ষষ্ঠ অধ্যায় – তত্ত্বটির প্রতিবন্ধসমূহ
রূপান্তরের সঙ্গে তত্ত্বটির প্রতিবন্ধকসমূহ–সংক্রমণগত বা উত্তরণমূলক ভ্যারাইটিদের অনুপস্থিতি অথবা বিরলতা–জীবদের স্বভাবের সংক্রমণ বা উত্তরণ–একই প্রজাতির বিচিত্র স্বভাবসমূহ– সাদৃশ্যযুক্ত অন্য প্রজাতিদের তুলনায় কিছু প্রজাতির স্বভাবসমূহের ব্যাপক পার্থক্য–চরম উৎকর্ষতার অঙ্গ সমূহ–সংক্রমণের বা উত্তরণের প্রণালী–প্রতিবন্ধকের ঘটনাসমূহ–প্রকৃতি লক্ষ্য দেয় না–গৌণ গুরুত্বের অঙ্গসমূহ-অঙ্গসমূহ সর্বক্ষেত্রেই নিখুঁত নয়–টাইপের একত্বের ও প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের দ্বারা অবলম্বিত অস্তিত্বের পরিবেশের নিয়ম।
.
আমার গ্রন্থের এই অংশে পৌঁছাবার পূর্বে পাঠক নিশ্চয়ই অনেক প্রতিবন্ধকের সন্মুখীন হয়ে থাকবেন। এদের মধ্যে কয়েকটি এত গুরুতর যে এমনকি আজও খানিকটা বিমূঢ় না হয়ে এগুলির বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে পারি না আমি। তবে আমার মতে, এদের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে কেবল বাহ্যত প্রতীয়মান, এবং প্রকৃত প্রতিবন্ধকগুলি, আমার মতে, তত্ত্বটির পক্ষে মারাত্মক নয়।
এইসব প্রতিবন্ধক ও আপত্তিগুলিকে নিম্নলিখিত বিভাগ অনুসারে ভাগ করা যেতে পারে : প্রথমতঃ সূক্ষ্ম ক্রমবিন্যাসের মাধ্যমে প্রজাতিরা যদি অন্য প্রজাতিদের থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে কেন আমরা সর্বত্র অসংখ্য উত্তরণমূলক আকারদের দেখি না? প্রজাতির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও, কেন সমগ্র প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা নেই?
দ্বিতীয়তঃ, এটি কি সম্ভব যে, উদাহরণস্বরূপ, একটি বাদুড়ের দেহগঠন ও স্বভাব সম্বলিত কোন প্রাণী ব্যাপকভাবে পৃথক স্বভাব ও দেহগঠনবিশিষ্ট অন্য কোন প্রাণীর রূপান্তরের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে? আমরা কি বিশ্বাস করতে পারি যে প্রাকৃতিক নির্বাচন, একদিকে তুচ্ছ গুরুত্বের একটি অঙ্গ, যেমন একটি জিরাফের লেজ যা মাছি তাড়ানোর যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং অন্যদিকে চোখের মতো এত বিস্ময়কর অঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে?
তৃতীয়তঃ সহজাত প্রবৃত্তিগুলি কি প্রাকৃতিক নির্বাচন মারফৎ অর্জিত ও রূপান্তরিত হয়ে থাকতে পারে? সেই সহজাত প্রবৃত্তিগুলি সম্পর্কে আমরা কী বলব যা মৌমাছিদের কোষ তৈরি করতে প্ররোচিত করে এবং যা বিখ্যাত গণিতজ্ঞদের আবিষ্কারগুলির পূর্বাভাস দিয়েছে?
চতুর্থতঃ, আমরা কেমন করে ব্যাখ্যা করতে পারি যে সঙ্করণের পর প্রজাতি বন্ধ্যা হয় এবং বন্ধ্যা বংশধর উৎপাদন করে, অথচ ভ্যারাইটিরা সঙ্করিত হলে তাদের উর্বরতা অক্ষত থাকে?
প্রথম দুটি বিষয় এখানে আলোচিত হবে। অন্যান্য আপত্তিগুলি পরবর্তী অধ্যায়ে; সহজাত প্রবৃত্তি ও সঙ্করণ পরের দুটি অধ্যায়ে আলোচিত হবে।
সংক্রমণগত বা উত্তরণমূলক ভ্যারাইটিদের অনুপস্থিতি অথবা বিরলতা
কেবলমাত্র উপযোগী রূপান্তরসমূহের সংরক্ষণের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে বলে প্রত্যেক নূতন আকার একটি পরিপূর্ণ দেশে তার স্থান গ্রহণ করার চেষ্টা করবে এবং অবশেষে, যাদের সঙ্গে তাকে সংগ্রাম করতে হয় তার এমন নিজস্ব কম উন্নত পিতামাতা আকার এবং অন্য কম আনুকূল্যপ্রাপ্ত আকারদের ধ্বংস করার চেষ্টা করবে। অতএব যদি আমরা এভাবে দেখি যে প্রত্যেক প্রজাতি অন্য কোন অজ্ঞাত আকার থেকে উদ্ভূত হয়েছে, তাহলে পিতামাতা এবং সমস্ত সংক্রমণগত বা উত্তরণগত ভ্যারাইটি উভয়েই নূতন আকারটির উৎপাদন ও নিখুঁত হওয়ার প্রক্রিয়ার দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে।
কিন্তু যেহেতু এই তত্ত্ব অনুসারে অসংখ্য সংক্রমণগত বা উত্তরণগত মধ্যবর্তী আকার অবস্থান করে থাকতে পারত, তাহলে কেন আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে এদের অসংখ্যকে দেখতে পাই না? ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডের অসম্পূর্ণ বিষয়ক অধ্যায়ে এই প্রশ্নটি আলোচনা করতে আরও সুবিধা হবে; এখানে আমি শুধু বলব যে আমার মতে প্রশ্নটির উত্তর মূলতঃ নিহিত আছে এই তথ্যের মধ্যে যে সাধারণভাবে যা মনে করা হয় তার তুলনায় ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড অনেক কম নিখুঁত। ভূত্বক হচ্ছে এক বিশাল যাদুঘর, কিন্তু প্রাকৃতিক সংগ্রহগুলি অসম্পূর্ণভাবে এবং দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে সংগৃহীত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন করা যেতে পারে যে যখন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি প্রজাতি একই অঞ্চলে বাস করে, তখন বর্তমানকালে সংক্রমণগত বা উত্তরণগত অনেক মধ্যবর্তী আকার আমাদের নিশ্চয় পাওয়া উচিত। একটি সরল ঘটনা আলোচনা করা যাক : একটি মহাদেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে ভ্রমণ করার সময়, কিছু সময় অন্তর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিদের সাধারণতঃ দেখতে পাব আমরা, যারা স্পষ্টত দেশটির প্রাকৃতিক মণ্ডলের প্রায় একই স্থানে বসবাস করে। এইসব প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিরা প্রায়শই মিলিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে সংবদ্ধ হয়; এবং একটি বিরল থেকে বিরলতর হয় বলে অন্যটিকে আরও বেশি করে বারংবার দেখা যায়, এবং এটি চলতে থাকে যতক্ষণ না একটি অন্যটিকে স্থানচ্যুত করে। কিন্তু যদি এদের একত্রে মেশার জায়গায় এই প্রজাতিগুলিকে আমরা তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে এরা সাধারণত দেহগঠনের প্রত্যেক ক্ষুদ্র অংশেও পরস্পরের থেকে সেইরকম সম্পূর্ণ ভিন্ন হয় যে-রকম তাদের নিজস্ব দেশের নমুনাগুলি পরীক্ষা করলে দেখা যায়। আমার তত্ত্বানুসারে এইসব সম্বন্ধযুক্ত প্রজাতিরা একটি সাধারণ পিতামাতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে; এবং রূপান্তর প্রক্রিয়া চলার সময় প্রত্যেকে তার নিজস্ব অঞ্চলের জীবন-পরিবেশে অভিযোজিত হয়েছে এবং তার আদিম পিতামাতা আকার ও তার অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে সমস্ত সংক্রমণগত বা উত্তরণগত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করেছে। সে জন্য প্রত্যেক অঞ্চলে বর্তমানে অসংখ্য সংক্রমণগত বা উত্তরণগত মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের সাক্ষাৎ পাওয়ার আশা করা আমাদের উচিত হবে না, যদিও এরা সেখানে অবস্থান করে এবং জীবাশ্ম অবস্থায় প্রোথিত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মধ্যবর্তী জীবন-পরিবেশ সম্বলিত মধ্যবর্তী অঞ্চলে, কেন এখন আমরা ঘনিষ্ঠভাবে সংযোগকারী ভ্যারাইটিদের দেখতে পাই না? এই অসুবিধাটি দীর্ঘদিন ধরে আমাকে বিমূঢ় করে রেখেছিল। কিন্তু আমি মনে করি বহুলাংশে এটির ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
প্রথমতঃ, আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অতিশয় সতর্ক হওয়া উচিত যে এখনকার একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে অবিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই রয়েছে। ভূতত্ত্ব আমাদের জানায় যে অধিকাংশ মহাদেশ এমনকি পরবর্তী টার্শিয়ারী যুগেও ভেঙ্গে গিয়েই দ্বীপগুলি সৃষ্টি হয়েছে; এবং এইসব দ্বীপগুলিতে মধ্যবর্তী এলাকার মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের থাকার সম্ভাবনা ব্যতিরেকে স্বতন্ত্র প্রজাতিরা পৃথকভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। দেশ ও জলবায়ুর আকার ও প্রকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, বর্তমানে অবিচ্ছিন্ন সামুদ্রিক অঞ্চলসমূহ সম্প্রতিকাল পর্যন্ত অতি অল্প অবিচ্ছিন্ন ও একইরূপ পরিবেশে অবশ্যই অবস্থান করে থাকবে। এই পথ অনুসরণ করেই আমি প্রতিবন্ধকটি অতিক্রম করব, কারণ আমি বিশ্বাস করি যে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত অনেক প্রজাতি সম্পূর্ণরূপে অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলিতেই সৃষ্টি হয়েছে; যদিও আমি সন্দেহ করি না যে বর্তমানে অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলির পূর্বের বিচ্ছিন্ন অবস্থা নূতন প্রজাতি সৃষ্টিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবু আরও বিশেষভাবে বললে বলা উচিত-স্বাধীনভাবে সঙ্করিত হওয়া ও ঘুরে বেড়ানো প্রাণীদের ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে।
একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বর্তমানে বিস্তৃত প্রজাতিদের লক্ষ্য করলে আমরা সাধারণতঃ দেখি যে একটি বিরাট অঞ্চলে এরা সংখ্যাতীত হয়, তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে নিজেদের সীমানায় বিরল থেকে বিরলতর হয় এবং অবশেষে অদৃশ্য হয়। অতএব, প্রতিনিধিত্বমূলক দুটি প্রজাতির মধ্যে নিরপেক্ষ অঞ্চলটি প্রত্যেকের পক্ষে উপযুক্ত অঞ্চলটির তুলনায় সাধারণতঃ সংকীর্ণ হয়। পাহাড়-পর্বতে ওঠার সময় আমরা একই দৃশ্য দেখি, এবং যেমন আলফনসে ডি ক্যাডোলে লক্ষ্য করেছেন, কোন কোন সময় এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা যে সুলভ একটি উচ্চ পাহাড়ি প্রজাতি নিতান্তই আকস্মিকভাবে অদৃশ্য হয়। ই. ফরবেশ ড্রেজার মারফৎ সমুদ্রের গভীরে একই জিনিস লক্ষ্য করেছেন। যারা বিস্তারের সার্বিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জলবায়ু ও জীবনের ভৌত পরিবেশসমূহকে দেখে, এইসব ঘটনা তাদের বিস্ময় উদ্রেক করবে, কারণ জলবায়ু ও উচ্চতা অথবা গভীরতা অচেতনভাবে ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যখন আমরা স্মরণ করি যে প্রায় প্রত্যেক প্রজাতি, এমনকি তাদের নিজস্ব বাসভূমিতেও, সংখ্যায় অত্যধিক বৃদ্ধি পেতে থাকবে, তখন তার প্রতিযোগী প্রজাতিদের ক্ষেত্রে কি এটি ঘটবে; এবং প্রায় সকলেই হয় নিজে শিকার হয় অথবা অন্যকে শিকার করে; সংক্ষেপে, প্রতিটি জীব অন্য জীবদের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধরনের হয় প্রত্যক্ষভাবে নয়তো পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত হয়। আমরা দেখি যে কোন দেশের অধিবাসীদের বিস্তার কেবলমাত্র অচেতনভাবে পরিবর্তনশীল ভৌত পরিবেশসমূহের উপর কোনভাবেই নির্ভর করে না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য প্রজাতিদের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে, যার উপর এটি বাঁচে বা যার দ্বারা এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় অথবা যার সঙ্গে এটি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়; এবং যেহেতু এইসব প্রজাতিরা অচেতন মাত্রাবিন্যাস দ্বারা একটির সঙ্গে অন্যটি মিশ্রিত না হয়ে ইতিমধ্যে সুসংজ্ঞায়িত বস্তুতে পরিণত হয়েছে, সেহেতু অন্যদের বিস্তারের ওপর নির্ভর না করে যে কোন একটি প্রজাতির বিস্তার স্পষ্টভাবে সীমা নির্ধারিত করার চেষ্টা করবে। অধিকন্তু, এটির বিস্তারের সীমানার মধ্যে প্রত্যেক প্রজাতির, যেখানে তারা কম সংখ্যায় অবস্থান করে, তার শত্রুদের অথবা তার শিকারীদের সংখ্যায় কমবেশি হওয়ার সময়, কিংবা ঋতুগুলির প্রকৃতির পরিবর্তনের সময়, সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এবং এভাবে তাদের ভৌগোলিক বিস্তার আরও সুনির্দিষ্ট হবে।
যেহেতু একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী সম্বন্ধযুক্ত অথবা প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিরা এমন একটি উপায়ে সাধারণতঃ বিস্তৃত হয় যে প্রত্যেকের একটি ব্যাপক বিস্তার থাকে, এর মধ্যে তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ নিরপেক্ষ অঞ্চল থাকে, যেখানে এরা বিরল থেকে বিরলতর হয়; তারপর ভ্যারাইটিরা মূলতঃ প্রজাতি থেকে ভিন্ন হয় না, একই নিয়ম উভয় ক্ষেত্রেই সম্ভবতঃ প্রযোজ্য হবে; এবং যদি আমরা একটি বিরাট অঞ্চলে বসবাসকারী একটি পরিবর্তনশীল প্রজাতিকে ধরি, তাহলে দুটি বড় অঞ্চলে দুটি ভ্যারাইটিকে এবং সংকীর্ণ মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি তৃতীয় ভ্যারাইটিকে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। ফলস্বরূপ, একটি সংকীর্ণ এবং কম বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাস করার জন্য মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিটি কম সংখ্যায় থাকবে; এবং বাস্তবিকপক্ষে, যতদূর আমি প্রমাণ করতে পারি, এই নিয়মটি প্রাকৃতিক অবস্থায় অবস্থিত ভ্যারাইটিদের ক্ষেত্রেও খাটে। ব্যালানাস গণের স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের মধ্যেকার মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিগুলির ক্ষেত্রে নিয়মটির চমৎকার উদাহরণ লক্ষ্য করেছি আমি। এবং মিঃ ওয়াটসন, ডঃ আসা গ্রে এবং মিঃ ওলাস্টনের প্রদত্ত তথ্যগুলি থেকে মনে হয় যে যখন অন্য দুটি আকারের মধ্যে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা অবস্থান করে, তখন এরা এদের সংযোগকারী আকারদের তুলনায় সাধারণতঃ সংখ্যায় বিরলতর হয়। এখন যদি আমরা এই তথ্য এবং সিদ্ধান্তগুলিকে বিশ্বাস করি, তাহলে সিদ্ধান্ত করতে পারি যে অন্য দুটি ভ্যারাইটির সংযোগকারী ভ্যারাইটিরা তাদের সংযোগকারী আকারদের তুলনায় সাধারণতঃ কম সংখ্যায় অবস্থান করে, তারপর আমরা বুঝতে পারি কেন মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা দীর্ঘস্থায়ী হয় নাঃ একটি সাধারণ নিয়মানুযায়ী, এদের প্রথমে একত্রে সংযোগকারী আকারদের তুলনায় কেন এরা শীঘ্র ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং অদৃশ্য হবে।
ইতিমধ্যে বলা হয়েছে যে বেশি সংখ্যার আকারদের তুলনায় অল্প সংখ্যার যে কোন আকারের ধ্বংসের সম্ভাবনা প্রবলতর হবে; এবং এই বিশেষ ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী আকারটি তার উভয় দিকে অবস্থিত নিকট সম্বন্ধীয় আকারদের মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হবে। কিন্তু এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ যে আরও বেশী রূপান্তর প্রক্রিয়া ঘটার সময়, যাতে দুটি ভ্যারাইটি দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে পরিবর্তিত ও সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে হয়, বৃহত্তর অঞ্চলসমূহে বসবাসকারী বৃহত্তর সংখ্যার দুটি সংকীর্ণ ও মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসকারীরা অল্প সংখ্যার মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকবে। কারণ কম সংখ্যার বিরলতর আকারদের তুলনায় বৃহত্তর সংখ্যার আকারদের যে কোন নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হওয়ার জন্য আরও অনুকূল পরিবর্তন উপস্থিত করার ভাল সম্ভাবনা থাকে। অতএব জীবনসংগ্রামে বেশি সুলভ আকাররা কম সুলভ আকারদের পরাজিত ও স্থানচ্যুত করতে চেষ্টা করবে, কারণ কম সুলভ আকাররা আরও মন্থরভাবে রূপান্তরিত ও উন্নত হবে। আমি বিশ্বাস করি যে এই একই নীতি অনুসারে প্রত্যেক দেশের সুলভ প্রজাতিরা, যেটি দ্বিতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে, বিরলতর প্রজাতিদের তুলনায় গড়ে বেশি সংখ্যার স্পষ্টচিহ্নিত ভ্যারাইটিদের উপস্থিত করে। আমি কী বলতে চাই তা ব্যাখ্যা করতে পারি। ধরা যাক ভেড়ার তিনটি ভ্যারাইটি আছে, প্রথমটি অতি উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অভ্যস্ত হয়েছে, দ্বিতীয়টি তুলনামূলকভাবে একটি সংকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে এবং তৃতীয়টি পাহাড়-পর্বতের তলদেশে সমতলভূমিতে; এবং সেখানকার বাসিন্দারা তাদের স্টকগুলিকে নির্বাচনের দ্বারা সমান দৃঢ়তা ও দক্ষতার সঙ্গে উন্নত করার চেষ্টা করছে; মধ্যবর্তী সংকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলের কম সংখ্যক বসবাসকারীদের তুলনায় উচ্চ পর্বতে ও সমতলভূমিতে অভ্যস্ত বেশি সংখ্যক অধিবাসীদের পক্ষে তাদের জাতগুলিকে আরও দ্রুতহারে উন্নত করার প্রবল সম্ভাবনা থাকবে; এবং উচ্চ পর্বতের অথবা সমতলভূমির উচ্চ জাতটি কম উন্নত পাহাড়ি জাতের স্থান শীঘ্র গ্রহণ করবে; এবং এভাবে পূর্বে অধিক সংখ্যায় অবস্থানকারী দুটি জাত স্থানচ্যুত মধ্যবর্তী পাহাড়ি ভ্যারাইটির মধ্যস্থলে উপস্থিত না হয়ে পরস্পরের খুব সন্নিকটে আসবে।
সংক্ষেপে বললে আমি বিশ্বাস করি যে প্রজাতিরা মানানসই সুসংজ্ঞায়িত বিচিত্র জিনিসে পরিণত হয়েছে, এবং এরা কখনোই পরিবর্তনশীল ও মধ্যবর্তী সংযোজকের অসমাধানযোগ্য বিশৃঙ্খলা উপস্থিত করে না; প্রথমতঃ, কারণ নূতন ভ্যারাইটিরা অতি মন্থরভাবে সৃষ্টি হয়, কারণ পরিবর্তনশীলতা একটি মন্থর প্রক্রিয়া, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত অনুকূল এককীয় পার্থক্য অথবা পরিবর্তনগুলি না ঘটে, ততক্ষণ প্রাকৃতিক নির্বাচন কিছুই করতে পারে না, এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি দেশের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলের একটি স্থান তার অধিবাসীদের কোন একটির অথবা আরও অনেকের কোন রূপান্তর দ্বারা পূর্ণ হয়, এবং এরূপ নূতন স্থানগুলি জলবায়ুর মন্থর পরিবর্তনের অথবা নূতন অধিবাসীদের আকস্মিক অভিবাসনের ওপর নির্ভর করবে, এবং এইরূপে নূতন আকারদের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বয়স্ক অধিবাসীদের কয়েকটি ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হওয়ার ওপর এবং বয়স্কদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর সম্ভবতঃ আরও অধিক মাত্রায় নির্ভর করবে। সেহেতু, যে কোন অঞ্চলে এবং যে কোন সময়কালে, আমরা কেবলমাত্র কয়েকটি প্রজাতিকে দেখব যারা কিছু পরিমাণ স্থায়ী দেহগঠনের অল্প পরিবর্তন উপস্থিত করে; এবং এটি আমরা নিঃসন্দেহেই লক্ষ্য করি।
দ্বিতীয়তঃ, এখনকার অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হিসেবে অবস্থান করে থাকবে, যেখানে অনেক আকার, আরও বিশেষ করে অধিক পরিভ্রমণশীল এবং একবার জন্মের জন্য মিলিত হয় এমন শ্ৰেণীদের মধ্যে, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতিতে পরিণত হওয়ার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে যথেষ্ট ভিন্ন হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে কয়েকটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতি এবং তাদের সাধারণ পিতামাতাদের মধ্যে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা দেশের প্রত্যেক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পূর্বে নিশ্চয় অবস্থান করে থাকবে, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া চলার সময় এই সংযোজকগুলি স্থানচ্যুত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে থাকবে, যাতে এদের জীবন্ত অবস্থায় আর দেখা যাবে না।
তৃতীয়তঃ, যখন একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন অংশে দুটি অথবা ততোধিক ভ্যারাইটির সৃষ্টি হয়, এটি সম্ভবপর যে মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা প্রথমে মধ্যবর্তী এলাকাগুলিতে সৃষ্ট হয়ে থাকবে, কিন্তু সাধারণতঃ এদের স্থায়িত্বকাল অল্প হয়ে থাকবে। কারণ এইসব মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিরা (কারণগুলি ইতিমধ্যে বর্ণিত হয়েছে; যথা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং প্রতিনিধিত্বমূলক প্রজাতির প্রকৃত বিস্তার সম্পর্কে আমরা কি জানি এবং এভাবে স্বীকৃত ভ্যারাইটিদের) এদের সংযোগ করার চেষ্টাকারী ভ্যারাইটিদের তুলনায় কম সংখ্যায় মধ্যবর্তী এলাকাগুলিতে অবস্থান করে। কেবলমাত্র এই কারণের জন্য মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিদের হঠাৎ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে; এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আরও রূপান্তর প্রক্রিয়া চলার সময় এরা সেই আকারদের দ্বারা প্রায় নিশ্চিতরূপে পরাজিত ও স্থানচ্যুত হবে যেগুলি এদের সংযুক্ত করে; এইসব কারণে অধিক সংখ্যার আকাররা সমষ্ঠিগতভাবে আরও বেশি ভ্যারাইটি সৃষ্টি করবে এবং এরূপে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আরও উন্নত হবে এবং আরও প্রাধান্য লাভ করবে।
শেষতঃ, কোন বিশেষ সময়ে নয়, বরং সব সময় লক্ষ্য করলে, যদি আমার তত্ত্বটি সত্য হয়, তাহলে একই গোষ্ঠীর সমস্ত প্রজাতিদের একত্রে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে অসংখ্য মধ্যবর্তী ভ্যারাইটি নিঃসন্দেহে অবস্থান করে থাকবে; কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচনের যথাযথ প্রক্রিয়াটি পিতামাতা আকার সংযোজকদের অনবরত ধ্বংস করার চেষ্টা করে, যেটি প্রায়শই বলা হয়েছে। ফলে, এসব পূর্ব অবস্থানের সাক্ষ্যটি কেবলমাত্র জীবাশ্মদের মধ্যে একটি অতি অসম্পূর্ণ অবস্থায় দেখা যেতে পারে, যা আমরা পরবর্তী একটি অধ্যায়ে দেখাতে চেষ্টা করব।
বিশেষ স্বভাব ও অবয়ব সম্বলিত জীবদের উৎপত্তি ও উত্তরণ
আমার এইসব মতবাদের বিরোধীরা প্রশ্ন করেন, কেমন করে একটি স্থলচর মাংসাশী প্রাণী জলচর স্বভাবের একটি প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে পারে? কেমন করে সংক্রমণগত বা উত্তরণগত অবস্থায় প্রাণীটি বেঁচে থাকবে? এটি দেখানো সহজ হবে যে স্থল থেকে জলে বাস করার স্বভাব সমেত মধ্যবর্তী স্তর সম্বলিত মাংসাশী প্রাণীরা এখনও রয়েছে; এবং যেহেতু প্রত্যেকে জীবনসংগ্রামের দ্বারা বাঁচে, তাই এটি স্পষ্ট যে প্রত্যেকে প্রাকৃতিক অবস্থায় তার জায়গায় নিশ্চয় ভালভাবে অভ্যস্ত হবে। উত্তর আমেরিকার মুসটেলা বাইসনদের দিকে লক্ষ্য করুন, যাদের লিপ্তপদ রয়েছে এবং যাদের লোম, ছোট পা এবং লেজের আকার একটি ভোঁদড়ের মতো হয়। গ্রীষ্মকালে এই প্রাণীটি জলে ডুব দেয় এবং মাছ শিকার করে, কিন্তু দীর্ঘ শীতকালে প্রাণীটি জমাটবাঁধা জল ত্যাগ করে এবং মেরু অঞ্চলের বিড়ালদের মতো ইঁদুর ও স্থলচর প্রাণীদের শিকার করে। যদি অন্য আর একটি ভিন্ন ঘটনা ধরা হয় এবং কেমন করে একটি পতঙ্গভুক চতুষ্পদ প্রাণী একটি উড়ন্ত বাদুড়ে রূপান্তরিত হয়ে থাকতে পরে–এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হলে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে। তবুও আমি মনে করি, এইসব প্রতিবন্ধকের গুরুত্ব খুবই অল্প।
অন্য অনেক ঘটনার মতো এখানেও আমি অতিশয় অসুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছি, কারণ আমার সংগৃহীত অনেক চিত্তাকর্ষক ঘটনার মধ্যে, নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতির সংক্রমণগত স্বভাব ও দেহগঠনসমূহের এবং একই প্রজাতির হয় অপরিবর্তনীয় নয়তো অনিয়মিত বিচিত্র স্বভাবের কেবল যে কোন একটি বিশেষ ঘটনার ব্যাখ্যা করার অসুবিধা দূর করতে এইসব ঘটনার একটি দীর্ঘ তালিকা যথেষ্ট নয়।
কাঠবিড়ালি গোত্রের দিকে লক্ষ্য করুন। অল্প চ্যাপ্টা লেজ সমেত প্রাণীদের চমৎকার দৃষ্টান্ত এরা। স্যার জে. রিচার্ডসনের মতানুসারে, শরীরের পশ্চাদভাগ প্রশস্ত এবং পঞ্জর ও জঙঘার মধ্যবর্তী পার্শ্বদেশের পরিপূর্ণ চর্ম সমেত অন্য প্রাণীগুলি থেকে সুপরিচিত উড়ন্ত কাঠবিড়ালি পর্যন্ত সুন্দরতম ক্রমবিন্যাস আমরা লক্ষ্য করেছি, উড়ন্ত কাঠবিড়ালির বাহু এবং এমনকি লেজের নিম্নভাগ একটি প্রশস্ত চামড়া দ্বারা যুক্ত থাকে, যা প্যারাসুটের মতো কাজ করে এবং বিস্ময়কর দূরত্বের গাছ থেকে গাছে বাতাসের মধ্য দিয়ে উড়ে যেতে এদের সাহায্য করে। আমরা সন্দেহ করতে পারি না যে পৃথক-পৃথক দেশের প্রত্যেক প্রকার কাঠবিড়ালির প্রত্যেক দেহগঠনের ব্যবহার আছে, যেমন পাখি ও শিকারিদের নাগাল থেকে পালিয়ে যাওয়া, দ্রুততার সঙ্গে খাদ্য সংগ্রহ করা অথবা আকস্মিক পতনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া। কিন্তু এই ঘটনা থেকে এটি বোঝা যায় না যে প্রত্যেক কাঠবিড়ালির দেহগঠনকে সমস্ত সম্ভবপর অবস্থায় সর্বোত্তম বলে কল্পনা করা সম্ভব। আবহাওয়া ও বনানী পরিবর্তিত হতে দেওয়া হোক, অন্য প্রতিযোগী রোডেন্ট অথবা শিকারি পশুপাখিদের বসবাসের জন্য আনা হোক, অথবা বয়স্করা রূপান্তরিত হোক, সেক্ষেত্রে সমস্ত উপমা আমাদের বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করবে যে কাঠবিড়ালিরা অন্ততঃ কিছু সংখ্যায় হ্রাস পাবে অথবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যদি না এরাও সদৃশ উপায়ে দেহগঠনে রূপান্তরিত অথবা উন্নত হয়। সুতরাং আরও বিশেষভাবে, জীবনের পরিবর্তিত অবস্থাসমূহে এবং স্ফীততর পাঁজরা ও নিতম্বের মধ্যবর্তী ঝিল্লি সমেত এককদের অনবরত সংরক্ষণে আমি কোন অসুবিধা দেখি না, যতক্ষণ না প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঞ্চিত প্রভাবসমূহের দ্বারা একটি নিখুঁত সুপরিচিত উড়ন্ত কাঠবিড়ালির সৃষ্টি হয়, ততক্ষণ প্রত্যেক রূপান্তরই উপকারী, প্রত্যেকেই বংশবিস্তার করে।
এরপর গ্যালিওপিথেকাস বা তথাকথিত উড়ন্ত লেমুরের দিকে লক্ষ্য করুন, যাদের পূর্বে বাদুড়ের শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু এখন মনে করা হয় এরা পতঙ্গভুকদের অন্তর্ভুক্ত। একটি অতিশয় বিস্তৃত ফ্ল্যাঙ্ক ঝিল্লি চোয়ালের কোণ থেকে লেজ পর্যন্ত প্রসারিত এবং লম্বাটে আঙ্গুলগুলি সমেত বাহুদের অঙ্গীভূত করে। এই ফ্ল্যাঙ্ক ঝিল্লি প্রতিনমক পেশী দ্বারা সজ্জিত। যদিও গ্যালিওপিথেকাসদের সঙ্গে অন্যান্য পতঙ্গভুকদের সংযুক্ত করার জন্য বাতাসে ওড়ার উপযুক্ত দেহগঠনের কোন ক্রমিক সংযোজক বর্তমানে নেই, তথাপি ধরে নিতে অসুবিধা নেই যে এই সংযোজকগুলি পূর্বে ছিল এবং প্রত্যেকে কম অসম্পূর্ণ উড়ন্ত কাঠবিড়ালিদের মতো একই উপায়ে বিকশিত হয়েছিল, দেহগঠনের প্রত্যেক ধাপ তার অধিকারীর পক্ষে উপকারী। অথবা আরও বিশ্বাস করা যায় যে গ্যালিওপিথেকাসের হাত ও আঙ্গুলসমূহকে সংযুক্তকারী ঝিল্লিটি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা বিরাটভাবে দীর্ঘায়িত হয়ে থাকবে এবং ওড়ার অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করলে এটি প্রাণীটিকে একটি বাদুড়ে রূপান্তরিত করে থাকবে। যে-সব বাদুড়ের ডানার ঝিল্লি স্কন্ধের শীর্ষ থেকে লেজ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় এবং পিছনের পাগুলিকে অঙ্গীভূত করে, তাদের ক্ষেত্রে আমরা বোধহয় একটি দেহাংশের চিহ্নগুলি দেখি যা ওড়ার চেয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানোর জন্য আদিম অবস্থায় সজ্জিত ছিল।
পাখিদের প্রায় এক ডজন গণ যদি বিলুপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে কে সন্দেহ করবে যে ঐ সব পাখিরা অতীতে অবস্থান করে থাকতে পারে যারা তাদের ডানাগুলিকে মাথামোটা হাঁসেদের মতো চ্যাটালো পাখনা হিসেবে, পেঙ্গুইনদের মতো জলে পাখনা হিসেবে এবং স্থলে মনের পা হিসেবে, উটপাখির মতো পাল হিসেবে এবং অ্যাপটেরিক্স-এর মতো কার্যকরী কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই ব্যবহার করত? তথাপি এইসব পাখিদের প্রত্যেকের দেহগঠন তাদের নিজস্ব জীবন-পরিবেশে সহায়ক, কারণ প্রত্যেককে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হয়; কিন্তু এটি সম্ভবপর সমস্ত পরিবেশে মোটেই সম্ভবপর সর্বোত্তম নয়। এইসব মন্তব্য থেকে নিশ্চয় এমন সিদ্ধান্ত করা উচিত হবে না যে এখানে উল্লিখিত ডানা গঠনের ধাপগুলি–যেগুলির প্রতিটিই অব্যবহারের ফল হতে পারে–সেই ধাপগুলির ইঙ্গি ত দেয়, যেগুলির দ্বারা পাখিরা তাদের ওড়ার প্রকৃত ক্ষমতা অর্জন করেছিল; কিন্তু এগুলি দেখাতে সাহায্য করে রূপান্তরের কী কী বিচিত্র উপায় অন্ততঃ সম্ভবপর।
ক্রাস্টেসিয়া (খোলকী বা বর্মী) ও মলাস্কার (কম্বোজ) মতো জলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণকারী শ্রেণীর কিছু সদস্যদের স্থলভাগে বসবাসে অভ্যস্ত হওয়া এবং উড়ন্ত পাখি ও স্তন্যপায়ীদের, অতি বিচিত্র ধরনের উড়ন্ত পতঙ্গদের এবং অতীতের উড়ন্ত সরীসৃপদের দেহ লক্ষ্য করে কল্পনা করা যায় যে এখন পাখনা ঝাঁপটানোর সাহায্যে বাতাসে উড়তে পারা উড়ন্ত মাছেরা নিখুঁত ডানা-যুক্ত প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে। এভাবে যদি ঘটে থাকে, তাহলে কেউ কি কখনও কল্পনা করতে পারবে যে প্রথমদিকে উত্তরণগত অবস্থায় খোলা সমুদ্রের অধিবাসী হয়েছিল এরা এবং অন্য মাছেদের দ্বারা গিলে খাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য নিজেদের ওড়ার জায়মান অঙ্গগুলি ব্যবহার করেছিল?
উড্ডয়নের জন্য একটি পাখির ডানার মতো, কোন বিশেষ স্বভাবের জন্য উপযুক্ত একটি অতি নিখুঁত দেহগঠন যখন আমরা দেখি, তখন আমাদের স্মরণ রাখা উচিত যে দেহগঠনের প্রথমদিককার উত্তরণগত ধাপসমূহ প্রদশর্নকারী প্রাণীরা বর্তমানকাল পর্যন্ত কদাচিৎ বেঁচে থাকবে, কারণ এরা এদের উত্তরাধিকারীদের দ্বারা স্থানচ্যুত হয়ে থাকবে এবং এজন্য উত্তরাধিকারীরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা ক্রমশ আরও নিখুঁত হয়ে থাকবে। এছাড়াও, আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে জীবনের অতিশয় ভিন্ন স্বভাবগুলির পক্ষে উপযুক্ত দেহগঠনসমূহের মধ্যে সংক্রমণগত ধাপসমূহ বিরাট সংখ্যায় এবং অনেক অধীনস্থ আকারগুলিতে প্রাথমিক পর্যায়ে কদাচিৎ বিকশিত হয়ে থাকবে। এভাবে উড়ন্ত মাছের কল্পিত ব্যাখ্যায় ফিরে আসলে এটি সম্ভবপর বলে মনে হয় না যে প্রকৃত উড্ডয়নে সমর্থ মাছগুলি জলে এবং স্থলে বিভিন্ন উপায়ে অনেক ধরনের শিকার ধরার জন্য অনেক হীনতর আকারে বিকশিত হয়ে থাকবে, যতদিন না এদের ওড়ার অঙ্গগুলি অতি নিখুঁত হয়ে থাকবে, যাতে করে এরা জীবনসংগ্রামে অন্য প্রাণীদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করার জন্য উন্নততর অবস্থান অর্জন করেছে। অতএব জীবাশ্ম অবস্থায় দেহগঠনের সংক্রমণগত ধাপগুলি সমেত প্রজাতিদের আবিষ্কারের সম্ভাবনা সর্বদাই কম হবে, কারণ পূর্ণ বিকশিত দেহগঠন সম্বলিত প্রজাতির তুলনায় এরা সংখ্যায় অল্পতর ছিল।
একই প্রজাতির এককদের বিচিত্র এবং পরিবর্তিত স্বভাবসমূহের উভয়েরই দুটি অথবা তিনটি উদাহরণ আমি এখন উল্লেখ করব। এদের পরিবর্তিত স্বভাবসমূহ অথবা এদের কতিপয় স্বভাবের কেবলমাত্র একটি সম্বলিত প্রাণীটির দেহগঠনকে যে কোন অবস্থায় অভ্যস্ত করানো প্রাকৃতিক নির্বাচনের পক্ষে সহজ হবে। তবে সিদ্ধান্তে আসা কষ্টকর এবং আমাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় যে স্বভাবসমূহ প্রথমে এবং দেহগঠন পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয় কিনা; অথবা দেহগঠনের অল্প রূপান্তর স্বভাবের পরিবর্তনে সাহায্য করে কিনা; সম্ভবতঃ উভয়ই প্রায়শঃ যুগপৎ ঘটে। পরিবর্তিত স্বভাবের ঘটনার মধ্যে অনেক ব্রিটিশ পতঙ্গের উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট যারা এখন বিদেশি গাছগুলি খায় এবং কেবলমাত্র কৃত্রিম পদার্থের ওপর জীবনধারণ করে। বিচিত্র স্বভাবের অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে : দক্ষিণ আমেরিকার টাইর্যান্ট মক্ষিভুককে ( সৌরফ্যাগাস সালফিউর্যাটাস) আমি প্রায়শই লক্ষ্য করি, যা একটি কেস্ট্রেল (এক জাতীয় ছোট বাজপাখি)-এর মতো একটি জায়গায় ইতস্ততঃ ঘুরত এবং তারপর অন্য জায়গায় অগ্রসর হত এবং অন্য সময়ে জলের ধারে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকত, অতঃপর মাছরাঙা পাখির মতো দ্রুতবেগে কোন মাছের দিকে ঝুঁপিয়ে পড়ত। আমার নিজের দেশে, প্রায় একটি বিসর্পীর মতো চামচিকাকে (প্যারাস মেজর) গাছের শাখাপ্রশাখার ওপরের দিকে উঠতে দেখা যায়; এরা অনেক সময় শ্রাইক (চিল জাতীয় পাখি)-এদের মতো মাথায় আঘাত করে ছোট ছোট পাখিদের হত্যা করে; এবং আমি অনেক সময় দেখেছি এবং ইউগাছের একটি শাখার ওপর বীজগুলিকে আঘাত করার শব্দ শুনেছি এবং একটি নুথ্যাচ পাখির মতো এদের বীজগুলিকে ভাঙতে দেখেছি। উত্তর আমেরিকায় মিঃ হিয়ার্নে দেখেছিলেন যে কৃষ্ণভল্লুকরা মুখ বিরাটভাবে খুলে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কাটতে এবং প্রায় তিমিদের মতোই জলের পতঙ্গদের ধরতে পারে।
যেহেতু আমরা নিজস্ব প্রজাতির এবং একই গণের অন্য প্রজাতিদের পক্ষে উপযুক্ত স্বভাবগুলি থেকে ভিন্ন স্বভাব সম্বলিত এককদের কোন কোন সময় লক্ষ্য করি, তাই আমাদের নিশ্চয় আশা করা উচিত যে এরূপ এককগুলি মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রমী স্বভাব সম্বলিত নূতন প্রজাতি সৃষ্টি করবে এবং তাদের দেহগঠন এদের টাইপের থেকে কম বেশি রূপান্তরিত হবে। এরূপ উদাহরণ প্রকৃতিতেও দেখা যাবে। কাঠঠোকরা পাখির। গাছে ওঠা এবং গাছের ছালের ফাটলের পতঙ্গ ধরার তুলনায় অভিযোজনের আরও আকর্ষণীয় উদাহরণ আর কী-ই বা হতে পারে? তথাপি উল্লেখ করা যায় যে উত্তর আমেরিকার অনেক কাঠঠোকরা পাখি ফল খায় এবং প্রসারিত ডানা সম্বলিত অন্য কাঠঠোকরা পাখিরা ডানার সাহায্যে পতঙ্গদের ধাওয়া করে। লা প্লাটার সমতলভূমিতে, যেখানে কদাচিৎ একটি গাছ জন্মায়, একটি কাঠঠোকরা পাখি বাস করে (কোলাপ্টেস ক্যাম্পেসট্রিস), যার সম্মুখে দুটি এবং পিছনে দুটি পায়ের আঙ্গুল, একটি লম্বা সূচাগ্র জিভ, লেজের সূচাগ্র পালক, পাখিটিকে একটি দণ্ডের উপর খাড়াবস্থায় দাঁড় করাতে যথেষ্ট শক্ত, কিন্তু প্রকৃত কাঠঠোকরার মতো এত শক্ত নয় এমন সূচাগ্র পালক এবং একটি শক্ত সোজা ঠোঁট থাকে। তবে ঠোঁটটি প্রকৃত কাঠঠোকরাদের মতো এত সোজা এবং এত শক্ত নয়, কিন্তু কাঠে গর্ত করার পক্ষে যথেষ্ট শক্ত। অতএব দেহগঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এই কাঠঠোকরা পাখিটি প্রকৃতই একটি কাঠঠোকরা পাখি। এমনকি রং, কর্কশ স্বর ও তরঙ্গায়িত উড্ডয়ন-এর মত তচ্ছ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিতেও আমাদের সাধারণ কাঠঠোকরা পাখির সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ রক্তসম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়; তথাপি শুধু আমার পর্যবেক্ষণ থেকে নয়, আজারার মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির পর্যবেক্ষণ থেকে আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে এরা কোন কোন বড় জেলার গাছে উঠতে পারে না, উঁচু জায়গায় গর্তে বাসা তৈরি করে। মিঃ হাডসন-এর পর্যবেক্ষণানুসারে, অন্য কয়েকটি জেলায় এই একই কাঠঠোকরারা প্রায়শই গাছে ওঠে এবং বাসার জন্য গাছের গুঁড়িতে গর্ত করে। এই গণের পরিবর্তিত স্বভাবদের অন্য একটি উদাহরণ হিসাবে আমি উল্লেখ করতে পারি যে মিঃ দে সসার মেক্সিকোর এক ধরনের কাঠঠোকরার বিবরণ দিয়েছেন যারা শস্যদানা সংগ্রহ করে রাখার জন্য শক্ত কাঠে গর্ত তৈরি করে।
পেট্রেল পাখিরা সাধারণতঃ বায়ুচর ও সামুদ্রিক পাখি, কিন্তু তিয়েরা দেল ফুয়েগোর শান্ত পরিবেশে, এদের সাধারণ স্বভাব, ডুব দেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা, সাঁতার কাটা ও উড্ডয়নের সময় ওড়ার পদ্ধতিতে পুফিনুরিয়া বেরার্ডি পাখিটিকে একটি অক অথবা গ্রেব পাখি হিসাবে যে কেউ ভুল করবে, তা সত্ত্বেও আসলে এটি একটি পেট্রেল, কিন্তু এদের দেহের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এদের নূতন জীবন-স্বভাবের জন্য ভীষণভাবে রূপান্তরিত হয়েছে; অন্যদিকে, লা প্লাটার কাঠঠোকরাদের দেহগঠন অত্যন্ত সামান্য পরিমাণে রূপান্তরিত হয়েছে। জলচর আউজেল-দের মৃত শরীর পরীক্ষা করার পর কোন প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন পর্যবেক্ষক এদের প্রায় জলচর স্বভাব সম্বন্ধে কখনও সন্দেহ করবে না; তথাপি থ্রাস গোত্রের অন্তর্গত এই পাখিরা জলের মধ্যে ডানা ব্যবহার করে এবং পায়ের পাতা দ্বারা পাথর আঁকড়ে ধরে ডুব দিয়ে শিকার ধরার ওপর জীবনধারণ করে। হাইমেনটেরাস পতঙ্গদের বিরাট বর্গের সমস্ত সদস্যরা স্থলচর হয়, কেবল প্রক্টেট্রাপেস গণ ছাড়া। স্যার জন লুবক এদের জলচর স্বভাব আবিষ্কার করেছিলেন। এরা প্রায়শই জলে প্রবেশ করে এবং পা ব্যবহার না করে কেবলমাত্র ডানার সাহায্যে জলে। ডুব দেয় এবং প্রায় চার ঘণ্টা ধরে জলের গভীরে অবস্থান করে, তবুও অস্বাভাবিক ধরনের স্বভাব অনুসারে এদের দেহগঠনের কোন রূপান্তর পরিলক্ষিত হয় না।
যিনি বিশ্বাস করেন যে আমরা এখন যেমন লক্ষ্য করি প্রত্যেক জীবকে তেমনভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে, তিনি সাময়িকভাবে বিস্মিত হবেন যখন তিনি স্বভাব ও দেহগঠনে মিল নেই এমন কোন প্রাণীকে দেখবেন। এর চেয়ে আরও সহজবোধ্য কী হতে পারে যে পাতিহাঁস এবং রাজহাঁসের লিপ্তপদ সাঁতারের জন্য সৃষ্টি হয়েছে? তথাপি উচ্চভূমি অঞ্চলে লিপ্তপদ রাজহাঁস আছে, যারা কদাচিৎ জলের দিকে যায়; এবং একমাত্র অডুবন ছাড়া আর কেউই পায়ের চারটি আঙ্গুলই যুক্ত ফ্রিগেট পাখিকে সমুদ্রে নামতে দেখেনি। পক্ষান্তরে, গ্রেব ও কুট-রা সঠিকভাবেই জলচর, যদিও এদের পায়ের আঙ্গুলের প্রান্তটি কেবল ঝিল্লি দ্বারা যুক্ত। এর চেয়ে আরও সহজ উদাহরণ কী হতে পারে যে এ্যালাটোরদের লম্বা পায়ের ঝিল্লিহীন আঙ্গুলগুলি জলাভূমি এবং ভাসন্ত উদ্ভিদের ওপর চলার জন্য সৃষ্ট হয়েছে? জলমুরগি এবং ল্যানড্রেলরা এই বর্গের সদস্য, তথাপি প্রথমটি কুটের মতো প্রায় জলচর এবং দ্বিতীয়টি কোয়েল অথবা প্যাট্রিজের মতো প্রায় স্থলচর। এসব ক্ষেত্রে এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে দেহগঠনের অনুরূপ পরিবর্তন ব্যতিরেকেই স্বভাবগুলি পরিবর্তিত হয়েছে। উচ্চভূমির রাজহাঁসের লিপ্তপদ ক্রিয়াকলাপে প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে, যদিও গঠনকাঠামোয় নয়। ফ্রিগেট পাখির পায়ের আঙ্গুলগুলির মধ্যে ছাঁকি জালের মতো ঝিল্লি থেকে বোঝা যায় যে দেহগঠনটি পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে।
পৃথক এবং অসংখ্য সৃষ্টিকার্যে যিনি বিশ্বাস করেন, তিনি বলতে পারেন যে এইসব ঘটনাগুলিতে সৃষ্টিকর্তা সন্তুষ্ট হয়ে একটি ধরনের জায়গায় অন্য ধরনকে সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু আমার মনে হয় এটা স্রেফ সম্ভ্রম-জাগানো ভাষায় একই কথাকে পুনর্বার বলা ছাড়া আর কিছুই নয়। যিনি অস্তিত্বের সংগ্রাম এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতিতে বিশ্বাস। করেন, তিনি স্বীকার করবেন যে, প্রত্যেক জীব সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে অনবরত চেষ্টা করছে, এবং হয় স্বভাবে অথবা দেহগঠনে কোন জীব যদি কখনও খুব অল্পভাবে। পরিবর্তিত হয় এবং এভাবে একই দেশে অন্য অধিবাসীদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, তাহলে তাদের নিজস্ব স্থান থেকে যতই পৃথক হোক না কেন, তারা উক্ত অধিবাসীদের জায়গা দখল করবে। অতএব এটি তার বিস্ময় উদ্রেক করবে না যে যারা স্থলে বাস। করে, কদাচিৎ জলে নামে, এমন লিপ্তপদ রাজহাঁস এবং ফ্রিগেট পাখিরা নিশ্চয়ই ছিল; জলাভূমির পরিবর্তে তৃণভূমিতে বসবাসকারী পায়ের লম্বা আঙ্গুলবিশিষ্ট কর্নক্রেকরা নিশ্চয়ই ছিল; যে অঞ্চলে কদাচিৎ গাছ জন্মায় এমন জায়গাতেও কাঠঠোকরারা নিশ্চয়ই ছিল; ডুবুরি গ্লাস পাখি ও ডুবুরি হাইমেনটেরা এবং অকদের স্বভাব সম্বলিত পেট্রেল পাখিরাও নিশ্চয়ই ছিল।
চরম উৎকর্ষতার এবং জটিলতার অঙ্গ
বিভিন্ন দূরত্বের জন্য ফোকাস ঠিক করার, আলোর বিভিন্ন পরিমাণ গ্রহণ করার, গোলকীয় এবং বর্ণালীসংক্রান্ত অপেরণ (aberration) সংশোধন করার জন্য এর সমস্ত অননুকরণীয় কৌশলগুলি সমেত চোখটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা সৃষ্ট হয়ে থাকবে– এটি কল্পনা বা ধারণা করা, আমার মতে, নিতান্তই হাস্যকর। যখন প্রথম বলা হয়েছিল যে সূর্য স্থির এবং পৃথিবী তার চতুর্দিকে পরিক্রমণ করে, তখন মানবজাতির সাধারণ জ্ঞান ঘোষণা করেছিল যে তত্ত্বটি ভুল। কিন্তু প্রত্যেক দার্শনিকই জানেন যে প্রাচীন প্রবাদবাক্য জনগণের মত, ভগবানের মত–একে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা যেতে পারে না। যুক্তি আমায় শেখায় যে, যদি একটি সরল ও অসম্পূর্ণ চোখ থেকে একটি জটিল ও সম্পূর্ণ চোখ পর্যন্ত অসংখ্য ক্রমবিন্যাসগত ধাপ বর্তমান আছে বলে দেখানো যায়, তাহলে প্রত্যেকটি ধাপ তার ধারণকারীর পক্ষে উপকারী হবে এবং বাস্তবেও এটিও সত্য; চোখটি যদি কখনও পরিবর্তিত হয় এবং পরিবর্তনগুলি আনুবংশিক বা বংশগত হয়–বাস্তবে ঠিক তা-ই ঘটে। এবং এরূপ পরিবর্তনগুলি যদি জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে যে কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে উপকারী হয়, একটি সম্পূর্ণ এবং জটিল চোখ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সৃষ্টি হতে পারত, যদিও আমাদের কল্পনায় অলঙ্ঘ্য, তখন বিশ্বাস করার অসুবিধাকে তত্ত্বটির পরাভব হিসাবে বিবেচনা করা উচিত হবে না। কেমন করে একটি নার্ভ (স্নায়ু) আলোয় সুবেদী হয়, কেমন করে জীবন সৃষ্টি হয়েছে, তা এর তুলনায় কদাচিৎ আমাদের আরও বিচলিত করে; কিন্তু আমি উল্লেখ করতে পারি যে, যেহেতু স্নায়ুহীন কতিপয় নিম্নতম জীব আলো অনুভব করতে সমর্থ, তাই এটি অসম্ভব বলে নয় যে এদের সারকোডে (sarcode) কোন সুবেদী উপাদান পুঞ্জীভূত হয়ে থাকবে এবং এই বিশেষ সংবেদনশীলতা গুণ সমেত নার্ভগুলি বিকশিত হয়ে থাকবে।
যে কোন প্রজাতির কোন অঙ্গ যে সব ক্রমবিন্যাসগত ধাপের মাধ্যমে নিখুঁত হয়েছে, তা অনুসন্ধান করার জন্য তার বংশানুক্রমিক পূর্বপুরুষদেরই কেবল লক্ষ্য করা উচিত। কিন্তু এটি মোটেই সম্ভবপর নয় বলে ক্রমবিন্যাসগত ধাপগুলি দেখার জন্য একই গোষ্ঠীর অন্য প্রজাতি এবং গণগুলিকে অর্থাৎ একই পিতামাতা আকার থেকে উদ্ভূত জ্ঞাতিসম্পর্কবিশিষ্ট বংশধরদের লক্ষ্য করতে বাধ্য হই আমরা। তবে ভিন্ন শ্রেণীগুলির একই অঙ্গটির অবস্থা থেকেও কখনও কখনও সেইসব ক্রমবিন্যাসগত ধাপসমূহের কথা জানা যেতে পারে, যেগুলির মাধ্যমে এটি নিখুঁত হয়ে উঠেছে।
সরলতম অঙ্গটি, যাকে একটি চোখ বলা যেতে পারে, তা একটি চক্ষু-স্নায়ু দিয়ে তৈরি, যা রঞ্জক কোষসমূহ দ্বারা বেষ্টিত এবং ঈষদচ্ছ ত্বক দিয়ে ঢাকা, কিন্তু এতে কোন লেন্স অথবা অন্য প্রতিসারক বস্তু নেই। এম. জোর্ডিয়ান-এর মতানুসারে, আমরা এমনকি এক ধাপ নিচে একে রাখতে পারি এবং রঞ্জক কোষগুলির পুঞ্জ দেখতে পারি যা কোন স্নায়ু ছাড়া আপাততঃ দৃষ্টির অঙ্গ হিসাবে কাজ করে এবং শুধুমাত্র একটি সার্কডিক (sarcodic) কলার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। উপরোক্ত সরল প্রকৃতির চোখগুলি স্পষ্ট দৃষ্টিশক্তির অধিকারী হয় না এবং অন্ধকার ও আলোকের মধ্যে পার্থক্য করতেই শুধুমাত্র ব্যবহৃত হয়। কোন কোন তারা মাছে, স্নায়ুটিকে বেষ্টনকারী রঞ্জক পদার্থের স্তরে ছোট ছোট গর্তগুলি ঈষদচ্ছ আঠালো নরম পদার্থ দ্বারা পূর্ণ, যা উচ্চতর প্রাণীদের কর্ণিয়ার মতো একটি উত্তল পৃষ্ঠ সৃষ্টি করে বিষয়টি সম্পর্কে এম. জোর্ডিয়ান বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে এটি প্রতিবিম্ব তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় না, বরং উজ্জ্বল আলোকরশ্মিগুলিকে কেন্দ্রীভূত করতে এবং আরও সহজভাবে অনুভব করতে সাহায্য করে। আলোকরশ্মিদের এই কেন্দ্রীভবন থেকে আমরা একটি প্রকৃত, প্রতিবিম্ব সৃষ্টিকারী চোখ সৃষ্টির দিকে প্রথম এবং সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ লাভ করি; কারণ কতিপয় নিম্নতর প্রাণীর শরীরের গভীরে অবস্থিত ও কতিপয় প্রাণীর শরীরের উপর পৃষ্ঠে অবস্থিত অপটিক স্নায়ুর উন্মুক্ত প্রান্তটি কেন্দ্রীভবন যন্ত্রের সঠিক দূরত্বে অবস্থিত থাকলে তার ওপর প্রতিবিম্ব তৈরি হবে।
রঞ্জক বস্তু দ্বারা আবৃত একটি দৃষ্টিগত স্নায়ু বিরাট আর্টিকুলাটা (Articulata) শ্রেণীতে আমরা দেখি। রঞ্জক বস্তুটি অনেক সময় চোখের মণির মতো বস্তু সৃষ্টি করে, কিন্তু লেন্স অথবা দৃষ্টি সংক্রান্ত তান্য কলাকৌশল এতে থাকে না। পতঙ্গদের ক্ষেত্রে এমন জানা গিয়েছে যে এদের বিরাট পুঞ্জাক্ষির কর্ণিয়ার উপর অসংখ্য ফ্যাসেট (facet) প্রকৃত লেন্সের কাজ করে এবং শঙ্কগুলি অদ্ভুতভাবে রূপান্তরিত নার্ভ ফিলামেন্ট দিয়ে তৈরি। কিন্তু আর্টিকুলাটা শ্রেণীতে এইসব অঙ্গ এত বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় যে মুলার পুঞ্জীভূত সরল চোখদের একসময় সাতটি উপবিভাগ সমেত তিনটি প্রধান শ্রেণী এবং একটি চতুর্থ প্রধান শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছিলেন।
নিম্নতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে গঠনের ব্যাপক, বিচিত্র ও ক্রমবিন্যাসগত ধাপ সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে প্রদত্ত ঘটনাগুলি, এবং ইতিমধ্যে বিলুপ্তদের তুলনায় যাবতীয় জীবন্ত আকাররা কত অল্প সংখ্যক হয়, এসব যখন আমরা স্মরণ করি তখন বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় না যে রঞ্জক পদার্থ দ্বারা আবৃত এবং স্বচ্ছ ঝিল্লি দ্বারা সজ্জিত একটি দৃষ্টিনার্ভের সরল অঙ্গটিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি দৃষ্টিযন্ত্রে রূপান্তরিত করে থাকতে পারে, যা আর্টিকুলাটা শ্রেণীর যে কোন সদস্যের দৃষ্টিযন্ত্রের মতোই নিখুঁত হয়।
কেউ যদি গ্রন্থটি আগাগোড়া পড়ার পর লক্ষ্য করেন যে অনির্ণেয় অসংখ্য ঘটনাকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে রূপান্তরের তত্ত্বের দ্বারা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তাহলে তিনি আরও একটু পড়বেন এবং আরও পড়তে ইতস্তত করবেন না, এবং তখন তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে ঈগলের চোখের মতো এত নিখুঁত একটি অঙ্গ এভাবে সৃষ্টি হবে, যদিও এক্ষেত্রে সংক্রমণগত ধাপগুলি তার জানা নেই। অনেকে বলেন যে চোখকে রূপান্তরিত করার জন্য এবং একটি নিখুঁত যন্ত্র হিসেবে চোখকে সুংরক্ষণ করার জন্য অনেক পরিবর্তন যুগপৎ ঘটাতে হবে, যা প্রাকৃতিক নির্বাচন মারফৎ করা যেতে পারে না বলেই মনে হয়। কিন্তু গৃহপালিত প্রাণীদের পরিবৃত্তি সংক্রান্ত আমার গবেষণাকাজে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি, এটি মনে করা আবশ্যিক নয় যে রূপান্তরগুলি সকলে যুগপৎ ঘটেছিল, যদিও এরা অতিশয় অল্প এবং পর্যায়ক্রমিক ছিল। বিভিন্ন ধরনের রূপান্তরসমূহ একই সাধারণ উদ্দেশ্যও সাধন করবে। যেমন মিঃ ওয়ালেস মন্তব্য করেছেন, “একটি লেন্সের ফোকাস অতি হ্র অথবা অতি দীর্ঘ হলে, বক্রতার পরিবর্তন অথবা ঘনত্বের পরিবর্তন দ্বারা তাকে সংশোধন করা যেতে পারে; যদি বক্রতাটি অনিয়মিত হয় এবং রশ্মিগুলি একটি বিন্দুতে আপতিত না হয়, তাহলে বক্রতার যে কোন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সুষমতার উন্নতি ঘটবে। অতএব কনীনিকাটির সংকোচন এবং চোখটির মাংসপেশীর বিচলনের কোনটিই দৃষ্টিশক্তির জন্য অপরিহার্য নয়, বরং প্রয়োজনীয় হল দৃষ্টিশক্তির উন্নতিসাধন যা যন্ত্রটি সৃষ্টি যে কোন ধাপে যুক্ত হয়ে ও নিখুঁত হয়ে থাকতে পারে।” প্রাণীজগতের সর্বোচ্চ বিভাগ তথা মেরুদণ্ডী শ্রেণীর মধ্যে, আমরা একটি অত্যন্ত সরল চোখ থেকে শুরু করতে পারি যে এটি ল্যান্সলেট মাছের মতো একটি স্নায়ু এবং চারিদিকে রঞ্জক পদার্থ সমেত স্বচ্ছ চামড়ার একটি ছোট থলি দ্বারা তৈরি, কিন্তু এটিতে অন্য কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। মাছ এবং সরীসৃপদের ক্ষেত্রে, ওয়েনের বক্তব্য হচ্ছে, ডায়োপট্রিক (dioptric) অঙ্গগুলির ক্রমবিন্যাসমতো বিস্তার অতিশয় বিরাট হয়। এটি একটি তাৎপর্যমূলক ঘটনা যে ভিরচোউ-এর মতো সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞের মতে, এমনকি মানুষের মধ্যেও চামড়ার একটি থলির মতো ভাজে অবস্থিত বহিঃত্বক কোষগুলির একটি পুঞ্জীভবন দ্বারা সুন্দর স্ফটিকতুল্য লেন্সটি ক্রুণটিতে সৃষ্টি হয়েছে এবং অক্ষিলেন্সের পিছনে তরল পদার্থটি অন্তঃত্বকীয় ভূণকলা থেকে সৃষ্ট। হয়েছে। যাই হোক না কেন, এটির সমস্ত বিস্ময়কর অথচ সম্পূর্ণ নিখুঁত নয় এমন বৈশিষ্ট্যগুলি সমেত চোখটির গঠন সম্পর্কে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এটি অপরিহার্য যে যুক্তির উচিত কল্পনাকে জয় করা। কিন্তু যারা প্রাকৃতিক নির্বাচন সূত্রটিকে পূর্ণাকারে প্রয়োগ করতে ইতস্ততঃ করেছে, তাদের এই মনোভাবে আশ্চর্যান্বিত হয়ে আমি আরও বেশি অসুবিধা অনুভব করেছি।
একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সঙ্গে চোখের তুলনা পরিহার করা মোটেই সম্ভব নয়। আমরা জানি যে এই যন্ত্রটি সর্বোচ্চ মানবগুণের দীর্ঘ প্রচেষ্টার দ্বারা নিখুঁত হয়েছে; এবং স্বাভাবিকভাবেই আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে চোখও কিছুটা অনুরূপ প্রক্রিয়া দ্বারাই সৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি কি দুঃসাহসিক নয়? আমাদের মনে করার কোন অধিকার আছে কি যে সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করেন? একটি অপটিক্যাল যন্ত্রের সঙ্গে চোখের তুলনা করতে হলে নিচে অবস্থিত আলো সুবেদী একটি স্নায়ু এবং ফাঁকা জায়গায় তরল পদার্থ পূর্ণ, এমন একটি স্বচ্ছ কলার স্তর কল্পনায় আনতে হবে এবং তারপর মনে করতে হবে যে এই স্তরের প্রতিটি অংশ ঘনত্বে মন্থরভাবে অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে, যাতে করে পরস্পরের থেকে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত বিভিন্ন ঘনত্বের এবং পুরুত্বের স্তরগুলি পৃথক হয় এবং স্তরের পৃষ্ঠগুলি আকারে মন্থরভাবে পরিবর্তিত হয়। আমাদের আরও মনে করা উচিত যে প্রাকৃতিক নির্বাচন অথবা যোগ্যতমের উদ্বর্তন নামে একটি শক্তি আছে, যা সর্বদা স্বচ্ছ স্তরসমূহের প্রত্যেক অল্প পরিবর্তনকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে এবং প্রত্যেকটিকে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করছে, যা আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে কোন উপায়ে অথবা যে কোন মাত্রায় একটি স্পষ্ট প্রতিবিম্ব সৃষ্টির চেষ্টা করে। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে যন্ত্রটির প্রত্যেক নূতন অবস্থা লক্ষগুণ বৃদ্ধি পায়; একটি ভাল প্রতিবিম্ব তৈরি হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকে সংরক্ষিত হয় এবং তারপর পুরনোগুলি বিনষ্ট হয়। জীবন্ত শরীরে পরিবৃত্তি অল্প রদবদল ঘটাবে, উৎপাদন প্রায় সাংখ্যাতীতভাবে এদের সংখ্যাবৃদ্ধি করবে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন অভ্রান্ত দক্ষতার সঙ্গে উন্নতটিকে চয়ন করবে। এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলুক, এবং প্রত্যেক বৎসরে অনেক ধরণের লক্ষ লক্ষ এককদের উপর এই প্রক্রিয়াটি চলুক; এবং আমরা কি বিশ্বাস করতে পারি না যে একটি জীবন্ত অপটিক্যাল যন্ত্র কাঁচের তৈরী ঐরূপ একটি যন্ত্রের তুলনায় উৎকৃষ্টতর হিসেরে এইভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে, যেভাবে সৃষ্টিকর্তার কাজ মানুষের কাজের থেকে উৎকৃষ্টতর হয়?
সংক্রমণ বা উত্তরণের প্রণালী
পরীক্ষা বা যুক্তির সাহায্যে যদি প্রমাণ করা যেতে পারত যে একটি জটিল অঙ্গ, অসংখ্য ধারাবাহিক ও অল্প রূপান্তরগুলির দ্বারা সম্ভবতঃ সৃষ্টি হয়নি, তাহলে আমার তত্ত্বটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ত। কিন্তু এরকম কোন ঘটনা আমি লক্ষ্য করিনি। নিঃসন্দেহে এমন অনেক অঙ্গ আছে যাদের সংক্রমণগত ধাপগুলি আমরা জানি না। আরও বিশেষভাবে যদি আমরা অতি বিচ্ছিন্ন প্রজাতিদের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে আমরা তত্ত্বানুযায়ী তাদের কেন্দ্র করে অনেক বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। অথবা, একটি শ্রেণীর সমস্ত সদস্যদের কোন সাধারণ অঙ্গকে ধরা যায়, কারণ এক্ষেত্রে অঙ্গটি নিশ্চয়ই বহু অতীতে প্রথম সৃষ্ট হয়ে থাকবে, যখন থেকে শ্রেণীটির সমস্ত সদস্যরা বিকশিত হয়েছে; এবং অঙ্গটির দ্বারা অতিক্রান্ত সংক্রমণগত ধাপগুলি আবিষ্কার করার জন্য অতি আদিম পূর্বপুরুষীয় আকারগুলির দিকে লক্ষ্য করা উচিত, যারা বহু পূর্বে বিলুপ্ত হয়েছিল।
এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে আমাদের অতিশয় সতর্ক হতে হবে যে একটি অঙ্গ কোন প্রকারের সংক্রমণগত ধাপ দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে না। নিম্নতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যেখানে একই অঙ্গ একই সময়ে সামগ্রিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন কাজ সম্পাদন করে; এরূপে ড্রাগন মাছির লার্ভা ও কোবাইটেস মাছের পৌষ্টিক নালী শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, পরিপাক করে এবং মল নিঃসরণ করে। হাইড্রা প্রাণীটির, ভিতরের অংশ বের হয়ে আসতে পারে এবং তখন বাইরের পৃষ্ঠ পরিপাকক্রিয়া সম্পাদন করে ও পাকস্থলী শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে, যদি কোন সুফল বা উপকার অর্জিত হয়ে থাকে, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন সমগ্র অঙ্গটিকে বা তার কোন বিশেষ অংশকে শুধুমাত্র একটি প্রক্রিয়ার জন্য বিশিষ্ট করে থাকবে, যা আগের দুটি প্রক্রিয়ার বদলে একটি প্রক্রিয়া সম্পাদন করত; এবং এভাবে অজানা ধাপগুলি দ্বারা এর স্বভাবে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন হয়ে থাকবে। এমন অনেক উদ্ভিদ আছে যারা নিয়মিতভাবে একই সময়ে ভিন্ন গঠনের ফুল সৃষ্টি করে; এবং এসব উদ্ভিদরা যদি শুধুমাত্র একই প্রকার ফুল সৃষ্টি করত, তাহলে প্রজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একটি বিরাট পরিবর্তন হঠাৎ ঘটে থাকবে। তবে এটি সম্ভবপর যে একই উদ্ভিদের দুই ধরনের ফুল সূক্ষ্ম ক্রমিক ধাপগুলির দ্বারা প্রথমে পৃথকীকৃত হয়েছিল, যেটি অন্য কিছু ক্ষেত্রেও অনুসৃত হতে পারে।
আবার, দুটি অতি ভিন্ন আকারের দুটি স্বতন্ত্র অঙ্গ অথবা একই অঙ্গ একই এককটিতে যুগপৎ একই কার্য সম্পাদন করতে পারে এবং এটি সংক্রমণের বা উত্তরণের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ফুলকা অথবা কানকো সম্বলিত মাছেরা জলে দ্রবীভূত বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে, একই সঙ্গে এরা পটকা বা ফটকার সাহায্যে মুক্ত বাতাস শ্বাসপ্রশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করে, এই পটকা বা ফটকাটি রক্তসংবহন ভেদক পদার্থে বিভক্ত ও বাতাস সরবরাহের জন্য এদের একটি বায়ুনালী আছে। উদ্ভিদজগৎ থেকে অন্য একটি উদারণ দেওয়া যাক। উদ্ভিদরা তিনটি ভিন্ন উপায়ে আরোহণ করে-সর্পিলভাবে পেঁচিয়ে, সুবেদী আকর্ষ দ্বারা একটি অবলম্বনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরে এবং বায়বীয় মূলিকার দ্বারা। এই তিনটি পদ্ধতি সাধারণতঃ তিনটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীতে দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু অল্প কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে দুটি অথবা তিনটি পদ্ধতিও দেখতে পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে, অন্য অঙ্গটির রূপান্তর প্রক্রিয়া চলার সময় সমস্ত প্রকার কাজ করার জন্য দুটির মধ্যে একটি অঙ্গ সহজেই রূপান্তরিত এবং নিখুঁত হয়ে থাকবে; এবং তখন এই অন্য অঙ্গটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অন্য কোন উদ্দেশ্যের জন্য রূপান্তরিত হয়ে থাকবে অথবা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে থাকবে।
মাছের পটকা একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, কারণ এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্পষ্টভাবে আমাদের দেখায় যে জলে ভাসার মতো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সৃষ্ট একটি অঙ্গ একেবারে ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রূপান্তরিত হতে পারে, যেমন নিশ্বাস প্রশ্বাসের জন্য। পটকাটি কোন কোন মাছের শ্রবণ অঙ্গের সহায়ক হিসাবেও কাজ করে। সমস্ত শারীরতত্ত্ববিদরা স্বীকার করেন যে পটকাটি মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ফুসফুসের সঙ্গে তুলনায় অবস্থানে ও গঠনে সমসংস্থ হয় অথবা “আদর্শরূপে অনুরূপ” হয়। অতএব সন্দেহ করার কোন কারণ নেই যে পটকা প্রকৃতই ফুসফুসে বা শুধুমাত্র নিশ্বাস-প্রশ্বাসের একটি অঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে।
এই মতানুসারে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে প্রকৃত ফুসফুস সম্বলিত সমস্ত মেরুদণ্ডী প্রাণীরা একটি আদিম এবং অজ্ঞাত আদিরূপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যাদের একটি ভাসমান যন্ত্র বা পটকা ছিল। এই সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলি সম্পর্কে ওয়েনের চমৎকার বর্ণনা থেকে এভাবে আমরা অদ্ভুত ঘটনাটি বুঝতে পারি যে খাদ্য ও পানীয়ের প্রত্যেকটি কণা যা আমরা খাই, তাদের শ্বাসনালীর ক্ষুদ্র রন্ধ্র অতিক্রম করতে হয়, ফুসফুসে এদের প্রবেশেরও ঝুঁকি থাকে, কিন্তু চমৎকার কৌশলে শ্বাসরটি বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চতর মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ফুলকা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু ভূণের গলার পার্শ্বের সরু গর্ত এবং ধমনীগুলির জালির মতো গতিপথ এখনও পর্যন্ত এদের পূর্বের অবস্থান চিহ্নিত করে। কিন্তু এটি কল্পনাসাধ্য যে এখন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত ফুলকা কোন স্বতন্ত্র উদ্দেশ্যের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ক্রমশ কাজ করে থাকতে পারত। উদাহরণস্বরূপ, ল্যান্ডোইস দেখিয়েছেন যে পতঙ্গদের ডানাগুলি শ্বাসনালী থেকে উদ্ভূত হয়েছে; সেজন্য এটি একান্তই সম্ভবপর যে এই বিরাট শ্রেণীতে কেবল শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ব্যবহৃত অঙ্গ গুলি প্রকৃতই উড্ডয়নের অঙ্গসমূহে রূপান্তরিত হয়েছে।
অঙ্গগুলির সংক্রমণ বা উত্তরণগত অবস্থাসমূহ বিচার-বিবেচনা করে, এক কাজ থেকে অন্য কাজে রূপান্তরের সম্ভাবনা মনে রাখার পক্ষে এটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমি আর একটি উদাহরণ দেব। প্রেডানকুলেটেড বা পদযুক্ত সিরিপেডদের চর্মে দুটি সূক্ষ্ম ভাঁজ থাকে, যাকে আমি ওভিজেরাস ফ্রেনা বলি, এবং যা নিঃসৃত আঠালো রস দ্বারা ততক্ষণ পর্যন্ত ডিমগুলিকে ধরে রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত না থলির মধ্যে এগুলি ফুটে বাচ্চা হয়। এই সিরিপেডদের কোন ফুলকা নেই, ছোট ফ্রেনাটি সমেত শরীরের এবং থলির সমগ্র পৃষ্ঠ শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে, ব্যালানিডা অথবা অনড় বা। পদহীন সিরিপেডদের কোন ওভিজেরাস ফ্রেনা নেই, সুবেষ্টিত খোলকের মধ্যে, থলির নিচে ডিমগুলি মুক্তভাবে থাকে; ফ্রেনার মত একই আপেক্ষিক অবস্থানে এদের অনেক ভাঁজ সম্বলিত ঝিল্লি থাকে, যা থলি ও শরীরের সংবহনশীল ল্যাকুনার (ফাঁক বা গহ্বর) সঙ্গে স্বাধীনভাবে সংযোগ রক্ষা করে এবং যাকে সমস্ত প্রকৃতিবিদরা ফুলকা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আমি মনে করি কেউ এমন তর্ক করবেন না যে একটি গোত্রের ওভিজেরাস ফ্রেনা অন্য গোত্রের ফুলকার সঙ্গে সমপ্রস্থ; প্রকৃতপক্ষে এরা ক্রমে ক্রমে পরস্পরে রূপান্তরিত হয়। অতএব সন্দেহ করা উচিত নয় যে চামড়ার দুটি ছোট্ট ভাঁজ, যা প্রথমে ওভিজেরাস ফ্রেনা হিসাবে কাজ করেছে, কিন্তু যা এরূপে শ্বাসপ্রশ্বাসে অল্প সাহায্য করেছে, সোজাভাবে এর আকার বৃদ্ধি ও এদের আঠালো লালাগ্রন্থির বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা ক্রমশ ফুলকাতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি সমস্ত পেডানকুলেটেড বা পদযুক্ত সিরিপেডরা বিলুপ্ত হত এবং সেসাইল অথবা পদহীন বা অনড় সিরিপেডদের তুলনায় আরও বেশি পরিমাণে লুপ্ত হওয়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকত, কেউ কি কখনও কল্পনা করবে যে এই পরবর্তী গোত্রের ফুলকারা থলি থেকে ডিমগুলি বের হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার অঙ্গ হিসেবে পূর্বেই অবস্থিত ছিল?
প্রজননকালের ত্বরণ বা মন্দনের মাধ্যমে সংক্রমণ বা উত্তরণের আরও একটি, সম্ভবপর প্রণালী রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস-এর অধ্যাপক কোপ এবং অন্যরা সম্প্রতি এটি জোরের সঙ্গে বলেছেন। এটি জানা গেছে যে নিখুঁত বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জিত হবার পূর্বে কতিপয় প্রাণী অতি প্রাথমিক বয়সে প্রজনন-ক্ষমতার অধিকারী হয়; এবং এই ক্ষমতা যদি একটি প্রজাতিতে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়, তাহলে এটি সম্ভবপর যে বিকাশের বয়স্ক দশায় একদিন না একদিন তা অন্তর্হিত হবে; এবং এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লার্ভাটি যদি পূর্ণবয়স্ক আকারটির থেকে বেশি পৃথক হয়, তাহলে প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বিরাটভাবে পরিবর্তিত হবে ও হ্রাস পাবে। আবার, বহু সংখ্যক প্রাণী পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর তাদের প্রায় সমগ্র জীবনকালব্যাপী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হতে থাকে। যেমন, স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে করোটির আকার প্রায়শই বেশি বেশি করে পরিবর্তিত হয়। এ বিষয়ে ডঃ মুরি শীল প্রাণীদের সম্বন্ধে চমৎকার কিছু উদাহরণ দিয়েছেন। প্রত্যেকেই জানেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে পুরুষ হরিণদের শিংগুলি বেশি বেশি করে শাখায় বিভক্ত হয় এবং কোন কোন পাখির পালকগুলি আরও সূক্ষ্মভাবে বিকশিত হয়। অধ্যাপক কোপ বলেন যে কোন কোন লিজার্ডদের। (সরীসৃপ) দাঁতগুলি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকারে অতিশয় পরিবর্তিত হয়; ফ্রিজ মুলার লিপিবদ্ধ করেছেন যে অনেক ক্রাস্টেসিয়া বা খোলকী প্রাণী পূর্ণতাপ্রাপ্তির পর, শুধুমাত্র তুচ্ছ অঙ্গের নয়, বরং কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গেরও নূতন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে, যদি প্রজননকালের বয়স হ্রাস পায়, প্রজাতির বৈশিষ্ট্যটি, অন্ততঃ তার পূর্ণবয়সাবস্থায়, রূপান্তরিত হবে; অথবা এমনটাও অসম্ভব নয় যে বিকাশের পূর্বে ও প্রাথমিক ধাপগুলি কয়েকটি ক্ষেত্রে ত্বরান্বিত হবে এবং অবশেষে লুপ্ত হবে। সংক্রমণের বা উত্তরণের এই কিছুটা আকস্মিক প্রণালীর মাধ্যমে প্রজাতিগুলি প্রায়শই অথবা কখনও রূপান্তরিত হয়েছে কিনা, এ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণা নেই। কিন্তু যদি তা ঘটে থাকে, তাহলে এটি সম্ভব যে পূর্ণবয়স্ক ও তরুণদের মধ্যে এবং পূর্ণবয়স্ক ও প্রবীনদের মধ্যে পার্থক্যগুলি প্রাক্কালিক অবস্থায় ক্রমিক ধাপ দ্বারা অর্জিত হয়েছিল।
প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটির বিশেষ প্রতিবন্ধকসমূহ
যে কোন অঙ্গ ধারাবাহিক, অল্প, সংক্রমণগত ধাপসমূহ দ্বারা সৃষ্ট হয়নি–এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যদিও আমরা অতিশয় সতর্ক হব, তথাপি সন্দেহাতীতভাবে প্রতিবন্ধকের গুরুতর ঘটনাগুলি ঘটে বা দৃষ্ট হয়ে থাকে।
সবচেয়ে গুরুতরগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে ক্লীব পতঙ্গদের সম্পর্কে, যাদের দেহগঠন পুরুষ অথবা উর্বর স্ত্রীদের থেকে প্রায়শই ভিন্নভাবে গঠিত হয়, এই বিষয়টি পরবর্তী অধ্যায়ে বিবেচিত হবে। মাছেদের বিদ্যুৎবাহী অঙ্গগুলি বিশেষ প্রতিবন্ধকের অন্য একটি ঘটনা উপস্থিত করে; কারণ এটি অনুমান করা অসম্ভব যে কোন্ কোন্ ধাপগুলি দ্বারা এইসব বিস্ময়কর অঙ্গ সৃষ্ট হয়েছে। কিন্তু এটি বিস্ময়কর নয়, কারণ এর ব্যবহার কী তা আমরা এখনও জানি না। জিমনোটাস ও টর্পেডোতে এগুলি নিঃসন্দেহেই আত্মরক্ষার শক্তিশালী উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং সম্ভবতঃ শিকার ধরার জন্যও ব্যবহৃত হয়; তথাপি, ম্যাটেউসির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এমন কি যখন প্রাণীটি বিশেষভাবে উত্তেজিত হয়, তখনও রে মাছের লেজে অনুরূপ একটি অঙ্গে অতি অল্প বিদ্যুৎ থাকে; এটি এতই অল্প যে উপরোক্ত উদ্দেশ্যের জন্য কদাচিৎ ব্যবহৃত হয়। অধিকন্তু এইমাত্র উল্লিখিত অঙ্গটি ছাড়া, ডঃ আর. ম্যাকডোনেল দেখিয়েছেন যে রে মাছের মাথার কাছে আর একটি অঙ্গ থাকে যা বিদ্যুৎবাহী নয়, বরং যা টর্পেডো মাছে বিদ্যুৎ ব্যাটারীর প্রকৃত সমসংস্থ বলে মনে হয়। এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত যে এইসব অঙ্গ ও সাধারণ মাংসপেশীর মধ্যে আভ্যন্তরীণ গঠনে, স্নায়ুবিন্যাসে এবং বিভিন্ন বিকারক দ্বারা প্রক্রিয়াগত উপায়ে একটি ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। এটিও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা উচিত যে মাংসপেশীর সংকোচন ও তড়িৎ নির্গত হওয়া একই সঙ্গে ঘটে; ডঃ র্যাডক্লিফ জোরের সঙ্গে বলেন, “বিশ্রামের সময় টর্পেডো মাছের বৈদ্যুতিক অঙ্গে মাংসপেশী ও স্নায়ুতে বিশ্রামের সময় যে রকম বিদ্যুৎপ্রবাহ থাকে সেই রকম বিদ্যুৎপ্রবাহ থাকে বলে মনে হয়, এবং টর্পেডো মাছের বিদ্যুৎপ্রবাহ, অদ্ভুত হওয়ার পরিবর্তে, প্রবাহের শুধুমাত্র অন্য একটি ধরনের হতে পারে যা মাংসপেশী ও মোটর নার্ভের প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে এর বেশি ব্যাখ্যায় আমরা যেতে পারি না, কারণ এইসব অঙ্গের ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অতি অল্প জানি, এবং যেহেতু বর্তমানের ইলেকট্রিক মাছদের পূর্বপুরুষদের স্বভাব এবং দেহগঠন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, সেহেতু এটি বলা নিতান্তই দুঃসাহসিক হবে যে কোন ব্যবহারযোগ্য সংক্রমণ বা উত্তরণ সম্ভবপর নয় যার দ্বারা এইসব অঙ্গগুলি ক্রমশ বিকশিত হয়ে থাকবে।
প্রথমে মনে হয় এইসব অঙ্গগুলি অন্য একটি এবং আরও গুরুতর প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে; কারণ এটি প্রায় এক ডজন ধরনের মাছেদের ক্ষেত্রে ঘটে, যাদের মধ্যে কয়েকটি দূর সম্পর্কিত। যখন একই অঙ্গ একই শ্রেণীর কতিপয় সদস্যের মধ্যে দেখা যায়, বিশেষভাবে যদি সদস্যদের অতিশয় ভিন্ন জীবন-স্বভাব থাকে, তখন এর উপস্থিতি একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে বলে ধরে নিতে পারি আমরা; এবং সদস্যদের কয়েকটিতে এর অনুপস্থিতি অব্যবহার অথবা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে লুপ্ত হওয়ার জন্য ঘটে। অতএব, যদি বৈদ্যুতিক অঙ্গগুলি কোন একটি আদিম পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়, তাহলে আমরা আশা করতে পারতাম যে সমস্ত বিদ্যুৎবাহী মাছ বিশেষভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকবে; কিন্তু এটি ঘটনাটি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অথবা ভূতত্ত্ব মোটেই এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে না যে অধিকাংশ মাছে পূর্বে বিদ্যুৎবাহী অঙ্গগুলি ছিল এবং যাদের রূপান্তরিত বংশধরেরা এখন হারিয়ে গেছে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে কতিপয় মাছে বৈদ্যুতিক অঙ্গ থাকে, এগুলি শরীরের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত এবং এদের গঠনকৌশলও ভিন্ন, যেমন প্লেটগুলির বিন্যাস, এবং প্যাসিনির মতে, প্রক্রিয়া অথবা পদ্ধতি দ্বারা যাদের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হয়–এবং শেষতঃ, বিভিন্ন উৎস থেকে আগত স্নায়ুগুলির অবস্থান, এবং সম্ভবতঃ এটি যাবতীয় পার্থক্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, বিদ্যুৎবাহী অঙ্গ সম্বলিত কতিপয় মাছে এগুলিকে সমসংস্থ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না, বরং কার্যকারিতায় অনুরূপ বলা যেতে পারে। ফলস্বরূপ, মনে করার কোন কারণ নেই যে এরা এটি কোন সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছে; কারণ তা যদি হত তাহলে এরা সমস্ত বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ হত। এভাবে কতিপয় দূরসম্পকীয় প্রজাতিতে উদ্ভূত একটি অঙ্গের, আপাতভাবে একই প্রতিবন্ধক দূরীভূত হয়, কিন্তু যেটি আরও কম অথবা বিরাট প্রতিবন্ধক উপস্থিত করে; যেমন, এসব অঙ্গগুলি কোন্ কোন্ ক্রমিক ধাপগুলির দ্বারা মাছেদের প্রত্যেক ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিকশিত হয়েছে।
ব্যাপকভাবে ভিন্ন গোত্রের অন্তর্গত অল্প কয়েকটি পতঙ্গের শরীরের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত আলো উৎপাদনকারী অঙ্গগুলি, আমাদের অজ্ঞতার বর্তমান অবস্থায়, বিদ্যুৎবাহী অঙ্গগুলির মতো প্রায় হুবহু একই প্রতিবন্ধক উপস্থিত করে। অনুরূপ অন্য অনেক ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে; উদাহরণস্বরূপ, উদ্ভিদগুলিতে; আঠালো গ্রন্থিসমেত বৃন্তে অবস্থিত পরাগরেণুপুঞ্জের অতি অদ্ভুত কলাকৌশল অর্কিস ও অ্যাসক্লেপিয়াস গণগুলিতে আপাততভাবে একইরকম হয়–সপুষ্পক উদ্ভিদসমূহের মধ্যে গণগুলি যতদূর সম্ভব দূরবর্তী হয়; কিন্তু এখানে আবার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সমসংস্থ নয়। দেহগঠনগত মানদণ্ডে পরস্পরের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ও সদৃশ অদ্ভুত অঙ্গগুলি দ্বারা সজ্জিত জীবদের সব ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে যদিও অঙ্গগুলির সাধারণ আকৃতি এবং কার্যপ্রক্রিয়া একই রকম হতে পারে, তথাপি এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য সর্বদাই আবিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন, সেফালোপড়া বা কাটল মাছ এবং মেরুদণ্ডী প্রাণীদের চোখগুলি বিস্ময়করভাবে একইরকম বলে মনে হয়; এবং এরূপ ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলিতে এই সদৃশতার কোন অংশ একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতির জন্য হতে পারে না। মিঃ মিভার্ট এই বিষয়টিকে একটি বিশেষ প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু তার যুক্তির প্রকৃত অর্থ বুঝতে আমি অসমর্থ। দৃষ্টির জন্য একটি অঙ্গ নিশ্চয় ঈষদচ্ছ কলা। দিয়ে তৈরি হবে এবং একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকোষ্ঠের পিছনের দিকে প্রতিবিম্ব সৃষ্টির জন্য লেন্সের মতো কিছু একটা নিশ্চয় থাকবে। এই উপরিগত সাদৃশ্য ব্যতীত, কাটল মাছ ও মেরুদণ্ডী প্রাণীদের চোখগুলির মধ্যে কোন প্রকৃত সাদৃশ্য কদাচিৎ থাকে; সেফালোপড়ার এই অঙ্গগুলির ওপর হেনসেন-এর বিস্ময়কর স্মৃতিকথামূলক প্রবন্ধটি পড়লে এটি দেখা যেতে পারে। আমার পক্ষে বিস্তৃতভাবে এখানে বলা অসম্ভব, পার্থক্যের কয়েকটি বিষয় আমি বিশেষভাবে বলতে পারি। উচ্চতর শ্রেণীর কাটল মাছের স্ফটিকতুল্য লেন্সটি একটির পিছনে অন্যটি স্থাপিত লেন্সের মতো দুটি অংশ দ্বারা তৈরি, মেরুদণ্ডীদের তুলনায় গঠনে ও অবস্থান বিন্যাসে উভয়ই অতিশয় ভিন্ন প্রকৃতির। অক্ষিপটটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যার মৌলিক অংশগুলি প্রকৃতই উল্টানো এবং যার চোখের ঝিল্লির মধ্যে একটি বিরাট স্নায়ুগ্রন্থী থাকে। মাংসপেশীর সম্পর্কগুলি যতদূর সম্ভব ভিন্ন প্রকৃতির, এবং এভাবে অন্য বিষয়গুলিও। অতএব সিদ্ধান্ত করা বেশ কষ্টকর যে সেফালোপড়া ও মেরুদণ্ডীদের চোখের বর্ণনা করতে একই পদ ব্যবহার করা কতখানি উচিত। যে কোন ব্যক্তি এটি অস্বীকার করতে পারে যে, যে কোন একটি ক্ষেত্রে চোখটি ধারাবাহিক অল্প পরিবর্তনগুলির প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু এটি যদি একটি ক্ষেত্রে স্বীকার করা হয়, তাহলে অন্য ক্ষেত্রেও এটি স্পষ্টত সম্ভবপর; এবং দুটি গোষ্ঠীর দৃষ্টিসংক্রান্ত অঙ্গগুলির গঠনের মৌলিক পার্থক্য সৃষ্টির এই মতানুসারে বিষয়টি বোঝা যেতে পারে। দুজন মানুষ যেমন কোন কোন সময় স্বাধীনভাবে একই জিনিস আবিষ্কার করে, তেমনি পূর্ববর্তী কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রে মনে হয় যে প্রাকৃতিক নির্বাচনে প্রত্যেক জীবের ভাল করার জন্য এবং সমস্ত অনুকূল পরিবর্তনগুলির সুবিধা গ্রহণ করে। শুধুমাত্র কার্যপ্রক্রিয়ার কথা ধরলে–স্বতন্ত্র জীবগুলিতে একইরূপ অঙ্গসমূহ সৃষ্টি করেছে, যারা একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতি মারফৎ প্রাপ্ত কোন সাধারণ দেহগঠনের অধিকারী হয় না।
এই গ্রন্থে উপনীত সিদ্ধান্তগুলি পরীক্ষার জন্য ফ্রিজ মুলার অতি যত্ন সহকারে প্রায় একইরূপ যুক্তির অবতারণা করেছেন। ক্রাস্টোসিয়ান বা খোলকী প্রাণীদের কয়েকটি গোত্রের মধ্যে কতিপয় প্রজাতি আছে, যাদের শরীরে বায়ুতে নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণকারী অঙ্গ থাকে এবং যার সাহায্যে তারা জলের বাইরেও বেঁচে থাকে। মুলার দ্বারা। বিশেষভাবে পরীক্ষিত ও পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কিত এই গোত্রগুলির দুটিতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে প্রজাতিরা প্রায় একইরূপ হয়, যেমন এদের জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলিতে, রক্তসংবহনতন্ত্রে, জটিল পাকস্থলীর মধ্যে রোমগুচ্ছের অবস্থানে এবং সর্বশেষে জলে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ফুলকার সমগ্র গঠনে, এমনকি পরিষ্কৃত হওয়ার অণুবীক্ষণীয় হুকগুলিতেও। অতএব আশা করা যেতে পারে যে স্থলভাগে বসবাসকারী উভয় গোত্রের অন্তর্গত কতিপয় প্রজাতিতে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বায়ুতে নিশ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণকারী যন্ত্রটি একই হয়ে থাকবে; কারণ একই উদ্দেশ্যের জন্য কেন এই যন্ত্রটি ভিন্নভাবে সৃষ্ট হয়ে থাকবে, যখন অন্য সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি ঘনিষ্ঠভাবে সদৃশ অথবা একইরূপ।
আমার প্রদত্ত মতানুসারে, ফ্রিজ মুলারও প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন যে দেহগঠনের এতগুলি বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতির দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছে বলে বিবেচনা করা যাবে। কিন্তু যেহেতু উপরোক্ত দুটি গোত্রের অংসখ্য প্রজাতি এবং অন্য অধিকাংশ ক্রাস্টোসিয়ান বা খোলকীরা স্বভাবে জলচর, তাই এটি একেবারেই অসম্ভব যে এদের সাধারণ পূর্বপুরষ বাতাসে নিশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অভিযোজিত হয়েছিল। মূলার সেজন্য বায়ুতে শ্বাসগ্রহণকারী প্রজাতিদের অঙ্গটিকে যত্নসহকারে পরীক্ষা করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন; এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রত্যেকটিতে যে এটি ভিন্ন হয় তা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, যেমন রন্ধ্রনালীর অবস্থানে, যে পদ্ধতিতে এটি খোলে এবং বন্ধ হয়, এবং কোন কোন সহায়ক অঙ্গে। এখন এই পার্থক্যগুলি বোধগম্য হয়, এবং আশা করা যেতে পারে যদি এটি এরূপ হয় তাহলে ভিন্ন গোত্রের অন্তর্গত। প্রজাতিরা আরও বেশি বেশি করে জলের বাইরে বসবাস করতে ও বায়ুতে নিশ্বাস প্রশ্বাস নিতে ধীরে ধীরে অভিযোজিত হয়েছে। কারণ, ভিন্ন গোত্রের অন্তর্গত এই প্রজাতিরা কিছু পরিমাণে ভিন্ন হয়ে থাকবে–এই নীতি অনুসারে প্রত্যেক পরিবর্তনের প্রকৃতি দুটি উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে, যথা জীবের প্রকৃতি এবং পার্শ্ববর্তী। পরিবেশের প্রকৃতি, এদের পরিবর্তনশীলতা নিশ্চয় ঠিক একই হতে পারে না। পরিণামে, একই নির্দিষ্ট কাজের ফলাফলে উপস্থিত হতে ভিন্ন উপাদান অথবা পরিবর্তনগুলির ওপর প্রাকৃতিক নির্বাচনকে কার্য করে থাকতে হবে এবং এভাবে অর্জিত দেহগঠনগুলি অবশ্যম্ভাবীরূপে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকবে। সৃষ্টি ভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত প্রকল্পটি অনুযায়ী সমগ্র ঘটনাটি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। এই ধরনের যুক্তি সম্ভবতঃ এই গ্রন্থে আমার উল্লিখিত মতবাদ গ্রহণ করতে ফ্রিজ মূলারকে প্রভূত উৎসাহ যুগিয়েছিল।
অন্য একজন বিশিষ্ট প্রাণীতত্ত্ববিদ প্রয়াত অধ্যাপক ক্লাপারেডে একই প্রকার যুক্তি প্রদর্শন করেছেন এবং একই ফল লাভ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে ভিন্ন উপ-গোত্র ও গোত্রগুলির অন্তর্গত পরজীবী মাইটদের (অ্যাকারিডি) লোম-ক্লাসপার থাকে। এই অঙ্গগুলি নিশ্চয় স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়েছে, কারণ এরা এটি কোন সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বংশগতভাবে প্রাপ্ত হয়নি; এবং কতিপয় গোষ্ঠীতে এগুলি সামনের পা, পিছনের পা, ম্যাক্সিলা অথবা চঞ্চুর, শরীরের পিছনের অংশের নিচের দিকের উপাঙ্গগুলির রূপান্তর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ববর্তী ঘটনাগুলিতে আমরা দেখি যে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন অথবা শুধুমাত্র দূরসম্পর্কীয় জীবগুলির আকৃতিতে গভীরভাবে সদৃশ অঙ্গগুলি একই লক্ষ্য অর্জন এবং একই কার্য করে। বিপরীতক্রমে, প্রকৃতিতে এটি একটি সাধারণ নিয়ম যে এমন কি কোন কোন সময় অতি নিকট সম্পর্কীয় জীবরাও অতিশয় বিচিত্র উপায়ে একই লক্ষ্য অর্জন করবে। একটি পাখির পালকসম্বলিত ডানা এবং একটি বাদুড়ের ঝিল্লি আচ্ছাদিত ডানা কত ভিন্নরূপে গঠিত; একইভাবে একটি প্রজাপতির চারটি ডানা, একটি মাছির দুটি ডানা, একটি বিটল-এর ইলাইট্রার সঙ্গে যুক্ত দুটি ডানাও কত ভিন্নরূপে গঠিত। দ্বিপুটক খোলকী প্রাণীরা তাদের ভালগুলি খোলে এবং বন্ধ করে, কিন্তু কজাটি কত রকম নকশায় তৈরি–একটি নুকুলা-র সুন্দরভাবে একত্রে সংবদ্ধ দাঁতগুলির দীর্ঘ সারি থেকে একটি মুসেলের (সামুদ্রিক ঝিনুক) সরল অস্থিবন্ধনী! বীজগুলি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এদের ক্ষুদ্রতার জন্য, এদের ক্যাপসুলটির একটি হাল্কা বেলুনের মতো মোড়কে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য-ফলের শাঁসে এবং মাংসল অংশের মধ্যে স্থাপনের জন্য, বীজগুলি অতি বিচিত্র প্রত্যঙ্গ দ্বারা তৈরি ও পুষ্টিকর এবং পাখিদের আকর্ষণ করা ও খাওয়ার জন্য সুস্পষ্টভাবে রঙ্গিন হয়–চতুষ্পদ প্রাণীদের লোমে আটকানোর জন্য অনেক প্রকারের হুক ও এ্যাপনেল এবং খাঁজকাটা শুয়ে থাকার জন্য-ডানা ও পালক দ্বারা সজ্জিত হওয়ার জন্য, বীজগুলি গঠনে যেমন সুন্দর এবং আকারে সেরকম ভিন্ন যাতে করে প্রত্যেক বায়ুপ্রবাহের দ্বারা তাড়িত হয়। আমি অন্য একটি উদাহরণ দেব, কারণ অতিশয় বিচিত্র উপায়ের দ্বারা একই লক্ষ্য অর্জন করার এই বিষয়টি আরও মনোযোগ দেওয়ার যোগ্য। কয়েকজন লেখক উল্লেখ করেছেন যে জীবরা একটি দোকানের খেলনাগুলির মতো শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের জন্য অনেক উপায়ে সৃষ্ট হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতি সম্বন্ধে এই মত অবিশ্বাস্য। পৃথক লিঙ্গ সমেত উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে এবং উভলিঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও উদ্ভিদদের ক্ষেত্রে, পরাগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গর্ভমুণ্ডে পড়ে না, এদের নিষেকের জন্য কোন কিছুর সাহায্য দরকার। কয়েকপ্রকার উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এটি পরাগরেণুর দ্বারা কার্যকর হয়, যা আলগা ও অসংলগ্ন এবং যা বায়ুতাড়িত হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে গৰ্জ্জুণ্ডে এসে পড়ে; এবং এটিই হচ্ছে অনুমানযোগ্য সরলতম কৌশল। যদিও অতিশয় ভিন্ন, তবুও প্রায় সমভাবে সরল একটি কৌশল অনেক উদ্ভিদে ঘটে থাকে যেখানে একটি সুষম ফুল কয়েক বিন্দু মধু নিঃসরণ করে আর তার ফলে পতঙ্গরা আসে; এবং এরা পরাগধানী থেকে গর্ভমুণ্ডে পরাগ বয়ে নিয়ে আসে।
এই সরল বিষয়টি থেকে আমরা অসংখ্য কলাকৌশল দেখতে পারি, যেগুলি একই উদ্দেশ্যে এবং মূলতঃ একই পদ্ধতিতে কার্যকরী হয়, কিন্তু এটি অনিবার্যরূপে ফুলের প্রত্যেক অংশের পরিবর্তন ঘটায়। মধু বিভিন্ন আকারের পুষ্পধারে সঞ্চিত হতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে পুংকেশর ও গর্ভকেশর বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হতে পারে, কোন কোন সময় ফাঁদের মতো কৌশল সৃষ্টি করতে পারে এবং কোন কোন সময় উত্তেজনা অথবা স্থিতিস্থাপকতার জন্য সুন্দরভাবে উপযোগী স্পন্দনে সমর্থ হতে পারে। এরূপ গঠনগুলি থেকে আমরা অগ্রসর হতে পারি, যতক্ষণ না আমরা অসাধারণ অভিযোজনের এমন ঘটনার সাক্ষাৎ পাই যা পরবর্তীকালে কোরিয়ানথেসদের ক্ষেত্রে ডঃ ক্রুগার বর্ণনা করেছেন। এই অর্কিডের ল্যাবেলাম বা অধরদল অথবা নিচের ওষ্ঠটির কিছু অংশ লম্বা গর্ত হয়ে একটি বিরাট পাত্রের মতো জিনিস সৃষ্টি করে; এর ওপরে অবস্থিত রস নিঃসরণকারী দুটি হর্ন থেকে এর মধ্যে অনবরত প্রায় বিশুদ্ধ জলের বিন্দু পড়তে থাকে, এবং পাত্রটি যখন অর্ধপূর্ণ হয়, তখন একদিকের ছিদ্র নল দ্বারা জল উপচিয়ে পড়ে। ল্যাবেলামের পাদদেশ পাত্রটির ওপরে অবস্থিত, এবং এটি নিজে গর্ত হয়ে দুটি পার্শ্ব প্রবেশদ্বার সমেত একটি প্রকোষ্ঠের মতো পাত্র তৈরি করে; এই প্রকোষ্ঠের মধ্যে রসালো খাঁজ থাকে। কী কী ঘটে তা লক্ষ্য না করে একজন দক্ষ বুদ্ধিমান মানুষ এইসব অংশগুলি কী কী উদ্দেশ্যসাধন করে তা কখনও কল্পনা করতে পারত না। কিন্তু মিঃ ক্রুগার লক্ষ্য করেছিলেন যে দলে দলে ভ্রমররা এই বিরাট অর্কিড ফুলে আসত, এরা আসত মধু সংগ্রহের জন্য নয়, বরং পাত্রের ওপরে প্রকোষ্ঠটির খাঁজগুলিকে অনবরত কামড়াতে; এটি করার সময় এরা বারবার পরস্পরকে পাত্রের মধ্যে ঠেলে ফেলে দিত এবং ডানাগুলি এভাবে সিক্ত হওয়ার ফলে এরা উড়ে যেতে পারত না, কিন্তু ছিদ্রনল অথবা উপছানোর দ্বারা সৃষ্ট প্রবেশদ্বারের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে বাধ্য হত। ডঃ ক্রুগার ভ্রমর-মৌমাছিদের অনবরত মিছিল দেখতেন যারা অনৈচ্ছিক স্নানের পর হামাগুড়ি দিয়ে বের হত। পথটি সঙ্কীর্ণ এবং তার ছাদ স্তম্ভ দ্বারা তৈরি, সুতরাং একটি মৌমাছি জোরে বের হওয়ার সময় আঠালো গর্ভমুণ্ডে তার পিছনটা ঘষে দেয় এবং তারপর পরাগপুঞ্জের আঠালো গ্রন্থিগুলিতেও পিছনের শরীর ঘষে দেয়। পরাগরেণুগুলি এবার মৌমাছির পিছনের আঠায় লেগে যায়। পরবর্তীকালে মৌমাছিরা সম্প্রসারিত একটি ফুলের পথটির মধ্য দিয়ে প্রথমে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয় এবং এরূপে পরাগরেণুগুলি বাহিত হয়। ডঃ কুঁগার মদের স্ফিরিটে ডোবানো অবস্থায় একটি মৌমাছি সমেত একটি ফুল আমাকে পাঠিয়েছিলেন, হামাগুড়ি দিয়ে বের হবার পূর্বে মৌমাছিটিকে তিনি হত্যা করেছিলেন এবং তখনও মৌমাছিটির পিছনে পরাগরেণু লেগেছিল। এরূপ অবস্থায় যখন মৌমাছিটি অন্য ফুলে অথবা দ্বিতীয়বার একই ফুলে উড়ে যায় এবং সহযোদ্ধাদের ঠেলাঠেলির দ্বারা পাত্রটিতে পড়ে ও পথটির মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়, তখন পরাগরেণুগুলি অবশ্যম্ভাবীরূপে আঠালো গর্ভমুণ্ডের সংস্পর্শে আসে ও তাতে লেগে যায়, এবং ফুলটি নিষিক্ত হয়। এখন অন্ততঃ আমরা ফুলটির প্রত্যেক অঙ্গের সম্পূর্ণ ব্যবহার দেখি, যথা জল নিঃসরণকারী শুঙ্গের, জল দ্বারা পরিপূর্ণ পাত্রটির, যারা মৌমাছিদের উড়ে পালাতে বাধা দেয়, এবং ছিদ্রনলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে এবং সঠিকভাবে স্থাপিত আঠালো পরাগরেণুগুলি ও আঠালো গর্ভমুণ্ডটিকে শরীর দ্বারা ঘষতে বাধ্য করে।
আর একটি নিকট সম্বন্ধীয় অর্কিড অর্থাৎ ক্যাটাসেটাম-এর ফুলের গঠনকৌশল বহুলাংশে ভিন্ন, যদিও তা একই উদ্দেশ্য সাধন করে; এবং সমভাবে বিস্ময়কর। করিয়ানথেস-এর মতো এক্ষেত্রেও অধরদলটিকে কামড়িয়ে ক্ষয় করার জন্য মৌমাছিরা এইসব ফুলগুলিতে আসে, কাজটি সম্পাদন করতে এরা অনিবার্যরূপে একটি লম্বা, ক্রমশ সরু, অভিক্ষিপ্ত অঙ্গ স্পর্শ করে, যাকে আমি শুঙ্গ বা অ্যান্টেনা বলেছি। স্পর্শের পর এই শুঙ্গটি কোন একটি ঝিল্লিতে অনুভূতি বা সংবেদন অথবা স্পন্দন প্রেরণ করে, যার ফলে তৎক্ষণাৎ এটি বিদীর্ণ হয়; এটি একটি স্প্রিংকে মুক্ত করে, যার দ্বারা পরাগরেণু তীরের মতো সঠিক দিকে সবেগে নিক্ষিপ্ত হয় এবং পরাগপুঞ্জগুলি তাদের আঠালো প্রান্ত দ্বারা মৌমাছির পেছনে আটকিয়ে যায়। পুরুষ ফুলের পরাগরেণু (কারণ এই অর্কিড ফুলের লিঙ্গ আলাদা) এরূপে স্ত্রী-ফুলে ধাবিত হয়, তারপর এটি গর্ভমুণ্ডের সংস্পর্শে আসে, যা কোন স্থিতিস্থাপক নরম সূত্র ভাঙ্গতে ও পরাগরেণুকে ধরে রাখতে যথেষ্ট আঠালো এবং নিষেকক্রিয়া এভাবে কার্যকরী হয়।
পূর্ববর্তী এবং অন্য অসংখ্য উদাহরণে, একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জটিলতার ক্রমিক মাত্রা এবং অসংখ্য উপায় কেমন করে সৃষ্টি হল তা আমরা কীভাবে জানতে পারি–এ প্রশ্ন উঠতে পারে। উত্তর হচ্ছে, যেমন ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, যে কোন অল্পমাত্রায় পরস্পরের থেকে ইতিমধ্যেই ভিন্ন দুটি আকার যখন পরিবর্তিত হয়, তখন। পরিবর্তনশীলতাটি ঠিক একই প্রকৃতির হবে না এবং ফলস্বরূপ একই সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলগুলিও এক হবে না। স্মরণ রাখা উচিত যে অতিশয় উন্নত প্রত্যেক জীব অনেক পরিবর্তন অতিক্রম করেছে; এবং প্রত্যেক রূপান্তরিত দেহগঠন বংশানুসৃতি অনুযায়ী প্রেরিত হতে চেষ্টা করে, যাতে কোরে প্রত্যেক রূপান্তর সহজেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে না, কিন্তু পুনঃ পুনঃ পরিবর্তিত হতে থাকবে। অতএব যে উদ্দেশ্যই সাধন করুক না কেন, প্রত্যেক প্রজাতির প্রত্যেক অঙ্গের গঠন হচ্ছে। বংশগতভারে প্রাপ্ত অনেক পরিবর্তনের যোগফল, যার মাধ্যমে প্রত্যেক প্রজাতি পর্যায়ক্রমিক অভিযোজনের সময় পরিবর্তিত স্বভাব ও জীবন-পরিবেশ অতিক্রম করেছে।
শেষতঃ, যদিও অনেক ক্ষেত্রে কল্পনা করা অতিশয় কষ্টকর যে কোন্ কোন্ সংক্রমণ বা উত্তরণগত ধাপগুলির দ্বারা অঙ্গগুলি বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে, তথাপি, বিলুপ্ত ও অজ্ঞাতগুলির তুলনায় বর্তমান ও জ্ঞাত আকারগুলির অনুপাত কত কম তা বিবেচনা করে, আমি বিস্মিত হয়েছি যে কী উপায়ে কদাচিৎ একটি অঙ্গের নামকরণ করা যেতে পারে, যে বিষয়ে কোন সংক্রমণগত ধাপ জানা নেই। এটি নিশ্চিত সত্য যে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হওয়া নূতন অঙ্গগুলি কোন জীবে কদাচিৎ আবির্ভূত হয় অথবা কখনই আবির্ভূত হয় না–যেমন প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক ইতিহাসে ঐ পুরানো অথচ কিছুমাত্রায় অতিরঞ্জিত প্রবাদ “প্রকৃতি কখনও লম্ফ দেয় না”-তে দেখানো হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক অভিজ্ঞ প্রকৃতিবিদের লেখায় এটির স্বীকৃতি খুঁজে পাই আমরা। মিলনে এডওয়ার্ড সুন্দরভাবে বলেছেন যে বৈচিত্র্যে প্রকৃতির দান অপরিমিত, কিন্তু নূতনত্বের প্রবর্তনে কৃপণ। সৃষ্টিতত্ত্বানুযায়ী কেন এত বেশি বৈচিত্র্য এবং এত অল্প প্রকৃত অভিনবত্ব থাকবে? অনেক ভিন্ন জীবের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি, যা প্রকৃতিতে তার উপযুক্ত স্থানের জন্য মনে হয় পৃথকভাবে সৃষ্টি হয়েছে, পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলির দ্বারা একত্রে এত সাধারণভাবে যুক্ত হবে কেন? দেহগঠন থেকে দেহগঠনে কেন প্রকৃতি হঠাৎ লম্ফ দেবে না? প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুযায়ী আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে কেন সে এটি করবে না; কারণ এটি প্রাকৃতিক অল্প ধারাবাহিক পরিবৃত্তিসমূহের সুফল গ্রহণ করেই শুধুমাত্র কার্যকরী হয়, সে কখনও একটি বিরাট ও আকস্মক লক্ষ্য দেয় না, কিন্তু অল্প ও নিশ্চিত অথচ মন্থর ধাপগুলির দ্বারা অগ্রসর হয়।
প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রভাবিত আপাত অল্প গুরুত্বের অঙ্গসমূহ
যেহেতু জীবন ও মৃত্যু দ্বারা, সর্বোত্তমের উদ্বর্তন দ্বারা এবং কম উপযুক্ত এককদের ধ্বংসসাধন দ্বারা প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যসম্পন্ন করে, তাই অল্প গুরুত্বের প্রত্যঙ্গগুলির উৎপত্তি ও গঠন সম্বন্ধে বুঝতে আমি কোন কোন সময় বিরাট অসুবিধা বোধ করি; অবশ্য অতি ভিন্ন প্রকৃতির সবচেয়ে নিখুঁত ও জটিল অঙ্গগুলির ক্ষেত্রেও বিরাট অসুবিধা বোধ করি।
প্রথমতঃ, কোন জীবের সমগ্র দেহগঠন সম্বন্ধে কোন্ কোন্ রূপান্তরগুলি গুরত্বপূর্ণ হবে বা হবে না, এ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান অতি অল্প। পূর্ববর্তী একটি অধ্যায়ে তুচ্ছ। বৈশিষ্ট্যগুলির উদাহরণ দিয়েছি, যেমন ফলের নরম ক্ষুদ্র রোম ও তার শাঁসের রং, চতুষ্পদ প্রাণীদের চামড়ার রং ও লোম, এগুলি জৈবিক পার্থক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ও পতঙ্গদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সৃষ্ট, এবং এগুলির উপর নিশ্চয় প্রাকৃতিক নির্বাচন কার্যকরী হবে। জিরাফের লেজটি কৃত্রিমভাবে নির্মিত মাছি ধরার চেপ্টা যন্ত্রের মতো দেখতে হয়, এবং প্রথমে এটি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয় যে মাছিদের তাড়ানোর মতো একটি তুচ্ছ বিষয়ের জন্য ক্রমশ উৎকৃষ্ট এবং উৎকৃষ্টতরভাবে উপযোগী পর্যায়ক্রমিক অল্প রূপান্তরগুলির দ্বারা এটি এর বর্তমান উদ্দেশ্যের জন্য অভিযোজিত হয়েছে; তথাপি এক্ষেত্রে দৃঢ় প্রত্যয়শীল হওয়ার পূর্বে আমাদের সাময়িক বিরত থাকা উচিত, কারণ আমরা জানি যে দক্ষিণ আমেরিকায় গো-মহিষাদি এবং অন্য প্রাণীদের বিস্তার ও অবস্থান পতঙ্গদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতার ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে, যাতে করে এইসব ক্ষুদ্রাকার শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম এককরা নূতন চারণভূমিতে বিচরণ করতে সমর্থ হত এবং এভাবে বিরাট সুবিধা লাভ করত। এর অর্থ এই নয় যে বড় চতুষ্পদ প্রাণীরা মাছিদের দ্বারা প্রকৃতই ধ্বংস হয়েছে (কতিপয় বিরল ঘটনা ছাড়া), বরং এরা অনবরত হয়রান হয়েছে ও এদের ক্ষমতা হাস পেয়েছে, সেইজন্য এদের রোগাক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে, অথবা অভাবের সময় খাদ্যের সন্ধান করার জন্য বা শিকারি পশুদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরা ভালভাবে সমর্থ হয় না।
বর্তমানে তুচ্ছ বৈশিষ্ট্যের অঙ্গগুলি সম্ভবতঃ কয়েকটি ক্ষেত্রে একটি আদিম পূর্বপুরুষের ক্ষেত্রে উচ্চ গুরুত্বের হয়ে থাকবে, এবং পূর্ববর্তী কোন যুগে ধীর গতিতে নিখুঁত হওয়ার পর প্রায় একই অবস্থায় বর্তমান প্রজাতিগুলিতে বংশগতভাবে প্রেরিত হয়েছে, যদিও এটি এখন নিতান্ত অল্প গুরুত্বসম্পন্ন; কিন্তু এদের দেহগঠনে যে কোন প্রকৃত ক্ষতিকর বিচ্যুতি নিশ্চয় প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকবে। অধিকাংশ জলজ প্রাণীদের লেজটির মতো একটি ভ্রমণ-অঙ্গ যে কত গুরুত্বের হয় তা লক্ষ্য করে অসংখ্য স্থলচর প্রাণীর ক্ষেত্রে এর সাধারণ অবস্থান এবং অসংখ্য উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার, যাদের ফুসফুস ও রূপান্তরিত পটকারা এদের জলজ উৎপত্তি প্রমাণ করে, বোধহয় এভাবে সন্তোষজনকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। একটি জলজ প্রাণীর লেজটি উন্নত হওয়ার পর, পরবর্তী সময়ে এটি সকল উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়-যথা মাছি তাড়ানোর পাখা, আঁকড়ে ধরার উপযোগী যন্ত্র, অথবা কুকুরের ক্ষেত্রে উল্টোদিকে ঘোরার যন্ত্র, যদিও শেষোক্ত যন্ত্রটি (লেজ) নিশ্চয় অল্প সাহায্যের হবে, কারণ যাদের কোন লেজ নেই বললেই চলে এমন শশকরা আরও দ্রুতহারে উল্টোদিকে ঘুরতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ, বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর আমরা ভুলবশতঃ গুরুত্ব আরোপ করতে পারি এবং ভুলভাবেই মনে করতে পারি যে এগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশের সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার প্রভাবসমূহকে আমরা কোনমতেই উপেক্ষা করতে পারি না, যথা সুপরিচিত স্বতঃস্ফূর্ত পরিবৃত্তিসমূহের যা সম্ভবতঃ পরিবেশে প্রকৃতির ওপর কিছুটা কম মাত্রায় নির্ভর করে–বহু পূর্বে লুপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলির পুনরাবির্ভাবের প্রবণতার-বৃদ্ধির জটিল নিয়মসমূহের–যেমন সহসম্পর্কের, ক্ষতিপূরণের, একটি অঙ্গের উপর অন্য অঙ্গের চাপ ইত্যাদি- এবং অবশেষে যৌন নির্বাচনের, যার দ্বারা একটি লিঙ্গে ব্যবহারের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায়শই অর্জিত হয় এবং তারপর অন্য লিঙ্গে কমবেশি নিখুঁতভাবে প্রেরিত হয়, যদিও এই লিঙ্গে এর কোন ব্যবহার নেই। প্রথমে একটি প্রজাতির ক্ষেত্রে এর কোন উপকার না থাকলেও অপ্রত্যক্ষভাবে অর্জিত গঠনকাঠামোর সুবিধ নূতন জীবন-অবস্থায় এবং নূতনভাবে অর্জিত স্বভাবসমূহের তার রূপান্তরিত বংশধররা গ্রহণ করে থাকতে পারে।
যদি শুধুমাত্র সবুজ কাঠঠোকরা পাখিই বর্তমান থাকত এবং আমরা যদি না জানতাম যে অনেক কালো এবং সাদা-কালো বর্ণবিশিষ্ট কাঠঠোকরা ছিল, তাহলে আমাদের মনে। করা উচিত ছিল যে সবুজবৰ্ণ গাছে প্রায়শই যাতায়াত করা পাখিটি তার শত্রুদের হাত থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয়েছিল; এবং ফলস্বরূপ আমরা মনে করতে পারতাম এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এবং এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারাই অর্জিত হয়েছে; বস্তুত, বর্ণটি সম্ভবতঃ প্রধানত যৌন নির্বাচনের দ্বারাই অর্জিত হয়েছে। মালয় দ্বীপপুঞ্জের একটি লতানে তালজাতীয় গাছ তার শাখাগুলির প্রান্তের চতুর্দিকে গুচ্ছবদ্ধভাবে অবস্থিত হুকগুলির দ্বারা উচ্চতম বৃক্ষে আরোহণ করে এবং নিঃসন্দেহেই এই কৌশল উদ্ভিদটির পক্ষে সবচেয়ে উপকারী, কিন্তু যেহেতু আরোহী নয় এমন অনেক উদ্ভিদে প্রায়শই সদৃশ হুক আমরা দেখি, এবং যেহেতু বিশ্বাস করার কারণ আছে যে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় অনেক কণ্টকসম্বলিত প্রজাতি আছে, সেহেতু পূর্বেরটির ঐ বৈশিষ্ট্যটি শাখাপল্লব ভক্ষণকারী চতুষ্পদ প্রাণীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়, সেইরূপ তালজাতীয় গাছটির পুষ্পমঞ্জরী প্রথমে এই উদ্দেশ্যে বিকশিত হয়ে থাকতে পারে, পরবর্তীসময়ে তা উন্নত হয়েছে ও উদ্ভিদটি তার সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং এটি আরও উন্নত হয়েছে ও আরোহী হয়েছে। শকুনির মাথার উন্মুক্ত চামড়া পচনশীল জিনিসের মধ্যে বসবাস করার জন্য একটি অভিযোজন হিসেবেই সাধারণতঃ বিবেচিত হয়; এবং সেরূপে এটি পচনশীল বস্তুর প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়ার জন্য হতে পারে বা সম্ভবতঃ হতে পারে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত করার সময় আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ যখন আমরা দেখি যে পরিষ্কার জিনিস ভক্ষণকারী পুরুষ টার্কিপাখির মাথার চামড়াও এভাবে উন্মুক্ত হয়। শিশু স্তন্যপায়ীদের করোটির অস্থিসন্ধি প্রসবে সুবিধার জন্য সুন্দর অভিযোজনের মাধ্যমে উন্নতিসাধন করেছে, এবং নিঃসন্দেহেই এরা এই প্রক্রিয়াকে সহজতর করে অথবা এই প্রক্রিয়ার পক্ষে অপরিহার্য হতে পারে; কিন্তু যেহেতু শিশু পাখি ও সরীসৃপদের করোটিতেও অস্থিসন্ধি থাকে, যা ভাঙ্গা ডিম থেকে এদের পালাতে সাহায্য করে, সেহেতু আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে এই দেহগঠনটি বৃদ্ধির নিয়মানুসারে উদ্ভূত হয়েছে এবং উচ্চতর প্রাণীদের প্রসবের সময় এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যেক অল্প পরিবর্তন অথবা এককীয় পার্থক্যের কারণ সম্বন্ধে আমরা নিতান্তই অজ্ঞ, এবং বিভিন্ন দেশের গৃহপালিত প্রাণীদের জাতগুলির মধ্যে পার্থক্য স্মরণ করলে আমরা তৎক্ষণাৎ সচেতন হই, আরও বিশেষভাবে কম সভ্য দেশগুলিতে, যেখানে প্রণালীবদ্ধ নির্বাচন কম হয়। বিভিন্ন দেশের বর্বর মানুষদের দ্বারা রক্ষিত প্রাণীদের বাঁচার জন্য প্রায়শই সংগ্রাম করতে হয়েছে এবং এরা কিছুমাত্রায় প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রভাবে পড়েছে, এবং অল্প পৃথক জৈব সংগঠন সমেত এককরা বিভিন্ন আবহাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কৃতকার্য হবে। গো-মহিষাদির ক্ষেত্রে মশামাছির আক্রমণ সম্পর্কে সংবেদনশীলতা রঙের সঙ্গে সহ-সম্পর্কিত, যেমন কোন কোন উদ্ভিদের রং বিষক্রিয়া ঘটাতে বাধ্য হয়; যার ফলে, এমনকি রংটিও এভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে। কয়েকজন পর্যবেক্ষক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আর্দ্র আবহাওয়া লেজের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এবং লোমের সঙ্গে শিংগুলিও সহ-সম্পর্কিত হয়। পাহাড়ি জাতগুলি সর্বদা নিচু অঞ্চলের জাতগুলির থেকে ভিন্ন হয় এবং একটি পাহাড় দেশ তার প্রাণীদের বেশি বেশি করে ব্যবহারের জন্য পিছনের অঙ্গগুলিকে প্রভাবিত করে এবং সম্ভবতঃ শ্রোণীর আকারকেও, তারপর সমসংস্থ পরিবর্তনের নিয়মের দ্বারা সম্মুখের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি ও মস্তিষ্কটিও প্রভাবিত হবে। শ্রোণীটি তার আকার ও চাপের দ্বারা গর্ভের শিশুর কোন কোন প্রত্যঙ্গের আকারকে প্রভাবিত করে। যেমন বিশ্বাস করার কারণ আছে যে পাহাড়ী অঞ্চলে কষ্টকর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বুকের ছাতির আকার বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে এবং এক্ষেত্রেও সহ-সম্পর্ক একটি ভূমিকা পালন করবে। সমগ্র, জৈব সংগঠনের ওপর প্রচুর খাদ্য যোগানোর সঙ্গে কম ব্যায়ামের প্রভাবসমূহ সম্ভবতঃ আরও গুরুত্বপূর্ণ; এবং যেমন এইচ. ভন নাথুসিয়াস তাঁর চমৎকার গ্রন্থে সম্প্রতি দেখিয়েছেন যে এটি বিরাট রূপান্তরের সম্ভবতঃ একটি প্রধান কারণ হয়, যা শুয়োরের জাতগুলিতে কার্যকরী হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের কয়েকটি জ্ঞাত ও অজ্ঞাত কারণের আপেক্ষিক গুরুত্বের ওপর দূরকল্পনা করতে আমরা ততোধিক অজ্ঞ; এবং আমরা যদি আমাদের কতিপয় গৃহপালিত জাতের বৈশিষ্ট্যমূলক পার্থক্যগুলি বিচার বিশ্লেষণ করতে অসমর্থ হই, যেগুলি তা সত্ত্বেও একটি অথবা অল্প কতিপয় পিতামাতা কুল থেকে সাধারণ বংশধারার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে বলে সাধারণত স্বীকার করা হয়, আমি এইসব মন্তব্য করেছি শুধুমাত্র এটা দেখাতে যে প্রকৃত প্রজাতিদের মধ্যে অল্প। অনুরূপ পার্থক্যগুলির উপযুক্ত কারণ সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতার ওপর অধিক জোর দেওয়া আমাদের উচিত হবে না।
উপযোগবাদ, কতদূর সত্য : সৌন্দর্য কেমনভাবে অর্জিত
দেহগঠনের প্রত্যেক ক্ষুদ্র অংশও তার অধিকারীর পক্ষে মঙ্গলকর–এই উপযোগবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে কয়েকজন প্রকৃতিবিদের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিবাদে কিছু বলতে পূর্ববর্তী মন্তব্যগুলি আমাকে প্রভাবিত করেছে। তারা বিশ্বাস করেন যে অনেক গঠনকৌশল মানুষ অথবা সৃষ্টিকর্তাকে আনন্দ দান করতে সৌন্দর্যের জন্য (এই শেষোক্ত বিষয়টি বৈজ্ঞানিক আলোচনার উদ্দেশ্যের বাইরে) অথবা শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছে, বিষয়টি ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে। এই মতবাদসমূহ, যদি সত্য হয়, আমার তত্ত্বের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক হবে। আমি সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করি যে অনেক দেহগঠন তার অধিকারীর কোন প্রত্যক্ষ ব্যবহারে লাগে না এবং তাদের পূর্বপুরুষদেরও কোন কাজে লেগে থাকতে পারে না; কিন্তু এ থেকে প্রমাণ হয় না যে এগুলি শুধুমাত্র সৌন্দর্য অথবা বৈচিত্র্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। সন্দেহ নেই যে পরিবর্তিত পরিবেশের নির্দিষ্ট ক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং সাম্প্রতিককালে নিরূপিত রূপান্তরসমূহের বিভিন্ন কারণগুলি সকলে একটি ফলাফল সৃষ্টি করেছে, সম্ভবতঃ কোন সুফল ছাড়াই এভাবে অর্জিত একটি বিরাট পরিমাণ এটি। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে প্রত্যেক জীবন্ত জীবের দেহের প্রধান অঙ্গটি বংশানুসৃতির জন্য হয়; এবং ফলস্বরূপ, যদিও প্রত্যেক জীব প্রকৃতিতে তার অবস্থানের জন্য নিশ্চিতই ভালভাবে মানানসই হয়েছে, জীবনের বর্তমান স্বভাবের সঙ্গে অনেক দেহগঠনের অতিশয় নিকট এবং প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এখন নেই। এভাবে, আমরা কদাচিৎ বিশ্বাস করি যে উচ্চস্থানের রাজহাঁস অথবা ফ্রিগেট পাখির লিপ্তপদের বিশেষ ব্যবহার আছে; আমরা বিশ্বাস করতে পারি না যে বাঁদরের বাহুর, ঘোড়ার সামনের পায়ের, বাদুড়ের ডানার এবং সীলমাছের দাঁড়ের সদৃশ হাড়গুলির কোন বিশেষ ব্যবহার এইসব প্রাণীদের পক্ষে আছে। আমরা নিরাপদেই বলতে পারি যে এগুলি বংশানুসৃতির জন্য হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ নেই যে উচ্চস্থানের রাজহাঁস এবং ফ্রিগেট পাখিদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে লিপ্তপদ যতখানি উপকারী ছিল, এখনও ততখানিই উপকারী বর্তমান পক্ষীকুলের অধিকাংশ জলচর সদস্যদের ক্ষেত্রে। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে সীলমাছের পূর্বপুরুষদের দাঁড় ছিল না, তবে চলন অথবা আঁকড়িয়ে ধরার জন্য পাঁচ আঙ্গুল সমেত একটি পায়ের পাতা ছিল; আমরা আরও বিশ্বাস করতে পারি যে বাঁদর, ঘোড়া এবং বাদুড়ের প্রত্যঙ্গগুলির কয়েকটি হাড় উপযোগবাদী সূত্রানুযায়ী সমগ্র শ্রেণীর কোন আদিম মাছের মতো পূর্বপুরুষের পাখনার আরও অসংখ্য হাড়ের হাসপ্রাপ্তির মাধ্যমেই প্রথমে উদ্ভূত হয়েছিল। সিদ্ধান্তে আসা মোটেই সম্ভবপর নয় যে পরিবর্তনের এইসব কারণগুলির কতখানি অনুমোদন করা উচিত, যথা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, সুপরিচিত স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনগুলি এবং বৃদ্ধির জটিল নিয়মসমূহ; কিন্তু এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমগুলি ছাড়া, আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে প্রত্যেক জীবন্ত জীবের দেহকাঠামো তার অধিকারীর কোন প্রত্যক্ষ অথবা অপ্রত্যক্ষ ব্যবহারে এখন লাগে অথবা পূর্বে লাগত।
জীবসমূহ মানুষের আনন্দ উপভোগের জন্য সুন্দররূপে সৃষ্টি হয়েছে–এই বিশ্বাসটি আমার সমগ্র তত্ত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক। আমি প্রথমেই বলতে পারি যে সৌন্দর্যবোধ মুগ্ধকর বস্তুর কোন প্রকৃত গুণ নিরপেক্ষভাবে স্পষ্টতঃ মনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে; এবং কোষ্টা সুন্দর সে ধারণা সহজাত অথবা অপরিবর্তনীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন জাতির পুরুষদের মধ্যে আমরা দেখি যে এরা এদের স্ত্রীলোকদের সৌন্দর্যের একটি সম্পূর্ণ পৃথক মান পছন্দ করে। যদি কেবল মানুষের সন্তুষ্টির জন্য সুন্দর বস্তুগুলি সৃষ্টি হয়ে থাকত, তাহলে দেখাতে হবে যে মানুষের আবির্ভাবের পূর্বে প্রকৃতি কম সুন্দর ছিল। ইয়োসিন অধিযুগে সুন্দর কুণ্ডলাকার ও শঙ্কু-আকৃতি শম্বুকরা এবং মধ্যবর্তীযুগে সুশোভিত আকারবিশিষ্ট এ্যামোনাইটরা এই কারণে সৃষ্ট হয়েছিল কি যে পরবর্তী সময়ে মানুষরা তাদের প্রশংসা করবে? ডায়াটোমেসির ক্ষুদ্র সিলিকাযুক্ত কোষগুলির থেকে সৌন্দর্যময় বস্তু খুব কমই আছে; এগুলি কি এই কারণে সৃষ্টি হয়েছিল যে এরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত হবে? শেষোক্ত ক্ষেত্রে এবং অন্য অসংখ্য ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সুসামঞ্জস্যের জন্যই আপাতভাবে এগুলি ঘটে থাকে। ফুল প্রকৃতির সুন্দরতম উৎপাদনসমূহের মধ্যে পড়ে; সবুজ পাতার সঙ্গে বৈসাদৃশ্যে এরা দৃষ্টিআকর্ষক হয়েছে এবং ফলস্বরূপ একই সময়ে সুন্দরও হয়েছে, যাতে পতঙ্গরা এদের সহজেই লক্ষ্য করতে পারে। এটিকে একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ম হিসেবে গণ্য করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বাতাস দ্বারা নিষিক্ত একটি ফুলের পাপড়িগুলি কখনও উজ্জ্বল। রঙের হয় না। কয়েকটি উদ্ভিদ স্বভাবগত কারণে দু’ধরনের ফুল উৎপাদন করে–একটি ধরণ হচ্ছে পতঙ্গদের আকর্ষণ করার জন্য খোলা ও রঙ্গিন, অন্য ধরনটি বন্ধ, রঙ্গিন। নয়, মধুবিহীন, যাতে কখনও পতঙ্গরা আসে না। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, পতঙ্গরা পৃথিবীতে সৃষ্ট না হলে আমাদের উদ্ভিদগুলি সুন্দর ফুল দ্বারা সজ্জিত হত, বরং শুধুমাত্র এমন নিষ্প্রভ ফুল উৎপাদন করত যেমনটা আমরা আমাদের ফার, ওক, নাট ও অ্যাস বৃক্ষগুলিতে, ঘাস, স্পাইন্যাক, ডক এবং নেটলদের ক্ষেত্রে দেখি, যারা সকলে বাতাসের মাধ্যমে নিষিক্ত হয়। ফলের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। একটি পরিপক্ক স্ট্রবেরি বা চেরি যেমন রসনাকে তৃপ্ত করে, তেমনি চোখকেও সন্তুষ্ট করে। স্পিন-উড গাছের উজ্জ্বল রঙের ফলগুলি এবং হোলি গাছের টকটকে লালরঙের ফলগুলি যে অতি সুন্দর বস্তু, তা সকলেই স্বীকার করবে। কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধুমাত্র পাখি ও পশুদের পথপ্রদর্শক হিসাবে ব্যবহৃত হয় যাতে এদের এরা গিলে খায় এবং ফলে পরিপক্ক বীজগুলি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি সিদ্ধান্ত করি যে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীন নিয়মটি হচ্ছে–যে কোন প্রকার ফলের মধ্যে আবদ্ধ থাকা বীজগুলি এভাবে সর্বত্র বিস্তৃত হবে।
বিপরীতক্রমে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আমি স্বীকার করি যে বিরাট সংখ্যক পুরুষ প্রাণীরা, যেমন আমাদের সমস্ত চমৎকার পাখিরা, কিছু মাছ, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এবং মনোমুগ্ধকরভাবে রঙ্গিন প্রজাপতিরা, সৌন্দর্যের জন্য সুন্দর হয়েছে; কিন্তু এটি যৌন নির্বাচনের জন্য হয়েছে, অর্থাৎ স্ত্রীদের অনবরত আরও সুন্দর পুরুষ পছন্দ করার মাধ্যমে, কিন্তু মানুষের আনন্দের জন্য নয়। সেরূপে এটি পাখিদের সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এগুলি থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে সুন্দর রংগুলির প্রতি এবং সুরেলা কণ্ঠস্বরের প্রতি প্রায় একইরকম আগ্রহ প্রাণীজগতের অধিকাংশের ক্ষেত্রে দেখা যায়। পুরুষের মতো স্ত্রীদেরও চমৎকারভাবে রঙ্গিন হওয়ার, যা পাখি এবং প্রজাপতিদের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায়, কারণটি যৌন নির্বাচন দ্বারা অর্জিত রংগুলি শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে প্রেরিত হওয়ার বদলে উভয় লিঙ্গেই বংশগতভাবে প্রেরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এর সরলতম সৌন্দর্যবোধ, অর্থাৎ কোন্ কোন্ রং, আকার এবং স্বর থেকে অদ্ভুত ধরনের সুখানুভব কিভাবে মানুষের মনে এবং নিম্নতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্রথমে বিকশিত হয়েছিল, তা অতি অস্পষ্ট। একই ধরনের প্রতিবন্ধক উপস্থিত হয়, যদি আমরা অনুসন্ধান করি যে কোন কোন সুগন্ধ ও গন্ধ আনন্দবর্ধন করে এবং অন্যরা অসন্তোষ সৃষ্টি করে, এর কারণ কী। এইসব ক্ষেত্রে স্বভাবগুলি সম্ভবতঃ কিছুটা ভূমিকা পালন করে, কিন্তু প্রত্যেক প্রজাতির স্নায়ুতন্ত্রের সংগঠনে কোন মৌলিক কারণ নিশ্চয় থেকে থাকবে।
শুধুমাত্র অন্য একটি প্রজাতির ভালর জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি প্রজাতির কোন পরিবর্তন সম্ভবতঃ সৃষ্টি করতে পারে না, যদিও প্রকৃতিমণ্ডলে প্রজাতিরা অন্যদের দেহকাঠামোগুলির সুবিধা ও উপকার অনবরত গ্রহণ করে। কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন অন্য প্রাণীদের প্রত্যক্ষ ক্ষতির জন্য দেহগঠনগুলি সৃষ্টি করতে পারে, অথবা প্রায়শই করে, যেমন আমরা ক্ষুদ্র বিষধর সাপ অ্যাডার-এর বিষদাঁতে এবং ইচনিউমন-এর ওডিপোসিটরে (ডিম্বস্ফালক) দেখি, যার দ্বারা এদের ডিমগুলি অন্য পতঙ্গের জীবন্ত শরীরে সঞ্চিত হয়। এটি যদি প্রমাণ করা যেতে পারত যে কোন একটি প্রজাতির দেহগঠনের যে কোন একটি অংশ শুধুমাত্র অন্য প্রজাতির ভালর জন্য সৃষ্টি হয়েছিল, তাহলে এটি আমার তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবে, কারণ এগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট হতে পারে না। যদিও প্রাকৃতিক ইতিহাসের এই বিষয়ের ওপর অনেক গবেষণাগ্রন্থে অনেক বক্তব্য দেখা যেতে পারে, তবু আমি এমন একটিও দেখতে পাইনি যেটিকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। এটি স্বীকৃত যে নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য এবং শিকারীর ধ্বংসসাধনের জন্য র্যাটল সাপের বিষদাঁত থাকে; কিন্তু কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এর নিজের ক্ষতির জন্য অর্থাৎ এর শিকারীকে সতর্ক করতে এর একই সময়ে একটি ঘর্ঘর শব্দযন্ত্রও আছে। এটি আমি সেই মুহূর্তে বিশ্বাস করব যখন দেখব যে হতভাগ্য ইঁদুরকে সর্তক করার জন্য একটি বিড়াল লাফানোর প্রস্তুতির সময় তার লেজের শেষপ্রান্ত গুটিয়ে নেয়। এটি আরও অধিক সম্ভবপর মত যে এমনকি অতিশয় বিষধর প্রজাতিগুলিকে আক্রমণ করে বলে জানা অসংখ্য পাখী এবং পশুদের সতর্ক করার জন্যই র্যাটল সাপরা তাদের ঘর্ঘর শব্দযন্ত্রকে ব্যবহার করে, গোখানোরা ফণাবিস্তার করে এবং জোরে ও কর্কশভাবে হিসহিস শব্দ করার সময় পাফ-অ্যাডার সাপরা নিজেদের ফোলায়। সাপরা সেই একই নীতি অনুযায়ী কাজ করে যে নীতিতে একটি কুকুর মুরগীর বাচ্চাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় এরা এদের পালক ঝাঁপটায়। এবং ডানা বিস্তার করে। কিন্তু অনেক পদ্ধতির বিষয়ে এখানে বিস্তৃত করে বলার মতো জায়গা নেই, যেগুলির দ্বারা প্রাণীরা তাদের শত্রুদের ভয় পাইয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
উপকারের তুলনায় বেশি ক্ষতিকর কোন দেহগঠন প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন জীবে কখনওই সৃষ্টি করবে না, কারণ প্রত্যেক জীবের ভালর জন্যই শুধু প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে। প্যালের বক্তব্য অনুযায়ী কোন জীবকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বা তার ক্ষতি করার জন্য কোন অঙ্গ সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেক অঙ্গের ভাল ও মন্দের মধ্যে যদি সমতা বজায় থাকে, তবে প্রত্যেকটিই সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে। সময়ের অন্তরে, জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে যদি কোন অঙ্গ ক্ষতিকর হয় তাহলে সেটি রূপান্তরিত হবে, অথবা তা না হলে জীবটি বিলুপ্ত হবে, যেমন অসংখ্য জীব বিলুপ্ত হয়েছে।
একই দেশের অন্য অধিবাসীরা, যাদের সঙ্গে তারা প্রতিযোগিতায় নামে, প্রাকৃতিক, নির্বাচন প্রত্যেক জীবকে যতদূর সম্ভব তাদের মতোই নিখুঁত অথবা আর-একটু বেশি, নিখুঁত করতে চেষ্টা করে এবং আমরা জানি যে এটা হচ্ছে প্রাকৃতিক অবস্থায় অর্জিত নিখুঁততার মান। উদাহরণস্বরূপ, নিউজিল্যান্ডের স্থানীয় উৎপাদনগুলি অন্যদের তুলনায় সম্পূর্ণ নিখুঁত, কিন্তু এরা ইউরোপ থেকে প্রবর্তিত অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দ্রুত পিছু হটছে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পূর্ণ নিখুঁত কিছু সৃষ্টি করবে না, অথবা যতদূর আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি, প্রাকৃতিক অবস্থায় আমরা সর্বদা এই উচ্চ মানের সাক্ষাৎ পাই না। মুলার বলেছেন যে সবচেয়ে নিখুঁত অঙ্গ, যেমন মানুষের চোখে আলোর অপেরণের (aberration) সংশোধন নিখুঁত হয় না। মানুষের চোখের বিস্ময়কর ক্ষমতা ভালভাবে বর্ণনা করে হেলমহোজ্জ, যাঁর বিশ্লেষণ সম্পর্কে কেউ তর্ক করবে না, এইসব উল্লেখযোগ্য মন্তব্য যোগ করেছেন, “অপটিক্যাল যন্ত্র ও রেটিনার ওপর প্রতিবিম্বের অযথাযথতা এবং অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে আমরা যা আবিষ্কার করেছি। তা সংবেদনশীলতায় বেমানানদের তুলনায় কিছুই নয়! কেউ বলতে পারেন যে আভ্যন্তরীণ এবং বহির্বিশ্বের মধ্যে পূর্বে অবস্থিত সমন্বয়ের তত্ত্ব থেকে সমস্ত ভিত্তি অপসারণ করার জন্য অসংগতিগুলিকে পুঞ্জীভূত করে প্রকৃতি আনন্দ উপভোগ করেছে।” প্রকৃতিতে অননুকরণীয় অসংখ্য কৌশলগুলিকে পরম আনন্দের সঙ্গে প্রশংসা করতে যদি আমাদের যুক্তি পথপ্রদর্শকের কাজ করে, তাহলে সেই একই যুক্তি আমাদের বলে যে-যদিও উভয় ক্ষেত্রেই আমরা সহজেই ভুল করতে পারি–অন্য সব গঠনকৌশল কম নিখুঁত হয়। মৌমাছির হুলকে কি আমরা নিখুঁত বলে বিবেচনা করতে পারি বিভিন্ন ধরনের শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়ার সময় পিছনের দিকে ক্ৰকচের জন্য টেনে বের করা যেতে পারে না, এবং নাড়িভুড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য এটি অনিবার্যরূপে পতঙ্গটির মৃত্যু ঘটায়।
একই বিরাট বর্গের অন্য সব সদস্যদের মতো, বহু দূরবর্তী পূর্বপুরুষে অবস্থিত থাকা একটি গর্ত করা ও ক্রকচ (serrated) যন্ত্র হিসেবে আমরা যদি মৌমাছির হুলকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব এটি প্রথমে গল (gall) সৃষ্টির মতো অন্য কোন উদ্দেশ্যের জন্যে বিষযুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে বর্তমান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কম নিখুঁতভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। এ থেকে আমরা বোধহয় বুঝতে পারি কেমন করে যে হুলের ব্যবহার প্রায়শই পতঙ্গের নিজের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে : কারণ যদি সামগ্রিকভাবে হুল-ফোঁটানোর ক্ষমতাটি সম্প্রদায়ের পক্ষে উপকারী হয়, তাহলে এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করবে, যদিও এটি অল্প কিছু সদস্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে। আমরা যদি ঘ্রাণশক্তির প্রকৃত বিস্ময়কর ক্ষমতার তারিফ করি, যার দ্বারা অনেক পতঙ্গদের পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের খুঁজে পায়, এই একটি উদ্দেশ্যের জন্য হাজারে হাজারে পুরুষ-মৌমাছির সৃষ্টিকে কি আমরা তারিফ করতে পারি, যারা অন্য কোন উদ্দেশ্যের জন্য সম্প্রদায়ের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে অনুপকারী এবং অবশেষে পরিশ্রমী ও বন্ধ্যা বোনেদের দ্বারা নিহত হয়। এটি কষ্টকর হতে পারে, কিন্তু রাণী-মৌমাছির বন্য সহজাত প্রবৃত্তিকে আমাদের প্রশংসা করা উচিত, যা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে যুবতী রাণীদের অর্থাৎ নিজেদের কন্যাদের ধ্বংস করতে তাকে প্ররোচিত করে, অথবা জীবনসংগ্রামে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে তাকে প্ররোচিত করে, কারণ এটি সম্প্রদায়ের পক্ষে মঙ্গলকর; এবং মাতৃস্নেহ ও মাতৃঘৃণা, যদিও সৌভাগ্যক্রমে পরেরটি খুবই বিরল, হচ্ছে সকল প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনমনীয় নিয়মের মতোই। যদি আমরা কয়েকটি নিখুঁত কলাকৌশলের তারিফ করি যার দ্বারা অর্কিড ও অন্যান্য উদ্ভিদরা পতঙ্গদের মাধ্যমে নিষিক্ত হয়, তাহলে আমাদের ফার গাছের পরাগরেণুর ঘনরাশির সম্প্রসারণকে সমভাবে নিখুঁত হিসেবে আমরা কি বিবেচনা করতে পারি, যাতে কতিপয় কণা হঠাৎ বায়ুতাড়িত হয়ে ডিম্বকে এসে পড়তে পারে?
সারাংশ : টাইপের একত্বের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব দ্বারা অবলম্বিত বাঁচার পরিবেশের নিয়ম
এই অধ্যায়ে আমরা তত্ত্বটির বিরুদ্ধে উপস্থাপনযোগ্য প্রতিবন্ধক ও আপত্তিগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। এদের অনেকগুলি গুরতর, কিন্তু আমি মনে করি সৃষ্টির স্বতন্ত্র কার্যকলাপের বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে আলোচনায়। আমরা দেখেছি কোন একটি যুগের প্রজাতিরা অনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তনশীল নয় এবং অসংখ্য মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপের দ্বারা একত্রে সংযুক্ত নয়, যার আংশিক কারণ হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া সর্বদা মন্থর হয় এবং যে কোন একটি সময়ে শুধুমাত্র কতিপয় আকারের ওপর কার্যকরী হয়; বাকি আংশিক কারণ হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের যথাযথ প্রক্রিয়াটি পূর্ববর্তী ও মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপগুলির অনবরত স্থানচ্যুতি ও বিলুপ্তির ইঙ্গিত দেয়। একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে বসবাসকারী নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা নিশ্চয় সেই সময় সৃষ্টি হয়েছিল যখন অঞ্চলটি অবিচ্ছিন্ন ছিল না এবং যখন জীবন-পরিবেশ এক অংশ থেকে অন্য অংশে অজ্ঞাতসারে ক্রমে ক্রমে সরে যায় নি। একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলের দুটি জেলায় দুটি ভ্যারাইটি যখন সৃষ্টি হয়, তখন মধ্যবর্তী অঞ্চলের পক্ষে উপযুক্ত একটি মধ্যবর্তী ভ্যারাইটি প্রায়শই সৃষ্টি হবে, কিন্তু উল্লিখিত যুক্তিগুলি অনুসারে, মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিটি তাকে সংযুক্তকারী দুটি আকারের তুলনায় সংখ্যায় সাধারণত কম হবে; পরিণামে রূপান্তর-প্রক্রিয়া চলাকালীন অধিক সংখ্যায় থাকা পরবর্তী দুটি, কম সংখ্যক মধ্যবর্তী ভ্যারাইটির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকবে এবং এভাবে এরা তাকে স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করতে সমর্থ হবে।
এই অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছি যে এমন সিদ্ধান্ত করতে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে জীবনের অধিকাংশ ভিন্ন স্বভাবগুলি পরস্পরের মধ্যে ক্রমে ক্রমে চালিত হতে পারে না; যেমন, একটি বাদুড় প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা শুধুমাত্র বাতাসে ভেসে চলে এমন একটি প্রাণী থেকে সৃষ্টি হতে পারত না।
আমরা দেখিয়েছি যে নূতন জীবন-পরিবেশে কোন প্রজাতি তার স্বভাবসমূহের পরিবর্তন ঘটাতে পারে অথবা তার সবচেয়ে স্বগোত্রীয়দের তুলনায় কিছুটা অসদৃশভাবে নিজের স্বভাবসমূহকে বৈচিত্র্যমুখী করে থাকতে পারে। অতএব প্রত্যেক জীব যেখানে বাস করতে পারে সেখানেই বসবাস করার চেষ্টা করছে, এটি মনে রাখলে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে লিপ্তপদ সমেত উচ্চভূমির রাজহাঁস, ভূমিতে বসবাসকারী কাঠঠোকরা, ডুবুরি গ্লাস পাখি এবং অক পাখিদের মতো স্বভাববিশিষ্ট পেট্রেল পাখিদের উদ্ভব ঘটেছে।
যদিও বিশ্বাস করা হয় যে চোখের মতো এত নিখুঁত একটি অঙ্গ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে, তবুও এটি যে কোন ব্যক্তিকে বিচলিত করার পক্ষে যথেষ্ট; তথাপি যে কোন একটি অঙ্গের ক্ষেত্রে, জটিলতার ক্রমিক ধাপগুলির একটি দীর্ঘ সারি সম্পর্কে যদি আমরা জানি যে প্রত্যেকটিই তার অধিকারীর পক্ষে কল্যাণকর, তখন, জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিখুঁততার যে কোন কল্পনাসাধ্য মাত্রা অর্জনে যুক্তিসঙ্গত কোন অসম্ভাব্যতা নেই। যে ঘটনাগুলিতে আমরা কোন মধ্যবর্তী অথবা সংক্রমণগত অবস্থার কথা জানি না, সেখানে এই সিদ্ধান্তে আসতে আমাদের অতিশয় সতর্ক হতে হবে যে এ ধরনের কোন অবস্থা ছিলই না, কারণ অনেক অঙ্গের রূপান্তর থেকে দেখা যায় কার্যপদ্ধতিতে কী বিস্ময়কর পরিবর্তন সম্ভবপর হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পটকা আপাতভাবে বায়ুতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসকারী ফুসফুসে রূপান্তরিত হয়েছে। একই অঙ্গের যুগপৎ অতি ভিন্ন কার্য সম্পাদন করা এবং তারপর অংশত অথবা সামগ্রিকভাবে একটি কার্যের জন্য বিশিষ্ট হওয়া, এবং দুটি স্বতন্ত্র অঙ্গের একই সময়ে একই কার্য সম্পাদন করা, অন্যের সাহায্যে নিখুঁত হওয়া, প্রায়শই অবস্থান্তর প্রাপ্তিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকবে।
আমরা দেখেছি যে প্রকৃতিমণ্ডলে পরস্পরের থেকে বিপুল ব্যবধানে অবস্থিত দুটি জীরে একই উদ্দেশ্যসাধনকারী এবং বহিরাকৃতিতে অতিশয় সদৃশ অঙ্গগুলি পৃথকভাবে এবং স্বাধীনভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু এইসব অঙ্গগুলিকে গভীরভাবে পরীক্ষা করা হলে এদের গঠনে মৌলিক পার্থক্যগুলি সর্বদাই আবিষ্কার করা যেতে পারে; এবং এটি স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বানুযায়ী হয়। বিপরীতক্রমে, সমগ্র প্রকৃতিমণ্ডলে সাধারণ নিয়মটি হচ্ছে, একই উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য দেহগঠনের সীমাহীন বৈচিত্র্য, এবং এটিও আবার একই নিয়ম অনুসারে সংঘটিত হয়।
অনেক ক্ষেত্রে জোরের সঙ্গে বলতে আমরা নিতান্তই অজ্ঞ যে একটি প্রত্যঙ্গ অথবা অঙ্গ কোন প্রজাতির মঙ্গলের জন্য এত অপ্রয়োজনীয় যে তার দেহগঠনের রূপান্তরগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সঞ্চিত হয়ে থাকতে পারে না। অন্য অনেক ক্ষেত্রে, রূপান্তরগুলি হচ্ছে কোন সহায়তা লাভ করা ব্যতিরেকে পরিবর্তনের অথবা বৃদ্ধির নিয়মগুলির প্রত্যক্ষ ফল। কিন্তু এমনকি এরূপ দেহগঠনগুলিও-আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি–জীবনের নূতন পরিবেশে প্রজাতিদের ভালর জন্য প্রায়শই উপযুক্ত সুবিধা গ্রহণ করেছে। এবং আরও রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা এ-ও বিশ্বাস করতে পারি যে পূর্বে অতি প্রয়োজনীয় একটি প্রত্যঙ্গ প্রায়শই বজায় রয়েছে ( যেমন নিজের স্থলচর বংশধরদের মধ্যে একটি জলচর প্রাণীর লেজ), যদিও এটি এত কম প্রয়োজনের যে এটি এর বর্তমান অবস্থায় প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা অর্জিত হয়ে থাকতে পারে না।
প্রাকৃতিক নির্বাচন কেবলমাত্র অন্যের ভাল ও অন্যের ক্ষতির জন্য একটি প্রজাতিতে কিছুই সৃষ্টি করে না, যদিও এটি অন্য প্রজাতির পক্ষে অত্যন্ত উপকারী অথবা অপরিহার্য বা অতিশয় ক্ষতিকর প্রত্যঙ্গ, অঙ্গ ও ক্লেদাদি সৃষ্টি করতে পারে, যা সব ক্ষেত্রে একই সময়ে অধিকারীর পক্ষে উপকারী হয়। প্রত্যেক পরিপূর্ণ দেশে প্রাকৃতিক নির্বাচন অধিবাসীদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কার্যকরী হয়। এবং পরিণামে, ঐ বিশেষ দেশের। নিজস্ব মান অনুযায়ী জীবনসংগ্রামে এরা কৃতকার্য হয়। অতএব সাধারণত ছোট একটি দেশের অধিবাসীরা সাধারণত অন্য বড় দেশের অধিবাসীদের নিকট বশ্যতা স্বীকার করে। কারণ বৃহত্তর দেশে আরও বেশি একক এবং আরও বেশি বৈচিত্র্যময় আকারগুলি অবস্থান করে থাকবে এবং প্রতিযোগিতা কঠোরতর হবে, এবং এভাবে নিখুঁততার মান উচ্চতর হয়ে থাকবে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পূর্ণ নিখুঁততার দিকে অবশ্যম্ভাবীরূপে দিকনির্দেশ করে না; অথবা যতদূর আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারি, সর্বত্র সম্পূর্ণ নিখুঁততা সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে না।
প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী আমরা প্রাকৃতিক ইতিহাসের “প্রকৃতি লক্ষ্য দেয় না“ এই পুরানো প্রবাদটি সম্পূর্ণ অর্থ স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। পৃথিবীর শুধুমাত্র বর্তমান অধিবাসীদের ক্ষেত্রে যদি আমরা এটি মনে করি, তাহলে এই প্রবাদটি সম্পূর্ণ সত্য নয়; কিন্তু যদি আমরা অতীত যুগের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সমস্তগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করি, তাহলে এটি এই তত্ত্বানুযায়ী প্রকৃতই সত্য।
এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত যে সমস্ত জীব দুটি বিরাট নিয়মের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে–টাইপের একত্ব এবং বাঁচার পরিবেশ। টাইপের একত্বের অর্থ হচ্ছে দেহগঠনের মৌলিক সমন্বয়সাধন যা আমরা একই শ্রেণীর জীবগুলিতে দেখি, এবং যা এদের জীবন স্বভাব থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমার তত্ত্ব অনুযায়ী, টাইপের একত্ব ব্যাখ্যাত হয় বংশগতির একত্বের দ্বারা। কুভিয়ার কর্তৃক দৃঢ়ভাবে কথিত বাঁচার পরিবেশ অভিব্যক্তিটি প্রাকৃতিক নির্বাচন নীতির দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অবলম্বিত হয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন হয় প্রত্যেক জীবের পরিবর্তনশীল প্রত্যঙ্গগুলিকে তাদের জৈব এবং অজৈব জীবন পরিবেশে এখন উপযোগী করে অথবা অতীতকালৈ এদের উপযোগী করে তবেই কার্যকরী হয়। অভিযোজনসমূহ অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যঙ্গগুলির বর্ধিত ব্যবহার অথবা অব্যবহারের দ্বারা সাহায্য পেয়েছে ও জীবনের বহিঃপরিবেশের প্রত্যক্ষ ক্রিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রে বৃদ্ধি এবং পরিবর্তনের কতিপয় নিয়মের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়েছে। অতএব, প্রকৃতপক্ষে বাঁচার পরিবেশের নিয়মটি হচ্ছে উচ্চতর নিয়ম, যেহেতু এটি পূর্বের পরিবর্তন এবং অভিযোজনসমূহের বংশানুসৃতির মাধ্যমে টাইপের একত্বের বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করে।