০৪. আধুনিক মাইড্যাস

অধ্যায় ৪ আধুনিক মাইড্যাস

 হথর্নের Tanglewood Tales যাদের পড়া আছে তারা মাইড্যাস-এর গোল্ডেন টাচ (সুবর্ণ স্পর্শ)-এর কাহিনী জানেন। এই সার্থকাম রাজার স্বর্ণের প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগ ছিল। ঈশ্বর একে এই বর দিয়েছিলেন যে, তিনি যা স্পর্শ করবেন তাই স্বর্ণে পরিণত হবে। প্রথমে রাজা তো খুবই খুশি। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন ঈপ্সিত খাদ্যবস্তু গলাধঃকরণ করার আগেই কঠিন ধাতুতে পরিণত হয়ে গেল, তখন উদ্বিগ্ন বোধ করতে শুরু করলেন; স্বীয় কন্যাকে চুম্বন করার সঙ্গে-সঙ্গে যখন সে পাষাণে পরিণত হলো তখন তার চক্ষু উঠল কপালে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন ঐ বর ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। ঐ মুহূর্ত থেকে তাঁর এ-ও উপলব্ধি হলো যে জগতে স্বর্ণই শুধু একমাত্র মূল্যবান সামগ্রী নয়।

এটি একটি অত্যন্ত সাদামাটা গল্প। তবু জগৎ এই গল্পের মর্মার্থ অনুধাবন করতে হিমসিম খায়। স্পেনবাসীরা ষোড়শ শতকে যখন পেরুতে সোনা পায়, তখন তারা ভাবল এই সোনা নিজেদের কাছেই রাখতে হবে এবং সোনা যাতে বাইরে রপ্তানি না হয়ে যায় তার জন্য সমস্ত রকম প্রতিবন্ধক খাড়া করল। ফলে স্পেন অধিকৃত দেশগুলোতে পণ্যসামগ্রীর দাম চড়ে গেল। এতে স্পেন প্রকৃত সম্পদের ক্ষেত্রে আগের চেয়ে সমৃদ্ধতর হলো না। একজন মানুষ এই ভেবে গর্ব ও সন্তোষ বোধ করতে পারেন যে, এখন তার টাকার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ, কিন্তু সে ডাবলুন যদি শুধু আগের চেয়ে অর্ধেক পণ্য ক্রয়ে সমর্থ হয়, তাহলে ঐ লাভটা আর বাস্তবিক থাকল না। এতে তার পক্ষে অধিকতর পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় ক্রয় সম্ভব হবে না, কিংবা উন্নততর বাড়ি ক্রয় করতে পারবে না বা চোখে দেখার মতো কোনো সুবিধা হবে না। ইংরেজ ও ওলন্দাজরা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর ছিলেন বলে আজকের ইস্টার্ন ইউনাইটেড স্টেটস নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে, এই অঞ্চল সোনা না থাকায় অবজ্ঞা কুড়িয়েছে। কিন্তু সম্পদের উৎস হিসেবে এই অঞ্চল নিউ ওয়ার্ল্ডের স্বর্ণ-উৎপাদনকারী অংশের চেয়ে অনেক বেশি উৎপাদনশীল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ এলিজাবেথের যুগে নিউ ওয়ার্ল্ডের সোনা উৎপাদনকারী অংশের প্রতি সকল জাতির লোলুপ দৃষ্টি ছিল।

ইতিহাসের বিষয় হিসেবে যদিও এই ঘটনা সবার জানা তবু আজকের সমস্যায় এর প্রয়োগ সরকার সমূহের মানসিক ক্ষমতার বহির্ভূত বলেই মনে হয়। বিষয় হিসেবে অর্থ শাস্ত্রকে সকল যুগেই উল্টাপাল্টাভাবে দেখা হয়েছে, তবে ব্যাপারটা বর্তমান সময়ের জন্য যতটা সত্য আগের যে কোনো সময়ে ততটা ছিল না। যুদ্ধের পর এ ক্ষেত্রে যা ঘটে তা এতটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ যে এটা বিশ্বাস করাই কঠিন সরকার যারা চালাচ্ছে, তারা সাবালক এবং তারা পাগলাগারদে বড় হয়ে ওঠেন নি। তারা জার্মানিকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল, আর বহুকাল চর্চিত শাস্তি প্রদানের পন্থা হলো ক্ষতিপূরণের দাবি আরোপ। অতএব তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করল। এতদূর ব্যাপারটা ভালোই ছিল। বিপত্তি বাঁধল এখানে যে, ক্ষতিপূরণ দাবির পরিমাণ এতটা বেশি ধরা হলো যে, জার্মানিতে যে পরিমাণ সোনা আছে দাবিকৃত পরিমাণ তার চেয়ে অনেক বেশি, হয়তো সমগ্র জগতেও এত সোনা নেই। সুতরাং গাণিতিকভাবেই জার্মানদের পক্ষে অসম্ভব পণ্য-সামগ্রী ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ে ক্ষতিপূরণ করা; জার্মানি পণ্য-সামগ্রী আকারে ক্ষতিপূরণ করতে পারবে কিংবা এ ব্যাপারে তারা কিছুই করতে পারবে না।

ইত্যবসরে সরকারসমূহের বোধধাদয় হলো যে, তারা একটি দেশের সমৃদ্ধির পরিমাপ করে আমদানির চেয়ে কতটা বেশি রপ্তানি করতে পারে তা দিয়ে। যখন একটি দেশ আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি করে তখন বলা হয় যে দেশটির বাণিজ্যিক ভারসাম্য অনুকূলে। ব্যাপারটা বিপরীত হলে ভারসাম্য প্রতিকূলে গণ্য করা হয়। জার্মানির পক্ষে অসম্ভব পরিমাণ সোনা দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করে প্রকারান্তরে তারা ডিক্রি জারি করে বসে যে, মিত্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারসাম্য জার্মানির অনুকূলে থাকবে, আর ভারসাম্য প্রতিকূলে থাকবে মিত্রশক্তির। অতঃপর তারা আতংকের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন জার্মানির রপ্তানি বাণিজ্য চাঙ্গা করে অনিচ্ছুকভাবে বরং দেশটির উপকার করা হচ্ছে। এই সাধারণ যুক্তির সঙ্গে আরো নির্দিষ্ট কিছু যুক্তি যোগ হলো। জার্মানি এমন কিছু উৎপাদন করে না যা মিত্রশক্তি উৎপাদন করতে পারে না। জার্মান প্রতিযোগিতার হুমকি সর্বত্রই অভিযোগের আকার ধারণ করল। ইংরেজদের জার্মানির কয়লার দরকার নেই। তাদের নিজেদের কয়লাখনি শিল্পেই তখন মন্দা দেখা দিয়েছে। ফরাসিদের জার্মানির লৌহ ও লৌহজাত সামগ্রীর দরকার নেই। কারণ তারা নব-অধিকৃত লোরেন প্রদেশের আকরিকের দ্বারা নিজস্ব লৌহ ও ইস্পাত সামগ্রীর উৎপাদন বাড়াচ্ছে। এমন আরো অনেক ব্যাপার। সুতরাং মিত্রশক্তি যদিও জার্মানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রইল, অপরদিকে তারা এ ব্যাপারেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো যে কোনো বিশেষ আকারে তাকে পরিশোধ করতে দেয়া যাবে না।

এই উন্মাদ পরিস্থিতির উন্মাদসুলভ সমাধানও খুঁজে পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো জার্মানি যা পরিশোধ করতে পারবে তাই তাকে ধার দেয়া হবে। বস্তুত মিত্রশক্তি বলতে লাগল; ক্ষতিপূরণ করা থেকে তোমাকে অব্যাহতি দেয়া যাবে না, কারণ এটা তোমার শয়তানির ন্যায়ানুগ শাস্তি। অপরদিকে, তোমাকে পরিশোধেরও সুযোগ দেয়া যাবে না, কারণ এতে আমাদের শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যাবে; অতএব আমরা তোমাকে ধার দেব এবং তুমি সে ধার পরিশোধ করবে। এইভাবে নিজেদের ক্ষতি না-করেও নীতিটা টিকিয়ে রাখা যাবে। তোমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে কথা হলো, আমরা আশা করছি ঐ ব্যাপারটা কেবল কিছুকালের জন্য মুলতবি রইল।

বলাবাহুল্য, এই সমাধান সাময়িক কালের জন্যই শুধু হতে পারে। জার্মানিকে যারা ঋণ প্রদান করল তারা ঋণের সুদ চায়। সুতরাং একই সংকট দেখা দিল যেটা ক্ষতিপূরণ ব্যাপারে দেখা দিয়েছিল। জার্মানির পক্ষে স্বর্ণ মাধ্যমে পরিশোধ সম্ভব নয়। আর মিত্রশক্তি পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধে গররাজি। অতএব সুদ পরিশোধের জন্যও ঋণ প্রদান দরকারি হয়ে পড়ল। স্পষ্টত জনগণ আগে হোক পরে হোক এই খেলায় এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। জনগণ যদি ধার দিয়ে কিছু না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন বলতে হবে দেশটির ক্রেডিট বা জমা ভালো অবস্থায় নেই। আর এটা যখন ঘটে তখন জনগণ পাওনা টাকার প্রকৃত পরিশোধ দাবি করে কিন্তু আমরা যেমন দেখেছি, জার্মানির পক্ষে তা সম্ভব নয়। ফলে স্থানে-স্থানে দেউলিয়া অবস্থা দেখা দিল বা লালবাতি জ্বলতে শুরু করল। প্রথমে লালবাতি জ্বলল জার্মানিতে, তারপর জ্বলল। জার্মানিকে ধারদাতা পক্ষগুলোর। তারপর তাদের মধ্যে যারা উক্ত পক্ষগুলোকে টাকা ধার দিয়ে বসে আছে; আরো ইত্যাদি। ফল দাঁড়াল সার্বিক মন্দা, দুর্বিপাক, অনাহার, ধ্বংস, সামগ্রিক বিপর্যয় এবং লাগাতর সামগ্রিক বিপর্যয়। যার দরুন সারা বিশ্ব ভুগছে।

আমি বলছি না যে, জার্মানির কাছে ক্ষতিপূরণ দাবিই আমাদের সকল অসুবিধার একমাত্র কারণ। এতে আমেরিকার কাছে মিত্রশক্তির দেনারও অবদান রয়েছে। অনুরূপভাবে, পরিমাণে কম হলেও ব্যক্তিগত ও সরকারি দেনাও অবদান রেখেছে, যেখানে ঋণদাতা ও গ্রহীতাকে শুল্কের উঁচু দেয়াল বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ফলে পণ্যসামগ্রীর মাধ্যমে পরিশোধ হয়ে পড়েছে দুষ্কর। জার্মানির ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যাপারটা কোনো অর্থেই সমগ্ৰ অসুবিধার উৎস না হলেও, বিভ্রান্ত চিন্তার অন্যতম স্বচ্ছ উদাহরণ, যা অসুবিধা মোকাবিলা কঠিন করে তুলেছে।

যে বিভ্রান্ত চিন্তা থেকে আমাদের দুর্ভাগ্য উৎসারিত হয়েছে, তা খাতক ও উৎপাদকের দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি কিংবা আরো সঠিকভাবে বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক নিয়মের অধীন উৎপাদনের বিভ্রান্তি। ক্ষতিপূরণের দাবি যখন আরোপ করা হয় তখন মিত্রশক্তি নিজেদের ভোক্তা মনে করেছে; তারা মনে করেছে কী সুখের ব্যাপারই না হবে জার্মানি তাদের হয়ে কাজ করবে অস্থায়ী ক্রীতদাস হিসেবে এবং জার্মানি যা উৎপাদন করবে তা বিনাশ্রমে তারা ভোগ করতে সমর্থ হবে। অতঃপর ভার্সাই সন্ধি সমাধা হবার পর তাদের হঠাৎ ঠাহর হলো যে তারাও উৎপাদক। এবং তাদের দাবিকৃত জার্মান পণ্যসামগ্রীর বন্যা দেশীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংস করবে। এতে তারা এতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল যে নিজেদের মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকে বসল, তখনও কিছু হলো না। মোদ্দা কথাটা এই যে, জগতের শাসক শ্রেণি এতটাই অজ্ঞ ও নির্বোধ যে সমস্যাটা নিয়ে ঠিক মতো ভাবতে তারা অসমর্থ। এবং তারা এতটাই দাম্ভিক যে যাদের সাহায্য কাজে লাগতে পারে তাদের উপদেশ গ্রহণেও অরাজি।

সমস্যাটা আরো একটু সরল করে দেখার জন্য অনুমান করা যাক, মিত্রশক্তির একটি দেশ একটি ব্যক্তি নিয়ে গঠিত। ব্যক্তিটি রবিনসন ক্রুসো এবং সে একটি মরুময় দ্বীপে বাস করে। ভার্সাই চুক্তির শর্তানুসারে তাকে জার্মানরা বিনামূল্যে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করতে বাধ্য। কিন্তু যদি সে মিত্রশক্তিসমূহের মতো আচরণ করে তাহলে সে বলবে, না, আমার জন্য কয়লা আনার দরকার নেই। কারণ এতে আমার কাষ্ঠসংগ্রহশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য রুটি আনবে না। এতে আমার কৃষিশিল্প এবং কারখানার যন্ত্রপাতি ধ্বংস হয়ে যাবে; আমার জন্য পোশাক আনতে হবে না, কারণ এতে আমি যে পশুর চামড়া দিয়ে পরিচ্ছদ তৈরির কারখানা গড়ে তুলছি (যা এখন শিশু অবস্থায় আছে) তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তুমি সোনা সরবরাহ করলে আমি কিছু মনে করবো না। কারণ এতে আমার কোনো ক্ষতি হবে না; ঐ সোনা আমি গুহায় লুকিয়ে রাখব এবং কোনোদিন ব্যবহার করব না; কিন্তু আমার পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হবে এমন কোনো পণ্য সরবরাহ করলে আমি তা গ্রহণ করব না। আমাদের কল্পিত রবিনসন ক্রুসো সত্যিই যদি এ ধরনের কিছু বলেন, তাহলে আমরা ধরে নেব যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করে তার বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, প্রত্যেকটি জাতি জার্মানিকে তাই বলেছে। কোনো ব্যক্তি নয়, একটি জাতি যখন উন্মাদরোগগ্রস্ত হয় তখন ভাবা হয় যে জাতিটি প্রজ্ঞার পরিচয় দিচ্ছে এবং উক্ত প্রজ্ঞা শিল্পকারখানা গড়ার জন্য দরকারি।

আমাদের ক্রুসো সাহেবের সঙ্গে একটি জাতির প্রাসঙ্গিক পার্থক্য এখানে যে, ক্রুসো সাহেবের সময়জ্ঞান প্রচণ্ড। পক্ষান্তরে একটি জাতির সময়জ্ঞান বলতে কিছু নেই। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই পোশাক পায়, তাহলে সে পোশাক তৈরি করার জন্য সময় নষ্ট করে না। কিন্তু একটি জাতি কিংবা যে কোনো জাতি মনে করে তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু তৈরি করা উচিত। (আবহাওয়ার মতো) কিছু প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক থাকলে অবশ্য ব্যতিক্রম হয়। জাতিগুলোর যদি কোনো জ্ঞানগম্যি থাকত তবে আন্তর্জাতিক সম্মতির মাধ্যমে তারা ঠিক করে নিত কোন জাতি কী উৎপাদন করবে। এবং সবকিছু উৎপাদন করার চেষ্টা করত না; কোনো ব্যক্তি যেমন সবকিছু উৎপাদনের চেষ্টা করে না। কোনো ব্যক্তিই নিজেই তার পোশাক, জুতো, মোজা, খাদ্য, বাড়ি ইত্যাদি তৈরি করার চেষ্টা করে না। তার এটা ভালোই জানা আছে। যে, সে যদি প্রয়োজনীয় সবকিছু তৈরির চেষ্টা করে তবে তার আরাম-আয়েস নিচু স্তরের হবে। কিন্তু জাতিসমূহ এখনও শ্রম বিভাগের নীতি বুঝে উঠতে পারে নি। যদি তাই বুঝত তবে তারা জার্মানিকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পণ্য দিয়ে পরিশোধ করতে দিত। এবং ঐ পণ্য নিজেরা আর তৈরি করত না। যাদের বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারা অন্য ধরনের কাজ জনগণের খরচে শিখে নিত। কিন্তু এর জন্য দরকার উৎপাদন সংগঠনের। যা ব্যবসায়িক গোঁড়ামির বিপরীত।

স্বর্ণ-সম্পর্কিত কুসংস্কারের কারণ কৌতুককরভাবে দৃঢ়মূল, এই কুসংস্কার শুধু যারা এর দ্বারা লাভবান হয় তাদেরই নয় যাদের জন্য এটা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে তাদেরও এই কুসংস্কার রয়েছে। ১৯৩১ সালের শরৎকালে ফরাসিরা যখন ইংরেজদের স্বর্ণমান বর্জনে বাধ্য করে, তখন তারা ভেবেছিল এতে ইংরেজদের ক্ষতি হবে। ইংরেজরাও তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হয়। এক ধরনের লজ্জা, জাতীয় গ্লানিতে ইংল্যান্ড প্লাবিত হয়ে যায়। অথচ সেরা অর্থনীতিবিদগণ স্বর্ণমান পরিত্যাগের পক্ষে বলে আসছিলেন। পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা ঠিকই বলেছিলেন। দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের রক্ষকগণও এতটা অজ্ঞ ছিলেন যে ব্রিটিশ সরকারকে বাধ্য করা হয় ব্রিটিশ জনগণের স্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট কাজটি করার জন্য, আর ফ্রান্স তার অবন্ধুসুলভ নীতির জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইংল্যান্ডের উপকার করে বসে।

সকল প্রয়োজনীয় পেশার মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর বা বিকট পেশা হলো সোনার খনিশিল্প। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সোনা উত্তোলন করা হয় ও চৌর্যবৃত্তি এবং দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অপরিসীম সাবধানতা অবলম্বন করে উক্ত সোনা লন্ডন, প্যারিস এবং নিউইয়র্কে আনা হয়। এবং এই শহরগুলোর ব্যাংকের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টে রাখা হয়। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার ভূ-গর্ভেই এই সম্পদ সংরক্ষণ করা যেত। ব্যাংকে ভবিষ্য প্রয়োজনে আমানত হিসেবে রাখলে তার কিছুটা উপযোগিতা থাকে, কিন্তু যদি বলা হয় এই আমানত নির্দিষ্ট পরিমাণের নিচে কোনোদিন নামতে দেয়া যাবে না তাহলে ঐ আমানত না থকার সামিল হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমি বলি বৃষ্টির দিনে কাজে লাগানোর জন্য ব্যাংকে এক শো পাউন্ড জমা রাখবো, সে কাজটা বিজ্ঞজনোচিত কাজই হবে। কিন্তু যদি আমি বলি যে, যত দরিদ্রই আমি হই ঐ এক শো পাউন্ডে আমি কোনদিন হাত দেব না তাহলে উক্ত টাকা আমার সম্পদের কার্যকরী অংশ হিসেবে আর থাকল না। এমন বলা যায় যে, ঐ টাকা আমি কাউকে দিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকে গচ্ছিত আমানত যদি কোনো অবস্থাতেই ব্যবহার করা না হয়। জাতীয় ক্রেডিটের একটা অংশ যদি এখন প্রকৃত স্বর্ণে রাখা হয় তবে তা নিতান্তই বর্বরতার নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত বিনিময়ের ক্ষেত্রে স্বর্ণের ব্যবহার উঠে গেছে। যুদ্ধের আগে কিছু পরিমাণে এর ব্যবহার ছিল, কিন্তু যারা যুদ্ধের পর বড় হয়ে উঠেছেন তারা স্বর্ণমুদ্রার চেহারাই দেখেন নি। তথাপি ভেলকিবাজি দেখিয়ে বলা হয় যে জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা বা স্থায়িত্ব নির্ভর করে কথিত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সোনা মজুদের উপর। যুদ্ধ চলাকালে সাবমেরিনের জন্য সোনা পরিবহন যখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় তখন এই কাল্পনিক ব্যাপারটা আরো অনেক দূর গড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উত্তোলিত স্বর্ণ কেউ ধরে নেয় যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, কেউ ধরে নেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা অন্য কোনো জায়গায়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ সোনা দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ছিল। কল্পনাটা আরো একটু বাড়িয়ে কেন ধরা হলো না যে খনি থেকে উত্তোলন করে সেখানেই রেখে দেয়া হয়।

তত্ত্বগতভাবে স্বর্ণ মজুদে সুবিধা এই যে, তা অসাধু সরকারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ সংকটকালে সরকারকে স্বর্ণমান মেনে চলতে বাধ্য করার কোনো উপায় নেই। বস্তুত সরকার সুযোগ বুঝে বা বিপদে পড়লে স্বর্ণমান বর্জন করে। বিলম্বে যুদ্ধে যোগ দেয়া ইউরোপের দেশগুলো তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে ঋণের একটা অংশ পরিশোধের দায় এড়িয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি ঘটিয়ে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া তাদের অভ্যন্তরীণ সমগ্র ঋণ পরিশোধের দায় এড়ায়। ফ্রান্স তার মুদ্রার মান এক-পঞ্চমাংশ কমিয়ে দিয়ে ফ্রা-তে হিসেবকৃত ঋণের পাঁচ ভাগের চারভাগ দায় অস্বীকার করে। স্বর্ণে পাউন্ড স্টার্লিং-এর মান আগের মূল্যের তুলনায় এখন চারভাগের তিন ভাগ মাত্র। রুশদেশ খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা ঋণ পরিশোধ করবে না। তবে এটা দুষ্ট আচরণ, রুশদের এই আচরণ কোনো দেশ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি; সম্মানজনকভাবে ঋণদায় এড়ানোর জন্য দ্রভাবে তা করতে হয়।

ব্যাপারটা হলো, যে কোনো সরকার, জনগণের মতোই স্বার্থের অনুকূলে হলেই শুধু ঋণ পরিশোধ করে, অন্যথায় নয়। বিশুদ্ধ আইনগত নিশ্চয়তা, যেমন স্বর্ণমান, প্রতিকূল সময়ে কোনো কাজে লাগে না। অন্য সময় এর দরকার করে না। কোনো ব্যক্তি সাধু হওয়াটা ততক্ষণ লাভজনক মনে করে যতক্ষণ সে ধার নেয়ার প্রয়োজন বোধ করে এবং ধার পরিশোধের ক্ষমতা রাখে। ধার পরিশোধের সামর্থ হারালে তখন গা ঢাকা দেয়াটাই সুবিধাজনক মনে করে। একটি সরকার দেশের জনগণের সঙ্গে যে আচরণ করে অপর দেশের সঙ্গে আচরণের তুলনায় তা আলাদা জাতের। দেশের জনগণ সরকারের করুণার উপর নির্ভরশীল, অতএব, তাদের প্রতি সদাচরণের কোনো ইচ্ছাই সরকারের নেই, যদি না পুনরায় ধার নেয়ার অভিলাষ থাকে। যুদ্ধের পর জার্মানিতে যেমন ঘটেছিল, যখন দেখা যায় দেশের ভেতর থেকে ধার পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই তখন চালু মুদ্রা মূল্যহীন করলে কাজ হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ সমস্ত দেনা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু অন্য দেশ থেকে নেয়া ঋণের ব্যাপারটা আলাদা। রুশদেশ যখন অপরদেশ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাল তখন তাকে সমগ্র সভ্য জগতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হলো। সঙ্গে সঙ্গে চলল মারমুখী প্রচারণা। অধিকাংশ দেশ এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় অসমর্থ, ফলে অন্য দেশ থেকে গৃহীত ঋণ সম্পর্কে সতর্ক থাকে। স্বর্ণ-মান নয়, যুদ্ধভীতিই অপর দেশকে দেয়া ঋণের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। এই নিরাপত্তা ঠুনকো এবং আন্তর্জাতিক সরকার গঠন ভিন্ন অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।

আর্থিক লেন-দেন কতটা সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করে তা অনেক সময় অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। অনেকটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি দ্বারা সম্পদের মালিকানা অর্জন করা হয়, কিন্তু উক্ত ব্যবসায়িক বুদ্ধি কেবল সম্ভব সেনা ও নৌশক্তির কাঠামোর ভেতর। সামরিক শক্তির জোরেই ওলন্দাজরা ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে নিউইয়র্ক কেড়ে নেয়, আবার ওলন্দাজদের কাছ থেকে ইংরেজরা ছিনিয়ে নেয়, সামরিক শক্তির বলেই মার্কিনীরা দখল কায়েম করে ইংরেজদের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে যখন তেল আবিষ্কৃত হলো তার মালিক হলো মার্কিন নাগরিকগণ। কিন্তু কম শক্তিধর দেশে তেল আবিষ্কৃত হলে ছলে-বলে-কৌশলে অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি-র নাগরিক তার মালিকানা লাভ করে বসে। যে পদ্ধতিতে এটা করা হয় তা গোপন থাকে। কিন্তু পেছনে ওৎ পেতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি। সুপ্ত হুমকিই চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় সাহায্য করে।

তেল ব্যাপারে যা প্রযোজ্য, ঋণ ব্যাপারেও তা সমানভাবে প্রযোজ্য। মুদ্রার মান। কমানো কিংবা ঋণ পরিশোধ অস্বীকার যখন সরকারের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করে, সরকার তখন তা করে থাকে। সত্য যে, কোনো-কোনো দেশ ঋণ পরিশোধের নৈতিক গুরুত্ব বিষয়ে লম্বা-চওড়া কথা বলে থাকে। আসল ব্যাপার হলো ঐ দেশগুলো ঋণ দিয়ে বসে আছে। যতদিন ঋণগ্রস্ত দেশ তাদের কথা শোনে, সে শুধু তাদের শক্তি আছে বলে, নীতিগত দিক বুঝে করে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে মুদ্রার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার একটা উপায়ই রয়েছে, আর তা হলো, বিশ্ব-সরকার গঠন। এই সরকারের অধীনে থাকবে সমগ্র সামরিক শক্তি। স্থায়ী মুদ্রা ব্যাপারে এই সরকারের স্বার্থ থাকতে হবে এবং নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে সমর্থ স্থায়ী ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন মুদ্রা চালু করবে। এটাই একমাত্র সত্য স্থায়িত্ব এবং স্বর্ণের এই স্থায়িত্ব প্রদানের ক্ষমতা নেই। সার্বভৌম দেশগুলো দুঃসময়ে স্বর্ণে নির্ভরতা বজায় রাখে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, স্বর্ণ মুদ্রা স্থায়িত্ব বিধান করে এই যুক্তি যে কোনো দিক বিচারে ভ্রমাত্মক।

যারা নিজেদের বড় বেশি বাস্তববাদী বলে বিবেচনা করে তারা আমাকে পুনঃপুন জানান যে, ব্যবসায়ীরা সাধারণত ধনী হওয়ার অভিলাষ পোষণ করে। পর্যবেক্ষণ করে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আমাকে যারা এই নিশ্চয়তা দিয়েছেন তারা বাস্তববাদী হওয়া তো দূরের কথা, তারা হলেন আবেগতাড়িত আদর্শবাদী মাত্র, যে জগতে তারা বাস করেন সেই জগতের মৌলিক বাস্তবতা তারা দেখতে পান না। ব্যবসায়ীরা যদি অপরকে দরিদ্র রাখার চেয়ে নিজেরা ধনী হওয়ার জন্য বাস্তবিক ইচ্ছা পোষণ করতেন, তাহলে জগত্তা দ্রুত স্বর্গে পরিণত হয়ে যেত। ব্যাংকিং এবং মুদ্রা থেকে একটা সুন্দর উদাহরণ আহরণ করা যায়। ব্যবসায়িক শ্রেণির সাধারণ স্বার্থই হলো এটা দেখা যে মুদ্রা স্থায়ী এবং ঋণ নিরাপদ। এই দুটি হাসিলের জন্য স্পষ্টতই সারা জগতে একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একটিই মুদ্রাব্যবস্থা থাকা দরকার। এই মুদ্রা অবশ্যই কাগজী হবে, যা পণ্য-সামগ্রীর গড়-মূল্য যতটা সম্ভব স্থির রাখবে। এই মুদ্রার ভিত্তি গোল্ড রিজার্ভ হওয়ার দরকার করে না। বরং বিশ্ব-সরকারের সুনাম বা ঋণ পরিশোধের সামর্থের উপর নির্ভর করবে। এবং বিশ্ব-সরকারের আর্থিক লেন-দেনের সংগঠন একটি থাকবে, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাপারগুলো এত স্বচ্ছ যে একটি শিশুর পক্ষেও তা বোঝ সম্ভব। কিন্তু এ ধরনের কোনো প্রস্তাবই ব্যবসায়ীদের দিক থেকে আসে না। কেন? জাতীয়তাবাদই এর কারণ। নিজেরা ধনবান হওয়ার চেয়ে অপর দেশকে দরিদ্র রাখতে তাদের আগ্রহ বেশি।

অপর একটি কারণ হলো, উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব। এটা স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলেই মনে হয় যে, টাকা ব্যবহার্য বস্তু শুধু এ কারণে যে টাকা দিয়ে পণ্য-সামগ্রী বিনিময় চলে। তবু খুব কম লোকই আবেগগত এবং যৌক্তিকভাবে তা সত্য মনে করেন। প্রায় প্রত্যেক লেন-দেনের ব্যাপারে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি খুশি হয়। আপনি এক জোড়া জুতো কেনেন তখন বিক্রেতা বিপণনের যাবতীয় কায়দা আপনার উপর আরোপ করে এবং বিক্রেতা ধরে নেন তিনি একটা ছোটোখাটো বিজয় অর্জন করেছেন। অপরপক্ষে আপনি মনে-মনে বলবেন না যে কি সুন্দর! ঐ নোংরা কাগজের টুকরোগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া গেল, যে টুকরাগুলো আহার্য হিসেবে গ্রহণও করতে পারতাম না, পোশাক হিসেবে ব্যবহারও চলত না। মাঝখান থেকে এক জোড়া চমৎকার জুতো পেয়ে গেলাম। আমার ক্রয়ের ব্যাপারটা বিক্রয়ের তুলনায় কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ঘটে যখন সরবরাহ হয় সীমিত। যে ব্যক্তি ওল্ড মাস্টারের চিত্রকর্ম ক্রয় করে সে বিক্রেতার চেয়ে বেশি খুশি হয়। কিন্তু ঐ ওল্ড মাস্টার যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি নিশ্চয় তার পৃষ্ঠপোষকের (ক্রেতার) চেয়ে বেশি খুশি হতেন। ক্রয়ের চেয়ে বিক্রি করে আমরা যে বেশি আনন্দিত হই তার মূল মনস্তাত্ত্বিক উৎস হলো সুখের চেয়ে ক্ষমতা আমরা বেশি পছন্দ করি। এটা সার্বিক চরিত্র নয়; এমন কিছু অমিতব্যয়ী ব্যক্তিও রয়েছেন যারা অনতিদীর্ঘ এবং আনন্দময় জীবন পছন্দ করেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য শক্তিমান ও সফল ব্যক্তিদের, যারা প্রতিযোগিতামূলক যুগে সামঞ্জস্য আনেন। যে কালে সকল সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা হতো তখন উৎপাদনের মনস্তত্ত্ব কম আধিপত্য করেছে। উৎপাদকের মনস্তত্ত্বই মানুষকে ক্রয়ের চেয়ে বিক্রয়ের প্রতি বেশি আগ্রহী করে তোলে। এবং এ জন্যই সরকারসমূহ এমন জগৎ সৃষ্টির হাস্যকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় যেখানে প্রত্যেক জাতি শুধু বিক্রি করে, কোনো জাতি ক্রয় করে না।

একটা অবস্থার জন্য উৎপাদকের মনস্তত্ত্ব জটিল হয়ে যায়। এই অবস্থাটা অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিশিষ্টতা দান করে। যদি কিছু আপনি উৎপাদন এবং বিক্রয় করেন তা হলে দুই ধরনের মানুষ আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনার ব্যবসার প্রতিযোগী এবং খদ্দেরগণ। প্রতিযোগী আপনার ক্ষতি করে। খদ্দের দ্বারা আপনি লাভবান হোন। প্রতিযোগীদের আপনার চেনা আছে, তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যাও কম, পক্ষান্তরে খদ্দেররা ছড়ানো-ছিটানো এবং অনেকাংশে অচেনা। ফলে আপনি খদ্দেরের চেয়ে প্রতিযোগীর প্রতি বেশি সচেতন হবার চেষ্টা করেন। এটা স্বীয় গোষ্ঠীর ভেতর না ঘটতে পারে, কিন্তু গোষ্ঠী যদি বাইরের হয় তাহলে এটা ঘটবেই। এবং ঐ গোষ্ঠীকে আপনার স্বার্থের প্রতিকূলে বলে ধরা হবে। এই বিশ্বাসই সংরক্ষণমূলক শুল্কের উৎস। বিদেশকে সম্ভাব্য খদ্দের হিসেবে না দেখে উৎপাদনে প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ বিদেশি প্রতিযোগীতা এড়ানোর জন্য বিদেশি বাজার হারাতে রাজি থাকে। এক ছোট্ট শহরে এক কসাই ছিল, সে অন্যান্য কসাইয়ের উপর চটে গেল, কারণ তারা তার খদ্দের কেড়ে নিয়েছে। উক্ত কসাই প্রতিজ্ঞা করে বসল সে সবার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। প্রতিজ্ঞা অনুসারে সে শহরটি নিরামীষ ভোজীতে পরিণত করল। অতঃপর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করতে হলো যে সে নিজেরও ধ্বংস ডেকে এনেছে। উক্ত কসাইয়ের বোকামি অবিশ্বাস্য বলেই মনে হয়। তবু তার বোকামি বৃহৎ শক্তিগুলোর বোকামির চেয়ে বেশি নয়। সবাই লক্ষ্য করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য অপরাপর জাতিকে ধনী করে এবং সবাই শুল্কের দেয়াল খাড়া করেছেন বৈদেশিক বাণিজ্য ধ্বংস করার জন্য। আর সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, তাদের প্রতিযোগীদের সমানই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কেউ ভেবে দেখেন নি যে, বাণিজ্য পারস্পরিক ব্যাপার এবং কোনো বৈদেশিক রাষ্ট্র যখন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে, একই সঙ্গে ক্রয়ও করে, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। ব্যাপারটা ভেবে দেখা হয় নি এজন্য যে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ জাতির প্রতি ঘৃণা তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে স্বচ্ছভাবে ভাবতে অসমর্থ করে তুলেছে।

গ্রেট ব্রিটেনে, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, যা যুদ্ধের পর থেকে দলগত বিভাগের ভিত্তি হয়ে রয়েছে, অধিকাংশ শিল্পপতিকে মুদ্রা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলো বুঝতে অসমর্থ করে তুলেছে। যেহেতু আর্থিক যোগান সম্পদের প্রতিনিধিত্ব করে তাই ধনীদের ভেতর একটা ঝোঁক পড়েছে যে, ব্যাংকার এবং অর্থের যোগানদারদের পদক্ষেপ অনুসরণ করে চলতে হবে। অথচ বাস্তব এই যে, ব্যাংকারদের স্বার্থ শিল্পপতিদের বিপরীত। মুদ্রা-সংকোচ ব্যাংকারদের অনুকূলে ছিল। পক্ষান্তরে এটা ব্রিটিশ শিল্পপতিদের পঙ্গু করেছে। এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, মজুরদের যদি কোনো প্রকার ভোট না থাকত তাহলে যুদ্ধের সময় থেকে ব্রিটিশ রাজনীতি অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিদের দ্বন্দ্বের ভেতর গঠিত হতো। যাহোক, অর্থের যোগানদার এবং শিল্পপতিরা এক জোট হয়ে যায় মজুরদের বিরুদ্ধে; শিল্পপতিরা অর্থের যোগানদারদের সমর্থন করে এবং দেশটা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায় এজন্য যে, ফরাসিরা অর্থের যোগানদারদের পরাস্ত করে।

শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে নয়, গোটা বিশ্বেই সাম্প্রতিককালে অর্থের যোগানদারদের স্বার্থ সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। এই অবস্থাটা নিজের থেকে পরিবর্তিত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো আধুনিক গোষ্ঠীর ধনী হবার সম্ভাবনা নেই যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে আর্থিক ব্যাপার অর্থের যোগানদারদের স্বার্থে কাজ করে। অবস্থাটা এরকম দাঁড়ালে অর্থের যোগানদারদের অবাধে ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের সুযোগ দেয়া বিজ্ঞজনোচিত কাজ হবে না। কোনো কোনো ব্যক্তি কিউরেটরের লাভের জন্য জাদুঘর চালাতে পারেন। তাকে এই স্বাধীনতাও দিতে পারেন উচ্চ মূল্য প্রদানের প্রস্তাব এলে তিনি জাদুঘরে রক্ষিত সামগ্রী বেচে দিতে পারবেন। কিছু কিছু কাজ আছে যাতে ব্যক্তিগত মুনাফার অভিপ্রায় সর্বসাধারণের অনুকূলে কাজ করে। আবার কিছু কিছু কাজের ফলাফল উল্টা দাঁড়ায়। আর্থিক ব্যাপারটা, আগের দিনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, বর্তমানে অবশ্যই শেষোক্ত শ্রেণিতে পড়ে। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, আর্থিক ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বেড়েই চলেছে। এখন দরকার হবে আর্থিক এবং শিল্পের ব্যাপারটা একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা, আর লক্ষ্য থাকবে এই একক সত্তা থেকে সর্বাধিক মুনাফা লাভ। আর্থিক ব্যাপারটা আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। উভয়ে যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে তখন অর্থ শিল্পের চেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু শিল্পের স্বার্থের সঙ্গে গোষ্ঠীর স্বার্থ অধিকতর মেলে। অর্থের স্বার্থের সঙ্গে যেমন ততটা নয়। অর্থের অতিরিক্ত ক্ষমতার জোরেই বর্তমান বিশ্বের এই হাল হয়েছে।

যেক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তি অধিক ব্যক্তির উপর ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হয়েছে তারা সব সময়ই ঐ অধিক ব্যক্তির কিছু কিছু কুসংস্কারের দরুন সহায়তা পেয়েছে। প্রাচীন মিশরের পুরোহিতরা চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণের সম্পর্কে ভবিষ্য-কথনের উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, যা তখনও জনগণ আতঙ্কজনক ব্যাপার বলে গণ্য করতেন; এর সুযোগ নিয়ে পুরোহিতরা মূল্যবান উপহার আদায় এবং ক্ষমতা খাটাতে সমর্থ হন। অন্য কোনো উপায়ে এটা সম্ভব হতো না। রাজা-বাদশাদের এক সময় স্বর্গীয় সত্তা মনে করা হতো। ফলে ক্রোমওয়েল প্রথম চার্লসের মুণ্ডু দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাঁকে এই দোষে দুষ্টু জ্ঞান করা শুরু হয় যে তিনি পবিত্র দেহ অপবিত্র করেছেন। আজকের দিনে অর্থের যোগানদারগণ জনগণের স্বর্ণের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ কুসংস্কারের উপর নির্ভর করেন। সাধারণ নাগরিক ভয়ে হতভম্ব হয়ে যায় যখন সে মজুদ স্বর্ণ, ইস্যুকৃত নোট, মুদ্রাস্ফীতি, মুদ্রাসংকোচ, পুনঃমুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি এবং আরো অনেক অজানা পরিভাষার ভেলকিবাজি সম্পর্কে শুনতে পায়। তখন তার মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে, যে ব্যক্তি এই সব ব্যাপার নিয়ে অনর্গল কথা বলতে পারেন তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত বিজ্ঞ ব্যক্তি হবেন। এবং এ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন জাগলেও জিজ্ঞেস করতে সাহস করেন না। তিনি বুঝতে পারেন না যে আধুনিক লেন-দেন ব্যাপারে বাস্তবিক পক্ষে স্বর্ণের ভূমিকা কত ক্ষুদ্র, অথচ স্বর্ণের ভূমিকা সম্পর্কে তাকে ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বিপাকে পড়বেন। তিনি অস্পষ্টভাবে অনুভব করেন যদি বেশ কিছু পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকে তবে দেশ অধিকতর নিরাপত্তার মধ্যে থাকবে। কাজেই দেখা যাবে, স্বর্ণের মজুদ বাড়লে তিনি খুশি হন, কমলে বড়ই বিষণ্ণ।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধরনের বুদ্ধিহীন শ্রদ্ধার অবস্থাই গণতন্ত্রের দ্বারা শৃঙ্খলামুক্ত থাকার জন্য অর্থের যোগানদারদের দরকার। অর্থের যোগানদারগণ অবশ্য গণমতের সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে আরো কিছু সুবিধা পান। অত্যন্ত ধনবান বলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অকাতরে অর্থ দান করতে পারেন, এতে বিদ্যায়তনিক মতের প্রভাবশালী অংশ তার অনুগত থাকে। ধনিকতন্ত্রের মাথায় বসে আছেন বলে যাদের রাজনৈতিক চিন্তা কম্যুনিজমের ভয়-তাড়িত তাদের স্বাভাবিক নেতায় পরিণত হন। অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী বলে সমগ্র জাতির ভেতর খেয়াল খুশি মতো সমৃদ্ধি কিংবা সর্বনাশ বিতরণ করতে পারেন। আমার সংশয় হয়, কুসংস্কার না থাকলে এই উপায়গুলোর কোনোটা সম্পূর্ণ উপযোগী হতো কি-না। একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই যে, অর্থ শাস্ত্র প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই বিষয়টা কোনো বিদ্যালয়ে একেবারে পড়ানো হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও একটা সংখ্যালঘু শ্রেণিই শুধু এই বিষয়ে শিক্ষা পেয়ে থাকে। উপরন্তু রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার দরুন এ বিষয়ে যে ধরনের শিক্ষা তাদের পাওয়া উচিত ছিল তা তারা পায় না। গুটিকয় প্রতিষ্ঠান মাত্র ধনিক শ্রেণির প্রতি পক্ষপাত না দেখিয়ে অর্থশাস্ত্রে শিক্ষা দিয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। কার্যত অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা গৌরবান্বিত করার জন্য শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। অনুমান করি, আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য কুসংস্কার ও রহস্যময়তা যে অত্যন্ত জরুরি এসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে।

যুদ্ধের মতো, আর্থিক ব্যবস্থাও বিপাকে পড়ে। কারণ এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের পক্ষপাত গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিকূলে যায়। যখন নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, নৌ এবং পদাতিক বাহিনীর বিশেষজ্ঞরা মূল উদ্দেশ্যের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে ঐ লোকগুলো অসাধু। তাদের পেশাগত অভ্যাসই অস্ত্রশস্ত্রের প্রশ্নটা প্রকৃত পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে দেখা বাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই একই ঘটনা ঘটে আর্থিক ব্যাপারে। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান কম লোকেরই আছে। ব্যতিক্রম শুধু তারা যাত্রা প্রচলিত ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ লাভে লিপ্ত। এদের পক্ষে স্বাভাবিক কারণে পুরোপুরি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনও সম্ভব হয় না। এই অবস্থার প্রতিকার করতে হলে পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে পৃথিবীর আর্থিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে আর্থিক নীতিমালা সহজতর করা জরুরি যাতে সবাই তা বুঝতে পারে। স্বীকার করতে হবে কাজটা সহজ নয়। কিন্তু আমি মনে করি না যে এটি একটি অসম্ভব কাজ। চলতিকালে গণতন্ত্র সফল করে তোলার জন্য অন্যতম বাধা এই যে, আধুনিক জগত্তাই জটিল, এ জন্য সাধারণ নর-নারীর পক্ষে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত মতামত গঠন ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে। কাদের বিশেষজ্ঞ মতামত সর্বাধিক শ্রদ্ধা করা উচিত যে সম্পর্কে মনস্থির করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার প্রতিকার সম্ভব শিক্ষাদর্শের উন্নতিসাধন করে। তাছাড়া সমাজের কাঠামো ব্যাখ্যা করার জন্য বর্তমানে যে উপায় প্রচলিত রয়েছে তার চেয়ে সহজ উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। যারা প্রকৃতই কার্যকর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তারা এ ধরনের সংস্কার সমর্থন করবেন। কিন্তু হয়তো শ্যামদেশ এবং মঙ্গোলিয়ার দূরাঞ্চল ছাড়া আজ আর কোথাও কোনো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তি অবশিষ্ট নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *