প্ৰমীলা রহস্যময়ী
অনেকসময়ই তার আচরণের দিক দিয়ে নারী রহস্যময়ী হয়ে দাঁড়ায়। এরূপ এক রহস্যময়ী নারীর বিশ্বস্ত চিত্র এঁকেছেন বাঙলার অপরাজেয় কথাশিল্পী বিমল মিত্ৰ তাঁর ‘আসামী হাজির’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের নায়িকা নয়নতারা এক রহস্যময়ী নারী। বিমল মিত্র তার এই উপন্যাসে নয়নতারার যে জীবনকাহিনী বিবৃত করেছেন, তার আকে-বাকে নয়নতারার আচরণ নয়নতারাকে এক রহস্যময়ী নারী করে তুলেছে। অথচ এই জীবনকাহিনীর মধ্যে কাল্পনিক কিছু নেই। আমাদের বাস্তবজীবনে আমরা নয়নতারাকে এখানে সেখানে সর্বত্রই দেখতে পাই। সেদিক থেকে বিমল মিত্রের এই কাহিনী এক চলমান সমাজের জীবন্ত চিত্র। এই অসামান্য উপন্যাসখানা র্যারা পড়েননি, ভঁাদের সকলকেই অনুরোধ করব, উপন্যাসখানা পড়তে। অবশ্য র্যারা বিমল মিত্রের অন্যান্য উপন্যাস পড়েছেন, তঁরা জানেন যে বিমল মিত্ৰ গত তিনশো বছরের বাঙালী জীবনের প্রশস্ত রাজপথ ও তার আলিগলির ভিতর প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রজন্মের বাঙালী নারীর যে স্বরূপ দেখেছেন ও আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন, তাতে নারী সর্বত্রই রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। তার মানে নারীর একটা কালজয়ী রূপ আছে। সে রূপ হচ্ছে নারী রহস্যময়ী।
নয়নতারা কেষ্টনগরের পণ্ডিতমশাই কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান। পণ্ডিতমশাইয়ের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। সেজন্য তিনি তাঁর প্রিয় ছাত্ৰ নিখিলেশকেই সবসময়ে ডাকেন নিত্যনৈমিত্তিক জিনিসপাত্তর কেনাকাটার জন্য, অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকবার জন্য, ওষুধপত্তর কিনে আনার জন্য।
নয়নতারা অপরূপা সুন্দরী। তার রূপ দেখেই নবাবগঞ্জের জমিদার নরনারায়ণ চৌধুরীর পরিবার তাকে পছন্দ করেছিল, নরনারায়ণের নাতি সদানন্দের সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্ম। বিয়ে কয়ে সদানন্দ যখন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, নবাবগঞ্জের লোক তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল নয়নতারার রূপ দেখে। সকলে একবাক্যে বলেছিল, এ যেন ডানাকাটা পরী। কথাটা শুনে নয়নতারার আনন্দ হয়েছিল। তখন সে ভাবেনি যে তার এত রূপ ব্যর্থ হবে সদানন্দকে তার সান্নিধ্যে আনতে।
সদানন্দ বিদ্বান ছেলে। বি. এ. পাস করেছে। কিন্তু তার মনোভাব এলোমেলো, আচার-আচরণ ছন্নছাড়া। নরনারায়ণের বিরাট ঐশ্বর্যের প্ৰতি সে বিমুখ। সে জেনেছিল নরনারায়ণের এই বিরাট বৈভবের রস্ত্ৰে রন্ধে লুকিয়ে আছে পাপের শাখা-প্ৰশাখা।
প্ৰথমজীবনে নরনারায়ণ ছিল কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর পনেরো টাকা মাইনের নায়েব। হর্ষনাথের ছিল অগাধ বিশ্বাস নরনারায়ণের ওপর। কিন্তু শেষজীবনে হৰ্ষনাথের চৈতন্যোদয় হয়েছিল। তিনি সজ্ঞানে নবদ্বীপের গঙ্গায় দেহত্যাগ করেন। মরবার সময় তিনি নরনারায়ণকে বলেছিলেন-বাবা, আমি চললাম, তুমি আমার বিধবাকে। দেখো। কয়েকদিনের মধ্যেই রহস্যজনকভাবে হর্ষনাথের ওয়ারিশনদের মৃত্যু ঘটল। নরনারায়ণ জমিদারীটা গ্ৰাস করে নিয়ে, নিজে জমিদারী পত্তন করল নবাবগঞ্জে। হর্ষনাথের অসহায়া বিধবা ‘কালীগঞ্জের বউ মামলা করল। নরনারায়ণ সে-মামলা ভঙুল করে দিল, তাকে দশ হাজার টাকা নগদ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
দশ বছর ধরে কালীগঞ্জের বউ এসেছে নরনারায়ণের কাছে ওই টাকার জন্য। কিন্তু নরনারায়ণ তাকে দেয়নি। দিয়েছে কেবল স্তোকবাক্য ও আশা। সদানন্দ নিজের চোখে দেখেছে তার দাদুর এই প্রতারণামূলক আচরণ। আরও দেখেছে যে, মাত্র চার পয়সার জন্য নিরীহ নিরপরাধ পায়রাপোরাকে ঠগ বানিয়ে তার সর্বনাশ করা হয়েছে। মনের দুঃখে সে আত্মহত্যা করেছে গলায় দড়ি দিয়ে। অথচ প্ৰকৃত ঠগ হচ্ছে কৈলাস গোমস্তা। সে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে বাবুদের নেকনজরে রয়ে গিয়েছে। সদানন্দ আরও দেখেছে যে একইভাবে সর্বনাশ করা হয়েছে মানিক ঘোষ ও ফটিক প্রামাণিকদেরও! বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে সদানন্দের মন, পাপের ওপর প্রতিষ্ঠিত নরনারায়ণের জমিদারীর ওপর।
নরনারায়ণ চায় এইভাবে তার জমিদারীর প্রসার ঘটুক। নিরবচ্ছিন্নভাবে তার বংশধারা চলুক। এই জমিদারীর ধারা সংরক্ষণে। সেজন্যই তিনি সদানন্দর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের দিন সদানন্দ হল নিরুদেশ। তার প্রকাশ মামা তাকে ধরে নিয়ে এল। কালীগঞ্জের বউয়ের বাড়ি থেকে। সদানন্দ বলে, আগে তোমরা কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা দাও, তবে আমি বিয়ে করব। নরনারায়ণ বলে, তুই বিয়ে করে এলেই আমি কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা দিয়ে দেব। বিয়ে করে এসে সদানন্দ কালীগঞ্জের বউয়ের টাকা চায়। কিন্তু নরনারায়ণ কথার খেলাপ করে।
বিয়ের ফুলশয্যার দিন রবাহুত হয়ে আসে কালীগঞ্জের বউ, সদানন্দের বউকে আশীৰ্বাদ করতে। আবার টাকার কথা ওঠে। নরনারায়ণ তাকে কড়া কথা বলে। উঠোনে দাড়িয়ে কালীগঞ্জের বউ অভিশাপ দেয়, ‘নারায়ণ, তুমি নির্বংশ হবে। ’
নরনারায়ণ বংশী ঢালীকে ডেকে গোপনে কি নির্দেশ দেয়। ইতিহাসের পাতা থেকে চিরকালের মতো কালীগঞ্জের বউ ও তার চার পালকিবাহক উধাও হয়ে যায়। সদানন্দ গোপনে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ আসে। কিন্তু অতীতের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। টাকা পেয়ে পুলিশ চলে যায়।
সদানন্দ এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। বিতৃষ্ণায় তার মন ভরে ওঠে। এর প্রতিঘাত গিয়ে পড়ে নয়নতারার ওপর। ফুলশয্যার দিন রাত্রে সে নয়নতারার সঙ্গে এক-বিছানায় শোয় না। সে ঘর থেকে পালায়। নিয়নতারার মন বিষাদে ভরে যায়। এদিকে খবর আসে যে ওই ফুলশয্যার দিন রাত্রেই কেষ্টনগরে তার মা কন্যা-বিচ্ছেদ সইতে না পেরে মারা গেছেন।
বাবাকে শান্ত করার জন্য নয়নতারাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হয়। নয়নতারা আবার ফিরে আসে ৷ ভট্টাচাৰ্যমশাইও একদিন নিজে নয়নতারার বাড়ি আসেন। যাবার সময়ে মেয়েকে আশীৰ্বাদ করে যান —‘মুখে থাক মা, স্বামীর সংসারে লক্ষ্মী হয়ে থাকো, মনেপ্রাণে স্বামীর সেবা কর, মেয়েমানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় আশীৰ্বাদ আর নেই। তুমি মনেপ্ৰাণে স্বামীর ঘর কর, তাই দেখেই তোমার মায়ের স্বৰ্গত আত্ম সুখী হবে।‘
এদিকে নবাবগঞ্জে সদানন্দর শয়নঘরে সেই একই দৃশ্য। শাশুড়ী রুষ্ট হয়ে বউকে ভৎসনা করে বলে,’তোমার রূপ নিয়ে কি আমরা ধুয়ে খাব ৷ আমাদের এই বিরাট ঐশ্বৰ্য ভোগ করবার জন্য চাই নাতি। সেজন্যই তো তোমাকে আমরা এনেছি। তুমি যেরকমভাবে পারি, তোমার রূপ দিয়ে সদাকে বশীভূত করে, আমাকে নাতি এনে দাও।‘
নয়নতারা সেদিন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে আর শোবার ঘরে নিৰ্বাক দৰ্শক হয়ে থাকে না। আজ সদানন্দকে সে বশীভুত করবেই। আজ তাকে সে বিছানায় টেনে আনবেই। আর তা নয়তো, সে একটা হেস্তনেস্ত করবে। একটা মোকাবিল এর চাই-ই।
কিন্তু সদানন্দ অচল অটল। নয়নতারার কথার উত্তর না দিয়ে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু নয়নতারা পিঠ দিয়ে কপাট চেপে ধরে, সদানন্দর মুখোমুখি হয়ে বলে–’তুমি না-হয় তোমার বাপঠাকুরদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছ, কিন্তু আমি কেন তোমার সঙ্গে প্ৰায়শ্চিত্ত করতে যাব? তারপর কথা-কাটাকাটি হয়। হঠাৎ সদানন্দ টেবিল থেকে একটা কাঁচের দোয়াতদানি তুলে নিয়ে কপালে ঠুকতে থাকে। কপাল ফুঁড়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দেয়। তাই দেখে নয়নতারা অজ্ঞান হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। সদানন্দ ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর থেকেই সে হয়। নিরুদ্দেশ।
এদিকে শব্দ শুনে শাশুড়ী প্রীতিলতা ছুটে এসে দেখে রক্তাক্ত মেঝের ওপর নয়নতারা অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। চৈতন্য ফেরবার সঙ্গে সঙ্গেই নয়নতারা প্রশ্ন করে, উনি কেমন আছেন? গ্ৰীতিলতা বলে, সদানন্দ ভাল আছে, উপরের ঘরে শুয়ে আছে। নয়নতারা বলে, আমি ওঁকে একবার দেখতে যাব। শ্ৰীতি বলে, ডাক্তারের মানা আছে, তুমি পরে দেখা কোরে।
রাত্রে যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে, নয়নতারা সদানন্দকে দেখবার জন্য চুপিচুপি উপরে উঠে যায়। কিন্তু যা দেখে, তা তার চােখের সামনে খুলে দেয় নবাবগঞ্জের ইতিহাসের আর এক কদৰ্য পৃষ্ঠা। কিছুদিন যাবৎ নরনারায়ণ অসুস্থ হয়েছেন। কৃপণ পুত্র হরনারায়ণ চিকিৎসার খরচে বিব্রত হয়ে পড়েছে। নয়নতারা জানালার ফঁাক দিয়ে দেখে খরচের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য তার শ্বশুর তার পিতাকে গলা টিপে মেরে ফেলছে।
সদানন্দ আর ফেরেনি। নয়নতারা একলাই শয়নঘরে শোয়। শাশুড়ী বলে—বউম শোবার অাগে ভাল করে দরজায় খিল দেবে। একদিন শাশুড়ী হঠাৎ বলে বৌমা, আজ থেকে তুমি দরজায় খিল না। দিয়েই শোবে। নয়নতারা তো অবাক। কেন এরকম বিন্দকুটে নির্দেশ! রাত্রে ভয়ে তার ঘুম এল না। বিহুনায় জেগেই পড়ে রইল। রাত্রে দেখে ঘরের দরজাটা খুলে একজন পুরুষমানুষ তার ঘরে ঢুকল। নয়নতারা তাকে চিনতে পারল-তার শ্বশুর। নয়নতারা আঁতকে ওঠে। লোকটা ভয় পেয়ে বেরিয়ে যায়। পরের দিন লোকটা ঘরে ঢুকে তার গায়ে হাত দেয়। এক ঝটকা মেরে নয়নতার হাতটা সরিয়ে দেয়। তারপর বিছানা থেকে উঠে জানালার ধারে দাড়িয়ে পাশে বিহারী পালের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বিহারী পালকে নবাবগজের – জমিদাররা দেখতে পারে না, কেননা ইদানিং কালে লড়াইয়ের মৌকায় বিহারী পালের সমৃদ্ধি বেড়েছে। কিন্তু বিহারী পালের স্ত্রী নয়নতারাকে খুব ভালবাসে। নয়নতারা তাকে দিদিমা বলে। শ্বশুরের কুৎসিত প্রয়াসে সন্ত্রস্তা হয়ে নয়নতারা পরের দিন বিহারী পালের বাড়ি গিয়ে দিদিমার কাছে আশ্রয় নেয়। ভোরের আগেই নিজের ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু শাশুড়ী সব টের পেয়ে নয়নতারাকে শাসায় সে যেন বিহারী পালের স্ত্রীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক না রাখে।
নয়নতারার বিদ্রোহী মন জ্বলে ওঠে। বিহারী পালের স্ত্রীকে সে বলে, ‘কাল আপনি নবাবগঞ্জের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আমাদের বৈঠকখানায় আসতে বলবেন।‘
পরের দিন বার-বাড়িতে নবাবগঞ্জের সমস্ত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমবেত হতে দেখে, নয়নতারার শ্বশুর বিস্মিত। জিজ্ঞাসাবাদে জানে তার বৌমা তাদের আসতে বলেছে। ক্ষণিকের মধ্যে নয়নতারা সেখানে উপস্থিত হয়ে, সমবেত জনমণ্ডলীর কাছে নবাবগঞ্জের কুৎসিত ইতিহাস বিবৃত করে যায়। তার শ্বশুর যে তার সতীত্বনাশের চেষ্টায় প্ৰবৃত্ত হয়েছে, সে-কথাও সে বলে। জনমণ্ডলী রায় দেয়, নয়নতারাকে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। বাপের বাড়ি যাবার আগে নয়নতারা কুয়োতলায় গিয়ে হাতের শাখা ভেঙে ফেলে, হাতের নোয়া খুলে জঙ্গলের দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়, কুয়োর জলে সিথির সিঁদুর ধুয়েমুছে ফেলে।
কেষ্টনগরে তার বাবার সামনে গিয়ে যখন নয়নতারা দাঁড়ায়, বাবা নয়নতারার এয়োস্ত্রী চিহ্নসমূহ না দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। প্রশ্ন করেন, ‘আমার জামাই কোথায়? নয়নতারা উত্তর দেয়, ‘নেই, নেই, নেই। তোমার জামাই কোনদিন ছিল না, এখনও নেই। আমি তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে চলে এসেছি। এখন আমি তোমার কাছেই থাকব।‘ নয়নতারার উক্তি বৃদ্ধ ভটচার্যি মশাইকে নিদারুণ মানসিক আঘাত দেয়। বৃদ্ধ সহ্য করতে পারেন না। স্ট্রোক হয়। মারা যান। তাঁর প্রিয় ছাত্ৰ নিখিলেশই তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যায়,।
শ্মশান থেকে ফিরে এসেই নিখিলেশ নয়নতারার কাছে প্ৰস্তাব করে, ‘তুমি আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী হয়ে এস।‘ নিয়নতারা তখন শোকে মুহমান। একমাত্র অবলম্বন বাবাকে হারিয়ে ভবিষ্যৎ তখন তার কাছে অন্ধকার হয়ে গেছে। নয়নতারার সমস্ত মন নিখিলেশের ওপর বিষিয়ে ওঠে। মনে হয় যেন নিখিলেশ এতদিন তার বাবার মৃত্যুর জন্যই প্ৰতীক্ষা করছিল। যেন নয়নতারার অসহায়তার সুযোগ খুঁজছিল সে। যেন নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসাটাই তার কাছে কাম্য ছিল। কিন্তু তারপরেই মনে পড়ে তার আশ্রয়ের কথা, তার জীবিকানির্বাহের কথা, তার নিজের ভরণপোষণের কথা। তখন তার চোখের সামনে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, বোধহয় বর্তমান বলেও কিছু নেই। শুধু আছে একটা অতীত, তা সেটা স্মরণ করতেও তার ভয় হয়। নয়নতারা নিখিলেশের কাছে আত্মসমপণ করে। একদিন কলকাতায় এসে তাদের বিয়ে রেজেষ্ট্রি হয়ে যায়। তারা যেমন বলল, তেমনি সই করল সে। রেজেষ্ট্রি অফিসে তারা কী প্রশ্ন করল, তা তার কানে ভাল করে ঢুকল না। কালীঘাটে গিয়ে সিথিতে সিঁদুরও পরানো হল। তারপর তারা নৈহাটিতে এসে একটা বাড়ি ভাড়া করে। নিখিলেশ তাকে যা বলত, সে তাই-ই করতে চেষ্টা করত। সে যেন এক কলের পুতুল। নিখিলেশ তাকে দম দিয়ে ছেড়ে দিত, আর সে কলের পুতুলের মতো শুত, ঘুমোত, ভাৰত, হাসত, নড়ত-সবকিছু করত। কিন্তু তার মধ্যে কোন প্ৰাণ ছিল না। নিখিলেশ তাকে বাড়িতে পড়িয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে, একটা সরকারী চাকরিও যোগাড় করে দেয়। নিখিলেশের অফিস আগে শুরু হয়। সেজন্য সে আগের ট্রেনে কলকাতায় আসে। নয়নতারা পরের ট্রেনে কলকাতায় আসে অফিস করতে। দু’জনে একসঙ্গেই বাড়ি ফেরে। মনে হয় নয়নতারার জীবন সহজ সরল হয়ে গেছে। কিন্তু আয়নার সামনে দাড়িয়ে সে যখন সিঁথিতে সিন্দুর পরে, মনে হয় কে যেন তার পিছনে দাড়িয়ে রয়েছে। লজ্জায় ঘেন্নায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলে। রাত্রে নিখিলেশের পাশে সে যখন শুয়ে থাকে, এক এক দিন একটা পুরানো মুখের ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে চমকে ওঠে।
এদিকে নবাবগঞ্জের ইতিহাসে ওলট-পালট ঘটে যায়। নয়নতারার শাশুড়ী গ্ৰীতিলতা মারা যায়। শ্ৰীতিলতা ছিল সুলতানপুরের জমিদার কীৰ্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান। গ্ৰীতিলতাই ছিল তাঁর বিরাট জমিদারির একমাত্র ওয়ারিসান। গ্ৰীতিলতার মৃত্যুর পর, কীৰ্তিপদবাবুও একদিন মারা যান। নবাবগঞ্জে নিঃসঙ্গ জীবন হরনারায়ণের পক্ষে অসহনীয় হয়ে ওঠে। নবাবগঞ্জের সমস্ত সম্পত্তি প্ৰাণকৃষ্ণ শা’কে চার লক্ষ টাকায় বেচে দিয়ে, হরনারায়ণ সুলতানপুর চলে যায়। কিন্তু ওই সম্পত্তি ভোগ করা প্ৰাণকৃষ্ণর সাইল না। সেও একদিন মারা গেল। তারপর নবাবগঞ্জের জমিদারদের বাড়ি ভগ্নকূপে পরিণত হয়।
হরিনারায়ণ সুলতানপুরে কৃচ্ছতা অবলম্বন করে পাউরুটি ও দুধ খেয়ে জীবন কাটাতে থাকে। একদিন সুলতানপুরের লোক দেখে, হরিনারায়ণ আর শোবার ঘরের দরজা খোলে না। শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তারা দেখে হরনারায়ণের জীবনাবসান ঘটেছে।
এদিকে সদানন্দর জীবনেও বিচিত্ৰ ঘটনাপ্রবাহ ঘটে যায়। বউবাজারের বিরাট ধনশালী ব্যক্তি সমরজিৎবাবু একদিন সদানন্দকে রানাঘাট স্টেশন থেকে তাঁর বাড়ি নিয়ে আসেন। সমরজিৎবাবু নিঃসন্তান বলে সুশীল সামন্ত নামে একটি ছেলেকে পুষ্যি নিয়েছিলেন। তাকে মানুষ করে তার বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু সুশীল সামন্ত পুলিশের চাকরিতে ঢুকে মদ্যপ ও বেশ্যাসক্ত হওয়ায়, সমারজিৎবাবু তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে, তার সমস্ত সম্পত্তি সদানন্দকে দেবার মতলব করেন। টের পেয়ে সদানন্দ কাউকে কিছু না বলে সমরজিৎবাবুর বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।
সদানন্দর এখন আশ্রয়স্থল বড়বাজারে পড়েজির ধরমশালা। পাড়েজি ধরমশালার ম্যানেজার। লোক ভালো। সদানন্দকে দুটো টুইশনি যোগাড় করে দেয়। কিন্তু সদানন্দ ছেলে পড়িয়ে যে টাকা পায়, ধরমশালায় নিয়ে আসে না। পথে ভিখারীদের বিলিয়ে দেয়। তাদের কাছে সদানন্দ ‘রাজাবাবু। ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে দেখে, পাড়েজি সদানন্দকে একখানা আলোয়ান কিনে দেয়। সদানন্দ সেটা এক নিরাশ্রয়া বুড়ীকে বিলিয়ে দেয়। ঠাণ্ড লেগে সদানন্দ অসুখে পড়ে। পাড়েজি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। সুস্থ হয়ে সে পড়েজিকে বলে, আমি একবার নবাবগঞ্জ থেকে ঘুরে আসি। ক্লান্তি, অবসাদ ও অনশনে নৈহাটির কাছে সে ট্রেনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ট্রেনের গার্ড তাকে নৈহাটি স্টেশনে নামিয়ে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করছে, এমন সময়ে একজন মহিলা ভিড় ঠেলে, সামনে এসে বলে, ওঁকে আপনার হাসপাতালে পাঠাবেন না। আমি ওঁকে বাড়ি নিয়ে যাব। উনি আমার নিকট আত্মীয়। আমার নাম নয়নতারা ব্যানাজি।
অচৈতন্য সদানন্দকে নিজ বাড়িতে এনে, নয়নতারা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে যায়। গড়িয়ে গড়িয়ে দু’মাস গত হয়, তবুও সদানন্দর জ্ঞান ফেরে না। নিরলসভাবে রাত জেগে৷ নয়নতারা তার সেবা করে যায়। চাকরি হবার পর নয়নতারা কিছু টাকা ব্যাঙ্কে জমিয়েছিল। নয়নতারার ইচ্ছে ছিল। কয়েক বছর পরে যখন আরও কিছু টাকা হবে তখন কলকাতা শহরে তারা একটা বেশ ছোটখাটো সাজানো-গোজানো বাড়ি করবে। কিন্তু সদানন্দর চিকিৎসার জন্য সে-সব টাকা নিঃশেষিত হয়ে যায়। নিখিলেশের দেওয়া দশ ভরির সোনার হারটাও সে বাধা দেয়। দিনের পর দিন, রাত জেগে সদানন্দের মাথার ওপর সে আইস-ব্যাগ ধরে বসে থাকে। ডাক্তারবাবু তো দেখে অবাক। বলেন, লোকের স্ত্রী তো দূরের কথা, নিজের মা-ও এমনভাবে সেবা করতে পারে না।
কিন্তু নিখিলেশ চটে লাল। তার মনে হয় তার জীবনটা যেন ছত্ৰখান হয়ে গেছে। নয়নতারাকে সে বলে, ওকে তুমি হাসপাতালে পাঠিয়ে দাওনা। তারপর যখন দেখে যে তার কথায় কোন কাজ হল না, তখন সে সদানন্দকে মারবার জন্য ওষুধের বদলে বিষ কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু ডাক্তারবাবুর নজরে পড়ায় সদানন্দ বেঁচে যায়। নয়নতারা শিশিটা তুলে রাখে, যদি কোনদিন ওটা তার নিজের কোন কাজে লাগে!
তারপর একদিন সদানন্দর জ্ঞান ফিরে আসে। সামনে নয়নতারাকে দেখে সে বিস্মিত হয়। তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ট্রেনের মধ্যে কিভাবে সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, নয়নতারা তাকে দেখতে পেয়ে নিজের বাড়িতে এনে কিভাবে তাকে ভাল করে তুলেছে, সব শোনে। একমুহূর্তও তার সেখানে থাকতে ভালো লাগে না। নিখিলেশের আচরণ থেকে সে বোঝে যে তার উপস্থিতির ফলে, নয়নতারার সুখের সংসারে চিড় ধরেছে। একদিন কাউকে কিছু না বলে সে সেখান থেকে সরে পড়ে। নয়নতারা নিখিলেশকে পাঠায় তার খোজে। নবাবগঞ্জে। নিখিলেশ নবাবগঞ্জে না গিয়ে, ফিরে এসে নয়নতারাকে বলে, সদানন্দ আবার বিয়ে করে দিব্যি সুখে আছে। কিন্তু নয়নতারার মনে সংশয় জাগে। সে নিজে নবাবগঞ্জে গিয়ে দেখে, নিখিলেশ তাকে সব মিছে কথা বলেছে। নিখিলেশের ওপর তার বিতৃষ্ণা হয়। সে আলাদা ঘরে শুতে থাকে। তারপর সে ঠিক করে, সে কলকাতায় গিয়ে মেয়েদের এক বোডিং-এ থাকবে।
এদিকে নৈহাটি থেকে চলে আসবার পর, সদানন্দর সঙ্গে তার প্রকাশ মামার দেখা হয়। প্রকাশ মামা তাকে নিয়ে যায়, হরনারায়ণ ও কীর্তিপদীর একমাত্র ওয়ারিসন হিসাবে সদানন্দকে দিয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করবার জন্য। সদানন্দ এখন আট লক্ষ টাকার মালিক। চার লক্ষ টাকা সে দান করে নবাবগঞ্জের লোকদের স্কুলকলেজ ও হাসপাতাল করবার জন্য, আর বাকী চার লক্ষ টাকা নিয়ে সে আসে। নৈহাটিতে নয়নতারার বাড়ি। ঠিক সেই মুহুর্তেই নয়নতারা বেরিয়ে যাচ্ছিল কলকাতায় মেয়েদের বোডিং-এ থাকবার জন্য। সদানন্দকে সে বাড়ির ভিতরে এনে নিজের ঘরে বসায়। নিখিলেশ সেদিন সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে নয়নতারার ঘরে সদানন্দকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। সদানন্দকে সে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারপর দেখে টেবিলের ওপর। সদানন্দ একটা প্লাষ্টিকসের ব্যাগ ফেলে গেছে। ব্যাগ খুলে দেখে তার ভিতর রয়েছে একখানা চার লক্ষ টাকার চেক নিখিলেশ ও নয়নতারার নামে। চেকখানা পাবার পর নিখিলেশ ও নয়নতারার মধ্যে সমস্ত মনোমালিন্য কেটে যায়। আবার তাদের মধ্যে ভাব হয়।
নিখিলেশ তাকে নয়নতারার বাড়ি থেকে বের করে দেবার পর, সদানন্দ আবার চলতে থাকে। শেষে এসে দাঁড়ায় ও আশ্রয় পায় চৌবেড়িয়ায় রসিক পালের আড়তবাড়িতে। কিছুকাল পরে সেখানে আবির্ভাব ঘটে সদানন্দর দ্বিতীয় সত্তার-হাজারি বেলিফের, যে এতদিন ছায়ারূপে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হাজারি বেলিফ বলে, আপনি আপনার পিতাকে খুন করেছেন, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে। হাজারি বেলিফকে সে অনুরোধ করে একবার তাকে যেন সুলতানপুর, নবাবগঞ্জ ও নৈহাটিতে নিয়ে যায়। আত্মগোপন করে সে সুলতানপুরের লোকদের জিজ্ঞাসা করে, সদানন্দ চৌধুরীকে তারা চেনে কিনা। একবাক্যে সকলে বলে, সদানন্দ চৌধুরী তো তার বোপকে খুন করবার পর থেকে পলাতক। নবাবগঞ্জে এসে দেখে অন্তদ্বন্দ্বে স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল সব জ্বলছে আর এই অশান্তির কারণ হিসাবে নবাবগঞ্জের লোক সদানন্দকে অভিশাপ দিচ্ছে। নৈহাটিতে এসে শোনে, নিখিলেশ ও নয়নতারা সেখানে থাকে না। লটারিতে চার লক্ষ টাকা পেয়ে, তারা থিয়েটার রোডে বাড়ি করে সেখানে থাকে। থিয়েটার রোডে এসে দেখে সেখানে সেদিন উৎসব, নয়নতারার প্রথম সন্তানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। এমবেসির লোক, পুলিশের বড়সাহেবরা, আরও কত কে বিশিষ্ট অতিথি সেখানে আসছে। সদানন্দ ও হাজারি বেলিফকে দারোয়ানরা সামনের গেট থেকে তাড়িয়ে দেয়। পিছনের সিড়ি দিয়ে উঠে তারা দাঁড়ায় মুখোমুখি হয়ে নয়নতারার সামনে। নয়নতারা প্ৰথমে সদানন্দকে চিনতে পারেনি, ভেবেছিল ডেকরেটরের লোক। তারপর সদানন্দকে চিনতে পেরে বলে, ওঃ তুমি, আজ আমি খুব ব্যস্ত, তুমি কাল এস। এই কথা বলে সে অতিথি আপ্যায়নের কাজে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ এক আর্তনাদের শব্দ শুনে ছুটে আসে। সদানন্দ তার দ্বিতীয় সত্তা হাজারি বেলিফকে খুন করেছে। পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে যাচ্ছে এমন সময় দু’হাত বাড়িয়ে নয়নতারা বাধা দিতে যায় } বলে, ‘তোমরা ওঁকে অ্যারেস্ট কোরোনা। যত টাকা লাগে আমি দেব, আমার যথাসৰ্বস্ব দেব। উনি আমার স্বামী। ’ থিয়েটার রোডের বাড়িটার পরিবেশ একমুহুর্তে বদলে যায়। সকলেই স্তম্ভিত। কেবল নিখিলেশ নয়। সে নয়নতারাকে বলে, কী পাগলামি করছি! কথাটা শুনে নয়নতারা অজ্ঞান হয়ে মেঝের ওপর পড়ে যায়। তার চোখের জলে তার মুখের ও গালের ম্যাকস ফ্যাকটর’ ধুয়ে মুছে যায়। তার কানে কেবল বাজতে থাকে সদানন্দর বলা শেষ কথাগুলো-’আমি আসামী, আমি মানুষকে বিশ্বাস করেছিলুম, আমি মানুষকে ভালবেসেছিলুম, আমি মানুষের শুভ কামনা করেছিলুম, আমি চেয়েছিলুম। মানুষ সুখী হােক, আমি চেয়েছিলুম মানুষের মঙ্গল হোক। কিন্তু আজি এই পনেরো বছর পরে জানলুম মানুষকে বিশ্বাস করা, মানুষকে ভালবাসা, মানুষের শুভ কামনা করা পাপ, আমি তাই আজ পাপী, আমি তাই আজ অপরাধী, আমি তাই আজ আসামী, আমাকে আপনার আমার পাপের শাস্তি দিন, আমাকে ফাঁসি দিন–।‘ বইখানির এইখানেই ইতি।
বিমল মিত্রের ৮৫৫ পাতার বই ‘আসামী হাজির’ উপন্যাসের এটাই হচ্ছে একটা সংক্ষিপ্ত কঙ্কাল বা কাঠামো। কিন্তু কুলাল-শিল্পী যেমন কাঠামোতে মাটি লেপে, রঙ চাপিয়ে, তাকে সুন্দর মূর্তিতে পরিণত করে, বিমল মিত্রও তাই করেছেন। বস্তুত বইখানির ‘ইসথেটিক বিউটি’ (aesthetic beauty) বা নান্দনিক সৌন্দৰ্য উপলব্ধি করতে হলে, সমগ্র বইখানি পড়া দরকার। এক ছাদের তলায় স্ত্রীর দুই স্বামীর সহাবস্থান, এবং দু’জনের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা পালনের melody আমি আর কোন উপন্যাসে পড়িনি। বেদ-পুরাণেও নয়। এ বই প্ৰমাণ করে, কথাশিল্পী হিসাবে বিমল মিত্ৰ কত বড় প্ৰতিভাশালী লেখক। বাংলা ভাষায় পূর্বে এরূপ বই লেখা হয়নি, পরেও হবে না। জীবন সম্বন্ধে এখনি এক মহাকাব্য-এ হিউম্যান স্টোরি। একমাত্র বিমল মিত্রের পক্ষেই এ-রকম বই লেখা সম্ভবপর হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে অ-সাধারণ লোককে, ‘ভালো মানুষ’কে জগতের লোক ভুল বোঝে। মানুষ সৎ হলে, তার যে কি শোচনীয় পরিণতি হয়, এখানা তারই এক বিশ্বস্ত দলিল। আর দেখিয়েছেন নারী চরিত্র কত দুর্ভেদ্য। নারী চরিত্রের এই দুৰ্ভেদ্যতাই নারীকে রহস্যময়ী করে তুলেছে। নারীর অবচেতন মনের গভীরে যে বাসনা বাসা বাধে, সেখানে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলে, তা অনুধাবন করা খুবই কঠিন। কিন্তু বিমল মিত্ৰ নারীর সেই অবচেতন মনকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। ধরেছেন, উচ্ছাস বা আবেগময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে নয়,-সংলাপ ও আচরণের মাধ্যমে, চরিত্র অঙ্কনের বিশিষ্ট মুন্সিয়ানাতে, বিচিত্র ও জটিল ঘটনাপ্রবাহের বিন্যাসে ও নারীর বাহ্যিক আচরণের ভিতর দিয়ে।
সদানন্দর পাশাপাশি তিনি চিত্রিত করে গেছেন, একজন কদাচারী ইতয়া ব্যক্তিকে, নিখিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নিখিলেশ যে একজন দুনীতিপরায়ণ ইতর ব্যক্তি সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। নৈহাটির বাড়িতে একদিন সামান্য কথা-কাটাকাটির মধ্যে নিখিলেশ নয়নতারাকে ‘স্কাউণ্ডেল’ বলে গালি দিয়ে অপমান করেছিল। কিন্তু সে নিজে যে কতবড় স্কাউণ্ডেল, তা সে নিজে কোনদিনই বুঝতে পারল না। তা না হলে যে পণ্ডিতমশাইয়ের সে ছিল প্রিয় ও বিশ্বাস্ত ছাত্র, সেই পণ্ডিতমশাইয়ের মৃত্যুতে তার বিন্দুমাত্ৰ শোক হল না। পণ্ডিতমশাইকে শ্মশানে দাহ করে ফিরে আসবার পরমুহুর্তেই সে পণ্ডিতমশাইয়ের অসহায় ও শোকে মুহ্যমান কন্যা নয়নতারার কাছে বিবাহের প্ৰস্তাব করে বসল। সব জেনেশুনেই সে পরস্ত্রীকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করবার লোভ সামলাতে পারল না। নয়নতারার রূপই তাকে লুব্ধ করল। মাত্র রূপ নয়। অর্থগৃধুতাও। নয়নতারার কোনদিনই কোন বিধিসম্মত বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেনি। সুতরাং শেষমূহুর্ত পর্যন্ত নয়নতারা পরস্ত্রীই ছিল। শেষমূহুর্তে থিয়েটার রোডের বাড়ির উৎসবের সমারোহের মধ্যে যখন নয়নতারা প্ৰকাশ্যে সদানন্দকেই স্বামী বলে ঘোষণা কয়ল, তখনও সে নয়নতারার ওপর তার লোভ পরিহার করতে পারল না। সে ভালো করেই জানত যে, যে-সমাজের মধ্যে তার ও নিয়নতারার অবস্থান সে-সমাজে এক নারীর দুই স্বামীর সহাবস্থান অবৈধ। এ কথা জেনেও সে নয়নতারার হাত ধরতে গিয়েছিল, বলেছিল-কী পাগলামি করছি। নয়নতারা নিখিলেশের ভুল ভাঙেনি দেখেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। নয়নতারা নিখিলেশকে ভালোরূপেই জানত। জানত তার ওপর নিখিলেশের অবৈধ আসক্তি ও লোলুপতা, জানত তার অর্থগৃষ্ণুতা, যার জন্য সে নয়নতারাকে চাকরি করতে বাধ্য করেছিল, জানত নিখিলেশ তার গহনাগুলোর লোভে নির্লজভাবে সেগুলো তার শ্বশুরবাড়িতে চাইতে গিয়েছিল, জানত সদানন্দকে বিষ খাইয়ে মারবার জন্য নিখিলেশ বিষ কিনে এনেছিল। এসব জেনেও সে নিখিলেশের সঙ্গে পনেরো বছর ‘কাগজের বউ’ সেজে ঘর করেছিল! এখানেই নয়নতারা রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। অথচ তার অন্তরাত্মা বা অবচেতন মন নিখিলেশকে চায়নি, চেয়েছিল। সদানন্দকে। সেজন্যই আয়নার সামনে সে যখন সিথিতে সিঁদুর পরতে যেত তখন সে নিজের পিছনে সদানন্দকে দেখত। রাত্রে নিখিলেশের পাশে সে যখন শুয়ে থাকত, সদানন্দর মুখখানাই তখন তার চোখের সামনে ভেসে উঠত। সে স্বপ্ন দেখত সদানন্দ এসেছে তাকে নিয়ে যাবার জন্য। সদানন্দ যেদিন নৈহাটিতে শেষবারের জন্য তার বাড়ি গিয়েছিল, সেদিন নয়নতারা নিজেই সদানন্দকে বলেছিল, তুমি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চল। সে মনে-প্ৰাণে জানত যে সদানন্দই তার প্রকৃত স্বামী, নিখিলেশ নয়। নিখিলেশের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে অবৈধ, তা সে ভালভাবেই জানত। সেজন্যই আয়নায় সে যখন তার পিছনে সদানন্দর মুখ দেখত, তখন লজ্জায় ঘেন্নায় সে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের মুখখান ঢেকে ফেলত। কিন্তু নিখিলেশের শেষ পৰ্যন্ত কোন লজা-ঘেন্না ছিল না। কেননা, নয়নতারা যখন সদানন্দকে স্বামী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করল সমবেত বিশিষ্ট অতিথিদের সামনে, তখন সমবেত অতিথিমণ্ডলী স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তাদের স্তম্ভিত হবার তো কথাই। কেননা, তারা একমুহুর্তের মধ্যে বুঝে নিয়েছিল। যে, যে-সন্তানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তারা সেখানে সমবেত হয়েছে, সে-সন্তান এক জারজ সন্তান-পরাস্ত্রীতে উপগত সন্তান। কিন্তু নিখিলেশের কিছুমাত্ৰ মনের বিকৃতি ঘটেনি। তা না হলে সে নয়নতারার হাত ধরতে গিয়ে বলে, কী পাগলামি করছি! হ্যা, যে সমাজের চিত্র বিমল মিত্র এঁকেছেন, সে সমাজে সত্যবাদিতার কোন স্থান নেই, সত্যবাদিতার কোন মূল্য নেই, সত্যবাদিত তো সে-সমাজে নিছক পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সত্যবাদিতার জন্যই তো সদানন্দকে আসামী হতে হয়েছিল।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তবে নয়নতারা কেন নিখিলেশের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী রূপে ঘর করতে সম্মত হল? নিজ মুখেই সে স্বীকার করেছিল, সেদিন সে সম্মুখীন হয়েছিল আদিম মানবীর সমস্যার। উত্তরাধিকারসূত্রে প্ৰত্নোপলীয় যুগের সেই আদিম মানবীর রক্তকণিকাই সে বহন করছিল, তার শিরা-উপশিরায়। প্ৰত্নোপলীয় যুগে আশ্রয় ও প্রতিরক্ষাই তো আদিম মানবীকে প্ৰবৃত্ত করেছিল পুরুষকে ভজনা করতে। পিতার মৃত্যুর পর সেই সমস্যারই সম্মুখীন হয়েছিল নয়নতারা। একমুহুর্তে নিখিলেশ। তো সেদিন সে সমস্যার সমাধান করে দিতে পারত, বোন হিসাবে নয়নতারাকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে আশ্রয় দিয়ে বোনের মতো তাকে উচ্চ-মাধ্যমিক পাস করিয়ে চাকরি সংগ্রহ করে দিয়ে। সেভাবে সে তো নয়নতারাকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারত। কিন্তু তা সে সেদিন করেনি। পণ্ডিতমশাইয়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণত সেদিন তার লুপ্ত হয়েছিল। সেদিন তার মধ্যে লেশমাত্র মানবিকতা ছিল না। নয়নতারার রূপই তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়িয়েছিল। নয়নতারার বিবাহের পূর্বে নিখিলেশ তো অনবরতই তাদের বাড়ি আসত। তখনই তো নিখিলেশের অবচেতন মনের কোণে নয়নতারা বাসা বেঁধেছিল। সেদিন নয়নতারার নিজেরই মনে হয়েছিল, নিখিলেশ কি তার অসহায়তার প্রতীক্ষা করছিল? শ্বশুরবাড়ি থেকে সে চলে আসে, এটাই কি তার কাম্য ছিল? আবার সেদিন নয়নতারার আচরণও আমাদের বিস্মিত করে। সেদিন নয়নতার হারিয়ে ফেলেছিল তার সেই তেজীয়ান সত্তা, যে সত্তা জ্যোতির্ময়ী হয়ে উঠেছিল নবাবগঞ্জে তার শয়নকক্ষে সদানন্দর গৃহত্যাগের দিন, বা যার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি সে প্ৰদৰ্শন করেছিল নবাবগঞ্জের জমিদারবাড়ির বৈঠকখানায় গণআদালতের সামনে। নিখিলেশ যেদিন তাকে তার স্ত্রী হবার প্রস্তাব করেছিল, সেদিন সে সেই কুৎসিত প্ৰস্তাব প্ৰত্যাখ্যান ক’রে, নিজেওতো স্বাবলম্বী হবার পথে পা বাড়াতে পারত। সে তো মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেছিল। সে তো টিউশনি করে নিজের স্বাধীন ও সাধ্বী সত্তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারত। তা কিন্তু সে করেনি। বোধহয় সে তখন পিতৃশোকে কাতরা। শোকের কাতরতায় সেদিন তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। তার সামনে আর এক বিকল্পও অবশ্য ছিল। সে বিকল্প হচ্ছে, আত্মঘাতী হওয়া। আত্মঘাতী হবার কথা তো নয়নতারার মনে একাধিকবার জেগেছে। নবাবগঞ্জের শয়নকক্ষে সেই মোকাবিলার দিন, সদানন্দকেই তো সে বলেছিল, আমি আত্মঘাতী হইনি কেন, সেটাই আশ্চৰ্য। আবার আর একদিন আত্মঘাতী হবার পরিকল্পনার বশীভূত হয়েই তো নৈহাটির বাড়িতে, সদানন্দকে মারবার জন্য নিখিলেশ যে বিষ কিনে এনেছিল, তা সে তুলে রেখে দিয়েছিল, যদি কোনদিন সেটা তার নিজের কাজে লাগে। কিন্তু কোনদিন সে আত্মঘাতী হয়নি। কেননা, আত্মঘাতী হবার জন্য যে মনোবল দরকার, সে মনোেবল তার ছিল না। অস্তিবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বিভোয়ার যিনি নারীচরিত্র সম্বন্ধে বিশেষভাবে অনুশীলন করেছেন, তিনি বলেছেন পুরুষের তুলনায় আত্মঘাতী হবার মনোেবল মেয়েদের অনেক কম। সে মনোবল ছিল কাদম্বরীর। শোনা যায়, স্বামীর জামার পকেটে এক অভিনেত্রীর প্ৰেমপত্র দেখে সে বিশুকে দিয়ে আফিম কিনে আনিয়ে আত্মঘাতী হয়েছিল। সে কেন আত্মঘাতী হয়েছিল, সে-কথা সে লিখে রেখে গিয়েছিল। সে-চিঠি যদি সেদিন মহৰ্ষি সঙ্গে সঙ্গে না। বিনষ্ট করতেন, তা হলে আজ আমরা নারীর জীবনের মর্মস্থলের বেদনার একটা সন্ধান পেতাম-নারী কেন আত্মঘাতী হয়?
পণ্ডিতমশাই যখন নবাবগঞ্জে মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলেন, তখন ফিরে আসবার সময় তিনি নয়নতারাকে আশীৰ্বাদ করেছিলেন, ‘মা, স্বামীর সেবা কর, মেয়েমানুষের জীবনে এত বড় আশীৰ্বাদ আর নেই, এই দেখেই তোমার মার স্বৰ্গস্থ আত্মা সুখী হবে।‘ বোধহয় যেদিন অফিস যাবার জন্য ট্রেন ধরতে গিয়ে নয়নতারা নৈহাটি স্টেশনে সদানন্দকে অচৈতন্য অবস্থায় প্লাটফরমের ওপর পড়ে থাকতে দেখেছিল এবং তার বাড়িতে তাকে তুলে নিয়ে এসে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল, সেদিন তাঁর অবচেতন মন জাগ্রত হয়ে উঠেছিল তার বাবার সেই আশীৰ্বাদকে সার্থক করবার জন্য। সেদিন তার সচেতন মন উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, কাগজের স্বামী’র পরিবর্তে প্ৰকৃত স্বামীর সেবা করবার জন্য। সেটাই ছিল তার অন্তরের আহবান। বাবার কথামতোই সে স্বামীর সেবা করেছিল, তার সর্বস্ব দিয়ে, নিখিলেশের ঈর্ষাকাতর বিরোধিতার বিপক্ষে। তার সেবা দেখে ডাক্তারবাবুও অবাক হয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘লোকের স্ত্রী তো দূরের কথা, লোকের নিজ মা-ও এরকম সেবা করে না।‘ ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা, এর কি স্ত্রী নেই? নয়নতারা বলেছিল, হঁ্যা, আছে। আবার তারই কয়েকদিন পরে তার সহকমিণী মালা যখন তার বাড়ি এসেছিল এবং তাকে প্রশ্ন করেছিল, ওই মানুষটার জন্য তুই এতদিন অফিস কামাই করে রয়েছিস, তা ওর কি নিজের স্ত্রী নেই? তার উত্তরে নয়নতারা বলেছিল, না। এই পরস্পরবিরোধী উক্তিই তো নারী-মনের এক গভীর রহস্যকে অনাবৃত করে। নারী নিজ আচরণের জন্য প্ৰায়ই লাজ-ঘেন্নায় মরে যায়! লাজঘেন্নাবশতই মালাকে ‘না’ বলা তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, কেননা ‘হঁ্যা’ বললে মালা আরও কৌতুহলী হয়ে উঠত, এবং প্রকৃত সত্য জানতে পারলে অফিসমহলে প্ৰচারিত হ’ত যে নয়নতারা ও নিখিলেশের সম্পর্ক অবৈধ। এখানে সংযত হয়ে গিয়ে বিমল মিত্ৰ এক অসামান্য মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কেননা, মেয়েদের স্বভাবসুলভ অভ্যাস অনুযায়ী তিনি যদি মালার সঙ্গে নয়নতারাকে খোলা-মন নিয়ে আলোচনায় প্ৰবৃত্ত করাতেন, তা হলে নয়নতারার পক্ষে সেটা কী লজা-ঘেন্নার ব্যাপার হ’ত! নয়নতারা সেদিন তার অবচেতন মনকে মালার কাছে উন্মুক্ত করেনি। এই হ্যা’ ও ‘না’র মধ্যেই আমরা প্ৰত্যক্ষ করি নারীর রহস্যময়ী স্বরূপ। সেজন্যই সারভেনটিস ষ্ঠার ‘ডন কুইকসোট’ উপন্যাসে বলেছেন-’Between a woman’s ‘yes’ or ‘no’, there is no room for a pin to go.’ নৈহাটিতে থাকাকালীন সদানন্দকে সে স্বামী বলেই গ্ৰহণ করেছিল, সদানন্দ সম্বন্ধে নিখিলেশ তাকে যাই বলুক-না কেন। কেননা, বিমল মিত্র নয়নতারাকে দিয়ে স্বগতোক্তি করিয়েছেন : ‘নয়নতারা বুঝতে পারে ও-মানুষটা যে এ-বাড়িতে শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে, ও-মানুষটার জন্যে যে এতগুলো টাকা খরচ হচ্ছে, নয়নতারার অফিস কামাই হচ্ছে, এটা নিখিলেশের পছন্দ নয়। কিন্তু পুরুষমানুষ এত অবুঝ কেন? এইটুকু বোঝে না কেন যে আজ না হয় ওর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা উচিত নয়, কিন্তু এককালে ওর সঙ্গেই তো অগ্নিসাক্ষী রেখে তার বিয়ে হয়েছিল।‘ কিন্তু সদানন্দ জানত যে, যাকে সে স্ত্রীর মৰ্যাদা দেয়নি, তার কাছ থেকে সেবা নেবার তার অধিকার নেই। এই অধিকারের প্রশ্ন নিয়েই তো নৈহাটির বাড়িতে রোগশয্যায় সদানন্দর সঙ্গে নয়নতারার বিতর্ক হয়েছিল। নয়নতারা তার অধিকার প্ৰতিষ্ঠিত করবার জন্যই তো সেদিন সদানন্দকে বলেছিল, ‘সাতপাক ঘুরে তোমার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছিল, আমার অধিকার নেই, তুমি এ কি কথা বলছ? যদিও সে তার এ অধিকার সম্বন্ধে সম্পূর্ণভাবে সচেতন ছিল, তবুও সে জানত যে নিখিলেশের কাছে এটা অপ্রিয় ব্যাপার, সেজন্যই সদানন্দ যখন চলে যেতে চেয়েছিল এবং বলেছিল, ‘আমার জ্ঞান থাকলে আমি কিছুতেই এখানে আসতুম না’, তখন সে সদানন্দকে বলেছিল, ‘তুমি আগে ভালো হও, তারপর চলে যেও, আমি তোমাকে এখানে আটকে রাখবো না, তুমি থাকতে চাইলেও আমি তোমাকে এখানে থাকতে দেবো না-’। আবার সেই নয়নতারাই একদিন সদানন্দকে বলেছিল, ‘যেখানে তুমি যাবে, সেখানেই আমি যাবো। তোমার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে পারলে, আমি বেঁচে যাই, আমার আর কিছু ভাল লাগছে না। এ-বাড়ি আমার কাছে এখন বিষ হয়ে গেছে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট আমার কাছে এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে, এখানে আর একদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, সত্যি। এর থেকে একমাত্ৰ তুমিই আমাকে বঁাচাতে পারে।‘ প্ৰমীলা যে এক রহস্যময়ী জীব, তা নয়নতারার এই পরস্পরবিরোধী উক্তি থেকেই বুঝতে পারা যায়।
দুইখাতে প্রবাহিত নয়নতারার জীবনকাহিনী আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করে। তার যুগলসত্তাতে আমরা বিস্মিত। সদানন্দই যদি তার অন্তরের দেবতা হয়, সদানন্দকেই যদি সে মনেপ্ৰাণে স্বামী বলে গ্ৰহণ করে থেকে থাকে, তবে কি করে তার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল দীর্ঘ পনেরো বছর নিখিলেশের সঙ্গে দাম্পত্যজীবন যাপন করা? বিশেষ করে যখন সে জানত যে নিখিলেশ একজন শঠ, প্ৰতারক ও প্ৰবঞ্চক। নবাবগঞ্জে গিয়ে সে নিজের চোখেই দেখে এসেছিল, নিখিলেশ। কত বড় মিথ্যাবাদী, কত বড় প্রবঞ্চক। নিখিলেশের এই প্রবঞ্চকতাই তাকে উত্তেজিত করেছিল, নবাবগঞ্জ থেকে ফিরে আসবার পর পৃথক ঘরে পৃথক শয্যায় রাত কাটাতে। নিখিলেশের ওপর তার এ অভিমান কেন? আবার, আর একদিন যখন সে নিখিলেশকে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছিল, তখন সে রাগে জ্বলে উঠে নিখিলেশকে ভৎসনা করেছিল। যদি নিখিলেশের প্রতি তার বিন্দুমাত্র অনুরাগ না থাকবে, তবে কিজান্য তার এই অভিমান, এই রাগ? নিখিলেশের সঙ্গে তো দাম্পত্যজীবন ব্যর্থও হয়নি। সে তো সন্তানের জননী হয়েছিল। মাতৃত্বের গর্বে গরবিনী হয়ে সে তো সমারোহের সঙ্গে উৎসব করতেও মত্ত হয়েছিল। তবে এসব কি তার অভিনয়? বলব, হ্যা, অভিনয়ই বটে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন এই অভিনয়? কিসের প্ররোচনায় তার এই অভিনয়? এ অভিনয়ের কারণ, সে তো নিজের মুখেই ব্যক্তি করেছিল। সদানন্দর মহানিস্ক্রমণের রাত্রে নবাবগঞ্জের শয়নকক্ষে। সেদিন সদানন্দকে সে বলেছিল, ‘আমার কি এখন থেকে কোন সাধ-আহ্লাদ থাকবে না? আমি কি তা হলে সারাজীবন এমনি করেই তোমাদের বাড়িতে একা এক রাত কাটাবো? আমার মনের কথা বলবার, তা হলে কোন লোকই থাকবে না? আমি কি নিয়ে থাকবে? আমি কাকে আশ্ৰয় করে বঁাচবো? আমার জীবন কেমন করে। সার্থক হবে? কাকে আশ্ৰয় করে সে বঁাচবে, কে তার জীবন সার্থক করবে, কে তার সাধ-আহলাদ মেটাবে, এসব প্রশ্নই তাকে প্ৰলুব্ধ করেছিল নিখিলেশের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে তার কাছে নিজেকে আত্মসমৰ্পণ করতে।
এককথায় নারী চায় আশ্রয়, নারী চায় একজনকে অবলম্বন করে। তার সাধ-আহ্লাদ মেটাতে, তার জীবনকে সাৰ্থক করে তুলতে। সে চায়তার দাম্পত্যজীবনে একজন দীপ্তিমান সহযাত্রী। নয়নতারার কাছে দুই সত্তাই সত্য। কোনটাই মিথ্যা বা nonentity নয়। এই দুই সত্তাকে সার্থক করবার জন্য যদি তাকে অভিনয় করতে হয়, তা হলে অভিনয়ের জন্যও সে প্ৰস্তুত। হয়তে। এই অভিনয়ের জন্য যে চাতুর্যের ও অনুষঙ্গের প্রয়োজন হয়, তাকেই বিমল মিত্র ‘ম্যাকস ফ্যাকটর’ বলেছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে নারী অসাধারণ পটুতার অধিকারিণী। তার এ অভিনয় চলচ্চিত্রের অভিনয়ের মতো। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের দাম্পত্যজীবনের অভিনয় করতে দেখে দর্শকের কি একবারও মনে হয় যে বাস্তবজীবনে এদের আর একটা সত্যিকারের দাম্পত্যজীবন আছে? নারীর দুটো সত্তা আছে। একটা আটপৌরে বা বাহ্যিক সত্তা, যেটা সে লোকসমাজে প্ৰকট করে। অপরটা তার অন্তরের সত্তা, যে সত্তা তার অবচেতন মনে সুপ্ত হয়ে থাকে, কচিৎ-কদাচিৎ অনাবৃত করে। এই যুগল। সত্তার বিদ্যমানতাই আমরা নয়নতারার মধ্যে দেখি। নয়নতারার বিসদৃশ আচরণ দেখে ডাক্তাররা হয়তো বলবেন, নয়নতারা ‘সিজেফ্রেনিয়া’ (Schizophrenia) ব্যাধিগ্ৰস্ত। কিন্তু আমি বলব, প্রমীলার ক্ষেত্রে সিজোফ্রেনিয়া মোটেই কোন ব্যাধি নয়। এটা প্ৰমীলার সহজাত বৈশিষ্ট্য। এই বিশিষ্টতার জন্যই বিধাতা প্ৰমীলাকে রহস্যময়ী করে তুলেছেন। মনে হয় এ-সম্বন্ধে সত্যিকথাটা বলেছেন জার্মান দার্শনিক নিটসে। তিনি বলেছেন, ‘নারী-সৃষ্টি বিধাতার দ্বিতীয় ভুল’ (‘Woman was God’s second mistake’)
প্ৰমীলার এই সহজাত বৈশিষ্ট্য, নারীদেহে কোন বিশেষ হরমোন’- এর বিদ্যমানতার জন্য ঘটে না। এটা ঘটে অবস্থাবিপাকে, যে ঘটনা বা মনের বিশেষ অবস্থার (situation) সে সম্মুখীন হয়, তারই ঘাতপ্ৰতিঘাতে। আদিমকাল থেকেই তার পারিপাৰ্থিক অবস্থা বা পরিবেশই তার চরিত্রগঠনে তাকে সহায়তা করেছে। সে যে রহস্যময়ী, এটা তার শাশ্বত ধৰ্ম। সেজন্যই সিমোন দ্য বিভোয়ার বলেছেন-‘She revels in immanence, she is contrary, she is prudent and petty, she has no sense of fact or accuracy, she lacks morality, she is contemptibly utilitarian, she is false, theatrical, self-seeking and so on.’ এটা এমন এক অস্তিবাদী নাবীর উক্তি, যে সারাজীবন অনুশীলন করে গেছে নারী-চরিত্র নিয়ে। এই উক্তির মধ্যেই আমরা নয়নতারার সত্তাকে খুঁজে পাই, তার বিচিত্র আচরণের ব্যাখ্যা পাই। মনে পড়ে কনফুসিয়াস-এর কথা। তিনি বলেছিলেন-চাদের ওপিঠে কি আছে তা পুরুষমানুষের পক্ষে জানা সম্ভবপর; কিন্তু মেয়েদের মাথায় কী ভাবনা চিন্তা বিরাজ করছে, তা জানা সম্ভবপর নয়। সেজন্যই আমাদের দেশের ঋষির বলেছেন – নারীর মনের মধ্যে যে কী আছে তা ‘দেবা; ন জানাচ্ছি। কুতে মনুষ্যাঃ’। তাদের মাথায় কী পোকা কিলবিল করছে, তা যদি আমরা জানতে পারতাম, তা হলে তো নারীকে আমরা রহস্যময়ী বলে মনে করতাম না। তা হলে তো নয়নতারাও আমাদের কাছে রহস্যময়ী হয়ে উঠত না।