০৮. কম্পিটিশান

০৮. কম্পিটিশান

পরের দিন গণিত প্রতিযোগিতায় গিয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম। বিয়ে বাড়ির মতো একটা গেট বানানো হয়েছে, তার কাছে একটা ব্যান্ডপার্টি। পা পা করে কয়েকজন ব্যাগ পাইপ বাজাচ্ছে তার সাথে ঢোল। ভিতরে ছোট ছোট স্টল, সেখানে মেলার মতো আয়োজন। কোথাও গণিতের বই কোথাও বিজ্ঞানের বই। এক জায়গায় গণিতের ধাধা, সঠিক উত্তর বলতে পারলেই পুরস্কার! আমার ধারণা ছিল অঙ্কের মতো নীরস একটা বিষয়ের প্রতিযোগিতায় আর কতজন আসবে? কিন্তু ভিতরে ঢুকে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, ছোট ছোট চশমা পরা ছেলে-মেয়েরা হাতে প্লাস্টিকের রুলার আর জ্যামিতি বক্স নিয়ে গম্ভীরভাবে ঘোরাঘুরি করছে। বিশাল একটা প্যান্ডেল, তার নিচে সারি সারি চেয়ার পাতা, সবাই সেখানে বসে যাচ্ছে। আমি প্রিয়াংকাকে খুঁজলাম, যারা ভলান্টিয়ার তারা নীল রংয়ের টি শার্ট পরে ব্যস্ততার ভান করে ঘোরাঘুরি করছে। আমি তাকে খুঁজে পেলাম না।

সাড়ে নয়টার সময় শুরু হবার কথা, আমি লিখে দিতে পারি সাড়ে দশটার এক মিনিট আগেও শুরু করতে পারবে না। আমার হাতে ঘড়ি নেই, আমি পাশের ছেলেটার হাতে দেখলাম সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। শুরু না হওয়া পর্যন্ত চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই, তাই আমি মাত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছি তখন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো। বুড়ো এবং রাগী রাগী চেহারার কয়েকজন মানুষ স্টেজে এসে বসেছে, আমি গুনে দেখলাম নয়জন। এই নয়জনের সবাই বক্তৃতা দিবে, কমপক্ষে দশ মিনিট করে। নয় দশে নব্বই মিনিট, তার মানে পাকা দেড় ঘণ্টা! মানুষের বক্তৃতার মতো খারাপ জিনিস আর কিছু নেই, এখন পাকা দেড় ঘন্টা এই রাগী রাগী চেহারার মানুষগুলোর বক্তৃতা শুনতে হবে ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে হালকা-পাতলা একটা মেয়ে। মেয়েটা খুব হাসিখুশি, সবসময়েই হাসছে। মাইকের সামনে দাড়িয়ে এমনভাবে কথা বলছে যে দেখে মনে হয় সুন্দর করে কথা বলার মতো সহজ কাজ আর কিছুই নয়! প্রিয়াংকা যখন বড় হবে, তখন নিশ্চয়ই এভাবে কথা বলবে। মেয়েটা গণিত প্রতিযোগিতার নিয়মকানুনগুলো বলে দিয়ে রাগী চেহারার একজনকে ডাকলো প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী ঘোষণা করতে। রাগী চেহারার মানুষটি কোন একটা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সে এসে দুই এক কথা বলে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করে দিল! কী আশ্চর্য ব্যাপার আর কোন বক্তৃতা নাই। স্টেজে বসে থাকা। আরো আটজন রাগী রাগী চেহারার বুড়ো মানুষগুলো নিশ্চয়ই খুব রাগ হয়েছে। যে তাদের বক্তৃতা দিতে ডাকছে না কিন্তু ততক্ষণে সব ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে কম্পিটিশনে অঙ্ক করার জন্যে তাদের ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। এখন তারা বক্তৃতা দিলেও কেউ শুনবে না। হালকা-পাতলা মেয়েটা যে কাউকে বক্তৃতা দিতে দেয় নাই সে জন্যে আমার ইচ্ছে হলো তাকে এক স্টিক চুইংগাম দিয়ে আসি!

আমরা সবাই ক্লাস রুমে বসে আছি, আমার ডানদিকে অসম্ভব মোটা একটা ছেলে, বাম দিকে চশমা পরা শ্যামলা রংয়ের একটা মেয়ে। আমাদের স্কুলের অন্য ছেলে-মেয়েরা কোথায় বসেছে আমি জানি না, আশেপাশে কাউকে দেখছি না। আমাদের রুমটা বেশ বড়–সব মিলিয়ে প্রায় একশ জন ছেলে-মেয়ে এসে বসেছে। অঙ্ক কম্পিটিশনটা কীরকম হবে সে বিষয়ে আমার কোন ধারণা নেই, তাই ধৈর্য ধরে বসে আছি।

এরকম সময় ঘন্টা পড়ল এবং সাথে সাতে ক্লাস রুমের শিক্ষকেরা সবার হাতে একটা করে খাতা আর প্রশ্ন দিতে লাগলো। আমার ডান পাশের মোটা ছেলেটা চোখ বন্ধ করে একটা দোয়া পড়ে নিজের বুকে ফু দিল, তারপর প্রশ্নটা এবং হাতের কলমটাকে একটা চুমু খেয়ে মাথায় লাগালো। বাম পাশের মেয়েটা। অবশ্যি দোয়া দরুদের মাঝে গেল না, সরাসরি অঙ্ক কষার মাঝে লেগে গেলো। আমিও আমার প্রশ্নটার দিকে তাকালাম। দুই ঘণ্টা সময়, তার মাঝে দশটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। প্রশ্নগুলো বাংলা আর ইংরেজিতে, ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলে-মেয়েরাও যেন আসতে পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা।

আমি প্রশ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। প্রশ্নগুলো একবারেই সোজা–একবার সন্দেহ হলো ভুল করে অন্য কোন ক্লাসের প্রশ্ন দিয়ে দিয়েছে কী না কে জানে! ভাল করে দেখলাম, আমাকে ঠিক প্রশ্নই দিয়েছে। এতো হৈচৈ করে গণিত প্রতিযোগিতা করছে কিন্তু এরকম সোজা বাচ্চা পোলাপানের প্রশ্ন। দিলো ব্যাপারটা কী? আমি ডানে-বামে সামনে-পিছনে তাকালাম, নাহ, অন্য। সবাই তো দেখি পেন্সিল কামড়ে কামড়ে গম্ভীর মুখে অঙ্ক করতে শুরু করেছে, মনে হয় প্রথম দিকে সোজা প্রশ্নগুলো দিয়ে শেষের দিকে কঠিন প্রশ্ন দিয়েছে। আমি শেষের প্রশ্নগুলো দেখলাম–আসলেই কঠিন! শুধু কঠিন না একেবারে ফাটাফাটি কঠিন। আমি কঠিন প্রশ্নটা পড়ে একটু হকচকিয়ে গেলাম। প্রশ্নটা কঠিন হতে পারে কিন্তু খুব চমৎকার একটা প্রশ্ন। শুধু প্রশ্নটা পড়েই আমার বুকটা ভরে গেলো, যারা এইরকম চমৎকার একটা প্রশ্ন করতে পারে তাদের মাথায় না জানি কতো বুদ্ধি! আগে সোজা প্রশ্নগুলো শেষ করে কঠিন প্রশ্নটা ধরা উচিত কিন্তু আমার যে কী হলো আমি কঠিন প্রশ্নটার উত্তর বের করতে শুরু করলাম।

আসল প্রশ্নটার উত্তর বের করার আগে আমার অন্য দুই একটি জিনিস প্রমাণ করতে হলো, সেগুলো প্রমাণ করার জন্যে আরো কয়েকটা জিনিস প্রমাণ করতে হলো। সবগুলো প্রমাণ শেষ করে যখন আসল সমস্যাটা করতে শুরু করেছি তখন মাঝামাঝি এসে আটকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে করতে হবে যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম তখন আমার যা আনন্দ হলো সেটা বলার মতো নয়! ঝটপট পুরোটা শেষ করে, আমি অন্য সমস্যাগুলো করতে বসলাম। মাত্র প্রথমটা শুরু করেছি তখন দেখি কে যেন আমার খাতাটা ধরে টানছে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি হলের গার্ড, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

সময় শেষ।

সময় শেষ মানে? আমি চমকে উঠলাম, প্রশ্নের উপর স্পষ্ট লেখা আছে। সময় দুই ঘণ্টা। আমি বললাম, দুই ঘণ্টা সময় না?

হ্যাঁ। দুই ঘণ্টা শেষ।

দুই ঘণ্টা শেষ? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, দুই ঘণ্টা কী ভাবে শেষ হলো?

গার্ড মুচকি হেসে বলল, যখন সময় খুব ভাল কাটে তখন কীভাবে যে সময় চলে যায় কেউ জানে না! তারপর হা হা করে হেসে উঠল, যেন খুব একটা উঁচু দরের রসিকতা করেছে।

আমার খাতাটা টেনে নিয়ে চলে যেতে যেতে মানুষটা ফিরে এলো, বলল, কী ব্যাপার খাতায় দেখি নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর কিছুই লিখ নি?

মানুষটা নাম লেখার জন্যে খাতাটা ফিরিয়ে দিল–একবার ভাবলাম লিখব–লিখে লাভ কী? কিন্তু মানুষটা দাড়িয়ে আছে তাই লিখতে হলো।

পরীক্ষার হল থেকে বের হতেই আমার প্রিয়াংকার সাথে দেখা হলো, সে এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে কোথায় জানি ছুটে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাড়িয়ে, গেলো, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো, কেমন হয়েছে?

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে–হঠাৎ করে দেখি সময় শেষ হয়ে গেল।

কয়টা করেছিস?

এ-একটা।

প্রিয়াংকার মুখটা দপ করে নিভে গেলো। শুকনো মুখে বলল, মাত্র একটা? সবাই যে বলছে খুব সোজা হয়েছে প্রশ্ন?

হ্যাঁ মানে ইয়ে–আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে হলো নিজের পিছনে একটা লাথি মারি! যদি শুধু সোজা প্রশ্নগুলো দিয়ে শুরু করতাম তাহলে আমিও অনেকগুলো করে ফেলতে পারতাম।

প্রিয়াংকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যাই হোক। পরের বার ভাল করে করবি। আমি এখন যাই–এই কাগজগুলো এখনই নিয়ে যেতে হবে।

প্রিয়াংকা হাতের কাগজের বান্ডিল নিয়ে ছুটে যেতে শুরু করল। ভলান্টিয়ারদের জন্যে আলাদা ভাবে তৈরি করা নীল রংয়ের একটা টি শার্ট পরেছে, বুকের মাঝে নাম লেখা ব্যাজ, খুব মানিয়েছে তাকে! দেখে মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে ভলান্টিয়ার হওয়ার জন্যে!

আমি মন খারাপ করে প্যান্ডেলের নিচে এসে দাঁড়ালাম। সবাই একজনের সাথে আরেকজন কথা বলছে, কার কয়টা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করেছে। যখনই একটার উত্তর মিলে যাচ্ছে তখনই তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, যখন মিলছে

তখন মুখটা কালো করে ফেলেছে! আমিই শুধু একা একা দাড়িয়ে রইলাম। জয়ন্ত মামুন আর মৌটুসিকে দেখলাম কথা বলতে বলতে আসছে, আমাকে দেখে দাড়িয়ে গেলো। মামুন ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে?

আমি ইতস্তত করে বললাম, হয়েছে একরকম।

কয়টা হয়েছে?

আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, একটা।

আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তারা হাসি গোপন করল। জয়ন্ত ভদ্রতা করে বলল, ও, আচ্ছা।

আমি জযন্তকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কয়টা হয়েছে?

পাঁচটা কনফার্ম। ছয় নম্বরটা কারো কারো সাথে মিলছে কারো কারো সাথে মিলছে না।

ও।

জয়ন্ত, মামুন আর মৌটুসি তখন জুস খেতে খেতে চলে গেলো। আমার খেয়াল হলো আমার হাতেও একটা জুস, যারা আজকে কম্পিটিশনে অংশ নিয়েছে সবাইকে এক প্যাকেট করে জুস দিয়েছে। আমি মনমরা হয়ে আমার জুসের প্যাকেটটা খুলে জুস খেতে লাগলাম।

দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি, তারপরে ব্ল্যাকহোলের ওপর একটা বক্তৃতা তারপর পুরস্কার বিতরণী। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার থাকার কোন ইচ্ছে নেই, কিন্তু ব্ল্যাক হোল নিয়ে কী বলে একটু শোনার ইচ্ছে আছে। তাই বক্তৃতাটা শোনার জন্যে থেকে গেলাম। সকালে রাগী চেহারার একজন বুড়োমতো মানুষ ব্ল্যাক হোল নিয়ে বিশাল একটা বক্তৃতা দিলো। মানুষটার উৎসাহ খুব বেশি এমন ভাবে কথা বলতে লাগলো যেন সে নিজেই টিপে টুপে ব্ল্যাক হোল তৈরি করেছে। বক্তৃতা দিতে দিতে মাঝে মাঝে সে রসিকতা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেগুলো খুব কাজে এলো না। এক দুইজন ভদ্রতা করে একটু হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু বেশির ভাগই মুখ শক্ত করে বসে থাকলো।

ব্ল্যাক হোলের উপর বক্তৃতাটা যত ভাল হবে ভেবেছিলাম সেটা তত ভাল হলো না। আমি মাঝখানেই উঠে যেতাম কিন্তু বসেছি একেবারে মাঝখানে, বের হওয়া খুব কঠিন।

বক্তৃতাটা শেষ হবার সাথে সাথে আমি বের হয়ে দেখি চারপাশে মিলিটারি, বের হওয়ার গেটটাও বন্ধ করে দিয়েছে, কাউকে বের হতে দিচ্ছে না। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম পুরস্কার দেওয়ার জন্যে প্রেসিডেন্ট আসছেন বলে এরকম কড়াকড়ি। যারা ভিতরে আছে তারা এখন আর বের হতে পারবে না।

আমি আর উপায় না দখে পিছনের দিকে একটা চেয়ারে বসলাম। আস্তে আস্তে পুরো প্যান্ডেলটা ভরে গেলো। এদিকে সেদিকে মিলিটারি তাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্টেজটা সুন্দর করে সাজিয়েছে, সেখানে মেডেলগুলো এনে রেখেছে। সকালবেলা যে মেয়েটা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল সেই মেয়েটাকে আবার দেখলাম ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। আমি বসে প্রিয়াংকাকে খুঁজলাম কিন্তু এত ভিড়ে তাকে আমি খুঁজে পেলাম না।

হঠাৎ করে চারিদিকে একটু ব্যস্ততা দেখা গেলো সবাই হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। তখন আমি দেখতে পেলাম কয়েকজন মিলিটারি প্রায় ঘেরাও করে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আসছে। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চয়ই খুব কষ্টের ব্যাপার—শান্তিমতো কোথাও যেতেও পারে না, সব সময় তাদের আগেপিছে গোটা দশেক মিলিটারি ঘুরঘুর করতে থাকে!

প্রেসিডেন্ট আসার সাথে সাথে তাকে নিয়ে বেশ কয়েকজন স্টেজে উঠে গেলো। সকালে বক্তৃতা দিতে পারে নি বলে যারা মন খারাপ করেছিল এখন তাদের খুব উৎফুল্ল দেখা গেলো, মনে হয় এখন তারা সবাই লম্বা লম্বা বক্তৃতা দেবে। প্রেসিডেন্টদের সময় নিয়ে খুব টানাটানি থাকে তাই ঝটপট অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেলো। হাসি-খুশি মেয়েটা আবার অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে থাকেসকালে সে অনেক হাসি-তামাশা করেছে এখন প্রেসিডেন্টের সামনে দরকারি কথা ছাড়া আর কোন কথা বলছে না। প্রথমে একজন এসে প্রেসিডেন্টের গুণগান গাইতে লাগলো, একজন প্রেসিডেন্ট এতো ব্যস্ত তারপরেও কষ্ট করে এখানে এসেছেন সেই জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিতে দিতে সে মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেলল। তারপর আরেকজন দাড়িয়ে গণিত যে কতো গুরুত্বপূর্ণ সেটার ওপর বিশাল বক্তৃতা দিতে শুরু করল। আরেকজন দাড়িয়ে যারা আয়োজন করেছে তারা যে কতো মহৎ কাজ করেছে সেটার ওপর বিশাল একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললো। বক্তৃতাগুলো একই রকম, একই গলায় একই সুরে বলা হয়। একটা শুনলেই মনে হয় সবগুলো শোনা হয়ে গেছে। আমি প্রায় অধৈর্য হয়ে গেলাম।

সবার শেষে প্রেসিডেন্ট বক্তৃতা দিতে উঠলেন, তিনি অল্প কথায় বেশ গুছিয়ে বক্তৃতা দিলেন। গণিত কী রকম জরুরি, আজকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যে ভবিষ্যতের বড় বড় বিজ্ঞানী হবে এরকম খুব ভাল ভাল কথা বললেন। বক্তৃতা শেষ হবার পর সবাই খুব জোরে জোরে হাততালি দিলপ্রেসিডেন্ট বক্তৃতা শেষ করার পর মনে হয় জোরে জোরে হাততালি দেওয়ার নিয়ম।

হালকা-পাতলা মেয়েটা বলল এখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করার জন্যে গণিতের একজন প্রফেসরকে অনুরোধ করল। মানুষটার উষ্কখুষ্ক চুল, বড় বড় গোঁফ। মোটামুটি সেজেগুজে এসেছে। তবু তার চেহারায় ভদ্রলোকের ভাবটা ফুটে ওঠে নি। মানুষটা স্টেজে উঠে প্রথমে গণিত কী রকম কঠিন সেটা নিয়ে একটা রসিকতা করল, কেউ একটুও হাসল না, তাতে একটা লাভ হলো, মানুষটা আর রসিকতা করার চেষ্টা না করে পুরস্কার নেওয়ার জন্যে একজন একজন করে ডাকতে লাগলো।

প্রথমে প্রাইমারি ক্লাস, তারপর জুনিয়র তারপর আমাদের গ্রুপ। সবশেষে কলেজ। দলভিত্তিক পুরস্কার, একক পুরস্কার। আমাদের স্কুল থেকে প্রাইমারি গ্রুপের একটা মেয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে গেলো আমরা সবাই তখন জোরে জোরে হাততালি দিলাম।

সব পুরস্কার দেওয়া শেষ, এখন কেউ একজন সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করে দেবে তারপর প্রেসিডেন্ট চলে গেলে আমারা বাসায় যেতে পারব। ঠিক কী কারণ জানি না আমার ভেতরটা তেতো হয়ে আছে। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিকভাবে হয় নি, কোনটা ঠিকভাবে হয় নি সেটা বুঝতে পারছি না বলেই মেজাজটা আরো বেশি খারাপ হয়ে আছে। উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর তখন হঠাৎ এমন ভাব করল যেন তার কিছু একটা মনে পড়েছে। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমরা এতক্ষণ প্রথম দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চ্যাম্পিয়নদের পুরস্কার দিয়েছি। এখন আমাদের সর্বশেষ পুরস্কার চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন।

আমি তখন লক্ষ করলাম সত্যিই টেবিলে এখনো একটা পুরস্কার রয়ে গেছে। গণিতের প্রফেসর হাত থেকে একটা কাগজ বের করে বলল, পুরস্কারটা যাবে সেকন্ডারি গ্রুপে। এই পুরস্কারটা পেয়েছে এমন একটা ছেলে যে এখনই আমার থেকে বেশি গণিত জানে! সব গ্রুপে আমরা একটা করে গণিতের সমস্যা দিয়েছি যেটা এতো কঠিন যে দুই ঘন্টার মাঝে করা সম্ভব নয়। সেকন্ডারি গ্রুপের এই অঙ্কটা আমি করেছি দুই দিনে, তাও অন্য অনেকের সাহায্য নিয়ে। কিন্তু আজকে একজন ছেলে সেই অঙ্কটি করে ফেলেছে। আমাদের কম্পিটিশনে সবগুলো অন্ধে যত মার্কস ছিল ঐ একটিতে ছিল তার। দ্বিগুণ মাকর্স! এই ছেলেটি আর কোন অঙ্ক স্পর্শ করে নি, সে শুধু ঐ একটি অঙ্ক করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তাকে আমি মঞ্চে এসে চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন। হিসেবে স্বর্ণপদক নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছি।

ঠিক জানি না কেন হঠাৎ করে আমার চোখে পানি এসে গেলো। আমি শুনলাম উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর বলছেন, ছেলেটি বি.কে, হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরিফুল ইসলাম তপু।

দর্শকদের ভেতরে কে যেন চিলের মতো শব্দ করে চিৎকার করে উঠল আমি না দেখেই বুঝতে পারলাম সেটা প্রিয়াংকা। সে চিৎকার করেই যাচ্ছে, অন্যদের প্রচণ্ড হাততালিতে সেটা আর শোনা যাচ্ছে না তবু সে থামছে না। গণিতের প্রফেসর তখনো আমাকে খুঁজছেন, মাইকে বলছেন, কোথায়। আরিফুল ইসলাম তপু? রেজিস্ট্রেশন নম্বর সাত এক চার তিন?

আমি যখন উঠে দাঁড়ালাম আমার পাশে যারা বসেছিল তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। একজন হাত বাড়িয়ে জোরে জোরে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করল, অন্যেরা তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে আমাকে মঞ্চে যাবার জন্যে জায়গা করে দিল। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে মঞ্চে যাচ্ছি, আমার মনে হচ্ছে সবকিছু যেন একটা অবাস্তব স্বপ্ন! চারপাশে সব কিছু কেমন যেন দুলতে লাগলো, আমি সব কিছু দেখেও দেখছি না। সবাই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, দিচ্ছে তো দিচ্ছেই, থামার কোন নাম-নিশানা নেই। আমি তার ভিতরে প্রিয়াংকার চিৎকার শুনতে পাচ্ছি, সে কোথায় আছে কে জানে?

আমাকে কয়েকজন মঞ্চে নিয়ে গেলো। প্রেসিডেন্ট আমাকে মেডেলটা পরিয়ে দিলেন, মনে হলো কয়েকশ ক্যামেরার ফ্লাশ জ্বলে উঠলো। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের জন্যে আমার চোখ ধাধিয়ে গেলো। আমাকে সার্টিফিকেট দেবার সময় প্রেসিডেন্ট সেটা কিছুক্ষণ ধরে রাখলেন যেন ক্যামেরাম্যানরা ভাল করে ছবি তুলতে পারে। তারপর প্রেসিডেন্ট আমার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন, মঞ্চে যারা বসে আছে তারাও দাঁড়িয়ে গেছে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্যে। আমার একজন একজন করে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে হলো, উষ্কখুষ্ক চুলের গণিতের প্রফেসর হ্যান্ডশেক করেই শান্ত হলেন না, আমার সাথে কোলাকুলি করে ফেললেন।

আমি যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসছি তখনও টেলিভিশনের ক্যামেরাগুলো আমার পিছনে পিছনে আসছে। প্যান্ডেলের মাঝামাঝি আসার পর দেখলাম কে যেন দর্শকদের ঠেলে আমার কাছে ছুটে আসছে। মিলিটারিরা তাকে থামানোর চেষ্টা করল, সে কনুই দিয়ে মিলিটারিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমার কাছে ছুটে এলো। মানুষটি যে প্রিয়াংকা সেটা আমি অনুমান করতে পারছিলাম। কাছে এসে আমাকে ধরে কী যেন বলতে লাগলো, আমি বুঝতে পারলাম না। তার শুধু ঠোঁট নড়ছে কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। চিৎকার করতে করতে সে তার গলা ভেঙ্গে ফেলেছে।

প্রেসিডেন্ট চলে যাবার পরও আমাকে বেশ কিছুক্ষণ প্যান্ডেলে থাকতে হলো। রাগী রাগী চেহারার বুড়ো মানুষগুলো সবাই এসে আমার সাথে কথা বলল, আমার নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে নিল। সাংবাদিকরা আমার সাথে কথা বলল, আমি কী করি, কী খাই, কী পরি এরকম নানা রকম প্রশ্ন করলো। টেলিভিশনের লোকেরা আমার ইন্টারভিউ নিলো। কয়েকজন মা তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে আমার পাশে দাড় করিয়ে ছবি নিলেন। প্রায় আমাদের বয়সী কয়েকটা মেয়ে তাদের খাতায় আমার অটোগ্রাফ নিয়ে আমার টেলিফোন নম্বর জানতে চাইলো। আমি টেলিফোন নম্বর দেবার সাহস করলাম না। জয়ন্ত, মামুন, মৌটুসি আর আমাদের স্কুলের অন্যেরাও আমার আশেপাশে দাড়িয়ে রইলো। তারা এমন ভাব করতে লাগলো যেন তারা সব সময়েই জানতো আমি অসাধারণ প্রতিভাবান। সাংবাদিকেরা যখন তাদের ইন্টারভিউ নিলো তারা বানিয়ে বানিয়ে আমার সম্পর্কে অনেকগুলো ভাল ভাল কথা বলে ফেললো।

বেচারি প্রিয়াংকা শুধু একটা কথাও বলতে পারল না। তার গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না।

 

আমি যখন বাসায় ফিরে এসেছি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আমি সাবধানে বাসার ভিতরে ঢুকলাম, আম্মু বসার ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। সামনে টেলিভিশনটা খোলা, কিছু একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, আপু সেটা দেখছে। ভাইয়া মনে হয় তার ঘরে।

আমি নিঃশব্দে রান্নাঘরে এসে ঢুকলাম, দুলি খালা রান্না করছিল, মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। আমি দুলি খালার কাছে গিয়ে পকেট থেকে আমার গোল্ড মেডেলটা বের করে দেখালাম, বললাম, এই দেখো দুলি খালা।

এইটা কী?

মেডেল।

কই পাইছ?

আমাকে দিয়েছে।

কে দিল?

প্রেসিডেন্ট।

দুলি খালা কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কুন জায়গার প্রেসিডেন্ট?

কোন জায়গা মানে কী? বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।

স্বয়ং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা মেডেল দিয়েছেন শুনেও দুলি খালার খুব একটা ভাবান্তর হলো না। সে মেডেলটা হাতে নিয়ে বলল, কীসের মেডেল এইটা? পিতলের?

আমি হেসে বললাম, ধুর দুলি খালা! পিতল হবে কেন? এইটা সোনার মেডেল!

আসল সোনা?

হ্যাঁ। আসল। একটা দেশের প্রেসিডেন্ট কখনো নকল সোনা দেয় নাকী?

দুলি খালার এইবার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মেডেলটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো, কতটুকু ওজন অনুমান করে বলল, দুই ভরির কম না। কমপক্ষে দশ হাজার টাকা!

সত্যি?

হ্যাঁ। সোনার কতো দাম তুমি জানো?

দুলি খালা মেডেলটা হাতে নিয়ে নানা ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলো এবং খাঁটি সোনা আর নকল সোনার পার্থক্য কীভাবে ধরতে হয় সেটা নিয়ে কথা। বলতে লাগলো। কেন এই মেডেলটা পেয়েছি জানার খুব এটা আগ্রহ দেখালো না। এক দিক দিয়ে ভাল, যদি আগ্রহ দেখাতো তাহলে দুলি খালাকে সেটা বোঝাতে পারতাম বলে মনে হয় না! নাচের কম্পিটিশন হয়, গানের কম্পিটিশন হয় এমন কী কবিতা আবৃত্তির কম্পিটিশন হয়। তাই বলে গণিতের কম্পিটিশন?

স্টোররুমে আমি আমার বিছানায় শুয়ে শুয়ে সার্টিফিকেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। মেডেলটা হাতে নিয়ে দেখলাম, তারপর সেগুলো তোশকের নিচে রেখে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। আম্মু, ভাইয়া কিংবা আপু কিছুই জানে না। কালকে নিশ্চয়ই খবরের কাগজে খবরটা ছাপা হবে, সেই খবরটা পড়ে আম্মু কী করবে? ভাইয়া আর আপুইবা কী করবে? তাদের সবার ধারণা আমি একজন অপদার্থ খারাপ ছেলে। আমাকে দিয়ে কিছু হবে না! খবরের কাগজে যখন দেখবে বাংলাদেশে আমার মতো গণিত কেউ জানে না—আমি হচ্ছি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন তখন তারা কী করবে?

আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে হলো। স্কুল থেকে ডিবেটের টিম গিয়েছে, আমিও আছি সেই টিমে! আম্মু আমাকে নিয়ে গেছেন, বসেছেন দর্শকদের সাথে। ডিবেটে যখন আমাদের টিম জিতে গেলো তখন আম্মুর সে কী হাততালি। মেডেলটা নিয়ে যখন এসেছি আম্মু আমাকে ধরে সবার সামনে দুই গালে চুমু খেয়ে ফেললেন! বাসায় যখনই কেউ এসেছে সাথে সাথে তাদের আমার সেই মেডেলটা দেখিয়েছেন, এখন আমি বাংলাদেশের গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, দেশের প্রেসিডেন্ট আমাকে একটা গোল্ড মেডেল দিয়েছে কিন্তু আমি সেটা আম্মুকে বলতে পারছি না।

আম্মু আর আপু বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। এখন ভাইয়ার গলাও শুনতে পাচ্ছি, তিনজনে মিলে টেলিভিশনে খবর শুনছে। আজকে মনে হয় ক্রিকেট খেলা ছিল, ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাসার সবার খুব উৎসাহ। যখনই ক্রিকেট খেলা হয় তখন সবাই মিলে সেটা দেখে। আমি অন্যমনস্কভাবে বসার ঘর থেকে টেলিভিশনের খবরের ছিটে ছোটা শুনছিলাম হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলাম। টেলিভিশনে আজকের গণিত প্রতিযোগিতার কথা বলছে! আমি পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজা পর্যন্ত চলে এলাম ভাল করে শোনার জন্যে। দুলি খালা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো, আমি ফিসফিস করে বললাম, দুলি খালা, টেলিভিশনে আমাদের খবর বলছে।

দুলি খালা তখন চুলো থেকে ডেকচিটা নামিয়ে হাত মুছে তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গেলো খবর শুনতে। আমি দরজায় কান লাগিয়ে খবরটা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম। আবছা আবছা শুনতে পেলাম খবরে বলছে, এই গণিত প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, আজকের শিশু-কিশোররাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। তারাই একদিন বড় বিজ্ঞানী। এবং গণিতবিদ হয়ে এই দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এই গণিত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে একমাত্র স্বর্ণপদকটি পেয়েছে হয় বি.কে. হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আরিফুল ইসলাম তপু। খবর এক মুহূর্তের জন্যে। থেমে যায় এবং অনেক মানুষের হাততালি শোনা যেতে থাকে, এখন নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে আমাকে গোল্ড মেডেলটি দেয়া হচ্ছে! ইস! আমি যদি একবার দেখতে পারতাম!

আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, অনুষ্ঠান শেষে একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানান আমি তখন হঠাৎ করে আমার নিজের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আমি বলছি, না মানে আমি কখনই ভাবি নাই আমি চ্যাম্পিয়নদের চ্যাম্পিয়ন হব। সবাই ছয়টা সাতটা করে অঙ্ক করেছে আমি করেছি মাত্র একটা! আমি বুঝি নাই আমি যেটা করেছি সেটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। তবে অঙ্কটা কঠিন হলেও খুব মজার অঙ্ক ছিল। আমার করতে খুব মজা লেগেছে। আমার কথা যখন বলেছে তখন টেলিভিশনে নিশ্চয়ই আমাকে দেখিয়েছে–কেমন দেখাচ্ছিল কে জানে! ইস যদি একবার দেখতে পারতাম!

টেলিভিশনে আবার কথা শোনা যেতে লাগলো, আমাদের ক্ষুদে গণিতবিদ আরিফুল ইসলাম তপু জানিয়েছে সে বড় হয়ে একজন সত্যিকার গণিতবিদ হতে চায়। সে জানায় তার সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে তার বন্ধুবান্ধব, তার স্কুলের শিক্ষক এবং অবশ্যই তার পরিবারের সদস্যরা।

খবরের মানুষটি বলল, এবারে খেলার খবর। তখন একটা বাজনা বাজতে লাগলো। এখন মনে হয় বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যাবে।

আমি কিছুক্ষণ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম, বসার ঘর থেকে আম্মু ভাইয়া বা আপুর কোন কথা শোনা যায় কী না সেটা শুনতে। কিন্তু কিছু শুনতে পেলাম না। সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। এই মুহূর্তে কী ভবছে তারা? আমি নিঃশব্দে আবার স্টোররুমে আমার বিছানায় ফিরে এলাম।

অন্যদিন খাবার টেবিলে আম্মু ভাইয়া আর আপু হালকা গলায় একটু কথাবার্তা বলে আজকে আমি এটা কথাও শুনতে পেলাম না, একেবারে নিঃশব্দে তারা খেয়ে উঠে গেলো। আমি শুনতে পেলাম সবাই নিজের নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করেছে।

ঠিক আধাঘণ্টা পরে বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। আমাদের বাসায় খুব বেশি কেউ আসে না–আম্মুর অফিসের লোকজন, ভাইয়া বা আপুর দুই একজন বন্ধুবান্ধব মাঝে মাঝে আসে। তারা অবশ্যি আরো আগে আসে–এখন একটু বেশি রাত হয়ে গেছে। কলিংবেল শুনে দুলি খালা দরজা খুলে দিয়েছে, আমি একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কে এসেছে, কার কাছে এসেছে। কিছু বোঝার আগেই আমি পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, রান্নাঘর হয়ে স্টোররুমে যে এসে হাজির তাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম, আমাদের প্রিন্সিপাল ম্যাডাম। ম্যাডামের হাতে একটা বিশাল ফুলের তোড়া।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্টোররুমে এসে চালের বস্তাটা ঠেলে সরিয়ে একটু জায়গা করে নোংরা মেঝেতে বসে পড়লেন। তাকে দেখে মনে হলো স্টোররুমের ছোট ঘুপচিতে ময়লা তোষক বিছিয়ে গুটিশুটি মেরে একজনের ঘুমানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার আর ফুলের তোড়া নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসা আরো স্বাভাবিক ব্যাপার। ম্যাডাম ফুলের তোড়াটা আমার বিছানায় রেখে বললেন, টেলিভিশনে এই মাত্র তোমাকে দেখেছি। আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তোমার মেডেলটা আমাকে দেখাও, নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাস হবে না।

আমি তখনও থতমত খেয়ে আছি। কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেমন করে আমার বাসায় এতো রাতে চলে এলেন, কেন এলেন? বাসার কারো সাথে কথা না বলে এই স্টোররুমে কেন চলে এলেন। আমাদের এভাবে দেখে একটুও অবাক কেন হচ্ছেন না কেন ভান করছেন এটাই স্বাভাবিক? আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ম্যাডাম-আ-আপনি আমার বাসা চিনলেন কেমন করে ম্যাডাম?

যতদিন আমাদের ভ্রাম্যমাণ এনসাইক্লোপিডিয়া প্রিয়াংকা আছে ততদিন তোমার বাসা চেনা কোন সমস্যা নাকী? প্রিন্সিপাল ম্যাডাম শব্দ করে হেসে বললেন, আজ বিকেলে সে আমার বাসায় হাজির! শুধু লাফঝাপ দেয় আর ঠোঁট নাড়ায়–গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। শুধু ফাস ফাস করে শব্দ হয়! অনেক কষ্ট করে আমাকে বুঝিয়েছে। তার সাথে বসে টেলিভিশনের নিউজ দেখে এখন আসছি!

হঠাৎ করে আমার অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন সোজা স্টোররুমে চলে এলেন, কেন আমাকে ময়লা তোষকের মাঝে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখেও অবাক হলেন না–সব আমি বুঝে গেলাম। আমি নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, প্রিয়াংকা কোথায় ম্যাডাম?

বাইরে ঘোরাঘুরি করছে! ভিতরে আসতে রাজি হলো না। আমি বললাম, ও।

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমার মাথায় হাত রাখলেন, তারপর নরম গলায় বললেন, তপু, তুমি একা একা অনেক দূর চলে এসেছ। এরকম আমি কখনো দেখি নি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার আর একা একা যেতে হবে না। আমরা সবাই থাকব তোমার সাথে।

আমি কোন কথা বললাম না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম উঠে দাড়ালেন, তারপর স্টোররুম থেকে বের হয়ে গেলেন। বাইরে নিশ্চয়ই আম্মুর সাথে দেখা হলো কারণ শুনলাম প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আপনি নিশ্চয়ই তপুর আম্মু? আমরা সবাই তপুকে নিয়ে খুব গর্বিত। এমন একটি সন্তানকে আপনি জন্ম দিয়েছেন–আপনি হচ্ছেন রত্নগর্ভা।

আম্মু কিছু বললেন না। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না। খবরটা শুনে আর বাসায় থাকতে পারলাম না।

আম্মু এবারে অস্পষ্ট গলায় কী যেন বললেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, আসি তাহলে?

দরজা খোলা এবং বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পেলাম–প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিশ্চয়ই চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ সময় নিঃশব্দে আমার ঘরে বসে রইলাম, আমার শুধু মনে হতে লাগলো এক্ষুণি হয়তো আম্মু আমার ঘরে আসবেন–কিছু একটা বলবেন, কিন্তু আম্মু আসলেন না।

 

গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আবছা। অন্ধকারে আম্মু আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন। আম্মুর হাতে একটা লোহার রড-হঠাৎ করে আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আম্মুর চুল এলোমেলো, চোখগুলো অন্ধুকারেও ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। আম্মু হিংস্র গলায় বললেন, তোর সাহস বেশি হয়েছে তপু?

আম্মু কিসের সাহসের কথা বলছেন আমি বুঝতে পারলাম না, তাই সব সময় যেটা করি সেটাই করলাম। একটা কথাও না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আম্মু বললেন, টেলিভিশনে বলেছিস তোর ফেমিলির সবাই তোকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেয়?

আমি সেটা বলেছি! টেলিভিশনের লোকেরা আমার কাছে সেটাই শুনতে চেয়েছিল তাই বলেছি। আম্মু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, তুই আমাদেরকে নিয়ে টেলিভিশনে টিটকারি মারিস? তোর এত বড় সাহস? আমি তোক খুন করে ফেলব আজকে?

আম্মু হাতের রডটা উপরে তুললেন, আমি কখনো আম্মুর সাথে কথা বলি, নিঃশব্দে মার খেয়ে যাই। আজকে কী হলো জানি না আমি হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলাম, বললাম, আম্মু!

কী বলতে চাস?

আসলেই আমি তোমার কাছ থেকে উৎসাহ পাই আম্মু।

আমার কাছ থেকে উৎসাহ পাস? আমি কী করেছি তোর জন্যে যে তুই উৎসাহ পাস? আম্মু রডটা ঝাকালেন, আমি জানি, এক্ষুণি আমার মাথায় নেমে আসবে সেটা।

আমি কাতর গলায় বললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তুমি আমাকে কতো আদর করতে মনে আছে? আমার যখন মন খারাপ হয় তখন আমি সেই সময়ের কথা ভাবি আর আমার মন ভাল হয়ে যায়! আমি এখনোও সেই সময়ের কথা চিন্তা করে উৎসাহ পাই আম্মু।

আম্মু নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইলেন, আমি ফিসফিস করে বললাম, এখন তুমি আমাকে যাই কর না কেন ছোট থাকতে আমাকে যে আদর করেছিলে সেটা। কেউ আমার কাছ থেকে নিতে পারবে না। বিশ্বাস করো তুমি।

আম্মু কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর নিঃশব্দে লোহার রডটা নামিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

আমি চুপচাপ আমার বিছানায় বসে রইলাম। এর আগে সবসময় আমার নিজের জন্যে মায়া হয়েছে আজকে কী হলো কে জানে হঠাৎ করে আমার আম্মুর জন্যে মায়া হতে শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *