ও পাড়ার দাসীঠাকরুন আসিয়া হাসিমুখে বলিল–পয়সা দুটোর জন্য এয়েছিলাম বৌ, ইন্দির পিসি কাল আমার কাছ থেকে একটা নোনা নিয়ে এল, বল্লে, কাল দাম গিয়ে চেয়ে নিয়ে এসো–
সর্বজয়া ঘরের কাজকর্ম করিতেছিল, অবাক হইয়া বলিল–নোনা কিনে এনেছে তোমার কাছ থেকে?
দাসীঠাকরুন ঘোর ব্যবসাদার মানুষ। সামান্য তেঁতুল আমড়া হইতে একগাছি শাক পর্যন্ত পয়সা না লইয়া কাহাকেও দেয় না। দাসীর অমায়িক ভাব অন্তহিত হইয়া গেল। বলিল–এনেচে কিনা জিজ্ঞেস করো না তোমার ননদকে! সকালবেলা কি মিথ্যে বলতে এলাম দুটো পয়সার জন্য? চার পয়সার কমে আমি দেবো না-বললে বুড়োমানুষ খাবার ইচ্ছে হয়েছে—তা যাক দু’পয়সাতেই–
রাগে সর্বজয়ার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। নোনার মতো ফল যাহা কিনা এত অপর্যাপ্ত বনে জঙ্গলে ফলে যে গরু-বাছুরের পর্যন্ত খাইয়া অরুচি হইয়া যায়, তাহা আবার পয়সা দিয়া কিনিয়া খাইবার লোক যে পাড়াগাঁয়ে আছে, তাহা সর্বজয়ার ধারণায় আসে না।
ঠিক এই সময় ইন্দির বুড়ি কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। সর্বজয়া তাহার উপর যেন ঝাঁপাইয়া পড়িয়া বলিল–বলি হ্যােগা, তিন কাল গিয়েছে, এককালে তো ঠেকেচ, যার বসে খাই তাঁর পয়সায় তো একটু দুখ-দরদ করে চলতে হয়? নোনা গিয়েচ কিনতে? কোথা থেকে তোমায় বসিয়ে আজ নোনা কাল দানা খাওয়াব? শখের পয়সা নিজে থেকে নিয়ে দাওগে যাও, পরের ওপর দিয়ে শখ করতে লজা হয় না?
বুড়ির মুখ শুকাইয়া গিয়াছিল, তবুও একটুখানি হাসি আনিবার চেষ্টা করিয়া বলিল–তা দে বৌ–পাকা নোনাডা, তা ভাবলাম নিই খেয়ে, কড়া দিনই বা বাঁচবো? তা দিয়ে দে দুটো পয়সা–
সর্বজয়া চতুগুণ চিৎকার করিয়া বলিল–বড় পয়সা সস্তা দেখোঁচ কিনা? নিজের ঘটিবাটি আছে, বিক্রি করে নিয়ে দাও গিয়ে পয়সা–
পরে সে ঘড়া লইয়া খিড়কি দুয়ার দিয়া ঘাটের পথে বাহির হইয়া গেল।
দাসী খানিকটা দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল-আমার নাকে খত কানে খত, জিনিস বেচে এমন হয়রান তো কখনও হইনি!! তোমায়ও বলি ইন্দির পিসি, নিজের পয়সাই যদি না ছিল। তবে তোমার কাল নোনাটা আনা ভালো হয়নি বাপু, ও-রকম ধারে জিনিসপত্তর আর এনো না। তা তোমাদের ঝগড়া তোমরা করো, আমি গরিব লোক, ও বেলা আসবো, আমার পয়সাদুটো বাপু ফেলে দিয়ো–
দাসীর পিছু পিছু খুকি। বাহিরের উঠান পর্যন্ত আসিল। বলিতে বলিতে আসিল–পিসিমা বুড়ো মানুষ, একটা নোনা এনেছে, তা বুঝি বকে? খেতে ইচ্ছে হয় না, হ্যাঁ দাসীপিসি? বেশ নোনা, আমায় আধখানা কাল দিয়েছে–তোমার বাড়ি বুঝি গাছ আছে পিসি?–পরে সে ডাকিয়া কহিল–শোনো না দাসীপিসি, আমি একটা পয়সা দেবো এখন, পুতুলের বাক্সে আছে, মা ঘরে চাবি দিয়ে ঘাটে গেল, এলে নুকিয়ে দেবো এখন, মাকে বোলো না যেন পিসি।
দুপুরের কিছু পূর্বে ইন্দির বুড়ি বাড়ি হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে। বাঁ হাতে ছোট একটা ময়লা কাপড়ের পুটুলি, ডানহাতে পিতলের চাদরের ঘটিটা বুলানো, বগলে একটা পুরোনো মাদুর, মাদুরের পাড় ছিড়িয়া কাঠিগুলি বুলিতেছে।
খুকি। বলিল, ও পিসি, যাসনে–ও পিসি কোথায় যাবি? পরে সে ছুটে আসিয়া মাদুরের পিছনটা টানিয়া ধরিল। তুই চলে গেলে আমি কাঁদবো পিসি—ঠিক–
সর্বজয়া ঘরের দাওয়া হইতে বলিল, তা যাবে যাও, গোরস্তর অকল্যাণ করে যাওয়া কেন? ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করি, এতকাল যার খেলে তার একটা মঙ্গল তো দেখতে হয়, অনখ সময়ে না খেয়ে চলে গিয়ে তারপর গোরস্তর একটা অকল্যেণ বাধুক, এই তোমার ইচ্ছে তো? ওই রকম কুচকুরে মন না হলে কি আর এই দশা হয়?…
বুড়ি ফিরিল না। খুকি। কাঁদিতে কাঁদিতে অনেক দূর পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে গেল।
বুড়ি গিয়া গ্রামের ও-পাড়ার নবীন ঘোষালের বাড়ি উঠিল। নবীন ঘোষালের বউ সব নিয়া গালে হাত দিয়া বলিল-ওমা, এমন তো কখনও শুনিনি, হ্যাগো খুড়ি? তা থাকো মি, এইখানেই থাকো।
মাস-দুই সেখানে থাকার পর বুড়ি সেখান হইতে বাহির হইয়া তিনকড়ি ঘোষালের বাড়ি ও তথা হইতে পূর্ণ চক্রবর্তীর বাড়ি আশ্রয় লইল। প্রত্যেক বাড়িতেই প্রথম আপ্যায়নের হৃদ্যতটুকু কিছুদিন পর উবিয়া যাওয়ার পরে বাড়ির লোকে নানা রকমে বিরক্তি প্ৰকাশ করিত। পরামর্শ দিত ঝগড়া মিটাইয়া ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইতে। বুড়ি আরও দু’এক বাড়ি ঘুরিল, সব সময়ই তাহার ভরসা ছিল বাড়ি হইতে আর কেহ না হয়, অন্তত হরিহর ডাকিয়া পাঠাইবে। কিন্তু তিনমাস হইয়া গেল, কেহই আগ্ৰহ করিয়া ডাকিতে আসিল না। দুৰ্গাঁও আসে নাই। বুড়ি জানে ও-পাড়া হইতে এ-পাড়া অনেক দূরে, ছোট মেয়ে এতদূর আসিতে পারে না। সে আশায় আশায় ও-পাড়ায় দু’একবার গেল, খুকির সঙ্গে দেখা হইল না।
বারো মাস লোকের বাড়ি আশ্রয় হয় না। পুব-পাড়ার চিন্তে গয়লানীর চালা ঘরখানি পড়িয়া ছিল–মাস দুই পরে সকলে মিলিয়া সেই ঘরখানি বুড়ির জন্য ঠিক করিয়া দিল এবং ঠিক করিল পাড়া হইতে সকলে কিছু কিছু সাহায্য করিবে। ঘরখানা নিতান্ত ছোট, ছিটে বেড়ার দেয়াল, পাড়া হইতে দূরে, একটা বাঁশবনের মধ্যে। লোকের মুখে শুনিত সর্বজয়া নাকি বলিয়াছে–তেজ দেখুক পাঁচজনে। এ বাড়ি আর না, আমার বাছাদের মুখের দিকে যে তাকায়নি—তাকে আর আমার দোরে মাথা গলাতে হবে না, ভাগাড়ে পড়ে মরুক গিয়ে।
যাহাদের সাহায্য করিবার কথা ছিল, তাহারা প্রথম দিনকতক খুব উৎসাহের সঙ্গে জোগাইল, ক্রমে কিন্তু তাহাদের আগ্রহও কিমিয়া গেল। বুড়ি ভাবে, কেন সেদিন অত রাগ করে চলে এলাম? বেী বারণ কল্লে, খুকি। কত কাঁদলে, হাতে ধরে টানাটানি কল্লে–! নিজের উপর অত্যন্ত দুঃখে চোখের জলে দুই তোবড়ানো গাল ভাসিয়া যায়। বলে—শেষ কালডা এত দুঃখুও ছিল আদেষ্টে-আজ যদি মেয়েডাও থাকতো–
চৈত্র মাসের সংক্রান্তি। সারাদিন বড় রৌদ্রের তেজ ছিল, সন্ধ্যার সময় একটু একটু বাতাস বহিতেছে, গোসাঁইপাড়ায় চড়কের ঢাক এখনও বাজিতেছে, মেলা এখনও শেষ হয়। नाङ्ग्रे।
রৌদ্রে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরিয়া ও দুর্ভাবনায় বুড়ির রোজ সন্ধ্যার পরে একটু একটু জ্বর হয়। সে মাদুর পাতিয়া দাওয়ায় চুপ করিয়া শুইয়া আছে, মাথার কাছে মাটির ভাঁড়ে জল। পিতলের চাদরের ঘটিটা ইতিমধ্যে চার আনায় বাঁধা দিয়া চাল কেনা হইয়াছে। জ্বরের তৃষ্ণায় মাঝে মাঝে একটু একটু জল মাটির ভাঁড় হইতে খাইতেছে।
–পিসিমা!…বুড়ি কাঁথা ফেলিয়া লাফাইয়া উঠিল, দাওয়ার পৈঠায় খুকি উঠিতেছে, পিছনে তাহাদের পাড়ার বেহারী চক্কত্তির মেয়ে রাজী। খুকির পরনে ফরসা কাপড়, আঁচলের প্রান্তে কি সব পোটলা-পুটলি বাঁধা। বুড়ির মুখ দিয়া বেশি কথা বাহির হইল না। প্রবল আগ্রহে সে শীর্ণ হাত বাড়াইয়া তাহাকে জ্বরতপ্ত বুকে জড়াইয়া ধরিল।
–বলিসনে কাউকে পিসি, কেউ যেন টের পায় না, চড়ক দেখে সন্দেবেলা চুপি চুপি এলাম, রাজীও এলো আমার সঙ্গে, চড়কের মেলা থেকে এই দ্যাখ, তোর জন্যে সব এনেচি–
খুকি। পুটলি খুলিল।
–মুড়কি পিসিমা, তোর জন্যে দু’পয়সার মুড়কি আর দুটো কদমা আর খোকার জন্যে একটা কাঠের পুতুল–।
বুড়ি ভালো করিয়া উঠিয়া বসিল। জিনিসগুলো নাড়িতে চাড়িতে বলিল–দেখি দেখি, ও আমার মানিক, কত জিনিস। এনেচে দ্যাখে। রাজরানী হও, গরিব পিসির ওপর এত দয়া! দেখি খোকার কাঠের পুতুলডা! বাঃ দিব্যি পুতুল-কডা পয়সা নিলে?…
এক ঝোঁক কথাবার্তার পরে খুকি। বলিল–পিসি, তোর গা যে বড্ড গরম?
–সমস্ত দিন টিউরে বেড়িয়ে এই রকমডা হয়েছে, তাই বলি একটু শুয়ে থাকি–
ছেলেমানুষ হইলেও দুর্গা পিসিমার রৌদ্রে ঘুরিবার কারণ বুঝিল। দুঃখে ও অনাহারে শীর্ণ পিসিমার গায়ে সে সস্নেহে হাত বুলাইয়া বলিল, তুই অবিশ্যি করে বাড়ি যাস-সন্দে বেলা গল্প শুনতে পাইনে, কিছু না-কাল যাবি—-কেমন তো?
বুড়ি আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া উঠিল, বলিল, বৌ বুঝি তোকে কিছু বলে দিয়েছে আজ?
রাজী বলিল–খুড়িমা তো কিছু বলে দেয়নি পিসিমা, ওকে তো এখানে খুড়িমা আসতে দেয় না। আমরা বললে বকে, তবে তুমিও যেয়ো পিসিমা। তুমি একটুখানি বোলো, তাহলে খুড়িমা আর কিছু বলবে না–
খুকি। বলিল-কাল তুই ঠিক যাস পিসি, মা কিছু বলবে না।–তাহলে এখন বাড়ি যাই পিসি, কাউকে যেন বলিসনে? কাল সকালে ঠিক যাস কিন্তু।
সকালে উঠিয়া বুড়ি দেখিল শরীরটা একটু হালকা। একটু বেলা হইলে ছোট্ট পুটুলিতে ছেড়া-খোঁড়া কাপড় দু’খানা ও ময়লা গামছাখানা বাঁধিয়া বুড়ি বাড়ির দিকে চলিল। পথে গোপী বোষ্টমের বৌ বলিল, দিদি ঠাকরুন, তা বাড়ি যােচ্ছ বুঝি?? বৌদিদির রাগ চলে গিয়েছে বুঝি?
বুড়ি একগাল হাসিল, বলিল–কাল দুৰ্গা যে সন্দে বেলা ডাকতে গিয়েছিল, কত কাঁদলে, বল্লে, মা বলেচে-চ’ পিসি বাড়ি চ’—তা আমি বল্লাম–আজ তুই যা, কাল সক্কাল বেলাডা হোক, আমি বাড়ি গিয়ে উঠবো।–মেয়ের আমার কত কান্না, যেতে কি চায়!..তাই সকালে যাচ্ছি।
বুড়ি ঢুকিয়া দেখিল কেহ বাড়ি নাই। কাল সারারাত জ্বর ভোগের পর এতটা পথ রৌদ্রে দুর্বল শরীরে আসিয়া বোধ হয় অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল, পুটুলিটা নামাইয়া সে নিজের ঘরের দাওয়ার পৈঠায় বসিয়া পড়িল।
একটু পরেই খিড়কি দোর ঠেলিয়া সর্বজয়া স্নান করিয়া নদী হইতে ফিরিল। এদিকে চোখ পড়িলে বুড়িকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া সে বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া একটুখানি দাঁড়াইল বুড়ি হাসিয়া বলিল–ও বৌ, ভালো আছিস? এই অ্যালাম অ্যাদ্দিন পরে, তোদের ছেড়ে আর কোথায় যাবো এ বয়সে–তাই বলি–
সর্বজয়া আগাইয়া আসিয়া বলিল–তুমি এ বাড়ি কি মনে করে?
তার ভাবভঙ্গি ও গলার স্বরে বুড়ির হাসিবার উৎসাহ আর বড় রহিল না। সর্বজয়া কথার উত্তর দিতে না দিয়াই বলিল–এ বাড়ি আর তোমার জায়গা কিছুতেই হবে না– সে তোমাকে আমি সেদিন বলে দিয়েচি–ফের কোন মুখে এয়েচ?
বুড়ি কাঠের মতো হইয়া গেল, মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। পরে সে হঠাৎ একেবারে কাঁদিয়া বলিল–ও বৌ, আমন করে বলিসনে–একটুখানি ঠাই দে আমারে–কোথায় যাবো। আর শেষকালডা বল দিকিনি—তবু এই ভিটেটাতে–
–ন্যাও, আর ভিটের দোহাই দিতে হবে না, ভিটের কল্যাণ ভেবে তোমার তো ঘুম নেই, যাও এক্ষুনি বিদেয় হও, নইলে অনাথ বাধাবো–
ব্যাপার এরূপ দাঁড়াইবে বুড়ি বোধ হয় আদৌ প্রত্যাশা করে নাই। জলমগ্ন ব্যক্তি যেমন ডুবিয়া যাইবার সময় যাহা পায় তাহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে চায়, বুড়ি সেইরূপ মুঠা আঁকড়াইয়া আশ্রয় খুজিতে লক্ষ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক চাহিল–আজ তাহার কেমন মনে হইল যে, বহুদিনের আশ্রয় সত্য সত্যই তাহার পায়ের তলা হইতে সরিয়া যাইতেছে, আর তাহাকে ধরিয়া রাখিবার উপায় নাই।
সর্বজয়া বলিল–যাও আর বসে থেকে না ঠাকুরঝি, বেলা হয়ে যাচ্ছে আমার কাজকর্ম আছে, এখানে তোমার জায়গা কোনোরকমে দিতে পারবো না–
বুড়ি পুঁটুলি লইয়া অতিকষ্টে আবার উঠিল। বাহির দরজার কাছে যাইতে তাহার নজর পড়িল তাহার উঠান-ঝাঁটের ঝাঁটাগাছটা পাঁচিলের কোণে ঠেস দেওয়ানো আছে, আজ তিন-চারি মাস তাহাতে কেহ হাত দেয় নাই। এই ভিটার ঘাসটুকু, ওই কত যত্নে পোঁতা লেবু গাছটা, এই অত্যন্ত প্রিয় ঝাঁটাগাছটা, খুকি, খোকা, ব্ৰজ পিসের ভিটা–তার সত্তর বৎসরের জীবনে এ সব ছাড়া সে আর কিছু জানেও নাই, বুঝেও নাই।
চিরকালের মতো তাহারা আজ দূরে সরিয়া যাইতেছে।
সজনেতলা দিয়া পুটুলি বগলে যাইতে পিছন হইতে রায়বাড়ির গিন্নি বলিল–ঠাকমা, ফিরে যাচ্ছে কোথায়? বাড়ি যাবে না? উত্তর না পাইয়া বলিল–ঠাকমা আজকাল কানের মাথা একেবারে খেয়েছে।
বৈকালে ও-পাড়া হইতে কে আসিয়া বলিল–ও মা-ঠাকরুন, তোমাদের বুড়ি বোধ হয় মরে যাচ্ছে, পালিতদের গোলার কাছে দুপুর থেকে শুয়ে আছে, রোদুরে ফিরে যাচ্ছিল, আর যেতে পারেনি–একবার গিয়ে দেখে এসো—দাদাঠাকুর বাড়ি নেই? একবার পাঠিয়ে দেও না।
পালিতদের বড় মাচার তলায় গোলার পাশে ইন্দির ঠাকরুন। মরিতেছিল একথা সত্য। হরিহরের বাড়ি হইতে ফিরিতে ফিরিতে তাহার গা কেমন করে, রৌদ্রে আর আগাইতে না পারিয়া এইখানেই শুইয়া পড়ে। পালিতেরা চণ্ডীমণ্ডপে তুলিয়া রাখিয়াছিল। বুকে পিঠে তেল মালিশ, পাখার বাতাস, সব করিবার পরে বেশি বেলায় অবস্থা খারাপ বুঝিয়া নামাইয়া রাখিয়াছে। পালিত-পাড়ার অনেকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কেহ বলিতেছে– তা রোদুরে বেরুলেই বা কেন? সোজা রোদুরটা পড়েচে আজ? কেহ বলিতেছে–এখুনি সামলে উঠবে এখন, ভিরমি লেগেছে বোধ হয়–
বিশু পালিত বলিল–ভিরমি নয়। বুড়ি আর বাঁচবে না, হরিজেঠা বোধ হয় বাড়ি নেই, খবর তো দেওয়া হয়েচে, কিন্তু এতদূর আসে কে?
শুনিতে পাইয়া দীনু চক্রবর্তী বড় ছেলে ফণী ব্যাপার কি দেখিতে আসিল। সকলে বলিল–দাও দাদাঠাকুর, ভাগ্যিস এসে পড়েচ, একটুখানি গঙ্গাজল মুখে দাও দিকি। দ্যাখো তো কাণ্ড, বামুনপাড়া না কিছু না—কে একটু মুখে জল দেয়?
ফণী হাতের বৈঁচিকাঠের লাঠিটা বিশু পালিতের হাতে দিয়া বুড়ির মুখের কাছে বসিল। কুশি করিয়া গঙ্গাজল লইয়া ডাক দিল–ও পিসিমা!
বুড়ি চোখ মেলিয়া ফ্যাল ফ্যাল করিয়া মুখের দিকে চাহিয়াই রহিল, তাহার মুখে কোন উত্তর শুনা গেল না। ফণী আবার ডাকিল–কেমন আছেন পিসিমা? শরীর কি অসুখ মনে হচ্ছে?
পরে সে গঙ্গাজলটুকু মুখে ঢালিয়া দিল। জল কিন্তু মুখের মধ্যে গেল না, বিশু পালিত বলিল–আর একবার দাও দাদাঠাকুর–
আর খানিকক্ষণ পরে ফণী বুড়ির চোখের পাতা বুজাইয়া দিতেই কোটরগত অনেকখানি জল শীর্ণ গাল-দুটা বাহিয়া গড়াইয়া পড়িল।
ইন্দির ঠাকরুনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল।