গোবিন্দপুর থানা একটু বেশি উদ্বিগ্ন, একটু বেশি ব্যস্ত। রাঁচি, হাজারিবাগ আর পালামৌয়ের পুলিশ জানিয়েছে, গুপী লোহার ও তার গ্যাং খুব সম্ভব দামোদর পার হয়ে গোবিন্দপুরের দিকে গিয়েছে।
রামগড় বাজারে ছোটোলাল মহাজনের বাড়িতে যে ডাকাতি হয়ে গিয়েছে, তার রকম সকম দেখে সন্দেহ করতে হয়, এটাও গুপী লোহারের কাজ। পাঁচ বছর আগে গুমলা থানার হাজত থেকে পালিয়ে ফেরার হয়ে গেল যে সেই গুপী লোহার। ঘরের জানালা দেয়াল থেকে একেবারে উপড়ে ফেলা, হেঁসে দিয়ে গলা ফাঁসিয়ে ঘুমন্ত মানুষকে খুন করা আর বাক্স ভেঙে শুধু নগদ টাকা আর সোনা রূপো নিয়ে চলে যাওয়া; সেই ভয়ানক গুপী লোহার ছাড়া ঠিক এই নিয়মে ডাকাতি আর করবেই বা কে? শেষ রাত্রি হওয়া চাই, আর খুব জোরে বৃষ্টি হওয়া চাই, এই রকমের লগ্নে এই পাঁচ বছরের মধ্যে ওই তিন জেলার যেখানে যতগুলি ডাকাতি হয়েছে, সবগুলিই গুপী লোহারের কীর্তি। পুলিশ এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ। কোন হৈ-চৈ হয় না, অঝোর বৃষ্টি আর আকাশভাঙা বাজের কড়কড় শব্দের মধ্যে ডাকাতির সব শব্দ লুকিয়ে, মহাজনের সিন্দুক একেবারে চেঁছেপুছে খালি করে দিয়ে পালিয়ে যায় গুপী লোহার ও তার দল। পাশের বাড়ির মানুষ জেগে থাকলেও ওদের পায়ের শব্দ শুনতে পায় না, জেগে তাকিয়ে থাকলেও ওদের ছায়া পর্যন্ত দেখতে পায় না।
গুপী লোহারের দল বলতেও প্রায় অশরীরী একটা সত্তা বোঝায়। সে দল কোথাও নেই, অথচ সব ঠাঁই যেন আছে। তার মানে, সত্যিই কোন দল সঙ্গে নিয়ে ঘোরে না গুপী লোহার। পুলিশ-রিপোর্ট বলে, নিয়মটা কতকটা পুরনো কালের সেই ঠগীদের মত। তিন জেলার নানা জায়গায় সারা বছর স্বভাব ঢাকা দিয়ে ভালমানুষটির মত কাজ করে গুপী লোহারের লোক। হঠাৎ হাজির হয় গুপী। তারপর একটা ডাকাতি, এবং তারপরেই শুধু ডাকাতির একটা গল্প পিছনে ফেলে রেখে দিয়ে কোথায় গিয়ে যে গা-ঢাকা দেয় গুপী, তা সে-ই জানে।
পালামৌয়ের এক জংলী ডিহিতে গুপী লোহারের ঘরের চিহ্ন আজও পড়ে আছে। লাল মাটির বড় বড় ঢেলা আর ঢিবি। গাঁয়ের লোক বলে, লালমাটি থেকে কাচা লোহা গলিয়ে লাঙ্গলের ফলা তৈরি করে বাজারে বেচতে যেত গুপী। তাতে কিন্তু পুরো পেটের ভাত হতো না। গুপীর বউটা তিনদিন উপপাসের পর একদিন ভয় পেয়ে, তিনটে ছেলে নিয়ে কোথায় যে পালিয়ে গেল, কেউ জানে না। তারপর গুপী যে কোথায় গেল, তা শুধু গুপীই জানে।
পুলিশের রিপোর্টে বলে গুপী লোহারের ট্রাইব আর ফ্যামিলির রক্তের মধ্যেও ডাকাতিপনার বীজ আছে। গুপী লোহারের বাপ রুপি লোহার যাবজ্জীবন কালাপানি খেটে মরে গিয়েছে। গুপী লোহারের বাপের বাপ দীনু লোহারকেও ধরতে পারা গিয়েছিল। ফাঁসির দড়িতে শেষ হয়েছে, প্রায় দশটা খুন আর পঁচিশটা ডাকাতির নায়ক সেই দীনু লোহারের প্রাণ। ট্রেনি পুলিশের পাঠ্যপুস্তকের ডাকাতি চ্যাপ্টারের ফুটনোটে দীনু লোহারের নামের উল্লেখ আছে। পুলিশ ট্রেনিং কলেজের মিউজিয়ামে আজও রাখা আছে, একটা প্রকাণ্ড টাঙ্গি–কাঁচা মেটে লোহার টাঙ্গি, দীনু লোহারের প্রিয় সেই খুনিয়ারা হাতিয়ার। সে টাঙ্গির মরচে লাল ধুলোকে এখনও শুকনো রক্তের ধুলো বলে মনে হয়।
সাবধান হয়েছে গোবিন্দপুর থানা। ভুবনপুরের দিকে জঙ্গলের কাছে একটা নতুন বীট হাউস খোলা হয়েছে। রামগড়ের দিক থেকে গোবিন্দপুরে আসার সড়কের উপর কঠোর পাহারা রাখা হয়েছে। যত দাগী পাপী আর বদমাসের নামে একটা নতুন লিস্টি করা হয়েছে। পুলিশ মুন্সী চৌধুরীজীও খুব ব্যস্ত। এই গাঁ আর সেই গা ঢুড়ে যত দাগীকে টেনে এনে হাজত-ঘর ভরে ফেলা হয়েছে। গোবিন্দপুর বাজারের দুটো বেশ্যাকেও ধরে আনা হয়েছে। সরাইয়ের তল্লাসী করা হয়েছে, কোন নতুন লোক এসেছে কি না! চিমটেধারী একটা সাধুকে সড়কের উপর চুপ করে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল, তাকেও ধরে এনে হাজতে ভরা হয়েছে।
হাজত ঘরের ভিতরে আলো নেই। দরজার গরাদের বাইরে পাহারাদার সেপাইটার পায়ের কাছে একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। হাজতঘরের এক কোণে একটা কম্বলের উপর দাশু ঘরামি চুপ করে বসে আছে। দাশুর সামনে শালপাতার ঠোঙ্গায় দুটো রুটি আর গুড়, মাটির ভড়ে জল।
দাশু ঘরামির কাঁধের দু জায়গায় দুটো ক্ষত। দাশুর কাঁধের অমন পাথুরে পেশীও দু জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছে। পুলিশ মুন্সী চৌধুরীজীর পিতল বাঁধানো লাঠি দাশু ঘরামিকে কবুল করবার জন্য এক ঘণ্টা ধরে নানা কায়দায় গুতো খোঁচা আর মার চালিয়ে আজকের মত শান্ত হয়েছে। চৌধুরীজী নিজেই শ্রান্ত হয়ে হাঁফ ছেড়েছে : এটা শক্ত দাগী বটে, আরও ভাল করে না বানালে শালা কবুল করবে না।
হেসে হেসে দাশুর গম্ভীর মুখটাকে দেখবার চেষ্টা করে একটা ছোকরা, আর, মাথার চুল হাতড়ে তামাকপাতার একটা টুকরো বের করে হাতের তেলোতে ফেলে ডলতে থাকে। দাশুর হাতে একটা ঠেলা দিয়ে বলে—খেয়ে নাও গো সরদার। থানা কি তোমার মাগ যে, গোসা করে থাকলে তোমাকে হাতটি ধরে আর চুমাটি খেয়ে খেতে সাধবে?
গামছা গায়ে জড়িয়ে আর একটা লোক কম্বলের উপর পড়ে নাক ডাকাচ্ছিল। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে লোেকটা বলে–কি বলছিস কালু? কার মাগ কাকে চুমা দিল রে?
ছোকরা বলে—তোর মাগ আমাকে।
গামছা গায়ে জড়ানো লোকটা ছোকরার পিঠের উপর একটা লাথি ছুঁড়ে দিয়ে বলে—তা বাপের মাগের চুমা লিবি, তাতে দোষ কেন হবে রে চোট্টা?
ছোকরা বলে-তুই কে রে?–আমি মহারাজ বোম শঙ্করের প্রজা রে।
ছোকরা দাশুর গায়ে আর একবার ঠেলা দিয়ে বলে-শুনছো সরদার, এ শালা গাঁজা চাষ করে চারবার কয়েদ খেটেছে।
ঘুমিয়েছিল যারা, তারা এক এক করে উঠে বসে আর আশ্চর্য হয়ে যায় : কি হলো? সরদার বেচারা খায় নাই কেন?
ছোকরা বলে-সরদারের উপর বড় জবর মার হয়েছে হে। কাঁধের উপর দুটা জখম হয়েছে।
একটা বুড়ো বলে—তা দাগী হয়েছে যখন, তখন দাগ নিতে হবে। আরও কত নিতে হবে।
এক টিপ খৈনি দাঁতের মাড়ির উপর চেপে ধরে ছোকরাটা হাসতে থাকে আচ্ছা তোর মত একটা বুড়া বাকে ধরে নিয়ে এসেছে কেন? তোকে চেলা করবে কোন ডাকাত? তোকে দেখলে গুপী লোহার যে ঘিন্নায় মরে যাবে রে বুড়া?
বুড়ো—আমি তো তাই জানি হে, কিন্তু থানা কি শুনবে? মুন্সীটা কি আমাকেও ডলে নাই ভাবছো?
–তুই তো জমি নিয়ে ফৌজদারি করেছিলি?
–হ্যাঁ ভাই। সে তত বিশ বছর আগের কথা। আমার বয়স তখন তোর চেয়েও কম।
–আর তুই? পাশের টাকমাথা লোকটাকে প্রশ্ন করে ছোকরা।
বুড়ো হাসে ও ওকে শুধিয়ে লাভ নাই। ও বলবে না।
ছোকরা যেন জেদ করে বলে—কেন গো ওস্তাদ, এত লাজ কেন? কার জরুকে ঘরের বার করেছিলে?
টাক মাথা নোকটা গম্ভীরভাবে বলে–মনে কর না কেন, তোর জরুকে।
ছোকরা বলে-হাঁ হাঁ, মনে পড়েছে। জরুটা ঘরে ফিরে এসে কত খুশি হয়ে বললে, দাদার ঘরে ছিলাম ভাল, তুমি মিছা রাগ কর কেন?
দাশু ঘরামির মাথাটা ভারি হয়ে দু হাঁটুর উপর ঝুলে পড়ে। হাজতঘরের ওই অদ্ভুত আলো-ছায়ার ভাষা শুনতে শুনতে মাথার ভিতরটা যেন কামড়াতে শুরু করেছে। দাগী দাগী দাগী; দাশু ঘরামি মানুষ নয়, মধুকুপির একটা মনিষও নয়; শুধু একটা দাগী। দাশু ঘরামির পিঠের উপর পুলিসের জুতোপরা পায়ের লাথি পড়েছে, চৌধুরীজীর পিতলবধানো লাঠির মার কাঁধের উপর দাগ করে দিয়েছে। হালের মহিষ গোঁয়ার হয়ে গেলেও কেউ কখনো তাকে এভাবে মেরে ঘায়েল করে না। দাশুর মাথার ভিতরে যেন একটা গরম হাওয়া ফোস ফেঁস করে। সন্দেহ হয়, প্রাণটা বোধহয় একটা পাগলা কুকুরের প্রাণ হয়ে গিয়েছে। নইলে মারে কেন ওরা?
মুরলীর শরীর তুলে গালি দিয়েছে মুন্সী চৌধুরীজী। দাগীর বউকেও বোধহয় একটা কুকুরী বলে মনে করে ওরা। গায়ের ব্যথাগুলি নয়, মধুকুপির কিষাণের সেই পাথুরে অহংকার ক্ষতাক্ত হয়ে জ্বলতে থাকে।
ঠিক ঘুমিয়ে পড়ে নি, কিন্তু চোখের পাতায় যেন একটা ক্লান্তি নেমে এসেছিল; দাশ ঘরামির চোখের সামনে একটা টাঙ্গির শাণিত হাসি ভাসছে। চমৎকার রক্তমাখা হাসি। ডরানির জলে টাঙ্গিটাকে ধুয়ে ফেলতেই লাল হয়ে গেল ডরানির জল। চমকে ওঠে দাশু, মাথা তোলে আর চোখ মেলে তাকায়। শুনতে পায় দাশু, ছোকরা চোট্টাটা অদ্ভুত একটা আক্ষেপ করছে : গুপী লোহারের নাম শুনলেই থানার পায়জামা ঢিলা হয়ে যায়। আমার সাথে যদি কোনদিন দেখা হতো গুপীর, তবে বলতাম-হে বাপ, তুই কিরপা করে এপাকে আর ডাকা মারতে আসিস না বাপ। থানা তো তোর কড়াপাক মোচের একটা ছাঁটা চুলকেও ধরতে পারে না; মারে শুধু আমাদিগে।
বুড়ো বলে-গুপী লোহরকে ধরবে, গোবিন্দপুর থানার বাপের সাধ্যি নাই।
-কেন? প্রশ্ন করে গামছা গায়ে জড়ানো রোগা লোকটা।
বুড়ো বলে-জাদু জানে রে ভাই। হেই দেখ খাড়া হাতে নিয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে, হেই দেখ নাই, একেবারে হাওয়া।
টাকমাথা লোকটা বলে—হাওয়া হবে কেন? কাক হয়, বক হয়, চিল হয়ে উড়ে যায়।
ছোকরা বলে-হাঁ হাঁ, সবই হয় গুপী, শুধু তোর মত বুদ্ধ হয় না।
হঠাৎ দাশুর দিকে তাকিয়ে ছোকরাটা বলে ওঠে—এ সরদারের লেগে আমার বড় দুখ হয়।
বুড়ো-কেন হে?
ছোকরা-আমাদিগের সবটিকে কাল ছেড়ে দিবে, শুধু ছাড়া পাবে না সরদার।
–কেন? বুড়ো দুঃখিতভাবে আবার প্রশ্ন করে।
–কে জানে? মুন্সী বললে, সরদারটা ছাড়া পাবে না। কাল আবার ওর মার হবে। সরদারকে চালান না করে ছাড়বে না মুন্সী।
টাকমাথা লোকটা হাই তুলে বলে-মাগি দুটা ছাড়া পাবে তো হে?
ছোকরা হাসে-হাঁ হাঁ, নিশ্চয় ছাড়া পাবে। কিন্তু তাতে তোর লাভ কিসের রে চাদিল? ওদের একটা তো মুন্সীটার খোরাক হয়ে গেছে। সে মাগির ঘরের দরজা খোলা পাবি না।
–আর একটা?
–আর একটা যে আমার বাঁধা বটে রে শালা।
দুই হাঁটুর ফাঁকে শুধু মুখটাকে নয়, কান দুটোকেও গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে চেষ্টা করে দাশু। ছোকরা চোট্টাটা যেন দাশু ঘরামির জীবনের মামলার রায় শুনিয়ে দিয়েছে। সবাই ছাড়া পেয়ে ঘরে চলে যাবে, শুধু ছাড়া পাবে না দাশু ঘরামি। আবার মার হবে। এবার হয়তো বুকের পাঁজরের উপর দুটো নতুন গুতোর দাগ ফুলে উঠবে। শুধু দাগ আর দাগ। দাশুর দাগী জীবনটা আবার এক হাকিমের এজলাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হয়তো তিন বছরের শক্ত কয়েদের আদেশ বরণ করে নেবে। বেশ হবে। সুখী হবে মুরলী, মুরলীর জীবনের সব দুর্ভাবনার কষ্ট মিটে যাবে।
শান্ত হয়ে গিয়েছে হাজতঘর। কম্বলের উপর পড়ে নাক ডাকিয়ে কী আরামে ঘুম দিচ্ছে হাজতী মানুষগুলো, যত দাগী পাপী আর বদমাস। হিংসে হয় দাশুর, শুধু দাশুর চোখ দুটো কেন জেগে জেগে ছটফট করে? ভোর হতে আর কত দেরি?
দরজার গরাদের ছায়া দাশুর মুখের উপরে লোহার লাঠির মোটা মোটা দাগের মত লেগে রয়েছে। কেরোসিনের বাতির ধোঁয়াটে আলো দাশুর চোখের তারার উপরে ধিকধিক করে। গরাদগুলি কি খুবই শক্ত? দম বন্ধ করে দরজার গরাদের দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু।
না, অসম্ভব, সাধ্যি নেই দাশুর। ওই গরাদের উপর মধুকুপির কিষাণ শুধু তার কপালটাকে ঠুকতে পারে, কিন্তু ওই গরাদ ভাঙতে পারে না। ছুটে গিয়ে মধুকুপির একটা মাটির ঘরের জামকাঠের দরজার কাছে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার আর সুযোগ হবে না। সুখী হবে পলুস হালদার; মুরলীকে কাছে পেয়ে শিকারীর দু চোখের আশার পিয়াস এইবার মিটে যাবে।
হাত দুটো থর থর করে কাঁপতে থাকে; দাশুর যন্ত্রণাময় তন্দ্রাটা যেন ছটফট করে টাঙ্গি টাকে ধরতে চেষ্টা করছে। ওই যে দাশুর ভাগ্যের দুশমন পলুস হালদার আসছে। শিকারী পলুস হালদারের মাথাটা টাঙ্গির একটি কোপে ধড় থেকে খুলে ধুলোর উপর পড়ে গেল। ভাল করে দেখে নে মুরলী, শিকারীটাকে এবার কত জল খাওয়াবি খাওয়া। মুরলীর চোখ পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর দাশু হো-হো করে হেসে মাদল বাজাতে বাজাতে কপালবাবার কাছে পুজো দিতে চলে যায়।
কাক ডাকে, ভোর হয়, হাজতঘরের এক কোণে কম্বলের উপর বসে সাধুটা চিমটে বাজিয়ে ভজন গাইতে শুরু করেছে। উপরের ঘুলঘুলি দিয়ে ভোরের আভা হাজত-ঘরের ভিতরে নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধে ভরা অন্ধকারকেও একটু হাসিয়ে দেয়।
ছোকরাটা জেগে উঠেই হাঁক দেয়-উঠ গো মহারাজেরা; ডাক হবে এখন।
তারপর আর বেশি দেরি হয় না। একটা সেপাই আসে, নাম ধরে এক-একজনকে ডাক দেয়। কম্বল গুটিয়ে এক-একজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়-তাব চলে যায়।
একে একে ফঁকা হয়ে যাচ্ছে হাজতঘর। চিমটেধারী সাধুটা চলে গেল। বেদিয়া দুটোও চলে গেল। ক্ষেতি দাঙ্গার যত পুরনো দাগীগুলো ছিল, তারাও চলে গেল। হাজতঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে সকালবেলার রোদ ভিতরে চুয়ে পড়ে।
ছোকরাটা এক টিপ খৈনি মাড়ির উপর টিপে ধরে আর একটু ব্যথিত স্বরে বলে—তুমি এখন ঘুমিয়ে থাক না কেন সরদার, তোমার তো ডাক হবে না।
-দাশু ঘরামি নিকল আও। সেই মুহূর্তে গরাদ-আঁটা দরজাটাকে ফাঁক করে ডাক দিল সেপাইটা। চমকে ওঠে দাশু। ছোকরাটাও আশ্চর্য হয়ে ফিস ফিস করে-কুছ পরোয়া নাই সরদার। কোন ডর নাই। কোনটি কথা কবুল করবে না; সব মার হজম করে নিবে।
হাজতঘরের দরজা পার হয়ে সেপাইয়ের পিছু পিছু চলে যায় দাশু, থানার বারান্দায় প্রকাণ্ড টেবিলের কাছে, উর্দিপরা একটা কঠোর ভিড়ের কাছে এসে দাঁড়ায়।
টেবিলের দু দিকে দুটি চেয়ারের উপর বসে দুটি অফিসারের দু জোড়া চোখ দাশু ঘরামির চেহারাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বড় দারোগা, শরীরটা ছোট, পেটটা প্রকাণ্ড। কোমর নেই বললেই চলে; তাই বুকের উপর বেল্ট। ছোট দারোগা খুব লম্বা, মুখটা রোগা, বেল্টটা কোমরের নীচে ঢলঢল করে। বড় দারোগার ভুরু কাঁপে, ছোট দারোগা গলার আঁচিল খুঁটতে থাকেন। তার পরেই দুজনে একসঙ্গে হেসে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেন।
বড় দারোগা গুপ্তবাবু বলেন—চেহারাটা সাংঘাতিক, কিন্তু মুখটা ফুলিশ। তাই নয় কি চ্যাটার্জি?
ছোট দারোগা চ্যাটার্জি হাসেন-ফুলিশ মুখটা একটা পোজ নয় তো, ভেবে দেখুন।
গুপ্তবাবু-ইনোসেন্ট বলেই তো মনে হচ্ছে। তা ছাড়া পলুস হালদার যখন বলেছে যে, লোকটা এই দুটো দিন ঘরেই ছিল, তখন…।
-কে? কে বটে? দাশু ঘরামির বাবা মুখটা যেন হঠাৎ আর্তনাদ করে ওঠে।
গুপ্তবাবু ভ্রুকুটি করেন–পলুস হালদার।
চ্যাটার্জি-পলুস হালদার মানে…।
গুপ্তবাবু-আরে মশাই, ওই যে, সেই লোকটা, সিস্টার মাদলিনের চিঠি নিয়ে যে লোকটা এসেছিল।
চ্যাটার্জি-বুঝেছি, ম্যান-ইটার মারবার জন্য যাকে বন্দুক দেওয়া হয়েছে।
গুপ্তবাবু–গুপী লোহারের চেহারার একটা ডেসক্রিপশনও পলুসকে দিয়েছি। জ্যান্ত অথবা মৃত…।
চ্যাটার্জি হাসেন : গুপী লোহারকে আর জ্যান্ত ধরা সম্ভব হবে না।
গুপ্তবাবু–মেরেই নিয়ে আসুক না কেন; পলুসের ভাগ্যে তা হলে..ধরুন তিন জেলার পুলিস প্রত্যেকে দু শো টাকা করে মোট ছ শশা টাকা রিওয়ার্ড দেবে। তা ছাড়া…।
চ্যাটার্জি–কিন্তু…আমার আশঙ্কা হচ্ছে…যাই হোক, আপাতত আমার এক মাসের ছুটির ব্যবস্থা করে দিন।
গুপ্তবাবু-তার চেয়ে বরং আমিই এক মাসের ছুটি নিই। আপনি ইন-চার্জ হয়ে থাকুন। এটাই ভাল নয় কি? অন্তত আপনার প্রসপেক্ট হিসাবে?
টেবিলের দু দিকে দুই চেয়ারে বসে দুই অফিসারের মুখ অদ্ভুত একটা মন কষাকষির উত্তাপে আবার গম্ভীর হয়ে যায়। গুপী লোহারের নামটা এই এলাকার নতুন আতঙ্কের খবর হয়ে দেখা দিতেই দুই অফিসারের মনে ছুটি নেবার তাগিদ দেখা দিয়েছে। তাই রোজই একবার এরকমের একটা তর্ক বাধে আর তর্কের শেষে দুজনেই গম্ভীর হয়ে যান।
–খামোখা এত কথা বলেন কেন আপনারা? পুলিস মুন্সী চৌধুরীজীর গলার স্বরে যেন একটা প্রচ্ছন্ন ধমকের আওয়াজ ঘড়ঘড় করে। দুই দারোগা একটু বিচলিতভাবে চৌধুরীজীর মুখের দিকে তাকান।
চৌধুরীজী বলে-কে ছুটি নিবে, কে ছুটি নিবে না, সে আমি বলে দিব। এখন কাজ করুন।
গুপ্তবাবু-বলুন মুন্সীজী, আর কি করবার আছে?
চৌধুরীজী বলে দাশু ঘরামির উপর কি অর্ডার হয়, বলেন। একটু তাড়াতাড়ি করেন। আরও দাগীর ডাক বাকি আছে।
–ও হ্যাঁ। গুপ্তবাবু তার বুকের বেল্টে হাত বুলিয়ে, আর চা-এর কাঁপে শেষ চুমুক দিয়ে দাশু ঘরামির মুখের দিকে তাকান : হ্যাঁ, দাশু ঘরামি, পলুস হালদার যখন বলছে যে, তুমি ঘরে ছিলে, তখন কথাটা আর অবিশ্বাস করলাম না। যাও…ওয়াক আউট; কিন্তু সাবধান, মাসে অন্তত একদিন এসে হাজিরা দিয়ে যাবে।
আস্তে আস্তে, যেন টলতে টলতে থানার বারান্দা থেকে নেমে, ঘেসো মাঠটা পার হয়ে সড়কের উপর এসে দাঁড়ায় দাশু। এইবার মনে হয়, পা দুটো অনড় হয়ে গিয়েছে। এই মুক্তি বিস্বাদ হয়ে গিয়েছে। এই মুক্তি মুক্তিই নয়।
পলুস হালদার দয়া করেছে। কেন দয়া করে পলুস হালদার? ভয় করে; জীবনে কোন ভয়ে এমন ভীরু হয়ে যায় নি দাশু ঘরামি।
এখন এই খোলা পথটাকেও প্রকাণ্ড একটা হাজতঘর বলে মনে হয়। এগিয়ে যাবার উপায় নেই। কোথায় যাবে দাশু? কার কাছে যাবে? গিয়ে কি কোন লাভ হবে? ঘর বলতে কি আছে কি? আপন বলতে কেউ আছে কি?
জমিটা আর মুরলীর মুখটা; দাশুর জীবনের দুটি সাধের ভুল বোধহয়। জমিটাকে ভালবেসে জেলে যেতে হয়, আর মুরলীকে ভালবেসে হাজতে আসতে হয়। দুটি ভুলে দাগা পেল; দাশু কিষাণ দাগী হয়ে গেল। তাই কি? কাকে শুধালে জবাব পাবে দাশু? শুধু মনে পড়ে, কপালবাবার কাছে যাওয়া যায়। হ্যাঁ, থানাতে হাজিরা দেওয়া হল, কিন্তু কই, কপালবাবার কাছে হাজিরা দেওয়া হয় নাই তো?
জঙ্গলের ছায়া থেকে একটু আলগা হয়ে, একটা একলা বেলগাছের গোড়ায় সেই সিঁদূরমাখানো নুড়িগুলি আর খুলিটাও আছে। কিন্তু বড় বড় ঘাসের ভিড়ে প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কপালবাবার এই আসন। তার উপর আবার মাকড়সার জাল।
বেলপাতা চিবিয়ে আর ক্লান্ত শরীরটাকে প্রায় গড়িয়ে দিয়ে কপালবাবার আসনের কাছে মাথা ঠুকে জীবনের অনেক আশা আর অনেক ইচ্ছার কথা, অনেক ভয় আর অনেক রাগের কথা জানিয়ে যখন উঠে দাঁড়ায় দাশু, তখন দুপুরের ঘুঘুর ডাক আর জঙ্গলের বাতাসের ছোট ছোট আর ঝড়ের শব্দগুলিকেও প্রায় ক্লান্ত করে ফেলেছে।
আর এখানে কোন কাজ নেই। কপালবাবার কাছে যা বলবার ছিল তার সবই প্রায় বলা হয়ে গিয়েছে। পাঁচ বিঘা জমি চাই, আর জমিটাকে ঘিরে গুলঞ্চের বেড়া চাই। আরও কিছু চাই যে কপালবাবা; কিন্তু সবার আগে মুরলীকে চাই; আর চাই, মুরলীর পেটে ছেইলাটার প্রাণ যেন বেঁচে থাকে।
কপালবাবার আসনের উপর থেকে ঘাসগুলিকে উপড়ে পরিষ্কার করে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে দাশু। কপালবাবাও যেন এতক্ষণে একটা মুখটকা অভিমানের হাজত থেকে মুক্তি পেল। নুড়িগুলি আর খুলিটা রোদ আর আলোর ছোঁয়া পেল।
কিন্তু কপালবাবারও এই দশা কেন হল? আবার কি ভুল করেছে গাঁয়ের লোক? লড়াইয়ের সময় মুঠো মুঠো কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে কপালবাবাকে ভুলে গিয়েছিল গাঁয়ের লোক; সেই রকম ভুল আবার হয়েছে মনে হয়। বোধহয় কপালবাবার জঙ্গলের মরা শাল কুড়োতে ও মৌচাক ভাঙতে কেউ আর আসে না। কপালবাবাকে ভয় করতে ভুলে গিয়েছে সবাই। কপালবাবার কাছে পূজা পড়ে নাই অনেকদিন।
কিন্তু আমি তো তোকে ভুলি নাই কপালবাবা; তবে আমার উপর তোর এত রাগ কেন? আমার জমি লুট হলো কেন? মুরলী আমাকে ঘিন্না করে কেন? আর থানা আমাকে মারে কেন?
ছি ছি, কপালবাবার উপর আবার এসব অভিমান কেন? ভুল করে দাশুও যে কপালবাবাকে অবিশ্বাস করে ফেলেছে। সন্দেহ করছে দাশু, কপালবাবাও বুঝি মরে গিয়েছে। কপালবাবার কৃপা আর ক্রোধের শক্তি নেই বুঝি?
মাপ করবি গো কপালবাবা। আর একবার শরীরটাকে মাটির উপর গড়িয়ে দিয়ে, মনের সব বিশ্বাস ঢেলে দিয়ে, আর মাথা ঠুকে ঠুকে যেন প্রাণের ক্লান্তিটাকে ব্যথা দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে তোলে দাশু।
হ্যাঁ, যেতে হবে। নিজের গাঁ, নিজের ঘর, আর নিজের মাগের কাছে যেতে ভয় কিসের? কপালবাবা সহায় আছে, কিষাণ দার জীবনের জোর ভেঙে দেবার সাধ্য আছে কার?
জঙ্গলের ঘুঘুর স্বর ক্লান্ত হয়ে আসে। কপালবাবার আসনের কাছ থেকে সরে গিয়ে, কাকরে ডাঙার ঢালু ধরে অদ্ভুত এক ক্লান্তিহীন সাহসের নেশায় যেন মত্ত হয়ে হাঁটতে থাকে দাও।
ছোট একটা বাবলার বন। বাবলার শুকনো পুঁটি পথের উপর ফণা-তোলা মরা সাপের মত ছড়িয়ে রয়েছে। এই পথটুকু পার হলেই উরানির নতুন পুলের কাছে সড়কের উপর এসে পড়বে দাও। উরানির স্রোতের কল কল শব্দ শোনা যায়।
হেসে ওঠে দাশুর মুখ। পাঁচ বছর পর এই প্রথম ডরানির স্রোতের ঠাণ্ডা জল খেয়ে পিয়াস মিটাবার সুযোগ পেয়েছে দাশু। জোর পিয়াসও পেয়েছে।
ডরানির গরম বালু মাড়িয়ে সরু স্রোতের কাছে পৌঁছে, ঠাণ্ডা জল খেয়ে আর হাত-মুখ ও মাথা ধুয়ে আবার বাবলার জঙ্গলের ছায়ার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে থমকে দাঁড়ায় দাশু। মস্ত বড় একটা ড়ুমুর গাছের নীচে চকচকে তিনটে মহিষ আর দুটো বাচ্চা মহিষ খুঁটোয় বাঁধা হয়ে আর ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে জাবর কাটছে। গাছতলায় ছোট একটা খাটিয়া, একটা কম্বল, একটা ঢোলক। লম্বা একটা লাঠি খাটিয়ার কাছে পড়ে আছে। আর একটা লোক খাটিয়ার উপর বসে দাশুরই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
দাশু এগিয়ে যেয়ে প্রশ্ন করে–তুমি এখানে এসে ডেরা নিয়ে কি করছে হে ভঁইসাল?
লোকটা হাসে ও জঙ্গলের ডহর ধরে এসেছি; একটু জিরিয়ে নিচ্ছি সরদার। ভঁইসগুলাকে আর রোদে হাঁটা করিয়ে কষ্ট দিতে চাই না।
দাশু–জঙ্গলের ডহর ধরলে কেন হে?
-তাতে ডরটা কিসের হে?
দাশু–তোমার ঊইস যে বাঘের পেটে যাবে হে।
-কিন্তু যায় নাই তো।
লোকটা আবার হেসে ফেলে আর দাশুর মনের প্রশ্নটাকে শান্ত করে দেয়। জঙ্গলের ডহর ধরে আসি কেন বুঝলে না? ভঁইসগুলা পেট ভরে ঘাস আর পাতা খেতে পায়। ঠাণ্ডা ছায়া পায়। গরীব ভঁইসালের অনেক পয়সা বেঁচে যায় হে। তোমাদিগের গাঁয়ের বাজারে ভূসির দর এখন কত?
দাশু–তিন টাকা মণ হবে?
–বুঝ তবে? গরীব ভঁইসাল নিজে ভাত খাবে, না তিন টাকা মণ ভুসি কিনে ঊইসগুলাকে খাওয়াবে।
দাশু–তুমি আসছো কোথা থেকে?
-তিন জিলার বাজার আর মেলা ধরে, অনেক ঘুরে আর অনেক জঙ্গল ছুঁড়ে আসছি হে।
দাশু—যাবে কোথা?
–যাব গোবিন্দপুর।
–গোবিন্দপুর কেন? ভঁইস বেচতে?
–হ্যাঁ, তবে সবগুলাকে বেচতে পারবো না। দুধলি ভঁইসি দুটা থাকবে, শুধু ঐ গাভিনটাকে বেচে দিব। তুমি কিনতে চাও নাকি হে সরদার?
দাও হাসে : না হে।
–কেন?
–আরে, আমি গরীব কিষাণ বটি, ভঁইসি কিনবার টাকা নাই।
–গরীব হলে কেন?
চমকে ওঠে দাশু। লোকটার প্রশ্ন যেন দাশুর কপালের উপর ভয়ানক একটা টোকা দিয়ে ঠাট্টা করে উঠেছে। দাশু রাগ করে, মুখটাকে শক্ত করে দিয়ে রুক্ষস্বরে জবাব দেয়—ভঁইস বেঁচে তুমি লাট হয়েছ; ভাগজোতের কিষাণ আর মনিষ কিষাণ গরীব হয় কেন, তুমি বুঝবে না।
–ভাগজোত কর কেন? মনিষ খাট কেন?
আবার একটা রূঢ় ঠাট্টার প্রশ্ন। ভঁইসাল লোকটার চোখ দুটো তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের হাসি হাসছে। চেঁচিয়ে ওঠে দাশু ও নিজের জমি না থাকলে কোন্ শালা কিষাণ মনিষ খাটে না আর ভাগজোত করে না?
–নিজের জমি থাকলেই বা তুমি কোন্ লাট হয়ে যাবে?
দাশু হাসে : লাট হব কেন রে ভাই, লাট হতে চাই না। কিষাণ মানুষ, ধান মকাই সরগুজা আর সজির ফলান করে বেঁচে থাকতে চাই।
লোকটা হো-হো করে হেসে ওঠে ও আগে জমি পাবে, তাতে পাঁচ পহর খাটবে, তাতে যদি ধান ফলে তবে ভাত খাবে। তারপর বাঁচবে। এর চেয়ে যে নরকের খাটুনিও ভাল। এমন বাঁচা বাঁচতে লাজ লাগে না সরদার?
দাশু ভ্রূকুটি করে তাকায় : তুমি কি আমাকে ডরাতে চাও?
লোকটা বলে-না, দুটো ভাল কথা শুনাতে চাই।
দাশু–নেশা করেছ মনে হয়।
লোকটা আবার হো-হো করে হেসে ওঠে।
আর খাটিয়ার তলা থেকে একটা হাঁড়ি বের করে : একটুক বসে যাও সরদার।
আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদের মেজাজ বুঝতে চেষ্টা করে দাশু। বিকাল হয়ে এল বোধহয়। দাশু বলে–না হে। সাঁঝ হবার আগেই ঘরে পৌঁছতে চাই। এখন আর হাঁড়িয়া নিতে সাধ নাই।
-একটুক নিয়ে যাও ভাই। ভঁইসালের বেরাদারি ঘিন্না কর কেন?
এগিয়ে আসে দাশু। নিজের হাতে শালপাতা মুড়ে একটা নতুন ঠোঙা তৈরি করে দাশুর হাতের কাছে এগিয়ে দেয় ভঁইসাল লোকটা। তারপর হাঁড়ি উপুড় করে যেন মহুয়া-মদের ছোট একটি ফোয়ারাকে দাশুর হাতের ঠোঙার উপর গড়িয়ে দিয়ে বিড়বিড় করে ডরানির জলে ছাতির পিয়াস মিটে বটে, কিন্তু কলিজার পিয়াস কি মিটে রে ভাই?
মিথ্যা বলেনি ভঁইসাল লোকটা। দাশু ঘরামির বুকটা জানে, পাঁচ বছর ধরে জেলের সেই বিরস কয়েদী-জীবনে, বুকের ভিতরে কলিজাটা কি-ভয়ানক শুকনো পিপাসার তরাস সহ্য করেছে।
ঠোঙাটা যেন পাঁচ বছর আগের আনন্দে রসাল হয়ে টলমল করে; পাঁচ বছর আগের জীবনে সুগন্ধ ভুরভুর করে। এক চুমুক ঠোঙার টলমল রসালতা বুকের ভিতরে টেনে নেয় দাশু, আর মুখ মোছে।
ভইসাল হাসে : তোমার খুব পিয়াস লেগেছে সরদার। আর একটুক নাও।
আপত্তি করে না দাশু। অচেনা এক ভঁইসালের এই নতুন বেরাদারির মাদকতায় দাশুও ধীরে ধীরে মুগ্ধ হয়ে উঠতে থাকে।
ভঁইসাল লোকটাও দাশু কিষাণের সঙ্গে এই হঠাৎ বেরাদারির সৌভাগ্যকে যেন নতুন নেশা দিয়ে মাতিয়ে দিতে থাকে। ওর পিয়াসও থামতে চায় না। হাঁড়িটাকে মুখের কাছে তুলে নিয়ে আর উপুড় করে দিয়ে ঢকঢক করে মহুয়ামদের তরল আনন্দ যেন গিলে গিলে খেতে থাকে।
আস্তে একটা হাঁপ ছেড়ে নিয়ে লোকটা বলে-তুমি কোন্ গায়ে থাক হে?
–মধুকুপি।
–কেন মিছা একটা গাঁয়ের দুখেব মধ্যে পড়ে থাক?
–গাঁয়ে যে আমার ঘর আছে গো।
–ঘরই বা রাখ কেন?
–ঘরণী আছে যে।
–দূর দূর। ঘরণী তোমাকে কী সুখ আর কত সুখ দিবে?
–তোমার ঘরণী নাই?
–নাই।
-কেন নাই?
–ঘর নাই।
–ঘর করলেই তো পার।
–তুই আমার ভঁইসটার চেয়েও বোকা বটিস সরদার। ঘর করবো কেন? ঘরে কোন সুখটা আছে?
দাশু মুখ টিপে হাসে? মরদে যে সুখ চায়, সেই সুখ আছে।
–আরে সরদার, সে সুখ কোথায় না পাওয়া যায় বল? বাজারে কি সে সুখের ঘর মিলে?
–সে ঘরকে কি ঘর বল হে?
–কেন, মাগির ঘরের চালাতে কি পাখি বসে না?
দাশু হাসে : কিন্তু মাগির ছেইলা তো তোমাকে বাপ বলবে না?
–না বলবে তো আমার কোন্ ভঁইসটা মরবে?
–নাঃ তোমাকে খুব নেশাতে ধরেছে ভঁইসাল।
লোকটা হাসে : আমি ভক্ত বটি সরদার; সাধুসন্তদের কথা বিশ্বাস করি।
ঢোলকটাকে কোলে তুলে নিয়ে তড়বড় করে হাত চালিয়ে একটা বোল বাজিয়ে নিয়ে লোকটা গেয়ে ওঠে—একেলাহি চলনা ভালা বাপা, চলনা একেলাহি। কোই কিসিকা নেহি রে বাপা, কোই কিসিকা নেহি।
ঢোলকটাকে আরও কিছুক্ষণ তড়বড় করে পিটিয়ে নিয়ে লোকটা বলে-জমি আর জরু, এই দুই চিজ কখনো আপন হয় না। আপন ভেবেছিস কি মরেছিস।
উঁইসালের লাল চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু করে; মুখটাকে একজন ভক্তের মুখ বলেই তো মনে হয়। দাশুর বুকের ভিতর দুরু দুরু করে অদ্ভুত একটা ভয়ের ঢোলক বাজতে থাকে।
হঠাৎ হেসে চেঁচিয়ে ওঠে লোকটা ও ছেইলাও বাপের কেউ নয় সরদার। হোই দেখ।
একটু দূরে, বাবলার জঙ্গলটা যেখানে বেশ ঘন, সেখানে একটা মহুয়া গাছে ফুল আর ফল ধরেছে। মহুয়ার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে দাশু। গাছের মাথার উপরে একটা ডাল থরথর করে কাঁপছে। থাবা দিয়ে একটা ডাল আঁকড়ে ধরে মহুয়া ঝরাচ্ছে একটা…হ্যাঁ, জানে দাশু, ওটা ভালুক হতে পারে না, ওটা একটা ভালুকী।
গাছের তলার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় দাশু, যদিও দৃশ্যটা দাশুর চোখের কোন নতুন অভিজ্ঞতা নয়, ভালুকীর দুটো ক্ষুধাতুর বাচ্চা নীচের ঘাসের উপর ঝরে-পড়া মহুয়াকে হুটোপুটি করে শুকছে আর খাচ্ছে।
-দেখছে তো। ছেইলা হলো মায়ের ছেইলা, বাপের নয়। বলতে গিয়ে আরও জোরে হাসতে থাকে লোকটা।
চুপ করে তাকিয়ে দেখতে থাকে দাশু। সেই অদ্ভুত ভয়ের জ্বালায় চোখ দুটো আরও লাল হয়ে উঠতে থাকে। লোকটা বলে যে মরদে মাগ আর ছেইলাকে আপন ভাবে, গা আর ঘরকে আপন ভাবে, তারাই নেশা করে বোকা হয়ে আছে।
দাশু–কিন্তু…।
–আবার কিন্তু কেন? সেদিন আর নাই, জমানা বদলে গিয়েছে সরদার তুমি যা ভাবছে সেটি আর হবে না।
-কি ভেবেছি আমি?
-তুমি গাঁয়ের কিষাণটি হয়ে ঘর বেঁধে, ভাগজোত করে মাগ ছেইলা নিয়ে সুখটি করবে, সেদিন আর নাই।
–কে বললে সেদিন আর নাই?
–আমি বলছি রে ভাই। মাগ বল আর ছেইলা বল, কেউ তোমাকে মিছামিছি পিয়ার করবে না। আগে হিসাব করে বুঝে নিবে, কেন পিয়ার করবো; তবে পিয়ার করবে। না হয় তো, ভেগে যাবে।
দাশু বিড়বিড় করে? কেন এমনটি হলো বলতে পার।
–আমি বলতে পারি না সরদার, আমি পরমাত্মা নই।
চুপ করে আর চোখ দুটো উদাস করে বসে থাকে দাশু। উরানির স্রোতের কলকল শব্দ শুনতেও যেন ভয় করছে।
লোকটা কোলের উপর থেকে ঢোলকটাকে সরিয়ে রেখে দাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে : তুইও বুঝে চল সরদার : না হলে বড় দুখ পাবি।
–কি বুঝতে বলছো?
-ওসব গাঁ ঘর মাগ আর ছেইলাকে ডরানির জলে ভেসে যেতে দে না কেন? তুই কেন ভাববি? সাধু-সন্তের কথাটা বিশ্বাস কর, কোই কিসিকা নেহি রে বাপা।
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–তবে কি ক্ষেপা হব, না ভিখমাগা সাধু হব?
বলে-খুব চালাক হবি, একটুও ক্ষেপা হবি না। নগদ সুখের সাধু হয়ে, পেট ভরে আর মন ভরে মজা নিয়ে ঘুরে বেড়াবি।
–সেটা কিসে হয়?
–টাকাতে হয় রে ভাই।
–টাকা কোথায় পাব?
-আমি দিব। দাশুর মুখের দিকে একটা ভয়ানক মোহময় আবেদনের জাদু ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে থাকে লোকটা।
–তুমি বা দিবে কেমন করে?
–সেকথা শুধাস কেন? তুই শুধু বল যে, টাকা চাস।
মাথা হেঁট করে ভাবতে থাকে দাশু। সব ভাবনা, সব ইচ্ছা আর সব আশা যেন নেশার ঘোরে এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। মধুকুপির ছোটকালুর আর বড়কালুর চেহারা দুটোও যেন স্পষ্ট করে দেখতে পারা যাচ্ছে না। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সবই। মধুকুপির যেন সব শব্দ হারিয়ে, সব গাছপালার রঙ হারিয়ে একটা শুকনো ডাঙা হয়ে গিয়েছে। জামকাঠের পুরনো কপাটটা পচে গলে ঘেঁড়া কাঠের আবর্জনা হয়ে পড়ে আছে। ঘর নেই, মুরলী নেই, কেউ নেই।
মন্দ কি? দাশু ঘরামির জীবনটাও যেন সব দুশ্চিন্তার বোঝা নামিয়ে ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। ঈশান মোক্তারের কুঠিতে গিয়ে চিঠা নেবার জন হাত পাততে আর হবে না।
লোকটা গলার স্বর এইবার যেন এক নতুন জগতের ঢোলকের বোল হয়ে বাজতে থাকে-টাকা হাতে নিয়ে ডাক দিলে এক রাতের মধ্যে পাঁচটা মাগি পাওয়া যায় সরদার। তারপর নাও না, কত সুখ করে নিতে চাও? খাও দাও, নেশা কর, সরে পড়। ব্যস, তুমি কার কে তোমার? সাধুসস্তেরা মিছা কথা বলেই নাই সরদার।
হঠাৎ হাত তুলে চোখের জল মোছে দাশু। লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে, লাল চোখ দুটোও যেন রাগ করে জ্বলে ওঠে : কি হলো হে সরদার?
দাশু বলে টাকা দিতে চাও, দাও। নিব আমি। শশাধ করেও দিব আমি। কিন্তু…তুমি যা বলছে, সেটি হবে না।
–কি হবে না? রুষ্ট হয়ে ক্ষেপা মহিষের মত চোখের তারা দুটোকে উল্টে দিয়ে দাশুর দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা।
দাশু–আমি গাঁ, ঘর, মাগ, ছেইলা ছাড়তে পারবো না। আমি ভাগজোত, ক্ষেত-খামার ছাড়তে পারবো না। কিষাণ মানুষ তোমার মত একটা নষ্ট ভঁইসাল হবে কেন?
লোকটার চোখের আক্রোশ আর আবেদনও যেন এইবার আস্তে আস্তে ক্লান্ত হয়ে আসতে থাকে। ক্লান্ত আক্ষেপের মত স্বরে একটা ধিক্কার দিয়ে বলে ওঠেনাঃ, তোকে আমি মরদ মনে করেই ভুল করছি। বুঝি নাই যে, তুই একটা হিজরা। সুখ নিবার জোর নাই তোর।
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–বেরাদারি করতে ডেকে নিয়ে খুব গালিটি দিয়ে নিচ্ছ ভঁইসাল।
–আমার টাকা নিতে চাও যখন, তখন দুটা শক্ত কথা শুনতে হবে সরদার।
দাশু উঠে দাঁড়ায়? তোমার টাকা চাই না। তুমি আমাকে চিন না ভইসাল; তুমি আমার টাঙ্গি দেখ নাই।
–কে বট তুমি?
–আমি মধুকুপির দাশু ঘরামি। আমার জমির দুশমনকে টাঙ্গিতে ঘায়েল করে পাঁচ বছর কয়েদ খেটেছি। আমাকে যদি জানতে হবে আমাকে ঐ গালিটা দিতে তোমার বুক থরথব করে…।
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে দাশু তার কথার আক্রোশটাকে হঠাৎ থামিয়ে দেয়, একটু আশ্চর্যও হয়। হাসছে লোকটা, আর চোখ দুটোও ছলছল করছে।
এরকমের নতুন চোখ-মুখ দিয়ে নতুন রকমের কথাও বলে লোকটা বেশ তো, আমার মত নষ্ট না হলে তো না হলে; আমার টাকা নিতে রাগ কেন?
–আমি ভিখমাগা নই।
–নিজেকে মিছা গালি দাও কেন সরদার? আমি কি তাই বলছি?
–তুমি টাকা দিবে কেন?
–কে জানে, ইচ্ছা করছে, তোমাকে টাকা দিই। অনেকদিন এমন ইচ্ছা করে নাই।
–তুমি টাকা পাবে কোথা থেকে?
–যেথা টাকা থাকে সেথা থেকে পাব। তোমাকেও পাইয়ে দিব।
–কি বললে?
–টাকা কোথায় না আছে রে ভাই! বাবুরবাজারের মহাজনদিগের হাতে কি টাকার থলি নাই? ঈশান মোক্তারের কুঠিতে কি টাকা নাই?
আস্তে আস্তে এক-পা দু-পা করে করে পিছনে সরে, আর, একবার কেঁপে উঠেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। ভঁইসালের সেই ঢুলু ঢুলু চোখ, উগ্র হাসি ও লাল চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকে দাশু, ভঁইসালের মুখের ভয়ানক ভাষার শব্দ শুনতে থাকে।
ভঁইসাল বলেবল, টাকা নিবে তো?
দাশু প্রায় একটা লাফ দিয়ে আরও পিছনে সরে যায় : না, নিব না।
–কেন? বলতে বলতে এগিয়ে আসে ভঁইসাল।
আরও দূরে সরে গিয়ে দাশু বলে—তোমার টাকা নিতে ঘিন্না করে।
ভঁইসাল-ঘিন্না করে লাভ কি সরদার? টাকা না পেলে জমি করবি, ঘর করবি, মাগ ছেইলা নিয়ে সুখে থাকবি কেমন করে?
দাশু–না, তোমার টাকা নিব না।
আর কোন কথা না বলে, ইসালের মুখের দিকে একটা ভ্রূক্ষেপও না করে হন হন করে হাঁটতে থাকে দাশু।
ভঁইসাল লোকটা চেঁচিয়ে হাসতে থাকে ও আমার টাকা নিতে হবে সরদার। আমি দিয়ে ছাড়বো।
চেঁচিয়ে উত্তর দেয় দাশু–দিতে এলে আমিও তোমাকে বুঝিয়ে দিব।
ভঁইসাল-আমাকে চিনতে পারলে না সরদার?
দাশু–চিনে দরকার নাই।
ভঁইসাল লোকটা আরও জোরে চেঁচিয়ে হাঁক দেয়–দরকার আছে হে সরদার। থানাতে গিয়ে বলে দাও, গুপী লোহার এখানে বসে আছে।
থমকে দাঁড়ায় দাশু। মুখ ফিরিয়ে তাকায়। চমকে ওঠে। কাঁপতে থাকে।
গুপী লোহার হেসে ওঠে : থানা তোমাকে অনেক ডাকা বকশিশ দিবে, এখনই দৌড়িয়ে ও আর থকে খবরটা শুনিয়া দাও।
গুপী লোহারের কালো মুখ, ঝকঝকে সাদা দাঁতের হাসি, আর লাল চোখের ঢুলু ঢুলু আবেশ যেন একটা বীভৎস রক্তমাখা জানোয়ারের আহ্লাদের চেহারা। কিন্তু আর এক মুহূর্তও দেরি করে না দাশু। গুপী লোহারের সেই মুখের দিকে দুর্দান্ত লোভীর মত একবার তাকিয়ে নিয়েই সড়কের দিকে ছুটে চলে যায়।
পথে চলতে কোন বাধা নেই। কাঁটা নেই, কাঁকর নেই, এমন কি ধুলোও নেই। একেবারে তকতকে পরিষ্কার একটি পাকা সড়ক।
সড়ক ধরে হন্ হন্ করে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে দাও। সড়কের ধারে মাঝে মাঝে গাছে ছায়া দেখতে পেয়েও জিরিয়ে নেবার জন্য থামতে চায় না। উরানির স্রোতের নতুন পুল অনেক পিছনে ফেলে রেখে অনেক দূর এগিয়ে যায় দাশু।
বিকেলের রোদের এখন তো আছে বেশ। পিঠটা জ্বলছে, আর, সেই সঙ্গে যেন মনের ভিরে একটা হিসাবও কটকট করে জ্বলছে। কানের কাছে গোবিন্দপুর থানাটা কথা বলছে। তিন জিলার পুলিশ তিন দফা বকশিশ দেবে। দুশো, দুশো, আর দুশো, মোট ছশো টাকা। কত জমি কিনতে চাও সরদার? পাঁচ বিঘা দো-আঁশ, না হয় তো দশ বিঘা এঁটেল কিনে ফেল না কেন? নতুন লাঙ্গল কিনবে, এক জোড়া হেলে গরুও কিনতে পার। দাও না, তোমার সাধের ক্ষেতের জমি ঘিরে কত বেড়া দিতে চাও? গুলঞ্চের বেড়া, লাল ঝিণ্টের বেড়া, বাঘভেরেণ্ডার বেড়া, ফণী-মনসার বেড়া। জেলের বাগানে পাঁচ বছর খেটে অনেক কেরামতি শিখেছো; তবে তো ইচ্ছা করলে আনারসের বেড়াও দিতে পার।
লাল চোখ দুটো কটমট করে; আরও জোরে পা চালিয়ে আর ছুটে ছুটে চলতে থাকে দাশু। কোনদিন ভুলেও হিসেব করে জীবনের লাভ-লোকসান বুঝতে পারেনি মধুকুপির যে দেহাতি কিষাণ, সেই দাশু ঘরামির প্রাণটা যেন আজ হঠাৎ হিসাব করে বুঝতে শিখে বিপুল এক লাভের উপহার দু হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরবার জন্য ছুটে চলতে থাকে।
ওই তো, আর বেশি দূরে নয়; বাবুরবাজার পুলিস ফাঁড়ির আলকাতরা মাখানো থামগুলী থামগুলি দেখা যায়। কিন্তু দাশু ঘরামির ছুটে চলবার খুশি উল্লাস হঠাৎ মালের মত টসতে টলতে থেমে যায়। আর এগিয়ে যাবার দরকার নেই, এগিয়ে আসছে পুলিস মুন্সী চৌধুরী আর রামাই দিগোয়ার। চৌধুরীজীর পিঠে একটা বন্দুক। রামাই দিগোয়ারের নীল কোর্তা আর টাঙ্গি টাও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। পিছু পিছু একটা পালকিও আসছে।
কিন্তু এ কি হলো? এই দিকে, এই পথে বাবুরবাজার ফাঁড়ির এত কাছে এরকম ছুটতে ছুটতে কেন চলে এসেছে দাশু? কিসের আশায়? কোন্ লোভ? গোবিন্দপুর থানার কাছে বকশিশ নিতে?
দাশু ঘরামির বুকের ভিতরের সব বুদ্ধির হিসাব যেন আর্তনাদ করে ছিঁড়ে যায়। আর, লাল চোখ দুটো যেন দাশু ঘরামির জীবনের ভীরুতার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় ও ঘৃণায় থরথর করতে থাকে। ছিয়া! ছিয়া! মধুকুপির এত তেজ আর এত দেমাকের কিষাণ দাও ঘরামির প্রাণটা কি ছশো টাকা বকশিশের লোভে সত্যিই হিজরা হয়ে গিয়েছে?
ওই তো, ওই সেই পাপীটা! গোবিন্দপুর থানার কসাইটা! দাঁতাল বনবরহার মত শুধু তেড়ে এসে মানুষের গায়ে দাঁত বসাতে ভালবাসে। ওর নাম চৌধুরীজী। দাশু ঘরামির কাঁধের পেশীর উপর দু জায়গায় দুটো গুঁতোর ক্ষত হঠাৎ যেন নতুন অপমানের জ্বালা নিয়ে জ্বলে ওঠে। ওই চৌধুরীজীকে আর ওই রামাই দিগোয়ারকে টঙ্গি দিয়ে টুকরো করে উরানির জলে ভাসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তা হলে দাশুর কাঁধের ক্ষত দুটোর জ্বালা আজ আর থাকতো না।
কিন্তু টঙ্গিটা হাতের কাছেই নেই আর বিকালের আলোটাও চারদিকের চোখ জাগিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া, ওদের হাতে বন্দুকও আছে। ওদের চোখের নাগাল থেকে এই মুহূর্তে সরে যাওয়াই ভাল।
সড়কের উপর থেকে উপ করে একটা লাফ দিয়ে নীচের একটা পাথরের আড়ালে একটা বড় গর্তের মধ্যে চোর নেকড়ের মত চুপ করে লুকিয়ে পড়ে দাও। মস্ত বড় পাথর, চারদিকে বাবলার ভিড়; দাশু ঘরামির এই চোরা চেহারাকে দেখতে পাবে না হিংস্র বনবরাহ ওই চৌধুরীজীও।
অনেকক্ষণ পার হয়ে যায়। কিন্তু কই? নিকটের সড়কে তো কারও পায়ের শব্দ বেজে উঠল না। কোথায় কোন দিকে দাগী খুঁজতে চলে গেল ওরা?
উঠে দাঁড়ায় দাশু। উঁকি দিয়ে তাকায়; সেই মুহূর্তে দাশু ঘরামির দু চোখ থেকে মহুয়ার নেশার সব লাল যেন সাদা হয়ে যায়। বুক কাঁপে দাশুর; বুকে; ভিতর যেন একটা ঝান্নাও গুমরে ওঠে।
এদিকে আসছে না চৌধুরীজী ও রামাই দিগোয়ার। জামুনগড়ার কঁচা সড়ক ধরে কপালবাবার জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলেছে ওরা। আর বেশি দূর নয়, আর মাত্র আধ ক্রোশ পথ ওরা এগিয়ে যেয়ে জামুনগড়ার সড়কের উপরে দাঁড়ালেই ড়ুমুর গাছের ছায়াটা ওদের চোখে পড়বে। এখান থেকে এখনও বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, ডরানির খাতের পাশে উঁচু এক টিলার কাছে ড়ুমুরের গাছটা যেন বিকালের রোদে পুড়ে কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে ওই ড়ুমুরের ছায়ায় বসে নেশার ঘোরে ঢুলছে গুপী লোহার। চৌধুরীজীর বন্দুক আজ গুপী লোহারের প্রাণের খবর নিয়ে ছাড়বে।
ওরা যাচ্ছে কঁচা সড়ক ধরে, বহেড়ার জঙ্গলটাকে ঘুরে ধীরে ধীরে। কিন্তু দাশু তো এখনি কোন চোরাপথে ছুটে গিয়ে আর ওদের আগেই পৌঁছে গিয়ে ভঁইসাল বেচারাকে জানিয়ে দিতে পারে? যাও ভাইসাল, জলদি সরে যাও। গোবিন্দপুর থানার কসাইগুলো আসছে।
চোরাপথ বলতে দাশুর চোখের নিকটে শুধু একটি পথের ছায়া ভাসে। এই যে সড়কের ধারে এই পাথর থেকে বিশ হাত পরেই শুরু হয়েছে সেকেলে গঙ্গানারায়ণী গড়ের যত ভাঙা ভাঙা ইঁটপাথরের ঢিবি। দুখন গুরুজী গল্প করেছে, অনেক দিন আগে গুরুজীর বাপের বাপও যখন বাচ্চা মানুষ ছিল, তখন ইংরাজের তোপ এক হাজার চূয়াড়কে মেরে এই গড়ের সামনের ডাঙায় তাদের লাস ছড়িয়ে দিয়েছিল। এক মাস ধরে শিয়াল আর শকুনের ভোজ চলেছিল। আর সাহেবরাও ঐ গড়ের ফটকে বসে বিলাতী সরাব আর কচি বাছুরের মাংস খেয়ে নেচেছিল। তাই আজও এই ভাঙা গড়ের নাম খানাপিনা।
হাজার চুয়াড়ের রক্তমাংস যে ডাঙার উপর পড়ে পচেছিল আর গলেছিল, সেই ডাঙাটা আজ মুলি বাঁশের জঙ্গলে ছেয়ে রয়েছে। খানাপিনার পুরনো ইঁটপাথরের ফাঁকে ফাঁকে রক্তশোষা গিরগিটি আর বজ্রকীট ঘুরে বেড়ায়। বিশাল করাইত ফণা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। বুড়ো বটের গোড়ার হাঁ-করা ফোকরে হুঁড়ারের বাসা। কোন রাখাল ভুলেও খানাপিনার কাছে গরু চরাতে আসে না।
খানাপিনার এই পুরনো ইঁটপাথর আর মুলি বাঁশের জঙ্গলটার ভিতর দিয়ে এক দমে একটা দৌড় দিলে কেমন হয়? পার হয়ে যেতে কতক্ষণই বা লাগবে? তারপরেই তো মরা মাটির উপর একটা পুরনো শালবনের ধড় আর যত উইটিবি। ও-জায়গাটা তো পাঁচ লাফে পার হতে পারা যায়; তার পরেই ডরানির স্রোত আর সেই ড়ুমুর গাছের ছায়া।
দাশুও যেন চতুর ক্ষিপ্র ও হিংস্র একটা নেকড়ে; খানাপিনার পুরনো ইঁটপাথরের উপর লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ছুটতে থাকে। বাঁশের খোঁচায় গায়ের গেঞ্জিটা ফালিফালি হয়ে ছিঁড়ে যায়। গেঞ্জিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড় দিতে দিতে একটা উইঢিবির উপর এসে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
কিন্তু তাতে কি আসে-যায়? পুরনো উইটিবির সাপ নিজেই ভয় পেয়ে কাতরাতে থাকে। গায়ের ধুলো ঝেড়ে ফেলতেও ভুলে যায় দাশু। সোজা ছুটে এসে ডরানির স্রোত পার হয়ে ড়ুমুরের ছায়ার কাছে এসে চেঁচিয়ে ওঠে–ভঁইসাল।
কোথায় ভঁইসাল? কেউ নেই। দুধলি ভঁইসি দুটো নেই, গাভিন ভঁইসিটাও নেই, আর বাচ্চা দুটোও নেই। ভঁইসালের খাটিয়া, ঢোলক, লাঠি আর কম্বলও নেই। শুধু মহুয়ামদের শূন্য হাঁড়িটা কাত হয়ে পড়ে আছে।
দাশু ঘরামির লাল চোখ খুশির পুলকে কাঁপতে থাকে। জাদু জানে ভঁইসাল। হেই দেখ আছে, হেই দেখ নাই। কে জানে, হতেও পারে, হয়তো চিল হয়ে বা কাক হয়ে নিকটেই কোথাও লুকিয়ে আছে ভঁইসাল। চারদিকে সাবধানে তাকিয়ে আস্তে আস্তে যেন গোপন মানতের প্রার্থনার মত নরম স্বরে হাঁক দেয় দাশু ও জলদি সরে পড় ভঁইসাল, যদি হেথা থাক। গোবিন্দপুর থানার নোক এসে পড়েছে।
সত্যিই একটা কাক ড়ুমুর গাছে পাতার আড়াল থেকে ডানার শব্দ ছটফটিয়ে হঠাৎ উড়ে চলে গেল। জোরে একটা স্বস্তির হাঁফ ছাড়ে দাশু।
কিন্তু এখানে দাশু ঘরামিরও যে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকবার কোন অর্থ হয় না। এই ভয়ানক নিরালায় ড়ুমুরের ছায়াতে মহুয়া মদের একটা শূন্য হঁড়ির কাছে দাশুকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বনবরাহ চৌধুরীর চোখ যে হিংস্র আহ্লাদে আবার ঘোলাটে হয়ে উঠবে।
কিন্তু কোন পথে ফিরে যাওয়া যায়? উরানির স্রোতের সেই পুলের দিকে আর যাওয়া যায় না। গোবিন্দপুর থানার এক জোড়া রক্তচোষা মতলব ওই পথ ধরে এদিয়ে এগিয়ে আসছে।
পশ্চিমের আকাশটার দিকে তাকায় দাশু। বিকেলের রোদের তেজ মরে এসেছে। অনেক দূরে মধুকুপি; ছোটকালু তার বড়কালুর মাথার পাথরে ঠাণ্ডা রোদের লালচে রঙ ধরেছে। ধানকাটা ক্ষেত্রে উপর ছোট পাখির দল এখনও উড়ুৎ ফুড়ুৎ করে। আর, তার চেয়েও একটু দুরে ডরানির স্রোতের বাঁকের দু পাশে পলাশবনের উপরে তিতিরের ঝক উড়ে বেড়ায়।
ধানক্ষেতের আলের উপর দিয়ে একটা দৌড় দিয়ে পলাশের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে দাশু। স্রোতটা এখানে বেশ চওড়া; স্রোতের কিনারা ধরে চলতে চলতে দাশুর এতক্ষণের রোদে-পোড়া আর পরিশ্রান্ত শরীরটার জ্বালাও শান্ত হয়ে আসতে থাকে। স্রোতের বুকের উপর ছড়ানো বড় বড় পাথরগুলি শেওলায় ঢাকা। পাথরের উপর দাঁড়িয়ে কোচবক ঝিমোয়। কুচো মাছের ঝাক পাথরের গায়ে শেওলা ঠুকরে খায় আর জলের উপর দাশুর ছায়া দেখতে পেয়ে ছটফটিয়ে পালিয়ে যায়।
দাশুর দু চোখের তারা থেকে মহুয়ামদের নেশার ঘোরে তখনও ঝরে পড়ে নি। বরং, পলাশবনের ছায়ায় স্রোতের পাশে পাশে হেঁটে সে নেশার সুখ এতক্ষণের সব ভয় জ্বালা আর ঘৃণা হারিয়ে আরও ঢুলু ঢুলু হয়েছে।
যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়ায় দাশু। মুখটাও হেসে ওঠে। স্রোতের ধারে একটা ছোট ডাঙার শুকনো ধুলোর উপর হুটোপুটি করে পাখা ঘষছে একটা পাখি। একটা পাপিয়া। হ্যাঁ, ওটা একটা ভরত পাপিয়া বটে। এত কাছে এমন সুন্দর একটা কলকলে স্রোতের এত ঠাণ্ডা ও এত পরিষ্কার জল থাকতেও ধুলোতে স্নান করছে পাখিটা। যার যেমন স্বভাব।
টি-হা টি-হা টি-হা! পাখিটাও যেন আশ্চর্য হয়ে, দাশু ঘরামিকে একটা মিষ্টি স্বরের ধমক দিয়ে পাখার একটি ঝাপটের জোরে খাড়া উড়ান উড়ে উপরের আকাশে মিলিয়ে গেল। বুকের ধুলো হাত দিয়ে মুছে দাশুও আবার একটা হাঁফ ছাড়ে। কী ভয়ানক পাগল হয়ে গিয়েছিল মাথাটা, তাই বকশিশের লোভে বাবুরবাজার পুলিশ-ফাঁড়ির দিকে ছুটে গিয়েছিল দাশু। ইস, মধুকুপির কিষাণের মান খুব বেঁচে গিয়েছে। তোর পাও লাগি কপালবাবা।
এগিয়ে এসে একটা পাথুরে ঢিবির কাছে দাঁড়ায় দাশু। স্রোতের কিনারায় এক জায়গায় এদিকে-ওদিকে গোবর শুকিয়ে রয়েছে। গায়ের গরু বোধহয় অনেকদিন আগে পলাশবনে চরতে এসে এখানে জল খেতে এসেছিল। স্রোতের বালুর উপর ছোট একটু জায়গা জুড়ে একটা গড়হা। চিকচিক ঝিকঝিক করে না জল। পরিষ্কার স্বচ্ছ জল একটুও কাঁপে না। আঁজলা ভরে জল খেতে ইচ্ছে করে দাশুর।
পাথুরে ঢিবিটার ওদিকে ঝুপ করে একটা শব্দ বেজে ওঠে। যেন হঠাৎ শব্দ করে কেঁপে উঠেছে আহত জলের ঝলক। একটা কোট্রা হরিণ কি ভয় পেযে জলের উপর লাফ দিয়ে পড়েছে?
এগিয়ে যেতে গিয়েই হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দাশু। শালপাতার একটা ঠোঙায় পাকা ড়ুমুর, আর লতা দিয়ে জড়িয়ে বাঁধা নীলকণ্ঠ ময়ুরের পালকের একটা গাদা পাথরটার উপর পড়ে আছে।
পাথরের উপর আরও দুটি জিনিস দেখতে পায় দাশু। ছোট একটি হাঁড়ি, সে হাঁড়ির মুখের কাছে একটা ভোমরা ঘুরে ঘুরে উড়ছে। আর, দু হাত বহর ও পাঁচ হাত লম্বা একটা মেটিয়া শাড়ি পাথরের উপর টান হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে। শাড়িটাকে যেন শুকোবার জন্য মেলে দেওয়া হয়েছে।
স্রোতের পাশে মাটির উপর যদি এক ফোঁটা রক্তের চিহ্নও থাকতো, তবে না হয় বুঝতে হতো যে, বাঘিন কানারানী একটা মাতাল গরু-চরানী মেয়েকে এখান থেকে একটি কামড়ে তুলে নিয়ে এখনি পালিয়েছে। চোখের বিস্ময় সহ্য করতে গিয়ে দাশুর বুকের ভিতরে একটা সন্দেহের ছায়া ছমছম করে। গুপী লোহারের নতুন জাদূর কোন খেলা তো? অনেক জাদু আর অনেক ছল জানে গুপী লোহার। নতুন একটা চেহারা ধরেছে নাকি গুপী লোহার?
শাড়ি আছে যখন, তখন মেয়েমানুষ নিশ্চয়। কিন্তু ডর নেই, লাজ নেই, এখানে এসে পাকা ড়ুমুর আর হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে, এমন মেয়েমানুষ কি সত্যিই মেয়েমানুষ? এই বনে যে একা একা কোন গরুও জল খেতে আসে না। সন্ধ্যা হতেও আর বেশি দেরি নেই। এই বনে ভালুক আসে, হুঁড়ার ঘুরে বেড়ায়। আর, আজকাল কানারানীও আসে। সে খবর কি জানে না মাগিটা?
সত্যিই একটা মাগি বটে, না, আর কেউ? না, কোন ক্ষেপী? ধমক দিয়ে আর ভয় দেখিয়ে ওকে এখান হতে না তাড়িয়ে দিলে ওর প্রাণটা যে আজ সন্ধ্যা হতেই জানোয়ারের ক্ষুধার খোরাক হয়ে যাবে।
-কে বট তুমি? পাথরটার উপব উঠে হাঁক দিতেই দাশু ঘরামির গলা স্বর পাল্টা ধমক খেয়ে চমকে ওঠে। কে যেন ধমক দিয়েছে–খবরদার; এদিক পানে আসবে না।
এইবার দেখা যায়, শরীরটার গলা পর্যন্ত জলে ড়ুবিয়ে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে যে, সে সত্যিই মেয়েমানুষ। মুখটাও দেখতে বেশ সুন্দর। নেশার ঘোরে লাল হয়ে টলমল করছে একজোড়া টানাটানা চোখ; ভেজা চুলের গোছা নুয়ে পড়ে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দুলছে। গল্প শুনেছিল দাশু, ডাইনীরা মাঝে মাঝে রূপসী সেজে বোকা মানুষকে ভুলিয়ে রাখে, তারপর নেশা করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়; তারপর বোকাটার কলিজা চুরি করে নিয়ে পালিয়ে যায়।
দাশু ঘরামি ভয়ে ভয়ে বলে–শুধাচ্ছি, কে বট তুমি?
–চোখ নাই? দেখতে পাচ্ছ না?
–দেখছি তো। তুমি মেয়েমানুষ।
–তবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
তবু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দাশু। দাশুর চোখের বিস্ময়ে বোধ হয় নতুন নেশার ছোঁয়া লেগেছে। কত কাছে, এই তো, দাশুর চোখের কাছ থেকে মাত্র পাঁচ হাত দূরে স্বচ্ছ জলের তরলতার মধ্যে শরীরটাকে ড়ুবিয়ে, শুধু সুন্দর মুখ আর নেশার চোখ ভাসিয়ে, তাকিয়ে রয়েছে একটা ছলনা।
চেঁচিয়ে ওঠে মেয়েমানুষটা–তুমি সরবে না কি সরদার? কেমন কিষাণ তুমি? লাজ লাগে তোমার?
–কেন? লাজ কিসের?
-আমি কি তোমার ঘরের গাই যে, আমার এত কাছে এসে দাঁড়াবে আর তাকাবে? দাশু–কি যে বলছো, বুঝছি না!
মেয়েমানুষটা বলে-বুঝ না কেন? চোখ নাই কি? দেখছো না আমার শাড়িটা কোথায় পড়ে আছে, আর আমি কোথায় আছি?
দাশু ঘরামির চোখের উদভ্রান্তি এতক্ষণে পরিষ্কার হয়। সত্যিই একটা মেয়েমানুষ লজ্জা পেয়ে আর ভয় পেয়ে দাশু ঘরামিকে সরে যাবার জন্য অনুরোধ করতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছে।
চলে যাওয়া উচিত, সরে যাওয়া উচিত। কিন্তু দাশুর চোখের কৌতূহল তবু যেন একটা মায়ার আবেশে ছটফট করে। দাশু বলে-কিন্তু তুমি কেমন মেয়েমানুষ গো?
–তোমার ঘরণী যেমন মেয়েমানুষটি, তেমনটি গো।
–তুমি ক্ষেপী বট, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।
–তুমি চালাক বট, মতলব নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছ।
–তুমি নেশা করেছ।
–তুমিও নেশা করেছ।
–তোমার ডর নাই?
–কিসের ডর?
–জানোয়ারের ডর?
–তোমার মত মানুষদিকে ডরাই; জানোয়ারদিগে ডরাই না।
–আমি তোমার কোন্ মান নাশ করেছি যে গালি দিচ্ছ?
–সরে যাচ্ছ না কেন? কি দেখবার মতলব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ?
–কিছু দেখতে চাই না। একটা কথা বলে দিতে চাই; যদি শুন তো বলি।
–কোন কথা শুনতে চাই না। তুমি জলদি সরে যাও।
–কোন্ গাঁয়ে ঘর তোমার?
–তুমি শুধাও কেন?
–শুধালে দোষটা কি বল?
–ভালটা কি, তাই বল?
–আমার ভাল কিছু নাই, তোমার ভাল হতে পারে।
–কেন? আমার কি ভালটা করবে তুমি?
–তোমাকে ঘর পোঁছিয়ে দিব।
–আমার ঘর নাই।
–মিছা কথা। যদি মেয়েমানুয় হও তো ঘর নিশ্চয় আছে।
–না গো না। আমার নাইহর নাই, শশুরার নাই, কিছু নাই।
–তুমি খুব নেশা করেছ। কেন করলে?
–তাতে তোমার কি?
–আমার কিছু নয়। তুমি মরবে।
–কে মরাবে আমাকে? কোন্ জানোয়ারে?
–জানোয়ারে নয়, মানুষে।
–কোন মানুষের সাধ্যি নাই গো সরদার।
হেসে ওঠে দাশু। কিন্তু মেয়েমানুষটার লাল চোখ শিকরে বাজের চোখের মত কটমট করে : হাস কেন গো সরদার? একবার ছুঁতে এসে দেখ না কেন, কি হয় তোমার?
–কি করবে তুমি?
–তোমার মত কত গাঁওয়ার এই কিষাণীর গা ছুঁতে এসে বুঝে নিয়েছে, আমার দাঁতে আর নখে কত বিষ আছে।
দাশু চেঁচিয়ে ওঠে–তুমি কিষাণী?
–হ্যাঁ গো। তুমি কি মনে করেছ?
–আমি ভেবেছিলাম তুমি একটা বেইদানী।
মেয়েমানুষটার লাল চোখ হঠাৎ ছলছল করে ওঠে : তুমি ভুল বুঝ নাই সরদার। কিষাণী ছিলাম, কিন্তু বেইদানী হয়েছি। আমার কপালটা আমাকে বেইদানী করে দিয়েছে সরদার।…ও
কি করছো? ছি।
দাশুর চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ধিক্কার দিয়ে ওঠে কিষাণী। আর চটপট হাত চালিয়ে জলের নীচে বালু ঘেঁটে স্বচ্ছ জল ঘোলা করে দেয়।
হ্যাঁ, খুবই স্বচ্ছ জল। সেই জল যেন এই কিষাণীর শরীরের একটা স্বচ্ছ সাজ। কী অদ্ভুত সাজ! সবই দেখা যায়। আবরণ বটে, তবু আবরণ নয়। কিষাণী গুটিসুটি হয়ে গলা পর্যন্ত শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকলে হবে কি? দাশু যে কিষাণীর ঢলঢল শরীরের সব ছবি দু চোখ ভরে দেখে ফেলেছে।
দাশু বলে-তোমাকে বড় দুখী মনে হয়।
কিষাণী হাসে : হয় তো হয়। এখন চুপচাপ চলে যাও, আর ঘরে গিয়ে কিষাণীর দুখের কথা ভেবে ভাত খেও না।
কথা বলে না দাশু। কিষাণীও আনমনা হয়ে ওর লাল চোখের নেশার সুখে কি-যেন ভাবে। বিকালের রোদ এবার সব তেজ হারিয়ে একেবারে সিঁদুরে হয়ে স্রোতের জল পাথর আর বালুর উপর যেন রংঝারি ঢালতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে তিতির ওড়ে। কুরর কুরর, বনমোরগের দল শব্দ করে উড়ে এসে স্রোতের ধারে বসে আর তখুনি উড়ে পালিয়ে যায়।
দাশু হাসে–তোমাকে বেশ সুখী মনে হয়।
কিষাণী এইবার যেন গর্ব করে চেঁচিয়ে হেসে ওঠে? কেন সুখী হব না? গায়ে গায়ে ঘূরি। মানঝিদের ঠাঁই মযুর-পাখা খরিদ করি। চার আনায় এক গোছা পালক পাই, বেপারীর কাছে চার টাকায় বেচে আসি।
দাশু–তোমার বিয়া হয় নাই?
–বিয়াতে লাভটা কি আছে গো সরদার? মরদের দাসী হতে বলছো?
–ঘরণী কি মরদের দাসী হয়?
–দাসীই হয়। কিন্তু মিছা নিজেকে ঘরণী ভেবে গমর করে।
–দাসী বল আর যা-ই বল, মেয়েমানুষ যদি মরদ না পায় তবে…।
খিলখিল করে হেসে আর দু হাত তুলে খোলা চুল গুটিয়ে পাকিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে কিষাণী বলেছিয়া ছিয়া!
দাশু–তুমি ক্ষেপী বট।
–আমি ক্ষেপী নই। যে মাগি মরদের গা ছোঁয়, সে মাগি ক্ষেপী।
–ক্ষেপী হয়েও ওরা তোমার চেয়ে সুখী।
–কেন?
–ওরা ছেইলা পায়।
–ছেইলাওয়ালীর কপালে ঝাড়ু।
–কেন?
–ছেইলা যে ডাইন বটে গো। মায়ের রক্ত খায়।…ও কি? আবার?
দু হাতে বালু ঘেঁটে জল ঘোলা করে দিয়ে আবার দাশুর মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে কিষাণী।
দাশু বলে—তুমি উঠে এসো!
কিষাণী-তুমি সরে যাও।
দাশু–আমি তাকাব না। এবার উঠে এসে শাড়িটা ধর।
ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকে কিষাণী। নেশায় ভরা লাল চোখে সন্দেহ টলমল করে।
দাশু বলে বিশ্বাস কর।
কিষাণী-ঠিক তো?
দাশু–হ্যাঁ।
কিষাণীর সন্দেহে ভুল নেই বোধহয়। দাশুর নিঃশ্বাস হঠাৎ উতলা হয়েছে। সত্যিই পলাশবনের এই নিভৃতের স্রোতের কাছে বিকালশেষের সিদুরে আলো যেন মহুযুরসের চেয়েও বেশি মাদক। সারা পলাশবন নেশা চাইছে। নাইহর নাই, শশুরার নাই; বিয়া করে না, ছেইলা চায় না; তবু মেয়েমানুষ। এ কেমন মেয়েমানুষ? এমন মেয়েমানুষের শরীরে কোন জাদু আছে? দাশু ঘরামির চোখের পিয়াস দূরস্ত হয়ে উঠেছে।
টি-হা টি-হা টি-হা!–ডেকে উঠেছে পাখিটা। কিষাণীও হেসে ওঠে : পাপিহাটা তোমার মত চালাক বটে। সরে যাও এবার; উঠতে দাও।
সরে যায় দাশু। মাথা হেঁট করে পায়ের কাছে শক্ত পাথরটার দিকে তাকিয়ে চোখ দুটোকেও যেন পাথরের মত শক্ত করে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
উঠেছে কিষাণী। কিষাণীর ছায়াটা দাশুর প্রায় গা ঘেঁষে চলে যায়। বুঝতে পারে দাশু, এইবার কিষাণী ওর শাড়িটাকে তুলে নেবার জন্য হাত নামিয়েছে।
কেঁপে ওঠে দাশুর চোখ। দাশুর লাল চোখের পিপাসার স্বপ্নটা এই মুহূর্তে ঢাকা পড়ে যাবে। ঠকে যাবে দাশু ঘরামির এতক্ষণের তপ্ত নিঃশ্বাসের আশা। মুখ ফিরিয়ে তাকায় দাশু।
কিষাণী রাগ করে আর চিৎকার করে ওঠবার, আর শাড়িটা হাতে তুলে নেবার আগেই দাশু তার বিবশ বুকের সব ধুকপুক শব্দের বেদনা নিয়ে ছুটে এসে কিষাণীকে দু হাতে বুকের উপর জড়িয়ে চেপে ধরে। পৃথিবীর কোন মেয়েমানুষ নয়, এই পলাশবনের মেয়েমানুষ। স্রোতের জলে স্নিগ্ধ করা, হাঁড়িয়ার নেশায় মাতাল করা, আর বিকালের সিঁদুরে আলোতে রঙিন করা একটা রক্তমাংসময় কোমলতা।
দাশু বলে-তোমার দাঁতে নখে বিষ আছে জানি। কিন্তু আমাকে মাপ কর কিষাণী।
–কি? দাঁতে দাঁত ঘষে মুখটাকে কুৎসিত করে নিয়ে প্রশ্ন করে কিষাণী। কিষাণীর নেশার চোখ থরথর করে কাঁপতে থাকে; কিন্তু কেঁপে কেঁপে যেন ক্লান্ত হতেও থাকে।
দাশুর গলার স্বর এইবার যেন বুকের ভিতর থেকে ফুঁপিয়ে উঠে আবেদন করে? আমাকে ঠকাবে না কিষাণী।
কিষাণী-কেন? তুমি আমার কে?
দাশু–তুমি যা বলবে, তাই।
কিষাণীর লাল চোখের উদ্ভ্রান্তি যেন নতুন এক উষ্ণতার আবেশে কোমল হয়ে ছলছল করে। দাঁতের আর নখের হিংস্র অহংকার হঠাৎ জব্দ হয়ে গিয়েছে। ফুঁপিয়ে ওঠে কিণীতা হলে কসম খাও; আমি যা বলবো, তাই মেনে নিবে।
দাশু–নিশ্চয়।
কিষাণী-তবে আমিও নিশ্চয়।
দাশু–এখনই তো?
কিষাণীনা সরদার, এখন না।
দাশু–কবে?
কিষাণী—পরে।
দাশু–না, এখনই।
আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে পলাশবনের মেয়েমানুষ। লাল চোখের নেশাটা যেন গলে গড়তে চাইছে। চোখ বন্ধ করে বলে-তুমি আমাকে মরতে বলছো সরদার! বেশ…কিন্তু কথা দাও যে…।
দাশু বল।
-তুমি আমার সাথে থাকবে। বিয়া হবে না, তবু থাকবে। আমি তোমাকে ভাত দিব, কাপড় দিব। তোমার নেশার মদ দিব। আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে যাবে। আমি না বললে তুমি আমার গা ছুঁবে না। আমি তোমার গা ছুঁলে তুমি না বলবে না। যেদিন চলে যাব সেদিন আর আমাকে খুঁজবে না।
দাশু–তুমি আমাকে বেইদা হতে বলছো?
কিষাণী-হ্যাঁ। যতদিন ভাল লাগবে দুজনে মাগিমরদ হয়ে এক সাথে থাকবো। ভাল লাগবে না যেদিন, সেদিন ছাড় হয়ে যাবে। ছেড়ে যেতে কারও মনে কোন দুখ হবে না।
দাশু—শুধু দুটো দিনের এমন সুখে লাভ কি?
কিষাণী-তবে একটিবারের এমন সুখে লাভ কি? তবে তুমি এখনই পাগল হয়েছ কেন, আর আমাকে এখনই মরতে বলছো কেন?
কিষাণীর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে থাকে দাও। ফিসফিস করে তপ্ত নিঃশ্বাসের বাতাস দাশুর মুখের উপর ছড়িয়ে দিয়ে কিষাণী বলে—ঢের দিন এক ঠাঁই ভাল নয়। ঢের দিন এক মরদ ভাল নয়। ঢের দিন এক মাগ ভাল নয়। ছেইলাও ঢের দিন ভাল নয় সরদার। দুটা দিন কাছে রাখ, তারপর চালান করে দাও। যে নিবে নিয়ে যাক্। ঢের দিন কারও সাথে মজেছ কি মরেছ। সুখ হবে এতটুকু, দুখ হবে এত!
দপ করে, যেন একটা উল্লাসের জ্বালায় দাশুর চোখ দুটো জ্বলে ওঠে; এই তত ভাল। বড় ভাল কথা, খুব ঠিক কথা, বড় ভাল সুখের কথা বলেছে কিষাণী।
–একটুক বুঝে নিয়ে কথা বল সরদার? যদি না বুঝে থাক, তবে…। কিষাণীর শরীরটা যেন অভিমান করে দাশুর বুকের ছোঁয়া থেকে সরে যেতে চায়; তাই কেঁপে ওঠে।
পলাশবনের নিভৃতে হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া যে স্বাদু দাশুর লুব্ধ বুকের উপর পড়ে আছে, সে স্বাদুতা হারিয়ে ফেলবার দুর্ভাগ্য সহ্য করতে হলে দাশু ঘরামির রক্তের সুখ বুঝি শুকিয়ে কাঙ্গাল হয়ে যাবে। যেন একটা স্বপ্নের ঘোরে বিড়বিড় করে দাশু–বুঝেছি।
কিষাণী—তবে শুন।
দাশু–বল।
–এই হাঁড়ির মদে আমি ধুতরা মিশিয়েছি।
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–না। তোমাকে আমি মরতে দিব না। এই হাড়িকে আমি লাথি মেরে এখনি সোতের জলে ফেলে দিব।
হেসে ফেলে কিষাণী–আমি আমাকে মরতে চাই না, সরদার।
–তবে কাকে মরাতে চাও?
–বলছি; তুমি আগে কথা দাও, আমার সাথে যাবে আর সে মাগিকে ধুতুরারা এই হাঁড়িয়া খাইয়ে দিবে।
–সে মাগিটা কে বটে? ডাইনী বটে কি?
–ডাইনীর চেয়েও খারাপ বটে গো।
–কে?
–মধুকুপির কিষাণী, দাশু ঘরামির মাগ মুরলী।
দাশুর হাত দুটো হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পলাশবনের মাতাল মেয়েমানুষের নগ্ন শরীরটাকে যেন দু হাতের দশ আঙ্গুলের নখ দিয়ে খিমচে শক্ত করে ধরে রাখে।–কি বললে তুমি?
–হ্যাঁ গো সরদার। ও মাগি একটা খিরিস্তান শিকারীর সাথে নষ্ট হয়েছে। কে জানে, মাগি কোন্ জাদু করে শিকারীটার মন টেনে নিলে। আচ্ছা…হ্যাঁ গো সরদার..একটা কথা বলবে?
-বল?
-ঢং করে একটুক হাসলে, গির্জাবুড়িকে সেধে সেধে দুটা জবর কথা শিখলে, একটা সিলাই কল নিয়ে ঘরঘর করে ফরফর করলে, একটা বাহারী রেশমী শাড়ি পরলে, গায়ে একটা জামা চড়ালে মেয়েমানুষের গতরের সোয়াদ কি মিঠা হয়ে যায়?
—এ কথা কেন বলছো?
–মনের জ্বালায় বলছি গো সরদার। আমার গতরে কী মজা নাই যে, আমাকে পেলে মরদ খুশি হবে না বল? তবু খুশি না হয়ে ভেগে গেল।
–দাশু ঘরামির মাগের নষ্টামির কথা তুমি কোথা থেকে জানলে?
–তেতরি ঘাসিনের ঠাঁই শুনলাম।
–তেতরি ঘাসিনের সাথে তোমার দেখা হলো কোথা?
–বাবুরবাজারে।
–তোমার ঘর বাবুরবাজারে?
–না গো। আমি হালে এসেছি। বাবুরবাজারের কাছে আমার সহিয়ার ঘর আছে। সহিয়ার মরদ পালকিতে খাটে।
–তুমি সেখানে থাক?
–এখন আছি। কাজ ফুরালেই চলে যাব।…এ কি, কি হলো সরদার? সরে যাও কেন?
হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে, ছোট্ট একটা আর্তনাদের মত করুণ স্বরে প্রশ্ন করে পলাশবনের মেয়েমানুষ। কারণ, ওর তপ্ত নিঃশ্বাসের স্বপ্নটাকে বুকের উপর থেকে হঠাৎ ঠেলে আলগা করে দিয়ে দু’পা পিছনে সরে দাঁড়িয়েছে দাশু।
তাড়াতাড়ি শাড়িটা তুলে নিয়ে গায়ে জড়ায় সেই অদ্ভুত নারী, এইমাত্র সর্বস্ব অঙ্গীকার করে ধুরাবিষ দিয়ে প্রচণ্ড এক হিংসার জ্বালা শান্ত করবার খেলায় দাশু ঘরামিকে সাথী করতে চেয়েছে যে। কিষাণীর মাতাল চোখ দুটোতে যেন ধুলোলাগা একটা ব্যথা কচকচ করছে। আস্তে আস্তে বলে–তুমিও কি আমাকে ঘিন্না করলে সরদার? আমি তোমাকে ঠকাতে চাই নাই।
চেঁচিয়ে ওঠে দাশু–তুমি চল।…সাঁঝ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি কর কিষাণী…আমার ডর লাগছে।
দাশুর গলার স্বর যেন দুঃসহ যন্ত্রণায় ফেটে পড়েছে। বুকের ভিতর দাউ দাউ করছে একটা পোড়া বাতাস। এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে না পারলে দাশু ঘরামির কলিজাট। ফেটে যাবে; মধুকৃপির মানুষ গল্প করতে গিয়ে হেসে উঠবে, রূপসী ডাইনীর পিছনে ছুটে, গিয়েছিল দাশ; আর ডাইনীটা ওর কলিজা চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে। ইচ্ছা করে নিজেকে মরিয়েছে বোকাটা।
পলাশবনের মেয়েমানুষের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যখন ডাঙার কাছে পৌছায় দাশু, এখন ঝিঁঝিঁর ডাক শুরু হয়ে গিয়েছে। সড়কের উপর উঠতেই দেখতে পাওয়া যায়, দূরে বড়কালুর মাথার উপর একটা তারা ফুটেছে।
দাশু বলে–খিরিস্তান শিকারীটা তোমার কে বটে গো?
–দুশমন বটে। একদিন আমারই কপালে সিঁদূর দিয়েছিল দুশমনটা।
দাশু–তোমার নামটা কি বটে?
–সকালী।
দাশু বলে-তুমি এখন সিধা বাবুরবাজারে চলে যাও, সকালী। আমি আমার গায়ে চললাম।
চেঁচিয়ে ওঠে সকালী–ছিয়া ছিয়া, তুমি আমাকে ঠকালে সরদার।
বড়কালুর মাথার উপর ফুটে-ওঠা বড় তারাটার দিকে আর-একবার তাকায় দাও। সকালীর হাত থেকে হাঁড়িটা কেড়ে নিয়ে এক আছাড় দিয়ে গুঁড়ো করে দেয়। তারপরেই এক লাফে পিছনে সরে যায়।
–তুমি কে বট সরদার? চেঁচিয়ে ডাক দেয় সকালী।
কোনও উত্তর না দিয়ে ছুটে চলে যায় দাশু। মধুকুপির বাতাসের গন্ধ বুকের ভিতরে না। পাওয়া পর্যন্ত দাশুর জীবনের এই বিষাক্ত ভুলের জ্বালা আর লজ্জা বোধহয় কাটবে না।