মাস দুয়েকের মধ্যে জঙ্গলের এই শিমুলতলায় এসে আশ্রয় নিল আরও বাইশজন মানুষ। গ্রাম থেকে দূরে, সমাজ থেকে দুরে, এখানে গড়ে উঠছে নতুন বসতি।
এরা সবাই দীন-দুঃখী, নির্যাতিত-নিপীড়িত, ছন্নছাড়া। কী করে যেন রটে গেছে, এই বনের মধ্যে একবার ঢুকে এলে, নিজের ইচ্ছে মতন বাস করা যায়। এখানে জমিদারের পেয়াদা আসে না। মোল্লা-পুরুতরা চোখ রাঙায় না। জমির কোনও মালিকানা নাই, যার যেমন সামর্থ্য ঘর তুলে নিতে পারে। দুবেলা ক্ষুধার অন্ন জুটুক বা না-জুটুক, শান্তি আছে।
এদের মধ্যে কেউ হিন্দু আর কেউ মুসলমান, উভয় সমাজেরই একেবারে নীচের তলার মানুষ। এদের তেমন কিছু সহায়সম্বল আগেও ছিল না, এখনও নেই, কিন্তু এখানে আছে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা থেকে মুক্তি।
সকাল থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে খাটাখাটনি শুরু করে। জঙ্গলেও কোনও না-কোনওভাবে কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। লালন নিজেই যেমন পান চাষ শুরু করেছে। তাল গাছের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে তালগুড়। কেউ কেউ গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে দিন-মজুরি খেটে যা পারে উপার্জন করে ফিরে আসে সন্ধের আগে।
এরমধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে দশ-বারোটা ঘর উঠে গেছে। যার যার নিজের রান্নার ব্যবস্থা। কে কী খেল, তা নিয়ে অন্য কেউ মাথা ঘামায় না। শুধু কমলি সব খবর রাখে। সারাদিন সে ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক ঘরে একবার করে উঁকি মারে। যদি কারও ঘরে একেবারেই আখা না-ধরে, সেই একজন-দুজন। মানুষকে ডেকে আনে নিজের ঘরে। তার হাতে কিছু পয়সা আছে, সঙ্গে এনেছিল। কাশেম এখনও দুর্বল শরীর নিয়ে কাজকর্ম করতে পারে না, কারা যেন মারের চোটে তার মাজা ভেঙে দিয়েছে। দু-চারদিন অন্তর অন্তর এখানকার কিছু কিছু মানুষ কাছাকাছি হাটে চাল-ডাল কেনাকাটি করতে যায়, কমলিও যায় তাদের সঙ্গে।
সন্ধের সময় সবাই মিলে একটা খোলা জায়গায় বসে। এই সময়টাই যেন এখানকার শ্রেষ্ঠ সময়। হাসি-মশকরা হয় যে যেমন পারে গান গায়। তখন কারও সঙ্গে কারও ভেদাভেদি কিংবা রেষারেষি থাকে না।
কেউ কিছু ঠিক করেনি, তবু সবাই যেন এখানকার নেতা হিসেবে লালনকে মেনে নিয়েছে। লালন মোটেই নেতা হতে চায় না, সব সময় সে বলে, ওরে আমি কেউ না, এই জঙ্গল-জমি আমার নয়, এখানে সবাই সমান। সে যত নেতৃত্ব অস্বীকার করতে চায়, তার মান্যতা বাড়ে। তার সাঁই নামটাও রটে গেছে।
এইসব নিপীড়িত মানুষেরা সমাজে থাকার সময় সবসময় কারুর না কারুর মোড়লগিরি সহ্য করেছে, তাদের পায়ের ধুলো চেটেছে। এখানে। সমাজ নেই। তবু এমন একজনকে সকলেই চায়, যার কাছে সুখ-দুঃখের কথা। বলা যায়। যারা নতুন আসে, অন্য কারুর সঙ্গে তার ঠোকাঠুকি লাগতেও পারে, মানুষের স্বার্থবোধ যে যায় না সহজে। কেউ কেউ পুরনো ঝগড়া সঙ্গে নিয়ে আসে।
অধিকাংশ নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষই ক্ষমতাবান, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। বলার সাহস পায় না। কেউ কিছু বলে ফেললেও তার জন্য চাবুক খেতে হয়, পেয়াদা এসে ঘর জ্বালিয়ে দেয়। সেই অবরুদ্ধ ক্রোধ সাধারণ মানুষ তার প্রতিবেশীর ওপর ফলায়। গরিবের সঙ্গেই গরিবের ঝগড়া হয় বেশি। সেই ঝগড়ার সময় ভাষার কত না অপমান হয়।
লালন নেতা হতে চায় না, তবু তার চরিত্রে যেন এক নতুন ব্যক্তিত্ব এসেছে। সে আগে লালু ছিল, জঙ্গলে আসার পর লালন হয়েছে, এ যেন দুইজন মানুষ। আগে যারা লালুকে চিনত, এখন তাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগবে। এখন লালন কোনও কথা বলতে শুরু করলে সবাই মন দিয়ে শোনে। কথা তো সে নিজে বলে না, তার ভিতরের অন্য মানুষটা বলে।
দুদ্দু শাহ নামক এক ব্যক্তি এসে একদিন নালিশ করল, সে যখন ফজরের নামাজ পড়ছিল, তখন দোলাই নামক একজন পিছন থেকে এসে ঠেলা মেরেছে। সে তখন তাহারিয়া অবস্থায় ছিল, ঠেলা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। তাতে তার নাকে আঘাত লেগেছে।
এই অভিযোগ শুনে লালন কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল দোলাইয়ের দিকে। তাকে ভৎসনা না করে হাসল। বলল, বেশ করেছ। তোমার মন যা চেয়েছে। তাই করেছ।
তারপর দুদ্দু শাহের দিকে চেয়ে বলল, কাল ফজরের নামাজের সময় আমারে ডাক দিবা। আমিও তোমার পাশে বইস্যে নামাজ পড়ব।
দোলাই বিদ্রূপের সুরে বলল, তুমি নামাজ পড়বা? তুমি নামাজের কী জানো?
লালন বলল, না-জানলেও শিখে নিতে ক্ষতি কী?
দোলাই বলল, লায়েক হবার পর আমিও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছি। কী হয় তাতে, কিছুই হয় না! কত মার খেয়েছি, দারিদ্রের জ্বালায় মরতেও বসেছি কয়েকবার, তবু আল্লাতালা মুখ তুলে তাকাননি। তিনি গরিবদের দেখেন না।
লালন বলল, যার হয়, তার হয়। তার হবে। হয়তো আমারও হবে। তোমার হয় নাই। কিছু পাও নাই। তুমি বসে বসে কান্দো।
দোলাই বলল, সাঁই, তুমি আগে হিন্দু আছিলা, আমি জানি। এখন মোছলমান হইছ? বেশি বেশি, তাই না! নামাজ পড়তে চাও?
লালন বলল, প্রতিদিন পারব কি না জানি না। তবে শিখতে চাই অবশ্যই।
দোলাই বলল, হিন্দু যখন নতুন মোছলমান হয়, তখন বেশি বেশি গোরু খায়। আমি অনেক দেখেছি।
লালন বলল, আমি আগে হিন্দু আছিলাম ঠিকই। এখন মোছলমান। কেরেস্তানও কইতে পারো। আমি ধর্ম মানি, ধর্মভেদ মানি না। জাতি মানি, জাতিভেদ মানি না। আমার অন্তরাত্মা কয়, আমরা সক্কলেই মানুষ, শুধু এইটুকু মানলেই বা ক্ষতি কী? আমার অন্তরাত্মা কী কয় জানো? তুমি তোমার। ধর্মের সব কিছু মান্য করেও শান্তি পেতে পারো। আবার কোনও কিছুই না মেনে, পুজো আচ্চা-নামাজ সব বাদ দিয়ে, শুধু মানুষকে ভালোবেসেও একটা সুন্দর জীবন পাওয়া যেতে পারে।
দুদ্দু শাহ বলল, এ তুমি কী বলছ সাঁই! ধর্ম না-মেনেও।
লালন হাসতে হাসতে বলল, ওগো, আমার বিদ্যা ফুরায়ে গেছে, আর কিছু বলার সাইধ্য নাই। এসো, গান ধরি। তোমরাও গান গাও!
খোলা আকাশের নীচে বসে শুরু হয় গান।
লালনের শুধু এইটুকু কথার জেরেই দোলাই আর দুদ্দু শাহের মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটে গেল, এমন নাও হতে পারে। হয়তো আরও কিছু ঘটেছিল। কিন্তু দুইদিন পরেই দেখা গেল, দুন্দু আর দোলাইয়ের গলায় গলায় ভাব।
প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন মানুষ আসছে। কেউ তাদের সাদর আহ্বান জানাচ্ছে না, আবার ফিরিয়েও দিচ্ছে না। গাছ কাটার দরকার হচ্ছে না, ফাঁকা ফাঁকা জায়গায় উঠছে নতুন ঘর। কী করে যেন এই নতুন বসতির নাম হয়ে গেছে শিমুলতলা।
কালুয়াকে বেশ কয়েকদিন হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লালনকে সে কিছুই বলেনি, কারুর সঙ্গে তার মনোমালিন্যও হয়নি, তবু সে উধাও হয়ে গেছে।
তার যাবার আগের দিন, সন্ধেবেলা হঠাৎ দেখা গিয়েছিল তার রুদ্র মূর্তি। মনিরুদ্দি আর দাসু নামের দুজন মাঝে মাঝেই ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল দুপুর থেকে। এখানে তাদের দ্বন্দ্বের কোনও কারণই নেই, এখানে তাদের ঘর বাঁধার পৃথক জায়গা ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের রেশারেশি নিয়ে এসেছিল পূর্ব জীবন থেকে।
লালন বারবার সবাইকে বলেছে, পূর্ব জীবনের ভেদাভেদ এখানে ভুলে যেতে, তা না-ভুলতে পারলে এখানকার নতুন জীবনের কোনও ধর্মই থাকে না। কিন্তু সকলেই কি আর তা ভুলতে পারে? আগে যার সঙ্গে স্বাথের সংঘাত হয়েছিল, সেই স্মৃতি এখনও দগদগ করে। স্বার্থের সংঘাত নয়, তুচ্ছ কথা কাটাকাটি, তাও কেউ সহজে ভুলতে পারে না।
মনিরুদ্দি আর দাসুর ওই ফোঁসফোঁসানি একসময় সহ্য করতে পারেনি কালুয়া। লালন তখন অনুপস্থিত, কালুয়া একসময় হঠাৎ লাঠি নিয়ে ওই দুজনের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলেছিল, শালের, চুতমারানির পুত, তগো মাথা ভাঙবো! বিড়ালে বিড়ালে ঝগড়া করে, তরা বিড়ালেরও অধম।
দুজনকে খানিকটা পিটিয়েও নিবৃত্ত হল না কালুয়া। সে ভয়ংকর গলায় বলতে লাগল, দূর হয়ে যা! সব দূর হয়ে যা! এইসব বাড়ি আমি বানাইছি, আমিই আবার ভাঙব!
তারপর সে সত্যি সত্যি একটার পর একটা বাড়ি ভেঙে দেবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেকে মিলে তাকে চেপেচুপে ধরে ঠান্ডা করল একসময়।
লালন ফিরে আসার পর সে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আমি ভুল করেছি, ওরে লালন, আমি পাগল হইছিলাম। কাল আমি সব বাড়ি আবার গড়ে দেব।
পরদিন ভোর থেকে সে বেপাত্তা!
লালন তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেল না, তার মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। কালুয়া কেন এখান থেকে চলে গেছে, তা লালন বুঝল একদিন রাতে।
তাদের চালা ঘরটির এখন আরও উন্নতি হয়েছে। ফাঁক-ফোকর সব বন্ধ করা গেছে, বৃষ্টি আর একেবারেই ঢোকে না। দরজা অবশ্য বসানো হয়নি। তার প্রয়োজনও বোধ করে না লালন। সে একা শুয়ে থাকে।
প্রায় মধ্য রাত, সবাই যখন সুষুপ্ত, তখন একটা গান শুনে লালনের ঘুম ভেঙে গেল।
গানটি নারী কন্ঠের। আজ বাইরে জ্যোৎস্না আছে। শূন্য দরজার কাছে দেখা গেল এক রমণী মূর্তি। কয়েক মুহূর্ত পর ঘোর কাটতেই লালন বুঝল, এ ছায়া মূর্তি কমলির। তবু সে বলল, কে?
কমলি বলল, আমি গো আমি, অভাগিনী কমলিনী। সাঁই, আজ আমার ঘুম আসছে না কিছুতেই। তোমার এখানে একটু বসতে পারি?
লালন বলল, বসো। কাশেম কী করে?
কমলি বলল, সে তো ঘুমায়ে একেবারে অজ্ঞান। ওর সর্বাঙ্গে ব্যথা, তাই। ঘুমাইলেই শুধু শান্তি পায়। তোমার ঘুম ভাঙ্গালাম।
লালন বলল, তাতে কিছু হয় নাই। তুমি কী গান গাইছিলে, সেইটা গাও। কমলি লালনের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলল, নাঃ! সে গান আর নাই। এমনিই দুইডা কথা কই। সাঁই, তুমি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানো?
লালন একটু ইতস্তত করে বলল, বিশেষ কিছু জানি না, যতদূর শুনেছি, তুমি এক ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা, পরে কাশেমরে শাদি করছ—
কমলি বাধা দিয়ে বলল, না, না, ঠিক না। কাশেমের সাথে আমার শাদি হয় নাই। আমি একটা নষ্ট, পতিত মাইয়া মানুষ। এক রাক্ষুসি! বামুন বাড়িতে জন্ম ঠিকই, বিয়া হইছিল নয় বছর বয়সে। মাইয়া মানুষ কত বয়েসে রজঃস্বলা হয়, তুমি জাননা? আমার তা হবার আগেই আমার সোয়ামি যমের ঘরে যায়। তার আর আমার দুই জনেরই ওলাওঠা হইছিল, সে গেল আর আমি বাঁইচ্যা রইলাম। সবাই কইল, আমিই আমার সোয়ামিরে খাইছি। ঠিক কিনা? কও?
লালন বলল, না। মানুষ মানুষরে খায় না।
কমলি বলল, লোকে তো তবু মাইয়া মানুষের নামে কয়, আরও কত কী কয়! শ্বশুরবাড়ি থিকা আমারে খেদাইয়া দিল, বাপের বাড়ি ছাড়া গতি নাই। সেইখানে দিনের পর দিন…
লালন বলল, জানি। বিধবা কন্যাদের বাপের বাড়িতে কেমনভাবে থাকতে হয়।
কমলি বলল, না, জানো না। মাইয়া মানুষের কত বিপদ, কত কষ্ট হয়, তা কোনও পুরুষই ঠিক ঠিক জানতে পারে না। দিনের পর দিন ছুতানাতায় উপাস, এটা খাবা না, ওইটা করবা না, দিনের পর দিন কতরকম অত্যাচার। বিধবা যত তাড়াতাড়ি মরে ততই সংসারের মঙ্গল। আর এমনই বিড়ালের মতন কড়া জান বিধবাদের, তারা সহজে মরেও না। আর সবাই বাঁচবে, আর আমি কেন মরব, কইতে পারো? আমি মরতে চাই না।
লালন বলল, এইখানে বাঁচবে, আর ভয় নাই।
কমলি বলল, শোনো, আমার কথা শ্যাস হয় নাই। আমারে প্রথম নষ্ট করে আমার আপন ছোটখুড়া। আমার বয়স তখন ষোলো। এই কথা যদি আমি সর্বসমক্ষে চ্যাঁচাইয়া চ্যাঁচাইয়া কই, কেউ মানবে না, বিধবারই তো সব দোষ হয়। আরও লাথি ঝাঁটা খেতে হবে। এইবার তোমারে একটা সত্যি কথা কমু, সাঁই? কাউরে না কাউরে খুব কইতে ইচ্ছা করে।
লালন বলল, কও। মিথ্যা কথা শুনাবার জন্য নিশ্চয় তুমি এত রাইতে আসো নাই।
কমলি বলল, ছোটখুড়া আমারে যখন নষ্ট করে, তখন আমার ভয় হয় নাই, পাপের কথা ভাবি নাই, বড় সুখ হইছিল, বুকের মইধ্যে যে-আগুন জ্বলতে ছিল, সেই আগুন যেন জ্যোৎস্নার আলো হইয়া গেল! এইটা কি পাপ। সৃষ্টিকর্তা তাইলে হিন্দু বিধবার বুকে যখন তখন এমন আগুন জ্বালেন ক্যান? মোছলমান, কেরেস্তান বিধবাদের দুই-তিনবার বিয়াতেও দোষ নাই, হিন্দুর ভগবানের এ কেমনধারা বিচার? হিন্দুর ভগবান ক্যান এত নিষ্ঠুর? তুমি কও।
লালন অস্বস্তির সঙ্গে বলল, এ-কথা আমারে জিগাইয়ো না কমলি। ভগবানের বিচার করার ক্ষমতা আমার নাই।
কমলি আবার ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, আমার ছোটখুড়াটা একটা শয়তান। তিন তিনবার লুকাইয়া আমার সাথে এ কাম করছে, অথচ দিনের বেলা সবার সামনে কী খারাপ ব্যবহারই না করে। দাঁত খিচায়। যেন আমি একটা ঘৃণ্য প্রাণী। আমি কেন্দেছি, গোপনে গোপনে অনেক কেন্দেছি, তবু আমার বুকের আগুন নেভে না, মাঝে মাঝে দপ করে জ্বইল্যা ওঠে। তখন বড় কষ্ট হয়। একদিন বোঝলাম, আমি রাক্ষুসি, আমার পুরুষ মানুষ চাই। ঠিক করলাম, ঘর ছাড়ব। কিন্তু কার সাথে কোনও হিন্দু পুরুষের সাহস হবে না। কেউ আমারে নিজের করে নেবে না। একজনরে মনে ধরছিল। বড় ভালো মানুষ, চেহারাখানাও ছিমছাম। আমার বাপের বাড়িতে একখান নতুন ঘর ছাওয়া হইতেছিল, সে একজন ঘরামি, কাজের সময় একটু-একটু গানও করে। সে মোছলমান, জাতে আমার মোটেই আপত্তি নাই। সে মানুষটা বিয়ে-শাদিও করে নাই, আমি দুই-চারবার কথা কয়েছি তার সাথে, তার কথা শুনলে বুকে দোলা লাগে। সে কে তুমি আন্দাজ করতে পারো?
লালন বলল, আমি কি তারে চিনি?
কমলি বলল, তার নাম সুলেমান মির্জা।
লালন খুবই চমকে উঠে বলল, সুলেমান? আমাগো কালুয়া?
কমলি বলল, হ। সে আবার কালী পূজা করে, তুমি জাননা?
লালন বলল, কালী পুজো করে কি না তা জানি না। তবে মা কালীর ভক্ত, তা শুনেছি। মায়ের গান গায়।
কমলি বলল, মা কালীরও ভক্ত আবার সিরাজ সাঁই-এরও চ্যালা। আসলে একটা ভিতুর ডিম। সে আমারে নিতে সাহস পাইল না, আমাগো বাড়ির কাজ ছাইড়া পিঠটান দিল। তারপর এই কাশেম। সেও কাজ করত আমাগো বাড়িতে।
লালনের প্রায় স্তম্ভিত হবার মতন অবস্থা। কালুয়া কেন প্রথম থেকেই কমলিকে পছন্দ করেনি, তা সে বুঝতেই পারছিল না। কমলি তাকে নিজস্ব পুরুষ হিসেবে চেয়েছিল, আবার সেই কমলিই এখানে তার চোখের সামনে। কালুয়া নিজেই তো কাশেমকে এখানে আসতে বলেছিল। আবার ওদের সহ্য করতে পারেনি বলেই কি এখান থেকে সহসা চলে গেল? নিয়তির কী বিচিত্র লীলা!
কমলি বলল, আমার জন্যই কাশেম এত মাইর খাইছে। মইরাই যাইতে পারত। আমারই দোষ। আমিই তো ওরে ভুলাইছি। কিন্তু আমারে একবারও দোষ দেয় না। ও এখন আর কিছুই পারে না। কিছুই না।
লালন তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বলল, কোনও অঙ্গের তো ক্ষতি হয় নাই। ধীরে ধীরে সাইরা ওঠবে।
কমলি একটু এগিয়ে এসে লালনের পায়ে হাত দিয়ে বলল, সাঁই, তোমারে একটা কথা জিগাই। তুমি কি পাথর?
লালন বলল, না। পাথর কেমনে হবে। আমি আর সকলেরই মতন রক্ত মাংসের মানুষ।
কমলি দুহাত দিয়ে লালনের পা ঘষতে ঘষতে বলল, রক্ত মাংসের মানুষ, কিন্তু তোমার কামনা-বাসনা নাই?
লালন বলল, থাকবে না ক্যান? সাধারণ মানুষের যেমন থাকে।
কমলি এবার মিনতির সুরে বলল, তয় তুমি আমারে লও।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে লালনও মিনতির সুরে বলল, আমারে তুমি ক্ষমা করো কমলি।
কমলি ব্যাকুলভাবে বলল, কান, কান, ক্ষমার কথা আসে ক্যান?
লালন বলল, তুমি এর মইধ্যে দু-তিনবার আমার দিকে চেয়ে চক্ষু তরল করেছ। তার মানে কি আমি বুঝি না! ঠিকই বুঝি। কিন্তু আমার মনের মইধ্যে যে আর একটা মানুষ আছে, সে আমারে নির্দেশ দেয়। সে আমারে কয়, রমণী রত্ন অতি দুর্লভ। এ তেমনই রমণী। কাশেম নামে একজন মানুষ এর জন্যে কত অপমান সহ্য করেছে, তার জীবন পর্যন্ত যেতে বসেছিল। এখন তার শরীরে আগৎ নাই, তার আর কিছুই নাই, সব আশা-ভরসা ওই রমণী। এখন তুমি যদি কাসেমের কাছ থিকা এই রমণীরে কেড়ে লও, তবে তুমি আর মানুষ থাকবা না। অমানুষরাই এমন কাম করে।
কমলি তার হাত লালনের ঊরু পর্যন্ত তুলে বলল, ধুৎ। রাখো তো ওইসব কথা। কাশেম কিছু জানবে না। কেউ কিছু জানবে না। তুমি আমারে রক্ষা করো সাঁই।
লালন বলল, কেউ জানবে না, কিন্তু আমার অন্তরাত্মা তো জানবে। তারে ঘুম পাড়াব কী করে?
কমলি বলল, কী যে তুমি কও, বুঝি না। মনের মধ্যে একটা মানুষ, অন্তরাত্মা না ছাই! আমাগো মনের মধ্যে অন্য কেউ কথা কয় না। নিজেরা যা বুঝি, তেমন কথা বলি।
লালন হেসে বলল, আমার তো নিজের বোধ-বুদ্ধি কিছু নাই। তাই অন্তরের কথার উপর নির্ভর করি। হাতটা সরাও কমলি!
কমলি এবার বেপরোয়া হয়ে গিয়ে আরও হাত বাড়িয়ে লালনের পুরুষাঙ্গটি চেপে ধরল।
সেটি উত্থিত তো বটেই, লোহার মতন কঠিন।
কমলি হি হি করে হেসে বলল, এই যে, এই যে, তোমার বাসনা আছে যোলোআনা। তুমি ভাবের ঘরে চুরি করো।
লালন বলল, শরীর জাগে শরীরের নিয়মে। কিন্তু মন যদি না-জাগে, তাইলে কি প্রকৃত মিলন হয়? শরীরে আগুন লাগে, কিন্তু বাসনার শিখা হয়। একটা সোনার প্রদীপের মতন… আরেঃ, এই সব কথাই বা আমি কইলাম। ক্যামনে? কী যে হয় আমার।
কমলি একটুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল
তারপর দুহাতে মুখ চাপা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। ঘরের মধ্যে সে রেখে গেল তার অশ্রুত কান্নার রেশ।
আর কি ঘুম আসে! সারারাত জেগে রইল লালন।