০৬.
কালুকে পুলিশ তেমন কিছু করেনি। দু-চারটে ঠোকনা যে না মেরেছে তা নয়, কিন্তু সে বলতে গেলে সিপাইদের আদর। পুলিশের আসল ধোলাই কেমন তা খানিকটা কালু জানে।
পুলিশের কাছে কালু কারও নাম বলেনি।
থানার বড়বাবু তাকে জিজ্ঞেস করল, তুই ফলিকে খুন হতে দেখেছিস?
কালু দম ধরে রেখে খানিক ভাবল। ভেবে দেখল, সে অনেককেই ঘটনাটা বলেছে, তাই এখানে মিছেকথা বললেনাহোক ধোলাই হবে। আর পুলিশ যদি মারে তো কোনও শালার কিছু করার নেই। তাই সে চোখ পিটপিট করে বড়বাবুর কেতকা চেহারাটা চোখ ভরে দেখতে দেখতে বলল, দেখেছি।
সত্যি দেখেছিস, না কি নেশার ঘোরে বানিয়েছিস?
কালুর সেই তেজ আর নেই, যেমনটা সে সুরেন খাঁড়া, গগন আর সন্তুকে দেখিয়েছিল। পুলিশের সামনে কারই বা তেজ থাকে?
কালু মেঝেয় উবু হয়ে বসা অবস্থায় মাথা চুলকে বলল, নেশাও ছিল, তবে আবছা দেখেছি।
বড়বাবুর বুটসুদ্ধ মোটা একখানা পা তার কাঁকালে এসে লাগল এ সময়ে। খুব জোরে নয়, তবে কালু তাতেই টাল্লা খেয়ে হড়াত করে পড়ে গেল। একদাঁত হেসে সে আবার উঠে বসে।
বড়বাবুর মুখে হাসি নেই, ভ্রু কুঁচকে বলে, ঠিকসে বল।
অন্ধকার ছিল যে।
সেখানে তুই কী করছিলি?
সাঁজ বাজারে একটা লোক তাড়ি আনে। রোজ যেয়ে তার কাছে বসি।
বড়বাবু পা ফের তুলে বলে, এটুকু বয়সেই মালের পাকা খদ্দের!
খাই মাঝে মাঝে, তাকত পাই না নাহলে।
এবারের লাথিটা আরও আস্তে এল। লাগল না তেমন।
বড়বাবু বলে, ঠিক করে বল কী করছিলি।
বড় একটা ভাড় নিয়ে লাইনের ধারে বসে খাচ্ছিলাম। এ সময় কতগুলো ছেলে এল লাইনের ওধারে। কী সব বলাবলি করছিল নিজেদের মধ্যে।
কিছুতে শুনতে পাসনি?
না, আস্তে বলছিল।
ঝগড়া কাজিয়া বলে মনে হয়েছিল?
না। আপসে যেমন কথা হয় দোস্তদের মধ্যে।
তারপর?
ওরা আমাকে দেখেনি, জায়গাটা অন্ধকার।
কজন ছিল?
চার-পাঁচ জন হবে। তাদের একজন খুব লম্বা-চওড়া।
অন্ধকারে বুঝলি কী করে?
বললাম তো আবছা দেখা যাচ্ছিল।
লম্বা-চওড়া নোকটা কে? গগন?
কী জানি!
তবে লোককে বলছিস কেন যে গগনবাবু লাশ নামিয়েছে?
কাল অবাক হয়ে বলে, কখন বললাম?
বলিসনি?-বড়বাবু চোখ পাকিয়ে বলে।
মাইরি না।
এই সময়ে একটা সিপাই পাশ থেকে ঠোকা মারে। খুব জোরে নয়, তবে তাতে কালুর ডান গালের চামড়া থেতলে রক্ত বেরিয়ে গেল, আর কষের একটা দাঁতের গোড়া বুঝি নাড়া খেয়ে আরও খানিক রক্ত চলকে দিল। মুখের রক্ত ঢোক গিলে পেটে চালান দিয়েছিল কালু। থানায় ধরে আনার পর থেকে দাতে কুটো পড়েনি। পেট জ্বলছে।
বড়বাবু বলে, সব ঠিকঠাক করে বল।
কালু হাসবার চেষ্টা করে বলে, বলছি তো বড়বাবু, গগনদার কথা কাউকে বলিনি।
খুনটা কেমন করে হল?
সে খুব সাংঘাতিক। হঠাৎ দেখি সেই চার-পাঁচজনের মধ্যে একজনকে সেই জোয়ান লোকটা পিছন থেকে কী দিয়ে যেন মাথায় মারল।
জোরে মারল?
তেমন জোরে নয়, তবে ছেলেটা পড়ে গেল মাটিতে।
তারপর?
তারপর একটা তোয়ালে বা কাপড় কিছু একটা দিয়ে ছেলেটার গলা পেঁচিয়ে সেই জোয়ান লোকটা খুব চেপে ধরল।
কতক্ষণ?
খুব বেশিক্ষণ নয়, ভয়ে আমি শব্দ করিনি।
তারপর কী হল?
লোকগুলো চলে গেল।
তুই খুনিকে চিনতে পারিসনি?
মাইরি না।
তবে তোকে টাকা দিল কে?
টাকা। কালু খুব অবাক হয়।
তোকে নাকি খুনি পাঁচশো টাকা দিয়েছে?
মাইরি না বড়বাবু
কালু পা ধরতে যাচ্ছিল, এ সময়ে আর একটা বেতাল ঠোকনা খেয়ে পড়ে যায়। মাথার পিছনে বাঁ ধারে মুহূর্তের মধ্যে একটা আলু ফুটে উঠল। ঝা ঝা করছিল ব্যথায়।
টাকা পাসনি?
কালু দাতে দাঁত চেপে ভাবছিল কোন শালা কথাটা ফাস করেছে! সন্তু জানে, আর রিকশাওয়ালা নিতাই তার দোস্ত, সে জানে। আর সুরেন, গগন এ রকম দু-চারজনকে সে মুখে বলেছিল বটে যে টাকা পেলে খুনির নাম বলবে। এদের মধ্যেই কেউ ব্যাপারটা ফাস করেছে। কালুর সন্দেহ সত্যুকে। ও রকম হাড়বজাত ছেলে হয় না।
না। কালু চোখের জল মুছে বলে পুলিশ অবশ্য তাকে ধরে এনে প্রায় উদোম করে সার্চ করেছে। টাকা পায়নি।
মারধর কালুর যে খুব লাগে তা নয়। কিন্তু এটা ঠিক তাকে কেউ গমের বস্তা বলে মনে করলে তার মাথায় খুন চেপে যায়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে হুজ্জত করার মুরোদ কারই বা থাকে?
বড়বাবু বললেন, দ্যাখ দড়ামি করিস না, করলে মেরে পাট করে দেব। আজ ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু রোজ এসে হাজিরা দিয়ে যাবি। সত্যি মিথ্যে কী কী বলেছিস তার সব আমরা টের পেয়ে যাব। এটা সত্যিই খুনের মামলা কি না, না কি তুই ব্যাপারটা ঘুলিয়ে তুলেছিস, এ সব জানতে আমাদের বাকি থাকবে না। যদি শালা আমাদের ঘোল খাওয়ানোর চেষ্টা করে থাকো তবে জন্মের মতো খতম হয়ে যাবে।
কালুকে এরপর প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে থানা থেকে বের করে দেওয়া হয়।
কাল অবশ্য তাতে কিছু মনে করেনি। সে জানে সে একটা রিকশাওয়ালা মাত্র। কাজটা এতই ছোট যে দুনিয়ার কারও কাছে কিছু আশা করা যায় না। ইস্কুলের নিচু ক্লাসে পড়বার সময়েই সে কেন যেন টের পেত যে তার জীবনটা খুব সুখের হবে না। গড়ফায় তার বাবার একটা টিনের ঘর ছিল, উঠোন নিয়ে মোট চার কাঠা জমি। উদ্বাস্তুদের জবর-দখল জায়গা। সেইখানে ছেলেবেলা থেকেই নানা অশান্তিতে বড় হয়েছে। বাবা রোজ মাকে দা বা কুড়ুল নিয়ে কাটতে যেত, দিদি বাসন্তী গিয়ে আটকাত। মা আর দিদি দুজনেই ঝিগিরি করে বেড়াত, বাবা ছিল কাঠের মিস্ত্রি, প্রায় দিনই কাজ জুটত না। তার ওপর লোকটার একটা ভয়ংকর অর্শের যন্ত্রণা ছিল যার জন্য বেশিক্ষণ উবু হয়ে বসে কাজ করতে পারত না, রোজগার যা হত তাতে দুবেলা খাওয়া জুটে যেত মাত্র, তা সে যে-ধরনের খাবারই হোক! দিদি বাসণ্ডীর চরিত্র খারাপ নয় তবে বাসন্তী যার সঙ্গে বিয়ে বসল তার আগের পক্ষের বউ আর চার-চারটে ছেলেমেয়ে আছে। জেনেশুনেই করল। সে লোকটার আবার বাসন্তীকে নিয়ে সন্দেহবাতিক, কোথাও বেরোতে দেয় না। এইসব ছেলেবেলা থেকে দেখেছে কালু। বাবার মৃত্যু দেখেছে চোখের সামনে। অর্শ থেকেই খারাপ ঘা হয়ে গিয়ে থাকবে। রক্ত পড়ত দিনরাত। শেষদিকে ওই রক্তপাতেই দিন দিন ক্ষীণ হয়ে হয়ে একদিন রাতে ঘুমিয়ে সকালে আর ওঠেনি। মা এখনও ঝি খেটে বেড়ায়, ছোট বোন হেমন্তীও বেরোচ্ছে কাজে, ছোট ভাই ভুতু আর হাবু সন্ধ্যাবাজারে ডিম বেচে আর চুরি করে বেড়ায়। ক্লাস নাইন পর্যন্ত উঠে কালুকে থামতে হল। পড়তে ভাল লাগত না।
সেই থেকে কালুর সব দুঃখবোধ আর কান্না বিদায় নিয়েছে। কেমন যেন ভোতা হয়ে গেছে সে। মনে কিছু ভুরভুরি কাটে না। গাল খেলে গাল দেয়, মার খেলে উলটে মার দেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যস, এই ভাবেই যতদিন বেঁচে থাকা যায়। কালু যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে শিখেছে তা হল টাকা। টাকার মতো কিছু হয় না।
সেলিমপুরে সওয়ারি ছেড়ে রিকশাওয়ালা মগন ফাঁড়ির উলটোদিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বসে ছিল। যাদবপুরে ফিরবে, সওয়ারি পাওয়ার লোভে খানিক অপেক্ষা করছিল।
কালু গিয়ে মগনকে বলল, নিয়ে চলো দেখি মগনদা।
তোর গাড়ি কে থায়?
ছেড়ে এসেছি, পুলিশ ধরে আনল একটু আগে।
মগন ঝুঁকে বলল, পুলিশ। আই বাপ। কী হয়েছিল?
সে অনেক কথা, পরে কোনও সময়ে শুনো।
পেঁদিয়েছে তোকে?
ও শালার সম্বন্ধীর পুতেরা কাকে না প্যাদায়?
মগন রিকশার হুড তুলে দিয়ে বলল, চেপে বোস, শালারা আবার টের না পায় যে আমার গাড়িতে উঠেছিস!
মগন রিকশা ছেড়ে জোরহাল।
কালু কেতরে বসেছিল তার সিটে, মারধর নয়, আসলে খিদেয় পেট ব্যথা করছে। মদের ঝোঁকটা উবে গেছে কখন। এখন পেটে একটা চোঁ-ব্যথা। তবে তার মনটা এই ভেবে খুব ভাল লাগছিল যে পুলিশের হাতে পড়েও সে কারও নাম বলেনি।
এইট বি বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিয়ে মগন বলল, মানিককে তিন দিনের পয়সা দিইনি।
কালু দাঁত বের করে বলল, আমার এক হর বাকি কাল থেকে গাড়ি দেবে না। তার ওপর পুলিশ লেগেছে।
দুদিন জোর বৃষ্টি হলে ভাল সওয়ারি পাওয়া যায়।
ইচ্ছেমতো তো আর বৃষ্টি হবে না।
মগন গাড়ি মালিয়ে বাড়িতে তুলে রাখতে বিজয়গড় গেল।
কালু স্টেশন রোডের মুখখানিক দাঁড়িয়ে আর-একটা রিকশা খুঁজল। পেল না, হাঁটতে লাগল। বাড়ি না গেলেও হয়। গরফা পর্যন্ত ঘটতে ইচ্ছে করছে না খিদে পেটে।
স্টেশনের গায়ে একটা তেলেভাজার ঝোপড়ার দোকান আছে। সেটা চালায় বিশে, তার দোস্ত, সেখানে গেলে কিছু খাবার জুটতে পারে। শোওয়ার কার অভাব নেই স্টেশনে গামছা পেতে পড়ে থাকলেই।
বিশে জেগে ছিল, কেপড়ায় হরিকেন জ্বলছে। এই বিধিকিধিরি কম দামের ট্রানজিস্টারে কোথাকার একটা পুরনো হিন্দি গান হচ্ছে।
তাকে দেখে বিশে দাঁতের বিড়ি ফেলে দিয়ে, পরশু মাল খাওয়াবি কথা ছিল।
কালু বলে, কাল খাওয়াব।
তোর শালা মুখ না ইয়ে।
বেশি মেজাজ লিস না বিশে, আমার কচকচে সাড়ে চারশো টাকা আছে।
যা যা।
কিছু পেটের ব্যবস্থা হবে?
বিশে বলল, শালা রোজ এসে জ্বালালে এবার ঝাপড় খাবি।
তা বলে বিশে ফিরিয়ে দেয় না। মুড়ি, ছোলাসেদ্ধ আর ঠাণ্ডা বেগুনি খাওয়ায়। তারপর দুই বন্ধুতে বিড়ি ধরিয়ে গিয়ে স্টেশনে শুয়ে পড়ে গল্পগাছা করতে থাকে। বিশের মা ঝোপড়া আগলে রাখে।
বিশে সব শুনে বলে, তুই শালা ঘুমচক্করে পড়বি। খুনখারাবি নিয়ে দিল্লাগি নয় দোস্ত। সত্যি কথা বল তো কাউকে দেখেছিলি?
স্টেশনের শক্ত মেঝের ওপর-চট পেতে শোয়া কালু ফিরে বিশের দিকে চেয়ে বিড়িতে টান মেরে বলে, তুই লাশটা দেখেছিলি?
বিশে বলে, দেখব না কেন? লাইনের ধারে দিনভর পড়ে ছিল। অনেক বার গিয়ে দেখেছি।
চিনতে পেরেছিলি?
বিশে মাথা নেড়ে বলে, খুব। ফলি গুন্ডাকে কে না চেনে? এ সব জায়গাতেই আড্ডা ছিল। সব সময়ে ট্রেনে আসত আর ট্রেনেই চলে যেত।
ট্যাবলেট বেচতে আসত যে আমিও জানি। কিন্তু ট্রেন আসত কেন বল তো?
মনে হয় পাড়ায় ঢুকতে ভয় পেত। বাসে-টাসে এলে তো বড় রাস্তা বা স্টেশন রোড ধরে আসতে হবে। ও সব জায়গায় ওর কোনও বিপদ ছিল মনে হয়।
কালু আর-একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, লুকিয়ে চুরিয়ে আসত তা হলে!
বিশে গম্ভীর হয়ে বলে, কিন্তু ফলিরও দল ছিল। সন্তোষপুর, পালবাজার, স্টেশন রোড এ সব এলাকার বিস্তর মস্তান ছিল ওর দোস্ত। আমার দোকানে এসে ইট পেতে বসে কত দিন দিশি মাল আর তেলেভাজা খেয়েছে।
তুই তা হলে ভালই চিনতি?
বললাম তো।
তুই খুনটা নিজে চোখে দেখলি?
নিজের চোখে।
খুনিকেও চিনলি?
কালু হেসে বলে, নাম বলব না তা বলে। চিনলাম।
বিশে একটা আস্তে লাথি মারল কালুর পাছায়।
তারপর বলল, মালকড়ি ঝাকবি?
ঝেঁকেছি, কাল তোকে মাল খাওয়াব।
বিশে ঘুমোয়। কালুর অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসে না। গালটা ফুলে টনটনে ব্যথা হয়েছে। মাজাতেও ব্যথা বড় কম নয়। এপাশ-ওপাশ করে সে একটু কোঁকাতে থাকে।
শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল কাল। উঠতে অনেক বেলা হল। দেখল, বিশে উঠে গেছে। স্টেশনে গিজগিজ করছে।
লাইন পার হয়ে কালু পাড়ায় ঢুকে বাড়িমুখো হাঁটতে থাকে।
দরজায় পা দিতে-না-দিতেই মা চেঁচিয়ে বলে, হারামজাদা বজ্জাত, কার সঙ্গে লাগতে গিয়েছিলি? কাল রাতে চারটে গুন্ডা এসে বাড়ি তছনছ করেছে। ছেলেদুটোকে ধরে কী হেনস্থা, যা বাড়ি থেকে দূর হয়ে! গুন্ডা বদমাশ কোথাকার!