“কি হবে গিন্নি?”
“কিসের কি হবে বড়-বৌ ?”
“বড় বৌ! ও নাম ধরে আর আপনি আমাকে ডাক্বেন না। বড়-বৌ! সে ত নেই। সে নেই গো! সে আর নেই! আজি সন্ধ্যা পর্যন্তও আমি এক গৃহস্থের বড়-বৌ ছিলাম গিন্নি! এখন আর তা নেই! সে সব আমার ঘুচে গেছে—চিরদিনের মত গেছে। কাল সকালে আর তার চিহ্নও থাক্বে না। সে কথা বল্ছিনে গিন্নি, মেয়েটার কি হবে? আমি চলে গেলে, কে তাকে দেখ্বে? সে কার কাছে দাঁড়াবে? তার যে আর কেউ নেই।” মানদা আর কথা বলিতে পারিলেন না; তিনি কাঁদিয়া উঠিলেন।
রমাসুন্দরীর কাছেই সুহার দাঁড়াইয়া ছিল; তিনি তাহাকে মানদার কোলের কাছে বসাইয়া দিতে গেলেন। মানদা চীৎকার করিয়া সরিয়া বসিলেন; বলিলেন “না, না, ওরে সুহার, তুই আমাকে স্পর্শ করিস্ না, আমার কাছে আসিস্ না। সরে যা মা আমার, সরে যা। তোর মা নেই! তোর মা যে সন্ধ্যার পরে মরে গিয়েছে রে”-
সুহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া মায়ের গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল “মা, ও মা, তুমি অমন করছ কেন? ওগো, তোমরা দেখ, মা যে কেমন করছে।” সুহার কাঁদিয়া উঠিল।
রমাসুন্দরী মানদাকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বসিলেন; কিন্তু, কি যে বলিবেন, তাহা ভাবিয়া পাইলেন না। এ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। যে দুইচারি জন স্ত্রীলোক সেখানে ছিলেন, তাঁহারা বলিলেন “ও বড়বৌ, অমন করছিস্ কেন? দেখ্ ত, সুহার কাঁদছে। ওকে কোলে কর; ওর মুখের দিকে চেয়ে সব ভুলে যা।”
মানদা বলিলেন “সব ভুলে যাব—সব আমি ভুলে যাব। আর একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, আমি সব ভুলে যাব। ওগো, তোমরা কেউ আমার এই অভাগী মেয়েটাকে কোলে তুলে নেও; তোমরা কেউ বল যে, ওর মুখের দিকে চাইবে। তা হলেই আমি যাই। গিন্নি, আপনিই একবার বলুন! আপনার পায়ে ধরে বলছি, এই আমার শেষ প্রার্থনা-আপনি এই বাপ-মা-হারা মেয়েটাকে নিন্—আমি চলে যাই। আর যে আমি দেরী করতে পারছি নে। আর যে আমার সহ্য হচ্চে না। দেখ্বে তোমরা—এই দেখ না আমার বুকের মধ্যে কি আগুন জ্বলছে-আমার মাথা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। আর যে আমি থাক্তে পারছি নে। আয় সুহার, তুইও আমার সঙ্গেই আয়! এ দেশে তোরও থেকে কাজ নেই। না, না, তোকে রেখে যাব না-তোকেও সঙ্গে করেই নিয়ে যাই। চল্ মা, চল্ অভাগীর মেয়ে, আমার সঙ্গে চল। ঐ নদীতে ডুবে সব জ্বালার হাত থেকে নিস্তার-পাই গে! চল্ মা, চল্; এখানে তোর কেউ নেই। চল্।” এই বলিয়া পাগলিনীর মত সুহারের হাত ধরিয়া মানদা দণ্ডায়মান হইতে গেলেন ।
রমাসুন্দরী তাহাকে জোরে কোলের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন “ও বড়বৌ, তুই পাগল হলি না কি? ও-সব কি বকৃচিস্। কি, তোর হয়েছে কি?”
মানদা বলিলেন “কৈ, কি হবে? না, না, কিছুই হয় নাই। হবে আবার কি? তোমরা সবাই সরে যাও, আমাকে ছেড়ে দেও, আমি মেয়ে নিয়ে চলে যাই। এখানে যে আমি থাক্তে পারছি নে, এ ঘরের দিকে যে আমি চাইতে পারছি নে। ওরে, এ যে আমার দেবতার ঘর ছিল রে! তোমরা কেউ এই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে পার? আমি তা হলে এই ঘরের মেজেয়—ঐ ঐখানে বসে সেই আগুনে পুড়ে মরি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “ও সব কি কথা বল্ছিস মানদা? তুই চুপ কর্। তোর ভয় কি? আমি আছি। তোর মেয়ে সুহারের জন্য তোর ভাবনা হয়েছে? আমি ধর্ম্ম সাক্ষী করে বল্ছি, তোর মেয়েকে আমি নিলাম; তার সম্পূর্ণ ভার আমার উপর রইল। তুই এখন একটু স্থির হয়ে আমার কথা শোন্। আমি এ কথা মানি যে, নরাধমের স্পর্শে তোর দেহ কলুষিত হয়েছে। পশুটা যখন পাপ মনে তোর গায়ে হাত দিয়েছে, তখনই তোর শরীর অপবিত্র হয়েছে। কিন্তু তোর মন ত অপবিত্র হয় নাই; এ কথা ত তুই বেশ বুঝিস্। তোর মনে ত কোন পাপ স্পর্শ করে নাই, তা ত তুই জানিস্, তবে এত কাতর হচ্চিস্ কেন? লোকে কত কথা বল্বে, কেমন? আমি তার ব্যবস্থা করেছি। আমি তোকে আর তোর মেয়েকে দেবীপুরে নিয়ে যাব। তুই সেখানে আমার মেয়ের মত থাক্বি; আমি তোকে কোলে করে রাখব; তোকে আমার সংসারের কর্ত্রী করে রাখব। কেউ তোকে ঘৃণা করতে পারবে না। তোর মেয়ের বিয়ে যাতে সুপাত্রের সঙ্গে হয়, আমি তা করব। তোকে এ দেশে থাক্তে হবে না;–এ মুখুয্যে-বাড়ী আর তোকে আস্তে হবে না,—এদের মুখ তোকে দেখ্তে হবে না। এর জন্য যত কিছু সহ্য করতে হয়, আমি করব। কা’ল সকালেই তোদের নিয়ে আমি দেবীপুরে চলে যাব।”
মানদা অবাক হইয়া রমামুন্দরীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না; পাগলিনীর মত তাঁহার শূন্যদৃষ্টি !
রমাসুন্দরী বুঝিতে পারিলেন, মানদা তাঁহার কথার মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারেন নাই, তাঁহার বুদ্ধি এখন প্রকৃতিস্থ নহে। তিনি বলিলেন “মানদা, আমি যা বললাম, শুন্তে পেয়েছিস্ ?”
মানদা অন্যমনস্ক ভাবে বলিলেন “হ্যাঁ—তা—হ্যাঁ কি বলছ ?”
রমাসুন্দরী বলিলেন “কা’ল সকালে আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব, বুঝলি ?”
মানদা তেমনই ভাবে বলিলেন “আমাদের-দেবীপুরে! কেন? সে কোথায়? দেবীপুরে? কেন? এ যে আমার সুবর্ণপুর। না, না, ওগো, আমি কোথাও যেতে পারব না—যাব না গো ! আমি এই সুবর্ণপুরেই মরব। তোমরা জান না, আমি নয় বছর বয়সের সময় এই সুবর্ণপুরে এসেছি, আর এতকাল এখানেই আছি, —কোন খানেই ত যাই নাই। এখানেই আজ আমার শেষ হবে। তিনি যে আমাকে এই ঘরে এনে তুলেছিলেন! আমি কি এ ঘর ছেড়ে যেতে পারি। না, না—আমি কোথাও যাব না; আমি আজ এই ঘরে—ঐ যে তিনি এসেছেন—ঐ যে তিনি আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আমি এই ঘরের মধ্যেই মরব। আজই আমার যাবার দিন! তোমরা কেউ আমাকে বাধা দিও না—দিও না। কি বলছ—সুহার, হ্যাঁ, সুহার! তা—আমি ওকেও নিয়ে যাব। ওর গলা-টিপে মেরে ফেলে তার পর আমিও মরব। ঐ শোন না তোমরা, তিনি যে সেই কথাই বল্ছেন। আমি কোন দিন তাঁর কোন কথা অমান্য করি নি; আজও তাঁর কথা-মতই কাজ করব। তোমার পায়ে পড়ি গিন্নি! আমাদের নিয়ে যেও না। তোমরা সরে যাও—তোমরা আমাদের ছেড়ে দেও; আমরা মায়েঝিয়ে তাঁর কাছে চলে যাই। তিনি ত ঘৃণা করছেন না—তিনি যে কোলে তুলে নিতে ডাক্ছেন। যাই গো—যাই—আর কি দেরী করা যায়—তিনি যে ডাক্ছেন—ঐ শোন।” বলিয়াই মানদা অচৈতন্য হইয়া পড়িলেন। তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া সুহার কাঁদিয়া উঠিল “মা, ও মা! মা যে কথা বলে না।”
রমাসুন্দরী তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহির হইতে জল আনিয়া মানদার মুখে-চোখে মাথায় ছিটাইয়া দিতে লাগিলেন। তাঁহার নাড়ীজ্ঞান ছিল; মানদার হাত দেখিয়া বলিলেন “ভয় নাই, মুর্চ্ছা গিয়েছে; এখনই জ্ঞান হবে। তোমরা ভাল করে বাতাস কর।”
ধীরে ধীরে বাতাস করিতে করিতে মানদার জ্ঞান-সঞ্চার হইল ; তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অতি কাতর স্বরে বলিল “মাগো, আর যে সয় না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “মানদা, সবই সইতে হবে। সুহারের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ্,; মেয়ে যে কেমন হয়ে গিয়েছে।”
“সুহার! আমি তার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ত, সুহারকে ফেলে কোথায় যাব। আয় মা, আয় আমার কোলে আয়। তোকে বুকে করে দেখি আগুন নেবে কি না।”
রমামুন্দরী বলিলেন “মানদা, অত কাতর হলে চল্বে না। তুই মরবি কেন ? তোর কি হয়েছে। আমার কথা বেশ করে বুঝে দেখ, তোর কিছুই হয় নাই। তুই যে ভগবানের কাছে খাঁটি আছিস্। বল দেখি, আমার কথা ঠিক কি না ?”
মানদা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিলেন। কেহই কোন কথা বলিয়া তাঁহার এই ভাবনায় বাধা দিলেন না। অবশেষে মানদা অতি ধীর ভাবে বলিলেন “গিন্নি, তোমার কথা আমার মনে লেগেছে। তুমি ঠিক কথা বলেছ। তাই ত! আমি যদি মনে প্রাণে ঠিক থাকি, তা হলে আর চাই কি। আমি বল্ছি তোমাকে গিন্নি! আমি কোন পাপই করি নাই—আমার মন ঠিকই আছে। আমি তাঁরই স্ত্রী আছি! আমি কোন অন্যায় কাজ করি নাই। যে যা বলে বলুক, না, কি বল গিন্নি, আমি খাঁটি আছি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “আমার কথা তা হলে বুঝেছিস্ ত! তবে আর অমন করছিস্ কেন ?”
মানদা তেমনই ধীর ভাবে বলিলেন “তা ত বুঝেছি গিন্নি, কিন্তু লোকে কি বলবে ? সকলে যে আমাকে কত কি বল্বে—আমার সঙ্গে কথা বল্বে না। তা হলে আমি কেমন করে বাঁচব? তা হলে আমার সুহারের কি গতি হবে ? তার যে বার বছর বয়স হোলো। তাকে কে নেবে গিন্নি! আমার সুহার! ”
রমামুন্দরী বলিলেন “সে কথা যে তোকে একটু আগেই আমি বল্লাম, তা বুঝি শুনতে পাস্নি; তুই স্থির হয়ে শোন্। আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব। সেখানে কেউ তোকে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। আর যেমন করে হোক, তোর সুহারকে আমি ভাল ঘর বর দেখে বিয়ে দিয়ে দেব।”
মানদা বলিলেন “তা আর হয় না গিন্নি ! আর হয় না । মনে ত বল বেঁধেছিলাম; কিন্তু সব যে ভেঙ্গে পড়ে। তা আর হবে না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “হয় কি না হয়, সে আমি দেখে নেব । তুই এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর্ দেখি !”
মানদা বলিলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথা বলেছ! আহা, ঘুমাতে হবে বই কি! ঘুমই যে এখন আমার একমাত্র পথ। মা দুর্গা, আমার চোখে একবার ঘুম এনে দাও মা! সে ঘুম যেন আর না ভাঙ্গে! ওগো, দয়াময়ী, আর তোমার কাছে কিছু চাইনে, আমার চোখে ঘুম এনে দাও—আমি সব ভুলে যাই—সব ভুলে যাই।”
রমামুন্দরী বলিলেন “আবার ও কি কথা ! তুই একটু স্থির হ, মানদা! রাত যে অনেক হয়ে গেল !”
মানদা চারিদিকে একবার চাহিয়া বলিলেন “তাই ত, রাত যে অনেক হোয়েছে! ও সুহার! তুই একটু ঘুমিয়ে নে মা! অসুখ করবে যে। আয়, আমার কোলের কাছে আয়!” এই বলিয়া সুহারকে কোলের মধ্যে তুলিয়া লইয়া মানদা নীরব হইলেন।
রমাসুন্দরী এবং আরও দুই তিনটি স্ত্রীলোক সারা রাত্রি সেই স্থানেই বসিয়া কাটাইলেন। মানদা কখন চুপ করিয়া থাকেন, কখন আপন মনেই কত কথা বলেন; কেহই কিন্তু সে সকল কথার উত্তর দিলেন না।
এমনই করিয়া সেই কালরাত্রির অবসান হইল। প্রাতঃকালে রমাসুন্দরী জোর করিয়া মানদা ও সুহারকে নৌকায় লইয়া গেলেন। একটু পরেই তাঁহাদের নৌকা সুবর্ণপুর ত্যাগ করিল।