সপ্তম পরিচ্ছেদ
ইহার পর প্রায় এক মাসের উপর চলিয়া গিয়াছে। পূজা আসিয়া পড়িয়াছে। ষষ্ঠীর দিন। চণ্ডীমণ্ডপে যথানিয়মে ঢাকের সঙ্গে ঢোল সানাই কঁসি আসিয়া পূজার সুর জমাইয়া তুলিয়াছে। দেশে অন্নের অভাব, কাপড়চোপড় দুমূল্য, এসব সত্ত্বেও পূজার সুর একেবারে কাটিয়া যায় নাই। আগেকার কালে এর সুর একটা দেশব্যাপী ঐকতানের ঝঙ্কার তুলিত, গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে পৌঁছিয়া সে গ্রামের বাজনার সঙ্গে সুর মিলাইত। আজ সুর ওঠে, কিন্তু সে সুর ঐকতান তুলিতে পারে না; গ্রামের প্রান্তদেশ পর্যন্ত গিয়া গ্রামান্তরের মধ্যবর্তী মাঠের সীমানার মুখেই এলাইয়া পড়ে। সেদিন বেলা তখন প্রহরখানেক, নবগ্রামের বাজারে কাপড় কিনিতে গিয়াছিল সেতাব। কেনাকাটা শেষ করিয়া ফিরিবার পথে ঘোঁতনের দলিজায় উঠিল। পুঁটি সত্য সংবাদই দিয়াছিল; ঘোঁতনের সঙ্গে সেতাবের এখন খুব মাখামাখি। নবগ্রামের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণীর অর্থাভাব ক্রমশই দারুণ হইতে নিদারুণ হইয়া উঠিয়াছে। সকলের আগে এ অবস্থায় তাহারা গহনা বন্ধক দিয়া অর্থ সংগ্রহ করে। প্রাণ ধরিয়া বিক্রয় করতে পারে না। ঘোত। এই কারবারটায় সেতাবকে ঢুকাইয়া দিতে সাহায্য করিতেছে।
ঘোঁতন বসিয়া বিড়ি টানিতেছিল। কোথায় পূজামণ্ডপে সানাই বাজিতেছে। দাওয়ার পাশেই একটা শিউলিগাছের তলায় শিউলি ঝরিয়া পড়িতেছে।
সেতাব আসিয়া দাওয়ায় উঠিতেই সে সমাদরের সহিত অভ্যর্থনা করিয়া তাহাকে বসাইল। বিড়ি দিল। সেতাবের বগলে একটি বান্ডিল, হাতে একটি পোটলা। বিনা ভূমিকাতেই সে ঘোঁতনের হাতে দিয়া বলিল, দেখ দিকি, ছেলেগুলার গায়ে হয় কি না।
পোটলা খুলিয়া ঘোঁতন দেখিল, কয়েকটা ফ্ৰক জামা, দুইখানা শাড়ি, একখানা ধুতি, একখানা থান কাপড়, দুইটা ব্লাউজ ও একটা শার্ট। ঘোঁতন বুঝিল, এগুলি তাহার জন্যই লইয়া আসিয়াছে। সে দন্ত বিস্তার করিয়া বলিল, দাঁড়াও, দিয়ে আসি বাড়িতে, বুঝলে।
পোঁটলাটা লইয়া সে ভিতরে চলিয়া গেল।
সেতাবের উবু হইয়া বসা অভ্যাস। সে হাঁটুর উপর কনুই রাখিয়া মাথায় এক হাত দিয়া অন্য হাতে বিড়ি টানিতে লাগিল।
পথের উপর দিয়া কয়েকটা গরু লইয়া একটা রাখাল চলিয়া গেল। তাহার পিছনে বহুবল্লভ বাউল একতারা এবং কোমরে গামছা বাঁধিয়া টুটুং শব্দ তুলিতে তুলিতে যাইতেছিল। বহুবল্লভ সেতাবকে দেখিয়া বলিল, বড় মোড়ল এখানে বসে?
সেতাব বলিল, বলি তার কৈফিয়ত তোকে দিতে হবে নাকি?
বহু বলিল, কাপড় কিনতে এসেছিলে?
সেতাব বিড়িতে টান দিয়া ধোঁয়া ছাড়িতে ছাড়িতে বলিল, উঁহুঁ, আকাশের তারা গুনতে এসেছিলাম।
বহু বৈষ্ণব মানুষ, রাগ তাহার নাই; সে হা-হা করিয়া হাসিয়া বলিল, দিনের বেলায়?
সেতাব বলিল, রেতের বেলা পথে সাপ-খোপ শেয়াল কুকুর; রেতের বেলা নিজের বাড়িতে তারা গুনি। নবগেরামের আকাশের তারা দিনে গুনতে আসাই ভাল!
—তা দিনে তারা দেখবার সময় তোমাদের বটে! যা ধান জমেছে তোমাদের! আঃ, যেমন কালো কষকষে রঙ, তেমনি গোছ! তা মহাতাপ একটা মরদ বটে! ক্ষ্যামতা ধরে বটে।
সেতাব তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পর ফতুয়ার পকেট হইতে একটা পয়সা বাহির করিয়া ফেলিয়া দিয়া বলিল, যা যেখানে যাবি চলে যা। বকর বকর করে কানের পোকা মারিস না আমার। মেজাজ খারাপ করে দিস না।
–হরিব-ল–হরিব-ল!—বলিয়া পয়সাটি কুড়াইয়া কপালে ঠেকাইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, তা মেজাজ খারাপ হবার কথা বটে! আঃ, আকাশ খখা করছে। মেঘের চিহ্ন নাই। তোমার উ মাঠে এখনও ক্যানেল আসে নাই। জল না হলে এমন বাহারের ধান সব মরে যাবে। আঃ! একটু চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিল, তা ভেবো না, জল হবে। এই পুজোতেই হবে জল।
–না, হবে না।
বহু চমকাইয়া উঠিল কথার সুর শুনিয়া।
সেতাব আবার বলিল, একেবারে শুকিয়ে খড় হয়ে যাবে। জ্বলে যাবে।
বহু বলিল, না না না। হবে। ভগবান তা করবেন না। না না। দেবেন দেবেন। মা ভগবতী আসছে–ভোগ খাবেন, মুখ ধোবেন না, এই হয়? হে মা, জল দাও। জল দিয়ে সৃষ্টি রাখ মা।
সেতাব বিরক্ত হইয়া উঠিয়া দাওয়ার উপর ঘরের দরজার মুখে গিয়া ডাকিল, ঘোঁতন! ও ঘোঁতন!
বহু আর দাঁড়াইল না, সে চলিয়া গেল।
ঘোঁতন তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিল। সে ইহার মধ্যে নতুন জামাটা পরিয়া ফেলিয়াছে। হাসিয়া বলিল, দেরি হয়ে গেল। চা করতে বললাম। দুধ নাই ঘরে, পুঁটি গেল দুধ আনতে।
—জামাগুলো গায়ে হল ছেলেগুলার?
–হয়েছে। তোমার চোখ আছে হে!
–তা বউয়ের, পুঁটির কাপড় পছন্দ হয়েছে?
—বউয়ের হয়েছে, পুঁটির কথা জানি না। ঝাঁটাখাগী আবার কথা বলে না। ওই এক রকম। বড় বজ্জাত হে।
—না না। বড় কাজের মেয়ে। ভাল মেয়ে।
–বউ কিন্তু হাসছিল।
–ক্যানে, হাসির কথাটা কি এর মধ্যে?
—সেই চাঁপাডাঙার বউয়ের সঙ্গে আমার ছেলেবেলায় বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল, সেই নিয়ে ঠাট্টা করছিল। সতীনের আড়ি প্রেম হল শেষে!
সেতাব একটু হাসিল, তারপর সহসা গম্ভীর হইয়া বলিল, তুই ভাগ্যিবান ঘোঁতন। তোর ভাগ্যি ভাল। অনেক ভাগ্যি তোর।
তারপর একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ওই ওর সঙ্গে তার বিয়ে হয় নি ঘোঁতন, তুই বেঁচে গিয়েছিস।
ঠিক এই সময় ঘোঁতনের মা বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, ধনে পুত্ৰে তোমার লক্ষ্মীলাভ হোক বাবা, কিন্তু এত টাকার জিনিস তুমি না দিলেই পারতে। এমন মিষ্টি কথাগুলি বলিলেও তাহার কণ্ঠস্বর কেমন বিরস। কেমন যেন বেসুর বাজিতেছে।
সেতাব চঞ্চল হইয়া উঠিল, বলিল, সইমা।
–বাবা।
–ঘোঁতনের ছেলে কাঁদছিল দেখে গেলাম, তা বলি–
—তা ছেলেদের দিলেই হত। এই বাজার। তার ওপর, কিছু মনে কোরো না, তোমার ভাই-ভাজ নিয়ে সংসার
–ভাই-ভাজ! সেতাব রাগিয়া উঠিল।–ভাই-ভাজের কি আছে এতে? আমি দেব আমার অংশ থেকে। তার ছেলে আছে। আমার ছেলে নাই, পুলে নাই। আমার খাবে কে? কি করব আমি? কি দরকার আমার যুগিয়ে?
—কাদুকে বলেছ বাবা?
—কাদুকে? চমকাইয়া উঠিল সেতাব। মাথা হেঁট করিয়া ঘাড় নাড়িয়া জানাইলনা, তাহাকেও বলে নাই।
—তুমি বাবা, আমার আর পুঁটির কাপড় দু জোড়া নিয়ে যাও।
–নিয়ে যাব?
–হ্যাঁ।
–মা! চিৎকার করিয়া উঠিল ঘোঁতন।
মা তাহাতে দমিল না। বলিল—কথা হবে বাবা। হবে নয়—হয়েছে। টিকুরীর বউসে থামিয়া গেল। একটু পর যেন শক্তি সঞ্চয় করিয়া বলিলটিকুরীর বউ আমাকে কাল বলছিল, সেতাব খুব আসছে যাচ্ছে। কনেও খুঁজছে। তা-পুঁটিকে। আবারও সে থামিয়া গেল।
সেতাব বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ঘোতনের মায়ের দিকে চাহিয়া রহিল। এই কথাটাই যেন তাহার একান্তভাবে মনের কথা অথচ এই মুহূর্তের পূর্বেও তাহার মন কথাটি হাতড়াইয়া পায় নাই। হ্যাঁ, সে সন্তান চায়। কাদু বন্ধ্যা; সে তাহার প্রতি একান্তভাবে অনুরক্ত আসক্ত তাহার প্রতি প্রেমপ্রীতিতে অভিষিক্ত স্ত্রী নয়। কাদু মহাতাপ মহাতাপ করিয়া সারা। তাহার প্রথম যৌবন অর্থোপার্জনের নীরস কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্যে উপবাসী রহিয়া গিয়াছে। বহুজনের বঞ্চনায় কৈশোরে সে নিষ্ঠুর আঘাত পাইয়া সংসারকে কুটিল অবিশ্বাসী হিসাবেই দেখিয়াছে। ঘোঁতন তাহার মনে সন্দেহ জাগাইয়া দিয়াছে। টিকুরীর খুড়ী তাহাতে বাতাস দিয়াছে। অবিশ্বাস তাহার জাগিয়াছে। এই লগ্নে পুঁটি আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইয়াছে। যুবতী মেয়ে। বিবাহ হয় না। বড় দুঃখী। এই তো ইহাকে বিবাহ করিলে এ তাহাকে পরম কৃতজ্ঞতায় অ্যাঁকড়াইয়া ধরিবে। আজ সব কথাগুলি এক কথায় পরিষ্কার হইয়া গেল। সে বলিতে গেল—চোখ তাহার জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল—বলিতে চাহিল–হা। আমি পুঁটিকে চাই। আমি আমার সবসব তাহাকে দিব।
কিন্তু বলা হইল না।
ঠিক এই সময়েই সেতাবের রাখাল গোবিন্দ ছুটিয়া আসিয়া বলিল, মোড়ল মশায়, শিগগির আসেন। বাড়ি চলেন।
–ক্যানে রে, কি হল? প্রশ্ন করিল ঘোঁতন।
সেতাব বলিল, কি হবে? নিশ্চয় সেই আমার জন্ম-শত্ৰু কিছু করেছে। ভাই তো নয়–জন্ম-শত্ৰু আমার। চিরদিন জ্বালিয়ে খেলে। সে-ই কিছু করেছে।
—হ্যাঁগো। মাঠে একেবারে ফাটাফাটি লাগিয়ে দিয়েছে। নিজের মাথা ফেটেছে। এই রক্ত পড়েছে। আর মীরবন্ধের শেখেদের দুজনার মাথা ফাটিয়েছে। সেও রক্ত-গঙ্গা। জল নিয়ে। মারামারি।
সেতাব চিৎকার করিয়া উঠিল, মরুক মরুক, নয়ত ধরে নিয়ে নিয়ে যাক। আমি জানি না, কিছু জানি না।
বলিয়া হনহন করিয়া অগ্রসর হইল।
এত বড় কাটার কারণ যেটি, সেটি শুনিতে সামান্য মনে হয়, কিন্তু চাষার জীবনে তাহা অসামান্য, তাহার গুরুত্ব অনেক বেশি।
কারণ, জল চুরি।
মহাতাপ নিজের মুখেই বলিল, কাল রাত এক প্রহর পর্যন্ত ধরে অমরকুঁড়ির বেঁকে বাকুড়িতে আল-ছাপুছাপু জল করেছি আমি। আঙুল দিয়ে মেপে দেখেছি, আল ছাপতে দু আঙুল বাকি ছিল। সেই জল চুরি করে নেবে শেকের পো? বললাম, তো বলে ক্ষ্যাপামি করিস না, বাড়ি যা। চাঁপাডাঙার বউ ভাত বেড়ে রেখেছে, খা গা। ধরলাম টুঁটি চেপে তো হায়দার মাথায় বসিয়ে দিলে পাঁচনের বাড়ি। আমি মহাতাপ! সেই পাঁচন কেড়ে নিয়ে দিলাম দু ভাইয়ের। মাথা পিটিয়ে ফাটিয়ে।
মহাতাপ তখন বাড়িতে বসিয়া বড় বউয়ের পরিচর্যা লইতেছিল। ভাল করিয়া রক্ত ধুইয়া গদাফুলের পাতা বাটিয়া চাপান দিয়া ন্যাড়া দিয়া বাঁধিয়া দিতেছিল। মানদা জল দিয়া রক্তাক্ত দাওয়াটা ধুইয়া ফেলিতেছিল।
সেতাব গম্ভীর মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল। মহাতাপের কথা শেষ হইতেই বলিল—বেশ করেছ, খুব করেছ। এইবার ফৌজদারি মামলা হোক। যাও জেলে। একটা পয়সা আমি খরচ করব না। সে আমি বলে দিলাম।
–তা বলে আমার জল চুরি করে নেবে?
–জল চুরির প্রমাণ হয় নাকি? জলের গায়ে নাম লেখা থাকে নাকি?
–ও জল পেল কোথা থেকে?
–যেখান থেকে পাক। তুই কোথা পেলি? গাড়োল, মুখ্যু পাগল কোথাকার!
বড় বউ এবার বলিল, দেখ, এমন করে ওকে তুমি যা মুখে আসে তাই বোলো না। তোমাকে বারণ করছি আমি। সহোদর বড় ভাই তুমি, তোমার মুখে এ সব বলতে বাঁধছে না? ছি-ছি!
মহাতাপ বড় বউয়ের হাত দুখানি পরম আবেগের সহিত জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, যার বড় বউ নাই তার কেউ নাই।
মুহূর্তে সেতাব যেন জোর পাইল; সে জ্বলিয়া উঠিল। চাঁপাডাঙার বউকে বলিল–তোমাকেও ছি, তোমাকেও ছি, তোমাকেও ছি! বুঝলে! বলিয়া কাপড়ের বান্ডিলটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল।
কণ্ঠস্বরে চমকিয়া উঠিল কাদু। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া স্বামীর গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল, তারপর মহাতাপকে বলিল, ছাড়, তোমার জন্য দুধ গরম করে আনি। যাও, ঘরে গিয়ে শোও একটু। মানু, নিয়ে যা ওকে।
বড় বউ রান্নাশালে আসিয়া উনানে দুধের বাটি বসাইয়া দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মহাতাপ ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া আপন মনেই বলিল, চামারের নেতার আমি একদিন নিকেশ করে দেব।
পাশের বিছানায় মানিক শুইয়া ছিল। মানু তাহার চাপাপড়া হাতখানা সরাইয়া দিতেছিল। চামার কথাটা সে শুনিতে পায় নাই। নেতার মারিয়া দিবে শুনিয়াই সে ভাবিল—তাহাকে বলিতেছে মহাতাপ। এ সংসারে পোড়াকপালী মানদা ছাড়া এত সহজে নেতার আর কাহার মারিবে সেই চকিতে ঘাড় ফিরাইয়া তীক্ষকণ্ঠে প্রশ্ন করি, কার?
-কার আবার ওই চামারের কেপনের, ওই বড় বউয়ের স্বামীর। ওই আমার, দাদার, তোর ভাসুরের।
—তোমাকেও ছি! বুঝলে?
–তোমার নেতারভি এক রোজ মার দেগা। হ্যাঁ!
বড় বউ কথাগুলি সিঁড়ি হইতেই শুনিতেছিল, বলিল, কি যা তা বলছ? তোমার জন্যে কি আমি শান্তি-স্বস্তি এক দণ্ড পাব না মহাতাপ? নাও, দুধটা খেয়ে ফেল।
–না। দুধ খাব না আমি। ভাত দাও। মছলি আওর ভাত। কাল পলুইয়ে ধরা মাছ আছে। মনে পড় গিয়া। মাছের মাথা আর ভাত। লে আও।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, মানু, ভাত এনে দে।
বলিয়া সে ফিরিল। মহাতাপ তাহার আঁচলটা ধরিয়া বলিল, নেহি, উ হামকো ছি করতা। উসকে হাতমে নেহি খায়েগা। তুমি এনে দাও ভাত।
চাঁপাডাঙার বউ বলিল, ছাড়, আঁচল ছাড়।
তাহার গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মহাতাপ আঁচল ছাড়িয়া দিয়া বলিল, কি, হল কি তোমার, বলতে পার?
—কিছু হয় নি, মাছ আজ ছোব না আমি। মানু এনে দিক্।
বলিয়া নামিয়া গেল।
মহাতাপ চিৎকার করিয়া উঠিল, ছোঁবে না ক্যানে? তুমি বিধবা হয়ছ, না, খড়দার মাঠাকরুন হয়েছ? মাছ ছোঁবে না?
সিঁড়ির মধ্যধাপ হইতেই উত্তর আসিল—আজ ষষ্ঠী।
—ষষ্ঠী?
মানদা মুখ বাঁকাইয়া এবার বড় বউ চলিয়া যাওয়ার সুযোগ পাইয়া স্বামীর কাছে আসিয়া বলিল, হা হ্যাঁ, ষষ্ঠী। ছেলে, বংশধর। চাই না? ছেলের জন্যে কি করছে দেখ না। গলায় এই এক ঝোলা মাদুলি। নিত্য উপোস, কানা নাকি?
মহাতাপ আজ রাগ করিল না। সে এক মুহূর্তে বিষণ্ণ বেদনায় অভিভূত হইয়া স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ অস্কুটস্বরে সে বলিল ছেলে! সন্তান! সীয়ারাম, সীয়ারাম! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল সে।
মানদা বলিল, বড় দরদ বড় বউয়ের জন্যে? এইবার বোঝ।
আবার একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহাতাপ বলিল, তুই ঠিক বলেছিস মানু, আমি বুঝতে পারতাম না। একটু পর বলিল, আমি তো একটু ক্ষ্যাপাটে বটে! মাথা তো একটু খারাপ।
–একটু? কিন্তু এইবার আক্কেল হল তো?
–হ্যাঁ, হল। আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, নেহি। ই হাম নেহি বুঝা!
–এখন যদি বুঝে থাক, তবে সময়ে বিধান কর। বুঝলে?
—কি করি বল্ তো মানু?
—কি করবে? তাও বলে দিতে হবে আমাকে? দাদাকে গিয়ে সোজা জিজ্ঞাসা কর, ঘোঁতনের সঙ্গে শলা করে কত টাকার গয়না বাধা রেখেছে বল? এ পর্যন্ত কত টাকার ধান বেচেছে, হিসেব দাও।
–বিষয়? মহাতাপ ঘৃণাভরা তিক্ত দৃষ্টিতে মানদার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, শিব-শিবশিব! এতক্ষণ ব্যাড়র ব্যাড়র করে হল বিষয়!
মানদা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া স্বামীর দিকে চাহিয়া রহিল। মহাতাপ তাহাকে সিঁড়ি দেখাইয়া দিয়া বলিল, বেরিয়ে যা, আমার সামনে থেকে তুই বেরিয়ে যা। আমার সারা অঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। বেরিয়ে যা। বিষয়।
—বেরিয়ে? মানদা ফোঁস করিয়া উঠিল—বেরিয়ে যাব ক্যানে? আমি ছেলের মা, এ। আমার ছেলের ঘর।
–হাম ছেলের বাবা। আর বেরিয়ে যাবি আর ভাল বলবি। বলিয়া ঘাড়টি ধরিয়া তাহাকে সিঁড়িতে বসাইয়া দিয়া আসিল। আসিয়া মানিকের মাথার শিয়রের কাছে জানালার ধারে বসিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল।
নিচে বড় বউ ক্লান্ত দেহে বিষণ্ণ অন্তরে দাওয়ার উপর আঁচল বিছাইয়া শুইয়া ছিল। শুইয়া ছিল ঠিক নয়, অন্তরের দুর্বিষহ আবেগের আলোড়ন সংবরণ করিবার জন্য উপুড় হইয়া পড়িয়া ছিল। সে আর পারে না, পারিতেছে না। এমন সময় মানদা দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া। আসিয়া বড় জাকে এইভাবে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। নিরুপায় দুরন্ত ক্ৰোধ যেমন মানুষ সর্বংসহ পৃথিবীর বুকে পা ঠুকিয়া জাহির করে, কখনও বা মাথা ঠুকিয়া নিজের কপাল ফাটাইয়া শান্ত হয় আঘাত করে মাটিকেই, রক্তাক্ত করে মাটিকেই তেমনি ভাবেই মানদা বড় জায়ের উপর সব ক্রোধ সব ক্ষোভ দিয়া আঘাত করিল। বলিল, তুমিই—তুমিই আমার কপালে আগুন ধরিয়ে দিলে। তুমি।
বড় বউ তেমনিভাবে পড়িয়া থাকিয়াই উত্তর দিল, দিনরাত চোখের জল ঢেলেও যে নেবাতে পারছি না, কি করব ব?
বলিতে বলিতে সে উঠিয়া বসিল। চোখের জল তখনও গড়াইয়া পড়িতেছিল।
মানু আজ প্রায় ক্রোধে জ্ঞান হারাইয়াছে। সে চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, এখন হয়েছে। কি? অনেক কাঁদতে হবে। অনেক কাঁদতে হবে তোমাকে।
মানদার চিারেই বোধ করি একসঙ্গে দুই দিক হইতে সেতাব ও মহাতাপ দুই ভাই আসিয়া হাজির হইল। সেতাব আসিয়াছে বাড়ির বাহির হইতে; মহাতাপ উপর হইতে নামিয়া আসিয়াছে। মহাতাপের কোলে মানিক।
সেতাব তীক্ষকণ্ঠে বলিল, এক দণ্ড শান্তি দেবে না তোমরা? এত অশান্তি কিসের? কাঁদছ? তুমি কাঁদছ? কেন কাঁদছ শুনি?
মহাতাপ স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সে হঠাৎ গতি সঞ্চয় করিয়া বড় বউয়ের কাছে আসিয়া কোলের মানিককে প্রায় বড় বউয়ের কোলে ফেলিয়া দিয়া বলিল, এই নাও, ছেলের জন্যই যদি এত দুঃখু তোমার, তবে এই নাও। আমার ছেলে তোমাকে দিলাম। নাও।
মানদা চিৎকার করিয়া উঠিল, নানা-না। আমার ছেলে—
মহাতাপ পথরোধ করিয়া দাঁড়াইল–না।
সেতাব অধীর পদক্ষেপে আসিয়া বড় বউয়ের কোলের মানিককে তুলিয়া লইয়া মানদা ও মহাতাপের কাছে নামাইয়া দিয়া বলিল, না। পরের ছেলে আমি চাই না। ভগবান যদি আমাকে দিয়ে থাকে, তবে সে আমি পাব। আমার হবে।
বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।
বড় বউ তাহাকে ডাকিল, শান, শান, যেয়ো না।
–কি? সেতাব ফিরিয়া দাঁড়াইল।
বড় বউ বলিল, আমাকে তুমি খালাস দাও।
সেতাব বলিল, বাঁচি বাঁচি, তা হলে বাঁচি আমি।–বলিয়া সে চলিয়া গেল।
বড় বউ উঠিল এবং খিড়কির পথের দিকে পা বাড়াইল।
মহাতাপ বলিল, কোথা যাবে তুমি?
বড় বউ বলিল, সর। পুকুরে ড়ুব দিয়ে আসি।
বলিয়া পাশ কাটাইয়া সে বাহির হইয়া গেল। মহাতাপ তাহাকে অনুসরণ করিতে উদ্যত হইয়া ডাকিল, বড় বউ!
মানদা বলিল, আদিখ্যেতা কোরো না। ড়ুবে মরবে না।
মহাতাপ মানদার দিকে ফিরিয়া বলিল, তোরা সাপের জাত। তোরা সাপের জাত। বিষ ছাড়া তোদের কিছুই নাই। জীবনটা জ্বালিয়ে দিলি। বলিস বড় বউকে, তোর কামড় সয়েও ছিলাম। ওর কামড় সইল না। আমি চললাম। এ বাড়িতেই আর আসব না আমি। দু চোখ যেদিকে যায় চলে যাব আমি। হে শিবো! হে ভগবান
বলিতে বলিতে সে চলিয়া গেল।
গেল সে খিড়কির পথেই। পুকুরঘাটে তখন বড় বউ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। ভরা পুকুরের দিকে তাকাইয়া ছিল সে। ডান হাতের মুঠায় চাপিয়া ধরিয়াছিল গলার কবচ মাদুলিগুলি।
দূর হইতে মহাতাপ তাহাকে দেখিয়া বলিল, আমি চললাম? আর আমি ফিরব না।
বড় বউ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিল, কথা বলিতে পারিল না।
মহাতাপ যাইতে যাইতেই বলিল, না। ছেলে—ছেলে তোমার হোক। তাই নিয়ে তুমি সুখে থাক। আমি চললাম। কি দরকার তোমার আমাকে?
সে চলিয়া গেল। বড় বউ দাঁড়াইয়া রহিল। মুখে তাহার বিচিত্ৰ হাসি ফুটিয়া উঠিল; তারপর সে সজোরে টান দিল হাতে ধরা কবরে মুঠায়; কবচ-বাধা সুতার ডোরটা পট করিয়া ছিঁড়িয়া গেল। কবচগুলা সে জলে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিল। সেখানে একটা টুপ করিয়া শব্দ তুলিয়া কবচগুলি জলে ড়ুবিয়া গেল। তারপর সে ধীরে ধীরে জলে নামিল। হাঁটু-জলে নামিয়া একবার থমকিয়া দাঁড়াইল। চোখ দিয়া তাহার জল গড়াইতেছিল।
মহাতাপ দুই চোখ যেদিকে যায় সেই দিকেই চলিবার সংকল্প লইয়াই বাহির হইয়াছিল। আধপাগল মানুষ। সে আজ গভীর আঘাত পাইয়াছে। বড় বউ তাহার ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী। দশ-এগার বছরের কাদম্বিনী শ্বশুরঘরে আসিয়া দেওরের সঙ্গে খেলাঘরে খেলা করিত—সে সাজিত মা, মহাতাপ সাজিত ছেলে। কাদাধুলার ভাত ব্ৰাধিয়া দেবরকে খাইতে দিত। উঠানের একটা খাল অংশকে পুকুর কল্পনা করিয়া সেখানে মহাতাপকে স্নান করাইয়া দিত। ছোট অ্যাঁজলায় শূন্যকে জল কল্পনা করিয়া তাই মহাতাপের মাথায় ঢালিয়া দিয়া মুখে বলিত পুস হুলুস।
ছেঁড়া ন্যাকড়ায় গা মুছাইয়া দিত।
এক একদিন মারিত। মহাতাপ কাঁদত এবং কান্না থামাইয়া হঠাৎ চাঁপাডাঙার বউয়ের ঘাড়ে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া উল্টা মার মারিত।
মহাতাপের মা আসিয়া বলিত, কি হল?
কাদু লজ্জায় চুপ করিয়া থাকিত।
মহাতাপ বলিত, আমাকে মারলে।
—তুমি কি করেছিলে?
–বলেছিলাম ভাত খাব না। ও মা সেজেছে কিনা!
–ও! তুমি ছেলে, ও মা!
–মা না কচু! ছাই! ছাই! ছাই!
–না-না-না। ও বলতে নাই, ও বলতে নাই। বড় ভাজ মায়ের মত। মত নয়–মা।
–ওইটুকু মেয়ে আবার মা হয়?
–হয়। লক্ষ্মণের চেয়ে সীতা বয়সে ছোট ছিলেন, তবু সীতা লক্ষ্মণের মায়ের চেয়ে বেশি। জান?
শুধু কি এই খেলা! কত খেলা তাহারা খেলিয়াছে—তাহার কথা একটা পালাগানের চেয়েও বেশি। সে ফুরায় না। লিখিতে গেলে রামায়ণ মহাভারত হইবে বোধহয়, বলিতে গেলে রাত ফুরাইয়া যায়। এইভাবে একসঙ্গে কতদিন কাটিয়াছে। তাহার উপর এতদিন নিঃসন্তান অবস্থায় মহাতাপকে নিবিড় ভালবাসায় জড়াইয়া থাকিয়া, আজ হঠাৎ সে ভালবাসাকে খাটো করিয়া তুচ্ছ করিয়া সন্তানকামনাকে বড় করিয়া তোলার সংবাদে মহাতাপ মর্মান্তিক দুঃখ পাইয়াছে।
সে নিজেদের স্বজাতি জ্ঞাতিগোষ্ঠীর পাড়া বাদ দিয়া আসিয়া উঠিল গ্রামপ্রান্তে বাউরিদের পাড়ায়। বাউরিপাড়া পার হইয়া আসিয়া উঠিল মাঠের প্রান্তে।
আশ্বিন মাসে ধানের জমিতে কানায় কানায় জল প্রয়োজন। কিন্তু সারা আশ্বিন জল নাই, মাঠ শুকাইয়া গিয়াছে। মাঠের মধ্যে উৎকণ্ঠিত চাষীরা কোদাল কাঁধে ফিরিতেছে। মহাতাপের ওই মাঠের মধ্যেই ঘুরিবার কথা। এই সকালবেলাতেও সে ঘুরিয়াছে; মারপিট করিয়া মাথা ফাটাইয়াছে। কিন্তু আর তাহার সে ইচ্ছা নাই। পাগল, মাঠের সীমানার প্রান্তে একটা গাছে চড়িয়া ডালে বসিয়া পা ঝুলাইয়া গান ধরিল–
এ সংসারে কেবা কার মন,
কেবা তোমার তুমি বা কার?
আমার আপন জনা যে জন
কে জানে হায় ঠিকানা তার?
দুই কলি গাহিয়াই তাহার কি মনে হইল। সে লাফ দিয়া নামিয়া পড়িল এবং হনহন করিয়া আলপথ ধরিয়া হটিয়া আসিয়া নিজের জমিগুলি যেগুলিতে সে দিনরাত্রি পরিশ্রম করিয়া দুনীতে তুলিয়া জল ভরিতেছিল, সেই জমিগুলির বাঁধ পায়ে লাথি দিয়া ভাঙিয়া দিল। জল বাহির হইতে লাগিল। সে সোল্লাসে চিৎকার করিয়া উঠিল—বিষয়! বিষ—বিষ! যা! বিষ বেরিয়ে যা! ধান মরে যাক! মরে যাক!
চারিপাশের মাঠেও চাষীরা অবাক হইয়া গেল। ছোট মোড়লের এ কি মতি! ইহাদের অধিকাংশই মজুর-শ্ৰেণী লোক, ধান বচাইবার জন্য মাঠে আসিয়া বুক দিয়া পড়িয়াছে। পুকুরে পুকুরে দুনী বসাইতেছে। নালা কাটিতেছে। খাওয়াদাওয়া মাঠেই, মাঠেই রাত্রি কাটিবে। কড়া পচাই মদের ঊড়ে চুমুক দিতেছে, কড়া তামাক টানিতেছে আর খাঁটিয়া চলিয়াছে। মহাতাপদের কৃষাণ নোটনও মাঠে ছিল। সে ছুটিয়া আসিল। সে মদের হাঁড়িতে চুমুক দিতেছিল, সেটা হাতে করিয়াই সে ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ছোট মোড়ল। ছোট মোড়ল!
মহাতাপ বলিল, যাক যাক, বিষ বেরিয়ে যাক।
নোটন হাঁড়িটা আলের উপর রাখিয়া ভাঙা আল বাঁধিতে লাগিল। মহাতাপের নজর পড়িল হাঁড়িটার দিকে। সে হাঁড়িটা তুলিয়া নাক সিঁটকাইয়া মুখ ঘুরাইতে বাধ্য হইল। আবার জোর করিয়া মুখ ফিরাইল। সে খাইবেই।
নোটন সবিস্ময়ে বলিল, কি, হচ্ছে কি? মদ খাবা নাকি?
—খাব। খাব।
–এই দেখ, বাড়িতে বকবে।
–বাড়ি? আমি আর বাড়ি যাব না।
বলিয়া চুমুক দিল ভাঁড়ে।
ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিমা তুলিয়া মোড়লেরা একদিকে পূজার আয়োজন করিতেছিল, অন্যদিকে জমিতে জলের কথা হইতেছিল।
বিপিন, সেতাব, রামকেষ্ট এবং আরও মোড়লেরা বসিয়া আছে। ঘোঁতনও আসিয়া জুটিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপে টিকুরীর খুড়ী এবং আরও দুই-তিন জন প্রবীণা মিলিয়া কেহ ঝাঁটা বুলাইতেছে, কেহ পূজার বাসনগুলিতে জল বুলাইতেছে অর্থাৎ ধুইতেছে। একজন খড়ের দড়িতে আমের শাখা পরাইতেছে। গোটা কয়েক ছেলে রঙিন কাগজ কাটিয়া শিকল তৈয়ারি করিতেছিল। একজন একখানা কাগজে মোটা হরফে লিখিতেছিল—যাত্রাভিনয়। একপাশে বসিয়া ছিল ঘোঁতন।
বিপিন বলিতেছিল, তা পূজার কটা দিন যাক। তারপরেতে ক্যানেল আপিসে চল। জল। যখন আসছে ক্যানেলে, তখন মাঠে এখনও খাল আসে নাই বলে জল দেবে না, ই তো হয় না। জল দেক। আমরা কোনো রকমে নিয়ে আসব।
ঘোঁতন বলিয়া উঠিল, সে দেবে না। পরম বিজ্ঞভরে সে ঘাড় নাড়িতে লাগিল।
বিপিন ঘাড় ঘুরাইয়া ঘোঁতনকে দেখিয়া বলিল, কে বটে? ঘোঁতন! ই, তাই বলি এমন বিজ্ঞ মানুষটা কে? ইউনিয়ন কোর্টের উকিল কিনা? আইন একেবারে ঠোঁটস্থ। দেবে না। ক্যানে দেবে না? তুই এখানে কোথা? অ্যাঁ?
সেতাব বলিল, ও আমার কাছে এয়েছে।
—তোমার কাছে তা বেশ। এসেছে বেশ করেছে। তাই সব কথার মধ্যে ও ক্যানে? আমাদের কথা আমরা বুঝব। সবতাতেই ওর পাক মারা চাই। দেবে না! চল সব জোট বেঁধে যাই। বলি, ক্যানেল যখন ধান বাঁচাবার জন্যে, তখন ক্যানে দেবেন না মশায়? না কি হে?
রামকেষ্ট-শিবকেষ্ট এবং অন্যান্য মোড়লেরা সায় দিয়া বলিল, সেই কথাই ভাল। গেরামসুদ্ধ লোক যাবে–
সেতাব উঠিয়া পড়িল। তার এসব ভাল লাগিতেছে না। তাহারও সংসার বিষ হইয়া গেছে।
সে ডাকিল, ঘোঁতন!
ঘোঁতন উত্তর দেবার পূর্বেই বিপিন বলিল, উঠলে যে সেতাব?
—কি করব? আমার জলে দরকার নাই। মরে যাক ধান, জ্বলে যাক মাঠ। যা হবে হোক। বুয়েছেন?
শিবকেষ্ট বলিল, সেতাবের জমিতে জল আছে। সে মহাতাপ করে রেখেছে আগে থেকে। ওর ভাবনা নাই।
—ওহে! বলিয়া সেতাব চিৎকার করিয়া উঠিল। তারপরই কিন্তু হঠাৎ থামিয়া গেল। বলিল, থাক সেসব কথা! আমার কথা আমার মনেই থাক্। বলিয়া সে খানিকটা চলিয়া গেল। কিন্তু একটা কথা মনে হতেই সে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, হ্যাঁ, আর একটা কথা জ্যাঠা। আমার পরিবার তো পূজার বরণের ডালা ধরে; তা এবার অন্য লোক দেখুন। সে ধরবে না।
ওদিক হইতে টিকুরীর খুড়ী সর্বাগ্রে বলিয়া উঠিল, তা ভাল, তা ভাল বাবা। আমরা বলতে পারছিলাম না। এ সুমতিটি ভাল হয়েছে তোমার।
বিপিন দৃঢ়স্বরে বলিল, কি, বলছ কি গো টিকুরীর বউমা?
–ন্যায্য কথা বলছি। মোড়ল কি কালা নাকি? কানে কথা যায় না?
–না। যায় না। অন্যায় কথাগুলান বোলো না।
সেতাব বলিল, ন্যায়-অন্যায় বিচারে কি কাজ জ্যাঠা? তার দেহ ভাল নয়, মন ভাল নয়—
–ক্যান রে? মন ভাল লয় ক্যানে? মহাতাপ নিজের ছেলে বড় বউকে দিয়েছে শুনলাম, তবু মন ভাল লয়? বাবা রে, দেওরের কি ভালবাসা।
—খুড়ী! সেতাব কঠিন স্বরে বাধা দিয়া বলিল, মহাতাপের ছেলে আমি নেব ক্যানে? আমার কপালে থাকে।
–হবে না রে বাজার ছেলে কার্তিক ঠাকুরের বাবা এলে। চাঁপাডাঙার বউয়ের কেক ফলবে না।
বাধা দিয়া সেতাব বলিল, চাঁপাডাঙার বউয়ের কপালের নেনই তো একটি নেকন নয় খুড়ী। আমার কপালের একটা নেকনও তো আছে!
সেতাব হনহন করিয়া পথে নামিয়া গেল। ঘোঁতন বলিল-দাঁড়াও, দাঁড়াও!
সে সেতাবের সঙ্গ লইয়া বলিল-আচ্ছা কথাটা তুমি বলেছ! ঠিক বলেছ! পরের ছেলে নিয়ে নিজের সাধ মেটে? মেটে না। মেয়ের অদেষ্ট আর পুরুষের অদেষ্ট এক নয়। বিয়ে করবে তুমি পুঁটিকে? দেব। আমি দেব। বল তুমি।
সেতাব কথা বলিতে গেল কিন্তু পারিল না। অন্তর তাহার লালায়িত। কিন্তু চাঁপাডাঙার বউ! চাঁপাডাঙার বউ! সে? ওঃ সে যেন পাগল হইয়া যাইবে!
ঘোঁতন পকেট হইতে সিগারেট বাহির করিয়া নিজে একটা মুখে গুঁজিয়া একটা সেতাবকে দিল, বলিলখাও।
—সিগারেট?
–হ্যাঁ। লাও ধরাও।
সে দেশলাই জ্বালিল।
ঘোঁতন আবার বলিল—ওই যে বললে, ন্যায়-অন্যায় বিচারে কাজ কি জ্যাঠা? খুব বুদ্ধিমানের মত কথা বলেছ। কথাটা যখন পাঁচজনে বলছে, সন্দেহ যখন–
সেতাব বলিল চুপ কর ঘোঁতন! চুপ কর। ওরে তুই চুপ কর।
সে রাস্তায় নামিয়া পড়িল।
পথে নামিতেই দেখা হইল নোটনের সঙ্গে। নোটন বলিল—বড় মুনিব! ছোট মুনিব–
ছোট মুনিবের কথা আমি কিছু জানি না। সে চলিতেই লাগিল।
–সে চলে গেল
নোটনও সঙ্গ ধরিয়া পিছন হইতে কথা বলিতেছিল। মহাতাপ মদ খাইয়া মাঠ হইতে চলিয়া গিয়াছে। বলিয়া গিয়াছে, সে বিবাগী হইবে। নোটন কোনোমতেই তাহাকে ফিরাইতে পারে। নাই।
–যাক—যাক—যাক।
–ওগো, নেশা করে—
–করুক, মরুক; উচ্ছনে যাক, চুলোয় যাক। যা বলবার বল্গা বড় বউকে।
–তিনি কথা বললে না।
–তবে ছোট বউকে বলগা্।
–সেও বললে, জানি না।
–আমিও জানি না। বুঝলি! আমিও জানি না।
সেতাব আর কথা না শুনিয়া হনহন করিয়া চলিতে লাগিল।
ঘোঁতন ডাকিল, দাঁড়াও হে। দাঁড়াও।
সেতাব যেন ছুটিয়া পলাইতে চাহিতেছে। কোথায় সে তাহা জানে না।
মহাতাপ তখন প্রান্তরের মধ্যে একটা গাছতলায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। নেশায় সে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের বাড়িতেও সেই অবস্থা। বড় বউ তেমনিভাবে উপুড় হইয়া শুইয়া আছে। ছোট বউ আপনার ঘরে মানিককে লইয়া বসিয়া নীরবে কাঁদিতেছে। শরতের আকাশ নীল, মেঘের দু-একটা টুকরা মধ্যে মধ্যে ভাসিয়া যাইতেছে। বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নাই।
অপরাত্ন গড়াইয়া আসিল। তবু বড় বউ উঠিল না, মানু বাহির হইল না, মহাতাপ ফিরিল না, সেতাবও সেই গিয়াছে—এখনও ফেরে নাই। ক্রমে সন্ধ্যা হইল। নির্মল নীল শরৎ আকাশ ষষ্ঠীর চাঁদের জ্যোৎস্না উঠানে, ঘরের চালে, গাছের শাখায় পল্লবে স্বপ্নলোকের শোভা জাগাইয়া ফুটিয়া উঠিল। সে আলো যেন স্বপ্নে দেখা রহস্যপুরীর আলোর মত স্পষ্ট অথচ আবছা আবছা অথচ স্পষ্ট। আকাশে ষষ্ঠীর চাঁদ, সন্ধ্যাতেই একেবারে সিকি আকাশ পার হইয়া ফুটিয়া ওঠে। যেন আকাশের নীল সায়েরের তলা হইতে মাথা তুলিয়া হাসিতে থাকে। চাঁদের আশপাশে তারা। ফুটিয়াছে। অসংখ্য সংখ্যা নাই, সীমা নাই, এক তারা উকিঝুঁকি, দুই তারা ঝিকিমিকি, তিন তারা ঘোর নামে, চার তারা পাখি থামে, পাঁচ তারা পঞ্চদীপ, ছয় তারা শাঁখ বাজে, সাত তারা সাতভেয়ে, আট তারা অরুন্ধতী, ন তারা অন্ধকার, দশ তারাতে একাকারগুনিতে গুনিতে দশ তারা ফুটিতেই অগুতি তারা ফুটিয়া ওঠে, আর গণনা করা যায় না। তাই উঠিল। তবু মণ্ডলবাড়িতে কেহ উঠিল না, আলো জ্বালিল না, রান্না চড়াইল না, বাহির দুয়ার খোলা হাঁ-হাঁ, করিতে লাগিল। ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে ষষ্ঠীর সন্ধ্যার দেবীর আবাহন অভিষেক হইয়া গেল, ঢাক ঢোল সানাই কঁসি বাজিয়া থামিয়া গেল। সেতাব সেখানকার কাজ সারিয়া এতক্ষণে বাড়ি ঢুকিল। ষষ্ঠীর আবছা জ্যোৎস্নায় স্তব্ধ বাড়িখানা যেন শোকাতুরা সদ্য বিধবার মত বিষগ্ন নিৰ্বাক। হইয়া অবগুণ্ঠন টানিয়া বসিয়া আছে। সেতাব ঘরে ঢুকিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। তাহার সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। সে তীক্ষকণ্ঠে বলিয়া উঠিল।–এ কি!
কেহ উত্তর দিল না।
সেতাব আরও চটিয়া বলিল, বলি কাণ্ড-কারখানাটা কি? ঘরে আলো নাই। উনোন জ্বলে নাই, ষষ্ঠীকৃত্যের দিন। শুভদিন! সব মরেছে নাকি?
বড় বউ দাওয়ার উপর শুইয়া ছিল; সেতাব তাহাকে এতক্ষণে ঠাওর করিয়া তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল—শুনতে পাও না?
কাদু ক্লান্তকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ওগো আর আমি পারছি না। আমাকে তুমি মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও।
–ভাল। দেব। তাই দেব। ভাল করেই দেব। তাই হবে।
বলিয়া সে উপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াইল।
–একটা কথা বলি। যতক্ষণ আছি ততক্ষণ বলতে হবে।
–কি?
–মহাতাপ সেই দুপুরে না খেয়ে চলে গিয়েছে। সেই ফাটা মাথা নিয়ে। এখনও ফেরে নি।
–তার কথা আমি জানি না।
—তোমার মায়ের পেটের ছোট ভাই।
–আমার শত্রু; তা ছাড়া সে কচি খোকা নয়।
–জেনেশুনেও একথা বলছ তুমি?
—বলছি! বলছি! বলছি! সে আমার শত্ৰু, তুমি আমার শত্ৰু, ঘর দোর সব আমার বিষ। আগুন। শ্মশান।
বলিয়া সে চলিয়া গেল।
যাইতে যাইতে আবার ফিরিয়া আসিয়া বাহিরের দরজাটা বন্ধ করিল এবং হনহন করিয়া চলিয়া গেল।
মানদা আপনার ঘরে বন্ধ দরজার গায়ে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া সব শুনিতেছিল। বাঘিনীর মত চোখ দুইটা তাহার ক্রোধে জ্বলিতেছিল এবং সে ক্রোধের সবটাই গিয়া পড়িতে চাহিতেছে ওই বড় জায়ের উপর। ওই তাহার অদৃষ্টকে ওই মহাতাপের মত পাগলের অদৃষ্টের সহিত জড়াইয়া দিয়াছে। গরিবের মেয়ে সে। সেই দারিদ্রের সুযোগ লইয়া তাহার পিতৃকুলের জ্ঞাতিকন্যা হিসাবে হিতৈষিণী সাজিয়া সচ্ছল অবস্থার লোভ দেখাইয়া মহাতাপের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধে তাহার পকে রাজি করাইয়াছিল। প্রথম প্রথম বড় বউয়ের স্নেহ যত্ন, মহাতাপের সঙ্গে তাহার অন্তরঙ্গতা মানদার ভালই লাগিত। ক্রমে ক্রমে চোখ খুলিয়া সে আজ দিব্য দৃষ্টি পাইয়াছে। বুকের ভিতর তাহার আগুন জ্বলিয়াছে। সেই আগুন চোখের দৃষ্টির মধ্য দিয়া বাহির হইয়া সব কিছুকে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া খাক করিয়া দিতে চাহিতেছে! আজ এই দুর্গাষষ্ঠীর দিন তাহার নাড়-ছেঁড়া ধন, একটি সন্তান তাহার, তাহাকে মহাতাপ দান করিয়া দিল ওই বন্ধ্যা নারীকে! বন্ধ্যা নারীর দৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষা বড় প্রবল, আকর্ষণ দুর্নিবার। ইহার জন্য যদি–
সে আর ভাবিতে পারিল না। ছুটিয়া গিয়া মানিককে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদতে অস্ফুটস্বরে বলিল, হে মা ষষ্ঠী! পাগল মানুষ মায়াবিনীর মায়ায় ভুলে বলেছে—দান করলাম ছেলে। আমি বলি নাই মা, আমি বলি নাই! হে মা! রক্ষা করো তুমি।
সে ছেলেকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বালিশে মুখ গুঁজিল।
আপন ঘরে সেতাব উত্তেজিত মনে অন্ধকারের মধ্যে চালের কাঠের দিকে চাহিয়া জাগিয়া ঘুমন্তের মত পড়িয়া ছিল। মনে মনে তাহার অনেক আলোড়ন, অনেক চিন্তা, অনেক কল্পনা।
বাহিরের পথে চৌকিদারের হক উঠিল। ও–ওই–
কয়েক মিনিট পর চৌকিদারটা বাড়ির দরজায় আসিয়া ডাকিল-বড় মোড়ল! বড় মোড়ল!
সেতাব হাঁকিল–হ্যাঁ, জেগেছি।
চৌকিদারটা বলিল, তোমাদের ছোট মোড়ল, ওই খিড়কির পুকুরের গাছের তলায় বসে কাঁদছে।
-কাঁদুক। তুই যা।
তবু সেতাব উঠিয়া বসিল।
কথাগুলা মানদাও শুনিয়াছিল। সেও উঠিয়া বসিল।
সিঁড়ি বাহিয়া নামিবার মুখেই শুনিল, একটা দরজা খুলিয়া গেল।
দরজা খুলিয়া সেতাব দাওয়ায় আসিয়া দেখিল, বাহিরের দরজাটা খোলা।
দরজা খুলিয়া বড় বউই বাহির হইয়াছে। কি করিবে সে? দুর্নিবার প্রাণের আকর্ষণ লঙ্ন করিতে সে পারিয়া ওঠে নাই। সেই গভীর রাত্রে একাকিনী নারী অন্ধকার পথ অতিক্রম করিয়া পুকুরের ধারের গাছতলাটিতে আসিয়া মহাতাপের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, ওঠ।
মহাতাপ বলিল, না—না। আমাকে তোমার দরকার নাই! তোমার সব মিছে কথা।
–না–না। কোনো মিছে কথা নয়। মিছে নয়—নয়-নয়। হল তো? ওঠ এখন।
–আমাকে ধর। আমি নেশা করেছি। মদ খেয়েছি।
–শুনেছি। নোটন বলেছে আমাকে।
–আমাকে বকবে না?
-–তোমার দোষ কি? সবই আমার অদৃষ্ট। ওঠ, আমার কাঁধ ধরে ওঠ।
মহাতাপকে সে ধরিয়া তুলিল। মহাতাপ তাহার কাঁধে ভর দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, জান, আমি বিবাগী হয়ে চলে যেতাম। কিন্তু ফিরে এলাম
বড় বউ অন্ধকারের মধ্যে একটু হাসিল।
পাগল বলিল, তোমার জন্যে ফিরে এলাম–
আর একপাশের অন্ধকার হইতে সেতাব বলিয়া উঠিল, তুমি আর আমার বাড়ি ঢুকো না, আমি বারণ করছি। ঠাঁই না থাকে তো গাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে মর।
বড় বউ থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল এবং পরমুহূর্তেই সংজ্ঞা হারাইয়া পড়িয়া গেল।