০৪. কাটুসোনা

কাটুসোনা

অনেকে মনে করে, অমিতের সঙ্গে আমার বুঝি ভাব-ভালবাসা আছে। তা মোটেই নয়।

এই শহরে কাছাকাছি থাকা হলে অনেকেই অনেকের চেনা হয়। তারপর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমাদের দুই পরিবারেও অনেকটা তেমনি। তা বলে অমিতের সঙ্গে আমার তেমন গাঢ় ভাব কোনওকালেই ছিল না। কথা হয়েছে খুবই কম। আমার দাদার বন্ধু বলে কখনও-সখনও অমিতদা বলে ডেকেছি মাত্র। অমিতও আমাকে তেমন করে আলাদাভাবে লক্ষ করত না।

অমিত খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলে, দারুশ ছাত্র, সব বিষয়েই সে ভীষণ সিরিয়াস, কথাবার্তা বেশি না, যেটুকু বলে তা খুব ওজন করে। এখান থেকে সে স্কলারশিপ নিয়ে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাশ করে শিবপুরে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায়। সেখানেও আবার দারুণ রেজাল্ট করে। তারপর যায় আমেরিকায়। সেখানেও সে আরও পড়েছে, এখন বড় চাকরি করছে টেকসাসে। আমেরিকায় যাওয়ার কথা যখন হচ্ছিল তখনই আমার হবু শাশুড়ি আর শ্বশুর একদিন খুব সাজগোজ করে মিষ্টির বাক্স নিয়ে আমাদের বাড়ি এলেন।

গিন্নি গিয়ে সোজা শোওয়ার ঘরে ঢুকে মাকে বললেন, তোমার কাটুকে আমার অমিতের জন্যে রিজার্ভ করে রাখলাম।

প্রস্তাব নয়, সিদ্ধান্ত। প্রস্তাবটা খুবই আচমকা, সৃষ্টিছাড়া। কেন না আমি তখন সবে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছি, ঢ্যাঙা রোগাটে চেহারা। সুন্দরী কি না তা সেই খোলস বদলের বয়সে অতটা বোঝও যেত না। এখন যায়।

আমার হবু শ্বশুর বাইরের ঘরে বাবাকে প্রায় হুকুম করে বললেন, ও মেয়েটার আর অন্য জায়গায় সম্বন্ধ দেখবেন না।

বাবা অবশ্য তেড়িয়া মানুষ, নিজের পছন্দ-অপছন্দটা খুব জোরালো। গম্ভীর হয়ে বললেন, কেন?

আমার অমিত কি ছেলে খারাপ?

অমিতের কথায় বাবা ভিজলেন। চরিত্রবান, তুখোড়, গুণী অমিতকে কে না জামাই হিসেবে চায়? বাবা গলাটলা ঝেড়ে বললেন, খুব ভাল। তবে কিনা আমেরিকায় যাচ্ছে শুনছি।

তা তো ঠিকই।

সেখানে গিয়ে যদি মেম বিয়ে করে।

হবু শ্বশুর খুব হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। বললেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা কি আগের দিনের মতো বোকা? এখন আর মেম দেখে তারা নালায় না, বুঝলেন! হাজার-হাজার বাঙালি ছেলে বিদেশে পড়ে আছে, তাদের মধ্যে ক’টা মেম বিয়ে করছে আজকাল?

বাবা ঠোঁটকাটা লোক। বলেই ফেললেন, আহা, শুধু বিয়েটাই কি আর কথা! ও দেশে গেলে চরিত্রও বড় একটা থাকে না। বড্ড বেশি সেক্স যে ওখানে!

হবু শ্বশুর গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখুন ভায়া, তা যদি বলেন তবে গ্যারান্টি দিতে পারি না। অমিত ফুর্তি মারবার ছেলে নয়। যদি বা কারও সঙ্গে ফুর্তি মারে তবে তাকে শেষতক বিয়েও করবে। ছ্যাবলা নয় তো। তাই ওকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। কিন্তু অঘটনের সম্ভাবনা খুব কম পারসেন্ট। আর যদি কাটুকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে যায় তবে চন্দ্র সূর্য ভেঙে পড়লেও করবেই!

 বাবা ভেবেচিন্তে বললেন, টোপটা বড় জব্বর। না গিলে করিই বা কী। তা গিললাম।

ভাল করে গিলন, যেন বঁড়শি খসে না যায়।

বাবার জেরা হল উকিলের জেরা। পরের মুহূর্তেই প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কাটুকে আপনাদের পছন্দই বা কেন?

মেয়ের বাপের তো এ প্রশ্ন করার কথা নয়। তারা বলবে, মেয়ে আমাদের অপছন্দ করলেন কেন? এ তো উলটো গেরো।

আফটার অল, ব্যাপারটা পরিষ্কার থাকা ভাল।

হবু শ্বশুর একটু বিপাকে পড়ে বললেন, আসলে কী জানে, মেয়েটিকে বোধ হয় আমি ভাল করে দেখিওনি, পছন্দের প্রশ্ন তাই ওঠে না। তবে আমার গিন্নির ভীষণ পছন্দ।

বাবা হেসে উঠে বললেন, এ তো পরের মুখে ঝাল খাওয়া।

হবু শ্বশুর গম্ভীর হয়ে বললেন, কথাটা ঠিকই। তবে খেতে খারাপ লাগে না। তা ছাড়া আমার মত হল, বিয়ের পর তো ঝগড়া করবে শাশুড়ি আর বউতে, তাই শাশুড়িরই বউ পছন্দ করা ভাল।

তবু কাটুকে আপনার নিজের চোখে একবার দেখা উচিত।

আহা, তার কী দরকার? ওসব ফর্মালিটি রাখুন। দেখার দরকার হলে রাস্তায় ঘাটেই দেখে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া ভাল করে দেখিনি বলে কি আর একেবারেই দেখিনি! শ্রীময়ী মেয়ে, অমিতের সঙ্গে মানাবে।

বাবা বিনয়ের ধার না ধেরে বললেন, আর একটা প্রশ্ন। ওকে যদি আপনাদের পছন্দই তবে অমিত আমেরিকায় যাওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছেন না নে?

শ্বশুরমশাই এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, সেটা কি উচিত হত? নিজের ছেলে সম্পর্কে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও বলছি, অনেক দূর দেশে যাচ্ছে, সেখানে কী হয় না হয়, ভাল ভাবে ফিরতে পারে কি না কে বলবে। সেক্ষেত্রে একটা মেয়েকে দুর্ভোগে ফেলা কেন? আরও একটা কথা হল, বিয়ে হয়ে থাকলে দু’জনেরই মন টনটন করবে, উড়ু উড়ু হবে, বিরহ-টিরহ এসে ভার হয়ে বসবে বুকের ওপর। তাতে দু’জনেরই ক্ষতি।

বাবা এই দ্বিতীয় পয়েন্টটা খুব উপভোগ করলেন, হেসে বললেন, সে অবশ্য খুব ঠিক। আমি ওকালতি পরীক্ষার আগে বিয়ে করায় তিন বারে পাশ করেছিলাম।

শ্বশুরমশাই চিমটি কেটে বললেন, নইলে হয়তো ছয় বার লাগত।

এ সব কথা শুনে আমি সেদিন অবাক, কাঁদো কাদো। রেগেও যাচ্ছি। এ মা! আমার বিয়ে! আমি তো মোটে এইটুকু, সেদিন ফ্রক ছেড়েছি, এর মধ্যেই এরা কেন বিয়ের কথা বলছে? মাথা-টাথা কেমন ওলটপালট লাগছিল, বুকের মধ্যে ঢিবঢ়িৎ। মনে হয়েছিল, বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই কোথাও।

বাইরের ঘরের পরদার আড়াল থেকে বাবা আর হবু শ্বশুরের কথা শুনে যখন চোখের জল মুছছি তখন চিনি এসে খবর দিল, মা ডাকছে।

গেলাম। শোওয়ার ঘরে বিছানায় দুই গিন্নি বসে। শাশুড়ি একেবারে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসালেন। বললেন, পেট ভরে খাবে দু’বেলা। শরীর সারলে তোমার রাজরানির মতো চেহারা হবে।

এইটুকু হয়ে আছে আজ ক’ বছর হল। বলতে নেই আমার শরীর সেরেছে। লোকে সুন্দরীই বলে। বাপের বাড়িতে আমার জীবনটা যেমন সুখে কাটছে শ্বশুরবাড়িতেও তেমনি বা হয়তো তার চেয়েও সুখে কাটবে।

তবে দুঃখও কি নেই? এই যেমন বাপি মরে যাওয়ার দুঃখ, পরীক্ষার ফল ভাল না হওয়ার দুঃখ, বিনা কারণে মন খারাপ হওয়ার দুঃখ। তবে তো আর সত্যিকারের দুঃখ নয়! আমি বেশ বুঝে গেছি, এই বয়সে আমার চেয়ে সুখের জীন ধূ বেশি মেয়ের নেই। সেইজন্যই আমার ওপর হিংসেও লোকের বড় কম নয়।

গরিব হলেও লিচুদের খুব দেমাক। ভাঙে তো মচকায় না। আমার সুখে ওর বুকটা যদি জ্বলত তবে এক রকম সুখ ছিল আমার। কিন্তু তা হওয়ার নয়। আজ পর্যন্ত ও অমিত আর আমার বিয়ে নিয়ে তেমন কিছু বলেনি। অমিতের মতো এত ভাল পাত্র যে হয় না তাও স্বীকার করেনি কোনওদিন।

বলতে নেই, লিচু দারুণ গান গায়। এই শহরে যত ফাংশন হয়, ও তার বাঁধা আর্টিস্ট। শিলিগুড়ি রেডিয়ো স্টেশনে বহুবার ওর গান হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, শিগগির কলকাতা থেকেও ডাক আসবে। প্র্যাকটিস করার জন্য ওর স্কেল চেঞ্জারের দরকার ছিল। কিন্তু সেটা হল না। পুরনো হারমোনিয়ামটা পাগলা দাশুকে দুশো টাকায় গছিয়েও লে চোরের দামের কানাকড়িও ওঠেনি।

আমিও ছাড়িনি। সে দিন নিউ মার্কেটে দেখা। একথা সেকথার পর বললাম, তোরা নাকি পুরনো হারমোনিয়ামটা বেচে দিয়েছিস?

শুনে মুখ চুন হয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ, বীরেনবাবুর এক ভাইপো এসেছে কলকাতা থেকে, সে জোর করে কিনে নিল।

জোর করে নে? তোদের বেচার ইচ্ছে ছিল না নাকি?

 আমার ছিল না। মা তবু বেচে দিল।

কততে বেচলি?

দুশো টাকায়।

 বাঃ, বেশ ভাল দাম পেয়েছিস তো!

 আমরা দাম-টামের কথা বলিনি, উনিই ওই দাম দিলেন।

লোকটা বেশ সরল আর বোকা বোধ হয়।

কে জানে? তোর হর দেওর, তোরই বেশি জানার কথা।

 আমি ও বাড়িতে যাই বুঝি? লোকটাকে চাখেই দেখিনি।

লিচু এবার খুব একটা রহস্যময় হাসি হেসে বলল, দেখে নিস। দেখতে খারাপ নয়।

আমিও খোঁচা দিতে ছাড়িনি, যার ইন্টারেস্ট আছে সেই বুঝুকঙ্গে খারাপ কি ভাল। আমার দরকার নেই,

লিচু বেশ অহংকারের সঙ্গেই বলল, তবে আমি ঠিক করেছি হারমোনিয়ামটা নিয়ে ওঁর টাকাটা ফেরত দেব।

কেন? আরও বেশি দাম পাবি নাকি?

মোটেই না। বরং দামটা উনি বেশি দিয়েছে বলেই ফেরত দেব।

তাতে লাভ কী?

সব ব্যাপারেই লাভ চাইলে চলবে মে? আমি একটু শ্লেষের হাসি হাসলাম। যাদের ঘটিবাটি বিক্রি করে খাওয়া জোটাতে হয় তাদের মুখে দেমাকের কথা মানায় না। বললাম, তাই নাকি? শুনলেও ভাল লাগে।

লিচুর মুখ আবার চুন হল। মৃদুস্বরে বলল, উনি গান গাইতেও জানেন না। হারমোনিয়ামটা শুধু শুধুই কিনেছেন।

আমি তো শুনেছি, তোরা ওঁকে গান শেখাচ্ছিস?

 সেটাও ওঁর মরজি। আমরা তো সাধতে যাইনি।

তবু শেখাচ্ছিস তো?

 শিখতে চাইলে কী করব?

শেখাবি। উদাস ভাব করে বললাম।

 লিচু একটু রেগে গিয়ে বলল, আমরা শেখালে যদি দোষ হয়ে থাকে তবে তুই-ই শেখা না!

এটা আমাকে গায়ে পড়ে অপমান। আমি বাথরুমে একটু-আধটু গুনগুন করি বটে, কিন্তু সত্যিকারের গান জানি না। এই গান না জানা নিয়ে মল্লিকবাড়ির কর্তা গিন্নির একটু দুঃখ আছে। বীরেনবাবু এককালে এ শহরের নামকরা তবলচি ছিলেন। অমিত কিছুকাল কলকাতায় ক্ল্যাসিকাল শিখেছিল, তবে এখন আর গান গাইবার সময় পায় না।

তবে গান না জানায় আমার জীবনে তো কোনও বাধা হয়নি। একটু দুঃখ মাঝে-মাঝে হয় বটে কিন্তু সেটিও সত্যিকারের দুঃখ কিছু নয়। গান না জানাটাকেও আমি আমার অহংকারের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছি। সকলের তো গান জানার দরকার হয় না।

তাই আমি দেমাক করে বললাম, আমি শেখাতে যাব কেন? গানের মাস্টারি করে তো আমাকে পেট চালাতে হবে না। গান শেখা বা শেখানোর দরকারই হয় না আমার। আমাদের বাড়িতে বাইজিবাড়ির মতো সব সময়ে গান বাজনা হয়ও না।

লিচু কতটা অপমান বোধ করল জানি না। তবে মুখটা আরও একটু কালো হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, কর্ণবাবুকে আমরা আর গান শেখাব না বলেও দিয়েছি।

পাগলা দাশুর নাম যে কর্ণ তা এই প্রথম জানলাম। কেউ তো বলেনি নামটা আমাকে। তবু সেই অচেনা মানুষটা যেহেতু আমার শ্বশুরবাড়ির দিককার লোক সেই জন্য ওঁর হারমোনিয়াম কেনা নিয়ে মনে মনে লিচুদের ওপর একটা আক্রোশ তৈরি হয়েছিল আমার। লিচুকে খানিকটা অপমান করতে পেরে জ্বালাটা জুড়োলা।

আমি ভোরবেলায় উঠি বটে কিন্তু ভৈরবকাকার মতো ব্রাহ্মমুহূর্তে নয়। সেদিন মাকে বললাম, এবার থেকে আমি ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠব, আমাকে ডেকে দিয়ে তো।

উঠে কী করবি?

গলা সাধব।

 মা একটু অবাক হলেও কিছু বলল না।

 বাবাকে গিয়ে বললাম, আমার একটা স্কেল চেঞ্জার চাই।

 বাবাও অবাক হয়ে বলল, কী করবি?

 গান গাইব।

বাবা শুনে খুশিই হলেন। বাবা মানুষের কর্মব্যস্ততা পছন্দ করেন। কাজ না থাকে তো যা হোক কিছু করো, পরের কাজ টেনে নাও নিজের ঘাড়ে। সময় যেন বৃথা না যায়।

বাবা বললেন, কিন্তু তোকে শেখাবে কে?

কালীবাবুর কাছে শিখব। ওঁকে তুমি রাজি করাও।

কয়েকদিনের মধ্যেই স্কেল চেঞ্জার এসে গেল। কালীবাবুও রাজি হলেন। উনি অবশ্য অ্যাডভান্সড ছাত্রছাত্রী ছাড়া নেন না, কিন্তু টাকা এবং প্রভাবে কী না হয়!

আমার গলা শুনে কালীবাবু খুব হতাশও হলেন না। বললেন, গলায় প্রচ্ছন্ন সুর আছে। শান দিলে বেরিয়ে আসবে। সকালে আর বিকেলে কম করেও দু’ঘণ্টা করে গলা সেবো।

তা সাধতে লাগলাম। প্রথম দিকে বুকের জ্বালা, আক্রোশ, টেক্কা মারার প্রবল ইচ্ছেয় দু’ ঘণ্টার জায়গায় তিন-চার ঘণ্টাও সাধতে লাগলাম।

কিন্তু গলায় প্রচ্ছন্ন সুর থাকলেও আমার ভিতরে গানের প্রতি গভীর ভালবাসা নেই। তাই গলা সাধার পর খুব ক্লান্তি লাগে। স্ব ছেড়েও দিচ্ছি না।

খবর পেয়ে মল্লিকবাড়ির কর্তা একদিন এসে হাজির। বললেন, তবলাডুগি কোথায়? তবলচি ছাড়া কি গান হয়? দাঁড়াও আমিই পাঠিয়ে দেবখন। আমারটা তো পড়েই আছে।

ভাবী বউমা গান শিখছে জেনে ভারী খুশি হয়েছেন, ওঁর চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। চিনি ছাড়া চা করে দিলাম। চুমুক দিয়ে বললেন, চমৎকার! সবই চমৎকার। কী চমৎকার তা অবশ্য ভেঙে বললেন না।

সেই দিনই ভাবী শ্বশুরবাড়ি থেকে ডুগি তবলা এল। রিকশা থেকে চামড়ার ওপর গদির ঢাকনা দেওয়া পেতলের ডুগি আর তবলা নিয়ে ও বাড়ির চাকর নামল। তবলার সঙ্গে শাড়ির পাড় দিয়ে জড়ানো বিড়ে পর্যন্ত।

দেখে এমন লজ্জা পেলাম!

মল্লিকবাড়ির চাকর সর্বেশ্বর বলল, বাবু তো শিকদার তবলচিকে দিদিমণির জন্য ঠিক করেছেন। কালী গায়েনের সঙ্গে তিনিও আসনে।

শুনে আমার হাত পা হিম হওয়ার জোগাড়। একেই কালীবাবুর কাছে গান শেখাটাই আমার আস্পদ্দা, তার ওপর শিকদার তবলচি! শিকদার হলেন এ জেলার সবচেয়ে ওস্তাদ লোক। কলকাতার সদারঙ্গ আর কজ সংস্কৃতিতেও বাজিয়েছেন। শোনা যায় কণ্ঠে মহারাজের কাছে শিখেছিলেন। দুই বাঘা ওস্তাদ আমার মতো আনাড়িকে শেখাতে আসবেন শুনে আমার গান সম্পর্কে ভয় বরং আরও বাড়ল।

বাড়ির লোকও আয়োজন দেখে কিন্তু কিন্তু করছে। ব্যাপারটা যে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে তা আমিও টের পাচ্ছি। কিন্তু বঁড়শি গিললে আর কি ওগরানো যায়?

আমার রাশভারী দাদা বলল, এ যে একেবারে মাথা ধরিয়ে ছাড়লি রে কাটু!

বাটুল আর চিনিকে পড়াতে আসেন জগদীশ মাস্টারমশাই। এ বাড়ির বাঁধা প্রাইভেট টিউটর। ওঁর কাছে দাদা পড়েছে, আমিও পড়েছি। গান বাজনা শুনে উনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন, এই তো চাই। কোয়ালিফিকেশন যত বাড়ানো যায় ততই মানুষের শক্তি বাড়ে। খুব গাও, গেয়ে একেবারে ঝড় তুলে দাও। সঙ্গে নাচও শিখে ফেলল। ছবি আঁকা, হোমিওপ্যাথি, ইলেকট্রিকের কত যা শিখবে তাই জীবনে কাজে লাগবে।

আমি হাসি চাপবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাঁটুল আর চিনি এমন বদমাশ যে, হি হি করে ওঁর মুখের সামনেই হেসে ফেলল। সেই দেখে মুখে আঁচল চাপা দিয়েও আমি হাসি সামলাতে পারলাম না।

জগদীশ সরল মানুষ। হাসি দেখে নিজেও হাসলেন। বললেন, ইদানীং একটা গানের হাওঃ এসেছে মনে হচ্ছে। বীরেনবাবুর ভাইপোও গান শিখছে। চারদিকেই গান আর গান। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে প্রত্যেকটা বাড়ি থেকেই গানের শব্দ কানে আসে।

আড়চোখে লক্ষ করি, জগদীশবাবুর জামার পকেট থেকে কাগজে মোড় লটকা মাছের শুঁটকি উঁকি দিচ্ছে। সেইদিকে চেয়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। শহরের সব বাড়িতে সবাই গান গাইলে আমার আর গান শেখার মানে হয় না।

একদিন সকালে উঠে গলা সাধতে বসে হারমোনিয়ামটার দিকে ক্লান্তভাবে চেয়ে রইলাম। একদম ইচ্ছে করছে না গলা সাধতে।

ভৈরবকাকা প্রাতঃভ্রমণে বেরোচ্ছিলেন। আমি বললাম, আমিও যাব।

গলা সাধবি না?

একদিন না সাধলে কিছু হবে না। ফিরে এসে সাধনখন।

 চল তা হলে।

এক-একটা সময় আসে যখন ঘাড়ে ভূত চাগে। মখটা পাগল-পাগল লাগে। সারা শরীরে খুসখুস একটা ভাব। তখন বেহেড এগ কিয় কমতে ইচ্ছে যায়। মনে হয় ঢিল মারি, চেঁচিয়ে-মেচিয়ে আবোল-তাবোল বলি, হাই উনাদের মতো খুব নাচি, হঠাৎ গিয়ে রাস্তার লোকের কান মলে দিই, হোঃ হোঃ করে হাসিবি হউউ করে কাদি।

কোনও মানে হয় না, তবু এ রকম হয়। আজ সকালে আমার এ রকম হচ্ছিল।

ভৈরবকাকাকে এগিয়ে যেতে দিয়ে আমি সত্যিই রাস্তা থেকে ঢিল কুড়িয়ে এ বাড়ি সে বাড়ির ছাদে ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। টিনের চাল না হলে হয় না। কী করব, ধারে কাছে টিনের চালই নেই। তখন কাকভোরের মায়াবী অন্ধকারে আমি পে খুলে চুল এলো করে দিই, কোমরে শক্ত করে আঁচল জড়াই, তারপর চৌপথিতে দাঁড়িয়ে ফিনফিরে খানিকটা বেতালা নেচে নিই।

শুলশুল ভাবটা তবু যায় না।

 মনের মধ্যে লুকোনো দুষ্টুমি ছিলই। নইলে খামে আবার মল্লিকবাড়ির ফটক খুলে বাগানে ঢুকব কেন? ধরা পড়লে লজ্জার একশেষ। বাড়ির ভাবী বউয়ের কোমরে আঁচলবাঁধা এলোকেশী মূর্তি দেখলে কর্তা গিন্নি মুছা যানে।

তবু কেন যে মনের মধ্যে এমন পাগল-পাগল! আমি গাছ মুড়িয়ে ফুল ছিঁড়তে থাকি। কোঁচড় ভরে ওঠে। তবু ছাড়ি না। ওদিকে আকাশ ফরু হয়ে যাচ্ছে। লোকজন জেগে উঠছে। ফুল ছেড়ে আমি কয়েকটা গাছের নরম ডাল শব্দ করে ভেঙে দিলাম।

ধরা পড়ব? পড়েই দেখি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *