০৬. জীবন মশায়ের মনে পড়ল

জীবন মশায়ের মনে পড়ল। এক কিশোর শাল আর এক কিশোর তমাল চারায় প্রতিযোগিতা হয়েছিল—তাতে কিশোর তমাল লজ্জা পায় নি।

নবগ্রামে মাইনর পাস করে জীবন ডাক্তার কাঁদী গেলেন এন্ট্রান্স পড়তে। কাঁদী রাজ হাই স্কুলে ভর্তি হলেন। এন্ট্রান্স পাস করে বর্ধমান মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হবেন। জীবনে সে কত কল্পনা, কত আশা। নিজের ডাক্তারি জীবনের ছবি অ্যাঁকতেন মনে মনে। রঙলাল ডাক্তারের মত গরদের পাতলুন আর গলাবন্ধ কোট পরে, সাদা একটা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াবেন এ অঞ্চল। বুকে সোনার চেনে বাঁধা সোনার পকেটঘড়ি। থারমোমিটার, স্টেথোসকোপ, কলবাক্স। ঘরে লক্ষ্মী ছিলেন, বাপও ছিলেন স্নেহময়, অর্থের অভাব ছিল না, জীবনের দেহেও ছিল শক্তি, মনেও ছিল সাহস; সুতরাং কাঁদীর পাঠ্যজীবনে উৎসাহের সূর্তির অভাব হয় নি। একদিকে করতেন হইহই, রইরই, অন্যদিকে বোর্ডিঙের তক্তপোশে শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন ভাবীকালে জীবন দত্ত এল. এম. এস, সাদা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন জীবনের মোড় ফিরে গেল। সদ্যযুবক জীবন দত্ত প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেমে পড়েছিলেন এক দরিদ্র কায়স্থ শিক্ষক-কন্যার। তার বয়স তখন আঠার, নায়িকার বয়স বার। সেকালে চোদ্দ বছরেই মেয়েরা যৌবনে প্রবেশ করত। দেহে মনে দুইয়েই তারা একালের বেণিদোলানো সতের বছরের মেয়েদের থেকে স্বাস্থ্য এবং মনে অনেক বেশি পরিপুষ্ট হয়ে উঠত। এ মেয়েটি আবার একটু বেশি পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছিল। আজকালকার মতে অকালপক্ব বললে একটু আপত্তি করেন জীবন ডাক্তার। বলেন অকালে পাকার আর সকালে পাকার তফাত আছে। অকালে যা পাকে তাতে গঠনে খুঁত থাকে; উপাদানে খামতি থাকে। কিন্তু সকালে যা পরিপুষ্টিতে পূর্ণতা লাভ করে পাকে তাতে খুঁত থাকে। না; যে-যে উপাদানের রস-পরিপূর্ণতায় স্বাভাবিকভাবে ফলই বল বা দেহমনই বল, রাঙিয়েওঠা রঙ ধরে মিষ্ট গন্ধে মনকে আকর্ষণ করে, তার সবই থাকে তার মধ্যে। বরং একটু বেশি পরিমাণেই থাকে, নইলে সকালে পাকে কী করে? মঞ্জরী একটু সকালে ফুটেছিল।

মেয়েটির নাম মঞ্জরী।

 

মঞ্জরীর স্বাস্থ্য ছিল সুন্দর। বার বছরের মঞ্জরী একালের কলেজে পড়া ষোড়শী বা পূর্ণিমার। চেয়ে স্বাস্থ্যে শক্তিতে পূর্ণাঙ্গী ছিল। শুধু চুল দেখে সন্দেহ হত যে মেয়েটি ষোড়শী নয়—কারণ। চুলগুলি পিঠ ছাড়িয়ে নিচে নামে নি। কালো চুলের রাশিটি পিঠ ছাড়িয়ে নিচে নামলে তবে ষোড়শী রূপটি পরিপূর্ণ হবার কথা। ঠিক কেমন জান? যেন কোজাগরী লক্ষ্মীপ্রতিমার পিছনে চালপট লাগানো হয়েছে অথচ তাতে ডাকসাজের বেড়টি এখনও লাগানো হয় নি। সেইগুলি অ্যাঁটা হলেই নিখুঁত হয়ে লক্ষ্মীপ্রতিমা হয়ে উঠবে। এইটুকু খুঁত ছিল। তার বেশি নয়।

 

একটু বাড়িয়ে বলা হয়েছে। জীবন ডাক্তার মনে মনেই সংশোধন করে নেন সেটুকু। লক্ষ্মীপ্রতিমা বটে—তবে শ্যামা। এবং তাতেই যেন অধিকতর মনোরম মনে হত মেয়েটিকে। মঞ্জরীর রূপটি তখন ছিল ভুঁইচাঁপার সবুজ নিটোল ডাঁটাটির মত, মাথায় এক থোকা ফুলের কুঁড়ি তখনও ফোটে নি; ফুটবার সব আয়োজন সম্পূর্ণ।

অন্তরের দিক থেকেও বার বছরের মঞ্জরী ষোড়শীর চেয়ে কম ছিল না। দেহের পরিপুষ্টিতায়, স্বাস্থ্যসমৃদ্ধির কল্যাণে সে তখন কিশোরীর মন পেয়েছিল। একেবারে ষোল আনার অধিকারীর চেয়েও বেশি, আঠার আনা বলা চলে; বলা চলে কেন, জীবন দত্তের হিসাবে তাই হয়। ষোল বছরে কৈশোর পূর্ণ হলে বয়স মেপে হিসেবের আইনে বার আনা তো পাওয়ারই কথা, ষোল আনার বাকি চার আনার দু আনা পূরণ করেছিল তার সমৃদ্ধ স্বাস্থ্য, বাকি দু আনা সেকালের ঘরের শিক্ষায় এবং মায়ের প্রদত্ত শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মন্ত্রপাঠের ফলে সে পেয়েছিল। এর ওপরও বাড়তি দু আনা মূলধন তার ছিল। সে পড়ে-পাওয়া নয়, সেটা সে পড়াশুনা করে পেয়েছিল। গরিব হলেও বাপ ছিলেন শিক্ষক, বাঙলা লেখাপড়া কিছু শিখিয়েছিলেন। বাপ শিশুবোধক থেকে বোধোদয় পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়ান নি, বলেছিলেন, কৃত্তিবাসী কাশীদাসী রামায়ণ মহাভারত পড়। কিন্তু রামায়ণ মহাভারত পড়েও সে ক্ষান্ত হল না। বৈষ্ণব পদাবলী থেকে ভারতচন্দ্র পর্যন্ত নিজেই পড়লে। ওগুলি বাড়িতেই তাদের ছিল। খাতায় লেখা পূর্বপুরুষের সম্পদ। এরপর বঙ্কিমচন্দ্র পেল হাতে। প্রতাপ-শৈবলিনী, জগৎসিংহ-আয়ের সঙ্গে পরিচয় হতেই ষোল আনা আঠার আনায় ফেঁপে উঠল। বঙ্কিমচন্দ্র তার হাতে এনে দিয়েছিল তারই বড় ভাই।

জীবন ওখানে সহপাঠী পেলে মঞ্জরীর বড় ভাই বঙ্কিমকে। বোর্ডিঙে জীবন নামক ছুটিয়েছিল; খরচ করত দরাজ হাতে। ওই যে বাপ জমিদারি কিনেছিলেন তারই হকটা জীবন ওখানে নানাপ্রকারে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে ভাল তামাকের গন্ধটা ছিল একটি বিশেষ প্রকার। ওই গন্ধে গন্ধে এলেন চতুরানন। বঙ্কিমের নামডাক ছিল চতুরানন। ছেলেরা বলত বঙ্কিম চার মুখে হুঁকো খায় চার মুখে কথা কয়। ভাল তামাকের গন্ধে এসে বঙ্কিমই আলাপ জমিয়ে তুললে। এবং আলাপের সূত্রে আবিষ্কার করলে যে, জীবন তাদের আত্মীয়। বঙ্কিমের মামা জীবনের নিজের মামির দেওরের আপন ভায়রার নাতজামাই। এবং একদা টেনে নিয়ে গেল নিজেদের বাসায়। বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল-জীবন আমাদের আপনার লোক বাবা। বঙ্কিমের বাবা নবকৃষ্ণ সিং সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দেন নি, তবুও তিনি পরিচয় পেয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেই সমাদর করলেন।

–দীনবন্ধু দত্ত মহাশয়ের পৌত্র তুমি? জগদ্বন্ধু দত্ত মহাশয়ের ছেলে? তোমরা তো মহাশয়ের বংশ গো। আয়ুর্বেদ তোমাদের কুলবিদ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুনেছি তোমার বাবা জমিদারি কিনেছেন।

পুলকিত হয়েছিল জীবন। সলজ্জমুখে মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভালই লেগেছিল এ প্রশংসাবাদ।

নবকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন–আমার বাড়িও তো তোমাদের ওই দিকে গো। চাকরি করি যাওয়া-আসা পুজোর সময় গরমের ছুটিতে বড় যাই না। দেশে তো সম্পত্তি তেমন কিছু নাই; বিঘে পাঁচ-সাত জমি, শরিকে শরিকে বিবাদ। কী করব গিয়ে? নইলে পাঁচ কোশ দূরে বাড়ি, আত্মীয়তাও যাহোক একটা আছে, আলাপ থাকত। তা ভাল হল আলাপ হল। কিন্তু

একটু ভুরু কুঁচকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন কিন্তু তুমি যে ইংরেজি পড়তে এলে?

প্রশ্নের মর্মার্থ বুঝতে পারে নি জীবন; উত্তরে প্রশ্নের সুরেই বলেছিল—আজ্ঞে?

—তোমাদের তো আয়ুর্বেদই এক রকম কুলগত বিদ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুলধৰ্মও বলতে পারি। এর জন্যে তোমার সংস্কৃত পড়া উচিত ছিল গো। ইংরেজি পড়তে এলে কেন? বিদ্যাই শুধু নয়, বাধা টাট, বাঁধা ঘর,সে এক রকম যজমানের মত। ওই থেকেই তো তোমাদের প্রতিষ্ঠা, মহাশয় উপাধি; জমি পুকুর জমিদারি সব তো ওই থেকে।

জীবন বলেছিল—আমার ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ব।

—ডাক্তারি! বাঃ বাঃ! খুব ভাল হবে। সে খুব ভাল হবে। মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন নবকৃষ্ণ সিংহ। তারপর তিনি বলেছিলেন যাও, বাড়ির ভিতরে যাও। বঙ্কিম, নিয়ে যা তোর মায়ের কাছে। তিনি তো হলেন আসল আত্মীয়। আমরা তো তার টানে-টানে আত্মীয়! যাও।

মঞ্জরী তখন উঠানে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আনি-মানি ঘুরছিল। গাছকোমর বেঁধে হাত দুটোকে দুদিকে প্রসারিত করে দিয়ে বনবন করে খাচ্ছিল ঘুরপাক। মুখে সে ছড়া আওড়াচ্ছিল–

আনি মানি জানি না
পরের ছেলে মানি না
লাগলে পরে নাইকো দোষ
মানব নাকো রাগ কি রোষ
সরে যাও–সরে যাও
নইলে এবার ধাক্কা খাও।

বলেই পাশে ঘুরন্ত ভাইদের কোনো একজনের সঙ্গে খাচ্ছিল ধাক্কা। একজন—সে ভাই-ই হোক বা বোনই হোক পড়ছিল। পড়ে গিয়ে কেউ অবশ্য এসব ক্ষেত্রে রাগ-রোষ সত্যই করে না, পড়ে শুয়েই থাকে চোখ বুজে, মনে হয় মাটি দুলছে—আকাশ দুলছে–ঘরগুলোও দুলছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে অতলের কি পাতালের দিকে সে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। সর্বাঙ্গ কেমন শিরশির করতে থাকে।

বঙ্কিম জীবনকে নিয়ে ঘরে যখন ঢুকল তখন মঞ্জরী পাক খেতে খেতে কাউকে ধাক্কা মারবার উদ্যোগ করছে এবং ঘুরপাকের বেগের মধ্যে ঠিক ঠাওর করতে না পেরে দাদা ভ্রমে জীবনের হৃৎপিণ্ডের উপর মারলে ধাক্কা; এবং নিজেই পড়ে গিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল। জীবন দত্ত থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। এদিকে মঞ্জরীর হাসিও স্তব্ধ হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের। মধ্যে। তার ভুল ভেঙেছে। দাদা ভ্ৰমে অপরিচিত একজনকে ধাক্কা মেরেছে বুঝে বিস্ময়ে ও লজ্জায় চোখ দুটো বড় করে ভূমিশয্যা থেকে উঠেই ও মাগো বলে ছুটে পালিয়ে গেল। গৃহাভ্যন্তরে। এবং আবার শুরু করলে খিলখিল হাসি। জীবন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

সে আমলে ওই যথেষ্ট।

 

ঘটনার ওইখানেই শেষ নয়, আরও আছে।

বঙ্কিম পলায়নপরা মঞ্জরীকে উদ্দেশ করে হেসে বলেছিল—মর হতচ্ছাড়ী! তারপর মায়ের সঙ্গে জীবনের পরিচয় করিয়ে দিলে। জীবন তাকে প্রণাম করতে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন না না। তুমি তো সম্পর্কে আমার বড় গো। আমার দাদা তোমার মাসিমার দেওরের ভায়রার নাতজামাই। সে হিসেবে তুমি আমার দাদার কোনো শ্বশুর-টশুর হবে। আমারও তাই তা হলে। বোসো, বোসো। প্রণাম আমিও তোমাকে করব না, তুমিও আমাকে কোরো না।

বঙ্কিম এ সম্পর্ক নির্ণয়ে খুব খুশি হয়েছিল—তা হলে তো তার সঙ্গে সম্পর্ক আর এক পর্ব তফাত অর্থাৎ তৃতীয় পুরুষ। নাতি দাদামশায় সম্পর্ক রসিকতার অবাধ অধিকার।

মা খাবার আনতে উঠে যেতেই বঙ্কিম ভিতরে গিয়ে মঞ্জরীকে ডেকে বলেছিল—আয় না হতচ্ছাড়ী, দাদামশায় দেখবি।

–কে? মঞ্জরীর কণ্ঠস্বর ঈষৎ চাপা হলেও শুনতে পাচ্ছিল জীবন।

–দাদামশায় রে!

–দূর! ওই আবার দাদামশায় হয়! ও একটা বুনো শুয়োর, মা গোকী হেঁতকা চেহারা, কালো রঙ!

—ছি! তুই ভারি ধিঙ্গি হচ্ছিস দিন দিন। আমাদের বড় মামা হল ওর মাসিমার দেওরের নিজের নাতজামাই।

—মরণ! সইয়ের বউয়ের বকুলফুলের বোনপোবউয়ের বোনঝি-জামাই!

–না। না। উঠে আয়, আমার বন্ধু। খুব ভাল ঘরের ছেলে।

–ভাল ঘরের ছেলে তো এমন হেতকা বুনো শুয়োরের মত চেহারা কেন?

–কী যা বলছিস? বীরের মত চেহারা। মুগুর ভাঁজে কিনা!

—তা হলে পড়তে না এসে যাত্রার দলে ভীম সাজতে গেল না কেন? আমরা সত্যিকারের ভাল গদাযুদ্ধ দেখতে পেতাম। তুই যা—আমি যাব না।

বঙ্কিম একটু ক্রুদ্ধ হয়েই ফিরে এল।

জীবনও বন্য বরাহের মত মাথা হেঁট করেই বসে ছিল; খুব প্রীতিপ্রদ নয়, তরুণ বয়সে ও কথায় কারুরই পুলক-সঞ্চার হয় না। সে চলে আসবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। বললে—আজ যাব ভাই, কাজ আছে।

মা ঠিক এই সময়েই জলখাবারের থালা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। থালাখানি নামিয়ে দিয়ে ডাকলেন মঞ্জী কই? মঞ্জী—জল নিয়ে আয় এক গেলাস। মঞ্জী!

মাটি বড় রাশভারী লোক। অমান্য সহজে করা যায় না। জীবন ওই কণ্ঠস্বর শুনেই না বলতে গিয়েও বলতে পারলে না। মঞ্জরীও মিনিটখানেকের মধ্যেই জলের গেলাস হাতে বেরিয়ে এল।

মা বললেন– প্রণাম কর। দাদার বন্ধুই শুধু নয়, আমাদের আপনার লোক। তাদের দাদামশায় হয়।

মঞ্জরী মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসতে লাগল।

–হাসছিস যে? প্ৰণাম কর।

–ওইটুকু আবার দাদামশাই হয়?

–হয়। মামা-কাকা বয়সে ছোট হয় না? তুলসীপাতার ছোট বড় আছে?

মঞ্জরী এবার প্রণাম করলে। সে আমলে গড় করে প্রণাম করত। এ আমলের মত হেঁট হয়ে পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকানো প্ৰণাম নয়। উঠেই আবার হাসতে লাগল।

মা বিরক্ত হয়েই বললেন– হাসছিস কেন?

–দাদামশাই মিলছে না বলে হাসছি।

–কী? কী মিলছে না?

–দাদামশায়ের গালে কাদা কই? ছড়ায় আছে, ঠাকুরদাদা গালে কাদা–। বলেই মঞ্জরী হাসতে হাসতেই চলে গেল।

এরপর কিশোর জীবন দত্তের অবস্থার কথা বোধ করি না বললেও চলে।

সে একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠল। মঞ্জরী! মঞ্জরী! মঞ্জরীকে সে জয় করবেই। কিন্তু অকস্মাৎ পথ রোধ করে দাঁড়াল একজন।

এই হল সেই ছেলে যার সঙ্গে বিবাদ করে জীবনের সমস্ত আশা বিসর্জন দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। অভিজাত বংশের উগ্ৰ দাম্ভিক ছেলে ভূপতিকুমার বসু। লোকে ডাকত ভূপী বসু বলে। ভূপী বসুওখানকার নামজাদা দুর্দান্ত। মাঝখানে শহরে-বাজারে বেশ গা দুলিয়ে হেলে দুলে যে মাতঙ্গ-গমন ধরনের চলনটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ওখানে অর্থাৎ কাঁদী অঞ্চলে আমদানি করেছিল ভূপী বোস। সে যখন যে পাখানা ফেলত-তখন তার সর্বাঙ্গটা সেই দিকে লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যেন হেলে যেত। সামনে বা পিছনে যারা থাকত তারা বাধ্য হয়ে দেখত; পাশে যারা চলত—যাদের পাশে তাকাবার অবকাশ থাকত না, তারা এই দোলার ধাক্কা খেয়ে তাকিয়ে সভয়ে সরে যেত; ওরে বাবা, ভূপী বসু যাচ্ছে।

ভূপী বসু ছিল গৌরবর্ণ দীর্ঘাকৃতি। মাথায় রেখেছিল বাবরি চুল; জমিদারের বাড়ির ছেলে। এই ভূপীও ছিল বঙ্কিমের বন্ধু। অনেক আগে থেকেই সে মঞ্জরীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল।

সুতরাং ভূপী বোসের সঙ্গে আরম্ভ হল প্রতিযোগিতা। ব্যাঘ্র-বরাহ-সংবাঁদরচনা শুরু করলেন কৌতুকপ্রিয় বিধাতা। ভূপী বোস ব্যাঘ্ৰ, জীবন দত্ত বরাহ। এ নাম মঞ্জরী দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *