চতুর্থ অধ্যায়– কেন প্রায় নিশ্চিৎভাবে বলা সম্ভব ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই
বিভিন্ন ধর্মীয় গোত্রের প্রচারকরা….বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে সদা শঙ্কিত, যেমন, কাহিনীর ডাইনীরা শঙ্কিত থাকে ভোরের আলোর আগমনের এবং তাদেরও ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে এই সব নিয়তি নির্ধারক অগ্রগতির প্রতি, যারা তাদের ছলছাতুরীর জীবিকার বিভক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে।
— টমাস জেফারসন
দি আলটিমেট বোয়িং ৭৪৭
যুক্তি হিসাবে ‘আর্গুমেন্ট ফ্রম ইমপ্রোবাবিলিটি’ বা ‘অসম্ভাব্যতা থেকে নেয়া যুক্তি’ সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রচলিত ‘আমেন্ট ফ্রম ডিজাইন’ বা ‘পরিকল্পনা থেকে যুক্তি’র ছদ্মবেশে অনায়াসে এটি বর্তমানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের সপক্ষে প্রস্তাবিত সবচেয়ে জনপ্রিয় যুক্তি এবং যুক্তিটি বিস্ময়কর সংখ্যক ঈশ্বরবাদীদের দৃষ্টিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ আর পুরোপুরিভাবে বিশ্বাসযোগ্য। অবশ্যই যুক্তিটি খুব শক্তিশালী এবং আমার ধারণা, উত্তর করা সম্ভব না বা উত্তরের অযোগ্য এমন একটি যুক্তি কিন্তু সেটা ঈশ্বরবাদীরা যা বোঝাতে চাইছেন, ঠিক এর বিপরীত অর্থে। অসম্ভাব্যতা থেকে নেয়া যুক্তি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে এটার মাধ্যমেই ঈশ্বরের যে অস্তিত্ব নেই তা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছানো যায়। প্রায় নিশ্চিভাবেই ঈশ্বরের যে কোন অস্তিত্ব নেই, সে বিষয়ে পরিসংখ্যানগত প্রমাণ প্রদর্শনকে আমি নাম দিয়েছিলাম: দি আলটিমেট বোয়িং ৭৪৭ গ্যামবিট (১)।
নামটার উৎপত্তি ফ্রেড হয়েলের (২) মজার সেই বোয়িং ৭৪৭ এবং স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড (বা পরিত্যক্ত কিংবা অবাঞ্ছিত লোহা লক্কড় আর নানা যন্ত্রের টুকরো যেখানে ফেলে রাখা হয়) রুপক চিত্রটি; আমি অবশ্য নিশ্চিৎ না, বিষয়টি হয়েল নিজে কোথাও লিখেছিলেন কিনা, কিন্তু এটি যে তার মন্তব্য সেটি সত্যায়িত করেছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চন্দ্র বিক্রমাসিংহে (৩) এবং ধারণা করা হয় হয়েলই এই মন্তব্যটি করেছিলেন (৪)। হয়েল বলেছিলেন, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি হবার সম্ভাবনা, কোনো একটা স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড এর মধ্য দিয়ে। ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেলে, সেখানে ঘটনাক্রমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যুক্ত হয়ে একটি আস্ত বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ তৈরীর হবার যতটুকু সম্ভাবনা, তার চেয়ে খুব একটা বেশী না। অন্যরা এই রুপকটি ধার করেছেন বিবর্তন পক্রিয়ায় পরের পর্যায়ে জটিল জীবদেহের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করতে, যেখানে এর একটি মিথ্যা আপাত-গ্রাহ্যতা আছে। এলোমেলোভাবে বিভিন্ন অংশ নাড়া চাড়া করে যোগ বিয়োগ করে পুরোপুরি কর্মক্ষম একটি ঘোড়া, গুবরে পোকা বা অস্ট্রিচ পাখী গঠন করার সম্ভাবনাটা সেই স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে এ ঘূর্ণিঝড় এর বানানো বোয়িং ৭৪৭ তৈরী করার মত বেশ উঁচু মাত্রায় অসম্ভাব্যতার পর্যায়ে পড়ে। এটাই, মোটামুটি সংক্ষেপে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের সবচেয়ে প্রিয় যুক্তি– আর এ ধরনের একটি যুক্তি শুধুমাত্র এমন কারো পক্ষেই প্রস্তাব করা সম্ভব, যার কিনা প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধে সামান্যতম কোন ধারণা নেই : এমন কেউ যিনি মনে করেন প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে শুধুমাত্র চান্স বা আপতন বা দৈবক্রমে ঘটা বিবর্তনীয় পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করতে পারে এমন কোনো তত্ত্ব, অথচ আপতন বা দৈবক্রমে ঘটা বিবর্তনীয় পরিবর্তনের প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষাপটে তা সম্পূর্ণভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণাটির ঠিক বিপরীত।
সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের আত্মসাৎকৃত অসম্ভাব্যতা থেকে নেয়া যুক্তিটির রুপ সবসময়ই একই সাধারণ রুপ ধারণ করে থাকে এবং সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা একে যতই রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের (৫) চমক দেখানো পোষাকে সজ্জিত করুক না কেন, কোন গুণগত পার্থক্য সেখানে ঘটেনা। কিছু পর্যবেক্ষণকৃত বিষয় –কখনো একটি জীবিত প্রাণী বা এর জটিল কোন একটি অঙ্গ, কিন্তু যে কোনো কিছুই হতে পারে, যেমন কোন একটি অণু থেকে শুরু করে পুরো মহাবিশ্বকে আসলেই সঠিকভাবে অতি প্রশংসায় মহিমান্বিত করা হয় পরিসংখ্যানগত দিক থেকে অসম্ভাব্য একটি বিষয় হিসাবে। ডারউইনবাদীদের প্রতি কখনো তথ্য তত্ত্বের ভাষা ব্যবহৃত হয় জীবিত পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান সকল তথ্যের উৎস ব্যাখ্যা দেবার জন্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে। কারিগরী অর্থে, তথ্যভাণ্ডার আসলে অসম্ভাব্যতার একটি পরিমাপ বা “সারপ্রাইজ ভ্যালু; বা যুক্তিটি হয়তো প্রস্তাবনা করে অর্থনীতিবিদদের বহু ব্যবহৃত মন্ত্র : কোনো কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না– এবং কোনো কিছু না করার বিনিময়ে, অনেক কিছুর জন্যে কৃতিত্ব দাবী করার জন্য ডারউইনবাদকে অভিযুক্ত করা হয়। আসলে, এই অধ্যায়ে আমি প্রমাণ করবো, ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে আমাদের জানা আছে এমন একটি মাত্র সমাধান, যা কিনা, কোথা থেকে তথ্যগুলো এসেছে, অন্যথায় এই অসমাধানযোগ্য ধাঁধাটিকে ব্যাখ্যা করছে। দেখা যাচ্ছে যে, ঈশ্বর হাইপোথিসিসটি চেষ্টা করছে কোনো কিছু না করেই সব কিছু পাবার জন্য। ঈশ্বর নিজেই বিনামূল্যেই কিছু পেতে চাইছেন এবং বেশ তাই হোক। তবে যত বড় পরিসংখ্যানের হিসাবে অসম্ভাব্য হোক না কেন, এই সত্তা যা আপনি খুজছেন, একটি মহান পরিকল্পনাকারী বা ডিজাইনারের অস্তিত্ব কল্পনা করার মাধ্যমে, কমপক্ষে সেই ডিজাইনারের নিজেকেও অবশ্যই সেই পরিমান অনুপাতেই অসম্ভাব্য হতে হবে। ঈশ্বরই হচ্ছেন সেই আল্টিমেট বা প্রকৃতার্থেই বোয়িং ৭৪৭।
অসম্ভাব্যতা থেকে নেয়া যুক্তি দাবী করছে, শুধু চান্স বা আপতনের মাধ্যমে কোনো জটিল কিছুর সৃষ্টি হতে পারে না (৬)। কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষই এই ‘চান্স বা আপতনের মাধ্যমে সৃষ্ট বক্তব্যটি ‘কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পক বা ডিজাইনারের পরিকল্পনা বা ডিজাইন ব্যতীত সৃষ্ট বক্তব্যটার সমার্থক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেন। সে কারণেই অবাক হবার কিছু নেই, যে তারা অসম্ভাব্যতাকে ডিজাইনের সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে মনে করেন। ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রদর্শন করে যে, জীববিজ্ঞানীয়। অসম্ভাব্যতার প্রেক্ষাপটে এই ব্যাখ্যা কতটুকু ভ্রান্ত। এবং যদিও ডারউইনবাদ সরাসরি অজৈব জগত, যেমন কসমোলজীর– সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়– তবে এটি আমাদের সচেতনতার স্তরকে উচ্চ একটি স্তরে নিয়ে যায়, এর মূল ক্ষেত্র জীববিজ্ঞানের বাইরেও।
ডারউইনবাদ সম্বন্ধে গভীর ধারণা আমাদেরকে চান্স বা আপতনের একমাত্র বিকল্প হিসাবে প্রস্তাবিত ডিজাইন বা পরিকল্পনার সহজ ধারণা থেকে সতর্ক থাকতে শেখায়। এবং ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া জটিলতার ক্রমানুসারে সাজানো পথগুলো অনুসন্ধান করতে আমাদের শেখায়। ডারউইনের আগে দার্শনিক যেমন হিউম বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের অসম্ভাব্যতা মানে কিন্তু এই না একে অবশ্যই ডিজাইনকৃত বা পরিকল্পিত হতে হবে, কিন্তু তারা এর বিকল্প কোনো কিছু কল্পনা করতে পারেননি। ডারউইনের পর, ডিজাইনের ধারণাটি সম্বন্ধে আমাদের সবারই, একেবারে অন্তস্থল থেকে, সন্দেহ অনুভব করা উচিৎ। ডিজাইনের এই বিভ্রম বা মায়া আসলেই একটা ফাঁদ, যা এর আগেও আমাদের বোকা বানিয়েছিল, এবং আমাদের সচেতনতাকে জাগিয়ে তুলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ডারউইনের অসাধারণ তত্ত্বটির; যদি তাই হতো, তাহলে আমাদের সবার ক্ষেত্রেই তিনি সফল হতেন।
সচেতনতা বর্ধক হিসাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন
কোনো একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর নভোযানে, নভোচারীরা পৃথিবীর জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, পৃথিবীতে এখন বসন্তকাল, শুধু এটা ভাবলেই…!”, আপনি হয়তো সাথে সাথে এই বাক্যটির ভুলটা ধরতে পারবেন না, কারণ উত্তর গোলার্ধের শভিনিজম বা নিজেদের সবকিছুর কেন্দ্রে মনে করার প্রবণতা, এখানে আমরা যারা বাস করি তাদের অবচেতন মনে গভীরভাবে খোদাই করা আছে; এমনকি যারা এখানে বাস করেনা তাদের অনেকেরও। “অবচেতন’ কথাটাই পুরোপুরি ঠিক আছে। এখানেই সচেতনতা বাড়াবার বিষয়টি আসে। শুধুমাত্র লোক দেখানো মজা করা ছাড়াও, আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণে, অষ্ট্রেলিয়া এবং নিউ জিল্যান্ডে আপনি পৃথিবীর মানচিত্র কিনতে পারবেন যেখানে দক্ষিণ মেরু উপরের দিকে অবস্থিত। সচেতনতা বাড়াতে এই মানচিত্রগুলো কতই না চমৎকার হতে পারতো, যদি উত্তর গোলার্ধের ক্লাসরুমগুলো দেয়ালে এদের আটকিয়ে রাখা যেত। দিনের পর দিন, সেটি শিশুদের মনে করিয়ে দিত “উত্তর’ একটি কাল্পনিক পোলারিটি বা মেরুকরণ, শুধুমাত্র যার একারই সবসময় ‘উপরে থাকার একচেটিয়া অধিকার নেই। মানচিত্রটি যেমন তাদের জানতে উৎসাহী করে তুলতো, তেমনি তাদের সচেতনতাও বৃদ্ধি করতো। বাসায় ফিরে তারা তাদের বাবা-মাদের তা বলতো প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শিশুদের এমন কিছু শেখানো যা দিয়ে তারা তাদের বাবা-মাদের বিস্মিত করতে পারে, সম্ভবত একজন শিক্ষকের পক্ষ থেকে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো উপহার হতে পারেনা।
নারীবাদীরাই সচেতনতা বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার শক্তি সম্বন্ধে আমার সচেতনতাকে বৃদ্ধি করেছিল। History না Herstory অবশ্যই হাস্যকর, এমনকি শুধুমাত্র এই কারণে, যে history শব্দটির মধ্যে His শব্দাংশটির উৎপত্তিগত কোনো সম্পর্কই নেই পুরুষবাচক সেই আপত্তিকর সর্বনামের সাথে। শব্দের উৎপত্তিগত দিক থেকে এটিও হাস্যকর সেই ১৯৯৯ সালে ওয়াশিংটনে একজন সরকারী কর্মকর্তার বরখাস্ত হবার ঘটনাটির মত। যার Niggardly শব্দটি ব্যবহার বর্ণবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল (Niggardly শব্দের আভিধানিক অর্থ: কৃপন, এবং শব্দটার উৎপত্তি কিন্তু কোনো ধরনের বর্ণবাদ ইঙ্গিত করেনা); এমনকি নির্বোধের মত উদাহরণও, যেমন, Niggardly বা Herstory কিন্তু আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। যখন আমাদের দার্শনিক ক্রোধটি প্রশমিত করতে এবং হাসি থামাতে পারবো, Herstory আসলেই আমাদের History কে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শেখাবে। এ ধরনের সচেতনা বৃদ্ধিতে কুখ্যাতভাবে লিঙ্গভিত্তিক সর্বনামগুলোর অবস্থান সবসময় সামনের কাতারে। He বা She অবশ্যই Himself বা Herself কে জিজ্ঞাসা করবে, His বা Her তার স্টাইল সেন্স কখনো Himself বা Herself কে এভাবে কোনো কিছু লেখার ব্যপারে সম্মতি দেয়। কিনা। কিন্তু আমরা যদি ভাষার এই অস্বস্তিকর ধ্বনির সমস্যাটা কাটিয়েছে উঠতে পারি, এটা আমাদের মানব জাতির অর্ধেক অংশের সংবেদনশীলতার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করবে। Man বা মানুষ, Mankind বা মানবজাতি, Rights of Man বা মানুষের অধিকার, সব Man বা মানুষ সৃষ্টি হয়েছে সমানভাবে, একজন Man বা মানুষ একটি ভোট– ইংরেজী ভাষা প্রায়শই মনে হয় Woman বা নারীদের বর্জন করেছে (৭); আমার যখন অল্পবয়স ছিল, আমার কখনো মনে হয়নি কোনো নারী The Future of Man বাক্যটি দ্বারা অপমানিত বোধ করতে পারেন। এরপরের মধ্যবর্তী দশকগুলোতে, আমাদের সবারই এ বিষয়ে সচেতনতার স্তর বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি যারা Human এর পরিবর্তে Man ব্যাবহার করেন, তারাও সেটা করেন একটি আত্মসচেতন ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে– অথবা কেউ সেটা সচেতন আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে, প্রচলিত ভাষার সপক্ষে অবস্থান গ্রহন করে, এমনকি পরিকল্পিতভাবে নারীবাদীদের উত্যক্ত করতে। সময়ের স্পিরিট বা জাইটগাইষ্ট এর সকল অংশগ্রহনকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি হয়েছে। এমনকি যারা এর বিরুদ্ধে নেতিবাচক অবস্থান নিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের অবস্থানে অনঢ় আছেন এবং তাদের আক্রমণও দ্বিগুণ করেছেন।
ফেমিনিজিম বা নারীবাদ আমাদের দেখিয়েছে এর সচেতনতা বৃদ্ধি করার শক্তিময় ক্ষমতা, এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্যে আমি সেই কৌশলগুলো ধার করতে চাই। প্রাকৃতিক নির্বাচন পুরো জীবনটাকেই শুধু ব্যাখ্যা করেনা, এটি বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার উপরে আমাদের সচেতনতাকেও বাড়িয়ে দেয়: কিভাবে প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনা ছাড়াই সংগঠিত জটিলতার উদ্ভব হতে পারে খুব সরল কোনো সূচনা থেকে। প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধে পূর্ণ ধারণা আমাদের সাহস যোগায় অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতেও সেই ব্যাখ্যাগুলো প্রয়োগ করতে। এই সব অন্য ক্ষেত্রেও আমাদের বিশ্লেষণী সংশয়কে এটি বৃদ্ধি করে, সেই সব মিথ্যা অপ্রমাণযোগ্য বিকল্প মতামতগুলো সম্বন্ধে, যা প্রাক-ডারউইন পর্বে একসময় জীববিজ্ঞানকে প্রতারিত ও দিকভ্রষ্ট করেছিল। ডারউইনের আগে, কেই বা, অনুমান করতে পেরেছিলেন, ডাগ্রন ফ্লাইয়ের ডানা বা ঈগল পাখির চোখ, আপাতদৃষ্টিতে যা পরিকল্পিত বা ডিজাইন করা মনে হলেও এটি আসলে রানডোম নয় (নন-র্যানডোম) এমন কোনো প্রক্রিয়ায় কিন্তু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সুদীর্ঘ ক্রমবিন্যাসের একটি পরিণতি মাত্র?
ডগলাস অ্যাডামস (৮) এর নিজের সক্রিয় বা র্যাডিকাল নিরীশ্বাবাদীতে রুপান্তরিত হবার মজার এবং হৃদয়স্পর্শী কাহিনীর বিবরণে র্যাডিকাল শব্দটির উপর তিনি জোর দিয়েছেন, যেন আবার কেউ তাকে ভুল করে অজ্ঞেয়বাদী বা অ্যাগনষ্টিক মনে না করে বসে– ডারউইনবাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করার ক্ষমতার একটি সাক্ষ্যপ্রমাণ, আমি আশা করি আমাকে, আমার এই আত্মপশ্রয়ের জন্য, যা পরবর্তী উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট হবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হবে। আমার অজুহাত হলো যে, আমার আগের বইগুলোর মাধ্যমে ডগলাসের রুপান্তর, যেগুলো অবশ্যই কাউকে রুপান্তরের প্রচেষ্টা না– আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই বইটি নিবেদন করার জন্য– কিন্তু সেটি তাই করেছিল! একটি সাক্ষাৎকারে, যে সাক্ষাৎকারটি ‘দ্য স্যামন অব ডাউট’ এ পুনমূদ্রিত হয়েছে, ডগলাসকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেমন করে তিনি নিরীশ্বরবাদী হয়েছিলেন, তিনি তার উত্তর শুরু করেছিলেন প্রথমে কিভাবে অজ্ঞেয়বাদী হয়েছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করে, তারপর তিনি বলেছিলেন:
এবং এরপর আমি ভাবতে শুরু করলাম বিরামহীনভাবে, কিন্তু আমার কাছে এভাবে ক্রমাগত চিন্তা করার যাবার মত যথেষ্ট পরিমান কিছু ছিল না, সুতরাং আমি কোন মতামতেও পৌঁছাতে পারিনি। ঈশ্বরের ধারণাটি সম্পর্কে আমার তীব্র একটা সন্দেহ ছিল, কিন্তু কোন কিছু সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট পরিমান জানা ছিল না, ব্যাখ্যা করার জন্য যা একটা কাজ চালানোর মত মডেল হতে পারে, যেমন, জীবন, মহাবিশ্ব এবং সবকিছু যা বর্তমানে যেভাবে যে অবস্থানে আছে। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, আমি আমার পড়া এবং চিন্তা দুটোই অব্যাহত রেখেছিলাম। আমার বয়স যখন ত্রিশের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই বিবর্তন জীববিজ্ঞান পড়ার সুযোগ হয়, বিশেষ করে, রিচার্ড ডকিন্সের বইয়ের মাধ্যমে, দ্য সেলফিশ জিন এবং পরে দ্য ব্লাইণ্ড ওয়াচমেকার এবং হঠাৎ করে (আমার মনে হয় দ্য সেলফিশ জিন দ্বিতীয় বার পড়ার সময়) সব কিছু আমার মনে স্পষ্ট হয়ে যায়। সেই ধারণা, যা কি বিস্ময়করভাবে সহজ সরল, কিন্তু সেটাই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি করে অসীম সংখ্যক এবং হতবাক করে দেবার মত জীবনের নানা জটিল রুপগুলো। যে শ্রদ্ধা আমার মধ্যে এটি জাগিয়ে তুলেছিল, সেটির তুলনায়, মানুষ ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে যে শ্ৰদ্ধার কথা বলে,স্পষ্টতই তা হাস্যকর মনে হয়েছিল। কোনো অজ্ঞতাপূর্ণ বিস্ময়কে গ্রহন করার চেয়ে, কোনো কিছু অনুধাবন করার বিস্ময় গ্রহন করতে আমি সদা প্রস্তুত (৯)।
যে বিস্ময়কর সহজ সরল ধারণাটির কথা ডগলাস বলছিলেন, তা অবশ্যই, আমার কোনো বিষয় না। সেটি ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন তত্ত্ব– সেই চুড়ান্ত বৈজ্ঞানিক সচেতনতা বৃদ্ধিকারক ধারণাটি। ডগলাস, তোমার অনুপস্থিতি ভীষণভাবে অনুভব করছি, তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে বুদ্ধিমান, কৌতুকময়, সবচেয়ে ভোলা মনের, তীক্ষ্ণ মেধার, সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত মাত্র একজন রুপান্তরিত অবিশ্বাসী। আমি আশা করছি এই বইটা তোমাকে হাসাবে, অবশ্য তুমি যতটা আমাকে হাসিয়েছ ততটা নয়।
বিজ্ঞানমনষ্ক দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট (১০) উল্লেখ করেছিলেন, বিবর্তন আমাদের অন্যতম একটি প্রাচীন ধারণাকে বিরোধিতা করে: ‘সে ধারণাটি হলো, অপেক্ষাকৃত ছোেট কোন কিছু সৃষ্টি করতে কোন বড় বিশাল বুদ্ধিমান কিছুর প্রয়োজন হয়, আমি একে বলবো ‘ট্রিকল ডাউন থিওরী অব ক্রিয়েশন’ বা ‘চুঁইয়ে পড়া সৃষ্টিতত্ত্ববাদের তত্ত্ব’। আপনারা কখনোই দেখবেন না যে একটি বর্শা আরেকটি বর্শাকে তৈরী করছে, কিংবা কোনো হর্স শু (ঘোড়ার পায়ে পরানো লোহার নাল) কে দেখবেন না আস্ত কামারকে সে বানাচ্ছে বা কোনো পাত্র বানাচ্ছে কুমারকে (১১); ডারউইনের একটি কার্যকরী প্রকাশ আবিষ্কার ঠিক সেই প্রচলিত ইনটুইশন বা আমাদের অন্তর্দষ্টি নির্ভর ধারণার বিপরীত কাজটাই করেছিল, সেকারণেই মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে তার অবদান এত বেশী বৈপ্লবিক এবং সচেতনতার স্তর বাড়ানোয় অনেক বেশী ক্ষমতাপুষ্ট। খুব বিস্ময়কর ব্যপার হচ্ছে, কত বেশী প্রয়োজন এই সচেতনতা বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি, এমনকি জীববিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও এটি অসাধারণ বিজ্ঞানীদের চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্য। ফ্রেড হয়েল একজন দুর্দান্ত মেধাবী পদার্থবিজ্ঞানী এবং কসমোলজিষ্ট কিন্তু তাঁর বোয়িং ৭৪৭’ এর ভুল অনুধাবন, এছাড়া জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত তার করা আরো কিছু ভুল যেমন, আর্কিওপটেরিক্স এর জীবাশ্মকে ভেলকিবাজী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিচ্ছে, সচেতনতার স্তর বাড়ানোর জন্য বেশ ভালোভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জগত সম্বন্ধে একটি ধারণার তার একান্ত প্রয়োজন ছিল। আমি মনে করি, একটি বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচনকে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নির্যাসের মধ্যে ঢুকে বিষয়টিকে বুঝতে হবে, পুরোপুরি অবগাহন করতে হবে, এর মধ্যে সাঁতার কাটতে হবে, তারপরেই এর আসল শক্তি সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা হবে।
বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রও আমাদের সচেতনতার স্তরকে উন্নীত করে পৃথক উপায়ে। ফ্রেড হয়েলের নিজের জ্যোর্তিবিজ্ঞানের বিজ্ঞান আমাদের অবস্থান নিশ্চিৎ করেছে এই মহাবিশ্বে, রুপকার্থে এবং আক্ষরিকার্থে, আমাদের দম্ভের আকৃতিকে হ্রাস করে একে বসিয়েছে দিয়েছে খুবই ছোট একটা মঞ্চে যেখানে আমরা আমাদের জীবনের নাটক করে যাচ্ছি– মহাজাগতিক বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আমাদের এই অতি ক্ষুদ্র ধ্বংসাবশেষে। ভূতত্ত্ববিদ্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো একক প্রাণী এবং প্রজাতি হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকালের ব্যপ্তি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। বিষয়টি জন রাসিকনের (১২) সচেতনতাকে বৃদ্ধি করেছিল এবং উদ্বুদ্ধ করেছিল তার স্মরণীয় হৃদয়গ্রাহী ১৮৫১ সালের উদ্ধৃতিটিকে :’যদি এই ভূতত্ত্ববিদরা আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিত। আমি ভালোই ছিলাম, কিন্তু ঐসব ভয়াবহ হাতুড়ী, বাইবেলের প্রতিটি অনুচ্ছেদের ছন্দের শেষে আমি তাদের শব্দ শুনি’; বিবর্তনও ঠিক সেই একই কাজ করে সময় সংক্রান্ত আমাদের ধারণার সাথে। ব্যপারটা বিস্ময়কর না, যেহেতু এটি ভূতাত্ত্বিক সময়ের মাপকাঠিতেই তার কাজ করে আসছে। কিন্তু ডারউইনীয় বিবর্তন, বিশেষ করে প্রাকৃতিক নির্বাচন আরো বেশী কিছু করে। এটি ডিজাইন বা পরিকল্পনার বিভ্রম সেই মায়াকে চুর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। জীববিজ্ঞানের পুরো সীমানায় এবং আমাদের শিখিয়েছে যে পদার্থবিদ্যা বা কসমোলজী বিষয়ে যে কোন ধরনের ডিজাইন বা পরিকল্পনার হাইপোথিসিসকে সন্দেহের চোখে দেখতে। আমি মনে করি পদার্থবিদ লিওনার্ড সাসকি (১৩) এই কথাগুলো ভেবেই লিখেছিলেন: ‘ইতিহাসবিদ নই, তবে আমি আমার একটি মতামত দেবো, আধুনিক কসমোলজীর যাত্রার আসল সূচনা হয়েছিল ডারউইন এবং ওয়ালেসের মাধ্যমে। তাদের মত করে এর আগে কেউই আমাদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, যেখানে পুরোপুরিভাবে অতিপ্রাকৃত কোন শক্তি বা এজেন্টদের উপস্থিতিকে অস্বীকার করা হয়েছে। ডারউইন এবং ওয়ালেস শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের জন্যই একটি মানদণ্ড দিয়ে যাননি, কসমোলজির জন্য তা দিয়ে গেছেন। অন্যান্য ভৌত বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাদের এ ধরনের কোনো সচেতনতার স্তর বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজন নেই তাদের অন্যতম ভিক্টর স্টোর (১৫), যার বই ‘হ্যাস সায়েন্স ফাউন্ড গড?’ (বা বিজ্ঞান কি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছে?), এর উত্তর হচ্ছে না), আমি সবাইকে পড়ার জন্য উৎসাহিত করছি এবং পিটার অ্যাটকিন্স (১৬), যার ‘ক্রিয়েশন রিভিজিটেড’ আমার সবচেয়ে প্রিয় কাব্যিক বৈজ্ঞানিক গদ্য।
আমি সারাক্ষণই সেই সব ঈশ্বরবাদীদের দেখে অবাক হই, আমি যেভাবে প্রস্তাব করেছি, সেভাবে তাদের সচেতনতার স্তর বৃদ্ধি করার বদলে, তারা বরং আনন্দিত এই ভেবে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে তার সৃষ্টিকে এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঈশ্বরের একটি পন্থা; তাদের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন হচ্ছে, খুবই সহজ এবং চমৎকার একটি উপায় পৃথিবী ভরা বিভিন্ন জীবের সমারোহ সৃষ্টিতে। ঈশ্বরের কিছুই করা লাগবে না! পিটার অ্যাটকিন্স, তার কিছুক্ষণ আগে উল্লেখ করা বইটি ঠিক এই চিন্তা সূত্রটি নিয়ে শুরু করে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ঈশ্বরহীন উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন, যখন তিনি প্রস্তাব করেন, একজন কল্পিত অলস ঈশ্বর যিনি চেষ্টা করেছেন যত সহজে কম কষ্টে জীবনের উপস্থিতি সহ একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা যায়। অ্যাটকিন্স এর অলস ঈশ্বর অষ্টাদশ শতাব্দীর এনলাইটেন্টমেন্ট বা নবজাগরনের যুগের ডেইষ্ট বা একাত্মবাদীদের ঈশ্বরের তুলনায় আরো বেশী অলস: deus otosius; আক্ষরিক অর্থে বিশ্রামরত ঈশ্বর, ব্যস্ততাহীন, কর্মহীন, অপ্রয়োজনীয়, বাড়তি। ধীরে ধীরে অ্যাটকিন্স অলস ঈশ্বরের করণীয় কাজকে এমন একটা পর্যায়ে কমিয়ে আনতে সফল হন, যে পরিশেষে দেখা যায়, তার আসলেই কোনো কাজ নেই; সেক্ষেত্রে বরং তার কোনো অস্তিত্ব থাকারই কি দরকার। আমি আমার স্মৃতিতে স্পষ্ট শুনতে পাই উডি অ্যালেনের একটি গভীর অনুধ্যানের সেই বিলাপ: ‘অবশেষে যদি দেখা যায়, আসলেই কোন ঈশ্বর আছেন, আমি মনে করি না তিনি খুব অশুভ একটি চরিত্র হবেন, কিন্তু সবচেয়ে খারাপ যেটা আপনি তার সম্বন্ধে বলতে পারেন তা হলো, আসলে তার যতটুকু অর্জন করার কথা ছিল, সেটা করতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
ইরিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি (১৭) বা অবিভাজ্য জটিলতা
খুবই বড় মাপের একটি সমস্যা, যা আসলেই অতিরঞ্জন করা প্রায় অসম্ভব, তারই সমাধান করেছিলেন ডারউইন এবং ওয়ালেস। আমি অ্যানাটমি, কোষের গঠন, প্রাণরসায়ন এবং আক্ষরিকার্থে যে কোনো জীবিত প্রাণীর আচরণ থেকে উদাহরণ দিতে পারি, তবে সৃষ্টিতত্ত্ববাদী লেখকরা আপাতদৃষ্টিতে ডিজাইন বা পরিকল্পনার সবচেয়ে চমৎকার কীর্তি হিসাবে যেসব সাফল্যগুলো বেছে নেয়া নিয়েছে (এবং অবশ্যই সুস্পষ্ট কারণে) এবং খানিকটা হালকা শ্লেষাত্মক কৌতুকময়তার মাধ্যমে আমিও আমারগুলো খুঁজে পেয়েছি সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের একটি বই থেকে, যার নাম: ‘লাইফ– হাউ ডিড ইট গেট হেয়ার’; বইটির লেখকের নাম কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, তবে বইটি প্রকাশ করেছে ‘দি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল’এবং ট্র্যাক্ট সোসাইটি, মোট ১৬টি ভাষায়, প্রায় ১১ মিলিয়ন কপি, এবং স্পষ্টতই বেশ জনপ্রিয়, কারণ এই এগারো মিলিয়ন কপির কমপক্ষে ছয়টি আমাকে অযাচিত উপহার হিসাবে প্রেরণ করছেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে শুভাকাঙ্খীরা।
এই অজ্ঞাতনামা লেখকের বিপুল সংখ্যক সংখ্যায় প্রকাশিত এবং ব্যাপক প্রচারিত এই বইটির যে কোনো পৃষ্ঠা এলোমেলোভাবে উল্টালেই, আমরা খুঁজে পাই একটি স্পঞ্জ, যার আরেক নাম ‘ভেনাস ফ্লাওয়ার বাস্কেট (১৮) এর সাথে আবার, যে কোনো কারো না, খোদ স্যার ডেভিড অ্যাটেনবুরোর (১৯) উদ্ধৃতি যোগ করা হয়েছে: ‘আপনি যখন স্পঞ্জদের জটিল কংকাল লক্ষ করেন, যেমন, যেগুলো তৈরী সিলিকার স্পিকিউল বা সুচের মত সরু কণা দিয়ে যা ভেনাস ফ্লাওয়ার বাস্কেট নামে পরিচিত, কল্পনাও হতবাক হয়ে যায়। কেমন করে প্রায় স্বাধীন আণুবীক্ষণিক একগুচ্ছ কোষ পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ কাঁচের (সিলিকা) কাঠামো বা প্লিন্টার নিঃসরণ করে এবং এরকম একটি জটিল ও সুন্দর জাফরি বা ল্যাটিস তৈরী করেছে? আমরা জানিনা?; ওয়াচটাওয়ারের লেখকরা এখানে তাদের তীর্যক মন্তব্য যুক্ত করে দিতে কালক্ষেপণ করেননিঃ কিন্তু আমরা একটা জিনিস জানি, ‘চান্স বা আপতন খুব সম্ভবত এর ডিজাইনার না’; এই একটা বিষয়ে আমরা সবাই একমত হতে পারি। এই প্রাকৃতিক ঘটনাটি ঘটার পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতা যেমন, ইউপ্লেকটেলার কংকাল হচ্ছে সেই কেন্দ্রীয় সমস্যাটির উদাহারণ, জীবনের যে কোনো তত্ত্বকে সেটার সমাধান করতে হবে; আর যত বেশী পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতা থাকবে, এর সমাধান হিসাবে চান্স বা আপতন ততই তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হবে: অসম্ভাব্যতার অর্থ বলতে সেটাই বোঝায়। কিন্তু অসম্ভাব্যতার এই ধাঁধার সম্ভাব্য সমাধান দুটি কিন্তু ডিজাইন এবং চান্স বা আপাতন না, যা সাধারণত ভুলভাবেই দাবী করা হয়ে থাকে, বরং সেগুলো হচ্ছে ডিজাইন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন। চান্স অবশ্যই কোনো সমাধান নয় যখন জীবিত প্রাণীদের মধ্যে উঁচু মাপের অসম্ভাব্যতা আমরা দেখি। কোনো সুস্থ জীববিজ্ঞানী সমাধান হিসাবে কখনোই এমন কিছু প্রস্তাব করেননি, ডিজাইনও আসল সমাধান নয়, কেন নয়, আমরা পরেই দেখবো। কিন্তু আপাতত আমি, জীবন সংক্রান্ত যে কোনো থিওরীর বা তত্ত্বের যে সমস্যার সমাধান করতে হবে, তাহলো চান্স থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে সেই সমস্যাটা নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে চাচ্ছি।
ওয়াচটাওয়ারের পাতা উল্টাতে গিয়ে আমরা দারুণ আরো একটি গাছ সম্বন্ধে জানতে পারি, যা পরিচিত ডাচম্যানস পাইপ (২০) নামে। এর প্রতিটি অংশ দেখে মনে হয়, সূক্ষ্মভাবে ডিজাইন করা হয়েছে পোকামাকড় আকর্ষণ করার জন্য, যাদের আকৃষ্ট করে ধরার পর তাদের গায়ে রেণু মাখিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় অন্য ডাচম্যানস পাইপ ফুলের পরাগায়নের লক্ষ্যে। ফুলটির অসাধারণ সূ জটিলতা ওয়াচটাওয়ারের লেখকদের বেশ আন্দোলিত করেছে একটি প্রশ্ন করতে: এসব কি ঘটেছে চান্স বা আপতনের মাধ্যমে? নাকি, এটা ঘটেছে কোনো বুদ্ধিমান সত্তার ডিজাইন বা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা পরিকল্পনা মাধ্যমে? আরো একবার আমি পুনরাবৃত্তি করছি, অবশ্যই চান্সের মাধ্যমে এটা ঘটেনি। এবং আবারো, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন চান্সের কোনো সঠিক বিকল্প না। প্রাকৃতিক নির্বাচন শুধুমাত্র যে একটা বাহুল্যবর্জিত প্রক্রিয়া তাই নয়, একটি ব্যাখ্যা উপযোগী এবং অসাধারণ সুন্দর একটি সমাধান; এটি একমাত্র কর্মক্ষম প্রক্রিয়া, যা চান্সের বিকল্প হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু একমাত্র কর্মক্ষম বিকল্প চান্সের যা প্রস্তাব করা হয়েছে। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনও চান্সের মতই একই সমস্যার মুখোমুখি; কোনোভাবেই এটি পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতার ধাঁধার ব্যাখ্যা দেবার মত সমাধান নয়। যত বেশী অসম্ভাব্যতা তত বেশী ব্যাখ্যার অযোগ্য হতে থাকে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন। স্পষ্টভাবে দেখলে, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সমস্যাটিকে দ্বিগুণে রুপান্তরিত করে। আরো একবার, এর কারণ ডিজাইনার নিজেই (Himself/Herself/itself) তাৎক্ষণিকভাবে তার নিজের উৎপত্তি কিভাবে হলো, সেই বৃহত্তর সমস্যাটি সৃষ্টি করে। যে কোনো একটি বুদ্ধিমান সত্তা, যার কিনা ডাচম্যানস পাইপের (বা মহাবিশ্ব) মত কোনো অসম্ভাব্য কিছু পরিকল্পনা করার ক্ষমতা আছে, তাহলে সেই সত্তাটি নিজেই ডাচম্যানস পাইপের তুলনায় আরো বেশী অসম্ভাব্য হবে। এই ভয়ঙ্কর পশ্চাৎমুখী ক্রমান্বয়ে পূর্ববর্তী কারণে ফিরে যাবার রিগ্রেস প্রক্রিয়াটিকে থামানোর বদলে, ঈশ্বর এটি উস্কে দেন আরো তীব্র প্রতিহিংসায়।
ওয়াচটাওয়ারের আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখুন, জায়ান্ট রেড উড (২১) সম্বন্ধে প্রাণবন্ত একটি বিবরণ পাওয়া যাবে। এই গাছটার প্রতি আমার একটা বাড়তি দুর্বলতা আছে কারণ আমার বাগানে এই গাছটি আছে– অবশ্য সেটি শুধু শিশু মাত্র, বড় জোর এক শতাব্দী বয়স হবে, কিন্তু তারপরও এটি এই এলাকায় সবচেয়ে দীর্ঘতম গাছ। একজন সামান্য মানুষ, সেকোইয়ার নীচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে নীরব বিস্ময়ে অভিভূত হয় এর সুবিশাল বিশালত্ব দেখে; একমাত্র সুপরিকল্পিত ডিজাইন ছাড়া অন্য আর কোনো বিশ্বাস কি অর্থবহ হতে পারে, এই রাজকীয় দানবাকৃতির বৃক্ষ এবং এর ছোট বীজের ক্ষেত্রে, যা এর আকৃতি ধারণ করে; আবারো, আপনি যদি মনে করেন ডিজাইন এর একমাত্র বিকল্প হচ্ছে চান্স, তাহলে না, এটি কোনো অর্থ বহন করেনা। কিন্তু এখানে লেখকরা সত্যিকারের বিকল্প ব্যাখ্যাটিকে উহ্য রেখেছেন, প্রাকৃতিক নির্বাচন, হচ্ছে এর কারণ, তারা আসলেই এটি বোঝেন বা তারা প্রকাশ করতে চান না।
যে প্রক্রিয়ায় কোনো উদ্ভিদ, তা সে ছোট পিম্পারনেল হোক বা সুবিশাল ওয়েলিংটনিয়া হোক না কেন, তাদের তৈরী করা জন্য শক্তি তৈরী করে, তা হলো সালোক সংশ্লেষণ। ওয়াচটাওয়ারের আবারো ৭০ টি পৃথক রাসায়নিক বিক্রিয়া আছে সালোক সংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় যা একজন জীববিজ্ঞানীর ভাষায়, সত্যিকারের অলৌকিক একটি ঘটনা’; সবুজ গাছদের বলা হয় প্রকৃতির ফ্যাক্টরী– সুন্দর শান্ত দুষণহীন অক্সিজেন উৎপাদনকারী, পানি চক্রকে গতিশীল রাখা, সারা পৃথিবীর খাদ্যের যোগান দেয়া। তাদের কি আসলেই উদ্ভব হয়েছে চান্সের মাধ্যমে? সত্যিই কি কথাটা বিশ্বাসযোগ্য? না, অবশ্যই তা বিশ্বাসযোগ্য না। কিন্তু বার বার নানা উদহারণের পুনরাবৃত্তি করে কোনো আলোচনাই আসলে সামনে আগায় না। সৃষ্টিতত্ত্ববাদী ‘যুক্তি’ সবসময়ই একই। কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা পরিসংখ্যানগত দিক থেকে আসলে অসম্ভাব্য, অনেক জটিল, অনেক সুন্দর, অনেক বেশী বিস্ময়কর, শুধু মাত্র চান্সের মাধ্যমে তাদের সৃষ্টি হবার জন্য বিষয়টা খুবই বিস্ময়কর। চান্সের একমাত্র বিকল্প ডিজাইনকেই শুধু এই লেখকরা কল্পনা করতে পারেন। সুতরাং একজন ডিজাইনার বা পরিকল্পনাকারী নিশ্চয়ই এসব করেছেন। এই ভ্রান্ত যুক্তির প্রতি বিজ্ঞানের উত্তরও সবসময় এক। চান্সের এর একমাত্র বিকল্প ডিজাইন নয়। এর চেয়ে উত্তম বিকল্পটি হলো প্রাকৃতিক নির্বাচন। ডিজাইন আসলেই সত্যিকারের কোনো বিকল্প না, কারণ এটি যে সমস্যার সমাধান করছে, তার চেয়ে আরো বদ আরো বড় একটি সমস্যারও সৃষ্টি করছে: ডিজাইনারকে তাহলে কে ডিজাইন করেছে? চান্স এবং ডিজাইন পরিসংখ্যানগত দৃষ্টিতে কোন অসম্ভাব্যতাকে ব্যাখ্যা করতে দুটোই ব্যর্থ কারণ, একটি হচ্ছে সমস্যা এবং আরেকটি প্রথম সমস্যার দিকে ক্রমান্বয়ে পশ্চাৎমুখী পূর্বধারণায় ফিরে যাবার নিরন্তর প্রক্রিয়ায়। প্রাকৃতিক নির্বাচনই হচ্ছে সত্যিকারের সমাধান। এখন পর্যন্ত প্রস্তাবিত সমাধানগুলোর মধ্যে এটি একমাত্র পরীক্ষা করা সম্ভব এমন কার্যকরী একটি সমাধান। শুধুমাত্র কর্মক্ষম সমাধানই নয়, বিস্ময়কর সুন্দর এবং শক্তিশালী একটি সমাধান।
তাহলে কোন বিষয়টি প্রাকৃতিক নির্বাচনকে সফল করেছে এই অসম্ভাব্যতার সমস্যার সফল সমাধান হিসাবে, যেখানে চান্স এবং ডিজাইন দুটোই ব্যর্থ একেবারে শুরুতে? এর উত্তর হচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে একটি কুমুলেটিভ বা ক্রমবর্ধমান পুঞ্জীভূত একটি প্রক্রিয়া, যা অসম্ভাব্যতার সমস্যাটিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে ফেলে। প্রতিটি ছোট টুকরো কিছুটা অসম্ভাব্য হতে পারে, তবে চূড়ান্তভাবে অসম্ভব নয়। যখন অনেক সংখ্যক এই খানিকটা বা ঈষৎ অসম্ভব ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে একের পর এক যখন সজ্জিত হয়, এই সমষ্টিগত ক্রম উত্তরণের শেষ ফলাফলটি আসলেই খুবই বেশী অসম্ভাব্য মনে হতে পারে; আর চান্সের সীমানার বাইরে সেই অসম্ভাব্যতা। এই সব চূড়ান্ত রুপগুলো সৃষ্টিতত্ত্ববাদীর ক্লান্তিকর বহুব্যবহৃত যুক্তির বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একজন সৃষ্টিতত্ত্ববাদী মূল বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন কারণ এই ব্যক্তিটি (বা He) (আমি পুরুষবাচক সর্বনাম ব্যবহার করছি, অন্তত এখানে নারীরা এই সর্বনাম দ্বারা নিজেদের বঞ্চিত হবার জন্য কিছু মনে করবেন না। বার বার জোর করছেন পরিসংখ্যানগত অসম্ভব ব্যপারটার সৃষ্টিকে একটি একক বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে, তিনি ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হবার বা অ্যাকুমুলেশন এর শক্তি বোঝেন না।
আমি আমার ক্লাইম্বিং মাউন্ট ইমপোবাবল’ বইটিতে একটি রুপকধর্মী উদাহরণ ব্যবহার করে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছিলাম: যে কোনো একটি পর্বতের যে পাশটা একেবারে খাড়া সেদিক দিয়ে এই পর্বতটি আহোরণ করা বা বেয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব কিন্তু অন্য দিকে একটা ক্রমশ উঁচু হতে থাকা ঢালু পাশ যা কিনা ধীরে ধীরে চুড়ায় গিয়ে মিশেছে। ধরা যাক এই চুড়ায় বা শীর্ষবিন্দুতে আছে জটিল কোনো অঙ্গ, যেমন একটি চোখ বা ব্যাক্টেরিয়ার ফ্ল্যাজেলাকে চলন শক্তি দেয় এমন কোনো জৈব মটর। আর এখানে মনে করা হয় এমন উদ্ভট ধারণাটা হচ্ছে এই ধরনের জটিলতা পূর্ণ কোনো অঙ্গ, যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের তৈরী করে ফেলে, যাকে তুলনা করা যায় পাহাড়ের নীচ থেকে এক লাফে পাহাড়ে চুড়ায় উঠার মত কোনো একটি ব্যপার। কিন্তু বিবর্তন ঠিক এর বিপরীত, পাহাড়ের খাড়া দিকটি বাদ দিয়ে এটি অন্যপাশের ঢালু দিয়ে ধীরে ধীরে প্রক্রিয়াটি পাহাড় চুড়া তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়: সহজ! হালকা, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা উচ্চতার ঢাল বেয়ে শীর্ষে পৌঁছাবার মূলনীতিটি, একলাফে নীচ থেকে পাহাড় চূড়ায় ওঠার মূলনীতি থেকে অনেক বেশী সরল। যে কারো বিস্মিত হবার সম্ভাবনা থাকে, কেন একজন ডারউইনের এই দৃশ্যে আসতে এবং বিষয়টি আবিষ্কার করতে এত সময় লাগলো। যখন তিনি কাজটা শেষ করেন, ততদিনে প্রায় তিন শতাব্দী পেরিয়ে গেছে নিউটনের অ্যানাস মিরাবিলিস বা চমৎকার সেই বছরের, যদিও তার কীর্তি সুস্পষ্টভাবে ডারউইনের কীর্তির চেয়ে অনেক বেশী কঠিন ছিল।
চূড়ান্ত অসম্ভাব্যতার আরেকটি প্রিয় রুপক হচ্ছে ব্যাঙ্ক-ভল্টের কম্বিনেশন লক। তাত্ত্বিকভাবে, একজন ব্যাঙ্ক ডাকাত ভাগ্যক্রমে সেই সংখ্যাগুলো চান্সের মাধ্যমে পেতে পারেন, কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের কম্বিনেশন লক যথেষ্ট সতর্কতার সাথে ডিজাইন করা হয় এর অসম্ভাব্যতাকে যথেষ্ট পরিমান বৃদ্ধি করার মাধ্যমে, প্রায় অসম্ভব ফ্রেড হয়েলের বোয়িং ৭৪৭ এর মত। কিন্তু এর বদলে কল্পনা করুন একটি খানিকটা বাজেভাবে ডিজাইন করা একটি কম্বিনেশন লক, যা ধীরে ধীরে তার গোপন সংখ্যাগুলো প্রকাশ করে, শিশুদের হান্ট দি স্লিপার খেলাটির শুরু অনুশীলনের মত (২৩); মনে করুন যখনই লকটি প্রত্যেকটি ডায়াল তাদের সঠিক সেটিং এ এসে পৌঁছায় দরজাটি খুব সামান্য একটু খোলে, এবং ভল্ট থেকে কিছু টাকা গড়িয়ে পড়ে সেই আংশিক খোলা জায়গাটি দিয়ে, চোর এভাবেই খুব তাড়াতাড়ি তার মূল লক্ষ্যে পৌঁছে যায়।
সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা যারা তাদের অবস্থানের সপক্ষে অসম্ভাব্যতা থেকে যুক্তি ব্যবহার করেন,তারা সবসময় ধরে নেন জীববিজ্ঞানের অভিযোজন অনেকটা লটারীতে ‘জ্যাকপট’ জেতা, নয়তো কোনো কিছু সম্ভবপর নয়। এই হয় ‘জ্যাকপট নয়তো কোনো কিছু হবে না, এই ভ্রান্ত ধারণাটির অন্য নাম ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি; হয় একটি চোখ তার দেখার কাজ করবে নয়তো না, হয় পাখনা বা ডানা উড়তে সাহায্য করবে নয়তা না, কৌশলে ধারণা করে নেয়া হয়েছে প্রজাতি সদস্যদের জন্য এদের মধ্যবর্তী কোনো উপযোগি বা কাজে আসতে পারে এমন কোনো অবস্থার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তাদের এই ধারণাটি পুরোপুরি ভুল। এ ধরনের অন্তবর্তীকালীন প্রকৃতির পর্যায়ের অসংখ্য উদাহরণ বিদ্যমান এবং ঠিক সেটাই কোনো তত্ত্বে আমাদের আশাকরা উচিৎ। জীবনের কম্বিনেশন লক হচ্ছে, ‘খানিকটা গরম হচ্ছে, তারপর ঠান্ডা আবার গরম হবার’ হান্ট দ্য স্লীপার খেলার সেই কৌশল বা ডিভাইস এর মত; আসল জীবন সেই অসম্ভাব্যতার পর্বত চুড়ায় পৌঁছাতে বেছে নেয় পর্বতের অন্য দিকের সেই ঢালু পথ, অন্য দিকে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা অন্ধ তাদের সামনের পর্বতের উঁচু খাড়া পিঠ ছাড়া অন্যকিছু ভাবার জন্য।
ডারউইন তার ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ বইটির একটি পুরো অধ্যায় উৎসর্গ করেছিলেন পরিবর্তনের সাথে বংশানুক্রমের তত্ত্বের সমস্যাগুলো সম্বন্ধে। পক্ষপাতহীনভাবে বলা যায় এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টি, আজ অবধি প্রস্তাব করা হয়েছে এমন প্রতিটি তথাকথিত সমস্যাই পূর্বধারণা করেছিল এবং এটি তা খণ্ডনও করেছে। সবচেয়ে বড় যে সমস্যাগুলো ছিল, ডারউইনের ‘অতি নিখুঁত সূক্ষ্ম এবং জটিলতম অঙ্গগুলো’, যা কখনো কখনো ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় ইররিডিউসিবলী কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্যভাবে জটিল অঙ্গ হিসাবে। ডারউইন সুনির্দিষ্টভাবে চোখের কথা উল্লেখ করেছিলেন বিশেষ চ্যালেঞ্জ হিসাবে: ‘বিভিন্ন দূরত্বে দেখার লক্ষ্যে ফোকাস ঠিক করার মাধ্যমে চোখের ভিতর প্রবেশ করা আলোর পরিমান নিয়ন্ত্রণ, আলোর এবং লেন্সের নানা অসঙ্গতিগুলোকে খাপ খাইয়ে নিয়ে সংশোধন করার জন্য চোখের অননুকরণীয় নানা কৌশলগুলো, এইসব বৈশিষ্ট্যগুলো তৈরী হতে পারে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, আমি দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নিচ্ছি, মনে হতেই পারে এটি খুবই বড় মাত্রার কোনো উদ্ভট ভাবনা; সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা সাধারণত তীব্র আনন্দের সাথে এই বাক্যটির উদ্ধৃতি দেয় বার বার। বলাবাহুল্য, অবশ্যই তারা এরপরের বাক্যগুলো কখনোই উদ্ধৃতিটিতে যোগ করেন না। অতি নম্রতার সাথে ডারউইনের এধরনের অকপট স্বীকারোক্তি আসলে উপস্থাপনার একটি কৌশল ছিল মাত্র। তিনি এই কথা দিয়ে তার বিরোধীদের তার দিকে টেনে নিচ্ছিলেন, কারণ তিনি চাচ্ছিলেন যখন আসল কথাটা বলবেন, তখন যেন তার কথাগুলো ঠিক জায়গামত আঘাত করে। এই আঘাতটা অবশই, ডারউইনের অনায়াসে দেয়া সেই ব্যাখ্যা কিভাবে ধীরে ধীরে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে চোখের বিবর্তন ঘটে। ডারউইন হয়তো ‘ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি’ বা অবিভাজ্য জটিলতা কিংবা “ধীরে ধাপে ধাপে ধাপে অসম্ভাব্যতার চুড়ায় ওঠা এসব বাক্যগুলো ব্যবহার করেননি, কিন্তু তিনি স্পষ্টতই দুটোর মূলনীতি বুঝেছিলেন।
‘অর্ধেকটা চোখের কি কোনো উপকার আছে?” এবং “অর্ধেকটা ডানারই বা কি উপকার আছে? এই দুই ক্ষেত্রেই যুক্তিটা এসেছে ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি’ থেকে। স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারে এমন কোনো একটি একক কোনো কিছুকে ‘ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্স’ বলা হয় তখনই, যখন এর কোনো একটি অংশ যদি অপসারণ করা হয়, তখন আর এটি কাজ করতে পারেনা; চোখ এবং পাখার ক্ষেত্রে, ধারণা করে আসা হয়েছে এই ব্যপারটা স্বপ্রমাণিত। কিন্তু যখনই আপনি এই ধারণাটি নিয়ে কয়েক মুহূর্ত ভাববেন, আপনি সাথে সাথে এর ভুলটা বুঝতে পারবেন। চোখে ছানি বা ক্যাটারাক্ট হবার পর সেই লেন্সটি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সরানোর পরে চশমা ছাড়া কেউই স্পষ্ট করে কিছু দেখতে পারেন না। কিন্তু তাসত্ত্বেও তাদের যে দৃষ্টি ক্ষমতা থাকে সেটি তাদের কোনো গাছের সাথে ধাক্কা খাওয়া বা পাহাড়ের খাদ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে কিন্তু রক্ষা করতে পারে। অর্ধেকটা ডানা অবশ্যই কোনো ডানা না থাকার চেয়ে উপকারী। অর্ধেকটা ডানা কিন্তু কারো জীবন বাঁচাতে পারে, একটি নির্দিষ্ট পরিমান উঁচু কোনো গাছ থেকে তার নিচে পড়াটা খানিকটা মসৃণ করে। প্রায় ৫১ শতাংশ পাখা আরো খানিকটা উঁচু থেকে পড়াটা সহজ করবে, যে পরিমান পাখাই আপনার থাকুক না কেন, সেই অনুযায়ী কোনো একটি উচ্চতা থেকে পড়ার সময় সেটা কাজে দেবে, যেখানে তার চেয়ে ছোট কোনো আংশিক পাখা কোনো কাজে আসবে না। এই বিভিন্ন উচ্চতার চিন্তার পরীক্ষাটি, যেখান থেকে কেউ পড়ে যেতে পারেন, হচ্ছে একটি উপায়ে বিষয়টি দেখা, যে তাত্ত্বিকভাবেই অবশ্যই ক্রমবর্ধমান সুবিধার একটি স্কেল আছে,শতকরা ১ ভাগ ডানা থেকে পুরোপুরি শতকরা ১০০ ভাগ ডানার। বনে জঙ্গল এ ধরনের গ্লাইডিং বা প্যারাস্যুট করে আংশিক উড়তে পারা প্রাণীদের দিয়ে পূর্ণ, যারা বাস্তবে অসম্ভবের সেই পর্বত চুড়ার দিকে প্রতিটি ধাপের প্রতিনিধিত্ব করছে।
বিভিন্ন উচ্চতার গাছের সাথে তুলনা করলে কল্পনা করতে সহজ হবে সেই পরিস্থিতিগুলো ভাবা, যখন অর্ধেক (৫০%) চোখ কোনো প্রাণীর জীবন বাঁচাবে এমন কোনো পরিস্থিতিতে যেখানে ৪৯% চোখ ব্যর্থ হবে। মসৃণ একটি ক্রমবিন্যাস যদি সৃষ্টি করা হয়। আলোর তীব্রতার মাত্রাকে পরিবর্তন করে এবং কোনো শিকারকে বা আপনাকে শিকার করবে এমন কোনো শিকারীকে যে দূরত্ব থেকে চোখে পড়তে পারে তার তারতম্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে, পাখার মতই বা উড়বার উচ্চতার মত সম্ভাব্য নানা অন্তবর্তীকালীন অবস্থা কল্পনা করা কঠিন হবে না; এবং প্রাণীজগতে তাদের সংখ্যার কোনো কমতি নেই। কোনো একটি ফ্ল্যাট ওয়ার্মের যে চোখ আছে, যে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য হিসাবে, তা মানুষের চোখের অর্ধেক এরও কম। নটিলাস (এবং হয়ত এর বিলুপ্ত আমোনাইট পরিবারের অন্যান্য জ্ঞাতি প্রাণিরা, যারা প্যালেওজোয়িক এবং মেসোজোয়িক সাগরে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল) তাদের একটা চোখ মানুষ এবং ফ্ল্যাটওয়র্মের মাঝামাছি একটা অবস্থান হতে পারে। ফ্ল্যাট ওয়ার্মের চোখ, যা আলো এবং ছায়া শনাক্ত করতে পারে কিন্তু কোনো ছবি নয়, তার থেকে আলাদা নটিলাসের চোখ, পিনহোল ক্যামেরার মত যা আসল দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি তৈরী করতে পারে।কিন্তু আমাদের চোখের তুলনায় যা ঝাপসা এবং অস্পষ্ট। এই ক্রমশ উন্নতিকে কোনো সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করাটা মিথ্যা পরিমাপ হবে, তবে সুস্থ মনের কেউই অস্বীকার করতে করতে পারবেন না যে এই অমেরুন্ডীদের চোখ এবং আরো অনেক ধরনের চোখ, অবশ্যই কোনো চোখ না থাকার চেয়ে অনেক বেশী উত্তম। এবং এদের সবার অবস্থান অসম্ভাব্যতার চড়ার দিকে একটি অবিচ্ছিন্ন, ক্রমশ উপরে উঠতে থাকা ঢালে বেয়ে। প্রায় চুড়ার কাছাকাছি আমাদের চোখ–অবশ্যই একেবারে চুড়ায় না তবে যথেষ্ট সুউচ্চে যার অবস্থান। আমি ‘ক্লাইম্বিং মাউন্ট ইমপ্রোবাবল’ বইটিতে একটি পুরো অধ্যায় আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করেছি চোখ এবং ডানা নিয়ে, দেখিয়েছি আসলে কত সহজ তাদের জন্য ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে বিবর্তিত হওয়া (বা এমনকি হয়তো অত বেশী ধীরেও না); এবং এখানে এ বিষয়ে বক্তব্য আর বেশী দীর্ঘায়িত করবো না।
সুতরাং আমরা দেখেছি যে, চোখ কিংবা পাখা, কোনোটাই অবশ্যই ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্যভাবে জটিল অঙ্গ না, কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো : এই উদাহরণ থেকে আমরা সাধারণ কোনো শিক্ষাটা পাচ্ছি। এবং বাস্তবতা হচ্ছে যে, কত বেশী মানুষ যে স্পষ্ট এই বিষয়টা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করেন, তা যেন আমাদের জন্য একটা সাবধানবাণী হয়ে এর চেয়ে খানিকটা অস্পষ্ট অন্যান্য উদাহরণগুলো বোঝার ক্ষেত্রে, যেমন কোষের বা প্রাণরাসায়নিক উদাহরণগুলোর ক্ষেত্রে, যার দালালী করছেন ঐসব সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা, যারা রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক সুভাষণ শব্দ ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তাত্ত্বিকের আড়ালে এখন আশ্রয় নিয়েছেন।
একটি সতর্কতা জ্ঞাপন মূলক কাহিনী আছে এখানে, যা আমাদের বলছে: কোনো কিছুকেই ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্যভাবে জটিল বলে ঘোষণা দেবেন না; সম্ভাবনা আছে যে, আপনি আসলেই যথেষ্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ করে দেখেননি, অন্যদিকে, আমরা যারা বিজ্ঞানের পক্ষে, আমাদেরও পুরোপুরি অন্ধ আত্মবিশ্বাসী হবারও অবশ্যই দরকার নেই, হয়তো প্রকৃতিতে সত্যি এমন কিছু আছে যা তার সত্যিকারের ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্য জটিলতার মাধ্যমে আসলেই অসম্ভাব্যতার পর্বত চড়ার দিকে মসৃন ক্রম উন্নতির ধারাবাহিকতাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা ঠিকই বলেন, সত্যিকারের ইররিডিসিউবল কমপ্লেক্সিটি স্পষ্টভাবে যদি প্রমাণ করে তারা দেখাতে পারেন, এটি ডারউইনের তত্ত্বটিকে ভিত্তিহীন হিসাবে প্রমাণ করবে। ডারউইন নিজেও বলেছেন: “যদি প্রমাণ করে দেখানো সম্ভব হয় এমন কোনো জটিল অঙ্গের অস্তিত্ব আছে, যা কোনোভাবেই অসংখ্য, ধারাবাহিক, সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভব হওয়া সম্ভব হয়নি, আমার তত্ত্বটির ভিত্তি পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়বে, কিন্তু আমি এমন কোনো উদাহরণ পাইনি’; ডারউইন এমন কোনো উদাহরণ পাননি, অনেক কষ্টকর, প্রায় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করার পরও আর কেউই তা পাননি সেই ডারউইনের সময় থেকে; ‘সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের এই ‘হলি গ্রেইল’ হিসাবে অনেক উদাহরণকে অবিভাজ্য জটিলতার যোগ্য প্রার্থী হিসাবে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কিন্তু কোনোটাই বিজ্ঞানীদের নীরিক্ষার সামনে টিকতে পারেনি।
যাই হোক না কেন, যদি সত্যিকারের ইররিডিউসিবলী কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্যভাবে জটিল কোনো কিছুর উদাহরণ কখনোও খুঁজে পাওয়া যায়, সেটি ডারউইনের তত্ত্বকে ধ্বংস করবে; তাহলে কি অন্যভাবে বলার উপায় আছে যে, এটি ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বকে ধ্বংস করতে পারবে না? আসলেই, এটি ইতিমধ্যেই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করেছে, কারণ যা আমি বলে আসছি এবং বলা অব্যাহত রাখবো আবার, ঈশ্বর সম্বন্ধে আমরা যত সামান্যই জানিনা কেন, একটা ব্যপারে আমরা নিশ্চিৎ, তাকে খুব, খুব বেশী মাত্রায় জটিল হতে হবে এবং অনুমেয়ভাবে ইররিডিউসিবল বা অবিভাজ্যভাবেই জটিল।
শূন্যস্থানের উপাসনা
সামনে অগ্রসর হবার জন্য ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি বা অবিভাজ্য জটিলতার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ অনুসন্ধান করা অবশ্যই মৌলিকভাবে বিজ্ঞানসম্মত কোনো উপায় নাঃ সেটা হবে বর্তমান অজ্ঞতা থেকে নেয়া যুক্তির একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। এর আবেদন সেই ভ্রান্ত যুক্তিটি ঘিরে, যা পরিচিত The God of the gaps (বা শূন্যস্থানের ঈশ্বর) কৌশল হিসাবে, যার বিশেষ নিন্দা করেছিলেন প্রখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ ডিয়েট্রিশ বনহোয়েফার (২৪)। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা দারুণ উৎসাহে বর্তমান সময়ে আমাদের জ্ঞানের শূন্যস্থানগুলোর সন্ধান করেন, যদি আপাতদৃষ্টিতে কোনো শূন্যস্থান পাওয়া যায়, ধরে নেয়া হয় এটাই, ঈশ্বর আমোঘ নিয়মানুযায়ী সেই শূন্যস্থানটি অবশ্যই পূর্ণ করবেন। চিন্তাশীল ধর্মতত্ত্ববিদদেরকে, যেমন বনহোয়েফার, যেটা ভাবায় হলো বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে এই শূন্যস্থানগুলোও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে, এবং ঈশ্বর ধীরে ধীরে কর্মহীন হয়ে যাবার কিংবা লুকিয়ে থাকার মত। জায়গার অভাবের হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভাবায় অন্যকিছু। বিজ্ঞানের সাথে জড়িত সকল কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয় একটি অংশ হচ্ছে অজ্ঞতাকে স্বীকার করা, এমনকি ভবিষ্যতের জয় করার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে এই অজ্ঞতায় উল্লাসিত হওয়া। আমার বন্ধু ম্যাট রিডলী (২৫) যেমন লিখেছিলেন, ‘বেশীর ভাগ বিজ্ঞানীরাই, তারা যা আবিষ্কার করে ফেলেছেন, সে বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। নতুন অজানা বা অজ্ঞতাই তাদের সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা। আধ্যাত্মবাদীরা রহস্যে উল্লসিত হয় এবং রহস্যময়তাকে টিকিয়ে রাখতেই তারা চান, বিজ্ঞানীরা রহস্যর মুখোমুখি আনন্দিত হন অন্য কারণে: কারণ এটা তাদের কিছু করার সুযোগ করে দেয়; খুব। সাধারণভাবে, আমি অধ্যায় আট এ বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করবো, ধর্মের সবচেয়ে ক্ষতিকর একটি দিক হলো, এটি আমাদের শিক্ষা দেয়, কোনো কিছু না বুঝে সন্তুষ্ট থাকাটাই হচ্ছে একটি ভালো গুণ।
অজ্ঞতাকে স্বীকার করে নেয়া এবং এর সাময়িক রহস্যময়তা ভালো বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিদেনপক্ষে কিছু বলতে গেলে বলতে হয়, বিষয়টা এ কারণে দূর্ভাগ্যজনক, সৃষ্টিতত্ত্ববাদী প্রচারণাকারীদের প্রধান কৌশলটিই নেতিবাচক, যার উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে আপাতত শূন্যস্থানগুলো খুঁজে বের করা এবং তা সাধারণভাবেই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন দিয়ে পূর্ণ করা। পরের উদাহরণটা যদিও হাইপোথেসিস নির্ভর তবে এটাই সচরাচর দেখা যায়: একজন সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বলছেন, লেসার স্পটের উইজেল ব্যাঙের কনুইয়ের অস্থিসন্ধি হচ্ছে অবিভাজ্যভাবে জটিল। এর কোনো অংশই একক ভাবে কার্যকর নয়, যতক্ষণ না সবগুলো অংশ একসাথে যুক্ত না হয়। বাজী রাখছি আপনি কোনোভাবেই এমন কোনো উপায় দেখাতে পারবেননা, যেখানে উইজেল ব্যাঙ এর কনুই ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে। ‘যদি বিজ্ঞানীরা এর একটি তাৎক্ষণিক এবং বোধগম্য উত্তর দিতে ব্যর্থ হন, সাথে সাথেই সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা তাদের সেই একটাই বহুব্যবহৃত উপসংহার টানেন: ‘বেশ তাহলে সেক্ষেত্রে বিকল্প তত্ত্ব, ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ স্বভাবত বিজয় লাভ করেছে। এখানে পক্ষপাতদুষ্ট যুক্তিটা খেয়াল করুন: যদি তত্ত্ব ‘এ’ কোনো ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, তাহলে তত্ত্ব ‘বি’ অবশ্যই সঠিক হবে। বলার প্রয়োজন নেই যে বিপরীত ক্ষেত্রে কিন্তু যুক্তিটি সেভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আমাদেরকে বিকল্প তত্ত্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমর্থন দেবার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে, যখন এটি যে তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব দিচ্ছে, সেই তত্ত্বের মত সেই বিশেষ ক্ষেত্রে এই তত্ত্বটিও ব্যর্থ হচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান ছাড়া। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে সবকিছু থেকেই নিঃশর্ত ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে, বিবর্তন তত্ত্বকে যে সুকঠিন প্রমাণের দাবীর মুখোমুখি হতে হয়, তা থেকে একে দেয়া হয়েছে লোভনীয় একটি সুরক্ষা, যেন কোনো জাদুর রক্ষা-বলয়।
কিন্তু এখানে আমার বর্তমান বক্তব্যটি হচ্ছে, সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের চাতুরীর কারণে, অনিশ্চয়তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের স্বাভাবিক– যা আসলেই প্রয়োজনীয়– আনন্দকে তুচ্ছ করে যে দেখা হয়, সে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। শুধুমাত্র খাঁটি রাজনৈতিক কারণে আজকের বিজ্ঞানীরা বলতে হয়তো ইতস্তত করেন : “হুম, বেশ কৌতূহলের একটি বিষয়তো, আমিও ভাবছি কেমন করে উইজেল ব্যাঙের পূর্বসূরিদের মধ্যে এই কনুইয়ের অস্থিসন্ধিটা বিবর্তিত হয়েছিল। আমি উইজেল ব্যাঙ বিশেষজ্ঞ না, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে যেতে হবে এবং ব্যপারটা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, হয়তো কোনো গ্রাজুয়েট ছাত্রের জন্য এটি চমৎকার একটি প্রোজেক্ট হতে পারে, যে মুহূর্তে একজন বিজ্ঞানী এভাবে উত্তর দেবেন, এবং কোনো ছাত্রের এই প্রোজেক্ট শুরু করার বহু আগেই– সেই একই সুপরিচিত শিরোনাম দেখা যাবে সৃষ্টিতত্ত্বাদীদেও প্রচারণাপত্রে: ‘উইজেল ব্যাঙ এর ডিজাইন একমাত্র ঈশ্বরই করতে পারেন।
এখানে সেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গবেষণার দিক নির্দেশনায় অজ্ঞাত বিষয়গুলোকে অনুসন্ধান করতে বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত প্রয়োজনীয়তা এবং ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মতবাদীদের সেই অজ্ঞাত স্থানগুলোকে খুঁজে বের করে বিজয় দাবী করার প্রবণতা যুক্ত হয়ে আছে। তাদের যে নিজস্ব কোনো প্রমাণ নেই, এবং বিজ্ঞানের আপতত না জানা শূন্যস্থানগুলোয় এটি যে আগাছার মত বৃদ্ধি পায়, ঠিক এই সত্যটাই, খানিকটা অস্বস্তির সাথেই সহাবস্থান করে বিজ্ঞানের এই সব শূন্যস্থানগুলোকে শনাক্ত এবং সেই একই শূন্যস্থানগুলোকে গবেষণার সূচনা বলে দাবী করার প্রয়োজনীয়তার সাথে। এই অর্থে, বিজ্ঞান তার মিত্র খুঁজে পায় মুক্তবুদ্ধি ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন ধর্মতত্ত্ববিদদের সাথে, যেমন বনহয়েফার, তাদের এই কৌশলগত ঐক্য হতে পারে নির্বোধ, জনতুষ্ঠকারী ধর্মতত্ত্ব এবং ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের এর শূন্যস্থান পূজারী নামের যৌথ শত্রুর মুখোমুখি।
জীবাশ্ম রেকর্ডে ‘শূন্যস্থানগুলো’র সাথে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের প্রেম তাদের পুরো শূন্যস্থান পূজারী ধর্মতত্ত্বের প্রতীক। আমি একবার ক্যামব্রিয়ান পর্বেও জীবনের বৈচিত্রের বিস্ফোরণ নিয়ে একটি অধ্যায় শুরু করেছিলাম এই বাক্যটি দিয়ে: ‘যেন বিবর্তনের কোনো ইতিহাস ছাড়াই জীবাশ্মগুলো সেখানে কেউ সাজিয়েছে রেখেছে। ‘কিন্তু, সেটা ছিল একটি অধ্যায় সুচনা করার লক্ষ্যে ভাষার আড়ম্বরপূর্ণ ব্যবহার, যার উদ্দেশ্য ছিল পাঠকের কৌতূহল আর জানার তৃষ্ণাকে জাগিয়ে তোেলা পুরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবার আগে। বিষক্ষভাবে এখন ভাবছি, কত বেশী সহজ ছিল ব্যপারটা বোঝা যে, সেখান থেকে উৎসাহী চতুরতার সাথে আমার বর্ণিত বিস্তারিত ব্যাখ্যাটি সযত্নে ছেটে ফেলে দেয়া হবে আর অপ্রাসঙ্গিকভাবে আনন্দের সাথে উদ্ধৃতি দেয়া হবে ভুমিকার সেই ছোট বাক্যটিকে তাদের নিজস্ব মতাদর্শকে সমর্থনের লক্ষ্যে। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা জীবাশ্ম রেকর্ডে ‘শূন্যস্থান’ দারুণ ভালোবাসে, যেমন সাধারণত যে কোনো জ্ঞানের শূন্যস্থানগুলো তাদের খুব পছন্দের।
অনেক বিবর্তনীয় পরিবর্তন অসাধারণ সুন্দরভাবে কম বেশী অবিচ্ছিন্ন এবং ক্রমান্বয়ে ধীরগতিতে পরিবর্তন হওয়া ক্রান্তিকালীন জীবাশ্মগুলোর মাধ্যমে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। কিছু আবার নেই, এবং সেটাই সেই বিখ্যাত শূন্যস্থান। মাইকেল শেরমার তার তীক্ষ্ম বুদ্ধির সাথে মন্তব্য করেছিলেন, যদি নতুন কোনো জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়, যা ঠিক মাঝখান থেকে কোনো জীবাশ্মের শূন্যস্থানকে দ্বিধাবিভক্ত করে, তারপরও সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা ঘোষণা দিতে দ্বিধা করবে না যে, এখন এখানে তাহলে দ্বিগুণ শূন্যস্থান! যাই হোক না কেন, লক্ষ করুন সেই আবারো প্রচলিত ধারণার অযাচিত ব্যবহার। যদি প্রস্তাবিত বিবর্তনীয় পরিবর্তনের কোনো জীবাশ্ম না পাওয়া যায়, সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের গতানুগতিক ধারণাটি হলো, কোনো বিবর্তনীয় পরিবর্তন হয়নি, সুতরাং ঈশ্বর নিশ্চয়ই কোনো হস্তক্ষেপ করেছেন।
বিবর্তন বা বিজ্ঞান, যেটাই হোক না কেন, এর কোনো কিছুর ব্যাখ্যার প্রতিটি ধাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রমাণ দাবী করাটা হবে পুরোপুরি অযৌক্তিক; এরকম দাবী করার মানে যেন, কাউকে খুনী হিসাবে অভিযুক্ত করার জন্য চলচ্চিত্রের মতো সম্পূর্ণ ঘটনাটির, অর্থাৎ হত্যা করার আগে খুনির প্রতিটা পদক্ষেপের রেকর্ড উপস্থিত করার জন্য দাবী করা, যেখানে একটা ফ্রেমও বাদ পড়া চলবে না। সমস্ত জীব মৃতদেহর অতি ক্ষুদ্র এটা অংশ আসলে জীবাশ্মীভুত হয়েছে, আমরা আসলেই ভাগ্যবান, যতটুকু পাওয়ার কথা ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশী অন্তবর্তীকালীন প্রাণীদের জীবাশ্ম আমরা খুঁজে পেয়েছি। কোনো জীবাশ্ম না পাওয়ার সম্ভাবনাই তো ছিল বেশী, কিন্তু তারপরও বিবর্তনের প্রমাণ আমরা পেতাম অন্য উৎস থেকে, যেমন আণবিক জিনতত্ত্ব এবং প্রজাতিদের ভৌগলিক বিস্তার বা বায়োজিওগ্রাফী থেকে, এবং সেগুলোই এককভাবেই যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। অপরদিকে বিবর্তন দৃঢ়ভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করছে যদি একটা জীবাশ্মও ভুত্বকের কোনো প্রস্তাবিত স্তর ছাড়া অন্য কোনো ভুল স্তরে পাওয়া যায়, পুরো তত্ত্বই আসলে ভিত্তিহীন হয়ে যাবে। জে. বি. এস. হলডেনকে (২৬) যখন একজন অতি উৎসাহী পপারীয় (২৭) চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বলতে, কিভাবে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করা যেতে পারে, তিনি তার বিখ্যাত গর্জন করে বলেছিলেন, প্রি-ক্যামব্রিয়ান স্তরে যদি খরগোশের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া যায়। এ ধরনের কোনো সময়-বিপরীত জীবাশ্ম আজও প্রকৃত অর্থেই খুঁজে পাওয়া যায়নি, যদিও সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের কয়লার স্তরে মানুষের খুলি বা ডায়নাসরদের সাথে মানুষের পায়ের চিহ্ন পাওয়ার বানোয়াট কাহিনী সত্ত্বেও।
শূন্যস্থানগুলো সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের মনে প্রথাসিদ্ধভাবে কেবল ঈশ্বর পূরণ করেন। একই নীতি প্রয়োগ করা হয় সেই অসম্ভাব্যতার পর্বত চুড়ায় ওঠার আপাতদৃষ্টিতে সেই খাড়া উঁচু পাশটির ক্ষেত্রে, যেখানে ধীরে ধীরে চুড়ায় ওঠার ঢালটি সাথে সাথে চোখে পড়ে না কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে উপেক্ষা করা হয়। যে সমস্ত ক্ষেত্রে উপাত্তের ঘাটতি আছে বা বোঝার এখনও ঘাটতি আছে, সেই জায়গাগুলো বিনাবাক্য ব্যয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঈশ্বরের কৃপায় ছেড়ে দেয়া হয়। খুব দ্রুত নাটকীয়ভাবে কোনো কিছুকে ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি বা অবিভাজ্য জটিলতা দাবী করে ঘোষণা দেয়ার এই আশ্রয় নেয়ার কৌশল তাদের কল্পনাশক্তির অভাবকেই ইঙ্গিত করে। কিছু জৈব অঙ্গ, যদি চোখ না হয়, তাহলে বাকটেরিয়া ফ্ল্যাজেলার মটর বা কোনো জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া, কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা কিংবা যুক্তি ছাড়াই অবিভাজ্যভাবে জটিল বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কোনো ‘প্রচেষ্টাই করা হয়না এই জটিলতাকে ব্যাখ্যা দেবার জন্য। চোখ, পাখা এবং আরো অনেক কিছুর সতর্কতামূলক কাহিনী সত্ত্বেও এই সন্দেহজনক প্রশংসার প্রতিটি নতুন প্রার্থীকে সুস্পষ্টভাবে স্বপ্রমাণিত অবিভাজ্য জটিলতা হিসাবে ধরে নেয়া হয়, এবং এর উপর সেই পদমর্যাদা আরোপিত করা হয়, যেন কোন ঐশী ডিক্রি বা ফিয়াট এর মাধ্যমে (২৮) এর সৃষ্টি; কিন্তু ব্যপারটা একটু ভেবে দেখুন। যেহেতু অসরলযোগ্য জটিলতা ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজাইনের পক্ষে একটি জোরালো যুক্তি হিসাবে, সুতরাং ডিজাইন এর চেয়ে কিন্তু এটি বেশী ফিয়াট বা ডিক্রির দাবী করতে পারেনা। এর চেয়ে আপনি বরং সরাসরি আরোপ করে দাবী করুন, যে উইজেল ব্যাঙ ডিজাইনের চিহ্ন বহন করে (বোমবার্ডিয়ার বীটল ইত্যাদি) কোনো যুক্তি বা সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই, কিন্তু সেটা বিজ্ঞানের পথ নয়।
এবং দেখা যায় যুক্তিও বেশী বিশ্বাসযোগ্য হয়না এর চেয়ে যেমন: আমি (এখানে নিজের নাম যোগ করুন) ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করে আর কোনো উপায় দেখছি না, যে কিভাবে ধাপে ধাপে (এখানে কোনো বায়োলজিকাল ফেনোমেনার বা ঘটনা বা বৈশিষ্ট্যের নামটি যোগ করুন) তৈরী হতে পারে। সুতরাং এটি অবিভাজ্যভাবে জটিল। এর মানে হচ্ছে এটি ঈশ্বর পরিকল্পিত বা ডিজাইন করা। এভাবে আপনি বিষয়টি প্রকাশ করে দেখুন এবং তাৎক্ষণিকভাবে আপনি দেখতে পাবেন এটি কোনো বিজ্ঞানীর একটি অন্তবর্তীকালীন রুপ খুঁজে বের করা বা অন্ততপক্ষে কল্পনা করার ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে। এমনকি যদি কোনো বিজ্ঞানী কোনো ব্যাখ্যা নিয়ে এগিয়ে না আসেনও, শুধুমাত্র কোনো কিছুকে ‘ডিজাইন’ মনে করার বাজে যুক্তির কারণে এটি কোনো সুবিধা করতে পারবে না। ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন ভিত্তির যুক্তি অলস এবং পরাজয়বাদী– সেই প্রথাগত ‘শূন্যস্থান পূর্ণ করা ঈশ্বরের’ যুক্তি। আমি অতীতে এটিকে নাম দিয়েছিলাম ব্যক্তিগত অবিশ্বাস থেকে আসা যুক্তি।
কল্পনা করুন আপনি আসলেই একটি অসাধারণ ম্যাজিক কৌশল দেখছেন। যাদুকর জুটি পেন এবং টেইলর-এর একটা প্রচলিত জাদু ছিল, তারা একই সাথে মঞ্চে এসে একে অপরকে পিস্তল দিয়ে গুলি করবেন এবং দুজনেই সেই বুলেট দাঁত দিয়ে আটকে দেবেন। প্রথমেই বেশ সতর্কতার সাথে দুটি বুলেটে শনাক্তকারী চিহ্ন দেয়া হয় পিস্তলে ঢোকানোর আগে, পুরো প্রক্রিয়াটা কাছ থেকে দেখানো হয় দর্শকদের মধ্য থেকে নেয়া স্বেচ্ছাসেবকদের যাদের আগ্নেয়াস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান আছে এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সব ধরনের ছলচাতুরীর সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। দেখা গেল টেলারের দাগ দেয়া বুলেট পেনের মুখে, পেনের দাগ দেয় বুলেট টেলারের মুখে; আমি (রিচার্ড ডকিন্স) সম্পূর্ণভাবে অন্য কোন উপায় কিন্তু ভাবতে পারছি না, এটা যে একটা চালাকি হতে পারে। ব্যক্তিগত অবিশ্বাস থেকে আসা যুক্তি আমার প্রাকবৈজ্ঞানিক মস্তিস্কেও কেন্দ্র থেকে চিৎকার করে বলছে এবং আমাকে প্রায় বাধ্যও করেছে বলতে যে, এটা তো একটি অলৌকিক ঘটনা, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, এটি অতিপ্রাকৃত হতে বাধ্য। কিন্তু আমার মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষুদ্র একটি আওয়াজ বলছে অন্য কথা। পেন এবং টেইলার বিশ্বসেরা জাদুকর জুটি। নিশ্চয়ই এর একটা সঠিক ভালো ব্যাখ্যা আছে। আমি শুধু এ বিষয়ে কম জানি বা বেশী ভালো করে লক্ষ করিনি বা কল্পনাশক্তির দুর্বলতার কারণে বিষয়টি ভেবে উঠতে পারছি না এই যা। এটাই জাদুকরী কোনো কৌশলের উচিৎ জবাব হতে পারে। এবং এটিও জীববিজ্ঞানের নানা প্রাকৃতিক ঘটনার, যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ইরিডিউসিবল কমপ্লেক্স তার ক্ষেত্রেও সঠিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। যে মানুষগুলো প্রাকৃতিক কোনো ঘটনার প্রতি ব্যক্তিগত হতভম্বতা থেকে দ্রুত অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যার শরণাপন্ন হন, তারা ঐসব নির্বোধদের তুলনায় কোনো অংশেই কম, যারা এই ধরনের জাদুকরদের চামচ বাকাতে দেখে এবং এদের ‘প্যারানর্মাল’ বা ‘অতিপ্রাকৃত’ বলে আখ্যা দেন।
স্কটিশ রসায়নবিদ এ. জি. কেয়ার্ন স্মিথ (২৯) তাঁর ‘সেভেন ক্লস টু অরিজিন অফ লাইফ’ বইটিতে একটি আর্চ বা খিলানের উদাহরণ ব্যবহার করে আরো একটি অতিরিক্ত বিষয় উল্লেখ করেছিলেন, অমসৃনভাবে কাটা পাথর দিয়ে তৈরী, কোনো সিমেন্ট ছাড়া, স্বাধীনভাবে দাঁড়ানো কোনো খিলান কিন্তু একটি ভারসাম্যপূর্ণ স্থায়ী স্থাপনা হতে পারে; তবে এটি ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্স বা অবিভাজ্যভাবে জটিল, কারণ একটা পাথর যদি মূল কাঠামো থেকে সরানো হয় তবে পুরো আর্চটাই ধ্বসে পড়বে। তাহলে প্রথমেই বা এটা কিভাবে তৈরী হলো। একটা উপায় হলো একসাথে অনেকগুলো পাথর একসাথে জড়ো করে একটা একটা করে পাথর সরানো। সাধারণত এমন অনেক কাঠামোর উদাহরণ আছে তারা অসরলযোগ্য সেই অর্থে যে, এদের কোনো অংশ বাদ দিলে এটি আর তার কাঠামোগত ঐক্য টিকিয়ে রাখতে পারেনা। কিন্তু তারা তৈরী হয়েছিল একটি কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই, যা পরবর্তীতে সরিয়ে ফেলা হয় এবং এখন যা আর দৃশ্যমান নয়। বিবর্তনেও একই ঘটনা ঘটে, কোনো অঙ্গ বা কোনো স্ট্রাকচার যা আপনি দেখছেন তারও এমন একটি কাঠামো হয়তা ছিল তার পূর্বসূরি প্রাণীদের শরীরে, যা এর পরবর্তী প্রজন্মে অপসারিত হয়েছে।
ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি নতুন কোনো ধারণা নয়, কিন্তু এই শব্দটি আবিষ্কার করেছেন সৃষ্টিতত্ত্ববাদী বিজ্ঞানী মাইকেল বিহি (৩০) ১৯৯৬ সালে (৩১)। তাকে কৃতিত্ব দেয়া হয় (অবশ্য যদি কৃতিত্ব এখানে সঠিক শব্দ হয়ে থাকে) সৃষ্টিতত্ত্ববাদকে জীববিজ্ঞানের নতুন শাখার দিকে নিয়ে যাবার জন্য, তা হলো: প্রাণরসায়ন এবং কোষ বিজ্ঞান, সম্ভবত তার দৃষ্টিতে চোখ কিংবা পাখার চেয়ে এই ক্ষেত্রগুলোয় শূন্যস্থান বা গ্যাপ শিকার করা বেশ সহজ মনে হয়েছিল। ভালো উদাহরণ হিসাবে তার সেরা প্রচেষ্টা (যদিও খারাপ একটা উদাহরণ) হলো ব্যাক্টেরিয়ার ফ্ল্যাজেলার মটর।
প্রকৃতির একটি অসাধারণ উদ্ভাবনী শক্তির নমুনা হলো ফ্ল্যাজেলার মটর। মানুষের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি বাদ দিলে, এটি প্রকৃতিতে আমাদের জানা একটি মাত্র উদাহরণ, যা স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারে এমন একটি অ্যাক্সল (Axle) বা অক্ষুদণ্ডে গতি সঞ্চার করে। আমার বরং মনে হয়, এর চেয়ে বড় আকারের প্রাণীদের জন্য গোলাকার চাকার উপস্থিতি হতে পারতো সত্যিকারে ইরিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি উদাহরণ, আর সম্ভবত এজন্যই প্রকৃতিতে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কেমন করেই বা স্নায়ু বা রক্ত নালী নানা ধরনের বিয়ারিং এর স্তর পার হতো (৩২)? ফ্লাজেলাম হলো সুতার মত একটি প্রপেলার, যার মাধ্যমে কিছু ব্যাক্টেরিয়া পানির মধ্যে চলাফেরা করে অনেকটা গর্ত খুড়ে খুড়ে, আমি গর্তে খুড়ে খুড়ে বলছি, সাঁতার বলছিনা, কারণ ব্যাক্টেরিয়ার পর্যায়ে তার অস্তিত্বে পানিকে আমাদের মত তরল মনে হবে না, তাদের কাছে মনে হবে, জেলী বা তরল গুড় বা এমন কি বালির মত কোনো মাধ্যম। এবং ব্যাক্টেরিয়ার মনে হবে সে তার মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ বা গর্ত করে চলাফেরা করছে, সাঁতার নয়। আরেকটু বড় কোনো জীবের ক্ষেত্রে ফ্লাজেলামের মত যেমন প্রোটোজোয়া, ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলাম চাবুকের মত ঢেউ তোলে না বা নৌকার দাঁড় টানার মত আচরণ করে না। সত্যি সত্যি এর একটি স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারে এমন অ্যাক্সল আছে, যা ক্রমাগত ভাবে ঘুরতে থাকে একটি বিয়ারিং সদৃশ জৈব কাঠামোর মধ্যে, এটিকে গতিশীল রাখে খুব ছোট একটি অসাধারণ মটর। আণবিক পর্যায়ে এই মটর মাংসপেশীর মত একই মূলনীতি ব্যবহার করে, তবে সবিরাম বা থেমে থেমে সংকোচনের বদলে এটি ঘুরতে পারে (ঘুর্ণনক্ষম) (৩৩); বেশ আনন্দের সাথে এটি বর্ণনা করা হয়েছ ক্ষুদ্র আউটবোর্ড মটর হিসাবে, যেমন, যান্ত্রিক নৌকার বাইরে থাকা ইঞ্জিনের মত ( যদিও প্রকৌশলগত দিক থেকে এবং ব্যতিক্রমী একটি জৈব সিস্টেম হিসেবেও এটি খুব বেশী মাত্রায় একটি অদক্ষ মটর)।
কোনো যুক্তিযুক্ত স্বাক্ষ্যপ্রমাণের একটি শব্দ ছাড়াই, ব্যাখ্যা বা বিস্তারিত কোনো আলোচনা ছাড়াই বিহি এটিকে এক কথায়। ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলার মটরটিকে অবিভাজ্যভাবে জটিল বলে দাবী করেছিলেন। দাবী করেছিলেন, যেহেতু তার দাবীর সপক্ষে তিনি কোনো যুক্তি দিতে পারেননি, আমরা শুরু করতে পারি, তার কল্পনাশক্তির ব্যর্থতা দিয়ে। তিনি আরো দাবী করেন, বিশেষায়িত জীববিজ্ঞানের গবেষণাপত্রগুলো নাকি ব্যপারটি উপেক্ষা করেছে; তার এই অভিযোগের অসত্যতা প্রমাণ করতে বিহির জন্য ভয়াবহ রকম বিব্রতকর বিশালকায় প্রমাণ সম্ভার পেনসিলভ্যানিয়ায়। ২০০৫ সালে বিচারপতি জন ই. জোনস এর আদালতে দাখিল করা হয়েছিল, যেখানে বিহি একজন বিশেষজ্ঞ সাক্ষী ছিলেন একটি ক্রিয়েশনিষ্ট বা সৃষ্টিতত্ত্ববাদী মতবাদী গ্রুপের পক্ষে, যারা স্থানীয় পাবলিক স্কুলের বিজ্ঞান কারিকুলামে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন মোড়কে সৃষ্টিতত্ত্ববাদকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। বিচারপতি জোনস এর ভাষায় তাদের সেই পদক্ষেপ হচ্ছে, অবিশ্বাস্যরকম নির্বুদ্ধিতার একটি পদক্ষেপ (বিচারপতি জোনস এর এই বাক্য এবং তিনি নিজেও নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন); এই বিচারের সময়ই শুধু বিহি এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়েননি, আমরা অচিরেই তা দেখবো।
কোনো কিছুকে অবিভাজ্য জটিল হিসাবে প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, প্রমাণ করে দেখানো যে, এর আলাদা আলাদাভাবে কোনো অংশই একক ভাবে কর্ম উপযোগী নয় বা তারা এককভাবে কোনো কাজ করতে পারেনা। এদের এককভাবে কাজ করার পূর্বশর্ত হলো, তাদের প্রত্যেকটি অংশকে এক জায়গায় জড়ো হতে হবে (বিহির প্রিয় উদাহরণ ছিল মাউস ট্রাপ); বাস্তবে আণবিক জীববিজ্ঞানীদের বেশী পরিশ্রম করতে হয়নি প্রমাণ করে দেখাতে যে, পুরো একটি একক ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারা এর নানা অংশগুলোকে, যেমন ফ্ল্যাজেলার মটর এবং বিহির অন্যান্য অসরলযোগ্য জটিল হিসাবে দাবী করা উদাহরণের ক্ষেত্রে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী কেনেথ মিলার ভালো বলেছিলেন, “আমি যদি বাজি রাখতে চাই, তবে এটাই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের সবচেয়ে সফল প্ররোচনাদায়ী শত্রু’, সবচেয়ে কম না কারণ তিনিও একজন নিবেদিত প্রাণ খ্রিষ্টান। আমি প্রায়ই ধর্মবিশ্বাসীদের মিলারের বই পড়ার জন্য উপদেশ দেই, যারা নিজেদের বিহির ধোকাবাজির শিকার বলে মনে করেন, যেমন, ‘ফাইণ্ডিং ডারউইনস গড’।
ব্যাকটেরিয়ার ঘুর্ণনক্ষম বা রোটারী ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে, মিলার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আরেকটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি, টাইপ থ্রি সিক্রেটরি সিস্টেম বা TTSS (Type Three Secretory System) এর প্রতি। টাইপ থ্রি সিক্রেটরি সিস্টেম বা টিটিএসএস ঘূর্ণায়মান কোনো গতি সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়না। (৩৪)। এটি পরজীবি ব্যাকটেরিয়াদের ব্যবহার করা অনেকগুলো পদ্ধতির একটি, যা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে বিষাক্ত পদার্থ তাদের শরীর থেকে ক্ষতির উদ্দেশ্যে পোষকের শরীরে মধ্যে তাদের কোষপর্দার মধ্য দিয়ে পাম্প করে বের করে দেবার জন্য। মানুষের মাত্রায় ভাবলে, আমরা ভাবতে পারি, কোনো ছিদ্রর মধ্য দিয়ে তরল কিছু ঢেলে দেয়ার মত বা চেপে ঠেলে বের করে দেবার মত কোনো পাম্প। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার পর্যায়ে বিষয়টি অন্যরকম, নিঃসরিত প্রতিটি অণু আকারে এবং ত্রিমাত্রিক গঠনে টিটিএসএস এর অণুদের মতই: বলা হয় ঘণ একটি কাঠামোর অণু, তরল নয়; প্রতিটি অণু এককভাবে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করে বাইরে বের করে দেয়া হয়, যেন স্বয়ংক্রিয় কোনো স্লট মেশিন, যা খেলনা বা বোতল সরবরাহ করে। সুতরাং সাধারণ কোনো ছিদ্র তারা যার মধ্য দিয়ে কোনো অণু ‘প্রবাহিত হয় শুধু। কোষীয় দ্রব্য-সরবরাহকারী নিজেই অনেক ছোট ছোট প্রোটিন অণু দিয়ে তৈরী, প্রত্যেকটির আকারে এবং গঠনগত জটিলতায় তারা যে অণুগুলো কোষের ভিতর থেকে বাইরে সরবরাহ করে, তাদের সমতুল্য। মজার ব্যপার হলো, ব্যাকটেরিয়াদের এই স্লট মেশিনগুলো কখনো কখনো সম্পর্কযুক্ত নয় এমন ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে প্রায় একই রকম দেখা যায়। তাদের তৈরী করার জিন যেন, কপি এবং পেষ্ট করা হয়েছে অন্য ব্যাকটেরিয়া থেকে: যে কাজটা করতে ব্যাকটেরিয়া অত্যন্ত দক্ষ, সেটা নিজ অধিকারেই একটা অসাধারণ বিষয়, তবে আমার অন্য বিষয় বলা তাড়া আছে।
টিটিএসএস তৈরী করে যে প্রোটিন অণুগুলো তারা ব্যাকটেরিয়ার ফ্ল্যাজেলার মটরের নানা গঠন উপাদানের সাথে সদৃশ্যতা বহন করে। বিবর্তনবাদীদের কাছে সুস্পষ্ট যে টিটিএসএস এর নানা অংশগুলো, একটা নতুন, তবে পুরোপুরি না, খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে পুরোপুরি অন্য কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছে, যখন ফ্ল্যাজেলার মটরটি বিবর্তিত হয়েছিল। যখন টিটিএসএস টাগিং বা কোনো অণুকে টেনে নেয় নিজের ভিতর থেকে, তখন (বিস্মিত হবার তেমন কোনো কারণ নেই যে) এটি ফ্ল্যাজেলার মটরের ব্যবহার করা মূলনীতির একটি আদি সংস্করণ ব্যবহার করে, যা অ্যাক্সল বা অক্ষদণ্ড হিসাবে কাজ করা অণুটিকে টেনে ধরে ঘোরাতে থাকে। স্পষ্টতই, ফ্ল্যাজেলার মটরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আগে থেকেই সেখানে কর্মক্ষম ছিল ফ্ল্যাজেলার মটর বিবর্তিত হবার আগে। বিদ্যমান কোনো প্রক্রিয়াকে ভিন্ন কাজের জন্য পুননির্দেশনা দেয়া আপাতদৃষ্টিতে অবিভাজ্য জটিল কোনো যন্ত্রের অসম্ভাব্যতার পাহাড় চূড়ায় উঠার একটি সুস্পষ্ট উপায়।
অনেক বেশী কাজ করার প্রয়োজন আছে অবশ্যই, আমি নিশ্চিৎ সেই গবেষণা হবে। এধরনের কাজ কখনোই শেষ হবে না, যদি বিজ্ঞানীরা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্ব যে অলস ডিফল্ট অবস্থান নেবার জন্যে প্ররোচিত করে তাতে সন্তুষ্ট না হন। একজন কাল্পনিক ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তাত্ত্বিকের বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত বার্তা হতে পারে এমন: ‘আপনি যদি না বুঝতে পারেন কিভাবে কোন কিছু কাজ করছে, কোন অসুবিধা নেই: সাথে সাথে সেটি বোঝার সব চেষ্টা ছেড়ে দিতে হবে এবং বলতে হবে ঈশ্বরের কাজ এটি। আপনি জানেন না স্নায়ু সংকেত কিভাবে কাজ করছে? ভালো, আপনি জানেন না, আমাদের মস্তিস্কে স্মৃতি কিভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে। চমৎকার! সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া খুবই জটিল? দারুণ, দয়া করে সমস্যা সমাধান করার দরকার নেই, হাল ছেড়ে দিন, তার চেয়ে বরং ঈশ্বরের কৃপা ভিক্ষা করুন। প্রিয় বিজ্ঞানীগন দয়া করে আপনাদের অজানা রহস্য নিয়ে কাজ করার কোন দরকার নেই, বরং আমাদের কাছে আপনার রহস্যগুলো নিয়ে আসুন, কারণ আমরা তা ব্যবহার করতে পারবো। খামোকা গবেষণা করে মূল্যবান অজ্ঞতার অপচয় করা থেকে বিরত থাকুন। ঈশ্বরের শেষ ভরসা হিসাবে এইসব মহান শূন্যস্থানগুলো আমাদের প্রয়োজন। সেন্ট অগাষ্টিন কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই বলেছেন, “আরো এক ধরনের প্রলোভন আছে, আরো বেশী বিপদসঙ্কুল, সেটা হচ্ছে কৌতূহলের অসুখ, এটাই প্রকৃতির গোপন রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করতে আমাদের পরিচালনা করে, যে গোপন রহস্য আমাদের বোধের বাইরে, যা আমাদের কোনো কাজে আসেনা, মানুষের যা শেখার আকাঙ্খা করাও উচিৎ না’ (৩৫)।
ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটির ক্ষেত্রে বিহির অন্য আরেকটি প্রিয় উদাহরণ হলো আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ তন্ত্র। বিচারপতি জোনস এর ভাষায় সেই কাহিনী শোনা যাক:
‘প্রকৃতপক্ষে, পাল্টা প্রশ্নোত্তর পর্বের সময় অধ্যাপক বিহি ১৯৯৬ সালে তার করা দাবী, বিজ্ঞান কখনোই রোগ প্রতিরোধ তন্ত্রের বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা দিতে পারবে না, বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তাকে ৫৮টি পিয়ার রিভিউ প্রকাশনা, নয়টি বই এবং বেশ কয়েকটি ইমিউনোলজীর পাঠ্যপুস্তকের অধ্যায় দেখানো হয়েছিল আমাদের ইমিউন সিস্টেমের বিবর্তনের ব্যাখ্যা হিসাবে। কিন্তু তিনি শুধু দাবী করেন, এগুলো বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ হিসাবে যথেষ্ট যেমন না, যেমন তেমনি শক্তিশালীও না।
বিহি, পাল্টা প্রশ্নোত্তর পর্বে, বাদীপক্ষের প্রধান কৌশুলী এরিক রথসচাইল্ডের প্রশ্নের উত্তরে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি সেই ৫৮টি গবেষণা পত্রের বেশীর ভাগই পড়েননি। অবশ্য এটি বিস্ময়কর না, কারণ ইমিউনোলজী অনেক কঠিন পরিশ্রমের ব্যপার। একারণে বিহির অবজ্ঞাসূচক ‘অর্থহীন’ বলে এসব গবেষণা প্রত্যাখ্যান করা আরো বেশী ক্ষমার অযোগ্য। এটা অবশ্যই অর্থহীন, সত্যিকারের পৃথিবী সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের বদলে যদি আপনার লক্ষ্য থাকে সহজে বিশ্বাসপ্রবণ সাধারণ মানুষ এবং রাজনীতিবিদদের পক্ষে প্রচারণা চালানো; বিহির কথা শোনার পর, রথসচাইল্ড সুন্দরভাবে পুরো ব্যপারটার সারাংশ করেন যা সেদিন সেই আলাদতে উপস্থিত সকল নীতিবান মানুষই হৃদয়ে অনুভব করেছিলেন:
আমাদের সৌভাগ্য এবং আমরা কৃতজ্ঞ যে কিছু বিজ্ঞানী আছেন যারা ইমিউন সিস্টেমের উৎপত্তির প্রশ্নের উত্তরটি খোঁজার চেষ্টা করেছেন.. এটি আমাদের ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকর অসুখের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ, যে বিজ্ঞানীরা এই সব বই লিখেছেন, বা নিবন্ধ লিখেছেন তারা সবার চোখের অন্তরালেই পরিশ্রম করে গেছেন, বই এর জন্য বা বক্তৃতার জন্য কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই। তাদের পরিশ্রম আমাদের সহায়তা করেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং চিকিৎসা করতে। তার ঠিক বীপরিতে, অধ্যাপক বিহি এবং পুরো ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন আন্দোলন বিজ্ঞান বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে সামনে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে কোনো অবদানই রাখছেন না, এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের বলছেন, এসব নিয়ে মাথা না ঘামাতে (৩৬)।
আমেরিকার জিনতত্ত্ববিদ জেরী কয়েন (৩৭) বিহির বইটি সম্বন্ধে তার পর্যালোচনায় লিখেছিলেন,’যদি বিজ্ঞানের ইতিহাস আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে, তা হলো আমাদের অজ্ঞতাকে ‘ঈশ্বর’ হিসাবে চিহ্নিত করে আমরা কিছুই করতে পারবো না’, বা একজন বাঙময় ব্লগারের ভাষায়, গার্ডিয়ান পত্রিকায় কয়েন এবং আমার ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সম্বন্ধে একটি নিবন্ধে যিনি মন্তব্য করেছিলেন:
কেন ঈশ্বরকে সবকিছুর ব্যাখ্যা হিসাবে গণ্য করা হয়? এটি অবশ্যই তা নয়, এটি ব্যাখ্যা করার ব্যর্থতা, কাধ ঝাঁকানো একটি “আমি জানিনা’ যা কিনা নিজেকে সাজিয়েছে আধ্যাত্মিকতার পোষাক ও আচারের মাধ্যমে। কেউ যদি কোনো কিছুর জন্য ঈশ্বরকে কৃতিত্ব দিতে চান, সাধারণত এর অর্থ হলো তারা এ সম্বন্ধে কিছু জানেন না, সুতরাং তারা এর কারণ হিসাবে আরোপ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে, জানা অসম্ভব আকাশ পরীর উপর। এখন আপনি যদি ব্যাখ্যা দাবী করেন ঐ ভদ্রলোক কোথা থেকে আসলেন, খুব সম্ভবত এর উত্তর হিসাবে আমি একটা অস্পষ্ট মিথ্যা দার্শনিক উত্তর পাবেন তার চির অস্তিত্বময়তা বা প্রকৃতির বাইরে তার অবস্থান সম্বন্ধে যা অবশ্যই কোনো কিছুরই ব্যাখ্যা করেনা (৩৮)।
ডারউইনবাদ, আমাদের সচেতনাতাকে বৃদ্ধি করেছে অন্যভাবে; বিবর্তিত অঙ্গ, যারা অসাধারণ এবং দক্ষ সাধারণত যেমনটি হয়, তবে তাদের অনেক ক্রুটিও আছে, ঠিক যেমনটা আপনি আশা করতে পারেন, যখন কিনা তাদের কোনো বিবর্তনের ইতিহাস থাকে এবং যদি তাদের কেউ ডিজাইন করে থাকতো তাহলে আপনি এসব ত্রুটি আশা করতেন না। আমি বেশ কিছু উদাহরণটা আগেও আলোচনা করেছি অন্য বইতে যেমন একটি স্নায়ু, রিকারেন্ট ল্যারিঞ্জিয়াল নার্ভ, এটি যে নির্দিষ্ট অঙ্গকে স্নায়ুসংযোগ দেয়, সেই অঙ্গের প্রতি এর উৎস থেকে তার যাত্রাপথের অতিমাত্রায়, অপব্যায়ী ঘুরপথ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিবর্তনের ইতিহাস। আমাদের অনেকগুলো অসুস্থতা, পিঠের নীচের দিকে ব্যাথা বা ব্যাক পেইন থেকে হার্নিয়া, জরায়ুর বাইরের দিকে বের হয়ে আসা এবং আমাদের সাইনাস সংক্রমণের প্রবণতা এর সবকিছুর কারণ সরাসরিভাবে আমাদের দুই পায়ে হাঁটার বিষয়টি, আমরা এখন যে শরীরটা নিয়ে দুই পায়ে হাঁটছি তা শত মিলিয়ন বছর ধরে আকারে পেয়েছে চারপায়ে হাঁটার উপর নির্ভর করা শরীর থেকে। আমাদের সচেতনতা আরো বাড়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিষ্ঠুরতা এবং অপচয় রোধের প্রবণতা দেখে। শিকারী প্রাণী দেখলে মনে হয় তার শিকার প্রাণীটিকে ধরবার জন্য সুন্দরভাবে তাদের ডিজাইন করা হয়েছে, অন্যদিকে আবার শিকার হওয়া প্রাণীটি ঠিক সেই একই সুন্দরভাবে ডিজাইন করা, আক্রমণকারী শিকারী প্রাণীর কবল থেকে রক্ষা পাবার সকল উপায়সহ; তাহলে ঈশ্বর আসলেই কোন পক্ষে (৩৯)।
অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি: গ্রহ সংস্করণ
শূন্যস্থানবাদী ধর্মতাত্ত্বিকরা যারা চোখ এবং পাখা, ফ্ল্যাজেলার মটর এবং রোগ প্রতিরোধ তন্ত্রের উপর থেকে হাল ছেড়ে দিয়েছেন প্রায়শই তারা তাদের আশার শেষ আশ্রয় স্থল হিসাবে বেছে নেন জীবনের উৎপত্তির প্রশ্নটি। অজৈব রসায়নের বিবর্তনের সূচনালগ্ন যে কারণেই হোক না মনে হতে পারে পরবর্তীতে বিবর্তনের নানা পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট অন্তবর্তীকালীন শূন্যস্থানগুলোর চেয়ে আরো বড় কোনো শূন্যস্থান উপস্থাপন করছে। এবং একটি অর্থে এটি অপেক্ষাকৃত বড় একটি শূন্যস্থান। তবে সেই একটি অর্থ খুব নির্দিষ্ট, যা ধর্মবাদীদের কোনো সান্ত্বনার বাণী শোনায় না। জীবনের উৎপত্তি শুধু একবারই ঘটতে হবে। সেকারণে আমরা এই ঘটনাটিকে অতি মাত্রায় অসম্ভাব্য বলে মেনে নিতে পারি, আর এই অসম্ভাব্যতার মাত্রা বেশী ভাগ মানুষ যা অনুধাবন করেন তার চেয়েও বহুগুণ বেশী। আমি তা ব্যাখ্যা করবো। পরবর্তীতে বিবর্তনের ধাপগুলোর প্রতিলিপি হয়েছে, কম বেশী একই ভাবে, লক্ষ কোটি প্রজাতির মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে ক্রমাগতভাবে যার পুনরাবৃত্তি হয়েছে সময়ের ধারাবাহিকতায়। সুতরাং জটিল জীবনের বিবর্তন ব্যাখ্যা করতে আমরা একই ধরনের পরিসংখ্যানগত যুক্তির আশ্রয় নিতে পারিনা, যা আমরা জীবনের উৎপত্তির ক্ষেত্রে গ্রহন করি। যে ঘটনাগুলো সাদামাটা আটপৌরে বিবর্তনের অংশ, সেগুলো এর একক উৎপত্তি বা সুচনালগ্ন থেকে ভিন্ন ( এবং হয়ত কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে) এবং যা খুব বেশী অসম্ভাব্য হতে পারেনা।
দুটির মধ্যে এই পার্থক্য বেশ ধাঁধার মত মনে হতে পারে, আমি অবশ্যই ব্যাখ্যা দিবো, তথাকথিত অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল ব্যবহার করে (৪০); অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপালটির নামকরণ করেছিলেন ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ব্র্যান্ডন কার্টার (৪১) ১৯৭৪ সালে এবং এর একটি বর্ধিত আকার দেন পদার্থবিজ্ঞানী জন বারো (৪১) এবং ফ্র্যাঙ্ক টিপলার (৪২) এ বিষয়ে তাদের প্রকাশিত একটি বইয়ে (৪৪); অ্যানথ্রোপিক যুক্তি সাধারণত কসমস বা মহাজগত এর প্রেক্ষিতে আরোপিত হয়, পরে সেখানে আসছি; কিন্তু আপাতত এখানে আমি সেই ধারণাটিকে খানিকটা ক্ষুদ্র পরিসরে উপস্থাপনা করবো, একটি গ্রহের পরিসরে। এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্ব, সুতরাং পৃথিবী এমন একটি গ্রহ, যার ক্ষমতা আছে আমাদের সৃষ্টি এবং প্রতিপালন করার, তা সে যত বেশী অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র গ্রহই হোক না কেন। যেমন, আমাদের মত জীবন, তরল পানি ছাড়া বাঁচতে পারেনা, আসলেই এক্সোবায়োলজীর বিশেষজ্ঞরা যারা ভীনগ্রহের জীবনের সন্ধান করছেন, তারা মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করছেন মূলত পানির সন্ধানে। সাধারণ একটি তারা, যেমন, আমাদের সূর্য, এর চারপাশে আছে সেই তথাকথিত ‘গোল্ডিলকস জোন’ যা খুব বেশী গরমও না আবার খুব শীতলও না বরং কোনো গ্রহে তরল পানির অস্তিত্ব থাকার জন্য ঠিক যতটুক দরকার (৪৫)। সুর্যের চারপাশে একটি অপ্রশস্ত কক্ষপথ আছে, সূর্য থেকে যা খুব বেশী দূরে না, যেখানে পানি বরফে রুপান্তরিত হয়, আবার খুব কাছেও না যেখানে পানি গরমে ফুটতে থাকবে, এই দুইয়ের মাঝখানে।
ধারণা করা হয়, জীবন বান্ধব কোনো কক্ষপথকে হতে হবে প্রায় বৃত্তাকার। একটি অতিমাত্রায় উপবৃত্তাকার কক্ষপথ, যেমন, নতুন আবিষ্কৃত দশম গ্রহ, যার বেসরকারী নাম জেনা, এই গল্ডিলকস জোনের মধ্যে আসার সুযোগ করে দেয় পৃথিবীর সময়ে বেশ কয়েক দশকে বা শতাব্দীতে একবার; জেনা নিজে কিন্তু গোল্ডিলকস জোনে মোটেও ঢুকতে পারেনা এমন সুর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি আসার সময়ও, যা এটি প্রতি ৫৬০ বছর পৃথিবীর হিসাবে) পর পর পৌঁছাতে পারে। হ্যাঁলীর ধূমকেতুর তাপমাত্রার তারতম্য হয়, যেমন পেরিহেলিওনে (৪৬) ৪৭ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে এপহেলিওনে (৪৭) মাইনাস ২৭০ ডিগ্রী। পৃথিবীর কক্ষপথও, অন্য সব গ্রহের মত টেকনিক্যালি উপবৃত্তাকার (জানুয়ারীতে এটি সুর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি এবং জুলাইতে এটি সবচেয়ে দূরে থাকে (আপনার যদি ব্যপারটা অবাক লাগে, তাহলে আপনি নিঃসন্দেহে উত্তর গোলার্ধের অতিআত্মমন্যতায় ভুগছেন); কিন্তু বৃত্ত হচ্ছে উপবৃত্তের একটি বিশেষ রুপ, আর পৃথিবী কক্ষপথ, বৃত্তাকারের এত কাছাকাছি এটি কখনোই গোল্ডিলকস জোনের বাইরে যায়না। সৌরজগতে পৃথিবী নানা ভাবে এত বেশী অনুকূল একটি অবস্থানে, যেন জীবনের বিবর্তনের জন্য এটিকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বিশাল জুপিটারের মধ্যাকর্ষনের ‘ভ্যাকুম ক্লিনার’টি ঠিক এমন জায়গায় অবস্থিত, কোনো গ্রহাণুকে এটি পৃথিবীর সাথে ভয়াবহ কোনো সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করে। আকারে অপেক্ষাকৃত বড় একটি উপগ্রহ, চাঁদ আমাদের পৃথিবীর ঘূর্ণনের অক্ষপথটি স্থিতিশীল রাখে এবং জীবনের প্রতিপালনে সহায়তা করে নানাভাবে (৪৮)। নক্ষত্রদের মধ্যে আমাদের সূর্য ব্যতিক্রম কারণ এটি বাইনারী নক্ষত্র না, যারা অপর একটি সঙ্গী নক্ষত্রের সাথে একই কক্ষপথে বন্দী; বাইনারী নক্ষত্রদের গ্রহ থাকা সম্ভব হতে পারে, তবে তাদের কক্ষপথ এতো গোলমেলে ভাবে বিচিত্র হবে, যা জীবন বিবর্তনের জন্য সহায়ক না।
আমাদের এই গ্রহের বিশেষভাবে জীবন বান্ধব হবার কারণ হিসাবে দুটি প্রধান ব্যাখ্যা প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিজাইন তত্ত্ব বলছে, ঈশ্বর তৈরী করেছেন এই পৃথিবী, এরপর এটি স্থাপন করেছেন গোল্ডিলকস জোনে এবং সুপরিকল্পিতভাবে বাকী সব বিষয়গুলো সাজিয়েছেন আমাদের সুবিধার কথা ভেবে। অ্যানথ্রোপিক দৃষ্টিভঙ্গিটি খুব আলাদা এবং এর একটা হালকা ডারউইনীয় ছোঁয়া আছে। মহাবিশ্বে বেশীর ভাগ গ্রহই তাদের সংশ্লিষ্ট তারাদের গোল্ডিলকস জোনে অবস্থান করে না এবং জীবনের জন্য উপযোগীও নয়। এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রহের ক্ষেত্রে কোথাও জীবনের অস্তিত্বও নেই। তবে অল্প কিছু গ্রহ আছে, যেখানে জীবনের বিবর্তনের জন্য উপযোগী পরিস্থিতি থাকতে পারে। আমরা অবশ্যই সেই অল্প কিছু গ্রহের একটি, কারণ আমরা এখানে থেকেই এই বিষয়টা নিয়ে ভাবছি।
অবাক একটি সত্য বিষয় হলো, ঘটনাক্রমে, সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি খুব ভালোবাসে। খুব অদ্ভুত কিছু বিচিত্র এবং অবোধ্য কারণে তারা মনে করেন এটি তাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করছে। কিন্তু ঠিক এর বিপরীতটাই সত্যি। অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতই ডিজাইন হাইপোথিসিসের একটি বিকল্প; এটি আমাদের একটি যৌক্তিক, ডিজাইনের ধারণা মুক্ত কোন ব্যাখ্যা দেয়, কেন এমন একটি পরিস্থিতিতে আমরা অবস্থান করছি, যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য অনুকুল। আমি মনে করি ধর্মীয় মানসিকতায় সংশয়টি ওঠার কারণ, অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি শুধু উল্লেখ করা হয় এমন সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে এবং প্রাসঙ্গিকতায় যা এটি সমাধান করতে পারে। যেমন, আমরা যে জীবনবান্ধব একটি জগতে বাস করছি সেই সত্যটায়। ধার্মিক মন যেটা বুঝতে ব্যর্থ হয় তা হলো, সমস্যাটির দুটি সম্ভাব্য সমাধান প্রস্তাব করা হয়েছে, ঈশ্বর হচ্ছে একটি, অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি হচ্ছে অপরটি। তারা একে অপরের বিকল্প।
আমরা জীবন বলতে যা বুঝি, তার জন্য তরল পানি অবশ্য প্রয়োজনীয়, তবে সেটি এককভাবে পূর্বশর্ত হিসাবে যথেষ্ট না। তারপরও জীবনের উৎপত্তি হতে হবে পানিতে, আর জীবনের উৎপত্তি হওয়াটা ছিল অতি অসম্ভাব্য একটি ঘটনা। এবং জীবনের একবার উৎপত্তি হবার পর ডারউইনীয় বিবর্তন তার খুশী মত কাজ করে গেছে জীবনের উপর; কিন্তু কিভাবে জীবনের সূচনা হয়েছিল? জীবনের উৎপত্তি ছিল একটি রাসায়নিক ঘটনা, বা ধারাবাহিক কতগুলো রাসায়নিক ঘটনা, যেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মূল উপাদানগুলোর প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল। প্রধান উপাদানটি হচ্ছে বংশগতি বা হেরেডিটি, যা হয় DNA বা (খুব সম্ভবত) এমন কিছু যা DNA এর মত বা তার চেয়ে কম নির্ভুলভাবে নিজেদের প্রতিলিপি বা কপি তৈরী করতে পারে, হয়ত এর সাথে সম্পর্কিত অণু DNA হতে পারে। একবার যখন এই এই প্রধান উপাদানটি কোনো এক ধরনের জিনগত অণু সৃষ্টি হয়েছে, সত্যিকারের ডারউইনীয় নির্বাচন এর উপর তার কাজ শুরু করে এবং এক সময় জটিল জীবনের উদ্ভব ঘটে এই প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে হঠাৎ করে বা বাই চান্স, প্রথম বংশগতি তথ্য বাহক কোনো একটি অণুর সৃষ্টি অনেকের কাছে মনে হতে পারে অসম্ভব একটি ঘটনা। হয়ত তাই, হয়ত এটা খুবই বেশী মাত্রায় অসম্ভাব্য এবং আমি এই বিষয়ে আরো খানিকটা আলোচনা করবো, কারণ বইটির এই অংশে এটাই মূল বিষয়।
যদিও এখনও ধারণা নির্ভর,তাসত্ত্বেও জীবনের উৎপত্তি ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা গবেষণার একটি ক্ষেত্র। এবং এই ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য যে দক্ষতাটি লাগবে, সেটি হল রসায়ন এবং যা আমার ক্ষেত্র নয়। আমি সাইড লাইনে বসেই অতি আগ্রহ নিয়ে। তাদের অগ্রগতি দেখছি। এবং আমি অবাক হবো যদি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দেন তারা ল্যাবরেটরীতে নতুন জীবনের উৎপত্তির ঘটনা ঘটাতে সক্ষম হন। যাইহোক সেটা এখনও ঘটেনি। এবং এখনও এটা ধারণা করা যায়, এটি ঘটার সম্ভাবনা এখন এবং সবসময়ই ছিল খুব বেশী ক্ষীণ-যদিও এটি একবার অবশ্যই ঘটেছিল।
গোল্ডিলকস কক্ষপথ নিয়ে আমরা যেমন ব্যাখা দিয়েছিলাম, আমরা প্রস্তাব করতে পারি যে, জীবনের উৎপত্তি, যতই অসম্ভব একটি ঘটনা হোক না কেন, আমরা জানি এটি পৃথিবীতে ঘটেছিল, কারণ আমাদের অস্তিত্ব এখানে। এবং আবারো কি হয়েছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য এখানে দুটি হাইপোথিসিস আছে: ডিজাইন হাইপোথেসিস এবং বৈজ্ঞানিক বা অ্যানথ্রোপিক হাইপোথিসিস। ডিজাইন দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করছে, একজন ঈশ্বর যিনি এই বিস্তারিত অলৌকিকতাকে নিজে হাতে গড়েছেন প্রিবায়োটিক বা প্রাক জীবনের স্যুপ বা জৈব মিশ্রণে তার স্বর্গীয় আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করেই ডিএনএ বা অন্য সমতুল্য কিছু সৃষ্টির মধ্য দিয়ে, পৃথিবীতে জীবনের অতি অসাধারণ যাত্রার সুচনা হয়েছিল।
আবার, গোল্ডিলকস এর মতই, ডিজাইন হাইপোথিসিসের বিকল্প অ্যানথ্রোপিক প্রস্তাবটিও পরিসংখ্যানগত। বিজ্ঞানীরা অনেক বড় সংখ্যার ম্যাজিকের অবতারণা করেন সেই সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করতে; অনুমান করা হয় যে, আমাদের ছায়াপথে প্রায় ১ বিলিয়ন থেকে ৩০ বিলিয়ন গ্রহ আছে এবং মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সী আছে; যদি কিছু শূন্যও বাদ দেয়া যায় পরিমাপের সাধারণ রক্ষণশীলতায়, তারপরও এক বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহের অস্তিত্ব আছে এই মহাবিশ্বে। এখন ধরুন, জীবনের উৎপত্তি, ডিএনএ সমতুল্য কোনো কিছুর স্বতঃস্ফুর্ত উৎপত্তি সত্যি অকল্পনীয় একটি অসম্ভাব্য ঘটনা, ধরা যাক ঘটনাটির অসম্ভাব্যতা এত বেশী যে, এটি প্রতি ১ বিলিয়ন গ্রহের কেবল একটিতে ঘটে; যে কোনো অনুদান সংস্থা হাসবে, যদি কোনো গবেষণার অনুদানপ্রার্থী কোনো রসায়নবিদ স্বীকার করেন যে, তার প্রস্তাবিত গবেষণার সফলতার সম্ভাবনা ১০০ তে একবার। আর আমরা এখানে কথা বলছি এক বিলিয়নে একবার ঘটা এমন কোন কিছুর সম্ভাবনা নিয়ে। এবং তারপরও এই অসম্ভব রকমের বিশাল সংখ্যায়, জীবনের উৎপত্তি হতে পারে ১ বিলিয়ন গ্রহে; এবং পৃথিবী, অবশ্যই যাদের মধ্যে একটি (৪৯)।
এই উপসংহারটি এত বিস্ময়কর, আমি আবার বলছি, যদি কোনো গ্রহে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে জীবনের উৎপত্তির সম্ভাবনা ১ বিলিয়নে ১ বার হয়, তারপরও সেই অদ্ভুত রকমের অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটবে মহাবিশ্বের ১ বিলিয়ন গ্রহে। তবে সেই ১ বিলিয়ন জীবন বহনকারী গ্রহ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার সেই প্রবাদ বাক্যটিকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের বেশী কষ্ট করার কোনো প্রয়োজন নেই সেই সূঁচ খোঁজার জন্য কারণ (আবার অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপালে ফেরত যাই); কারণ এমন কোনো জীব, যে কিনা এই খোঁজার যোগ্য, নিঃসন্দেহে তারা অবশ্যই সেকরমই একটি অতিমাত্রায় দূর্লভ সুইয়ের উপরে বসে আছে, এমনকি তাদের অনুসন্ধান শুরু হবার আগেই।
যে কোনো সম্ভাবনার প্রস্তাবনা করা হয় একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের অজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে। আমরা যদি কোনো একটি গ্রহ সম্বন্ধে কিছুই না জানি, তারপরও আমরা কিন্তু সেখানে জীবনের উৎপত্তি হবার সম্ভাবনা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারি, যেমন, এক বিলিয়নের মধ্যে একবার। কিন্তু যদি আমাদের পরিমাপে কিছু নতুন ধারণা বা তথ্য যোগ করতে পারি, এই সম্ভাবনারও পরিবর্তন হয়। কোনো একটি নির্দিষ্ট গ্রহের হয়ত কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেমন, কোনো বিশেষ কতগুলো মৌলের উপস্থিতি আছে এর পাথরে, যা জীবনের উৎপত্তির সম্ভাবনার পাল্লা ভারী করতে পারে। কিছু গ্রহ, অন্য ভাষায় বলা যায়, অন্য গ্রহদের তুলনায় বেশী ‘পৃথিবী সদৃশ’, পৃথিবী নিজে অবশ্যই বিশেষভাবে পৃথিবী সদৃশ। এই বিষয়টি আমাদের রসায়নবিদদের উৎসাহ দেয়া উচিৎ ল্যাবে কৃত্রিমভাবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য, এটি তাদের সফল হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু আমার আগের হিসাব দেখিয়েছে যে এমনকি একটি রাসায়নিক মডেল যার সফল হবার সম্ভাবনা এক বিলিয়নে একবার, সেটিও ভবিষ্যদ্বাণী করছে মহাবিশ্বে অন্ততপক্ষে এক বিলিয়ন গ্রহে জীবনের উৎপত্তি হবে; অ্যানথ্রোপিক মূলনীতির সৌন্দর্যটা হচ্ছে এটি আমাদের বলছে, সব অন্তর্জানের বিপরীত, একটি রাসায়নিক মডেলের শুধু ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে যে জীবনের উৎপত্তি হতে পারে এক বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহের কেবল একটিতে, যা আমাদের উত্তম এবং সম্পূর্ণভাবে সন্তোষজনক ব্যাখা দেবে এখানে জীবন উপস্থিতির। আমি এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করিনা, কোথাও জীবনের উৎপত্তি বাস্তবিকভাবে এতটাই অসম্ভাব্য। এবং আমি মনে করি, অবশ্যই ল্যাবরেটরিতে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার জন্য অর্থ ব্যয় করা যুক্তিসঙ্গত এবং একই কারণে SETI প্রজেক্টও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার উপযোগী,কারণ আমি মনে করি মহাবিশ্বে বুদ্ধিমান জীবনের সম্ভাবনা আছে।
এমনকি যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবনের উৎপত্তি হবার সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী সম্ভাবনার পরিসংখ্যানগত পরিমাপকে আমরা গ্রাহ্য করি, সেই পরিসংখ্যানগত যুক্তি, শূন্যস্থান পূর্ণ করার জন্য কোনো ধরনের পরিকল্পনাকারী বা ডিজাইনারের প্রস্তাবকে পুরোপুরি ধ্বংস করে। নিত্যদিনের সম্ভাবনার হার বা ঝুঁকি পরিমাপে অভ্যস্ত মস্তিস্কের জন্য বিবর্তনের কাহিনীতে সব আপাত শূন্যস্থানের মধ্যে জীবনের উৎপত্তি মনে হতে পারে অসমাধানযোগ্য একটি অসম্ভাব্যতা : যে স্কেলে বা পরিমাপের মাত্রায় কোনো গবেষণা অনুদানকারী কর্তৃপক্ষ রসায়নবিদদের প্রস্তাবিত গবেষণা প্রস্তাবগুলো যাচাই করে। তারপরও এমনকি এমন বড় কোনো শূন্যস্থান অনায়াসে পূর্ণ করে পরিসংখ্যানের জ্ঞানপুষ্ট বিজ্ঞান, অন্যদিকে সেই একই পরিসংখ্যানগত বিজ্ঞান কোনো স্বর্গীয় সৃষ্টিকর্তার সম্ভাবনা বাতিল করে দেয় পুর্বে উল্লেখিত সেই আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭ এর প্রেক্ষিতে।
কিন্তু আপাতত, এই সেকশনের শুরুর সেই কৌতূহলদ্দীপক বিষয়টিতে ফিরে আসা যাক। ধরা যাক কেউ জৈববৈজ্ঞানিক অভিযোজনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছেন ঠিক যেভাবে আমরা জীবনের উৎপত্তির ব্যাখ্যা করেছিলাম সেভাবে: বিশাল সংখ্যক গ্রহের বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি পর্যবেক্ষিত সত্য হচ্ছে যে প্রতিটি প্রজাতি এবং এই সব প্রজাতির মধ্যে প্রতিটি অঙ্গ, যাদের নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, দেখা গেছে তাদের যার যা কাজ সেই কাজে তারা খুবই দক্ষ। পাখির, মৌমাছি এবং বাদুড় এর পাখা ওড়ার জন্য চমৎকার। দেখার জন্য চোখ হচ্ছে পারদর্শী, উদ্ভিদের পাতারা দক্ষ সালোক সংশ্লেষণে। আমরা এমন একটা গ্রহে বাস করি, যেখানে আমাদের চারপাশে প্রায় ১০ মিলিয়ন প্রজাতি, প্রত্যেকেই স্বতন্ত্রভাবে আপাতদৃষ্টিতে বিশেষভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে একটি শক্তিশালী বিভ্রম সৃষ্টি করে। প্রতিটি প্রজাতি তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যময় জীবন যাপনের জন্য বিশেষভাবে দক্ষ। আমরা কি ‘বহু সংখ্যক গ্রহ আছে’ বলে যুক্তি দিয়ে এই সব আলাদা আলাদা ডিজাইনের বিভ্রমের ব্যাখ্যা এড়াতে পারবো। না, আমরা পারবো না, আবারও বলছি, পারবো না; এটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ডারউইনবাদ সম্বন্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার কেন্দ্রে অবস্থিত।
আমরা যে কোনো সংখ্যক গ্রহ নিয়ে বাজী খেলি না কেন, কিছুই আসে যায় না, ভাগ্য নির্ভর কোনো চান্স বা সুযোগ কখনোই যথেষ্ট হবেনা পৃথিবীর জীবনের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময়তা ব্যাখ্যা করার জন্য, যেমন করে আমরা যুক্তিটিকে ব্যবহার করি এখানে জীবনের অস্তিত্ব প্রথমে কেমন করে সৃষ্টি হলো– সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য। জীবনের বিবর্তন, জীবনের উৎপত্তি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, কারণ, পুনরাবৃত্তি করি, জীবনের উৎপত্তি ছিল একটি অনন্য ঘটনা যা শুধু একবার ঘটতে হবে। কিন্তু কোনো প্রজাতির তাদের নিজস্ব পৃথক পরিবেশে অভিযোজনীয় দক্ষতা অর্জনের ঘটনা ঘটছে শত লক্ষবার এবং এখনও তা চলছে।
স্পষ্টতই এখানে পৃথিবীতে আমরা জৈব প্রজাতিদের জীবনধারণ ও বংশবিস্তারের জন্য উপযোগী হবার করার একটি প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করছি। যে প্রক্রিয়া সমস্ত গ্রহে প্রতিটি মহাদেশে, দ্বীপে এবং সব সময় একই ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা নিরাপদে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি যদি আমরা আরো দশ মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করি, সম্পূর্ণ নতুন এক সেট প্রজাতিকে দেখা যাবে তাদের জীবনধারার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে দক্ষতার সাথে বর্তমানের প্রজাতিরা যেমন তা করেছে তাদের জীবনযাত্রার সাথে। এটি নিরন্তরভাবে বার বার ঘটা, অনুমেয়ভাবেই বহু ঘটনার সমষ্টি, কোনো পরিসংখ্যানের ভাগ্য না, যা পূর্বদৃষ্টি দ্বারা আমরা শনাক্ত করেছি। এবং ডারউইনের কল্যানে আমরা জানি কেমন করে এসব ঘটেছিল: প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা।
জীবিত প্রাণিদের বহুমুখী বিচিত্রতার ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল। আমাদের আসলেই ডারউইনের সেই শক্তিশালী রুপক ‘ক্রেইন’ এর প্রয়োজন পৃথিবীতে জীবনের বৈচিত্রতা ব্যাখ্যা এবং ডিজাইনের মোহনীয় বিভ্রমকে মোকাবেলা করার জন্য। জীবনের উৎপত্তি, ঠিক এর বীপরিতার্থেই সেই রুপক ক্রেইনের এখতিয়ারের বাইরে, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন জীবন ছাড়া সামনে অগ্রসর হতে পারেনা। এখানে অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি এককভাবে স্বতন্ত্র। জীবনের উৎপত্তির অনন্যতা বিষয়টিকে আমরা মোকাবেলা করতে পারি একটি অতি বিশাল সংখ্যক সম্ভাব্য গ্রহে জীবনের উৎপত্তির সুযোগের সম্ভাবনা প্রস্তাব করে। যখনই একবার প্রথম জীবনের উৎপত্তি সম্ভাবনাটি সৌভাগ্যের স্পর্শ পায়– যা অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল নিশ্চিভাবে মঞ্জুর করে নানা নিয়ামকের সমন্বয়ে– প্রাকৃতিক নির্বাচন তখন এর দ্বায়িত্ব নেয়: আর খুবই সুস্পষ্টভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন কোনো ভাগ্যের খেলা না।
যাই হোক, হতে পারে জীবনের উৎপত্তি বিবর্তনের ইতিহাসে শুধু একটি মাত্র প্রধান শূন্যস্থান নয়, যা শুধুমাত্র অত্যন্ত ভাগ্যক্রমে সম্পর্কযুক্ত এবং অ্যানথ্রোপিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিদ্ধ। যেমন আমার সহকর্মী মার্ক রিডলী (৫০) তার মেন্ডেলস ডেমন’ (কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি, আমেরিকার প্রকাশকরা একে ‘দ্য কো অপারেটিভ জিন’) শিরোনাম দিয়ে খানিকটা সংশয়পূর্ণ পুননামকরণ করেছিলেন। বইটিতে প্রস্তাব করেছিলেন, প্রকৃত কোষের উৎপত্তি (আমাদের মত কোষ, যেখানে নিউক্লিয়াস আছে, এবং আরো কিছু জটিল অঙ্গাণু আছে, যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, যা ব্যাকটেরিয়ায় নেই) যা আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কঠিন এবং জীবনের উৎপত্তি থেকেও অনেক বেশী পরিসংখ্যানগত ভাবে অসম্ভাব্য। এরকম একটি স্বতন্ত্র ঘটনা হয়তো ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি দিয়ে, খানিকটা নিম্নলিখিত উপায়ে: মহাবিশ্বে হয়তো বিলিয়ন সংখ্যক গ্রহ আছে, যেখানে জীবনের উদ্ভব হয়েছে, ব্যাকটেরিয়া সমপর্যায়ে, কিন্তু সেই নানা গঠনের জীবনের খুব সামান্য একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ সেই শূন্যস্থানটা অতিক্রম করতে পেরেছে এবং তৈরী করতে পেরেছে প্রকৃত কোষের মত কিছু। এবং এদের মধ্যে আরো ক্ষুদ্র একটি অংশ সেই পরবর্তী ক্রান্তিসীমার রুবিকোনটি (৫১) পার হতে পেরেছে কনশাসনেস বা চেতনা বা সজ্ঞানতার উদ্ভবের মাধ্যমে; যদি এই দুটো ঘটনাই শুধু একবার ঘটতে পারে এমন কোনো ঘটনা হয়, আমরা তাহলে সর্বব্যাপী বা সর্বত্র দৃষ্ট কোনো প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলছি না, যেমন সাধারণ, আটপৌরে জীববিজ্ঞানের অভিযোজনের ক্ষেত্রে করে থাকি। অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি বলছে, যেহেতু আমরা জীবিত, প্রকৃতকোষী এবং সজ্ঞানতা সম্পন্ন, আমাদের গ্রহটিকে অবশ্যই সেই অস্বাভাবিক রকম দূর্লভ গ্রহ হতে হবে, যেখানে এই তিনটি ধাপের মধ্যেই সেতু বন্ধন রচিত হয়েছে।
প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে কারণ সামগ্রিক ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এটি একমুখী একটি রাস্তা। প্রথমে শুরু করতে খানিকটা ভাগ্যের (জীবনের উৎপত্তি) প্রয়োজন হয়ত আছে এবং বহু ‘বিলিয়ন গ্রহে’র অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি সেই ভাগ্যটা দিয়েছে। হয়তো পরবর্তীতে বিবর্তনের ইতিহাসে আরো কিছু শূন্যস্থানেরও প্রয়োজন আছে বড় ধরনের ভাগ্যের সংযোগের, তবে তা অ্যানথ্রোপিক মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু আমরা আর যাই বলিনা কেন, জীবনের ব্যাখ্যায় ‘ডিজাইন’ নিঃসন্দেহে অর্থহীণ, কারণ ডিজাইন শেষ অবধি ক্রমান্বয়ে ক্রমবর্ধমান উন্নতি নয়, সেকারণে এটি যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়, তার চেয়ে বড় প্রশ্নের জন্ম দেয় ডিজাইন আমাদের সরাসরি নিয়ে যায়, সেই আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭ এর অসীম ক্রমান্বয়ে পূর্ববর্তী প্রশ্নে ফিরে যাবার বা রিগ্রেস প্রক্রিয়ায়।
আমরা এমন একটি গ্রহে বাস করি যা আমাদের মত জীবনের জন্য সহায়ক, এবং আমরা দেখেছি দুটো কারণ, কেন এমনটি হচ্ছে। একটি হচ্ছে, এই পৃথিবীর পরিবেশের দেয়া শর্তানুযায়ীই জীবন বিকশিত হবার মত করেই বিবর্তিত হয়েছে। এর কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন। অন্য কারণটি অ্যানথ্রোপিক; মহাবিশ্বে বহু বিলিয়ন গ্রহ আছে, এবং বিবর্তন বান্ধব গ্রহ যতই সংখ্যালঘু হোক না কেন, আমাদের গ্রহটিকে অবশ্যই তাদের একটি হতে হবে। এবার সময়এসেছে অ্যানথ্রোপিক মূলনীতিকে আরো আগের পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য, জীববিজ্ঞান থেকে পুনরায় কসমোলজীতে।
অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি: মহাবিশ্ব সংস্করণ
শুধুমাত্র একটি মিত্র গ্রহেই আমরা বাস করিনা, একটি মিত্র মহাবিশ্বেও আমাদের বাস। এর কারণ, আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করে আছে সেই সত্যটিতে, পদার্থবিদ্যার মহাজাগতিক আইনগুলো অবশ্যই যথেষ্ট জীবন বান্ধব হতে হবে জীবনের উৎপত্তির জন্য। সুতরাং বিষয়টি কোনো দুর্ঘটনা নয়, আমরা যখন রাতের আকাশে তারাদের দেখি, সিংহভাগ রাসায়নিক মৌলর অস্তিত্বের জন্য এই নক্ষত্ররা অবশ্য প্রয়োজনীয়, আর এই সব মৌল এবং রাসায়নিক উপাদান ছাড়া জীবনের কোনো অস্তিত্বই থাকার কথা না। পদার্থবিজ্ঞানীরা পরিমাপ করে দেখেছেন, যদি পদার্থবিদ্যার আইন এবং ধ্রুবগুলো যদি সামান্যতম ভিন্ন হত তাহলে এমন মহাবিশ্ব সৃষ্টি হতো,যেখানে জীবনের উৎপত্তির ঘটনাটি অসম্ভব হতো। বিভিন্ন পদার্থবিদরা এটিকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু উপসংহার সবসময়ই এক (৫২)। মার্টিন রীস তার বই, “জাষ্ট সিক্স নাম্বারস’এ ছয়টি মৌলিক ধ্রুব সংখ্যার একটি তালিকা করেছিলেন, যা মনে করা হয় সমগ্র মহাবিশ্বে প্রযোজ্য। এই ছয়টি সংখ্যার প্রতিটি এমনই সূক্ষ্মভাবে সাজানো যে, যে তারা যদি সামান্য ভিন্ন হয়, মহাবিশ্বও সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন হত এবং তা সম্ভবত জীবন বৈরী হত (৫৩)।
রীস এর ছয়টি সংখ্যার একটি উদাহরণ হচ্ছে, তথাকথিত শক্তিশালী বা স্ট্রং (strong) ফোর্সের মাত্রা, যে শক্তিটি কোনো একটি পারমানুর নিউক্লিয়াসের উপাদানগুলোকে একসাথে ধরে রাখে: যে পারমানবিক শক্তিকে অতিক্রম করতে হয় আগে কোনো অণুকে বিভাজিত করার আগে। এটি মাপা হয় E দিয়ে, হাইড্রোজেনের একটি পরমাণুর ভরের যে অংশ শক্তিতে রুপান্তরিত হয় যখন হাইড্রোজেন সন্নিবেশিত বা যুক্ত হয়ে একটি হিলিয়াম অনু তৈরী করে। আমাদের এই মহাবিশ্বে এই সংখ্যার মান, ০.০০৭ এবং মনে করা হচ্ছে যে, কোনো রসায়নের (যা জীবনের উৎপত্তির জন্য অবশ্য শর্ত) অস্তিত্বের জন্য, এই E এর মান এই মাত্রার খুব কাছাকাছি হতে হবে। আমরা যে রসায়নের সাথে পরিচিত, তা মূলত, সন্নিবেশিত এবং পুনসন্নিবেশিত হওয়া মোট ৯০ টি বা সেরকম সংখ্যক প্রকৃতিতে উপস্থিত পর্যায়-সারণীর মৌল দিয়ে তৈরী। হাইড্রোজেন হচ্ছে সবচেয়ে সাধারণ ও সবচেয়ে বেশী মাত্রায় বিদ্যমান মৌল। মহাবিশ্বের সব অন্য মৌলই হাইড্রোজেন থেকেই তৈরী হয় নিউক্লিয়ার ফিউশনের বা পারমাণবিক সংযোজনের মাধ্যমে। নিউক্লিয়ার ফিউশন কিন্তু খুবই কঠিন একটি প্রক্রিয়া, যা নক্ষত্রের অভ্যন্তরে খুবই উচ্চ তাপমাত্রার পরিবেশে ঘটে (এবং হাইড্রোজেন বোমায়); অপেক্ষাকৃত ছোটো নক্ষত্রগুলো, যেমন আমাদের সূর্য এই প্রক্রিয়া শুধু মাত্র হালকা মৌল তৈরী করতে পারে, যেমন হিলিয়াম, হাইড্রোজেন এর পরেই পর্যায় সারণীয় যা দ্বিতীয় লঘুতম মৌল। আরো বড় আরো উত্তপ্ত নক্ষত্রর দরকার সেই তাপমাত্রার সৃষ্টি করার জন্য, যা বাকী প্রায় সব ভারী মৌল সৃষ্টি করতে পারে নিউক্লিয়ার ফিউশনের ধারাবাহিক বিক্রিয়া প্রক্রিয়ায়, যার বিস্তারিত প্রক্রিয়াটি উৎঘাটন করেছিলেন ফ্রেড হয়েল এবং তার দুই সহকর্মী (এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি সরুপ, রহস্যজনকভাবে অন্য দুইজনের পাওয়া নোবেল পুরষ্কারের ভাগ হয়েলকে দেয়া হয়নি); এই বড় নক্ষত্রগুলো সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হতে পারে এবং এভাবে মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয় তাদের তৈরী উপাদানগুলো, পর্যায় সারণীর মৌলগুলো সহ, ধুলোর মেঘ হিসাবে। এই ধুলোর মেঘগুলো ঘনীভুত হয়ে তৈরী করে নতুন নক্ষত্র, আমাদের পৃথিবীর মত গ্রহ। একারণে পৃথিবী সর্ব ব্যাপী হাইড্রোজেন এর চেয়ে আরো বেশী অন্য অনেক ধরনের মৌলে সমৃদ্ধ; যে মৌলগুলো ছাড়া রসায়ন, এবং জীবন হতো অসম্ভব।
এখানে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি হচ্ছে, স্ট্রং ফোর্সের মান হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিউক্লিয়ার ফিউশনের ধারাবাহিক বিক্রিয়ায় পর্যায় সারণীর কোনো মৌল অবধি তৈরী হবে তা নির্ণয় করার জন্য। যদি এর পরিমান হয় খুব সামান্য, ধরুন ০.০০৬, ০.০০৭ এর বদলে, মহাবিশ্বে হাইড্রোজেন ছাড়া আর কিছুই থাকতো না, কোনো ধরনের উপযোগী রসায়ন এর অস্তিত্বই থাকতো না। এবং এটি যদি খানিকটা বেশী হত, ধরুন ০.০০৮, তাহলে সব হাইড্রোজেন একসাথে যুক্ত হয়ে ভারী মৌলগুলো তৈরী করতো। হাইড্রোজেন ছাড়া কোনো রসায়নই আমরা যে জীবনকে চিনি, তা সৃষ্টি করতে পারতো না। একটা কারণ তো অবশ্যই কোনো পানির অস্তিত্ব থাকতো না। সুতরাং গোল্ডিলকস পরিমাপ হলো ০.০০৭, যা এই মাত্রায় একদম সঠিক, প্রয়োজনীয় মৌল সরবরাহ করার জন্য, একটি চমৎক্কার এবং জীবন সহায়ক রসায়নের ভিত্তি গড়ে দিতে যার প্রয়োজন।
রীস এর ৬ টি সংখ্যার বাকীগুলো নিয়ে আমি আলোচনা করবোনা। তবে প্রত্যেকটি সম্বন্ধে মূল উপসংহার একই। প্রতিটি সংখ্যার পরিমাপ ঠিক সেই গোল্ডিলকস অনুকূল সীমায় অবস্থান করছে, যার বাইরে জীবনের উৎপত্তি অসম্ভব একটি ব্যপার। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিৎ? আবারো, ঈশ্বরবাদীদের উত্তর আছে একদিকে, আর অন্যদিকে আছে অ্যানথ্রোপিক উত্তর। ঈশ্বরবাদীরা বলবেন, ঈশ্বর যখন এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, এর মূল ধ্রুবগুলো তিনি নিজহাতে এমনভাবে সূক্ষ্মতা দিয়েছেন, যে প্রত্যেকটি জীবনের উৎপত্তির গোল্ডিলকস সীমানায় অবস্থান করে। যেমন, ঈশ্বরের কাছে ৬ টি নব বা সুইচ বা বোতাম ছিল, এবং তিনি সাবধানে সেটা নাড়াচাড়া করে এর গোল্ডিলকস সীমানার মানাট ঠিক করেছেন। সবসময়ের মতই, ঈশ্বরবাদীদের এই উত্তর খুব অসম্পূর্ণ এবং ভীষণ অপূর্ণতার চিহ্ন বহন করে। কারণ এটি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করার বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছে। একজন ঈশ্বর যিনি ৬ টি সংখ্যার জন্য সঠিক গোল্ডিলকস পরিমান পরিমাপ করতে পারেন, তাকেও অন্ততপক্ষে অবশ্যই সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সংখ্যাগুলোর মতই অসম্ভাব্য হতে হবে। এবং এই অসম্ভাব্যতাই আসলেই সেই প্রসঙ্গ, যার আলোচনা আমরা করছি। ঈশ্বরবাদীদের উত্তর সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে মূল সমস্যাটার সমাধানে উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থানে পৌঁছাতে। আমি কোনো বিকল্প দেখছি না এটিকে বাদ দেয়া ছাড়া, এবং একই সাথে বিস্ময়বোধ করছি সেই বিশাল সংখ্যক মানুষদের দেখে, যারা এই সমস্যাটি আদৌ দেখতে পাচ্ছেন না এবং মনে হচ্ছে আন্তরিকভাবেই তারা সন্তুষ্ট, এই স্বর্গীয় কারো কলকজা নাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করার যুক্তিতে।
এ ধরনের বিস্ময়কর অন্ধত্বের মনস্তাত্বিক কারণ হয়তো হতে পারে, প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং অসম্ভাব্যতাকে এর পোষ মানানোর শক্তি দ্বারা জীববিজ্ঞানীদের মত অনেক মানুষের সচেতনতার স্তরটি আসলে বাড়নি। জে অ্যান্ডারসন থমসন (৫৪), বিবর্তন মনস্তাত্ত্বিকতায় তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাকে দেখিয়েছেন অন্য আরেকটি কারণ: সেটা হচ্ছে সকল অজৈব বস্তুকে কোনো এজেন্ট বা প্রভাব ফেলতে এবং কাজ করতে সক্ষম এমন কোনো সত্তার সাথে একাত্ম করে চিহ্নিত করার আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পক্ষপাতিত্ব এবং প্রবণতা। থমসন যেমনটি বলেছেন, কোনো চোরকে ছায়া ভাবার চেয়ে কোনো ছায়াকে চোর ভাবার প্রবণতাই আমাদের বেশী। একটি মিথ্যা পজিটিভ বা যা সত্য বলে ভাবছিলাম তা আসলে মিথ্যা প্রতিপন্ন হওয়াটা হয়তো সময় নষ্ট করে, তবে কোনো মিথ্যা নেগেটিভ, বা যা মিথ্যা ভাবছেন তা আসলে সত্যি হলে, এর ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। আমাকে লেখা তার একটি চিঠিতে তিনি প্রস্তাব করেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষের অতীতে আমাদের চারপাশে আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা আসলে এসেছে আমাদের স্বগোত্রীদের একে অপরের কাছ থেকে: ‘মানুষের উদ্দেশ্য নিয়ে সেই ধরে নেয়া বা ডিফল্ট ধারণাটির ফলাফল, প্রায়শই ‘ভয়’; আমাদের খুবই কষ্ট হয়, মানুষের দ্বারা সৃষ্টি হয়নি এমন কোনো কিছু ভাবতে’; আমরা প্রাকৃতিকভাবে সবকিছু গন হারে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য বলে চিহ্নিত করি। এই কোনো কিছু কারো দ্বারা সৃষ্ট বা এজেন্ট এর মোহময়তার ধারণায় আবার ফিরে আসবো পরে পঞ্চম অধ্যায়ে।
জীববিজ্ঞানীরা, প্রাকৃতিক নির্বাচনের শক্তি দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত তাদের সচেতনতা দিয়েই ব্যাখ্যা দিতে পারে অসম্ভাব্য জিনিসগুলোর উদ্ভবের, তাদের এমন কোনো তত্ত্বতে সন্তুষ্ট হবার কথা না যা অসম্ভাব্যতার সমস্যাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। ঈশ্বরবাদীদের এই অসম্ভাব্যতার ধাঁধার উত্তর হচ্ছে একটি বিশাল সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া। যা সমস্যাটিকে নতুন করে তো ব্যাখ্যা করেই না বরং উদ্ভটভাবে বিষয়টি আরো বিশাল করে তোলে। তাহলে, এবার অ্যানথ্রোপিক বিকল্প ব্যাখ্যাটির দিকে দৃষ্টি ফেরাই। অ্যানথ্রোপিক উত্তর, এর সবচেয়ে সাধারণ রুপে হলো, আমরা কেবল মাত্র সে ধরনের মহাবিশ্বে এই প্রশ্নগুলো আলোচনা করতে পারবো, যা কিনা আমাদেরকে তৈরী করতে সক্ষম। সুতরাং আমাদের অস্তিত্ব নির্ধারণ করছে যে পদার্থবিদ্যার মৌলিক ধ্রুবগুলো থাকতে হবে তাদের সংশ্লিষ্ট গোল্ডিলকস জোনে বা সীমানায়, বিভিন্ন পদার্থবিদরা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অ্যানথ্রোপিক সমাধানকে সমর্থন করেন আমাদের অস্তিত্বের রহস্য ব্যাখ্যা করতে।
কট্টরপন্থী পদার্থবিদরা বলেন, এই ছয়টি ধ্রুব সংখ্যার সুইচ বা নবগুলো শুরুতেই তাদের নিজেদের ইচ্ছামত পরিবর্তন হবার মত স্বাধীন ছিল না; এবং আমরা যখন শেষ পর্যন্ত আমাদের দীর্ঘদিন আশায় থাকা থিওরী অব এভরিথিং এ পৌঁছাতে পারবো, আমরা দেখবো যে এই ছয়টি প্রধান সংখ্যা একে অপরের উপর নির্ভরশীল বা এমন কিছুর উপর নির্ভরশীল যা এখনও অজানা বা এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত যে আজ আমরা তা কল্পনাও করতে পারবো না। এই ছয়টি সংখ্যা হয়তো দেখা যাবে, বত্তের পরিধির সাথে তার ব্যাসের অনুপাতের যে ভিন্নতা থাকতে পারে তার চেয়ে বেশী স্বাধীন না। দেখা যাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হবার আসলে একটাই উপায় ছিল। সেই ছয়টি নৰ নাড়া চাড়া করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন তো বহুদূরের কথা, কোনো নবইতো ছিলনা নড়াচাড়া করার মত।
অন্য পদার্থবিদরা (তাদের একজন উদাহরণ হতে পারেন মার্টিন রীস) মনে করেন, এই ব্যাখ্যাটি সন্তোষজনক না। এবং আমি মনে করি, আমি তাদের সাথে একমত। আসলে এটি যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য যে মহাবিশ্ব হবার একটি পথই আছে, কিন্তু সেই একটি পথ বা উপায় কেনই বা এমন ভাবে সাজানো আছে যা ধীরে ধীরে আমাদের বিবর্তনের জন্য? কেনই বা এটাকে সেই ধরনের মহাবিশ্ব হতে হবে, যা মনে হয়-তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন (৫৫) এর ভাষায়, মহাবিশ্ব যেন অবশ্যই আগে থেকেই জানতে আমরা আসছি?’ দার্শনিক জন লেসলী (৫৬) ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন মানুষের রুপক ব্যবহার করে ব্যাখ্যা করেছেন, হতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াড টিমের ১০ জনই তাদের বন্দুকের নিশানা ভুল করলো। পরে বিষয়টি ভেবে দেখলে, এমন অবস্থায় বেঁচে যাওয়া কেউ তার ভাগ্য নিয়ে আনন্দিত হয়ে বলতেই পারেন, ‘বেশ, নিশ্চয়ই তারা সবাই নিশানা ভুল করেছে নয়তো সে কথা ভাবার জন্য আমি এখানে থাকতাম না। কিন্তু তারপরও সে কিন্তু ক্ষমাযোগ্য কোনো বিস্ময় নিয়ে ভাবতেই পারেন, কেন তারা সবাই নিশানা ভুল করলো, এবং নানা সম্ভাব্য হাইপোথিসিস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারেন, যেমন তাদের ঘুষ দেয়া হয়েছে অথবা তারা সবাই মাতাল ছিল ইত্যাদি।
এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আরো একটি প্রস্তাব দিয়ে উত্তর দেয়া যেতে পারে, যা মার্টিন রীস নিজেই সমর্থন করেছিলেন, তা হলো অনেক গুলো মহাবিশ্ব আছে, ফেনার বুদ্বুদের মত যারা সহাবস্থান করছে, কোনো একটি মাল্টিভার্স বা বহুমহাবিশ্বে ( বা মেগাভার্স যেমন লিওনার্ড সাসকিন্ড বলতে পছন্দ করেন) (৫৭); কোনো একটি মহাবিশ্বে আইন এবং ধ্রুবগুলো, যেমন আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে,আসলে বহুমহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্সে হচ্ছে উপআইন বা বাই ল বা স্থানীয় আইন। সম্পূর্ণ মাল্টিভার্সে স্পষ্টতই অসংখ্য সেট বিকল্প উপ-আইন বা বাই ল আছে। অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি এখানে বলছে যে, সেই মহাবিশ্বগুলোর কোনো একটিতে (যা সংখ্যায় খুবই কম বলেই অনুমান করা হয়) আমরা অবশ্যই অবস্থান করছি, যেখানকার পদার্থবিদ্যার উপ-আইনগুলো ঘটনাক্রমে আমাদের ক্রমান্বয়ে বিবর্তনের পক্ষে উপযোগী এবং সেজন্যই আমরা সমস্যাটি নিয়ে ভাবতে পারছি।
মাল্টিভার্স তত্ত্বের একটি মজার সংস্করণের উৎপত্তি হয়েছে। আমাদের মহাবিশ্বের সর্বশেষ পরিণতির কথা বিবেচনা করে। মার্টিন রীসের ৬ টি ধ্রুব সংখ্যার মাণের উপর নির্ভর করে আমাদের মহাবিশ্ব হয়ত অনির্দিষ্ট কালের জন্যে সম্প্রসারণশীল হতে পারে বা এটি একটি ভারসাম্যে স্থিতাবস্থায় পৌঁছাতে পারে বা এই ক্রমসম্প্রসারণশীলতা বিপরীতমুখী হতে পারে এবং সৃষ্টি করতে পারে একটি মহাসংকোচন বা বিগ ক্রাঞ্চ। কিছু বিগ ক্রাঞ্চ মডেলে মহাবিশ্ব আবার সম্প্রসারিত হওয়া শুরু করে এবং এভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য, যেমন ধরুন ২০ বিলিয়ন বছরের একটি সময় চক্রে। আমাদের স্ট্যাণ্ডার্ড মডেল মহাবিশ্বে, সময় তার নিজের যাত্রা শুরু করে মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাঙ্গ এর সময়ে মহাশূন্যে সূচনার সাথেই প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর আগে। ধারাবাহিক বিগ ক্র্যাঞ্চ মডেল হয়তো এই বাক্যটিকে পরিবর্তন করতে পারে এভাবে: আমাদের সময় এবং মহাশূন্যের আসলে সূচনা হয়েছিল আমাদের বিগ ব্যাঙ্গ এর সময় কিন্তু অসংখ্য বিগ ব্যাঙ্গ এর সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম; যাদের প্রত্যকটির শুরু হয়েছিল আবার বিগ ক্রাঞ্চের মাধ্যমে, যা এই ধারাবাহিকতায় এর আগের মহাবিশ্বটির সমাপ্তির কারণ। কেউই বুঝতে পারেননি কি ঘটেছিল আসলে বিগ ব্যাঙ্গ এর মত কোনো সিঙ্গুলারিটি ঘটনার সময়। সুতরাং এটা ধারণা করা যায় যে সব আইন এবং ধ্রুবগুলো নতুন একটি মানে রিসেট হয়, প্রতিবারই এই চক্রে। যদি এভাবে ব্যাঙ্গ– সম্প্রসারণ- সংকোচন- ক্র্যাঞ্চ চক্র চলতেই থাকে মহাজাগতিক অ্যাকর্ডিয়নের মত, আমরা কোনো সমান্তরাল কোনো মাল্টিভার্সেও সংস্করণের পরিবর্তে পাবো ধারাবাহিক মাল্টিভার্স। আরো একবার অ্যানথ্রোপিক নীতি তার ব্যাখ্যার দ্বায়িত্ব পালন করে। ধারাবাহিক মহাবিশ্বের সবকয়টির মধ্যে হয়তো অল্প কয়েকটির ধ্রুব বং আইনগুলো এমন করে সাজানো যে তারা জীবনের উদ্ভবের জন্য সহায়ক। এবং অবশ্যই, বর্তমান মহাবিশ্ব সেই সংখ্যালঘু মহাবিশ্বের একটি, কারণ আমরা এখানে বসবাস করছি। এই মাল্টিভার্সের এই ধারাবাহিক সংস্করণটি একসময় যেমন ভাবার হতো এখন এর সম্ভাবনাকে সেভাবে ভাবা হয়না। কারণ সামপ্রতিক প্রমাণ আমাদের মহা সংকোচনের ধারণা থেকে অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্বের নিয়তিতে চিরন্তন সম্প্রসারণে আছে।
লী স্মোলিন (৫৮),আরেকজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ, যিনি মাল্টিভার্স তত্ত্বটির একটি কৌতূহলোদ্দীপক ডারউইনীয় সংস্করণ প্রস্তাব করেছেন, যার মধ্যে ধারাবাহিক এবং সমান্তরাল দুটি মহাবিশ্বের ধারণাই বিদ্যমান। স্মোলিন এর ধারণাগুলো- যার বিশদ ব্যাখ্যা আছে ‘দ্য লাইফ অব দি কসমস’ এ– নির্ভর করে আছে সেই তত্ত্বের উপর, যা বলছে, কোনো একটি মা মহাবিশ্ব বা ইউনিভার্স থেকে কন্যা ইউনিভার্স সৃষ্টি হয় পুরোমাত্রার মহাসংকোচনের মাধ্যমে না বরং স্থানীয়ভাবে কোনো কৃষ্ণ গহবর বা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে। বংশগতির একটি অন্যকরম ধারণা স্মোলিন এখানে তার প্রস্তাবিত তত্ত্বে যোগ করেন: কন্যা মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় তাদের মৌলিক ধ্রুবগুলোও খানিকটা মিউটেশন বা পরিবর্তিত হয় মা মহাবিশ্ব থেকে। ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচনে এই হেরেডিটি বা বংশগতি হচ্ছে অপরিহার্য একটি উপাদান, আর স্মোলিন এর বাকী তত্ত্ব এখান থেকেই প্রাকৃতিকভাবেই অগ্রসর হয়। যে মহাবিশ্বগুলোর সেই বৈশিষ্ট্য আছে যা তাদের টিকে থাকতে এবং আরো পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টি করতে সহায়তা দেয়, মাল্টিভার্স এ সেই সব মহাবিশ্বগুলো ক্রমান্বয়ে প্রাধান্য বিস্তার করে। যেহেতু এই পরবর্তী প্রজন্মের মহাবিশ্ব তৈরীর প্রক্রিয়াটা ঘটে কৃষ্ণ গহবরে, সফল সব মহাবিশ্বগুলোর কৃষ্ণ গহবর তৈরী করার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী থাকে। এই দক্ষতা ইঙ্গিত করছে, আরো বাড়তি কিছু বৈশিষ্ট্যের। যেমন, পদার্থের ঘণীভুত হয়ে মেঘ এবং নক্ষত্র ও পরবর্তীতে কৃষ্ণ গহবর সৃষ্টি করা; নক্ষত্রদেরও, যাদের আমরা দেখেছি প্রয়োজনী রসায়ন সৃষ্টির এবং সেভাবেই জীবনেরও পূর্বসূরি। সুতরাং স্মোলিন এর প্রস্তাব, মাল্টিভার্সেও মহাবিশ্বদের উপরও কাজ করছে একটি ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন, যা সরাসরি কৃষ্ণ গহবর সমৃদ্ধ মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং পরোক্ষভাবে জীবনের উৎপত্তিকে বিশেষ সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্যই সব পদার্থবিদরা স্মোলিন এর প্রস্তাবের সাথে একমত নন, যদিও নোবেল জয়ী পদার্থবিদ মারে গেল-মানের এর উদ্ধৃতি, ‘স্মোলিন? সেই ক্ষ্যাপাটে চিন্তার অল্প বয়সী ছেলেটি না? তার ধারণা ভুল নাও হতে পারে’ (৫৯)। একজন দুষ্ট জীববিজ্ঞানী হয়তো ভাবতেই পারেন, অন্য কোনো পদার্থবিদদের ডারউইনীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করার দরকার আছে কিনা।
খুব সহজ কিন্তু চিন্তা করা (এবং অনেকেই এর স্বীকার) যে, এক। গুচ্ছ মহাবিশ্বের ধারণার প্রস্তাব করা মাত্রাতিরিক্ত বিলাসিতা এবং এ ধরনের চিন্তাকে প্রশ্রয় না দেয়াই উত্তম। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তিটি হচ্ছে, যদি অসংখ্য মহাবিশ্বের এই বাহুল্যর ধারণাটিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তাহলে আমরা কেনই বা আরেকটু বেশী ধারণা করি না কেন, কেনই বা তাহলে প্রশ্রয় দেই না ঈশ্বরের ধারণাটিকে। উভয়। ধারণাদুটি কি সমানভাবে অমিতব্যায়ী না, যা বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত হাইপোথিসিস এবং সমানভাবে অসন্তোষজনক? যারা এভাবে ভাবেন তাদের সচেতনতার স্তর বৃদ্ধি হয়নি প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা। সত্যিকারের বাহুল্যময় ঈশ্বর হাইপোথিসিস এবং আপাতদৃষ্টিতে বাহুল্যময় মাল্টিভার্স হাইপোথিসিস এর মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে মূলত পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতা। মাল্টিভার্স তার সব বাহুল্য আড়ম্বর নিয়ে সরল। ঈশ্বর বা বুদ্ধিমান, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা সম্পন্ন, গননাকারী কোনো এজেন্ট, খুবই অসম্ভাব্য সেই একই পরিসংখ্যানগত পরিমাপের ধারণা যে সত্তাগুলোর অস্তিত্ব তার ব্যাখ্যা করা কথা। মাল্টিভার্সকে মনে হতে পারে বাহুল্যময় মহাবিশ্বর সংখ্যার ‘সুবিশাল পরিমানে, কিন্তু এই প্রত্যেকটি মহাবিশ্ব কিন্তু তার মৌলিক সুত্রের ক্ষেত্রে সরল। আমরা কিন্তু এখানে এমন কিছু এখন প্রস্তাব করছি না যা খুব বেশী মাত্রায়। অসম্ভাব্য। কিন্তু অন্য যে কোনো বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীতটাই বলতেই হবে।
কিছু পদার্থবিদ আছেন যারা সবার জানা মতেই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসী (রাসেল স্ট্যানার্ড এবং জন পোলকিংহর্ণ, এই দুইজন ব্রিটিশ পদার্থবিদের উদাহরণ আমি আগেই উল্লেখ করেছি।); যেমনটা হবার কথা ছিল, তারা ভৌত ধ্রুবগুলোর সবকয়টির কম বেশী সংকীর্ণ একটি গোল্ডিলকস সীমায় টিউন করার বিষয়টির অসম্ভাব্যতার বিষয়টি লুফে নিয়েছেন এবং প্রস্তাব করেছেন, নিশ্চয়ই কোনো মহাজাগতিক বুদ্ধিমান সত্তা এই টিউনিং এর কাজটি করেছে পরিকল্পিতভাবে। আমি আগেই এই ধারণার অসারতা প্রমাণ করেছি, কারণ এটি যা সমাধান করছে, তারচেয়ে আরো বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিন্তু এর উত্তর হিসাবে প্রস্তাব করতে ঈশ্বরবাদীরা কি চেষ্টা করেছে? তারা কিভাবে এই যুক্তির সাথে সমঝোতা করতে পারে, যে কোনো ঈশ্বর যিনি এই মহাবিশ্বকে ডিজাইন করতে পারেন,সাবধানে, পূর্বদৃষ্টি নিয়ে এর সব ধ্রুবগুলোকে উপযোগী করে তুলেছেন আমাদের বিবর্তনের জন্য, অবশ্যই তাকে খুবই জটিল এবং অসম্ভাব্য একটি সত্তা হতে হবে, যার অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা দেবার জন্য তার যে ব্যাখ্যা প্রস্তাব করার কথা, তার চেয়ে আরো বেশী ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে?
ধর্মতাত্ত্বিক রিচার্ড সুইনবার্ন, আমরা যেমনটা আশা করতে শিখেছি ধর্মবাদীদের কাছে, ভাবেন এই সমস্যার জন্য তার একটি সমাধান আছে। তিনি তার বই “ইস দেয়ার এ গড?’ এ বিষয়টির বিশদ ব্যাখা দিয়েছেন। তিনি শুরু করেছিলেন, বিষয়টি ব্যাখ্যা করার ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই, কেন আমাদের সবসময় সবচেয়ে সরলতম হাইপোথিসিসটিকে বেছে নেয়া উচিৎ যা সব ফ্যাক্ট বা বাস্তবতার সাথে খাপ খায়। বিজ্ঞান সব জটিল জিনিস ব্যাখ্যা করে সরল জিনিসের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে, পরিশেষে মৌলিক কণাদের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। আমি ( আমি সাহস করে বলতে পারি আপনিও) মনে করি এটি খুব সুন্দর সরল একটি ধারণা যে, সব কিছুই তৈরী হয় মৌলিক কিছু কণা দিয়ে, যা যত অগণিত সংখ্যকই হতে পারুক না কেন তাদের সৃষ্টি সীমিত সংখ্যক এক সেট মৌলিক কণা থেকেই উদ্ভূত। আমরা যদি ধারণাটিতে সংশয় বোধ করি তার কারণ শুধু এটাকে খুবই সরল একটি ধারণা বলেই আমরা তা ভাবছি। কিন্তু সুইনবার্নের জন্য, এটি আসলেই সরল কোনো বিষয় একদমই না, বরং ঠিক এর বিপরীত।
কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রকারের কণিকা, যেমন ধরুন ইলেক্ট্রন, এর সংখ্যা এত বিশাল যে, সুইনবার্ণ মনে করেন বিষয়টা শুধু কাকতলীয় কোনো ঘটনা হতে পারেনা যে, এদের সবার একই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকবে। একটি ইলেক্ট্রন তিনি হজম করতে পারবেন, তবে বিলিয়ন বিলিয়ন ইলেক্ট্রন, ‘সবার একই বৈশিষ্ট্য, বিষয়টি তার অবিশ্বাসকে বেশ উত্তেজিত করে তোলে। তার মতে যদি সবগুলো ইলেকট্রন পরস্পর থেকে আলাদা হতো, সেই ব্যাখ্যাটা হত অনেক বেশী সরল, বেশী স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক, যথেষ্ট কম কষ্টসাধ্য হত সেই ব্যাখ্যা। আরো খারাপ তার মতে, কোনো ইলেকট্রনের উচিৎ না তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য একসাথে এক মুহূর্তের বেশী সময় ধরে স্থিতিশীল রাখা, তাদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য বদলানো উচিৎ, নিজের খেয়াল খুশী মত, এলোমেলো, এই মূহূর্ত থেকে অন্য মূহূর্ত আলাদা, দ্রুত পরিবর্তনশীল। সুইনবার্নের দৃষ্টিতে এটাই সরলাবস্থা, সবকিছুর আদি অবস্থা। সমবৈশিষ্ট্যপূর্ণ (যা আমি বা আপনি হয়তো বলবেন আরো বেশী সরল) কোনো কিছুর জন্য দরকার বিশেষ ব্যাখ্যা। শুধুমাত্র এর কারণ হচ্ছে, ইলেক্ট্রন এবং তামা’র কণাগুলো এবং অন্যান্য সব পদার্থগুলোর বিংশ শতাব্দীতে শক্তি ধারণ করে, সেই একই শক্তি তাদের ছিল উনবিংশ শতাব্দীতেও এবং সেই সবকিছুই আগে যেমন ছিল এখনও তেমন আছে।”
এখানে ঈশ্বরের আগমন, ঈশ্বরের প্রবেশ হলো, এই ইচ্ছাকৃত এবং নিরন্তর একই বৈশিষ্ট্য বজায় রাখার মাধ্যমে এই সব বিলিয়ন বিলিয়ন ইলেক্ট্রন, তামা’র টুকরাদের বুনো এলোমেলো আচরণ ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের জন্য তাদের নিজস্ব অন্তর্গত প্রবণতাকে উদ্ধার করতে। এ কারণে আপনি যখন একটি ইলেকট্রন দেখবেন, আপনার সব দেখা হয়ে যাবে, সে কারণেই তামা’র টুকরাগুলো সবাই তামা টুকরার মত আচরণ করে। একারণে প্রতিটি ইলেক্ট্রন এবং তামার প্রতিটি টুকরো ঠিক নিজের মত থাকে মাইক্রোসেকেন্ড থেকে মাইক্রোসেকেণ্ড, শতাব্দীর পর শতাব্দী, এর কারণ ঈশ্বর নাকি সারাক্ষণই প্রতিটি কণার উপর তার ঐশী আঙ্গুল দিয়ে রেখেছেন, কোনো ধরনের স্বেচ্ছাচারী বাড়াবাড়ি আচরণ দমনের উদ্দেশ্যে এবং তিনি শাসন করেন যেন বেয়াড়া কণারা তাদের বাকী ইলেক্ট্রন সহকর্মীদের সাথে এক লাইনেই থাকে; যেন তারা সবাই ঠিক একই রকম আচরণ করে।
কিন্তু সুইনবর্ণের পক্ষে কিভাবে সম্ভব হবে তার এই অদ্ভুত হাইপোথিসিসটাকে টিকিয়ে রাখা? যেখানে ঈশ্বর একই সাথে গ্যাজেলিয়ন (অগণিত) আঙ্গুল দিয়ে নিয়ম না মানা ইলেক্ট্রনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করেন, এটা কিভাবে একটি সরল হাইপোথিসিস হতে পারে? অবশ্যই এটা সরলের ঠিক বিপরীত। সুইনবার্ণ এখানে খেলা দেখালেন তার নিজের মনমত চমক দেখানো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ‘ঔদ্ধত্ব দেখিয়ে। কোনো যৌক্তিকতা ছাড়াই তিনি দাবী করেন যে ঈশ্বর হচ্ছে ‘একক’ একটি বস্তু দিয়ে গঠিত। কি অসাধারণ তার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার এই অর্থনীতি, যদি তা তুলনা করা হয় ঐ গ্যাজেলিয়ন সংখ্যক ইলেক্ট্রন স্বতন্ত্রভাবে মূলত একই, সেই ধারণার সাথে!
ঈশ্বরবাদীরা দাবী করছেন, প্রতিটি জিনিস যার অস্তিত্ব আছে, তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কারণ হচ্ছে মাত্র একটি.. ঈশ্বর। এবং এটি দাবী করা যে, প্রতিটি বৈশিষ্ট্য যা প্রতিটি জিনিসের আছে, তা হচ্ছে ঈশ্বরের কারণে বা তার অনুমতিতে শুধুমাত্র তারা অস্তিত্বশীল। এটি বেশ কিছু কারণকে ব্যাখ্যার জন্য সাধারণ সরল একটি ব্যাখ্যার বিশিষ্ট উদাহরণ। এই ক্ষেত্রে সম্ভাবনা আছে একটার বেশী সরলতম কোনো ব্যাখ্যা না থাকার, শুধু সেটাই যা কেবল একটি কারণকেই প্রস্তাব করে। বহুঈশ্বরবাদ থেকে ঈশ্বরবাদ এ কারণে সরল।এবং ঈশ্বরবাদ এর জন্য একটি কারণ প্রস্তাব করছে, একটি সত্তা (যার আছে) অসীম ক্ষমতাময় (ঈশ্বর যৌক্তিকভাবে সম্ভব এমন সব কিছুই করতে পারেন), অসীম জ্ঞানের অধিকারী ( যৌক্তিকভাবে যা জানা সম্ভব তা সবকিছু জানেন ঈশ্বর), অসীম স্বাধীন।
সুইনবার্ণ দয়াপরবশ হয়ে মেনে নিয়েছেন, ঈশ্বর এমন কোনো কিছু করতে পারেন না যা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব এবং তার এই সংযমের জন্য তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। এটা মেনে নিয়েই বলছি, কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতার ব্যবহারের কোনো সীমাবদ্ধতা ঈশ্বরবাদীরা অনুধাবন করেননি কখনোই। বিজ্ঞানের কি ‘ক’ ব্যাখ্যা করতে খানিকটা সমস্যা হচ্ছে? কোনো অসুবিধা নেই, ‘ক’ নিয়ে আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই, ঈশ্বরের অসীম ক্ষমতাকে টেনে নিয়ে আসা হয় ‘এক্স’ কে ব্যাখ্যা করতে (সেই সাথে বাকী সবকিছুই), এবং এটাকে দাবী করা হবে সর্বশ্রেষ্ট সরলতম ব্যাখ্যা হিসাবে, কারণ, সর্বোপরি ঈশ্বরতো শুধুমাত্র একজন। এর চেয়ে জটিলতামুক্ত আর কি হতে পারে?
বেশ, সত্যিকথা বলতে গেলে, প্রায় সবকিছুই। এমন একজন ঈশ্বর যিনি কিনা মহাবিশ্বের প্রতিটি কণাকে বিরামহীনভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি তার যাই হোন না কেন সরল কোনো সত্তা হতেই পারেন না। তার নিজের অস্তিত্বটির বর্ণনা জন্যই তো প্রয়োজন আছে বিশাল একটি ব্যাখ্যার আরো খারাপ (সরলতার দৃষ্টিকোণ থেকে) ব্যপার হচ্ছে, ঈশ্বরের অতিকায় চেতনার অন্য প্রান্তগুলোও একই সাথে প্রতিটি মানুষের কর্মকাণ্ড, তাদের আবেগ ও অনুভূতি এবং প্রার্থনা নিয়ে ব্যস্ত; এছাড়া ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সীর অন্যান্য গ্রহে যদি অন্য কোনো বুদ্ধিমান ভীনগ্রহবাসী থাকে তারাতো আছেনই। সুইনবার্নের মতে তিনি এমনকি নিরন্তরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন অলৌকিকভাবে হস্তক্ষেপ ‘না’ করার জন্য আমাদের রক্ষা করতে, যেমন যখন আমরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হই। সেটা তিনি কখনই করবেন না, কারণ, ‘ঈশ্বর যদি কোনো আক্রান্ত রোগীর স্বজনের বেশীর ভাগ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন তাকে ক্যান্সার থেকে বাঁচানোর জন্য, তাহলে মানুষের জন্য ক্যান্সার কখনো সমস্যা থাকবে না সমাধানের জন্য। তাহলে আমরা আমাদের সময় নিয়ে কি করবো?
সব ধর্মতাত্ত্বিকরা আবার সুইনবার্নের মত এত দূর যেতে চান না, তবে যাই হোক, ঈশ্বর হাইপোথিসিস যে সরল, এই অদ্ভুত দাবী কিন্তু বেশ কিছু আধুনিক ধর্মতাত্ত্বিকদের রচনায় দেখা যায়, যেমন কিথ ওয়ার্ড, যখন তিনি অক্সফোর্ডের ডিভিনিটির রিজিয়াস অধ্যাপক ছিলেন, তার লেখা ১৯৯৬ সালের ‘গড, চান্স অ্যান্ড নেসেসিটি’ বইটিতে এই বিষয়ে বেশ স্পষ্ট একটি বক্তব্য ছিলো:
আসল কথা হলো, ঈশ্বরবাদীরা দাবী করেন মহাবিশ্বর অস্তিত্বের জন্য ঈশ্বর হচ্ছেন অতি অসাধারণ, সুন্দর, সুবিধাজনক এবং কার্যকর একটি ব্যাখ্যা। এটি সহজসাধ্য উপযোগি কারণ এটি মহাবিশ্বের সবকিছুর অস্তিত্ব এবং তাদের প্রকৃতির গুণাবলী আরোপ করেছে একটি মাত্র সত্তার উপর, সেই চূড়ান্ত কারণ, যা সবকিছুর অস্তিত্বের কারণ, এমনকি তার নিজের অস্তিত্বেরও। ধারণাটি সুন্দর, কারণ একটি প্রধান ধারণা থেকে, সম্ভবপর এমন কোনো নিখুঁততম সত্তা– ঈশ্বরের সম্পূর্ণ প্রকৃতি এবং সমগ্র মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে (৬০)।
সুইনবার্নের মত, কোনো কিছু ব্যাখ্যা করা বলতে কি বোঝায়, সে বোঝানো ক্ষেত্রেও ওয়ার্ডও একই ভুলটি করেন তার এই বক্তব্যে। এবং মনে হয় তিনি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, কোনো কিছুকে যদি সরল বলা হয়, আসলে সেটা সম্বন্ধে কি বোঝাচ্ছে। আমি স্পষ্ট না ওয়ার্ড আসলেই কি ঈশ্বরকে সরল ভাবছেন কিনা? বা উপরের অনুচ্ছেদটি অস্থায়ী ‘তর্কের খাতিরে বলা’ এমন কোনো অনুশীলনের প্রতিনিধিত্ব করছে? স্যার জন পোলকিংহর্ন, ‘সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিষ্টিয়ান বিলিফ’ বইয়ে ওয়ার্ডের টমাস অ্যাকোয়াইনাসের আগের সমালোচনার উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন,’এটা মৌলিক একটি ভুল, ঈশ্বরকে যৌক্তিকভাবে সরল মনে করা- সরল এখানে শুধুমাত্র এই অর্থে না যে তার সত্তা অবিভাজ্য বরং আরো বেশী দৃঢ় অর্থে যে, ঈশ্বরের কোনো অংশ সত্যি হলে ঈশ্বর সম্পূর্ণভাবে সত্য। একারণে এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত হবে মনে করা যে, ঈশ্বর, যখন অবিভাজ্য, অন্তর্গতভাবে জটিল। ওয়ার্ড কিন্তু এখানে ব্যপারটা ঠিকই ধরতে পেরেছেন। আসলে, জীববিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলী, ১৯১২ সালে, জটিলতার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন গঠনের নানা অংশের বৈসাদৃশ্যতা হিসাবে, যা দিয়ে তিনি একটি বিশেষ ধরনের বৃত্তিগত বা প্রায়োগিক অবিভাজ্যতাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন।
কোথা থেকে জটিল জীবনের উদ্ভব হয়েছে তা বোঝার জন্য ধর্মতাত্ত্বিক মানসিকতার বিশেষ পদ্ধতিগত সমস্যা সৃষ্টি করে সেই বিষয়ে অন্য জায়গায় ওয়ার্ড কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি আরেকজন ধর্মবাদী বিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি দিয়ছেন, প্রাণরসায়নবিদ আর্থার পিকক (আমার আগেই উল্লেখ করা ব্রিটিশ ধর্মীয়। বিজ্ঞানীত্রয়ের তৃতীয় সদস্য) জীবিত পদার্থের অস্তিত্বকে ক্রমান্বয়ে জটিলতর হয়ে ওঠার প্রবণতা হিসাবে প্রস্তাব করার সময়। ওয়ার্ড যাকে বিশেষায়িত করেছেন বিবর্তনীয় পরিবর্তনের কোনো একটি অন্তর্নিহিত নির্দেশনা হিসাবে যা জটিলতার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবার বিষয়টিকে বাড়তি সুযোগ দেয়। তিনি এরপর আরো প্রস্তাব করেন, এ ধরনের পক্ষপাতিত্ত্ব, হতে পারে কোনো মিউটেশন প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়, যেন আরো জটিল মিউটেশনের উদ্ভব হতে পারে। ‘ওয়ার্ডের এ বিষয়ে সংশয় ছিল, তার যা হওয়া উচিৎ সঙ্গতকারণে। ক্রমশ জটিলতর হবার পথে বিবর্তনীয় বিভক্তি যে সকল বংশধারায় আদৌ এসেছে, তা তাদের ক্রমান্বয়ে জটিল হবার অন্তর্গত প্রবণতা থেকে না বা পক্ষপাতদুষ্ট কোনো মিউটেশনের কারণেও না। এটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে : যে প্রক্রিয়া, আমরা যতটুকু জানি, এখনও একমাত্র প্রক্রিয়া, যা সরলাবস্থা থেকে জটিলতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব আসলেই খুবই সরল। এবং যেখান থেকে এটি শুরু করে, সেটিও। কিন্তু অপরদিকে এটি যা ব্যাখ্যা করতে পারে, সেটি বর্ণনাতীতভাবে জটিল: আমরা কল্পনার চেয়েও জটিল, শুধুমাত্র ঈশ্বরবাদীদের প্রস্তাবিত ঈশ্বর ছাড়া যিনি এটি ডিজাইন করতে সক্ষম।
কেমব্রিজে একটি সংক্ষিপ্ত বিরতি
কেমব্রিজে সম্প্রতি বিজ্ঞান এবং ধর্ম নিয়ে একটি সম্মেলনে এই যুক্তিটি আমি প্রস্তাব করেছিলাম, যা এখানে উল্লেখ করেছি আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭ যুক্তি হিসাবে। আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, অন্ততপক্ষে সেটি ছিল একটি ঈশ্বরের সরলতা প্রশ্নে চিন্তার সম্মিলনের একটি আন্তরিক ব্যর্থতা। এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য ছিল বেশ শিক্ষনীয়, সেই অভিজ্ঞতাটাই আপনাদের সাথে ভাগ করে নেবো এখানে।
প্রথমেই আমার স্বীকার (সম্ভবত এটিই সঠিক শব্দ) করে নেয়া উচিৎ এই সম্মেলনটি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল টেম্পলটন ফাউন্ডেশন। ব্রিটেইন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন বিশেষভাবে বাছাই করা বিজ্ঞান সাংবাদিকরা ছিলেন এর দর্শক। আমন্ত্রিত বক্তাদের মধ্যে আমি ছিলাম একমাত্র নিরীশ্বরবাদী। এদের মধ্যে একজন সাংবাদিক জন হরগান, উল্লেখ করেছিলেন, এই সম্মেলনে অংশগ্রহন করার জন্য অন্য সব খরচ বাদ দিয়ে তাকে ১৫০০০ ডলার এর একটি মোটা পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছিল। ব্যপারটি আমাকে বিস্মিত করেছিল। অ্যাকাডেমিক সম্মেলনের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে দর্শকদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য পারিশ্রমিক প্রদান করা হয় (বক্তাদের ব্যতিক্রম); আমি যদি আগে জানতাম, সাথে সাথেই তাহলে আমার সন্দেহ হত। টেম্পলটন কি তার অর্থ ব্যবহার করছে বিজ্ঞান সাংবাদিকদের কোনো বেআইনী কাজ করার প্ররোচনা দেবার জন্য এবং তাদের বৈজ্ঞানিক সততাটিকে বিপথগামী করা চেষ্ঠায়? জন হরগান পরবর্তীতে তেমনটি ভেবেছিলেন এবং তার পুরো অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছিলেন; যেখানে তিনি প্রকাশ করেন, আমার কারণেই, একজন বক্তা হিসাবে আমার নাম দিয়ে প্রচারণা করার কৌশল তার মতই আরো অনেক সাংবাদিকের সন্দেহ কাটাতে সাহায্য করেছিল:
ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স- এই সম্মেলনে যার অংশগ্রহন আমাকে এবং আমার অনেক সহকর্মীকে বিশ্বাস যুগিয়েছিল এর বৈধতা সম্পর্কে– ছিলেন একমাত্র বক্তা যিনি ধর্ম বিশ্বাসকে সমালোচনা করেন বিজ্ঞানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অযৌক্তিক এবং ক্ষতিকর হিসাবে উল্লেখ করে। অন্যান্য বক্তারা • তিনজন অজ্ঞেয়বাদী, একজন ইহুদী, একজন একাত্মবাদী এবং বারো জন খ্রিষ্টীয় (শেষ মূহুর্তে একজন মুসলিম দার্শনিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন)– সবাই সুস্পষ্টভাবে ধর্ম এবং খ্রিষ্টীয় ধর্মের প্রতি সুস্পষ্টভাবে পক্ষপাতমূলক বক্তব্য রাখেন (৬১)।
হরগানের এই নিবন্ধটি পছন্দনীয়ভাবে নিরাপদ মাঝামাঝি একটা অবস্থান। তার নানা সংশয়বোধ সত্ত্বেও তার অভিজ্ঞতার বেশ কিছু ব্যপার ছিল, যা তিনি নিঃসন্দেহে স্বীকার করেছেন এবং আমিও, নীচের অনুচ্ছেদগুলোয় যা সুস্পষ্ট হবে); হরগান লিখেছিলেন:
বিশ্বাসীদের সাথে আমার কথপোকথন আমার সেই বোধকে দৃঢ় করেছে কেন কিছু বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষ ধর্মকে একাত্ম করে নিয়েছেন। একজন রিপোর্টার আলোচনা করেছেন স্বয়ংক্রিয়, অচেতন স্তরে কথা বলার অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং আরেকজন যীশুর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকার কথা বলেছেন। আমার বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়নি কিন্তু অন্যদের হয়েছে। অন্তত একজন সহকর্মী বলেছেন তার বিশ্বাস দোলা খেয়েছে ডকিন্স এর ধর্মকে ব্যবচ্ছেদ করার ফলাফল হিসাবে। এবং যদি টেম্পলটন ফাউন্ডেশন আমার স্বপ্নের সেই ধর্ম মুক্ত পৃথিবী দিকে অগ্রসর হতে সামান্যতম সহায়তা করে, তা কি এমন খারাপ হতে পারে?
লিটারেরী এজেন্ট জন ব্রকম্যানের ওয়েবসাইট এজ (৬২) এটি প্রকাশ করে দ্বিতীয় দফা প্রচারও করা হয় (যাকে বলা অনলাইন বৈজ্ঞানিক স্যালন), যেখানে এটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যাদের মধ্যে একটি ছিল তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসনের। আমি ডাইসনের মন্তব্যেও প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলাম, তিনি যখন টেম্পলটন পুরস্কার গ্রহন করেছিলেন, সেই সময় দেয়া তার একটি ভাষণ থেকে একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করে। তার ভালো লাগুক বা না লাগুক, টেম্পলটন পুরস্কার গ্রহন করে ডাইসন সারা পৃথিবীকে একটি শক্তিশালী অন্য রকম বার্তা দিয়েছিলেন। সেটা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর ধর্মকে সমর্থন করার ইঙ্গিত:
‘আমি সন্তুষ্ট অসংখ্য খ্রিষ্ট ধর্মমতাবলম্বীদের একজন হিসাবে, যারা আদৌ ট্রিনিটির ডকট্রিন বা গসপেলের
ঐতিহাসিক সত্য নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নয়।
কিন্তু ঠিক এমন ভাবেই কি বলার কথা না কোনো একজন নিরীশ্বরবাদী বিজ্ঞানীর, যিনি নিজেকে একজন খ্রিস্টান হিসাবে ধারণা দিতে চাইবেন? আমি ডাইসনের আরো উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলাম তার পুরষ্কার গ্রহন করার সময় দেয়া সেই ভাষন থেকে, যার মধ্যে কাল্পনিক ব্যাঙ্গাত্মক কিছু প্রশ্নও জুড়ে দিয়েছিলাম (নীচে) একজন টেম্পলটন কর্মকর্তার প্রতি।
ওহ, আপনি আরো গভীর কিছু শুনতে চাইছেন তাহলে? বেশ এটা কেমন?
‘আমি মন এবং ঈশ্বরের মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট কোনো পার্থক্য করিনা, কারণ ঈশ্বর হলো আমাদের মনের একটি অবস্থা যখন এটি আমদের বোধের সীমানা অতিক্রম করে।
আমি কি যথেষ্ট বলিনি এর মধ্যে, আমি কি আমার পদার্থবিদ্যার গবেষণায় ফেরত যেতে পারি এখন?
ওহ, এখনও যথেষ্ট না? বেশ তাহলে, এটা কেমন:
এমন কি বিংশ শতাব্দীর ভয়ঙ্কর অতীত সত্ত্বেও আমি ধর্মে প্রগতির কিছু চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। দুই জন ব্যক্তি যারা আমাদের শতাব্দীতে শয়তানের প্রতিরুপকে প্রতিনিধিত্ব করেন, অ্যাডলফ হিটলার এবং জোসেফ স্ট্যালিন, তারা দুজনেই আত্মস্বীকৃত গোঁড়া নিরীশ্বরবাদী ছিলেন (যা অবশ্য পুরোটাই মিথ্যা, বিস্তৃত আলোচনা আছে সপ্তম। অধ্যায়ে)।
বেশ, এবার কি যেতে পারি আমি?
টেম্পলটনে পুরষ্কার গ্রহনের ভাষণে করা এই উদ্ধৃতিগুলোর প্রভাব ডাইসন কিন্তু অনায়াসে প্রতিরোধ করতে পারতেন, যদি তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন, ঈশ্বর বিশ্বাসের সপক্ষে তিনি আসলে কি প্রমাণ পেয়েছেন, যা কিছুটা শুধুমাত্র আইনস্টাইনীয় অর্থেও চেয়ে বেশী, যা আমি প্রথম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা দিয়েছি, যা আমরা অনেকেই সহজভাবে নিজেদের ধারণার সাথে একাত্ম করতে পারি। আমি যদি হরগানের বক্তব্যটা বুঝি, এটা হচ্ছে টেম্পলটনের টাকা যা বিজ্ঞানকে কলুষিত করছে দুর্নীতি দিয়ে। কিন্তু তার ভাষণ তারপরও দুঃখজনক, কারণ এটি অন্যদের জন্য উদাহরণ তৈরী করবে। টেম্পলটন পুরষ্কার কেমব্রিজে সেই সম্মেলনে যোগ দেয়া সাংবাদিকদের দেয়া সন্মানীর অনেক গুন বেশী, পরিকল্পিত ভাবে এর পরিমানকে রাখা হয়েছে নোবেল প্রাইজের অর্থমূল্যের চেয়ে বেশী। ফাউস্তিয়ান অর্থে আমার বন্ধু ও দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট একবার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “রিচার্ড, যদি কোনো দিন তুমি অর্থ কষ্টে পড়ো।
ভালো হোক কিংবা খারাপ, আমি কেমব্রিজ সম্মেলনে দই দিনই উপস্থিত ছিলাম, আমার নিজের বক্তৃতা দিয়েছি, আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম বেশ কিছু বক্তৃতায়। আমি ধর্মতাত্ত্বিকদের চ্যালেঞ্জ করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গে এর উত্তর দিতে, একজন ঈশ্বর যে কিনা এই জটিল মহাবিশ্বকে ডিজাইন করতে পারেন বা যে কোনো কিছু, তাকেও সেই পরিমান জটিল আর পরিসংখ্যাণগতভাবে অসম্ভাব্য হতে হবে। সবচেয়ে কঠিন যে প্রতিক্রিয়া আমি পেয়েছিলাম তাহলো, আমি খুব নিষ্ঠুরভাবে একটি বৈজ্ঞানিক এপিসটেমিওলজি বা জ্ঞানগত ধারণাকে অনিচ্ছুক ধর্মতত্ত্বের উপর চাপিয়ে দিচ্ছি (এই অভিযোগ সেই NOMA র কথা মনে করিয়ে দেয়, দ্বিতীয় অধ্যায়ে যা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম); ধর্মতাত্ত্বিকরা চিরকালই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করেছে খুব সাধারণ সরল হিসাবে, আমি কে? একজন বিজ্ঞানী হয়ে ধর্মতাত্ত্বিকদের জ্ঞান দেবার, যে তাদের ঈশ্বরকে জটিল হতে হবে? বৈজ্ঞানিক যুক্তি, যেমন আমি আমার নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত, এখানে তা অপ্রযোজ্য কারণ ধর্মতাত্ত্বিকরা মনে করেন তাদের ঈশ্বরের অবস্থান বিজ্ঞানের বাইরে।
আমি কিন্তু এমন মনে হয়নি যে, ধর্মতত্ত্ববিদরা যারা এই এড়িয়ে যাবার মত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিচ্ছেন তারা ইচ্ছা করেই অসৎ হচ্ছেন। আমি মনে করি তারা সৎভাবেই আন্তরিক। যাইহোক বারবার আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল, ফাদার টেইলহার্ড দ্য শারদাঁর দ্য ফেনোমোেেন অব ম্যান বইটি সম্পর্কে পিটার মেদাওয়ারের (৬৩) মন্তব্যটি, যেটাকে বলা যেতে পারে সর্বকালের সেরা নেতিবাচক পুস্তক সমালোচনাঃ ‘এর লেখককে অসতোর জন্য ক্ষমা করা যেতে পারে শুধুমাত্র এই অর্থে যে, তিনি অন্যদের প্রতারণা করার করা আগে নিজেকে প্রতারণা করার জন্য বিশেষ কষ্ট করেছেন’ (৬৪)।; আমার সেই কেমব্রিজে দেখা হওয়া ধর্মতাত্ত্বিকরা তাদেরকে সুরক্ষা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন একটি এপিসটেমোলজিক্যাল নিরাপদ এলাকায়, যেখানে যৌক্তিক কোনো যুক্তি তাদের স্পর্শ করতে পারেনা কারণ তারা বিশেষ ঐশী আদেশের মত তারা ঘোষণা দিয়েছেন, এই যুক্তির আক্রমণ থেকে তারা মুক্ত। আমি বলার কে যে, যৌক্তিক যুক্তি হলো একমাত্র গ্রহনযোগ্য যুক্তি? বৈজ্ঞানিক ছাড়াও আরো অনেক প্রক্রিয়া আছে জ্ঞান আহরণের এবং সেরকম কোনো একটি প্রক্রিয়াকে অবশ্যই বেছে নিতে হবে ঈশ্বরকে বুঝতে।
এই অন্যভাবে জানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ হচ্ছে ব্যক্তিগত, ঈশ্বর সংক্রান্ত সাবজেকটিভ বা আত্মগত অভিজ্ঞতা। কেমব্রিজে বেশ কয়েকজন আলোচক দাবী করেছিলেন, ঈশ্বর তাদের সাথে কথা বলেছেন, তাদের মাথার মধ্যে, কোনো মানুষ যেভাবে কথা বলতে পারে, সেভাবে স্পষ্টভাবে, ব্যক্তিগতভাবে। আমি তৃতীয় অধ্যায়ে ইল্যুশন বা মায়া এবং হ্যালুসিনেশন নিয়ে কথা বলেছি (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তি); কিন্তু কেমব্রিজ সম্মেলনে আমি দুটি বিশেষ পয়েন্ট যোগ করেছিলাম : যদি ঈশ্বর সত্যি সত্যি মানুষের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন, তাহলে সেই বিষয়টি বা সত্যটি খুবই স্পষ্টভাবেই অবশ্যই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে না। ঈশ্বর তার কোনো অপার্থিব জগতের নিজস্ব নিবাস থেকে হঠাৎ করেই আবির্ভুত হবেন, আমাদের বিশ্বর মধ্য দিয়ে যেখানে তার বার্তা মানুষের মস্তিস্ক বুঝতে সক্ষম হবে এবং সেই ঘটনার সাথে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তা কি করে হতে পারে? দ্বিতীয়ত, একজন ঈশ্বর যিনি বহু মিলিয়ন মানুষকে একই সাথে বোধগম্য বার্তা পাঠানো ও তাদের সবার কাছে থেকে বার্তা একই সাথে গ্রহন করতে সক্ষম, তিনি আর যাই হোক না কেন, জটিল ব্যতীত সরল কোনো সত্তা হতে পারেন না। এত বেশী ব্যান্ডউইথ! ঈশ্বরের অবশ্যই নিউরন দিয়ে তৈরী মস্তিস্ক নেই বরং একটি সিপিইউ যা সিলিকন দ্বারা তৈরী। যদি তার যে ক্ষমতা আছে বলে বলা হয়, তিনি অবশ্যই এমন কিছু হবেন যিনি খুব সূক্ষ্ম জটিলতার সাথে বিস্তারিত ভাবে নন র্যানডোম ভাবে সৃষ্ট আমাদের জানা মতে সবচেয়ে বড় কোনো ব্রেইন বা সবচেয়ে বড় কোনো কম্পিউটার এর চেয়েও বহুগুনে বিশাল হবে।
বার বার আমার ধর্মতত্ত্ববিদ বন্ধুরা একটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন, তাহলো, কোনো কিছু না থাকার চাইতে কিছু থাকার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। সবকিছুর নিশ্চয়ই একটি প্রাথমিক কারণ থাকার কথা এবং আমরাও বরং এর নাম দিলাম ঈশ্বর। হ্যাঁ, আমি বলেছি, এটা অবশ্যই এমন কিছু ছিল যা খুব সাধারণ এবং সরল, এবং সুতরাং আমরা একে যে নামেই ডাকিনা কেন ঈশ্বর অবশ্যই এর সঠিক নাম হতে পারেনা (যদি না আমরা স্পষ্ট ভাবে খুব ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন বিশ্বাসী কারো মনে ‘ঈশ্বর’ শব্দটির সাথে জড়িত নানা অনুসঙ্গ এবং ভাবকে পরিহার করতে পারি); যে প্রথম কারণটাকে আমরা খুজছি, সেটা নিশ্চয়ই খুব সরল একটা ভিত্তি ছিল কোনো স্বয়ংক্রিয় এবং স্বতঃস্ফুর্ত বা সে বুটস্ট্র্যাপিং ক্রেইন এর, যা আমাদের জানা সমস্ত পৃথিবীটাকে টেনে তুলে এনেছে আজকের এই জটিল অস্তিত্বের পর্যায়ে। যদি প্রস্তাব করা হয় মূল আদি কারণ বা প্রক্রিয়া শুরু কারী সত্তাটি যথেষ্ট জটিল ছিল, যে কিনা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা পরিকল্পনা সৃষ্টির পিছনে সময় ক্ষেপন করেছে এবং একই সাথে বহু মিলিয়ন মানুষের মন পড়তে পারার ক্ষমতা তো আছেই, ব্যপারটা অনেক শের ব্রীজ খেলায় পারফেক্ট কার্ড বা হাত পাওয়ার সমতুল্য। পৃথিবীতে জীবনের বৈচিত্রর দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমাজনের ক্রান্তীয় বনে, জালের মত করে ছড়ানো গাছের কাণ্ড, ব্রোমেলিয়াডের ঝোঁপ, শিকড় আর ফ্লাইং বাট্রেস, এদের নিজস্ব পিপড়া বাহিনী এবং তাদের জাগুয়ার, টাপির, পেকারী, গেছোব্যাঙ এবং প্যারোট। যা দেখছেন তা হলো সেই নিখুঁত তাসের হাত পাওয়ার মত প্রায় অসম্ভাব্য পরিসংখ্যানের সমতুল্য (এবার ভাবুন আরো কতভাবে আপনি এটি সন্নিবেশ করতে পারেন এর অংশগুলো, যার কোনোটাই সফল হবে না)– শুধু আমরা জানি কেমন করে এসবের সৃষ্টি হয়েছে : প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্রমান্বয়ে কাজ করা ক্রেইনের মাধ্যমে। সবকিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে এই প্রস্তাবকে মুখ বুজে মেনে নেয়ার জন্য শুধুমাত্র বিজ্ঞানীরাই প্রতিবাদ করছেন না, আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও সরব এর বিরুদ্ধে, প্রথম কারণ হিসাবে প্রস্তাব করা, সেই মহান অজানা যা কোনো কিছু না থাকার বদলে অস্তিত্ব থাকার জন্য দায়ী, যে কিনা পুরো মহাবিশ্ব ডিজাইন করতে সক্ষম এবং একই সাথে লক্ষ কোটি মানুষের মনের কথা পড়তে সক্ষম। এ ধরনের প্রস্তাব আসলে কোনো ব্যাখ্যা খোঁজার প্রচেষ্টা থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ার মত। এটি আত্মতুষ্টি ও আত্মপ্রবঞ্চনা, চিন্তাকে অস্বীকারকারী দ্বিতীয় অধ্যায় ব্যাখ্যা করা আকাশ হুক প্রস্তাবের একটি ভয়াবহ প্রদর্শনী।
আমি কোনো সংকীর্ণ বৈজ্ঞানিক চিন্তা করার প্রক্রিয়ার ওকালতি করছি না। কিন্তু অন্ততক্ষে যেকোনো সৎ সত্য অনুসন্ধান প্রচেষ্টা অবশ্যই এই অকল্পনীয় সুবিশাল অসম্ভাব্যতাগুলোকে, যেমন কোনো ক্রান্তীয় বনাঞ্চল, কোনো প্রবাল প্রাচীর বা একটি মহাবিশ্ব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, যা তা হলো ‘ক্রেইন’, কোনো স্কাই হুক’ না। এই ক্রেইনকে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন হতে হবে তেমন না। তবে স্বীকার করতেই হবে এরচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা আর কেউ কখনো ভাবেনি। কিন্তু অন্য প্রক্রিয়া থাকতে পারে যা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। হয়েতো এটাই সেই ইনফ্লেশান বা স্ফীতি যা পদার্থবিদরা প্রস্তাব করেছেন যা মহাবিশ্বের অস্তিত্বের প্রথম ইয়োক্টো সেকেন্ড ( ১ X ১০২৪) অংশ বিশেষ দখল করে ছিল, যখন হয়তো এটা আরো ভালো করে বোঝা সম্ভব হবে, হয়তো দেখা যাবে এটি একটি কসমোলজিক্যাল ক্রেইন যা ডারউইনের বায়োলজিক্যাল ক্রেইনের মত। বা হয়েতো সেই দুর্লভ ক্রেইন যা কসমোলজিষ্টরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তা হয়তো ডারউইনের ধারণাটারই একটি অন্য সংস্করণ: সম্মালিন এর প্রস্তাবিত মডেল বা এর সদৃশ কিছু। বা হয়তো বা এটা হবে সেই মাল্টিভার্স এবং অ্যানথ্রোপিক মূলনীতির, যা মার্টিন রীস এবং অন্যরা সমর্থন করেন। এমন কি এটা হতে পারে কোনো অতিমানবীয় ডিজাইনার, কিন্তু, যদি তাই হয়, এটা অবশ্যই সেই ঈশ্বরবাদীদের প্রস্তাবিত ডিজাইনার হবেন না, যিনি হঠাৎ করে অস্তিত্বশীল হওয়া কেউ না বা এমন কেউ না যিনি সবসময়ই ছিলেন। যদি ( যা আমি একমুহূর্তের জন্য বিশ্বাস। করিনা) আমাদের মহাবিশ্ব ডিজাইন করা হয়ে থাকে, এবং এ ফর্টিওরি বা আরো জোরালো যুক্তির কারণে, যদি ডিজাইনার আমাদের চিন্তা পড়ার ক্ষমতা রাখেন, আমাদের সবজান্তা উপদেশ দেয়া, ক্ষমা এবং পাপ থেকে মুক্তি দেন, সেই ডিজাইনার নিজেও কোনো এক ধরনের ক্রমান্বয়ে পরিবর্ধনশীল এসকেলেটর বা ক্রেইন এবা অন্য কোনো মহাবিশ্বের ডারউইনবাদের একটি সংস্করণের সর্বশেষ ফলাফল।
কেমব্রিজে আমার সমালোচনাকারীদের শেষ আশ্রয়ের ভরসা ছিল আক্রমণ। আমার সমস্ত বিশ্ব চিন্তাকে অপবাদ দেয়া হলো ‘উনবিংশ শতাব্দীর’ আখ্যা দিয়ে। এটা এত বাজে একটা যুক্তি, আমি বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রায়শই এর মুখোমুখি হতে হয় আমার। বলাবাহুল্য, কোনো যুক্তিকে উনবিংশ শতাব্দীর বলা কিন্তু এই যুক্তির কি সমস্যা সেটা ব্যাখ্যা করা না। অনেক উনবিংশ শতাব্দীর ধারণাই ছিল বেশ ভালো ধারণা, আর ডারউইনের ভংঙ্কর ধারণাটি তো অবশ্যই। যাই হোক এই বিশেষ ধরনের সমালোচনা মনে হয় একটু বেশী বাড়াবাড়ি, কারণ এটি এমন একজন ব্যক্তির কাছে থেকে এসেছে (একজন বিখ্যাত কেমব্রিজ ভূতত্ত্ববিদ, নিঃসন্দেহে ফাউস্তিয় পথ ধরে টেম্পলটন পুরস্কার পাবার পথে অনেক এগিয়ে আছেন); যিনি তার খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছেন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে, যাকে তিনি বলেছেন, নিউ টেষ্টামেন্ট এর নব্য ঐতিহাসিক সত্যতা। ঠিক এই বিষয়টার প্রতি সংশয়ের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর জার্মান ধর্মতাত্ত্বিকরা প্রমাণ ভিত্তিক ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে। আসলেই এ বিষয়ে খুব দ্রুত তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন সম্মেলনে উপস্থিত ধর্মবিদরা।
যাই হোক না কেন আমি জানি প্রাচীনদের এই ‘উনবিংশ শতাব্দী’র বিদ্রূপটা। এটা সেই গ্রামের নাস্তিক’ এর সাথে মানানসই, এটা সেই ‘আপনি যা মনে করুন না কেন, হা হা হা, আমরা কোনো সাদা দাড়ীওয়ালা বৃদ্ধ মানুষকে বিশ্বাস করি না আর, হা হা হা। এই সব ঠাট্টাই অন্য কিছুকে বোঝানোর একটি সংকেত। যেমন ১৯৬০ সালে আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম ‘আইন শৃঙ্খলা ছিল কালোদের বিরুদ্ধে বিরুপ মনোভাবের একটি সাংকেতিক প্রকাশ। তাহলে, ধর্ম সম্পর্কে যুক্তির ক্ষেত্রে আপনার চিন্তাধারা সেই উনবিংশ শতাব্দীর আসলে কি সাংকেতিক বার্তা বহন করে? এটা আসলে সংকেত হচ্ছে এই বাক্যটার: ‘এ ধরনের সরাসরি প্রশ্ন আমাকে জিজ্ঞাসা করতে আপনি এত সুলরুচির, চক্ষু লজ্জাহীন, কেমন করে আপনি এত অনুভূতিহীন এবং অভদ্র হতে পারলেন: যেমন, আপনি কি অলৌকিক অতিপ্রাকৃত ঘটনায় বিশ্বাস করেন ‘বা আপনি কি বিশ্বাস করেন যীশুর জন্ম হয়েছিল কুমারী মায়ের গর্ভে? আপনি কি জানেন না ভদ্র সমাজে এ ধরনের প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করেনা? এই ধরনের প্রশ্নের চলন ছিল উনবিংশ শতাব্দীতে। কিন্তু চিন্তা করুন ধর্মবাদীদের প্রতি আজ এ ধরনের এমন সরাসরি, সত্যিকারের প্রশ্ন করাটা কেন অনম্রতার পরিচয়, কারণ এটি বিব্রতকর! কিন্তু প্রশ্ন না এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হচ্ছে। বিব্রতকর, যদি এদের উত্তর হ্যাঁ হয়ে থাকে।
উনবিংশ শতাব্দীর সম্পর্কটা এখন স্পষ্ট। উনবিংশ শতাব্দীই ছিল শেষ সময়, যখন সম্ভব ছিল কোনো শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কুমারী মায়ের জন্ম দেয়ার মত অলৌকিক ঘটনাকে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার সম্ভাবনা ছাড়াই সত্য বলে বিশ্বাস করা যেত। উত্তরের জন্য চাপাচাপি করে প্রশ্ন করলে, অনেক শিক্ষিত খ্রিষ্টান আজও অনেক বেশী অনুগত, যারা কুমারী মাতার জন্ম দেয়া এবং পুনর্জন্মকে অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু বিষয়টি তাদের বিব্রত করে, কারণ তাদের যৌক্তিক মন জানে এটি কত অসম্ভব একটি ব্যপার, সুতরাং তাদের প্রতি এ ধরনের প্রশ্ন না করাটাকে তারা শ্রেয়তর মনে করেন। সেকারণে আমার মত কেউ যদি নাছোড়বান্দার মত এই প্রশ্নটি করতেই থাকে, আমাকেই অভিযুক্ত করা হয় “উনবিংশ শতাব্দীর’ মানসিকতা সম্পন্ন বলে। চিন্তা করলে দেখবেন বিষয়টি আসলেই হাস্যকর।
আমি সেই সম্মেলন ত্যাগ করি, আরো প্ররোচিত, নতুন শক্তিতে বলীয়ান এবং আমার বিশ্বাস দৃঢ়করণের মাধ্যমে, যে অসম্ভাব্যতা থেকে যুক্তি–সেই আল্টিমেট বোয়িং ৭৪৭– প্রস্তাবটি আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্বেও বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি, যার বিরুদ্ধে আমি এখনও কোনো ধর্মতাত্ত্বিককে কোনো যুক্তিযুক্ত উত্তর দিতে শুনিনি, বহুবার তাদের সেই সুযোগ এবং আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও। ড্যান ডেনেট সঠিকভাবেই বর্ণনা করেছিলেন, এটি হচ্ছে একটি অখণ্ডনযোগ্য পাল্টা যুক্তি। এখনও এটি শক্তিশালী সেই সময়ের মত যখন দুই শতাব্দী আগে হিউমের সংলাপে ফিলো একে ব্যাবহার করেছিলেন ক্লীনথেসকে পরাজিত করার জন্য। কোনো আকাশ থেকে নেমে আসা স্কাইহুক বড় জোর এই সমস্যার সমাধানকে স্থগিত করতে পারে। কিন্তু হিউম তখন কোনো ক্রেইনের কথা ভাবতে পারেননি, সুতরাং খানিকটা পিছু তাকে হটতে হয়েছে; অবশ্যই ডারউইন, সেই গুরুত্বপূর্ণ ক্রেইনটি সরবরাহ করেছিলেন, হিউম এটিকে কত বেশী যে পছন্দ করতেন তা বলাবাহুল্য।
এই অধ্যায়ে আমার বই এর কেন্দ্রীয় যুক্তিগুলো আছে এবং সে কারণে, পুনরাবৃত্তি হবার ঝুঁকি নিয়েও আমি সংক্ষিপ্ত আকারে এই ছয়টি আলাদা পয়েন্টের আকারে উল্লেখ করছিঃ
১. বহু শতাব্দী ধরেই মানুষের বুদ্ধিমত্তার প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি ছিল, কেমন করে মহাবিশ্বে জটিল এবং আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভাব্য ডিজাইন বা পরিকল্পনার এই রুপটির উদ্ভব হয়েছে।
২. স্বাভাবিকভাবে প্রবণতা হলো, এই আপাতদৃষ্টিতে ডিজাইন বা পরিকল্পনাকে সত্যিকারের ডিজাইন হিসাবে গুনারোপ করে। মানুষের তৈরী কোনো বস্তু যেমন একটি ঘড়ি, যেখানে পরিকল্পনাকারী বা ডিজাইনার আসলেই একজন বুদ্ধিমান প্রকৌশলী। খুবই লোভনীয় যে একটি চোখ, একটি পাখা, একটি মাকড়শা বা কোনো মানুষের ক্ষেত্রেও এই একেই যুক্তি প্রয়োগ করা।
৩. এই লোভনীয় প্ররোচণাটি মিথ্যা, কারণ ডিজাইনার হাইপোথিসিসটি আরো বড় একটি প্রশ্নের জন্ম দেয়, কে ডিজাইন করেছে এই সবকিছুর ডিজাইনারকে। আমরা যে মূল সমস্যাটি নিয়ে প্রথমে শুরু করেছিলাম তা ছিল পরিসংখ্যানগত দিক থেকে অসম্ভাব্যতাকে ব্যাখ্যা করার বিষয়টি। বেশী অসম্ভব কিছুকে প্রস্তাবকরা অবশ্যই কোনো সমাধান নয়। আমাদের দরকার একটি ক্রেইন, কোনো স্কাই হুক না। কারণ ক্রেনই পারে সেই কাজটি করতে, ধীরে ধীরে ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো একটি উপায়ে সরলতা থেকে সেই অসম্ভাব্য জটিলতার দিকে অগ্রসর হতে।
৪. সবচেয়ে অসাধারণ এবং শক্তিশালী ক্রেইন এই অবধি যা আবিষ্কার হয়েছে তা হলো প্রাকৃতিক নির্বাচেনের মাধ্যমে ডারউইনীয় বিবর্তন। ডারউইন এবং তার পরবর্তী অনুসারীরা প্রমাণ করেছেন কিভাবে জীবিত প্রাণি, তাদের অবিশ্বাস্য রকম চমকপ্রদ পরিসংখ্যানগত অসম্ভাব্যতা ও আপাতদৃষ্টিতে ডিজাইন মনে হওয়ার মত বৈশিষ্ট্যগুলো কিভাবে বিবর্তিত হয়েছ মন্থর একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়ায় খুব সরল একটি সুচনা থেকে। আমরা এখন নিরাপদে বলতে পারে, জীবিত প্রাণিদের মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্যের ডিজাইনের বিভ্রম আসলেই শুধুমাত্র একটি বিভ্রম।
৫. পদার্থবিজ্ঞানের জন্য সমতুল্য কোন ক্রেইন আমাদের নেই। কোনো একধরনের মাল্টিভার্স তত্ত্ব নীতিগত ভাবে পদার্থবিদ্যার জন্য সেই ব্যাখ্যার কাজটি পারে যা জীববিজ্ঞানের জন্য ডারউইনবাদ করেছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা ডারউইনবাদের জীববিজ্ঞানীয় সংস্করনের হালকাভাবে কম সন্তোষজনক হবে, কারণ ভাগ্যের উপর এটির দাবী অনেক বেশী। কিন্তু অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে প্রস্তাব করার জন্য যে, আমাদের সীমাবদ্ধ মানবীয় অন্তর্দৃষ্টি যতটুকু স্বস্তিবোধ করে তার চেয়ে বেশী ভাগ্যের ভূমিকার কথা।
৬. জীববিজ্ঞানে ডারউইনবাদ যেমন শক্তিশালী পদার্থবিজ্ঞানে তেমন শক্তিশালী কোনো কিছু, আরো উত্তম কোনো ক্রেইনের ব্যাখ্যার জন্য আমাদের আশা ছাড়া ঠিক হবেনা। কিন্তু এমনকি জীববিজ্ঞানের ক্রেইনের মতো আরো বেশী সন্তোষজনক কোনো ক্রেনের অনুপস্থিতিতে, অপেক্ষাকৃতভাবে দুর্বল ক্রেইনটি যা বর্তমানে আমাদের আছে, যা সাথে বাড়তি শক্তি হিসাবে যুক্ত অ্যানথ্রোপিক মূলনীতি সুস্পষ্টভাবেই একজন বুদ্ধিমান। ডিজাইনারের স্বপরাজিত স্কাই হুক হাইপোথিসিসের চেয়ে উত্তম।
যদি এই অধ্যায়ের যুক্তিগুলো মেনে নেয়া হয়, তাহলে ধর্মকে সত্যি দাবী করার যুক্তি দ্য গড হাইপোথিসিস, আসলেই প্রমাণযোগ্য থাকে না। ঈশ্বরের প্রায় নিঃসন্দেহে কোনো অস্তিত্ব নেই। এই বই এর আপাতত এটাই মূল উপসংহার। অনেক ধরনের প্রশ্ন এখন উঠবে। এমন কি আমরা যদি মেনে নেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই, তারপরও কি ধর্মের টিকে থাকার বহু রসদ থাকার কথা নয়? বিষয়টা কি সান্ত্বনার নয়? এটা কি মানুষকে ভালো কাজ করতে প্ররোচিত করেনা? ধর্ম না থাকলে, আমরা কিভাবে কোনোটা ভালো তা জানবো? কেনই বা, তাহলে এর প্রতি এত শত্রুভাবাপন্ন হচ্ছি? যদি এটি মিথ্যাই হয়ে থাকে, তাহলে কেন পৃথিবীর প্রতিটি সাংস্কৃতিকে ধর্ম বিষয়টির অস্তিত্ব আছে? সত্যি হোক কিংবা মিথ্যা, ধর্মর উপস্থিতি সর্বব্যাপী, তাহলে কোথা থেকে এটি আসলো? পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা এই শেষ প্রশ্নটির উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো।
পাদটীকা:
(১) গ্যামবিট (Gambit): দাবা খেলার একটি চাল, যেখানে কোনো খেলোয়াড় তার কোনো একটি গুটিকে (সাধারণত সৈন্য) বিসর্জন দেয় আরো সুবিধাজনক কোনো একটি অবস্থান পাবার পাবার আশায়। সাধারণত কোনো কিছু করা বা বলা সুবিধা কিংবা কাঙ্খিত ফলাফল পাবার আশায়।
(২) ফ্রেড হয়েল (১৯১৫-২০০১) ব্রিটিশ কসমোলজিষ্ট, লেখক; বিশেষভাবে খ্যাত তিনি স্টেলার নিউক্লিওসিনথেসিস তত্ত্বের এর জন্য।
(৩) নালিন চন্দ্র বিক্রমাসিংহ (জন্ম ১৯৩৯), শ্রীলংকা জন্ম নেয় ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিজীববিজ্ঞানী।
(৪) সৃষ্টিতত্ত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই উদ্ধৃতির গুরুত্ব, ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আছে গের্ট কর্টহফের একটি পর্যালোচনায়, সেটি পাওয়া যাবে এখানে: http:// home.wxs.nl/–gkorthof/ kortho46a.htm;
(৫) ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে অনেক সময়ই নির্দয়ভাবে বলা হয় স্যুট বা টাক্সিডো পরা সৃষ্টিতত্ত্ববাদ।
(৬) বিজ্ঞানের প্রেক্ষিতে চান্স (Chance) শব্দটার অর্থ ভিন্ন। বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট নন অনেকেই মনে করেন বিবর্তন হচ্ছে চান্সের বা সুযোগের মাধ্যমে। এই শব্দটা ব্যবহার করে তারা যেটা বোঝাতে চাইছেন, বিবর্তন হচ্ছে কোনো কারণ বা কোনো লক্ষ্য ছাড়াই। সেই সূত্রানুযায়ী প্রকৃতিতে সবকিছুই –রাসায়নিক বিক্রিয়া, আবহাওয়া, গ্রহের গতি, ভুমিকম্প সবকিছু হচ্ছে চান্সের মাধ্যমে, এইসব কিছু কোনোটারই কোনো উদ্দেশ্য বা পারপাস নেই। কিন্তু আসলেই বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে এই উদ্দেশ্য এবং ‘লক্ষ্য’,এই বিষয়গুলোর শুধু অস্তিত্ব আছে মানুষের চিন্তার জগতে, তারা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাকে উদ্দেশ্যপূর্ণ মনে করেন না। কিন্তু বিজ্ঞানীরাও রাসায়নিক বিক্রিয়া বা গ্রহদের গতি এসব কিছুকেও কোনো চান্স জনিত ঘটনা মনে করেন না। কারণ বিজ্ঞানে, চান্স। শব্দটার ভিন্ন অর্থ আছে। যদিও চান্স এর অর্থ হতে পারে জটিল কোনো দর্শনের বিষয়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা চান্স বা র্যানডমনেস শব্দকে ব্যবহার করেন এই অর্থে: যখন কোনো ভৌত কারণ বেশ কয়েকটি ফলাফল সৃষ্টি করতে পারে, আমরা আগে থেকে যা অনুমান করতে পারিনা যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ফলাফল কি হবে। যাই হোক, আমরা হয়তো নির্দিষ্ট করতে পারি, এদের কোনো একটি ফলাফলের সম্ভাবনা বা প্রোবাবিলিটি এবং এভাবে তাদের ঘটার হার বা ফ্রিকোয়েন্সি কত। যেমন, আমরা কোনো দম্পতির পরবর্তী শিশুর লিঙ্গ কি হবে বলতে পারিনা, তবে যথেষ্ট নিশ্চয়তার সাথে আমরা এটা বলতে পারি, পরবর্তীতে তাদের মেয়ে শিশু হবার সম্ভবনা প্রায় ০.৫ বা ৫০ শতাংশ; প্রায় সবকিছুতে একই সাথে দুটি জিনিসের প্রভাব দেখা যায়, চান্স ( অনুমান করা যায় না) এবং নন-র্যানডোম বা ডিটারমিনিষ্টিক বা অনুমানযোগ্য কারণগুলো। আমাদের মধ্যে যে কারোই গাড়ী দুর্ঘটনা হতে পারে অন্য কোনো ড্রাইভারের অনুমান করা সম্ভব না বা আনপ্রেডিকটেবল আচরণের জন্য, এবং এই সম্ভাবনাকে আমরা অনুমান করা যায় এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি যদি আমরা মাতাল হয়ে গাড়ী চালাই। বিবর্তনের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন হচ্ছে ডিটারমিনিষ্টিক (deterministic বা predictable), নন-র্যানডোম একটি প্রক্রিয়া। এবং সেই একই সাথে বিবর্তনে গুরুত্বপর্ণ র্যানডোম প্রক্রিয়াও আছে, যেমন মিউটেশন এবং জেনেটিক অ্যালিল বা হ্যাপ্লোটাইপদের র্যানডোম কমবেশী নানা হার হওয়া (random genetic drift)।
(৭) ধ্রুপদী ল্যাটিন কিংবা গ্রীকে সেটা তেমনভাবে কিন্তু ঘটেনি, ল্যাটিন Home (গ্রীক Anthropo) অর্থ হচ্ছে মানুষ, যেমন Vir (Andro-) অর্থ পুরুষ, এবং Femina (Gyne-) র অর্থ হচ্ছে নারী। সেকারণে Athropology র বিষয় হচ্ছে মানব জাতি। যেখানে Andrology ও Gynecology চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র দুটি শাখা।
(৮) ডগলাস অ্যাডামস, ব্রিটিশ লেখক,নাট্যকার।
(৯) এই উদ্ধৃতিটি প্রয়াত ডগলাস অ্যাডাম এর দি স্যামন অব ডাউট এর ৯৯ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া। আমার Lament for Douglas লেখাটি তার মৃত্যুও ঠিক একদিন পরেই লেখা, এবং তার বই দি স্যামন অব ডাউট (The Salmon of Doubt (২০০৩) এর এপিলোগ এবং আমার A Devils Chaplain বইটিতে; যেখানে St. Martin-in-the-Fields চার্চে তার স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে আমার দেয়া ইউলোজটি প্রকাশিত হয়েছে।
(১০) ড্যানিয়েল ডেনেট, যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক।
(১১) Der Spiegel, 26 Dec. 2005 এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকার।
(১২) জন রাসকিন (১৮১৯-১৯০০): ব্রিটিশ শিল্প সমালোচক, পৃষ্ঠপোষক, শিল্পী, চিন্তাবিদ।
(১৩) লিওনার্ড সাসকিন্ড (জন্ম ১৯৪০) যুক্তরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।
(১৪) Susskind, L. (2006). The Cosmic Landscape: String Theory and the Illusion of Intelligent Design. New York: Little, Brown. Susskind (2006: 17).
(১৫) ভিক্টর জন স্টেঙ্গার (১৯৩৫-২০১৪) যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থবিজ্ঞানী,দার্শনিক, লেখক।
(১৬) পিটার অ্যাটকিন্স (জন্ম ১৯৪০) ব্রিটিশ রসায়নবিদ, অক্সফোর্ডের প্রাক্তন অধ্যাপক।
(১৭) ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি (Irreducible Complexity) হচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বেও প্রস্তাবকদের একটি যুক্তি যা বলছে, কোন কোন জীববিজ্ঞানীয় সিস্টেম বা তন্ত্র এতবেশী সূক্ষ্ম এবং জটিল যা কিনা কোন সরলতর বা অধিক অসম্পূর্ণ কোন পূর্বসূরি থেকে বিবর্তিত হতে পারে না, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, যে প্রক্রিয়াটি কিছু সুবিধাজনক প্রাকৃতিকভাবে ঘটিত ধারাবাহিক চান্স বা আপতনের মাধ্যমে সৃষ্ট মিউটেশনেরর উপর কাজ করে। এই যুক্তিটি ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের একটি, এবং বৃহত্তর বৈজ্ঞানিক সমাজে এটি প্রত্যাখ্যাত, সংখ্যাগরিষ্ট বিজ্ঞানীরা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনকে ছদ্মবিজ্ঞান হিসাবে মনে করেন। সৃষ্টিতত্ত্ববাদী প্রাণরসায়নবিদ মাইকেল বীহি এই ধারণাটির উদ্ভাবক, তিনি একে সংজ্ঞায়িত করেন, কোন একটি ইররিডিউসিবল কমপ্লেক্সিটি সিস্টেম হচ্ছে এমন কোনো একটি সিস্টেম যা তৈরী করে বেশ কিছু পারস্পরিক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশদের সমন্বয়ে, পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল এই অংশগুলো প্রত্যেকেই মূল কিছু কাজের সাথে জড়িত, এবং এদের যে কোন একটিকে যদি সরিয়ে ফেলা হয়য় পুরো সিস্টেমটাই কার্যকরীভাবে কাজ করা স্থগিত করে দেয়। তবে বিবর্তন জীববিজ্ঞানী প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, এ ধরনের কোন সিস্টেমও বিবর্তিত হতে পারে।
(১৮) Euplectella
(১৯) ডেভিড অ্যাটেনবরা, ব্রিটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা ও উপস্থাপক।
(২০) Aristolochia trilobata
(২১) Sequoiadendron giganteum
(২২) Climbing mount improbable
(২৩) Hunt The Slipper: বোকা বানানোর একটি খেলা। সব খেলোয়াড়রা যেখানে গোল হয়ে আসন করে বসে এমনভাবে যেমন একটি স্যান্ডেল তাদের হাটুর নীচ দিয়ে একজন থেকে অন্যজনের কাছে হাতবদল করা যেতে পারে। প্রতিটি খেলোয়াড় এভাবে একে অপরের কাছে স্যান্ডেল বা কোনো কিছু হস্তান্তর করে হাটুর নিচ দিয়ে গোপনে, এবং বৃত্তের বাইরে ঘুরতে থাকা একজন সেটি হাতে আছে যার তাকে অনুমান করে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। যে শিকার করছে তাকে যারা লুকাচ্ছে তারা ইঙ্গিত দেয় সংকেতের সাহায্যে, যেমন যদি সে যার কাজে স্যান্ডেলটি লুকানো আছে তার কাছাকাছি আসে, বলা হয় সে খুব গরম হয়ে আছে, যদি দূরে যায় তখন বলা হয় সে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
(২৪) ডিয়েট্রিশ বনহোয়েফার (১৯০৬-১৯৪৫) জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক, যাজক।
(২৫) ম্যাথিউ রিডলী (জন্ম ১৯৫৮) সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক।
(২৬) জে বি এস হলডেন (১৮৯২-১৯৬৪) ব্রিটিশ (পরে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহন) বিজ্ঞানী, গবেষণার বিষয় শরীরতত্ববিদ্য, বিবর্তন জীববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জৈবপরিসংখ্যান।
(২৭) কার্ল পপার (Karl Popper ) এর তত্ত্ব বা তার মতবাদ সংশ্লিষ্ট; বিশেষ করে সেই তত্ত্ব সংক্রান্ত কোনো একটি হাইপোথিসিস যাকে কোন পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে দৃষ্ট কোন ব্যতিক্রম দিয়ে মিথ্যা প্রমাণ করা যায় কিন্তু কখনোই চূড়ান্তভাবে হিসাবে তাদের প্রমাণ করা যায়না।
(২৮) ফিয়াট (Fiat) ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে কোন ঐশী আদেশ বা নির্দেশ যা কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে শূন্য থেকে বা কোন বাড়তি প্রচেষ্টা ছাড়াই। যেমন ফিয়াট লুক্স (লেট দেয়ার বি লাইট);
(২৯) আলেক্সজান্ডার গ্রাহাম কেয়ার্ণ-স্মিথ (জন্ম ১৯৩১) স্কটিশ রসায়নবিদ, জীবনের উৎপত্তির ব্যপারে ক্লে ক্রিষ্টাল সেলফ রেপলিকেশন তত্ত্বটি প্রস্তাব করেন।
(৩০) মাইকেল বিহি (জন্ম ১৯৫২) আমেরিকার প্রাণরসায়নবিদ, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন এর সমর্থক।
(৩১) Behe, M. J. (1996). Darwin’s Black Box, New York: Simon & Schuster
(৩২) কল্পকাহিনীতে এর একটি উদাহরণ দিতে পারি এর, লেখক ফিলিপ পুলম্যান তার ডার্ক ম্যাটেরিয়ালস এ কল্পনা করেছিলেন এক প্রজাতির প্রাণীর, মুলো, যাদের সহাবস্থান ছিল বৃক্ষের সাথে যারা মাঝখানে ছিদ্রযুক্ত গোলাকৃতি বীজবাহী পড় তৈরী করতো; এই পড়গুলো মুলো ব্যবহার করতে চাকা হিসাবে। চাকাগুলো যেহেতু শরীরের অংশ ছিলনা, সে কারণে তাদের স্নায়ু বা রক্ত সংযোগও ছিলনা যারা মুলেফার অ্যাক্সল ( শিং এর বাকানো নোখ, হাড়) মধ্যে পেচিয়ে যেতো। পুলম্যান দূরদৃষ্টিপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ ছিল, সিস্টেমটি কাজ করতো কারণ গ্রহটিতে প্রাকৃতিক ভাবে ব্যাসল্ট এর ফিতা বেছানো রাস্তা ছিল, যা রাস্তা হিসাবে কাজ করতো। রাস্তাহীন অমসৃন ভুমিতে চাকা খুব একটা উপকারী নয়।
(৩৩) বিস্ময়করভাবে, মাংসপেশীর মূলনীতি আরো একটি তৃতীয় মোডে বা উপায়ে ব্যবহৃত হয়, কিছু কীটপতঙ্গ, যেমন মৌমাছি, মাছি; যেখানে ওড়ার মাংশপেশীটি মূলত অসিলেটরী, যা রেসিপ্রেকেটিং ইঞ্জিনের মত কাজ করে। অন্য পতঙ্গ যেমন লোকাষ্টরা প্রতিটি পাখনা নাড়ানোর জন্য স্নায়ু সংকেত প্রেরন করে (যেমন পাখীরা), মৌমাছিরা একবারই সংকেত পাঠায় অসিলেটরী মটোরকে সক্রিয় করতে (বা নিষ্ক্রিয় করতে); ব্যাকটেরিয়ার যে মেকানিজমটি আছে সেটি সাধারণ সংকোচনশীল কিছু (যেমন পাখীদের) নয় বা রেসিকের নয়,(যেমন মৌমাছি) বরং একটি সত্যিকারের ঘুর্ণায়মান বা রোটেটর। সেই ক্ষেত্রে এটি বৈদ্যুতিক মটর বা ওয়াঙ্কেল ইঞ্জিনের মত।
(৩৪)। http://www.millerandlevine.com/km/evol/design2/arti cle.html,
(৩৫) Freeman Dyson 47. The Closing of the Western Mind থেকে উদ্ধৃত।
(৩৬) Dover trial, এর বিবরণ সংশ্লিষ্ট উদ্ধৃতিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে A. Bottaro, M. A. InlayIN. J. Matzke এর লেখা Immunology in the spotlight at the Dover Intelligent Design trial (Nature Immunology 7, 2006,433) থেকে।
(৩৭) জেরী অ্যালেন কয়েন, বিবর্তন জীববিজ্ঞানী, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়র অধ্যাপক।
(৩৮) জেরী কয়েন এর নিবন্ধটি : Coyne, God in the details: the biochemical challenge to evolution, Nature 383, 1996); কয়েন ও আমার যৌথ নিবন্ধ: One side can be wrong প্রকাশিত হয়েছিল গার্ডিয়ান পত্রিকায় (Guardian,1 Sept. 2005: http://www.guardian.co.uk/lifel feature/story/ 0,13026,1559743,00.html; আর বাঙময় ব্লগার এর উদ্ধৃতিটি আছে এখানে: http://www.religionisbullshit. net/blog/2005_09_01_archive.php)
(৩৯) Dawkins, R. (1995). River Out of Eden. London: Weidenfeld & Nicolson.
(৪০) Anthropic Principle: অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল, জ্যোতিপদার্থবিদ্যা এবং কসমোলজিতে একটি দার্শনিক বিবেচনা যা প্রস্তাব করছে যে কোনো একটি পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বকে অবশ্যই সচেতন যে জীবনের রুপ বা জীব এটিকে পর্যবেক্ষণ করছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপাল এর কিছু প্রস্তাবক যুক্তি দেন যে এটি ব্যাখ্যা করে কেন মহাবিশ্বের যে পরিমান বয়স এবং মৌলিক ভৌত ধ্রুবগুলো আছে যা সচেতন জীবনের উদ্ভব হবার জন্য সহায়ক। আর সেকারণেই মনে করা হয় সেই বাস্তব সত্যটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ না যে, মহাবিশ্বের মৌলিক ধ্রুবগুলো আসলে একটি সংকীর্ণ জীবনের-উদ্ভব-হবার সহায়ক সীমানায় থাকে।
(৪১) ব্রান্ডন কার্টার (জন্ম ১৯৪২) ব্রিটিশ পদার্থবিদ ও গণিতজ্ঞ
(৪২) জন ডি ব্যারো (জন্ম ১৯৫২) ব্রিটিশ কসমোলজিষ্ট,গণিতজ্ঞ
(৪৩) ফ্রাঙ্ক জেনিংস টিপলার (১৯৪২) যুক্তরাষ্ট্রের কসমোলজিষ্ট ও গণিতজ্ঞ।
(৪৪) কার্টার (ব্র্যান্ডন কার্টার) স্বীকার করেছিলেন যে এই সর্বজনীন মূলনীতির একটি ভালো নাম হতে পারতো cognizability principle, ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত anthropic principle 93 656341 B. Carter, The anthropic principle and its implications for biological evolution, Philosophical Transactions of the Royal Society of London A, 310, 1983, 347-63., Barrow and Tipler (1988) : Barrow, J. D. and Tipler, F, J. (1988), The Anthropic Cosmological Principle. New York: Oxford University Press;
(৪৫) গোল্ডিলকস জোন (Goldilocks zone): গ্রহ ও প্রাকৃতিক উপগ্রহ (যেমন চাঁদ) এর মূল নক্ষত্রের বাসযোগ্য সীমানায় ( এবং প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে) অবস্থান করাটা কোন একটি গ্রহের জীবনের বাসযোগ্যতা বহু পূর্বশর্তগুলোর একটি। এবং তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব এই বাসযোগ্য সীমানার বাইরেও বাসযোগ্য কোন গ্রহের উপস্থিতি। Goldilocks planet শব্দটি ব্যবহার করা হয় যে কোনো গ্রহের জন্য যা কিনা নক্ষত্রের চারপাশের বিদ্যমান বাসযোগ্য এলাকায় অবস্থান করে (circumstellar habitable zone)। অবশ্য শব্দটি যখন কোনো গ্রহের বাসযোগ্যতা প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়, এটি বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে পৃথিবী সদৃশ গ্রহগুলো যেখানকার বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ মোটামুটিভাবে পৃথিবীর সাথে তুলনা করা যায়। Goldilocks নামটির উৎস Goldilocks and the Three Bears এর রুপকথা থেকে। যেখানে একটি ছোট বালিকাকে তিন সেট জিনিস থেকে একটি সেট বেছে নিতে হয়েছিল চরম মাত্রার কোন কিছু বাদ দিয়ে (চরম বড় বা ছোট, চরম গরম বা ঠাণ্ড্য বাদ দিয়ে ইত্যাদি), এবং সে ঠিক এর মাঝামাঝি কোন একটি অবস্থার সেটটি বেছে নেয়, যেটি হচ্ছে ‘প্রায় ঠিক’ একটি অবস্থা। এভাবে কোন একটি গ্রহ এই মূলনীতি ব্যবহার করে যা কোন নক্ষত্র থেকে খুব দূরেও না আবার খুব কাছেও অবস্থান না করলে সেখানে যা করা যেতে পারে।
(৪৬) পেরিহেলিওন, কক্ষপথে সেই বিন্দু যা সূর্যের নিকটবর্তী প্রান্তে।
(৪৭) এপহেলিওন, কক্ষপথে সেই বিন্দু যা সুর্যের দূরবর্তী প্রান্তে।
(৪৮) Comins, N. F. (1993). What if the Moon Didn’t Exist? New York: HarperCollins.
(৪৯) এ বিষয়ে বিস্তারিত যুক্তি আছে রিচার্ড ডকিন্সের The Blind Watchmaker (1986) এ।
(৫০) মার্ক রিডলী (জন্ম ১৯২৬): ব্রিটিশ প্রাণী বিজ্ঞানী এবং বিবর্তন বিষয়ক লেখক। (রিচার্ড ডকিন্স এর পিএইচডি ছাত্র।
(৫১) রুবিকন অতিক্রম: (Rubicon– Latin: Rubico, Italian: Rubicone) উত্তর পূর্ব ইতালীতে অবস্থিত একটি অগভীর নদী। Crossing the Rubicon প্রবাদ বাক্যটির অর্থ এমন একটি পর্যায় অতিক্রম করা যে সেখানে থেকে আর পিছিয়ে আসা যায়না। এই প্রবাদের সাথে জড়িয়ে আছে সেনাপতি জুলিয়াস সীজারের নাম যিনি ৪৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এটি অতিক্রম করেছিলেন রোমের প্রত্যক্ষ নির্দেশ অমাণ্য করে। তার এই বিদ্রোহ পরবর্তীতে তাকে রোমান সাম্রাজ্যের শীর্ষে নিয়ে যায়।
(৫২) পদার্থবিদ ভিক্টর স্টোর (যেমন, তার God, The Failed Hypothesis) সাধারণ ঐক্যমতের এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এবং ভৌতিক সব আইন এবং ধ্রুব যে বিশেষভাবে জীবন সহায়ক এই বিষয়টি তিনি মানতে নারাজ। যাই হোক আমি একটু অতিমাত্রায় নমনীয় হয়ে বিষয়টি মেনে নেবো, শুধু যুক্তি দেখানোর জন্য যে, যাই হোক না কেন, এই ধারণাটি কোনভাবেই ঈশ্বরবাদীরা ব্যবহার করতে পারেননা যুক্তিসঙ্গত ভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বে সপক্ষে তাদের প্রস্তাবনায়।
(৫৩) আমি বলবো ‘সম্ভবতআংশিকভাবে যার কারণ, আমাদের জানা নেই ভিন গ্রহে জীবনের আকার আকৃতি কতটা ভিন্ন আমাদের থেকে, এবং আংশিকভাবে এর অপর কারণটি হল, শুধু মাত্র একটি ধ্রুব এককভাবে পরিবর্তন করলে আমাদের ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে বেশী। আসলে কি কয়েটি ধ্রুব একটি সমন্বয় থাকতে পারে না, যা হতে পারে জীবন বান্ধব? আমরা যে সমন্বয়টি এখনও আবিষ্কার করতে পারিনি, কারণ আমরা ব্যস্ত এককভাবে ধ্রুবগুলোর মাত্রা নিয়ে। যাইহোক আমি আমার আলোচনা করে যাবো, এমনভাবে যেন, আসলেই আপাতদৃষ্টিতে মৌলিক ধ্রুবগুলোর পরিমাপের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ বা ফাইন টিউনিং এর বিষয়টি ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আসলেই আমাদের বড় একটি সমস্যা আছে।
(৫৪) জে অ্যান্ডারসন থমাস (জুনিয়র), যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী।
(৫৫) ফ্রিম্যান জন ডাইসন (জন্ম ১৯২৩) ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ।
(৫৬) জন, এ লেসলি (জন্ম ১৯৪০) কানাডীয় দার্শনিক।
(৫৭) সাসকিণ্ড তার The Cosmic Landscape: String Theory and the Illusion of Intelligent Design TRIOCO অ্যানথ্রোপিক প্রিন্সিপালের একটি চমৎকার সমর্থন করেছিলেন মেগাভার্সে। তিনি বলেন, বেশীর ভাগ পদার্থবিদরাই এই ধারণাটি অপছন্দ করেন। যদিও আমি বুঝতে পারিনা কেন, আমি মনে করি এটি দারুণ সুন্দর একটি প্রস্তাব হয়তো এর কারণ ডারউইন আমার সচেতনতার স্তরটিকে উন্নীত করেছেন।
(৫৮) লী লেীন (জন্ম ১৯৫৫) আমেরিকার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।
(৫৯) Murray Gell-Mann, quoted by John Brockman on the Edge website, http:// www.edge. org/3rdculture/ bios/ smolin.html.
(৬০) Ward, K. God, Chance and Necessity. Oxford: Oneworld. (1996: 99); Polkinghorne, J. (1994). Science and Christian Belief: Theological Reflections of a Bottom-Up Thinker. London: SPCK (1994: 55).
(৬১) J. Horgan, The Templeton Foundation: a skeptics take, Chronicle of Higher Education, 7 April 2006;
(৬২) http://www.edge.org /3rd_culturel horgan06/horgan06_index.html.
(৬৩) পিটার মেদাওয়ার (৯১৫-১৯৮৭) ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী, ইমিউনোলোজী, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের গবেষণার অগ্রদূত, বিজ্ঞান লেখক।
(৬৪) P. B. Medawar, review of The Phenomenon of Man, repr. in Medawar, P. B. (1982). Pluto’s Republic. Oxford: Oxford University Press (1982: 242).