১০. ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন এগিয়ে গেল

৯১.

সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন এগিয়ে গেল সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়া

চার্চের দরজার দিকে। সেখানে এগিয়ে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। ভিতর থেকে সেটা বন্ধ। ওলিভেট্টির সেমি অটোমেটিক দিয়ে দরজার লকের উপর তিনটা গুলি চালাল মেয়েটা।

ভিতরে ঢোকার পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল। হাট হয়ে খুলে গেল দরজা।

আশা করেনি কেউ এমন দৃশ্য। চোখ ধাঁধিয়ে গেল ল্যাঙডনের। ভিতরের সবকিছু সোনামি আপোয় জুলজুল করছিল। দুপাশের সারিবদ্ধ বেঞ্চ, বর্ণিল দেয়াল, তাক, সব।

আর ঠিক মাঝখানে একটা আগুনের লেলিহান শিখা লকলক করছিল, উঠে যাচ্ছিল উপরের দিকে, উপরের গম্বুজের দিকে।

মাথার উপরে, দুটা জিনিস ঝুলছে, এগুলো অনেক গির্জায় থাকে। এগুলোতে করে দোলানো হয় বিশে বিশেষ সময়ে বিশেষ বিশেষ বন্ধু। কিন্তু এসব এখন অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে…

সেখানে একজন বিবস্ত্র মানুষ ঝুলছে। লোকটার দু হাতে দুই লোহার শিকল আটকানো। আর ছিড়ে পড়ে যেতে চাইছে তার দেহ। ঈশ্বরের ঘরে আরো একজন সেক অসহায় অবস্থায় ঝুলে আছে উপর থেকে, নিচে আগুনের লেলিহান শিখা।

উপরের দিকে তাকিয়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেল ল্যাঙ৬ন। যেন প্যারালাইজড হয়ে গেছে তার সারা শরীর। অসার।

বৃদ্ধ লোকটা এখনো জীবিত! অসহায়ভাবে সে তার চোখ মেলল, তুলল মাথা! তাকাল নিচের মূর্তিমান বিভীষিকার দিকে। লোকটার বুকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে একটা এ্যালিগ্রাম।

এখান থেকে তেমন দেখতে পাচ্ছে না ল্যাঙডন বুকের লেখাটা। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই, সে বুঝতে পারছে কী লেখা আছে সেখানে।

ফায়ার।

আগুনের শিখা আরো আরো উপরে উঠে যাচ্ছে। অগ্নিশিখার স্পর্শ ছুয়ে দিচ্ছে লোকটার পা। একটা বিচিত্র, অশ্রুতপূর্ব, রক্ত জমাট করা চিৎকার বেরুল লোকটার বুক চিরে। কাঁপছে তার সারা শরীর।

কোন এক অচেনা শক্তির সাহায্যে ল্যাঙডন টের পেল তার শরীর এর গতি ফিরে পেয়েছে। মূল পথের দিকে তাকিয়ে সে বিনা দ্বিধায় এগিয়ে যেতে শুরু করল। ফুসফুস ভরে উঠল ধোয়ায়। কিন্তু চলা থামাল না সে। আগুনের শিখা থেকে দশফুট দূর থেকেই তাপের একটা দেয়ালের মুখখামুখি হল সে। কুঁচকে গেল তার মুখমন্ডলের চামড়া, এক ঝটকায় পিছিয়ে গেল অনেকটা। চোখে আগুনের হল্কা লেগেছে। দ্বিধান্বিতভাবে সে পড়ে যায়। হাত দিয়ে চোখ রক্ষা করে এগুতে থাকে।

সাথে সাথেই টের পায়, আগুন অনেক অনেক উত্তপ্ত।

পিছিয়ে গিয়ে সে চ্যাপেলের দেয়ালগুলোয় চোখ বুলাতে শুরু করে। কোন ঢাল পেলেই হয়ে যায়… ভাবছে সে, তারপর নিজের চিন্তা দিয়ে নিজেই অসন্তষ্ট হয়ে পড়ে। এটা একটা চ্যাপেল। কোন জার্মান দুর্গ নয় যে ঢাল তলোয়ার পাওয়া যাবে। কিছু একটা কর! ভেবে বের কর কী করা যায়!

খুন হয়ে যেতে থাকা লোকটার দিকে আবার দৃষ্টি ফেলে সে।

লোকটা সেখানে অনেক কষ্টে ভেসে আছে। উঠে আসছে কুন্ডলী পাকানো আগুনের হল্কা, ধোঁয়া, গরম বাতাস। লোহার চেনগুলোতে আটকে আছে জ্যান্ত একটা মানুষ। মারা যাচ্ছে আগুনে একটু একটু করে পুড়ে।

আশপাশে চোখ বোলাল ল্যাঙডন। না, তার কাছাকাছি পৌঁছার যে উপায়গুলো আছে সেগুলো অনুসরণ করতে গেলে তার পোড়া মৃতদেহ নামানো যাবে। ব্যস। কাজের কাজ কিছু হবে না।

আগুনের আরো একটা শিখা উঠে গেল উপরে লকলক করে। আর ল্যাঙডন শুনতে পেল জান্তব চিত্তার। পায়ে ফোস্কা পড়তে শুরু করেছিল আগেই। এখন চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। কালো হয়ে যাচ্ছে। লোকটা রেস্ট হচ্ছে জ্যান্ত। উপরে তাকাল ল্যাঙডন। তার কাছাকাছি পৌঁছতে হবে যে করেই হোক।

 

চার্চের পিছনে ভিট্টোরিয়া তড়পাচ্ছে কিছু করতে না পেরে। সে সোজা উপরের দিকে তাকায় একবার, হতাশায় চোখ ফিরিয়ে নেয় সাথে সাথে। কিছু একটা কর, কর কিছু একটা!

সে ভেবে পায় না কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছে ওলিভেটি। সে কি হ্যাসাসিনকে ধরতে পেরেছে? দেখতে পেয়েছে লোকটাকে? অন্তত কার্ডিনালকে দেখতে পাবার কথা। কী করছে সে? সামনে এগিয়ে গেল সে, ল্যাংডনকে সাহায্য করবে। কিন্তু একটা শব্দ থামিয়ে দিল তাকে।

আগুনের পটপট আওয়াজ বেড়ে গেছে হঠাৎ করে। তবু, তার সাথে সাথে একটা ধাতব শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। নিয়মিত, অনিয়মিত। কীভাবে যেন এই শব্দটার সাথে পরিচিত সে। কীভাবে ভেবে পাচ্ছে না। তাকাল ঝট করে। একটা র‍্যাটল সাপের শব্দ। আসছে পিছন থেকে। এগুলোর লেজটা নিয়মিত বিরতিতে ঝুনঝুনির মত কাঁপে। আওয়াজ উঠছে ফোনের রিং বাজার মত। ভাইব্রেশনের মত। একবার আওয়াজ উঠছে, আরেকবার থামছে। নিয়মিত বিরতিতে।

সামনে এগিয়ে গেল সে, দেখেনি, আড়ালে সাপটা আছে কিনা। তার এক হাতে গান, আরেক হাতে অন্য কিছু ধরা। টের পেল সে, সেলফোন। উত্তেজনার চোটে সে ভুলেই গেল যে বাইরে থাকার সময় সে এটাকে ব্যবহার করেছিল কমান্ডার ওলিভেট্টিকে ফোন করার কাজে।

কানের কাছে ফোনটাকে ধরল ভিট্টোরিয়া। বোঝার চেষ্টা করল ওলিভেট্টি সেটাকে ধরেছে কিনা। না এখনো রিং হচ্ছে, ধরছে না কমান্ডার। ব্যাপার কী! তারপর হঠাৎ করেই সে বুঝতে পারল কী থেকে এই শব্দটা আসছে।

তারপর, হঠাৎ তার সমস্ত দুনিয়া দুলে উঠল তার। যেন ডুবে গেল সমগ্র চার্চ। মেঝের দিকে তাকাল সে। শরীর থেকে কোন তরলের বন্যা চলছে না। তার মাংসে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। শুধু কমান্ডারের মস্তকে একটা বৈপরীত্য দেখা দিচ্ছে। তার মাথাকে একশো আশি ডিগ্রি বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছে জোর খাঁটিয়ে।

সাথে সাথে পাথর হয়ে গেল ভিট্টোরিয়া। মনে পড়ে গেল তার বাবার কথা।

মেঝেয় পড়ে আছে ওলিভেট্টির ফোনটা। ঠান্ডা মেঝেতে কেঁপে চলেছে একাধারে। ভিট্টোরিয়া তার নিজের ফোনটা তুলে রাখল। কেটে দেয়ায় ফলে থেমে গেল। সেলফোনটার কম্পন। শব্দ থেমে গেল।

কিন্তু সাথে সাথে নতুন একটা আওয়াজ উঠল। পিছন থেকে।

কেউ একজন শ্বাস নিচ্ছে তার পিছনে।

ঘুরতে শুরু করল সে। একই গতিতে ঘুরিয়ে নিতে থাকল পিস্তলটাকে। কিন্তু ভালভাবেই জানে, দেরি হয়ে গেছে। অনেক দেরি। আলোর একটা রেখা বিস্ফোরিত হল তার মাথায়। মাথার উপর থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত ব্যথার একটা স্পর্শ এগিয়ে গেল শিরশির করে। তার গলা জাপ্টে ধরল খুনির কনুই।

এবার… তুমি আমার। বলল সে হিসহিস করে।

এরপর, আঁধার ঘনিয়ে এল চারধারে।

***

স্যাঙচুয়ারি পেরিয়ে, সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল ল্যাঙডন। গির্জাগুলোয় এমন অবস্থা থাকে। এখনো চেনটা মাথার ছফিট উপরে। ল্যাঙডন জানে, এগুলোর দিকে এগিয়ে যায় প্রিস্টরা কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করে। মইগুলোর নাম পিউওলি। লোকটাকে ফাঁসিয়ে দিতে নিশ্চই খুনি ঐ মই ব্যবহার করেছে। কোন সন্দেহ নেই। তাহলে কোন চুলায় এখন গিয়ে আছে ল্যাডারটা!

নিচে তাকাল ল্যাঙডন। আতিপাতি করে খুজছে একটা মই। নেই, কোথাও নেই। এক মুহূর্ত পরই টের পেল সে কোথায় আছে সেটা। আর কোথায় থাকতে পারে! অগ্নিকুন্ডের ঠিক মধ্যখানে। আগুন লকলক করে এগিয়ে যাবে এটার সাহায্যে।

এবার মরিয়া হলে সারা গির্জায় চোখ বুলাল ল্যাঙডন। উপরের স্তরে উঠে যাবার কাজে লাগবে এমন যেকোন কিছু পাওয়া দরকার। এখনি প্রয়োজন। সারা চার্চে চোখ বুলাতে বুলাতে সে টের পেল, কিছু একটা ঘটছে আশপাশে।

কোন চুলায় গিয়ে আছে ভিট্টোরিয়া? একেবারে ভোজবাজির মত উবে গেছে মেয়েটা। সে কি সাহায্যের জন্য গেল কোথাও? এবার না পেরে সে ভিট্টোরিয়ার নাম ধরে ডাকাডাকি করল। কিন্তু কোথাও কোন জবাব ধ্বণিত প্রতিধ্বণিত হল না। আর কোন মরা মরেছে ওলিভেট্টি?

এখনি উপর থেকে যাতনার একটা বীভৎস কাত্নানি শোনা যাচ্ছে। অনেক অনেক দেরি হয়ে গেল। উপরের দিকে চোখ চলে গেল তার। দেখতে পেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে বয়েসি লোকটা। ধীরে ধীরে একেবারে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটা কথাই মনে হল তার বারবার। পানি। অনেক অনেক পানি। আগুন নিভিয়ে ফেলতে হবে। অন্তত কমিয়ে আনতে হবে লকলকে শিখার উচ্চতা।

আমার পানির দরকার, ড্যাম ইট! চিল্কার করল সে জোরে জোরে।

এটাই পরের কাজ। বলল একটা কণ্ঠ।

চমকে তাকাল ল্যাঙডন নিচে। কেউ একজন অন্ধকার থেকে কথা বলে উঠেছে। তাকাল সে সেই অন্ধকারে থাকা অবয়বের দিকে।

আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে নেকটা। বিশালদেহী। এবং অত্যন্ত স্কুল। না। সে তেমন স্কুল নয়। তার হাতে ধরা আছে আরেকজন মানুষ।

ভিট্টোরিয়া!

পিচকালো চোখ খুমির চকচক করছে। একহাতে জড়িয়ে রেখেছে ভিট্টোরিয়াকে, অন্যহাতে তারই বুক পকেট থেকে তুলে নেয়া অস্ত্র।

সাথে সাথে ভয়ের একটা ঘুমভাঙা স্রোত নেমে এল শিরদাঁড়া বেয়ে। অন্ধ ক্রোধও টের পেল সে তার ভিতরে ভিতরে। কী করেছে জানোয়ারটা ভিট্টোরিয়ার সাথে? সে কি আহত? নাকি তারচেও বেশি কিছু?

একই মুহূর্তে ল্যাঙডন টের পেল, মাথার উপরের লোকটার চিৎকারে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। জান্তব গোঙানি বেরিয়ে আসছে তার গলা চিরে। কার্ডিনাল হয়ত সত্যি সত্যি মারা পড়বেন। তাকে আর বাঁচানোর কোন উপায় বাকি থাকল না।

তারপর, খুনি যখন তার অস্ত্রটা তাক করল ল্যাঙডনের বুকের দিকে, আরো একটা অপরিচিত অনুভূতিতে শিরশির করে উঠল সে। চার্চের বেঞ্চগুলোয় লাথি দিয়ে নিচু হয়ে গেল। প্রাণ বাচানোর তাগিদে যেতে থাকল এগুলোর নিচ দিয়ে।

বেঞ্চগুলোয় আঘাত করার সময় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জোর প্রয়োগ করেছিল। সাথে সাথে সেগুলো পড়ে যেতে যেতে মেঝেতে বিচিত্র ধাতব ঘষটানোর শব্দ তুলল।

 

চ্যাপেলের মেঝের অনেক উপরে, কার্ডিনাল গাইডেরা তার সজ্ঞানতার শেষ বীভৎস মুহূর্তগুলো পার করছিলেন। নিজের চোখে নিম্নাঙ্গের দিকে চোখ দিলেন। দেখতে পেলেন, পায়ের পোড়া চামড়া উঠে আসছে। আমি নরকে আছি, সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ঈশ্বর, কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত এটা!

তিনি জানেন, তিনি এখন সত্যি সত্যি নরকে আছেন। তাকালেন বুকের দিকে। সেখানে ঠিক ঠিক কুঁদে দেয়া হয়েছে একটা শব্দ। টের পেলেন। এর একটা অর্থ আছে। একেবারে স্পষ্ট অর্থ।

 

৯২.

তিনবার ব্যালটিং হয়েছে, কোন পোপ নির্বাচিত হয়নি।

সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে কার্ডিনাল মর্টাটি একটা অলৌকিক ব্যাপারের জন্য প্রার্থণা করছে। আমাদের কাছে প্রার্থিদের পাঠিয়ে দাও ঈশ্বর!

অনেক অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। কেউ আসেনি। একজন প্রার্থি না থাকলে মনকে কোন না কোন উপায়ে শান্তনা দেয়া যায়। কিন্তু চারজনই হাপিস! কী করে হয়! দুই তৃতীয়াংশ ভোেট পাওয়া একেবারে অসম্ভব। ঈশ্বর নিজে সাহায্য না করলে কোন আশা নেই।

বাইরের বোল্টে আঘাতের শব্দ ওঠায় মাটি এবং আর সব কার্ডিনাল একই সাথে প্রচন্ড আশা নিয়ে ঘুরে তাকালেন। মর্টাটি জানেন, এই আনসিলিং এর একটা অর্থ আছে। কনক্লেভ ভঙ্গ হয়নি কখনো, কখনো হবে না। শুধুমাত্র প্রেফারিতিরা আসলেই এমন কিছু হতে পারে। এই দরজা আর মাত্র দুটা কারণে খোলা যায়, একঃ কোন প্রচন্ড অসুস্থ কার্ডিনালকে বের করার জন্য অথবা অনুপস্থিত প্রেচারিতিদের প্রবেশ করানোর

জন্য।

প্রেফারিতিরা আসছেন!

নেচে উঠল মাটির হৃদপিন্ড। কনক্লেভকে বাঁচানো গেছে।

কিন্তু দরজা হাট হয়ে খুলে যাবার পর পুরো ঘরে যে আশার একটা আলো দেখা দিয়েছিল সেখানে বড় একটা আঘাত এল।

ভিতরে এসে যাচ্ছে একজন ক্যামারলেনগো!

ভ্যাটিকানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত কনক্লেভ সিল করার পর পোপ নির্বাচিত হবার আগে কনক্লেভকে ভঙ্গ করল কোন ক্যামারলেনগো।

কী ভাবছে লোকটা?

এগিয়ে গেল ক্যামারলেনগো, হাজির হল সবার সামনে। তারপর ভাঙা মন নিয়ে তাকাল হতাশ লোকগুলোর দিকে। সিনরি, বলল সে, আমি যতক্ষণ সম্ভব অপেক্ষা করেছি। এমন একটা ব্যাপার আছে যা আপনাদের জানার অধিকার রয়েছে…

 

৯৩.

ল্যাঙডন জানেই না কোথায় যাচ্ছে সে। রিফ্লেক্সের উপর নির্ভর করে সে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। কোথায় জানে না। জানে, বাঁচাতে হবে নিজেকে।

বেঞ্চগুলোর নিচে নিচে এগিয়ে যেতে যেতে তার কনুই আর হাঁটু ব্যাথায় জরজর হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে ডানে যেতে বলছে। তুমি যদি ডানে যেতে পার, তাহলে চম্পট দেয়ার একটা সুযোগ থেকে যাবে।

সে জানে, ব্যাপারটা অসম্ভব। তার আর মূল প্রবেশপথের মধ্যে একটা আগুনের দেয়াল আছে। সে মনকে সচল রাখতে চায়। এরপর কী করার সুযোগ থাকে সেটা। নিয়ে ভাবতে চায়। কিন্তু সে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই পায়ের শব্দ আসছে এগিয়ে।

কিন্তু অবশেষে ধাক্কা খেল সে। ধারণা ছিল, আরো দশ ফুট বেঞ্চি পিেরয়ে তারপর চার্চের সামনে চলে যেতে পারবে।

বিধি বাম।

কোন রকম আগাম সতর্কতা ছাড়াই তার মাথার উপরের এতক্ষণ থাকা ছাউনি উবে গেল। যেজন্য সে এখানে এসে হাজির হয়েছে সেটার দেখা পেল সে এবার। এক্সটাসে অব সেন্ট টেরেসা। নগ্নতা আর যৌনতার মূর্তিমান চিত্র। মেয়েটা আনন্দে, শিহরণে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে, তার পিছন থেকে আগুনের বর্শা তাক করে রেখেছে একজন এ্যাঞ্জেল।

ল্যাঙডনের মাথার উপর একটা বেঞ্চে বুলেট লেগে চলে গেল। সে টের পেল, একজন প্রিন্টার দরজার বাইরে যেভাবে দৌড় দেয় সেভাবে পড়িমরি করে ছুটে যাচ্ছে তারই নিজের শরীর। নিজের অজান্তেই সে দেখতে পেল সামনের দিকে শরীর ঝুঁকিয়ে দিয়ে সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে চার্চের সামনের দিকে। বিন্দুমাত্র খেয়াল করে। ডানদিকের দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ পিছলে পড়ার সময় সে টের পেল, আরো একটা বুলেট এগিয়ে যাচ্ছে তার দেহ ঘেষে।

এরপর সে মেয়েটাকে দেখতে পেল। চার্চের পিছনে। ভিট্টোরিয়া! মেয়েটার নগ্ন পা কেমন করে যেন প্যাচানো। এখনো বেঁচে আছে সে। বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার মত কোন সময় নেই হাতে।

টের পাচ্ছে ল্যাঙডন, সময় ফুরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে। বাতাসের বেগে এগিয়ে এসেছে খুনি, বেঞ্চগুলো টপকে, হাতে তার উদ্যত পিস্তল, এমন মুহূর্তে যা করা উচিৎ এবং যা লোকে করে তাই করছে ল্যাঙউন।

এক ঝটকায় নেমে গেল সে নিচের দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা স্তম্ভের আড়ালে। সেখানে পড়তে না পড়তে টের পেল যেখানে একটু আগেও দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

কোণঠাসা জানোয়ারের মত অনুভূতি হচ্ছে তার। সামনে মঞ্চ, এটার নিচে কোনমতে জায়গা করে নিল সে। এগিয়ে গেল উপবৃত্তাকার নিচটার দিকে। আর কোন পথ নেই। যে কোন দিক দিয়ে সে এগিয়ে আসুক না কেন, মুখখামুখি হতে হবে খুনির। উপায়ান্তর না দেখে চোখ বোলাল পুরো তলাটায়। আড়াল পাবার মত কিছু নেই। তারপরই, ঝিকিয়ে উঠল তার চোখের তারা, আনন্দে, সেখানে একটা পাথরের তৈরি কফিনের মত বাক্স রাখা। মাটি থেকে একটু উপরে। নিচের দুটা স্তম্ভ জিনিসটাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে রেখেছে। আশার ছোট্ট একটা রেখা দেখতে পেয়েই প্রস্তুত হল সেটার ভিতরে যাবার জন্য। আটবে কি? আটতেই হবে।

ঠিক পিছনে, পদদ্ধণি শোনা যাচ্ছে।

আর কোন উপায়ান্তর না দেখে সোজা সামনের দিকে নিজেকে ঠেলে দিল। কোনক্রমে ঢাকনার ভারি পাথুরে গডনটাকে সরিয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। গোলাগুলির তীব্র আওয়াজ কমে এল মুহূর্তে।

কিন্তু শেষ পলে একটু বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য। একটা বুলেট ছুটে এল ঠিক ঠিক। ঘেঁষে গেল গা। তপ্ত সীসার স্পর্শ পেল গায়ে টের পেল–গরম তরলের একটা প্রবাহ বেরিয়ে আসছে। একই সাথে সেটা বিস্ফোরিত হল মার্বেলের কফিন-সদৃশ বাক্সের গায়ে।

কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত্রি হয়।

তার শরীরকে জায়গা করে দেয়ার মত ফাঁকা স্থান নেই সেটার ভিতরে।

মরিয়া হয়ে উঠে এল ল্যাঙডন। পিছিয়ে গেল। ঠেকল গিয়ে মঞ্চের শেষ প্রান্তে। আর কিছু করার নেই।

কোন সন্দেহ নেই, এটাই তার কবরখানা। এবং, তা হবে খুব দ্রুত… উপলব্ধি করতে পারছে সে, কারণ একটা আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াল, কালচে নল উঁকি দিচ্ছে পিছন থেকে। ঠিক তার দিকে। খুনি আগ্নেয়াস্ত্রটাকে মাটির সাথে সমান্তরালে ধরে রেখে তাক করেছে ল্যাঙডনের শরীরের মাঝামাঝি।

মিস করার কোন সুযোগ নেই।

মনের কোন গভীর থেকে, যাকে লোকে অবচেতন মন বলে, সেখান থেকে নিজেকে রক্ষা করার এক অদৃষ্টপূর্ব, অপ্রতিরোধ্য ভাবনা আছড়ে পড়ল তার সচেতন মনে। কীভাবে যেন বুঝে গেল, এখন লম্বা হয়ে থাকলে গুলি লাগার সম্ভাবনা অনেক বেশি, তারচে গুলির দিকে হাত দিয়ে হাতের পিছনে শরীর এগিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে থাকলে বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বাড়বে। তাই করল সে। হাতের যেখানটা আর্কাইভের। ভাঙা কাঁচ লেগে ছড়ে গিয়েছিল সেটা ব্যাথা করছে। আমলে নিল না ব্যাপারটাকে। এরপরই একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে গেল, সাঁতারুর মত সামনের দিকে নিজেকে ছুঁড়ে দিল সে, গায়ের পাশে বিদ্ধ হওয়া গুলির ঝাঁপ্টা শেষ হবার সাথে সাথে তারপর চোখ বন্ধ করে প্রার্থণা করল যেন গুলি করাটা থেমে যায়।

অবশেষে তাই ঘটল।

খালি চেম্বারে পড়ল আঘাত, থেমে গেল গর্জন। আর কোন গুলি নেই সেখানে।

অত্যন্ত ধীরে ধীরে চোখের পাতা মেলল ল্যাঙডন। ভয় পাচ্ছে, পাতা খোলার কোন শব্দ হবে নাতো! না কোন শব্দ নেই। নিরবতা চারদিকে। শুধু ঝা ঝা করছে কানের পর্দাদুটো। গুলির আওয়াজে আওয়াজে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। জোর করে। একটা শ্বাস নেয়ার সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দিতে চায় সে। কোন সুযোগ দিবে না। খুনিকে।

এরপর অপেক্ষার পালা।

কখন পালাবে হ্যাসাসিন? তারতো আরো কাজ আছে। না, যাবার কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

মন এতক্ষণে অন্যান্য কথা ভাবার ফুরসৎ পেল। মনে পড়ল তার ভিট্টোরিয়ার কথা। তাগিদ পেল ভিতর থেকে, সহায়তা করতে হবে মেয়েটাকে।

এরপর এক অতিমানবীয় শব্দ শুনতে পেল সে।

বুঝে উঠতে পারল না প্রথমে, হচ্ছেটা কী। তারপর একে একে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। যে ভারি মঞ্চের নিচে সে শুয়ে আছে, কোন এক বিচিত্র কারণে সেটা ভেঙে পড়ছে। আৎকে উঠল সে। সরে যাবার চেষ্টা করল। বাঁচানোর চেষ্টা করল মাথাটাকে, একই সাথে প্রত্যক্ষ করল সাক্ষাৎ যমদূতকে! আর কোন ভয় নেই, নেই কোন ভুল, যমরাজ চলে এসেছে। মৃত্যুদূত মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

অবাক হয়ে ল্যাঙডন লক্ষ্য করল, ব্যাথা পাওয়া হাতে যতটা অনুভূতি হবার কথা তেমন কিছু হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত কফিনের মত বাক্সটার কল্যাণে কোনক্রমে বেঁচে গেল

সে। একেবারে অক্ষত।

শক্ত একটা হাত এগিয়ে এল বাইরে থেকে। পেশীবহুল, কালো, প্রচন্ড শক্তিশালী। এগিয়ে এল সেটা ল্যাঙডনের মাথার দিকে। মাথা থেকে শক্ত করে ধরে রেখে এগিয়ে এল আরো নিচে। খুঁজে নিল গলা। ক্ষুধার্ত অজগরের মত নির্দ্বিধায় পেঁচিয়ে ধরল খুনির হাতটা ল্যাঙড়নের গলাকে। প্রতি পলে পলে চাপ আরো বাড়ছে। চোখে সর্ষেফুল দেখল ল্যাঙডন। আর কোন উপায় নেই। অন্ধকার হয়ে আসছে চোখ দুটা।

কিন্তু কী মনে করে যেন সে পা বাড়াল সামনে। ভাঁজ করে টের পেল, বাক্সটার ভারি পাল্লার নিচে পা দিতে পারছে। জোর খাঁটিয়ে, হাতের মত করে ব্যবহার করে পা দুটা ঢুকিয়ে নিল ভিতরে, তারপর জান্তব শক্তি পেয়ে গেল পা দুটা। সোজা করে নিল

সে ঢাকনাটাকে। অমানুষিক শক্তি প্রয়োগ করল, ছুঁড়ে দিল সামনের দিকে।

সেটা যে মাথাতেও পড়তে পারত, গুঁড়ো করে দিতে পারত তার বুক, সে চিন্তার তোয়াক্কা না করে কাজটা করতে পারায় সাফল্যও ধরা দিল তৎক্ষণাৎ।

উড়ে গেল ভারি পাল্লাটা, তারপর পড়ল সোজা খুনির হাতের উপর। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল খুনি।

সাথে সাথে হাতের করাল গ্রাস থেকে বেঁচে গেল ল্যাঙডন। হাত বের করে আনার জন্য কসরৎ করল লোকটা। পারল না প্রথমে কিছু করতে। অবশেষে যখন হাতটা বের করা গেল, টেনে নিল লোকটা সেটাকে। সশব্দে বাক্সের ঢাকনা পড়ে গেল মেঝেতে।

নিরেট অন্ধকার। আবারো।

এবং পিনপতন নিরবতা।

বাইরে কোন তাড়াহুড়োর চিহ্ন নেই, নেই ভিতরে ঢোকার কোন প্রচেষ্টা। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ল্যাঙডন আবারো খেয়াল দিতে পারল মেয়েটার চিন্তায়।

ভিট্টোরিয়া! বেঁচে আছতো তুমি?

সত্যিটা যদি জানতে পারত সে–যে ভয় আর আতঙ্ক গ্রাস করবে মেয়েটাকে কামনা করত, মারা যাওয়াও এরচে অনেক ভাল।

 

৯৪.

সি স্টিন চ্যাপেলের ভিতরে বসে, আপন সারথিদের সাথে নিয়ে, কার্ডিনাল কোনক্রমে :

শুনতে থাকা শব্দগুলোকে গলাধঃকরণ করছিলেন কষ্টেসৃষ্টে। চোখের সামনে, শুধুই মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে, ক্যামারলেনগো যে কাহিনী শোনাচ্ছে তা বিশ্বাস করা খুব কষ্টের; সে কাজটা করতে গিয়ে কাঁপছে তার সারা গা। টের পেলেন তিনি। স্পষ্ট।

ক্যামারলেনগো বলছেন কিডন্যাপ করে নেয়া কার্ডিনালদের কথা, বুকে কুঁদে দেয়া চিহ্নের কার্ডিনালদের কথা, খুন হয়ে যাওয়া কার্ডিনালদের কথা।

সে এমন এক গোত্রের কথা বলছিল, যার নাম শোনার সাথে সাথে ভিতর থেকে পাক খেয়ে ওঠে এক বীভৎস ভয়। চার্চের বিরুদ্ধে শত্রুতার একটা ভয়াল রূপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিমিষে।

কণ্ঠে বাষ্পরুদ্ধ কষ্ট নিয়ে ক্যামারলেনগো বিগত পোপের কথা বলে… ইলুমিনেটির বিষপ্রয়োগে যিনি প্রাণত্যাগ করেছেন।

এবং সবশেষে, কণ্ঠে এক অচেনা ফিসফিসানি নিয়ে তিনি বলেন এক আনকোরা, নূতন প্রযুক্তির কথা, যেটা শুনলেই রূপকথা বলে মনে হয়। এন্টিম্যাটার। আর দু ঘণ্টাও বাকি নেই, প্রাচীণ পবিত্র নগরী ভ্যাটিকানকে ধূলার সাথে আক্ষরিক অর্থেই মিশিয়ে দিতে যাচ্ছে সেটা।

যখন সে কথা বলে যাচ্ছিল–যেন স্বয়ং শয়তান হাজির হয়ে ঘরের সমস্ত বাতাস শুষে নিয়েছিল এক পলকে। কেউ নড়তে পারেননি। বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে ফিরছিল ক্যামারলেনগোর কণ্ঠ, দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হচ্ছিল।

আর যে ব্যাপারটা সবাইকে অবাক করছিল, তা হল, ইতিহাসে প্রথমবারের মত কোন ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র প্রবেশ করেছে কনক্লেভে। একটা ক্যামেরা এবং তার সাথে আনুষাঙ্গিক যন্ত্র। ফ্ল্যাশলাইট, রিফ্লেক্টর ইত্যাদি। ক্যামেরাটা কখনো ঘুরছিল ঘরের চারধারে, কখনো স্থির হচ্ছিল ক্যামারলেনগোর চেহারায়। সাথে বিবিসির দুজন রিপোর্টার। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা ক্যামেরাম্যান। এই ঘোষণা এই মুহূর্তেই সারা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। লাইভ।

এবার, সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে থেমে গেল ক্যামারলেনগো, তারপর বলতে শুরু করল, ইলুমিনেটির প্রতি… আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসছে তার কথা, এবং তথাকথিত বিজ্ঞানের লোকদের প্রতি… থামল সে আবারও, আপনারাই জিতে নিয়েছেন এ যুদ্ধ।

চ্যাপেলের কোণায় কোণায় এবার খেলে গেল নিরবতার এক নিষ্ঠুর তরঙ্গ। মাটি তার নিজের হৃদপিন্ডের ধ্বক ধ্বক শব্দ ঠিক ঠিক শুনতে পাচ্ছিলেন।

সময়ের চাকা ঘুরছে অনেকক্ষণ ধরে। বলছে ক্যামারলেনগো, আপনাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। এর আগে এমন নিশ্চয়তা আর কেউ দিতে পারেনি। কেউ আর কখনো এত নিশ্চিত হতে পারেনি। সায়েন্স ইজ দ্য নিউ গড!।

কী বলছে সে বিষম খেলেন মাটি। পাগল হয়ে গেল নাকি! পুরো দুনিয়া এই ঘোষণা শুনতে পাচ্ছে।

মেডিসিন, ইলেক্ট্রনিক কমুনিকেশন্স, স্পেস ট্রাভেল, জেনেটিক ম্যানিপুলেশন… এগুলোই আজকের মিরাকল, এই জাদুর কথাই আমরা আমাদের সন্তানদের বলি। এ রহস্যগুলো নিয়ে আমরা মেতে উঠি, উঠি তেতে, এবং বিজ্ঞান এসবের সঠিক জবাব বের করে দেয়। আদ্যিকালের যত মিথ, যত লোককথা, যত কাহিনী, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের • কথা, সাগর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাবার ঘটনা এখন আর প্রমাণিত সত্য নয়। হেরে গেছেন ঈশ্বর। জিতেছে বিজ্ঞান। হার মানছি আমরা।

চ্যাপেলে বয়ে গেল একটা অস্থিরতার ইঙ্কা।

কিন্তু বিজ্ঞানের এই জিতে যাওয়াটা, যোগ করল ক্যামারলেনগো, তার কণ্ঠ আরো তীক্ষ্ণ্ণ হচ্ছে, আমাদের সবাইকে বলির পাঁঠা বানিয়ে নিয়ে তারপর অর্জিত হল। অর্জিত হল আমাদের সবার নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা, সারা জীবন ধরে রক্ষা করা ধৈর্য, রূপকথাতুল্য সততার সাথে পাল্লা দিয়ে।

নিরবতা।

বিজ্ঞান হয়ত আমাদের জীবনের সমস্ত রহস্যের দ্বার খুলে দিয়েছে, রক্ষা করেছে। দুরারোগ্য অসুখের হাত থেকে, দূর করে দিয়েছে জ্বরা, কিন্তু একই সাথে আমাদের জীবনকে করে তুলেছে রহসাহীন, একঘেয়ে।

আমাদের অনিন্দ্যসুন্দর সন্ধ্যাগুলোর অপরূপ আলোছায়ার খেলাগুলো আজ আর রহস্যময় নেই, সেখানে আছে তরঙ্গদৈর্ঘের খেলা।

পুরো সৃষ্টিজগতের সমস্ত জটিলতা রহিত করে দেয়া হয়েছে একটা মাত্র ইকুয়েশনে।

এমনকি আমাদের মানব হয়ে থাকার অপরূপতাও মুহূর্তে ম্লান হয়ে যায় কঠিন বৈজ্ঞানিক তথ্যের সামনে।

বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে আমাদের এই পৃথিবী গ্রহটায় প্রাণের উন্মেষ একটা নিছক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়, থামে ক্যামারলেনগো, এমনকি যে টেকনোলজি আমাদের এক সুর লহরীতে আবদ্ধ করে সেটাই বিভক্ত করছে আমাদের বিনা দ্বিধায়। আমাদের প্রত্যেকেই পুরো দুনিয়ার সাথে একেবারে এক সুরে আবদ্ধ হই ইচ্ছা হলেই, একই সাথে, আমাদের মত একলা আর কেউ নেই। আমরা বোমার মুখে পড়ে যাই প্রতিহিংসায়, জিঘাংসায়, বিভক্তিতে, বেঈমানিতে।

এতে আর অবাক হবার মত কী আছে যে আজকের দিনে আমরা, মানুষেরা সবচে বেশি একা, সবচে বেশি হিংস্র, সবচে বেশি অসহায়, সবচে বেশি নিকৃষ্ট, মানব ইতিহাসে আর কখনো এমন চরম বিন্দুতে মানুষ কখনো দাঁড়ায়নি সেটা ভেবে অবাক হবার আর কী আছে?

বিজ্ঞান কি কোন ব্যাপারকে আর সব কিছুর বাইরে, পবিত্র রেখেছে? বিজ্ঞান শুধু উত্তর খুঁজে যায়, ছিড়েখুড়ে জানতে চেষ্টা করে সবটা। বিজ্ঞান এমনকি আজকের দিনে আমাদের সমস্ত রহস্যের আধার ডি এন এ কে তন্ন তন্ন করে আবার আমাদের সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। অর্থ খোঁজার ধাঁধায় পড়ে গিয়ে ঈশ্বরের রহস্যগুলোকে আরো অযুত নিযুত ভাগে বিভক্ত করে আমরা শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছি জবাব… আর এত প্রাপ্তি আমাদের শুধুই অপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যা পাচ্ছি তার নাম আরো আরো প্রশ্ন।

ব্যথা নিয়ে দেখছেন মাটি। ক্যামারলেনগোর কন্ঠে যেন স্বয়ং ঈশ্বর ভর করেছেন। যেন সে সম্মােহিত করছে সারা দুনিয়াকে, শুধু কথার জাদু দিয়ে, আর সেটা যেন তার নয়, যেন অন্য কারো কাছ থেকে ধার করে আনা। তার নড়াচড়ায় এমন এক দৈহিক শক্তির প্রকাশ যেটা দেখে যে কেউ মিইয়ে যাবে; এমন এক ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাচ্ছে তার বাচনভঙ্গিতে, যেটা কোনকালে কোন ক্যামারলেনগোর কথায় প্রস্ফুটিত হয়নি। যেটা আর কখনো দেখা যায়নি কোন ভ্যাটিকান প্রতিনিধির ভিতরে। মানুষটার কণ্ঠে অন্য কোন জগতের শক্তি, অন্য কোন ভুবনের শোক।

বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে চলা সেই সুপ্রাচীণ যুদ্ধের এখানেই ইতি, বলছে ক্যামারলেনগো, জিতে গেলেন আপনারা। জিতলেন ঠিকই। জিততে পারলেন না ন্যায্য কাজ করে, ন্যায়ের পথে থেকে। সার্বিক আদর্শ তো দূরের কথা, আজ আর আপনারা আপনাদের আদর্শে থেকেও জিততে পারলেন না। দিলেন না কোন প্রশ্নের জবাব।

ধর্মের আর থেকে কী লাভ? কোন লাভ নেই। ক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়। বিজ্ঞান এক স্বভোজী ভাইরাসের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বেশি দেরি নেই। প্রতিটা ধ্বংস, প্রতিটা রূপ-বদল নতুন ধ্বংস এবং আরো নূতন রূপ-বদলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

চাকা থেকে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে মানবজাতির হাজার হাজার বছর লেগে গেছে। কিন্তু গাড়ি থেকে স্পেস ক্রাফটে পরিণত হতে সময় লেগেছে মাত্র এক শতাব্দি, আর এখন আমরা বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে হিসাব করছি প্রতি সপ্তাহে। পুরো পাশার ছক উল্টে যাচ্ছে প্রতিটা মিনিটে। পলকে পলকে নতুনত্ব এসে আমাদের আরো আরো পিছিয়ে দিচ্ছে, আমরা ঘুরে চলেছি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। আমাদের অগ্রগতি হচ্ছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি ক্রমেই শুধু আমাদেরকে, অন্য কিছু নয়। আত্মকেন্দ্রীকতা ঘনীভূত হচ্ছে, আদর্শহীনতায় পড়ে গিয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে অস্থির, অতৃপ্ত, অর্জন বলতে থাকছে শুধুই শূণ্যতা।

আমরা অর্থের জন্য কেঁদে উঠি, এবং বিশ্বাস করুন, আমরা কেঁদে উঠি। আমরা ইউ এফ ও দেখি, আটকে যাই চ্যানেলের ফাঁকগুলোয়, আত্মিক সম্পর্ক টের পেয়ে ভীত চোখে তাকাই, অশরীরীর দেখা পেয়ে ভড়কে যাই, মনের গভীরে জেগে ওঠা প্রশ্ন দেখে আৎকে উঠি-এই সব ব্যাপারেরই কোন না কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, আর সত্যি বলতে গেলে, এই সব ব্যাখ্যাই নির্লজ্জভাবে আমাদের সামনে আরো রহস্যের দুয়ার খুলে দেয়।

আমাদের ভিতরে সব সময়, অহর্নিশি, অষ্টপ্রহর যে ভাবনা গুমরে মরে সেটার নাম একাকীত্ব আর অসহায়ত্ব। আধুনিক নিঃসঙ্গতা, টেকনোলজির হাত থেকে, সব পাবার জগতের হাত থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা।

টের পাচ্ছেন মাটি, নিজের সিটে বসে থেকেই সামনের দিকে ঝুঁকে চলে এসেছেন। তিনি, তার চারপাশের যাজকদল, সারা দুনিয়ার তাবৎ মানুষ বুকে এসেছে। এ লোকটার অস্পৃশ্য শক্তির সামনে। নিজেদের অজান্তেই। ক্যামারলেনগো কোন ধার্মিকতার আশ্রয় নিচ্ছে না তার কথা শেষ করার কাজে। কোন পবিত্র গ্রন্থ থেকে শ্লোক আউড়ে যাচ্ছে না, বলছে না জিসাস ক্রাইস্টের কথা। তার কথায় ঝরে পড়ছে আধুনিক বাচনভঙ্গি; তার পরও, কণ্ঠে ধ্বণিত হচ্ছে সুপ্রাচীণ ঐশ্বরিকতা। যেন… যেন স্বয়ং ঈশ্বর এ লোকের কণ্ঠ দিয়ে বলে যাচ্ছেন কথা, আধুনিক স্বরে… প্রচার করে যাচ্ছেন সেই অদেখা ভুবনের আহ্বান, যা প্রচারিত হচ্ছে যুগ-যুগান্ত ধরে। এ

হঠাৎ করে টের পাচ্ছেন মর্টাটি কেন মৃত পোপ এই তরুণ তুর্কীকে তার কাছাকাছি রেখেছেন সব সময়। টের পাচ্ছেন তিনি, এই পরিবর্তনের যুগে চার্চ চায় এমন কষ্ঠ, এমন তেজধারা, এমন অমিত অজেয় বাণী, এমন যুগশ্রেষ্ঠ কথা, এমন বাস্তবতা ঘেঁষা বাণী। এ-ই চার্চের আশা।

এখন ক্যামারলেনগো আরো অনেক তেজদীপ্ত কণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছে অবিরল বারিধারার মত, সায়েন্স, আপনারা বলেন, রক্ষা করবে আমাদের। সায়েন্স, আমি বলি, ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের। গ্যালিলিওর যুগ থেকেই গির্জা চেষ্টা করছে, বিজ্ঞানের বল্পবিহীন ঘোড়ার অবাধ্য শিরে লাগাম পরানোর চেষ্টা। কখনো কখনো সেই চেষ্টার কোথাও কোথাও ভুল পন্থা ব্যবহার করা হয়েছে, কোথাও কোথাও ব্যাপারটা হয়েছে ভুল ভাবে। কিন্তু আমাদের চেষ্টার পবিত্রতা আর আন্তরিকতার কোথাও কোন খাদ ছিল। নী।

আজ আমি আপনাদের জানিয়ে দিতে চাচ্ছি, একবার, মাত্র একবার আপনার চারপাশে দৃষ্টি রাখুন, চোখ মেলে তাকান চারধারে, বিজ্ঞান, অজেয় বিজ্ঞান তার কথা রাখেনি। সারল্যের ছলনায় আমরা পাচ্ছি অসহ্য জটিলতা, অবিরাম সমস্যা উঠে এসেছে আমাদের ঘাড়ে। আমরা আজ এক ভেঙে পড়া, বিনষ্ট প্রজাতি… ধ্বসের অন্ধকূপে পতিত হওয়া এক দল।

লম্বা একটা মুহূর্তের জন্য থামল ক্যামারলেনগো, তারপর তার সবুজ চোখে ঠিকরে বেরুল অপার্থিব আলো।

এই ঈশ্বর বিজ্ঞান কে? কে তিনি, যিনি ক্ষমতার অসীম সমুদ্রে অবহাগন করাচ্ছেন আমাদের, কিন্তু জানিয়ে দিচ্ছেন না কী করে সেটাকে ব্যবহার করতে হয়? কেমনধারা পিতা তিনি যিনি সন্তানের হাতে আগুন তুলে দেন কিন্তু বলেন না কী করে সেটাকে ব্যবহার করতে হয়? বিজ্ঞানের সাইনবোর্ডে, সায়েন্সের ভাষায় ভাল আর মন্দকে আলাদা করা হয়নি। বিজ্ঞানের বই আমাদের শেখায় কী করে একটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাকশন করতে হয়। এখানেই খালাস বিজ্ঞানের ঐশ্বরিকতা। সে বইতে কোথাও লেখা থাকে না এ শক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। কী করে সেটাকে কল্যাণের পথে চালিত করতে হবে।

বিজ্ঞানের প্রতি, বলছি আমি এ কথা। ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গির্জা। আপনাদের দিকপাল থাকার চেষ্টা করতে করতে আজ আমরা নিঃস্ব। ভালমন্দের কথা বলতে বলতে আমাদের প্রাণ অতিষ্ট হয়ে উঠছে, যেখানে আপনাদের একমাত্র লক্ষ্য কী করে আরো ছোট একটা চিপ বানানো যায়, কী করে লাভের অঙ্কটাকে আরো মোটা করা যায়। আপনাদের নিজেদের শাসন করার মত কেউ থাকছে না, এটুকুই আপনাদের আনন্দ। এ জগত এত দ্রুত ঘুরছে যে একটা, মাত্র একটা মুহূর্তের জন্যও পিছনে ফেরার সময় নেই; ভাবার, সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নেই। একটা ব্যাপারই এখানে তুলাদন্ডে পরিমাপ করা হবে, আপনার চেয়ে বেশি গতির কেউ আপনার ঝান্ডাটা তুলে নিয়ে যাবে, ব্যস।

তাই আপনি অহর্নিশি ছুটে চলেছেন। অবিরাম। কিন্তু পোপ সেই ব্যক্তি যিনি আপনার কৃতকাজের দিকে তাকাতে বলেন। আপনার তৈরি করা আরো আরো আরো ব্যাপক ধ্বংসাত্বক অস্ত্রের রাশ টেনে ধরতে বলেন। ব্যালেন্সের বাণী শোনান তার নির্দেশিত নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে। আজ আপনারা সবাই ক্লোন প্রাণীতে পরিণত হয়েছেন, আধুনিক সভ্যতার অভিন্ন একক। কিন্তু চার্চ বলে চলেছে আদ্যিকাল থেকে, আপনি আলাদা একজন মানুষ, এবং কর্মফল সম্পর্কে আপনাকে সজাগ থাকতে হবে। পুরনো দিনের কথা আরকী!

আপনারা পোপকে বাধ্য করেন ফোনে আলাপচারিতা করার জন্য, টিভি স্ক্রিনে উঠে আসার জন্য, কম্পিউটার ব্যবহার করার জন্য… কিন্তু চার্চ সেই প্রতিষ্ঠান যা আপনাদের আলাদা আলাদা মানুষ হিসাবে, একজন প্রাণী হিসাবে থাকতে বলে যেমনটা আমাদের থাকার কথা। গবেষণার নাম নিয়ে আপনারা পৃথিবীর আলো না দেখা শিশুর দ্রুণ নষ্ট করে দেন। কিন্তু চার্চ বলে, তারও একটা আলাদা অধিকার ছিল।

আর এত কথার পরও, আপনারা বলেন, বিজ্ঞান বলে, গির্জা অবজ্ঞার পাত্র। কে বেশি অবজ্ঞার পাত্র? যে লোকটা বজ্রপাতের আলোকে দেখতে পায় না, নাকি সে ব্যক্তি যে অত্যুজ্বল ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করতে জানে না?

এই চার্চ আপনার দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে যায়, পৌঁছে যায় প্রত্যেকের কাছে। আর এখনো, যতই আপনাদের কাছে আমরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাই, ততই আপনারা আমাদের অবজ্ঞাভরে দূরে ঠেলে দেন। একটা প্রমাণ দেখাও যে ঈশ্বর বলে কেউ আছে, বলেন আপনি। আর আমি বলছি, আপনাদের আকাশ ছত্রখান করা অতিকায় টেলিস্কোপগুলো দিয়ে স্বর্গভেদ করুন, তারপর আমাকে জানান যে সেখানে ঈশ্বর বলে কেউ নেই।

এবার জলে ভরে গেল ক্যামারলেনগোর চোখ, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল তার কষ্ঠ, প্রশ্ন তোলেন আপনারা চায়ের কাপে ঝড় তুলে, দেখতে কেমন তোমার ঈশ্বর? আমি জিজ্ঞেস করি, কোত্থেকে এই প্রশ্নটা এল? দু প্রশ্নের জবাব এক, অভিন্ন। আপনারা কি বিজ্ঞানের আধুনিক খোলস না ছাড়িয়েই ঈশ্বরকে দেখতে পান না? টের পান না তার অজেয় মূর্তিমান উপস্থিতি? কী করে তার অস্তিত্ব না দেখেন আপনি বিজ্ঞানের একচক্ষু আয়নায়!

বিজ্ঞান, সর্বেশ্বর বিজ্ঞান, আপনি বলেন, প্রচার করেন, মাধ্যাকর্ষণের ভিতরে, এমনকি একটা মাত্র পরমাণুর ভরের ভিতরে দেখা যায় পুরো সৃষ্টি জগৎ আসলে নিপ্রাণ একটা ধোঁয়াশা ছাড়া কিছুই নেই, কোথায় গেল স্বর্গ, কোথায় তার প্রাণসাগর? আমরা বলি, এই স্তম্ভিত করে দেয়া ব্যাপারটার ভিতরে কি ঈশ্বরের হাতের কাজ দেখা যায় না? আমরা কি এতই ক্ষমতাবান হয়ে গেলাম যে বিলিয়নের ভিতর থেকে সঠিক কার্ডটাকে এক তুড়িতে তুলে আনতে পারব? আমরা এতই সংকীর্ণ কী করে হই যে গাণিতিক একটা হিসাবের বেড়াজাল তৈরি করে দিয়ে ভেবে আপুত হই যে আমাদের চেয়ে শ্রেয় আর কোন অস্তিত্ব নেই। কী সংকীর্ণমনা আমরা মেনে নিতে জানি না যে আমাদের চেয়ে ক্ষমতাবান কেউ থাকতে পারে।

আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, তীক্ষ্ণ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ্ণতর হচ্ছে ক্যামারলেনগোর কণ্ঠ, আপনাকে অবশ্যই একটা ব্যাপার বিশ্বাস করতে হবে। যখন আমরা, একটা প্রজাতি হিসাবে আমাদের চেয়ে শ্রেয়তর শক্তির উপস্থিতি অস্বীকার করি, আমরা আমাদের হিসাব করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলি আত্মগরিমায়হয়ে পড়ি। একচোখা দানব, যে নিজেকেই সবচে বড় বলে জানে।

বিশ্বাস… সকল বিশ্বাস… একটা কথাই জোর দিয়ে বলে, আমরা জানতে পারি, বুঝতে পারি না এমন কিছু একটার অস্তিত্ব ঠিক ঠিক আছে। আমরা সবাই গণ্য, একে অন্যের কাছে গণ্য, উচ্চতর বিশ্বাসের কাছে গণ্য। আজ ধর্ম হালকা হয়ে গেছে, একমাত্র কারণ, মানবজাতিই হালকা হয়ে গেছে। হয়ে গেছে পল্কা। যদি বাইরের লোকজন, ভ্যাটিকানের দেয়ালের বাইরের লোকজন আমাদের দেখতে পায়, দেখতে পায় এই গির্জাকে যেভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি… একটা আধুনিক মিরাকল তারা দেখতে পাবেন… অপূর্ণ একটা ব্রাদারহুড, সাধারণ আত্মার একটা দল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলতে থাকা একটা বিশ্বের ক্ষমতা কজা করার চেষ্টা করছে।

চোখ ফেলল ক্যামারলেনগো সারা কলেজ অব কার্ডিনালসের উপরে। বিবিসি ক্যামেরাম্যান ঠিক তাই করল। ঘোরাল ক্যামেরা সিস্টিন চ্যাপেলের প্রান্তে প্রান্তে।

আমরা কি দানব? প্রশ্ন তুলল ক্যামারলেনগো, এই লোকগুলো কি ডায়নোসর? আমি? সত্যি সত্যি কি এই পৃথিবীর প্রয়োজন আছে এমন কোন কন্ঠের যা দরিদ্রের প্রতিনিধি হবে; দুর্বল, প্রতারিত, জন্ম না নেয়া শিশুর পক্ষে কণ্ঠ মিলিয়ে শোর তোলার মত কোন প্রতিষ্ঠানের কি আদৌ প্রয়োজন আছে? এমন কোন মানুষের আদৌ কোন দরকার কি আছে আমাদের যারা, একেবারে দক্ষ না হলেও তাদের জীবনটা উৎসর্গ করবে মানুষকে নৈতিকতার সাইনবোর্ড দেখানোর কাজে, মূল পথ অনুসরণ করার কাজে, তাদের কোন প্রয়োজন কি পড়ে?

মর্টাটি টের পাচ্ছেন, ক্যামারলেনগো সজ্ঞানে হোক বা অচেতনতায়, একটা চমৎকার কাজ করে ফেলেছে। কার্ডিনালদের দেখিয়ে সে চার্চের উপর প্রাণ প্রতিষ্ঠা। করছে। গির্জাকে দেখাচ্ছে মানব কেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠান রূপে। এখন আর ভ্যাটিকান সিটি কোন বিল্ডিং নয়, বরং কিছু মানুষের সমন্বয়। কিছু মানুষ, যারা সারাটা জীবন মানবজাতির জন্য উৎসর্গ করেছে, স্বীকার করেছে সবচে বড় ত্যাগ। ছুটে এসেছে সংসার জীবন থেকে। ঈশ্বরের জন্য ক্যামারলেনগোর মত মানুষগুলো অতিবাহিত করছে তার সারা জীবন।

আজ রাতে আমরা একটা চরম মুহূর্তে উপনীত হয়েছি। বলছে ক্যামারলেনগো, আমাদের কেউ জিঘাংসায় ভরা মানুষ নয়। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন–শয়তান, দুনীতি, অমরত্ব… দেখতেই পাচ্ছেন, তারা পাখা বিস্তার করেছে। বাড়িয়ে চলেছে তাদের শক্তি। অন্ধকারের শক্তি। এটাকে মোটেও হেলা করে দেখবেন না। মৃদু হয়ে গেল ক্যামারলেনগোর কণ্ঠ, আরো ক্লোজ-আপ নিল ক্যামেরা, সেই শক্তি, যত শক্তিমত্তই হোক না কেন, অজেয় নয়। শুভশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবেই। আপনার হৃদয়ের ধ্বক ধ্বক শব্দ শুনুন। শুনুন ঈশ্বরের বাণী। আমরা আবার এই ধ্বংসস্তুপের ভিতর থেকে নূতন রূপে আভির্ভূত হব।

এবার মাটি বুঝতে পারলেন। এই হল সেই কারণ। কনক্লেভ ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তার পিছনে বড় কারণ ছিল। এ ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই।

ক্যামারলেনগো এখন একই সাথে তার বন্ধুদের প্রতি এবং শত্রুদের প্রতি কথা বলছিল। সে বন্ধু-শত্রু সবার হৃদয়ে পৌঁছে গিয়ে আলোর সন্ধান দিয়ে পাগলামি বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে উদাত্ত কণ্ঠে। এই ষড়যন্ত্রের নগ্নতা যে কেউ উপলব্ধি করবে এবং এগিয়ে আসবে।

তাকাল সামনে ক্যামারলেনগো, আমার সাথে প্রার্থণা করুন।

কলেজ অব কার্ডিনালস হাঁটু ভেঙে বসল। যোগ দিল তার প্রার্থণায়।

সিস্টিন চ্যাপেলের বাইরে, সেন্ট পিটারের চত্বরে, রোমে, রোমের বাইরে, সারা পৃথিবীতে, মানুষ নত হল। ভেঙে পড়ল হাঁটুতে। তারপর যোগ দিল প্রার্থণায়।

 

৯৫.

হ্যাসাসিন তার পুরস্কারকে ভ্যানে তুলল। তারপর মেয়েটার অনিন্দ্যসুন্দর রূপের একটু প্রশংসা না করে পারল না মনে মনে। মেয়েটার শরীর যে একেবারে কল্পনার মত, তা নয়, কিন্তু তার কোথায় যেন একটা শক্তিমত্তা আছে, টের পেয়েছে খুনি। এবং খুশি হয়ে উঠেছে তার মন।

পুরস্কারকে দেখতে দেখতে তৃপ্তিতে চোখ ভরে উঠছিল। হাতের ব্যাথার কথা মনেই নেই একদম। আর যেটুকু ব্যাথা হচ্ছে সেটাকে অবহেলা করা যায় সহজেই। একটা শান্তুনা আছে তার। যে লোকটা এই আঘাত দিল সে এখন হয়ত চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে। তার বেঁচে থাকার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই।

দখলে নেয়া কয়েদিকে দেখে আরেকবার নেচে উঠল রক্ত। জামার নিচে হাত দিল সে। বুকে। ব্রার ভিতরে স্তনের আকৃতি একেবারে নিখুঁত। ইয়েস! দাঁত কেলিয়ে হাসে সে। চাওয়ার চেয়েও বেশি তুমি! সেখানে নিয়ে যাবে কিনা সেই চিন্তার সাথে যুঝতে যুঝতে অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে গেল খুনি ভ্যানটাকে চালিয়ে নিয়ে।

এবার আর প্রেসকে ঘটা করে জানাতে হবে না যে তৃতীয় খুনটা করা হয়ে গেছে। আগুনই যা জানানোর সব জানিয়ে দিবে।

***

সার্নে, সিলভিয়া আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে ক্যামারলেনগোর ঠিকানার সামনে। এর আগে সে কখনোই ক্যাথলিক হবার জন্য এত বেশি গর্বিত বোধ করেনি এবং সার্নে কাজ করার জন্য এত লজ্জিত হয়নি।

রিক্রিয়েশন উইং পেরিয়ে এসে সে দেখতে পেল প্রত্যেকে শোকাতুর এবং মোহাবিষ্ট। যখন সে কোহলারের অফিসরুমে ঢুকল, দেখতে পেল খাস কামরার সাত ফোনের প্রতিটাই তারস্বরে চিৎকার করছিল। এখানে মিডিয়ার ফোন আসবে না। এমন কোন নিয়ম নেই।

তাহলে কীসের ফোন এগুলো?

টাকা। এর মধ্যেই এন্টিম্যাটারের এই বিপুল পরিমাণ সৃজনের কথা জেনে গেছে সারা দুনিয়া। কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে হাজার রকমের প্রতিষ্ঠান এখন একযোগে ভেঙে পড়বে সার্নের উপর।

 

সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে, গুন্থার গ্লিক যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছিল ক্যামারলেনগোর পিছন পিছন। এই দশকের সবচে দামি লাইভ ট্রান্সমিশনটা শেষ করেছে গুন্থার গ্লিক আর ম্যাক্রি। আর কী ট্রান্সমিশন ছিল এটা। সম্মােহিত করে ফেলেছে ক্যামারলেনগো সারা দুনিয়াকে।

এখন, বাইরে বেরিয়ে এসে ক্যামারলেনগো গ্লিক আর ম্যাক্রির দিকে ফিরে বলল, আমি সুইস গার্ডকে বলে দিয়েছি। ছবি সরবরাহ করবে তারা। ব্র্যান্ডেড কার্ডিনাল আর বিগত পোপের ছবিও থাকবে সেখানে। আগেই বলে রাখছি, ছবিগুলো মোটেও আনন্দদায়ক নয়। দগদগে পোড়া মাংসের চিত্র। কালো হয়ে যাওয়া জিহ্বার ছবি। কিন্তু আমি চাই আপনারা সেই ছবিগুলো বাইরে প্রচার করুন।

সিদ্ধান্ত নিল গ্লিক, অসময়ের ক্রিসমাস আসবে এখন ভ্যাটিকানের ভিতরে। মৃত পোপের ছবি দিবে সে আমাদের? এও কি সম্ভব?

আপনি কি শিওর? কণ্ঠ থেকে উত্তেজনাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করতে করতে সে বলল।

নড করল ক্যামারলেনগো, সুইস গার্ড আপনাদের আরো বেশি কিছু দিতে যাচ্ছে। এন্টিম্যাটারের কাউন্ট ডাউনের লাইভ চিত্র।

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গ্লিক। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা করছে তার। কোন সাতজন্মের ভাগ্যে সে সাংবাদিকতায় যোগ দিয়েছিল?

ক্রিসমাস। ক্রিসমাস। ক্রিসমাস!

ইলুমিনেটি খুব দ্রুত জানতে পারবে যে, বলছে হিসহিস করে ক্যামারলেনগো, কিন্তু এখনো তার কণ্ঠে যাজক সুলভ কোমলতা, অনেক বেশি অতিরিক্ত করে ফেলেছে তারা

 

৯৬.

এক রক্ত হিম করা নিঃসঙ্গতা নিয়ে নেমে এল কালিগোলা অন্ধকার। আলো নেই, বাতাস নেই, বেরুবার পথ নেই।

একটা অন্ধকূপের মত ফাঁদে পড়ে গেছে ল্যাঙডন। ফাঁদে আটকানো ইদুরের মত অনুভূতি তার। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে। এখনো, সরু হয়ে আসতে থাকা পথের নিচে শুয়ে শুয়ে চিন্তাকে সামনে প্রসারিত করার চেষ্টা করছে সে।

যে কোন যৌক্তিক কাঠামো নিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে। যে কোন বিষয়। গণিত, মিউজিক, যে কোন বিষয়। একটা ব্যাপার থেকেই দূরে থাকতে চাচ্ছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে…।

আমি নড়তে পারছি না। পারছি না দম নিতে।

একটু পর একটা ব্যাপার ভেবে যার পর নাই স্বস্তি পায় সৈ। হাত নড়ছে। দুহাতই নড়ছে। সাহস বেড়ে যায় অনেকখানি। হাতদুটো যথাসম্ভব উপরে তোলার চেষ্টা করে, নাড়ানো করে মাথার উপরে নেমে আসা ছাদটাকে। কিন্তু এ শুধুই অরণ্যে রোদন। বরং সে আশা করে, হাতটা যদি আটকে পড়ত,কী ভালই না হত! অন্তত কিছু বাতাস আসা যাওয়া করতে পারত সেখান দিয়ে। হাত হারানো দম বন্ধ হয়ে মারা যাবারচে অনেক অনেক শ্রেয়।

হাত উপরের দিকে তুলে দিতে গিয়ে সে এক পুরনো বন্ধুর হদিস পেল। মিকি তার সবজে মুখে চির অম্লান হাসি। টিকটিক করে যাচ্ছে ঘড়িটা ঠিকঠিক।

চারপাশের পিচকালো অন্ধকারে চোখ বুলায় সে, আর কোন আলোর উৎস কি আছে? নেই। এ হল গিয়ে গডড্যাম ইতালিয় স্থাপত্য। এর কোথাও কোন ফাঁক থাকবে না। একেবারে নিরেট, একদম নিখুঁত। এ ব্যাপারটা সগর্বে সে তার ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে এসেছে এ্যাদ্দিন। কারারা মার্বেলের শক্ত প্রাচীর।

কিন্তু উদ্যমের কাছে সবকিছু নতমুখ হয়ে যায়।

মরার জিনিসটাকে উপরে তোল! বলল সে জোরে জোরেই, হাড্ডিতে চাপ অনুভব করেও উপরের দিকে বল প্রয়োগে তার বিন্দুমাত্র উৎসাহের কমতি নেই। বাক্সটা একচুল নড়ল। চোয়াল শক্ত করে আবার চাপ দিল। বোল্ডারের মত ভারি হয়ে থাকা জিনিসটা এবার উঠল এক ইঞ্চির চার ভাগের একভাগ। চারপাশ ভরে গেল আলোর পরশে। তার পরই ভারি পাল্লার মত নেমে গেল বাক্সের মুখ।

মাথা নিচু করে হাঁপাচ্ছিল সে। অন্ধকারে। পা দিয়ে চাপ দেয়ার বৃথা চেষ্টাও কম করা হল না। যেখানে হাঁটু সোজা করার যো নেই সেখানে পা দিয়ে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।

দম বন্ধ করে দেয়া আতঙ্ক গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। টের পাচ্ছে ল্যাঙডন, গুটিয়ে আসায় বিরাম নেই আশপাশটার। আতঙ্কে মুষড়ে গিয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসল সে। সাধারণ বোধবুদ্ধিও আচ্ছন্ন হয়ে এল।

সার্কোফৗগাস! জোরে জোরে বলছে সে, এলোমেলো হয়ে আসছে চিন্তাধারা।

সার্কোফাগাস এসেছে গ্লিক শব্দ সার্ক্স থেকে যার অর্থ মাংস। আর ফাগেইন মানে খাওয়া। আমি এমন একটা বাক্সে আটকা পড়ে গেছি যেটা তৈরি হয়েছে মাংস ভক্ষণের জন্য।

ভাবনা চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। গুটিয়ে আসছে চারপাশ। মাংস কী করে খাওয়া হয় একটা হাড় থেকে, কী করে নগ্ন হয়ে যায় হাড়ি, খসে খসে পড়ে গোস্ত, সে চিন্তায় বিভোর হয়ে গেল সে। লোপ পেল কান্ডজ্ঞান হয়ে পড়ল সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

কিন্তু একই সাথে, একটু পর পর সে জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে। চলছে মাথা এ সময়টাতেই।

বন্ধ হয়ে আসা কফিনের চারধারে হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে গেল সে দুটা হাড়। রিব কি? কে কেয়ার করে? যা ইচ্ছা তা হোক। একটা চিন্তাই মাথায় গিজগিজ করছে। কোনক্রমে ঢাকনাটা একটু আলগা করতে হবে, কোনক্রমে সেখানে একটা হাড্ডির টুকরা ঢুকিয়ে দিতে হবে, তাহলেই বগল বাজানোর মত বাতাস আসা যাওয়া করবে, টিকে যাবে সে এ যাত্রা। কোনমতে যদি…

শর্বশক্তি দিয়ে সে এক হাত উপরে তোলে; নিচে, মেঝেতে রাখে অন্য হাত; তারপর ধাক্কা দেয় প্রাণপণে। কিন্তু পাথুরে কফিনের হৃদয় ভরে না। অরণ্যে রোদন করে যায় সে প্রচন্ড আক্রোশে। চেষ্টা করে যায় প্রাণপণে। একবার মনে হল কাজ হয়েছে, তারপর যে-সেই।

চারপাশ আরো আরো গুটিয়ে আসছে। বন্ধ হয়ে আসছে মহামূল্য অক্সিজেনের অভাবে। বুঝতে পারছে ল্যাঙডন, এখন দু হাত কাজে লাগাতে হবে, ধাক্কা দিতে হবে উভয় হাত দিয়ে। এ-ও বুঝতে পারে, সময় শেষ হয়ে আসছে। পরে আর এ চেষ্টা করার মত দম থাকবে না বুকে।

আবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে প্রান্তটায় কোনমতে সে হাড়ের কোণাটা ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়, ঠেলে দেয় শরীরটাকে। কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিতে থাকে হাড়টাকে। তুলে আনে দু হাত উপরে, সতর্কভাবে।

ধাক্কা দিয়ে কাজ না হওয়ায় ঘেমে নেয়ে একাকার হয় সে। তার কাছে সবচে অতিঙ্কের ব্যাপার হল বদ্ধ জায়গা; সাধারণ অবস্থায়ও এটা সহ্য হয় না, অথচ আজ এক দিনে এমন দুটা ঘটনা ঘটল। আটকে থাকতে হল দমবন্ধ জায়গায়।

সর্বশক্তি এক হয়ে জান্তব একটা ধাক্কা পৌঁছে যায় বাক্সটার প্রান্তে প্রান্তে, একটু লাফিয়ে ওঠে উপরের পাথুরে ঢাকনাটা, কাঁধের একটা ধাক্কায় অনেকটা সেঁধিয়ে যায় হাড়। ভারি পাথর নেমে আসে মুহূর্তে, ভেঙে যায় হাড়, কিন্তু আশার একটা ক্ষীণ আলো হয়ে বাইরের রঙ দেখা দেয় কফিনের প্রান্তে। ফাঁকা হয়েছে একটু।

খিতিয়ে পড়ে শ্রান্ত ল্যাঙডন। একটাই আশা, চেপে আসা গলার চারপাশের দমবন্ধ আবহ কমে আসবে। অপেক্ষা করল সে। কিন্তু মুহূর্তগুলো উড়ে যাবার সাথে সাথে পরিস্থিতি আরো আরো সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। টের পাচ্ছে ঠিক ঠিক, বাতাস যে আসছে

তা নয়, কিন্তু তাতে একজন মানুষের চাহিদা পূরণ হবে না।

ভেবে পায় না ল্যাঙডন, এটুকুতে জীবন চলবে কিনা। আর যদি ব্যাপারটা তাই হয়, কতক্ষণ টিকে থাকা যাবে? আর যদি টিকেও যায়, কোন লোক ভাববে যে সে এখানে ফাদে পড়ে আছে?

হাতের ঘড়ি দেখার জন্য চোখ এগিয়ে নেয় সে, দেখে মিকি কী বলছে। দশটা বারো। শেষ খেলা খেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে ঘড়ির ছোট্ট ডায়ালের একটা বাটন চেপে ধরে।

আবার লুপ্ত হচ্ছে সচেতনতা, আবার গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে পুরননা আতঙ্ক, আবার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। চেপে আসছে চারধারের দেয়াল। অনেকবার সে একটা খেলা খেলেছে এমন দমবন্ধ পরিবেশে, ট্যাক্সির ছোট ক্যাবে, ছোট কোন ঘরে, পিচ্চি লিফটে… দাঁড়িয়ে আছি কোন খোলা প্রান্তরে, চারপাশে খেলা করছে খোলা বাতাস।

কিন্তু এবার, কোন কাজেই লাগল না চিন্তাটা। যে দুঃস্বপ্ন তার তারুণ্য থেকে পিছু ধাওয়া করে আসছে সেটাই গ্রাস করে নিচ্ছে ল্যাঙউনকে…

এখানকার ফুলগুলো দেখতে পেইন্টিংয়ের মত। সমভূমি ধরে ছোটাছুটি করতে করতে বাচ্চাটা চেষ্টা করল ভাবতে যে তার বাবা-মা এগিয়ে আসছে পিছনে পিছনে। কিন্তু বাবা-মা ব্যস্ত ক্যাম্পের খুঁটি পুঁতে দেয়ার কাজে।

বেশি দূরে যেও না। বলেছিল ছেলেটার মা।

বনের ভিতরে হারিয়ে যেতে যেতে মায়ের কথার থোড়াই পরোয়া করেছে সে।

সামনে অবারিত সবুজ ঘাসের সমভূমি দেখে থমকে যায় সে, এগিয়ে আসে একসাথে জবুথবু হয়ে পড়ে থাকা কতগুলো পাথরের সামনে। ভেবে ঠিক করল সে, এটা নিশ্চই কোন প্রাচীণ ঘরে গাঁথুনি। এর কাছে যাবার তেমন কোন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এগিয়ে যেতে হল। সেখানে পড়ে আছে এক মহিলার চপ্পল। এগিয়ে গেল সামনে, এবং এমন এক ফুল দেখতে পেল যেটা আর কখনো দেখেনি। দেখেছে শুধু বইতে।

আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে গেল ছেলেটা ফুলের কাছে। বসল হাঁটু গেড়ে। তারপরই টের পেল, পায়ের নিচের মাটি কেমন যেন ফাঁপা ফাঁপা। তার পরই বুঝতে পারল, ফুলটা এক ভিন্ন জগতে জন্ম নিয়েছে, জন্ম নিয়েছে ফাঁপা মাটির উপরে, সেখানে থাকা এক কাঠের মেঝের উপর, পচা কাঠের মেঝে।

উত্তেজনায় চমকে গিয়ে, বাসায় তার পুরস্কার নিয়ে যাবার লোভে, এগিয়ে যায় বাচ্চা ছেলেটা সামনে, হাত বাড়ায় ফুলের গোড়ার দিকে।

কিন্তু কখনোই সেখানে পৌঁছতে পারেনি সে।

একটা প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে দ্বিধা হয়ে গেল ধরণী।

তিন সেকেন্ড ধরে পড়তে পড়তে ছেলেটা ঠিক ঠিক বুঝে গেল, মরতে চলেছে সে। নামতে নামতে হাড় গুড়ো করে দেয়া সংঘর্ষ এগিয়ে এল। এরপর সে কোন ব্যথা টের পায়নি। টের পেয়েছে কেবল কোমলতা।

এবং ঠান্ডা।

নামল সে কাদাপানির উপরে। নরম কাদাপানি। ব্যথা পেল না, কিন্তু পেল ভয়। হৃদপিন্ড কাঁপানো ভয়, আর সে সাথে শিতলতা। চারপাশ ঠান্ডা, চারপাশে দমবন্ধ করা সোদা গন্ধ, বাতাসের অভাব, আলোর অভাব।

আলো আসছে কেবল উপর থেকে।

অনেক মাইল উপর থেকে, মনে হল।

মেঝে হাতড়ে বেড়াল সে, উপরে উঠে যাবার মত কিছু একটা খুঁজে বের করার আসায়। কিন্তু কোন লাভ নেই, শুধুই নিরেট পাথর।

আস্তে আস্তে উপলব্ধি করল, এখানে জলীয়তা থেকে তৈলাক্ততা বেশি, পড়ে গেছে একটা পরিত্যক্ত তেলের ডিপোতে, পড়ে গেছে অন্ধকার এক কবরখানায়।

চিৎকার করল বাচ্চাটা।

চিৎকার করতেই থাকল।

শুনল না কেউ। খুব বেশি শব্দ যে বাইরে যেতে পারল তাও না। হীরে ধীরে উপরের আলোর রেখা ক্ষীণ থেকে ক্ষতির হয়ে এল।

নেমে এল রাতের অন্ধকার।

গুটিয়ে আসছে সময়, এগিয়ে আসছে আরো আরো আঁধার। হাতড়ে বেড়াল সে, চেষ্টা করায় কোন বিরতি ছিল না, চিল্কার করল, হল্লা করে মরল। সে ভয়ে আধমরা হয়ে গেল ব্যাপার দেখে, চারপাশ থেকে মাটি খসে খসে পড়ছে তার ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে, জ্যান্ত কবর দিচ্ছে তাকে। আশা করে প্রতি মুহূর্তে, কোন না কোন আওয়াজ উঠবে তাকে উদ্ধারের আশায়, কিন্তু আশার গুড়ে বালি, কোন শব্দ নেই। কবরের নৈশব্দ। নিজের কণ্ঠ গুমরে মরল ভিতরে ভিতরে… স্বপ্নের মত।

রাত যত বাড়ল, গহীন হয়ে এল গর্ত, অন্তহীন হয়ে উঠল। দেয়ালগুলো চেপে এল এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে। চেপে ধরল ছেলেটা দেয়াল, সরিয়ে দিতে চাইল দূরে। হাঁপিয়ে উঠে হাল ছেড়ে দিল শেষে। একেবারে নিথর হয়ে পড়া পর্যন্ত তার জ্বলন্ত ভয়কে তাড়া করে ফিরল হিম শিতল পানি।

উদ্ধারের দল হাজির হয়ে বাচ্চাটাকে একেবারে ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া, অস্থির, হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য অবস্থায় পেল। হাতড়ে বেড়াচ্ছিল সে পানি। দুদিন পরে বোস্টন গ্লোবে হেডলাইন এল, ক্ষুদে সাঁতারু যা পেরেছিল

 

৯৭.

টাইবার নদীর পাড়ে দানবীয় পাথুরে বাসায় যখন হ্যাসাসিনের ভ্যান হাজির হল, পুরষ্কারকে সে সাথে করে উঠে এল উপরে… প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল, একটাই আনন্দ তার, পুরস্কারের ওজন খুব একটা বেশি নয়।

হাজির হল সে দরজায়।

দ্য চার্চ অব ইলুমিনেটি, গোঁ গোঁ করল সে, ইলুমিনেটির আদ্যিকালের মিটিং রুম। কে কল্পনা করবে যে এটা এখানে আছে!

ভিতরে, একটা ডিভানের উপর রেখে দিল সে মেয়েটাকে। তারপর দক্ষহাতে তার হাত বেঁধে দিল পিছমোড়া করে, বেঁধে দিল পা। মনে মনে হিসাব কষে চলে খুনি, তার শেষ কাজটা করে তবে এই উপহারকে উপভোগ করা যাবে। ওয়াটার।

তার পরও, লোভের চিন্তা উন্মাতাল করে তুলল তাকে, হাত বাড়াল সে ভিট্টোরিয়ার কোমরের দিকে। কোমল। উঁচু। মেয়েটার শর্টসের ভিতর তার কালো হাতের আঙুলগুলো হাতড়ে বেড়াল। উঁচু।

থামল সে। বলল নিজেকে, আবেগ কমিয়ে এনে… কাজ। কাজ বাকি আছে। এখনো।

চেম্বারের উঁচু, পাথুরে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল সে। বিকালের মৃদু হাওয়া ঠান্ডা লাগিয়ে দিল তার হাড়ে। টাইবারের শান্ত বাতাসে একটু জিরিয়ে নেয় খুনি। মাত্র পৌনে এক মাইল দূরের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার দিকে তাকায় সে, শত শত প্রেস লাইটের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে সেখান থেকে।

তোমার শেষ ঘণ্টা, বলল সে নিজেকে জোরে জোরে শুনিয়ে, মনে মনে কল্পনা করে নিল ক্রুসেডের সময় শহীদ হওয়া হাজার হাজার মুসলমানের কথা, আজ মধ্যরাতে, তোমরা দেখা করবে তোমাদের গডের সাথে।

পিছনে মৃদু শব্দ তুলল মেয়েটা। ঘুরে দাঁড়াল হ্যাসাসিন। আশা করল মেয়েটা জেগে উঠবে। কোন মহিলার চোখে নগ্ন ভয় দেখার মত মজার আর কী আছে?

কিন্তু একটা ব্যাপার মনে খোঁচা দিচ্ছে। সে এখানে না থাকার সময়টায় মেয়েটা অজ্ঞান থাকলেই ভাল হয়। মেয়েটা শুয়ে আছে, তার মোটেও জোর নেই এমন কঠিন বাঁধন আলগা করার, কিন্তু তবু, সাবধানের মার নেই। আর শক্তি বেশি থাকলেই আনন্দ বেশি, সে মরা পার্টনার পছন্দ করে না। তেজ খুব ভাল জিনিস…

সোজা তার ঘাড় তুলে ধরল খনি। উঁচু করল। তারপর যেভাবে অনেকবার অজ্ঞান করার কাজ করেছে, সেভাবে চাপ দিল মাথার নিচে। আবার নেতিয়ে পড়ল মেয়েটা।

বিশ মিনিট, অপেক্ষা কর আমার জন্য।

কাজটা শেষ হয়ে গেলে… অপেক্ষার পালা। তারপর, এগিয়ে আসবে সে, উপভোগ করবে। এবং তার চাহিদা মিটাতে মিটাতে মারা পরলে সে এগিয়ে আসবে চার্চ অব ইলুমিনেটির বারান্দায়, তাকিয়ে থাকবে সোজা ভ্যাটিকান সিটির দিকে। খ্রিস্টবাদের কারখানা। তাকিয়ে থাকবে সে অপলক। দেখবে স্বপ্ন সাকার হতে।

দেখবে, ভ্যাটিকান মধ্যরাতে কীভাবে আলোর ফুলকি ছোটায়।

কাউচে পুরস্কারটাকে রেখে এগিয়ে গেল হ্যাসাসিন নিচের দিকে। শেষ কাজ।

পানি। ওয়াটার। শেষ কাজ।

আগের তিনবারের মত, দেয়াল থেকে একটা মশাল নিয়ে এগিয়ে গেল সে।

ভিতরে একজন বুড়োমত লোক দাঁড়িয়ে আছে। বয়েসি, একাকী।

কার্ডিনাল ব্যাজ্জিয়া, বলল সে, এখনো প্রার্থনা করেননি আপনি?

ইতালিয় লোকটার চোখে ঝরে পড়ল আগুন, নির্ভয়, শুধু তোমার আত্মার জন্য।

 

৯৮.

হ্যালোন গ্যাস দিয়ে সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়ার আগুন নিভাচ্ছে ছজন ফায়ারম্যান। তারা পম্পেইয়েরি। ভ্যাটিকান তাদের একটা বাড়তি বৃত্তি সব সময় দিয়ে আসছে যেন ভ্যাটিকানের সম্পদের সঠিক যত্ন আত্তি নেয়া হয়। পানি ব্যবহার করা অনেক সহজ এবং খরচও কম। কিন্তু ভিতরের দেয়ালচিত্রগুলোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অক্ষত রাখতে হবে সেগুলোকে।

হররোজ পম্পেইয়েরি অনেক আগুন নিভায়, তাদের এ কাজ একেবারে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ তারা যা দেখল সেটার কথা কখনো ভুলবে না। এভাবে কোন হত্যাকান্ড সংঘটিত হতে পারে তা তাদের কল্পনাতেও ছিল না।

খানিক ঝুলে থাকা, খানিক ভেসে থাকা, খানিক সিদ্ধ হওয়া, খানিক পুড়ে যাওয়া লোকটার কথা তারা কোন দুঃস্বপ্নেও ভুলবে না।

আর দুঃখজনক হলেও সত্যি, আর সব বারের মত, প্রেস ভ্যানগুলো ফায়ার ডিপার্টমেন্টের আগেই হাজির হয়েছে। চার্চের সমস্যা মিটিয়ে ফেলার আগে তারা অযুত নিযুত ফ্রেম নিয়ে ফেলবে ভিতরের।

অবশেষে যখন ফায়ারম্যানরা লোকটাকে নামিয়ে আনল মেঝেতে, কারো কোন সন্দেহ ছিল না কে তিনি।

কার্ডিনাল গাইডেরা, ফিসফিস করল একজন, ডি বার্সেলোনা।

লোকটা নগ্ন, গায়ের নিম্নাংশ একেবারে কালো। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। চুইয়ে পড়ছে ফাটাগুলো দিয়ে।

সাথে সাথে একজন ফায়ারম্যান বমি করে দিল। অন্যজন বাইরে গেল শ্বাস নিতে।

কার্ডিনালের বুকে আকা সিম্বলটা আসলেই সত্যিকার আতঙ্ক। স্কোয়াড চিফ রাজ্যের আতঙ্ক চোখে নিয়ে চারধারে ঘুরল। চক্কর দিল লাশটাকে। লালভারো ডেল ডিয়াভোররা, বলল সে নিজের মনে।

স্বয়ং শয়তান এ কাজ করেছে। সে

ই বাল্যকালের পর, প্রথমবারের মত নিজেকে ক্রস করল স্কোয়াড চিফ।

উন অল্টো কর্পো! কেউ একজন চিৎকার করল। আরেকজন ফায়ারম্যান আরো একটা মরদেহ উদ্ধার করতে পেরেছে।

পরের লোকটাকেও মুহূর্তে চিনে ফেলল চিফ। কমান্ডান্টে ওলিভেট্রিকে রোমের সব বাহিনীর সব হর্তাকতাই মোটামুটি চেনে। কল করল চিফ ভ্যাটিকানে। কিন্তু সেটার সব সাইনই ব্যস্ত। জানে সে, এতে কিছু যায় আসে না। সুইস গার্ড এক মিনিটের মধ্যেই এটা দেখতে পাবে টিভিতে।

সামনে আরো বিভৎস কিছু ব্যাপার লক্ষ্য করল। মঞ্চের নিচে বুলেটের অনেকগুলো দাগ! বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছে মঞ্চটা। সেখান থেকে নেমে আসছে পাথুরে মেঝে। তার নিচেই একটা কফিন।

এ কাজ আমাদের নয়। পুলিশ আছে, আছে গির্জার লোকজন। নিজেকে শোনায় লোকটা। ঘুরে দাঁড়ায়।

ঘুরে দাঁড়াল যখন সে, দাঁড়িয়ে পড়ল। কফিন থেকে আসতে থাকা একটা শব্দ শুনতে পেল। এমন কোন শব্দ কখনোই কোন ফায়ারম্যান শুনতে চায় না।

বোম্বা! চিৎকার করল সে আবার, টুডি ফিওরি!

বোমার স্কোয়াড যখন কফিনটাকে উদ্ধার করল, একটা চিক্কার দিল তারাও।

মেডিকো! মেডিকো!

 

৯৯.

ওলিভেট্টির পক্ষ থেকে কোন সাড়া এসেছে? জিজ্ঞেস করল ক্যামারলেনগো, রোচার যখন তাকে পোপের অফিসে নিয়ে এসেছে।

না, সিনর, আমি সবচে ভয়ংকর সম্ভাবনার আশংকা করছি।

যখন রোচার তাকাল ক্যামারলেনগোর দিকে, ক্ষিপ্ত হয়ে বলল চ্যাম্বারলেইন, আজ রাতে এখানে করার মত আর কোন কাজ নেই আমার। মনে হয় অনেক বেশিই করে ফেলেছি। এখন এ অফিসে বসে বসে একটু প্রার্থনা করতে চাই। আশা করি কেউ আমাকে বিরক্ত করবে না। বাকীটা ঈশ্বরের হাতে।

ইয়েস, সিনর।

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, ক্যাপ্টেন। ক্যানিস্টারটা খুঁজে বের কর।

আমাদের সার্চ চলছে, ইতস্তত করল রোচার, মনে হচ্ছে এত সুন্দর করে কখনো কোন বোমা লুকিয়ে রাখা যায়নি।

ক্যামারলেনগো তাকাল বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে। তার ব্রেন আর কাজ করছে না। ঠিক তাই, ঠিক ঠিক এগারোটা পনের। এখনো যদি চার্চ ক্ষতির সম্ভাবনায় থাকে, আমি তোমাকে বলব, কার্ডিনালদের সরিয়ে নাও। তাদের নিরাপত্তা তোমার হাতে ন্যাস্ত করছি। একটা কথাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, এই লোকগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে নাও। সরিয়ে নাও তাদের সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে। আর পুরো দুনিয়ার সাথে দাঁড়া করিয়ে দাও।

আমি চাই না এ চার্চের অন্তিম মুহূর্তে বয়োবৃদ্ধ লোকগুলো চোরের মত পিছনের খিড়কি দিয়ে পালিয়ে যাক।

খুব ভাল, সিনর। কিন্তু আপনি? শোয়া এগারোটায় আমি কি আপনার জন্যও আসব?

কোন প্রয়োজন নেই।

সিনর?

যখন স্পিরিট আমাকে সরাবেন, তখনি সরব আমি।

ভেবে পাচ্ছে না রোচার, ক্যামারলেনগো কি জাহাজের সাথে তলিয়ে যেতে চাচ্ছেন?

পোপের অফিসের দরজা খুলল ক্যামারলেনগো, ফিরে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে, আসলে… বলল সে, একটা ব্যাপার আছে এখানে।

সিনর?

আজ রাতে এ অফিসে একটা কেমন যেন শিতলতা ভর করেছে। শিউরে উঠছি আমি।

ইলেক্ট্রিক পাওয়ার অফ করে দেয়া হয়েছে। আমাকে আপনার জন্য একটু আলো জ্বেলে দিতে দিন।

ক্লান্ত হাসি দিল ক্যামারলেনগো, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, ভেরি মাচ।

***

পোপের অফিস থেকে বেরিয়ে গেল রোচার। মাতা মেরির একটা মোহনীয় মূর্তির সামনে আলোর জন্য প্রার্থনা করছে ক্যামারলেনগোর ঝকঝকে মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে একটা কালো মূর্তি, দেখতে কষ্ট হয়। খুব।

নোচার নিচের দিকে নেমে যাওয়ার সময় একজন গার্ড এগিয়ে এল। দৌড়ে আসছে। এমনকি মোমের আলোতেও ঠিক ঠিক চিনতে পারল ক্যাপ্টেন। এ হল তরুণ লেফটেন্যান্ট চার্ট্রান্ড। চির সবুজ, তরুণ, উদ্দাম।

ক্যাপ্টেন, বলল চার্ট্রান্ড, হাতে একটা সেলফোন ধরে রেখে, আমার মনে হয় ক্যামারলেনগোর প্রার্থনায় কাজ হয়েছে। আমরা একজন কলারকে পেয়েছি যে আমাদের সাহায্য করবে। ভ্যাটিকানের এক প্রাইভেট এক্সটেনশন থেকে ফোন করেছে সে। আমার কোন ধারণাই নেই কী করে সে নাম্বারটা পেল।

থেমে গেল রোচার, কী?

সে শুধু র‍্যাঙ্কিং অফিসারের সাথে কথা বলবে। ওলিভেট্টির কোন খবর?

না, স্যার।

রিসিভার নিল সে, দিস ইজ ক্যাপ্টেন রোচার। আমি এখানকার র‍্যাঙ্কিং অফিসার।

রোচার, বলল কণ্ঠটা, আমি আপনার কাছে আমার পরিচয় ব্যখ্যা করব। তারপর জানাব এরপর কী করবেন আপনারা।

তারপর কলার কথা বন্ধ করে দিল। ঝুলিয়ে দিল ফোন। স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল রোচার। এবার সে ঠিক ঠিক বুঝতে পারল কার কাছ থেকে সে আদেশ নিচ্ছে।

 

সার্ন। কোহলারের ভয়েস মেইলে কোথা থেকে এত শত শত কেনাবেচার আবেদন আসছে সেটা ভেবে পায় না সিলভিয়া। ডিরেক্টরের ঘরের প্রাইভেট লাইন আবার যখন বাজতে শুরু করল, লাফ দিয়ে উঠল সিলভিয়া। কারো কাছে এ নম্বর নেই। উঠে এল সে।

ইয়েস?

মিসেস বডেলক? ডিরেক্টর কোহলার বলছি। আমার পাইলটের সাথে যোগাযোগ কর। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার জেট প্রস্তুত চাই।

 

১০০.

রবার্ট ল্যাঙডনের কোন ধারণাই নেই সে কতক্ষণ যাবৎ অজ্ঞান ছিল, কোথায় আছে,  কীভাবে আছে। শুধু চোখ মেলে দেখতে পেল উপরে আছে একটা গম্বুজ। এটাও কি একটা গির্জা? কিছু একটা তার মুখে চেপে বসে আছে।

অক্সিজেন মাস্ক?

টেনে তুলে ফেলল সেটাকে। ঘরের গন্ধ বীভৎস। যেন মাংস পোড়ানো হয়েছে।

মাথায় একটা দপদপ ব্যথা টের পায় সে। তাকায় আশপাশে। সাদা পোশাক পরা এক লোক হাঁটু গেড়ে বসে আছে তার পাশে, প্রার্থনা করছে।

রিপোসাটি! বলল লোকটা, সোনো ইল প্যারামেডিকো!

মাথা চক্কর দিচ্ছে তার, উপরের সাদা ধোঁয়ার মত। কোন জাহান্নামের ব্যাপার ঘটেছে? অসংলগ্ন ভাবনা আর ভয় জাপ্টে ধরল।

টোপো সালভাটোরে! বলল প্যারামেডিক, লোকটা তাহলে যাজক নয়! মাউস… বলছে!

মাউস বলছে!

মিকি মাউস ঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্যারামেডিক। সাথে সাথে ল্যাঙডনের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে আসতে শুরু করল। মনে পড়ে গেল, সে এ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল। ঘড়ির দিকে আলস্যে তাকাতে তাকাতে টের পেল সে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। দশটা আটাশ।

সাথে সাথে চট করে উঠে বসল সে।

আর ঠিক তখনি, সব ব্যাপার মনে পড়ে গেল এক ঝটকায়।

 

ফায়ারচিফ আর তার কয়েকজন লোকের সাথে দাঁড়াল ল্যাঙডন। প্রশ্নবাণে তাকে বিদ্ধ করছে লোকগুলো।

শুনছে না ল্যাঙডন। তার নিজের কাছেই প্রশ্নের কোন শেষ নেই। দুলছে তার সমস্ত শরীর। কিন্তু সে জানে, আলসি করে সময় কাটানোর মত পরিস্থিতি নেই।

একজন ফায়ারম্যান এগিয়ে এল গির্জার অপরপ্রান্ত থেকে, আমি আবারও চেক করেছি, স্যার। দুটা শরীর পাওয়া গেছে। কার্ডিনাল গাইডেরা আর সুইস গার্ড কমান্ডার। এখানে কোন মহিলার কেশাগ্রও নেই।

গ্রাজি, বলল ল্যাঙডন, আতঙ্কের একটা আবহ তার শিরদাঁড়া বেয়ে উপরে উঠে আসছে। মনে আছে স্পষ্ট, ভিট্টোরিয়ার অচেতন দেহ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। এখন কী করে উধাও হয়ে গেল মেয়েটা? কীভাবে হাপিস হয়ে গেল? একমাত্র যে ব্যাখ্যাটা উঠে আসে তার কোন আগাপাশতলা নেই। ফোনে যে কথাগুলো বলেছিল হ্যাসাসিন তা ভেবে আতঙ্কে শিউরে ওঠে ল্যাঙডন।

তেজি মেয়ে। ভালই লাগছে আমার। এ রাতটা ফুরিয়ে যাবার আগেই আমি হয়ত

তোমার দেখা পাব। আর যখন পাব…

চারপাশে চোখ রাখল ল্যাঙডন, সুইস গার্ড কোথায়?

এখনো যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। ভ্যাটিকানের সব লাইন জ্যাম হয়ে গেছে।

উত্তেজনার বাঁধভাঙা জোয়ারে ল্যাঙডন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। একই সাথে একাকী বোধ আড়ষ্ট করে তুলল তাকে।

মারা পড়েছে ওলিভেট্টি!

কার্ডিনাল নিহত।

পাওয়া যাচ্ছে না ভিট্টোরিয়াকে!

জীবনের আধঘণ্টা এক পলকে উধাও হয়ে গেল।

বাইরে প্রেসের কোলাহল ঠিক ঠিক টের পাওয়া যায়। তৃতীয় কার্ডিনালের হত্যাকান্ডের চিত্র যে ঠিক ঠিক তাদের হাতে চলে গেছে সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। হয়ত এখন পৃথিবীজুড়ে তা প্রচারিত হচ্ছে। মনে হয় এতোক্ষণে ক্যামারলেনগো ঠিক ঠিক করণীয় ঠিক করে নিয়েছে।

খালি করে ফেল ড্যাম ভ্যাটিকান! অনেক খেলা হল! হেরে ভূত হয়ে গেছি আমরা।

ল্যাঙডন ভেবে পায় না, এই এতটুকু সময়ের মধ্যে কী হয়ে গেল। কী কী ব্যাপার তাকে এখানে এনে জড়িয়ে ফেলল–ভ্যাটিকান সিটি রক্ষার কাজে সহায়তা করা, চার কার্ডিনালাকে উদ্ধারের অভিযান, বছরের পর বছর ধরে যা নিয়ে সে গবেষণা করে যাচ্ছে সেই প্রাচীণ ব্রাদারহুডের পিছু ধাওয়া করা, মুখোমুখি হওয়া এই সব ব্যাপার উবে গেছে তার মন থেকে। যুদ্ধ আর নেই। হেরে গেছে তারা। এক নতুন লক্ষ্য গড়ে উঠেছে তার ভিতরে। আর সব হয়ে গেছে হাওয়া।

খুঁজে বের কর ভিট্টোরিয়াকে!

ভিতরটায় কেমন যেন শূণ্যতা ভর করেছে। সে জানে, ঘটনাক্রম দুজন মানুষকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এত কাছে আনতে পারে যতটা সাধারণ সময়ে এক যুগ ধরেও হয় না। ব্যাপারটাতে ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে সে আজ। ভিট্টোরিয়ার অনুপস্থিতিতে সে এমন এক বোধ অনুভব করে ভিতরে ভিতরে, অনেক বছর ধরে যা তার ধারেকাছে ঘেঁষতেও পারেনি। একাকীত্ব! এই শোকই এনে দিল অপার শক্তি।

মাথা থেকে আর সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ল্যাঙডন বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গেল সামনে। তার মনে একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। উপভোগের চেয়ে বেশি হয়ে যেন খুনির মনে কাজটা দেখা দেয়। তা নাহলে… ল্যাঙডন জানে, দেরি হয়ে গেছে বড়। না, বলে সে নিজেকে, তোমার হাতে আরো অনেক সময় আছে।

দ্য লাস্ট অল্টার অব সায়েন্স, ভাবে সে, বিভোর হয়ে, আরো একটা কাজ বাকি আছে খুনির 1 আর্থ। এয়ার। ফায়ার। ওয়াটার।

হাতের ঘড়ির দিকে মনোযোগ দেয় সে। ত্রিশ মিনিট। বার্নিনির এক্সটাসে অব সেন্ট টেরেসার সামনে থেকে ফায়ারম্যানকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এবার, বার্নিনির মার্কারের দিকে তাকায় সে, ল্যাঙডনের মনে কোন দ্বিধা নেই কিসের দিকে তাকাচ্ছে সে।

লেট এ্যাঞ্জেল গাইড ইউ অন ইউর লফটি কোয়েস্ট…

সাধুর আশপাশে, আগুনের শিখার পিছনে আছে এ্যাঞ্জেল। বার্নিনির ভেসে থাকা ফেরেশতা। আগুনের শিখা দেখায় তার হাতের বর্শা। চার্চের ডানপাশে দিক নির্দেশ করছে এ্যাঞ্জেলের বর্শা। সেখানে কিস্যু নেই। কিন্তু ঠিক ঠিক জানে ল্যাঙডন, ঐশ্বরিক প্রাণীটা দেয়ালের দিকে তাক করেনি, সেটা ভেদ করে, রোমের অন্য কোন প্রান্তে অন্য কিছুকে দেখাচ্ছে সে।

কোন দিক এটা? সরাসরি ফায়ার চিফের দিকে তাকাল সে, ছুঁড়ে দিল প্রশ্ন।

দিক? বিভ্রান্ত দেখায় ফায়ারচিফকে। সে একটু চুপ থেকে বলে, পশ্চিম, আমার মনে হয়।

সেদিকে কোন কোন চার্চ আছে? চিফের কথায় এবার একটু বিরক্তি ঝরে পড়ে, কয়েক ডজন, কেন?

অবশ্যই, তাই হবে, আমার এক্ষুণি একটা সিটি ম্যাপ দরকার। এক্ষুণি।

সাথে সাথে চিফ চলে গেল তাদের ফায়ার ট্রাকের দিকে ফিরে দাঁড়াল ল্যাওড়ন স্ট্যাচুর দিকে। আর্থ… এয়ার… ফায়ার… ভিট্টোরিয়া। ।

শেষ মার্কারটা হল ওয়াটার। বলল সে নিজেকে, বার্নিনির ওয়াটার।

এটা বাইরে কোথাও, খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার যন্ত্রণা। বার্নিনির যত কাজের কথা মনে করা যায়, চেষ্টা করল সে মনে করার। আমি পানির একটা উৎস চাই।

ট্রাইটনের কথা মনে পড়ে গেল তার। বার্নিনি গ্লিক সমুদ্রদেবের জন্য একটা মূর্তি গড়েছিলেন। সাথে সাথে তার মনে পড়ে গেল, এ গির্জার বাইরেই সেটা অবস্থিত। উল্টোদিকে। কাজে লাগবে না জানাটা। চাপ দিল নিজেকে। পানির মহত্ত্ব বোঝাতে বার্নিনি কোন খোদাইয়ের কাজ করেছিলেন? নেপচুন এ্যান্ড এ্যাপোলো? দুর্ভাগ্যবশত সে কীর্তিটা লন্ডনের ভিট্টোরিয়া এ্যান্ড এ্যালবার্ট মিউজিয়ামে।

সিনর? একজন ফায়ারম্যান হাতে একটা মানচিত্র নিয়ে এগিয়ে এল।

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে সাথে সাথে সেটাকে মেঝেতে বিছিয়ে ধরল ল্যাঙডন। তারপর মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিল। সৌভাগ্যবশত সে সবচে দক্ষদের শরণাপন্ন হয়েছে। দমকলের মত আর কোন ডিপার্টমেন্টে এত সূক্ষ্ম ম্যাপ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কোথায় আমরা?

নির্দেশ করল লোকটা, পিয়াজ্জা বার্বারিনির ঠিক পাশে।

দিক বোঝার জন্য ল্যাঙডন আবার তাকাল এ্যাঞ্জেলের বর্শার দিকে। চিফের ধারণা নির্ভুল। ম্যাপ অনুযায়ী, বর্শাটা পশ্চিম দিক নির্দেশ করছে। একটা রেখা তৈরি করল ল্যাঙডন সোজা পশ্চিমে। আর সেই সাথে সমস্ত আশা ভরসার সলিল সমাধি ঘটল। যত এগিয়ে যাচ্ছে তার আঙুল, ততই একটা করে কালো ক্রস দেখা যাচ্ছে মানচিত্রে। প্রতিটাই গির্জা। পুরো মহানগরী চার্চে ঠাসা। এক সময় গির্জার ঘনঘটা কমে এল, একই সাথে ফুরিয়ে এল পথচলা। সিটি শেষ। ড্যাম।

পুরো রোম চষে ফেলে ল্যাঙডনের চোখ পড়ল গিয়ে সেই তিন গির্জার উপর, যেখানে তিন কার্ডিনালকে বাধ্য হয়ে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। চিগি চ্যাপেল… সেন্ট  পিটার্স… এখানে…

সেই তিন চার্চকে এক নজর দেখে তাদের অবস্থানে একটা অসামঞ্জস্য দেখতে পেল। সে আশা করেছিল যে গির্জাগুলো রোমে এলোমেলো ছড়ানো থাকবে। কিন্তু প্রায় নির্ভুলভাবে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গাণিতিকভাবে সেগুলো ছড়ানো ছিটানো। সুচারু রূপে। পুরো সিটি জুড়ে একটা ত্রিভূজ গডছে সেগুলো। সাথে সাথে ল্যাঙডন আরো একবার চেক করে নিল। আর কিছু ভাবতে পারছে না সে এ মুহূর্তে। পেন্না, বলল সে, উপরের দিকে মুখ না তুলেই।

কেউ একজন তাকে একটা বল পয়েন্ট কলম ধরিয়ে দিল।

সাথে সাথে ল্যাঙডন তিনটা চার্চকেই বৃত্তবন্ধ করল বেড়ে গেল হৃদস্পন্দন। তৃতীয়বারের মত পরীক্ষা করল দিকগুলো। একেবারে নিখুঁত ট্রায়াঙ্গল।

প্রথমেই ল্যাঙডনের মনে পড়ে গেল এক ডলার নোটের উপর রাখা গ্রেট সিলের কথা। সর্বদ্রষ্টা চোখের সাথে যে ত্রিভূজটা অঙ্কিত হয়ে আছে সেটার কথা। কিন্তু এতে কোন কাজ হবে না। সে মাত্র তিনটা পয়েন্ট নির্দেশ করেছে; কিন্তু আদপে সেখানে চারটা থাকার কথা।

তাহলে কোন চুলায় গেল ওয়াটার?

ল্যাঙডন জানে, যেখানেই সে কলম বসিয়ে চতুর্থ বিন্দু রাখতে যাক না কেন, ত্রিভূজটার সমান মাপ নষ্ট হয়ে যাবে। আর একটা মাত্র কাজ বাকি থাকে। চতুর্থ বিন্দুর জন্য এই ত্রিভূজের ভিতরেই কোথাও কলম বসানো। ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে। কিস্যু হবে না তাতে। ব্যাপারটা ভোগালো আরো। চার প্রাচীণ মৌলকে সমান ধরা হত। পানির তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। পানিতে বাকীদের কেন্দ্রে থাকতে হবে তেমন কোন কথা নেই।

একটা ব্যাপার অবচেতন মন ঠিক ঠিক জানিয়ে দিচ্ছে। এই নিখুঁততা কোন দৈব ব্যাপার নয়। আমি এখনো পুরো ছবিটা দেখতে পাচ্ছি না। আর মাত্র একটা বিকল্প পথই খোলা থাকছে। চারটা বিন্দু মিলে আর যাই তৈরি করুক না কেন, কোন ব্রিভূজ তৈরি করছে না।

আবার চোখ রাখল সে নতুন করে, ম্যাপের উপর। যেন তার ফলে কিছু চোখে। পড়ে যাবে। একটা স্কয়ার? চতুর্ভূজ? যদিও চতুর্ভুজে কোন সেন্স পাওয়া যায় না, তবু ভাবতে তার দ্বিধাও হয় না। চোখ বোলাল সে। আবার। আবার। তারপর আঙুল রাখল এমন কোথাও যেখান থেকে একটা মোটামুটি নিখুঁত চতুর্ভুজ আকা যায়। সাথে সাথে এটাও বুঝতে পারল, নির্ভুল স্কয়ার তৈরি করাও সম্ভব নয়।

ত্রিকোণের আশপাশে আরো একটু নজর বুলিয়ে নেয় সে। এবং তখনি, আশা না করা একটা ব্যাপার ঘটে যায়। একটু আগে সে যে পথে একটা রেখা কল্পনা করছিল। সেদিকে চোখ ফেরায়। এবং সাথে সাথে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।

সে রেখাটাকে হিসাবে নিলে একটু গন্ডগোল হয় বৈকি! এমন একটা শেপ পাওয়া যায় যেটা দিয়ে নির্দ্বিধায় একটা ঘুড়ির মত গডন তোলা যাচ্ছে। অনেকটা কাটা হিরার মত।

চিন্তাটাকে বাতিল করে দিতে দেরিও করে না সে, ডায়মন্ড আর যাই হোক, ইলুমিনেটি সিম্বল নয়… এবং….

ইলুমিনেটির সাথে হিরকের কোন সম্বন্ধ নেই তা নয়, কিন্তু সেটাকে এমন দেখানোর কথাও নয়। নিখুন গডন থাকবে ইলুমিনেটি ডায়মন্ডের। একেবারে চতুষ্কোণ।

পিয়াজ্জা নাড়োনায় সেই বিন্দুটা পড়ছে। সে জানে, পিয়াজ্জায় একটা বড় চার্চ আছে। তার যদ্দূর মনে পড়ে, সেখানে বার্নিনির কোন কাজ নেই। চার্চের নাম সেন্ট এগনেস ইন এগোনি।

এ গির্জায় কিছু না কিছু আছেই, অবশ্যই আছে। বলল সে মনে মনে। চোখ বন্ধ করল সে, চেষ্টা করল ভিতরে দৃষ্টি দেয়ার। না। বার্নিনির এমন কোন কীর্তির কথা মনে পড়ছে না যা পানির সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এখানেই বিন্দু। একটা হিরক। হিরা হবার কোন কারণ আছে কি? নাকি এর সাথে ঘুড়ির কোন সম্বন্ধ আছে? এখনো ভেবে পাচ্ছে ল্যাঙডন, সে কোন ভুল করেছে কি? করার কথা নয়। কী মিস করছি আমি বারবার?

কথাটা আরো আধ মিনিটের জন্য তার মাথাব্যাথার কারণ হয়ে থাকল, কিন্তু যখন সে আসল ব্যাপারটা দেখতে পেল, ক্যারিয়ারের আর সব উফুল্ল ভাবকে ছাড়িয়ে গেল তার চিন্তা।

মনে হচ্ছে ইলুমিনেটি জিনিয়াসের হার মানার কিছু নেই।

এবং ধপ করে মনে পড়ে গেল আসল ব্যাপারটা। ইলুমিনেটি তার মত করে ভাকেনি। তারা এরকম করে এক একটা রেখা একত্র করেনি কোণাকুণি করে। কোন ঘুড়ি গড়েনি তারা। গড়েছে দুটি রেখা যা ছেদ করে পরস্পরকে।

এভাবে বসাতে গিয়ে কেঁপে গেল ল্যাঙডনের হাত। থরথর করে। এবং অবশেষে আসল ব্যাপারটা দেখতে পেল সে।

এটা এক নিখুঁত ক্রস! তিনটা রেখা সমান, নিচের রেখাটা অপেক্ষাকৃত বড়!

চোখের সামনে ভাসতে লাগল ফোর এলিমেন্ট অব সায়েন্স… সারা রোমের বুক ভেদ করে এক বিশাল, সুবিশাল ক্রস মাথাচাড়া দিচ্ছে….

অবাক বিস্ময়ে সে চেয়ে থাকে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে পদ্যের পুরনো পদ; নূতনতর অর্থ নিয়ে।

ক্রস রোম, দ্য মিস্টিক এলিমেন্টস আনফোল্ড…

ক্রস রোম…

কেটে যাচ্ছে ধোঁয়াশা। হঠাৎ টের পেল ল্যাঙডন, সারা রাতই তার চোখের সামনে উত্তরটা ঝকঝক করছিল। এই কবিতা তাকে শোনাচ্ছিল কী করে অল্টারগুলো বসানো হয়। একটা ক্রসের মত করে।

ক্রস রোম, দ্য মিস্টিক এলিমেন্টস আনফোল্ড!

কী ভুলটাই করেছিল সে! ক্রস বলতে বুঝেছিল এক্রসকে ছোট করা হয়েছে। কবিতাকে আরো সুন্দর রূপ দিতে। কিন্তু না, এটাও এক ক্লু।

ম্যাপের ক্রুসিফর্মটা বিজ্ঞানের রসে জারিত ধর্ম! গ্যালিলিও তার কাজকে সত্যি সত্যি একই সাথে বিজ্ঞান আর ঈশ্বরকে উৎসর্গ করেছেন!

ধাঁধার বাদবাকি উত্তরটা মুহূর্তে সামনে চলে এল।

পিয়াজ্জা নাড়োনা।

পিয়াজ্জা নাড়োনার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে, সেন্ট এ্যাগনেস এগোনির একেবারে বাইরে সেই সূত্র বসে আছে। রোমে যে-ই আসে, একবার করে দেখে যায় দর্শনীয় জায়গাটাকে।

দ্য ফাউন্টেন অব দ্য ফোর রিভার্স!

পানির জয়জয়কার এরচে ভালভাবে আর কোথায় করা সম্ভব? বার্নিনির এই অজেয় কীর্তি প্রাচীণ পৃথিবীর সবচে দামি চার মহানদের জন্য উৎসর্গীকৃত–নীলনদ, গঙ্গা, দানিয়ুব আর রিও প্লাটা।

ওয়াটার, ভাবল ল্যাঙডন। একেবারে শেষ মার্কার। অসাধারণ।

আর কেকের মধ্যে যেভাবে চেরি থাকে, তেম্নি করে সেখানে, বার্নিনির সেই ঝর্ণাগুলোর মধ্যে মাথা উঁচু করে আছে অহঙ্কারী এক ওবেলিস্ক।

 

বিমূঢ় ফায়ারম্যানকে একপাশে ফেলে রেখে ল্যাঙডন দৌড়ে যায় ওলিভেট্টির নিপ্রাণ দেহের কাছে।

দশটা একত্রিশ! হাতে অগাধ সময়। এই প্রথম ল্যাঙডন অনুভব করল, এগিয়ে আছে সে।

হাটু গেড়ে বসল সে কমান্ডান্টের সামনে, পিছনে তার উল্টে যাওয়া কয়েকটা বেঞ্চি, একপাশে পড়ে আছে সেমি অটোমেটিক, আরেকপাশে ওয়াকিটকি।

ল্যাঙডন জানে, এখন আর সহায়তা চাওয়ার কোন উপায় নেই। এখন সায়েন্সের শেষ অল্টারটাকে গোপন রাখতে পারলেই ভাল। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট আর মিডিয়ার লোকজনকে নিয়ে সেখানে হুমড়ি খাওয়ার কোন মানেই হয় না।

আস্তে করে পিছলে গেল সে। তোয়াক্কাই করল না ফায়ার ডিপার্টমেন্টের। লোকজনকে বা মিডিয়ার ঢুকতে থাকা হর্তা কর্তাদের। কোনক্রমে পিয়াজ্জা বার্বারিনি পেরিয়ে গিয়েই অন করল ওয়াকিটকি। অন্ধকারে। কিন্তু কোন শব্দ নেই ওয়াকিটকিতে। হয় সে আউট অব রেঞ্জ, নয়ত এটাকে চালু করতে হলে কোন না কোন কোড ব্যবহার করতে হয়। বুঝতে পারল আরো কয়েকবার চেষ্টা করে, কোন লাভ নেই। তাকাল আশপাশে, কোন ফোন বুথ? না, নেই। আর পেলেও লাভ নেই, জানে সে, এখন ভ্যাটিকানের লাইনগুলো পুরোপুরি জ্যাম থাকবে।

সাহায্য পাবার আশার গুড়ে বালি। সে একা। একদম একা।

আত্মবিশ্বাস নিচু হতে দেখে সে নজর দিল শরীরের উপর। কম অত্যাচার হয়নি। ধূলা বালিতে সারা গা বিবর্ণ, তার উপর পেটে ছোটাছুটি করছে ছুঁচো।

ফিরে যাবে কি ধোঁয়া ওঠা চার্চের ভিতরে? সাহায্য চাইবে অদক্ষ লোকজনের কাছে? হিতে বিপরীত হতে পারে তাতে। আর যদি সাহায্য চায়ই… খুনি যদি একবার দেখে ফেলে তাদের… কেল্লা ফতে। ভিট্টোরিয়াকে পাবার কোন সম্ভাবনাই থাকছে না তাতে।

এগিয়ে যেতে হবে সেখানে। কিন্তু আশপাশে কোন ট্যাক্সির ছায়াটাও নেই। সব ট্যাক্সি ড্রাইভার কাজ বাদ দিয়ে টিভি সেটের সামনে বসে পড়েছে নিশ্চই। মাত্র মাইলখানেক দূরে পিয়াজ্জা নাভোড়া। কিন্তু পদব্রজে সেখানে যাবার কসরৎ করার কোন ইচ্ছা নেই তার। গির্জার দিকে আবার চলে গেল তার দৃষ্টি। কারো কাছ থেকে একটা গাড়ি ধার করতে পারলে বর্তে যায়।

ফায়ার ট্রাক? প্রেস ভ্যান? বি সিরিয়াস।

এরপর সে এক লহমায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বের করল পকেট থেকে সেমি অটোমেটিকটা। তাক করল একটা সেডানের খোলা জানালায়।

ফিউরি!

কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল ড্রাইভার।

সোজা হুইলের পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাবাল সে গ্যাস প্যাডেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *