পরদিন খুব সকালে মুরাদ এলো, সঙ্গে ইয়াসিন। খোকা তখন বারান্দায়। বসে বসে সে পাখির ডাক শুনছিলো। এতো পাখির ডাক এর আগে সে আর কখনো শোনে নি। পাতার আড়ালে গা লুকিয়ে চোখগেল আর বউকথাকও ডাকছে এখন।
মুরাদকে কিছুটা বিষণ্ণ মনে হলো খোকার। টাকা-পয়সার টানাটানি কিংবা গাঁজাভাঙের নেশা, যে-কোনো একটার ফেরে পড়েছে বেচারা, খোকা এই সিদ্ধান্তে এলো; সে জানে অনেকদিন দাওয়াই পড়ে নি মুরাদের পেটে, ওর সমস্ত অন্তরাত্মা এখন সামসু সামসু করে দাপাচ্ছে।
খবর শুনেছিস কিছু? ইয়াসিন ঠোঁট কামড়ে জিগ্যেস করে।
কই আর–
মুরাদ বললে, ও খবর রাখতে যাবে কোন দুঃখে, আমরা তো আছিই মাইনে করা চাকর; এসে এসে ওকে শুনিয়ে যাবো। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামবে বুঝলি!
তুই জানলি কি করে?
ইকবাল হলের ছেলেরা কানাঘুষো করছে। হল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ছেলেরা।
এখানে আসার একটা ছুতো খাড়া করার জন্যে রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামাচ্ছে মুরাদ সে ভাবলো। বললে, নেহাত গুজব–
মুরাদ চিন্তিত মুখে জিগ্যেস করলে, ঠিক করেছিস কিছু?
না।
ইচ্ছে করলে বান্দুরায় গঞ্জালেসের ওখানে উঠতে পারিস। কাছাকাছি হয়। গঞ্জালেস নিজেই প্রস্তাব দিয়েছে!
এখনো ওরকম হুটোপুটি করার সময় আসে নি।
মুরাদ অপ্রতিভভাবে বললে, বলে-কয়ে আসবে না কি সব? সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে শেষে পস্তাবি। একটা কিছু হুলস্থুল শুরু হয়ে গেলে তখন আর পালাবার পথ খুঁজে পাবি না, আমরাও কেউ পায়ে ধরে সাধাসাধি করতে আসবো না–
খোকা বললে, ভাগার কথা উঠছে কেন, লড়বে কারা? গাছপালা রাস্তাঘাট লাইটপোস্ট? আজকের পৃথিবীর স্বাধিকার প্রমত্ত বলবান মানুষেরা ছাদে কেবল ফ্ল্যাগ উড়িয়ে একচোটে সবাই যদি ভাগোয়াট হয়ে যায় সংগ্রাম চালাবে কারা? ভক্কিবাজি!
যারাই লড়ক, তারা অন্তত তোর পাঠশালায় পড়া কেউ নয়। তোদের মতো ঝিনুকে দুধগেলাদের নিয়েই যতো ল্যাঠা!
ইয়াসিন বললে, জয়দেবপুরের গোলাগুলির খবর তো শুনেছিসই!
শুনেছি, কিন্তু ভিতরের রহস্যটা বুঝিনি।
অতো বুঝতে গেলে রাত ফরসা হয়ে যাবে–ইয়াসিন বললে, নিজের মাথা বাঁচাতে চাইলে মানে মানে একদিকে কেটে পড়ো এখনই। তলে তলে অনেক কিছুই ঘটে গিয়েছে, জান নিয়ে টানাটানি শুরু না হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত।
রঞ্জুর কথা ভেবেছিস? গম্ভীর গলায় জিগ্যেস করলে মুরাদ।
ভেবেছি—
কি ঠিক করলি?
ওর কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই!
ইচ্ছে-অনিচ্ছেটা বড় কথা নয় এই সময়। শখ করে তো আর কেউ হাওয়া বদলাতে যাচ্ছে না। তোকেই ইনিসিয়েটিভ নিতে হবে। ঠুঁটোর মতো হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় এটা নয়। ভেবেছিস খামখেয়ালিপনা করে সবকিছু সামলাতে পারবি? ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে। ফ্যাল, গঞ্জালেসের ওখানে উঠলে কোনো অসুবিধে হবে না। সুবিধে বুঝলে হুট করে আবার ফিরে আসতে পারবি–
তুই কি ঠিক করেছিস?
আমার যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মেয়েরা গ্রামে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করলে রঞ্জুকে নিয়ে তুইও যেতে পারিস ওদের সঙ্গে–
গালটা ভালোই হলো—
মুরাদ বললে, বড়বোনের ঢাকায় থাকার কথা ছিলো, কিন্তু থাকছে না সেও, কারো কাছ থেকে খারাপ কিছু শুনে থাকবে, এখানে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করছে না–
খোকা ইয়াসিনকে উদ্দেশ করে বললে, তোর খবর কি বল?
খবর কেরোসিন, বিধবা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি—
দেখা-সাক্ষাৎ হচ্ছে না?
প্রথম দুদিন হয়েছিলো, শালার আঁটুলি হয়ে লেগেছিলাম সমানে। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই পিঙখাডুমার্কা এক মামার সঙ্গে কাটি মারবে।
গ্রামের বাড়ি! খোকা হেসে বললে, গেরো শক্ত রেখেছিস তো, ফসকে না যায় আবার!
কি জানি, লক্ষণ ভালো ঠেকছে না। বিয়েটা পিছিয়ে গেল, দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হলো, শালা বেঁচে না যায় শেষঅব্দি, কতোবারই তো ভণ্ডুল হলো। এই মেয়েজাতটা বড় অদ্ভুত! আমরা যে এতো কষ্ট পাই ওরা তা বোঝে না।
জিগ্যেস করে দেখলেই পারিস তোর মিছরিকে, কি বলে!
হয়তো শালার মেরেই বসবে, কানপাটি লাল করে দেবে। এতো আর শালার গোপাল উড়ে বড় চণ্ডিদাস পড়া ল্যাবেন্ডিস মেয়ে নয়, এ্যাঁপলায়েড সাইন্সের ডাকসাইটে ছাত্রী, চাড়িখানি কথা নয়—
আখের খারাপ তোর, ভটটা করবে তোকে উঠতে বসতে!
নিলাম আর কি একটা রিস্ক, যা থাকে ভাগ্যে। সে রকম বেগতিক দেখলে ফুটে যাবো একদিকে–
খোকা বললে, হঠাৎ পিছিয়ে দিলি কেন ডেটটা, তোর বিয়ে তো ল্যাং মেরে, দেশের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কটা কি?
আমি কি আর পিছিয়েছি, পিছিয়েছে ও নিজেই। বোনের এক বাচ্চা মরে গেছে, মন খারাপ; খচ্চরটা পটল তোলার আর সময় পেলো না। বিয়ে-টিয়ে নিয়ে অতো গাবাগাবি ছিলো না আমার, আসলে বিয়েটা করা দরকার। বিয়ে না করা পর্যন্ত শুনি ভাগ্যের দরোজা খোলে না। করেই দেখি কটা দরোজা খোলে। মফস্বলের কলেজে এই পৌঁনে তিনশো টাকায় পচে মরতে মরতে গা দিয়ে বিটকেল গন্ধ ছুটছে–
মুরাদ উঠে দাঁড়ায়। ইয়াসিনও। বিভিন্ন ছাত্রাবাসে বমবম করে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের ধান্ধায় আছে ওরা; সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে চায়, খোকা আন্দাজ করে। যে-কোনো আন্দোলন কিংবা দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হলে চর্কিবাজির মতো ঘুরে বেড়ানো পুরানো অভ্যেস মুরাদের, ফলে একটা সুবিধে সে পায়, অন্যের মতামতকে হামেশাই নিজের বলে চালিয়ে দিতে আর কোনো অসুবিধাই হয় না।
যা বললাম চিন্তা করে দেখিস। গোয়ার্তুমি রেখে মনস্থির করে
ফ্যাল!
উভয়ে বেরিয়ে যায়।
এতোদিন পর বাড়ি ছাড়ার সমস্যা নিয়ে সত্যিই মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে খোকা। বাপির পিন্ডি থেকে না ফেরা অবধি যে করেই হোক অপেক্ষা করতে হবে। তারিখ পার হয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন আগেই, কোনে চিঠিপত্রও আসেনি এর মধ্যে, অস্বাভাবিকতা নেই তো এই নীরবতায়! বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক রঞ্জু, তার নিজেরও উৎসাহ নেই তিলবিন্দু, কিন্তু একথাও সত্যি, যে হারে শহরের মানুষজন গ্রামের দিকে ছুটছে তাতে শেষ পর্যন্ত মনের দৃঢ়তা চিড় খেয়ে যাবে বলেই তার বিশ্বাস। মুরাদের মতো মানুষজন স্রেফ বানোয়াট পরিস্থিতির গালগপ্পো কেঁদে ধীরে ধীরে উন্মত্ততার দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে, এসবও অল্পবিস্তর সত্যি। বাংলা নিয়ে পাশ করে একেবারে গাবুতে পড়ে গিয়েছে বেচারা, ছেঁড়া চটিজুতার মতো অবহেলাভরে একপাশে পড়ে আছে। বাঙালিদের অধিকার, মানে মুরাদের চাকরি; বাংলা নিয়ে পাশ করার দল হাতে মোয়া পাবে। দশজোড়া করে গোপ গজাবে ওদের। মুরাদের উৎসাহের মূল কারণ এইসব, খোকা জানে।
রঞ্জুর ভালোমন্দ নিয়ে মাথাব্যথার আর শেষ নেই মুরাদের। কি বোঝাতে চায় মুরাদ। ইয়াসিনের সামনে এমনভাবে রঞ্জুর কথা পেড়েছিলো যেন কতোদিনের সম্পর্ক ওর রঞ্জুর সঙ্গে। রঞ্জুর ব্যাপারে এই প্রবল উৎসাহের পিছনে যুক্তিটা কি, খোকার তা বোধগম্য নয়। সহ্যের সীমা পার করে দিচ্ছে মুরাদ, ওকি শেষ দেখতে চায়?
এ এক ধরনের শত্রুতা। ভিতরে ভিতরে একটা কিছু পাকাচ্ছে কি না তা-ই-বা কে বলবে, নির্লজ্জ বেহায়া, মতলব কি ওর! রঞ্জুর ভালোমন্দ নিয়ে আকাশ ভেঙে পড়ছে ওর মাথায়। কে ওকে অধিকার দিয়েছে? পাত্তা না পেয়ে ভিন্ন পথে হিসেব করে এগোতে চায় মুরাদ। মরিয়া হয়ে উঠছে জানোয়ারটা; ঝাঁ-ঝাঁ করতে থাকে খোকার মাথা। সে দিশেহারা হয়ে পড়ে একসময়।
খোকা পায় পায় রঞ্জুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নখ কাটতে বসেছিলো
আমার কাছে দে–নেলকাটার নিয়ে নেয় খোকা, পা বাড়িয়ে দে দেখি এদিকে।
কুটকুট করে রঞ্জুর পায়ের নখ কাটতে থাকে খোকা। রঞ্জুর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। রুপোর তোড়া পায়ে ঘরময় ঝুমঝুম করে ছুটে বেড়াতো রঞ্জু, শখ করে মা পরিয়েছিলো। কি ছিচকাঁদুনেই না ছিলো সে সময়। তাকানো যেতো না ওর দিকে; সবসময় দ্যাখো ঠোঁট ফুলিয়ে আছে, ছলছল করছে চোখজোড়া; যেন কতো না ওর দুঃখ, দুনিয়ার সবাই বিরাট এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে ওর কাঁধে।
নখ কাটতে কাটতে ওর পায়ে ছোট্ট একটা চাপ দিলো খোকা, বললে, এই বাঁদরী, ছোটোবেলায় টম্যাটো বললে ভ্যাঁ করে কেঁদে ভাসাতিস কেন রে?
বললেই হলো!
তোর বোধহয় মনে নেই।
ফাঁক পেলেই তুই আমার কান মলে দিতিস, আর আমি মার কাছে নালিশ করতাম–
তখন তোর কানজোড়া বেজায় ছোটো ছিলো, টেনে টেনে আমিই লম্বা করেছি!
গুলবাজ! নিজের কথা মনে নেই তোর? বুড়ো ধামড়া হয়েও তুই বিছানায় পেচ্ছাব করতিস। একবার তোকে কাপে করে পেচ্ছাব খাওয়ানোও হয়েছিলো, মার মুখে তোর সব কেচ্ছাই আমি শুনেছি।
আর কেন্নো দেখলেই তুই যে চিংড়ি ভেবে গপ করে গালে পুরতিস, তারপর ক্যাঁচম্যাচ চিবিয়ে খেতিস–
ইশ, সত্যি বলছিস দাদা?
তবে কি? গাল ফুলে যেত, জিভ ফুলে যেত, চুন লাগিয়ে দিতো মা। তুই কি কম জ্বালিয়েছিস মাকে?
আহা, নিজে কতো লক্ষ্মী ছেলেটিই না ছিলে! ন্যাড়ারাজামার্কা গিনি দিয়ে চিনেবাদাম কিনে খেয়েছিলো কে? কেমন পিটুনি পড়েছিলো পিঠে?
এমন গবামার্কা ছিলি যে ইস্কুলের ক্লাসে বসে বসে গাল বন্ধ করে খোসাসুদ্ধ চিনেবাদাম খেতিস, যাকে বলে একদম গাধা!
তোর পায়ে একবার কাঁকড়াবিছে কামড়েছিলো, মনে আছে?
ইশ, সেকি হুলস্থুল কাণ্ড! মা ফিট হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, ভেবেছিলো বুঝি সাপে কামড়েছে!
অনেকক্ষণ পর খোকা বললে, তোর ভয় করছে?
তোর?
তোর জন্যে আমার ভয়। চল কোথাও রেখে আসি তোকে—
রঞ্জু হেসে বললে, পায়ের নখ কেটে দেবে কে তাহলে?
সময় হলে আমি কেটে দিয়ে আসবো।
আমাকে কাটাতে পারলে তোর বোধহয় মস্ত সুবিধে হয়, তাই না? ইচ্ছেমতো খোকামি করে বেড়াতে পারবি–
একশোবার—
বুড়োবাড়ি হলেও এখনো তুই নিজেকে খোকা মনে করিস, এটাই তোর দোষ!
আর তোর দোষ কোটা জানিস, ওর উল্টোটা। একফোঁটা পুঁচকে ছুঁড়ি তার আবার এতো কথা কিসের!
খুব সাবধানে নখের ধার মারতে থাকে খোকা ফাইলিং করে। খোকার মনে হয় এই তো সেই রঞ্জু, এ আমার কতো চেনা, রুপোর তোড়াপরা ঝুমঝুমি বাজানো ছোট্টবেলার সেই রঞ্জু, মুরাদ একে চেনে না, কাব্যচর্চার ঘোড়ারোগ দিন দিন বানোয়াট করে তুলেছে তাকে। রঞ্জুর স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে খোকা স্বস্তি পায়, সুস্থ হয়; এমন স্নিগ্ধ এমন নির্মল এমন নিষ্কলঙ্ক হতে পারে কেবল করুণাধারা।