০৭. পর্যালোচনা করে বুঝতে পারি

মনে মনে পর্যালোচনা করে বুঝতে পারি এ এমন একটা ব্যাপার যা নিয়ে হৈ-চৈ করা চলে না। শাঁখের করাত আসতেও কাটে যেতেও কাটে। এও তেমনি উভয় সঙ্কট। যদি কিছু ঘটেও থাকে তবু সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতে যাওয়ায় বিপদ আছে; কারণ তার প্রতিক্রিয়া কি হয় বলা মুশকিল। ও সাবধান হয়ে নিজেদের মধ্যে আরও গুটিয়ে যেতে পারে নয়তো পেতে পারে দুঃখ। আবার কিছু না বললেও মানসিক যন্ত্রণা।

তার চেয়ে ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ভুলে যাওয়াই বোধ হয় ভালো। মেয়েমানুষের শরীর তার ওপর বিশ্বাস নেই বিনা কারণেও এমন হতে পারে। তাছাড়া নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতা শূন্য থাক, এইতো উত্তম পন্থা। যেমন করে পেয়েছি এ পাওয়ায় কোনো ফাঁকি নেই। এটুকুনই সত্য হোক না কেন। আসলে তো প্রত্যেকটি মানুষ একেকটি স্বতন্ত্র দ্বীপ। কে কাকে পুরোপুরি জানে? জানা সম্ভব নয়। অন্তর বাহির কারুরই এক হতে পারে না। সে শুধু দোষ ঢাকবার জন্য নয়, বরং এমন জিনিসও আছে মঙ্গলের খাতিরেই যা গোপন রাখা সমীচীন। ছবি যদি তেমন কিছু গোপন রেখে থাকে। তাহলে তো ওর কোনো অপরাধ নেই?

কিন্তু তবু আভাসে ইঙ্গিতে সুযোগ-মতো ওকে বাজিয়ে নিতাম। কোনো আকস্মিক আঘাতে আচমকা বেরিয়ে আসতে হয়তো ওর না-বলা কাহিনির এক টুকরো।

কিন্তু সেরকম পরীক্ষা চালাতেও ইচ্ছে হলো না। নিজের অজান্তেই আমি যে ভুলে গেছি সব! কারণ মাসখানেকের মধ্যেই ছবির দেহে ভুবন ভোলানো রূপ ফুটে উঠেছে। ঠোঁটজোড়া মেদুর কোমল, গায়ে আপেলের রং চোখে যেন স্বপ্নের ঘোর। কণ্ঠস্বর মিষ্টি মধুর। ধীরস্থির চলনে বিজয়িনীর অব্যর্থ গরিমা। দেবীর মতো অভ্রান্ত পদক্ষেপে সে আমার ছোট্ট ঘরটিকে এবং ততোধিক অকিঞ্চিৎকর জীবনটিকে আলোকিত করে তুলেছে। এক অঙ্গে এত রূপ জানতাম না, চাইলে চোখ ফেরানো যায় না, এমনি।

বৌদি সেদিন ঠাট্টা করে বললেন, আবার আসবার সময় দোলনা কিনে আনব একটা। আগেভাগেই তৈরি হয়ে থাকা ভালো কি বলো?

প্রাচুর্যের ধারা খুলে গেছে, মনটা সারাক্ষণ তাই শিহরিত থাকে। ঘরে নবজাতকের পদধ্বনি, বাইরে ফসলের আগমনী। শারদীয় ছুটিটা কাজের মত্ততা দিয়ে ভরে তুলি। মাঠে মাঠে ধান, গাঁয়ের পথে কৃষকদের ব্যস্ততা, ঘরে ঘরে একটা উল্লাসের রেশ। যাদের জমি নেই তাদের কাজ মিলছে, বগলে কাস্তে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেই হলো। সপ্তাহে একদিন আমরা বেরোই বাইরে; আমরা ছয়জন-দাদা বৌদি ছেলেমেয়ে এবং আমরা দু’জন। যেদিন যেদিকে ইচ্ছে চলে যাই রাজধানী ছাড়িয়ে অনেক দূরে পয়সাকড়ি কিছু থাকে সে জায়গাতেই খাবার জোগাড় করে খাই। দু’দিন তো গেরস্থ বাড়িতে দাওয়াতই মিলেছে। সে কি আদর যত্ন। দুধ-গুড় পিঠা পায়েস!

