১০. নরম গভীর শয্যা

নরম গভীর শয্যার শুয়ে উদিতের যেন ঘুম আসতে চাইল না। এতটা বিলাসে ভোগে ও অভ্যস্ত না। তা ছাড়া নতুন জায়গা, অপরিচিত পরিবেশ। কিন্তু শরীর অসম্ভব ক্লান্ত। খানিকটা নিঝুম হয়ে পড়ে রইল। আর সমস্ত ব্যাপারটাই ওর কাছে, অভাবিত আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। গতকাল বিকালেও ও জানত না, নয়নের সঙ্গে ওর এভাবে পরিচয় হবে। এখানে এভাবে আসতে হবে। ভাবতেও পারেনি, নয়ন হল দীপেন সিংহের মেয়ে, চা-জগতে যাকে বলা হয় জায়ান্ট। উদিত এখন সেই জায়ান্টের বিলাস-প্রাসাদের এক ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করছে। কোনও রকমেই যেন ভাবা যায় না। ভাবা যায় না, সুতপা নামে যে মেয়েটিকে ও একসময়ে খানিকটা করুণা-ই করেছিল, সে হল নয়ন সিনহা, যে আজকে বিরাট টি-এস্টেটের মালিক। অথচ নয়ন ওর সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করেছে, এখনও করছে সেগুলোও যেন বিশ্বাস করা যায় না।

খানিকটা চোখ বোজা নিঝুম অবস্থাতেই শুয়ে প্রায় ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল। ঘুম না হলেও, বিশ্রাম হল। শরীর এখন অনেকটা ঝরঝরে। উদিত উঠে বসল। ঘরের দরজাটা খোলা। মোটা পরদা ঢাকা দেওয়া রয়েছে। উদিত উঠে বসে দরজার দিকে তাকাতেই, পরদা একটু ফাঁক হল।

নয়নের মুখ দেখা গেল। চোখাচোখি হতে, নয়ন ঘরে ঢুকল। জিজ্ঞেস করল, ঘুম হল?

উদিত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এক রকম। আপনি ঘুমোননি?

নয়ন বলল, আমার ঘুম আসছে না। আমি এখনও রীতিমতো উত্তেজিত। বাড়িতে আসতে পেরেছি, সেটাই আমার উত্তেজনা।

উদিত নয়নকে দেখল। সত্যি, তাকে ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না। একটু চোখের কোণ বসা। কিন্তু তার সারা মুখে একটি চকচকে ভাব। চোখের দৃষ্টি ঝকঝকে।

উদিতের চোখ ফেরাতে একটু দেরি হল। এখন যেন নয়নকে ও অন্য চোখে দেখছে। নয়ন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন?

উদিত যেন একটু থতিয়ে গেল। বলল, না, মানে—

একটু ভেবে নিয়ে আবার বলল, সমস্ত ঘটনাটা আমার জানতে ইচ্ছে করছে।

নয়ন ঘাড় নেড়ে বলল, কোন ঘটনা? আমার কলকাতা থেকে পালানো?

উদিত বলল, যদি কোনও অসুবিধে না থাকে।

 তাও আবার আপনাকে?

নয়নের চোখে ঝিলিক হানল। বলল, আপনাকে না বলতে পারলে, আর কাকে বলা যাবে। চলুন, চায়ের টেবিলে যাই। মা আর আমি দুজনেই আপনাকে সব কথা বলব।

চলুন।

নয়নের সঙ্গে উদিত গিয়ে দেখল, মাথা ঢাকা চওড়া বারান্দায় চায়ের টেবিল। সামনে সবুজ লন। চারপাশে ফুলের সমারোহ। টিলার ওপর থেকে, দূরে দেখা যায় চালসা ফরেস্ট। বিকেলের আলো নেই। সবই মেঘে ঢাকা। তবে বৃষ্টি হচ্ছে না। টিলার এই প্রাসাদের বারান্দায় বসে, বন্যার অবস্থা কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে বন্যা পরিস্থিতির সে রকম কোনও পরিবর্তন হয়নি, তা অনুমান করা যায়।

চায়ের টেবিলে হেমলতা বসে ছিলেন। ডাকলেন, এসো উদিত। ঘুম হয়েছে তো একটু।

উদিত বলল, অনেকটা বিশ্রাম হয়েছে।

চাকর ট্রেতে করে টি-পট, চায়ের সব সরঞ্জাম টেবিলের ওপর বসিয়ে দিয়ে গেল। আর একজন রেখে গেল কিছু খাবার।

নয়ন হেমলতাকে বলল, মা, উদিতবাবুকে তুমি সমস্ত ঘটনা বলো।

 হেমলতা বললেন, আমি কেন, তুই-ই বল না। তোকে নিয়েই তো ঘটনা।

 কিন্তু কথা শুরু করলেন হেমলতা।

.

মা আর মেয়ে, দুজনের কথা থেকে যা জানা গেল, তা হল একটি নিখুঁত ষড়যন্ত্রের কাহিনী। দীপেন্দ্র সিংহের এক ভাই থাকেন কলকাতায়। অর্থাৎ নয়নের কাকা, বীরেন্দ্র সিংহ। বীরেন্দ্র কলকাতার একটি বেসরকারি ফার্মের বড় চাকুরে। তাঁর বাড়ির চাল-চলনে পুরো বিলিতিয়ানা। দীপেন্দ্র সিংহের আর্থিক সঙ্গতির তুলনায়, বীরেন্দ্রকে গরিব বলতে হয়। কিন্তু দীপেন্দ্র তাঁর ছোট ভাইকে নানাভাবে সাহায্য করতেন।

দীপেন্দ্রর মৃত্যুর পরে, বীরেন্দ্র হেমলতাকে বলে, তাঁর সম্মতি আদায় করে, নয়নকে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতায়। তাঁর সদুদ্দেশ্য ছিল, নয়নকে কলকাতার উচ্চতর সমাজে পরিচিত করানো, সেই সমাজের চাল-চলনে পাকা করে তোলা। বীরেন্দ্রের বাড়িতে নাকি কলকাতার উচ্চ সমাজের যুবকদের যাওয়া-আসা। তাদের সঙ্গে নয়নের পরিচয় হলে, সব দিক দিয়েই ভাল। কারণ নয়নের উপযুক্ত পাত্র কলকাতার উচ্চ সমাজেই আছে। ভবিষ্যতে যে বিখ্যাত ডি. সিনহা টি-এস্টেটের দায়িত্ব নিতে পারবে।

কিন্তু বীরেন্দ্রর আসল উদ্দেশ্যটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। নয়ন সেটা কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল। উচ্চ সমাজ সম্পর্কে নয়নের যে একেবারে কোনও ধারণা ছিল না, তা নয়। ছেলেবেলা থেকে, ও একটা বিশেষ সমাজের মধ্যেই মানুষ হয়েছে। দার্জিলিঙে থেকে পড়াশোনা করেছে। কলকাতায় ও কম যাতায়াত করেছে বটে, উচ্চ সমাজটা ওর অপরিচিত ছিল না। কিন্তু কলকাতায় কাকার বাড়িতে যে উচ্চ সমাজের স্পর্শে ও এসেছিল, তারা এক ধরনের মুখোশ-আঁটা, শহুরে ফেরেববাজ ছাড়া আর কিছু না।

নয়ন আগে কখনও কাকার পরিবারের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেনি। ক্রমে, কাকাকেও ওর কলকাতার সেই সব তথাকথিত উচ্চ পর‍্যায়ের মুখোশ-আঁটা লোক বলে মনে হয়েছিল। পরিবারের চেহারাটাও ওর ভাল লাগেনি। ওর খুড়তুতো বোনেরা নাচ গান মদ্যপানে অভ্যস্ত। সকলেরই অনেক পুরুষ বন্ধু। অধিক রাত্রের আগে কেউ বাড়ি ফেরে না। কাকার নিজের বন্ধুবান্ধব আড্ডাও নয়নের ভাল লাগেনি। তিনি নিজেও একজন মাতাল।

মদ সম্পর্কে নয়নের কোনও কুসংস্কার নেই। কিন্তু সীমাহীন মত্ততা, উচ্ছ্বঙ্খলতা ও সহ্য করতে পারে না। দীপেন্দ্র সিংহ নিজে ছিলেন সাত্ত্বিক প্রকৃতির কর্মঠ মানুষ। তথাপি তিনি ক্লাবে যেতেন, বাড়িতে পার্টি দিতেন, সবাইকে পান-ভোজনে আপ্যায়ন করতেন। কিন্তু সে চেহারাটা সম্পূর্ণ আলাদা।

কাকার বাড়িতে নয়নের তা ভাল লাগেনি। ক্রমেই যেন ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। যে সব যুবকের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিল, তারা এক ধরনের লোভী উচ্চুঙ্খল। চেহারায় বেশবাসে তারা যতই মার্জিত হোক, আর গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াক, তাদের আসল চেহারাটা চিনতে ভুল হয়নি। নয়ন সব কথাই ওর মাকে লিখে জানাত। কিন্তু ওর সে সব কোনও চিঠিই কোনওদিন হেমলতার কাছে পৌঁছয়নি।

নয়ন কার্যত কাকার বাড়িতে বন্দি হয়ে পড়েছিল। কাকা তাঁর নিজের পছন্দমতো যুবকদের সঙ্গে, নয়নের বিয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। নয়ন সবগুলোই নাকচ করেছিল। বুঝতে পেরেছিল, সেই সব যুবকেরা সবাই কাকার বিশেষ অনুচর। তাদের কারোর সঙ্গে নয়নের বিয়ে হলে, সে হবে কাকার একটি প্রভুভক্ত জীব। অথচ মা যে ওর সত্যিকারের কোনও খবরই পাচ্ছেন না। সেটা ও বুঝতে পেরেছিল। আর কাকার চিঠিতে হেমলতা জানতে পারতেন, নয়ন কলকাতায় বেশ বহাল তবিয়তে আছে। মাকে চিঠি লেখার সময়ও ওর নেই।

বীরেন্দ্র শেষ পর্যন্ত যখন বুঝতে পেরেছিলেন, নয়নকে বাগে আনা যাবে না, তখনই উনি স্থির করেছিলেন একটি ছেলের সঙ্গে জোর করেই নয়নের বিয়ে দেবেন। উদ্দেশ্য নয়নের ওপরে ভবিষ্যতে পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখা। যদি বিয়ে দিতে না পারেন, তা হলে নয়নকে কোথাও লুকিয়ে ফেলবেন।

নয়ন সমস্ত বুঝতে পেরেই, কাকার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। কাকার বাড়ি বা পরিচিতদের ছাড়াও, নয়নের আরও জানাশোনা দু-একটি পরিবার ছিল। দার্জিলিঙের কলেজেই সেই পরিচয়। গত পাঁচ দিন আগেই, ও পালিয়ে গিয়ে উঠেছিল সেইরকম একটি বাড়িতে। সেখান থেকে হেমলতাকে চিঠি লিখেছিল। ট্রেনে রওনা হবার আগের দিন টেলিগ্রাম করেছিল। নয়ন কলকাতাতেই কয়েক দিন লুকিয়ে ছিল। বীরেন্দ্রের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, সোজা উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা হলে, ট্রেনেই ধরে ফেলতে পারত। নয়ন জানত, কাকা ওর পালাবার কথা জানা মাত্র চারদিকে তাঁর অনুচরদের ছড়িয়ে দেবেন। দিয়েছিলেনও নিশ্চয়ই। তিন-চার দিনেও কোনও খোঁজ খবর না পেয়ে, হতাশ হয়ে ধরে নিয়েছিলেন, নয়ন ওর মায়ের কাছে পালিয়ে গিয়েছে। আসলে নয়ন চার দিন পরে, হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিল। তারপরের ঘটনা উদিতের মোটামুটি সবই জানা।

উদিত অবাক হয়ে সব শুনল। মনে মনে নয়নের সাহসের প্রশংসা না করে পারল না। কিন্তু স্বার্থের জন্য, অর্থের জন্য, নিজের ভাইঝির জীবনকে কেউ এভাবে বিপন্ন করে তুলতে পারে, এরকম চরিত্রের কথা ওর জানা ছিল না।

.

রাত্রে খাবার আগেই, নারায়ণ এসে পৌঁছুল। সে এসেই হইচই শুরু করে দিল। নয়ন খুশি হয়ে উঠল। নারায়ণকে হেমলতারও ভাল লেগেছে বোঝা গেল। নারায়ণের খালি এক কথা, আরে আমার চোখকে কখনও ফাঁকি দেওয়া যায়? আমি তো বারে বারেই বলেছি, এ মুখ আমার চেনা।

হেমলতা বেশি রাত করলেন না। ওদের তিন জনকে গল্পের আসরে বসিয়ে, তিনি শুতে চলে গেলেন। ওরা তিনজন অনেক রাত অবধি গল্প করল। কিন্তু নারায়ণের কথায় কথায় ইশারা আর ইঙ্গিত, উদিতকে রীতিমতো বিব্রত আর ত্রস্ত করে তুলল। অথচ যার জন্যে উদিত বিব্রত এবং ত্রস্ত, সেই নয়ন কেবল চোখে ঝিলিক হেনে হাসল।

পরের দিনও মেটেলি ছেড়ে যাওয়া হল না। হেমলতাই ছাড়লেন না। নয়নের তো কথাই নেই। উদিত লক্ষ করে দেখল, হেমলতার সঙ্গে নারায়ণের আলাদা কথাবার্তা হচ্ছে। একবার নয়নের সঙ্গেও, ওদের যেন কী কথাবার্তা হল।

বিকেলবেলা চায়ের টেবিলে, সকলের সামনেই, হেমলতা বললেন, উদিত, তোমার কি চলে যাওয়ার খুবই দরকার।

উদিত বলল, বাড়িতে.তো আমাকে যেতেই হবে। তা ছাড়া আমি বেকার মানুষ, শুনেছি বাবা একটা কী ব্যবস্থা নাকি করেছেন।

হেমলতা বললেন, তোমাকে এমনি একটা চাকরি দেব, সে কথা আমি ভাবতে পারছি না। তবে, বুঝতেই পারছ, আমাদের কেউ দরকার। যে আমাদের নিজেদের লোক হিসেবে, এস্টেট দেখাশোনা করবে, দায়িত্ব নেবে। তুমি কি সে দায়িত্ব নিতে পার না?

উদিত চোখ কপালে তুলে বলল, আমি!

নারায়ণ বলে উঠল, হ্যাঁ, তুই।

 উদিত নয়নের দিকে দেখল। চোখাচোখি হল।

 উদিত বলল, অসম্ভব। আমার সে যোগ্যতা নেই।

 হেমলতা বললেন, যোগ্যতা অর্জন করতে হয় বাবা। তুমি আরম্ভ করো। আমিও আছি। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

নারায়ণ বলল, নিশ্চয়ই। উদিত আগামীকাল আমার সঙ্গে চলুক। বাড়িতে গিয়ে দেখা করে, দু দিন বাদেই আবার ফিরে আসবে। আমিও আসব ওর সঙ্গে।

হেমলতা বললেন, সেই ভাল।

 উদিত যেন সমস্ত ব্যাপারটার কিছুই বুঝতে পারল না। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল, এবং এরকম একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ভাবতে ভাবতে, একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কতক্ষণ এভাবে বসেছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ ওর কানে এল, কী দুর্ভাবনায় পড়ে গেলেন?

উদিত চমকে তাকিয়ে দেখল, নয়ন ওর সামনে। সেখানে আর কেউ নেই।

উদিত বলল, কী করে পারব, তাই ভাবছি। আপনি কী বলেন?

আমি?

 নয়নের চোখে একবার ঝিলিক দিল। তারপরে যেন ওকে একটু গম্ভীর দেখাল। বলল, না পারলে কী করে চলবে? অন্তত আমার জন্যও পারতে হবে।

উদিতের মনে বিস্ময়ের চমক। নয়নের দিকে চেয়ে, কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারল না। তারপরে উচ্চারণ করল, আপনার মুখ চেয়ে–?

নয়ন বলল, আপনার নয়, তোমার।

বলতে বলতেই নয়নের মুখে রঙের ছোপ লেগে গেল। উদিত সেই মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাল। নয়ন এক বার মুখ নামাল। আবার চোখ তুলে তাকাল। দুজনেই হাসল, উদিতের মনে হল, নয়নের একটা নতুন পরিচয় যেন এই মাত্র পেল।