সেকালে শখ বলে একটা জিনিস ছিল। সবার ভিতরে শখ ছিল, সবাই ছিল শৌখিন। একালে শৌখিন হতে কেউ জানে না, জানবে কোত্থেকে। ভিতরে শখ নেই যে। এই শখ আর শৌখিনতার কতকগুলো গল্প বলি শোনো।
উপেন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন মহা শৌখিন। তাঁর শখ ছিল কাপড়চোপড় সাজগোজে। সাজতে তিনি খুব ভালোবাসতেন, ঋতুর সঙ্গে রঙ মিলিয়ে সাজ করতেন। ছয় ঋতুতে ছয় রঙের সাজ ছিল তার। আমরা ছেলেবেলায় নিজের চোখে দেখেছি, আশি বছরের বুড়ো তখন তিনি, বসন্তকালে হলদে চাপকান, জরির টুপি মাথায়, সাজসজ্জায় কোথাও একটু ক্রটি নেই, বের হতেন বিকেলবেলা হাওয়া খেতে। তাঁর শখ ছিল ঐ, বিকেলবেলায় সেজেগুজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গিন্নিকে ডেকে বলতেন, দেখো তো গিন্নি, ঠিক হয়েছে কিনা। গিন্নি এসে হয়তো টুপিটা আর-একটু বেঁকিয়ে দিয়ে, গোঁফজোড়া একটু মুচড়ে দিয়ে, ভালে করে দেখে বলতেন, হ্যাঁ, এবারে হয়েছে। গিন্নি সাজ ‘অ্যাপ্রুভ’ করে দিলে তবে তিনি বেড়াতে বের হতেন। তিনি যদি অ্যাপ্রুভ না করতেন তবে সাজ বদল হয়ে যেত। রোজ এই বিকেলের সাজটিতে ছিল তাঁর শখ। দাদামশায়ের শখ ছিল বোটে চড়ে বেড়ানো। পিনিস তৈরি হয়ে এল—পিনিস কী জান, বজরা আর পানসি, পিনিস হচ্ছে বজরার ছোটো আর পানসির বড়ো ভাই—ভিতরে সব সিল্কের গদি, সিল্কের পর্দা, চার দিকে আরামের চুড়োন্ত।
ফি রবিবারেই শুনেছি দাদামশায় বন্ধু-বান্ধব ইয়ার-বক্সী নিয়ে বের হতেন—সঙ্গে থাকত খাতা-পেন্সিল, তাঁর ছবি আঁকার শখ ছিল, দু-একজোড়া তাসও থাকত বন্ধু-বান্ধবদের খেলবার জন্য। এই জগন্নাথ ঘাটে পিনিস থাকত, এখান থেকেই তিনি বোটে উঠতেন। পিনিসের উপরে থাকত একটা দামামা, দাদামশায়ের পিনিস চলতে শুরু হলেই সেই দামামা দকড় দকড় করে পিটতে থাকত, তার উপরে হাতিমার্কা নিশেন উড়ছে পত পত করে। ঐ তাঁর শখ, দামামা পিটিয়ে চলতেন পিনিসে। ঐ বোটেতে খুব যখন তাসখেলা জমেছে, গল্পসল্প বন্ধ, উনি করতেন কী, টপাস করে খানকয়েক তাস নিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিতেন, আর হো-হো করে হাসি। বন্ধুরা চেঁচিয়ে উঠতেন, করলেন কী, রঙের তাস ছিল যে। তা আর হয়েছে কী, আবার এক ঘাটে নেমে নতুন তাস এল। ঐ মজা ছিল তাঁর। তাঁর সঙ্গে প্রায়ই থাকতেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। অনেক ফরমাশী কবিতাই ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছেন সে সময়ে। ঈশ্বর গুপ্তের ঐ গ্রীষ্মের কবিতা দাদামশায়ের ফরমাশেই লেখা। বেজায় গরম, বেলগাছিয়া বাগানবাড়িতে তখন, ডাবের জল, বরফ, এটা-ওটা খাওয়া হচ্ছে—দাদামশাই বললেন, লেখো তো ঈশ্বর, একটা গ্রীষ্মের কবিতা। তিনি লিখলেন—
দে জল দে জল বাবা দে জল দে জল,
জল দে জল দে বাবা জলদেরে বল্।
দাদামশায়ের আর-একটা শখ ছিল ঝড় উঠলেই বলতেন ঝড়ের মুখে পাল তুলে দিতে। সঙ্গীরা তো ভয়ে অস্থির—অমন কাজ করবেন না। না, পাল তুলতেই হবে, হুকুম হয়েছে। সেই ঝড়ের মুখেই পাল তুলে দিয়ে পিনিস ছেড়ে দিতেন, ডোবে কি উল্টোয় সে ভাবনা নেই। পিনিস উড়ে চলেছে হুহু করে, আর তিনি জানালার ধারে বসে ছবি আঁকছেন। একেই বলে শখ।
দাদামশায়ের যাত্রা করবার শখ, গান বাঁধবার শখ—নানা শখ নিয়ে তিনি থাকতেন। ব্যাটারি চালাতেন, কেমিস্ট্রির শখ ছিল। আর শৌখিনতার মধ্যে ছিল দুটাে ‘পিয়ার্গ্লাস’ তার বৈঠকখানার জন্য। বিলেতে নবীন মুখুজ্জেকে লিখলেন—বাবাকে বলে এই দুটাে যে করে হোক জোগাড় করে পাঠাও। তিনি লিখলেন এখানে বড়ো খরচ, গভর্নার বড়ো ক্লোজ-ফিস্টেড হয়েছেন। তবে দরবার করেছি। হুকুমও হয়ে গেছে, কার-টেগোর কোম্পানির জাহাজ যাচ্ছে, তাতে তোমার দুটাে ‘পিয়ার্গ্লাস’ আর ইলেকট্রিক ব্যাটারি খালাস করে নিয়ো।
কানাইলাল ঠাকুরের শখ ছিল পোশাকি মাছে। ছেলেবেলা থেকে শখ পোশাকি মাছ খেতে হবে। বামুনকে প্রায়ই হুকুম করতেন পোশাকি মাছ চাই আজ। সে পুরোনো বামুন, জানত পোশাকি মাছের ব্যাপার, অনেকবারই তাকে পোশাকি মাছ রান্না করে দিতে হয়েছে। বড়ো বড়ো লালকোর্তাপরা চিংড়িমাছ সাজিয়ে সামনে ধরল, দেখে ভারি খুশি, পোশাকি মাছ এল।
জগমোহন গাঙ্গুলি মশায়ের ছিল রান্নার আর খাবার শখ। হরেক রকমের রান্না তিনি জানতেন। পাকা রাঁধিয়ে ছিলেন, কি বিলিতি কি দেশী। গায়ে যেমন ছিল অগাধ শক্তি, খাইয়েও তেমনি। ভালো রান্না আর ভালো খাওয়া নিয়েই থাকতেন তিনি সকাল থেকে সন্ধে ইস্তিক। অনেকগুলো বাটি ছিল তাঁর, সকাল হলেই তিনি এ বাড়ি ও বাড়ি ঘরে ঘরে একটা করে বাটি পাঠিয়ে দিতেন। যার ঘরে যা ভালো রান্না হত, একটা তরকারি ঐ বাটিতে করে আসত। সব ঘর থেকে যখন তরকারি এল তখন খোঁজ নিতেন, দেখ্ তো মেথরদের বাড়িতে কী রান্না হয়েছে আজ। সেখানে হয়তো কোনোদিন হাঁসের ডিমের ঝোল, কোনোদিন মাছের ঝোল—তাই এল খানিকটা বাটিতে করে। এই-সব নিয়ে তিনি রোজ মধ্যাহ্নভোজনে বসতেন। এমনি ছিল তাঁর রান্না আর খাওয়ার শখ। এইরকম সব ভোজনবিলাসী শয়নবিলাসী নানারকমের লোক ছিল তখনকার কালে।
কারো আবার ছিল ঘুড়ি ওড়াবার শখ। কানাই মল্লিকের শখ ছিল ঘুড়ি ওড়াবার। ঘুড়ির সঙ্গে পাঁচ টাকা দশ টাকার নোট পর পর গেঁথে দিয়ে ঘুড়ি ওড়াতেন, সুতোর প্যাঁচ খেলতেন। এই শখে আবার এমন ‘শক্’ পেলেন শেষটায়, একদিন যথাসর্বস্ব খুইয়ে বসতে হল তাঁকে। সেই অবস্থায়ই আমরা তাঁকে দেখেছি, আমাদের কুকুরছানাটা পাখিটা জোগাড় করে দিতেন।
ঐ ঘুড়ি ওড়াবার আর-একটা গল্প শুনেছি আমরা ছেলেবেলায়, মহর্ষিদেব, তাঁকে আমরা কর্তাদাদামশায় বলতুম, তাঁর কাছে। তিনি বলতেন, আমি তখন ডালহৌসি পাহাড়ে যাচ্ছি, তখনকার দিনে তো রেলপথ ছিল না, নৌকো করেই যেতে হত, দিল্লী ফোর্টের নীচে দিয়ে বোট চলেছে—দেখি কেল্লার বুরুজের উপর দাঁড়িয়ে দিল্লীর শেষ বাদশা ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। রাজ্য চলে যাচ্ছে, তখনো মনের আনন্দে ঘুড়িই ওড়াচ্ছেন। তার পর মিউটিনির পর আমি যখন ফিরছি তখন দেখি কানপুরের কাছে—সামনে সব সশস্ত্র পাহারা—শেষ বাদশাকে বন্দী করে নিয়ে চলেছে ইংরেজরা। তাঁর ঘুড়ি ওড়াবার পালা শেষ হয়েছে।
কর্তাদাদামশায়েরও শখ ছিল এক কালে পায়রা পোষার, বাল্যকালে যখন স্কুলে পড়েন। তাঁর ভাগনে ছিলেন ঈশ্বর মুখুজ্জে— তাঁর কাছেই আমরা সেকালের গল্প শুনেছি। এমন চমৎকার করে তিনি গল্প বলতে পারতেন, যেন সেকালটাকে গল্পের ভিতর দিয়ে জীবন্ত করে ধরতেন আমাদের সামনে। সেই ঈশ্বর মুখুজ্জে আর কর্তাদাদামশায় স্কুল থেকে ফেরবার পথে রোজ টিরিটিবাজারে যেতেন, ভালো ভালো পায়রা কিনে এনে পুষতেন। আমাদের ছেলেবেলায় একদিন কী হয়েছিল তার একটা গল্প বলি শোনো, এ আমাদের নিজে চোখে দেখা। কর্তাদাদামশায় তখন বুড়ো হয়ে গেছেন, বোলপুর না পরগনা থেকে ফিরে এসেছেন। বাবা তখন সবে মারা গেছেন, তাই বোধ হয় আমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে একবার দেখেশুনে যাবার ইচ্ছে। বললেন, কুমুদিনী-কাদম্বিনীকে খবর দাও আমি আসছি। খবর এল, কর্তামশায় আসবেন, বাড়িতে হৈ-হৈ রব পড়ে গেল। আমার তখন নয় কি দশ বছর বয়স। আমাদের ভালো কাপড়-জামা পরিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন, যেন কোনোরকম বেয়াদপি দুষ্টুমি না করি। চাকর-বাকররাও সাজপোশাক পরে ফিটফাট, একেবারে কায়দাদোরস্ত। বাড়িঘর ঝাড়পোঁছ সাজানো-গোছানো হল। আজ কর্তাদাদামশায় আসবেন। সকাল থেকে ঈশ্বরবাবু সদরি-টদরি পরে এলেন আমাদের বাড়িতে। সত্তর বছরের বুড়ো সেজেগুজে, কানে আবার একটু আতরের ফায়া গুঁজে তৈরি। নিয়ম ছিল তখনকার দিনে পুজোর সময় ঐ-সব সাজ পরার। সকাল থেকে তো ঈশ্বরবাবু এসে বসে আছেন—আমরা বললুম, তুমি আর কেন বসে আছ সেজেগুজে। কর্তাদাদামশায় তোমাকে চিনতেই পারবেন না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, চিনতে পারবেন না! ছেলেবেলায় একসঙ্গে স্কুলফেরত কত পায়রা কিনেছি, দুজনে পায়রা পুষেছি। আমাকে চিনতে পারবেন না, বললেই হল! দেখো ভাই, দেখো। আমরা বললুম, তুমিই দেখে নিয়ো, সে ছেলেবেলার কথা কি আর উনি মনে করে রেখেছেন। এখন উনি মহর্ষিদেব, পায়রার কথা ভুলে বসে আছেন। কর্তাদাদামশায় তো এলেন। বড়োপিসেমশায়, ছোটোপিসেমশায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, কে, যোগেশ? নীলকমল? বেশ বেশ, ভালো তো? উপরে এলেন কর্তাদাদামশায়। আমরা সব বারান্দার এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলুম, আস্তে আস্তে এসে ভক্তিভরে পেন্নাম করলুম—জিজ্ঞেস করলেন, এরা কে কে। পিসেমশায়রা পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ গগন, এ সমর, এ অবন। সব ছেলেকে কাছে ডেকে মাথায় হাত দিয়ে আশীৰ্বাদ করলেন। একে-একে সবাই আসছে, পেন্নাম করছে। দূরে ঈশ্বরবাবুর মুখে কথাটি নেই। হঠাৎ কর্তাদাদামশায়ের নজর পড়ল ঈশ্বরবাবুর উপরে। এই যে ঈশ্বর—বলে দু হাতে তাকে বুকে জাপটে ধরে কোলাকুলি। সে কোলাকুলি আর থামে না। বললেন, মনে আছে ঈশ্বর, আমরা স্কুল পালিয়ে টিরিটিবাজারে পায়রা কিনতে যেতুম, মনে আছে? আরে, সেই ঈশ্বর তুমি—ব’লে এক বুড়ো আর-এক বুড়োকে কী আলিঙ্গন। অনেক দিন পরে দেখা দুই বাল্যবন্ধুতে, দেখে মনে হল যেন দুই বালকে কথা হচ্ছে এমনি গলার স্বর হয়ে গেছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। ঈশ্বরবাবুর আহ্লাদ আর ধরে না, কর্তাদাদামশায়ের আলিঙ্গন পেয়ে। তার পর কর্তাদাদামশায় মা-পিসিমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করে তো চলে গেলেন। এতক্ষণে ঈশ্বরবাবুর বুলি ফুটল; বললেন, দেখলে, বলেছিলে না উনি চিনবেন না আমাকে—দেখলে তো? ঠিক মনে আছে পায়রা-কেনার গল্প। তোমাদের তো আলাপ করিয়ে দিতে হল, আর আমাকে—আমাকে তো উনি দেখেই চিনে ফেললেন।
কর্তাদাদামশায়ের এক সময়ে গানবাজনার শখ ছিল, জানো? শুনবে সে গল্প? বলব? আচ্ছা, বলি। তখন পরগনা থেকে টাকা আসত কলসীতে করে। কলসীতে করে টাকা এলে পর সে টাকা সব তোড়া বাঁধা হত। টাকা গোনার শব্দ আর এখন শুনতে পাই না, ঝন্ ঝন্ রুপোর টাকার শব্দ। এখন সব নোট হয়ে গেছে। কর্তার ‘পার্সোনাল’ খরচ, সংসারখরচ, অমুক খরচ, ও বাড়ির এ বাড়ির খরচ যেখানে যা দরকার ঘরে ঘরে ঐ এক-একটি তোড়া পৌঁছিয়ে দেওয়া হত, তাই থেকে খরচ হতে থাকত। এখন এই-যে আমার নীচের তলার সিঁড়ির কাছে যেখানে ঘড়িটা আছে, সেখানে মস্ত পাথরের টেবিলে সেই টাকা ভাগ ভাগ করে তোড়া বাঁধা হত। এ বাড়ি ছিল তখন বৈঠকখানা। এ বাড়িতে থাকতেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, জমিদারির কাজকর্ম তিনি নিজে দেখতেন। কর্তাদাদামশায় তখন বাড়ির বড়ো ছেলে। মহা শৌখিন তিনি তখন, বাড়ির বড়ো ছেলে। ও বাড়ি থেকে রোজ সকালে একবার করে দ্বারকানাথ ঠাকুরকে পেন্নাম করতে আসতেন—তখনকার দস্তুরই ছিল ঐ; সকালবেলা একবার এসে বাপকে পেন্নাম করে যাওয়া। ছোকরা-বয়স, দিব্যি সুন্দর ফুটফুটে চেহারা, সে-সময়ের একটা ছবি আছে রথীর কাছে, দেখো। বেশ সলমা-চুমকি-দেওয়া কিংখাবের পোশাক পরা। তখন কর্তাদাদামশায় ষোলো বছরের—সেই বয়সের চেহারার সেই ছবিটা পরে মাঝে মাঝে দেখতে পছন্দ করতেন, প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন আমাকে, ছবিটা যত্ন করে রেখেছ তো—দেখো, নষ্ট কোরো না যেন।
যে কথা বলছিলুম। তা, কর্তাদাদামশায় তো যাচ্ছেন বৈঠকখানায় বাপকে পেন্নাম করতে—যেখানে তোড়া বাঁধা হচ্ছে সেখান দিয়েই যেতে হত। সঙ্গে ছিল হরকরা—তখনকার দিনে হরকরা সঙ্গে সঙ্গে থাকত জরির তকমাপরা, হরকরার সাজের বাহার কত। এই যে এখন আমি এখানে এসেছি, তখনকার কাল হলে হরকরাকে ঐ পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, নিয়ম ছিল তাই। কর্তাদাদামশায় তো বাপকে পেন্নাম করে ফিরে আসছেন। সেই ঘরে, যেখানে দেওয়ানজি ও আর-আর কর্মচারীরা মিলে টাকার তোড়া ভাগ করছিলেন, সেখানে এসে হরকরাকে হুকুম দিলেন—হরকরা তো দু-হাতে দুটাে তোড়া নিয়ে চলল বাবুর পিছু পিছু। দেওয়ানজিরা কী বলবেন—বাড়ির বড়ে ছেলে, চুপ করে তাকিয়ে দেখলেন। এখন, হিসেব মেলাতে হবে— দ্বারকানাথ নিজেই সব হিসাব নিতেন তো। দুটো তোড়া কম। কী হল।
আজ্ঞে বড়োবাবু—
ও, আচ্ছা—
এখন দু-তোড়া টাকা কিসে খরচ হল জানো? গানবাজনার ব্যবস্থা হল পুজোর সময়। ছেলেরা বাড়িতে আমোদ করবে পুজোর সময়। খুব গানবাজনার তখন চলন ছিল বাড়িতে। কুমোর এসে ঘরে ঘরে প্রতিমা গড়ত; দাদামশায় কুমোরকে দিয়ে ফরমাশমত প্রতিমার মুখের নতুন ছাঁচ তৈরি করালেন। এখনো আমাদের পরিবারের যেখানে যেখানে পুজো হয় সেই ছাঁচেরই প্রতিমা গড় হয়।
কর্তাদাদামশায়ের কালোয়াতি গান শেখবার শখ ছিল, সে তো আগেই বলেছি। তিনি নিজেও আমাদের বলেছিলেন, আমি পিয়ানো শিখেছিলুম ছেলেবেলায় সাহেব মাস্টারের কাছ থেকে তা জানো?
আমরা তাঁর গানবাজনা শুনি নি কখনো, কিন্তু তাঁর মন্ত্র আওড়ানো শুনেছি। আহা, সে কী সুন্দর, কী পরিষ্কার উচ্চারণ, সে শব্দে চারি দিক যেন গম্গম্ করত।
কর্তাদাদামশায়ের নাক ছিল দারুণ। আমরা তাঁর কাছে যেতুম না বড়ো বেশি, তবে কখনো বিশেষ বিশেষ দিনে পেন্নাম করতে যেতে হলে হাত-পা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে, গায় একটু সুগন্ধ দিয়ে, মুখে একটি পান চিবোতে চিবোতে যেতুম। পাছে কোনোরকম তামাক-চুরুটের গন্ধ পান। আমাদের ছিল আবার তামাক খাওয়া অভ্যেস। একবার কী হয়েছে, পার্কস্ট্রীটের বাড়িতে বাপ-ছেলেতে আছেন—উপরের তলায় থাকেন কর্তাদাদামশায়, নীচের তলায় বড়ো ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড়োজ্যাঠামশায় তখন পাইপ খেতেন। একদিন বড়োজ্যাঠামশায় নীচের তলায় চানের ঘরে পাইপ টানছেন। উপরের ঘরে ছিলেন কর্তাদাদামশায় শুয়ে, চেঁচিয়ে উঠলেন, এ-ই! চাকর-বাকরের নাম ধরে কখনো ডাকতেন না, ‘এ-ই’ বলে ডাকলেই সব ছুটে যেত। তিনি বললেন, গাঁজা খাচ্ছে কে। চাকররা তো ছুটোছুটি করতে লাগল বাড়িময়, খোঁজ খোঁজ, শেষে দেখে বড়োজ্যাঠামশায়ের ঘর থেকে গন্ধ বেরচ্ছে। এ দিকে বড়োজ্যাঠামশায় তো এই-সব শুনে তক্ষুনি জানলা দিয়ে পাইপ-তামাক সব ছুঁড়ে একেবারে বাইরে ফেলে দিলেন। কর্তাদাদামশায় যখন খবর পেলেন, বললেন, দ্বিজেন্দর তামাক খাবেন, তা খান-না, তবে পাইপ-টাইপ কেন। ভালো তামাক আনিয়ে দাও।
কর্তাদাদামশায় মহর্ষি হলে কী হবে—এদিকে শৌখিন ছিলেন খুব। কোথাও একটু নোংরা সইতে পারতেন না। সব-কিছু পরিষ্কার হওয়া চাই। কিছুদিন বাদে-বাদেই তিনি ব্যবহারের কাপড়-জামা ফেলে দিতেন, চাকররা সেগুলো পরত। কর্তাদাদামশায়ের চাকরদের যা সাজের ঘটা ছিল—একেবারে ধোপ-দোরস্ত সব সাজ।
কর্তাদাদামশায় কখনো এই বৃদ্ধকালেও তোয়ালে দিয়ে গা রগড়াতেন না, চামড়ায় লাগবে। সেজন্য মসলিনের থান আসত, রাখা থাকত আলমারির উপরে, তাই থেকে কেটে কেটে দেওয়া হত, তারই টুকরো দিয়ে তিনি গা রগড়াতেন, চোখ পরিষ্কার করতেন। চাকররা কত সময়ে সেই মসলিন চুরি করে নিয়ে নিজেদের জামা করত। দীপুদা বলতেন, এই বেটারাই হচ্ছে কর্তাদাদামশায়ের নাতি, কেমন মসলিনের জামা পরে ঘুরে বেড়ায়, আমরা এক টুকরোও মসলিন পাই না—আমরা কর্তাদাদামশায়ের নাতি কী আবার। দেখছিস না চাকর-বেটাদের সাজের বাহার?
ঈশ্বরবাবু গল্প করতেন, একবার কর্তামশায়ের শখ হল, কল্পতরু হব। রব পড়ে গেল বাড়িতে, কর্তাদাদামশায় কল্পতরু হবেন। কল্পতরু আবার কী। কী ব্যাপার। সারা বাড়ির লোক এসে ওঁর সামনে জড়ো হল। উনি বললেন, ঘর থেকে যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাও। কেউ নিলে ঘড়ি, কেউ নিলে আয়না, কেউ নিলে টেবিল— যে যা পারলে নিয়ে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে ঘর খালি হয়ে গেল। সবাই চলে গেল। ঈশ্বরবাবু বললেন, বুঝলে ভাই, তোমার কর্তাদাদামশায় তো কল্পতরু হয়ে খালি ঘরে এক বেতের চৌকির উপর বসে রইলেন।