বাইরে বেরিয়ে জামিল ভাই অনেকগুলো ভালো ওয়াটারকালার করেছেন সেটাই বড় কথা। আমিও কম আঁকিনি। কিন্তু আঁকাটাই বড় কথা নয় বরং বৈচিত্র্যের স্বাদ। শহরের বদ্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এক অপূর্ব মুক্তি। পৃথিবীর কবিতা মরে না কখনো এই সত্য নতুনভাবে উপলব্ধি করি। শালিক টুনটুনি ধানের শিষ ঘাসফড়িংকে কতকাল ভুলে ছিলাম কিন্তু এরা যে পরম আত্মীয়! তাই বোধ হয় নতুন করে পেলাম।

সেদিন সকালে খাওয়া-দাওয়া করে বাইরে বেরিয়েছিলাম একলা, সন্ধ্যের সময় ফেরার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে গেল। ছবি কিনবেন বলেছিলেন, বিদেশি দ্রলোকের সঙ্গে দেখা হওয়ায় চলে আসব ঠিক করলাম। রাশেদ বলছিল বাসায় যখন বলে এসেছি ওর ওখানে গিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে দিতে, এমনকি, ইংরেজি ছবির মেটেনি শো দেখবার অফারও ছিল। কিন্তু মনটা বাসায় আসার জন্য রুখে উঠেছে।

বললাম, নতুন একটা অয়েল শুরু করেছি, এখন সেটার ওপর কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে বড়।

আরে রাখ। রাত্রে কাজ করলেই চলবে! আর এত এঁকে কি হবে? জীবনে দুতিনটে কাজ করবি এরপর দাড়ি রেখে গম্ভীর হয়ে বসে থাকবি ব্যস নির্ঘাৎ বিখ্যাত! আসল শিল্পীরা আঁকে না, আঁকার ভান করে!

আমি তো আঁকছি না, রং তুলি দিয়ে হাতের চুলকানো মেটাচ্ছি মাত্র! বুঝলে কিনা?

রাশেদকে এককাপ চা খাইয়ে বিদায় নিয়ে এলাম। আসবার সময় ও পরিহাস করে বলল, আরে শালা লঙ্কায় গেলেই হনুমান। এদ্দিন হয়ে গেল এখনো এত টান, ভীমরতি আর কাকে বলে!

এর জবাবে কিছু না বলে শুধু একটু হেসেছিলাম। বালখিল্যতার কাছে চুপ থাকাই বাঞ্ছনীয়। পুরুষের সংস্পর্শে না এলে নারী পূর্ণ হয় না, আবার নারী সংসর্গহীনতায় পুরুষও থাকে অপূর্ণ। গাছের মতো পাশাপাশি না বাড়লে উভয়ের খর্ব অবশ্যম্ভাবী। এদেশে মেয়ের সঙ্গে ছেলের দেখা হয় একবারই বাসরঘরে আর সে দেখা দুজনকে কদাচিৎ সমৃদ্ধ করে। তাতে দেহের ক্ষুধা মেটে কিন্তু মেটে না মনের দাবি। দৌড়-ঝাঁপ, খেলাধুলা, হাসিকান্নায় পরস্পরের গন্ধ শুঁকে বড় হতে না পারলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ধারা চোরাবালিতে মুখ গুঁজে থাকবেই!

একটি সাধারণ মেয়েরই সংস্পর্শে এসে আমি কতটা বিস্তৃতিলাভ করেছি বন্ধুরা তা জানে না। উপলব্ধি করার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাই সময়ে অসময়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ।

বাসার কাছে এসে একটা দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে মাথায়। আমি সন্ধ্যায় ফিরব এ বিষয়ে ছবি স্থিরনিশ্চিত; কাজেই কাছে গিয়ে হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করে ওকে চমকে দেওয়া যাবে।

দোরের পর্দা ফাঁক করে পা টিপে ঘরে ঢুকলাম। ছবি কোণার জানালার ধারে বসে আছে পেছন ফিরে খোলাচুলের মাথাটা কোলের দিকে নিচু করা। কিন্তু আশ্চর্য, ওর ডানহাতের কনুইয়ের কাছে দু’টি ছোটো ছোটো পা, মাঝে মাঝে নড়ছে নিশ্চয়ই শিশুর পিঠের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে দেখি সত্যই বাচ্চা। চিনতে পারি অধ্যাপকের ছেলে, মুষ্টিবদ্ধ হাতদুটো মাঝে মাঝে তুলছে। আমি হতভম্ব নির্বাক; আস্তে আস্তে বরফের মূর্তির মতো জমে যেতে থাকি।

যেভাবে ঢুকেছিলাম তেমনি চুপি-চুপি উঠে বেরিয়ে এলাম। স্টুডিও ঘরে ঢুকে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিই। ছবি সন্তানের জননী এ বিষয়ে আজ আমি একেবারে নিঃসন্দেহ।

ওর উৎকট শিশুপ্রীতির একটা হদিস পাওয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরতলায় যাওয়ার আগে ছবি স্টুডিওতে একটু উঁকি মারল। আমাকে দেখতে পেয়ে একেবারে তাজ্জব। ঘরে ঢুকে বলল, ওমা! তুমি যে!

স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললাম, হ্যাঁ আমি। অবাক হয়ে গেলে বুঝি?

তা নয়তো কি? আমি আশাই করিনি। কেন গিলবার্ট সাহেবের কাছে যাওনি?

গিয়েছিলাম। পাইনি তাকে। কেন, চলে আসায় তোমার কোনো অসুবিধা হলো নাকি?

না, না। সে কেন হবে! ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, ওর মা একটু রাখতে দিয়েছিল! রাখ ওকে দিয়ে আসছি!

ছবি আর অপেক্ষা না করে ঘর থেকে বেরুবার পর তাড়াতাড়ি সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে গেল।

আমি ওঠে গিয়ে এলবামটা আনি। ছবির বহু যত্নে করা জিনিসটা, চকচকে কোণ দিয়ে প্রত্যেকটি ছবি লাগানো। প্রথমদিকের পাতাগুলোতে আমাদের ছবি দু’জনের নানা ভঙ্গিমার। ম্যারাজ গ্রুপটা প্রথম পৃষ্ঠায়। বেনারসি শাড়ি, নেকলেস, টিকলি-পরা আধো ঘোমটার মাঝে ছবি লাজুক লতাটি, আমি তার পাশে স্বমূর্তিতে বিরাজমান। রাশেদ ক্যামেরা এনে অনেকগুলো ম্যাপ নিয়েছিল একদিন, সে সমস্তই আছে। একটাতে আমি আঁকছি ছবি সিটিং দিচ্ছে; আরেকটা, ছবির মাথায় ফুল গুঁজে দিচ্ছি। অন্যটাতে দাঁত বার করে হাসছি দু’জনেই। জীবনের একেকটি মুহূর্ত কিন্তু কোনটাই তো কৃত্রিম নয়? অ্যালবামে আর আছে দাদার ছবি বৌদির ছবি। নোটন-শিউলির ছবি। কলকাতার কিছু দৃশ্যও আছে।

ছবি নেমে এলো। কাছে এসে বলে উঠল, একি! হঠাৎ অ্যালবাম দেখার শখ?

এই এমনি! আমি বললাম, আর শখ জিনিসটা তো হঠাই জাগে!

তাই নাকি? এত সূক্ষ্ম দর্শন আমি বুঝিনে, বাপু। ছবি আমার কাঁধে ভর দিয়ে রহস্যপূর্ণ স্বরে শুধাল, একটু যেন গম্ভীর মনে হচ্ছে? ব্যাপার কি?

বয়স হচ্ছে, মাঝে মাঝে একটু গম্ভীর হওয়া দরকার।

আরে বাব্‌বাহ্! সত্যিই দেখি রাগ করেছ! ছবি দু’হাতে আমার গলা জড়িয়ে আবদারের সুরে বলল, কি হয়েছে বলো না?

কিছু হয়নি! আমি হাসবার চেষ্টা করে বললাম, ছবি বিক্রির ব্যবস্থাটা করতে পারলাম না, খুব খারাপ লাগছে।

সত্যি? ছবি উচ্ছল হয়ে বলল, তাহলে তোমাকে একটা জিনিস খাওয়াব!

কি জিনিস?

এখন বলবো না। খোলা আঁচলটা কোমরে জড়াতে জড়াতে ও বড়ঘরে চলে গেল।

একটু পরে এসে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, চোখ বোজ এবং হা করো।

কি জিনিস দেখিই না একটু!

না। আমার কথা না শুনলে দেব না! বেশ এই নাও।

চোখ বুজে হা করতেই ও গোলমতো একটা খাদ্যবস্তু টুপ করে ছেড়ে দিল। চিবিয়ে দেখি নারকেলের নাড়।

এরপর বাঁ হাতে ধরা পিরিচটা ডান হাতে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন হয়েছে!

চিবোতে চিবোতে বললাম, বেশ!

আমি সব দেখেছি, ছবি টের পায়নি, তাতে একটু সুবিধে হলো বটে, কিন্তু বুকের ভিতরে যে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে তাকে কতদিন ঢেকে রাখব? তা’তে জমবেই বাষ্প, নীলবিষের মতো কুটিলস্রোত, আর তা বাড়তে থাকবে ক্রমেই এবং কোনো দুঃসময়ে অগ্নিগিরির জ্বালামুখ ফেটে যাওয়ার মতো প্রবলবেগে উৎক্ষিপ্ত হবে। যে সুখ স্বর্গ গড়ে তুলেছি, নিজের হাতে তা ভাঙতে যাওয়া মহাপাপ; অথচ এখন মনের যে অবস্থা বোঝাঁপড়া না করেও উপায় নেই।

বিকেলে ছবি সেজেগুজে তৈরি হলো। বৌদির ওখানে যেতে চাইলে বললাম, আমি না গেলে হয় না? একটু কাজ করব ভেবেছিলাম।

ছবির অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। কারণ আমার মুখ থেকে এমনি সময়ে এই ধরনের কথা এ পর্যন্ত শোনে নি। ও কোথাও যেতে চাইলে শত কাজ থাকলেও ফেলে গিয়েছি। ও ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, বেশ, তবে কাজই করো। আমাকে একটা রিকশা ডেকে দাও।

একলাই যাবে? জিজ্ঞেস করলাম।

ও বলল, কি আর করব। গুণ্ডায় যদি ধরে তোমার জিনিসই নিয়ে যাবে, আমার কি? নিজের জন্য আমার কোনো চিন্তা নেই।

আমি কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে, নিজের জন্য তুমি বাঁচতে চাও? বেঁচে আছ শুধু আমার জন্য?

ছবি কি ভেবে নিয়ে বলল, যদি বলি তাই?

বললাম, প্রমাণ চাইব।

এত কিছুর পরও প্রমাণ? ছবি ক্ষণকাল নীরব থেকে বলল, না, তোমাদের সত্যি নির্ভর করা যায় না!

আর তোমাদের বুঝি খুব যায়? আমার কথায় উষ্মর রেশ লাগলো, সে বিষয়ে সচেতন হওয়ায় শান্তস্বরে বললাম, বেশ চলো। তোমার সঙ্গে গেলেই তো আর কোনো ক্ষোভ থাকবে না?

না, থাক্। ছবি হাতব্যাগটা টেবিলে ফেলে দিয়ে বলল, যাব না আজকে।

কি ব্যাপার। উল্টো রাগ করলে নাকি? ও বেতের মোড়ায় বসে পড়েছিল আমি কাছে গিয়ে বললাম, আমি তো খারাপ কিছু বলিনি?

ছবি আমার হাতটা ওর কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, না তা নয়। যাবোই না আজকে। কোনো কাজ তো নেই।

শার্ট গায়ে দিতে দিতে বললাম, এমনই যখন করছ যেতেই হবে। না গেলে এখন আমি রাগ করব। তবে বৌদির ওখানে যাব না! চলো একটা ছবি দেখব।

ছবি আমার কথার জবাব না দিয়ে আঙুলের নখ খুঁটতে থাকে। ওর ভিতরে একটা আলোড়ন চলছে বুঝতে পারি। গুরুতর কিছু নয়। আলোছায়ার খেলা একটুখানি। সত্যি মেয়েদের মন অতি সূক্ষ্ম জিনিস।

আমি চটপট তৈরি হওয়ার পর রাস্তায় গিয়ে একটা রিকশা নিয়ে এলাম।

হয়তো কেউ চাইনি। কিন্তু তবু দু’জনের মাঝখানে ধীরে ধীরে নেমে এসেছে নীরবতার দেয়াল, দু’একবার কিছু বলবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছে একান্ত অপ্রাসঙ্গিক। আলাপে সুর লাগেনি। পৌনে দশটায় বাসায় ফিরে কাপড় বদলাতে বদলাতে শুধোলাম, কেমন লাগছে ছবিটা কিছু বললে না তো?

কি আর বলবো! আলনা থেকে একটা ব্যবহারি শাড়ি তুলে নিয়ে ছবি বলল, ইংরেজি ছবি আমার কখনো ভালো লাগে না। বড্ড বেশি উলঙ্গ!

উলঙ্গ নয়, বল বলিষ্ঠ। জীবনটাকে ওরা বলিষ্ঠভাবে নিতে জানে বলেই তার প্রকাশটাও বলিষ্ঠ।

তা বটে। একজনের বৌ হয়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে ঢলাঢলি মাখামাখি করার মধ্যে বলিষ্ঠতা আছে বৈকি!

আমাদের দেশের মেয়েরা যা গোপন করে সে দেশের মেয়েরা কারুর প্রেমে পড়লে ছলনা দিয়ে তাকে ঢাকে না, এতে অপরাধ কোথায়?

না অপরাধ নেই! এক জায়গায় পচে মরার চেয়ে ফুলে ফুলে মধু খাওয়া বরং আনন্দদায়ক।

ছবি তেরছা কথা বলতে শিখেছে মন্দ নয়। নীরবতার দেওয়াল ভেঙে গেছে কিন্তু এখন পড়ছে ধরা-না-দেওয়ার কাঁটাতার।

খাওয়া-দাওয়ার শেষে বারান্দায় খানিকক্ষণ পায়চারি করে নিয়ে গিয়ে বিছানায় কাত হলে আমি বসে ওর চুলে আদর করতে থাকি। সিগারেটটা পুড়ে শেষ হলে আস্তে ডাকলাম ছবি।

কি!

একটা কথা জিজ্ঞেস করি জবাব দেবে তো?

কোন্‌দিন জবাব দিইনি বলতো? ঘাড়ের কাছে হাত ভর দিয়ে পাশ ফিরে শুল!

ওর মনটা হালকা হয়ে গেছে দেখে আশ্বস্ত হলাম। বললাম, কথাটা বলবো কি ভাবছি।

আমার গলা গম্ভীর এবং গুরুতর; ছবি এবারে একেবারে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার! মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু

মিথ্যে বলনি, একে সাংঘাতিকই বলা যায়! আমি অনেকক্ষণ চুপ হয়ে থাকি।

ছবি অধীর হয়ে বলল, কি ব্যাপার বলো!

হঠাৎ মগজের একটি কোষে যেন এক ঝলক দুষ্টরক্ত উজিয়ে গেল। আর তৎক্ষণাৎ বলে উঠলাম, তোমার একটা ছেলে হয়েছিল একথা সত্য কিনা?

তার মানে? ছবির মুখখানা একটি ফুকারে বাতির শিখা নিভে যাওয়ার মতো একেবারে রক্তহীন, সে যেন কাঁপছে মৃগীরোগীর মতো। ফিসফিস্ করে কোনো মতে উচ্চারণ করল, তুমি কি বলছ এসব?

সত্য বলছি, তুমি সন্তানের জননী! আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার মাস ছয়েক আগে তোমার ছেলে হয়েছিল!

মিথ্যে! মিথ্যে! সব দুষ্টলোকের কারসাজি। আমাদের সুখ সইতে পারছে না। কে বলেছে একথা? বলল, বলো কে বলেছে?

কেউ বলেনি আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি।

ছবি অপ্রকৃতিম্ভের মতো বলল, তুমি ভুল বুঝেছ, সব ভুল!

না, না, ভুল নয় এ সত্য। আমি ক্ষিপ্তের মতো ওর দু’ কাঁধে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলতে থাকি, কেন, কেন? কেন এমন প্রতারণা করলে! বল নইলে গলা টিপে মেরে ফেলব!

ছবির দু’চোখ দিয়ে দর্দ করে পানি বেরিয়ে এলো। বলল, আমাকে মেরে ফেল তুমি, সেই ভালো! সেই অনেক ভালো।

হিংস্ৰচোখে চেয়ে আরো দৃঢ়স্বরে আমি বললাম, যা ভেবেছ সহজে তোমাকে ছাড়ছিনে। বলতে হবে! সব বলতে হবে! বলো!

আমার চিৎকারে দরোজা-বন্ধ ঘরটা কেঁপে উঠল, ছবি বাঁ হাতে আমার মুখ চেপে ধরে! সে কাঁপছে আমিও কাঁপছি।

ছিঃ ছিঃ! এমন করো না। লোক জড়ো হবে! বলবো সব বলবো শুনতে যখন চাও নিশ্চয়ই বলবো!

আমার মুখ ছেড়ে দিয়ে ও কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। ঘন ঘন ভারি নিঃশ্বাস পড়ছিল, আস্তে আস্তে কমে। স্থির হয়ে বসে স্বগতোক্তির মতোই বলল, আমি জানতাম এমন হবে একদিন। আর সেজন্যই তোমাকে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আমার মানা তো তুমি শোননি? দেখলাম সত্যিই তুমি আমাকে ভালোবাস, সব দোষ ঢেকে দেবে, সব ক্ষতি সব বঞ্চনা। তবু তোমাকে বলতাম। কিন্তু বড্ড ভয় হলো। হতভাগী আমি, তোমাকে পেয়েছি হয়তো অনেক জন্মের পুণ্যের ফলেই। তাই বড্ড ভয় হয়। বললে যদি তোমাকে হারাই। দুর্ঘটনা একটা ঘটেছিল, সেটাই তো জীবনে চরম সত্য নয়। তোমাকে পেয়ে তার শেষ দাগটুকু পর্যন্ত মুছে গেছে, তাহলে মিছে পীড়িত হয়ে থাকি কেন। ভাবলাম ঐটুকু থাক্‌, কোনদিন সুযোগ এলে বলবো। কিন্তু সেই সুযোগ যে এত তাড়াতাড়ি এমনভাবে আসবে তা বুঝতে পারিনি!

আমি বিপর্যস্ত ভস্মীভূত, শুধু বিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকি। আঁচলে চোখ মুছে ছবি বলে চলল, আজ আমি কিছু লুকোবো না। সব বলবো। তুমি বিশ্বাস করতেও পারো নাও পারো। একটি মিনতি শুধু জানাব, তোমাকে একবিন্দু ফাঁকি আমি দিইনি এইটুকু যেন বোঝবার চেষ্টা করো। সেরকম কিছুর সম্ভাবনা আছে বুঝলে আমি প্রথমেই এই ঘটনাটি বলে নিতাম। আমি একবারই ভালোবেসেছি এবং সে তোমাকেই। মরি আর বাঁচি এটাই আমার জীবনের পরম সত্য! এ সত্য পদদলিত হলেও হতে পারে। কিন্তু সত্যের মৃত্যু নেই।

ছবি একমনে প্রায় ফিসফিস্ স্বরে আরো কত কি বলে যাচ্ছিল। এক সময় গিয়ে কিছুই আমার কানে ঢুকল না। সারাদেহে মৃত্যুর মতো ক্লান্তি, ঝিমিয়ে এসেছে চোখ। শরীরটা কখন এলিয়ে পড়ল তাও বলতে পারবো না। বাইরের জগৎ নিমজ্জিত হয়ে গেল। তা একরাত্রির জন্য বটে কিন্তু আমার চেতনায় অনন্তকালের মতো।

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি ছবি আলুথালু বেশে আমার বুকের ওপর। আমার চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে ওর চুলের রাশ এবং আমি তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *