০৫.
তারপর তিয়াত্তরের এপ্রিল। সাক্ষাতে নয়, টেলিফোনে আলাপ। এ-কথা অন্যত্র ও সূচনায় বলেছি। আবার পুনরাবৃত্তি করছি এখানে। কারণ, এ-ও শেখ মুজিবেরই কথা। ১৯৭৩-এর ৫ এপ্রিলের ডায়রিতে যা লিখে রেখেছিলাম অবিকল তাই উদ্ধৃত করছি।
৫-৪-৭৩
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বৈঠকখানায় বসে দৈনিকের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। তখন বাইরের দিকের দরজায় হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি একজন অপরিচিত লোক। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো–
আমি বিমান অফিস থেকে আসছি। শিগগির আসুন, বঙ্গবন্ধু আপনার সঙ্গে ফোনে আলাপ করবেন, তিনি ফোন ধরে আছেন।
লুঙ্গির উপর পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে ছুটে গেলাম বাংলাদেশ বিমান অফিসে। আমার বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। বড়জোর তিন মিনিটের পথ। বলাবাহুল্য আমার বাড়িতে তখন কোনো ফোন ছিল না। ফোনে সংযোগ হতেই শেখসাহেব সর্বাগ্রে জানতে চাইলেন, আমার শরীর কেমন আছে।
বললাম–
এ বয়সে যেমন থাকার সে রকমই আছে। খুব ভালোও না, আবার তেমন মন্দও না। বয়সানুসারে মোটামুটি ভালো আছি বলতে পারি।
শেখসাহেব বললেন–
চট্টগ্রামে আপনাকে আমি একটা দায়িত্ব দিতে চাই, আপনি তা নিতে রাজি তো?
বললাম–
: যেসব ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা আছে, যেমন শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি–এসব ক্ষেত্রে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে আমি তা যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করবো।
আরও কিছু ঘরোয়া আলাপের পর ফোন রেখে দেয়ার সময় তিনি বললেন–
: আমি আপনাকে আগামীকাল খবর দেবো।
আগামীকাল দেশের প্রধানমন্ত্রী কী খবর দেবেন? মনে বেশ কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে আগামী দিনের প্রতীক্ষায় রইলাম। বাসায় কাউকে কিছু জানালাম না।
পরদিন ভোরে নিয়মমাফিক অভ্যস্ত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছি। পথে সহপ্রাতঃভ্রমণকারীদের সাথে দেখা হতেই তাঁরা সবাই প্রায় সমস্বরে আমাকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করলেন।
কী ব্যাপার! আমি তো অবাক!
তাঁরা জানালেন, গত সন্ধ্যায় ঢাকা বেতারের আটটার নিউজে ঘোষণা করা হয়েছে, আপনাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয়েছে।
সবার মুখে একই প্রশ্ন–
আপনি শোনেননি? আপনাকে আগে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি?
শেখসাহেবের সঙ্গে গতকাল ফোনে আমার যে আলাপ হয়েছে, এবার তাদের সে খবরটা জানালাম।
তখন আমার বাসায় রেডিও বা ট্রানজিস্টরও ছিল না। তাই গতরাতের রেডিওর খবর বাড়িতে আমরা কেউ শুনিনি।
সরকারি আদেশপত্র পেলাম ১৮ এপ্রিল।
১৯ এপ্রিল, ১৯৭৩-এ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম।
.
৭-৫-৭৩
আজ সন্ধ্যা ৬টায় গণভবনে শেখসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। এ সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা। আগেরদিন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডক্টর নূরুল ইসলাম আর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গেও আমি দেখা করেছি। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকট সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা। শেখসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যও তাই।
দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে আলাপ। মনে হলো তিনি আজ বেশ খোশমেজাজে আছেন। ঘরোয়া রসিকতা থেকে রাজনীতি কিছুই বাদ গেল না। তার কনিষ্ঠ পুত্র রাসেলকেও দেখলাম ওখানে একা একা ঘুরঘুর করছে। বাপের সঙ্গে এসেছে গণভবনে, শিশুসুলভ উৎসাহ, কৌতূহল নিয়ে এ কক্ষ থেকে ও কক্ষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। হ্যাংলা শীর্ণ চেহারা, মাথার চুল খাটো করে ছাঁটা বলেই বোধকরি দেখাচ্ছিল রোগা রোগা।
বললাম—
: বাপের স্বাস্থ্য পায়নি।
আমার এ মন্তব্যের পর উপস্থিত ওখানকার বয়স্ক এক সেবক বললো–
চৌদ্দ-পনের হতে হতেই, দেখতে দেখতে ইয়া লম্বা হয়ে যাবে স্যার। ও হয়তো পুরনো লোক, দেখেছে শেখসাহেবের ছেলেরা প্রথমে রোগা-পটকা থাকলেও কৈশোরে পা দিতে না দিতেই ল ল করে বেড়ে ওঠে।
স্বয়ং শেখসাহেবও নাকি প্রথমে তাই ছিলেন। চায়ের হুকুম হলো। চা এলো। চা খেতে খেতেই আলাপ চললো।
বললেন–
গত পনেরো মাস ধরে তিনি কোনো মাইনে নিচ্ছেন না। কেউই এখন জানে না। প্রচার করেন নি কথাটি। স্ত্রীর কিছু আয় আছে, তাতেই সংসার চলে। নাস্তা করে সকাল ন’টায় গণভবনে আসেন আর রাত দশটা-এগারোটায় ফেরেন। দুপুরে খাবার পাঠিয়ে দেন বেগমসাহেবা বাড়ি থেকে।
.
০৬.
স্বাধীনতার পর আমাদের তরুণ সমাজের একাংশের অত্যন্ত মতিভ্রম ঘটেছে। এদিকে শিক্ষার মান দ্রুত নেমে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃংখলা রক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক দুরূহ ব্যাপার। ছাত্ররা চলে গেছে শাসন-শৃংখলার বাইরে। পরীক্ষা, পরীক্ষার ফলাফল স্রেফ প্রহসনে পরিণত। চুরি, ডাকাতি, ব্যাংকলুট, রাহাজানি, হাইজ্যাকিং ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে বা নেয়নি এমন বহু তরুণও এসব কাজে লিপ্ত। চারদিকে শুধু নিন্দাই শুনতে পাচ্ছি আমাদের তরুণদের সম্বন্ধে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে এখন দেশের মানুষের ওপর। শিক্ষিত আর দক্ষ লোক ছাড়া দেশের শাসনকার্য চালাবো কী করে আমরা? স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা সফল করে তোলা আরো কঠিন। শিক্ষাঙ্গনে যেভাবে নৈরাজ্য বেড়ে গেছে তাতে কোনোরকম সুশিক্ষাই চলতে পারে না। যারা দূরদর্শী আর সেইসঙ্গে আর্থিক সঙ্গতিও যাদের রয়েছে তারা অনেকে নিজেদের ছেলেমেয়েদের বাইরে, বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ দিয়েছেনও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছি বলে দেশের শিক্ষাঙ্গনের দুর্দশার চিত্র আমার মনে সবসময় আনাগোনা করছিল। শেখসাহেবের নিজের ছেলেদের নিন্দার কথাও আমাদের কানে আসতো। সঙ্গত কি অসঙ্গত জানি না, তবে স্বভাবতই দুঃখ বোধ করতাম।
তাই অপ্রাসঙ্গিক হলেও বললাম–
ছেলেদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে ভালো শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন না কেন? এখানে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে ভালো লেখাপড়া না হওয়ারই কথা।
উত্তরে তিনি বললেন—
দেখুন, আমার ছেলেদের যদি আমি বিদেশে পাঠাই অন্যেরা কী করবে? দেশের সবার ছেলেমেয়েকে তো আর আমি বিদেশে পাঠাতে পারবো না।
কথাটা সত্য। এ সেন্টিমেন্ট প্রশংসারও যোগ্য।
তবুও আমি বললাম–
নেহেরুরা কিন্তু ওঁদের মেয়েদের পর্যন্ত বিদেশ পাঠিয়ে সুশিক্ষা দিতে কখনো দ্বিধা করেননি। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন সমুদ্রপথ নিরাপদ ছিল না, তখনো ওঁরা লেখাপড়ার জন্য মেয়েদের বিদেশ পাঠিয়েছেন। ওঁদের সম্বন্ধে যেসব বই লেখা হয়েছে তাতে আমি এসব কথা পড়েছি।
তাঁর এক ছেলে নাকি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চায়, সে কথা বলে যোগ করলেন–
: দেখি ওকে স্যান্ডহাস্টে পাঠাতে পারি কিনা।
শুনে খুশি হলাম। ছেলেটা অন্তত একটা ডিসিপ্লিনের মধ্যে আসবে। সুকঠিন ডিসিপ্লিনের জন্য বিলাতের সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্যান্ডহার্স্ট বিশ্ববিখ্যাত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা ছাড়া আরো কিছু কথা, যার সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সুনাম-দুর্নাম জড়িত, তা বলার সংকল্প নিয়ে এবারকার সাক্ষাৎকার চেয়েছিলাম তার সঙ্গে। অনেক সময় স্বার্থান্বেষী অবুঝ আত্মীয়স্বজনেরা অসাধারণ প্রতিভাধর নেতৃত্বের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে নেতারা যে নিন্দাভাজন হন তার মূলে এ ধরনের আত্মীয়স্বজনদের কার্যকলাপ কম দায়ী নয়। আমাদের কালে এ. কে. ফজলুল হক আর খাজা নাজিমউদ্দীন-দুই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত–যাদের সুনাম আত্মীয়দের দ্বারা নানাভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
বললাম–
আপনারও অজানা থাকার কথা নয়, শেরে বাংলার মতো অসাধারণ জনপ্রিয় নেতাকেও তার আত্মীয়রাই ডুবিয়েছেন। যে সুনাম তার প্রাপ্য ছিল শেষ পর্যন্ত তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি। তার ভাগিনারাই যদি তাঁকে…
বাক্য শেষ না করে অপর দৃষ্টান্তটিও উল্লেখ করলাম–
খাজা নাজিমউদ্দিন অত্যন্ত পরহেজগার ও সচ্চরিত্র লোক ছিলেন শুনেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও সুনাম বজায় রাখতে পারেন নি। ভাই-বেরাদারদের জন্য তাঁকেও বহু দুর্নামের ভাগী হতে হয়েছে।
ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে শেখসাহেব বলে উঠলেন–
আমার একটা ভাগিনাই তো শুধু কিছুটা কাজকর্ম করছে। আমি তাকে বলে দিয়েছি, একজনের পক্ষে সব কাজ করা সম্ভব নয়। তুমি সাংবাদিকতাও করবে, একসাথে আবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগও করবে–এ হয় না। দেখ না আমি সারাজীবন একটা ধরে ছিলাম বলে আজ এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। তাকে আমি বারণ করে দিয়েছি।
লাল বাহিনীর দৌরাত্মের কথাও তুললাম। বললাম—
: এতে আপনারই বদনাম হচ্ছে। লোকে বলছে আপনিই নাকি প্রশ্রয় দিচ্ছেন এদের।
বললেন–
আমি তো ইতোমধ্যে নিষেধ করে দিয়েছি। এদের কার্যকলাপ বন্ধ করে দিতে বলেছি।
বললাম–
আমি আজও ওদের লাঠি হাতে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে দেখতে পেলাম। আর ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন ঝটপট দোকানপাট বন্ধ করে পালাচ্ছে। এ দৃশ্যও দেখে এলাম পথে।
তিনি স্থানটা, অর্থাৎ location জানতে চাইলেন।
ঢাকায় অলিগলি আমার চেনা নয়। তাই স্থান নির্দেশ করা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো আমার ঢাকায় আসা। সহযাত্রী হয়ে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা সবাই মিলে আমাকে হোটেল পূর্বাণীতে তুলেছিলেন। সেখান থেকে আসার পথে ওই দৃশ্য আমি দেখেছি। হোটেলের বন্ধ কক্ষ, নিঃসঙ্গতা আমার মোটেই পছন্দ নয়। এরপর আমি আর কখনো হোটেলে উঠিনি। যদিও সাঙ্গপাঙ্গরা বার বার বলছিলেন আপনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠারও হকদার। আমি কিন্তু এর পর থেকে সবসময় মেয়ে-জামাই’র বাসায় উঠেছি। আর কোনোদিন হোটেলমুখো হইনি।
স্থান বা রাস্তার নাম আমি বলতে পারলাম না। তবে পূর্বাণী হোটেলের কাছাকাছি লাল বাহিনীর লাঠিয়ালদের দোকানে দোকানে ঢু মারা আমি নিজের চোখে দেখেছি তাকে সে কথা জানালাম।
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থাভাবের কথা তুলাম। অনুরোধ জানালাম কিছু অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ডক্টর নূরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ হতেই বললেন–
আমার সামনে এক গুরুজন বসে আছেন। আবুল ফজল সাহেব বলছেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু টাকা না দিলে চলে না। দেখুন না কিছু টাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
নূরুল ইসলাম কী বললেন তা আমি শুনতে পাই নি। পরে দেখেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়েছিল ওই বার। গণভবনের ভিতরে-বাইরে অনেক দর্শনার্থী অপেক্ষমান। আমি রীতিমত বিব্রত বোধ করছিলাম।
বললাম—
: আমি উঠি। ওঁরা বসে আমাকে হয়তো বদদোয়া দিচ্ছেন।
বসেন, বসেন, আজ আর কাউকে ইন্টারভিউ দেব না। তার স্বাভাবিক উচ্চহাসির সঙ্গে বলে উঠলেন।
লিয়াজোঁ অফিসারেরা বার বার দরজা ফাঁক করে উঁকি মারতে লাগলো। তবুও তিনি ছাড়েন না আমাকে। উঠতে গেলেই বাধা দেন। মনের অনেক পুঞ্জীভূত খেদকেই যেন মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। দুঃখের সাথে বললেন–
কী করি, কোথাও তো ভালো লোক পাচ্ছি না। যাকে যেখানেই বসাই সে-ই চুরি করে। অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেদের বেছে বেছে নানা কল-কারখানায় প্রশাসক বানালাম, দুদিন যেতে না যেতে তারাও চুরি করতে শুরু করলো। যাকে পাই বলি, আমি কিছু সৎ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি।
সাধারণ ক্ষমার কথা আমি কাগজে একাধিকবার লিখেছি।
এবার সুযোগ পেয়ে সামনাসামনি কথাটা তাকেও আবার বললাম।
উত্তরে তিনি জানালেন, এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে তারা একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিন-চার দিনের মধ্যেই তা ঘোষণা করা হবে। তাতে প্রথম কিস্তিতে হাজার দশেক লোক উপকৃত হবে। ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে আমরা এ পথে অগ্রসর হবো। যারা সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেছে শুধু তাদেরই শাস্তি হবে, বাদবাকি সবাইকে আমরা ছেড়ে দেবো।
উৎফুল্ল কণ্ঠে বললাম—
: আমরাও তো তাই চাই।
লিয়াজোঁ অফিসারের উঁকি মারা আর দরজায় মুখ বাড়িয়ে থাকার মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। আমার অস্বস্তি দেখে শেখসাহেব এবার পাইপটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি দরজার বাইরে পা বাড়াতেই জিজ্ঞাসা করলেন
: গাড়ি আছে?
বললাম—
: আছে।
লিয়াজোঁ অফিসারকে বললেন—
: ওঁকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো।
ছ’টায় ঢুকেছিলাম গণভবনে, সাতটার পরে বেরিয়ে এলাম।
.
০৭.
১১-১১-৭৩
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো নয়। স্বাধীনতার পর নানা কারণে দেশের আর্থিক বুনিয়াদ ধসে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উপার্জনী সংস্থা নয় বলে আর্থিক সংকটের তীব্রতা ওখানেই বেশি অনুভূত হয়। সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই এ দশা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সংকটের প্রতিকারের আশায় শেখসাহেবের সঙ্গে আজ আবার সাক্ষাৎ করলাম। সময় নির্দিষ্ট হয়েছিল সকাল সাড়ে দশটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা শেষে দেশের নানা ব্যাপারেও দীর্ঘ আলোচনা হলো তাঁর সঙ্গে। আত্মীয়দের অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেওয়ার পরিণতি কখনো শুভ হয় না। বিশেষ করে আমাদের দেশে অনেকে যোগ্যতা-অযোগ্যতার বিচার করে না। ক্ষমতাসীনদের আত্মীয় শুনলেই অকারণেও উদ্দেশ্য আরোপ করে থাকে। ফলে সত্য-মিথ্যা নানা নিন্দার সম্মুখীন হতে হয় ক্ষমতাসীনকে। শেখসাহেবকেও হতে হয়েছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত দুঃখিত ও মর্মাহত ছিলাম। সারা দেশের তিনিই একমাত্র নেতা, জাতির একমাত্র আশা-ভরসা। তাঁর মানসচিত্র (ইমেজ) দিন দিনই অত্যন্ত অবনমিত হচ্ছে দেখে আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছিলাম। শেখ তো সাধারণ একজন নেতা নন, ছলে-বলে-কৌশলে কিংবা সামরিক শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাসীন হননি। তিনি ক্ষমতাসীন হয়েছেন বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পথে। কাজেই এমন নেতার সুনাম নষ্ট হতে দেখলে কার না মনে দুঃখ হয়?
স্বজনপ্রীতি যে অনেকের ধ্বংসের কারণ হয়েছে আমি আবারও আজ সে কথা উত্থাপন করলাম। আলোচনায় ফজলুল হক-নাজিমউদ্দীনের কথা স্বভাবতই পুনরুত্থাপিত হলো। এ দু’জন নেতার দৃষ্টান্ত সবসময় আমার মনে জাগরূক ছিল। তবে এসব দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করে ইশারা করার বেশি আমার তো করণীয় ছিল না কিছু। আমি দলের বা সরকারের লোক ছিলাম না। কাজেই ভিতর থেকে চাপ সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ ছিল না আমার।
.
১১-১২-৭৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরো কয়েকজন দেশবিখ্যাত জ্ঞানী-গুণীর সাথে এবার আমাকেও সাহিত্যের অনারারি ডক্টরেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুদিন আগে ৯ ডিসেম্বর এক বিশেষ সমাবর্তনে ওই ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে। প্রধানত সে উপলক্ষেই আমার এবার ঢাকা আগমন। ন’ তারিখ অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে সমাবর্তন পর্ব শেষ হলো। দশ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের মিটিং-চ্যান্সেলরের নমিনি হিসেবে আমিও উক্ত সিনেটের সদস্য। ঢাকায় যখন এবার কয়েকদিন থাকতে হবে তখন মনে করলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও একবার দেখা করে আসা যায়। চাটগাঁ থেকেই ফোনে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এগারো তারিখ সকাল সাড়ে দশটায় তিনি সাক্ষাৎকারের সময় দিয়েছেন।
আমি আজ সাড়ে দশটায় শেখসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি এ খবর বন্ধুদের কেউ কেউ আগে থাকতেই জানতেন। এবারও আমি মেয়ে-জামাই’র বাসায় (৩১/ই বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা) উঠেছি। ওই দিন সকালে ওই বাসায় দেখা করতে এলেন সরদার ফজলুল করিম। তাঁর সদ্য প্রকাশিত ‘প্লেটোর রিপাবলিক’ বইটির বাংলা অনুবাদ উপহার দিতে। সঙ্গে ছিলেন ওই গ্রন্থের প্রকাশক ‘বর্ণ মিছিল’-এর জনাব তাজুল ইসলাম। প্লেটোর রিপাবলিক বিভিন্ন বিদ্যার একটি মৌলিক গ্রন্থ। এটি অনুবাদ করে সরদার ফজলুল করিম আমাদের নির্মীয়মাণ সাহিত্যের এক মহাউপকার সাধন করেছেন। প্রকাশনার এমন ব্যয়বহুল অবস্থায় এ বিরাট বইটি প্রকাশ করে ‘বর্ণ মিছিল’ও আমাদের সাহিত্যের এক দীর্ঘস্থায়ী উপকার যে করলো তাতে সন্দেহ নেই। তারা থাকতে থাকতেই কবি তালিম হোসেন এলেন। বর্তমানে তিনি নজরুল একাডেমির সম্পাদক। তিনি আগের দিনও এসেছিলেন। আজ সাড়ে দশটায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাঙ্কার। এ তিনি জানতেন।
মরহুম কবি ফররুখ আহমদ ঢাকা বেতারের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সেই সুবাদে একটি সরকারি বাড়ি তিনি পেয়েছিলেন। সপরিবারে সে বাড়িতেই থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর পাছে তার পরিবারবর্গকে গৃহচ্যুত করা হয় কিনা স্বভাবতই তাঁর বন্ধু আর হিতৈষীরা এ দুশ্চিন্তায় ভাবিত হয়ে পড়েন। ওঁদের যাতে গৃহচ্যুত করা না হয় এ অনুরোধটি যেন আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানাই–তালিম হোসেন এ কথাটি বলতেই ফের এসেছিলেন। এর মধ্যে একদিন জনাব ফেরদৌস খান এসে বলে গেছেন-আপনার সঙ্গে যখন প্রধানমন্ত্রীর দেখা হবে তখন দয়া করে শিক্ষা কমিশনের কথা একবার জিজ্ঞাসা করবেন, অর্থাৎ ওই কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে তাঁরা কিছু করবেন কিনা তা জেনে নেবেন।
গণভবনের দরজায় নামতেই সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গেল এক সুদর্শন তরুণের সাথে। তরুণটি এগিয়ে এসে সালাম জানিয়ে বললো
: আমি আনোয়ার হোসেন, ইত্তেফাকের মানিক মিয়ার ছেলে।
মানিক মিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন (মঞ্জু)! ও যখন ছাত্র ছিল তখন একবার ওকে দেখেছিলাম।
বললাম—
: ও, তুমি মঞ্জু, আমার মেয়ের সহপাঠি ছিলে।
হ্যাঁ স্যার। সাড়ে দশটায় তো প্রধানমন্ত্রীর সাথে আপনার সাক্ষাৎকারের কথা।
: হ্যাঁ। তুমিও তার সাথে দেখা করতে এসেছিলে বুঝি?
না। অন্য কাজে এসেছিলাম। তবে তার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল।
গাইড আমাকে উপরে ডেকে নিয়ে গেলেন।
এবার আমি এসেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ নির্মাণ তহবিলে কিছু অর্থ সাহায্য চাইতে। ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে তিনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন। আজ আবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি ব্যক্তিগত সচিবকে ডেকে কথাটা নোট করে রাখতে বলে দিলেন।
ফররুখ আহমদের বাড়িটা ওঁর ছেলের নামে বরাদ্দ করে দিতে আর ওঁর পরিবারবর্গকে কিছু আর্থিক সাহায্য দানের অনুরোধ জানালাম। সচিবকে বলে দিলেন আমার এ অনুরোধটিও টুকে রাখতে। পরে জেনেছি এ দুই অনুরোধ শেখসাহেব রেখেছেন অর্থাৎ বাড়িটি ফররুখের ছেলের নামে অ্যালট করে দিতে বলে দিয়েছেন এবং ফররুখ আহমদের পরিবারকে নগদ পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তবে তাঁর প্রথম নির্দেশটা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের গাফিলতির জন্য আজো নাকি বাস্তবায়িত হয়নি।
শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের কী দশা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন–
শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ পরীক্ষা আর বাস্তবায়নের জন্য একটি সেল করা হচ্ছে আর তার প্রধান করা হবে ফেরদৌস খানকে।
তাঁর এ সিদ্ধান্তের কথা তিনি নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছেন। আমি যখন জানালাম ফেরদৌস খান ওই মর্মে এখনও পর্যন্ত কোনো নির্দেশ পাননি, সচিবকে ডেকে এ ব্যাপারেও নোট করে রাখতে বলে দিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা যাতায়াত অর্থাৎ যানবাহনের। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বি.আর.টি.সি’র) কিছু বাস যেন বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে চলাচল করে সে ধরনের একটা নির্দেশ দানের জন্য তাঁকে অনুরোধ জানালাম। তিনি সচিবকে আমার এ অনুরোধটাও লিখে রাখতে বলে দিলেন। আর বললেন– বি.আর.টি.সি’র চেয়ারম্যানকে যেন এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ-ও লেখা হলো সচিবের ডায়রিতে। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি আজো।
.
০৮.
৩১-১২-৭৪
এদিনও সকাল ১০টায় গণভবনে শেখসাহেবের সাথে দেখা হলো। আজ অনেককিছু আলাপ করার নিয়ত করে এসেছিলাম। টুকে এনেছিলাম আলোচ্য বিষয়গুলো। কয়েকদিন আগে এক পরিচিত সাংবাদিক দেখা করতে এসেছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি বললেন, কয়েকদিন আগে তিনি নেপাল থেকে ফিরেছেন, পরে ঘুরে এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম। বললেন–
: মনে হলো বাংলাদেশ-নেপাল সীমান্ত অরক্ষিত, কোনো রকম পাহারার ব্যবস্থা নেই, খানাতল্লাশি নেই, এমনকি স্যুটকেসটাও কেউ একবার খুলে দেখে না। মনে হয় পাকিস্তানি গুপ্তচরেরা এ পথেই ওদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালিয়ে থাকে। আশুগঞ্জ সার কারখানায় যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তার পেছনেও ওদের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাহাড়িদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখে এলাম। বাংলাদেশের ইনটেলিজেন্স তথা গোয়েন্দা বিভাগ খুব দুর্বল বলে মনে হয়।
সাংবাদিক বন্ধুটি শেষকালে বললেন, শেখসাহেব এসব কথা জানেন কিনা জানি না। এসব দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত। এসব কথা আমার মনে ছিল, এসব কথাও শেখসাহেবকে বললাম। নেপালি সীমান্তের কথা শুনে তিনি যেন কিছুটা ভাবিত হলেন। হ্যাঁ-না কিছু মন্তব্য করলেন না।
যেসব কথা আমার মনে আনাগোনা করতো এবার তারও কিছু কথা না বলে পারলাম না। বললাম–
যেসব বাঙালি আটকা পড়ে আছে তাদের ফিরিয়ে আনুন না, তাহলে ওঁরা কোনোরকম ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হবে না, ওঁদের কাছ থেকে পাকিস্তানিরা পাবে না কোনো মদদ। মাহমুদ আলী, হামিদুল হক চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর-এমনি কয়েকজনের নামও উল্লেখ করলাম। এঁরা প্রায় সবাই কাজের লোক। এঁদের সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে, এটা আমার অন্যতম দুঃখ।
শেখ বললেন, ওরা আমার কাছে লিখলেই পারে। তখন আমি অনুমতি দিয়ে দেবো।
খদ্দর সাহেবের এক ছেলে ঢাকা বিমানবন্দরে কাজ করে। চাটগাঁ ফেরার পথে ওকে আমি ডেকে বলেছিলাম তার বাবাকে এসব কথা লিখতে। খদ্দরসাহেব আমারও পরিচিত।
শফিউল আজমকে উপযুক্ত পদে নিয়োগের কথা আগেও কয়েক দফা বলেছি, এবারও ফের বললাম। বললাম, উপযুক্ত অফিসারদের এত অভাব রয়েছে, এ অবস্থায় শফিউল আজমের মতো অফিসারদের নিয়োগ না করার কোনো মানে হয় না। ইতিপূর্বে আর একবার পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর একইসঙ্গে শফিউল আজম, খাজা ওয়াসউদ্দিন ও এ. কে. এম. আহসানের কথাও উত্থাপন করে এঁদের যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার ব্যবহারের কথা বলেছিলাম। খাজা উয়াসীউদ্দিন সম্বন্ধে শেখসাহেবের মন্তব্য–
দেখুন, আমরা দীর্ঘকাল ধরে নবাব পরিবারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছি। তার ওপর ও বিয়ে করেছে পাকিস্তানে, ওদের পরিবার পাকিস্তানে থাকে, ওদের সব সম্পর্ক পাকিস্তানের সঙ্গে, অধিকন্তু ও বাংলা বলতে পারে না, আর আমার আর্মি হলো বাঙালিদের নিয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মাটিতে যার শিকড় নেই তাকে কী করে আমি বাঙালি আর্মির প্রধান করি?
মনে মনে তার যুক্তির সারবত্তা অন্তত কিছুটা না মেনে আমি পারলাম না।
শফিউল আজম সম্বন্ধে বললেন–
দেখুন পাকিস্তানিরা যখন বাংলাদেশে আক্রমণ চালিয়েছিল তখন ওরা traitor নামে এক ডকুমেন্টারি করেছিল। তাতে শফিউল আজম নিয়েছিল অংশ। ওই বইতে ওর ছবি আছে, ইত্যাদি।
আহসান সম্বন্ধে বললেন–
: আহসান যদি আরো আগে ফিরে আসতো, ওকে আমি আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারতাম। এখনো অবশ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ওকে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা দপ্তরের কৃষি উন্নয়নের সামগ্রিক দায়িত্ব এখন ওর ওপর। তবে ওর কিছু দোষ যে নেই তা নয়…।
আমি বুঝতে পারলাম। তাই কোনো মন্তব্য করলাম না।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার অনুরোধও জানালাম তাঁকে। বললেন–
দেখি কী করা যায়। কিছু ক্ষতিপূরণ আদায় না করে খালি হাতে ছেড়ে দিই কী করে?
বাঙালিরা সবেমাত্র এক পা এক পা করে পাটশিল্পের দিকে এগোচ্ছিল। পাটের বাজারে তারা এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ অবস্থায় তাদের জুটমিলগুলো জাতীয়করণ সঙ্গত হয়নি। ওইগুলো অন্তত ছেড়ে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে বললাম—
যদিও ওইসব ক্ষেত্রে আমার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই, তবুও এদিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এ বিষয়ে দেখলাম তিনি অনেকখানি অনড়। বললেন–
না, যা একবার জাতীয়করণ করা হয়েছে তা আর denationalise করা হবে না। তবে নতুন যেসব মিল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে সেগুলো আর জাতীয়করণ করা হবে না। এখন কল-কারখানার জন্য আমরা উদারভাবে লাইসেন্স দিচ্ছি।
এর কিছুদিন আগে কোরবানির ঈদ গেছে। বললাম–
: ট্যানারিগুলো অচল হয়ে আছে বলে এবার কোরবানির চামড়া বিক্রি হয়েছে একদম পানির দরে। ফলে প্রভূত আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দেশের।
বললেন–
এগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা করছি আমরা। ওই ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞ লোক নেই বলে এ দুর্দশা। সামনে এ রকম আর হবে না। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এদিন প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনেক বিষয়ে অনেক আলাপ হলো। তাঁকে কখনো অধৈর্য হতে দেখিনি। অন্তত আমার বেলায় তেমন কখনো ঘটেনি। অনেকদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল আমাকে মন্ত্রিসভায় নেবেন। স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। তবে গতবারও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এবারও করলেন আমি অন্য পদে আসতে রাজি কিনা। আমার একই উত্তর
চাটগাঁর বাইরে কোনো এসাইনমেন্ট নিতে আমি রাজি না। এ বয়সে আমি আমার ঘর ছাড়তে চাই না, তাতে আমার খুব কষ্ট হবে।
আজও সে কথাটা নতুন করে পাড়লেন। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আমি কিছুটা শংকিত হলাম। এবারও সেই একই উত্তর দিলাম। বয়সের যুক্তিটাই বেশি করে দেখালাম। তিনি জোর করলেন না।
.
২-১-৭৫
গতকাল ঢাকা থেকে চাটগাঁ ফিরে এসেছি। মঞ্জুরি কমিশনের সভা ছিল, পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছি। মঞ্জুরি কমিশনের সভা শেষ করে ফেরার পথে ফেরদৌস খার বাসায় নেমে তাকে বললাম–
শফিউল আজম সম্বন্ধে শেখসাহেবের সুর কিছুটা নরম হয়েছে মনে হলো। ডাক্তার নূরুল ইসলামকে (পিজির মহাপরিচালক দিয়ে পার্স করাতে হবে। তিনি তো শেখসাহেবের বাবাকে রোজই একবার করে দেখতে যান। আমি তার বাসা চিনি না, তাই আপনাকে সঙ্গে যেতে হবে।
ফেরদৌস সাহেব বললেন–
: খুব ভোরে না হলে ওঁকে ধরা যাবে না। আপনি তাহলে কাল খুব ভোরে আসুন। সাতটার আগে আসতে হবে, নাস্তা এখানেই করবেন।
.
৩-১-৭৫
আজ সকালে ফেরদৌসসাহেবকে নিয়ে ডাক্তার ইসলামের বাসায় গেলাম। ওখানেই নাস্তা করা গেলো। শেখসাহেবের বাবাকে দেখতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। গত রাতে ফোনে ফেরদৌস খান ওঁকে আমাদের আসার কথা জানিয়ে রেখেছিলেন।
ডাক্তার ইসলামকে বললাম–
শফিউল আজম সম্বন্ধে আমি আবারও শেখসাহেবের সঙ্গে আলাপ করেছি। এবার সুর কিছু নরম মনে হলো। আর একটু চাপ দিতে পারলে কাজ হয়ে যেতে পারে। আপনি তো রোজই যাচ্ছেন। সুযোগমতো কথাটা পাড়বেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের জন্য কিছু চাঁদা আদায় করে দেওয়ার কথাও ডাক্তার ইসলামকে বললাম।
তিনি আশ্বাস দিলেন, নিজেও কিছু দেবেন আর তার রোগী চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইব্রাহীম মিয়াকেও বলে দেবেন জানালেন।
দুপুরের ফ্লাইটে চাটগাঁ ফিরে এলাম। অধ্যাপকদের অনেকে দেখা করতে এলেন। এরই মধ্যে এখানে গুজব রটেছে আমি নাকি শিগগির মন্ত্রী হচ্ছি। গত মাসে দু’দিন–১১ আর ৩১ তারিখ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে। তার থেকেই গুজবটার উৎপত্তি।
প্রধানমন্ত্রীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে আমি আমার মনের ভাব জানিয়ে দিয়েছি। চাটগাঁর বাইরে কোনো দায়িত্ব গ্রহণে আমার কোনো রকম আগ্রহ নেই। বলেছি তাতে আমার খুব অসুবিধা হবে।
তিনি আমার কথাটা অগ্রাহ্য করেননি।
যাঁরা দেখা করতে এলেন তাদের এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার যেটুকু আলাপ হয়েছে তা শুনিয়ে দিলাম। অনেকে নিশ্চিন্ত বোধ করলেন।
.
৪-১-৭৫
মঞ্জুরি কমিশনের ৩১ তারিখের সভায় সব কর্মসূচির আলোচনা শেষ করা যায়নি। তাই ৪ তারিখ আবার সভা ডাকা হয়েছে। চেয়ারম্যান ডক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী আমাকে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানালেন। গতকাল সকালের বিমানে ঢাকা এসেছি। বিকেলে শেখসাহেবের সঙ্গে সাক্ষাঙ্কার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এযাবৎ কোনো সমাবর্তন হয়নি। তাই সমাবর্তন করা একরকম অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। কারণ সমাবর্তনে চ্যান্সেলরের উপস্থিতি অপরিহার্য। এর কিছুদিন আগে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত আলোচনার পর আজকেও ফের শফিউল আজমের কথা তুললাম। বললেন–
: আপনি যখন এত করে বলছেন, দেখি তার সম্বন্ধে কিছু করা যায় কিনা। অন্তত পেনশনের ব্যবস্থাটা করা সম্ভব কিনা ভেবে দেখি।
.
১১-২-৭৫
আগামীকাল কক্সবাজারে সরকারি উদ্যোগে একটি পপুলেশন তথা জনসংখ্যার ওপর সেমিনার হচ্ছে। আমার ওপর অনুরোধ আর তাগাদা এসেছে ওই সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার জন্য।
জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সম্পর্কে আমার নিজেরও কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে। তাই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। কিন্তু যেতে হবে নাকি ঢাকা হয়ে। ঢাকা থেকে একদল হোমরা-চোমরাও অংশ নেবেন, একটি গোটা প্লেন এ উদ্দেশ্যে চার্টার্ড করা হয়েছে, আমাকেও ওঁদের সহযাত্রী হতে হবে। অধিকন্তু ওইদিন নাকি চাটগাঁ হয়ে কক্সবাজারে যাওয়ার কোনো যাত্রীবাহী প্লেন নেই। তাই আমার জন্যও এ ব্যবস্থা। চাটগা থেকে ঢাকা যাওয়ার আলাদা টিকিটও তারা আমার জন্য যথাসময়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তাই সই। ঢাকা থেকে বিকেল আড়াইটার ফ্লাইট। কক্সবাজার বিমানবন্দরে নেমে দেখি প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর দাঁড়িয়ে। এর আগের দিন শেখসাহেব এসেছেন কক্সবাজার। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরেরও আগমন তাঁর অন্যতম সঙ্গী হয়ে। আগামীকালের জনসংখ্যা সেমিনার তাঁরই উদ্বোধন করার কথা।
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এগিয়ে এসে বললেন–
শেখসাহেব আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি আসছেন শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। আমাকে বলেছেন আপনাকে সালাম জানাতে আর তাঁর কাছে ধরে নিয়ে যেতে। আমি বলেছি-আপনার সালাম আমি পৌঁছাতে পারবো, আপনি তার সঙ্গে আলাপ করতে চান সেকথাও বলতে পারবো, কিন্তু ধরে আনতে পারবো না।
অতি বুদ্ধিমান ঠাকুরের এ উত্তর শুনে হেসে উঠলাম। কক্সবাজার কলেজের অধ্যক্ষও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন–
: আপনি আসবেন শুনে আমরা কলেজে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করছি। উপলক্ষ আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি। প্রতিমন্ত্রী সাহেবও থাকবেন। সবাইকে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
আমার পুরনো বন্ধু দেওয়ান আজরফও সেমিনার উপলক্ষে আমাদের সহযাত্রী হয়ে এসেছেন। তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো।
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর বললেন–
এখন শেখসাহেবের কাছে গিয়ে লাভ নেই। সভাটা শেষ করে তারপর আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাবো।
সময় তখন বিকেল সাড়ে চারটা-পাঁচটার মতো হতে পারে। কলেজীয় সভা-সমিতির উপযুক্ত সময়। অধ্যক্ষও জানালেন
: আপনারা গেলেই সভা শুরু করা যাবে। সবকিছু প্রস্তুত।
তাতে আমাদেরও সুবিধা। প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি করে বিমানবন্দর থেকে আমরা সোজা কলেজে চলে এলাম। ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষকে হল টইটম্বুর। অনেক প্রবন্ধ পাঠ আর বক্তৃতা হলো। মাঝখানে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর উঠে গেলেন। বললেন–
আমি নামাজটা সেরে আসি। বুঝলাম তিনি নামাজি-কালামি লোক। রাজনৈতিক নামাজ কিনা বলতে পারবো না!
সভার কাজ শেষ হতে হতে বেশকিছু রাত হয়ে গেলো। ওখান থেকে তাহেরউদ্দিন আমাকে সোজা সার্কিট হাউসে শেখসাহেবের কাছে নিয়ে হাজির করলেন।
.
০৯.
শেখসাহেব তখন সার্কিট হাউসের বারান্দায় গেঞ্জির উপর আলোয়ান জড়িয়ে ইজি চেয়ারে বসে আছেন। আশপাশে কয়েকজন এমপিও রয়েছেন। শেখসাহেব তাঁদের সঙ্গে আলাপরত। চাটগাঁর তখনকার ডিসি জনাব এ বি চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। আমি যেতেই শেখসাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে অত্যন্ত উফুল্ল কণ্ঠে অভ্যর্থনা জানিয়ে তার পাশের চেয়ারে নিয়ে আমাকে বসালেন। বাচ্চা এসডিও আশফাকুর রহমান ফাইফরমাশ খাটছেন। শেখসাহেব এসডিওকে উদ্দেশ্য করে বললেন–
এখানকার মুড়ি বেশ ভালো, মুড়ি নিয়ে এসো তেল-পেঁয়াজ দিয়ে মেখে।
মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বভাব শেখসাহেব কখনো ছাড়তে পারেননি–খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও ছিলেন তাই। একটা দেশের রাষ্ট্রপতিসুলভ ব্যবহার তাঁর মধ্যে আমি কখনো দেখিনি। আমৃত্যু তিনি মধ্যবিত্ত বাঙালিই থেকে গেলেন। ধামাভরা গরম গরম মুড়ি এলো। পেঁয়াজ ছাড়ানো তেলে মাখা। উপস্থিত সবাই মিলে একই ধামা থেকে পরম আনন্দে মুঠি মুঠি খেতে লাগলাম শুধু নয়, উপভোগ করে খেতে লাগলাম। শেখসাহেবের এক এক মুঠ তিন মুঠের সমান। মনে হলো মুড়ি শেখের প্রিয় খাদ্য। কবি জসীমউদ্দীনও ফরিদপুরের মানুষ, দেখেছি তিনিও মুড়ির অত্যন্ত ভক্ত। জসীম তো মুড়ির ঠোঙ্গা হাতে পথ চলতে চলতেই মুড়ি চিবাতো। শুনেছি তার বাড়ি গেলে সর্বাগ্রে বাসনভরতি মুড়িই সামনে দেওয়া হতো, আর তার বেশিরভাগ ও নিজেই সাবাড় করতো।
কথাপ্রসঙ্গে হঠাৎ ডিসি বললেন–
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনেক অনাবাদী জমি পড়ে রয়েছে, মাত্র দুতিন লাখ টাকা খরচ করে একটা বাঁধ দিতে পারলে ওইসব জমিতে প্রচুর ফসল উৎপাদন করা যাবে।
সায় দিয়ে আমিও বললাম—
: তাহলে খুব ভালো হয়।
শেখসাহেব জানতে চাইলেন–
: কত টাকা লাগবে? দু’লাখে হবে?
আমি বললাম—
: তিন লাখ দিয়ে দিন। তাতেই বোধ হয় হয়ে যাবে।
ডিসি’র দিকে ফিরে জানতে চাইলাম—
: ডিসি সাহেব কী বলেন?
ডিসিও আমার কথায় সায় দিয়ে বললেন—
: তিন লাখে হয়ে যাবে।
সচিবকে তখনই ডেকে পাঠালেন শেখসাহেব। সচিব ফরাশউদ্দীন বোধ হয় কাছেই ছিলেন। এসে দাঁড়াতেই বললেন–
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তিন লাখ টাকা মঞ্জুর করা হলো। লিখে রাখো। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–
আপনার অনেক আদেশ কিন্তু দেখেছি বাস্তবায়িত হয় না। আপনি গুড ফেইথে অনেক হুকুম দিয়ে থাকেন, তার সব কটি কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট হয় না। আমার বিশ্বাস আপনার সব আদেশ যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে না। তাই এমন ঘটে থাকে।
তিনি কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন–
: আমার কোন আদেশ কার্যকর হয় নি?
বললাম–
আপনি তো আমাকে বলেছিলেন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের জন্য আপনি আদেশ দিয়েছেন, একটা সেল করেছেন আর ফেরদৌস খানকে বাস্তবায়ন কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করেছেন, কিন্তু ফেরদৌস খান আজ পর্যন্ত ওই মর্মে কোনো আদেশ পাননি।
আমার এ কথায় মনে হলো তিনি কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। তাই স্পষ্ট কিছু বলতে পারলেন না। বললেনও না। আমার বিশ্বাস এ ব্যাপারে কিছু প্রশাসনিক বটলনেক রয়েছে। না হয় কবে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট করা হয়েছে, এখনো তার বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।
রাত হয়ে যাচ্ছে, আর বোধ করছিলাম বেজায় ক্লান্তি।
বললাম—
: আমি উঠি। রাত অনেক হলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—
: আচ্ছা।
সচিবকে উদ্দেশ্য করে বললেন—
: এঁর জন্য গাড়ি আছে তো?
বললাম–
ও হয়ে যাবে। তাহেরউদ্দীন নিয়ে এসেছেন, তিনিই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
গাড়িতে উঠতে যাওয়ার সময় সচিব ফরাশ অনুযোগের সুরে বললেন–
আপনি স্যার আমরা যা করতে পারিনি তারই শুধু উল্লেখ করলেন। আমরা যা করেছি তার কিছু বললেন– না। আমি নিজে গিয়ে কবি ফররুখ আহমদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। এ রকম আরো কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করলেন তিনি।
পরদিন সকালে সেমিনার করে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে আসবো।
বিমানবন্দরে এসে দেখি আমার বাল্যবন্ধু জাফর আলম চৌধুরী দাঁড়িয়ে। তিনি একটি লাগেজ টিকিট আমার হাতে দিয়ে বললেন–
একটি ছোট ডেকচি বুক করে দিয়েছি। আজ ভোররাতে পুকুর থেকে একটি রুইমাছ ধরা হয়েছে। গিন্নি সেটি রান্না করে দিয়েছেন।
জাফর আলম চৌধুরী একটি বাগান করেছেন, তাতে অন্যান্য ফলফলারির সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলা ইত্যাদি উৎপাদনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাচ্ছেন, যেমন লং, এলাচ, দারচিনি, গোলমরিচ, তেজপাতা ইত্যাদি। তারও কিছু নমুনা আমার হাতে দিলেন বাড়িতে গিন্নিকে দেখাতে।।
খোঁচা দিয়ে কথা বলার ফলেই বোধকরি সে তিন লাখ টাকার মঞ্জুরি আসতে কিছুমাত্র দেরি হলো না। এ টাকা দিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটা পুকুর আর বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছি।
.
৬-৩-৭৫
আজও প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সাক্ষাৎকারের কথা ছিল। তাঁর বাবার হঠাৎ অসুখ বৃদ্ধির খবর পেয়ে তিনি খুলনা চলে গেছেন। তাঁর বাবা তখন ছোট ছেলের কাছে খুলনায় ছিলেন। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর সব এনগেজমেন্ট বাতিল, এ খবর সেদিনের কাগজে দেখে বুঝতে পারলাম তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা কম। তিনি ঢাকা-খুলনা আসা-যাওয়া করছেন এ-বেলা ও–বেলা। তার ওপর রয়েছে রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজকর্ম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কাজ সেরে আমি চাটগাঁ ফিরে এলাম পরের দিন।
শেখসাহেবের সঙ্গে আমার আরও দু’একবার সাক্ষাৎকার ঘটেছে। এখন ডায়রি উল্টিয়ে দেখছি সব সাক্ষাত্তারের কথা ডায়রিতে লেখা হয়নি।
একটি সাক্ষাৎকারের সময় আমি একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ জানিয়েছিলাম, সেটি এখন মনে পড়ছে। আমার দ্বিতীয় ছেলে আবুল মনজুর পাস করার পর এখানে-ওখানে এটা-ওটা করে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে দিয়েছে। স্থায়ীভাবে কিছু একটা ধরেনি। ওর জীবিকা সম্পর্কে আমরা তাই খুব চিন্তিত। চাকরির প্রতি ওর একটা স্বাভাবিক অনীহা রয়েছে। ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য নয়, অথচ ও চায় ব্যবসা করতে। আমাদের পরিচিত জগৎ বই আর কাগজপত্রে সীমিত। তাই ঠিক হলো ও প্রথমে কাগজের একটা ডিলারশিপ নিয়ে আরম্ভ করুক, ভালো করতে পারলে পরে বইপুস্তকের দিকে ওটাকে সম্প্রসারিত করা যাবে। যথাবিধি কর্ণফুলী পেপারের ডিলারশিপের জন্য দরখাস্ত করা হলো। সব শর্ত পূরণ করা হলো। যথানিয়মে কিছু হচ্ছে না দেখে মঞ্জু প্রতিমন্ত্রীকে গিয়ে বললে তিনি সাফ জবাব দিলেন কিছু করতে পারবেন না। এ প্রতিমন্ত্রী আমার ছাত্র এবং আত্মীয়ও। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব মঞ্জুকে বলেছে–
এসডিও-র সুপারিশ নিয়ে আসুন, আমি করে দিচ্ছি। এসডিও-র সুপারিশ নিয়ে যখন যাওয়া হলো তখন বলল–
স্থানীয় এমপি-র সুপারিশও দরকার। এমপি একজন তরুণ, মঞ্জুরও জুনিয়র। ওর সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলো, সে নাকি কথাই বলতে চাইলনা। তাচ্ছিল্যভরে শুধু বলল–
আমার এলাকায় অনেক ডিলার রয়েছে, আর সুপারিশ করা যাবে না।
তরুণ এমপি আমার ছেলেকেও চেনে–আমাকেও।
তিন-চার মাসেও যখন কিছু হলো না তখন, ব্যাপারটি যদিও অতি সামান্য, অনেক দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে কথাটা আমি একদিন শেখসাহেবকে বললাম।
তিনি তো শুনে অবাক। তখন শেখ মণি ছিলেন ওখানে। ওকে বললেন–
: তুমি ওদের বলে দিও আমি বলেছি এটা করে দিতে।
মণি বলল–
আপনিই বরং ওদের ডেকে বলে দিন, আমার বলাটা সঙ্গত হবে না।
মণি চলে গেলো। শেখসাহেব সচিবকে ডেকে বললেন–
পেপার বোর্ড কর্পোরেশনের ওদেরকে ডেকে পাঠাও, না হয় এখনি ফোনে বলে দাও আবুল ফজল সাহেবের ছেলের ডিলারশিপের ব্যাপারটা যেন অবিলম্বে করে দেওয়া হয়।
আমি চলে আসার পর তিনি নাকি সচিবের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি যেমন জীবনে কারও কাছে কিছু চাই নি, আবুল ফজল সাহেবও তো আমাদের কাছে কোনোদিন কিছু চাননি। আজ তাঁর ছেলের একটা সামান্য ডিলারশিপ হবে না–এ কেমন কথা!’
এরপর কোনো বাধা দেখা দেয়নি। যথাসময়ে ডিলারশিপ ওর হয়ে গিয়েছিল। পরে এটিকে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেছিল ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। সংবাদপত্রে ওদের বিবৃতি দেখে অনেকে অবাক হয়েছেন।