পঞ্চম পরিচ্ছেদ
॥১॥
আজকাল শ্যামার দিন কাটে অবিচ্ছিন্ন একটিমাত্র চিন্তার মধ্য দিয়েই। সেটা হল অর্থ-চিন্তা। হেম রং-কলে কাজ করে কিন্তু সে সামান্য কাজ। দশ টাকা মাইনেতে ঢুকেছিল, এখন পনেরো টাকা পায়। সকাল সাতটায় খেয়ে বেরোতে হয়–ফেরে সেই সন্ধ্যা ছটায়। কারণ আটটায় হাজিরে। দেড় ক্রোশ হেঁটে যাও। –পুরো একটি ঘণ্টা সময় লাগে। তা হোক–মাইনেটা যদি আর একটু বেশি হ’ত–শ্যামার অত দুঃখ করার কিছু থাকত না। এধারে যজমানি কাজটা হেম মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছে বটে, তবে তার অবসর কৈ? সাতটায় যাকে বেরোতে হবে সে আর পুজো করে কখন? সরকার–বাড়ির নিত্যসেবাটা সারতেই হয়, তাতেও অন্তত পনেরো মিনিট সময় লাগে।
হেম অবশ্য খুব ভোরে ওঠে কিন্তু অত সকালে যজমানরা পুজোর আয়োজন ক’রে রাখবে–এটা আশা করা যায় না। খন্দ লক্ষ্মীপুজোর দিনগুলোতে হেম অফিস কামাই করে–কারণ পাঁচ-সাত বাড়ির পুজো সেদিন পাওয়া যায়। তাও দুটো বৃহস্পতিবার পর পর পেটের অসুখের অজুহাতে কামাই করা যায় না–অফিসে সন্দেহ করবে। যেদিন সংখ্যায় বেশি পুজো পাওয়া যায় সেদিনিই কামাই করে শুধু। পরেরটা বা আগেরটা–যার খুব গরজ সে আগে বলে রাখে, ভোরে উঠে যোগাড়ও ক’রে রাখে। কিন্তু সে আর ক’টা? মোট কথা চাকরি করতে গেলে যজমানির আয় খুব বেশি হয় না। আর শুধু যজমানির আয়ের ওপর নির্ভর করে চাকরি ছাড়ার কথা বলতে পারে না শ্যামা। হেমও তাতে রাজি হয় না। ন-মাসে ছ-মাসে ষষ্ঠীপুজো বছরে ছটা দিন লক্ষ্মী পুজো তার ওপর ভরসা ক’রে বসে থাকতে সে রাজি নয়। তিনপো এক সের চাল, একখানা ক’রে গামছা আর দু’আনা চার আনা দক্ষিণে! কী হয় এতে? আর মেলে কিছু কাটা ফল–তাও এখানে কেউ ফল কিনে দেবতাকে দেয় না–যা বাড়ির উঠোনে হয়–কালা পেয়ারা শসা–তাই দিয়ে কাজ সারে। সেসব ফল ছেলেমেয়েরা খেতেও চায় না। ফলগুলো আস্ত দিলেও না হয় বিক্রি করা যেত!
সরকাররা নিত্যসেবার মজুরি একটু কিছুও বাড়াতে রাজি হন না। নরেন যেদিন এই কাজটি ভরসা ক’রে শ্যামাকে এই তিন দিক চাপা ঘরটিতে এনে তুলেছিল সেদিনও যা মিলত আজও তাই মেলে। সকালে আধ সের আতপ চালের একটা নৈবেদ্য, রাত্রে খানকতক বাতাসা আর একপো দুধ। অবশ্য এই ঘরটায় থাকতে দেন–সেটাও একটা বড় লাভ। কিন্তু আধ সের চালে আজকাল এক বেলাও কুলোয় না। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তাদের পেটও বেড়েছে। তা ছাড়া কিছুই খেতে পায় না বেচারীরা, ভাত আর ভাত–দুবেলা দুটি মুঠো ভাত শুধু! সেটা কমাতে গেলে চলে না। জলখাবারের কথা কেউ চিন্তাও করে না। কোনদিন দৈবাৎ যদি কিছু মেলে সে কথা আলাদা–সেটা রীতিমত উৎসবের দিন হয়ে ওঠে ওদের কাছে। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে বটে–কিন্তু এখনও কান্তি আছে, কানু আছে–ছোট মেয়ে তরু আছে। তবু এর মধ্যে গোটাকতক মরে গেছে। কেউ হয়ে দু’এক দিনের মধ্যেই মরেছে–কেউবা মাস দুই তিন ভুগে ও ভুগিয়ে মরেছে। সে আর এক কষ্ট- এমন পয়সা নেই যে চিকিৎসা হয়। সন্তান নিজের চোখের সামনে ভোগে–বসে বসে দেখতে হয়। ভগবান তাকে যেন সব দিক দিয়েই মারতে চান। …তার কাছেই বা এতগুলো পাঠান কেন? আর পাঠানই যদি তো এমন আধমরা ক’রে পাঠাবার কী দরকার!
মঙ্গলা বলেন নেহাত মিছে নয়, ‘মহাপাপ! মহাপাপ! এসব হ’ল মহাপাপের ফল–বুঝলি বামনী? আর জন্মে কত লোককে বঞ্চিত করেছিলি, তাই এই জন্মে ভগবান এমন বেঁধে মারছেন! মুয়ে আগুন বামুনের–কোন্ চুলো থেকে কতকগুলো খারাপ ব্যামো ধরিয়ে এসে এমনি ক’রে দগ্ধাচ্ছে তোকে। আমি বাজি রেখে বলতে পারি মেয়ে, ওর গর্মির ব্যামো আছে। তাইতেই নাকি এমনি সব হয়। …দেখিস্ তোরও শরীর ঝাঁঝরা ক’রে দিয়ে যাচ্ছে–তোর কী হয় তাও দেখিস!…তাও বলি বাপু, তুই তেমনি নিঘিন্নে নিপিত্তে–আমি হলে সাত জন্মে অমন ভাতারের তির্–সীমানায় ঘেঁষতুম না।’
কথাগুলো শুনতে শুনতে রাগে দুঃখে অপমানে শ্যামার চোখে জল এসে যায়। অথচ কী বা উত্তর দেবে সে!…এ সন্দেহ তার অনেক কালের। বহু দিন আগে তার বড় জাও এই কথাটি বলে গিছলেন, ‘নিশ্চয়ই এরা কোন খারাপ ব্যামো ধরিয়েছে ভাই।’ সেদিন অবশ্য কথাটার মানে বুঝতে পারে নি–কিন্তু আজ পারে।
দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল শ্যামার–সতেরো বছরের রূপবান কিশোর স্বামীর সঙ্গে। সে মূর্খ, সে গোঁয়ার–কিন্তু তবু সেদিন বালিকা-বয়সের সমস্ত মনটুকু দিয়েই ও স্বামীকে ভালবেসেছিল–তাকে অন্তরের কামনার আসনে বসিয়েছিল। –যা নিঃশেষে দিয়েছিল তা আর নিঃশেষে ফিরিয়ে নিতে পারে নি।
অনেক সয়েছে সে। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির টাকা নির্বোধের মতো উড়িয়ে নরেন আর তার দাদা এইসব রোগ কিনেছে। সে-সময় ওদের ফেলে রেখে দিয়েছিল গুপ্তিপাড়ার এক নির্জন বাড়িতে। দিনের পর দিন উপবাসে কেটেছে–মারধোর নির্যাতন, অনেক কিছুই পেয়েছে সে স্বামীর কাছ থেকে। নরেন ঠগ, নরেন বাটপাড়, নরেন মিথ্যুক। সবই জানে শ্যামা। তবু যখন সে এসে দাঁড়ায়–তখন আজও বুকটা তার দুলে ওঠে বৈকি! যতই সে প্রতিজ্ঞা করুক মনে মনে যে কিছুতেই আর কোন সম্পর্ক রাখবে না স্বামীর সঙ্গে–কোন প্রতিজ্ঞাই টেকে না শেষ পর্যন্ত।
আজকাল নরেনও আসে কালেভদ্রে, কখনও-সখনও। পাঁচ-ছ মাস তো বটেই, এক-এক সময় আট মাস দশ মাসের ব্যবধানে আসে সে। কোথা থেকে উল্কার মতো হাজির হয়। কখনও কিছু হাতে ক’রে আসে–ব্রাক্ষণ-বিদায়ের বা দৈবাৎ-জোটা যজমানির দু-একটা জিনিস নিয়ে। কখনও একেবারেই শুধু হাতে এসে ওঠে। সেসব সময় বরং ঘর থেকে কাপড় কিনে দিতে হয় শ্যামাকে–এমনিই অবস্থায় এসে ওঠে। শতছিন্ন কাপড়, গায়ে জামা নেই, পরনে জুতো নেই–একহাঁটু ধুলো। মুখচোখ দেখে মনে হয় কত কাল কিছু পেটে পড়ে নি।
কিন্তু তবু–সে সব দিনে পূর্ব সংকল্প মতো তাকে দোরের কাছ থেকে বিদায় দিতে সে পারে না কিছুতেই। বরং খাইয়ে, পরিচর্যা ক’রে, সুস্থ ক’রে তুলতেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কোথায় থাকে সে এই দীর্ঘ সময়গুলো–কী করে–কী খায়–এসব প্রশ্ন অনাবশ্যকাবোধে কোনদিনই করে নি শ্যামা, এখনও করে না। কী উন্মত্ত উৎসবে তার দিন কাটে, কোন্ সংসর্গে সে এমন স্ত্রী, ফুলের মতো ছেলেমেয়ে ছেড়ে পথে মাঠে ঘাটে দিন কাটায়, ভেসে ভেসে বেড়ায় তা সে-ই জানে! জিজ্ঞাসা করলেও তো সত্য জবাব পাবে না–সে কথা শ্যামা ভাল ক’রেই জানে। তাই ইচ্ছা করে না ওর, অকারণে কাদা ঘাঁটবার।
তবে নরেনের লম্ফঝম্ফ আজকাল অনেক কমেছে। আগেকার সে সপ্রতিভ ভাবটাও যেন আর নেই। ছেলে বলে হেমকে সে যেন একটু সমীহই করে বরং। হয়তো হেমের কথাবার্তা শুনে তার মতিগতিও অনুমান করতে পারে অনায়াসে–চাপ বেশি সহ্য করানো যাবে না তাকে দিয়ে। অবশ্য হেম যখন থাকে না তখন মাঝে মাঝে পুরোনো অভ্যাসবশত হাঁকডাক করে এক-এক দিন—-উঁঃ! রোজগের ছেলে বলে ওকে ভয় ক’রে চলতে হবে নাকি! ভারি তো রোজগার! এখনও এই শম্মা বেরোলে ওর এক মাসের রোজগার সাত দিনে কামিয়ে আনতে পারে!… অত মেজাজের ধার ধারি না আমি, ছেলেকে তোমার বলে দিও। আমার বাড়ি, আমার সংসার–তেমন বুঝলে গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেব বাড়ি থেকে। হুঁ! রাগলে আমি বাপেরও বেটা নই!’
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কণ্ঠে আগেকার সে উগ্র সুর আর ফোটে না। শ্যামা গ্রাহ্য করে না আজকাল। কথায় কানই দেয় না। খুব অসহ্য হলে বলে, ‘থাম দিকি। মেলা ভ্যানর্ ভ্যানর্ করতে হবে না। তোমার মুরোদ এ সংসারের কারও আর জানতে বাকি নেই–টিক্টিকি আরশোলাগুলো পর্যন্ত জেনে গেছে। চুপ কর!’
‘বটে! বড্ড যে তেজ হয়েছে দেখছি। অনেক দিন পিঠে তোমার চেলাকাঠ ভাঙি নি–নয়?’
বলে–কিন্তু আশ্চর্য রকম ভাবে চুপ ক’রেও যায়। …যেমন শামুকগুলো আঘাত পেলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয় খোলের মধ্যে, কতকটা সেই রকম। ওর এই অধঃপতন (?) দেখে বরং শ্যামার এক-এক সময় বিচিত্র কারণে একটু দুঃখবোধই হয়।
.
খরচ দিন দিন বেড়েই যায়। সে অনুপাতে আয় বাড়ে না। নানারকম উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়। সরকারদের বিস্তৃত বাগানের কলাটা আমটা নারকেলটা আনজটা চুরি ক’রে বিক্রি করা–এইটেই বেশি ভরসা। কিন্তু ওরাও কড়া পাহারা রাখে। পিঁটকীর ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে–তারা তো সারদিনই চোখে চোখে রাখে। তারই মধ্যে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে সরাতে হয়। ফলে কান্তি কানু তরু–এরা বেশ সুদক্ষ চোর হয়ে উঠেছে। অনেক সময় প্রথম রাত্রে ঘুমিয়ে নিয়ে মাঝরাতে উঠে অন্ধকারেই বেরিয়ে পড়ে ওরা–সাপখোপের ভয়ও করে না। অক্ষয়বাবু আজকাল হাঁস পুষছেন, মাঝে মাঝে তারা জলে ডিম পেড়ে যায়। তরুটা বড্ড ডিম খেতে ভালবাসে–তাই সারাদিনই বলতে গেলে পুকুর–ধারে বসে থাকে সে। একটা ডিম পেলে ওদের উল্লাসের সীমা থাকে না–শ্যামা সেইটিই ভেজে বড়া করে–তার ডালনা করে দেয় ছেলেমেয়েদের, একটা ডিমে সকলকার খাওয়া হয়ে যায়। কিন্তু এ কাজটি সারতে হয় খুব গোপনে। ডিমের খোলাটা কাপড়ের মধ্যে ক’রে লুকিয়ে সকলের অগোচরে পগারে ফেলে আসতে হয় কিংবা একেবারে বড় রাস্তায়, নইলে ধরতে পেলে তার রক্ষা থাকে না। সবাই মিলে গালাগাল দিয়ে ভূত ছাড়ায় একেবারে। বিশেষ পিঁটকীর যা মুখ হয়েছে–সে বামুন বলে মানে না শাপমন্যিরও ভয় করে না। এত কাণ্ড ক’রেও সব দিন শ্যামা পেট ভরে ছেলেমেয়েদের দু’বেলা খেতে দিতে পারে না, সেইটেই বড় দুঃখ ওর। মা রাসমণি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তবু মধ্যে মধ্যে গিয়ে হাজির হয়ে দু-পাঁচ দিন ছেলেমেয়েগুলোকে খাইয়ে আনত, এখন সে পথও ঘুচেছে। কোন দিকেই আর কেউ নেই ওর।
।।২।।
এত দুঃখের মধ্যে একটি সান্ত্বনা ছিল শ্যামার–মেয়ে দুটি ভাল ঘরে পড়েছে। বড়র তো কথাই নেই। অভয়পদর মতো জামাই পাওয়া বহু ভাগ্যের কথা। হয়তো খুব সচ্ছল অবস্থা নয় কিন্তু শ্যামা এতদিনে মানুষ চিনতে শিখেছে–সচ্ছল অবস্থা আসতেও খুব দেরি হবে না ওদের। পরিশ্রমী, বুদ্ধিমান, হৃদয়বান ছেলে অভয়পদ–ওর উন্নতি অবশ্যম্ভাবী।
মেজ মেয়ে ঐন্দ্রিলার শ্বশুররা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। ধান-চাল খেত-খামার গরু-বাছুর–জাজ্বল্যমান সংসার। শ্বশুর মেয়ে দেখে পছন্দ ক’রে বলতে গেলে বিনা পয়সায় নিয়ে গেছেন। পথ চলতে চলতে পুকুর-ঘাটে ঐন্দ্রিলাকে দেখে খোঁজ করে এসেছিলেন মাধব ঘোষাল। নিজেই কথা পেড়ে সেধে নিয়ে গেছেন। অবশ্য সেধে নিয়ে যাবার মতোই মেয়ে ঐন্দ্রিলা। তার গর্ভের সর্বশ্রেষ্ঠ ফল। অমন রূপসী মেয়ে রাজারাজড়ার ঘরেও দুর্লভ। হরিনাথ দেখতে ভাল নয় তত, রংটা বিশেষ করে খুবই কালো। সেজন্য প্রথমটা ঐন্দ্রিলা রীতিমত বিদ্রোহই করেছিল। ছেলেবেলা থেকে কালো দেখতে পারত না সে, কালো মাছ খেত না, কালো হাঁড়ির ভাত খেতে চাইত না। কিন্তু কালো হোক, হরিনাথের স্বাস্থ্যটি ভাল–লম্বাচওড়া জোয়ান ছেলে। বলতে নেই, দুটিতে ভাবও হয়েছে খুব। খুব বেশি দূর তো নয়, দু’ক্রোশের মধ্যেই ঐন্দ্রিলার শ্বশুরবাড়ি। ও গাঁয়ের বহু লোক এপাড়ায় আত্মীয় বা কুটুমবাড়ি আসে, মুখে মুখে বহু কথাই ছড়ায়। অনেকে শুধু খবর শোনাবার জন্যই একেবারে অপরিচিত বাড়িতেও যেচে আলাপ করতে ঢোকেন–
‘কৈ গো বামুন দিদি,–এই বাছা এলুম, তোমার ঘর সংসার দেখতে। আমাদের আড়গোডের ফল্না ঘোষালের বেয়ান তো তুমি? বেশ, বেশ। আসব আসব করি অনেক দিন থেকেই–আবার ভাবি তোমরা কি মনে করবে! শুনেছি তুমি বাছা আবার লেখাপড়া জান, তার ওপর শহরের মেয়ে–হয়তো কথাই কইবে না। আমরা হলুম গে মুর্খ-সুখু, সেকেলে মেয়েমানুষ। তা কী বল বাছা, বসব একটু–না চলে যাব?’
‘ওমা সে কী কথা! আসুন আসুন–এই যে। অ তরু, ও মা আসনটা পেতে দে মা। শিগির। কী ভাগ্যি আমার–আপনারা দয়া ক’রে গরীবের ঘরে পায়ের ধুলো দিয়েছেন! এই যে বসুন।’
শ্যামাকে জোর ক’রেও মুখে আপ্যায়নের হাসি ফুটিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে হয়।
ভাগ্যে কাপড়খানা কালই ফুটিয়েছিল। সেলাইও করা হয়েছে। সেলাইটা আবার চোখে না পড়ে যায়–হে মা সিদ্ধেশ্বরী!
যিনি এসেছেন তিনি জাঁকিয়ে বসেন।
‘তা বাপু বেশ মিষ্টি ব্যাভার তোমার, মানতেই হবে। শুনেছি কলকাতার মেয়েরা সব মারমুখো হয়েই থাকে। তাই তো ভরসা ক’রে এতকাল ঘেঁষি নি তোমার বেয়াইবাড়ি সেদিন গিছ–তোমার মেয়েই বললে, যাবেন না কাকীমা, আমার বাপের বাড়ি। ঐ তো কাছেই যান। বলি তাই আজ–। যা হয় ক’রে মরীয়া হয়েই ঢুকে পড়লুম। এই পাশেই আমার কুটুম-বাড়ি কি না। এই চণ্ডীরা–ওদের বৌ হ’ল আবার আমার আপন পিসীমার ননদ। সেই সুবাদেই জানা-শুনো যাতায়াত। তা ছেলেমেয়ে কটি গা তোমার সবসুদ্দু?’
এইভাবে শুরু হয়, অন্তহীন আলাপ এবং পরিচয়ের এক-একটি ইতিহাস। মোটামুটি কাঠামো সবগুলোরই এক। শুধু বর্ণ-বৈচিত্র্যে বা তথ্যে হয়তো একটু- আধটু এদিক-ওদিক
এদেরই মুখে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ির খবর পায় শ্যামা।
‘শ্বশুর খুবই ভাল। তবে শাশুড়ি মাগী বাপু একটু দজ্জাল আছে। মুখে যে খুব গালমন্দ দেয় তা নয়। কেমন জান–ঐ যাকে বলে শেতল-বৌ-কাঁটাকী। আর ছেলেমেয়েগুলো সব মা’র দিকে। বড় ছেলের মোটা রোগজার বলে মুখে কিছু বলতে পারে না–কিন্তু কালোর বাড়ি সোন্দর মেয়ে গিয়ে পড়েছে তো, সবাই হিংসে করে। আর যাই বল বাপু, তোমার মেয়েটারও একটু বাড়া-বাড়ি আছে। বড্ড বেহায়া। রূপের দ্যামাকও তো আছে, তার ওপর সোয়ামীর সোহাগ–ধরাকে সরা জ্ঞান করে। অতটা কিন্তু ভাল নয়। এলে বাপু সাবধান ক’রে দিও একটু।
একই কথা বলে সবাই।
কী ক’রে এমন সাহস পেল ঐন্দ্রিলা–শ্যামা ভেবে পায় না, মনে মনে লজ্জা অনুভব করে সত্যিই।
মঙ্গলার কানেও নানা কথা আসে। আর তিনি রেখে-ঢেকে বলবারও চেষ্টা করেন না। সোজাই বলেন, ‘না বাপু বামনী, যতই বলিস এতটা ভাল নয়। হ’লই বা ভাতার-সোয়াগী–বলি আমাদেরও তো বয়স ছিল লো, সোমায়ী যে ঘরে নেয় নি তাও নয়, চিরকাল উঠেছে বসেছে আমার কথায়। তাই বলে আমরা অত ঢলাঢলি বেলেল্লাগিরি করেছি কখনও? কি ঘেন্নার কথা মা। তোর মেয়েটা পাগলী আছে–তা যা-ই বলিস।’
শ্যামার লজ্জা করে–আবার আনন্দও হয় বৈকি!
একটু যেন গর্বও অনুভব করে ঐন্দ্রিলার এই দুর্জয় সাহসে। মেয়ে- জামাইয়ের খুব ভাব হয়েছে। একটু অসাধারণ রকমেরই। জামাই যতক্ষণ বাড়ি থাকে–নাকি কেবলই মেয়ের দিকে চেয়ে থাকে। মেয়েও নানা ছুতোনাতায় যখন তখন ঘরে গিয়ে তার বরের সঙ্গে গল্প ক’রে আসে। দুজনের চোখ শুধু দুজনের দিকে। এর বাইরে কোন লোক বা কোন পৃথিবীর যেন অস্তিত্বই নেই। দিনের বেলা স্বামীর ঘরে যাওয়া বা গল্প করা–এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট নিন্দের ব্যাপার। কিন্তু তাতেও থামে নি ঐন্দ্রিলা। হরিনাথ যখন অফিস যায় তখন সংসারের যতই কাজ থাকুক–ঐন্দ্রিলা গিয়ে ছাদে ওঠে। ছাদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণটা থেকে সেই বড় রাস্তার বাঁক পর্যন্ত নাকি দেখা যায়। সেই কোণে গিয়ে আল্সেয় বুক চেপে ঝুঁকে পড়ে দেখে ঐন্দ্রিলা–যতক্ষণ হরিনাথকে বিন্দুর মতও দেখা যায় ততক্ষণ। শ্বশুর-শাশুড়ি কত গালাগালি দিয়েছেন, দেওর- ননদরা ঠাট্টা ক’রে ক’রে ক্লান্ত হয়ে গেছে–কোন কথাই গায়ে মাখে না মেয়ে। …শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বারো মাস ঐ এক অবস্থা। আবার ফেরবার সময়ও ঠিক সময় বুঝে ছাদে উঠে যায় সে। যেদিন হরিনাথের ওভারটাইম থাকে–সেদিন তো কথাই নেই। যতক্ষণ না সন্ধ্যা হয়ে অন্ধকার নেমে আসে চারিদিকে–ততক্ষণ ঐন্দ্রিলা ছাদ থেকে নামে না। নামলেও ভাল ক’রে কাজকর্ম করে না–কারুর কথা শোনে না, মুখ ভার ক’রে থাকে। রাত্রে হরিনাথ এলে তবে তার মুখে আবার হাসি ফোটে, কাজে-কর্মে উৎসাহ আসে।
‘না-না, তুইই বল বামনী, এত ঢলাঢলি কি ভাল? এ বাপু দস্তুরমত বেলল্লাগিরি। গেরস্ত-বাড়িতে এসব কাণ্ড ভাল নয়। শ্বশুর মিসে নাকি বড্ড ভালবাসে, তাই কিছু বলে না। তারই দাপটে বাড়ির আর সকলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। সে মিসে চোখ বুজলে–ত্যাখন?’
প্রায়ই বলেন মঙ্গলা।
‘ভাতার আবার ভালবাসে না কার?…তোর মতো ভাতার ধর দৈবে-সৈবে এক আধ-জনের। কিন্তু তাই বলে জগৎ সংসার সব পর ক’রে শুধু তার গলা জড়িয়ে বসে থাকতে হবে–আর শ্বশুরবাড়িকে শত্তুরপুরী ক’রে তুলতে হবে এই বা কেমন কথা। ঈশ্বর না করুন–বলতে নেই, বরেরই যদি ভালমন্দ কিছু হয়? ঐ শ্বশুরবাড়িতে কি ওকে বাস করতে হবে? লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে না? তুই একটু বুঝিয়ে বলিস বামনী। –পাড়া ঘরে যে আর কান পাতা যায় না। শাশুড়ি ননদ সহ্য করবে কেন?’
.
কথাটা ভাল লাগে না শ্যামার। শিউরে উঠে নিজেই সিদ্ধেশ্বরীর উদ্দেশে কানমলা খায় গোপনে, আর মনে মনে প্রতজ্ঞা করে যে ঐন্দ্রিলা এলে বকে দেবে খুব। কিন্তু মেয়ে আসে না বাপের বাড়ি। নিজে থেকে তো আসেই না–কখনও-সখনও শ্যামা আনতে পাঠালেও সে-ই সোজা বলে দেয় যে তার আসার সুবিধা হবে না। অপমান বোধ করে শ্যামা–কিন্তু কারণটা বুঝে অপরাধ নেয় না। আসলে জামাইকে ছেড়ে আসতে রাজী নয় সে। ষষ্ঠী বা ঐরকম কোন উপলক্ষে হরিনাথের সঙ্গে এসে তখনই চলে যায়। সে সময় কোন কথাই বলা যায় না। কেমন যেন লজ্জাও করে–এসব প্রসঙ্গ তুলতে।
একটা রাত থাকলেও না হয় পাশে শুইয়ে কথাটা পাড়ত সে। অন্ধকারে চক্ষুলজ্জা থাকে না ততটা–কিন্তু এক রাতও মেয়ে থাকতে রাজী হয় না। অনুরোধ করলে বলে, ‘না বাপু সে আমার সুবিধে হবে না। তোমার জামাইয়ের বড় অসুবিধে হয় আমি না থাকলে। একখানা ঘরে বাস তোমাদের–জামাইকে তো আর রাখতে পারবে না!’
আহত হয় শ্যামা। চোখে জল এসে যায় তার। মনে হয় শুনিয়ে দেয় ভাল ক’রেই–কিন্তু শেষ অবধি সামলে নেয় নিজেকে। ষাট্ ষাট্!
এরই মধ্যে এক দিন খবর এল ঐন্দ্রিলা সন্তান-সম্ভবা।
আন্দেরই কথা–কিন্তু খরচের কথা মনে পড়ে শ্যামার মুখ শুকিয়ে যায়। মহাশ্বেতা তাকে সাধের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল, প্রথমবার সাধ হয় নি বলে তার পরের সন্তানের বেলাতেও সে ঝঞ্ঝাটা ছিল না। কিন্তু ঐন্দ্রিলার এই প্রথম। অন্তত একটা কাপড় দিতেই হবে। আর খুব খেলো কাপড় দিলেও চলবে না।
ভেবে শ্যামার ঘুম হয় না রাত্রে।
একেবারে যে নেই তা নয়–এত দুঃখের মধ্যেও হাঁড়িকুঁড়ির মধ্যে ন্যাকড়ায় বাঁধা কটি টাকা জমেছে তার। তবে সে টাকায় হাত দিতে কিছুতেই ইচ্ছা করে না। ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত-করা অর্থ–বিশেষ উদ্দেশ্যেই সে জমাচ্ছে–এক একটি আধূলা ক’রে।
উমাকেই একটা চিঠি দেবে কাকুতি-মিনতি করে–না কৌশলে মেয়েকে দিয়ে বড় জামাইয়ের কাছে কথাটা পড়বে, এই কথাটাই রোজ ভাবে সে–কিন্তু কিছুতেই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না। উমা হয়তো সটান ‘পারব না’ বলে দেবে–কেমন এক রকমের মন হয়েছে তার। গোবিন্দও বোনপো–হেমও তাই। গোবিন্দর সংসারে টাকা গুঁজতে পারে অথচ তার বেলায় এক পয়সা বার করতে গেলেই কষ্ট!
না, বলতে গেলে জামাইকে বলাই সুবিধা।
কিন্তু —
এখনও একটা দুর্নিবার লজ্জা এসে যেন বাধা দেয়। এখনও ওটুকুকে জয় করতে পারে নি শ্যামা। …
অবশেষে এই দুশ্চিন্তা থেকে অভয়পদই অব্যাহতি দেয় ওকে। এক দিন অফিসের ফেরত এসে অতি সহজেই এখানা নতুন তাঁতের শাড়ি দাওয়ায় নামিয়ে রেখে চলে যায়। কেন, কার জন্য–কিছুই বলে না। বলার দরকারও নেই। শ্যামা বোঝে–এবং মনে মনে অভয়পদের শতবর্ষ পরমায়ু কামনা করে মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
॥১॥
ঐন্দ্রিলার সাধে মাধব ঘোষাল বেশ একটু ঘটাই করলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান হরিনাথ। তার সন্তান আসছে, তাঁর প্রথম পৌত্র বা পৌত্রী। বংশের আর এক পুরুষের সূচনা হচ্ছে। এ একটি বিশেষ ঘটনা বৈকি। তাছাড়া ঐন্দ্রিলাকে তিনি একটু বেশি স্নেহের চোখে দেখেন সে কথাটাও অস্বীকার করার উপায় নেই! তাঁর কালোর বংশ–যেদিকে তাকান নিকষ কালো গায়ের রং। তার ভেতর পদ্মফুলের মতো এই বধূটি যখন ঘোরাফেরা করে, তখন তাঁর চোখ জুড়িয়ে যায়। শুধু ও-ই সুন্দরী নয়, সম্ভবত ওর দ্বারা তাঁর এই বংশের ‘পণ’ বদলাবে, এ আশাও তিনি রাখেন মনে মনে। আবার হয়তো কোন দিন এই বাড়িতেই ফুটফুটে সব ছেলে-মেয়েরা ঘুরে বেড়াবে, সেদিকে চেয়ে চেয়ে অনাগত কালে ভাবী গৃহস্বামীদের মন তৃপ্ত হবে–এমন ক’রে তাঁর মতো প্রতিনিয়ত দৃষ্টি আহত হবে না অবিরাম কালো রঙের দিকে চোখ পড়ে!
সে অসম্ভব ঘটনাও–অন্তত আজ তাঁর কাছে এটা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়–যদি ঘটে তো সে তাঁর এই পুত্রবধূটির জন্যই ঘটবে, এই রকম একটা ধারণাও কেমন ক’রে জন্মে গেছে তাঁর। তাই নিজেরই অজ্ঞাতে তিনি ঐন্দ্রিলাকে বেশি আদর এবং প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেন কখন–তা তাঁর হুঁশ থাকে না। হুঁশ হয় একেবারে গৃহিণীর গঞ্জনায়; তিনি বলেন, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে হতচ্ছাড়া মিন্-সের। মতিচ্ছন্ন হয়েছে। …আদর দিয়ে দিয়ে ছুঁড়ীর পরকালটি খাচ্ছেন একেবারে। সোন্দর! সোন্দর বৌ যেন ভূ-ভারতে আর কারু হয় না! আর কী এমন সোন্দার তাও তো বুঝি না–থাকার মধ্যে তো আছে এক ঐ রংটা–হাঁসা মোমবাতি! ড্যাবা ড্যাবা গোরুর মত চোখ, নাকের তো কত বাহার, মাঝখান দিয়ে যেন রেলগাড়ি চলে গেছে। না গড়নের সোষ্টব, না মুখের কোন ছিরিছাঁদ। চলনটাও যদি একটু ভাল হ’ত তো বুঝতুম। মেয়ে যেন দিনরাত নেচেই আছেন! রাম রাম! সোন্দার দেখে একেবারে জ্ঞানগম্যি হারিয়ে বসল মিসে–তখনই বারণ করেছিলুম যে শুধু ঐ রং দেখে অমন ডোমের চুপড়ি ধুয়ে ঘরে তুলো না!…আমারই ভুল হয়েছিল–তখন যদি আর একটু জোর করতুম তো এমন কাণ্ডটা ঘটত না। …ভিখিরীর ঘর থেকে মেয়ে এনে আমার সব দিক গেল!’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
মাধব ঘোষাল এসব কথা কানে তোলেন না। প্রথম প্রথম ভয় হ’ত তাঁর ঐন্দ্রিলার জন্য। ঐটুকু মেয়ে–সে হয়তো কষ্ট পাবে। কিন্তু ঐন্দ্রিলাও নির্বিকার। সে যে শুধু গ্রাহ্য করে না তা নয়–মনে হয় যেন শুনতেই পায় না। এক-এক সময় খুব অসহ্য হলে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি শাশুড়ির নাকের কাছে তুলে দেখিয়ে চরম উপেক্ষা হেনে সরে যায় সেখানে থেকে। মাধব ঘোষালই বরং উপযাচক হয়ে কোন কোন দিন সান্ত্বনা দিতে যান, ‘ও মাগীর কথা গায়ে মেখো না বৌমা, ওর মুখখানা চিরদিনই অমনি কদুয্যি! আমায় সারাটা জীবন জ্বালাচ্ছে!’
‘কে কান দিচ্ছে ওদিকে বাবা। আপনিও যেমন, কুচ্ছিতরা কখনও সোন্দরকে সহ্য করতে পারে? হিংসে তো হবেই একটু। ওদের আর দোষ কি, মাসীর মুখে শুনেছি কত তা-বড় তা-বড় লেখাপড়া-জানা লোকও সহ্য করতে পারে না–তার চেয়ে সোন্দর মানুষ!’
মাধব ঘোষাল নিশ্চিন্ত হয়ে হুঁকোয় টান দিতে শুরু করেন আবার।
সুতরাং এই পুত্রবধূটির প্রথম সাধে একটু বেশি ঘটা করবেন সেইটেই স্বাভাবিক। এমনিতেই বড় গুষ্টি তাঁদের, খুব নিকট-আত্মীয়দের বললেও একশোর ওপর দাঁড়ায়। মাধব ঘোষাল হুকুম করলেন, তা ছাড়াও পাড়াঘরের সব সধবাদেরই বলা হোক। তখনকার দিনে মহিলারা কেউ একা আসতেন না, এমন কি শুধু কোলের সন্তানটিকে নিয়েও নয়। আট-দশ বছর বয়সের মধ্যে যতগুলি সন্তান থাকত সব কটিকেই নিয়ে আসতেন। ফলে লোক দাঁড়াল–ব্রাহ্মণ-সজ্জন কুটম্ব-প্রতিবেশী সব জড়িয়ে চারশোর মতো। গৃহিণী দাঁতে দাঁত ঘষলেন, অন্য ছেলেরা একরকম অসহযোগই করল–কিন্তু মাধব কোন কিছুতেই দমলেন না। পুকুরে জাল ফেলে মাছ উঠল, চাষের চাল–তরি- তরকারিও কিনতে হ’ল না–মোটা খরচের মধ্যে শুধু দই মিষ্টি, তার জন্য তিনি এমন দিনে কৃপণতা করবেনই বা কেন? তা ছাড়া হরিনাথও কিছু টাকা দিয়েছিল তাঁকে গোপনে।
দুপুরের খাওয়া–প্রথম দল বসতেই বেলা দুটো বেজে গেল। ফলে অতিথি-অভ্যাগতের পালা যখন চুকল তখন সন্ধ্যা পার হয়ে রীতিমত রাত হয়ে গেছে। সারাদিনের পর পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে ম্লান পূজা সেরে মাধব ঘোষাল এসে খেতে বসবেন–হঠাৎ তাঁর একটা কাঁপুনি দেখা দিল। প্রবল কাঁপুনি। খাওয়া আর হ’ল না–কোনমতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। প্রথমে কাঁথা চাপা দেওয়া হ’ল, তারপর লেপ–তাতেও কাঁপুনি থামে না। দু-তিন জনে চেপে ধরে রইল–তবুও তিনি কাঁপতেই থাকলেন হি-হি ক’রে।
হরিনাথ ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনল। আড়গোড়েতে ডাক্তার নেই, আদুল থেকে ডেকে আনতে হ’ল। তিনি এসে দেখে এবং সব শুনে বললেন, ‘সারাদিনের ছুটোছুটি, ঘামের পর গিয়ে পুকুরে ডুবে চান করেছেন–তাই একটু সর্দি-গর্মি মতো হয়েছে। ভয় নেই, আরাম হয়ে যাবে।’
ডাক্তার ওষুধ বাবস্থা ক’রে চলে গেলেন। সে ওষুধও আসবে তাঁরই ডাক্তারখানা থেকে। প্রথম ওষুধ পড়তে পড়তেই রাত বারোটা বাজল। সেদিন বাড়ির কারুরই আর খাওয়া হ’ল না। ঐন্দ্রিলা সারারাত মাথার পিয়রে বসে রইল। কাঁপুনির মধ্যেই মাধব বার বার বলতে লাগলেন, ‘তুমি গিয়ে শুয়ে পড় মা, এই অবস্থা–ঠায় বসে রয়েছ, বিষম ব্যথা হবে কোমরে।’
কিন্তু ঐন্দ্রিলা সে কথা কানেই তুলল না, ‘আপনি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন বাবা, আপনার ঘুম এলেই আমি উঠে যাব।’
শেষ রাত্রে কাঁপুনি থেমে প্রবল জ্বর এল।
পরের দিন হরিনাথকে ডেকে বললেন, ‘বুকটায় এমন ব্যথা করছে কেন বল্ দিকি? নিঃশ্বেস নিতে কষ্ট হচ্ছে!’
আবারও ডাক্তার এলেন। বাবুরমা ডাক্তার। বড় নাম-করা চিকিৎসক। তিনি এসে পরীক্ষা ক’রে সংক্ষেপে বললেন, ‘নিমোনিয়া। দুটো দিকেই–। আশ্চর্য! এক রাত্তিরের মধ্যে কী ক’রে এমন হ’ল।’
পুটিশ, সেঁক তাপ, মিক্সচার–কিছুরই ত্রুটি ঘটল না। কিন্তু আশা যে বিশেষ নেই, তা ডাক্তারের গম্ভীর মুখ দেখেই বোঝা গেল।
তিন দিনের দিন সন্ধ্যাবেলা মাধব ঘোষাল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন!
তাঁর বংশের সম্ভাব্য সুশ্রী শিশু–নবাগত সেই অত্যাশ্চর্য ও বহু-প্রতীক্ষিত আগন্তুককে দেখা আর তাঁর হয়ে উঠল না।
॥২॥
ঐন্দ্রিলা আঘাত পেলে খুবই। বাপের মত স্নেহময় শ্বশুর তার। বাপের চেয়েও বেশি আপন বরং। পিতৃস্নেহ যে কি জিনিস তা তারা কটি ভাই-বোন টেরই পেলে না। ছেলেবেলা থেকেই দেখছে যে সে লোকটি অত্যন্ত ভয়াবহ এবং অবাঞ্ছিত এক জীব। শ্বশুরের কাছে এসেই সে প্রথম পিতৃস্নেহের স্বাদ পেয়েছিল। এগারো বছরের ফুটফুটে মেয়েটিকে পুকুর-পাড়ে বসে থাকতে দেখে সেই যে মাধব ঘোষালের পছন্দ হয়েছিল, তিনি আর কারও কোন কথাই শোনেন নি–সমস্ত রকম বাধা ও প্রতিরোধ অগ্রাহ্য ক’রে তাঁর ‘মা’-কে তিনি ঘরে এনেছিলেন। সে প্রীতি ও সে স্নেহ কোনদিনই কমে নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েই গেছে। আজ হঠাৎ এমন অসময়ে ওর সেই প্রিয় ও নিরাপদ আশ্রয়টি মাথার ওপর থেকে সরে যেতে অনেকখানিই অসহায় বোধ হ’ল।
আর বোধ করি সেই জন্য শাশুড়ি-দেবর-ননদের কথাগুলো এখন কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারলে না। তারই সাধ উপলক্ষে এই সর্বনাশটি হ’ল–এ কথা সে অস্বীকার করে কেমন ক’রে? কথাটা যে সর্বাগ্রে তার মনেই এসেঝে। কোন্ সর্বনেশে রাক্ষস তার পেটে আসছে–ভূমিষ্ঠ হবার আগেই তার প্রধান অবলম্বন এমন ক’রে মুচিয়ে দিলে!
শাশুড়ি আজকাল প্রকাশ্যেই বলছেন, ‘ডাইনী! অত বড় সাড্ডোল মানুষটাকে শুষে খেয়ে ফেললে! কী মন্তরে যে ভুলোল তা জানি না। …ডাইনীর নিঃশ্বেসে বিষ আছে। ডাইনীর পেটে রাক্ষস এসেছে–মা’র পেট থেকেই মানুষ খেতে শুরু করলে। এ বংশে বাতি দিতে কেউ থাকবে না। দেখে নিও তোমরা!’
দেবর-ননদরা এতকাল বাপের ভয়ে কিছু বলতে পারত না, তারাও এবার প্রকাশ্যে ধিক্কার দিতে লাগল। হরিনাথ যদিও জ্যেষ্ঠ–সে একে শোকার্ত, তায় কেমন একটু অপ্রতিভও হয়ে পড়েছে; বাপের এই আকস্মিক মৃত্যুর জন্য অংশত নিজেকেও যেন দায়ী বোধ করছে সে–সুতরাং সে এসব কথার কোন প্রতিবাদ করতে বা ভাইবোনদের তিরস্কার করতে পারে না। ঐন্দ্রিলার মনের অবস্থা অনুমান ক’রে তার কষ্ট হয় খুবই–তবুও পারে না! যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে শুধু।
ঐন্দ্রিলা উত্তর দিতে পারত। তার অভ্যস্ত মুখে জবাবটা আসত ঠোঁটের কাছাকাছি–’মন্তর জানা থাকলে তো তোমাদেরও বশ করতে পারতুম মা। তাহলে আর এমন কথা শুনব কেন?’ কিন্তু কিছুই বলতে পারত না। নিরতিশয় আত্মধিক্কার এবং আত্মগ্লানি বোধ করতে করতে সে মনকে এই বলে শাসন করত যে–এ গঞ্জনা এবং লাঞ্ছনা তার প্রাপ্য। তারই কোনও পাপে এই রাক্ষস পেটে এসেছে। সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে বৈকি!
কান্না এবং পরিতাপের সময় অবশ্য বিশেষ ছিল না। ব্রাহ্মণের অশৌচ দশরাত্রেই শেষ। শ্রাদ্ধের আয়োজন আছে। কিন্তু এধারেও শুধু যে মন ভেঙেছে তাই নয়, দেহটাও যেন এলিয়ে এসেছে। তবু কোনমতে যতটা সম্ভব করে ঐন্দ্রিলা, কিন্তু এমনই অদৃষ্ট–শ্রাদ্ধটাও নির্বিঘ্নে হ’ল না। শ্রাদ্ধের পরের দিন, নিয়মভঙ্গের আগেই–তার প্রসব-বেদনা উঠল।
আবারও একটা ধিক্কার এবং গঞ্জনার ঝড় বয়ে গেল। যেন এজন্যও সে দায়ী। চুপ ক’রে দাঁতে দাঁত দিয়ে প্রসব-যন্ত্রণা সহ্য করলে সে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অসহ্য যেন এই বাক্যবাণ।
হরিনাথকে নিজে গিয়েই দাই ডেকে আনতে হ’ল। মেজ ভাই শিবুকে বলতে সে সাফ জবাব দিলে, ‘আমি পারব না! এখনও অশৌচ গেল না, আমি দাইয়ের বাড়ি যাব? যেতে হয় তুমি যাও।’
এ সময়ে আর এই সব কথা নিয়ে হাঙ্গামা করা যায় না। উদ্গত নিঃশ্বাস চেপে দৌড়য় হরিনাথ। ঐন্দ্রিলা একা পড়ে কাতরায়–গোয়ালঘরের পাশের সেই অপরিচ্ছন্ন আঁতুড়ঘরে। ঘরটা কেউ সাফ্ ক’রেও দেয় নি। স্তূপাকৃতি জঞ্জালের মধ্যে কোনমতে নিজেই একটা মাদুর পেতে শুয়ে পড়েছিল সে। ননদরা তো নয়ই, শাশুড়িও এসে উঁকি মারেন নি এর ভিতর।
দাই শশীর মা অনেক কালের লোক। এ বাড়ির হরিনাথ ছাড়া সবাইকে প্রসব করিয়েছে সে। এ অঞ্চলের ডাকসাইটে দাই, কাউকে পরোয়া করার লোক সে নয়। সে এসে বেশ চারটি কথা শুনিয়ে দিলে হরিণাথের মাকে, হ্যাঁ গা, বলি ও বাছা শিবুর মা! এ তোমাদের কেমন ধারা ব্যাপারে? শোক কার না হয়? শোকের জন্যে কি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছ তোমরা? তা তো আর কর নি। তবে? বাড়ির বড় বৌ, বংশের প্রথম সন্তান হচ্ছে–এই আঁস্থাকুড়ে! বলি ওরই বরের রোজগারে তো খাচ্ছ। এখন তো সে-ই বাড়ির কর্তা। কথাটা একটু হুঁশ ক’রে ভেবে দেখ! ছিঃ! পাড়ার লোকে শুনলে বলবে কি?’
গৃহিণী একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন। সামনেই যে মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঝালটা গিয়ে পড়ল তারই, ‘আমার না হয় শোকে-তাপে মাথার ঠিক নেই–বলি তোরাও কি সব হুঁশপব্বের মাথা খেয়ে বসে আছিস?–জানি তো রাক্কস আসছে–সপুরী একগাড় করতে–কিন্তু তাই বলে তো আর পার পাব না। আমাদের কাজ তো আমাদের করতে হবে। যা দা-দেইজী শত্তুর চারদিকে–একটি কথার ফ্যাকড়া পেলে তো আর রক্ষে নেই। উপকার করতে কেউ আসবে মা–কিন্তু চুনকালি দিতে সবাই পা বাড়িয়ে বসে আছে। …ঘরটা ঝাঁট দিয়ে দে না একটু–হাঁ ক’রে সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কি?
হরিনাথ ওরই মধ্যে এক ফাঁকে গিয়ে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে আসে, ‘দ্যাখো না…কোল-আলো করা খোকা আসছে তোমার, এক বাবা গিয়ে আর এক বাবা আসছে। ছেলে দেখলেই মা ভুলে যাবেন।
ঐন্দ্রিলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘ওগো আমি আর বাঁচব না। আর আমি বাঁচব না কিছুতেই–’
শশীর মা খন্ খন্ করে ওঠে, ‘ও মা, ওকি ছিরির কথা! বালাই ষাট্। এই তো–আর দেরি নেই বাছা একটুও–এখুনি সব ব্যথা জুড়িয়ে গেল বলে। তুমি দাদা এবার যাও দিকি এখান থেকে, আমাকে গোছ করতে দাও একটু।’
সন্ধ্যার একটু পরেই নবজাত শিশুর কান্না শোনা গেল।
শাশুড়ি ননদরা এবার সবাই ছুটে এলেন–কৌতূহলই আরও স্থির থাকতে দিল না।
‘কী হ’ল গো, ও শশীর মা?’
দালানে দাঁড়িয়ে হরিনাথ আশা-আশঙ্কায় কন্টকিতে হয়ে কান পেতে থাকে উত্তরের দিকে। অর্ধ-অচেতন ঐন্দ্রিলাও।
শশীর মা বলে, ‘খুকী গো বাছা–খুকী। পদ্মফুলের মত ফুটফুটে খুকী!’
‘আবার খুকী। পোড়া কপাল হরের। এক ফুটফুটে খুকী আমার গুষ্টিসুদ্দু, জ্বালিয়ে খেলে, আবার সেই! ডাইনীর বেটি ডাইনী, মায়ের পেট থেকে খেতে শুরু করেছে। হাড় খাবে, মাস ঘাবে, চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাবে!
শাঁখ বাজল না, হুলুধ্বনি উঠল না–আনন্দ প্রকাশও কেউ করলে না। ঐন্দ্রিলার প্রথম সন্তান হ’ল।
ক্লান্ত মুদিত দুই চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল তার। আশা তারও ছিল মনে মনে। তার ওপর হরিনাথের সান্ত্বনাটাতে বড়ই আশ্বাস পেয়েছিল সে।
সে-ই মনে মনে বলতে লাগল, ‘রাক্কুসী রাক্কুসী। আমার সুখের বাসায় আগুন লাগাতে এসেছে!’
সপ্তম পরিচ্ছেদ
॥১॥
কোথায় কোন্ মুলুকে যুদ্ধ বেধেছে–তার জন্যে এখানে কেন জিনিস-পাত্রের নর চড়বে, মহাশ্বেতা কিছুতেই তা বুঝে পায় না। যুদ্ধ বলতে কি বোঝায়, সে সম্বন্ধেও যে ওর খুব পরিষ্কার ধারণা আছে তা নয়–মারামারি কাটাকাটি–একটু বড় রকমের–এই মাত্র বোঝে। কিন্তু তার জন্যে এখানে কাপড়ের দর চড়ে যাবে, নুনের বাজারে আগুন লাগবে–তার মানে কি?
লড়াইয়ের খবর যে ওদের রোজ এনে দেয়–এ সন্ধন্ধে সেও খুব ওয়াকিবহাল নয়। মহার ছোট দেওর দুর্গাপদ ইস্কুলের পড়া শেষ ক’রে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে এসে বসেছে। বার দুই পরীক্ষাও দিয়েছিল কিন্তু সুবিধা হয় নি। ক্ষীরোদার একান্ত সাধ–তাঁর ছোট ছেলে একটা পাস করুক, তিনি পীড়াপীড়ি ক’রে রাজী করিয়াছিলেন ওকে আরও এক বার পরীক্ষায় বসতে, কিন্তু অম্বিকাপদ এক কথায় সে প্রস্তাব নাকচ ক’রে দিলে। বললে, ‘উঠন্তি মুলো পত্তনেই বোঝা যায়। ওর আর কিছু হবে না, মিছিমিছি আরও একরাশ টাকা খরচা!…তার চেয়ে দিনকতক ঘরেই বসে থাক, বাগান-টাগানগুলো দেখুক–এর ভেতরে চাকরি-বাকরির চেষ্টা দেখি একটা।’
এর পর আর ক্ষীরোদা কিছু বলতে সাহস করেন নি। সুতরাং দুর্গাপদর অখণ্ড অবসর। মাঝে অম্বিকাপদ হেঁটে কলকাতায় গিয়ে পোস্তা থেকে আলু কিনে আনার ভার দিয়েছিল ওকে, পর পর দুবার রাস্তায় পয়সা হারিয়ে ফেলতেই কথাটা বুঝে সে চেষ্টা থেকে নিবৃত্ত হ’ল। এখন দুর্গাপদ ঘণ্টা দু-তিন ক’রে পাড়াটা ঘুরে আসে আর লাফাতে লাফাতে বাড়ি ঢুকে নতুন নতুন খবর দেয়।
‘ইউরোপে বুঝলে বৌদি–দারুণ এক কাণ্ড হয়ে গেছে। এক রাজ্যের রাজপুত্তুর আর এক রাজত্বে গিয়েছিল, সেখানকার কে এক বেটা তাকে মেরে ফেলেছে। তাই নিয়ে মহা হৈ চৈ হচ্ছে। হয়তো খুব বড় লড়াই একটা বেধে যেতে পারে।’
‘কি বললে? কী দেশ? ইউরোপ? সে আবার কোথায়?’ চোখ বড় বড় ক’রে মহাশ্বেতা প্রশ্ন করে।
ইউরোপ গো, ইউরোপ জান না? কি মুশকিল! তোমরা ছাই জিওগ্রাফি পড় নি, মুখু মেয়েমানুষ–তোমাদের কি বোঝাব!
‘তুমি তো এত পণ্ডিত, এক্জামিন দিতে বসে এসব লেখাপড়া কোথায় যায়?’
মুখ টিপে হেসে প্রমীলা ফোড়ন কাটে।
দুর্গাপদ কোন দিনই মেয়েদের কথা গ্রাহ্য করে না, সে একটা ‘হুঁ!’ বলে কথাটা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে মহাশ্বেতাকে বোঝাতে বসে, ‘সে অনেক দূর বড় বৌদি–হাজার হাজার ক্রোশ দূর। সেখানে শুধু সাহেবরা থাকে, সাদা চামড়ার লোক।’
‘ও সায়েবদের দেশ! বিলেত বল! মিছিমিছি ইউরোপ-মিউরোপ অত কথা বলছ কেন!’
‘তোমরা ঐ এক বিলেতই শিখেছ। আরে বাপু সাহেব কি এক রকম আছে? ইংরেজ ফরাসি জার্মান রুশ–সবাই সাহেব। তোমরা দেখলে কি চিনতে পারবে?–তা পারবে না। যারা জানে তারা ঠিক চিনে নেয় কোন্টা কে। বিলেত হ’ল ইংরেজের দেশ। খুবই ছোট্ট একরত্তি দেশ। তাও ওটা ঠিক ইউরোপে নয়, দেশ ছাড়া–আলাদা মুল্লুক একটা।’
‘তুমি বুঝি সব দেখলেই চিনতে পারো ছোট্ ঠাকুরপো!’ প্রমীলা আবারও চিমটি কাটে।
এবার আর উত্তরও দেয় না দুর্গাপদ, চরম তাচ্ছিল্যভরে পিছন ফিরে দাঁড়ায়।
মহাশ্বেতার কিন্তু এসব দিকে লক্ষ্য থাকে না। ঝাসবা ঝাপসা ভাবে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করে। সাহেবদের আবার আলাদা জাত আছে? মাগো, সব সাহেবই তো এক রকম দেখতে, ওদের আলাদা আলাদা চেনে কেমন ক’রে–কে জানে!
অনেক দিনের কথা মনে পড়ে যায়। মহার দিদিমা ছিলেন চন্দননগরের মেয়ে, তিনি ফরাসিদের কতকটা বেশি আপন মনে করতেন। পথেঘাটে সাহেব দেখলে নাক সিঁটকে বলতেন, ‘যতই বলিস তোরা, আমাদের ফরাসিদের মত ইংরেজরা সুন্দর নয়। হুম্দো হুদো মুখ আর রূপী বাঁদরের পেছনের মতো লাল রং। না চেহারার লালিত্য আর না রঙের বাহার!’
তখন কথাটার মানে বুঝত না–এখন যেন খানিকটা, খানিকটা বুঝতে পারে। ‘সত্যি, দিদিমা অনেক জানত শুনত বাপু–যত যা-ই বল। এখনকার লেখাপড়া জানা পুরুষদের মোল খাইয়ে দিতে পারত!’ মহাশ্বেতা মনে মনে তারিফ করে।
আর এক দিন তেমনি ঝড়ের মতো ছুটে এসে দুর্গাপদ খবর দিলে, ‘ভয়ানক কাণ্ড মা। ইংরেজ আর জার্মানে লড়াই বেধে গেল। দ্যাখো না–কী কাণ্ড হল!’
‘সে আবার কি রে? এই সেদিন কী একটা বললি অষ্টিরিয়া-মষ্টিরিয়া–কত লড়াই বাধছে রে? কলি দেখছি এইবারেই চার-পে হয়ে উঠল!’
‘না!…তোমাদের দেখছি বোঝানোই মুশকিল। ওরে বাপু সেই একই লড়াই। আগে তো দুটো দেশই ঝগড়া বাধালে। লড়াইও শুরু হ’ল। এখন দু’ পক্ষই চাচ্ছে দল ভারী করতে। এ দেশ ও দলে হাচ্ছে তো ও দেশ এ দলে আসছে। এমনি আর কি! এখন শুনছি আসল লড়াইটা হচ্ছে ইংরেজদের সঙ্গে ওদের–মানে জার্মানির লোকদের। জার্মানির মতলব নাকি আগাগোড়াই এই–ইংরেজদের মুল্লুকগুলো হাতাবে। ওদের নাকি বড্ড লোভ এই বাংলাদেশের ওপর। এখানকার মাটিতে তো সোনা ফলে। আর ওদের দেশে শুনেছি কিছু পাওয়া যায় না।’
ক্ষীরোদা অবিশ্বাসের হাসি হাসেন, ‘হ্যাঁ, ইংরেজদের মুল্লুক অমনি নিলেই হ’ল! মহারাণীর রাজত্বে সূয্যি অস্ত যায় না–এদের দাপটা কী সোজা!’
‘সেই জন্যেই তো ওদের এত আক্রোশ গো। এরা কেন এত রাজত্ব ভোগ করবে?’
তার পর একটু দম নিয়ে দুর্গাপদ ওদের জ্ঞান দিতে বসে, ‘ইংরেজদের আর অত দাপট নেই। এখন নাকি জার্মানির জোরই বেশি। সবাই তাই বলছে। বলছে যে ইংরেজরা তিন মাসের মধ্যেই হেরে ভূত হয়ে যাবে। জার্মানি নাকি অনেক দিন ধরেই এই মতলব আঁটছে। একটা মজার কথা আছে শুনে এলুম–চক্কত্তি মশায় গল্প করছিলেন–মহারাণী ভিক্টোরিয়া বেঁচে থাকতেই নাকি জার্মানির রাজা এক তাস বার করেছিল, তাতে সায়েবের জায়গায় নিজের ছবি ছেপেছিল আর বিবির জায়গায় মহারাণীর…সে তো আবার মহারাণীর নাতি হয় কি না–মুখে বললে দিদিমাকে নিয়ে রসিকতা করেছি। দিদি-নাতির রসিকতা তো এমন চলেই। কিন্তু সবাই বললে আসল মতলবটা ঐতেই বুঝিয়ে দিলে!’
ক্ষীরোদা গালে হাত দিয়ে বলেন, ‘ওমা তাই নাকি! পেটে পেটে এত!…অবাক করেছে। তা মহারাণী কিছু বললেন না?’
‘কী বলবেন? হাজার হোক নাতি তো!’
‘ওমা–তা মামাতো ভায়ের সঙ্গে লড়াই করবে?’
‘হ্যাঁ রাজারাজড়াদের আবার মামাতো পিসতুতো ভাই!…নিজের ভাইকেই বড় রেয়াত করে!…নবাবরা তো শুনেছি রাজা হয়েই আগে ভাইগুলোকে কেটে ফেলত। …তার ওপর এরা তো আবার সাহেব!’
॥২॥
এসব গল্প-কথা–শুনতে মন্দ লাগে না কোন্ সুদূর মুলুকে–কাদের যেন গল্প, তার সঙ্গে ওদের জীবন-যাত্রার সম্পর্ক কি?
কিন্তু সম্পর্ক সম্বন্ধে অবহিত হতে হ’ল বৈ কি।
বিলিতি কাপড়, কেরোসিন তেল, চিনি–এমন কি নুন পর্যন্ত দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠল। দশ আনা বারো আনার কাপড়খানা দেড় টাকা দু’টাকায় পাওয়া দায়, আরও দূর গাঁ অঞ্চলে নাকি ভদ্দর ঘরের মেয়েরা গামছা পরে কাটাচ্ছে। লজ্জা নিবরাণ করতে না পেরে নাকি কোথায় একটি মেয়েছেলে গলায় দড়ি দিয়েছে। এর মানে কি?
স্বামীর কাছে প্রশ্ন করে উত্তর মেলে না। খুব বিরক্ত করলে অভয়পদ বলে, ‘ও তুমি বুঝবে না। মেলাই কাণ্ড।’
অম্বিকাপদরও তো সময়ই নেই। দিনরাত সংসারের কাজ আর হিসেব। এই নিয়েই ব্যস্ত সে। তাকে কিছু বলতে গেলেই হাত নেড়ে বলে,
‘সর সর। আবার এমন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। ওসব ঘ্যানর ঘ্যানর করার সময় নেই।
অগত্যা দুর্গাপদকেই পাকড়াও ক’রে ধরে মহাশ্বেতা।
ব্যাপারটা কি, তাকে বুঝতেই হবে।
দুর্গাপদ বিজ্ঞভাবে বোঝাতে বসে, ‘আরে, এটা আর বুঝলে না? ওসব মাল তো বিলেত থেকেই আসে। জার্মানিরা একখানা জাহাজও আসতে দিচ্ছে না। গোটা গোটা জাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছে রোজ, মাল আসছেই না, তার পাবে কি।’
ব্যাপারটা যে ঠিক বোঝে–তা নয়। তবু এক রকম সান্ত্বনা পায়। কারণ একটা আছে–সেইটেই বড় কথা।
‘তা এ পোড়ার যুদ্ধ থামবে কবে। থামলে যে বাঁচি, হাড় জুড়োয়।’
‘বল না কথাটা একবার দাদাকে। …দাদা হরির নুট মানছে যুদ্ধ এখন না থামে। আর তোমার কী এমন অসুবিধেই বা হচ্ছে? তোমার কি পরনে কাপড় নেই? না ব্যান্ননে নুন জুটছে না?’
.
সে-ও এক সমস্যা মহাশ্বেতার।
ইদানীং অস্বাভাবিক একটা কি কাণ্ড-কারখানা চলছে ওদের বাড়িতে, যার কোন মাথা-মুণ্ডু সে বোঝে না। দু’ভাইই অনেক রাত ক’রে বাড়ি ফেরে, কোথায় যায় কি করে–কোন হদিসই পাওয়া যায় না। বাড়ি ফিরেও দুজনে মেজকর্তার ঘরে দোর দিয়ে বসে কি সব করে, বাইরে থেকে আড়ি পেতে দু এক দিন টাকা গোনবার শব্দও পেয়েছে। মেজকর্তার হিসেব-নিকেশের কাজও বেড়েছে যেন আজকাল।
আবার এক-একদিন রাত-দুপুরে দু’ভাই কোথায় বেরিয়ে যায়। সঙ্গে দুর্গাকেও নিয়ে যায় তুলে। তারপর ভারী ভারী লোহার মাল গড়াতে গড়াতে বয়ে নিয়ে আসে। মোটা মোটা তারের বাণ্ডিল, কলকজা যন্ত্রপাতি–এক এক দিন এক-এক রকম। এই সব মাল–চুপিচুপি রাত-দুপুরে এসে ঘরে ওঠে, আবার দু-চার দিন পরে কারা সব এসে নিয়ে যায়। মনে হয় টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়।
ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘরেরও অভাব নেই আর। এর মধ্যে দু-দুখানা ঘর ক’রে ফেলেছে অভয়পদ। যদিও মহাশ্বেতা শোয় সেই আগেকার ভাঙা-ঘরেই। নতুন ঘর একখানা নিয়েছে অম্বিকা–আর একখানায় বুড়ী, দুর্গা আর ওর শাশুড়ি শোয়। পুরোনো ঘরগুলোতে শুধু মাল থাকে আজকাল।
ব্যাপারটা দিন-দিনই হেঁয়ালি হয়ে উঠছে মহাশ্বেতার কাছে। মনে হয় প্রমীলা জানে কিন্তু তার কাছে ভালরকম কোন জবাব পাওয়া যায় না–শুধু সে মুখ টিপে হাসে আর বলে, ‘নেকু!…কী দিয়ে ভগবান তোকে গড়েছিল দিদি, তাই ভাবি!’
অনেকদিন পরে, অনেক সাধ্য-সাধনায় প্রমীলাই ওকে কথাটা বুঝিয়ে দিলে, ‘ওলো চোরাই মাল লো চোরাই মাল। বটঠাকুর যে কোম্পানির ভাঁড়ার দেখেন, এস্টোর না কি বলে সেইখানে থাকেন। গঙ্গার ওপর বড় টিনের চালা–সেইখানে বসেন উনি একা। এদিক ওদিক দেখে বড় বড় ভারী মাল গঙ্গায় গড়িয়ে ফেলে দেন। নৌকো ঠিক করাই আছে, সন্ধ্যোর পর সেই নৌকো গিয়ে মাল তুলে নেয়। তার পর তারা এসে এই সরস্বতীর খালের মুখে মাল দিয়ে যায়। নৌকোয় আসে বলেই তো অত রাত হয়। রাত্তিরে গিয়ে মাল তুলে আনে। অনেক মাল ঐখানে ঐখানেই বিক্কিরি হয়ে হায়, যা হয় না সেইগুলোই বাড়ি আসে। আবার খদ্দের ঠিক হলে তারা রাত-দুপুরে বাড়ি এসে মাল তুলে নিয়ে যায়। যুদ্ধর বাজারে লোহা লক্কড়ের দাম তো বিস্তর বেড়েছে কিনা–চারগুণো পাঁচগুণো দাম। তাই চোরাই মালও মোটা টাকায় বিক্কিরি হয়!’
অনেকক্ষণ অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে মহাশ্বেতা। তার পর বলে, ‘ও মা, তা ধরা পড়ে না?’
‘এঁরা তো গোড়ার দিকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে থাকেন না। এস্টোরের দারোয়ান জানে–তা সে তো ভাগ খায়! ধরা পড়ে নৌকোর মাঝি-মাল্লারা জেল খাটবে। তারা মোটা টাকা মুনাফা পায়, এক-আধ মাস জেল খাটলেই বা কি? দু-একবার ধরা পড়েছেও নাকি এর মধ্যে–কিন্তু আগে থাকতেই বলা- কওয়া ছিল, এদের নাম করে নি তারা, কোথা থেকে তুলে এনেছে তাও বলে নি।’
এতক্ষণে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হয় মহাশ্বেতার কাছে। দুর্গাপদর সেদিনের ইঙ্গিতটাও বুঝতে পারে।
সেইজন্যে যতদিন যুদ্ধ চলে ততদিনই ভাল–এদের কাছে।
রাত্রে শোবার সময় মহাশ্বেতা আর কথাটা চেপে রাখতে পাখলে না। যদিচ এখনও অভয়পদ সেই আগের চলনেই রাত কাটায় তবু প্রথম রাত্রে খানিকক্ষণ ঘরে শোয় সে, ছেলেমেয়েদের আদর করে এই সময়টা। দু-একটা কি হিসেব-নিকেশও করে প্রদীপের আলোতে বসে। এই সময় একটু যা দেখাশুনো হয় তার সঙ্গে। আজ ঘরে আসতেই মহাশ্বেতা কথাটা বলে ফেললে, ‘তোমরা চোরাই মালের কারবার কর! তোমরা চোর? ছি!’
এই প্রথম অভয়পদর মুখের প্রশান্তি যেন একটু নষ্ট হয়। ভ্রূ কুঁচকে সে বলে, ‘কে–বললে কে তোমায়? তুমি এসব কথায় থাক কেন? কী বোঝ তুমি সংসারের?
‘যে-ই বলুক। কথাটা তো সত্যি। আর সংসার বুঝি না বুঝি চুরি করা যে দোষ সেটা বুঝি।’
‘সে আমিও জানি। কিন্তু এক্ষেত্রে দোষ নেই। তিনটে সায়েবের কাজ আমি একা করি, মাইনে পাই সিকির সিকি! আরও কম বরং। একেবারে গোমুখু সায়েবও একটা পায় তিন শো টাকা, আমি পাই তেত্রিশ টাকা। তাও এ্যাদ্দিনে। আমার সংসারটা চলে কিসে?’
মহাশ্বেতা খানিকটা চুপ ক’রে থাকে। এই যুক্তিগুলোর যেন জবাব খুঁজতে থাকে সে মনের মধ্যে। শেষের কিছুই না পেয়ে বলে, ‘তা হোক বাপু, কাজটা ভাল না। শেষে কোন রকমে লোক জানাজানি হয়ে গেলে সে একটা ঢিঢিক্কার!
অভয়পদ এ কথার উত্তর দেয় না। খাতাপত্র কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
এত পয়সা কার জন্যে তাও তো বোঝে না মহাশ্বেতা। নিজে তো বাবু বিছানাও ছেড়ে দিয়েছেন আজকাল। খালি একটা কাঠের বেঞ্চিতে একটা কাঠের পিঁড়ি মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকেন!
ভোগই যদি না করলে তো এমন অধর্মের পয়সা কামিয়ে লাভ কি?
নিবন্ত দীপশিখার কম্পিত মৃদু আলো ধীরে ধীরে ঝাপ্প্সা হয়ে আসে, কিন্তু মহাশ্বেতার চোখে ঘুম নামে না।
কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভোগ করতে থাকে সে।
।।৩।।
যুদ্ধের খবর পুরোপুরি শ্যামাও রাখে না। কিন্তু ওর প্রত্যক্ষ ফল যেটা, সেটার খবর তার কানে পৌঁছয় ঠিকই। পয়সা নাকি বাতাসে উড়ছে, ধরে নিতে পারলেই হ’ল। ধরে নিচ্ছেও অনেকে, তা তো সে চোখেই দেখছে। তার মধ্যে বড় জামাইও একজন। কথাটা বুঝতে মহাশ্বেতার যত সময় লেগেছে ততটা হেমের লাগে নি–এবং হেমের মুখ থেকে শ্যামার কানে উঠতেও দেরি হয় নি। মেয়ে-জামাইয়ের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে হোক, তাতে শ্যামা আনন্দিতই–যদিচ বোকা অভয়পদ নাকি সব টাকাই, মায় এই চুরির টাকাও, মেজ ভাইয়ের হাতে ধরে দেয়, মেয়ের কথাবার্তা থেকে এই কথাটা শোনা পর্যন্ত শ্যামার মনে স্বস্তি নেই, যত জেরা করেছে মেয়েকে তত সেই সন্দেহটাই দৃঢ় হয়েছে।
কিন্তু উপায়ই বা কি? মেয়েটা যা আকাট বোকা, ওর দ্বারা একটি পয়সাও আদায় হবে না, তা শ্যামা বিলক্ষণ জানে। মেয়েকে ‘বোকা’ মুখু’ নেকী বলে গালাগাল দিয়ে মনের ঝাল মেটাবার চেষ্টা করে শুধু। উপদেশও দেয় মাঝে মাঝে, ‘রোজ একটা ক’রে পয়সা চেয়ে নিলে তোর মাসে আট আনা জমে যায়, বছরে ছ টাকা! টাকায় দু’ পয়সা ক’রে সুদ সব জায়গায়, দুটো টাকা খাটালেও মাসে এক আনা ক’রে হাতে আসে! বছরে বারো আনা। তুই এমন বোকা যে তাও আদায় করতে পারিস না! আর দেবে নাই বা কেন? জোরের সঙ্গে চাইবি। স্বামীর টাকা পরিবার চাইবে-এর মধ্যে আবার লজ্জাই বা কি ভয়ই বা কি? ওদিকে দেখ্ গে যা, তোর জা টাকার বাণ্ডিল সরাচ্ছে। সে তো তোর মতো বোকা নয়। সে তোর শ্বশুরের গুষ্টির সব কটাকে এক হাটে বেচে আর এক হাটে কিনে আনতে পারে! ঐ হবে আর কি, দিন থাকতে দিন কিনে নিচ্ছ না, এর পর ঐ জায়ের বাঁদীগিরি করতে হবে বলে দিলুম!…আমার পেটের মেয়ে তুই–এত বোকা!
মহা মাথা নিচু ক’রে থাকে, নয়তো অন্যদিকে তাকায় আর মুচকি মুচকি হাসে অপ্রতিভের মতো। বড় জোর বলে, ‘কী জানি বাপু, সে আবার যা মানুষ, চাইতে ভয় হয়। হয়তো এক বিপরীত কাণ্ড ক’রে বসবে। যে লোকের সঙ্গে ঘর করতে হয়–চেন না তো তাকে! আমাকে কোন কথা বলে নাকি? না আমি কিছু টের পাই? যা কিছু পরামর্শ এ মেজর সঙ্গে–দুটি ভাই-ই সমান, মনকলা খায় শুধু ভেতরে ভেতরে ওরা।
‘যা, যা!’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয় শ্যামা, ‘সে শুধু তোরই কাছে। তোর জার কাছে মনকলা খেয়ে পার পায় কি? সে দ্যাখ্ নাড়ী-নক্ষত্র জেনে বসে আছে। তোকে বলবে কি কথা–তুই কি মানুষ একটা! যা বলবে সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সারা গাঁয়ে ঢাক পিটিয়ে বেড়াবি!’
যতই বলুক আর যা-ই করুক, ও চুরির পয়সা মেয়ের বাক্সে একটিও উঠবে না–তা শ্যামা বিলক্ষণ বোঝে। বোঝে বলেই জামাইয়ের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ও অসন্তোষ জমে ওঠে মনের মধ্যে। সে অসন্তোষ মেয়ের দোতলায় ঘর ওঠবার সংবাদেও যেমন যায় না–মেয়ের গায়ে নতুন সাত ভরির তাগা আর পাঁচ ভরির কেবল হার উঠতে দেখেও যায় না। কারণ প্রশ্ন করার আগেই মহাশ্বেতা খুশী হয়ে খবরটা দেয়, ‘তা ওদের বাপু নেয্য বিচার, কোন অর্থদর্শ নেই, আমারও যত ভরির জিনিস হয়েছে, মেজ বৌয়েরও ঠিক তত ভরির। এক চুল ইদিক উদিক নেই। এক প্যাটেন–এক সব। বরং আমার হারটার দেড় পাই বেশি ওজন আছে। ওজনে বেশি বেরোতে মেজ বললে, তবে হারটা বৌদি নিক, হাজার হোক মান্যে বড়!’
‘নে বাপু, চুপ কর্।’ শ্যামা বিরস মুখে ধমক দিয়ে ওঠে, ‘তোর ঐসব ন্যাকাপনা কথা শুনলে আমার গা জ্বালা ক’রে ওঠে। অত বোকামি আমি সইতে পারি নে। অর্শদর্শ নেই। কেন অর্শদর্শ থাকবে? …বলি টাকাটা কি তোর দেওর বাড়তি রোজগার করে? সে তো থাকে কলকাতার আপিসে বসে, চুরিটা তো হয় গঙ্গার ধারের গুদোমে। ওর মধ্যে তো মেজ কর্তার এক পয়সাও পাওয়া হয় না।
তার বৌ পাবে কেন?…তুই যেমন নেকী। পড়ত আমার পাল্লায় তো সমান ওজনের গয়না গড়ানো বার ক’রে দিতুম। …তুই ঝগড়া করতে পারিস না?…কেন পাবে মেজ বৌ, কেন পাবে ও–তাই শুনি?’
‘ওমা তাই কি বলা যায় নাকি? একত্তরে রয়েছি।’ কেমন একটা অপ্রস্তুত ভাবে বলে মহাশ্বেতা। একটুখানি চুপ ক’রে থেকে কুণ্ঠিত স্বরে আবার বলে, ‘তাই তো শুনেছি মেজ দ্যাওর আমাদের এঁর চেয়ে মাইনে বেশি পায়। …তার ওপর আমার সংসার বড়–ওর তো এখনও ছেলে-পিলেই হ’ল না। আমার তো ষেটের তিনটি–এরই মধ্যে। খরচ তো আমারই বেশি।’
কুণ্ঠিত ভাবের মধ্যেই সামান্য একটু গর্বের সঙ্গে তাকায় মায়ের দিকে 1 খুব জ্ঞান ও বুদ্ধির কথা, হিসেবের কথা মা’র সামনে বলতে পেরেছে–গর্বটা যেন এই জন্যেই।
অসহিষ্ণু ভাবে শ্যামা জবাব দেয়, ‘তুই থাম বাবা। তোর কথা শুনলে হাসব কি কাঁদব তাই ভেবে পাই না। …ক টাকা মাইনে বেশি পায় তাই শুনি? আমি হেমের কাছে সব শুনেছি। বড় জামাই পান তেত্তিরিশ, মেজকত্তা পায় চল্লিশ। …কী এমন তফাতটা? ওদিকে যে বাড়তি মোট মোট টাকা আনছে জামাই? তার হিসেবটা দেখছিস? জানিস কত টাকা রোজগার হয় এক-এক দিনে? আমি হেমের মুখে সব শুনেছি। এক বাণ্ডিল তারের দামই ছিয়ানব্বুই টাকা!’
চোখ বড় বড় ক’রে তাকিয়ে থাকে মহাশ্বেতা। জবাব দিতে পারে না।
.
কিন্তু শুধু মেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে এইটেই একমাত্র অভিযোগ নয়। মনে মনে আরও একটা অভিযোগ শ্যামার আছে জামাই সম্বন্ধে।
হেমকে অভয়পদই চাকরি ক’রে দিয়েছে, আর এমনই চাকরি যে এক পয়সা বাড়তি আয় হবার সম্ভাবনা নেই সেখান থেকে। রং কলের চাকরি। এক টিন রং পাচার করতে পারে বড় জোর–কিন্তু তার কীই বা দাম? অথচ ঝুঁকিও কম নয়। হেমকে সে ইঙ্গিতও দিয়েছে দেখেছে শ্যামা–কিন্তু কোন সুবিধা হয় নি। একেবারে নিরাশ ক’রে দিয়েছে হেম, ‘বাব্বা, চারদিকে সাতশো লোক। সবাই ঐ তাল খুঁজছে! আমি কী এমন মাতব্বর চারে বল? চুরি কি আর হচ্ছে না, দেদার চুরি হচ্ছে ঠিকই–তবে সে সব উঁচু মাইনের বাবুরা, সায়েবরা করছে। আমাদের কোন সুবিধা নেই।’
মা’র অসন্তোষ ও অসষ্ণুিতাতে এক-এক দিন হেসে ফেলত হেম, বলত, ‘মা তুমি কি মনে করে যে লোহার কারখানাতে ঢুকলেই আমার দেদার রোজগার হ’ত? ঐ বড় জামাইবাবুর অফিসেই কি সবাই অমনি রোজগার করছে? ওটা বরাত, নইলে এত লোক থাকতে ঐ তেত্রিশ টাকা মাইনের লোককেই বা সাহেবরা অত বড় স্টোরের ভার দেবে কেন? আর ঐ নির্জন গঙ্গার ওপর জায়গায়? স্টোরও তো ঢের আছে!’
এসব কথা বোঝে না শ্যামা, বিশ্বাসও করে না। অদৃষ্টকে দোষ সে-ও দেয় অবশ্য, কিন্তু আসলে সে এর জন্য দায়ী করে ওদের দুজনকেই। কতকটা হেমের অকর্মণ্যতা, তার চেয়েও বেশি অভয়পদর আক্রোশ! সে চায় না যে হেম তার ভাইয়ের চেয়ে বেশি রোজগার করুক। নইলে এর চেয়ে ভাল চাকরি কি একটা যোগাড় ক’রে দিতে পারত না?
অস্ফুট কণ্ঠে আপন মনেই গজ গজ করে এক-এক দিন, ‘আড়ি আকোচ–আড়ি আকোচ! আসল কথা–করবেনা কিছু। ভিখিরী ভিখিরীর মতো থাক-অত কেন? আমি কি আর বুঝি নে মনের ভাব! সবাই বলে জামাই ভাল, জামাই ভাল। মিট্মিটে ডান। …নিজেরা মড়-মড় টাকা রোজগার করছেন, আমার বেলায় এমন এক চাকরি–যে একটা পয়সা বাড়তি আমদানি নেই!…ভগবানও তেমনি একচোকো। যাকে দেবে, ঢেলে দেবে একেবারে–যাকে দেবে না তাকে কিছুই দেবে না। …সকলকারই দিন ফেরে, আমার দিন ফেরবার নাম নেই!’
।।৪।।
হঠাৎ একটা সুযোগ কিন্তু এসে যায়।
অক্ষয়বাবু যুদ্ধ বেধে পর্যন্ত মেতে উঠেছেন লড়াই নিয়ে। আগে একখানা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ নিতেন, এখন দৈনিক কাগজ নিচ্ছেন। অসিফ থেকে ফিরে এলে রোজ বৈঠক বসে তাঁর দাওয়ায়। গ্রামসুদ্ধ লোক আসে, আলোচনা চলে অনেক রাত পর্যন্ত। সে হল্লায় শ্যামা বিরক্তই হয়। লড়াইয়ের খবরে তার কোন কৌতূহল নেই। এদের এই অতিরিক্ত কৌতূহলের কোন কারণ তাই সে বুঝতে পারে না। ‘কোথায় লড়াই বেধেছে তার ঠিক নেই, তোদের তা নিয়ে এত মাথা ঘামানো কেন? বলে এক গাঁয়ে ঢেকি পড়ে আর গাঁয়ে মাথাব্যথ্যা। …কোথায় কোন্ মুলুকে জার্মানিরা কী করছে, তাই নিয়ে তোরা গেলি যেন! আসল কথা যাহোক একটা কিছু নিয়ে খানিক চকড়বা করা চাই। উত্তম ওষুধ জুটেছে এখন!
অক্ষয়বাবু বাড়ির মধ্যেও জ্ঞান দেন মধ্যে মধ্যে, তামাক খেতে খেতে বলেন, ‘জান গিন্নী, ইংরেজ রাজত্ব আর থাকবে না। জার্মানেরা নিয়ে নেবে সব। আমাদের বাবুরা তো ইরি মধ্যে জার্মানি পড়তে লেগে গেছেন।
মঙ্গলা গালে হাত দিয়ে বলেন, ‘ওমা সে কি কথা গো! এমন কথা বলো না–ইংরেজদের হারিয়ে দেবে অমনি এক কথায়? বলে এত বড় মোগল পাঠান যা পারলে না জার্মানেরা তাই পারবে!’
‘রেখে দাও তোমার মোগল পাঠান। সে সব ঢাল-তলোয়ারের রাজত্ব আর নেই। এখন কামান-বন্ধুক, জেপেলিন, মাইন, বোমা। জার্মানেরা জেপেলিন বার করেছে, এই গেরামের মতো একটা জাহাজ বাতাসে ওড়ে। …আর হাউইজার না কি কামান–তার গোলা গিয়ে পড়ে দশ-বারো ক্রোশ দূরে!’
অবিশ্বাসের হাসি হেসে মঙ্গলা জবাব দেন, ‘কার গাঁজায় দোক্তা কম হয়েছে? দশ ক্রোশ দূরে কামানের গোলা গিয়ে পড়ছে আর গেরাম উড়ছে বাতাসে! রেখে বসো দিকি!’
অক্ষয়বাবু চটে ওঠেন, ‘তুমি কামানের কি বোঝ? কামান দেখেছ চোখে যে ফট্ ক’রে একটা কথা বলে বসলে? আর জেপেলিন আকাশে উঠছে কি না–এই ছবিতে দ্যাখো, এই, এই!’
খবরের কাগজখানা মেলে ধরেন অক্ষয়বাবু মঙ্গলার চোখের সামনে।
এবার মঙ্গলা বিশ্বাস করেন। বলেন, ‘ওমা কী হবে! তা হলে তো ইংরেজরা পারবে না! বলি সত্যি সত্যিই জার্মান আসবে নাকি? …আমাদের ছেলেদের ইংরিজি ছেড়ে আবার জার্মানি শিখতে হবে? তা হ্যাঁগা, কদ্দিনে আসবে ওরা?’
তার পরই হঠাৎ গলাটা খাটো ক’রে আবার প্রশ্ন করেন, ‘তাই বুঝি তুমি কোম্পানির কাগজগুলো সব বেচে দিয়ে নগদ ক’রে নিলে!
‘চুপ চুপ!’ চাপা ধমক দিয়ে ওঠেন অক্ষয়বাবু, ‘মাগী আমার সব্বনাশ না ক’রে ছাড়বে না দেখছি, বাড়িতে ডাকাত না পড়ালে আর চলছে না!
কিন্তু এসবে প্রায়ই কান দেয় না শ্যামা। কান দেবার তার অবসরও নেই। দুঃখের ধান্দায় যাকে ঘুরে বেড়াতে হয় তার অত বাজে খবর নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে চলে না। ইংরেজই থাক আর জার্মানিই আসুক–তার দুঃখু ঘুচবে না!
এর মধ্যে একদিন একটা কথা কানে আসে। শ্যামা আর হেম দুজনেই চমকে ওঠে সে কথা শুনে।
অক্ষয়বাবু কাকে বোঝাচ্ছেন, ‘বলি শুধু কাপড়ের কথা তুলছ কেন? কোন জিনিসটা এদেশে হয় বল। ছিষ্টি তো সেই জাহাজ ভর্তি হয়ে আসত, তবে আমাদের দিন চলত। …অত কথা কী বলব, শিশি-বোতলগুলোর কি দাম হয়েছে! একটা ছোট শিশুি, তাই তিন-চার আনায় বিকুচ্ছে! পুরোনো শিশি যোগাড় করে না নিয়ে গেলে ডাক্তারখানায় ওষুধ মেলে না আজকাল। যদি বা দেয়, এক শিশি মিকচারের দামের সঙ্গে শিশির দাম ধরে নেয় চার আনা।’
শ্যামা উত্তেজনায় বিবর্ণ হয়ে উঠেছে শুনতে শুনতে।
কিছুদিন আগেই ওর ফোড়ন আর মশলা রাখবার ভাঁড় ভেঙে গিয়েছিল, শ্যামা বলেছিল খাবারের দোকান থেকে কটা ভাঁড় চেয়ে আনতে। হেম তার বদলে অফিস থেকে দু-তিনটে শিশি এনে দিয়েছিল। ওদের অফিসে নানান জিনিস আসে–ছোট বড় মাঝারি শিশি ক’রে। সে সব শিশি এক পাশে জড়ো হয়, যার যা দরকার নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ফেলে দেওয়া হয় ঝেঁটিয়ে, শিশিগুলো দেবার সময় এই ইতিহাসটুকুও বলেছিল হেম।
এমনিই যদি রোজ কটা ক’রে শিশি আনতে পারে তা হলেও তো হয়! রোজ দুটো ক’রে আনলেও অন্তত চার আনা পয়সা। মাসে সাড়ে সাত আট টাকা!
লোভে, আশায় শ্যামার চোখ জ্বলতে থাকে।
চাপা গলায় সে ছেলেকে তিরস্কার করে, ‘তুই বেটাছেলে হাটে বাজারে ঘুরে বেড়াস–তা কি একটা খবরও কান দিয়ে শুনিস না? অ্যাদ্দিন রোজ একটা ক’রে শিশি জমলেও কতগুলো জমে যেত বল্ দিকি? মেয়েমানুষেরও অধম তোরা!’
হেম বিরক্ত হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ দুটো পূজো সেরে সাড়ে ছটায় অফিস যাই, সন্ধ্যে সাতটায় ফিরি–কত সময় আমার। আমি এখন যাই বাজারে বাজারে ঘুরে কোন্ জিনিসের কী দর বাড়ল তাই খবর নিতে!
তখনকার মতো মাকে থামিয়ে দিলেও হেম শেষ অবধি রাত্রে বাড়ি ফিরল দুই পকেটে দুটো শিশি নিয়ে। অ্যাসিডের শিশি, ছোট ছোট। তা হোক, শ্যামা সেগুলো সযত্নে সাজিয়ে রাখে। তক্তপোশের নিচে। সস্নেহে তাদের গায়ে হাত বুলোয়। এখন আর ওগুলো সমান্য কাঁচের শিশি নয় তার কাছে–মণিমুক্তার মতই মূল্যবান।
সেদিন থেকে প্রায়ই নিয়ে আসে হেম–একটা দুটো ক’রে। কোন কোন দিন তিন-চারটেও আনে। কিন্তু সে অবাক হয় মায়ের ভাবগতিক দেখে। জমিয়েই যাচ্ছে শিশিগুলো, কৈ বেচবার তো কোন লক্ষণ নেই!
একদিন মুখ ফুটে, প্রশ্নও করে, ‘কাল তো ছুটি আছে বাজারে গিয়ে দেখব কত দর ওঠে?’
‘ক্ষেপেছ তুমি! এইখানে বেচতে যাও আর চারদিকে ঢিঢিক্কার পড়ে যাক। যা শত্রুপুরীতে বাস। ও এখন জমুক। এক পুঁটুলি হলে কলকাতায় গিয়ে বেচে আসব আমি নিজে। তাতে দামও বেশি পাব। তুমি যা হাঁদা ছেলে, আধাকড়িতেই হয়তো বেচে দিয়ে বসে থাকবে, ভাববে খুব লাভ করেছ!’
সত্যি-সত্যিই শ্যামা একদিন এক পুঁটুলি শিশি নিয়ে কলকাতায় এল। নতুন বাজারের ধারে সার সার যে সব পুরনো শিশিবোতলের দোকান সেইখানে ঘুরে দরদস্তুর ক’রে বেচে পয়সা গুছিয়ে আঁচলে বাঁধলে–মোট এক টাকা চৌদ্দ আনা!
তার পর কমলাদের ওখানে গিয়ে উঠল 1
কমলা জিজ্ঞাসা করলে, ‘কি রে, হঠাৎ?’
‘না। এমনিই। অনেকদিন তোমাদের দেখি নি, তাই।’
অষ্টম পরিচ্ছেদ
॥১॥
একটু একটু ক’রে সাহস বাড়ে হেমের। আজকাল সে একটা ছোট ঝাড়ন নিয়ে অফিসে যায়, আসবার সময় পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে আসে শিশি-বোতল। সেখান থেকে বার করা অসুবিধা নয়, এখানে আনাই অসুবিধা। কে দেখবে, কী ভাববে! তবু আসবার পথে ওল কি কচুর শাক কি কালকাসুন্দা তুলে পুঁটুলির ওপরের দিকে বেঁধে নেয়–যাতে বোতলগুলো ঢাকা পড়ে থাকে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা এ তো কথাতেই আছে, শাক দিয়ে বোতল ঢাকতে দোষ কি! আপন মনেই হাসে হেম এক এক দিন। তাও সাধ্যমত দিনের আলোয় পাড়ায় ঢোকে না–বেশ একটু অন্ধকার হলেই আসে।
কিন্তু তাতেও মুশকিলের শেষ হয় না শ্যামার
ঘর তো ঐ একখানা। তক্তপোশের নিচে ছাড়া কোন জিনিস রাখবার জায়গা নেই। অথচ পিঁটকীর ছেলেমেয়েরা হরদমই আসছে এ ঘরে। ওর কপালে যে হয়েছে সবই বিপরীত। বিয়ে হলে মেয়েছেলে শ্বশুরঘর করবে–এই তো সবাই জানে। কপাল পোড়ে সে আলাদা কথা–এর বর আছে, আসে যায়, ভাব-সাবেরও কমতি নেই। অথচ বারো মাসই পড়ে আছেন বাপের বাড়ি। কি না–তাদের অবস্থা ভাল নয়, খাওয়া-দাওয়া ভাল নয়। মুখে আগুন অমন নোলার আর অমন পিরবিত্তির। এ শুধু শ্যামারই কপাল! এক আধটা হলে ঢেকে রাখা যায়, কিন্তু একপুঁটুলি বোতল-শিশি ঢাকা সোজা কথা নয়। অথচ একপুঁটুলি না হলে কলকাতায় যাওয়ার মজুরি পোষায় না। শিশি- বোতল এখানে কিনবে কে? মৌড়ীর খটিতে নাকি দোকান হয়েছে–কিন্তু সে- ও তো বহুদূর। তার চেয়ে সোজাসুজি কলকাতাতে যাওয়াই ভাল। দর হু-হুঁ ক’রে বাড়ছে সেখানে। একটু ভারী পুঁটুলি বয়ে নিয়ে যেতে পারলে তিন টাকা সাড়ে তিন টাকাও হয়। তা নইলে চলেই বা কেমন ক’রে। বারো আনা দামের রেলির বাড়ির ধুতিটা আড়াই টাকা হয়ে গেছে। তাও দুষ্প্রাপ্য।
শ্যাম্যা নিত্য নুতন জায়গা উদ্ভাবন করে সেগুলো লুকোবার। ছোট ছোট পুঁটুলি বেঁধে রেখে দেয়। দিনের বেলা বিছাবার কাঁথাগুলো একপাশে গোটানো থাকে–তার আড়ালে রাখা চলে, কিন্তু রাত্রে সে আশ্রয় থাকে না। অথচ ওদের আসবার সময়-অসময় নেই। আর তার ছেলেমেয়েগুলো হয়েছে তেমনি-দিনরাত ঐ পিঁটকীর ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গেই খেলা! মঙ্গলার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তারা বড় জোর হেমের সঙ্গে গল্প করে, বাইরে বাইরেই সেটা চলে। এরা শুধু ঘরে নন, সটান দুম্ ক’রে তক্তপোশের ওপরই উঠে পড়ে–হুঁড়যুদ্ধ তো লেগেই আছে। কোন্ দিন না ঐ বোতলগুলোর ঘাড়ে পড়ে সব ভাঙে! ভাঙুক, সেটা অত ভয়ঙ্কর ক্ষতি নয়, কিন্তু যা ঢিঢিক্কার হবে তারপর এই নিয়ে–ভাবতেই শ্যামা শিউরে ওঠে।
দাঁতে দাঁত চেপে গালাগাল দেয় ছেলেমেয়েদের, ‘মুখে আগুন নাথখোরের ঝাড়! এমন নইলে এ দুগ্গতি হয়! আমার পেটেই বা আসবে কেন? লজ্জা–ঘেন্না হায়া-পিত্তি কিছু নেই! হরদম মার খাচ্ছেন, অপমান হচ্ছেন–কথায় কথায় তো ওরা দিয়ে যাচ্ছে দুমদাম বসিয়ে,–তবু কি লজ্জা আছে? ওদেরই সঙ্গে যত খেলা। আর ওরাও তেমনি–ছেলেমেয়ে তো নয়–দস্যি এক-একটি, গিলছে কুটছে আর ডাকাত তৈরি হচ্ছে!’
শুধু কি তাই!
ভয় ওর নিজের ছেলেমেয়েদেরও কম নয়! যা বোকা, ওরাই হয়তো গল্প ক’রে কোন্ দিন বলে ফেলবে। মঙ্গলার স্বভাব–নিজের কোটে পেলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করা–কী রান্না হ’ল, কী দিয়ে খেলি, কী করলি সারাদিন, মা কোথায় যায়, কি করে–এই সব নানা প্ৰশ্ন।
সে অবশ্য নিত্য একবার ক’রে আড়ালে ধমক দেয় কান্তি-তরু–কানুকে, রোজ সতর্ক ক’রে দেয়, তবু দুশ্চিন্তা থেকেই যায় একটা।
অবশ্য সমস্যা যতই হোক্–শ্যামা অসাধ্য সাধনই করে। একটি একটি ক’রে দশ মাস কেটে যায়–ওর রহস্য প্রকাশ পায় না তখনও। কেবল ওর নিজেরই বুদ্ধির দোষে কথাটা উমাদের কাছে জানিয়ে ফেলেছিল। লাভ হয় নি কিছুই–শুধু শুধু জানাজানি হয়ে ওদের কাছে একটু খাকতাই হতে হ’ল।
কার কাছে যেন শুনেছিল শ্যামা, দোকানে নিজেরা নিয়ে গেলে বড় ঠকায়, তার চেয়ে ঘরে রেখে ফিরিওয়ালাদের কাছে দরদস্তুর ক’রে বেচতে পারলে অনেক বেশি দাম পাওয়া যায়। তাই একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে কথাটা দিদির কাছে পাড়তে গিয়েছিল। এই উপকারটুকু ওরা করতে পারবে না? কোথাও যেতে হবে না–হ্যাঁটে নয় বাজারে নয়, বাড়ির দোরে শিশিবোতলওলা ডেকে দর ক’রে বেচা–এ আর এমন কঠিন কাজ কি?
কমলা হয়তো এক কথাতেই রাজী হয়ে যেত, কিন্তু ঊমা একেবারে বেঁকে দাঁড়াল, ‘ছি! ও তো চোরাই কারবার ছোড়দি। কথাটা তুমি মুখে আনলে কি ক’রে! ছোটখাটো ফল-পাকুড় চুরি করতে করতে তোমার গা-সওয়া হয়ে গেছে, তাই আর এর অপমানটা দেখতে পাও না, কিন্তু আমরা ভদ্রলোকের ঘরের মেয়েছেলে হয়ে চোরাই মাল বেচব–এ কথা তুমি মুখে আনলে কি ক’রে? গোবিন্দ কী শিক্ষা পাবে বল তো? বৌমাই বা কি ভাববেন?…তাছাড়া আমরাও একজনদের বাড়ির মধ্যে বাস করি–তারা কি বলবে! তোমার না হয় লাভ হবে, তোমার সবই সইবে–আমাদের লাভের মধ্যে তো চোর বদনাম! ও আমরা পারব না!’
মাথা হেঁট ক’রে চলে আসতে হয়েছিল শ্যামাকে। নিজের বোনকে জেনেশুনেও কেন যে কথাটা পাড়তে গিয়েছিল! নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেরই গালে মুখে চড়াতে ইচ্ছা করে।
.
হঠাৎ পর পর দু-তিনটে দিন হেম এল শুধু হাতে।
শ্যামা প্রশ্ন করলে, ‘কি রে, কি ব্যাপার!’
হেম উত্তর দিলে না প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন সংক্ষেপে শুধু বললে, ‘একটু অসুবিধে হচ্ছে।
তৃতীয় দিনেও ঐভাবে আসতে দেখে শ্যামা চেপে-চুপে ধরল, ‘আজও আনতে পারলি না কিছু? কি ব্যাপার? নাকি পথে নিজেই বেচে দিয়ে আসছিস?’
কুটিল সংশয়ের সুর তার কণ্ঠে। কাঁচা টাকার ব্যাপার–কাউকেই বিশ্বাস নেই তার।
হেম এ খোঁচা গায়ে মাখল না, কিন্তু একটু বিরক্তভাবেই বললে, সকলেরই তো চোখ আছে, পয়সারও দরকার আছে! শুধু আমিই লুটেপুটে খাব-অন্য লোকে তা সইবে কেন?’
শ্যামা একটু চুপ ক’রে থেকে বলে, ‘এত কাল সইছিল, এখন আর হঠাৎ সইছে না?’
‘জানি নে। চুপ কর দিকি একটু–বকো না।’
ছেলের মুখের ভাব কেমন থমথমে। গলার আওয়াজটাও ভাল নয়, শ্যামা আর পীড়াপীড়ি করে না–তখনকার মত চুপ ক’রে যায়। কিন্তু ভাবগতিক তার আদৌ ভাল লাগে না।
সারারাত ঘুম, হ’ল না তার। এটা বাড়তি, হিসেবের মধ্যে নয়, তবু এতদিন ধরে নিয়মিত পেয়ে আসার ফলে, টাকাটা যেন প্রাপ্যর মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেছে। ন্যায্য পাওনার মতোই ওটার ওপর ভরসা জন্মেছে–তেমনি ভয় ও হচ্ছে বৈকি বন্ধ হওয়ার আভাসে-ইঙ্গিতে।
সমস্ত রাত অজ্ঞাত আশঙ্কার কণ্টক-শয্যাতে ছটফট করার পর ভোরের দিকে একটুখানি তদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ অতি-পরিচিত একটি কণ্ঠের চিৎকারে চমকে ধড়মড়িয়ে উঠল শ্যামা।
নরেন এসেছে।
উঠোনের মধ্যে দাঁড়িয়ে যেন তুড়িলাফ খাচ্ছে। বিজয়গর্বে তার সমস্ত মুখ উদ্ভাসিত, কণ্ঠে উচ্ছ্বসিত উল্লাস।
.
‘হবে না! এ যে হতেই হবে! ঈশ্বর তো আছেন একজন মাথার ওপর! দপ্পহারী মধুসূদন কারুর দপ্প সন না। তেজ হয়েছিল–তেজ! বলি, এখন সে তেজ রইল কোথায়? দু’পয়সা রোজগার ক’রে ধরাকে সরা দেখেছিল একোবারে। যেমন দেমাক ঐ গোরবেটার, তেমনি দেমাক মাগীর। নে, এখন মায়ে-পোয়ে বসে বসে দেমাকের গোড়ায় জল ঢাল!’
শ্যামা আজকাল আর ভয় করে না স্বামীকে। বেরিয়ে এসে ধমক দিলে, ‘বলি ও হচ্ছে কি, ষাঁড়ের মতো গাঁক্ গাঁক্ ক’রে চেঁচাচ্ছ কেন!… পাঁচটা মানুষ ঘুমোচ্ছে, তারা কি মনে করবে! ভোরবেলাই নেশা-ভাঙ করেছ বুঝি?’
‘নেশা! নেশা হয়েছিল তোর–তোদের। পয়সার নেশা। সে নেশা ছুটে যাবে!’
শেষের দিকের কথাগুলো বলবার সময় অদ্ভুত একটা সুর বেরোল নরেনের কণ্ঠে। সে যেন একপাক্ নেচেই নিল।
এতক্ষণে শ্যামার তন্দ্রা ভেঙেছে রীতিমতই। সে একটু শঙ্কিত হয়ে উঠল। এতখানি উল্লাস–প্রতিহিংসার মতো আনন্দ–একেবারে অকারণ হতে পারে না।
সে উঠোনে নেমে এসে এবার একটু চাপা গলাতেই বললে, ‘বলি এবার একটু থামবে কি? কী হয়েছে কি? অত ফুর্তি কিসের?’
‘তোদের তেজ ভেঙেছে যে। ফুর্তি করব না? ছেলের চাকরির অংকারে ধরাকে সরা দেখছিলি একেবারে! চাকরি তো গেল! আমাকে, চোর বলে অপগেরাজ্যি করা হ’ত। এবার ছেলেকেও তো চোর বলে দেগে ছেড়ে দিলে একেবারে! তার কি করবি? বেটাছেলের চোর-বদনামের চেয়ে আর কোন বদনাম আছে? এই বয়সে চোর বদনামে চাকরি গেল। তোরা নাকি নেহাত নিঘিন্নে নিপিত্তে, তাই লোকের কাছে মুখ দেখাচ্ছিস! অন্য লোক হলে গলায় দড়ি দিত!’
সে চিৎকারে বাড়িসুদ্ধ কেন, পাড়াসুদ্ধ লোকেরই ঘুম ভাঙবার কথা। মঙ্গলারাও ভিড় ক’রে এসে পড়েছিলেন। এইবার বাসিমুখে গোটা দুই পান আর খানিকটা দোক্তা পুরে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলি কার চাকরি গেল গো ঠাকুর? ভোরবেলা শুভ সংবাদটি নিয়ে এলে কার?
‘কার আবার–ঐ গোরবেটার! এই যে–এই হারামজাদী মাগী–বুঝলেন না, বেউড় বাঁশের ঝাড়ে বেউড় বাঁশই হয়–বুঝলেন না। ঐ মাগী চোর, দেখছেন না, আপনাদের বাগানকে বাগান চুরি ক’রে ভুষ্যিনাশ করলে! তার ছেলে আর কত ভাল হবে! আবার ঐটি যে পেয়ারের ছেলে!’
‘বলি তোমার ছেলের–আমাদের হেমের চাকরি গেল? কী বলছ গো ঠাকুর? হ্যালো, ও বামনী, কি বলছে পাগলা ঠাকুর?
‘কি বলছি ঐ গোরবেটার জাতকেই জিজ্ঞেস করুন না। চাকরি গেল, তাই কি এমনি? চোর দুর্নামে। আমার ছেলে তুই—সামান্য শিশিবোতল চুরি ক’রে চাকরিটা খোয়ালি! মারি তো হাতি, লুটি তো ভাণ্ডার! তা নয়–কিনা শিশিবোতল! তা আবার হাতে-নাতে ধরা পড়ে গেলি। বেটা বেজন্মা আকাট কোথাকার।’
শ্যামার মনে হ’ল সমস্ত মাটিটা টলছে। এই বাড়ি, উঠোন শুধু নয়–সমস্ত পৃথিবীটাই। –কিন্তু পৃথিবীটা টলে নি, টলছে ওর নিজেরই মাথা। এই মুহূর্তে সত্যি সত্যিই একটা বড় ভূমিকম্প হলে যেন বাঁচত সে…সীতার মতো মাটিতে সেঁধিয়ে যেতে পারত।
কিন্তু তা হ’ল না। মঙ্গলা আর সবাইকে ঠেলে ঘরে এসে ঢুকলেন এবার, সঙ্গে সঙ্গে পিঁটকীও–যেখানে হেম মাথা হেঁট ক’রে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। তার পর অবিশ্রান্ত জেরায় সবই বেরিয়ে এল–একটি কথাও গোপন করা গেল না।
শিশিবোতলগুলোর যখন কোন দাম ছিল না–তখন কারুরই নজরে পড়ে নি। শেষে টনক নড়ল সবাইকারই। বিশেষ ক’রে দারোয়ানদের। ওটা ওদেরই প্রাপ্য বলে তারা মনে করলে–মাঝখান থেকে এই বাবুটা ভাগ বসায় কেন? দু-তিন দিন হুঁশিয়ার ক’রে দিয়েছিল তারা। শেষে একটা বন্দোবস্ত হয়েছিল–চার ভাগের এক ভাগ নেবে হেম। কিন্তু হেম বেছে বেছে ভালগুলোই নিত, তার ফলে দারোয়ানরা চটে একেবারেই কণ্টক দূর করলে। ছোট সাহেবকে জানিয়ে হাতে-নাতে ধরিয়ে দিয়েছে সেদিন।
.
ঐ কটা শিশিবোতল কোম্পানির লাভের ঘরে জমা হ’ত না এবং হবেও না কোন দিন। সাহেবও ভাগ বসাতে আসবেন না। কিন্তু চুরি চুরিই–সাহেব সেটা বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নন। নেহাতই ছেলে-মানুষ, কাজটা ক’রে ফেলেছে–বাবুরাও সকলে ওর হয়ে অনুরোধ উপরোধ করায়–সাহেব পুলিসে দেন নি বটে, কিন্তু ওকে চাকরিতে বহাল রাখতে আর কিছুতেই রাজী হন নি। কালও হেম গিয়েছিল–এই তিন দিনই যাচ্ছে–অনেকেই ওর হয়ে বলেছেন, কিন্তু সাহেব কোন অনুরোধই শুনতে রাজী হন নি। কাল একেবারে জবাব হয়ে গেছে।
.
মঙ্গলা মুখে কিছুই বললেন না, বরং ক্ষেত্র-মাফিক দু’একটা সাহানুভূতি ও সান্ত্বনার কথাই বললেন, কিন্তু তাঁর এবং মেয়ের ওষ্ঠপ্রান্তে যে সানন্দ কৌতুক ব্যঙ্গের হাসি উঁকি মারছিল তা নিতান্ত বালকদের চোখেও চাপা রইল না। পিঁটকী বেরিয়ে গিয়ে, এ উঠোন পেরিয়ে নিজেদের উঠোনে পড়বার মুখে বেশ সকলের শ্রুতিগোচর ভাবেই বললে শুধু, ‘ঠিকই বলেছে ঠাকুর, ভগবান আছেন। পাঁচ দিন চোরের এক দিন সেধের–এ তো জানা কথা।’
॥২॥
বিপদ একা আসে না–একতাল শুনেই এসেছিল শ্যামা–কথাটার মর্ম এবার হাড়ে হাড়ে অনুভব করলে।
হেমের চাকরি যাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঐন্দ্রিলার খবর।
এর মধ্যে অবশ্য প্রথম সংবাদটাই সবচেয়ে মর্মান্তিক–
ওদের মতো হতদরিদ্রের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী লোকের আয়ের পথ বন্ধ হওয়ার মতো দুর্ঘটনা আর নেই। এমন কি তা বোধ হয় সাধারণ আত্মীয়-বিয়োগ-ব্যথার চেয়েও দুঃসহ। অন্তত শ্যামার তাই মনে হ’ল। এর আগে তার দু-তিনটি সন্তান হয়ে মরে গেছে–একটি তো বেশ বড় হয়েই–তাতেও বোধ হয় দুঃখটা এত দুর্বহ বলে মনে হয় নি। প্রতিটি দিন- রাত্রি যেন চিন্তাটা জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে থাকে মনে। ঘুম হয় না কিন্তু জাগরণের মুহূর্তগুলিও কাটে যেন একটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে।
টাকা আছে। এই ক মাসের শিশিবোতল বেচা টাকার একটি পয়সাও সে সংসারে খরচ করে নি। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে–তার জন্য কৃচ্ছ্রসাধনই বাড়িয়েছে, বাড়তি টাকায় হাত দেয় নি। কাপড়ের দামটাই সব চেয়ে বেশি–তার জন্য ছেলেমেয়েগুলোরই দুর্দশা। বাড়িতে তারা ছেঁড়া ‘কানি’ পরে থাকে বললেই হয়। শ্যামাও তাই–তবে তাকে মাঝে মাঝে বাইরে বেরোতে হয় বলে আস্ত শাড়ি একখানা অন্তত বাঁচিয়ে রাখে। আর গোটা কাপড় লাগে হেমের। তবে যত অভাবই হোক–ব্রতপার্বণের কল্যাণে লালপাড় শাড়ি এবং ধুতি এক-আধখানা মেলেই।
কিন্তু সে অন্য কথা।
টাকা জমেছে। আছেও তা খুব সঙ্গোপনে। নরেনের কেন–ছেলে-মেয়েদেরও ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে।
কিন্তু সে টাকাতে শ্যামা প্রাণ ধরে হাত দিতে পারবে না। সে টাকার একটি ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশও খরচ করতে রাজী নয় সে।
ধীরে ধীরে একটু একটু ক’রে, মনের সঙ্গোপনে একটি অতিশয় উচ্চাভিলাষ মাথা তুলেছে ওর মধ্যে। ওর পক্ষে তা অসম্ভব, একান্ত দুরাশা–সে উচ্চাশা সফল হবার সুদূরতম সম্ভাবনা এমন কি নিজের মনের কাছেও স্বীকার করতে পারে না সে–তবু তা কী এক অমোঘ এবং দুর্নিবার শক্তিতে ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। বিলাস তো নয়ই–জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুগুলি থেকেও নিজেকে বঞ্চিত ক’রে সে সেই আশা-তরু-মূলে জল সিঞ্চন করছে। বরং বুকের রক্ত সিঞ্চন করছে বলাই উচিত।
নিজের বাড়ি।
কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করতেও হাসি পায় ওর নিজেরই। তার মত পরাশ্রয়ীর নিজের বাড়ি, একে উচ্চাশা বললেও যথেষ্ট বর্ণনা হয় না।
একেই বুঝি বলে বামনের চাঁদ ধরবার শখ। ব্যাঙের সাগর পার হবার সাধনা।
তবু–তাই-ই তো করছে সে।
একটি একটি ক’রে প্রায় ছ’শোটি টাকা জমেছে ওর।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।
গুনতে বসলে নিজের হাত এবং চোখকেও বিশ্বাস হয় না যেন। কিন্তু বার বার গুনে দেখেছে সে। আর মাত্র কয়েকটি টাকা হলেই ঐ কল্পনাতীত সংখ্যা পূর্ণ হবে।
ওর মতো ভিখারীর পক্ষে কুবেরের ঐশ্বর্য।
এর থেকে সামান্য কিছু টাকা খরচ করলেও এখন অনেকখানি স্বাচ্ছন্দ্য পেতে পারে–তা শ্যামা জানে। একটি পয়সারও ক্রয়ক্ষমতা কতখানি তা তার বেশ জানা আছে। যত আক্ৰাই হোক–এখনও এক পয়সার নুনে সাত দিন চলে। এক পয়সার পাঁচফোড়নে মাস চালায় সে। অবশ্য ফোড়ন ব্যবহার করার খুব পক্ষপাতীও নয় শ্যামা। সামান্য তেলে তাকে রাঁধতে হয়–ফোড়ন দিলে সেটুকু তেল ফোড়নেই শুষে নেয়। ব্যঞ্জনের সঙ্গে মিশে তার স্বাদ বাড়াবার কোন কাজে লাগে না।
ছেলেমেয়েগুলো সদা-সর্বদাই ক্ষুধার্ত হয়ে থাকে। তাদের কোটরগত চক্ষুর উদগ্র লোলুপ দৃষ্টির দিকে তাকালে মায়ের প্রাণে আঘাত লাগে বৈ কি! শতচ্ছিন্ন মলিন বেশ–ভিখারীরও অধম। তবু ঐ টাকা থেকে একটি পয়সাও ভাঙতে পারে না শ্যামা।
না। ভাঙবেও না। বহু অপমান সয়েছে সে। বহু লাঞ্ছনা। প্রতিটি অপমানের স্মৃতি তার মনে জমা আছে। স্মৃতির গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে মিশে আছে সে ইতিহাস। একা পথ চলতে চলতে কিংবা নির্জন নিস্তব্ধ দুপুরে পাতা কুড়োতে কুড়োতে সেই রশিতে টান পড়লেই নতুন ক’রে জ্বলতে থাকে প্রত্যেকটি ঘা। লোকে বলে মার খেয়ে খেয়ে কড়া পড়ে যায়–তখন আর লাগে না। ভুল কথা, কড়ার ওপর লাগলে আরও বেশি যন্ত্রণা হয়। অবিশ্রান্ত পথ চলে চলে তার পায়ের নিচে অগুন্তি কড়া পড়েছে। সে কড়ার কোনটি দৈবাৎ যদি কোন কাঁকর কি খোয়ার ওপর পড়ে–বেদনায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। …
যদি উপবাস ক’রে ক’রে সত্যিই কোনদিন ছেলেমেয়েরা মরতে বসে–তখন যা হয় করবে। তার আগে নয়।
.
হেম ঘোরে টো টো ক’রে। লজ্জাই বেশি তার। বাড়ির লোক বিশেষত সরকারদের সামনে মুখ দেখাতেও তার লজ্জা করে। মনে হয় প্রতিটি লোকের সকৌতুক দৃষ্টি চোর বলে তাকে বিদ্রূপ করছে। চুরি তারা বহুদিন থেকেই করছে সত্যি কথা–কিন্তু সে চুরি আলাদা। চুরি ক’রে চাকরি যাওয়ার মতো অপমানকর নয় তা।
চাকরি অবশ্য বসে নেই তার জন্যে। তার ওপর অফিস থেকে কোন সার্টিফিকেট পায় নি। তবু ঘোরে–এখানে ওখানে, পাগলের মতো। অফিসে অফিসে ঘোরে আর ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
শ্যামা নিজে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ছেলের হয়ে যজমানির কাজ চায়। কিন্তু সকলকারই পুরনো লোক আছে। বাড়তি কাজ মেলা শক্ত। লক্ষ্মীপূজো মনসাপূজো ছাড়া বাড়তি কাজ পাওয়া যায় না।
তা ছাড়া–শ্যামা বেরিয়ে আসতে আসতে তাকে শুনিয়েই কেউ কেউ মন্তব্য করে, ‘বাব্বা, ও চোরকে কে বাড়িতে ঢোকাবে! তার পর পূজোর বাসনকোসন নিয়ে পালাক একদিন!’
এই অনিষ্টটি ক’রে গেল নরেন। নইলে কাকে-বকেও টের পেত না। বাপ হয়ে চিরদিন ছেলেমেয়েদের অনিষ্টই ক’রে যাচ্ছে সে। স্ত্রী-পুত্রকন্যাদের পথে বসিয়ে, অপরের বাড়ির দাসত্ব করিয়েও শান্তি নেই তার।
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে শ্যামা। অনুপস্থিত স্বামীকে গালাগালি দেয় অনুচ্চ কন্ঠে।
আর এদেরও চেনে সে। ভাল করেই চেনে। সবাই সাধুপুরুষ। অফিসে যারা চাকরি করে–অফিস উজোড় ক’রে নিয়ে আসে। কাগজ, পেনসিল, নিব, কলম—এগুলো কি চুরি নয়। নিজেরাই বলে ‘উপরি’ আছে। ‘উপরি’টা কি? চুরি, না হয় ঘুষ–কিন্তু সেও তো জুচ্চুরি।
গালাগাল দিয়ে তখনকার মতো গায়ের জ্বালা মেটে বটে কিন্তু আয়ের কোন উপায় হয় না। উত্তেজনায় শেষে আসে অবসাদ আর একটা হিম- হতাশা। একটু একটু ক’রে মনটা ভেঙে আসে কোথায় যেন!
.
এরই মধ্যে এল দ্বিতীয় দুঃসংবাদ।
ঠিক আগের দিন শ্যামা ভাত বেড়ে দিতে দিতে হেমকে উপদেশ দিয়েছে, ‘একবার হরিনাথের কাছে যা না। ওর তো রেল অফিস–যখন-তখন লোক নেয়। যদি একটা কাজকর্ম ক’রে দিতে!’
‘গিছলুম তো। তুমিও তো বলেছ! আবার গিয়ে লাভ কি!’ হেম সংক্ষেপে জবাব দেয়। এ জ্বালাতন তার ভাল লাগে না। মায়ের নিত্য অভিযোগ এবং নিত্য নূতন উপদেশ। মায়ের অতিরিক্ত আগ্রহই তাকে চুরিতে প্ররোচিত করেছিল সেটা আজ মায়ের মনে নেই। মা তো এখন স্পষ্টই বরং বলে, ‘চাকরি বাঁচিয়ে চুরি করতে পারতিস তো চুরির মানে হ’ত! এমন কাঁচা চুরি করতে যাস কেন? তার চেয়ে যা পেতিস–দুঃখের ভাত সুখ ক’রে খেতুম।
শ্যামা আজও ছেলের কথার উত্তরে জিদ করে, ‘একবার গেলে কি একবার বললে যদি চাকরি হ’ত তা হলে আর ভাবনা ছিল না! এসব ব্যাপারে বার বার যেতে হয়, অনেক সময় মানুষ বিরক্ত হয়ে ক’রে দেয়! দয়া কার? তার না তোর?’
হেম নিঃশব্দে খেয়ে উঠে যায়।
নাজনে ডাঁটা সস্সড়ি আর ভাত। চুরি ক’রে নাজনে ডাঁটা পাওয়া যায়–ডাঁটা আর আমড়া। ডাঁটা সস্সড়ির সঙ্গে আমড়া-গোলা কাঁচা অম্বল। এই চলছে কদিন ধরে। তাতে তত কষ্ট ছিল না–মায়ের বাক্যিতে যত কষ্ট। প্রতিদিনই ভাত খেতে বসলে শুরু হয় এই নাকে-কান্না এবং অভিযোগ! অন্য সময় পালিয়ে বেড়ায়, খেতে বসলেই জব্দ! এই সময়টা চোখকান বুজে শুনতেই হয়। ফলে ভাতটাই বিষ মনে হয় আজকাল।
অবশেষে ক্লান্ত হয় হেমকে প্রতিজ্ঞা করতেই হয় যে কাল সকালে সে আড়গোড়ে যাবে।
কিন্তু সেই কাল সকালের আগেই ভোরবেলা দোরে ধাক্কা পড়ে ওদের।
প্রথমটা মনে হয় নরেন–শ্যামার চোখমুখ কঠিন হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গেই, কিন্তু তার পরেই মনে হয়, শুধু দোরে ধাক্কা দিয়ে চুপ ক’রে থাকবার লোক তো নয় সে, এতক্ষণ তার চিৎকারে পাড়া জেগে উঠত
বিস্মিত এবং কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে দোর খুলতেই চোখে পড়ল–ঐন্দ্রিলা, মেয়ে কোলে দাঁড়িয়ে অঝোরঝরে কাঁদছে। তার চুল উস্কোখুসকো, বেশবাস অবিন্যস্ত, চোখেমুখে কালি, যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে।
ভয়ে উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে গেল শ্যামা।
‘এ কী রে? এমনভাবে কোথা থেকে? কার সঙ্গে এলি? ব্যাপার কি? ওদের বলে এসেছিস তো? এত ভোরে এলিইবা কেন? জামাই ভাল আছেন তো?’
একসঙ্গে এক সহস্র প্রশ্ন করে শ্যামা।
ঐন্দ্রিলা প্রায় টলতে টলতেই ঘরের মধ্যে এসে মেঝেতে বসে পড়ে।
‘একটু জল দাও মা–জল!‘
ততক্ষণে ছেলেমেয়েরাও উঠে পড়েছে। হেমই ছুটে গিয়ে জল গড়িয়ে নিয়ে এল। তরু কোল থেকে মেয়েটাকে নিয়ে নিলে তাড়াতাড়ি।
শ্যামা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তবু তখনও সর্বনাশের পরিমাণ আন্দাজ করতে পারে নি সে। সে ভাবছে জেদী মেয়ে তার–শ্বশুরবাড়িতে, হয়তো বা জামাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া ক’রেই এমনভাবে পালিয়ে এসেছে। এই নিয়ে কত অশান্তি হতে পারে সেই ভেবেই সে আকুল!
সে প্রশ্ন ক’রেই যাচ্ছে উপর্যুপরি।
জল খেয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে সেই চরম দুঃসংবাদটি দিলে ঐন্দ্রিলা।
না, কারুর সঙ্গে আসে নি সে। কাউকে বলেও আসে নি। সে সময়ও ছিল না।
হরিনাথের অসুখ করেছে। সাংঘাতিক অসুখ।
পরশু জ্বর নিয়েই ফিরল অফিস থেকে। সামান্য জ্বর। কাল অফিস যেতে বারণ করেছিল ঐন্দ্রিলা, শোনে নি। বিকেলে অফিস থেকে ওকে ধরে নিয়ে এল অন্য বাবুরা–ধরাধরি ক’রে। অজ্ঞান, অচৈতন্য। সেখানে গিয়ে নাকি কাশতে গিয়ে রক্তবমি করেছে। একবার নয়–অনেক বার। অফিসের ডাক্তার দেখে বলেছে–যক্ষ্মা–কাশ, রাজযক্ষ্মা। এখন থেকেই খুব ভাল চিকিৎসা হয়ে একআনা আশা আছে বাঁচবার। নইলে
কথা শেষ করতে পারলে না ঐন্দ্রিলা। আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আবারও।
পাথর হয়ে গেছে শ্যামা। কিছুই তার মাথাতে যাচ্ছে না যেন। তার অমন স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ জামাই, কষ্টিপাথরের মতো রং এবং তেমনি কঠিন শরীর।
তার ঐ রোগ হ’ল? যক্ষ্মা! যে রোগের নাম শুনলেই লোকে শিউরে ওঠে!
‘না না খেঁদি, তোর ভুল হচ্ছে!’ শ্যামা বলে ওঠে।
সেইজন্যেই তো এসেছে ঐন্দ্রিলা।
কালই হাতে যা ছিল তাই দিয়ে বাবুরাম ডাক্তারকে এনেছিল সে। কাল রাত্রেই। তিনি বলে গেছেন সাহেব-ডাক্তার ডাকতে হবে। তিনিও রাজযক্ষ্মাই মনে করেন, কিন্তু এ রোগের এখানে চিকিৎসা করা অসাধ্য। বাইরে পাঠাতে হবে। কিন্তু তার আগে এখনই আর, এল. দত্ত অথবা কোন ভাল সাহেব- ডাক্তার আনা উচিত।
অর্থাৎ এখনই একশোটি টাকা বার করতে হবে। বত্রিশ টাকা ফি, পাড়াগাঁয়ে এলে ডবল। তা ছাড়া গাড়িভাড়া আছে।
টাকা ঐন্দ্রিলার কাছে ওর অর্ধেকও নেই।
একে তো মাইনের সব টাকা আজও মায়ের হাতেই ধরে দেয় হরিনাথ, তার ওপর দু-এক টাকা ক’রে যা ঐন্দ্রিলা জমিয়েছিল, মাত্র মাসখানেক আগেই ধার নিয়ে বসে আছে–হরিনাথ নিজেই অফিসের কোন্ বন্ধুর বোনের বিয়ে হচ্ছিল না–তাকে দিয়েছে। সে নাকি মাসে মাসে শোধ দেবে কিছু কিছু ক’রে। কিন্তু এখন?
শ্যামা তাকে অন্তত পঞ্চাশটি টাকা ধার দিক, সে গয়না বেচে পরে শোধ ক’রে যাবে। কিন্তু গয়না বেচা বা বাঁধা দেওয়া কোনটাই তো এখনই হতে পারে না, অথচ এখনই ডাক্তার ডাকা দরকার। মাত্র পঞ্চাশটি টাকা–দেবে না, দিতে পারবে না শ্যামা?
পাথরের মধ্যেও কি এমন অনুভূতি থাকে?
একটা হিম-শৈত্য মেরুদণ্ড বেয়ে নামছে কেন ওর এমনভাবে!
পঞ্চাশ টাকা!
‘দোহাই মা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। এখনও ডাক্তার ডাকলে হয়তো বাঁচতে পারে, বাঁচবার পথ থাকে একটা।’
হ্যাঁ থাকে। কিন্তু সে সম্ভাবনা এক আনা মাত্র। মেয়ে নিজেই বলেছে একটু আগে। মেয়ে আর জামাই। না দিলে তাগাদা করা যাবে না, আদায় করা যাবে না।
‘আমি, আমি কোথায় পাব মা টাকা? আজ ছ মাস তোর দাদার চাকরি নেই।’ শ্যামারই মনে হল–আর কে যেন দূর থেকে কথা কইছে। সে নয়।
ঐন্দ্রিলা চিরদিনই মুখফোঁড়।
বলে, ‘টাকা তুমি জমিয়েছ মা, তা আমি খুব জানি। যে শিশি বোতল চুরি ক’রে দাদার চাকরি গেল, সেগুলো বেচার সব টাকাই তো তোমার হাতে আছে!’
‘ছিল বৈ কি মা–ছিল। কিন্তু এই ছ মাস কি খাওয়ালুম এই রাবণের গুষ্টিকে? কী হাল নয়ে আসছে দেখছ না? হাতে পয়সা থাকলে কি এমন দশা ক’রে রাখি ছেলেমেয়েদের?’
ঐন্দ্রিলা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে
‘পঞ্চাশটা টাকাও দিতে পারলে না মা!
‘কেন, তা তোর শাশুড়ি দিতে পারলে না? চেয়েছিলি তার কাছে? মাগীর হাতে তো যথাসর্বস্ব। এ-ই বড় ছেলে!’
‘তোমরা সবাই সমান মা। কাল রাত্রে তাঁকেই তো বলতে গিয়েছিলুম। তিনি বল্লেন–এ রোগে কেউকে বাঁচতে তিনি দেখেন নি, কানেও শোনেন নি কারুর বাঁচবার কথা। ছেলে মারা গেলে সংসার তো ঠিকই থাকবে, তাঁকেই চালাতে হবে। মিছিমিছি যে বাঁচবে না তিনি জানেন, তার পেছনে যথাসর্বস্ব খরচ ক’রে তিনি সর্বস্বান্ত হতে পারবেন না।’ কঠিন ব্যঙ্গের সুরে কথা কটা বলে ঐন্দ্রিলা, তার চোখে আর জল নেই।
শ্যামা মাটির দিকে চেয়ে ছিল। সেই ভাবেই বললে, ‘তুমি মিছিমিছিই ঠেস দিয়ে কথা বলছ মা! তোমার শাশুড়িতে আমাতে ঢের তফাত। তার আছে সে দিচ্ছে না, আমার সত্যিই নেই। –ভিখিরী আমি–কী ভাবে আমার দিন চলে তা কি আর তুমি জান না?’
ঐন্দ্রিলা তরুর কোল থেকে একটানে মেয়েটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘সবই জানি মা, তোমাকেও জানি। তবু মন মানেনি তাই ছুটে এসেছিলুম!
ঘরের বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল আবার।
‘একটা উপকার করবে? এই চারগাছা চুড়ি রেখে কায়েত দিদির কাছ থেকে এনে দিতে পারবে একশোটা টাকা! দেড় ভরি ক’রে আছে এক-এক গাছা।’
‘দেখি না হয় বলে। তুই একটু কিছু মুখে দিয়ে যা না হয়!’
‘থাক। আমার এমন মুখে না দিলেও চলবে মা। মুখে দেওয়ার পব্বটাই তো শেষ হতে বসেছে। এখন এই উপকারটা করতে পার কিনা দেখ দিখি!’
সে মেয়েটাকে সেইখানেই মেঝেতে নামিয়ে রেখে চুড়িগুলো খুলতে শুরু করে!
তা হোক। তবু শ্যামা পারবে না তার সেই পাঁচশ ছিয়াশি টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা ভাঙতে!
ছেলেদের উপবাস করতে দেখেও প্রাণ ধরে ভাঙতে পারে নি সে। জামাইয়ের জন্যে ভাঙতে পারবে না। হরিনাথের মা ছেলেরই উপার্জন করা টাকার গাদায় বসে যদি ছেলের চিকিৎসার জন্যে সেই টাকা বার করতে না পেরে থাকে তো ওর দোষ কি!
বহু কষ্টের টাকা তার–বহু সাধনের টাকা। …
চুড়িগুলো নিয়ে মঙ্গলার কাছে গিয়ে সংবাদটা দিতে দিতে শ্যামা কেঁদে ফেলল।
সে কান্নাও তার সত্য। কিন্তু যে দুঃখ ঐ টাকা কটা সম্বন্ধে তাকে এমন কঠিন করেছে সে দুঃখ আরও সত্য। তাই কিছুতেই পারল না সে মেয়েকে চুড়ি ক-গাছা ফেরত দিতে।
আর মেয়ে তো চুড়ি বাঁধা দিতে দেরি হবে বলেই তার কাছে চাইছিল, শেষ পর্যন্ত সেই বাঁধা দিয়েই তার টাকা শোধ দেবে বলেছিল। সেই কাজটাই যখন অবিলম্বে হয়ে গেল তখন আর কী এমন অপরাধই বা তার হয়েছে!
বার বার নিজের মনের কাছেই কৈফিয়তে দেয় শ্যামা।
মঙ্গলা একেশো টাকার একখানা নোট ওর হাতে আলতো ফেলে দিয়ে বললেন, ‘উনি বললেন যে, ছ’ ভরিতে একশ টাকা দেওযা যায় না, তা ছাড়া হাতের চুড়ি ক্ষয়েও গেছে হয়তো–তা হোক, খেঁদির এত বড় বিপদে ওসব কথা আর ভেবো না–দিয়েই দাও।’
চুড়ি ক-গাছা তখনও অবশ্য ওঁরই পেটকাপড়ে বাঁধা–গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে সিন্দুকে পুরতে হবে।
নবম পরিচ্ছেদ
॥১॥
ঐন্দ্রিলা এদের কোন খবর দেয় নি। দেওয়ার ইচ্ছা বা অবসর কোনটাই ছিল না। মাসীদের অবস্থা সে জানে–মিছিমিছি ব্যস্ত ক’রে লাভ কি? তা ছাড়া খবর দিতে গেলে চিঠি লিখতে হয়–চিঠি লেখার সময় কৈ তার?
কথাটা শ্যামার মুখেই শুনলে এবং একেবারে হতবাক্ হয়ে গেল এরা–উমা ও কমলা। বিশ্বাস হয় না কথাটা, যেমন হয় নি শ্যামারও। বিশ্বাস হবার কথাও নয়। হরিনাথ? ঐ লোহার মতো সুস্থ সবল শরীর যার!
এদের খবর দিয়ে যে বিশেষ ফল হবে না–তা শ্যামাও জানত কিন্তু সে কথা হিসেব ক’রে সে আসে নি। চুপ ক’রে বসে থাকতে পারে নি বলেই এসেছে। কথাটা কাউকে দরকার। অন্তত কারুর সঙ্গে দুঃখটা ভাগ ক’রে নিতে না পারলে সে যে পাগল হয়ে যাবে। …তাই হঠাৎ আজ ভোরেই বেরিয়ে পড়েছে, উদ্ভ্রান্তের মতো। ছেলেমেয়ে কাউকে নেয় নি সে, তাদের কথা ভাবেও নি। হেম আছে–যা হয় করবে। এই সমস্ত পথটা এক-টানা কোথাও না বসে একরকম ছুটে চলে এসেছে সে।
তার শুষ্ক শীর্ণ চেহারা, রুক্ষ কেশ, অপরিসীম ক্লান্ত এবং অবসন্ন দৃষ্টি–সবটা মিলিয়ে মূর্তিমান হতাশা যেন। কোনমতে এদের এখানে পৌঁছে বাইরের রকটার ওপরই এলিয়ে পড়ল একেবারে।
কমলা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এল।
‘কি রে? এমন ক’রে এই অসময়ে, একা? কী হয়েছে? ছেলেমেয়ে ভাল আছে তো?’
আশঙ্কায় রুদ্ধনিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে কমলা।
উত্তর দিতে গিয়ে চোখের জলই বেরিয়ে আসে প্রথম।
তার পর একটু একটু ক’রে এই সংবাদ!
অবিশ্বাস্য শ্বাসরোধকারী সংবাদ। বলে এবং কপাল চাপড়ায় শ্যামা।
‘কি পাপ ক’রে এসেছিলুম দিদি, এততেও কি তার শেষ হ’ল না!’ বার বার বলে সে।
অনেকক্ষণ পরে অনেক কষ্টে কমলা শুধু বললে, ‘কী বলছিস শ্যামা! তুই–তুই ভুল শুনিস নি?
শ্যামা সজোরে একটা চাপড় মারলে কপালে!
‘আমার কপাল যে দিদি। এ সবই আমার কপালের ফল। এ কপাল না হলে ভুল হ’ত হয়তো। খারাপ খবর আমার কপালে কখনও ভুল হবে না!’
এ কী শোনালে, হে ভগবান! এ কী শোনালে!
মনে মনে দুজনেই শুধু এই প্রশ্ন করে অবিরাম, যদিও মুখে কারুরই আর স্বর ফোটে না।
অনেকক্ষণ পরে উমাই প্রথম সংবিৎ ফিরে পায়।
এগিয়ে এসে শ্যামার ডান হাতখানা ধরে ফেলে বলে, ‘অমন ক’রে কপাল চাপড়াতে নেই ছোড়দি। ওতে মেয়ে-জামাইয়েরই অকল্যাণ হবে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। নাও, ওঠো–মুখে মাথায় একটু জল দাও দিকি
উমার কথাতে কমলারও যেন চৈতন্য হয়। সক্রিয় হয়ে ওঠে তার হাতপাগুলো, আর মাথাও।
সেও উঠে পড়ে বলে, ‘ঠিক কথাই তো–সেই কোন্ ভোরে বেরিয়েছে হয়তো, এখনও মুখে একটু জল পড়ে নি। আমার যেমন পোড়া বুদ্ধি, আগেই গেলুম ঐসব কথা পাড়তে। …তুই ওকে কল-তলায় নিয়ে যা উমি, আমি ততক্ষণ একটু শরবত করি।’
হাত-পা ধুয়ে, ঘাড়ে মাথায় খানিক জল থাড়ে দিয়ে একটু সুস্থ হ’ল শ্যামা। শরবত খেয়ে প্রশ্ন করলে, ‘বৌমা কোথায়? গোবিন্দ?’
‘বৌমা আরায় গেছেন। বিয়ের পর এতকাল পাঠানো হয় নি তো! ওরা এসে নিয়ে গেলেন। আর গোবিন্দ আপিস গেছে।’
‘আপিস!’ প্রশ্নটা আচম্বিতে বেরিয়ে আসে–তাই সতর্ক হবার অবসর পায় না শ্যামা। তীক্ষ্ণ, আর্ত শোনায় কণ্ঠস্বর।
সঙ্গে সঙ্গে–সমস্ত দুঃখের মধ্যেও মনে পড়ে হেমের চাকরি নেই।
এরা কাকে ধরে কেমন ক’রে চাকরি পেলে? আমার হেমের হয় না?
.
কমলা অতটা লক্ষ্য করে না, মাথা হেঁট কঁ’রে বলে, ‘আর কি করব বোন! ওর লেখাপড়া আর হবে না। এত বয়স হয়ে গেল–বার বার বাধা পড়ছে–আর কবে পাস করত বল! বসিয়ে খাওয়াবারও সঙ্গতি নেই; এক্ষেত্রে চাকরি- বাকরির চেষ্টা করা ছাড়া উপায় কি?’
‘কোথায় বেরোচ্ছে? পাচ্ছে-টাচ্ছে কিছু? কাকে ধরে ব্যবস্থা করলে দিদি? আমার হেমের একটা উপায় হয় না?’
‘পোড়া কপাল। তুমিও যেমন ছোড়দি!’ উমা বলে উঠে, ‘দিদি কাকে ধরবে–কাকে চেনে? গোবিন্দরই এক ইস্কুলের বন্ধু–তার বাবার বুঝি ম্যাপ ছাপার কারখানা আছে–সেখানে ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছে বাবাকে বলে। এখন কিছুই পায় না, কাজ শিখছে। ছ মাস গেলে দশ টাকা জলপানি দেবে, আরও ছ মাস পরে মাইনে। এখন কোথায় কি!’
তবু ভাল! নিজের অজ্ঞাতেই কথাটা নিঃশব্দে মনের মধ্যে উচ্চারিত হয়। সে নিঃশ্বাস ফেলে একটা। স্বস্তির নিঃশ্বাসের মতোই আরাম অনুভব করে যেন।
গোবিন্দ চাকরি করছে এবং মাইনে পাচ্ছে–দুটো খবর একসঙ্গে সহ্য করা কঠিন হ’ত বৈকি!
গোবিন্দর উপার্জন শুরু হলে, কমলার হাতে টাকা এলে শ্যামার লাভ ছাড়া লোকসান নেই–তবুও, সংবাদটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বুকের মধ্যে নিঃশ্বাসটাকে চেপে ধরেছিল; এখন সেইটেই সহজে বেরিয়ে এল। খেতে বসে প্রসঙ্গটা আবারও হরিনাথের অসুখে ফিরে এল। শ্যামা যায় নি কিন্তু হেম রোজই যায়। হরিনাথের জিনের ভাইরা কেউ সেদিক মাড়ায় না। এমন কি মা-ও না। তিনি শুধু বাইরে থেকে ঐন্দ্রিলার ভাত জল আর রুগীর পথ্যি দিয়ে যান। কি ভাগ্যি মেয়েটাকে রেখেছেন তবু। কিন্তু সেদিকে যাই হোক–চিকিৎসার জন্যে একটি পয়সাও খরচ করতে রাজী নন তিনি। ছেলে গেছেই–ঘটনাটা দুঃখের হলেও, পরিতাপের হলেও, অস্বীকার করার উপায় নেই যখন–তখন সেই মতই চলতে হবে। এত বড় সংসার তার, রোজগারের কেউ রইল না, আবার তিনি ঘরের যথাসর্বস্ব বার ক’রে দিয়ে কি পথে দাঁড়াবেন? যে যাবেই তার জন্যে, যারা থাকবে তাদের সর্বনাশ করবেন কেন?
‘এ ধারে বড় ডাক্তার আসছে,’ শ্যামা বলতে থাকে, ‘মড়-মড় টাকা খরচ হচ্ছে; এবেলার ওষুধ ওবেলা পালটে দিচ্ছে–অ্যাকো অ্যাকো ওষুধের দামই চার টাকা পাঁচ টাকা। ডাক্তার বলছে এই অবস্থাতেই পাহাড়ের ওপর কি সমুদ্দুরের ধারে নিয়ে যেতে–কিন্তু সে ব্যবস্থা করবে কে? তাতেও তে একগাদা টাকা চাই! অর্থবল লোকবল ছাড়া কি হাওয়া-বদল হয়? তা ছাড়া ঐ সাংঘাতিক রুগী সেকেন ক্লাস ছাড়া নিয়ে যাওয়া যাবে না–সেও শুনছি রিজাব করতে হবে। এ সব তো চাট্টিখানি টাকার খেলা নয়!…খেঁদির গয়না সব গেছে–সোনা-রত্তি বলতে আর কোথাও কিছু নেই–এখন নাকি ওর অফিসের টাকায় হাত পড়েছে! মেয়েটার আর ইহকাল পরকাল কিছুই রইল না।’
শ্যামা বলছে–এরা শুনছে। তিনজনের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে কখন। হাতের ভাত কড়কড়িয়ে উঠেছে, থালায় ভাত-তরকারি অখাদ্যে পরিণত হচ্ছে–কারুরই খেয়াল নেই।
মেয়েদের এত বড় বিপদ এবং দুর্ভাগ্য আর নেই–এরা সকলেই মেয়েছেলে, সেইটে অনুভব করছে মর্মে মর্মে। তিন জনেরই দৃষ্টি সজল হয়ে উঠেছে, বুক কাঁপছে থর থর্ ক’রে। আহারে রুচি নেই কারুরই।
উমা প্রশ্ন করল,’তুমি গিয়েছিলে?’
‘না। আমি যাই নি।’
‘কেন?’ আশ্চর্য হয়ে যায় উমা, ‘মেয়ের এত বড় বিপদ!’–
আমি গিয়েই বা কি করব বল্। যদি কোন কাজে লাগতুম তো সে কথা আলাদা। মেয়ের এত বড় বিপদে–এক পয়সা সাহায্য করার ক্ষমতা তো নেই–শুধু শুধু জামাই-বাড়ি যাওয়া, সে ভারি লজ্জার কথা। তা ছাড়া কখনই যাই নি।’
‘ক্ষমতা নেই’ কথাটা বলার সময় শ্যামার গলাটা অকারণেই কেমন যেন কেঁপে যায়। …কদিন আগে ঐন্দ্রিলার কথাগুলো কি মনে পড়ে? কে জানে।
‘তা বলে মেয়ের এত বড় বিপদে–। অর্থে না পার, সামর্থ্যেও তো কিছু করতে পার।
‘তাই বা পারি কি করে বল্!’ আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে বলে শ্যামা। দু’দিন ‘চার দিন গিয়ে থাকলে হয়তো ওর একটু আসান হ’ত, কিন্তু এদিকে আমার সংসার যে অচল হয়ো যায়–হেমের চাকরি নেই, জানিসই তো–আমার উঞ্ছবৃত্তি ক’রে খাওয়া। তা ছাড়া ওর শাশুড়ি মাগীর যা মুখ, নিজে দিচ্ছে না এক পয়সাও কিন্তু শুধু-হাতে গিয়ে দাঁড়ালে একঝুড়ি কথা শোনাবে। সে ভারি অপমান!‘
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে সকলেই।
শেষে যেন কমলাই জোর করে নিজেকে সচেতন করে ‘নে–ভাত ব্যান জল হয়ে এল, যা পারিস দুটো মুখে দিয়ে নে।
কিন্তু সে ভাত আর মুখে তোলা সম্ভব নয়–কমলাও তা জানে। উমা আর চেষ্টাই করলে না। শ্যামা পাতে ভাত নষ্ট করার কথা কল্পনা করতে পারে না–তবু সেও দু’চার গ্রাস মুখে তোলবার পর চেষ্টা ছেড়ে দিলে।
একটু ইতস্তত ক’রে বললে, ‘একটা হাঁড়ি-টাড়ি বরং দাও দিদি–ভাতগুলো কুড়িয়ে তুলে রাখি। যাবার সময় নিয়ে যাব।
শিউরে ওঠে কমলা, ‘এই ডাল-মাখা–এঁটো ভাত–নিয়ে যাবি কি রে! তা হোক। আমাদেরই তো এঁটো। ছেলেমেয়ে খেয়ে বাঁচবে। এত ভাত নষ্ট করতে পারব না।
॥২॥
শ্যামা বিকেলেই আবার ফিরে গেল। সব ফেলে রেখে হঠাৎ চলে এসেছে, এ অবস্থায় থাকা সম্ভব নয় তার–তাই কমলাও থাকতে অনুরোধ করলে না।
উমা যথারীতি পড়াতে বেরিয়েছিল। কিন্তু দু-এক বাড়ি ঘোরার পরই সে ফিরে এল। ভাল লাগছে না তার–অপরিসীম ক্লান্তি লাগছে যেন। তারই বেশি লেগেছে খবরটায়। ঐন্দ্রিলা তার কাছে অনেকদিন ছিল ছেলেবেলায়। বলতে গেলে তার কাছেই মানুষ। ফুটফুটে বুদ্ধিমতী মেয়ে। একটু প্রখরা হয়তো, তবে সে প্রাখর্যকে অনায়াসে দীপ্তিও বলা চলে।
মায়া বসাতে দেবে না কিছুতেই–ঐন্দ্রিলাকে যখন কাছে রাখতে রাজী হয়, বার বার এই প্রতিজ্ঞাই করেছিল উমা–তবু সে মনের মুখে পুরো লাগাম লাগাতে পেরেছিল কি?
পারে নি। মনের অনেকখানিই সেদিন দখল ক’রে নিয়েছিল ঐন্দ্রিলা।
নিঃসন্তান রমণীর সমস্ত বুভুক্ষা সেদিন তার প্রাণরস সংগ্রহ করেছিল ঐ মেয়েটির মধ্যে। সকল তৃষ্ণা মেটে নি এটা সত্য কথা–কিন্তু আংশিক শান্তি হয়েছিল বৈকি!
ঐন্দ্রিলার বিবাহে তার সমস্ত অন্তরে বেদনার টান পড়েছিল।
হয়তো নিজের মেয়ে হলে আরও আঘাত লাগে কিন্তু তাতে একটা সান্ত্বনা থাকে, তৃপ্তি থাকে। ভবিষ্যতের আশাও থাকে। উমার কাছ থেকে এই যাওয়া যে একেবারে যাওয়া। তার লেগেছিল বেশি। অন্তরে অন্তরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল সে।
দীর্ঘদিনের অদর্শনে সে ব্যথায় একটা প্রলেপ পড়েছিল–আজ আবার নতুন করে দগ্দগিয়ে উঠল ঘা-টা!…
কিছুতেই প্রাত্যহিক কাজে মন বসাতে পারল না। ছাত্রীদের নির্বুদ্ধিতা অন্যদিন ক্লান্তিকর মনে হয়, বিরক্তিকর হয়ে উঠল।
ঐন্দ্রিলার এই বিপদ। এই সাংঘাতিক বিপদ 1
এর চেয়ে সর্বনাশ মেয়েদের যে আর কিছুই হতে পারে না। যথাসর্বস্ব হারাতে বসেছে সে–আক্ষরিক অর্থেও যথাসর্বস্ব। চরম সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। অথচ কীই বা বয়স তার! বলতে গেলে কৈশোরও কাটে নি, এই ঠিক প্রথম বয়স।
শুনেছে এ জগতে সৎ যে তারাই ভাল হয়; সতীত্বের বহু গৌরব, বহু বিজয়গাথা শুনেছে ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু না তার জীবনে না তার আত্মীয়স্বজন কারুর জীবনে–কখনই সে তার কোন প্রমাণ পেলে না।
শ্যামার যত দোষই থাক্–মনে-প্রাণে দেহে সে সতী।
আর ঐন্দ্রিলা! স্বামীকে এমন উগ্র, আবেগময়, সকল সংস্কারের অতীত ভালবাসার কথা–দেখা তো দূরে থাক্ শোনে নি পর্যন্ত। ঐন্দ্রিলা যদি সতী না হয় তো সতীত্বের কী অর্থ তা বোঝে না উমা। তাহলে স্বয়ং সতীকুলরাণীরও সতীত্বে সংশয় জাগা সম্ভব।
এই তো কিছু আগেই শ্যামা বলছিল, কী অত্যন্দ্র, অস্খলিত সেবা দিয়েই না ঐন্দ্রিলা ঘিরে রেখেছে স্বামীকে। গত কদিনে এক রাত্রিও সে বিশ্রাম পায় নি, ঘুম তো কল্পনাতীত। দিনরাত্রের একটি মুহূর্তেও স্বামীকে ছেড়ে ওঠবার তার উপায় নেই–হয়তো তার ইচ্ছাও নেই। হেম নাকি দু-এক বার প্রস্তাব করেছিল, সে বসছে, ঐন্দ্রিলা একটু গড়িয়ে নিক–কিন্তু ঐন্দ্রিলা রাজী হয় নি। হরিনাথের কখন কি অসুবিধা হয়, কখন কি প্রয়োজন হয়–তা সে ছাড়া বাকি আর কেউ বুঝবে না!
এই তো কালই নাকি–হেম যখন গিয়েছিল তার কিছু আগেই রক্তবমি করেছে হরিনাথ–সেই বমি দু’হাত ধরতে গিয়ে সমস্ত কাপড় ভেসে গিয়েছে ঐন্দ্রিলার। সে বেরিয়ে এসেছে একেবারে যোগিনী হয়ে, মনে হয়েছে রক্তবস্ত্রই পরেছে সে!
হে ঈশ্বর, এ কী করলে! এ কী করলে। কী পাপ করেছিল ঐটুকু মেয়ে তোমার কাছে! কেন ওর সুখের বাসা এমন করে ভেঙে দিচ্ছ!
বার বার পাগলের মতো অস্ফুট কণ্ঠে আপন মনেই বলে উমা।
নিষ্ঠুর, নীরন্ধ্র, কোন পাষাণপ্রাচীরে যেন সে প্রশ্ন বারবারই প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। নির্মম কোন অন্ধ এবং বধির দেবতা তাঁর দৃষ্টিহীন চোখ মেলে এই সংসারের দিকে চেয়ে আছেন, কিছুই তাঁর চোখে পড়ে না, কোন হাহাকার কানে পৌঁছে না।
উমা বাড়ি ফিরেও স্থির হয়ে বসতে পারে না।
কমলাকে প্রশ্ন করে, ‘দিদি কিছুই কি আমরা করতে পারব না। কোন কিছুই করবার নেই আমাদের?’
কমলা নিঃশব্দে চোখের জল মোছে।
অথচ সময়ও যে আর নেই তা দুজনেই বোঝে। ঐন্দ্রিলার চরম সর্বনাশের মুহূর্তট এগিয়ে আসছে, অমোঘ অপ্রতিহত গতিতে। শ্যামার মুখে শোনা রোগের বিবরণেই তা বোঝা যায়। আর বড় জোর পনেরো দিন, কি কুড়ি দিন, কি এক মাস।
ডাক্তার বলে গেছেন, একেই বাংলায় বলে রাজযক্ষ্মা–ইংরেজিতে গ্যালপিং থাইসিস। এ রোগ প্রকাশ পাবার পর রোগী দু মাসের বেশি নাকি বাঁচে না সাধারণত। এক মাস তো কেটেই গেছে কবে। …
অবশেষে উমা এক সময় বলে ওঠে, দিদি আমি একবার দেখতে যাব।
‘সে কি রে! তুই যাবি কি? কার সঙ্গে যাবি? তার মা-ই গেল না–। সে কী বলবে—’
‘কী বলবে? আর বললেই বা কি? আমার আর মান অপমান কি দিদি? তা ছাড়া আমি–আমি তো হরিনাথের নিজের শাশুড়ি নই–আমার কোন অপমানই গায়ে লাগবে না। …কিন্তু একবার না গিয়ে যে আমি থাকতে পারছি না–ভেবে দ্যাখো তো মেয়েটার অবস্থা, এই বিপদে একলা কী করছে সে, ঐটুকু একফোঁটা মেয়ে। …ঐ রুগী কোলে ক’রে একা বসে থাকা…আপনার লোক কেউ কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও তবু খানিকটা জোর পায়। নইলে পাগল হয়ে যাবে যে!’
‘কিন্তু সে জায়গা তো তুই চিনিসও না–কি করে কোথা দিয়ে যেতে হয়।’
‘ইস্টিশন থেকে জিজ্ঞেস ক’রে ক’রে চলে যাব এখন–সে আমি ঠিক খুঁজে নেব।’
‘তা হলে না হয় একবার খোকাকে সঙ্গে ক’রে’–কমলা অনেক ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত মত দেয়।
‘না মা, দিদি। একে গোবিন্দর শরীর ভাল নয়, তার উপর ঐ সর্বনেশে রোগ। ওকে নিয়ে যাব না। পদ্মগ্রামের পথও চিনি না যে–নইলে ওখানে গিয়ে হেমকে নিতুম সঙ্গে। গোবিন্দ আমাকে হাওড়ায় তুলে দিয়ে আসুক বরং–আমি ঠিক চলে যাব।
কমলা প্রবলবেগে ঘাড় নাড়লে, ‘না উমি, তা হয় না। একলা যাওয়া তোমার কিছুতেই হয় না। বিপদ আপদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম—পাড়াগাঁ জায়গা, নানা কথা উঠবে, সে সব শুনতে হবে তাকেই। মাঝখান থেকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে মেয়েটার!’
বিমূঢ় নিরুপায় হয়ে বসে থাকে উমা।
গোবিন্দর কথা দিদি বলেছে উপায় নেই বলেই–তা উমা জানে। রোগের মধ্যে গোবিন্দকে নিয়ে যাওয়া যায় না। দিদিরও একমাত্র সন্তান।
অথচ আর তেমন লোকই বা কৈ?
অনেকক্ষণ ধরে ভাবল উমা বসে বসে।
ক্রমশ অপরাহ্ন ম্লান হয়ে এল। কলকাতার গলিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে বহুক্ষণই। বুকচাপা ধূমমলিন দুঃসহ সন্ধ্যা। তারই মধ্যে ঝুসি অন্ধকারে পাথরের মতো বসে রইল উমা।
একটা কথা অনেকক্ষণ ধরে–সেই প্রথম থেকেই আবছা আবছা মাথা তুলতে চাইছে বার বার, বার বারই প্রবল বেগে সরিয়ে দিচ্ছে সে চিন্তাটাকে।
না, না, তা হয় না। তা সে করবে না। পারবেও না। সে বড় অসম্মান। বড় লজ্জার কথা। ছিঃ!
অথচ ঘুরে-ফিরেই আসছে কথাটা। অস্পষ্ট তার রূপ–তবু মনের অগোচরে পাপ নেই। সে আবছা ভাবনাটাকে উমা অস্বীকর করে উড়িয়েও দিতে পারে না।
॥৩॥
অবশেষে তেতলা বাড়িগুলোর কার্নিস থেকেও আকাশের শেষ রক্তরাগ মিলিয়ে এল। নিচে রাস্তার নতুন আমদানি গ্যাসের আলো জ্বলে উঠেছে বহুক্ষণ। তারই একটা ফালি আলো তেরছা ভাবে এসে পড়েছে ওদের ঘরের নোনাধরা দেওয়ালে–
গোবিন্দ ফিরল অফিস থেকে।
‘কী হয়েছে ছোট মাসী? এমন ভাবে বসে যে! পড়াতেও যাও নি তুমি?’
‘না রে!…বাবা, শোন একটা কথা। …তুই ওর–মানে, এই তোর মেসোমশায়ের ছাপাখানা চিনিস?’
‘কার?’ যেন বিস্ময়ে দু’পা পিছিয়ে যায় গোবিন্দ। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারে না।
‘তোর ছোট মেসোমশাইয়ের কথা বলছিলুম।’
প্রায় ফিসফিসিয়েই বলে কথাগুলো। সমস্ত রক্ত কানে এবং মাথায় চড়ছে বলতে বলতে। কান আগুন হয়ে উঠেছে। মাথার মধ্যে ঝাঁ-ঝাঁ করছে।
‘ছোট মেসোমশাই?…অ। ….হ্যাঁ চিনি। এই তো গরানহাটার মোড়টা ঘুরলেই।
‘আমাকে একবার নিয়ে যাবি বাবা? এখনই?
‘তু-তুমি? তুমি যাবে সেখানে? কী বলছ? তোতলা হয়ে যায় গোবিন্দ, ‘তুমি সেখানে যাবে কি?
হ্যাঁ বাবা, বিষম দরকার। আমাকে নিয়ে চ।’
তবু গোবিন্দর বিশ্বাস হয় না কথাটা।
‘তুমি যাবে কেন–আমি বরং গিয়ে ডেকে আনি না।’
‘না রে, সে সময় আর নেই।’
‘চল তবে।’ জুতোটা আবার পায়ে গলাতে গলাতে প্রশ্ন করে গোবিন্দ ‘কিন্তু ব্যাপারটা কি, কিছুই তো বুঝছি না!’
‘হরিনাথের বড্ড অসুখ, রাজযক্ষ্মা। একা মেয়েটা সেই মরণাপন্ন রুগী নিয়ে, বসে আছে, দেখবার কেউ নেই। আমি একবার যাব। তাই–’
কমলা ওদিকে রান্নায় ব্যস্ত ছিল, গোবিন্দর গলার আওয়াজ পেয়ে এখন ছুটে এল। উমার প্রস্তাব শুনে সে-ও অবাক।
‘তোর মাথা খারাপ হল উমি? খোকা গিয়ে শরৎ জামাইকে ডেকে আনুক না!’
‘আর সময় নেই। আজই রাত্তিরে আমি যেতে চাই। আয় খোকা–’ উমা কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে এসেছে সদরের কাছে। অগত্যা গোবিন্দকে নেমে আসতে হয়।
‘তাই বলে এমন করে এক বস্ত্রে–টাকা-পয়সা–’ কমলা ব্যাকুল হয়ে বলতে যায়, কিন্তু তার আগেই উমা হাঁটতে শুরু করেছে, কথাগুলো সম্ভবত তার কানেও গেল না।
শরৎ হেঁট হয়ে নিজের ডেস্কের ওপর ঝুঁকে পড়ে বোধ করি কী একটা হিসেব দেখছিল, বাইরে রাস্তার জুতোর আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে চেয়ে অবাক হয়ে গেল।
গোবিন্দর আসাটাই যথেষ্ট অপ্রত্যাশিত–কিন্তু তার পেছনে ও কে!
চকিতে একবার কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বিস্মিত এবং বিমূঢ় মুখে উঠে বেরিয়ে এল সে।
‘এ কী কাণ্ড? এমন ভাবে হঠাৎ? এসো এসো, এদিকে এসো। ট্রিডিম্যানটা আবার হাঁ করে এই দিকে চেয়ে আছে–’
একটু এদিকে সরে এসে উমা বিনা ভূমিকাতেই কথাটা পাড়লে–’হরিনাথের মরণাপন্ন অসুখ। খেঁদি একা, ওর বাড়ির লোকেরা পর্যন্ত কেউ ঘরে ঢোকে না। ছোড়দিও যাচ্ছে না…মেয়েটা পাগল হয়ে উঠেছে একেবারে। ….আমি একবার যাব এখনই। ….তুমি, তুমি আমায় নিয়ে যাবে?….অসুখটা খারাপ–গোন্দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়।
প্রস্তাবটা এমন অভাবনীয় আর আকস্মিক যে, কথাটা বুঝতেই শরতের বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। উমা অসহিষ্ণু ভাবে কয়েক মুহূর্ত প্রতীক্ষা ক’রেই চাপা অথচ প্রায় আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুমি,তুমি এটুকুও পারবে না?’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। পারব না কে বলেছে তোমাকে? কিন্তু এখনই কি করে হয়। এই রাত্রিবেলা, অচেনা জায়গা, তুমিও যাও নি কখনো। কাল ভোরে গেলে কি হয়?’
‘হরিনাথের অবস্থা যা শুনলুম এখন-তখন। এই অন্ধকার রাত– একা মেয়েটা একটা–যদি সত্যিই সেই অবস্থা হয়–’
কথাটা শেষ করতে পারে না উমা, কান্নায় গলা আটকে যায়।
একটু পরে আবার বলে, ‘আমি একাই যেতুম। রাত বলেই তোমার কাছে এসেছি। এত রাত্রে, বিপদ-আপদের কথা ছেড়েই দাও, ওরা কী বলবে না বলবে–। একমাত্র-একমাত্র তোমর সঙ্গেই এত রাত্রে কুটুম বাড়ি যাওয়া যায়।’
কথাটা বলে সেই অশ্রুবিকৃত মুখেও একটু হাসল উমা। অদ্ভুত, অর্থপূর্ণ, অথচ হতাশায় এক রকমের হাসি।
সে হাসিতে মুহূর্তে লাল হয়ে উঠল শরৎ। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি বললে, ‘কিন্তু অন্তত আধ ঘণ্টা তো তোমাদের দাঁড়াতেই হবে। ছাপাখানা না হয় ওরা কেউ বন্ধ করবে–চুরির ভয় আছে, কী আর করব–কিন্তু খুব জরুরী কাজগুলো বুঝিয়ে দিতে হবে, খদ্দেরের বাড়ি পুরুফ পাঠাতে হবে–বাড়িতেও একটা খরব–’
বলতে বলতে সচেতন হয়ে থেমে যায় শরৎ।
উমা বলে, ‘হ্যাঁ বাড়িতে একটা খবর পাঠাতে হবে বৈকি!… বেশ, আমরা এখানেই দাঁড়াচ্ছি। তুমি সেরে নাও।’
আবার ম্লান হাসে সে।
‘তুমি–তুমি বরং বাড়িতেই থাক না। আমি এখনই গিয়ে পড়ছি।’
শরৎ একটু বিব্রত ভাবে বলে।
‘না, বাড়ি আর ফিরব না। এখানেই দাঁড়াচ্ছি।’
শরৎ আর একটু ইতস্তত ক’রে মেরজাইয়ের পকেট থেকে চারটে টাকা বার করে গোবিন্দর হাতে দেয়। বলে, ‘জামাইয়ের অসুখ দেখতে যাচ্ছি–ফল-টল তো কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত। তোমরা বরং কযেকটা বেদানা, আঙুর–আর যা ভাল বোঝ কিছু কিছু নিয়ে এসো–ততক্ষণে আমার সারা হয়ে যাবে।’
‘জামাই শব্দটা নিজেরই কানে বোধ করি আঘাত করে। আবারও রক্তাভ হয়ে ওঠে তার সুগৌর শুভ্র ললাট।
।।৪।।
গোবিন্দ ওদের হাওড়া স্টেশনে তুলে দিয়ে গেল। তার মুখে ওদের দেখা হওয়া থেকে যাওয়া পর্যন্ত সব বিবরণ শুনে কমলা দুই হাত জোড় করে বার বার কপালে ঠেকাল।
‘হে মা আনন্দময়ী, শরৎ জামাইকে সুমতি দাও মা। এই থেকেই যেন ওর সব পাল্টে যায়–আর যেন ছাড়াছাড়ি না হয়। বুক চিরে রক্ত দেব মা তোমাকে, সোনার বিল্বিপত্তর দিয়ে।
উমার জীবনে এ এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা। স্বামীর সঙ্গে যে কোন দিন সত্যি-সত্যিই কোথাও যাবে বা যেতে পারবে–এ চিন্তা আজ সকাল পর্যন্ত ছিল ওর সুদূরতম কল্পনারও বাইরে। কিন্তু তাই তো শেষ পর্যন্ত হল।
শরতের মনে আর যা-ই হোক, যে ঝড়ই উঠুক–বাইরের প্রশান্তিটা বোধ করি প্রাণপণ চেষ্টাতেই সে আবার ফিরিয়ে এনেছিল। তার শান্ত নিরুদ্বিগ্ন মুখ দেখে বাইরের কোন লোকের কিছু অনুমান করার উপায় ছিল না। সাধারণভাবেই এক স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে কোথায় যাচ্ছে–একটুকুই মনে হবার কথা।
উমার অবশ্য এদিকে এত সচেতনতা ছিল না–থাকবার কথাও নয়–ঐন্দ্রিলার চিন্তাই তার মনের বেশির ভাগ জুড়ে তখন–তবুও এই ঘটনায় অভিনবত্ব একই সঙ্গে তার মনে একটা বেদনা ও সকরুণ কৌতুকের দোলা দিচ্ছিল বৈকি!
তবু ট্রেনের পথটা একরকম কাটল। গাড়িতে ভিড় ছিল না বেশি, এক বেঞ্চিতে পাশাপাশি বসলেও যতদূরে সম্ভব ব্যবধান বজায় রেখেই বসতে পেরেছিল ওরা। দুজনে দুদিকে চেয়ে বসে থাকারও কোন অসুবিধা ছিল না। উমা প্রায় সমস্তক্ষণই স্তব্ধ দৃষ্টিতে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বসে রইল–আর শরৎ রইল বেশির ভাগ সময়ই চোখ বুজে আত্মচিন্তায় ডুবে।
কিন্তু বিপদ বাধল স্টেশনে নেমে।
রাত বেশি হয় নি–কিন্তু তখনই সমস্ত স্টেশনটা থমথম করছে–মধ্য রাত্রির মতই নির্জন ও নিস্তব্ধ। বাইরে যতদূর দৃষ্টি যায় কোন লোকালয়ের চিহ্ন পর্যন্ত নজরে পড়ে না–বড় বড় গাছ ও বাঁশঝাড়ে এক নিবিড় নীরন্ধ্র অন্ধকার রচনা ক’রে রেখেছে।
এই অবস্থায় অজানা পথে যাওয়া যায় না। পথ জিজ্ঞাসা করতে গেলেও লোক চাই।
শরৎ বিপন্ন মুখে উমার দিকে চাইলে। উমা বিমূঢ়।
শেষে শরৎ এগিয়ে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের শরণাপন্ন হ’ল।
‘বলতে পারেন–আড়গোড়ার পথটা কোন্ দিকে পড়বে; আর কী ভাবে যাওয়া যায়?’
স্টেশন মাস্টারটি প্রবীণ। তিনি খানিকক্ষণ সন্দিগ্ধভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা ক’রে বললেন, ‘দেখুন, আমি স্থানীয় লোক নই। আড়গোড়ে একটা জায়গা আছে শুনেছি কিন্তু ঠিক কোথা দিয়ে যাওয়া যায় তা জানি না। আর সে আপনারা বলে দিলেও যেতে পারবেন না। তার চেয়ে এক কাজ করুন–একটা পালকি নিন, পালকিবেহারারা এখানকার বেশির ভাগ লোককেই চেনে–ওরা ঠিক পৌঁছে দেবে।’
‘পালকি।’ শরৎ যেন আরও বিব্রত বোধ করে, ‘দুটো পালকি পাওয়া যাবে তো?’
‘বোধ হয় না! দিনের গাড়িগুলোর সময় দু-তিনটে থাকে তবু–রাত্রিবেলা একটাই পড়ে থাকে সাধারণত। দেখছি–’
তিনি লণ্ঠন হাতে করে বেরিয়ে এলে তারই ক্ষীণ আলোতে দেখা গেল–পালকি একটা পড়ে আছে বটে কাঁটাগাছের বেড়ার ধারে–একটা বিরাট কাঠচাঁপা গছের তলায়–কিন্তু একদম বেওয়ারিশ, অর্থাৎ তার বেহারাদের পাত্তা নেই। অনেক ডাকাডাকিতে যখন সাড়া পাওয়া গেল না–তখন মাস্টারমশাই একজন চাকর পাঠালেন খোঁজ করতে।
বললেন, ‘এই কাছাকাছিই থাকে। তবে বাসায় থাকে তো ভাল, আর যদি নেশাভাঙ্ ক’রে কোথাও পড়ে থাকে তাহলে ঐ পর্যন্ত।’
স্টেশনে মাস্টারের ছোট ঘরে চেয়ার নেই, টুলের সংখ্যাও প্রয়োজনাতিরিক্ত নয়। তবু তিনি একটু সংকোচের সঙ্গে বললেন, ‘মেয়েদের একটা ওয়েটিং রুম তৈরির কথা হচ্ছে–তা কবে হবে জানি না। ওকে বরং এই টুলটা বাইরেই বার ক’রে দিই–একটু বসতে বলুন–!’
শরৎ প্রবল ভাবে ঘাড় নেড়ে জানালে, ‘না না–দরকার নেই। অমরা বাইরে ততক্ষণ একটু পায়চারি করি।’
উমা সব কথাই শুনেছিল–স্টেশনে মাস্টারের সামনে কিছু বলতে পারে নি, এখন শরৎ বাইরে আসতেই নিচু গলায় কেমন এক রকম সংকোচের সুরে বললে, ‘একটা পালকিতে কী ক’রে–মানে পালকিতে না চড়ে ওদের কিছু পয়সা দিলে আলো ধরে পৌঁছে দেয় না?’
শরৎ কুণ্ঠিত ভাবে বললে, ‘কিন্তু সেটা বড় খারাপ দেখবে, স্বামী-স্ত্রী এক পালকিতেই চড়ে থাকে সাধারণত। মাস্টারবাবু আবার কী ভাববেন হয়তো। তা ছাড়া দেরিও হয়ে যাবে অনেক। রাস্তা ভাল নয়, খালি পা তোমার, হোঁচট খাবে–কী করবে। লতা-টতার ভয়ও তো আছে।’
অর্থাৎ সাপখোপ। রাত্রে নাম করতে নেই।
উমা আর কথা কইলে না।
অনেকক্ষণ পরে স্টেশনের চাকরটি ফিরে এল। বেহারাদের পাওয়া গেছে। মূল্যবান কোন নেশা করে নি–একটু ভাঙ্ খেয়েছে বোধ হয়–তা তাতে কাজ আটকাবে না।
সংবাদটা ফিসফিস করে জানাল পোর্টার নগেন, আরও জানাল যে এত রাত বলে ওরা ভাবল ভাড়া চাইছে, তবে সে অনেক বলে-কয়ে বারো আনাতে রাজী করেছে।’
অগত্যা। শরৎ বললে, ‘পালকি এই ফাঁকায় আনতে বল-আর দেশলাই জ্বেলে দ্যাখো–তাঁরা কেউ আছেন কিনা।’
উমা চুপি চুপি বললে, ‘ভাঙ খেয়েছে বলছে–খানা ডোবা কি পগারে ফেলে দেবে না তো?’
শরৎ একটু হেসে উত্তর দিলে, ‘আমাদের বরাত। তবে নেশা করা ওদের অভ্যাস আছে, মনে তো হয় কিছু হবে না!’
সংকীর্ণ-পরিসর পলিকির মধ্যে দুজনকে মুখোমুখি বসতে হ’ল। হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু ঠেকাই শুধু নয়–একজনের হাঁটুর ওপর আর এক-জনের হাঁটু এসে পড়ল।
এই প্রথম দীর্ঘক্ষণ ধরে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে স্বামীকে ছুঁয়ে থাকার সুযোগ ঘটল উমার। মন যথেষ্ট ভারাক্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন থাকলেও ঘটনার অভিনবত্ব কিছুক্ষণের জন্য বিহ্বল করে তুলল বৈকি।
দুদিকের দরজা যতটা সম্ভব খোলা। তারই মধ্য দিয়ে প্রাণপণে মুখ বার করে রইল উমা। শরৎ ঠিক অতটা না হলেও, আর এক দিকে মুখ ফিরিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
স্বামী-স্ত্রী। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। নিস্তব্ধ রাত্রে নির্জন পালকির সংকীর্ণ পরিবেশে ঘনিষ্ঠ হয়েই বসে ওরা। দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ দুজনে শুনছে, হাঁটু দুটোর যেখানটা ছুঁয়ে আছে পরস্পরের–সেখানকার শিরাগুলো দুজনেরই দপদপ্ করছে। অপরের সম্পূর্ণ অনুভূতিগোচর সেটা। হয়তো কান পেতে থাকলে স্ত্রীর বুকে শোণিত তরঙ্গ-উদ্বেল হয়ে ওঠার শব্দও স্বামীর কানে যেত। তবু দুজনেই নির্বাক এবং যতদূর সম্ভব বাহ্যত নিস্পন্দ।
অন্ধকার রাত। সরু, পায়ে-চলা পথের মতো অপরিসর রাস্তা–তার দু’ধারে নিবিড় বাঁশবন ও বড় বড় বিভিন্ন গাছ জড়াজড়ি। নিরেট নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আকাশ দেখা যায় না–জনবসতির চিহ্ন চোখে পড়ে না–শুধু সেই একাকার অন্ধকারে অসংখ্য জোনাকি ঘুরে বেড়াতে থাকে–ওপরে নিচে, চারপাশে। যেন চারিদিকে ঘূর্ণমান নক্ষত্ররাশির মধ্যে অন্ধকার মহাশূন্যে চলেছে ওরা। বাইরে পালকি বেহারাদের নিঃশ্বাসের শব্দ না থাকলে–সবটা অপার্থিব ও অবান্তর বোধ হবার কথা।
একবার মাত্র ফিসফিস করে প্রশ্ন করল শরৎ, ‘ভয় করছে?’
উমা কোনমতে উত্তর দিল, ‘না।’
নিজেদের কাছেই ওদের গলা অপরিচিত মনে হ’ল। কেমন যেন বিকৃত রুদ্ধ স্বর। অতিকষ্টে স্বর ফুটল দুজনেরই। …
উমা যেন একটু বিস্মিত হয় নিজের অবস্থায়। কৈশোর কেটে গেছে কবে–যৌবনও। সন্তান হয় নি বলেই হয়তো–এখনও দেহের বাঁধন আছে, মধ্যবয়সী দেখায় না। প্রথম বয়সের মাদকতাও নেই, চাপল্যও নেই। সে সব কোন্ অতীতের কথা। অনুভূতি আবেগ–এগুলাও তো আজ কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, তবে বুকের রক্তে অকারণে এ কিসের তরঙ্গ জেগেছে, সমস্ত স্নায়ুতে এ কিসের কাঁপন? কেন স্বর বেরোয় না কণ্ঠে, কেন রাজ্যের সংকোচ গলা চেপে ধরে?
সে কি পাগল হয়ে গেল?
না, না, না। এ তাদের প্রণয়-অভিযান নয়।
এসব কিছুই নয়। নিতান্তই দায়ে-পড়ে পড়ে প্রয়োজনের গরজে সে স্বামীর কয়েক ঘণ্টার সাহচর্য প্রার্থনা করেছিল এবং স্বামীও, একান্তই ইচ্ছার বিরুদ্ধে, নিতান্ত এড়াতে না পেরে, সেটুকু দিতে রাজী হয়েছেন। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। সে যেন ভুল না বোঝে!
বার বার মনকে চোখ রাঙায় উমা। বুড়ো বয়সের আদিখ্যেতা বলে নিজেকেই ব্যঙ্গ করে। জামাই মৃত্যুশয্যা পেতেছে, একা মেয়ে বসে আছে সেখানে–শুধু সেই কথাটাই প্রাণপণে ভাবতে চেষ্টা করে।
অবশেষে একসময়, সে যে সহজ হয়েছে, এইটে প্রমাণ করবার জন্যই, নিজে থেকে কথা বলে, ‘ওরা বোধ হয় সব শুয়ে পড়েছে এতক্ষণে, না? এ তো নিষুতি রাত দেখছি এখানে!’
প্রাণপণ চেষ্টায় কথাগুলো বেরোল বটে কিন্তু তবু এখনও সে কণ্ঠস্বর এমনই বিকৃত শোনাল যে–নিজের এই শোচনীয় পরাজয়ের লজ্জায় সত্যি- সত্যিই চোখে জল এসে গেল উমার–শরৎ জবাব দিলে, তা তার কানেও গেল না।
॥৫॥
বেহারাই ডাকাডাকি ক’রে জাগালে সবাইকে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হরিনাথের মাও বেরিয়ে এলেন, হ্যারিকেনটা তুলে ধরে আগন্তুকদের চেনবার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘কে গা এত রাত্তিরে–কৈ চিনতে তো পারছি না!
উমা এগিয়ে এসে মাথার কাপড়টা একটু তুলে উত্তর দিলে, ‘আমি আপনার বেয়ান হই দিদি!’
‘বেয়ান? সে আবার কি?’
‘আমি আপনার হরিনাথের ছোট মাসশাশুড়ি। এতদিন তো খবর পাই নি, আজই খবর পেয়ে ছুটে আসছি।’
হরিনাথের মা ঈষৎ কান্নার ভঙ্গি করে বললেন, ‘আর কী করতে এলে বেয়ান, এতদিন পরে? আমার অমন সাজোয়ান সাড্ডোল ছেলের কিছুই যে নেই আর!…সে যে যেতে বসেছে। তার রক্ত যে শুষে নিয়েছে সব।’
তার পরই যেন কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন। অপেক্ষাকৃত সহজ কণ্ঠে বললেন, ‘তা সঙ্গে ইনি?’
কোথায় যেন একটু খোঁচা থাকে সে প্রশ্ন।
উমা ওপরের রকে উঠে এসে জবাব দিলে, ‘উনি যে আপনার বেয়াই। এত রাত্রে মেয়েছেলে কার সঙ্গে আর আসতে পারে বলুন?’
‘অ। তবে যে শুনেছিলাম–! তা বেশ বেশ। মিটে-টিটে গেছে ভাই, ঘরকান্না করছি, এইটেই আনন্দের কথা। …যার কথা হক, তা পাবেই–দু দিন আগে হোক আর দুদদিন পিছে হোক।’…
উমার কান-মাথা অপমানে ঝাঁঝাঁ করতে লাগল। সমস্ত শরীর দুলে উঠল যেন। সে পড়েই যেত–কোনমতে ঘরের দেওয়ালটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিল।
হয়তো হরিনাথের মা আরও কিছু বলতেন–মুখরোচক প্রসঙ্গের তৃপ্তি তাঁর মুখে চোখে ফুটে উঠেছিল–কিন্তু অকস্মাৎ বাধা পড়ল। ঐন্দ্রিলা ইতিমধ্যে অতি-পরিচিত গলার স্বর শুনে বিস্মিত হয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল, হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলোতেও উমাকে চিনতে পেরে সে প্রায় আর্তকণ্ঠ চিৎকার করে উঠল।
‘মাসীমা! ছোট মাসীমা।’
তার পর একেবারে ওর পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ল, ‘ওগো মাসীমা কী দেখতে এলে মাসীমা? আমার সব্বনাশের যে আর দেরি নেই! ওগো আমি যে আর পারছি না। আমি যে পাগল হয়ে যাব।’
পাগলের মতোই টিপ্ টিপ্ করে মাথা খুঁড়তে লাগল সে উমার পায়ের কাছে। তার পাশে বসে উমা কোনমতে জোর ক’রে ঐন্দ্রিলার মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিলে, কিন্তু সান্ত্বনার একটি কথাও মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারলে না। মর্মান্তিক দুঃখের এই বুকফাটা অভিব্যক্তির সামনাসামনি দাঁড়িয়ে তারও এতক্ষণকার সমস্ত হৃদয়াবেগ, সমস্ত ক্ষোভ দুঃখ অপমান বুকের মধ্যে উদ্বেল হয়ে উঠেছে–চোখের জল কিছুতেই কোনমতেই অভিমান ও মর্যাদাবোধের পাষাণপ্রাচীরে আবদ্ধ থাকছে না।
ঐন্দ্রিলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে হু হু ক’রে কেঁদে উঠতে পেরে অবশেষে সে যেন বাঁচল।
আতিথেয়টার কোন ত্রুটি হ’ল না অবশ্য। শরতের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেই রাত্রেই নতুন করে রান্নার আয়োজন করা হ’ল। এবং ঠিক চর্ব্য-চোষ্য গোছের ব্যবস্থা না হলেও নিতান্ত নগণ্য হ’ল না। উমার গলা দিয়ে কোন আহার্য নামা সম্ভব নয়–এ কথা করজোড়ে বার বার জানিয়েও কোন ফল হ’ল না। অশোভন পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হয়েই শেষ পর্যন্ত উঠে এসে থালার সামনে বসল এবং দু-এক গ্রাস নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ল।
তারপর শোয়ার পালা।
বেয়ান একটু যেন বিশেষ, অর্থপূর্ণ মুচকি হেসে জানালেন যে ওপাশের ঘরে খাটে তাদের শয্যা প্রস্তুত, উমারা এইবার শুয়ে পড়ুক। আর রাত করবার দরকার নেই।
উমা একবার অপাঙ্গে শরতের মুখের পানে তাকাল। তার প্রশান্ত ভাবলেশহীন মুখে কোন উত্তেজনা কি উদ্বেগই নেই, সে যেমন বাইরের রকে পায়চারি করছিল তেমনই করছে–শুধু তার মুখের চুরুটটা প্রতিবারই দীর্ঘটানে অনেকখানি করে পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে।
মাথা নামিয়ে উমাও সহজ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি শুয়ে পড় গে যাও। আমি এ ঘরে এসেছি, এ কাপড়ে খাটে শোব ন। আমি খেঁদির কাছেই থাকব রাত্রে।’
হরিনাথের মা বিষম ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ‘না না, বেয়ান। এই এত কাণ্ড করে আসা–আবার রাত জাগা উচিত হবে ন। তুমি শুয়ে পড়। আমরা তো আছিই, বৌমা একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবেন স্বচ্ছন্দে
বিরক্তিটা এবার আর উমার কণ্ঠে চাপা রইল না। সে বললে, ‘না বেয়ান–ঘুমোতে আমি আসি নি। তাছাড়া বেশিদিন তো থাকতে পারব না, কাল সকালেই আমাকে চলে যেতে হবে। যে ক-ঘণ্টা আছি একটু মেয়ের পাশেই বসে থাকি। কিছুই করতে পারব না। তা জানি–তবু দুঃখটা একদিন ভাগ ক’রে নিতে পারব অন্তত। আপনি বরং শুয়ে পড়ুন গে। ….আপনারা তো রোজই রাত জাগছেন–একদিন একটু বিশ্রাম নিন।’
তার কণ্ঠস্বরে কী ছিল এক জানে, হরিনাথের মা যেন একটু থতমত খেয়ে গেলেন। হয়তো বেশি ঘাঁটাতেও সাহস হ’ল না। আস্তে আস্ত বললেন, ‘তবে যা ভাল হয় করো। বেয়াই মশাই আপনি শুয়ে পড়ুন বরং–আর অনর্থক রাত করবেন না।’
শরৎ হাতের চুরুটটা ফেলে দিয়ে এবার উমার মুখের দিকে তাকাল। বেশ সহজ কণ্ঠেই বলল, ‘আমিও না হয় থাকি না তোমাদের সঙ্গেই। একটা রাত না-ই ঘুমুলুম!’
এইটুকু সহানুভূতিতেই কি উমার গলা এত অবাধ্য হয়ে ওঠে? শরৎকে এই মুহূর্তে ঈর্ষাই করে সে। কেমন অনায়াসে সহজ ও স্বাভাবিক হয় ও–উমা পারে না কেন? প্রাণপণে গলার কাঁপন চেপে সে বলে, ‘না না। অনর্থক তোমাকে আর রাত জাগতে হবে না। দরকারও তো নেই। ….আবার কাল সকালেই তো তোমাকে কাজে বেরোতে হবে। …..তা ছাড়া ঐ রোগের মধ্যে যাওয়া!….পুরুষ মানুষ তোমরা–তোমাদের ওপর বহুলোকের ভাত-ভিক্ষে নির্ভর করছে।’