১০
দুপুর বেলার ঠা ঠা রোদ্দুরে পার্ক স্ট্রিটের বিশাল ম্যানসনটা থেকে ক্লান্ত পরিশ্রান্তভাবে ট্রাভেল এজেন্সি গ্লোবাল টুরসের কলকাতা সার্কেলের বড়োকর্তা অম্বিকেশ যখন বেরোলেন, তখন এতক্ষণ কনকনে এসিতে থাকা সত্ত্বেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে।
পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুখটা মুছলেন তিনি। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে একবার দেখলেন আকাশ ঢেকে যাওয়া বিশাল অফিসবাড়িটাকে।
নিজের মনেই নিজেকে বললেন, আর কোনোদিনও তিনি এই বাড়িতে ঢুকবেন না। লিফট লবিতে গিয়ে তিনি দাঁড়ানোমাত্রই আর কোনোদিনও এখানকার সিকিউরিটি গার্ড তাঁকে লম্বা সেলাম ঠুকবে না। আর কোনোদিনও লাঞ্চের সময় তাঁর নিজস্ব খাস বেয়ারা সুরেশকে দিয়ে পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের সামনে থেকে আলুর পরোটা বা চিঁড়েদই আনাতে হবে না তাঁকে।
রোজকার এই ডিউটি থেকে আজ চিরতরে মুক্তি পেলেন অম্বিকেশ! নিত্যদিনের মিটিং, ফোনাফুনি, ই-মেল চালাচালি থেকে রেহাই। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে উঠল অম্বিকেশের। একঝলক মনে হল, ভালোই ছিলেন বোধ হয়!
পরক্ষণেই ভাবলেন, নাহ! যা করেছেন ভালোই করেছেন। সারা দিনরাত মনপ্রাণ ঢেলে যতই কাজে ডুবে থাকুন, গত কয়েক বছর ধরে কিন্তু এটাই তিনি মনে মনে চাইছিলেন। আর সেইজন্যই সুযোগ পেলে বেরিয়ে পড়তেন কাছাকাছি কোথাও। কখনো উত্তরবঙ্গের কোনো অখ্যাত পাহাড়ি গ্রামে, কখনো সুন্দরবনের কোনো অজানা দ্বীপে। তবু যেন ফিরে এসে আশ মিটত না। ইচ্ছে হত সব ছেড়ে দিতে।
তবু শেষ দু-মাসের এই নোটিশ পিরিয়ডটা যেন ঝড়ের গতিতে কেটে গেল।
অসংখ্য জুনিয়র স্টাফের ‘স্যার, আপনি সত্যিই চলে যাচ্ছেন?’ কিংবা ‘প্লিজ স্যার, যাবেন না!’ এ-র মাঝে ঝপ করে ফুরিয়ে এল যেন গোটা সময়টা।
তবে সত্যি বলতে কী, বেসরকারি ফার্মের নিত্যদিনের চাপ যেন আর নিতে পারছিলেন না অম্বিকেশ। না, তাই বলে যে তাঁর কাজের প্রতি কোনো ঢিলেমি এসেছে তা নয়, এখনও তিনি অনেক খাটার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মনের ভেতরের কথায়, এই দাসত্ববোধটা আর নেওয়া যাচ্ছিল না।
হয়তো নিতে পারছিলেন না অনেকদিনই, তবু ঘষটে ঘষটে চলছিলেন।
কিন্তু জিনির কথায় আর ক্রমাগত ইন্ধনে সেই বিরক্তিটা চামড়া ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এল। ঝপ করে রিজাইন করে ফেললেন অম্বিকেশ।
তাও তো নয় নয় করে বছর পঁচিশ হলই এই জাঁতাকলে পিষ্ট হলেন। প্রতি কোয়ার্টারে কাস্টমার ধরার টার্গেট, একেকটা ট্রিপের পর কাস্টমার ধরে ধরে তাঁদের থেকে স্যাটিসফ্যাকশন রিপোর্ট আদায়, কোনো অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখা, কোনো টুর ম্যানেজার বাইরে গিয়ে বিপদে পড়লে হোটেল বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এখান থেকে মিটিং করা, দু-মাস তিনমাস অন্তর দেশবিদেশের নানারকম সেরা ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাওয়ার্ডের জন্য নমিনেশন পাঠানো, সেইসব অ্যাওয়ার্ড কমিটির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের সঙ্গে মিটিং ফিক্স করে উপহারে ভরিয়ে দেওয়া, সেই একঘেয়ে কাজ।
এইসব কর্পোরেটে সার কথা আসলে একটাই, তেল দাও, তেল মাখো।
সঙ্গে অফিসের জুনিয়র কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমস্যা, প্রয়োজনে রাশ আলগা করা কিংবা টেনে ধরা, প্রতি বছরের ইনসেন্টিভের ওঠাপড়া এসব তো আছেই।
সাধারণত এইসব বেসরকারি ট্রাভেল এজেন্সিতে পাঁচ-ছয় বছর কাটিয়ে দেওয়াই বেশ অবাক ব্যাপার। এই সেক্টরের মূল মন্ত্রই হল, এই কোম্পানি ছেড়ে ওই কোম্পানি, এই শহর থেকে ওই শহর। তবেই তো ঝপ ঝপ মাইনে বাড়ে। সেখানে পঁচিশ বছর অম্বিকেশ এই কোম্পানিতে কাটালেন, এও একটা রেকর্ড বটে।
এত কিছু কারণের জন্যই মুম্বাইয়ের হেড অফিস বলতে গেলে অম্বিকেশকে একেবারে মাথায় করে রেখেছিল। শেষ ক-বছর অম্বিকেশ কলকাতা ব্র্যাঞ্চের শুধু যে সর্বেসর্বা ছিলেন তাই নয়, কলকাতা অফিসে কখন কোন ক্যাম্পেইন করা হবে, কোন টুরে কী অফার দিলে লাভ, এইসমস্ত খুঁটিনাটি ব্যাপারে মুম্বাই থেকে খোদ ম্যানেজিং ডিরেক্টর শর্মাসাহেব ফোনে প্রায়ই আলোচনা করতেন অম্বিকেশের সঙ্গে।
তা ছাড়া কলকাতা অফিসে এইচ আর ডিপার্টমেন্ট হোক কিংবা অ্যাকাউন্টস, চূড়ান্ত পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে শেষ সিলমোহর দেওয়াও ছিল অম্বিকেশের দায়িত্ব। দিনের তেরো থেকে চোদ্দো ঘণ্টা কীভাবে যে অফিসে কেটে যেত, টেরই পেতেন না তিনি।
তাই কাজপাগল অম্বিকেশ সান্যাল সময়ের আগেই রিজাইন করতে চান শুনে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। মুম্বাইয়ের অনেক তাবড় তাবড় বড়ো, মেজো, ছোটোকর্তা তো ফোনও করেছিলেন তাঁকে। বুঝিয়েছেন, লোভনীয় টোপ দিয়েছেন। কিন্তু অম্বিকেশ সান্যালকে ওইসবের ফাঁদে আটকানো যাবে না তা ওঁরা ভালো মতোই জানতেন। আর তা ছাড়া, বয়সও তো ষাট বছর হল, সরকারি চাকরির হিসাব ধরলে রিটায়ারমেন্টের বয়স তো হয়েই গিয়েছে, নেহাত গ্লোবাল টুরসে সংখ্যাটা বাষট্টি তাই।
আর কদ্দিন এই জোয়াল টানা? এবার যে ক-টা দিন শরীরে বল থাকবে, শুধু নিজের খুশিমতো, মর্জিমাফিক বাঁচবেন তিনি।
অম্বিকেশ ইচ্ছে করেই আজ নিজের গাড়ি নিয়ে আসেননি। তাঁর জায়গায় সদ্য পদোন্নতি হওয়া কলকাতা রিজিয়নের বর্তমান প্রধান সঞ্জয় সামন্ত সৌজন্য দেখিয়ে কোম্পানির গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেছিল, অম্বিকেশ সেটাও প্রত্যাখ্যান করেছেন।
লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে হাত দেখিয়ে একটা এসি বাসে উঠলেন অম্বিকেশ।
নাহ, মাথা উঁচু করে আগেভাগেই রাজ্যপাট ছেড়ে বেরিয়ে আসা, এও এক তৃপ্তি বটে।
এখন ট্র্যাভেল অ্যান্ড হসপিটালিটি সেক্টরে ছোটোখাটো কোম্পানিও টুরিজমের ডিগ্রি ছাড়া লোক নিতে চায় না, সেখানে পঁচিশ বছর আগে অম্বিকেশ যখন এই গ্লোবাল টুরসে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন, কাঁধের কালো ব্যাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সাধারণ গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রি ছাড়া কিছুই ছিল না। আর ছিল কয়েক বছর এদিক-ওদিক ওষুধ সাপ্লাইয়ের ব্যবসা আর কিছু খুচরো ইন্সিয়োরেন্সের দালালি করার মামুলি অভিজ্ঞতা।
কিন্তু তাতে কি কিছু আটকেছে? নেহাত অম্বিকেশ একাবোকা মানুষ, মুম্বাই গিয়ে থিতু হয়ে টাকা রোজগারে বুঁদ হয়ে কোনো লাভ নেই, তাই সারাটা জীবন এই কলকাতাতেই কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু তাই বলে কি তাঁকে লোকে ডাকেনি? অন্তত কুড়িটা অফার পেয়েছেন গোটা কেরিয়ারে। নিজের কোম্পানি তো প্রোমোশন দিয়ে মুম্বাই নিয়ে যেতে চেয়েছেই, এ ছাড়া আরও অনেক কোম্পানি টাকার লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে গ্লোবাল টুরসের এই রত্নটিকে।
সেইসব অফার ঠিকমতো লুফলে আজ অম্বিকেশের খোদ কলকাতা শহরে খান পাঁচেক বাড়ি, দামি গাড়ি থাকত।
কিন্তু অম্বিকেশ যাননি। শুধুই যে তিনি গ্লোবাল টুরসকে ভালোবাসেন বলে যাননি, এমনটা নয়।
যাননি এই ভালোয় মন্দয় মেশানো গোটা শহরটাকে ভালোবেসে, যাননি কলকাতার সাবেক গন্ধটার প্রেমে পড়ে।
আর হয়তো যাননি বিশেষ একজন এই কলকাতার শহরের বুকেই কোথাও রয়েছে সেটা জেনে।
উল্টোডাঙার ওই একচিলতে আবাসনেই তিনি খুশি। কী হবে বেশি লোভ করে। কে আছে তাঁর? গাড়িটাও কিনতেন না, নেহাত শেষ কয়েক বছরে পায়ের ব্যথাটা বড্ড ভোগাচ্ছিল, তাই।
গ্লোবাল টুরসের নতুন পুরোনো সব কর্মীর কাছেই তাই তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। যিনি নির্লোভ তো বটেই, নিরাসক্তও বটে। প্রতি বছর কোম্পানির থেকে ফ্রি-তে একটা বিদেশ টুরের প্যাকেজ পেলেও নেননি। কেউ প্রশ্ন করলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছেন, ‘একা মানুষ, কী করব ওইসব জায়গায় ঘুরতে গিয়ে! প্রথম কয়েক বছরে তো গিয়েছিলাম। শুধু শুধু কোম্পানির বিল বাড়িয়ে কী লাভ? এই বেশ ভালো আছি। আমি যে নিজে বেড়াই না, তা তো নয়। প্রচুর বেড়াই নিজের মতো করে। অত বিলাসিতার মধ্যে ঘুরতে ভালো লাগে না।’
বাসের জানলার ধারে বসে বিশাল চওড়া কাচ দিয়ে বাইরের শহরটাকে দেখতে দেখতে আনমনে এমন অনেক কথাই ভাবছিলেন অম্বিকেশ, এমন সময় বুড়িদি ফোন করল।
‘ফুলু, তুই কোথায়? অফিসে?’ বুড়িদি জিজ্ঞেস করল।
অম্বিকেশ বললেন, ‘নাহ, এই বেরোলাম। বল।’
ওপাশ থেকে বুড়িদি সামান্য থেমে বলল, ‘ওহ। আজই তো শেষ দিন ছিল। তাই না?’
অম্বিকেশ হালকা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। আজ সব ঝামেলা মিটে গেল রে।’
বুড়িদি বলল, ‘এখন কি সোজা বাড়ি চলে যাচ্ছিস?’
‘না, কিছু কাজ আছে এসপ্ল্যানেডে, ওই জিনির কোম্পানির কিছু লাইসেন্সের ব্যাপারে, সেগুলো সেরে ফিরব।’ অম্বিকেশ একহাতে ফোনটা কানে চেপে ধরে কনডাক্টরের দিকে টিকিটের টাকাটা বাড়িয়ে দিলেন, ‘কেন বল? দরকার আছে কিছু?’
বুড়িদি বলল, ‘কাজ হয়ে গেলে যদি পারিস তো একবার আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবি? খুব চিন্তায় আছি।’
অম্বিকেশ বেশি গুরুত্ব দিলেন না, সামান্য কারণেই বুড়িদির চিন্তায় জর্জরিত হয়ে পড়াটা কিছু মানুষের অকারণে পা নাচানোর মতোই একরকমের বদভ্যাস।
এইজন্য ছোটোবেলা থেকে বুড়িদিকে তিনি ‘চিন্তাবুড়ি’ বলে খেপাতেন।
তিনি হালকা চালে বললেন, ‘হ্যাঁ সে না যাওয়ার কী আছে? কিন্তু চিন্তার কী হল? জামাইবাবুর শরীর ঠিক আছে তো? সামনে লোকসভা ভোট, রোদে রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুঝি? জনদরদি নেতা বলে কথা!’
‘আরে না রে।’ বুড়িদি চাপা গলায় বলল, ‘সমস্যাটা জিনিকে নিয়ে। তুই একবার আয় না। ফোনে তো সব কথা বলা যায় না বল!’
‘জিনি আবার কী করল? বেশ তো ছিল!’ অম্বিকেশ একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে আসছি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে। গিয়ে তোর ওখানে খাব। রান্না কর।’
ফোনটা রেখে অম্বিকেশ আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন। জিনিকে নিয়ে বুড়িদির চিন্তায় পড়াটা বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার বই কী। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে হয়, যারা ছোটো থেকেই বাবা-মাকে এতরকমভাবে গর্বিত করে, এত সুখ দেয় যে, তাদের নিয়েও যে মা বাবা-র দুশ্চিন্তা হতে পারে তা বিশ্বাস হয় না।
জিনিয়াও অনেকটা সেইরকমই।
আর একেক সময় অম্বিকেশ নিজেই ভুলে যান, যে, বুড়িদি তাঁর নিজের দিদি নয়। এমনকী লতায় পাতায়ও কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই দু-জনের মধ্যে। অথচ অম্বিকেশ আর বুড়িদি নিজেরা তো বটেই, বুড়িদির বর মানে অজিতেশ জামাইবাবু কিংবা জিনিও কথাটা ভুলে গিয়েছে বহু বছর হল।
বুড়িদির ভালোনাম স্মৃতি। বুড়িদির বাবা কালীচরণ মেসোমশাই আর অম্বিকেশের বাবা প্রাণেশ সান্যাল পূর্ববঙ্গে ঢাকায় ছিলেন প্রতিবেশী। দু-জনের মা-ও ছিলেন বন্ধু। প্রতিদিনের তরকারি বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখদুঃখেও তাঁরা ছিলেন একে অন্যের সাথি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশ থেকে এপার বাংলায়, তখন কয়েক হাজার উদবাস্তুর সঙ্গে এই দুই পরিবারও কাঁটাতার পেরিয়ে চলে এসেছিল এদিকে, এই অ্যাওবড়ো কলকাতা শহরে। তখন অম্বিকেশের বয়স বড়োজোর দশ বছর,আর বুড়িদি তেরো-চোদ্দো।
ওই উঠতি বয়সের মেয়েকে নিয়ে বর্ডার পেরনো যে কী প্রবল আতঙ্কের বিষয় ছিল তা সেইসময় বড়োদের আলোচনায় শুনতে শুনতে এখনও একটু একটু মনে আছে অম্বিকেশের।
বুড়িদির মা, মানে গোপা মাসিমা আর অম্বিকেশের মা দু-জনে বলতে গেলে বুক দিয়ে আগলে নিয়ে এসেছিলেন বুড়িদিকে। তারপর কলকাতা শহরে এসে আরেক কষ্ট। এত বড়ো শহর, রাস্তাঘাটে পিলপিল করছে উদবাস্তু। এদিকে কেউ তেমন নেইও যে, কিছুদিনের জন্য ঠাঁই পাবে দুটো পরিবার।
মাথার ওপর ছাদ নেই, খাবার নেই, জল নেই, ভাবলে এখনও বুক হিম হয়ে আসে।
অনেক কষ্টে দু-জনের বাবা একটা বাড়ি একসঙ্গে ভাড়া নিয়েছিলেন, তাও কলকাতায় নয়, হুগলি নদীর পাশে, সেই কোন্নগরে। এখন কোন্নগর বেশ আধুনিক, আধাশহরই বলা যায়, কিন্তু তখন ছিল প্রায় জঙ্গল। গঙ্গার ঘাটের পাশে প্যাচপেচে কাদায় কিছুটা হেঁটে ছিল সেই বাড়ি।
কিন্তু তা ছাড়া আর উপায়ই-বা কী ছিল? দু-জনের বাবা-ই তো বলতে গেলে তখন বেকার, দেশ থেকে নিয়ে আসা জমানো পয়সায় চলছে।
সেই থেকে কোন্নগরের ওই বাড়িতে টানা পনেরো বছর সুখে দুঃখে একসঙ্গে কাটিয়েছিল দুটো পরিবার।
সেখান থেকেই বুড়িদি কলেজ পাশ করল, যথাসময়ে বিয়েও হল খড়দায়। অম্বিকেশও পড়াশুনো শেষ করে ঝাঁপ দিলেন জীবনযুদ্ধে। এতগুলো বছরে কখনো মনে হয়নি যে বুড়িদি বা গোপা মাসিমা এরা আপনজন নয়।
আর আপনজনের সংজ্ঞাটাই বা কী, ভাবতে ভাবতে নিজের মনকেই প্রশ্ন করেন অম্বিকেশ। শুধুমাত্র রক্তের বা জিনের সম্পর্ক থাকলেই কি আপনজন হয়? ভুল। তাহলে গোপা মাসিমা অম্বিকেশকে এত ভালোবাসতে পারতেন না, অম্বিকেশও পারতেন না আরও এক আপনজনের জন্য সারাটা জীবন একা রয়ে যেতে।
সত্যি, এত বছর হয়ে গেল, কোন্নগরের মিনুর কোনো খোঁজ পেলেন না অম্বিকেশ। অবশ্য খোঁজ রাখাটাও সম্ভব ছিল না। তখন আজকালকার যুগের মতো সোশ্যাল মিডিয়াও ছিল না, মোবাইলও না। কোথায় যেন একবার শুনেছিলেন, মিনু কলকাতার হোস্টেলে থেকে পড়াশুনো করত। ভালো করে খোঁজ নিলে হয়তো আরও বিশদ জানতে পারতেন, কিন্তু তার আগেই একদিন ওর বিয়ের খবরটা পেয়েছিলেন। তখন অম্বিকেশ সবে পাশ করে বেরিয়ে টুকটাক ইন্সিয়োরেন্সের দালালি করছেন। খবরটা পেয়ে, আজও মনে আছে, বুকটা কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল অম্বিকেশের।
আজও ভাবলে আশ্চর্য লাগে। তখন অতগুলো বছর কোন্নগরের ওই পাড়ায় ছিলেন, কোনোদিনও মুখ ফুটে মিনুকে বলতেও পারেননি নিজের মনের কথা। মিনুর যদি আপত্তি থাকে? সেই অপমানের আশঙ্কাতেই গুটিয়ে যেতেন অম্বিকেশ।
তবে তার আপত্তি অমূলক ছিল না। মিনুদের বিশাল সাবেক আমলের বাড়িটা গমগম করত ওদের পাড়ার মধ্যে। তার ওপর মিনু ছিল অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী, ওই বয়সেই তার ইংরেজিতে দখল ছিল দেখার মতো। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট হোক বা বায়রনের কোনো কবিতা যেকোনো সময় নিখুঁত উচ্চারণে আবৃত্তি করতে পারত। সেখানে অম্বিকেশ নেহাতই বর্ডার পেরিয়ে আসা এক রিফিউজি। পড়াশুনোতেও সাধারণ।
তবে আজ জীবনের ষাটখানা বসন্ত পার করে এসে ভাবেন অম্বিকেশ, বলে দিলেই-বা কী ক্ষতি হত! মিনুর উত্তর ‘না’ হলেও অম্বিকেশ একা জীবন কাটাতেন, আজও তাই কাটাচ্ছেন। তবু মিনু যদি ‘হ্যাঁ’ বলতো সেই সম্ভাবনা বুকে চেপে কষ্ট পেতে হত না তাঁকে। মিনু তখনও তাঁর আপনজন ছিল, আজও আছে।
আপনজন হওয়ার সঙ্গে রক্তের বা আত্মীয়তার কোনো যোগাযোগ নেই আসলে। যে মানুষ আত্মার বড়ো কাছের, সে-ই আপনজন।
আর আরেকটা ব্যাপারও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করেন অম্বিকেশ, মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যত বাড়ছে, ততই যেন মানুষকে আপন করার প্রবণতা কমে যাচ্ছে, বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা, শুধুমাত্র নিজেকে, নিজেদেরটুকু নিয়ে থাকার অভ্যেস। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কিছুটা হলেও মানুষকে সামাজিক সহাবস্থানে বাধ্য করত, সে আগেকার দিনের একান্নবর্তী পরিবারগুলোই হোক বা দুটো অনাত্মীয় পরিবার হিসেবে অম্বিকেশদের অতগুলো বছর একসঙ্গে থাকাই হোক। সেটাই হয়তো ভালো ছিল। মানুষ সহজেই অন্যকে আপন করে নিতে পারত।
এই যে জিনিকে অম্বিকেশ প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন, পঁচিশ বছর আগে নার্সিং হোম থেকে যে ন্যাকড়া জড়ানো রক্তমাংসের ছোট্ট মানুষটাকে পরম মমতায় নিয়ে এসেছিলেন, সেই জিনিও কি অম্বিকেশের আপনজন নয়?
কখনো মাথাতেও এসেছে যে জিনির নিজের মামা তিনি নন?
জিনি যখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেয়েছে, অম্বিকেশ আনন্দে পাড়া মাথায় করেছেন। খড়দায় বুড়িদিদের পাড়ায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি মিষ্টি বিলি করে এসেছেন। অফিসে বড়োসড়ো পার্টি দিয়েছেন।
আর জিনির বিয়েতে? জিনির শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা বরযাত্রীরা তো প্রথমে বুঝতেই পারেনি অম্বিকেশ জিনির নিজের মামা নন। হতে পারে অজিতেশ জামাইবাবু খড়দা পুরসভার বারো নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, শাসক দলের একজন একনিষ্ঠ কর্মী, কিন্তু বাড়ির দিকে তাঁর নজর কোথায়? জিনির বিয়ের বাজার থেকে শুরু করে বুড়িদির সঙ্গে গিয়ে নিমন্ত্রণ সারা, ক্যাটারিং থেকে ডেকরেশন সবই তো করেছেন অম্বিকেশ।
সেই জিনি কী এমন করল যে বুড়িদি এত চিন্তায় পড়ে গেল?
সত্যি বলতে কী, ভাগনি বলে নয়, চারপাশে আজকালকার এত মেয়ে দেখেন অম্বিকেশ, জিনির মতো মেয়ে ক-টা হয়? যেমন পড়াশুনোয় ভালো ছিল, তেমনই চাকরি পেয়ে বাবামা-র পাশে দাঁড়াল, তারপর ঠিক সময়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়েও করল।
হোক ভাব ভালোবাসা করে, অতন্দ্র ছেলেটাকেও ভারি ভালো লাগে অম্বিকেশের। মিতবাক, ভদ্র, এখনকার ছেলেদের মতো নয়। প্রথমে জিনি নিজের পছন্দে বিয়ে করবে জেনে বুড়িদি টেনশন করলেও অম্বিকেশ তাই কখনো চাপ নেননি, তিনিই বুঝিয়েছিলেন, ‘দেখ বুড়িদি, জিনির ওপর আমার ভরসা আছে। ও পছন্দ করেছে মানে ছেলেও তেমনই। তুই নিশ্চিন্তে থাক।’
এই নিশ্চিত বিশ্বাস থেকেই কিন্তু জিনি যখন মাস কয়েক আগে দুম করে এসে বলেছিল যে ও চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে চায়, তখনও কিন্তু তিনি আগুপিছু না ভেবেই জিনিকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
বুড়িদি, অজিতেশদা বা অন্যদের মতো আকাশ থেকে পড়ে বলেননি, ‘এত ভালো চাকরি ছেড়ে যে লাইনের কিছু জানিস না বুঝিস না, সেখানে … তুই কি পাগল হলি জিনি?’
না, নিজে পারেননি বলে অন্যকে সব ভুলে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ঝাঁপ দিতে বাধা দেন না অম্বিকেশ। বরং দরাজ গলায় বলেছিলেন, ‘দারুণ হবে। যদি সত্যিই করিস, আমি তোর পাশে আছি, জিনি। আর এ তো আমারই লাইন!’
অম্বিকেশের এখনও মনে আছে, জিনি শুনে মুখ টিপে হেসে বলেছিল, ‘তোমার লাইন তো কী হয়েছে, তুমি তো সেই গ্লোবাল টুরসেই থাকবে। আমার সঙ্গে তো আর কাজ করবে না।’
অম্বিকেশও তখন ঝেঁকের মাথায় বলেছিলেন, ‘কেন করব না? আলবাত করব। তুই শুরু করেই দেখ না, গ্লোবাল টুরস ছেড়ে আমি তোর সঙ্গেই ভিড়ে যাব। অনেকদিন তো হল চাকরগিরি, এবার নতুন কিছু না করলে নয় এই একঘেয়ে কাজ আর পোষাচ্ছে না।’
সেই শুরু। তারপর থেকে এই কয়েক মাসে কাজ ক্রমশই এগিয়েছে। আর যতই জিনি তার অভীষ্টের দিকে এগিয়েছে, পথের সারথি হতে গিয়ে অম্বিকেশ নিজেও জড়িয়ে পড়েছেন সেই কর্মকাণ্ডে।
যার ফলাফল আজকের স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ। এতদিন তিনি জিনিয়া-অতন্দ্রর মুখ থেকেই যা শোনার শুনেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, আজকের পর থেকে পূর্ণোদ্যমে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন, সবার সামনে তুলে ধরবেন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসকে।
অম্বিকেশের একটা সিগারেট ধরাতে খুব ইচ্ছে হল। কিন্তু এসি বাস বলে সেই ইচ্ছে দমন করলেন। তিনি ভেতরে ভেতরে একটু দোনোমনায় পড়ে গেছেন। এখন কি জিনিকে একটা ফোন করে আগে থেকে জানবেন ব্যাপারটা কী? যাতে বুড়িদি বাড়ি ঢুকতে-না-ঢুকতেই হাউমাউ করে কিছু বলতে না পারে?
পরক্ষণেই সেই পরিকল্পনাটাকে বাতিল করে দিলেন তিনি। আগে থেকে কিছু না জেনেবুঝে মা-মেয়ের মধ্যে ঢোকার কোন মানে হয় না। আগে বুড়িদি কী বলে সেটা শোনা যাক বরং। সেই বুঝে এগোনো যাবে।
১১
এই নিয়ে পাক্কা পাঁচবার বেজে চলা মোবাইলটাকে সাইলেন্ট করল অতন্দ্র। একে জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ভেসে এসে চুল-টুল উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আরাম লাগলেও ঠিকমতো চেয়ে থাকা যাচ্ছে না, তার মধ্যে এই উৎপাত।
রিং হওয়ামাত্র ভলিউম কমানোর বোতামটা টিপতে টিপতে মনে মনে তেড়ে গালাগাল করছিল ও। শালা এই হল বিজ্ঞানের অভিশাপ। জাহান্নামে যাক কিংবা পায়খানায়, ফোন বাজতেই থাকবে। কোনো প্রাইভেসি নেই, নিজস্ব সময় বলতে চব্বিশ ঘণ্টায় আর একটি মুহূর্তও নেই কারোর।
মাঝে মাঝে ওর মনে হয় ফোন জিনিসটার সঙ্গে যতদিন তার লাগানো ছিল, ততদিনই ভালো ছিল। দুর্গাপুরে ওদের বাড়িতে সেই ঘুরিয়ে ডায়াল করা কালো মিশমিশে ল্যান্ডফোন ছিল। গরমের ছুটির দুপুরগুলোয় মা যখন বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তেন, অতন্দ্র তখন চুপিসারে মায়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে ডাইনিং-এ রাখা সেই টেলিফোন থেকে টেলিফোন ডিরেক্টরি দেখে দেখে ফোন করত নানা অজানা নম্বরে। গলা কখনো সরু, কখনো গম্ভীর করে কথা বলে কত মজাই না করেছে সেইসব দিনগুলোয়। একদিকে ফোনের রিঙের মতো তারটাকে হাত দিয়ে পেঁচাত, অন্যদিকে এইসব দুষ্টুমি ও করে যেত।
আর সেদিন থেকে ফোনের পেছন থেকে সেই তারের ল্যাজ খসে পড়েছে, সেই তার এসে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে মানুষকে। গজগজ করতে করতে ষষ্ঠবারের জন্য ফোনটা সাইলেন্ট করে ও।
কেটে দিয়ে লাভ নেই, পুষ্পম এখুনি লম্বা-চওড়া মেসেজ করতে শুরু করবে, আর তাতে উপচে পড়বে গ্যালন গ্যালন আবেগ।
রেগেমেগে অতন্দ্রর একবার ইচ্ছে হল বাসের জানলা দিয়ে ফোনটা হাত গলিয়ে সটান নীচে ফেলে দেয়। দিনের পর দিন এই ফোনটা যেন ওর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক ভেবে ও দেখেছে, এই মোবাইল ফোন জিনিসটা মানুষের মধ্যে ঝগড়া, অশান্তি, বিচ্ছেদ বহু গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই ব্যাপারে ওর একটা নিজস্ব থিয়োরিও আছে।
আগেরকার দিনে একে অন্যের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলেও সেই মুহূর্তে রাগের কথাগুলো উগরে দেওয়ার কোনো উপায় থাকত না। স্বামী অফিসে, স্ত্রী বাড়িতে কিংবা অফিসে। বাড়ি ফিরে দু-জনের হয়তো দেখা হবে সেই রাতে।
ততক্ষণে সারাদিনের ব্যস্ততায়, মনের মধ্যে টানাপোড়েনে সকালের রাগ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে সেই জায়গা দখল করত অভিমান। রাগের তীব্রতা কমে গিয়ে হিংস্রতা রূপ নিত অনুযোগের, নিজের ভুলগুলোও মনের মধ্যে ক্রমাগত কাটাছেঁড়ায় চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ থাকত। ফলে দিনের শেষে দাম্পত্যকলহ হলেও ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে তার প্রাবল্য অনেক কম হয়ে যেত।
প্রেমিক প্রেমিকার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা আরও খাটত যখন চিঠিপত্রের যুগ ছিল। প্রেমের মানুষটির বিরহ সহ্য করার যে অনুভূতি সেটাও তখন মানুষের পাওয়ার সুযোগ ছিল।
আর এখন? সবই চটজলদি। টেলিফোন সার্ভিস প্রোভাইডারগুলোর নিত্যনতুন প্রায় ফ্রি-তে কথা বলার সুযোগ এই সমস্যাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে চলেছে। এখন যার যখন রাগ হচ্ছে, যে অবস্থায় বা যে পরিস্থিতিতেই থাকুক, ধাঁ করে বোতাম টিপে হড়হড়িয়ে বমি করে দিচ্ছে উলটোদিকের মানুষটির গায়ে। কোনো আগল নেই, কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, কামনা, বাসনা, রাগ, দুঃখ সবই তাৎক্ষণিক প্রকাশ করা যাচ্ছে। ফলে, কমে আসছে মনের টান, যা মুখে আসছে তাই বলার মধ্য দিয়ে আলগা হচ্ছে আশপাশের কোটি কোটি সম্পর্ক।
ফোনটা বেজেই চলেছে। তুলে সেটাকে আছাড় মারার ইচ্ছেটা অতি কষ্টে সংবরণ করল অতন্দ্র। কিছু করার নেই। প্রোজেক্টের ক্লায়েন্ট বা কলিগদের প্রয়োজনেও তারা এই নম্বরেই ফোন করে।
ওর পাশে বসে এতক্ষণ ধরে ঝিমোচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। এই গরমেও পাতলা চাদরে সারা গা আপাদমস্তক মোড়া তাঁর। কনডাক্টর টিকিট কাটতে আসার সময় তাঁর চোখ দুটো একঝলক শুধু দেখার সুযোগ পেয়েছিল অতন্দ্র, এবার তিনিই মুখ থেকে চাদরটা খুলে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ফোনটা ধরুন না মশাই! তখন থেকে একবার করে বেজে উঠেই থেমে যাচ্ছে। যে ফোন করছে সেও বিরক্ত হচ্ছে, আর আমার ঘুমটাও একবার করে আসামাত্র চটকে দিচ্ছেন! বিবেক বলে কি কিছুই নেই আপনার? ফোনটা ধরুন, কথা বলুন, রেখে দিন, হয়ে গেল।’
অতন্দ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘আশ্চর্য তো! আমি তো ফোনটা আসামাত্র কেটে দিচ্ছি। তাতেও আপনার এত সমস্যা হচ্ছে?’
ভদ্রলোক এতক্ষণ হেলান দিয়ে সিটে লম্বা হয়ে প্রায় আধশোয়া ভঙ্গিতে বসেছিলেন, এবার অতন্দ্রর উত্তর শুনে ধীরেসুস্থে সোজা হয়ে উঠে বসলেন। তারপর একটা বিশাল হাই তুলে অতন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সমস্যা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এমনি এমনি তো আর ভোর চারটেয় উঠে তড়িঘড়ি দৌড়ে এসে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকিনি, এই সামনের দিকের রো-টা দখল করার জন্যই এত কিছু করেছি। যাতে একটু শান্তিতে এই ঘণ্টা আড়াই ঘুমোতে ঘুমোতে যেতে পারি। জানলার ধারটাই পেয়ে যেতাম, নেহাত আপনি কয়েক সেকেন্ড আগে লাইনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন তাই। বিবেক বোধ থাকলে অবশ্য বুড়ো মানুষটাকে জায়গা ছেড়ে দিতেন, কিন্তু আজকালকার ছেলেপুলেদের তো আর বিবেক বলে কিছু নেই। এ তো আর আমরা নই। যাকগে, তাও ধারের সিটে বসে ঘুমোচ্ছি, সেটাও আপনার সহ্য হচ্ছে না। বলি বিবেকদংশন হয় না?’
পেছন থেকে কে একটা অল্পবয়সি ছোকরা ফুট কাটল, ‘এই বিবেক কোথায় থাকে, কাকু? দুর্গাপুরেই?’
লোকটা আচমকাই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। পেছনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘তোদের মত অমানুষরা কী করে বিবেককে জানবে বল! দু-পায়ে চললেই তো বিবেক থাকে না, বিবেক থাকতে গেলে সত্যিকারের মানুষ হতে হয়!’
সামনের সিটের আরেকটা লোক হঠাৎ এই গোলমালের মধ্যে কৌতূহলী হয়ে পেছনে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। অতন্দ্রর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এক গাল হেসে বলল, ‘চার বচ্ছর এই ফার্স্ট বাসে চেপে কলকাতা যাচ্ছি মশাই, দুর্গাপুর শহরেও থাকি আজ দশ বছর হয়ে গেল। এতদিনে বহুবার কোক ওভেন কলোনির বিবেক দাদুর নাম শুনেছি। কিন্তু কখনো চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজ হল। ইনিই তাহলে তিনি!’
বিরক্তিতে অতন্দ্রর মুখ কুঁচকে গেল।
এই পৃথিবীতে কি কোথাও শান্তি নেই? একে সোমবার, আবার এক সপ্তাহের জন্য অফিসের যুদ্ধ শুরু।
ভেবেছিল, অন্যান্যবারের মতো রবিবার রাতে কলকাতায় না ফিরে সোমবার ভোরে দুর্গাপুর থেকে বাসে হাওয়া খেতে খেতে ফিরবে। বহু বছর এই ভোরের বাসে আসা হয় না। বিয়ের আগে যখন ও কলকাতায় মেসে থাকত, তখন প্রায়ই এভাবে আসত। দু-পাশে সবুজ ধানখেত, মাঝখান দিয়ে চওড়া হাইওয়ে, উল্কার গতিতে ছুটে চলা এক্সপ্রেস বাসে বসে থেকে হাওয়া খেতে খেতে আসতে দারুণ লাগত ওর।
কিন্তু এখন ওর এতই খারাপ সময় চলছে, যে এই সুখেও ও এখন বঞ্চিত। ঠিক একটা-না-একটা আপদ জুটে যায়।
জানলার কাচ দিয়ে এত ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছিল, যে ওর চোখ এবার জ্বালা করছিল। কাচটা অল্প করে টেনে দিয়ে ও পুষ্পমকে ঘুরিয়ে ফোন করল।
পাশের সেই বৃদ্ধ এখনো গজগজ করে যাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ভদ্রলোকের কথায় কথায় ‘বিবেক’ বলাটা মুদ্রাদোষ। এবং এইজন্য তিনি বেশ বিখ্যাতও। পেছন দিকের কিছু ফচকে ছেলে তাই নিয়ে মাঝে মাঝেই টিপ্পনী কাটছে, আর ভদ্রলোক আগুনে ঘি দেওয়ার ভঙ্গিতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে চেঁচাচ্ছেন।
পুষ্পম ফোন তুলেই বকতে শুরু করল, ‘কী ব্যবসা করবি তুই? ঠিকমতো ফোনই তুলিস না। কাস্টমার কেয়ারের যদি এই অবস্থা হয়, কী করে লোক টানবি? এমনিতেই অন্য সব টুর এজেন্সিতে ফোন করলে সুন্দরী টেলিকলার মিষ্টি স্বরে কথা বলে হেল্প করে, সেখানে তোর হেঁড়ে গলা, তাও ফোন বেজে বেজে কেটে যায়। এভাবে চললে তো দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের দফারফা!’
সাতসকালে নামটা শুনে অতন্দ্রর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। পুষ্পম ছেলেটার মনটা এমনিতে ভালো, কিন্তু একটাই রোগ, প্রচণ্ড বাজে বকে। ও গম্ভীরভাবে বলল, ‘এটা টুর এজেন্সির হেল্পলাইন নম্বর নয়। এটা আমার পার্সোনাল নম্বর। কী বলবি বল।’
‘আরে ওই হল।’ পুষ্পম বলল, ‘যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন’ বস। তুই হলি গিয়ে একটা কোম্পানির মালিক, এইসব অভিযোগগুলোকে সিরিয়াসলি নে, তোরই রেপুটেশনের উন্নতির জন্য বলছি। যাই হোক, একটু হোল্ড কর, বাবা তোকে কী জিজ্ঞাসা করবে বলে কাল রাত থেকে উতলা হয়ে উঠেছে, বাবাকে ফোনটা দিচ্ছি।’
অতন্দ্র সঙ্গেসঙ্গে বলতে গেল, ‘আরে শোন শোন, দাঁড়া ফোনটা দিস না…!’
কিন্তু কে শোনে কার কথা, ততক্ষণে পুষ্পমের বাবা ফোনটা ধরে ‘হ্যালো হ্যালো’ শুরু করেছেন।
নাহ, আজ সকাল থেকে ছোটোখাটো নানা ঝঞ্ঝাটে অতন্দ্র যেভাবে পড়ছে, মনে হচ্ছে সারা দিনটা খারাপই যাবে। কিছু কিছু মানুষ জীবনেও সভ্যতা ভব্যতার ধার মাড়ায় না। ছোটোবেলার বন্ধু বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে?
ও বিরক্তি চেপে রেখে বলল, ‘হ্যাঁ মেসোমশাই, বলুন। কেমন আছেন?’
‘আরে আমি তো ঠিক আছি, কিন্তু তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার তো আমি কিছু বুঝছি না হে!’ পুষ্পমের বাবা তাঁর স্বভাবগত হামবড়া ভঙ্গিতে শুরু করলেন।
ব্যস, শুরু হল!
পুষ্পম এতদিনের বন্ধু হলেও অতন্দ্র যদি মাসখানেক আগেও টের পেত যে ওর বাবা এইরকম নাক-উঁচু একজন মানুষ, ও কি ভুলেও ইউরোপ ঘুরতে যাওয়ার জন্য প্যাকেজ গছাতে যেত ওঁকে? যেদিন থেকে অ্যাডভান্স করেছেন, সেদিন থেকে উনি অতন্দ্রকে মোটামুটি নিজের কেনা চাকর ভেবে ফেলেছেন। তুচ্ছ সমস্ত কারণে ফোন করে যাচ্ছেন, সব কিছুতেই ওঁর সন্দেহ, আশঙ্কা আর সমস্যা। আর কথায় কথায় বড়ো বড়ো টুর এজেন্সির সঙ্গে তুলনা টানা তো আছেই।
অতন্দ্রর মনে পড়ে গেল, সেদিন জিনিয়ার সঙ্গে অশান্তি যখন চরমে উঠেছিল, সেইসময় পুষ্পমের বাবা বারবার ফোন করছিলেন। বিরক্ত হয়ে ওঁর নম্বরটাকে ব্লক করে দিয়েছিল অতন্দ্র। সেইজন্যই এখন ছেলের ফোন থেকে ফোন করে ওঁকে জ্বালানোর প্রচেষ্টা করছেন ভদ্রলোক।
ও তেতো গলায় বলল, ‘কেন, আবার কী হল মেসোমশাই? সেদিন আপনি বলার পর তো পুরো প্রোগ্রামটাই আপনাকে ই-মেল করে দিয়েছিলাম।’
‘আরে কই পাঠালে। খুলছেই না।’ পুষ্পমের বাবার গলা থেকে বিরক্তি চুঁইয়ে পড়তে শুরু করল, ‘চারদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তোমাকে ফোন করলাম কতবার, ফোনেও পাচ্ছি না। সাইবার ক্যাফের ছেলেটা বলল তুমি তো পাসওয়ার্ডই পাঠাওনি।’
‘পাসওয়ার্ড আবার কীসের? অ্যাটাচমেন্টটায় কোনো পাসওয়ার্ডই নেই। সাধারণ একটা ডকুমেন্ট ফাইল। আমি নিজে আপনাকে মেলের সঙ্গে ডকুমেন্টটা অ্যাটাচ করে পাঠিয়েছি। আপনি ভালো করে দেখেছেন?’ কথা বলতে বলতে অতন্দ্র ফোন থেকেই দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের নামে খোলা ই-মেল অ্যাকাউন্টটা খুলল।
জিনিয়ার সাধের এই কোম্পানির সঙ্গে ওর দূরত্ব এখন যত আলোকবর্ষই হোক না কেন, তালেগোলে ফোন থেকে এখনও ই-মেল অ্যাকাউন্টটা ডিলিঙ্ক করা হয়নি। অতন্দ্র ঠিক করল, পুষ্পমের বাবার বক্তব্য শেষ হলে ফোন রেখে প্রথম কাজ ও সেটাই করবে।
যন্ত্রণার আর শেষ নেই। তার মধ্যে পাশের সেই বিবেকদংশনের মাস্টারমশাই বৃদ্ধটি এখন অকাতরে ঘুমোচ্ছেন, ঘুমোতে ঘুমোতে মাঝেমধ্যেই তাঁর মাথাটা হেলে পড়ছে অতন্দ্রর ঘাড়ে। অতন্দ্র ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে কোনোমতে ভদ্রলোকের মাথাটা সোজা করে দিল।
এই তো, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, পুষ্পমের বাবার ই-মেলে পাঠানো মেলটা চলে গেছে সেদিনই।
ও আবার একবার সেটাকে ফরোয়ার্ড করে ফোনটা কানে দিল, ‘আমার এখানে কিন্তু দেখাচ্ছে মেলটা আপনার আইডিতে চলে গেছে মেসোমশাই। আপনি ঠিক দেখেছেন তো? আমি আর একবার পাঠালাম।’
পুষ্পমের বাবা এবার বেশ ঝাঁঝ দেখিয়ে বললেন, ‘কী মুশকিল! আমি কি তোমাকে মিথ্যে কথা বলছি? নাহ, এই হল নামকরা ট্রাভেল কোম্পানির সঙ্গে অনামিদের পার্থক্য। নামি ব্র্যান্ড হলে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকা যায় যে, ঘুরতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া, হোটেল, বেড়ানো নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে না। আমরা সেবার নৈনিতাল মুসৌরি বেড়াতে গেলাম হ্যাপি হলিডের সঙ্গে। কী ভালো সব সিস্টেম! লাগেজগুলো অবধি বয়ে বয়ে হোটেলের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। আর এ তো যে সে জায়গা নয়, বিদেশবিভুঁই বলে কথা। পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, পাউন্ড, ইউরো, কতরকম ঝামেলা! আমরা বুড়ো মানুষ, বিপদ হতে তো এক সেকেন্ডও লাগবে না। তোমাদের দেখছি কোনো প্রফেশনালিজমই নেই। সাইবার ক্যাফের পল্টু বলে ছেলেটা খালি বার বার জিজ্ঞেস করছিল ই-মেলের পাসওয়ার্ড কী, আর তুমি ফোনই তুলছ না!’
অতন্দ্রর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল শুনতে শুনতে, কিন্তু ভদ্রলোকের শেষ বাক্যটায় ও আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘মানে? আপনার ই-মেলের পাসওয়ার্ড?’
‘তা নয় তো কি তোমার?’ অতন্দ্র ফোনের ওইপাশে পুষ্পমের বাবার মুখটা দেখতে না পেলেও পরিষ্কার বুঝতে পারল ভদ্রলোক প্রায় দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমার ই-মেলের পাসওয়ার্ডটা বলেছ আমায়?’
‘অদ্ভুত ব্যাপার! আপনার ই-মেলের পাসওয়ার্ড আমি কী করে জানব?’ অতন্দ্র বলল, ‘আপনার ই-মেল আইডি খুলে দিয়েছিল কে? পুষ্পম?’
‘না না, ও-ও তোমারই মতো, কোনো কাজের নয়। ই-মেল আইডি খুলেছিল আমার এক খুড়তুতো নাতনি। সে দিল্লিতে থাকে। বছরে একবার আসে। খুব স্মার্ট মেয়ে। ও-ই খুলে আমাকে চিরকুটে আইডিটা লিখে দিয়ে গিয়েছিল। আমি কি ওসব পারি নাকি! তারপর থেকে চিরকুটটা মানিব্যাগের ভাঁজেই রাখা ছিল। তুমি সেদিন চাইলে, দেখে বলে দিলাম।’ পুষ্পমের বাবা সগর্বে ঘোষণা করলেন।
অতন্দ্র প্রচণ্ড কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে শান্তগলায় বলল, ‘আপনার ওই স্মার্ট নাতনিকে বলুন পাসওয়ার্ডটাও এবার আপনাকে লিখে পাঠাতে। তারপর সেটা গিয়ে ওই পল্টু বা বিল্টু, তাকে দিন, সে আপনাকে আমাদের টুর প্রোগ্রামটা দিয়ে দেবে।’
‘বলছ? রিঙ্কিই জানে পাসওয়ার্ডটা?’ ভদ্রলোক রীতিমত বিস্মিত, ‘কিন্তু ইমেল আইডিটা তো তোমায় দিলাম সেদিন!’
‘উনিই জানেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করুন।’
‘তু-তুমি জানো না?’ পুষ্পমের বাবা এখনো দ্বিধাগ্রস্থ।
পাশের বিবেকবাবুর মাথাটা আবার হেলে পড়েছে অতন্দ্রর কাঁধে। সেটা তুলে সোজা করতে করতে এবার অতন্দ্রর মুখে কিছুক্ষণ আগের আসা গালাগালগুলো আবার চলে এল।
ও কেটে কেটে বলতে গেল, ‘শুনুন মেসোমশাই, আপনাকে দুটো কথা বলি। এক, কথায় কথায় নামি কোম্পানি দেখাবেন না। আপনি তো অনেক নামকরা এজেন্সির সঙ্গে এখানে ওখানে ঘুরেছেন, তা নামি কোম্পানির সঙ্গে ঘুরতে যেতে গেলে তো অন্তত তিনমাস আগে পুরো টাকাটা পেমেন্ট করে দিতে হয়। সেখানে আমাদের আপনি মাত্র দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স ঠেকিয়ে বুক করেছেন, তাই না? আর যে টুরটায় আপনি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে যাচ্ছেন, সেটা নামি দামি কোনো কোম্পানি দু-আড়াই লাখের নীচে আপনাকে নিয়ে যাবে না। আর সেটা আপনি নিজে ভালো করে জানেন বলেই আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছেন, আমাদের ওপর কোনো দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে নয়। আর দুই, আমাকে এখন থেকে এই ব্যাপারে বিরক্ত করবেন না। দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ওই কোম্পানির মালিক জিনিয়া দাশগুপ্তর ফোন নম্বর আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, আপনি এবার থেকে ওঁকেই আপনার মনে যা যা প্রশ্ন আসবে, সব জিজ্ঞেস করবেন।’
‘হ্যালো হ্যালো। অতন্দ্র, শুনতে পাচ্ছ?’
ফোনের ওপাশের ক্রমাগত চিৎকারে অতন্দ্র আবার বাস্তবে ফিরে এল। এই ওর এক রোগ, মনে মনে ও অনেক কিছু ভাবে, ঠিক করে এই বলবে সেই বলবে। কিন্তু আসলে কিছুই বলতে পারে না।
না, মনের কথা মুখ দিয়ে বলতে পারে, কিন্তু খুব কাছের কিছু মানুষের ক্ষেত্রে। সেইসব ব্যাপারে অতন্দ্রর মুখে কোনো আগল থাকে না।
তাই এখনও অনেক কড়া কড়া জবাব মনে মনে দিলেও ও মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, ‘হ্যাঁ। আমি এখন ব্যস্ত আছি। রাখছি। আপনি পাসওয়ার্ডটা নিয়ে ই-মেলটা খুলুন, টুর প্রোগ্রামটা পেয়ে যাবেন।’
ফোনটা রেখে ও একটা লম্বা শ্বাস নিল।
পাশের বিবেকবাবুর মাথা আবার হেলে পড়েছে। এবার আর ও সেটা সোজা করে দিল না।
থাক, বুড়ো মানুষ, এত সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতা যাচ্ছেন মানে নিশ্চয়ই কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে। হয়তো সেই চিন্তায় রাতে ঘুমও হয়নি। এখন একটু ঘুমোলেনই নাহয়! চারপাশের এতরকম মানুষ, কে কেমন লড়াই লড়ছে, তা ও কতটুকু জানে?
এই ভাবনাটা আসামাত্র ও একটু সুস্থির হয়ে বসে চোখ বুজল। জানলার বাইরে চোখ মেললেই দূরে সবুজ আলুর খেত, পাশ দিয়ে পানিফলের চাষ চলছে এঁকেবেঁকে।
ঠান্ডা হাওয়াটা উপভোগ করতে করতে এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হল, সেদিন রাতে নিজেকে এভাবেই কোনোরকমে যদি সংবরণ করতে পারত? যদি জিনিয়ার ওই কাজের পরেও মাথা ঠান্ডা রেখে এভাবে চুপ করে শুয়ে পড়ত?
তাহলে আজ সবকিছু এইভাবে শেষ হয়ে যেত কি?
আর ও যখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের কেউ নয়, তাহলে আর কয়েকদিন পর যখন অফিসের নোটিশ পিরিয়ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে, তখন ও কী করবে? ও তো তখন পুরোপুরি বেকার হয়ে যাবে!
এক মুহূর্তের জন্য অতন্দ্র ভাবল, তাহলে কি ওর রেজিগনেশন তুলে নেওয়া উচিত? ফিরে যাওয়া উচিত পুরোনো জীবনে?
১২
যাদবচন্দ্র হাঁটছিলেন। পাশে পাশে হেঁটে চলেছিল পুতো। হাটতলার মোড়ে এসে পুতো একটু ইতস্তত করে বলল, ‘মাস্টারমশাই, আপনি এগোন, আমি একটু পরে আসছি।’
যাদবচন্দ্র বাধা দিলেন না। বেচারা কোন সকালে বেরিয়েছে, যাদবচন্দ্রের সঙ্গে ছিল বলে বিড়িও খেতে পারেনি। এখন একটু খাবে তো খাক। যাদবচন্দ্র ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
মানকড় স্টেশন থেকে তাঁর বাড়ি অনেকটা। প্রায় পনেরো মিনিটের হাঁটাপথ। জমিটা যখন কিনেছিলেন, তখন অনেকেই বারণ করেছিল বৃদ্ধবয়সের কথা ভেবে। ওদিকটা তখন বাড়িঘর নেই বললেই চলে, বাসস্ট্যান্ড, স্টেশন সবই অনেক দূর। যাদবচন্দ্র স্টেশনের পাশেই আরেকটা জমি পেয়েছিলেন। দামটা যদিও অনেকটা বেশি ছিল, তবু সব দিক ভেবেচিন্তে যাদবচন্দ্রের পছন্দ ছিল ওটাই। অনেক বছর হয়ে গিয়েছে তখন ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে ফেলেছেন, নিজের মনোমতো একটা বাড়ি বানাবার জন্য তাঁর মনটা যেন হাঁসফাঁস করছিল।
কিন্তু বাধা দিয়েছিলেন আরতি। তখন রাজু এম এস সি পড়ছে। বর্ধমানেই থাকে। আরতি বলেছিলেন, ‘রাজু তো আর মানকড়ে থাকবে না, হয় বর্ধমান নাহলে কলকাতায় চাকরি নেবে। আমরাও তখন ওখানেই চলে যাব। কী হবে এখানে এত দামের জমি কিনে? বরং ওই দূরের জায়গাটাই কেনো, বাড়তি টাকাটা এখন রাজুর নামে ব্যাঙ্কে রেখে দাও। ওর দরকারে অদরকারে লাগবে’খন।’
তা সেই টাকা সত্যিই কয়েক বছর পর রাজুর লেগেছিল। বিদেশে ডক্টরেট করতে যাওয়ার পরীক্ষার ফর্মের দাম ছিল আকাশছোঁয়া, তেমনই দাম বইপত্রের। তখনই টাকাটা অল্প অল্প করে তুলে নিয়েছিল রাজু।
যাদবচন্দ্র বাধা দেননি। দেবেনই-বা কেন? টাকাটা তো রাজুরই। যাদবচন্দ্রর সব কিছুই তো ওর! নিজের টাকা সে নিজের মতো করে খরচ করবে, তাতে বাবা হয়ে তিনি বাধা দেবেন কেন!
যাদবচন্দ্র হনহনিয়ে হাঁটছিলেন। সব কিছুরই ভালোমন্দ দুই দিকই আছে। এত দূরে জমি কিনেছিলেন বলেই এখন দিনে দু-বেলা বাজারহাট করতে আসার জন্য এতটা করে হাঁটা হয়। সেটা কি শরীরের পক্ষে কম উপকারি?
‘স্যার, ভালো আছেন?’
যাদবচন্দ্র চমকে তাকালেন। অন্ধকারে রাস্তার আলোতেও দিব্যি চিনতে পারলেন সোমতীর্থকে। হাসিহাসি মুখে একটা বাচ্চা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার আগেই সোমতীর্থ ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিল, ‘জেঠিমা কেমন আছেন’ স্যার?’
যাদবচন্দ্র তাড়াতাড়ি প্রাক্তন ছাত্রের মাথায় হাত রেখে ওপরে তুলতে তুলতে বললেন, ‘আরে সোম! কতদিন পর দেখলাম তোকে! কেমন আছিস?’
‘এই তো, আপনাদের আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে স্যার।’ সোমতীর্থ একমুখ হাসল, ‘আজই এসেছি মানকড়ে। থাকব ক-দিন। ছেলেটার পরীক্ষা শেষ, দাদুর বাড়ি যাব বলে বায়না করছিল। তাই নিয়ে চলে এলাম।’
‘বেশ করেছিস।’ যাদবচন্দ্র বাচ্চাটার দিকে তাকালেন, ‘এই তোর ছেলে বুঝি?’
‘হ্যাঁ স্যার।’ সোমতীর্থ ছেলের গাল টিপে আদর করে বলল, ‘প্রণাম করো দাদুকে, পুটু। আমার মাস্টারমশাই উনি।’
‘আরে থাক থাক। যাদবচন্দ্র সস্নেহে ছেলেটার মাথায় হাত রাখলেন, ‘ভাল মানুষ হও, দাদুভাই।’ কথাটা বলে সোমতীর্থর দিকে তাকালেন তিনি, ‘তুই এখনও বর্ধমানেই আছিস তো?’
‘হ্যাঁ স্যার।’ সোমতীর্থ মাথা নাড়ল, ‘পরে কলকাতায় আরও ভালো একটা অফার পেয়েছিলাম। কিন্তু গেলাম না। বর্ধমানে একটা আঁকার স্কুল খুলেছি, অনেক বাচ্চা শেখে। অফিস থেকে এসেই লেগে পড়ি। তা ছাড়া ওখানে থাকলে শনি রবিবার তো বাড়ি আসতে পারিই, দরকার পড়লে সপ্তাহের মাঝেও যেকোনোদিন চলে আসি। বাবা তো চলে গেলেন কয়েক বছর হল। মায়েরও বয়স হচ্ছে। আমি তো বার বার বলছি আমার ওখানে গিয়ে থাকবে চলো, কিন্তু মা মানকড় ছেড়ে কিছুতেই নড়তে চায় না, বললেই বলে, যতদিন শরীর দিচ্ছে এখানেই থাকি, সব চেনাজানা মানুষ, দুটো কথা বলতেও তো ভালো লাগে। একেবারে যখন পড়ে যাব, তখন তো যেতেই হবে।’ সোমতীর্থ একটু থেমে বলল, ‘সোমাও তাই। কিছুতেই এখান ছেড়ে যাবে না।’
যাদবচন্দ্র মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন, শেষ বাক্যে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
বহু যুগ পরে বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এসে যেন আচমকাই সোমার নামটা শুনলেন তিনি। অথচ একদিন এই নামটাই ওদের তিনজনের সংসারে ঝড় তুলে দিয়েছিল। পাঁচ ফুটের চেয়ে সামান্য লম্বা লাজুক শ্যামলা মেয়েটা যেন আচমকা পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজু আর ওঁদের দু-জনের মধ্যে।
তিনি বললেন, ‘সোমাকে তো দেখতেই পাই না রাস্তাঘাটে। ও কেমন আছে?’
‘ভালোই আছে। দুর্গাপুরের একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ায়।’ সোমতীর্থ ছোটো একটা নিশ্বাস ফেলল, ‘বিয়ে তো কিছুতেই করল না।’
সোমতীর্থ চলে যাওয়ার পরেও যাদবচন্দ্র অনেকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন রাস্তার মধ্যে। কেমন একটা অপরাধবোধ এসে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল তাঁকে। মনে হচ্ছিল তাঁর লজ্জিত হওয়া উচিত।
ভীষণভাবে লজ্জিত হওয়া উচিত।
কতক্ষণ ওইভাবে ছিলেন খেয়াল করেননি, হঠাৎ খেয়াল হতে হাঁটা শুরু করলেন।
সামনের আশ্বিনে ছিয়াত্তরে পড়বেন, এখনও যেন কিছু সাবেক প্রশ্ন এসে তাঁর অন্তরাত্মাকে গুলিয়ে দিয়ে যায়।
আচ্ছা, ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি বাবা-মায়েরা সবসময় ‘সন্তান যেন পড়াশুনোয় উজ্জ্বল হয়’, এটা চায় কেন? ছোটো থেকে প্রতিটা বাবা-মায়ের কামনা থাকে ছেলে বা মেয়ে যেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা কোনো তথাকথিত হাইপ্রোফাইল চাকরি করে। ক-জন বাবা-মা ছেলেমেয়েকে ব্যবসা করতে উৎসাহ দেন? ক-জন বাবা-মা-ই বা এইসব ধামাধরা সাফল্যের সংজ্ঞা পেরিয়ে ছেলেমেয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ গড়ে তুলতে! মোটা মাইনের চাকরি, ঝাঁ চকচকে বাড়ি, দামি গাড়ি এইসবের চেয়ে কি একজন সংবেদনশীল মানুষ হওয়াটা কম গুরুত্বপূর্ণ?
যাদবচন্দ্র নিজে সারাজীবন ছাত্র পড়িয়েছেন, অঞ্চলে তিনি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত, তা সত্ত্বেও নিজের মনের কাছে তিনি আজ অকুন্ঠভাবে স্বীকার করেন, তিনি নিজেও জীবনের একটা বড়ো সময় সাফল্য বলতে ওই স্টেটাসগুলোকেই বুঝতেন। ক্লাসে কোনো ছাত্র সহজ সরল হয়েও যদি অঙ্কে খারাপ নম্বর পেত, তার সারল্যকে তিনি একটা গুণ হিসেবে দেখতেন না, বড়ো করে দেখতেন তার ওই নম্বর কম পাওয়ার ব্যর্থতাকেই। অন্যদিকে কোনো ক্লাসের ফার্স্ট বয় স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর, হিংসুটে জেনেও তার মার্কশিট নিয়ে গর্বিত হতেন।
আসলে ছোটো থেকে এই সমাজের মধ্যে বেড়ে উঠতে গিয়ে তাঁরও মানসিকতা ওটাই হয়ে উঠেছিল। নিজের অজান্তেই ওই নম্বর সর্বস্ব সিস্টেমের অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
আর সেইজন্যই নিজের ছেলে রাজু পড়াশুনোয় ভালো, সে গোটা মানকড়ের মধ্যে সেরা ছেলে, এ আনন্দেই মাতোয়ারা ছিলেন তিনি। প্রতিবছর ভূরি ভূরি নম্বরসমেত উজ্জ্বল মার্কশিট নিয়ে বাড়ি ফিরত রাজু, আর যাদবচন্দ্রের ভেতরের সেই আনন্দ সূক্ষ্ম কিন্তু নিরন্তর গতিতে মনের মধ্যে চারিয়ে দিত অহংকারকে।
আমার ছেলে সবার সেরা, সেই অহমিকা বোধ নিয়েই যাদবচন্দ্র অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন। সেই সময়গুলোতে তাঁর মনে একবারও প্রশ্ন আসেনি, পড়াশুনোয় সেরা ভালো কথা, মানবিকতা বোধেও কি আমার ছেলে উৎকর্ষের উদাহরণ হতে পারে?
না, একবারের জন্যও ভাবেননি। ভেবেছেন ধাক্কা খাওয়ার পর।
সোমতীর্থ শুধুই এই এলাকার আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো যাদবচন্দ্রের স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র নয়, একসময় সে ছিল রাজুর অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ছোটোবেলা থেকে লেখাপড়াতেও একজন অন্যজনকে টক্কর দিত। কখনো রাজু ফার্স্ট হত তো সোমতীর্থ সেকেন্ড, কখনো সোমতীর্থ প্রথম তো রাজু দ্বিতীয়। দু-জনের ঘনিষ্ঠতার প্রভাব এসে পড়েছিল দুই পরিবারেও। সোমতীর্থ দিনের অনেকটা সময় কাটাত যাদবচন্দ্রের বাড়িতে, আবার রাজুও ওদের বাড়িতে প্রায়ই যেত।
সোমতীর্থর বাবা চাকরি করতেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে। প্রতিদিন সকালে মানকড় থেকে ট্রেন ধরে তিনি যেতেন দুর্গাপুর। সোমতীর্থের সঙ্গে রাজুর বন্ধুত্বর সুবাদে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হতে খুব বেশিদিন লাগেনি। সোমতীর্থর মা আর বোন সোমা-র সঙ্গে আরতির বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সোমতীর্থ আর রাজু একইসঙ্গে বর্ধমানে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভরতি হল, কিন্তু ততদিনে সোমতীর্থর পড়াশুনোয় বেশ কিছুটা অবনতি ঘটেছিল। এত বছরের শিক্ষকজীবনে যাদবচন্দ্র একটা বিষয় লক্ষ করেছেন, অনেক ছেলেমেয়ে ছোটোবেলায় লেখাপড়ায় খুব ভালো থাকে, অনেক সময় মাধ্যমিক পর্যন্তও খুব ভাল ফলাফল করে, কিন্তু তারপর যখন বিশেষ কোনো বিষয় নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার দিকে এগোয়, আস্তে আস্তে তাদের মেধার মান পড়তে থাকে। আবার উলটোটাও হয়। অনেক মধ্যমেধার ছাত্র বা ছাত্রী ছোটোবেলায় সাধারণ থাকলেও পরবর্তীকালে নিজের পছন্দসই বিষয় পেয়ে চোখধাঁধানো রেজাল্ট করে।
এইসবই ভারতীয় সমাজের সিস্টেমের কুফল। এখানে কিছু বাঁধাধরা মিথ রয়েছে, যার বাইরে ছাত্র, শিক্ষক বা অভিভাবক, কেউই বেরোতে পারে না। কেউ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করলেই তাকে সায়েন্স নিতে বাধ্য করা হয়। যেন ধরেই নেওয়া হয়, ভালো ফল করলে অন্য কিছু নিয়ে পড়ার কোনো গুরুত্বই নেই। এর ফলে যে ছেলেটা হয়তো ইতিহাস বা ইংরেজি নিয়ে পড়লে তার ভালোলাগাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত, তাকে ইচ্ছে না থাকলেও কষতে হয় ক্যালকুলাসের দুরূহ অঙ্ক, বুঝতে হয় ফিজিক্সের লাপ্লাস থিয়োরি। যেখানে প্যাশন নেই, সেখানে উৎকর্ষতা কমবেই।
ফলত, পরবর্তীকালে যে ছেলেটা দেশের অন্যতম সফল ইতিহাসবিদ বা ইংরেজির পণ্ডিত হতে পারত, তাকে মধ্যমেধার সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট হয়েই থেকে যেতে হয়।
এই গোটা ব্যাপারটা সোমতীর্থ আর রাজুর মধ্য দিয়ে খুব ভালো করে উপলব্ধি করেছেন যাদবচন্দ্র। সোমতীর্থ ছেলেটা পড়াশুনোয় ভালো ছিল, কিন্তু তার চেয়েও ওর বেশি খ্যাতি ছিল আঁকায়। ছোটো থেকে ও এত সুন্দর আঁকত, নরনারীর দেহের প্রতিটি ভাঁজ যেভাবে নিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলত খাতার পাতায়, খরস্রোতা নদীর প্রচণ্ড আস্ফালন যেভাবে কথা বলত ওর হাতের তুলিতে, তা দেখে মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। অথচ ও কোনোদিনই কারুর কাছে আঁকা শেখেনি।
মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করলেও উচ্চমাধ্যমিকে সোমতীর্থের রেজাল্ট একটু হলেও খারাপ হল। অন্যদিকে রাজুর রেজাল্ট আরও ভালো হয়েছিল। উচ্চমাধ্যমিক স্তরেই সোমতীর্থের বিজ্ঞান শাখার প্রতি অনীহা আস্তে আস্তে জন্ম নিচ্ছিল, ওদিকে রাজুর সেদিকে আকর্ষণ বাড়ছিল।
উচ্চমাধ্যমিকের পর সোমতীর্থ ঠিক করল আঁকা নিয়ে পড়বে। কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে ভরতির শর্তাবলি জেনে ফর্মও জোগাড় করে নিয়ে এল। রাজুও গিয়েছিল ওর সঙ্গে।
কিন্তু বাদ সাধলেন ওর বাবা। যে ছেলে ছোটো থেকে স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হয়, সে আর কিছু নিয়ে না পড়ে শেষে আঁকা নিয়ে পড়বে তা উনি কল্পনাও করতে পারছিলেন না।
তারপর যা হয়। বাড়িতে তখন নিত্যদিন অশান্তি, অভিযোগ। তখন প্রায়ই সোমতীর্থ চলে আসত যাদবচন্দ্রদের বাড়িতে। এসে মনখারাপ করে বসে থাকত। আরতি দুই বন্ধুকে একসঙ্গে ভাত বেড়ে দিতেন। সোমতীর্থ মুখ কালো করে আরতিকে বলত, ‘তুমি একটু মাকে বোঝাও না, কাকিমা। মা তাহলে বাবাকে রাজি করাবে। আমার একটুও ইচ্ছে নেই ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ার। আর্ট নিয়ে পড়ে কত শিল্পী কি বিখ্যাত হননি? তাঁদের কি মানুষ চেনেন না?’
সোমতীর্থ আরতিকে তুমি করে বলত, কিন্তু যাদবচন্দ্রকে আপনি বলেই ডাকত। তাঁর সঙ্গে অত সাবলীলও ও ছিল না, যতটা ছিল ওর আরতি কাকিমার সঙ্গে।
তবু একদিন শুনতে পেয়ে যাদবচন্দ্র বলেছিলেন, ‘বিখ্যাত হয়ে কী হবে সোম? কত আর্টিস্ট দেখিস না বিখ্যাত হয়েও কত কষ্টের মধ্যে জীবন কাটান? তোর বাবা তো ঠিকই বলছেন! জয়েন্ট তো দুই বন্ধুতেই দিলি না, এবার ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনে ভরতি হ। তারপর মাস্টার্স করে ভালো চাকরি জোটা। এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই!’
সোমতীর্থ একা আর সকলের সঙ্গে যুঝতে পারেনি। রাজুর সঙ্গে গিয়ে ভরতি হয়েছিল বর্ধমানের একটা কলেজে, কেমিস্ট্রি নিয়ে। পড়াশুনোর সুবিধার জন্য কলেজের দ্বিতীয় বছর থেকেই দুজনে একটা ঘর নিয়ে থাকত বর্ধমানে।
কিন্তু মন থেকে সায় না থাকলে যা হয়। রাজু যেখানে বি এসসি-তে দুর্দান্ত রেজাল্ট করল, সেখানে সোমতীর্থ অনার্সটুকুও রাখতে পারল না। তারপর রাজু ভরতি হল এম এসসি-তে, সোমতীর্থ চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
ততদিনে দুই বন্ধুর মধ্যে অনেক দূরত্ব এসে গিয়েছে। রাজু তার নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে খুঁজে নিয়েছে নতুন বন্ধুদের, সোমতীর্থও কিছুটা হীনম্মন্যতায়, কিছুটা রাজুর দিক থেকে অনিচ্ছাতে আলাদা থাকতে শুরু করেছে।
কিন্তু এই দূরত্বের আঁচ তখন সেভাবে মানকড়ের দুটো পরিবারে এসে পৌঁছোয়নি। রাজু যে বছর এম এসসি পড়তে পড়তেই প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়ে গেল, সেই বছরে একরকম নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা বলে সোমতীর্থর বোন সোমার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে ফেলেছিলেন ওদের বাবা আর যাদবচন্দ্র।
আরতি একবার মিনমিন করেছিলেন, ‘একবার রাজুর সঙ্গে কথা বলে নিলে হত না? ও ছুটিতে বাড়ি আসুক, তারপর না হয় …!’
সোমতীর্থ আর সোমার মা তখন আরতিকে নিয়ে আড়ালে বলেছিলেন, ‘আপনাকে ছেলে হয়তো লজ্জায় বলেনি দিদি, সোমা তো বর্ধমানে পড়তে যেত, তখন দুজনে সিনেমা-টিনেমা দেখতে যেত। মেয়ে আমাকে বলেছে।’
এরপর আর কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না। গ্রামগঞ্জে ভালোবাসার বিয়ে অতটা প্রচলিত না হলেও আরতি যাদবচন্দ্র স্বস্তিত নিশ্বাস ফেলেছিলেন। যাক! সোমা মেয়েটা সত্যিই ভালো।
কিন্তু এক বছর আগের বর্ধমানে থাকা রাজু আর এম এসসি-তে চোখধাঁধানো রেজাল্ট করে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া রাজুর মধ্যে যে আকাশ পাতাল পার্থক্য তা ওঁরা কেউই বুঝতে পারেননি।
ফলে যা হওয়ার তাই হল। রাজু এসে সব শুনে প্রথমে মৃদু আপত্তি করল, তারপর পরিস্থিতি একেবারেই প্রতিকূল বুঝে সোজাসুজি বেঁকে বসল।
আরতি কিছুই বুঝতে না পেরে বলেছিলেন, ‘কিন্তু তুই তো সোমাকে পছন্দ করিস! দুজনে বর্ধমানে ঘুরতিসও নাকি …!’
‘মানুষের পছন্দ পালটায় মা!’ রাজু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘কারুর সঙ্গে কোথাও যাওয়া মানেই কি তাকে বিয়ে করতে হবে? সোমার তেমন কিছু কোয়ালিটি আছে? ওই তো পাতি একটা স্কুলে পড়ায়। আর আমার এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। আমার লক্ষ্য অন্য।’
রাজুর লক্ষ্য কী, আরতি আর যাদবচন্দ্র সেদিন কিছুই বোঝেননি। তারপর থেকে যখন রাজু ক্রমশ বাড়ি আসা কমিয়ে দিচ্ছিল, তখন সেটাকে ছেলের ব্যস্ততা ভেবে ভুল করেছেন।
তার বছরখানেক পর যেদিন রাজু ডক্টরেট করতে প্যারিস চলে গেল, যাওয়ার আগে সে ব্যস্ততার জন্য একবারও মানকড়ে দেখা করে যাওয়ার সময় পেল না, সেদিনও কষ্ট হলেও অন্য কিছু ভাবেননি তাঁরা।
রাজুর দৃঢ় আপত্তিতে সোমার সঙ্গে সম্বন্ধটা ভেঙে যাওয়ায় সোমার বাবা মা কড়া ব্যবহার না করলেও স্বাভাবিক কারণেই তারপর দু-বাড়ির মধ্যে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু তবু যাদবচন্দ্র ছেলের ওপর রাগ করেননি। বরং রাজু বিদেশ চলে যাওয়ার পর আরতি নীরবে চোখের জল ফেললে তিনি তিরস্কারই করেছেন, ‘এ কী! ছোটো থেকে ছেলে যখন ভালো রেজাল্ট করত, তখন বুক ফুলিয়ে সবার কাছে বলতে, তাকে আরও ভালো রেজাল্ট করতে উৎসাহ দিতে, এখন সে এত পড়াশুনো করে কি এই মানকড়ে পড়ে থাকবে? তাকে তার মতো করে বাঁচতে দিতে হবে না?’
‘আমার তো ওই একটাই ছেলে বলো!’
আরতির কথায় আরো রেগে যেতেন যাদবচন্দ্র, ‘তো কী? বাঙালি মায়েদের এই আঁচলের তলায় ছেলেকে রেখে দেওয়ার মানসিকতার জন্যই অর্ধেক বাঙালি কিছু করে উঠতে পারল না। শোনো, জীবনটা ওর। ওকে ওর মতো করে বাঁচতে দাও। প্যারিসের মতো শহরের শতাব্দীপ্রাচীন ইউনিভার্সিটিতে ও ডক্টরেট করার সুযোগ পেয়েছে, এ কি কম গর্বের কথা?’ কথাটা বলে নিজের মনেই ভেবেছেন যাদবচন্দ্র, টাকাপয়সা তো কিছুই চাইল না ছেলে! পুরোটাই কি স্কলারশিপ পেয়েছে? ভাবামাত্র ছেলের জন্য গর্বে বুক ফুলে উঠত তাঁর।
কিন্তু মানুষ নিজের মনে ভাবে এক, আর বাস্তবে ঘটনা ঘটে আরেক!
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে নিজের ছোট্ট একতলা বাড়ির গেটটা হাত দিয়ে খুলে ভেতরে ঢোকেন যাদবচন্দ্র।
১৩
কথা কও, কথা কও,
অনাদি অতীত, অনন্ত রাতে
কেন বসে চেয়ে রও?
কথা কও, কথা কও।
ঋতুপর্ণা আজকাল প্রায়ই মাঝরাত পর্যন্ত জেগে থাকে। দূরে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর ওপর আলোকবিন্দুর মতো গাড়ি যাওয়া আসা করে। গঙ্গা দিয়ে মধ্যরাতে স্টিমার ভেসে যায়। দূরের কোনো চটকলে সাইরেন বাজে একনাগাড়ে। দামাল হাওয়ায় ঘাটের পাড়ে নদীর জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কত গল্প করে। ঋতুপর্ণা সব শুনতে পায়।
ইমরান সারাদিনের ক্লান্তির শেষে বিছানায় পড়লেই ঘুমে ডুবে যায়। কিন্তু ঋতুপর্ণার ঘুম আসে না। ও জানলায় গিয়ে বসে থাকে। কী যে ভাবে বসে বসে, ও-ই জানে। রাত দুটো আড়াইটে বেজে যায়, ও বসেই থাকে।
ইমরানের কখনো কখনো ঘুম ভেঙে যায়। ও উঠে আসে, বলে, ‘কী ব্যাপার, ঘুমোওনি কেন?’
ঋতুপর্ণা উত্তর দেয় না। একভাবে তাকিয়ে থাকে দূরের গঙ্গার দিকে। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর একেবারে কাছে হাওড়ার দিকে গঙ্গার ধারে শিবপুরে ওদের এই ফ্ল্যাট। দক্ষিণ খোলা, সারাদিন চমৎকার আলো বাতাস আসে।
ঋতুপর্ণা বসে বসে ভাবে, কোথায় সেই হিন্দমোটরের ঘুপচি বাড়ি, নোনা ধরা দেওয়াল, আর কোথায় এই হাইরাইজের মাখন মসৃণ দেওয়াল।
আর এই চিন্তা আসার সঙ্গে সঙ্গে সুখী হওয়ার বদলে কী-একটা পোকা যেন কামড়ায় ওকে। ঋতুপর্ণা পোকাটাকে চেনে। অনুতাপে জর্জরিত করে দেওয়ার পোকা সেটা।
বিছানার নরম গদিতে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে দিতেও যে পোকা ওর কানের কাছে উড়তে থাকে, ‘কেমন মেয়ে তুমি? বাপ-মায়ের বিছানাটা মনে পড়ে একবারও? বাবার কারখানা বন্ধ হওয়ার পরে পাওয়া থোক টাকাটা যেন কী কাজে লেগেছিল? মনে আছে? নাকি ভালোবাসায় মজে সেটাও ভুলেছ!’
ঋতুপর্ণা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘ভুলব কেন। ভুলিনি বলেই তো বারবার ছুটে গিয়েছি, ক্ষমা চেয়েছি। তাঁরা আমাকে ফিরিয়ে দিলে আমি কী করব!’
‘ব্যস তবে তো মিটেই গেল। আর তোমার আদরের ছোটু? সে কী দোষ করল?’ পোকাটা মাছির মতো ভনভন করতে থাকে, ‘তাঁর খোঁজ একবারও নিতে মন চায়?’
ঋতুপর্ণার চোখ জলে ভিজে যায়।
পোকাটার ব্যঙ্গাত্মক হাসিতে ঋতুপর্ণার চারপাশ ভরে যায়। মনে হয় সেই পোকাটা থেকে জন্ম নিচ্ছে আরও একটা পোকা। আরও দুটো পোকা। আস্তে আস্তে গোটা ঘরটাই পোকায় ভরে যায়। ওরা সবাই কিলবিল করতে থাকে ওর চারপাশে।
আতঙ্কে ঋতুপর্ণার দমবন্ধ হয়ে আসে। কোথাও একটু নিশ্বাস নেওয়ার তাগিদে ও মুখ ফেরায় গঙ্গার দিকে। কিন্তু সেখান থেকেও অজস্র অদৃশ্য অশরীরী যেন ওর দিকে আঙুল তোলে আর বিদ্রূপের হাসিতে নিজেদের মধ্যে ফেটে পড়ে।
‘বাবা-মা আমাকে বলেছিলেন, ছোটুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে ওর বিয়ে হবে না। আমি যদি ওর ভালো চাই, একম যেন যোগাযোগ না রাখি।’ ঋতুপর্ণা ধরা গলায় বলে।
পোকাগুলো যেন ওর কথা শুনতেই পায় না। ঋতুপর্ণা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে ওর অসহায়তার কথা।
কিন্তু আর কোনো লাভ হয়না। নদী থেকে অক্টোপাসের মতো কিলবিল করতে করতে উঠে আসা অশরীরীগুলো কিংবা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা পোকাগুলো নিজেদের মধ্যে ওকে নিয়ে মশকরায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
ঋতুপর্ণা চিৎকার করতে করতে একসময় হাঁপিয়ে যায়।
ইমরান এসে বলে, ‘এভাবে প্রায়ই রাত জাগলে কিন্তু তোমার শরীরের বারোটা বেজে যাবে, ঋতু। একেই সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি, রাতের ঘুমটা তো ঠিকঠাক হতে হবে, নাকি?’
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ঋতুপর্ণার তখন আর ওঠার শক্তিও থাকে না, টলতে টলতে গিয়ে নিজেকে ছেড়ে দেয় বিছানায়।
এভাবেই একটা করে দিন কেটে যায়।
অথচ প্রথম যখন বাড়ির সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়ে ইমরানের সঙ্গে সে উঠেছিল এই ফ্ল্যাটে, তখনও ওর অবসাদ এতটা তীব্র হয়ে ওঠেনি। আসলে, তখনও ও উপলব্ধি করতে পারেনি যে সত্যি সত্যিই সারাজীবনের জন্য বাড়ির সঙ্গে ওর যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল।
ভেবেছিল বাবা-মা-র রাগ সাময়িক। সমাজের মুখ চেয়ে তাঁরা মুখ ফিরিয়েছেন আদরের বড়োমেয়ের থেকে। সময় সব ভুলিয়ে দেয়। সব আঘাত সারিয়ে দেয়। কিছুদিন কেটে গেলে ঠিক আবার আদর করে নিজেদের কাছে টেনে নেবেন তাঁরা।
কিন্তু ও ভুল ভেবেছিল। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত সেরে যায় ঠিকই, কিন্তু কিছু ক্ষত এতটাই গভীর হয় যে তার দাগটা রয়ে যায় সারাজীবন।
বাবা-মা-র ক্ষেত্রেও হয়ত সেটাই হয়েছে; যে কারণে ইমরানকে প্রকাশ্যে পাড়ার লোকজনের সামনে বিশ্রী অপমান করতেও দ্বিধা করেননি তাঁরা।
না, ইমরান এই নিয়ে কখনোই কিছু বলেনি ওকে। কিন্তু ও নিজেই তারপর থেকে অনেক গুটিয়ে গিয়েছে। বুঝে গিয়েছে ওর জীবনে বাবা-মা-ছোটু আর ইমরান হল সম্পূর্ণ দুটো বিপরীত মেরু। কোনো কিছুর পরিবর্তেই তাঁদের মেলানো যাবে না।
অফিসেও ভীষণ চাপ। ঋতুপর্ণাকে এখন একসঙ্গে দুটো প্রোজেক্ট দেখতে হচ্ছে, প্রায় বারো ঘণ্টা অফিসে কাটিয়েও ঠিক সময়ে ক্লায়েন্টকে ডেলিভারি দিতে পারছে না।
তার ওপর শুরু হয়েছে নতুন এক উটকো বিপদ। ঋতুপর্ণার ম্যানেজার বিরূপাক্ষদা আর কলিগ রূপার মধ্যে ইদানীং একটু বেশিই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে। বিরূপাক্ষদা রোজ রূপাকে গাড়িতে লিফট দিচ্ছে, টিফিনের সময় নিজের কিউবিকলে ডেকে নিচ্ছে রূপাকে। রূপাও নিজের স্বামীকে পাত্তা না দিয়ে সপ্তাহান্তে বিরূপাক্ষদা-র সঙ্গে হরদম বেরিয়ে পড়ছে লং ড্রাইভে।
তা বেরোক। যে যার সঙ্গে বেরোক, তাতে ঋতুপর্ণার কী! কিন্তু এই নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে ভুগতে হচ্ছে ওকে। ওদের ছোটো টিম, বিরূপাক্ষদা, রূপা আর ও। এর ফলে যেটা হচ্ছে সেটা হল, সারাদিন কাজ করে মরছে ঋতুপর্ণা, আর সারাদিন রঙ্গরসিকতা করে দিনের শেষে বিরূপাক্ষদা-র কাছে ক্রেডিট নিচ্ছে রূপা। ঋতুপর্ণা মাথা খাটিয়ে যত ভালোভাবেই ডেলিভারি দিক না কেন, অনসাইটে ক্লায়েন্টের কাছে সেই কাজের জন্য নাম হচ্ছে রূপারই।
মধ্যরাতে এইসব ভাবতে ভাবতে ঋতুপর্ণা ফোনের নোটিফিকেশনের আওয়াজে চমকে ওঠে। দেখে, জিনিয়া মেসেজ করেছে।
—ঘুমোচ্ছিস?
ও একটু চুপ করে থেকে উত্তর দেয়,
—না! এমনিই বসে আছি। ভাবছি।
—ওই ভেবে ভেবেই তুই গেলি। সারাদিন কী যে এত ভাবিস, তুই-ই জানিস! আচ্ছা শোন, আমার জন্য তো এত করলি। ইমরানদাকে বলে ওর চাচার গ্যারাজটা জোগাড় করে দিলি এত সস্তায়। আমার আরেকটা উপকার করবি?
—কী?
—আমাকে প্রথম ট্রিপের জন্য ক-টা কাস্টমার জোগাড় করে দে না ইমরানদাকে বলে। খুব ভালো হয় তাহলে।
—আচ্ছা, কথা বলে দেখি।
—অতন্দ্র বলেছে, ওকে ছাড়া আমি নাকি কিছু করতে পারব না। আমি ওকে দেখিয়ে দিতে চাই ঋতুপর্ণা। যে ওকে ছাড়াও দাশগুপ্ত ট্রাভেলস চলতে পারে।
অন্যসময় হলে ঋতুপর্ণা জিনিয়াকে বোঝাত। বলতো, নিজেদের মধ্যে এইসব নিয়ে ঝামেলা করে কোনো লাভ নেই। রাগের মাথায় দু-জনেই আজেবাজে বলে। সেগুলোকে অত ধরলে হয় না। কিন্তু এখন আর বলতে ইচ্ছে হল না। জিনিয়া এখন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। নিজের ব্যবসাটাকে দাঁড় করাবার ঘোর। অতন্দ্রর সঙ্গে বিচ্ছেদের জন্য সেই ঘোর জেদের পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
যাক। এতে ওরই ভালো হবে হয়তো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঋতুপর্ণা সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর প্রিয় পেজটা খোলে। পেজটার নাম চিত্রকর। সেখানে প্রায়দিন অসম্ভব সুন্দর সব পোর্ট্রেইট আপলোড করা হয়। দেখলেই বোঝা যায়, কোনো সুনিপুণ শিল্পী নিজের তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছে সেই পোর্ট্রেইটগুলোকে। শিল্পীর দক্ষতায় প্রতিটা পোর্ট্রেইট যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। মুখের বলিরেখা থেকে শুরু করে হাওয়ায় উড়ন্ত চুলের গোছা, সবই যেন সুস্পষ্টভাবে ধরা দেয় এই পোর্ট্রেইটগুলোয়।
অথচ এই পেজের মালিক কে, চিত্রশিল্পীই বা কে, তার কোনো পরিচয় থাকে না।
ঋতুপর্ণা ভারি আগ্রহ নিয়ে দেখে। কোনো বিখ্যাত মানুষজন নয়, নানা অজানা অচেনা মানুষের পোর্ট্রেইট দেখার অদম্য আকর্ষণ পেয়ে বসে ওকে।
আর এভাবেই রাত কেটে যায়। জীবন থেকে মুছে যায় একটা দিন।
১৪
জিনিয়া এমন মগ্ন হয়ে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল, যে অম্বিকেশ কখন বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে গ্যারাজের দিকে এগিয়ে আসছেন, ও খেয়ালই করেনি।
একেবারে কাছাকাছি এসে পড়তে ওর নজর পড়ল সেদিকে, ‘আরে ফুলুমামা তুমি! একটু আগে ফোন করলাম তখন তো বললে যে আজ আসার সময় হবে না। তারপর চলে এলে?’
অম্বিকেশ ঘরের একমাত্র টেবিলের ওপর ল্যাপটপের পাশে কোনোমতে ব্যাগটাকে রেখে পাশের বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। সত্যিই তাঁর আজ আসার ইচ্ছে ছিল না। শরীরটা ভালো নেই তেমন। কিন্তু বুড়িদি এতবার করে ফোন করছে যে বাধ্য হয়ে এই সল্টলেকে ছুটে আসতে হল তাঁকে।
অম্বিকেশ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘জল আছে তোর কাছে?’
‘হ্যাঁ, আছে তো।’ জিনিয়া ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এগিয়ে দিল, ‘শরীর খারাপ লাগছে নাকি? এই রোদে, গরমে কেন আসতে গেলে বলো তো? এলেই যখন সকাল সকাল আসতে পারতে, রোদটা এত কড়া হত না।’
‘ও ঠিক আছে।’ অম্বিকেশ এক নিশ্বাসে অনেকটা জল ঢকঢক করে গলায় ঢাললেন, তারপর রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে চারপাশে একঝলক চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘তারপর? কতদূর কী এগোল?’
‘এই তো। যেক-টা অতন্দ্র জোগাড় করেছিল, আপাতত ওই ক-জনই আছে। জিনিয়া ল্যাপটপের দিকে তাকাল, ‘নেতাজি ইনডোরের মেলায় মোট সতেরোটা ক্লায়েন্টের নম্বর জোগাড় করেছিলাম …।’
অম্বিকেশ চমকে উঠে বললেন, ‘সতেরোটা? মাত্র? এত টাকা ইনভেস্ট করে, একটা লোক রেখে তুই মাত্র সতেরোটা কনট্যাক্ট পেলি? সেখানে আমাদের গ্লোবাল ট্যুরস ছ-শোর ওপর কনট্যাক্ট এনেছে।’
‘কীসে আর কীসে তুলনা!’ জিনিয়ার মুখটা তোম্বা হয়ে গেল, ‘তোমার ওই গ্লোবাল টুরসের জন্যই তো আমি আরও মার খেলাম, ফুলুমামা। এমনিই আমাকে একটা ঘুপচি মতো স্টল দিয়েছিল, তাও পজিশনটা এমন বিশ্রী, দু-দিকে দুটো দৈত্যের মাঝখানে একটা খুপড়ি মতো জায়গায়। একপাশে গ্লোবাল টুরস, অন্যপাশে হ্যাপি ট্রাভেল। দুটোই হেভিওয়েট। আর দুটোই সারাক্ষণ কোনো না -কোনো কনটেস্ট করে চলেছে। লোকজনের ভিড় উপচে পড়ছে। সঙ্গে ফ্রি কুপন, ফ্ল্যাশ সেল এসব তো আছেই।’
‘তুই যদি এখন ইচ্ছে করে ইন্টারন্যাশনাল প্যাভলিয়নে স্টল নিস, তাহলে তো এইসব জায়েন্টদের সঙ্গেই তোকে কমপিট করতে হবে। তাও তো আমার সোর্স ছিল বলে ওই পজিশনে পেয়েছিস। নাহলে এক কোণে ঠেলে দিত।’ অম্বিকেশ হাত নাড়ালেন, ‘তোকে প্রথম থেকে যা যা বলে আসছি, তুই কি তার একটাও শুনছিস? যারা নতুন এজেন্সি খোলে তারা স্টল নেয় ডোমেস্টিকে, সেখানে ছোটোদের জন্য আলাদা সেগমেন্ট থাকে। অনেকটা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের মতো। প্রথমে তোর উচিত ছিল ছোটোখাটো টুর করানো, সাতদিনের দার্জিলিং-গ্যাংটক, তিনদিনে বৃন্দাবন, সাতদিনে দিল্লি-আগ্রা এইসব। তাতে তোর এখনকার পুঁজির পাঁচ ভাগের এক ভাগ লাগত। তারপর লোকের মুখে ছড়াতে ছড়াতে টুর বাড়ত, প্রফিটও হত, সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিও বাড়ত। কিন্তু তুই তো তা শুনলি না। প্রথমেই তোর বড়োসড়ো টুর চাই। লোনে লোনে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিস, নিজেদের অ্যাসেট বলতে ছিল ওই একটা ফ্ল্যাট, সেটাকেও মর্টগেজ দিলি, এরপর যদি কাস্টমার না পাস, বা টাকা না ওঠে, কী করবি ভেবে দেখেছিস?’
জিনিয়া নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ারে হেলান দিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে ঘরের ওপরের সিলিংটা দেখতে লাগল ও।
অবশ্য, এই তো একচিলতে দশ বাই বারো ফুটের গ্যারাজ, তাকিয়ে দেখার আছেটাই বা কী! গোটা ঘরটায় একটা প্লাস্টিকের বড়ো টেবিল, চার-পাঁচটা চেয়ার আর সব কাগজপত্র রাখার একটা আলমারি। আর মেঝেতে এদিক সেদিক নানা লিফলেট, হ্যান্ডবিল আর ব্যানারের রোল রাখা।
গোটা ঘরটাই গ্যারাজের নিয়ম মেনে অসম্ভব গরম আর বদ্ধ।
আগে হলে এই ধরনের ঘরে বৈশাখ মাসের এই প্রচণ্ড গরমে পাঁচ মিনিট বসে থাকতে গেলে জিনিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসত, দু-মিনিট অন্তর বাথরুমে গিয়ে ঘাড়ে-মুখে জল দিত।
কিন্তু এখন কিছু করার নেই। যে স্বপ্ন নিয়ে ও নেমেছে, তাতে এইসব বাহ্যিক সমস্যায় পিছিয়ে গেলে চলবে না। একেই ব্যক্তিগত টানাপোড়েনে ভেতরে ভেতরে ও দগ্ধে মরছে, তার ওপর এখন এতদূর এসে আর পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা ওর আর নেই।
কিন্তু ও দাঁতে দাঁত চেপে এই প্রতিকূল অবস্থায় কাজ করলেও কোনো কাস্টমার কি অফিসের এই অবস্থা দেখে টুরে যেতে রাজি হবে?
এই যুক্তিটা প্রথম দিন এই গ্যারাজ দেখতে এসেই অতন্দ্র দিয়েছিল ওকে।
‘এটা কী!’ ঋতুপর্ণার স্বামী ইমরানদা চাবি খুলে দিয়ে চলে যাওয়ার পরই চোখ গোল গোল করে বলেছিল অতন্দ্র।
জিনিয়া ঘুরে ঘুরে ঘরের চারপাশ দেখছিল, যদিও একটা আয়তাকার লম্বাটে ফাঁকা ঘরে কী দেখার আছে ও বুঝে উঠতে পারছিল না। অতন্দ্রর কথা শুনে বলল, ‘বললাম তো! ইমরানদার কাকা বিদেশে থাকেন, ওপরে তিনতলায় ওঁর ফ্ল্যাট আর এই গ্যারাজ ভাড়া দেওয়া, দেখভাল করার দায়িত্ব ইমরানদার। আমি অফিসঘর খুঁজছি শুনে ঋতুপর্ণা বলল, খুব কম টাকায় এটা দিতে পারে …।’
‘এটা অফিসঘর!’ অতন্দ্র যেন তখন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না, ‘মানে, তুমি বলতে চাইছ, এটা হবে দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের অফিসঘর? সল্টলেকে পাড়ার মধ্যে এই আদ্যিকালের শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের কো-অপারেটিভ হাউজিং এর বোঁটকা গন্ধওয়ালা গ্যারাজে? এখানে তোমার কাস্টমাররা এসে আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ইউরোপের প্যাকেজ বুক করবে?’
জিনিয়া আমতা আমতা করে বলেছিল, ‘তা কী করব তুমিই বলো? পার্ক স্ট্রিট বা ওয়েলিংটনের দিকে তো ছেড়েই দাও, কৈখালি বা বাগুইআটির দিকেও তো ভাড়া দেখলে। যত লোন নিতে হয়েছে, তার দ্বিগুণ লোন করতে হবে তাহলে।’
‘দ্বিগুণ কেন তিনগুণ লোন করলে তবু সেটা কাজে দেবে, এখানে তো পুরো টাকাটাই নষ্ট! এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি বিজনেস করবে? আর তোমার এই বুদ্ধির ওপর ভরসা করে আমরা দুজনে চাকরি ছাড়ছি?’ অতন্দ্র আঙুল নাচিয়ে বলেছিল, ‘কাস্টমাররা একবার এলে তো বাপ বাপ বলে পালাবেই, সঙ্গে তোমার নামে মামলা ঠুকে দিতে পারে, এই বদ্ধ ঘরে তুমি তাদের দম আটকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিলে বলে।’
সেদিনের কথা মনে পড়ে যেতে অদ্ভুতভাবে সব ভুলে কেমন হাসি পেয়ে গেল জিনিয়ার, সিলিং থেকে দ্রুত ও চোখ নামিয়ে আনল।
না, অতন্দ্রর নিষেধ শোনার ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না জিনিয়ার। কোম্পানির জন্য খুব তাড়াতাড়ি একটা অফিসঘরের প্রয়োজন ছিল, আর এটা ছাড়া আর কিছু নেওয়ার সামর্থ্য ওর ছিল না।
তাই এক মাস আগে গ্যারাজের সামনে দাশগুপ্ত ট্রাভেলস নামের বেশ বড়ো সাইনবোর্ডটা লাগিয়ে অফিসটা খুলেই ফেলেছিল ও। তখন সবে গীতিকাকে নিয়ে ওদের খুচখাচ অশান্তি শুরু হচ্ছে। সব কিছু তখন তছনছ হয়ে যায়নি।
অতন্দ্র গোমড়া মুখে গাঁদা ফুলের মালা দিয়ে সাইনবোর্ডটা সাজানো, দরজার সামনে নারকেল ফাটানোর বন্দোবস্ত করা, সবই করেছিল গজগজ করতে করতে। ফুলুমামা, বাবা, মা-ও সেদিন এসেছিলেন, সবাইকে গিয়ে গিয়ে বলছিল জিনিয়ার নির্বুদ্ধিতার কথা।
তারপর তো কোথা থেকে কী হয়ে গেল। এক মাস আগে অতন্দ্র ছিল ওর লাইফ পার্টনার, আবার বিজনেস পার্টনারও, এখন কোনোটাই নয়। এক মাস সময় মনে হয় কতটা কম, অথচ এই অল্প সময়ে কত কী হয়ে যেতে পারে।
অম্বিকেশ এবার জোর গলায় বলে উঠলেন, ‘তুই যখন আমার কোনো কথাকে গুরুত্বই দিবি না, তবে আমাকে এসবের মধ্যে জড়ালি কেন! আমি আমার নিজের কোম্পানিই-বা ছাড়লাম কেন! স্পষ্ট বলেই দে, এই বুড়োকে তোর দরকার নেই।’
জিনিয়া করুণ মুখে ফুলুমামার দিকে তাকাল। কাছের মানুষগুলোও যখন ওকে বুঝতে চায় না, তখন জিনিয়ার ভীষণ অসহায় লাগে। এমনিতেই ওর মনের মধ্যে সারাক্ষণ ঝড় বইছে, সেই ঝড়ের প্রাবল্য যে কতটা তা ওর নিজেরও মাপার ক্ষমতা নেই। অন্য কেউ হলে হয়তো বিবাহবিচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়ে এখন দিনরাত কেঁদে ভাসাত, কিংবা রাগে দুঃখে কাছের লোকেদের উৎপাত করত। তার ওপর বাড়িতে বাবা-মাও ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছে দু-জনের মধ্যে কী হয়েছে জানার জন্য। বাবা-মা-র পরেই যে মানুষটা সবচেয়ে কাছের, যার কাছে ছোটো থেকে নিঃশর্ত ভালোবাসা পেয়ে এসেছে, তিনিও যদি ওকে ভুল বুঝতে শুরু করেন, কী করবে জিনিয়া? কোথায় যাবে?
ও তবু অম্বিকেশের অভিমানের কথাগুলো গায়ে মাখল না, ভাঙা গলায় বলল, ‘ফুলুমামা, তোমাকে তো আগেও বলেছি, দার্জিলিং পুরী দিঘা নিয়ে যাব বলে আমি টুর কোম্পানি খুলছি না। ওরকম এজেন্সি তো হাজার একটা রয়েছে। তারা অনেক সস্তায় ঘোরায়, নিজস্ব রাঁধুনি নিয়ে যায়, হলিডে হোমে ওঠায়। তাদের সঙ্গে আমি পারব কেন?’
অম্বিকেশ তীক্ষ্ন চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘ওই পুঁচকে এজেন্সিগুলোর সঙ্গে তুই পারবি না, আর আমাদের গ্লোবাল টুরসের সঙ্গে তুই বিদেশ ঘোরানোর কম্পিটিশনে পারবি বুঝি? ইঁদুরকে ভয় পাচ্ছিস আর এদিকে হাতির সঙ্গে লড়তে যেতে চাইছিস।’
জিনিয়া বলল, ‘গ্লোবাল টুরস এখন আর তোমার নয় ফুলুমামা, তুমি এখন দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের, সেটা ভুলে যেয়ো না। আর আমি হাতির সঙ্গে লড়তে যেতে চাইছি কারণ সেটা আমার ভালোলাগার জায়গা। আমি বাঙালিকে সাধ্যের মধ্যে দুনিয়া ঘোরাতে চাই। আর হতে পারে নেতাজি ইনডোরের মেলায় আমার কিচ্ছু লাভ হয়নি, কিন্তু আমি বড়ো বড়ো এজেন্সিগুলোর ক্যাম্পেইন, প্রোমোশনগুলো খুব কাছ থেকে অবজার্ভ করেছি, ওদের অনেক সেলসের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথাও বলেছি। সব কিছু দেখেশুনে বুঝেছি, ওরা সবাই একইরকম স্ট্র্যাটেজি ব্যবহার করছে কাস্টমার টানার জন্য। তাতে লাভ কারুরই হচ্ছেনা, কাস্টমার নিজের মতো করে কোনো একটা এজেন্সি পছন্দ করছে কিংবা পরিচিত কারুর কথা শুনে। আগের যে কয়েকজনকে অতন্দ্র এনেছে, তাঁদের ছাড়াও নতুনদের জন্য খবরের কাগজে আমি বিজ্ঞাপন দিয়েছি এই সপ্তাহে, রেসপন্স আসতে শুরু করলে তাঁদেরকে বোঝানোর সময় আমি সম্পূর্ণ অন্য দিক দিয়ে এগোব ঠিক করেছি।’
‘কীরকম?’ অম্বিকেশ এবার কিছুটা শান্ত হয়ে জানতে চাইলেন।
মুখে যতই হম্বিতম্বি করুন, তাঁর এই ভাগনিটিকে তিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এর এক কথায় নিজের অত বড়ো দীর্ঘদিনের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন অম্বিকেশ। জিনি ঝাঁপ দিতে চলেছে এক বিরাট কর্মযজ্ঞে, তিনি ভীষ্মের মতো পেছন থেকে তাকে সাহায্য করবেন, সেইজন্য।
আর ছোটো থেকে জিনি তাঁকে এতভাবে গর্বিত করেছে, যে তিনি এখন ভাবতেই পারেন না যে জিনি কোনো ব্যাপারে ব্যর্থ হতে পারে।
নিজের রক্তের বলতে এই পৃথিবীতে অম্বিকেশের এখন আর কেউ নেই, সেই প্রয়োজন তিনি অনুভব করেন না। করবেনও না, যতদিন বুড়িদি আর জিনি থাকবে। তাই জিনির দুঃখ তিনি দেখতে পারেন না। যতদিন দেহে প্রাণ থাকবে, নিজের সবটুকু দিয়ে তিনি তাঁর ভাগনিকে আগলে রাখবেন।
‘দেখো।’ জিনিয়া এবার ল্যাপটপে একটা পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন খুলল, ‘আমি টুর এজেন্সি খুলতে যাচ্ছি শুনে প্রথমদিন আমাকে কী বলেছিলে মনে আছে? চায়ের দোকানের ব্যবসা হোক কিংবা পেট্রোল পাম্প, সব ধরনের ব্যবসাতেই সফল হতে গেলে একটা ইউএসপির প্রয়োজন হয়। ইউনিক সেলিং প্রোপোজিশন। অর্থাৎ এমন কিছু একটা জিনিস যেটা শুধু আমার আছে, অন্য কারুর নেই। তাই তো?’
‘হ্যাঁ বলেছিলাম। তো?’ অম্বিকেশ বললেন।
জিনিয়া ল্যাপটপটা অম্বিকেশের দিকে ঘুরিয়ে দিল, ‘আমি ইনডোরের মেলা থেকে ফিরে এসে এই কয়েকদিনে দেশের প্রথম সারির পাঁচটা টুর কোম্পানির সমস্ত ফ্যাক্টগুলো নিয়ে একটা কম্পারেটিভ স্টাডি করেছি। গ্লোবাল টুরস, হ্যাপি ট্রাভেল, জয় ট্রিপ, দুনিয়া দেখ লো আর চোপড়া টুরস। এই কয়েকটা এজেন্সির কাজ করার স্ট্র্যাটেজি, প্রোমোশন, ক্যাম্পেইন এগুলো দেখে দেখে আমি একটা রিপোর্ট বানিয়েছি, যেটা ভালো করে অ্যানালিসিস করলে তুমি বুঝতে পারবে এরা প্রত্যেকে একই বৃত্তে ঘুরে যাচ্ছে। কাস্টমাররা নতুন কিছু পাচ্ছে না কারুর থেকে, ফলে এদের হাত ধরে যাওয়ার থেকে নিজেরা ইন্টারনেটের ভরসায় বেরিয়ে পড়াটাকেই সবদিক থেকে সুবিধের মনে করছে। ফলে দিনে দিনে টুরিজম সেক্টরে মন্দা দেখা দিচ্ছে।’
‘এটা তুই ঠিক বলেছিস কিন্তু।’ অম্বিকেশ মাঝপথে বাধা দিলেন, ‘গ্লোবাল টুরসে আমার শেষ সপ্তাহে মুম্বাই থেকে মি জোশী এসেছিলেন, তিনিও এই কথাই বলেছিলেন যে গত দু-বছরে টুরিস্টদের মধ্যে নিজেরা ঘোরার প্রবণতা বাড়ছে। কোনো ব্রাঞ্চেই তেমন প্রফিট হচ্ছে না।’
জিনিয়া হাতের পেনটা উঁচিয়ে ধরে মাথা নাড়ল, ‘তার প্রথম কারণ হল, টেকনোলজি এবং ইন্টারনেটের বাড়বাড়ন্ত। আমি যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল টুর করাব, সেটা দিয়েই ব্যাখ্যা করছি। প্রথমত এই টুরগুলোর টার্গেট অডিয়েন্স কারা সেটা আমাদের দেখতে হবে। সকলের পক্ষে বিদেশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। তাই, লোক নির্বিশেষে প্রোমোশন করে আমাদের কোনো লাভ নেই। বিদেশে পড়তে যাওয়া বা চিকিৎসা করাতে যাওয়া এইসব কারণ বাদ দিলে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য ঘুরতে যায় তিন শ্রেণির মানুষ। প্রথম শ্রেণি হল যারা সমাজের উচ্চবিত্ত মানুষ। ধরো কোটিপতি ব্যবসায়ী, ফিল্মস্টার, বিশাল চাকরি করে কিংবা কোনো নামকরা ডাক্তার উকিল। অর্থাৎ কিনা, যাদের কাছে বিদেশ ভ্রমণ দিল্লি আগ্রা যাওয়ার মতোই জলভাত। এরা এমনিতে কাজের সূত্রে প্রায়ই বিদেশ যায়, আর বছরে একবার দু-বার সপরিবারে ঘুরতেও যায়। গ্লোবাল টুরসের মতো নামি এজেন্সিগুলোর সেলসের ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে মেলায় কথা বলে বুঝলাম ওরা এইসব ধনী মানুষদের কিংবা তাদের সেক্রেটারিদের টার্গেট করে। ভাবে, একবার টুর করে তুষ্ট হলে বারবার এঁরা প্যাকেজ নেবে।’ জিনিয়া একমুহূর্ত থেমে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি প্রথমেই এই ক্লাসটাকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি।’
‘বাদ দিচ্ছিস? সে কী!’ অম্বিকেশ এবার সত্যিই অবাক হলেন, ‘আমাদের সেলস ডিপার্টমেন্টের কিছু ছেলের কাজই ছিল মাসে একবার গিয়ে এই সমস্ত মানুষের অফিসে আমাদের ব্রোশিয়োর দিয়ে আসা। আর তুই বাদ দিয়ে দিচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। তার কারণ, যারা মুড়িমুড়কির মতো বিদেশে যায়, তাদের আর যাই হোক কোনো টুর এজেন্সির দরকার পড়বে না। তারা নিজেরাই যেতে পারবে। তুমি আমাকে বলো, তুমি ক-বার পুরী গেছ জীবনে?’ জিনিয়া জিজ্ঞেস করল।
‘পুরী?’ অম্বিকেশ ভাবতে ভাবতে বললেন, ‘উমম, তা প্রায় বাইশ-পঁচিশ বার তো হবেই। আমার মা আর বুড়িদির মা মানে তোর দিদিমা যতদিন বেঁচে ছিল, ফি-বচ্ছর তো রথের সময় ওদের পুরী নিয়ে যেতে হত। অম্বুবাচি চলত, দুই বুড়িরই শরীর খারাপ, শরীর দেবে না, তবু অম্বুবাচি করতেই হবে। তীর্থস্থানে গেলে তো অত নিয়ম পালন করতে হয় না, তাই নিয়ে চলে যেতাম। তুইও ছোটোবেলায় কয়েকবার আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলি, মনে নেই হয়তো তোর।’
জিনিয়া বলল, ‘তুমি এখন পুরী ঘুরতে গেলে কি কোনো টুর এজেন্সির সঙ্গে যাবে? নাকি একাই চলে যাবে?’
‘পুরী যাব টুর এজেন্সির সঙ্গে?’ অম্বিকেশ বললেন, ‘পাগল হলি নাকি তুই! পুরীর প্রতিটা অলিগলি, দোকানপাট আমার হাতের তালুর মতো চেনা। চাইলে গিয়ে গাইডের কাজও করতে পারি। সেখানে তুই কিনা বলছিস এজেন্সির সঙ্গে যাব? ধুৎ!’
‘তাহলে দেখো, তোমার কথা থেকে পরিষ্কার, ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই যায় যারা নিজেরা যেতে ভরসা পায় না। কোন ট্রেনে উঠব, গাড়ি কীভাবে বুক করব, হোটেল ঠিক করা, খাওয়া দাওয়া, এইসব ঝামেলা ঝক্কি এড়াতে তারা ট্রাভেল এজেন্সি বেছে নেয়। কোনো চিন্তা নেই, ওরাই নিয়ে যাবে, খাওয়াবে, ঘোরাবে, দেখাবে, একদম নিশ্চিন্ত। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষের প্রধান চিন্তা থাকে, ভিসা, পাসপোর্ট, ইমিগ্রেশন এইসব। তার সঙ্গে ডলার, পাউন্ড, ইউরো, এইসব নেওয়ার নিয়মকানুন। যারা উঠতে বসতে বিদেশ যায়, তারা তো এগুলো সম্পর্কে ভালোমতো ওয়াকিবহাল, তারা কেন এজেন্সির সঙ্গে যেতে যাবে? এরা বড়োজোর এজেন্সি মারফত প্লেনের টিকিট বুক করবে। তাই না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক।’ অম্বিকেশ চিন্তা করতে লাগলেন, ‘মুম্বাই থেকে অর্ডার আসায় আমি প্রতিমাসে ছেলেগুলোকে পাঠাতাম ঠিকই, কিন্তু কেউ কখনো আমাদের কোনো প্যাকেজ অ্যাভেইল করেছে বলে মনে পড়ছে না। বরং খুব এমারজেন্সি বেসিসে ফ্লাইটের টিকিট কাটার অনুরোধ আসত। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে। গ্লোবাল টুরসে স্পেশাল প্যাকেজ ছিল …।’
‘জানি। আমাকে বলতে দাও। এই উচ্চবিত্তদের মধ্যেও দুটো ব্যতিক্রম আছে। এক, যাঁরা একসময় যদি প্রচুর ঘুরেও থাকেন, অভিজ্ঞতা আর পয়সা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যান বয়সের কারণে। কারণ বৃদ্ধ বয়সে অত ঝক্কি তাঁরা সামলাতে পারবেন না। সাধারণত এঁরা হচ্ছেন উচ্চবিত্ত বয়স্ক দম্পতি। সাধারণত এঁদের ছেলেমেয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত, নিজেরাও আধুনিকমনস্ক। এঁদেরকেও আমি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের সম্ভাব্য কাস্টমারের তালিকা থেকে বাদ দেব। কারণ এঁদের যতই কনভিন্স করার চেষ্টা করা হোক, এঁরা ব্র্যান্ড ছাড়া কিছু চিনবেন না। টাকাটা এঁদের কাছে কোনো সমস্যা নয়, কাজেই এঁরা নামিদামি এজেন্সির সঙ্গেই ঘুরতে যাবেন। আর দুই হল, কোনো স্কুল বা কলেজের কনডাক্ট করা বিদেশ টুর। এটাকেও আমি বাদ দেব। যে স্কুল বা কলেজ ছাত্রছাত্রীদের বিদেশে এক্সকারশনে নিয়ে যায়, তারা সব দামি স্কুল, এরা নামি কোনো এজেন্সির সঙ্গে প্রতি বছরের কনট্র্যাক্ট করেই রেখেছে। আনকোরা কোনো কোম্পানির সঙ্গে এরা যাবে না।’
অম্বিকেশ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন।
জিনিয়া বলে চলেছিল, ‘দ্বিতীয় শ্রেণি হল সত্যিকারের ঘোরাপাগল মধ্যবিত্ত বয়স্ক মানুষ। যাঁরা ভারতের মধ্যে ঘুরেছেন অনেক, ঘোরার নেশাতেই তাঁরা বার্ধক্যের নিশ্চিন্ত সঞ্চয়ের কিছুটা ভেঙে একটু বিদেশ চাক্ষুষ করে আসতে চান। এরা একেবারেই শৌখিন নন, কম পয়সায় পুষ্টিকর খাবারের মতোই এঁরা ব্র্যান্ডের দিকে না গিয়ে বাজেট অনুযায়ী এজেন্সি খুঁজবেন। আর তৃতীয় শ্রেণি হল একদম নতুন প্রজন্ম। এরা হচ্ছে এই জেনারেশনের ছেলেমেয়ে। প্রধানত আমাদের আই টি সেক্টরের ছেলেমেয়ে। আমাদের আগের প্রজন্মে বাবা-কাকাদের অনেক দায়িত্ব ছিল। বেশিরভাগেরই বাড়ির অবস্থা ছিল অসচ্ছল, প্রচুর ভাইবোন। বাবা-কাকারা চাকরি পেয়েই বোনের বিয়ে দিতে, বাড়ি করতে কিংবা অন্যান্য দায়দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ত্রিশ পেরোতেই বিয়ে হয়ে যেত। আরও বড়ো দায়িত্ব চেপে বসত মাথায়। ফলে, সরকারি বা কোনো ভালো চাকরি করলেও লাগামছাড়া বিলাসিতা করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। কিন্তু আমাদের প্রজন্মে এই ব্যাপারটা পুরো উলটে গেছে। আমাদের বাবা-কাকারা এখন প্রত্যেকে সচ্ছল, তাঁরা নিজেদের যৌবনে অনেক সংগ্রাম করে বাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সবই করে ফেলেছেন এবং তাঁদের একটি বা বড়োজোর দুটি করে ছেলেমেয়ে, তাদের দুঃখকষ্ট পেতে না দিয়ে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন, ভালো স্কুল-কলেজে পড়িয়েছেন। আমরা, অর্থাৎ তাদের ছেলেমেয়েরা এই যুগের আই টি সেক্টর বা অন্যান্য কর্পোরেট চাকরির কল্যাণে প্রোফেশনাল ডিগ্রি করে একুশ বাইশ বছরের মধ্যেই বেশ ভালো মাইনের চাকরি পেয়ে গেছি। সংসারের প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব নেই, বাবা-মা নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে আমাদের ওপর নির্ভর করেন না। কাজেই এত অল্প বয়সে মাসে মাসে এত টাকা নিয়ে আমরা অনেক বেশি বিলাসী হয়ে পড়েছি। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে গাদা গাদা টাকা খরচ করে রেস্টুরেন্টে খাওয়া কিংবা বিদেশে ঘুরতে যাওয়া। আমাদের আগের প্রজন্মে সাধারণ মানুষ ভাবতেই পারত না দু-তিন হাজার টাকা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে কিংবা হানিমুনে সুইজারল্যান্ড কি নিউজিল্যান্ড যাবে। কিন্তু এখন তরুণ স্বামী স্ত্রী, দু-জনেই ভালো চাকরি করে, দু-জনেরই কোনো লায়াবিলিটি নেই, তারা ঘোরা-খাওয়ার পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করছে। কিছুটা নিজেদের শখপূরণে, আর বাকিটা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের স্টেটাস দেখানোর জন্য। আমি আমার অনেক বন্ধুকে চিনি, যারা আগে মোটেই ঘুরতে যেতে ভালোবাসত না, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তে তারা হঠাৎ ভ্রমণপ্রেমী হয়ে উঠেছে, তারা প্রতি টুরে নতুন জামা, নতুন প্যান্ট, নতুন সানগ্লাস নিয়ে যায়। তারা শান্তিতে ঘুরতেও পারে না, ঘুরতে ঘুরতেই ভাবে কতক্ষণে ছবি আপলোড করবে, কতক্ষণে ভার্চুয়াল দুনিয়ার প্রতিক্রিয়া গায়ে মাখবে।’ জিনিয়া অনেকটা বলার পর একটু দম নিল, ‘আমার টার্গেট অডিয়েন্স এই দুটো ক্লাস। কারণ এরা নতুনদের সুযোগ দিতে চাইবে।’
অম্বিকেশ এতক্ষণ মুগ্ধচোখে শুনছিলেন, জিনিয়া থামতে বললেন, ‘তুই তো দারুণ রিসার্চ করেছিস দেখছি! আমি এত বছর টুরিজম সেক্টরে ছিলাম, এভাবে তো কখনো ভাবিনি!’
১৫
আলোকপর্ণা হিন্দমোটর স্টেশন থেকে ধস্তাধস্তি করে রোজকার মতো ট্রেনে উঠল, ডাউন বর্ধমান লোকালে প্রতিদিনের মতোই তিলধারণের জায়গা নেই। তার ওপর মহিলা কামরাতেও সামনে ঝুলছে কিছু পুরুষ। প্রতিবাদ করলে তারা কথা কানেও তোলে না, মরা মাছের মতো তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে।
ও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল না। বসতে পাওয়ার দূরতম আশাও নেই, মাঝখান থেকে চারপাশের ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে আসবে। তার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঢের ভালো।
ও কানে হেডফোন গুঁজে এক হাতে ওপরের হাতল ধরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ট্রেন হিন্দমোটর পেরিয়ে কিছুটা ঢিমেতালে এগোচ্ছিল, এখন আবার হু- হু করে ছুটছে। ঠান্ডা হাওয়া এসে ওর গতকাল রাতের একফোঁটাও না ঘুমোতে পারার ক্লান্তিটা অনেকটাই যেন জুড়িয়ে দিচ্ছে।
আজ শনিবার। অন্যান্য শনিবারে সকাল থেকে ওর মেজাজ বেশ খুশি খুশি থাকে, দিনটা কোনোমতে উতরে গেলেই একটা গোটা দিন ছুটি। সারা সপ্তাহের হাড়ভাঙা খাটুনি, এতটা যাতায়াতে শরীর যেন সেদিন ভেঙে পড়তে চায়। মনে হয় সারাদিন বিছানায় শুয়েই কাটিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। অন্যান্যদিন ও বাইরে কাজ করে, রবিবার দিন ঘরে। সারা সপ্তাহের কাচাকুচি, ঘর পরিষ্কার, টুকটাক নানারকমের কাজ সেদিনই সারতে হয়।
দু-বছর আগেও এমনটা ছিল না। তখন মা একাই সংসারে এত পটু ছিল যে ও আর দিদি টুকটাক কাজ ছাড়া নিজেদের নিয়েই কাটাত। কিন্তু, এই দু-বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। দিদি চলে গেছে, বাবা-মা-ও সতেজ দু-জন সতেজ মানুষ থেকে পরিণত হয়েছে জীবন্ত পাথরে। এই দু-বছরেই তাদের বয়স বেড়ে গেছে প্রায় দশ গুণ। আর আলোকপর্ণা এইসবের মাঝে পড়ে হাঁপিয়ে উঠছে।
তবুও শনিবার দিনটা ওর মন খুশিতেই থাকে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম।
এমনিতেই সপ্তাহখানেক আগের সেই জঘন্য ঘটনাটা মাঝে মাঝেই ওর মনকে এসে এখনও দোলা দিয়ে যাচ্ছে। আর তখনই কাজের ফাঁকেও কুঁকড়ে যাচ্ছে ও। ঘৃণায়, বিরক্তিতে। তার ওপর কাল ও অফিসে একটা কড়া চিঠি পেয়েছে। ওর নাকি দিন দিন পারফরম্যান্সের অবনতি ঘটছে।
বাড়ি ফিরে সেদিনের লোকটার ঘটনাটা কাউকে বলতে পারেনি আলোকপর্ণা। বলে লাভ তো নেইই, উলটে মা শুনলে এমন টেনশন শুরু করবে, আলোকপর্ণার নিজের মতো চলাফেরাটাই তখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যাবে।
যার কাছে এইসব কথা বিনা দ্বিধায় বলা যেত, সে তো কাছে নেই। তাই আলোকপর্ণা নিজের মনেই গুমরেছে সারা রাত।
শরীরের শেষ রক্তবিন্দু অবধি জীবনযুদ্ধে লড়া যায়, কিন্তু এইসমস্ত নোংরা মানুষ এসে কে ভেতরে ভেতরে কী লড়াই লড়ছে, কার ওপর দিয়ে কী ঝড় বইছে না জেনেই শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে নিজেদের বিকৃত যৌনকামনার শিকার ধরতে শুরু করে।
তখনই আলোকপর্ণা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। হয়তো আলোকপর্ণা একা নয়, সব মেয়েই এইসব বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ে।
আলোকপর্ণা ভীতু মেয়ে নয়, আর এটা ঠিক ভয় নয়, আতঙ্ক নয়। হাজার প্রতিকূলতাতেও ও ভয় পায় না। সেদিন অফিসে মি জোশীর ওইরকম অপমানজনক কথাতেও ও ভেঙে পড়েনি। কিন্তু এই শুধুমাত্র নিজের লিঙ্গর জন্য এই লাঞ্ছনা যেন ওর ভেতরে দাবানল লাগিয়ে দেয়। মনে হয়, শেষ করে দেয় এই বিকৃতকামদের।
আর তখনই ও ছটফট করতে শুরু করে। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না ও কোনো একটা ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আগুপিছু না ভেবে দুম করে এমন কোন কাজ করে ফেলে যা করার কথা স্বাভাবিক সময়ে ও ভাবতেই পারে না। তখন যেন একটু হলেও মনটা শান্ত হয়।
এখনও তাই হল। কানে হেডফোন গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকলেও আলোকপর্ণা কোনো গানই শুনছিল না, ভেতরে ভেতরে ছটফটিয়ে উঠছিল। অবশেষে হাওয়া খেতে খেতে ও ঠিক করে ফেলল, অফিসের জন্য বেরোলেও আজ ও অফিস যাবে না।
কিছুতেই যাবে না।
হিসেবমতো কালকের বকাঝকার পর গ্লোবাল টুরসের নিয়ম অনুযায়ী আজ থেকে এক সপ্তাহ ও মনিটরিং-এর মধ্যে থাকবে। মি জোশী কাল হেড অফিসে ফিরে যাওয়ার পরেই এই কথা জানিয়েই ও ই-মেল পেয়েছিল এইচ আর ডিপার্টমেন্টের।
গ্লোবাল টুরসের নিয়মকানুন এইসব ব্যাপারে খুব কড়া। ওরই অজান্তে ওদের ব্রাঞ্চের বাকি তিনজন সেলস এগজিকিউটিভের মধ্যে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হবে আলোকপর্ণার কার্যকলাপ রিপোর্ট করার জন্য। কতটা টার্গেট অ্যাচিভ করতে পারছে, সেটা তো এমনিই জানা যাবে, কিন্তু কথার মাধ্যমে কাস্টমারকে পুশ সেল করার জন্য ও কতটা নিজের এফর্ট দিচ্ছে, সেটা এভাবেই জানবে হেড অফিস।
সাত দিন পর আবার ওর কাছে ই-মেল আসবে ওর কাজে কোম্পানি কতটা সন্তুষ্ট তার আপডেট জানিয়ে। এই সাতটা দিনে আলোকপর্ণা যদি বেশ ভালোরকম টাকার প্যাকেজ বিক্রি করতে পারে আর পুশ সেল করতে পারে তো ভালো, যদি না পারে, তাহলে আরও এক সপ্তাহের জন্য ও চলে যাবে পিআইপি তে।
পিআইপি। এই শব্দটা শুনলেই গ্লোবাল টুরসের সব কর্মীর মুখে বিদ্যুৎগতিতে কালো মেঘ এসে জমা হয়, এই তিন বছরে লক্ষ করেছে আলোকপর্ণা।
পিআইপি অর্থাৎ পার্সোনাল ইমপ্রূভমেন্ট প্রোগ্রাম। বাংলা ভাষায় যার আক্ষরিক অর্থ ব্যক্তিগত উন্নতি প্রকল্প। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হল তাড়ানো।
কর্পোরেট সেক্টরের যেকোনো কোম্পানিতে এই গ্যাঁড়াকলটা থাকে। সে ওদের টুরিজম সেক্টর হোক, ব্যাঙ্কিং সেক্টর হোক কিংবা আই টি সেক্টর। নাম পলটে বিভিন্ন নামে পিআইপি বিরাজ করে প্রতিটি বেসরকারি বড়ো কোম্পানিতে। সোজা কথায়, কোনো কর্মীকে পিআইপি-তে পাঠানো হলে তাকে পরবর্তী একটা সময়কাল নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় অমানুষিক খেটে আশাতীত ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে। এই সময়টা কোন কোম্পানির ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ, কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে এক মাস, আবার কারুর ক্ষেত্রে তিন মাস পর্যন্ত যায়।
ওদের গ্লোবাল টুরসে পিআইপি-র মেয়াদ মাত্র সাত দিন।
কিছু কোম্পানি আবার পিআইপি-তে লোক দেখানো ট্রেনিংও রাখে, ম্যানেজমেন্ট থেকে টিউটর পাঠিয়ে নতুন করে কোম্পানি প্রোফাইল, সেক্টরের খুঁটিনাটি কেঁচে গণ্ডূষ করা হয়। পরীক্ষাও দিতে হয় আবার। কিন্তু প্রতিটা কর্মীই জানে ওটার কোনো মূল্য নেই, আসল ওই পুশ সেলের পারফরম্যান্স, নিজেকে বেচুবাবু হিসেবে কতটা সার্থকভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে, তার হিসেব।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পিআইপি থেকে লোকে আর অফিসে ফিরে আসে না। পিআইপি-র শেষ দিনে বা শেষ সপ্তাহে হেড অফিস থেকে ডেকে প্রথামাফিক দুঃখ প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়া হয় পিঙ্ক স্লিপ। মানে, এক্সপিরিয়েন্স সার্টিফিকেট আর এক মাসের মাইনের চেক। সোজা কথায়, ‘অনেক খেল দেখিয়েছ। তুমি কোনো কম্মের নও ভাই, এবার তুমি মানে মানে করে কেটে পড়ো।’
অন্য কেউ হলে হয়তো সাতদিনের নোটিশে পিআইপি-তে পাঠানোর মেল পেয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিত।
কিন্তু আলোকপর্ণা অনেক শক্ত স্বভাবের। বাড়ির পরিস্থিতির জন্য যত দিন যাচ্ছে ওকে আরও বেশি করে দৃঢ় হয়ে উঠতে হচ্ছে। মেলটা পেয়ে ও কাঁদেনি, তবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। বহ্নিশিখা, সংযুক্তা বা অতীশ কাউকেই বলেনি। কী হবে বলে? ওরা শুনে চমকে উঠবে, তারপর, ‘ভয় পাস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’ গোছের সহানুভূতি দিয়ে ওকে আরো দুর্বল করে দেবে।
তার চেয়ে ও একাই জানুক।
জীবনে কিছু লড়াই থাকে, যা একাই লড়তে হয়। সেদিনের ওই জঘন্য ঘটনাটা না ঘটলে ও হয়তো আরও শক্ত থাকত। যাইহোক, যা হয়েছে, হয়েছে। পৃথিবী উলটে যায় যাক, আজ ও অফিস যাবে না।
ও আজ সারাদিন কলকাতা শহরে নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরবে। যতই ভ্যাপসা গরম পড়ুক, রাস্তার পিচ গলে আটকে যাক ওর চটিতে, ঘামে ভিজে উঠুক জামাকাপড়, তবু ও থামবে না। খিদে পেলে ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে গলা অবধি কবজি ডুবিয়ে খাবে, তারপর আবার হাঁটবে।
বাড়ি ফিরবে একেবারে সন্ধে হলে।
মন ভালো করার এই টোটকাটা ওর নয়, দিদির। দিদিই একদিন রাতে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে বলেছিল, ‘মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানিস ছোটু, সবকিছু ছেড়ে পালিয়ে যাই। রোজকার ক্লায়েন্টের সঙ্গে কল, এসক্যালেশন মেলের জবাবদিহি, ডিপ্লয়মেন্ট, একজিকিউশন, ম্যানেজারের ধমকানি, আর ভাল লাগে না। তখন হঠাৎ একদিন হারিয়ে যাই, ফোন, মেল, অফিস, বাড়ি, সবকিছুর থেকে। সেদিন আমি সারাদিন হাঁটি।’
‘হাঁটিস? কোথায় হাঁটিস? মন খারাপ করে কেউ হাঁটে বুঝি?’ কলেজপড়ুয়া আলোকপর্ণা অবাক চোখে দিদিকে সেদিন বলেছিল, ‘আমরা তো মনখারাপ হলে বন্ধুরা দল বেঁধে সিনেমা যাই কিংবা আড্ডা মারি।’
‘তোদের মনখারাপ একরকম আর অফিসের চাপে অবসাদ আসা আরেকরকম। এখন জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়ে আছিস। চাকরিতে ঢোক, তারপর বুঝবি।’ দিদি পাশ ফিরে শুতে শুতে বলেছিল, ‘তখন খালি মনে হবে সিনেমা, আড্ডা, গল্পগুজব, এসব নয়, একা কোথাও পালিয়ে যাই। মনে হবে কী তাড়াতাড়ি সময় ফুরিয়ে আসছে।’
‘কিন্তু তুই কোথায় হাঁটিস?’ আলোকপর্ণা বলেছিল।
‘এমনিই, পুরোনো কলকাতার পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। বাড়িঘর, মানুষজন দেখতে দেখতে।’ দিদি বলেছিল, ‘ভাঙা মন্দির, কর্পোরেশনের পুরোনো কল, হাতে টানা রিকশার টুং টাং শব্দে ছুটে যাওয়া। ভালো লাগে দেখতে।’
ট্রেন থেকে নেমে আলোকপর্ণা অন্যদিন যেদিকে বাস ধরার জন্য ছোটে, আজ সেদিকে গেল না। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে একটা ট্যাক্সি ধরে উঠে বসল।
ড্রাইভার বলল, ‘কোথায় যাবেন দিদি?’
আলোকপর্ণা থমকে গেল। সত্যিই তো কোথায় যাবে ও? আর দুম করে ট্যাক্সিতেই বা উঠে পড়ল কেন? ওর তো দিশাহীনভাবে হাঁটার কথা ছিল। ঠিক আছে, তাই হাঁটবে ও। কিছুটা ট্যাক্সি করে গিয়ে যাওয়া যাক নাহয়।
ও এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, ‘ইয়ে, ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে নামব দাদা।’
হ্যাঁ, ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দিয়ে যে চওড়া রাস্তাটা গড়ের মাঠের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে, সেখান দিয়েই হেঁটে যাবে ও। একদিকে খেলার ক্লাবের মাঠগুলোয় সাদা ঘোড়াগুলো চড়ে বেড়াবে, অন্যদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা এসে বসবে দূরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথার পরির গায়ে।
এই সব কিছুই সারাদিন ধরে ও দেখবে।
এমনিতে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ও, ছোটো থেকে বাসে ট্রেনেই অভ্যস্ত করেছিল ওকে বাবা মা। কাজেই এখনও চট করে ট্যাক্সি চাপতে ও ঠিক ধাতস্থ হয় না। তবু আজ সব আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে আরামে ও সিটে গা এলিয়ে দিল।
ভাবল, আজ প্রচুর টাকা খরচ করবে। কিছু কিছু দিন আছে নিয়ম ভাঙার জন্যই আসে।
আজকের দিনটাও তেমনই।
আলোকপর্ণা খুব ভালো করে জানে, ওকে সাতদিনের এই মনিটরিং আর তার পরের সাত দিনের পিআইপি-র পরে গ্লোবাল টুরস এক মাসের মাইনে দিয়ে পিঙ্ক স্লিপ ধরিয়ে দেবে।
বাইরে যতই ঠাটবাট থাক, গ্লোবাল টুরসের ভেতরের অবস্থা ভালো না, এমন কানাঘুসো ওরা শুনছে কয়েক মাস ধরেই। অন্যান্য রাজ্যের অফিসে এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার কর্মী ছাঁটাই হয়েছে, যদিও কলকাতায় সেভাবে কাউকে এখনও তাড়ানো হয়নি। কিন্তু তার কারণ এতদিন অম্বিকেশ সান্যালের প্রধান কর্তা পদে থাকাটা।
অম্বিকেশ স্যার এতদিন একটা বটগাছের মতো গোটা কোম্পানিটার মাথায় ছিলেন। উনি ম্যানেজমেন্টের সেই বিরলতম লোক যিনি কর্মীদের শুধুই কাস্টমার ধরে আনার কল হিসেবে দেখতেন না। তাদের সুবিধা-অসুবিধা, বিপদ-আপদ এগুলোও দেখতেন, প্রয়োজনে কোম্পানি প্রটোকলের বাইরে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেন।
আলোকপর্ণার মনে পড়ে গেল, দিদি যেদিন বাবা-মা-র কথার তোড়ের সামনে একটাও প্রতিবাদ না করে ছলছলে চোখ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, সেদিন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বাবার প্রথম স্ট্রোকটা হয়েছিল।
আর পরের দিন থেকে ছিল গ্লোবাল টুরসের কলকাতা অফিসের স্পেশাল ক্যাম্পেইন। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের এক নামকরা কর্পোরেট বিল্ডিং-এ। আকাশছোঁয়া সেই বিল্ডিং-এ অনেকগুলো অফিস। ওদের কাজ ছিল প্রতিটা অফিসে ভিজিট করে ম্যানেজমেন্টকে তাদের বিভিন্ন ইভেন্ট বা প্রোগ্রাম গ্লোবাল টুরসের মাধ্যমে বুক করার জন্য ইনসিস্ট করা। গত তিন-চার বছরে লোকজনকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, প্লেনের টিকিট বুক করা আর পাসপোর্ট-ভিসার ব্যবস্থা করা ছাড়াও আরও কিছু দিকে গ্লোবাল টুরসকে ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে হয়েছে। সেটা ভ্রমণে মন্দার জন্যই। এখন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পাঁচতারা সাততারা হোটেলের সঙ্গে গ্লোবাল টুরসের এগ্রিমেন্ট রয়েছে, বিভিন্ন অফিস গ্লোবাল টুরসের মাধ্যমে তাদের বার্ষিক অফিস মিট আয়োজন করে বিভিন্ন হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েটে। এই দিকটা খোলার পর গ্লোবাল টুরসের তবু নাকি কিছু লাভ হতে শুরু করেছে।
আলোকপর্ণা ওদের ব্রাঞ্চের হেড হওয়ার জন্য পরের দিন ওরই ওই অফিসগুলোর ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। বাবার স্ট্রোকটা হওয়ার পরের পাঁচ-ছ-ঘন্টা কেটেছিল কাছের নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা আর চরম উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে।
বাবার অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল হতে ও যখন অম্বিকেশ স্যারকে ফোন করেছিল, তখন রাত সাড়ে এগারোটা।
অম্বিকেশ স্যার গোটা ইস্টার্ন রিজিয়নের কর্তা, আলোকপর্ণার সমস্যা জানানোর জন্য তাঁকে ফোন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবু আলোকপর্ণা ওঁকেই করেছিল, কিছুটা পরের দিন ওর না যেতে পারাটা কোম্পানির গুড উইলে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা অনুধাবন করে আর বাকিটা স্যারের সমব্যথী মনের সঙ্গে ওর পরিচয় ছিল বলে।
অম্বিকেশ স্যার গোটা বিষয়টা মন দিয়ে শুনেছিলেন। তারপর একটুও না ভেবে তিনি আলোকপর্ণাকে যতদিন প্রয়োজন ছুটি নিতে বলেছিলেন, আর ওর বদলে পরের দিন অফিসগুলোয় কথা বলার জন্য পার্ক স্ট্রিট অফিস থেকে অন্য একজনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও আর নেই। অম্বিকেশ স্যার ইস্তফা দেওয়ার পর এখন তাঁর জায়গায় এসেছেন সঞ্জয় সামন্ত। তিনি গ্লোবাল টুরসে বেশিদিন আসেননি, বছরদুয়েক আগেও হ্যাপি হলিডেতে ছিলেন। কিন্তু আসার কয়েকমাসের মধ্যেই গোটা কলকাতা অফিস বুঝে গিয়েছে যে সঞ্জয় স্যারের কাছে ‘প্রফিট’ আর ‘টার্গেট’ এই দুটো শব্দের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নয়। আর উনি প্রধান হওয়ার পরেই আলোকপর্ণার মতো আরও অনেককে ঝটিতি পিআইপি-তে পাঠানোর বন্দোবস্ত হয়েছে, যারা কেউই মির্যাকল না ঘটলে আর ফিরে আসবে না।
তার মানে ঠিকমতো দেখতে গেলে ওর অফিশিয়ালি বেকার হতে আর দশ দিনও বাকি নেই।
ধুর! যা হওয়ার তাই হবে। এই চব্বিশ বছরের জীবনে ও একটা জিনিস বুঝেছে, কারুর জন্য কিচ্ছু আটকে থাকে না। এই যেমন দিদি। দিদিকে ও এত ভালোবাসত, মনে হত একটা দিন দিদিকে ছাড়া থাকতে পারবে না। দিদি কখনো কোথাও দু-তিনদিনের জন্য গেলেও ওর দমবন্ধ হয়ে আসত। ওদের দু-বোনের মধ্যে কোনোদিন ঝগড়াও হত না।
কিন্তু কই? এই যে একটা বছর হতে চলল দিদিকে চোখের দেখা তো দূর, দু-জনে ফোনে কথাও বলেনি, তাতে দিদির কিছু যাচ্ছে আসছে কি? নতুন সংসার নতুন জীবন নিয়েই সে মেতে আছে। আলোকপর্ণা নাহয় ইচ্ছা থাকলেও বাবা-মা-র কঠোর নিষেধে ফোন করতে পারেনা, দিদির তো তেমন কিছু নেই। সে তো অবলীলায় করতে পারে।
কিন্তু মনের টানটাই চলে গেছে। আসলে পৃথিবীতে নিজে ছাড়া কোনো কিছুই আপন নয়। আর এই চাকরি, টাকাপয়সা সবই মোহমায়া।
হঠাৎ করে দার্শনিক হয়ে উঠে ওর নিজেকে বেশ হালকা লাগল, গুনগুন করে একটা পুরোনো হিন্দি গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ও বাইরের দিকে তাকাল। ট্যাক্সি হু-হু করে হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে। অফিস টাইম হলেও কোনো রহস্যময় কারণে আজ যেন হাওড়া ব্রীজ বেশ ফাঁকা।
আলোকপর্ণা দূরের গঙ্গায় ভাসতে থাকা স্টিমারগুলো দেখছিল। এতদূর থেকে সেগুলো কেমন যেন পাহাড়ের মতো নিশ্চল মনে হচ্ছে।
দেখতে দেখতে ওর হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা, দিদিরও যদি এমন চাকরি চলে যেত? দিদির সঙ্গেও যদি কেউ রাতের অন্ধকারে অমন অসভ্যতা করতে চাইত?
দিদিও ওর মতোই অফিস না গিয়ে এভাবে ঘুরতে বেরত কি? নাকি সেদিন এসে ওর গলা জড়িয়ে কাঁদতে চাইত?
১৬
অতন্দ্র এমন অকাতরে ঘুমোচ্ছিল যে সাড়ে ন-টা বেজে গেছে খেয়ালই করেনি। জানলা দিয়ে কড়া রোদ এসে প্রায় পুড়িয়ে দিচ্ছে ওর গা, তবু এতই ক্লান্তি যে ঘুম ভাঙেনি।
ঘুম ভাঙল টানা দশ-পনেরো বার বেলের আওয়াজে।
শেষের দিকে বেলটা একটানা বেজে চলাতে ও হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল। এত গাঢ় ঘুম যে কয়েক মুহূর্তের জন্য ও মনে করতে পারল না কোথায় রয়েছে। তারপর চোখ-টোখ কচলে অলস ভঙ্গিতে বিছানা থেকে উঠে মেঝেতে প্রায় পা ঘষে ঘষে গিয়ে ও দরজাটা খুলে দিল।
দরজা খোলামাত্র মঙ্গলাদি গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকল, ‘তোমাদের ব্যাপারটা কী বলো তো দাদা? একসপ্তাহ হতে চলল রোজ আসছি আর তালা মারা দেখে ফিরে যাচ্ছি। বলি, তোমরা যে থাকবে না সেটা তো আমাকে জানিয়ে দিতে পারতে! তাহলে তো আমাকে কমপ্লেক্সে ঢুকে এতদূর হেঁটে এসে লিফট বেয়ে ওপরে উঠে দেখে যেতে হয় না!’
‘তো কী আছে!’ অতন্দ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘লিফটেই তো আসছ, সিঁড়ি বেয়ে তো উঠতে হচ্ছে না তোমায়!’
মঙ্গলাদি খনখনে গলায় বলল, ‘থামো দিকিনি। লিফট তো কী, গেট থেকে এতটা আসতেই তো কত সময় চলে যায়। সাত বাড়ি কাজ করি, সময় আছে নাকি আমার এত? ফোন করে জানিয়ে দিলে তো ল্যাঠা চুকে যেত। আমি তো দিদিকে ফোনও করলাম কাল, তুললই না।’
বলতে বলতে মঙ্গলাদি দুটো ঘরে উঁকি দেয়, তারপর রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। তারপরেই এসে বলে, ‘দিদি কোথায়?’
অতন্দ্র টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিল, খেয়ে ধীরেসুস্থে বলল, ‘দিদি খড়দা গেছে, বাবা-মায়ের কাছে।’
মঙ্গলাদির চোখ এবার কপালে উঠে গেল, ‘ওমা! তোমাকে ছাড়া?’
মঙ্গলাদি ঢুকে থেকে বুলেটের মতো প্রশ্ন ছুড়ে যাচ্ছে, অতন্দ্রর এবার বিরক্ত লাগল।
জিনিয়া রাগারাগি করে চলে যাওয়ার পর থেকে ও নিজে এই ক-টা দিন ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, একবার দুর্গাপুরে বাড়ি চলে যাচ্ছে, একবার এই বন্ধুর ফ্ল্যাটে রাতে শুয়ে পড়ছে, একবার ও-বন্ধুর ফ্ল্যাটে।
কিন্তু যাযাবর হয়ে বেশিদিন কি কারুর ভালো লাগে? বিশেষ করে এই বয়সে?
একটা সময় পর মনে হয়, যত যাই হোক, নিজের বাড়িই ভালো।
কাল অফিস থেকে তাই ও ফিরেছে নিজের ফ্ল্যাটে। রুটি আর কষা মাংস কিনে এনেছিল, কোল্ড ড্রিঙ্ক দিয়ে তাই খেয়েছে, তারপর একটা বিদেশি সিনেমা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেবেছিল আজ অনেক বেলা অবধি ঘুমোবে।
কিন্তু কোথায় কী! সাতসকালে মঙ্গলাদি এসে চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে।
অবশ্য মঙ্গলাদির অবাক হওয়াতে দোষের কিছু নেই। সাড়ে তিন বছর হয়ে গেল ওদের বিয়ে হয়েছে, জিনিয়া এই ঝামেলার আগে কোনোদিনও একা খড়দায় যায়নি। শুধু জিনিয়া নয়, ওদের দু-জনের কেউ কখনো এই সাড়ে তিন বছরে আলাদা একটা রাতও কাটায়নি। অতন্দ্রর বাড়ি দুর্গাপুর গেলেও দু-জনে গেছে, জিনিয়ার বাড়ি খড়দায় গেলেও। মঙ্গলাদি ওদের বাড়ি থেকে বিয়ের পর থেকেই কাজ করছে, সুতরাং হঠাৎ জিনিয়ার না থাকাতে ও অবাক হতেই পারে।
তবু ও ইচ্ছে করে একটু কড়া গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। আমাকে ছাড়া। তো, কী হয়েছে তাতে? তুমি পরে বকবক করবে, আগে চা করো তো! তারপর জলখাবারে সাদা লুচি আর আলুরদম করবে। আমার খিদে পেয়েছে।’
মঙ্গলাদি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দ্বিগুণ গলা চড়িয়ে হাত নেড়ে বলল, ‘কিচ্ছু হবে না। একফোঁটা বাজার নেই রান্নাঘরে। শুধু একটা পোকায় ধরা আলু পড়ে আছে। না অন্য সবজি, না আটা, না ময়দা। রান্নার তেলও নেই। দুর দুর! এইরকমভাবে ভালো লাগে? এখন তুমি কখন বাজারে যাবে আর আমি কখন রান্না করব? সব দেরি হয়ে যাবে এবার।’
অতন্দ্র বলল, ‘ঠিক আছে। তোমায় কিছু করতে হবে না। তুমি চলে যাও, আমি হোটেলে খেয়ে নেব’খন।’
‘তোমার তো পেটের রোগ আছে, রান্না না করে গেলে দিদি এসে আমাকে বকবে।’ মঙ্গলাদি কিছুক্ষণ গজগজ করে বলল, ‘শোনো, আমি এক বাড়ি কাজ সেরে আসছি, তুমি বাজারটা সেরে আসো বরং।’
কিন্তু অতন্দ্র ততক্ষণে শুয়ে পড়েছে। ও আগে থেকেই ঠিক করে ফেলেছিল আজ সারাদিন ও নির্ভেজাল ছুটি কাটাবে, বাজারদোকান তো দূর, খুব প্রয়োজন না হলে বাথরুমেও যাবে না।
ও ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, ‘বললাম তো লাগবে না। তুমি চলে যাও। দরজাটা টেনে দিয়ে যেয়ো। আর আমি ফোন না করলে আসতে হবে না তোমায়।’
‘মানে!’ মুহূর্তে মঙ্গলাদির চোখ দুটো গোলগোল, ‘আর আসব না কেন গো দাদা? ছাড়িয়ে দিচ্ছ নাকি আমায় তোমরা?’
ধুর! কিছুতেই যেন ওর জীবনে একটু শান্তি নেই। উৎপাত লেগেই রয়েছে। অতন্দ্র এবার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার দিদি এলে তোমায় ফোন করে ডাকব। ততদিন আমি অফিস ক্যান্টিনে বা হোটেলে খেয়ে নেব। বুঝেছ? এখন তুমি যাও।’
মঙ্গলাদি চলে যেতে ও আবার শুয়ে পড়ল। ফোনে এর মধ্যেই দশ বারোখানা মেসেজ এসে জমা হয়েছে। সবই ওদের প্রোজেক্টের সহকর্মীদের মেসেজ। কাল থেকে সবার কৌতূহল যেন উপচে পড়ছে ওর জন্য।
অতন্দ্র একজনকেও উত্তর দিল না। কিন্তু তাতেও স্বস্তি নেই। এবার ফোন। শুভ্রদীপের। অন্যসময় এই বিরক্তিকর প্রাণীটির ফোন এলেই ও আস্তে করে সাইলেন্ট করে রেখে দেয় ফোনটা। কিন্তু এখন তাড়াহুড়োয় কলটা রিসিভ করে ফেলেছে।
অতএব কানে দিতেই হল।
‘কী গো অতন্দ্রদা, তুমি নাকি রেজিগনেশন ”উইথড্র” করে নিয়েছ?’ শুভ্রদীপ ওর ট্রেডমার্ক ঘ্যানঘেনে সুরে বকবক শুরু করল।
অতন্দ্র ইদানীং শুভ্রদীপের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার একটা কায়দা বের করেছে। ওর প্রতিটা বিরক্তিকর প্রশ্নের উত্তরে অতন্দ্র প্রথমে মনে মনে একটা করে গালাগাল দেয়, তারপর মুখে উত্তর দেয়। এইভাবে অল্টারনেট করে চালালে অনেকক্ষণ অবধি ধৈর্য রাখা যায়, সেটা অতন্দ্র খেয়াল করে দেখেছে।
এখনও ও মনে মনে তেমনই একটা অপশব্দ প্রয়োগ করে মুখে বলল, ‘হ্যাঁ রে। তোকে কে বলল?’
‘ওই তোমাদের প্রোজেক্টের পাশেই আমার এক বন্ধু বসে, সায়ক, সে-ই জানাল। তোমার একজন জুনিয়র নাকি ওকে বলেছে।’ শুভ্রদীপ মিনমিনে গলায় বলে চলল, ‘আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেলাম। প্রথমে বিশ্বাসই করিনি, তোমরা তো ট্রাভেল কোম্পানি খুলছ, এর মধ্যে অফিস করবে কী করে। তারপর ভাবলাম হতেও পারে, হয়তো কোনো ভালো কোম্পানি থেকে অফার পেয়েছ। আমি তো এই নিয়ে তেইশটা ইন্টারভিউ দিলাম, কিছুতেই ফাইনাল কল পাচ্ছি না। এদিকে আমার ম্যানেজার যে আমার ওপর কী অত্যাচার শুরু করেছে কী বলব তোমায়!’
শালা, এর মুখে আর কোনো কথা ভগবান ফিট করে দেননি! প্রতিটা বার এক ডায়ালগ!
দাঁতে দাঁত চিপে চরম বিরক্তি নিয়ে অতন্দ্র শুনে যেতে লাগল। মনে মনে ও ঠিক করল আর ঠিক কুড়ি সেকেন্ড হলেই ও ‘হ্যালো হ্যালো’ শুরু করবে, তারপর শুনতে না পাওয়ার ভান করে ফোনটা কেটে দিয়ে সুইচ অফ করে দেবে।
‘তারপর আমি কনফার্ম করার জন্য জিনিয়াদিকে ফোন করলাম। সে-ও ফোন তোলে না। করেই যাচ্ছি করেই যাচ্ছি।’
তোর ফোন কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ তুলবে না রে গাধা। তুই নিজে সারাক্ষণ ডিপ্রেশনে ভুগিস, তোর সঙ্গে কথা বললেও যে কেউ ডিপ্রেশনে চলে যেতে বাধ্য।
অতন্দ্র মনে মনে গজরাতে থাকে।
‘তারপর আমি মেসেজ করলাম, কী গো জিনিয়াদি, কেমন আছ? তবু উত্তর নেই। তারপর আমি লিখলাম তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। সেদিন অতন্দ্রদা আর ওদের প্রোজেক্টের একটা মেয়ে দেখলাম ট্যাক্সি করে অফিস থেকে বেরোল। আমি তোমার কথা জিজ্ঞেস করব বলে জোরে জোরে হেঁটে কাছে যাওয়ার আগেই ট্যাক্সিটা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।’ শুভ্রদীপ কয়েক সেকেন্ড থামল, ‘এরপরেই দেখলাম জিনিয়াদি ঘুরিয়ে আমায় ফোন করল।’
অতন্দ্র এমন হতভম্ব হয়ে গেল, মনে মনে গালি দিতেও ও ভুলে গেল, কুড়ি সেকেন্ড পরে ‘হ্যালো হ্যালো’ করে ফোন সুইচ অফ করে দেওয়ার পরিকল্পনাটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গেল।
বলল, ‘মানে? তুই কবে আবার আমায় দেখলি?’
শুভ্রদীপ সেইরকমই মাখন লাগানো গলায় বলল, ‘কেন? কয়েক দিন আগেই তো দেখলাম তুমি আর গীতিকা বলে তোমার জুনিয়রটা বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠলে। সেদিন আমারও অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, বাস-টাস পাব না ভেবে তোমাদের ডাকতে গেলাম, কিন্তু গাড়িটা বেরিয়ে গেল।’
অতন্দ্রর ইচ্ছে হল কোনো অলৌকিক উপায়ে মোবাইলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে শুভ্রদীপকে পিটিয়ে আসতে। একেই ওদের মধ্যে এই চলছে, তার মধ্যে এই হতভাগা ইনিয়ে বিনিয়ে জিনিয়ার কাছে গীতিকার সঙ্গে রাত করে বেরনোটা বলেছে।
‘তো, জিনিয়াদি প্রথমে জিজ্ঞেস করল, অতন্দ্র আর গীতিকাকে সেদিন ক-টার সময় দেখেছিলি? আমি বললাম রাত সাড়ে ন-টা দশটা। তারপর জিনিয়াদি আর কিছু বলল না, শুধু বলল ও কিছু জানে না তোমার রেজিগনেশন উইথড্র করার ব্যাপারে। তাই তোমাকে ফোন করলাম।’ শুভ্রদীপ পুরোনো দিনের নষ্ট হয়ে যাওয়া রেকর্ডের মতো ঘরঘর শব্দে পুরোটা বলে গেল।
অতন্দ্র বলল, ‘হ্যাঁ, আমি রেজিগনেশন উইথড্র করেছি। আর আমি অন্য কোথাও চাকরি পাইনি ভাই, আপাতত টেকি ওয়ার্ল্ডেই থাকব। তুই এখন রাখ, আমি একটু ব্যস্ত আছি।’
ফোনটা কেটে দিয়ে অবশ্য ওর নিজের ওপরেই বিরক্ত লাগল। জিনিয়া কী ভাবল, না ভাবল তা নিয়ে ওর এত চিন্তারই-বা কী আছে? জিনিয়া যা করেছে, তারপর কোনোভাবেই আর ওদের মধ্যে জোড়া লাগা সম্ভব নয়। ওদের এত বছরের সম্পর্কে এতটা তিক্ততা এর আগে কখনো আসেনি।
হ্যাঁ, জিনিয়া যে বরাবরই আবেগপ্রবণ, সেটা ও প্রথম থেকেই জানত। ভালোবাসলেও হইহই করে, ঝগড়া হলেও চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একশা করে। কখনো কখনো আবেগের বশে হঠকারী কাজও করে ফেলে। তা নিয়ে মাঝে মাঝে অতন্দ্রর মাঝেমাঝে বিরক্ত লাগলেও এতটা বাড়াবাড়ি জিনিয়া কখনো করেনি। এখনও সেদিন রাতের ঘটনাটা ভাবলে ওর মাথায় রক্ত উঠে যায়। অফিসে কাজ করতে করতে কখনো মনে পড়লে কুঁকড়ে যায় নিজে থেকে, মনে হয় গীতিকা নিশ্চয়ই সবাইকে বলে দিয়েছে ঘটনাটা। সবাই আড়ালে অতন্দ্রকে দেখে হাসছে।
গীতিকা মেয়েটার বাবা-মা নেই। আত্মীয়স্বজনও তেমন যোগাযোগ রাখে না। মেয়েটা উচ্ছল প্রাণবন্ত হলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ একা। চট করে মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, এমনভাবে কথা বলে যেন মনে হয় কতদিনের পরিচয়! ওর মধ্যে অফিসসুলভ হিংসুটেপনাও নেই। হয়তো চাকরিতে নতুন বলে ওইসব এখনও শিখে উঠতে পারেনি। তার ওপর মেয়েটার মধ্যে কোনো ন্যাকামি নেই, যা এই সেক্টরে দেখতে দেখতে অতন্দ্র অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। কিছু মেয়ে অকারণে এমন ন্যাকামি করে, বোঝা যায় না তারা অফিসে এসেছে, না, র্যাম্পে হাঁটতে এসেছে।
এইসব কারণের জন্য শুধু অতন্দ্র নয়, ওদের প্রোজেক্ট এবং গোটা উইং-এ খুব অল্প সময়ে গীতিকা পুরুষ নারী সব মহলেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু অতন্দ্র ওর সঙ্গে ভালোভাবে মিশেছিল বলেই জানে হাসিখুশি মেয়েটার মনের মধ্যে রয়েছে অনেক কষ্ট। ও বলেওছিল একবার, ‘জানো অতন্দ্রদা, বাবা-মা যতই বৃদ্ধ হোক, অসুস্থ হোক, অথর্ব হোক, তাঁরা এই পৃথিবীতে আছেন জেনেও অনেক স্বস্তি বোধ করা যায়। মনে হয় এমন কেউ আছে যার কাছে গিয়ে আমি ভরসা পেতে পারি। কিন্তু আমার তেমন কেউ নেই। বিবস্বান না থাকলে আমি হয়তো এতদিনে কিছু একটা করে ফেলতাম।’
‘তুই-ই তো বলিস, গ্লাসের অর্ধেক ফাঁকা না দেখে অর্ধেক ভরতি দেখতে।’ অতন্দ্র নরম গলায় বলেছিল, ‘বাবা-মা নেই ঠিকই, কিন্তু বিবস্বান তো তোকে সত্যিই ভালোবাসে। তোর বিপদে, আপদে, দুঃখে সবসময়েই পাশে থাকে। তুই নিজেই বলেছিস। তার ওপর একদম পাশের বাড়ি। তোর কোনো অসুবিধাই নেই। দ্যাখ, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। তুই এবার ভবিষ্যতের দিকে তাকা।’
গীতিকা মাথা নেড়ে সেদিন চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু ওর একমাত্র কাছের মানুষ, যার সঙ্গে ও জীবনের বাকিটা কাটাবে বলে ঠিকই করে রেখেছিল, তার কাছ থেকেই যে এমন প্রচণ্ড আঘাত পেতে পারে, সেটা বোধ হয় মেয়েটা কল্পনাও করতে পারেনি।
মাসকয়েক আগে গীতিকা ছুটি নিয়ে জলপাইগুড়িতে নিজের বাড়ি গেছিল। ব্যাঙ্কের কিছু কাজ, বাড়ি দেখাশোনা, এসব তো ছিলই, প্রায় মাস ছয়েক পর বিবস্বানের সঙ্গে দেখা করাটাও ছিল ওর একটা উদ্দেশ্য।
কিন্তু কলকাতা ফিরে মেয়েটা মনমরা হয়ে বসেছিল। অতন্দ্র বারবার জিজ্ঞেস করতে একটা কথাই বলছিল, ‘সবাই কি পালটে যায় অতন্দ্রদা? কেউ কি একরকম থাকে না? তবে আমি কেন পালটাতে পারিনা নিজেকে?’
‘কী হয়েছে কী?’ অতন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বিবস্বানের সঙ্গে ঝগড়া হল নাকি গিয়ে?’
‘নাহ, ঝগড়া হবে কেন!’ গীতিকা কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে বসেছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘ঝগড়া করার জন্যও সময় লাগে অতন্দ্রদা। বিবস্বানের আমার জন্য সেই সময়টুকুও নেই।’
অতন্দ্র বোঝানোর ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘আরে তুই নিজেই তো বলেছিস, ছেলেটা কেবল অপারেটরের ব্যবসায় খুব খাটছে। আর এখন তো এমনিই ডিশ টিভিগুলোর দৌরাত্ম্যে মনে হয় ওদের একটু হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। তুই আর ও দু-জনে যাতে ভাল থাকতে পারিস, সেইজন্যই তো পরিশ্রম করছে। সেটা তো তোকে বুঝতে হবে, নাকি?’
গীতিকা ম্লানমুখে বলেছিল, ‘আমি সেসব বুঝি অতন্দ্রদা। কিন্তু, আমি সেটা বলতে চাইছি না। বিবস্বান কেমন যেন হয়ে গেছে। ওর কাছে আমি হয়তো একটা রক্তমাংসের মেয়ে ছাড়া আর কিছুই নই। আমার দুঃখ কষ্ট ইচ্ছে এসব শোনার ওর কোনো তাগিদ নেই। নিজের চাহিদা পূরণ করতে পারলেই ওর হল।’
সেদিন গীতিকা এর চেয়ে বেশি কিছু খুলে বলতে পারেনি। অতন্দ্রও ওই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তখন তার অফিস এবং ট্রাভেল এজেন্সির কাজ নিয়ে ব্যস্ততা চরমে। অনেক কষ্টে পুষ্পমের বাবা-র মতো কয়েকটা কাস্টমার ও জোগাড় করতে পেরেছে।
অফিসেও শেষদিন এগিয়ে আসছিল। অতন্দ্রর এতদিনের স্কিল ঝড়ের গতিতে শেখাতে হচ্ছিল প্রোজেক্টের জুনিয়ারদের। কথা বলতে হচ্ছিল ক্লায়েন্টের সঙ্গেও।
এইরকম সময়ে এত ব্যস্ততার মধ্যেও অতন্দ্র খেয়াল করত, গীতিকা জলপাইগুড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে রেখেছে। আগের মতো কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে না, দুমদাম মজার কথা বলে প্রোজেক্টে হাসির রোল ফেলে দেয় না। অতন্দ্র নিজের মতো করে মজা করে, হালকা ইয়ার্কি মেরে গীতিকার মন ভালো করার চেষ্টা করত, কিন্তু তেমন কোনো লাভ হত না। অতন্দ্রর সবসময় মনে হত, মেয়েটা কিছু একটা লুকিয়ে রাখছে মনের ভেতর, যেটা কাউকে বলতে পারছে না বলেই গুমরে গুমরে মরছে।
তখন গীতিকা সবটা খুলে বলতে না পারলেও শেষমেষ কিছুটা বলেছিল। সেদিন নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে রাজ্য পর্যটন মেলার শেষ দিন ছিল। অতন্দ্রর যাওয়ার কথা থাকলেও ওইসময় হঠাৎ একটা ডেলিভারি এসে যাওয়ায় ও যেতে পারেনি, পুরো চাপটা গিয়ে পড়েছিল জিনিয়ার ওপর। ও যতটা পারছিল ফোনে জিনিয়াকে পরামর্শ দিচ্ছিল, বোঝাচ্ছিল, ঠিক করে রেখেছিল শেষদিন জিনিয়ার সঙ্গে বসে পুরোটা শুনবে, তারপর আগামী পরিকল্পনা তৈরি করবে। শুধু তাই নয়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জিনিয়াও ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে অশান্তি করছে, ভুলভাল জেরা করছে, ও-ও মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে আজেবাজে বলে দিচ্ছে।
সেদিন বাড়ি ফেরার সময় ও জিনিয়ার সবচেয়ে পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি-কাবাব পার্সেল করে নিয়েছিল। আজ দু-জনে একটু ভালো করে খাবে, গল্পগুজব করবে। এত বড়ো একটা ঝুঁকি নিচ্ছে দু-জনেই, তার মধ্যে নিজেদের এই সব ছোটোখাটো ভুল বোঝাবুঝি হলে চলে?
কিন্তু কিছুই করা গেল না। তার আগের কয়েকদিন গীতিকা অফিস আসেনি। মেসেজ করে জানিয়েছিল শরীরটা খারাপ, তাই যেতে পারছে না। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা অতন্দ্র যখন বাড়িতে ঢুকছে, তখনই ফোন করেছিল মেয়েটা।
অতন্দ্র বলেছিল, ‘দেখ, কিছু মনে করিস না, আমি বুঝতে পারছি তোর শরীরটা ভালো নেই বলে আসছিস না, কিন্তু প্রোজেক্টে এই নিয়ে কথা উঠছে। অনেকেই ঠারেঠোরে কৌশিকদাকে বলছে যে, ডিপ্লয়মেন্ট চলছে, এইসময় গীতিকা কতদিন বাড়িতে বসে থাকবে! তোর কী হয়েছে, সেটাও তো কেউ জানে না। আমি বলি কী, তুই তোর ডাক্তারকে দিয়ে রেস্ট নেওয়ার কথাটা লিখিয়ে আমাকে প্রেসক্রিপশন পাঠা, তারপর আমি দেখছি।’
গীতিকা চুপ করে গিয়েছিল। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় খালি বলেছিল, এই কদিন কেমন ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে ওকে। অতন্দ্রকে অনেক বিশ্বাস করে ও বলে চলেছিল, কীভাবে হঠাৎ প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছে ও। বিবস্বান জলপাইগুড়ি গিয়ে থেকেই শারীরিক চাহিদা ছাড়া অন্য কোনো অর্থে ওকে ব্যবহার করেনি। গীতিকা ফিরে আসার পর আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছিল। দিনে একবারও নিজে থেকে ফোন করত না, খোঁজখবর রাখা তো দূরের কথা। আর কী প্রচণ্ড নিষ্ঠুরভাবে গীতিকার এই খবর শোনার পর থেকেই ও আরও উন্নাসিক ব্যবহার করছে।
না, গীতিকা পুরোনো দিনের মেয়েদের মতো এর দায় বিবস্বানকে একবারও নিতে বলেনি। দু-জনের সম্মতিতেই ওরা মিলিত হয়েছিল। সুতরাং গীতিকা নিজে কেন এর দায় অস্বীকার করবে! কিন্তু ওর কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে এই খবর শোনার পর ও ভেবেছিল বিবস্বান আবার আগের মতো হয়ে উঠবে। কিন্তু না, বিবস্বান একটু বেশিই যেন রূঢ় ব্যবহার করছে।
অতন্দ্র শুনতে শুনতে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। জীবনে কোনোদিনও এই অবস্থায় ও কাউকে পড়তে দেখেনি। সিনেমাতেই এতকাল দেখে এসেছে, যে প্রেমিকা অন্তঃসত্ত্বা অথচ প্রেমিক পাশে নেই।
কিন্তু বাস্তবে কি এমন কেউ হতে পারে? নিজের এত বছরের প্রেমিকা, যার নিজের বলতে কেউ নেই, তার এই অবস্থায় কেউ পাশে না দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?
ও কী বলবে বুঝতে না পেরে বলেছিল, ‘কেন, বিবস্বান এখনো বলছে দু-বছর পরেই বিয়ে করবে?’
গীতিকা ক্লান্ত গলায় বলেছিল, ‘দু-বছর পর! অতন্দ্রদা, তুমি যে কী বলছ! আমি জলপাইগুড়ি থেকে ফিরে আসার পরে পরেই বিবস্বান আমাকে এড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। কারণ হিসেবে বলছিল, ওর মা নাকি আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে একদমই চান না।’
‘সে কী! চায় না কেন?’ অতন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিল।
গীতিকা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলেছিল, ‘অনেক কারণ। আমি অনাথ। বাবা-মার কোনো ব্যাক আপ নেই। মা মারা যাওয়ার আগে মায়ের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা পাড়ায় প্রতিবেশীদের কাছে ধার করতে হয়েছিল। সেগুলো আমাকে এখনও শোধ করে যেতে হচ্ছে। এগুলো ওদের কাছে লজ্জার। তার ওপর এখন আমি একা কলকাতায় থাকছি, চাকরি করছি। তার মানে আমি নির্ঘাত উচ্ছৃঙ্খল, সংসারী ঘরোয়া মেয়ে নই।’
‘কী আশ্চর্য!’ অতন্দ্র আর কোনো কথা খুঁজে পায়নি, ‘তুই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিস, আর চাকরি করবি না? আর চাকরি না করলে ওই ধারগুলো কি ওরা শোধ করে দেবে?’
‘এসব বুঝিয়ে লাভ নেই, অতন্দ্রদা। ওরা এসব বোঝে না। আমি গত কয়েকদিন অনেক লড়াই করেছি। ওর সঙ্গে, শেষমেশ নিজের সঙ্গে। তাতে শরীর আরও খারাপ হচ্ছিল। অবশেষে গত পরশু সব ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছি।’
‘ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছিস মানে?’ অতন্দ্র তখন বোঝেনি গীতিকা কী বলতে চাইছে।
‘আর দেরি করলে কিছু করা যেত না। তাই কাছের একটা ঘুপচি ক্লিনিকে গিয়ে … জানি খুব বড়ো অন্যায় করলাম। কিন্তু কী করব বলো!’ গীতিকার গলাটা প্রচণ্ডভাবে কাঁপছিল, ‘এই সপ্তাহটা গোটাটাই অফিস যেতে পারব না। শরীর মন দু-দিক থেকেই পুরো ভেঙে গেছি। অ্যাবরশন করতে গেলে হাজব্যান্ডেরও সম্মতি লাগে, কিন্তু সেই সই আমি কোথায় পাব! তাই বাধ্য হয়ে নোংরা বাজে একটা ক্লিনিকে গিয়ে … তুমি কৌশিকদাকে অন্য কিছু বলে একটু সামলে দিও, ডেলিভারির কাজ রয়েছে তো!’
অতন্দ্র তড়িঘড়ি বলেছিল, ‘আরে সেসব নিয়ে ভাবিস না। আমি কথা বলে নেব। কিন্তু তুই এটা কেন করলি? মানে … আমি কী বলব বুঝতে পারছি না! বিবস্বান এইরকম কেন করল?’
‘জানিনা।’ গীতিকা ভারী গলায় বলেছিল, ‘একটা মানুষের সঙ্গে এতবছর সম্পর্কে থেকেও আমি তাকে চিনতে পারিনি। এটা আমারই দোষ অতন্দ্রদা!’
এইসব কথোপকথনের মাঝে জিনিয়া যে প্রচণ্ড উশখুশ করছিল, তা অতন্দ্র বুঝতে পারছিল। কিন্তু অতন্দ্র চাইলেও ফোনটা রাখতে পারছিল না। একটা মেয়ে, এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা, তার এত বড়ো বিপদে, এত বড়ো বিপর্যয়ে সে অতন্দ্রকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলে একটু হালকা হচ্ছে।
এইসময় ফোনটা ও কী করে রেখে দেবে?
যাই হোক, এইভাবে প্রায় পনেরো মিনিট বোধ হয় কথা বলেছিল। তারপর ফোন রেখে ঘরে এসে জিনিয়ার গাল টিপে বলেছিল, ‘সরি জিনি। বিরিয়ানি এনেছি। তোমার প্রিয় দোকান থেকে। ঝটপট গরম করো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
জিনিয়া তখন রেগে ছিল, তবু মুখ ভার করেই বলেছিল, ‘মঙ্গলাদি সব রান্না করে গেল তো!’
‘ভাঁড় মে জায়ে মঙ্গলাদি! আজ বিরিয়ানিই খাব। ওসব খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও। কাল দেখা যাবে’খন।’
আর তারপরই ঘটনাটা ঘটল। অতন্দ্র যখন বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হচ্ছিল, তখন গীতিকা ওকে একটা মেসেজ করেছিল, যে এগুলো যেন অতন্দ্র কাউকে না বলে।
কিন্তু অতন্দ্র সেটা দেখার আগেই জিনিয়া দেখতে পেয়ে গেছিল। আর পুরো ব্যাপারটাকে এত অসম্ভব উলটোভাবে নিল, যেটা ভাবলে রাগে অতন্দ্রর এখনও শরীর গরম হয়ে ওঠে।
অতন্দ্র বাথরুম থেকে শুনতে পেয়েছিল, জিনিয়া প্রচণ্ড চিৎকার করছে। ও দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।
জিনিয়া হিস্টিরিয়া রুগির মতো কাঁপতে কাঁপতে বলছে, ‘তোমাদের নোংরামি এতদূর পৌঁছেছে? এতদূর?’
অতন্দ্র কিছু বুঝতে পারার আগেই জিনিয়া ততক্ষণে ফোন করে ফেলেছে গীতিকাকে, আর ওপারে ফোন রিসিভড হওয়ামাত্র যাচ্ছেতাই বলতে শুরু করেছে। সেই সংলাপ শুনলে কেউ বলবে না জিনিয়া একটা শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন মেয়ে। প্রতারণা, চরিত্রহীনতা, লাম্পট্যের মতো একাধিক গুরুতর অভিযোগ তুলে তুলে গীতিকাকে ধারালো ছুরির মতো করে কাটছিল জিনিয়া।
অতন্দ্র মুহূর্তে পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছিল। আর বুঝে ও হতবাক হয়ে গিয়েছিল। জিনিয়া কী করে এটা কল্পনা করতে পারল যে গীতিকার ওই অ্যাবরশনের সঙ্গে অতন্দ্র জড়িয়ে! অন্য সময় হলে ও রেগে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত, কিন্তু জিনিয়ার সেই মূর্তি দেখে ও-ও সেই মুহূর্তে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
গীতিকা যতই মুহূর্তের দুর্বলতায় ওকে সবকিছু খুলে বলুক, ও অতন্দ্রর সহকর্মী। পাশাপাশি ডেস্কে বসে দিনে দশ ঘণ্টা কাজ করে ওরা। আর সেই সহকর্মীকে ওর স্ত্রী এইসমস্ত অকল্পনীয় বাজে কথা বলছে, ভাবতে গিয়ে ওর মাথার স্নায়ুগুলোতে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছিল। ও জোড় হাত করে জিনিয়াকে বোঝাচ্ছিল, ‘তুমি ভুল ভাবছ জিনিয়া! ভুল! গীতিকার কোনো দোষ নেই। পুরো ব্যাপারটাই তুমি উলটে ভাবছ। ফোনটা রাখো, আমি সব বোঝাচ্ছি, প্লিজ!’
জিনিয়া একমুহূর্তের জন্যও সেই কাতর আবেদনে সাড়া দেয়নি। উলটে যে মেয়েটা এমনিই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে, তাকে জঘন্য সমস্ত কথা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল।
সেদিন অতন্দ্র সত্যিই চণ্ডাল হয়ে গেছিল। প্রচণ্ড লজ্জায় আর গ্লানিতে উন্মত্ত হয়ে ও আর মানুষের মধ্যে ছিল না।
পুরোটা খুলে বলার পর জিনিয়া হয়তো বিশ্বাস করেছিল। হয়তো বুঝতে পেরেছিল কী ভুল করেছে। সম্ভবত প্রচণ্ড অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিল, বার বার করে অতন্দ্রর কাছে ক্ষমাও চাইছিল। কিন্তু সেসব করে অতন্দ্রকে আর থামানো যায়নি।
জিনিয়া ক্ষমা চাওয়ার জন্য গীতিকাকে ফোনও করতে গিয়েছিল। অতন্দ্র হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল।
রাত আড়াইটের সময় জিনিয়া যখন ক্যাব বুক করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, ততক্ষণে ফ্ল্যাটের কোনো জিনিসই বলতে গেলে আস্ত ছিল না। জানলার পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, কাচের শো-পিস, ড্রেসিং টেবিলের আয়না সব ভেঙেচুরে ছড়িয়েছিল গোটা ফ্ল্যাটে।
ভাবতে ভাবতে অতন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যখন কোনো সম্পর্ক ঠিক হওয়ার, তখন সব দিক থেকেই তা ঠিক হয়। আর যখন ঠিক হওয়ার নয়, তখন আশপাশের নানা ঘটনায় সেটা আরও অবনতির দিকে চলে যায়।
এই যেমন শুভ্রদীপের কি সেদিন ওদের দেখতে পাওয়াটা একান্তই দরকার ছিল? আর যদি বা পেল, সেটা জিনিয়াকে বলাটা?
শুভ্রদীপের ওপর রাগ করে লাভ নেই, এটা নিয়তি।
অতন্দ্র ভাবল, শুভ্রদীপের কথা শুনে জিনিয়ার নিশ্চয়ই ওর ওপর ঘৃণা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। কিন্তু তাতে ওর কিছু যায় আসে না।
ঠিক যেমন সেই রাতে জিনিয়া যখন চিৎকার করে কথাগুলো গীতিকাকে বলছিল, অতন্দ্র পাশ থেকে হাতজোড় করে ওকে ওইসব বলতে বারণ করছিল, তখন যেমন জিনিয়ার কিচ্ছু যায় আসছিল না, ঠিক তেমনই এখনও অতন্দ্রর কিছু যায় আসছে না।
এই উপলব্ধিটা করামাত্র অনেক হালকা লাগল ওর। নিজে অপরাধবোধে ভোগার চেয়ে অন্যকে একই দোষে দোষী করে নিজেকে হালকা লাগানো অনেক ভালো। ও মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে একটা সিনেমা দেখায় মন দিল।
মনে মনে নিজেকে বলল, দাশগুপ্ত ট্রাভেলস ওর জীবনের একটা শেষ হয়ে যাওয়া অধ্যায়।
দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের মালকিনও তাই। টেকি ওয়ার্ল্ডের সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ওর জীবনটা যেমন চলছিল, এরপর থেকে তেমনই চলবে।
১৭
আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিশাইলে মূলতানে—
গুঞ্জন তার রবে চিরদিন, ভুলে যাবে তার মানে।
টেপরেকর্ডারে রবীন্দ্রসংগীত বেজে চলেছিল খুব মৃদু লয়ে। আরতি বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিলেন। তাঁর একতলার ঘরের বিছানার পাশে দক্ষিণ খোলা জানলা, সেখান দিয়ে বাইরের বাগানের লঙ্কাগাছগুলো দেখা যাচ্ছে। ছোটো ছোটো গাছ, তার মধ্যে থোকা থোকা লাল লঙ্কা হয়েছে।
সবুজের মধ্যে লাল কচি লঙ্কাগুলো নরম রোদের পড়ন্ত বিকেলে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে হালকা হাওয়া দিচ্ছে আর গাছের পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
এত দূর থেকে আরতির মনে হচ্ছে, ওগুলো লঙ্কা নয়, একেকটা লাল রঙের ফুল। তাঁর জীবনের ভুলগুলো সব ফুল হয়ে ফুটেছে তাঁরই হাতে।
আরতি স্থিরচোখে তাকিয়ে ছিলেন। এই লঙ্কাগাছগুলো তিনি অনেক যত্নে লাগিয়েছিলেন। শুধু এগুলোই নয়, গাছগুলোর পেছনের দিকে যে টবগুলো এখন পেটে শুধু জমাট মাটি নিয়ে অপেক্ষা করছে নতুন বীজরোপণের, সেগুলোতেও আগের বছর পর্যন্ত আরতি শীতকালে অনেক ফুল ফুটিয়েছেন। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, লিলি, জিনিয়া।
হাটতলার আকবরকে বলাই ছিল। নতুন কোনো চারা এলেই সে দিয়ে যেত মাস্টারমশাইয়ের বউকে। মানকড় পাথুরে এলাকা বলে বাগানের জমিতে নয়, টবেই ফুল ফোটাতে হয়। অনেকে বলে, টবে সব ফুল হয় না। কিছু ফুলগাছ অত অল্প পরিসর নয়, পুরো জমির ভালোবাসা চায়।
কিন্তু আরতি বিশ্বাস করতেন, তাঁর হাতের ভালোবাসায় সব ফুল ফুটবে। আর ফুটতও।
আরতি আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে নিলেন। বাহারি ফুলগাছে অনেক খাটনি, নিয়মিত মাটি চাঁছা, সার দেওয়া, আরও নানা কাজ লেগেই থাকত। আরতি একাই সেসব করতেন।
কিন্তু শরীর খারাপ যখন দিনদিন বাড়ছিল, তখন প্রাণপণ ইচ্ছে থাকলেও আর পেরে উঠছিলেন না। মালি রেখেও লাভ হয়নি, এই বিছানায় বসে জানলা দিয়ে সব দেখতে পেতেন তিনি, কিছুতেই মালির কাজ পছন্দ হত না তাঁর। মনে হত মালির হাতের স্পর্শে কোনো ভালোবাসা নেই, আছে শুধুই যান্ত্রিকতা। সেই কঠোর নিয়মমাফিক হাতে যেন তাঁর আদুরে ফুলগুলো অভিমানে কেঁপে উঠছিল। শেষে এমন হল, মালি আসতে থাকলেও তিনি তাকে গাছে হাত দিতে দেন না, অসুস্থ শরীরে গিয়ে নিজেই পরিচর্যা করেন।
কিন্তু শেষে তাও পেরে উঠলেন না। মাঝে বেশ কিছুদিন একেবারে শয্যা নিতে হল। সেই ফাঁকে অর্ধেক গাছই মরে গেল। যত্ন না পেয়ে।
একটু সুস্থ হয়ে উঠে স্বামীর পরামর্শে তাই তিনি লঙ্কাগাছ লাগিয়েছিলেন। কোনো ঝামেলা নেই, শুধু নিয়মিত জল দিলেই হল।
কিন্তু সেই জলটুকুও দিতে পারেননি কত মাস। তাঁর হয়ে কখনো কাজের মেয়ে টুম্পা, কখনো যাদবচন্দ্র নিজে দিনে একবার করে জল দিয়েছেন। এই রুক্ষ এলাকায় এত অযত্নে কোনো গাছ বেঁচে থাকার কথা নয়।
তবু লঙ্কাগাছটা বেঁচে রয়েছে এবং এত সুন্দর সব লঙ্কাও হয়েছে তাতে।
আরতি একটা নিশ্বাস ফেললেন। রোজ অন্তত কুড়িটা ওষুধ খেতে হচ্ছে তাঁকে। ইচ্ছে থাকলেও তিনি ওই লঙ্কাগুলো খেতে পারবেন না, ডাক্তারের নির্দেশে তাঁর এখন ঝাল খাওয়া পুরোপুরি বারণ।
আরতির কষ্টটা আজ সকাল থেকে আবার বেড়েছে। তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণা দপ দপ করতে করতে ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা শরীরে। সেই অসহ্য ব্যথাটা গিয়ে যোগ দিচ্ছে কোমর, পা ও শরীরের আর অনেকগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে। সব মিলিয়ে আরতির মনে হচ্ছে কেউ তলপেটটা ধারালো ছুরি দিয়ে তাঁর শরীর থেকে কেটে নিলে তিনি হয়তো একটু আরাম পাবেন।
তিনি নীরবে জানলা দিয়ে দেখতে দেখতে মাথায় হাত বোলান। চুল প্রায় নেই, তালুর স্পর্শে মাথার শক্ত খুলিটাই শুধু ছুঁতে পারেন এখন তিনি।
এককালে তাঁর অনেক চুল ছিল। সোজা আঁচড়ালে ঢাল বেয়ে নামত কোমরের নীচ পর্যন্ত। যাদবচন্দ্র বহুবার বলেছেন, পাত্রী দেখতে গিয়ে ওই চুলই নাকি তাঁকে টেনেছিল সবচেয়ে বেশি। বছরকয়েক আগেও মোটা বিনুনি করতে গিয়ে হাত ব্যথা করত।
সেই চুলের এক ছটাকও এখন আর আরতির নেই।
কেমোয় সব উঠে গেছে। গোটা মাথাটাই ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল। এখন সেই ন্যাড়া মাথায় হালকা মেঘের মতো পাতলা চুল ছড়িয়ে আছে। কোটরে প্রায় ঢুকে যাওয়া চোখ নিয়ে, সুতির রাতপোশাক পরে তিনি বসে থাকেন। কয়েকমাস আগে অবধিও শাড়ি পরতেন। কিন্তু টুম্পার পরিয়ে দেওয়ার অসুবিধার জন্য সেসব পাট চুকেছে।
আরতি উঠে বসে জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। ঘরের মধ্যে মেঝেতে টুম্পা বসে আছে।
আরতির দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে বসে আনাজ কাটছে। বঁটিতে সবজি কাটার শব্দ হচ্ছে, কচ কচ।
আরতি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাই টুম্পা, ক-টা আলু কাটছিস? পটলগুলো সরু সরু করে কাটবি। মোটা করে কাটলে তোর জেঠু কিন্তু খাবে না।’
টুম্পা ওদিকে ফিরেই জবাব দিল, ‘সব ঠিক কাটছি। তুমি ঘুমোও তো!’
আরতি হঠাৎ রেগে গেলেন, ‘কেন রে? ঘুমোব কেন আমি? আমি ঘুমোলে তোর বুঝি খুব সুবিধে হয়? কলাটা মুলোটা সরাতে পারিস না বুঝি? আমি দেখতে পেয়ে যাব বলে উলটো দিক করে বসেছিস!’
টুম্পা উত্তর দিলনা, জেঠিমার কথায় রেগেও গেল না। শুধু বঁটিটা ঘুরিয়ে আরতির দিকে মুখ করে বসল।
জেঠু ওকে বুঝিয়ে বলে দিয়েছে। জেঠিমার শরীর দিন দিন যত খারাপ হচ্ছে, মুখও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পান থেকে চুন খসলে চিৎকার করে। অথচ টুম্পা যখন প্রথম এই বাড়িতে কাজে এসেছিল, জেঠিমা খুব শান্ত আর হাসিখুশি ছিল। রান্না করতে করতে গুনগুন করে গান গাইত। টুম্পাকে দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার, বাসন মাজা এইসব করালেও রান্নাঘরটা কিছুতেই ছাড়ত না। জেঠু বহুবার বললেও না। বলত, ‘এই ব্যাপারটা অন্তত আমায় সামলাতে দাও। আমার কষ্ট হবে না। আমার সবটুকু কেড়ে নিয়ো না।’
কিন্তু যেদিন থেকে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে, সেদিন থেকে জেঠিমা খুব বদলে গিয়েছে। রান্নাঘরের দায়িত্বটাও যে আর নিতে পারছে না, এই মানসিক দুঃখেই হয়তো তিরিক্ষি হয়ে পড়েছে।
হয়তো সব মানুষই এমন অবস্থায় পড়লে, শরীরে মনে এত কষ্ট পেলে বদলে যায়। টুম্পা বোঝে। তাই ও চেষ্টা করে যতটা সম্ভব জেঠিমাকে শান্ত রাখতে।
ও ফালি ফালি করে পটল কেটে একটা উঁচু করে তুলে দেখাল, ‘দেখো, পছন্দ হয়েছে?’
আরতি এবার একটু শান্ত হলেন। যন্ত্রণায় মুখটা তাঁর বেঁকেচুরে যাচ্ছে। কিছু কিছুদিন তলপেটের যন্ত্রণাটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। তখন পেনকিলার খেয়েও কাজ হয় না। কিছু করার নেই।
এসব যে হবে, ডাক্তার তা আগেই বলে দিয়েছেন। জরায়ুতে ক্যানসার, এত দ্রুত খারাপ কোষগুলো শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে যে কেমোথেরাপি করেও পুরোপুরি বাগে আনা যাচ্ছে না।
আরতি নরম গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক আছে। তোর জেঠু কোথায়? একবার ডাকবি?’
টুম্পা গিয়ে ডাকতে যাদবচন্দ্র উদবিগ্নমুখে বাইরের বারান্দা থেকে ঘরে এলেন। তাঁর হাতে একটা ডায়েরি আর পেন। চোখে দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘কী হল? এখনও ব্যথা হচ্ছে? ওষুধ খেলে, কমেনি? ড ত্রিপাঠীকে কি একটা ফোন করব?’
আরতি হাত নেড়ে বারণ করলেন। জোরে শ্বাস নিলেন কিছুক্ষণ, তারপর একটু থেমে বললেন, ‘ওদিকের কী খবর গো? যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে গেল?’
যাদবচন্দ্র বললেন, ‘না। সেই ব্যাপারেই সকালবেলা মনস্থ করলুম তোমার সঙ্গে কথা বলব, তা সকাল থেকে তোমার যন্ত্রণা দেখে …।’
‘আমি এখন ঠিক আছি।’ আরতি টুম্পার দিকে তাকালেন, ‘যা তো মা, একগ্লাস জল নিয়ে আয়। হ্যাঁ তুমি বলো। সাতসকালেই যে ব্যাঙ্কে ছুটলে, কিছু গোলমাল হল নাকি?’
টুম্পা কুটনো কোটা ফেলে জল আনতে গেল। কে বলবে, একটু আগের সেই চিৎকার করা মানুষটা আর এই মানুষ এক! শারীরিক কষ্ট মানুষকে অনেক সময় বদলে দেয়। ওর কখনো এমন কিছু হলে ও নিজে হয়তো অমন হয়ে যাবে।
যাদবচন্দ্র বললেন, ‘ব্যাঙ্কে ছুটলাম গ্লোবাল টুরস বলে কোম্পানিটাকে যে চেকটা দিয়ে এসেছিলাম সেটা স্টপ পেমেন্ট করার জন্য।’
আরতি তাকিয়ে আছেন দেখে যাদবচন্দ্র বোঝাবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্টপ পেমেন্ট করলে ওরা আর চেকটা ভাঙাতে পারবে না। আপাতত ওদের সঙ্গে যাব না ঠিক করেছি। টাকাটাও বেশি নিচ্ছে, আর অতগুলো দেশ আমাদের দরকার নেই। তার চেয়ে নতুন একটা কোম্পানির খোঁজ পেয়েছি। ওদের সঙ্গে একবার কথা বলব বলে ভাবছি।’
‘ও!’ আরতি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে যাওয়া তাদের?’
যাদবচন্দ্র মাথা নাড়লেন, ‘কিছুই জানি না। কলকাতায় সেদিন একটা হ্যান্ডবিলের বিজ্ঞাপন দেখলাম। ফোন করব আজ।’
‘খুব বেশি দেরি হলে …।’ আরতি এক লহমার জন্য ঠোঁট কামড়ালেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আমি ততদিন থাকব তো?’
‘এ আবার কী কথা?’ যাদবচন্দ্র রেগে উঠতে গিয়েও পারলেন না। আরতির কেমোর সংখ্যা দিন দিন যত বাড়ছে, তাঁর নিজের মনের জোরও ততই কমে আসছে যেন। তবু বললেন, ‘থাকবে না কেন? এইবার ড ত্রিপাঠী বললেন? কেমোতে ভালো রেসপন্ড করছ তুমি।’
আরতি যেন শুনতেই পেলেন না স্বামীর বলা মিথ্যা কথাটা।
জানলা দিয়ে বাইরের লঙ্কাগাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাজু আমার হাতের সেই লঙ্কার আচার খেতে কী ভালোবাসত মনে আছে? তুমি তারিখ ঠিক করে ফেললেই টুম্পাকে বলব সব লঙ্কাগুলো পেড়ে ফেলতে। ওদেশে তেমন ঝাল খেতে পায় কি না কে জানে!’ বলতে বলতে স্বামীর দিকে ফিরলেন আরতি, ‘আমরা সত্যি সত্যি রাজুর কাছে যাচ্ছি গো? সত্যি? ঠাকুর আমায় এত করুণা করবেন? তদ্দিনে আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে না তো?’
বলতে বলতে আরতি দু-হাত মাথায় ঠেকিয়ে ঘনঘন প্রণাম ঠুকতে শুরু করলেন, ‘এইটুকু আমায় দয়া করে ঠাকুর! যাওয়ার আগে ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখতে চাই! কতদিন ওর মুখটা দেখিনি!’
যাদবচন্দ্র কান্নাটাকে গলার মধ্যেই গিলে ফেললেন। কান্না গিলে ফেলার অনেক সুবিধে আছে। এক, কান্নাটা বাড়তে পারে না। দুই, নিজের কষ্টটা অন্যের কাছে দিব্যি লুকিয়ে রাখা যায়। বহু কষ্টে তিনি এই কৌশল রপ্ত করেছেন। শিক্ষিত সমর্থ ছেলে এতই ব্যস্ত যে মাকে দেখতে আসা তো দূর, ফোন করে খবরও নেয় না।
যাদবচন্দ্রর কাছে রাজুর ফোন নম্বরও ছিল না। ছিল শুধু একটা ই-মেল আইডি। বছরখানেক আগে আরতির এই কালরোগ ধরা পড়ার পর প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। কীভাবে, কোথায় এ রোগের চিকিৎসা করাবেন, তার খরচাপাতি এসব ভেবে ভেবে রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল তাঁর।
সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে পাড়ার একটা ছেলেকে দিয়ে ই-মেলে সব লিখে পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। তারপর অন্তত একটা মাস অধীর হয়ে অপেক্ষা করে থেকেছেন কখন ছেলের ফোন আসবে। বাইরের গেট টুং করে খোলার শব্দ পেলেই বুক ছ্যাঁত করে উঠেছে। মায়ের এত বড়ো অসুস্থতার খবর পেয়ে ফোন না করে ওই বুঝি ছেলে নিজেই চলে এল।
কিন্তু না। কিছুই আসেনি। স্ত্রীকে নিয়ে চূড়ান্ত উদবেগ, বিভিন্ন ডাক্তারের সঙ্গে কথাবার্তার মাঝেও ছেলের আসার, ছেলের গলা শোনার আশায় থাকা মন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে গিয়েছে।
যাদবচন্দ্র বুঝেছেন যে ছেলে আসবে না। আরতি যেদিন শেষবারের মতো এই বাড়ি থেকে চলে যাবেন, সেদিনও তার আসার সময় হবে না। কোনো যোগাযোগই রাখে না সে, আসা তো অনেক দূরের কথা!
আগে আরতি ছেলে দূরে চলে গিয়েছে বলে কাঁদলে যাদবচন্দ্র বিরক্ত হতেন। বলতেন, নিজে চিরকাল ছেলে সবার সেরা হোক, কাঁড়ি কাঁড়ি নম্বর পাক, দেশের দশের একজন হোক, তাই চাইতে। এখন সেইসব হয়ে কি সে এই মানকড়ে পড়ে থাকবে?
কিন্তু মায়ের ক্যান্সার শুনেও ছেলের কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় যাদবচন্দ্র বুঝেছিলেন। উপলব্ধি করেছিলেন যে সফল হওয়া এক জিনিস আর প্রকৃত মানুষ হওয়া আরেক জিনিস। রাজুকে তিনি লেখাপড়ায় সেরা করতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষ করতে পারেননি।
পারেননি তার মনে ন্যূনতম স্নেহ, মায়া, মমতা চারিত করতে।
এই এক বছরে যাদবচন্দ্রের জীবনে ডাক্তার-ওষুধ-হাসপাতাল ভীষণভাবে ঢুকে গেছে। জলের মতো টাকা বেরিয়েছে, গোটা বাড়িটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেছে। আরতির ছোটোখাটো কিন্তু লাবণ্যে ভরা কমনীয় চেহারাটা ঝড়ের গতিতে ভেঙেছে। একেকটা কেমোথেরাপি শেষ হয়েছে, আর আরতি বিধ্বস্ত হতে থেকেছেন, ভেবেছেন এই নারকীয় যন্ত্রণা সহ্যের চেয়ে মৃত্যুই ভালো।
এতকিছুর মধ্যেও যাদবচন্দ্র মনে মনে অপেক্ষা করেছেন একটা ফোনের। অসুস্থ স্ত্রীর ছেলেকে দেখতে চাওয়ার অবুঝ আর্তি সামলাতে সামলাতে প্রার্থনা করেছেন তিনি, একবার যেন আরতি রাজুর গলা শুনতে পায়।
কিন্তু না। রাজু আসেনি।
যে ছেলে মায়ের এই সংবাদ পেয়েও একটা খবর অবধি নেয় না, তার কথা কি ভাবা উচিত? মনে হলেই যাদবচন্দ্রের শিরায় রক্তপ্রবাহ দ্রুত হতে থাকে, রাগে নাড়ির গতি বেড়ে যায়। তবু তাঁর কিছু করার নেই।
যেদিন মনের খেয়ালে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন শেষ ইচ্ছের কথা, আরতি সেদিনই তাঁর হাত ধরে ছলছলে চোখে তাকিয়েছিলেন, ‘রাজুকে দেখতে চাই।’
যাদবচন্দ্র সেদিন কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন। রাজুর ঔদাসীন্যের কথা প্রথম প্রথম লুকিয়েও পরে স্ত্রীকে সবই বলেছেন তিনি। এরপরেও এই প্রশ্ন কেন? তিনি বলেছিলেন, ‘একই কথা বলে নিজে কষ্ট পাও, আমাকেও বিব্রত করো। জানো না কতবার ওকে জানিয়েছি? কোনো খোঁজ নিয়েছে?’
আরতি যাদবচন্দ্রের বিরক্তিতে রাগেননি। বলেছিলেন, ‘জানি। সেইজন্য তো ওকে আর আসতে বলছি না। তুমি যতই লেখো, আমি জানি ও আসবে না।’
‘তবে?’ যাদবচন্দ্র হঠাৎ করেই যেন অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন। চল্লিশ বছরের পুরোনো স্ত্রীকে শেষ ইচ্ছে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে কেমন যেন অক্সিজেনের অভাব বোধ করছিলেন তিনি, ‘তবে ওকে দেখতে চাইছ কেন? ওসব ছাড়ো।’
‘ওটাই আমার শেষ ইচ্ছে।’ আরতি দৃঢ় স্বরে জানিয়েছিলেন, ‘রাজুকে দেখব আমি। ও আসবে না জানি। তুমি আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো। ওকে না দেখলে আমি মরতেও পারব না।’
যাদবচন্দ্র হাঁ করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এই শরীরে এই অবস্থায় আরতি সেই সুদূর ফ্রান্সে যেতে চাইছেন? কিছুক্ষণ কী বলবেন বুঝতে না পেরে বলেছিলেন, ‘রাজু তো প্যারিসে থাকে।’
আরতি সঙ্গেসঙ্গে ঘাড় দুলিয়েছিলেন, ‘আমি প্যারিসেই যাব। কখনো তো তোমার কাছে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইনি! তুমি শেষবারের মতো এই প্যারিসে নিয়ে চলো আমায়।’
‘কিন্তু সে তো অনেক দূর! বিদেশ। যেতে পাসপোর্ট ভিসা লাগে।’ যাদবচন্দ্র যেন কোনো শিশুকে বোঝাচ্ছেন এইভাবে বলেছিলেন, ‘তা ছাড়া সেটা মস্ত শহর। রাজু ওখানে যে কলেজে পড়ায় সেটা ছাড়া তো কিছুই জানি না। ঠিকানাও নেই। কোনোদিন কোনো চিঠিও পাঠায়নি যে জানতে পারব। তবে?’
আরতি বলেছিলেন, ‘ও যে কলেজে পড়ায়, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলেই তো জানা যাবে। আমাকে একজন বলেছে ইন্টারনেটে ওই কলেজের নাম দিয়ে দেখলে ওর ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে।’
তখনও যাদবচন্দ্র আরতির জেদকে অত গুরুত্ব দেননি, অসুখের মধ্যে করা ছেলেমানুষি ভেবেছেন।
কিন্তু দিনে দিনে আরতির জেদ বেড়েছে। ঘুম থেকে উঠেই অবোধ শিশুর মতো বায়না জুড়তে শুরু করেছেন তিনি। যাদবচন্দ্র শেষমেস বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছেন।
তারপর থেকে এই ক-টা মাস ডাক্তার-ওষুধ ছাড়াও যাদবচন্দ্রর কেটেছে পাসপোর্ট বের করতে গিয়ে। অসুস্থ আরতিকে টেনে নিয়ে যেতে হয়েছে পাসপোর্ট অফিসেও। যাদবচন্দ্র নিজে সারাজীবন স্কুলে পড়ানো নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে খুব বেশি বাইরে বেড়াতে যেতে পারেননি। ফলে, ঘোরার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই বললেই চলে। সেখানে বিদেশ বলে কথা। নিজেরা যাওয়া সম্ভবই নয়। তাই পাসপোর্ট পর্ব মেটার পর খোঁজ শুরু হয়েছে ভালো কোনো টুর কোম্পানির যারা এই বৃদ্ধ দম্পতিকে প্যারিস নিয়ে যাবে।
আরতির ক্রমাগত কাশিতে যাদবচন্দ্র ভাবনার জগৎ থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন। বললেন, ‘ঠান্ডা লাগল নাকি আবার?’
‘না না।’ আরতি নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললেন, ‘জলটা গলায় আটকে গেছিল। ও ঠিক আছে। তুমি নতুন কোম্পানিটায় ফোনটা করলে না?’
যাদবচন্দ্র স্থির চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, ‘করছি। কিন্তু তুমি কি এই শরীর নিয়ে যেতে পারবে?’
‘পারব।’ আরতি শীর্ণ ফর্সা হাতটা বাড়িয়ে স্বামীর হাতের ওপর রাখলেন, ‘তুমি শুধু নিয়ে চলো আমায়।’
১৮
জিনিয়া বলল, ‘ইনডোরের মেলা থেকে কোনো লাভ না হলেও আপাতত অতন্দ্রর আগের কয়েকজন আর আমার মিলিয়ে আটজন হয়েছে প্রথম টুরে। মানে চার জোড়া আর কি!’
অম্বিকেশ বললেন, ‘আটজন হয়ে গেছে? বলিসনি তো! অবশ্য আমিও শেষ ক-দিন অফিসে ব্যস্ত ছিলাম। কীভাবে জোগাড় করলি?’
জিনিয়া টেবিলের ড্রয়ার থেকে লিফলেটের একটা গোছা বের করে একটা খুলে এগিয়ে দিল, ‘এই দেখো।’
অম্বিকেশ হাত বাড়িয়ে লিফলেটটা নিলেন।
‘পার্ক স্ট্রিটে যত কটা বড়ো বড়ো টুর কোম্পানির অফিস আছে, প্রত্যেকটার সামনের রাস্তায় লোক ফিট করে রেখেছি। সপ্তাহে দু-তিনদিন করে তারা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো টুরিস্ট ওদের অফিস থেকে বেরোতেই তাঁকে এই লিফলেট ধরিয়ে দেয়। রোজ দু-শো টাকা করে দিই।’ জিনিয়া ঝলমলে মুখে হাসল, ‘ভালো বুদ্ধি না? একটু সতর্ক থাকতে হয় অবশ্য। বুঝতে পারলে ঝাড় খাওয়ার চান্স আছে।’
অম্বিকেশ উলটে পালটে দেখলেন। সাধারণ ম্যাট কাগজের একটা লিফলেট। রং বা ডিজাইন কোনো কিছুরই খুব বেশি বাহুল্য নেই। তবে অনেক কিছু লেখা। অম্বিকেশ আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলেন।
অম্বিকেশ পড়া শেষ করে চমকে উঠলেন, ‘মানে? ঘুরে আসবে, পরে টাকা দেবে? এ আবার হয় নাকি?’
‘কেন হবে না?’ জিনিয়া বলল, ‘ফ্ল্যাট, গাড়ি লোকে যদি ইএমআই-তে কিনতে পারে, বিদেশ ভ্রমণ নয় কেন?’
‘ফ্ল্যাট, গাড়ি এগুলো একেকটা অ্যাসেট। টাকা না শোধ করলে তুই ওগুলোকে বাজেয়াপ্ত করতে পারবি। কিন্তু ঘুরে চলে এসে টাকা না দিলে তুই কী করবি?’ অম্বিকেশ যুক্তি দেখালেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফটো অ্যালবামটা তুলে নিয়ে চলে আসবি?’
‘বলছি। আগে পুরোটা শোনো। তুমি আমার প্রথম টুরটা দেখো। নাম দিয়েছি ”বারো দিন— দেশ— ইউরোপে — ঘোরা বেশ”। টুরটায় যাত্রীপিছু আমি যদি দশ পার সেন্টও প্রফিট রাখি, আমাকে প্যাকেজ কস্ট রাখতে হবে এক লাখ আশি হাজার। এটা গ্লোবাল টুরস বা অন্যান্য এজেন্সিতে খরচ দু-লাখ পঁচিশ হাজারের ওপরে। তার দুটো কারণ, এক ওদের ব্র্যান্ড, দুই ওদের হোটেল, খাওয়া দাওয়া। আমি এই দুটোতেই খরচ কমাব। সঞ্জিতদা অলরেডি আমাকে অনেক কনট্যাক্ট দিয়েছেন। আমি সব জায়গাতেই মাঝারি হোটেলগুলোয় ই-মেল করেছি। অনেকে রেসপন্ডও করেছে। কয়েকটা শহরে কনফার্মও করেছি। এবার এই এক লাখ আশি হাজার টাকাও আমি নেব কিস্তিতে। প্রথমে দশ হাজার টাকা দিয়ে বুক করলেই ঘুরতে যেতে পারবে টুরিস্টরা। ভিসার চার্জ অবশ্য আলাদা। এবার বাকি থাকছে এক লক্ষ সত্তর হাজার। প্রতি মাসে কেউ যদি পাঁচ হাজার টাকা দিতে থাকে, তাহলে ঘুরে আসার পরবর্তী চৌত্রিশ মাস অর্থাৎ তিন বছরেরও কম সময়ে তার পুরো লোনটা শোধ হয়ে যাচ্ছে। আর এতে তার কোনো চাপও পড়ছে না।’
‘হ্যাঁ, কিছু এজেন্সি ইদানীং ইএমআই শুরু করেছে বটে কিন্তু তাতে একটু বেশি টাকা লাগে একবারে থোক টাকা দেওয়ার থেকে। আর এজেন্সির নিজেরও চাপ থাকে টাকাটা মাসে মাসে ঠিকমতো রিকভারি হচ্ছে কি না দেখার।’ অম্বিকেশ বললেন, ‘গ্লোবাল টুরসে একবার মুম্বাইতে রিভিউ মিটিং-এ এই প্রোপোজালটা উঠেছিল, কিন্তু পরে নাকচ হয়ে যায়। আমাদের অত বড়ো কোম্পানি, তবু চালু করেনি, সেখানে তুই কী করে পরে টাকা রিকভার করবি?’
জিনিয়া বলল, ‘আমি কেন করব? যে ব্যাঙ্কের সাথে আমি বিজনেস অ্যাকাউন্ট রাখছি, লোন নিয়েছি, তারা রিকভার করবে। যখনই কোনো টুরিস্ট আমার কাছে ইএমআই ভিত্তিতে প্যাকেজ বুক করবে, তার ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে দেবে ওই ব্যাঙ্ক। মাসে মাসে তার ইএমআই জমা পড়ছে, কিনা সেটার দেখভাল করার দায়িত্ব ব্যাঙ্কের। তুমি ধরো ইএমআই-তে এসি বা ফ্রিজ কিনলে, তখন কি যে দোকান থেকে কিনেছ তারা তোমার থেকে টাকা নেয়? না। তাদের হয়ে কোনো ব্যাঙ্ক বা ফিন্যান্স কোম্পানি নেয়। এটাও তেমনই। এতে ব্যাঙ্কেরও লোন প্রোফাইল বাড়বে। এই করেই তো ব্যাঙ্কের ঝামেলাটা মেটালাম।’
অম্বিকেশ চুপ করে শুনছিলেন।
জিনিয়া বলল, ‘আর একটা কথা। গ্লোবাল টুরসের মতো এজেন্সিগুলো বিদেশ ভ্রমণের সময় টুরিস্টদের সাথে কজন লোক দেয়?’
অম্বিকেশ বললেন, ‘কোথাকার টুর, কত বড় টুর তার ওপর নির্ভর করছে। আমেরিকার টুর আর শ্রীলঙ্কার টুর তো এক হবে না। ব্যাংকক পাটায়া-র মতো টুরগুলোতে তো সঙ্গে কোনো লোকই যায় না, ব্যাংকক এয়ারপোর্টে লোক থাকে, সে-ই ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেয়।’
জিনিয়া বলল, ‘ব্যাংকক-ফ্যাংকক ছাড়ো, ইউরোপ টুরের কথা বলো। কতদিনের আর কতগুলো লোক থাকে সঙ্গে?’
‘ইউরোপেরও অনেকরকম প্যাকেজ আছে। তার ওপর নির্ভর করছে।’ অম্বিকেশ বললেন, ‘সবচেয়ে ভালো যেটা, সেটা হল এসেন্স অফ ইউরোপ। এগারো রাত বারো দিনের টুর, পাঁচটা দেশ, সাতটা শহর। গোটা টুরটায় একজন অভিজ্ঞ টুর ম্যানেজার থাকে, কলকাতা ছাড়া থেকে ফেরত আসা অবধি। তারপর প্যারিস এয়ারপোর্টে নামার পর ওদের ওখানকার একজন গাইড বাসে থাকবে। সে-ই গোটা রাস্তাটা বর্ণনা করতে করতে যায়। একটা করে দেশে ঢুকলে সেই গাইড পালটে ওই দেশের গাইড নিতে হবে। তাছাড়া আর কেউ থাকবে না।’
‘হুম।’ জিনিয়া বলল, ‘এবার ইনডোরের মেলা থেকে ঘুরে এসে আমার অবজারভেশন বলি। বিদেশি যে গাইডগুলো একেকটা দেশে বাসের মধ্যে মাইক নিয়ে আশপাশের রাস্তাঘাট, স্মৃতিসৌধ, এইসবের ইতিহাস রিলে করতে করতে যায়, তাদের উচ্চারণ এতটাই জড়ানো থাকে, যে গ্রুপের বেশিরভাগ লোকই তা বুঝতে পারেন না। বিশেষ করে যাঁরা বয়স্ক মানুষ। ফলে, কোনো ইতিহাস ভূগোল আগুপিছু না জেনে জিনিসগুলো দেখে তাঁদের সেই আনন্দটা হয় না, ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানলে যেটা হত।’
‘এটা ঠিকই বলেছিস।’ অম্বিকেশ মাথা নাড়লেন, ‘টুরের পর আমরা ক্লায়েন্টদের থেকে একটা করে ফিডব্যাক ফর্ম নিতাম, ঘোরার পর তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন, ভালো লাগল না খারাপ লাগল ইত্যাদি লিখতে হত তাতে। মাঝে মাঝে ফাঁকা থাকলে চোখ বুলোনোর জন্য আমি সিআরএম ডিপার্টমেন্ট থেকে কিছু ফর্ম পাঠাতে বলতাম। তাতে দেখতাম, অনেকেই লিখেছেন যে গাইডের কথা তাঁরা কিছু বুঝতে পারেননি।’
‘পারবে কী করে?’ জিনিয়া বলল, ‘আগের বছর ওয়ান্ডার হলিডে-র সঙ্গে আমার এক কলিগের বাবা-মা গিয়েছিলেন মিশর বেড়াতে। কায়রো শহরে নেমে সেখান থেকে আলেকজান্দ্রিয়া, লুক্সর হয়ে নীল নদে ক্রুজ ভ্রমণ সব কিছুই ছিল ওঁদের প্যাকেজে। খাওয়া-দাওয়া, হোটেলও খুব ভালো। কিন্তু ওখানকার যে গাইডকে ওয়ান্ডার হলিডে গোটা টুরটার জন্য নিয়েছিল, তার ইংরেজি উচ্চারণ এতই জড়ানো যে দীপ্তর বাবা মা কিছু বুঝতেই পারেননি। ফলে গিজা, স্ফিংক্স এর মতো পিরামিডই বলো কিংবা ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মরুভূমির মধ্যে বানানো আবুল সিম্বেলের মন্দির, সবই ওঁরা দেখতে হয় দেখেছেন। সেগুলোর পেছনের রোমহর্ষক ইতিহাসগুলো কিছুই জানতেই পারেনি, তাই মিশর ঘোরার সেই স্বাদটাও পাননি। আর এটা প্রতিটা এজেন্সিতে এক। আমি এই অসন্তোষটা দূর করে দেব।’
‘এক্ষেত্রে তুই কী করবি তাহলে?’ অম্বিকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওখানে গাইডের কাজ করে অথচ ভারতীয় এমন কাউকে নিবি? আমার কিন্তু এক্সপিরিয়েন্স বলছে ওরা অতটা দক্ষ নয়। যেখানেই আমাদের টুর ম্যানেজার ভারতীয় গাইড হায়ার করেছে, পরে টাকাপয়সা আরও নানারকম ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করেছে। প্রশিফেশনালিজমের অভাব। তাই আমরা সবসময়েই বিদেশিদের সঙ্গে কনট্র্যাক্ট করতাম।’
‘ওখান থেকে কেন নেব?’ জিনিয়া বলল, ‘এখন তো আমার কোম্পানি নতুন, প্রথম কয়েক বছর আমরাই টুর ম্যানেজার কাম গাইড হিসেবে কাজ করব। আর যেহেতু আমরা পুরো বাঙালিদের নিয়ে টুর করাচ্ছি, ঘোরার সময় সব কিছু বাংলাতেই বলব।’
‘বাংলায়?’ অম্বিকেশ ভ্রূ কুঁচকে বললেন।
‘হ্যাঁ।’ জিনিয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘তুমি শুধু দৃশ্যটা কল্পনা করো। লন্ডন শহরের রাজপথ দিয়ে আমাদের বাস চলেছে, বাসভরতি বাঙালি। একে একে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে লন্ডন আই, ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে, ডাউনিং স্ট্রিট। আর বাসের মধ্যে মাইকে পুরো বাঙলা ভাষায় কেউ বলে চলেছে লন্ডন শহরটার ইতিহাস, বিগ বেন কবে তৈরি হয়, গল্পচ্ছলে শোনাচ্ছে বাকিংহ্যাম প্যালেসের রাজপরিবারের নানা কথা। ট্রাফালগার স্কোয়ার বা পিকাডেলি সার্কাসে যত্ন করে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ানোর সময় বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছে সব কিছু। ভাবতেই মনটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে না?’
‘শোন, অনেক কিছু ভাবনার সময় ভালো লাগে, কিন্তু বাস্তবে ঠিকমতো অভিজ্ঞতা না থাকলে বিপদে পড়তে হয়।’ অম্বিকেশ বললেন, ‘এই ধরনের টুর ম্যানেজার হতে গেলে কত অভিজ্ঞতা চাই, জানিস? সব টুরই যে ভালোভাবে শেষ হবে তার তো কোনো মানে নেই। ধর, তুই আমেরিকা ঘোরাতে নিয়ে গেলি। সেখানে ঘোরার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে কোনো বয়স্ক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ল। এবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বিদেশি পর্যটক হিসেবে নিয়মানুসারে ইন্ডিয়ান এমব্যাসির সঙ্গে যোগাযোগ করা, তার ঠিকমতো দেখভাল করা, ফেরার টিকিট রিশিডিউল করা, এসব করতে হবে। তার ওপর একজন অসুস্থ হয়েছেন মানে তো এই নয় যে বাকিরা তাঁর জন্য সাফার করবেন। অন্যরা মোটা টাকা দিয়েই ঘুরতে গিয়েছেন। সুতরাং গোটা দলের শিডিউল একটুও না হ্যামপার করে অসুস্থ মানুষটির ব্যবস্থা করা, এইসবের জন্য বিদেশ বিভুঁইয়ে অনেক ধরনের চেনাজানার প্রয়োজন হয়, যেটা একবার গেলে হয় না। আমাদের গ্লোবাল টুরসে চাইলেই কেউ টুর ম্যানেজার হতে পারে না, তাকে প্রথমে কয়েক বছর অ্যাসিস্ট্যান্ট টুর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে হয়, পাশে পাশে থেকে শিখতে হয় কীভাবে টুর ম্যানেজার সবকিছু সামলাচ্ছে। কারণ এটা তো আর দেশের মধ্যে নয় যে কিছু হলে পকেটে টাকা থাকলেই কেউ বাড়ি আসতে পারবে। তারপর ধর, কেউ পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলল, কিংবা এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার সময় লাগেজ ফেলে এল আগের হোটেলে, এরকম খুচরো ঝামেলা। তা ছাড়া ফ্লাইট ক্যানসেল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব তো ছেড়েই দিলাম। ঝামেলা কি একটা? এমনি যতই ভালো হোক, একটু এদিক থেকে ওদিক হলে কাস্টমাররা এসে কনজিউমার ফোরামে মামলা করে দেবে।’
জিনিয়া বলল, ‘কী মুশকিল! আমরা গাইডের কাজ করব মানে কি আমি নিজে করব বলেছি নাকি! আমি বলতে চাইছি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের নিজের লোকই করবে, বাইরের কনট্র্যাকচুয়াল কেউ নয়।’
‘নিজের লোক বলতে তো আমি, তুই, অতন্দ্র। আর কে?’ অম্বিকেশ বললেন, ‘আর ওই ইনডোরের মেলায় যাকে ক-দিন রেখেছিলি সেই ছেলেটাকে যদি নিস। আর তো কেউ নেই। যাত্রীদের ভিসা প্রসেসিং, ফ্লাইটের টিকিট থেকে শুরু করে যেখানে যেখানে যাবি, সেখানকার হোটেলে রুম বুক, খাওয়ার অ্যারেঞ্জমেন্ট, শহর ঘোরার জন্য গাড়ি, এইসব তোকে তো পুরোটাই কনট্র্যাক্ট দিয়ে কাজ করাতে হবে। আর কনট্র্যাক্ট মানেই মাঝখানে মিডলম্যান ঢুকবে। সে কমিশন খাবে, তোর খরচও বাড়বে। তুই তো ঘরের পয়সায় লোককে ঘোরাবি না, খরচ তুলতে গেলে টুর প্যাকেজের দাম বাড়াতে হবে। সেটা আবার নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে মুশকিল। এই সব কিছুর জন্যই বলেছিলাম আগে ছোটো টুর দিয়ে শুরু করতে।’
‘বুঝলাম।’ জিনিয়া এবার একটু থেমে বলল, ‘আচ্ছা তুমি সঞ্জিত হাজরা বলে কাউকে চেনো?’
‘না। কে সঞ্জিত হাজরা?’ অম্বিকেশ বোঝানোর মুডে ছিলাম, হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠলেন, ‘তোকে যেটা বলছি শোন। যা করেছিস করেছিস, আর তো ফিরতে পারবি না, আমি কিছু ইন্টারমিডিয়েট এজেন্সির সঙ্গে কনট্যাক্ট করছি, আমার রেফারেন্স দিলে তবু একটু কম করবে। এইবারটা যা লস হয় হোক, পরেরবার থেকে আগে কয়েক বছর ছোটো ডোমেস্টিক টুর করা।’
জিনিয়া এবার একটু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আহ ফুলুমামা, যা বলছি, তার উত্তরটা দাও না। ভালো করে মনে করো, সঞ্জিত হাজরাকে তুমি চেনো।’
অম্বিকেশ ভ্রূ কুঁচকে মনে করতে লাগলেন। হাজরা পদবির খুব বেশি কাউকে তিনি চেনেন না। কিন্তু জিনি এমন করে বলছে মানে কি সত্যিই অম্বিকেশ চেনেন, অথচ মনে করতে পারছেন না? এমনও তো হতে পারে, ওই হাজরা নামক ব্যক্তিটি অম্বিকেশকে চেনে, কিন্তু তিনি চেনেন না। ছোটোবড়ো অনেক ট্রাভেল এজেন্টই মিটিং করতে আসত গ্লোবাল টুরসের কলকাতা রিজিয়নের বড়োকর্তার সঙ্গে।
তাদের সবার নাম কি মনে রাখা সম্ভব নাকি?
জিনিয়া বলল, ‘মাসকয়েক আগে তোমাদের লখনৌ অফিস থেকে ছাঁটাই করা হয়েছিল সঞ্জিত হাজরাকে। টুর ম্যানেজার হিসেবে প্রায় পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা ছিল লোকটার। গ্লোবাল টুরসের আগেও দুটো বড়ো এজেন্সির হয়ে কাজ করেছে। ছাঁটাই হওয়ার পর তোমায় ফোন করেছিল, যদি তুমি কিছু করতে পারো সেই ব্যাপারে।’
‘ওহো! একদম ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে ছেলেটাকে তো কখনো সামনাসামনি দেখিনি, তাই নাম বলাতে মনে করতে পারছিলাম না।’ গোটা ব্যাপারটা মনে পড়ে যেতে অম্বিকেশ সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটলেন, ‘আরে সঞ্জিত হাজরা তো আমাদের লখনৌ রিজিয়নের স্টার ছিল। কতবার সেরা কর্মীর পুরস্কার পেয়েছে। কোম্পানি ওকে অনেক কিছু দিয়েছিল, গাড়ি, মোটা মাইনে। কিন্তু ওকেই যে এই বছর ছাঁটাই করবে সেটা বোঝা যায়নি একদম।’
জিনিয়া কী বলতে যাচ্ছিল, অম্বিকেশ বাধা দিয়ে বলে যেতে লাগলেন, ‘কিন্তু ম্যানেজমেন্টেরও শুনেছি কিছু করার ছিল না। ইদানীং প্রতিটা টুর থেকে এসে সঞ্জিত খুব ঝামেলা করছিল। নানারকম ব্যাপারে নাকি কাস্টমারদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, এমন জানিয়ে ই-মেল করছিল হেড অফিসে। কাস্টমারদেরও বলছিল অভিযোগ জানাতে। প্রথম প্রথম ম্যানেজমেন্ট পাত্তা দিচ্ছিল, ওর বক্তব্য খতিয়ে দেখছিল। কিন্তু তারপর থেকে ওকে আর গুরুত্ব দিত না। কিন্তু শেষে নাকি ও মেলগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন দপ্তরে ফরোয়ার্ড করার হুমকি দিয়েছিল। তখনই তড়িঘড়ি ওর সব ক্রেডেনশিয়াল আর সার্ভারে অ্যাক্সেস কেড়ে নিয়ে ছাঁটাই করা হয়।’
অম্বিকেশ এক মুহূর্ত থেমে আবার মুখ খুললেন, ‘আমি সবসময় চেষ্টা করি যতটা সম্ভব কর্মীদের পাশে থাকতে, তাদের সুবিধে অসুবিধে বুঝতে। কিন্তু সঞ্জিতের ক্ষেত্রে আমার কিছু করার ছিল না। এমনিতে ও আমার আন্ডারে ছিল না। অন্য রিজিয়নের ভিতরের ব্যাপারে আমার নাক গলানো সম্ভব নয়। তবু আমি লখনৌয়ের হেডকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু সঞ্জিতের কাজটা এতটাই মারাত্মক ছিল যে কোম্পানির চেয়ারম্যান মি খাদিলকর পর্যন্ত রেগে গিয়েছিলেন।’
‘জানি।’ জিনিয়া বলল, ‘তুমি চেষ্টা করেছিলে।’
‘তুই কী করে ওকে চিনলি?’ অম্বিকেশ একটু অবাক হলেন। সঞ্জিত হাজরা সম্পর্কে যেটুকু শুনেছিলেন, ছেলেটা বাঙালি হলেও জন্ম থেকেই প্রবাসী। জিনিয়া আই টি-র মেয়ে, সঞ্জিত টুরিজম ম্যানেজমেন্টের। দু-জনের চেনা পরিচয় থাকাটা আশ্চর্যের বই কী।
‘আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ ইন্টারনেটে। তুমি তো জানোই, দাশগুপ্ত ট্রাভেলস আমি এখন খুলেছি ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই নিয়ে আমি পড়াশুনো, খোঁজখবর বা চিন্তাভাবনা করছি দু-বছর আগে থেকে। তখনই একটা ভ্রমণ বিষয়ক অনলাইন ফোরামে পরিচয় হয়। আমার একটা ট্রাভেল এজেন্সি খোলার ইচ্ছে দেখে সঞ্জিত খুব আগ্রহী হন।’ জিনিয়া কাঁধ নাচাল, ‘সামনের মাসের এক তারিখ থেকে উনি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসে টুর ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিচ্ছেন।’
অম্বিকেশ বিস্মিতচোখে বললেন, ‘কী! সঞ্জিত হাজরা তোর কোম্পানির টুর ম্যানেজার? কী বলছিস তুই! গ্লোবাল টুরস ওকে কত টাকা মাইনে দিত জানিস? ওর যা অভিজ্ঞতা আর রেপুটেশন ছিল, কম করে মাসে দেড় লাখ টাকা তো হবেই। সঙ্গে যত টুর করত, দিন বেসিসে একটা অ্যালাওয়েন্স পেত। তুই সঞ্জিতকে নিলে তো সর্বস্বান্ত হয়ে যাবি রে! তোর কোম্পানির মান্থলি টার্ন ওভার অত হবে না।’
জিনিয়া মাথা নাড়াল, ‘তুমি না জেনে এত ভয় পেয়ো না তো, ফুলুমামা। আগে পুরোটা শোনো। সঞ্জিত হাজরা লোকটা একটু আদর্শবাদী টাইপের। গ্লোবাল টুরসেও এই কারণেই ও ঝামেলা শুরু করেছিল। সব কোম্পানিরই কিছু হিডন কস্ট থাকে। গ্লোবাল টুরসে নাকি বেশিরভাগ টুরে প্রতিদিন শুধু ব্রেকফাস্ট আর ডিনার দেওয়া হয়। লাঞ্চের কোনো ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু যাওয়ার আগে কাস্টমারদের সেটা বলা হয়না। এবার ওখানে গিয়ে তারা পড়ে যায় ফ্যাসাদে। আমেরিকা বা ইউরোপে লাঞ্চ মানে তো খুব সস্তা নয়। তা ছাড়া, এমন টাইট শিডিউল থাকে, যে কোথাও ভালো করে দুপুরে খাওয়াও যায় না। ফলে, শুকনো খাবার কিনে পেট ভরাতে হয়। সঞ্জিতের মতে, এটা এক ধরনের চিটিং। যে কাস্টমার প্রথমবারের জন্য বিদেশ যাচ্ছেন, তাঁকে না বলা হলে কী করে জানবেন যে লাঞ্চের পেছনে তাঁর অতিরিক্ত কত খরচ হতে পারে? এরকম আরও ছোটোখাটো লুকনো কাজ সব এজেন্সিই করে থাকে। যেমন সব ইউরোপ টুরেই নাকি লন্ডনের মাদাম তুসো মিউজিয়াম ভ্রমণ লেখা থাকে, কিন্তু সেখানে গিয়ে মিউজিয়ামে ঢোকার প্রবেশমূল্য নিজেদের দিতে হয়। সেটা নেহাত কম নয়, চল্লিশ পাউন্ড মানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা।’
জিনিয়া সামনে রাখা জলের বোতল থেকে কিছুটা জল ঢকঢক করে গলায় ঢেলে বলল, ‘এইরকম প্রতিটা শহরে গিয়েই কোনো-না-কোনো জায়গায় এনট্রি ফি নিজেদের দিতে হয়। কোনো কাস্টমার গাঁইগুঁই করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রসপেকটাস খুলে খুদে খুদে অক্ষরে ওগুলো যে আলাদা পেমেন্ট করতে হবে সেই লেখাটা দেখিয়ে দেওয়া হয়। কাস্টমারের আর কিছু করার থাকে না। এক-দেড়শো পাতার প্রসপেকটাস কে পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে? অনেকটা সেই অশ্বত্থামা হতঃ ইতি গজ-র মতো। সঞ্জিত হাজরার মতে, এগুলো সবই প্রতারণা। এবং এই ব্যাপারেই প্রতিবাদ করে উনি ম্যানেজমেন্টের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। উনি দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের একজন স্টেকহোল্ডার হিসেবে যোগ দিচ্ছেন। আরও বেশি আগ্রহী হয়েছেন আমি পুরো টুরে একটা বাঙালি পরিবেশ রাখতে চাইছি বলে। বাংলায় গাইড করবেন বলে উনি খুবই এক্সাইটেড।’
অম্বিকেশ হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন।
জিনিয়া ফুলুমামার ভাবভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল, ‘কী হল?’
‘এমনই এক্সাইটেড যে মাইনেপত্র নেবে না?’ অম্বিকেশ এখন যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না, ‘আর তা ছাড়া ও যে ভীষণই অভিজ্ঞ টুর ম্যানেজার তাতে সন্দেহ নেই, কিন্ত ও যে যে ব্যাপারগুলো প্রতারণা হিসেবে ধরছে, সেগুলো তার মানে তুই করবি না?’
‘প্রশ্নই ওঠেনা।’ জিনিয়া দ্রুত মাথা নাড়ল, ‘ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার সব আমরা দেব। শুধু তাই নয়, প্রতিদিন অনেকটা জার্নি করতে হবে সবাইকে। প্রত্যেককে একটা করে শুকনো খাবারের প্যাকেট দেওয়া হবে রোজ, যাতে যাওয়ার পথে খিদে পেলে খেতে পারেন। আমার কাস্টমাররা কেউ প্যাকেজ ছাড়া একটা পয়সাও খরচ করুন সেটা আমি চাই না।’
অম্বিকেশ একটা লম্বা নিশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, ‘লোনটা কোন ব্যাঙ্ক থেকে নিয়েছিস?’
এমন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল জিনিয়া, ‘কেন?’
‘না, মানে সরকারি না বেসরকারি, তাই জিজ্ঞেস করছি। বছরখানেকের মধ্যে তো দেউলিয়া হবিই, তখন উৎপাতটা তো তোকেই সহ্য করতে হবে!’
জিনিয়া কথাটা শুনে স্থিরচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর অল্প হেসে বলল, ‘ফুলুমামা, দেউলিয়া আমরা সবাই হই। কেউ টাকার দিক থেকে, কেউ মনের দিক থেকে। আমি যদি আজ এত বড়ো ঝুঁকি না নিতাম, চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় না নেমে যেমন চলছিল, তেমনভাবেই অফিস যেতে আসতে বুড়ো হতাম, তাহলেও আমার মনটা দেউলিয়া হত। তার চেয়ে এখন যদি মুখ থুবড়ে পড়িও, তবুও একটা তৃপ্তি থাকবে যে আমি চেষ্টা করেছিলাম।’
‘কিন্তু এই ঝুঁকিটা তো তোর একার নেওয়ার কথা ছিল না।’ অম্বিকেশ এবার বললেন, ‘তুই আর অতন্দ্র পার্টনার হিসেবে কাজটা করবি তেমনই কথা ছিল।’
জিনিয়া এবার চোখ সরিয়ে নিল ফুলুমামার থেকে। ও কাজের মুডে ছিল, হঠাৎ এই প্রসঙ্গ আসতে ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।
অনেক কষ্টে ও সবকিছু ভুলে রয়েছে। তবু মাঝে মাঝেই এই প্রসঙ্গ উত্থাপন কি লোকের না করলেই কী নয়?’
অম্বিকেশ জিনিয়ার মনোভাব বুঝতে পেরেও থামলেন না, বলে চললেন, ‘বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল, অতন্দ্রকে একবারও দেখিনি। তা ছাড়া ও রোজ অন্তত দু-বার করে আমায় ফোন করত, কোন কাস্টমার পেয়েছে ইত্যাদি, অনেকদিন কোনো ফোনও পাইনি ওর। তুই তো খড়দার বাড়িতে রয়েছিস, ও-ও কি তোর সঙ্গে ওখানে রয়েছে?’
জিনিয়া এবার হেসে ল্যাপটপের দিকে মুখ ফেরাল, ‘মা আমাকে এইসব বোঝানোর জন্য তোমায় এখন পাঠিয়েছে বুঝি?’
‘না।’ অম্বিকেশ নির্জলা মিথ্যে বললেন, ‘বুড়িদি আমাকে কিছুই বলেনি। কেন, কেউ না বললে কি আমি বুঝব না? কী হয়েছে তোদের মধ্যে? এইরকম একটা সময়ে খুচখাচ ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা করলে নিজেদেরই সমস্যা। দু-জনেই ইগো নিয়ে বসে থাকলে হবে? মিটিয়ে নে।’
জিনিয়া প্রাণপণ ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের জল আটকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা ঝরে পড়ল। বাধ্য হয়ে ও মুখ ফেরাল অন্যদিকে। এই এক ঝামেলা। অতন্দ্রর প্রসঙ্গ উঠলেই কোথা থেকে যে চোখে বৃষ্টি নামে! এখনও কীসের এত দুঃখ, কে জানে!
ও বলল, ‘অতন্দ্র ওর রেজিগনেশান উইথড্র করে নিয়েছে ফুলুমামা। ও এই ব্যবসায় আর ইন্টারেস্টেড নয়।’
‘সে কী!’ অম্বিকেশ ভ্রূ কুঁচকোলেন, ‘হঠাৎ কী হল? ও তো ভালোই উৎসাহী ছিল। এই ব্যাঙ্ক থেকে ওই ব্যাঙ্ক, লোনের জন্য ও-ই তো প্রথমে ঘোরাঘুরি করল। অনেক জায়গায় পুশ সেল করতেও চেষ্টা করছিল। কী হল দুম করে?’
‘জানি না।’ জিনিয়া চুপ করে গেল। যেটা বলতে পারল না সেটা হল, শুধু দাশগুপ্ত ট্রাভেলস নয়, জিনিয়া দাশগুপ্তও অতন্দ্রর কাছে এখন ফেলে আসা অতীত।
অত বড়ো গণ্ডগোলের পরও সেদিন রাতে গীতিকা বলে মেয়েটার সঙ্গে অতন্দ্র একসঙ্গে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চেপেছে, শুভ্রদীপ না বললে জানতেই পারত না জিনিয়া। হতে পারে সেই রাতে জিনিয়া ভুল করে ফেলেছিল, হঠাৎ করে অ্যাবরশন লেখাটা দেখে আজেবাজে চিন্তা ওর গোটা ভাবনাটাকে গ্রাস করে ফেলেছিল।
কিন্তু ওদের মধ্যে যে মেলামেশাটা অত্যধিক বাড়ছে, সেটা তো মিথ্যে নয়!
যে মেয়েটা ওদের বিচ্ছেদের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী, তার সঙ্গে অতন্দ্র এখনও একটুও ঘনিষ্ঠতা কমাতে পারল না?
নিজেকে সারাক্ষণ কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে জিনিয়া, চেষ্টা করে ওই তিক্ততাগুলো মনে না করতে। কিন্তু ফুলুমামার একটা প্রশ্ন ওকে ভাবনার জগতে অনেক দূর একলাফে নিয়ে চলে গেল।
হঠাৎ ওর মনে হল, অতন্দ্র কি গীতিকাকে নিয়ে সেই রাতে লেকটাউনে ওদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল?
কথাটা মনে হওয়া মাত্র ওর বুকের ভেতরটা কেমন দুলে উঠল।
সারাদিন অজস্র মেসেজ চালাচালি, ফোন, রসিকতা, ভাবতে ভাবতে জিনিয়ার মনের শক্ত দিকটা হঠাৎ বলে উঠল, যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। অতন্দ্র দাশগুপ্ত ট্রাভেলসের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে, টেকি ওয়ার্ল্ডেই থাকবে বলে মনস্থির করে ফেলেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এত অশান্তির পরেও সবাইকে দেখিয়ে গীতিকাকে নিয়ে ঘুরছে। এত দিন ওরা আলাদা রয়েছে, একটা ফোন তো করেইনি, মিটমাট করারও কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
হ্যাঁ, জিনিয়া অতন্দ্রকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নিজের আত্মসম্মান খর্ব করে ওকে ভালোবেসে যেতে হবে।
সেদিন রাত আড়াইটের সময় জিনিয়া যখন ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, স্বামী হিসেবে অতন্দ্র তখন একবারের জন্যও আটকায়নি। যত রাগই হোক, জিনিয়ার নিরাপত্তাটা তার মানে ওর কাছে কিচ্ছু নয়? সেই রাতে ও বাবা-মা-র প্রশ্নের মুখে পড়বার জন্য বাড়িও যায়নি। রাত কাটিয়েছিল সল্টলেকেরই একটা চারতারা হোটেলে। ওই পরিস্থিতিতে মাথা তো কাজ করছিলই না, তার সঙ্গে ওই গভীর রাতে বেশিদূর ক্যাবে করে যেতে ওর ভয়ও লাগছিল। তাই কিছুদূর গিয়েই নেমে পড়েছিল ওই অঞ্চলের নামি একটা হোটেলের লবিতে। ভালো হোটেল, তাই পরিচয়পত্র দেখিয়ে জিনিয়ার রুম পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি, সমস্যা হয়নি ক্যাবচালককে নিয়েও। পরের দিন ভোর হতেই বাড়ির জন্য বেরিয়ে পড়েছিল ও।
কিন্তু অতন্দ্রর তরফ থেকে কি কোনো খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল না? নাকি গীতিকার সমস্যা নিয়ে ও এতই ব্যতিব্যস্ত যে স্ত্রী-র খবর নেওয়ার ইচ্ছে বা সময় কোনোটাই ওর হয়নি!
ফুলুমামার প্রশ্নের জুতসই জবাব খুঁজতে খুঁজতে জিনিয়া মনে মনে স্থির করে ফেলল।
জোর করে আর যাই হোক সম্পর্ক জিইয়ে রাখা যায় না। ওদের দু-জনের পথ যখন আলাদা হয়েই গেছে, তখন সেটা আইনি পথে হওয়াই ভাল। আর ও-ই সেই উদ্যোগটা নেবে।
১৯
স্টেশনে নেমে আজ অন্যদিনের মতো বাড়ির দিকে রুদ্ধশ্বাসে হাঁটা লাগাল না আলোকপর্ণা। দেরি হলে মা ফোন করবে, তাই আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল যে আজ অফিসে মিটিং রয়েছে, ফিরতে দেরি হবে।
অফিস থেকে বেরিয়ে আজ আর বাদুড়ঝোলা বাসে চেপে হাওড়া আসেনি আলোকপর্ণা। একটা নামী রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি পার্সেল করে নিয়েছে, বিশাল বড় ঠান্ডা একটা গাড়ি ডেকে এনেছে মোবাইল অ্যাপে বুক করে, তারপর কোল্ড ড্রিঙ্ক খেতে খেতে এসেছে স্টেশন। ট্রেনও আজ বেশ ফাঁকা ছিল। জানলার ধারে বসে চোখ বন্ধ করে হাওয়া খেতে খেতে হিন্দমোটর পৌঁছেছে ও।
স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে আলোকপর্ণা শান্তপায়ে হাঁটছিল। গত দু-মাস ধরে যে আশঙ্কায় ও সারাক্ষণ কাঁটা হয়েছিল, তার আজ শেষ হল। ওর চাকরিটা আজ চলে গেল।
পিআইপি-তে থাকার মেয়াদ তিনদিন আগেই ফুরিয়েছিল। পিআইপি থেকে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম, তবু যারা আসে, শেষদিন সন্ধেতেই আসে। কোম্পানি কাউকে রাখবে মনে করলে এক বেলাও তার কাছ থেকে কাজ নিতে ছাড়ে না।
কিন্তু আলোকপর্ণাকে ফিরিয়ে আনা হয়নি। তারপর থেকে এই তিন দিন তাকে অলসভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছিল হেড অফিসের রিসেপশনে। তিনবছরের পুরোনো কর্মী সে, অনেকেই তাকে সেখানে চেনে। লাঞ্চের সময়ে বা অন্যান্য ফাঁকা সময়ে এসে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছিল কী হল। সবাই-ই জিজ্ঞেস করতে হয় তাই করত। কারণ পিআইপি থেকে ফেরার চান্স আলোকপর্ণার আর ছিল না।
অবশেষে আজ সকালে অফিস পৌঁছে ও যখন সবে রিসেপশনের সোফায় বসেছে, এইচ আর ডিপার্টমেন্টের হেড জয়তী ম্যাডাম ওডেকে পাঠিয়ে চিঠি ধরিয়ে দিলেন। সঙ্গে দিলেন কিছু নিয়মমাফিক সমবেদনা। ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে রাখতে পারছি না ধরনের কৃত্রিম সংলাপ।
আলোকপর্ণা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। আপাতত তার ব্যাগে বিরিয়ানির প্যাকেট ছাড়াও রয়েছে এক মাসের স্যালারি বাবদ চেক। সেই চেক ভাঙিয়ে আরও একমাস চলবে। বাবা বসে পড়ার সময় কোম্পানি থেকে যা দিয়েছিল, তা ওর আর ওর দিদির পড়াশুনোর সময়েই খরচ হয়ে গিয়েছিল।
দিদি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতি মাসের চেকটা পাওয়ার পর সেটা সরাসরি মাকেই গিয়ে ও দিয়ে দেয়। মা প্রথমবার একটু থমকে গেছিল, তারপর থেকে বিনাবাক্যবয়ে নীরবে নিয়ে নেয়, পরেরদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে ভাঙিয়ে নিয়ে আসে। আলোকপর্ণার হাতখরচের জন্য সেখান থেকে কিছু টাকা তুলে দেয় ওর হাতে।
আলোকপর্ণা ভাবল, আর এক মাস পর মা যখন মাসের পয়লা তারিখে ওর কাছ থেকে চেক পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করবে, তখন ও কী দেবে?
কথাটা মনে হতেই ও ঠোঁট কামড়াল। আচমকাই ওর নিজেকে খুব অসহায় লাগল। নিজের দুঃখটাকে দূরে সরানোর জন্য এতক্ষণ জোর করে যেগুলো ও করে চলেছিল, সেগুলো খুব ক্লিশে লাগল।
সন্ধেবেলা। অফিস থেকে সকলের ফেরার সময়। ওর দু-পাশ দিয়ে কেউ সাইকেলে, কেউ বাইকে, কেউ হেঁটে বাড়ি ফিরছে। যারা ফিরছে, তারা প্রত্যেকে কাল সকালে আবার বেরোবে, কর্মস্থলে পৌঁছোবে। শুধু আলোকপর্ণা বেরোবে না।
আলোকপর্ণা বাড়ি বসে থাকবে।
ও ধীরগতিতে হাঁটতে হাঁটতে ফোন করল বহ্নিশিখাকে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওদের ব্রাঞ্চ অফিসে ওর খবরটা পৌঁছে গেছে। বহ্নিশিখা, সংযুক্তা, অতীশ সবাই জেনে গিয়েছে আলোকপর্ণার চাকরি আর নেই। এবার আলোকপর্ণার বদলে কাকে ব্রাঞ্চের হেড করা হবে? নিশ্চয়ই অতীশকে। সেদিন ও অত ভালো একটা লিড এনেছে, ওর ভাগ্যেই জুটবে ব্র্যাঞ্চ হেডের তকমা।
বহ্নিশিখা ফোনটা রিসিভ করে একটু আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘হ্যালো।’
‘কী রে, কেমন আছিস। কী খবর তোদের?’ আলোকপর্ণা সহজ ভঙ্গিতে বলল।
বহ্নিশিখা বোধ হয় এতটা সপ্রতিভ কথা আশা করেনি আলোকপর্ণার থেকে। এতদিন ধরে পাশাপাশি টেবিলে বসে কাজ করেছে, আলোকপর্ণার আর্থিক অবস্থার কথা ওদের সকলেরই জানা। আলোকপর্ণার রোজগারের ওপর ওর বাবা-মা যে বেশ ভালোভাবেই নির্ভরশীল তাও ওদের অজানা নয়। এই অবস্থায় আলোকপর্ণার চাকরি চলে যাওয়াটা মাথায় বাজ ভেঙে পড়ার মতোই বটে!
বহ্নিশিখা বলল, ‘আমি তো ঠিকই আছি। তোর কী খবর?’
‘কেন খবর শুনিসনি?’ আলোকপর্ণা হাঁটতে হাঁটতে পায়ের সামনে পড়া ছোট্ট একটা নুড়িকে ঠেলে রাস্তার কোণায় পাঠিয়ে দিয়ে বলল, ‘পিআইপি থেকে আর রেজিউম করল না সার্ভিস। আজ জয়তী ম্যাম ডেকে ছুটি দিয়ে দিলেন।’
‘হ্যাঁ, শুনলাম।’ বহ্নিশিখা একটু থেমে বলল, ‘শোন, তুই মন খারাপ করিস না। ভেঙে পড়িস না প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সবারই চাকরি হল সরু তারের ওপর দিয়ে হাঁটা। একটু এদিক-ওদিক হল তো ব্যস। অম্বিকেশ স্যার চলে যাওয়ার পর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।’
‘হুম। সেই জন্যই আর মন খারাপ করছি না।’ আলোকপর্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরল।
বহ্নিশিখা আবার বলল, ‘এদিকে আজ সকালে অতীশের কাছেও ইমেল এসেছে জানিস। ওরও মনিটরিং আর পিআইপি শুরু হচ্ছে সামনের সপ্তাহ থেকে।’
আলোকপর্ণা এবার চমকে উঠল। গত কয়েকমাস ধরে ও আর অতীশ একসঙ্গেই হেড অফিসের নজরে ছিল এই কয়েক মাসের সেল কম হওয়ার জন্য। কিন্তু অতীশ তো সেদিন অত ভালো দুটো প্যাকেজ বিক্রি করল।
ও বলল, ‘সে কী রে! সেদিন যে দুটো ইউরোপিয়ান এসেন্স বেচল?’
‘চেক বাউন্স করেছে। ফোন করলে বলেছে অন্য কোনো নতুন এজেন্সির সঙ্গে যাচ্ছে। আসলে কোথাওই যাবে না, বুঝলি তো! ফালতু এসে সময় নষ্ট করে গিয়েছিল। আমার সেদিনই সন্দেহ হয়েছিল। আরে, জামাকাপড় দেখলে তো একটা আইডিয়া হয় নাকি!’ বহ্নিশিখা এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছিল, ‘যাকগে ছাড়। তোকে যেটা বলতে ফোন করলাম। ”পায়ে পায়ে ভ্রমণ” বলে যে কোম্পানিটা আছে না? ওরা অফিস স্টাফ নিচ্ছে খবর পেলাম। অ্যাপ্লাই করবি?’
‘ ”পায়ে পায়ে ভ্রমণ” তো একেবারেই ছোট কোম্পানি।’ আলোকপর্ণা বলল, ‘সব মেলায় একশো স্কোয়্যার ফুটের স্টল দেয়।’
‘হ্যাঁ। বেনারস, হরিদ্বার, এইসব টুর করায়। শিয়ালদায় অফিস। গ্লোবাল টুরসের কাছে কিছুই নয়।’ বহ্নিশিখা একটু থেমে বলল, ‘তবু, তোর তো চাকরিটা দরকার, তাই ভাবলাম খবরটা দিই। আমাদের প্রফেশনে জানিসই তো কন্টিনিউটি কতটা ইম্পর্ট্যান্ট, সিভি-তে কোন গ্যাপ থাকলেই ইন্টারভিউতে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয়।’
কথা হয়ে যাওয়ার পর আলোকপর্ণা ফোনটা বন্ধ করল। টুরিজম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ে গ্লোবাল টুরসের মতো দেশের পয়লা নম্বর কোম্পানির সেলস এগজিকিউটিভ পদে সাড়ে তিন বছর কাজ করে, একটা ব্রাঞ্চ সামলে ও কিনা যাবে শিয়ালদার এঁদো গলির ঘুপচি টিমটিমে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে? কলকাতার পর্যটন মেলাগুলোয় গ্লোবাল টুরসের দু-হাজার স্কোয়্যার ফুটের বিশাল প্যাভিলিয়নের চারপাশে ওইরকম এজেন্সির পুঁচকে স্টলগুলো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে থাকে।
কিন্তু বহ্নিশিখার ওপর চাইলেও ও রাগতে পারল না। বহ্নিশিখা তো আর খারাপ ভেবে বলেনি। ওর আর্থিক সমস্যার কথা ভেবেই হয়তো বলেছে।
আলোকপর্ণার মনে হল, আজ অম্বিকেশ স্যার থাকলে হয়তো গ্লোবাল টুরসের ম্যানেজমেন্ট এতটা নির্দয় হতে পারত না। শেষ একটা সুযোগ দিত ওকে রেভিনিউ বাড়ানোর। আগে ওর মতো এমন অনেকেরই হত আগে। মনিটরিং-এর সময় অম্বিকেশ স্যার নিজে তাকে ডেকে পাঠিয়ে কিছু অসুবিধা হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করতেন, সাহায্য করতেন।
কিন্তু সে-দিন আর নেই। আজ যাকে সাবাশ বলে পিঠ চাপড়ে দেওয়া হচ্ছে, পরেরদিনই তার পিঠে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে।
এইসব আনমনে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল আলোকপর্ণা, হঠাৎ উদ্দেশ্যহীনভাবে বাঁ-দিকে তাকাতে ও দাঁড়িয়ে পড়ল।
বাঁ-পাশে সেদিনের সেই মিনতি মাসিমার বাড়ি। একইরকম পরিচ্ছন্নভাবে সাজানো বাগানের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। এই কয়েকদিন দু-বেলা এদিক দিয়ে যেতে আসতে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছে ও, যদি কারুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়।
কিন্তু না। হয়নি। কাউকেই ও বাইরে ব্যালকনিতে কিংবা বাগানে দেখতে পায়নি।
সেদিনের পর একদিন রাস্তায় সুজন মিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সুজন মিত্র এই এলাকার কাউন্সিলর তায় কলেজের অধ্যাপক, অনেকবার নানা কাগজপত্র সইসাবুদের জন্য আলোকপর্ণা ওঁর বাড়ি গিয়েছে। বাবার কারখানা বন্ধ হওয়ার পরেও উনি নানা চেষ্টা করেছিলেন বাবাকে অন্য কোনো কাজে ঢোকানোর। ওঁর সুপারিশে কলেজ স্ট্রিটের এক পুরনো প্রকাশনা সংস্থায় কাজও পেয়েছিল বাবা। কিন্তু প্রচণ্ড চাপে বেশিদিন টানতে পারেনি। সে যাইহোক, এইসবের পর থেকে রাস্তায় দেখা হলে আলোকপর্ণা সৌজন্যমূলক কথা বলে টুকটাক। উনিও হেসে জবাব দেন।
কিন্তু সেদিন সুজন মিত্র নিজেই আলোকপর্ণাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। সামান্য ভ্রূ কুঁচকে বলেছিলেন, ‘তোমার সেদিন রাতের ব্যাপারটা মিনতিদি-র কাছে শুনলাম আলোকপর্ণা। এরকম আরও দু-একটা ঘটনা ইদানীং কানে এসেছে। আমি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। ওইদিকটা স্ট্রিট লাইটগুলো বড্ড দূরে দূরে। আমরা ওদিকে আরও ঘন ঘন আলো লাগাবার ব্যবস্থা করছি।’
‘ধন্যবাদ, জেঠু।’ আলোকপর্ণা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ওই ভদ্রমহিলা মানে মিনতি মাসিমা খুব ভালো।’
‘মিনতিদিকে আমি আজ থেকে চিনি নাকি? সেই যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তাম, আমার থেকে দু-বছরের সিনিয়র ছিল মিনতিদি। সেইসময়ের দর্শনের নামকরা ছাত্রী। যেমন পড়াশুনোয়, তেমনই তুখোড় ডিবেটে, এক্সটেম্পোতে। পাস করার কিছুদিনের মধ্যেই একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে গেছিল মিনতিদি। আমরা তখন ফাইনাল ইয়ার।’
আলোকপর্ণা বলেছিল, ‘উনি এখানকারই মেয়ে?’
সুজন মিত্র মাথা নেড়েছিলেন, ‘কোন্নগরের। ওঁর বাবা ছিলেন শ্রীরামপুর কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট। বিয়ের পর অবশ্য মিনুদি চলে যান শ্বশুরবাড়ি বাগবাজারে। কিন্তু একটা দুর্ঘটনায় ওঁর স্বামী মারা যান, ছেলেটা তখন ছোটো। তারপর মিনুদি একাই এখানে এসে থাকতে শুরু করেন।’
আলোকপর্ণা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে সারাজীবনে একবার দেখা হলেও তার রেশ রয়ে যায় সারাজীবন। ওই মিনতি মাসিমাও তেমনই।
সুজন মিত্র যাওয়ার আগে বলে গেছিলেন, ‘মিনুদি খুব অন্যরকম। কারুর বিপদে-আপদে যেভাবে পাশে ছুটে যায়, আমরা অনেকেই তা পারি না। পিকলুর চোখের সমস্যার জন্য নিজের স্কুলের চাকরি ছেড়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্লাইন্ড স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। শুধু ওই ধরনের বাচ্চাদের কথা ভেবে।’
আলোকপর্ণা বাড়িটার গেটটা পেরিয়ে যেতে গিয়েও কী মনে হল, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ও ভেতরে ঢুকে গেল।
এই চত্বরে ছবির মতো সাজানো বাড়ি কম নেই। হিন্দমোটর কারখানার বড়ো বড়ো কর্তারা অনেকেই অবসরের পর এখানে থাকতে শুরু করেছেন। সামনে বিশাল গ্যারাজ, বাগান, টেরেস সমেত বিশাল বাড়ি রয়েছে একাধিক। কিন্তু এই বাড়িটার মধ্যে একটা অন্যরকম ভালোলাগা আছে। বিত্তের কোনো দেখানেপনা নেই এখানে, ছিমছাম রঙের দোতলা একটা বাড়ি। সামনের জায়গাটা পুরোটাই বাগান, মাঝখান দিয়ে বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে লাল সুরকি বিছানো লন।
আলোকপর্ণা দু-পাশের পাতাবাহারি গাছগুলো দেখতে দেখতে লন দিয়ে কয়েক সেকেন্ড হাঁটতেই বাঁ-পাশের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা মিনতি মাসিমাকে দেখতে পেয়ে গেল।
ওঁকে সেদিন ওই কিছুক্ষণই দেখেছিল আলোকপর্ণা, তাও ওইরকম মানসিক অস্থিরতার মধ্যে। আজ দ্বিতীয়বারের জন্য দেখে আরও একবার মুগ্ধ হতে বাধ্য হল আলোকপর্ণা। কিছু মানুষের দিকে একঝলক তাকালেই মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি অনুভব করা যায়। মনে হয় যত বিপদই হোক, যত প্রতিকূল অবস্থা আসুক না কেন, এঁকে সবকিছু বিনা দ্বিধায় বলা যায়।
সাজপোশাক দেখলেই বোঝা যাচ্ছে মিনতি মাসিমা কোথাও বেরোচ্ছেন। ডিমের কুসুম রঙা একটা তাঁতের শাড়ি পরেছেন, আঁচলে সুন্দর হাতের কাজ। চুলে মস্ত খোঁপা, কপালে একটা কালো টিপ। আর কোনো প্রসাধনই নেই। অথচ কী সুন্দরই না লাগছে ওঁকে!
আলোকপর্ণা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। উনি কোথাও বেরোচ্ছেন, আলোকপর্ণা এসে গেল বলে হয়তো আটকে পড়বেন। ওর কি চলে যাওয়া উচিত?
কিন্তু এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মিনতি মাসিমা ওকে দেখতে পেয়ে গেলেন। আর দেখামাত্র যেন কতদিনের চেনা, এইভাবে চওড়া হাসি হাসলেন, ‘আরে, তুমি! কেমন আছ? এই ক-দিন তোমাকে দেখতেই পাইনি। এসো, এসো।’
আলোকপর্ণা অল্প হেসে মাথা নাড়ল, ‘না মাসিমা। আজ আর যাব না ভেতরে। আপনি তো কোথাও বেরোচ্ছেন।’
‘সে একটু পরে গেলেও চলবে।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘তুমি এসো তো!’
আজ আর ব্যালকনি নয়, আলোকপর্ণা বাড়ির ভেতরেই ঢুকল। বেশ বড়ো ডাইনিং, একপাশ দিয়ে সিঁড়ি চলে গেছে দোতলায়। ভেতরের কোনো ঘর থেকে একটা বাজনার শব্দ ভেসে আসছে। বাইরের বাগানে পাখির কিচকিচের সঙ্গে এই বাজনা মিশে কানে বড়ো মোলায়েম হয়ে বাজছে।
ঘরের পরিশীলিত আসবাবপত্র বাদ দিলে যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে, সেটা হল দেওয়ালের ছবি। প্রতিটি দেওয়ালেই অপরূপ সুন্দর সব আঁকা ক্যানভাস। কোনো ছবিতে উড়ন্ত চিল ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট শিকারকে, কোনো ছবিতে অর্জুন পাখির চোখে তির বেঁধানোর জন্য ধনুক নিয়ে বদ্ধপরিকর।
আলোকপর্ণা মুগ্ধ চোখে সেগুলো দেখছে দেখে মিনতি মাসিমা বললেন, ‘ওগুলো সব আমার ছেলে পিকলুর আঁকা।’
‘পিকলু মানে সেদিন যিনি …।’ আলোকপর্ণা এবার সত্যিই অবাক হল।
মিনতি মাসিমা হাসলেন, ‘হ্যাঁ, ও আমাদের মতো হয়তো অত ভালো দেখতে পায় না, কিন্তু ওর মন দিয়ে ও যতটা স্পষ্ট কাউকে দেখতে পায়, ততটা আমরাও পাই না।’ তাই ওর হাতে কলম কথা বলে ওঠে। কখনো আঁকায়, কখনো কবিতায়।’
আলোকপর্ণা বলল, ‘উনি কবিতাও লেখেন বুঝি?’
‘ওই টুকটাক।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘কয়েকটা পত্রিকায়।’
আলোকপর্ণা জিজ্ঞেস করল, ‘ওঁর চোখ এতটা খারাপ কী করে হল?’
মিনতি মাসিমা ডাইনিং-এর একপাশের খোলা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন, ‘ওর যখন দশ বছর বয়স, ও আর ওর বাবা উত্তরবঙ্গ বেড়াতে গিয়েছিল। পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে। আমি যাইনি। সেখানেই বৃষ্টির মধ্যে ওদের গাড়িটা প্রচণ্ড অ্যাক্সিডেন্ট করে। পিকলুর মাথায় একটা আঘাত লাগে, আর তারপর থেকেই ওর দৃষ্টিশক্তি কমতে শুরু করে। আর ওর বাবা তো সামনে বসে ছিল। চলেই গেল।’ মিনতি মাসিমা একটা প্লেটে কিছু নোনতা নিয়ে এলেন, ‘খেয়ে নাও।’
আলোকপর্ণা থ হয়ে গেল। সুজন মিত্র সেদিন দুর্ঘটনায় ওঁর স্বামী মারা যাওয়ার কথা বললেও তাতেই যে ওঁর ছেলের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা বলেননি।
কোনোমতে ও শুধু বলতে পারল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! আমার একার যুদ্ধ শুরু হল। আমি একটা স্কুলে পড়াতাম। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির সেটা পছন্দ ছিল না প্রথম থেকেই। তাঁরা বাগবাজারের নামকরা চৌধুরী পরিবার, বাড়ির বউ কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রোজ সকালে ছাত্র ঠ্যাঙাতে যাবে, এটা তাঁরা কল্পনাই করতে পারতেন না। আমার স্বামী অবশ্য কোনোদিন আপত্তি করেননি। উৎসাহও দেননি। আমি একাই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পর কড়া নির্দেশ এল, চাকরি না ছাড়লে ছেলে সমেত শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হবে।’ মিনতি মাসিমা সামনের সোফায় বসে মিষ্টি করে হাসলেন, ‘আমি দ্বিতীয়টাই ছাড়লাম। তার অনেক কারণ ছিল। সে সব পরে কোনোদিন বলব’খন।’
‘আচ্ছা, আপনি তো প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন, তাই না? সুজন জেঠু বলছিলেন সেদিন।’ আলোকপর্ণা বলল।
‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা এখন গর্ব করে বলতে লজ্জা করে।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাই দিতে পারিনি। তার আগেই আমার বিয়ে দিয়ে দেয় দাদা। বাবা মারা গিয়েছিলেন তার আগেই। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি অনেক বড়ো হই। কিন্তু তিনিও চলে গেলেন, আর তাঁর ইচ্ছেও তাঁর সঙ্গেই চলে গেল। দাদা অবিবাহিতা বোনকে তাড়াতাড়ি পার করার জন্য একটা সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে বিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলল।’
আলোকপর্ণা বলল, ‘সেইজন্যই আপনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়েও কোন্নগরের বাড়িতে না গিয়ে হিন্দমোটরে এলেন?’
‘হ্যাঁ। বাবার অবর্তমানে দাদার কাছে গিয়ে থাকতে কোনো ইচ্ছেই হয়নি। তা ছাড়া, শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ি এই চক্করে তখন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। যত কষ্টই হোক, ঠিক করেছিলাম নিজের বাড়িতেই থাকব। তাই নিজের চাকরিটাকে সম্বল করে প্রথমে এখানে এসে একটা বাড়ি ভাড়া নিই।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘তখন আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। তার আগে পর্যন্ত আমার জীবনে যে একেবারেই কোনো ঝড়ঝাপটা আসেনি, তা নয়। কিন্তু সেগুলোর তীব্রতা এমন অসহনীয় ছিল না। তবে আমি কী বিশ্বাস করি জানো? প্রতিটা মানুষের ভেতর সংগ্রাম করার প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে। কেউ সেটাকে কাজে লাগাতে পারে। কেউ পারে না। আমি একা জীবন শুরু করলাম। সঙ্গে আমার দশ বছরের ছেলে, যার দৃষ্টি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম সারাক্ষণ চোখে জল আসত। ভাবতাম, কীভাবে আমি একা পার করব এই সংসার বৈতরণী? তারপর আস্তে আস্তে শক্ত হলাম। মনকে বোঝালাম, দৃষ্টি চলে যাওয়াটাই জীবনের শেষ নয়। হৃৎস্পন্দন থেমে যাওয়া হল শেষ। চোখ একটা ইন্দ্রিয়মাত্র, সেটা চলে গেলে আমার পিকলু যেন অন্যগুলোর ওপর ভর করে বাঁচতে পারে, সেই দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। তাই একটু থিতু হওয়ার পর ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ানোর ট্রেনিং নিলাম। শিখলাম ব্রেইল ল্যাঙ্গুয়েজ, কয়েক বছর পর যোগ দিলাম উত্তরপাড়ার একটা ব্লাইন্ড স্কুলে। ততদিনে আমি এই জমিটা কিনে বাড়ি করেছি। পিকলুও স্কুলের বেশ উঁচু ক্লাসে উঠে গেছে। আমার ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ানোর ট্রেনিং অবশ্য ওর কাজে লাগেনি। ঢাউস চশমা পরলেও ও সাধারণ স্কুলেই পড়েছে, তোমার দিদি ঋতুপর্ণার মতো বন্ধুরা ওকে অনেক সাহায্য করেছে। পাওয়ার বেড়েই চলছিল। দু-বার ভেলোর নিয়ে গিয়েছি। কোনো লাভ হয়নি। শেষে কলেজের ফাইনাল ইয়ারে একটা চোখ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। অন্যটা খুব ঝাপসা…।’
আলোকপর্ণা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল।
‘তবে এখন আমি অনেক সুখী। রিটায়ারমেন্টের পর নিজের মতো থাকি, মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাই, গান শুনি, বাগান করি। পিকলুও আমাদের স্কুলে জয়েন করেছে। আঁকে, লেখালেখি করে। গানবাজনার দিকেও ঝোঁক আছে। ওই যে বাজাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ না?’ মিনতি মাসিমা বললেন।
‘ভেতরের ঘর থেকে যে বাজনাটা ভেসে আসছে সেটা কি …?’ আলোকপর্ণা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল। ততক্ষণে বেহালার ছড়ের মূর্ছনা গোটা ঘরকে আবিষ্ট করে ফেলেছে।
যদিও ও গানের তেমন কিছু বোঝে না, কিন্তু এত দ্রুত লয়ে সুরের ওঠাপড়া চলছে, যে ওর কানের পর্দায় সেটা প্রচণ্ড একটা সুখানুভূতির সৃষ্টি করছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বাজাচ্ছে, সে অত্যন্ত পারদর্শী।
‘হ্যাঁ। পিকলুই বাজাচ্ছে।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘ও আমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়ায়, তার সঙ্গে মিউজিক টিচারও। ছোটো থেকে ওর খুব বেহালা শেখার শখ ছিল। প্রতি রবিবার সকালে সব কাজ সেরে ওকে দক্ষিণ কলকাতায় শেখাতে নিয়ে যেতাম। আঁকাটা অবশ্য কোথাও শেখেনি, নিজেই নিজেই আঁকে।’
কী অসম্ভব মনের জোর এই মহিলার! এই মানসিক শক্তির এককণাও যদি ও পেত, জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে পারত। সারাক্ষণ এইরকম অবসাদগ্রস্তভাবে নয়। আলোকপর্ণা মনে মনে ভাবল।
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে মিনতি মাসিমা মিষ্টি করে হাসলেন, এবং আবারও ওর মন পড়ে ফেললেন, ‘কী ভাবছ? আমার কী প্রচণ্ড মনের জোর, তাই তো? ভুল ভাবছ। মনের জোর তোমারও আছে। নিজেকে কখনো অসহায় মনে করবে না আলোকপর্ণা, তাহলেই দেখবে শক্তি এসে ভর করছে তোমার মনে। সেই শক্তিতে ভর দিয়ে চললেই একদিন দেখবে সব মেঘ কেটে গেছে।’
আলোকপর্ণা কেঁপে উঠল। দিদি চলে যাওয়ার পর থেকে বাবা-মা আমূল বদলে গিয়েছে, ওদের হাসিখুশি মা হয়ে উঠেছে কর্কশ বদমেজাজি। অনেকদিন এমন স্নেহের পরশ আলোকপর্ণা কারুর কাছে পায়নি। এই দীর্ঘ সময় ও খালি বুকের মধ্যে পাথর চেপে অফিস করেছে, বাড়ি ফিরেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে।
আজ হঠাৎ মিনতি মাসিমার কাছে এই আন্তরিকতা মাখা কথাগুলো শুনতে শুনতে কী হল কে জানে, আলোকপর্ণার চোখ দুটো জলে ভরে গেল। বড়ো বড়ো দুটো জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে।
মিনতি মাসিমা সেটা লক্ষ করে থমকে গেলেন। কাছে এসে ওর পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার আলোকপর্ণা? কোনো সমস্যা?’
আলোকপর্ণার কী হল কে জানে! গত দু-বছর ধরে বাড়ির ওই পরিবেশ, এই কয়েকদিন ধরে অফিসে চলা টেনশন, সেদিনের লোকটার অসভ্যতা, আর আজ অফিসে ওকে পিঙ্ক স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া, এই সব কিছু বুকে অভিমান, কষ্ট হয়ে জমতে জমতে যে পাহাড়টা তৈরি হয়েছিল, সেটা কোনো বড়োসড়ো ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ল।
চোখ মোছার বদলে ঝরতে লাগল একের পর এক ফোঁটা। ও বাধা দিল না। হোক দু-দিনের পরিচয়, এমন একটা মানুষের সাহস জোগানোটা ওর কাছে এখন বড়ো প্রয়োজন।
ও বলল, ‘আমার চাকরিটা আজ চলে গেল। বাড়িতে আমি ছাড়া কেউ রোজগেরে নয়। আমি এখন কী করব মাসিমা? আমার কি সুইসাইড করা উচিত?’
‘আত্মহত্যা মহা পাপ আলোকপর্ণা।’ মিনতি মাসিমা বললেন, ‘প্রত্যেককে নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়। আত্মহত্যার অর্থ, জোর করে সেই কাজের মেয়াদ শেষ করে দেওয়া। জোর করে একটা সক্রিয় আত্মাকে খুন করা। শান্ত হও। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।’
আলোকপর্ণার চোখ জলে ভিজে উঠছিল।