০৫. তনয়া

তনয়া

প্রাচীন ভারতবর্ষে পুত্র জন্মালে শাঁখ বাজত, কন্যা জন্মালে নয়। তা ছাড়া ভাইফোঁটা, জামাইষষ্ঠী, সবই পুরুষকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান। জন্মদিনও ছেলেদেরই বেশি হয়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে: যে নারী পুত্রের জন্ম দেয় সেই শ্রেষ্ঠ নারী। যে নারী কন্যার জন্ম দেয় তাকে বারো বছর পরে ত্যাগ করা যায় (৬:৩:১৭:১৩)। বৌধায়ন ধর্মসূত্র (২:৪:৬) ও আপস্তম্ব ধর্মসূত্র (১:১০:৫১-৫৩; ২:৫:১১,১৪) অনুযায়ী প্রাচীন সমাজ কন্যার জন্মে হতাশ হত। মনুসংহিতা-য় বলা হয়েছে, পুৎ নামক নরক থেকে উদ্ধার করে বলে ‘পুত্র’ বলা হয়; শাস্ত্রকারেরা কল্পনাশক্তি দিয়ে এমন একটি নরক সৃষ্টি করার প্রয়োজন মনে করেননি, যেখান থেকে কন্যা তার পিতামাতাকে রক্ষা করতে পারে। পিতার মুখাগ্নি করার মৌলিক অধিকার পুত্রেরই আছে, মৃত পিতাকে পিণ্ডদান ও পিতামাতার শ্রাদ্ধেরও অধিকার আছে। কারণ সমাজে বাল্যবিবাহের অনুপ্রবেশ ঘটার পর বিবাহের সময়ে বালিকা কন্যার গোত্রান্তর হত, তাই ভিন্ন গোত্রের পিতামাতার জন্য তার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করার অধিকার ছিল না। কিন্তু পিতামাতার সঙ্গে একই গোত্র হওয়ায় পুত্রের সেই অধিকার ছিল। পিতা যেহেতু পরলোকে তার মঙ্গলের জন্য শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করার বিষয়ে পুত্রের উপর নির্ভরশীল ছিল, পুত্রের সামাজিক মূল্য কন্যার চেয়ে বেশি, কন্যা সেই অনুপাতে উপেক্ষিত।

তৈত্তিরীয় সংহিতা-য় আমরা দেখি, সোমযাগের একটি বিশিষ্ট অনুষ্ঠানে কতগুলি যজ্ঞীয় পাত্র মাটিতে রাখা হত, কতগুলি আবার উপরে রাখা হত। ‘সেইজন্য শিশুকন্যাদের জন্মের পর মাটিতে রাখা হয়, শিশুপুত্রদের তুলে ধরা হয়।’ (৬:৫:১০:৩) রোমে শিশুকে জন্মের পর মাটিতে রাখা হত এবং পিতাকে ডাকা হত। পিতা যদি শিশুকে দেখে বেঁচে থাকার যোগ্য মনে করত, সে তাকে মাটি থেকে তুলে নিত। এখান থেকেই আমরা ইংরেজি ‘rearing up the child’ বাক্যাংশটি পেয়েছি। কিন্তু লক্ষণীয় যে এই ‘তুলে ধরায় ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোনও পার্থক্য করা হত না। এ দেশে কন্যাসন্তান জন্ম থেকেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

গর্ভাবস্থায় ‘পুংসবন’ অনুষ্ঠান করা হত, যাতে নলজাতক পুত্রসন্তানই হয়, কন্যা নয়। সমাজ নানা মন্ত্র ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটাই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে— সদ্যোজাত সন্তানটি যেন সব সময়ে পুত্রই হয়। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর আশপাশে রচিত ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, ‘নারী অমঙ্গলজনক, কন্যা অভিশাপ।’ (৬:৩:৭:৩) মহাভারত-এও দেখি কন্যা শোকের কারণ। (১:৫৯:১)

আমরা শুনতে পাই পূর্বজন্মের পুণ্যফল পুরুষ হয়ে জন্মানো যায়। মহাভারত-এ স্পষ্টই বলা হয়েছে, পূর্বজন্মের পাপের ফলে নারী হয়ে জন্মাতে হয়। (৬:৩৩:৩২) এক নারীর আত্মত্যাগে সন্তুষ্ট হয়ে বুদ্ধ এক সময়ে তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন, সে যেন পরজন্মে পুরুষ হয়ে জন্মায়। সোজা কথায়, এই গল্পটি সেই ধারণাই সমর্থন করে যে নারী হিসেবে জন্ম ঘৃণ্য, কিন্তু পুরুষ হয়ে জন্মানো শুভ, কারণ তা পূর্বজন্মের পুণ্যকর্মের ফল। তাই কন্যার জন্মে পরিবারের বা সমাজের সব সদস্যরা তৎক্ষণাৎ মনে করত, সে নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে কোনও পাপ করেছে, তাই কন্যা হয়ে জন্মেছে।

সমাজ সাধারণ ভাবে কন্যাদের শিক্ষার অধিকার দেয়নি, কারণ উপনন না হলে কেউ বেদ পড়তে পারে না এবং কন্যাদের উপনয়ন হতে পারে না। কিন্তু কয়েকটি সম্মানজনক ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল; বৃহদারণ্যকোপনিষদ-এ বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি পণ্ডিতা ও দীর্ঘায়ু কন্যা কামনা করে, তার উচিত তার পত্নীকে তিল ও ঘি দিয়ে অন্ন খাওয়ানো।’ (৬:৪:১৭)

অতএব কিছু মানুষ নিশ্চয়ই শিক্ষিত কন্যা চাইত এবং কন্যাদের শিক্ষা দেওয়ার কোনও উপায় খুঁজে পেয়েছিল, এগুলি যদি ব্যতিক্রমও হয়। সারা পৃথিবীতেই কিছু দিন আগে পর্যন্ত নারীর শিক্ষার অধিকার স্বীকার করা হত না। এখানেও ঠিক তাই। মনু বলেছেন, ‘বিবাহ হল নারীর উপনয়ন, স্বামীর গৃহে জীবন কাটানো গুরুগৃহবাস এবং স্বামীসেবা বেদপাঠ।’ (মনু সংহিতা ২:৬৭)

সাহিত্যে কন্যার শৈশবের কোনও বর্ণনা নেই। কালিদাসের কুমারসম্ভব-এ দু’ একটি শ্লোকে গৌরীর শৈশবের বর্ণনা আছে, যদিও গৌরী পূর্ণ দেবী। কৃষ্ণের শৈশব সম্বন্ধে কিন্তু শুধু যে বিশাল সাহিত্য সৃষ্টি আছে তাই নয়, সঙ্গীতে, চিত্রে, মূর্তিতে, যাত্রাভিনয়ে তার অসংখ্য বর্ণনা আছে। কোনও দেবীর বা কোনও নারীর শৈশবের এ রকম বর্ণনা কিন্তু কখনও মেলে না।

পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে কন্যা অবাঞ্ছিত অতিথি। রাজস্থানে জন্মের পরেই কন্যা হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এখনও ওই রাজ্যে এমন কিছু গ্রাম আছে যেখানে কোনও কন্যাসন্তান নেই; গ্রামবাসীরা প্রতিবেশী গ্রাম থেকে স্ত্রী জোগাড় করে। এ দেশে অন্তত ২৫০০ বছর ধরে দৃঢ়মূল ধারণা আছে যে কন্যা অমঙ্গল। কন্যাপণ যখন ধীরে ধীরে অথচ সাধারণ ভাবে যৌতুকে পরিণত হল, যা আবশ্যিক এবং আকাশচুম্বী, যাতে পিতামাতা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়, সমাজ যে তখন এই যন্ত্রণার মূল কন্যাকে দৈব নিষ্ঠুরতা হিসেবে দেখেছিল, তা আশ্চর্য নয়। তাই পণপ্রথা প্রচলিত হওয়ার পর এই বিশ্বাস, যা জনমানসে আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা অর্থনৈতিক স্বীকৃতি পেল।

তার মানে সব কন্যাসন্তান সব সময়েই পিতামাতার কাছে অবাঞ্ছিত ছিল বা তাদের স্নেহ পেত না, তা নয়; সমাজে নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিল। অনেক পরিবার ও ব্যক্তির উদারনৈতিক মতবাদ কন্যার আগমনকে উষ্ণ ভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, কিন্তু আগে যা বলা হল তা হল সাধারণ চিত্র। পরিবারে পুত্র ও কন্যার প্রতি যত্ন ও স্নেহের তারতম্য এখনও অনেক ক্ষেত্রেই চমকে দেয়। সমাজতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকদের গবেষণা দেখিয়েছে যে অপুষ্টির অনুপাত ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মধ্যে অনেক বেশি। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অবহেলা অনেক বেশি হয় এবং অনেক বেশি দিন ধরে হয়। যে মায়ের শুধু মেয়ে আছে, সে সঙ্কুচিত হয়ে থাকে, অপরাধবোধে ভোগে। সে যে উত্তরাধিকারী ও শ্রাদ্ধাদিকারী না হতে পারার অপরাধবোধ। পুত্র ও কন্যার মধ্যে সাম্যভাবের অভাবে অনেক পরিবারে মেয়েরা সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। শাস্ত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যার ফলে বহু শতাব্দী ধরে তাকে কোথাও জন্মের পরেই হত্যা করা হয়েছে, কোথাও অবহেলা করা হয়েছে এবং সারা দেশেই পরিবারে ও সমাজে নীচু চোখে দেখা হয়েছে। সে অস্বাস্থ্যে ভোগে, রোগের সময়ে অবহেলিত হয় এবং অবহেলা ও অপুষ্টির কারণে তার ক্ষেত্রে মৃত্যুর আনুপাতিক হার অনেক বেশি।

আধুনিক যুগে এর আর একটি প্রকাশ হল, গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য পিতামাতার অশোভন, উগ্র আগ্রহ, যাতে চিকিৎসকেরা সহায়তা করেন। এগুলি একত্র হয়ে দিবালোক দেখতে পাওয়ার পূর্বেই কন্যাসন্তানকে হত্যা করে। আজকেও কী আমরা শুধু কথায় নয়, কাজেও স্বীকার করতে পারি না, যে পুত্র এবং কন্যার দু’জনকেই সমান স্থান দেওয়া পিতামাতা ও সমাজের আবশ্যিক মানবিক কর্তব্য? এর ব্যতিক্রমকে মহাপাপ বলে গণ্য করার সময় হয়েছে? এবং সেই ব্যতিক্রমকে আইনত দণ্ডনীয় করতে এখন আইন তৈরি করা উচিত। জন্মসূত্রে যে অধিকার এবং পারিবারিক ও সামাজিক অভ্যর্থনা কন্যাসন্তানের প্রাপ্য যা এতদিন তাকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাই এখন তাকে দেওয়া উচিত? তা না হলে মানবিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়ন ঘটবে; তা না হলে আমাদের সব শিক্ষা লজ্জা পাবে এবং কুটিল বলে গণ্য হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *