০৫. অধৈর্য বোধ করছিল অহনা

॥ ৫ ॥

বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য বোধ করছিল অহনা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বুড়ো মতো লোকটা ম্যানেজারের ঘরে ঢুকেছে তো ঢুকেইছে, বেরোনোর নাম করছে না। কে এমন কেষ্টবিষ্টু কে জানে, ট্রে সাজিয়ে চা-বিস্কুট-মিষ্টি গেল অন্দরে। তুৎ, এভাবে পুরো সকালটা ব্যাঙ্কে নষ্ট করার কোনও মানে হয়?

জরুরি দরকার না পড়লে অহনা বড় একটা আসে না জেলা সমবায় ব্যাঙ্কের এই শাখায়। ভাল লাগে না পরিবেশটা। ভিড় যথেষ্টই থাকে, কিন্তু কর্মচারীরা কেমন গা-ছাড়া। দেখে মনে হয় এইমাত্র ঘুম থেকে উঠল, এখনও খোঁয়াড়ি কাটেনি। টাকা জমা নিতে অনীহা, পেমেন্ট করতে বিরক্তি…। নেহাত সুদ এরা হাফ পারসেন্ট কম নেয়, নইলে কবেই অহনা এখান থেকে অ্যাকাউন্ট সরিয়ে নিত।

অহনা ঘড়ি দেখল। বারোটা পঁয়ত্রিশ। কৃষ্ণা বড়জোর একটা, সওয়া একটা অবধি থাকবে। চলে গেলে আর কিছু নয়, নিজেকেই ভাত বাড়তে হবে, খাবার-দাবার নিয়ে বসতে হবে টেবিলে। অজস্র গাঁইগুই সত্ত্বেও মাকে গতকাল বেহালা পৌঁছে দিয়ে এসেছে অহনা, এ ক’দিন কৃষ্ণাই তো ভরসা। বিশেষ করে এই দুপুরবেলাতে। কৃষ্ণা থাকতে থাকতেই অর্ঘ্য যদি সকালের চক্করটা সেরে ফিরে আসে তাও খানিকটা বাঁচোয়া, নইলে দামড়া খোকাটিকে খাওয়ানো দাওয়ানোর দায়িত্ব তো অহনার ঘাড়েই চাপবে।

হ্যাঁ, খোকাই তো। অর্ঘ্যর ডাকনাম তো খোকাই। কাজেকম্মেও খোকা রয়ে গেছে এখনও। কাল রাত্রে বাড়ি ফিরে শরীর আর চলছিল না, অর্ঘ্যকে একটু চা বানিয়ে দিতে বলল, সে সরসুদ্ধ দুধটুধ দিয়ে যে দ্রব্যটি করে আনল, মুখে দেয় কার সাধ্যি! চুমুক দিয়ে নিজে পর্যন্ত বলছে, খুব অখাদ্য হয়েছে, না অণুদি! এদিকে কত না বারফাট্টাই কথা। অহনার বাড়ির সব কাজ নাকি করে দেবে! মাকে বাগানের কাজে সাহায্য তো দূরস্থান, নিজের ঘরটি পর্যন্ত এখনও সেই দশাতেই আছে। কৃষ্ণা হাত লাগাতে গেলেও হাঁ হাঁ করে ওঠে। ছেলেটার বোধশক্তি বলে বোধহয় কিস্যু নেই, না হলে ওই ঘরে কেউ বাস করতে পারে!

ম্যানেজারের দরজা খুলেছে। অহনা টানটান। বেরোচ্ছে ধুতি-পাঞ্জাবি, সঙ্গে বিনয়ে গদগদ ম্যানেজার। প্রায় ব্যাঙ্কের গেট অবধি ভদ্রলোককে এগিয়ে দিয়ে ফিরছে। অহনার ওপর চোখ পড়ামাত্র হাসিহাসি মুখে বলল, “সরি। আপনাকে অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হল। আসুন।”

ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে অহনা জিজ্ঞেস করল, “ভদ্রলোকটি কে? আমাদের মতো হেঁজিপেঁজি নয়, নিশ্চয়ই কোনও বড় বিজনেসম্যান?”

“দূর, টিয়াডাঙায় আবার ব্যবসায়ী কোথায়! সব তো সবজিওয়ালা। বড়জোর সার-সিমেন্টের ডিলার।” বছর পঞ্চাশের ম্যানেজারটি মুচকি হেসে চোখে একটা অর্থপূর্ণ মুদ্রা ফোটাল, “উনি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।”

“মানে?”

“যে বোর্ড এই সমবায় ব্যাঙ্ক চালায়, উনি তার প্রেসিডেন্ট। সরকার বদলের পর আগের সভাপতিকে সরিয়ে এঁকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আজই প্রথম পা রাখলেন আমাদের ব্রাঞ্চে। একটু খাতির না করলে চলে!”

এতক্ষণে অহনার বোধগম্য হল ব্যাপারটা। নতুন সরকার আসার পর থেকেই চারদিকে পরিবর্তনের ঢেউ। স্কুল কলেজ ইউনির্ভাসিটি সমবায়, সর্বত্রই এখন পুরনো কমিটি ভেঙে যাচ্ছে, আসছে নতুন লোক। সাধারণ মানুষের তাতে কত লাভ হচ্ছে কে জানে, তবে নয়া দেবতাদের তুষ্ট রাখা তো ম্যানেজারবাবুদের পরম কর্তব্য। আগের জমানার মতোই ইনিও নিশ্চয়ই স্থানীয় রাজনীতির ওজনদার লোক, সেটাও তো ম্যানেজারবাবুকে মাথায় রাখতে হয়।

যাক গে, আদার ব্যাপারী অহনার জাহাজের খবরে কী দরকার! অহনা নিস্পৃহ স্বরে বলল, “তা আমাকে আবার ফোন করে ডাকলেন কেন? বললেন জরুরি কাজ আছে…”

“হ্যাঁ, আছে তো।” ম্যানেজার সোজা হয়ে বসল। টেবিলে হাত দুটো রেখে বলল, “আমাদের ব্যাঙ্কের তরফ থেকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।”

“কীরকম?”

“আপনার আশাবরীর ওভারড্রাফ্ট লিমিট আছে দশ লাখ। ওটা বাড়িয়ে বিশ লাখ অবধি করতে পারেন। অ্যাট লিস্ট মেক ইট ফিফটিন।”

“হঠাৎ এমন উদারতার কারণ? আমি তো অ্যাপ্লাই করিনি?”

“আমরা দেখছি আপনার অ্যাকাউন্টটা চমৎকার রান করছে। লোনের অ্যামাউন্ট বাড়ছে ক্রমশ, রিপেমেন্ট ইজ অলসো ভেরি রেগুলার। দ্যাট মিন্স আপনার ব্যাবসা ভালই চলছে। অ্যান্ড এক্সপ্যান্ডিং। সে জন্যই বলছি, আপনি আরও বেশি পরিমাণ ওভারড্রাফ্ট তো পেতেই পারেন…”

“কিন্তু আমার তো দশ লাখ টাকার জন্যই সিকিউরিটি দেওয়া আছে। আমার বাড়ি জমি ধরে ওরকমই তো একটা হিসেব করেছিলেন তখন। আমি তো নতুন করে আর কিছু…”

“প্রয়োজন নেই।” ম্যানেজার হাসছে, “ক্লায়েন্ট বুঝে সিকিউরিটির হেরফের করাই যায়। আপনি তো অলরেডি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। জ়াস্ট একটা ফরমাল প্রেয়ার দিন, আমরা অ্যাপ্রুভ করে দেব। আপনারও ব্যাবসা বাড়ুক, সমবায় ব্যাঙ্কের ঘরেও দু’-চার পয়সা আসুক। চাইলে আপনার ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটটাকে আরও বড় করতে পারেন। নতুন মেশিনারি কিনুন, হ্যান্ড আরও বাড়ান…”

শুনতে তো অহনার ভালই লাগছে। কারখানার শ্রীবৃদ্ধি ঘটলে মন্দ হয় না। ওই বাড়িটা আধাখ্যাঁচড়া অবস্থায় পড়ে আছে, বাকিটুকু নির্মাণ করে নিলে অনেকটা জায়গা বাড়ে। এখন স্টোররুমটা বড্ড ছোট, ও দিকের বাড়তি ঢালাইয়ের নীচে স্বচ্ছন্দে একটা বড় ঘর উঠে যাবে। অফিসটারও কোনও সৌষ্ঠব নেই, লোকজন এলে বসতে দেওয়া যায় না, সাজিয়ে গুছিয়ে চেকনাই বাড়ালে আশাবরীরই ইজ্জত চড়বে। মাত্র সাতজনে অনেক দিন আটকে আছে সোলার ইউনিট, আশিটা ল্যাম্প ডেলিভারি দেওয়ার পর এবার তো প্রোডাকশন বাড়ানোর ব্যাপারটা ভাবাই উচিত। স্যার না বলেন, উঁহু, শুধু বলেই থেমে থাকেননি, হিসেব কষেও দেখিয়েছেন, ব্যাবসা ক্রমাগত না বাড়ার অর্থ আস্তে আস্তে কমে যাওয়া, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। সুতরাং আরও স্টাফ নিয়ে আশাবরীর কলেবর যদি হৃষ্টপুষ্ট হয়, তো সেটা নিশ্চয় খারাপ কিছু নয়।

কিন্তু কেন এসব করবে অহনা? ব্যাবসা বাড়ল, না কমল, তাতে সত্যিই কি অহনার কিছু যায় আসে? সে কি এক পা এক পা করে বিজনেস টাইকুন হওয়ার জন্য গড়েছিল আশাবরী? মোটেই না। বরং তার উদ্দেশ্যটাই তো ব্যর্থ। উদ্যম দূরে থাক, কাজেকর্মে আগ্রহই তো সে হারিয়ে ফেলেছে। আশাবরী এখন এমনই এক জেলখানা, যার পরিধি বাড়লে অহনার হয়তো আরও শ্বাস রোধ হয়ে যাবে। এখন তো আফশোস হয়, একটু মুক্ত বাতাস খুঁজতে এসে কেন যে সে এক বাঁধাধরা নিষ্প্রাণ গণ্ডিতে নিজেকে বেঁধে ফেলল? না, আর নয়, কোনও প্রলোভনের ফাঁদেই আর পড়বে না অহনা।

শুকনো হেসে অহনা বলল, “আপনাদের অফারের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমার কোনও এক্সপ্যানশান প্রোগ্রাম নেই, আমি বাড়তি কোনও ঝুঁকি নিতেও চাই না।”

“কেন ম্যাডাম? আপনি একজন সাকসেসফুল এন্টারপ্রেনার। আমরা আপনার উদ্যোগের কত প্রশংসা করি…”

সফলতা আর ব্যর্থতা কি এত সহজে মাপা যায়? অহনা হাসল মনে মনে। আরও শুকনো গলায় বলল, “না ম্যানেজার সাহেব। এই মুহূর্তে ব্যাবসা বাড়ানোর আমার কোনও প্ল্যান নেই।”

“নো প্রবলেম। তবে অফারটা মাথায় রাখুন। ইউ আর অলওয়েজ় ওয়েলকাম।”

অহনা ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল। আকাশে আজ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ঢাকনা। ফাঁকফোকর দিয়ে গলে আসা রোদ্দুরের তেজও যেন অনেকটা কম। গ্রীষ্মকালের এই সময়টায় পথেঘাটে বড় একটা ভিড় থাকে না। গতি বাড়িয়ে মোপেড চালাচ্ছিল অহনা। বেশি স্পিড ওঠে না অবশ্য। তিরিশ কিলোমিটার পেরোলেই থরথর কাঁপতে থাকে ইঞ্জিন। তবু এই বাহনটি অহনার বড় সাধের। বেশি জোরে ছুটতে পারে না বলেই কি? হয়তো। জোরে ছোটা যে কী ভয়ংকর নেশা, অহনা তা হাড়ে হাড়ে জানে।

ফিরে আজ আর অফিস নয়, সোজা বাড়ি। এবং যা ভয় পেয়েছিল তাই, কৃষ্ণা ভেগে গেছে। অর্ঘ্য বাইরের ঘরের সোফায় বসে দেরিতে আসা খবরের কাগজ পড়ছিল, সুসমাচারটি সেই দিল।

অহনা জিজ্ঞেস করল, “তুই কখন এলি?”

“এই তো দশ-পনেরো মিনিট হবে। তোমার ইলাদেবীর কাছ থেকে চাবি নিয়ে ঢুকলাম।”

“অর্থাৎ খাওয়া হয়নি?”

“তোমার জন্যই ওয়েট করছি।”

“আমি এখন না ফিরলে? খেতিস না?”

“তা নয়…তবু…দুটো মানুষ বাড়িতে আছি…”

“বুঝেছি।…আয়, থালা লাগাচ্ছি।”

“তুমি স্নান করে এসো। আমার তেমন তাড়া নেই।”

“কেন রে? খিদে পায়নি?”

“সে এক কাণ্ড। এক বাড়িতে জল চাইলাম, মুড়ি বাতাসা নারকোল ধরিয়ে দিল। ঘরের ঢেকি ছাঁটা চালের মুড়ি… কী অপরূপ স্বাদ…”

“কোথায় এত আপ্যায়ন করল তোকে?”

“এই তো, ঈশ্বরপুরে।”

অহনা বিস্মিত স্বরে বলল, “তুই লাস্ট উইকেও ঈশ্বরপুর গেছিলি না?”

“হ্যাঁ…মানে….” অর্ঘ্য যেন সামান্য থতমত। তারপরই আলগা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “অনেক সময়েই এক গাঁয়ে একাধিক বার যেতে হয়।”

পালটা আর প্রশ্ন জুড়ল না অহনা। তবে মনে যেন একটা খচখচানি রয়েই গেল। স্নান সেরে এসে যখন খেতে বসল, তখনও খটকাটা যায়নি।

হঠাৎই অহনা জিজ্ঞেস করে ফেলল, “তোর কোশ্চেনেয়ারটা আমায় দেখাস তো।”

“কেন? কী করবে?”

“এমনি। কৌতূহল। কী ধরনের ডাটা কালেকশন করিস সেটাই একটু বুঝতে চাইছি।”

“আমরা সোশিও ইকনমিক ইনফর্মেশনই বেশি জোগাড় করি। সামাজিক নানান নিয়ম-কানুন সম্পর্কে কার কীরকম ভিউ তাও জানার চেষ্টা করি। যেমন ধরো, অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়া… ছেলে মেয়ে দু’জনকেই লেখাপড়ার সুযোগ দেওয়া নিয়ে কে কী ভাবছে… সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের পাস্ট হিস্ট্রিটাও জানার চেষ্টা…।” বলতে বলতে একটু থামল অর্ঘ্য, “আজ একটা বেশ ইন্টারেস্টিং তথ্য পেলাম। তুমি তো অনেক দিন এখানে আছ, নিশ্চয়ই তোমার নলেজে আছে…”

“কী বল তো?”

“পাশের ওই গ্রামটার নাম ঈশ্বরপুর কেন? কেনই বা এই গ্রামের নাম আলাইপুর?”

এমন কথা কোনও দিন মাথাতেই আসেনি অহনার। তাচ্ছিল্যের সুরে অহনা বলল, “ধুস, ওসব খবর আমি রাখি না।”

“রাখা উচিত। তুমি যাদের সঙ্গে আছ… যাদের নিয়ে কাজ করছ… তাদের তুমি ভাল করে চিনবে না?”

“জ্ঞান মারিস না। কী শুনলি সেটা বল।”

“তুমি কি জানো এক সময়ে এই গ্রামটার নাম আগে ছিল শিবনগর? আর ঈশ্বরপুর তখন মামুদপুর?”

“তা হবে। তো?”

“শিবনগরে তখন এক ঘরও মুসলমান ছিল না। আর মামুদপুর ছিল হান্ড্রেড পারসেন্ট মুসলিম ভিলেজ। এই শিবনগরে একটা বিখ্যাত শিবমন্দির ছিল। প্রত্যেক চৈত্র সংক্রান্তিতে সেখানে মেলা বসত।”

“মন্দির তো এখনও আছে। বাইরের চত্বরটায় চড়কের মেলাও বসে।”

“এটা সেই মন্দির নয়। আমার কথা শোনোই না।” অর্ঘ্য গলা ঝাড়ল, “দুই গাঁয়ে তখন একটা চাপা রেষারেষি ছিল। সেই সময়ে শিবনগরের এক ছেলে মামুদপুরের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটিকে নিয়ে সে পগার পার হয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু পালানোর দিন মেয়ের বাবা সব জেনে যায়। অমনি মামুদপুরের সমস্ত জোয়ান-মদ্দ লাঠিসোঁটা নিয়ে হানা দেয় শিবনগরে। ওই শিবমন্দিরে মেয়েটাকে নিয়ে লুকিয়েছিল সেই তরুণ, টের পেয়ে মামুদপুরের লোকেরা মন্দিরটাই অ্যাটাক করে। মন্দিরের দরজা ভেঙে মেয়েটাকে উদ্ধার করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। ছেলেটাকে তারা মেরে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে শিবের মন্দিরটাকেও চুরমার করে দিয়ে যায়। শিবনগর প্রথমে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল, তারপর তারাও দল বেঁধে চড়াও হল মামুদপুর। ব্যস, বেধে গেল লাঠালাঠি। মেয়েটিও খুন হল, মামুদপুরের মসজিদও গুঁড়িয়ে দেওয়া হল মাটিতে। তারপর থেকে দুই গাঁয়ের ভয়ংকর শত্রুতা। পরস্পরের আকচাআকচি এমন একটা আকার ধারণ করল, এ গ্রামের লোক ও গ্রামের লোককে একা পেলে জানে মেরে দিচ্ছে। রাতের অন্ধকারে গিয়ে এ ওর খেত জ্বালিয়ে দিচ্ছে, পুকুরে বিষ ঢেলে আসছে…। খুনোখুনি লাঠালাঠির ঠেলায় দু’ গাঁয়েই চাষবাস লাটে ওঠার দশা, সদাই কাজিয়া বাধার আতঙ্কে দু’পক্ষই সিঁটিয়ে থাকে। এমনই এক সময়ে সিরাজ সাঁইয়ের এক চেলা এসে হাজির হয়। কেউ বলে সে হিন্দু, কেউ বলে সে মুসলমান…”

অহনা বলল, “সিরাজ সাঁইয়ের নামটা তো খুব শোনা শোনা! লালন ফকিরের গুরু না?”

“হতে পারে, জিজ্ঞেস করিনি। তোমাদের এখানে কাছেই যেন কোথায় সতীমায়ের মেলা হয়, সেখানেই যাচ্ছিল সেই চ্যালাটি। দু’গাঁয়ের কোন্দলের কথা শুনে চলে আসে এখানে। গাঁয়ের মাথাদের ডেকে সে জিজ্ঞেস করে, এই লড়াই ঝগড়ায় কার কী লাভ হয়েছে এখনও পর্যন্ত। কারও মুখে বাক্যি নেই। অবশেষে সে মিটমাটের এক রাস্তা বাতলায়। বলে, দু’পক্ষকেই সাজা ভুগতে হবে, নইলে নাকি মনে জমে থাকা রাগ যাবে না। মুসলমানরা নিজের হাতে মন্দিরটা গড়ে দেবে আর মসজিদখানা বানাতে হবে হিন্দুদের। শুধু তাই নয়, আল্লার নামে শিবনগরের নাম হবে আলাইপুর, আর মামুদপুর হবে এখন থেকে ঈশ্বরপুর। নতমস্তকে সেই দরবেশের কথা সেদিন মেনে নিয়েছিল সবাই। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, তারপর থেকে দুই গ্রামে একটি বারের তরেও আর বিবাদ বাধেনি।”

অর্ঘ্যর মুখে গাঁয়ের উপাখ্যান শুনতে বেশ আজব লাগছিল অহনার। কাহিনি শেষ হওয়ার পর বলল, “এসব গপ্পোও তোর সমীক্ষার কাজে লাগে নাকি?”

“তা একটু লাগে বই কী।” অর্ঘ্যকে যেন সামান্য আনমনা দেখাল, “এইসব গল্পকথা দিয়েই তো দেশের মানুষকে ভাল করে চেনা যায়।”

“বটে? তা আলাইপুর-ঈশ্বরপুর এপিসোড থেকে কী চিনলি?”

“মানুষ শান্তি চায়।” বিড়বিড় করে আবার বলল অর্ঘ্য, “মানুষ শান্তি চায়।”

একটু যেন থমথমে হয়ে গেছে অর্ঘ্যর মুখ। ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আঙুলগুলো। আপন মনে দোলাচ্ছে মাথা। অহনা যে সামনে বসে ড্যাবড্যাব চোখে দেখছে তাকে, তা যেন খেয়ালই নেই।

হঠাৎ অর্ঘ্য এত ভাবিত হয়ে পড়ল কেন? অহনার মাথায় ঢুকছিল না। তবে আর কৌতূহলও দেখাল না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে থালা নিয়ে উঠে গেল রান্নাঘরে। আঁচিয়ে এসে বাড়তি খাবার তুলছে ফ্রিজে। নজরে পড়ল এখনও নিথর বসে আছে অর্ঘ্য।

এই অর্ঘ্য যেন অহনার একেবারেই অচেনা। হাসিখুশি রগুড়ে ছেলেটার সঙ্গে এই চিন্তামগ্ন যুবকের যেন আকাশ-পাতাল ফারাক। যেন কচি কচি নেই আর, দুম করে বেড়ে গেছে বয়সটা।

অহনা মৃদু স্বরে বলল, “এই, শেষ কর।”

যেন ঈষৎ চমকাল অর্ঘ্য। তারপর ঘাড় নামিয়ে মন দিয়েছে থালায়।

অহনা ঘরে যাচ্ছিল, কী ভেবে ঘুরে এল, “আবার বেরোবি নাকি?”

“উঁ?…হুঁ।”

“এবেলা বেশি দূরে যাস না। আকাশে মেঘ করছে। গুমোটও আছে। বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি নামতে পারে।”

অর্ঘ্য চোখ তুলে তাকাল। স্বর ফুটেছে। চিলতে হেসে বলল, “নয় একটু ভিজলামই।”

“থাক। ওই সব শখ বাড়ি গিয়ে মেটাস। হঠাৎ জ্বরটর বাধালে এখানে কে দেখবে, অ্যাঁ?”

“কেন, তুমি তো আছ।”

“আমার বুঝি কাজ নেই? ঘরে বসে তোর সেবা করলে চলবে?” অহনার স্বরে ছদ্ম কোপ, “সাফ বলে দিচ্ছি, পাকামি করে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি কিন্তু স্রেফ ঘেটি ধরে বের করে দেব। তারপর রাস্তায় পড়ে থাকো, জাহান্নমে যাও, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।”

মজারু ভাবটা ফিরে এসেছে অর্ঘ্যর, “তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারবে অণুদি? আমার ওপর?”

“আমি তো নিষ্ঠুরই।” আচমকা কোত্থেকে এক দলা ক্ষোভ ঠিকরে এল অহনার গলা থেকে, “সব্বাই তো আমাকে তাই বলে।”

অর্ঘ্য অপ্রস্তুত মুখে বলল, “আরে তুমি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ কেন? আমি তো মজা করছি।… ঠিক আছে, বৃষ্টির জল গায়েই লাগাব না। ফোঁটা পড়ার আগেই লক্ষ্মী ছেলের মতো প্যাভিলিয়ানে ফিরে আসব। খুশি?”

হাসতে চেষ্টা করল অহনা। সেভাবে ফুটল না হাসিটা। মন্থর পায়ে এল নিজের ঘরে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। দেখছে বিম্বিত অহনাকে। মনে মনে নিজেকে ধমকাচ্ছে কড়া গলায়। কেন যে হঠাৎ হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারায় স্নায়ু? তাই কি রুক্ষ কর্কশ ছাপ পড়ে যাচ্ছে মুখে? দেখতে সে কোনও কালেই রূপসি নয়, মেরেকেটে সুশ্রী বলা চলে, একফালি স্নিগ্ধ লাবণ্যও হয়তো ছিল একসময়। কিন্তু এখন তার লেশমাত্র আছে কি? চোয়াড়ে মার্কা রং জ্বলে যাওয়া মুখখানায় রাগ বিরক্তি নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কোনও অনুভূতিই যেন ফোটে না আজকাল। একটা মানুষকে ঘেন্না করে নিজেকেই কি আমূল বদলে ফেলল অহনা? অথচ সেই মানুষটা দিব্যি মজাসে আছে! থাকবেও। লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি চড়ছে। আর প্রেমের সুধায় অবগাহন করছে নিত্যদিন। হায় রে অহনা, তুই শুধু আশাবরীই কর আর দিনকে দিন কুত্সিত হ। ভেতরে বাইরে, সর্বাঙ্গে। অর্ঘ্যর মতো কচি সরল ছেলেটাও নিশ্চয়ই তোর চালচলন দেখে মনে মনে হাসছে।

নিজেকে খানিক গাল পেড়ে অহনা শুয়ে পড়ল বিছানায়। চোখ জড়িয়ে আসছিল, উঠল জোর করে। আজ বুধবার, মাইক্রো-ফিনান্সের মেয়েগুলোকে নিয়ে সপ্তাহের এই দিনটাতে বসে অহনা। গত সাত দিনের কাজের হিসেব নেয়, বানিয়ে দেয় আগামী সাত দিনের কর্মসূচি। সুতরাং ঘুমকে বিদায়, নেমে পড়ো পার্থিব লেনাদেনায়।

তার আগে সুশোভন স্যারকে একটা ফোন। ব্যাঙ্কের প্রস্তাবটা জানিয়ে রাখা উচিত। যাহ, আজও সুইচড অফ। হল কী স্যারের, সেই অর্ডার মেলার দিন থেকেই নিরুদ্দেশ। কোথাও গেছেন নাকি! খোঁজ নিতে হবে তো।

ঘর থেকে বেরোতেই চোখ পড়েছে অর্ঘ্যর কামরায়। দরজা আধখোলা, শয্যায় অর্ঘ্য উদাস শুয়ে, বুকের ওপর ল্যাপটপ। কী ভাবছে? হিসেব করছে কিছু?

নিঃশব্দে সরে যেতে গিয়েও অহনা ফিরে এসেছে। গলা খাকারি দিয়ে বলল, “শুনছিস?”

ল্যাপটপ সামলে অর্ঘ্য ঘুরে তাকিয়েছে, “বলছ কিছু?”

“হ্যাঁ।…বেরোনোর সময়ে চাবিটা আর অফিসে দিয়ে যাওয়ার দরকার নেই।”

“তা হলে তুমি…? কৃষ্ণা…?”

“আমাদের কাছে এক সেট করে আছে। তুই কখন ঢুকিস, কখন বেরোস… ওটা তোর কাছেই থাক এখন।”

গ্রিলগেট খুলে ছোট্ট মাঠটুকু পেরিয়ে অহনা এল অফিসে। মায়া শান্তা দেবিকা, আশাবরী মাইক্রো-ফিনান্সের তিন সৈনিকই উপস্থিত। গল্প করছে নিজেদের মধ্যে। কে কেমন আছে, জানারও আগ্রহ নেই অহনার, চেয়ারে বসেই টাকা সংগ্রহের হিসেব নিতে শুরু করেছে।

পাঁচটা মিনিটও কাটেনি, মোবাইল সরব। মনিটরে মাতৃদেবী।

সেলফোন কানে চেপে অহনা উঠে অফিসের বাইরেটায় গেল, “হ্যাঁ, বলো।”

“ঝুমারা তো এইমাত্র রওনা দিল। হাওড়া থেকে ট্রেন। সাড়ে পাঁচটায়।”

“বাহ, তুমি তো তা হলে এখন পুরোপুরি স্বাধীন। ফ্ল্যাটময় ঘুরে ঘুরে নাচো।”

“ধ্যাৎ! সারাটা দিন একা একা কী করে যে কাটবে!”

“এখানে কীভাবে কাটে? টিভি দেখা, কাগজ পড়া, গড়াগড়ি খাওয়া, বাগান করা… ওখানেও তো সবই মজুত। শুধু বাগানের বদলে টব। বাড়তি কাজও তো আছে একটা। ছেলের জন্য রোজ ভাল ভাল খাবার বানানো। ছেলের পছন্দসই মালাইকারি, চিতল মাছের মুইঠ্যা…।”

“লাল্টুর তেলমশলা খাওয়া বারণ হয়ে গেছে রে।”

“কেন, প্রেশার-টেশার ধরা পড়ল নাকি?”

“শুধু কি প্রেশার, কোলেস্টেরলও নাকি বেশ হাই। ঝুমা পইপই করে বলে দিয়েছে, আমি যেন ওকে রিচ কিছু না খাওয়াই।”

“তা হলে তো তোমার হাতে বেড়ি। মন দিয়ে স্টু-ই রাঁধো।”

“তোদের ও দিকের কী খবর? অর্ঘ্য এখন কোথায়?”

“ঘরে।”

“আর তুই?”

হয়তো নিছকই সরল জিজ্ঞাসা। তবু ঝাং করে চটে গেল অহনা। মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, অর্ঘ্যর সঙ্গে লীলাখেলায় মেতে আছি। কোনওক্রমে সামলে নিয়ে বলল, “রোজ এই সময়ে যেখানে থাকি, ঠিক সেখানেই আছি।”

বাক্যের চোরা ঝাঁঝ বুঝি টের পেল না শেফালি। সহজ ভঙ্গিতে বলল, “আশাবরীতে? তা ভাল। আজ কৃষ্ণা কী রাঁধল?”

শেফালির প্রশ্নের শেষ নেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছে ঘরদোরে ঠিকঠাক ঝাঁট পড়েছে কি না, কৃষ্ণা কখন এল, কতক্ষণ ছিল, ফিনাইল দিয়ে ঘর মুছেছে না স্রেফ ভিজে ন্যাতা বুলিয়েছে, বাগানে জল পড়েছে কি না, কে জল দিল, আকাশে রোদ না মেঘ, বৃষ্টি নামার আগে যেন মনে করে জানলা বন্ধ করা হয়…। অহনা ফোন যখন ছাড়ল, কান রীতিমতো গরম হয়ে গেছে।

অফিসে ফিরে ফের কাজ। শুনতে হচ্ছে নানান সমস্যার কথা। কোন স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সদস্যদের মধ্যে মতের অমিল হচ্ছে, কারা টাকা দিতে টালবাহানা করছে, কী কী ব্যাবসার জন্য ঋণ দেওয়া এখন উচিত হবে না, এরকম অজস্র সাতসতেরো। তারই মাঝে হঠাৎ এক আবদার জুড়ল মায়া। ঝালকাঠি গ্রামের গামছার খুব সুনাম। যারা গামছা বোনে তাদের বাড়ির মেয়ে-বউরা একটি নতুন গোষ্ঠী গড়তে ইচ্ছুক, সবাই মিলে ধার নিয়ে একটা পাওয়ারলুম বসাতে চায়। মায়ার প্রবল বাসনা, তার ওপর যেন ছেড়ে দেওয়া হয় নয়া সেল্ফহেল্প গড়ার ভার। প্রস্তাবটা অহনা এক কথায় নাকচ করল না বটে, তবে এক্ষুনি অনুমতিও দিল না। কাঁধে বাড়তি জোয়াল নেওয়ার আগে অনেক কিছু খতিয়ে দেখার ব্যাপার আছে। সে নিজে আগে সরেজমিন করবে, সবাইকে নিয়ে মিটিং ডাকবে, শেখাবে নিয়মকানুন। সময়ে টাকা ফেরত না দিলে কী হতে পারে তাই নিয়ে ভয় দেখানোটাও খুব জরুরি। তার পরেও যদি মেয়েগুলোর ইচ্ছে থাকে, তখন না হয়…। কোনওক্রমে কাটাতে পারলে অহনা তো বেঁচে যায়। তা বলে নিজের অনিচ্ছের ব্যাপারটা মেয়েগুলোকে টের না পেতে দেওয়াই ভাল। তাতে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের বড় ক্ষতি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

বিকেল থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সূর্য ডুবতেই ঝাঁপিয়ে এসেছে বৃষ্টি। অর্ঘ্য বেআক্কেলেপনা করেনি, আলো থাকতে থাকতেই সেঁধিয়ে গেছে কুলায়।

সন্ধে থেকে টিভি গিলছে অর্ঘ্য। কৃষ্ণা রুটি করে চলে গেছে, অহনা একটু চাউমিন বানাচ্ছিল। রান্নায় তার মোটেই স্পৃহা নেই, অর্ঘ্যর জন্যই ঢুকেছে হেঁশেলে। একবার হালকা ভাবে মুখ ফুটে বলতেই যেভাবে হ্যাংলার মতো রাজি হয়ে গেল!

দু’হাতে দু’খানা প্লেট নিয়ে অহনা হাজির। স্বভাববিরুদ্ধ তরল স্বরে হাঁকছে, “খানা তৈয়ার, জলদি খাও। আওর লাগেগা তো নেহি মিলেগা।”

অর্ঘ্যর ভ্রূক্ষেপ নেই, টিভিতে একটা খবর দেখছে গভীর মনোযোগে। কোরাপুটের কাছে একদল সশস্ত্র পুলিশের সঙ্গে উগ্রপন্থী বাহিনীর লড়াই হয়েছে জোর। অতর্কিতে হানা দিয়েছিল উগ্রপন্থীরা, মারা গেছে বারোজন পুলিশ, আহতও হয়েছে উনিশজন। উগ্রপন্থীদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম, তাদের মাত্র চারজন কমরেডের মৃত্যু ঘটেছে, তিনজন ধরা পড়েছে অকুস্থলে।

দু’-দু’বার ডাকার পরেও সাড়া না পেয়ে অহনা বিরক্ত। গোমড়া গলায় বলল, “একই নিউজ কেন চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিস। এইসব মারামারি তোর ভাল লাগে?”

“এটা তো মারামারি নয়। এরা একটা আদর্শের জন্য লড়ছে?”

“কী জানি বাবা। মানুষ খুন কি কখনও আদর্শ হতে পারে?”

“যুদ্ধে মানুষ মরে না? যুদ্ধ কি খুন? ভাল কারণে যুদ্ধ কি হয় না? কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে তোমরা তো ধর্মযুদ্ধই বলো?”

“অত বুঝি না। তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরিণামে কি শান্তি এসেছিল? খারাপরা হয়তো মরল, কিন্তু তাদের বাড়ির লোকরা? বউ-ছেলে-মেয়েরা? তাদের কী হাল হয়েছিল? এ ছাড়া আরও যে লাখো সৈনিক মরেছিল, তাদের প্রাণের দাম নেই? নাকি আদর্শ ধর্মযুদ্ধ এইসব ভারী ভারী কথার আড়ালে তাদের অস্তিত্বই মূল্যহীন হয়ে গেছে। তা ছাড়া যারা জিতেছিল, তারাই কি ভাল? অন্যায়যুদ্ধে একের পর এক যোদ্ধাকে মেরেছে…”

আচমকা ঝুপ করে টিভি বন্ধ করে দিল অর্ঘ্য। চাউমিনের প্লেট ছুঁলই না। উঠে ঢুকে গেল নিজের গলতায়।

অহনা থ। হঠাৎ হলটা কী অর্ঘ্যর? সে কি ভুলভাল কিছু বলল?

.

॥ ৬ ॥

অহনার সাইকেলখানা পাশে রেখে নদীর পাড়ে বসে ছিল অর্ঘ্য। সামনে একটা বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঘন সবুজে ভরা দ্বীপের আড়ালে একটু একটু করে মুখ লুকোচ্ছে সূর্য। শ্রান্ত আলো তাপ হারিয়ে স্তিমিত ক্রমশ। গাছ-গাছালি রং হারাচ্ছে। বহতা জলে মৃদু একটা ধ্বনি জাগছে বটে, তবে স্রোত বেশি নেই। ভালভাবে লক্ষ না করলে নদীতে এখন জোয়ার চলছে না ভাটা, ঠাহর করা মুশকিল।

বিকেলে আজ সেভাবে কোথাও যায়নি অর্ঘ্য। এমনিতেও যে সে খুব নিয়ম করে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে, তা নয়। কাছেপিঠে কোথাও একটা গেল, কোনও একটা বাড়ির আঙিনায় ঢুকে পরিবারের কর্তা-গিন্নি-ছেলে-মেয়ে যাকে হাতের কাছে পেল তার সঙ্গেই আলাপ জমাল, তাদের সংসারের বিষয়েই হয়তো গল্পগাছা করল খানিকক্ষণ, তারপর ধীরেসুস্থে বেরিয়ে পড়ে আর একটা বাড়ির সন্ধানে। প্রায় সর্বত্রই আশাবরীর পরিচয়টা দিতে হয় অবশ্য, নইলে অজানা অচেনা লোকের কাছে কেউ মুখ খুলতে চায় না বড় একটা। এভাবে পাঁচ-সাতটা বাড়ি ঘুরলেই দিব্যি বেলা কাবার। আর কোনও গপ্পোবাজের পাল্লায় পড়ে গেল তো অর্ঘ্যর পোয়া বারো। একজনেতেই হু হু কেটে যায় সময়। তাতেই যা মালমশলা জোটে, স্বচ্ছন্দে সে ম্যানেজ করে নেয় অহনাকে।

কিন্তু সেরকম কাউকে খুঁজে নিতেও তো ইচ্ছে করল না আজ। এলোমেলো সাইকেল চালাল খানিকক্ষণ, তিন-চারখানা গ্রাম পেরিয়ে একটা শানবাঁধানো পুকুরের ধাপিতে জলে পা ডুবিয়ে বসে রইল কিছুটা সময়। ঘাটে কয়েকজন মেয়ে বউ ছিল, তারা এমন সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল! গাঁ-গঞ্জের মানুষজন আর মোটেই গল্পের বইয়ে পড়া সরল গ্রামবাসীটি নেই, অপরিচিত কাউকে তারা সহজে বিশ্বাস করে না, এ সত্যিটা ক’দিনেই টের পেয়ে গেছে অর্ঘ্য। অগত্যা উঠে আসতেই হল, সাইকেল নিয়ে ফিরেই এল আলাইপুর। অস্থায়ী ডেরায় গিয়ে শুয়ে পড়লেই চলত, কিন্তু কেন যে নদীর পানেই ঘুরে গেল সাইকেলের মুখ?

অহনার কাছাকাছি থাকতে অর্ঘ্য কি অস্বচ্ছন্দবোধ করছে? হ্যাঁ, কিছুটা তো বটেই। ক’দিন ধরে এত বেশি প্রশ্ন করছে তার অণুদি! শুধু অর্ঘ্যর দৈনিক কাজ নিয়ে নয়, কখনও দিদি, কখনও আসানসোল, কখনও বা অর্ঘ্যর কলেজ ইউনিভার্সিটি জীবন…। বর্তমানকে ঢেকে, অতীতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একের পর এক জবাব দিয়ে যাওয়া যে কী দুরূহ! তাও সামাল দিতে পারে অর্ঘ্য, কিন্তু অণুদির মুড? তার থই পাওয়া বুঝি আরও কঠিন, অর্ঘ্যর পক্ষে বোধহয় অসম্ভব। এই ঠান্ডা, তো এই গরম। এই মোটামুটি হাসিখুশি, তো পর মুহূর্তে তোলা হাঁড়ি।

কাল সন্ধেবেলাই তো কী বিশ্রী কাণ্ডটাই না হল। পুরনো একটা উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা হচ্ছিল টিভিতে। তেমন একটা মনোযোগ দিয়ে নয়, তবু দেখছিল অর্ঘ্য। পাশের সোফায় বসে অহনাও।

হঠাৎ অহনার প্রশ্ন, “হ্যাঁরে, তুই বিয়ে করবি না?”

অর্ঘ্য এড়ানোর ভঙ্গিতে বলেছিল, “ধুস স্টেডি জব কিছু করছি না… এখন ওসব ভাবনার কোনও মানে আছে?”

“গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়ই? কবে তোর সময় হবে সেই প্রতীক্ষায়?”

“সরি। আমি ওসব লাইনে নেই।”

“বাজে বকিস না। তোর এত সুন্দর চেহারা, পেটে বিদ্যে গজগজ করছে, চেষ্টা করলেই সামনে ব্রাইট ফিউচার… কোনও মেয়ে তোকে দেখে পটেনি এ আমায় বিশ্বাস করতে হবে?”

“কোরো না বিশ্বাস। যা সত্যি তাই বলছি।”

“স্টুডেন্ট লাইফেও তোর কোনও মেয়ে বন্ধু ছিল না?”

“হ্যাঁ। অজস্র ছিল। তবে তুমি যা ভাবছ তেমন নয়। তারা স্রেফ বন্ধুই ছিল।”

“তুই কক্ষনও তাদের কারও ওপর অ্যাট্রাকশান ফিল করিসনি?”

“আমি তাদের সে চোখে দেখিইনি কখনও। সত্যি বলতে কী, প্রেম ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। আমার মনে হয়, ও ব্যাপারটা যুক্তিবুদ্ধির একটা অসুখ। মগজের টেম্পোরারি ইনস্যানিটি।”

শুনে অহনার কী হিহি হাসি। অহনাকে এ ক’দিনে কখনও অমনটা হাসতে দেখেনি অর্ঘ্য। পরের মিনিটেই আচমকা সিরিয়াস। রাগরাগ গলায় বলল, “পাগলামি কি সাধে আসে, পাগল বানিয়ে ছাড়ে।”

কথাটার মানে বুঝতে পারেনি অর্ঘ্য। ভ্যাবাচ্যাকা মুখে তাকিয়েছিল অহনার দিকে। অহনার তখন চোখ জ্বলছে। ক্রুদ্ধ নাগিনীর মতো ফুঁসে উঠল, “পুরুষমানুষ জাতটাই নেমকহারাম। আর মেয়েরা বোকার হদ্দ। ফাঁদে তারা পড়বেই।”

অর্ঘ্য নার্ভাস গলায় বলেছিল, “এসব কী বলছ? সব ছেলে খারাপ হবে কেন? মেয়েরাও মোটেই সবাই নির্বোধ নয়। এই তো, তুমিই কি কম ইন্টেলিজেন্ট লেডি? কীভাবে কতজনকে নিয়ে একটা এত বড় প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছ!”

পলকে অহনা আরও ক্ষিপ্ত, “কে চায় এসব চালাতে? যত্তসব রাবিশ।”

বলেই পুরো স্পিকটি নট। মুখে এমন কুলুপ এঁটে রইল, সামনে বসে থাকতে অর্ঘ্যর বুক দুরদুর। সেই অহনাই আবার এক ঘণ্টা পরে স্বাভাবিক স্বরে খেতে ডাকল, বাতচিত করছে টুকটাক…। অর্ঘ্য তো হতবাক। হঠাৎ হঠাৎ কী যে হয় অণুদির! অসুখী দাম্পত্যের কারণেই মনে এত ভাঙচুর!

হতে পারে। হতেও পারে। হতেই পারে।

তা অহনার ক্ষণভঙ্গুর মেজাজ মর্জিই কি এখন নদীতীরে ঠেলে পাঠিয়েছে অর্ঘ্যকে? খানিক তফাতে থাকবে বলেই কি বসে বসে ঢেউ গুনছে সে?

উঁহু, অর্ঘ্যর মনটাই আজ ভাল নেই। আজ কাকভোরে ফোন এসেছিল বাবার, তখন থেকেই। কাল বিকেলে আসানসোলের ফ্ল্যাটে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মা, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়, কোমরে জোর চোট পেয়েছে। কাঁধেও। তার চেয়েও বড় দুঃসংবাদ, মাথায় একটা বিশ্রী আঘাত লেগেছে। পড়ার পরে মা অচেতন হয়ে গিয়েছিল, হাসপাতালে গিয়ে জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু কারওকে চিনতে পারছে না। ডাক্তাররা সন্দেহ করছে, ব্রেন হেমারেজ। আগামীকাল স্ক্যান করা হবে, তারপর প্রয়োজন হলে অপারেশন।

সমাচারটা শোনার পর থেকেই অর্ঘ্য অস্থির অস্থির বোধ করছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ মানে তো এক ধরণের সেরিব্রাল স্ট্রোক। মা বাঁচবে তো? যদি বা প্রাণে রক্ষা পায়, প্রায় অচেতন ভেজিটেবল হয়ে যাবে না তো চিরতরে? যদি পরে আর সুযোগ না মেলে, চুপিচুপি একবার দেখে আসবে মাকে? বাবা অবশ্য বলল, ঝুঁকি নেওয়ার এক্ষুনি দরকার নেই, তবু…। বাবা তার অবস্থান জানে না, হয়তো ভাবছে খোকা এখনও মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড়ের বনে বাদাড়ে বাস করছে। যেমন অহনারা জানে অর্ঘ্যর বাবা-মা এখন সিঙ্গাপুরে, তেমন বাবা-মাকেও অর্ঘ্য ওই রকমই একটা ধারণা দিয়ে রেখেছে কিনা। চরম প্রয়োজন ছাড়া এই নম্বরটায় ফোন করতেও তো নিষেধ করেছিল বাবাকে। তার পুরো পরিচয় সম্ভবত এখনও পুলিশের খাতায় নেই, তবে আসানসোলের অর্ঘ্য রায় নিশ্চয় তাদের সন্দেহের তালিকার বাইরে নয়। সুতরাং মাকে দেখতে যাওয়া মানে বাবাকে বিপন্ন করা। উচিত হবে কি?

যুক্তিবুদ্ধির বাইরে গিয়ে অর্ঘ্য একটা বড়সড় শ্বাস ফেলল। উচিত আর অনুচিতের দ্বন্দ্ব কি অর্ঘ্যকে শোভা পায়? ক্লাস নাইনে চে গুয়েভারার জীবনীটা পড়ার দিনই কি তার বাকি জীবনটা কোন পথে গড়াবে, স্থির হয়ে যায়নি? সেই রাত থেকেই তো উচিত অনুচিতের বোধ একটা মাত্র নির্দিষ্ট অভিমুখে গড়িয়েছে। কলেজে পড়ার সময় যখন সে বাঁধাছকের বাইরের রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি শুরু করল, বাবা তো বটেই, মাও কি কম বাধা দিয়েছে? বলেনি, তুই কি চাস, তোর জন্য আমাদের কোমরে দড়ি পড়ুক? সে তখন বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর, আদৌ মূল্য দেয়নি তাদের আকুতিতে। সঠিক কাজই করেছে সে, কারণ বিপ্লব ওই ধরনের ব্যক্তিগত আবেগকে অনুচিতের লিস্টেই রাখে সর্বদা। এম-এ পরীক্ষার মুখে মুখে সে যখন চলে গেল ওড়িশায়, নয়াগড়ে পার্টির গোপন সম্মেলনে যোগ দিল, তখনই তো পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কটা সে মনে মনে ছিঁড়ে ফেলেছে। তারপর সে বাড়িতে আবার এসেছে ঠিকই, কয়েক বছর হয়তো বাসও করেছে মা বাবার সঙ্গে, কিন্তু ভবিষ্যতের ছবি তো তখন পরিষ্কার। গত আড়াই বছরে এক-দু’বারের বেশি মা-বাবার খোঁজ নেয়নি অর্ঘ্য, উচিত মনে করেছে বলেই নেয়নি, এবং তার জন্য অর্ঘ্যর মনে কোনও পাতিবুর্জোয়াসুলভ পাপবোধও নেই। তা হলে আজ কেন এই দোলাচল? কেনই বা মা’র বিষণ্ণ মুখখানা বারবার হানা দিচ্ছে চোখের পাতায়?

নাহ, এইসব জোলো অনুভূতিকে বেশি প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। মিছিমিছি মনকে দুর্বল করে লাভ আছে কোনও? বরং এখানে থাকতে থাকতেই ছকে নেওয়া দরকার, আগামী দিনে কী হবে তাদের কর্মপন্থা। পার্টি যে রাস্তা ধরেছে, সেটা কি অভ্রান্ত? শুধু অর্ঘ্য নয়, দলের অনেকের মনেই তো এখন সংশয়। রাজন, সৌরভ, গণেশন তো বলছে হয় স্টিয়ারিং ধরে গাড়ির মোড় ঘোরাও, নয়তো ঝাঁপ মেরে নেমে পড়ো, ক’জন মিলে অন্য একটা গাড়ি বানিয়ে নেব আমরা।

কিন্তু নতুন গাড়িটাও যে ভুল পথে যাবে না তার কী নিশ্চয়তা?

এতেও সেই দোলাচল? উফফ, কী যে করে অর্ঘ্য?

বসে থেকে থেকে হাঁটু ধরে গেছে। অর্ঘ্য উঠে দাঁড়াল। পাশেই এক কালীমন্দির, বেশ চকচকে চেহারা, মেঝেয় টাইলস, দিনের অন্তিম কিরণ মেখে নতুন রং করা দেওয়াল ঝকঝক করছে। ভালই ভিড়। আজ কোনও বিশেষ পুজোটুজো আছে নাকি?

তাকিয়ে থাকায় ব্যাঘাত ঘটল। নদীর ধার থেকে কে একজন ডাকছে। অর্ঘ্য এগিয়ে এল, “আমাকে বলছ কিছু?”

“হ্যাঁ কত্তা।” খাটো মলিন ধুতি পরা খালি গা লোকটা লজ্জা লজ্জা মুখে হাসছে, “তখন থেকে দেখছি, নদীর ধারে ঠায় বসে আছেন। আপনে বুঝি সিন সিনারি ভালবাসেন?”

“ওই আর কী।” হেসেই বলল অর্ঘ্য, “খারাপ লাগে না।”

“চলেন না কত্তা, একটু নৌকো বিহার করে আসবেন। নদী থেকে চারদিক আরও মনোহর লাগবে।”

“তোমার নৌকা আছে বুঝি?”

“এই তো। নীচেই পাড়ে বাঁধা একটা ডিঙি নৌকা দেখাল লোকটা,” আসেন না কত্তা, “গরমকালের সাঁঝবেলায় নদীর হাওয়ায় মনটা তর হয়ে যাবে।”

বড্ড পীড়াপীড়ি করছে তো? সারাদিন ভাল রোজগারপাতি হয়নি সম্ভবত। অর্ঘ্য হেসে বলল, “তা নেবে কত?”

“সে আপনার যা প্রাণ চায়। আপনি হলেন গিয়ে আশাবরী দিদির অতিথি, একটু সেবা করার সুযোগ পেলেই ধন্য হই।”

বিনয়ের অবতার! চালাক লোক, দরাদরির মওকা দিল না। তবে অণুদি আর তার প্রতিষ্ঠান যে এই অঞ্চলে সমার্থক হয়ে উঠেছে তার আরও একটা প্রমাণ পাওয়া গেল। বলতে হবে অণুদিকে। চটে না যায়!

ঘাট বলে কিছু নেই, ভাঙাচোরা পাড় বেয়েই সাবধানে নেমে অর্ঘ্য চড়েছে নৌকায়। পাটাতনে মেলে দিয়েছে পা। লোকটা বাঁশে বাঁধা দড়ি খুলে লগি দিয়ে চাড় দিল পাড়ে। দুলতে দুলতে সরে যাচ্ছে ডাঙা। বাড়ছে ছলাৎ ছল।

মসলিনের চাদর গায়ে জড়িয়ে আঁধার নামছে নদীতে। ভিজে ভিজে বাতাসে ভারী নরম একটা আমেজ। কাঁসর ঘণ্টা বাজছে মন্দিরে, আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। আয়েসি সুখে মনটা সত্যিই তর হয়ে যাচ্ছিল অর্ঘ্যর।

আচমকাই মগজে হাতুড়ির ঘা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মা এখন পাঞ্জা লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে, আর সে কিনা নদীবক্ষে সান্ধ্যভ্রমণে বেঁচে থাকার মজা চাখছে তারিয়ে তারিয়ে!

পলকে উবে গেছে আনন্দ, ফের সেই বিস্বাদ অনুভূতি। তখনই মাঝির গলা পেল অর্ঘ্য “আরাম হচ্ছে না কত্তা। শরীর যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে, তাই না?”

প্রশ্নটা যেন পরিহাসের মতো বাজল অর্ঘ্যর কানে। জবাব দিল না, তেতো মুখে স্থলভূমির পানে তাকিয়ে আছে শুধু। একটু পরে সামান্য স্থিত হল মন। নৌকা সফর যাতে পুরোপুরি বৃথা না যায়, কেজো কৌতূহলে ব্যস্ত করতে চাইল নিজেকে। ফিনফিনে অন্ধকারমাখা মায়াবী চরাচর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “তোমার নামটা কী, ভাই?”

“আজ্ঞে, দুলাল।” লোকটা ঘাড় ফেরাল, “দুলাল দাস।”

“নৌকাটি কি তোমার?”

“আজ্ঞে। গত সনে বলাগড় থেকে বানিয়েছি। খুব মজবুত কাঠ। অন্তত দশ বছর টিকবে।”

“এই মাঝিগিরি করে বুঝি পেট চলে?”

“আমি তো মাঝি নই কত্তা। এ তো মাছের নৌকো। জাল ফেলে নদীতে মাছ ধরি।”

“তা পাও মাছ? শুনি নদীতে আজকাল মাছ নাকি খুব কমে গেছে?”

“হ্যাঁ কত্তা। এত ভুটভুটি চলে হরদম! পোড়া ডিজেলে মাছেদের বংশ নাশ হয়ে যাচ্ছে। এই তো মা ভাগীরথীর জলে, আগে বহরমপুর পর্যন্ত ইলিশ মিলত, এখন আর তেনাদের ঝাঁক নৈহাটি পেরিয়ে আসেই না।” লোকটা মেশিনের মতো দাঁড় টানছে দু’হাতে। ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, “তারপর ধরুন জল তো অনেক কমে গেছে। চোখের সামনে কত যে চর গজিয়ে উঠল। সান্যালের চর, কালিগঞ্জের চর… এই তো সামনেই কেমন একটা গজিয়েছে, এখনও নাম দেয়নি কেউ, তবে এরই মধ্যে সবুজে সবুজ। যে পারছে গিয়ে চাষবাস শুরু করে দিচ্ছে।”

“তুমিও ওখানে চাষ করো নাকি?”

“না কত্তা, জমিজিরেতের কাজ আমার আসে না। বংশের পেশাতেই টিকে আছি কোনওমতে। আর আপনাদের মতো লোকজন জুটে গেলে দুটো বাড়তি পয়সা হাতে আসে।”

“তা লেখাপড়া করেছ কদ্দূর?”

“পেরাইমারির পাশটা দিয়েছিলাম। তারপর বাবা ঘেঁটি ধরে নৌকোয় নিয়ে এল। বলল, ঢের বিদ্যে হয়েছে, এবার মাছ মেরে পেটের জোগাড় করো।”

চিনদেশের সেই মহান বিপ্লবীর কথাটা মনে পড়ে গেল অর্ঘ্যর। মাটির সঙ্গে যাদের নিবিড় যোগ, তাদের আগে চেনো জানো, তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি করো বিপ্লবী চেতনা। দুলালও তো সেরকমই একজন, নয় কি?

উৎসাহ নিয়ে অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করল, “তা দুলালভাই, পড়াশোনা যে করতে পারলে না, তার জনা আফশোস হয় না?”

“কী হত লেখাপড়া শিখে?” দুলাল দাঁড় টানা থামিয়ে অবাক চোখে তাকাল, “আমি কি আপনাদের মতো প্যান্টশার্ট পরে অফিস যেতাম? মাঝখান থেকে ছেলের মতো দশা হত আমার।”

“তোমার ছেলে? কেন তার কী হয়েছে?”

“সে আর বলবেন না কর্তা। তাকে ইস্কুলে পাঠালাম, খেয়ে না খেয়ে মাস্টার রাখলাম, তিনিই ঠেলে গড়িয়ে স্কুল পার করে দিলেন, কলেজে ভরতি হল ছেলে। তবে কলেজের দরজা আর পেরোতে পারল না, ইতি হয়ে গেছে পড়াশোনায়। লাভের মধ্যে লাভ, জাল ফেলে মাছ ধরার বৃত্তিতে সে আর আসতেই রাজি নয়। নদীতে জাল ছুড়ছে, ভাবতেই নাকি তার মানে লাগে। এদিকে চাকরি জোটানোরও মুরোদ নেই। কিন্তু সারাক্ষণ কানে মোবাইল গোঁজার অভ্যেসটি ধরে গেছে বাবুর। পয়সার ধান্দায় এখন পার্টির বাবুদের পেছনে ল্যাং ল্যাং করছে।”

“কোন পার্টি করে তোমার ছেলে?”

দুলাল কেমন যেন সন্দিগ্ধ চোখে অর্ঘ্যর দিকে তাকাল। তারপর ফের সক্রিয় হয়েছে তার দু’কাঁধ। দাঁড়ে জল কাটতে কাটতে বলল, “সরকারি দলের সঙ্গেই থাকে আর কী।”

“মানে এখন যারা সরকারে আছে?”

“আগের সরকারের সঙ্গেও ছিল।”

“মানে লাল থেকে তেরঙা? ডিগবাজি?”

দুলাল এবার ধূর্তের মতো হাসছে, “আমাদের গরিব ঘরের ছেলেদের কি পতাকার রং দেখলে চলে? সরকারে যে আছে তার সঙ্গে থাকলে তাও দুটো-চারটে পয়সা ঘরে আসে।”

“সরকারের ডোল মেলে বুঝি? মানে সাহায্য?”

“সাহায্য বলেন সাহায্য, ভিক্ষে বলেন ভিক্ষে… সে আপনি যে নামই দ্যান… খুদকুড়ো মেলে বই কী। দেড়শো টাকা রোজে বছরে অন্তত ষাট সত্তর দিন। পুকুর কাটার কাজ, রাস্তা সারানোর কাজ…। তাও অর্ধেক দিন যেতে হয় না। কার্ডে সই করে দিলেই রোজের অর্ধেক হাতে গুঁজে দেয় দাদারা।”

“এটা তো দুর্নীতি। কাজ করো, পুরো পয়সা নাও। এইসব দু’নম্বরিকে তোমরা প্রশ্রয় দিচ্ছ কেন?”

“ছাড়েন কত্তা। যা জোটে তাই কম কী। যারা সরকার গড়ে, তাদের অনেক খরচ-খরচা আছে না? তারা নিজেদের ভাগ নেবে না?”

আশ্চর্য, চলে আসা সিস্টেমটার সর্বাঙ্গে ঘূণ ধরে গেছে, গরিব মানুষের রক্ত চুষছে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো, তবু এই দুলালদের কোনও হেলদোল নেই?

অর্ঘ্য সামান্য বিরক্ত স্বরে বলল, “কিন্তু তোমাদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া যে এক ধরনের চুরি, এটা তো মানো?”

“যেতে দ্যান কত্তা। আমাদের কি কিছু করার আছে?”

“কে বলল নেই? তোমরা যদি সবাই মিলে প্রতিবাদ করো, গর্জে ওঠো…”

“কী হবে তাতে? বড়জোর সরকার বদলে যাবে। কিন্তু যারা আসবে, তারা কি সগ্গোভোস্টো দেবতা? আসবে তো নরেনবাবুর বদলে হরেনবাবু। দেবেনের জায়গায় খগেন। আমাদের তাতে বাড়তি কী সুসার?”

“যদি এরকম কারওকেই না আনো…”

“মানে? তা হয় নাকি? কাউকে না কাউকে তো আসতেই হবে। সরকার গড়তেই হবে।”

ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা বোধ করছিল অর্ঘ্য। পার্টির অন্দরে তত্ত্ব আলোচনা অনেক করেছে, কিন্তু পার্টির নিয়মেই তাকে বাস করতে হয়েছে প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে। কচিৎ কখনও মধ্যপ্রদেশ ছত্তিশগড় কিংবা ঝাড়খণ্ডের আধা শহরে পা রাখলেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার অনুমতি ছিল না, ভাষার ব্যবধানও ছিল দুস্তর। আলাইপুরে এসে সে প্রথম নিজের মতো করে কথাবার্তা বলতে পারছে সমাজের হ্যাভনটদের সঙ্গে। এদের মাঝে কি পার্টির ভাবনাকে চারিয়ে দেওয়া যায় না?

অর্ঘ্য জোরে একটা শ্বাস টেনে বলল, “ধরো, সরকার ব্যাপারটাকেই যদি উত্খাত করে ফেলা যায়? যেখানে যে পার্টির যত বদলোক আছে সবাইকে নিকেশ করে ফেলা হল? অকারণে উত্পাত করার পুলিশ নেই, ঘুঘুর বাসা পঞ্চায়েত নেই, ঘুষখোর সরকারি অফিস নেই… সমস্ত ক্ষমতা চলে এল তোমাদের হাতে…”

“মানে?”

“তোমরা তখন নিজেরাই সরকার হয়ে গেলে। নিজেদের মতো করে কাজ করছ, দরকার মতো পয়সা পাচ্ছ…”

“কে দেবে?”

“নিজেরাই। ভাগবাঁটোয়ারা করে নেবে।”

“তা হয় নাকি? কী যে আজব বাক্যি কন কত্তা! সরকারটাই বেবাক উধাও হয়ে যাবে? কে সরাবে তাদের?”

“বললাম তো, তোমরা। বন্দুক চালানো শিখবে, তাদের সঙ্গে লড়াই করবে…”

“আমরা…? লড়াই…?”

“আহা, তোমরা সবাই কেন? তার জন্য লোক আছে। তোমাদের হয়ে তারাই লড়বে। তোমরাও তাদের সঙ্গে থাকবে।”

“বুঝেছি। তারাই তখন সরকার হবে। তাই তো?” দুলাল বুঝদারের মতো মাথা দোলাচ্ছে, “এখন যেমন লাল-তেরঙ্গা, তখন তারাই হবে আমাদের প্রভু।”

“না মানে…তুমি ঠিক…”

“বললাম তো কত্তা। বুঝে গেছি।” দুলাল আপনমনে বিড়বিড় করছে, “ঠিকই তো। এদের যদি কেউ লড়ে হঠায়, গদি তো তাদের হকের পাওনা। কিন্তু যাই বলেন কত্তা, আমরা যেমন আছি তেমনই থাকব। মনিব বদলালে কি গরিবের কপাল বদলায়?”

যাহ, দুলাল তো বিশাল ব্যাপারটা উপলব্ধিই করতে পারছে না! অর্ঘ্যদের মহান তত্ত্বে পৃথিবীর চেহারাই যে অন্য রকম হয়ে যাবে, এ যেন গেঁয়ো জেলেটা কিছুতেই মানতে রাজি নয়!

মরিয়া হয়ে অর্ঘ্য বলল, “তোমাদের অত কিছু ভাবতে হবে না। শুধু বন্দুকটা কাঁধে তুলে নাও। নিদেনপক্ষে যারা লড়বে, তাদের পাশে পাশে থাকো।”

“কী দরকার কত্তা লড়াই কাজিয়ায়? এই তো বেশ আছি। যেভাবে যেটুকু, জুটুক, শান্তিতে থাকলেই যথেষ্ট। খুনোখুনি রক্তারক্তি ভাল লাগে না কর্তা। দুনিয়ায় কে কার শত্রু বলেন? পঞ্চায়েত প্রধানই হোক কী, মন্ত্রীই হোক, কী আমার অকালকুষ্মাণ্ড ব্যাটাই হোক, মরলে তো সবাই সমান। যে ক’টা দিন দুনিয়ায় আছি, সবাই মিলে ভাব-ভালবাসা করে থাকলে তো ল্যাটা চুকে যায়।”

“এ কী অদ্ভুত দর্শন? দুলাল যা বলছে তা কি শুধু দুলালেরই কথা? নাকি দেশের গড়পড়তা মানুষ এরকমই ভাবে? এরা কি তবে শ্রেণিসংঘর্ষের আদর্শকে মন থেকেই বিশ্বাস করে না। শোধনবাদী শ্রেণিসমন্বয়ের ধারণা কি এদের রক্তেই মিশে আছে?”

কিংবা এমন নয় তো, ভারী ভারী তত্ত্বগুলোই আদতে ফালতু? মানুষ কোনও তত্ত্বেরই দাস নয়। অতীতেও ছিল না। ভবিষ্যতেও হবে না। শুধু তারা, অর্ঘ্যরাই তত্ত্বের ভারে দূষিত করে ফেলছে পৃথিবীটাকে?

কথাগুলো মনে আসতেই অর্ঘ্য থরথর কেঁপে উঠল। এ কী প্রতিবিপ্লবী চিন্তা মনের কোণে উঁকি দেয় আজ? তার এতগুলো বছর কি তা হলে মিথ্যে? একটা কল্পদুনিয়ার দিকে অন্ধের মতো ছুটেছে নাকি সে?

নৌকো ক্রমশ ফিরছে পাড়ের দিকে। আস্তে আস্তে বাড়ছে কালীমন্দিরের কাঁসরঘণ্টার আওয়াজ। বাড়িঘরের টিমটিম আলোর দ্যুতি উজ্জ্বল এখন।

দুলালকে একখানা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে অর্ঘ্য নেমে এল। ক্ষণিক দেখল অন্ধকার গঙ্গা, চোখ বুজে শুনল নদীর কলকল। তারপর সাইকেলটা নিয়ে ফিরছে। চড়ল না আর, হাঁটছে শিথিল পায়ে। আলাইপুরে এসে আজ পর্যন্ত যত বাড়িতে গেছে, দুলালের সঙ্গে মেলাচ্ছে তাদের কথাবার্তা। না, নিজের আদর্শের কথা তাদের কারওকে বলেনি। তবু কেন যেন মনে হয় সকলেরই সুর এক তারে বাঁধা। বেশি কিছু তাদের আকাঙ্খা নেই, দুলালের মতো তারাও যেন শুধু শান্তি চায়।

উঁহু, ভাবনাটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই হচ্ছে। অর্ঘ্য দাঁড়িয়ে পড়ল। মোবাইল হাতে নিয়ে মনে করে করে টিপল একটা নম্বর।

বাজছে ওপারে। ধরেছে। রাজনের গলা।

ইংরিজিতে রাজন বলল, “তুমি এখন কোথায়?”

নিষিদ্ধ প্রশ্নের উত্তরটা এড়িয়ে গেল অর্ঘ্য। বলল, “আমার একটা কথা ছিল। আমাদের প্ল্যান অফ অ্যাকশন নিয়ে আমরা প্রচুর সময় ব্যয় করি, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনোভাব আমরা খেয়াল করছি কি? আমাদের প্রতি?”

“স্টপ ইয়োর ননসেন্স। তেজস তোমায় পাগলের মতো খুঁজছে। কোরাপুট অপারেশন সফল হয়েছে, দেখেছ নিশ্চয়ই?”

“মৃত্যুর অনুপাত হিসেব করলে সফলই বলা যায়।”

“না। সব দিক দিয়েই সাকসেসফুল। গোটা এলাকা এখন আতঙ্কে কাঁপছে। প্রশাসন চরম হেনস্থা হয়েছে। কিন্তু এই জয়ের পর তেজস দলের সর্বময় ক্ষমতা চায়। ও মনে করছে তুমি তার প্রধান বাধা। আমাকে ফোন করেছিল তেজস। বলছিল অর্ঘ্য একজন রেনিগেড, জলদি জলদি ওর সন্ধান চাই।”

“লোকেশন জানানোর তো নিয়ম নেই।”

“আমিও তাই বলেছি। ও আমায় প্রোভোক করে বলল, তুমি নাকি ঝাড়গ্রাম থেকে কলকাতামুখো ট্রেনে উঠেছ। আমাকে এও শাসাল, তোমার মোবাইল টাওয়ার থেকে তোমায় লোকেট করবে। মনে হল ফাঁকা আওয়াজ নয়, সিরিয়াসলি চেষ্টা করছে।”

“কেয়ার করি না। আমি এখন কয়েকটা আদর্শগত প্রশ্ন নিয়ে…”

“পরে কথা হবে।” রাজন মাঝপথে অর্ঘ্যকে থামিয়ে দিল, “ফোনটা আপাতত বন্ধ রাখো। চটপট সিম বদলাও।”

লাইন কেটে গেল। হতবুদ্ধির মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অর্ঘ্য পা চালিয়েছে। আশাবরীর গেট পেরিয়ে একটু থমকাল। বাড়ি অন্ধকার। অফিসে আলো জ্বলছে। এখনও কাজ করছে অণুদি? কাজে নাকি অণুদির প্রবল অনীহা?

নাহ মানুষকে চেনা মুশকিল। অজস্র দিনরাতের সঙ্গী এক সময়ের হরিহর আত্মা তেজসকে চিনতে পারেনি অর্ঘ্য। কালোকুলো আধবুড়ো অভাব অনটনে জর্জরিত দুলালকেও কি চেনা গেল ঠিকঠাক? আর ক্যালিডোস্কোপের কুচি কুচি পাথরের মতো রং বদলে যাওয়া ওই নারী তো তার অচেনাই।

একটা গরম শ্বাস অর্ঘ্যর পাঁজর ঠেলে উঠে এল। সে নিজেও কি এই মুহূর্তে অচেনা নয়? নিজের কাছেই?

.

॥ ৭ ॥

ঝালকাঠি থেকে ফিরছিল অহনা। পিছনে মায়াকে নিয়ে। অবিরাম বকর বকর করে চলেছে মায়া, কিছু শুনছিল অহনা, বেশির ভাগটাই তুলছে না কানে। মগজে চিন্তা গজগজ করছে যে। তাঁতিপাড়ার মেয়েগুলো ছাড়ল না কিছুতেই। ঋণ নাকি তাদের এক্ষুনি প্রয়োজন, দলবেঁধে নিতে পারলেই নাকি তাদের সুবিধে, সুতরাং স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়া ছাড়া তাদের নাকি উপায় নেই। এদিকে ঝামেলা বাড়ল অহনার। এককাঁড়ি কাগজ তৈরি করো, সরকারি দপ্তরে নতুন গোষ্ঠীর নাম জানাও, মোট কতজন আছে, কে কে আছে তার তালিকা পাঠাও…। সব কাজ একা হাতে করতে হবে। এমনকী সরকারি দপ্তরে হাতে করে দিয়েও আসতে হবে চিঠিগুলো। পোস্টে পাঠালে বেমালুম অস্বীকার করবে হয়তো। কম বখেড়া!

মায়ার প্রশ্ন ঠিকরে এল, “ম্যাডাম, কী নাম ঠিক হল তা হলে?”

“ওরা যা বলেছে তাই। তাঁতিয়া।”

“কেমন যেন শোনাচ্ছে না! কিছু একটা শ্রী ফি দিয়ে নাম হলে ভাল হত। গৃহশ্রী, তন্তুশ্রী, গোছের…”

“আমাদের তো পাকামি করার দরকার নেই। ওদের ব্যাপার ওদেরই বুঝতে দাও।”

“এরা কবে থেকে লোন পাবে ম্যাডাম? মানে আমাকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করছিল কিনা…”

প্রশ্নটা মায়া কেন করল অহনা ভাল মতোই জানে। ধার না পেলে ধার শোধ শুরু হবে না, আর দেনা যখন শুধবে, তখনই তো মায়াদের আসল রোজগার। ঘরে গিয়ে টাকাটা নিয়ে আসে বলে প্রতি একশোয় আট টাকা করে দিতে হয় মেয়ে বউদের। তার অর্ধেক আশাবরীর প্রাপ্য, বাকি অর্ধেক পায় মায়ারা। কমিশনের ওই বাড়তি টাকাটা আছে বলেই না মাত্র দেড় হাজার মাইনে পেয়েও মাসভর উদয়াস্ত খাটে এরা।

তবু মায়ার এই হাঁকপাকানিটা অহনার পছন্দ হল না। কেঠো গলায় বলল, “এক্ষুনি এক্ষুনি হবে না। কলকাতায় যাই, গভর্নমেন্টের খাতায় এদের নাম তুলে দিয়ে আসি, তারপর।”

“গর্ভমেন্ট তো তখন তাঁতিয়ার জন্য আশাবরীকে একটা টাকাও দেবে, তাই না?”

অহনা এবার একটু বিরক্তই হল। কোত্থেকে কী শুনেছে কে জানে, মায়া শান্তা দেবিকাদের মনে ধারণা জন্মেছে, স্বনিভর্র গোষ্ঠীগুলোর দৌলতে বিস্তর টাকা পায় অহনা। আদতে মোটেই তো তা নয়। সরকার তো দেয় মাত্র একবার। গোষ্ঠী পিছু দশ হাজার। সেই টাকাও আসে চার-পাঁচ দফায়। নাম পাঠানোর পরে কিছু দিল, টাকা ধার নিয়ে কাজ শুরু হল, তখন কিছু দিল…। এভাবেই খেপে খেপে দু’-তিন হাজার করে…। প্রতিবারই কাগজ পাঠাতে হয় গাদাগুচ্ছের। টাকার গন্ধ পেয়েই নাচে মেয়েরা, অহনার এ ঝঞ্ঝাটগুলো থোড়ি বোঝে।

অহনা গম্ভীর মুখে বলল, “ফালতু কৌতূহল কমাও। নিজের কাজ মন দিয়ে করো। মাথায় রেখো, আশাবরী তার কর্মচারীদের কখনও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে না।”

“আমি কি তাই বলেছি?”

“ভবিষ্যতেও বোলো না। আশাবরী সরকারের কাছ থেকে কী পায়, কেন পায়, কিছুই যখন জানো না, আজেবাজে চিন্তাও মাথায় এনো না।”

বকুনিতে কাজ হল। চুপ মেরে গেছে মায়া। গণেশপোতার মুখটায় নেমে গেল। বাড়ি যাবে সোজা। দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। পথে জীবনবাবুর দোকান খুলে গেছে, টুকিটাকি জলখাবারের সরঞ্জাম কিনল অহনা। পাঁউরুটি ডিম মাখন…। এক প্যাকেট চানাচুরও নিল, খানিকটা চিঁড়েও। মা থাকলে এসব নিয়ে ভাবতে হয় না, নিজেই হাঁটতে হাঁটতে এসে কিনে নিয়ে যায়। সে একা থাকলেও সমস্যা নেই, স্রেফ মুড়ি বিস্কুটেই চালিয়ে নিতে পারে এক দু’ সপ্তাহ। অর্ঘ্য রয়েছে বলেই না এসবের বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে, রোজ রোজ তো থোড়-বড়ি-খাড়া খাওয়ানো যায় না। তাও কপাল ভাল, চেনা লোক, মাছটা সবজিটা বাড়িতে এসে দিয়ে যায়, নইলে তো অহনাকে রোজ ছুটতে হত বাজারে।

আশাবরীর কম্পাউন্ডে ঢুকে মৃদু চমক। অফিসের সামনে দু’-দু’খানা গাবদা মোটরবাইক। কে এল রে বাবা?

জিনিসগুলো বাড়িতে রেখে আসবে ভেবেছিল অহনা, সামান্য দোনামোনা করে আগে অফিসেই এল। দেখল, এসেছে মোট তিনজন। এক মধ্যবয়সি আর এক বছর তিরিশের গাঁট্টাগোট্টা অফিসঘরে আসীন। তিন নম্বরটি একেবারে ছোকরা, মেরেকেটে একুশ-বাইশ, পাশের ঘরের দরজায় কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করছে মেয়েদের কাজকর্ম।

অহনার আগমনে উঠে দাঁড়িয়েছে গাঁট্টাগোট্টা। ঝুঁকে অহনাকে নমস্কার করে পাশের মধ্যবয়সিকে দেখিয়ে বলল, “দাদাকে চেনেন নিশ্চয়?”

“না, মানে…” অহনা সামান্য কুণ্ঠিতভাবে বলল, “আমি তো এখানে তেমন একটা কাউকে… কাজে এমন আটকে থাকি…”

“অত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন?” এবার মধ্যবয়সি নড়েচড়ে বসল, “আমরা তো জানি আপনার কর্মকাণ্ড কত সুদূর অবধি বিস্তৃত। আপনার নিরলস নিঃস্বার্থ সেবা পেয়ে ধন্য হয়েছে টিয়াডাঙার আপামর জনগণ। আমরা যে আপনাকে চিনি, এই তো আমাদের পরম সৌভাগ্য।”

কী বলছে রে বাবা! অহনা মহান কিছু করেছে বলে তো মনে হয় না। বরং অর্ঘ্য সেদিন যা বলছিল, সেটাই তো সত্যির অনেক কাছাকাছি। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য চটজলদি ধারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বটে, কিন্তু প্রাথমিক সার্ভিস চার্জ, প্রসেসিং ফি, বাড়ি বয়ে টাকা পৌঁছে দেওয়া, বাড়ি গিয়ে মাস মাস কিস্তি সংগ্রহ বাবদ যা নেয়, সব মিলিয়ে সুদের হার গ্রামীণ কুসীদজীবীদের চেয়ে বেশিই হয়, কম তো কিছুতেই নয়। তারপরও কেউ এমন বিশেষণ ঝাড়লে মোটেই গর্ব হয় না, উলটে ধন্দ জাগে মনে।

মধ্যবয়সিটির ওজনদার ভাষণ শুনে গাঁট্টাগোট্টা কিন্তু মোহিত। জুলজুল চোখে দাদাটিকে দেখতে দেখতে অহনাকে বলল, “ইনি তারক মজুমদার। আমাদের টিয়াডাঙা বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক সত্যেন্দ্র আচার্যের একান্ত কাছের লোক।”

অহনা দু’-এক সেকেন্ড ভেবে পেল না, এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। তারপরই বাস্তববোধ ফিরেছে। নরম হেসে বলল, “ওয়েলকাম টু আশাবরী। বলুন কী খাবেন? চা না কফি? বাইরে থেকে আনতে হবে না, আমার মেয়েরাই বানিয়ে দেবে।”

“যা খুশি। তবে বিকেলের দিকে… কফি হলেই ভাল।”

বিকেলের সঙ্গে কফির কী সম্পর্ক, অহনার মাথায় ঢুকল না। তবে এঁদের যে তুরন্ত আপ্যায়ন প্রয়োজন, এটুকু বুদ্ধি অহনার ঘটে আছে। উঠে গিয়ে ইলাকে বলে এল কফির সঙ্গে যেন বিস্কুট ফিস্কুটও দেওয়া হয়। অফিসঘরে যখন ফিরল, মধ্যবয়সি আর গাঁট্টাগোট্টা অনুচ্চস্বরে কী যেন আলোচনা করছে। অহনাকে দেখেই ঝুপ করে থেমে গেল দু’জনে।

অহনা অস্বস্তিবোধ করল। এমনিতেই রাজনীতির লোকদের সে এড়িয়ে চলে প্রাণপণ, কিন্তু ঘরের মধ্যে এসে গেলে সে তো নাচার। এদের আজ মতলব একটা আছে নিশ্চয়। কায়দা না মেরে চটপট ঝেড়ে কাশুক না।

মুখে অহনা বলল, “আশাবরীর কাজকর্ম দেখতে এসেছেন বুঝি?”

“না না, আমরা তো সব জানিই।” ফের খোনাখোনা গলা বেজে উঠল, “আর জানি বলেই তো…”

“এম এল এ সাহেব আমাদের পাঠালেন। বললেন, জিজ্ঞেস করে এসো ওঁকে আমরা কীভাবে হেল্প করতে পারি।”

“ভাষাটা ঠিক কর গদা।” তারক মৃদু ধমক দিল, “সত্যেনদা বললেন, ওঁর কী কী লাগবে দেখে এসো।”

“অনেক ধন্যবাদ। মাননীয় এম এল এ সাহেবকে আমার নমস্কার জানাবেন।” অহনা সৌজন্যের সুরে বলল, “তবে আমার ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান… মোটামুটি তো চলেই যাচ্ছে।”

“তা বললে হয় নাকি? বিধায়ক মশাই আপনার জন্য ফান্ড অ্যালট করবেন বলে বসে আছেন।”

সংশয়ের মাত্রাটা বেড়ে গেল অহনার। তবু বিনীত স্বরে বলল, “আমি একা মানুষ, এই যা করছি, আমার পক্ষে যথেষ্ট। বেশি বড় করতে গেলে আমার সাধ্যের বাইরে চলে যাবে।”

“আপনার এই বিল্ডিংটা তো আপনি কমপ্লিট করে নিতেই পারেন ম্যাডাম।” গদাধ্বনি শোনা গেল। গলা চড়িয়ে বলল, “অ্যাই শাঁটুল, কীর’ম পড়বে একটু হিসেব করে দ্যাখ তো।”

“ও আমার মাপা হয়ে গেছে। তিন লাখে ঝকাস নেমে যাবে।” শাঁটুলের বিশেষজ্ঞ মতামত মুহূর্তে হাজির, “তবে বস, পিডব্লুডি তো করবে কাজ, আরও দশ পার্সেন্ট হেসে খেলে ধরে রাখো।”

“ঠিক আছে, সাড়ে তিনই স্যাংশন করিয়ে দেব।” খোনাস্বর অভয় দিল, “ওপাশে আরও দু’খানা ঘর পেলে আশাবরীর তো অনেকটাই সুবিধে…”

সংলাপগুলো অলীক মনে হচ্ছিল অহনার। সে আর্জি জানায়নি, কোথাও কারও কাছে প্রকাশ করেনি তার বাসনা, হঠাৎ আশমান থেকে টাকা ঝরে তৈরি হয়ে যাবে বাড়িটা! রাজনীতির লোকরা কি অন্তর্যামী! উঁহু, ছোটবেলায় কোথায় যেন পড়েছিল না, দেয়ার ইজ় নাথিং কল্‌ড্‌ অ্যাজ় ফ্রি লাঞ্চ। জীবনে তো সে দেখেওছে বিনামূল্যে কিছুই জোটে না, মা-বাবা-দাদার ভালবাসা পেতেও মোটা দাম চুকোতে হয়!

কফি এসে গেছে। অহনাই কাপগুলো বাড়িয়ে দিল হাতে হাতে। নিজেও নিল। স্মিত মুখে বলল, তা আমাকে এর জন্য কী করতে হবে?

“কিচ্ছু না। পি ডব্লু ডি-র ইঞ্জিনিয়রকে পাঠিয়ে দেব, উনিই মেপেজুপে হিসেব করে একটা এস্টিমেট বানিয়ে দেবেন। আপনি সেইটা আর সঙ্গে একটা আবেদনপত্র লিখে রাখবেন। গদা নিজে এসে নিয়ে যাবে।… দু’মাসের মধ্যে আপনার এখানে মিস্ত্রি লেগে পড়বে, শীতের আগেই দেখবেন কাজ শেষ।” তারক একটু দম নিল। তারপর কফিতে একটা বড় চুমুক দিয়ে বলল, “তা ম্যাডাম, আমরা যেমন আশাবরীর জন্য মাঠে নামব, আশা করি আপনিও আমাদের একটু মদত করবেন।”

অহনার স্নায়ু নাড়া খেল সামান্য। সামলে নিয়ে বলল, কীভাবে?

“তেমন কিছু না।” গদা একবার তারককে দেখে নিয়ে বলল, “আপনি নিশ্চয় শ্যামাঙ্গিনীর নাম শুনেছেন?”

“ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি?” অহনা সতর্ক ভাবে বলল, “হ্যাঁ, সাইনবোর্ড বিজ্ঞাপন দেখেছি।”

“খুব জেনুইন প্রতিষ্ঠান, ম্যাডাম। ওরাও গ্রামের লোকদের ভাল চায়। আপনারই মতন। …তাই বলছিলাম কি… আশাবরীর পাশে পাশে এখানে যদি শ্যামাঙ্গিনীরও একটা অফিস খোলা যায়… আপনিই তার হেড থাকবেন, …মানে এখানে শ্যামাঙ্গিনীর টাকাপয়সা যা সংগ্রহ করা হবে… আপনি তার থেকে একটা মোটা কমিশনও পাবেন। আপনাকে খাটতেও হবে না… আমাদের লোকই যা করবার করবে…”

শ্যামাঙ্গিনীর ব্যাবসার ধরন মোটামুটি জানে অহনা। জমা টাকার বিনিময়ে চড়া সুদ দেয়। কীভাবে দেয়, সে সম্পর্কে তার সম্যক ধারণা আছে বই কী। সেই মানুষটাই তো আছে এই ধান্দায়। কোন দিকে নিয়ে যায় এই কারবার, আন্দাজ আছে বলেই না সে আজ আলাইপুরে। জেনেশুনে সেই বিষ পান করবে অহনা। কভি নেহি। আস্ত সংসার ভেঙে সে চলে এল, আর এ তো সামান্য একটা বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার টোপ!

কিন্তু এদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি তো করা যাবে না, বুদ্ধি করেই ঠেকাতে হবে। পলক ভেবে অহনা সবিনয় তারককে বলল, “সরি স্যার। আশাবরীতে ওরকম কিছু তো করা যাবে না।”

“কেন?”

“জমি বাড়ি সব তো ব্যাঙ্ককে মর্টগেজ করা আছে। সত্যি বলতে কী, আমি এখন মর্টগেজ না ছাড়িয়ে বাড়ির কাজেও হাত দিতে পারব না।”

“তো ছাড়িয়ে নিচ্ছেন না কেন? আমরা কি হেল্প করতে পারি?”

“অনেক টাকার ব্যাপার স্যার। পনেরো-ষোলো লাখ। তা ছাড়া আমার মাও তো মর্টগেজে একজন পার্টি… বুঝতেই তো পারছেন… ওঁর বয়স হয়েছে…”

একেবারেই অর্থহীন যুক্তি, কিন্তু এই মোটা মাথা ধান্দাবাজদের জন্য এটাই যথেষ্ট, একটু ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে পারলেই এরা ভারী বিজ্ঞের মতো মুখ করে গিলে নেবে, অহনার এই অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। তুম্‌বো মুখে একটুক্ষণ বসে রইল তিন মূর্তি, তারপর গিয়ে উঠেছে মোটরসাইকেলে। হেলমেট ছাড়াই। স্টার্ট দেওয়ার আগে অহনা ভারী দুঃখী দুঃখী মুখ করে তারককে বলল, “আমার ভাগ্যটাই খারাপ স্যার, কত বড় একটা সুযোগ মিস হয়ে গেল বলুন তো?”

ঢকঢক ঘাড় নেড়ে লোকগুলো চলে যেতেই অহনার পেট গুলিয়ে হাসি এসে গেল। অনেক দিন পর হাসছে প্রাণ খুলে। ইলারাও অবাক। এমন উচ্ছল মূর্তিতে ম্যাডামকে তারা কখনও দেখে না তো।

বেশিক্ষণ আর অফিসে না থেকে বাড়ি এল অহনা। কৃষ্ণা রাতের রান্না বসিয়েছে, এরপর রুটি করবে। তাকে চা বানাতে বলে বিছানায় গড়াগড়ি খেল খানিকক্ষণ। পলকের জন্য মনে হল ব্যাঙ্কে গিয়ে ওভারড্রাফটের লিমিটটা বাড়িয়ে দিয়ে আসবে। পরক্ষণে মত বদলাল। তুৎ, বোকাগুলো থোড়াই ব্যাঙ্ক অবধি গিয়ে খোঁজখবর করবে, মিছিমিছি তার চাপ বাড়ানোর প্রয়োজন কী।

চা শেষ করে বৈকালিক স্নান। ক’দিন খুচরো খাচরা বৃষ্টির কারণে আজ গরমটা বেশ প্যাচপ্যাচে, গায়ে জল ঢেলে আরাম হল খুব। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা ছটফটানিও চলছে। ঘটনাটা কারওকে না বলতে পারলে স্ফূর্তিটা যেন জমছে না। কাকে জানাবে? ফোন করবে মাকে? নাহ মা যা ভিতু, ঘাবড়ে যাবে, উলটে হয়তো জ্ঞান ঝাড়তে আরম্ভ করবে। অর্ঘ্যটা গেল কোথায়? সন্ধে তো নেমে গেল, সে এখনও ফিরছে না কেন?

মোবাইলে অর্ঘ্যর নম্বর টিপল অহনা। যান্ত্রিক ঘোষণা বাজছে… যে নম্বরটি আপনি ডায়াল করেছেন এই মুহূর্তে সেটি সুইচড অফ অথবা মোবাইল পরিষেবার বাইরে…। কী ব্যাপার, অর্ঘ্য তো ফোন বন্ধ রাখে না! কোথায় এমন গেল যেখানে টাওয়ার মিলছে না?

বাইরে মোটরসাইকেলের আওয়াজ। অহনার বুক ধক করে উঠল। মক্কেলরা ফিরে এল নাকি?

শঙ্কিত পায়ে গ্রিলবারান্দায় আসামাত্র অহনার মুখমণ্ডল হাসিতে ভরে গেছে। সুশোভন স্যার।

দরজা খুলে দিয়ে অহনা হাউমাউ করে উঠল, “কোথায় ছিলেন অ্যাদ্দিন? কতবার চেষ্টা করেছি, কিছুতেই আপনাকে ধরতে পারছি না। ফোন কেন বন্ধ রেখেছিলেন? ভাবছিলাম কাল পরশুই আপনার বাড়ি গিয়ে হানা দেব…”

“আস্তে আস্তে। এত প্রশ্নের উত্তর কি একবারে দেওয়া যায়?” দীর্ঘদেহী মানুষটি দু’হাত তুলে থামালেন অহনাকে, “একটু জিরোতে দাও, চা জল খাওয়াও… ওফ, বড্ড থকে গেছি।”

এই বাক্যটি সুশোভনের মুখে কখনও শোনেনি অহনা। বয়স অনেকই হয়েছে স্যারের, চুয়াত্তর পঁচাত্তর তো বটেই, কিন্তু টগবগ করেন সারাক্ষণ। এত জোরে হাঁটেন, অল্পবয়সিরাও পাল্লা দিতে হাঁপিয়ে যায়। মুখেচোখে বয়সের ছাপও নেই তেমন। মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা না হলে স্বচ্ছন্দে পঞ্চান্ন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

বাইরের ঘরের সোফায় বসেছেন সুশোভন। হেলান দিয়ে। লম্বা পা সামান্য ছড়িয়ে। পরনে আজ পাজামা পাঞ্জাবি নয়, প্যান্ট-শার্ট। হেলমেটখানা রেখেছেন সেন্টারটেবিলে।

তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে জল আনল অহনা। সুশোভনের হাতে গ্লাস ধরিয়ে বলল, “আপনাকে এত টায়ার্ড দেখাচ্ছে কেন স্যার?”

“আই অ্যাম ফাইন।” এক চুমুকে জল শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখলেন সুশোভন। দু’হাত সোফার কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “ব্যক্তিগত কাজে কয়েক দিন কলকাতায় গিয়ে থাকতে হচ্ছিল। আজই ফিরেছি। ভাবলাম তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই। আমার বিশ্বস্ত স্কুটারটা আমায় বিট্রে করল, ব্যাটা স্টার্ট নিল না। অগত্যা ভাইয়ের এই দামড়া মোটরসাইকেল। অনেক দিন অভ্যেস নেই তো… এত ভারী… তার ওপর তোমাদের এই রাস্তা… দম নিকলে গেছে।”

“আপনার ভাই মানে সুশীতলবাবু তো? স্টেশনের ধারে যাঁর ওই বড় ওষুধের দোকান…”

“ভাল নামটা জানো তা হলে?” হাসছেন সুশোভন, “টিয়াডাঙার লোকরা তো ওকে অন্য নামে চেনে। সুশোভনের ভাই অশোভন।”

“এমা ছি ছি কেন?”

“দ্যাখোনি ওর কারবার? কলকাতা থেকে নামকা ওয়াস্তে স্পেশালিস্ট ডাক্তার এনে বসাচ্ছে আর তিন হাতে কামাচ্ছে। ডাক্তারের ফি থেকে কমিশন, তাদের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ বিক্রির লাভ, প্লাস ডাক্তারবাবুরা হেন টেস্ট নেই যা করান না, সেই সুবাদে ওর প্যাথোলজিকাল ল্যাবরেটরিটাও গড়গড়িয়ে চলছে।” সুশোভন একটু দম নিলেন, “জানো, ও এক সময়ে দারুণ মার্কস পেয়ে ডাক্তারি পাশ করেছিল। প্যাথোলজি ছিল ওর স্পেশাল পেপার। বাবার স্বপ্ন ছিল, তখনকার এই অজ টিয়াডাঙার মানুষদের যেন আর রক্তটক্ত পরীক্ষার জন্য দূরদূরান্তরে যেতে না হয়, ছোটন যেন একটা ল্যাবরেটরি খোলে এখানে। মিনিমাম চার্জ় নেবে, দরকার হলে গরিবদের কাছে থেকে পয়সা নেবে না…। ছোটনও সেই মটো মেনে ওই জায়গায় গোড়ায় একটা ডিসপেন্সারি খুলেছিল। নিজে চিকিৎসাও করত, পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালাত নিজের ল্যাবরেটরিতে। দশ বছরও গেল না, চিকিত্সাটা একেবারেই ছেড়ে দিয়ে ব্যাটা পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী বনে গেল। এখন রোগীর গলায় গামছা দিয়ে টাকা কামায়।”

“আপনি স্যার অকারণে নিন্দে করছেন। আজকাল মাগনা কি কিছু হয়?” অহনা ঠাট্টার সুরে বলল, “ওভাবে দেখলে তো স্যার আমিও তো মেয়েগুলোকে চুষছি। ওরা হয়তো টের পাচ্ছে না, কিন্তু আমি তো একশো টাকা ধার দিয়ে দুশো টাকা উশুল করছি।”

“তোমার ব্যাপারটা আলাদা।” সুশোভন দু’দিকে ঘাড় নাড়ছেন, “তুমি জানো না, গ্রামের মেয়ে-বউদের তুমি কতটা ভরসা। ব্যাবসা করতে করতেই কত সহায় সম্বলহীনাকে তুমি পায়ের তলায় মাটি জুগিয়েছ… পরিবারে তাদের ওজন কত বেড়ে গেছে…। আর লাভের পয়সায় তো তুমি ব্যাঙ্কের পাশবই মোটা করছ না, আরেক দল মেয়ের পিছনে ঢালছ।”

সুশোভনের মুখে প্রশংসা শুনলে অহনা যেন গুটিয়ে যায়। সে তো জানে অত কিছু ভেবে সে আশাবরী খোলেনি। শুধু নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার তাড়নায় স্যারের পরামর্শে এই পথটা বেছে নিয়েছিল। প্রথম প্রথম হয়তো তৃপ্তিও পেত, কিন্তু এখন একঘেয়েমির ফাঁসকলে বিরক্তির গাদ পুরু হচ্ছে ক্রমশ।

কৃষ্ণার কেটে পড়ার সময় হয়েছে। উঠে গিয়ে তাকে চা জলখাবারের কথা বলে এল অহনা। ফের বসতেই সুশোভনের প্রশ্ন, “তোমার মাকে দেখছি না যে?”

“কলকাতা গেছে। দাদার কাছে। সামনের সপ্তাহে ফিরবে।”

“ও। তার মানে তুমি এখন একা?”

“না। অতিথি আছে একজন।”

সংক্ষেপে অর্ঘ্যর পরিচয় দিল অহনা। শুনে সুশোভন বললেন, “বাহ, তোমার তো তা হলে গল্পে আড্ডায় ভালই সময় কাটছে।”

অহনা মনে মনে বলল, সে আর থাকে কতক্ষণ? যদি বা থাকে, নিজের খুপরিতে বেশিটা সময় কাটায়। টিভিতে শুধু খবরের চ্যানেল দেখে, সিনেমা সিরিয়াল খেলাধুলো কোনও কিছুতেই উত্সাহ নেই। অহনাও তো খুব বাকপটু গপ্পো টাইপ নয়, দু’জনের তা হলে জমবে কী করে?

মন্তব্য না করে মৃদু হাসল অহনা। কেজো প্রসঙ্গে ঢুকতে চাইল, “আপনাকে স্যার একটা খবর দেওয়ার ছিল।”

“আমি জানি। সরকারি অর্ডার পেয়েছ তো?”

“হুঁ।”

“সুষ্ঠু ভাবে ডেলিভারিটা দাও, আরও অর্ডার পাবে। বোধহয় শিগগিরি কিছু সোলার প্যানেলও চাইবে। পরিবেশ নিয়ে এখন খুব মাতামাতি চলছে তো… তুমিও তার কিছুটা ফায়দা নাও।”

“কিন্তু স্যার…তা হলে তো কারখানাটা আরও বাড়াতে হয়…”

“কে বারণ করেছে বাড়াতে? বিল্ডিংটা ওভাবে ফেলে রেখেছ কেন, শেষ করো। তেমন হলে ব্যাঙ্কে অ্যাপ্রোচ করো, তারা নিশ্চয়ই তোমায় টাকা দেবে। ব্যাঙ্ক আপত্তি করবে না, আই অ্যাম শিয়োর।”

অহনা কাঁটা হয়ে গেল। সুশোভন যদি শোনেন ব্যাঙ্কের প্রস্তাবে সে না বলে এসেছে… আহত হবেন নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে লঘু পরিবেশ আনতে চাইল ঘরে। বৈকালিক উপদ্রবের কাহিনি বলল স্যারকে। রসিয়ে রসিয়ে।

সুশোভন তো শুনেই গম্ভীর। বললেন, “কাজটা কিন্তু তুমি ঠিক করোনি।”

“মানে? এখানে শ্যামাঙ্গিনীর অফিস খুলবে, আমি অ্যালাও করে দেব?”

“না। কায়দা করে না এড়িয়ে সরাসরি ওদের প্রস্তাব নাকচ করা উচিত ছিল।”

“ওরা তাতে ছাড়ত? জোরজার করত না?”

“এখনও কি তুমি ছাড় পাবে ভেবেছ? রাজনীতির লোকদের আন্ডার এস্টিমেট কোরো না। ওরা আবার আসবে, আসবেই। আশাবরীর গুডউইল ওরা ব্যবহার করতে চায়। তোমায় ওদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে হবে, তুমি এটা হতে দেবে না। কাজটা হয়তো কঠিন, কিন্তু কৌশল করে তুমি আশাবরীকে বাঁচাতে পারবে না। একমাত্র তুমি রুখে দাঁড়ালেই ওরা হয়তো পিছু হঠতে পারে।”

সুশোভনের যুক্তি একেবারেই মনঃপূত হল না অহনার। স্যারের আর কী, বলেই খালাস, ভুগতে তো হবে অহনাকেই। লোকগুলো মোটেই সুবিধের নয়, আক্রোশের বশে যখন তখন হামলা করতে পারে। অতএব তুইয়ে-বুইয়ে চলাই তো ভাল। কোনও অনৈতিক ব্যাবসার সঙ্গে সে সংস্রব রাখবে না, এতে যদি আশাবরী উঠে যায় তো যাক।

টোস্ট ওমলেট রেখে গেল কৃষ্ণা। চা-ও। প্লেট হাতে তুলে কী যেন ভাবছিলেন সুশোভন। টোস্টে ছোট কামড় দিয়ে বললেন, “যাক গে, কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার। তোমার ডিসিশন তো এখন থেকে তোমাকেই নিতে হবে।”

অহনা কথাটা ঠিক বুঝল না। অস্ফুটে বলল, “মানে?”

“কালই কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। কবে আসব ঠিক নেই। মে বি এক মাস, মে বি দু’মাস, মে বি এক বছর… অনাথ আশ্রমের জন্য একজন লোক ঠিক করেছি… ইনফ্যাক্ট সেই কারণেই আজ আমার টিয়াডাঙায় আসা।”

অহনা বিস্মিত স্বরে বলল, “কেন স্যার? এখানে থাকবেন না কেন?”

“উপায় নেই বলে।” সুশোভনের লম্বাটে উজ্জ্বল মুখে ফ্যাকাশে হাসি, “আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। প্রায় মৃত্যুশয্যায়, দুটো কিডনিই তার ফেল করেছে। লাস্ট উইকে অ্যাডমিট করেছি হসপিটালে, পরশু ছাড়বে। জানোই তো টালিগঞ্জে ছোট একটা ফ্ল্যাট আছে আমার। ওখানেই তুলব। তারপর ডায়ালিসিস চলবে রোজ। যে ক’টা দিন বাঁচে।”

প্রায় সহজ স্বরেই বললেন সুশোভন, কিন্তু অহনার বুকে যেন ধক করে লাগল। গীতালি আন্টিকে সে বেশ কয়েকবার দেখেছে। সুশোভনের ঠিক বিপরীত। নির্জীব ধরনের মহিলা। কথাবার্তা বলেন খুব কম। পুজোআর্চা নিয়েই থাকেন সারাক্ষণ। তাঁর এই দশা?

অহনা বিড়বিড় করে বলল। “হঠাৎ ধরা পড়ল বুঝি?”

“ফাইনাল ডায়াগনোসিস এখন হল। তবে অনেক দিন ধরেই তো ভুগছিল। সুগার, হাই প্রেশার…। চিকিৎসা করাতে চাইত না ঠিক মতো। তার যা ফল হয়।” সুশোভনকে কেমন যেন বিমনা দেখাল, “আসলে বহুকাল আগেই তো বাঁচার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিল।”

জিজ্ঞেস করব না করব না করেও অহনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “কেন স্যার?”

“সে এক বিশ্রী উপাখ্যান। আমাকেই তার ভিলেন বলতে পারো।” সুশোভনের প্রাণবন্ত মুখখানা হঠাৎই করুণ, “আমার একমাত্র ছেলেটা… তাতার… ও ছিল একটু অন্য ধাতের। পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না। কবিতা লিখত, ছবি আঁকত…। গীতালি ওসব একদম পছন্দ করত না। ছেলেকে একটা বড় কিছু হতে হবে, দারুণ ব্রাইট কেরিয়ার গড়বে, এই ছিল তার স্বপ্ন। ছেলের পিছনে এঁটুলির মতো লেগে থাকত সারাদিন।… আমার মনে হত গীতালি ঠিক করছে না। কিন্তু অশান্তির ভয়ে প্রতিবাদ করিনি। বুঝিয়ে বাঝিয়ে ম্যানেজ করতে চেয়েছি গীতালিকে। লাভ হয়নি, গীতালি তার জেদে অনড়। পাঁচটা টিউটর লাগিয়ে রগড়াচ্ছে ছেলেকে… জয়েন্টে বসতে বাধ্য করল… মার গুঁতোয় কেমিক্যালে চান্সও পেয়ে গেল যাদবপুরে। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ার ওঠার পরীক্ষায় ফেল করল তাতার। তারপরই হঠাৎ একদিন সিলিংফ্যান থেকে…”

অহনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু স্বরযন্ত্র যেন বিকল। স্যারের ছেলে মারা গিয়েছে শুনেছিল, বটে, তবে এভাবে…? আশ্চর্য, অমন একটা অতীত আছে, স্যারকে দেখে তো বিন্দুমাত্র টের পাওয়া যায় না?

সুশোভন স্যার বলেই চলেছেন, “একটা সুইসাইড নোটও রেখে গিয়েছিল। মা, তোমার আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পারলাম না। ক্ষমা কোরো। …তারপর থেকেই গীতালি ডুবে গেল বিষাদের গহ্বরে। বেঁচে রইল বটে, কিন্তু মৃত্যুকে আহ্বান করে চলেছে এক মনে। প্রায় সাধনার মতো।”

অহনা নিচু স্বরে বলে উঠল, “পাপবোধ…?”

“পাপবোধ কি আমার নেই? দোষ কি আমার কম?” সুশোভনের কণ্ঠ দিয়ে আচমকা আর্তনাদ ছিটকে এল। পরক্ষণেই সামলে নিয়েছেন। অদ্ভুত শান্ত গলায় বললেন, “তোমাকে একটু আগেই বলছিলাম না, যেটাকে ভুল মনে হবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করবে? বলছি, কারণ সে কাজটা আমি নিজে করতে পারিনি। আমার তো উচিত ছিল গীতালিকে আটকানো। তাতার যাতে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠে সেটা নিশ্চিত করা। আই ফেইল্ড মাই টাস্ক। ট্যাক্টিক্যালি এড়াতে চেয়েছি অশান্তি। পরিণামটা কী হল? টানা বাইশ বছর ধরে তিলে তিলে আত্মহত্যা করেছে গীতালি। আমারই চোখের সামনে। এ বড় কঠিন সাজা। এরকম ভুল কিন্তু কোরো না।”

অনেকক্ষণ চলে গেছেন সুশোভন। অহনা শুয়ে ছিল বিছানায়। অসম্ভব ভার হয়ে গেছে মনটা। বাইরে মেঘ ডাকছে। মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ। কিছুই যেন প্রবেশ করছিল না অহনার চেতনায়। স্যারের শেষ কথাগুলো এখনও যেন ঘণ্টাধ্বনির মতো বাজছে মাথায়।… “যাই, অন্তিম কাজটা সারি, তারপর তো শুরু হবে আমার প্রতীক্ষা। একা একা…।”

সুশোভন স্যার কি ভুলেরই প্রায়শ্চিত্ত করতে কাজে ডুবে থাকেন? কিন্তু অহনা কীসের প্রায়শ্চিত্ত করছে? একটা মানুষকে চিনতে ভুল হয়েছিল, শুধু এইটুকুর জন্য এই তরঙ্গহীন সুখবিহীন জীবনকে টেনে ঘষটে বয়ে নিয়ে যেতে হবে? যতক্ষণ না দেহটা চিতায় ওঠে?

দরজায় ছায়া। অর্ঘ্য ঢুকল ঘরে। কখন এল, অহনা টের পায়নি তো!

অর্ঘ্যর হাতে অহনার মোবাইল। ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হল, কখন থেকে বাজছে… ধরছ না…”

অহনা মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসল, “কার ফোন?”

“শেফালি মাসির।”

হাত বাড়িয়ে অহনা নিল ফোন, “হ্যাঁ বলো?”

“এই অবেলায় ঘুমোচ্ছিলি নাকি?”

আমার তো দিন রাত সর্বক্ষণই অবেলা। বলতে গিয়েও অহনা সংবরণ করল নিজেকে। গলা ঝাড়ল, “কী বলবে বলো?”

“জানিস কী হয়েছে আজ? সুগত এসেছিল আমার কাছে?”

“তো?” অহনার ক্ষণপূর্বের বিষণ্ণতা সেকেন্ডে খানখান। তপ্ত স্বরে বলল, “আমি শুনতে আগ্রহী নই। অন্য কিছু বলার আছে?”

“আরে শোনই না। ও খুব দুঃখ করছিল। অহনা আমাকে সারাজীবন ভুল বুঝে গেল… আমি কিন্তু অহনাকে মাথায় করেই রাখতে চেয়েছি…”

“আহ মা, থামবে। কতবার তোমাদের বলব আমি ওকে ঘেন্না করি…”

“ও মনে হল ভীষণ অনুতপ্ত। নিজের দোষটা বুঝতে পেরেছে।”

“স্টপ ইট।” অহনা চিৎকার করে উঠল, “আমি শুনতে চাই না, তোমার ভাট বকা বন্ধ করো, প্লিজ়।”

আবার কী যেন বলতে যাচ্ছিল শেফালি, ফোন বন্ধ করে অহনা মোবাইলটা আছড়ে ফেলল বিছানায়। অন্ধ রাগে ফুঁসছে।

হঠাৎ পিঠে কার হাত। চমকে তাকাল অহনা। অর্ঘ্য।

কী আশ্চর্য, হাতটা ঠেলে সরাতে পারছে না কেন অহনা! বরং ছোঁয়াটা যেন ভাল লাগছে! কেন যেন মনে হচ্ছে, এমনই একটা স্পর্শের বড় প্রয়োজন ছিল এখন!

.

॥ ৮ ॥

ঝড়ের গতিতে কম্পিউটারে টাইপ করছিল অহনা। আজ সক্কালবেলায় এসে তাঁতিয়ার ভাবী সদস্যদের পুরো লিস্ট দিয়ে গেছে মায়া, দেরি না করে হাতের কাজটা চুকিয়ে রাখছে। সতেরো জনের বিশদ বায়োডাটা তৈরি, কম ঝকমারি। কাল রোববার, অহনা কাল অফিসের ছায়া মাড়াবে না। সপ্তাহে ছ’-ছ’টা দিন সে বিস্তর খাটে, একটা দিন অন্তত তার নিজস্ব থাকুক। মা কলকাতা যাওয়া ইস্তক কৃষ্ণার হাতের অখাদ্য রান্নাই সোনামুখ করে খেয়ে চলেছে অর্ঘ্য, এক-আধ দিন তো অহনারও উচিত রান্নাঘরে ঢোকা, নয় কি?

তা ছাড়া অহনারও তো ভাল লাগবে। বহুকাল পর আবার কারও জন্যে হাতাখুন্তি ধরতে ইচ্ছে করছে যে। অর্ঘ্য এত ভাল, কাল ওইরকম ভয়ংকর রেগে গিয়েছিল অহনা, কী নরম করে কথা বলে বলে শান্ত করল অহনার মনটাকে। মা’র মুখে ওইসব বাক্য শুনলে দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না অহনা, বিচ্ছিরি স্মৃতিগুলো ঝাপটা মারে সারারাত, শেষ পর্যন্ত ঘুমের বড়ি গিলতে হয়। কাল কিন্তু অহনার দিব্যি নিদ্রা এসে গেল, ট্যাবলেট ছাড়াই। এর জন্যই কি একটু বাড়তি যত্ন পেতে পারে না অর্ঘ্য?

ওফ, শেষ হয়েছে কাজ। এবার প্রিন্ট নেওয়ার পালা। প্রিন্টারের ট্রে-তে কাগজ ভরতে গিয়ে অহনার ভুরুতে ভাঁজ। প্যাকেট প্রায় খালি, শেষ দু’-চার পিস মাত্র পড়ে, ওতে তো কুলোবে না। বাজারে মোবাইলের দোকানটায় জেরক্স মেশিন বসিয়েছে, ওদের কাছে থাকতে পারে কাগজ। বিকেল হয়ে এল, অনেকক্ষণ টানা কম্পিউটারে বসে শরীরও আর চলছে না… ইলাকে পাঠিয়ে দেবে? তুৎ, যা ঢ্যাঁড়শ মেয়ে, কী কাগজ এনে হাজির করবে তার ঠিক আছে? কাল রোববার দোকানটা বন্ধ থাকতে পারে… তা হলে সেই সোমবার। ওই দিন কাগজে এনে, ছেপে, আর বোধহয় কলকাতা যাওয়া হবে না। ওদিকে সোলারিসের লোক খানিক আগে ফোন করেছিল। ডেমো দেওয়ার মাল নাকি এসে গেছে। অহনা সোমবার ওদের অফিসে যাবে বলল…

আলস্য ঝেড়ে অহনা উঠেই পড়ল। মোবাইলে মাত্র আট টাকা পনেরো পয়সা ব্যালেন্স আছে, রিচার্জ় করিয়ে নেওয়াটাও খুব জরুরি। মোপেড নিয়ে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছেছে দোকানে।

কাউন্টারে মুখচেনা তরুণ। কানে হেডফোন গোঁজা। সংগীতপ্রেমের হদ্দমুদ্দ! নামটা বোধহয় রাজু। অহনা অবশ্য নাম ধরে ডাকে না কখনও, তাতে একটা বাড়তি ঘনিষ্ঠতার ভাব এসে যায়।

অহনাকে দেখে রাজু উঠে দাঁড়িয়েছে। কান থেকে সরাল হেডফোন। শশব্যস্ত গলায় বলল, “কী লাগবে ম্যাডাম?”

“প্রিন্টারের কাগজ রাখেন নিশ্চয়ই?”

“আছে। তবে আমরা তো বেচি না। নিজেদেরই কাজে লাগে। আপনার ক’টা দরকার?”

“অন্তত খান পঞ্চাশেক। তারপর নয় টিয়াডাঙা থেকে কিনে নেব।”

“হয়ে যাবে।”

গুনে কাগজ প্যাক করে দিল রাজু। মোবাইলেও টাকা ভরে নিল অহনা। একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়েছে। ফেরত দিতে দিতে রাজু বলল, “ম্যাডাম, আপনার বাড়িতে যিনি এসেছেন, উনি কি আপনার রিলেটিভ?”

এই ধরণের প্রশ্ন অহনা একদম পছন্দ করে না। তার বাড়িতে কে এল গেল তাই নিয়ে গাঁয়ে যেন বড় বেশি কৌতূহল। বাবলা যখন এসেছিল তখনও টুকটাক জিজ্ঞেস করত লোকে। একেই বোধহয় বলে গ্রাম্যতা।

অহনা নীরস স্বরে বলল, “ওই রকমই।”

“বাঙালি?”

“মানে?”

“নাহ…উনি কাল একটা নতুন সিম করালেন… অদ্ভুত এক টাইটেল দেখলাম… রত্নম না কী যেন। বাংলা অবশ্য ভালই বলছিলেন।” রাজুর হাসি চওড়া হল, “কলকাতায় থাকেন বুঝি?”

“হুঁ।”

সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে প্যাকেট হাতে বেরিয়ে এল অহনা। অবাক হয়েছে খুব। ওরকম দু’নম্বরি বাড়তি সিম বানানোর কী অর্থ? ফোনও তো অর্ঘ্য আজকাল বন্ধই রাখে সারাক্ষণ। কোনও গোলমেলে ব্যাপার নেই তো? হয়তো কোনও অপকর্ম করে এসে এখানে গা-ঢাকা দিয়েছে!

না না, ছি ছি, এসব কী ভাবছে সে? অর্ঘ্য মোটেই এরকম ছেলে নয়। হতেই পারে না। অন্যায় কিছু করে লুকিয়ে থাকলে তার ছাপ ফুটে উঠত না অর্ঘ্যর মুখেচোখে? কথায় বার্তায়? গ্রামে গ্রামে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের কাজটাও তো করছে সত্যি সত্যি। অহনা খবর পায় নিয়মিত, তা ছাড়া অর্ঘ্য তাকে ডাটাশিটও দেখিয়েছে। তা হলে…?

এইসব ভাবতে ভাবতেই অহনা চলেছে মোপেডে। আশাবরীতে ফিরল। কাগজ নিয়ে অফিসের দিকেই এগোচ্ছিল, আচমকা মাটিতে গেঁথে গেল পা।

একটা দুধসাদা মহার্ঘ প্রাইভেট কার ঢুকছে কম্পাউন্ডে। চালকের আসনে কে ও? সুগত না?

হ্যাঁ, সুগতই। পরনে সেই চিরাচরিত পোশাক। নেভি ব্লু সুট, গলায় টাই।

মাথায় ঠাঁইঠপাঠপ নেহাই পড়ছিল অহনার। একটুক্ষণ ন যযৌ ন তস্থৌ দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা স্বরে বলল, “আবার? বারণ করেছি না এখানে আসতে?”

“তবু এলাম। সুগত যেন নির্বিকার। গাড়িতে হেলান দিয়ে পকেট থেকে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট বার করল। ঠোঁটে রাজা মাপের সিগারেট ঝুলিয়েছে। লাইটার জ্বালিয়ে ধরাল। আলাইপুরের বাতাসে কটু ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “গাড়িখানা দেখেছ? লাস্ট উইকে কিনলাম। এইট্টিন প্লাস পড়ল। ভেরি স্মুথ ড্রাইভিং। রাস্তাঘাটে বাম্প খানাখন্দ কিছু টের পাওয়া যায় না।”

সেই হামবড়া। সেই চালমারা কথাবার্তা। মা বলছিল লোকটার নাকি পরিবর্তন এসেছে! ওহ্, পরিবর্তন শব্দটায় ঘেন্না ধরে গেল!

অফিসের দিক থেকে উঁকিঝুকি আসছে কি না দেখে নিয়ে অহনা তীব্রস্বরে বলল, “আউট। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। ইউ নো, আমি তোমায় এক মুহূর্ত স্ট্যান্ড করতে পারি না।”

“তা বললে চলে ডার্লিং? পাক্কা আড়াই ঘণ্টা ড্রাইভ করে এলাম তা কি এক্ষুনি বিদেয় হওয়ার জন্যে?” সুগতও চারদিকটা একবার দেখে নিল, “আশা করি চেঁচামিচি জুড়ে সিনক্রিয়েট করবে না। তাতে তোমারই কিন্তু লোকসান। আফটার অল আশাবরী ম্যাডামের একটা প্রেস্টিজ় আছে তো।”

“কী চাও তুমি? কেন এসেছ?”

“বাইরে দাঁড়িয়ে কথা হয় নাকি। চলো, ভেতরে গিয়ে বসি।”

“তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই।”

“সো হোয়াট? আমার তো আছে।” সুগত সিগারেটটা চেপে চেপে নেভাল জুতো দিয়ে। মশমশিয়ে হেঁটে গ্রিলবারান্দা খুলে ঢুকেছে অন্দরে।

অহনার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। দরজা খোলা… কৃষ্ণা এসে গেছে নাকি? সুগত শেষ যেবার হানা দিয়েছিল, দিনটা ছিল রোববার। কৃষ্ণা তখন সবে যোগ দিয়েছে কাজে। অহনার কাছে প্রবল ঝাড় খেয়ে সুগত সেদিন গনগনে মুখে চলে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি। কৃষ্ণা ব্যাপারটা পুরো আঁচ করতে পারেনি। তবু তার কত কৌতূহল… “সুন্দর মতো বাবুটা কে গো! তুমি এত বকছিলে কেন! বাবুর গাড়িটা কী ভাল, এস্টাট দিলেও শব্দ হয় না!” সেদিন যা হোক কিছু বুঝিয়ে পরিস্থিতি ম্যানেজ করা গিয়েছিল, আজ কি তা পারবে? কৃষ্ণা এখন অনেকটাই পুরনো, অহনা শেফালির তর্কাতর্কি থেকে কিছুটা হয়তো আন্দাজও আছে তার। আজকের বাদানুবাদের পর আর কি কিছু বোঝার বাকি থাকবে কৃষ্ণার! তারপর গ্রামে গ্রামে রাষ্ট্র হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। চাটনি সহযোগে। কে কী জানল অহনা তার পরোয়া করে না। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে লোকজন রসালো চর্চা করছে, এটা ভাবলেই অহনার গা গুলিয়ে ওঠে।

এখন উপায়ও তো নেই। সে বাড়ি না ঢোকা অবধি সুগত গেঁড়ে বসে থাকবে। আত্মপরিচয় ঘোষণা করে কৃষ্ণাকে হুকুমও ছুড়তে পারে। যা দু’কান কাটা লোক, কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প জোড়াটাও বিচিত্র নয়। উফ কী জ্বালা। অহনা রে, তোর মান মর্যাদা সব গেল!

অহনা বড় করে একটা শ্বাস টানল ফুসফুসে। শক্ত করল নিজেকে। যা হয় হবে, আজ এমন শিক্ষা দেবে সুগতকে যেন আলাইপুরের ছায়া আর না মাড়ায়।

ভেতরে পা রেখে অহনার বিস্ময় আরও বেড়ে গেল। রান্নাঘরের শিকল টানা তার মানে কৃষ্ণা আসেনি। তবে কি অর্ঘ্য…? সন্ধে নামার আগে সে ফেরে না সচরাচর, আজ এত তাড়াতাড়ি? ওহ, এ তো আর এক ধরনের অস্বস্তি। তবু কৃষ্ণা এসে পড়ার চেয়ে ভাল। সে শুনল তো শুনল, অহনার তাতে কী এমন ক্ষতি!

সুগত বড় সোফায় বসে। হাতে আবার সিগারেট। একটা খালি কাপ এনে ঠং করে টেবিলে রাখল অহনা, “দয়া করে ঘর নোংরা কোরো না। এটাতে ছাই ফ্যালো।”

কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। একটু যেন জোরে জোরেই টান দিচ্ছে সুগত।

অহনা বসল মুখোমুখি। পলকের জন্য চোখ অর্ঘ্যর দরজায়। বেরিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে অর্ঘ্য। কী আশ্চর্য, সংকোচের বদলে যেন একটু ভরসাই পেল অহনা।

ঠান্ডা গলায় অহনা বলল, “কেন তুমি এখনও আমার ওপর অত্যাচার চালাচ্ছ? কী করলে আমায় নিষ্কৃতি দেবে?”

“তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি…।” সুগতর স্বর গম্ভীর, “ফিরে চলো কলকাতায়। আবার নতুনভাবে জীবনটা শুরু করি।”

“তুমি তো ভাল মতোই জানো সেটা সম্ভব নয়।… টাকার জোরে ডিভোর্সের মামলা তুমি ঠেকিয়ে রাখতে পারো, কিন্তু আমি যা ছেড়েছি তা চিরকালের জন্যই ছেড়েছি।”

“সে তো তোমার ছ’বছর আগের ডিসিশন। তারপর তোমারও বয়স বেড়েছে, আমারও। এখন কি আমাদের কারও আর মাথা গরম করা সাজে!” সুগত থামল। বুঝি বা পড়তে চাইল অহনাকে। তারপর গলাটা সামান্য নরম করে বলল, “ডিভোর্স যে তোমাকে দিতে চাইনি তা তো অকারণে নয় অহনা। আমি বিশ্বাস করি একদিন না একদিন আমাদের ভুল বোঝাবুঝির পালা শেষ হবে, আবার আমরা…”

“স্টপ দিস ননসেন্স।” অহনা দুম করে চেঁচিয়ে উঠল, “কীসের ভুল বোঝাবুঝি? পরের পর অন্যায় করে গেছ, থামাতে চেয়েছি, শোনোনি। যা খুশি নোংরামি করে গেছ, চোখের ওপরে, আমাকে মানুষ বলেই গণ্য করোনি। যেই না প্রতিবাদ করেছি, ওমনি প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিয়েছ আমাকে।”

“থাক না ওসব পুরনো কথা। ভুল তো আমি করেইছি।” সুগত গলা ঝাড়ল, “তবে তুমিও তখন বড্ড টাচি হয়ে গিয়েছিলে, নয় কি? আমি তোমার কোনও অভাব রেখেছিলাম, বলো?… অত বড় একখানা ফ্ল্যাট, শুধু তোমার ব্যবহার করার জন্যে একটা গাড়ি… খরচ করার জন্য অঢেল টাকা… যেভাবে খুশি ওড়াও, কেউ কোনও প্রশ্ন করবে না…। তবু তুমি সেই মিডলক্লাস পিটপিটানি শুরু করলে…”

“আমি তো এখনও সেই রকমই আছি। কেন আসো আমার কাছে? আমি বদলাইনি। সরি, তুমি তোমার টাকা নিয়ে, মেয়েমানুষ নিয়ে, যেভাবে খুশি থাকো। ঈশ্বরের দোহাই, শয়তানের দোহাই, আমাকে আর ডিস্টার্ব কোরো না, প্লিজ়।”

মিনিট খানেক ঘর নিস্তব্ধ। এতই শব্দহীন, মাথার ওপর পাখা ঘোরার আওয়াজও যেন উচ্চকিত লাগে। আচমকাই সুগতর মুখমণ্ডল বদলে গেছে। রাজকীয় ভঙ্গিমা ছেড়ে ঝুঁকেছে টেবিলে। আবার একখানা সিগারেট ধরিয়ে টানছে ফসফস। সেটাও নিভিয়ে দিয়ে করুণ স্বরে বলল, “আমার বড় বিপদ অহনা। এই সময়ে তুমি পাশে না থাকলে…”

“ঢং কোরো না।” অহনা একটুও গলল না, “তোমার আবার কীসের বিপদ? টাকার পাহাড়ে বসে আছ, মুশকিল আসানও তো তুমি তুড়ি মেরে কিনে নিতে পারো।”

“না অহনা, না। তুমি বুঝতে পারছ না। আমি এখন আগ্নেয়গিরির মুখে বসে আছি।”

“হোয়াট?”

“টাকাপয়সা কালেক্ট করে যে ক’টা বিজনেসে লাগিয়েছিলাম, সব ডুবে গেছে। আমার লোকেরাই ডুবিয়েছে। কত লাখ টাকা আমার নাম করে তুলেছে এজেন্টরা, জমাই পড়েনি। যাদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা তারা এখন তাগাদা দিচ্ছে। আমি যে কীভাবে কী করব…”

“তাতে তো তোমার ঠাঁটবাটের কিছু কমতি দেখছি না। গাড়িটা গত সপ্তাহে কিনেছ বললে না?”

“তুমি তো মানি মার্কেটের ব্যাপার-স্যাপার বোঝো অহনা। টাকা আসছিল বলেই স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং একভাবে চলছিল। এখন যদি সেটা হঠাৎ বদলাই, সঙ্গে সঙ্গে বাজার বুঝে যাবে আমার কী হাল। ওমনি চারপাশটা ক্র্যাশ করে যাবে।”

“পন্‌জি সিস্টেমের এটাই তো নিয়ম। তোমাকে তো আগেও বলেছি।”

“ভেবেছিলাম আমি একটা এক্সেপশন। হয়তো সারভাইভ করে যাব। সুগত ঢোক গিলল। মৃদু গলায় বলল, হয়তো এখনও পারি। যদি বিশ্বাস করার মতো কেউ একজন পাশে থাকে… আমাকে গাইড করে…”

“আছে তো। তোমার সেই চন্দ্রাণী।”

“আহ, ডোন্ট টক অ্যাবাউট দ্যাট ডার্টি হোর।”

“খবরদার। আমার বাড়িতে বসে কোনও মেয়ের সম্পর্কে নোংরা মন্তব্য করবে না।” অহনা প্রায় গর্জে উঠল, “ওই মেয়ের সঙ্গেই না তুমি থাকতে এক সময়ে! বিজনেস বাড়বে বলে তাকে আনলে, তারপর তুমিই তাকে বিছানায় তোলোনি? সটান বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমার মুখের সামনে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দাওনি? সে যদি হোর হয়, তবে তুমি কী? ক্রিমিকীট? না নর্দমার পোকা?”

“তুমি জানো না অহনা, চন্দ্রাণী আমাকে কীভাবে চিট করেছে। কত পারসোনাল অ্যাসেট বানিয়ে ফেলেছে, আমায় টের পেতে দেয়নি।… তুমি শুধু আমার সঙ্গে চলো, দেখবে ওকে আমি কেমন লাথি মেরে তাড়িয়ে দিই।”

রাগে বিরক্তিতে রগের শিরা দপদপ করছিল অহনার। তবু কেন যে অহনা হেসে ফেলল! বিদ্রূপের সুরে বলল, “সে এখনও আছে তা হলে? তোমার সঙ্গে?”

“উপায় কী? ও ব্যাবসার এত কিছু সিক্রেট জেনে ফেলেছে…।” সুগত অস্থির ভাবে দু’হাত ঝাঁকাল, “তাই তো বলছি তুমি চলো। আমি যদি একটু ভরসা পাই তা হলে ওকে…”

“আমার মতো করে বিদেয় করতে পারো, তাই তো? তারপর চন্দ্রাণীর পরিবর্তে আমাকে সেই সার্ভিসটা দিতে হবে? বোথ ইন বেড অ্যান্ড বিজ়নেস!”

“কী বলছ তুমি? কোথায় তুমি আর কোথায় চন্দ্রাণী? তুমি হলে আমার বিয়ে করা বউ আর সে একটা…। তোমার মাকেও আমি বলেছি, তোমার সম্মান আর আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। সোনাদানা দলিল দস্তাবেজ কিচ্ছু আর ওই নচ্ছার মেয়েমানুষটার জিম্মায় রাখব না। সব চলে আসবে তোমার কাছে।”

আবার অহনার ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। সুগত সেই একই রকম আছে। নিজের স্বার্থজ্ঞান টনটনে। কোনও একটা ধান্দায় এখন চন্দ্রাণীকে ছেড়ে অহনাকে দরকার। সম্ভবত দু’ নম্বরি কারবারে অহনাকে বেশি নিরাপদ সহযোগী ভাবছে। মা ওসব আহ্লাদিপনায় ভুলতে পারে, কিন্তু অহনা তো বহু বছর আগেই বুঝে গেছে, মাংসলোলুপ ওই সুগতর চোখে তার আর চন্দ্রাণীর কোনও তফাত নেই।

অহনা রূঢ় স্বরে বলল, “তুমি ডিভোর্স দাও না দাও, তোমার সঙ্গে সব চুকেবুকে গেছে। সে সিদ্ধান্তের আর নড়চড় হবে না।”

“কেন এক জেদ আঁকড়ে আছ? বি সেন্সেবল।” আবার একটা সিগারেট ধরাল সুগত। বছর পঁয়তাল্লিশের সুদর্শন মানুষটার চকচকে মুখখানা বেশ নিষ্প্রভ এখন। সিগারেট ধরা আঙুলগুলো যেন কাঁপছে অল্প অল্প। কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “তুমি যা বলবে, যেভাবে চাইবে, সেভাবেই নয় বদলাব নিজেকে।”

“হাসিয়ো না। আমি বললেই ওমনি আপাদমস্তক জালি সুগত চৌধুরী সাধুসন্ত বনে যাবে!”

“চেষ্টা তো করতে পারি। ব্যাবসার ঝাঁপ গুটিয়ে দু’জনে মিলে নয় অন্য কোথাও চলে যাব। যেটুকু যা থাকবে, তাতেই আমাদের বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে…”

ওফ, সেই দু’ নম্বরি চিন্তা। রাশি রাশি লোককে পথে বসিয়ে পালানোর তাল করছে নাকি? আর অহনা তার সঙ্গী হবে? ভাবল কী করে সুগত?

ধারালো গলায় অহনা বলল, “তোমার কোনও মতলববাজিতে আমি ভুলছি না। তুমি কী করবে না করবে তা তুমি ভাবো। আমি তোমার সঙ্গে নেই, থাকবও না কোনও দিন। মা দাদা বউদি যাকে খুশি জপাতে পারো, আমার সিদ্ধান্তে নড়চড় হবে না।”

“একটু ভাবো। ক’দিন সময় নাও।”

“না। এবং কোনও অছিলাতেই তুমি আর আলাইপুরে আসবে না। বিয়ের পর কয়েকটা বছর তো আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। জ্ঞানত আমি তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। কোনও মেটিরিয়াল লস ঘটাইনি। তার বিনিময়ে এইটুকু তো পেতে পারি। শান্তিতে তোমাকে ঘেন্না করার সুযোগটুকু অন্তত দাও।”

সপাং করে যেন চাবুকের ঘা পড়ল সুগতর গায়ে, কেঁপে উঠল সোফায় আসীন দেহকাণ্ড। ঝলসে উঠল সুগতর চোখের মণি। তর্জনী উঁচিয়ে কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। ঘাড় নামিয়ে বসে রইল মিনিটখানেক। তারপর উঠে দাঁড়িয়েছে। বিড়বিড় করে বলল, “একটু বাথরুমে যেতে পারি?”

বারণ করতে পারল না অহনা। এবং যে আশঙ্কাটা পিনপিন করছিল মাথায় সেটাই ঘটল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে সুগতর দৃষ্টি আটকেছে অর্ঘ্যর ঘরে। একটুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে এল পায়ে পায়ে। ভুরু কুঁচকে বলল, “ও কে?”

পলকের জন্য থমকে গিয়েছিল অহনা। কেন যে…? পরক্ষণে অবশ্য কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক। পালটা ভুরু কুঁচকে বলল, “জেনে কী করবে?”

“ও কি এখানেই থাকে?”

“দেখতেই তো পাচ্ছ, আছে। বাড়তি প্রশ্ন কোরো না, জবাব পাবে না।”

“এখানে যে কেউ একজন থাকে… কই, মা তো কিছু বললেন না…?”

“প্রয়োজনবোধ করেনি। তোমার বাড়িতে তুমি কাকে এনে তোলো, রাখো, মাকে জানিয়েছ কখনও?”

“ও।”

নিজের মনেই মাথা দোলাল সুগত। তারপর চলে গেল। বুঝি বা একটু দ্রুতই। গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতে একটু বুঝি বেশি সময় লাগল। আশাবরীর চৌহদ্দি ছেড়ে আস্তে আস্তে মিলিয়েও দেল দুধসাদা।

অহনা সোফা ছেড়ে নড়েনি। বসে ছিল কপাল টিপে। বুঝি শান্ত করছিল রক্তকণিকার অবাধ্য ছোটাছুটি। চোখ না তুলেই টের পেল অর্ঘ্য এসেছে।

অর্ঘ্যর স্বর কানে এল, “আই অ্যাম সরি অণুদি।”

অহনা মুখ তুলল, “কেন?”

“ঘরের দরজাটা বন্ধ রাখলেই বোধহয় ভাল হত। ভদ্রলোক এমন ভাবে দেখছিলেন…”

“তাতে আমার কী এসে যায়?” অহনা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আমি কি ওকে কেয়ার করি?”

“তবু… যা সত্যি নয়… হয়তো তেমন একটা ধারণা নিয়ে চলে গেলেন।”

কোনটা সত্যি, আর কোনটা যে সত্যি নয়, কে বলতে পারে? অহনাও কি জানে ঠিকঠাক? এ বাড়িতে অর্ঘ্যর ক’দিনের উপস্থিতি যে তাকে একটা অন্য ধরনের পুরুষের সাহচর্য দিচ্ছে, সর্বদা অহনার স্মরণেও থাকছে না অর্ঘ্য তার বান্ধবীর ভাই, এই সত্যিটাকে কি অহনা অস্বীকার করতে পারে জোর গলায়?

অহনা ঠোঁট উলটে বলল, “ছাড় তো। ভাবুক যা খুশি।”

কৃষ্ণা ঢুকছে হেলেদুলে। দু’জনকে একসঙ্গে বাইরের ঘরে দেখে একটু যেন অপ্রস্তুত। কাঁচুমাচু মুখে বলল, “চায়ের জন্য বসে আছ, না?”

কৃষ্ণার দেরিতে আসায় অহনা স্বস্তিই পেয়েছে। তবু গম্ভীর সুরে বলল, “দয়া করে তাড়াতাড়ি জলটা চড়াও।”

কৃষ্ণা প্রায় দৌড়োল রান্নাঘরে। সে দিকে তাকিয়ে অহনা হাসিহাসি মুখে বলল, “তা কী বুঝলি আজ, অ্যাঁ?”

অর্ঘ্যর চোখ পিটপিট, “কী ব্যাপারে বলো তো?”

“আমরা তো কেউ আস্তে কথা বলছিলাম না। সবই তো গিলেছিস নির্ঘাত। লোকটাকে কেমন টাইট দিলাম বল?”

“একটা কথা বলব? রাগ করবে না?”

“কী?”

“ভদ্রলোককে এতটা হিট না করলেই পারতে।”

“বেশ করেছি। জানিস ও আমায় কত জ্বালিয়েছে?”

“হতে পারে। তবে এও তো হতে পারে, তোমার হাজ়ব্যান্ডের মধ্যে একটা চেঞ্জ এসেছে? গলার স্বর শুনে যথেষ্ট বিচলিত মনে হচ্ছিল। হয়তো সত্যি আন্তরিক ভাবে চাইছেন…”

“থাম তো। ওকে তুই কতটুকু চিনিস? কথা দিয়েই তো লোককে মোহিত করেছে চিরকাল।” অহনার গলায় ঝাঁঝ, “কথার কায়দায় ভুলেই তো আমি ফেঁসেছিলাম।”

“তাই বুঝি?”

“না তো কী। প্রথম ওর সঙ্গে মোলাকাত আমাদের বাড়িতে। বাবা কোল ইন্ডিয়ার বড় অফিসার ছিল, তুই তো জানিসই। সুগত বাবার কাছে এসেছিল। বাবাকে দিয়ে কিছু ইনভেস্ট করাতে। শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, চার-পাঁচটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির ব্রোকারি, একসঙ্গে চালাত। পরিচয় দেওয়ার সময়ে বলত, আমি হেঁজিপেঁজি দালাল নই, বিনিয়োগ পরামর্শদাতা। কার্ডে লেখা থাকত, ইনভেস্টমেন্ট কন্সালটেন্ট। কত যে ডিগ্রি ডিপ্লোমার লিস্ট ছিল সেই কার্ডে।”

“অর্থাৎ প্রচুর পড়াশোনা করা মানুষ।”

“তুৎ, সব মিথ্যে। মানুষটাই তো ভুয়োর ডিপো। তবে কথাবার্তায় অতি অতি চৌখস। তখনই সুট-প্যান্ট-টাই পরত। ফিল্মস্টারদের মতো ঝকঝকে চেহারা, এখন তো তাও মাথার সামনেটা অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে, তখন চুলের কী বাহার, মুখে অনর্গল ইংরিজির খই ফুটছে… এমন ভাবে বোঝাবে, মনে হবে সর্বস্ব এর হাতে তুলে দেওয়া যায়। তবে বাবা ছিল হার্ড নাট টু ক্র্যাক। সুগতকে তাই আসতে হচ্ছিল বারবার। শেষমেশ বাবা বোধহয় কিছু টাকা রেখেছিল, কিন্তু আমি তদ্দিনে পুরো মোহিত হয়ে গেছি। সুগতর দিক থেকেও সাড়া পেয়ে আমি তো আত্মহারা। এম.এস.সি করে তখন সবে নেটে বসব বসব ভাবছি, ও হঠাৎ তাড়া লাগাতে শুরু করল বিয়ের জন্য। বাবা তখনই আমাকে সাবধান করেছিল। বলত, সুগতর ভেতর একটা মেকি ব্যাপার আছে, ওর দেখনদারিতে ভুলিস না…। কানে তুললাম না। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা অগ্রাহ্য করে সেরে ফেললাম বিয়েটা। প্রথম তিন-চার মাস তো কিছুই টের পাইনি। দিব্যি একটা সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে নিয়ে তুলল আমায়। আমিও সুখের সাগরে ভাসছি। তারপর তো বিকশিত হল বাবুর স্বরূপ। যে বাবা মা ভাই টাইকে দেখেছিলাম সুগতর, তাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই, শুধু ওই দিনগুলোতে কোনওভাবে পটিয়ে পাটিয়ে বরানগরে এনে রেখেছিল। কয়েকটা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মেম্বরশিপ ছিল, সেগুলোকেই ডিগ্রি বলে চালাত। আদতে লেখাপড়ার দৌড় মোটে বি.কম।”

“ও…তার মানে তোমায় ঠকিয়ে বিয়ে করেছিল?”

“সুগত তা কখনই মানতে চায় না। বলে, তুমি যদি আমার সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে নাও, তার জন্য আমি দায়ী? তখন মনে হয়েছিল যুক্তিটা মিথ্যে নয়। ও তো কখনও গলা ফুলিয়ে দাবি করেনি, বোঝার ভুলটা আমারই গলতি।”

কৃষ্ণা চা বিস্কুট দিয়ে গেছে। অর্ঘ্য কাপ টানল। বিস্কুট চিবোতে চিবোতে নিচু গলায় বলল, “তারপর বুঝি ওই মহিলা… কী যেন নাম…”

“না রে। সে অনেক পরে। তার ঢের আগে থেকেই আমাদের সম্পর্কটা…।” অহনা দূরমনস্ক মুখে চুমুক দিল চায়ে, “হঠাৎ একদিন শুনলাম, ও আর অন্য কোম্পানির কাজ করবে না, নিজেই কারবার খুলবে। যারা যারা ওর টিমে কাজ করত, তাদের নিয়ে। কী ব্যাবসা? এক বছর, দু’ বছর, পাঁচ বছর, দশ বছরের জন্যে টাকা ফিক্সড ডিপোজিট রাখবে, চড়া সুদ সমেত ফেরত দেবে সময় মতো। বিশেষ কায়দায়। বেশি সময়ের জন্য যারা রাখবে, তাদের টাকার একটা অংশ দিয়ে যারা কম সময়ের জন্য রাখছে, তাদের টাকাটা মিটিয়ে দেবে। আর বছরের পর বছর ব্যাবসাটা চলতে থাকলে লং টার্ম ডিপোজ়িটারদের ফেরত দেওয়ার কোনও সমস্যা নেই। টাকার একটা অংশ রিয়েল এস্টেটে লাগাবে, জমি কিনবে বেচবে, তাতেই নাকি লাল হয়ে যাবে সুগত।”

“তা হয় নাকি? ওভাবে টাকা তোলা, চড়া সুদ দেওয়া তো একেবারে বেআইনি।”

“সে তো জানি। তা ছাড়া ওটা অসম্ভবও। অঙ্কে তো আমি নেহাত মূর্খ নই, হিসেব কষে ওকে দেখিয়েও দিলাম। পাত্তাই দিল না, উলটে রেগে গেল। নেমে পড়ল বিজ়নেসে। কী কাণ্ড, ওর ক্যারিশমার জোরে হোক, কী ওর টিমের কেরামতি, হু হু করে টাকা আসতে লাগল। স্যাটাস্যাট ফ্ল্যাট কিনছে, গাড়ি কিনছে, আর আমি শিউরে শিউরে উঠছি। অন্য নেশাও ধরল ক্রমশ। আগে ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্ক করত… শুরু হল বেহেড মাতলামি। যত্র তত্র পড়ে থাকা, আজ এই হোটেলে রাত কাটাচ্ছে তো কাল ওই হোটেলে…। এবং একলা নয়, সর্বদাই কোনও নর্মসহচরী মজুত। এতই নির্লজ্জ সেটা আবার সগর্বে ঘোষণা করে।”

“তখনই তুমি চলে আসোনি?”

“পারিনি আসতে। সংকোচে পা আটকে ছিল যে। শুধু মনে হত, বাপের বাড়ি ফিরলেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে, আমি হেরে গেছি। অবশেষে সিনে এন্ট্রি নিল চন্দ্রাণী। প্রথম প্রথম বলত, ও আমার বিজ়নেস এগজ়িকিউটিভ। তারপর ওকে নিয়ে এমন লোচ্চামি শুরু করল… ফিরে আসতেই হল একদিন। এমনই কপাল, একটু সুস্থির হয়ে বাঁচব তার উপায় নেই। বাবা দুম করে মারা গেল। দাদা তখন অবিরাম ঘ্যানাচ্ছে, ভুল করিস না। সুগত যাই করুক, যে ব্যাবসাই করুক, তার টাকায় তোর ন্যায্য অধিকার আছে, তোর পাওনা তুই ছাড়বি কেন…।”

“লাল্টুদা এ কথা বলেছিল?”

“দুনিয়ায় স্বার্থ বড় বিষম বস্তু রে। আলাইপুরের জমিবাড়ি বাবা আমার নামে লিখে দিয়েছে, যদি সুড়সুড়িয়ে সুগতর কাছে ফিরে যাই, তা হলে ক’দিন পরে দাদা এটাকে বেচার কথা বলতে পারে। আর বিক্রি হলে বোন কি দাদাকে বখরা দেবে না!” অহনার গলা সামান্য ধরা ধরা শোনাল, “সাধে কি বলি, জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে… ওই সব দেখেশুনেই না…”

অর্ঘ্য নিশ্চুপ। খোলা জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখছে। নাকি ভাবছে কিছু? হঠাৎ বলল, “তবু… মানুষ তো বদলায়… তোমার হ্যাজ়বেন্ডের হয়তো অনুতাপ এসেছে…”

“সুতরাং ফিরে গিয়ে তুমি তার সংসার করো!” অহনার মুখ বিদ্রূপে বেঁকে গেল, “তুই এটা বলতে পারছিস? এ কি সম্ভব? ওই আদ্যন্ত অসৎ ডিবচ লোকটার সঙ্গে আবার এক ছাদের নীচে কাটাব? স্রেফ পুরুষমানুষ বলে ও জগৎ সংসারের কাছে ছাড় পেয়ে যাবে? আমি তাকে ক্ষমা করব না। পদে পদে যে আমায় অপমান করেছে, আমার বিশ্বাস ভেঙেছে, তার সঙ্গে কীসের আপস?”

অর্ঘ্য আর কিছু বলল না। উঠে আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে ঘরে। জীবনে এই প্রথম মনের কথাগুলো উগরে দিতে পেরে একটু যেন হালকা বোধ করছিল অহনা। যেন গুহার মুখে আটকে থাকা পাথরের চাঁই একটু একটু করে সরছে।

কেন অহনা এত কথা বলল অর্ঘ্যকে? অর্ঘ্য তার কে? সুগত যখন এল, কাকতালীয় ভাবে অর্ঘ্য উপস্থিত ছিল বলেই কি? নাকি অন্য এক অহনা ছটফট করছিল অর্ঘ্যকে শোনানোর জন্যে? কিন্তু অর্ঘ্যই বা সুগতর হয়ে ওকালতি করল কেন? নাকি পরখ করছিল অহনাকে? আশ্চর্য, কেন অহনার এমন মনে হচ্ছে?

অহনা বুঝতে পারছিল না। রাতে শুয়েও ঘুরে ঘুরে আসছিল ভাবনাটা। আধো তন্দ্রায় আরও নানান চিন্তা এলোমেলো পাক খাচ্ছে মাথায়। সুগত আজ ঠিক কেন এসেছিল? তাকে ফেরানোর জন্যই বা এত আকুল কেন? কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে সুগতর? সত্যি কি কোনও ঝামেলায়…? বড্ড সিগারেট খাচ্ছিল…

কীসের একটা শব্দ হচ্ছে না? ঘোরটা ছিঁড়ে গেল অহনার। হালতা রাতবাতি জ্বলছে ঘরে, কিন্তু কিছুই যেন ঠিক ঠিক ঠাহর হয় না। মশারি সরিয়ে নামল বিছানা ছেড়ে। টলমল পায়ে টিউব লাইটটা জ্বালাল। ফ্যাটফেটে আলোয় আওয়াজটা আরও যেন উচ্চকিত। অর্ঘ্যর ঘর থেকে আসছে কী?

হ্যাঁ, তাই তো। একটা গোঙানির শব্দ। যেন বোবায় ধরেছে অর্ঘ্যকে। দুঃস্বপ্ন দেখছে কি কোনও?

অহনা ডাকতে যাচ্ছিল, ঝুপ করে থেমে গেল শব্দটা। আবার নিয়মিত লয়ে শ্বাস পড়ছে অর্ঘ্যর।

অহনা স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে। এগোতেও পারছে না, পিছোতেও না। শিরশির করছিল বুকটা। হঠাৎই।

.

॥ ৯ ॥

দুপুরে খেয়েদেয়ে উঠে অর্ঘ্য একটু যেন ছটফট করছিল। সকাল থেকেই মন আজ ভারী উচাটন হয়ে আছে। কেন যে হঠাৎ হঠাৎ ধড়াস করে উঠছে বুকটা। তেমন কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই। এ কি কোনও বিপদের সংকেত? অনেক সময়েই মন নাকি আসন্ন সংকটের পূর্বাভাস পায়। ধুৎ, এ ধরনের আধিভৌতিক কিংবা দৈব ব্যাপারস্যাপারে কণামাত্র বিশ্বাস নেই অর্ঘ্যর। যে দর্শনে তার প্রগাঢ় আস্থা, তাতেও বলছে এসব স্রেফ মনগড়া কল্পনা। কিন্তু মন যে তার অসম্ভব চঞ্চল হয়ে আছে, তত্ত্বের দোহাই দিয়ে অর্ঘ্য সেটা উড়িয়ে দিতে পারছে কই?

কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলেই কি ভেতরে ভেতরে একটা অস্বস্তি চলছে অর্ঘ্যর? সকালেই অহনার মুখে শুনেছে, রাত্রে ঘুমের ঘোরেও নাকি অর্ঘ্যর গলা দিয়ে বিটকেল আওয়াজও শোনা যাচ্ছিল…

নাহ, ফোনাফুনি একটু করতেই হবে আজ। বিজয় রত্নম নামের ভোটের কার্ডখানা দিয়ে নতুন একখানা সিম বানাল, এখনও ব্যবহারই হয়নি। নয়া নম্বরটা বেশ কয়েকজনকে দিয়ে রাখা দরকার।

কিন্তু ঘরে বসে তো শান্তিতে কথা বলা যাবে না। আজ অহনাদেবী বাড়িতে মজুত। একটু নিরিবিলি চাই, সামান্য নিভৃতি। সুখের বিষয়, এমন জায়গার এখনও অভাব ঘটেনি আলাইপুরে।

মোবাইল পকেটে নিয়ে, চটি গলিয়ে অর্ঘ্য বেরোতে যাচ্ছে, পিছন থেকে অহনার ডাক, “চললি কোথায়?”

অর্ঘ্য দাঁড়িয়ে পড়ল। আলগা ভাবে বলল, “সকাল থেকে বসে আছি, যাই একটু হেঁটে আসি।”

“এই দুপুরবেলা টো টো করবি?”

“কোথায় দুপুর? প্রায় তিনটে বাজে। বাইরে তো রোদও নেই খুব একটা।”

“বেশি দেরি করিস না। বিকেলে বেরোব একটু। তোকে নিয়ে।”

“কোথায়?”

“তোকে সাইট সিয়িং করাব।”

“মানে?”

“পরে তো আমার নিন্দে করবি, এতদিন রইলাম অণুদি নিজে আমাকে আলাইপুরের আশপাশটাও ঘুরে দেখাল না। চল, তোতে আমাতে আজ চরে যাব।”

“কোন চর?”

“নদীর চর। গঙ্গার মাঝখানে যেটা গজিয়েছে।”

“কী আছে ওখানে? এনিথিং স্পেশাল?”

“জানি না। বহুকাল আগে, সেই যখন এলাম, ওখানে গিয়েছিলাম একবার। তখন বিলকুল ন্যাড়া ন্যাড়া ছিল। এখন তো দেখি সবুজে ছয়লাপ। প্রচুর পিকনিক পার্টিও যায় শীতকালে।” বলতে বলতে অর্ঘ্যকে লঘু ধমক দিল অহনা, “গিয়েই দেখবি কী আছে না আছে। আমার সঙ্গে বেড়াতে কি তোর আপত্তি আছে?”

অর্ঘ্য হেসে ফেলল, “না না, যাব।”

বেরিয়ে এল অর্ঘ্য। চলতে চলতে মনে হল, তার সঙ্গ যেন একটু বেশিই পছন্দ করছে অণুদি। যতটা না ভাইয়ের মতো, তার চেয়ে বেশি বন্ধুর মতো। তারও কি অণুদিকে এখন দিদি গোছের কিছু মনে হচ্ছে। উঁহু। জীবনে এই প্রথম যেন কোনও নারীর সৌরভ পাচ্ছে অর্ঘ্য। যা মা-দিদিদের মতো নয়, সহপাঠীদের মতো নয়, তার মহিলা কমরেডদের মতো তো নয়ই। এই ঘ্রাণ যেন সম্পূর্ণ আলাদা। নিজের সুখ-দুঃখ, গোপন কষ্ট কী অকপট ভাবে বলছে তাকে। মতামত চাইছে। কখনও দুঃখে ভেঙে পড়ছে, আবার অর্ঘ্যর ওপর নির্ভর করেই সুস্থিত হচ্ছে কখনও কখনও। সব মিলিয়ে এক অন্য ধরনের অনুভূতির স্বাদ মিলছে যেন। কী বলে একে?

এই অর্ঘ্য, তুই প্রেমে টেমে পড়ে যাচ্ছিস না তো? মাত্র কয়েক দিন ফাঁকা বাড়িতে এক নিঃসঙ্গ মহিলার সান্নিধ্যে থাকতে থাকতে তোর জ্ঞানগম্যি লোপ পেল নাকি? দেখিস বাবা, যুক্তিবুদ্ধির অসুখে পড়ে যায় না যেন। বিপ্লবীকে ওটা মানায় না।

আপন মনেই অর্ঘ্য হাসল একটু। যে তিরতিরে অজানা উদ্বেগে ভুগছিল এতক্ষণ, তা যেন কমেছে খানিকটা। ইটভাঁটা পেরোল অর্ঘ্য। আশাবরী থেকে তাকে আর চোখেই পড়বে না। রোববার বলেই জায়গাটা আজ বড় বেশি নির্জন। একফালি ছায়া খুঁজে নিয়ে অর্ঘ্য বসল নিশ্চিন্তে। কাকে ফোন করবে প্রথমে? রাজন? তেজস কী মতলব ভাঁজছে জানাটা ভীষণ জরুরি। কিন্তু তার আগে একবার আসানসোলের খোঁজ নেবে না?

আগে বাবার নম্বরটাই টিপল অর্ঘ্য। বাজছে, বাজছে। বেজে বেজে থেমে গেল। আবার টিপল নম্বরটা। বেজেই গেল ফোন, ধরল না কেউ।

কী হল ব্যাপারটা? বাবা মোবাইলের ধারেকাছে নেই নাকি? এমন অবশ্য হয় মাঝেসাঝে। একটু চিন্তা করে অর্ঘ্য ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছে। বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে, অন্য কেউ ধরতে পারে ফোন, তবুও…।

নাহ, কপাল ভাল। বাবাই তুলেছে, “হ্যালো?”

“বাবা, আমি খোকা।”

“ওমা, তুই? তোকে পরশু সন্ধে থেকে খুঁজছি, সারাক্ষণ সুইচড অফ…”

বাবার উদ্বিগ্ন গলা শুনে একটু যেন কেঁপে গেল অর্ঘ্য। জিজ্ঞেস করল, “মা আছে কেমন?”

“তার তো যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। স্ক্যানের রিপোর্ট খুব খারাপ। ব্রেনে তিন-চার জায়গায় ব্লাড ক্লট করেছে।”

“অপারেশন করাতেই হবে?”

“কাল একজন স্পেশালিস্টের সঙ্গে কথা হল। উনি কোনও ভরসা দিতে পারলেন না। বলছেন অপারেশন খুব রিস্কি, বরং মেডিসিন দিয়ে ট্রাই করা যেতে পারে। সময় বেশি লাগলেও রিকভার করার চান্স আছে। তোর দিদি তো কাল জামশেদপুর থেকে এসেছে। থাকবে কিছুদিন। তোর মা অবশ্য ওকেও চিনতে পারছে না। চোখটা খোলা, জ্ঞানটা আছে, এইটুকু যা সান্ত্বনা।”

অর্ঘ্যর মুখে কোনও কথা ফুটল না। একটা মৃদু ধ্বনি বেরোল শুধু, “ও।”

“যে জন্যে তোকে আমি খুঁজছিলাম…” অরবিন্দের গলা সহসা খাদে, “পরশু বিকেলে… কে কী খবর দিয়েছে জানি না… দুই পুলিশ অফিসার বাড়িতে হাজির। লোকাল থানার নয়, বেশ হোমরাচোমরা গোছের।”

সেই অস্ফূট ধ্বনিই ফুটল আবার, “ও।”

“তারা প্রায় দু’ ঘণ্টা ছিল বাড়িতে। অনেক অনেক জেরা করল। তুই কোথায় পড়তিস, কতদিন বাড়িছাড়া, শেষ কবে বাড়িতে এসেছিলি, তোর কোন কোন বন্ধুবান্ধবকে আমি চিনি, তাদের কারও ঠিকানা জানি কিনা… তোর মা’র অবস্থা দেখে বোধহয় দয়া হল, নইলে আরও কতক্ষণ যে আমায় রগড়াত, কে জানে।” অরবিন্দের গলা একটু যেন বেশিই ভারী শোনাল, “এক দিকে তোর মা, অন্য দিকে তুই, কী জ্বালায় যে ভগবান ফেললেন আমায়… জানি না জীবনে কী পাপ করেছিলাম।..”

সরল আক্ষেপ, কিন্তু বিষাক্ত তিরের মতোই কথাগুলো বিঁধছিল অর্ঘ্যকে। যেন বাবাকে থামানোর জন্যই বলে উঠল, “এখন তো তা হলে কোনও ভাবেই আমি আসানসোলে যেতে…”

“ভুলেও ও চেষ্টা করিস না। আমার ধারণা, পুলিশ আমাদের বাড়ির ওপর ওয়াচ রাখছে।” অরবিন্দের গলা থেকে ক্ষোভ ঠিকরে এল, “না রাখলেই বা কী? সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। মায়ের এই ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে তুমি বাড়তি কোনও উপদ্রব না বাধালেই আমি কৃতজ্ঞ থাকব।”

“মনে থাকবে উপদেশটা।”

“আমার কত উপদেশই না মনে রেখেছ!” অরবিন্দর হতাশ সুরে বুঝি বা বিলাপ এসে মিশল, “কোথায় কোথায় মানুষ মেরে কী দেশোদ্ধার করছ জানি না, কবে যে নিজেও তুমি গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকবে, সেই খবরও বুড়ো বোকা বাপটাকে গিলতে হবে… তাও জানি না। তবে পুলিশ যখন একবার আসা শুরু করেছে, তখন সে বারবার আসবে, আমাদের উত্যক্ত করবে… যতক্ষণ না তোমার সন্ধান পায়। তদ্দিন অত্যাচার তো আমায় সইতেই হবে… তোমার বাপ হওয়ার মাশুল তো গুনতেই হবে…”

সহ্য হচ্ছিল না অর্ঘ্যর। বাবা তো প্রলাপ বকছে না, সশস্ত্র ব্যাটেলিয়নের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে যেন গুলি ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে। বিদ্ধ করছে যত্রতত্র।

গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং মাফিক আড়াল খুঁজল অর্ঘ্য। বলল, “বেশিক্ষণ ফোনে কথা বলা সেফ নয়। আজ রাখছি।”

“এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড।” অরবিন্দের স্বর ঝাপটে এল কানে, “তুমি কিন্তু আমার মোবাইলে আর কল কোরো না।”

“কেন?”

“পুলিশ আমার মোবাইল সিইজ় করেছে। সিম বদলে ভাল করেছ, নইলে হয়তো… আমি অবশ্য সব সময়েই তোমার কল মুছে দিয়েছি… তোমার নম্বরটাও ওতে নোট করা নেই… তবু সাবধান থাকাই তো…”

কথা ফুরোনোর আগেই বাটন টিপেছে অর্ঘ্য। কেটে গেল ফোন। হৃত্পিণ্ড তড়াক তড়াক লাফাচ্ছে। এইমাত্র বাবার মোবাইলেই রিং করেছিল…! অর্থাৎ, তার এই নম্বরটাও হয়তো এখন পুলিশের কবজায়। আগের নম্বরের শেষ কলগুলো থেকে যে টাওয়ার লোকেশন মিলবে, নতুন নম্বরেও তো সেখান থেকেই…

উদাসীন প্রকৃতি মানুষের বিপদ আপদের হদিশ রাখে না। মনোরম একটা বাতাস পাঠাচ্ছে নদীর দিক থেকে। ভিজে ভিজে। ঠান্ডা ঠান্ডা। চিলতে মেঘে ঢাকা পড়েছে সূর্য, ভারী মায়াময় আলোয় সেজে উঠছে আলাইপুরের বিকেল।

অর্ঘ্য ঘামতে শুরু করল। রাজনকে আর ফোন করা যাবে না, রাজনও বিপদে পড়ে যেতে পারে। ধরা পড়ার সম্ভাবনাও যেন বেড়ে গেল অনেকটা। আর কি আলাইপুরে ডুব মেরে থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ? যত জলদি জলদি সম্ভব কেটে পড়াই তো শ্রেয়। পারলে কালই। উঁহু, কাল কেন, আজই নয় কেন? যত দেরি করবে, ততই তো বাড়বে বিপদের আশঙ্কা।

কিন্তু এক্ষুনি সে যাবে কোথায়? কলকাতার ডেরাটায় এক দু’দিনের জন্য উঠতে পারে, কিন্তু তার বেশি নয়। মেসের মালিক তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল, এবার হয়তো পুলিশ লেলিয়ে দেবে। একটু ভদ্রস্থ গোছের কোনও বাড়িতে পেয়িংগেস্ট থাকবে, সেও তো আর পেরে উঠবে না। হাতে টাকাপয়সা বেশি নেই যে। তা ছাড়া আইডেন্টিটি হ্যাঙ্গামা তো থাকছেই। সোর্স অবশ্য একটা আছে কলকাতায়, গেলে কিছু মালকড়িও মিলতে পারে, কিন্তু সে তেজসের লোক। তার কাছে যাওয়া মাত্র অর্ঘ্যর অবস্থান জেনে ফেলবে তেজস। বাবার কাছে পুলিশ পাঠানোর বদমাইশিটা কে করল? তেজস? পুলিশের মধ্যেও তাদের পার্টির ইনফর্মার আছে। তাদের কারও মাধ্যমেই কি তেজস পৌঁছে দিয়েছে অর্ঘ্যর আসানসোলের ঠিকানা? অসম্ভব নয়, পার্টির পূর্ণ কন্ট্রোল পাওয়ার জন্য যেভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির শেষ মিটিং-এ ব্যক্তি হত্যার নীতি থেকে সরে আসতে বলেছিল অর্ঘ্য, তার অনুগামীও কম ছিল না। ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে প্রস্তাবটাই সুকৌশলে বানচাল করে দিল। এত বড় সিদ্ধান্ত নাকি ক’জনে মিলে বসে নেওয়া যায় না, প্রতিটি সদস্যের মতামত যাচাই করা দরকার। সে ভোটেও তেজস হারবে জানে বলেই বোধহয় অর্ঘ্যকে বেমালুম ছেঁটে ফেলতে চাইছে।

ভাল লাগে না। ভাবতেও ভাল লাগে না। মানুষের ভাল করতে এসে নিজেদের মধ্যে লড়াই, এর চেয়ে কুত্সিত আর কী আছে! তারা সব্বাই একই আদর্শে বিশ্বাসী। একটা শোষণহীন সমাজ দেখতে চায়। অথচ মতে সামান্য অমিল হলেই একে অপরের শত্রু! অর্ঘ্যর তো এখন বেশ মনে হচ্ছে তাদের লক্ষটা স্রেফ উপলক্ষ। আসলে অস্ত্রশস্ত্রের জোরে ছোট ছোট এলাকার সম্রাট হওয়াই বুঝি স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে পার্টি নেতাদের। দুলাল সেদিন ভুল বলেনি। ক্ষমতা পেলে তাদের পার্টিও হয়তো দুলালদের বাধ্য চাকর বাকরই বানিয়ে ছাড়বে। অর্ঘ্য কি এটাই চেয়েছিল?

অর্ঘ্যর ফুসফুস নিংড়ে একটা বাতাস বেরিয়ে এল। শিথিল পায়ে ফিরছে আশাবরীতে। নাহ, কলকাতা সে যাবে না। আরও দূরে কোথাও পাড়ি জমাবে। জঙ্গলমহল নয়, ঝাড়খণ্ড নয়, আরও দূরে কোথাও। কিন্তু টাকা? অণুদির কাছে চাইবে? মিলতেও পারে। কিছু একটা গুলতাপ্পি দিতে হবে, এই যা।

অজান্তেই এক চিলতে করুণ হাসি ফুটে উঠল অর্ঘ্যর মুখে। সে নাকি সত্যের সাধনায় নেমেছে, মহান আদর্শের জন্য জীবন উত্সর্গ করাই নাকি তার ব্রত, অথচ পদে পদে তাকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়! মিথ্যের রাস্তা ধরে আদৌ কি সত্যে পৌঁছোনো যায়?

আনমনা অর্ঘ্য কখন যে আঙিনা পেরিয়ে পৌঁছে গেছে বাড়ির দরজায়। গ্রিলগেট ঠেলতেই অহনার গলা উড়ে এল, “সেই দেরি করলি তো? বিকেল যে প্রায় ফুরিয়ে এল!”

“সরি।”

বলতে বলতে বসার ঘরে ঢুকেছে অর্ঘ্য। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ছলাৎ।

হ্যাঁ, হৃদয়ে ঢেউ তোলার মতোই সাজগোজ করেছে অহনা। সালোয়ার কামিজের বদলে পরনে আজ মেরুন রঙ সিল্কের শাড়ি, শুকনো শুকনো মুখখানায় সুষমা এনেছে প্রসাধনে। মাপসই ওষ্ঠরঞ্জনী, কপালে ছোট্ট টিপ, আর লম্বা বিনুনিতে সে যেন অন্য মানবী আজ। পারফিউম মেখেছে কি? একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসে যেন? অচেনা কোনও ফুলের সুরভি?

অহনা মুচকি হেসে বলল, “প্যাটপ্যাট করে কী দেখছিস, অ্যাঁ?”

“ম্যাজিক।” অর্ঘ্য দু’ আঙুলে তারিফের মুদ্রা ফোটাল, “দারুণ ব্রাইট লাগছে।”

“যাক, নজরে পড়েছে তা হলে। …খুব যে বলিস মেয়েদের দিকে নাকি তাকাসই না…”

“তা বলে অন্ধ তো নই।”

“বটে?” অহনা হাসতে হাসতে গলা চড়াল, “কৃষ্ণা, চটপট চা দিয়ে যা। আমরা বেরোব।”

কৃষ্ণার উত্তর শোনা গেল, “জল বসিয়ে দিয়েছি দিদি।”

“রুটিটাও সেঁকে ফ্যাল। আমি তালা দিয়ে যাব।”

অহনার এই সপ্রতিভ উচ্ছল রূপ অবাক করছিল অর্ঘ্যকে। আজ তো সকালেও এমনটা ছিল না। হাসিমুখেই কথা বলছিল, তবে এখনকার উচ্ছ্বাস যেন একটু বাড়তি। অর্ঘ্য সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে বলে এত খুশি? এখন কি আজই চলে যাওয়ার কথা উচ্চারণ করা যায়? উঁহু, মন থেকে সায় পাচ্ছে না। বরং একটা অন্য রকম বিকেলের সম্ভাবনাই তাকে টানছে যেন।

অহনা হালকা ধমক দিল অর্ঘ্যকে, “হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে? তৈরি হয়ে নে।”

অর্ঘ্য কাঁধ ঝাঁকাল, “আমি তো রেডি।”

“ওই বারমুডা পরে যাবি? আমার সঙ্গে? চটি ফটর ফটর করতে করতে? আশাবরীর ম্যাডামের একটা ওজন নেই?” অহনা ঠোঁট টিপে হাসল, “যা, একটু ভদ্রগোছের পোশাক পরে আয়।”

অগত্যা অর্ঘ্য ঘরে এল। পলক ভাবল, কী পরে এখন। ঘিয়েরঙা কর্ডের প্যান্টটা বার করবে? সঙ্গে যা হোক একটা টি-শার্টই যথেষ্ট। ঝুঁকে ঝোলাব্যাগটা খাটের তলা থেকে টানতে গিয়ে দেখল, অনেকটা ভেতরে ঢুকে আছে। নির্ঘাত কৃষ্ণার কাজ। ঝাঁট দিতে গিয়ে কখনও টেনে বাইরে নিয়ে আসে তো কখনও ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়।

শার্ট-প্যান্ট চড়িয়ে পায়ে স্নিকার গলাচ্ছিল অর্ঘ্য। ফিতে বাঁধতে বাঁধতে পলকা চিন্তার ঝিলিক। মুডটা ভাল আছে অণুদির, আজই চাইবে টাকাটা। মোটামুটি কত বলবে? তার আগে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ছকে নেওয়া দরকার। কলকাতা নয়, অন্য কোনও বড় শহরে যাবে এখন। অন্তত মাস চারেক কোনও সাড়াশব্দ করবে না। লুকোনোর জন্যে বেঙ্গালুরু সবচেয়ে নিরাপদ শহর। স্কুলের সহপাঠী তাপস আছে বেঙ্গালুরুতে। আই টি সেক্টরে। গত বছর দিল্লি গিয়েছিল অর্ঘ্য, হঠাৎ সেখানে তাপসের সঙ্গে দেখা। ব্যাটা বিয়ে-থা করেনি, করার নাকি বাসনাও নেই। হোয়াইট কলার জব করে তাপস, পাক্কা প্রতিক্রিয়াশীল। তবে খুব আন্তরিক, প্রায় সেই স্কুল লাইফের মতোই। অর্ঘ্যকে বলেছিল, চলে আয় ক’দিন জমিয়ে কাটানো যাবে। ইন্দিরানগরে থাকে তাপস, ওর কার্ডটাও আছে পার্সে, ওখানেই নয় এক দু’মাস…। এরকম রিসার্চের বাহানায় বেশি দিনও থাকা যায়। তেমন খরচ হয়তো কিছু হবে না, তবু হাজার পনেরো-বিশ তো রাখতেই হয় পকেটে।

কিন্তু কী অজুহাত দেখাবে? সত্যি সত্যি তার মা’র অসুখ… কিন্তু মা তো এখন সিঙ্গাপুরে…! মিথ্যে বলার কী বখেড়া! আরও যে কত মিথ্যেকে আঁকড়ে ধরে তাকে থাকতে হবে এখন!

অহনা ডাকাডাকি করছে, “কী রে হল? চা যে জুড়িয়ে যাচ্ছে।”

অর্ঘ্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। টেবিল থেকে কাপ-ডিশ তুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুমুক দিচ্ছে চায়ে। বলল, “বড্ড বেশি ছটফট করছ। জুন মাসের বিকেল, সূর্য ডুবতে এখনও ঢের দেরি।”

“একটু আগে আগে যাওয়াই তো ভাল। ঘুরে ঘুরে চরটা দেখা যাবে।”

“যদি দেখার মতো কিছু থাকে। আছে তো কিছু চাষের খেত আর জংলা ঝোপঝাড়।”

“আলো না থাকলে তাই বা দেখবি কী করে? সন্ধের মধ্যে ফিরে আসব, অন্ধকারে ওখানে কিন্তু থাকব না।”

“যো আপকি মর্জি।”

চা শেষ করে কাপ-ডিশ রান্নাঘরে দিয়ে এল অর্ঘ্য। কৃষ্ণা রুটি বানিয়ে রাখছিল ক্যাসারোলে। পেয়ালা-পিরিচ ধুয়ে এবার তার বেরিয়ে পড়ার পালা।

যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কবে আসছে গো দিদি?”

“সামনের শনিবার।”

“তুমি আনতে যাবে?”

“ঠিক নেই। দাদাও পৌঁছে দিতে পারে।”

“মাসিমা এলে আমি কিন্তু ক’দিন ছুটি নেব।”

“কেন?”

“বাবার শরীরটা ভাল নেই। হার্টের খুব ব্যামো। মাঝে তো যায় যায় হয়েছিল, কোনও গতিকে সামলেছে। ক’দিন বাপের বাড়ি গিয়ে থেকে আসব ভাবছি। কবে পুট করে মরে যায়…”

অহনা বলল, “আচ্ছা সে দেখা যাবেখন।”

কৃষ্ণার আর্জি শুনতে শুনতে অর্ঘ্য সামান্য উদাস। মা’র কথা মনে পড়ল কি? আর কি দেখা হবে মা’র সঙ্গে?

কৃষ্ণার প্রায় পিছু পিছুই বেরোল অর্ঘ্যরা। হাঁটছে দু’জনে, অলস মেজাজে। ফুরফুরে হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে, কেমন যেন চাপা গুমোট চরাচরে। প্রকৃতি যে কখন কীভাবে মেজাজ মর্জি বদলায়!

ঘাটের কাছাকাছি এসে দুলালের সঙ্গে দেখা। ছাতা বগলে কোথায় যেন যাচ্ছিল, অর্ঘ্য ধরেছে তাকে, “কী গো, চললে কোথায়?”

“আজ্ঞে মেয়ে-জামাই এসেছে। তাই একটু বাজারের দিকে…”

“সে কী? তোমার ভরসাতেই যে বেরোলাম।”

দুলাল অবাক মুখে বলল, “কেন কর্তা?”

“আমি আর তোমাদের আশাবরী ম্যাডাম একটু চরে বেড়াতে যাব যে।”

“কিন্তু কর্তা আজ যে আমি…। দেখেন না, ঘাটে আরও নৌকো আছে।”

“না না, তোমাকে ছাড়া যাবই না।” দুলালের পিঠে আলগা চাপড় দিল অর্ঘ্য, “এসো এসো। কতক্ষণই বা লাগবে? গিয়ে হয়তো ঘণ্টা খানেক থাকব, ফিরে তার পরে নয় বাজার যেয়ো।”

দুলাল তবু যেন দোলাচলে। ঘাড় চুলকোচ্ছে।

“কী হল, অত ভাবনার কী আছে?” অর্ঘ্য চোখ টিপল, “আমাদের ঘুরিয়ে আনলে তোমার মেয়ে-জামাইয়ের বাজার খরচাটা কিন্তু উঠে যাবে।”

অব্যর্থ দাওয়াই। ধরেছে ওষুধ। দুলাল রাজি।

নৌকোয় উঠতে বেশ কসরত করতে হল অহনাকে। বিপদও ঘটছিল প্রায়। অসমান পাড়, ঘাটে নামতে একবার খামচে ধরছে অর্ঘ্যর হাত, পরক্ষণে দুলালকে। পাটাতনে পা রাখতেই বিশ্রীভাবে দুলে উঠল নৌকো, টলে গেল ব্যালেন্স। দু’ কাঁধ চেপে ধরে কোনও ভাবে অহনাকে স্থিত করল অর্ঘ্য। বসিয়েছে।

অহনা হাঁপাচ্ছিল অল্প অল্প। যত না পরিশ্রমে, তার চেয়ে বেশি নার্ভাসনেসে।

বাবু-বিবিদের এমন বেপথু হাল দেখে অভ্যস্ত দুলাল, টেরিয়ে হেসে ছাড়ছে নৌকো। অহনার পাশে বসে অর্ঘ্য বলল, “খুব ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে?”

অহনা ফ্যাকাশে হাসল, “খুব নয়। একটু। জলে পড়লে কী কেলেঙ্কারিটাই না হত।”

“অমন টলমল করছিলে কেন? আগে তো চড়েছ নৌকোয়।”

“সে কবে… কত দিন হয়ে গেল…। তখন শাড়িও পরা ছিল না।”

“হ্যাঁ ম্যাডাম, সালোয়ার কামিজেই সুবিধে।” দুলাল এবার ফুট কাটল। পাড় থেকে নৌকো সরাতে সরাতে বলল, “সব্বাই বলে, ওই ডেরেসেই ম্যাডামকে বেশি এস্মাট দেখায়।”

অর্ঘ্য গলা নামিয়ে বলল, “দেখেছ তো, তোমাকে কোন পোশাকে কেমন লাগে তাই নিয়েও লোকেরা…”

অহনা ভ্রূকুটি হানল, বুঝি মন্তব্যটা তার পছন্দ হয়নি। চুপ করে গেল অর্ঘ্য। তাকিয়ে আছে পাড়ের দিকে। আগের দিন ছিল পড়তি বেলা, আজ সূর্যের আলো এখনও মরেনি খুব একটা। তীরভূমির রূপও তাই আজ অন্য রকম। মায়াবী মায়াবী নয়, বড্ড বেশি বাস্তব।

শুধু এই অহনার পাশে বসে থাকাটাই যা অলীক। একটু আগে সে অহনার কাঁধদুটো ধরেছিল, এখনও যেন স্পর্শটা লেগে আছে হাতে। এত কোমল হয় রমণীদেহ? যে বাতাস অহনাকে ছুঁয়ে তার গায়ে এসে লাগছে, তারও রূপ রস গন্ধ যেন আলাদা রকম। মেয়েদের স্পর্শ পেয়ে বাতাসও কি আপনা আপনি বদলে যায়?

দুলালের গলা শোনা গেল, “জলের বেশ টান আছে কর্তা। জোয়ার চলছে তো, তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবেন।”

অর্ঘ্যর আগে অহনাই বলল, “ভালই তো। একটু বেশিক্ষণ থাকা যাবে।”

“আমি একটা কথা বলব ম্যাডাম? যদি অনুমতি দেন?”

“কী?”

“যদি আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আমি একবার বাড়ি ঘুরে আসি? মানে বাজারটা যদি…?” দুলাল কাঁচুমাচু মুখে বলল, “আমার হয়েছে বিপদ। ছেলেটা কোন ভুবনে চরে বেড়াচ্ছে কে জানে, এদিকে জামাই মানুষটা ঘরে এল… ষষ্ঠীতে সে এবার থাকবে না… আজ তাকে বিশেষ আপ্যায়ন না করলে চলে? রাতদুপুরে বাজার নিয়ে গেলে মেয়ের মা কখন রাঁধবে, কখন খেতে দেবে…”

“হয়েছে হয়েছে। আর সাতকাহন শোনাতে হবে না।” হাত তুলে অহনা থামাল, তা আমাদের কী হবে? আমরা পড়ে থাকব?

“না ম্যাডাম। আপনারা একটু ঘুরুন, সন্ধে নামতে না নামতে আমি এসে যাব।”

“দেখো, ঝুলিয়ো না যেন। অন্ধকার হলে আমাদের তখন আর কিচ্ছু করার নেই। তার ওপর সাপখোপ…”

“মোটে ভাববেন না। আমি ঠিক চলে আসব।”

দুলাল ভারী আহ্লাদিত হয়েছে। দাঁড় টানছে জোরে জোরে। এগিয়ে আসছে সবুজ।

জল আর নারীর গন্ধ নিতে নিতে ঊর্ধ্বপানে তাকিয়েছিল অর্ঘ্য। ফস করে জিজ্ঞেস করল, “আকাশের গতিক কেমন বুঝছ দুলাল?”

ভুরু কুঁচকে দুলাল ঈশানকোণটা দেখল। বিজ্ঞের মতো রায় দিল, “বৃষ্টি এক-দু’ পশলা হবে।”

“মুষলধারে নামবে না তো?”

“মনে হয় না। এ বছর কবেই বা তেমন ঝমরঝমর নামল! তবে একটু ঝড়ও উঠতে পারে।”

“তুমি তার আগে আসছ তো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। জল নামতে এখনও ঢের দেরি।”

অর্ঘ্য তবু পুরোপুরি স্বস্তি পেল না। আবার যেন টিপটিপ দুশ্চিন্তাটা ফিরে আসছে। হৃদয়ের কোনও এক গোপন কোণে জমছে মেঘ। শুধু মেঘের উত্সটা বুঝতে পারছিল না অর্ঘ্য।

মা’র অসুখ? বাবার মোবাইলে সেই ফোন? তেজস? পুলিশ? নাকি অন্য কিছু?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *