০৮. ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০

৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০

পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ নয়। গুলি ছিটকে এল প্রায় পনেরো মিটার দূরত্ব থেকে। অব্যর্থ নিশানায় যাঁর শরীরে বিঁধল বুলেট, তিনি মুখ থুবড়ে পড়লেন মাটিতে। এবং আর উঠলেন না।

দ্বিতীয় বুলেট নিশানাচ্যুত হল। এবার যাঁকে লক্ষ্য করে ছোড়া, তাঁর বুকে নয়, লাগল কাঁধে। যিনি ক্ষতস্থানে হাত চেপে বসে পড়তে পড়তেই সশস্ত্র রক্ষীদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন, ‘There he is! Get him!’

কর্তাদের একজন মাটিতে পড়ে গুলিবিদ্ধ। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, প্রাণহীন। আরেকজনের কাঁধে আঘাত করেছে বুলেট। হতভম্ব রক্ষীরা আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে যতক্ষণে তাড়া করলেন সাদামাটা ফতুয়া আর ধুতি পরা আততায়ীকে, দেরি হয়ে গেছে কিছুটা। উল্কাবেগে ছুটেছেন যুবক, চলে গেছেন নাগালের বাইরে। আপ্রাণ ধাওয়া করেও ব্যর্থ হল বাহিনী। কাউকে তাড়া করা নেহাত সহজও নয় ওই থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে।

ভিড় অবশ্য স্বাভাবিকই। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং হাসপাতালের জনাকীর্ণ প্রাঙ্গণ। আশেপাশের জেলা থেকে আসা রোগীদের ভিড় অবিশ্রান্ত। যা সামলাতে হিমশিম ডাক্তারবাবুরা। অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে-বেরচ্ছে, স্ট্রেচার নিয়ে ব্যস্তসমস্ত চলাচল হাসপাতালের কর্মীদের। আর বইখাতা নিয়ে ছাত্রদের আসা-যাওয়া তো আছেই। আছে এদিক-সেদিক পড়ুয়াদের জটলা-আড্ডা-হইহল্লা। যেমন হয়ে থাকে।

ওই ভিড়ের মধ্যে দিয়েই পালিয়ে গেলেন যুবক। এমন কাণ্ড ঘটিয়ে, যা কল্পনাতীত ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের। যা বাংলায় তো বটেই, সাড়া ফেলে দিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের মধ্যে আসমুদ্রহিমাচল।

হত্যাকারী অজ্ঞাতপরিচয় থাকলেন না। নামধাম জানা গেল সহজেই। পাওয়া গেল ছবি। খোঁজখবর দিতে পারলে আর্থিক পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিসহ ‘সন্ধান চাই’-এর হাজার হাজার ছবি ছাপানো হল ফেরারি যুবকের। ছবির নীচে বড় বড় অক্ষরে পলাতকের নাম।

বিনয়কৃষ্ণ বসু।

.

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কলিকাতা

১৮ জুন, ১৯৩১

বউদি,

তোমার দীর্ঘ পত্র পাইলাম। অ-সময়ে কাহারও জীবনের পরিসমাপ্তি হইতে পারে না। যাহার যে কাজ করিবার আছে, তাহা শেষ হইলেই ভগবান তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লন। কাজ শেষ হইবার পূর্বে তিনি কাহাকেও ডাক দেন না।

তোমার মনে থাকিতে পারে, তোমার চুল দিয়া আমি পুতুল নাচাইতাম। পুতুল আসিয়া গান গাহিত, ‘কেন ডাকিছ আমার মোহন ঢুলী?’ যে পুতুলের পার্ট শেষ হইয়া গেল, তাহাকে আর স্টেজে আসিতে হইত না। ভগবানও আমাদের নিয়া পুতুল নাচ নাচাইতেছেন। আমরা এক একজন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পার্ট করিতে আসিয়াছি। পার্ট করা শেষ হইলে প্রয়োজন ফুরাইয়া যাইবে। তিনি রঙ্গমঞ্চ হইতে আমাদের সরাইয়া লইয়া যাইবেন। ইহাতে আপশোস করিবার আছে কি?

ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া উঠে। কিন্তু তবে আমাদের মরণকে এত ভয় কেন? বলি ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত। সবার চেয়ে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি। একটা তুচ্ছ গোরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্য শুনিয়া আমরা ভাই-ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ‘ভগবান’ আমাদের জন্য বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না ‘খোদা’ বেহেস্তে স্থান দিবেন?

যে দেশ জন্মের মত ছাড়িয়া যাইতেছি, যার ধূলিকণাটুকু পর্যন্ত আমার কাছে পরম পবিত্র, আজ বড় কষ্টে তার সম্বন্ধে এসব কথা বলিতে হইল।

আমরা ভাল আছি। ভালবাসা ও প্রণাম লইবে।

স্নেহের ছোট ঠাকুরপো।

.

image

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কলিকাতা

৩০ জুন, ১৯৩১

মা,

যদিও ভাবিতেছি কাল ভোরে তুমি আসিবে, তবু তোমার কাছে না লিখিয়া পারিলাম না।

তুমি হয়তো ভাবিতেছ, ভগবানের কাছে এত প্রার্থনা করিলাম, তবুও তিনি শুনিলেন না! তিনি নিশ্চয় পাষাণ, কাহারও বুক-ভাঙা আর্তনাদ তাঁহার কানে পৌঁছায় না। ভগবান কি আমি জানি না, তাঁহার স্বরূপ কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবু এ-কথাটা বুঝি, তাঁহার সৃষ্টিতে কখনও অবিচার হইতে পারে না। তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা কর। কি দিয়া যে তিনি কি করিতে চান, তাহা আমরা বুঝিব কি করিয়া?

মৃত্যুটাকে আমরা এত বড় করিয়া দেখি বলিয়াই সে আমাদিগকে ভয় দেখাইতে পারে। এ যেন ছোট ছেলের মিথ্যা জুজুবুড়ির ভয়। যে মরণকে একদিন সকলেরই বরণ করিয়া লইতে হইবে, সে আমাদের হিসাবে দুই দিন আগে আসিল বলিয়াই কি আমাদের এত বিক্ষোভ, এত চাঞ্চল্য?

যে খবর না দিয়া আসিত, সে খবর দিয়া আসিল বলিয়াই কি আমরা তাহাকে পরম শত্রু মনে করিব? ভুল, ভুল। ‘মৃত্যু’ মিত্ররূপেই আমার কাছে দেখা দিয়াছে। আমার ভালোবাসা ও প্রণাম জানিবে।

—তোমার নসু

.

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

৩০. ৬. ৩১. কলিকাতা।

স্নেহের ভাইটি,

তুমি আমাকে চিঠি লিখিতে বলিয়াছ, কিন্তু লিখিবার সুযোগ করিয়া উঠিতে জীবন-সন্ধ্যা হইয়া আসিল।

যাবার বেলায় তোমাকে কি বলিব? শুধু এইটুকু বলিয়া আজ তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি, তুমি নিঃস্বার্থপর হও, পরের দুঃখে তোমার হৃদয়ে করুণার মন্দাকিনী-ধারা প্রবাহিত হউক।

আমি আজ তোমাদের ছাড়িয়া যাইতেছি বলিয়া দুঃখ করিও না, ভাই। যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া-আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই। আর কিছু লিখিবার নাই। আমার অশেষ ভালবাসা ও আশিস জানিবে।

তোমার দাদা

বউদির কাছে তিনি ‘স্নেহের ঠাকুরপো’। ছোটভাইয়ের কাছে ‘স্নেহশীল দাদা’। আর মায়ের কাছে আদরের ‘নসু’।

দীনেশচন্দ্র গুপ্ত।

.

—মাস্টারমশাই, ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর ঘটনাটা আর একবার বলুন না…

শিক্ষক সস্নেহে হাসেন কিশোর ছাত্রের দিকে তাকিয়ে।

—গত পরশুই তো শুনলি। আর কতবার শুনবি?

—আর একবার শুধু… দোহাই আপনার…

মাস্টারমশাই ফের বলতে শুরু করেন অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীর অকুতোভয় অভিযানের কথা। ছাত্র শুনতে থাকে নিষ্পলক। বিপ্লবীদের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের বিবরণ শুনে কখনও রাগে থমথম করে মুখ, কখনও কেঁদেই ফেলে।

এই ছাত্রটিকে বিশেষ স্নেহ করেন মাস্টারমশাই। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। ভারী ডাকাবুকো। স্কুল শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আবদার করে বিপ্লবীদের গল্প শোনার। আর শুনতে শুনতে যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।

মাস্টারমশাই বড় একটা অবাক হন না। শুনেছেন ছেলেটির পরিবারের কথা। জানেন, তাঁর এই কিশোর ছাত্রটির দুই কাকা, ধরণীনাথ গুপ্ত এবং নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে। বোঝেন, এ ছেলের শিরা-ধমনীতে স্বদেশব্রতের স্রোত বইছে।

ক্ষুদিরাম কীভাবে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন, সেই কাহিনির পুনর্কথনের মধ্যেই মনে হয় মাস্টারমশাইয়ের, এই ছেলেটিকে সমিতিতে ভর্তি করে নিলে হয় না? বয়স কম, কিন্তু সমিতির কাজে যা দরকার, সেটা তো আছে পূর্ণ মাত্রায়। দেশের জন্য নিখাদ আবেগ। আর বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস।

—এই শোন, সমিতিতে আসিস তো কাল সন্ধের দিকে একবার…

চোখে খুশি উপচে পড়ে ছেলেটির। সমিতির কাজ করার ভীষণ ইচ্ছে তার। মাস্টারমশাইকে বলতে সাহসে কুলোচ্ছিল না এতদিন। যদি না বলে দেন!

হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বাড়ির দিকে রওনা দেয় কিশোর।

আসল নাম সুধীর গুপ্ত। সে নামে কেউ ডাকে না অবশ্য। সবাই ডাকনাম ধরেই ডাকে। বাদল।

বাদল গুপ্ত।

.

সাল, ১৯২৮। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে স্বাধীনতাকামী তরুণদের নিয়ে গঠিত হল ‘Bengal Volunteers’। সামগ্রিক নেতৃত্বে থাকলেন মেজর সত্য গুপ্ত। সর্বাধিনায়ক (GOC—General Officer Commanding) সুভাষচন্দ্র বসু স্বয়ং। ক্রমে Bengal Volunteers (B.V.) হয়ে উঠল বাংলার সবচেয়ে সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠন। যার শাখা ছড়িয়ে পড়ল জেলায়-জেলায়, শহরে-শহরে, গ্রাম-গ্রামান্তরে।

শৌর্যের অনুশীলন, শৃঙ্খলার পাঠ এবং দেশের জন্য যে-কোনও ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত থাকা—এই ত্রিমুখী লক্ষ্যেই পথ চলা শুরু B.V.-র। বঙ্গজ বিপ্লবীদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়দের অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন এই সংগঠনের সঙ্গে।

কাকে ছেড়ে কার কথা লিখি? চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী। ময়মনসিংহে সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ। ঢাকায় মদনমোহন ভৌমিক। কলকাতায় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত প্রমুখ। বরিশালে সতীন সেন এবং মনোরঞ্জন গুপ্ত। রাজশাহিতে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী এবং আরও অনেকে।

তিরিশের দশকের শুরুর দিক তখন। বিপ্লবীদের উপর পুলিশের দমন-পীড়ন নীতি ক্রমশ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছে। চলছে কথায় কথায় ধরপাকড়, মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে জেলবন্দি রাখা, জেলে পাশবিক নির্যাতন। Bengal Volunteers-এর শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রতিবাদ প্রয়োজন, প্রয়োজন সশস্ত্র প্রত্যাঘাতের।

প্রত্যাঘাতের সূচনা ১৯৩০-এর ২৯ অগস্ট সকালে। ঢাকা মেডিক্যাল স্কুল এবং হাসপাতালে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন এক পুলিশ অফিসারকে দেখতে এসেছিলেন ঢাকার তৎকালীন ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ মিস্টার লোম্যান। সঙ্গে ছিলেন সুপারিন্টেেন্ডন্ট অফ পুলিশ মিস্টার হডসন।

দুই উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তা যখন হাসপাতালের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন সশস্ত্র রক্ষী-পরিবেষ্টিত, ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলেরই এক ছাত্র সবার অলক্ষ্যে কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। পনেরো মিটার দূরত্ব থেকে পরপর দুটো গুলি ছুড়লেন। যার প্রথমটা লক্ষ্যভেদ করল অব্যর্থ। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন লোম্যান, যিনি বিপ্লবীদের উপর অকথ্য অত্যাচারে চার্লস টেগার্টের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। দ্বিতীয় গুলির নিশানা ছিলেন হডসন। যাঁর কাঁধে বিঁধল বুলেট। ক্ষতস্থান চেপে মাটিতে বসে পড়তে পড়তে যিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘There he is! Get him!’

হাসপাতালের প্রতিটি ইঞ্চি-সেন্টিমিটার হাতের তালুর মতো চিনতেন বিনয়। পুলিশের সাধ্য কী, তাঁকে ধরে, তা-ও আবার ওই ভিড়ের মধ্যে? ফেরার হলেন বাইশ বছরের বিনয়।

বিনয়কৃষ্ণ বসুর জন্ম ১৯০৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর। মুনশিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। ম্যাট্রিকুলেশনের পর ডাক্তারি পড়তে পড়তেই বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসা এবং গুপ্ত সংগঠন ‘মুক্তিসংঘ’-য় যোগদান। বিপ্লবী কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ায় শেষ হয়নি ডাক্তারি পড়া।

পলাতক বিনয়ের সন্ধান পেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করল ব্রিটিশরাজ। প্রকাশ্যে খুন করেছে আইজি-কে, একে ধরতেই হবে যে করে হোক। ছবি ছাপিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হল রাজ্যের সর্বত্র। বাসস্ট্যান্ডে-রেলস্টেশনে-হাটেবাজারে-রাস্তাঘাটে, কোথায় নয়? বিনয় ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, খবর ছিল পুলিশের কাছে। ঢাকা থেকে ছাড়া প্রতিটি ট্রেন স্টেশনে স্টেশনে থামিয়ে শুরু হল মরিয়া চিরুনিতল্লাশি।

ওই নিশ্ছিদ্র নজরদারির মধ্যে যেভাবে বিনয় ঢাকা থেকে পালিয়ে এলেন কলকাতায়, রোমহর্ষক। পুলিশের নজর এড়িয়ে লোম্যান-নিধনের নায়ককে কলকাতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নিলেন বিনয়ের সতীর্থ বিপ্লবী সুপতি রায়।

গ্রাম্য চাষির সাজে সুপতি সাজালেন বিনয়কে। ছেঁড়া লুঙ্গি, ছেঁড়া গেঞ্জি, মাথায় নোংরা গামছা জড়ানো। বিনয় ছিলেন গৌরবর্ণ, সুপুরুষ। চেহারায় আভিজাত্যের সিলমোহর। ছদ্মবেশ যতই নিখুঁত হোক, চাষির বেশে বেমানানই লাগছিল বিনয়কে। কিন্তু কী আর করা! নকল সাজে কতটাই বা বদলানো যায় আসল চেহারা?

সুপতি নিজেও বারকয়েক সাজ বদলালেন। কখনও জমিদারপুত্রের বেশভূষা, কখনও চাষির। পুলিশের ট্রেন-তল্লাশি থেকে বাঁচতে কখনও দু’জনে গা ঢাকা দিলেন প্ল্যাটফর্মের ওয়েটিং রুমে, কখনও ট্রেনযাত্রায় চাদরমুড়ি দিয়ে অসুস্থ রোগীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হল বিনয়কে। কিছু পথ ট্রেনে, কিছু পথ স্টিমারে অতিক্রম করে দু’জনে পৌঁছলেন দমদম স্টেশনে। শিয়ালদহে নামার ঝুঁকি নেওয়া গেল না। বিনয়ের ছবিতে ছবিতে স্টেশন-চত্বর ছয়লাপ, খবর পাঠিয়েছিলেন কলকাতার বিপ্লবীরা।

সুপতির কাজ ছিল নিরাপদে বিনয়কে কলকাতাস্থিত নেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করলেন নিখুঁত। ৩ সেপ্টেম্বর বেলা দশটা নাগাদ বিনয়কে নিয়ে সুপতি উপস্থিত হলেন ওয়েলেসলি স্কোয়ারের উত্তর দিকে ৭নং ওয়ালিউল্লা লেনে। যেখানে একটি দোতলা বাড়িতে গোপন আস্তানায় অপেক্ষায় ছিলেন বিপ্লবী হরিদাস দত্ত এবং রসময় শূর। যাঁরা সোল্লাসে জড়িয়ে ধরলেন বিনয়কে।

.

স্বাধীনতা আন্দোলনে বাদল গুপ্তের হাতেখড়ি Bengal Volunteers থেকেই। ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলের পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্ম ১৯১২ সালে। ছাত্রাবস্থা কেটেছিল বানারিপাড়া হাইস্কুলে। যে স্কুলের মাস্টারমশাই নিকুঞ্জ সেন নিজে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে এবং যাঁর প্রভাবেই বাদলের যোগ দেওয়া B.V.-র সংগঠনে। যাঁর কাছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপ্লবীদের গল্প শুনতেন বাদল।

—মাস্টারমশাই, ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর ঘটনাটা আর একবার বলুন না…

ওই কিশোর বয়সেই বাদল পরিচয় দিলেন চমকপ্রদ সাংগঠনিক ক্ষমতার। ক্রমে সমিতিতে উন্নীত হলেন পদমর্যাদার গুরুত্বে। নিকুঞ্জ সেন এবং অন্য নেতারা বুঝে গেলেন, বয়স আঠারো না ছাড়ালে কী হয়, এ ছেলে বড় দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তৈরি।

তৈরি ছিলেন দীনেশ গুপ্তও। ১৯১১ সালে তদানীন্তন ঢাকা জেলার যশোলং গ্রামে জন্ম দীনেশের। ডাকনাম নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন তৃতীয়। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর বেড়াতে আসেন মেদিনীপুরে কর্মরত দাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের বাড়িতে। মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার স্বপ্ন লালনের শুরু তখন থেকেই।

স্বপ্ন পরিণতি পেয়েছিল বছরদুয়েক পর, যখন পরম যত্নে মেদিনীপুরে Bengal Volunteers-এর শাখা গড়ে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়। অসামান্য সংগঠক ছিলেন দীনেশ। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসই হোক বা বিপ্লবী আদর্শের গ্রামভিত্তিক প্রচার, মেদিনীপুর B.V. ছিল তখনকার বাংলায় অগ্রগণ্য। দীনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরাই ডগলাস, বার্জ এবং জেমস পেডি— এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন স্থানীয় প্রশাসনকে।

সাহিত্য বড় প্রিয় ছিল দীনেশের। পড়তে ভালবাসতেন আশৈশব। রবীন্দ্রনাথের অন্ধ অনুরাগী। রবিঠাকুরের অজস্র কবিতা-গান ছিল মুখস্থ।

এক অগ্রজ বিপ্লবীর গ্রন্থিত স্মৃতিচারণায় ধরা আছে দীনেশ গুপ্তের নিখাদ রবীন্দ্রপ্রেম। কথোপকথন চলছে অগ্রজের সঙ্গে অনুজের।

—দীনেশ, তুমি কবিতা ভালবাসো?

—বাসি।

—লেখো না কেন?

—ভালবাসি বলেই লিখি না। কারণ, দু’-একটা লিখে দেখেছি, ও আমার হয় না।

—আচ্ছা দীনেশ, তুমি তো ভীষণ চঞ্চল ছেলে, কোন বস্তু পড়বার সময় তুমি শান্ত হয়ে যাও?

—কবিতা।

—গীতার শ্লোকগুলোও কবিতা। তবে একদিন বলেছিলে কেন যে, গীতা পড়বার সময় তোমায় কষ্ট করে মন বসাতে হয়?

—গীতা পড়তে ভাল লাগে, কিন্তু দু’লাইন পড়লেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের কথা মনে পড়ে, আর তখুনি ভাবতে বসি, কবে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে, কবে আমি সে যুদ্ধের সৈনিক হব! ব্যস, গীতাপাঠ খতম হয়ে যায়।

—কিন্তু কার কবিতা তুমি স্থির হয়ে পড়ো?

—রবীন্দ্রনাথের।

—কেন?

—রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যেই আমি ‘গীতা’র বাণী আমার মাতৃ-কণ্ঠে খুঁজে পাই, আরও পাই এই পৃথিবী ও তার অগণিত মানুষকে, পাই আলো-বাতাস জীব-জন্তু ও সবুজ গাছগুলোকে।

—রবীন্দ্রনাথের কবিতা তোমাকে চঞ্চল করে না?

—অভিভূত করে, ক্ষিপ্ত করে না। ভাল লাগে এত বেশি যে, আমার রক্তধারা বিবশ হয়ে আসে, মনে রোমাঞ্চ লাগে। আমি স্থির হই।

.

সাহিত্যরস উপভোগের থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অবশ্য তখন বাকি রয়েছে দীনেশের।নেতৃস্থানীয়রা দীনেশ আর বাদলকে ডেকে পাঠালেন কলকাতায়। বিনয় আগেই এসে পৌঁছেছেন। বিনয়-বাদল-দীনেশের উপর দায়িত্ব দেওয়া হল দুঃসাহসিক কাজের। এমন কাজ, যা আগামীতে দুঃস্বপ্নেও তাড়া করবে ইংরেজদের।

কী কাজ? বাংলার আইজি (প্রিজ়নস) তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল নরম্যান সিম্পসন। কারাবন্দি বিপ্লবীদের উপর নির্মম নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পেতেন সিম্পসন। রাজদ্রোহের মামলায় কেউ জেলে এলেই তাঁকে যথেচ্ছ লাঠিপেটা করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আইজি সাহেবের। কখনও কখনও দাগি কয়েদিদের লেলিয়ে দিতেন বিপ্লবীদের উপর। তাঁর নির্দেশেই রাজবন্দি সুভাষচন্দ্র বসুকে একবার জেলের গুন্ডা-কয়েদিরা নির্মম ভাবে মেরেছিল। সুভাষের সহবন্দি তখন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন, কিরণশংকর রায়, সত্য গুপ্ত প্রমুখ। সকলেই সেদিন মার খেয়েছিলেন অল্পবিস্তর।

এই সিম্পসনের কী করে আর বাঁচার অধিকার থাকে? জল্লাদ সাহেবকে প্রাণে মারতে হবে, কিন্তু কোথায়, কী ভাবে? যাতায়াতের পথে বা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে মারাই যায় নিখুঁত ছক কষতে পারলে, কিন্তু সেটা স্রেফ আর পাঁচটা বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র আক্রমণের মতোই বিবেচিত হবে। লক্ষ্য তো তা নয়। লক্ষ্য এমন তীব্রতম অভিঘাত তৈরি করা, যাতে থরহরিকম্প হবে ব্রিটিশ সরকার, যাতে আপাদমস্তক নড়ে যাবে অত্যাচারী শাসকের মনোবল।

সিদ্ধান্ত হল অভূতপূর্ব। সিম্পসনকে হত্যা করা হবে তাঁর অফিসে, খোদ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। সেই রাইটার্সে, যা বাংলায় ব্রিটিশরাজের প্রশাসনিক সদর দফতর, যা ইংরেজ প্রভুত্বের সদম্ভ প্রতীক হয়ে বিরাজমান তৎকালীন ডালহৌসি স্কোয়ারে। বার্তা দিতে হবে, অন্যায় অত্যাচারের ক্ষমা নেই। প্রয়োজনে শাসকের রাজদরবারেই অভিনীত হবে প্রতিশোধের নাট্যরূপ। ক্ষমতা থাকলে বাঁচাক সিম্পসনকে।

জানাই ছিল, কাজ সম্পন্ন হলেও অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। মৃত্যু বা গুরুতর আহত হওয়া নিশ্চিত বিনয়-বাদল-দীনেশের, যাঁরা সম্ভাব্য ঘাতক হিসাবে নিজেদের নির্বাচনে আপাদমস্তক রোমাঞ্চিত তখন। যাঁদের তখন ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন।’

পরিকল্পনার খুঁটিনাটি জানলেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। কেনা হল বিদেশি সাজপোশাক। জোগাড় হল আগ্নেয়াস্ত্র এবং যথেষ্ট পরিমাণে কার্তুজ। ওয়ালিউল্লা লেন থেকে বিনয়কে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল মেটিয়াবুরুজে রাজেন্দ্রনাথ গুহের বাড়িতে। রাজেন্দ্রনাথ যে গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, খুব বেশি লোক জানতেনই না। বিপ্লবী রসময় শূর রাতের অন্ধকারে বিনয়ের সঙ্গে দেখা করে আসতেন।

বাদল আর দীনেশকে রাখা হল নিউ পার্ক স্ট্রিটের এক গোপন আস্তানায়। তত্ত্বাবধানে থাকলেন নিকুঞ্জ সেন, বাদলের স্কুলের ‘মাস্টারমশাই’।

‘অপারেশন সিম্পসন’-এর দিন স্থির হল ৮ ডিসেম্বর। খিদিরপুরের পাইপ রোডের কাছে মিলিত হবেন ত্রিমূর্তি, এমনই ঠিক হল। নিকুঞ্জ নির্দিষ্ট সময়ে নিউ পার্ক স্ট্রিটের ডেরায় পৌঁছলেন এবং স্তব্ধ হয়ে গেলেন ঘরের দৃশ্য দেখে। অভাবনীয়!

ইউরোপীয় সাজে সজ্জিত হয়ে তৈরি বাদল-দীনেশ। একটু পরেই রওনা হওয়ার কথা মৃত্যুযাত্রায়, অথচ ভ্রুক্ষেপহীন দীনেশ পাঠ করছেন রবীন্দ্র-কবিতা। বাদল শুনছেন মন্ত্রমুগ্ধ।

‘যে মস্তকে ভয় লেখে নাই লেখা, দাসত্বের ধূলি

আঁকে নাই কলঙ্কতিলক।’

….

‘তার পরে দীর্ঘ পথশেষে

জীবযাত্রা-অবসানে ক্লান্তপদে রক্তসিক্ত বেশে

উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শান্তির উদ্দেশে

দুঃখহীন নিকেতনে।’

নিকুঞ্জের উপস্থিতি টের পেতেই সচকিত হয়ে ওঠেন বাদল।

—মাস্টারমশাই, আমরা রেডি।

দীনেশ বন্ধ করলেন কাব্যগ্রন্থ। দুই বন্ধু উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। কোটের পকেটে রাখা রিভলভার আর গুলি ঠিকঠাক রয়েছে কিনা শেষবারের মতো দেখে নিলেন। বাদল পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি। হ্যাঁ, প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এবার রওনা দেওয়া যেতে পারে।

নিকুঞ্জ সেনের সুহৃদ বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায়ের ‘ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব’ বইটিতে বিস্তারে লিপিবদ্ধ আছে রাইটার্স যাত্রার প্রাক্‌মুহূর্তে দীনেশের কবিতাপাঠের অনুপুঙ্খ বর্ণনা।

যাত্রা হল শুরু। ঘড়িতে বেলা বারোটা। পাইপ রোডে বিনয়কে নিয়ে পৌঁছলেন রসময় শূর। তার কয়েক মিনিটের মধ্যে বাদল-দীনেশকে নিয়ে হাজির হলেন নিকুঞ্জ। তিন যুবক উঠে বসলেন একটি ট্যাক্সিতে। রওনা দিল ট্যাক্সি। গন্তব্য রাইটার্স। তিন বিপ্লবীর ‘The last ride together’।

.

বাকি ইতিহাস বহুপঠিত-বহুচর্চিত-বহুআলোচিত। যার ইতিবৃত্ত সবিস্তার নথিভুক্ত রয়েছে সে যুগের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ফাইলে। ‘Shooting outrage in Writers Buildings on 8.12.30, Murder of IG Prisons’। ফাইল নম্বর 59/19/30। সেই ফাইল এবং সংশ্লিষ্ট প্রামাণ্য নথি থেকে রইল ঘটনাপ্রবাহ। ঠিক কী ঘটেছিল, কখন ঘটেছিল, এবং কী ভাবে?

৮ ডিসেম্বর, ১৯৩০।

রাইটার্স বিল্ডিং-এর মেন গেটের সামনে যখন ট্যাক্সিটা এসে থামল, ঘড়িতে সোয়া বারোটা। গেটে প্রহরারত পুলিশ অফিসার দেখলেন, ট্যাক্সি থেকে নামছেন তিন যুবক। ধোপদুরস্ত ইউরোপিয়ান সাজপোশাক ত্রয়ীর। টুপি-কোট-টাই-ট্রাউজার-বুটজুতো। ড্রাইভারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তিনজন সপ্রতিভ ভঙ্গিতে যখন ঢুকলেন, সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার ন্যূনতম কারণ পেলেন না পুলিশ অফিসার বা তাঁর সহযোগী কনস্টেবলরা।

সিঁড়ি দিয়ে যখন প্রত্যয়ী পদক্ষেপে দোতলায় উঠছেন বিনয়-বাদল-দীনেশ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিম্পসন তখন নিজের চেয়ারে বসে একটি চিঠি লিখছেন। পাশে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত আপ্তসহায়ক জে সি গুহ আর হেড চাপরাশি ভাগল খান। দরজার বাইরে সহকারী চাপরাশি ফাগু সিং।

রাইটার্সের দোতলার বারান্দা। লম্বা, পশ্চিম থেকে চলে গেছে পূর্বে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে বেশ কিছুটা গিয়ে পশ্চিমপ্রান্তের শেষে সিম্পসনের অফিস। অন্য দিনের মতোই চেহারা সেদিনের করিডরের। সার দিয়ে অফিসঘর সাহেবদের, যার সামনে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে আরদালিরা। ফাইলপত্র বগলে করণিকদের হেঁটে যাওয়া ধীরেসুস্থে। অফিসারদের দর্শনপ্রার্থী যাঁরা, তাঁরা ঘরগুলির সামনে বেজার মুখে অপেক্ষমাণ। কে জানে কখন ডাক আসবে!

তিন যুবক দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে থামলেন সিম্পসন সাহেবের ঘরের সামনে। ফাগু সিং তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে।

—সাব সে মিলনা হ্যায় আপ লোগো কো?

বিনয় উত্তর দিলেন।

—হ্যাঁ, সাহেব আছেন?

—আছেন, তবে ব্যস্ত। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আপনাদের? ভিজিটিং কার্ড থাকলে দিন। না থাকলে ওই রেজিস্টারে নাম লিখুন। আমি জানিয়ে রাখছি সাহেবকে। ওঁর সময় হলে ডাকবেন। ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।

আর অপেক্ষা! ভাগল খান বেরিয়ে এসেছেন ভিতর থেকে তখন। দুই চাপরাশিকেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন ত্রয়ী। কোটের ভিতরে থাকা রিভলভার উঠে এল হাতে।

সিম্পসন মুখ তুলে দেখলেন, তিন যুবক টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে, রিভলভার তাক করে। আপ্তসহায়ক গুহমশাই আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন কয়েক পা। এবং দাঁড়িয়ে দেখলেন বজ্রাহত, তিন মূর্তির রিভলভার থেকে ছিটকে আসা একঝাঁক গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে সিম্পসনের শরীর। নড়ারও সুযোগ পাননি আইজি প্রিজ়নস। টেবিলেই ঢলে পড়েছেন, নিমেষে নিঃশেষিত হয়েছে প্রাণবায়ু।

সংবিৎ ফিরে পেয়ে গুহবাবু দৌড়লেন দরজার দিকে, ভয়ার্ত আর্তনাদ সমেত। দীনেশ রিভলভার তাক করলেন, কিন্তু ট্রিগারে চাপ দিলেন না। পড়িমরি করে দরজা ঠেলে বারান্দায় বেরিয়েই আপ্তসহায়ক ছুটলেন পশ্চিম দিকে। গলা ফাটিয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চিৎকার করতে করতে। ফাগু সিং ছুটলেন পাশের ঘরের এক অফিসারের কাছে। নাম মিস্টার টাফনেল ব্যারেট। যিনি ফোন করলেন ঢিলছোড়া দূরত্বের লালবাজারে, ‘Shootout here in Writers! Simpson shot dead. Armed reinforcement needed at the earliest.’

কলকাতা পুলিশের নগরপাল তখন স্যার চার্লস টেগার্ট। গাড়ি ডাকা মানে অমূল্য কয়েক মিনিট বরবাদ। লালবাজারে উপস্থিত রিজার্ভ ফোর্সের সশস্ত্র জওয়ানদের নিয়ে নগরপাল দৌড়লেন রাইটার্সে। লালবাজার থেকে রাইটার্স পায়ে হেঁটেই লাগে বড়জোর দু’-তিন মিনিট। দৌড়লে তো মিনিটখানেক। বাহিনীসহ পৌঁছে গেলেন টেগার্ট।

বাংলার ইনস্পেকটর জেনারেল অফ পুলিশ ক্রেগের অফিস ছিল তিনতলায়। রিভলভার হাতে তিনিও ততক্ষণে নেমে এসেছেন দোতলায়। কোথায় আততায়ীরা? যারা অবলীলায় খুন করল সিম্পসনকে?

কার্যসিদ্ধির পর বিনয়-বাদল-দীনেশ তখন হেঁটে চলেছেন রাইটার্সের বারান্দা দিয়ে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে। হাতে রিভলভার তিনজনেরই। করিডরের ঘরে ঘরে তখন ‘সেই বার্তা রটি গেছে ক্রমে’। শুনশান হয়ে গেছে বারান্দা। যে যেখানে পেরেছেন, ঢুকে পড়েছেন। কোনও ঘর থেকে কৌতূহলী মুখ উঁকিঝুঁকি মারলেই গুলি চালাছেন তিন বিপ্লবী। বেশ কয়েকটি ঘরের কাঁচের শার্সি ভেঙে পড়েছে ঝনঝন করে। স্তব্ধ বারান্দায় বীর ত্রয়ীর কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’। ব্রিটিশরাজের প্রশাসনিক ভরকেন্দ্র মুখরিত জাতীয়তাবাদী স্লোগানে, যা দূরতম কল্পনাতেও কেউ কখনও ভাবেনি।

ফোর্ড নামের এক সার্জেন্ট সেদিন রাইটার্সে এসেছিলেন ব্যক্তিগত কাজে। সঙ্গে অস্ত্র ছিল না। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলেন সব। ইনস্পেকটর জেনারেল ক্রেগ দোতলায় নেমে এসে গুলি চালালেন তিন যুবককে লক্ষ্য করে। গুলি লাগল না। ফোর্ড রিভলভার কেড়ে নিলেন ক্রেগের হাত থেকে। ফায়ার করলেন। নিশানাভ্রষ্ট।

বিনয়-বাদল-দীনেশ গতি বাড়ালেন। চেম্বারের গুলি শেষ হয়ে এসেছে। রি-লোড করা প্রয়োজন। থামলেন একটা ঘরের সামনে, যেখানে বসেন পদস্থ আধিকারিক মিস্টার নেলসন। পাশেই ছিল পাসপোর্ট অফিস। বিনয়-বাদল রিভলভারে গুলি ভরতে সেখানে ঢুকলেন। যে কয়েকজন কর্মী ছিলেন ঘরে, ছুটে বেরিয়ে এলেন ভয়ে।

দীনেশ যখন মিস্টার নেলসনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রিভলভার রি-লোড করছেন দ্রুত, দরজা ঠেলে উঁকি দিলেন নেলসন। ঝটিতি ফায়ার করলেন দীনেশ, গুলি লাগল নেলসনের ঊরুতে। তাড়া করে নেলসনের ঘরে ঢুকে পড়লেন দীনেশ। নেলসন শক্তসমর্থ চেহারার অধিকারী ছিলেন, আহত অবস্থাতেই ধস্তাধস্তি শুরু হল দীনেশের সঙ্গে। কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন রিভলভার। গুলির আওয়াজে পাশের পাসপোর্ট অফিস থেকে লোডেড রিভলভার নিয়ে বেরিয়ে এলেন বিনয়-বাদল। নেলসনের মাথায় রিভলভারের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন বিনয়। নেলসন মাটিতে পড়ে গেলেন। এবং দ্রুত সামলে নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থাতেই কোনওমতে বেরলেন ঘর থেকে।

সাড়ে বারোটা থেকে পৌনে একটার মধ্যে যখন রাইটার্সের অলিন্দ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিন বঙ্গসন্তান, পুলিশ আক্ষরিক অর্থেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। লালবাজার থেকে বাড়তি সশস্ত্র পুলিশ এসে পজিশন নেওয়ার আগে পর্যন্ত ইনস্পেকটর জেনারেল ক্রেগ এবং সার্জেন্ট ফোর্ড ছাড়া কারও সাহসে কুলোয়নি যুবক ত্রয়ীর মোকাবিলা করার। অথচ তিনতলাতেই ছিল এক ডজন পদস্থ পুলিশ অফিসারের ঘর। দোতলায় নেমে আসার একাধিক সিঁড়িও ছিল। ত্রাস সঞ্চারিত হয়েছিল এতটাই, কর্তাদের কেউ নামেননি। নামার চেষ্টাও করেননি।

পরিস্থিতি বদলাল বাড়তি বাহিনী আসার পর। পাসপোর্ট অফিসের সংলগ্ন যে ঘরটিতে তখন বিনয়-বাদল-দীনেশ, তা কার্যত ঘিরে ফেলল পুলিশ। দীনেশ দরজা ফাঁক করে দু’রাউন্ড গুলি চালালেন পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশ সতর্ক ছিল, গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পালটা ফায়ার করলেন পুলিশ অফিসার জোনস। দীনেশের গলা থেকে যন্ত্রণাকাতর ‘উঃ’ ছিটকে বেরল। গুলি সম্ভবত লেগেছে কাঁধে।

ঘরের ভিতর তিন যুবক। বাইরে দরজার দু’দিকে সশস্ত্র পুলিশ। দীর্ঘ অলিন্দের দখল নিয়ে ফেলেছে উর্দিধারীরা। পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় হয় বিপ্লবীত্রয়ীর। প্রাণ নিয়ে বেরনো দুঃসাধ্য হবে, জানাই তো ছিল। ধরা পড়া যখন প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, শেষ হয়ে এসেছে গুলির ভাণ্ডার, প্রস্তুতি শুরু হল মৃত্যুবরণের।

বাদল পকেট থেকে বের করলেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি। ঢেলে দিলেন গলায়। মিনিটখানেকের মধ্যেই নিষ্প্রাণ দেহ ঝুঁকে পড়ল টেবিলের উপর। বাইরে দাঁড়ানো পুলিশ পরপর দুটো গুলির আওয়াজ শুনল ঘরের ভিতর থেকে। বিনয় আর দীনেশ দু’জনেই গুলি চালিয়েছেন নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে।

পূর্ব দিকের দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে ডেপুটি কমিশনার বার্টলে দেখলেন, দুটি দেহ পড়ে আছে মাটিতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। পুলিশ ঢুকল দরজা ঠেলে।

ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে একটা টেবিল। যার সামনের চেয়ারে বাদল গুপ্তের প্রাণহীন দেহ। মাথা ঢলে পড়েছে টেবিলে। বিনয় আর দীনেশ, দু’জনেই পড়ে আছেন মেঝেতে। দীনেশ সংজ্ঞা হারিয়েছেন। বিনয়ের জ্ঞান রয়েছে তখনও। দীনেশের শুধু মাথা নয়, কাঁধেও বুলেটের ক্ষত, জোনসের ছোড়া গুলিতে।

দীনেশের পাশে পড়ে .৪৫৫ বোরের Webley রিভলভার। চেম্বারে দুটো কার্তুজের খোল। একটা ‘মিসফায়ারড’, অন্যটা ‘ফায়ারড’। বিনয়ের ট্রাউজারের পিছনের পকেটে একটা পাঁচ চেম্বারের .৩৪ বোরের Ivor Johnson রিভলভার। চেম্বারে পাঁচটি ‘ফায়ারড’ কার্তুজের খোল। বাদলের দেহের পাশে পড়ে দুটো .৩২ বোরের ছ’ঘরা আমেরিকান রিভলভার, কিছু কার্তুজ এবং পটাশিয়াম সায়ানাইডের শিশি।

মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও বেশ কিছু কার্তুজের খোল। তিনটি বিদেশি টুপি। জাতীয় কংগ্রেসের দুটি পতাকা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর একটি পতাকা বিনয়ের ট্রাউজারের পিছনের পকেটে। রাইটার্সের অলিন্দ থেকেও উদ্ধার হল প্রায় গোটা কুড়ি বুলেট হেড।

বাদলের দেহ রওনা দিল মর্গে। বিনয় আর দীনেশকে নিয়ে ছুটল পুলিশের গাড়ি, গন্তব্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। লালবাজারের কর্তারা দিব্যি বুঝতে পারছিলেন, এদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার, সুস্থ হলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে অনেক অজানা তথ্য।

বাংলা তথা ভারত কাঁপিয়ে দেওয়া এই ঘটনা পরের দিন দেশের সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতার সিংহভাগ দখল করে নিল। ৯ ডিসেম্বরের আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন তুলে দিলাম নীচে।

[মঙ্গলবার, ২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৩৩৭; ইং ৯-১২-১৯৩০]

‘গুলির আঘাতে বাঙ্গলার কারা-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেল নিহত

গতকাল বেলা ১২টার সময় কলিকাতার বুকের উপর রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এক বিষম দুঃসাহসিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়া গিয়াছে। ৩ জন বাঙ্গালী যুবক বাঙ্গলার কারা-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেল লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিমসনকে গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে।

বেলা ১২-১৫ মিঃ —১২-৩০ মিনিটের মধ্যে ৩ জন বাঙ্গালী যুবক কারাগার-বিভাগের ইন্সপেক্টর-জেনারেলের অফিসে (রাইটার্স বিল্ডিং) আসিয়া উপস্থিত হয়। কর্নেল সিমসন তখন তাঁহার খাস মুন্সির (পারসন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট) সঙ্গে তাঁহার অফিসে বসিয়া কথা বলিতেছিলেন। যুবকত্রয় তাঁহার সহিত সাক্ষাতের অভিলাষ ব্যক্ত করিলে চাপরাশি তাহাদিগকে উপরোক্ত কারণে অপেক্ষা করিতে বলে এবং কী কাজের জন্য তাহারা দেখা করিতে চায়, তাহা যথারীতি এক টুকরা কাগজে লিখিয়া দিতে বলে। কিন্তু যুবকগণ ইহা করিতে অস্বীকৃত হয় এবং তাহাকে এক পার্শ্বে ঠেলিয়া ভিতরে প্রবেশ করে এবং দ্রুতগতিতে কর্নেল সিমসনের প্রতি ৫/৬ বার গুলি নিক্ষেপ করে। গুলির আঘাতে কর্নেল সিমসন তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। …

কর্নেল সিমসনের ঘর হইতে বাহির হইয়া আততায়ীরা বারান্দা দিয়া চলিয়া আসে। দৌড়াবার সময় তাহারা অফিসগুলির কাঁচের জানালায় এবং সিলিং-এ গুলি করিতে থাকে। রাজস্ব-সচিব মিঃ মারের অফিসের জানালায় গুলির চিহ্ন রহিয়াছে। মিঃ জে. ডব্লিউ. নেলসনের অফিসে গুলির চিহ্ন রহিয়াছে।

অতঃপর তাহারা পাসপোর্ট অফিসে প্রবেশ করে এবং একজন আমেরিকানকে গুলি করে। কিন্তু গুলি ব্যর্থ হয়। কোন চাপরাশীর গায়ে গুলি লাগে নাই।

অতঃপর আততায়ীগণ নেলসন সাহেবের ঘরে প্রবেশ করে এবং তাঁহার ঊরুদেশে গুলি করে। তাঁহার আঘাত গুরুতর নহে।…

।। শেষ খবর ।।

শেষ খবরে জানা যায়, একজন আততায়ী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে, অপর দুইজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় অবস্থান করিতেছে। একজনকে বিনয়কৃষ্ণ বসু বলিয়া নিশ্চিতরূপে জানা গিয়াছে। সে নাকি এই মর্মে এক মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দিয়াছে যে, সে-ই বিনয়কৃষ্ণ বসু এবং সে-ই মিঃ লোম্যানকে হত্যা করিয়াছে। আততায়ীগণ তিনজনই ইউরোপীয় পোশাকে ভূষিত হইয়াছিল। বারান্দা দিয়া গুলি করিতে করিতে অগ্রসর হইবার সময় উহারা বন্দে মাতরম্ ধ্বনি করিতেছিলেন।…’

.

ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও বিনয় বাঁচলেন না। শহিদ হলেন ১৩ ডিসেম্বর। মৃত্যুর দু’দিন আগে বিনয়ের বাবা ব্রিটিশ সরকারের কাছে ছেলেকে শেষ দেখার আর্জি জানালেন। ছেলের মৃত্যু যে অবশ্যম্ভাবী, বুঝে গিয়েছিলেন। আর্জি মঞ্জুর করেছিল সরকার।

দীনেশকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টার কসুর করলেন না চিকিৎসকরা। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন দীনেশ। স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হল সেশনস জজ Ralph Reynolds Garlick-এর নেতৃত্বে। শুরু হল মামলার বিচারপর্ব। নামেই বিচার, আসলে প্রহসন। যে প্রহসনের অনিবার্য পরিণতি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

গার্লিক তাঁর রায়ের শেষাংশে লিখলেন, ‘The punishment of murder is death. We are asked to refrain from passing the death sentence on the ground that the case is not free from doubt. But though there is some doubt about particular incidents of the story, we have no doubt at all that Dinesh was one of the three men who murdered Col Simpson…… We unanimously find Dinesh Chandra Gupta guilty of murder and sentence him under Sec 302 IPC to be hanged by the neck until he is dead.’

আলিপুর জেলে ১৯৩১-এর ৭ জুলাই ভোর পৌনে চারটেয় ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন উনিশ বছরের দীনেশ। জেলের কুঠুরি থেকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত রাস্তাটুকু অতিক্রমের পথে দৃপ্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘বন্দে মাতরম!’

দীনেশের ফাঁসির আদেশ বঙ্গজ বিপ্লবীদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতির কাজ করেছিল। ফাঁসির হুকুম রদ করার আবেদন জানিয়ে গণস্বাক্ষরিত আর্জি গভর্নরের কাছে জমা পড়েছিল অসংখ্য। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সে আর্জি।

আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কায় দীনেশের ফাঁসির দিনক্ষণ গোপন রাখতে মরিয়া চেষ্টা করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। সে চেষ্টা সফল হয়নি। পরের দিন সকালে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের ‘Advance’ কাগজের হেডিং, ‘Dauntless Dinesh Dies at Dawn!’ শিরোনামটি দিয়েছিলেন পত্রিকার তৎকালীন চিফ সাব-এডিটর শ্রীইন্দু মিত্র।

আনন্দবাজার পত্রিকার ৭-৭-৩১, ২২শে আষাঢ়, ১৩৩৮-এর সংস্করণেও ছাপা হয়েছিল খবর, ‘সোমবার শেষরাত্রিতে দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হইয়া গিয়াছে। মঙ্গলবার প্রাতে কলিকাতার প্রতি রাস্তার মোড়ে বহু পুলিশ দেখা যায়। ইহা হইতেই প্রবল অনুমান হয় যে, ফাঁসি হইয়া গিয়াছে।’

দীনেশের মৃত্যুদণ্ডের নেপথ্যে যিনি ছিলেন পুরোধা, সেই Ralph Reynolds Garlick-কে অচিরেই প্রাণ দিতে হয়েছিল। জয়নগরের বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য ১৯৩১-এর ২৭ জুলাই, দীনেশের ফাঁসির কুড়ি দিনের মধ্যে, ভরা এজলাসে গুলি করে খুন করেছিলেন গার্লিক সাহেবকে।

কারাবাস চলাকালীন আত্মীয়পরিজনদের একাধিক চিঠি লিখেছিলেন দীনেশ। যাতে ধরা রয়েছে উনিশের যুবকের চিন্তার ব্যাপ্তি, জীবনদর্শনের গভীরতা।

বউদিকে যেমন লিখছেন, ‘যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, সে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত’, ভাই-কে তেমনই দিশা দেখাচ্ছেন জীবনবোধের, ‘যুগ যুগ ধরিয়া এই যাওয়া-আসাই বিশ্বকে সজীব করিয়া রাখিয়াছে, তাহার বুকের প্রাণস্পন্দনকে থামিতে দেয় নাই।’ আর সান্ত্বনার পরশ দিতে চাইছেন শোকাচ্ছন্ন মা-কে, ‘তাঁহার বিচার চলিতেছে। তাঁহার বিচারের উপর অবিশ্বাস করিও না, সন্তুষ্ট চিত্তে সে বিচার মাথা পাতিয়া নিতে চেষ্টা করো।’

ফাঁসির আগের সন্ধ্যায় গর্ভধারিণীকে লেখা শেষ চিঠি তুলে দিলাম হুবহু।

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল,

কলিকাতা

৫টা সন্ধ্যা

৬.৭.৩১

মা,

তোমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না। কিন্তু পরলোকে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করিব।

তোমার জন্য কিছুই কোনওদিন করিতে পারি নাই। সে না-করা যে আমাকে কতখানি দুঃখ দিতেছে, তাহা কেউ বুঝিবে না, বুঝাইতে চাই-ও না।

আমার যত দোষ, যত অপরাধ দয়া করিয়া ক্ষমা করিও।

আমার ভালবাসা ও প্রণাম জানিও।

—তোমার নসু।

বিনয়-বাদল-দীনেশ। স্বাধীনতার পর ডালহৌসি স্কোয়ার নতুন ভাবে চিহ্নিত হওয়া যাঁদের নামে, ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে যাওয়া যাঁদের অসমসাহসী রাইটার্স অভিযান।

বিনয়কৃষ্ণ বসু। জন্ম: ১৯০৮, সুধীর (বাদল) গুপ্ত। জন্ম: ১৯১১, দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। জন্ম: ১৯১২

প্রয়াত ব্যক্তিদের মৃত্যুকাল লেখাই রীতি। এই লেখায় যা অনুসরণ করার কোনও প্রয়োজন দেখছি না। ওঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী। কী এসে যায় শারীরিক পূর্ণচ্ছেদে, অমরত্বের আশ্বাস যখন বিস্তৃত স্থান-কাল-পাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *