ইসলাম কি অমুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত করে?
ভ্যাকেশনের সময়টাতে আমরা সাধারণত ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। ঘোরাঘুরির প্রতি আমার আগ্রহ বা কৌতূহল—কোনোটাই কোনোকালে ছিল না। ক্লাস, ল্যাব, এক্সাম— এসবের ভিড়ে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতাম কবে একদিন ছুটি পাব আর পুরোদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেবো। করতামও তাই। ছুটির দিন মানেই আরামসে ঘুম; কিন্তু এই অভ্যাসের যবনিকাপতন ঘটে সাজিদের হাতে। যখন থেকে তার সাথে পরিচয়, ঠিক তখন থেকেই তার মধ্যে দুটি নেশা প্রবলভাবে দেখে আসছি। একটি হচ্ছে বই পড়া আর অন্যটা ঘোরাঘুরি।
ট্রাভেলিং বিষয়ক বাংলা এবং ইংরেজিতে যতগুলো বই আছে মোটামুটি সবগুলো তার পড়া। সে শিডিউল করে রেখেছে, ফাইনাল সেমিস্টারের পরে আমাকে নিয়ে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডাম যাবে। আমস্টারডামের কোথায় কোথায় ঘুরব তারও একটি শর্ট লিস্ট রেডি করে রেখেছে সে।
সেই শিডিউলে আছে Anne Frank House, যে গৃহটির ওপর নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত মুভি The Diary of a Young Girl, পৃথিবীর একমাত্র ভাসন্ত ফুলের মার্কেট Bloemenmarkt, Tuschinski Theater, Dam Square-সহ আরও বিভিন্ন বিখ্যাত জায়গা। সাজিদের ভাষ্যমতে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই পৃথিবীকে এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন—যাতে মানুষ তার অবসরে এইসব সৌন্দর্য অবলোকন করে নৈসর্গিক আনন্দ লাভ করতে পারে। অন্যথায় একটি ছোট্ট ফুলের পাঁপড়ির মধ্যে এরকম অঢেল লাবণ্য আর কারুকাজ দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না।
আমাদের কাছে সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ মাপকাঠি হচ্ছে জান্নাত। সাজিদ বলে, সৌন্দর্যের এই পরম মাত্রা বুঝাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা খুবই কমন কিছু জিনিস উপমা হিশেবে ব্যবহার করেছেন। যেমন—ঝরনা, বাগান ইত্যাদি, যা আমাদের হাতের নাগালের মধ্যেই। আমরা হরহামেশাই চাইলে দুনিয়ায় এসব দেখতে পারি। এসব উপমা দেওয়ার কারণ হতে পারে এই—আল্লাহ চাইছেন আমরা এসব দেখে, এসবের সৌন্দর্য দেখে বিমুগ্ধ হই এবং ভাবি—আহ! এগুলোই এত মনোহর! জান্নাতের নহর আর বাগান না জানি কত সুন্দর! আল্লাহ চান মানুষ ভ্রমণ করুক। দেখুক। বুঝুক। অনুধাবন করুক।
এই সব আলাপ সামনে এলে সাজিদ ট্রাভেলিং ইস্যুতে বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি কপচানোর সাথে সাথে ভ্রমণ বিষয়ক কুরআনের আয়াতগুলোও শুনিয়ে দেয়। আমরা যারা ভ্রমণকে নেহায়েত সময় আর অর্থ নষ্ট ভেবে ছুটির দিনে রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে অঘোর ঘুমে মজে থাকি, তাদের তখন চেহারা মলিন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ফিরছিলাম রাজশাহী থেকে। গিয়েছিলাম দাওয়াতে। সাজিদের ফুফাত ভাইয়ের বিয়ে সেরে ফেলা হলো। দাওয়াত-খাওয়া আর মহাস্থানগড় ভ্রমণ করা। সাহিত্যের ভাষায় যাকে রথ দেখা আর কলা বেচা বলে।
সে যাহোক, রাতের ট্রেন। তিন দিনের সফর শেষে বাসায় যাচ্ছি। আমি খুব ক্লান্ত। মনে হচ্ছে বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম চলে আসবে। সাজিদের দিকে তাকালাম। সে। বসে আছে আমার পাশেই। তার চেহারায় ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেউ যদি তাকে ৫০০ মিটার দৌড়ে আসতে বলে তবুও সে হাসিমুখেই। রাজি হয়ে যাবে।
আমাদের ঠিক উল্টোদিকের সামনের সিটে, সাজিদের মুখ বরাবর মধ্যবয়স্ক একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। চুল আর দাড়িতে মেহেদীর কলপ করেছেন বলে বয়স তেমন বোঝা যাচ্ছে না। খুবই শৌখিন মানুষ হয়তো। শৌখিন মানুষগুলোই চুল-দাড়িতে মেহেদীর কলপ করে থাকে সাধারণত। আমার দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সরকারি চাকুরিজীবী। দাদাও প্রতিমাসে তার চুল আর দাড়িতে মেহেদীর কলপ লাগাতেন। আমাদের বাড়ির উঠোনে ইয়া বড় একটি মেহেদী গাছ ছিল। দাদির দাবি, এই গাছের দুই-তৃতীয়াংশ পাতা দাদাই ব্যবহার করতেন। মৃত্যুর মাস
দেড়েক আগেও দাদা চুল-দাড়িতে মেহেদীর কলপ লাগিয়েছিলেন বলে দাদির কাছে শুনেছিলাম। সে যাহোক, আমাদের সামনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তার হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকার ম্যাগাজিন। নাম-Lifestyle.
দাড়িতে মেহেদী লাগিয়ে সেগুলোকে কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো টকটকে লাল করে ফেলার পদ্ধতিটি হয়তো এই ম্যাগজিন থেকেই শেখা। এই মুহূর্তে আমার খুব ঘুম দরকার; কিন্তু ট্রেন চলার শব্দ আর ঝাঁকুনির কবলে পড়ে চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে গেছে ততক্ষণে।
সাজিদ একমনে বই পড়ছে। বইটির নাম There is a God: How Worlds most notorious Atheists changed his mind. একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ ফিলোসফারের লেখা বই, যিনি একসময় কট্টর নাস্তিক ছিলেন। পরে নাস্তিকতা থেকে ফিরে এসে তিনি এই বই লিখে ব্যাপক হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সাজিদের পাশে বসে আমি কেবল হাই তুলছি আর ঝিমুচ্ছি।
একটুপরে আমাদের সামনের ভদ্রলোক কথা বলে উঠলেন। তিনি একটি চিপসের প্যাকেট খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন—Please Take.
ভদ্রলোকের আবদার দেখে আমার হাই আর ঝিমুনি দুইটাই উবে গেল। মুহূর্তেই আমি স্বাভাবিক চেহারা বানিয়ে বললাম—No, Thanks.
ভদ্রলোক একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ভয় পাচ্ছ নাকি?
আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ভদ্রলোক ভাবছেন হয়তো তাকে কোনো হাইজ্যাকার-টাইজ্যাকার ভেবে আমি তার কাছ থেকে চিপস নিতে চাচ্ছি না। আমার হয়ে জবাব দিল সাজিদ। বলল, আঙ্কেল, ওর আসলে ফাস্টফুডে এলার্জি আছে।
ওহ আচ্ছা। তাই বলো ভদ্রলোক বললেন। এরপর সাজিদের দিকে প্যাকেটখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তুমি নাও।
সাজিদ নিল। দুটুকরো পটেটো চিপস মুখে পুরে দিয়ে সে ভদ্রলোককে বলল, Thank You.
তোমার নাম? ভদ্রলোকের প্রশ্ন।
সাজিদ
কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
রাজশাহীতে বেড়াতে এসেছিলাম। ঢাকা ফিরছি।
এতটুকু আলাপের পরে সাজিদ আবার বই পড়ায় মন দিল। ততক্ষণে ভদ্রলোক পটেটো চিপসের প্যাকেটটি খালি করে সেটি জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। একটুপরে তিনি সাজিদকে জিজ্ঞেস করলেন, খুবই পারসোনাল একটি প্রশ্ন করতে পারি?
সাজিদ সাতপাঁচ না ভেবে বলল, কোনো সমস্যা নেই।
তোমার হাতে থাকা বইটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। কিছু মনে না করলে আমি কি বইটি একটু দেখতে পারি?
সাজিদ হাসি মুখে অবশ্যই বলতে বলতে ভদ্রলোকের দিকে বইটি এগিয়ে দিল। তিনি বইটি হাতে পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলেন। এরপর বইটি আবার সাজিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। বেশ ভালো বই বলে মনে হলো।
সাজিদ কিছু না বলে বইটি খুলে আগের জায়গা থেকে পড়তে শুরু করল। ভদ্রলোক একটু পরে আবার বললেন, সরি, ইফ আই মাইট হ্যাভ বদারড ইউ। আমার মনে হচ্ছে তুমি কম্পারেটিভ রিলিজিওনের ছাত্র। আসলে তোমার হাতে থাকা বইটি দেখেই অনুমান করছি।
সাজিদ বলল, জি না। কম্পারেটিভ রিলিজিওন আমার অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট নয়। তবে বিষয়টি আমার খুব ফেভারিট। এজন্যেই সুযোগ পেলে আমি এটা নিয়ে পড়াশোনা করি।
সাজিদের উত্তর শুনে ভদ্রলোক বললেন, দ্যাটস গ্রেট। এরপর সাজিদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাইস টু মিট ইউ।
সাজিদ মুখে কোনোকিছু না বলে হাত মিলাল। করমর্দন-পর্ব শেষ হতেই তিনি আবার বললেন, কিছু মনে না করলে আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতাম।
সাজিদ তার হাতে থাকা বইটি বন্ধ করে বলল, জি, অবশ্যই।
মুচকি হাসলেন ভদ্রলোক। সম্ভবত আড্ডা দেওয়ার মানুষ পেয়ে তিনি যারপরনাই খুশি এই মুহূর্তে।
প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়ে তিনি বললেন, আসলে, পারিবারিকভাবে আমি মুসলিম পরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয়েছে ইসলাম হলো একটি সাম্যের ধর্ম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার মনে নানা ধরনের প্রশ্ন দানা বাঁধতে শুরু করে। আমি অবশ্য ধর্ম কিংবা স্রষ্টা কোনোটিই অস্বীকার বা অবিশ্বাস করি না। ইসলাম নিয়েও আমার ঢের কোনো আপত্তি নেই। তবুও মাঝে মাঝে আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগে। আমার খুব করে জানতে মন চায় ইসলাম অমুসলিমদের স্বাধীনতা রক্ষায়, অধিকার রক্ষার ব্যাপারে আদৌ তৎপর কি না? তুমি প্রশ্ন করতে পারো, আমার মধ্যে এই প্রশ্ন জাগল কেন? আসলে, ব্যক্তিগত জীবনে এবং চাকরির সুবাদে দেশে-বিদেশে প্রচুর অমুসলিমের সাথে আমি লেনদেন করেছি। তাদের অধিকাংশকেই আমি সৎ ও ভালো মানুষ হিশেবে পেয়েছি। এমতাবস্থায়, যদি ধরে নিই যে, দেশে শারয়ী আইন বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাহলে তাদের সাথে ইসলামিক পারস্পেক্টিভ থেকে কীরকম আচরণ করা হবে? তাদের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করা হবে? তাদের ধর্মান্তকরণে জোর-জুলুম, জবরদস্তি করা হবে কি না?
ভদ্রলোক এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন কথাগুলো। কোথাও একটিবারের জন্যও থামেননি। প্রশ্ন করা শেষে তিনি উৎসুক চোখ নিয়ে সাজিদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন উত্তর পাবার আশায়। সাজিদ খানিকটা সময় নিয়ে কিছু চিন্তা করে বলল, ভেরি গুড় কোয়েশ্চান। এই ব্যাপারে সঠিক ধারণাটি আমাদের প্রত্যেকেরই জানা উচিত। এমন নয় যে, এটা আমাদের মুষ্টিমেয় কয়েকজনের প্রশ্ন। ইসলামকে আক্রমণ করতে আসা অনেকে এই প্রশ্নটা করে থাকে। তারা বলে, শারয়ী আইন নাকি অমুসলিমদের অধিকার খর্ব করে, তাদের ধর্মান্তকরণে জোর জবরদস্তি করে ইত্যাদি।
আমার চোখেমুখে ঘুমের যে লেশটুকু অবশিষ্ট ছিল, এখন তাও লাপাত্তা। এদের দুজনের আলোচনা শোনার জন্য একটু নড়েচড়ে বসলাম। ট্রেনের জানালার ফাঁক গলে বাইরের বাতাস এসে ভেতরে ঢুকছে। তাতে হালকা শীত শীতও লাগছে। ভদ্রলোক সাজিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী যেন নাম তোমার?
সাজিদ সুন্দর করে তার নাম বলল। তারপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আমাকেও জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?
বললাম, আরিফ।
বেশ! শুরু করা যাক তাহলে?
দূর্বার গতিতে ছুটে চলছে ঢাকাগামী ট্রেন। শামসুর রাহমানের কবিতার মতো ঝকঝক শব্দ করে করে এটি পার করছে একটির পর একটি স্টেশন। আশপাশের গাছপালা, মানুষগুলোকে খুবই ক্ষুদ্রাকৃতির মনে হচ্ছে।
সাজিদ বলল, ব্যাপারটি ভালোমতো বোঝার জন্য প্রথমে আমাদের দেখতে হবে এই ইস্যুতে কুরআন কী বলছে। কুরআন বলছে, There shall be no compulsion in (acceptance of) the religion. oporte aos 1687 কোনোরকম জোরজবরদস্তি নেই।[১]
কথাটি খুবই স্পষ্ট এবং পরিষ্কার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলে দিচ্ছেন যে, ধর্মে কোনোরকম চাপাচাপি নেই। আপনি হিন্দু ধর্ম পালন করতে চান? খ্রিষ্টান অথবা ইহুদী ধর্ম? ফাইন। ইসলাম বলছে, আপনি সেটি অবশ্যই পারেন। ইসলাম এক্ষেত্রে আপনাকে বাঁধা দেবে না।
তিনি বললেন, তাহলে কেউ অন্য ধর্ম মানতে চাইলে তাকে তার ধর্ম ছেড়ে আমার ধর্মে আসার জন্য বলতে পারব না?
সাজিদ বলল, অবশ্যই পারবেন। এটা তো জোরজবরদস্তি নয়। এটা আপনার বিশ্বাসের প্রচারণা। আর এই প্রচারণা কীভাবে করতে হবে সেটারও খুব সুন্দর উপায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, Invite (all) to the way of ur Lord with wisdom & beautiful preaching; And argue with them in ways that are best & most gracious.[২] অর্থাৎ স্বীয় রবের পথে মানুষকে আহ্বান করুন জ্ঞান এবং হিকমার মাধ্যমে। আর তাদের সাথে কথা বলুন সুন্দরভাবে। দেখুন, এখানে খুবই স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে মানুষদের দ্বীনের পথে ডাকার পদ্ধতি। ইসলাম বলছে, আপনি তাদের সাথে অহেতুক, অযৌক্তিক কথা বলতে পারবেন না। আপনি যদি দাবি করেন যে আপনার বিশ্বাস সত্য, আপনার ধর্ম সত্য, তাহলে উপর্যুপরি যুক্তি, প্রমাণ, দলীল দেখিয়ে তাদের সাথে তর্ক করতে বলা হয়েছে এবং তর্কের সময়ে আপনাকে তাদের সাথে সর্বোত্তম ব্যবহারটাই করতে বলা হয়েছে।
হুম; কিন্তু কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছে মুশরিকদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই হত্যা করতে। এটা কেন?
খুবই সহজ জিনিস। হ্যাঁ, কুরআন বলেছে মুশরিকদের যেখানেও পাও, হত্যা করো; কিন্তু, আপনাকে এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট জানতে হবে। এই আয়াত নাযিল হয়েছিল যুদ্ধের উত্তপ্ত সময়ে যখন মুসলিম বাহিনী এবং মুশরিক বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি। এই আয়াতে যে-নির্দেশ এসেছে সেটি কেবল ওই প্রেক্ষাপটে। যেমন—৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কালজয়ী ভাষণে বলেছিলেন, আমরা ওদের ভাতে মারব, পানিতে মারব। তার এই কথাগুলো তখন যুদ্ধশিবিরে অবস্থানরত সৈনিকদের উদ্দীপ্ত করেছিল; প্রেরণা জুগিয়েছিল; কিন্তু আজকে এই সময়ে কি আমরা বলি, পাকিস্তানীদের আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব? বলি না। ঠিক একইভাবে, কুরআনের সেই আয়াত বিশেষ একটি সময়, প্রেক্ষাপট ও একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করেই নাযিল হয়েছিল। এটা কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় না যে, এই আয়াত দিয়ে ইসলাম সবসময় অমুসলিমদের হত্যার বিধান দিয়েছে বা এরকম কিছু।
সাজিদ থামল। লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, কুরআন কি এমন কারও সাথে রক্তারক্তিতে জড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিচ্ছে না, যারা আদতে সংখ্যালঘু এবং নিরপরাধ?
আমি সাজিদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নেওয়ার মতো করে বললাম, একদমই না। প্রথমত এই আয়াত যখন নাযিল হয়, তখন কাফির-মুশরিকরা সংখ্যালঘু ছিল না; বরং মুসলিমরা ছিল সংখ্যালঘু।
সাজিদ বলল, আপনার পয়েন্টটি দারুণ। কুরআন কি অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বলেছে? দেখুন, আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলছেন, Fight in the way of Allah (with) those who fight you.[৩] অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, তাদের সাথেই কেবল যুদ্ধ করা, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পৃথিবীর কোনো জাতি কি এই থিওরিতে বিশ্বাস করে যে, অন্য একটি জাতি এসে তাদের মেরে সাফ করে যাবে, আর তারা তাদের জামাই আদর দিয়ে বরণ করে নেবে?
ভদ্রলোক বললেন, না।
সাজিদ আবার বলল, এরপরেই কুরআন বলছে, But do not transgress. অর্থাৎ কিন্তু সীমা অতিক্রম কোরো না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, তোমাদের সাথে যারা যুদ্ধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো; কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে না। এটা কীরকম সীমা? মানে, যারা যুদ্ধ করতে চায় না বা করে না, যারা মুশরিক-কাফির; কিন্তু অত্যাচারী সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, যারা নিরপরাধ, তাদের যেন জান এবং মালের কোনো ক্ষতি না হয়। এরকম বাড়াবাড়ি করলে কী হবে? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা একই আয়াতে স্পষ্ট করে বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের ভালোবাসেন না। এটাই হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে মুসলিমদের জন্য যুদ্ধের শর্ত এবং বাউন্ডারি। বলুন তো এরমধ্যে আপনি এমন কিছু কি দেখছেন যেটা আপনার দৃষ্টিতে খারাপ বা বাড়াবাড়ি?
লোকটা না সূচক মাথা নাড়ল।
আমি বললাম, ধর্মগ্রহণে ইসলাম কখনোই জোরজবরদস্তি করে না। কুরআন স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে—তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।[৪]
সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, গেল কুরআনের কথা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী দেখলেই বোঝা যায়, তিনি অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কতটা তৎপর ছিলেন।
ভদ্রলোক বললেন, যেমন?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সাবধান! তোমাদের যে-ব্যক্তি কোনো নিরপরাধ অমুসলিম ব্যক্তির ওপর নির্যাতন চালাবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তাকে দুঃখ দেবে, অথবা তার অনুমতি ব্যতীত তার কাছ থেকে কোনোকিছু ছিনিয়ে নেবে, জেনে রাখো কিয়ামতের মাঠে আমি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবো।[৫] এরচেয়ে উত্তম কিছু আর কী হতে পারে বলুন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম স্বয়ং সেই মুসলিমের সাথে যুদ্ধে নামার ঘোষণা দিচ্ছেন, যে একজন নিরপরাধ অমুসলিমকে কষ্ট দেয়, আঘাত করে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তিনি আরও বলেছেন, যদি কোনো মুসলিম কোনো নিরপরাধ অমুসলিমকে বিনা কারণে হত্যা করে, তাহলে সে জান্নাতের খুশবু পর্যন্ত পাবে না, যদিও জান্নাতের এই খুশবু ৪০ হাজার বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।[৬]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীরা যখন নিজেদের ওপর অকথ্য, অবর্ণনীয় অত্যাচার, নির্যাতনের পরে প্রিয় স্বদেশ ত্যাগ করে মদীনায় চলে যান, কয়েক বছর পরে তারা মক্কা বিজয় করে আবার দেশে ফিরে আসেন। মক্কায় ফেরার পরে মুসলিমদের এক সেনাপতি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করে বসেন, আজ হচ্ছে আমাদের প্রতিশোধ নেবার দিন। তার মুখে এই কথা শুনে রাসূল। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, না! আজ হচ্ছে উন্মুক্ত ক্ষমার দিন। এরপরে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার মুশরিকদের দিকে ফিরে বললেন, আজ তোমরা আমার কাছ থেকে কেমন আচরণ আশা করো? মুশরিকরা বলল, আমরা আপনার কাছ থেকে তেমন আচরণই আশা করি, যেমন আচরণ ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার পাপিষ্ঠ ভাইদের সাথে করেছিলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিক সেই কথাটাই, বললেন যা ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার ভাইদের সাথে বলেছিলেন—আজ তোমাদের আর কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আজ তোমরা সকলেই মুক্ত।[৭]
সাজিদ বলে চলল, কতটুকু নরম, কোমল প্রকৃতির অধিকারী হলে একজন নেতা তার পরম শত্রুদের এত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে ক্ষমা করে দিতে পারে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা করা আমার ওপর আরোপিত বিশেষ কর্তব্যগুলোর একটি।[৮]
আমরা গভীর মনোযোগ দিয়ে সাজিদের কথা শুনছি। সে বলে যাচ্ছে—একবার মিশরের এক মুসলিম শাসক একজন অমুসলিমকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন। এই খবর যখন খলিফা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু এর কানে এলো, তখন তিনি সেই অমুসলিমকে নির্দেশ দিলেন; মুসলিম শাসককে ঠিক সেভাবেই শাস্তি দেওয়ার জন্য যেভাবে অমুসলিম ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি তখন ক্ষুন্ধস্বরে মুসলিম শাসককে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, কখন থেকে মানুষকে তুমি তোমার দাস ভাবা শুরু করেছ?[৯]
দেখুন, এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে অমুসলিমদের অধিকার, মর্যাদা রক্ষায় ইসলাম কতটা উদার ও তৎপর।
সাজিদ থামল। ভদ্রলোক বললেন, ইসলামী শাসন চালু হলে ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমদের সাথে কী করা হবে?
সাজিদ পানির বোতল থেকে পানি ঢেলে মুখে ছিটিয়ে নিল হালকা। এরপরে বলল, আরেকটি চমৎকার প্রশ্ন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজরান অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের ভূমি এবং তার শাসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের জীবন, তাদের ভূমি, তাদের সম্পদ, তাদের উপসনালয় সবকিছুরই নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কোনো যাজককে তার কাজ হতে, কোনো অফিসারকে তার চাকরি থেকে চাকরিচ্যত করা হবে না।[১০]
শুধু তাই নয়, মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত কোনো অমুসলিম বহিঃশত্রুদের সাথে কোনো প্রকার যুদ্ধে অংশ নিতেও বাধ্য নয়। বাইরের কোনো শত্রু যদি মুসলিমরাষ্ট্র আক্রমণ করে, তাহলে মুসলিমরাই তাদের প্রতিহত করবে। সেই মুসলিমরাষ্ট্রে বসবাসরত অমুসলিমরা কোনো ধরনের যুদ্ধে যেতে বাধ্য নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, অমুসলিমরা কি এমনিতেই সুফল ভোগ করবে কোনোরকম ত্যাগ ছাড়াই?
সাজিদ বলল, না। অমুসলিমদের হয়ে মুসলিমরা সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ সামলাবে ঠিক, তবে অমুসলিমদেরও কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সেটি হলো অমুসলিমরা এর পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স দেবে কেবল।
আমি বললাম, ও আচ্ছা। যেটিকে জিজিয়া কর বলা হয়, তাই না?
ঠিক ধরেছিস। এটার নাম জিজিয়া কর। তবে ইসলামী আইনশাত্রে বলা আছে, গরিব, বৃদ্ধ এবং অসমর্থলোক এই জিজিয়া কর প্রদানের বিধানমুক্ত। শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্রের রাজকোষ বায়তুল মাল থেকে রাষ্ট্রের গরিব, দুঃস্থ, অসহায় অমুসলিমদের অর্থ প্রদান করে সহায়তারও বিধান রয়েছে ইসলামী আইনে।[১১]
আমাদের সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকের চেহারায় হাসির আমেজ দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। ইসলাম যে অমুসলিমদের সাথে কোনো অন্যায় করে না, তাদের অধিকার দানে যে কোনো কারচুপি করে না, সেটি হয়তো তিনি এখন বুঝতে পেরেছেন। লোকটির সাথে আমাদের আরও আলাপ হলো। জানতে পারলাম তার নাম মুহাম্মদ আজহার উদ্দীন। একটি বেসরকারী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে আছেন। রাজশাহীতে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিলেন।
ট্রেন থেকে নামার আগে ভদ্রলোক আমাদের হাতে তার অফিসের কার্ড দিয়ে বললেন, বয়েজ, সময় করে আমার অফিস থেকে কফি খেয়ে যেয়ো।
আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বললাম, জি আচ্ছা।
আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, তোমার আবার কফিতে এলার্জি নেই তো আরিফ?
এটা বলে ভদ্রলোক হা-হা-হা করে হাসলেন। আমি খুব লজ্জা পেলাম। সাজিদের দিকে তাকালাম। সেও মুচকি হাসছে।
———
১ সূরা বাকারা, ০২ : ২৫৬
২ সূরা নাহল, ১৬ : ১২৫
৩ সূরা বাকারা, ০২ : ১৯০
৪ সূরা কাফিরুন, ১০৯ : ০৬
৫ সুনানু আবি দাউদ, ৩/ ১৭০
৬ সহীহ আল-বুখারী, ০৩ / ২২৯৫
৭ ফাতহুল বারী, ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালীন, খণ্ড : ০৮; পৃষ্ঠা : ১৮
৮ সুনানু বায়হাকী, খণ্ড : ০৮; পৃষ্ঠা : ৩০
৯ কানযুল আমাল, খণ্ড : ০৪; পৃষ্ঠা : ৪৫৫
১০ তাবাকাত ইবনু সাদ, খণ্ড : ০১; পৃষ্ঠা : ২২৮ ১১ কিতাব আল-খিরাজ, ইমাম আবু ইউসুফ, পৃষ্ঠা : ১৫৫