কয়েকটা বছরের মধ্যে প্রীতি ফ্ল্যাট গুছিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে। প্রথম প্রথম ঘরগুলো বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগত। একটাই লাভ ছিল, টিপু নড়বড়ে পায়ে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াতে পারত। এখন আর ওর পা নড়বড়ে নেই, দিব্যি হাঁটতে পারে, দৌড়তে পারে। কিন্তু দৌড়ে বেড়ানোর জায়গা নেই আর।
বসার ঘরে চমৎকার সোফাকৌচ বানিয়ে নিয়েছে।
ওসব ধ্রুবর একটুও পছন্দ ছিল না। ওর ইচ্ছে ছিল বেশ হেলান দিয়ে বসা যায় এমন একসেট বেতে বোনা চেয়ার। তার দামও বেশ কম, বসেও আরাম। কিন্তু প্রীতি রাজি হল না।
কোত্থেকে একটা আমেরিকান ফ্যাশন ম্যাগাজিন নিয়ে এল, বোধহয় নীচের তলার বঙ্কিমবাবুদের কাছ থেকে। পাতা উল্টে উল্টে এমন একটা ডিজাইন পছন্দ করল, যা কারও বাড়িতে দেখা যায়নি। যেন অন্য কারো বাড়িতে দেখা গেলেই সেটাকে যথেষ্ট ভাল বলা যাবে না।
বসার ঘরে একটা ডিভান এল। এক কোণে টি ভি।
ধ্রুব আপত্তি করে বলেছিল, কেই বা আসছে আমাদের এখানে, এত শোফাকৌচ ডিভান কি হবে।
প্রীতি বললে, বাঃ রে, কেউ আসবে বলেই কি বসার ঘর? কেউ যদি আসে হঠাৎ, ওই তো পাশের ফ্ল্যাটের ওরা একদিন এল, খাটে বসতে দিতে হল।
হেসে বললে, ধরো দাদাই যদি একদিন এসে থাকতে চায়। শশাবে কোথায়। আমি ডিভানের অডার দিয়ে এসেছি, বক্স মতো হবে। ভিতরে লেপতোষক তুলে রাখা যাবে,
ওপরে গদি। কেউ এলে শুতেও পারবে।
তারপরই এই ডিভান। আর একটা আলমারিও এল। কাপড় রাখার নাকি জায়গা নেই। শেষে ফ্রিজ।
ফ্ল্যাটটা ক্রমশ সাজিয়ে তুলছে প্রীতি, আর তা দেখে ধ্রুবর ভালই লাগত। কিন্তু ধ্রুবর আরেক চেষ্টা ছিল টাকা জমানোর। সেটা আর সম্ভব হচ্ছিল না বলেই ভিতরে ভিতরে রাগ।
আসলে ধ্রুব একটা স্বপ্ন দেখত। কোথাও এক টুকরো জমি কিনে বাড়ি করবে। অন্তত একটা ফ্ল্যাট কিনবে। আজকাল তো লোন পাওয়া যায়, সব টাকা দিতে হয় না। মাসে মাসে ভাড়ার মতোই কিস্তিতে লোন শোধ করা যায়। আছে তো সেই বাবার দেওয়া হাজার পঞ্চাশ টাকা। না, সুদে বেড়ে এখন বোধহয় ষাট। কিন্তু আরও অনেক লাগবে।
প্রীতিকে খরচ কমানোর জন্যে সে কথা বলতেই ও বলে উঠেছিল, অত টাকা জমাবে তুমি? টিপু বড় হচ্ছে না? স্কুলে দিতে হবে না?
অর্থাৎ খরচ বাড়বে বই কমবে না।
অথচ এখন ধ্রুবর বড় অনুশোচনা হয়। প্রথম থেকেই যদি চেষ্টা করে টাকা জমিয়ে ফেলত, তা হলে লোনটোন নিয়ে হয়তো হরিশ মুখার্জি রোডে ওদের বাড়ির সামনে যে চারতলা ফ্ল্যাট বাড়িটা উঠল, তার একখানা ছোট ফ্ল্যাট কিনে ফেলতে পারত। তখন কত সস্তায় পাওয়া যেত। এখন শুনছে দিনে দিনে নাকি দাম বাড়ছে।
প্রীতিকে সেকথা বলতেই ঈষৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বললে, ভাগ্যিস কিনে ফেলনি। ও বাড়ির সামনেই? দরকার নেই আমার ফ্ল্যাটের।
আসলে স্মৃতির গায়ে জড়ানো তিক্ততাটুকু ও কিছুতেই যেন ভুলতে পারছে না।
তিক্ততা একসময় ধ্রুবর মনেও ছিল। কিন্তু এতদিন বাদে, এখন তো ও রীতিমত সুখী, তেমন কোনও অশান্তি নেই, তাই তিক্ততাটুকুও ধুয়ে মুছে গেছে। হাল্কা হয়ে গেছে চাপা অপরাধবোধ।
প্রথম প্রথম ও অফিস থেকে ফেরার সময় বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে আসত। একদিন তো ভুলে ও বাড়িতে চলে গিয়েছিল। যেন বাড়ি ফিরছে। দরজার সামনে পৌছে ভুল ভাঙল। নিজের মনেই হেসে ফেলেছিল সেদিন। এতদিনের অভ্যাস, ভুল সেজন্যেই। যেন ওদের সঙ্গেই দেখা করতে গেছে এমন স্বাভাবিক মুখ করেই ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু এতদিনের সেই ভুলটা নিজের মধ্যেই গোপন হয়ে আছে। ওদের তো বলেইনি, প্রীতিকেও না। শুনলেই কিছু একটা বলে বসত।
আজকাল মাঝেসাঝে যায়। সময়ের ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে। বাস থেকে ওখানে নামলে বকুলবাগানে আসা রীতিমত কষ্টকর। সরাসরি বাস নেই, হয় ট্যাক্সি, কিংবা হেঁটে আসা। আজকাল বড় ক্লান্ত লাগে।
ওখানে গেলে মা এটা ওটা খাওয়াতে চায়, বাবা টিপুর কথা, প্রীতির কথা জিগ্যেস করে। ধ্রুবর বড় অস্বস্তি লাগে।,
কেবলই মনে হয় কী স্বার্থপর আমি। অথচ স্বার্থপর না হলেও বাঁচাও যায় না। যেন সুখ শান্তি সব স্বার্থের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।
বড়বৌদি মেজবৌদি খুব অন্তরঙ্গ হয়ে কথা বলে, যেতে না যেতে চা করে নিয়ে আসে, প্লেটে করে খাবার।—আহা, তুমি তো আপিস থেকে আসছ।
মেজবৌদি একদিন হেসে বলেছিল, বাড়ি থেকে যদি আসতে, দিতাম নাকি? স্রেফ এক কাপ চা। খাওয়াতে হয় সে মুখপুড়ি খাইয়ে পাঠাবে, আমি কেন দেব।
কথাগুলো খুব আপন আপন মনে হত।
মেজবৌদিও মাঝেমধ্যে ধ্রুবদের কাছে বেড়াতে আসে। সিমলিকে সঙ্গে নিয়ে। সিমলি কেমন চড়চড় করে বড় হয়ে গেল।
কলিং বেল বাজাতেই ধ্রুব ভেবেছিল মেজবৌদি এসেছে। রবিবারের দুপুরে, এ সময়ে আর কেই বা আসতে পারে। প্রীতিদের বাড়ি থেকে কেউ এলে সন্ধের দিকে আসে।
প্রীতি দরজা খুলতে গেল। খুলেই, ও মা আপনি? কি ভাগ্যি।
কথা শুনেই বিছানা ছেড়ে ধ্রুবও এগিয়ে গেল।
তারপরই বলে উঠল, ছোটমাসি, তুমি। এতকাল পরে হঠাৎ? পিছনে ছোটমেসো, হেসে বললে, পর্বত তো মহম্মদের কাছে যাবে না।
আসলে ছোটমাসিকে দেখে অবাক হবার কথা নয়। আগেও একবার এসেছে। অবাক করেছে ছোটমেসো। এই প্রথম।
ওদের বসার ঘরে বসিয়ে প্রীতি বাচ্চা চাকরটাকে ফিসফিস করে কী বললে, টাকা দিল।
মিষ্টি আনতে পাঠাল।
ছোটমাসি বোধহয় বসার ঘরে বসেই টের পেল। চিৎকার করে বললে, এই ধ্রুব, বৌকে বারণ কর, কিছু যেন না আনায়। আমরা এইমাত্র খেয়ে এলাম।
কিন্তু প্রীতি সে-কথায় কান দিল না।
অনেক হাসাহাসি-গল্পগুজবের পর ছোটমেসো ঘুরে ঘুরে ঘর কখানা দেখল, রান্নাঘরে উঁকি দিল, একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রোদ্দুরের জন্যে চলে এল।
বারান্দায় রেলিং ধরে একটা লতানে মানি প্ল্যান্ট অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রীতি, কয়েকটা ঝোলানো টবে ফুলের গাছ।
ছোটমেসো হেসে বললে, বাড়িতে মানিপ্ল্যান্ট রাখলে নাকি খুব টাকা হয়? কি বৌ, সত্যি?
প্রীতি হেসে উঠল।–প্রচুর। রাখার জায়গা পাচ্ছি না।
ছোটমেসো বললে, নাঃ, চমৎকার ফ্ল্যাট, চমৎকার।
আর তখনই ছোটমাসি বললে, নিজে তো দিব্যি এমন একটা ফ্ল্যাট বাগিয়ে নিয়েছিস ধ্রুব, আমাদের একটা জোগাড় করে দে না।
এই ব্যাপার! সেজন্যেই আসা।
প্রীতি বললে, কেন মাসিমা, আপনাদের ও বাড়ি কি হল?
ছোটমাসি দুঃখী দুঃখী মুখ করে বললে, সে আব বলিস না। তোর ছোটমেসো বলছে। উকিল ওকে ড়ুবিয়েছে, উকিল বলছে তোর ছোটমেসো ড়ুবিয়েছে। মামলা তো হেরে গেছি, মাত্র এক বছর সময় দিয়েছিল…
-সে কি! আজকাল আবার মামলায় হবে নাকি কেউ? ধ্রুব অবিশ্বাসের সুরে বললে।
আর সঙ্গে সঙ্গে ছোটমাসি ধ্রুবর হাত দুখানা ধরে বললে, দ্যাখ না বাবা তুই, আমরা তো খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে গেলাম।
ছোটমেসো জিগ্যেস করল, তোমাদের ফ্ল্যাটের কত ভাড়া ধ্রুব?
-সাড়ে চারশো। আগে চারশো ছিল, পঞ্চাশ টাকা বাড়াতে হয়েছে।
ছোটমেসো বলে উঠল, মাত্র?
তারপরই বললে, খুব সময়মতো পেয়ে গিয়েছিলে। এখন আটশো হাজারেও পাবে না, তার ওপর দশ বিশ হাজার অ্যাডভান্স। তাও তো পাচ্ছি না।
এবার ধ্রুবরই অবাক হবার পালা। বাড়ি ভাড়ার কোনও খবরই রাখত না ও। জানার প্রয়োজনও হয়নি।
এই ফ্ল্যাটের ভাড়া এখন আটশো কিংবা হাজার! শুনে ভালই লাগল।
ভিতরে ভিতরে বেশ একটা গর্ব অনুভব করল।
যাবার সময়েও ছোটমাসি মনে পড়িয়ে দিল।–একটু খোঁজ রাখিস বাবা, কোথায় যে গিয়ে উঠব কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি না।
ছোটমেসোকেও খুব উদভ্রান্ত লাগল।
ওরা চলে যেতেই প্রীতি বললে, দেখলে তো? যে আসে সেই বলে চমৎকার ফ্ল্যাট, তোমারই কেবল দক্ষিণ দক্ষিণ। তখন না নিলে কী হত বুঝতে পারছ!
ধ্রুব কোনও উত্তর দিল না। এই ফ্ল্যাটটা নিজের মনোমত হয়নি, মন্দের ভাল, কিন্তু অন্য অনেকে চমৎকার চমৎকার বলে বলেই পছন্দ করিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এর চেয়ে ভাল আর কোথায় বা পেত।
কিন্তু ছোটমেসোর চিন্তিত উদভ্রান্ত মুখ দেখে ওর মনও খারাপ হয়ে গেল। বেচারি। এই বয়সে নিরাশ্রয় হওয়ার ভয় যে কি দুঃসহ, ধ্রুব বুঝতে পাবে। বাবাকেও তো দেখেছে, যখনই বাড়িওয়ালা এসে মিষ্টি মিষ্টি হেসে উঠে যাওয়ার কথা বলত, বেশ কয়েকদিন ধরে বাবার মুখে ভয়ের ছাপ দেখতে পেত। ছোটমেসো তো আবার মামলায় হেরে বসে আছে। এক বছর সময় পেয়েছে, এই যথেষ্ট। কিন্তু যত দেরি হবে, ততই তো ভাড়া বাড়বে।
ইনফ্লেশন কথাটা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। তর্কবিতর্ক উঠলে ধ্রুবও উচ্চারণ করে। কিন্তু কাউকে যেন স্পর্শ করে না, নাড়া দেয় না। যেন স্বাভাবিক কোনও ব্যাপার। অবয়বহীন, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, অনুভূতির বাইরে কোনও অশরীরী দৈত্য যেন।
আজকাল বাড়ি ভাড়া এত বেড়ে গেছে ওর ধারণাই ছিল না। এই সেদিনও তো রাখালবাবুদের ওপর রেগে গিয়ে প্রীতিকে বলেছিল, এভাবে থাকা যায় না, অন্য ফ্ল্যাট দেখতে হবে।
ভেবেছিল, আরো বেশি ভাড়া দিলে আরো ভাল ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে।
ধ্রুবর অবশ্য ইতিমধ্যে অফিসে দুদুটো লিট হয়েছে। মাইনে বেড়েছে। কিন্তু খরচখরচাও বেড়েছে। তবু মনে হয়েছে আরো বেশি ভাড়া দিতে পারবে।
দিতে পারবে বলে ভিতরে ভিতরে একটু অহঙ্কারও ছিল।
প্রীতিকে বলেছিল, তোমার দাদার কথা মনে আছে? বলেছিল, সাড়ে চারশো টাকা বাড়ি ভাড়া দিলে খাবে কি!
বলে হাসল। হাসির মধ্যে যেন একটা অহঙ্কার। অর্থাৎ দিতে তো পারছি। দিয়েও অভাবের মধ্যে তো সংসার চালাতে হচ্ছে না।
প্রীতি বলল, দাদা সেভাবে বলেনি। সত্যি তো, যেভাবে বাড়ি ভাড়া বাড়ছে, লোকগুলো যাবে কোথায়?
তারপরই বললে, আর এখন যাদের নতুন করে ফ্ল্যাট দরকার, তাদের কথা ভাবো তো।
এ সব ভাবনাচিন্তার বাইরে। কেউ কিছু ভাবে না। যে যার নিজের কথা ভাবে। নিজের সমস্যার নিজেকেই সমাধান করতে হয়।
ধ্রুব ভেবে রেখেছে যেমন করে তোক একটা ফ্ল্যাট কিনবে। টাকা জমানোর চেষ্টাও করছে। কিন্তু তার দামও তত বাড়ছে চড়চড় করে। নাগাল পাবে কি না কে জানে।
রাখালবাবুর সঙ্গে সম্পর্কটা এখন আর তেমন নেই। অথচ প্রথম প্রথম কত অন্তরঙ্গতা। ওঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীও দু-একবার এসেছেন।
ধ্রুবর, প্রীতির ভালই লেগেছিল।
তারপরই একটা ব্যাপার ঘটে গেল।
রাখালবাবু একদিন রাস্তায় ধরলেন ধ্রুবকে। মর্নিং ওয়াক করে ফিরছিলেন, ধ্রুব ফিরছে বাজার থেকে।
রাখালবাবু চারপাশ দেখে নিয়ে গলার স্বর নামিয়ে বললেন, একটা কথা ভাবছিলাম।
ধ্রুব সপ্রশ্ন চোখে তাকাল ওঁর দিকে।
রাখালবাবু একমুখ হেসে বললেন, তোমরা তো সোয়া দুজন লোক, তিন-তিনখানা ঘর নিয়েছ। অনেক জায়গা।
ধ্রুবর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। একটা ঘর ছেড়ে দিতে বলবে নাকি? নাকি আবার কোনও অজুহাত দেখিয়ে আবার ভাড়া বাড়াতে বলবে।
ভয় পাওয়া মুখে ও শুধু তাকিয়ে রইল।
রাখালবাবু ট্রাউজার্সের দু পকেটে দুখানা হাত ঢুকিয়ে একেবারে আধুনিক ছোকরা হবার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন পা ফাঁক করে। ওঁকে অবশ্য এ সব একেবারেই মানায় না, তার ওপর পায়ের ঘের বড় বেশি ঢিলেঢালা। মানুষটার মতোই।
বললেন, তোমাদের অসুবিধে কিছু হবে না। মানে…
ধ্রুব অধৈর্য হয়ে বললে, বলুন না, কি বলতে চান।
রাখালবাবু বললেন, আমার একটা লোহার সিন্দুক আছে, তোমাদের ঘরে রাখতাম। কখনো-সখনো হয়তো এসে খুলব, কাগজপত্র রাখব…
ধ্রুব প্রায় বলে ফেলেছিল, তাতে আর আপত্তি কি!
আসলে উনি যে একখানা ঘর ছিনিয়ে নিতে চাইছেন না, সেটুকু জেনেই ও খুশি হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, প্রীতিকে একবার জিগ্যেস করে দেখি।
–সিন্দুক রাখবে আমার ঘরে? প্রীতি শুনেই স্তম্ভিত হয়ে গেল।
রেগে গিয়ে বললে, সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতে পারলে না যে ও-সব চলবে না।
ধ্রুব ওর রাগ দেখে হেসে ফেলল। বললে, বলব বলব, এত তাড়া কিসের।
প্রীতি বললে, বুঝতে পারছ না, ব্ল্যাকের টাকা রাখবে, আর নয়তো কাঁড়ি কাঁড়ি সোনা। সার্চ হলে তো ওর বাড়ি সার্চ হবে। কিছুই পাবে না।
ধ্রুব বললে, আর আমাদের বাড়ি সার্চ করে যদি পায় আমরা ধরা পড়ব। ওর জিনিস প্রমাণ করতেই পারব না।
বলে দুজনেই হেসে উঠল।
পরের দিনই রাখালবাবুকে জানিয়ে দিল ধ্রুব। জানিয়ে দিয়ে তবে স্বস্তিযেন দেরি হলে জোর-জবরদস্তি সিন্দুকটা ঢুকিয়ে দিতেন উনি।
বললে, প্রীতি রাজি হচ্ছে না। আপনি ব্যাঙ্কের লকারে রাখছেন না কেন? ওখানে রাখুন। উল্টে উপদেশ দিয়ে দিল ও, যেন সে কথা রাখালবাবু জানেন না।
মনোমালিন্যের সূত্রপাত তখন থেকেই। বেশ বোঝা গেল, রাখালবাবু রেগে গেছেন। কিন্তু মুখে হাসিটা লেগেই রইল।
সপ্তাহখানেক বাদেই একটা ঘটনা ঘটল।
ধ্রুবর নিজের টেলিফোন নেই। প্রয়োজনও হয় না। রাখালবাবু অবশ্য প্রথম দিকে, যখন খুব সদ্ভাব, বলেছিলেন, দরকার হলে আমার ওখান থেকেই করো।
ধ্রুব কখনও করেনি। প্রয়োজনই হয়নি। আর রাখালবাবুর টেলিফোনের নম্বরটাও জেনে রাখেনি।
ধ্রুব অফিসেই দাদার ফোন পেল।–বাবার খুব শরীর খারাপ, একবার আসিস।
ধ্রুব তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল।
হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে ইদানীং ওর যাওয়া হয়ে ওঠে না। পনেরো বিশ দিন পরপর যায়। রবিবার তো একটাই ছুটির দিন, কখনো সিনেমা থিয়েটার, কখনো টি ভি-তে ভাল ছবি থাকে। বন্ধুবান্ধবের বাড়ি, নেমন্তন্ন। সময়ই পায় না।
তাই বাবার শরীর খারাপ শুনেই ধ্রুব বিচলিত বোধ করল। কেমন একটা অন্যায়বোধ। দু সপ্তাহ কোনও খবরই রাখেনি। তেমন গুরুতর কিছু নয় তো?
ভাবল, প্রীতি আর টিপুকে নিয়ে যাওয়া উচিত।
এসেই প্রীতিকে বললে, শিগগির তৈরি হয়ে নাও, বাবার খুব অসুখ। দাদা ফোন করেছিল।
ওদের নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে এসে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল।
বাড়ির সামনে পৌঁছেই দেখল ডাক্তারের গাড়ি। কাচের ওপর লাল ক্রশ।
দ্রুত ওপরে উঠে গেল ও। সিমলিকে দেখতে পেয়েই জিগ্যেস করল, কেমন আছেন রে!
সিমলি দৌড়ে এসে টিপুকে কোলে নিল। প্রীতিকে বললে, কতদিন পরে এলে কাকিমা! তোমাদের একটু আসতেও ইচ্ছে হয় না।
আধখানা সিঁড়ি উঠতেই ধ্রুব দেখতে পেল ডাক্তারবাবু নামছেন।
ও সরে দাঁড়াল। দু-চারটে কথা শুনল। উনি বেরিয়ে গেলেন।
সিমলি এতক্ষণে ওর কথার জবাবে বললে, দুপুরে তো বড় ডাক্তার এসেছিল। কাল যে কি অবস্থা গেছে ভাবতে পারবে না।
ওপরে উঠে এসে বাবার খাটের পাশে দাঁড়াল। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে শুয়ে আছেন।
দাদা ডাক্তারবাবুকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে বললে, সকালে এত ছুটোছুটি গেছে, তোকে খবর দিতে পারিনি।
তারপর বললে, কিডনির রোগ। দুপুরে ডাক্তার দা এসেছিলেন, বললেন, ভয়ের কিছু নেই। এখন ভালর দিকে। দিন সাতেক আগে থেকেই, আমরা ভেবেছিলাম ঠাণ্ডা লেগে জ্বর…
ধ্রুবকে যে আরো আগে খবর দেওয়া হয়নি সেজন্যেই যেন দাদার এত সঙ্কোচ।
ধ্রুবর নিজেরও খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ওকেই সব শেষে খবর দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। মামা মাসিমাও এসে গেছেন। পিসিমাকেও দেখেছে। ওদের আগে খবর না দিলে এসে পড়ল কি করে। ওরা অবশ্য, ধ্রুব আগে যে ঘরে থাকত, সেই ঘরে বসে গল্প করছে। যেন গল্প করতেই আসা। দু বৌদি ওদের চা বানানো, খাবার দাবার নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িতে একটা গুরুতর অসুখ না হলে আত্মীয়স্বজনের আজ্ঞা জমে না। যাদের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়, এই সুযোগে তাদের রীতিমত একটা রি-ইউনিয়ন।
খুব ভেবে এসেছিল বাবার অসুখ বাড়াবাড়ি দেখলে রাতে এখানেই থেকে যাবে। কিন্তু এত লোকজন দেখে থাকতে ইচ্ছে হল না। শোবার জায়গাই হবে না।
মেজবৌদি বললে, রাত্রে থাকবে তো।
ধ্রুব বললে, না।
-সে কি, তোমাদের যে ভাত চড়িয়ে দিলাম। অন্তত এখানে খেয়ে যাও।
প্রীতিই জবাব দিল—কেন ওসব করতে যাচ্ছ। দিদি। তাছাড়া এত লোকজন, আমরা ফিরেই যাব।
তবু মেজবৌদি ওদের ছাড়ল না। না খেয়ে যেতে দেবে না।
তারপরও কিছুক্ষণ থাকতে হল। শোবার জায়গা, বিছানাপত্তর যে পিসিমা আর মাসিমার দল দখল করে নিয়েছে বলেই চলে যেতে হচ্ছে তা কি আর ওরা বুঝবে! হয়তো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করবে, দ্যাখো, ছেলের কাণ্ড, বাবার এমন অসুখ, শুনেই আমরা ছুটে এলাম, আর ছেলে তার বৌকে নিয়ে চলে গেল।
দাদা বললে, তোরা চলেই যা। এখন তো আর ভয়ের কিছু নেই।
কেন বললে কে জানে। হয়তো অসুবিধে বুঝেই। নাকি পিসিমা মাসিমার কাছে দেখাতে চাইল বড়ছেলে কত কর্তব্যপরায়ণ, আর ছোটছেলে বাবা-মার তোয়াক্কাই করে না।
ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কি এমন রাত।
বকুলবাগানের এই দিকটা দিনের বেলাতেই নির্জন। সন্ধের পর থেকে লোকজনের যাতায়াত কমে যায়। বড় বেশি নিঃশব্দ। আশপাশের বাড়ির আলোও তখন নিভে গেছে।
ট্যাক্সি আসতে রাজি হয়নি বলেই একটা রিক্সা ধরতে হয়েছিল।
ঠুং ঠুং করে রিক্সাটা এলও খুব আস্তে আস্তে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রিক্সাওয়ালা বোধহয় ক্লান্ত। তাই তাড়া দিতে ইচ্ছে হয়নি।
বাড়ির সামনে এসে নামল। বাড়িটা একেবারে রাস্তার ওপর।
দেখল সদর দরজা বন্ধ।
এত তাড়াতাড়ি তো দরজা বন্ধ হয় না।
দরজা থেকেই সিঁড়ি উঠেছে। নীচের তলায় দুদিকে দুই ভাড়াটে, আর সিঁড়ির পাশেই। একখানা ছোট ঘর।
ওই ঘরে সেই গোঁপওয়ালা লম্বা চওড়া চেহারার দারোয়ান থাকে। একাই। কোনও কোনওদিন দেহাতি বন্ধুদের জুটিয়ে এনে তাস খেলে, কি রেডিও শশানে। একটা ট্রানজিস্টার রেডিও সব সময় ওর বগলে ঘোরে।
ভাড়াটেরা সকলে ফিরে আসার পর রাত এগারোটা কি বারোটায় ও সদর দরজা বন্ধ করে।
ধ্রুব দরজার কড়া নাড়ল। কিন্তু কোনও সাড়া পেল না।
বিরক্ত হয়ে খুব জোরে জোরে কড়া নাড়ল।
শেষে জোরে জোরে চিৎকার করে ডাকল, রামদয়াল! এই রামদয়াল।
নীচের তলার ভাড়াটেরাও কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না?
তিনতলার জানালার দিকে তাকিয়ে দেখল আলো নেভানো। এত তাড়াতাড়ি সব শুয়ে পড়েছে? হাতের ঘড়িটা দেখল। কই তেমন রাত তো হয়নি।
ভিতরে ভিতরে বিব্রত বোধ করছিল। প্রীতি আর টিপুকে নিয়ে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সেজন্যেই অস্বস্তিতে উত্তেজিত হয়ে উঠছিল। দড়াম দড়াম করে দরজায় দুটো লাথি কষিয়ে দিল! সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিমবাবুদের একটা জানালা খুলে গেল।
বঙ্কিমবাবু প্রশ্ন করলেন, কে?
—আমি ধ্রুব। দেখুন তো, দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভিতর থেকে বঙ্কিমবাবুর হাঁকডাক শোনা গেল।
রামদয়াল দরজার তালা খুলল। রাত্রে ও দরজায় তালা দিয়ে রাখে। কপাট খুলে দিয়ে বললে, ছাদে ছিলাম।
ধ্রুব তখনও উত্তেজিত। ঘড়ি দেখিয়ে বললে, এর মধ্যে তালা দিয়েছিলে কেন?
ও কোনও উত্তর দিল না।
আর ধ্রুব সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রাগের মাথায় বললে, শালা!
ঘরে ঢুকে প্রীতি বললে, এমন এক একটা কাণ্ড করো, দারোয়ানটা শুনতে পেল।
ধ্রুবর রাগ তখনও পড়েনি। বললে, শোনাবার জন্যেই।
প্রীতি অবাক হয়ে বললে, তুমি দারোয়ানকে শালা বললে? ও যদি কিছু বলে বসত?
ধ্রুব বললে, ও বুঝতে পেরেছে যে ওকে বলিনি।
একটু থেমে বললে, তুমিই বুঝতে পারোনি। ছাদে গিয়েছিল না ছাই। সব ওই রাখালবাবুর প্ল্যান, আমাদের যাবার সময় দেখেছিল। অপদস্থ করার জন্যেই তালা দিতে বলেছে।
প্রীতি হেসে ফেলে বললে, কি যে বলো!
ধ্রুব বললে, ঠিকই বলছি। ওই যে সিন্দুক রাখতে দিইনি আমাদের ঘরে, সেজন্যেই।
ধ্রুবর খুব অপমান লেগেছিল। এতদিন বুঝতে পারেনি বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটের মধ্যে কোনও দাগ টানা আছে কিনা। এই একটা ঘটনায় বুঝতে পারল। রাগের মাথায় গালাগাল দিয়ে ফেলেছে, দারোয়ান নিশ্চয় রিপোর্ট করবে, তখন আবার রাখালবাবু যদি কিছু বলতে আসেন..
সকালে উঠেই বাকি তিনটে ফ্ল্যাটের বঙ্কিমবাবু, সুধাংশুবাবু, অমিতবাবু—প্রত্যেককে গিয়ে রাতের ঘটনার কথা বললে।
—এভাবে যদি দবজায় তালা দিয়ে দেয়, এ কি মেয়েদের হোস্টেল পেয়েছে মশাই?
সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠল। অবশ্য চাপা স্বরে।
বঙ্কিমবাবু বললেন, দরকার হয় আমরা সব একসঙ্গে গিয়ে বলব। প্রোটেস্ট করা উচিত।
আর তখনই তিনতলার সিঁড়ির মাথা থেকে রাখালবাবুর হাঁক শোনা গেল, রামদয়াল! এই রামদয়াল!
নীচের ঘর থেকে রামদয়াল সাড়া দিল।
সঙ্গে সঙ্গে রাখালবাবুর চটির শব্দ শোনা গেল। নীচে নামছেন।
বঙ্কিমবাবুকে দেখতে পেয়েই বললেন, আর পারছি না মশাই, ওই রামদয়ালটাকে নিয়ে। রিনি বলছিল, কাল রাত্রে নাকি তাড়াতাড়ি দরজায় তালা দিয়ে দিয়েছিল…
রাখালবাবু রামদয়ালকে ধমকে দিলেন।–সকলে ফিরেছে কিনা দেখে তবে তো তালা দিবি।
রামদয়াল কোনও কথা বলল না। মাথা নীচু করে রইল।
আবার উঠে চলে গেলেন।
প্রীতি বললে, দেখলে তো। অকারণ চটে গিয়েছিলে।
ধ্রুবর নিজেরও মনে হল, অকারণ। তবু কেমন একটা সন্দেহ রয়েই গেল। সব ব্যাপারটাই বোধহয় সাজানো।
সামান্য একটা ঘটনা। হয়তো সত্যিই পো দারোয়ানটা খেয়াল করেনি যে ধ্রুবরা তখনও ফেরেনি, গরমের জন্যে ছাদে চলে গিয়েছিল, আর দরজায় তালা দেওয়া তো ওর অভ্যাস, তাই তালা দিয়েছিল।
ধ্রুবকে সেজন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে প্রীতি আর টিপুকে নিয়ে। নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকতে পারছি না, বিশেষ করে প্রীতিকে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তাই বর নিজেকে অপমানিত লেগেছে।
অফিসে এসে পরের দিনই বললে। বাবার অসুখ নিয়েই শুরু করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দরজায় তালা দেওয়া।
অবিনাশ হাসতে হাসতে বললে, এই তো সবে শুরু। সেদিন বলছিলে না, তোমাদের রাস্তায় একটা ফ্ল্যাট খালি হয়েছিল…
ধ্রুবর মনে পড়ে গেল। অবাক হয়ে বললে, তার সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?
–সম্পর্ক আছে ব্রাদার, আছে। কলকাতায় কোথাও এখন ফ্ল্যাট খালি হয় না। কারণ, আইন ভাড়াটেদের পক্ষে। তবু ফ্ল্যাট খালি হয় কেন?
ধ্রুব বেশ কিছুদিন আগে বাজারে যাওয়ার সময় দেখেছে ওদের বাড়ির তিন-চারখানা বাড়ির পরেই একটা লরিতে মালপত্র বোঝাই হচ্ছে। ফ্রীজ, আলমারি, খাট, আরো কত কি। ঠিক একদিন ধ্রুব এ বাড়িতে যেভাবে এসেছিল।
রাস্তার একজনকে জিগ্যেস করে জানল, তিনতলার ভদ্রলোক চলে যাচ্ছেন।
কেন চলে যাচ্ছেন জিগ্যেস করার কৌতূহল হয়নি। ফ্ল্যাট খালি হচ্ছে এটাই বড় খবর। এসেই প্রীতিকে বলেছিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রীতি বলেছে, একবার গিয়ে খবর নিয়ে দেখো না, কেমন ফ্ল্যাট। কত ভাড়া।
অর্থাৎ ছোটমাসিদের জন্যে। ওদের কথা ধ্রুবরও মনে পড়েছিল। মন্দ কি, একই পাড়ায় যদি আত্মীয়স্বজন কেউ থাকে সে তো ভালই।
বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছে পরের দিনই।
গিয়ে শুনেছে, ভাড়া হয়ে গেছে। পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে বলেছেন, বিশ্বাস করবেন না, এই ছোট ছোট তিনখানা ঘর, এক হাজার টাকা ভাড়া। সিন্ধি ব্যবসাদার, অ্যাডভান্স যে কত নিয়েছে কে জানে।
রাখালবাবুও সে খবর পেয়েছেন। পেয়েই ধ্রুবর নীচের ফ্ল্যাটের বঙ্কিমবাবুকে শুনিয়েছেন।
দুটো বছর ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, কিন্তু ধ্রুবর তো মনে হয় এই সেদিন। এরই মধ্যে ফ্ল্যাটের ভাড়া যে এমন আকাশচুম্বী হয়ে উঠবে কল্পনাও করেনি।
রাখালবাবুর হয়তো সেজন্যেই অনুশোচনা। তখন এমন বাজার ছিল না, তখনও দুচারটে ফ্ল্যাট খোঁজাখুঁজি করলে পাওয়া যেত।
অবিনাশ বললে, সিন্দুক নয় হে, সিন্দুক নয়। আসলে এখন তোমার বাড়িওয়ালা পস্তাচ্ছেন, ভাবছেন কি ভুলই করে ফেলেছি।
তারপর হেসে বলেছে, স্টেপ বাই স্টেপ, দেখে নিও। এ তো সবে শুরু। কপোরেশনের ট্যাক্স বেড়েছে, বলবে ভাড়া বাড়াতে হবে। ইলেকট্রিকের চার্জ বেড়েছে, ভাড়া বাড়াও। তারপর মোক্ষম দাওয়াই, জলযুদ্ধ।
—মানে? ধ্রুব বুঝতে পারেনি।
হো হো করে হেসে উঠেছে অবিনাশ।—তাও জানো না? আমিও ভুক্তভোগী হে, এখন জলপথে যুদ্ধ চলছে।
সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলেছে, নাও একটা ধরাও। হার্টকে তাজা করে নাও।
তারপর।-স্টেপ বাই স্টেপ, মিলিয়ে নিও। ভাড়া বাড়ালেও যা, না বাড়ালেও তাই। তিনবারের জায়গায় দুবার পাম্প চালাবে। কতক্ষণ চালায়? আধ ঘণ্টা হলে বিশ মিনিট, তারপর পনেরো কি দশ। তুমি চটবে। চ্যাঁচাবে, গালাগালি দেবে। দুদিন পাম্প চালাবে ঠিকমত, কিন্তু ছাদে বসে বাড়িওয়ালা কলকাঠি নাড়বে। ট্যাঙ্কের চাবি আছে জানো? সেটা তিন প্যাঁচ মাত্র খোলা রাখবে। চুরচুর চুরচুর করে জল পড়বে কলের মুখ দিয়ে, বালতি ভরবে না।
সিগারেটে দুটো বড় বড় টান দিয়ে অবিনাশ পাশের টেবিলের সুনন্দকে ডাকল।–এই যে বাড়িওয়ালা শুনে যাও।
সুনন্দ হাসল। তারপর সামনে উঠে এসে বললে, সব শুনছি, কিন্তু আমার ভাড়াটেদের তো দেখেননি। গুণ্ডা, দাদা, সব গুণ্ডা। গালাগালির ভাষা যদি শোনেন…
অবিনাশ বললে, ওদের মতো হতে পারলে তবেই ভাই টেকা যায়। আইন আদালত নিয়ে কি আর জলপথে যুদ্ধ করা যায় তোমাদের সঙ্গে।
তারপরই ধ্রুবকে প্রশ্ন করল, ভাড়াটেরা যে এখনও টিকে আছে কেউ কেউ, এই আমার মতো, কেন বলো তো? কারা টিকিয়ে রেখেছে?
ধ্রুব হেসে বললে, জানি না।
—ভারী! ভারী কাকে বলে জানো? ওই যে বাঁকের দুপাশে দুটো কেরোসিনের টিন বাঁধা? রাস্তার টিউবওয়েল থেকে জল নিয়ে বাড়ি বাড়ি পৌছে দেয়। ওরা। সব রাস্তায় দেখতে পাবে।
হাসতে হাসতে বললে, পুরমন্ত্রীমশাই মাঝে মাঝে বিবৃতি দেন দেখেছ? জল সাপ্লাই বাড়িয়ে দিচ্ছি। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে, কাকে সাপ্লাই দিচ্ছ? সে তো বাড়িওয়ালাকে। আমাদের সাপ্লাই তো ওই ভারী, তাও কল নয়, টিউবওয়েল থেকে। সকাল থেকে দেখবে, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঝগড়া মারামারি। কি? না, ওবাড়ির তিনতলায় এবাড়ির দোতলায় জল সাপ্লাই দিতে হবে। রীতিমত একটা প্রফেশন তৈরি হয়ে গেছে যে, এই বাড়িওয়ালাদের কল্যাণে।
স্টেপ বাই স্টেপ। অবিনাশ বলেছিল।
ঠিক তাই। ধ্রুব একবার পঞ্চাশটা টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল, রাখালবাবু সন্তুষ্ট হবেন।
বঙ্কিমবাবু রাজি হননি। বলেছিলেন, জলে দিচ্ছেন টাকাটা।
অমিতবাবু প্রথমে খুব হম্বিতম্বি করেছিলেন। গালাগালিও। আইন আছে বলে শাসিয়েছিলেন। তারপর বুঝে গেলেন আইন ওই খাতাকলমেই।
শেষ পর্যন্ত চার-চারটে ফ্ল্যাটেই ভারী এসে ঢুকল। সুযোগ বুঝে তারাও রেট বাড়িয়ে দিল। এক ভার জল ষাট থেকে লাফিয়ে এক টাকা। তার আবার দুদিন আসে না, দর বাড়ায়। কোনওদিন টিউবয়েলটাই খারাপ। গরমের দিনে মাথা গরম হয়ে যায়। বঙ্কিমবাবু একদিন বাড়িওয়ালার ওপর এমন রেগে গিয়েছিলেন, বাড়িওয়ালাকে হয়তো খুনই করে বসতেন।
এর ওপর আবার নতুন ঝগড়া গোঁপওয়ালা দারোয়ানের সঙ্গে। কারণ সিঁড়িতে জল পড়লে ভারীকে ধমক লাগায় সে। একদিন নাকি ঢুকতে দেবে না বলে শাসিয়েছিল।
একদিকে রাখালবা। অন্যদিকে চার-চারজন ভাড়াটে। এক ভাড়াটের সঙ্গে অন্য বাড়ির ভাড়াটের দেখা হলেই ফিসফিস আলোচনা।—কি করা যায় বলুন তো। এক বাড়িওয়ালাকে আরেক বাড়িওয়ালা পরামর্শ দেয়। চাবি বন্ধ করে দিন, চাবি বন্ধ করে দিন।
অবিনাশ কথাটা ভালই বলেছিল। জলপথে যুদ্ধ।
শেষে বাড়ির মধ্যেই অশান্তি।
প্রীতির মেজাজ সব সময়েই সপ্তমে। কণ্ঠস্বরও।
কোথাও শান্তি নেই। পৃথিবীটাই যেন অগোছালো। এক অশান্তি থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যে আরেক অশান্তিতে ঝাঁপ দেওয়া। আলাদা ঘরসংসার করেও সুখ নেই।
ধ্রুবর এক একসময়ে মনে হয় বিয়ের আগের দিনগুলোই যেন ভাল ছিল।
দিনরাত সংসার সংসার, অফিস থেকে ফিরে ধ্রুবর হঠাৎ একদিন মনে হয়েছিল প্রীতির ওপর বড় অবিচার হচ্ছে, মাঝে মাঝে সেই পুরনো দিনে ফিরে যেতে পারলে মন্দ হয় না।
অফিস থেকে ফিরে একদিন বললে, বাইরে যাওয়া মানে তো সিনেমা আর দোকান, দোকান আর সিনেমা, চলো আজ একবার লেকে বেড়িয়ে আসি।
প্রীতি হেসে বললে, যাক তা হলে এখনও ইচ্ছে হয়!
লেকে বেড়াতে বেড়াতে ওরা একটা গাছের নীচে দিয়ে যখন চলেছে, নড়বড়ে পাযে টিপু হাঁটছে ধ্রুবর হাত ধরে, প্রীতি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বললে, এই, কিছু মনে পড়ে?
ধ্রুবর মনে পড়ছে না দেখে হেসে উঠল। প্রশ্ন করলে, কী গাছ বলো তো এটা?
ধ্রুবর মনে পড়ে গেল। বললে, সোঁদাল।
—ইস কি আনরোমান্টিক, অমলতাস বলতে পারো না!
দুজনেই হেসে উঠল। কারণ বিয়ের আগে ঠিক এই গাছটাকে নিয়ে এই কথাগুলোই হয়েছিল।
গাছের তলা দিয়ে যেতে যেতে ধ্রুব মৃদু হেসে বললে, গাছটা মনে থাকবে না? দ্য বিগিনিং।
প্রীতি হেসে বললে, এখন তো মনে হয় দি এন্ড।
ধ্রুব হাসল। এই গাছটার অন্ধকার মেখে যাবার সময়েই, সেই প্রথম সাহস করে ধ্রুব বলেছিল, আমি এবার একটা চুমু খাবো।
পায়ে সাপ জড়িয়ে গেছে এমনভাবে আতঙ্কে লাফিয়ে উঠেছিল প্রীতি। এই না, ন্না, ন্না।
ততক্ষণে প্রতিরোধ দুর্বল, প্রীতি স্থির।
ধ্রুবর বাঁ হাত প্রীতির কাঁধ বেষ্টন কবে সাপের মতোই তার কণ্ঠতট বেয়ে নেমে আসতে চাইছিল।
প্রীতি ঝট করে ধ্রুবর সরীসৃপ আঙুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে জোরে মোচড় দিয়েছে।
–উফ। চিৎকার করে উঠেছে ধ্রুব।
ফেরার সময়ে ধ্রুবর অভিমানে থমথম মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, আগেই সব শেষ করে দিলে বিয়ের পরে আর কি থাকবে!
লেকে আবার বেড়াতে গিয়ে সেই গাছটার তলা দিয়ে যেতে যেতে প্রীতি স্বগত উক্তিতে বললে, বিয়ের আগের দিনগুলোই ভাল ছিল। একটু থেমে বললে, সব সুখ কেড়ে নিল ওই রাখালবাবুটা। একটা ট্যাঙ্কের চাবি!
দুজনেই হেসে উঠল।
এমনি সময়েই হঠাৎ একটা সুখবর শুনল অফিসে এসেই। অনেকদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল, সুরাহা হয়ে গেছে। অফিসের কো-অপারেটিভ থেকে মোটা টাকা লোন পাওয়া যাবে বাড়ি তৈরির জন্যে। ফ্ল্যাট কেনার জন্যেও।
সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুবর মনে হল যেন ওর ফ্ল্যাট কেনা হয়ে গেছে। কিংবা একটা বাড়ি।
স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিল।
প্রীতিও শুনল। স্বপ্ন দেখল। সে কি উল্লাস।
এই সময়ে হঠাৎ একদিন বঙ্কিমবাবু বিশুষ্ক মুখ নিয়ে এসে হাজির হলেন। ধ্রুববাবু, আপনার সঙ্গে কথা ছিল।
ধ্রুব আসুন আসুন বলে তাঁকে নিয়ে গেল বসার ঘরে। কপাট বন্ধ করে দিল। একটাই তো আলোচনা এখন। একটাই বিষয়। বাড়িওয়ালা। সেজন্যে যখনই নিজেদের মধ্যে কোনও পরামর্শ হয়, বসার ঘরের কপাট বন্ধ করে দেয় ধ্রুব। রাখালবাবু বা তার ছেলেমেয়ে কেউ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করার সময় না শুনতে পায়।
বঙ্কিমবাবু একখানা লম্বা খাম এগিয়ে দিলেন।
-কী ব্যাপার? ধ্রুব সন্ধিগ্ধ স্বরে জিগ্যেস করল।
বঙ্কিমবাবু বললেন, বাড়ি ছাড়ার নোটিস।
ধ্রুব চমকে উঠল।–সে কি?
বঙ্কিমবাবু বিষণ্ণ হাসি হাসলেন। —হ্যাঁ। কাল এসেছে রেজিষ্ট্রি ডাকে।
ধ্রুব সাহস জোগাতে চাইল। –ছেড়ে দাও বললেই ছেড়ে দিতে হবে, কি আন্দার। কোন গ্রাউন্ডে তুলবে শুনি!
বঙ্কিমবাবু হাসলেন।–মামলা করবে ভয় দেখাচ্ছে, মামলাকে আমি ভয় পাই না। আমাকেও তো আত্মরক্ষা করতে হবে ধ্রুববাবু, ও জানে না তখন আমার অন্য চেহারা দেখবে। তবে ওই, মামলা মকদ্দমার ঝামেলা কে চায় বলুন। কিন্তু উপায় তো নেই।
বঙ্কিমবাবু খবরটা জানিয়ে গেলেন। বললেন, ভাড়া দিতে গিয়েছিলাম, তাও নেয়নি। নেয়, রেন্ট কন্ট্রোলে দেব।
বলে চলে গেলেন।
আর সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুব কেমন বিচলিত বোধ করল। বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে বিরোধ, ধ্রুবর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। ওর বিরুদ্ধে তো রাখালবাবু মামলা করতে যাচ্ছেন না। তবু মনে হল যেন ওরই বিরুদ্ধে। বঙ্কিমবাবুও তো একজন ভাড়াটে। সব ভাড়াটের স্বার্থ তো একসঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ওর মনে হল বাইরের পরিচয়গুলো কিছুই নয়। বঙ্কিমবাবুকে ও চিনতও না। হয়তো ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে মন কষাকষিও হয়েছে কখনো-সখনো। বঙ্কিমবাবুরা সিঁড়ির প্যাসেজে বাড়িসুদ্ধ লোকের জুতো রাখতেন। ধ্রুব বলে বলেও বন্ধ করাতে পারেনি।
শেষে একদিন রেগে গিয়েই বলেছিল, এটা কমন প্যাসেজ, এভাবে এনক্রোচ করা চলে না। আমার বাড়িতে কেউ এলে সে সামনে জুতোগুলো দেখলে কি ভাববে বলুন তো। ভাববে আমিই রেখেছি।
বাগ সামলে নিয়ে হেসে বলেছিল, জুতো দেখিয়ে অভ্যর্থনা!
সেদিন থেকেই ওটা বন্ধ হয়েছিল।
অন্যদিকে রাখালবাবুর সঙ্গে কতদিনের চেনা, পুরনো সম্পর্ক। কিছুই ভুলিনি, কিছুই ভুলিনি, বলে পঞ্চাশটা টাকা ফেরত দিয়েছিলেন। তখন কত ভালমানুষ।
এখন বুঝতে পারছে, বঙ্কিমবাবু অনেক আপন। কারণ ধ্রুব আর বঙ্কিমবাবু একই শ্ৰেণী। রাখালবাবুরা অন্য শ্ৰেণী। ওঁরা বাড়িওয়ালা। অর্থাৎ ওঁদের ভাড়াটে আছে। অথচ দু-চারজন ভাল বাড়িওয়ালার কথাও তো শুনেছে। আর যারা ভাড়াটাড়া দেয় না, বাড়ির মালিক, নিজেই থাকে, কই তারা তো এত খারাপ হয় না। নাকি তারা আবার আরেক চরিত্রের! একই মানুষ এক-এক পরিচয়ে এক-এক চরিত্রের মানুষ হয়ে ওঠে হয়তো।
বঙ্কিমবাবু চলে যাবার পরই কি মনে হতে আলমারি খুলে ভাড়ার রসিদগুলো দেখল খুব। কয়েক মাস আগে থেকেই খটকা লাগছিল। রেভিনিউ স্ট্যাম্পের ওপর সইটা যেন অন্য কার, আগের সইগুলোর সঙ্গে হুবহু মিল নেই।
বঙ্কিমবাবুকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে জেনেই এক পরিচিত উকিলের কাছে ছুটে গিয়েছিল ধ্রুব।
সে তো প্রথমেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, তা হলে তো ফোজারির মামলা হবে। উপদেশ দিল, সামনে সই করতে বলবেন।
যেন এতই সহজ। সামনে সই করতে বললে তো রেগে টং হয়ে যাবে। তারপর কী করবে কে জানে। টাকা দেওয়ার পর বারবার মনে পড়াতে হয় রসিদ দেবার জন্যে। তার চেয়ে বড় কথা নিজেকে মনে রাখতে হয়। যেন টাকা নিয়েই তিনি ধ্রুবকে ধন্য করছেন।
অবশ্য দেখা গেল অন্য ভাড়াটের সঙ্গে রসিদের নম্বরের কোনও গরমিল নেই। উকিলবাবু বললেন, ওটাই যথেষ্ট প্রমাণ। দরকার হয় ভাড়াটেদের সাক্ষী ডাকবেন।
তারপর হাসতে হাসতে উকিলবাবু বললেন, ভাড়াটে তোলা যায় না মশাই, খোলা যায়। ঘাবড়াচ্ছেন কেন? মৌলালিতে আমার একটা বাড়ি আছে, মাত্র দেড়শো টাকা ভাড়া দেয়, নিজে উকিল হয়েও কিছুতেই তুলতে পারলাম না। পারব কি করে, নিজে তো থাকি না!
একটু থেমে বিষণ্ণ মুখে বললেন, অথচ তুলে দিতে পারলেই বেচে দিতাম। ভাল দামও পাওয়া যেত। স্রেফ ব্যাঙ্কে এফ ডি করে মাসে মাসে সুদ খাও। বাবা কেন যে বাড়ি করতে গিয়েছিল…
ধ্রুব কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করল। কিন্তু জলপথে যুদ্ধ নিয়েও থাকা যায় না। নিত্যদিন জল নিয়ে শান্তি। মাথা গরম হয়ে গিয়ে কখন যে কী করে বসবে ধ্রুবর সেও এক ভয়।
প্রীতি বললে, ওসব ছেড়ে দাও, একটা ফ্ল্যাট কেনার ব্যবস্থা করো, অন্তত মাথা গোঁজার জায়গা।
হেসে ফেলে বললে, কিছু চাই না, শুধু কল খুললেই জল চাই।