০. সব মানুষই ভগবান

ভূমিকা

সব মানুষই ভগবান, ভগবানের আদলে তৈরি। সাধক দার্শনিকরা নানাভাবে এই সত্যটি আমাদের বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য।’ স্বামীজী বললেন, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর।’ এটি যেমন একটি দিক, আর একটি দিক হল, কখনও কখনও ভগবান স্বয়ং মানুষ হয়ে জগৎ-সংসারে প্রবেশ করেন। অবতীর্ণ হন। স্বেচ্ছায়। তখন তিনি অবতার। মনুষ্যরূপী ভগবান। এখানেও আবার বিভাজন, যেমন, ‘পূর্ণাবতার’, ‘খণ্ডাবতার’, ‘অংশাবতার’। কখনও কখনও স্বয়ং ভগবানও এসে পড়েন। মানুষ হয়ে এসে মানুষের সংসারে লীলা করবেন। কেন করবেন— তিনিই জানেন। যতদূর মনে হয়, মানুষকে মানুষের স্বরূপ বোঝাবেন। তুচ্ছ সংসারের ঊর্ধ্বে সৃষ্টির যে বিরাট অংশটি ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে তার স্বাদ দেবেন। জন্মের সঙ্গে যে ভ্রম স্বভাবতই থাকে তা চিনতে সাহায্য করেন। জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হল ভয়। এই ভয়ের উৎস হল মায়া। প্রপঞ্চ। প্রপঞ্চের অর্থ হল, সংসার ভ্রম মায়া। এই মায়ার জাল কেটে বেরোতে পারলেই ব্রহ্ম, তখন—

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বাঽভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোঽয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে॥

শ্রীকৃষ্ণ ভগবান ভীত, সন্ত্রস্ত সখা অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে দাঁড়িয়ে এই সত্য প্রকাশ করছেন। একটু পরেই তিনি দেখতে পাবেন মৃত্যুর তাণ্ডব। রক্তগঙ্গা। অর্জুন! এই আত্মা কখনও জন্মায় না। আর জন্ম যখন নেই, তখন মৃত্যুর কথা আসে কী করে! আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই, অপক্ষয়হীন, বৃদ্ধিশূন্য। তবে শরীর আছে, দেহ পিঞ্জর। সেটির ক্ষয় আছে। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু আছে। ব্যাখ্যা যেভাবেই করা হোক— শুরু হলেই শেষ হবে, উদয় হলেই অস্তে যাবে, তবে চক্রবৎ। একটি প্রদীপ নিবলেই শিখা যাবে আর একটিতে। আর এই মধ্যবর্তী সময়টিতেই থাকল অদ্ভুত এক রহস্য। যতক্ষণ না আর একটি প্রদীপ জ্বালাচ্ছে ততক্ষণ অদৃশ্য সেই শিখাটি তার সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে শূন্যে বিরাজিত। ধরতে হবে ধরাতে হবে। তা হলে আর একটি উপস্থিতি স্বীকার করতেই হবে। টানটান একটি শক্তি। তিনি কে? কৃষ্ণ, কালী? রথারূঢ় বাসুদেব। মধুরং, মধুরং। না, এ তো তাঁর সহজ রূপ! ভক্তি আর ভক্ত। তাঁর যে বহুরূপ। বিশ্বরূপটি কেমন? যেন আণবিক বিস্ফোরণ। সে কেমন?

দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ

সহস্র সূর্যের প্রভা আকাশে। সব যেন দীর্ণ, বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সমগ্র জগৎ গলিত স্খলিত। বিশাল, বিরাট এক মুখগহ্বর যেন ‘ব্ল্যাক হোল’। অসীম অভাবনীয় আকর্ষণী শক্তি। সমগ্র জীবজগৎ তুচ্ছ পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হয়ে সেই গহ্বরে প্রবিষ্ট হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে নিমেষে। লস আলামেসে প্রথম আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ দেখে বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার আতঙ্কিত হয়ে বলে উঠলেন, Good, God, the long-haired boys have lost control. তারপরেই গীতার ওই শেষ শ্লোকটি:

If the radiance of a thousand suns
were to burst into the sky
that would be like
the splendour of the mighty one.

ম্যানহাটানের রাস্তায় উন্মাদের মতো ছুটছেন আর বলছেন, thousand Suns। কৃষ্ণ কালো, কালী কালো, অজানা অপরিজ্ঞাত সৃষ্টি-রহস্য। শ্রীকৃষ্ণ ভগবান অর্জুনকে বললেন, ‘আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল।’ সমগ্র সৃষ্টিকে তিনি গ্রাস করতে পারেন। অথচ তিনি নিজেই পরাভূত হলেন কালের কাছে। নিজের বিনাশ, নিজের পরিবার, পরিজনের বিনাশ রোধ করতে পারলেন না। নিয়তিকে মেনে নিলেন অদ্ভুত উদাসীনতায়। নিজের জীবনের শেষ অঙ্ক সাজালেন আশ্চর্য রকমের হেলাফেলায়। কেউ রইল না কাছে। ফুল নেই, মালা নেই, ধূপ-দীপ-চন্দন নেই, মন্ত্রপাঠ নেই। সামান্য এক ব্যাধের তিরে নিহত হলেন। বংশধরদের শীতল উপেক্ষা। নিজের বংশ ধ্বংস করে, কালকে পা দিয়ে ঠেলে দিলেন ধর্মশূন্য কলির গ্রাসে। তিনি কেমন ভগবান? কী ভয়ংকর তাঁর ‘শেষ কটা দিন’।

Leave a Reply to বাংলা লাইব্রেরি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *