১০. ছদ্মবেশ

১০. ছদ্মবেশ

বিকেল গড়িয়ে গিয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কেন্টাকি প্রদেশের এ গ্রাম্য-সরাইখানায় একজন বৃদ্ধ মুসাফির প্রবেশ করলেন। ভেতরের পানকক্ষটায় দেখলেন বেশ ভিড়। ওদের অধিকাংশই ভবঘুরে ধরনের মানুষ, বিশ্রী আবহাওয়ার জন্যেই তারা এখানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ঘরের ভেতরে কয়েকটা জায়গায় আগুন জ্বলছে আর চারপাশ দিয়ে কেউ বসে রয়েছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অধিকাংশেরই পরনে শিকারির পোশাকের ওপর বর্ষাতি, মাথায় তালপাতার ঢোলা টুপি। ঘরের এককোণে কতকগুলো রাইফেল আর বারুদের থলি সাজানো রয়েছে। ভিড়ের মধ্যে দিয়েই নিগ্রো পরিচারকরা ব্যস্ত পায়ে যাওয়া আসা করছে। একপাশে একটা বিজ্ঞাপনকে ঘিরে কয়েকজন ভিড় জমিয়েছে দেখে বৃদ্ধ মুসাফির, মিস্টার উইলসন, পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিনিসটা কী?’

লোকটা সংক্ষেপে জবাব দিল, ‘পালিয়ে যাওয়া একটা নিগ্রোর বিজ্ঞাপন।’ মিস্টার উইলসন হাতের ছোট ব্যাগ আর ছাতাটা একটা চেয়ারের ওপর রেখে পকেট থেকে চশমাটা বার করলেন তারপর খুব সন্তর্পণে ওটা নাকের ওপর এঁটে ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বিজ্ঞাপনটা পড়তে লাগলেন।

“জর্জ হ্যারিস নামে আমার একজন মুলাটো ভৃত্য পালাইয়া গিয়াছে। বয়স পঁচিশ- ছাব্বিশ, ছ’ফুট লম্বা, মাথায় হালকা বাদামি রঙের ঘন-কোঁকড়ানো চুল। অসম্ভব বুদ্ধিমান, চমৎকার ইংরেজি বলিতে পারে, লিখিতে পড়িতেও জানে। সম্ভবত শ্বেতকায় কোনো পুরুষের ছদ্মবেশে সে পালাইতে চেষ্টা করিবে। তাহার পিঠে ও কাঁধে গভীর ক্ষতচিহ্ন এবং তাহার ডান হাতে ‘এইচ’ অক্ষরটি উল্কিতে খোদাই করা আছে।

তাহাকে জীবিত ধরিয়া দিতে পারিলে চারশত ডলার পুরস্কার দিব। তাহাকে যে হত্যা করা হইয়াছে, সে বিষয়ে যথাযথ প্রমাণ দিলে ওই একই পরিমাণ অর্থ দেওয়া হবে।”

ভীষণ অবাক হয়ে মিস্টার উইলসন আর একবার বিজ্ঞাপনটার ওপর চোখ রাখলেন, তারপর নীরবে ব্যাগ আর ছাতাটাকে চেয়ারের নিচে চালান করে দিয়ে চোখ বুজে চুপচাপ বসে রইলেন।

তাঁর পাশে বসা পশুপালকদের মতো দেখতে রোগা লিকলিকে চেহারার একটি লোক থলি থেকে তামাক বের করে নলে ঠাসতে ঠাসতে সশব্দে আগুনের মধ্যে থুতু ফেলল। থুতু ফেলার সেই বিশ্রী শব্দে বৃদ্ধ চমকে উঠলেন, ‘কী ব্যাপার!’

‘কিছু না, আমি থুতু ফেললাম।’ নিস্পৃহ গলায় লোকটা জবাব দিল। ‘যে ওই বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে সে যদি আমার সামনে উপস্থিত থাকত, আমি ঠিক এমনি ভাবেই তার মুখের ওপরে থুতু ফেলতাম। সত্যি, নিজেকে একজন কেন্টাকিবাসী হিসেবে ভাবতে আমার নিজেরই লজ্জা করছে।’

‘এক দিক থেকে কথাটা অবশ্য সত্যি।’ বৃদ্ধ উইলসন সোজা হয়ে বসলেন।

তামাকের নলটা ধরিয়ে নিয়ে লোকটা গলগল করে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ল, তারপর থলিটা বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটু তামাক চলবে নাকি?’

‘না, ধন্যবাদ আমি ধূমপান করি না।’

‘এ রকম বিশ্রী আবহাওয়ায় আমার আবার তামাক না হলে মেজাজ ঠিক থাকে না। তার ওপর বিজ্ঞাপনটা পড়ে মেজাজটা আরো খিঁচড়ে গেল। দেখে তো মনে হচ্ছে ছেলেটি খুবই বুদ্ধিমান আর মনিবটি তার সঙ্গে রীতিমতো নিষ্ঠুর ব্যবহার করত।’

‘হ্যাঁ ঠিক তাই।’

নির্দ্বিধায় বৃদ্ধকে সমর্থন করতে দেখে লোকটি উৎসাহিত হয়ে উঠল। আমারও কিন্তু অল্পবয়েসী অনেকগুলো নিগ্রো চাকর আছে। আমি সব সময়েই তাদের বলি, যেটা করবি মন দিয়ে করিস আমি কখনো তোদের পেছনে লেগে থাকব না বা দেখতেও আসব না, কিন্তু আমি লক্ষ করেছি ওরা সেই কাজগুলো ঠিক গুছিয়ে করে রেখে দিয়েছে। আমি সবসময়েই এমন ব্যবহার করি যেন ওরা স্বাধীন, যখন যা খুশি করবে, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারে। যদি কোথাও কোনো কাজে কয়েকদিনের জন্যে আটকে পড়ি সেই জন্যে ওদের যেখানে খুশি যাবার অনুমতিপত্রও দেওয়া আছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আজ পর্যন্ত একটা নিগ্রো চাকরও কখনো খারাপ কিছু করে নি … এমন কী সবচেয়ে তেজি ঘোড়া আর পাঁচ শো ডলারেরও বেশি টাকা সঙ্গে নিয়ে ঠিক ঘরে ফিরে এসেছে। আমি জানি ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে ওরা খুব ভালো, আর কুকুরের মতো ব্যবহার করলে ওরা আপনার সঙ্গে ঠিক সেই রকমই ব্যবহার করবে।’

‘নিশ্চয়ই’, উইলসন বললেন, ‘বিজ্ঞাপনের ওই জর্জ হ্যারিস ছেলেটিকে আমি খুব ভালো করেই জানি। অবশ্য যাকে আমি চিনি সেই ছেলেটিই যদি এ হয় তাহলে বলব—ছেলেটি শুধু বুদ্ধিমান নয়, প্রতিভাবানও বটে। ছেলেটি প্রায় ছয় বছর আমার চট তৈরির কারখানায় কাজ করেছে। যেমন সুন্দর তার ব্যবহার, তেমনি কর্মী হিসেবে ছিল অসাধারণ দক্ষ। নিজে মাথা খাটিয়ে শন পরিষ্কার করার ভারি চমৎকার একটা যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিল। ওর আবিষ্কার করা যন্ত্রটা আজকাল অনেক কারখানাই ব্যবহার করছে। কিন্তু ওর মনিব, যে এই বিজ্ঞাপনটা দিয়েছে, লোকটা একটা হাড়-বজ্জাত। তার একজন নিগ্রো ক্রীতদাস বুদ্ধিতে তাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা তার কিছুতেই সহ্য হলো না। আমার অনেক উপরোধ অনুরোধ, কাকুতি-মিনতি, এমন কি বেতন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও লোকটা জর্জকে কারখানা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আগাছা নিড়ানির কাজে লাগিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, কারণে অকারণে তাকে নিষ্ঠুরের মতো মারধরও করত …’

‘নিশ্চয়ই’, নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পশুপালক বলল, ‘না হলে কাঁধে-পিঠের ক্ষতচিহ্ন আসবে কোত্থেকে।’

‘লোকটা যদি অসম্ভব নীচ না হতো, জর্জকে ভাড়া খাটিয়েই ও অনেক পয়সা রোজগার করতে পারত।’

‘ইস্ ও-রকম একটা প্রতিভাবান ছেলে পেলে আমি তাকে মাথায় করে রাখতাম।’ পশুপালকের কণ্ঠস্বরে আফশোসের সুর ফুটে উঠল। ‘আসলে কি জানেন, নিগ্রোরাও যে মানুষ এই কথাটা অনেকে বুঝতে চায় না।’

ভেতরে যখন এই ধরনের আলাপ আলোচনা চলছে, সরাইখানার বাইরে তখন ঘোড়ায় টানা একটা এক্কা এসে থামল। এক্কার নিগ্রো চালককে সঙ্গে নিয়ে একজন তরুণ ভেতরে প্রবেশ করতেই সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল তার ওপর।

আগন্তুক অত্যন্ত দীর্ঘকায়, রীতিমতো সুপুরুষ চেহারা, গায়ের রঙ অনেকটা স্প্যানিয়ার্ডনের মতো। মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো ঘন কালো চুল, অত্যন্ত উজ্জ্বল ধরনের আশ্চর্য সজীব, কুচকুচে কালো দুটো চোখ, তীক্ষ্ণ নাক, সুসংবদ্ধ পাতলা ঠোঁট। সুন্দর পরিপাটি পোশাকের মধ্যেও একটা রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে উপস্থিত সকলেরই মনে ধারণা হলো—লোকটা অনন্যসাধারণ।

অনায়াস ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে এসে আগন্তুক মাথা থেকে টুপি খুলে সবাইকে অভিবাদন জানাল, নিগ্রো পরিচারককে ইঙ্গিতে ট্রাঙ্কটা মেঝেতে নামিয়ে রাখার কথা বলে সে সোজা সরাইওয়ালার কাছে গিয়ে নিজের নাম বলল–হেনরি বাটলার, ওক্‌ল্যান্ডস্, শেলবি কাউন্টি। তারপর অনেকটা নির্লিপ্তের ভঙ্গিতেই বিজ্ঞাপনটার কাছে গিয়ে পড়তে লাগল।

পড়া শেষ হতে না হতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিগ্রো ভৃত্যটিকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা জিম, তোমার কি মনে হয় না আমরা বার্নানে ঠিক এইরকম একটা লোককে দেখেছি?’

‘হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু তার হাতটা …’

‘না সেটা দেখি নি বটে, তবে বলা যায় না, হয়তো সেও হতে পারে।’ অলস ভঙ্গিতে দীর্ঘ একটা হাই তুলে হেনরি বাটলার সরাইওয়ালার কাছে গিয়ে তাকে আলাদা একটা ঘর দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করল। ‘আমাকে এখুনি কয়েকটা জরুরি চিঠি লেখার কাজ শেষ করতে হবে।’

সরাইওয়ালা তখুনি তার অনুরোধ রাখার জন্যে কয়েকজন নিগ্রো ভৃত্যকে ওপরতলায় পাঠালেন ঘরটা সাজিয়ে গুছিয়ে আগুন জ্বেলে ঠিকঠাক করে দেয়ার জন্যে।

হেনরি বাটলার ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে পাশের লোকটির সঙ্গে গল্প করতে লাগল।

আগন্তুক সরাইখানায় প্রবেশ করার পর থেকেই কারখানার মালিক, মিস্টার উইলসন কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর কৌতূহল অনুভব করছিলেন। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল—হেনরি বাটলার নামক এই আগন্তুকটিকে তিনি যেন কোথায় দেখেছেন, কিন্তু কোথায় দেখেছেন সেটাই স্পষ্ট মনে করতে পারছেন না। মনের অনেক গভীরে খুঁজেও তিনি কূল-কিনারা করতে পারলেন না হেনরি বাটলারের সঙ্গে তাঁর কোথায় পরিচয় হয়েছিল। অথচ আগন্তুক যখনই কোনো কথা বলছে, বৃদ্ধ চমকে তার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। আর যখনই তার শান্ত স্থির কালো চোখের দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে, উনি চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অবশেষে হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতেই উনি এমন পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকালেন যে আগন্তুক মনে মনে শঙ্কিত না হয়ে উঠে পারল না। তাই তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে সে বৃদ্ধের কাছে উঠে এল।

চিনতে পারার ভঙ্গিতে হাতটা বাড়িয়ে সে বলল, ‘আশা করি আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার উইলসন? ক্ষমা করবেন, প্রথমে আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারি নি। মনে হচ্ছে আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। আমি শেলবি কাউন্টির হেনরি বাটলার।’

‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ …নিশ্চয়ই!’ স্বপ্নাবিষ্ট মানুষের মতোই মিস্টার উইলসন কথাগুলো বললেন।

এমন সময় একটি নিগ্রো চাকর এসে খবর দিল ঘরটা সাজানো হয়ে গেছে।

‘জিম, ট্রাঙ্কটা ওপরে নিয়ে যাও, আমি আসছি।’ তারপর বৃদ্ধের দিকে ফিরে আগন্তুক বলল, ‘মিস্টার উইলসন, যদি কিছু মনে না করেন, অনুগ্রহ করে কি একবার আমার ঘরে আসবেন? আপনার সঙ্গে জরুরি দু-একটা কথা আছে।’

কোনো জবাব না দিয়ে মিস্টার উইলসন এমনভাবে আগন্তুককে অনুসরণ করতে লাগলেন যেন ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলা কোনো মানুষ। বারান্দা দিয়ে ওরা বেশ বড় একটা ঘরে প্রবেশ করল। কেবল জ্বালা আগুনে ঘরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে। তরুণ সন্তর্পণে দরজায় চাবি দিয়ে চাবিটা নিজের পকেটে রেখে দিল, তারপর বুকের ওপর হাত দুটো জড়ো করে রেখে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে সোজা তাকাল বৃদ্ধের মুখের দিকে। স্তব্ধ বিস্ময়ে উইলসন বলে উঠলেন, ‘জর্জ তুমি!’

‘সত্যি, আমি ভাবতেও পারি নি!’

‘ছদ্মবেশে আমি আত্মগোপন করেছি। বাদাম গাছের ছাল দিয়ে গায়ের রঙ হলুদ করেছি, কলপ দিয়ে কালো করেছি চুলের রঙ। ফলে বিজ্ঞাপনে দেওয়া চেহারার বর্ণনার সঙ্গে আমার তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘ও, জর্জ! তবু আমি বলব তুমি ভয়ঙ্কর বিপদের ঝুঁকি নিয়ে খেলা করছ। আমি তোমাকে কখনই এ ধরনের কাজ করার পরামর্শ দিতে পারি না।’

‘আমি নিজের দায়িত্বেই এ বিপদের ঝুঁকি নিয়েছি, মিস্টার উইলসন।’ এবার জর্জের ঠোঁটের সেই ম্লান হাসিটা কেমন যেন প্রচ্ছন্ন একটা বিদ্রূপে পরিণত হলো।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, জর্জের বাবা একজন শ্বেতাঙ্গ, মা হতভাগ্য নিগ্রো ক্রীতদাসী, অসামান্য রূপের জন্যে যাকে কামনার শিকার হতে হয়েছিল। মায়ের তরফ থেকে জর্জ কেবল হালকা একটু বাদামি রঙ আর উজ্জ্বল একজোড়া কালো চোখ পেয়েছিল, বাকি সবটুকুই সে পেয়েছিল অজ্ঞাত পরিচয় তার বাবার কাছ থেকে। তাই একজন শ্বেতাঙ্গের ছদ্মবেশে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে জর্জ প্রয়াসী হয়েছিল। কিন্তু জর্জের এই দুঃসাহসিকতায় ধর্মভীরু আর আইন-শৃঙ্খলা মেনে-চলা বৃদ্ধটি যে মনে মনে বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন, সেটা তাঁর অস্থির ভঙ্গি দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল।

‘জর্জ, সত্যিই আমি দুঃখিত, তবু না বলে পারছি না, নিজের দেশের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে তোমার এভাবে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।’

‘নিজের দেশ!’ জর্জ হ্যারিস হেসে উঠল।

‘কবরখানা ছাড়া আমাদের আবার নিজেদের দেশ কোথায়, স্যার? ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি উনি যেন সেইখানেই আমাকে স্থান দেন!’

‘না না, এভাবে বলো না, জর্জ। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করা।’

‘আমি জানি, মিস্টার উইলসন। তবু না বলে পারছি না, যদি ঈশ্বরের সঙ্গে কখনো দেখা হতো, আমি তাকে জিজ্ঞেস করতাম, মুক্তি চাওয়াটা কি অপরাধ? স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে আমি কি কোনো অন্যায় করেছি?’

‘আমি তোমার মনোভাব বুঝতে পারছি, জর্জ। আমি জানি তোমার মনিব মিস্টার হ্যারিস, তোমার সঙ্গে খুবই নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করেছেন। তবু একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমি কিছুতেই তোমারই পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে সমর্থন করতে পারছি না।’

চওড়া বুকের ওপর হাত রেখে জর্জ একই ভঙ্গিতে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন শুধু বিদ্রূপের হাসিতে ঠোঁট দুটো একটু বেঁকে উঠল।

‘আচ্ছা মিস্টার উইলসন, যদি কখনো এমন হতো, একদল রেড ইন্ডিয়ান এসে হঠাৎ আপনাকে জোর করে ধরে নিয়ে অনেক দূরে নির্জন কোনো একটা জায়গায় সারা জীবনের মতো বন্দি করে রাখল, তখন আপনি কী করবেন? পালাবার কি কোনোরকম চেষ্টা করবেন না? ধরুন দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর হঠাৎ দলছুট কোনো ঘোড়া কিংবা অপ্রত্যাশিত একটা সুযোগ এসে গেল আপনার হাতের সামনে, তখনো কি চুপ করে বসে থাকবেন? পালাবার কোনোরকম চেষ্টাই করবেন না?’

সেই মুহূর্তে মিস্টার উইলসন কোনো জবাব দিতে পারলেন না, আনমনে হাতের ছাতাটা নিয়ে বারবার নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। তারপর একসময় মৃদুভাষে বললেন, ‘জর্জ, তুমি তো জানো, আমি তোমাকে বরাবরই বন্ধুর মতো ভালোবাসতাম এবং যা কিছু বলতে চেয়েছি সব তোমারই ভালোর জন্যে। এখন আমার মনে হচ্ছে তুমি সত্যিই ভয়ঙ্কর এক বিপদের ঝুঁকি নিয়েছ। ওরা নিশ্চয়ই এত সহজে তোমাকে নিষ্কৃতি দেবে না, যেভাবেই হোক ধরার চেষ্টা করবে। আর একবার যদি ধরতে পারে, তোমার কপালে ভোগান্তির শেষ থাকবে না। মারতে মারতে একেবারে আধমরা করে নদীর ওপারে বিক্রি করে দেবে।’

‘মিস্টার উইলসন, আমি সব জানি’, দৃঢ় স্বরে জর্জ বলল, ‘আর সব জেনেশুনেই আমি এই বিপদের ঝুঁকি ঘাড়ে নিয়েছি। কিন্তু এখন আমি সব কিছুর জন্যে প্রস্তুত হয়েই আছি। এই দেখুন!’ ওভারকোটের বোতাম খুলে জর্জ দুটো পিস্তল আর বেশ বড় একটা ভাঁজ-করা ছুরি দেখাল। জীবিত অবস্থায় ধরে নিয়ে গিয়ে ওরা আমাকে কোনোদিনই দক্ষিণদেশে বিক্রি করে দিতে পারবে না। আর যদি তেমন কোনো ঘটনা কখনো ঘটে, ছ-ফুটের মতো জমির ব্যবস্থা আমি তার আগেই করে নিতে পারব, কেন্টাকিতে আর কোনোদিনও ফিরে আসব না।’

‘এসব বড় ভয়ঙ্কর কথা জর্জ! নিজের হাতে তোমার দেশের আইন ভাঙতে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না।’

‘আবার বলছেন আমার দেশ। আপনার দেশ আছে মিস্টার উইলসন, কিন্তু আমার মতো যে ক্রীতদাসী মায়ের গর্ভে জন্মেছে তার আবার দেশ কোথায়? আর যে দেশের আইন আমরা তৈরি করি নি, তার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র সমর্থন নেই, আমাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ আইন শুধু আমাদের ধ্বংস করার জন্যে, আমাদের দমিয়ে রাখার জন্যে।’ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে জর্জ মিস্টার উইলসনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল।

‘আশা করি আপনি নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন, এর আগে আমি কখনো আপনার…’

‘তারপর?’

‘বুড়ো মনিবের সঙ্গে মিস্টার হ্যারিসের যোগাযোগ ছিল। উনিই আমার বড়বোনকে কিনেছিলেন। হঠাৎ কেন জানি পছন্দ হয়ে যাওয়ায় মিস্টার হ্যারিস আমাকে আবার বুড়ো মনিবের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন। মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। অন্তত একজন বন্ধুকে আমার কাছে পাব, যার সঙ্গে দুটো মনের কথা কইতে পারব। রূপে গুণে বড় আপা ছিল ঠিক আমার মায়ের মতো। খুব ভালো লিখতে-পড়তেও পারত। প্রথম প্রথম আমি কিছু বুঝতে পারি নি, কিন্তু পরে একদিন আবিষ্কার করলাম দরজা বন্ধ করে মিস্টার হ্যারিস প্রায়ই আমার বড় আপাকে চাবুক মারতেন। চাবুকের প্রতিটা শব্দ ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার মতো এসে বিধত আমার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে। আমি নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম, কিন্তু কোনো সাহায্যই করতে পারতাম না। এবার আপনি বলতে পারেন, কেন, কেন ওকে অকারণে অমনভাবে চাবুক মারা হতো? মিস্টার হ্যারিস ওর কাছ থেকে যা চাইতেন, ও তা দিতে রাজি হতো না। ও যেকোনো মানুষের মতো অত্যন্ত সাধারণভাবেই বাঁচতে চাইত। কিন্তু আপনাদের দেশে ক্রীতদাসী মেয়ের বাঁচার জন্যে কোনো আইন নেই। বাগে আনতে না পেরে অবশেষে একদিন দেখলাম দাসব্যবসায়ীদের অন্যান্য ক্রীতদাসদের সঙ্গে আমার বড় আপাকেও শেকলে বেঁধে অর্লিয়েন্সের হাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্যে। সেই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা! বাবা নেই, মা নেই, ভাই নেই, বোন নেই, আশেপাশে এমন একটাও মানুষ নেই যে আমাকে কুকুরের চাইতে একটু বেশি ভালো মনে করবে। ছোটবেলায় সারারাত জেগে আমি একা-একা কাঁদতাম। খিদে বা চাবুকের জন্যে নয়, কাঁদতাম আমার মার জন্যে, আমার বড় আপার জন্যে। এ পৃথিবীতে এমন একটা লোক ছিল না যে আমাকে একটু ভালোবাসবে। আপনার কারখানায় আসার আগে পর্যন্ত কেউ আমার সঙ্গে একটু ভালো করে কথাও বলে নি। সেই তুলনায় আপনার কারখানাতেই আমার জীবনের সবচাইতে সুখের দিনগুলো কেটেছে। আপনিই প্রথম আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করেছেন, আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আপনার চেষ্টাতেই লেখাপড়া শিখেছি। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন এর জন্যে আমি আপনার কাছে কত কৃতজ্ঞ! আপনার ওখানে না থাকলে আমি কোনোদিনই এলিজাকে খুঁজে পেতাম না। আপনি তো আমার স্ত্রীকে দেখেছেন। ও যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি মিষ্টি ওর স্বভাব। ওর ভালোবাসা পেয়েই আমি প্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম আমি একজন মানুষ এবং এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু আমার সুখ মনিবের সহ্য হলো না। উনি আমাকে বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন আর যা যা ভালোবাসতাম সবকিছু থেকে সরিয়ে নিয়ে এলেন। কিন্তু কেন? সে শুধু নোংরা আর কদর্যতার মধ্যে আমাকে পিষে ফেলার জন্যে, আমাকে শেখানোর জন্যে যে আমি একজন নিগ্রো ক্রীতদাস ছাড়া আর কিছুই নই।’

জর্জ এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। ততক্ষণে চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে তা চাপা ক্রোধে ঝিকমিক করছে। মাঝে মাঝে আপনা থেকেই শক্ত হয়ে উঠছে হাতের মুঠো। উদ্দীপ্ত আবেগে সে আবার বলে চলল, ‘তা সত্ত্বেও আমি সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু এলিজাকে ত্যাগ করে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে থাকার জন্যে উনি এমন পীড়াপীড়ি শুরু করলেন যে ব্যাপারটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। ঈশ্বর বা মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাদের দেশের আইনই ওঁকে এই অন্যায় আচরণ করার প্রেরণা যুগিয়েছে। আপনাদের দেশের আইনই আমার মা, বোন, স্ত্রী, এমন কী আমার নিজের হৃদয়কেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আপনাদের দেশের আইনই মানুষকে এমন শক্তিশালী করে তুলেছে যে কেন্টাকির একটা লোকও ওর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পায় নি। এই আইনকে আপনি বলেন আমাদের দেশের আইন? না স্যার, আমার যেমন বাবা নেই, তেমনি আমার কোনো দেশও নেই। তাই আমি চলেছি অন্য একটা দেশের খোঁজে। শুধু শান্তিতে চলে যাওয়া ছাড়া আমি আপনাদের দেশের কাছ থেকে আর কিছুই চাই না। কানাডায় যদি একবার পৌঁছতে পারি, সে দেশের আইন আমাকে আশ্রয় দেবে, আর তাকেই আমার দেশের আইন বলে মেনে নেব। কিন্তু কেউ যদি আমার স্বাধীনতা অর্জনের পথে বাধা দিতে আসে, আমি ছেড়ে কথা কইব না, কেননা এখন আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। মুক্তির জন্যে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্তও যুদ্ধ করতে রাজি আছি। আপনাদের পূর্বপুরুষরা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন। সেটা যদি তাঁদের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত হয়ে থাকে, তাহলে আমার পক্ষেই বা এটা অন্যায় হবে কেন?’

‘ঠিক আছে জর্জ, আর তোমার পথে বাধা সৃষ্টি করতে চাই না।’ হলদে রেশমি একটা রুমালে মুখ মুছতে মুছতে মিস্টার উইলসন উত্তেজিত স্বরে বললেন। ‘শুধু বৃদ্ধ মানুষ হিসেবে তোমাকে একটা অনুরোধ করব, খুব সাবধানে থেকো আর অকারণে খুনখারাপি করো না। তুমি তো জানো, কারুর গায়ে হাত দেওয়াটা আমি একদম পছন্দ করি না।’

‘আপনার অনুরোধ আমি চিরকাল স্মরণ রাখব, মিস্টার উইলসন।’

‘তোমার স্ত্রী কোথায়?’

‘বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। এ পৃথিবীতে ওর সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে কিনা তাও জানি না!’

‘আশ্চর্য, এও কী সম্ভব! ও রকম দয়ালু একটা পরিবারের আশ্রয় ছেড়ে …‘

‘দয়ালু পরিবারও ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে এবং আপনাদের দেশের আইনই মার বুক থেকে দুধের শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে মনিবের ঋণ পরিশোধ করার জন্যে বিক্রির অনুমতি দেয়।

‘সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে … কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না …’

কথা বলতে বলতেই পকেট হাতড়ে বৃদ্ধ এক তোড়া নোট বার করে জর্জের দিকে এগিয়ে দিলেন, ‘এগুলো তুমি রেখে দাও।’

‘না স্যার, আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন, সে-জন্যে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনার টাকা আমি নিতে পারব না। তাছাড়া এর জন্যে হয়তো আপনি বিপদেও পড়তে পারেন। আমার কাছে যা টাকা আছে, মনে হয় চালিয়ে নিতে পারব।’

‘না জর্জ, এ টাকা তোমারই বরং। আমিই তোমাকে ঠিক দেওয়ার সুযোগ করে উঠতে পারি নি। সুতরাং তুমি আর না করো না, বাবা।’

জর্জ এবার আর সত্যিই ‘না’ করতে ভরসা পেল না। হাত বাড়িয়ে নোটগুলো মিস্টার উইলসনের কাছ থেকে নিয়ে সে পকেটে রেখে দিল।

‘এ ভাবে তুমি কদ্দূর যাবে ঠিক বুঝতে পারছি না! তোমার সঙ্গে ওই ছেলেটি কেন?’

‘আমার বন্ধু। ছেলেটি সত্যিই খুব খাঁটি। বছরখানেক আগে ও কানাডায় পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ও শুনতে পায় ওর মনিব ওর ওপর এত ক্রুদ্ধ হয়েছে যে ওর বুড়ো মাকে নির্মমভাবে চাবুক মেরেছে। সেখান থেকে ও ছুটে এসেছে মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে। সুযোগ পেলে মাকে নিয়েই পালিয়ে যাবে।’

‘মার সঙ্গে কি ওর দেখা হয়েছে?’

‘না, এখনো হয় নি। তবে সুযোগ খুঁজছে। আমার সঙ্গে ওহিও পর্যন্ত গিয়ে যেসব বন্ধুরা আমাকে সাহায্য করবে তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে ও আবার ফিরে আসবে।’

‘সত্যিই তোমরা ভয়ঙ্কর একটা আগুন নিয়ে খেলছ!’

জর্জের চাপা ঠোঁটে ফুটে উঠল বিদ্রূপের তীক্ষ্ণ হাসি।

স্তব্ধ বিস্ময়ে মিস্টার উইলসন ওর সর্বাঙ্গ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন।

‘তোমার এখন চেনাই যায় না, জর্জ। মনে হয় তুমি যেন অন্য কোনো মানুষ।’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই, মিস্টার উইলসন। আগে ছিলাম ক্রীতদাস, এখন আমি স্বাধীন।’

‘বলা যায় না জর্জ; তুমি যেকোনো মুহূর্তে ধরা পড়তে পার।’

‘যদি তাই ঘটে, জানবেন করবে সব মানুষই সমান আর স্বাধীন, মিস্টার উইলসন।’

‘তোমার সাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি জর্জ! কিন্তু তুমি ঠিক এই সরাইখানাতে এসে উঠলে কেন?’

‘সরাইখানাটা এত কাছে যে ওরা কোনোরকম সন্দেহই করবে না। ওরা আমাকে সাধারণত দূরের পথে বা সরাইখানাগুলোতে খুঁজবে। ওই জিমের মনিব এখানে থাকে না। কাজেই কেউ ওকে চিনতে পারবে না। ওর আশা সবাই প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। তার ওপর ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে আমার চেহারারও কোনো মিল নেই।’

‘কিন্তু তোমার হাতের দাগটা?’

দস্তানা খুলে জর্জ প্রায় শুকিয়ে-আসা একটা গভীর ক্ষত চিহ্ন দেখাল।

‘দিন পনেরো আগে মিস্টার হ্যারিস এটা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ওর একটা বদ্ধ ধারণা হয়েছিল আমি একদিন নিশ্চয় পালাব।’ মুচকি হেসে দস্তানাটা আবার পরতে পরতে জর্জ বলল ‘ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে, তাই না মিস্টার উইলসন?’

‘ঠাট্টা রাখ, বাবা। সব দেখে শুনে এমনিতেই আমার বুকের রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে।’

‘এত বছর আমার বুকের রক্তও জমাট বেঁধে ছিল, এখন টগবগ করে ফুটছে।’ একটু নীরবতার পর জর্জ আবার বলল, ‘কাল সকালে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাব। আশা করছি সন্ধ্যে নাগাদ ওহিওতে পৌঁছে যাব। পলাতক নিগ্রোরা সাধারণত যা করে, এ ক্ষেত্রে আমি কখনই তা করব না। আমি দিনের বেলাতেই পথ চলব, রাত্তিরে আশ্রয় নেব সবচাইতে নামী কোনো সরাইখানায়। সুতরাং, বিদায়, মিস্টার উইলসন। আর কোনোদিন আপনার সঙ্গে দেখা হবে কিনা জানি না। যদি কখনো জানেন আমি ধরা পড়েছি, তাহলে জানবেন আমি মারাও গেছি।

খাড়া পাহাড়ের মতো একেবারে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে জর্জ হাতটা বাড়িয়ে দিল। মিস্টার উইলসন আন্তরিক ভঙ্গিতে করমর্দন করলেন, তারপর খুব সর্তকে থাকার জন্যে অনুরোধ করে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

বিষণ্ন মনে জর্জ বৃদ্ধের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ তার একটা কথা মনে হতেই সে বলল, ‘শুধু আর একটা কথা, মিস্টার উইলসন।’

‘কী, বলো?’

‘আপনি আমার সঙ্গে প্রকৃত খ্রিস্টানের মতোই ব্যবহার করেছেন। আমি শুধু আপনার কাছে ছোট্ট একটা অনুগ্রহ ভিক্ষা চাইব, মিস্টার উইলসন।’

নতমুখে একটু নীরব থাকার পর জর্জ ধীরে ধীরে বলতে লাগল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি ভয়ঙ্কর একটা বিপদের ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে চলেছি। যদি মরিও এ পৃথিবীতে আমার জন্যে কাঁদার আর কেউ থাকবে না। খুন করে ওরা যদি আমাকে কুকুরের মতো মাটির নিচে পুঁতে রাখে, আমার হতভাগ্য স্ত্রী ছাড়া আর সবাই আমার কথা ভুলে যাবে। কেবল ওকেই সারাজীবন বিলাপ করে কাটাতে হবে। অনুগ্রহ করে এই পিনটা যদি ওকে পাঠিয়ে দিতে পারেন খুব ভালো হয়। বড়দিনে ও এটা আমাকে উপহার দিয়েছিল। বলবেন জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম। আপনি কি অনুগ্রহ করে এই উপকারটা করবেন?’

‘নিশ্চয়ই … নিশ্চয়ই দেব, বাবা!’ কাঁপা কাঁপা গলায় বৃদ্ধ বললেন, কান্নায় তখন রুদ্ধ হয়ে এসেছে তাঁর কণ্ঠস্বর। তিনি হাত বাড়িয়ে পিনটা নিলেন।

‘ওকে আমার শেষ ইচ্ছেটা জানাবেন, বলবেন যদি ও পারে, যেন কানাডায় চলে যায়। ওর মনিবানি যত ভালো হোক, আর ওকে যতই ভালোবাসুক না কেন, দাসত্বের পরিণতি দুঃখ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। ওকে বলবেন আমাদের ছেলেটা স্বাধীন, তাকে যেন স্বাধীন কোনো মানুষেরই মতো গড়ে তোলে, যাতে আগামী দিনে আমার মতো তাকে কষ্ট পেতে না হয়। এই কথাটা কি ওকে অনুগ্রহ করে বলবেন, মিস্টার উইলসন?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ … বলব, বাবা … অবশ্যই বলব! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি নিশ্চয়ই জীবিত থাকবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের মতো দুঃসাহসী ছেলেদের ঈশ্বর নিশ্চই সাহায্য করবেন। ‘

‘ঈশ্বর আছেন কিনা আমি জানি না’, হতাশার সঙ্গে ম্লান বেদনা মেশা এমন অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে জর্জ কথাগুলো বলল যে বৃদ্ধ অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘সারা জীবন চলার পথে এত অন্যায়-অবিচার দেখেছি যে ঈশ্বর আছেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না। আপনি খ্রিস্টান, তাই আমার মনোভাব আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না …,

‘না না, জর্জ, দোহাই তোমার, ও কথা বলো না!’ মিস্টার উইলসন যেন আঁতকে উঠলেন। ‘আমি বলছি, তুমি বিশ্বাস করো ঈশ্বর আছেন।’

‘হয়তো আছেন, আছেন আপনাদের জন্যে। কিন্তু আমাদের জন্যে কি সত্যিকারের কোনো ঈশ্বর আছেন?’

‘ঈশ্বর একটাই, বাবা। আলো আর অন্ধকার জড়ানো মেঘের মধ্যে ন্যায়ের সিংহাসনের ওপর তিনি প্রতিষ্ঠিত। তাঁকে তুমি ভুলো না, তাঁর ওপর বিশ্বাস রেখো, তিনি তোমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করবেন। আমি বলছি, দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

প্রচ্ছন্ন একটা তিক্ততা সত্ত্বেও ধর্মভীরু সরল মানুষটার নিষ্করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে জর্জ রূঢ় কিছু বলতে সাহস পেল না, তাই শান্তস্বরে শুধু ছোট্টো করে বলল, ‘ধন্যবাদ, মিস্টার উইলসন। আপনার কথাটা আমি অবশ্যই ভেবে দেখব।’

১১. নিলাম

তীব্রবেগে গাড়িটা ছুটে চলেছে। হ্যালি আর টম, সিটের দুদিকে দুজন বসে যে যার নিজের চিন্তায় ডুবে রয়েছে। একই গাড়ি, একই আসন, দুজনের একই চোখ, কান হাত, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, একই দৃশ্য ওদের দুজনের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছে। অথচ দুজনের মানসিক চিন্তাধারা কী আশ্চর্য রকমেরই না ভিন্ন!

হ্যালি ভাবছে লম্বা-চওড়ায় টমের দেহখানা, যত বড়, এখনই তাকে বাজারে বিক্রি করা উচিত, না খাইয়ে-পরিয়ে আর একটু মোটা করে বাজারে নিয়ে যাওয়া উচিত? ছেলে- মেয়ে বুড়ো ক্রীতদাসের সংখ্যা আপাতত কম থাকায় হাটে এখন ওদের চাহিদা খুব। ঠিক দামে টমকে বিক্রি করতে পারলে সেই দামে সে দু-তিনটে ক্রীতদাস কিনতে পারবে। তাছাড়া মানুষ হিসেব সে যে কত বড়, আজ সবাই তা দেখবে! অন্য ব্যবসায়ীরা যখন তাদের ক্রীতদাসদের শেকলে বেঁধে নিয়ে যায়, আমি তখন টমের পায়ে শুধু বেড়ি আর হাতে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি! যদিও এখনো পর্যন্ত বেচারা কিছু করে নি, তবু নিগ্রো জাতটাকে বিশ্বাস করা সত্যিই খুব কঠিন। আর ঠিক সেই জন্যেই আমার মানবতা, আমার সাহসকে ওরা বাহবা না দিয়ে পারবে না!

আর টম ভাবছে তার জরাজীর্ণ পুরনো বাইবেল থেকে পড়া যিশুর বাণীগুলো, যে বাণীর আলোকে সে তার হতোদ্যম বিষণ্ণ আত্মাটাকে হৃদয়ের অতল অন্ধকার থেকে টেনে তুলতে পারবে।

একসময়ে হ্যালি পকেট থেকে কয়েকটা খবরের কাগজ বার করে বিজ্ঞাপনগুলো গভীর মনোযোগরে সঙ্গে পড়তে লাগল। হ্যালি লেখাপড়া বেশি জানত না তাই সাবলীল ভঙ্গিতে সে পড়তে পারছিল না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে বানান করে করে পড়তে হচ্ছিল। বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করল এই বিজ্ঞাপনটি :

নিগ্রো ক্রীতদাস বিক্রয় আদালতের নির্দেশক্রমে রুচারফোর্ড স্টেটের সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় করিয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ পাওনাদার ও উত্তরাধিকারদের প্রদান করা হইবে। সেই হেতু ২০ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, কেন্টাকির ওয়াশিংটন শহরে, আদালত-প্রাঙ্গণের সম্মুখে যে সমস্ত নিগ্রো ক্রীতদাসদের নিলামে বিক্রয় করা হইবে, তাহাদের নাম ও বয়স : হ্যাগার ৬০, জন ৩০, বেন ২১, সাউল ২৫, অ্যালবার্ট ১৪।

কাৰ্যনিৰ্বাহক
স্যামুয়েল মরিস
টমাস ফ্লিন্ট

বিজ্ঞাপনটা দুয়েকবার পড়ার পর, হাতের কাছে কথা বলার আর কাউকে না পেয়ে হ্যালি টমকে বলল, ‘আমাকে এই নিলামটা একবার দেখে আসতে হবে। দামে পোষালে কিনব। তোরও তখন দু-চার জন সঙ্গী হয়ে যাবে। আমরা এখান থেকে সোজা যাব ওয়াশিংটনে। সেখানে তোকে জেল-ফটকে আটকে রেখে আমি পরের দিন নিলামটা ঘুরে আসব।’

কোনো জবাব না দিয়ে টম নীরবে কথাগুলো শুনে গেল। তার মনে হলো সেদিন নিলামে আরো কত লোকের যে কপাল ভাঙবে সে শুধু ওরাই বলতে পারবে। স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বাবা-মা সন্তান ছেড়ে ওরা পাড়ি দেবে দূরের দেশে। তখন তার মতো ওরাও ঠিক এমনিভাবে বেদনায় মুষড়ে পড়বে। কোনো অন্যায় না করা সত্ত্বেও চোর বদমাইশ গুণ্ডা আর খুনীদের সঙ্গে ওদেরকেও আটকে রাখা হবে জেল-ফটকে।

সারাদিন চলার পর সন্ধ্যেবেলায় ওরা পৌছে গেল ওয়াশিংটন শহরে। টমের থাকার ব্যবস্থা হলো জেলখানায় আর অন্যজন গেল সরাইখানায়।

পরের দিন বেলা এগারোটার সময় আদালত প্রাঙ্গণের সামনে রীতিমতো ভিড় জমে উঠেছে। ক্রেতা, বিক্রেতা উভয় ধরনের লোকই ঘোরাফেরা করছে, চেঁচাচ্ছে আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন জীবন্ত পণ্যগুলোকে নিলামে তোলা হয়। যে-সব নিগ্রো ক্রীতদাসদের নিলাম তোলা হবে তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নারী পুরুষ সব একসঙ্গে বসে রয়েছে আর নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথা বলছে।

রুচারফোর্ড সম্পত্তির জন্যে যে নিগ্রোগুলোর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল, ওরা বসে রয়েছে ভিন্ন একটা দলে। আদালত প্রাঙ্গণে পৌছে হ্যালি বীরদর্পে সেই দলটার দিকে এগিয়ে গেল। প্ৰায় বৃদ্ধা হয়ে আসা, অথর্ব ক্রীতদাসী হ্যাগারের দিকে সে ফিরেও তাকাল না, কিন্তু ক্রীতদাসদের মধ্যে যার বয়স সবচেয়ে বেশি, সেই জনকে জোর করে দাঁড় করিয়ে মুখ ফাঁক করে তার দাঁত দেখল, পিঠ বাঁকিয়ে পিঠের হাড় শক্ত কিনা পরখ করল, বিভিন্ন জায়গায় মাংসপেশি টিপে টিপে পরীক্ষা করল। এমনিভাবে একের পর এক দলের সবকটা ক্রীতদাসকে সে যাচাই করল, সব চাইতে পছন্দ হলো চৌদ্দ বছর বয়সের অ্যালবার্টকে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সে যতই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, খুশিতে তার চোখ দুটো ততই ঝিকিয়ে উঠল

সম্ভবত হ্যালির মনোভাব বুঝতে পেরেছে বুড়ি হ্যাগার। সে বলল, ‘আমাকে ছাড়া ওকে বিক্রি করা হবে না, স্যার। ওরা বলেছে আমার ছেলে আর আমাকে একইসঙ্গে বিক্রি করা হবে। চোখে খুব একটা ভালো দেখতে না পেলেও আমি অনেক কাজ করতে পারি।’

ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে হ্যালি একটু দূরে, একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। মুখে চুরুট, হাত দুটো পকেটে ঢোকানো, মাথার টুপিটা হেলানা রয়েছে একপাশে।

ওদের দেখে কেমন মনে হলো, স্যার?’ পাশের দাঁড়ান লোকটি হ্যালিকে জিজ্ঞেস করল। এমনভাবে ও কথাটা বলল, যেন হ্যালির মতামতের ওপর ওর অনেক কিছু নির্ভর করছে।

‘বেশ ভালোই।’ উপেক্ষার ভঙ্গিতে হ্যালি হালকা করে জবাব দিল, ‘তবে আমি শুধু ওই ছেলেটার ওপরেই আগ্রহী।’

‘বুড়ির সঙ্গে ছাড়া ওরা নাকি ছেলেটাকে বিক্রি করবে না।’

‘আরে রাখেন সাহেব, কে ওই হতচ্ছাড়া বুড়িটাকে কিনতে যাবে?’

‘তাহলে আপনি ওই বুড়িটাকে কিনছেন না?’

‘পাগল হয়েছেন আপনি! আমি কি এতই বোকা যে আধমরা বেতো বুড়িটাকে কিনতে যাব?’

এমন সময় ভিড়ের মাঝ থেকে একটা গুঞ্জন শোনা গেল, হাঁকনদারকে দেখা গেল ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে। ফাঁকা একটা জায়গায় টেবিল পেতে হাতুড়ি পিটিয়ে শুরু হয়ে গেল হাঁক-ডাক। খোলা বাজারের দাস-ব্যবসার চাইতে নিলামে কিছুটা সস্তাই মনে হলো। অপ্রত্যাশিত কম দামে হ্যালি দুটো নিগ্রো ক্রীতদাস পেয়ে গেল। এবার নিলামে চড়ানো হলো কিশোর অ্যালবার্টকে। বুড়ি হ্যাগার ছেলের হাতটা টেনে ধরে চিৎকার করতে লাগল, ‘আমাকেও ওর সঙ্গে নিলামে চড়ানো হোক মাস্টার… আমাদের দুজনকেই একসঙ্গে চড়ানো হোক …’

‘সর, সর এখান থেকে! তোরটা পরে ডাকা হবে।’

হাঁকনদার ঠেলে ওকে সামনে থেকে সরিয়ে দিল। বুড়ি পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু ওর মর্মভেদী আর্তনাদ তেমন কারুর কানেই পৌছল না। অ্যালবার্টের জন্যে দর আর উত্তেজনা তখন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে, ছ’জন ডাক দিয়ে চলেছে সমানে। বড় বড় সজল চোখে অ্যালবার্ট স্পষ্ট করে কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই হ্যালি তাকে কিনে নিল।

বুড়ি তখন হ্যালির পায়ের ওপর আছড়ে পড়ল। ‘আমাকেও ওর সঙ্গে কিনে নিন স্যার … নইলে আমি সত্যিই মরে যাব!’

‘আমি কিনি বা না-কিনি, তুই এমনিতেই মরবি। যা, ভাগ এখান থেকে!’ হ্যালি লম্বা এক লাথি মারল।

বুড়ি চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করার আগেই তাকে নিলামে তোলা হলো এবং সেই লোকটা, যে একটু আগে হ্যালির সঙ্গে কথা বলছিল, বুড়ি হ্যাগারকে জলের দামে কিনে নিল।

মুহূর্তের জন্যে মাকে একবার দেখতে পেয়ে অ্যালবার্ট কান্নাভেজা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার জন্যে তুমি কিছু ভেবো না, মা! ওরা বলছিল তুমি নাকি খুব ভালো মনিবই পেয়েছ।

‘তাতে আমার কিছু এসে যায় না রে, সোনামণি। আমি আর তোকে কোনোদিনও দেখতে পাব না!’

‘তুমি কেঁদো না, মামণি, লক্ষ্মীটি!’

‘সোনা আমার, সোনা রে …’

বুড়ি হ্যাগারের বুকফাটা আর্তনাদ এবার সবারই কানে এসে বিঁধল। হ্যালি তাড়াতাড়ি হাতকড়া পরিয়ে, হাতকড়ার মধ্যে দিয়ে একটা শেকল গলিয়ে ক্রীতদাস তিনটেকে জেলখানার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।

.

এই ঘটনার কয়েকদিন পর তার পণ্যগুলোকে নিয়ে, হ্যালি ওহিরও একটা স্টিমারের গিয়ে উঠল। পথের মাঝে মাঝে হ্যালির কয়েকজন দালাল তার জন্যে আরো কিছু দাসদাসী কিনে রেখেছিল। ফেরিঘাট থেকে সেগুলোকেও স্টিমারে তোলা হলো। স্টিমারে হ্যালি ছাড়া আরো কয়েকজন দাসব্যবসায়ী ছিল। বলা বাহুল্য, অন্যান্য মালপত্রের সঙ্গে জীবন্ত পণ্যগুলো রইল নিচের ডেকে।

লা বেল রিভিয়ের, স্টিমারের নামটাই যে শুধু সুন্দর তাই নয়, দেখতেও বেশ সুন্দর। যেমন ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, তেমনি মজবুত। জল কেটে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। মাথার ওপর রোদ ঝলমলে নীলাকাশ, দুপাশে একটু পরপরই বদলে যাচ্ছে মনোরম সব দৃশ্যাবলি। মাস্তুলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা হাওয়ায় পত্ পত্ করে উড়ছে। ওপরের ডেকে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীরা মনের আনন্দে নদীর দুপারের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগব্যাথায় কাতর হ্যালির লোকজনেরা বিষণ্ন মুখে নিচের ডেকে বসে রয়েছে আর নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলছে।

মাঝে মাঝে হ্যালি এসে সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছে, ‘এই, ভদ্রলোকের মতো সব চুপচাপ বসে থাকবি। গোলমাল করেছিস কি মুশকিলে পড়বি।’

হ্যালি চলে যেতেই ওরা আবার সুখ-দুঃখের কথা পাড়ছে।

‘সত্যি, আমার এত খারাপ লাগছে’, শেকলবাঁধা হাতে টমের হাঁটু আঁকড়ে ধরে জন বলল, ‘আসার সময় স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো না। এ সবের ও বিন্দু-বিসর্গও জানে না। বেচারি নিশ্চয়ই খুব ভাববে!’

টম জিজ্ঞেস করল, ‘ও কোথায় থাকে?’

‘খুব কাছেই, একটা সরাইখানায় ঝিয়ের কাজ করে। জানি না ওর সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কি না!’

টম কোনো জবাব দিল না, শুধু তার বুকের অতল থেকে বেরিয়ে এল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস!

ওপরের ডেক থেকে ভেসে আসছে শ্বেতাঙ্গ বাবা-মা স্বামী-স্ত্রী ভাই-বোনদের মুখর কলহাস্য। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা রঙিন প্রজাপতির মতো চারপাশে ঘুরছে, বেড়াচ্ছে, খেলছে, হাসছে।

‘জানো মামণি, আমি এক্ষুনি দেখে এলাম’, নিচে থেকে উঠে আসা ফুটফুটে একটা ছোট ছেলে তার মাকে বলল, ‘এই স্টিমারেই একজন দাসব্যবসায়ী রয়েছে! সে অনেকগুলো ক্রীতদাস কিনেছে।’

‘ওমা, তাই নাকি!’ মা সত্যিই খুব অবাক হলেন।

‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ পাশের মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন।

‘নিচের ডেকে কয়েকজন ক্রীতদাস রয়েছে।’ মা বললেন।

ছেলেটি অমিত উৎসাহে বলে উঠল, ‘আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওদের প্রত্যেকের হাতে শেকল বাঁধা রয়েছে।’

‘সত্যি, আমাদের দেশে যে এখনো দাসপ্রথা রয়েছে, ভাবতেও লজ্জা করে!’ হাই তুলতে তুলতে পাশের মহিলাটি বললেন।

ছেলেটি আবার দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

জল কেটে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে লা বেল রিভিয়ের। ডেকের উপর পুরুষরা ঘুরছে, কেউবা কুর্সিতে গা এলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে, নয়তো ধূমপান করছে। মেয়েরা বুনছে, ছোটরা খেলছে।

পরের দিন কেন্টাকির ছোট শহরে স্টিমারটা কিছুক্ষণের জন্যে থামল। কী যেন একটা জরুরি কাজে হ্যালি নেমে গেল। একটু পরে সে যখন আবার ফিরে এল, তার সঙ্গে এল একটি কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। মহিলাটির পরনে বেশ সুন্দর ভদ্র পোশাক, কোলে ছোট্ট একটা শিশু। নিগ্রো চাকরটা মেয়েটির পেটরাটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে নেমে যেতেই, ইঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জনে কাঁপিয়ে বাঁশি বাজিয়ে স্টিামার ছেড়ে দিল।

নিচের ডেকে মালপত্তর আর বাকস পেঁটরার মধ্যে দিয়ে পথ করে মেয়েটি নিগ্রো দাসদাসীদের জায়গায় গিয়ে বসল, তারপর হঠাৎ কেঁদে ওঠা শিশুটিকে শান্ত ও পরিচর্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

একটু পরে হ্যালি এসে চাপা স্বরে মেয়েটিকে কী যেন বলতে লাগল। টম লক্ষ করল মেয়েটার মুখখানা মেঘের মতো ক্রমশই কালো হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

‘আমি আপনার একটা কথাও বিশ্বাস করি না।’ রাগতস্বরে মেয়েটি বলে উঠল ‘আপনি মিছেমিছি আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছেন।’

‘আমার কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তাহলে এটা দেখো।’ পকেট থেকে একখানা কাগজ বার করে হ্যালি মেয়েটাকে দেখাল। ‘তোমাকে যে বিক্রি করা হয়েছে এটা তার দলিল। এতে তোমার মনিব নিজে হাতে সই করেছেন এবং আমি তাকে গুণে গুণে নগদ টাকা দিয়েছি। সুতরাং আমি যে তোমাকে মিছেমিছি বোকা বানাবার চেষ্টা করছি না, এটা তারই প্রমাণ।

‘আমি বিশ্বাস করি না মনিব আমাকে ঠকাবেন’ রীতিমতো উত্তেজিত স্বরে মেয়েটি পুনরায় বলল, ‘সুতরাং এটা কখনো সত্যি হতে পারে না।’

‘বেশ, আমার কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তাহলে যেকোনো ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করো। উনিই তোমাকে বলে দেবেন এতে কী লেখা আছে। এই যে শুনুন, অনুগ্রহ করে একটু শুনবেন …’ অদূরে একজন শ্বেতাঙ্গকে দেখে হ্যালি ডাকল। যদি কিছু মনে না করেন, এতে কী লেখা আছে মেয়েটাকে একটু পড়ে শুনিয়ে দিন না। ও কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না।’

‘এ-তো দেখছি জন ফসডিকের সই করা একটা বিক্রয়-দলিল। উনি লুসি নামে একটি ঝি আর তার বাচ্চাটাকে মিস্টার হ্যালি নামে এক ভদ্রলোককে বিক্রি করে দিয়েছেন।’

হ্যালি সদর্পে ঘোষণা করল, ‘কী, এবার বিশ্বাস হলো তো?’

দুহাতে কান চেপে লুসি আর্তনাদ করে উঠল। ‘না না, এ সত্যি নয় কখনো সত্যি হতে পারে না। উনি নিজে মুখে বলেছেন আমাকে লুসিভিলে পাঠাচ্ছেন। ওখানে যে সরাইয়ে আমার স্বামী চাকরি করে, সেখানে আমাকে রাঁধুনির কাজে ভাড়া খাটাবার জন্যে পাঠাচ্ছেন। উনি যে মিথ্যে বলবেন আমি বিশ্বাস করি না।’

শান্ত স্বভাবের মিষ্টভাষী সেই ভদ্রলোক ধীরে ধীরে বললেন, ‘কিন্তু উনি যে তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছেন, সেটা সত্যি। অন্তত এই দলিলে তাই-ই লেখা আছে।’

‘ও দলিলের কোনো দাম নেই।’ দৃঢ়স্বরে কথাগুলো বলেই লুসি নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রইল।

স্টিমারটা তার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রথম গ্রীষ্মের ঝিরঝিরে মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। তার মন্দ মধুর পরশে দেহ-মন একেবারে জুড়িয়ে যায়। রৌদ্র-দীপ্ত বিচ্ছুরিত সোনালি তরঙ্গমালার দিকে লুসি অপলক তাকিয়ে রয়েছে। ওপরের ডেক থেকে আসছে শিশুদের মুখর কলহাস্য,, কিন্তু হৃদয়টাকে মনে হচ্ছে যেন একটা অনড় পাথরের মতো। বাচ্চাটা জেগে উঠে ওর কোলের মধ্যে খেলা করছে আর সত্যিই জেগে আছে কিনা তা পরখ করার জন্যে যেন কচি হাতে বারবার মার চিবুকে আঘাত করছে। এক সময়ে যেন হঠাৎ নির্ঝরের স্বপ্ন ভেঙে মা শিশুটিকে নিবিড় করে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরল। তখনই ওর মসৃণ চিবুক বেয়ে নেমে এল অশ্রুধারা। তারপর ধীরে ধীরে একসময়ে ওকে অনেকটা শান্ত মনে হলো।

লুসির বাচ্চাটা অসম্ভব ছটফটে, মাকে মুহূর্তের জন্যেও স্থির থাকতে দিচ্ছে না, সবসময়েই কোল থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।

তাই দেখে নিচের ডেকে তার ক্রীতদাস-দাসীদের তদারক করতে আসা অন্য একজন শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক বললেন, ‘বাঃ, ছেলেটি ভারি সুন্দর দেখতে তো! কত বয়স এর?’

লুসি ছোট্ট করে জবাব দিল, ‘সাড়ে দশ মাস।‘

ভদ্রলোক শিস দিতে দিতে পকেট থেকে একটা টফি বার করে বাচ্চাটার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন, বাচ্চাটা সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে ওটা নিয়েই মুখে পুরে দিল।

ভদ্রলোক গাল টিপে বাচ্চাটাকে আদর করলেন। ‘দারুণ বিচ্ছু তো! এরই মধ্যে সব বুঝে ফেলেছে।‘

পকেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে আপন মনে শিস দিতে দিতে ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন রেলিং-এর দিকে। সেখানে একটা প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে হ্যালি ধূমপান করছিল। ভদ্রলোক হ্যালির কাছ থেকে দেশলাইটা চেয়ে নিয়ে একটা চুরুট ধরালেন।

‘ধন্যবাদ।’ রেলিং-এ হেলান দিয়ে ভদ্যলোক হ্যালির দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। ‘আপনার সংগ্রহ তো বেশ ভালোই দেখছি।’

‘এর জন্যে কম দৌড়-ঝাঁপ করতে হয় নি।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই হ্যালি মাথা দুলিয়ে সায় দিল।

‘আমার মনে হয় খামারের কাজে ওকে বিক্রি করলে বেশ ভালোই দাম পাওয়া যাবে।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’ হ্যালি বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘যদিও শুনেছি মেয়েটা রান্না কাজে খুব দক্ষ, তবুও ওর আঙ্গুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে তুলো তোলার কাজে আরো বেশি দক্ষতা দেখাতে পারবে।’

‘কিন্তু সেক্ষেত্রে মুশকিল হবে ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে। অতটুকুন দুধের বাচ্চাকে নিয়ে তুলো তুলতে যাওয়া আদৌ সম্ভব হবে না।’

‘সে তো বটেই। সুযোগ পেলে আমি প্রথমেই চেষ্টা করব বাচ্চাটাকেও কোথাও বিক্রি করে দিতে।’

‘ইচ্ছে করলে আপনি বাচ্চাটাকে আমার কাছে বিক্রি করতে পারেন।’

‘স্বচ্ছন্দে।’ মুখে বললেও হ্যালি খুব একটা উৎসাহ দেখাল না।

এর পরেই শুরু হয়ে গেল দরাদরির পালা। অবশেষে হ্যালি পঁয়তাল্লিশ ডলারে বাচ্চাটাকে বিক্রি করতে রাজি হলো। এ সম্পর্কে লুসি কিছুই জানতে পারল না।

হ্যালি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোথায় নামবেন? ‘

‘লুসিভিলে।

‘ভালোই হবে। আমরা যখন ওখানে পৌছব, তখন সন্ধ্যে হয়ে যাবে। বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে পড়বে .. সেই ফাঁকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কাজটা এমন গোপনে করতে হবে যাতে ওর মা কিছু জানতে না পারে। আমি আবার কান্নাকাটি একদম পছন্দ করি না … বিক্রয় দলিল লিখে দেওয়ার পর ভদ্রলোক টাকা মিটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

লুসিভিলের জেটিঘাটে যখন স্টিমার ভিড়ল, উতরানো সন্ধ্যার নিবিড় একটা প্রশান্তি নেমে এসেছে চারদিক জুড়ে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েই লুসি চুপচাপ বসে ছিল। বাচ্চাটা এখন ঘুমে একেবারে কাদা। লুসিভিলের নাম কানে যেতেই লুসি বাচ্চাটাকে দুটো প্যাকিং বাক্সের মাঝে সন্তর্পণে শুইয়ে রেখে রেলিং-এর ধারে গেল, তারপর রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে জেটিঘাটে ভিড় করে দাঁড়ানো হোটেল পরিচালকদের মধ্যে ওর স্বামীকে ব্যাকুল আগ্রহে খুঁজতে লাগল। অথচ ওর আর শিশুটির মাঝে যাওয়া-আসার পথটা তখন যাত্রীদের ভিড়ে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই অবকাশে সেই ভদ্রলোক চুপিচুপি বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন।

একটু পরে প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করে, ধোঁয়া ছেড়ে স্টিমার চলতে শুরু করল। একটু একটু করে জেটিঘাটটা সরে যেতে লাগল দূরে।

একসময়ে লুসি ওর জায়গায় ফিরে এল। দেখল বাচ্চাটা নেই, কেবল হ্যালি সেখানে বসে রয়েছে।

লুসি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ‘কী ব্যাপার! বাচ্চাটা কোথায়?’

‘লুসি, তোমার বাচ্চাটা নেই। একদিন না একদিন তুমি যখন সবই জানতে পারবে, তখন আর তোমার কাছে গোপন করে কোনো লাভ নেই। তুমি যাচ্ছ দক্ষিণ দেশে, সেখানে তোমার বাচ্চাটাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ওকে আমি এখানকার একটা লোকের কাছে বেচে দিয়েছি। ভদ্রলোক খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবারের। তোমার চাইতে অনেক বেশি যত্ন নিয়ে ওঁরা ওকে মানুষ করবেন।’

লুসি কাঁদল না বা চিৎকার চেঁচামেচি করল না, এমন কী একটা কথাও বলল না। শেলটা সোজা গিয়ে বিঁধেছে ওর হৃৎপিণ্ডের একেবারে মাঝখানে।

অবসন্ন দেহে ও বসে পড়ল। হাত দুটো শিথিলভাবে পড়ে রইল কোলের ওপর। সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বটে, কিন্তু কোনো কিছুই ওর চোখে পড়ছে না। ওপরের যা কিছু শব্দ, ইঞ্জিনের গর্জন আর জলের ছলছলাৎ আর্তনাদ মিশে একাকার হয়ে স্বপ্নের মতো অস্পষ্ট ওর কানে এসে প্রবেশ করছে। দুঃখ, বেদনা আর হতাশায় লুসি একেবারে পাথরের মতো নিস্পন্দ নিথর।

‘আমি জানি লুসি, মা হিসেবে প্রথম প্রথম তোমার খুবই কষ্ট হবে’, সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে হ্যালি নরম গলায় বলল। ‘কিন্তু তোমার মতো দেখতে-শুনতে ভালো, চটপটে একটা মেয়ের পক্ষে …‘

‘স্যার, আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এখন আমার সঙ্গে একটা কথাও বলবেন না।’

লুসির কণ্ঠস্বরে এমন অদ্ভুত একটা ক্রোধ মেশানো ছিল যে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী স্পষ্টই বুঝতে পারল, এখন আর মিছেমিছি ওকে ঘাঁটিয়ে কোনো লাভ হবে না, বরং সময়ই ওকে সান্ত্বনা দিতে পারবে। তাই কোনো কথা না বলে হ্যালি উঠে পড়ল আর লুসি বাচ্চার পরিত্যক্ত জামায় মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে রইল।

.

এই ঘটনার শুরু থেকে শেষপর্যন্ত টর্ম সমস্ত ব্যাপারটাই নীরবে লক্ষ করেছিল এবং এরপর পরিণতি যে কী হতে পারে তাও তার অজানা ছিল না। যদিও আইনসঙ্গত ব্যবসায় এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে, তবু তার মনে হলো এর চাইতে নিষ্ঠুর বর্বরতা আর কিছু হতে পারে না। অথচ তার মতো অতি তুচ্ছ একজন মানুষের পক্ষে এর বিরুদ্ধে কিছুই করার ছিল না, কেবল মেয়েটির দুঃখে নিজের হৃদয়কে নিভৃতে রক্তাক্ত করে তোলা ছাড়া।

ধীরে ধীরে টম মেয়েটির কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে কিছু বলতেই লুসি ডুকরে উঠল, চোখের কোল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। বাইবেল সম্পর্কিত টমের কোনো কথাই ওর কানে গেল না, যেন ক্রোধে কান দুটো বধির হয়ে গেছে, শোকে পাথর হয়ে গেছে বুকটা।

ক্রমে ক্রমে রাত্রি নামল। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চারদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। শুধু শোনা যাচ্ছে মৃদু তরঙ্গোচ্ছ্বাস। সুন্দর, বড় বড় চোখ দুটো মেলে দিয়ে লুসি আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো সান্ত্বনার বাণী ওর কানে এসে পৌঁছচ্ছে না।

একটা প্যাকিং বাকসের ওপর নিজেকে টানটান করে মেলে দিয়ে টম মেয়েটির চাপা বিলাপ শুনতে শুনতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝ রাত্তিরে তার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো তার পাশ দিয়ে কালো মতন কী যেন একটা চলে গেল এবং তারপরেই ঝপ করে জলে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পেল। টম চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল মেয়েটির জায়গাটা খালি। তাড়াতাড়ি উঠে সে বৃথাই চারদিকে খুঁজে দেখল। তখন বুঝতে পারল হতভাগিনী মেয়েটা শেষপর্যন্ত চিরদিনের মতো শান্তি লাভ করেছে, এখন আর কোনো বেদনাই ওর হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবে না! চোখের নিমেষে এতবড় একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল, অথচ নদীর ঊর্মিল স্রোত আগেরই মতো মনের আনন্দে নাচতে নাচতে ছুটে চলেছে।

উজ্জ্বল সূর্যালোকিত ভোরে হ্যালির ঘুম ভেঙে গেল। সজীব মালপত্রগুলোর খোঁজখবর নিতে এসে দেখল মেয়েটি নেই।

‘কী ব্যাপার মেয়েটা গেল কোথায়?’ টমকে সে জিজ্ঞেস করল।

টম বলল, ‘জানি না।’

‘নিশ্চয়ই রাত্তিরে ও অন্য কোনো ইস্টিশনে নেমে যায় নি। কেননা স্টিমারটা যখনই কোথাও থেমেছে, আমি কড়া নজর রেখেছি। আসলে তোদের কাউকে আমি এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না।’

টম নীরবে কথাগুলো শুধু শুনেই গেল, কোনো জবাব দিল না।

হ্যালি তখন বাকস গাঁটরি উল্টিয়ে স্টিমারের আগপাশ-তলা তন্নতন্ন করে খুঁজল, কিন্তু কোথাও লুসিকে খুঁজে পেল না। শেষে ফিরে এসে টমকে বলল এবার সত্যি কথাটা বল তো। আমি তোকে কাল রাত চারটে অব্দি জেগে বসে থাকতে দেখেছি, তারপর আর দেখি নি। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে, যা তুই জানিস।’

‘স্যার শেষ রাতের দিকে মনে হলো কে যেন আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। তারপরেই জলে কী যেন একটা পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না।’

লুসির মৃত্যুতে হ্যালি বিস্মিত বা আদৌ মর্মাহত হলো না। শুধু পকেট থেকে ছোট খাতাটা বার করে মেয়েটির নামের পাশে লিখে রাখল, ‘ক্ষতি’। মৃত্যুর চাইতে বরং এই ক্ষতির জন্যেই সে মনে মনে অস্বস্তি অনুভব করতে লাগল।

১২. ইভানজেলিন

মিসিসিপি নদী। দুপারের দৃশ্য এখন এমনই বদলে গেছে, মনে হয় যেন একটা অন্ধ কোনো দেশ। ওহিও নদী এসে পড়েছে এই মিসিসিপির বুকে এবং দুটো নদীর মিলিত ঘোলা জলভারা জোয়ারে ফুলে ফেঁপে পাগলের মতো ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। এখানে নদী এমনই চওড়া যে পারাপার চোখে পড়ে না। স্টিমারটা নানা জায়গা থেকে যাত্রী আর পণ্য বোঝাই করতে করতে এগিয়ে চলেছে। এখন তাতে আর স্টিমারটাতে তিল ধারণের জায়গা নেই।

কোমল কোনো স্বপ্নের দেশ পেরিয়ে আসা এটা যেন একটা বাস্তব পৃথিবী। তার বেলাশেষের সূর্যটা তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। সমুদ্রের মতো সীমাহীন সেই নদীর জলে সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। নদীতীরে বাতাসে কেঁপে ওঠা বেতবন আর ঝাঁকড়া সাইপ্রেসের শাখাগুলো রক্তিম একটা আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

আপন খেয়ালে এগিয়ে চলা স্টিমারের উপচে ওঠা ভিড়ের মধ্যে আমাদের বিশ্বস্ত বন্ধু টমকে দেখা যাচ্ছে ডেকের নিভৃত এক কোণে তুলোর একটা গাঁটরির ওপর বসে তার বাইবেলখানা মন দিয়ে পড়ছে। হ্যালির মতো লোকও এই কদিনে বিশ্বাস করে তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিয়েছে। প্রথম প্রথম সতর্ক দৃষ্টিতে দিনরাত তার ওপর কড়া নজর রাখত, কিন্তু কোথাও সামান্যতমও কোনো ত্রুটি চোখে পড়ে নি। এখন টম যেখানে খুশি যায়, প্রতিটা সালাসীর সঙ্গে গল্পগুজব করে, স্বেচ্ছায় হাসি মুখে তাদের সাহায্য করে। ওরাও টমকে ভালোবেসে ফেলেছে ঠিক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। যখন করার মতো আর কিছুই থাকে না, টম তখন ডেকের নিভৃত একটা কোণে তুলোর গাঁটরির ওপর বসে বাইবেল পড়ে।

নিউ অর্লিয়েন্সে পৌছতে তখনো প্রায় একশ মাইল পথ বাকি কি তার চাইতেও বেশি। নদীটা বয়ে চলেছে প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু একটা মালভূমির ওপর দিয়ে। ফলে মাইলের পর মাইল চারপাশের গ্রাম, ক্ষেত খামার, ঘর বাড়ি, দুর্গের উত্তুঙ্গ চূড়া, জীবনের সমস্ত মানচিত্রটাই স্পষ্ট চোখে পড়ে।

টম দেখতে পাচ্ছে দূরের ক্ষেত-খামারের ক্রীতদাসরা কাজ করছে। আরো দূরে তাদের সারি সারি কুঠরি আর মাঝে মাঝে তাদের প্রভুদের প্রাসাদোপম সব অট্টালিকা। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মন ছুটে যাচ্ছে সুদূর কেন্টাকি প্রদেশের সেই খামারবাড়িটায়, যেখানে সারি সারি প্রাচীন বিচগুলো গাঢ় ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনিবের বাড়ির প্রশস্ত আঙিনার ওপারে মাল্টিফ্লোরা আর বিগনোনিয়া দিয়ে ঘেরা ছোট একটা কুঠরি। সেখানে আশৈশব যাদের সঙ্গে খেলেছে, সেই সব সঙ্গীদের পরিচিত মুখগুলো ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছে, দেখতে পাচ্ছে ঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত তার স্ত্রীকে, শুনতে পাচ্ছে খেলায় মত্ত ছেলেমেয়েদের মুখর কলহাস্য। মনে হচ্ছে সবচেয়ে ছোট ছেলেটা যেন তার কোলের ওপর বসে পাখির মতো অনর্গল বকবক করে চলেছে। বুকের ভেতরটা সহসা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠতেই সমস্ত দৃশ্যটা যেন বদলে গেল এবং তখনই আবার দেখতে পেল নদীতীরে বাতাসে কেঁপে ওঠা বেতবন আর ঝাঁকড়া সাইপ্রেসের শাখাগুলো রক্তিম একটা আভায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। ইঞ্জিনের যান্ত্রিক শব্দ তাকে খুব সহজ করেই জানিয়ে দিল, জীবনের সুখ চিরকালের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেছে।

মনের এমনি একটা অবস্থায় যে কেউ তার স্ত্রী বা বাচ্চাদের কাছে চিঠি লিখতে পারে, কিন্তু টম লিখতে পারে না। তার কাছে ডাকঘরের কোনো অস্তিত্বই নেই, এমন কী তার আর এই বিচ্ছেদের মাঝের অন্তরীপটাতে যোগাযোগের জন্যে অন্তরঙ্গ কথার ছোট্ট কোনো সেতুও নেই। তাই নিজের মনে অন্তরঙ্গ কথার মালাগুলো গাঁথতে গাঁথতে কখনো অনবধানেই খোলা বাইবেলের জীর্ণ পাতাতে টুপটাপ ঝরে পড়ে দু-এক ফোঁটা তপ্ত অশ্ৰু। তখনই আবার চমকে উঠে সে পড়ায় মন দেয় :

‘অযথা তোমার মনকে কষ্ট পেতে দিও না। আমার পিতার ভবনে অজস্র বাসকক্ষ রয়েছে। আমি তারই একটিতে তোমার জন্য জায়গা করে দেব।’

স্টিমারের যাত্রীদের মধ্যে সেন্ট ক্লোয়ার নামে অল্প বয়েসী এক ভদ্রলোকও চলেছেন অর্লিয়েন্সে। তাঁর সঙ্গে রয়েছে পাঁচ-ছয় বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে আর একজন মহিলা। মহিলাটি সম্ভবত তাঁর কাছে আত্মীয়া এবং এঁর ওপরেই রয়েছে মেয়েটিকে দেখাশোনা করার ভার।

রঙিন প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ানো ছোটদের ভিড়ের মধ্যেই টম বহুবার মেয়েটিকে দেখেছে। কিন্তু মেয়েটি এমনই অদ্ভুত যে একবার দেখলে ওকে আর কোনো দিনই ভোলা যাবে না। চঞ্চল মেয়েটাকে যে শুধু দেখতে সুন্দর তাই নয়, ওর লাবণ্যউজ্জ্বল দেহখানা মনে হয় যেন আশ্চর্য মিষ্টি একটা স্বপ্নে গড়া। পুরাণের কোনো দেবীর মতো ওর মুখখানা এমনই অনিন্দ্য সুন্দর যে এ পৃথিবীর বিষণ্নতম মানুষও ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোথাও কোনো খুঁত নেই। ছোট হলেও, ওর গ্রীবাভঙ্গিমাটা সত্যিই দেখার মতো। মাথায় দীঘল একরাশ সোনালি চুল গাঢ় মেঘের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। ঘন পল্লব ঘেরা টানাটানা গভীর দুটো নীল চোখ। প্রকৃতপক্ষে স্বৰ্গীয় সুষমামাখা মুখ আর টলটলে নীল চোখ দুটোই ওকে অন্যান্য বাচ্চাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রেখেছে, যার জন্যে বার বার সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে ওর ওপর। ও যে অসম্ভব চঞ্চল বা বিষণ্ণ, তা নয়, বসন্ত বাতাসের মতো কোথাও এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। গোলাপি ঠোঁটের কোণে সবসময়েই ছড়িয়ে রয়েছে আধ-ফোটা একটা হাসি, যেন সুন্দর একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে গান গাইতে গাইতে ও একাই হেঁটে চলেছে।

পরীদের মতো ও সবসময়েই সাদা পোশাক পরে, যেখানে খুশি যায়, যার সঙ্গে খুশি পল্প করে। স্টিমারের বিপজ্জনক জায়গাগুলো ও যখন হেলায় অতিক্রম করে, কালিঝুলি মাখা রুক্ষ হাতগুলো ওর দিকে বাড়ানোই থাকে, যদি কোনো বিপদ ঘটে! ইঞ্জিনে কয়লা- যোগানদার থেকে শুরু করে খালাসি, কুলি-কামিনরা পর্যন্তও ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। টমের কাছে ওই ছোট মেয়েটির অস্তিত্ব অনেকটা স্বর্গীয়। সে যখনই ওর দীঘল সোনালি চুল আর অতল নীল চোখ দুটো দেখতে পায়, তার মনে হয় বাইবেল থেকে এইমাত্র কোনো দেবদূত যেন নেমে এসেছে।

মেয়েটি প্রায়ই নিচের ডেকে, যেখানে হ্যালির শৃঙ্খলিত ক্রীতদাস-দাসীরা রয়েছে, সেখানে আসে, ওদের মধ্যে দিয়ে পথ করে হেঁটে যায়, এমনভাবে নীরবে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন গভীর বেদনায় একেবারে ম্লান হয়ে গেছে। কখনো কখনো ভারী শেকলটা ও ফুলের মতো মসৃণ হাতে স্পর্শও করে দেখে, তারপর করুণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নতমুখে ধীরে ধীরে ফিরে যায়। কখনো আবার হঠাৎই কোঁচড় ভর্তি টফি, বাদাম আর কমলা নিয়ে এসে সবাইকে ভাগ করে দেয়।

টম গভীর আগ্রহে মেয়েটিকে লক্ষ করতো কিন্তু ঠিক ভাব জমাবার মতো সুযোগ বা সাহস হয়ে ওঠে নি। চেরি ফলের বীচি দিয়ে টম সুন্দর সুন্দর সব ঝুড়ি, বুনো বাদাম দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত যত মুখ আর খেলনা বানাতে পারত। টমের নিপুণ দক্ষতা ছিল নানা ধরনের বাঁশি বানানোর কাজে। একসময়ে এগুলো সে বানাতে মাস্টার জর্জ আর পাড়াপড়শীদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে। এখন করে নিজেরই সময় কাটানোর জন্যে।

মেয়েটি এমনই চঞ্চল আর লাজুক যে ওকে বশে আনা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। একদিন টম একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসে খেলনা বানাচ্ছে, মেয়েটি তার পাশে এসে বসল। তারপর নিজের মনেই ছোট্ট একটা ক্যানারি পাখির মতো মিষ্টি গলায় অনর্গল বকে যেতে লাগল। এক সময়ে টম কয়েকটা খেলনা ওকে উপহার দিল। এতে মেয়েটি খুবই লজ্জা পেল, কিন্তু একটু পরে দুজনের মধ্যে বেশ ভাব জমে উঠল।

মেয়েটির আস্থা অর্জন করতে পারার পর টম জিজ্ঞেস করল, ‘খুকুমনি, তোমার নামটা কী আমাকে বললে না-তো?’

‘ইভানজেলিন সেন্ট ক্লোয়ার। সবাই আমাকে ইভা বলে ডাকে। তোমার নাম কী?’

‘আমার নাম টম। কেন্টাকিতে ছোটরা আমাকে টম চাচা বলে ডাকত।’

‘তাহলে আমিও তোমাকে টম চাচা বলে ডাকব, কেননা তোমাকে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগে।’ টমের কোলের ওপর ঝুঁকে ইভা বলল, ‘তুমি কোথায় যাবে, টম চাচা?’

‘আমি তো জানি না, কুমারী ইভা’

‘তুমি জানো না?’

‘সত্যিই আমি জানি না, ইভা। ওরা আমাকে কারুর কাছে বেচার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায়, কার কাছে তা আমি বলতে পারব না।’

‘আমার বাবা কিনতে পারেন’, কিছু না ভেবেই ইভা বলল। ‘আমাদের বাড়িতে তুমি খুব আনন্দে থাকতে পারবে। আমি আজই বাবাকে বলব।’

‘অসংখ্য ধন্যবাদ, সোনামণি।’

ইতিমধ্যে স্টিমার ছোট একটা জাহাজঘাটে এসে থামল। এখানে কাঠ তোলা হবে। বাবার গলা শুনতে পেয়েই ইভা দৌড়ে চলে গেল। টমও উঠে পড়ল স্বেচ্ছায় কাঠ তোলার কাজে খালাসিদের সাহায্য করার জন্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যে ইভাও ওর বাবার সঙ্গে রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে কাঠ তোলা দেখছে। কাঠ তোলা শেষ হবার পর সিঁড়িটা তুলে নেওয়া হলো। জাহাজঘাটা থেকে স্টিমারটা সবে সরতে শুরু করেছে, জলের মধ্যে চাকাটা দুতিন পাক ঘুরছে কিনা সন্দেহ, হঠাৎ কীভাবে যেন টাল সামলাতে না পেরে ইভা সোজা গিয়ে পড়ল নদীর মধ্যে। হকচকিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে নদীর জলে ঝাঁপ দিতে যেতেই, অন্যান্য যাত্রীরা মিস্টার সেন্ট ক্লেয়ারকে আটকে রাখল। কেননা ওরা আগেই লক্ষ করেছিল মেয়েটিকে উদ্ধারের জন্যে আর একজন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

ইভা নদীতে পড়ে যাবার সময় টম ছিল নিচের ডেকের একেবারে সামনেই। সুতরাং মেয়েটা জলে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেও চিলের মতো ছোঁ মেরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নদীতে। তার মতো সাঁতার-জানা বলিষ্ঠ কোনো মানুষের পক্ষে কাজটা আদৌ কঠিন ছিল না। পড়ার পরক্ষণে মেয়েটাকে জলের ওপর ভেসে উঠতে দেখেই টম ক্ষিপ্রগতিতে সাঁতরে গিয়ে ওকে ধরে ফেলল, তারপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে নিয়ে এল স্টিমারের ধারে। তখন অজস্র মানুষ নির্দ্বিধায় তাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে টমকে সাহায্য করার জন্যে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ইভার সিক্ত, অবচেতন দেহটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মেয়েদের কেবিনে। সবার আন্তরিক মিলিত প্রচেষ্টায় ইভা সুস্থ হয়ে উঠল

পরের দিন, স্টিমার নিউ অর্লিয়েন্সের কাছাকাছি এসে পড়ায় যাত্রীদের মধ্যে জিনিসপত্র গোছগাছ করার ধুম পড়ে গেল, যাতে জেটিঘাটে স্টিমার ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিচে নামতে পারে। খালাসি আর কেবিনের পরিচারিকারাও ব্যস্ত হয়ে পড়ল স্টিমারটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে।

নিচের ডেকে টম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বার বার তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে রেলিং-এর ধারে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইভানজেলিনের ওপর। অন্য দিনের তুলনায় ওর মুখখানাকে যা কেবল একটু ম্লান মনে হচ্ছে, তাছাড়া গতকালের দুর্ঘটনার আর কোনো চিহ্নই নেই। ওর বাবাকেও দেখতে ঠিক ইভার মতো। একমাথা কোঁকড়ানো সোনালি চুল, স্বচ্ছ নীল দুটো চোখ, প্রতীভাদীপ্ত মুখটায় সবসময়ই জড়িয়ে রয়েছে মিষ্টি একটা হাসি।

‘টমকে যদি আমি কিনতে চাই’, হ্যালিকে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত টাকায় বিক্রি করতে পারবেন?’

হ্যালি বলল, ‘খুব একটা লাভ না করে আমি তেরোশো ডলারেই ছেড়ে দিতে পারি।’

‘দামটা কি বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না, মিস্টার হ্যালি?’

‘সত্যি বিশ্বাস করুন, আমার একটুও লাভ থাকবে না। শুধু আপনার মেয়ে বায়না ধরেছে বলেই আমি ওই দামে ছেড়ে দিতে রাজি হচ্ছি। অন্য কেউ হলে টমের মতো এমন বিশ্বাসী, নম্র, বলিষ্ঠ চেহারার একজন ক্রীতদাসের জন্যে আমি দেড় হাজারের একটা কানাকড়িও কম করতাম না।’

এমন সময় ইভা বাবার গলা জড়িয়ে তার কানে কানে বলল, ‘টমকে তুমি কিনে নাও, বাপি। টাকার জন্যে ভেব না। আমি জানি তোমার অনেক টাকা আছে। ওকে আমি চাই।’

হাসতে হাসতে মিস্টার সেন্ট ক্লেয়ার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ওকে নিয়ে কী করবে, মামণি? গল্প শুনবে, না কাঁধে উঠে ঘোড়ায় চড়বে, নাকি অন্য কোনো খেয়াল আছে?’

‘আমি ওকে সুখী করতে চাই, বাপি।’

নিটোল কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে সেন্ট ক্লেয়ার অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ছোট্ট করে বললেন, ‘আচ্ছা, তাই হবে।’

হ্যালির চাওয়া দামেই সেন্ট ক্লেয়ার টমকে কিনতে রাজি হয়ে গেলেন। হ্যালি পকেট- বই থেকে মিস্টার শেলবির সই করা দলিলখানা বের করে সেন্ট ক্লেয়ারের হাতে দিল। সেন্ট ক্লেয়ার নিতান্ত অবহেলায় সেটা নিয়ে পকেটে রেখে দিলেন।

হ্যালি তখন ইভার হাত ধরে টমের কাছে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল ‘টম তোমার নতুন মনিবের দিকে তাকিয়ে দেখ তো পছন্দ হয়েছি কিনা?’

টম মুখ তুলে তাকাতেই ইভার পাশে ওর বাবাকেও দেখতে পেল। সুন্দর মুখে অহমিকার কোনো চিহ্ন নেই, বরং মেয়েকে খুশি করতে পেরে উনি যেন নিজেই খুশি হয়েছেন। আনন্দে টমের দুচোখে তখন জল এসে গিয়েছিল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক।’

‘আমিও তাই আশা করি। তোমার নাম কী?’

‘টম।’

‘আচ্ছা টম, তুমি ঘোড়ার গাড়ি চালাতে পার?’

‘পারি, স্যার। আগের মনিবের ওখানে আমি বহুদিন ঘোড়ার গাড়ি চালিয়েছি।’ তোমাকে ওই কাজেই দেব। কিন্তু সাবধান, কখনো মদ খেয়ে যেন আবার মাতলামি করো না।’

টম মনে মনে বিস্মিত এবং আহত না হয়ে পারল না, তবু সংযত স্বরেই সে বলল, ‘মদ আমি খাই না।’

‘বাঃ, শুনে খুশি হলাম।’

ইভা বলল, ‘আমাদের ওখানে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না, টম চাচা। আমার বাবা খুব ভালো। কাউকে কিচ্ছু বলেন না।’

‘বাবার সম্পর্কে তোমার এই মনোভাবের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ কথাটা বলে সেন্ট ক্লেয়ার হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেলেন।

১৩. টমের নতুন মনিব

সেন্ট ক্লেয়ার যেহেতু আমাদের বিনম্র নায়ক, টমের জীবন সমাজের উঁচু স্তরের কিছু মানুষের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে, এখানে তাঁদের সংক্ষিপ্ত একটা পরিচয় দেওয়া দরকার।

আগাস্টিন ক্লেয়ার লুসিয়ানার অত্যন্ত ধনী একজন আবাদকারীর সন্তান। এক সময় সেন্ট ক্লেয়ারদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন ক্যানাডিয়ান। আগাস্টিনরা মাত্র দুভাই, চেহারা, চরিত্র এবং মানসিকতায় দুজনের মধ্যে সামান্যতমও কোনো মিল ছিল না। এক ভাই ভারমন্টের সমৃদ্ধশালী জমিদারিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, অন্য ভাই রয়ে গেছে লুসিয়ানার এই পৈত্রিক জমিদারিতে। আগাস্টিনের মা ছিলেন হিউগ্যান্ট ধর্মাবলম্বী ফরাসি একটি পরিবারের মেয়ে, যে পরিবারটা বহুকাল আগে থেকেই লুসিয়ানায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল।

চেহারা আর স্বভাবের দিক থেকে আগাস্টিন মায়েরই আদল পেয়েছিল। ছোটবেলা থেকে আগাস্টিন ছিল অসম্ভব খেয়ালি আর লাজুক প্রকৃতির। চাষাবাদ দেখার চাইতে পড়াশোনার ওপরেই তার ঝোঁক ছিল সবচাইতে বেশি। কলেজে পড়াশোনার সময়েই অত্যন্ত সরল, উন্নতমনা আর আশ্চর্য রূপসী একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে এবং মেয়েটিকে পাবার জন্যে প্রায় পাগল হয়ে ওঠে। কিন্তু মেয়েটির বাবা-মা রাজি না হওয়ায় ওদের দুজনের সম্পর্ক ভেঙে যায়। পরবর্তী কালে মেরি নামে যে মেয়েটির সঙ্গে আগাস্টিনের বিয়ে হয়, সে মেয়েটিও রীতিমতো রূপসী এবং অগাধ পৈত্রিক ধনসম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। কিন্তু বিবাহিত জীবনে আগাস্টিন সুখী হতে পারে নি। বিশেষ করে ইভানজেলিনের জন্মের পর থেকে ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্যে মেরিকে প্রায়ই শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে হয এবং কখনো কখনো অসহ্য মাথার যন্ত্রণায় সপ্তাহে তিনদিন বিছানা ছেড়ে নড়তেই পারে না। ফলে সংসারের যাবতীয় কাজের ভার চাকর-বাকরদের হাতে। ওরাও প্রশ্রয় পেয়ে যা খুশি তাই করে। বলার কেউ নেই, ইভাকে সত্যিকারের দেখাশোনা করার নেই কেউ। সেই জন্যেই আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ার ভারমন্টে গিয়েছিলেন কুমারী ওফেলিয়াকে নিয়ে আসার জন্যে।

কুমারী ওফেলিয়া আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ারের সম্পর্কে চাচাতো বোন। বয়সে তাঁর চাইতেও কয়েক বছরের বড়। দুজনেরই শৈশব কেটেছে ইংল্যান্ডের ভারমন্টে। কুমারী ওফেলিয়া ছোট ভাইটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাই যখন শুনলেন ইভাকে দেখাশোনা করার কেউ নেই, বিশেষ করে আগাস্টিনের স্ত্রীর অসুস্থতার জন্যে অত বড় একটা সংসার ডুবতে বসেছে। কেননা সংসারের প্রতি ভাইয়ের উদাসীনতা, আর অগোছালো স্বভাবের কথা ওঁর অজানা ছিল না, তাই উনি আর আগাস্টিনের মুখের ওপর কিছুতেই না করতে পারলেন না। তাছাড়া ওঁর মনে হয়েছিল ইভার মতো মেয়ে এ পৃথিবীতে সত্যিই খুব কম দেখা যায়।

কুমারী ওফেলিয়া আর আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ার, দুজনের মধ্যে মানসিকতার সুন্দর একটা মিল থাকলেও স্বভাবের দিক থেকে ওফেলিয়া কিন্তু ভাইয়ের ঠিক বিপরীত। ওঁনার সবকিছুই চলে ঘড়ির কাঁটা ধরে, কাজের ধারার মধ্যেও বিশৃঙ্খলার কোনো স্থান নেই। চেহারাটা যেমন সহজ স্বাভাবিক, উজ্জ্বল কালো চোখে তাকানোর ভঙ্গিটাও তেমনি সহজ। সবার মুখের ওপরেই স্পষ্ট কথা বলেন, সরাসরি কারুর মুখের দিকে যখন তাকান, মনে হয় যেন তার ভেতরটা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। ফলে অনেকেই ওঁকে যেমন সমীহ করে, তেমনি অনেকে আবার এড়িয়ে চলতে পারলেই বেঁচে যায়।

ইভাদের গাড়িটা এসে থামল প্রাসাদোপম বিরাট একটা অট্টালিকার সামনে। মুর এবং ফরাসি স্থাপত্যরীতিতে তৈরি কারুকার্য করা এই বাড়িটা বেশ পুরনো আমলের। ভেতরে প্রকাণ্ড একটা আঙ্গিনা। আঙ্গিনার মধ্যে দিয়ে বেশ খানিকটা গেলে তবে গাড়ি বারান্দা। উল্টো দিকে সম্পূর্ণ মর্মর পাথর দিয়ে বাঁধানো একটা ফোয়ারা, তাতে অবিশ্রান্ত ধারায় ফিনকি দিয়ে উঠছে রূপালি জলস্রোত। নিচে কাচের মতো স্বচ্ছ জলে খেলে বেড়াচ্ছে দ্যুতিবিচ্ছুরিত সব রঙিন মাছ। ফোয়ারার চারপাশে মোজাইক করা পথ। পথের ওপরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফল আর ফলের বাগান, মাঝে মাঝে আশ্চর্যসুন্দর সুন্দর সব মর্মর পাথরের মূর্তি। গাড়িবারান্দার সামনেই ফুলে ফুলে ছাওয়া দুটো কমলার গাছ গাঢ় দু- টুকরো ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেসে আসছে আরবীয় জুঁই আর রাজকীয় গোলাপের মিষ্টি খুশবু। সব মিলিয়ে সমস্ত পরিবেশটা যে শুধু কাব্যিক তাই নয়, রীতিমতো স্বপ্নিলও বটে।

বারান্দার নিচে এসে গাড়িটা থামতে না থামতেই ইভা খাঁচা খোলা পাখির মতো বিপুল আনন্দে কলকলিয়ে উঠল, ‘দেখো আমাদের বাড়িটা সুন্দর নয়, তুমি বলো?’

ওফেলিয়া ওর গালটা টিপে দিয়ে আদর করে বললেন, ‘সত্যিই খুব সুন্দর, মামণি।’

গাড়ির পেছন থেকে টমই প্রথম নিচে নেমে চারদিকে তাকাল। মনে মনে কিছুটা অবাক হলেও বাইরে কিন্তু সে আগেরই মতো শান্ত, স্থির। তাই আগাস্টিন ঠাট্টার সুরে বললেন, ‘কী টম, আমাদের বাড়িটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

ইতিমধ্যে ঘোড়ার গাড়ির শব্দ পেয়ে দাস-দাসীরা সব ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে বয়স্ক একজন চাকরকে আগাস্টিন বললেন, ‘অ্যাডলফ, আমরা ভেতরে যাচ্ছি, তুমি জিনিসপত্তর সব গুছিয়ে তুলে রেখো আর আস্তাবলের ওপরের ঘরটায় টমের থাকার ব্যবস্থা করে দিও।’

ওরা পৌছবার আগেই ইভানজোলিন ডানা মেলা পাখির মতো দৌড়ে ভেতরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমু খেল।

‘মা, মামনি, আমি এসে গেছি।’

গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকা শীর্ণ চেহারার অত্যন্ত রূপসী একটি মহিলা কোনোরকমে অল্প একটু উঠে বসল।

‘এসে গিয়ে খুব ভালো করেছ, মামণি। কিন্তু বেশি দুষ্টুমি করো না। আমার ভীষণ মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।’

‘আমি টিপে দেব, মামণি?’

‘না, তোমাকে কিছু করতে হবে না।’

মার কথা শেষ হতে না হতেই ইভা অন্য একটি মহিলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

‘ও মামি, তুমি!’

মহিলাটিও ইভাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করল।

এমন সময় ওফেলিয়াকে নিয়ে আগাস্টিন ভেতরে প্রবেশ করলেন। ‘মেরি, দেখো কাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি।’

‘ও, মিস ওফেলিয়া! কেমন আছ?’ মেরি হাতটা বাড়িয়ে দিল।

পাপড়ির মতো মসৃণ হাতটা নিজের মুঠোর মধ্যে আঁকড়ে ধরে ওফেলিয়া বললেন, ‘ভালো। কিন্তু তোমার শরীরটা তো দেখছি খুবই ভেঙে গেছে।’

‘হ্যাঁ, অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সারাতে পারছি না।’

‘এখন আর তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না’, কিছুটা গর্বিত স্বরেই আগাস্টিন বললেন। ‘অনেক সাধ্য-সাধনা করে আমার নিউ ইংল্যান্ডে বাস্তববাদী বোনটাকে ধরে আনতে পেরেছি। এখন থেকে ঘর-সংসার আর ইভার যা কিছু দায়িত্ব থাকবে ওফেলিয়ারই ওপরে। তুমি একটু স্বস্তিতে বিশ্রাম নিতে, পারবে।’

মেরি ম্লান ঠোঁটে হাসল। ‘এখন এসব কথা থাক মামি’, একটু আগে ইভা যার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লাল পোশাকপরা বেশ লম্বা, সুন্দর চেহারার সেই পরিচারিকাটির দিকে তাকিয়ে মেরি বলল, ‘মিস ওফেলিয়ার ঘরটা তুমি দেখিয়ে দাও। উনি খুব ক্লান্ত, একটু বিশ্রাম নেবেন। দেখো যেন ওঁর কোনোরকম অসুবিধে না হয়।’

টমরা এসে পৌঁছনোর কয়েকদিন পরে মেরি কুমারী ওফেলিয়া আর ইভানজেলিন বসে রয়েছে প্রাতরাশের টেবিলে, পরিচারিকা এসে চায়ের সাজসরঞ্জাম সব নিয়ে গেল।

‘আসলে কী জানেন, মিস ওফেলিয়া’, ম্লানস্বরে মেরি বলল, ‘এই চাকর-বাকররাই আমার কাল হয়েছে। ওদের জন্যেই আমার শরীর দিন দিন এমন ভেঙে যাচ্ছে

ওফেলিয়া কিছু বলতে যাবার আগেই ইভা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তুমি ওদের কেন রেখেছ, মামণি?

‘কেন রেখেছি আমি নিজেই জানি না। ছোটবেলা থেকে এমন একটা অভ্যেস হয়ে গেছে যে ওদের ছাড়া আমার আবার একটা দিনও চলে না।’ মেরি সেন্ট ক্লেয়ার আরাম কুর্সিটায় হেলান দিয়ে বসে ওফেলিয়ার দিকে তাকাল। ‘সত্যি বলতে কী জানেন, ক্রীতদাসদের জাতটাই হলো অকৃতজ্ঞ। এই মামির কথাই ধরুন না কেন। এতটুকু বয়েস থেকে ও আমার বাপের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। শুধু খাওয়াপরা কেন, কোনো কিছুরই অভাব আমি রাখি নি। ওর আবার রুটি মুখে রোচে না, সাদা চিনি দিয়ে কফি ছাড়া কখনো চা খায় না, আর ওর জামা-কাপড়ের ড্রয়ার খুললে আপনার তাক লেগে যাবে। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, বাবার হাতে দুএকবার ছাড়া ও জীবনে কখনো চাবুক খায় নি। অথচ ও এমন স্বার্থপর আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। যখন আমার শরীর খুব খারাপ হয়, রাত্তিরে এক ফোঁটাও ঘুমোতে পারি না। ও কিন্তু মোষের মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়। এই গত রাত্তিরের কথাই ধরুন না কেন, একবার ডেকে তুলতে গিয়ে আমার যা অবস্থা হলো, তারপর ওকে ডাকতে আমার আর সাহস হয় নি।’

ইভা বলল, ‘কিন্তু ও তো বছরের পর বছর তোমার পাশে বসে রাত্তির জেগেছে, মামণি?’

‘ও, মামি তোমার কাছে এসব অভিযোগ করেছে বুঝি!’

‘না না, মামি কোনো অভিযোগ করে নি। এমনিই গল্প করতে করতে ও বলেছে কোনো কোনোদিন রাত্তিরে তুমি খুব কষ্ট পাও।’

‘হ্যাঁ, আমার কষ্টে ও তো দিনরাত একেবারে গলে যাচ্ছে।’

বোনা থামিয়ে ওফেলিয়া বললেন, ‘মামি যদি না পারে তার বদলে জেন কিংবা রোজাও তো দু’একটা রাত জাগতে পারে?’

‘আপনি জানেন না দিদি, ওরা সবকটা সমান। এ বাড়িতে দেখার বা বলার কেউ নেই বলে ওরা অসম্ভব অলস হয়ে গেছে। কেন, মামিরই বা অসুবিধেটা কোথায় আপনি বলুন? ইচ্ছে থাকলে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে রাত্তিরেও ঠিকই জেগে থাকতে পারত। কিন্তু এ বাড়ির প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ও এমন হয়ে গেছে যে ইচ্ছে করেই তা করে না।’

‘ওর কি স্বামী আছে?’ বোনা থেকে মুখ না তুলেই ওফেলিয়া জানতে চাইলেন।

‘হ্যাঁ, স্বামী আর দুটো বাচ্চা আছে, বিয়ের পর আমি ওকে এখানে নিয়ে আসি। বাবা ওর স্বামীকে কিছুতেই ছাড়তে পারলেন না। ওর স্বামী আমাদের ওখানে কামারের কাজ করে। আর মামির বাচ্চা দুটো এমনই নোংরা যে আমি ইচ্ছে করেই ওদের এখানে আনতে দিই নি। প্রথম প্রথম ও কিন্তু এতটা স্বার্থপর ছিল না, কিন্তু এখন ঘুমোতে পারলে আর কিছু চায় না। আপনি জানেন না দিদি, ও বসে বসে, এমন কী হাঁটতে হাঁটতেও ঘুমাতে পারে।

‘মামণি’ চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে ইভা নরম হাতে মার গলাটা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে বলল, ‘তুমি যদি রাগ না কর, আমিও তো তোমার পাশে দুএকটা রাত জেগে থাকতে পারি। তুমি দেখো, আমি একটুও দুষ্টুমি করব না।’

মেয়ের সোনালি চুলে হাত বুলোতে বুলোতে মেরি হাসল। ‘দুষ্টুমির জন্যে না, মামণি ছোটরা রাত জাগতে পারে না। ছোটদের রাত জাগা উচিতও নয়।’

‘তুমি বিশ্বাস করো, মামণি।’ আহ্লাদি সুরে ইভা বলল, ‘বিছানায় শুয়ে অনেকদিন আমি একা একা রাত জেগে থেকেছি, আমার একটুও কষ্ট হয় নি।’

‘কেন শুধু শুধু এমন রাত জেগে থাক?’

‘এমনিই রোজ রাত্তিরে আমি অনেককিছু ভাবি, কোনো কোনো দিন রাত্তিরে আমার একদম ঘুম আসে না।’

‘না না, এমন করো না, এ অভ্যেসটা খুব খারাপ। ঠিক আছে, তুমি বরং এখন খেলতে যাও। তাছাড়া বড়দের এসব কথা তোমার শুনতে নেই।’

কোনো কথা না বলে ইভা মা আর ফুপুর গলা জড়িয়ে ধরে ফুলের পাপড়ির মতো মিষ্টি ঠোঁটে চুমু দিয়ে ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ইভা চলে যাবার পর মেরি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘মাঝে মাঝে ইভার জন্যে আমার সত্যিই খুব ভাবনা হয় … ‘

‘না না, ওর জন্যে তুমি কিচ্ছু ভেবো না’, ওফেলিয়া দ্রুত বাধা দিলেন। ‘ইভা খুব ভালো মেয়ে। ওর মতো সুন্দর মেয়ে আমি আর একটাও দেখি নি।’

‘যাই বলুন, ইভা কিন্তু অদ্ভুত। ও ঠিক আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়।’

‘হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।’

‘ওর যত ভাব সব ওই ক্রীতদাস-দাসীদের সঙ্গে, তা সে ছোট হোক বা বড়ই হোক। ওদের সঙ্গেই ওর শোয়া-বসা, খেলাধুলো, গল্প-গুজব সব। ওদের সঙ্গে যে আমাদের একটা তফাৎ আছে, সেটা আমি ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না। আর ওর বাবা ও এসব দেখেও দেখে না।’

‘ইভা এখন ছোট, ওর এসব বুঝতে না যাওয়াই তো ভালো।’ কুমারী ওফেলিয়া প্রতিবাদ না করে পারলেন না।

সম্ভবত ওর কথাটা মেরির মনঃপূত হলো না, তাই কিছুটা ক্ষুব্ধস্বরেই ও বলল, ‘ইভা না হয় ছোট, কিন্তু ওর বাবা তো আর ছোট নয়। ওর বাবাই ওকে প্রশ্রয় দেয় সবচাইতে বেশি। তাছাড়া চাকর-বাকরদের কখনো কিছু বলে না। এতে আস্কারা পেয়ে পেয়ে ওরা একেবারে মাথায় চড়ে বসেছে। এ বাড়িতে ওরা যার যা খুশি তাই করে। আর আমি যদি এ সম্পর্কে কিছু বলতে যাই, এমনভাবে বুঝিয়ে দেবে যেন সব দোষ আমারই। অথচ দিনের পর দিন ওরা যে একেবারে অলসের বেহদ্দ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কারুর নজরই নেই।

‘আবার ওদের কুড়েমি সম্পর্কে সেই পুরনো রেকর্ডটা বাজাতে শুরু করেছ তো?’ খবরের কাগজটার খোঁজে এসে আগাস্টিন স্ত্রীর শেষ কথাগুলো শুনতে পেয়ে হাসতেই হাসতেই মন্তব্য করলেন।

‘আমি তোমাকে কতবার বলেছি না তুমি কখনো এভাবে আমার সঙ্গে কথা বলবে না।

‘আমার ধারণা ছিল, আমি বেশ ভালো কথা বলতে পারি। ঠিক আছে, তোমার যখন পছন্দ নয়, তুমি যেভাবে চাইবে আমি সেইভাবেই বলব।’

ঠোঁট ফুলিয়ে মেরি বলল, ‘আমাকে তুমি রাগাবে না বলে দিচ্ছি।’

‘বেশ তুমি যখন চাও না, আমি তোমাকে নিশ্চয়ই রাগাব না।’ আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ার আপন মনে শিস দিতে দিতে খবরের কাগজখানা তুলে নিলেন।

‘আমি তো তোমাকে বহুবার নিষেধ করেছি আগাস্টিন, আমার সামনে কখনো এমন বিশ্রীভাবে শিস দেবে না। এতে আমার সত্যিই খুব মাথা ধরে

‘ওহো! আমি একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি আর কী কী যেন আমাকে নিষেধ করেছিলে?’

‘আচ্ছা, আমার প্রতি তোমার কি একটুও সহানুভূতি নেই?’ মেরি করুণ চোখে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল।

‘কে বললে নেই?’ একই ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আগাস্টিন জবাব দিলেন। ‘তুমি যে আমার অনুযোগকারিণী!’

‘এভাবে কথা বললে আমি কিন্তু সত্যিই রেগে যাব, আগাস্টিন।’

‘বেশ তো, কীভাবে কথা বললে তুমি খুশি হবে আমাকে বলো।’

এমন সময় বাইরের আঙ্গিনা থেকে ভেসে এল খুশিতে উপচে ওঠা মিষ্টি হাসির কলতান। সেন্ট ক্লেয়ার উঠে গিয়ে জানলার রেশমি পর্দাটা সরিয়ে দিলেন। বাইরের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে তিনি ইঙ্গিতে ওফেলিয়াকে কাছে ডাকলেন।

জানলা দিয়ে স্পষ্ট দেখা গেল আঙ্গিনার ওপারে, গাছের গুড়ির চারপাশে শেওলাপড়া বাঁধানো বেদিটার ওপর টম নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছে আর তার জামার প্রতিটা বোতামঘর জুঁইফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। টমের গলাতেও ঝুলছে বেশ বড় একটা রক্ত গোলাপের মালা। ইভা তার কোলের ওপর বসে হাততালি দিয়ে হাসতে হাসতে একেবারে লুটিয়ে পড়ছে।

‘ইস্, টম চাচা, তোমাকে এখন যা অদ্ভুত দেখাচ্ছে না!’

টম ইভার আনন্দ দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।

আগাস্টিন চাপাস্বরে বললেন, ‘সত্যি ওফেলিয়া, চোখ বুঝে ভাব তো একবার, নিঃস্ব রিক্ত এইসব মানুষদের জীবনে যদি শিশুরা না থাকত, তাহলে ওদের জীবনটা কী দুর্বিষহ হয়ে উঠত বল তো? আমাদের কাছে শিশুরা যেমন আমাদের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি, ওদের কাছে ওদের শিশুরাও ঠিক তেমনি প্রতিচ্ছবি। হয়তো এই ইভাকে দেখেই টম এখন তার নিজের ছেলে-মেয়েদের কথা ভাবছে। আর ইভার কাছে টম সত্যিকারের একজন নায়ক। যার গল্প ওর কাছে রূপকথা, যার গান ওর কাছে স্বর্গীয়, যার পকেটের টুকিটাকি খেলনা ওর কাছে দামি দামি রত্নের চাইতেও মূল্যবান। আর ইভা টমের জন্যে মালা গাঁথবে বলে সব চাইতে ভালো রক্ত গোলাপগুলোকেই নির্বাচন করে নিয়েছে। এর চাইতে সুখের আর কী হতে পারে তুমি বলো?’

রোববার সকালে গির্জায় যাবে বলে মেরি বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর পরনে সেবার রানির মতো ধবধবে সাদা রেশমি পোশাক, গলায় দামি একটা মুক্তোর মালা। গাড়ি-বারান্দার নিচে টম গাড়ি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ছিমছাম, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন পোশাকে তার চেহারাতেও ইতিমধ্যে যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে।

বিদায় জানাতে এসে ইভা দেখল মামি তার ঘরে শুয়ে রয়েছ।

‘আমি মার সঙ্গে গির্জায় যাচ্ছি।’

‘শুনে খুব খুশি হলাম, সোনামণি।’ মামি উঠে বসল।

‘কী ব্যাপার মামি, তোমার কি শরীর খারাপ?

‘হ্যাঁ, কয়েকদিন ধরে খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।’

মামির কথা শুনে ইভার ফুলের মতো সুন্দর মুখখানা চকিতে ম্লান হয়ে গেল। ‘তুমি বরং আমার এ ভিনেইগ্রেটটা নাও।’

‘হা ঈশ্বর, এ তুমি কী বলছ, দিদিমণি!’ মামি মনে মনে শুধু সংকুচিত নয়, আতঙ্কিতও হয়ে উঠল। ‘হীরে-বসানো সোনার তোমার এই সুন্দর জিনিসটা আমি নেব কেমন করে? তাছাড়া গির্জায় ওটা হয়তো তোমারই কাজে লাগতে পারে

‘আমার কোনো কাজে লাগবে না। বরং এটা তোমারই বেশি কাজে লাগবে দেখো। তুমি না করো না মামি, লক্ষ্মীটি।’

কারুকার্য করা সোনার সুন্দর আধারটা মামির বুকের মধ্যে গুজে দিয়ে, ওর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ইভা আবার দৌড়ে বারান্দায় ফিরে এল। এখন বাবার সঙ্গে ওফেলিয়া ফুপুও অপেক্ষা করছেন।

‘এতক্ষণ তুমি মামির ঘরে কী করছিলে?’

‘মামির খুব মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে, মা। তাই ওকে আমার ভিনেইগ্রেটটা দিতে গিয়েছিলাম।’

‘ইভা!’ বিস্ময়ে মেরি প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ‘তোমার অমন সুন্দর দামি জিনিসটা ওকে দিয়ে দিলে? যাও, এই মুহূর্তে গিয়ে ওটা ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’

নীরবে কয়েক মুহূর্তে মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ইভা ধীরে ধীরে দৃষ্টি আনত করে নিল।

মেয়ের সেই বেদনাহত মূর্তির দিকে তাকিয়ে আগাস্টিন দৃঢ়স্বরেই বললেন, ‘মেরি, তুমি ওকে কিছু বলো না। ওর যা খুশি তাই করতে দাও।’

‘বাবা হয়ে তুমি ও কথা কী করে বলতে পারলে, আমি সেটাই বুঝতে পারছি না!’ মেরি এবার রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠল। ‘এরপরে ও যখন বড় হবে, কী অবস্থা হবে একবার বুঝতে পারছ?’

‘সে একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।’ নিস্পৃহ গলায় আগাস্টিন বললেন। ‘তবে আমার তো মনে হয়। তোমার বা আমার চাইতে ও বেশ ভালো ভাবেই স্বর্গে পৌঁছতে পারবে। ‘

‘না না, বাবা’, বাবার হাতটা আলতো করে জড়িয়ে ধরে ইভা বলল, ‘এভাবে বললে মামণি সত্যিই খুব কষ্ট পায়।’

‘ঠিক আছে ওফেলিয়া’, আগাস্টিন বললেন, ‘মিছেমিছি আর দেরি না করে এবার তোমরা বেরিয়ে পড়ো।’

ওফেলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, তুমি যাবে না?’

‘ধন্যবাদ, আমি যাচ্ছি না।’

মেরি ব্যঙ্গের সুরে বলল, ‘ও আবার কোনোদিন গির্জায় যায় নাকি? চাকর-বাকরদের মতো ও-ও ধর্মের ধারে-কাছে ঘেঁষে না।

আগাস্টিন স্ত্রীর মন্তব্য গায়ে না মেখেই ইভাকে বললেন, ‘ভালো না লাগলে তোমারও যাবার দরকার নেই। বাড়িতে আমরা দুজনে বেশ একসঙ্গে খেলতে পারব।’

‘আমার মনে হয় গির্জাতে যাওয়াই ভালো, বাপিসোনা।’ মৃদুভাবে ইভা বলল।

‘কেন পুসিসোনা; চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে তোমার তো ওখানে ঘুম পেয়ে যায়?’

‘হ্যাঁ, ঘুম পেয়ে যায়, আর একটুও ভালো লাগে না। ওর চাইতে টম চাচা অনেক ভালো প্রার্থনা করে। প্রার্থনা করতে করতে টম চাচার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তবু আজ আমি জেগে থাকার চেষ্টা করব, বাপিসোনা

‘কী হবে শুধু শুধু কষ্ট করে মামণি?’

ইভা বাপির কানে কানে বলল, ‘ফুপুও বলেছে, ঈশ্বর আমাদের সবাইকে কাছে চান, আর আমরা যে যা চাই উনি আমাদেরকে তাই-ই দেন। তাই আমি ওঁর কাছে যাব সবার জন্যে প্রার্থনা করতে।

‘তাহলে তুমি যাও, মামণি’, সেন্ট ক্লেয়ার মেয়ের মাথাটা নিবিড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ওর সোনালি চুলে চুমু দিলেন। ‘আমার জন্যেও প্রার্থনা করো।’

‘নিশ্চয়ই, আমি সবসময়েই করি, বাপি।’

ছেড়ে দিতেই ইভা লাফিয়ে গাড়িতে উঠে মার পাশে গিয়ে বসল। টমও মুখে বিচি শব্দ করে লাগাম নাড়িয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল।

আগাস্টিন একটা চুরুট ধরিয়ে নিষ্পলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন।

তোরণ পেরিয়ে গাড়িটা রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যেতেই মেরি বলল, ‘চাকর-বাকরদের প্রতি দয়া দেখানোটা খুবই ভালো ইভানজেলিন, কিন্তু ওদের সঙ্গে আত্মীয়ের মতো সম্পর্ক গড়ে তোলাটা ঠিক নয়। মামি অসুস্থ হলে ওকে নিশ্চয়ই সহানুভূতি জানাতে পারো, কিন্তু অত দামি সোনার অমন সুন্দর জিনিসটা দিয়ে দিতে পার না বা ওকে তুলে এনে নিজের বিছানায় শোয়াতে পার না।’

‘আমার তো তাই-ই ইচ্ছে করে, মামণি’, খুব আস্তে আস্তেই ইভা বলল। ‘এতে যেমন ওকে দেখাশোনা করা সহজ, তেমনি ওর চাইতে আমার বিছানাটা নরম বলে ওর কষ্টও অনেক কম হবে।’

মেয়ের জবাবে মেরি স্পষ্টতই হতাশ হয়ে উঠল, ওফেলিয়ার দিকে ফিরে বলল, এখন আমি কী করে বোঝাই বলেন তো?’

‘ওকে এখন বোঝাবার কোনো দরকার নেই, পরে বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ হালকাভাবেই ওফেলিয়া কথাটা বললেন।

সেই মুহূর্তে ইভাকে বেশ ম্লান আর অপ্রতিভ মনে হলো, কিন্তু বেশিক্ষণের জন্যে তা স্থায়ী হলো না। টগৰগিয়ে ছুটে চলা গাড়িটার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কী যেন একটা দেখে ইভা নিজের মনেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

১৪. স্বাধীন মানুষটার প্রতিরোধ

বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্পের খামারবাড়িটায় যাত্রার আয়োজন তখন প্রায় সম্পূর্ণ বললেই চলে। বেলা শেষের ম্লান সূর্যটা যখন ঢলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে, গোধূলির রাঙা আলোয় গাছগাছালির ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে আরো দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে, একজন কোয়াকার এসে বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্পের কানে কানে খবর দিয়ে গেল, জর্জ হ্যারিস, তার বউ আর জিমকে ধরার জন্যে ছয়-সাত জনের একটা দল খুব শিগগিরই পেছনের সরাইখানা থেকে রওনা দেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।

অপ্রত্যাশিত এই সংবাদে বৃদ্ধ আদৌ বিস্মিত হলেন না, বরং ঠাণ্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে ভেতরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন অতিথিদের আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে, উনি যেন ওদের তাড়াতাড়ি খাবার ব্যবস্থা করে দেন। তারপর ছয় ছেলের একজনকে পাঠালেন ওঁর বন্ধু ফিনিয়াস ফ্লেচারের কাছে, সে যেন ঘোড়ায় টানা ওয়াগনটা নিয়ে এখনি একবার চলে আসে।

এই প্রসঙ্গে পাঠকদের জানিয়ে রাখি : উড়ো একটা খবরের ভিত্তিতে জর্জ জিমকে নিয়ে ওহিও নদীর সেই ছোট সরাইখানায় এসে হাজির হয়েছিল এবং সেই ভদ্রমহিলার কাছ থেকে খবর নিয়ে এলিজা আর হ্যারির খোঁজ করতে করতে অবশেষে আজই সকালে এই বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্পের খামার বাড়িটায় এসে পৌঁছতে পেরেছে। জিমের সঙ্গে তার মাও রয়েছে। স্বামীকে দেখে এলিজা যত না খুশি হয়েছিল, অবাক হয়েছিল তার চাইতেও বেশি। কেননা স্বামীর চেহারার এই আমূল পরিবর্তন দেখে কী যেন একটা অশুভ আশঙ্কায় ওর বুক কেবলই কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কিন্তু অসম্ভব ক্লান্ত থাকায় জর্জ বেশি কথা বলতে পারে নি, সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়ার পর দুপুরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এলিজা কিন্তু সারাক্ষণই জেগে বসেছিল স্বামীর পাশে। তাই বিকেলে একসময় ঘুম ভাঙতেই জর্জ দেখতে পেল সুন্দর টানাটানা দুটো চোখ ব্যাকুল আগ্রহে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

‘জর্জ!’

‘এখনই এত মুষড়ে পড়লে চলবে না, লিজি। যেভাবে হোক আমাদের কানাডায় পৌঁছতেই হবে।’

‘কিন্তু তার আগে ওরা যদি আমাদের ধরে ফেলে?’

‘ধরতে পারবে না। আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকা পযন্ত কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আজ আমি সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে গেছি। এখন আমার প্রতিটা শিরা-উপশিরায় বইছে স্বাধীন মানুষের রক্ত। তাছাড়া আমার পাশে যখন জিম রয়েছে তখন আমি আর কোনো কিছুকেই পরোয়া করি না।’

এমন সময় বৃদ্ধ ভ্যান ট্রম্পের মেয়ে র‍্যাচেল এসে জানালো অতিথিদের জন্যে রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে, কেননা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার আগেই ফিনিয়াস ফ্লেচার তার গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল। ওটা এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে উঠোনের অস্পষ্ট আঁধারে। সিমেয়ন হ্যালিডের পাশে দাঁড়িয়ে ফিনিয়াস চাপা গলায় কথা বলছে। দুজনের চেহারা সম্পূর্ণ বিপরীত। বড় ছেলে সিমেয়ন হ্যালিডে লম্বায় ছয় ফুটের ওপর, বাবারই মতো বলিষ্ঠ চেহারা। চেহারার তুলনায় মুখখানা অসম্ভব সরল। ফিনিয়াস ফ্লেচার মাথায় বেশ খানিকটা লম্বা হলেও, বেতের মতো তার রোগা লিকলিকে চেহারা। তবে চেহারাখানা যে পেটা লোহার মতো মজবুত, সেটা ওর হাত দুটো দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। মাথায় লালচে চুল, চঞ্চল, সতর্ক চোখ দুটোয় ফুটে ওঠে নিপুণ তৎপরতারই প্রতিচ্ছবি। আপাত চোখে দেখলে মনে হবে লোকটা নিজের সম্পর্কে অসম্ভব গর্বিত।

আর দেরি না করার জন্যে বৃদ্ধ ভ্যান ট্রাম্প তাড়া লাগালেন। জর্জ, জিম আর এলিজাদের বেরিয়ে আসতে দেখে ফিনিয়াস তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে গাড়ির ভেতরে বসার জায়গাগুলো ঠিক করে দিল। এলিজার বুকের ওপর হ্যারি ঘুমিয়ে পড়েছে, জিমের বৃদ্ধা মা এমনভাবে ছেলেকে আঁকড়ে রয়েছে যেন রাতের অন্ধকারে যেকোনো দিক থেকে শত্রুরা অতর্কিতে হানা দিতে পারে। ওদের পেছনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মেয়েরা। এই অল্প কদিনের উষ্ণ আন্তরিকতায় এলিজা আর হ্যারির প্রতি সবারই একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল।

সবাই গাড়িতে ওঠার পর বাড়ির কর্ত্রী দুটো পুঁটলি এলিজার হাতে দিলেন। একটাতে সবার জন্যে কয়েক দিনের খাবার আর অন্যটাতে হ্যারির জন্যে কয়েকটা জামা, মোজা, টুপি, ইত্যাদি।

বাবা, মা মেয়ে ছেলে সবাই একসঙ্গে বিদায় জানাল।

‘বিদায় বন্ধুরা আমার, বিদায়!’

ভেতর থেকে সবার একসঙ্গে মিলিত জবাব এল, ‘ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুক!’

ফিনিয়াস চালকের আসনে গিয়ে বসল। ভ্যান ট্রম্প ওকে বললেন, ‘তোমরা এগিয়ে যাও। আমি মাইকেল ক্রসকে খবর পাঠাচ্ছি। সবচেয়ে তেজি ঘোড়াটা নিয়ে সেও তোমাদের পেছন পেছন যাবে বিপদ বুঝলে আমাকে ফাঁকা বন্দুকের আওয়াজ করে তোমাদের সংকেত দেবে। আর কোথাও কোনো অসুবিধে হলে ওকে দিয়ে আমার কাছে একটা খবর পাঠাবে।’

‘ধন্যবাদ, ভ্যান ট্রম্প, এদের জন্যে তুমি কিছু ভেবো না। ওদিকের পথঘাট আমার সব খুব ভালোই জানা আছে।’

‘তাহলে আর একটুও দেরি করো না।’

ফিনিয়াস গাড়ি ছেড়ে দিল।

এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথে প্রচণ্ড দুলুনি আর চাকার কর্কশ শব্দে কিছু শোনা সম্ভব নয় বলে সবাই চুপ করে রয়েছে। একটু পরে বিপুল অন্ধকার ভাসিয়ে চাঁদ উঠল। ফলে জ্যোৎস্নার আঁধারকে এখন আর তত গাঢ় মনে হচ্ছে না। কখনো পাহাড়, কখনোবা উপত্যকার ঘন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পথটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে। চাকার উৎকট শব্দে হ্যারি প্রথমটায় জেগে উঠেছিল, এখন মার কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। বৃদ্ধার মুখ থেকেও একটু একটু করে মুছে গেছে ভয়ের চিহ্ন। এখন আরোহীদের চোখের পাতাগুলো ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইছে। শুধু ঘুম নেই চালক ফিনিয়াসের চোখে। আপন মনে শিস দিয়ে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সে যতটা সম্ভব জোরেই গাড়িটাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে।

রাত তিনটে নাগাদ হঠাৎ জর্জই প্রথম ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা মনে হলো কিছুটা দূরে, ওদের গাড়ির ঠিক পেছনেই। জর্জ জিমের কানে কানে বলল, ‘তোমার পিস্তল দুটো ঠিক আছে তো, জিম?’

‘হ্যাঁ, জর্জ।’

‘ওরা যদি আমাদের ধরতে আসে তাহলে তোমাকে কী করতে হবে আশা করি নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।’

‘নিশ্চয়ই না। তুমি কী ভাবো আমি আবার বুড়ো-মাকে ধরে নিয়ে যেতে দেব?’

‘ধন্যবাদ, জিম।’

ঘোড়ার ঘুরের শব্দ এখন আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কনুই দিয়ে জর্জ আলতো করে খোঁচা মেরে ফিনিয়াসের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ফিনিয়াস ঘোড়া দুটোর রশি টেনে ধরে গাড়ি থামিয়ে কান পেতে শুনল। খুব মন দিয়ে শোনার পর সে বলল, ‘ও নিশ্চয়ই মাইকেল ক্রস। আমি ওর ঘোড়ার খুরের শব্দ চিনি।’

মুখে বললেও উদ্বিগ্নতার ভাবটা কাটিয়ে উঠে ফিনিয়াস সম্পূর্ণ সুনিশ্চিত হতে পারল না। তাই নিজের আসনে উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের ওপর দিকে ঝুঁকে পেছনের পথের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল।

একটুপরে দূরের একটা পাহাড়ি চড়াইয়ের ওপর একজন সওয়ারিকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেল। লোকটা ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। ফিনিয়াস বলল, ‘মাইকেল বলেই মনে হচ্ছে!’

জর্জ, জিম দুজনেই গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দিকে গিয়ে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল। লোকটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। সবাই নিশ্চুপ। উপত্যকার একটা ঢাল বেয়ে নিচে নেমে যেতেই লোকটাকে আর দেখা গেল না, কিন্তু তার ঘোড়ার খুরের শব্দ স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল। শব্দটা যতই চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল অদৃশ্য সওয়ারিকে ততই ওদের কাছে মনে হতে লাগল। অবশেষে লোকটিকে আবার একটা চড়াইয়ের ওপর দেখা গেল।

‘ওই তো মাইকেল!’ নিজের অজান্তেই যেন ফিনিয়াস কথাগুলো বলল, তারপর গলা চড়িয়ে হাঁক পাড়ল, ‘কে হে, মাইকেল নাকি?’

‘কে, ফিনিয়াস?’

‘হ্যাঁ, আমি। লোকটা কাছে আসার পর জিজ্ঞেস করল, ‘কোনো খবর আছে নাকি?’

‘হ্যাঁ, আমাদের ঠিক পেছনেই ওরা আসছে।’

‘সংখ্যায় ওরা কত জানো?’

‘আট-দশ জন।’ হাঁফাতে হাঁফাতে মাইকেল জবাব দিল।

‘তবে নেশায় একেবারে ডুবে আছে। নিজেদের মধ্যে এমনভাবে চিৎকার চেঁচামেছি করছে, দেখলে মনে হবে একপাল হিংস্র-নেকড়ে।’

মাইকেলের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই শোনা গেল দূর থেকে নিশান্তিকার স্বচ্ছ বাতাসে ভেসে আসা কতকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ।

ফিনিয়াস বলল, ‘চটপট সবাই গাড়িতে উঠে পড়ো। যুদ্ধ যদি ওদের সঙ্গে করতেই হয়, তাহলে তার আগে আমি তোমাদের একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।’

জর্জ আর জিম গাড়িতে লাফিয়ে উঠতেই ফিনিয়াস চাবুক হাঁকিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। মাইকেল ঘোড়ায় চড়ে চলল ওদের পাশাপাশি। তুষার-ছাওয়া পাহাড়ি পথে গাড়িটা প্রচণ্ড শব্দে হেলে দুলে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে উড়ে চলেছে। ওদিকে কিন্তু পিছু- ধাওয়া করে আসা সওয়ারিদের ঘোড়ার খুরের শব্দও স্পষ্ট থেকে ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। গাড়ির আরোহীরা সবাই তা কান পেতে শুনতে শুনতে শঙ্কাতুর চিত্তে দূরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভোরের রাঙা আলোয় উদ্ভাসিত আকাশের পটভূমিতে একসময়ে অন্য একটা শৈলচূড়ায় অশ্বারোহী মূর্তিগুলোকেও দেখা গেল। ওদের উল্লসিত চিৎকার শুনে বোঝা গেল ওরা এবার গাড়িটাকে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছে।

এলিজা হতাশায় ভেঙে পড়ে হ্যারিকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরল, জিমের মা আর্তস্বরে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতে লাগল। জর্জ আর জিম শক্ত মুঠোয় পিস্তল দুটো আঁকড়ে ধরে নিশ্চল পাথরের মতো চুপচাপ বসে রয়েছে।

পিছু ধেয়ে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ যত কাছে এগিয়ে আসছে, গাড়িটা ততই জোরে ছুটে চলেছে। হঠাৎ এক সময়ে বেশ বড় একটা বাঁক নিতেই গাড়িটা গভীর একটা খাদের প্রান্তে এসে পৌঁছল দুদিকেই মসৃণ খাড়া পাহাড় একেবারে সোজা প্রাচীরের মতো অনেকখানি ওপরে উঠে গেছে। সামনে ত্রিশ ফুটের বেশি গভীর একটা গিরিখাদ। হঠাৎ নিচে তাকালে মনে হবে ওরা যেন একটা ঝুলন্ত পাথরের চাতালের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আর মাথার ওপরে ভোরের রাঙা আলোয় উজ্জ্বল আকাশটার দিকে তাকালে মনে হবে পৃথিবী থেকে নির্বাসিত হয়ে যেন ছোট্ট একটা জায়গায় বন্দি হয়ে রয়েছে।

এই জায়গাটা ফিনিয়াস ফ্লেচারের খুব ভালোই চেনা। এক সময়ে সে ছিল সুদক্ষ শিকারি। বন্দুকের নিশানা ছিল যেমন অব্যর্থ, তেমনি তার সাহসও ছিল দুর্জয়। গহন অরণ্য আর দুর্গম গিরিকন্দরে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিল তার নেশা। পরিচিত এই জায়গাটাতে পৌঁছবার জন্যেই সে এতক্ষণ প্রাণপণ শক্তিতে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল।

ঘোড়ার রাশ টেনে গাড়ি থামিয়ে সে বলল, ‘এইখানে আমরা পৌছে গেছি!’ তারপর নিজেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে এল। ‘চটপট সবাই বেরিয়ে এসো। আমার সঙ্গে ওপারের ওই পাহাড়টায় যেতে হবে। মাইকেল, তোমার ঘোড়াটা গাড়ির সঙ্গে যুতে গাড়িটাকে আমারিয়ার ওখানে ছুটিয়ে নিয়ে যাও। ওই লোকগুলোর সঙ্গে মোলাকাত করার জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমারিয়া আর ওর ছেলেগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এসো।’

ততক্ষণে সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।

ফিনিয়াস হ্যারিকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, ‘তোমরা দুজনে মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে এসো। এবার কিন্তু প্রাণপণ শক্তিতে ছুটতে হবে।

কাউকেই বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার দরকার হলো না। জিম তার বৃদ্ধা-মাকে কাঁধে তুলে নিল, জর্জ এলিজার হাত শক্ত করে ধরে ফিনিয়াসের পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। এত ব্যস্ততার মধ্যেও এলিজা কিন্তু পুঁটলি দুটোকে সঙ্গে নিতে ভোলো নি। মাইকেলও নিমেষে নেমে ঘোড়াটাকে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে আগের পথেই দ্রুত ফিরে গেল।

খাঁড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছানোর পর ফিনিয়াস বলল, ‘চলে এসো। এটা আমাদের শিকারের পুরনো আস্তানা।’

নক্ষত্র আর ভোরের প্রথম আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল সরু একটা পায়ে-চলা পথ খাদটার মধ্যে দিয়ে সোজা ওপরে উঠে গিয়ে অন্য পাহাড়ে পড়েছে।

ফিনিয়াস হ্যারিকে কাঁধে নিয়ে পাহাড়ি ছাগলের মতো পাথর টপকে টপকে খাদের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছল, ওর পেছনে আর সবাই। এখান থেকে পথটা এমন সংকীর্ণ হয়ে গেছে যে একজনের বেশি পাশাপাশি হাঁটা সম্ভব নয়। পথটার একপাশে খাড়া পাহাড়, অন্য পাশে আগাছায় ভরা গভীর বড় খাই। খুব সন্তর্পণে খানিকটা এগুনোর পর, শেষ প্রান্তে দেখা গেল হাত-দুয়েক চওড়া ফাটল, যেটা একটা পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়টাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফাটলটার ওপারে ছোট্ট একটা চাতাল, চাতালের গা থেকে দুর্গপ্রাচীরের মতো ক্রমশ ঢালু হয়ে উঠে গেছে রুক্ষ পাহাড়। ফিনিয়াস অনায়াসে এক লাফে ফাটলটা পেরিয়ে এসে হ্যারিকে শেওলা জমা মসৃণ একটা পাথরের ওপর বসিয়ে দিল, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, ‘ওখান থেকেই সোজা লাফিয়ে পেরিয়ে এসো। কোনো ভয় নেই, কিন্তু খুব সাবধানে।’

এক এক করে সবাই চাতালটাতে পৌঁছল। চাতালের ঠিক সামনে পড়ে রয়েছে বুক- সমান উঁচু আলগা কয়েকটা পাথরের টুকরো, যার ওপর দাঁড়ালে নিচের পাহাড়টাকে স্পষ্ট দেখা যায়। ফিনিয়াস প্রথমেই হ্যারি পরে মেয়েদের সেই নিরাপদ পাথরের আড়ালে সরিয়ে দিল, তারপর পাথরের ওপর দিয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যাস, এবার যদি কেউ এসে আমাদের ধরতে পারে তো ধরুক। যেই আসুক না কেন, একজন একজন করে তাদের ওই পথটা দিয়েই আসতে হবে। আশা করি পথটা নিশ্চয়ই তোমাদের পিস্তলের টার্গেটের মধ্যে পড়বে?’

‘হ্যাঁ।’ দৃঢ়স্বরে জর্জ বলল। ‘সত্যিই আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এবার যা কিছু দায়িত্ব সব আমাদের। যুদ্ধ যদি করতে হয় আমরাই করব।’

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে খাদের পারের চাতালটায় ঘোড়াসওয়ারিদের দেখা গেল। চিৎকার চেঁচামেচি আর পথশ্রমে ওদের মুখগুলো টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ঘোড়াগুলো রীতিমতো হাঁফাচ্ছে ভোরের আলোয় বিশাল বপু থলথলে চেহার টম লকার আর মার্কাসকে চেনা গেল। বাকি সবাই ওদের ভাড়া করা লোক। দলের সঙ্গে দুজন পুলিশ কর্মচারীও রয়েছে।

পাহাড়ের ওপারে পলাতকের দলটাকে দেখতে পেয়ে সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠল। ওদের মধ্যে থেকে কে যেন টম লকারকে বলল, ‘টম, ব্যাটারা এবার ফাঁদে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে।

‘হ্যাঁ, এই পথটা দিয়ে গিয়েই ওরা ওখানে পৌঁছেছে’, টম বলল। ‘এখন ওদের আর পালাবার কোনো পথ নেই। আমি পথটা দিয়ে গিয়েই ওদের পাকড়াও করব। তোমরাও আমার পেছন পেছন এসো।’

মার্কস বলল, ‘কিন্তু ওরা যদি পাথরের আড়াল থেকে আমাদের ওপর গুলি চালায়, তখনকি ব্যাপারটা সুবিধের হবে বলে তোমার মনে হয়?’

‘আরে, দূর! ছাড়তো ওদের কথা।’ বিদ্রূপভরা গলায় টম হেসে উঠল। ‘নিগ্রোরা হলো ভীরুর জাত। ওরা আবার কি গুলি চালাবে শুনি?’

‘তুমি জানো না টম, এক এক সময় ওরা পাকা শয়তানের মতো লড়ে যায়।’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে মার্কস দ্বিধাজড়ানো স্বরে বলল।

মার্কসের কথা শুনে টম চটে উঠল। ‘সব সময়ই খালি নিজের চামড়া বাঁচাবার ধান্দা।’

‘কিন্তু কোন দুঃখেই বা আমি নিজের চামড়া বাঁচানোর চেষ্টা করব না তুমিই বলো?’

এমন সময় জর্জ একখানা পাথরের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে বেশ শান্তভাবে পরিষ্কার গলায় বলল, ভদ্রমহোদয়গণ, ওখানে আপনারা কে এবং কী চান?’

টম লকার চেঁচিয়ে বলল, ‘আমরা পলাতক একদল নিগ্রো ক্রীতদাসকে চাই। ওদের মধ্যে জর্জ হ্যারিস, এলিজা হ্যারিস, তাদের ছেলে, জিম শেলডম আর একটা বুড়ি আছে। আমাদের সঙ্গে পুলিশ এমন কী পরোয়ানাও রয়েছে। আমরা ওই লোকগুলোকে চাই। শুধু তাই নয়, আমরা ওদের ধরবও। তুমিই তো কেন্টাকির শেলবি কাউন্ট্রির মিস্টার হ্যারিসের ক্রীতদাস জর্জ হ্যারিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ, আমিই জর্জ হারিস। একসময়ে কেন্টাকির মিস্টারর হ্যারিস আমাকে তাঁর সম্পত্তি বলেই দাবি করতেন। কিন্তু এখন আমি স্বাধীন মানুষ, ঈশ্বরের স্বাধীন ভূমির ওপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার স্ত্রী আর ছেলেকে আমার নিজেরই বলে দাবি করি। জেমি শেলডন আর তার বৃদ্ধা মাও এখানে রয়েছে। আত্মরক্ষা করার মতো যথেষ্ট অস্ত্রও আমাদের সঙ্গে আছে। যদি চান আপনারা নিশ্চয়ই আসতে পারেন। প্রথমেই যে আমাদের গুলির আওতার মধ্যে এসে পড়বে, তাকেই খতম করে দেব। তারপরে যে আসবে তাকে, তারপরেও কেউ যদি আসে তাকেও। এমনিভাবে শেষ মানুষটিকে পর্যন্ত আমরা হত্যা করব।

বেঁটে, গাট্টাগোট্টা চেহারার একটা লোক রুমালে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে এসে বলল, ‘আরে বাপু, থামো থামো। দেখছ তো আমরা পুলিশের লোক। এখন মিছেমিছি না তোড়পিয়ে সোজা নেমে এসো। ধরা এক সময় পড়তেই হবে। আইন আমাদের দিকে, শক্তি আমাদর প্রচুর ‘

‘আমি জানি আইন আপনাদের দিকে, শক্তিও আপনাদের প্রচুর। আপনারা ইচ্ছে করলেই আমার স্ত্রীকে নিউ অর্লিয়েন্সের হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে দিতে পারেন, আমার বাচ্চাটাকে গরুবাছুরের মতো দাসব্যবসায়ীর খোয়াড়ে পুরে রাখতে পারেন। ছেলেকে শাস্তি দিতে না পেরে যে তার বুড়ি মাকে চাবুক মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, সেই শয়তানটার কাছে জিমের বুড়ি মাকেও পাঠিয়ে দিতে পারেন। আমাকে আর জিমকে দারুণ নির্যাতন সহ্য করার জন্যে পাঠিয়ে দিতে পারেন সেই লোকগুলোর কাছে, যাকে আপনারা বলেন মনিব। আপনাদের দেশের আইন আপনাদের সমস্ত কাজকে সমর্থন করবে। কিন্তু আমরা এখন মুক্ত, স্বাধীন। আপনাদের আইনকে আমরা মানি না, আপনাদের দেশকে আমাদের দেশ বলে স্বীকার করি না। পরমেশ্বরের অসীম আকাশের নিচেই আমরা স্বাধীন মানুষেরই মতো দাঁড়িয়ে আছি। যিনি আমাদের স্বাধীন করেছেন, তাঁর নামে শপথ করে বলছি : মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্যে আমরা সংগ্রাম করে যাব।

পাথরের উপর দাঁড়িয়ে মুক্তকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা করার সময় জর্জের মুখখানা ভোরের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দীপ্ত আবেগে ঝিকমিক করছিল তার কালো চোখ দুটো, যেন সমগ্র নিপীড়িত জাতির সে এক জ্বলন্ত প্রতীক। জর্জের সেই উদ্দীপ্ত বলিষ্ঠ মূর্তি দেখে সবাই ক্ষণিকের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কেবল মার্কসই যা এর ব্যতিক্রম। সবার অলক্ষে পকেট থেকে পিস্তলটা বার করে জর্জের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে গুলি করল। তারপর কোটের হাতায় পিস্তলের নলটা মুছতে মুছতে বলল, ওকে জীবিত বা মৃত যে অবস্থাতেই ধরে নিয়ে যাও না কেন, একই টাকা পাওয়া যাবে।

চকিতে জর্জ এক লাফে পেছনে সরে গেল, এলিজা ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল। গুলিটা জর্জের চুল আর এলিজার চিবুক ঘেঁষে সোজা গিয়ে বিঁধল ওপরের একটা গাছের গুঁড়িতে। ঠিক মুহূর্তে সরে না গেলে গুলিটা নির্ঘাৎ জর্জের বুকে লাগত।

জর্জ দ্রুত বলে উঠল, ‘ভয় নেই, এলিজা; আমার কোনো ক্ষতি হয় নি।‘

ফিনিয়াস বলল, ‘দেখো জর্জ, বক্তৃতা যদি দিতে হয় তো আড়ালে গিয়ে দাও। ওরা অসম্ভব নীচ, ওদেরকে আদৌ বিশ্বাস করা উচিত নয়।’

জর্জ বলল, ‘জিম তোমার পিস্তল দুটো ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার সঙ্গে তুমিও ওই পথটার ওপর নজর রাখো। যে লোকটাকে প্রথম দেখা যাবে, আমি তাকে গুলি করব। তুমি গুলি করবে তার পরেরটাকে। একজনের ওপর দুটো গুলি ছুড়ে গুলি নষ্ট করার কোনো দরকার নেই।’

‘কিন্তু যদি না মারতে পার?

‘মারবই।’ জর্জের কণ্ঠস্বরে উত্তেজনার কোনো আভাস নেই।

মার্ক গুলি ছোড়ার পর শত্রুদল নিচে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে লাগল। ওদের মধ্যে একজন বলল, ‘সাবাস, মার্কস্! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয়ই একজনকে খতম করতে পেরেছ। কেননা আমি একজনের আর্তনাদ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি।’

‘আমিও একটাকে মারতে যাচ্ছি। নিগ্রোদের আমি ভয় পাই না। কে আমার সঙ্গে যাবে চলে এসো।

কথাটা বলেই টম লকার গুঁড়ি পথটা ধরে ধীরে ধীরে এগুতে লাগল।

জর্জ টমের কথাগুলো স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল, তাই পিস্তলটা বের করে ভালো করে পরীক্ষা করে নিল, তারপর ফাটলটার ঠিক ওপরে প্রথমেই যেখানে লোকটাকে দেখা যাবে সেইদিকে লক্ষ্য স্থির রেখে অপেক্ষা করতে লাগল।

দলের সবচেয়ে সাহসী লোকটা এগিয়ে আসছে টমের পেছন পেছন, তারও পেছনে রয়েছে অন্য সবাই। অমন বিশাল চেহারা নিয়ে স্বেচ্ছায় টমের পক্ষে যত দ্রুত ওপরে ওঠা সম্ভব ছিল, পেছনের ধাক্কায় সে আরো দ্রুত ওপরে উঠতে লাগল। এমনিভাবে চলতে চলতে অল্পক্ষণের মধ্যে গর্তের ঠিক মুখটার সামনেই তাকে দেখা গেল। জর্জও সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালাল।

গুলিটা সোজা গিয়ে বিঁধল টমের পাঁজরায়। কিন্তু আহত হওয়া সত্ত্বেও টম পিছিয়ে গেল না, বরং ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো ক্রুদ্ধ গর্জন করে সে এক লাফে ফাটলটা পেরিয়ে এল আর ফিনিয়াসও সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে দুহাত দিয়ে তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘আমাদের এখানে তোমাকে কোনো দরকার নেই, বন্ধু। তুমি স্বচ্ছন্দে বিদায় হতে পারো।’

পেটা লোহার মতো বলিষ্ঠ দুহাতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে টিম ডালপালা ভেঙে, ঝোপঝাড় নিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল ত্রিশ ফুট খাদের নিচে। খাদের মধ্যে বড় একটা গাছ ছিল, তার ডালে টমের পোশাক আটকে না গেলে সে নিশ্চয়ই মারা যেত। অবশ্য ডালটাও তার অমন বিশাল দেহের ভার ধরে রাখতে পারল না, ভেঙে টমকে নিয়ে সোজা পড়ল একেবারে নিচে।

‘ওরা পাকা শয়তান। করতে পারে না হেন কাজ নেই!’ বলতে বলতে মার্কসই প্রথম পিছু হটল এবং যতটা উৎসাহ নিয়ে সে এগোতে শুরু করেছিল, তার চাইতেও বেশি উৎসাহ নিয়ে সে পিছিয়ে গেল। তার দেখাদেখি দলের অন্যরাও তাকে অনুসরণ করল। বিশেষ করে বেঁটে, মোটাসোটা চেহারার সেই পুলিশ কর্মচারীটির অবস্থা তখন সত্যিই দেখার মতো।

ওপারের ফাঁকা জায়গাটাতে পৌঁছেই মার্কস বলল, ‘তোমরা ওইদিক দিয়ে ঘুরে টমের দেহটাকে তুলে আনো, আমি ততক্ষণে ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে দেখে আসি সাহায্যের জন্যে কিছু লোকজন পাওয়া যায় কি না।’

মার্কসের যা কথা সেই কাজ। ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে সে চোখের নিমেষে উধাও হয়ে গেল।

একজন বলল, ‘লোকটা কেমন শয়তান দেখেছ? আমাদের এরকম বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে বাবু দিব্যি কেটে পড়লেন!’

অন্য একজন বলল, ‘চলো ওখান থেকে আমরা টমের দেহটাকে তুলে নিয়ে আসি। লোকটা বেঁচে আছে না মরে গেছে সেটা একবার দেখা দরকার।’

পাহাড়ের একটা পাশ দিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে টমের আর্তনাদ অনুসরণ করে ওরা খুব ধীরে ধীরে নামতে লাগল, তারপর একসময় খাদের নিচে পৌঁছে গেল।

একজন বলল, ‘টম, তোমার কি খুব লেগেছে?’

গোঙাতে গোঙাতে টম বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে কি তোমরা ওপরে তুলতে পারবে বলে মনে হয়? ওই কদাকার শয়তানটার মাথায় বাজ পড়ুক। আজ ও যদি ওদের সঙ্গে না থাকত, তাহলে ওদেরই কাউকে না কাউকে এখানে এসে পড়তে হতো।’

সবাই মিলে খুব কষ্টে টমের দেহটাকে কোনোরকমে টেনে-হিঁচড়ে ওপরে তুলে নিয়ে এল, তারপর বয়ে নিয়ে গেল ঘোড়াগুলো, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান পর্যন্ত। বেচারি টম লকারের অবস্থা তখন সত্যিই সঙ্গীন। অনেক কষ্টে হাঁফাতে হাঁফাতে সে বলল, ‘কষ্ট করে তোমরা যদি কোনোরকমে আমাকে ওই সরাইখানাটা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পার খুব ভালো হয়। ক্ষত জায়াগাটায় চেপে ধরার মতো তোমরা কেউ আমাকে একটা রুমাল বা ওইরকম কিছু দিতে পারো? কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।‘

জর্জ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দেখল লোকগুলো টমকে ঘোড়ার পিঠে তুলে জিনের ওপর বসাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু বার কয়েক ও-রকমভাবে চেষ্টা করার পর একসময় টমের দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

এলিজা বলল, ‘আশা করি লোকটা নিশ্চয়ই মারা যায় নি!’

ফিনিয়াস বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে ওকে ওখানে ফেলে রেখে সবাই পালাচ্ছে!’

সত্যিই তাই। টমের বন্ধুরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন পরামর্শ করল, তারপর টমকে সেখানেই ফেলে রেখে যে যার ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলে গেল।

চোখের সামনে থেকে সওয়ারিদের শেষ চিহ্নটুকু মিলিয়ে যাবার পর ফিনিয়াসকে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেল।

‘এখান থেকে মাইল দুয়েক পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে। বলা যায় না, পথে হয়তো ওদের সঙ্গে আবার দেখাও হয়ে যেতে পারে। তাই লোকজন নিয়ে মাইকেল ফিরে আসলে খুব ভালো হতো। কেননা এত সকালে এ পথে লোক চলাচল প্রায় করে না বললেই চলে। ওদের কাছ থেকে সাহায্য পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবশ্য একবার যদি কোনোরকমে ওই মাইল-দুয়েক পথ পেরোতে পারি, তাহলে ওরা আমাদের আর কোনোদিনই ধরতে পারবে না।’

তারপর সবাই একএক করে পাথরের আড়াল ছেড়ে ধীর ধীরে নিচে নামতে শুরু করল। ওঠার চাইতে নামার কাজটা ছিল আরো বিপজ্জনক। তা সত্ত্বেও সবাই নিরাপদে খাদের ওপারের চত্বরটাতে গিয়ে পৌঁছল আর তখনই দূরের ঢালু পথটাতে গাড়ি নিয়ে মাইকেলকে ফিরে আসতে দেখা গেল। ওদের পেছনে কয়েকজন ঘোড়সওয়ারও রয়েছে।

‘আরে, মাইকেলের সঙ্গে আমারিয়া আর স্টিফেনকেও দেখতে পাচ্ছি!’ উপচে ওঠা খুশির সুরে ফিনিয়াস বলে উঠল। ‘যাক, এবার কোনো ভয় নেই। এখন বলতে পারি আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।’

টমের দেহটার ওপর ঝুঁকে পড়ে এলিজা বলল, ‘লোকটা যেভাবে পড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে, আমার মনে হয় ওর একটা কিছু ব্যবস্থা করা উচিত।’

‘হুঁ আমারও তাই মনে হচ্ছে!’

ফিনিয়াস টমের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষতস্থানটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখল।

টম ক্ষীণস্বরে বলল, ‘কে, মার্কস?’

টমের ভুল ভাঙিয়ে দেবার জন্যেই ফিনিয়াস বলল, ‘না, তোমার বন্ধু নিজের পিঠ বাঁচাবার জন্যে অনেক আগেই সরে পড়েছে।

‘মনে হচ্ছে আমার দফা শেষ’, কোনোরকমে শ্বাস নিতে নিতে টম বলল।

‘কুকুরের মতো মরে পড়ে থাকার জন্যেই ওরা আমাকে ওখানে ফেলে পালিয়েছে। এরকমটা যে ঘটবে আমার মা প্রায়ই আমাকে বলতেন।’

‘আহারে, বেচারি!’ কথাটা শুনে জিমের মার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। ওর জন্যে আমার সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে।’

‘গুলিটা মাংসের মধ্যেই বিঁধে আছে, হাড়ে গিয়ে লাগে নি। সেদিক থেকে ক্ষতি হবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু রক্ত বন্ধ করতে না পারলে কোনো মতেই বাঁচানো যাবে না।’

টম আরো ক্ষীণস্বরে বলল, ‘ও, আপনিই আমাকে খাদটার নিচে ফেলে দিয়ে ছিলেন?’

‘হ্যাঁ, ঠিক সময়ে না ফেললে তুমিই আমাদের সবকটাকে ওই খাদের মধ্যে ফেলতে। উঁহুঁ, অত ছটফট করো না, আগে ভালোভাবে বাঁধতে দাও।’ ক্ষতস্থানে সম্পূর্ণ একটা রুমালি ঠেসে দিয়ে গলার মাফলারটা জড়িয়ে শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে ফিনিয়াস বলল।

‘তখন আমি তোমাকে খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলাম, এখন আমিই তোমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে নিজের মায়ের চাইতে কোনো অংশে কম যত্ন পাবে না। মনে রেখো, আমরা তোমার বন্ধুদের মতো অকৃতজ্ঞ নই।’

চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে টম অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে। টকটকে লালচে মুখখানা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। দৈত্যের মতো অমন বিরাট চেহারার মানুষটাকে এখন ছোট্টো একটা শিশুরই মতো অসহায় মনে হচ্ছে।

ইতোমধ্যে দলবল নিয়ে মাইকেলও সেখানে এসে পড়েছে। বড় একটা মোষের চামড়াকে চার ভাঁজ করে পেতে তার ওপর ধরাধরি করে টম লকারকে শুইয়ে দেওয়া হলো। টম কিন্তু তখন সম্পূর্ণ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। গাড়িতে উঠে জিমের মা-ই প্রথম টমের মাথাটা নিজের কোলের ওপর তুলে নিল। এলিজাও যথাসাধ্য শুশ্রূষা করার চেষ্টা করল।

আগের মতো জর্জ আর জিম সামনের আসনে গিয়ে বসতেই ফিনিয়াস গাড়ি ছেড়ে দিল। মাইকেলের দলবল ঘোড়ায় চড়ে আসতে লাগল পেছন পেছন।

এক সময়ে জর্জ হ্যারিস জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি মনে হয় লোকটাকে বাঁচান যাবে?’

‘নিশ্চয়ই। বেশ জোর দিয়েই ফিনিয়াস কথাগুলো উচ্চারণ করল, ‘দেহ থেকে অনেকখানি রক্ত বেরিয়ে গেছে বলেই ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, নইলে আঘাত তেমন মারাত্মক নয়।’

অনুতপ্ত গলায় জর্জ বলল, ‘লোকটা মারা গেলে নিজেকে আমার সত্যিই অপরাধী মনে হতো।’

‘হ্যাঁ, কাউকে খুন করাটা খুবই জঘন্য কাজ। তা সে মানুষ হোক, কিংবা পশুই হোক। তুমি হয়তো জানো না, একসময় আমি খুব নামকরা শিকারি ছিলাম। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিল আমার নেশা। একবার একটা হরিণীকে দেখামাত্রই গুলি করেছিলাম। মরার সময় জলভরা চোখে এমন করুণভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল যে যন্ত্রণায় আমার বুকের ভেতরটা পর্যন্ত মুচড়ে উঠেছিল। সেই থেকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আর কোনোদিনও বন্দুক ছোঁব না।’

‘ধন্যবাদ, মিস্টার ফ্লেচার’, চাপাগলায় জর্জ বলল, ‘আপনার কথাটা আমার চিরকাল স্মরণে থাকবে।’

প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পর গাড়িটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর একটা খামারবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সেখানেই অতিথিদের জন্যে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করা হলো। ডোরকাস নামে একজন বয়স্কা মহিলার তত্ত্বাবধানে টমকে শুইয়ে দেওয়া হলো ধবধবে সাদা চাদরপাতা নরম একটা শয্যায়। টমের জ্ঞান ফিরে আসার পরপরই তাকে বিদায় জানিয়ে অতিথিরা আবার দূরের পথে যাত্রা শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *