সাধে কি এদের ছোটলোক বলে! পত্নীপ্রেমে এতটুকু একনিষ্ঠতা নেই!

বিশ্বজিৎ নয়, নিরঞ্জন চটপট বলে উঠেছে, ও বিয়ে করতে চায়নি, আমরাই জোরজার করে…। মা মরা ছেলের সব হ্যাপাই যখন মাসি পোয়াচ্ছে, তখন সেই নয় লিগাল মাদার হল।…তবে এখনই কী, বছরটা ঘুরুক।

—আহা, বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। অসীম ফের টিপ্পনি কাটল, সাহাবাবু, শুনলাম আপনি ব্যবসায় নামছেন?

—কে বলল? ফের আগ বাড়িয়ে বলে উঠল নিরঞ্জন।

—কেন, আপনাদের শালাবাবুই তো বললেন।…শালা ভগ্নিপতি মিলে নাকি…?

—শালা বললেই হয় নাকি? বিশ্বজিৎ সার্ভিস লাইনের লোক, ও সোনাদানার ব্যবসার কী বোঝে?

—তা হলে টাকাটা কী করা হবে? ফিক্সড?

—দেখি। এবার বিশ্বজিতের উত্তর, এখনও কিছু স্থির করিনি।

কিংশুক চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়াল দেখছিল। দামি প্লাস্টিক পেন্ট। হালকা লেমন। রংটা ফ্ল্যাটের দেওয়ালে খারাপ লাগবে না। এই রংটাই লাগাবে, না অফহোয়াইট…?

মিষ্টির হাঁড়ি এসে গেছে। নবীন ঘুরে ঘুরে রসগোল্লা ধরছে সবার সামনে। দুই উকিল দুটো করে মুখে পুরল, নিরঞ্জনও। যুযুধান দুই প্রতিপক্ষই শুধু একটা করে। ওই লোকগুলোর সঙ্গে বসে মিষ্টি খেতে রুচিতে বাধল কিংশুকের, বিশ্বজিৎও বোধহয় সঙ্কোচ বোধ করল।

প্রায় পুরো হাঁড়িটাই রণজিতের বাড়ির অন্দরে চালান হয়ে গেল।

বিশ্বজিৎ উঠে পড়েছে, এবার তাহলে আমরা যেতে পারি?

—আসুন। রণজিৎ লঘু গলায় বলল, মনে আর কোনও খেদ নেই তো?

কিংশুকের দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিল বিশ্বজিৎ। তীক্ষ্ণ ফলার মতো দৃষ্টি। কেঠো গলায় বলল, উপায় কী! আমরা গরিব মানুষ, আমাদের তো সবই মেনে নিতে হবে।

—আহা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। নিরঞ্জন ভায়রার পিঠে হাত রাখল, উকিলবাবু, আপনি কি উঠবেন এখন?

সামান্য ইতস্তত করে চেয়ার ছাড়ল মধ্যবয়সি স্থূলকায় অসীম হাজরা, তা হলে সমাদ্দার…?

—হ্যাঁ দাদা, আমি রাত্রেই আপনার সঙ্গে কথা বলে নেব। কী ভাবে কী করা যায়, না যায়…

—অলরাইট। অলরাইট।…আমি বাড়িতেই আছি।

তিনজন বেরিয়ে যেতেই কিংশুকের মুখে কথা ফুটেছে। চোখ কুঁচকে বলল, আরও কিছু প্যাঁচ ট্যাচ রয়ে গেল নাকি মিস্টার সমাদ্দার?

—আরে না না। হাজরার পোর পঞ্চাশ হাজার রয়ে গেল না আমার কাছে? ওটাই স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল আর কি।

—ও। কিংশুক চেয়ারে হেলান দিল, ভদ্রলোক কিন্তু মক্কেলদের ভালই ট্যাকল করেছেন।

—আরে মশাই, ওই অসীম হাজরাকে ট্যাকল করতে আমায় কম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে? যেই আমি ওর সঙ্গে কনট্যাক্ট করেছি, সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছে ব্যাপারটা।…যত বলি ডক্টর গুহর সঙ্গে ডাক্তারদের ইয়ে হয়ে গেছে, মেডিকেল বোর্ড এগেনস্টে রিপোর্ট দিচ্ছে না…অসীম হাজরা কি ভোলার পাত্র? বলে, আপনি এমনি এমনি ছুটে এসেছেন সমাদ্দার…! তখন বললাম, ঝুটঝামেলায় যাচ্ছেন কেন, মিটিয়ে নিন…। দেবদূতের মতো ভায়রাটাও জুটে গেল। সেও এরকমই একটা কিছু চাইছিল…।

—হ্যাঁ, ওই লোকটাকে বেশ সেন্সেবল্‌ মনে হল। ঠাণ্ডা মাথার লোক।

—ঠাণ্ডা মোটেই নয়। ও হচ্ছে জিলিপির বাপ অমৃতি। ও হল গিয়ে পেশকার, আমাদের মতো শয়ে শয়ে উকিল ঘেঁটে খায়। রণজিৎ খ্যাক খ্যাক হাসল, ওই নিরঞ্জন ছিল এ কেসের লুজিং সাইড। বিশ্বজিৎ সাহা শালীর প্রেমে দ হয়ে আছে, শালার সঙ্গে এখন তার খুব মাখো মাখো…শালা ভগ্নিপতি নিজেদের মধ্যে চার লাখের বিলিবন্দোবস্তও করে ফেলছিল…মাঝখান থেকে নিরঞ্জন ভোঁ ভোঁ…তাই নিরঞ্জনও সিনে এসে স্ক্রু ঘোরাল। এমন পট্টি পরাল ভায়রাকে…ওরে, যা পাচ্ছিস নিয়ে নে…ওরে, বেশি লোভ করে সব খোওয়াবি…তাইতেই তো বিশ্বজিৎ…।

—কিন্তু দেখে তো সেরকম মনে হল না? লোকটা দেখলাম এখনও বেশ ট্যাড়া হয়ে আছে!

—আরে মশাই, চার লাখের স্বপ্ন দেড় লাখে হড়কে গেলে বদন তো একটু বিগড়োবেই। এখন যেটা দেখছেন, ওটা হল ঢোঁড়া সাপের ফোঁস। বিষ দাঁত ওর ভেঙে গেছে। ব্যাটা যখনই টাকা গিলেছে…

পকেটে মোবাইল ডাকছে। কিংশুক ফোন কানে চাপল, ডক্টর গুহ স্পিকিং।

—হ্যালো ডাক্তারসাহেব! আমি দেবনাথ কুণ্ডু বলছি।

এক উকিলের ডেরায় আর এক উকিলের হানা!

—হ্যাঁ, বলুন।

—আপনি কি রায়ের কাগজপত্র ইনকামট্যাক্স অফিসে জমা করেছেন?

—না তো। কেন?

—আমার আর একটা কেস ইনকামট্যাক্স অফিসে যাচ্ছে, ভাবলাম এক সঙ্গে আপনারটাও…। আপনার একটু খরচাও বাঁচত।

—দরকার নেই। আমি এক্ষুনি রেজিষ্ট্রি করছি না

—সে কি! জুলাই-এ পজেশান নেবেন না?

—পজেশান তো টাকা ক্লিয়ার করলেই পেয়ে যাব। রেজিষ্ট্রি নয় দু চার মাস পরেই হবে।

—ও।…আপনিই বলেছিলেন তাই…। ছাড়ছি। প্রয়োজন হলে রিং করবেন।

—হুঁ।

মোবাইল পকেটে রাখল কিংশুক। জোর করে রসগোল্লাটা খেয়ে গলার কাছটা কেমন করছে। টেবিলে জল চাপা আছে, জলের ব্যাপারে কিংশুক যথেষ্ট খুঁতখুঁতে, তবু খেয়ে নিল এক ঢোক।

ঠোঁট কামড়ে রণজিৎকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু ওই ছোকরাকে দিয়ে একটা সইসাবুদ করিয়ে রাখলে ভাল হত না?

—কী হবে সইসাবুদে?

—যদি ছোকরা বেগড়বাঁই করে? টাকা গাপ করে নিয়ে যদি ফের মামলা লড়তে চায়?

—দূর মশাই, তা হয় নাকি? রণজিৎ হা হা হাসল, চোর ডাকাতদের এথিক্স আছে, উকিলদের নেই! অসীম হাজরা এ মামলা আর লড়বেই না।

—ও যদি অন্য উকিল পাকড়ায়?

—ডাক্তারবাবু, এ আপনাদের লাইন নয়। এক ডাক্তারকে দেখাতে দেখাতে আর এক ডাক্তারের কাছে চলে গেল…ওটি এখানে চলে না। অসীম হাজরা স্বেচ্ছায় ব্রিফ না ছাড়লে কোনও লইয়ার ওকে ছোঁবে না। পেপারস এখন হাজরার জিম্মায়, বিশ্বজিৎ এখন ঠুঁটো জগন্নাথ…

আবার মোবাইল সংগীত।

কিংশুক টেলিফোনের বোতাম টিপাল, ডক্টর গুহ বলছি।

—হ্যালো, ডক্টর গুহ বলছেন?

—ইয়েস।

—আমি সজল পাণিগ্রাহী স্যার। চিনতে পারছেন?

—না…আমি তো ঠিক…

—আপনার সঙ্গে সায়েন্স সিটিতে দেখা হয়েছিল স্যার। মনে পড়ছে? সেই আপনাদের গায়নোকলজিস্ট অ্যান্ড অবস্টেট্রিশিয়ানদের কনফারেন্স হচ্ছিল…? উই ওয়্যার ওয়ান অফ দা স্পনসরস।

কিংশুক তাও মনে করতে পারল না। বলল, ও আচ্ছা।

—আপনার সঙ্গে আমাদের মাইক্রো ওভেন নিয়ে কথা হয়েছিল স্যার। আপনাকে বলেছিলাম আমাদের স্লোগান, কুইক ফুড হেলদি ফুড…আপনি স্যার খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করেছিলেন।

—মে বি।

—আমাদের লিটারেচারও স্যার দিয়েছিলাম আপনাকে। আপনি স্যার একদিন বাড়ি গিয়ে ডেমনস্ট্রেট করতে বলেছিলেন। যদি কাইন্ডলি একটা ডেট দ্যান…

শালা মাল বেচার ফিকির!

কিংশুক বিরক্তি চেপে বলল, এখন আমার লাগবে না। থ্যাংক ইউ।

—নিতে হবে না স্যার, আমরা শুধু একটু ডেমনস্ট্রেট…। কোনও মেটিরিয়ালও আপনাকে রাখতে হবে না। চিকেন মাটন গ্রিন ভেজিটেবল্‌স যা আপনি প্রেফার করেন আমরা নিয়ে যাব। অ্যান্ড দা কুকড ফুড উইল বি ইয়োরস। আপনি যদি একটা প্রভিশনাল ডেটও দেন, আমি তা হলে রিং করে কনফার্ম করে নেব।

—বলছি তো ভাই এখন লাগবে না।

—আমরা কিন্তু ইস্টার্ন জোনের জন্য একটা লুক্রেটিভ অফার রেখেছি স্যার। টোয়েন্টি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট, প্লাস ওয়্যারেন্টি ফর অল দা পার্টস, প্লাস একটা ছাব্বিশ ইঞ্চির মোল্ডেড ফাইবার গ্লাস স্যুটকেস…

ওফ অসহ্য! সাধে কি মোবাইলটা মাঝে মাঝে অফ করে রাখতে ইচ্ছে করে! কাল এরকম আর একজন ফোন করেছিল, ওয়াশিং মেশিনের জন্য।

দুদিকে মাথা নাড়ল কিংশুক, প্লিজ…আমি এখন খুব ব্যস্ত আছি।

—তা হলে কি আমি পরে রিং করব? আরও কয়েকটা ইন্টারেস্টিং স্কিমও আছে…

—কখনওই করবেন না।

কিংশুক ফোন কেটে দিল। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারল না, আবার কানে চেপেছে। মনে হল লোকটা বকেই চলেছে একটানা।

রণজিৎ হাসি হাসি মুখে বলল, কী ব্যাপার?

—আর বলবেন না। সেলসম্যান। বোধহয় কখনও কার্ড ফার্ড দিয়েছিলাম…জ্বালিয়ে মারছে।

—যার যা প্রফেশান। বুদ্ধি বেচা, জ্ঞান বেচা, মাল বেচা, বিদ্যে বেচা…। সবাইকেই তো করে খেতে হবে।

—খাক না, কে মানা করেছে!…প্রেশার দেওয়া ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়।

—হুম্‌। রণজিৎ সমাদ্দার ক্ষণকাল চুপ। ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। সিগারেট ধরাল একটা। দরজায় এক কর্মচারী, মক্কেলের আগমনবার্তা দিতে এসেছে। সুলতানি মেজাজে তাদের অন্য ঘরে বসানোর নির্দেশ দিল। চায়ের অর্ডার ছুড়ে আবার ফিরেছে কিংশুকে। হঠাৎ বলল, আমি কিন্তু আপনাকে প্রেশার দিইনি ডাক্তারবাবু।

পঁচিশ হাজার হাতিয়েও বলে প্রেশার দিইনি!

কিংশুক শুকনো হাসল, কেন, আপনার অ্যামাউন্টটা কি কম হয়েছে?

—না না, তা বলছি না। তবে মিউচুয়াল কেসে আমি সাধারণত ফিফটি ফিফটিই নিয়ে থাকি।

তামাকের ধোঁয়া অশালীন ভাবে নাকে এসে লাগছে। কিংশুক মুখ সামান্য সরিয়ে নিল, কিন্তু কেসটা চললে তো বড় জোর আর দুটো হিয়ারিং হত। সে তুলনায় আপনার তো…

—এক লাখ পঁচাত্তর যে আপনার বেঁচে গেল সেটাও হিসেবে রাখুন।…যাক গে যাক, আপনি মানী ডাক্তার, তার ওপর আবার মিস্টার লালের রেফারেন্সে এসেছেন…। আবার যদি এ রকম কোনও কেস হয় স্মরণ করবেন।

শালা টিজ করছে, না কু গাইছে? এরা কি রেপ কেসের আসামীকে ছাড়িয়ে দিয়েও এই কথা বলে?

এক ক্লিন্ন অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছিল কিংশুক। এই সব মানুষের সঙ্গে তাকে সঙ্গত করতে হচ্ছে? আজ চেম্বার সেরে বাড়ি ফিরে খুব ভাল করে একটা স্নান করতে হবে। তারপর রাতে একটা গভীর নিদ্রা। কাল থেকে সে একেবারে ক্লিন ম্যান—ঝরঝরে তরতাজা কিংশুক।

আবার ফোন বাজছে। উফ্‌, আর পারা যায় না!

একটু রুক্ষভাবেই বলল কিংশুক, ইয়েস?

—বাবলু? তুই কোথায়?

তাপসীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে থমকাল কিংশুক, এই তো…। কী ব্যাপার?

—সর্বনাশ হয়ে গেছে রে বাবলু। আমি কখন থেকে তোকে চেষ্টা করে যাচ্ছি, খালি এনগেজড, খালি এনগেজড…

—আহ্, কী হয়েছে বলবে তো?

—রুমির একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। পুকুরপাড়ে পড়ে গিয়ে…। তাপসীর গলা বুজে এল, বোধহয় মিসক্যারেজ হয়ে গেছে রে।

—ও নো। কিংশুক আর্তনাদ করে উঠল। মুহূর্ত সময় নিল না, ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো ব্রিফকেস হাতে লাফিয়ে উঠেছে, ছুটছে গাড়ির দিকে, কানে টেলিফোন, কখন হয়েছে?

—চারটে নাগাদ। রুমির মা ফোন করেছিল।…. বেয়াই আজ নেই, রানা ওকে নার্সিংহোমে নিয়ে গেছে।

স্টিয়ারিং-এ বসতে বসতে ঘড়ি দেখল কিংশুক। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। মানে দেড় ঘণ্টা আগে! দেএএড় ঘন্টা!

—কোন নার্সিংহোমে গেছে কিছু জানো?

—ওদের পাড়ার মোড়েই যেটা…। কী হবে রে বাবলু?

—যাচ্ছি। দেখছি। বাবা কোথায়?

—তোর বাবা শুনেই দৌড়েছে। আমি তোকে খবর দেওয়ার জন্য…। কী করি বল তো রে বাবলু? যাব?

—না। তুমি বাড়ি থাকো।

—খুব ভয় করছে রে।…রুমির কোনও বিপদ নেই তো?

—আহ্, মা। নার্ভাস করে দিও না। দেখছি।

ফোন অফ করেই গাড়ি স্টার্ট। রণজিৎ সমাদ্দার ঘাবড়ে বেরিয়ে এসেছিল, সেদিকে না তাকিয়ে ঝড়ের গতিতে গাড়ি ছুটিয়েছে কিংশুক। সিক্সটিন উইকসের বেশি হয়ে গেছে, এখন মিসক্যারেজ হলে…! হে ঈশ্বর, রুমির যেন কোনও ক্ষতি না হয়। উফ্‌, পুকুরপাড়ে কী জন্য গেছিল? সাড়ে তিনটের সময়ও কিংশুকের সঙ্গে কথা হল…! বড় অভিমানী মেয়ে, ভাল করে কথাও বলেনি কিংশুকের সঙ্গে।…! রাগ করে ছিল কিংশুকের ওপর? হঠাৎ ফোন পেয়ে ডিসটার্বড হয়ে গেছিল? এমনিই তো প্রচণ্ড ডিপ্রেশান যাচ্ছে…! অবুঝ অবুঝ, বড্ড অবুঝ। পাড়ার নার্সিংহোমে গেছে…কেমন নার্সিংহোম? ডাক্তার আছে তো ভাল? কিংশুক যে কেন এই মুহূর্তে পাশে নেই? রুমি রুমি রুমি রুমি…

গড়িয়াহাট মোড়ে রক্তচক্ষু। গাড়ি নিথর। লাল বাতিটা মৃত্যুর মতো জ্বলছে। কতক্ষণ…? কতক্ষণ…? সময় যে পেরিয়ে যায়।

সিগনাল সবুজ হতেই অ্যাক্সিলেটার চাপল কিংশুক। সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে থিক থিক করছে গাড়ি, স্পিড তোলা যাচ্ছে না, হেঁচকি তুলতে তুলতে এগোচ্ছে মারুতি। একটা প্রাইভেট বাস ওভারটেক করল হঠাৎ, রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে গেছে, যাত্রী তুলছে ডেকে ডেকে। কিংশুক হর্ন টিপেই আছে, বাসের ভ্রূক্ষেপ নেই। ছোটলোক। ছোটলোক। কবে যে দেশটা সভ্য ভদ্র হবে!

টেলিফোন! ভীষণ চমকে কিংশুক মোবাইল কানে চাপল, কিংশুক বলছি।

—আমি রানা কিংশুকদা। ছোড়দি….

—হ্যাঁ, খবর পেয়েছি। কেমন আছে?

—নষ্ট হয়ে গেছে বাচ্চাটা।

—….।

—প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে কিংশুকদা। পেটে খুব ক্র্যাম্প হচ্ছিল….

—হ্যাঁ, হওয়ারই তো কথা। … এখন কী অবস্থা?

—ও টিতে নিয়ে গেছে। বলল কিউরেট করছে।

—ডি অ্যান্ড সি তো করতেই হবে।…. তুমি আছ তো? আমি এক্ষুনি পৌঁছচ্ছি।

রাসবিহারীর কাছে এসে বড় রাস্তা ছাড়ল কিংশুক। ভেতর ভেতর দিয়ে চলে যাবে, অপেক্ষাকৃত ফাঁকা থাকে রাস্তাগুলো।…ফিটাস ফর্ম করে গেছিল, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে এসেছিল প্রায়, নষ্ট হয়ে গেল? প্রোডাক্ট পুরো বার হয়ে গেছে কি? ঠিক মতো ওয়াশ করবে তো? এক কণা থেকে গেলেও সেপ্‌টোসেমিয়া হয়ে যেতে পারে।…রুমি কি খুব ভেঙে পড়বে? কান্নাকাটি করছে কি খুব? মা বলে কথা…

গাড়ি হাজরা রোডে পড়তে পারল না। মিছিল। জঙ্গি ভাষায় গলা ফাটাচ্ছে পাল পাল লোক, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুড়ছে শূন্যে। দুই রাজনৈতিক দলের হানাহানিতে কাল নিহত হয়েছে এক উঠতি নেতা, তারই প্রতিবাদে …। এ ভাবে কারণে অকারণে রাস্তা আটকানোর কোনও মানে হয়? কারোও কি এতটুকু আক্কেল নেই? হাইলি আনএথিকাল।

চলেছে মিছিল। চলেছে, অন্তহীন। কুৎসিত সরীসৃপের মতো।

কিংশুকের কোষে কোষে গর্জন করে উঠল বুনো ষাঁড়। মস্তিষ্কের স্নায়ু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। শিরা উপশিরায় অসহ্য দপদপানি, ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে পৃথিবীকে।

কী করবে কিংশুক? গাড়ি ফেলে ছুটতে শুরু করবে? নাকি ছিন্নভিন্ন করে দেবে নির্বিকার পোকামাকড়গুলোকে?

কিংশুক টের পাচ্ছিল সে ক্রমশ বিশ্বজিৎ হয়ে যাচ্ছে। যুক্তিহীন ব্যাকুল এক নাচার স্বামী। এই মুহূর্তে বিস্ফোরিত হওয়া ছাড়া যার আর কোনও পথ নেই।

রম্যাণি তাকে শেষে এই শাস্তি দিল!

চোদ্দ

পাশ ফিরে শুয়ে ছিল রম্যাণি। কেবিনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরেছে। কিংশুককে দেখে পলকে চোখের মণি উজ্জ্বল, পলকেই দ্যুতিহীন।

কিংশুক টুলে এসে বসল। হাত ধরেছে রম্যাণির। অস্ফুটে বলল, আমায় ক্ষমা করে দাও রুমি।

রম্যাণির ঠোঁটের কোণে মলিন আলোর রেখা। ক্লান্ত স্বরে বলল, কীসের জন্য?

—সব কিছুর জন্য। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।

—আমার তো আর কোনও কষ্ট নেই!

—মন খারাপ কোরো না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। মনে করো এটা একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা। ভুলে যাও।

রম্যাণির বুকটা মুচড়ে উঠল। তার ক্ষণিক মৃত্যু বাসনার কথা কিংশুকের অজানাই থেকে যাবে।

মৃদু স্বরে রম্যাণি বলল, চেষ্টা করব।

আবেগে কিংশুকের গলা ধরে এল, সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো। আবার আমরা আগের মতো…

চাইলেই কি সব আগের মতো হয়? রম্যাণির চোখে কিংশুক কি আবার সেই পুরনো কিংশুক হয়ে যেতে পারবে? কিংবা কিংশুকের চোখে রম্যাণি?

সম্ভব? একবার পোকায় কেটে দিলে আর কি সম্পর্ককে নিটোল রাখা যায়?

তবু রম্যাণির আশা করতে দোষ কি? যদি বদলায়, যদি বদলায় …

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *