১০. দূরে বৃষ্টি নামলে

১০

দূরে বৃষ্টি নামলে যেমন সব সাদা ঝাপসা দেখায়, সকালের কুয়াশা সেই রকম ধোঁয়াটে ঘন ভিজে আবরণ ছড়িয়ে অনেকক্ষণ শূন্যের সমস্ত স্বচ্ছতা ঢেকে রেখেছিল। রোদ উঠতে বেলা হল। আলোর রঙ প্রথমটায় মেঘলা দিনের মতন খুব ফিকে এবং নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল। তারপর এক সময় শূন্যের সমস্ত আবিলতা মুছে গেল, কুয়াশার আর্দ্র কণা রৌদ্রে শুষ্ক হল, এবং অতিশয় উজ্জ্বল রোদ উঠল।

কৃষ্ণা সাইকেল নিয়ে কলাঝোপের দিকে মাঠে স্লো-সাইকেল প্র্যাক্‌টিস করছিল; ঠিক পারছিল না, পড়ে যাচ্ছিল, পা দিয়ে মাটি ধরছিল। এ-সব আর কিছু নয়, নিতান্ত যেন ভূমিকা, সামান্য পরে বাড়ি ছেড়ে লীলার কাছে পালাবে।

আনন্দমোহন ফুলবাগানে কাজ করছিলেন। হাতে মস্ত এক কাঁচি আর মাটি কোপানো ছোট্ট খুরপি। মরসুমীফুলের নরম মাটি আলগা করে হিমে-ভেজা রোদে-মরা পাতা সরিয়ে এবার তিনি গোলাপগাছগুলোতে হাত দিয়ে-ছিলেন। ডালপালা কেটে দিচ্ছিলেন, গোড়ায় চা-পাতার সার দিচ্ছিলেন অল্প-স্বল্প। ঠোঁটের ডগায় সিগারেট পুড়ছিল।

অমল কাছাকাছি ছিল। কখনও কৃষ্ণার স্লো-সাইকেল দেখে হাসছিল, কখনও মেসোমশাইয়ের ফরমাস খাটছিল।

আজকের রোদটি সময় পেরিয়ে এসেছে বলেই যেন তার কুন্ঠা ছিল, খুব দ্রুত তপ্ত ও ঘন হয়ে আসছিল। দেখতে-দেখতে মাঠ ঘাস ফুলপাতার ওপর রোদের পাতলা পালিশ ঘন হয়ে এসে যেন রোদ্দুরের একটি সর পড়ে যাওয়ার মতন হয়েছে। নরম তাতের আমেজ লাগছিল গায়ে। বাতাস তেমন চঞ্চল ছিল না। সোনাঝুরি গাছের মতন সেই গাছগুলি থেকে আলতারঙের ফল ফেটে সুতোর মতন আঁশ বাতাসে উড়ে-উড়ে আসছিল, শীতের মরাপাতা ঝরছিল কখনো বা। পাখিগুলি বাগানে নিত্যকার মতন আসা-যাওয়া করছে। সাদা পুচ্ছ, কালো পাখা, লাল ঠোঁটঅলা একটি পাখি এসেছিল একবার, উড়ে চলে গেছে আবার।

আনন্দমোহন গোলাপবাগান থেকে ছাঁটা ডালগুলি তুলে জড় করে অমলকে ফেলে দিতে বললেন। অমল যখন ডালপালা জড় করছিল, ফটকের সামনে মজুমদার-ডাক্তারের মোটরবাইক এসে দাঁড়াল।

কৃষ্ণা ফটক খুলতে গিয়েছিল। ফটক খুলে দিয়ে সে আর ফিরল না, মজুমদারডাক্তার ভেতরে এলে আবার গেট বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকেই পালাল।

আনন্দমোহন হাতের কাঁচি খুরপি রেখে দিলেন মাটিতে, ধুলোময়লা রুমালে মুছতে মুছতে এগিয়ে গেলেন। অমল গোলাপডালগুলো জড় করে একপাশে ফেলে দিতে গেল।

মজুমদারডাক্তারের বয়েস অনেক আগেই চল্লিশ পেরিয়েছে, গায়ে দোহারা, মুখ চৌকো মতন। চোখে চশমা। মোটামুটি ফরসা রঙ। মানুষটিকে দেখলেই মনে হয়, রোদ-জল খাওয়া অভিজ্ঞ মানুষ। চোখের মণি একটু, কটা রঙের, ঠোঁট মোটা।

মোটরবাইক ঠেলে আসতে-আসতে মজুমদারডাক্তার বড়দিনের সুখ-শুভেচ্ছা জানালেন সহাস্য গলায়।

এগিয়ে গিয়ে আনন্দমোহন অভ্যর্থনা করলেন, “এস এস, তোমার দেখা পাওয়া ভাগ্য।” বলে আনন্দমোহন মজুমদারের কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ির বারান্দার দিকে যেতে লাগলেন।

অমল কলাবাগানের দিকে গোলাপগাছের ছাঁটা ডালপালাগুলো ফেলে দিয়ে বারান্দার দিকে আসছিল; বুড়ো আঙুলে একটা কাঁটা ফুটে গেছে জোরে, মুখে আঙুল পরে যন্ত্রণা সইয়ে নিচ্ছিল।

“এদিকে এসেছিলাম! মিসেস যোশী কাল সন্ধেবেলায় পড়ে গিয়ে পা মচকেছেন। একে ভারী চেহারার মানুষ, তাতে আবার সামান্যতেই অধীর হয়ে পড়েন।” মজুমদারডাক্তার মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে রাখলেন।

“হাড়টাড় ভেঙেছে নাকি?” আনন্দমোহন শুধোলেন।

“না। সেরকম কিছু না।”

কথা বলতে-বলতে বারান্দার সিঁড়িতে উঠলেন দুজনে। অমল সামান্য পিছনে। বারান্দায় উঠে আনন্দমোহন নিজের হাতে বেতের চেয়ার টেনে আনছিলেন রোদে, অমল একটু, তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে গিয়ে তাঁকে সাহায্য করল। মজুমদার অমলকে দেখে হাসলেন একটু, পরিচিতজনের মতন দু-একটা কথা বললেন: কি খবর, কেমন লাগছে গোছের, তারপর চেয়ার টেনে বসার উপক্রম করে বললেন আনন্দমোহনকে, “এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাকে খবরটা দিয়ে যাই।”

আনন্দমোহন যেন জানতেন খবরটা কিসের হতে পারে, চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, “অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছ বুঝি কিছু?”

“খুব ভাল অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়েছে, বেস্ট পসব্‌ল্‌, হেল্‌প আপনি পাবেন। ডাক্তারও বাঙালী—আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।” মজুমদারডাক্তার চেয়ারে বসলেন।

সামান্য চুপচাপ। আনন্দমোহন হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে অমলকে বললেন, “অমল, তোমার মাসিমাকে বল ডাক্তারবাবু এসেছেন চা-টা দিতে।”

অমল চায়ের কথা বলতে ঘরের দিকে চলল। এখন সে সবই অনুমান করতে পারছে, বুঝতে পারছে। ভ্রমরকে নিয়ে মেসোমশাই বাইরে যাবেন ডাক্তার দেখাতে। মজুমদারডাক্তার ব্যবস্থা করছিলেন, ভাল কোনো ব্যবস্থা হয়ে গেছে বলে জানাতে এসেছেন।

এখন অমলের মন কেন যেন একটু খারাপ হয়ে গেল। ক্ৰীশমাসের ছুটিতেই মেসোমশাই যাবেন কথা ছিল, কিন্তু এ ক’দিন এ-বাড়ি উৎসবে আনন্দে এরকম মুখর ও মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে, ভ্রমরের অসুখের কথাটা যেন কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল, কেউ আর সে-কথা তুলত না, বলত না। এমন কি ভ্রমরই তার অসুখ-বিসুখ ভুলে গিয়েছিল। অমলের খুব একটা মনে পড়ে নি, যখনই হঠাৎ মনে এসেছে, সঙ্গে-সঙ্গে অমল ভেবেছে, হয়ত ভ্রমর ভাল হয়ে আসছে, হয়ত আর বাইরে যাবার দরকার হবে না। কিংবা মনে হয়েছে, এখনও দেরি আছে।

অমল বসারঘর খাবারঘর পেরিয়ে করিডোর দিয়ে রান্নাঘরের দিকে হিমানী-মাসিকে খুঁজতে গেল।

যেতে-যেতে অমলের মনে হল, ভ্রমরের অসুখের কথাটা বাস্তবিকই তারা কেউ ভোলে নি, চাপা দিয়ে রেখেছিল। সুখের দিনে দুঃখের চিন্তা করতে কারুর ইচ্ছে হয় নি। নয়ত মেসোমশাইয়ের মতন অমল এবং ভ্রমরও মনে-মনে জানত, এই ক্ৰীশমাসের ছুটিতেই তাদের আলাদা হয়ে যাবার কথা; একজন যাবে ডাক্তার-ওষুধের জিম্মায়, অন্যজন আর মাত্র ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে।

ভ্রমরের ঘর দেখতে পেল অমল। দরজা খোলা। ভ্রমর ঘরে আছে কি না বোঝা গেল না। হয়ত নেই। অমল একবার ভাবল, ভ্রমরকে খুঁজে বের করে খবরটা দিয়ে আসে; পরে ভাবল, থাক, এখন থাক।

হিমানীমাসি রান্নাঘরের মধ্যেই ছিলেন, আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন। অমল চায়ের কথা বলে ফিরল।

মেসোমশাইয়ের কাছে যাবার আগ্রহ অত্যন্ত প্রবল হচ্ছিল অমলের। ভ্রমর কোথায় যাবে, ক’দিন থাকবে, কবে যাবে—এসব খুঁটিনাটি জানবার জন্যে সে অধৈর্য ও উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠছিল। কৃষ্ণার ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় পায়ের শব্দে অমল মুখ তুলল, ভ্রমর কৃষ্ণার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। চোখে-চোখে দুজনে দুজনকে দেখল, অমল দাঁড়াল একটু, ডাক্তার আসার কথাটা বলতে গেল, অথচ শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না। কিছু না বলেই অমল বারান্দার দিকে পা বাড়াল।

মেসোমশাই এবং মজুমদারডাক্তার কথা বলছিলেন, নিঃশব্দ পায়ে অমল কাছা-কাছি এসে দাঁড়াল, পিছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকল।

“নাগপুরে আমারও এক বন্ধু রয়েছেন—” আনন্দমোহন বললেন, “এখন বোধ হয় সিনিআর প্রফেসার।”

“এখান থেকে একটু, কাছেও হয়।”

“তা হয়।” আনন্দমোহন উদাস যেন। সিগারেটের ধোঁয়া টানলেন এক মুখ। “ওদের হাসপাতালটা ভালই, কি বল?”

“বেশ বড় হাসপাতাল, সব রকম ব্যবস্থা আছে।” মজুমদার বললেন, “আমি হাসপাতালের কথা বলছি এইজন্যে যে, হাসপাতালে না থাকলে প্রপার ইনভেস্টি-গেশন হয় না। বাড়িতে নানা রকম অসুবিধে।”

অমল কাঁটাফোটা বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে আবার জিব দিয়ে আস্তে-আস্তে ভিজিয়ে নিল। ভ্রমর তবে নাগপুরের হাসপাতালে যাচ্ছে! জব্বলপুর নয়। কেন জব্বলপুর গেল না! হাসপাতালেই বা কেন যাবে?

“কত দিন থাকতে হবে?” আনন্দমোহন জিজ্ঞেস করলেন।

মজুমদারডাক্তার সামান্যক্ষণ চুপ করে থাকলেন, হয়ত হিসেব করছিলেন; বললেন, “তা ঠিক কিছু বলা যায় না। খুব শর্ট স্টে হতে পারে, আবার কিছুদিন থাকতেও হতে পারে। ওখানে গিয়ে ডাক্তার না দেখানো পর্যন্ত কিছুই জানতে পারছেন না।”

আনন্দমোহন আরও একমুখ ধোঁয়া নিলেন গলায়। আস্তে-আস্তে বুকে টানলেন। “আমার পাঁচ তারিখ পর্যন্ত ছুটি, তার মানে কাল তোমার নিউ ইয়ার্স ডে পড়ছে। পরশু, যদি বেরুই, পাঁচ তারিখের মধ্যে ফিরতে পারছি না।”

“না। হাতে আরও কিছু ছুটি নিয়ে যান! অন্তত দিন পনেরোর।” বলে মজুমদার কি যেন ভেবে আবার বললেন, “কাজ শেষ হয়ে যায় চলে আসবেন, না হয় ক’দিন ওদিক থেকে বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসবেন, ক্ষতি কিসের।”

সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিলেন আনন্দমোহন। অল্পক্ষণ উভয়েই নীরব থাকলেন। মনে হল আনন্দমোহন কিছু ভাবছেন। মজুমদার তাঁর চেয়ার সামান্য সরিয়ে নিলেন, রোদ লাগছিল চোখে।

“আচ্ছা ভাই—আমি একটা কথা ভাবছি”, আনন্দমোহন বললেন, “মেয়েটার শরীর এখন একটু ভালই যাচ্ছে…আজকাল আর অত সিক্‌ মনে হয় না। তোমার হাতে আর কিছুদিন থাকলে পারত না? যদি এখানে থেকেই রিকভার করতে পারত কথাটা—” কথাটা শেষ না করে আনন্দমোহন মজুমদারের চোখের দিকে যেন কোনো আশ্বাস পাবার প্রত্যাশায় তাকালেন।

মজুমদারডাক্তার কোনো জবাব দিলেন না। বোধ হয় বলার মতন কিছু ছিল না। সামনের দিকে তাকালেন, চোখের চশমা খুলে মুছলেন, তারপর বললেন, “কই, ভ্রমরকে একবার দেখি।”

“আজকাল খানিকটা ইমপ্ৰুভ করেছে বলেই মনে হয়—”

“ডাকুন একবার—দেখি।”

আনন্দমোহন ঘাড় ফেরাতেই অমলকে দেখতে পেলেন। বললেন, “অমল, ভ্রমরকে ডাকো একবার।”

অমল ভ্রমরকে ডাকতে চলল। সহসা তার আবার একটু ভাল লাগছে: যদি ভ্রমর না যায়, তার হাসপাতালে যাওয়া না হয়, তাহলে ভাল হয়। নাগপুরের হাসপাতালে গিয়ে ভ্রমর পড়ে থাকবে এই চিন্তা তাকে অত্যন্ত ক্লিষ্ট ও কাতর করছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, ভ্রমর চলে গেলে সে এ-বাড়িতে একা থাকবে কি করে? তাকে এখনও দশ বারো দিন থাকতে হবে।

বসারঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে অমল হঠাৎ দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দরজার মাথায় তাকাল। মেহগনি কাঠের সেই যীশু, মূর্তি। ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে আসা আলো অনেক দূরে সরে গেছে। অমল অত্যন্ত কাতর হয়ে যীশুর কাছে মনে-মনে ভ্রমরের না-যাওয়া প্রার্থনা করল।

খাবারঘরে হিমানীমাসির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অমল ভ্রমরকে ডাকতে চুলল।

“ভ্রমর কোথায় মাসিমা?”

“দেখ, ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল দেখলাম। কেন?”

“ডাক্তারবাবু, ওকে দেখবেন।”

“ও!”

অমল ভ্রমরের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

ঘরের সামনে রোদে ভ্রমর দাঁড়িয়ে ছিল। চুল খুলেছিল। ওর পায়ের কাছে তার বেড়াল ঘুরঘুর করছে।

অমল বলল, “তোমায় বাইরে ডাকছে।”

“আমায়! কে ডাকছে?”

“ডাক্তারবাবু। মেসোমশাই রয়েছেন।”

ভ্রমর এমন চোখ করে অমলের দিকে তাকাল যেন মনে হল সে অমলকে জিজ্ঞেস করছে, কেন ডাকছে বল তো?

অমল বলল, “ডাক্তারবাবু, তোমায় দেখবেন।…তোমাদের নাগপরে যাবার কথা হচ্ছে।”

ভ্রমর বুঝতে পারল অথচ যেন পরিষ্কার সব জানতে পারল না। সামান্য বিস্মিত অথচ চিন্তিত মুখ করে বলল, “নাগপুর!”

অমল কিছু ভাবছিল, বলল, “তোমার শরীর যদি ভাল হচ্ছে দেখেন ডাক্তার-বাবু, তবে হয়ত যেতে হবে না।” বলে অমল আজ এই মুহূর্তে আগ্রহের চোখে ভ্রমরকে দেখতে লাগল। সে দেখছিল, ভ্রমরের শরীর সেরে উঠছে কি না। মনে হল, আগের চেয়ে সেরেছে।

“তোমার কি রকম মনে হয়, ভ্রমর?” আগের চেয়ে ভাল না?”

“খানিকটা।”

“তোমার মুখ মধ্যে একেবারে ফ্যাকাশে দেখাত, এখন অতটা দেখায় না।” অমল বলল, “তুমি সেরে উঠছ। এবার সেরে যাবে পুরোপুরি।”

ভ্রমর চুল খুলতে-খুলতে বলল, “তুমি যাও; আমি আসছি।”

অমল ফিরে এল। ফিরে এসে দেখল, মজুমদারডাক্তার এবং মেসোমশাই অন্য কথা বলছেন। ভ্রমর এখুনি আসছে জানিয়ে অমল সামান্য পাশে সরে গিয়ে ফুলগাছের টবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন কত বেলা হয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এখানে থাকতে-থাকতে রোদের স্বভাব দেখে অমল বেলা বুঝতে শিখছে। প্রায় দশটা হবে। সূর্য সামান্য হেলতে শুরু করেছে, শিরীষগাছের তলায় দোলনার ছায়াটা বেঁকেছে সামান্য। আকাশ সাদাটে নীল, কালচে দু-চারটি রেখা লেগে আছে উত্তরের দিকে। ফটকের ও-পাশ দিয়ে টাঙা যাচ্ছে, ঘণ্টি শোনা যাচ্ছিল। একটা কুকুর ডাকছে কোথায়।

বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়ে অমল মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ভ্রমর। ভ্রমর চা কেক-টেক সাজিয়ে নিয়ে বারান্দা দিয়ে আসছে। অমলের সঙ্গে চোখাচোখি হল। অমল বুঝতে পারল, ভ্রমর তাকে গোল বেতের টেবিলটা ডাক্তারবাবুদের সামনে এনে দিতে বলছে।

অমল বেতের গোল টেবিল মেসোমশাইদের সামনে এনে দিল। ভ্রমর চা ও খাবারের প্লেট সমেত ট্রে-টা নামিয়ে রাখল সাবধানে। চা তৈরী করেই নিয়ে এসেছে।

মজুমদারডাক্তার ভ্রমরকে দেখছিলেন। ভ্রমরের মুখ যেন খুব খুঁটিয়ে নজর করছিলেন। “কি, কেমন আছ?” মুখে বললেন, কিন্তু মনোযোগ বিন্দুমাত্র শিথিল হল না। “কি রকম লাগছে আজকাল?”

ভ্রমর কথা বলল না। চোখ নামিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

“কি, বলছ না যে! কেমন মনে হচ্ছে আজকাল?”

“ভাল।”

“কি রকম ভাল?” বেশী না খানিকটা?” মজুমদার হাসিমুখে শুধোলেন।

“আগের চেয়ে ভাল।”

“ভাল!…ভালই লাগছে, কি বল?”…শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে আজকাল, খিদে ঘুম…কই, বসো, আমার সামনে বসো একবার দেখি।”

বসার চেয়ার ছিল না। অমল বারান্দায় গিয়ে আরও একটা চেয়ার এনে দিল। ডাক্তারবাবুর মুখোমুখি রাখল। ভ্রমরের বসতে অস্বস্তি হচ্ছিল, তবু বসল। একটু জড়সড়, বিব্রত ভঙ্গিতে।

চামচে করে কেক কেটে নিয়ে মজুমদারডাক্তার মুখে দিলেন। দিয়ে ভ্রমরের হাত তুলে নিয়ে ভ্রমরের চামড়ার রঙ দেখলেন যেন, তারপর হাত দেখলেন, শেষে নখের ডগা দেখতে লাগলেন।

“ওকে একটু, ভালই দেখায় আজকাল—” আনন্দমোহন বললেন। যেন তিনি বার বার কথাটা ডাক্তারকে মনে করিয়ে নিজেও সাহস পেতে চাইছেন। আনন্দ-মোহন তাঁর চায়ের পেয়ালা তুলে নিলেন আলগা হাতে।

মজুমদারডাক্তার কোনো জবাব দিলেন না, সামান্য ঝুঁকে বসে ভ্রমরের চোখের ভেতরকার কোল দেখতে লাগলেন। বার কয়েক দেখলেন। দেখে আবার সোজা হয়ে বসলেন, আর-একটুকরো কেক মুখে দিলেন। চোখের দৃষ্টি বেশীর ভাগ সময়েই ভ্রমরের ওপর। আরও একবার হাতের নখের ডগাগুলি পরীক্ষা করলেন।

মনে-মনে সম্ভবত কিছু ভাবছিলেন, হয়ত কোনো কথা মনে করার চেষ্টা করছিলেন। চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে চা খেলেন এক চুমুক। “জ্বরটর হয়েছে আর?”

“না।” ভ্রমর আস্তে করে মাথা নাড়ল।

“শরীরে কোথাও ব্যথাট্যথা আছে?” পেটের দিকে যেটা হত?”

“না।” ভ্রমর মাথা নাড়ল।

অমল সঙ্গে-সঙ্গে বলতে যাচ্ছিল, ব্যথা আছে, ভ্রমরের পা থেকে কোমর পর্যন্ত ব্যথা হয়েছিল সেদিনও। ক’দিন ছিল। ভ্রমর কথাটা কেন চেপে গেল অমল বুঝল না।

“তোমার তাহলে বেশ ভালই লাগছে, কি বল? …কই, দেখি, হাতটা বাড়াও। ঢিলে করে রাখ।” মজুমদারডাক্তার ভ্রমরের হাত সামনে টেনে নিয়ে এসে আস্তে-আস্তে মণিবন্ধের খানিকটা ওপরে, ভেতর দিকের হাতের মাংসের ওপর যেন খুব আলতো করে আঙুল বোলালেন, বোলাতে-বোলাতে হঠাৎ নিজের আঙুলের ডগা দিয়ে ক্যারামের গুটি মারার মতন জোরে মারলেন মাংসের ওপর, মেরে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকলেন। একটু, পর-পর, থেমে-থেমে এই রকম চলল ক’বার, কখনও আঙুলের ঠোক্কর, কখনও চিমটি কাটার মতন মাংস টেনে দিলেন। শেষে বললেন, “আচ্ছা, এবার তুমি যাও।”

ভ্রমর চলে গেল। অমল সামনে থেকে সরে এল। তার মনে হল, সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হবে না। সরে এসে টবের কাছে দাঁড়াল, মেসোমশাইদের পিছন দিকে।

মজুমদারডাক্তার এবার বাকি চা শেষ করলেন আস্তে আস্তে। আনন্দমোহন সিগারেট দিলেন, সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টানলেন মজুমদারডাক্তার।

আনন্দমোহন বেশ উদ্বিগ্ন ও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, বললেন, “ইমপ্রুভড্‌ মনে হল না তোমার?”

মজুমদার কিছু বললেন না সঙ্গে-সঙ্গে, খানিকটা পরে বললেন, “খানিকটা।” তিনি আর কিছু বললেন না যদিও, তবু, তাঁর গাম্ভীর্য ও সহসা অবিচ্ছিন্ন নীরবতা কেমন কঠিন মনে হল। অদ্ভুত একটি আশঙ্কা অকারণে ঘনিয়ে আসছিল যেন।

অর্ধেকটা সিগারেট চুপচাপ শেষ করার পর মজুমদারডাক্তার এবার বললেন, “আপনি নাগপুরে যান একবার। যাওয়া ভাল।”

আনন্দমোহন উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন, মজুমদার নাগপুর যাবার কথা তুলবে না। হতাশ গলায় বললেন, “তুমি এখনও ইনসিস্ট করছ?”

“হ্যাঁ, আপনি যান।” মজুমদার আনন্দমোহনের চোখের দিকে তাকালেন, থেমে-থেমে বললেন, “আমি বড় ডাক্তার নই, বিশ্বাসদা। আপনি আমার উইকনেসও বুঝতে পারবেন। এ-রকম কেস হাতে রাখতে আমার ভয় হয়…”

“তুমি ত বল অ্যানিমিয়া।”

“কিন্তু ক্রনিক অ্যানিমিয়া ভাল না। আমি বোধ হয় গত এক দেড় বছর ধরে ভ্রমরের ট্রিটমেন্ট করছি। কখনও এটা, কখনও ওটা লেগেই আছে। ওষুধপত্রে অ্যানিমিয়া একটু কমে, ক’দিন পরে আবার। খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে উঠেছে। ডাক্তারখানায় ওর সব ব্লাড রিপোর্ট-টিপোর্ট আমি কালও দেখেছি। বেটার টু টেক সম গুড অ্যাডভাইস।”

“খারাপ কিছু?” আনন্দমোহন বেশ ভয় পেয়ে গেলেন, “টিউবারকুলেসিস?”

“না, সে-রকম কিছু নয়।”

“তবে?”

“ঠিক করে কিছু বলা যায় না। তবে ভয় হয়, লিউকোমিয়ায় না গিয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত।”

“লিউকোমিয়া! সেটা কি?”

“রোগটা খারাপ, খুব ভয়ের রোগ; এ ডিজিজ অব ব্লাড; ব্রেকিং অফ রেড ব্লাড সেলস্‌—” মজুমদারডাক্তার সিগারেটের টুকরো ফেলে দিয়ে পা দিয়ে নিবিয়ে দিলেন। দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কথা বলার মতন করে বললেন, “ক্রনিক অ্যানিমিয়া, এনলার্জমেন্ট অফ দি স্‌প্লীন্‌ অ্যান্ড লিম্ফ্যাটিক প্লাণ্ডস মোটেই ভাল না।” চোখ ফিরিয়ে মজুমদারডাক্তার এবার অত্যন্ত সহানুভুতিবশে আনন্দমোহনের দিকে তাকালেন, আস্তে-আস্তে বললেন, “বিশ্বাসদা, আপনি আমার স্বজাতি, আমরা প্রবাসে রয়েছি; যদি আমার হাতে আপনার মেয়ের কিছু মন্দ হয়ে যায়, সে-আপসোস আমার যাবে না। আমি রিস্ক নিতে রাজী না। আপনার মেয়ে গেলে আপনারই বেশী যাবে। আপনি নাগপুরে যান, আমি ভাল ব্যবস্থা করে রেখেছি, চিঠিপত্র লেখালেখি করেছি।…হয়ত আমারই ভুল হচ্ছে রোগ বুঝতে। তবু যান একবার দেখিয়ে আসুন—”

আনন্দমোহন পাথরের মতন বসে, তাঁর মুখে খড়ির দাগ ফুটছে যেন, শুকনো বিবর্ণ দেখাচ্ছে। চোখের পলক পড়ছিল না, মুখ হাঁ হয়ে ছিল। ভীষণ ভয় পেলে মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে থাকে, আনন্দমোহন সেই রকম হয়ে গিয়েছিলেন।

বসে থাকতে বোধ হয় অস্বস্তি লাগছিল মজুমদারডাক্তারের। গলার শব্দ করে, চেয়ার সরিয়ে, সামান্য শুকনো করে কেশে উনি শেষ পর্যন্ত উঠলেন। বললেন, “কবে যাবেন ঠিক করে আমায় জানাবেন। যত আরলি হয়…! আমার রিপোর্ট আর একটা চিঠি দিয়ে দেব—”

মজুমদার চলে যাবার উদ্যোগ করতেই আনন্দমোহন ধরা বসা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “মেয়েটা বাঁচবে না?”

মজুমদার দাঁড়ালেন। সামান্য সময়ের জন্যে তাঁর মুখ হঠাৎ খুব ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অত্যন্ত বিব্রত ও আড়ষ্ট হলেন। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “মরা বাঁচা ভগবানের হাত।…তা বলে এখন থেকেই ভেঙে পড়বেন না। হয়ত আমার ভুল—” কথা শেষ না করেই মজুমদারডাক্তার বিদায় নিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামলেন আস্তে-আস্তে, অন্যমনস্ক। মোটরবাইক ঠেলে ঠেলে ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন।

অমল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পায়ের তলায় যেন মাটি নেই, সব ফাঁকা লাগছিল। অসাড়, স্পন্দনহীন। নিজের হাত-পা, মুখ—কোনো কিছু সে অনুভব করতে পারছিল না। চোখের সামনে রোদ-ভরা বাগান, গাছ, ফুল, পাতা সবই স্থির হয়ে আছে, কিন্তু অমল কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, অত্যন্ত ধারালো এবং ধাঁধানো রোদে দৃষ্টি যেমন সহসা অন্ধ হয়ে যায়, অমলের সেই রকম লাগছিল।

ডাক্তারবাবুর মোটরবাইক যখন গেটের বাইরে গিয়ে হঠাৎ এঞ্জিনের তীব্র ও বিশ্রী একটা শব্দ তুলল, তখন অমল যেন তার চেতনা ফিরে পেল। সে কেঁপে উঠল হঠাৎ, পা কাঁপতে লাগল, হাতের তালুতে ঘাম জমেছে, বুক ধকধক করছিল।

মানুষের সমস্ত ভয় অন্ধকারে। অন্ধকার তাকে কোনো কিছু জানায় না, দেখায় না। অমল খুব ভয় পেয়েছিল। মজুমদারডাক্তারের কথাবার্তার ভঙ্গি থেকে সে অনুভব করতে পেরেছিল, ভ্রমরের কোনো কঠিন রোগ হয়েছে; মেসোমশাইয়ের মুখের ভাব দেখে সে বুঝতে পারছিল, উনি ভীষণ বিচলিত ও ভীত হয়ে পড়েছেন। ভ্রমর বাঁচবে কি বাঁচবে না—এই ভীষণ কথাটাও তিনি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ডাক্তারবাবুও সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে কথাটা এড়িয়ে গেলেন।

অসুখটা কি, কেমন তার চেহারা, কি হয় না-হয়, অমল কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। সাধারণ জ্বরজ্বালা, হাম, জল-বসন্ত এমন কি টাইফয়েড হলে অমল বুঝতে পারত; সে এ-সব দেখেছে এবং জানে। কিন্তু ভ্রমরের অসুখ তার জ্ঞানের বাইরে, কখনও সে শোনে নি নামটা, কি হয় না-হয় তার জানা নেই। তবু, অসুখটা যে ছোট বা সাধারণ নয় বোঝা যাচ্ছিল, নয়ত ডাক্তারবাবু, ভ্রমরকে ওভাবে নাগপুরের হাসপাতালে পাঠাবার জন্য জোর করতেন না; মেসোমশাইকে বলতেন না, “মেয়ে গেলে আপনারই বেশী যাবে…।”

অমলের ভাল লাগছিল না। তার মনে হচ্ছিল, ভ্রমর যেন কাল কিংবা পরশু এ-বাড়ি ছেড়ে নাগপুরের হাসপাতালে চলে যাবে। নাগপুর কোথায়, কতদূরে, অমল জানে না; সেখানের হাসপাতাল কেমন কে জানে; ভ্রমরকে সেখানে কি করা হবে, ভ্রমর কেমন থাকবে—অমল কিছু দেখতে পাবে না, না, জানতে পারবে না। অমলের চোখের আড়ালে কি ঘটবে সে কল্পনা করবার চেষ্টা করল, পারল না; বরং নানারকম ভীতিকর দুশ্চিন্তা এসে তাকে আরও আকুল করে তুলল।

দুপুরবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে অমল ভ্রমরের হোম সাইন্স-এর বই দেখল, কিছু, পেল না। মেসোমশাইয়ের ঘর থেকে চেম্বার্স ডিকশনারী এনে ঘাঁটল। বানান না-জানা থাকায় কতক্ষণ যে ঘাঁটতে হল অভিধান! শেষে শব্দটা পেল। অমল বুঝল, এ-রোগে মানুষের শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা খুব বেড়ে যায়। অমল জানত, শরীরের রক্তে লাল এবং সাদা দু-রকম রক্তকণিকা থাকে; কিন্তু সে জানত না এদের কমাবাড়ায় কি ক্ষতি হতে পারে। তার জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, জানাবার লোক ছিল না। তার মনে হল, হয়ত এমন হতে পারে, রক্ত আর রক্ত থাকে না, শ্বেতকণিকায় ভরে যায়। অমলের ভয় হল ভাবতে। সে আর ভাবতে চাইল না।

দুপর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেলে অমল মেসোমশাইয়ের চেহারা দেখে ভয় পেল। মেসোমশাইকে খুব উদ্‌ভ্রান্ত এবং বিহ্বল দেখাচ্ছিল। তাঁর চোখ মুখ যেন ক্রমশ বসে আসছে, উদ্বেগের আঁচড়গুলি ওঁর মুখের সদাপ্রসন্নতা ও হালকা ভাবটি সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলেছে। হিমানীমাসিকেও বিকেল থেকে আরও গম্ভীর চুপচাপ দেখাচ্ছিল। এবং বিকেল থেকেই বেশ বোঝা গেল, এই বাড়িতে খুব অদৃশ্য-ভাবে একটি অস্বস্তিকর ভীত উদ্বিগ্ন আবহাওয়া নেমে এসেছে।

মেসোমশাই বিকেল ফুরিয়ে যাবার পর-পরই যেন কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। অমল লক্ষ করল, তিনি খুব অন্যমনস্ক ও ব্যস্ত হয়ে আছেন। অমল এই সময় ভয়ে-ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করল, “ভ্রমরের কি অসুখ, মেসোমশাই?” আনন্দমোহন বললেন, “খুব খারাপ অসুখ, বাবা। মেয়েটার কি হবে কে জানে! ওই আমার একটি মাত্র মেয়ে।” বলতে-বলতে আনন্দমোহন বরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তারপর অমল বুঝতে পারল উনি ডাক্তারবাড়ি যাচ্ছেন। এ-বাড়ির গোপন উদ্বিগ্নতার মধ্যেই সন্ধে নামল। সন্ধের পর ওরা তিনজনে বসে ক্যারাম খেলছিল—অমল, কৃষ্ণা, ভ্রমর। অমল খেলতে পারছিল না। তার মন ছিল না খেলায়, চোখও ছিল না। ক’বারই হারল। খেলা শেষ হয়ে গেলে কৃষ্ণা উঠে গেল।

ভ্রমর বলল, “তুমি আজ খুব ভাল ছেলে হয়ে গেছ! সারাদিন চুপচাপ।”

অমল জবাব দিল না। আজ সারাদিন সে ভ্রমরকে এড়িয়ে-এড়িয়ে থাকছে। ভ্রমরের কাছে আসতে তার সাহস হচ্ছিল না, যদি ভ্রমর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে ডাক্তারবাবুর কথা, তবে অমল কি বলবে! বা অমলও যদি বোকার মতন আচমকা বলে ফেলে ভ্রমরকে অসুখের কথা—তবে?” কে জানে, কাছাকাছি থাকলে অমল কি বলে বসবে, কিংবা অমলের মুখ দেখে ভ্রমর কি বুঝবে—এইসব চিন্তা করে অমল, একটু, দূরে-দূরেই কাটিয়েছে।

এখন ভ্রমরের কথায় অমল হঠাৎ বেশ ভয় পেল, তার বুক কাঁপল; সে ভাবল, ভ্রমর এখুনি তাকে অসুখের কথা জিজ্ঞেস করবে। ভ্রমর যাতে সে সুযোগ না পায় অমল তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেল। “কাল নতুন বছর পড়ছে—নিউ ইয়ার্স ডে। কাল তোমরা কি করবে?”

ভ্রমর অমলকে দেখছিল। ওর চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার নয়। ভ্রমর বলল, “কাল সকালে তা বলে আমি তার গানটান গাইছি না; তুমি খুব ঘুমিয়ো।”

অমল, মুখ তুলল। কথাটা তার কানে ঠাট্টার মতন শোনাল না। কি বলবে বুঝতে না পেরে অমল বলল, “কেন? নতুন বছরে তোমাদের গান নেই?”

“আছে; অনেক আছে—” ভ্রমর বলল, তারপর অল্প সময় থেমে খুব মৃদু, জড়িত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানো না?”

“কি?”

“কাল বাবা আমায় নিয়ে নাগপরে যাচ্ছে।”

“কা-ল?” অমল চমকে উঠল যেন।

“মা বলেছে, কাল। কখন যাওয়া হবে জানি না, রাত্তিরে বোধ হয়।”

অমল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। যেন সে ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তার অজ্ঞাত অতি দূর কোনো শহরের একটি ভীষণ বড় হাসপাতালের স্তব্ধ নির্জন একটি কক্ষ দেখছিল। ভ্রমর হাসপাতালের সাদা কনকনে বিছানায় শুয়ে আছে। তার লাল রক্তকণাগুলি প্রতি মুহূর্তে যেন ফুরিয়ে আসছে। অমলের মখে কেমন ভেঙে আসছিল। কান্না এসে তার গাল ও ঠোঁটের মাংস কুঁচকে দুমড়ে দিচ্ছিল। ঠোঁট কাঁপছিল।

ভ্রমর বলল, “আমি ফিরে না-আসা পর্যন্ত তুমি থেকো, থাকবে না?”

মাথা হেলিয়ে অমল বলতে যাচ্ছিল, হ্যাঁ, সে থাকবে, কিন্তু তার আগেই অমল ছেলেমানুষের মতন কেঁদে উঠল।

১১

গাড়ি দুটো চলতে শুরু করেছিল। সামনের টাঙায় আনন্দমোহন আর কৃষ্ণা, পেছনে ভ্রমর ও অমল। মালপত্র বেশী নেই, তবু, দুটো সুটকেশ, বাস্কেট, টুকিটাকি আরও কিছু, আনন্দমোহনরা নিয়েছেন, ভ্রমরদের টাঙায় মোটা হোল্ডঅল আর বেতের টুকরিটা কোচোআনের পাশে বসানো রয়েছে। ভ্রমরকে স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্যে এখন সবাই ব্যস্ত; এমন কি মেসোমশাই বার বার বলা সত্ত্বেও হিমানীমাসি ভ্রমরকে গাড়িতে উঠিয়ে দেবার সময় অমলকে বললেন, একটু সাবধানে নিয়ে যেও।

কটেজগুলো ছাড়িয়ে গাড়ি মোতি রোডে পড়ল। সামনের টাঙাটা সামান্য এগিয়ে আছে, বিশ পঁচিশ গজ হবে হয়ত। এখন সাড়ে সাতটা সন্ধে, আটটা পঞ্চাশে ট্রেন; স্টেশনে পৌঁছতে সোয়া আটটা হবে।

আকাশে চাঁদ রয়েছে। জ্যোৎস্না রাত্রি। কুয়াশা এবং হিম চাঁদের আলো শুষে রেখেছে। খুব পরিষ্কার নয়, জ্যোৎস্না, মরা-মরা লাগছিল, মলিন আয়নার কাচের মতন। কনকনে শীত, বাতাস যেন গা গুটিয়ে বসে পৌষের প্রখর ও শুকনো ঠাণ্ডাকে জমে উঠতে দিচ্ছিল।

ভ্রমরকে যথাসাধ্য সাবধানে বেরুতে হয়েছে, যাতে ঠাণ্ডা না লাগে তার জন্যে বাবা নিজেই একশোবার করে এক কথা বলেছে: তুই সোয়েটারের ওপর লং-কোট পরবি, তুই পুরো মোজা পরবি, স্কার্ফ নিবি—মাথা কানে যেন ঠাণ্ডা না লাগে, ট্রেনে ঠাণ্ডা লাগবে খুব। ভ্রমর গরম সব কিছুই পরে বেরিয়েছে: ভেস্ট, গরম কোট, মোজা—বাদ দেয় নি কিছু। গাড়িতে ওঠার সময় হিমানীমা’র কথায় মাথার স্কার্ফও বেঁধে নিয়েছে।

মোতি রোডে গাড়ি ওঠার পর মনে হল, গাড়ির চাকা আরও অক্লেশ হল, ঘোড়ার কদম জোর পেল।

ভ্রমরই কথা বলল প্রথমে। বলল, কারণ, অমল একেবারেই চুপচাপ ছিল, সারাদিনই প্রায় চুপচাপ থেকেছে, বিকেল থেকে তাকে অনেকক্ষণ ভ্রমর বাড়িতে দেখতে পায় নি, অমল রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভ্রমরের ভাল লাগে নি। এভাবে অমলকে রেখে যেতে, ছেড়ে যেতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে; তবু যখন উপায় নেই, যখন ভ্রমর একটা দরকারী কাজে যাচ্ছে—ডাক্তার দেখাতে, তখন অমলের খানিকটা বোঝার মন ও সহ্য করার শক্তি থাকা উচিত ছিল। কি রকম ছেলে-মানুষ! আমি না-হয় আগে যাচ্ছি, নয়ত আর ক’দিন পরে তুমিও ত যেতে, তখন কি ভ্রমর এইরকম করত, করলে তোমার কেমন লাগত বল! সন্ধেবেলায় অমলের সঙ্গে এক ফাঁকে দেখা হলে ভ্রমর বলেছে কথাটা ‘তুমি এরকম করছ কেন, ছেলে-মানুষের মতন! দুঃখ যেন নিজেরই, আর কারও নয়, না—! যখন তুমি যাবে আমিও এইরকম করব—একবারও কাছে আসব না।’

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় ভ্রমরের নিজের মনও বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হওয়া স্বাভাবিক; সে আগে আর কখনও এমন করে বাড়ির বার হয় নি। তা ছাড়া, মানুষের আচরণ এক ধরনের অর্থ বোঝায়। বাবা, হিমানী-মা এবং অমলের ব্যবহার থেকে ভ্রমর অনুভব করতে পারছিল, কোথাও যেন কিছু একটা ঘটেছে। এতকাল বাবা তার ব্যাপারে খুব একটা গা দিয়ে কখনও কিছু করে নি, হচ্ছে হবে, চলছে চলুক করে কাটিয়েছে, এখন একেবারে অতিব্যস্ত। কেন এত ব্যস্ত? কেন হিমানী-মা তার ওপর হঠাৎ মায়া মমতা দেখাতে শুরু করল? হিমানী-মা অবশ্য বাবার মতন ব্যস্ত ভাব দেখাচ্ছে না, মাথা গোলমাল হয়ে যাবার মতন ছটফটে ব্যবহারও কিছু করে নি। তবু, হিমানী-মা’র সামান্য কিছু, কথা, জিনিসপত্র গোছগাছ করে দেবার চেষ্টা থেকে, চোখ এবং মুখের ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল, ভ্রমরের অসুখের ধাত নিয়ে এই একটা কি দেড়টা দিন মা বিরক্ত নয়। বরং এমন কথাও মা বলেছে যা মানুষ মায়া-মমতা অনুভব করেলেই বলে। হিমানী-মা আজ সন্ধের মুখে-মুখে একবার প্রমরকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণার ঘরে বসেছে। তখন কৃষ্ণা ঘরে ছিল না। চুপচাপ একটু বসে থাকার পর হিমানী-মা বলল, ‘দূরে যাচ্ছ, একা থাকবে—ভয় পেও না, মন খারাপ করো না, বুঝলে।…প্রভুকে সব সময় মনে করো। তিনিই মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্গী, রোগ বল দুঃখ বল, তাঁর চেয়ে বড় ভরসা আর নেই। এই বলে হিমানী-মা চোখ বন্ধ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ, যেন প্রার্থনা করল মনে-মনে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রমরের মাথায় একটু, হাত ছুঁইয়ে রাখল, ‘সাবধানে থেকো, মন ভাল রেখো।’…হিমানী-মা’র ব্যবহার এবং কথাবার্তায় ভ্রমরের তখন মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হয়ত সে কেঁদে ফেলত, অনেক কষ্টে সামলেছে। কিন্তু ভ্রমরের কেমন সন্দেহ হল, হঠাৎ হিমানী-মা এত আদর-যত্ন করে কথা বলছে কেন? কেন এত উপদেশ দিচ্ছে? ডাক্তারের কাছে অসুখ-বিসুখ দেখাতে গেলে মানুষ কি এই-রকম করে? তবে? …অমলের ব্যবহারও ভাল লাগছিল না ভ্রমরের। অমল সারাক্ষণ আড়াল-আড়াল হয়ে থাকছে। মুখ শুকনো, করুণ, কেমন যেন নিষ্প্রাণ; চোখ দুটি উদাস, চোখের তলায় জল জমে থাকার মতন ভিজে-ভিজে। ভ্রমর বুঝতে পারছিল না, এই অমলই এতদিন তাকে বড় ডাক্তারের কথা, জব্বলপুর যাবার কথা বলেছে; বলেছে ভ্রমরের শরীর ভাল করা উচিত, ভ্রমরের অসুখ সারাবার জন্যে তার কত আগ্রহ ছিল, অথচ আজ যখন ভ্রমর শরীর থেকে রোগ তাড়াতে চলেছে তখন অমল একটুও সুখী নয়, সান্ত্বনা দিচ্ছে না, আশা-ভরসার কথা বলছে না। কেন? অমল কেন এতটা মুষড়ে পড়েছে?

ভ্রমর তার সন্দেহ এবং আশঙ্কার কথা ক্ষীণভাবে জানাল এবার। সে স্পষ্ট করে কিছু বুঝছিল না, জানতে পারছিল না বলেই, এখন—গাড়িতে উঠে, যেতে-যেতে, অমলকে খুব কাছে এবং একা পেয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল, প্রথম কথা বলল, “আমার কি হয়েছে বল ত?”

অমল রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখন পর্যন্ত সে ভ্রমরের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি, একবার বুঝি তাকিয়েছিল—গাড়ি যখন মোড় ঘুরে মোতি রোডে উঠল। ভ্রমর টাল খেয়ে পড়ে যায় কি না, ঝুঁকে পড়ে কি না দেখছিল। ভ্রমর সামান্য দলে আবার সোজা হয়ে বসায় অমল চোখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। গাড়ি চলছিল।

ভ্রমরের কথা কানে গিয়েছিল অমলের, তবু, সে মুখ তুলল না, তাকাল না।

সামান্য অপেক্ষা করে ভ্রমর অমলের গায়ে হাত রাখল, “এই—!”

অমল সামান্য মুখ তুলল। সে মনে-মনে কতবার শক্ত ও স্থির হবার চেষ্টা করেছে, পারে নি। এখন সে খুব ভয় এবং ব্যাকুলতার মধ্যে শক্ত হবার চেস্টা করল। ভ্রমরের ডাকে একটু, শব্দ করল কোনো রকমে।

“আমার কিসের অসুখ হয়েছে, জানো তুমি?” ভ্রমর জিজ্ঞেস করল।

“না। আমি কি করে জানব!” অমল গলার মাফলার কানের ওপর তুলে দিতে দিতে বলল, কোটের কলারও তুলে দিল। যেন সে ভ্রমরের কাছ থেকে মুখ আড়াল করে রাখতে চাইছে।

“তা হলে—?” ভ্রমর শুধলো, তার গলার স্বরে সন্দেহ ছিল।

“কি?”

“সবাই এ-রকম করছে কেন? বাবা, মা, তুমি—?”

“এ-রকম মানে, কি রকম?” অমল সব জেনেশুনেও ভয়ে-ভয়ে বলল।

“সবাই যে খুব ভয় ভাবনা করছে, ছটফট করছে—”

“করছে! কই…” অমল রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তার মাথায় কোনো রকম বুদ্ধি খেলছিল না। ভ্রমরকে এখন আগাগোড়া সামলে যেতে হবে, মিথ্যে বলতে হবে, ভরসা দিতে হবে। কিন্তু কি করে সামলাবে অমল! তার অত সাহস কোথায়, জোর কোথায়। মনে-মনে অমল ভগবানের কাছে সাহস চাইল।

“এই শোনো—” ভ্রমর সামান্য পরে আবার বলল; অমলের দিকে ঝুঁকে বসল।

“উঁ—”

“আমার অসুখ কি খুব খারাপ?”

“খারাপ! কে বলল খারাপ!”

“তুমি জানো না?”

“না।”

“বাবা তোমায় কিছু বলে নি?”

“না, না।” অমল জড়সড় হয়ে বসল, যেন তার শীত করছে খুব।

অল্প চুপ করে থেকে ভ্রমর এবার হিমানী-মা’র কথাটা বলল, সন্ধেবেলায় কৃষ্ণার ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে কি বলেছে হিমানী-মা ভ্রমরকে। অমল নীরবে শুনল। হিমানীমাসির ওপর তার রাগ এবং ঘৃণা হল। এ-বাড়ির সকলের ওপরই অমলের বিরক্তি, রাগ ও ঘৃণা জমেছে কাল থেকে। সবাই মিলে এরা ভ্রমরকে উপেক্ষা করে, একপাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে আস্তে-আস্তে মেরেছে, আজ খুব বড় করে স্নেহ দয়ামায়া দেখাতে এসেছে! নিষ্ঠুর, এরা সবাই নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, অমানুষ।

“কি জানি, আমার এক একবার মনে হচ্ছে, আমার খুব কঠিন অসুখ—” ভ্রমর বলল মৃদু, গলায়, হতাশ গলায়। বলে নিশ্বাস ফেলল, দীর্ঘনিশ্বাস। বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল ওকে।

অমল প্রাণপণ নিজেকে ভয় এবং বিহ্বলতা থেকে তুলে নেবার চেষ্টা করছিল, বলল “তোমার সব মনে মনে; নিজেই নিজের অসুখের কথা ভেবে নিচ্ছ।”

“ভাবছি কোথায়! আমার কেমন মনে হচ্ছিল, তাই বললাম।”

“হবেই বা কেন?”

“তোমরা তাহলে এ-রকম করছ কেন?”

“আমি কিছু করি নি—”

অমলের শ্বাসনালী ঠাণ্ডা, বুক শক্ত পাথর-পাথর লাগছিল, তবু, অমল বলল, “আমার একেবারে ভাল লাগছে না, তাই চুপ করে থাকছি।” বলে সামান্য সময় অমল আর কিছু বলল না, শেষে ভ্রমরকে যেন সন্দেহ করতে দেবে না, কোনোরকম, তাই আবার বলল, “হাসপাতাল-টাসপাতাল পাঠাতে হলে মানুষ এমনিতেই একটু, ভয় পায়; তোমর বেলায় আবার বিদেশে, নাগপরে—তাই হয়ত মেসোমশাই মাসিমা ওরকম করছেন।”

ভ্রমর মন দিয়ে শুনল। শুনতে-শুনতে সে মাথায় বাঁধা স্কার্ফটা কানের পাশ থেকে সরিয়ে দিল একটু, যেন অমলের কথাবার্তা সে বাকি সময়টুকু মন দিয়ে শুনতে চায়। ভ্রমর বলল, “আমিও তাই ভাবছিলাম। ডাক্তার দেখানো পর্যন্ত যা ভাবনা, তারপর ত ফিরেই আসব।”

অমল মনে-মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল, যেন তাই হয়; ভ্রমর ফিরে আসে তাড়াতাড়ি। তারপরই সে ভাবল, কাল থেকে অনেকবার অমল বিশ্বাস করতে চাইছে, ভ্রমর ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে আসবে, সুস্থ নীরোগ হয়ে উঠবে। মজুমদার-ডাক্তার এমন কথা ত বলেন নি যে, ভ্রমরের ঠিক ওই রোগটাই হয়েছে। বরং তিনি বলেছেন, তাঁর ভুল হতে পারে; সময় থাকতে সাবধান হবার জন্যেই যা বড় ডাক্তারের কাছে যাওয়া। ডাক্তাররা কি ভুল করে না! হামেশাই করে। অমলের যখন টাইফয়েড হল তখন তাদের মধুপুরার ডাক্তারকাকা প্রথম দশ বারো দিন কখনও বলল ঠাণ্ডা লেগে জ্বর, কখনও বলল ম্যালেরিয়া হতে পারে, কখনও বলল লিভার বেড়ে গিয়ে জ্বর হয়েছে। শেষে টাইফয়েড সাব্যস্ত হল। ভ্রমরেরও সেই রকম হতে পারে, হয়ত রোগটা মোটেই ভয়ের নয়, ঠিক-ঠিক ধরা পড়লে সেরে যাবে তাড়াতাড়ি।

“আমি কিন্তু খুব ভয় পাই নি, জানো…” ভ্রমর বলল হঠাৎ।

অমল মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। স্কার্ফের মধ্যে ভ্রমরের ছোট্ট মুখ ঘোমটার তলায় বউ-বউ দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো না পড়ায় পরিষ্কার করে মুখটি দেখা যাচ্ছিল না।

“তোমরা যদি ওরকম না করতে আমি একটুও ভয় পেতাম না।” ভ্রমর যেন অমলদেরই সান্ত্বনা সাহস দিচ্ছে এমন গলা করে বলল, “আমার ভয় কম।”

“ভয়-টয়ের কিছু নেই।” অমল খানিকটা সাহস পেয়েছে যেন এতক্ষণে।

“থাকলেও বা কি!…তুমি লাজার-এর গল্প জানো?”

“না, লাজার কে?”

“বাইবেলে আছে। লাজার একটা লোরে নাম, মরিঅমের ভাই। যীশুকে ওরা খুব ভালবাসত, যীশু, ওদের খুব ভালবাসতেন।” ভ্রমর ধীরে ধীরে বলল, “লাজার-এর খুব অসুখ হল, সে মরে গেল, তাকে কবর দিয়ে দেওয়া হল। যীশু তখন অনেকটা দূরে এক জায়গায় ছিলেন। লাজার-এর অসুখের কথা শুনে তিনি বলেছিলেন, লাজার-এর অসুখের শেষ মত্যু নয়, তার অসুখ প্রভুকে মহিমান্বিত করবে।”

অমল মন দিয়ে গল্প শুনছিল না, তবু শুনছিল। তার মনে হল, ভ্রমর বোকার মতন কথা বলছে।

ভ্রমর বলল, “লাজার মারা গিয়েছিল, কিন্তু চার দিন পরে যীশু, তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।”

“এ-সব গল্প!” অমল অন্যমনস্কভাবে বলল।

“গল্প কেন!…তুমি কিছু বিশ্বাস কর না। ভগবানকে যে ভালবাসে সে মরে না, ভগবান তাকে বাঁচান।” ভ্রমর এমন সরল গলায় বলল যেন ভগবান তাকে বাঁচাবেন, না বাঁচালে তিনি মহিমান্বিত হবেন না।

অমল কিছু বলল না। ভগবান কি সত্যি এত দয়ালু! অমল কেমন বিতৃষ্ণা এবং রাগের সঙ্গে ভাবল, ভগবান এত দয়াল, বলেই কি তোমায় অসুখে ভোগাচ্ছেন? কেন তোমার মা নেই, ভ্রমর? কেন হিমানীমাসি তোমায় এতকাল অযত্ন করে এসেছেন? অমল ভগবানের ওপর রাগ এবং ঘৃণার চোখ করে তাকাতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত হঠাৎ ঝোথায় বাধা পেল, ভয় পেল। তার মনে হল, কি দরকার, ভ্রমর হাসপাতালে যাচ্ছে, ভগবান দয়ালু, হোন না-হোন, নির্দয় হতে পারেন; যদি তিনি অসন্তুষ্ট হন, ভ্রমরের ক্ষতি হতে পারে। অমল আর ও-বিষয়ে ভাবতে চাইল না।

টাঙাগাড়ি মোতি রোডের প্রায় শেষাশেষি এসে গিয়েছিল। আনন্দমোহন-দের গাড়িটা একটু তফাতে চলে গেছে। ঘোড়াটা হয়ত বেশী তেজী। অমলদের ঘোড় সমান তালেই ছুটেছে, তার সারা গায়ের মচমচ শব্দ বাতাসে বাজছে, কান না করলে শোনা যায় না, গলার ঘন্টি এই নির্জনতায় ঝুমঝুম ঝুমঝুম করে নিরবচ্ছিন্ন একটি সুর সষ্টি করে যাচ্ছিল। আকাশে চাঁদটি কোথায় রয়েছে অমলরা দেখতে পাচ্ছে না, টাঙার মুখ না ফেরা পর্যন্ত পারে না, জ্যোৎস্না আরও অস্বচ্ছ হয়ে আসছে বুঝি, ময়লা তুলোর মতন দেখাচ্ছে, যেন প্রাণ নেই; কুয়াশা হিমে আলোর কণাগুলি ভিজে থাকায় আলোক ফুটছে না। মোতি রোডের বাড়িগুলি নিস্তব্ধ, এক একটি পাঁচিল এবং বাগান পেরিয়ে এলে মনে হচ্ছে ভৌতিক অসাড় কোনো বাসস্থান পার হয়ে এল গাড়িটা।

ভ্রমর আরও একটু, সরে এল অমলের দিকে, ঠান্ডা লাগছিল ঘাড়ের কাছটায়। অমল ভ্রমরের পোশাকের স্পর্শ অনুভব করতে পারছিল, এমন কি ভ্রমরের গায়ের ভার তার গায়ে লাগছিল।

ভ্রমর বলল, “তোমার মুখ দেখলে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।” বলে অনেকটা যেন অভিমান করার মতন করে ঠোঁট মুখ ফোলাল, চোখের দৃষ্টি ক্ষুব্ধ করল, “তুমি যখন যাবে তখন আমার মন খারাপ হবে না? তবে!”

অমল ব্যথিত উদাস চোখ ভ্রমরের চোখে রাখল। জ্যোৎস্নার মরা আলোয় ছায়ায় ভ্রমরকে স্বপ্নের মতন দেখাচ্ছে। আছে, তবু যেন নেই; খুব কাছে অথচ অনেকটা দূরের মানুষ। অমল এই মূহূর্তে বোধ হয় নিজের কাছে কোনো রকম বিশ্বাস ও সান্ত্বনা পেতে চাইল। হাত বাড়িয়ে ভ্রমরের কোলে রাখল। রেখে মনে হল, ভ্রমর তার সামনে তার পাশেই রয়েছে। অমল কোনো কথা বলতে পারল না।

“আমি ফিরে আসার পরও তোমার যাওয়া হবে না।” ভ্রমর গাঢ় গলায় বলল, “একেবারে মাসের শেষে যেও, জানুআরির শেষে।”

অমল এই মুহূর্তে বিশ্বাস করল ভ্রমর ফিরে আসবে, জানুআরির শেষ পর্যন্ত থেকে যাবার কথাও সে ভাবল। বলল, “বাড়িতে লিখতে হবে।”

“লিখে দিয়ো। তোমার তাড়াতাড়ি কি, চাকরি করতে যাচ্ছে না ত, তবে—!”

অমল চুপ করে থাকল। কয়েকটা দেবদারুগাছের ছায়ার তলা দিয়ে টাঙাটা এগিয়ে এল, এগিয়ে এসে বাঁ-হাতি মোড় ঘুরল। সাইকেলের অতি ক্ষীণ আলো ফেলে এক জোড়া লোক এ-সময় তাদের পেরিয়ে উলটো মুখে চলে গেল। কোচোআন পা দিয়ে ঘন্টি বাজাল বারকয়েক, তার মনে হয়েছিল সামনে কেউ রয়েছে, বস্তুত কেউ ছিল না, কুয়াশার মধ্যে একটা ভাঙা ঝুড়ি মানুষের মতন দেখাচ্ছিল, যেন কোনো মানুষ রাস্তার পাশ ঘেঁষে বসে আছে।

তফাত-তফাত কয়েকটা একতলা বাড়ি পেরিয়ে ফাঁকায় পড়ল ভ্রমরদের গাড়ি। সামান্য দূরে আনন্দমোহনদের টাঙা ছটছে। ফোটা-ফোটা দুটি আলোর বিন্দু, চোখে পড়ছিল।

ভ্রমরই আবার কথা বলল। “আমার ঘরে তোমার সেই কালো মোজা দুটো পড়ে আছে, গোড়ালি সেরে রেখেছি, নিয়ে নিয়ো।”

অমল সাড়া দিল না। ভ্রমরকে সে দেখছিল না, রাস্তা দেখছিল। রাস্তাটা যেন পায়ের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রমাগত চলে যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোয় মোরম-পেটানো এই রাস্তা ঘোলাটে দেখাচ্ছিল, কোথাও-কোথাও পাথরের গুঁড়ো সামান্য চকচক করছে। অমলের মনে হচ্ছিল, তাদের পায়ের তলা দিয়ে ঘোলাটে জল বয়ে যাচ্ছে।

“তুমি একটাও কথা বলছ না।” ভ্রমর বলল।

হুঁশ করল অমল। “বলছি ত!”

“কই বলছ? চুপ করে বসে আছ।”

অমল মুখ তুলে ভ্রমরের দিকে তাকাল। নিশ্বাস ফেলল বুক হালকা করার জন্যে। “আমার কিছু ভাল লাগছে না।”

ভ্রমর নিবিড় ও অতি বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকল। টাঙার মুখ ঘুরে যাওয়ায় সামান্য জ্যোৎস্না ভ্রমরের কাঁধ ও গলার কাছে এসে পড়েছে। মুখ আরও একটু পরিষ্কার দেখাচ্ছিল। কোলের ওপর থেকে অমলের হাত তুলে নিয়ে ভ্রমর সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, “আমারও কি ভাল লাগছে!”!

“জানি—” অমল ছোট্ট করে বলল, বলল—কেননা ভাবল, এটা তার বলা উচিত।

“আমি একটা কথা বলব—?” ভ্রমর অল্প করে বলল আবার।

“কি?”

“তুমি মন খারাপ করো না।” বলে ভ্রমর কি ভাবল সামান্য, “তুমি এখন দুঃখ পাচ্ছ, ক’দিন পরে আমি আবার ফিরে আসব, তখন দুঃখ থাকবে না।”

অমল ভ্রমরের মুঠো থেকে হাত সরিয়ে নিজের মুঠোয় হাত ধরল ভ্রমরের। শক্ত করে ধরে থাকল। যেন সত্যি-সত্যি সে বিশ্বাস করতে চায় ভ্রমর ফিরে আসবে, ভ্রমর ফিরে এলে তার দুঃখ থাকবে না।

ভ্রমর অমলের কাঁধের পাশে মাথা রাখল। টাঙাটা আর দুলছে না, সমান গতিতে চলছে, চাকার শব্দ, ঘোড়ার শরীরের শব্দ, ঘণ্টির শব্দ—সব মিলে মিশে পৃথক একটি জগৎ রচনা করেছে এখন। ভ্রমর এই বিচ্ছিন্ন এবং অতি নিভৃত জগতের মধ্যে বসে অমলকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করতে পারছিল। এবং এই মুহূর্তে সে বিচ্ছেদ বেদনা দুঃখকে নগণ্য ও মিথ্যা করল। বলল, “দুঃখ তুমি ভালবাস না। একদিন এই টাঙাগাড়িতে বসে বলেছিলে, মনে আছে—সেই যে আমরা যেদিন বাজার থেকে ফিরছিলাম।” বলে ভ্রমর অপেক্ষা করল, যেন অমলকে মনে করতে সময় দিল।

অমলের মনে পড়ল না। মনে করার চেষ্টাও সে করল না। দুঃখকে সে সত্যিই ভালবাসে না। কে ভালবাসে! অমল বলল, “দুঃখকে কেন ভালবাসব! কোন লোক ভালবাসে!”

“কেউ বাসে না। কিন্তু দুঃখ ত আছেই। নেই?”…আমার মা বরাবর দুঃখী ছিল। আমিও দুঃখী ছিলাম। ছিলাম না?”

অমল ভ্রমরের মাথায় চিবুক ছোঁয়াল। তার গলার তলায় ঠাণ্ডা কনকনে ব্যথা লাগছিল, বুকের সবটুকু ফাঁকা—যেন এক মুঠো বাতাস একটা ঘরের মধ্যে ছটফট করে উড়ে বেড়াচ্ছে, পথ পাচ্ছে না বাইরে আসার।

“দুঃখীদের জন্যে বাইবেলে অনেক কথা আছে।” ভ্রমর অতি মৃদু, গলায় বলল। নিজেকে এবং অমলকে যেন ভরসা দিচ্ছে, “তোমার দুঃখ হবে, কিন্তু দুঃখই এক-দিন আনন্দ হয়ে দেখা দেবে।—যীশু বলেছিলেন, এখন দুঃখে সও, কিন্তু আমি আবার এসে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব, তখন সুখী হবে।” আই উইল সি ইউ এগেইন অ্যান্ড ইওর হার্ট শ্যাল রিজয়েস—কথাটা ভ্রমর এখন পরম বিশ্বাসে মনে মনে বলল, বলে শক্তি পেল, সাহস পেল।

অমল ভাবল, বলে—তোমাদের যীশু, কিন্তু আর আসেন নি। কিন্তু অমল বলল না, এমন কি কথাটা সে মোটেই ভাবল না। বাইবেল বা যীশু সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ এখন নেই।

“যে ক’দিন আমি না থাকি তুমি কৃষ্ণার সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে খেলেটেলে সময় কাটিয়ো; তারপর ত আমি ফিরে আসছি।” ভ্রমর বলল।

কথাটা আচমকা অমলের কানে অন্য রকম শোনাল। সে ঠিক বুঝল না, স্পষ্ট করে বুঝতে পারল না, তবু, মনে হল ভ্রমর যেন বলছে, ভ্রমর একদিন না একদিন ফিরে আসবে, না-আসা পর্যন্ত অমলকে অন্য সঙ্গী নিয়ে সময় কাটাতে হবে। অমলের ভাল লাগল না। সংসারের কোনো অতি নিগৃঢ় ও সত্য কথা বয়সকালে অনুভব করতে পারলে মানুষ যেমন বিষণ্ণ হয়, অসহায় বোধ করে, এবং অক্ষম অভিমানে কাঁদে, অমল এই বয়সে সেই রকম কোনো সত্য অনুভব করতে পেরে কাতর ও ক্ষুদ্ধ হচ্ছিল।

দু-পাশে ফাঁকা মাঠ পড়েছে। মাঠের কোথাও কোথাও ক্ষেতী। শাকসবজির ছোট ছোট ক্ষেত। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। মাঠ মাটি সবজি-ক্ষেত এবং শূন্যতার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, চাঁদের আলো আরও নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে, বাতাসও উঠছে। নখের মতন সাদা লাগছিল জ্যোৎস্না, ধোঁয়াকালির মতন দেখাচ্ছিল ক্ষেতক্ষেতী।

অমল হঠাৎ ডাকল, “ভ্রমর—।”

ভ্রমর অমলের কাঁধের ওপর মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে চলেছে। সাড়া দিল মুখ বন্ধ করেই।

“আমি একদিন একটা কিছু করে বসব।” অমল আবেগবশে বলল।

ভ্রমর বুঝল না। বলল, “কি করবে?”

“জানি না। আমার কিছু ভাল লাগছে না।…আমি একদিন মরে যাব।”

অমলের কাঁধ থেকে ভ্রমর মাথা সরিয়ে নিল। অবাক হচ্ছিল সে। মাথা সরিয়ে অমলের দিকে তাকাল ভ্রমর। “কি বলছ! কি বাজে কথা ভাবছ! মরে যাবে কেন?”

“কষ্ট আমার ভাল লাগে না। এত কষ্ট আমি সইব না।”

“আমার জন্যে কষ্ট?”

“হ্যাঁ।…তুমি না থাকলে আমি কিছু কেয়ার করি না। আমি যীশু-টীশু, জানি না, ভগবান আমার কি করবে! আমি দেখব, আমি দেখব ক’দিন—তুমি ফিরে না এলে তারপর দেখো কি করি। অমলের গলার স্বর বিকৃত হয়ে গিয়েছিল—যন্ত্রণায়, কান্নায়, আবেগে, হাহাকারে।

“আমি ফিরব না কেন?” ভ্রমর বলল, বলে অমলের চোখের দিকে স্থির অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল। যেন সে বুঝতে পারছে না, অমল কেন ও-কথা বলল, কেন বিশ্বাস করতে পারছে না ভ্রমর ফিরে আসবে!

ভ্রমরের দৃষ্টি সহসা অমলকে সতর্ক ও সচেতন করল; সে বুঝতে পারল তার ও-কথা বলা ভুল হয়ে গেছে, ভীষণ ভুল; আর-একটু, হলেই হয়ত ভ্রমর সন্দেহ করত, জানতে পেরে যেত। অমল আবার ভয় পেল, ভয় পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। জবাব দিল না কথার।

“বললে না?” ভ্রমর আবার বলল।

“কি?”

“আমি নাগপুর থেকে ফিরব না কেন? ওখানে আমার কে আছে?”

“জানি না। এমনি বলেছিলাম।…আমার কিছু ভাল লাগছে না। খারাপ লাগছে।” বলেই অমল আর দেরী করল না, বলল, “ভ্রমর, আমি খুব ভীতু, আমার হাসপাতাল শুনলে ভয় হয়।”

“তোমার একটুও বিশ্বাস নেই।”

“কে বলল নেই…”

“তাহলে ভগবানকে ও-রকম কথা আর বলো না। তুমি আমি তাঁকে দেখি না, তিনি অনেক দুরে বলে, কিন্তু তিনি আছেন। তিনি না থাকলে আমি তোমায় দেখতাম না কোনোদিন, তুমি আমায় দেখতে পেতে না।”

অমল নীরব, তার শরীরের স্নায়ুগুলি কাপছিল, তার বুকের মধ্যে আশ্চর্য এক অনুভব এসে ধোঁয়ার পঞ্জের মতন ফেনিয়ে উঠছিল। অমল কিছু বুঝতে পারছিল না, অথচ তার অনুতাপ হচ্ছিল, দুঃখ হচ্ছিল।

ভ্রমর বলল, “আমি যখন নাগপুরে থাকব তুমি কি আমায় দেখতে পাবে?”

“না।”

“আমিও তোমায় দেখতে পাব না।…তবু, তুমি আমার কথা ভাববে সব সময়, আমি তোমার কথা ভাবব।”

“আমিও সারাক্ষণ তোমায় ভাবব, ভ্রমরঃ সকালে দুপুরে রাত্তিরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও।” অমল ছেলেমানুষের মতন বলল।

“আমিও ভাবব।…ভগবানকেও তুমি ভেবো, দেখতে পাবে না, তবু ভেবো। দূরে যে থাকে তাকে অবিশ্বাস করতে নেই।”

অমলের মনে পড়ে গেল কথাটা। ভ্রমর বলেছিল একদিন, সব ভাল জিনিসই দূরের, অনেক দুরের। ভগবান দূরে থাকেন। ভালবাসাও বোধ হয় ভগবানের মতন দূরে থাকে। অমল মুখ তুলে ভ্রমরকে দেখল। চাঁদের অমন মলিন আলোতেও ভ্রমরের মুখ হিমে-ভেজা ফুলের মতন দেখাচ্ছে, ক্ষীণ শীর্ণ কিন্তু পবিত্র, মলিন অথচ সুন্দর। ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে অমলের মনে হল, ভ্রমরের দুঃখ হচ্ছে, সে কাতর কিন্তু তার ভয় নেই, দ্বিধা নেই, সে জানে সে ফিরে আসবে। যেন তার অসুখ সত্যিই বাইবেলের লাজার-এর মতন, মৃত্যুতে যার শেষ নেই, সত্যিই ভগবানের মহিমার জন্যে এই অসুখ।

অমল কোমল ও আলতো করে, ভালবেসে ভ্রমরের চোখের কোলে, গালে আঙুল রাখল। মোমের মতন লাগছিল। সামান্য ভেজা। অমল যেন আঙুল দিয়ে ভ্রমরের চোখের কোলের ভিজে ভাবটুকু মুছে দিচ্ছিল, বলল, “ভ্রমর, তোমায় আজ কেমন যেন দেখাচ্ছে—” বলে ভাবল একটু, “প্রতিমার মুখের মতন।” বলেই অমলের মনে দুর্গাপুজোর বিজয়ার দিনের প্রতিমার মুখ মনে পড়ল।

ভ্রমর নম্র স্নিন্ধ চোখে হাসল। বলল, “খুব বিউটিফুল বললে না যে!”

অমল শুনল; শুনে হাসবার চেষ্টা করল। হাসতে পারল না, যেন এখানকার সমস্ত স্মৃতি ওই একটি কথায় উদ্ভাসিত হল, এবং সঙ্গে-সঙ্গে অনুভব করল, সে এই স্মৃতি থেকে বিদায় নিচ্ছে। অমল ছেলেমানুষের মতন কেঁদে ফেলল, ফুঁপিয়ে-ফাঁপিয়ে, মুখ নীচ করে। ভ্রমরও কাঁদছিল।

ওদের কান্নার মধ্যে গাড়ি স্টেশনের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল, তে-রাস্তার মোড়ের কিছু কিছু কোলাহল ভেসে আসছিল।

অমল বলল, “আর একটু পরেই তুমি চলে যাবে।” বলে সমস্ত বুক খালি করে নিশ্বাস ফেলল।

ভ্রমর মুখে তুলে দূরের স্টেশনের আলো দেখতে দেখতে বলল, “আবার আমি ফিরে আসিব।”

অমল কোনো জবাব দিল না।

টাঙাগাড়ি ক্রমশ তে-রাস্তার মোড়ের কাছে এল, তারপরে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।

অমল কখনও শ্মশানে যায় নি, শ্মশান থেকে ফেরার অনুভূতি তার নেই; তবু, ফেরার পথে তার মনে হচ্ছিল, জীবনের সমস্ত সে যেন কারও হাতে তুলে দিয়ে এসেছে, কার হাতে কে জানে, তবে যার হাতে দিয়ে এসেছে সে অতি নির্মম নিষ্ঠুর হৃদয়হীন; তার দয়ামায়া মমতা নেই, ভালবাসা নেই। ভ্রমরকে নেবার সময় তার একবিন্দু, মমতা হল না।

টাঙাগাড়িটা ফিরে আসছিল। মাত্র একটি টাঙা। পাশে ভ্রমর নেই, কৃষ্ণা আছে। রাত হয়ে আসায় শীত দুঃসহ হয়ে উঠেছে, কুয়াশা নিবিড়, জ্যোৎস্না চলে যাচ্ছে, পথঘাট শূন্য ও খাঁ-খাঁ করছিল। বাতাস ভেঙেছে, ভেঙে হুহু করে মাঠ-ঘাট রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে-ছুটে যাচ্ছে।

অমল অসাড় স্থির হয়ে বসে ছিল। অনেক দিনের বাস-করা সাজানো গোছানো অভ্যস্ত বাড়ি হঠাৎ খালি ফাঁকা হয়ে গেলে যেমন লাগে, অমলের অনেকটা সেই রকম লাগছিল। তার চারপাশে অস্বাভাবিক শূন্যতা; কেউ নেই। কিছু নেই; সে একা—সে একা-একা একটি শূন্য বাড়িতে বসে আছে।

নাগপুরের মেলগাড়ির চাকা যেন ক্রমাগত অমলের মনের ওপর দিয়ে অনেক-গুলি ধারালো ভারী নৃশংস চাকা পিষে দিয়ে চলে যাচ্ছে! অসহ্য কষ্টে এবং যন্ত্রণায় অমল মৃতের মতন পড়ে ছিল। সে অনুভব করতে পারছিল, এই যন্ত্রণার শেষ নেই, হয়ত একদিন সত্যি-সত্যি অমল কিছু করে বসবে।

কৃষ্ণা কি একটা কথা বলল হঠাৎ। অমল শুনতে পেল না। কৃষ্ণা হিহি করে কেঁপে জড়সড় হয়ে বসল। অমল লক্ষ করল না। মনে-মনে সে ভ্রমরকে ভাবল। গাড়ির কামরায় মাঝখানের বেঞ্চে ভ্রমর এতোক্ষণে শুয়ে পড়েছে বোধ হয়, তার চোখের ওপর কামরার হলুদ রঙের বাতিটা জ্বলছে। ভ্রমর শুয়ে-শুয়ে অমলের কথা ভাবছে। গাড়িতে জায়গা করে বসার পর খুব অল্পসময়ের জন্য ভ্রমর অমলকে পাশে পেয়েছিল। একসময় খুব নীচু, গলায় যেন কানে-কানে ভ্রমর বলেছিল, এখন আর আমার যেতে ইচ্ছে করলে না।’ তারপর খানিকটা পরে ফিস-ফিস করে বলেছিল, ‘এই, তুমি কিন্তু এখন কাঁদবে-টাঁদবে না; বাবা রয়েছে; তুমি কাঁদলে আমিও…’ কথাটা ভ্রমর শেষ করে নি।

ভ্রমর কি এখন শুয়ে-শুয়ে মুখ ঢাকা দিয়ে কাঁদছে? কে জানে। অমল বুক ভেঙে নিশ্বাস ফেলল। সে একবার রাস্তা ও মাঠের দিকে তাকাল, জ্যোৎস্না মরে এল, সামান্য দূরে সবজিক্ষেতের দিকে বুঝি কয়েকটি জোনাকি উড়ছে, অমলের দেওয়ালির দিনের কথা মনে পড়ল, ময়দানে জোনাকি-বাজি দেখেছিল দুজনে পাশাপাশি বসে…।

চোখের ভুল, মনের অতি নিভৃত জগৎ থেকে যেমন করে স্বপ্ন উঠে আসে —ভ্রমরও সেই রকম উঠে এল, এসে সেই মত জ্যোৎস্নায় কনকনে শীতে অমলের টাঙাগাড়ির পাশে-পাশে চলতে লাগল যেন। অমল ভ্রমরের মুখ দেখতে পাচ্ছিল না, হাওয়ায় ভেসে-ভেসে চলেছে। ছুটেছে যেন। অমল সেই মুখ দেখতে লাগল। কয়েক দন্ড পরেই হারিয়ে গেল ভ্রমর।

কৃষ্ণা আবার কি একটা কথা বলল, অমল খেয়াল করল না। ঘোড়াটা পিছনের পা তুলে লাফিয়ে উঠেছিল বলেই হয়ত কৃষ্ণা টলে পড়ে যেতে-যেতে অমলের হাত ধরে ফেলেছিল। আবার ঠিক হয়ে বসল। অমল মাঠের দিকে তাকাল, জ্যোৎস্নার গায়ে-গায়ে ছায়ার মতন অন্ধকার এসে যাচ্ছে।

এ বড় আশ্চর্য যে, অমল এখন অনুভব করছিল, তার কোথাও কেউ নেই, সে আত্মীয়-স্বজনহীন; একমাত্র ভ্রমরই তার আত্মীয় ছিল, নিজের ছিল, ভ্রমর না থাকায় সে সম্পূর্ণ একা তার কোনো আশ্রয় নেই তাকে ভালবাসার কেউ নেই।

ভালবাসা যে কতটা দেয় অমল এই মুহূর্তে তা অনুভব করতে পারছিল, তার মনে হচ্ছিল, সুখের সমস্তটা এই ভালবাসা—বাঁচার সবটুকু এই ভালবাসা —ভাল লাগার যা কিছ, ভালবাসার মধ্যে। ভ্রমর ঠিকই বলত আমরা বড় নিষ্ঠুর, ভালবাসা জানি না।’

ভালবাসা যে জানে সে ভ্রমরের মতন। ভালবাসা জানলে ভ্রমরের মতন অসুখ করে, ভগবান ভ্রমরের মতন অসুখ দেয়, যে অসুখে রক্তের লালটুকু মরে যায়, মরে গিয়ে মানষ ফ্যাকাশে হয়ে ঠান্ডা হয়ে ভুগে-ভুগে মরে যায়।

দাঁত দিকে ঠোঁট কামড়ে ধরল অমল। তার গলায় বুকে আক্রোশ এবং কান্না থমথম করছিল। কিন্তু অতি কষ্টে সে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করল। ভ্রমর তাকে কাঁদতে বারণ করেছে, বলেছে, দুঃখ করো না, আমি আবার ফিরে আসব।

ভ্রমর ফিরে আসবে কিনা অমল বুঝতে পারল না, কিন্তু সে অনুভব করতে পারল, ভ্রমর এখন অনেকটা দূরে; অনেকটা দূরে বলে সে শুধু ভাববে, ভাববে এবং অপেক্ষা করবে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *