দৈত্যের আত্মকথা চলছে
কেন আমি বেঁচে আছি? এ অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী?
কে আমি? কোথা থেকে আমি এসেছি? মানুষরা আমাকে এত ঘৃণা করে কেন?
ঘৃণা! আমি দিতে চাই প্রেম, আর ওরা করবে ঘৃণা! কেন, কেন, কেন?
প্রচণ্ড ক্রোধে ফুলতে ফুলতে এক-একবার মনে হতে লাগল, দি বাড়িসুষ্ঠু ওদের ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে ধুলোয় ধুলো করে মিশিয়ে। ওরা যখন করুণ আর্তনাদ করবে, আমি করব
তখন উৎকট আনন্দে আকাশ ফাটানো চিৎকার। হ্যাঁ, সে শক্তি আমি রাখি!
অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করলুম।
প্রভু, তারপর স্মরণ হল তোমাকে। কেন জানি না, মনে হল আমার জন্মের সঙ্গে কোনও রহস্য জড়ানো আছে। আমি পৃথিবীর কোনও মানুষেরই মতন দেখতে নই কেন? মানুষরা আমায় দেখলেই ভয় পায় কেন? তবে কি আমি মানুষ নই? বুঝলুম, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো কেবল তুমি। তৎক্ষণাৎ তোমার সন্ধানে ছুটে চললুম।
আবার সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম—যেখানে প্রথম আমি চোখ মেলে তাকিয়েছিলুম।
রাত তখন অনেক! আমি পা টিপে টিপে তোমার শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।
উঁকি মেরে দেখলুম, তুমি একটা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছ আর দু-পাশে বসে আছে দুজন অচেনা লোক।
হঠাৎ তুমি চিৎকার করে বলে উঠলে, এ আমার অদ্ভুত আবিষ্কার। জড়পিণ্ডকে আমি জীবিত করতে পারি। মাটির তাল থেকে গোরস্থানের অস্থি-পিঞ্জর কুড়িয়ে আমি গড়েছি নতুন জাতের এক বৃহৎ মানুষ! আমি হচ্ছি সৃষ্টিকর্তা! আমি মানুষ গড়েছি না, না, মানুষ গড়তে গিয়ে আমি গড়েছি প্রকাণ্ড এক দৈত্য, আমি গড়েছি মূর্তিমান অভিশাপ!
কে বললে, ডাক্তার, অজয় আবার বিকারের ঘোরে প্রলাপ বকতে শুরু করলে।
উত্তরে ডাক্তার কী বললে তা আমার কানে গেল না। যেটুকু শুনেছি আমার পক্ষে তাইই যথেষ্ট। আবার ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠবার ইচ্ছা হল, কিন্তু প্রাণপণে সে ইচ্ছা সামলে সেখান থেকে আমি পালিয়ে এলুম!
একেবারে গভীর অরণ্যে! কৃষ্ণপক্ষের ঘুটঘুটে কালো রাত্রি। আকাশের অন্ধকারে সঙ্গে মিশল গিয়ে আমার মনের অন্ধকার। ঝোড়ো বাতাসে সারা অরণ্য করছে গভীর গর্জন। কিন্তু সেই মর্মর গর্জনে জেগে উঠল আমার আহত রক্তাক্ত হৃদয়ের অশান্ত চিৎকার। বনে বনে ছুটে বেড়াই আর করি প্রচণ্ড হাহাকার!
তাহলে আমি মানুষ নই? আমার এ কৃত্রিম দানব দেহ বহন করছে ক্ষুদ্র মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম জীবন? আমার স্রষ্টারও মতে আমি হচ্ছি একটা মূর্তিমান অভিশাপ? প্রভু, তোমাকে হাতের কাছে পেলে আমি কী করতুম জানি না—কারণ তখন আমার মনে হচ্ছিল, অরণ্যের গাছগুলোকে পর্যন্ত দুই হাতে উপড়ে ছিন্নভিন্ন করে ছড়িয়ে দি আকাশে-বাতাসে। সেইদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করলুম, আমি যখন মানুষ নই তখন মনুষ্য-জাতির কারুকেই আর দয়া ক্ষমা করব না। আর যে স্রষ্টা নিজের খেয়াল চরিতার্থ করবার জন্যে আমাকে এই অভিশপ্ত জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছেন, তাকেও আমি দেব উপযুক্ত শাস্তি!
সারারাত দাপাদাপি করে ভোরের দিকে শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।
পরদিন অনেক বেলায় যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেহ আমার পীড়িত হলেও মন হয়েছে কতকটা প্রকৃতিস্থ। বসে বসে ভাবতে লাগলুম, নিজের জন্মরহস্য তো বুঝেছি, এখন আমার কী করা উচিত? মানুষের সমাজে আর আমার আশ্রয় নেই, কিন্তু আমার সমাজ কোথায়? সাধারণ দানব-দেত্যদেরও সমাজ আছে কিন্তু আমি যে অসাধারণ! এই বিপুল ব্রহ্মাণ্ডে আমি যে সম্পূর্ণ একাকী!
কিছুই স্থির করতে পারলুম না। কেবল এইটুকুই মনে করে রাখলুম, মানুষের ছায়াও আর মাড়াব না—মানুষের কাছে আর আমার কিছুই প্রাপ্তির আশা নেই। আমি হচ্ছি অন্ধকারের আত্মা—আমার ঠাঁই জীবরাজ্যের বাইরে।
তারপর আরম্ভ হল আমার নিরুদ্দেশ যাত্রা। আজ যেখানে থাকি কাল সেখান থেকে চলে যাই অনেক দূরে। এক জায়গায় বসে দু দিনের সূর্যোদয় দেখবার ধৈর্য আমার নেই—এমনি আমার পথের নেশা! আমি যেন ঝোড়ো হাওয়া—হু হু শ্বাসে বিশ্বময় ছুটে বেড়ানোই আমার ধর্ম!
অজানা পথের পথিক হওয়ার সুযোগ পাই কিন্তু কেবলমাত্র রাত্রিবেলায়। মানুষ হচ্ছে। দিনের আলোকের জীব, তাদের সঙ্গে চোখাচোখি করবার সাধ নেই।
সমস্ত মধুর অনুভূতি আমার লুপ্ত হয়ে গেল। আমার কাছে সূর্য উত্তাপহীন, চন্দ্র জ্যোৎস্নাহীন, আকাশ নীলিমাহীন, পুষ্পলতা বর্ণহীন। সারা পৃথিবীকে আমি দি অভিশাপেরপর-অভিশাপ! দেহের ভেতরে সর্বদাই জাগে জ্বরের জ্বালা, মনের ভেতরে সর্বদাই মাথা খোড়ে অপরিতৃপ্ত প্রতিহিংসার নিষ্ফল আক্রোশ, দৃষ্টি দেখে সর্বদাই ধ্বংসের উৎসব! আমার স্বভাবের সমস্ত সৎগুণ নষ্ট হয়ে গেল—দিনে দিনে আমি হয়ে উঠলুম দানবেরও পক্ষে ভীতিকর মহাদানব!
একদিন এক জায়গায় আমি ভুল করে একটু সকাল সকাল—অর্থাৎ সন্ধ্যার একটু আগে পথে বেরিয়েছিলুম। জায়গাটি নির্জন ছিল বলে ভেবেছিলুম, হয়তো ঘৃণ্য মানুষের সঙ্গে দেখা হবে না।
নদীর ধারে দেখলুম একটি বাগানের মতন রঙিন ঠাঁই। প্রভু, তুমি আমাকে মানুষ করে গড়োনি, কিন্তু আমার বুকে দিয়েছ দুর্বল মানুষের মন। সেদিনের সবে ওঠা চাদ, সুগন্ধ বাতাস আর নদীর কলতান মুহূর্তের জন্যে আমার মনকে করলে অভিভূত। হঠাৎ ক্ষণিকের জন্যে পৃথিবীকে কেমন মিষ্টি লাগল।
পৃথিবীকে মিষ্টি লাগার ফুল কিন্তু ভালো হল না। আমি বরাবরই লক্ষ করে দেখেছি এমন বিকৃত কৃত্রিম ভাবের মধ্যে আমার জন্ম যে, মনের মধ্যে মাধুর্য এলেই আমাকে পেতে হয় দুর্ভাগ্যের আঘাত!
একটা ঝোপের পাশে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে দাঁড়ালুম, এমন সুন্দর সন্ধ্যায় মানুষরা কী করছে দেখবার জন্যে।
হঠাৎ একটি ছোট্ট খোকা খেলা করতে করতে আমার সামনে ছুটে এল।
ভাবলুম, এই তো অবোধ শিশু,,এর বুকের ভেতরে হয়তো এখনও মানুষী-ঘৃণার জন্ম হয়নি, একে একটু আদর করি।
আমি শিশুর হাত চেপে ধরতেই সে মহা ভয়ে চেঁচিয়ে বলল, ভূত! রাক্ষস! ছেড়ে দে—ছেড়ে দে আমাকে। তার হাত থেকে একখানা ছবি মাটির ওপর্কে পড়ে গেল।
ছবিখানার দিকে চোখ পড়তেই চিনলুম, তাতে রয়েছে তোমার মূর্তি! হ্যা, তোমার আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রুর মূর্তি! পরমুহূর্তে আমার মন থেকে সমস্ত মধুর দুর্বলতা মুছে গেল—আবার ফিরে এল আমার দানবত্ব!
কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করলুম, ওখানা কার ছবি?
শিশু ছটফট করতে করতে বললে, আমার দাদার ছেড়ে দে আমাকে,নইলে বাবাকে ডাকব?
আমার চিরশত্রুর ভাই এই শিশু! নিজের অজ্ঞাতসারেই তার কণ্ঠের ওপরে আমার হাতের চাপ কঠিন হয়ে উঠল, তারপর শিশুর মৃতদেহ পড়ল আমার পায়ের তলায় লুটিয়ে!
সেই শিশুর মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে অনুভব করলুম নরকের প্রচণ্ড উৎসব। দুই হাতে তালি দিয়ে বিপুল আনন্দে বলে উঠলুম, আমিও তাহলে ধ্বংস করতে পারি! শত্রু তাহলে আমার নাগালের বাইরে নেই—এই শিশুর মৃত্যুই এ সত্য তাকে বুঝিয়ে দেবে। এর পরেও তার জন্যে তোলা রইল আরও অনেক শাস্তি। তারপর শত্রু নিপাত।
তারপর কিছুকাল আমি আর সে দেশ ত্যাগ করলুম না। কারণ আমার মন বললে, এইখানেই আবার আমার নির্দয়, নির্বোধ সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে।
মন ভুল বলেনি। একদিন তোমার দেখাও পেলুম। কিন্তু সেদিন আমি তোমার সামনে যাইনি।
তবে তারপর আর তোমাকে আমার চোখের আড়ালে যেতে দিইনি। দিন-রাত আড়াল থেকে রেখেছি তোমার গতিবিধির ওপরে তীক্ষ্ণদৃষ্টি!
কেন? সেই কথা বলবার জন্যেই আবার এসেছি তোমার কাছে। প্রভু, এই শিশুহত্যা– অর্থাৎ আমার এই প্রথম অপরাধটাই হয়তো তোমার কাছে বড়ো হয়ে উঠবে! কিন্তু এটাকে বড়ো করে দেখবার আগে বিচার কোরো, আমাকে সহ্য করতে হয়েছে কতখানি! তুমি, আমাকে সৃষ্টি করে নিক্ষেপ করেছ আগ্নেয়গিরির গর্ভে!
তোমাকে দোয সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার জন্যেই আবার তোমার কাছে এসেছি। এখন আমার প্রার্থনা পূর্ণ করো। যতক্ষণ না আমার অনুরোধ রক্ষা করবে, ততক্ষণ আমি এ স্থান ত্যাগ করব না। মনে রেখো, এটা কেবল মিনতি নয়, তোমার দয়ার ওপরে আমার দাবি আছে!