০৮. সম্মানিত অতিথিকে স্বাগত

সম্মানিত অতিথিকে স্বাগত জানাবার অর্থ কী, সেদিন করবী দেবীর বিষণ্ণ অথচ কর্তব্যপরায়ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। আমারই চোখের সামনে ব্যাংকোয়েটে নিমন্ত্রিত কলকাতার সম্মানিত অতিথিরা একে একে বিদায় নিয়েছিলেন। ঘোমটার আড়ালে মিসেস পাকড়াশী স্বামীর সঙ্গে মানবতার আলোচনা করতে করতে অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে বসেছিলেন। মিস্টার আগরওয়ালা এবং তার ইংরেজ সঙ্গীও কালবিলম্ব করেননি। শুধু যিনি রয়ে গিয়েছিলেন তিনি মাননীয় সভাপতি। কর্তব্যে ক্লান্ত শরীরটাকে দু-নম্বর সুইটের শান্ত শীতল আশ্রয়ে একটু পুনরুজ্জীবিত করার জন্যই তিনি থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে থাকাও কিছু বেশিক্ষণের জন্যে নয়। ক্যালেন্ডারের দিন পরিবর্তনের আগেই তিনি দ্রুতবেগে হোটেল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। রিসেপশন কাউন্টার থেকে তার দ্রুত নিষ্ক্রমণের যে দৃশ্য সেদিন দেখেছিলাম, তা আজও ছবি হয়ে আমার স্মৃতির অ্যালবামে সাজানো রয়েছে। প্রভাতের সংবাদপত্রে তার যে ফটো প্রকাশিত হয়েছিল, তার সঙ্গে এই ছবির সামান্যতম সাদৃশ্য খুঁজে না পেয়ে আমি মুহুর্তের জন্যে চমকে উঠেছিলাম। মনের মধ্যে সন্দেহ হয়েছিল, কে জানে, এই এমনি করেই সংবাদের জন্ম হয় কিনা, এই এমনি করেই অনেক স্মরণীয়দের বরণীয় নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় কিনা।

আজও আমি অবিশ্বাসী নই; আজও আমি মানুষের মহত্ত্বে আস্থাশীল। তবুও কোনো অলস অবসরে যখন সেই রাত্রের কথা স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে, তখন নিজের চোখদুটো ছাড়া আর কোনো কিছুকেই বিশ্বাস করতে সাহস হয় না। মনে পড়ে যায়, করবী দেবী সম্মানিত অতিথিকে হোটেলের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। যাবার পথে তিনি একবার আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন–সে দৃষ্টিতে কেতাদুরস্ত এক হোস্টেসের ছবিই দেখেছিলাম। কিন্তু ওঁকে বিদায় দিয়ে, একলা ফিরে আসবার পথে করবী গুহ আর একবার থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। কেন যে তিনি আমার দিকে অমন ভাবে তাকিয়েছিলেন, তা আজও আমি ভেবে পাই না। সেদিন আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় সব কিছু বোঝবার মতো বুদ্ধি ছিল না—কিন্তু করবী দেবীর কাজলকালো চোখে যেন যুগযুগান্তের পুঞ্জীভূত ক্লান্তি আবিষ্কার করেছিলাম। আমি কিছুই তেমন বুঝিনি; কিন্তু করবী দেবীর অভিমানিনী চোখ দুটো যেন ভেবেছিল আমি সব বুঝে নিয়েছি; আমার নীরবতাই যেন করবী দেবীর অত্যাচারিত দেহকে প্রকাশ্যে অপমানিত করেছিল।

সন্ধ্যার সেই সদ্যপ্রস্ফুটিত লাবণ্য তার দেহ থেকে কখন বিদায় নিয়েছে। সেই অবস্থায় আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে করবী দেবী প্রশ্ন করছিলেন, আর কতক্ষণ?

আমি যেন তাঁর মধ্যে আমার পরম আপন-জনকে আবিষ্কার করে বলেছিলাম, অনেকক্ষণ। আজ রাত্রে আমাকে জেগে থাকতে হবে।

বেচারা! অস্ফুট স্বরে করবী দেবী উচ্চারণ করেছিলেন। তারপর যেন টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে চলে গিয়েছিলেন।

 

সেই রাত্রির কথা মানসপটে ভেসে উঠলে আজও আমি লজ্জিত হই। অভিজ্ঞ বুদ্ধিমান পাঠক, সেদিনের শাজাহান হোটেলের এক অপরিণতবুদ্ধি কর্মচারীকে ক্ষমা করুন। সেই রাত্রে মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি বেচারা নই। আমি পরম ভাগ্যবান। বিধাতার আশীর্বাদে মানুষের এই সংসারে আমি আমি হয়েই জন্মেছি—করবী গুহ হইনি। আর যা মনে হয়েছিল, তা ভাবতে আজও আমি লজ্জিত হই। কিন্তু লিখতে বসে আজ যে লজ্জার সুযোগ নেই। সেদিন মনে হয়েছিল, বিধাতার সৃষ্টি-পরিকল্পনায় পুরুষকে তিনি অনেক ভাগ্যবান করে সৃষ্টি করেছেন। নারীর স্রষ্টা যে-বিধাতা, তিনি আর যাই হোন, সমদর্শী নন।

এই একই কথা আর একবার আমার মনে হয়েছিল। সেদিন করবী গুহকে শ্ৰীমতী পাকড়াশী বলেছিলেন, হে ঈশ্বর, এমন মেয়েমানুষও তুমি সৃষ্টি করেছিলে!

কিন্তু মাধব পাকড়াশীর ইউরোপীয় অতিথিদের শাজাহান হোটেলের দু-নম্বর সুইটে আতিথ্য গ্রহণ করতে এখনও দেরি রয়েছে। তারা এসে হাজির হোন, তারপর যা হয় হবে।

তাঁরা আসবার আগেই যিনি হোটেলে এসেছিলেন, যার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তার নাম কনি। কনিকে না দেখলে, শাজাহান হোটেলকেই আমার জানা হত না। অন্তত, কনিকে বিয়োগ দিলে আমার শাজাহান হোটেলের অঙ্কে বিশেষ কিছুই থাকে না। আজও যখন কোনো অপরিচিতার সংস্পর্শে আসি, আজও যখন কাউকে বিচার করবার প্রয়োজন হয়, তখন আমি কনিকে মনে করবার চেষ্টা করি। কনিকে আজ আর রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না—সে যেন এক দীর্ঘস্থায়ী রঙিন স্বপ্ন। কিংবা কে জানে, তাকে হয়তো অন্য কোনোভাবে বর্ণনা করা উচিত ছিল। নগর-সভ্যতার অন্ধকার জনারণ্যে সে যেন আমার অভিজ্ঞতা-ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ বাবের কাজ করেছিল—তার মুহূর্তের ঝলকানিতেই সমাজের প্রকৃত রূপকে আমি মনের ফিল্মে ধরে রাখতে পেরেছিলাম।

কনি যে কে, আমি জানতাম না। তার নামও কোনোদিন আমি শুনিনি। মার্কোপোলাই ওর একটা ফটোগ্রাফ নিয়ে একদিন আমার কাউন্টারে এসেছিলেন। রোজি তখন আমার পাশে বসে নেল-কাটার দিয়ে নখ কাটছিল। কাটতে কাটতে বলছিল, একটুও ধার নেই।

আমি বলেছিলাম, ব্লেড় দিয়ে নখ কাটলেই পারো।

রোজি জিভ কেটে বলেছিল, কোথাকার ইয়ংম্যান তুমি? একজন ইয়ং লেডি তোমাকে বলছে, তার নেল-কাটারটা ভোতা হয়ে গিয়েছে, কোথায় তুমি টুক করে কোনো স্টেশনারি দোকানে গিয়ে একটা নতুন কাটার কিনে এনে তার হাতে দিয়ে দেবে, তা নয়, বলে দিলে ব্লেডে কাটো।

মাই ডিয়ার গার্ল, এই ইয়ংম্যান তোমাকে ভালো অ্যাড়ভাইস দিয়েছে। ব্লেড় দিয়ে কাটলে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না। মার্কোপোলার গলার স্বরে আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম, উনি যে কখন ওখানে এসে পড়েছেন বুঝতে পারিনি। মার্কোপোলো মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, রোজি, এয়ারওয়েজের চিঠিটা আমি এখনই চাই। ওরা কলকাতা থেকে যে নতুন সার্ভিস ইনট্রোডিউস করবে, তাতে ঘরের সংখ্যা আরও বেশি লাগবে। ডেলি রিজার্ভেশন! চিঠিটা আপিসে রয়েছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো তো।

রোজি তড়াং করে লাফিয়ে উঠে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে পড়ল। মার্কোপোলো তখন হেসে বললেন, এবার কাজের কথায় আসা যাক। স্ট্রিক্টলি স্পিকিং, এটা তোমার কাজ নয়—রোজির কাজ। কিন্তু জিমির কাছে শুনেছি, ও মেয়েদের একদম বরদাস্ত করতে পারে না। শাজাহান হোটেলে অন্য কোনো মেয়ে আসবে শুনলে ওর গা জ্বলতে আরম্ভ করে।

মার্কোপোলো আমার হাতে একটি ফটোগ্রাফ দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, এই সব ছবি ইয়ংম্যানদেরও দেখা উচিত নয়। তবে হোটেলে যখন চাকরি করো তখন আলাদা কথা। আদর্শ হোটেল ওয়ার্কারের জেন্ডার ম্যাসকুলাইনও নয়, ফেমিনিনও নয়। সে হল নিউটার!

মার্কোর মুখেই শুনলাম, ছবিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে তিনি নীল-নয়না সুন্দরী। তাঁর মাথার চুল নাকি প্ল্যাটিনামের মতো। মার্কোপোলো বললেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসোকনি দি উয়োম্যান ইজ কামিং।

প্রাত্যহিক সংবাদপত্রে আমাদের সে বিজ্ঞাপন হয়তো আপনারা অনেকেই দেখে থাকবেন।

সত্যসুন্দরদা অনেকগুলো ছবি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বললেন, ডিসপ্লের কাজ শেখো। তোমাকে তো একাই একশ হতে হবে।

ছবিগুলো সবই কনির। ঢোকবার পথে দুটো বোর্ডে কায়দা করে ছবিগুলো টাঙিয়ে দিয়েছিলাম-কনি ইজ কামিং।

আমার টাঙানো দেখে বোসদা খুব খুশি হলেন। বাঃ, চমৎকার হাত। যেন গতজন্মেও তুমি শাজাহান হোটেলে ক্যাবারে গার্লদের অর্ধ-উলঙ্গ ছবি ডিসপ্লে করতে।

প্রত্যুত্তরে হেসে বললাম, আমি পূর্বজন্মে বিশ্বাস করি না। আসলে ভালো গুরু পেলে ছাত্ররা খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে।

বোসদা জিজ্ঞাপনটা আবার পড়লেন-কনি ইজ কামিং। তারপর বললেন, শমিং। কিন্তু কোথা থেকে কামিং জানো?

ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। হেসে বোসদা বললেন, অনেকে ভাবে এই সব সুন্দরীরা একেবারে নীল আকাশ থেকে শাজাহানের নাচঘরে নেমে আসে। উনি এখন মধ্যপ্রাচ্য জয় করে পারস্যের এক হোটেলে শো দিচ্ছেন। ওখান থেকে সোজা চলে আসবেন আমাদের শাজাহানে।

বোসদার মন-মেজাজ তখন বেশ ভালো ছিল। ওঁর মুখেই শুনলাম, কনি অনেক টাকা নিচ্ছে। ক্যাবারে গার্লরা নিয়েই থাকে-তিনি বললেন। কত নিয়ে থাকে, তা শুনলে তোমাদের অনেক হোমরাচোমরা ব্যারিস্টার এবং এফ-আর-সি-এসধারী সার্জেন মাথায় হাত দিয়ে বসবেন। তাদের সব গর্ব, সব সাধনা, সব বিদ্যা ক্যাবারে সুন্দরীদের নৃত্যরত পদযুগলের ধাক্কায় উল্টে গিয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাবে!

বাধা দিয়ে বললাম, তুলনাটা তো ঠিক নাচের হল না, ফুটবলের মতো শোনাচ্ছে!

ঠিকই বলেছ। বোসদা বললেন। নৃত্যপটীয়সীরা তো দামি দামি মাথা নিয়ে ফুটবলই খেলেন!

বোসদা আমাকে সাবধান করে দিলেন, অনেক সময় গেস্টরা কাউন্টারে এসে জিজ্ঞাসা করবে, মেয়েরা কত পায়? সব সময় বলবে, মাপ করবেন, জানি না। ক্যাবারের চিঠিপত্তর একেবারে কনফিডেন্সিয়াল।

ক্যাবারে গার্লদের নেপথ্য সমাচার বোসদার কাছেই শুনেছিলাম। ছমাস-আট মাস আগে থেকে এনগেজমেন্ট ঠিক হয়ে থাকে। প্যাবিসে এমন কোম্পানি আছে যাদের কাজ হল এইসব প্রোগ্রাম ঠিক করে দেওয়া। আমাদের হোটেলভাষায়—চেন প্রোগাম; যেমন উত্তরা-পূরবী-উজ্জ্বলাতে সারারণত একই ছবি এসে থাকে। ক্যাবারে গার্লরাও সেই ভাবে নেচে বেড়ায়। পৃথিবীর ম্যাপে ওরা যেন কয়েকটা শহরের উপর লাল ফেঁটা দিয়ে দেয়। হয় পশ্চিম দিক দিয়ে, কিংবা পূর্ব দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কোথাও তিন সপ্তাহ, কোথাও দুসপ্তাহের প্রোগ্রাম থাকে। এক শহরের প্রোগ্রাম শেষ হবার আগে থেকেই পরের শহরে ছবি চলে যায়। বিজ্ঞাপন ছাপা আরম্ভ হয়। এই ভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত দিয়ে তারা দেশে ফিরে আসে।

আজকাল পৃথিবীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। একটা বিরাট ভূখণ্ড, যার নাম চিন, ক্যাবারে ম্যাপ থেকে সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে। ওখানেই আগে মাস পাঁচেক লেগে যেত। এখন ভরসা কেবল মাত্র হংকং। সেখানে আর কদিনই বা থাকা যায়? তাছাড়া ফ্রি পোর্ট। সব কিছুতেই প্রচুর স্বাধীনতা। তাই ওখানকার রাত্রের অতিথিরা অনেক বেশি আশা করেন। ফ্রি পোর্টের অতিথিদের সন্তুষ্ট করা, অনেক মেয়ের পক্ষেই বেশ শক্ত হয়ে ওঠে।

ক্যাবারে-বাজারের সবচেয়ে মূল্যবান পণ্যটির নাম যৌবন। ওই তরল পদার্থটির জোয়ার-ভাটা অনুযায়ী নর্তকীদের দাম ওঠা-নামা করে। তিন মাস অন্তর তাই ছবি তোলাতে হয়। ছবি যে খুব পুরনো নয়, তার সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয় এবং সেই ছবি খুঁটিয়ে দেখে জহুরীরা দর ঠিক করেন। মার্কোপোলোই কতবার বলেছেন, বড় ট্রেচারাস লাইন। চার-পাঁচ বছর আগের পুরনো ছবি চালিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে খুব। সেই জন্যে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা নামকরা ছবির দোকান বেঁধে দিয়েছি। সেখান থেকে ছবি তুলিয়ে, পিছনে ছবি তোলার তারিখটা লিখিয়ে নিতে হয়। কলকাতার এক আধটা দোকানও শুনেছি এই লিস্টে আছে। এখান থেকে ছবি তুলে কুয়ালালামপুর, টোকিও, কিংবা ম্যানিলায় পাঠিয়ে দিতে হয়; এমন কি প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারে সুদূর আমেরিকায় সে ছবি যায়।

বোসদা হেসে বলেছিলেন, হোটেলের রজনীগন্ধাদের দাম অনেক। তোমাকে দুএকটা লিস্টি দিচ্ছি। হাইড্রোজেন বোমা বলে যে জার্মান মেয়েটি এসেছিল, তার রেট প্রতি সপ্তাহে একহ আশি পাউন্ড। থাকা খাওয়া অবশ্যই ফ্রী। আর প্যাসেজ খরচা তো আছেই। তার পর ইজিপসিয়ান ফরিদা, মাখনবক্ষ (বাটার-ব্রেস্টেড) সুন্দরী বলে কাগজে বিজ্ঞাপন লেখা হয়েছিল। তার এবং তার বোন-এর জন্যে প্রতি মাসে তিন হাজার পাউন্ড অর্থাৎ কিনা প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। লোলা দি টমাটো গার্ল, কিউবার মেয়ে। সে রোজ দশটা করে টমাটো সর্বাঙ্গে ঝুলিয়ে রাখত। একশ টাকা করে এক-একটা টমাটো বিক্রি করেছে। দাম দিয়ে দিলেই, নিজের পছন্দ মতো একটা টমাটো দেহ থেকে ছিড়ে নিতে পারো। সে তখন দাঁত দিয়ে টমাটো ফুটো করে, নিজে একটু রস চুষে নিয়ে তোমাকে দেবে। তুমি তারপর একটু চুষে তাকে আবার ফেরত নিতে পারো। সে নিত পাঁচশো ডলার প্রতি সপ্তাহে। কিন্তু মার্জরি, অত বড় গায়িকা, সে পেত মাত্র একশ ডলার সপ্তাহে। তার গান শোনবার জন্যে তেমন ভিড়ও হয়নি। মার্জরি নিগ্রো মেয়ে—এমন অপরূপ কণ্ঠ আমি কখনও

শুনিনি।

এই যে ক্যাবারে সুন্দরীদের এত টাকা দেওয়া হয়, এও বিরাট এক জুয়া। কলকাতার রসিক নাগরিকরা খুশি হয়ে প্রচুর মদ খেয়ে, বার বার এসে হোটেল জমজমাট রেখে, দাম তুলে দেবেন কিনা কে জানে। সপ্তাহে ছদিন তারা কলকাতার রাত্রিকে দিন করে রাখবে। শুধু ড্রাই-ডেতে, অর্থাৎ যেদিন মদ বিক্রি হয় না, সেদিন কোনো শো নেই। সেদিন শুকনো গেলাস নিয়ে কে আর নাচ দেখতে কিংবা গান শুনতে চাইবে? তার পরিবর্তে রবিবারের লাঞ্চের দিন দুপুরে স্পেশাল প্রোগ্রাম। সে প্রোগ্রাম অবশ্য অনেক সংযত। অনেক ভদ্র।

কনির বিজ্ঞাপন বেরোবার পর থেকেই রসিকমহলে সত্যি বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বোসদা বলেছিলেন, বিজ্ঞাপনের ভাষাটা এর জন্যে অনেকটা দায়ী। নারীর সৌন্দর্য বর্ণনার জন্যে অভিধানে যত ভাষা ছিল, তা সিনেমা-ওয়ালা এবং আমরা খতম করে দিয়েছি। যতরকম উত্তেজক শব্দই ব্যবহার করো না কেন, আর তেমন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় না। পোলাও, মুরগির দোপিঁয়াজা বিরিয়ানি ইত্যাদির মধ্যে কিছুদিন ড়ুবে থাকবার পর যা ভালো লাগে তা হল শুক্তো আর মাগুর মাছের ঝোল। তাই বিজ্ঞাপনে সোজা ভাষায় লিখে দিয়েছিলাম, কনি দি উয়োম্যান, মেয়েমানুষ কনি, কলকাতায় আসছে।

বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হবার পরেই টেলিফোনে অনেক অনুসন্ধান এসেছিল। কলকাতায় যাঁদের বাবাদের অনেক টাকা আছে, যে-সব কনট্রাক্টরদের অনেক কাজের প্রয়োজন আছে, যে-সব সেলস অফিসাররা পারচেজ অফিসারদের খুশি করতে চান, তাঁদের অনেকেই ফোন করেছেন। সেই সব ফোনের অনেক কলই আমাকে ধরতে হয়েছে।

হ্যালো, শাজাহান হোটেল?

গুড আফটারনুন, শাজাহান রিসেপশন কথা বলছি।

কনি দি উয়োম্যান সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন? উনি এই শনিবারেই শো আরম্ভ করছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

প্রথম দিনেই একটা টেবিল বুক করতে চাই।

স্যরি। প্রথম দিনে সব বোঝাই। মাত্র সাড়ে তিন শো সিট, বুঝতেই পারছেন।

হ্যালো, শাজাহান হোটেল? কনি দি উয়োম্যান। অ্যাডমিশন ফি কত?

অ্যাডমিশন ফি সেই পাঁচ টাকাই রাখা হয়েছে। আর ডিনার সাত টাকা আট আনা।

ড্রেস?

হ্যাঁ, ড্রেসের রেসট্রিকশন আছে। ইভনিং অথবা ন্যাশনাল।

ফোকলা চ্যাটার্জিও ফোন করেছেন। হ্যালো, বোস নাকি? আমি ফোকলা চ্যাটার্জি কথা বলছি।

মিস্টার বোস এখন নেই, স্যর। আমি শংকর কথা বলছি।

শোনো, ওপনিং ডেটে আমার তিনখানা টিকিট চাই। মিস্টার রঙ্গনাথনের নামে।

একটাও টিকিট নেই স্যর। সব বিক্রি হয়ে গেছে।

বলো কী হে? নিশ্চয় ব্ল্যাক হচ্ছে?

বললাম, না স্যর, আমরা পাঁচখানার বেশি কাউকে দিই নি।

ফোকলা চ্যাটার্জি ছাড়নেওয়ালা নন। বললেন, বাই হুক অর কুক, আমার টিকিট চাই-ই। রঙ্গনাথন তার পরের দিনই চলে যাবেন। তোমার টেবিল কারা কারা বুক করেছে, নাম বলো দেখি। তোমরা বেঙ্গলি বয়, তোমাদের কাছে সব সময় আমরা ফেসিলিটি আশা করি। এই ক্যালকাটার সব আমোদই নন-বেঙ্গলিরা এনজয় করবে, এটা কি ভালো? ফোকলা চ্যাটার্জি কাতর আবেদন করলেন।

বললাম, আমার হাতে কিছুই নেই, স্যর। আমি নাম পড়ে যাচ্ছি। মিস্টার খৈতান, মিস্টার বাজোরিয়া, মিস্টার লাল, মিস্টার ম্যাকফারলেন, সাহা, সেন, চ্যাটার্জি, লোকনাথন, যোশেফ, ল্যাং চ্যাং সেন। আরও অনেক আছেন, সিং, শর্মা, আলী, বাসু, উপাধ্যায়, জাজোদিয়া, মতিরাম, হীরারাম, চুনিরাম, ছাতাওয়ালা, হুইস্কিওয়ালা।

ফোকলা রেগে উঠে বললেন, সব শালা ফোটে ফুর্তি করছে। আর আমরা জেনুইন পার্টি টিকিট পাচ্ছি না।

মানে? আপনি কী বলছেন, স্যর?

সব শালা এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টওয়ালা। মেয়েমানুষের ফুর্তির বিলও কোম্পানিরা কাছে সাবমিট করবে। অথচ আমরা নিজের পয়সায় যেতে চাই, তবু জায়গা যাচ্ছি না। গবরমেন্ট আজকাল নাকডেকে ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা দেখ লে আগরওয়ালার নাম আছে কিনা।

বললাম, আছে স্যর, পাঁচখানা করে দুটো টেবিল আছে।

যাক বাঁচালে ভায়া, ওঁকেই বলি একটা টেবিল ছেড়ে দিতে। ব্যাটারঙ্গনাথন, তেঁতুল। বাঙ্গালোরে তেঁতুল গোলা খায়, আর বুড়ি বউ-এর আঁটা হজম করে। বেচারা বিজনেসের কাজে কয়েকদিনের জন্যে এখানে এসেছে। একটু মনটাকে তাতিয়ে নেবার ইচ্ছে। অথচ একেবারে নিউম্যান।ক্যালকাটার কিছুই জানে না। তার উপর ভীতু মানুষ। প্রাণের ভয়, মানের ভয়, রোগের ভয়। যেখানে সেখানে যেতে সাহস পায় না। তাই আমি গাইডের কাজ করছি।

ফোনটা নামিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মিস্টার চ্যাটার্জি এবার এমন একটি প্রশ্ন করলেন, যা আমি কখনও শুনিনি। বললেন, হ্যাঁ মশাই, মোস্ট ইম্পর্টান্ট পয়েন্টটাই ভুলে যাচ্ছিলাম। স্ট্যাটিসটিকসটা বিজ্ঞাপনে দেননি কেন?

আজ্ঞে স্ট্যাটিসটিকস?

আচ্ছা, আপনি বোসকে জিজ্ঞাসা করে রাখবেন, আমি পরে জেনে নেব। ফোকলা চ্যাটার্জি এবার ফোনটা ছেড়ে দিলেন।

স্ট্যাটিসটিকস শব্দের অর্থ বোসদার কাছে শুনেছিলাম। বোসদা বলেছিলেন, ছিঃ, তুমি না হাইকোর্টে কাজ করেছ। সভ্যতার মাপকাঠি জানো না? আজকের সভ্যতায় পুরুষকে মাপা হয় ব্যাংকের ফিগার দিয়ে, আর মেয়েদের মাপা হয় দেহের ফিগার দিয়ে। ৩৬-২২-৩৪, ৩৪-২০-৩৪-এতেই আমাদের পৃষ্ঠপোষকেরা সব বুঝে নেন।

কনির স্ট্যাটিসটিকস তখন আমাদের জানা ছিল না। মার্কোপোলো বলেছিলেন, ছমাসের পুরনো স্ট্যাটিসটিকস আমার কাছে আছে। কিন্তু তা দেওয়া যায় না।

ফোকলা চ্যাটার্জি আবার ফোন করেছিলেন। বোসদা টেলিফোন ধরে বলেছিলেন, হা স্যর, লেটেস্ট স্ট্যাটিসটিকসের জন্যে আমরা রিপ্লাই-পেড় টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়েছি, এখনও উত্তর আসেনি। বোসদা আরও বলেছিলেন, এবার খুবই সুন্দর জিনিস হবে। শুধু নাচ নয় স্যর, সঙ্গে অন্য জিনিসও আছে।

কী জিনিস মশাই? একটু হিন্ট দিন না। রঙ্গনাথনকে গরম করে রাখি। পুওর ফেললা—ওঁর বউ ভদ্রলোককে ডেলি বঁটা মারে!

বোসদা বললেন, স্যরি, এখন বলবার হুকুম নেই। ওখানেই বুঝতে পারবেন।

 

রাত আটটা থেকে শাজাহান হোটেলের সামনে গাড়িতে গাড়িতে জম-জমাট। যেন কোনো বিশাল জালে দেশের সব সুন্দর গাড়িগুলোকে মাছের মতো টানতে টানতে কেউ শাজাহান হোটেলের সামনে এনে জড়ো করেছে। গাড়ি আসছে, গেটের সামনে মুহুর্তের জন্য থামছে, দারোয়ানজি দরজাটা খুলে স্যালুট দিয়ে সরে দাঁড়াচ্ছে। সায়েব নেমে পড়ছেন।

সান্ধ্য পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে, আমাকে একবার ন্যাটাহারিবাবুর কাছে যেতে হয়েছিল। আমার বিছানার চাদরটা একটু ময়লা হয়ে গিয়েছিল। এক কাড়ি ময়লা কাপড়ের মধ্যে ভদ্রলোক বসেছিলেন। ন্যাটাহারিবাবু বললেন, আপনার চাদর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তা আজ গাড়ি আসছে কেমন?

অনেক—আমি বললাম।

দেশের সবাই এখন সায়েব হয়ে গিয়েছেন, ন্যাটাহারিবাবু বললেন। ১৭৫৭ সালে পলাশির আমবাগানে ইংরেজরা ভারতবর্ষ জয় করেছিল যারা বলে, তারা হিস্ট্রির কচু জানে! আসলে ইংরেজ জিতল তার অনেকদিন পরে, আমাদের এই চোখের সামনে—উনিশো সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট। দেশটা রাতারাতি চিরকালের জন্যে ইংরেজের হয়ে গেল। ন্যাটাহারিবাবু থামলেন। তারপর আবার আরম্ভ করলেন, গান্ধী যখন আন্দোলন করছেন, লোকে যখন জেলে যাচ্ছে, বন্দে মাতরম্ গাইছে, খদ্দর পরছে, আমরা তখন ভয় পেতাম। বেশিদিন হোটেলের চাকরি আমাদের কপালে আর নেই। আমার সম্বন্ধী চৌরঙ্গী পাড়ার সায়েবি সিনেমার অপারেটর। আমরা দুজনে ভাবতাম, স্বাধীন হলেই এ-সব বন্ধ হয়ে যাবে। বিলিতি সিনেমায় মাছি বসবে না, শাজাহান হোটেল খাঁ-খাঁ করবে, মমতাজ বার লাটে উঠবে। ক্রাইস্ট, ক্রিকেট আর ক্যাবারেকে প্যাক করে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে ব্যাটাচ্ছেলে সায়েবরা লম্বা দেবে। বুড়ো বয়সে আমাদের পথে বসতে হবে।

ন্যাটাহারিবাবু এবার উঠে পড়লেন। বললেন, আমাকে একবার আপনাদের কনি মেমসায়েবের কাছে যেতে হবে।

কনির ঘরের দিকে যেতে যেতে ন্যাটাহারিবাবু বললেন, অথচ তাজ্জব ব্যাপার, আমার বালিশের সংখ্যা শুধু বেড়ে যাচ্ছে। মদের বিক্রি ডবল হয়ে যাচ্ছে। ঘরও খালি পড়ে থাকছে না। সেই যে রঞ্জিত সিং বলেছিল, তাই হল—সব লাল হয়ে গেল।

ন্যাটাহারিবাবু বললেন, যাই, আপনার সঙ্গে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান করলে আমার চলবে না। এই কনি মেমসায়েবের আরও বালিশ লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে আসি। আমি পাশ-বালিশ পর্যন্ত অফার করব। ন্যাটাহারিবাবু নাকটা বাঁ হাতে ঘষতে ঘষতে বললেন, ব্যাটারা পাশ-বালিশ ব্যবহার করে না। আমার মাঝে মাঝে প্রতিশোধ নেবার জন্যে ওদের পাশ-বালিশের নেশা ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। দুএকজনের ধরিয়েও দিয়েছি। ওরা নাম দিয়েছে-ন্যাটাহারি পিলো। অভ্যাসটা একবার ধরলে আর ছাড়তে পারবে না। বারোটা বেজে যাবে। এই পাশবালিশ নিয়ে শুয়ে শুয়েই তো আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেল।

বাইরে এসে দেখলাম, আরও গাড়ি আসছে। বুড়ো গাড়ি থেকে ছোকরা নামছে, ছোকরা গাড়ি থেকে বুড়ো নামছে। পুরুষ কলকাতার নির্যাস যেন আমাদের এই শাজাহান হোটেলে ভিড় করছে। আর, আমরা সেইখানে বসে আছি যার দুমাইল দূরে একদা রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অরবিন্দ, সুভাষচন্দ্র ভারত সন্ধানে আত্মনিবেদন করেছিলেন। উইলিয়ম জোন্স প্রাচ্যবাণীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ডেভিড হেয়ার ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন।

 

শাজাহানের মমতাজ রেস্তোরাঁয় আজ তিলধারণের স্থান নেই। রেস্তোরাঁর দরজার সামনে একটা টেবিল, টিকিট বই ও ক্যাশবাক্স নিয়ে উইলিয়ম ঘোষ জাঁকিয়ে বসে আছে। অনেকে অ্যাডভান্স টিকিট কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ফোকলা চ্যাটার্জি তাঁর মিস্টার রঙ্গনাথনকে নিয়ে ইতিমধ্যেই সামনের সারিতে চেয়ার দখল করেছেন। মিস্টার চ্যাটার্জি আজ জাতীয় পোশাক পরেছেন। পরবাসীয়া দরজার মুখে দাঁড়িয়ে সায়েবদের জামাকড়ের দিকে নজর রাখছে।

এক ভদ্রলোক বুশশার্ট পরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। পরবাসীয়া বাধা দিলে। উইলিয়ম উঠে পড়ে দরজার সামনে নোটিসটা দেখিয়ে বললে, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আপনি এই ড্রেসে ঢুকতে পারবেন না। ইংরিজিতে দরজার সামনে জ্বলজ্বল করছে রাইট অফ অ্যাডমিশন রিজার্ভড।

ভদ্রলোকের মুখটা লাল হয়ে উঠল। বললেন, স্বাধীন ভারতে এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার রাজত্ব চলছে? আমি বললাম, যথেষ্ট সময় রয়েছে, আপনি এখনও জামাকাপড় পাল্টিয়ে আসতে পারেন।

ভদ্রলোক রাগে গরগর করতে করতে চলে গেলেন। কিন্তু মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যেই সম্পূর্ণ সায়েব হয়ে ফিরে এলেন। দেখতে পেয়েই আমি তাকে নমস্কার করলাম। ভদ্রলোক বললেন, আমার আড়াইশো টাকা গচ্চা গেল। দোকান থেকে রেডিমেড কিনে পরে আসতে হল। আপনাদের টাইট দিচ্ছি—এ-বিষয়ে আমরা কাগজে চিঠি লিখব।

মদ বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। আটটা থেকেই তোবারক ও রাম সিং ভটাভট সোডার বোতল খুলছে। বিয়ার, হুইস্কি, রাম ও জিন বোতলের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে গেলাসের মধ্যে নাচানাচি করছে। মার্কোপোলো রাম সিং-এর কাছে খবর নিয়ে গেলেন। রাম সিং বললে, বহুৎ গরম। ছে-সাত হাজার রুপিয়াকো সেল হো যায়েগা।

ফোকলা চ্যাটার্জি দুটো হোয়াইট লেবেল টেনে, একটা বড়া পেগ ডিম্পস্কচ-এর অর্ডার দিলেন। এদিকে কাঁচা-পাকা চুলওয়ালা রঙ্গনাথন এক পেগ সিনজানো ভারমুথ নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখেই চ্যাটার্জি বললেন, মিস্টার রঙ্গনাথনকে নিয়ে যে কী মুশকিলেই পড়েছি। বলছি যস্মিন দেশে যদাচার। স্কটল্যান্ডের মেয়ে কনি, আর স্কটল্যান্ডের মাল ডিম্পল। কিন্তু রঙ্গনাথন সায়েব ইটালিকে কোলে করে বসে আছেন।

রঙ্গনাথন মৃদু মাথা নেড়ে বিমর্যভাবে বললেন, ব্লাড় প্রেসার। চ্যাটার্জি বললেন, একটা পেগ চড়ান। প্রেসার তালগাছ থেকে মাটিতে নেমে আসবে। আর কনি আপনার সর্পগন্ধার কাজ করবে। ভারি সিডেটিভ মেয়ে— নার্ভগুলোকে যেন ঘুমপাড়িয়ে দেয়। ক্যালকাটায় ওর এই ফাস্ট-কিন্তু আমার এক বন্ধু কায়রোতে ওকে দেখেছে। ওর শো দেখবার জন্যে বন্ধু আমার দামাস্কাস থেকে কায়রো চলে গিয়েছিলেন।

রঙ্গনাথন বললেন, হুইস্কিটা ঠিক আমার অভ্যাস নেই। জিভ কেটে ফোকলা বললেন, এই সব ইয়ংম্যানদের সামনে ও-কথা বলবেন না। বাহান্ন বছর বয়সে হুইস্কি অভ্যাস করেননি শুনলে এরা হাসতে আরম্ভ করবে। ক্যালকাটায় এটা আমাদের স্বপ্নেরও অতীত।

রাম সিং তোবারক আলি এবং অন্যান্য ওয়েট বয়দের ছোটছুটি বাড়ছে, সিগারেটের কটু ধোঁয়ায় হ-এর বাতাস ঝাঁঝালো হয়ে উঠেছে, যেন একটু আগেই কারা টিয়ার গ্যাস ছুড়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটাও ক্রমশ দশটার ঘরে উঁকি মারছে, ডিনারের প্লেটের টুংটাং শব্দ যেন কোনো অর্কেস্ট্রার অংশ বলে মনে হচ্ছে। ফোকলা চ্যাটার্জি চিৎকার করে উঠলেন, আর কতক্ষণ?

এবার আমার পালা। সর্দিতে বোসদার গলা বুজে গিয়েছে। মাঝে মাঝে কাশছেন। মার্কোপোলেও রাজি হয়েছিলেন। বলেছিলেন ইয়ংম্যানকে একটা সুযোগ দেওয়া যাক। ওধারে গোমেজের দল অবিশ্রান্তভাবে বাজিয়ে চলেছে।

বোসদা দরজার কাছ থেকে আমার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সিনেমা হ-এর মতো হঠাৎ কোণের উজ্জ্বল আলোগুলো নিভে গেল। স্টেজের সামনে গিয়ে মাইকটা বাঁ হাতে নিয়ে দুরু দুরু বক্ষে আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ইঙ্গিতে অর্কেস্ট্রা বন্ধ হয়ে গেল। গোমেজ চাপা গলায় বললেন, চিয়ারিও।

আমি দেখলাম সাড়ে তিনশ লোকের সাতশ চোখ হঠাৎ প্রত্যাশায় সজাগ হয়ে উঠল। আমার মুখ দিয়ে আমার অজান্তেই বেরিয়ে পড়ল—লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। সমস্ত হ-এ সেদিন একটাও প্রকৃত লেডিকে খুঁজে বার করতে পারলাম না। তবু পুনরাবৃত্তি করলাম, গুড ইভনিং, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। শাজাহান হোটেলের এই মধুর সন্ধ্যায় আপনারা আশা করি আমাদের ফরাসি সেফের রান্না এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সযত্নে চয়ন করা ড্রিঙ্কস উপভোগ করেছেন। নাউ, আই প্রেজেন্ট টু ইউ কনি। আপনাদের বৈচিত্র্যময় জীবনে আপনারা অনেক উয়োম্যান দেখেছেন। বাট সি ইজ দি উয়োম্যান—যা এই শতাব্দীতে ভগবান একটিই সৃষ্টি করেছিলেন।

এবার আলোগুলো একসঙ্গে নিভে গেল। সমস্ত হ-এর মধ্যে একটা চাপা প্রত্যাশার গুঞ্জন উঠল।

চাপা প্রত্যাশার গুঞ্জন হঠাৎ যেন কোনো অদৃশ্য প্রভাবে স্তব্ধতায় বিলীন হয়ে গেল। কিন্তু সে কেবল মুহুর্তের জন্য। কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সেই হারিয়ে-যাওয়া শব্দ যেন অকস্মাৎ আলোতে রূপান্তরিত হল। অন্ধকারের বুক ভেদ করে ছুঁচের মতো সরু আলোর রেখা স্টেজের সামনে এসে পড়ল। সেই আলোর রেখা মত্ত অবস্থায় কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কে যেন স্টেজের উপর এসেও দাঁড়িয়েছে; কিন্তু মাতাল আলোর রেখা কোথাও স্থির হয়ে। দাঁড়াতে পারছে না। স্টেজের উপর যে দেহটা অন্ধকারের ঘোমটা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই কি কনি?

পৃষ্ঠপোষকদের ঔৎসুক্যে আর সুড়সুড়ি না দিয়ে আলোর রেখাটা এবার বেশ মোটা হয়ে উঠল। কিন্তু কোথায় কনি? কনি নেই। সেখানে ইভনিং স্যুটপরা দুফুট লম্বা এক বামন ঘোরাঘুরি করছে। তার মাথায় একটা তিনফুট উঁচু টুপি। বামন সায়েবের হাতে ছড়ি।

আশাহত দর্শকদের বিস্ময় প্রকাশের কোনো সুযোগ না দিয়ে বামনটা টুপিটা খুলে বাঁ হাতে নিয়ে, হাতের ছড়িটা ঘুরিয়ে, একটা চেয়ারের উপর উঠে পড়ে বললে—গুড ইভনিং, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। আমিই কনি দি..বলে, যেন ভুলে গিয়েছে এমনভাবে বিড় বিড় করে গুনতে লাগল—ছেলে না মেয়ে, মেয়ে না ছেলে…না, আমিই সেই মেয়েমানুষ কনি, কনি দি উয়োম্যান।

দর্শকরা এবার একসঙ্গে হই-হই করে উঠলেন। সমৃদ্ধ কলকাতার দুএকজন সম্রান্ত নাগরিক আর স্থির থাকতে পারলেন না। চেয়ার থেকে উঠে পড়ে চিৎকার করে বললেন, আমরা কনিকে চাই। এই বিটলে বামনটা কোথা থেকে এল?

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকেও অভিনয় করতে হল। যেন কনির বদলে এই বামনকে স্টেজের উপর দেখে আমিও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছি, এমন ভাব করে মাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই পাঁচ মিনিট আগেও আমি কনির ঘরে গিয়েছিলাম। ওর জামাকাপড় পরা হয়ে গিয়েছিল। একটা ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে যাচ্ছিল। আমাকে বললে, তুমি অ্যানাউন্স করোগে যাও, আমি রেডি, তারপর এই দুফুট ভদ্দরলোক যে কোথা থেকে এলেন!।

বামন কিন্তু দমল না। আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই তেড়ে মাইকের কাছে এসে, মাইকটা নামিয়ে মুখের কাছে এনে, মেয়েদের মতো সরু গলায় বললে, বিশ্বাস করুন, আমিই কনি। আমি একটা ভুল ওষুধ খেয়ে ফেলেছি। সে যাই হোক, আপনারা যে আমার জন্যে এই রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে রয়েছেন, এর জন্যে আমি গর্ব বোধ করছি। বলা শেষ করেই, বামন ক্যাবারে মেয়েদের কায়দায় নাচতে আরম্ভ করলে। সমস্ত হল এবার হই-হই করে উঠল।

আমি এবার মাইকের কাছে গিয়ে বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আপনারা অধৈর্য হবেন না। আমি এখনই ডাক্তার ডাকবার জন্যে লোক পাঠাচ্ছি। ভুল ট্যাবলেট খাবার ফলেই এই অঘটন ঘটেছে।

বামন এবার বললে, পাঁচ মিনিট আগে আমার নারীত্ব, আমার যৌবন সব ছিল। কিন্তু এখন তারা যে কোথায় গেল, বামন এবার নিজের দেহটা নিজেই হাত দিয়ে খোঁজ করতে লাগল। পকেট থেকে আর একটা ট্যাবলেট বার করে সে খেলো। তারপর কি যেন মন্ত্র পড়তে লাগল।

হঠাৎ আবার আলো নিবে গেল এবং প্রথম সারির এক মারওয়াড়ি ভদ্রলোক পরমুহূর্তেই কাতর চিৎকার করে উঠলেন। ও। আমার কোলে কে যেন এসে বসেছে।

আমি এদিকে থেকে অন্ধকারের মধ্যে বললাম, ভয় পাবেন না। কেমন বুঝছেন? মারওয়াড়ির ততক্ষণে ভয় কেটে গিয়েছে। তার কোলে কী জিনিস হঠাৎ ধপাস করে বসে পড়েছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি এবার অবলীলাক্রমে উত্তর দিলেন, বহুত্ সফট—খুব নরম!

এবার একটা আলো জ্বলে উঠল, এবং সেই আলোতে দেখা গেল মারওয়াড়ি ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে বসে রয়েছে কনি। তার মাথায় টায়রা, গলায় হার, পায়ের গোড়ালি থেকে হাতের মণিবন্ধ পর্যন্ত রঙিন নরম কাপড়ে ঢাকা। এবার আরও কয়েকটা আলো জ্বলে উঠল এবং সেই মারওয়াড়ি ভদ্রলোককে টানতে টানতে স্টেজের উপর নিয়ে এসে দর্শকদের দিকে মাথা নত করলে, কনি দি উয়োম্যান।

মারওয়াড়ি ভদ্রলোক ভুড়ি নিয়ে কোনোরকমে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজের চেয়ারে ফিরে গেলেন। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, কনি আপনাদের সামনে উপস্থিত। ইনি টেলিভিশনে বহুবার অভিনয় করেছেন। একবার মহামান্য ষষ্ঠ জর্জের সামনেও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আজ আপনারা সকলেই এই বালিকার মহারাজা। কিং এমপারার অফ কনি দি উহোম্যান!

কনি এবার নাচতে শুরু করল। সেই পুরো কাপড়ের আলখাল্লা সমেত নাচের মধ্যে তেমন গতি ছিল না। দর্শকরা যেন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কনি বললে, মাই ডার্লিং ক্যালকাটাওয়ালাজ, আমি শুনলাম তোমাদের কয়েকজন আমার স্ট্যাটিসটিকস চেয়েছ। আমি দুঃখিত, আমার সংখ্যা কিছুতেই মনে থাকে না। তোমরা কেউ যদি আমার ফিগারগুলো হিসেব করে নিয়ে যাও। অঙ্কের কোনো প্রফেসর এখানে আছেন নাকি?

দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ উত্তর দিলেন না। চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট? কনি মুখ বেঁকিয়ে এবার প্রশ্ন করল। এবারেও কোনো উত্তর নেই।

এনি দর্জি? এবারেও সভাগৃহ নিঃস্তব্ধ হয়ে রইল। মাই ডিয়ার ডিয়ার—কনি কপট দুঃখে চোখ মুছতে লাগল। এই গ্রেট সিটিতে কি দর্জি নেই? তোমাদের গার্লরা কি সেলাই করা কিছুই পরে না?

এবার সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল। আমার গা-টা কিন্তু কেমন ঘুলিয়ে উঠল। মনে হল মাথাটা ঘুরছে। এখনই হয়তো পড়ে যাব। গোমেজ আমার কোটটা টেনে ধরে বললেন, চিয়ার আপ! খুব ভালো হচ্ছে।

এনিবিডি, যে ভালো অঙ্ক করে?-কনি এবার আবেদন জানাল। ফোকলা চ্যাটার্জি যেন সুযোগের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে স্টেজের দিকে আসতে আরম্ভ করলেন। আমি একটা দর্জির ফিতে কনির দিকে ছুড়ে দিলাম।

এদিকে বেঁটে সায়েব আবার হল-এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সুবেশা সুন্দরী কনিকে দেখে যেন সে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। জিভ বার করে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। মাথা চুলকোচ্ছে। কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। স্টেজের অপর অংশে কনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে; ফোকলার হাতে ফিতেটা দিয়ে বলছে, মাপো। গতকালও ছিল ৩৮-২৪-৩৬।

বামনটা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের কানে কানে বললে, আমার ভুল হয়ে গিয়েছিল, আমি কনি নই। আমার নাম ল্যামব্রেটা। ল্যামব্রেটা দি ম্যান।

তারপর মেমসায়েবের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে সে বললে, হ্যালো মি, আমি স্ট্যাটিসটিকসে সুপণ্ডিত। আমি পাশকরা অ্যাকাউন্টেন্ট। আমি নামকরা দর্জি। আমি মুখে মুখে ঢাউস-ঢাউস অঙ্ক কষে ফেলতে পারি। খুব লজ্জিতভাবে কথাগুলো বলে মিস্টার ল্যামব্রেটা কোটের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘন ঘন মুখ মুছতে লাগল।

এদিকে ফোকলা চ্যাটার্জি দীর্ঘাঙ্গিনী কনিকে মাপজোখ করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে দেখে ল্যামব্রেটা আর ধৈর্য ধরতে পারল না। বিচিত্র ভঙ্গিতে সেদিকে ছুটে গেল। তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমার মনে হল ল্যামব্রেটার চোখ দুটো জ্বলছে। ফোকলাকে হাটিয়ে দেবার চেষ্টা করে সে বললে, সরো, আমি মাপব।

ফোকলা প্রথমে তাকে পাত্তা দেননি। কিন্তু ল্যামব্রেটা তখন সত্যিই সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ঠেলতে আরম্ভ করেছে। হলসুদ্ধ লোক হাসিতে হল ফাটিয়ে দেবার উপক্রম করছে। বাধ্য হয়ে তখন বামনের হাতে ফিতেটা দিয়ে মিস্টার চ্যাটার্জি ফিরে এলেন। কনি তখন গুনগুন করে গান ধরেছে। তার হাঁটুর কাছ থেকে ল্যামব্রেটা চিৎকার করে কী যে বলছে, সে যেন শুনতেই পাচ্ছে না। কনি পা-দুটো একটু ফাঁক করে দাঁড়িয়েছিল। তার পায়ের তলা দিয়ে বামন ল্যামব্রেটা দুবার চলে গেল। অশ্লীল ইঙ্গিতে হল-এর কয়েকজন দর্শক সিটি বাজিয়ে দিলেন। ল্যামব্রেটার সেদিকে কিন্তু খেয়াল নেই। বিনয়ে বিগলিত হয়ে সে মেমসায়েবের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। কিন্তু গরবিনী, দীর্ঘাঙ্গিনী কনি যেন তাকে দেখতেই পাচ্ছে না।

বহু চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়ে, ল্যামব্রেটা হঠাৎ কোথা থেকে একটা মই যোগাড় করে নিয়ে এল। মইটা কনির পিঠে লাগিয়ে সে যেমন উঠতে আরম্ভ করেছে অমনি কনি আবার হাঁটতে শুরু করলে। ল্যামব্রেটাও ছাড়বার পাত্র নয়। কনির ফ্রকটা টেনে ধরে রইল। মই-এর তলায় যে দুটো ঢাকা লাগানো ছিল, এবার তা বোঝা গেল। কারণ ল্যামব্রেটাকে নিয়ে মইটাও চলতে আরম্ভ করল। যতই মই-এর গতি বেড়ে যাচ্ছে, ততই ল্যামব্রেটার ভয় বাড়ছে। সে যেন নিরুপায় হয়ে কনির কোমরটা জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে কনি একবার ঘুরে দাঁড়াল। বামন সায়েবও সঙ্গে সঙ্গে বোঁ করে ঘুরে গেল। এবার তার সাহস বেড়ে গিয়েছে, মই বেয়ে সে আরও খানিকটা উঠে গিয়ে বললে, মিস কনি, তোমার জন্যে আমি একটা গোলাপফুল নিয়ে এসেছি।

কনি সৌজন্যে বিগলিত হয়ে বললে, তোমার মতো লোক হয় না, সত্যি সুন্দর গোলাপ ফুল।

এই কথা শোনামাত্রই ল্যামব্রেটা উত্তেজনায় ধপাস করে মই থেকে মেঝের উপর পড়ে গেল। কনি সেদিকে কোনো নজরই দিলে না। ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে, ধুলো ঝেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ল্যামব্রেটা আবার মইটা জোগাড় করে মেমসায়েবের পিঠে লাগিয়ে কনিকে চুমু খাবার চেষ্টা করল। দৈহিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে, ল্যামব্রেটা এবার মুখের ভাষায় কনিকে প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করলে। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। মই বেয়ে উঠে কানে কী বলতেই কোপবতী কনি ল্যামব্রেটার কানটা ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলে। পা দুটো শূন্যে দোলাতে দোলাতে কাতর কণ্ঠে ল্যামব্রেটা বললে, প্লিজ, প্লিজ। আমি ক্ষমা চাইছি, মিস। আমি কখনও আর এত লম্বা মেয়েকে প্রপোজ করব না। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।

ল্যামব্রেটাকে কনি যখন ছুড়ে মেঝের উপর ফেলে দিলে, তখন হাসতে হাসতে কয়েকজন চেয়ার থেকে কার্পেটের উপর গড়িয়ে পড়ল। একমুহূর্তের জন্যে আলো জ্বলে উঠল, এবং সেই আলোতে ল্যামব্রেটাকে ছুটে পালাতে দেখা গেল।

এবার আমি মাইকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ওই বামনটাকে বহুকষ্টে দূর করা গেছে, এবার নাচ আরম্ভ হচ্ছে।

আমার দিকে মিষ্টি হেসে, কনি তার বাইরের আলখাল্লাটা খুলে ফেললে। গোমেজের দল তখন তাদের বাজনার চটুলছন্দে মানুষের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা পশুপ্রবৃত্তিগুলোর ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করছে। নাচতে নাচতে কনি স্টেজ থেকে নেমে একজনের কোলে গিয়ে বসল। আর একজনের রুমাল নিয়ে হাসতে হাসতে নিজের দেহের ঘামটা মুছে ফেললে। আর একজন ভদ্রলোক ডাক দিলেন, আমরা পিছনে পড়ে রয়েছি। কনি ছুটে সেদিকে গেল। ভদ্রলোকের কোলে কিছুক্ষণ বসে রইল। এবার উঠে সে মিস্টার রঙ্গনাথনকে টেনে আনলে। রঙ্গনাথনকে আদর করে বললে, হ্যালো মাই বয়, আমার কোলে বোসো।

রঙ্গনাথন আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কনি শুনলে না, জোর করে তাঁকে নিজের কোলে বসিয়ে দিলে। রঙ্গনাথনেরা মনটা এতক্ষণে বোধহয় নরম হল। নেশার ঘোরে কনির ফ্রকটা হাত দিয়ে দেখে বললেন, বাঃ, চমৎকার তো।

কনি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললে, আমি একটা খনির মতো। যতই খুঁড়বে ততই ভালো জিনিস পাবে।

কনির কথা থেকে রঙ্গনাথন কী বুঝলেন কে জানে। কিন্তু কনির নিজের আর সময় নেই। রঙ্গনাথনকে এবার স্টেজ থেকে সরিয়ে দিয়ে সে তার নৃত্য শুরু করে দিল। এক-এক করে তার দেহের বাস খসে পড়ছে। মাথার মুকুট বিদায় নিয়েছে। হাতের দস্তানা উধাও হয়েছে। এবার স্কার্টটাও খুলে পড়ল। নারী-মাংসাশী কলকাতা এবার প্রত্যাশার উত্তেজনায় হই-হই করে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আশাভঙ্গের বেদনা। তারা যা চেয়েছিলেন তা যেন হয়নি। কনি ভিতরে যে পরের পর অনেকগুলো জামা পরেছে তা তাঁরা এতক্ষণে বুঝলেন।

তারপর? তারপর আমার কিছুই মনে নেই। দেখলাম, গোমেজের মুখটা যেন ঘৃণায় এবং ক্লান্তিতে বেঁকে গিয়েছে। তার সহকারীরা যন্ত্রের মতো দ্রুতবেগে বাজিয়ে চলেছে। হঠাৎ মনে হল, কনির দেহে কিছুই নেই। সেই মুহূর্তেই সমস্ত হল্টা অন্ধকার হয়ে গেল। একটা পাতলা ওড়না মেঝে থেকে তুলে নিয়ে কোনোরকমে লজ্জানিবারণ করতে করতে কনি অদৃশ্য হয়ে গেল।

আবার আলো জ্বলে উঠল। প্রচণ্ড হই-ই-এর মধ্যে অবিশ্রান্ত হাততালি পড়তে লাগল। স্টেজে দাঁড়িয়ে দেখলাম, অসংখ্য জামাকাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে। বেঁটে ল্যামব্রেটা স্কার্ট, প্যান্টি, ফ্রক, ব্রেসিয়ারের টুকরোগুলো আস্তে আস্তে কুড়িয়ে নিচ্ছে। আমি মাইকে ঘোষণা করলাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টালম্যান, এবার আমাদের কয়েক মিনিট বিরতি।

গোমেজ রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, ডেথ-নেল অফ সিভিলাইজেশন—সভ্যতার মৃত্যু-ঘণ্টা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না?

আবার বাজনা বেজে উঠল। কয়েক মিনিটের অবসরে অতিথিদের অনেকেই আরও কয়েক পেগ টেনে নিলেন। আর রঙ্গনাথনও দেখলাম হুইস্কির স্বাদ গ্রহণ করছেন।

আবার আলো নিভে হোল। ঝুমুরের ঝুমঝুম শব্দে এবার সমস্ত হঘরটা ভরে গেল। গোমেজের সঙ্গীতযন্ত্র থেকে এক অদ্ভুত শব্দধারা বেরিয়ে আসতে লাগল। মনে হল, যেন কোনো গভীর অরণ্যে আমি বসে রয়েছি—যেখানে ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে। পুরুষ হরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার, তাহারা পেতেছে টের, আসিতেছে তার দিকে। আজ এই বিস্ময়ের রাতে তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে। মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে, তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে হরিণেরা আসিতেছে।

আস্তে আস্তে আলো জ্বলে উঠল। স্টেজের উপর কনি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ কী! কনির দেহে এবার কোনো কাপড় নেই। শুধু বেলুন। অসংখ্য রবারের রঙিন বেলুন ওর লজ্জা নিবারণ করছে। রঙিন বেলুনের উপর রঙিন আলো পড়ে নানা বিচিত্র রঙের সৃষ্টি হতে লাগল। আর তার মধ্যেই কনি নাচ শুরু করল। কনি নাচছে। নাচছে তো নাচছেই। নাচতে নাচতেই সে তার বেলুনশরীর নিয়ে অতিথিদের মধ্যে নেমে এল। হাতে একটা ছোট লোহার যন্ত্র রয়েছে। সেইটা একজনের হাতে দিয়ে বললে, একটা বেলুন ফাটাও।

ভদ্রলোক লোহার খোঁচাটা কনির বুকের কাছের একটা বেলুনে সজোরে ঢুকিয়ে দিলেন। একটা বিকট আওয়াজ করে বেলুনটা ফেটে চুপসে গেল।

একটু নাচানাচি করে কনি একজনের কাছে গেল। তিনিও একটা বেলুন ফাটিয়ে দিলেন। বেলুনের সংখ্যা যতই কমছে কনির নিরাবরণ দেহের তত বেশি অংশ দেখা যাচ্ছে। ততই হ-এর উন্মাদনা বাড়ছে। পুরুষ হরিণদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নেই। সন্দেহের ছায়া নেই কিছু। কেবল পিপাসা আছে। আর আছে রোমহর্ষ। আজ এই বসন্তের রাতে লালসা, আকাঙ্ক্ষা, সাধ, স্বপ্ন সবদিকে স্ফুট হয়ে উঠেছে।

কনির দেহে এখন মাত্র তিনটে বেলুন রয়েছে। সেই বেলুনগুলো ফুটো করবার জন্যে কয়েকজন বুড়ো একসঙ্গে ছুটে এলেন। দুম দুম করে কয়েকটা আওয়াজ হল—আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত আলো নিভে গেল। সেই অন্ধকারে পালাতে গিয়ে কার্পেটে পা আটকিয়ে বেচারা কনি হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অন্ধকারের মধ্যেই তাড়াতাড়ি তাকে টেনে তুললাম। হাঁপাতে হাঁপাতে সে কোনোরকমে বললে, প্লিজ, আমার আলখাল্লাটা দাও।

আলখাল্লাটা তার হাতে দিয়ে দিলুম। এবং সে ছুটে হল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আলো জ্বলে উঠল। সেই আলোতে এতক্ষণে যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমারই ঠিক পাশে কনির একজোড়া জুতো পড়ে রয়েছে। গোমেজ মাথা নিচু করে তাঁর ছেলেদের নিয়ে যন্ত্রগুলো গুছোতে লাগলেন। মাইকের কাছে গিয়ে কোনোরকমে বললাম, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, এই আনন্দসভায় উপস্থিত থাকবার জন্যে কনি এবং শাজাহান হোটেলের তরফ থেকে আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শুভরাত্রি।

 

এখনও মুক্তি নেই। ফোকলা চ্যাটার্জি কাছে এসে বললেন, মিস্টার রঙ্গনাথন কনির সঙ্গে একটু দেখা করতে চান।

আরও দু-একজন একই অনুরোধ করলেন। বললাম, স্যরি, তার কোনো উপায় নেই।

ফোকলা দেহটা দুলিয়ে বললেন, এইজন্যেই আমি প্রথম শোতে আসতে চাই। পরের শোতে মেয়েটা এতটা ফ্রি থাকবে না। কলকাতার ল অ্যান্ড অর্ডারের মালিকরা এতটা কিছুতেই অ্যালাউ করবে না। অন্তত লাস্ট তিনটে বেলুন কিছুতেই ফাটাতে দেবে না। যাবার আগে ফোকলা চ্যাটার্জি বললেন, আর-একটা কথা, আপনি বেঙ্গলি বলেই জিজ্ঞাসা করছি। আচ্ছা, ওরা বোধহয় একেবারে নেকেড হয় না। তাই না? সেটা তো ক্যালকাটায় চলে না। বোধহয় একটা পাতলা সিল্কের নাইলনের কিছু পরে থাকে, তাই না?

কানের পাতা দুটো বেশ গরম হয়ে উঠেছিল। মুখ দিয়ে কথাও বেরুচ্ছিল। ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি।

আমার সামনে গোমেজ তখন এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, চলুন, এবার ঘরে ফেরা যাক।

ফোকলা চ্যাটার্জি আর রঙ্গনাথনের মধ্যে কী কথা হল। ফোকলা আমার হাতটা ধরে বললেন, চলুন না, একটু প্রাইভেট কথা ছিল। স্ট্রিক্টলি প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল।

ফোকলার সঙ্গে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আপনাদের এখানে এলে বড় আনন্দ হয়। এমন রেসপেক্টেবল হোটেল ইন্ডিয়াতে আর একটাও নেই। অন্য জায়গাতেও তো শো হয়, কিন্তু সেখানে ডিগনিটি থাকে না। যা বলছিলাম, আপনি বেঙ্গলি। আপনাকে আমার দেখা কর্তব্য। যাতে আপনিও মাইনে ছাড়া দুটো পয়সা হাতে পান, তার জন্যে চেষ্টা করা আমার ডিউটি।

আমি তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। ফোকলা চ্যাটার্জি এবার রঙ্গনাথনের দিকে ঝুঁকে, ওঁর কাছ থেকে গোটা কয়েক দশ টাকার নোট নিয়ে আমার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বললেন, আসলে মুশকিল হয়েছে কি জানেন? মিস্টার রঙ্গনাথন খুবই লোনলি ফিল করছেন। কলকাতায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে আছেন। আমি এখনই বাড়ি ফিরে যাব। আমার ওয়াইফ এখনও ওয়েট করছেন। কনিকে একটু রাজি করিয়ে দেন যদি। রাত্রি তো এখনও বেশি হয়নি। তাছাড়া ওদের তো রাত্রিজাগা অভ্যাস আছে। সারাদিন ওরা ঘুমোতে পারে।

কোনো উত্তর দেবার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। শুধু হাতটা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সরিয়ে নিয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রাত্রের অন্ধকারে হা-হা করে হেসে উঠলেন ফোকলা চ্যাটার্জি। হাসতে হাসতেই বললেন, টু ইয়ং! আপনি একেবারে কঁচা। একেবারে কচি!

নোটগুলো নিজের পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে তিনি বললেন, বেশ মুশকিলে ফেললেন আপনি। এ-জানলে অন্য কোথাও আগে থেকে অ্যারেঞ্জ করে রাখতাম। ভেরি ইম্পর্টেন্ট পারচেজ অফিসার। ওঁকে তো আর যে-কোনো জায়গায় রাত কাটাতে বলতে পারি না।

মিস্টার রঙ্গনাথনকে নিয়ে ফোকলা চ্যাটার্জির গাড়ি চলে গেল। আমারই চোখের সামনে দিয়ে একে একে সমস্ত গাড়িগুলো তাদের মালিকদের নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আজ আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আজ সন্ধ্যাতে খাওয়ার সময় পাইনি। তবু এখনও কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হঠাৎ হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

অনেকক্ষণ বাস-ট্রাম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলকাতা এবার সত্যিই ঝিমিয়ে পড়েছে। কে যেন পেথিডিন ইঞ্জেকশন দিয়ে অসুস্থ কলকাতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। রাত্রের কলকাতার এমন শান্ত অথচ ভয়াবহ রূপ আমি কোনোদিন দেখিনি। হোটেল থেকে বেরিয়েই চিত্তরঞ্জন এভিন ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে যাঁর সামনে এসে দাঁড়ালাম, তার নাম স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। চৌরাস্তার মোড়ে বিচারকের বেশে বিশালবপু স্যর আশুতোষ সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। স্যর আশুতোষের মাথার অনেক উপরে কলকাতা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের সদর দপ্তরের চূড়ায় গোলাকার আলোর পৃথিবীটা তখনও নিজের মনে ঘুরছে।

 

আবার আপনাদের মার্জনা ভিক্ষা করি। বোসদা বলে দিয়েছিলেন, শুধু দেখে যাবে। প্রশ্ন করবে না। তবুও দুপুর রাতে নিজেকে প্রশ্ন করতেই হল, এই কি কলকাতা? এই কি আমাদের সব স্বপ্নের ধন শহর কলকাতা? না, লিবিয়ার গহন অরণ্যে সহায়-সম্বলহীন আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি?

সেই রাত্রেই এই কলকাতার এক নাগরিক কবিকে মনে পড়ে গিয়েছিল। তিনি সত্যসুন্দরদার প্রিয় কবি। সত্যসুন্দরদাই আমাকে অনেকবার পড়ে শুনিয়েছেন–

হাইড্রান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল;
অথবা সে-হাইড্রান্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।

 

নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদি রমণী;

 

ফিরিঙ্গি যুবক কটি চলে যায় ছিমছাম।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার করে
বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে।

 

নাগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব–অতিবৈতনিক,
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।

 

হুজুর, আপনি এখানে?

আমি চমকে উঠে দেখলাম, আমাদেরই হোটেলের দুজন ওয়েটার দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোমরা এখানে? আমি প্রশ্ন করলাম।

আমরা এখানে ঘুমোই। রান্নাঘরে একটুও জায়গা নেই। কুকের মেটরা সেখানে কাউকে ঢুকতে দেয় না।

হোটেলের লাউঞ্জে অনেক জায়গা পড়ে আছে, কার্পেটের উপর ইচ্ছে করলেই কয়েকটা লোক ঘুমিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে হোটেলের সৌন্দর্য নষ্ট হবে! সেখানে কাউকে শুতে দেওয়া যায় না। বাইরের গাড়িবারান্দাও নিষিদ্ধ। সেখানে হোটেলের কর্মচারী পড়ে থাকলে হোটেলের সম্মানের ক্ষতি হয়। তাই স্যর আশুতোষ এবং ভিক্টোরিয়া হাউসের পদতলে আশ্রয় গ্রহণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

তোমরা খেয়েছ? প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, ছোট শাজাহানের সঙ্গে পাকা ব্যবস্থা করা আছে। প্রত্যেক মিল চৌদ্দ পয়সা। শুধু মায়াধর খায়নি।

কেন মায়াধর, তুমি খাওনি কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। মায়াধর তখন ঘাসের উপর বসে পড়েছে : যন্ত্রণায় পায়ের ডিমটা সে চেপে ধরে আছে। বেয়ারাদের একজন বললে, ওর পায়ের ব্যথা বেড়েছে। পায়ের শিরাগুলো আজকে খুব কষ্ট দিচ্ছে।

হাঁটু গেড়ে বসে ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনের বিনা পয়সার আলোয় দেখলাম, ওর পায়ে নীল শিরাগুলো দড়ির মতো ফুলে ফুলে উঠেছে। যেন অনেকগুলো নীল সাপ একসঙ্গে ওর পা জড়িয়ে ধরেছে। সত্যদার কাছে শুনেছি, এর নাম ভেরিকোজ ভেন।

বেয়ারাদের একজন বললে, হুজুর, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়। পা দুটোকে কেটে ফেলে দিই। আমাদের শেষ ওতেই। বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শিরাগুলো ফুলতে আরম্ভ করে। সায়েবেদের কাছে লুকিয়ে রাখতে হয় হুজুর। স্টুয়ার্ড জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে।

ডাক্তার দেখাও না তোমরা? আমি জিজ্ঞেস করেছি।

সুই লাগাতে হয়, অনেক টাকা লাগে। আর ডাক্তার বলে, পা দুটোকে বিশ্রাম দাও। তা হুজুর, হোটেলের কাজ করব আবার পা-কে বিশ্রাম দেব তা তো হয় না।

মায়াধরকে বললাম, তুমি এখনও ডাক্তার দেখাওনি?

মায়াধর বললে, বোসবাবু এক জানাশোনা ডাক্তারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু যাওয়া হয়নি। টাকা জমাচ্ছি—অনেক সুই দিতে হবে যে। এবার যেতেই হবে। নইলে ভরতের মতো হবে। এর পরেই সমস্ত পায়ে ঘা হবে। সে ঘা ফেটে রক্ত পড়বে। আর দাঁড়িয়ে থাকবার মতো অবস্থা থাকবে না। চাকরি যাবে। ছেলেপুলে নিয়ে না খেতে পেয়ে মারা যেতে হবে হুজুর।

রাত অনেক হয়েছে, তোমরা শুয়ে পড়ো। এই বলে আমি হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

কোথায় যাব আমি? আমি নিজেই তা জানি না। রাত্রের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে কার্জন পার্কে এসে ঢুকলাম। সেখানেও অনেকে ঘুমিয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যেও শাজাহান হোটেলের আমার সহকর্মীরা আছে কিনা কে জানে। স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার পদতলে পাথরবাঁধানো লোভনীয় জায়গাটা কয়েকজন ভাগ্যবান অনেক আগেই দখল করে নিয়েছে। রেলিংয়ের পশ্চিমদিক থেকে রাস্তার আলো এসে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার পা ধুইয়ে দিচ্ছে। সেই আলোর অত্যাচার থেকে রক্ষে পাবার জন্যে হরিরাম ধর্মশালার অতিথিরা বেশ সুন্দর বুদ্ধি খাটিয়েছে। চোখের উপর বড় বড় শালপাতা চাপিয়ে তারা একটা আবরণ সৃষ্টি করেছে। কর্পোরেশনের বিনা পয়সার বিতরিত আলো শালপাতার উপর এসে আটকে গিয়েছে। তার তলায় অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারেই যেন ঘুমিয়ে রয়েছে আমার ভারতবর্ষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *