এই বয়সের পুরুষ যত জন আসে, বেশিরভাগেরই তেমন অভিজ্ঞতা থাকে না দেখেছে সে। তারা আসে, দরজা বন্ধ হতেই খুলে ফেলে পোশাক। আর তাড়াহুড়ো করে সঙ্গমে পৌঁছে যায়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে জানে না আনন্দ, জানে না উপভোগ। শুধু ভোগ জানে। যেহেতু অর্থের বিনিময়ে আসে সেহেতু অজ্ঞতার সঙ্গে লিঙ্গ মিশে এক ধরনের ক্ষুধা মেটাবার জান্তবতাই শুধু প্রকাশ পায়। যতখানি পারে, মাংস ঘাঁটা শুধু।
যখন তার সঙ্গে মধ্যবয়সী নয়, বৃদ্ধ নয়, শুধু কোনও যুবকের দেওয়ানেওয়া হয়, তখন সে সুখ প্রার্থনা করে। কামনা করে উপভোগ্য। পেশাদারিত্বের বাধ্যতামূলক দেহদানের যন্ত্রণার বাইরে শৈল্পিক কামকলার আনন্দ পেতে ইচ্ছে করে তার।
কাম বহু ব্যবহারে ক্লিষ্ট হলে পাঁকের মতো উঠে আসে যন্ত্রণা কেবল। বাচ্চুদি বলে, দশ বছর এরকম চললে সে আর আনন্দ প্রার্থনা করবে না। সে তখন সঙ্গম করতে করতে হয়তো-বা এক গামলা বমি করবে মনে মনে। কিংবা চিতাকাঠ কল্পনা করে ভুলে যেতে চেষ্টা করবে পুরুষটির দুর্গন্ধ শাসবায়ু। অথবা হিসেব করবে, দিনে আর কতজনকে টানতে পারলে বছরের শেষে একখানি বাতানুকূল যন্ত্র লাগিয়ে ফেলা যায়।
সম্ভব। এমনই হওয়া সম্ভব। বাচ্চুদির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সুখের কাঙাল বাচ্চুদিও হয়তো ছিল তার মতো বয়সে।
মাঝে মাঝে কল্পনা করে সে। এক রাজপুত্র এসে যাবে একদিন আর তার প্রেমে মুগ্ধ হবে। কোলে মাথা রেখে সারাজীবনের কাহিনি শুনতে চাইবে তার। সে চোখের জলে ঠোঁট নোত করে বলবে সমস্ত কথা। বলবে মায়ের পঙ্গুত্ব। বাবার মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়া। ভাইয়ের অসহায় শৈশব। বলবে, অর্থের প্রয়োজনের কথা বলতে কলেজের এক বান্ধবী কীভাবে তাকে স্তোক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মধুচক্রে।
হ্যাঁ, সে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছিল। মানাতে পারেনি সেখানে। টাকা পেয়েছিল অনেক। কিন্তু শরীরে লেগে থাকা ক্লেদ মুছে ফেলতে পারেনি। সারাক্ষণ গায়ে ঘৃণা গিশগিশ করত।
তাদের অভাবের সংসারে একের পর এক অমঙ্গল আছড়ে পড়ছে যখন, আত্মীয়রা গুটিয়ে যায় যে-যার নিজস্ব খোলে। তখনও ন্যায় ছিল অন্তরে। নীতি ছিল। মধুচক্রের অর্থে অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকা সংসার মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে ফের বাঁচার আকুলতায়। তার মায়া হয়। নিজের চেয়ে অনেক বেশি বাবা-মা-ভাইয়ের জন্য। মায়াবশে মধুচক্র ছেড়ে দেবার ইচ্ছা নিয়েও সে কাটিয়ে দেয় দু’বছর।
ততদিনে চিনেছে অনেক। দেখেছে প্রচুর। যারা আসে, তাদের সকলেরই অভাব নেই তার মতো। কিন্তু অভাব তাদের মনে। তাদের আরও-চাই মিটবে না কোনও দিন। মেটাবেনা জগতের লোভের উৎসার।
বাড়ির বউ আসত। কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আসত। পুরুষ আসত যারা—সব ধনবান, প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাশালী। তবু, ক্ষমতার পাশ দিয়ে পিপড়ের সারির মতো সরু হয়ে লেগে থাকে অক্ষমতা। একদিন তাকে চিহ্নিত করে ফেলে আরও আরও ক্ষমতার হাত। আর ধাবমান হয়। অক্ষমতার সরু ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে ন্যায়দণ্ড। আর, অন্য অনেকের সঙ্গে সে-ও ধরা পড়ে যায়।
এইসব কাহিনি তার। বলতে বলতে রাত ভোর হয়ে যাবে। সেই মানুষটা সারা রাত জেগে জেগে শুনবে তার কথা। তারপর একে বুকে টেনে নেবে। তার কষ্টে কষ্ট পেয়ে শূন্যতা ঢেকে দেবে পলাশ-গোলাপো। ঘরবর পাবে সে। সিঁদুরে সীমন্তিনী হবে। একদিনও পিলখবে না তখন। সন্তানের জন্ম দেবে।
তার একটি খাতা আছে। সমস্ত পুরুষ—যাবৃতর দেহ ক্রয় করে, সে লিখে রাখে নাম। শুধু নাম। কেন রাখে, জানে না সে। সংসারের যে স্বপ্ন তার—পেয়ে গেলে সেইসব, সে এই খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। ইতু, মঙ্গলচণ্ডী, সন্তোষী ব্ৰতর মতো নামব্রত তার। আর এইভাবে তার জমে গেছে একান্ন জন অমল, তিয়াত্তরজন দীপক। দশজন হরিবাবু। এই দশজনের মধ্যে আছে হরিপদ, হরিমাধব, হরিসাধন, হরিপ্রসাদ, হরিশঙ্কর, হরিবিষ্ণু, হরিবন্ধু… ইত্যাদি সব নাম। দুজন কালীকিঙ্কর আছে, একজন মাত্র আছে সুবলসখা। এবং আরও আছে। আরও। সে মাঝে মাঝে সংগোপনে এই নামাবলির পাতা ওল্টায় আর ভাবে—আরও কত নাম হবে? কত নাম? থামবে না? কোনও দিন থামবে না?
অতি সংগোপনে সে রেখে দিয়েছিল আরও কয়েকটি জিনিস। একটি কলম। কলেজের বই আর খাতা। পাতার মধ্যে অধ্যাপকদের বক্তব্য তুলে রাখা। উই সেগুলি ধ্বংস করেছে।
যদিও এখন আর সে কাঁদে না তেমন। ইচ্ছে করলেও মনে হয় কান্না তাকে ছেড়ে গিয়েছে কবেই। যেমন আত্মীয়-পরিজন, ছোটবেলার প্রিয় মামা-মামি, মিষ্টিকাকু আর ইতিকাকি, যেমন একই বাড়িতে থাকা এবং তারই অন্নে প্রতিপালিত হওয়া ভাই! ছেড়ে গেছে। সকলেই ছেড়ে গেছে তাকে। সংক্রামক ব্যাধি লাগা ছোট গ্রামটির মতো। ছেড়ে গেছে এমনকী বাবা-মাও। সে যদি চলে যেত অন্য কোথাও, ধরা যাক নামকরা বেশ্যাপাড়ায়, আর ঘরভাড়া নিত, মাসে-মাসে টাকা পাঠাত শুধু—তবে বেঁচে যেত বাবা-মা। বেঁচে যেত ভাই। অন্তত লোককে তো বলা যেত–অসভ্য মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেউ কারও নয়। এ-জগতে শেষ পর্যন্ত কেউ কারও নয়। স্বার্থে টান পড়লে নাড়ির বন্ধনও খুলতে খুলতে ন্যাড়া। কিন্তু যাবে না সে। বেশ্যাপাড়ায় যাবে না। বুক খুলে সারি সারি দাঁড়াবে না গোরু-ভেড়াছাগলের মতো। হ্যাঁ, সে নিজেকে বিকোয়। বিকোয় অপারগ হয়ে। নিরুপায় হয়ে। বিকোয় কেন-না সে যদি মনোহারী দোকানের কর্মচারী হত-এমন একটি কাজ সে পেয়েছিল সঙ্কটের কালে—তুকে যা মাইনে পেত তাই দিয়ে সংসারের ভরণ, পোষণ, পুষ্টি, ওষুধের দাম তো দূরের ব্যাপার, সারা মাসে শুধু আলু আর চালও জুটত না।
জুটিয়েছে সে। নিজেকে মেরে, পুড়িয়ে ভেঙে বাঁচিয়েছে বাবা-মা-ভাই। বাঁচিয়েছে। ওরা তার নিজেরই তো সে তো চায় বাবা সুস্থ হোক, মা সুস্থ হোক, ভাই গড়ে তুলুক জীবনকে সুন্দর। তার তো অধিকার আছে চাইবার। অধিকার আছে এই ভাঙাচোরা বাড়িটাতে থাকবার। তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু সে জানে, জম্মগত অধিকারের মূল ছিন্ন করে দিতে পারে পরিবেশ পরিস্থিতির দুর্মর শক্তি। সে জানে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে থেকে যেতে চায়। অর্থ অশুচি হয় না। দেহব্যবসায়ের জন্য সে ঘৃণ্য কিন্তু অর্থ নয়। এ বাড়িতে ব্যবসা করলে তার দেহমন্দির পরিত্যাজ্য, গৃহমন্দির অপবিত্র কিন্তু টাকাপয়সা গঙ্গাবারি।
তিক্ত লালায় ভরে যায় তার মুখ। রাগ-রোষ-দুঃখ আর হতাশায় স্পষ্ট হয়ে সে নিজের হাতে হাত বোলায়। ভালবাসে সে। এই হাত, এই বুক, এই শরীরের প্রত্যেকটি কোণ সে ভালবাসে। প্রত্যেকটি প্রান্ত। যেমন সে ভালবাসে বাড়ি। এই ভাঙাচোরা বাড়ি। ভালবাসে ভাই। ভালবাসে বাবা-মা। ভালবাসে।
ভালবাসা। এখনও গেল না তার। এখনও তা লটকে রইল স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে। ভালবাসা শেষ হলে, ফুরিয়ে গেলেই, সে তখন একটু একটু করে খুলে খুলে ফেলে দেবে হাড় রক্ত অস্থি মজ্জা মাংস।
ভালবাসা এই ছেলেটির মধ্যে কোথাও সংগোপনে রাখা আছে ভালবাসা, বুঝেছে সে। প্রাথমিক জড়তার পর সে যখন ধারে ধীরে শরীরে আসছিল, তখন, যেভাবে চুম্বন করছিল গালে ও কপালে, বন্ধ করে চোখ, যেভাবে আলতো হাত বুলিয়েছিল নাভিতে আর গহন অরণ্যময় গিরিখাত গভীরতায়, যেভাবে ঠোঁটের নরম দ্বারা চেপেছিল স্তনবৃন্ত–তাতে তার বার বার মনে হয়েছিল, এক শরীরে শুয়ে অন্য কোনও শরীরকে সে মনে মনে ডাকছে।
তার ভাল লাগছিল খুব। আবেশ। গভীর আবেশ। ছেলেটি তার আঙুলের পরিচালনে এই বহুজনে অভ্যস্ত শরীরকে দিয়েছিল অপূর্ব তরঙ্গরেখা। সে চুরি করে ভালবাসা নিচ্ছিল তখন। রাহাজানি ছিল। সে জানে, চূড়ান্ত খরিদ্দার, বেশ্যার শরীরে ভালবাসা আঁকে না কখনও। তারা উচ্ছল সুখ আঁকে, বিষণ্ণ আঁচড় আঁকে, যন্ত্রণার কামড় একে দাগ করে দেয়। কিন্তু ভালবাসা আঁকে না ভুলেও।
অভ্যস্ত ছেলেটি। বুঝেছিল সে। ভাবছিল, এই কি হতে পারে, তার স্বপ্নের কুমার?
না। পারে না কখনও। চাইলেও সে নিজেই গররাজি হবে। কারণ ছেলেটি অর্থবান নয়। পাঁচশো টাকার জন্য যে দামাদামি করে সে কিছুতে অর্থবান নয়। আর সে চায় অর্থবান স্বামী। না হলে, সে জানে, বাজুদির মতো, বিয়ের পরেও তাকে নামতে হতে পারে আবার ব্যবসায়।
আবার ব্যবসা। মানে আবার বিবিধ যন্ত্রণা, উপদ্রব, ঘৃণা ও আশঙ্কা। চায় না সে। চায় না আর। এমনকী কারও রক্ষিতা হয়ে থাকতেও চায় না। চট করে, বেশি অর্থের লোভে বাইরেও যেতে চায় না। চেনাজানাদের চেয়ে তাই তার টাকা কম।
বেশি রোজগার করতে চাইলে অত ভয় থাকলে চলে না এ কথা বাচ্ছদি তাকে বহুবার বুঝিয়েছে। কিন্তু নিরঞ্জন জানা তাকে আজও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে।
দিঘা নিয়ে গিয়েছিল তাকে। নিরঞ্জন। নিরঞ্জন জানা। পাঁচ হাজারের চুক্তি। চার দিন তিন রাত্রি থাকা। মা তখন সদ্য এসেছে হাসপাতাল ফেরত। হাঁ-মুখ সংসারে টাকার গভীর আর্তি। পাঁচ হাজার টাকা তার লেগেছিল অপূর্ব আশীর্বাদ। সে গিয়েছিল সহজেই আর ফিরেছিল একরাশ যন্ত্রণা ও সংক্রমণ নিয়ে।
কোনও মানুষের যে এতখানি খিদে থাকতে পারে–সে জানত না। কিন্তু এইরকম, সারা দিনমান নিম্নাঙ্গসেবী মানুষ আর দেখেনি। নিরঞ্জনের ক্লান্তি নেই। সে তখন বার করত গাজর, মুলো, পটল, বেগুন এবং মোমবাতি। বিমুখ যযানি হয়ে যেত শুকনো খটখটে। দারুণ যন্ত্রণা হত। সে আপত্তি করেছিল। হাত পা ছুড়েছিল। নিরঞ্জন জানা তখন অরগা দুটি খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলে এবং প্রহারে ভরিয়ে দেয় গাল। শেষ দিন সে যন্ত্রণায় কঁকিয়েছিল সারাক্ষণ। কেঁদে ফেলছিল মাঝে মাঝে। নিরঞ্জন জানার দয়া হয়নি। প্রাপ্য বুঝে নিয়েছিল।
সাত দিন ঠিকমতো হাঁটতে পারেনি সে। বাদির কাছে গিয়ে আকুল কেঁদেছিল।
শরীরের লোভেই আসে, অথচ শরীরকে এতটুকু যত্ন করে না, সম্মান দেয় না, ভালবাসে না তারা। বুঝিয়েছিল বাজুদি। পৃথিবীতে শরীরই একমাত্র যাকে অর্থব্যয় করে অবহেলা ও অপমান করা হয়।
বাচ্চুদিই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। যে পাঁচ হাজার টাকা সে আয় করেছিল তার থেকে এক হাজার টাকা তার নিজেরই কিন্তু নেই। সে ঘন হয়ে যেত। নিরঞ্জন চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তার ওপর পনেরো দিন টানা সে লোক নিতে পারেনি। রোজগার বন্ধ ছিল।
সেবার যখন সে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল বাবার হাতে, বাবার ঘোলাটে চোখে চকচকে ঝিলিক উঠেছিল। পরদিন সে যখন পাঁচশো টাকা চায় এবং তার পরদিন আরও পাঁচশো, বাবার কপালে তখন তীব্র কুটি। যেন দিয়ে দেওয়া টাকা চেয়ে অনধিকার চর্চা করছে সে। সে যে নিজের জন্য রাখেনি কিছুই, তার কোনও মূল্যই ছিল না।
বেশ্যাবৃত্তি সমাজের দৃষ্টিতে তার নারীত্ব নৈতিকতাকে খর্ব করেছে। তাই, তার আর সব মানবিক গুণগুলি সম্পর্কেও সকলেই অন্ধ। সেগুলো আছে কিন্তু নেই হয়ে আছে। কারণ নারী যখন স্বদেহ বিক্রয় করে তখন ভোগ্যপণ্য ক্রয় নিমিত্ত সমাজ বহু প্রতিনিধি পাঠায়। একবার বিক্রি হয়ে গেলে নারী আর মানুষ থাকে না।
পুরুষেরা চিরক্রেতা। কেনে। খায়। সমাজ বানায়। নারী মানে। মেনে নেয়। রীতিনীতি শাসন-শোষণ স্কন্ধে নারী হয় সমাজধারিণী।
সেদিন, বাবার কুটি দেখে তার কান্না পেয়েছিল। সেই প্রথম, তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। পরিবারে সে এক উৎপাদন যন্ত্রবৎ। অর্থ। যদি অন্য কোনও সম্মানীয় উপায়ে এই অর্থ এসে যায়, ধরা যাক তার ভাই একটি চাকরি পেল সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িতে সে অচ্ছুকন্যা হবে।
সে জানে, নগরনটীদের নিয়ে, গণিকা, বেশ্যা, উর্বশী, রম্ভা, মেনকা, মালবিকাদের নিয়ে এখন তুমুল আন্দোলন। শ্রমিকের সম্মান দিতে হবেদাবি। স্বাস্থ্যের অধিকার দিতে হবে–দাবি। সমাজের এক কোণে নয়–তারা মধ্যমণি হবে। যারা গায়ে ঢাকা দিয়ে গণিকালয়ে যায়, তাদের গৃহের পাশে মুখ তুলে দাঁড়াবেই গণিকার বাড়ি। আরও—আরও–আরও কিছু।
হাক্—থু! থুঃ থুঃ!
সে মানে না এসব। হবে না। হবে না কিছুই। কুরং স্বীকৃতি পাবার মোহে দলে দলে নেমে আসবে অভাবী মেয়েরা। উদ্বৃত্ত আয়ের লোভে মধ্যবিত্ততার সীমিত সামর্থ্য থেকে আরও—আরও—আরও পেতে গৃহবধূ রাস্তায় দাঁড়াবে। আরও বেশি শোষণের জাল নেমে আসবে শ্রমিকের স্বীকৃতিবেশে।
হ্যাঁ। মানে সে। লোকালয়ে বসবাস মানে। আলাদা থাকবে কেন? অস্পৃশ্য থাকবে কেন গণিকার দল?
সম্মেলনে গেছে সে কয়েকবার উত্তেজিত দাবি-দাওয়া বিতর্কের পর হাজার গণিকার মধ্যে মঞ্চের মুখাপেক্ষী বসে থেকে ভেবেছে—দাবি হোক একটাই–পৃথিবী হোক এমনই সমৃদ্ধ যাতে গণিকাবৃত্তি লুপ্ত হয়ে যায়।
দেওয়াল ঘড়িটা একবার দেখে নেয় সে। সময় আছে। আরও একবার রাস্তায় যাওয়া যেতে পারে। আগরাত্রে খদ্দের পেয়ে যাওয়ায় তার আজ আরও রোজগারের সম্ভাবনা।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে খাতা টানে সে। ছেলেটি শার্টের বোতাম আঁটছে। এলোমেলো চুল আঙুলে সাজিয়ে নিল। এখনও অন্যমনা। চশমাটা পরে নিল এবার। সে নাম চাইল। জিজ্ঞাসায় অনুরোধ মেখে। ছেলেটি থমকাল একটু। হয়তো অবাক হল। কিংবা ভয় পেল মনে মনে।
সে জানে, সকলে সঠিক নাম জানায় না তাকে। কিছু এসে যায় না তার। সে শুধু একটা নাম চায় নাম।
এমনও হয়েছে, সে দেখেছে এমন যে একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে এল তার কাছে। একই লোক। সে চেনে। চিনে ফেলে। লোকটিও কি চেনে না তাকে? চেনে। কিন্তু চেনা দেয় না বেশির ভাগ। চলতে থাকে ভানের লড়াই। সে তখন নাম জানতে চায়। হতে পারে একই নোক দু’রকম নাম বলল। হতে পারে। হয়ে থাকে। সে সবসময় বুঝতেও পারে না। মুখ মনে থাকে তার। কিন্তু বেশির ভাগ নাম ভুলে যায়।
তার কাছে একজন মানুষের জন্য একটি নাম। একই মানুষ পর পর চারদিন এলেও তারা সব আলাদা আলাদা লোক। কারণ, সে জানে, আজকের লোকটি আর থাকে না কোথাও। কালকেই অনেকটা বদলে যায়।
ছেলেটি সারা ঘর দেখে। সে হাতে কলম ধরে খাতা ধরে চুপচাপ। ছেলেটি জানতে চায় না কিছু। তার চোখে চোখ সরাসরি। সেই চোখে সুদুরের ভাষা। সে মৃদু হাসে। ঘড়ির দিকে হাত বাড়ায়। তিনশো টাকায় যতটুকু সময় দেওয়া যায়, পেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি ইশারা বুঝে ফেলে দ্রুত। নাম বলে। রুমালে মুখ মুছে নেয়। আর সে নাম লেখে।
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তারা। অজানিত কেউ প্রলম্বিত ছায়া ফেলে তাদের পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে যায়।
দু’জন দুদিকে চলে যাবে। কোনও টান নেই। বন্ধন নেই। কোনও দাবি-দাওয়া-অধিকার নেই। শরীর। তুচ্ছ শরীর। মল, মূত্র, কৃমি, কফ, পুঁজ ও রোগজীবাণুমণ্ডিত আকাট শরীর। তাই দিয়ে বন্ধন হয় না কখনও।
গলি থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছে যায় তারা। হঠাৎ ছেলেটি তার হাত ধরে। প্রশ্ন করে, এই পেশা অবলম্বন করে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহত্যাকেই তার শ্রেয় মনে হয় কিনা।
আত্মহত্যা। মানে হত্যা। মানে মৃত্যু।
মালবিকা হাত ছাড়িয়ে নেয় এবং দৃঢ় জানায়, এই জীবনে থাকবে বলেই, জীবনের থেকে পালিয়ে যাবে না বলেই, মৃত্যুর অভিমুখে নিজেকে এবং পরিবারের কারওকে যেতে দেবে না বলেই সে অপারগ গ্রহণ করেছে এ বৃত্তি।
ছেলেটি কথা বলে না কোনও ব্যাগ কাঁধে ফেলে ধীর পায়ে হেঁটে যায়। সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এ বৃত্তি গ্রহণ করা কি সহজ ছিল? ছিল না, ছিল না। অসম্ভব দাহ থেকে যায় সারা জীবন। অসম্ভব কষ্ট। অভ্যাসের আড়ালে সে কষ্ট চাপা থাকে মাত্র।
সে জানে না, এই ছেলেটি, শুভদীপ নাম, অনুভব করে কিনা, জানে কিনা যে কোনও-কোনও পরিবার এক একটি সময় বজ্র-বিদ্যুতে ভরে যায়। তখন জ্বলে জ্বলে ছাই হয় মানুষগুলি।
এই যে তারা, নিরুপায় বৃত্তিকে নির্ভর করে জীবনকৈ ধারণ করেছে, প্রাণকে ধারণ করছে, তার সঙ্গে-সঙ্গে ক্ষয়ও কি ধারণ করছে না?শুকনো বালুরাশির ওপর দিয়ে ছুটতে চাইছে তারা। হাত নড়ছে, পা চলছে, পেশির আন্দোলন ঘটে যাচ্ছে কিন্তু গতি আসছে না। জীবন-জীবন করে মাবাবা-ভাই কেউ আর ঠিকঠিক মা-বাবা-ভাই নেই, যে রকম থাকার কথা ছিল। সেও নেই যথাযথ মালবিকা। সে হারাল কাহীরাল পরের বর্ণ, আর সকলকেই নিয়ে পরিচয় ভাসিয়ে শুধু বেঁচে থাকল। বেঁচে থাকতে হয় বলে বেঁচে থাকল। বজ্রবিদ্যুৎ প্রত্যাহৃত হলেও তারা আর স্বাভাবিক হবে কখনও। বেশ্যাবৃত্তির গাঢ় দাগ তাদের গায়ে দগদগে লেগে থাকবে।
একটি গাড়ি আলোর ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার। গম্ভীর ভাবনা, থেকে বেরিয়ে আসে সে। ছেলেটি চলে গিয়েছে কোথায়। সে সামনের দিকে তাকায়। লোকের ভিড় এখানে। বাস ধরার জন্য জমায়েত সব। এক মধ্যবয়সী পুরুষ, গোঁফদাড়ি নিখুঁত কামানো, হাতে বান্স, গাঢ় নীল কোটের মাঝখানে টকটকে লাল গলাবন্ধ, আকুল অসভ্য ভুড়ি দৃশ্যমান অভিজাত পোশাকের ফাঁকে। সে এই লোকটির লোভী চোখ দেখে। চকচকে ইচ্ছাময় দৃষ্টি দেখে। আর মনে মনে বড়সড় দাও মারার অভিপ্রায়ে মৃদু হাসি তুলে অগ্রসর হয়।
Tilotomma Majumder is one of my favorite writer… She wrote like a River which flows her own way