১০. একটু বেলা বাড়তেই

১০.

একটু বেলা বাড়তেই সুদীপ্তবাবু এসে হাজির হলেন! এখনও তাঁর চোখ লাল! মাথার চুল উসকোখুসকো। মুখ দেখলেই বোঝা যায় কাল রাতের কথা বিস্মৃত হননি। সম্ভবত কাল রাতের খোঁয়াড় কাটতেই আবিষ্কার করেছেন যে বাদলরা ওঁর বাড়িতে নেই। নিজের ব্যবহারের কথাও মনে পড়ে গেছে। তাই একেবারে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির!

বাদলের মনে ওঁর সম্পর্কে কোনও অভিযোগ ছিল না। সুদীপ্ত ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। সে শান্তভাবেই সুদীপ্তর দিকে তাকায়। আসুন দাদাভাই।

রূপসা… রূপসা এখন কেমন…? ইতস্তত করতে করতে বললেন তিনি।

আগে থেকে একটু ভালো।

কাল রাতে নেশার ঘোরে কী বলতে কী বলে ফেলেছি ভাই…! ভদ্রলোক খপ করে বাদলের হাত জড়িয়ে ধরলেন। আত্মগ্লানি ও অনুতাপ তাঁর মোমের মতো মুখে ফ্যাকাশে ছাপ ফেলেছে। তাই বলে এমন করে চলে আসতে হয়? বরং উলটে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিতে পারতে! কিন্তু এভাবে বাড়ি ছেড়ে কেন চলে এলে! প্লিজ ফিরে চলো।

তাঁর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল বাদল, অভিমান করিনি দাদাভাই। তবে আপনি ঠিকই বলেছেন! এ দেশটাকেই তো আমার বলার অধিকার অনেক আগে হারিয়েছি আমরা। এবং সেই সঙ্গেই অজান্তেই আপনার বাড়িতে থাকার অধিকারও বহু আগে হারিয়ে গেছে। সেজন্যই চলে এসেছি।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন সুদীপ্ত। বুঝলেন, হয়তো শত অনুরোধেও আর ফেরানো যাবে না ওদের। ঘা-টা আজকের নয়। বহু। পুরনো ক্ষতে হাত পড়ে গেছে। ব্যথা টনটনিয়ে উঠেছে আবার।

ইতিমধ্যেই ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। লায়লা ফিরে এসেছে। এর মধ্যেই কখন যেন টুক করে সিঁদুরের দাগটা চুল দিয়ে আড়াল করেছে। লাল টিপ খুলে ফেলেছে। খুলে ফেলেছে শাঁখাও। মেয়ের নজরে পরিবর্তনটা পড়েনি। এখন তার মুখে নিশ্চিন্ততার ছাপ। মেয়েকে উঠে বসতে দেখে একটু আশান্বিত হয়েছে। বুকে একটু বলও বোধহয় পেয়েছে। কিন্তু আচমকা সুদীপ্তকে দেখে থমকে গেল! তাকে একটু আশঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বাদলের কাছে সরে এসে জিজ্ঞাসা করে, তোমায় যে ডাক্তারবাবু ডেকেছেন বলল। কথা হয়েছে?

বাদল মাথা নাড়ল, হ্যাঁ হয়েছে। উনি বললেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রূপসার হার্ট অপারেশন করাতে হবে। মেজর অপারেশন। এখানে হবে না। কলকাতায় যেতে হবে।

কলকাতা! সুদীপ্ত ও লায়লা, দুজনেই চমকে ওঠে! লায়লার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। অপারেশন মানে কাটাছেঁড়া! ওইটুকু মেয়ের হৃৎপিণ্ডে ছুরি কাঁচি চালাবে ডাক্তাররা! অতটুকু কোমল হৃদয় কেটে ফেললে আর কি জোড়া যাবে? মেয়ে বাঁচবে কি?

লায়লা অবুঝের মতো মাথা নাড়ে, না…না! অপারেশনের দরকার নেই! চলো, আমরা ফিরে যাই। রূপসাকে তার থেকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে নিয়ে যাব। ও তো অনেকটাই সুস্থ এখন…

বাদল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। লায়লা, এ সুস্থতা সাময়িক। অপারেশন না করালে রূপসা সুস্থ হবে না।

সুদীপ্ত এতক্ষণ কী যেন ভাবছিলেন। এবার আস্তে আস্তে বললেন, বাদল ঠিকই বলছে। ডাক্তারবাবু যদি বলে থাকেন যে মেজর অপারেশন, তবে সাতক্ষীরাতেও হয়তো হবে না। কলকাতাই বেস্ট অপশন। ওরা আর কিছু বলেছে?

হ্যাঁ। বাদল জানায়। বলেছে দরকার পড়লে ওরা কলকাতার হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। কাল সকালেই তবে রূপসাকে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।

তুমি কিছু বলেছ?

বাদল মাথা নাড়ে।

কেন?

সে একটু ইতস্তত করছে। ডাক্তারবাবু বলেছেন বড় টাকার ধাক্কা…!

লায়লা জেদি গলায় আবার বলে, তবে দরকার নেই। চলো, ফিরে যাই।

আঃ, লায়লা! মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে, কোমল অথচ বিরক্ত স্বরে বলে বাদল, একটু চুপ করবে?

বাদল! বয়স্ক মানুষটি বাদলের কাছে এসে আন্তরিক স্বরে বলেন, যদিও জানি বলার মুখ নেই। কাল তোমাদের সঙ্গে যা করেছি তারপর আর বিশ্বাস করো কথাটা বলা যায় না। তবু বলছি, আমি অত বড় জানোয়ারও নই! অন্তত একবার সুযোগ দেবে ভাই? যে পাপ করেছি তার ক্ষমা নেই। আমি ঠিক সেই কাজটাই করেছি যা ওই ধর্মান্ধ লোকগুলো করেছিল। তুমি যদি একবার বিশ্বাস রাখো…!

বাদল কয়েকমুহূর্ত কী যেন ভাবে। একটা দ্বিধা, একটু সংশয় তার মুখে ছায়া ফেলে, কিন্তু দাদাভাই, অনেক টাকা লাগবে যে।

আমি আছি তো!

সে তবু একটু ভাবল। কয়েকমুহূর্ত ভাবার পর আস্তে আস্তে বলল, আচ্ছা, তবে চলুন ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলে আসি।

দুজন হাঁটতে হাঁটতে ডা. দত্ত-র কেবিনের দিকে চলে যায়। লায়লা সজল ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাদের গমন পথের দিকে…

.

পরদিন সকালবেলাই ফাস্ট আওয়ারে রূপসাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সাদা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে হাসপাতালের সামনে। স্ট্রেচারে করে রূপসাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। সুদীপ্ত নিজেই উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশি টাকা ভারতীয় টাকায় বদলে দিয়েছেন। যে লোকটা ঠিকমতো মিথ্যে কথাও বলতে পারে না, তার জন্য জাল প্রমাণ জরুরি! নয়তো মুখ ফসকে কী বলে ফেলবে ঠিক নেই। তিনি বাদলকে একটা মোবাইলও জোগাড় করে দিয়েছেন। বাদল প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল। মোবাইল সে ব্যবহার করতে জানে না। এমন নয় যে তাদের গ্রামের ছেলে-ছোকরারা মোবাইল ব্যবহার করে না। কিন্তু সে নিজে কখনও এই যন্ত্রটির প্রতি আকর্ষণ বোধ করেনি। বরং মুঠোফোনের প্রতি একটু বিতৃষ্ণাই আছে। যখন তখন সময়ে অসময়ে বেজে ওঠে। তার প্রতিবেশী আনিসুরকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেখেছে সে। সে বেচারির শুয়ে, বসে, খেয়ে, ঘুমিয়েও শান্তি নেই। সর্বক্ষণই কানের কাছে মোবাইল বাজছে!

দাদাভাই, এটার কী দরকার…!

দরকার আছে বাদল। তিনি ওর বুকপকেটে যন্ত্রটা রেখে দিলেন, আমি তো ওখানে সবসময় তোমাদের সঙ্গে থাকতে পারব না। তোমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসব টাকিতে। কোনওরকম দরকার পড়লে যোগাযোগ করবে কী করে? আমিই বা ততোমাদের খবর জানব কী করে? হেমন্তকে রোজ রূপসার আপডেট দিতে হবে যে।

বাদল যেন একটা অদ্ভুত হজবরল প্রাণীর পাল্লায় পড়েছে। বিপন্ন ভাবে বলল, আমি তো এটা ব্যবহার করতেই জানি না!

একদম সহজ। এই তো, এই বোতামটা টিপলে…! সুদীপ্তবাবু মোবাইলের ডেমন্সট্রেশন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাদল ও লায়লাকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছেন যে কীভাবে ফোন করতে হয় বা ফোন ধরতে হয়।

সেই ফাঁকেই রূপসা প্রাণপণে মুখ ভেঙুচাচ্ছিল তার মিতাকে। মিতাও উত্তর দিচ্ছিল নানারকম মুখভঙ্গি করে। অর্জুন সিং রাওয়াত আজও সিভিল পোশাকে। রূপসা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, মিতা, তোমায় যে ভোঁদড়ের মতো দেখায়!

ভোঁ-দ-ড়! অর্জুন সিং রাওয়াত বলে, উয়োহ কী চিজ আছে। মিট্টি?

উয়োহ ভাল চিজ আছে। মিট্টি মাথা চুলকে বলে, যদিও আমি চোখে দেখিনি। ছবিতে দেখেছি।

তো কলকত্তা মে দেখ লে না! সে হাসছে, তুমতো কলকত্তা যাবি। উধার জু আছে, মালুম তুম কো? উধার ভোঁদড় ভি আছে, হালুম ভি আছে!

মিট্টির মুখ বিমর্ষ৷ মিতা, আমি কলকাতা যাব না!

কিঁউ? অর্জুন তার মাথায় হাত বোলায়, কলকত্তা বহুত আচ্ছা জগাহ আছে,

কলা বহুত আচ্ছা। সে নাক সিঁটকেছে– পচা জায়গা আছে। হেমন্ত দাদাভাই বলেছে ওখানে গাছপালা নেই জানো? খালি নাকি বড় বড় বাড়ি আর শুধু গাড়ি আর গাড়ি। পুকুর নেই, মাঠ নেই, গাছ নেই!

গাছ নেই তো ক্যায়া। অর্জুন মুখভঙ্গি করে, মেরি মিট্টি উধার যায়েগি। সাথ গাছ লেকর যায়েগি। কলকত্তায় বহুত সারে পেড় পুঁতে আসবে মিট্টি।

হ্যাঁ। মিট্টি বলল, আমি পেড় পুঁততে যাই, আর পুলিশ আমায় ধরুক। ওখানে কিছু করলেই পুলিশ ধরে জানো? আর পুলিশগুলো খুব রাগী। লাল লাল চোখ, ইয়াব্বড় গোঁফ, হাতে ডান্ডা আর পেল্লায় ভুঁড়ি।

পুলিশ মিট্টিকে পাকড়াবে? সে ছদ্মরাগে বলে, তো হামভি পুলিশকো পাকড়াবে। উসকি ডান্ডাসে আচ্ছা পিট্টি দিয়ে দেবে!

তুমি পুলিশকে পেটাবা! হাঁ হয়ে গেছে মিট্টি।

জরুর! হাম ভি কুছ কম নেহি! অর্জুন এমনভাবে হাতা গোটাচ্ছে যেন এখনই সে পুলিশকে ধরে কয়েক ঘা বসিয়ে দেবে, অ্যায়সা ওয়সা লোগ থোড়াই আছে হাম হাম ভি মাউড়া আছে…!

মিট্টি উৎসাহিত হয়, তুমিও তবে আমার সঙ্গে যাবা?

অর্জুনের হাসিমুখ বিষণ্ণ হয়ে যায়। তার পক্ষে কি যাওয়া সম্ভব? সে চিরকালই সীমান্তে থাকে। দেশের হৃদয়ে যাওয়ার সময় বা সুযোগ হয় কই?

মিট্টি যেন বুঝতে পারে তার মনের কথা। অভিমানে তার চোখ ভিজে আসে। ধরা গলায় বলল, তুমি যাবা না, তাই না মিতা?

অর্জুন কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে, যাবে। হাম ভি যাবে।

না তুমি যাবা না! আমি বুঝেছি। মিট্টির কণ্ঠস্বর কান্নাভেজা—আমার গ্রাম ছেড়ে এলাম। এখন তোমাকেও ছেড়ে যেতে হবে। ওখানে আমার কী হবে মিতা? অতবড় শহরে যদি আমি হারিয়ে যাই?

অর্জুনের চোখও সজল হয়ে আসে, অ্যায়সা নহি বোলতে পাগলি। তুমহারা মা-বাবা হ্যায় না? এইসে ক্যায়সে হারিয়ে যাবি? তুম উধার বড়া সা অসপাতাল মে যাবে। বড়া বড়া ডাগদার লোগ তুমকো দেখবে। তুম ফিট, তন্দুরস্ত হো কর আনা। ফির ইস মাউড়া কো লে যানা কলকত্তা ঘুমাতে।

কিন্তু আমি যদি আর না ফিরি?

এই অদ্ভুত হাহাকার অর্জুনের বাপের প্রাণকে বিচলিত করে তোলে। সে দুহাতে মিট্টির মুখ চেপে ধরে, অ্যায়সা নেহি বোলতে হ্যায়। লাডো জরুর ফিরবে। হাম ভি আয়েগা তুমকো দেখনে৷

আসবা তো?

জরুর আউঙ্গা।

অভিমানে মিট্টির অধর স্ফুরিত হয়, তুমি যদি না আসো, তবে আমিও ফিরব না! দেখে নিয়ো..ফিরব না…ফিরব না…ফিরব না!

অর্জুনের পিতৃহৃদয় কেঁপে ওঠে! কী বলছে মেয়েটা! মিট্টির চোখ অভিমানে ছলছল করছে। তার ছোট্ট দেহটাকে সবাই মিলে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়। পিছনের সিটে লায়লা ও বাদল উঠে বসে। ড্রাইভারের পাশে বসলেন সুদীপ্তবাবু।

অ্যাম্বুলেন্সের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার যান্ত্রিক ঘড়ঘড় শব্দ! পরক্ষণেই একরাশ ধুলো উড়িয়ে চলে গেল সাদা গাড়িটা।

অর্জুন অপলকে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। অ্যাম্বুলেন্সটা তার দৃষ্টিপথ থেকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়।

.

এখনও সেইভাবেই সে তাকিয়ে ছিল কাঁটাতারের ওপ্রান্তে। দুষ্টু দুষ্টু মুখটা আর বলবে না, মিতা, মেলায় যাব। তুমি আমায় নিয়ে যাবা?

এবারও পানিত্তারে বিরাট মেলা বসেছে। কাল থেকে কত আলো, কত রোশনাইয়ে ভেসে যাচ্ছে মাঠ, জনপদ। কত তার ধমক, চমক। এই মেলায় ভারত-বাংলাদেশ এক হয়ে যায়। যেমন এক হয়ে যায় দুর্গামূর্তি ভাসানের সময়। দুই বাংলার মিলনমেলাও বলা যায় এই পানিত্তারের মেলাকে।

গত বছরও এই মেলায় প্রচুর ভিড় হয়েছিল। সারি সারি দোকান ক্রেতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। নাগরদোলা হু-উ-স করে মাটি ছুঁয়েই ফের উঠে যাচ্ছিল আকাশের দিকে। কত মানুষ, কত শিশু ভিড় করে এসেছে মেলা দেখতে। আলোর মালায় ঝলমল করছে। পানিত্তারের মেলা কলরবে, কোলাহলে জমজমাট!

সেদিন চুপিচুপি কাঁটাতারের ওপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল মিট্টি। তার মুখ করুণ। অর্জুন পেট্রোলিং থেকে সদ্য ফিরেছিল। মিট্টিকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে, ক্যায়া বাত হ্যায় মিট্টি? মুড খরাব?

মিট্টি কোনওরকম ভণিতা ছাড়াই বলে, ও মিতা, তুমি আমায় মেলায় নিয়ে যাবা? সেই সকাল থেকে বলছি, কেউ নিয়ে যায় না।

কিঁউ? তুমহারা মা-বাপু?

সে ঘাড় নাড়ল, বাবা স্কুলের ছেলেদের নিয়ে চড়ুইভাতি করতে গেছে। আর মায়ের সময় নাই। আনিসুর দাদাকে বললাম। বলে,মেলায় দেখার আছেটা কী? ওসব বাচ্চাদের জন্য। বলতে বলতেই মিট্টি নাক মুখ কুঁচকেছে, আচ্ছা বলো, আমি কি বাচ্চা নই? বুড়ি দামড়ি?

অর্জুন তার নাক টিপে দেয়, নেহি তুম বাচ্চা নেহি, তুম তো ফুলনদেবী।

ফাজলামি করবা না। রাগ হয়ে গাল ফুলিয়েছে সে, তুমি নিয়ে যাবা কিনা বলো। নয়তো আমি এখানেই থানা দিয়ে বসে থাকব! খাব না, ঘুমোব না।

অর্জুনের চোখে বাৎসল্য আর দুষ্টুমি, এ ল্লো! কেয়া আজিব লড়কি! ব্ল্যাকমেল ভি করতি হ্যায়!

পিছন থেকে অন্য একজন বাঙালি জওয়ান হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে, অর্জুনভাই, তুমি বরং ওকে নিয়ে মেলাটা ঘুরেই এসো৷ নয়তো এ মেয়ে ছাড়বে না! ভুখ হরতাল করবে বলে হুমকি দিচ্ছে।

ভুখ হরতাল! বাপ রে! অর্জুন ছদ্মভয়ে বলে, এক মিনট ঠাহরো মেরি মা! হাম হোড়া চেঞ্জ করকে আতে হ্যায়।

দেরি করবা না কিন্তু। কচি গলায় ধমক ভেসে আসে।

অর্জুন স্মিত হেসে ভিতরে চলে যায়। উর্দি পালটে সাদা রঙের শার্ট আর নীল জিন্স পরে আসে। মিট্টি তাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।

মেলায় যাবি? ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে বলতে থাকে অর্জুন, মেলায় যাবি, মেলায় যাবি, মেলায় গোলগাপ্পা খাবি?

মিট্টি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে! তারপর বলে, তুমি ওদিক দিয়ে আসো। আমি এদিক দিয়ে মেলার গেটের সামনে যাই।

সেদিন দুজনে মিলে ভারী মজা করেছিল। অতবড় মেলা দেখে মিট্টির চক্ষু চড়কগাছ। সে কৌতূহলে ছুটে ছুটে সব দোকানের দিকে দৌড়োয়। অর্জুনও তার পিছন পিছন। পাছে মেয়েটা হারিয়ে যায়। মিট্টি মনের সুখে ফুচকা খাচ্ছে। অর্জুন ফুচকা না খেলেও পাশে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকে দেখে। তার বিকট হাঁ করে ফুচকা মুখে পোরার ভঙ্গি দেখে আপনমনেই ফিক করে হেসে ফেলে। তেঁতুলজলের টকে বা ঝালে সে নানারকম উদ্ভট উদ্ভট মুখভঙ্গি করে। অর্জুন কখনও হেসে ফেলে। কখনও তার গাল টিপে দেয়। মিট্টি ফাউ দেওয়া নিয়ে ফুচকাওয়ালার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে। সে বাধা দেয় না! এই যে ছোট্ট মেয়েটা তার মিতার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে মেলায়– সে যেন আসলে বেড়াতে আসেনি। মেলাটাই যেন শুধু তার আসার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। একটা দুষ্টু মেয়ের হাসিতে মেলা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। সে চাপবে বলেই এই এতবড় নাগরদোলা আকাশচুম্বী মাথা হুস করে নামিয়ে আনছে তার পদপ্রান্তে! মিট্টি নাগরদোলায় চাপলে অর্জুনকেও টেনে তোলে। তার দুষ্টুমির কাছে রাজপুতি গাম্ভীর্যও লোপ পেয়েছে। মিট্টিও দৌড়োয়, তার হাত চেপে ধরে অর্জুনও নানা দোকানে ঘুরে বেড়ায়। বেলোয়ারি চুড়ির নানা রঙে সে মিট্টির দুহাত ভরিয়ে দেয়।

ইয়ে লো লাল, ইয়ে পিলা, ইয়ে হরা…। কতরকমের কাঁচের চুড়িতে ভরে গেল শিশুকন্যার হাত! সে দুহাত ঝাঁকায়। কাঁচের চুড়ি মধুর শব্দে ঝমঝম করে ওঠে আনন্দে। তার শীর্ণ মুখ উজ্জ্বল– এগুলো সব আমার?

সব তেরা হ্যায়। অর্জুন সিং রাওয়াত তার চুল আদর করে ঘেঁটে দেয়, পতা হ্যায়? যব তু চলতি হ্যায়, তেরি প্যায়র মে উয়োহ পায়ল বজতি হ্যায়, তব মুঝে মেরি গাঁও কি বহোত ইয়াদ আতি হ্যায়! মেরি বেটি ভি তেরা য্যায়সা হি হ্যায়। যব চলতি হ্যায়, তব উসকি পায়ল ভি বজতি হ্যায়। উসে ভি চুড়িয়া বহোত পসন্দ হ্যায়! বলতে বলতেই থেমে যায়। চোখদুটো তার বিষণ্ণ হয়ে আসছিল। বোধহয় ফেলে আসা সংসারের ছবি কয়েকমুহূর্তের জন্য মনে ছাপ ফেলে দেয়।

মিট্টি সেটা লক্ষ করে। তাড়াতাড়ি হাত থেকে খুলতে শুরু করে বেলোয়ারি চুড়ি।

আরে…মত খোল! অর্জুন বাধা দেয়, ভাল লাগছে।

অর্ধেক চুড়ি খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে সে, আর্ধেক হলেও ভাল লাগবে।

অর্জুন কাঁচের চুড়িগুলো হাতে নিয়ে স্তম্ভিতের মতো তাকিয়ে থাকে। সে হতভম্ব!

ওগুলো তোমার মেয়ের জন্য। মিট্টি একগাল হাসল, যখন দেশে যাবা, তখন ওকে দিয়ে বলবা তোমার মিতা বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছে। বলবা না?

আচমকা চোখে জল এসে গিয়েছিল অর্জুনের। সামলে নিয়ে বলল, জরুর।

তুমি তোমার মেয়েকে মিতার গল্প বলবা তো?

জরুর বলবে।

মিট্টির মুখ বিষণ্ণ হয়ে যায়, দেশে গিয়ে আমার কথা ভুলে যাবা না তো মিতা?

কভি নহি!

অর্জুন সিং বিড়বিড় করে আপনমনেই বলে, তোমার কঁহানি হামি সবাইকে বলবে মিট্টি। রাজিস্তান কে গাঁও গাঁও মে সব জানেঙ্গে মেরি মিট্টি কো উয়ো হুরি, পরি নেহি থি। উয়ো সির্ফ ইনসান থি, ইনসান থি…!

ইচ্ছামতী স্মৃতি ভারাক্রান্ত বুকেই ছলছলিয়ে চলে যায়…

.

মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

রূপসার প্রশ্নে মৃদু হাসল লায়লা, আমরা আরও বড় একটা হাসপাতালে যাচ্ছি। দেখবা খনে, কত্ত বড় ঝকঝকে হাসপাতাল! সেখানে কত লোক! কত বড় বড় ডাক্তার। সবাই সেখানে গেলে ভাল হয়ে যায়! সব রোগ সেরে যায় ওখানে গেলে।

সব রোগ সেরে যায়! রূপসা অবাক–তা হলে কলকাতার লোকেরা কি মরে যায় না?

লায়লা কেঁপে ওঠে। এ কী অলুক্ষুনে কথা! মুখে বলে, ও কী কথা!

বা রে! সব রোগই যদি সেরে যাবে, তবে তো কেউ মরবেই না! কলকাতার লোকেরা বুঝি অমর!

লায়লা এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। বাদল তখন অন্যমনস্ক। অ্যাম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে বাইরের ছবি দেখছে। সেই এক পুকুর-ডোবা, সেই একই ধানখেত, একই আকাশ, একই রঙের মাটি! রোজ সকালে সে দাঁতন করতে করতে যেভাবে আপনমনে মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেত, এখানেও সেই একই মেঠো পথ যেন তেমনভাবে হেঁটে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে! এক কিশোরী পুকুরে স্নান করছে। বয়েস কতই বা হবে– রূপসার বয়েসি! রূপসাও ইচ্ছে করলে এমন করেই স্নান করতে পারে। বাদল অবাক হয়ে ভাবে, এই দেশটাও একদিন তারই ছিল। এই মেঠো পথ, পুকুর, আলপথ সবই তার বহু বছরের অতীত বুকে নিয়ে বসে আছে। এই যে পানকৌড়িটা জলে ডুব দিল, এই যে মাছরাঙা জলের ওপর দিয়ে উড়ে গেল, এই যে বড় বড় প্রবীণ বটগাছের ঝুরি নেমে এসেছে, অথবা এই যে দ্বাদশী এলোকেশী জলসিক্ত কিশোরীর কাজলচোখের সরল অভিমানী দৃষ্টি– ওরা কি বাদলকে চেনে? এই যে মাটির বাড়ির সামনে মার্বেল খেলছে যে বালক, অথবা খড়ির দাগ টেনে এক্কা দোক্কা খেলছে যে বালিকা, উন্মুক্ত মাঠে কাটা ঘুড়ির পিছনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে যে ছেলেরা– ওরা কি জানে যে বাদল ওদের নিকটাত্মীয়!

বাদলের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভাগীরথীর পাড়ে তাদের বাড়ির অবিন্যস্ত টুকরো টুকরো ছবি! বাপ-দাদার মুখে সে ভিটের কথা অনেকবার শুনেছে। মনে হল সেই স্মৃতিগুলো তাকে ক্রমাগত টানছে। যেন অদ্ভুত অভিমানে বলছে, তুমি কি সব ভুলে গেছ? না আজও মনে আছে…

আমার কাছে এখনও পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো!
থুতনি প’রে তিল তো তোমার আছে
এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?
চিঠি তোমায় হঠাৎ লিখতে হল
চাবি তোমার পরম যত্নে কাছে
রেখেছিলাম, আজই সময় হল
লিখিও, উহা ফিরত চাহো কি না?
অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু-ঝলোমলো
লিখিও, উহা ফিরত চাহো কি না?

ঠিক তখনই তার মনে পড়ে যায় দাদামশায়ের গাওয়া সেই গানটা। মৃত্যুর আগে খুব গাইতেন। আজ আরও একবার যেন স্মৃতির বুক থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর–

এ যে নয়নের জল, হতাশের শ্বাস, কলঙ্কের কথা, দরিদ্রের আশ,
এ যে বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে গভীর মরমবেদনা
এ কি শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছে কথা ছলনা?
আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না…!

কতক্ষণ তার হুঁশ ছিল না কে জানে। কানের কাছে তখনও যেন বেজে চলেছে দাদামশায়ের কণ্ঠস্বর! চোখের সামনে সেই চিরপরিচিত মূর্তি! ভাঙা হৃদয়ের এক ব্যথিত বাঙালি ইজিচেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছেন! হাওয়ার ধাক্কায় প্রদীপের নিবু নিবু শিখার মতো তাঁর কম্পিত অস্ফুট কণ্ঠস্বর! চোখ বেয়ে নম্র অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে হয়তো অজান্তেই। কাঁপা কাঁপা বয়স্ক গলাটি অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাকে যেন অনুরোধ করে চলেছে, আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না…!

শুনছ! কলকাতা এসে গিয়েছি বোধহয়!

চতুর্দিকে গাড়ির আওয়াজে ও লায়লার কথায় বাদলের সংবিৎ ফেরে। কলকাতা শহর চলে এসেছে! সামনে লম্বা গাড়ির লাইন! চতুর্দিকে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির লাইনে, সিগন্যালের লাল চোখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে সব চতুষ্পদ বাহন!

ভাই…। বাদল সবিনয়ে অনুরোধ করে ড্রাইভারকে, হুটারটা বাজিয়ে ভিড়টা কাটানো যায় না?

সামনে সিগন্যাল দাদা। ড্রাইভার উত্তর দেয়, বিরাট লাইন। কেউ কাউকে জায়গা ছাড়বে না! হুটার বাজালে বিরক্ত হবে। গালাগালি দেবে। কী করব বলুন। রাস্তা তো আমার বাপের নয়, সরকারের!

কথাটা শুনে সে আরও কুঁকড়ে গুটিসুটি মেরে বসল! ড্রাইভার কী করে জানবে যে এই রাস্তা বাদলের বাপের তো নয়ই, এমনকী তার সরকারেরও নয়!

.

১১.

হাসপাতালের আই সি ইউ-র বেডে শুয়ে রূপসা পিটপিট করে চতুর্দিকে তাকায়। নানারকম মুখভঙ্গি করছে সে। একবার এসির দিকে তাকায় পরক্ষণেই বিড়ালের মতো গুটিসুটি মেরে বসে হু হু করে। বুঝিয়ে দেয় যে তার শীত করছে। কর্তব্যরত নার্স সেটা লক্ষ করে। এসির মাত্রা সামান্য কমিয়ে দিয়েছে। তার গম্ভীর মুখে এক ঝলক হাসি ভেসে ওঠে।

হাই মম। হাউ আর ইউ টু ডে?

রূপসা অবাক হয়ে দেখে তার উলটোদিকের বেডে এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা শুয়ে আছেন। আর তাঁকে দেখতে এসেছে তাঁর ছেলে! ছেলের পরনে বারমুডা, হাওয়াই শার্ট! দাড়ি গোঁফ কামানো! বিস্ময়ে রূপসার চোখ গোলগোল হয়ে যায়। এ আবার কী জাতীয় অবতার!

মম-এর উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। সেটা লক্ষ করেই ছেলেটি বলল, ডোন্ট ওরি মম। ইউ উইল বি ওকে…

সে বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই বাধা।

এই যে! শোনো!

কচি গলার ডাকে অবাক হয়ে সেদিকে তাকায় লোকটা। দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে হাত নেড়ে তাকে ডাকছে।

মি?

হ্যাঁ রে বাবা! তুমিই। রূপসা ফিচিক করে হেসে ফেলে, তুমি কি মাউড়া?

হো-য়া-ট? ছেলেটা প্রায় লাফিয়ে ওঠে, কী?

মাউড়া! তার চোখে-মুখে দুষ্টু হাসি খেলা করছে, তুমি কি মাউড়া?

লোকটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কী বলবে বুঝতে পারে না। কোনওমতে বলল, মাউড়া? না তো!

মাউড়া নও? রূপসা সপ্রতিভ ভাবে বলে, তবে হাউহাউ করে কথা বলছ কেন? আমাদের গ্রামে যারাই হাউহাউ করে কথা বলে, বাবা তাকে মাউড়া বলে। বলতে বলতেই সগর্বে ঘোষণা করে, আর আমার বাবা কখনও মিথ্যে কথা বলে না। তবে তুমি নিশ্চয়ই মাউড়া?

না! আমি বাঙালি।

তুমি বাঙালি! বাংলা শেখোনি বুঝি?

হাউ ডেয়ার ইউ! লোকটা এবার রীতিমতো খেপে গেছে, কে বলেছে বাংলা শিখিনি? অফকোর্স শিখেছি।

তা হলে তোমার মা কি মেমসাহেব? মায়ের সঙ্গে বিদঘুঁটে ভাষায় কথা বলবা কেন? বাংলায় কথা বলতে লজ্জা করে? রূপসা বলতে বলতেই ফিকফিক করে হেসে ফেলে, আর এটা কী পরেছ? এ রাম! হাফপ্যান্ট! আমাদের গ্রামে ছোট ছোট ছেলেরা হাফপ্যান্ট পরে। তুমি তো রীতিমতো দুম্বা। তবে হাফপ্যান্ট পরেছ কেন?

লোকটার ফরসা মুখ লাল হয়ে ওঠে। অস্ফুটে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়! চাপা গলায় বলে, ডিসগাস্টিং!

কর্তব্যরত নার্স কোনওমতে উৎকট মুখ করে হাসি চেপে আছে! ছেলেটির মা-ও অক্সিজেন মাস্কের পেছনে হেসে ফেলেছেন। একজন সুদর্শন ডাক্তার এতক্ষণ অন্য একজন পেশেন্টকে চেক করছিলেন। এবার গটগট করে রূপসার দিকে এগোলেন। সম্ভবত কথাগুলো তাঁর কানে গেছে। সুন্দর হাসি হেসে বললেন, উনি বাঙালি। তবে আমি কিন্তু মাউড়া। আমার নাম ডা. অসীম গোয়েঙ্কা।

পাঁচ টাকার রসগোল্লা খাওয়ার মতো হাঁ করল রূপসা, ও মা! তুমি মাউড়া! কিন্তু কেমন সুন্দর বাংলা বলছ। তারপর বাঙালি ছেলেটার দিকে তাকিয়েছে, কী মজা! বাঙালি মাউড়ার মতো কথা বলে, আর মাউড়া বাংলা বলে!

ছেলেটির আর সহ্য হয় না। সে গটগট করে চলে যায়। নার্স এবার হেসে বলে, উনি বোধহয় রেগে গেলেন স্যার।

বেশ হয়েছে। ওকে মিস বাঙালি! ডা. গোয়েঙ্কা বললেন, দয়া করে জিভটা বের করুন। একটু দেখি।

অ্যাঁ অ্যাঁ। রূপসা আধহাত জিভ বের করে। ডা. গোয়েঙ্কা চেক করলেন। তারপর চোখ, পালস রেট, হার্ট বিট একে একে চেক করে রূপসার গাল টিপে দিলেন, সুইট বেবি!

তার একদম মুখোমুখি বেডে এক বৃদ্ধ উঠে বসেছিলেন। তাঁকে দেখতে অনেকটা হেমন্ত দাদাভাইয়ের মতো। রূপসার মাথায় ফের দুষ্টুবুদ্ধি চেপেছে। সে জিভ বের করে লোকটিকে ভ্যাংচায়, ই-লি বি-লি বি-লি!

কী সর্বনাশ! বৃদ্ধের কপালে ভাঁজ পড়েছে। ভুরু কুঁচকে গেছে। আশেপাশের সিরিয়াস পেশেন্টদের যন্ত্রণাকাতর মুখে হাসি ভেসে ওঠে! অথচ বুড়োর মুখ পুরো ফুলকো লুচি! রূপসা এবার পুরো ট্যারা হয়ে গেছে! নিজের চোখের তারা গড়িয়ে গড়িয়ে নাকের কাছে নিয়ে এসেছে! বুড়োর মুখ আরও গোমড়া হল। শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে চোখ বুজে শুয়েই পড়লেন!

যাঃ! রূপসা মুখ কাঁচুমাচু করে হাল ছেড়ে দিয়েছে! ডা. গোয়েঙ্কা তার হাবভাব লক্ষ করে হেসে ফেলেছেন। মৃদু হেসে বললেন, মিস বাঙালি, আপনার নাম কী?

রূপসা।

ওকে মিস রূপসা, কোথায় থাকেন আপনি?

রূপসা মিটিমিটি হেসে বলে, আমি কিন্তু এ দেশে থাকি না।

সে তো বুঝেছি৷ ডা. গোয়েঙ্কা বললেন, আপনি চাঁদে থাকেন। মাঝেমধ্যে ভুল করে ডানাদুটো খুলে চলে আসেন তাই না?

না রে বাবা! আমি তো ওই…! রূপসা চোখ গোলগোল করে তার দেশের কথা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই বাদল তাড়াতাড়ি পিছন থেকে এসে বাধা দেয়। ভিজিটিং আওয়ার্সে সে আর লায়লা রূপসাকে দেখতে এসেছিল। তার আগের কথাগুলো বাদলের কানে গেছে। সন্ত্রস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি এসে বলে, আমরা টাকিতে থাকি।

ডক্টর হেসে ফেললেন, ও আচ্ছা! টাকিতে থাকেন।

রূপসা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবা মিথ্যে কথা বলছে! এমন ঘটনা তার ছোট্ট জীবনে আর ঘটেনি! বিহ্বল হয়ে সে তাকিয়ে থাকে। একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, একবার মায়ের দিকে! যেন কিছুই মিলছে না। সরল জীবনে চলতে চলতে আচমকা একটা জটিল অঙ্ক মা-বাবার রূপ ধরে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে! যার উত্তর বালিকা কিছুতেই মেলাতে পারছে না!

ভারী মিষ্টি মেয়ে আপনার! অ্যাবসোলিউট ডার্লিং! তার গাল আরেকবার টিপে দিয়ে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। বাদল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তার বুকের ভিতরটা তখনও গুড়গুড় করছে। সে একটা চেয়ার টেনে রূপসার পাশে বসে পড়ে। রূপসার কানে ফিসফিস করে বলল, মা, কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবি, আমরা টাকিতে থাকি কেমন? আর আল্লাহ বলবি না।

রূপসা কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। তার বড় বড় চোখে বিপন্নতা! আগে ঠিকমতো লক্ষ করেনি। এতদিনে তার নজরে পড়ল মা যেন ঠিক মা নয়! তার মা সিঁদুর পরে না, লাল টিপ পরে না! হাতে শাঁখা পরে না, ঘোমটা টানে না! তবে মায়ের বদলে এ কে! বাবা যেন বাবা নয়, দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনও মূর্তিমান বিভীষিকা! সে ভয় পায়। এসব কী ঘটছে! এমন বিপন্নতা সে তার ছোট্ট বারো বছরের জীবনে কখনও অনুভব করেনি। নিজের গ্রাম ছাড়ল, মিতা ছাড়ল, এখন আল্লাও তাকে ছেড়ে গেল! এমনকী নিজের বাবা-মাকেও চিনতে পারছে না! এ কোথায় এসে পড়ল রূপসা!

তার বড় বড় চোখে বিপন্ন অসহায়তা ফুটে ওঠে। তারপর ভয়ার্ত স্খলিত গলায় বলে, তোমাদের কী হয়েছে? আমি তোমাদের চিনতে পারছি না কেন?

.

আমি কে?

লোকটার মুখ বিষণ্ণ হয়ে আসে– সত্যিই তো! আমি কে? রূপসা জানত তার বাবা মিথ্যেবাদী নয়! মরে গেলেও তার বাবা মিথ্যে বলবে না! অথচ সেই লোকটাই ওকে মিথ্যে কথা বলতে শেখাচ্ছিল! ছোট্ট প্রাণটা সব কিছু সহ্য করেছিল। মায়ের মাথার সিঁদুর, হাতের শাঁখা দেখেও কোনও প্রশ্ন করেনি। কিন্তু তার বাবার নৈতিক অধঃপতন আর সহ্য হল না! কী করে বুঝব যে ও এত অভিমান করবে যে…!

বলতে বলতেই থামল। তারপর নির্লিপ্ত মুখে বলল, কী করে বোঝাব যে আমি মিথ্যে কথা বলতে চাইনি। অথচ উপায় কী ছিল?

সে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে–

বাতাস আমাকে লম্বা হাত বাড়িয়ে
চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে আজ সারাদিন
কয়েকটা লতাপাতা নিয়ে
বিদঘুটে বাতাস,
হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে আমাকে,
লাল পাগড়ি-পরা পুলিশের মতো কৃষ্ণচূড়া
হেঁকে বলল:
তুমি বন্দি!
আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক
গোয়েন্দার মতো ঘুরছে
যেন অ্যাভিনিউ পার হয়ে নির্জন সড়কে
পা রাখলেই আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে ঠিক!

রূপসা সেদিন বিছানায় মুখ লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল! তার কান্নার কারণ কেউ জানে না। ওইটুকু মেয়ের মনের ভিতরে কত বড় বেদনাবোধ, কতবড় একাকিত্ব সেদিন জন্ম নিয়েছিল তার খবর কেউ রাখেনি। তার স্বভাবগত বাঁচালতা ওই একরাতেই নিস্তব্ধতায় পরিণত হয়েছিল। নার্সরা, ডাক্তাররা, এমনকী আশেপাশের পেশেন্টদের সঙ্গে আর একটিও কথা বলেনি সে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছে যেন কথা বলা বারণ! কথা বললেই কেউ শাস্তি দেবে!

শুধু মধ্যরাত্রে কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে এসেছিলেন বর্ষীয়সী মেট্রন। রূপসা প্রাণপণ কান্না চাপার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।

অতটুকু মিষ্টি মেয়ে! এমন হাপুশ নয়নে কাঁদে কেন? মেট্রন তার মাথা স্পর্শ করলেন, কী হয়েছে মা? কাঁদছ কেন?

স্নেহের স্পর্শটুকু পেয়ে রূপসার কান্না উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সে মেট্রনকে জড়িয়ে ধরে– আমি এখানে থাকব না আমি বাড়ি যাব!

বাড়ি যাবে তো! মেট্রন আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করেন, আর কয়েকদিন এখানে থাকো। একদম সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবে!

না আমি আজই বাড়ি যাব। এখানে থাকব না! রূপসা বারবার অবুঝের মতো এদিক ওদিক তাকায়। কাকে যেন খোঁজে আর গভীর নিঃসঙ্গতায় অসহায় ভাবে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাড়ি যাব…বাড়ি যাব…!

যদি জানতেম আমার কীসের ব্যথা তোমায় জানাতাম
কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম
কোথায় যে হাত বাড়াই মিছে, ফিরি আমি কাহার পিছে–
সব যেন মোর বিকিয়েছে, পাই নি তাহার দাম ॥

সে রাতে বাদলেরও ঘুম হয়নি। মনে পড়ে যায় রূপসার সেই বিহ্বল দৃষ্টি। মনে পড়ে যায় তার সেই অদ্ভুত চেয়ে থাকা! সে নিজের বাবা মাকে চিনতে পারেনি! যে বাবাকে সবচেয়ে ভালবাসত, সবচেয়ে বড় আসন দিত, আচমকা সেই আসনচ্যুত হল তার বাবা! কতবড় দাগা পেল ওইটুকু মেয়ে। অপরাধের বোঝা ক্রমাগতই ভারী হচ্ছে! বাদল বিড়বিড় করে শুধু বলে।

বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
আপন বাসনা মম
ফিরে মরীচিকাসম।
বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে
বক্ষে ফিরিয়া পাই না
যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,
যাহা পাই তাহা চাই না।

তার চোখ বেয়ে জল পড়ে। সে হাঁটুতে মুখ গুঁজে চুপ করে বসে থাকে। লায়লা মেঝেতে চোখ বুজে শুয়েছিল। বাদল ভেবেছিল হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার বন্ধ চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা অশ্রুবিন্দু।

.

১২.

তখন সকাল। আকাশে মেঘ করেছে ঠিকই, কিন্তু মেঘের পেছন থেকে একটা দুষ্টু রোদের রশ্মি যেন কাঠবিড়ালির মতো লুকোচুরি খেলছে। রোদের রংটা ফ্যাকাশে, কিন্তু দৃপ্ত! হাসপাতালের বাইরে একটা নাম না জানা একা গাছ দাঁড়িয়ে আছে। তার পাতায় পাতায় আলোছায়ার খেলা চলছে। যেখানে রোদ পড়ছে সেখানে পাতাগুলো সোনালি-সবুজ আর যেখানে ছায়া, সেই পাতাগুলোয় ঘন কালচে সবুজ রং। ধরেছে!

বাদলের চশমার কাঁচে ঝলমল করছিল সকালের রোদ। সে ভারাক্রান্ত মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কখন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সংবিৎ ফিরল লায়লার ডাকে।

শুনছ?

হ্যাঁ।

ওরা আমাদের খুঁজছে। বারবার রিসেপশনে দেখা করতে বলছে। তুমি শোনোনি?

চলো। বাদল এস্তব্যস্ত হয়ে এগিয়ে যায়। এখানেও সে বাদল চৌধুরী লায়লা, লীলা চৌধুরী কান্ট্রি ইন্ডিয়া, কাস্ট হিন্দু, ব্রাহ্মণ–এখনও সে শুধু বাদল চৌধুরী নামটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই নাম অ্যানাউন্স করলেও লক্ষ করেনি।

রিসেপশনে তখন দুজন সুন্দরী মহিলা। এই সাতসকালেই ভয়ংকর সেজেগুজে এসেছে। একজন লাল লিপস্টিক মেখে এমন ঠোঁট লাল করেছে যে সন্দেহ হয়, বুঝি এইমাত্র রক্ত খেয়ে এল। মহিলা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, বাদল চৌধুরী, রাইট? রূপসা চৌধুরীর ফ্যামিলি তো আপনারা?

হ্যাঁ।

ইমিডিয়েটলি পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা করুন।

বাদল আকাশ থেকে পড়ে। তার কাছে এই মুহূর্তে সাকুল্যে দশ হাজার টাকা পড়ে আছে! সে ইতস্তত করে বলে, এখনই দিতে হবে?

নেই?

এই মুহূর্তে তো…! বাদল দশ হাজার টাকা বের করে এগিয়ে দেয়। লাল লিপস্টিক পরা মহিলা একমুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা বরং একবার মেডিক্যাল সুপারের সঙ্গে দেখা করুন। উনি যা বলবেন তেমনই হবে।

সুপার ভদ্রমহিলা কিন্তু বেশ অমায়িক। ভদ্রমহিলার নাম ভ্রমর প্রজাপতি। যদিও চেহারার সঙ্গে ভীমরুলেরই সাদৃশ্য বেশি! একেবারে জাঁদরেল। আবলুশ কাঠের মূর্তির মতো পেল্লায় মহিলা! নাকের নীচে রীতিমতো প্রকট গোঁফের রেখা! ভগবান জানেন, যে ওঁকে দেখে হার্ট পেশেন্টের অভিভাবকদেরই হার্টফেল হয় কি না! বাদল আর লায়লারও গলা প্রায় শুকিয়ে এসেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি হাসলেন, সে মুহূর্তেই বোঝা গেল– মানুষটি বহিরঙ্গে যাই হন, অন্তরে সুন্দর!

আপনারা রূপসা চৌধুরীর পেরেন্টস তো?

আজ্ঞে!

ভ্রমর বললেন, ভারী মিষ্টি মেয়ে আপনাদের। খুব কো-অপারেট করছে। বলতে বলতেই মৃদু মৃদু হাসলেন, যদিও ও প্রথমেই আমাকে কাকু বলে ডেকে ফেলেছে, এবং পরে আমি মহিলা জেনে আপনার রেজারটা ধার নিয়ে ক্লিন শেভড হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, তবু বলতে বাধা নেই– শি ইজ আ ব্রাইট গার্ল!

সর্বনাশ! রূপসা শেষে মহিলা সুপারকেই দাড়ি-গোঁফ চাঁছতে বলে বসে আছে! বাদল ভয়ে কাঠ হয়ে বসে থাকে। গোঁফের বদলে মহিলা ছাল-চামড়াই না তুলে নেন!

আমাকে রিসেপশন থেকে জানানো হল যে আপনাদের কাছে এখনই অ্যাডভান্সের টাকাটা নেই।

বাদল তাড়াতাড়ি দশ হাজার টাকা বের করে দেখায়, আপাতত এইটুকুই আছে দিদি…!

দিদি শব্দটা বলে ফেলেই সভয়ে তাকাল সে। কে জানে, এখানে হয়তো ম্যাডাম বলারই চল। যদি মহিলা কিছু মনে করে বসেন।

ভ্রমর হাসলেন, ঠিক আছে আপাতত তাড়ার কিছু নেই। তবু একটু আগেভাগে দিলেই ভাল হয়। মেডিকেশনের একটা খরচ তো আছেই। অপারেশনের টাকা আলাদা। টোটাল দেড়লাখ টাকা পড়বে। পঞ্চাশ হাজারটা জাস্ট অ্যাডভান্স। বাকি টাকাটা অপারেশনের পর দিলেই চলবে।

দেড়লাখ! বাদল কিছুক্ষণ অসহায়ের মতো লায়লার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর যেন কোনওমতে ধাক্কাটা গিলে নিয়ে যন্ত্রবৎ বলে, আচ্ছা!

রূপসা ঠিক হয়ে যাবে তো?

লায়লার প্রশ্নটা অবিকল হাহাকারের মতো শোনাল। ভ্রমর তার দিকে তাকিয়ে শান্ত হাসল, অফকোর্স! ডক্টর রমানাথনের নাম শুনেছেন? চেন্নাইয়ের নামকরা হার্ট সার্জেন। উনি পরশু এসে পৌঁছোবেন। কলকাতায় রূপসার সার্জারি উনিই করবেন। হি ইজ আ গ্রেট ডক্টর! আপনাদের মেয়ে একদম সুস্থ সবল হয়ে উঠবে। ডোন্ট ওরি!

লায়লা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অস্ফুটে বলে আল…!

পুরো শব্দটা উচ্চারিত হয় না। বাদল খপ করে তার হাত চেপে ধরেছে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হাসি হাসে লায়লা! সে ভুলে গিয়েছিল, এখানে ওই শব্দটি উচ্চারণ করা মানা। কারণ হাসপাতালের রেজিস্টার অনুযায়ী তারা হিন্দু, ব্রাহ্মণ!

.

১৩.

হাসপাতালের সামনের রাস্তার পাইস হোটেলে তিনদিন পরে একটু ভাত-মাছ খায় ওরা। তিনদিন ধরে পেটে একফোঁটা ভাতও পড়েনি। বাদলের মুখে চিন্তার ছাপ। কী করে বাকি টাকাটা জোগাড় করবে বুঝতে পারছে না। রূপসার যে এতবড় অসুখ হবে, তার জন্য এত টাকা লাগবে– আগে ভাবেনি। ভারতে চিকিৎসার খরচ সম্বন্ধে কোনও ধারণা ছিল না। যেটুকু হাতের কাছে পেয়েছে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনেছে। কিন্তু সে অর্থও অপ্রতুল।

বলি কী… লায়লা আস্তে আস্তে বলে, আমার গয়নাগুলো…!

বাদলও একই কথা ভাবছিল। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। লায়লার কথায় সে মাথা নেড়ে সায় দিলেও তার মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ প্রকট। নিজেকে বারবার কাঠগড়ায় তুলছে। আত্মদাহের যন্ত্রণা তার মুখে স্পষ্ট।

হাসপাতাল থেকে খানিকটা দূরেই বড়সড় গয়নার দোকান। খাওয়া দাওয়া সেরে দুজনে গুটিগুটি ঢুকে পড়ল দোকানে। সামনে কাঁচের দরজা। লোকজনের ধাক্কায় ক্রমাগত খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানের বাইরে উর্দিপরা সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। সিকিউরিটি গার্ডকে দেখে ফের অদ্ভুত একটা ভয় বাদলকে চেপে ধরে। সে ঘামতে শুরু করেছে! লায়লা তার হাত চেপে ধরে।

এ কী! এ তো কে ডি এম সোনা! হলমার্ক নয়!

জহুরির মুখ দেখলে মনে হয় এতদিনে তার ওপর যমের করুণা হওয়া উচিত ছিল! বলিরেখায় কাটাকুটি মুখে আরও কয়েকটা এক্সট্রা ভাঁজ ফেলে বললেন, কার গয়না এগুলো?

লায়লা ঢোঁক গিলে জানায়, আমার।

আপনি কোথায় থাকেন? বাংলাদেশে নাকি? জহুরি সন্দিহান দৃষ্টি মেলে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?

বাদলের বুকের ভিতরে মেঘ গর্জন করে ওঠে। সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় লায়লার মুখের দিকে। লায়লার মুখেও আতঙ্ক! লোকটা জানল কী করে? ও কীভাবে জানতে পারে যে এই গয়না এখানকার নয়!

ন নাঃ! না তো! মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে জিভ জড়িয়ে যায় লায়লার। কোনওমতে বলল, আমি এখানেই থাকি।

লোকটার চোখের সন্দেহ আরও গম্ভীর হয়, মা, আপনার যত বয়েস তার দ্বিগুণেরও বেশি সময় ধরে আমি সোনা দেখে আসছি। এই চোখদুটো জীবনে অনেক সোনা দেখেছে। অনেক রকম ডিজাইন দেখেছে। এ সোনার রং আর গয়নার ডিজাইন বাংলাদেশেরই।

শুধু রং আর ডিজাইন দেখেই বোঝা যায় নাকি যে গয়নাটা কোথা থেকে এসেছে? বাদল ক্ষীণ প্রতিবাদ জানায়, এ কীরকম কথা!

সবাই বোঝে কি না জানি না। জহুরি ভদ্রলোক হাসলেন– তবে আমি বুঝি। গয়না ঘেঁটে খাই তো! আমাদের দোকানের অনেক বাংলাদেশি খরিদ্দার আছে। তাদের ওখানকার ডিজাইন পছন্দ হয় না বলে এখান থেকে গয়না গড়িয়ে নিয়ে যায়। ওদের গয়নার স্টাইল, মিনের কারুকার্য, ডিজাইন আমার মুখস্থ। যাকগে, আপনারা যখন বলছেন, তখন হয়তো আমারই ভুল হয়েছে। বাদ দিন। সোনা বেচবেন তো? রসিদ আছে?

রসিদ! দুজন দুজনের দিকে তাকায়। রসিদ নিয়ে আসার কথা তাড়াহুড়োয় ওদের কারওই মনে পড়েনি। লায়লা স্খলিত গলায় বলে, রসিদ তো নেই!

রসিদ নেই! ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ চোখদুটো সন্দেহে আরও ধারালো হয়ে উঠেছে। তিনি একবার দুজনকে ভালভাবে দেখলেন। বলা ভাল, মাপলেন! আস্তে আস্তে বললেন, সে কী কথা মা! একেই এখন তো হলমার্ক ছাড়া আমাদের সোনা কেনার নিয়ম নেই। কে ডি এম গোল্ড সহজে বিক্রি হয় না। তার ওপর রসিদও নেই! একটু থেমে ফের যোগ করলেন, এগুলো চোরাই সোনা নয় তো? আঁ?

বাদলের মনে হল এবার তার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাবে! সে তড়িদাহতের মতো লায়লার হাত ধরে ছিটকে বেরিয়ে যায়। জহুরি পিছনদিক থেকে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলেন, আরে! কী হল? কোথায় যাচ্ছেন…?

দোকানভরতি লোকজন সচকিত হয়ে ওঠে। বাদল সেদিকে ফিরেও দেখে না। তারা দুজন তখন ফুটপাথ ধরে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে যেন এখনই তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাবে কেউ! যেন এক্ষুনি কেউ চিৎকার করে উঠে বলবে, অনুপ্রবেশকারী! অনুপ্রবেশকারী! চোর! চোর!

এক ক্রেতা অবাক হয়ে জহুরির কাছে জানতে চাইলেন, কী হল মশাই! অমন করে পালিয়ে গেলেন কেন ওঁরা?

জহুরি ফের অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কাজ করতে করতে বললেন, গড়বড় কেস। চোরাই মাল বেচতে এসেছিল বোধহয়। বাংলাদেশি সোনা বিক্রি করার ধান্দায় ছিল। অথচ দেখলে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়! চেহারা দেখে বোঝারই উপায় নেই যে…!

ক্রেতাটি সখেদে স্বগতোক্তি করেন, সত্যি! কী দিনকাল পড়েছে। কে যে চোর আর কে নয় দেখে বোঝাই দায়!

জুয়েলারির দোকানটাকে অনেকটা পিছনে ফেলে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ওরা। বাদল পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছছে। লায়লা আঁচলে মুখ মুছল। এই মুহূর্তে আর রোদ নেই। তার বদলে আকাশে জমাট মেঘ। গুমোট গরম! পিচের রাস্তার আগুনজ্বলা উষ্ণতা যেন আকাশের মেঘে ধাক্কা খেয়ে ভ্যাপসা গরম হাওয়ার ঝলক নিয়ে আছড়ে পড়ছে। তার ওপর এই অসহ্য আতঙ্ক! বাদলের মনে হচ্ছিল গোটা কলকাতা শহরই বুঝি ওদের দেখছে। ফুটপাথের হকাররা, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশ, পথচারীরা– এমনকী সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারিরাও ভুরু কুঁচকে দেখছে। ওদের লক্ষ লক্ষ দৃষ্টি যেন ধাওয়া করে জানতে চাইছে, কে বট হে তুমি!

ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে বাদলের মনে হল এ কী অকূল সমুদ্রে এসে পড়েছে! চতুর্দিকে শুধু মানুষের ভিড়! কেউ কারও দিকে দেখছে না! শুধু একরাশ অর্থহীন কালো মাথা পিলপিল করে ঢেউয়ের মতো আসছে আর যাচ্ছে!

আচমকা পুলিশের জিপের হুটার! বাদল বিদ্যুস্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠল। অবধারিত ভাবে মনে হল, জহুরি নির্ঘাত সব বলে দিয়েছে। হয়তো বলে দিয়েছে যে এক দম্পতি বেওয়ারিশ সোনা বেচতে এসেছিল। হয়তো বলে দিয়েছে হুলিয়াও! কে বলতে পারে যে সারা শহরের পুলিশ এখন তাদেরই খুঁজছে না!

সামনেই একটা টিভির শোরুম ছিল। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে টিভিতে খবর দেখছে। পুলিশের জিপ দেখেই বাদল লায়লার হাত ধরে মিশে গেল দর্শকদের ভিড়ে। পুলিশ জিপটা হুটার বাজাতে বাজাতেই চলে গেল। টিভিতে তখন বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডের ফুটেজ দেখানো হচ্ছে।

সংবাদ পাঠিকা বলে চলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড়ে গ্রেনেড বানানো হয়েছিল বাংলাদেশে হামলা চালানোর জন্য। আর এই গ্রেনেড বানানোর কাজে যারা নিযুক্ত ছিল তারা সকলেই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এর সদস্য। ভারতের জাতীয় ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সির মহাপরিচালক শরদ কুমারের বিস্ফোরণ স্থল সহ একাধিক জায়গা পরিদর্শন এবং তদন্তকারী গোয়েন্দাদের সঙ্গে একাধিক পর্যালোচনা বৈঠক শেষে গত শুক্রবার গভীর রাতে এনআইএ-এর এক প্রেস বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২রা অক্টোবর বর্ধমানের বিস্ফোরণ কাণ্ডের তদন্তভার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে আট দিন পরে এনআইএ-র হাতে তুলে দেবার পর পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি মডিউলের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য গোয়েন্দারা হাতে পেয়েছেন।

পাশের লোকটি বলল, তা জঙ্গিগিরি করবি তো বাংলাদেশেই কর! এখানে ঝামেলা করিস কেন?

অন্যজন বলল, নয়তো কী? কত বাংলাদেশি ইললিগ্যাল ইমিগ্র্যান্ট এদেশে এসে জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। সে খবর রাখিস? নিজেদের দেশে জায়গা হয় না, এ দেশে এসে জুড়ে বসেছে। যেন ওদের বাপের জায়গা!

আর সহ্য হল না বাদলের। সে লায়লার হাত ধরে টান মারে। এদের বাক্যালাপ শোনার ইচ্ছে তার আর নেই। ইতিমধ্যেই তার মুখ বিবর্ণ হয়ে এসেছে! আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো সে আত্মহত্যা করবে!

বাদল টলমল পায়ে অনির্দিষ্ট পথে হেঁটে চলল! পা যেন ঠিকমতো পড়তে চায় না। পা দুটো যেন ক্রমাগত কুঁকড়ে আসছে তার। এ মাটি তার নয়। একথা হয়তো পা দুটোও এতক্ষণে বুঝে গেছে! সে নিরুপায়ের মতো চতুর্দিকে তাকায়। কোথায় যাবে! কী করবে? রূপসা…! রূপসা কেমন আছে? টাকাটা জরুরি…!

লায়লা অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ করছিল এক সিঁড়িঙ্গে, কালো চেহারার লোক অনেকক্ষণ ধরেই ওদের পেছন পেছন আসছে! মুখে এমন বীভৎস কাটা দাগ যে দেখলেই ভয় করে। এমনভাবে আসছে, যেন সাধারণ এক পথচারী। কিন্তু লায়লা দেখেছে, ঠিক যেখানে যেখানেই ওরা থামছে, লোকটাও সেখানেই কোনও ছুতোনাতায়। দাঁড়িয়ে পড়ছে। দেখলেই মনে হয়, কোনও মতলব আছে। সে ক্রমাগত আতঙ্কিত হয়ে উঠছে, কিন্তু বাদলকে বলবে বলবে করেও বলতে পারে না! মানুষটা এমনিতেই এখন আশ্রয়হীন, অসহায়ের মতো সিঁটিয়ে আছে। তার মনোযোগ যে কোনদিকে কে জানে। এই পরিস্থিতিতে এ কথা বললে হয়তো আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে! তবু শেষপর্যন্ত বলেই ফেলল লায়লা, শুনছ?

বাদল শুষ্ক, ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দেয়, উঁ?

একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে পিছু নিয়েছে।

কথাটার মর্মার্থ যেন বুঝতে পারে না বাদল, কী?

আর কিছু বলা বা বোঝার আগেই পিছনের লোকটা আচমকা হুড়মুড় করে এসে পড়ল বাদলের গায়ের ওপর! খণ্ড মুহূর্তেই কী হয়ে গেল। কেউ বুঝতে পারল না! একটা হ্যাঁচকা টান! বাদলের হাতে ধরা পুঁটলিটা কোথায় অন্তর্হিত হয়ে গেল কে জানে!

চোর! চোর!

বাদলের গোটা ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল। পরক্ষণেই সে প্রাণপণে কেপমারকে ধাওয়া করল। কিন্তু কলকাতার ভিড়ের মধ্যে কি কাউকে ধাওয়া করা সম্ভব! একে ঠ্যালা মেরে, ওকে ধাক্কা দিয়ে, অনেকের পা মাড়িয়ে দিয়ে প্রাণপণে লোকটাকে চেজ করছে বাদল। চতুর্দিক থেকে বিরক্ত জনগণের উত্তপ্ত গালাগালি গরম শিসার মতো কানে ঢুকছে তার। মুখ চোখ এখন উন্মত্তের মতো। ওই পুঁটলিতে যথাসর্বস্ব আছে ক্যাশ টাকা, লায়লার গয়না! সুদীপ্ত দাদাভাই-এর দেওয়া আই ডি কার্ডগুলোও…! রূপসার অপারেশনের টাকা…!

সামনের লোকটা চতুর চোর! বাদলের মতো আনাড়ি লোকের চোখে ধূলো দেওয়া তার কাছে ছেলেখেলা মাত্র! সে কিছুক্ষণের মধ্যেই এঁকেবেঁকে দৌড়োতে দৌড়োতে ট্রাফিক সিগন্যালের কোন গলি খুঁজিতে ঢুকে গেল কে জানে! বলা ভাল, অন্তর্হিত হয়ে গেল! বাদল অসহায়ের মতো হাঁফাতে হাঁফাতে চতুর্দিকে তাকায়। নেই…লোকটা নেই! ও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে চলে গেল শেষ সম্বলটুকুও! এত কিছু হয়ে গেল, কিন্তু তিলোত্তমার কোনও তাপ উত্তাপ নেই। এই যে এতক্ষণ একটা লোক চোর চোর চিৎকার করতে করতে প্রাণপণে দৌড়োচ্ছিল, একটা মানুষও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি! ট্র্যাফিক পুলিশ একটু বিরক্ত হয়েই একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। যেন চোরের পেছনে দৌড়োনো তার ডিউটির মধ্যে পড়ে না!

শুধু একটা লোকই জানত এই ঘটনার গুরুত্ব কী! সেই মানুষটা, যে এক মুহূর্তের মধ্যেই নিঃস্ব হয়ে গেল! যে একমাত্র সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে লড়াই করতে করতে আচমকা দেখল তার হাতে কোনও অস্ত্র নেই! বাদল কাঁপতে কাঁপতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। ফুটপাথের ওপরে কান্নার শক্তি নেই! বজ্রাহতের মতো রাস্তাতে বসে জনগণের ঠ্যালা, লাথি খেতে থাকল সে! যেন একটা পুতুল! কোনও চেতনা নেই তার! শুধু ভেবে চলেছে– এবার কী হবে! কী হবে!

তাকে বসে থাকতে দেখে এবার যেন জনগণের হুশ ফিরল। বাদলের চতুর্দিকে এখন ভিড় জমে গেছে! এতক্ষণ এরাই দেখছিল, মানুষটা পাগলের মতো কেপমারের পেছনে দৌড়াচ্ছে! তখন টনক নড়েনি অথচ এখন গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসেছে। অসহায় লোকটার অবস্থা দেখে মজা লুটতে এদিক ওদিক থেকে প্রশ্ন উড়ে আসে, কী হল দাদা? পকেটমার?

কী ছিল? খুব জরুরি কিছু?

এক প্রবীণ বিজ্ঞ মন্তব্য করলেন, সত্যিই দেশটার কী হাল হয়েছে! কলকাতার রাস্তায় এত চোরের উপদ্রব! নিশ্চিন্তে হাঁটাও যায় না?

পুলিশের কাছে যান দাদা। এখনই রিপোর্ট লেখান!

পুলিশের নাম শুনে ফের কেঁপে উঠল বাদল বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়িয়ে লায়লার হাত ধরে টান মারে সে, চলে এসো।

পিছনের ভিড় অবাক! কে যেন একজন মন্তব্য করল, পাগল নাকি? উড়ে এল আরও কিছু বাক্য, ও দাদা, বলি কী, পুলিশের কাছে চলে যান।

হ্যাঁ…হ্যাঁ! ডায়রি লেখান এখনই!

ওই তো! সামনেই পুলিশ স্টেশন! এক্ষুনি চলে যান!

সামনে পুলিশ স্টেশন শুনে প্রায় ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল বাদল। উন্মাদের মতো হনহন করে উলটোদিকে হাঁটা মারল। প্রথমে হাঁটা, পরমুহূর্তেই লায়লার হাত ধরে প্রাণপণ টেনে দৌড়! যেন এখনই এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে।

স্তম্ভিত জনতা কয়েকমুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল তারপর আবার মিশে গেল জনস্রোতের প্রবাহমানতায়!

.

ফুটপাথে তখন জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিখারি শিশুর দল। কেউ দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছে। কেউ বা আবার বসে পড়েছে ক্লান্ত হয়ে! তাদের কারও বাটিতে কিছু খুচরো পয়সা জমেছে। কারও তেমন রোজগার এখনও হয়নি। ঠিক তাদের পাশেই হতভাগা একটা লোক ভিখিরির ভঙ্গিতেই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মাঝেমধ্যে উন্মত্তের মতো রেলিং-এ মাথা ঠুকছে! তার পাশে বিবর্ণ শাড়ি পরা তস্য বিবর্ণ এক রমণী কেঁদে কেঁদে চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে! কী করবে, কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না! সামনে কোথায় এগোবে জানে না! ফিরে যাওয়ার পথও নেই কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে টাকা দিতে হবে! কিন্তু টাকা কোথায়? যেটুকু সম্বল ছিল তাও…!

বাদল বুঝতে পারছিল সে এক অন্ধগলির মধ্যে এসে পড়েছে। এখানে এগোনোও যায় না, পিছোনোও যায় না। এই মুহূর্তে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মরছে! সে অন্ধ নয়, কিন্তু তার দৃষ্টি অন্ধ। সে ভিক্ষুক নয়, তবু রাস্তার লোক তাকে ভিখিরি ভেবেই হয়তো পাশে গোটা কয়েক কয়েন ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেছে।

কী গেল?

একটা শিশুকণ্ঠের প্রশ্নে আচমকা সংবিৎ ফিরে পায় দুজনেই। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল প্রায় রূপসারই বয়েসি কিংবা তার থেকে একটু বড় একটি মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা সম্ভবত ভিখারি। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক। হাতে টিনের বাটি। বাদল স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল। তাকে দেখতে রূপসার মতোই, কিন্তু চোখে মুখে একটুও সারল্য নেই! শৈশব যেন বাস্তব জগতে পোড় খেতে খেতে বিদায় নিয়েছে। একেবারে বয়োবৃদ্ধের মতো জিজ্ঞাসা করল, খুব দামি জিনিস বুঝি?

বাদল উদগত অশ্রুকে গিলে ফেলে মাথা নাড়ে। মেয়েটা হাসছে, তা হলে তো গেল! পুলিশে গিয়েও কিছু হবে না। ওসব সেটিং করা থাকে। পুলিশও বখরা নেবে! রোজই নেয় শুয়োরের বাচ্চারা…!

বাদল ও লায়লা বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখছে। তাকে কী বলে মেয়েটা! সেটিং! পুলিশের সঙ্গে চোরের সেটিং!

এ কলকাতায় সব হয় বাবু। মেয়েটা এবার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ওই সিগন্যালে গেছে তো? ওটা পোড়া রামুর এরিয়া! বেশিক্ষণ মাল হাতে রাখে না ওরা। এক ঘণ্টার মধ্যেই সব চোর বাজারে বিক্কিরি হয়ে যাবে। বিক্কিরির হিস্যা নেবে পুলিশ। আপনি খুঁজেও পাবেন না। কে নিয়েছে? রোগা, ঢ্যাঙা কালো মতন একটা লোক, তাই না? মুখে একটা কাটা দাগ ছিল?

হ্যাঁ…হ্যাঁ…! লায়লা উত্তেজিত হয়ে বলে, ঠিক।

তা হলে বাবুলের কাজ। ও শালা দিনভর এই করে।

বাদল স্তম্ভিত, স্থলিত গলায় বলে, তুমি ওকে চেনো?

মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, লাও ঠ্যালা! শুধু আমি কেন? এ ট্র্যাফিক এরিয়ার সব্বাই ওকে চেনে। পুলিশও জানে কিন্তু কেউ কিস্যু বলে না! নয়তো ব্যাবসা চলবে কী করে?

কিছুই ওদের বোধগম্য হয় না! এ কী ধরনের কথাবার্তা বলছে। মেয়েটা বাংলাই বলছে কিন্তু একবর্ণও মাথায় ঢুকছে না তার।

লায়লা যেন অন্ধকারের মধ্যেও ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পায়। ঢোঁক গিলে বলে, তুমি জানো। এখন ওরা কোথায় আছে?

মেয়েটা ফের হেসে ওঠে, জানি কিন্তু বলব না।

কেন?

বিনে পয়সায় কেউ উবগার করে? মেয়েটা চটুল মুখভঙ্গি করে, একশো টাকা দাও নয়তো মুখ খুলব না!

একশো টাকা! বাদল পকেট হাতড়িয়ে দেখল। দুটো দশটাকার নোট পড়ে আছে আর একটা এক টাকার কয়েন! সর্বসাকুল্যে একুশ টাকা! সেটুকুই সে সর্বহারার মতো এগিয়ে দেয়। কুণ্ঠিত ভাবে বলে, আর নেই যে!

ও ত্তেরি! মেয়েটা কপাল চাপড়ায়, তোমার দশা আমার থেকেও খারাপ বাবু। রাখো, তোমার টাকা। এমনিই বলছি শোনো। কিন্তু কাউকে বলতে পারবে না কোথা থেকে খোঁজ পেয়েছ।

বাদল ও লায়লা দুজনেই মাথা নাড়ে।

ওই ট্র্যাফিক লাইটের গোটাটাই পোড়া রামুর এরিয়া। ফুটপাথ দিয়ে সোজা এগিয়ে যাও। ডানদিকে একটা কাপড়ের দোকান পড়বে। তার পাশ দিয়ে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে গলিটা ধরে সোজা যেতে হবে…!

.

১৪

এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল? বাদল আজন্ম শান্ত, মার্জিত স্বভাবের মানুষ। ছাপোষা গৃহস্থ। শান্তিতে ঘেরা একটা নিরিবিলি সংসারের সুখী গৃহস্বামী। পেশায় শিক্ষক। অনেক হাত আন্তরিক শ্রদ্ধায় ছুঁয়ে যায় তার পদপ্রান্ত। তার পায়ের কাছে হেঁট হয়ে অনেক মাথা। তার গ্রামের সব মানুষ সসম্ভ্রমে তার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোথায় সেই বাদল! উন্মাদের মতে, বা বলা ভাল গোঁয়ারের মতো সে গলি খুঁজিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে! লায়লা তার স্বামীর রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়! কী করতে যাচ্ছে লোকটা? কী করে বসবে?

বাদল নিজেও জানত না কী করতে চলেছে সে! শুধু এইটুকু জানত যে তাকে যেভাবেই হোক ওই পুঁটলিটা উদ্ধার করতে হবে! ওর মধ্যেই এখন আটকে আছে রূপসার প্রাণ! রূপসাকে বাঁচাতেই হবে।

প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল এই কানা গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। এ গলির বুঝি ল্যাজা মুড়ো কিছুই নেই! কোথা থেকে যে ঢুকেছিল, ভুলে গেছে! কোথা থেকে বেরোতে হয়, তাও জানে না। গোলকধাঁধার মতো বোধহয় একই জায়গায় ঘুরে চলেছে ওরা! এমন ঘিঞ্জি গলি ঝকঝকে কলকাতার বুকে যে থাকতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। একপাশে চূড়ান্ত নোংরা নর্দমা! অন্যদিকে জঞ্জালের স্তূপ! কতগুলো খুপরি খুপরি বাড়ির সামনে দুনিয়ার আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে আছে! রাস্তায় অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিকরে দাঁড়িয়ে মেয়েরা অশ্লীল রঙ্গরসিকতায় ব্যস্ত! দেখলেই বোঝা যায়, ওরা বারবণিতা! এর মধ্যে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে ফাটা রামুর আড্ডা! বাদল যাকেই পাচ্ছে, তাকেই আঁকড়ে ধরছে। লায়লা তার স্বভাবজাত লজ্জার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে কাকুতি মিনতি করছে, এমনকী পায়েও ধরছে পোড়া রামুর আড্ডার ঠিকানাটা দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ বলছে না! মুখ শক্ত করে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রশ্নটা।

ওদিকে সময়ও ক্রমশ হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটি বলেছিল ওরা চোরাই মাল এক ঘণ্টার মধ্যেই হাপিশ করে দেয়। তখন আর ফিরে পাওয়া অসম্ভব! বাদলের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হচ্ছিল। এর মধ্যেই আধঘন্টা হয়ে গেছে! কে জানে, এর মধ্যেই তার সর্বস্ব পাচার হয়ে গেছে কি না!

ও বাদল দুজনেই পিছন ফিরে তাকায়। একটি মেয়ে কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার। রকমসকম দেখলেই বোঝা যায় সে বেশ্যা! অনেকক্ষণ ধরেই এই দম্পতির কাকুতিমিনতি লক্ষ করছে। এখন সামনে এসে জানতে চাইল, পোড়া রামুকে কী দরকার? খুঁজছ কেন? খোচর নাকি?

বাদল শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে দৃষ্টিতে একমাত্র সেই মানুষটাই তাকাতে পারে, যার প্রবল স্রোতের মধ্যে শেষ অবলম্বন খড়কুটোটুকুও নেই! মেয়েটি কাজল পরা চোখে তার সম্বলহীন শূন্য চোখের ভাষা কতটুকু পড়তে পারল কে জানে। শুধু কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ওই সামনের ঝুপড়িটা পোড়া রামুর আড্ডা! সাবধানে যাও।

পোড়া রামুর আড্ডায় তখন চোরাই জিনিসপত্রর ভাগ বাটোয়ারা চলছিল। তিনজন ছিল ভিতরে। তার মধ্যে কালো সিঁড়িঙ্গে লোকটা অর্থাৎ বিখ্যাত চোর বাবুলকে স্পষ্ট চেনা যায়। এই মুহূর্তে টেবিলের ওপরে বাদলের বোঁচকাটাই রাখা।

শালা, আজ বিরাট দাও মেরেছিস বাবুল! বাবুলের উলটোদিকে বসে থাকা লোকটি একরাশ শাঁকালুর মতো দাঁত বের করে বলে, নগদ দশহাজার টাকা! গয়না!

বাবুলও হাসছে, ওস্তাদ, লোকটা পুরো ট্যালা! মা কসম, এক নম্বরের বাকাচোদা! যখন বোঁচকাটা টেনে নিলাম তখনও মালটা বুঝতে পারেনি। তারপর কী চিৎকার! চোর! চোর!

বাদলকে নকল করেই দারুণ আমোদে হাসতে শুরু করল বাবুল। তার সঙ্গীরাও হেসে ওঠে। একটা লোকের করুণ আর্তনাদও যে কত বড় মজার বস্তু হতে পারে তা ওদের না দেখলে বোঝা যায় না! হাসির চোটে খেয়ালও করেনি ঘরের ভেজানো দরজাটা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। এক মলিন চেহারার লোক ভিতু ভিতু পদক্ষেপে ঢুকছে ঘরে। তার পাশে এক মহিলা।

প্রথমে দৃশ্যটা লক্ষ করল বাবুলই। সে সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়ায়! আরে! সেই লোকটা না? মালটা শুঁকে শুঁকে এখানে এসে পৌঁছেছে! সর্বনাশ! খোচর নাকি!

বাবুল সবিস্ময়ে বলে ওস্তাদ!

ওয়ারে একটা বোমা ওর প্রায় ওপরেই ফেটেছিল। প্রাণে মরেনি কিন্তু মুখে দাগ ফেলে গেছে। একদিকের মুখ আস্ত! অন্যদিকের মুখ দেখলে যে কেউ হার্টফেল করবে! একটা চোখের মণি পুরো সাদা। একদিকের মুখ পোড়া! সে বীভৎস মুখটা ফিরিয়ে উঠে দাঁড়ায়, কে বে?

বাদল সসংকোচে এগিয়ে আসতে চায়। তার আগেই তার পরিচয় দিয়ে দেয় বাবুল, এই সেই মাকড়াটা ওস্তাদ! একটু আগেই যার কথা বলছিলাম…

আবে শা-লা! মুহূর্তের মধ্যেই পোড়া রামুর হাতে উঠে আসে ধারালো ছুরি, তোর সাহস তো কম না! পুলিশের লোক নাকি! খোচর? এখনই যদি তোকে সাইজ করে দিই বাড়া, কে বাঁচাবে?  

বাদল একটু পিছিয়ে যায়। বিব্রত, অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল, ভাই, আমি কাউকে কিছু বলব না। পুলিশের কাছেও যাব না। তুমি শুধু আমার জিনিসগুলো দিয়ে দাও!

পোড়া রামু কিছুক্ষণ বাদলকে পর্যবেক্ষণ করে। তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝেছে এ লোকটা আর যাই হোক, পুলিশ বা খবরি নয়। সে সজোরে হেসে ওঠে, মা-মা-বাড়ি! কে বলেছে এগুলো তোর?

আমি বলছি…

বাদল আরও কয়েক পা এগিয়ে আসতেই তার গলায় ছুরি চেপে ধরল পোড়া রামু। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, এবার বল! কার?

বাদল স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফের তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। সে কিছু বলার আগেই লায়লা লুটিয়ে পড়ল পোড়া রামুর পায়ে! দুহাতে তার পা জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ভাই, ছেড়ে দেন! দিয়ে দেন আমাদের জিনিস! আমার মেয়ে হাসপাতালে! খুব অসুখ! টাকা না দিতে পারলে ও মরে যাবে! পায়ে পড়ি আপনার!

লজ্জাবতী গৃহবধূর আঁচল বুক থেকে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। সেদিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিনজনেই। পোড়া রামুর নির্লজ্জ দৃষ্টি চাটছে লায়লার দেহ! বাদল দেখল এই সুযোগ! তিনজনেই অন্যমনস্ক!

তার মধ্যে আচমকা ঈশ্বর ভর করলেন কি না কে জানে! অথবা দানব! সে বিদ্যুৎগতিতে একটা চেয়ার তুলে রামুর মাথা লক্ষ্য করে বসিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, লা-য়-লা!

রামু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। বাকি দুজন বিহ্বল! এই নিরীহ লোকটা যে এমন কিছুও করে বসতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবেনি তারা। কিছু বোঝার আগেই বাদল বিদ্যুৎগতিতে তুলে নিয়েছে বোঁচকাটা। লায়লাও বিস্ময়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার হাত ধরে টেনে বলল সে, চলো!

আবে…! রামুর মাথায় চেয়ার লাগলেও সে খুব আহত হয়নি। মাথা ফেটেছে ঠিকই, কিন্তু গুরুতর নয়! সে চেঁচিয়ে বলল, আবে শালা, দেখছিস কী, ধর বাঞ্চোতটাকে!

এতক্ষণে সংবিৎ ফিরে পেল দুই স্যাঙাত। ততক্ষণে বাদল আর লায়লা দুজনেই বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। রাস্তা দিয়ে প্রাণপণে ছুটছে তারা! বাদলের বুকের কাছে বোঁচকাটা ধরা! লায়লা সামলাতে না পেরে বেশ কয়েকবার পড়ে গেল। বাদল তাকে প্রায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে চলল! সময় নেই! একদম সময় নেই! পিছনে দুই যমদূত ছুরি, চপার নিয়ে ছুটে আসছে। চেঁচাচ্ছে, চোর! চোর! ধর শালাকে!

ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছিল ওরা দুজনে! লায়লার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পা থেকে চটি কোথায় গেছে কে জানে। পা কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। চামড়া উঠে গিয়েছে। তবু থামল না সে! বাদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুতবেগে দৌড়োচ্ছে লায়লা! এবার চরম বিপদে বেরোবার রাস্তা চিনতে ভুল হল না ওদের!

যে নির্বিকার জনস্রোত তাদের সাহায্য করেনি, এবার তারাই সহায় হল! ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে মিশে গেল বাদল ও লায়লা দুবৃত্তরা খুঁজে পেল না! ঈশ্বর সহায় হয়েছেন! ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছিল। সেই মিছিলের অজস্র মুখের মধ্যে হারিয়ে গেল দুজন!

.

অনেক চেষ্টা করেও বিক্রি করা গেল না গয়নাগুলো!

আশেপাশে যত দোকান ছিল, সবগুলোতেই চেষ্টা করল ওরা কিন্তু কেউ রাজি নয়। সকলের চোখেই সন্দেহ! তার ওপর ওদের সন্ত্রস্ত ভাব আরও বেশি সন্দেহ জাগাচ্ছে দোকানদারের। ওই ঘটনার পর একমুহূর্তও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না ওরা! সবসময়ই সন্ত্রস্ত! লায়লা বারবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছন দিকে দেখছে। যেন এখনও ওই লোকদুটো পিছু করছে ওদের। এখনই হয়তো প্রাণঘাতী চপারের কোপ বসে যাবে ওদের গলায়। অথবা…অথবা হয়তো কেউ পিছু নিচ্ছে! ওই যে! ওই ভিড়ের মধ্যে কে যেন শুট করে সরে গেল না? অথবা আলো ঝলমলে দোকানের পাশে অন্ধ গলিতে বোধহয় বসে আছে কেউ…!

বেচতে পারলেন না তো?

পিছন থেকে একটা হেঁড়ে আওয়াজ ভেসে এল। বাদল ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পিছনে তাকায়। একটা কালো মতন ট্যারা, মুশকো লোক কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁত বের করে বলল, কেউ ওখানে বেওয়ারিশ গয়না বেচতে যায়? বড় বড় জুয়েলার্সরা এসব গয়না কেনে না, জানেন না? কলকাতায় নতুন নাকি?

বাদল কোনও উত্তর দেয় না। বরং লায়লার হাত ধরে হনহন করে হাঁটা দেয়।

আরে! লোকটা ওর পেছনে দৌড়োয়, বলি যাচ্ছেন কোথায়? সেই তখন থেকে আপনার পিছনে ধাওয়া করছি। আপনি তো মশাই কথা বলারই সুযোগ দেন না। শুনুন, শুনুন কাজের কথা আছে।

বাদল থমকে দাঁড়ায়। লায়লা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখছে আগন্তুককে।

চোরাই মাল এখানে বিক্রি করতে পারবেন না। তার জন্য অন্য জায়গা আছে। ভাল দাম পাবেন।

এগুলো চোরাই মাল নয়!

বাদল তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়। লোকটা পুচ করে খানিকটা গুটখা রাস্তার ওপরে ফেলে ছোপ ধরা দাঁত বের করে হাসল, না, না চোরাই কেন হবে! আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি! সোনার আর কী! যখন যার, তখন তার।

সে তীব্র অথচ বিরক্ত দৃষ্টিতে আরেকবার লোকটাকে দেখে নিয়ে চলে যাবার উপক্রম করে। কিন্তু ব্যাটা জগদ্দল শরীর নিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

আরে মশাই, আপনার সুবিধার কথাই বলছি আর আপনি শুনছেনই! লোকটা গা জ্বালানো হাসি হেসে বলে, এখানে বড় বড় জুয়েলারি শপে এ গয়না বিক্রি হবে না। আর ছোট দোকানে ঠিক দাম পাবেন না। তার চেয়ে ব্ল্যাকমার্কেটে চলুন। কেউ কোনও কথা বলবে না দিব্যি মাল বিক্রি হয়ে যাবে। ওখানে সব মাল বিকোয়। বলতে বলতেই তার দৃষ্টি লায়লাকে কুৎসিত ভাবে জরিপ করে নিল। লায়লা বুকের আঁচলটা তাড়াতাড়ি ঠিক করে নেয়! জড়োসড়ো ভাবে ঘোমটাটা আরও একটু টেনেছে সে।

ব্ল্যাকমার্কেট! নামটাই যেন সপাং করে চাবুক মারল বাদলকে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলে, ব্ল্যাকমার্কেট মানে?

মানে জেনে কাজ নেই। চলুন তো! শুধু মনে রাখবেন, এ অধমকে দশ পার্সেন্ট দিলেই হবে। লোকটা হাত তুলে চেঁচিয়ে ওঠে, ট্যাক্সি!

তখন কলকাতার বুকে টুপটুপ করে বৃষ্টি নেমেছে…!

‘তুমি অপরাধী।’
এই কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেন
বলে গেল বজ্রসহ এক পশলা হঠাৎ বৃষ্টিপাত
‘তুমি অপরাধী’
মানুষের মুখের আদলে গড়া একটি গোলাপের কাছে’
বৃষ্টিভেজা একটি কালো কাক
একটি কম্পমান আধ-ভাঙা ডালের ওপর থেকে
কিছুটা কাতর আর কিছুটা কর্কশ গলায়
আবার বলে উঠল: তুমি অপরাধী!
আজ সারাদিন বাতাস,বৃষ্টি আর শালিক
আমাকে ধাওয়া করে বেড়াল
এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত
তোমার বাড়ির
কিন্নরকণ্ঠ নদী অবধি আমি গেলাম
কিন্তু সেখানে ঘাটের উপর একটি প্রাচীন বুড়ি
সোনার ছাই দিয়ে ঘটি-বাটি মেজে চলেছে আপন মনে
একটা সাংঘাতিক সূক্ষ্ম ধ্বনি শুয়ে আছে
পিরিচে, পেয়ালায়
ওই বাজনা শুনতে নেই
ওই বাজনা নৌকার পাল খুলে নেয়
ওই বাজনা স্টিমারকে ডাঙার ওপর আছড়ে ফ্যালে
ওই বাজনা গ্রাস করে প্রেম, স্মৃতি, শস্য, শয্যা, ও গৃহ
তোমার বাড়ির
কিন্নরকণ্ঠ নদী অবধি আমি গিয়েছিলাম
কিন্তু হাতভরতি শালিকের পালক
আর চুলের মধ্যে এলোপাথারি বৃষ্টির ছাঁট নিয়ে
উলটোপালটা পা ফেলে
তোমার দরজা পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে হল না
ওই শালিকের ভেতর উনুনের আভা, মশলার ঘ্রাণ
তোমার চিবুক, রুটি আর লালচে চুলের গন্ধ,
ওই বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে পাতা আছে তোমার
বারান্দার চেয়ারগুলো
তা হলে তোমার কাছে গিয়ে আর কী হবে!
আজ একজোড়া শালিক
গোয়েন্দা পুলিশের মতো
বাতাস একটা বুনো একরোখা মোষের মতো
আমাকে ধাওয়া করে বেড়াল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত
আমি অনেকদিন পর একজন হা-ঘরে
উদ্বাস্তু হয়ে চরকির মতো গোটা শহর ঘুরে বেড়ালাম’

অনেক ঘোরাঘুরির শেষে কাজ হল। গয়নার বিনিময়ে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়া গেল! লোকটা নিজের ভাগের পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে খোলতাই হাসল।

আপনার কপাল ভাল মশাই। সে ফের বত্রিশ পাটি বের করে ফেলেছে, ভাল দাম পেয়েছেন। চোরাই মালের এত দাম হয় না!

বাদলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। কপালের রগটা অসহ্য রাগে দপদপিয়ে উঠছে। সে টাকাটা ঝোলায় পুরে ফেলে। লায়লার হাত ধরে টান মারে, চলো।

লোকটা রীতিমতো নির্লজ্জ ও নাছোড়বান্দা। সে ফের ওদের পিছনে ধাওয়া করেছে, শুনুন না। মনে হচ্ছে আপনার সঙ্গে ব্যাবসা ভাল জমবে! আপনি শুধু সোনাই বেচবেন? না আরও কিছু? মানে… ডবকা থেকে কচি, সব চলবে!

বলতে বলতে তার দৃষ্টি দিয়ে লায়লার সর্বাঙ্গ চেটে নিল! অশ্লীল ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বাদল আর নিজেকে সামলাতে পারে না। এতক্ষণের অপরাধবোধ, আত্মগ্লানি ফেটে বেরোল অসহ্য রাগ হয়ে।

শা–লা! হা-রা-ম জা-দা! বলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লোকটার ওপর! তার হুশ নেই। ভীষণ আক্রোশে অন্ধের মতো হাত পা চালিয়ে এলোপাথাড়ি লাথি, ঘুষি মারতে শুরু করল! লোকটা প্রথমে হকচকিয়ে গেল। বাদলের এক মোক্ষম ঘুষি তার নাক ছুঁয়ে গেছে! মুহূর্তের মধ্যেই নাক থেকে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করল!

লোকটা স্তম্ভিতের মতো নাক স্পর্শ করেছে। তার আঙুল রক্তে ভিজে গেছে। রক্ত দেখে বোধহয় তারও খুন চেপে গেল। অমন দশাসই চেহারার লোকটাও এবার তেড়ে আসে। বাদলের মারপিট করার অভিজ্ঞতা নেই। সে কখনও কারো গায়ে হাত তোলেনি। ফলস্বরূপ কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিপক্ষের লাথি, ঘুষি তাকে পেড়ে ফেলল মাটিতে। মারামারি নয়, এ শুধু একতরফা মার খেয়ে যাওয়া।

লায়লা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল! তার অসহায় কান্না দেখে কয়েকজন লোক ছুটে এসেছে। তারা মুষকো লোকটাকে জাপটে ধরেছে। কোনওমতে টেনে হিঁচড়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করছে। লোকটা বাদলের পেটে একটা লাথি মেরে চেঁচিয়ে ওঠে, আমার গায়ে হাত তুলিস! স্লা বাঞ্চোত! চোরের মায়ের বড় গলা! চোর কোথাকার! শালা স্মাগলার! পুলিশ যে এতক্ষণে গাঁড়ে লাঠি ঠুসে দেয়নি তা তোর চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য! কে বাঁচিয়েছে তোকে! এই শর্মা! আবার গাল দেয়! শালা হারামখোর…!

বাদল আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। হাতাহাতির সময়ে তার চোখ থেকে চশমাটা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। সে হাতড়ে হাতড়ে চশমাটা খুঁজছে। দেখে লায়লা এগিয়ে যায়। ভাঙা চশমাটা তুলে তার হাতে দেয়। বাদলের ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। কপালের একদিকটা ফুলে গেছে। পাঞ্জাবি ফরদাফাই৷ সে চশমাটা পরে নিয়ে ভয়ার্ত চোখে অসহায়ের মতো চতুর্দিকটা দেখে। চারদিকে তখন তামাশা দেখার লোক জমে গেছে।

লোকটা অসহ্য আক্রোশে তখনও গালিগালাজ করে চলেছে। চিৎকার করছে, পুলিশ ডাকব? ডাকব পুলিশ? দেখবি?

লায়লা বাদলের পাঞ্জাবির হাতা টেনে ধরে। তার চোখে ভয়। বাদল মুখ নিচু করে লায়লাকে নিয়ে কোনওমতে সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে আসে।

.

শহরের রাস্তা তখন বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। রাস্তার ওপরে জমে থাকা জলের ওপর আলো ছিটিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলল ট্যাক্সি! পিছনের সিটে বসে বাদল তখনও বিড়বিড় করছে, আমি চোর, আমি স্মাগলার! লায়লা, আমি চোর…স্মাগলার…স্মাগলার!

লায়লা কোনও কথা না বলে তার কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করল। বাদল গোঁয়ারের মতো তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে দেখলে তাকে উন্মাদ বলে মনে হয়। মুখ বিকৃত হয়ে আসছে। কান্না দুবৃত্তের মতো বুক ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। প্রাণপণে তার সামনে ক্ষীণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। জোরে জোরে দুলে নামতা মুখস্থ করার মতো বলছে, আমি চোর! আমি মিথ্যেবাদী! আমি স্মাগলার! আমি বেইমান…!

বলতে বলতেই এবার হা হা করে কেঁদে উঠল সে। সমস্ত অপমান, সমস্ত যন্ত্রণা, অসহায়তা তার বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে এল অশ্রু হয়ে! আত্মধিক্কারে, যন্ত্রণায়, অপমানে সে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে কাঁদতে লায়লার বুকে আশ্রয় খোঁজে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *