তপতী সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল মিঃ বোস তপনকে নমস্কার করিতেছে। তপতীকে চোখ খুলিতে দেখিয়াই কহিল,–মাসিমার কাছে শুনলাম আপনার মাথাব্যথা, তাই এলাম সন্ধান করে করে। কেমন, বোধ করছেন এখন? অ্যাসপিরিন খাবেন?
মিঃ বোসের এত কথার জবাবে তপতী কিছু না বলিয়া পুনরায় চোখ বুজিল। তাহার অত্যন্ত রাগ হইতেছে—কি জন্য আসে সেই মিষ্টার বোস? সে স্বামীর সহিত বেড়াইতে আসিয়াছে, মাথা ধরুক আর মরিয়া যাক–তিনি দেখিয়া লইবেন; মিঃ বোরে অ্যাসপিরিন লইয়া দরদ দেখাইতে আসিবার কী প্রয়োজন। কিন্তু তপতীর সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল—কাটার যে জাল সে এতকাল ধরিয়া নিজের চারিদিকে বয়ন করিয়াছে, তাহা হইতে মুক্তি পাইতে হইলে হাতপা এক-আধটু ছড়িয়া যাইবেই। অন্য কোনো অঘটন ঘটিবার আশঙ্কায় তপতী কথাই কহিল না। চতুর মিঃ বোস তপতীর মনের ভাব বুঝিয়া ফেলিলেন। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে স্বামীর সহিত বেড়াইতে আসিলে লোকে মন্দ বলিবে! তপতীর আজিকার অভিনয় একটা বিশেষ ধাপ্পা। কহিলেন,
—ওয়েল, মিঃ গোস্বামী, আমি আবার মার্জনা চাইছি আপনার কাছে।
—কি হেতু?—-তপন পরম ঔদাসীন্যের সহিত প্রশ্ন করিল।
–সেইদিনকার ব্যাপারটার জন্য সত্যিই আমি লজ্জিত।
তপনের মনটা একেই তো তপতীর লজ্জাকর অভিনয়ে তিক্ততায় ভরিয়া ছিল, তার উপর মিঃ বোসের আগমনের সঙ্গে এবং দ্বিতীয়বার ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে চতুরা তপতীর কোনো উদ্দেশ্য যুক্ত আছে কিনা সে বুঝিতে পারিতেছে না–যথা সংযত হইয়াই উত্তর দিল, সে কথা আর নাই বা বললেন, মিঃ বোস। আর অপরাধ তো আপনার কিছু নয়—ওর পিছনে ছিল যার সমর্থন, অপরাধ যদি কিছু ঘটে থাকে তো, সে তার। কিন্তু যারই হোক—আমি সর্বান্তঃকরণে ক্ষমা করছি। বার বার এক কথা বলার দুঃখ থেকে আমায় রেহাই দিন—এই মিনতি করছি আমি।
তপতীর মাথাটা ভূমি হইতে উর্ধ্বে উঠিয়া পড়িল। তপন এমনি করিয়া ভাবিতে পারে। মিঃ বোসের কৃত আচরণের অন্তরালে রহিয়াছে তপতীর সমর্থন! তপনের মননশীলতাকে তপতী আজ কি বলিয়া মিথ্যা প্রমাণ করিবে? আর, মিথ্যা তো নয়! তপতীর সমর্থন না। পাইলে মিঃ বোসের সাধ্য কি যে তপনের অসম্মান করে। তপতী চাহিল তপনের মুখের দিকে। মুখ অন্যদিকে ফিরানো রহিয়াছে—তপতী বুঝিল, সে মুখে রাগ বা দ্বেষের কোনো চিহ্ন নাই।
মিঃ বোস বড় থতমত খাইয়া গিয়াছিলেন! একটু সামলাইয়া কহিলেন, আপনাকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম, মিঃ গোস্বামী। আজ কিন্তু সত্যিই আপনাকে আমরা বন্ধুভাবে পেতে চাই–নাউ উই মাষ্ট বি ফ্রেন্ড।
তপন চুপ করিয়া রহিল। তপতীর মাথায় হাত তাহার সমানে চলিতেছে।
—চুপ করে আছেন যে মিঃ গোস্বামী? আমার বন্ধুত্ব আপনি স্বীকার করলেন তো?
-আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মিঃ বোস–আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব কি করে সম্ভব হতে পারে। আমি দীন, দরিদ্র, নগন্য, অশিক্ষিত মানুষ-আপনারা অভিজাত; আপনার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলা আমার পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক নয় শুধু, অসম্ভব
-কিন্তু আমি সেটা প্রার্থনা করছি। আমি চাইছি আপনার বন্ধুত্ব।–ক্ষমা করবেন মিঃ বোস–আমি জীবনে অসত্য কথা উচ্চারণ করিনি; আমার অভিধানের অত্যাগ সহনো বন্ধু সঠিক অর্থে আপনাকে পাচ্ছিনে–আপনাকে বন্ধু ভাবা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
মিঃ বোস নীরব হইয়া গেলেন। অপমানিত বোধ করলেন তিনি। মুখখানি তাহার কালো হইয়া গেল। তপন পুনরায় কহিল, হয়তো আপনি দুঃখ পাচ্ছেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? আমার নীতি জগতের কিছুর জন্যই বদলায় না। আপনার সঙ্গে আমার আলাপ মাত্র দুদিন পড়লো আজই। এর মধ্যে এমন কিছু হয়নি যে, আমার বিরহে আপনি বুক ফাটাবেন বা আপনার জন্য আমি বুক ফাটাবো। অবশ্য, বন্ধু না বলে আলাপী বলা যেতে পারে!
মিঃ বোস যেন বিদ্রূপ করিবার জন্য বলিলেন—এরকম বুক ফাটা বন্ধু আপনার কজন আছেন, মিঃ গোস্বামী?
বিদ্রূপটাকে গ্রাহ্যমাত্র না করিয়া তপন উত্তর দিল,–বেশী তো পাওয়া যায় না, মাত্র একজন আছে।
—আশা করি তিনিও আপনার মতো সংস্কৃত সূত্র মিলিয়ে বন্ধুত্ব করেন?
–তিনি কী করেন, আমার তো জানার দরকার নেই, মিঃ বোস। আমি যা করি তাই আপনাকে বললাম–তপন উঠিয়া গিয়া তপতীর ললাট-আহৃত ক্ৰীষ্টার তৈলাক্ত পদার্থটা গঙ্গার জলে ধুইতে বসিল।
মিঃ বোস চাহিলেন তপতীর দিকে সহাস্যে। স্মিতমুখে বলিলেন এমন অদ্ভুত গোঁড়ামী আর দেখেছেন, মিস চ্যাটার্জি? ধন্য আপনার ধৈৰ্য্য, ওর সঙ্গে এতক্ষণ বসে রয়েছেন।
–আপনার অধৈৰ্য্য বোধ হয়ে থাকে তোত চলে যান–বলিয়া তপতী উঠিয়া বসিল এবং তপনের অত্যন্ত নিকটে গিয়া বলিল,–চলন, বাড়ী যাই-—ভালো লাগছে না এখানে।
নিস্পৃহের মতো তপন গাড়ীতে আসিয়া বসিল, তপতী পাশে বসিয়াই বলিল,–চলুন, খুব জোরে চালাবেন না লক্ষ্মীটি! ভয় করে।
মিঃ বোস যে ওখানে তখনও বসিয়া আছে তপতী লক্ষ্যমাত্র করিল না। সারা পথ সে তপনের বাম বাহুতে মাথা রাখিয়া চুপ বসিয়া রহিল-তপন একটা কথাও কহিল না, একবারও জিজ্ঞাসা করিল না তপতীর ব্যথাটা সারিয়াছে কিনা।
গাড়ী গেটে ঢুকিতে দেখিয়া তপতী মাথা তুলিল। বুকের আটকানো নিশ্বাসটা যেন তাহাকে রিক্ত-সৰ্বস্ব করিয়াই বাহির হইয়া যাইতেছে!
পরদিন কলেজ হইতে ফিরিতেই মা বলিলেন,–আয় খুকী, কিছু রান্না কর দেখি?
তপতী কুষ্ঠিতপদে আসিয়া কহিল,—আজ থাক মা–ও ভাববে, তুমি আমায় প্ররোচিত করেছ, নিজের ইচ্ছায় আমি রান্না করিনি-দুদিন যাক তারপর রাঁধবো।
মা কথাটার মূল্য উপলব্ধি করিলেন।
তপতী কহিল,—ও তো রবিবারে যাবে, মা, শনিবার একটা পার্টি আছে, ও না গেলে কিন্তু আমি যাবো না—লোকে বড় কথা বলে।
—তা তুই বলিনে কেন? অত লাজুক তো তুই নোস্ খুকী?
–লজ্জা নয়, মা, ও এড়িয়ে যায় নানা ছুতোয়—তুমি তো জানো না–বড্ড চালাক ও! আর দেখো মা, এবার যেন ও থার্ডক্লাসে না যায়, বলে দিয়ো তুমি—তপতী একটা বালিশের ওয়াড়ে ফুল তুলিতেছিল। মাকে বলিল,–এটা ওর বিছানার সঙ্গে দিতে হবে, মা, কী লিখবো বলো তো?
মা হাসিয়া বলিলেন—আচ্ছা মেয়ে তুই, কী লিখবি আমি তার কি জানি? নিজে না জানিস, ওকেই জিজ্ঞাসা করিস।
-–ও কথাই বলতে চায় না—গম্ভীর মেজাজ! ভয় করে আমার।
মোটে গম্ভীর নয়, খুকী তবে এই কদিন বোধ হয় একটু ব্যস্ত আছে, তাই—তপন আসিয়া ঢুকিল খাইবার জন্য। মা হাসিয়া বলিলেন, তুমি কেন এত গম্ভীর হচ্ছো বাবা, তপন? এর মধ্যে এমন বুড়ো তুমি কিছু হওনি! বড্ড কাজের মানুষ হয়েছে, না? কথা বলো না কেন?
উচ্চহাস্য করিয়া তপন বলিল,–আমাদের বয়সের কাটাটা আপনার ঘড়িতে ঠিক আপনার প্রয়োজন মতোই চলেনা মা? কিন্তু কী কথা শুনতে চান–বলুন?
—যে কোন কথা বলল, বাবা—গম্ভীর-হওয়া তোমার মানায় না।
আচ্ছা—মা যদি তুই আকাশ হতিস, আমি চাঁপার গাছ—
তোর সাথে মোর বিনি-কথায় হোতি কথার নাচ!
শুনলেন কথা: আপনি আকাশ তো আছেই, আমি চাপা গাছ হতে পারবে বলে মনে হচ্ছে-বোশেখের খররোদে ফুটবে আমার ফুল, যখন আর সব ফুলের মেলা শেষ হয়ে যাবে, সাঙ্গ হয়ে যাবে বাসন্তী-উৎসব।
–মা তপনের বেদনাহত চিত্তের সন্ধান জানেন না; কিন্তু তপতীর অন্তর আলোড়িত করিয়া আজ অসাগর উদ্বেলিত হইয়া উঠিতেছে–কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। তপন স্মিতমুখেই খাইতে বসিয়াছে।
মা বলিলেন,–মাদ্রাজে যাবে বাবা, তোমার বিছানাপত্র সব ঠিক করতে হবে। খুকী একটা ওয়াড় তৈরী করছে কী লিখবে, ওকে বলে দাও তো।
–কিছু তো দরকার নেই বিছানা আমার ঠিক আছে। কিছু লাগবে না, মা!
কোথায় ঠিক আছে, বাবা! তোমার বোনর বাড়ি? তাহলে ওয়াড়টাই নিয়ে শুধু। ঘরের জিনিস বাইরে কেন নিয়ে যাব, মা–বাইরের জিনিস ঘরে আনাই তো দরকার।
তপতী অত্যন্ত বিষণ্ণ হইয়া উঠিল! তাহার পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখিয়া মা অত্যন্ত কষ্টবোধ করিলেন, কিন্তু তপনের সহিত বেশী কথা বলিতে তাঁহার ভয় করে। আজন্ম সত্যনিষ্ঠ এই ছেলেটি একবার না বলিয়া বসিলে চেষ্টাতেও হাঁ হইবে না। অন্য কথার জন্য মা বলিলেন,–এবার কিন্তু তোমার রিজার্ভ-গাড়ীতে যেতে হবে, বাবা, কথা শুনো মায়ের।
-ওরে বাপরে! রিজার্ভ-গাড়ীতে তো রোগী আর ভোগীরা যায়, মা! আমি ভোগী তোনই-ই, আপনার আশীর্বাদে রোগও নেই কিছু আমার।
–দুষ্টুমি কোরো না, বাবা, আজই গাড়ী রিজার্ভ করে গিয়ে; টাকা নিয়ে যাও।
—আমি তো অফিসের কাজে যাচ্ছি না, মা। নিজের কাজে যাচ্ছি।
—হোলই বা তোমার নিজের কাজ। টাকা নাওনইলে আমি বড় দুঃখ পাবো।
তপন বড়ই বিপন্ন বোধ করিতে লাগিল। সত্য বলিলে মা বেশী দুঃখ পাইবেন। এই স্নেহশীলা নারীর ব্যথা চোখের সম্মুখে তপন দেখিতে পারে না,–কী জবাব দিবে? ক্ষণেক ভাবিয়া বলিল,নিজের কাজটা নিজের টাকায় করা কি বেশী পৌরুষের কথা নয়, মা? সন্তানগর্ব তাতে তো মায়ের বাড়াই উচিত-তপন হাসিয়া উঠিল।
মা নিরুত্তর রহিলেন। এ কথার পর কিছু বলতে যাওয়া চলে না। একটু ভাবিয়া কহিলেন,–কিন্তু থার্ডক্লাসে গেলে আমাদের যে অসম্মান হয়, বাবা! তোমার শ্বশুরের দিকটাও তো তোমার দেখা উচিত?
-–আচ্ছা মা সেকেন্ড ক্লাসে যাবো—কেমন, খুশী হয়েছেন?
মা চুপ করিয়া রহিলেন। তপতী বুঝিতে পারিল না, মা কেন টাকা লইবার জন্য তপনকে এত ব্যাকুল হয়ে সাধছেন। মার কোলের কাছে ঘেঁসিয়া সে কহিল,—পার্টিটার কথাও তুমি বলো মা।
তুই কেন বলতে পারিসনে, খুকী? শুনছো বাবা, শনিবার তোমাদের একটা পার্টি আছে-যেতে হবে তোমায়, বুঝলে?
—আমার না-গেলে হয় না, মা?-আমি তো কোনদিন যাইনি।
বাবা, যাও না বলে আমাদের কথা শুনতে হয়। লোকে বলে জামাইকে আমরা লুকিয়ে রেখেছি। তুমি তো লুকোবার মতো জামাই নও, বাবা আমাদের সম্মান তুমি রক্ষা করবে তো
তপন নীরবে খাইতে লাগিল। মা আবার বলিতে লাগিলেন, এখানে না-থাকলেও অবশ্য কথা ছিল না, কিন্তু বাড়িতে থেকেও তুমি সমাজে মুখ দেখাবে না, এ আমাদের বড় লজ্জার কথা। খুকী দুঃখ করে।
আচ্ছা, মা, যাবো—বলিয়া তপন উঠিল।
তপন বাহিরে যাওয়ার পর তপতী মাকে প্রশ্ন করিল,—কিছুই কি নিতে চায় না মা? টাকা নেবার জন্য তুমি এত সাধাসাধি কেন করছো?
–খুকী, কিছুই নেয় না। ওর দুশ টাকা মাসোহারার সব টাকাই আমার কাছে জমা রয়েছে, একটি পয়সা কোনদিন নেয়নি।
—তাহলে দুলাখ টাকা নিয়েছে, শুনলাম যে? সে কথা মিথ্যে?
–না। দুলাখ টাকা ও নিয়েছে, কিন্তু কি যে করলো সে-টাকা নিয়ে তার কোন খবর পাচ্ছি না আমরা। জিজ্ঞাসা করতেও ভয় হয়, বাছা–ও অদ্ভুত ছেলে। যদি অপমান করে বলে বসে–চল্লুম আপনার বাড়ি থেকে, তাহলে নিশ্চয় তখুনি চলে যাবে।
কি করে বুঝলে তুমি? টাকা দুলাখ নিশ্চয় নিয়েছে মা, নইলে ওর এইসব হিল্পী দিল্লী যাওয়ার খরচ জুটছে কোথা থেকে?
—ও টাকা সে নিজের জন্য নেয়নি, খুকী। আমায় কতবার বলেছে, আপনার স্নেহঋণ কি করে শুধবো তাই ভাবছি, মা, টাকা নিয়ে আর ঋণভার বাড়াতে চাইনে। কারও দান গ্রহণ করে না, কখনও মিথ্যা বলে না ও। একদিন এসে বলল-দিন মা ভাত। ভাত রান্না হয়নি বলে বললাম, ভাত তে, রাধিনি বাবা। তাতে বললে কি জানিস,—বললে রান্না তবে করুন, মা-নাহলে চাকরদের ভাত আনিয়ে দিন। ভাত খাব বলেছি, ভাতই খেতে হবে, নইলে মিথ্যা কথা বলা হবে। সেই রাত্রে চাকরদের ভাত ওকে দিতে হল খেয়ে আবার বললে, আপনার বাড়িতে চাকররা কেমন খায়, মা, সেটা দেখে নিলুম কেমন কৌশলে—আপনি বুঝতেই পারলেন না।
তপতী বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর করুণ কণ্ঠে কহিল,—এসব কথা তুমি আমায় একদিনও তত বল নি, মা!
–তুই-যে কিছু খবর রাখিস না, তা আমি কেমন করে জানবো, বাছা?
তপতী আর কথা না বাড়াইয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেল। ভুল তাহার হইয়া গিয়াছে অত্যন্ত সাংঘাতিক ভুল, সংশোধনের উপায় আছে কিনা কে জানে!
তপতী সারারাত্রি বসিয়াই কাটাইয়া দিল।
জীবনের ধারাই যেন বদলাইয়া যাইতেছে তপতীর। স্নান সারিয়াই সে আসিয়া দাঁড়াইল তপনের কক্ষের সম্মুখে! পূজারত তপন স্তোত্র পাঠ করিতেছে,শরণাগত দীনার্ত-পরিত্রাণপরায়ণে, সর্বস্যার্তিহরে দেবী নারায়ণি নমোহস্তুতে। তপতীও সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করিয়া গেল মনে মনে। এমনি কত-কিছুই সে তাহার ঠাকুরদার কাছে শিখিয়াছিল সবই প্রায় ভুলিয়া গিয়াছে। অথচ এই মহার্ঘ রত্নগুলি রহিয়াছে তাহারই স্বামীর কণ্ঠে। হ্যাঁ স্বামী! তপতীর যে আজ তপনকে স্বামী ভাবিতে অত্যন্ত তৃপ্তি বোধ হইতেছে। কেন কে এতদিন দেখে নাই তপনকে? কেন এতবড় ভুল করিল। ঐ-যে সুমিষ্ট কণ্ঠের প্রণতি ঝরিতেছে–
অম্ভোধরশ্যামলকুন্তলায়ৈ, বিভূতিভূযাঙ্গ-জটাধরায়,
হেমাঙ্গদায়ৈ চ ফণাঙ্গদায়, নমঃ শিবায়ৈ চ নমঃ শিবায়।।
কী অপরূপ সুন্দর ঐ শ্লোক-মালা! শেলী, কীটস, বায়রণ, টেনিসন সুন্দর সন্দেহ নাই কিন্তু ঐ যে–অরণ্যে শরণ্যে সদা মাং প্রপাহি, গতিস্তং গতিস্তং ত্বমেকা ভবানি—উহাই কি কিছু কম সুন্দর, কম আন্তরিকতাপূর্ণ!
তপতীর মনে হইল, ঠাকুরদা বাঁচিয়া থাকিলে তাহার আজ এই দুর্গতি হইত না। কিন্তু ঠাকুরদা তাহার কাজ যথাসম্ভব করিয়া গিয়াছেন, মোল বৎসর পর্যন্ত তিনি তপতীরে শিখাইয়া গিয়াছেন আৰ্য্যনারীর কর্তব্য–স্বামীর প্রতি, সংসারের প্রতি, সমাজের প্রতি। আধুনিক সমাজের সহিত সে পদ্ধতি হয়ত মিলে না কিন্তু তপতী সমন্বয় করিতে পারিল না কেন? কেন সে ঠাকুরদার এতদিনের শিক্ষা একেবারে ভুলিয়া গেল।
তপতীর মনে হইল তাহার পিতামাতাই ইহার জন্য দায়ী। একদিন তপতীর অন্তর ছিল শুষ্ক হোমাগ্নির মতো পবিত্র, আজ তাহা বাড়বাগ্নি হইয়া উঠিয়াছে। দুটাই অগ্নি, কিন্তু তফাৎ আছে; কত বেশী তফাত তাহা হোমশিখা যিনি না দেখিয়াছেন, তিনি বুঝিবেন না। তপতীর মনে পড়িল—জন্মদিনে তপন তাহাকে আশীর্বাদ করিয়াছিল—জীবনে তোমার হোমশিখা জ্বলে উঠুক—হয়তো আজ তাই হোমশিখা জ্বলিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু ঋত্বিক তো আসিতেছে না! আসিবে, আসিবে, তপতীর জীবনে তাহার পিতামহের আশীর্বাণী ব্যর্থ হইবে না।
তপন উঠিয়া কখন খাইতে গিয়াছে। তপতীও বুঝিতে পারিয়াই খাবার ঘরে আসিয়া দাঁড়াইল! মা তাহার মুখের পানে চাহিয়া কহিলেন,–খেয়ে একটু ঘুমে গিয়ে, মা-মা। মৃদু হাসিলেন।লজ্জায় তপতী লাল হইয়া উঠিল। মা হয়তো ভাবিয়াছেন, তপনের সহিত তপতী রাত্রি-জাগরণ করিয়াছে। মাথা নিচু করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল তপতী। কথাটা সত্য হইলে আজিকার লজ্জাটা তপতীর আনন্দেরই দ্যোতক হইতে পারিত; কিন্তু সত্য নয়। কবে যে সত্য হইবে তাহাও তপতী জানে না। তাহার শ্বাস ভারী হইয়া উঠিল। তপতীর দিকে না চাহিয়াই তপন কহিল,–অধ্যয়ন একটা তপস্যা, মা ভালো করে ওকে পড়তে বলুন–
—হাঁ বাবা, পড়ছে তত, আর তুমি কি করবে, বাবা?—মাতা হাসিয়া প্রশ্ন করিলেন।
তপন হাসিয়াই জবাব দিল,–অজরামরবৎ প্রাজ্ঞবিদ্যামর্থঞ্চ চিন্তয়েৎ। ও বিদ্যার চিন্তা করুক, মা, আমি অর্থ চিন্তা করছি। ওর তো অর্থের অভাব নেই।
-তোমার বুঝি বড্ড অভাব? মা প্রশ্নটা করিলেন অভিমানহত স্বরে।
–অর্থেব অর্থটা অত্যন্ত ব্যাপক, মা, তার অভাব আমারও আছে বৈকী। ধরুন—পুরুষার্থ, পৌরুষার্থ, পরমার্থ অর্থের মানে তো শুধু টাকা নয়।
মা চুপ করিয়া রহিলেন; তপতী মাকে লক্ষ্য করিয়াই যেন অত্যন্ত নিম্নস্বরে কহিল,অনর্থের মূল হয় অর্থটা সময় সময়
ব্যবহার না জানলেই হয়। ব্যবহারের গুণে বিষও অমৃত হয়ে ওঠে—উত্তরটা তপনই দিল।
তপতী চুপচাপ বসিয়া ভাবিতেছে—তপন তাহার কথায় উত্তর দিয়াছে। আরো কিছু কথা বলিয়া দেখিবে কি, তপতীর উপর উহার মনের ভাব কিরূপ? বলিল,—অনেক সময় বিষকেও আবার অমৃত বলে ভ্রম হয়।
–বিষকে বিষ বলে চিনবার শক্তিটা মানুষ লাভ করে জন্মার্জিত সংস্কার থেকে, আর শিক্ষা দ্বারা অর্জন করে তাকে অমৃতরূপে ব্যবহার করার শক্তি।
মা উহাদের কথোপকথন শুনিতেছিলেন; আনন্দিত স্বরে প্রশ্ন করিলে,—বিষ আর অমৃতে তাহলে তফাৎ কোথায় বাবা?
–শুধু ব্যবহারে, মা, আর কোন তফাত নেই। সব-ভালো আর মন্দর অতীত এই বিশ্বের প্রত্যেকটি অণু। দেশ ভেদে, কাল ভেদে, পাত্র ভেদে সে বিষ হয়, আবার অমৃত হয়; যেমন-নারী, কোথাও বিলাসের ধ্বংসমূৰ্ত্তি কোথাও কল্যাণী মাতৃমূর্তি।
তপনের খাওয়া হইয়া গিয়াছে, উঠিয়া যাইতেছিল, তপতী কহিল ধ্বংসমূর্তিকে কল্যাণী-মূৰ্ত্তি করে গড়ে তোলার ভার থাকে শিল্পীর হাতে।
-হ্যাঁ। কিন্তু শিল্পীর নিষ্ঠুর ছেনীর আঘাত লইবার জন্য মূৰ্ত্তিকে প্রস্তুত থাকতে হয় বলিয়াই তপন চলিয়া গেল। কিন্তু কী সে বলিয়া গেল। তপতীকে কি তাহার নিষ্ঠুর ছেনীর আঘাত সহ্য করিতে হইবে? হয় হোক,তপতী সহ্য করিবে। কথায় কথায় যে-লোক বাক্যের এমন ফুলঝুরি ফুটাইতে পারে, অত্যন্ত সহজ ভাষায় অতিশয় আন্তরিকতা দিয়া যে বলিতে পারে—আমি শিল্পী আমি তোমায় ভালবাসি বলিয়াই আমার নিষ্ঠুর অস্ত্রাঘাতে তোমায় নিখুঁত করিয়া তুলিব, তপতী তাহার হাতে আত্মসমর্পণ করিয়া ধন্য হইয়া যাইবে আসুক ঐ রূপকার, আঘাতে আঘাতে তপতীর সমস্ত কুশ্রীতা ঝরাইয়া দিক, ফুটাইয়া তুলব তপতীর সারা দেহ-মনে অপরূপের মহিমান্বিত ঐশ্বৰ্য্য!
তপতীর চোখে দুইবিন্দু জল টলমল করিয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি সে চলিয়া গেল মা কাছ হইতে। আশ্চর্য্য! এমন না হইলে মা-বাবা উহাকে কেন এত ভালবাসিবেন? তপত কেন এতকাল দেখে নাই? কেন সে বন্ধুদের কথা শুনিয়া আপনার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনকে এম করিয়া অবহেলা করিয়াছে!
কালই মাদ্রাজ চলিয়া যাইবে। আজ বিকেলে উহাকে পার্টিতে লইয়া যাইতে হইবে দেখিবে সকলে, তপতীর স্বামী অপরূপ, অত্যাশ্চর্য্য!
বিকেলে সুসজ্জিত তপতী অপেক্ষা করিতেছিল, তপন আসিতেই তাহাকে পাক বসাইয়া স্বয়ং গাড়ী চালাইয়া চলিল। মুখখানি তাহার হাসিতে দীপ্ত হইয়া উঠিয়াছে, রঞ্জিৎ হইয়া গিয়াছে তাহার অন্তর আজ প্রেমের রক্তিমায়। যথাযোগ্য সম্বৰ্ধনার সহিত তপন। তপতীকে বসনো হইল। তপন ভাবিতেছে, তাহাকে এভাবে এখানে লইয়া আসিবার ক কারণ থাকিতে পারে তপতীর পক্ষে! তপতী কি আজ এতকাল পরে তাহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিল নাকি! না-লোকের কথা বলা বন্ধ করিবার জন্যই তপতী খেলা খেলিতেছে! আপনার প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার জন্য তপতীর মতো মেয়ে সব করিতে পারে। কিন্তু তপতীর অদাকার আচরণ অত্যন্ত আন্তরিক। তপন নীরবে ভাবি লাগিল।
একটি মেয়ে বলিল,–আপনি নিরামিষ খান–এখানে অসুবিধা হবে না তো?
–না, কিছু না। মাংস ছুঁলেই আমার জাত যায় না।
—তাহলে খান না কেন? গোঁড়া তো আপনি নন দেখছি।
—অনেকগুলো কারণ আছে না-খাবার। তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক কারণটা হচ্ছে—বহু যুগ ধরে সিদ্ধকরা খাদ্য খেয়ে আর শাকশজি খেয়ে মানুষের পাকস্থলী বেশী মাংস খাবার যোগ্যতা হারিয়েছে। যে-কোন মাংসাশী জন্তুর পাকস্থলীর সঙ্গে মানুষের পাকস্থলীর তুল করলেই সেটা বোঝা যাবে।
–অন্য কারণটা কি?
—পৃথিবীতে ফল-মূল-শস্যের তো অভাব নেই—মাংস খাওয়া নিষ্প্রোয়োজন, অন্তত আমাদের গরম দেশে অলস কৰ্ম্ম-জীবনে দরকার হয় না মাংস খাবার।
–মাংস কিন্তু শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে!
–ওটা ভুল ধারণা। ঘোড়ার থেকে বেশি শক্তি নেই বাঘের; থাবা থাকলে ঘোড়ার সঙ্গে যুদ্ধে বাঘ নিশ্চয় হেরে যেত। ঘোড়া মাংস খায় না।
তপনের যুক্তির উৎকৃষ্ট সকলকে আকৃষ্ট করিল। মেয়েটি বলিল,—আরো কোনো কারণ আছে কি আপনার মাংস না-খাবার?
হ্যাঁ, মনের সাত্ত্বিকতা ওতে ক্ষুন্ন হয়। মনকে যারা লালন করতে চায় মানুষের মতো করে, এই উষ্ণ দেশে তাদের মাংস না খাওয়াই উচিত। পার্থিব চিন্তার ধারা হয়তো ওতে বিকৃত না হতে পারে কিন্তু পৃথিবীর ওপারের বিষয়ও চিন্তা করে এমন লোকের অভাব নেই।
আলোচনাটা গম্ভীর হইয়া উঠিতেছে, তরল করিবার জন্য একজন কহিল,–আপনি এতকাল আমাদের কাছে আসেননি কেন বলুন তো? ভয়ে?
অপরাধটা তপতীরই। সে তপনকে লইয়া অসিবার জন্য কোনদিন আগ্রহ প্রকাশ করে নাই। তপন কি বলে, শুনিবার জন্য সে উৎসুক হইয়া উঠিল। তপন হাসিয়া উত্তর দিল—অত্যন্ত বেমানান ঠেকবে বলে। পলাশফুল বনেই থাকে—মার্কেটের কাচের ঘরে ওকে মানায় না।
কথাটায় তপনের বিনায়াতিশয্যের সহিত তীক্ষ্ম ব্যঙ্গ মিশিয়া আছে।
—আমরা বুঝি কাচের ঘরে থাকি।আমাদের এমনি অসম্মান করবেন নাকি আপনি?—মেয়েটি বলিল।
–ঐ ভয়েই তো আসিনি। আপনাদের সম্মান এবং অসম্মানের দেওয়ালগুলো এত ঠুনকো যে ঢুকতে ভয় করে। অতি সাবধানে টেলিফোন করে বলতে হয়-চার ডজন গোলাপ, দু ডজন ক্রীসান্থীমাম, পাঁচ ডজন কস্মস্…।
তপনের বলার ভঙ্গীতে অনেকেই হাসিয়া উঠিল। কিন্তু যে মেয়েটি অসম্মানের কথা তুলিযাছিল, সে বলিল বিদ্রূপ করিয়া—আর বনে গিয়ে আপনার ঘাড় মটকে আনতে হয়, কেমন?—তপন নিঃশব্দে হাসিল। মেয়েটি পুনরায় বলিল,—আমরা যে কাচের ঘরের সাজানো ফুল, সেটা আপনি প্রমাণ করুন, নইলে ছাড়ছি না।
–না-ছাড়লে অসুবিধা হবে না, কাচের ঘরে ঢুকতে সাধ হয় মাঝে মাঝে।
–তা হলে এবার ঢুকে পড়লেন—কেমন? মেয়েটি তপনকে ঠকাইয়াছে।
আমার ঢুকবার অনুমতি দিয়ে এবার কিন্তু আপনিই প্রমাণ করলেন যে, এটা কাচের গর।–তপন হাসিল।
মেয়েটি আপনার বাক্যজালে জড়িত হইয়া এমন নির্বোধের মতো ঠকিয়া গেল দেখিয়া সকলেই বলিল—যা যা, কথা কহিতে জানিস নোলজ্জিত হইয়া মেয়েটিও হাসিতে লাগিল! তপতীর অন্তর আনন্দে শিহরিয়া উঠিতেছে। এই তপন–তাহার স্বামী যাহার নহিত কথায় পাল্লা দিতে পারে এমন মেয়ে এখানে একটিও নাই?
মিঃ অধিকারী এবং মিঃ বোস আসিয়া দর্শন দিলেন তপনের আসনের পার্শ্বে। মিঃ বোস ব্যঙ্গ করিয়া বলিয়া উঠিলেন,—পূজোর সঙ্গে পার্টির মিক্সচারের ঋষি-সূত্রটা কি তপনবাবু?
কিছুমাত্র ইতস্তত না করিয়া তপন উত্তর দিল,–মোগলের সঙ্গে খানা-খাওয়া।
মিঃ বোসকে পরাজিত দেখিয়া মিঃ অধিকারী আরম্ভ করিলেন,—টিকির মাহাত্মাটা একটু বর্ণনা করবেন, তপনবাবু-আপনার পাঁচালী থেকে?
সদাহাস্যময় তপন তৎক্ষণাৎ আরম্ভ করিল,–
টিকির মাহাত্মকথা করিব বর্ণন,
অবধান করো সব টিকিহীন জন!
টিকিটি রাখিবে যেবা জয় হবে তার,
টিকি না-থাকায় হারে জজ-ব্যারিষ্টার!
কহিল টিকির কথা বেচারা তপন,
টিকিতে বাঁধিয়া নিয়ো রমণীর মন।
হা হা করিয়া তরুণীর দল কলহাস্যে সভা মুখরিত করিয়া তুলিল। মিঃ অধিকারী ও মিঃ বোস রোষে ফুলিয়া উঠিতেছিলেন—মিঃ বোস কহিলেন,—অত উৎফুল্ল হবেন না। ইংরাজীতে একটি কথা আছে, ফুস রাশ ইন হোয়্যার এঞ্জেল্স…মিঃ বোস থামিলেন।
ক্রোধে তপতীর দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিতেছে। তাহার স্বামীকে তাহারই সম্মুখে ইহারা ফুল বলিবে এবং তাহা তাহারই জন্য? কিন্তু তপন জবাব দিল, দেবদূতরা বেশী সাবধানী, তাদের পথ গোনাগাঁথার গলিতে, আর বোকাদের পথ দরাজ বড় রাস্তা–তাই এসব ব্যাপারে বোকারাই জয়ী হয় চিরদিন। জয়ী না হলেও তারা মরতে পিছোয় না, চালাক দেবদূতদের মতো লাভ আর লোকসান খতিয়ে দেখবার বুদ্ধি তাদের নেই।
মুখের মতো জবাব হইয়া গিয়াছে। নির্ভীক তপন নিঃসঙ্কোচে নিজেকে বোকা মানিয়া লইয়াই যাহা জবাব দিল, তরুণীর দল তাহার প্রশংসা না করিয়াই পারে না।
জনৈকা মহিলা কহিলেন—আপনি বোকা? চালাক কে তবে!
—যাদের লাক চা-চকোলেট আর চপ খেয়ে দিনে দিনে ফুলে ওঠে। তপন উত্তর দিল।
কথাটার মধ্যে যে হুল ছিল, তাহার বিষ তপতীকে পর্যন্ত কুণ্ঠিত করিয়া দিল। মিঃ অধিকারী দাঁড়াইয়া উঠিলেন; বলিলেন,–আপনি আর আমাদের চা-চপ খেতে ডাকবেন না, তপতী দেবী, উনি সইতে পারেন না বোঝা যাচ্ছে
তপতী অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া বলিল,–আমি বড় লজ্জা পেলাম, মিঃ অধিকারী আমিই আপনাদের কাছে মাপ চাইছি এর জন্যে।—তপতী হাতজোড় করিল।
যেন কোন মহার্ঘ্য বস্তু লাভ করিয়াছে, তপন এমনি ভাবে হাসিয়া উঠিল; বলিল, আমিও মাপ চাইছি, মিঃ অধিকারী। কিন্তু রসিকতা করে আঘাত করতে এলে প্রতিঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত, এই কথা আমাদের বোকার অভিধানে লেখে। আর আমি শুধু প্রমাণ করে দিলাম যে, বোকা অসুররা মাঝে মাঝে জয়লাভ করলেও স্বর্গরাজ্য পরিণামে দেবতাদেরই, কারণ বোকা অসুররা সেটা রক্ষা করতে পারে না—এ কথা জেনেও তারা স্বর্গরাজ্য লাভের জন্য হাত বাড়ায়—বোকা কিনা, তাই! স্বর্গ কিন্তু দেবতাদের পথ তাকিয়েই থাকে।
মিঃ অধিকারী ও মিঃ বোস খুসী হইয়া উঠিয়াছেন তপতীর সহানুভূতি পাইয়া। তপন বলিয়া চলিয়াছে তখনও,—আপনারা আমার এই ইচ্ছাকৃত অপরাধটা ক্ষমা না করলেও জয়ী আপনারাই।
তপন কী বলিতে চাহিতেছে ঠিক বুঝিতে না পারিয়া মিঃ অধিকারী ও মিঃ বোস তাকাইয়া রহিলেন। তপতী কিন্তু অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। কেন সে মরতে সহানুভূতি দেখাইতে গেল! মিঃ অধিকারীরা চটিলে তাহার কি বহিয়া যাইবে? কিছু একটা বলা উচিত ভাবিয়া সে বলিল, খাওয়ার খোঁটা দেওয়া খুব অন্যায়।
তপন কহিল,—চা-চপ-খাদকদের চালাক আর লাকী বলায় কোনো ব্যক্তিকে খোঁটা দেওয়া হয়, আমার ধারণা ছিল না!
–অন্য ক্ষেত্রে হয়তো কথাটা দোষের নয়, এক্ষেত্রে অত্যন্ত অভদ্র শোনাচ্ছে। তপন নির্বিকার চিত্তে তপতীর কথার উত্তরে মিঃ অধিকারীকে হাসিয়া কহিল,–ভদ্র তো আমি নই, মিঃ অধিকারী-বুদ্ধিও নেই। আমার কথাটা তো আপনাদের সুবুদ্ধি হেসেই উড়িয়ে দিতে পারতো।
একটি তরুণী বলিল,—রিয়েলি! রসিকতা করতে এসে রাগ করা চলে না। আপনারা ফুল বলায় উনি কত সুন্দর করে জবাব দিলেন, আর উনি এমন কিছুই বলেননি যাতে আপনাদের চটে যাওয়া চলে।
মিঃ অধিকারী এতক্ষণে বুঝিলেন, চটিয়া যাওয়া তাহার অন্যায় হইয়াছে। কহিলেন, আপনাকে এরকম কথা বললে আপনি কী করতেন?
তপন বলিল, আমার বোকা বুদ্ধিতে চা আর চপ বেশী করে খেয়ে লাকী হতাম।
তপনের মুখের ভাব ও কথার ভঙ্গীতে সকলেই হাসিয়া উঠিল।
মিঃ বোস কহিলেন,—আচ্ছা, যেতে দিন—আসুন, চা-ই খাওয়া যাক আর এক কাপ।
একটি মেয়ে বলিল, তা হলে আপনি সত্যই চালাক হতে চান?
মিঃ অধিকারীর মুখখানা তখনও গম্ভীর ছিল; বলিলেন,—দিন, খেয়েছি কিন্তু–
তপন হাসিয়া কহিল,—কিছু কিন্তু না, মিঃ অধিকারী, অধিকন্তুটা অনেক সময় আরাম দেয়। যেমন ধরুন—চশমার উপর সান্-গ্লাস, চিবুকের নীচে নেকটাই; পাঞ্জাবীর উপর চাদর, চামড়ার উপর উল্কী, চায়ের উপর চাদমুখ…।
হাসিতেছে সকলেই। মিঃ অধিকারীও আর না হাসিয়া পারিল না। স্মিমুখে কহিলেন,—রিয়েলি, বাংলা ভাষাটা আপনার আশ্চৰ্য্য রকম আয়ত্তে
মিঃ বোস কহিলে,—কিন্তু উনি আমাদের বন্ধু হতে চান না—সো স্যরি।
–সার্টেনলি হি উইল বি। নইলে আমরা ওঁকে ছাড়বো না—মিঃ অধিকারী কহিলেন।
তপতী নীরবে চা খাইতেছে। ইচ্ছা করিয়াই যে কঠিন পরিস্থিতির সে সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা হইতে সে মুক্তিলাভ করিল এতক্ষণে। তপতীর মনে এখনও ইহারা যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়া আছে। তপন বুঝিল, ইহাদের এতটুকু অসম্মান আজও তপতী সহিতে পারে। আর তপনের বেলায়?–আমাকে এবার যেতে হবে, অনুগ্রহ করে অনুমতি দিন! পন আবেদন করিল।
–না-না-না, ভারী সুন্দর লাগছে আপনার কথা, এখনি কেন যাবেন?
তরুণীর দল তপনকে ছাড়িতে চাহে না।মিঃ অধিকারী ও মিঃ বোস ঈর্ষাপরায়ণ হইয়া উঠিতেছেন। তাহাদিগকে অসম্মান করিয়াই লোকটা তরুণীমহলে খাতির জমাইয়া ফেলিতেছে! মিঃ বোস কহিলেন, কারও কথায় ওঁর নীতি বদলায় না শুনেছি। অনুরোধ বৃথা!
মিঃ অধিকারীও কথাটায় সায় দিয়া কহিলেন, কাজের মানুষদের আটকাতে নেই। তরুণীদের একজন চটিয়া বলিল,–আপনারা চান যে, উনি চলে যান, নয়?-রাগটা সামলাইতে গিয়া মিঃ বোস ও মিঃ অধিকারী চুপ হইয়া গেলেন!—সমস্ত অবস্থাকে সামলাইবার জন্য তপতী কহিল,না রে, কাজ আছে—যাই আমরা।
–তুই থাম তো তপি! ওকে এতকাল কিসের জন্য লুকিয়ে রেখেছিলি বল?
তপতী কোনো উত্তর দিবার পূর্বেই তপন হাসিয়া কহিল,–অচল টাকা বার করা বোকামী-লুকিয়ে রাখতে হয় নিতান্ত ফেলে দিতে না পারলে।
তপন উঠিল; তপতীর মন আচ্ছন্ন করিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বেদনার সুর। তপনকে সে অচল টাকাই মনে করিয়াছে। বারম্বার আঘাত করিয়াছে হাতুড়ী দিয়া নখের কোণায় বাজাইয়া দেখে নাই।
গাড়ী চলিতে চলিতে তপন একটা কথাও বলিতেছে না। তপতীর মন বিষাদ সাগরে ড়ুবিয়া যাইতেছে। কেন সে মিঃ অধিকারীদের সহানুভূতি দেখাইতে গেল? যে-কোন অবস্থা-বিপৰ্যয়কে অনায়াসে আয়ত্তে আনিবার শক্তি যে তপনের অসাধারণ, ইহা তপতী আজ ভালো করিয়াই বুঝিয়াছে। তপন নিজেই তো সমস্ত সামলাইয়া লইল। বরং রসিকতা করিতে আসিয়া চটিয়া যাওয়ার জন্য মিঃ অধিকারী লজ্জাই পাইলেন। কিন্তু তপন কী ভাবিতেছে তপতীর সম্বন্ধে? হয়তো ভাবিতেছে, তপতী আজও উহাদের জান্য তপনকে অভদ্র বলে। এখনও তপতী উহাদের অসম্মান সহিতে পারে না। তপতীর মাথা ঠুকিয়া মরিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। কিন্তু এখন আর উপায় নাই।
গেটে গাড়ীটা ঢুকাইয়া দিয়া তপন পুনরায় বাহির হইয়া গেল।
প্রেম যখন অন্তরে সত্য-সত্যই জাগিয়া উঠে তখন অনেক কথাই বলি-বলি করিয়া বলা হয় না। সমস্ত রাত্রি তপতী জাগিয়া রহিয়াছে, এতটা সময় চলিয়া গেল, অথচ কিছুই তাহার বলা হইল না তপনকে। কতবার তপতী ভাবিল—ঐ তো ও-ঘরে তপন ঘুমাইতেছে, তপতী গিয়া ডাকিলেই পারে; কিন্তু লজ্জায় পা চলিতেছে না। এত কাণ্ডের পর তপতী আজ কি করিয়া তপনকে ভালবাসার কথা বলিবে। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির ন্যায় তাহার অন্তরাত্মা কাদিয়া ফিরিতেছে, তপতী আপনাকে নিঃশেষে তপনের কাছে মুক্ত করিয়া দিবার কোনো পথই খুঁজিয়া পাইতেছেনা! তপন যদি তাহাকে তাড়াইয়া দেয়! যদি বলে কেন এ ছলনা করিতে আসিয়াছ? তপতী সে অপমান সহ্য করিতে পারে; কিন্তু ৩পন হয়তো কিছুই বলিবে না, নীরবে শুনিবে এবং নির্লিপ্তর মতো চলিয়া যাইবে। তথাপি তপতী একবার চেষ্টা করিবেই; রাত্রিতে আর উঠাঁইবার কাজ নাই, ঘুমাক, সকালে সময় পাওয়া যাইবে নিশ্চয়।
প্রত্যুষে গান সারিয়া তপতী গিয়া দাঁড়াইল খাইবার ঘরে! মাও আসিলেন—তপনের জন্য খাবার প্রস্তুত করিতে হইবে।
–কাল পার্টিতে তপনকে দেখে সবাই কি বললো রে খুকী?–মাতার প্রশ্নের উত্তরে তপতী হাসিমুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রইল; তারপর বলিল,—সবাই খুব ভালো বললো।
মা মধুর হাসিয়া বলিলেন,–আমার কথা ঠিক তো? দেখ এবার–
তপতী কিছু বলিল না; হাসিমুখে লুচি বেলিতে লাগিল। তপন আসিয়া ঢুকিল। এত সকালে আসিবে, মা তাহা ভাবেন নাই। বলিলেন,–আটটার ট্রেন, বাবা, এত তাড়া কেন তোমার? ছটা তো বাজলো।
–সাতটায় বেরবো, মা,–খাবো, কাপড় পরো,একঘন্টা তো সময়। দিন!
তপন খাইতে বসিল! তাহার ললাটের ত্রিপুণ্ড রেখায় আজ রক্তচন্দনের আভা, পরণে ক্ষৌমাবস্ত্র, গলায় উত্তরীয়। তপতী বিমুগ্ধ বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল এই অসাধারণ পবিত্রতার দিকে। তপন কথা বলিতেছে না দেখিয়া মা কহিলেন,–পৌঁছেই চিঠি দিয়ে বাবা, ভুলো যেন।
মা, চিঠি দেবো পৌঁছেই!
–খুকী তো স্টেশন যাচ্ছিস সী-অফ করতে?
–না মা, ও কিজন্যে কষ্ট করে যাবে? ফিরতে বেলা হয়ে যাবে অনর্থক। তাছাড়া আমি ট্যাক্সিতে যাচ্ছি, বাড়ির গাড়ী নিলাম না–বলিয়া খাইতে লাগিল। তপতী কিছুই বলিতে পারিল না।
বাকী যাহা বলিবার তপতী বলিবে ভাবিয়া মা আর কিছু বলিলেন না। তপন নীরবে খাইয়া উঠিয়া গেলে মা তপতীকে চা ও খাবার দিয়া বলিলেন,–সুটকেশগুলো গুছিয়ে দিয়েছিস?
দারুণ মানসিক উত্তেজনায় তপতীর সে কথা মনেই ছিল না।
—যাচ্ছি বলিয়া তপতী তাড়াতাড়ি খাইয়া তপনের ঘবে আসিল, সুটকেস গুছানো এবং চাবিবন্ধ রহিয়াছে। তপনের কাপড় পরাও হইয়া গিয়াছে, একটা চাকর তাহার জুতার ফিতা বাঁধিয়া দিল। অন্য একজন সুটকেস-দুইটি গাড়ীতে লইয়া গেল। তপনও বাহিরে যাইতেছে, সম্মুখে তপতীকে দেখিয়া বলিল আচ্ছা-চাম–নমস্কার। তপন চলিয়া গেল মাকে প্রণাম করিতে; পরে মিঃ চ্যাটার্জিকেও প্রণাম করিল—এবং নীচে নামিয়া গেল।
সম্বিৎলব্ধা তপতী ছুটিয়া নীচে আসিবার পূর্বেই তপনের গাড়ী ছাড়িয়া দিয়াছে।
কিছুই বলা হইল না…না, বলিতেই হইবে। তপতী তৎক্ষণাৎ একখানা গাড়ী আনাইয়া স্টেশনে ছুটিল। ট্রেন ছাড়িতে মাত্র কয়েক মিনিট বিলম্ব আছে। তপতী ছুটিতে ছুটিতে গিয়া প্ল্যাটফর্মে ঢুকিয়াই দেখিল-বোনটির হাত ধরিয়া তপতী দাঁড়াইয়া আছে। মনটা তাহার দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া উঠিল ক্ষণিকের জন্য, কিন্তু সবলে সমস্ত দৌর্বল্য ঝাড়িয়া ফেলিয়া তপতী নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল…মেয়েটা কাঁদিতেছে—উদ্বেল আকুল হইয়া কাঁদিতেছে। তপন বলিতেছে তাহাকে,—লক্ষ্মী বোনটি, এমন করে কাদে না—যাও, স্বামীর কাছে যাও, স্বামীর চেয়ে বড় বস্তু নারীজীবনের আর কিছু নেই, এই কথা তোকে আমি আজন্ম শিখিয়ে এসেছি—ওরে ধর ওকে!—একটি সুন্দর যুবক আগাইয়া আসিল। মেয়েটা কিছুতেই তপনকে ছাড়িতেছে না, হু হু করিয়া কাঁদিতেছে। তপন তাহার মাথায় হাত রাখিয়া কহিল,—ছি মীরা, এতকালের শিক্ষা আমার সব পণ্ড করে দিবি তুই? চুপ কর-আয়, ওঠ, ধরিত্রির মতো সহিষ্ণু হোস্—আকাশের মতো উদার হোস—সূর্যালোকের মতো পবিত্র পাকিস…।
গাড়ী ছাড়িতেছে। তপন পা-দানিতে উঠিয়া পড়িল। চোখের জলে কিছুই দেখিতে পাইতেছে না, তথাপি মেয়েটা তাকাইয়া আছে, অপসৃয়মান গাড়ীটার দিকে। তপতী যে এত কাছে দাঁড়াইয়া আছে উহাকে কেহ দেখিলই না।তপন এ মুখে ফিরে নাই, আর ইহারা তপতীকে চেনে না! কিন্তু কেন ও এত কাঁদিতেছে? মাদ্রাজ গেল, কয়েকদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে, তাহার জন্য এত কান্নার বাড়াবাড়ি কেন। তপতী বিস্মিতা ও ব্যাকুল হইয়া উঠিল। কী গভীর কারণ থাকিতে পারে ঐ কান্নার? ধীরে ধীরে সরিয়া আসিয়া সে সহানুভূতি জানাইতে মীরার হাতটা ধরিতে গেল, চমকাইয়া মীরা কহিল,–কে আপনি? তৎক্ষণাৎ তপতীর মুখের পানে তাকাইয়া বলিল,–ও, লজ্জা করে না আমায় ছুঁতে-হাতখানা মীরা টানিয়া লইল।
তাহার স্বামী বলিল,–ছিঃ ছিঃ, ওরকম করে বলতে আছে?
মীরা সরোষে গর্জিয়া উঠিল,–জুতোর ঠোক্করে নাক ভেঙে দেব না। দাদাকে আমার দেশান্তরী করে দিল, আবার লাভার-এর দেওয়া আংটি হাতে পরে সী-অফ করতে এসেছে। চলো, চলো-ওর মুখ দেখলে গঙ্গানাইতে হয়!—মীরা তৎক্ষণাৎ স্বামীর হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিয়া গেল।
যে কথা কেহ কোনদিন বলে নাই, বলিবার কল্পনা পর্যন্ত করিতে পারে না, মীরা তাহাই বলিয়া গিয়াছে। তপতীর সমস্ত আভিজাত্য সমস্ত অহঙ্কার ধরার ধুলায় লুটাইয়া দিয়া গেল। লাভার-এর দেওয়া অংটিহাতে পরে…তপতী শিহরিয়া আপনার বাম হাতের অনামিকার দিকে চাহিল-মিঃ অধিকারীর প্রদত্ত আংটির হীরকখণ্ডটি জ্বলজ্বল করিতেছে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো। আপনার অজ্ঞাতসারেই তপতী আংটি খুলিয়া ফেলিল।
তপন যাহা কোনদিন বলে নাই, মীরা তাহাই নিতান্ত সহজে বলিয়া দিল! বিরুদ্ধে তপতীর কিছু বলিবার নাই। আজ দীর্ঘ পাঁচমাস সে ঐ আংটি পরিয়া আছে। তপতীর চরিত্রের বিরুদ্ধে ঐ জ্বলন্ত জাগ্রত প্রমাণকে লুপ্ত করিবার শক্তি আজ আর কাহারও নাই।
মৃত্যু-পাণ্ডুর তপতী আসিয়া গাড়ীতে উঠিল।
—ওর বোনের ঠিকানাটা তুমি জানো মা? তপতী মাকে প্রশ্ন করিল।
–না রে–কেন, তুই জানিস নে? দেখিনি তাকে তুই?—মা প্রতিপ্রশ্ন করিলেন।
–দেখেছি সেদিন স্টেশনে! কিন্তু ঠিকানা জানবার আগেই চলে গেল।
–বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে মা! ওকে একদিন তোর গিয়ে আনা উচিত ছিল।
—তুমিও তো বললানি মা, আজ বলছে অন্যায় হয়েছে।—তপতীর কণ্ঠস্বর ব্যথা করুণ শুনাইতেছে।
স্বামী বিরহ-বিধুর কন্যার কথা শুনিয়া মা সস্নেহে বলিলেন,—তপন ফিরে এলেই যাবি একদিন,আজ বোধ হয় তার চিঠি পাবি তুই।
বিষণ্ণা তপতী বিশুষ্ক মুখে চলিয়া গেল। সে চিঠি পাইবে! এতবড় ভাগ্য সে অর্জন করে নাই আজও। এই দীর্ঘ সাতদিন প্রতিটি মুহূর্ত তপতীর অন্তর ধ্যান করিয়াছে তপনের মূর্তি–কিন্তু তাহার অত্যন্ত দেরী হইয়া গিয়াছে। শুধু দেরী হইলেই হয়তো ক্ষতি হইত না, তপতীর অন্তঃসারশূন্য অহঙ্কার তপনকে বিদীর্ণ করিয়া দিয়াছে, বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছে তপতীর অন্তর হইতে তাহার অন্তরতমকে। ভাবিয়া ভাবিয়া তপতী ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছে। তাহার পুণ্যশ্লোক ঠাকুরদা যেন তাহাকে চোখ রাঙাইয়া বলেন,—অ্যাতো শেখালাম, খুকী—সব পণ্ড করে দিলি!” কিন্তু কেন সে এত ভাবিতেছে? তপন তো কয়েকদিন পরেই ফিরিয়া আসিবে। মীরা বলিয়াছে তাহাকে অত্যন্ত কুৎসিৎ কথা, কিন্তু তপন তো কোনদিন কিছু বলে নাই। যেদিন সে মিঃ ব্যানার্জীর কোলে শুইয়া তপনের কাছে মুক্তি-ভিক্ষা চাহিয়াছিল, সেদিন…হা, সেদিন কিন্তু তপন অসহ্য বেদনায় লুটাইয়া পড়িয়াছিল।
সময় আব কাটিতে চাহে না–কতক্ষণে ডাক আসিবে। তপতী জানে তপন তাহাকে চিঠি লিখিবে না কিন্তু মার পত্রে খবরটা জানা যাইবে। অতদূর রাস্তা, ইন্টার ক্লাসে গিয়াছে, ভালোয় ভালোয় পৌঁছাইলেই ভালো।
মা ডাকিলেন,–আয় খুকী-চিঠি এসেছে, পড়—
তপতী পড়িল,—মা আপনার শ্রীচরণাশীৰ্বাদে নিরাপদে এসে পৌঁছেছি; আছি সমুদ্রের কিনারে। এ নীড় কালই ছাড়তে হবে। গতরাত্রে শুনেছি সাগরের অশান্ত করোল; মনে হচ্ছিল, দুহিতা ভারতের দুর্দশায় বিগলিত-হৃদয় মহাসিন্ধুর আর্তনাদ বুঝি আর থামবে না।
আমার কোটি কোটি প্রণাম জানবেন। ইতি-তপন।
সামান্য কয়েকটি লাইন মাত্র। কিন্তু তপতীর মনে হইল, দুহিতা ভারতের দুর্দশায় বুঝি কোনো হৃদয়-সমুদ্র-ক্রন্দনে উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে। মাকে চিঠিখানা ফিরাইয়া দিয়া তপতী আসিয়া বিছানায় লুটাইয়া পড়িল।
বিকালে ঝি আসিয়া সংবাদ দিল—মিঃ ব্যানার্জী, মিঃ বোস, মিঃ অধিকারী ইত্যাদি সব আসিয়াছেন। তপতী যাইতে পারিবে না বলিয়া দিল। মা মেয়েকে একটু অন্যমনা করিবার জন্য বলিলেন,–যা না, মা একটু গল্প কর গিয়েনা-হয় খেলা করগে একটু–
তপতী অকস্মাৎ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। বলিল, যাবো না, যাও!
মা তাহার মনের অবস্থা বুঝিয়া নীরবেই চলিয়া গেলেন। ভাবিতে লাগিলেন সেই তপতী, যে দিনরাত হাসিখুসি আর গল্প লইয়া মাতিয়া থাকিত, সেই কিনা স্বামী বিরহে একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে।
তাঁহার আনন্দ হইল, হাসিও পাইল। ভাবিলেন, তপন খুকীকে আলাদা পত্র নাদেওয়ায় উহার অভিমানটা হয়তো বেশী হইয়াছে। যা রাগী মেয়ে। তপন যে খুব ব্যস্ত রহিয়াছে সেখানে, ইহা খুকী কেন বুঝিতেছে না।
কিন্তু দিনের পর দিন চলিয়া যাইতেছে, প্রায় পনের দিন কাটিল, না-আসিল খুকীর চিঠি, নাবা মার চিঠি। মা-ও এখন ভাবিতেছেন। স্বামীকে তিনি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলেন, তিনিও তপনের কোনো পত্র পান নাই। তপতীকে ডাকিয়া কহিলেন,—তোকে কি বলে গেছে রে খুকী?
—মাস দুই দেরী হবে, বলেছে, মা। তপতী মৃদুস্বরে উত্তর দিল।
মা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তপতী অত্যন্ত বিমনা হইয়া পড়িয়াছে। মেয়ে কষ্ট পাইতেছে ভাবিয়া মা আর কোনো কথা তুলিলেন না।
তপতীর কিন্তু মনে পড়িয়া গিয়াছে মীরার কথাটা—-দাদাকে আমার দেশান্তরী করে দিল! সত্যিই কি তাই? সত্যই কি তপন আর আসিবে না? তারই জন্য কি মীরা সেদিন অত কান্নায় ভাঙিয়া পড়িতেছিল? হয়তো তাই-—হয়তো তপতীকে সত্য-সত্যই তপন মুক্তি দিয়া গিয়াছে!
তপতী আর অধিক ভাবিতে ভরসা পাইতেছে না। ভাবনার সূত্র ধরিয়া উঠিয়া আসিতেছে মিঃ ব্যানার্জি, মিঃ বোস, মিঃ সান্যাল-তপনকে অপমান করিতে তপতী যাহাদিগকে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করিয়াছে। যাহারা বলিয়াছে,–তপন নির্লজ্জ, উহার মানঅপমান জ্ঞান নাই—তাহারাই আজ অজস্র অবহেলা সহ্য করিয়া তপতীর দরজায় ধরণা দেয়। আর তপন, প্রত্যেকটি কথায় যাহার অনুভূতির মণি-মাণিক্য ছড়াইয়া যাহার বিনয়ের মধ্যেও জাগিয়া থাকে যুগ-সঞ্চিত সংস্কারের আভিজাত্য, অপমানকে যে নীলকণ্ঠের মতো আত্মসাৎ করিয়া অমৃত বর্ষণ করিয়া যায়—সেই ঋষির মতো স্বামী তপনকে সে অপমান করাইয়াছে ঐসব পথের কুকুর দিয়া!…বেদনায় তপতীর অন্তর অসাড় হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু কী করিবার আছে। ঠিকানা পর্যন্ত দিল না। বোনের ঠিকানাটাও জানিয়া লওয়া হয় নাই। তপতী চারিদিকেই অন্ধকার দেখিতে লাগিল।
মিঃ চ্যাটার্জী আসিয়া কহিলেন,—ওগো শুনছো, তোমার জামাই-এর কাণ্ড দ্যাখো—
তপতী তৎক্ষণাৎ কান খাড়া করিল। মা বলিলেন,–খবর পেয়েছ?
—না। খুকী চিঠি পায় নি?–মিঃ চ্যাটার্জী উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিলেন।
–না।–বলিয়া তপতীর মাতা একটা নিঃশ্বাস ফেলিলেন! পুনরায় বলিলেন,–কী কাণ্ড তবে?
–অফিসের একটা কেরানীর অসুখ ছিল প্রায় তিন-চারমাস। তপন তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। আজ সে ফিরে এসে আমার পায়ে আছড়ে পড়ে বললে–তার অ্যানিমিক হয়েছিল, তপন তাকে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে।
—রক্ত!—তপতী শিহরিয়া পিতাকে প্রশ্ন করিল।
-হ্যাঁ রে–তুই জানিস না তাহলে। তারপর হাসপাতালে কত টাকা দিয়েছে, ঐ রকম রোগীদের কিনে রক্ত দেবার জন্যে। সেই দুলাখ টাকায় এসবই করেছে বোধ হয়। আমায় বলেছিল-ভালো কাজেই টাকাটা লাগাবো বাবা!
দুলাখ কেন, দশ লাখ তপন খরচ করুক সর্বস্ব বিলাইয়া দিক কিন্তু নিজের রক্ত কেন দিল! কবে সে করিল এ কাজ! তপতীর সারা মন ব্যথা কন্টকিত হইয়া আসিতেছে। কারুণ্যে শীতলতম স্রোতে অবগাহন করিতেছে, তাহার হৃদয়টা বুঝি বা ফাটিয়া চূর্ণ হইয়া যাইবে।
অনেকক্ষণ একা বসিয়া থাকার পর অকস্মাৎ তপতী উঠিয়া মার কাছে গিয়া বলিল,–ওর ঘরের চাবিটা দাও তো, মা?
মা চাবি বাহির করিয়া দিলেন। তপতী আসিয়া ঘরটা খুলিয়া ফেলিল! একটা ছোেট টেবিল রহিয়াছে, উপরে মোটা কাচের আবরণের প্যাড। কাচটার নীচে একখণ্ড কার্ড-এ কী লেখা আছে টানিয়া পড়িল তপতী—আমার বিদায়-অশু রাখিলাম, লহো নমস্কার!
তপতীর স্নায়ুতন্ত্রী অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। সামলাইবার জন্য সে টেবিলের উপরেই মাথা খুঁজিয়া বসিয়া পড়িল তপনেরই চেয়ারটায়।
কতক্ষণ কাটিয়াছে খেয়াল নাই তাহার মা স্নেহভরা তিরস্কার করিয়া ঢুকিলেন-কি তুই করছিস, খুকী! স্বামী সবারই বিদেশে যায়, অমনি করে কাদে নাকি তার জন্যে? আয় খেতে আয়।
কাঁদিনি মা, যাচ্ছি–তুমি যাও—যাচ্ছি আমি—
তপতীর কণ্ঠস্বরে মা অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িলেন। প্রশ্ন করিলেন,—এমন করে কথা বলছিস্ : চিঠি না-পেলে কি অত করে কাদে?
—ঠাকুরদা আমায় ঠকায়নি, মা-ঠকায়নি গো, ঠকায়নি!–বলিতে বলিতে তপতী ছুটিয়া গিয়া পড়িল পিতামহের প্রকাণ্ড অয়েল পেন্টিংটার পদপ্রান্তে।
বিমূঢ়া মাতা কিছুই বুঝিতে না পারি ব্যথিত মনে দাঁড়াইয়া রহিলেন। স্নেহময় পিতা ছুটিয়া আসিয়া হাজার প্রশ্নে তপতীকে বিভ্রান্ত করিতে চাহিলেন–কিন্তু তপতীর মুখ হইতে শুধু একটিমাত্র কথাই বাহির হইল,–ও আর আসবে না মা, আসবে না…।
দিনের পর দিন করিয়া দীর্ঘ দুইমাস অতীত হইয়া গেল, না আসিল তপন, না-বা তাহার চিঠি। প্রতীক্ষমান তপতী ম্লান হইতে ম্লানতরা হইয়া উঠিয়াছে। বিশুষ্কা বিবর্ণা হইয়া উঠিয়াছে তাহার রক্তাভ কপোলতল। তপতী আশা ছাড়িয়া দিয়াছে তপনের, মিঃ চ্যাটার্জীও আর আশা করেন না, কিন্তু তপতীর মা এখনও আশায় বুক বাঁধিয়া আছেন—তপন তাহার ফিরিয়া আসিবে। এমন ছেলে, হৃদয়ে যাহার অতখানি কোমলতা, সে কি তাহার বিবাহিত পত্নীকে ত্যাগ করিতে পারে! নিশ্চয় ফিরিয়া আসিবে। হয়তো কোনো বিপাকে পড়িয়াছে। হয়তো অসুস্থ হইয়াছে—হয়তো…না, মা আর অধিক ভাবিতে পারেন না।
তপতীকে প্রশ্ন করা বৃথা; সে কাদে না পর্যন্ত, উদাসদৃষ্টিতে মাঠের দিকে চাহিয়া থাকে। বাবা একদিন ডাকিয়া বলিলেন,—চল্ খুকী পূজার বন্ধে শিলং যাই, নুতন বাড়িটা দেখসনি তুই–!
তড়িতাহতের মতো তপতী চমকিয়া উঠিল। ঐ বাড়িতে তাদের মধুচন্দ্রিমা যাপনেব কথা ছিল। নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাস কি?
বুদ্ধিমতী তপতী বুঝিতে পারিয়াছে, পিতামাতার হৃদয়ে যে কী দারুণ শেল বিধিয়াইছে। তপন তো যাইত না তপতী যে তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছে, একথা কেমন করিয়া সে বলিবে! শত অপমান সহ্য করিয়াও তপন যায় নাই, গিয়াছে নিতান্ত নিরূপায় হইয়া। কিন্তু যেদিন সে গেল, সেদিন তো তপতী তাহাকে চাহিয়াছিল। তপনের মতো আশ্চর্য বুদ্ধিমান ছেলে কেন সে কথা বুঝিল না!
চিন্তার কুল-কিনারা নাই। কলেজ হইতে ফিরিয়া সেই-যে তপতী ঘরে ঢোকে, আবার বাহির হয় রাত্রে খাইবার সময়। বেড়াইতে যাওয়া বন্ধ করিয়াছে, কাহারও সহিত কথা পর্যন্ত বলিতে চাহেনা। মা সেদিন বহু কষ্টে তাহাকে বাহির করিয়া লেকে বেড়াইতে লইয়া গেলেন। তপতী জলের ধারে গিয়া বসিতে যাইতেছে, হাসির শব্দে চাহিয়া দেখিল, শিখা এবং মীরা বসিয়া আছে অদূরে একটা বেঞ্চে। তপতী ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিল মীরাই বটে। মাকে বলিল, ঐ শিখার কাছে বসে রয়েছে, মা ওর বোন।–মাতা সাগ্রহে বলিলেন,–আয় তবে দেখি—আয় শীগগীর-মা তপতীকে টানিতেছেন। কিন্তু তপতীর ভয় করিতেছে। যদি মার সম্মুখেই মীরা তাহাকে অপমান করে! করিবেই তো! তপতী যাইতে চাহিতেছে না। মা কিন্তু টানিয়া লইয়া গেলেন। তপতী ধীরে ধীরে করুণ কণ্ঠে ডাকিল শিখা? উভয়েই চকিত চাহিল। শিখা দৃষ্টি নত করিয়া বলিল—আয় বোস।–মীরা কিন্তু উঠিয়া দাঁড়াইল। মা বলিলেন,–তুমি তপনের বোন? তোমার দাদার খবর…
–তার তত আর কিছু দরকার নেই। মেয়ের বিয়ে দিন-গে আবার। দাদা এসে মুক্তিপত্রটা রেজেষ্টারী করে দেবেন, যেদিন বলবেন আপনারা।
মা একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন,–সেকি কথা মা! কী বলছো তুমি?
অত্যন্ত জোরে হাসিয়া উঠিল মীরা, কহিল—আপনার খেলুড়ে মেয়ে বুঝি কিছুই বলেনি আপনাকে। বেশ, বেশ, আমি বলে দিচ্ছি। আপনার মেয়ে আমার দাদার কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছে—স্থির চিত্তেই—যাকে বলে কুল ব্রেনে। দীর্ঘ সাতমাস ধরে দাদা তাকে ভাববার সময় দিয়েছিল আর সেই সাতমাস আপনার গুণবতী কন্যা আমার দেবতার মতো দাদাকে নিজে অপমান করেছে, বন্ধু দিয়ে অপমান করিয়েছে, শেষকালে একজন বন্ধুর কোলে শুয়ে দাদার কাছে চেয়ে নিয়েছে মুক্তি। যান, এখন সেই বন্ধুটিকে কিম্বা যাকে ইচ্ছে জামাই করুন গিয়ে।—মীরা খানিকটা দূরে চলিয়া গেল। শিখা নির্নিমেষ নেত্রে চাহিয়া আছে তপতীর দেহের সমস্ত রক্ত যেন শ্বেতবর্ণ ধারণ করিতেছে। মার কিছুক্ষণ সময় লাগিল সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিতে, কিন্তু তপতীর এই দুই মাসের আচরণ তাহাকে চকিত করিয়া দিল—ইহা সত্য, অতিরঞ্জন নহে।
–খুকী!—মা ডাকিলেন। তপতী সাড়া দিতে পারিতেছে না।—এমন সর্বনাশ তুই করেছিস, খুকী? বল—উত্তর দে।—তপতী কাঁপিতেছিল শিখা তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। অস্থির হইয়া মা মীরাকে গিয়া ধরিলেন,তোমার দাদা কি ফিরেছে, মা।
-না, ফিরতে দেরী আছে। কিন্তু তার ফেরায় আপনার আর কী কাজ? আমার দাদা আপনার মেয়ের মোগ্যপাত্র নয়; যোগ্যপাত্র দেখুন গিয়ে–
কী কথা বলিবেন, মা খুঁজিয়া পাইতেছেন না। মীরাকে এতটুকু চটানো তার ইচ্ছা নয়। অত্যন্ত সাবধানে তিনি বলিলেন,–মুক্তি চাইলেই কি হয় মা? আমরা ওকে তপনের হাতে দিয়েছি—ও ছেলেমানুষ—যদিই-বা–
মীরা আবার সজোরে হাসিয়া উঠিল,–ছেলেমানুষ! বেশ মা, আপনার ছেলেমানুষ খুকীকে জিজ্ঞাসা করুন তো, রাত বারটার সময় ক্যাসানোভায় বসে জনৈক বন্ধুর সঙ্গে ধর্মান্তর গ্রহণ করার মতলব আঁটা কোনদেশী ছেলেমানুষী?
তপতী রুদ্ধশ্বাসে মীরার কথা শুনিতেছিল; সরোষে কহিল,–মিথ্যা।
–চুপ কর শয়তানী। আজন্ম সত্যসিদ্ধ তপনের বোন শ্রীমতী মীরা কোনকালে মিথ্যে বলে না। ডাইরীতে তারিখ অবধি লিখে রেখেছি, তোদের দুজনের ফটো পর্যন্ত ভোলা হয়ে গেছে। আর চাস্ প্রমাণ।
মা বুঝিলেন, তপতী বহু দূর আগাইয়া গিয়াছে। তপতী করুণকণ্ঠে কহিল,–প্ল্যানটা আমার নয়, মা, মিঃ ব্যানার্জি বলেছিলেন একদিন–
–বেশ! রাজী হোন-গে এবার–মীরা আরো খানিকটা চলিয়া গেল।
মা মীরাকে কোনরূপে একবার তপতীর বাবার নিকট লইয়া যাইবার জন্য হাত ধরিয়া বলিলেন,–তুমি একবার আমার বাড়ি চলো, মা, ওর বাবাকে সব কথা বলে গিয়ে–
–কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, মা, যার সঙ্গে খুশি আপনার খুকীর বিয়ে দিন-গে—
—হিন্দুমেয়ের কি দুবার বিয়ে হয়, মা?
—খুব হয়। আপনাদের আবার হিন্দুত্ব। হিন্দু, খ্রীষ্টান, মুসলমান—আপনারা কিছু নন।
–যাবে না, মা একবার? চলো–লক্ষ্মী মেয়ে আমার, চলো!
—যেতে পারবো না-মাপ করবেন। যে বাড়িতে আমার দাদার অসম্মান হয়, সে বাড়ির ছায়াও আমি মাড়াইনে।
–তোমার দাদা তাহলে নিশ্চয় ফিরবে না?
—আমার দাদা আপনার ধন-দৌলতের প্রত্যাশী নয়। আপনার সঙ্গে আর কী সম্পর্ক অর?
ক্রোধে অকস্মাৎ তপতী জ্ঞানহারা হইয়া উঠিল। এই ভণ্ডামী তাহার অসহ্য। বলিল—দুলাখ টাকা বুঝি খোলামকুচি? সেটা গ্রহণ করতে তত বাধেনি?
হাসিতে মীরা ফাটিয়া যাইবে কেন! হাসি থামিলে-বলিল—ঐ দুলাখ টাকা আপনার দ্বিতীয় বিয়েতে যৌতুক দিয়ে আসবো গিয়ে।
শিখা স্নানকণ্ঠে কহিল,—ছিঃ তপি, টাকার কথাটা তুলতে পোর লজ্জা করলো না?
মীরা গিয়ে গাড়ীতে উঠিয়া ডাকিল-আয় রে শিখা? শিখাও চলিয়া যাইতেছে! মা ছুটিয়া আসিয়া তপতীকে কহিলেন,–তুই নিজে একবার ডাক, খুকী! যন্ত্রচালিতের মতো তপতী গিয়া মীরার হাত ধরিল; বলিল—আসুন—চলুন আমাদের ওখানে
সরোষে মীরা গর্জন করিয়া উঠিল, ছেড়ে দিন। আপনাকে ছুঁলে গঙ্গা নাইতে হয়। অকস্মাৎ ক্রোধে তপতীর আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল। কী এমন সে করিয়াছে যাহাতে তাহাকে ছুঁলে গঙ্গানাইতে হইবে?
সক্রোধে সে বলিয়া উঠিল,—যান যান, আপনার দাদা না এলেও আমার চলবে। গাড়ীটায় স্টার্ট দিয়া স্টিয়ারিংটা ধরিয়া মীরা অত্যন্ত সহজ সুরে কহিল,–তাই চলুক–
তোমার যে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়
ভালো-মন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিয়ো তুমি বলি!…
মীরা কি তাহাকে আশীর্বাদ করিয়া যাইতেছে! তাহার শান্ত কণ্ঠস্বর তপতীকে অভিভূত করিয়া দিল। এই অত্যন্ত কোপন স্বভাবা মেয়েটি এত সহজে তাহাকে কবিতা বলিয়া আশীর্বাদ করিতে পারে। মীরার হাতটা পুনরায় ধরিতে গিয়া তপতী বলিল,–যাবেন না একবার?
হাতটা সরাইয়া গাড়ীখানা চালাইয়া দিতে দিতে মারা কহিল,—না, এখনও আমার সময় হয়নি। সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে!
শিখা ও মীরা এক গাড়ীতেই চলিয়া গেল। মা তপতীর সঙ্গে কথা বলিতেও বিরক্তি বোধ করিতেছেন আজ। কী ভয়ানক কাণ্ড তপতী করিয়াছে, অথচ কিছুই তাহারা জানেন। তপতী আসিয়া গাড়ীতে উঠিয়া এককোণে বসিল। মা বুঝিলেন, কথা সে আর কহিবে। বাড়ি যাইবার জন্য তিনিও গাড়ীতে উঠিলেন।
গাড়ীতে যাইতে যাইতে শিখা কহিল,—তপতী কিন্তু একেবারে বদলে গেছে, মীরা বড্ড রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা।
একটুও বদলায়নি। তুই জানিস কচু। ও মেয়ে অত শীগ্গীর বদলাবে!
-কিন্তু যদি সত্যি বদলায়, তাহলে কি দাদা নেবে ওকে আবার?–না সে অসম্ভব। ও অন্য কাউকে বিয়ে করলেই আমাদের ভালো হয়।
শিখা চুপ করিয়া রহিল। কিছুক্ষণ পরে পুনরায় কহিল, দাদা যে নীল গোলাপ ফুটালো—যার জন্য কৃষি-প্রদর্শনী ওকে প্রথম পুরস্কার দিয়েছে, সে গোলাপের নাম নীল গোলাপ কেন দিল জানি?
–না ভাই, জানি না তো!মীরা চাহিল শিখার দিকে।
–তপতীর মার নাম নীলা ওঁর নামটা দাদা অমর করে দিল।
–ওঃ! দাদা একদিন বলেছিল,–শাশুড়ীর স্নেহঋণ কি দিয়ে শুধবো, মীরা—তাই চাষ করতে আরম্ভ করেছি। তাই বুঝি নীল গোলাপ।
উভয়েই চুপ করিয়া রহিল কিছুক্ষণ। মীরাই কথা কহিল,—পুরস্কারের টাকাটা দাদা বোটানী শিক্ষায় দান করেছে।
–আমাকে লিখেছে চিঠিতে। কিন্তু বিদেশে দাদা আর কতদিন থাকবে রে?
–কাজ হয়ে গেছে। এবার ফিরবে, এই মাসেই; দুজনে একসঙ্গে দেশে যাবো।
মীরার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইতে গিয়া করুণ হইয়া গেল। বলিল, ঐ হতভাগীটাও যেতে পারতো। শিখা, আজ ঠাট্টা করে উড়াই সখী, নিজের কথাটাই! …কেঁদে কি করবো বল? আমার কতদিনের সাধ, দাদা গল্প বলবে, তার ডানদিকে থাকবো আমি বাঁদিকে বৌদিদি-দুজনায় ঝগড়া করবো আবার ভাব করব!…সুদীর্ঘ নিঃশ্বাসটা মীরা আর চাপিতে পারিল না।
শিখার দুই চোখে জল টলমল করিতেছে। মুছিয়া আস্তে কহিল,—বিয়ের সময় আমি থাকলে এমনটা হোত না। ওর বন্ধুগুলোই ওকে ভুলপথে চালিয়েছে তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। কিন্তু আমার আশা ছিল, ওর মা ওকে সামলে নেবেন।
—ছন্নমতিকে কেউ সামলাতে পারে না, শিখা। ওর পতন বোধহয় বিয়ের পূর্বেই হয়েছে-ও আর পবিত্র নেই, মনে হয়।
–আমি কিন্তু তা মনে করিনে, মীরা! ওর বাল্যজীবন বড় সুন্দর। আর ও বন্ধুদের কেবল খেলিয়ে নিয়ে বেড়াতো। কেউ ওর মন কোনদিন এতটুকুও টানতে পারেনি। আজও যে ও কাউকে ভালবাসে তা বিশ্বাস হয় না…হয়তো সে…
বাধা দিয়ে মীরা বলিল,–তাতে ক্ষতি বেশী আমাদের। ও বিয়ে না করলে দাদা শাস্তি পাবে না। দাদা ওকে নেবে না, এ সূর্যের মতো সত্য—ভালবেসে ও মরে গেলেও নয়। দাদার সত্য কিছুর জন্য ভাঙে না, শিখা, একথা তুই-ও তো জেনেছিস।
—হুঁ, বলিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর ধীর কণ্ঠে কহিল,—দাদা মুক্তিটা দিলেই পারতো। অত শীগগীর কেন দিল ভাই?
—তুই বন্ধুর দিকটা বেশী মমতায় দেখছি শিখা, দাদার দিকটা তেমনি দ্যা দেখি। মিঃ ব্যানার্জির কোলে মাথা রেখে সে দাদাকে বুঝিয়ে দিয়েছে মুক্তিই সে চায়, দাদাকে চায় না। সেদিনের সে-চাওয়ায় তার কোনো ছলনা ছিল না। ছিল সত্য, সহজ চাওয়া।
–কিন্তু আজ সে আবার দাদাকে চাইছে কেন? ভালবাসছে বলেই তো।
—ও প্রেম অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, শিখা! দাদা চলে যাওয়ায় ওর নারী গর্বে আঘাত লেগেছে। দাদাকে ও বশ করতে পারলো না বলেই এই আকুতি ওর: তুই এত পড়াশুনা করেছিস এসব কিছু বুঝিস নে। উপেক্ষা সইতে পারে না নারী-হৃদয়। দাদাকে পেলে ও আবার অপমান করবে।
—কিন্তু এবার বিরহের আগুনে খাঁটি হয়ে ও দাদাকে সত্যি ভালবাসতে পারে তো?
—সেদিন যেন না আসে, শিখা, সে-কামনা আর করিস নে। ও যাক।
শিখা চুপ করিয়া গেল। তপতীর অদৃষ্টের নির্মমতা তাহাকে অত্যন্ত বিমনা করিয়া তুলিছে! তপনের জন্যও মন কাঁদে, কিন্তু তপন অসাধারণ শক্তিমান মানুষ, সমস্ত দুঃখ সে সহ্য করিতে পারিবে; কিন্তু তপতী—যদি সত্যিই সে তপনকে আবার ভালবাসে তবে তাহার জীবন দুঃখের অমানিশার চেয়ে কালো।
–বিনুদার খবর কি রে? কত গরু হলো তোর গোয়ালে?…মীরা প্রশ্ন করিল।
—তা হাজারখানেক। আমি রোজই যাই ওঁর সঙ্গে দমদম। আজ তুই আসবি বলে গেলাম না।
-দুজনেই তোরা অত গরুর যত্ন করিস্! দুধটা কি করিস ভাই :
-যত্ন করবার লোক রয়েছে। দুধটা বিক্রী করা হয়, এক-চতুর্থাংশ বিলি করা হয় শিশু আর রোগীদের। গোবরে হয় দাদার চাষ-বাড়ির সার। খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না বলে দুধের চাষ করা, ভাই! দেশের লোক দুধ খেয়ে বাঁচুক।
আমার ওঁকে দাদা আদেশ করেছেন, বিনে-মাইনের স্কুল-কলেজ করতে। খরচ অবশ্য দাদার সমস্ত উপার্জন, আমাদের আয় আর দেশের বড়লোকদের তহবিল থেকে আসবে। কিন্তু পড়ানো হবে খাঁটি বৈদিক প্রথায়, আর ছাত্র হবে যাদের এক পয়সা দেবার সমর্থ নেই। আর নারী-বিভাগের কর্মী হবে তুই আর আমি। দাদার মনে কষ্ট আছে, পয়সার অভাবে কলেজে পড়তে পায়নি। তাই গরীবদের জন্যই তার স্কুল কলেজ, কোন বড়লোকের ছেলেমেয়ে সেখানে ঠাঁই পাবে না।
শিখাও কথাটার কিছু কিছু জানিত। বলিল, আরম্ভ হোক, আমরা তো আছিই।
–হয়ে গেছে আরম্ভ। শিবপুরে আমাদের যে হাজার বিঘে পতিত জমি ছিল, সেখানে পাঁচশো খোলার কুঁড়ে ঘর তৈরী হয়েছে। গেটে লেখা হয়েছে–
সবার উপর মানুষ সত্য,—তাহার উপর নাই।
মানুষের মাঝে, হে মানুষ—তুমি তোরে দিয়ো ঠাঁই।
শেষের লাইনটা অবশ্য দাদার রচনা—মীরা আপন মনে হাসিয়া উঠিল।
শিখা মীরার মনের তল পাইতেছেনা! তপতী-ভাগ্য-বিপর্যয়ে ব্যথিত শিখা মীরার হাস্য শুনিয়া কহিল,—মীরা, দাদা মহীয়ান, এ কথা তুই জানি, আমিও জানি। কিন্তু তপতীর জন্য তোর মন কি এতটুকু বিচলিত হচ্ছে না আজ?
মীরা মিনিটখানের চুপ করিয়া রহিল; তারপর বলিল,–সে কথা তোকে অনেকক্ষণ বলেছি সখী, ঠাট্টা করেই আজ ওড়াতে চাইছি আমার সেই একান্ত আপনার কথাটা!—তাহার কণ্ঠস্বরে শিখা চকিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, মীরার দুই গণ্ড অশ্রুতে প্লাবিত হইয়া গিয়াছে।
মার মনে যে আশাটুকুও ছিল, তাহা একেবারে নিভিয়া গিয়াছে। স্বামীকে সমস্ত জানাইতে তিনিও কিছুক্ষণ নির্বাক থাকিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। তপতী মা বাবার সম্মুখে আসাটা এড়াইয়া যাইতেছে। কিন্তু এমন করিয়া দিন চলা কঠিন। পূজায় কলেজ বন্ধ হইলে পিত কন্যাকে ডাকিয়া বলিলেন,–যা হবার হয়ে গেছে; তুই ভালো করে পড়াশুনা কর।
যদি নিতান্তই সে না ফেরে, তখন অন্য পথ দেখা যাবে…
তপতী চুপ করিয়া রহিল। বাবা তপনকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন, ইহা সে জানে। বাবা আবার বলিলেন,—তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে, তোর সুখের জন্য আমরা সবাই করিতে পারি, খুকী—তোর আবার বিয়ে দেব–
কথাটা বলিয়া যেন মিঃ চ্যাটার্জী চমকিয়া উঠিলেন।
তপতী এখন কোনো কথা কহিল না দেখিয়া তিনি আঙুর ফল টক এই নীতি অনুসরণ কবিবার জন্যই বোধহয়, এবং তপতীর নিকট তপনকে এখন খাটো করিবার জন্যই হয়তো বলিয়া উঠিলেন,—এতো গোঁয়ার সে জানলে কি বিয়ে দিতাম। আমারই বোকামী।
মা কথাটা কিন্তু সমর্থন করিতে পারিলেন না, নীরবেই বসিয়া রহিলেন।
—কাপড়-চোপড় গুছাইয়া তপতী শিলং যাইবার জন্য প্রস্তুত হইল। নাই যদি আসে তপন, কী সে করিতে পারে! তপনকে পাইলে হয়তো সে সুখীই হইতে পারিত, কিন্তু যদি একান্তই না পাওয়া যায় তো তপতী কি তাহার পিতামাতার বুকে শেলাঘাত করিয়া বিধবার মতো বসিয়া রহিবে! এই কয়দিন ধরিয়া তপতী বারংবার এই চিন্তাই করিয়াছে। যে লোক একটা দিনের জন্য এতটুকু রাগ দেখায় নাই, একটু প্রতিবাদমাত্র করে নাই, সে কিনা একেবারে অকস্মাৎ সমস্ত ছাড়িয়া চলিয়া গেল! তপতী ইহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না। তাহার পিতার কোটি মুদ্রা মূল্যের সম্পত্তি, তাহার অতুলনীয় রূপগুণ, তাহার মাতার এত যত্ন আদর কিছুই কি তপনকে এখানে ফিরিয়া আনিতে পারে না। থাক, ফিরিবার দরকার নাই, তপতী তাহার ভাগ্য বিধাতার উপরেই নির্ভর করিয়া চলিবে। কিছুই ভয়ঙ্কর অপরাধ তপতী করে নাই, যাহার জন্য তপন তাহাকে এমনভাবে ত্যাগ করিতে পারে। অকস্মাৎ তপতীর মনে পড়িল তপনের কথাটা—ত্যাগ মানে মুক্তি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহতে লঘিষ্ট থেকে গরীয়ানে। হ্যাঁ, মুক্তিই সে তাহাকে দিয়া গেছে। বেশ তপতী চলিয়া যাইবে।