০৫.
প্রকাণ্ড ক্লাসরুমের বেঞ্চি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে আজ। তাদের স্থান নিয়েছে গোটা আষ্টেক বড়সড় টেবিল। কোনও টেবিলে আকর্ষণীয় বৈজ্ঞানিক মডেল, কোথাও চলছে বিজ্ঞানের খেলা। প্রতিটি মডেল সযত্নে বানানো। আগ্নেয়গিরির খুদে প্রতিরূপ, বিভিন্ন জটিল যৌগের পারমাণবিক গঠনপ্রণালী, নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু, সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ …..। খেলাগুলোও বেশ মজাদার। কংকাল ভকভক সিগারেট টানছে, বরফ ঘষে আগুন জ্বালানো হচ্ছে কাঠে, গপাগপ চলছে আগুনখাওয়া ……। দেখাচ্ছে কয়েকজন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলেমেয়ে, মডেলগুলোর ব্যাখ্যা করতেও তাদের বিপুল উৎসাহ।
ঘরে অবশ্য দর্শক তেমন একটা বেশি নেই। মাঝে মাঝে অলস মেজাজে ঢুকছে কিছু তরুণ তরুণী, এক আধ জন বয়স্ক মানুষও পা রাখছে কখনও সখনও, ব্যস। এক একটা টেবিলের সামনে থমকে দাঁড়াচ্ছে তারা, দেখছে, শুনছে, বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে কারুরই বিশেষ মন নেই, একটু পরেই অডিটোরিয়ামে গানবাজনার আসর বসবে, সেদিকেই সকলের এখন আগ্রহ বেশি।
ঘরের এক পাশে ডায়াস। হঠাৎ এক দাড়িঅলা যুবক আবির্ভূত হল সেখানে, উচ্চঃস্বরে হাঁক পাড়তে শুরু করল, —আসুন আসুন, দেখে যান দেখে যান, গণেশবাবাজির খেল্ দেখে যান, জয় হনুমানজীর খেল্ দেখে যান ….. আমার বাচ্চা ইঁদুরের খেলা দেখে যান……।
বলতে বলতেই কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে গোটা কয়েক মূর্তি বার করে ফেলেছে যুবক। পটাপট টেবিলে সাজিয়ে ফেলল। খেলা দেখানো বন্ধ করে ছুট্টে এল এক কিশোরী, একটা দুধের ক্যান ধরিয়ে দিল যুবকের হাতে, সঙ্গে মধুপর্কের বাটি। যুবকের আহ্বানেই হোক, কি কৌতুহলেই হোক, বেশ কিছুটা সাড়া জেগেছে। ডায়াসের সামনে এখন ছোট্ট ভিড়। তিন মূর্তিকে দুধ খাওয়াতে শুরু করল যুবক। গণেশের শুঁড়ের মুখে দুধের বাটি ধরল, সুড়ুৎ দুধ সাবাড়। এবার হনুমান খাচ্ছে, তার পর ইঁদুর …….।
সঙ্গে সঙ্গে চলছে যুবকের গলা। কখনও চড়ায় উঠছে, কখনও খাদে নামছে, লাগ বাবা লাগ্, ভেল্কি লাগ্….. মাদারিকা খেল্ দেখো, আমার জব্বর ভেল্কি দেখো ……. এমন খেলা আর পাবে না, দিয়ে যাও সব চার আনা চার আনা …..!
ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে তন্নিষ্ঠা বড় বড় চোখে অভিমন্যুকে দেখছিল। কী আমূল বদলে গেছে ছেলেটা! সত্যি যেন এক ম্যাজিশিয়ান! এতটুকু জড়তা নেই, মুখ চলছে, হাত চলছে, সেদিনের সেই শান্ত শান্ত ভঙ্গি পুরোপুরি উধাও!
খেলা দেখানো শেষ। ঋজু স্বরে এবার দুধপানের রহস্য বোঝাতে শুরু করেছে অভিমন্যু। বৈজ্ঞানিক কারণ ব্যাখ্যা করছে প্রাঞ্জল ভাষায়। ক্ষণপূর্বের খ্যাপামির আর কণামাত্র চিহ্ন নেই।
বহুরূপী নাকি?
তন্নিষ্ঠার পাশটিতে একদা কলেজসহপাঠী শ্রেয়সী। চোখ ঘুরিয়ে শ্রেয়সী বলল, —এ নির্ঘাৎ কোনও কলেজের কচি লেকচারার। বক্তৃতার কায়দাটা দ্যাখ।
অন্য পাশ থেকে মধুঋতা বলল, —চেহারাটা কিন্তু দারুণ। হেভি সেক্সি। একেই রাফ অ্যান্ড টাফ বলে, না রে?
—আমরা এরকম একটা টিচার পেলাম না। সব শুড্ডা শুড্ডা পার্টি ….
—তোর খুব পছন্দ মনে হচ্ছে? যা না, গিয়ে আলাপ করে আয়। শ্রেয়সী চোখ টিপল, —তোকে স্পেশাল কেয়ার নিয়ে দুধ পান বোঝাবে।
ভাষণ থেমেছে। বক্তা হঠাৎ জটলা ছেড়ে এদিকেই আগুয়ান। তন্নিষ্ঠার সামনে এসে এক গাল হাসল, —তুমি এখানে?
তন্নিষ্ঠা অপাঙ্গে দুই বান্ধবীর ভেবলে যাওয়া মুখ দুটো দেখে নিল একবার। মুচকি হেসে বলল, —আমি তো আসবই, এটা আমার কলেজ। তুমি এখানে ভিড়লে কোত্থেকে?
—আমার এক পাড়ার দাদা, তার এক ভাইঝি এখানে পড়ে, এই কলেজের প্রেসিডেন্ট সেই দাদাটির …. ও এক জটিল ইকুয়েশান। যাক গে, আমার বিজ্ঞান মঞ্চের প্রোগ্রাম কেমন লাগল?
তন্নিষ্ঠা বান্ধবীদের দেখিয়ে দিল —এদের জিজ্ঞেস করো। এ হল শ্রেয়সী বসু। আর এ মধুঋতা চাকলাদার। সরি, এখন তো চেঞ্জ হয়ে ….. কী যেন রে?
—রাহা। মধুঋতা বোকা বোকা মুখ সপ্রতিভ করার চেষ্টা করল, আপনি?
—আমি অভিমন্যু। হাটে বাটে ঘাটে ভেল্কি দেখিয়ে বেড়াই। পুরো নাম অভিমন্যু ভেল্কিবাবা।
তন্নিষ্ঠা বলে উঠল, —অভিমন্যু গন্ধবাবা নয় কেন?
—হ্যাঁ, তাও বলতে পারো। তবে ওই পরিচয়টা এখানে ঠিক খাটে না।
মধুঋতা শ্রেয়সী কিছুই বুঝতে পারছে না। চোখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
তন্নিষ্ঠা ঠেটি টিপে বলল, —অভিমন্যু একজন মিনি ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। পারফিউমের বিজনেস।
—ওমা তাই? শ্রেয়সী মুগ্ধ চোখে তাকাল, —কী কিউট! কী পারফিউম বানান আপনি?
—না না, সে বলার মতো কিছু নয়। অভিমন্যু যেন অস্বস্তি বোধ করল। এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে তন্নিষ্ঠাকে বলল, —তুমি কি এখন আছ কিছুক্ষণ?
—সাড়ে-সাতটা আটটা পর্যন্ত তো আছিই। তন্নিষ্ঠা কবজি উল্টে ঘড়ি দেখল, —তাসের দেশটা দেখব, ব্ৰত গোস্বামীর আবৃত্তিটা শুনব ……। তোমার কী প্রোগ্রাম? এক্ষুনি তল্পি তল্পা গোটাবে?
—ছটা অব্দি আছি। দেখি, বিজ্ঞানের যুগে কেউ যদি একটু বিজ্ঞান সম্পর্কে ইন্টারেস্ট দেখাতে আসে…। অভিমন্যুর পরনে জিনস্ আর হাল্কা গেরুয়া রঙ পাঞ্জাবি, হাত দুটো পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে বলল, —তুমি তা হলে এখন অডিটোরিয়ামেই থাকবে?
—হুঁউ। কেন?
অভিমন্যু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগে ঘরের ও প্রান্ত থেকে তার এক অনুচর ডাকছে তাকে, দ্রুত পায়ে চলে গেল সেদিকে।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেই দুই বান্ধবী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তন্নিষ্ঠার ওপর।
—খুব, অ্যাঁ দারুণ চুক্কি দিলি?
—কীসের চুক্কি?
—আহা নেকু! বুঝি না যেন কেন তুই এদিকে আমাদের ডেকে নিয়ে এলি!
—শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিলি বুঝি? অবাক হওয়ার ভান করল কেন?
—কদ্দিন ধরে চালাচ্ছিস?
—এই না না। বিশ্বাস কর …। তন্নিষ্ঠা দু হাত তুলে দিল, —ছেলেটাকে আমি জাস্ট চিনি। ইউনিভার্সিটির ক্লাসমেট মালবিকার বিয়ে হল গত মাসে, ওখানেই আলাপ। মালবিকার বরের বন্ধু।
—ওসব টপ তুই অন্যকে দিস। মধুঋতার চোখে ব্যঞ্জনা ফুটে উঠল, —আমি এখন ছেলেদের চোখ দেখলে বুঝতে পারি। ওই চোখের ল্যাঙ্গুয়েজই আলাদা।
ছ বছর হল বিয়ে হয়েছে মধুঋতার, সে এখন নিজেকে পুরুষচরিত্রঅভিজ্ঞা রমণী বলে মনে করে। তন্নিষ্ঠা একবার ভাবল তার বিয়ে স্থির হয়ে যাওয়ার কথাটা বলে দেয় বন্ধুদের। সেই মধুর বিয়ের পর আজ আবার এই প্রথম দেখা বন্ধুদের সঙ্গে, শৌনকবৃত্তান্ত এরা কিছুই জানে না। থাক গে, শুনলে বেচারাদের এরকম একটা টাটকা খোরাকে জল পড়ে যাবে।
মজা করে বলল, —তোর তো এখন একজনেরই চোখের ল্যাঙ্গুয়েজ জানার কথা মধু, সব ছেলের চোখের ভাষা বোঝা তুই শিখলি কোত্থেকে?
—জানিস না, বিয়ে হলে থার্ড আই গজায়?
—সেই চোখে তুই পরপুরুষ দেখিস? সায়ন্তনকে ডজ মেরে খুব চালিয়ে যাচ্ছিস, অ্যাঁ?
—যেতেই পারি। মধুঋতা সিঁথিতে আঙুল ঠুকল, —এটাকে অ্যাপারেন্টলি রেড সিগনাল বলে মনে হয়, আসলে এটাই গ্রিন সিগনাল। আমি এখন পূর্ণ স্বাধীন, বিপদ আপদের কোনও চান্স নেই।
—অ্যাই মধু, থাম্। তনুর ট্র্যাপে পা দিস না। বুঝছিস না, ও কায়দা করে লাইন ঘুরিয়ে দিচ্ছে? শ্রেয়সী চিমটি কাটল তন্নিষ্ঠাকে, তনু, খুলে বল্ না বাবা কেসটা।
—বিশ্বাস কর, কিইইচ্ছু নেই।
ইচ্ছে করে কথাটায় একটু ঢেউ খেলিয়ে দিল তন্নিষ্ঠা। যাতে রহস্যটা খুলেও না খোলে। অথবা রহস্যহীনতা একটা মোড়কের আস্তরণে থেকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছিল তার এই দুই বান্ধবী কলেজ ছাড়ার পরও বিশেষ বদলায়নি।
কলেজেই এদের ধারণা ছিল ছেলে আর মেয়েদের বুঝি একটাই সম্পর্ক। খাদ্য খাদক, বা ঘি আগুন, এই গোছের। কলেজে ছেলেদের থেকে একটু দূরে দূরেই থাকত এরা। মানসিক ভাবে শ্রেয়সী এখনও এগোতে পারেনি, মধুঋতা বিয়ে হয়েও না। বি এ পাশ করেই দুজনে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে, আর একটু এগোলে কি এদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাত? মনে হয় না। সম্ভবত এদের রক্ষণশীলতার বীজ বাড়িতেই পোঁতা আছে। প্রতি পদে এদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে তুমি মেয়ে। সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই। ভাগ্যিস তন্নিষ্ঠা ওই রকম কোনও পরিবারে জন্মায়নি!
মানসিক খিচখিচ সত্ত্বেও এই বন্ধুদের সঙ্গ ভাল লাগছিল তন্নিষ্ঠার। দীর্ঘ অদর্শনের পর সাক্ষাৎটাই একমাত্র কারণ নয়, ফেলে যাওয়া কলেজটাও কেমন অনুঘটকের কাজ করছে। এই করিডোরেই তো কেটেছে কত উচ্ছ্বাসময় দিন। ওই ছোট্ট ঘরটায় অনার্সের ক্লাস হত। সেকেন্ড ইয়ার, না না থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ে। একদিন ক্লাসরুমের দরজা ভেজিয়ে জয়ন্ত সিগারেট ধরিয়েছিল, তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জোর একটা টান দিয়েছিল তন্নিষ্ঠা, সঙ্গে সঙ্গে কী কাশি। এবং ঠিক সেই সময়েই দরজা ঠেলে ঊর্মিলা ম্যাডাম …..। ক্যান্টিন অফিস লন কমনরুম কোথায় যে সোনালি মুহূর্তের কুচি ছড়ানো নেই!
আজ রবিবার, তবু কলেজ বেশ জমজমাট। তিনতলা বিশাল বিল্ডিং-এর প্রায় প্রতিটি আনাচে কানাচে তরুণ তরুণী। সবই প্রায় অচেনা মুখ, বর্তমান ছাত্রছাত্রী। হঠাৎ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে যায় এক আধটা পরিচিত প্রাক্তনী, দাঁড়িয়ে পড়ে কুশল বিনিময় করে, কিংবা মৃদু হেসে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। দোতলার অডিটোরিয়াম গেটেই সব চেয়ে জমাট ভিড়, অনুষ্ঠানের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।
তন্নিষ্ঠারা অডিটোরিয়ামের দিকেই এগোচ্ছিল, সামনে তন্ময়। গটগট হেঁটে আসছিল তন্ময়, তন্নিষ্ঠাদের দেখে থেমে গেল। চোখ পিটপিট করে বলল, —কী রে, তোরা এসেই একটা গ্রুপ তৈরি করে নিয়েছিস?
তন্ময় ব্যাচেরই ছেলে, তবে অনার্সের নয়, পাসের ক্লাসে দেখা হত মাঝে মাঝে। ইউনিয়ন করার সুবাদে ক্লাসের প্রায় সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে মোটামুটি হৃদ্যতা ছিল তন্ময়ের।
তন্নিষ্ঠা হেসে বলল, —আমাদের ব্যাচের আর তো কাউকে দেখছি না?
—আছে কয়েকজন। হলে। বেশির ভাগই অফ্। যে যার ধান্দায় ঘুরছে আর কী।
— তুই করছিস কী এখন?
—আর্মস কালেক্ট করছি।
তন্নিষ্ঠা হকচকিয়ে গেল। মধুঋতা পাশ থেকে আমতা আমতা করে বলল, —মানে?
—যুদ্ধ লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বেকারির বিরুদ্ধে।
— বুঝলাম না।
—তোরা বুঝবি কী করে? সব তো বিয়ে করে করে বরের কোর্টে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিস। মেজাজে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল তন্ময়, —আমাদেরও তো বউ ধরার জন্য কোর্ট তৈরি করতে হবে, না কি?
—খালি ভাট বকা অভ্যাস! করছিসটা কী বল না? লঘু ধমক দিল তন্নিষ্ঠা।
—গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর ভর্তি হয়েছিলাম পাইন কলেজ অব ফারদার এডুকেশানে। সেখানে প্রথমে একটা ছ’ মাসের ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে ফেললাম। চাকরি হল না। তার পর করলাম ছ মাসের কম্পিউটার কোর্স। তাতেও কিছু হল না। তারপর তিন মাস টাইপ। এক অবস্থা। তারপর আবার ছ মাস কম্পিউটার শিখতে চেয়েছিলাম, বাবা জুতো দেখাল। আবার একটা কোর্সে যুতে গেলাম। সস্তার। পাবলিক রিলেশানস্। একটা শ্বাস ফেলল তন্ময়,—শুধু অস্ত্র শস্ত্রই জোগাড় করে যাচ্ছি, চালানোর স্কোপ পাচ্ছি না। চাকরির লটারিটা শালা কিছুতেই উঠছে না! মার্কেট কী ডাউন মাইরি!
পলকের জন্য শুভেন্দুর মুখটা মনে পড়ল তন্নিষ্ঠার। ভি আর-এর চিঠি পেয়ে বাবা ভেতরে ভেতরে এত ভেঙে পড়েছে, শতেক বাহানা দেখিয়ে অনবরত অফিস ডুব মারছে এখন। রোজ মার সঙ্গে খটাখটি! ভাল্লাগে না।
তন্নিষ্ঠা একটু বিরস গলাতেই তন্ময়কে বলল, —খুব তো ইউনিয়ন করতিস, এখন তোর দাদারা কী বলে?
—সেখানে আমার থেকে অনেক সরেস মাল বডি ফেলে বসে আছে। এনট্রিই নিতে পারছি না। তাও আমি অবশ্য এম-এল-এর দরজায় ইঁট পেতে রেখে এসেছি। তবে লাইন পৌঁছতে পৌঁছতে তন্ময় শিকদার বুড়ো ভাম হয়ে যাবে। …এখন আমি একটা নতুন ফ্রন্ট খুলছি। জ্যোতিষ। এটা না লাগলে হোমিওপ্যাথি ট্রাই নেব। সেটাও না লাগলে অন্য একটা বিজনেস। অটো কিনে চালাব। তন্ময় হ্যা হ্যা হাসছে, হাসিতে আনন্দের চেয়েও ব্যঙ্গ বেশি। সঙ্গে যেন হাহাকারের কণাও মিশে আছে। মলিন টিশার্ট পরা তন্ময় একদা বান্ধবীদের পার হয়ে গেল। খানিক দূরে গিয়ে কথা ছুড়ল আবার,—অটোটা যদি কিনে ফেলি, তোদের একদিন ফ্রি চড়িয়ে দেব।
তন্ময় চলে যাওয়ার পর একটুক্ষণ নীরব তিন বান্ধবী।
একটু পরে শ্রেয়সী মুখে চুকচুক শব্দ করল,—বেচারা।
মধুঋতা বলল, —শুধু বেচারা নয়, বল আহা বেচারা! মনে আছে কী দাপটে লেকচার দিত ক্লাসে? স্যারদের অবলীলায় বলত, একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান তো, মিনিট দশেকের একটা ছোট্ট ইয়ে সেরে নিই!
মধুঋতার বাক্ভঙ্গিতে একটুও হাসি পাচ্ছিল না তন্নিষ্ঠার। তন্ময়ের মরিয়া লড়াই দেখে বিষণ্ণ বোধ করছিল। আগামী দিন বুঝি আরও ভয়ঙ্কর। শৌনকের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেলেই কি মুশকিল আসান? উঁহু, জন্ম থেকে মাকে চাকরি করতে দেখছে তন্নিষ্ঠা, অচেতনে সেই ছবিটাই মাথায় গাঁথা থাকে সর্বক্ষণ, চাকরি সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকার কথা তন্নিষ্ঠা ভাবতেই পারে না। তার কপালেও কিছু জুটবে কি?
শ্রেয়সী চিমটি কাটছে তন্নিষ্ঠাকে। চাপা স্বরে বলল, —এই, এই, এই তনু, তোর অভিমন্যু আসছে!
তন্নিষ্ঠা এদিক ওদিক তাকাল, দেখতে পেল না,। বলল, —কই? কোথায়?
—ওই তো করিডোরের এন্ডে। কাকে যেন খুঁজছে। বোধহয় তোকেই।
সত্যিই তো! ওই তো অভিমন্যু! তার হাইপাওয়ার চশমা পরা চোখ করিডোরের ছেলেমেয়েদের মাঝে ইতিউতি ঘোরে যেন?
তন্নিষ্ঠা ঈষৎ বিরক্ত হল। বন্ধুদের ভুল ধারণাটাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য এত কেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অভিমন্যু?
ভেবেছিল মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে, তার আগেই অভিমন্যু পৌঁছে গেছে। মুখে পেঁতো হাসি নেই, বরং যেন গম্ভীর। একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলল, —তোমাদের কলেজটা তো যাচ্ছেতাই!
চোখ সরু করে তাকাল তন্নিষ্ঠা, —কেন, কী হল?
—সেই দুপুর বারোটা থেকে আমার ছেলেমেয়েরা একটানা শো করে যাচ্ছে, তাদের সামান্য একটা টিফিনের ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হবে না? দু বার কেটলি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল, ব্যস?
তন্নিষ্ঠা অপ্রস্তুতের একশেষ। ছিঃ, কী উল্টোপাল্টা ভাবছিল!
যেন অভিমন্যু কলেজের নয়, তারই অতিথি, এমন স্বরে বলল,—সে কী! মিষ্টি খাবার কিচ্ছু দেয়নি?
—তাহলে আর বলছি কী!…ওরা মুখ ফুটে কিছু বলছে না, কিন্তু আমার তো খারাপ লাগছে। তোমাদের ইউনিয়নের পাণ্ডাকে ধরলাম, সে হচ্ছে হচ্ছে পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে কোথায় যে হাওয়া মারল… তাও তো প্রায় ঘণ্টা খানেক! এই দুঃখেই আমি কলকাতার কলেজ টলেজে শো করতে চাই না।
রীতিমত আহত হয়েছে তন্নিষ্ঠা। কলেজের সম্পর্কে দুর্নাম যেন তাকেও বিঁধছে। বলল,—তুমি এক সেকেন্ড দাঁড়াও, আমি দেখছি।
বলেই ছুটেছে অডিটোরিয়ামে। সেখানে এখন মহা হট্টগোল, স্টেজ সাজানো চলছে। এই মাত্র প্রেসিডেন্ট কাম এম এল এ এসেছেন, তাঁকে ঘিরে গ্রহমণ্ডলীর মতো ঘুরছেন প্রিন্সিপাল আর কয়েকজন অধ্যাপক। এখনকার ইউনিয়নের ছেলেমেয়েদের আদৌ চেনে না তন্নিষ্ঠা, চেনার কথাও নয়। মরিয়া হয়ে তন্নিষ্ঠা স্টেজে উঠেছে। তাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের টিকেজিকে দেখতে পেয়ে হালে পানি পেল।
একটু দূর থেকে টিকেজিকে ডাকল তন্নিষ্ঠা, —স্যার?
মধ্যবয়সী তরুণকুমার গুপ্ত ফিরে তাকিয়েছে।
তন্নিষ্ঠা সামনে গিয়ে একটা প্রণাম করল,—চিনতে পারছেন স্যার? আমি তন্নিষ্ঠা দাশগুপ্ত। নাইনটি টুর ব্যাচ।
—চিনেছি। প্রেসিডেন্ট জগন্নাথ ভৌমিক স্টেজের দিকে এগোচ্ছে, সেদিকে তাকিয়ে থমকাল তরুণ গুপ্ত। মুখে অন্যমনস্ক হাসি টেনে বলল, —কী করছ এখন?
—এবার স্লেটে বসেছি।
—বাহ্ বাহ্, খুব ভাল।
কথাটা বলেই জগন্নাথবাবুকে ধাওয়া করতে যাচ্ছিল তরুণ গুপ্ত, তন্নিষ্ঠা পিছু ডাকল, —স্যার, একটা কথা ছিল।
তরুণ গুপ্ত ভুরু কুঁচকোল, —কী?
—আমার একজন পরিচিত, কলেজে সায়েন্স এগ্জিবিশান করছে, ওদের এখনও স্ন্যাকস্ ট্যাকস্ কিছু দেওয়া হয়নি…
—তার আমি কী করব? সায়েন্সের বীরেনবাবুকে গিয়ে বলো। উনি এগ্জিবিশানের চার্জে আছেন।
—আমি তো স্যার ঠিক…
—তাহলে ইউনিয়ন রুমে যাও। ওরাই বোধহয় কুপন টুপন দেবে।
বলতে বলতে জগন্নাথবাবুর দিকে ছুটল তরুণ গুপ্ত। প্লুটো থেকে বুধ হওয়ার প্রচেষ্টায়। হেসে হেসে কথা শুরু করেছে ভদ্রলোকের সঙ্গে, বিগলিত ভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছে।
অপমানিত মুখে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে এল তন্নিষ্ঠা। রোদ মরে গেছে, ছায়া ঘনাচ্ছে। তন্নিষ্ঠা মন্থর পায়ে ফিরছিল। শ্রেয়সীরা নেই, অভিমুন্য একা দাঁড়িয়ে করিডোরে।
তন্নিষ্ঠাকে দেখে অভিমন্যুর ঠোঁটে চোরা হাসি,—হল অ্যারেঞ্জমেন্ট?
তন্নিষ্ঠা গুম গুম গলায় বলল, —তোমার কজন আছে? চলো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
—হাহ্, তুমি কেন খাওয়াবে? অভিমন্যু ঘড়ি দেখে বলল, —যাই, আমি একবার চা খেয়ে আসি, তখনি দোকানে বলে দেব, ওরা একে একে টিফিন করে যাবে।
তন্নিষ্ঠা বলে ফেলল,—চলো, আমিও যাব।
—এখন নামবে তুমি? এক্ষুনি তো তোমাদের প্রোগ্রাম স্টার্ট হবে।
—হোক গে। চলো।
অভিমন্যু চোখ ছোট করে দেখছে তন্নিষ্ঠাকে।
তন্নিষ্ঠা ঝেঁঝে উঠল, —আমি গেলে তোমার অসুবিধে হবে?
অভিমন্যু হেসে ফেলেছে, —নিজের কলেজের দোষস্খালন করতে চাইছ?
—সে তুমি যা বোঝো তাই।
রাস্তার ওপারে ছোট্ট মতন রেস্টুরেন্ট। চা কেক টোস্ট ওমলেট ঘুগনি চপ সিঙাড়া পাওয়া যায়। ছোট ছোট নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসল দুজনে, সামনে টিনের টেবিল।
অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল, —কী খাবে?
—কিচ্ছু না। শুধু চা।
—সে হয় নাকি! কিছু একটা অন্তত খাও। নইলে আমি খাই কী করে?
—আমি তো দুপুর থেকে চেঁচাচ্ছি না, সুতরাং আমার না খেলেও চলবে।
—কলেজের ওপর খুব চটেছ মনে হচ্ছে?
—গায়ে চামড়া থাকলে তো চটারই কথা। ছি ছি, তোমাদের ইনভাইট করে এনে…। আমাদের সময়ে কক্ষনও এরকম হত না।
—তোমাদের সময়ে সব নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন হত, তাই তো?
—হতই তো।
বুড়োটে কথাবার্তা বোলো না। আমাদের কালে সব গোল্ডেন ছিল, এখন সব খারাপ…! বাজে কথা। কলেজে ফাংশান টাংশান হলে চিরকাল এরকম হয়। সে কি বা তোমাদের সময়ে, কি বা আমাদের সময়ে। দু চারটে ছোটখাটো ইরেগুলারিটি না ঘটলে অনুষ্ঠানগুলো স্মৃতিতেই থাকে না। আমি তোমাদের কলেজের এগেনস্টে সব চার্জ মনে মনে উইথড্র করে নিয়েছি।…এবার অন্তত হাসো।
আর মুখ ভেটকে থাকা হল না তন্নিষ্ঠার, ফিক করে হেসে ফেলেছে। খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাফপ্যান্ট পরা এক বুড়ো মতো লোক জল দিয়ে গেল টেবিলে, তাকে টোস্ট ওমলেটের অর্ডার দিল অভিমন্যু, সঙ্গে আরও কটা বানিয়েও রাখতে বলল, ঠোঙায় করে নিয়ে যাবে। সিগারেট ধরিয়েছে একটা।
পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,—তোমার বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলে নাকি এর মধ্যে?
—নাহ, হয়ে ওঠেনি।
—আমি গেছিলাম। এই তো কবে যেন সন্ধেবেলা খুব মেঘ মেঘ করল, বৃষ্টি হল না…?
—শুক্রবার?
—তা হবে। মালবিকা আইসক্রিম বানিয়েছিল, খাওয়াল।…দারুণ হানিমুন করে এসেছে ওরা। ভিড় পায়নি বিশেষ। ওখান থেকে গুর্দুম ফরেস্টে গিয়েছিল। যেখানে সেখানে ট্রেকিং করেছে…। সুপ্রিয় দু রিল ছবি তুলেছে, দেখাচ্ছিল।
—হুঁ? গিয়ে দেখে আসতে হবে।
—কবে যাবে?
—দেখি। ঠিক নেই।
অভিমন্যু একটু যেন হতাশ হল মনে হয়। টেবিলে রাখা দেশলাই-এর বাক্সটা হাতে ঘোরাচ্ছে। হঠাৎ বলল,—যদি যাও…আমাদের বাড়ি কিন্তু ওদের বাড়ির খুব কাছে।
আমন্ত্রণ? না তথ্য জ্ঞাপন?
অভিমন্যুর চোখে ঝলক চোখ রাখল তন্নিষ্ঠা,—তোমাকে বাড়িতে গেলে পাওয়া যাবে?
—দিনের বেলা ফ্যাক্টরিতে থাকি, সেটাও কাছেই। সেন্টের কারখানা বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে। সন্ধের পর বাড়িতেই অ্যাভেলেবল।
—আডডা ফাড্ডা নেই? তন্নিষ্ঠা টেরচা চোখে তাকাল,—বান্ধবী টান্ধবী?
—আছে তো। এই যেমন ধরো তুমি।
—দূর, আমার মতো কেন? স্পেশাল কেউ।
—তা জেনে তোমার লাভ?
—এমনিই। জাস্ট কৌতূহল।
—মেয়েলি কৌতূহল।
—মেয়েলি কৌতূহল?
—অ্যাই, বাজে কথা বলবে না। ছেলেদের কৌতূহল থাকে না?
—থাকে বইকী। একটু বেশি রকমই থাকে। যেমন এই মুহূর্তে আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোমার শৌনককুমার মানুষটি কেমন?
—চলতা হ্যায়। তন্নিষ্ঠা ঠোঁট চেপে একটু ভাবল,—স্মার্ট। হ্যান্ডসাম। হাইট পাঁচ সাড়ে আট। কমপ্লেকশন ডার্ক ব্রাউন! চুল স্লাইট কোঁকড়া। চোখ দুটো ব্রাইট। নাকটা একটু…
—থামো থামো এ তো নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন! আমি জিজ্ঞেস করছি তোমার ইঞ্জিনিয়ার সাহেব…
—নেচারের কথা বলছ? হাসিখুশি, কিন্তু সিরিয়াস, গুছিয়ে কথা বলতে পারে। নিজের মতকে সুন্দর যুক্তি দিয়ে সাজাতে পারে। মেজাজ হারায় না…
অভিমন্যু মিটিমিটি হাসছে,—উঁহু, এতেও মানুষটাকে বোঝা গেল না।
আর কী জানতে চায় অভিমন্যু? শৌনক কেরিয়ার সচেতন, দোষ? উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আবেগের চেয়ে যুক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেয়, শৌনকের ভালবাসা বড্ড তাড়াতাড়ি শরীরী হতে চায়, এই সেদিনও নিউ এম্পায়ারে প্রেটি উওম্যান দেখতে গিয়ে শৌনক…। কিন্তু এসব কি গুণ, না দোষ? যাই হোক না কেন, তন্নিষ্ঠা এত কথা কেন বলতে যাবে অভিমন্যুকে? তাও এই সামান্য আলাপে?
তন্নিষ্ঠা চোখ ঘোরাল,—শৌনকের কথা ছাড়ো, তোমার কথা বলো। তুমি মানুষটা কী রকম?
—যেমন দেখছ।
—উঁহু, যা দেখছি সেটাই সব নয়। তন্নিষ্ঠা ক্ষণিক জরিপ করল অভিমন্যুকে। জেরা করার ভঙ্গিতে বলল,—এ সব খ্যাপামি করে বেড়াও কেন?
—খ্যাপামি?
—বান্জারাদের মতো চেঁচাচ্ছ, ঘুরে ঘুরে বিজ্ঞানের খেলা দেখিয়ে বেড়াচ্ছ….
—বা রে, মানুষকে কনশাস করে বেড়াতে হবে না? মানুষ হিসেবে এটা তো আমার কর্তব্য।
—তাহলে আর ব্যবসা ট্যবসা করার দরকার কী? এসব করে বেড়ালেই হয়।
অভিমন্যু শব্দ করে হেসে উঠল,—ব্যবসা তো করি আমি পেট চালানোর জন্যে।…..। অবশ্য সুগন্ধ তৈরি করাটা আমার নেশাও বটে। আই হ্যাভ এ প্যাশান ফর ফ্রাগরেন্স।
—এক দিকে বিজ্ঞানমঞ্চ, অন্য দিকে ফ্রাগরেন্স! তোমার দুটো নেশা কিন্তু মেলে না।
—অফকোর্স মেলে। মানুষের মন থেকে কুসংস্কার মরে গেলে এক ধরনের সুরভি তৈরি হয়।
বাবাও এই ধরনের কী একটা কথা বলে না? একটা ভাল নাটক, একটা ভাল বই, কিংবা একটা ভাল সিনেমা মানুষের মনে সুবাস ছড়িয়ে দিতে পারে!
টোস্ট ওমলেট এসে গেছে। ছেলেমেয়েদের খাবারও তৈরি, বড় একটা প্যাকেটে পুরে ফেলেছে রেস্টুরেন্টের লোকটা। অভিমন্যুর নির্দেশে সে ছুটেছে কলেজে।
তন্নিষ্ঠা ওমলেটে চামচ চালাতে চালাতে বলল,—তুমি কিন্তু একটু পিকিউলিয়ার আছ।
—তাই কি? কে স্বাভাবিক, কে পিকিউলিয়ার তার তফাত তুমি করতে পারো?
চটজলদি জবাব এল না তন্নিষ্ঠার ঠোঁটে। স্থির চোখে ছেলেটাকে দেখছিল। মাথা নামিয়ে প্লেট টেনেছে অভিমন্যু, বুভুক্ষুর মতো খাচ্ছে গপাগপ। চামচের পরোয়া না করে, হাত দিয়েই। একটি কথাও আর বলছে না এখন। শৌনক যত ক্ষুধার্তই হোক, কক্ষনও এভাবে খাবে না।
ভাবনাটা চমকে দিল তন্নিষ্ঠাকে। আশ্চর্য, শৌনকের সঙ্গে তুলনা এল কেন?
.
০৬.
বাসবেন্দ্রর ভরাট কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল,—তাহলে আমরা এবার মিটিং শুরু করতে পারি?
—করাই তো উচিত। নির্মল ঘড়ি দেখল,—সাড়ে ছটা বাজে। অলরেডি আমরা আধ ঘণ্টা লেট।
—আমি অ্যাজেন্ডা পড়ছি। প্লিজ, সাইলেন্স।
সমিধের ঘর আজ কানায় কানায় পূর্ণ। চেয়ার টুল বেঞ্চিতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না, কিছুটা ঠাসাঠাসি করেই বসেছে অনেকে। গ্রুপের মোট সদস্যসংখ্যা ছাব্বিশ, আজ তেইশ জন উপস্থিত। শুভেন্দুদের বয়সী মেম্বার মাত্র সাত আট জন, বাকিরা বেশির ভাগই তরুণের দলে। মহিলাও আছে জনা চারেক, বাসবেন্দ্রর স্ত্রী সমেত। এতক্ষণ ভাঁড়ে ভাঁড়ে চা পান চলছিল, সঙ্গে অল্পবিস্তর অসংলগ্ন আড্ডা, বাসবেন্দ্রর ঘোষণায় ঘর এক লহমায় গুঞ্জনহীন।
টেবিল থেকে সুমিধের একটা প্যাড হাতে তুলল বাসবেন্দ্র,—আমাদের প্রথম অ্যাজেন্ডাম, সমিধের আগামী নাটক। দুই, সদস্যদের আচরণবিধি সম্পর্কে আলোচনা। তিন, বিবিধ।……প্রথমটা দিয়েই সভা শুরু হোক।
প্রণবেশ শুভেন্দুর পাশের চেয়ারে। হাতের ভাঁড়ে সিগারেট নিবিয়ে সে উঠে দাঁড়াল,—আমি কি প্রথমে বলতে পারি?
—বলো।
প্রণবেশ দু পকেটে হাত ঢোকাল। কয়েক সেকেন্ড চুপ, বক্তব্য সাজিয়ে নিচ্ছে মনে মনে। তারপর বলল,—আলোচনার গোড়াতেই একটা কথা বলে নিতে চাই। আমাদের গ্রুপের বয়স বাইশ বছর পার হয়ে গেছে, এখনও পর্যন্ত আমরা নামিয়েছি ষোলোটা প্রোডাকশন। প্রথম দিকে চোদ্দো পনেরোটা বছর আমাদের দল খুব টালমাটাল অবস্থার ভেতর দিয়ে গেছে। তবু আমরা ভেঙে পড়িনি। উইথ নিউ জিল আমরা পর পর নাটক নামিয়ে গিয়েছি। ওই কঠিন সময়েও। গত কয়েক বছরে আমাদের দলের কিছু গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। এতদিন পর আমরা ক্রমশ কয়েকটা নাটক মঞ্চস্থ করেছি, যেগুলো দর্শকরা খুব ভাল ভাবে নিয়েছে। পর পর তিনটে নাটক সাকসেসফুল, এমন দল পশ্চিমবঙ্গে কটা আছে হাতে গুনে বলা যায়। এই তিনটে নাটক আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে, সমিধ এখন সমস্ত বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে এক অতি পরিচিত নাম। যার সুযোগ্য নেতৃত্বে সমিধ আজ এইখানে পৌঁছেছে, দলের প্রত্যেক সদস্যের পক্ষ থেকে তাকে অভিনন্দন না জানালে সেটা অন্যায় করা হবে……..
নির্মল উসখুস করে উঠল,—প্রণবেশ, কাজের কথায় এসো।
বাসবেন্দ্র হেলান দিয়ে বসে ছিল। চোখ বুজে। নড়েচড়ে উঠল। মৃদু ধমকের সুরে বলল,—প্রণবেশ, আমাদের গ্রুপে ব্যক্তিপূজার কোনও স্থান নেই, তুমি জানো। আমাদের প্রতিটি সাফল্যই দলের, নো ইনডিভিজুয়াল শ্যাল গেট ইটস্ ক্রেডিট। এটাই আমাদের ঘোষিত নীতি।
প্রণবেশ সহাস্যে বলল,—ওকে, ওকে। কাজের কথায় আসি। আমাদের লাস্ট যে তিনটে প্রোডাকশন সাকসেসফুল হয়েছে সেগুলোকে যদি আমরা অ্যানালিসিস করি, তাহলে কী দেখতে পাব? আমরা বর্তমান দর্শকদের রুচিটা মোটামুটি ধরে ফেলেছি। আমাদের ফর্মও দর্শকরা পছন্দ করেছে, কনটেন্ট্ও। এবং দর্শকদের রুচিবিকৃতি না ঘটিয়েই এটা করা সম্ভব হয়েছে। বলা যেতে পারে, সাধারণ দর্শকের রুচিবোধকে আমরা আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। টু কিপ্ আপ দিস টেম্পো আমি এবার দলকে একটু অন্য ভাবে ভাবনা করতে বলছি। তোমরা কি কেউ দীনেন সেনগুপ্তর রংমশাল উপন্যাসটা পড়েছ?
দলের নবীন সদস্য বিশাখা শেষ প্রযোজনার কিছুদিন আগে সমিধে এসেছে। কোণ থেকে সে বলে উঠল,—আমি পড়েছি। হাল্কা উপন্যাস।
—হ্যাঁ, তেমন গভীর নয়, তবে বেশ একটা মজা আছে। বর্তমান সমাজটাকে একটু তির্যক ভাবে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। কনটেক্সটটা সোশাল, তার মধ্যেই…
—তা ঠিক। উপন্যাসের যে নায়ক, সে সব জায়গায় রিজেক্টেড হচ্ছে, তবে নরমাল ভাবে নয়। এমনকী তার প্রেমিকা, সে তাকে মুখে প্রত্যাখ্যান করছে না, অথচ অন্য একজনকে বিয়ে করার দিন তাকে রেজিস্ট্রি অফিসে সাক্ষী থাকার জন্য রিকোয়েস্ট করছে…। আইডিয়াটা একটু নতুন, তবে দাঁড়ায়নি। মাঝে মাঝে কেমন ছ্যাবলামি বলে মনে হয়।
—আমরা তো শুধু উপন্যাসের নির্যাসটুকু নেব। বাসবেন্দ্র নাট্যরূপ দেবে, ও তো মোটামুটি ঘষে মেজে ঠিক করে নেবেই, যেখানে যেখানে চার্জ আনার স্কোপ আছে আনবে। দরকার হলে এন্ড্টাও একটু টুইস্ট করে দিতে পারবে বাসবেন্দ্র।…আই মিন ওই উপন্যাসটাকে ধরেই আমি পরের প্রোডাকশানটা নামানোর কথা ভাবছিলাম। আইডিয়াটা কি খুব খারাপ?
বাসবেন্দ্র সোজা হয়ে বসল,—আমিও উপন্যাসটি পড়েছি। ওতে উত্তম ড্রামার প্রচুর মালমশলা আছে। কোন্ নাটক দর্শকরা নেবে আগে থেকে বলা মুশকিল, তবু…মনে হয় রংমশালের বক্স পাওয়ার সম্ভাবনা হাই।
প্রণবেশের কথার সময়ে টুকটাক বাক্যবিনিময় চলছিল ঘরের আনাচে কানাচে, বাসবেন্দ্র বক্তব্য রাখার পর আবার হিরন্ময় নীরবতা। যেন প্রণবেশের ইচ্ছেটায় কর্তৃত্বের সীলমোহর পড়ে গেছে, এমনই বোধ চারিয়ে গেছে সদস্যদের মধ্যে।
তরুণ সদস্য দ্বৈপায়ন হঠাৎ বলে উঠল,—তাহলে তো কাজ শুরু করে দেওয়াই যায়। বাসবদা ড্রামাটাইজেশানটা শুরু করে দিন, একটা ডেট্ ফিক্স করে সকলকে সেটা পড়ে শোনান।
বাসবেন্দ্র বলল,—দাঁড়াও, তাড়াহুড়ো কীসের? সকলের মতামতটা শুনি, আলোচনা হোক।
তৃণাঞ্জন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল,—আর আলোচনার কী আছে? এ তো সেটলড্ই হয়ে গেল। বাসবদা যখন বলছেন গল্পটার প্রসপেক্ট আছে তখন নিশ্চয়ই আছে।
শুভেন্দু হতবাক চোখে সকলকে দেখছিল। আর চুপ থাকতে পারল না, বলে ফেলল,—কিন্তু একটা কথা তো ভাববার আছেই। সমিধের লং টার্ম ট্র্যাডিশান অরিজিনাল প্লে মঞ্চস্থ করা। বড় জোর দু চারটে অনুবাদ… টু বি এগ্জ্যাক্ট চারটে অনুবাদ আমরা স্টেজ করেছি। বাট নেভার নেভার নেভার বিফোর একটা উপন্যাসকে আমরা…
বাসবেন্দ্র মৃদু স্বরে বলল,—উপন্যাস মঞ্চস্থ করায় কি কোনও ক্ষতি আছে সাহেব?
নির্মল বলে উঠল,—লাভ ক্ষতি তো ব্যবসার কথা বাসবেন্দ্র। উপন্যাসে আমার কোনও ছুতমার্গ নেই। টলস্টয় রবীন্দ্রনাথ অদ্বৈত মল্লবর্মন অনেক নাম আছে লিস্টে। অ্যান্ড দোজ আর সাকসেসফুল প্লে। আমাদের যুদ্ধযাত্রা বা অচিনপুরীর চেয়েও অনেক বেশি মঞ্চসফল। কিন্তু যে উপন্যাসটা করার কথা উঠেছে, সেটা কি ওই স্তরে পড়ে? বরং আমি একটা অল্টারনেট প্রোপোজাল দিতে পারি। সাহেব দারিও ফোর একটা নাটক অনেকটা ট্রানস্লেট করে ফেলেছে, তুমি বোধহয় জানোও, হোয়াই কান্ট উই প্রসিড উইথ দ্যাট ওয়ান? ফো’র নাটক আমরা আগে করিনি, এটা একটা স্বাদ বদলানোও হবে। প্লাস, ফো’র স্যাটায়ার বর্তমান দিনে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। অন্তত আমাদের দেশে। হাসি মজা গান মিলিয়ে ও নাটক জমেও যেতে পারে।
—হয়তো। বাসবেন্দ্র সিগারেট ধরাল,—কিন্তু দর্শকরা এখন যখন সমিধের নাটক দেখতে আসে, তখন একটা বিশেষ প্রত্যাশা নিয়ে আসে। সেটা তো ফুলফিল করতে পারব না।
সঙ্গে সঙ্গে প্রণবেশও বলে উঠেছে,—সুতরাং আমাদের ওই এক্সপেরিমেন্টেশানে না যাওয়াই ভাল।
—স্ট্রেঞ্জ, এখন সমিধের কোমরের জোর হয়েছে, এখনই তো পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর সময়! আমরা স্টেট থেকে গ্র্যান্ট্ পেয়েছি, সেন্ট্রাল থেকে গ্র্যান্ট্ পেয়েছি, ওয়ার্কশপ চালাচ্ছি, সেমিনার করছি, নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা আমাদের কাছে নতুন থট্ এক্সপেক্ট করে, সেখানে আমরা আবার ট্র্যাডিশনাল সোশাল স্টোরিতে ফিরে যাব? আই বেগ টু ডিফার। বাসবেন্দ্র, তুমি আমার নোট অফ ডিসেন্ট লিখে রাখো।
কে যেন চাপা স্বরে মন্তব্য ছুড়ল,—ও ভাবে কি সাহেবদাকে প্রোমোট করা যাবে?
—কে? কে বলল কথাটা?
ঘরে কবরখানার নৈঃশব্দ্য।
নির্মল তেতো হেসে বলল,—যে কথাটা উচ্চারণ করল তার জেনে রাখা উচিত আমাদের দলে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে সে স্বচ্ছন্দে তার বক্তব্য রাখতে পারে।
এবারও কোনও উত্তর নেই।
নির্মল হা হা হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,—বাসবেন্দ্র, আমাদের গ্রুপ কি ভেড়ায় ভরে গেল?
—উইথড্র উইথড্র। সুজিত চেঁচিয়ে উঠেছে,—আপনার কোনও রাইট নেই আমাদের ইনসাল্ট করার।
আরও দু তিনটে দিক থেকে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ভাষা খুব শ্রুতিসুখকর নয়, মন্তব্যগুলোও রীতিমতো হৃদয়বিদারক। মোদ্দা অভিমত একটাই, নির্মলকে ক্ষমা চাইতে হবে।
নির্মল এতটুকু নুইতে রাজি নয়। সে চেঁচামেচিকে আমলই দিচ্ছে না। হট্টগোল ক্রমশ চড়ছিল, বাসবেন্দ্র মন্ত্রবলে সকলকে শান্ত করে ফেলল। গমগমে গলায় বলল,—নির্মল তো এক্সাইটেড হতেই পারে। সাহেবের সম্পর্কে ও রকম সুইপিং রিমার্ক করা মোটেই ঠিক হয়নি। সাহেব আমাদের কতদিনের পুরনো কমরেড, কতকাল আমরা এক পথে হাঁটছি…। সাহেবের তিন তিনটে অনুবাদ তো আমরা করেওছি। সেগুলো হয়তো তখন চলেনি, কিন্তু তা বলে তো সাহেব খাটো হয়ে যায় না! হয়তো এবার না করলাম, নেক্সট্বারই আমরা সাহেবের লেখা কিছু একটা নিয়ে…
নির্মল বাঁকা চোখ তাকাল, —তার মানে অন্য কোনও নাটক হবে না, এটা আগে থেকেই স্থির হয়ে গেছে।
—শান্ত হও, শান্ত হও। বাসবেন্দ্ৰ হাত তুলল,—তুমি না এইমাত্র বললে আমাদের গ্রুপে ডেমোক্রেসি চলে! আমিও জানি আমাদের দলের মতো ডেমোক্রেসি কোনও গ্রুপে নেই…
—তো? নির্মলের ভুরু জড়ো হল।
—ডেমোক্রেসিই ঠিক করুক কোন্ প্রোডাকশানটা হবে। সদস্যরা ভোট দিয়ে চয়েস জানাক।
শুভেন্দু ভেতরে ভেতরে এরকমই একটা প্রস্তাব আঁচ করছিল। এই মুহূর্তে বাসবেন্দ্রকে দেখে মনে মনে পীড়িতও হচ্ছিল খুব। কত কাছের মানুষ কত সহজে অচেনা হয়ে যায়।
আহত ভাবটা লুকোতে পারল না শুভেন্দু। তীক্ষ গলায় বলল,—তুমি কি বলছ তার মানে জানো বাসবেন্দ্র? ভোট দিয়ে নাটক সিলেকশান করবে?
—দোষের কী আছে? মেজরিটির মতই গ্রাহ্য হওয়া উচিত। আমরা বেশি দিন আছি বলে আমাদের ইচ্ছে জোর করে কারুর ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না।
শুভেন্দু অস্ফুটে বলল,—আমাদের এতদিনের জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতা, এত কাণ্ড করে গড়ে তোলা নাট্য আন্দোলন, সব মিথ্যে? সত্যি শুধু ভোট?
—এবং সেই ভোট, যেটা আগে থেকে ম্যানিপুলেট করা আছে। নির্মল শ্লেষের সুরে বলল, —চমৎকার। আবার বলি ঔরঙ্জেব, চমৎকার।
—মুখ সামলে নির্মল। বাসবেন্দ্র দুম করে গলা চড়াল,—তুমি কিন্তু আমায় ইনসাল্ট্ করছ। আমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলাতে পারছি, গ্রুপের সকলের চিন্তাভাবনা আমার সঙ্গে মিলছে, এটা আমার দোষ? নাটকের জন্য তোমাদের চেয়ে আমি কম মুভমেন্ট করেছি? তোমাদের চিন্তাভাবনা এখনও একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, অ্যান্ড ফর দ্যাট রিজ্ন ইউ আর সাসপেক্টিং ইওর ওল্ড কমরেড।
—বটেই তো। নির্মলের ঠোঁটে শাণিত ব্যঙ্গ—কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কতটা বদলাবে বাসবেন্দ্র? গ্রুপটাকে প্রফেশনাল বোর্ড করে ফেলবে?
—এগেইন অ্যান ইন্সাল্টিং কমেন্ট। তুমি জাননা, প্রফেশনাল বোর্ডে কত বড় বড় ব্যক্তিরা কাজ করে গেছেন?
—এবং তুমিও জানো আমি তাঁদের ইনসাল্ট করছি না। আই ডু রেসপেক্ট দেম, কিন্তু আমাদের পথ আলাদা। এন্টারটেনমেন্টকে তাঁরা এক চোখে দেখেছেন, আমরা আর এক চোখে। আমাদের একটা ইজম্ ছিল। আমরা নাটকের মধ্যে দিয়ে কোথাও একটা পৌঁছতে চেয়েছিলাম। সেই গোলটা বক্স অফিস নয়। আমাদের নিজস্ব কিছু বলার আছে, সেটাকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরার আছে…
—মানে আর কী, মুক্তাঙ্গন যোগেশ মাইম কিংবা বয়েজ ওউন হলের কাউন্টারে বসে বসে মাছি তাড়ানো, তাই তো? সুজিত টুকুস টিপ্পনী কেটে উঠল, —তখন বছরে কটা কল’শো করতেন, নির্মলদা?
—ব্যাটেলিয়ান একেবারে ফিট, অ্যাঁ? এবার মেজরিটি যদি পতির কোলে সতী চায়, তাই করবে তো বাসবেন্দ্র? নির্মলের গলাও চড়ে গেছে।
আবার গোলমাল শুরু হয়ে গেল। এক সঙ্গে অনেকে উঠে এসেছে বাসবেন্দ্রর টেবিলের সামনে, চেঁচাচ্ছে উত্তেজিত মুখে। বাসবেন্দ্রর মুখ লাল, চোয়ালে চোয়াল ঘষে চুপ করতে বলছে সকলকে। তার মুখ দেখে কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় এই মুহূর্তে সভাটা যে নিয়ন্ত্রণহীন, এটাই তার অভিপ্রেত ছিল।
নির্মল ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়িয়েছে, তারও দৃষ্টিতে আগুন। ফুটন্ত গলায় বলল, —বাসবেন্দ্র, চলি তাহলে। তুমি তোমার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে গ্রুপ চালাও।
শুভেন্দু কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না, মস্তিষ্কের একটি কোষও যেন কাজ করছে না এখন। এই তার নাট্যজগৎ? তার ত্রিভুবন? এর জন্য সে ঘর সংসার চাকরি সব উপেক্ষা করেছে? ঢেলে দিয়েছে সমস্ত উদ্যম?
নির্মলের ডাকে হুঁশ ফিরল। ঘর ছাড়ার আগে নির্মল সামনে এসে কাঁধে হাত রেখেছে, কী সাহেব, তুমি কি এখনও বসে থাকবে?
সম্মোহিতের মতো উঠে পড়ল শুভেন্দু। বেরিয়ে রাস্তাতেও পৌঁছয়নি, মেয়েলি ডাকে ঘুরে তাকিয়েছে। তাপসী। বাসবেন্দ্রর স্ত্রী। অন্যান্য মিটিং-এ কিছু কিছু বলে না তাপসী, আজ সারাক্ষণ চুপ করে ছিল।
নির্মল গোমড়া মুখে বলল,—তোমার আবার কী দরকার পড়ল আমাদের?
—তোমরা কি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছ নির্মলদা?
—নয় তো কি ঘাড় ধাক্কা দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল?
ফর্সা মধ্যবয়স্ক তাপসীর মুখমণ্ডলে ছায়া। অনুচ্চ স্বরে বলল, —তোমরা কিছু বেঠিক বলোনি। আমাদের আগের নাটক-কটা তাও যুক্তি বুদ্ধির ভেতরে ছিল, সামান্য হলেও তাতে মেসেজ ছিল কোনও!…… কিন্তু দিস ইজ টু মাচ। ওই রংমশাল উপন্যাসটা আমি পড়েছি। নেহাতই বাজারচলতি নভেল। ট্র্যাশ। সমিধকে নিয়ে অলরেডি কানাকানি শুরু হয়ে গেছে, রংমশাল নামালে অনেকেই ছি ছি করবে।….. কিন্তু প্রবলেমটা কী হয়েছে জানো? বাসবেন্দ্রর মাথায় ঢুকে গেছে, গ্রুপটাকে আরও বড় করতে হবে। একটা বিশাল ছাতার মতো প্রতিষ্ঠান হবে সমিধ।
—ভালই তো! তোমরা ছাতার নীচে রইলে।
—ঠাট্টা করছ? স্ট্রিট লাইটের আলো কৌণিক ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাপসীকে। তার মুখের কিছুটা আলোয়, কিছুটা অন্ধকারে। আর একটু এগিয়ে এল তাপসী। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, —বাসবেন্দ্রকে আমি অনেক বুঝিয়েছি নির্মলদা। আদর্শের সঙ্গে আপস মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে না। আলটিমেটলি যেখানে পৌঁছনো যায়, সেটা তার ডেসটিনেশান ছিল না।
—কথাগুলো তো তুমি ঘরেই বলতে পারতে।
—লোক হাসাতে ভাল লাগে না।
—তাহলে এখনই বা বলতে এলে কেন?
—এলাম। আমি তো শুধু বাসবেন্দ্রর বউ নই, আমি তো তাপসীও। যে তাপসী সমিধের জন্ম-মুহূর্ত থেকে সঙ্গে সঙ্গে আছে। অ্যাক্টিং ট্যাক্টিং হয়তো তেমন করিনি, তোমাদের টুল চেয়ার তো এগিয়ে দিয়েছি! হেসে। ভালবেসে। মন থেকে। আজ গ্রুপের প্রত্যঙ্গ খসে গেলে আমার কষ্ট হবে না? তাপসী শুভেন্দুর চোখে চোখ রাখল,— তোমরা বোধহয় ঠিকই করেছ সাহেবদা। একটাই শুধু রিকোয়েস্ট, বসে যেও না।
তাপসী ফিরে যাচ্ছে। শিথিল, অন্যমনস্ক পায়ে। মলিন আবছায়া মাড়িয়ে। একটুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। ঢুকে গেল।
নির্মল, শুভেন্দু হাঁটা শুরু করেছে। খানিকটা গিয়ে নির্মল ঝেঁঝে উঠল, — ন্যাকামোটা দেখলে ?
শুভেন্দু বলল, —ন্যাকামি বলছ কেন? তাপসী তো সত্যিই নিজের ফিলিংটা জানিয়ে গেল।
—ডোন্ট টক রাবিশ। তুমি বিশ্বাস করতে বলো তাপসী জানত না আজ এই সাজানো নাটকটা অভিনীত হবে? যার লাস্ট সিন আমাদের এগজিট? তাপসী জাস্ট বাসবেন্দ্রর হয়ে আমাদের প্যাসিফাই করতে এসেছিল। বাসবেন্দ্ররই শেখানো পড়ানো কথা…..
—নাও তো হতে পারে। কেন তাপসীকে আমরা অবিশ্বাস করব?
—তুমি আর বদলালে না সাহেব। সব কিছু সাদা চোখে দেখা এবার ছাড়ো। আজকের টোটাল প্যান্ডেমোনিয়ামটার কারণটা কিছু আন্দাজ করতে পেরেছ?
—হ্যাঁ, ওরা ফো-র নাটক করতে চায় না। ওরা কমার্শিয়াল হয়ে গেছে।
—কাঁচকলা বুঝেছ। নির্মল জোরে জোরে মাথা নাড়ল,—ওটাকে ইস্যু করেছিল বটে, কিন্তু ওটাই মেন নয়। সেকেন্ড অ্যাজেন্ডামটা কী ছিল মনে আছে? সদস্যদের আচরণবিধির পর্যালোচনা। ওটা আমিই জোর করে ঢুকিয়েছিলাম। বাসবেন্দ্রর ইচ্ছের বিরুদ্ধে। বাসবেন্দ্ৰ ভাল মতো জানে ওই প্রসঙ্গটা উঠলে নিজেকেই ওর ডিফেন্ড করার জায়গা থাকবে না। ইয়াং ছেলেমেয়েগুলো টিভিতে চান্স পাওয়ার জন্য সারাক্ষণ স্টুডিওপাড়ায় ঘোরাঘুরি করছে, রিহার্সাল স্কিপ করে যাচ্ছে, বাসবেন্দ্র ওদের কিচ্ছুটি বলতে পারে না। কোন মুখে অ্যাজেন্ডামটা তুলবে বাসবেন্দ্র?
—হুঁ। শুভেন্দু শুকনো হাসল,—এখন আমরা আউট হয়ে গেলাম। সবাই এখন মুক্ত বিহঙ্গ।
—সব চেয়ে বড় আয়রনিটা দেখলে? যে বাসবেন্দ্র একদিন ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করত না, সে এখন নিজের দলে ভোট চালু করতে চায়।
শুভেন্দু বিড়বিড় করে বলল,—দোষটা হয়তো আমাদেরই। একটু একটু করে ক্ষমতা বাড়ছিল বাসবেন্দ্রর। যেখানেই ছুটতে হোক, যাকেই মিট করতে হোক, বাসবেন্দ্র আছে। দেখেও তো আমরা চোখ বুজে থেকেছি। আমরা নিজেরা কিছু করিনি। ভেবেছি, বেশিটাই যখন ও পোহাচ্ছে, নয় ক্ষমতাও বেশি ভোগ করুক। কিন্তু ও যে একদিন গোটা দলটাকে ম্যানুভার করে পুরো ওয়ান ম্যানস্ টিম বানিয়ে ফেলবে, এটা ভাবতে পারিনি।
—ভাবা উচিত ছিল। আমি তো কত বারই ভোকাল হতে চেয়েছি, তুমি আমায় চুপ করিয়ে দিয়েছ। নির্মল দাঁতে দাঁতে ঘষল,—পাওয়ার কোরাপ্টস্। অ্যাবসোলিউট পাওয়ার কোরাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি। ও এখন স্বচ্ছন্দে অটোক্রেসিটা ডেমোক্রেসির মোড়কে মুড়ে লোকসমক্ষে তুলে ধরবে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে এসেছে দুজনে। ট্রাম রাস্তা পেরিয়ে গলি, গলি পেরিয়ে রাজপথ, আবার গলি, আবার ট্রামরাস্তা। পার হয়ে যাচ্ছে ভিড়, পথের আলো কমছে বাড়ছে কমছে। বৈশাখী সন্ধ্যা রাতের দিকে গড়িয়ে চলল, টের পাচ্ছে না দুই বন্ধু। হাঁটছে। এখন বড় নিঃশব্দ এই পথ চলা।
শুভেন্দু বুকে একটা চাপ অনুভব করছিল। মস্তিষ্ক আবার অবশ ক্রমশ। আজ হোক, কাল হোক, নন্দিতা তো জানবেই, কী বলবে? নাটক থেকেও ভলানটারি রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেল? উফ্, কী সুতীক্ষ্ণ পরিহাস সহ্য করতে হবে শুভেন্দুকে। নিজের আয়নাতেই বা কোন মুখ দেখতে পাবে শুভেন্দু? একজন সম্পূর্ণ পরাজিত বিতাড়িত মানুষ….একটা ক্ষয়ে যাওয়া আত্মা! বেঁচে থাকাটাই কী অর্থহীন এখন। উপায় একটা আছে। নিঃশর্তে নন্দিতার পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করা। পাথর হয়ে, ঘাস হয়ে জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দেওয়া। মাস দুয়েকের মধ্যে পি এফ ছাড়া বাকি টাকাটা হাতে এসে যাবে। মোটামুটি সাড়ে তিন লাখ। নন্দিতার কথা মতো একটা ব্যবসা ট্যবসা নয় শুরু করে দেবে। তিন্নির বিয়ের জন্যও অবশ্য রাখতে হবে কিছু টাকা……
অকস্মাৎ থমকে দাঁড়াল শুভেন্দু। কতক্ষণ হেঁটেছে? এ কোথায় এসে পড়েছে তারা? সামনে তো গঙ্গা! ওই তো কাশী মিত্তিরের ঘাট। চমকে পাশে তাকাল শুভেন্দু। নির্মলও কেমন অবাক মুখে স্থির।
নির্মলও তাকাল শুভেন্দুর দিকে। হঠাৎই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে। হাসতে হাসতে বলল, — মনে পড়ে কবে প্রথম এখানে এসেছিলাম?
শুভেন্দু মাথা নাড়ল,—হ্যাঁ। দুজনেই একটা পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছিলাম, দুজনেরটাই অমনোনীত হয়েছিল। মনের দুঃখে কফিহাউস থেকে হাঁটতে হাঁটতে…..।
—লং থারটিথ্রি ইয়ার্স এগো। কী একটা গান আছে না, প্রতিটি লাইনের শেষে লং লং এগো…? এ যেন ঠিক তেমনি, তাই না?
শুভেন্দু করুণ হাসল।
—ডাজ ইট মিন এনিথিং সাহেব?
—কোনটা?
—এই আমাদের এখানেই এসে পড়াটা? মনে হচ্ছে না, একটা ইনার ফোর্স আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে এল?
শুভেন্দু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকাল।
—মনে আছে, সেদিন এই গঙ্গার ধারে বসে আমরা কী ঠিক করেছিলাম?
মনে আছে শুভেন্দুর। নদীর পাড়ে বসে তারা কোরাসে গেয়েছিল, উই শ্যাল ওভারকাম……। কী অসম্ভব শক্তি পেয়েছিল সেদিন। রাতে বাড়ি ফিরেই আবার কবিতা লিখতে বসেছিল।
কিন্তু সেই শুভেন্দু আর এই শুভেন্দু কি এক মানুষ?
মলিন স্বরে, শুভেন্দু বলল,—মনে রাখা মানে তো শুধু কষ্ট পাওয়া।
—তা কেন? আমাদের এখানে আসাটাই বলে দিচ্ছে, আবার আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।
—কী শুরু করব?
—আমরা নতুন গ্রুপ ফর্ম করব।
—শুধু দুজন মিলে?…। আমি লিখব, তুমি অ্যাক্টিং করবে, আমি লাইট ফেলব, তুমি ড্রপ টানবে….।
—ডোন্ট বি পেসিমিস্ট ম্যান। নির্মল পিঠ চাপড়াল শুভেন্দুর, —এত বছরে কি আমরা কিচ্ছু শিখিনি? আট দশটা ইয়াং ব্লাডকে আমরা দলে টানতে পারব না? আমি শিওর বিশ্বজিৎ আর সুকান্ত আমাদের সঙ্গে চলে আসবে। আজ সামনাসামনি ওরা বাসবেন্দ্রকে ডিফাই করতে পারেনি, বাট অ্যাট হার্ট ওরা আমাদের সঙ্গেই আছে। ইনফ্যাক্ট, পরশু আমার বিশ্বজিতের সঙ্গে কথাও হচ্ছিল। আমার ইন্টিউশান বলছে, বিশাখাও আসবে। গ্রুপ শুরু করতে পাঁচ জনই যথেষ্ট। সমিধের যখন গোড়াপত্তন হল, তখন আমরা কজন ছিলাম সাহেব?
—বয়সটা তখন বাইশ বছর কম ছিল নির্মল। মাঝে শরীরের কোটি কোটি সেল্ নষ্ট হয়ে গেছে।
—ওতে কিচ্ছু আসে যায় না। তিপ্পান্ন পঞ্চান্ন বছর বয়সটা নতুন লাইফ শুরু করার জন্য এমন কিছু লেট নয়।
শুভেন্দু চুপ করে গেল। পায়ে পায়ে গঙ্গার পাড়টিতে এসেছে। কাশী মিত্তিরের ঘাট একটুখানি দূরে, এ জায়গাটা বেশ নির্জন। কাঠের গুঁড়ি পড়ে আছে একটা, শুভেন্দু গুঁড়িটায় বসল।
নির্মলও পাশে এসে বসেছে। সিগারেট ধরাল, শুভেন্দুকেও দিল। গলা ঝেড়ে বলল, —তোমার অনুবাদের কাজ কদ্দুর?
—গোটা চারেক সিন বাকি।
—শোনাও একদিন।
শুভেন্দু আলগা ভাবে নির্মলের হাতে চাপ দিল,—সে আর হয় না। বাদ দাও।
—কেন হয় না সাহেব?
—আমাকে এবার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন অবসরজীবন যাপন করতে দাও।
সোনালি করমর্দনের কাহিনী এই সবে গত সপ্তাহে নির্মলকে খোলসা করে বলেছে শুভেন্দু, তথাপি শুভেন্দুর কথাটাকে নির্মল গ্রাহ্যই করল না। বলল, —সে তুমি পারবেই না।
—পারতেই হবে। নন্দিতাকে সুখী তো করতে পারলাম না, এবার অন্তত একটু স্বস্তি দিই।
—কেন এত ভেঙে পড়ছ বলো তো? বুঝতে পারছ না তোমার এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে, করার আছে……। কথায় বলে লাইফ বিগিনস অ্যাট ফরটি। তার মানে তুমি এখনও কৈশোর পেরোওনি।
—তুমি দেখি একদম আমার তিন্নির মতো কথা বলছ!
—স্বাভাবিক। আমার মনের বয়স এখনও যে তিন্নির বয়সের থেকে কম। নির্মল হাসছে। হাসতে হাসতেই শুভেন্দুর পিঠে হাত রাখল আবার,—কী সাহেব, আমরা তাহলে নতুন দল গড়ছি?
শুভেন্দু হ্যাঁ না কিছুই বলল না। থেকে থেকে বুকের মধ্যে রক্তের কল্লোল জাগছে আবার হঠাৎই কেঁপে কেঁপে উঠছে হাঁটু। নদীর ওপারটায় আলো, এপারেও, মাঝখানে তরল আঁধার। ভাটা চলছে, ঠেলে ঠেলে উজান স্রোতে নৌকো বাইছে এক মাঝি। আলো ঝলমল একটা লঞ্চ চলে গেল, ঢেউয়ে নৌকো টলমল। সিল্যুয়েট নৌকা আবার এগোচ্ছে। ধীরে ধীরে। দুলতে দুলতে।
শুভেন্দু দোদুল্যমান নৌকোটাকে দেখছিল। নিষ্পলক চোখে।
.
০৭.
ভরদুপুরে তন্নিষ্ঠাকে দেখে অবাক হয়ে গেল কোয়েল,—কী রে, তুই হঠাৎ?
তন্নিষ্ঠা ঠোঁট টিপে হাসল,—তোর অফিস দেখতে এলাম।
—খুব ভাল করেছিস। আয়, বোস। কোয়েল খোলা স্টেপকাট চুল ঝাঁকাল, আঙুল তুলে বলল, —এক সেকেন্ড।
হাতলঅলা বেঁটে ঘুরনচেয়ারে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি পাক খেল কোয়েল। সামনে রাখা কম্পিউটারের কি টিপছে টকাটক, দৃষ্টি স্থির পর্দায়। থামছে মাঝে মাঝে, ঝটাঝট প্রিন্টআউট বেরোচ্ছে, আলগা চোখ বুলিয়ে কাগজগুলো জড়ো করছে টেবিলের এক পাশে।
গদিআঁটা হাতলবিহীন চেয়ারে বসতে বসতে তন্নিষ্ঠা অফিসটাকে দেখে নিল একবার। ছোট, তবে ভারী ছিমছাম সাজানো অফিস, দেওয়াল মেঝে সব একেবারে ঝকঝকে তকতকে, কোথাও এতটুকু ধূলিকণার চিহ্নমাত্র নেই। খোলা জায়গায় পর পর বিন্যস্ত টেবিলে জনা পনেরো কর্মী, বেশির ভাগই তরুণ তরুণী, কাজ করছে অখণ্ড মনোযোগে। কোয়েলের মতো আরও কয়েক জনের টেবিলে কম্পিউটার, সেখানেও চলছে শব্দ সংখ্যা আর অক্ষরের খেলা। প্রান্তে প্লাইউড ঘেরা ঘরও আছে দু তিনটে। একটা ঘর থেকে সবুজ বুশসার্ট পরা এক মধ্যবয়সী লোক ব্যস্তসমস্ত মুখে বেরিয়ে এল। একটা টেবলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এক রাশ প্রিন্টআউট হাতে আবার ঘরে ঢুকে গেল। গোটা অফিসে চড়া এসি চলছে, বেজায় ঠাণ্ডা। কে বলবে বাইরে এখন প্রখর বৈশাখ?
প্রিন্টআউটের স্তূপ পেপারওয়েটে চাপা দিয়ে তন্নিষ্ঠার দিকে ফিরেছে কোয়েল,—বল্? কী খবর?
প্রাইভেট অফিসের কর্মব্যস্ত রূপ দেখে অস্বস্তি হচ্ছিল তন্নিষ্ঠার। বলল, তোকে ডিসটার্ব করলাম না তো?
—আরে দূর। টেবিলে রাখা পেনসিল তুলে কোয়েল হালকা ঠুকছে,—কেমন দেখছিস আমাদের অফিস?
—এ ওয়ান। দু আঙুলে মুদ্রা করল তন্নিষ্ঠা।
—খাটায়ও খুব। কোনওদিন সাতটা আটটার আগে বাড়ি ফিরতে পারি না। বলতে বলতে চোখ ছোট করল কোয়েল,—তুই সত্যি সত্যি আমার অফিস দেখতে এসেছিস?
তন্নিষ্ঠা হাসি হাসি মুখে বলল,— কলেজ সার্ভিস কমিশনের অফিসে এসেছিলাম। ভাবলাম সামনেই তোর অফিস, একবার ঢুঁ মেরে যাই।
কোয়েল এক সেকেন্ড থমকাল। পরমুহূর্তে চোখ গোল গোল, —ও হ্যাঁ, আজ তো তোদের স্লেট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। পেয়ে গেছিস?
তন্নিষ্ঠা চোখ বন্ধ করে ঘাড় নাড়ল,—লেগে গেছে।
—কনগ্র্যাট্স্। হাত বাড়িয়ে দিল কোয়েল। তন্নিষ্ঠার হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, —হোয়াট আ গ্রেট নিউজ! একটা ট্রিট দে।
—আরে দাঁড়া, সবে তো রিট্ন গেল, এর পর ইন্টারভিউ আছে, তাতেও তো ছেঁটে যেতে পারি।
—কক্ষনও না। বড় গাঁটটা যখন পেরিয়েছিস, তখন ওটাও উতরে যাবি। ….কবে ইন্টারভিউ?
—সেটা জানতেই তো এসেছিলাম। ভ্যাৎ, কেউ কিছু বলতেই পারে না। কেউ বলে তিন মাস, কেউ বলে ছ মাস, কেউ উত্তরই দেয় না।… তবে মনে হয় পুজোর আগেই ইন্টারভিউ বোর্ড বসবে।
—তুই চাকরিটা পেলে আমাদের ব্যাচের সাত জন কলেজে যাবে। আমাদের ব্যাচটা কী রকম ভাল ছিল বল্?
তন্নিষ্ঠা সামান্য সঙ্কুচিত বোধ করল। কোয়েল ছ নম্বরের জন্য ফিফ্টি ফাইভ পারসেন্ট পায়নি, বেচারা কোনওদিন স্লেট পরীক্ষায় বসার চান্স পাবে না।
কোয়েল জিজ্ঞাসা করল,— আঁখির কী হল রে?
—বুঝতে পারছি না।
—ফোন করিসনি?
—ভেবেছিলাম করব, তারপর…. যদি এবার ওর না হয়ে থাকে! বেচারার লাকটাই খারাপ। গতবার পরীক্ষা দিতে দিতে অসুস্থ হয়ে পড়ল…
—দিন পনেরো আগে একদিন দেখা হয়েছিল। বলল, এবার স্লেট না পেলে স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসে যাবে।
—কিন্তু ওর মতো অ্যাকাডেমিক মাইন্ডেড মেয়ের কলেজটাই বেশি স্যুট করত। এম ফিল করে নিত, রিসার্চে জয়েন করত….। তা ছাড়া ওরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ সেম প্রফেশানেও থাকতে পারত।
—হাজব্যান্ড বলিস্ না, বল্ হচ্ছে হবে হাজব্যান্ড।
—ওই হল।
আলাপচারিতায় ছেদ পড়ল। একটা পিওন গোছের লোক এসেছে কোয়েলের কাছে, কোয়েল তাকে প্রিন্টআউটগুলো গুছিয়ে দিল। টেবিল টেবিলে কফি দিয়ে যাচ্ছে আর একটা লোক, কোয়েলের টেবিলেও এসেছে।
দুটো কফি নিল কোয়েল। গরম প্লাস্টিক গ্লাস তন্নিষ্ঠাকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, —নে, তুই তো কিছু খাওয়ালি না, আমিই তোকে মিষ্টিমুখ করাই।
কফিতে চুমুক দিতে দিতে তন্নিষ্ঠা বলল, তুই কিন্তু একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছিস কোয়েল। মালার বউভাতের দিন তোরা কথা দিলি আমাদের বাড়ি আসবি, খাওয়া দাওয়া করবি, এক সঙ্গে ডে-স্পেন্ট করব…..!
—হয়ে ওঠে না রে। সারা সপ্তাহ গাধার খাটুনি, একটা মাত্র ছুটির দিন, বাড়িতে এত কাজ থাকে …. শেখরও আর নড়তে চায় না…
কাজ, না বাহানা? বিয়ের পর শেখর বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেছে, আপনি-কোপনির সংসারে কী এত কাজ থাকে?
কোয়েল বলল, —রাগ করিস না, এবার একদিন ঠিক চলে যাব। ….. মাসিমা মেসোমশাই কেমন আছেন রে?
—ওই একরকম। বাবার তো অফিস থেকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক হয়ে গেল…..
—সে কী! কবে?
—এই তো জুনেই বাবার লাস্ট…। কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোম্পানি খালাস।
কোয়েল এক সেকেন্ড কী যেন ভাবল। বলল, — তোর মা সার্ভিস করেন না?
উত্তর দেওয়ার আগেই আবার আলাপচারিতায় ছন্দপতন, পিওন গোছের লোকটা ফের এসেছে, —শর্মা সাহেব আপনাকে ডাকছেন।
কোয়েল শশব্যস্ত, —আমি একটু আসছি রে। বস কলিং।
কোয়েল উঠে দাঁড়িয়েছে। তন্নিষ্ঠা বলল, —তোর অফিস থেকে একটা ফোন করা যাবে?
চোখ টিপল কোয়েল, — শৌনককে?
—হ্যাঁ রে। সকাল থেকে তিন বার ওকে ট্রাই করেছি, খালি এনগেজড্। সুখবরটা ওকে জানিয়ে দিই।
—কর, কিন্তু বেশিক্ষণ না। টেলিফোন তন্নিষ্ঠাকে এগিয়ে দিয়ে কোয়েল প্রায় ছুট লাগাল।
বান্ধবীর রাধা-ভাবে আপন মনে হাসল তন্নিষ্ঠা। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিতে বড় যাঁতা! উফ্, কলেজটা যদি লেগে যায়।
খুশি খুশি মুখে টেলিফোনের বোতাম টিপল তন্নিষ্ঠা। যাক, রিং হচ্ছে।
ওপারে শৌনকেরই গলা, —রায়চৌধুরী হিয়ার।
তন্নিষ্ঠার গলা খাদে, — আমি বলছি।
—ও, তন্নিষ্ঠা! হোয়াট আ কোইন্সিডেন্স। আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। হয়তো এক্ষুনি তোমায় ফোন করতাম।
—কেন?
—সুখবর আছে। আমার একটা ইন্টারভিউ এসেছে। দিল্লি থেকে।
—তাআআই? কোথায়?
—মিলার ইন্ডিয়া। কস্মেটিকস জগতে যাদের ভুবনজোড়া নাম।
—যাদের নাইটিঙ্গেল পারফিউম?
—হতে পারে। ওরা তো ওসবই ম্যানুফ্যাকচার করে। তোমাদের যত রকম। লিপস্টিক নেলপলিশ এট্সেট্রা এট্সেট্রা…
—কবে ইন্টারভিউ?
—কামিং ফ্রাইডে। আমি পরশুর রাজধানী ধরব। ওরা রাজধানী টু টায়ারের ফেয়ার দিচ্ছে। …তুমি আমার হয়ে একটু প্রে করবে তো?
—করব। তন্নিষ্ঠা নরম করে বলল। এক সেকেন্ড থেমে থেকে স্বরে উচ্ছ্বাস আনল একটু, —আমারও একটা সুখবর আছে। আমি স্লেটের রিট্নে পাশ করেছি।
—তাই নাকি? বাহ্ বাহ্। এই জানো, এরা কিন্তু আমায় খুব বড় পোস্টের জন্য ডেকেছে। ডেপুটি চিফ। খোঁজখবর করে যা জানলাম পে অ্যারাউন্ড থ্রি পয়েন্ট সিক্স প্লাস প্লাস…। যদি চান্সটা লেগে যায় কত বড় হাইক হবে ভাবতে পারো?
তন্নিষ্ঠা ছোট্ট করে বলল, —সে তো বটেই।
—ভেবেছিলাম আজ সন্ধেবেলা তোমাদের ওখানে যাব, হচ্ছে না। এক্ষুনি আমায় হাইড রোড ছুটতে হবে। প্ল্যান্টে। আমার চেনা এক ট্রাভেল এজেন্টের কাছেও যেতে হবে। পরশুর টিকিট তো…! তেমন হলে অবশ্য ফ্লাইট ধরে নেব।
—ও।
—এখন রাখি, কেমন? সুইট ড্রিম।
—হুঁ।
টেলিফোন রেখে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড কোয়েলের কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে রইল তন্নিষ্ঠা। আত্মমগ্ন চোখে। খবরটা তো আনন্দেরই, তবু তেমন উৎফুল্ল হতে পারছে না কেন? শৌনকটা যেন কী, তন্নিষ্ঠার সুসংবাদটা শুনলই না ভাল করে!
কোয়েল হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে, —এই তনু, কিছু মনে করিস না প্লিজ। আমায় এখন একটু বসের ঘরে থাকতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ লাগবে না। আধঘন্টা মতন। তুই বসবি?
—না রে, চলি আজ। তন্নিষ্ঠা দাঁড়িয়ে পড়ল, — আসিস কিন্তু একদিন। শেখরকে নিয়ে।
বাইরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে পুড়ছে। মাঝে কটা দিন বেশ ছিল, দিনভর গরমের পর সন্ধেবেলা কালবৈশাখী আসছিল রোজ, সাত আট দিন হল মেঘেরা পুরোপুরি উবে গেছে। রাত নটার আগে সিমেন্টের দেওয়াল পর্যন্ত শীতল হয় না। একটাই বাঁচোয়া, গরমটা এখন শুকনো, ঘাম প্যাচপেচে নয়।
পথে বেরিয়ে কোনও দিকে তাকাল না তন্নিষ্ঠা, সোজা পাতালে নামল। মেট্রো রেলের সেন্ট্রাল স্টেশনে। এখান থেকে মেট্রোতেই তার সুবিধে। টালিগঞ্জে নেমে অটো ফটো কিছু একটা ধরে রানিকুঠি।
দুপুরের ট্রেনে তেমন একটা ভিড় নেই। চাঁদনিচকেই বসার জায়গা পেয়ে গেল তন্নিষ্ঠা। পাতালেও এখন বেজায় গরম, তবু বসাটুকুই যা শান্তি। ব্যাগ থেকে রুমাল বার করে ঘাড় গলা মুছল, এলোমেলো এদিক ওদিক চোখ চালাচ্ছে। হঠাৎই দূরে চেনা মুখ। বাসবেন্দ্ৰকাকু না?
বাসবেন্দ্ৰ হাত নেড়ে নেড়ে এক ফ্রেন্চকাট দাড়ির সঙ্গে গল্প করছে। ওই মুখটাও যেন তন্নিষ্ঠার হাল্কা চেনা! মনে পড়েছে, টিভিতে দেখা মুখ। বাসবেন্দ্রর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল তন্নিষ্ঠার, আলতো হাত নেড়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছে বাসবেন্দ্র। এসপ্ল্যানেডে লোক উঠেছে কিছু, পার্ক স্ট্রিট ময়দানের পর কামরায় হাল্কা ভিড় ভিড় ভাব, বাসবেন্দ্র তন্নিষ্ঠার চোখের আড়ালে।
তন্নিষ্ঠা বসে আছে স্থির। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। ঘোষিকার যান্ত্রিক স্বর পীড়া দিচ্ছে কানে। কেন যে এরা স্পিকারটা সারায় না!
কালীঘাট স্টেশনে অনেক লোক নামল। বাসবেন্দ্রও এই গেটের দিকে এগিয়ে এসেছে। নামার পূর্ব-মুহূর্তে তন্নিষ্ঠাকে বলল, —এই তিন্নি, তোর বাবাকে একবার ফোন করতে বলিস তো। বাড়িতে।
তন্নিষ্ঠা ঘাড় নাড়ার আগেই বাসবেন্দ্র প্ল্যাটফর্মে, ট্রেনের দরজা বন্ধ।
তন্নিষ্ঠার একটু অদ্ভুত লাগল। এতক্ষণ বাসবেন্দ্ৰকাকু মাত্র আট দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, স্বচ্ছন্দে আগেই বলতে পারত….! নাটকের লোকেরা কি নাটুকে কায়দা ছাড়া কথা বলতে পারে না?
বাড়ি ফিরে তন্নিষ্ঠা ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখ খুলল ডোরবেলের আওয়াজে। কমলা এসেছে। বাসন কোসন মাজবে, রাতের খানাও বানিয়ে ফেলবে এখন।
বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে দিল তন্নিষ্ঠা। সিনেমা। হিন্দি। তবু চোখ থেকে ঘুম ছাড়ছে না, ঘন ঘন হাই উঠছে।
গলা ওঠাল, —কমলাদি, এক কাপ চা খাওয়াবে?
—দিই। …..খাবার খাবে কিছু?
—নাহ্। ভাল্লাগছে না।
চা খেয়ে একটু বুঝি আলস্য কাটল। সিনেমাটাও জমে উঠেছে বেশ। পুরনো দিনের ছবি, রোমান্টিক। গানগুলো ভারী সুরেলা। দেখতে দেখতে ক্রমে তন্ময় হয়ে পড়ছিল তন্নিষ্ঠা।
নন্দিতা ফিরল সাতটা নাগাদ। দু হাত ভর্তি প্যাকেট, দু চোখে খুশির ঝিলিক। একটা প্যাকেট ডাইনিং টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, —তিন্নি, তোর জন্য চিকেন পকোড়া এনেছি। আয়, গরম গরম খেয়ে নে।
ছবিটা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে করছিল না তন্নিষ্ঠার, তবু উঠে এল। একটা চিকেন পকোড়া মুখে ফেলে বলল, — এটা কি আমার প্রাইজ?
—শুধু তোমার নয়, শৌনকেরও প্রাইজ। ধরে নাও তুমি শৌনকের হয়েও খাচ্ছ।
—আমারটা তো বুঝলাম, শৌনকের কী জন্য?
—শৌনক তোকে রিঙ করেনি? বীথিকাদি তো আমায় অফিসে টেলিফোন করে বলল খুব ভাল একটা কোম্পানিতে ইন্টারভিউ পেয়েছে শৌনক….
—ও, এই কথা। তন্নিষ্ঠা বিচিত্র মুখভঙ্গি করল। বিদ্রূপ নয়, উপেক্ষাও নয়, মজাও নয়, অথচ সব কিছু মেশানো। হেসেই বলল,— তাও তো চাকরিটা এখনও পায়নি!
—সে তো তুমিও পাওনি। তোমার জন্য যদি আনন্দ হয়, ওর জন্য কেন হবে না?
তন্নিষ্ঠা মাথা দোলাল,—এ যুক্তি জজে মানে বটে।
অন্য দিন এই গরমে নন্দিতা বাড়ি ফিরেই স্নানে ঢুকে যায়, আজ সেদিকে গেলই না। মেয়ের চিকেন পকোড়া ভক্ষণ শেষ হতে না হতেই তাকে টেনে নিয়ে এসেছে ঘরে। বিছানায় পড়ে থাকা প্যাকেট দুটোর দিকে আঙুল দেখাল,—খোল্। দ্যাখ পছন্দ হয় কি না।
—কী আছে ওতে?
—শাড়ি। একটা কাঞ্জীভরম, একটা ওয়ালকালাম।
প্যাকেট খুলে প্রায় চোখ ধাঁধিয়ে গেছে তন্নিষ্ঠার। ওয়ালকালামটা ময়ূরকণ্ঠী, কাঞ্জীভরম টিয়ারঙ্। কী অপূর্ব!
তন্নিষ্ঠা আহ্লাদী গলায় বলল,—এত দামি শাড়ি হঠাৎ কিনতে গেলে কেন মা? তোমার কি পয়সা কামড়ায়?
—অফিসের সুষমাদি সাউথ ইন্ডিয়ান হ্যান্ডলুম হাউসের কার্ড করিয়ে দিয়েছে একটা। পোস্ট-ডেটেড চেক দিতে হয়েছে। বারো মাসের। গায়ে লাগবে না। … বিয়ের শাড়ি এখন থেকেই স্টক করতে হবে, বোঝো না?
—সে তো তুমি আগেই অনেকগুলো কিনেছিলে!
—আরও নয় দুটো হল। বড়লোকের ঘরে যাবে, ওরা যেন মনে কোনও খেদ না রাখে। এমনিই তো মানসী বলছিল, বীথিকাদি নাকি তোকে ঢেলে দিচ্ছেন। গয়না শাড়ি…..একটা মাত্র ছেলের বউ…..মানসী বলছিল তোকে নাকি হিরের সেটও দেবে বীথিকাদি।
মানসী নন্দিতার স্কুলজীবনের বন্ধু, এখন এক নামী ডাক্তারের গৃহিণী। শৌনক-তন্নিষ্ঠার সম্বন্ধটা মানসীই করে দিয়েছে। বীথিকার সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ পরিচয়, এক সঙ্গে নানা রকম সমাজ সেবামূলক কাজ করার সূত্রে।
অনবরত বিয়ের প্রসঙ্গ আজ ভাল লাগছিল না তন্নিষ্ঠার। তবু বলল,—তুমি কি ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে চাইছ মা?
—সে ক্ষমতা আমার কোথায়! নন্দিতা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল,—তাও তোর বাবা যদি একটু অন্য রকম মানুষ হত ….! এখন তো আমার মাথায় দুশ্চিন্তা ঢুকে গেছে কী করে বিয়েটা তুলব!
মার ওপর মায়া হচ্ছিল তন্নিষ্ঠার, বাবার ওপরও। দুটো সম্পূর্ণ পৃথক মেরুর মানুষ কেন যে তাকে এক সঙ্গে ভাবায়! দুটো মেরুই কি তার মনের কুঠুরিতে বাসা বেঁধে আছে!
ঈষৎ ভারাক্রান্ত বুকে তন্নিষ্ঠা আবার সোফায় এসে বসল। রিমোট হাতে পুট পুট টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছে। কোনও প্রোগ্রামই পছন্দ হচ্ছে না, বন্ধ করল টিভি। একটা ম্যাগাজিন খুলে পাতা ওল্টাতে শুরু করল।
ফোন বেজে উঠেছে। নন্দিতা বাথরুমে ঢুকছিল, তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলল। একটা দুটো কথা বলেই ডাকছে,—তিন্নি, তোর ফোন।
—কে?
—কোয়েল।
কোয়েল? তন্নিষ্ঠা আশ্চর্য হল। ফোন তুলে কোয়েলের দুপুরের বিস্ময়টাই ফিরিয়ে দিল কোয়েলকে,—কী রে, তুই হঠাৎ?
—শেখর তোকে কী বলবে।
—কী রে?
—শোন্ই না।
শেখর ফোন নিয়েছে, —এই তনু, তোর বাবার কেসটা শুনলাম।
—বাবার? কী কেস?
—ওই যে….চাকরি থেকে…
—ও হ্যাঁ…বাবাকে ওরা রিটায়ার করিয়ে দিয়েছে।
—আমি বলছিলাম…..মেসোমশাই কী রকম টাকাপয়সা পাচ্ছেন রে?
—কেন বল্ তো? তন্নিষ্ঠার কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।
—না ….উনি টাকাটা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রাখবেন….আই মিন ডিপোজিট করবেন?
—হয়তো করবে। তো?
—যদি করেনই, আমাদের কথাও ভাবতে পারিস। মানে আমাদের কোম্পানির কথা। জানিসই তো, আমরা খুব সিকিওরড্ অরগ্যানাইজেশান। রেট অফ ইন্টারেস্টও খুব ভাল। থারটিন পারসেন্টের ওপর। প্লাস, আমার থ্রু দিয়ে ইন্ভেস্ট করলে একটা অ্যাডভানটেজ আছে। এজেন্টের কমিশনের ফিফ্টি পারসেন্ট আমি মেসোমশাইকে দিয়ে দিতে পারব। ইনসেন্টিভ আর কী।
তন্নিষ্ঠার বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছিল না। কী ধান্দাবাজ ছেলে রে! তার বাবা, তরতাজা প্রাণবন্ত একটা মানুষ, মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে চাকরি থেকে হুটআউট হয়ে গেল, তাই নিয়ে শেখরের বিন্দুমাত্র সমবেদনা নেই, প্রথম চিন্তাই হচ্ছে ওই টাকাটা থেকে কী ভাবে দু পয়সা রোজগার করে নেওয়া যায়? কয়েক লাখ টাকা ডিপোজিট দেখিয়ে কোম্পানিতেও বাহবা কুড়োবে? একেই কি প্র্যাকটিকাল হওয়া বলে?
শেখর ও প্রান্তে ছটফট করছে,—কী রে, চুপ করে গেলি কেন?
তন্নিষ্ঠা নীরস স্বরে বলল,—আমি কী বলব? ওসব বাবা জানে।
—আমি কি গিয়ে মেসোমশায়ের সঙ্গে কথা বলব?
—সে তোর ব্যাপার, তুই বোঝ্।
—হুম, তাহলে তো তোর ওখানে একদিন যেতে হয়। সারাদিন চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে, মেসোমশায়ের সঙ্গে কাজের কথাটাও সেরে ফেলব …..। তুই মেসোমশাইকে একটু বলে রাখিস কিন্তু।
—উঁ।
—কবে যাব? এই রোববার?
তন্নিষ্ঠা গলা আরও শুকনো করে বলল,—আসতে পারিস, বাবার সঙ্গে দেখা হবে কি না বলতে পারছি না। বাবা রোববার সারাদিনই গ্রুপে থাকে।
—তাহলে কোনও একদিন অফিস ফেরতা? একটু রাতের দিকে?
—কদিন পরে আসিস। তন্নিষ্ঠা প্রাণপণ চেষ্টায় গলায় ঝাঁজটা চেপে রেখে বলল,—বাবাকে অন্তত রিটায়ারটা করতে দে।
—ও কে। অল রাইট। দেখিস, অন্য কাউকে যেন আবার….। আমরা কিন্তু রিয়েলি খুব সিকিওরড্ কোম্পানি, মাথায় রাখিস। ছাড়ছি, অ্যাঁ?
ফোনটা কেটে যাওয়ার পর চোরা বিবমিষা জাগছিল তন্নিষ্ঠার। ওই ঘ্যানঘেনেপনাটাই কি সাফল্যের চাবিকাঠি? একেই কি জান লড়িয়ে দেওয়া বলে? এত আবেগহীন হয়ে, অন্যের মনঃকষ্টকে উপলব্ধি না করে, কোথায় পৌঁছতে চায় মানুষ? কী পেতে চায়?
তন্নিষ্ঠা আবার নিজের ঘরে গিয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। এ মুহূর্তে তার মনেই পড়ে না, আজ সকালটা ভারী সুন্দর শুরু হয়েছিল। এক একটা দিন যে কত ভাবে রং বদলায়!
একটা তন্দ্রা তন্দ্রা ঘোর এসেছিল, তার মধ্যেই মার গলা শুনতে পেল তন্নিষ্ঠা। খেতে ডাকছে। উঠল, যন্ত্রমানবীর মতো এসে বসল টেবিলে। শুভেন্দুও এসে গেছে, সেও খাচ্ছে। মাথা নিচু করে, নীরবে।
নন্দিতাই টুকটাক কথা বলছিল। পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে, কেউ আর কিছু নেবে কি না জিজ্ঞাসা করল, বাজার থেকে কাল ছোট চিংড়ি আনতে বলল শুভেন্দুকে, অফিস যাওয়ার আগে কাল লাউচিংড়ি করবে, কমলার রুটি করা নিয়েও রুটিনমাফিক বিরূপ মন্তব্য করল কিছু…। শুভেন্দু খেয়ে উঠে চলে গেছে, তখনও চলছে খুচখাচ কথা। মাঝে মাঝে হুঁ হ্যাঁ করছিল তন্নিষ্ঠা। শুনেও শুনছিল না।
খাওয়া দাওয়ার পর টিভি চালিয়েছে নন্দিতা। অভ্যাস মতো টুকুন পাশে বসেছিল তন্নিষ্ঠা, রঙিন পর্দায় শূন্য দৃষ্টি রেখে। খানিক পর উঠে চলে গেল। ঘরে ঢুকতে গিয়ে চোখ পড়েছে ব্যালকনিতে। শুভেন্দু চেয়ার টেনে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
কী মনে করে তন্নিষ্ঠা ব্যালকনিতে এল। শুভেন্দুকে বলল,—তুমি আজকাল একটু বেশি সিগারেট খাচ্ছ বাবা?
শুভেন্দু যেন অন্য গ্রহে ছিল। ধড়মড় করে মর্তে ফিরল,—আমি? কই না তো!
—তুমি এ সময়ে সিগারেট খাও না বাবা। আমি অন্তত দেখিনি।
—আজ ইচ্ছে করছে।
—ও। … দুপুরে কখন বেরোলে আজ?
—ওই তো, বারোটা সাড়ে বারোটার পর।
—অফিস যাওনি?
—গেছি। থাকিনি বেশিক্ষণ।
ব্যালকনিতে হেলান দিয়ে শুভেন্দুর সামনে দাঁড়াল তন্নিষ্ঠা। একটু একটু হাওয়া দিচ্ছে এখন, নরম বাতাস, চোখ বুজে তন্নিষ্ঠা বাতাসটাকে মাখছিল।
হঠাৎ চোখ খুলে বলল,—বাবা জানো, আজ বাসবেন্দ্ৰকাকুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
শুভেন্দু যেন চমকে উঠল,—কখন? কোথায়?
—মেট্রো রেলে। বাসবেন্দ্ৰকাকু যা একটা কাণ্ড করল না …! সারাক্ষণ কাছে দাঁড়িয়ে রইল, তখন কিছু বলল না … ট্রেন থেকে নামছে, দরজা বন্ধ হচ্ছে, তখন হঠাৎ …। তন্নিষ্ঠা বাসবেন্দ্রর গলা নকল করল,—এই তিন্নি, তোর বাবাকে একবার ফোন করতে বলিস তো! বাড়িতে! সঙ্গে বাসবেন্দ্ৰকাকুর একজন কোস্টার ছিল। টিভির। … তুমি কিন্তু ফোন কোরো, নইলে বাসবেন্দ্ৰকাকু ভাববে আমি তোমায় বলতে ভুলে গেছি।
—হুম্।
—বাসবেন্দ্ৰকাকু কি রোজ রিহার্সালে আসে না? দেখা হয় না তোমার সঙ্গে?
—কয়েক দিন হয়নি। জ্বলন্ত সিগারেটখানা টোকা দিয়ে ছুড়ে ফেলল শুভেন্দু, একবার ঝুঁকে দেখল কোথায় পড়েছে। পুরো নেবেনি সিগারেট, আগুনের লাল আভা দেখা যাচ্ছে অন্ধকার মাখা ঘাসে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামান্য গলা তুলে বলল,—ও হ্যাঁ, তোকে বলা হয়নি। তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর তোর একটা ফোন এসেছিল।
—কার ফোন?
—কী যেন নাম বলল একটা? … হ্যাঁ হ্যাঁ, অভিমন্যু।
হঠাৎই যেন বুকটা তিরতির করে উঠল তন্নিষ্ঠার। বলল,—কিছু বলেছে?
—খবরের কাগজে স্লেটের রেজাল্টটা বেরিয়েছে দেখে … আমি বলে দিয়েছি তুই রিট্নে পাশ করে গেছিস।
এই চমকটাও আজ পাওনা ছিল? হলুদ রাধাচূড়া ফুলগুলোর দিকে তাকাল তন্নিষ্ঠা। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে হঠাৎ। পদ্মকাঁটা।
.
০৮.
কারখানায় ঢুকতেই খারাপ খবর। কাল বিকেলে আবার নাকি অমূল্যবাবু এসেছিল। অনেকক্ষণ ধরে গজগজ করে গেছে, সেন্টের গন্ধে আর নাকি টেকা যাচ্ছে না!
সাতসকালেই অভিমন্যুর মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। অমূল্য কুণ্ডু মনামি কেমিক্যাল্সের বাড়িঅলা। এমনিতে মানুষটা নিপাট ভদ্রলোক, সম্প্রতি রেলের চাকরি থেকে রিটায়ার করেছে, এক সময়ে অভিমন্যুকে এই ব্যবসায় খুব উৎসাহ দিয়েছিল, তবে ইদানীং তার সুর একটু অন্য রকম। মাঝে মাঝেই এসে গোবিন্দদের কাছে ওই এক অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছে। অভিমন্যুর অনুপস্থিতিতে।
একটু দোনামোনা করে আজ দোতলায় গেল অভিমন্যু,—মেসোমশাই, প্রবলেম কী হয়েছে?
অমূল্য কুণ্ডু টিভি সিরিয়াল দেখছিল। উঠে এসে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলল,—দ্যাখো বাবা, ভুল বুঝো না।…তোমার এই কারখানা নিয়ে আমি যে ঝঞ্ঝাটে পড়ে যাচ্ছি!
—কেন, অসুবিধে কী হল? আমি তো কাজের সময় জানলা টানলা সব বন্ধ রাখি, আমার পারফিউমের গন্ধ তো আপনার দোতলায় পৌঁছয় না!
—একদম পৌঁছয় না কী করে বলছ? তবে হ্যাঁ, আমরা সহ্য করে নিই। যত অসুবিধেই হোক। তোমার মাসিমা বলে, ছেলেটা যখন এত উদ্যম নিয়ে কিছু একটা করছে…। কিন্তু পাড়াপড়শিরা যে বড় অশান্তি শুরু করেছে বাবা।
—কিন্তু আমার কারখানা তো এখানে নতুন নয় মেসোমশাই? এ গন্ধ তো আগেও ছিল!
—তখন তুমি অল্পস্বল্প বানাতে। এখন তোমার কাজের ভল্যুম বেড়েছে…। এই তো পরশুই পাশের বাড়ির রণেনবাবু রাস্তায় ধরে ঝুড়ি ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিল। তার ছেলের বউয়ের গন্ধে অ্যালার্জি, সেন্টের ঝাঁঝে নাকি হাঁপানির টান উঠেছে।
আশ্চর্য, দিনের পর দিন সামনের কাঁচা ড্রেন থেকে ভকভক গন্ধ ওঠে, প্রায়শই করপোরেশনের লোক খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাঁক তুলে রাস্তায় ছড়িয়ে রেখে যায়, সে সব দিব্যি হজম হয়ে যায়, অভিমন্যুর সেন্টেই যত অ্যালার্জি!
অভিমন্যু বিনীত ভাবেই বলল,—কিন্তু করবটা কী বলুন?
—কারখানাটা অন্য কোথাও নিয়ে গেলে হয় না? এই, কোনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ফেস্টেটে?
—বললেই তো জায়গা পাওয়া যাবে না মেসোমশাই। একে ওকে ধরতে হবে, মোটা টাকা ঢালতে হবে…। ঠিক আছে, কটা দিন সময় দিন।
—হ্যাঁ, দ্যাখো। বোঝই তো হেলথ্গ্রাউন্ডে কেউ কমপ্লেন ঠুকে দিলে বিপদে পড়ে যাব। পাড়ার মধ্যে কারখানা…
অভিমন্যু আর কথা না বাড়িয়ে নেমে এল। নতুন একটা চিন্তা ঢুকল মাথায়। অমূল্যবাবু যা শোনাল, তা এক ধরনের নোটিশই। পাড়াপ্রতিবেশী যদি সত্যিই না চায়, তাহলে তো ছাড়তেই হবে। কোথায় খুঁজবে ঘর? টালিগঞ্জে করুণাময়ীর দিকে সন্ধান করলে হয়তো…। দেখা যাক কী করা যায়।
ভাবনাটাকে আপাতত মুলতুবি রেখে কাজে মন বসানোর চেষ্টা করল অভিমন্যু। মালতী আজ দেরিতে আসবে বলে গেছে। বাচ্চার অসুখ। গোবিন্দ একা একা পারফিউমের বাক্স বানাচ্ছে। অভিমন্যু ডাকল তাকে,—কী কী মাল লাগবে লিস্ট করেছিস?
—এই তো। গোবিন্দ পকেট থেকে কাগজ বার করে এগিয়ে দিল,—আপনি একবার দেখে নিন অভিদা।
তালিকায় চোখ বোলাল অভিমন্যু। বেনজিন, মাসক্ কিটোন, স্যান্টালোল, লিনালুল…মোটামুটি ঠিকই আছে। পকেট থেকে পার্স বার করে গুনতে গুনতে প্রশ্ন করল,—ইথাইল অ্যালকোহল কতটা আছে রে?
—পাঁচ লিটারের একটু বেশি।
—আর ডিস্টিলড্ ওয়াটার?
—আছে মোটামুটি। দিন পনেরো চলে যাবে।
—গুড। আমি তাহলে বেরোচ্ছি। মার্কেট হয়ে বাড়ি থেকে একেবারে খেয়ে টেয়ে ফিরব।
ঢাউস কিট্স ব্যাগ কাঁধে এখন বাসে ওঠা ভারী কঠিন। সবে সাড়ে দশটা বাজে, যানবাহনের এখন বস্তাবোঝাই দশা। বেশ খানিকক্ষণ কসরতের পর কোনক্রমে একটা মিনিবাসের পা-দানিতে নিজেকে প্রবেশ করাতে পারল অভিমন্যু। ঠেসাঠেসি গুঁতোগুতিতে হাঁসফাঁস করছে ভেতরটা, গরমে প্রায় সেদ্ধ হওয়ার জোগাড়।
তার মধ্যেই অবিরাম গলা ফাটাচ্ছে ছোকরা কন্ডাক্টার,—পিছনে এগোন…পিছনে বাড়ুন…
তারাতলার মোড়ে দু-চারটে লোক নেমেছে, ঠেলেঠুলে অভিমন্যু ওপরে উঠল একটু। এত চাপেও রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারছে না। বলল,—পেছন দিকে কী করে এগোনো যায় রে ভাই?
ওমনি কোত্থেকে আলগা টিপ্পনী,—দেশ তো এখন পেছন দিকেই এগোচ্ছে দাদা!
কন্ডাক্টার ঠাট্টা ইয়ারকির ধার ধারে না। টেরিয়া ভঙ্গিতে বলে চলেছে,—কী হচ্ছে কী দাদা? গেটের সামনে গ্যাঞ্জাম করছেন কেন?
—যাব কোথায় রে ভাই? পিঁপড়ে গলার জায়গা আছে?
—জায়গা থাকে না মোওয়াই, জায়গা করে নিতে হয়।
বটেই তো, বটেই তো। লড়াই করে করে এগোতেই সত্যি-সত্যি সামনেটা দিব্যি ফাঁকা। পুরো একটা মানুষ এঁটে যেতে পারে!
অভিমন্যু হ্যান্ডেল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেলনা টাইম মেশিনের মতো ছুটছে বাস, উদ্দাম ঝাঁকুনির সঙ্গে ক্রমাগত অভিমন্যু ব্যালেন্স করে চলেছে নিজেকে। রেসকোর্সের কাছাকাছি এসে হঠাৎই দৃষ্টি নিথর।
জানলার ধারে ও কে বসে? মুখ বাইরে ফেরানো?
তন্নিষ্ঠা না?
অভিমন্যুর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। হ্যাঁ তো, তন্নিষ্ঠাই তো! ওই রকমই রেশম রেশম চুল, ওই রকমই রাজহংসী-গ্রীবা, ওই রকম গালের আদল! কিন্তু এখানে কী করে এল তন্নিষ্ঠা, এই বাসে? কখন উঠল? এসেছিল কোথায়? কোথায়ই বা চলেছে? ঘাড় ফিরিয়ে দেখে যদি…কেমন হবে তন্নিষ্ঠার মুখভাব? অবাক অবাক? খুশি খুশি? ইশ্, সেদিন পারফিউমটার কথা বলা হয়নি, আজ বলতে হবে।
কন্ডাক্টার কর্কশ স্বরে টিকিট চাইছে, মেয়েটি ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে অভিমন্যু হতাশ। তন্নিষ্ঠা তো নয়ই, তন্নিষ্ঠার বয়সীও কেউ নয়। নিখাদ দিদিমণি দিদিমণি চেহারার এক বিবাহিত মহিলা। অধ্যাপিকা হয়ে গেলেও তন্নিষ্ঠা কক্ষনও ওরকম হাঁড়িমুখো হবে না।
চড়া সূর্য প্রখর তাপ ছড়াচ্ছে। ময়দান এসে গেল। বাইরে সবজেটে গাছগাছালি, তবু বাতাসে এতটুকু কোমলতা নেই এখন। মনে হয় যেন উষ্ণ নিশ্বাস ফেলছে পৃথিবী।
অভিমন্যুও একটা নিশ্বাস ফেলল। তপ্ত। বাষ্পময়। অঘটন আজকাল আর ঘটে না।
বি-বা-দী বাগে নেমে অভিমন্যু ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। কর্মব্যস্ত শহরে এখন অন্তহীন যানবাহনের স্রোত, পেরোচ্ছে লম্বা লম্বা পায়ে।
সহসা পিঠে শক্ত থাবা,—কী রে অভি, চললি কোথায়?
ভাস্কর। অভিমন্যুর এক্স এমপ্লয়ার। একদা বাবার ছাত্র ছিল বলে অন্য এক ধরনের ঘনিষ্ঠতাও আছে অভিমন্যুর সঙ্গে। দাদা ভায়ের সম্পর্কের মতো।
আজ ভাস্করের সঙ্গে দেখা না হলেই কি হত না?
অভিমন্যু বেশ অসহজ বোধ করল। দেঁতো হেসে বলল,—এই তো…এদিকেই…
—তোকে বার বার খবর পাঠাচ্ছি, দেখা করছিস না কেন?
কেন আহ্বান জানে অভিমন্যু। মোটামুটি পয়সাঅলা ঘরের ছেলে ভাস্কর, কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিল, এম-এস-সি করে বড় সড় এক ল্যাবরেটরি খুলেছে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। অবাঙালি পার্টনার নিয়ে। একটা মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিংয়ের গোটা ফ্লোর জুড়ে ভাস্করের অফিস কাম পরীক্ষাগার। কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কাজই বেশি আসে সেখানে। ছোটখাটো বা মাঝারি ব্যবসায়ী, যাদের গুণমান নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব পরীক্ষাগার নেই, তারাই প্রধানত ভাস্করদের ক্লায়েন্ট। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের লাইসেন্স আছে, দেশে বিদেশে ভাস্করদের ল্যাবরেটরির সার্টিফিকেট বিশেষ মূল্যবান। অভিমন্যুকে আবার সেখানেই ফেরাতে চায় ভাস্কর।
অভিমন্যু নিজেকে গুছিয়ে নিল। মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বলল,—একদম সময় পাচ্ছি না ভাস্করদা।
—কীসের এত ব্যস্ততা? তোর সেই পারফিউমের ব্যবসা? এখনও করছিস?
—টিকে আছে।
—তার মানে চলছে না ভাল?
—মোটামুটি চলছে। ধরছে আস্তে আস্তে।
—কী রকম থাকে হাতে?
—বলার মতো কিছু নয়।
—নিজে ব্যবসা করার বখেড়া কী বুঝছিস তো?
ভাস্কর কথাগুলোকে কোন দিকে ঠেলছে, বুঝতে পারছিল অভিমন্যু। সতর্ক স্বরে বলল,—বখেড়া তো জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আছে ভাস্করদা, একটু দেখে বুঝে চলতে হয়।
—বুঝছিস এ কথা? এখন বুঝছিস? তোর সেলট্যাক্স আছে, ইনকামট্যাক্স আছে, হেলথ্ লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, ই এস আই, পরিবেশ দূষণ…সব ঠিকঠাক করছিস তো? নাকি পয়সা গুনছিস?
ভাস্করের বলার ভঙ্গি চ্যাটাং চ্যাটাং হলেও কোথায় যেন একটা সাদামাঠা সুর আছে। অভিমন্যু রাগতে গিয়েও রাগল না। বলল,—তুমি কী বলতে চাও পষ্টাপষ্টি বলো তো! ঝেড়ে কাশো।
—সবই তো জানিস। এক কথা কত বার বলব! ভাস্কর অভিমন্যুর কাঁধে হাত রাখল,—মিছিমিছি তেজ দেখিয়ে কাজ ছেড়ে দিলি।…ওসব শতেক ফ্যাচাং ঘাড় থেকে নামিয়ে ফ্যাল্। চলে আয় ল্যাবরেটরিতে।
অভিমন্যু দু এক সেকেন্ড দেখল ভাস্করকে। তারপর মুখের ওপরই বলল,—কেন কাজ ছেড়েছিলাম, তুমি তো সেটা ভালই জানো ভাস্করদা। আমার পোষায় না। পার্টি এসে টাকা গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে, মাল টেস্ট না করেই তাদের চাহিদা মতো সার্টিফিকেট তৈরি হয়ে যাচ্ছে…। টেস্টিংয়ের নাম করে ওখানে যা চলে তা তো ফ্রড।
—তোর কী ? তোর তো ঠিকঠাক মাইনে পেলেই হল। ভাস্কর কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিল। আহত গলায় বলল,—আর একদম টেস্ট হয় না, এটা কি তুই ঠিক বললি? একেবারে কিছুই না করলে আমাদের বি এম ল্যাবরেটরির এত গুডউইল থাকত?
—কী করে গুডউইল আর্ন করছ, তাও তো আমি জানি ভাস্করদা। গভর্নমেন্টের লোকগুলোকে তাজ গ্র্যান্ড গ্রেট ইস্টার্নে পার্টি দিচ্ছ, দেদার মদ গেলাচ্ছ,…। আরও যা যা হয়, নাই বা বললাম।
—তুই কিন্তু একটু বেশি অফেনসিভ কথা বলছিস অভি।
—আমাকেই বা ঘাঁটাচ্ছ কেন? আমাকে ছাড়াই তো তোমাদের দিব্যি চলছে…। চালিয়ে যাও।
এতক্ষণ ভাস্করের মুখে বেশ চালিয়াত চালিয়াত ভাব ছিল, এবার যেন পল্কা ছায়া পড়েছে,—একটু প্রবলেম হচ্ছে বলেই তোকে…। ইনফ্যাক্ট, দু এক দিনের মধ্যে আমি তোর বাড়ি যেতামও। আফটার অল্ তুই স্যারের ছেলে, আমার নিজের লোক…
অভিমন্যু ঈষৎ উদ্বিগ্ন হল,—কেন? ফেঁসেছ নাকি কোথাও?
—দূর, আমি অত কাঁচা কাজ করি না।…আসলে নতুন কয়েকটা কেমিস্ট জয়েন করেছে, বাচ্চা বাচ্চা ছেলে, কিন্তু ত্যাঁদোড়ের ঝাড়। কাজকর্ম কিছুই জানে না, কথায় কথায় শাসায়, বাম্বু দিয়ে দেব…!
—স্যাক করে দাও।
—তার কিছু মেটিরিয়াল অসুবিধে আছে রে। জানিসই তো, আমাদের কিছু সিক্রেট ব্যাপার ট্যাপার থাকে। এই কোম্পানির খবর ওই কোম্পানিতে চালান করে দিলে…!
—কিছু মনে কোরো না ভাস্করদা, মালিক বাঁকা পথে চললে কর্মচারীরাও সোজা থাকে না।
—পিউরিটানের মতো কথা বলিস না তো। আজকের দুনিয়ায় আবার বাঁকা পথ সোজা পথ কী রে? ভাস্কর উত্তেজিত হতে গিয়েও সামলে নিল,—ওসব ডগ্মা স্টিগ্মাগুলো ঝেড়ে ফ্যাল। চলে আয়। আমি তোকে চিফ কেমিস্ট করে দেব। তোর মতো অনেস্ট ছেলে মাথার ওপর থাকলে আর কেউ ট্যাঁ ফোঁ করতে পারবে না।
—অর্থাৎ আমাকে তোমাদের শিল্ড্ হতে হবে, তাই তো?
—না করিস না অভি, জয়েন করে যা। রাকেশও তাকে ভীষণভাবে চাইছে।…শোন্, কাজের ধারা সব পাল্টে ফেলব। নো জালি, নাথিং! সব এক নম্বরে হবে।
নির্ঘাত বি এম ল্যাবরেটরি ভাল মতন লটকেছে কোথাও! গঙ্গাজল মেখে শুদ্ধ হতে চাইছে! অভিমন্যু মনে মনে বলল, তোমরা চেষ্টা করলেও তা আর পারবে না ভাস্করদা। আজ লোক দেখানো কাজ করবে, কাল থেকেই…! টাকা কামানোর শর্টকাট রাস্তায় একবার ঢুকে পড়লে, সেটাই রক্তে মজ্জায় মিশে যায়। ওই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা বড় কঠিন।
মুখে বলল,—আমায় ছেড়ে দাও ভাস্করদা। চাকরিকে যখন একবার কুইট করেছি, আর ও পথ মাড়াব না। আমার ছোটমোট বিজনেসই ভাল। আই নিড হ্যাপিনেস।
হ্যাপিনেস শব্দটা যেন ভাস্করের কোনও গোপন তন্ত্রীতে আঘাত করল, পলকের জন্য ফ্যাকাশে হয় গেছে তার মুখ। অভিমন্যু ভাসা ভাসা শুনেছিল ভাস্করদার সঙ্গে গোপাবউদির কী সব গণ্ডগোল চলছে। বোধহয় মামলার দিকেও এগোচ্ছে সম্পর্কটা। ভাস্করদা তো আর খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ জীবন যাপন করে না।
পলকের গ্লানি পলকে মুছে ফেলেছে ভাস্কর। ঠোঁট উল্টে বলল,—নাহ্, তুই বদলাবি না।…যাক গে যাক, স্যার কেমন আছেন? কাকিমা?
—ওই একরকম। বাবা পেনশানের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে…। মার শরীরও গোলমাল করছে একটু, ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে।
—আর উপমন্যু?
—আছে।…বেঁচে আছে।
—কোথায় আছে? ওই মানকুন্ডুতেই?
—হুঁ। এই তো দিন আট দশ আগে ঘুরে এলাম।
—ডাক্তাররা হোপ দিচ্ছে না কোনও?
—নাহ্।
—পুওর সোল। অভিমন্যুর কাঁধে আবার হাত রাখল ভাস্কর,—চলি রে। যাব একদিন স্যারের কাছে। এমনিই যাব।
ভাস্করের গমনপথের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মন্থর পায়ে হাঁটা শুরু করল অভিমন্যু। ভাস্করদা মানুষটা ভারী অদ্ভুত। ভেতরে একটা সারল্য আছে, আবার কখনও কখনও কী ভয়ানক জটিল! জীবনের কেমিস্ট্রিটা বুঝি একটু বেশি বদহজম হয়ে গেছে ভাস্করদার।
ট্রামরাস্তা পেরিয়ে অভিমন্যু রাধাবাজার স্ট্রিটে ঢুকল। শহরের এই রাস্তাটা তার বড় প্রিয়। দু ধারে সার সার ঘড়ির দোকান। চলমান সময়। স্থির সময়। এই পথ পেরনোর সময়ে ভারী রোমাঞ্চ বোধ করে অভিমন্যু। মনে হয় যেন কাল সরণি ধরে হাঁটছে।
একটা দোকানে অদ্ভুত সুন্দর এক পেন্ডুলাম দুলছে, দেখতে একটু দাঁড়িয়েছিল অভিমন্যু, দুম করে আবার হৃৎপিণ্ডে লাবডুব।
দোকানে অমন মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলে কে?
আসমানিরঙ সালোয়ার কামিজ, ফিরোজারঙ ওড়না? রেশমি চুল উদাস উড়ছে হাওয়ায়?
তন্নিষ্ঠা রাধাবাজারে কেন? সময় কিনতে?
ডাকবে অভিমন্যু? নিয়ে যাবে তন্নিষ্ঠাকে গন্ধের মায়াপুরীতে?
ডাকবে, নাকি পাশে গিয়ে চমকে দেবে?
কিছুই করতে হল না। মেয়েটা ঘুরে দাঁড়াতেই অভিমন্যু ছিটকে সরে গেছে। কী বিশ্রী ব্রণ ভর্তি মুখ, ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক, চোখে ধ্যাবড়া কাজল! তন্নিষ্ঠাকে নামীদামি বিউটিপার্লারও অত কুৎসিত করে সাজাতে পারবে না!
আবার ছোট্ট শ্বাস পড়ল অভিমন্যুর। অঘটন সত্যিই আর আজকাল ঘটে না।
রাধাবাজারে দু একটা সেন্টের দোকান আছে বটে, তবে মূল দোকান সব এজ্রা স্ট্রিটে। আসগর আলির দোকানটাই বড়, এখান থেকেই কেনাকাটা সারে অভিমন্যু।
কাউন্টারে যথারীতি ক্রেতার মেলা। বেশির ভাগই ছোটখাটো সুগন্ধি প্রস্তুতকারক। অভিমন্যু সেখানে দাঁড়াল না, পাশের গলি দিয়ে ঢুকে গেছে অন্দরে।
সঙ্কীর্ণ কুঠুরিতে বসে আছে আসগর আলি। বৃদ্ধ মানুষ, টকটকে লাল রং, টিকোলো নাক, ধবধবে সাদা দাড়ি, মাথায় ফেজ। অভিমন্যুর সঙ্গে আসগর আলির দিব্যি বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র পারফিউম ব্যবসায়ীদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম, অভিমন্যু তাদের তুলনায় অনেক বেশি কেমিক্যালসের নাম জানে, তাদের গুণাগুণও, হয়তো বা সেই কারণেই।
অভিমন্যুর স্লিপ কাউন্টারে পাঠানোর আগে আসগর আলি দেখে নিল একবার। স্মিত মুখে বলল, —তা মজুমদারবাবু, আপনার মাল মেটিরিয়ালসের অর্ডার বাড়ে না কেন?
—কেন, এবার তো মাসক্ কিটোন বেশি নিচ্ছি।
—কই বেশি! কারবার একটু বাড়ান এবার।
—কী হবে? এই তো বেশ চলছে।
—উহুঁ। চলছে বটে, কিন্তু চলবে না। ব্যবসায় টিকে থাকতে গেলে আপনাকে বাড়তেই হবে। আসগর আলি আতর মাখানো দাড়িতে হাত বোলাল,—হয় কমা, নয় বাড়া, কারবারে কোনও মাঝরাস্তা নেই। থামলেই হয় আপনাকে পেছনের লোক ধাক্কা মেরে চলে যাবে, নয়তো সামনের লোক আপনাকে মাড়িয়ে পিষে দেবে। বুঝলেন?
—হুম্।
—শুধু কারবার কেন, জীবনেরও এই নিয়ম। কোথাও থেমে থাকার জো নেই। আসগর আলি মিটিমিটি হাসছে, —শাদি তো করেননি, করলে বুঝবেন।
অভিমন্যু হেসে ফেলল। বুড়োর এখনও রস আছে। ভাবল একবার বলে, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আরও একজন দুজন সেলস্ম্যান নেওয়ার কথা মাথায় ঘুরঘুর করছে। থাক, সত্যি সত্যি এখনও কোনও কিছু মনস্থ করে উঠতে পারেনি, আগ বাড়িয়ে ঘোষণা করার কী দরকার! সমীরণ ছুটি থেকে ফিরে মেদিনীপুর গেছে, দেখা যাক ওখানে কদ্দূর কী হয়। তেমন সুবিধে করতে না পারলে সমীরণকেই নয় নর্থ বেঙ্গল টেঙ্গল….
অন্য কথায় এল অভিমন্যু। দাড়ি চুলকে বলল, —আলি সাহেব, একটা নতুন পারফিউম বানাব ভাবছি…। দামি।
—বানান, বানান। আসগর আলি সোৎসাহে বলল, —মার্কেটে তো এখন দামি মালেরই ইজ্জত বেশি।
—হুঁ।…ইলাং ইলাং-এর কিছু আছে আপনার?
—এখন সাপ্লাই নেই। কম চলে তো, আনাই না। বলেন তো কেল্কারের কাছে খোঁজ করতে পারি।
—দেখবেন তো একটু।…ভাবছি, এটাতে সিভেটোন ফিক্সেটিভ দেব। অরিজিনাল সিভেটোন হবে আপনার কাছে?
—চাইলেই হবে। এখন তো সবাই সিন্থেটিক দিয়েই সস্তায় বাজিমাৎ করতে চায়…। ঢক ঢক মাথা দোলাচ্ছে আসগর আলি। সপ্রশংস চোখে বলল, —ভাল আইডিয়া। আপনার কারবার বাড়বে। দুনিয়ায় নতুন একটা খুশবু যদি আনতে পারেন…
নতুন সৌরভের জন্যই তো মানুষের বেঁচে থাকা। মনে মনে কথাটা আওড়াল অভিমন্যু। আরও দু একটা টুকিটাকি কেজো সংলাপ সেরে কিট্সব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ল। বাসে না উঠে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে এস্প্ল্যানেড। কাল মাকে নতুন ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার। এখন মা মোটামুটি স্বাভাবিক, কথা বলছে, হাসিখুশি আছে, তবু যেন চোরা আনমনা ভাবটা রয়েই গেছে, এই বদলি ওষুধটা খুব জরুরি, কাল বেহালার কোনও দোকানে পাওয়া যায়নি।
ধর্মতলা ঢুঁড়ে ওষুধটা মিলে গেল। অভিমন্যু বাড়ি ফিরল প্রায় দুটোয়। দরজা খুলেছেন অহীন্দ্র, পরনে তাঁর ধুতি পাঞ্জাবি।
বাবার হাতে ওষুধ দিয়ে অভিমন্যু জিজ্ঞাসা করল, —বেরোচ্ছ? না ফিরলে?
উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে অহীন্দ্র বললেন —এই মাত্র গোবিন্দ এসেছিল তোর খোঁজে। কে একজন এসেছে কারখানায়, তোর জন্য অনেকক্ষণ ধরে ওয়েট করছে।
কে এল রে বাবা? অর্ডার দিতে এসেছে, নাকি সরকারি উৎপাত? আজই ভাস্করদা অলুক্ষুণেদের নাম করছিল! শয়তানের নাম করতেই শয়তানের উদয়! কে আসতে পারে? গত সপ্তাহের সেই খেঁকুরেটা, যে কত এমপ্লয়ি আছে খোঁজ করছিল? খাতাপত্র দেখল ঘেঁটে ঘেঁটে, গোবিন্দ মালতীকে বিস্তর জেরা করল, শেষ পর্যন্ত টাকা চাওয়ার কোনও উপলক্ষ না পেয়ে চা মিষ্টি আনাতে বলল! ওই ব্যাটাই যদি হয়, থাকুক বসে।
ধীরে সুস্থে স্নান টান করল অভিমন্যু। তারিয়ে তারিয়ে খেল। মৃদু বচসাও হল বাবার সঙ্গে। পেনশান অফিস থেকে ফেরার সময়ে পথে ননীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল অহীন্দ্রর, এখনও অহীন্দ্র পেনশান পাচ্ছেন না শুনে ননী নাকি খুব আহা উহু করেছে। বলেছে, শিক্ষক সেলের কোন নেতার সঙ্গে নাকি অহীন্দ্রর দেখা করিয়ে দেবে, যাতে কাজটা ত্বরান্বিত হয়। অহীন্দ্রর যে ননীর ওপর বিশেষ আস্থা আছে, তা নয়। তবু একটু দোটানায় পড়ে গেছেন তিনি। নয় নয় করে প্রায় আড়াই বছর হতে চলল, এখনও পেনশান-ভগবানের দেখা নেই, ফলত তিনি খুব উতলা এখন, মনোগত বাসনা একবার নেতার সঙ্গে দেখা করে এলে ক্ষতি কী! অভিমন্যু পই পই করে বাবাকে বারণ করল। ননীদার এই অযাচিত উপচীকিৰ্ষা তার পছন্দ নয়।
খেয়ে উঠে পাঞ্জাবি চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল অভিমন্যু। মৌজ করে সিগারেট টানতে টানতে চলেছে কারখানায়। রণেনবাবুকে রাস্তায় দেখতে পেল। লুঙ্গি আর হাফ পাঞ্জাবি পরে ছাতা মাথায় নাতিকে নিয়ে ফিরছে নার্সারি থেকে। অভিমন্যু একবার ভাবল ডেকে জিজ্ঞেস করে কিছু। থাক, ভদ্রলোক হয়তো সামনের বাড়ির দেবেনবাবুকে দেখিয়ে দেবে। কিংবা হয়তো অমূল্যবাবুকেই। মানুষ চেনা বড় দায়।
কারখানার দরজায় পৌঁছেই অভিমন্যুর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। সেই বিচিত্র সুরভি! তারই চেয়ারে বসে আছে তন্নিষ্ঠা।
অঘটন আজও ঘটে!
.
০৯.
চেয়ার ছেড়ে উঠে দু দিকে দু হাত ছড়িয়ে দিল তন্নিষ্ঠা। মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
—ওয়েলকাম টু মনামি কেমিক্যালস।
অভিমন্যুর চোখে পলক পড়ছে না, রীতিমতো বিমূঢ় দশা। কাঁধের ইয়া কিটস্ব্যাগ একবার টেবিলে রেখে তুলে নিল, জায়গা পাচ্ছে না নামাবার। সামনের চেয়ার এ পাশে টানল একবার, ও পাশে সরাল…
তন্নিষ্ঠার বেশ মজা লাগছিল। স্মার্টলি ডাকল, গোবিন্দ, ঝোলাটা এ ঘর থেকে নিয়ে যাও তো। আর তোমার মালিকের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে নাও। বহুক্ষণ বসে আছি, একটু চা ফা আসুক।
অভিমন্যু তাড়াতাড়ি পার্স বার করেছে। একটা একশো টাকার নোট গোবিন্দকে দিয়ে বলল, —যা, ঝট করে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে আয় তো।
তন্নিষ্ঠা নকল কড়া-গলায় বলল, —আমি ঠাণ্ডা খাই না। গোবিন্দ তুমি চা’ই আনো।
—একশো টাকার নোটে চা? বলেই অভিমন্যু সংশোধন করে নিয়েছে, —আর কী খাবে বলো?
— কিচ্ছু না। স্রেফ চা।
গোবিন্দ চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে সমে ফিরছে অভিমন্যু। চেয়ারে বসে বলল, —তুমি বাজে কথা বললে কেন? আমি সেদিন নিজের চোখে বিয়েবাড়িতে তোমায় বোতল টানতে দেখেছি!
—আজও টানতাম। তন্নিষ্ঠা হেসে ফেলল, —যদি না এখানে এসে তোমার বিজনেসের হাল দেখতাম!
—মানে?
—মানে, আমি একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস খেলে গোবিন্দ বেচারার হয়তো একদিনের মাইনে চলে যেত!
—আজ্ঞে না। আমার গোবিন্দ মালতী মোটেই হ্যাক থু করার মতো টাকা পায় না। পার ডে ষাট। খুব খারাপ? অভিমন্যু ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, —তা হঠাৎ দেবীর দর্শন দেওয়ার কারণটা জানতে পারি কি?
—থ্যাঙ্কস্ জানাতে। থ্যাঙ্কস ফর দা ফোন কল। তন্নিষ্ঠা চোখ নরম করল, —কদিন ধরেই আসব আসব ভাবছি, বাব্বাঃ যা রোদ…! আজ ন্যাশনাল লাইব্রেরি গিয়েছিলাম, বই ফেরত দিতে। হঠাৎ বেহালার মিনি দেখে ভাবলাম যাই, এক ঢিলে দু পাখি মেরে আসি।
অভিমন্যু চোখ সরু করল, একটা পাখি তো বুঝলাম, অন্য পাখিটা কে? সুপ্রিয় মালবিকা?
—উহুঁ, তোমার ফ্যাক্টরি। অত করে সেদিন ইনভাইট করলে…
—খুঁজে পেতে প্রবলেম হয়নি?
—একটুও না। তোমার অ্যারোমা সত্যিই গোটা লোকালিটিতে ছড়িয়ে আছে। নাম বলতেই রিকশাওলা পৌঁছে দিল। তোমায় না দেখে ভাবছিলাম ফিরেই যাই, তারপর মনে হল বাইরে এত চড়চড়ে রোদুর…। বসে আরাম করে রেস্ট নিচ্ছিলাম।
—বেশ করেছ। অভিমন্যু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, —আর একটু বোসো, আমি মালগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় রেখে আসি। হাতের কাজ পড়ে থাকলে আমার কেমন আনকমফর্টেবল্ লাগে।
বসে থেকে কী করবে তন্নিষ্ঠা? অভিমন্যুর পিছু পিছু সেও এসেছে পাশের ঘরে। গোবিন্দ চা এনে ফেলেছে, হাতে ধরিয়ে দিয়েছে গরম গ্লাস, চুমুক দিচ্ছে সইয়ে সইয়ে। অভিমন্যুর ব্যাগ থেকে একের পর এক জিনিস বেরোচ্ছে, চলছে কাচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা। কত রকম যে শিশি বোতল বয়াম জার, বাপস্! ঝাঁঝ কী! মিষ্টি গন্ধ উগ্র হলে বড় গা গুলিয়ে ওঠে। কোণের টেবিলে খান তিনেক কাচনল। ওগুলোকেই ব্যুরেট পিপেট বলে না? অভিমন্যু কুমার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালায় দেখি!
গোবিন্দ আবার মালতীর সঙ্গে হাত লাগিয়েছে। মেঝেয় অ্যাটোমাইজারের পাহাড়, চলছে ঝাড়াই বাছাই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মালতীর চোখ ঘুরছে তন্নিষ্ঠায়, হাসির রেখা উঁকি দিয়েও দিচ্ছে না মালতীর ঠোঁটে।
তন্নিষ্ঠার মজা লাগছিল। মহিলা তাকে অভিমন্যুর ফিঁয়াসে টিয়াসে ভাবে নাকি?
অভিমন্যুর মুখ চোখে এখন বেশ মালিক মালিক ভাব। গম্ভীর গলায় মালতীকে জিজ্ঞেস করল, — তুমি আজ কটায় ডিউটিতে এলে?
—সাড়ে এগারোটা।
—এখন কেমন আছে তোমার ছেলে?
—জ্বরটা এখনও আছে দাদা।
মালতীর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তাকে দেখে বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই। শ্রীহীন ক্ষয়াটে চেহারা। পঁচিশও হতে পারে, চল্লিশও।
আলগা কৌতূহল হচ্ছিল তন্নিষ্ঠার। চাপা স্বরে অভিমন্যুকে প্রশ্ন করল, —কত বড় ওর ছেলে?
মালতী শুনতে পেয়ে গেছে। সেই উত্তর দিল, —পৌষে চার পুরবে গো দিদি।
—আহারে। বাড়িতে কার কাছে রেখে এলে?
—মেয়ে। মেয়েই দেখছে।
অভিমন্যু পাশ থেকে বলল, —ওর মেয়ের বয়স আট।
—সে কী! ওইটুকু মেয়ে সামলাতে পারবে?
—পারতেই হবে দিদি। এ ছাড়া উপায় কী?
অভিমন্যু ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, —তোমার বর বাবাজীবন গেলেন কোথায়?
তিনি তো একটু বাড়িতে বসে ছেলেটাকে দেখতে পারেন।
—হুঁহ্, তাহলেই হয়েছে। এমনিই তার কত মেজাজ! বউ-এর অন্ন খেতে হচ্ছে বলে মানে মটমট করছে!
—ওমা, কেন? তোমার বর বুঝি কিছু করে না? তন্নিষ্ঠা প্রশ্ন করে ফেলল।
—কারখানায় লক আউট। প্রায় চোদ্দো মাস।
—ও। তন্নিষ্ঠা চুপ করে গেল।
অভিমন্যু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, —কী, আমার কারখানায় এসেছ, কাজকর্ম দেখবে না?
ঈষৎ অন্যমনস্ক তন্নিষ্ঠা মুখে হাসি ফেরাল, —দিখাও।
গোবিন্দ যেন তৈরিই ছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে হাতলওলা কাচের পাত্র থেকে অতি সন্তর্পণে সুগন্ধি তরল ঢালছে চ্যাপ্টা ঘষা কাচের শিশিতে। মালতীর হাত থেকে একটা অ্যাটোমাইজার নিয়ে বোতলের মুখে বসাল, সিলিং মেশিনের নীচে রেখে চাপ দিচ্ছে। শূন্যে সামান্য একটু স্প্রে করল সুগন্ধি, সৌরভ বিছিয়ে গেল ঘরে। সুদৃশ্য ক্যাপ লাগাল শিশিতে, ঢেউ খেলানো পিজবোর্ডে মুড়ল, ঢুকিয়ে দিল বাক্সে।
অভিমন্যু ম্যাজিশিয়ানের মতো হাত দোলালো, —অ্যান্ড দিস ইজ অল্। আমি শুধু পারফিউমটা বানাই।
—ও মা, ওটাই তো আসল।
—হ্যাঁ। তবে ওটা এক্ষুনি তোমায় দেখানো যাবে না। ওটা একটা লং টার্ম প্রসেস।…দেখলেও অবশ্য বুঝবে না কিছু।
—কেন?
—ওটা অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি। তোমার সাবজেক্ট তো শব্দের রসায়ন।
—অ্যাই, বেশি এয়ার নিও না। তোমরা কি শেক্সপিয়ার শেলি কিট্স এলিয়ট বোঝো না?
—তা বটে। চলো তবে ও ঘরে, দেখি তোমার মগজে ঢোকানো যায় কি না।
সত্যি সত্যি অফিসঘরে এসে ড্রয়ার থেকে কাগজ বার করে ফেলল অভিমন্যু। খসখস ডায়াগ্রাম টানছে, পর পর ষড়ভুজ এঁকে চলেছে, —এই ধরো, পারকিন রিঅ্যাকশান। এই এখানে একটা সি এইচ ও, আর এখানে একটা ও এইচ… এর সঙ্গে আসছে সোডিয়াম অ্যাসিটেট আর স্যালিসিল অ্যালডিহাইড…
আচ্ছা খ্যাপা তো! এ যে রীতিমতো ক্লাস শুরু করে দিল!
তন্নিষ্ঠা ছদ্ম আতঙ্ক ফোটাল চোখে। হাত জোড় করে বলল, —ক্ষ্যামা দাও। তুমি কি এক্ষুনি আমায় কেমিস্ট করে তুলবে নাকি?
—উৎসাহ নিবে গেল তো? অভিমন্যু হেসে পেন বন্ধ করল, —আমরা কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেক্সপিয়ার পড়তে পারি।
দরজায় মালতী, —দাদা, আজ তো বেশি কাজ নেই, আমি কি একটু তাড়াতাড়ি চলে যাব?
এক সেকেন্ড কী যেন ভাবল অভিমন্যু। তারপর বলল, —যাও…তোমার ডাক্তার কী বলছে? ম্যালেরিয়া নয় তো?
—তেমন তো কিছু বলেনি। শুধু বলেছে আজও জ্বর না ছাড়লে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।…একা একা যে কদ্দিক সামলাই! বাজারহাট রান্নাবান্না…। কাল রাত্তিরে জগোর জ্বরটা খুব বেড়েছিল। মাথা ধোওয়াতে হয়েছে, জলপট্টি দিতে হয়েছে…
ঘরের আবহাওয়া সামান্য ভারী হয়ে গেছে। মালতী চলে যাওয়ার পর তন্নিষ্ঠা জিজ্ঞেস করল, —মহিলার খুব প্রবলেমেটিক লাইফ, তাই না?
—হুঁউ। খাটাখাটুনি তো আছেই, তার ওপর বেকার বরের মেল ইগো সামাল দিতে হচ্ছে…
মুহূর্তের জন্য শুভেন্দুর মুখটা তন্নিষ্ঠার সামনে উঁকি দিয়ে গেল। একই স্তরের মানুষ নয় তার বাবা, তবুও। পরশু রাত্রে বাবা দুম করে বলে বসল, তোর বিয়েতে আমি ক্যাশ দু লাখ ডাউন করব তিন্নি, তোর মাকে একটা কথা বলারও সুযোগ দেব না! আসন্ন কর্মহীনতা কি বাবার পুরুষ অহংকে আহত করছে?
একটু চুপ থেকে তন্নিষ্ঠা বলল, —একটা কাজ করো না। ওর বরটাকেও তোমার এখানে লাগিয়ে দাও।
—ধ্যাৎ, তা কী করে হয়! পার ডে মেরেকেটে এখানে সাত আট ডজন মাল সিলিং প্যাকিং হয়, তিনজন তো এখন এখানে সুপার সারপ্লাস।
—তোমার প্রোডাকশান বাড়াও।
—দরকারটা কী! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে।
—স্ট্রেঞ্জ! তুমি ব্যবসা বাড়াবে না?
—বিজনেস নিজের গরজে যেটুকু বাড়ার নিশ্চয়ই বাড়বে। এই তো নর্থ বেঙ্গলে মার্কেট ধরার চেষ্টা করছি, বাঁকুড়া বীরভূম পুরুলিয়ার কথাও ভাবছি…। কিন্তু তা বলে…। অভিমন্যু একটু থামল,—দ্যাখো তন্নিষ্ঠা, বিজনেস মানে যদি হয় অন্ধের মতো ছুটে বেড়ানো, তা হলে তাতে আমার আগ্রহ নেই। তোমাকে তো বলেইছি, পারফিউম তৈরি শুধু আমার জীবিকা নয়, এতে আমার এক ধরনের সুখও আছে। ব্যবসা বাড়ানোর নেশায় সেই সুখ আমি খোয়াতে রাজি নই।
কথাগুলো ঠিক বোধগম্য হল না তন্নিষ্ঠার। অবাক মুখে বলল, —এ তো উদ্যমহীনের মতো কথা! তুমি লাইনটা জানো, ভাল পারফিউম তৈরি করতে পারো…জিল থাকলে কোথায় না রাইজ করতে পারো তুমি? কে বলতে পারে তোমার এই মনামি কেমিক্যালস্ই একদিন মিলার ইন্ডিয়া হয়ে যাবে না?
—হল। তারপর?
—তার পর আবার কী! আরও বড় হবে? আরও বড় হবে…
—তারপর? হোয়্যার ডাজ ইট এন্ড? একটা লক্ষ্যে পৌঁছলে আপনাআপনিই সামনে আর একটা লক্ষ্য এসে যায়…এই ছোটার কোনও শেষ আছে?
—ছোটাটাই তো জীবন অভিমন্যু।
—না। আগে আমায় স্থির করতে হবে টাকা রোজগারের জন্যই আমার বেঁচে থাকা, নাকি বেঁচে থাকার জন্য টাকা রোজগার? আমার মিলিয়নিয়ার বিলিয়নিয়ার হওয়ার বাসনা নেই। বেসিক নিডগুলো পুরে গেলেই আমি খুশি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান। অন্ন বস্ত্র মোটামুটি জুটে যাচ্ছে… হ্যাঁ, বাসস্থান নিয়ে একটু সমস্যা আছে, তাও ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে…। হোয়াট মোর ডাজ এ হিউম্যান বিয়িং নিড?
অভিমন্যুর কথা যত শুনছে, স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে তন্নিষ্ঠা। শ্লেষের সুরে বলল, —বুঝেছি, তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না। তুমি একটি আদ্যন্ত অ্যাম্বিশানবিহীন মানুষ।
—অ্যাম্বিশান শব্দটার মানে তুমি জানো? তার পরিণাম জানো? এতক্ষণ শান্ত হয়ে থাকা অভিমন্যুর চোখ যেন সহসা ঝলসে উঠেছে। চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। পায়চারি করছে। হঠাৎই তন্নিষ্ঠার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল, —তুমি নিশ্চয়ই সুপ্রিয় মালবিকার কাছে আমার দাদার কথা শুনেছ?
—না তো। কী হয়েছে তোমার দাদার?
—আমার দাদা হচ্ছে অ্যাম্বিশানের জ্যান্ত ধ্বংসস্তূপ। তাকে দেখলেই তুমি বুঝতে পারতে উচ্চাকাঙক্ষা মানুষকে কোন খাদে ঠেলে দিতে পারে। অভিমন্যু ফিরে চেয়ারে বসল। ডটপেনটা ঠুকছে টেবিলে, তন্নিষ্ঠার চোখে চোখ রেখে বলল, —আমার দাদা খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। উপমন্যু মজুমদার কোনওদিন ক্লাসে সেকেন্ড হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় ঢুকেছিল অ্যাম্বিশানের পোকা। দোষটা শুধু তার নয়, তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তুই অনেক বড় হবি, অনেক অনেক উঁচুতে উঠবি…। আমার মা বলত, বাবা বলত, প্রতিবেশীরা বলত, আত্মীয়স্বজনরা বলত। আট বছরের বড় দাদা আমার চোখেও বিরাট একটা কিছু ছিল সেসময়ে। মাধ্যমিকে সাংঘাতিক একটা ভাল রেজাল্ট করতে পারল না দাদা, টেনেটুনে স্টার পেয়েছিল। সবাই বলল, এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, তুই হায়ার সেকেন্ডারিতে ফাটিয়ে দিবি। প্রত্যাশার চাপে আরও খারাপ করল হায়ার সেকেন্ডারিতে, ফাস্ট ডিভিশানটাও পেল না। পর পর দু বার জয়েন্টে বসল। প্রথম বারে চান্স পেল না, দ্বিতীয় বারেও না। তখন থেকেই দাদার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল! ম্যাথমেটিক্স অনার্স নিয়ে বি এসসি ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু তখন আর পড়াশুনো করতে পারে না দাদা, বইখাতা খুলে দিনরাত্রি শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। আমার দরিদ্র হতভাগ্য স্কুলমাস্টার বাবা তখন আশাভঙ্গের বেদনায় ছটফট করছে। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার আগে দাদাকে কী যেন একটা বলেছিল বাবা, ব্যস্ সঙ্গে সঙ্গে দাদা কী ক্ষিপ্ত! দেওয়ালে মাথা ঠুকছে! দরজায় লাথি মারছে! বইখাতা ছিঁড়ছে! চেয়ার টেবিল আছড়াচ্ছে!…তার পরেই সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গেল। এক্কেবারে নীরব। ডাকলে সাড়া দেয় না, কথা বলে না, সারাদিন ঘর বন্ধ করে বসে আছে, মানুষ দেখলেই কেমন কুঁকড়ে এক কোণে চলে যায়, যেন কোনও হিংস্র জন্তুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে চাইছে…! সে যে কী টেরিবল্ ফিয়ার সাইকোসিস, তুমি নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবে না তন্নিষ্ঠা। অভিমন্যুর গলা ধরে এল, —দাদা আর সুস্থ হয়নি। এখন আছে মানকুণ্ডুর অ্যাসাইলামে। দেখা করতে গেলেও বেরোয় না, অ্যাসাইলামের লোকজনও তাকে টেনে আনতে পারে না। দিন রাত্রি এক অন্ধকার কুঠুরিতে…। লোকে যে যাই বলুক, আমি তো জানি কেন পাগল হয়েছে আমার দাদা। দাদা আমায় বলত, বুঝলি অভি, আমি এত উঁচুতে উঠে যাব, মানুষ আমায় দূরবিন দিয়ে দেখবে! প্রাসাদের মতো বাড়ি বানাব, বিদেশি গাড়ি চড়ব, খোলামকুচির মতো টাকা ওড়াব…! এর পরও তুমি আমায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে বলো?
তন্নিষ্ঠা চুপ। হঠাৎই প্রবল এক চাপ অনুভব করছিল ফুসফুসে। যেন কেউ নিংড়ে নিচ্ছে বাতাস। তীব্র একটা কষ্ট অনুভব করছিল তন্নিষ্ঠা। শুধু সেই অচেনা মানুষটার জন্য নয়, সামনে বসে থাকা অভিমন্যুর জন্যও।
ফ্যাসফেসে গলায় বলল, —কিন্তু তোমার দাদা তো ফেলিওর…!
—যারা সাকসেসফুল, তারা কি আমার দাদার চেয়ে খুব আলাদা? তারাও তো নিজেদের অন্ধ বৃত্তে ঘুরে মরছে। লিভিং ইন আ সলিটারি সেল অফ দেয়ার ওউন। তফাত একটাই, তাদের অ্যাসাইলাম এই গোটা পৃথিবীটা।
সহসা কোনও শব্দ এল না তন্নিষ্ঠার গলায়। মুহূর্তের জন্য কি শেখরকে দেখতে পেল? শৌনককে? অভিমন্যুর কথায় যেন এক গভীর সত্য নিহিত আছে, মনে হচ্ছিল তন্নিষ্ঠার। তবু আজন্মলালিত ধ্যানধারণাগুলো ভেঙে ফেলতেও কেমন যেন খারাপ লাগে।
কথাটা বেরিয়েও গেল মুখ থেকে, —কিন্তু অ্যাম্বিশান না থাকলে কী নিয়ে বাঁচবে মানুষ? কীসের জন্য বাঁচবে?
—স্বপ্ন নিয়ে বাঁচবে।
—স্বপ্ন?
—হ্যাঁ স্বপ্ন। স্বপ্ন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এক নয় তন্নিষ্ঠা। আমার কোম্পানিতে একটা সেলস্ম্যান আছে, খুবই সাধারণ ছেলে, পরিবারটাও নিম্নবিত্ত। বাপ নেই, মা অসুস্থ, ভাইবোনের লেখাপড়া, এসব নিয়ে ছেলেটা জেরবার। অসুরের মতো খাটে, ছোটখাটো চুরিচামারি করে, তাতেও ভাল করে দিন গুজরান হয় না। তবু তার মধ্যে ছেলেটার চোখে একটা স্বপ্ন লেগে আছে। ও একদিন মাউন্টেনিয়ার হবে, এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখবে। শুধু এই স্বপ্নটা আছে বলেই না…!
অভিমন্যুর দুচোখে হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। স্বপ্ন আমারও আছে তন্নিষ্ঠা। তীব্র খরার পর জঙ্গলে প্রথম বৃষ্টি নামলে বুনো লতায় যে গন্ধ ওঠে, আমি আমার পারফিউমে সেই সুগন্ধ আনব।…আমি এমন একটা সুঘ্রাণ সৃষ্টি করতে চাই, যা আমার আগে আর কেউ কখনও পারেনি। সে গন্ধকে আমি পণ্য করব না, সে শুধু আমার…। এটাই কি আমার বেঁচে থাকার যথেষ্ট কারণ নয়?
তন্নিষ্ঠা নির্বাক। নিষ্পন্দ। মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে অভিমন্যুর দিকে। যে তরুণ মালবিকার বিয়ের রাতে অন্ধকার রাস্তাটাকে বহমান কালো নদী বলেছিল, তাকে যেন একটু একটু চিনতে পারছে এখন। নাকি আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছে অভিমন্যু?
দুপুরটা কখন যেন বিকেল হয়ে গেছে। কোত্থেকে এক কুচি মায়া-হলুদ আলো এসে পড়েছে ছোট্ট অফিসঘরে, কাঁপছে তিরতির। টেবিলফ্যানের হাওয়া এখন চামর দোলায়, দেওয়ালে আছাড়ি পিছাড়ি খাওয়া ক্যালেন্ডারে ঘণ্টাধ্বনি বাজে, বাতাসের চাপা সুগন্ধে ধুপধুনোর অনুষঙ্গ—নিদাঘবেলায় অভিষেক হচ্ছে বসন্তের।
মুহূর্তটাকে অবশ্য বেশি দীর্ঘ হতে দিল না অভিমন্যু। তন্নিষ্ঠার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ফিকফিক হাসছে, —আমার বকবকানিতে মাথা ধরে গেল তো?
তন্নিষ্ঠা জোরে মাথা ঝাঁকাল। ঘোর ঘোর ভাবটা কাটানোর চেষ্টা করছে।
অভিমন্যু ফের বলল, —প্রচুর ভাট বকলাম, এবার তোমার খবর বলো? শৌনক কেমন আছে?
মনে মনে তন্নিষ্ঠা বলল, শৌনক শৌনকের মতোই আছে।
মুখে বলল, —দিল্লি গেছিল ইন্টারভিউ দিতে। পরশু ফিরেছে।
—ইজ ইট? কোন কোম্পানিতে?
মিলার ইন্ডিয়া নামটা উচ্চারণ করতে পারল না তন্নিষ্ঠা। কেন যে পারল না? বলল, —কী যেন একটা নাম। খুব বড় পোস্ট।
—বাহ্ বাহ্। কেমন হল ইন্টারভিউ?
—বলল তো ভালই হয়েছে। ওরা দিন পনেরোর মধ্যে জানাবে। ও এক্সপেক্ট করছে হয়ে যাবে।
—গ্র্যান্ড। তাহলে তুমি পাকাপাকি দিল্লিওয়ালি হয়ে যাচ্ছ?
—জানি না। তন্নিষ্ঠা সামান্য উদাস, —হয়তো দিল্লি থেকে মুম্বই, মুম্বই থেকে দুবাই, দুবাই থেকে আরও দূরে কোথাও, হয়তো অন্য কোনও মহাদেশে…
আবার ক্ষণিকের নৈঃশব্দ্য। আবার হাওয়া চামর দোলাচ্ছে, আবার ঘণ্টাধ্বনি, আবার বাতাসে সুরভি…
ক্ষণপরেই অভিমন্যু প্রগল্ভ হয়েছে, —ও হো, তোমাকে তো একটা জিনিস দেখানো হয়নি। তোমার সেই পারফিউমটা আমি তৈরি করার চেষ্টা করছি। এসো এসো, দেখে যাও।
পাশের ঘরে গিয়ে মেঝে থেকে একটা ছোট কাচের জার তুলল অভিমন্যু। ঢাকনা খুলে তন্নিষ্ঠার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
লম্বা ঘ্রাণ নিল তন্নিষ্ঠা। উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, —এই তো আমার ডেড্লির স্মেল।
অভিমন্যুর দাড়ি গোঁফের জঙ্গল দুলে উঠল, —উঁহু, হয়নি। আমি জানি।
—কে বলল হয়নি? অবিকল সেম স্মেল!
—মোটেই না। কী যেন একটা মিসিং আছে।
—কী মিসিং আছে?
—জানি না। অভিমন্যু মাথা নামিয়ে নিল। মৃদু গলায় বলল, —এখনও খুঁজছি।