বিকেল
বাড়িটা তাঁর বাড়ির কাছেই। যেতে আসতে সুজাতা বাড়িটা অনেকবারই দেখেছেন, কখনো ঢোকেন নি, কার বাড়ি তা জানেন না। পুরনো দিনের দোতলা বাড়ি, সামনে টানা বারান্দা, বাড়ির ওপরে মেট্রো নকশা, গায়ে লেখা পব-গঙ্গা নগর, সম্ভবত মালিকের গ্রামের নাম। সুজাতার চোখের সামনে বিশ বছরের বাড়িটার চেহারা কলকাতার মত হয়ে গেল। খানিকটা নতুন ঝকঝকে, এনামেল রঙে উদ্ধত, জানালার নিচে এয়ারকুলার। খানিকটা জীর্ণ, পলেস্তার খসা, জানালায় শাড়িকাটা ময়লা পর্দা। নিচে রাস্তার সামনে ঘরে ঘরে ধোবিখানা, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান, রেডিও মেরামতী দোকান। শরিকে শরিকে ঐশ্চর্য ও দারিদ্র্য ভাগ হয়ে গেছে, বোঝা যায়।
অন্ধকার প্যাসেজ পেরিয়ে শরিকী উঠোনের পাশে একটা বড় ঘর। বাড়িটার পেছন দিক এটা। সামনে একটা অযত্নের আতগাছ। ঘরটার দেওয়াল ও ছাতের আস্তর খসা, মেঝের সিমেন্ট ওঠা। একটা বড় তক্তপোশ। আলমারিতে ময়লা ও অব্যবহৃত আইনের বই, আলমারির তলায় জং। সুজাতা তক্তপোশে বসেছিলেন। নন্দিনী তাঁর সামনে, মোড়ায় বসে।
বিট্রে করেছিল অনিন্দ্য।
নন্দিনী আবার বলল। আগেও বলেছে কথাটা, এখনো যখন বলল, ওর চোখে সামান্য বিস্ময়, ভাসমান মেঘের মত অস্থায়ী ছায়া ফেলে চলে গেল। যেন ও এখনো সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারে না, অথবা ভেবে পায় না, এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে সমরা নিহত হতে পারে জেনেও অনিন্দ্য কেমন করে এ কাজ করেছিল।
আমি সব কথা জানি না নন্দিনী।
জানি, আপনারা কখনোই কোন কিছু জানেন না। যা হয়, সব যেন একেকটা ঘটনামাত্র; কেন হয় কেমন করে হয়…তা জানলেও চলে যায় যে বিশ্বাসটা ঠিক নয় এখন দেখতে পাচ্ছেন।
সুজাতা কথা বললেন না।
অনিন্দ্য বিট্রে করেছিল। ব্রতী, লাইক এ ফল, অনিন্দ্যকে বিশ্বাস করেছিল। তার কারণ অনিন্দ্যকে এনেছিল নিতু, ব্রতীর বন্ধু।
নিতু যাকে এনেছে, তাকে অবিশ্বাস করা চলে না, ব্রতী তাই ভেবেছিল, কেননা নিতু ব্রতীর বন্ধু। নিতু কি জেনেশনেই অনিন্দ্যকে এনেছিল? সুজাতা মনে মনে ভাবলেন।
বহুদিন সলিটারি সেলে একা থাকলে বোধহয় মানুষের মন অত্যন্ত অনুভূতিপ্রখর হয়ে যায়। কেননা সলিটারি সেল বড় একাকী, বড় নিজন, সেখানে মানুষ চারদেওয়াল, লোহার কপাট ও দেওয়ালে একটি ফোকরের পাহারায় নিজের সঙ্গে বড় একা একা বাস করে। সব সময়েই মনকে লাশঘরের ডাক্তারের ছরি অথবা বেয়নেটের ফলার মত তীক্ষ্ণ শাণিত, একলক্ষ করে সলিটারি সেলের মানুষ বাইরের জগৎকে ফুঁড়ে ফুঁড়ে জানতে যায় কে তাকে মনে রেখেছে? মাঝে মাঝে দরজা খুলে যায়। তখন যেখানে যায়, তাও তার কাঙ্ক্ষিত বাইরের জগৎ নয়। সে ঘর অন্যরকম। সাউণ্ডপ্রুফে। দরজা-জানালায় ফেল্টমোড়ানো ফাঁপা রবারের নল বসিয়ে সাউণ্ডপ্রুফ করা। ঘরের আর্তনাদ, গোঙানি, মারের আওয়াজ, জেরাকারীর গর্জন, সব শব্দ ওই নলের জন্য ঘরের ভেতরেই বন্দী থাকে। সে ঘরে যাকে জেরা করা হচ্ছে, তার চোখের ওপর হাজার ওয়াটের বাতি জলে। যে জেরা করে সে থাকে অন্ধকারে। সে সিগারেটখোর হোক বা না হোক, হাতে সিগারেট জলে। কখনো কখনো ‘ও, আপনি চ্যাটার্জির বন্ধু? এ হেন সামাজিক ভদ্র প্রশ্ন মিহিগলায় করে শিক্ষিত ভদ্রবংশের জেরাকারী জলন্ত সিগারেটটা হাজার ওয়াটে উদ্ভাসিত মুখের ওপর চেপে ধরতেও পারে। সিগারেটের ছ্যাঁকায় শুধু ‘সারফেস কিউটেনাস ইনজুরি’ হয়। চামড়া সামান্য পেড়ে। সে পোড়ার ঘা মলম লাগালে সেরে যায়। তখন ‘সারফেস কিউটেনাস হীলিং’ হয়। চামড়ার ঘা ওপর ওপর সেরে যায়। কিন্তু ভেতরে, তরুণ হৃদয়ে, প্রত্যেকটা ছ্যাঁকা চিরকাল ক্ষত হয়ে থাকে, থেকে যায়। তারপর আবার সলিটারি সেল নিজের সঙ্গে একা।
নিজের সঙ্গে একা থাকলে মন অনুভূতিপ্রখর হয়। লাশঘরের ডাক্তারের ছুরি অথবা বেয়নেটের ফলার মত তীক্ষ্ণ, শাণিত, একলক্ষ। তাই নন্দিনী বুঝতে পারলে সুজাতা নির্বাকে প্রশ্ন করেছেন নিতু জেনেশনেই অনিন্দ্যকে এনেছিল কিনা?
নন্দিনী বলল, নিতু অনিন্দ্যকে জেনে এনেছিল কিনা, অথবা না জেনে, সে আর কোনদিন জানা যাবে না। নিতুর কি হয়েছিল জানেন?
না।
নিতুর অনেকগুলো অ্যালায়াস ছিল। অনেক দাম। ব্রতীর সরে যাবার পর অসম্ভব রাউণ্ড আপ হতে থাকে। ওর এলাকার সবাই, ওকে দীপা বলে জানত। নিতু সেই সময়ে পালায়। ও কাছাকাছিই গিয়েছিল। ইনডাসট্রিয়াল বেল্টে। সেখানে, এমন ব্যাপার, ওকে সম্পূর্ণ অন্য আরেকজন মনে করে লোকাল থানায় ধরে। সেই সময় সেখানে গিয়ে পড়ে ওর অঞ্চলের থানার ও, সি,। ও, সি-র তখন ওখানে যাবার কথা নয়। কিন্তু কাগজও আমাদের বিট্রে করছিল। কোথায় হাই আউট, কোথায় হাসপাতালের ব্যবস্থা, কোথায় গ্রামে কাজ চলছে, ওরা মাঝে মাঝেই ছাপছিল। প্রবন্ধ লিখছিল। সেইরকম একটা খবরের পর ও. সি. ওই বেলটে যায়। জীপ থামিয়ে ও চা খেতে ঢুকেছিল। আর গড় নিতে।
গুড় নিতে!
হ্যাঁ! ওখানকার আখের গড় ফেমাস। ওর জন্য দু হাঁড়ি কেনা ছিল। ও ঢুকেই নিতুকে দেখে। বলে, দীপু, তুমি? নিতু তখন ভয়ে, জেরার চোটে মার খেয়ে, খুব নার্ভাস ছিল। বলে ফেলে হ্যাঁ! দেখুন না, আমাকে এরা ধরে এনেছে। ও. সি. ওকে তখনি জীপে তুলে নেয়। পথে হোটেলে খাওয়ায়, সিগারেট দেয়। যেহেতু নিতু পাড়ার অত্যন্ত পপুলার ছেলে, কোন অ্যাকশনই পাড়ায় করেনি সেহেতু ও ভেবেছিল বেরিয়ে আসতে পারবে।
পারে নি?
না। ওকে পাড়ায় এনে থানার সামনে পিটিয়ে মেরেছিল। পাড়ার মেয়েরা সেদিন প্রোটেসট জানাতে গিয়েছিল। তাদের ওপর টিয়ারগ্যাসিং হয়।
কাগজে বেরোয় নি?
না।
তারপর?
নিতু নেই। অনিন্দ্যর সব উদ্দেশ্য ও জানত কিনা তা কোনদিন জানা যাবে না। তবে আমার মনে হয়…
কি?
জানা উচিত ছিল।
কার? নিতুর?
যাকে চেনেন না, তার নামটা সহজেই বলতে পারলেন সুজাতা, ব্রতী কি তাঁকে এদের সঙ্গে, যাদের জানেন না সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছে?
হাঁ। তার, আমার, ব্রতীর।
কি জানা উচিত ছিল?
আমরা যা করেছি, তার সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের প্রোগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা প্রোগ্রাম অন্যদের ছিল।
কি প্রোগ্রাম?
কেন, বিট্রেয়ালের।
নন্দিনী শান্ত, নিরুত্তাপ, প্রায় উদাসীন গলায় বলল। এখন সুজাতা বুঝলেন, অনিন্দ্য নামটা উচ্চারণের সময়েও চোখ দিয়ে বিস্ময়ের ছায়া ক্ষণিক মেঘের মত ভেসে যেতে দেখেছিলেন। সে বিস্ময়টা অনিন্দ্য যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে জন্যে নয়। বিস্ময় ওর, ব্রতীর এবং অন্যদের জন্য। সব রকম স্থায়ী ব্যবস্থায় প্রচণ্ড বিশ্বাসহীনতাকে ওর প্রজ্বলন্ত বিশ্বাসে গ্রহণ করেছিল। সেই সঙ্গে কেউ কেউ যে সুপরিকল্পিত ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলতে পারে বন্ধু সেজে, খবর লিখে, তা ওরা ভেবে দেখে নি বলে বিস্ময়।
সব কিছুকে মনে হয় বিট্রেয়াল।
নন্দিনী আবার বলল। সুজাতা দেখলেন ওর শীর্ণ, কালো, ক্লান্ত মুখে চোখের নিচে এক স্থায়ী ছায়া। পাহাড়ের ঢাল গায়ে সানদেশে ওরকম করেই ছায়া স্থায়ী হয়ে থাকে। পাহাড়ের সান দেশে কোন অজানা জায়গা চিরছায়ার দেশ।
মনে হল নন্দিনীকে কোনদিন চেনা যাবে না, জানা যাবে না। সহসা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে মনে হল, শুন্যতার অনুভূতি। ব্রতী যাকে ভালবেসেছিল, তাকে কোনদিন জানবেন না, চিনবেন না, তার মন তাঁর কাছে চির অচেনা হয়ে থাকবে, ভাবতে সুজাতার বড় কষ্ট হল। ব্যথা। সমুর মার কাছে আর যেতে পারবেন না। নন্দিনীকে কোনদিন ভাল করে চিনতে পারবেন না, বড় ব্যথা, বড় ক্ষতির শোক। নন্দিনীর কোন বিশ্বাস, কোন অভিজ্ঞতা সুজাতা ভাগ করে নেন নি, বুঝতে বা জানতে চেষ্টা করেন নি নন্দিনীদের, ব্রতীদের। যা যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তার কতটা অপচয়, কতটা সাথকতা, কে তাঁকে বলে দেবে? সুজাতার স্বভাব ও মনের ঘাটতিগুলোকে সুজাতা এমনি করে চিনবেন সেই জন্যেই কি ব্রতী সেদিন সন্ধ্যায় নীল শার্ট পরে বেরিয়ে গিয়েছিল? সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে চেয়ে দেখেছিল সুজাতার মুখের দিকে?
যদি সেই সময়টা ফিরে পান সুজাতা তবে নেমে যান সিঁড়ি দিয়ে। জড়িয়ে ধরেন ব্রতীকে, তাঁর আত্মজকে। বলেন, সব আমি জানব ব্রতী, সব জানতে শুরু করব। শুধু তুই বেরিয়ে যাস না ব্রতী। কলকাতায় একটা বিশ বছরের ছেলে এ পাড়া থেকে ওপাড়া যেতে পারে না রে। তুই যাস না।
সময় ফিরে পাওয়া যায় না। সময় চলে যায় নির্মম, ঘাতক, নিয়তিসমান সময়। সময় জাহ্নবী, শোক বেলাভূমি। সময়ের স্রোতে শোকের ওপর পলিমাটি চাপা পড়ে। তারপর একদিন সেই পলিমাটি ফুঁড়ে নতুন নতুন অকুরের আঙুল বেরোয়। আলগলো আকাশপানে আবার উঠতে চায়। আশার, বৈদনার, সুখের, আনন্দের অকুরের আঙুল।
সব, সবাইকে বিট্রেয়াল মনে হয়।
সুজাতার চিন্তা দেওয়ালের ওপার থেকে নন্দিনী বলল।
এতে তোমার কষ্ট বাড়বে নন্দিনী।
না না। বরং ব্রিটেয়ালও যে আছে তা যখন জানতাম না তখন নিজেদের ওপর বিশ্বাস ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু সে বিশ্বাসে কোন বনেদ ছিল না। তাই, হোয়েন আই স্টার্স্টেড ডাউটিং, হোয়েন আই থট অ্যান্ড থট ওভার দি ফ্যাক্ট্স, আমি অনেক বেশি শিওর হতে পারলাম। নাউ আই নো হোয়্যার আই স্ট্যান্ড।
ডাজ, ইট হেলপ য়ু এনি?
হ্যাঁ। এখন মনে হয়, তখন কত সহজে মনে হত সত্যিই একটা এরা শেষ হয়ে যাচ্ছে। উইং আর ব্রিংগিং এ নিউ এজ ইন। আমি আর ব্রতী শুধু কথা বলতে কতদিন শ্যামবাজার থেকে ভবানীপুর হেঁটে ফিরেছি। তখন যা দেখতাম, মানষ বাড়ি-পথের-নিয়ম–ফুটপাতে ফেরিওয়ালার কাছে লাল গোলাপ, পথের ধারে ফেসটুন–বাসস্টপে সাঁটা খবরের কাগজ, মানুষের মুখে হাসি–পথের দোকানে কোন লিটল ম্যাগাজিনে কোন কবিতার সুন্দর ইমেজ যখন ময়দানে মিটিঙে জনতার হাততালি—হিন্দী গানের সুন্দর সুর শুনতাম, আমাদের কি তীব্র আনন্দ হত—আনন্দ ধরে রাখা যেত না, উই ফেলট এক্সপ্লোসিভ। ফেলট লয়াল টু অল অ্যান্ড এভরিথিংসে মন আর ফিরে আসবে না, আর ফিরে পাব না আমি। কোনদিন ফিরে পাব না। টোটাল লস। একটা এরা সত্যিই শেষ হয়ে গেছে। সেদিনের আমি মরে গেছি।
কেন নন্দিনী? ব্রতী নেই বলে?
ব্রতী নেই বলে। আরো অনেক কিছু নেই। সলিটারি সেলে থাকতে ভেবে ভেবে আমিও শেষ হয়ে গেছি।
ওরকম করে বল না।
মাও আপনার মত করে কথা বলে! মা বোঝে না, আপনি বুঝবেন না।
একেবারে বুঝব না নন্দিনী?
কেমন করে বুঝবেন? আপনারা কি আমাদের মত করে নিজের লয়লিটি প্লেজ করেছিলেন? টু এভরিথিং অফ এভরি ডে লাইফ?
না। সুজাতা করেন নি। অনুগত্য গচ্ছিত রাখেন নি পথচারীর হাসিতে ভেসে আসা গানের টুকরোয়, লাল গোলাপে, উজ্জ্বল আলোয়, ঝুলন্ত ফেসটুনের কাপড়ে। সুজাতা কোথায়, কোন কোন জিনিসে আনুগত্য গচ্ছিত রেখেছিলেন?
এখন বুঝি কিভাবে বিট্রেয়াল চলেছিল। এখনো চলছে।
এখনো, নন্দিনী?
এখনো। নইলে জেলে জেলে পাঁচিল উঁচু কেন, কেন ওয়াচ টাওয়ার? কেন হাজার হাজার ছেলে জেলে আছে তব কেউ একটি কথাও বলে না? যখন বলে, তখন দলের স্বার্থ বাঁচিয়ে তবে বলে? কেন? আমরা, যারা কাজ করতে চাই, একটা কাগজও ছাপতে পারি না? প্রেস, টাইপ, কিছু পাই না, অথচ অজস্র ম্যাগাজিন বেরোয়, শুধু বেরোয়, শোনা যায় সেগুলো সিমপ্যাথেটিক টু দি কজ? ব্রিট্রেয়াল। কতজন বিট্রে করছে না জেনেও শুধু আলগা কথা বলে? কেন কতকগুলো কবি সে সময়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ করে মাতামাতি করে, আর এখন কেঁদে কেঁদে কবিতা লেখে? বিট্রেয়াল কেন এখনো রাউনড আপ, জেলে গলি, ধরপাকড়? বিট্রেয়াল।
এখনো?
এখনো। কেন, কাগজে বেরোয় না বলে ধরপাকড় হচ্ছে না? গুলি চলছে না? কি হচ্ছে না? কেন হবে না? কি শেষ হয়েছে? কিছু না। নাথিং হ্যাজ এনডেড। যোল থেকে চব্বিশ, একটা জেনারেশন শেষ হয়ে গেল। যাচ্ছে…
সুজাতা হঠাৎ যা করেন না, তাই করলেন। আবেগের বশে কাজ করা ওঁর স্বভাবে নেই। জীবনেও যা স্বাভাবিক ইচ্ছে, যাতে আগ্রহ, তা করতে সাহস পান নি। অল্প বয়সে দিব্যনাথ তাঁকে ঝড় দেখতে জানালায় দাঁড়ালেও শাসন করতেন। অল্প বয়সে স্বভাবে যে যে অনুশাসন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আর সেগুলো অতিক্রম করা যায় না। তবু সুজাতা নন্দিনীর হাতে হাত রাখলেন। মনে মনে এই মুহূর্তেই কি সুজাতা জানছেন না, এই সময়, এই সুযোগ আর ফিরে পাবেন না তিনি? সময়ের মত পলাতক আর কে? ব্রতীর নীল শার্ট পরে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে চেয়ে থাকার অমূল্য দুর্লভ সময় আর ফিরে পাবেন না। এখন মনের নিচে, অতলে কি শুন্যতা, কিসের যেন অপরিমেয় শোক, নন্দিনীকে আর কাছে পাবেন না।
তাই সুজাতা নন্দিনীর হাতে হাত রাখলেন। নন্দিনী কি তাঁর হাত সরিয়ে দিয়ে তাঁকে তাঁর জীবনের অভ্যস্ত গণ্ডীতে ঠেলে দেবে আবার? সমুর দিদির চোখে যেরকম প্রত্যাখ্যান ছিল, নন্দিনীর চোখেও কি সেই প্রত্যাখ্যানই দেখতে পাবেন সুজাতা? ভাবতে গেলেই ভয় করছে। সুজাতা জানেন, এখন থেকে শুধু বাইরে দিব্যনাথ-জ্যোতি-তলি-নীপা-বিনি ব্যাঙ্কের সহকমীরা, ভেতরে শুধু ব্রতী, শুধু ব্রতী কেন, ব্রতী–-সমুর মা–নন্দিনী, প্রত্যেকের সঙ্গে বিচ্ছেদের শোক নিয়ে গুমরে থাকা, সেটাই তাঁর সলিটারি সেল হবে। এখন থেকে তিনি একা হয়ে যাবেন, একেবারে একা, কেউ দরজা খুলে তাঁর নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে আর জিজ্ঞেস করবে না, আপনি ব্রতী চ্যাটার্জির মা?
কিন্তু নন্দিনী হাত সরিয়ে দিল না।
নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ভীর কঠিত, অনিচ্ছক হাতে ওঁর হাতে নিজের আঙুল বোলাল। সুজাতা হাত নামিয়ে নিলেন। কৃতজ্ঞ তিনি, নন্দিনী তাঁর হাতে হাত রেখেছে!
আমি ব্রতীকে ভালবাসতাম।
ব্রতী তোমার কথা আমাকে বলেছিল।
বলেছিল?
হ্যাঁ। ষোলই জানয়েরী।
আশ্চর্য!
কি?
আগে বলে নি?
না।
আমার মনে হয়েছিল, বললে ব্ৰতী আপনাকেই বলবে। বাড়িতে আর কারো ওপর ওর ফেইথ ছিল না।
ব্রতীর!
আপনি অবাক হচ্ছেন কেন?
ব্রতী অন্যদের সঙ্গে খুব ক্লোজ ছিল না। কিন্তু…
আশ্চর্য হবার কি আছে। বাবা, দিদি, দাদা হলে তাদের ভালবাসতে হবে? তাদের দিক থেকে কোন জেসচার না থাকলেও?
আমি জানি না নন্দিনী, ব্রতীকে আমি কত কম চিনতাম তা আজ বুঝতে পারি। তখন বুঝি নি।
বোঝার চেষ্টা করেছিলেন?
সুজাতা মাথা নাড়লেন। কখনো কোন অবস্থাতেই তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। ব্রতী জানত।
আপনার আপনাদের জেনারেশনটাই এই রকম। আপনারা সব কিছ চান। ভালবাসা, বিশ্বস্ততা, বাধ্যতা। কেন চান, কেমন করে চান?
চাইব না নন্দিনী?
না। চাইবেন না। চাইবার অধিকার আপনারা কতজন ফরফিট করেছেন? আবার কতজনের বাবা মার সঙ্গে অন্য সম্পর্ক ছিল। অন্তু, দীপ, সঞ্চয়ন, অল হ্যাভ হাপি লাইভ্স্! তবু তারা এসেছিল? কেমন করে এসেছিল। কে বলে দেবে?
তুমিই বল নন্দিনী।
ব্রতীর কথাই ধরন। ওর বাবার সঙ্গে ওর কোন পরিচয় ছিল। প্রথমে যখন জেস-চার বাবার দিক থেকে আসতে পারত, তখন বাবা কোন রিলেশান গড়তে চেষ্টা করেন নি। উনি আপনাকে ব্যবহার করতেন পাপোশের মত, ব্রতী বলত।
ব্রতী একথা বলেছিল?
আমি কি করে জানব বলুন?
ব্রতী বলেছিল।
সুজাতার মুখ লাল হয়ে গেল, তারপর স্বাভাবিক রং ফিরে এল। ব্রতী তাহলে সবই বুঝত। তাই মা’র ওপর ছিল সস্নেহ ভালবাসা। ছোটবেলা একেবারে, তিনি নীরবে কাঁদছেন দেখে ছয় বছরের ব্রতী বলেছিল আমি তোমাকে একটা বাঘ আর শিকারী ছাপা শাড়ি কিনে দেব।
ও বলত বাবা ঘষে দিয়ে অন্যের ক্লায়েন্ট নিয়মিত ভাঙিয়ে আনেন। হি ইজ ওয়ান সি. এ. যে মরে গেলে কেউ দুঃখ করবে না। বলত আপনার মত গ্রী, চার ছেলে মেয়ে থাকা সত্ত্বেও উনি মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত…একজন টাইপিসট মেয়েকে উনি ফ্ল্যাট ভাড়া করে রেখেছিলেন। ব্রতী সেজন্য ওঁকে শাসিয়েছিল, আপনি জানেন?
কবে?
নভেম্বরে। ব্রতী মারা যাবার দুমাস আগে।
এখন সুজাতা বুঝলেন কেন কয়েকমাস ব্রতী দিব্যনাথের সামনে আসে নি, কথা বলে নি। কেন দিব্যনাথ ব্রতীর নাম উচ্চারণ করেন নি। একবারও আগেকার মত বলেন নি, তোমার ছোট ছেলে কি বাড়িতেই থাকে?
ওর দাদা দিদিরা বাবাকে অ্যাডমায়ার করত। ব্রতী বলত ওরা মানুষ নয়। ওর দিদি একটা নিমফো। ছোটটি একটা কমপ্লেক্স বোঝাই অসভ্য মেয়ে, দাদা একটা দালাল, ওর কাছেই শুনেছি। শুধু আপনার ওপর …আপনাকে ও ভালবাসত। সেই জন্যেই চলে যায় নি।
কোথায় চলে যায় নি?
ওর বাড়িতে থাকার কথা নয়। মনে হয় আপনার জন্যে ও যাচ্ছিল না। কিন্তু উনিশে জানুয়ারী ওর, আমার, চলে যাবার এ কথা, আরো অন্যদের।
কোথায়?
বেসে।
ব্রতী বাড়ি ছেড়ে চলে যেত?
থাকলে যেত। অনিন্দ্য বিট্রে না করলে যেত। ব্রতীদের ডিসট্রাস্ট শুরু হয় বাড়ি থেকে। তারপর…
সমুর বাবা ব্রতীর বাবার মত ছিলেন না…
সমুদের ডিসট্রাষ্ট অন্য দিক থেকে শুরু হয়। সমু ত বলত ওর বাবাকে ও আগে মারবে। খেপে গেলে বলত। বলত বাবা টেকস এভরিথিং লাইং ডাউন। মাছওয়ালা থেকে পাড়ার মস্তান সবাই বলি করছে জিনিস কিনে কেউ দাম দিত না। আবার অন্তু, দীপ, সঞ্চয়ন, এরা এদের বাবাদের শ্রদ্ধাই করত। এদের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। এখন সব হিসাবের বাইরে।
আমার কথা ব্রতী আর কি বলত?
অনেক, অনেক বলত। সব সময়ে নয় মাঝে মাঝে। এই দেখুন। না, ব্রতীর বেসে যাওয়ার কথা পনেরই জানুয়ারী। ও ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে উনিশে নিয়ে গেল। শুধু আমি জানতাম জমদিনটা, ওর জন্মদিনটা আমার কাছে খুব মূল্যবান। ও সব বিশ্বাস করত না। তবু আপনার জন্যই ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে…আমি জানতাম, কাউকে বলি নি। তবে ওকে খুব বলেছিলাম।
ও কি বলল?
হাসল। যে কথার জবাব দিতে চাইত না, সে কথার উত্তরে ব্ৰতী হাসত। বলল, আমি তোর মত স্ট্রং নয় বোধহয়।
আর কী বলত ব্ৰতী?
বলত আপনি খুব ভাল। বলত আপনি থরোলি ননআন্ডারস্ট্যানডিং কিন্তু আপনাকে ও একসপ্লেইন করতে পারে। আপনার ওপর ওর কোন রাগ নেই। ও ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে প্রথমটা চাকরি-বাকরির কথা ভাবত। তখন বলত আপনাকে নিয়ে ও চলে যাবে কোথাও। পরে অবশ্য সে সব কথা আর বলে নি।
তাহলে সুজাতার ক্ষুধিত, অকড়েধর ভালবাসাও পরোক্ষে ব্রতীর মৃত্যুর জন্য দায়ী? তাঁর কষ্ট হবে বলে ব্রতী সেদিন কলকাতায় ছিল। নইলে ব্রতী চলে যেত বেসে। বেস কোথায়?
সলিটারি সেলে থাকলে মানুষের মন অনুসন্ধানী ও ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। লাশঘরের ডাক্তারের ছরির মত।
নন্দিনী বলল, নিজেকেই শুধু দোষ দেবেন না। যেভাবেই হোক, ব্রতী হয় ত বেসেও মরত। যদিও অনিন্দ্য বিট্রে না করলে…
তবু মনে হয়…
অনিন্দ্য বিট্রে করল সেটাই আসল কথা। আমরা কোন দল ভেঙে বেরিয়ে আসি নি। সরাসরি কনভার্ট। অনিন্দ্য দল ভেঙে এসেছিল। এসেছিল বলে কয়ে নির্দেশ মত। সমরা সেদিন পাড়ায় ফিরবে, আগে কথা হল। পরে ডিসিশান, চেনজ হল। আমরা সময়ে অর্গানাইজেশনের এইসব দুবলতার জন্যে সাফার করেছি। একেবারে আন্ডারগ্রাউন্ড অর্গানাইজেশন য়ু অলওয়েজ ডিপেনড আপ অন অদাস। সমুর যাবে না, এ কথা তাদের অনিন্দ্য জানিয়ে দেবে, তারপর সে যে জানিয়েছে সে খবর ব্রতীকে জানাবে।
ব্রতী সেজন্য বাড়িতে বসেছিল।
হ্যাঁ। কিন্তু অনিন্দ্য সমুদের কিছুই বলে নি। ও পাড়ায় চলে গিয়ে অন্যদের খবর দেয়। দিয়ে আর ও ফেরে নি সোজা কলকাতার বাইরে চলে যায়। আবার সন্ধ্যায় লালটুকে মিট করার কথা। আমি যখন জানি ওরা চলে গেছে, ব্রতীকে সে কথাই জানাই। তারপর ব্রতী আর ফারদার্ ডিরেকশনের জন্যে অপেক্ষা করে নি। নিজেই ও সমুদের সাবধান করতে চলে যায়।
তুমি…তুমি কি করে জানলে?
আমি জেনেছিলাম ভোরে। পার্থর যে ভাই সেই রাতেই পালায়, সে আমাকে জানায়।
তুমি তখন…
আমি সেই সকালেই অ্যারেস্ট হলাম।
সেই সকালেই?
হ্যাঁ! অনিন্দ্য আমাদের ইউনিটটাকেই বিট্রে করেছিল।
সে তখন কোথায়?
কে, অনিন্দ্য? অনিন্দ্য তখন বাইরে।
বাইরে?
অন্য স্টেটে।
তারপর?
তারপর জেলে ছিলাম। তখন মনে হত…
কি?
অনিন্দ্যকে মারব। এখন আর মনে হয় না।
এখন কি?
না মাসীমা, আমি বদলাই নি। তাই শুধু অনিন্দ্য নয়, অন্যভাবে সবকিছুর বিরুদ্ধে হয়ত আবার লড়তে হবে।
আবার, নন্দিনী?
হোআই নট?
কেন বল? তা হলে তোমাকেও…
আপনি বুঝতে পারছেন না। য়ু লাভ টু ইনটেনসলি… তারপর জেল-জেরা-চোখের ওপর বাতি–দে ট্রাই টু ব্রেক য়ু—তখন য়ু ফাইন্ড ইওরসেলফ। আমি কোনদিন, আপনি যে রকম ভাবছেন, সে রকম সহজ, স্বাভাবিক হতে পারব না। শুধু ব্রতীর জন্য নয়। থাকলে হয়ত আমরা বিয়ে করতাম। কিংবা করতাম না। কি করতাম তা নির্ভর করছিল অন্যান্য জিনিসের ওপর। জানিনা কি হত। তারপর সব কথা আমি বলব না, য়ু লজ টেস্ট ফর সো মেনি থিংস।
ব্রতীকে তুমি খুব ভালবাসতে?
তখন তাই মনে হত। এখনো তাই মনে হয়। শুনেছি সময়ে সবই সবাই ভুলে যাব। কিংবা ওর মুখ আবছা হয়ে যাবে মনে। ভাবলে ভয় করে।
হ্যাঁ।
আপনারও?
হ্যাঁ।
জানি না ভুলে যাব কি না। জানি না কম মনে পড়বে কি। কিন্তু শুধু ব্রতী নয়……যখন ভাবি সো মেনি ডায়েড, ফর হোআট? জানেন জেল থেকে বেরিয়ে সবচেয়ে আগে কি বুকে লেগেছিল?
কি?
যখন দেখলাম সব কিছু নমল, চমৎকার, যেন যা হবার হয়েছে এখন সব শান্ত হয়ে গেছে, এই ভাবখানা চতুর্দিকে। তখন বক ভেঙে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন তো সব শান্ত হয়ে গেছে নন্দিনী?
না!
নন্দিনী চেঁচিয়ে উঠল। সুজাতা আবার বিমূঢ়।
শান্ত হয় নি, হতে পারে না। তখনও কিছুই কোয়ায়েট ছিল না। এখনো নেই। ডোন্ট সে সব শান্ত হয়ে গেছে। আফটার অল য়ু আর ব্রতীজ মাদার। সব শান্ত হয়ে গেছে এ কথা আপনার বলা বা বিশ্বাস করা উচিত নয়। কোত্থেকে এই কমপ্লাসেন্সি আসে?
কিছুই শান্ত হয় নি?
না। হয় নি। হোয়াই ডিড দে ডাই? কি শেষ হয়েছে? মানষ সুখে আছে? রাজনীতি খেলা শেষ হয়েছে? ইজ ইট এ বেটার ওআর্লড?
না।
হাজার হাজার ছেলে বিনা বিচারে আটক, তবও বলবেন সব
শান্ত হয়ে গেছে?
নন্দিনী মাথা নাড়ল, বার বার। বলল সবাই আমাকে তাই বোঝায়। মা বলে তুই ত আর কিছু করবি না। তবে কেন বিয়ে করবি না, সংসার করবি না।
তুমি কি…
মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডে। নইলে বেরোতে দিত না। আমি মরতে চাই নি। না বেরোলে আমার ট্রিটমেনট হত না। এখনো আমি ইনটার্নড।
কিসের ট্রিটমেন্ট?
ও, আপনি বোঝেন নি? আমার চোখের নাভ, আলোর নীচে বাহাত্তর ঘণ্টা, আটচল্লিশ ঘণ্টা থেকে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ডান-চোখে বলতে গেলে দেখতে পাই না। দেখে বোঝা যায় না।
না। আমি ত বঝি নি।
নষ্ট হয়ে গেছে একটা চোখ।
এখন তুমি কি করবে?
জানি না। মানে, চোখের চিকিৎসা করব জানি। আর কি করব জানি না। তবে মার কথামত বিয়ে করব না সন্দীপকে।
সন্দীপ কে?
একটি ছেলে। ভাল চাকুরে। এখন বোধ হয় আমাদের মত মেয়েকে বিয়ে করা ধীমান রায়ের কবিতা লেখার মত আরেকটা ফ্যাশন। নইলে সে আমায় বিয়ে করবে কেন, আমি কারণ খুঁজে পাই না।
কি করবে তুমি নন্দিনী?
বললাম যে জানি না। এখনো খুব ডিসটার্বড, কনফিউজ লাগে কোন কোন বিষয়ে। সব অচেনা অজানা মনে হয়। নিজেকে বা কোন কিছুর সঙ্গে আইডেনটিফাই করতে পারি না। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা হ্যাজ মেড মি আনফিট ফর দিস সোকলড নমালসি। যা আপনাদের কাছে নর্মাল মনে হয়, তাই আমার কাছে আবনর্মাল মনে হয়। কি করব বলুন?
না, কিছু বলব না।
আমার বন্ধুদের কেউ বলতে গেলে বেঁচে নেই। সে সব কথা, যাদের কথা, আমার সব সময়ে মনে হয় যে সব কথা, তাদের কথা বলি, এমন একজন নেই।
তোমার বাড়িতে ত সবাই আছেন?
তা আছেন। এটা আমার বাড়ি নয়। এক আত্মীয়ের বাড়ি। বাবা মা কলকাতায় থাকেন না।
তাঁদের সঙ্গে…
তাঁদের কাছেও আমি একটা সমস্যা, বুঝতে পারি। কি জানি কি করব। হয়ত শুনবেন …
কি?
নন্দিনী হাসল। সন্দর, উজ্জ্বল হাসি। বলল, হয়ত শুনবেন আবার ধরে নিয়ে গেছে। কি করব বলন?
সুজাতা বসে রইলেন। এখন বসে থাকার সময় নেই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। শীতের সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে। এখন তাঁর বাড়ি ফেরা উচিত। কিন্তু পা যেন উঠতে চাইছে না।
আপনি যাবেন না?
এবার যাব।
আর কিন্তু দেখা হবে না।
তুমি কি কোথাও যাবে?
না। এখানেই থাকব। কিন্তু আর দেখা করে কি হবে?
সুজাতা মাথা নাড়লেন। কিছুই হবে না। কেননা নন্দিনী আর তাঁর জীবনের রেখা সমান্তরাল। মিলিত হন, এমন একটি বিন্দও রেখাদটির মধ্যে নেই।
একটা জিনিস তোমায় দেব?
কি?
এটা তুমিই রাখ।
ব্রতীর ছবি। সর্বদা তাঁর ব্যাগে থাকে, কাছে থাকে।
নন্দিনী ছবিটা নিল। তক্তপোশের ওপর রাখল। তারপর বলল, আমার কাছে আর কিছু নেই। ছিল।
আমার আরো আছে।
এ ছবিটা বোধহয় কলেজে তুলেছিল কেউ।
জানি। অনিন্দ্য।
চলি নন্দিনী। তুমি, তুমি ভাল থেক। কখনো কোন দরকার হলে জানিও।
জানাব।
নন্দিনী হেসেই বলল। কিন্তু সুজাতা জানলেন নন্দিনী জানাবে। নন্দিনীও জানল সে জানাবে না। দুজনে দুজনের কাছে আবার অপরিচিত হয়ে যাবেন। শুধু সুজাতার জগৎ আর আগেকার মত থাকবে না। ব্রতী কেন সেদিন সন্ধ্যায় নীল শার্ট পরে বেরিয়ে গেল, কেন হাজার চুরাশি হয়ে গেল, আজ সারাদিন তার ব্যাখ্যা টুকরো টুকরো খুঁজে পেয়েছিলেন সুজাতা। বাকী জীবনটা সেই টুকরোগুলো খাপে খাপে মেলাতে মেলাতে কাটবে।
একটু এগিয়ে দিই, বাইরে আলো নেই।
নন্দিনী হাতড়ে হাতড়ে দরজার কাছে গেল। ওর হাঁটা দেখে মনে হল বোধহয় ওর দু’চোখের দৃষ্টিই ক্ষতিগ্রস্ত।
বাইরে আসবে?
না।
আমি বাইরে যেতে পারব না। হোম ইনটার্ন্ড। তা ছাড়া কেউ না থাকলে ভরসাও পাই না।
তবে থাক।
সুজাতা ওর কপালে আর মুখে হাত বোলালেন। খুব ইচ্ছে করল ওকে বকে টেনে নিতে। ওকে দোলা দিতে। ব্রতীকে যেমন করে বুকে টেনে নিতেন তেমনি করে ওকে টেনে নিতে। স্বাভাবিক জীবন্ত ক্ষুধিত ইচ্ছে। সমুর মা যে ইচ্ছের বশে মশানে বলেছিল অরে আমার বুকে আইনা দে। অরে বুকে নিলে আমি অহনই শান্ত অইম। আর কাম না।
একদিন আমি আর ব্রতী কথা বলতে বলতে আপনাদের বাড়ী অব্দি হেঁটে এসেছিলাম। ব্রতী বলেছিল আপনার কাছে একদিন আমাকে নিয়ে যাবে। সে অনেকদিন আগে।
সুজাতা মাথা নাড়লেন। অনেকদিন নয় নন্দিনী, হয়ত বছর চারেক আগে কিন্তু বছরের হিসাব নয়, অন্য হিসাবে তা অনেকদিন হয়ে গেছে। সেইসব স্বাভাবিক দিনের পর যে দিনের অন্তে একবার ব্রতীর মাকে দেখে আসা যায়, সে সব দিনের পর অজস্র আলোকবর্ষ কেটে গেছে।
সুজাতা আস্তে বললেন চলি।
নন্দিনী কিছুই বলল না। পেছন ফিরল ও, ময়লা ও অন্ধকার দেওয়ালে হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগল ভেতরপানে। ওর প্রতিটি পদক্ষেপ ওকে সুজাতার কাজ থেকে কতদর নিয়ে যেতে থাকল। সুজাতা বেরিয়ে এলেন। কলকাতার রাস্তা।