কুষাণ সাম্রাজ্য
পহ্লবদের পরে ইউয়েহ চিহ্ন বা তুষার (তোখারিয়) নামে একটি গোষ্ঠী মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে আসে, এদের পরিচয় কুষাণ নামে। এদের আদি বাসভূমি ছিল চিনের কাছাকাছি। কুষাণরা প্রথমে ব্যাকট্রিয়া দখল করে শকদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয় ও পরে কাবুল গান্ধার হয়ে হিন্দুকুশ পার হয়ে সিলিউকিড ও পহ্লবদের তাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে সিন্ধু নদীর দক্ষিণে গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ ভূভাগ দখল করে। এরা যে অঞ্চল অধিকার করেছিল তার পরিধি অক্সাস (বেদে উল্লিখিত বক্ষু নদী) থেকে গঙ্গা ও মধ্য এশিয়া থেকে বারাণসী পর্যন্ত, আজকের পুরো পাকিস্তান ও পুরো উত্তর ভারত। এই ব্যাপ্তির ফলে একটি বৃহৎ অঞ্চলে নানা গোষ্ঠীর মানুষের পরস্পরের মধ্যে জাতিগত, ভাষাগত, শিল্পগত, সংস্কৃতিগত অন্তমিশ্রণ ঘটে, এই সমস্ত অঞ্চল জুড়ে একটি বৃহৎ সভ্যতা গড়ে ওঠে।
রাষ্ট্র
কুষাণদের দুটি রাজবংশ পরপর রাজত্ব করে। প্রথমটির নাম কাদফিসেস, এঁরা খ্রিস্টিয় ২৮] সাল থেকে ৭৮] সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। প্রথম রাজা কাদফিসেস হিন্দুকুশের দক্ষিণে তামার মুদ্রা চালু করেন। দ্বিতীয় রাজা দ্বিতীয় কাদফিসেসের সময়ে সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে ও সোনার মুদ্রার প্রচলন হয়। এই বংশের পরে অন্য একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন কণিষ্ক। এ বংশ সিন্ধুনদের দক্ষিণ অঞ্চল থেকে উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তার করেন। এঁরা বিস্তর খাঁটি সোনার মুদ্রা চালু করেন। এগুলি তৈরি হত প্রধানত পশ্চিম ভারতে ও সিন্ধুপ্রদেশে, কিন্তু মথুরা, শ্রাবস্তী, কৌশাম্বী, বারাণসী এবং অন্যত্রও এঁদের মুদ্রা পাওয়া যায়। মথুরায় পাওয়া মুদ্রাসঞ্চয় ও ভাস্কর্য থেকে মনে হয়, মথুরাই এঁদের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল; প্রথমটি ছিল পুরুষপুর অর্থাৎ পেশোয়ারে; সেখানে কণিষ্ক এক প্রকাণ্ড বৌদ্ধ স্তূপ ও একটি মঠ নির্মাণ করেন যা পাশ্চাত্য পর্যটকদেরও বিস্ময় উদ্রেক করে।
কুষাণদের সর্ব প্রধান রাজা কণিষ্ক। যদিও চিনাদের হাতে এঁর পরাজয় ঘটে তবুও ইতিহাসে এঁর প্রাধান্য দুটি কারণে। প্রথমত, এঁর সিংহাসনে আরোহণের বৎসর ৭৮] খ্রিস্টাব্দ থেকে শকাব্দ গণনা শুরু হয়; দ্বিতীয়ত, কণিষ্কের একান্ত চেষ্টায় এই বৃহৎ ভূখণ্ডে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে। কাশ্মীরে তিনি যে বৌদ্ধ মহাসভার আয়োজন করেন সেখানেই মহাযান বৌদ্ধধর্ম তা, পরিচিত রূপটি লাভ করে। কণিষ্ক নিজে শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; তাঁর আমলে সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। কণিষ্কের বংশধররা ২৩০] খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তরপশ্চিম ভারতে রাজত্ব করেন, এঁরা ততদিনে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন মিশে গেছেন যে কারও কারও ভারতীয় নামও ছিল, যেমন এঁদের এক রাজার নাম ছিল ‘বাসুদেব’। ভারতীয় সমাজ এদের ক্ষত্রিয় বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ক্ষত্রিয়, কারণ এঁরা যোদ্ধা ছিলেন।
কুষাণ সাম্রাজ্য বহু বিস্তৃত ছিল বলে নানা দেশের সংস্কৃতির উপাদান এখানে এসে মেশে। কুষাণদের নিজস্ব লিপি বা লিখিত ভাষা ছিল না বলে এখানকার লিপিই এরা ব্যবহার করত, তেমনই নিজস্ব কোনও সুসংহত ধর্ম ছিল না বলে এখানকার বিভিন্ন ধর্মের নানা উপাদান এরা গ্রহণ করে। এরা এনেছিল ঘোড়ায় চড়ার (শুধু রথে নয়) অভ্যাস এবং এরা খুব উঁচুদরের ঘোড়সওয়ার ছিল।, যুদ্ধক্ষেত্রে এরা খুব তাড়াতাড়ি যাতায়াত করতে পারত বলে যুদ্ধে এদের সামনে কেউই দাঁড়াতে পারত না। এদের পোশাক লম্বা আচকান, পায়জান।। ও টুপির প্রভাব রয়ে গেছে এখানকার উত্তরপশ্চিম ভারতের শেরওয়ানি, কামিজ ও টুপির ওপরে। এই সময়কার মাটির তৈরি বহু ঘোড়সওয়ার মূর্তি পাওয়া গেছে আফগানিস্তানের নানা অঞ্চলে। ঘোড়ায় চড়া ও তার উপযুক্ত পোশাকের জন্যে যুদ্ধে এদের চলাফেরা সহজ ছিল বলে দক্ষ ভাবে যুদ্ধ করে এরা উত্তর পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল জয় করেছিল। কুষাণরা এ দেশের জনসমাজে সম্পূর্ণ ভাবে মিশে গিয়েছিল বলে অল্পকাল পর থেকেই তাদের আর কোনও আলাদা সত্তা ছিল না।
মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক থাকায় কুষাণরা আলতাই অঞ্চলের বিস্তর সোনার খনির মালিক ছিল, রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে সেখান থেকেও প্রচুর সোনা পেত। বিখ্যাত রেশম পথটি (যে পথে বহু পূর্ব থেকে রেশম বাণিজ্য চলত) এদের দখলে ছিল। এটি চিন থেকে মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান হয়ে রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্গত পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই দীর্ঘ পথের যাত্রী বণিকদের কাছে পথকর আদায় করার ফলে এদের সমৃদ্ধি খুব বাড়ে। ভারতবর্ষের সোনার মুদ্রা প্রথম চালু করে কুষাণরা নিজেদের সমৃদ্ধির পরিচয় রেখে গেছে।
যে বিস্তৃত ভূখণ্ডে কুষাণদের সাম্রাজ্য ছিল তার অনেক অংশই আগে ছোট ছোট রাজার অধীনে ছিল; এরা পরে কুষাণদের করদ রাজ্যে (যারা খাজনা দিত) পরিণত হয়। ফলে এত বড় অঞ্চলে কোনও কেন্দ্রীয় রাজ্য সুসংহত ভাবে স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। গ্রিকরা যেমন তাদের সাম্রাজ্য ছোট ছোট অংশে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একজন রাজপ্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, কুষাণরাও সে রকম প্রত্যেক ছোট ছোট রাজ্যে দুজন করে সামন্তরাজার শাসনে রেখেছিল। ছোট ছোট অংশ ভাগ করার দরুন কেন্দ্রীয় শাসন সব রাজ্যে সমান ভাবে পৌঁছত না, দূরের প্রত্যন্ত অংশে খানিকটা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ত। কেন্দ্রের রাজধানীতে কুষাণ সম্রাট অসম্ভব জাঁকজমক ও বিলাসের জীবনযাপন করতেন। সম্রাট তখন শুধু রাজাধিরাজ ছিলেন না, তাঁকে দেবতার অংশ বলে মনে করা হত। পরেও এ দেশের রাজাকে দেবতার অংশে নির্মিত বলে শাস্ত্রকাররা ঘোষণা করেছিলেন; ‘অষ্টানাং লোকপালান মাত্রাভির্নির্মিতো নৃপঃ’, অর্থাৎ আটটি লোকপালের অংশ নিয়ে (দেবতারা) রাজাকে নির্মাণ করেন। এ ধারণা কুষাণ আমলেই প্রথম বার আসে, রাজার দেবত্ব প্রমাণের জন্যে মূর্তিতে ও চিত্রে রাজার মাথায় জ্যোতির্বলয় থাকত।
ধর্ম
কুষাণরা ভারতবর্ষে আসবার আগে কোন ধর্মে বিশ্বাস করত, কী তাদের ধর্মাচরণ ছিল তা আজ আর জানা যায় না। মৌর্যযুগের পর থেকে ভারতবর্ষে নানা দেবতাকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল, আগন্তুক বিদেশিরা এদের কোনও এক বা একাধিক দেবতা ও উপাসনা গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে গ্রিক রাষ্ট্রদূত হেলিওডোরাস মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় একটি স্তম্ভ নির্মাণ করেন, এর ওপর লিপিতে তিনি নিজেকে ‘ভাগবত’ বা বিষ্ণুভক্ত বলে বর্ণনা করেন। স্তম্ভটি বাসুদেব-কৃষ্ণের উদ্দেশে সমর্পিত। গ্রিক শাসনকর্তা মিনান্ডার বৌদ্ধমতে দীক্ষিত হন। শক-পহ্লব-কুষাণরা ভারতবর্ষের তখনকার নানা উপাসনা সম্প্রদায়ের কোনও কোনওটির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।
মৌর্যযুগের পরে ব্রাহ্মণ্যধর্মের যজ্ঞ, এবং পরে প্রতিবাদী নানা সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থান, উপনিষদীয় জ্ঞানমার্গের সাধনা, বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম এ সবই একই সঙ্গে সমাজে বর্তমান ছিল। যতদূর জানা যায়, বৈষ্ণব, সাত্বত, পাঞ্চরাত্র, শৈব, পাশুপত, লকুলীশ ও আরও বহু ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায় প্রাচীন যজ্ঞধারার বিভিন্ন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়, বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক মত ও আচরণের সঙ্গে সহাবস্থান করত। মতের পার্থক্য থাকলেও তা নিয়ে বিদ্বেষ কখনও উগ্র হয়ে ওঠেনি। বৌদ্ধ মঠ, বিহার, চৈত্য, স্তূপ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় কিছু কিছু ধ্বংস করেছিল বটে, কিন্তু এ ধ্বংস স্থানে ও কালে সীমিত ছিল। মোটামুটি ভাবে ভিন্নমত সম্বন্ধে কতকটা সহিষ্ণুতা ছিল। জিজ্ঞাসা, তর্ক, আলোচনার আবহাওয়াই ব্যাপ্ত ছিল দেশে।
জ্ঞানবিজ্ঞান
তখনও সমাজে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবই সবচেয়ে বেশি ছিল। শিক্ষিত মানুষ বেদ, বেদাঙ্গ, উপাঙ্গ, মনুসংহিতা, কণাদের বৈশেষিক দর্শন, পতঞ্জলির যোগ, মেধাতিথির ন্যায়, প্রচেতার শ্রাদ্ধতত্ত্ব— এ সবের চর্চা করত। এর থেকে বোঝা যায় বৈদিক ধর্মাচরণের সঙ্গে অনেক লৌকিক বিশ্বাস ও আচরণ ক্রমেই মিশে যাচ্ছিল; অন্য দিকে দুরূহ দার্শনিক চর্চারও সূত্রপাতও এই সময়েই বীজাকারে শুরু হয়, হয়তো সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু কিছু দর্শনসূত্রও রচিত হয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অবক্ষয়ের বেশ কিছু লক্ষণ এখনই চোখে পড়ে; নিয়তিবাদ মাথা তুলেছে সমাজে, শ্রেণিবিভাজনও বেশ স্পষ্ট। সাহিত্যে দেখি, দুঃখী মানুষও বেশ সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করে। এ সময়ে ব্যাকরণ ও অলংকার শাস্ত্রের চর্চা যে বিশেষ ভাবে চলছিল তার নজির গির্নার শিলালিপিতেই লক্ষ করা যায়; এটি অলংকৃত ধ্রুপদী সংস্কৃতে রচিত। ব্যাকরণচর্চা বহু আগেই শুরু হয়, তবুও এ যুগের সাহিত্যের মহাকাব্যের ভাষা প্রায়ই পাণিনির অনুশাসন মানে না; অশ্ব ঘোষের বুদ্ধচরিতও সৌন্দরনন্দ কাব্য দুটিতেও অপানিণীয় (অর্থাৎ পাণিনিক ব্যাকরণের নির্দেশের বাইরে) প্রয়োগ চোখে পড়ে। বেশ একটা মার্জিত কথ্য ভাষা নাটকগুলিতে পাই; এতে শিক্ষিত সমাজের কথ্য ভাষারই প্রতিফলন। মহাবিশ্ব সম্বন্ধে তখন একটা আবছা ধারণা গড়ে উঠেছে, যা বিজ্ঞানসম্মত হওয়া সম্ভব ছিল না। তবুও একটা নিটোল বুদ্ধিগ্রাহ্য রূপ তখনই তৈরি হয়ে গেছে। সমাজে শ্রেণিগুলির মধ্যে প্রচুর বৈষম্য বেড়ে চলেছে এবং নিম্নবর্গের মানুষের সমস্যার সমাধানের বিশেষ কোনও চেষ্টা শাস্ত্রে বা সাহিত্যে চোখে পড়ে না। ভাসের অবিমারক নাটকে দেখি কুসংস্কার ও জাতিভেদ প্রেমের মিলনে বাধা। সমাজের এ সব অসঙ্গতির প্রতিবাদ যদি নিচু জাত ও গরিব মানুষ করেও থাকে, তার কোনও চিহ্ন বিশেষ কোথাও নেই। জন্মান্তরবাদ ও কর্মবাদ এ ধরনের প্রতিবাদকে ঠেকাবার দুটি মারাত্মক অস্ত্র। বৈপরীত্য এ যুগের এক বড় বৈশিষ্ট্য।
এই সময়ে বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে বিশেষ উন্নতি দেখা যায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের বিকাশ এই সময়েই প্রথম ঘটে। যজ্ঞের জন্যে ঋতুর পরিবর্তন ও গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান আগেই জ্যোতির্বিদরা লক্ষ করতেন এবং সেই অনুসারে যজ্ঞের তিথি ঠিক করতেন। সংস্কৃত জ্যোতিষের পরিভাষায় কিছু কিছু গ্রিক প্রভাব যেমন দেখা যায়, তেমনই ভারতীয় ‘হোরাশাস্ত্র’ (জ্যোতিষ) থেকে গ্রিক ‘হরস্কোপ’ শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। কিছু গ্রিক মুদ্রায় ভারতীয় অতিকথা— মিথ— (প্রধানত দেবকাহিনি) থেকে কাহিনি চিত্রিত হয়েছে। গ্রিসের সঙ্গে ভারতবর্ষের যে-বাণিজ্য ছিল তাতে গ্রিকরা গাভী, কুকুর, মশাল, হাতির দাঁতের জিনিস এখান থেকে রফতানি করত। চিকিৎসাশাস্ত্রে ভারতবর্ষ স্বনির্ভর ছিল; চরকসংহিতা-য় রোগনির্ণয়, শবব্যবচ্ছেদ, ভেষজনির্বাচন এবং নানা ধরনের ওষুধ ও পথ্য তৈরির প্রক্রিয়া বিশদ ভাবে আলোচনা করা আছে। চরকের দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ বৈদ্যের মতো বৈজ্ঞানিক। রসায়নবিদ্যায় প্রাচীন ভারত যে কত অগ্রসর ছিল তার বিশেষ প্রমাণ আছে চরকসংহিতা-য়। ওষধি, ধাতু ও নানা প্রাকৃতিক দ্রব্য নিয়ে ওষুধ তৈরি হত। সুশ্রুত ছিলেন শল্যচিকিৎসক, সুশ্রুতসংহিতা-য় বিভিন্ন রোগে অস্ত্রচিকিৎসার বিধান ও নির্দেশ দেওয়া আছে, আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরির প্রণালী বলা আছে।
বিদেশি প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা দলগুলির সঙ্গে বাণিজ্য ও সামাজিক সম্পর্কের ফলে ভারতবর্ষ নানা নতুন প্রযুক্তির চর্চা শুরু করে, সম্ভবত, জুতোর জন্যে চর্মশিল্প তার মধ্যে একটি। কণিষ্ক’র জুতো-পরা মূর্তি থেকে অনুমান করা হয় যে এই সময়ে পাদুকা বা চটি ছাড়া জুতোও পরা হত। ধাতু গলিয়ে নানা উন্নতমানের শিল্প দ্রব্যও তৈরি হত। কাচ তৈরির কৃৎকৌশলও সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশের প্রভাব এসেছিল। কাচের বাসন, পুঁতি ও অলংকার তখন প্রচুর পরিমাণে তৈরি হত। রোমের সম্রাট অগাস্টাসের সময়ে (২৭-২৮] খ্রিস্টাব্দে) ও সম্রাট ট্রাজানের দরবারে (১১০-২০] খ্রিস্টাব্দে) ভারতীয় রাজদূত গিয়েছিল। ভারতীয় মনীষা রোমের উন্নত প্রযুক্তি ও রোম মারফৎ গ্রিসের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার সংস্পর্শে আসে। সব দেশেই সমাজের অবসংগঠন (infrastructure) নির্মাণে, কারিগরি বিদ্যার চর্চায় সমাজের মূল কাঠামোকে ধরে রাখার জন্যে চেষ্টা চলে, তারই ওপরে নির্ভর করে সমাজের প্রাথমিক শ্রীবৃদ্ধি। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান অবসংগঠনকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। এই উন্নতির মানের ওপরে অনেকটাই নির্ভর করে চিন্তা ও শিল্পের উন্নতি; সেগুলো কোনও নির্বাত মণ্ডলে সৃষ্টি হয় না। শিল্পীর ব্যক্তিগত প্রেরণা ও শক্তির মূল অবশ্যই আছে, কিন্তু শিল্পীর জীবনযাপনের পরিবেশের ওপরে তার সৃষ্টিশীলতা অনেকটাই নির্ভর করে। সমস্ত সমাজের চিন্তা, উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিল্পসাহিত্যের যে অধিসংগঠন (superstructure) তার মান পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই অবসংগঠন (infrastructure)-এর সঙ্গে আনুপাতিক, যদিও সমান্তরাল নয়। এই অবসংগঠনে যেমন, অধিসংগঠনেও তেমনই ভারতবর্ষ বারেবারেই বিদেশি প্রভাব আত্মস্থ করেছে। ভারতীয় সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিদেশের বাণিজ্যিক আমদানির এবং চিন্তা ও সৃষ্টিগত আমদানির বিস্তর প্রভাব রয়েছে। সব দেশেই এ ধরনের আদানপ্রদানের দ্বন্দ্বসংঘাতে চিন্তা ও সৃষ্টির উন্নতিই হয়। যতদিন ভারতবর্ষ বাইরে থেকে এ সব নিতে পেরেছে ততদিন সে নতুন নতুন সৃষ্টির দ্বারা বহির্জগৎকে দিতেও পেরেছে। যে দিন দ্বৈপায়ন কুনো মনোবৃত্তির ফলে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিল, সে দিন থেকে পৃথিবীকে কিছু দেওয়ার সামর্থ্যও তার সংকুচিত হয়ে এল।
মৌর্য যুগের পরে কৃষি বাণিজ্য, কারখানা ও কুটিরশিল্প হঠাৎ অনেকটা বেড়ে ওঠায় ব্যবসায়ীদের হাতে অর্থ, অতএব ক্ষমতাও জমে ওঠে। তারা মঠে মন্দিরে অর্থ সাহায্য করে। ব্রাহ্মণ শ্রমণকে জমি, টাকা ও অন্যান্য জিনিস দান করতে থাকে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে বৌদ্ধধর্মে। বুদ্ধের নির্দেশে সন্ন্যাসীদের সাদাসিধে জীবনযাপন করার কথা, তাই করছিলও তারা। কিন্তু হঠাৎ-ধনী বৈশ্যদের এবং কোনও কোনও রাজার দানে সন্ন্যাসীরা অশনে-বসনে শৌখিন হয়ে ওঠে, আরামে থাকার অভ্যাস মঠেও দেখা দিল। সন্ন্যাসীদের জীবনযাত্রার নীতি শিথিল হতে লাগল, ভোগের প্রবণতা বেড়ে উঠল, গৃহীর সঙ্গে পার্থক্য কমে গেল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে বুদ্ধ পথিকৃৎ থেকে দেবতা হয়ে উঠলেন। আগে বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হত প্রতীকী চিহ্নে— যেমন ছত্র, পদচিহ্ন, পাদপদ্ম, ধর্মচক্র, ইত্যাদি। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ফলে বুদ্ধের মূর্তি নির্মিত হতে লাগল এবং রীতিমতো পূজা শুরু হয়ে গেল। এই সময়ে বৌদ্ধরা দুটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে গেল। যারা আগের মতো চলতে চাইল, পরবর্তীকালের পরিবর্তিত জীবনধারার অনুগামীরা তাদের মতের নাম দিল হীনযান, নিজেদের মতকে বলল, মহাযান। মহাযানে বুদ্ধ আর সন্ন্যাসী রইলেন না, হলেন দেবতা, রাজপুত্র অথবা রাজা। ভক্তদের আরাধনায় সন্ন্যাসের সঙ্গে জুড়ল বুদ্ধপুজা, নানা জাঁকজমক। অন্ধ্রে নাগার্জুনকোণ্ডার বৌদ্ধবিহারগুলিতে প্রচুর মুদ্রা পাওয়া গেছে, অন্যান্য মহাযান বিহারেও নানা শৌখিন জিনিস ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। কণিষ্ক বৌদ্ধদের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, অগাধ ধনী এই রাজা দু’ হাতে অর্থ, জমি দান করেন মঠ, বিহার, চৈত্য, ও সঙ্ঘারাম নির্মাণের জন্যে। কাশ্মীরে কণিষ্ক যে বৌদ্ধ মহাসভা আহ্বান করেন সেখানে মূল বৌদ্ধগ্রন্থ ত্রিপিটক (সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম— এই তিনটি) তিন লক্ষ শব্দে সংকলিত হয়। সেগুলি নাকি লাল তামার পাতে খোদাই করে পাথরের সিন্দুকে রেখে তার ওপরে একটি স্তূপ গেঁধে দেওয়া হয়।
শিল্প সাহিত্য
কুষাণ রাজারা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে অনেক ভাস্কর, স্থপতি ও অন্যান্য শিল্পী এ দেশে আনিয়েছিলেন। এঁদের সংস্রবে ভারতীয় শিল্পে তিনটি মুখ্য ধারার সৃষ্টি হল: মধ্য এশীয়, গান্ধার ও মথুরা। বৌদ্ধ প্রভাব মধ্য এশিয়াতে বেশি ছিল, সেখানে পাওয়া কিছু কিছু শিল্পকৃতির মধ্যে ভারতীয় ও মধ্য এশীয় আঙ্গিকের সংমিশ্রণ বেশ বোঝা যায়। গান্ধারে প্রধানত গ্রিক প্রভাবে রচিত ভারতীয় ভাস্কর্য দেখা যায়। বুদ্ধমূর্তিতে এই প্রভাবের ফলে কোঁকড়া চুলের বিন্যাস, মুখে গোঁফ, কাপড়ে পরতে-পরতে ভাঁজ— এ সবই ভারতীয় শিল্পে নতুন। এই প্রভাব মথুরা শিল্পরীতিতেও দেখা যায়, তবু মথুরায় ভারতীয় স্বকীয়তা সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট। লাল বেলেপাথরে বুদ্ধ ছাড়াও মহাবীরের মূর্তিও এখানে গড়া হত। আর পাওয়া গেছে কণিষ্কের মুণ্ডহীন মূর্তি, তার নিচে কণিষ্কের পরিচয় দেওয়া আছে। মথুরা কৃষ্ণকাহিনির পীঠস্থান, তবু ওই সময়ের কৃষ্ণের কোনও মূর্তি এখানে পাওয়া যায়নি। খ্রিস্টিয় প্রথম তিনটি শতকেই মথুরা শিল্পের বিকাশ। মথুরা রীতির শিল্প নিদর্শন মথুরার বাইরেও অনেক জায়গায় পাওয়া যায়, বোঝা যায় ওই ধরনের ভাস্কর্যের চাহিদা ও সমাদর ছিল। অন্ধ্রে ও মহারাষ্ট্রে নাগার্জুনকোণ্ডা ও অমরাবতীতে যে বৌদ্ধ শিল্পের স্বতন্ত্র কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় ওই সব জায়গা থেকে পাওয়া শিল্পকর্মে। আর্যাবর্তে বৌদ্ধ শিল্পকলার সমধিক বিকাশ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাঁচি। ভারহুত ও বুদ্ধগয়ার বিস্তৃত স্তূপ, প্রাচীন তোরণ ও মঠের নির্মাণে সমকালীন জীবনযাত্রাও সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়ে রয়েছে।
শুধু স্থাপত্যে ভাস্কর্যে নয়, সংস্কৃত সাহিত্যেও এ যুগের শিল্পের উৎকর্ষ দেখা যায়। নাট্যকার ভাস তেরোটি নাটক রচনা করেন, সংস্কৃতে এগুলিই প্রথম নাটক। ভাব, ভাষা, অলংকার ও রচনার উৎকর্ষে ভাসের নাটকগুলি খুবই উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধ অশ্বঘোষের রচনা বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরনন্দ কাব্য দুটি প্রথম ধ্রুপদী রীতির কাব্য। এ ছাড়া অশ্বঘোষের দুটি খণ্ড নাট্য পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটির প্রভাব পরবর্তী সাহিত্যে বিশেষ লক্ষণীয়। ভাস ও অশ্বঘোষে তখনকার, সমাজচিত্রও রয়ে গেছে।
মহাযানের বিপুল ‘অবদান’ সাহিত্য মহাবস্তু এবং ‘দিব্যাবদান’ মিশ্র বৌদ্ধ সংস্কৃতে (অর্থাৎ সংস্কৃত, পালি ও আঞ্চলিক প্রাকৃতে নির্মিত এক ভাষায়) রচিত। কিছু পরে ললিতবিস্তার শুদ্ধ সংস্কৃতে রচিত, এ গুলিতে সে যুগের ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যের চেয়েও বেশি করে সমাজ প্রতিফলিত। গরিব দুঃখী খেটে-খাওয়া মানুষ, দাসদাসী, –এদের সুখদুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নসাধনা খুব স্পষ্ট করে আঁকা এ সাহিত্যে। এ যুগ থেকে মানুষ শিল্প সাহিত্যে ও ভাস্কর্যে জীবনের অভিজ্ঞতার চিত্র এঁকে চলল।
প্রথমে যজ্ঞকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্য পরে বৌদ্ধ জৈন, ইত্যাদি প্রতিবাদী ধর্মের অভ্যুত্থান হয়; আরও পরে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের বিলোপের পরে যবন-পহ্লব আক্রমণের পরে কুষাণরা যখন বৃহৎ ভূখণ্ডে দীর্ঘকাল যাবৎ রাজত্ব করে তখন বহু অভারতীয় অব্রাহ্মণ্য চিন্তা-আচরণ ভারতবর্ষে আসে। জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম সম্বন্ধে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। এ সময়ে নানা ধরনের ধর্ম একই সঙ্গে ভারতবর্ষে ছিল; তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল; প্রত্যেকেই নিজের মতকে যাচাই করে দিচ্ছিল। ফলে পরস্পরের প্রভাবে মতগুলিও একটু আধটু বদলাচ্ছিল। এমন একটা অবস্থাতেই ধর্ম সম্বন্ধে নতুন দিগদর্শন করায় ভৃগুবংশের কিছু শাস্ত্রকার যাঁদের রচনাই মহাভারতের শেষতম প্রক্ষেপ (অর্থাৎ পরবর্তী সংযোজন)। ধীরে ধীরে এঁদের মতই প্রবল হতে থাকে এবং অভি-পৌরাণিক একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয় যার বর্তমান নাম ‘হিন্দু’, তখন অবশ্য এ নাম ছিল না। তবে ওই সময়ে— যেমন— এখনও, নানা পরস্পর-বিরোধী পরস্পর-পরিপূরক মত একই সঙ্গে সমাজে বর্তমান ছিল।
মহাভারতও রামায়ণ-এর রচনা বেদাঙ্গ রচনার যুগেই শুরু হয়; রামায়ণ সম্ভবত আগেই, খ্রিস্টিয় তৃতীয় (বা চতুর্থ) শতকে শেষ হয়, মহাভারত আরও শ’ দেড়েক বছর পরে। এই সময়ে এই রচনাগুলি বিশেষ এক ধরনের জীবনবোধ প্রকাশ করছিল যা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মে অনুপ্রবিষ্ট হয়। আগেকার কিছু গৌণ দেবদেবী এখন মুখ্য হয়ে উঠল, আবার আগেকার বেশ কিছু প্রধান দেবদেবী গৌণ হয়ে গেল। আঞ্চলিক কিছু নতুন দেবদেবী দেবমণ্ডলীতে স্থান পেল। যজ্ঞ তো চলছিলই, পাশাপাশি পূজাও। ওঝাদের তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, কবচ-মাদুলি, মানত, তীৰ্থ, দানধ্যান, জপতপ— এ সব নতুন করে প্রাধান্য পেল। এদের মধ্যে শুধু ভারতবর্ষে নির্মিত ধর্মবোধই নয়, তারই সঙ্গে মিশেছিল গ্রিক, পহ্লব, শক, কুষাণ, প্রভৃতি আগন্তুক আক্রমণকারীদের ধর্মচিন্তা ও অনুষ্ঠানের পদ্ধতিও। আগন্তুকরা নিঃশেষে জনসমাজে মিশে যাওয়ার ফলে আর আলাদা করে কোনও তন্তুকে বের করা যাবে না, কিন্তু এদের চিন্তা আচরণ যে ভারতীয় ধর্মধারার একটি উপাদান তা অস্বীকার করা যায় না। যজ্ঞ থেকে ঝাড়ফুঁক, তীর্থমানত অনেকটা পথ: এর মধ্যে কোথায় যে আগন্তুকের ধর্মচেতনার কতটা প্রভাব ফেলেছে তা আজ নিশ্চিত ভাবে নির্ণয় কে করবে? কিন্তু এই সব অযজ্ঞীয় বিশ্বাস-আচরণ নিশ্চয়ই বেশ কিছুকাল ধরেই সমাজচেতনায় সুপ্ত ছিল, তাই এক সময়ে এ ভাবে এদের প্রত্যক্ষ করা গেল। প্রগার্য ও আর্যদের মধ্যে বেশ কিছুকাল ধরেই কিছু মানুষ জাদুর চর্চা করে এসেছে, শাস্ত্রে সেগুলির জায়গা হয়নি, কিন্তু জীবনে তা আচরিত হত। বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যখন ক্ষীণ হয়ে এল তখন আবার প্রকাশ্যেই তার চর্চা হতে লাগল। রামায়ণ-এর প্রক্ষিপ্ত অংশে, অর্থাৎ আদি ও উত্তরকাণ্ডে এবং মহাভারত-এর শেষতম ভার্গব প্রক্ষেপে এ সব আবার প্রাধান্য পেল। দুটি মহাকাব্যেই তাই তীর্থস্থানের তালিকা আছে। তীর্থে স্নান, দান-দক্ষিণা, জপ-তপ, ধ্যান এ সব বেশ স্পষ্ট ভাবেই আলোচিত ও বর্ণিত হয়েছে। এ ধর্মের এক প্রান্তে যজ্ঞ, যা তখন বেশ অপ্রচলিত হয়ে আসছে; অন্য প্রান্তে পূজা, যা তখনও সর্বত্র চলিত হয়নি, কিন্তু হওয়ার মুখে। এ ধর্মের ওপরে অভিঘাত আসছে জ্ঞানকাণ্ডের নানা প্রস্থান, উপনিষদ, বৌদ্ধজৈনধর্মের মোক্ষ ও নির্বাণতত্ত্ব থেকে; এবং এ ধর্মের বড় একটি উপাদান হল লোকায়ত ধর্ম যা অন্তত তিন হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে অন্তঃস্রোতা ভাবে কিন্তু একটানাই আচরিত হচ্ছিল। এর কোনও সংহত শাস্ত্র ছিল, কিন্তু এবার রামায়ণ-এর ও মহাভারত-এর ভার্গব প্রক্ষেপে শুরু হল, পরবর্তীকালে পুরাণে বিপুল এক শাস্ত্র সৃষ্টি।