ভারতবর্ষ
হালের ভারতবর্ষ নিয়ে আমাদের ইংরেজ সরকারের যে মুশকিল হয়েছে তার বিশগুণ বিপদে পড়েছি আমরা ভারতবাসীরা প্ৰাচীন ভারতবর্ষকে নিয়ে।
বর্তমান যাহোক অনেকটা চোখের সামনে রয়েছে। ওর ভিতরে কি আছে না আছে আশঙ্কা হলে সঙিন দিয়ে খুঁচিয়ে দেখা যায়; ওর ধড়ফড়ানি লাঠি পিঠে ঠান্ড করা চলে; ওর মুখরতার মুখ বন্ধের জন্য মােয়া লাড়ু, রাহা খরচ আছে। কিন্তু অতীতকে নিয়ে কী করা যায়। ওকে না যায় চোখে দেখা, না চলে চেপে ধরা। অথচ অবস্থার গতিকে এমনি দাঁড়িয়েছে যে, আজকার দিনে ভারতবর্ষের অতীত ছাড়া অন্য দিকে চোখ ফিরাতে গেলেই গালে চড় পড়ে; ওর বোঝার চাপে পিঠ বঁকা হওয়ার নামই মুক্তি নয়। এ বলার জোট নেই। কারণ আমরা দশে মিলে ভোটে প্রায় ঠিক করে ফেলেছি যে ভারতবর্ষের অতীতই তার বর্তমানের পথের আলো; ও-আলো আমাদের পেছন থেকে সামনে ছায়া না ফেলে কেবল আলোই ছড়াচ্ছে। আর এতেও আমাদের সন্দেহ নেই যে ওই অতীতকে পিঠে সোয়ার করতে পারলেই সে আমাদের সোজা গম্য অর্থাৎ কাম্য স্থানে পৌছে দেবে। জাতি যখন তার বর্তমানের হীনতা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়, পঙ্গুতা পরিহার করে এগিয়ে চলার বল সংগ্রহ করে, তখন নিজের অতীত থেকে শক্তি লাভের চেষ্টা কিছু নূতন নয়। সামনে এগিয়ে চলাকে পিছনে ফিরে যাওয়া বলে কল্পনার মধ্যেও নূতনত্ব কিছু নেই। এ-সব ঘটনা মানুষের ইতিহাসে নানা জাতির মধ্যে বার বার ঘটেছে। এর কারণ কোনও সভ্যতার গতিই একটানা নয়। দৌড়ে বসে জেগে ঘুমিয়ে, উঠে পড়ে এমনি করেই সভ্যতা চলছেও চলবে। সেই জন্য কোনও আপাত-স্থবির জাতির মধ্যে যখন নব-জীবনের স্পন্দন আসে এক অর্থে সেটা তার পুনর্জন্ম। তার অতীতের যে-সব অংশে প্রাণের প্রাচুর্য ছিল তার সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। নবজাগ্ৰত জাতির চোখের সম্মুখে প্ৰাণে ভরপুর ভবিষ্যতের যে ছবি থাকে প্রাণহীন বর্তমানের চেয়ে প্ৰাণবন্ত অতীতের সঙ্গে তার মিল ঢের বেশি। এই জন্য ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়াকে মনে হয়। অতীতের দিকে ফিরে চলা। কিন্তু মুখে যাই বলুক, জাতির অন্তরাত্মা যা’ চায় তা’ অতীতকে মকসো করতে নয়, নিজের প্রাণে অতীতের প্রাণের সেই স্পর্শ পেতে যার বেগে অতীত তার বর্তমানকে ছাড়িয়ে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলেছিল।
আজকে আমরা ভারতবর্ষের বর্তমান সমস্যা পূরণে যে তার অতীতকে ডাক দিচ্ছি, তারও নিশ্চয় এই অর্থ। আমরা ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের সেই সব যুগের সঙ্গে মনের যোগ ঘটাতে চাচ্ছি। যার প্রাণের বেগ ও গতি আমাদের বর্তমান চেষ্টা ও ভবিষ্যৎ আদর্শের অনুকুল ও অনুরূপ। না হলে কোনও জাতিরই সমস্ত অতীতটা তার গৌরবের নয়; ভারতবর্ষেরও নয়। সুতরাং এ প্রশ্নটা উঠে পড়ে, আমাদের এই বাঞ্ছিত অতীত ভারতবর্ষের বিচিত্র ও দীর্ঘ ইতিহাসের কোন অতীত? ভারতবর্ষের প্রাণ মনের বিকাশের কোন ছবিটা বর্তমানে আমাদের চোখের সামনে রাখা সবচেয়ে দরকারি। সকলেই জানে এর এক কথায় উত্তর আধ্যাত্মিকতা’। আর এ উত্তরের সুবিধা এই যে সংক্ষিপ্ত হলেও ওর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। কারণ উত্তর যাঁরা দেন তাঁরা বলেন ও বস্তু অনুভূতিগম্য, কথায় বোঝানোর জিনিস নয়। ওর স্বরূপ অবাচ্য; কেবল ও কী নয়। তাই কতকটা নেতি নেতি করে বলা যায়। এবং তা বলতে গেলে যা দাড়ায় সে হচ্ছে ও পদার্থ সমাজতত্ত্ব নয়, রাজনীতি নয়, অর্থনীতি নয়; ধর্ম-ব্যবহার, শিল্পকলা নয়; কাব্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন-কিছু নয়। অর্থাৎ মানুষের প্রাচীন ও নবীন আর সমস্ত সভ্যতা যা গৌরবের জিনিস বলে জানে তার সঙ্গে এর কোনও সম্বন্ধ নেই। আর ওই বস্তু হল ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার বিশিষ্টতা, যাকে ফিরিয়ে আনতে পারলেই আমাদের সমস্ত দুঃখ-দীনতার অবসান হবে। সোজা কথায় ভােলা তবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ছিল একটা সৃষ্টিছাড়া জিনিস, যার সঙ্গে বাকি পৃথিবীর কোনও যোগ ছিল না। বর্তমানে আমাদের হতে হবে কিন্তুতকিমাকার জাতি, যার সঙ্গে আর কারওর কোনও মিল থাকবে না।
মন বোজার হলেও সত্যের খাতিরে স্বীকার কবতে হবে, প্রাচীন ভারতবর্ষের এই আধ্যাত্মিক সভ্যতার ছবি আমরা আঁকিনি। একেছে একদল ইউরোপীয় পণ্ডিত, যাদের বলে ‘ওরিয়েন্টালিস্ট’–প্ৰাচ্যতত্ত্ববিদ। এদেরই ক’জন মিলে এই উপন্যাসটি রচনা করেছে যে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা একটা অদ্ভুত জিনিস ছিল। অন্য সব সভ্যতার সঙ্গে তার মিলের চেয়ে গরমিল বেশি। আর আর সভ্যতা বাস করে ইহলোকে, ও-সভ্যতা বাস করে পরলোকে; আর সবাই চায় জীবন, ও চাইত মৃত্যু; আর সবার চোখ ছিল চেয়ে দেখবার জন্য, ওর ছিল বুজে ধ্যান করবার জন্য? এই উপন্যাসটি মুখস্থ করেই আমরা জোর গলায় প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার বক্তৃতা উদগিরণ করছি। এর এক প্রধান কারণ আমাদের বর্তমান প্ৰভুদের উপর অভিমান। তাঁরা নাকি আমাদের বুটের তলায় চেপে রেখেছেন, তাই আমরা সেখান থেকেই বলছি, ‘আছি বটে নীচে পড়ে। কিন্তু তোমরা বুঝবে না। আমাদের বাস কত উচুতে। তোমরা যা’ সবের গৌরব কর ও-সব তো কিছুই নয়। আমাদের প্রাচীন পিতামহেরা ও-সবকে সভ্যতার উপকরণ বলেই গণনা করতেন না। তাঁরা ছিলেন আধ্যাত্মিক; আমরাও তাদেরই বংশধর।’ নইলে এ-সব কথা বোঝা শক্ত যে, যে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস হল মহাভারত, ধর্মশাস্ত্র ছিল মনুসংহিতা, যার অর্থশাস্ত্রের আচাৰ্য কৌটিল্য, যার মোক্ষশাস্ত্র ছিল গৃহীর অপাঠ্য, আর বাৎস্যায়নও যার ঋষি, তার ছবি আমরা আধ্যাত্মিকতার একরঙা তুলিতে কেমন করে এঁকে তুলি। তবে এ কথাও ঠিক, ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার বক্তৃতা দিতে তার যা সব নিদর্শন আছে তার সঙ্গে পরিচয়ের কোনও প্রয়োজন নেই; মনের খুশিতে কল্পনা করে নিলেই হল। আমার এক শ্ৰদ্ধেয় বন্ধু ছিলেন, বাল্মীকির রামায়ণের উপর তার অগাধ ভক্তি তিনি সব সময়ে প্রচার করতেন। কথাপ্রসঙ্গে সন্দেহ হল ও-বই তিনি কখনও চোখে দেখেননি। জিজ্ঞাসায় বললেন, বাল্মীকির রামায়ণ মুলে কি অনুবাদে তিনি কখনও পড়েননি। বটে। কিন্তু তুলসীদাসের রামায়ণের ইংরাজি অনুবাদ অনেকটা পড়েছেন। একদিন কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড থেকে বর্ষায় রামের বিরহ বর্ণনা তাকে পড়ে শোনালে দেখলেম তিনি বড় মনঃক্ষুন্ন হলেন। তার বিশ্বাস ছিল স্ত্রীর জন্য ও-রকম বিলাপ একালের কলেজের ছেলেদের ফ্যাশান; কিন্তু রামচন্দ্রের পক্ষে— স্পষ্ট বুঝলুম রামায়ণের রামসীতা প্রভৃতি সম্বন্ধে তাঁর মনে কল্পনার যে-ছবি ছিল রামায়ণ বইটা তাতে একটা জবর ঘা দিল।
কিন্তু আজ যখন আমরা কল্পনার জাল বোনা ছেড়ে জীবনের জাল নিয়ে বসেছি তখন এ কথা জোর করে স্পষ্ট করে বলার সময় হয়েছে, কি ভারতবর্ষের অতীত, কি তার বর্তমান কিছুই পৃথিবী-ছাড়া সৃষ্টিছাড়া নয়। ভারতের প্রাচীন সভ্যতার বিশিষ্টতা অবশ্যই ছিল, কারণ দুটো সভ্যতা দূরে থাকুক, এক গাছের দুটো পাতাও ঠিক একরকম নয়। ঠিক একই ছাঁচের বহু জিনিস বের হয়। কল থেকে, জীবন থেকে নয়; কিন্তু এই বিশিষ্টতার যা ভিত্তি তা মানব-সভ্যতার সাধারণ ভিত্তি। ইমারতের গড়ন আলাদা কিন্তু তার মালমশলা একই। প্রাচীন পৃথিবীর যেগুলি শ্রেষ্ঠ সভ্যতা, ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে তাদের বৈষম্যের চেয়ে সাদৃশ্যই বেশি। যেমন মানুষে মানুষে তফাতের চেয়ে মিলই বেশি। ইংরেজ টেবিল পেতে কঁাটা চামচে দিয়ে খায়, আমরা পাতা পেতে হাত দিয়ে খাই। এর মধ্যে তফাতের চেয়ে এই মিলই নিশ্চয়ই ঢের বেশি যে, শরীর ধারণের জন্য ইংরেজকেও খেতে হয়, ভারতবাসীকেও খেতে হয়। আজকার চিত্তবিভ্ৰমের দিনে এই সহজ কথা আমাদের মনে করা দরকার হয়েছে যে প্রাচীন ভারতবর্ষেও রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, সবল দুর্বলের উপর অত্যাচার করত, দুর্ভিক্ষে লোক মরত, কবিরা প্রেমের কবিতা লিখত, উৎসবে মোহমুদগর পাঠ হত না। এবং আমরা বর্তমান ভারতবর্ষে যে সভ্যতা গড়ে তুলব। তারও বিশিষ্টতা থাকবে সন্দেহ নেই। কিন্তু চারপাশের সভ্যতার সঙ্গে সে একটা খাপছাড়া কিছু হবে না। তারও রাজনীতি, সমাজনীতি, ব্যবহার দরকার হবে। সে-ও হবে মানুষের সভ্যতার বিচিত্ৰ লীলার একটা প্রকাশ। এ নাস্তিকতা মন থেকে দূর করতে হবে, যে, ভগবান সমস্ত পৃথিবীকে বঞ্চিত করে শ্রেষ্ঠ যা কিছু তা ভারতবর্ষের উপরেই বর্ষণ করবেন।
এখন মনে হচ্ছে, এই যে তর্ক করছি এও বিশিষ্টতার দাবি শুনে শুনে একটু বিভ্রান্ত হয়ে। ভাবটা প্রকাশ করছি যেন এ দাবির মধ্যে একটা বিশিষ্টতার কিছু আছে। কিন্তু ভেবে দেখছি ওই বিশিষ্টতার দাবি সব সভ্যজাতিই করেছে। ‘আমরা আর কারু মতো নাই’ এ কথায় সবাই আর সবার মতো; বিশেষ করে যে-সব জাতি ঘা খেয়ে পড়ে আবার উঠতে যাচ্ছে। নেপোলিয়নের মার খেয়ে প্রশিয়া যখন শক্তিসঞ্চায়ের চেষ্টা করছিল, তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকদের কাছে দার্শনিক ফিক্তে ঠিক এই বক্তৃতাই দিয়েছিলেন। ‘আমরা জার্মান জাতি বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি। মানুষের ভবিষ্যৎ আমাদের উপরেই নির্ভর করছে। আমরা যে সভ্যতা গড়ব সে ‘ন ভূতো ন ভবিষ্যতি’।’
এতক্ষণ যা বললুম তা এই কল্পনা করে যে বর্তমান ভারতবর্ষ কেবল হিন্দুর ভারতবর্ষ। অতীত থেকে যা কিছু আলো চাই সে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার আলো। কিন্তু সবাই জানি এটা কেবলই কল্পনা। বর্তমান ভারতবর্ষ কেবল হিন্দুর ভারতবর্ষ নয়। অন্ততপক্ষে হিন্দু মুসলমান এ দুয়ের ভারতবর্ষ। এবং যে অতীত হিন্দুর গৌরবের তাতে মুসলমানের স্পর্শ নেই। আর যে অতীত মুসলমানের গৌরবের তা ভারতবর্ষের অতীত নয়। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের গড়ে তুলতে হবে ভারতবর্ষের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সন্দেহ মাত্র নেই, এই ব্যাপারে আমরা যেই খেলা ছেড়ে কাজে লাগিব আমনি বর্তমানের ঘষায় প্রাচীন গৌরবের খোঁচাগুলি পালিশ হয়ে যাবে। হিন্দুর যাবে, মুসলমানেরও যাবে। এবং বিধাতার কৃপায় আমাদের হয়তো সেই ভূমিতেই যেয়ে দাঁড়াতে হবে যেখানে মানুষের বিভিন্ন সভ্যতা গোঁড়ামি ছেড়ে নির্বিরোধে মিশতে পারে।