০৯. পীরবাড়ি ২

পীরবাড়িতে ঢুকলে আমার গা ছমছম করে। এ বাড়ির সবগুলো গাছই, আমার আশংকা হয়, জ্বিন ভূত পেত্নীর বাসা। কখন কোন গাছের তল দিয়ে যাওয়ার সময় জ্বিন লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে কে জানে, মা’র আঙুল শক্ত করে ধরে পীরের ঘরের দিকে হাঁটি। আসলে আমি হাঁটি না, মা হাঁটেন, আমাকে হাঁটতে হয়। মা মুরিদ হয়েছেন পীরের। শাড়ি ছেড়ে জামা পাজামা ধরেছেন। মা’কে মা বলে মনে হয় না।

পীরের ঘরে বসে আছেন ছ’সাতটি মেয়ে, পরনে ওদের পায়ের পাতা অবদি ঝুলে থাকা লম্বা জামা, মাথায় ওড়না। জামাগুলো শরীরের সঙ্গে এমন মিশে থাকে যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় উদোম গায়ে বুঝি ওরা। একজনের পরনে কেবল শাড়ি। গলায় তাবিজ ঝুলছে চারটে। মাথায় ঘোমটা টানা। খুব বিমর্ষ মুখ তাঁর। পীরের পায়ের ওপর দু’হাত রেখে তিনি বলেন

— পুলা না হইলে স্বামী আমারে তালাক দিব হুজুর।

খুব ধীরে কথা বলেন পীর আমিরুল্লাহ, কথা যখন বলেন পাঁচ আঙুলে দাড়ি আঁচড়ান। ছাদের কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে, চোখে অপার মায়া, বলেন– আল্লাহর নাম লও, আল্লাহ ছাড়া দেওয়ার মালিক কেউ নেই, আমি তো উছিলা মাত্র। মাঝরাতে জিকির করবে। তিনি পরওয়ার দেগার, দো জাহানের মালিক, তার কাছে কাঁদো আলেয়া। না কাঁদলে তার মন নরম হবে কেন, বল! বান্দা যদি হাত পাতে, সেই হাত আল্লাহ ফেরান না। তার অসীম দয়া।

আলেয়া উপুড় হয়ে পায়ের ওপর, যেন সেজদা করছেন, ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলে হওয়ার শর্তে তিনি মাঝরাত কেন, সারারাতই জিকির করবেন। আমিরুল্লাহ দাড়ি থেকে হাত সরিয়ে আলেয়ার পিঠে রাখেন, কড়িকাঠ থেকে নামিয়ে আলেয়ার ঘোমটা খসে বেরিয়ে আসা চুলে চোখ রেখে বলেন আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, সর্বশক্তিমান। তার আদি নেই, অন্ত নেই। তার পিতামাতা পুত্রকন্যা নেই। তিনিই সবকিছু দেখেন অথচ তার আমাদের মত চক্ষু নেই। তিনি সবই শোনেন, অথচ তার কর্ণ নেই। তিনি সবকিছুই করতে পারেন অথচ আমাদের মত তার হাত নেই। তিনি সর্বত্র সর্বদা বিরাজিত। তিনি আহার করেন না, নিদ্রা যান না। তার কোনও আকৃতি নেই। তার তুলনা দেওয়া যেতে পারে এমন কোনও বস্তু নেই। তিনি চিরদিনই আছেন এবং চিরদিনই থাকবেন। তিনি সকলের অভাব পূরণ করেন, তার নিজের কোনও অভাব নেই। তিনি চিরজীবিত, তার মৃত্যু নেই, ধ্বংসও নেই। তিনি পরম দাতা, অসীম দয়ালু। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ইজ্জতের মালিক, মানুষকে তিনি ইজ্জত দান করেন। তুমি তার দরবারে হাত ওঠাও, তোমার নিশ্চয় ছেলে হবে, সমাজে তোমার ইজ্জত রক্ষা হবে।

মা’র পেছনে জড়সড় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিরাকার শরীরটির কথা ভাবি। ‌এ অনেকটা আমাদের ইস্কুলে যাদু দেখাতে আসা লোকটির মত, কালো কাপড় দিয়ে তাঁকে ঢেকে ফেলা হল, পরে কাপড় সরালে যাদুকর আর নেই ওতে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। আমারও যদি নিরাকার শরীর থাকত, সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একা একা চলে যেতাম, কেউ আমার ঘাড় খুঁজে পেত না ঘরে ঠেলার।

নতজানু আলেয়ার উপুড় হওয়া শরীরের তল থেকে পীরসাব পা সরিয়ে নেন। যুবতীদের ভিড় থেকে হুমায়রা ছুটে এসে আলেয়াকে ধরে উঠোনে নিয়ে যায়। জবা গাছ তলে দাঁড়িয়ে আঁচলের গিঁট খুলে ভাঁজ করা নোট বার করে হুমায়রার হাতে দেন আলেয়া। হুমায়রা মুঠোর ভেতর নোটটি নিয়ে পীরসাবের হাতে গুঁজে দেয়, অভিজ্ঞ হাত। টাকা এক হাত থেকে আরেক হাতে যায়। অনেকটা রিলে রেসের মত। পীরসাব তাঁর আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে দেন টাকার হাতটি, ওটিই আপাতত চলমান ক্যাশবাক্স। পকেটে ঢোকানো হাতটির ওপর চোখ গেঁথে থাকে আমার। আমার চোখের পাতায় তীক্ষ্ণ চোখ রেখে–হামিমা, সঙ্গে কে তোমার, মেয়ে নাকি! পীর বলেন।

মা আমার বাহু টেনে সামনে এনে বলেন–জ্বি হুজুর। এই মেয়ে জন্মাইছে বারই রবিউল আওয়ালে। মেয়ে আমার সাথে দাড়ায়া নামাজ পড়ে। কায়দা সিফারা পইড়া সাইরা কোরান শরিফ ধরছে। এরে এট্টু দুয়া কইরা দিবেন হুজুর, যেন মেয়ে আমার ঈমানদার হয়।

মা আমার পিঠ ঠেলে বলেন–যা হুজুরকে কদমবুসি কর।

আমি গা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। কদমবুসি করার জন্য এক পাও এগোতে ইচ্ছে করে না আমার। মা গা ঠেলেন আমার, আবারও। আমি এক পা দু’পা করে পেছোতে থাকি। মুখে শাদা লম্বা দাড়ি, পায়ের গোড়ালি অবদি আলখাল্লা, মাথায় আল্লাহু লেখা গোল টুপি লাগানো পীর থাবা বাড়িয়ে খপ করে ধরেন আমাকে, যেন গাছ থেকে টুপ করে পড়া একটি চালতা ধরছেন মুঠোয়। আমাকে তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে ফেলেন এত যে আলখাল্লার ভেতর হারিয়ে যায় আমার শরীর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে কিছু বলে পীরসাব ফুঁ দেন আমার সারা মুখে। ফুঁএর সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ে মুখে আমার।

আলখাল্লা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মোহাবিষ্ট মা’র পেছনে। জামার হাতায় থুতু মুছতে মুছতে শুনি পীর বলছেন–তুমার মেয়ে কি দুনিয়াদারির পড়া পড়ছে নাকি! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–হ। আমার ত কোনও হাত নাই হুজুর ছেলেমেয়ের ওপর। এর বাপে সেই পড়াই পড়াইতেছে। এই মেয়ের আবার আল্লাহ রসুল সম্পর্কে খুব জানার ইচ্ছা। তাই ভাবছি এহানে নিয়া আসলে ওর ভাল লাগবে। মনটা ফিরবে আল্লাহর দিকে আরও।

হুজুর চুক চুক দুঃখ করেন জিহবায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে বলেন–মুশকিল কি জানো! দুনিয়াদারির লেখাপড়ায় মনে শয়তান ঢুকে যায়, পরে শয়তানের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যে দেখ নাজিয়া, নাফিসা, মুনাজ্জেবা, মতিয়া এরা সবাই কলেজে পড়ত, সবাই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে এখন আল্লাহর পথের পড়াশুনা করছে। আখেরাতের সম্বল করছে। ওরা এখন বুঝতে পারে, ওইসব পড়ালেখা আসলে মিথ্যা। ওরা ঢাকা ছিল ভয়ংকর অন্ধকারে। সত্যিকার জ্ঞানের আলো ওরা পায়নি।

মা আমাকে ইঙ্গিতে উঠোনে যেতে বলে হুজুরকে তালপাতার পাখায় বাতাস করেন। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে যেই না উঠোনে পা দেব, চিলের মত ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নেয় হুমায়রা, নিয়ে সোজা উত্তরের ঘরে। এ ঘরটির তোষকগুলো গুটোনো থাকে দিনের বেলা, চৌকির ওপর বিছানো থাকে কেবল শীতল পাটি। পাটির ওপর বসে ফজলিখালার মেয়েরা তসবিহ জপে, নামাজ পড়ে। তারা কেউ ইস্কুলে যায় না, তারা আল্লাহর পথের লেখাপড়া করে বাড়িতে।

হুমায়রা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। মুখখানা গোল চালতার মত ওর।

— তুমি বড় খালার মেয়ে, তুমি আমার খালাতো বোন হও, তা জানো! হুমায়রা আমার কাঁধে টোকা মেরে বলেন।

— দুনিয়াদারির লেখাপড়া কর কেন? এই লেখাপড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ অনেক গুনাহ দেবেন তোমাকে।

বলে আমাকে পাটির ওপর বসিয়ে হুমায়রা পাশে বসে আমার।

— তোমার বাবা হচ্ছে একটা কাফের। কাফেরের কথা শুনলে তোমাকেও দোযখে পাঠাবেন আল্লাহতায়ালা।

চোখ বুজে দোযখের কল্পনা করতে গিয়ে গায়ে কাঁপুনি ওঠে হুমায়রার। আমার হাতদু’খানা হঠাৎ চেপে ধরে সে কি কারণে, ঠিক বুঝতে পারি না। গা হিম হতে থাকে আমার। বড় একটি গর্তে আগুন জ্বলছে, ফুটন্ত পানির ওপর ভাসতে ভাসতে কাতরাচ্ছে অগুনতি মানুষ। মানুষগুলোর মধ্যে দেখি আমিও কাতরাচ্ছি। আমাদের সামনে ততক্ষণে এসে দাঁড়ায় একজন একজন করে সাতজন মেয়ে, ওদের দৃষ্টির হুল ফোঁটে আমার শরীরে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া করা অদ্ভুত এক জীব যেন আমি। চোখে ওদের খলসে মাছের মত লাফ দিয়ে ওঠে এক ঝাঁক করুণা, ওরা যেন বেহেসতের বাগানে বসে দেখতে পাচ্ছে আমি দোযখের আগুনে পুড়ছি। আমাকে দেখে আহা আহা করে ওরা। লম্বা মত এক মেয়ে বলে–হুমায়রা, ও কি আল্লাহর পথে আসতে চায়!

— হ্যাঁ, কিন্তু ওর বাবা ওরে দিতে চায় না। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে। আমি খালাতো বোন বলেই বোধহয় ওর দীর্ঘশ্বাস অতি দীর্ঘ।

লম্বা মত জিভে চুক চুক শব্দ করে। বাকিরাও করে চুক চুক। চুক চুক। চুক চুক। যেন অনেকগুলো বেড়াল দুধ খাচ্ছে শব্দ করে। শব্দ শুনি আর ঋষি-মূষিকের মত বসে গুণি ওদের, সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক। লম্বা, খাটো, মাঝারি, খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি। ওদের মনে মনে ইস্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড় করাই। খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি, মাঝারি, লম্বা। ওদের দিয়ে গাওয়াই, ও সাত ভাই চম্পা জাগোরে!

আমার মগ্নতা ভাঙে হুমায়রার গুঁতোয়–দেখ এদের বাবা এদেরকে, সাতজনকে থুতনি তুলে দেখিয়ে বলে সে, আল্লাহর পথে দিয়ে গেছে। এরা এইখানেই থাকে। কোরান হাদিস শেখে।

হুমায়রা আবারও অতি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–খালুকে নছিহত করলে তিনি নিশ্চয় আল্লাহর পথে আসতেন। ছেলেমেয়েদেরও আল্লাহর পথে দিতেন।

বাবাকে করলে কাজ হত কি না আমার সংশয় আছে, তবে জজ সাহেবকে নছিহত করে কাজ হয়েছিল। জজ তাঁর ষোল বছরের মেয়ে মুনাজ্জেবাকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে গেছেন, লম্বা মেয়েটি, হুমায়রা বলে, মুনাজ্জেবা, জজের মেয়ে। কোথাকার জজ? ঢাকার। ঢাকা শব্দটি এমন স্বরে হুমায়রা উচ্চারণ করে যে ঢাকার জজ মানে বুঝতে হবে বড় জজ। ঘটনাটি এরকম ছিল, ষোল বছরের মেয়ে লেখাপড়ায় ভাল হলেও গোল্লায় যেতে শুরু করে, বখাটে এক ছেলের সঙ্গে প্রেম করে। জজ সাহেবের মেয়েকে নাকি পাড়ার মাঠে বখাটেটির সঙ্গে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দেখেছে কারা। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেল। মেয়েকে ইস্কুল বন্ধ করে বাড়িতে বসিয়ে রাখলেন জজ সাহেব। তখন কেউ একজন তাঁকে বললেন আমিরুল্লাহ পীরের নাম, তিনি মেয়েদের বাড়িতে রেখে কোরান হাদিস শেখান, মেয়েরা নামাজি হয়, ঈমানদার হয়, অন্দরমহলের বাইরে পা দেওয়া নিষেধ তাদের, কঠোর পর্দার মধ্যে তাদের জীবন যাপন করতে হয়। শুনে ঢাকার জজ একবার মজলিশ শুনতে আসেন পীরের বাড়ি। পীরের ব্যাবহারে তাঁর মন গলে। তিনি তাঁর উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েকে হুজুরের হাতে সঁপে দিয়ে যান ক’দিন পরেই। রুবিনা পাল্টে পীরসাব মেয়ের নাম দিয়েছেন মুনাজ্জেবা। মুনাজ্জেবা লম্বা লম্বা জামা গায়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে পর্দা পুশিদা মত অন্দরমহলে থাকে, কোরান হাদিস পড়ে, মজলিশে হুজুরের দোযখের বর্ণনা শুনে কেঁদে বুক ভাসায়, হুজুরের গা হাত পা টেপে। সেই থেকে শুরু এ বাড়িতে বড় বড় ঘরের মেয়ে আসার, পুলিশের মেয়ে, উকিলের মেয়ে, সরকারি কর্তাদের মেয়ে। হযরত ইব্রাহিম আল্লাহর হুকুম মত নিজের ছেলেকে কোরবানি দিয়েছিলেন, আর আজকালকার বাবারা কেন পারবেন না নিজের মেয়েকে আল্লাহর পথে দিতে! হুমায়রা ভাবে। এ বাড়িতে মেয়েদের আল্লাহর প্রেমে দিওয়ানা হতে বলা হয়, মেয়েরা হয়। নিরাকার আল্লাহর সঙ্গে মেয়েদের প্রেম ভীষণ জমে ওঠে এ বাড়িতে আসা মাত্র। পীর আমিরুল্লাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন দেখে, তাঁর মনে হয় এরা মুনাজ্জেবা নাজিয়া নাসিমা নয়, এরা শ্রেফ বেহেসতের বাগানের ফুল।

আমিরুল্লাহ পীর জঙ্গল সাফ করা আঙিনায় ঘর তুলে দেন মেয়েদের। কারও ঘরে টিনের চাল, কারও ঘরে সিমেন্টের। ঘরগুলোয় জানালা নেই, গরমে হাঁসফাঁস করে মেয়েরা। পীরসাব বলেছেন–আরবে এইরকম ঘর ছিল, যে ঘরে আমাদের নবী জীবন যাপন করতেন। এরকম ঘরে থাকলে সওয়াব হয়। নবীজি যে কষ্ট করেছেন, সে কষ্ট যদি তোমরা করতে পার, তবে নবীজি নিজে তোমাদের জন্য হাশরের ময়দানে সাক্ষী দেবেন।

মেয়েরা আবেগমথিত কণ্ঠে বলে আহা আহা। তাদের জানালার দরকার নেই। দরজাও, যদি এমন হত যে নবীজির ঘর ছিল না, তবে সেটিও ত্যাগ করতে সম্ভবত ওরা আপত্তি করত না।

দু’তিন বছর পার হলে বাবারা ফেরত নিতে আসেন ঈমানদার মেয়েদের। মেয়েরা ঘাড় শক্ত করে বলেন–যাব না। মুনাজ্জেবার বাবা শয্যাশায়ী বলে তার মা এসেছিলেন নিতে। মুনাজ্জেবা যায়নি। কলুষিত দুনিয়ায় তার আর ফেরার ইচ্ছে নেই। এ বাড়ির আঙিনা থেকে বেরোলেই তার বিশ্বাস গায়ে তার পাপের ফোসকা পড়বে।

কেবল মুনাজ্জেবা নয়, অন্যরাও, বিয়ের বয়স হলে বাবারা পাত্র ঠিক ক’রে যখন নিতে আসেন, ওরা যেতে রাজি হয় না। সাফ সাফ জানিয়ে দেয়, ওরা আল্লাহর পথে থাকবে। এই শেষ জমানায় বিয়ে করা উচিত নয়, হুজুর বলেছেন। ওরা তাই অনুচিত কোনও কাজে আকৃষ্ট হয় না। বাবাদের ফিরে যেতে হয় মেয়েরা পীরবাড়ির পবিত্র মাটি কামড়ে রাখে বলে।

বিয়ে করা উচিত নয় কেন, প্রশ্ন জাগে মনে। উত্তর ওদের জিভের ডগায়, হুজুর মোরাকাবায় বসে কথা বলেছেন আল্লাহতায়ালার সঙ্গে। বেহেসতের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে দু’জনের কথা হয়। মুনাজ্জেবা চোখ বুজে বেহেসতের বাগানে পাখি হয়ে ওড়েন। আল্লাহ নিজমুখে হুজুরকে বলেছেন–শেষ জমানা শুরু হয়ে গেছে। ইসরাফিলের শিঙ্গা ফুকার সময় হয়ে গেছে। কেয়ামত খুব সামনে। শেষ জমানায় সমাজ সংসার সব বাদ দাও, সময় নেই, তাড়াতাড়ি আখেরাতের সম্বল কর।

মেয়েদের বিশ্বাস, হুজুর নিজে ওদের পুলসেরাত পার করে দেবেন। হুজুর বলেছেন তিনি তাঁর প্রিয় মুরিদদের হাত ধরে বেহেসতে যাবেন, তাদের না নিয়ে তিনি বেহেসতের দরজায় ঢুকবেন না। মেয়েরা তাই শেষ জমানায় আর হুজুরের চোখের আড়াল হতে চায় না। হুজুর বলেছেন, মুরিদদের নিয়ে শীঘ্র তিনি মক্কা চলে যাবেন, কেয়ামতের আগ অবদি নবীজির দেশেই থাকার ইচ্ছে তাঁর।

মুনাজ্জেবা বলে, আল্লাহতায়ালা বাহন পাঠাবেন মক্কা যাওয়ার।

বাহন কি রকম, সাত জনের সঙ্গে হুমায়রা গভীর মগ্ন অনুমান করতে, সম্ভবত বোররাখ। আল্লাহতায়ালার বাহনটি সম্পর্কে তাদের এখনও স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু যে কোনওদিন যে বাহনটি এসে পৌঁছবে এ বাড়িতে, এ সম্পর্কে কারও কোনও দ্বিধা নেই। লিস্টিও তৈরি হয়ে গেছে কে কোন ব্যাচে যাবে। মুনাজ্জেবার নাম প্রথম ব্যাচে, খোঁজ নিয়ে জেনেছে সে। লিস্টি পীরসাবের বালিশের নিচে।

মেয়েদের মুখে আতঙ্ক, যেন আজ বাদে কালই কেয়ামত আসছে।

আমার ভেতরেও একটু একটু করে কেয়ামতের ভয় ঢোকে। তাহলে বাবা যে ইচ্ছে করছেন আমাকে লেখাপড়া করে বড় হতে! বড় হওয়ার আগেই তো কেয়ামত চলে আসবে! পৃথিবী ধ্বংস হয়ে ঢুকে যাবে পৃথিবীর পেটে। বিচার হবে হাশরের ময়দানে, যেখানে আল্লাহ নিজে বসবেন দাঁড়িপাল্লা নিয়ে নেক মাপতে।

বুক ঢিপঢিপ করে। সামনে দাঁড়ালে নিশ্চয় আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, নিয়মিত নামাজ রোজা করেছি কি না, তসবিহ জপেছি কি না, কোরান পড়েছি কি না! আল্লাহর আদেশ মত চলেছি কি না। উত্তর কি দেব! যদি বলি হ্যাঁ সব করেছি, তাহলে নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব। কারণ আল্লাহ তো লিখেই রেখেছেন সবার ভবিষ্যত। ভবিষ্যত যদি সব লেখাই থাকে, তবে ময়দানে আবার দুনিয়ায় কি করেছি না করেছি খামোকা জিজ্ঞেস করার কি মানে হয়! আমার কেন জানি না বিশ্বাস হয় হাশরের মাঠে, দুনিয়ার সব লোক জড়ো হবে যে মাঠে, যে মাঠের কথা ভাবলে কেবল ঢাকায় বড় মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে লালমাটিয়ার যে মাঠ দেখেছিলাম, সে মাঠের ছবি মনে ভাসে–সেটির পুলসেরাত, আমার বিশ্বাস, যাদুকর লোকটি হাওয়া হয়ে গিয়ে নির্বিঘ্নে পার হয়ে যেতে পারবেন। ইস্কুলে যাদু দেখাতে এসে যেমন করে কালো কাপড়ের মধ্য থেকে নেই হয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ!

আমি বিভোর ছিলাম যাদুকরের পুলসেরাত পার হওয়ার দৃশ্যতে। চোখের সামনে আর কিছু নেই, কেবল একটি সুতো। সুতোর ওপর হাঁটতে গিয়ে টলমল করছে আমার পা। কিন্তু দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন, এক চুল নড়ছে না যাদুকরের শরীর। যাদুকর লোকটি হিন্দু, নাম সমীর চন্দ্র। কোনও হিন্দু লোক যদি পুলসেরাত পার হতে পারে, তবে আল্লাহ তাকে পাঠাবেন কোথায়, যেহেতু সে হিন্দু, দোযখে, নাকি বেহেসতে যেহেতু সে পুলসেরাত পার হয়েছে! আমি বিচারক হলে, ভাবি, বেহেসতেই পাঠাতাম। কিন্তু শুনেছি কেউ যদি হিন্দু হয়, সে যা কিছুই পার হোক, নেকের বোঝা তার যত ভারি হোক না কেন, দোযখেই যেতে হবে তাকে, কারণ তার জন্য দোযখ লিখে রেখেছেন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। আগে থেকেই লিখে রাখার ব্যাপারটি আমার মোটেও মনে ধরে না। লেখালেখির ব্যবস্থা থাকলে আর বিচারের আয়োজন করা কেন! হাশরের ময়দানে যা হবে, তা নেহাত নাটক ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেই নাটকের শরিক হওয়ার জন্য সে কি ভীষণ উত্তেজিত মানুষ!

লক্ষ করি নি, কি কারণে এক এক করে মেয়েরা উত্তরের ঘর খালি করে হুজুরের ঘরের দিকে চলে গেল, হুমায়রাও। আমি একা বসে অপেক্ষা করতে থাকি মা’র জন্য। কখন মা’র এ বাড়ির কাজ ফুরোবে আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। এর আগে যতবার এসেছি বিকেলে ফিরবেন বলে সন্ধে আর সন্ধেয় ফিরবেন বললে রীতিমত রাত করেছেন। কখনও আবার এমন হয়েছে যে ফিরতে দেরি হবে বললেন, কিন্তু কি রহস্যজনক কারণে বোরখা পরে নিয়ে তাড়া লাগিয়েছেন চল শিগরি চল। আমি উত্তরের ঘরে একা বসে আছি, মা’র সেদিকে মন নেই। তিনি ছুটে ছুটে এর ওর সঙ্গে কানাকানি করছেন। কানাকানি কথা, সে যারই হোক, বড় শুনতে ইচ্ছে করে। কানাকানি শেষ হলে আমি অনুমান করি তিনি হুজুরকে বাতাস করবেন, হুজুরের পা টিপবেন, শরবত বানিয়ে দেবেন, পান সেজে দেবেন, চিলুমচি ধরবেন মুখের সামনে। চিলমচি থেকে তুলে হুজুরের কফ থুতু খেয়ে বা মুখে মাথায় ডলে মা’র এ বাড়ির কাজ আপাতত ফুরোবে।

মা যার সঙ্গে কানে কানে কথা বলছিলেন তার মুখ খানা আমি চেষ্টা করছিলাম দেখতে, কলসির তলার মত দেখতে এক নিতম্ব ছাড়া আর কিছু সম্ভব হচ্ছিল না দেখা । হঠাৎ, আমার গায়ের ওপর দিয়ে ঝড়ো বাতাসের মত দৌড়ে গেল দুটো মেয়ে জানালার দিকে। তারা, আমার মনে হয় না খেয়াল করেছে যে আমি, একটি প্রাণী বসে আছি ঘরে। এ দুটো আগের সাতজনে ছিল না। আনকোরা, অন্তত আমার চোখে। গায়ের পোশাক আগের সাতজনের মতই। মাথা থেকে পা অবদি ঢাকা। জানালায় দাঁড়িয়ে দুটো মেয়ের কে বলছে আমি ধরতে পারি না, যে, দেখ দেখ ওই হইল মহাম্মদ, ফাতেমা আপার ছেলে।

আরেকটি কণ্ঠ, আমি এও অনুমান করতে পারি না, ডান বা বামের জনের, এই যে ঘাড়ে হাত দিল, সে হাজেরাখালার ছেলে, মহাম্মদ।

দুূ’টো মেয়ের পশ্চাতদেশ ছাড়া আর কিছু নেই চোখের সামনে।

আমাকে ডিঙিয়ে আরও ক’টি মেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জানালায়। আরও পশ্চাতদেশ। জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে বাহিরবাড়ির আঙিনা। আঙিনায় পুরুষেরা যারা মজলিশে শরিক হবে, পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে। অন্দরমহলে কেবল মেয়েরা ছাড়া আছে হাতে গোণা কিছু ছেলের প্রবেশাধিকার আছে। হাতে গোনাদের মধ্যে বেশির ভাগই হুজুরের আত্মীয়। আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকারা হাতে গোণা নয়।

— আর ওই যে মহাম্মদ, নুরুননবী ভায়ের ছেলে। নতুন একটি কণ্ঠস্বর।

মেয়েরা হাসছে। হাসতে হাসতে, মুখে ওড়না চেপে কারও ঘাড়ের ওপর দিয়ে, বগলের তল দিয়ে, দু’মাথার ষিনকোণ দিয়ে, গলার ফাঁক দিয়ে, দেখছে। সামনের মেয়েরা পেছনের মেয়েদের জন্য জায়গা ছাড়ছে না, পেছনের মেয়েগুলো মাছের মত পিছলে সামনে যেতে চাইছে। পেছনের পেছনের মেয়েরা বলছে, এইবার সর, দেখলা তো! আমাদেরে দেখতে দেও। আমি পেছনের পেছনের পেছনে দাঁড়িয়ে এক পলক দেখি, কিছু যুবক শাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে, কারও কোমরে হাত, কারও ঘাড়ে, কেউ পাছা চুলকোচ্ছে, কেউ হাই তুলছে, কেউ অযু করছে, কেউ মশা তাড়াচ্ছে গা থেকে। এত দেখার কি আছে এসব, আমি ঠিক বুঝে পাই না।

আরও কিছু মেয়ে হুড়মুড়িয়ে জানালায় ভিড় করে, এরা সাতজনের অংশ। সবাই মহাম্মদদের দেখে। এত ছেলের নাম মহাম্মদ কেন, মনে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্নটি তেঁতুলের কালো বিচির মত গলায় আটকে থাকে। একটিই কেবল জানালা এ ঘরে, তাও পুরোনো ঘর বলে এটি। নতুন ঘরগুলোয় জানালা হবার নিয়ম নেই। নতুন ঘর থেকে মেয়েদের কোনও মহাম্মদকে দেখার সুযোগ নেই।

ফজলিখালার এক ছেলের নামও মহাম্মদ, এটিই প্রথম ছেলে, মহাম্মদের আগে জন্মেছে হুমায়রা, সুফায়রা, মুবাশ্বেরা। তিন মেয়ে হওয়ার পর ফজলিখালাকে ঘন ঘন জ্বিনে ধরত। মুবাশ্বেরার পর মহাম্মদ জন্মানোর পর জিনে ধরা কমেছিল। মহাম্মদের পর এক এক করে আরও তিনটে মেয়ে জন্মেছে, জিনে ধরা বেড়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। হুমায়রাকে শুনেছি ক’দিন আগে জিনে ধরেছে। তিনদিন তিনরাত পর জিন ছেড়েছে ওকে। এ বাড়িতে এমনই, আজ এ মেয়েকে, কাল ও মেয়েকে জিনে ধরছে, আর ঘর অন্ধকার করে, দরজা জানালা বন্ধ করে পীরসাব নিজে জিন তাড়ান। আমি নিজে দেখেছিলাম যূথির জিন তাড়ানো। যূথি আমার এক ক্লাস ওপরে পড়ত। মেয়েটি চমৎকার দেখতে ছিল। ইস্কুলের বট গাছের নিচে একা একা বসে ও গান গাইছিল একদিন, ঘন্টা পড়লে মেয়েরা ক্লাসে চলে গেল সব, যূথি গানই গাইছিল, পরের ক্লাসের ঘন্টাও পড়ল, যূথি তখনও গান গাইছে একা একা, চুল হাওয়ায় উড়ছে। খবর পেয়ে এক মৌলভি ছিলেন, উর্দু পরাতেন আমাদের, আমরা উর্দু স্যার বলে ডাকতাম, যূথিকে বটতলা থেকে টেনে এনে মাস্টারদের জানালেন যে ওকে জিনে ধরেছে। যূথি গলা ছেড়ে চিল্লাচ্ছিষ আমারে ছাইড়া দেন ছাইড়া দেন বলে। ওকে শক্ত মুঠোয় ধরে উর্দু স্যার জিন তাড়ানোর আয়োজন করলেন। পাক পানিতে আল হামদু সুরা, আয়াতুল কুরসি, আর সুরা জিনের প্রথম পাঁচ আয়াত পড়ে পানি ছিটোলেন যূথির মুখে, আর মুখের সামনে আগুন ধরে নিমের ডাল দিয়ে পেটালেন। পেটালেন যূথি মুখ থুবড়ে পড়া অবদি। যূথির জিন তাড়ানো দেখেছিলাম দু’চোখে জগতের সকল বিস্ময় নিয়ে, ইস্কুলের আর সব মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ওর জন্য বড় মায়া হচ্ছিল আমার।

উত্তরের ঘরে বসে আমার অস্থির লাগে, গা ছমছম করে। এ বাড়িতে, ভয় হয় আবার আমাকেও না জ্বিনে ধরে। আমাকেও না অন্ধকার ঘরে জিন তাড়াতে হাতে ছড়ি নিয়ে ঢোকেন পীর আমিরুল্লাহ।

আমি যখন কুঁকড়ে আছি ভয়ে, মেয়েরা ততক্ষণে জানালা থেকে সরে গেছে, মা এসে দ্রুত বলে যান, মজলিশ শেষ করে তিনি বাড়ি ফিরবেন। মজলিশের অভিজ্ঞতা আমার কিঞ্চিত আছে, এটি আমাকে মোটেও উৎফুল্ল করে না। মজলিশ বসে বড় এক ঘরে, অন্দরমহল থেকে মেয়েরা সরাসরি ঢুকে যেতে পারে মেয়েদের জন্য পর্দা ঢাকা জায়গায়। মেঝেয় ফরাস পাতা, ওতেই হাঁটু মুড়ে বসতে হয় সবাইকে। সামনে উচু চৌকিতে গদি পাতা, ওখানে বসেন পীরসাব। লোবানের গন্ধঅলা মজলিশ-ঘরে যখন ঢোকেন তিনি, ডানহাতখানা উঁচু করে, গম্ভীর মুখে। সকলে দাঁড়িয়ে বলেন আসসালামু আলায়কুম ইয়া রহমতুল্লাহ। শব্দে গমগম করে ঘর। পীর সাব ভারি গলায়–ওয়ালায়কুম আসসালাম বলে হাত নেড়ে বান্দাদের বসতে ইঙ্গিত করেন। মেয়েদের গা থেকে পাউডারের গন্ধ বেরোতে থাকে, চোখে সুরমা পরা মেয়েরা, পর্দা ফাঁক করে হুজুরকে দেখেন, আড়চোখে দেখেন বাকি পুরুষদের।

হুজুর দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন বুঝলেন কি না আবু বকর, এই দুনিয়া মিছে দুনিয়া। এই দুনিয়ায় টাকা কড়ি করে কী লাভ, কেউ কি সঙ্গে নিয়ে যাবে কিছু! বলুন, কেউ সঙ্গে নেবে কিছু কবরে!

আবু বকর, কালো মুখে কালো দাঁড়ি বেটে এক লোক, সামনের সারিতে বসা, উত্তর দেন–জী না হুজুর।

— তো আল্লাহর প্রেমে নিজেকে সমপ্পন কব্বেন নাকি ধন দৌলতের প্রেমে! হুজুর প্রশ্নটি আবু বকরকে করেন, কিন্তু দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন মজলিশের শাদা মাথাগুলোয়।

— আল্লাহর প্রেমে হুজুর। ঘোর লাগা গলায় বলেন আবু বকর।

মেয়েরা পর্দার আড়াল থেকে আবু বকর লোকটিকে পলকহীন দেখে। সে দিনের জন্য আবু বকরের নাম মুখে মুখে ফিরবে। ্‌হুজুর যেচে কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। এ কম সম্মান নয় আবু বকরের! কেউ কেউ এও মন্তব্য করবে আবু বকরের ভাগ্য ভাল, হুজুর তাঁর বেহেসত নসীবের জন্য আল্লাহর কাছে তদবির করবেন।

মজলিশের সময় ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা। আজকের ঘন্টা তিনি পার করেছেন নবীজির দারিদ্রের বর্ণনায়, ছেঁড়া একটি কম্বল সম্বল ছিল তাঁর। নবীজির দুঃখে মজলিশের লোকেরা হাউমাউ করে কেঁদেছেন। যে যত কাঁদতে পারে, তার সুনাম বাড়ে এ বাড়িতে। সুনাম অবশ্য স্বপ্ন দেখলেও বাড়ে। ফজলিখালা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি নবীজির সঙ্গে এক চমৎকার ফোয়ারার ধারে বসে কথা বলছেন, শাদা শাদা পাখি উড়ছে, বাতাস বইছে ঝিরিঝিরি, কী কথা বলছেন তা খেয়াল করতে যদিও পারেননি, হুজুর বলেছেন ফজলিখালার বেহেসত নিশ্চিত। পীরবাড়িতে ফজলিখালার মূল্য অনেকখানি বেড়ে গেছে এরপর, অনেকে আলাদা করে জানতে চেয়েছে ফোয়ারার পাশে বসা নবীজিকে ঠিক কেমন দেখতে লাগছিল, কেমন তাঁর চেহারা। মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে স্বপ্নের বর্ণনাটি যখন তিনি দেন, কী যে নূর তাঁর মুখে, কী যে অপূর্ব সুন্দর তিনি, কী যে আশ্চর্য সুন্দর কোমল তাঁর হাত! ফজলিখালা যখন বলেন চোখ ধীরে ধীরে মুদে আসে যেন তিনি এখনও সে হাতের স্পর্শ পাচ্ছেন। হাত ধরে দু’জন ফোয়ারার দিকে গিয়েছেন গোসল করতে, গোসল করছেন, ঘুম ভেঙে গেল। ফজলিখালার এই স্বপ্নের কথা শোনার পর এ বাড়ির অনেকেই নবীজিকে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তাঁদেরও সুনাম হল। মা বড় আক্ষেপ করেন কখনও তিনি নবীজিকে স্বপ্ন দেখেননি বলে। ঘুমোনোর আগে খুব করে নবীজিকে ভেবে ঘুমোন, যেন স্বপ্নে তাঁর সাক্ষাৎ পান। পাননি। নিজেকে বড় গুনাহগার মনে হয় মা’র।

মজলিশ শেষ হতেই এক এক করে লাইন ধরে পুরুষেরা কদমবুসি সেরে পীরের হাতে টাকা গুঁজে দেন। হাদিয়া যে কোনও অঙ্কের হতে পারে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে যা পারে তাই দেবেন হুজুর এ রকমই বলে দিয়েছেন।

আবু বকর পরম শ্রদ্ধায় হুজুরকে কদমবুসি সেরে বলেন–হুজুর বড় ভয় হয়, শেষ জমানা চইলা আসছে, কেয়ামত আইসা যাইতেছে। ব্যবসা বাণিজ্যে আর মন দিই না। খালি হাতেই তো দাড়াইতে হইব পরকালে। কী আছে কে জানে কপালে। সারাজীবন তো আমলই করা হয় নাই। দোয়া করুইন হুজুর, আপনের দোয়া ছাড়া কপালে দুর্গতি আছে। হুজুর কথা দেন, দোয়া তিনি করবেন।

পুরুষের হাদিয়া এবং কদমবুসি গ্রহণ করার পর অন্দরমহলে ঢোকেন হুজুর। বাইরে থেকে আসা মেয়ে মহিলা এখন এক এক করে কদমবুসি করে হাদিয়া দেবেন। এইপর্ব শেষ হলে হুজুর গা এলিয়ে দেবেন বিছানায়, তখন যুবতীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন গা টিপতে। আমি মা’র ওড়না টেনে নাকি সূরে বলি–ও মা। চল। বাসায় যাইতে হইব। বাবা বাসায় ফিইরা যদি দেখে আমি নাই, মারব ত!

এক ঝটকায় আমার মুঠো থেকে ওড়না ছাড়িয়ে মা বলেন–বিরক্ত করিস না।

আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি উঠোনের অন্ধকারে, জবা গাছের তলায়। চুল খোলা থাকলে জ্বিনে ধরে শুনেছি। চুল ঢেকে রাখি ওড়নায়। ওড়না পাজামা পরার অভ্যেস নেই আমার, ওগুলো মেয়েরা আরও বড় হয়ে পরে। এখনও বাড়িতে ফ্রক পরি আমি। কিন্তু পীর বাড়িতে যে বয়সেরই হও না কেন, হুজুর অনুমোদিত পোশাক ছাড়া ফটকের ভেতরে ঢোকা যাবে না। দুনিয়ার ভেতরে এ এক আজব দুনিয়া।

রিক্সায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে মা’কে জিজ্ঞেস করি–এই যে লক্ষ লক্ষ বছর ধইরা আল্লাহ তায়ালা ইসরাফিলরে মুখে শিঙ্গা দিয়া বসাইয়া রাখছেন, এর দরকারটা কি ছিল? আল্লাহ ত জানেন কখন কেয়ামত হইব, তখনই তিনি ইসরাফিলরে কইতে পারতেন শিঙ্গা মুখে লইতে। বেচারা ইসরাফিল! কোনও নড়ন চড়ন নাই।

মা বোরখার তল থেকে বলেন–আল্লাহ ইহকাল পরকালের সৃষ্টিকর্তা। ইসরাফিল এক ফেরেসতা মাত্র। ইসরাফিলরে আল্লাহ যেভাবে বলছেন সেভাবেই আল্লাহর হুকুম মাইনা চলতে হয় তাঁর। সব ফেরেসতাদের চলতে হয়। আল্লাহর ইচ্ছা নিয়া প্রশ্ন করবি না। আল্লাহরে ভয় পাইতে হইব।

আমি বলি–তুমার হুজুর তো বলছেন আল্লাহর প্রেমে পড়তে হইব। ভয় পাইলে কি প্রেমে পড়ন যায় নাকি!

প্রেম শব্দটি উচ্চারণ করতে আমার বরাবরই জিভে জড়তা ছিল, শব্দটি উচ্চারণে এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে। সে নিষেধ নর নারীর প্রেমের বেলায় কেবল। কারণ এ রকমই শুনেছি প্রেমে পড়ে মন্দ লোকে, ঝুনু খালাকে দেখেছি লুকিয়ে প্রেম করতে। দাদাও লুকিয়ে কবিতা লিখতেন অনিতার জন্য। ঝুনু খালার সঙ্গে রাসু খালুর ইয়ে ছিল, দাদা বলেন। ইস্কুলে মেয়েরাও প্রেম শব্দটি উচ্চারণ করে না, বলে ওই মেয়ের সঙ্গে ওই ছেলেটির ইয়ে আছে। ইয়ে শব্দটির মানে বুঝতে প্রথম প্রথম আমার অসুবিধে হত। পরে বুঝে, নিজেও, ইয়ে বলতে অভ্যেস করেছি। এটিই, লক্ষ করেছি, বাড়ি এবং বাড়ির বাইরে, যেখানে আমার এবং আমার পরিচিতদের চলাচল, চলে। আল্লাহর সঙ্গে পীরসাবের ইয়ে আছে, এ ধরনের বাক্য আমি শুনিনি পীর বাড়িতে। আল্লাহর প্রসঙ্গে প্রেম শব্দটি অবাধে উচ্চারণ করা হয়। হুমায়রার সঙ্গে আতিক নামে ওর এক ফুফাতো ভাইয়ের প্রেম চলছে না বলে, শুনেছি বলা হয়, ইয়ে চলছে, তাও বলা হয় ফিসফিসিয়ে, কেউ যেন না শোনে, কিন্তু কারও কোনও অস্বস্তি হয় না বলতে যে হুমায়রা আল্লাহর প্রেমে মগ্ন, সেটি সজোরেই বলা হয়, যেন একশ লোকে শোনে।

মা বলেন–আল্লাহরে যায়।

— তুমি ত বলছ, আল্লাহ সব লিইখা রাখছেন খাতায়, প্রত্যেকটা মানুষের জন্ম মৃত্যু, কার সাথে কার কখন বিয়া হবে তাও। এমন কি কে বেহেসতে যাইব, কে দোযখে যাইব তাও লেখা আছে। তা যদি লেখাই থাকে, ধর আবু বকর, তার যদি বেহেসত আল্লাহ লিইখাই রাখেন, তাইলে কি সে গুনাহ করলেও বেহেস্তে যাইব! আর ধর আমিই, আমার জন্য যদি আল্লাহ আগে থেইকাই দোযখ লেইখা রাখেন, তাইলে আমারই বা কি লাভ আল্লাহরে ডাইকা! আল্লাহ কি পরে তাইলে নিজের লেখা সংশোধন করেন! এক দমে বলে আমি থামি।

— এমনে ত বোবা হইয়া থাকস মানষের সামনে। আমার সামনেই তর খই ফুডে মুহে। মা রুষ্ট-স্বরে বলেন।

— আল্লাহ ত সব পারেন করতে, ঠিক না! কণ্ঠে প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করি।

মা বলেন–হ। আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, সবই হয়। আল্লাহ হও বললে হয়। আল্লাহ হও না বললে কারও শক্তি নাই কিছু হওয়াইতে। আল্লাহর আদেশ ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না।

মা’র সারা শরীর কালো বোরখায় ঢাকা, কপাল থেকে নেমে এসেছে পাতলা কালো কাপড়, যেন হাঁটতে গিয়ে সামনে কোনও গর্ত পড়লে পা ফেলার আগে অন্তত দেখেন। পাতলা আবরণটির দিকে, যার তলে মা’র চোখ থেকে হলকা বেরোচ্ছে আগুনের, তাকিয়ে বলি–ধর, কিছু নাই, খালি হাত, আল্লাহ কি কিছু নাই থাইকা ফুল বানাইতে পারেন!

— হ। মা বলেন।

— ধর, আল্লাহর হাতে একখান রুমাল। রুমালের মধ্য থেইকা আল্লাহ কি একটা কবুতর বানাইতে পারবেন! আবারও প্রশ্ন করি।

মা নিশ্চিত স্বরে বলেন–হ।

— আমগোর ইস্কুলে যাদু দেখাইতে আইছিল যে লোকটা, সেও পারে। সেও পারে বাতাসে আল্লাহর মত মিলাইয়া থাকতে। আমি ঠোঁট উল্টে বলি।

— কি কইলি তুই! তর ত ঈমান নষ্ট হইয়া গেছে। তুই আল্লাহর সাথে তুলনা করলি যাদুকররে! কত সাহস তর! পাজি ছেড়ি, পাজ্যামি করস। আমি কি আশায় লইয়া যাই তরে হুজুরের কথাবার্তা শুনতে! দিন দিন আস্তা শয়তান হইতাছস। এইসব তর বাপের কাছে শিখছস! তর ঠোঁট আমি সিলাই কইরা দিয়াম, আরেকবার এইসব কইলে। মা’র রুখে ওঠায় আমি দমে যাই।

মা একবার বলেছিলেন আবদুল কাদের জিলানি আল্লাহর আদেশ পেয়ে কবর থেকে জ্যান্ত হয়ে বেরিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস হয়, যাদুকর লোকটিও তা পারবেন। মা’কে আর সে কথা বলতে যাই না। এত গাল খাওয়ার ইচ্ছে হয় না আমার। তবে মাথার ভেতর আরেকটি প্রশ্ন খুব আঁকু পাঁকু করে, সেটি মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–পীরবাড়ির মানুষদেরে এত জ্বিনে ধরে ক্যান? আমাদেরে ত জ্বিনে ধরে না! ওই বাড়িতে তুমি কইছ আল্লাহ নাইমা আসেন, তাইলে আল্লাহর এরিয়ায় জ্বিন আসার সাহস পায় ক্যান!

মা আমার পেটে কনুইএর গুঁতো দিয়ে বলেন–আর একটা কথা না। বাসাত গিয়া তওবা কইরা নামাজ পইড়া আল্লাহর কাছে মাপ চা। আল্লাহরে ডরাস না, ডরাস না দেইখাই ত শয়তানি চিন্তা মাথাত আয়ে।

আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর জোটে না।

ইস্কুলের বিজ্ঞান বই সামনে নিয়ে মা’কে বলি–আল্লাহ ত আদম হাওয়া প্রথম সৃষ্টি করছে, ঠিক না?

— করছে না, করছেন। মা আমার বেয়াদবি শুধরে দেন।

— এই যে দেখ, বিজ্ঞান বইয়ে আদিম মানুষের ছবি দেখিয়ে বলি, এক কোষি প্রাণী থেকে বহুকোষী প্রাণী, তারপর বানর থেইকা বিবর্তন ঘইটা এইরকম আদিম মানুষ হইছে। তারা গুহায় থাকত, মারামারি করত, ফল মুল খাইত, কাচা মাংস খাইত। অনেক পরে পাথরে পাথর ঘইষা আগুন জ্বালাইতে শিইখা তারপরে তারা অনেক কিছু করতে শিখে। ধীরে ধীরে মানুষ সভ্য হইছে। আল্লাহর বানানো হযরত আদম আলায়েসসাল্লাম কি এরম লোমঅলা ল্যাংটা বান্দরের মত দেখতে ছিল নাকি, যারে আল্লাহ মাটি দিয়া বানাইয়া বেহেসতের বাগানে হাঁটতে দিছিলেন!

মা চোখ নাক কুঁচকে, যেন দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে বই থেকে, বলেন–সর, সর, সর। দূর হ সামনে থেইকা। এই বইএ যা লেহা সব মিছা কতা। আল্লাহ যা বলছেন, তাই একমাত্র সত্য। আল্লাহর উপরে আর কুনো সত্য নাই।

মা’র সামনে থেকে আমাকে সরে আসতে হয়। বাবার কাছে ব্যাপারটি তুলব, তা সম্ভব নয়। তাঁর সামনে দাঁড়ালে গলায় স্বর ফোটে না। আল্লাহ সত্য নাকি বিজ্ঞান সত্য– কে আমাকে উত্তর দেবে। আল্লাহ যা বলেছেন তার ভেতরে যুক্তি কম দেখি। যুক্তি শব্দটি নতুন শিখেছি আমি, বাবা তাঁর বাণীতে ইদানীং প্রায়ই বলছেন, যুক্তি ছাড়া কোনও কাজ করবি না, যা কিছুই করস নিজের বিবেকরে জিগাস করবি, বিবেকে যদি কয় কাজটা করতে তাইলেই করবি। সব মানুষেরই বিবেক বইলা একটা জিনিস থাকে। মানুষ হইল এনিমেল, কিন্তু র‌্যাশনাল অ্যানিমেল। যুক্তিবুদ্ধি না থাকলে মানুষ আর জন্তুতে কোনও তফাৎ নাই।

বাবা অবশ্য বাণীটি দিতে শুরু করেছেন উঠোনে রাখা খড়ির স্তুপে দেশলাই জ্বেলে খেলতে গিয়ে আগুন প্রায় ধরিয়ে দিয়েছিলাম বলে। আগুন যদি ছড়াতো, বাবার বিশ্বাস বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেত।

বিজ্ঞানের কথায় আমি যুক্তি দেখি বেশি। আল্লাহ আদম হাওয়াকে ধাম করে বেহেসত থেকে ফেলে দিলেন পৃথিবীতে, কেমন যেন গপ্প গপ্প মনে হয়। রূপকথার বইয়ের মত। মা’কে বললে মা বলেন আল্লাহ সম্পর্কে বাজে কথা কইলে তর জিব খইসা পড়ব। আমি জিভ খসে কি না দেখতে ঘরের দরজা বন্ধ করে আল্লাহ তুই পচা, আল্লাহ তুই শয়তান, আল্লাহ তুই একটা আস্তা বদমাইশ, আল্লাহ তুই শুয়োরের বাচ্চা বলেছিলাম। জিভের জায়গায় জিভ রইল, আমিও নিশ্চিত হলাম আল্লাহকে গালাগাল করলে আসলে জিভ খসে না, মা ভুল বলেন। আর আল্লাহর কাছে চাইলেই যে আল্লাহ কিছু দেন না, তারও প্রমাণ পেয়েছি। নামাজ সেরে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে পোড়াবাড়ির চমচম চেয়েছিলাম, শরাফ মামারা যেমন ঠান্ডার বাপের দোকানের লুচিবুন্দি নাস্তা খায়, তা চেয়েছিলাম, জোটেনি। একটা কাঠের ঘোড়া চেয়েছিলাম, রাজবাড়ি ইস্কুলে চমৎকার রঙিন একটি কাঠের ঘোড়া দেখে লোভ হয়েছিল, কেউ আমাকে কাঠের ঘোড়া দেয়নি, আরও কত কী চেয়েছিলাম—- আমান কাকা আর শরাফ মামা কুষ্ঠ হয়ে মারা যান চেয়েছিলাম, ওঁদের কুষ্ঠও হয়নি, ওঁরা মরেনও নি। মা প্রায়ই আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করেন বাবা যেন কুষ্ঠ হয়ে শিগরি মরে যান। অথচ বাবা দিব্যি সুস্থ, দিন দিন পেশীতে শক্তি বাড়ছে। জ্বরেও যে একদিন বিছানায় পড়বেন, তাও নয়। আমার প্রায়ই জ্বর হয়, সে কি খুশি হই জ্বর হলে, তখন আর লেখাপড়া করতে হয় না, বাবা তখন বেশ নরম গলায় কথা বলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ওই একটি সময়, যখন বাবার আদর বড় সুলভ। থোকা থোকা আঙুর, কমলালেবু এনে শিয়রে রাখেন, শুয়ে শুয়ে ভাইবোনকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাই। ওরা হাত পেতে প্যান প্যান করে চাইলে সামান্য দিই। মা আদা কেটে নুন মেখে দেন খেতে। কিন্তু ওষুধ খেতে গেলেই বিরক্তি ধরে, জ্বর হওয়ার আনন্দ সব উবে যায়। বড় বড় ট্যাবলেট গিলতে বললে মনে হয় অসুখ হওয়াটা বড় বাজে এক ব্যাপার। পাঁচ ছ’রকম ওষুধ ঘন্টায় ঘন্টায় গিলতে বলেন বাবা। খাচ্ছি খাব বলে টুপ করে জানালার বাইরে ওষুধ ফেলে দেওয়ার অভ্যেস আমার। জ্বর সাত আটদিনেও যখন ছাড়ে না, বাবার সন্দোহ হয়। তিনি নিজে আমার মুখের ভেতর পানি ঢেলে বলেন হা কর, হাঁ করলে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল ঢুকিয়ে দেন মুখে। গলায় ওসব আটকে যায়, ওয়াক করে মেঝে ভাসিয়ে ফেলি। বাবা আবার বলেন হাঁ কর। এ ঠিক একবার না পারিলে দেখ শতবার এর মত। বাবা হাল ছাড়েন না যতক্ষণ না ওষুধ আমার পেটে ঢুকছে। বাবা ঘরে না থাকলে মা সুরা পড়ে ফুঁ দিয়ে দেন বুকে। ফুঁ দেওয়াতে ভালই লাগে। ফুঁ তো আর তেতো ওষুধ নয় যে গিলতে হয়। গ্লাস ভরে ময়লা পড়া পড়া পানি খাওয়ান। অসুখ সারলে মা বলেন মা’র ফুঁয়ে আর পীরের পড়া পানিতে অসুখ সেরেছে, বাবা বলেন ওষুধে সেরেছে।

বাবার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা নেই মোটে, তিনি সামনে দাঁড়ালে মনে হয় এক দৈত্য এসে দাঁড়াল, প্রাণ যায় যায়, তবু বাবা যখন বলেন জ্বর হচ্ছে অসুখের উপসর্গ, শরীরে জীবাণু ঢুকে অসুখ তৈরি করে, ওষুধে জীবাণু নাশক জিনিস আছে, তা শরীরে গিয়ে জীবাণু ধ্বংস করলে তবেই অসুখ সারে–বাবার কথাকেই আমার যৌক্তিক মনে হয়। নানিবাড়ির পেছনের বস্তিগুলোয় কারও অসুখ হলে ফুঁ দেওয়ার চল ছিল। ক’দিন পর পরই সুরা টুরা পড়ে রোগে ভোগা গেঁতুকে ফুঁ দিয়ে যেত এক মৌলবি, পানিতে ফুঁ দিয়ে রেখে যেত, পড়া পানি খেলে নাকি অসুখ সারবে। ফুলে ঢোল হয়ে, শেষে গেঁতু, ছ’বছর বয়স মাত্র, মরেই গেল। ঝুনু খালার পাগলামি কমাতেও মৌলবি ফুঁ দিয়েছিলেন, কমেনি। বাবাকে ফুঁ দিতে গোপনে এক মৌলবি যোগাড় করেছিলেন মা, যেন রাজিয়া বেগমের কবল থেকে মুক্ত হন বাবা। বাবার গায়ে তো ফুঁ দেওয়া সম্ভব নয়, ফুঁ দিয়েছিলেন বাবা যে ঘরে ঘুমোতেন, সুতোয় গিঁট দিয়ে চার টুকরো সুতো পুঁতে রেখেছিলেন সে ঘরের চার কিনারে, গোপনে। মৌলবি বলে গিয়েছিলেন, এখন আপনের স্বামীর মন ফিরব। মা আর নানিকে ফিসফিস কথা বলতে শুনেছিলাম এ নিয়ে। বাবার মন তো ফেরেনি, মা’র চেয়ে বেশি আর এ কথা কে জানে! তবু ঝাড় ফুঁকে অন্ধ বিশ্বাস মা’র।

মা বলেন সব মিথ্যে যা লেখা ইস্কুলের বইয়ে। আমার বিশ্বাস হতে চায় না। পীরবাড়িতে যাওয়া শুরু করার আগে ইস্কুলের লেখাপড়াকে মা দোষ দেন নি, বরং তিনি নিজে আরও লেখাপড়া করতে পারেননি বলে দুঃখ করতেন। দুঃখ হঠাৎ হঠাৎ এখনও করেন, সে জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, লেখাপড়া না করাতে তিনি কোনও চাকরি জুটিয়ে বাবার সংসারে ঝাড়ু মেরে মহানন্দো বিদায় নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না বলে। চোখের সামনে কী ভীষণ পাল্টে গেলেন মা। মা কি ভূল পথে যাচ্ছেন, নাকি সত্য পথে। আমি ঠিক বুঝে পাই না, মা না হয় যুক্তি ছাড়া কথা বলেন কিন্তু লেখাপড়া জানা, রীতিমত বিএ এমএ পাশ করা লোকেরাও তো কখনও মানুষ বা জগতের উৎপত্তি বিষয়ে কোনও তর্কে মাতেন না, আল্লাহ যা বলেছেন তা দিব্যি মেনে নেন, নিশ্চয় মেনে নেন, মেনে না নিলে নামাজ রোজা করেন কেন! নানিবাড়ির পেছনে বস্তি, সামনে ছিল শিক্ষিত লোকদের বাড়ি। সেসব বাড়ির এত লোক যখন আল্লাহকে মানেন, আল্লাহ ব্যাপারটি নেহাত ফেলনা নয়। বাবা নিজেই রোজা করেন, রমজান এলে। ছোটবেলায় আমার শখ হত রোজা রাখতে, শেষ রাতে উঠে আমিও সবার সঙ্গে বসে প্রথম মাছ মাংস পরে দুধ কলা মেখে ভাত খেতাম। দুপুর বেলা বাবা বলতেন এখন তুমাকে কিছু খেতে হবে।

আমি মাথা নেড়ে বলতাম–আমি রোজা রাখছি।

— উহুঁ, ছোটদের রোজায় এখন খাইয়া পরে আবার ইফতারি করতে হয় সন্ধ্যার সময়। তাইলে রোজা হইব দুইটা। বাবা বলতেন।

আসলে দুটো রোজার মানেটি হচ্ছে আমাকে খেতে হবে, সারাদিন না খেয়ে থাকলে আমার কষ্ট হবে, আমি কষ্ট পাই বাবা চাইতেন না। শেষ রাতে সাইরেন বাজার সময় বেশির ভাগ দিনই আমাকে ডাকা হত না, কিন্তু ঘরে থাল বাসনের শব্দ পেয়ে লাফিয়ে উঠে শেষ রাতের খাবার খেতাম, রোজা রাখব। আল্লাহ বলেছেন উপোস করতে, তাই উপোস করতে চাইতাম তা নয়। ছোটরা রোজা রাখলে বাড়িতে বেশ আদর পাওয়া যায়, লক্ষ করেছি। আদর পাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য, সম্ভবত। আদরের বাইরেও এ অনেকটা খেলার মত ছিল, উপোস উপোস খেলা, খেলা শেষে মুড়ি, ছোলা, ডালের বড়া, বেগুন বড়া, গরম গরম জিলিপির সামনে বসে থেকে সাইরেন বাজলে খাওয়া শুরু করা। সাইরেন সাইরেন, খাওয়া খাওয়া।

পুরো মাস রোজা রেখে বাবা ঈদের উৎসবও করেন জাঁক করে। ছেলেমেয়েদের জন্য জামা কেনেন, মা’র জন্য শাড়ি, বড় ঈদে কোরবানি দিতে গরু কেনেন, নয়ত খাসি। সারাবছরে বাবার এটুকুই ধর্ম পালন। অবশ্য মাঝে একবার ্‌এক মৌলবি রাখলেন প্রতি সকালে এসে যেন তাঁকে কায়দা পড়িয়ে যান। হঠাৎ এ শখ কেন হয়েছিল তাঁর, কাউকে বলেননি। তবে শখটি হওয়ার ক’দিন আগে তিনি, আমি মনে করতে পারি, রাতে বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে মা’র কাছে বলেছিলেন যে এক রোগীর বাড়িতে অদ্ভুত এক লোক দেখেছেন তিনি, লম্বা চুলদাড়ি লোকটির, ছেঁড়া জামা জুতো, কাগজে আল্লাহ লিখলেন আরবিতে, আর সে লেখা থেকে স্পষ্ট আওয়াজ বেরোতে লাগল আল্লাহু আল্লাহু। কাগজটি হাতে নিয়ে বাবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছেন কোনও চালাকি আছে কি না, নেই। জামার পকেটে কোনও যন্ত্র লুকোনো আছে কি না, নেই। লোকটি নিজে শব্দ করছে কি না মুখে, না। কাগজের অক্ষর এমন জিকির কী করে তোলে বাবা বুঝে পান না। মা আহা আহা করলেন বাবার গল্প শুনে। বাবা লাটিমের মত ঝিম ধরে বসে রইলেন। মুখে খাবার উঠল না। ভাত নেড়ে চেড়ে ক্ষিধে নেই বলে থাল সরিয়ে রাখলেন। রক্তচাপ বাড়লে বাবা সকাল সকাল ঘুমোতে চলে যান যেমন, সে রাতেও গেলেন। বাবা কখনও, কী করলেন তিনি বাড়ির বাইরে, কী রোগী দেখলেন, কোথায় কী ঘটল কিছু বলেন না কাউকে, আমাদের তো নয়ই, মা’কেও না। কিন্তু সেদিন বাবা অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। তার সপ্তাহ খানিক পর সকাল বেলা রাতকানা মৌলবি, রাতে লোকটি পথ চেনেন না বলে লোকে ডাকে তাই, নতুন একটি কায়দা হাতে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়লেন, বাবা খবর দিয়েছেন। অবশ্য বাবার এসব সয়নি বেশিদিন। দুদিন আলিফ জবর আ বে জবর বা পড়েই মৌলবি এলে বলতেন, মৌলবি সাব চা টা খান, আজ আর পড়তে ইচ্ছা করতাছে না। আগামী কাল পড়ব। চা নাস্তা দেওয়া হত মৌলবিকে বাইরের ঘরে, ও খেয়ে তিনি বিদেয় হতেন। আগামীকাল আসে, পরশু আসে, ছাত্রের টিকিটির আর দেখা পাওয়া যায় না। দিন পাঁচেক পর মৌলবিকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে একেবারই বিদেয় করে দিলেন। এই হচ্ছে ধর্মের গ্রাস বাবার ওপর, কেবল দু’দিনের জন্যই ছিল তার থাবা। এরপরই বাবা আবার আগের বাবা, অহংকারি, নীতিবান, কর্মঠ, ব্যাকব্রাশ, প্যান্টের ভেতরে শার্ট, শার্টের ওপর টাই, টাইয়ের ওপর কোট। শীতকালে ওভারকোট। ছয় ঋতুতেই জুতোর মচমচ।

বড় মামা ঢাকা থেকে প্রতিমাসে অবকাশের ঠিকানায় উদয়ন নামে একটি পষিনকা পাঠান। এটি আমাদের কাজে লাগে বই খাতার মলাট বাঁধায়। উদয়ন এল, ছবি টবি দেখে ব্যস মলাট। বইখাতায় মলাট বাঁধা সেই লেখাপড়া শুরু করা অবদি শেখা। প্রথম প্রথম মলাট বেঁধে দিতেন মা, বিস্কুটের ঠোঙা, বাবা টোস্ট বিস্কুট কিনে আনতেন ভরে, কেটে। পরে সৌন্দর্যজ্ঞান বাড়লে নিজেই মলাট বাঁধি ক্যালেন্ডারের রঙিন পাতায়, গ্লাক্সোর ক্যালেন্ডারই বেশি, এরপর শুরু হল মাসিক উদয়নের পাতা ছিঁড়ে। উদয়ন পষিনকাটি সোভিয়েত ইওনিয়নের দূতাবাস থেকে বেরোয়, বড় মামা দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পষিনকাটির যুগ্ম সম্পাদকের চাকরি করেন। ময়মনসিংহে বেড়াতে এলে সঙ্গে করে বেশ বই আনেন, কিছু বই আবার রেখে যান আমাদের বাড়িতে। কী মনে করে কে জানে, সম্ভবত দাদারা যেন পড়েন। আদৌ ওসব বই খুলে দেখেন না দাদা কিংবা ছোটদা। আমি অলস বিকেলগুলোয় মাঝে মাঝে নেড়ে চেড়ে দেখি ছোটদের লেনিন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাস, সমাজতন্ত্র কি ও কেন, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, আমার ছেলেবেলা, পৃথিবীর পাঠশালা এসব।

বড়মামা বাড়ি এলে বেশ ভাল ভাল রেঁধে খাওয়ান মা, চলে গেলে বলেন–মেবাই কি যে হইয়া গেল, মাদ্রাসায় পড়া ছাত্র, হইল কি না কমুনিস্ট। ছি ছি। মা’র ছি ছি শব্দ আমাকে সজাগ করে। জিজ্ঞেস করি, কমুনিস্ট কি, মা?

— আর কী, আল্লাহ খোদা মানে না। মা মন-মরা স্বরে বলেন।

এই প্রথম বিস্ময় আমার, তাহলে আল্লাহ খোদা না মানা লোকও জগতে আছে! বড় মামা চাঁদে নীল আর্মস্ট্রং মুতে এসেছেন বলেন, আরবি ভাষাটি যে কোনও ভাষার মত একটি ভাষা, এ ভাষাতেও অশ্লীল কথা লেখা হয়, অবলীলায় বলেন, কিন্তু তিনি আল্লাহ খোদা মানেন না এ আমাকে আগে কেউ বলেননি। বড় মামা কেন তা মানেন না আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনও উপায় নেই জানার, বড় মামা থাকেন দূরের শহরে, যখন আসেন, তাঁর রাজকন্যাটিকে তিনি একটি ছোট খাট শিশুই ভাবেন, রাজকন্যা যে দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে, কতরকম প্রশ্ন জমছে মনে, তা তিনি মোটেও দেখতে পান না। বোকা সোকা লাজুক মেয়ের হাতে দু’টো লজেন্স তুলে দেয়াই ভাবেন যথেষ্ট। বড় মামার রেখে যাওয়া বইগুলো প্রথম নেড়ে চেড়ে এরপর পড়ে পড়ে আমার ধারণা জন্মেছে সেই ফ্রক পরা বয়সেই যে পৃথিবীটা কেবল ঝাড়ফুঁকের জগত নয়, এসবের বাইরে বড় একটি জগত আছে, যুক্তির জগত। নামাজ রোজা সবাই করে না, কোরান হাদিস সবাই পড়ে না। সবাই বারো মাসে তেরো পূজার আয়োজন করে না। মাটির মূর্তি বানিয়ে মাথা ঠোকে না। মিলাদ হয় না, কীর্তন হয় না। খ্রিস্টান মানেই মিশনারির কালো আলখাল্লা পরা নান আর ফাদার নয়। এর বাইরে অন্যরকম কিছু আছে। আমার সেই টলমল সময়ে বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায় একদিন। বড় মামা খবর পাঠিয়েছেন তিনি এক বিদেশি লোক নিয়ে বাড়িতে আসবেন। বাড়ি ঝাড়া মোছা হল, মুছে মেঝে চকচক করা হল, বিছানাগুলোয় ধোয়া চাদর বিছানো হল, খাবার টেবিলের ওপর কাপড় বিছিয়ে দেওয়া হল। জানালা দরজায় নতুন পর্দা টাঙানো হল। দুপুরের আগেই আমাদের সবাইকে গোসল করে সবচেয়ে ভাল জামাটি পরে শান্ত হয়ে বসে থাকতে বলা হল বৈঠকঘরে। ভিক্তর ই পিরোইকো যখন বাড়ি ঢুকে সবার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবেন, আমাদেরও হাত বাড়াতে হবে, আমাদের মুখস্ত করানো হল বলতে হাউ ডু ইউ ডু। ব্যস এটুকুই, এরপর আমাদের ঢুকে যেতে হবে ভেতরের ঘরে। ঠিক হল, দাদাই ঠিক করলেন, তিনি যেহেতু ইংরেজি বলতে জানেন, তিনিই খাবার টেবিলে বড় মামা আর ভিক্তরের সঙ্গে বসবেন খেতে। সব ঠিক। ভিক্তর এলেন, হাত মেলানো হল, কিন্তু হাউ ডু ইউ ডু, শেখানো বাক্যটি আমার মুখ থেকে কিছুতেই বেরোল না। বাক্যটিতে বড় হাডুডু হাডুডু গন্ধ আছে।

শেখানো জিনিসে, আজকাল এই হয়েছে আমার, মন সায় দেয় না। বাড়িতে প্রচুর খাবার রান্না হয়েছিল। খেয়ে দেয়ে ভিক্তর বাড়ি ঘুরে দেখতে বেরোলেন। উঠোনে আলম থাকত যে ঘরটিতে, সে ঘরের পেছনে জংলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব করলেন।

ওই প্রথম আমার কোনও শাদা লোক দেখা।

কী শাদা রে কী শাদা! জীবনে অনেক শাদা ইংরেজ দেখা মা’র চোখও বিস্ময়ে অভিভূত হল।

ভিক্তর চলে গেলে, যেন এ বাড়ি ভিক্তরের পদধুলোয় ধন্য হয়েছে, বিগলিত হেসে দাদা বারান্দার চেয়ারে বসে পা দোলাতে লাগলেন। তাঁর পরনে ইস্ত্রি করা শার্ট প্যান্ট, পালিশ করা জুতো।

মা পরদিন পীরবাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর বললেন–শাদা হইলে কী হইব! দেখলাম ত খাড়োয়া পেশাব করছে বেডা। পেশাব কইরা পানিও লইছে না। শয়তানরা খাড়োয়া পেশাব করে। কম্যুনিস্ট ত, করত না! আল্লাহ রসুল বিশ্বাস করে না, আগে জানলে আমি রান্ধা বাড়া করতাম না।

শয়তানে, মা’র বিশ্বাস, জগত ভরে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *