০৮. বিশ্বাস

০৮. বিশ্বাস

[এক]

দূরের দিগন্তে, যেখানে একটু আগে সূর্যের শেষ রক্তিম আভাটুকু মিলিয়ে গেছে, সেখানে এখন ভর করেছে অঘোর অন্ধকার। আর সেই অন্ধকার কেটে কেটে, মাথায় পাটের বোঝা নিয়ে লোকালয়ে ফেরত আসছে দুটো ছায়ামূর্তি। নাজিমুদ্দিন এবং তার ছেলে মতি। বয়সের তুলনায় মতির শরীরের বাড়ন চোখে পড়ার মতো। চাষাভুষার ছেলে, প্রকৃতির নির্মল আলো-বাতাস খেয়েদেয়ে বড় হয়। মাটি আর জলের সংস্পর্শ পেয়ে এরা যেন পতিত জমির মাঝে আগাছার মতো তরতর করে বেড়ে ওঠে।

মতি নাজিমুদ্দিনের আগে আগে হাঁটছে। চারপাশের প্রকৃতির মতো তারাও চুপচাপ, শান্ত। একটু পরে কথা শুরু করে দেয় মতি। ‘জানো বাজান, আমাগো ইশকুলে নতুন যে হেডমাস্টার আইছেন, উনি কইছেন আমি নাকি বিরিত্তি পাইবার পারি।’

নাজিমুদ্দিন ক্লান্ত, কিন্তু কোমল গলায় জানতে চাইলো, এইটা আবার কী জিনিস, বাজান?’

‘একটা পরীক্ষা হয় বাজান। ইশকুলের যেই পোলা-মাইয়ারা পড়ালেহায় ভালো, তারা এই পরীক্ষা দেয়। তাগো মইধ্যে থেইকা যারা বেশি ভালো পরীক্ষা দিবার পারে, তাগোরে সরকার পুরস্কার দেয়। ম্যালা ট্যাহা দেয়।’

‘সইত্য?’, ক্লান্ত চোখে বিস্ময় জাগে নাজিমুদ্দিনের। তার ছেলে এই বয়সে টাকা পাবে, তাও আবার পড়ালেখা করে–তা যেন অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে।

‘হ বাজান। আমাগো নতুন হেডমাস্টার তো এমনডাই কইছে।’

‘হেডমাস্টরে কইছে তুই এই পুরস্কার পাইবি?’

‘হ, কইছে ভালা কইরা পইড়তে। আরও মন দিয়ে পইড়লে আমি নাকি এই পুরস্কার পাইবার পারি।’

চোখমুখ ঝলমল করে ওঠে নাজিমুদ্দিনের। সন্তানের এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কাছে, চোখের সামনে থাকা ঘুটঘুঁটে অন্ধকারকে তার বিভ্রম বলে মনে হয়। কিন্তু, পরক্ষণেই আজমল ব্যাপারীর কথা মনে পড়লে নাজিমুদ্দিনের স্বপ্নভঙ্গ হয়। বেপারীর কাছে তার সমস্ত ভিটেমাটি বন্ধক দেওয়া। চড়া সুদের ঋণ শোধ করা না গেলে নাজিমুদ্দিনকে সংসার পাততে হবে খোলা আকাশের নিচে। সন্তানের কাঁধে ভর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন নাজিমুদ্দিনের চোখের তারায় ভেসে উঠেছিল–বেপারীর কথা মনে পড়ায় তা যেন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আবার ক্লান্তি ভর করে নাজিমুদ্দিনের শরীরে। মাত্র এক ক্রোশের পথ, কিন্তু তার কাছে মনে হয়–অনন্তকাল ধরে সে এই পথে হাঁটছে। এই পথ যেন কোনোভাবে ফুরোবার নয়।

দুজনের মাঝে আবারও নীরবতা ভর করে; কিন্তু থামে না নির্জনতার গায়ে ভর করে পথ পাড়ি দেওয়ার তাদের সেই আবহমানকালের যাত্রা। এভাবেই কেটে যায় তাদের জীবন। জীবিকার অন্বেষণে কতো স্বপ্নকে তারা পায়ে মাড়িয়ে যায় এই দিগন্ত-বিস্তৃত মাঠে, কতো স্বপ্ন যে কর্দমাক্ত মাটির সাথে লেপ্টে যায়–মহাকাল তার সাক্ষী।

হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে জ্বলে ওঠে একটা ছোট্ট আলোর রেখা। খানিক দূরে, কেউ যেন একটি ছোট্ট পিদিম হাতে এগিয়ে আসছে এদিকে। আলোটা কাঁপছে। এই সময়ে এদিকটায় কারও আসবার কথা নয়। নাজিমুদ্দিন থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পড়ে মতিও। আগত আগন্তুককে দেখার আশায় বিলের একপাশটায় তারা অপেক্ষা করে।

অনেকক্ষণ পরে একটা ছায়ামূর্তি চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। আরও কাছাকাছি আসার পরে তারা আবিষ্কার করে আগন্তুককে। পাশের গ্রামের রাসুর মা। পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলাকে সন্ধ্যার এমন ঘোর অন্ধকারে দেখতে পেয়ে নাজিমুদ্দিন বেশ অবাক হয়। নাজিমুদ্দিনের বিস্ময়ের রেশ কাটবার আগেই রাসুর মা বলতে শুরু করে, নাজিমুদ্দিন না?’

‘হ বুজান।’, নাজিমুদ্দিনের ত্বরিত উত্তর। ‘এই রাইতের বেলা, একলা কই থেইকা আইতাছো গো বু?’

রাসুর মা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে তার শরীর ক্লান্ত। হাতে থাকা জ্বলন্ত পিদিম মাটিতে রেখে আইলের ওপর বসে পড়লো রাসুর মা। হাত দিয়ে ইশারা করে নাজিমুদ্দিনকেও বসতে বললো। রাসুর মায়ের ইশারা পেয়ে মাথা থেকে পাটের বোঝা দুটো আইলে রেখে বসে পড়লো নাজিমুদ্দিন এবং মতি।

‘আরে শোনো নাজিমুদ্দিন, দুনিয়ার খবর কোনোকিছু রাহো?’

বিস্ময়ের রেশ যেন আরও বেড়ে যায় নাজিমুদ্দিনের। কৌতূহলী গলায় জানতে চাইলো নাজিমুদ্দিন, ‘কিছু হইছেনি বু?’

‘হইছে মানে? আমাগো কপাল খুইল্লা গেছে গা।’

নাজিমুদ্দিনেরা হাভাতে মানুষ। কপাল খোলার গল্প শুনলে তাদের আগ্রহ এবং আবেগ–দুটোই হড়বড় করে জেগে ওঠে। রাসুর মায়ের পিদিমের আলো হোক কিংবা কপাল খুলতে যাওয়ার আনন্দ এবং আগ্রহের উচ্ছ্বাস–কোনো এক বিচিত্র কারণে নাজিমুদ্দিনের চেহারা থেকে সমস্ত অন্ধকার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। মাটিতে হাত-পা ছেড়ে বসে পড়লো নাজিমুদ্দিন। বললো, ‘বুজান, কী হইছে খুইল্লা কও তো!’

রাসুর মা খুলে বসল গল্পের ঝাঁপি। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো এক আল্লাহওয়ালা পীর সাহেবের গল্প, যিনি গতকাল সোনারচরে আবির্ভূত হয়েছেন। উনি কোথা থেকে এসেছেন, কীভাবে এসেছেন তা সম্পর্কে কেউ ওয়াকিবহাল নয়। কারও কারও ধারণা–তিনি বাতাসে উড়ে এসেছেন, আবার কারও কারও মতে তিনি পানির ওপর হেঁটে সাগর পাড়ি দিয়ে এই সোনারচরে এসেছেন কেবল এখানকার গরিব মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে। সবাই বলাবলি করছে–এই পীরের হাতে মাটিও সোনা হয়। পাথর হয়ে যায় বরফ। এই পীরের আবির্ভাবের পর থেকেই সোনারচরে মানুষজনের ঢল নেমেছে। দল বেঁধে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা আসছে পীর সাহেবের পায়ের ধুলো নিতে। জানা গেছে–পীর সাহেবের ফুঁ দেওয়া পানি খেয়েই ভালো হয়ে গেছে শমসু তরফদারের নাতির পেটের অসুখ। মরতে বসা ওই বাচ্চাটার জীবন বাঁচানোয় শমসু তরফদার ওই পীর সাহেবের জন্য খানকা শরীফও বানিয়ে ফেলেছে।

নাজিমুদ্দিনের আগ্রহ যেন আকাশ ছুঁতে চায়। এমন কামেল পীর কেন আরও আগে এই তল্লাটে পা রাখেনি, সেই দুঃখটাও একটুখানি ঢু মেরে গেলো খুশিতে তড়পাতে থাকা নাজিমুদ্দিনের মনে।

রাত বাড়ে, রাসুর মায়ের গল্প থামে না। জানো নাজিমুদ্দিন, পীর সাবের এক্কেবারে নূরানি ছুরত। দেখলে মনে অইবো আল্লাহর ফেরেশতা নাইমা আসছে আকাশ থেইকা। হুনছি, চোখ বাঁইধলে পীর সাবে মক্কা-শরীফ দেখতে পায়। কতো বড় কামেল পীর ভাবো তাইলে?

‘তাঁতিপাড়ার ওপরে এইডা আল্লাহর খাস রহমত গো বু৷ নইলে দুনিয়ার এতো জায়গা রাইখা এমন পীরে আমগো এদিকে আইবো ক্যান, কও?’, নাজিমুদ্দিন বলে।

‘ঠিকই কইছো তুমি। এইটা আমাগো কপালের জোর।

ঠিক হলো আগামীকাল ভোরে নাজিমুদ্দিন মতিকে নিয়ে পীর সাহেবের দর্শনে যাবে। মতির জন্য প্রাণভরে দুআ নিয়ে আসবে যাতে সে হেডমাস্টারের বলা বৃত্তিটা পেয়ে যায়। নাজিমুদ্দিনের বিশ্বাস–এই পীর মতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই সব হয়ে যাবে। যে পীরের ফুঁ দেওয়া পানি খেলে পেটের কঠিন অসুখ সেরে যায়, তার হাতের স্পর্শ পেলে যে-কারও ভাগ্যও যে বদলে যাবে–তা তো চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু বাধ সাধে মতি। এই এতোক্ষণ পরে সে একটা কথা বলে উঠলো। ঠিক কথা নয়, যেন প্রতিবাদ করে উঠেছে নাজিমুদ্দিনের সরলমনা ছেলেটা।

মতি বললো, ‘বাজান, আমার কাইলকা ইশকুল আছে। কতোগুলান পড়া জমা আছে তুমি জানো? আমি কোনোখানে যাবার পারুম না। তোমরা যাও গা।

মতির এমন আস্পর্ধা, এমন দুঃসাহস আর দুর্মতি দেখে সবচেয়ে বেশি অবাক হয় রাসুর মা। পীর সাহেবের সোহবতে যেতে অস্বীকার করা মতিকে একপ্রকার তিরস্কার করে রাসুর মা নাজিমুদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলে, নাজিমুদ্দিন, কী পোলা বানাইতাছো তুমি, হ্যাঁ? পোলা তো নয় যেন সাক্ষাৎ শয়তান দেখতাছি। পীরের বাড়িত যাইতে চায় না তোমার পোলায়। শয়তান না হইলে এমন কথা মুখ দিয়ে বাইর হয় ক্যামনে?

অপমানটা বেশ ভালোভাবেই গায়ে মাখে দুরন্ত কিশোর মতি। সে বলে, আমারে নিয়া তোমার এতো ভাবা লাগবো না গো ফুফু। তুমি তোমার ঘর লইয়াই ভাবো। মাঠে আসার কালে দেখলাম ফুফা কাশতে কাশতে শেষ হইয়া যাইতাছে, আর তুমি কিনা পীরের কেরামতির গল্প বিলাইতে বিলাইতে হয়রান।

আর নিতে পারলো না রাসুর মা। রাগ আর অপমানে যেন মাটির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলেই বেঁচে যায়। যতো বড়ো মুখ নয় ছেলের ততো বড়ো কথা! নাজিমুদ্দিনের মতো ভদ্রগোছের কারও ঘরে এমন ইবলিশ যে পয়দা হতে পারে–তা যেন রাসুর মা বিশ্বাস করতে পারে না। শেষ জামানা যে চলেই এলো, এ বুঝি তারই সাক্ষী!

মাঝখানে কথা বলে ওঠে নাজিমুদ্দিন। মতিকে থামাতে চেয়ে বলে, ‘মতি, কেমন কথা কস বড় মাইনষের লগে? তুই না গেলে না গেলি, তাই বইলা আরেকজনরে খোঁটা দিয়া কথা কইবি?’

মতি বিনীত সুরে বলে, ‘না বাজান, আমি খোঁটা দিই নাই। ফুফার শইলের যে কী অবস্থা, মাঠে আওনের সময়ে দেখলা না তুমি? কাশতে কাশতে গলা দিয়া রক্ত আওনের জোগাড়। কেউ নাই যে এক গেলাস পানি আগাইয়া দিবো। ফুফার জায়গায় তুমি হইলে, তোমারে রাইখা মা যদি এমনে পীর-বাবার গুণগান গাইয়া পাড়া বেড়াইতো, তোমার কেমন লাইগতো কও তো?’

মতির বয়স কম, কিন্তু তার যুক্তি-তর্ক দেখে নাজিমুদ্দিনের মনে হলো–ছেলের যেন বয়স অনেক বেড়ে গেছে। আষাঢ় মাসের এমনই এক গুমোট-লাগা সময়ে মতির জন্ম। যেন সেদিনকার কথা, এখনো সবটা মানসপটে জ্বলজ্বল করছে। সেই মতি আজ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের তফাৎ করা শিখে গেছে। বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা আনন্দোৎসব লেগে যায় নাজিমুদ্দিনের। কিন্তু রাসুর মায়ের সামনে সেই আনন্দ উদযাপন করা যাবে না কোনোভাবে। নাজিমুদ্দিন নিজেকে সামলায়, এরপর শাসনের সুরে মতিকে পাল্টা জবাব দেয়, ‘হইছে, তোর আর এইহানে মাথা দেওন লাগবো না। তুই ইশকুলেই যাইস। পীর-বাবার কাছে যাওনের দরকার নাই তোর। আমি আর বুবু মিইল্যা যামু নে।’

কিন্তু নাজিমুদ্দিনের কথায় খুব একটা তৃপ্ত হতে পারে না রাসুর মা। রাগে গিজগিজ করতে করতে নাজিমুদ্দিনের মুখের ওপর বলে, একটা কালসাপ জন্ম দিছস রে, নাজিমুদ্দিন। পীর-বাবার কেরামতি নিয়া সন্দেহ করে তোর পোলা। আমি কইয়া গেলাম আইজ, তোর এই পোলা ঈমানহারা হইয়া মরবো।

কথাগুলো বলতে বলতে, মাটিতে রাখা পিদিম হাতে তুলে নিয়ে, অন্য আরেকটা সরু আইল ধরে হাঁটা শুরু করে রাসুর মা। নাজিমুদ্দিনদের সাথে একই আইল ধরে বাড়ি যাওয়ার কোনো ইচ্ছে হয়তো বা আর নেই। অথবা, মতির মতো এমন দুর্মতিসম্পন্ন নাবালকের সাথে যাওয়াটাকে রাসুর মা হয়তো পাপ হিশেবে গণ্য করছে।

[দুই]

সোনারচরের যে খানকায় পীর সাহেব আসর পেতেছেন, সেখানে নিত্যনিয়ত শত মানুষের ঢল নামে। কেউ ব্যবসাপাতির উন্নতির বায়না নিয়ে আসে, কেউ আসে পেটের অসুখ থেকে মুক্তি-প্রার্থনা করতে। নানান মানুষের নানান চাহিদা। এমন বাহারি পদের চাহিদা মেটানোর আশা দেখানো পীর সাহেব একদিন এক ঘোরতর বিপদের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। জানালেন, এই তল্লাটের মানুষের ভাগ্যাকাশে চরম এক বিপদের আনাগোনা তিনি টের পাচ্ছেন। আগামীকাল এক প্রলয়ংকরী ঝড়ে লন্ডভন্ড হতে যাচ্ছে সোনারচর এবং তার আশপাশের মানুষের জানমাল। তবে তিনি ধ্যান-মারফত আরও জ্ঞাত হয়েছেন, এই ঝড় দুনিয়ার আর যা ক্ষতিই করুক, পীর সাহেবের খানকার আশপাশে ঘেঁষার দুঃসাহস সে করবে না।

পীর সাহেবের মুখে আসন্ন দুর্দিনের দুঃসংবাদ শুনে ভেঙে পড়ে খানকায় আগত সকল মানুষ। ঘরে-বাইরে কান্নার রোল পড়ে যায়। কী করে বাঁচা যাবে এই বিনাশী ঝড়ের কবল থেকে, তা জানতে ভক্তকুল উদগ্রীব হয়ে ওঠে। তাদের ধারণা–এই ঝড় যতোই শক্তিশালী হোক, যদি পীর সাহেব চান, তাহলে মুহূর্তে সেটাকে উল্টোদিকে তাড়িয়ে দিতে পারবেন। বাতাসে উড়ে যিনি চোখের পলকে এক তল্লাট থেকে আরেক তল্লাটে চলে যেতে পারেন, তার সামনে এমন কতো ঝড় শক্তি হারিয়ে বিলকুল বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য তা নিয়েও ভক্তদের মাঝে মাতামাতির কমতি নেই।

দীর্ঘ ধ্যানমগ্নতার পরে, পীর সাহেব আসন্ন বিপদের হাত থেকে বাঁচার একটি উপায় নিয়ে হাজির হলেন সকলের সামনে। সবার মুখে মুখে ধন্যি ধন্যি রব পড়ে গেলো। আর কোনো দুশ্চিন্তা অবশিষ্ট নেই। ঝড়-তুফান এবার যা-ই আসুক, পীর সাহেবের অব্যর্থ মারণাস্ত্রের সামনে, ভয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে ব্যাটা যাবেই।

জনতার মঞ্চে উপস্থিত হলেন সুন্দর চেহারা এবং নিটোল স্বাস্থ্যের এক বৃদ্ধ। ঠিক। বৃদ্ধ নয় যদিও, কিন্তু লম্বা আলখেল্লায় তাকে বেশ অনেকখানি বয়স্ক মনে হচ্ছে। হাতে আভিজাত্যের লাঠি। তাতে ভর দিয়ে, জনতার উদ্দেশে তিনি যা বললেন তার সারমর্ম নিম্নরূপ–

‘সোনারচরের ওপর আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডব অবশ্যম্ভাবী। তিনি হাজার রকমের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনোভাবে এই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ঝড়কে পোষ মানানো গেলো না। এই ঝড়কে এবার তিনি থামাতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু পরের বার এই ঝড় আরও ভয়ংকর চেহারা নিয়ে হানা দিবে। পীর সাহেব যদি তার গোপন-অত্র এবারেই প্রয়োগ করে ফেলেন, তাহলে পরের বারের প্রলয়ংকরী ঝড়কে থামানোর আর কোনো অস্ত্র তার হাতে অবশিষ্ট থাকবে না। তাই, এবার কিছু ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে এই ঝড়কে না আটকানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। জানের ক্ষতি যদিও এড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু, একটা উপায়ে মালের ক্ষতিটা এড়ানো পুরোপুরি সম্ভব।’

সকলের কৌতূহলী চোখ দ্বিগুণ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলো, ‘কোন সে উপায়?’

পীর সাহেবের পক্ষে নিযুক্ত এক খাদেম বললো, আপনারা তো জানেন দুনিয়ায়। এমন কোনো বিপদ নাই, যা আমাদের পীর সাহেবকে স্পর্শ করতে পারে। আসন্ন ঝড়ের তাণ্ডবে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, আমাদের পীরের এই পবিত্র খানকার কোনো ক্ষতি করার দুঃসাহস বাতাসের নাই।

সকলে মাথা নেড়ে সায় দিলো, যেন এই বিশ্বাস তাদের বহুযুগ পুরোনো, বহু আদিম এই জ্ঞান।

খাদেম পুনরায় বলতে শুরু করলো, আপনারা যদি আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, গহনা, টাকা-পয়সা এই খানকায় এনে রাখতে চান, রাখতে পারেন। আমাদের পীর সাহেবের যদিও বা তাতে খানিকটা অসুবিধে হবে, কিন্তু আপনাদের মালের নিরাপত্তার লক্ষ্যে তিনি এই অসুবিধায় বিব্রত হবেন না। আমাদের মহান এই পীরের কাছে আপনাদের সুবিধাই সবকিছুর আগে।

এমন জনদরদি, ভক্ত-দরদি পীর পেয়ে, সোনারচরের মানুষ নিজেদের আরেকবার ধন্য মনে করলো। তারা সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে যার যার গুরুত্বপূর্ণ মাল, গহনাগাটি, জমানো টাকা-পয়সা পীরের খানকায় এনে জমা দিতে শুরু করে দিলো। যেহেতু মাত্রই আষাঢ় ঢুকেছে, তাই আকাশের ওপর আজকাল আর ভরসা করা চলে না। রোদ আর মেঘের লুকোচুরি প্রকৃতিজুড়ে। সেদিনও, বিকেল থেকে আকাশের কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কালো মেঘে ধীরে ধীরে ছেয়ে যাচ্ছে সোনারচরের আকাশ। আর, সাথে সাথে জনজীবনে জেঁকে বসছে এক অজানা আতঙ্ক।

[তিন]

ত্রস্ত-পায়ে, বিলের আইল ধরে এগিয়ে আসছে রাসুর মা। খানিক বাদে অন্ধকার নামবে। প্রকৃতি অন্ধকারে তলিয়ে যাবার আগে যে-করেই হোক রাসুর মাকে পীরের খানকায় গিয়ে, নিজের সারাজীবনের জমানো সম্বল, দুই ভরি সোনার গহনা জমা দিয়ে আসতে হবে। খেয়ে না-খেয়ে যে সম্বল রাসুর মা জমা করেছে, ঝড়ের তাণ্ডবে তা উড়ে বিলীন হবে–সেটা কোনোভাবে হতে দেওয়া যাবে না।

যাওয়ার পথে একবার নাজিমুদ্দিনের ঘরে ঢু মারতে এলো রাসুর মা। নাজিমুদ্দিনকে তো বিপদের সংবাদ দেওয়া হয় নাই। সুপারি গাছের খোলের দরজা সরিয়ে, ঘরের ভেতরে চোখ ফেলে রাসুর মা বললো, ‘নাজিমুদ্দিন ঘরে আছো?’

ঘরের এক কোণে বই-খাতা নিয়ে অঙ্ক কষছিল মতি। রাসুর মায়ের এমন হাঁকডাকে খাতা-কলম রেখে উঠে এসে বললো, ‘বাপজান নাই।’

এই দুর্মতিসম্পন্ন নাবালকের সাথে কথা বলার কোনো শখ রাসুর মায়ের নেই, কিন্তু নাজিমুদ্দিনকে বিপদটা সম্পর্কেও সতর্ক করে যাওয়া দরকার। অগত্যা বাধ্য হয়েই, আগের রাগ কোনোভাবে নিজের ভেতর চাপা দিয়ে রাসুর মা বললো, ‘শোন ব্যাটা, তোর বাপ আইলে কইস আইজ রাইতে কঠিন এক ঝড় আইবো দুনিয়ায়। আমাগো পীরে কইছে, ঝড়ে জান আর মালের ক্ষতি হইব। তয়, যাগো মাল পীরের খানকায় জমা থাকব, তাগো মালের কোনো কিছু হইব না। তোর বাপেরে বলবি, তোর মায়ের যদি কোনো গয়নাগাটি থাকে, তাইলে পুটলি বাঁইধা যেন পীরের খানকায় রাইখা আসে।

বুড়ির এমন অবোধ বিশ্বাসে যেন বিরক্তিই হলো মতি। মুখের ওপরেই বললো কিনা, ‘ফুফু, আমারে একটা কথা কও তো৷ ঝড় যদি আসে, ক্যান সেইটা তোমাগো পীরের খানকার ওপর দিয়া যাইব না? তোমাগো পীরের খানকা কি জাদু-মন্ত্র পড়া কোনো দালান যে ওইখানে ঝড় ধাক্কা খাইয়া পলাইবো?’

না, এখানে আর এক মুহূর্তও না। ভালো-মানুষি করে যাদের উপকার করতে এলো, তাদের কাছ থেকেই কিনা এমন ধারার অপমান! তবে চলে যাওয়ার আগে রাসুর মা মতিকে বললো, ‘তাওবা কইরা দুআ-কালেমা পইড়া নিস। তোর তো ঈমানটাই চইলা গেলো রে দুর্মতি।’

কথাগুলো জপতে জপতে পীরের খানকার উদ্দেশে হাঁটা ধরল রাসুর মা। মতি সেদিকে তাকিয়ে আছে। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে এক অবোধ, অবুঝ বৃদ্ধার ছায়ামূর্তি।

[চার]

ভোর হলো। এক আলো ঝলমলে ভোর। সোনারচরের আকাশজুড়ে যেন আলোর মাখামাখি। গতরাতে যে বিপদ বয়ে যাওয়ার কথা ছিলো সোনারচরের ওপর দিয়ে, তা হয়তো বা কেউ টের পায়নি। কী আশ্চর্য! সবাই তো জেগেই ছিলো, তবুও ঝড়ের একটু রেশ কোথাও কেউ দেখতে পায়নি কেন? তবে কি শেষ পর্যন্ত পীর সাহেব কোনো এক গুপ্ত কৌশলে আটকে দিয়েছেন আসন্ন বিপদকে? তা-ই তো হবে’, সবাই ভাবলো। পীর সাহেবের প্রতি ভক্তি আর শ্রদ্ধায় সোনারচরের মানুষগুলোর মাথা যেন আরেকবার নুইয়ে আসে।

বিপদ কেটে গেছে। সবাই দলবেঁধে, হই-হুঁল্লোড় করতে করতে পীর সাহেবের খানকার দিকে এগুতে লাগলো। ওই ভিড়ের মাঝে, ধীরপায়ে হেঁটে আসছে একজন বয়োবৃদ্ধ মহিলাও। রাসুর মা। পীর সাহেবের উসিলায় জীবনের শেষ এবং একমাত্র সম্বলটুকু এই যাত্রায় ভীষণ বাঁচা বেঁচে গেলো’–-এই খুশিতে রাসুর মায়ের চোখ দিয়ে যেন কান্না চলে আসে।

কিন্তু, পীর সাহেবের খানকার কাছে এসে সবাই পাথর-মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। থেমে গেলো এতোক্ষণের সমস্ত হৈ-হুঁল্লোড়। এই দৃশ্য দেখার জন্যে সোনারচরবাসী কখনোই প্রস্তুত ছিলো না, প্রস্তুত ছিলো না রাসুর মাও। সবাই দেখছে–পীর সাহেবের খানকা শরিফের দুয়ারের একটা অংশ ভোলা। ভেতরে পীর সাহেব নেই। উনি ছুটেছেন অন্য কোথাও, অন্য কোনো সোনারচর এবং অন্য আরেক রাসুর মায়ের খোঁজে। নাজিমুদ্দিনের ছেলে মতির ঈমান কতোটুকু গেছে জানা যায়নি, তবে রাসুর মা জীবনের শেষ সম্বলটুকু যে খুইয়েছে, তা নিশ্চিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *