প্রতি হপ্তায় একদিন দাড়ি কামায় নরমান বেটস। শনিবার। কিন্তু দাড়ি কামাতে ভাল লাগে না ওর। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কেমন অস্বস্তি হয়। আয়নার দাগগুলো চোখে বড় লাগে। হয়তো দোষটা আয়নার নয়, ওর চোখের। হ্যাঁ, তাই হবে। নরমানের মনে পড়ে ছোটবেলায় আয়নার সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়াতে তার কি ভাল লাগত। একবার মা তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলে। রূপোর বড় চিরুনিটা ছুঁড়ে মেরেছিল সে তার দিকে। ঠকাশ করে মাথায় লেগেছিল ওটা। তারপর থেকে আয়নার দিকে তাকালেই মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় নরমানের। মা শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার ওকে চশমা পরতে বলেন। কিন্তু চশমা নেয়ার পরও কাজ হয়নি তেমন। আয়নার দিকে চাইলেই মাথা ব্যথা করতে থাকে। চিরুনি ছুঁড়ে মারার জন্য নরমান প্রথমদিকে মার ওপর খুব রাগ করলেও পরে বুঝেছে। আসলে মা সেদিন ঠিক কাজই করেছে। আয়নার সামনে ওভাবে জামাকাপড় খুলে উদোম হয়ে দাঁড়ানো রীতিমত অশ্লীল। বিশেষ করে থলথলে চর্বিওয়ালা এই বিশাল বপু নিয়ে আয়নার সামনে উলঙ্গ হওয়া তো মারাত্মক অপরাধ। অবশ্য হত যদি চাচা জো মার্কের মত লম্বা, সুঠাম শরীরের অধিকারী তাহলে ন্যাংটো হওয়ার যৌক্তিকতা ছিল। তোমার চাচার মত হ্যাঁণ্ডসাম মানুষ আর কখনও দেখেছ? মা প্রায়ই বলত কথাটা।
কথাটা সত্য। নরমান নিজেও স্বীকার করে জো চাচার মত সুদর্শন মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেনি সে। কিন্তু তারপরও চাচাকে ভয়ানক ঘৃণা করত সে। লোকটাকে চাচা বলে ডাকতে ভয়ানক আপত্তি ছিল তার। তাদের কোন রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ছিল না সে, মার বন্ধু। ফার্ম বিক্রির পর তার পরামর্শেই মা এই মোটেল তৈরি করে। লোকটা মাকে যা বলত মা সুবোধ বালিকার মত তাই শুনত। এই ব্যাপারটাই নরমানের কাছে সবচেয়ে অবাক লাগত। চির পুরুষ বিদ্বেষী মা, যে সব সময় বলত, তোমার বাপই আমার সর্বনাশ করে গেছে, সেই মহিলা কিনা কোথাকার কোন জো মার্কের অঙ্গলীহেলনে নাচত। সে যা চাইত তাই মার সঙ্গে করত। জো চাচার মত হতে পারলেই বোধহয় ভাল হত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারণ চাচা মারা গেছে অনেকদিন। প্রায় বিশ বছর।
দাড়ি কামাতে কামাতে আয়নার দিকে পিটপিট করে চাইল নরমান বেটস। ভাবল, সময়ের ব্যাপারটা তো আপেক্ষিক। আইনস্টাইন তাই বলে গেছেন। অ্যালিস্টেয়ার ক্রলি, অউসপেনস্কি প্রমুখ বড় বড় আধুনিক মনস্কবিদরাও একই কথা বলেছেন। নরমান এঁদের সবার বই পড়েছে। কিছু বই তার নিজের সংগ্রহেও আছে। কিন্তু মা ব্যাপারটা পছন্দ করে না। তার ধারণা এসব বই ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করে লেখা। আসল কারণ ওটা নয়। আসলে বই পড়ে নরমান বড় হোক, তার মধ্যে সচেতনতা আসুক, সে আর ছোট্ট খোকাটি না থাকুক, এটা মা চায় না।
নরমান বোঝে তার মধ্যে দুটো সত্তা কাজ করে। সে যখন মায়ের কথা মনে করে তখন একদম শিশুদের মত হয়ে পড়ে। তার ভাষা, জ্ঞান, মন সবকিছুই বাচ্চা ছেলেদের মত হয়ে ওঠে। আবার সে যখন নিজস্ব মানসিকতায় ফিরে আসে তখন সাবালকত্ব ফিরে পায়। মায়ের ছোট্ট খোকা হওয়ার সমস্যা অনেক। কিন্তু সাবালক নরমান সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। মার ভাগ্য ভাল সে মনোবিজ্ঞানের ওপর অনেক বই পড়েছে, নইলে এসব বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া খুব কঠিন হত।
নরমান তার রেজরে আঙুল বোলাল। খুব ধার। সাবধানে দাড়ি না কামালে গাল কেটে রক্তারক্তি অনিবার্য। তবে কাজ শেষ করার পর রেজরটাকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে যাতে মার চোখে না পড়ে। এত ধারাল একটা জিনিস দিয়ে মাকে বিশ্বাস নেই। এজন্যই সে বেশিরভাগ রান্নার কাজ একাই করে, বাসনকোসনও ধোয়। মা এখনও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসে। তার ঘরটি নতুন আলপিনের মতই ঝকঝকে, তকতকে। সে বাড়ির ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখলেও নরমান সেধে রান্নাঘরের দায়িত্ব নিজে নিয়েছে।
নরমানের মা সেদিনকার ব্যাপারে এখনও তাকে কোন প্রশ্ন করেনি। এজন্য সে মনে মনে খুশিই বলা চলে। সেও উপযাচক হয়ে কিছু বলতে যায়নি। প্রসঙ্গটা যে কেউ উত্থাপন করলে দুজনের জন্যই অস্বস্তিকর হত বলেই হয়তো কেউই ওটাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি। মা ইচ্ছে করেই হয়তো নরমানকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্য বেশিরভাগ সময়ই সে নিজের ঘরে বসে থাকে। হয়তো ভেতরে ভেতরে সে খুব অনুতপ্ত।
অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ খুন একটি মারাত্মক অপরাধ। সে তোমার মাথার গোলমাল হলেও তুমি ঠিকই বুঝতে পারবে। মা নিশ্চই এখন বিবেকের যন্ত্রণায় ভুগছে।
যন্ত্রণায় ভুগছে নরমান নিজেও। তবে বিবেকের নয়, ভয়ের। গত এক হপ্তা ধরে ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে। বার বার মনে হয়েছে খারাপ কিছু একটা বুঝি ঘটতে যাচ্ছে। যতবার তাদের মোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি গেছে, ততবার বুকের মধ্যে লাফিয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ড। পুরানো হাইওয়েতে গাড়ি দেখলেও নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে।। গত শনিবার নরমান গিয়েছিল জলার ধারে। গাড়ি বোঝাই করেছে জ্বালানী কাঠ দিয়ে, তারপর খুব ভালভাবে জায়গাটা পরিষ্কার করেছে যাতে কোন চিহ্ন না থাকে। মেয়েটার যে দুলটা পেয়েছিল, ফেলে দিয়েছে সে ওটাকে জলার মধ্যে। বাকিটার অবশ্য আর খোঁজ পায়নি। কিন্তু নরমান নিশ্চিত তাকে সন্দেহ করার মত এখন কোন ব্লু নেই।
কিন্তু তারপরও বৃহস্পতিবার রাতে স্টেট হাইওয়ে পেট্রলের গাড়ি তার মোটেলের সামনে থামলে সে ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশ অফিসারটি এসেছিল তার ফোন ব্যবহার করতে। পরে, নরমান আপন মনে হেসেছে ভয় পাওয়ার কথা ভেবে। কিন্তু ওই সময় ব্যাপারটা মোটেই হাসির কিছু ছিল না।
মা তার বিছানার কাছের জানালায় বসা ছিল। ভাগ্য ভাল যে অফিসার তাকে দেখতে পায়নি। গত হপ্তা ধরে মা প্রায়ই জানালার ধারে বসে থাকছে। সম্ভবত লোকজনের আগমন তাকে খুব চিন্তিত করে তুলেছে। নরমান ভেবেছে বলে ওভাবে জানালার পাশে বসে থাকা ঠিক না, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। বরং মা যেখানে আছে সেখানেই থাকুক। নিচে নামা তার জন্য মঙ্গলজনক নয়। অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে মার পরিচয় না হওয়াই ভাল। তারা মা সম্পর্কে যত কম জানবে, ততই ভাল। এখন নরমানের মনে হচ্ছে ওই মেয়েটাকে মার সম্পর্কে বলা মোটেও ঠিক হয়নি।
নরমানের দাড়ি কামানো শেষ হলো। হাত ধুলো। নিচে গিয়ে মোটেল খোলার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
এই হপ্তায়, জনা কয়েক খদ্দের তার মোটেলে এসেছে। তবে বেশি নয়। খুব বেশি লোকজন তার এখানে কখনোই আসে না। কিন্তু এটা একদি থেকে তার জন্য শাপে বর হয়েছে। তাকে ছয় নম্বর রুমটা ভাড়া দিতে হয়নি। ছয় নম্বর রুমটা ছিল ওই মেয়েটার। নরমান ঠিক করল ওই রুমট। সে আর কাউকেই ভাড়া দেবে না। ওইভাবে চুপিচুপি মেয়ে মানুষের শরী: দেখে নিজের উত্তেজনা প্রশমন মোটেও ঠিক কাজ নয়। সে যদি সেদিন মদ খেত আর ফুটো দিয়ে ওই মেয়েটাকে না দেখত
এক ধরনের অপরাধবোধ আচ্ছন্ন করল নরমান বেটসকে। যাকগে, যা হবার হয়েছে, বেহুদা ওসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোন মানে নেই। টাই বেঁধে সে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। মাকে দেখল আবার জানালার ধারে বসে আছে। কিছু বলবে কিনা ভাবল নরমান। কিন্তু তাতে আবার কথা কাটাকাটি হতে পারে। দরকার নেই বাবা রগচটা মহিলাকে খামোকা চটিয়ে। সে যেমন থাকতে চায়, থাকুক সেভাবে।
মাকে এখন ঘরে তালা মেরে রাখে নরমান। বাড়ি এবং মোটেলের সমস্ত চাবি সে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। মার এখন আর ঘরের বার হওয়ার কোন উপায় নেই। মা তার ঘরে নিরাপদেই থাকছে আর নরমানও তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে। যা ঘটেছে ওটার আর পুনরাবৃত্তি হোক সে চায় না। মার জন্য এটা বরং একদিক থেকে ভালই হলো। পাগলা গারদের চেয়ে ঘরে বন্দী হয়ে থাকা অনেক ভাল।
অফিসে এসে বসল নরমান। যে লোকটা প্রতি হপ্তায় তোয়ালে দিয়ে যায়। সে তার ট্রাক নিয়ে এল। নরমান আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। নতুন তোয়ালে নিয়ে পুরানোগুলো দিল ধোলাইর জন্য। ইস্ত্রি করা বিছানার চাদর এবং বালিশের ওয়ারও সরবরাহ করল ড্রাইভার। তারপর চলে গেল।
নরমান চার নম্বর রুমে ঢুকল। ইলিনয়ের এক ব্যবসায়ী ছিল এই রুমে। ভোরেই চলে গেছে। কিন্তু ঘরটার অবস্থা জঘন্য করে রেখেছে। ঘরটা গোছগাছ করে, তোয়ালেগুলোর একটা ব্যবস্থা করে আবার অফিসে এসে বসল নরমান।
দেখতে দেখতে চারটা বাজল। কিন্তু কোন খদ্দেরের দেখা নেই। বিরক্ত হয়ে উঠল নরমান। কাঁহাতক আর এভাবে বসে থাকা যায়। গলা ভেজানোর জন্য মনটা উসখুস করে উঠল। নিজেকে চোখ রাঙাল ও, ব্যাটা, কসম খেয়েছিস না যে আর মদ খাবি না। এই মদই জো চাচাকে খেয়েছে। আর মদের কারণেই মেয়েটাকে সেদিন মরতে হয়েছিল। সুতরাং, যতই তেষ্টা লাগুক, মদের বোতলের দিকে হাত বাড়ানো যাবে না কিছুতেই। কিন্তু তারপরও ইচ্ছেটা ক্রমশ চাগিয়ে উঠতে থাকল। মাত্র এক পাত্র—
খাবে কি খাবে না ইতস্তত করছে নরমান, এই সময় গাড়িটাকে থামতে দেখল সে মোটেলের সামনে। মাঝ বয়সী এক দম্পতি বেরিয়ে এল এটা থেকে। অফিসে এসে ঢুকল তারা। পুরুষটার মাথায় বিশাল টাক, চোখে গাঢ় রঙের চশমা। তার গিন্নী বেজায় মোটা। দরদর করে ঘামছে। দশ ডলার দিয়ে ওরা এক নম্বর রুমটা ভাড়া করল। লোকটা খাতায় সই করল মি. এবং মিসেস হারম্যান প্রিটজলার নামে। ঠিকানা বার্মিংহাম। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাধারণ টুরিস্ট এরা। মোটা গিন্নী ঘর দেখার পর কেমন গুমোট ঠেকছে বলে অভিযোগ করল। নরমান পাখা খুলে দিতেই সে খুশি হয়ে উঠল। না, এ ঘরে থাকতে তার আর কোন আপত্তি নেই। নরমান টুরিস্ট দম্পতিকে ঘর বুঝিয়ে দিয়ে আবার আগের জায়গায় বসল। একটা সায়েন্সফিকশনের পাতা ওল্টাতে লাগল। অন্ধকার ঠেকছে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আলো জ্বালল সে।
এই সময় আরেকটি গাড়ি এসে দাঁড়াল মোটেলের সামনে। ড্রাইভিং সীটে একজন মাত্র আরোহী। সম্ভবত কোন ব্যবসায়ী হবে। সবুজ রঙের বুইকটার লাইসেন্স প্লেটের দিকে চোখ যেতেই বুক ধক করে উঠল নরমানের। টেক্সাস লাইসেন্স! ওই মেয়েটা, জেন উইলসনও টেক্সাস থেকে এসেছিল।
নরমান সিধে হলো, কাউন্টারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখল সে, নুড়ি বেছানো পথে তার জুতোর শ উঠল, নরমানের হৃৎপিণ্ডের ধক ধক শব্দের সঙ্গে যেন চমৎকার মিলে গেল ছন্দটা।
এটা নিছক কাকতালীয় ব্যাপার, নিজেকে বোঝাল সে। লোকজন প্রতিদিনই টেক্সাস থেকে আসে। আর আলাবামা তো আরও অনেক দূর। সুতরাং ঘাবড়াবার কিছু নেই।
ভেতরে ঢুকল লোকটা। লম্বা, রোগা। ছাই রঙের স্টেটসন হ্যাঁটের চওড়া কার্নিসে তার মুখের বেশির ভাগ অংশ ঢাকা পড়েছে। গালে ঘন দাড়ি।
গুড ইভনিং, বলল লোকটা। কণ্ঠে কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট।
গুড ইভনিং, নরমান অস্বস্তিভরে পায়ের ওজন বদলাল।
আপনি এই মোটেলের মালিক?
জ্বী। আপনার কি ঘর চাই?
না, ঠিক তার জন্য আসিনি। আসলে আমি কিছু খবর জানতে এসেছি।
সাহায্য করতে পারলে খুশি হব। বলুন কি জানতে চান?
আমি একটি মেয়েকে খুঁজছি।
নরমানের হাত কেঁপে উঠল। পরক্ষণে মনে হলো ও দুটোতে কোন সাড়া পাচ্ছে না সে। পুরো শরীরটাই যেন নিঃসার হয়ে গেছে। বুকের ভেতর ধধ শব্দটাও আর নেই। সব কিছু যেন অদ্ভুত রকম শান্ত। ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়।
তার নাম ক্রেন, বলল লোকটা, মেরি ক্রেন। টেক্সাসের ফোর্টওয়ার্থ থেকে এসেছে। মেয়েটা কি আপনার এখানে উঠেছিল?
এখন আর চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে না নরমানের। এখন হাসতে ইচ্ছে করছে। টের পেল হৃৎপিণ্ড আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু করেছে। এখন প্রশ্নের জবাব দিতে আর কোন অসুবিধে নেই।
না, বলল সে। ওই নামে এখানে কেউ আসেনি।
আপনি শিওর?
অবশ্যই। আমাদের এদিকে ইদানীং লোকজন তেমন আসে না। আর আমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট ভাল। যারা আসে তাদের কথা আমার মনে থাকে।
এই মেয়েটা হপ্তাখানেক আগে এদিকে এসে থাকতে পারে। দিনটা খুব সম্ভব শনিবার রাত কিংবা রোববার।
গত হপ্তায় এদিকে কেউ আসেইনি। তখন আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল।
আপনার ঠিক মনে আছে তো? এই মেয়েটা- মানে এই মহিলার বয়স হবে সাতাশ-আটাশ, উচ্চতা পাঁচ ফিট পাঁচ, ওজন একশো বিশ পাউণ্ডের কাছাকাছি, চুলের রঙ কালো, চোখ নীল। সে উনিশশো তিপ্পান্ন মডেলের একটি প্লাইমাউথ সেডান চালাচ্ছিল, তার লাইসেন্স নাম্বার হচ্ছে।
নরমান আগন্তুকের কথা শুনেও শুনছে না। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। কেন সে বোকার মত বলতে গেল এখানে কেউ আসেনি? লোকটা যেভাবে মেয়েটার বর্ণনা দিচ্ছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে সে ওর সম্পর্কে ভাল ভাবেই জানে। কিন্তু নরমান যেহেতু একবার ব্যাপারটা অস্বীকার করেছে, তখন শেষ পর্যন্ত মিথ্যেই বলে যেতে হবে। তাহলে এই লোক কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। না, মনে হচ্ছে না এ ব্যাপারে আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারব।
আচ্ছা, অন্য কাউকে কি দেখেছেন যার সঙ্গে আমার বর্ণনা মিলে যায়? হয়তো সে অন্য নামেও উঠতে পারে। আপনার রেজিস্টার বইটা যদি একটু দেখতে দিতেন-
নরমান লেজার বইয়ের ওপর হাত রেখে মাথা নাড়ল। দুঃখিত, মিস্টার, বলল সে, আপনাকে তা আমি কখনোই দেব না।
এই জিনিসটা দেখার পরও দেবেন না?
আগন্তুক তার পকেটে হাত ঢোকাল। নরমান ভাবল ওকে বুঝি ঘুষ দিতে যাচ্ছে সে। কিন্তু মানিব্যাগ খুলে একটি কার্ড বের করে সে কাউন্টারে রাখল। নরমান কার্ডটি পড়ল।
মিলটন অ্যারবোগাস্ট, বলল লোকটা। প্যারিটি মিউঁচুয়ালের পক্ষে কাজ করছি।
আপনি গোয়েন্দা?
মাথা ঝাঁকাল অ্যারবোগাস্ট। আমি এখানে এসেছি, মি.-
নরমান বেটস।
মি, বেটস, আমাদের কোম্পানি এই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে চায়। তাই আপনার সাহায্যের খুব প্রয়োজন। অবশ্য আপনি যদি স্বেচ্ছায় আপনার রেজিস্টার বই দেখতে না দেন তাহলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ব্যাপারটা জানাব। তারপর কি হবে বুঝতেই পারছেন।
নরমান একটা ব্যাপার নিশ্চিতই জানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তার ব্যাপারে মোটেই নাক গলাতে আসবে না। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে তার বিশেষ সুবিধের মনে হচ্ছে না। এর সঙ্গে মামদোবাজি করতে না যাওয়াই ভাল। সে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করল, তারপর বলল, কি হয়েছে? এই মেয়েটা কি করেছে?
গাড়ি চুরি করেছে। বলল অ্যারবোগাস্ট।
ও, নরমান যেন খানিকটা স্বস্তি পেল। ও ভেবেছিল মেয়েটা বুঝি হারিয়ে গেছে কিংবা মারাত্মক কোন অপরাধের কারণে পুলিশ তাকে খুঁজছে। অবশ্য তাহলে তাকে আরও বেশি খোঁজাখুঁজি চলত।
ঠিক আছে। বলল সে। দেখুন তাহলে। হাত সরিয়ে নিল সে লেজার বইয়ের ওপর থেকে।
কিন্তু মিলটন অ্যারবোগাস্ট প্রথমেই রেজিস্টার বইয়ের দিকে আগ্রহ দেখাল না। পকেট থেকে একটা খাম বের করে ওটাকে সে কাউন্টারের ওপর রাখল। তারপর লেজার বই খুলে সইগুলো দেখতে শুরু করল। এক জায়গায় এসে তার চোখ আটকে গেল।
আপনি যে বললেন শনি-রোববারে কোন কাস্টমার আসেনি আপনার মোটেলে?
মনে ছিল না। দুএকজন আসতেও পারে। কিন্তু বেশি লোকজন আসেনি।
তাহলে এর ব্যাপারটা কি? এই যে সান অ্যান্টেনিয়ার জেন উইলসন? শনিবার রাতে সে এখানে উঠেছিল দেখতে পাচ্ছি।
আ- দাঁড়ান দাঁড়ান, মনে করি। বুকের ভেতর আবার হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করল। বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছে বুঝতে পারছে নরমান। লোকটা যখন মেয়েটার চেহারার বর্ণনা দিচ্ছিল তখন তাকে না চেনার ভান করা মোটেই ঠিক হয়নি। কিন্তু এখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। এখন কি জবাব দেবে সে? বিশ্বাসযোগ্য কি বলতে পারে সে গোয়েন্দাটাকে যাতে তাকে সে সন্দেহ না করে?
অ্যারবোগাস্ট অবশ্য নরমানের দিকে তাকিয়ে নেই। লেজার বুকের দস্তখতের সঙ্গে খামের লেখার মিল খুঁজতে ব্যস্ত সে। এ জন্যই খামটা নিয়ে এসেছে ও। আরে, দুটো হাতের লেখাই দেখি হুবহু এক। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে এক সেকেণ্ডও দেরি হলো না বুদ্ধিমান গোয়েন্দার। নরমানের দিকে চোখ তুলে চাইল সে। তার শীতল চাউনি দেখেই নরমান যা বোঝার বুঝে নিল। ওই চোখ বলছে জানি আমি, সব জানি।
এই জেন উইলসনই মেরি ক্রেন। হাতের লেখা একই।
তাই নাকি? আপনি শিওর?
জী। আমি এটার একটা ফটোকপি করব। আপনি বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে আমি আদালতের শরণাপন্ন হতে বাধ্য হব। কিন্তু সত্যি কথা বললে কিছুই করব না। এখন বলুন আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন কেন?
আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলিনি। আমি আসলে ভুলে গেছিলাম। একটু আগে বললেন আপনার স্মৃতিশক্তি নাকি খুব প্রখর।
হ্যাঁ। তা বটে। কিন্তু–
সিগারেট ধরাল অ্যারবোগাস্ট। এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, গাড়ি চুরি একটা মারাত্মক অপরাধ, জানা আছে আপনার? আপনি কি নিজেকে এর মধ্যে জড়াতে চান?
জড়াব? আমি কেন এর মধ্যে নিজেকে জড়াব? একটা মেয়ে এখানে এসেছিল, রুম ভাড়া করল, রাতটা কাটিয়ে পরদিন আবার চলে গেল। এরমধ্যে আমার জড়াজড়ির প্রশ্ন আসে কোত্থেকে, মি. অ্যারবোগাস্ট?
তথ্য গোপন রাখার অপরাধে। ফুসফুঁসে ধোঁয়া টেনে নিয়ে বলল অ্যারবোগাস্ট। এখন বাজে কথা ছাড়ুন, লাইনে আসুন। আপনি মেয়েটাকে দেখেছেন। কেমন ছিল সে দেখতে?
আপনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেরকম। ওইদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। কাজে ব্যস্ত থাকায় তাকে ভাল করে লক্ষ্যও করিনি। সে দস্তখত করল, আমি তার ঘরের চাবি দিলাম, সে তার ঘরে চলে গেল। ব্যস, এই তো!
আপনাদের মধ্যে কোন কথাবার্তা হয়েছিল? আপনি কিছু বলেছিলেন?
এই আবহাওয়া নিয়ে দুএকটা কথা হয়েছিল বোধহয়। আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
তাকে দেখে কি আপনার মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল? ধরুন, তার আচার আচরণে কিংবা কথাবার্তায়?
না। একেবারেই না। তাকে আমার আর সব সাধারণ টুরিস্টদের মতই মনে হয়েছিল।
তাই? অ্যারবোগাস্ট সিগারেটের শেষ অংশটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিল। তাহলে আপনি কেন মেয়েটাকে রক্ষা করতে চাইছিলেন? কেন ভান করছিলেন যে ওর সম্পর্কে আপনি কিছুই জানেন না?
না, না ভান করিনি তো! বললামই তো ওর কথা আমার একদম মনে ছিল না। নরমান বুঝতে পারছে সে ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এই আলোচনা আরও বেশিক্ষণ চললে সে কেঁসে যেতে পারে। এই ভেবে সে বলল, আপনি খামোকা আমাকে দোষারোপ করছেন। আপনার কি ধারণা আমি ওই মেয়েটাকে গাড়ি চুরিতে সাহায্য করেছি?
সে অভিযোগ আপনাকে কেউ করতে যাচ্ছে না। মি. বেটস। আচ্ছা, সে কি একা এসেছিল?
জ্বী! একরাত থেকে পরদিন আবার চলে যায়। একাই।
কখন যায়?
তা আমি বলতে পারব না। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম।
তাহলে তো আপনি ঠিক ঠিক জানেন না যে সে সত্যি একা গিয়েছিল কিনা।
তা অবশ্য প্রমাণ করতে পারব না।
রাতে কি হলো? কেউ কি মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?
না।
আপনি ঠিক জানেন?
অবশ্যই। ওইদিন সে ছাড়া আর কোন কাস্টমার আসেনি।
আপনি একাই ডিউটি করছিলেন?
জ্বী।
মেয়েটি কি তার ঘরে ছিল?
জ্বী।
পুরো সন্ধ্যা? এমন কি কোন ফোনও করেনি?
না।
তাহলে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যে সেদিন তাকে এখানে দেখেছিল?
আপনাকে সে কথা আগেই বলেছি।
তাহলে ওই বুড়ি ভদ্রমহিলা- তিনি ওকে দেখেননি?
কোন্ মহিলা?
বাড়ির পেছন দিকে যিনি আছেন?
নরমানের বুকে আবার হাতুড়ি পেটা শুরু হলো; যেন হৃৎপিণ্ডটা খাঁচা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। সে প্রায় বলতে যাচ্ছিল, এখানে কোন বুড়ি থাকে না, কিন্তু অ্যারবোগাস্টের পরবর্তী কথাটা তাকে অফ করে দিল।
গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় তাকে আমি জানালার পাশে বসে থাকতে দেখেছি। উনি কে?
আমার মা, স্বীকার করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই নরমানের। ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করল সে। উনি খুব অসুস্থ। উনি নিচে কখনও নামেন না।
তাহলে উনি মেয়েটাকে দেখেননি বলতে চাইছেন?
জ্বী। আমরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছিলাম তখন তিনি তাঁর ঘরেই-
মুখ ফস্কে আমরা শব্দটা বেরিয়ে এল। ওটাকে এখন আর ফিরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। অ্যারবোগাস্টের মুখে মার কথা শুনেই নরমান কেমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। আর তার ফলে
মিলটন অ্যারবোগাস্ট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল নরমানের দিকে, আপনি তাহলে বাড়িতে বসে মেরি ক্রেনের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন?
শুধু কফি আর স্যাণ্ডউইচ। আ-আমি ভেবেছিলাম কথাটা আপনাকে বলব। আসলে এদিকে ফেয়ারভেল ছাড়া অন্য কোথাও খাবারের দোকান নেই। আর মিস মেরির খুব খিদে পেয়েছিল। বৃষ্টির মধ্যে ওই রাতে অতদূরে তিনি কষ্ট করে খেতে যাবেন ভেবে আমার খুব মায়া লাগছিল। তাই তাঁকে আমি আমার বাসায় নিয়ে আসি খাওয়াবার জন্য।
আপনাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল?
তেমন কিছু না। আপনাকে তো বলেইছি আমার মা খুব অসুস্থ। তাই কথাবার্তা বলে তাকে আমরা বিরক্ত করতে চাইনি। মার জন্য আমি খুব চিন্তায় আছি। হয়তো এই কারণেই আমি ওই মেয়েটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম।
আরও কিছু ভুলে যাননি তো? ধরুন, খেয়ে দেয়ে এখানে এসে দুজনে মিলে অল্পস্বল্প মৌজ-মস্তি-
না, না, সেরকম কিছু আমরা করিনি! কিন্তু আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনার কী অধিকার আছে আমাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করার? আপনি যা জানতে চেয়েছেন সবই আমি বলেছি। এবার দয়া করে আসুন।
ঠিক আছে। যাব, অ্যারবোগাস্ট তার হ্যাঁটের কিনারা আরেকটু টেনে নামাল চোখের ওপর। কিন্তু তার আগে আপনার মার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলতে হবে। আপনি বলতে ভুলে গেছেন এমন কোন নতুন তথ্য উনি হয়তো আমাকে দিতে পারেন।
আপনাকে আমি বললাম না যে উনি মেয়েটাকে দেখেননি! উত্তেজনায় গলা চড়ে গেল নরমানের। আপনি তাঁর সঙ্গে কিছুতেই কথা বলতে পারবেন না। উনি খুবই অসুস্থ। আমি আপনাকে বারণ করছি, মি. অ্যারবোগাস্ট।
সেক্ষেত্রে আমি সার্চ ওয়ারেন্ট আনতে বাধ্য হব।
গোয়েন্দাটা যে ভাঁওতা দিচ্ছে, বুঝতে পারল নরমান। কেন বোকার মত কথা বলছেন? কে আপনাকে সার্চ ওয়ারেন্ট দেবে? কেউ বিশ্বাস করবে না যে আমি পুরানো গাড়ি চুরি করতে গেছি।
অ্যারবোগাস্ট আরেকটা সিগারেট ধরাল। কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলল অ্যাশট্রেতে। শান্ত গলায় বলল, আপনি আসলে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। গাড়ি নয়, আসলে এই মেয়েটা-মেরি লুইসফোর্থ ওয়ার্থের একটা এস্টেট ফার্ম থেকে চল্লিশ হাজার ডলার চুরি করেছে।
চল্লিশ হাজার–
জ্বী, হ্যাঁ। টাকাটা নিয়ে শহর থেকে কেটে পড়েছে। সুতরাং বুঝতেই সাইকো পারছেন ব্যাপারটা কি সাংঘাতিক। তাই এই জরুরী প্রয়োজনেই আপনার মার সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। সে আপনি অনুমতি দেন আর না দেন।
কিন্তু আপনাকে তো আমি বারবার বলেছি তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই জানেন না। কেন অসুস্থ মানুষটাকে শুধু শুধু বিরক্ত করতে চাইছেন?
কথা দিচ্ছি তাঁকে এমন কোন কথা জিজ্ঞেস করব না যাতে তিনি আপসেট হন। তবে আপনি যদি এরপরও আমাকে ভেতরে যেতে না দেন তাহলে আমাকে বাধ্য হয়ে শেরিফ এবং ওয়ারেন্টসহ আবার এখানে আসতে হবে।
না, না, মাথা নাড়ল নরমান। শেরিফের কাছে যাবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনি মার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে আগে তাঁকে আপনার খবরটা দিতে হবে। হঠাৎ করে আপনি কথা বলতে শুরু করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন। সে দরজার দিকে পা বাড়াল। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।
ঠিক আছে, অ্যারবোগাস্ট সায় দিল। নরমান তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল।
হাঁপাতে হাঁপাতে চাবি খুলে মার ঘরে ঢুকল সে। আগেই ঠিক করেছে খুব শান্তভাবে ব্যাপারটা গুছিয়ে বলবে তাকে। কিন্তু মাকে জানালার ধারে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে কি হয়ে গেল নরমানের, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে। হাঁটু গেড়ে বসল তার পাশে। মুখ গুঁজল স্কার্টে। কাঁদতে কাঁদতে সব কথা খুলে বলল।
ঠিক আছে, বাছা, সব শুনে মা বলল। যেন ঘটনাটা একটুও আশ্চর্য করতে পারেনি তাকে। চিন্তা কোরো না। আমার ওপর সব ছেড়ে দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা, তুমি ওর সঙ্গে মাত্র এক মিনিট কথা বলো। বলো যে তুমি মেয়েটার ব্যাপারে কিছুই জানো না। তাহলেই সে চলে যাবে।
কিন্তু সে আবার ফিরে আসবে। চল্লিশ হাজার ডলার তো অনেক টাকা। তুমি আমাকে এই টাকার কথা আগে বলোনি কেন?
জানতাম না। বিশ্বাস করো, মা, আমি টাকার কথা কিছুই জানতাম না।
আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি, কিন্তু ওই লোক করছে না। আমাকেও সে বিশ্বাস করছে না। তার ধারণা টাকার জন্য আমরা দুজনে মিলে ওই মেয়েটার কিছু করেছি।
মা- চোখ বুজে আছে নরমান, মার দিকে তাকাতে পারছে না। আমরা তাহলে এখন কি করব?
আমি এখন তোমার ওই লোকের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্তুত হব। আমি বাথরুমে যাচ্ছি দুএকটা জিনিস নেয়ার জন্য। তুমি ততক্ষণে মি. অ্যারবোগাস্টকে নিয়ে এসো এখানে।
না, মা। আমি ওকে কিছুতেই এখানে নিয়ে আসতে পারব না। কিন্তু তুমি–
নরমান মাকে বাধা দেয়ার জন্যেও উঠতে পারল না। নড়ার শক্তি পাচ্ছে না সে, ইচ্ছে করছে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কোনই ফায়দা হবে না। অপেক্ষা করতে করতে মি. অ্যারবোগাস্ট কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে উঠবে, তারপর নিজেই চলে আসবে এখানে। দরজায় নক করবে, ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকেই দেখবে–
মা, মা। আমার কথা শোনো। আকুল হয়ে ডাকল নরমান।
কিন্তু তার কথা মহিলার কানে গেল না। সে তখন বাথরুমে ঢুকে পোশাক পরতে ব্যস্ত।
একটু পরেই সে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। চমৎকার একটা পোশাক পরে আছে। মুখে পাউডার এবং রুজ। ছবির মত সুন্দর লাগছে তাকে। একটু হেসে সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল নিচে।
সিঁড়ির মাঝামাঝি নামার আগেই দরজায় ধাক্কা।
ব্যাপারটা সত্যি সত্যি ঘটছে তাহলে। মি. অ্যারবোগাস্ট চলে এসেছে এখানে, দরজা ধাক্কাচ্ছে। নরমানের ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে, সাবধান করে দেয় লোকটাকে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুল না। শুধু শুনল মার উল্লসিত কণ্ঠ, আমি আসছি! আমি আসছি! একটু দাঁড়ান!
দরজা খুলল মা। ভেতরে ঢুকল মিলটন অ্যারবোগাস্ট। মহিলার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলার জন্য মুখ খুলল সে, মুখটা হাঁ হয়েই থাকল, চোখে ফুটে উঠল নগ্ন আতঙ্ক। মহিলার হাতে কি একটা ধাতব পদার্থ ঝকমক করে উঠল, সাপের মত ছোবল মারল অ্যারবোগাস্টের গলায়। বারবার ছোবল মারতেই লাগল।
চোখ বন্ধ করে ফেলল নরমান। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা আর দেখতে চায় না সে। কারণ মার হাতে যে ধাতব জিনিসটা রক্তের নেশায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে, ওটা তারই দাড়ি কামানোর ক্ষুর।
.
১০.
নরমান প্রৌঢ় লোকটির দিকে তাকিয়ে মুখে চেষ্টাকৃত হাসি ফোঁটাল। এই যে আপনাদের চাবি। আপনাদের দশ ডলার বিল হয়েছে, স্যার।
প্রৌঢ়ের স্ত্রী তার পার্স খুলল। আমি দিচ্ছি, হোমার। একটা দশ ডলারের নোট টেবিলের ওপর রেখে নরমানের দিকে তাকাতেই তার ভ্র কুঁচকে উঠল। আপনার শরীর খারাপ নাকি?
না না। আমি ঠিকই আছি। একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এই যা। ও এমন কিছু নয়। এখনই মোটেল বন্ধ করে বাসায় যাব ভাবছি।
এত তাড়াতাড়ি? আমার ধারণা ছিল মোটেলগুলো সারারাত খোলা থাকে। বিশেষ করে শনিবারে।
আমাদের এখানে লোকজন তেমন আসে না। তাছাড়া, দশটা তো প্রায় বাজে।
ও আচ্ছা। গুডনাইট।
গুডনাইট।
প্রৌঢ় দম্পতি বেরিয়ে গেল অফিস ঘর থেকে। এখন নরমান আলোটালো নিভিয়ে অফিস বন্ধ করতে পারে। কিন্তু সবার আগে ওর দরকার মদ। কয়েক পেগ পেটে না গেলে আর চলছে না। ইতিমধ্যে সে বেশ কয়েক ঢোক গিলেছেও। ছটার সময় অফিসে বসেছে। তখন থেকে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর এক পাত্র করে মদ খেয়েছে। না খেলে এতক্ষণ সে টিকতেই পারত না। বাড়িতে, কার্পেট দিয়ে যে জিনিস সে মুড়ে রেখে এসেছে ওটার শিগগির কোন গতি না করলেই নয়। তবে যা করার এই রাতেই করতে হবে। দিনের বেলা ওতে হাতই দেয়া যাবে না। ততক্ষণে ওটা পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করবে। সুতরাং এখনই ওর বাড়ি ফেরা দরকার। মাকে সে কঠোরভাবে নিষেধ করে এসেছে কোন কিছুতে যেন হাত না দেয়। জানে মা তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস পাবে না। আশ্চর্যের ব্যাপার এই ধরনের ঘটনা ঘটলেই মা কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। তখন নরমানকেই সব কিছু ম্যানেজ করতে হয়। সে আসার সময় মাকে তালা মেরে দিয়ে এসেছে। বার বার বলে দিয়েছে মনের ভুলেও সে যেন আর জানালার পাশে না বসে। স্রেফ শুয়ে থাকতে হবে, আর কোন কথা নয়।
নরমান অফিস বন্ধ করে বাইরে এল। মিলটন অ্যারবোগাস্টের বুইকটা চুপচাপ আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটায় চড়ে এখান থেকে কেটে পড়লে কেমন হয়? আর কখনও সে এদিকে আসবে না। সব ঝামেলা থেকে তাহলে দিব্যি মুক্তি পাওয়া যায়। ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে একবার পাক খেয়ে উঠল, তারপর আবার মিইয়ে গেল। নরমান কাঁধ ঝাঁকাল। জানে, চাইলেই সে তা করতে পারবে না। কারণ কার্পেটে মোড়ানো ওই যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা না পাওয়া পর্যন্ত
হাইওয়ের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত নরমান একবার চোখ বোলাল। তারপর তাকাল এক এবং তিন নম্বর রুমের দিকে। ওগুলোর জানালা বন্ধ। নিশ্চিত মনে সে এবার এগোল মিলটন অ্যারবোগাস্টের গাড়ির দিকে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। পকেট থেকে বের করল চাবির গোছা। গোছাটা সে অ্যারবোগাস্টের পকেট থেকে হাতিয়েছে। ইগনিশন সুইচ অন করল নরমান। ধীর গতিতে এগোল বাড়ির দিকে।
বাড়ির সমস্ত বাতি নেভানো। মা তার ঘরে ঘুমাচ্ছে। কিংবা এমনও হতে পারে ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। যাই হোক নরমান এই মুহূর্তে এসব কেয়ার করে না। মা যত দূরে দূরে থাকে ততই ভাল। সে কাজগুলো অন্তত ঠিকঠাক ভাবে করতে পারবে। বরং মহিলা কাছে থাকলে নিজেকে শিশুর মত মনে হয় নরমানের। অথচ যে কাজ সে এখন করতে যাচ্ছে ওটা রীতিমত শক্তসমর্থ পুরুষের কাজ।
ঘরে ঢুকেই কাজে লেগে গেল নরমান। কার্পেট দিয়ে মোড়ানো মিলটন অ্যারবোগাস্টের লাশটা তুলে নিয়ে গাড়ির পিছনের সীটে রাখল। তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল।
জলার ধার দিয়ে বুইক চালিয়ে একটা ভোলা জায়গায় এসে থামল নরমান। ইচ্ছে করেই সে আগের জায়গায় লাশটাকে ফেলল না। কিন্তু লাশটাকে গায়েব করল আগের পদ্ধতিতেই। গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দেখল মিলটন অ্যারবোগাস্টের বুইক ধীরে ধীরে পাতালে সেঁধুচ্ছে। এটা আগেরটার চেয়ে ভারী। কিন্তু তারপরও যেন কয়েক হাজার বছর সময় লাগল ডুবতে।
বসে বসে ভাবতে থাকে নরমান।
শেষ পর্যন্ত ঝামেলামুক্ত হওয়া গেল। মেয়েটা আর তার চল্লিশ হাজার ডলারের মতই এই লোকটাও চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে চোরাবালির অন্ধকারে। টাকার কথা মনে পড়তেই সচেতন হয়ে উঠল ইরমান। আচ্ছা, মেয়েটা অতগুলো টাকা রেখেছিল কোথায়? পার্সে অবশ্যই নয়, সুটকেসেও নয়। তাহলে হয় ওভারনাইট ব্যাগটাতে, নয়তো গাড়ির মধ্যে কোথাও। আফসোস হলো ইরমানের কেন সে একবার গাড়ির ভেতরটা ভাল করে সার্চ করেনি। অবশ্য সার্চ করার মত তখন অবস্থাও ছিল না। নিজেকে সান্ত্বনা দিল সে। আর যদি সে সত্যি টাকাটা পেয়ে যেত তাহলে হয়তো এমন আচরণ করত যে ওই গোয়েন্দার কাছে ধরা পড়ে যেত। কারণ মন অপরাধী হলে তা নিশ্চিতভাবেই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
নরমান মাঠের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে আসতে আসতে ভাবে কাল আবার গাড়ি এবং ট্রেলার নিয়ে তাকে এখানে আসতে হবে। গত বারের মতই চিহ্ন মুছে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে আছে তার সামনে। মার ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে।
নরমান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ভাবতে থাকে। কারণ ভবিষ্যতে তাকে যাতে নতুন কোন সমস্যায় পড়তে না হয় সেজন্য আগে ভাগেই সাবধান হওয়া ভাল। সে নিশ্চিত কেউ না কেউ নিশ্চই এই গোয়েন্দাটার খোঁজে আসবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ লোকটা যেখানে কাজ করত সেখানকার লোকজন তার খবর না পেলে অবশ্যই তার সন্ধান জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। হয়তো অ্যারবোগাস্ট তার অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। সুতরাং হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে ওখানকার লোকজন কিছু একটা সন্দেহ করে বসবে। তখন তারা তার খোঁজে লোক পাঠাবে। আর সেই রিয়েল এস্টেট ফার্মের লোকরাও নিশ্চই অ্যারবোগাস্টের অন্তর্ধান রহস্য সহজভাবে মেনে নেবে না। তারাও খোঁজ খবর নিতে শুরু করবে। কারণ চল্লিশ হাজার ডলার মোটেই ছেলেখেলার ব্যাপার নয়।
সুতরাং আজ হোক আর কাল হোক, নরমানকে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে। তবে এবার সে সবদিক থেকেই প্রস্তুত। মনে মনে গল্পটা সে সাজাতে লাগল। কি বলবে তার একটা রিহার্সালও দিয়ে ফেলল। মুখ ফস্কে এবার আর কোন কথা বেরোবার অবকাশ নেই। কেউ তাকে মেয়েটার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে সে বলবে হ্যাঁ, অমুক নামের একটা মেয়ে সত্যি তার মোটেলে উঠেছিল। রাত কাটিয়ে পরদিন সে চলে যায়। না, তাদের মধ্যে কোন কথাবার্তা হয়নি। মেয়েটা শুধু জানতে চেয়েছিল এখান থেকে শিকাগো কতদূর এবং সে একদিনে ওখানে পৌঁছুতে পারবে কিনা। মেয়েটা চলে যাওয়ার এক হপ্তা পর মিলটন অ্যারবোগাস্ট নামে এক লোক এখানে আসে এবং মেয়েটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। মেয়েটা শিকাগো যাওয়ার কথা বলেছে শুনে লোকটা আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে চড়ে বসে। না, তার ধারণা নেই অ্যারবোগাস্ট কোন দিকে গেছে। তবে শনিবার, রাতের খাবারের কিছুক্ষণ পরে সে চলে যায় এটা নরমানের স্পষ্ট মনে আছে।
নরমান গল্পটা বানিয়ে নিজের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে উঠল। কোথাও কোন ফাঁক নেই। নরমান জানে এই গল্প সে চমৎকার ভাবে, ঠাণ্ডা মাথায় বলতে পারবে। কারণ মাকে নিয়ে তার আর চিন্তা করতে হবে না। মা আর জানালার পাশে বসবে না। আসলে বলা ভাল বসার সুযোগই পাবে না। কারণ তাকে সে বাড়ি থেকেই সরিয়ে ফেলবে। সুতরাং ওরা যদি সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়েও আসে তাহলেও র কোন সন্ধান পাবে না।
অতএব, মার ব্যবস্থা সবার আগে করতে হবে। কারণ নিরাপদে থাকতে চাইলে ওই মহিলার ব্যবস্থাই আগে করা দরকার। আর করতে হবে আজকের মধ্যেই। এবং এখুনি। মনস্থির করে ফেলল নরমান। সোজা চলে এল দোতলায়। মার ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল। মা বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুমায়নি নিশ্চই। মটকা মেরে পড়ে আছে।
নরমান, এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি? তোমার জন্য এদিকে আমি চিন্তায় চিন্তায়- নরমান যা ভেবেছিল ঠিক তাই।
কোথায় ছিলাম সে তুমি ভাল করেই জানো, মা। মিছিমিছি ঢঙ কোরো না।
কোথাও কোন সমস্যা হয়নি তো?
না। গভীর করে শ্বাস টানল নরমান। তারপর বলল, মা, সামনের কয়েকটা দিন তোমার এ ঘরে থাকা চলবে না।
কি?
তুমি নিশ্চই শুনেছ আমি কি বলেছি?
তোমার মাথা খারাপ! এটা আমার ঘর।
তা ঠিক। কিন্তু তোমাকে এখান থেকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে বলছি না। মাত্র কয়েকটা দিন।
কিন্তু কেন?
মা, দয়া করে আমার কথা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আজ আমাদের এখানে একজন-
কথাটা কি না বললেই নয়?
অবশ্যই বলতে হবে। কারণ তোমার বোঝা উচিত ওই লোকের খোঁজে একদিন না একদিন এখানে কেউ না কেউ আসবেই। আমি তখন বলব লোকটা এসেছিল এবং চলে গেছে।
হ্যাঁ, তোমাকে তাই বলতে হবে, নরমান। তাহলেই ঝামেলা চুকে যাবে।
আশা করি। কিন্তু তবুও আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না। কে জানে ওরা যদি বাড়ি তল্লাশি করতে চায়?
করুক। করলেও তাকে তো আর ওরা খুঁজে পাচ্ছে না।
তুমিও আর এখানে থাকছ না, মা, এক মুহূর্তের জন্য থামল নরমান। তারপর বলে চলল, তোমার নিরাপত্তার জন্যই তোমার এখানে থাকা ঠিক হবে না, মা। আজ গোয়েন্দাটা এসে তোমাকে যেভাবে দেখে ফেলেছে, আমি চাই না এই ভাবে অন্য কেউ তোমাকে দেখে ফেলুক কিংবা প্রশ্ন করুক। আমাদের দুজনের স্বার্থেই তোমাকে এই ঘর থেকে কয়েকদিনের জন্য সরে থাকা দরকার।
তুমি তাহলে কি করতে চাও- আমাকে ওই জলায় কবর দিতে চাও?
মা- চিৎকার করে উঠল নরমান।
হঠাৎ হাসতে শুরু করল মহিলা। নরমান জানে এই হাসি সহজে থামবে না। যদি না সে–
নরমান প্রচণ্ড জোরে ধমক দিল, চুপ! একদম চুপ! হাসি থেমে গেল মহিলার। গলার স্বর নিচে নামাল নরমান। দুঃখিত মা, কিছু মনে কোরো না। কিন্তু আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। তোমাকে থাকতে হবে ফুট সেলারে।
ফ্রুট সেলার? না, আমি ওখানে কিছুতেই যাব না।
তুমি যাবে। তোমাকে যেতেই হবে। ওখানে থাকতে তোমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি এখানে তোমার জন্য বিছানার ব্যবস্থাও করব। তুমি–
বললাম তো আমি যাব না!
তোমাকে আমি অনুরোধ করছি না, মা। তোমাকে আমি আদেশ করছি। যতদিন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় ততদিন তোমাকে ওখানেই থাকতে হবে। আমি দেয়ালে পুরানো ইণ্ডিয়ান কম্বলটা ঝুলিয়ে দেব। তাতে আর সেলারের দরজাটা চেনা যাবে না। নিজেদেরকে বাঁচানোর এখন এটাই একমাত্র পথ।
নরমান, তোমার সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে আমি আর একটা কথাও বলতে চাই না। আমি এই ঘর ছাড়ছি না।
তাহলে তোমাকে কোলে করে নিয়ে যাব।
কি! তোমার এতবড় সাহস-
মার কথা শেষ হতে না হতেই পাজাকোলা করে তাকে কোলে তুলে নিল নরমান। শরীরটা পাখির পালকের মতই হালকা। নরমানের ব্যবহারে মহিলা এমন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল যে প্রতিবাদ করার ভাষা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল। নাকি কান্না শুরু করল সে। নিজেকে নরমানের বীরপুরুষ মনে হলো। মার মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস তাহলে সত্যি এখন তার হয়েছে। এই দুর্বল, অসুস্থ মহিলাকে এতদিন সে খামোকই ভয় করে এসেছে। এখন দেখছি এই মহিলাই উল্টো তাকে ভয় পাচ্ছে।
মাকে নিয়ে ফ্রুট সেলারে ঢুকল নরমান। ঝটপট সব ব্যবস্থা করে ফেলল। তারপর তাকে শুইয়ে দিল বিছানায়। মহিলা আবার নাকি কান্না শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি তো আমাকে জেলখানায় ঢোকালে, নরমান। তুমি আমাকে আর ভালবাসো না। ভালবাসলে কি আর এখানে নিয়ে আসতে?
তোমাকে যদি ভাল না বাসতাম তাহলে এখন তোমার জায়গা কোথায় হত, জানো? তুমি থাকতে পাগলা গারদে পাগলদের সাথে।
নরমান আলো নিভিয়ে বেরিয়ে আসছে, এই সময় মার ধারাল কণ্ঠ ভেসে এল অন্ধকার থেকে, যেন ছুরির পোঁচ মারল।
হ্যাঁ, নরমান। তুমি ঠিকই বলেছ। আমি হয়তো সেখানেই থাকতাম। কিন্তু একা থাকতাম না।
নরমান দড়াম করে দরজা বন্ধ করল। সেলারের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ওপরে, মনে হলো, কান পাতলেই সে শুনতে পাবে মার বিদ্রূপাত্মক হাসি।
.
১১.
স্যাম আর লিলা দোকানের পেছনের রুমে বসে আছে। অপেক্ষা করছে। মিলটন অ্যারবোগাস্টের জন্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে। অ্যারবোগাস্টের কোন খবর নেই। অপেক্ষা করতে অসহ্য লাগছিল বলে স্যাম এটা ওটা বলে সময় কাটাবার চেষ্টা করছে। লিলা শুধু হুঁ হাঁ করে যাচ্ছে। এক সময় আর থাকতে না পেরে সে প্রশ্নটা করেই ফেলল, নটা তো বেজে গেল, স্যাম। মিলটন অ্যারবোগাস্ট আসছে না কেন এখনও?
হ্যাঁ, অনেক রাত হয়েছে। তোমার নিশ্চই খিদে পেয়েছে?
আমি খিদের কথা ভাবছি না। ভাবছি লোকটা এখনও আসছে না কেন।
হয়তো কোন কাজে আটকে গেছে। কিংবা গুরুতুপূর্ণ কিছুর সন্ধান পেয়েছে।
কিন্তু একটা ফোন তো অন্তত করবে। জানে যে আমরা কি রকম চিন্তায় আছি!
আরেকটু ধৈর্য ধরো, লিলা।
ধৈর্য ধরতে ধরতে আমি ক্লান্ত। উঠে দাঁড়াল লিলা, চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে দিল পেছনে। ছোট ঘরটায় অস্থির ভাবে পায়চারি শুরু করল। এতক্ষণ অপেক্ষা করাটাই বোকামি হয়েছে। প্রথমেই পুলিশে যাওয়া উচিত ছিল। ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো- গত এক হপ্তা ধরে এই শুনে আসছি আমি। প্রথমে মি. লোরি, তারপর অ্যারবোগাস্ট, আর এখন আপনি। আপনারা কেউ আমাকে পুলিশের কাছে যেতে দিচ্ছেন না। কারণ সবাই খালি টাকার কথাই ভাবছেন, আমার বোনের ব্যাপারে কারও কোন মাথাব্যথা নেই। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে সেদিকে কারও খেয়ালই নেই!
কথাটা তুমি ভুল বললে, লিলা। তুমি জানো তোমার বোনকে আমি কত ভালবাসি!
তাহলে আপনি এভাবে বসে আছেন কেন? কেন কিছু একটা করছেন না? কি রকম লোক আপনি, মশাই? এখানে বসে বসে খালি লোহালক্কড় ঘাঁটছেন আর মাঝে মাঝে দার্শনিকের মত কথা বলছেন?
লিলা তার পার্সটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল। ওকে বাধা দিল গ্যাম। একি, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আপনাদের শেরিফের কাছে।
শেরিফের সঙ্গে ফোনে এখান থেকেই কথা বলা যাবে। তাছাড়া দোকান ছেড়ে আমাদের কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ অ্যারবোগাস্ট যে কোন সময় চলে আসতে পারে।
আর সে এসেছে! দেখুন গিয়ে আপনার অ্যারবোগাস্ট বহু আগেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। উত্তেজিত গলায় বলল লিলা।
স্যাম ওর হাত ধরে ফেলল। বলল, বসো। আমি এক্ষুণি- শেরিফকে ফোন করছি। কিন্তু লিলা বসল না। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কাউন্টারে গিয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে শুরু করল স্যাম। ওয়ান-সিক্স-টু, প্লীজ। এটা কি শেরিফের অফিস? হার্ডওয়্যার স্টোরের গ্যাম লুমিস বলছি। আমি শেরিফ চেম্বারসের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।…কি বললেন? না, ও ব্যাপারে এখনও কিছু শুনিনি। উনি কোথায় গেছেন বললেন? ফুলটন? উনি কখন ফিরবেন বলে গেছেন কিছু? না, না তেমন কোন ব্যাপার নয়, তার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। যখন নেই তখন আর কি করা। শুনুন, উনি যদি মাঝরাতের আগে ফেরেন তাহলে কি দয়া করে তাঁকে একবার আমার কাছে রিং করতে বলতে পারবেন? আমি আজ সারারাত দোকানেই আছি। ঠিক আছে। ধন্যবাদ। রাখি, ভাই।
স্যাম ফোন রেখে লিলার কাছে চলে এল।
কি বলল শেরিফ?
শেরিফ অফিসে নেই। ফুলটনে নাকি সন্ধ্যার সময় ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। শেরিফ তার পুরো বাহিনী নিয়ে সেখানে গেছে রোড ব্লক করতে। বুড়ো পিটারসনের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললাম। সে বলল দুজন কনস্টেবল ছাড়া আর কেউ নেই ওখানে। কিন্তু ওদেরকে দিয়ে আমাদের কোন কাজ হবে না।
তাহলে আমরা এখন কি করব?
অপেক্ষা তো করতেই হবে। কাল সকালের আগে শেরিফকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
আশ্চর্য! আমরা অতক্ষণ এখানে বসে থাকব? মেরির জন্য কি আপনার একটুও চিন্তা হচ্ছে না?
হচ্ছে। তবে অধৈর্য হয়ে কোন লাভ নেই। আমি যদি ওই মোটেলে ফোন করে অ্যারবোগাস্টের খোঁজ নেই তাহলে তুমি খুশি হবে?
লিলা মাথা ঝাঁকাল।
আচ্ছা, আমি তাই করছি। স্যাম আবার কাউন্টারে গিয়ে ঢুকল। অপারেটরকে ডেকে নরমান হোসেনের নম্বরটা চাইল। কয়েক সেকেণ্ড পর অপারেটর ওকে নরমানের মোটেলের সঙ্গে কানেকশন দিল। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও কেউ সাড়া দিচ্ছে না দেখে ফোন রেখে দিল স্যাম। অবাক হয়ে বলল, আশ্চর্য তো! কেউ ফোন ধরছে না।
তাহলে আমি নিজেই এখন ওখানে যাচ্ছি।
না, তুমি যাবে না। স্যাম লিলার কাঁধ চেপে ধরল। আমি যাচ্ছি। তুমি এখানে থাকো, অ্যারবোগাস্ট আসতে পারে।
স্যাম, কি হলো বলুন তো?
আমি ফিরে এসে বলতে পারব। নাউ রিল্যাক্স। আমি মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই চলে আসব।
পঁয়তাল্লিশ নয়, বিয়াল্লিশ মিনিটের মাথায় স্যাম ফিরে এল। লিলা উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করল, কোন খবর পেলেন?
নাহ্, মাথা নাড়ল স্যাম। মোটেলটা বন্ধ দেখলাম। এমনকি একটা আলোও জ্বলছে না কোথাও। মোটেলের পেছনের বাড়িটার অবস্থাও তথৈবচ। আমি ঝাড়া পাঁচ মিনিট দরজা ধাক্কালাম কিন্তু কারও কোন সাড়া শব্দ নেই। বাড়ির পাশের গ্যারেজটাও দেখলাম শূন্য। মনে হলো নরমান বেটস কোথাও বেরিয়েছে।
মি. অ্যারোগাস্টের কি খবর?
তার গাড়িটাও নেই। মোটেলের সামনে দুটো গাড়ি পার্ক করা ছিল। ট্যুরিস্টদের।
তবে-
আমার মনে হচ্ছে অ্যারবোগাস্ট নিশ্চই কিছু একটা খুঁজে পেয়েছে। হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাই সে নরমান বেটসকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। সেজন্যই আমরা কোন খবর পাইনি।
স্যাম, আমি আর পারছি না। যে করেই হোক আমাকে খবর পেতেই হবে।
খবর একটা কিছু নিশ্চই পাব। কিন্তু তার আগে তোমার কিছু খেয়ে নেয়া দরকার। খাবারের একটা প্যাকেট রাখল স্যাম টেবিলের ওপর। ফেরার পথে ওগুলো কিনে এনেছে। এসো, কিছু খেয়ে নিই, বলল সে।
খেতে খেতে এগারোটা বেজে গেল।
তুমি এখন সোজা হোটেলে চলে যাও। বলল স্যাম। খানিক বিশ্রাম নাও। কোন খবর এলেই আমি তোমাকে ফোন করব। এভাবে অহেতুক বসে থাকার কোন মানে নেই।
কিম্ভ-
কোন কিন্তু নয়। খামোকা এখানে বসে রাত জাগলে শরীর খারাপ হবে। আর তোমাকে তো বলেইছি কোন না কোন খবর আমরা অবশ্যই পাব। অ্যারবোগাস্ট যখন মেরির খোঁজ পেয়েছে তখন সে অবশ্যই কোন খবর নিয়ে আসবে।
কিন্তু পরদিন সকালেও কোন খবর এল না।
সকাল নটার দিকে লিলা চলে এল স্যামের দোকানে।
কিছু জানতে পেরেছেন? জানতে চাইল সে। স্যাম মাথা নাড়ল।
কিন্তু আমি জেনেছি। অ্যারবোগাস্ট তার কাজ শুরু করার আগেই গতকাল সকালে হোটেল ছেড়ে চলে যায়।
স্যাম কোন কথা বলল না। হ্যাটটা মাথায় চাপিয়ে লিলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দোকান থেকে।
রোববারের এই সকালে ফেয়ারভেলের রাস্তায় নোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। লিলাকে সঙ্গে করে স্যাম সোজা শেরিফের অফিসে চলে এল। বুড়ো পিটারসন তার ডেস্কে বসে আছে, একা।
মর্নিং, স্যাম।
গুডমর্নিং মি. পিটারসন। শেরিফ আছেন?
নাহ্। কাল অনেক রাতে তিনি ফিরেছিলেন।
আমার কথা তাঁকে বলেছেন?
বুড়ো একটু ইতস্তত করে বলল, আ-আমি বলতে ভুলে গেছি। আসলে ব্যাংক ডাকাতির খবরটা নিয়ে এত উত্তেজিত ছিলাম যে- আজ উনি আসলেই আপনার কথা সবার আগে বলব।
কখন আসবেন উনি? সাইকো
লাঞ্চের পর। রোববার সকালে তিনি চার্চে যান। ওখান থেকে এখানে চলে আসেন।
কোন্ চার্চ?
ফার্স্ট ব্যাপ্টিস্ট।
ধন্যবাদ।
আপনি তাঁকে–
স্যাম বুড়োর কথা শেষ করতে না দিয়ে লিলাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। বাইরে।
লিলা অবাক হয়ে বলল, এটা কেমন জায়গা? ওদিকে ব্যাংক লুট হয়ে গেছে অথচ আপনাদের শেরিফ গেছেন চার্চে। তিনি কি ওখানে বসে প্রার্থনা করছেন যে কেউ ব্যাংক ডাকাতদের ধরে দেবে?
স্যাম কোন কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে লাগল। মূল রাস্তায় আসতে লিলা জানতে চাইল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
ফার্স্ট ব্যাপ্টিস্ট চার্চে।
চার্চে গিয়ে ওদের আর শেরিফকে বিরক্ত করতে হলো না। দেখল প্রার্থনা সভা ভেঙে গেছে, পিলপিল করে লোক বেরিয়ে আসছে চার্চ থেকে।
ওই তো শেরিফ, বলল স্যাম। চলো, ওকে ধরি।
আস্তাবলের কাছে দাঁড়ানো এক দম্পতির দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল স্যাম। ব্লু সার্জের স্যুট পরা লম্বা, দীর্ঘদেহী লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল, শেরিফ। একটু সময় দেবেন?
আরে স্যাম লুমিস যে! কি খবর? শেরিফ চেম্বারস তার লালচে হাত বাড়িয়ে দিল জনের দিকে। স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, মিলা, তুমি তো স্যামকে চেনোই।
লিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল স্যাম। ইনি মিস লিলা। ফোর্থ ওয়ার্থ থেকে এসেছেন।
প্লীজড টু মিট ইউ! স্যাম প্রায়ই যার কথা বলে আপনিই কি সেই-
না। সে আমার বোন। বলল লিলা। তার ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে আমরা কথা বলতে এসেছি।
আপনার অফিসে গিয়ে কথা বললে হয় না? বলল স্যাম। ওখানে বসে খোলাখুলিভাবে সব আলাপ করা যাবে।
হবে না কেন অবশ্যই হবে। শেরিফ তার স্ত্রীর দিকে ফিরল, মিলা, তুমি বাড়ি যাও। আমি এদের বিদায় করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে শেরিফের কাজ শেষ হলো না। স্যামের গল্প শুনতেই প্রায় বিশ মিনিটের মত চলে গেল। এই দীর্ঘ সময় সে কোন কথা বলল না। তারপর প্রশ্ন করল, তোমাদের মিলটন অ্যারবোগাস্ট প্রথমেই আমার কাছে আসেনি কেন?
আপনাকে তো বলেইছি সে চায়নি ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি হোক। তাতে লোরি এজেন্সীর বদনাম হওয়ার ভয় ছিল। বলল গ্যাম।
আপনাদের সে পরিচয়পত্র দেখিয়েছে?
জ্বী। মাথা দোলাল লিলা। তার কাছে লাইসেন্সড ইনভেস্টিগেটরের কার্ড ছিল। আমার বোনের খোঁজে সে ওই মোটেলে পর্যন্ত সন্ধান চালিয়েছে। তারপর থেকে তার আর কোন খবর নেই। অথচ আমাদেরকে তার খবর দেয়ার কথা ছিল।
কিন্তু তুমি মোটেলে গিয়ে তাকে আর দেখোনি, তাই না?
জ্বী, শেরিফ, বলল স্যাম। ওখানে কেউ ছিল না।
আশ্চর্য তো! কিন্তু যতদূর জানি মোটেলের মালিক ওই নরমান বেটস সব সময় ওখানেই থাকে। শহরে সে বলতে গেলে আসেই না। সকালে ফোন করেও তাকে পাওনি? হয়তো তখন সে ঘুমাচ্ছিল। আচ্ছা, আমি দেখি একবার চেষ্টা করে।
টাকার ব্যাপারে তাকে কিছু বলার দরকার নেই, বলল স্যাম। আপনি শুধু অ্যারবোগাস্টের কথা জিজ্ঞেস করুন।
ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। বলল শেরিফ। আমি জানি কি বলতে হবে।
কিছুক্ষণ পর লাইন পেল শেরিফ, কথা বলতে শুরু করল।
কে…নরমান? শেরিফ চেম্বারস বলছি, শোনো, একটা খবর চাই আমার। এখানে একজন লোক অ্যারবোগাস্ট নামের কাউকে খোঁজ করছে। পুরো নাম মিলটন অ্যারবোগাস্ট। ফোর্থ ওয়ার্থ থেকে এসেছে। প্যারিটি মিউঁচুয়াল নামের একটা ফার্মের প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।
সে কি? ও এসেছিল? কখন? আচ্ছা। কিছু বলছিল? ও আচ্ছা, চলে গেল? আঁ কোথায় গিয়েছে জানো কিছু?…আচ্ছা! তোমার তাই মনে হলো? না, না তেমন কিছু নয়। ভাবছিলাম সে হয়তো আবার আসতে পারে,..আচ্ছা, লোকটা সন্ধ্যা নাগাদ আবার আসতে পারে কি? তাই, না?
…তুমি সাধারণত কটার সময় ঘুমাতে যাও? আচ্ছা, আচ্ছা। এখন ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, নরমান। ধন্যবাদ।
ফোন রেখে শেরিফ ওদের দিকে ফিরল।
তোমাদের ওই লোক বোধহয় শিকাগোর দিকে চলে গেছে, বলল সে।
শিকাগো?
চেম্বারস মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ। মেয়েটি নাকি বলছিল সে শিকাগোতে যাচ্ছে।
লিলা, প্রায় ফুঁসে উঠল। এসব কি যা-তা বলছেন? ওই লোকটা আপনাকে ঠিক কি বলল বলুন তো?
অ্যারবোগাস্ট গতকাল সন্ধ্যায় আপনাদের যা বলেছে ঠিক তাই। আপনার বোন গত শনিবার ওই মোটেলে ওঠে জেন উইলসন নামে। নিজের ঠিকানা দিয়েছে স্যান অ্যানটোনিও। কথায় কথায় বলেছে সে শিকাগো যাচ্ছে।
লিলা প্রতিবাদ করল। অসম্ভব! ওই মেয়ে তাহলে মেরি নয়। কারণ শিকাগোয় তার জানাশোনা কেউ নেই। জীবনেও সে ওখানে যায়নি।
নরমান আরও বলেছে অ্যারবোগাস্টের নাকি নিশ্চিত ধারণা ওই জেন উইলসনই আপনার বোন মেরি। তার চেহারার বর্ণনা, মায় হাতের লেখা পর্যন্ত মিলে গেছে। মেরির শিকাগো যাবার কথা শুনে অ্যারবোগাস্ট নাকি প্রায় উড়ে নরমানের মোটেল থেকে বেরিয়ে গেছে।
কিন্তু তা কি করে সম্ভব? মেরি যদি সেখানে যায়ও, অ্যারবোগাস্ট কি আর তাকে খুঁজে পাবে? এক হপ্তা তো হয়েই গেল।
অ্যারবোগাস্ট হয়তো জানে কোথায় খুঁজলে তাকে পাওয়া যাবে। সে ইচ্ছে করেই তার প্ল্যানের কথা তোমাদের বলেনি। হয়তো সে এমন কিছু জানতে পেরেছে যা তোমরা জানো না।
কিন্তু অ্যারবোগাস্ট এমন কি কথা জানে যা আমরা জানি না? বলল লিলা।
এসব লোকরা খুব ধুরন্ধর হয়। হয়তো ওখানে গিয়ে আপনার বোনের প্ল্যানটা জেনে ফেলেছিল। আর একবার যদি সে আপনার বোনের খোঁজ পায়- এবং টাকাটা উদ্ধার করতে পারে তখন কি সে আর ওটা তার কোম্পানিকে ফেরত দেবে ভেবেছেন?
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন মি. অ্যারবোগাস্ট একটা বিশ্বাসঘাতক, চোর?
আমি তা বলছি না। আমি শুধু বলতে চাই যে চল্লিশ হাজার ডলার বেশ বড় অঙ্কের টাকা। সে যেহেতু কথা দিয়েও এখানে আসেনি তাই আমার মনে হচ্ছে ওরকম কিছু একটা প্ল্যান সে করেছে। নইলে এখানে আসার পর সে আমাকে খবর দেয়নি কেন? আর কেনই বা বিল মিটিয়ে সে চলে যাবে?
এক মিনিট, শেরিফ, বলল স্যাম, এভাবে এক লাফে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুবেন না। এই নরমান বেটস আপনাকে যা বলেছে তাছাড়া আপনি কারও কথা তো শোনেননি। এই লোকটাও তো মিথ্যা কথা বলতে পারে?
তার মিথ্যা বলার দরকার কি? সে যা জানে তাই বলেছে।
তাহলে কাল রাতে আমি যখন তার মোটেলে গিয়েছিলাম তখন সে কোথায় ছিল?
ঘুমাচ্ছিল। আমি যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বলল শেরিফ।
দেখো, এই নরমান বেটসকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। লোকটা একটু বোকা স্বভাবের। কিন্তু মিথ্যেবাদী নয়। তাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণ দেখছি না আমি। কিন্তু তোমাদের অ্যারবোগাস্ট হচ্ছে একটা আস্ত মিথ্যুক।
মানে?
তুমি বললে না যে সে তোমাকে নরমানের মোটেল থেকে ফোন করেছিল? তোমাদের পরে খবর জানাবে বলে আসলে সে তখন শিকাগোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে।
কিন্তু এখানে সে মিথ্যে বলল কোথায় কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না।
কেন, সে বলেছিল না যে সে নরমানের মার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে? নরমান বেটসের মা-ই নেই।
নেই। নরমান বেটসের মা নেই!!
হ্যাঁ। বিশ বছর আগে তার মা মারা গেছে, বলল শেরিফ। তুমি তখন খুব ছোট। ঘটনাটা তোমার মনে না থাকারই কথা।
এই নরমান বেটসের বাপ এ রাজ্যে এসেছিলেন চাকুরির খোঁজে। স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টে কাজ জুটিয়ে নেন তিনি। ওখানেই নরমা, মানে নরমানের মার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। নরমা সুন্দরী ছিলেন না, কিন্তু তারপরও মি, বেটস তার দিকে ঝুঁকে পড়েন। আমার ধারণা নরমার প্রচুর সহায় সম্পত্তিই এর প্রধান কারণ। তিনি ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁদের বিবাহিত জীবন, যতদূর জানি, সুখের ছিল না। খুব বদমেজাজী ছিলেন নরমা। স্বামীর সঙ্গে খিটিমিটি লেগেই থাকত। এই সময় তাদের অশান্তির সংসারে আগুনে ঘৃতাহুতি দেন জো বনসিডাইন। জো নরমার বয়ফ্রেন্ড। অনেকদিন স্পেনে ছিলেন। কিসের যেন ব্যবসা করতেন। ফেয়ারভেলে এসে তার পুরানো প্রেম আবার নতুন করে চাগিয়ে ওঠে। তাঁর সঙ্গে নরমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি মি. বেটস। নরমানের জন্মের পর তাদের মধ্যে কোন্দল আরও বেড়ে যায়। লোকে বলাবলি শুরু করে নরমান আসলে জো-র অবৈধ সন্তান। মি. বেটস নিজেও নরমানের ব্যাপারে দারুণ উদাসীন ছিলেন। একদিন নরমার সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া করে তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, পরে টেক্সাস থেকে উকিলের মাধ্যমে ডিভোর্স নোটিশ পাঠান। নরমা ডিভোর্স লেটারে সই করে দেন। তারপর থেকে মি, বেটস সাহেবের খবর কেউ জানে না। ডিভোর্সের পর জো-র সঙ্গে নরমার দারুণ মাখামাখি- ইয়ে- শেরিফ আড়চোখে লিলার দিকে তাকাল, তারপর হাত দিয়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলল, বুঝতেই পারছ সম্পর্ক কোথায় গড়িয়েছিল। নরমা কোনকালেই জো-কে বিয়ে করেননি। একসঙ্গেই থাকতেন দুজনে। সুতরাং স্ক্যাণ্ডাল ভালমতই ছড়িয়েছিল। এই মোটেল তিনি জো-র সহায়তায় তৈরি করেন। তারপর দুজনের মধ্যে কি জানি একটা গোলমাল হয়। হয়তো নরমা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েন, কিংবা জো-র প্রাক্তন স্ত্রী তার দাবি নিয়ে ফিরে আসে। যাহোক, সমস্যাটা বোধহয় গুরুতর ছিল। কারণ একরাতে দুজনেই স্ট্রিকনিন খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আর নরমান বেটসের সামনেই এই ঘটনাটা ঘটে। মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাত পায় সে। মাসকয়েক তাকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। এমন কি তার মার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও সে যেতে পারেনি। থামল শেরিফ।
আচ্ছা, বুঝলাম, বলল স্যাম, কিন্তু নরমানের মা যে মারা গেছে সে ব্যাপারে আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কি করে?
আরে! আমি নিজে ওর মার কফিন বহন করেছি।
.
১২.
স্যাম এবং লিলা হোটেলে বসে ডিনার খাচ্ছিল। স্রেফ খেতে হবে বলে খাওয়া! নইলে খাওয়ার ইচ্ছে বা রুচি কারোই তেমন ছিল না।
আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে মিলটন অ্যারবোগাস্ট আমাদের কোন খবর না দিয়েই চলে গেছে, কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল লিলা। আর মেরি শিকাগো গেছে এটা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু শেরিফ বিশ্বাস করছেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম।
তাছাড়া অ্যারবোগাস্ট নরমান বেটসের মার কথা বলে আমাদের বিরাট একটা ধোঁকা দিয়েছে।
হ্যাঁ। তা ঠিক। পুরো গল্পটাই বানোয়াট ছিল। কিন্তু শিকাগোর গল্পটাও আমার কাছে কেমন কেমন মনে হচ্ছে। মেরির ব্যাপারে অ্যারবোগাস্ট আমাদের চেয়ে নিশ্চই বেশি জানে না।
শরবতের গ্লাসে চিনি মেশাতে মেশাতে স্যাম বলল, ইদানীং আমার মনে হয় কি জানো মেরির ব্যাপারে আমরা আসলে কেউই খুব একটা বেশি জানি না। আমি তার প্রেমিক। তুমি তার বোন। আমরা কেউই বিশ্বাস করি না যে সে টাকাটা মেরে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির কারণে বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যে মেরি কাজ করেছে।
হ্যাঁ, লিলা নিচু গলায় বলল, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু কাজটা সে নিজের জন্য করেনি। হয়তো তার আশা ছিল ওই টাকা দিয়ে আপনাকে সে ঋণমুক্ত করবে।
তাহলে সে আমার কাছে এল না কেন? যদিও তার টাকা আমি কিছুতেই নিতাম না কিন্তু সে আমার সঙ্গে দেখা করল না কেন?
সে দেখা করতেই আসছিল। অন্তত ওই মোটেল পর্যন্ত এসেছিল, লিলা ন্যাপকিনে হাত মুছল। আমি এই কথাটাই শেরিফকে বোঝাতে চাইছিলাম। কিন্তু শেরিফ আমার কথা কানেই তুললেন না। অ্যারবোগাস্ট যদি মিথ্যা কথা বলতে পারে তাহলে নরমান বেটস যে সত্যি কথা বলছে তার প্রমাণ কি? ফোনে তার সঙ্গে কথা না বলে শেরিফ নিজে কেন একবার ওখানে গেলেন না?
এ জন্য আমি শেরিফকে দোষ দেব না, বলল স্যাম। উনি এগোবেন কোন ভরসায়? কি প্রমাণ আছে তাঁর হাতে যে তিনি হুট করে একজন মানুষের বাড়ি সার্চ করবেন? চাইলেই তুমি বেহুদা কারও ঘরে তল্লাশি করতে পারো না। তাছাড়া নিজের কানেই তো শুনলে শেরিফ ওই লোককে মোটও সন্দেহ করছেন না। তিনি ওকে অনেকদিন ধরে চেনেন।
আমিও মেরিকে সারাজীবন ধরে চিনি। তাই মন মানে না। কিন্তু শেরিফ তো এও বলেছেন নরমান নাকি একটু অদ্ভুত স্বভাবের।
ঠিক ওভাবে কিছু বলেননি। তিনি বলেছেন লোকটা সন্ন্যাসীদের মত একা একা থাকে। অবশ্য এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ তার মার মৃত্যুতে মানসিক ভাবে যে আঘাত পেয়েছে সেটা হয়তো সে সামলে উঠতে পারেনি।
তার মা? লিলা ভ্রু কোঁচকাল। এই একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, স্যাম। অ্যারবোগাস্ট আমাদের যদি মিথ্যা বললই তাহলে এমন একটা ব্যাপারে মিথ্যা বলল কেন?
তা জানি না। হয়তো প্রথমে সে-
তাছাড়া সে যদি কেটে পড়ার তালই করবে তাহলে আবার আমাদেরকে ফোন করতে গেল কেন? সে যে মোটেলে গিয়েছিল এ ব্যাপারটাও সে দিব্যি গোপন করে কেটে পড়তে পারত। বরং এটাই স্বাভাবিক ছিল। ন্যাপকিনটা ফেলে দিয়ে লিলা স্যামের দিকে তাকাল। স্যাম, আ-আমার কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব সন্দেহ হচ্ছে।
কি ব্যাপারে?
শেষবার যখন সে আপনাকে ফোন করে তখন কি বলেছিল? নরমানের মাকে দেখার ব্যাপারে কিছু?
হ্যাঁ। গাড়ি নিয়ে ঢোকার সময় সে শোবার ঘরের জানালায় নরমানের মাকে বসে থাকতে দেখে।
হয়তো সে সত্যিই দেখেছে। আপনি এটাকে মিথ্যা ভাবছেন কেন?
কারণ মিসেস নরমা মৃত। একজন মৃত মানুষকে জানালার পাশে বসে থাকতে দেখার ব্যাপারটা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কি?
কিন্তু নরমানই যদি মিথ্যা বলে থাকে? অ্যারবোগাস্ট তো আন্দাজে বলেছিল জানালার ধারের মহিলাটি নরমানের মা। নরমান হয়তো ব্যাপারটা স্বীকার করল। কিন্তু অ্যারবোগাস্ট তার মার সঙ্গে দেখা করার জন্য জিদ ধরলে সে হয়তো বলেছে তার মা ভীষণ অসুস্থ, দেখা করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যারবোগাস্ট এমনই তো বলেছিল আপনাকে, নাকি?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না যে-
কিন্তু অ্যারবোগাস্ট বুঝতে পেরেছিল। আসল ঘটনা হচ্ছে সে গাড়ি নিয়ে ঢোকার সময় সত্যি জানালার কাছে কাউকে বসে থাকতে দেখে। এবং আমার ধারণা সেই মেয়েটি মেরি ছাড়া অন্য কেউ নয়।
কি বলছ লিলা?
আমি ঠিকই বলছি। এতে অযৌক্তিক কি আছে? মেরির শেষ খোঁজ পাওয়া যায় ওই মোটেলে। তারপর থেকে তার আর কোন ট্রেস নেই। অ্যারবোগাস্টও ওই মোটেলে পৌঁছার পর পর রহস্যজনকভাবে নেই হয়ে গেছে। দুদুটো লোক এভাবে নিখোঁজ। এরপরও কি আমি মেরির বোন হিসেবে শেরিফের কাছে গিয়ে দাবি করতে পারি না যে এ ব্যাপারে থরো ইনভেস্টিগেশন দরকার?
ঠিক আছে। তাহলে চলো শেরিফের কাছে যাই।
ওরা শেরিফের বাসায় গেল। শেরিফ খাওয়া দাওয়া শেষ করে টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে লিলার অভিযোগ শুনল।
আপনাকে কিন্তু অভিযোগ পত্রে সই করতে হবে, বলল সে।
আমি যে কোন জায়গায় সই করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনাকে ওখানে গিয়ে ভাল করে খোঁজ খবর নিতে হবে।
কাল সকালে গেলে হয় না? মানে ব্যাংক ডাকাতির জন্য আমাকে-
এক মিনিট শেরিফ, বাধা দিল স্যাম। দেখুন, ব্যাপারটা খুবই সাংঘাতিক। এই মেয়েটির বোনকে এক হপ্তা ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটা শুধু টাকার ব্যাপার নয়। এর বোনের জীবন মৃত্যুর প্রশ্নও এর সঙ্গে জড়িত। সে হয়তো-
ঠিক আছে, ঠিক আছে! আমাকে আর কিছু বলতে হবে না, স্যাম। এখন অফিসে যাই, চলো। মিস লিলাকে অভিযোগ পত্রে সই করতে হবে। কিন্তু আবারও বলছি নরমানকে সন্দেহ করে আমরা বৃথা কালক্ষেপণ করছি। নরমান খুনী নয়।
ওদেরকে অফিসে বসিয়ে রেখে শেরিফ বেরিয়ে গেল এনকোয়ারিতে। ওরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল শেরিফের জন্য। সন্ধ্যার খানিক আগে সে ফিরে এল। অফিসে ঢুকেই সে ওদের দিকে রাগী দৃষ্টিতে চাইল, সেই সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আমি যা বলেছিলাম ঠিক তাই, বলল শেরিফ। ফলস অ্যালার্ম।
লিলা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি দেখলেন?
ধীরে, ইয়াং লেডী, ধীরে। আমাকে সুস্থির হয়ে একটু বসতে দিন। তারপর সব খুলে বলছি। আমরা সরাসরি নরমানের মোটেলে যাই। সে তখন বাড়ির পেছনের বনে কাঠ জোগাড় করছিল। ওয়ারেন্টও দেখাতে হলো না, আমাদের দেখেই এগিয়ে এল। মোটেলের চাবি পর্যন্ত হাতে তুলে দিয়ে বলল আমি যেখানে ইচ্ছে সার্চ করে দেখতে পারি।
আপনি দেখলেন?
অবশ্যই। মোটেলের প্রতিটি জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। অবশ্য দেখব আশাও করিনি। কারণ নরমান ছাড়া ওখানে আর কেউ থাকে না তোমাদের আগেই বলেছি।
শোবার ঘর?
তিনতলায় একটা শোবার ঘর আছে। নরমানের মা যখন বেঁচে ছিল তখন ওটা সে ব্যবহার করত। কিন্তু এখন ওখানে কেউ ঘুমায় না। তবে ঘরটাকে সে আগের মতই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখেছে। তার মার স্মৃতি সে আজও ভুলতে পারেনি।
মিলটন অ্যারবোগাস্ট যে বলেছিল সে তার মাকে দেখেছে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন? স্যাম জানতে চাইল।
নিশ্চই। সে বলল এটা ডাহা মিথ্যা কথা। অ্যারবোগাস্ট কাউকে দেখেনি। তাকে শিকাগোর ব্যাপারেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার ব্যাখ্যা শুনে মনে হলো মেরি ওদিকেই গেছে।
আমি বিশ্বাস করি না, লিলা প্রতিবাদ করল। নরমানের মাকে নিয়ে অ্যারবোগাস্ট শুধু শুধু কেন বানিয়ে বলবে?
যদি তার সঙ্গে কখনও দেখা হয় তাহলে তাকেই জিজ্ঞেস করবেন, মিস লিলা। বলল শেরিফ। অ্যারবোগাস্ট নিশ্চই জানালার পাশে নরমানের মার ভূত দেখেছে।
আপনি এত নিশ্চিন্ত হন কি করে যে সে মৃত?
বললাম তো মহিলার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি ছিলাম। মৃত্যুর আগে তিনি নরমানকে যে চিঠিখানা লিখে যান ওটাও আমি দেখেছি। তারপরও যদি তোমাদের বিশ্বাস না হয় আমি কি করব? আমি কি কবর খুঁড়ে তার কঙ্কাল তোমাদের সামনে হাজির করব? রেগে গেল শেরিফ। তারপর নিজেই লজ্জা পেয়ে বলল, সরি, মিস লিলা। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমার সাধ্য অনুযায়ী আমি করেছি। পুরো বাড়ি সার্চ করেছি। আপনার বোন ওখানে নেই। নেই মিলটন অ্যারবোগাস্টও। তাদের গাড়িরও কোন চিহ্ন খুঁজে পাইনি আমি।
তাহলে এখন আমরা কি করব? জিজ্ঞেস করল স্যাম।
কেন, মিলটন অ্যারবোগাস্টের অফিসে খোঁজ নাও। দেখে তারা কোন খবর দিতে পারে কিনা।
ধন্যবাদ, উঠে দাঁড়াল লিলা। আপনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য দুঃখিত।
আপনাদের জন্য কষ্ট করাই আমার কর্তব্য, তাই না, স্যাম?
তাই।
শেরিফ চেম্বারসও চেয়ার ছাড়ল। আপনার কষ্টটা আমি বুঝি, মিস লিলা। কিন্তু আমার পক্ষে যা করা সম্ভব তাই করেছি আমি। শুধু সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে এর বেশি এগোনোও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অবশ্য আপনারা যদি পরবর্তীতে কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেন তাহলে-
জানি, শেরিফ, বলল স্যাম, আপনি আপনার সাধ্যমতই চেষ্টা করেছেন। আপনার সহযোগিতার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ঘুরল সে লিলার দিকে। যাবে এখন? লিলা মাথা দোলাল।
ওরা রাস্তায় নেমে এল। শেষ বিকেলের সূর্যের লাল আলো ওদের শরীরে খেলা করতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে স্যাম জিজ্ঞেস করল, আমার ওখানে যাবে?
লিলা এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। যাবে না।
তবে কি হোটেলে?
না।
তাহলে কোথায় যাবে? আপনি কি করবেন জানি না। বলল লিলা। কিন্তু আমি এখন ওই মোটেলে যাব। উদ্ধত ভঙ্গিতে মাথা তুলল সে। চোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।